2 of 8

রোগীর বন্ধু

রোগীর বন্ধু

রবীন্দ্রনাথের রোগীর বন্ধু প্রহসনের দুঃখীরাম ডাক্তার ছিলেন না। তিনি রোগীর বন্ধুও ছিলেন না। শুধু রোগী কেন, ডাক্তারদেরও তিনি শত্রুতা করেছেন।

দুঃখীরামের মতে, ‘অ্যালোপ্যাথরা তো বিষ খাওয়ায়। ব্যানোর চেয়ে ওষুধ ভয়ানক। যমের চেয়ে ডাক্তারকে ডরাই।’ আর, ‘হোমিওপ্যাথি তো শুধু জলের ব্যবস্থা।’ এবং বদ্যি দেখানোর চেয়ে দুঃখীরামের মতে, ‘খানিকটা আফিং তুঁতের জলে গুলে হরতেল মিশিয়ে খান না কেন?’

দুঃখীরামবাবুর প্রতি আমার নিজস্ব মনোভাব সদয় নয়। তিনি ডাক্তারদের অপবাদ দেন, রোগীকে অযথা ভয় দেখান। কিন্তু কালক্রমে, দৈবের অদৃশ্য লিখনে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি আরেক দুঃখীরাম হয়ে উঠেছি।

হয়তো কোনও রোগী বা অসুস্থ ব্যক্তিকে মৃত্যুভয় দেখানোর মতো অমানুষ আমি নই কিন্তু সেই কবে থেকে আমি ডাক্তারবাবুদের অপবাদ দিয়ে যাচ্ছি, তাঁদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করছি তাঁরা যে আজও আমি অসুস্থ হলে আমাকে দেখতে আসেন, ওষুধের দোকানি আজও আমাকে ওষুধ দেন সেটাই আশ্চর্য।

অথচ ভাল ডাক্তার দেশে যে নেই তাতো নয়। আমি এক ডাক্তারবাবুকে জানি কঠিন রোগগ্রস্ত আমার এক আত্মীয়কে যিনি চিকিৎসা করছিলেন। সেই মহিলা একটি অনারোগ্য অসুখে ভুগছিলেন, তিনি জানতেন, (তিনি বুদ্ধিমতী ছিলেন), তিনি বুঝেছিলেন এই অসুখই তাঁর কাল, তবু স্বাভাবিক দুর্বলতাবশত তিনি ডাক্তারবাবুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন তাঁর পরমায়ু কত? তিনি আর কতদিন বাঁচবেন?

ডাক্তারবাবু ভাল লোক, সৎ লোক। একটু আমতা আমতা করে বললেন, ‘আপনি কি টিভিতে কোনও নতুন সিরিয়াল দেখছেন?’

ভদ্রমহিলা বললেন, ‘হ্যাঁ।’

ডাক্তারবাবু আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি কোনও রবিবাসরীয় বা সাময়িক পত্রিকায় কোনও ধারাবাহিক লেখা পড়তে আরম্ভ করেছেন?’

ভদ্রমহিলা বললেন, ‘হ্যাঁ।’

ডাক্তারবাবু বললেন, ‘এটা ঠিক করেননি। আর কোনও নতুন ধারাবাহিক সিরিয়াল দেখা বা ধারাবাহিক লেখা পড়া আরম্ভ করা উচিত হবে না।’ ডাক্তারবাবুর বক্তব্য পরিষ্কার হলেও, ওই মহিলার পক্ষে ভাল নয়। ডাক্তারবাবুর মতে একটা ধারাবাহিক যতদিন চলবে ততদিন পর্যন্ত মহিলার বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।

শুধু এ ক্ষেত্রেই নয়। চিকিৎসকেরা অনেক সময় এ জাতীয় প্রশ্নে নিষ্ঠুর জবাব যে দেন না তা নয়। অনেক সময় না দিয়ে উপায় থাকে না।

এক চিকিৎসককে মধ্যরাতে ফোন করে ঘুম থেকে তুলেছিলেন এক অনিদ্রার রোগিণী। সারাদিন এবং সন্ধ্যার কঠোর পরিশ্রমের পর সদ্য ঘুমিয়েছিলেন ডাক্তারবাবু। ঘুম থেকে উঠে ফোন তুলে তিনি শুনতে পেলেন রোগিণীর প্রশ্ন, ‘ডাক্তারবাবু আপনি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?’

ডাক্তারবাবু শুকনো গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন, কী হয়েছে?’ রোগিণী বললেন, ‘আপনি তো বেশ ঘুমোচ্ছেন। এদিকে আমার যে কিছুতেই ঘুম আসছে না। দু’বার ঘুমের ওষুধ খেলাম। তাও ঘুম কেটে কেটে যাচ্ছে। এখন আমি কী যে করি?’

রোগিণীর জিজ্ঞাসা শুনে ডাক্তারবাবুর ঘুম সম্পূর্ণ চটে গেল। তিনি বললেন, ‘আপনি কিছু চিন্তা করবেন না। ফোন ধরে থাকুন। আমি আপনাকে ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে শোনাচ্ছি।’ এই বলে হেঁড়ে, বেসুরো গলায় ফোনে গান গাইতে লাগলেন, ‘খুকু ঘুমোলো, পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে…’ ইত্যাদি।

অনিদ্রা রোগিণীর এই গল্প সত্যি হলেও হয়তো হতে পারে। কিন্তু দুর্বল হৃদয়া রোগিণীর ঘটনাটা সত্যি নয়। এক কুৎসিত দর্শনা এবং দুর্বলহৃদয়া রোগিণী ডাক্তারবাবুকে বড় জ্বালাচ্ছিলেন। ডাক্তারবাবু তাঁকে বলেছেন যে তাঁর হার্ট ভাল নয়, সাবধানে থাকতে। সবসময়ে লক্ষ রাখতে যে কখনও হাঁপ ধরে না যায়, কোনও শক না লাগে।

মহিলা একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছেন, ‘আমি কি পাঁঠার মাংসের মেটে খেতে পারি?’ ‘আমি কি সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় আস্তে আস্তে উঠব?’ ‘আমি কি ভয়ের সিনেমা দেখতে পারি?’

একটার পর একটা প্রশ্নের উত্তরে কোনওটায় ‘হ্যাঁ’, কোনওটায় ‘না’ বলতে বলতে অবশেষে ডাক্তারবাবু ধৈর্য হারিয়ে ফেললেন। বললেন, ‘দেখবেন কোনও কিছুতে যেন শক না লাগে। চমকে না ওঠেন হঠাৎ।’ রোগিণী বললেন, ‘যেমন?’ রোগিণীর মুখের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে ডাক্তারবাবু, বললেন, ‘যেমন, আয়নায় মুখ দেখবেন না। কখনও আয়নার কাছে যাবেন না।’

এই কাল্পনিক ডাক্তার রোগীকে খুশি রাখতে চান না এবং নিতান্ত বাধ্য হয়ে, তিতিবিরক্ত হয়ে কটুবাক্য ব্যবহার করেছেন। তবে অনেক সময় চিকিৎসকেরা না বুঝেও রোগীর মনে আঘাত দিয়ে থাকেন।

এক তরুণ কবির চিকিৎসা বিভ্রাটের কথা মাত্র কয়েকদিন আগে একটা কাগজে পড়লাম। এই কবিকে আমি দীর্ঘদিন ধরে চিনি, যখন সে নিতান্ত নাবালক অথচ কবিতা লেখা আরম্ভ করেছে তখন থেকে তাকে এবং তাদের দলের প্রায় সবাইকার সঙ্গে আমার একটা নিকট সম্পর্ক রয়েছে। সে থাকে একটা প্রত্যন্ত জেলার সদর শহরে এবং সেখান থেকে ডাকে কবিতা পাঠায় কলকাতায়। সেখান থেকেই যোগাযোগ রক্ষা করে। আমি যতবার সেই শহরে গেছি তার এবং তার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করেছি, খোঁজখবর নিয়েছি। দুয়েকবার তারাও আমাকে উৎসাহভরে সভা সমিতিতে নিয়ে। যাচ্ছে কলকাতায় এসে।

কিন্তু তরুণ কবিটি এবার মোক্ষম বিপদে পড়েছে। যাকে বলে রীতিমতো চিকিৎসা বিভ্রাটে। চিকিৎসা বিভ্রাটের অতুলনীয় বিচিত্র গল্প পরশুরাম লিখেছিলেন। কিন্তু অনেক সময়েই ব্যাপারটা অত সরস নয়।

তরুণ কবি স্থানীয় ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন হাইড্রোসিল অপারেশন করার জন্যে। কিন্তু অপারেশন করার পরে নাকি বোঝা গেছে যে তার হাইড্রোসিল নয় হয়েছে ফাইলেরিয়া।

অবশ্যই এই দুই রোগের দুইরকম চিকিৎসা। যে ডাক্তার রোগ নির্ণয় করলেন আর যিনি অপারেশন করলেন, যে যাঁর মতো ভেবেছেন। সুখের বিষয় তরুণ কবি এখন ভাল আছেন এবং শীঘ্রই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন।

কিন্তু সবসময় সুখবর এত সহজ হয় না। দুঃখজনক ঘটনার মধ্যে যাব না। এই সূত্রে একটা বিলিতি হাসির আখ্যান বলি।

গল্পটি পুরনো, বোধহয় আগেও লিখেছি। এক ব্যক্তি তার ডাক্তারকে বলেছিলেন, ‘স্যার, একটু দেখেশুনে আমার চিকিৎসা করবেন। আমার জামাইবাবু গত মাসে মারা গেলেন, তাঁর চিকিৎসা করা হয়েছিল টাইফয়েডের কিন্তু হয়েছিল নিউমোনিয়া। আমার অফিসের বড়বাবুর ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা হল কিন্তু হয়েছিল এনসেফেলাইটিস। তিনিও মারা পড়েছেন।’ শুনে চিকিৎসক গম্ভীর হয়ে রোগীকে আশ্বস্ত করলেন, ‘অত ভয় পাবেন না। আমি যে রোগের চিকিৎসা করি, সেই রোগেই রোগীরা মারা যায়। আমি যদি আপনার টাইফয়েড বলে চিকিৎসা করি আপনি টাইফয়েডেই মারা যাবেন। নিউমোনিয়া বা ম্যালেরিয়ায় নয়।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *