2 of 8

মিথ্যা কথা

মিথ্যা কথা

পুরনো গল্পটা দিয়ে আরম্ভ করি। রাস্তায় কয়েকটা অল্পবয়সি ছেলে একটা রবারের বল কুড়িয়ে পেয়েছিল। বলটা কে নেবে এই নিয়ে তাদের মধ্যে প্রচণ্ড কলহ বেধে যায়। রীতিমতো বাদবিতণ্ডার পরে শেষে তারা নিজেদের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেয় যে, সবচেয়ে বেশি মিথ্যা কথা যে বলতে পারবে, সে-ই বলটার মালিক হবে।

সেই সময়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন এক অতিশয় নীতিবাগীশ ভদ্রলোক। ছেলেদের এই কাণ্ডকারখানা দেখে তিনি খুব বিচলিত বোধ করলেন। তিনি তাড়াতাড়ি ছেলেদের বাধা দিয়ে বললেন, ‘এ কী সাংঘাতিক কথা! তোমরা মিথ্যা কথা বলতে যাবে কেন? এই যে আমাকে দেখছ, জানো, আমি জীবনে কোনওদিন মিথ্যা কথা বলিনি!’

ছেলেরা এই কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে তাদের কুড়িয়ে পাওয়া বলটা ভদ্রলোকের হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘এই বলটা আপনি নিন।’

নীতিবাগীশ ভদ্রলোক বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘সেকী! বলটা আমাকে কেন? আমি কেন নেব?’

ছেলেদের দলপতি জানাল, ‘আপনি যা বললেন, তার চেয়ে সেরা মিথ্যা কথা আমরা কেউই বলতে পারব না। তাই বলটা আপনিই পেলেন।’

মিথ্যা কথা নিয়ে অনেক কথা। মহাজনেরা নানাজনে এ বিষয়ে নানা কথা বলেছেন। সব কথা উল্লেখ করার দরকার নেই। তবে সব ধর্মেই একথা বলা আছে যে মিথ্যা কথা মহাপাপ। কিন্তু এ সত্ত্বেও যুধিষ্ঠিরের মতো লোক পর্যন্ত মিথ্যা কথা বলেছে, অথবা বলা উচিত, মিথ্যা কথা বলতে বাধ্য হয়েছে।।

কিন্তু বিনা কারণে, বিনা প্রয়োজনে নির্বিকার ভাবে মিথ্যা কথা বলে এ রকম লোকের সংখ্যাও কিছু কম নেই। কেউ কেউ অহংকার করার জন্যে মিথ্যা কথা বলে। যেমন, বড় সাহেব বললেন, ‘আমার চেয়ে ভাল ইংরেজি এ অফিসে কেউ লিখতে পারে না।’ কিংবা ‘আমার মামার বাড়িতে এগারোটা বড় বড় পুকুর ছিল।’ কিংবা ‘আমার মেজদা মাধ্যমিক পরীক্ষায় অঙ্কে একশোর মধ্যে একশো পেয়েছিল।’

অনেকে আত্মরক্ষার জন্যে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অথবা পুলিশের জেরায় জর্জর হয়ে মিথ্যা কথা বলে। রাতে দেরি করে বাড়ি ফিরে স্ত্রীর কাছে মিথ্যা কারণ দেখানোরও অনেকের প্রয়োজন পড়ে।

ইস্কুলের ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রী মিথ্যা কথা বলবে কিংবা অফিসে বড়বাবুর কাছে কনিষ্ঠ সহায়ক অসত্য অজুহাত দেবে দেরিতে আসার, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। বাড়ির কাজের লোকটি বাজার করে এসে সত্যি হিসেব দেবে কিংবা থানায় ভাড়াটের বিরুদ্ধে এজাহারে বাড়িঅলা সম্পূর্ণ সত্য বিবৃতি দেবে, এ রকম আশা করাও অন্যায়।

এগুলোর তবু কার্যকারণ আছে। এসব মিথ্যা-ভাষণের প্রয়োজন বোঝা কঠিন নয় এবং যে মিথ্যা বলছে তার কাছে এর প্রয়োজনও রয়েছে।

কিন্তু এর বাইরে এক ধরনের প্রয়োজনহীন মিথ্যা কথা আছে। মিথ্যা কথা বলার আনন্দেই সেই কথা। তার মধ্যে কোনও উদ্দেশ্য নেই, কারণ বা প্রয়োজনও নেই। মনের আনন্দে, নির্দ্বিধায় উলটো-পালটা, বাঁয়ে-ডাইনে মিথ্যা কথা বলা অনেকের স্বভাব, এবং বলতে না পারলে এরা দম বন্ধ হয়ে পেট ফেটে মরে যাওয়ার অবস্থায় পৌঁছে যায়।

বলা বাহুল্য, ছবি আঁকা, কবিতা লেখা, টবে নীলমণি লতার চাষ করা কিংবা কালোজামের সিরাপ বানানোর মতো বহু লোকের হবি হল মিথ্যা কথা বলা। খারাপ মিথ্যা কথা নয়, নিরর্থক, অপ্রয়োজনীয়, সরল, নিস্পাপ মিথ্যা কথা বলা কারও হয়তো সব চেয়ে আনন্দের ব্যাপার।

সে হয়তো এমন কথা বলবে, যার কোনও মানে নেই, যাতে কারো কোনও ক্ষতি হবে না, তারও কোনও লাভ হবে না। সে হয়তো বলবে, সে একবার রামপুরহাটে স্টেশন মাস্টারের কোয়ার্টারের বাগানে হলুদ রঙের অপরাজিতা ফুল দেখেছিল। সে হয়তো বলবে, ‘কাল দুপুরে অমুক ব্যাঙ্কে যখন ডাকাতি হয়, আমি সেখানে চেক ভাঙাতে গিয়েছিলাম,’ তারপর সে সেই ডাকাতির এবং ডাকাতদের পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং লোমহর্ষক বিবরণ দেবে। কিন্তু তার সে বিবৃতি যদি কোনও কারণে পুলিশের কানে পৌঁছায় এবং পুলিশ সেই সূত্রে যদি তাকে জেরা করে, তা হলে মহা গোলমাল। কারণ সে সেই ব্যাঙ্ক মোটেই চেনে না, কস্মিনকালে তার চত্বরে সে পদার্পণ করেনি, এবার তা ছাড়া কাল দুপুরে সে গিয়েছিল মেয়ের সঙ্গে মেয়ের ইস্কুলে মাধ্যমিকের অ্যাডমিট কার্ড আনতে।

তা যাই হোক, এ ধরনের মিথ্যা কথায় আমাদের কারও কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়। গল্প, উপন্যাস, রূপকথা সবই অল্পবিস্তর এ জাতের। সত্য মিথ্যায় মিশিয়ে অলীকবাবুর অলৌকিক কলমে যা সাহিত্যিকেরা লেখেন তা মিথ্যা নয়, সত্যিও নয়।

শুধু তাই নয়।

‘সদা সত্য কথা বলিবে’ এই মহৎ উপদেশবাক্য সদা সর্বদা গ্রাহ্য নয়। প্রকৃত জ্ঞানীরা বলেছেন, অপ্রিয় সত্য বলবে না। হয়তো জ্ঞানীদের রুচি ও বিবেকে বেধেছিল, তাই তাঁরা সরাসরি বলতে পারেননি, ‘প্রিয় মিথ্যাকথা বলো।’

বিদেশি প্রবাদ আছে, যে মিথ্যাকথা কাউকে সান্ত্বনা দেয়, সুখী করে সে অনেক ভাল যে সত্যকথা কাউকে আহত করে আঘাত করে তার চেয়ে।

এসব তত্ত্বকথা আপাতত থাক। একটা স্বর্গীয় গল্প বলে এ যাত্রা শেষ করি।

একটি সরল প্রকৃতির বালক তার মাকে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘মা, স্বর্গে কোনও মিথ্যেবাদী আছে?’ প্রচণ্ড নীতিপরায়ণা মা বললেন, ‘অসম্ভব।’

বালকটি তবুও মাতৃদেবীর কাছে আরও জানতে চাইল, ‘মা, স্বর্গে কোনও মিথ্যেবাদী যেতে পারে?’

মা এবার খুব চটে গেলেন, রেগে বললেন, ‘বলছি না, তা সম্ভব নয়। কোনও মিথ্যেবাদী কোনওদিন স্বর্গে যায়নি, যাবে না, যেতে পারবে না।’

খোকা তখন বলল, ‘মা, তা হলে স্বর্গে তো বড় কষ্টের জীবন হবে।’

মাতৃদেবী বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘কেন? স্বর্গে কষ্ট কীসের?’

খোকা সরলভাবে জিজ্ঞাসা করল, ‘স্বর্গে কার সঙ্গে খেলা করব? কার সঙ্গে গল্প করব?’

খোকার মা অতঃপর কিছু বলার আগেই খোকা নিজেই গুছিয়ে বলল, ‘স্বর্গে তো ভগবান ছাড়া বড় জোর ওই তোমাদের মহাত্মা গান্ধী আর রামকৃষ্ণদেব থাকবেন, সেখানে কার সঙ্গে গল্প করব, কার সঙ্গে খেলা করব?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *