2 of 8

ও চাঁদা চোখের জলে

ও চাঁদা চোখের জলে

চাঁদা আদায়ের সবচেয়ে ধূম পড়ে যায় শারদীয়া পুজোর সময়। অবশ্য যারা চাঁদা তোলার তারা বছরের সব সময়েই চাঁদা তোলে। গৃহস্থের দরজায় দরজায়, রাস্তার মোড়ে মোড়ে, বাজারে, দোকানে, ফুটপাথে এমন কী হাইওয়ের রাস্তায় চলন্ত গাড়ি থামিয়ে অক্লান্ত প্রয়াস চলে সারা বছর ধরে চাঁদা আদায়ের।

কখনও চাঁদা সরস্বতী পুজোর জন্যে, কখনও মা শীতলা বা ওলাবিবির নামে, আবার কখনও কাল্পনিক বিদ্যালয় কিংবা অস্তিত্ববিহীন সাধারণ পাঠাগারের নামে তোলা হয় চাঁদা। তবে প্রকৃত চাঁদার মরশুম হল শরৎকাল।

চাঁদা আদায়ের ভাষা ও ভঙ্গি সর্বত্র কিন্তু একরকম নয়। কোথাও অনুনয়-বিনয়, ‘বউদি, আর দুটো টাকা দিন, বাজারের অবস্থা বুঝছেন না’ আবার কোথাও বা চোখ রাঙানি, ‘দেবেন কি দেবেন না ফর্সা করে বলে দিন, তারপরে দেখা যাবে’ আবার কখনও এর থেকেও কয়েক মাত্রা উপরে বাঁশ দিয়ে গাড়ি আটকিয়ে কিংবা ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে চাদার টাকা সংগ্রহ।

এই চাঁদা, এ হল আবশ্যিক চাঁদা। ইচ্ছায় অনিচ্ছায়, সুখে-দুঃখে দিতেই হবে। তবে, অনেক চাঁদা আছে যেমন, ক্লাবের চাঁদা, লাইব্রেরির চাঁদা, দরিদ্র-বান্ধব ভাণ্ডার অথবা স্বাধীনতা সংগ্রামী সমিতির বাৎসরিক অনুদান সেসব দেওয়া না দেওয়া অনেকটা স্বেচ্ছার ব্যাপার; ইচ্ছা না হলে, অসুবিধে হলে না দিলেও চলে।

বাংলা অভিধানে চাঁদা শব্দের অর্থ লেখা আছে, ‘কোনও বিশেষ কার্য নির্বাহার্থে বহুজনের নিকট হইতে সংগৃহীত অর্থ। উদাহরণ, ‘বারোয়ারি পুজোর চাঁদা।’ এ ছাড়াও চাদা অর্থে বলা আছে, ‘নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে দেয় মূল্য বা অর্থসাহায্য’, যেমন, ‘মাসিক পত্রের চাঁদা।’

প্রচলিত অভিধান অনুসারে চাঁদা শব্দটি এসেছে ফারসি চন্দ্‌ শব্দ থেকে। এ বিষয়ে অবশ্য সন্দেহের অবকাশ আছে। অন্যদিকে একটি পুরনো অভিধানে চাঁদা শব্দটিকে দেখানো হয়েছে প্রচলিত বাংলা শব্দ হিসেবে।

এই সূত্রে একটি প্রাচীন গ্রন্থের উল্লেখ করছি। পণ্ডিত ঈশানচন্দ্র ঘোষের আশ্চর্য বাংলা অনুবাদে সে বই অনেকেই পড়েছেন। বুদ্ধদেবের পূর্বজন্ম সংক্রান্ত বৌদ্ধ-কাহিনী গ্রন্থ ‘জাতক’ প্রায় আরব্য উপন্যাসের মতোই চমকপ্রদ।

জাতকে ‘ছন্দক’ বলে একটি শব্দ আছে, ছন্দক শব্দের অর্থ হল, ইচ্ছাপূর্বক যাহা দেয়।

পারস্যের চন্দ্ এবং ভারতবর্ষের ছন্দক মূলত একই শব্দ কিনা শ্রদ্ধেয় সুকুমার সেন হয়তো এ বিষয়ে আলোচনা করতে পারবেন কিন্তু কেউ যদি বলে বাংলা চাঁদা শব্দটি অর্ধ-তৎসম বা তদ্ভব তাকে যুক্তি দিয়ে ঠেকানো কঠিন হবে।

অয়ি চপলমতি পাঠিকা, ওগো স্থিরচিত্ত পাঠক, এই হাস্যকর লেখকের রচনা পড়তে গিয়ে তোমরা এত জ্ঞানগর্ভ বিপাকে পড়বে জানলে হয়তো সাবানের বিজ্ঞাপন বা দুরদর্শনের হিন্দি সংবাদের মতো এই নিবন্ধটি সরাসরি টপকিয়ে যেতে। সুতরাং আপাতত তোমাদের জন্যেই একটি চাঁদা সংক্রান্ত গল্প বলে নিই।

পাড়ার ছেলেরা গেছে রমেশবাবুর বাড়িতে চাঁদা তুলতে, দুর্গাপুজোর চাঁদা। রমেশবাবুর ধনী হিসেবে খ্যাতি আছে। কিন্তু তাঁর ততোধিক খ্যাতি কৃপণ হিসেবে।

ছেলেরা রমেশবাবুকে ভালই চেনে, রমেশবাবুও ছেলেদের চেনেন। ছেলেরা চেপে ধরল, ‘স্যার, এবার পুজোয় আপনাকে অন্তত পাঁচশো এক টাকা দিতেই হবে।’

নিজের বাড়ির বারান্দায় কোলাপসিবল গেটের নিরাপদ ব্যবধানে ইজিচেয়ারে বসে রমেশবাবু ছেলেদের আবদার খুব মনোনিবেশ সহকারে শুনলেন, তারপর ইজিচেয়ারে উঠে বসে বললেন, ‘তোমরা তো জানো আমার মা আমার ছোট ভাইয়ের কাছে থাকতেন। আমার সেই ছোট ভাই যে কারখানায় কাজ করত সে কারখানা আজ আটমাস লক-আউট। আমার ছোট ভাই চেয়ার-টেবিল, বাসনপত্র বিক্রি করে এ কয়মাস চালাল। এখন আর তাও নেই। আমার মা তার ওখানে এখন প্রায় অনাহারে রয়েছে।’

রমেশবাবু এই ঘটনাটা বলে একটু থামলেন, তারপর বললেন, ‘এদিকে আমার বড়দা যক্ষ্মারোগে হাসপাতালে আজ দেড় বছর। এক পয়সার সংগতি নেই, ওষুধ-পথ্য কিছুই কিনতে পারছে না। হাসপাতালের টাকাও দিতে পারেনি। তাকে হাসপাতাল থেকে বার করে দিয়েছে। সে হাসপাতালের সিঁড়ির নীচে ধুঁকছে আর অসহায়ভাবে মৃত্যুর দিন গুনছে।’

ছেলেরা চাঁদার কথা বিস্মৃত হয়ে রমেশবাবুর কথা হতভম্ব হয়ে শুনছিল; রমেশবাবুর বক্তব্য অবশ্য এখনও শেষ হয়নি। তিনি আরও বললেন, ‘আর আমার ভাগনে, একমাত্র ভাগনে রনটু, একই বোনের একই ছেলে, সেই রনটু তার অফিসের তহবিল তছরূপ করেছে। গত সপ্তাহে এসে বলছে, “মামা, আপাতত যদি পাঁচশো টাকাও ফেরত দিই, তা হলে বড়বাবু বলেছেন পুলিশে দেবেন না, না হলে জেল খাটতে হবে। অন্তত পাঁচশো টাকা তুমি আমাকে দাও,” অনেক কাকুতি-মিনতি করল রনটু।’

এতটা বলার পর দম নেওয়ার জন্যে থামলেন রমেশবাবু, তারপর বললেন, ‘দ্যাখো ছোকরার দল, আমার ছোট ভাই, বড়দা আর ভাগনের কথা শুনলে তো, খোঁজ নিয়ে দ্যাখো এদের কাউকে আমি একটি পয়সাও দিয়েছি কিনা। দেখবে এদের কাউকে কিছুই দেইনি। তা হলে তোমরা আমার কাছে টাকা আশা করো কী করে?’

আধুনিককালের এই উদ্ভট উপাখ্যানের পরে এবার প্রাচীনকালের কথায় যাই।

যাঁরা ভাবেন চাঁদা একটা আধুনিক উৎপাত, আগে এ রকম ছিল না, তাঁরা ভুল ভাবেন। সব যুগে, সব কালে, সব জায়গায় চাঁদার উপদ্রব ছিল।

সুপ্রাচীন জাতক কাহিনীতে দেখা যায় যে, জগতের সমস্ত অধিবাসী চাঁদা তুলে দানের বা উৎসবের ব্যবস্থা করতেন। ১৬৩ সুসীম জাতকে দেখা যায় যে এই চাঁদা নিয়ে রীতিমতো বাদ-বিসম্বাদ হত। চাঁদা দ্বারা ক্রীতদ্রব্য তীর্থযাত্রীদের দেওয়া হবে নাকি বৌদ্ধ ভিক্ষুসঙ্ঘকে দেওয়া হবে তাই নিয়ে কলহ। অবশেষে সর্বসাধারণের মত নিয়ে দেখা গেল ভিক্ষুসঙ্ঘকে দান করাই অধিকাংশ লোকের ইচ্ছা।

শুধু সুসীম জাতক কেন, অন্য জাতকেও যেমন ২২১ কাষায় জাতকে চাঁদার কথা রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, যে, চাঁদা দান নির্বাহ করা হয়।

অবশ্য সেই জাতকের যুগ থেকে এ যাবৎ চাঁদা তোলার কায়দা ও ভঙ্গিমা অনেক পালটেছে। এই তো গত বছর দক্ষিণ কলকাতার একটি পুজো মণ্ডপের বাইরে চাঁদার খাতা হাতে কয়েকটি যুবক দাঁড়িয়ে সবাইকে বলছে, ‘পঙ্গু যুবকদের এই শারদীয়া পুজোয় যথাসাধ্য সাহায্য করুন।’ যারা চাঁদা তুলছিলেন তাদের কাউকে দেখে আপাতদৃষ্টিতে পঙ্গু মনে হল না। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কে পঙ্গু? কোথায় সেই পঙ্গু যুবকেরা যারা এই পুজো করছে?’ যুবকেরা মৃদু হেসে বলল, ‘আমরাই পঙ্গু’। আমি অবাক হয়ে তাকাতে সামনের যুবকটি তার পাঞ্জাবির পকেট দুটো উলটিয়ে দেখাল যে একদম ফাঁকা, তারপর বুঝিয়ে বলল, ‘বুঝলেন দাদা, পঙ্গু, মানে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু।’

চাঁদা কিন্তু খুশিমনে কেউই কখনও দেন না। একথা চাঁদা আদায়কারীরাও জানেন। অনে নানা কায়দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। বলেন, ‘সামনের শনিবার এসো,’ ‘গত বছরের রসিদ বই নিয়ে এসো’ ‘আমি মণ্ডপে দিয়ে আসব’ ইত্যাদি ইত্যাদি। চাঁদা আদায়কারীরা জানেন এসবই ঘোরানোর এবং অবশেষে একেবারে না দেওয়ার ফিকির।

তবে ফিকিরে সবসময় কাজ হয় না। এক পাড়ায় শুধু দুর্গাপুজোয় চাঁদা দিলে চলবে না, পুজোর সঙ্গে যাত্রা হচ্ছে, সেই যাত্রাগানের টিকিটও কাটতে হবে। টিকিট নিয়ে উদ্যোক্তারা এসেছে, গৃহস্থ বললেন, ‘ওইদিন সন্ধ্যায় যে আমি অন্য জায়গায় থাকব। আমার জরুরি দরকার আছে। তোমাদের যাত্রায় তো আমি থাকতে পারব না। তবে, আমার মন পড়ে থাকবে তোমাদের আসরেই।’ উদ্যোক্তারা বললেন, ‘তা হলেই হল। আপনাকে সশরীরে না থাকলেও হবে, শুধু আপনার মন কয় টাকার সিটে থাকবে, দশ টাকার না পনেরো টাকার, সেটা বলে দিন, টিকিটটা রেখে দিয়ে যাচ্ছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *