2 of 8

রুপোলি পর্দার অন্তরালে

রুপোলি পর্দার অন্তরালে

এ গল্পটা পুরনো বিলিতি জোকবুকে আছে। প্রাতঃস্মরণীয় শিবরাম চক্রবর্তী তাঁর হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন ভাতৃদ্বয়ের বিখ্যাত কাহিনীমালার এক আখ্যানে চমৎকারভাবে পরিবেশন করেছিলেন এই গল্প।

গল্পের ঘটনাটা এ রকম।

একদা এক সরল প্রকৃতির মফস্বলি ভদ্রলোক শহরের প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখতে এসেছেন। তিনি হলের বাইরের কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে হলের দরজায় গেলেন, তারপর সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এসে সেই কাউন্টার থেকে আরেকখানা টিকিট কেটে হলের দরজার দিকে ছুটে গেলেন।

আবার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত প্রত্যাবর্তন, আবার আরেকটি টিকিট ক্রয়, তারপর হলের দরজায় দৌড়। আবারও ভদ্রলোক ঘামতে ঘামতে ফিরে এলেন।

বার কয়েক এইরকম টিকিট ক্রয়, দৌড় এবং দ্রুত দৌড়ে প্রত্যাবর্তন লক্ষ করার পর কাউন্টারে যে ভদ্রলোক টিকিট বেচছিলেন তিনি একটু সচেতন হলেন। প্রথম দুয়েকবার তিনি ব্যাপারটাকে খেয়াল করেননি, তারপর তিনি ধরে নিয়েছেন হয়তো গেটে চেনাশোনা আপনজন কারও সঙ্গে দেখা হয়েছে ভদ্রলোকের, তাই আবার টিকিট কিনতে এসেছেন।

কিন্তু বার বার, বেশ কয়েকবার একই নাটকের একই দৃশ্যের পুনরাভিনয় দেখে কাউন্টার-ক্লার্ক ভদ্রলোকের কেমন খটকা লাগে, তিনি পঞ্চমবার টিকিট কেনার সময় দ্রুত ধাবমান ক্রেতাকে বললেন, ‘দাদা, আপনার যে-ক’টা টিকিট দরকার একবারে কিনে নিন, বারবার ছুটে ছুটে আসছেন কেন?’

দাদা হাঁফাতে হাঁফাতে কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে একটু দম নিয়ে তারপর বললেন, ‘আমার তো দরকার মাত্র একটা টিকিটের। আমি একাই সিনেমা দেখতে এসেছি।’

কাউন্টার-ক্লার্ক বললেন, ‘তবে?’

দাদা বললেন, ‘তবে আর কী? কোথা থেকে একটা খ্যাপা লোক গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যেই টিকিট নিয়ে হলে ঢুকতে যাচ্ছি সে লোকটা টিকিট ছিঁড়ে দু’টুকরো করে ফেলছে। আর আমি সঙ্গে সঙ্গে ফেরত আসছি আরেকটা টিকিট কিনতে।

এরপর পকেট থেকে একটা রুমাল বার করে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে দাদা বললেন, ‘এত ঝামেলা জানলে আমি সিনেমা দেখতে আসতুম?’

সিনেমা সংক্রান্ত দ্বিতীয় গল্পটি পুরোপুরি সত্য ঘটনা অবলম্বনে।

একটি সিনেমা হলে নাইটশো ভেঙেছে, তা রাত প্রায় বারোটা হবে। সিনেমা ভেঙে দর্শকেরা বাইরে এসে দেখেন, ভীষণ দুর্যোগ, জল-ঝড় চলছে। রাস্তায় কোমর সমান জল জমে গেছে এর মধ্যেই। এদিকে বৃষ্টি থামার কিংবা ঝড় কমার কোনও লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না।

দশর্করা হল থেকে বেরতে পারছেন না আর সেই জন্যে হলের ম্যানেজারবাবুও হল বন্ধ করতে পারছেন না। কিন্তু ম্যানেজারবাবু ভদ্রলোক, যখন দেখলেন যে দর্শকদের হল ছেড়ে চলে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই, তিনি সবাইকে অনুরোধ করলেন, ‘আপনারা কষ্ট করে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। বৃষ্টি সহজে ধরে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। আপনারা বরং যে যার সিটে গিয়ে বসুন। আমি না হয় সিনেমাটা আরেকবার দেখাই।’

ম্যানেজার সাহেবের এই নির্দোষ এবং সরল প্রস্তাব মন্ত্রের মতো কাজ করল। সহসা দুর্যোগ তুচ্ছ করে সমস্ত দর্শক ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে রাস্তায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এই সিনেমা দ্বিতীয়বার দেখা অসম্ভব, তার চেয়ে যদি ঝড়-বাদলে নিউমোনিয়া হয় কিংবা জলে ডোবা রাজপথে খানাখন্দে পড়েন সেও ঠিক আছে তবু এ সিনেমা আবার নয়, কিছুতেই নয়। উদভ্রান্ত হয়ে পাগলের মতো দর্শকেরা ম্যানেজারবাবুর প্রস্তাব শোনামাত্র হুড়োহুড়ি করে দুর্যোগের রাস্তায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন, মুহূর্তের মধ্যে হল শূন্য হয়ে গেল।

আমাদের ছোটবেলায় সিনেমা দেখেনি এমন লোকের সংখ্যা কম ছিল না, বিশেষ করে সেই সুদূর মফস্বলে যেখানে আমাদের শৈশব কেটেছিল। সিনেমা দেখতে ভয় পেত এমন লোকের সংখ্যা যথেষ্ট ছিল। পর্দায় চলন্ত ট্রেনের দ্রুত এগিয়ে আসা কিংবা টারজানের গল্পে বন্যপশুর ক্রুদ্ধ গর্জন কত নিরীহ দর্শককে যে বিচলিত করেছে, তার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে তা আর কহতব্য নয়।

মেট্রো গোল্ডউইন মায়ারের বইয়ের শুরুতেই সেই গর্জনোদ্যত সিংহের মুখব্যাদান দেখে আসল ছবি ফেলে রেখে কত দর্শক যে চম্পট দিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই।

তবু এতদিনে সিনেমা আমাদের ঘরের ভিতরের ঘরে, অন্তরের ভিতরের অন্তরে প্রবেশ করে গেছে। দেবতার অষ্টোত্তর শত নামের মতো এখন তারও অসংখ্য নাম। সেই আদি যুগের বায়োস্কোপ, টকি থেকে শুরু করে সিনেমা, চলচ্চিত্র, ছবি, বই, শো এবং সর্বশেষে যোগ হয়েছে ঘরোয়া ভিডিয়ো, সে একেবারে শোয়ার ঘরে বিছানার পাশে এসে গেছে।

সুতরাং সিনেমা নিয়ে সাবধানে রসিকতা করতে হবে। তাই এবার আমার নিজের নয়, একটি মার্কিনি রসিকতা করি।

হলে একটা মারমার কাটকাট ছবি চলছে। সমস্ত হলে তিল ধারণের জায়গা নেই, সব সিট ভর্তি। শুধু একটা রোতে দেখা গেল এক ভদ্রমহিলার পাশের একটা সিট খালি।

ভদ্রমহিলার আরেক পাশে এক ভদ্রলোক বসে আছেন, তাঁর সঙ্গে এ মহিলার কোনও পরিচয় নেই। সে যা হোক ইন্টারভ্যালের সময় প্রায় উপযাচক হয়ে ওই ভদ্রলোক ভদ্রমহিলাকে বললেন, ‘দেখুন তো কী অপচয়, হাজার হাজার লোক টিকিট না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে, আর এ সিটটা খালি পড়ে রয়েছে। যে কিনেছে সে শুধু শুধু টিকিটটা নষ্ট করল।’

এই আলাপে ভদ্রমহিলা জানালেন, ‘এই সিটটার টিকিট আমার স্বামীর জন্য কেনা হয়েছিল।’ শুনে সেই কৌতূহলী ভদ্রলোক স্বভাবতই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তিনি বুঝি কোনও কাজে আটকে গেছেন, তাই আসতে পারলেন না?’

ভদ্রমহিলা নির্বিকারভাবে বললেন, ‘আজ্ঞে ঠিক তা নয়। আমার স্বামী মারা গেছেন।’ প্রশ্নকারী ভদ্রলোক একটু ‘আহা-আহা’ করে তারপর বললেন, ‘কিন্তু তাঁর কিংবা আপনার বন্ধু-টন্ধু কেউ আসতে পারতেন।’

ভদ্রমহিলা আবার নির্বিকারভাবে বললেন, ‘তার উপায় নেই। তাঁরা সবাই আমার স্বামীকে কবর দিতে শোকযাত্রায় গেছেন। আমার স্বামী আজ দুপুরেই মারা গেলেন কিনা!’

এতক্ষণের এই যে গল্প কয়টি এসবই রুপোলি পর্দার সামনের গল্প। অবশেষে আমরা পর্দার অন্তরালের আখ্যানে যাচ্ছি।

প্রযোজক মহোদয় নায়ক নবীনকুমারকে বললেন, ‘দ্যাখো তুমি দেখতে ভাল, তোমার অভিনয়ও খারাপ নয় কিন্তু তুমি বড় দুশ্চরিত্র। তুমি যদি স্বভাব না বদলাও আমি তোমাকে নেবো না।’

নবীনকুমার অনুনয় করে বললেন, ‘স্যার আর কখনও খারাপ ব্যাপারে যাব না। আমার স্ত্রী ছাড়া আর কারো সঙ্গে আপনি আমাকে দেখতে পাবেন না।’

কিন্তু কয়েকদিনের মাথায় এক মহিলার সঙ্গে নবীনকুমার এক হোটেলের লাউঞ্জে প্রযোজকের মুখোমুখি পড়ে গেলেন। নবীনকুমার সুঅভিনেতা, তিনি প্রযোজকের কাছে ছুটে গিয়ে বললেন, ‘স্যার, আপনি ভুল বুঝবেন না। এ কোনও আজেবাজে মেয়েছেলে নয়, ইনি আমার স্ত্রী।’

রাগে ফেটে পড়লেন প্রযোজক, ‘কী বললে, তোমার স্ত্রী? বদমায়েস, রাস্কেল, জানো ইনি আমার স্ত্রী।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *