2 of 8

হায় ছবি

হায় ছবি

জন ওপি, আঠারো শতকের শেষের এবং উনিশ শতকের গোড়ার দিকের অসামান্য ইংরেজ চিত্রকর, বিখ্যাত হয়েছিলেন ঐতিহাসিক চিত্রমালা এঁকে। তাঁর তুলির ছোঁয়ায় ইতিহাসের পৃষ্ঠার মোক্ষম ঘটনাবলি উজ্জ্বল, জীবন্ত হয়ে উঠত। একদা তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘আপনার ছবি এত ঝলমল করে, এত জীবন্ত হয়ে ওঠে, আপনি ছবি আঁকার রঙের সঙ্গে কী মেশান?’ অহংকারী জন ওপি হেসে বলেছিলেন, ‘মাননীয় মহোদয়, আমি আমার ছবি আঁকার রঙের সঙ্গে আমার মাথার ঘিলু মেশাই।’

আমি নিজে বর্ণান্ধ বা রংকানা। হলুদ এবং সবুজের মধ্যে সবসময় পার্থক্য করতে পারি না অবশ্য ডাক্তারি মতে এটা নাকি খুব অস্বাভাবিক নয়। বর্ণান্ধের সংখ্যা নাকি অনেক, বহু বর্ণান্ধই আছে, যারা জানে না যে রঙের হেরফের, নীল-সবুজের ব্যতিক্রম তাদের চোখে ধরা পড়ে না।

আসলে কিন্তু রঙের হেরফের ধরা খুবই কঠিন কাজ। এক ভদ্রমহিলা তাঁর বাইরের বসবার ঘর রং করাচ্ছিলেন। তিনি কারিগরকে একটি বড় ফুলদানি দেখিয়ে নির্দেশ দিলেন, ‘ঠিক এইরকম রং হবে দেয়ালে। এই ফুলদানিটার সঙ্গে ম্যাচ করে, একদম মিলিয়ে। একটুও যেন এমন-তেমন না হয়।’

ফুলদানিটার রং ছিল এক রকমের আবছায়া স্বচ্ছ নীল, প্রায় আকাশি বলা চলে। কারিগর ভদ্রলোক রং মেলাতে গিয়ে পড়লেন বিপাকে। কত রকম যে রং কতবার মেশালেন, সাদা-নীল, নীল-সাদা, একটু বেগুনি আবার একটু সবুজ সবরকম মিশিয়ে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়লেন কিন্তু কিছুতেই ওই ফুলদানির গায়ের রঙের মতো রং তৈরি করতে পারলেন না।

অবশেষে উপায়ান্তর না দেখে কারিগর একটি অসাধু কাজ করলেন। যে রংটা শেষ পর্যন্ত বানিয়েছেন সেটা দিয়ে প্রথমে ফুলদানিটা রং করলেন, তারপর ওই ড্রইংরুমের দেয়াল। ঘটনাটা ভদ্রমহিলার অনুপস্থিতিতে ঘটল। যখন মহিলা ফিরে এলেন, তিনি দেয়ালে এবং ফুলদানিতে ম্যাচিংয়ের বাহার দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, কারচুপিটা ধরতে পারলেন না।

রঙের কথা আপাতত থাক। এবার আসল ছবিতে যাই, ছবির প্রদর্শনীতে।

একদা এক চিত্রসমালোচক তাঁর বান্ধবীকে নিয়ে একটি চিত্র প্রদর্শনীতে গিয়েছিলেন। যে ভদ্রলোকের ছবির প্রদর্শনী হচ্ছিল তিনি মনুষ্যমুখের কারিগর। খারাপ-ভাল কয়েক ডজন মানুষের পোর্ট্রেট তিনি ওই প্রদর্শনীতে দেখাচ্ছেন।

হলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে চিত্রসমালোচক তাঁর বান্ধবীর সঙ্গে অবশেষে এক প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন। বান্ধবী বেচারিনী ইতিপূর্বে ছবি-টবি বিশেষ কিছু দেখেননি। তা ছাড়া আজ একসঙ্গে এতগুলো বাঁদরমুখো, গোরুচোখো; কুকুরকপালী আধামানুষ চেহারার ছবি দেখে তিনি রীতিমতো আপসেট, বিপর্যস্ত। এবার প্রদর্শনীর প্রান্তে এসে দেখা শেষ হয়ে গেছে এই ভেবে ভদ্রমহিলা যেই সামনের দিকে হাঁফ ছেড়ে তাকিয়েছেন অমনিই চমকে উঠলেন, এতক্ষণ নিজেকে সামলে রেখেছিলেন, আর বরদাস্ত করতে পারলেন না, বেশ জোর গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘হরিবল! সহ্য করা অসম্ভব।’ সমালোচক চমকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন, কী হল?’

ভদ্রমহিলা, মানে উক্ত বান্ধবী, সামনের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে বললেন, ‘একবার ভাল করে দ্যাখো। এসব ছবির কোনও মাথামুণ্ডু আছে? এমন ছুঁচোর মতো চেহারা কোনওদিন কোনও মেয়েছেলের হয়?’

বান্ধবী-নির্দেশিত ছবিটির দিকে এক পলক তাকিয়ে চিত্রসমালোচক খুব নরম গলায় বললেন, ‘সখী, ভাল করে পর্যবেক্ষণ করো, ওটা কোনও হাতে আঁকা ছবি নয়, ওটা একটা দেয়াল-আয়না, ওতে একটা প্রতিচ্ছবি, তোমার।’

এরপর কী হয়েছিল সেকথা বলা কঠিন। কিন্তু উপরিউক্ত সমালোচক মহোদয় যদি পরিচ্ছন্ন লোক হতেন, তাহলে তাঁর বান্ধবীটিকে উপনিষদের ভাষায় বলতেন, ‘আত্মানাং বিদ্ধি। অয়ি ছুঁচোমুখি, নিজেকে জানো, নিজের ছায়াকে চিনতে শেখো।’

ইতিহাস-প্রসিদ্ধ (এবং কুখ্যাত) অলিভার ক্রমওয়েল তাঁর ব্যক্তিগত চিত্রকরকে, যিনি ক্রমওয়েলের ছবি আঁকতে এসেছিলেন, তাঁকে বলেছিলেন, ‘আমি যেমন, ঠিক তেমন আঁকো। তুমি যদি আমার ক্ষতচিহ্ন আর বলিরেখা বাদ দিয়ে আমাকে আঁকো, আমি তোমাকে এক পয়সাও দেব না।’

খারাপ হোক, ভাল হোক ক্রমওয়েল সাহেব বেশ বড় জাতের মানুষ ছিলেন। নিজের সম্পর্কে সকলের ধারণা এরকম পরিষ্কার থাকে না। নিজের মুখচ্ছবি সম্পর্কে অনেকেরই খুব উচ্চ ধারণা, আয়নার সামনে নানা কায়দায় মুখভঙ্গি করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিচ্ছে, আমাদের চেনাজানার মধ্যেই এমন মানুষ-মানুষীর সংখ্যা অনেক।

তা ছাড়া আরেকটা গোলমাল হল এই যে, নিজের প্রতিচ্ছবি সম্পর্কে অনেকেরই উচ্চাশা অপরিসীম। সবাই ছবি-আঁকিয়ে দিয়ে নিজের ছবি আঁকাতে পারে না। অবশ্য আজকাল বইমেলায় বা প্রদর্শনীতে দেখা যায় সামান্য পাঁচ বা দশ টাকা নিয়ে আর্টিস্ট মুখের ছবি আঁকাছেন সামনে মূর্তিমান বা মূর্তিমতীকে বসিয়ে।

সে যা হোক, হাতে আঁকা ছবি নয়, ফটোর ব্যাপারে গোলমাল হামেশাই হয়। কালীঘাট মন্দিরের পাশে ফটোর স্টুডিয়োতে যেখানে দু’-চার টাকা বেশি দিলেই ভাড়া করা চশমা দিয়ে বা চাদর কাঁধে ফেলে ফটো তোলা যায় সেখানে ঝগড়া হতে দেখেছি। যাঁর ফটো তিনি বলছেন, ‘এ কী কুৎসিত ছবি উঠেছে আমার, এ আমি নেব না।’ ফটোগ্রাফার গলা উচ্চগ্রামে তুলে বলছেন, ‘ফটো আবার কুৎসিত কী? যেমন চেহারা তেমন ফটো উঠবে তো?’

গোপাল ভাঁড়ের বইয়ে এ বিষয়ে চমৎকার গল্প আছে। গল্পটি বহুবিদিত এবং যতদূর মনে পড়ছে, আমিও আগে লিখেছি।

চিত্রকর পুত্রের গর্বিত পিতা তাঁর বন্ধুকে নিয়ে এসেছেন ছেলের আঁকা ছবি দেখাতে। একটা ছবি দেখিয়ে বললেন, ‘দেখছ আমার ছেলে কী সুন্দর বাঁদরের ছবি এঁকেছে। বাঁদরের মুখটা দেখছ কীরকম শয়তানিতে ভরা।’ পিতৃদেবকে হতবাক এবং পিতৃবন্ধুকে স্তম্ভিত করে দিয়ে চিত্রকর শ্রীমান বললেন, ‘না বাবা বাঁদর-টাঁদর নয়, এটা তোমার ছবি।’

অবশেষে ছবি সম্পর্কে আমার নিজের একটা চুড়ান্ত বোকামির ঘটনা বলি। অনেকদিন আগে আমার এক বন্ধুর চিত্রপ্রদর্শনীতে যাই। সেখানে একটি বর্ণাঢ্য ছবি দেখিয়ে বন্ধুটি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেমন দেখছ?’ আমি বললাম, ‘চমৎকার! দেখে জিবে জল আসছে।’

বন্ধুটি অবাক হলেন, বললেন, ‘ছবি দেখে কারো জিবে জল আসে কখনও এমন শুনিনি।’

আমি বললাম, ‘এমন সুন্দর ডিমের ওমলেটের ছবি দেখে জিবে জল আসবে না?’ বন্ধুটি অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘লোভী, এটা কোনও ওমলেটের ছবি নয়, এটা সূর্যাস্তের ছবি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *