2 of 8

রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথই তো লিখেছিলেন,

কোনোদিনও এত বুড়ো

হবো নাকো আমি,

হাসি তামাসারে যবে

কবো ছ্যাবলামি

ভয়ে ভয়ে এই উদ্ধৃতিটা দিলাম। উদ্ধৃতি দিতে গেলে মূল বই খুঁজে শুধু বানান বা শব্দ নয়, কমা-সেমিকোলন পর্যন্ত মিলিয়ে দেওয়া উচিত; কিন্তু জ্ঞানগম্যির মতো এই তরল দ্রুত লেখায় তার অবসর কোথায়। মাথায় কিংবা কলমে যা আসে, যা মনে পড়ে প্রাণের আনন্দে তরতর করে লিখে যাই। মেলানো বা সংশোধনের অবকাশ মেলে না। সুধী সাবধান ! এই তুচ্ছ রচনার ত্রুটি ধরবেন না।

ঝলমল করে একশো পঁচিশটা বছর পার হয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। একশো পঁচিশ বছর সোজা কথা নয়। আজ যদি কেউ কোনও ভালো বা বড় কোম্পানির একশো টাকার ডিবেঞ্চার কেনে পাঁচ বছরে সেটা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। এইভাবে বেড়ে গেলে একশো টাকা একশো পঁচিশ বছরে বহু কোটি টাকার অবিশ্বাস্য একটি অঙ্কে পরিণত হবে।

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অঙ্কের হিসেবে যাওয়া ঠিক হবে না, বরং হালকা আলোচনায় থাকাই নিরাপদ।

বলা বাহুল্য, শতবার্ষিকীর বছরে যে রকম উত্তেজনা, উন্মাদনা, সভাসমিতির ধুম পড়েছিল একশো পঁচিশ বছরে ঠিক তেমন দেখা গেল না। এর মানে অবশ্য এই নয় যে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব প্রতিপত্তি কমে গেছে, তা মোটেই নয়। কিন্তু সেই শতবার্ষিকীর বছরে সিনেমা-নাটক, গান-কবিতা, উৎসব-অনুষ্ঠান সব মিলিয়ে যে বৃহৎ কাণ্ড হয়েছিল এবার তা হল না।

মনে আছে, সে বছর উত্তর কলকাতায় এক ক্ষৌরকারের চুল কাটার সেলুনে সাইন বোর্ডের নীচে বিশাল ফেস্টুন টাঙানো হয়েছিল, ‘হেথায় সবারে হবে মিলিবারে আনত শিরে।’ রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কবিতার এই বহুমুখস্থ বাক্যটির এখানে চমৎকার অন্য অর্থ। অর্থটি অবশ্যই স্পষ্ট, ক্ষৌরকার মহোদয়ের কাঁচির নীচে সবাইকেই মাথা নিচু করে বসতে হবে চুল কাটার জন্যে, কারোর রক্ষা নেই।

শতবার্ষিকীর সময়কার একাধিক কৌতুককর গল্প শুনেছিলাম স্বর্গীয় অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের কাছে। অতুলনীয় বাচনভঙ্গি ছিল অচিন্ত্যকুমারের, আমার এই অক্ষম কথিকায় তার ছিটেফোঁটাও প্রকাশ পাবে না, তবু বলা যাক।

অচিন্ত্যকুমার আমন্ত্রিত হয়ে গেছেন এক সরকারি অফিসের রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসবে, সভাপতিত্ব করতে। বর্ণনা শুনে মনে হয়েছিল অফিসটা সম্ভবত নিউ সেক্রেটারিয়েট ভবনের সাততলায় কিংবা আটতলায়। গঙ্গার ধার ঘেঁষে পশ্চিম কিংবা উত্তরমুখী একটা ঘরে অনুষ্ঠানটি হচ্ছে।

অফিসেরই এক ভদ্রলোকের রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু। ভদ্রলোক হারমোনিয়ম টেনে নিয়ে রুমাল দিয়ে মুখ মুছে বেশ দরাজ গলায় গান ধরেছেন, ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রন।’ গান শুরু হতে দেখা গেল ভদ্রলোক শুধু একা নন তাঁর সঙ্গে কোরাসে গান ধরেছেন তাঁরই পিছনে বসা ওই অফিসারটি এবং আরও আট-দশ জন পুরুষ ও মহিলা।

ভালই গান জমেছে, একটা অফিসের অনুষ্ঠানের পক্ষে বেশ ভাল। সভাপতির আসনে বসে অচিন্ত্যকুমার মনোযোগ দিয়ে চোখ বুজে শুনছেন, কোরাস ‘বাজাই আমি বাঁশি’ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, হঠাৎ সমবেত আর্ত চিৎকার, ‘গেলো, গেলো, ধর, ধর’, চমকে চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন অচিন্ত্যকুমার। কী হল, কী হয়েছে কিছুই অনুমান করতে পারছেন না। সবিস্ময়ে দেখলেন ঘরের প্রত্যেকটি লোক জানলার কাছে দাঁড়িয়ে, ‘ওই, ওই, ওই যে, ওই যাচ্ছে,’ সবাই চেঁচাচ্ছে; আর এরই মধ্যে কয়েকজন দ্রুত ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে বাইরে সিঁড়ির দিকে যেখানে লিফট ওঠানামা করছে। লিফট দেরি হচ্ছে দেখে কয়েকজন সিঁড়ি দিয়েই পাগলের মতো ছুটে নেমে গেল।

কীসের কী ব্যাপার অচিন্ত্যকুমার কিছুই বুঝতে পারছেন না, তাঁর জিজ্ঞাসু মুখভঙ্গি দেখে তাঁরই পরিচিত এই অফিসেরই জনৈক টাইপিস্ট যে তাঁকে আজ নিয়ে এসেছে সে এসে অচিন্ত্যকুমারকে বলল, ‘গানটা উড়ে গেল।’ অচিন্ত্যকুমার যশস্বী লেখক হলেও পেশায় ছিলেন দক্ষ বিচারক। কিঞ্চিৎ জিজ্ঞাসাবাদের পর তিনি বুঝতে পারলেন, হারমোনিয়ামের উপরে একটি পেপার ওয়েট চাপা ছিল টুকরো কাগজে লেখা গানটি, হঠাৎ পাতা ওলটাতে গিয়ে কাগজটা ফ্যানের হাওয়ায় উড়ে জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেছে, গানটা কারো মুখস্থ নেই, তাই এত হইচই।

ইতিমধ্যে লিফট এবং সিঁড়িবাহিত সংগীতলিপি সন্ধানীরা ফিরে এসেছেন, তাঁদের কাছে জানা গেছে, ‘একদম উড়তে উড়তে মাঝগঙ্গায় গিয়ে পড়েছে।’

এর পরে সে গান আর হল না। সভাই আর তেমন জমল না। অচিন্ত্যকুমার সেখান থেকে একটু পরে বেরিয়ে এলেন, কাছেই আরেকটা অফিসে যেতে হবে, সেখানকার উদ্যোক্তারা অনেকক্ষণ ধরে বারান্দায় অপেক্ষা করছে।

পরের সভায় কিন্তু এ জাতীয় অঘটন কিছু ঘটল না। প্রথমে একটি মেয়ে গাইল ‘হারে রে রে রে।’ এর পরে আরেকটি মেয়ে, সেও ওই ‘হা রে রে রে রে…’, তারপরে আরেকজন, তারপরে, তারোপরে একে একে ক্রমাগত মহিলারা গাইতে লাগলেন, ‘হারে রে রে রে রে।’

দ্বাদশ গানের মাথায় দম নিতে অচিন্ত্যকুমার সামনের বারান্দায় গেলেন পায়চারি করতে, একজন উদ্যোক্তা উঠে এসে বললেন, ‘স্যার, গান ভালো হচ্ছে না ?’ অচিন্ত্যকুমার স্পষ্টই প্রশ্ন করলেন, ‘সবাই হারে রেরে গাইছে, আপনারা বলেননি তো সংগীত প্রতিযোগিতা।’ উদ্যোক্তা ভদ্রলোক তখন বুঝিয়ে বললেন, ‘না স্যার, প্রতিযোগিতা নয়। আমাদের অফিসে একটা নতুন মেয়ে এসেছে আজ তিন মাস, ওই যে মেয়েটা প্রথম গাইল, ওর মামার গানের ইস্কুল আছে, ও আসার পরে অফিসের অন্য মেয়েরা ওর কথা শুনে সেই ইস্কুলে ভর্তি হয়েছে। এখন পর্যন্ত সবাই ওই একটাই গান শিখেছে, ওই হারে রে রে রে রে।’

অচিন্ত্যকুমারের পর মহাত্মা শিবরাম চক্রবর্তী। শিবরাম চক্রবর্তীর হাতে আমরা মানুষ হয়েছি, আনন্দবাজারের পাতায় ‘অল্প বিস্তর’-এর কলমে আমাদের রসিকতার হাতেখড়ি।

শতবার্ষিকীর প্রাক্কালে এক অনুষ্ঠানের জন্যে শিবরাম চক্রবর্তীকে নিমন্ত্রণ করতে গেছি, আমার সঙ্গে সেদিন তেমন বেশি ঘনিষ্ঠ নয় এক বান্ধবী। দু’-চার কথার পর হঠাৎ শিবরাম আমাকে বললেন, ‘এ মেয়েটি তো চমৎকার। তুমি একে বিয়ে করছ না কেন।’ আমি এই প্রশ্নে দিশেহারা, কিন্তু আমার বান্ধবীটি প্রগলভা, তিনি শিবরামকে বললেন, ‘ওকে আমার পছন্দ নয়, আপনাকে বেশ লাগছে, আপনিই আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিন।’ চিরকুমার, চির সপ্রতিভ শিবরাম স্মিত হেসে বললেন, ‘কিন্তু ভাই, সে তো হবার নয়, আমি যাকে বিয়ে করব সে তো ঝরিয়ায় চলে গেছে।’ বান্ধবীটি অবাক হয়ে বললেন, ‘ঝরিয়া ?’ শিবরাম বললেন, ‘হ্যাঁ ভাই, ঠিক তাই। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন না, “ফাগুনের ফুল যায় ঝরিয়া”।’

অতঃপর শেষ কাহিনী। শেষ কাহিনীটি বোম্বাই মার্কা। কয়েক মাস আগে বোম্বাইয়ের একটি ফিল্ম স্টুডিয়োর ম্যানেজারের ঘরে দেখি রবীন্দ্রনাথের নানা বয়সের নানা ফটো। ভাটিয়া ভদ্রলোক এত রবীন্দ্রপ্রেমী দেখে খুব ভাল লাগল কিন্তু তিনি যা বললেন তা একটু অন্যরকম। সিনেমায় একেকরকম চরিত্রে একেকরকম দাড়ির জন্যে মেকআপ-ম্যানকে সঠিক নির্দেশ দিতে পারেন সেই জন্যেই কবিগুরুর এই নানা বয়সের ছবিগুলি টাঙানো হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ আমাদের এত কাজে লাগবেন তিনি নিজেই কি জানতেন ?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *