1 of 8

প্রসূতি সদন

প্রসূতি সদন

শ্রীমান কখগ আজ সকালেই পিতৃত্বের গৌরবান্বিত পদে উন্নীত হয়েছেন। তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী অআ কলকাতার একটি নার্সিংহোমে একটি সুস্থ সাড়ে আট পাউন্ড বলবান পুত্র-সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। প্রসূতি ও নবজাতক দু’জনেই চমৎকার। কোনও গোলমাল নেই। আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধবী বিকেল থেকে ভিড় করে শ্রীমতী অআকে এবং সদ্যোজাত শিশুপুত্রটিকে দেখতে এসেছে। রীতিমতো আনন্দ-উৎসব। একটু আগে সাতটা বাজতে নার্সিংহোমের বিদায় ঘন্টা বেজেছে। কিছুটা বিলম্বিত লয়ে হলেও সবাই ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেছে। প্রত্যেককে শ্রীমান কখগ মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছেন। শেষ দলটিকে ট্রামে তুলে দিয়ে সন্তর্পণে শ্রীমান কখগ নার্সিংহোমে ফিরে এসেছেন। তারপর সদর দরজায় দারোয়ানকে দুটি টাকা বকশিস দিয়ে দোতলায় শ্রীমতী অআ-র কেবিনে চলে এসেছেন। তারপর আবার দু’টাকা খরচ। রাতের আয়াকে বকশিস দিয়ে অনুরোধ করলেন বাচ্চাকে একটু নিয়ে আসতে।

বাচ্চাটি এল। শ্রীমতী অআ একটু কষ্ট করে খাটে হেলান দিয়ে বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে বসলেন। শার্টের পকেট থেকে বাজারের ফর্দের মতো একটা লম্বা তালিকা বার করলেন শ্রীমান কখগ। এরপরে আরম্ভ হল তালিকা মেলানো। একটি মনুষ্য-শিশুর শরীরের সমস্ত বিবরণ রয়েছে সেই তালিকায়। শ্রীমান একটি করে আইটেম বলেন আর শ্রীমতী সেটা মেলান, সঙ্গে সঙ্গে টিক পড়ে ফর্দে। মাথা এক, কান দুই, নাক এক, নাকের ফুটো দুই, চোখ দুই, মুখ এক, জিব এক। এইভাবে নামতে নামতে বাঁ হাত এক, বাঁ হাতে আঙুল পাঁচ, ডান হাত এক, ডান হাতে আঙুল পাঁচ। সর্বশেষে গোড়ালি দুই, চৌষট্টি দফায় এই ফর্দে আগাগোড়া যখন টিক পড়ল, শ্রীমান কখগ-শ্রীমতী অআ নিশ্চিন্ত হলেন, ‘না, সবই ঠিকঠাক মিলেছে। তাঁদের সন্তান পুরোপুরিই জন্মেছে। কোনও খুঁত-টুঁত নেই।’ একটা পাষাণভার নেমে গেল দু’জনারই বুক থেকে।

এই দুশ্চিন্তা কিন্তু কখগ-অআ দম্পতির নিজস্ব নয়। প্রতিটি দম্পতিরই অন্তত প্রথম সন্তানের বেলায় ভাবনা থাকে কেমন হবে, সব ঠিকঠাক হবে কিনা। তবে এ ব্যাপারে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নতুন বাবা নতুন মায়ের চেয়ে অনেক বেশি মাথা ঘামান। এবং সেই মাথা ঘামানো শুধু সন্তানকে নিয়ে নয়, সন্তানের মাকে নিয়েও।

ডাক্তার এবং হাসপাতালের কাছে সন্তানসম্ভবা মাতার চেয়ে সন্তানসম্ভব পিতা অনেক বেশি বিপজ্জনক। আজ থেকে প্রায় আঠারো বছর আগে আমার ছেলে জন্মানোর সময় চিত্তরঞ্জন সেবাসদনের ভারপ্রাপ্ত ডাক্তার আমাকে তাঁর চেম্বারে তালা দিয়ে আটকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। সদ্যোজাত অথবা সদ্যসম্ভব সন্তানের বাবা অত্যন্ত বিরক্তকারী প্রাণী। বহু সময়ে দেখা যায় যে-মহিলাটি সন্তান ধারণ করেছেন, তিনি মোটামুটি নির্বিকার; দাঁত চিপে, মুখ বন্ধ করে প্রাচীন যন্ত্রণা সহ্য করছেন। কিন্তু ভাবী পিতা অস্থির হয়ে দৌড়োদৗড়ি করছেন। একবার ডাক্তারকে, একবার নার্সকে, এমনকী অচেনা লোককে অস্থির করে দিচ্ছেন তাঁর কাল্পনিক এবং উদ্ভট সমস্ত জিজ্ঞাসা ও দুর্ভাবনা নিয়ে। ধাত্রীবিদ্যার এক বিখ্যাত মহিলা ডাক্তার আমাকে পরোক্ষে একদা বলেছিলেন যে প্রত্যেক প্রসূতি সদনের একতলায় একটি হাজত-ঘর করা উচিত, যেখানে ভাবী বাবাদের তাঁদের সন্তান না জন্মানো পর্যন্ত আটকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। তিনি অনুযোগ করেছিলেন, ‘বউয়ের স্টেচারের বা ট্রলির পিছু পিছু এরা লেবার রুমে পর্যন্ত ঢুকে যায়।’

এসব সমস্যা সন্তান জন্মানোর সময়কার। তার আগের সমস্যাগুলিও কিছু কম নয়। ওষুধ-পথ্য, আচার-কাসুন্দি, ভাল ডাক্তার, নির্ভরযোগ্য নার্সিংহোম—এসব সমস্যা তো আছেই; তার পরেও আছে সেই পুরনো প্রশ্ন, ছেলে না মেয়ে ?

মাঝে-মধ্যেই ফ্রান্স কিংবা কানাডা থেকে ডাক্তারি সংবাদ আসে পেটের বাচ্চা ছেলে না মেয়ে জানার খুব সহজ পন্থা আবিষ্কার হয়ে গেছে। রয়টারের পাঠানো তিন সেন্টিমিটার খবর। কিন্তু খবরটা নির্ভরযোগ্য নয়, কারণ খবরটা পুরনো অথবা বলা চলে পৌনঃপুনিক—‘আর চিন্তা নাই’ গোছের। ক্যানসারের ওষুধ আবিষ্কার হওয়ার মতো, একটা নিয়মিত ব্যবধানে ও রকম সংবাদ পাঠানো একটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তার চেয়ে খনার বচন ভাল। ফুলের নাম, মায়ের নাম, বাবার নাম সব গুণ কিংবা যোগ কিংবা বিয়োগ করে সোজাসুজি তিন দিয়ে ভাগ। ভাগফল দুই হলে ছেলে, এক হলে মেয়ে, আর শূন্য হলে সর্বনাশ।

এই সর্বনাশের কথায় মনে পড়ে যাচ্ছে সেই গোলমেলে গল্পটি। কফি হাউসে বসে কয়েকজন ভদ্রলোক গল্প করছিলেন। গল্পের বিষয়বস্তু অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুগম্ভীর, পণ্ডিতি ভাষায় বলা যায়, ‘ভাবী জাতকের উপরে মাতার মানসিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রভাব।’

একজন একটা আশ্চর্য ঘটনা বললেন। তাঁর শ্যালি পেটে বাচ্চা আসার পর “শ্যামদেশের যমজ” নামে একটা বই পড়ে খুব চমৎকৃত হয়েছিলেন এবং কী আশ্চর্য, পরশুদিন তার নিজেরই যমজ ছেলে হয়েছে।

দ্বিতীয় ভদ্রলোক প্রায় একইরকম কিন্তু অধিকতর বিস্ময়জনক কাহিনী শোনালেন। তাঁর এক প্রতিবেশিনী গর্ভবতী জীবনে “The Strange Stories of Triplets” অর্থাৎ একসঙ্গে তিনটি বাচ্চা জন্মানোর বিচিত্র গল্পমালা নামে একটি ইংরেজি বই পাঠ করেছিলেন, পরিণামে অবশেষে তাঁর তিনটি বাচ্চা জন্মেছে।

টেবিলের অপর প্রান্তে এক নিরীহ ভদ্রলোক এতক্ষণ উৎকণ্ঠার সঙ্গে এইসব কাহিনী শুনছিলেন। এই গল্পটি শোনার পরে তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বন্ধুরা বললেন, ‘কী হল, এত তাড়াতাড়ি উঠলে কেন ? রাত তো তেমন কিছু হয়নি। একটু বসে যাও।’ ভদ্রলোক বললেন, ‘না ভাই, আমার সর্বনাশ হয়েছে !’ সবাই জানতে চাইলেন, ‘কেন, কী সর্বনাশ হল ?’

ভদ্রলোক করুণ কণ্ঠে বললেন, ‘ভাই, আমার বউয়ের তো বাচ্চা হবে। সন্ধ্যাবেলা বাড়ি থেকে বেরনোর সময় দেখলাম সে বসে বসে “আলিবাবা ও চল্লিশ চোর” পড়ছে। দুই-তিন তবু ভাবা যায়, কিন্তু চল্লিশ চোর ? আমার কী হবে ?’ এই বলে সে নিরীহ বেচারি পাগলের মতো বাড়ির দিকে ছুটতে লাগলেন। হতভম্ব বন্ধুরা স্তব্ধ হয়ে তাঁর প্রস্থানপথের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

সাহেবরা সন্তান জন্মানোর পরে চুরুট বিলি করেন। চুরুটের মোড়কে লেখা থাকে—ইটস এ বয়, ইটস এ গার্ল। আমাদের বাল্যকালে মফস্বল শহরে দেখেছি শাঁখ বাজাতে। আমরা কতবার শাঁখ বাজানো হল গুণতাম। বোধহয় জোড় সংখ্যা বাজলে ছেলে আর বিজোড় সংখ্যায় মেয়ে, উলটোটাও হতে পারে। কোনদিক থেকে কোন বাড়ির শাঁখের আওয়াজ আসছে শুনে প্রবীণা গৃহিণীরা বুঝে ফেলতেন, ‘আহা, বিপিনের আবার মেয়ে হল।’

অতঃপর, অশৌচ, আটকড়াই, ছয় ষষ্ঠী ইত্যাদি নানা সংস্কার। ধোপা-নাপিতের কিঞ্চিৎ আয়। সম্ভবমতো প্রতিবেশীদের মিষ্টান্ন লাভ।

এসব পুরনো দিনের কথা। আজকাল শহুরে নার্সিংহোমে দারোয়ান, বেয়ারা, আয়াকে কিছু বকশিস দিয়েই মিটে যায়। এক সরকারি হাসপাতালে দেখেছিলাম, এক ভদ্রলোক প্রসূতি ও প্রসূতকে নিয়ে বেরতে গিয়ে হয়রান হয়ে পড়েছেন। সবাই বকশিস চাইছে। অবশেষে ভদ্রলোক হাত জোড় করে সবাইকে বললেন, ‘ভাইসব, এবার আর নয়। বউদিকে দেখে রাখুন। উনি এখানে বছর বছর আসবেন, আমিও আপনাদের বছর বছর বকশিস দেব।’

পুনশ্চ: একটু অপ্রাসঙ্গিক, তবু একটা উড়ো ঘটনার উল্লেখ করছি। একবার এক প্রসূতি সদনের ডাক্তারবাবুকে কথাচ্ছলে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘ডাক্তারি বিদ্যার এত শাখা থাকতে আপনি কেন এই সন্তান জন্মানোর নারী-ঘটিত ব্যাপারে এলেন, টাকার জন্যে ?’ ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘না, ঠিক তা নয়। দেখুন, ক্যানসারের রোগী দেখলে ভয় হত আমারও বুঝি ওরকম হয়েছে, টিবির রোগী কাশত, আমিও কাশতাম। যেখানে যে রোগীর যে রোগ দেখতাম মনে হত আমারও সে রোগ আছে। সব লক্ষণ মিলে যেত। অবশেষে এই মাতৃসদনে এসে নিশ্চিত হয়েছি—এই রোগ অন্তত আমার হবে না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *