1 of 8

ভাগ্যফল

ভাগ্যফল

এ গল্প অনেকদিন আগেকার। রবিবারের সকালবেলা উকিলবাবু তাঁর বাইরের ঘরে বসে মক্কেলদের কাজ সারছিলেন। এমন সময়ে এক জ্যোতিষীঠাকুর এলেন। সে আমলের জ্যোতিষীরা আজকের জ্যোতিষীদের মতো প্যান্ট-শার্ট বা ধুতি-পাঞ্জাবি পরতেন না। মাথায় টিকি, কপালে ফোঁটা, পরিধানে গেরুয়া বা রক্তাম্বর, হয়তো বা পায়ে কাঠের খড়ম, হাতে সিঁদুরমাখা তুলোট কাগজ। তাঁদের দেখলেই চেনা যেত। তারা কালেভদ্রে সংসারী মানুষদের দর্শন দিতেন। তাঁদের দেখা পেতে হলে নির্জন বটতলায় অথবা পোডোমন্দিরে অমাবস্যার সন্ধ্যাবেলায় অথবা গলির গলি তস্য গলিতে বেনারস শহরের গোলক-ধাঁধায় খোঁজ করতে হত। আজকালকার মতো যে কোনও গয়নার দোকানের দেড়তলার চেম্বারে ঢুকে গেলেই তাদের দর্শন পাওয়া যেত না।

সে কথা পরে বলছি, আগে এই গল্পটা বলি। উকিলবাবু জ্যোতিষীঠাকুরকে দেখে যথাসাধ্য সন্ত্রম প্রদর্শন করতে ইতস্তত করলেন না। এবং কিছুক্ষণ কথাবার্তা, কুশল বিনিময়ের পরে নিজের ডানহাতটি জ্যোতিষীর হাতে সমর্পণ করলেন। জ্যোতিষী তাঁর নামাবলির ঝোলা থেকে একটি আতস কাচ বার করে খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন।

অনেকক্ষণ দেখার পর জ্যোতিষীটি খুব নিম্ন কণ্ঠে যেন খুব গোপন কথা শোনাচ্ছেন এইভাবে বেশ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বললেন, ‘আপনার মাতাঠাকুরাণী গত শীতে মারা গেছেন।’ উকিলবাবু কিছু বললেন না, চুপ করে রইলেন। কিন্তু ততক্ষণে গণকঠাকুর উকিলবাবুর হাত দেখে তাঁর আদি-অন্ত, ভুত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান জেনে গেছেন, প্রায় স্বগতোক্তির মতো গড়গড় করে বলে যাচ্ছেন। ‘বড় মেয়েটির বিয়ে দিয়েছেন পশ্চিমে, শিগগিরই বাচ্চা হবে অথচ সপ্তাহ দুয়েক চিঠি পাননি, খুব চিন্তিত আছেন। আপনার গৃহিণীর শরীরটা আজ কিছুদিন হল ভাল যাচ্ছে না। আপনি নিজেও কয়েকদিন আগে আদালতের সিঁড়ির ওপরে হোঁচট খেয়ে বেশ কাহিল হয়েছিলেন, এখনও গোড়ালিতে ব্যথা আছে।’

উকিলবাবু একথার পর নিজের দু’পায়ের গোড়ালির দিকে তাকাতে লাগলেন, অপেক্ষা করতে লাগলেন গণকঠাকুরের অনিবার্য মন্তব্যের জন্যে। অবশেষে যখন গণকঠাকুর আসল কথায় এসে বললেন, ‘আপনার এখন সময় খারাপ যাচ্ছে। আপনার শনি আর রাহু…’, তখন উকিলবাবু একবার খুব জোরে কেশে উঠলেন। উকিলবাবু কাশি শুনে জ্যোতিষীঠাকুর বাধ্য হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কিছু ভুল বললাম?’ উকিলবাবুর কাশি থামিয়ে রীতিমতো বিস্মিত দৃষ্টিতে জ্যোতিষীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘না ঠিক ভুল নয়, তবে…!’ জ্যোতিষী বললেন, ‘তবে? অবশেষে উকিলবাবু পরিষ্কার করে বললেন, ‘দেখুন, কী আশ্চর্য! সবই ঠিকঠাক, খুবই মিলে গেছে। কিন্তু এগুলো একটাও আমার নয়।’ সন্ত্রস্ত জ্যোতিষীবাবু বললেন, ‘আপনার নয়, মানে?’ উকিলবাবু বললেন, ‘আপনার সমস্ত কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে কিন্তু সেটা হল এই গলিরই ওই মাথায় সাতান্ন নম্বর বাড়ির মহেশ উকিলের সম্পর্কে, আর আমার বাড়ির নম্বর সাতাশ এবং আমি হলাম মহিম উকিল।’

সব জ্যোতিষীই যে এ রকম আগেভাগে খোঁজখবর করে জেনে নিয়ে ভবিষ্য‌দ্‌বাণী করেন তা কিন্তু নয়। এঁরা অনেকেই তীক্ষ্ণ অনুমানের ওপরে নির্ভর করেন। একবার ট্রাম থেকে নামতে গিয়ে চোট খেয়েছিলাম, এক শৌখিন জ্যোতিষী আমাকে বলেছিলেন, ‘বাঁ দিকের দরজা দিয়ে নামতে গিয়ে?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, তাই।’ ভদ্রলোক অনেকক্ষণ আমার দু’হাত উলটে-পালটে দেখে চলন্ত যানের বাঁদিকের দরজা সম্পর্কে সাবধান করে দিয়ে গেলেন। ভদ্রলোক চলে যাওয়ার পর মুহূর্তে আমার খেয়াল হল, ট্রাম গাড়ির ডানদিকে কোনও দরজা নেই, কোনও কালে ছিল না। সব দরজাই বাঁদিকে এবং এর জন্যে কোনও জ্যোতিষ বিচার দরকার পড়ে না।

অসংখ্য বাঙালির নাম ইংরেজি ‘এস’ অক্ষর দিয়ে আরম্ভ। সুতরাং কোনও জ্যোতিষী যদি আপনার ললাট কিংবা কররেখা নিদেনপক্ষে রাশি-নক্ষত্র গভীরভাবে বিবেচনা করে বলেন, আপনার জনৈক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর নাম ‘এস’ দিয়ে আরম্ভ কিংবা ‘এস’ আদ্যক্ষর দিয়ে নাম-বিশিষ্ট আপনার একজন শত্রু আছে, তা হলে চমকিত বা বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।

তেমনই আপনার বয়েস যদি চল্লিশ পঞ্চাশ, জন্ম হয়ে থাকে বাংলাদেশের মফস্বলে, তা হলে আপনার সম্পর্কে অনায়াসে দুটি অতীতবাণী করা সম্ভব। এক, আপনি অল্প বয়েসে ভীষণ জ্বরে ভুগেছেন, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড কিংবা সান্নিপাতিক। দুই হল, একবার আপনি জলে ডুবে প্রায় মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছেন।

আর মধ্যবয়সিনী পাঠিকা, আপনি যে বিয়ের আগে একবার প্রথম যৌবনে প্রেমে পড়েছিলেন, সেই প্রেমিক যে আপনার পাশের বাড়িতেই থাকতেন, চিকন, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা ছিল তার; আপনার উষ্ণ করতল হাতে ধরার আগেই একথা রয়ে-সয়ে বলে দেওয়া যায়, দশজনের মধ্যে নয়জনের ক্ষেত্রে মিলবেই।

জ্যোতিষীর সংখ্যা খুব বেড়ে গেছে ইদানীং। প্রত্যেক আড্ডায়, প্রত্যেক অফিসে এক বা একাধিক ভবিষ্যদ্‌দ্রষ্টা। এ ছাড়া প্রতিটি পাড়ায়, প্রতিটি গলিতে আছেন একজন করে লোক্যাল জ্যোতিষী। অনেক সময়েই দেখা যায় দু’জন জ্যোতিষী মুখোমুখি বসে পরস্পর পরস্পরের ঠিকুজি বিচার করছেন। এই বিচারের ফলাফল উভয় ক্ষেত্রেই প্রায় একই রকম অর্থাৎ এখন সময়টা খুব ভাল যাচ্ছে না, তবে সামনে বছরখানেক বছর দেড়েকের মাথায় ভাল সময় আসছে আর সব যদি ঠিকঠাক যায় তিন বছরের মধ্যে ভাগ্য তুঙ্গে।

অধিকাংশ লোকেরই, বিশেষ করে যখন একজন ভাগ্য নিয়ে মাথা ঘামায়, ধারণা যে তার বর্তমান সময়টা ভাল যাচ্ছে না এবং সে অদূর ভবিষ্যতের গোলাপি সুদিনের স্বপ্ন দেখে। তিরিশ বছরের কোনও কেরানিকে যদি বলেন যে সে ষাট বছরে রাজা হবে, সে যতটা খুশি হবে তার চেয়ে যদি বলা হয় যে সে চৌত্রিশ বছর বয়েসে বড়বাবু হবে তা হলে সে অনেক বেশি খুশি হবে। হাত দেখেই হোক বা ঠিকুজি দেখেই হোক সমস্ত গণৎকারই শেষ পর্যন্ত যা বলেন তার সারমর্ম হল বাল্যকালে মৃত্যুযোগের থেকে রক্ষা, প্রথম যৌবনে ব্যর্থ প্রেম, এখন সময়টা তেমন ভাল নয়, সামনে কয়েকটা ফাঁড়া, দুটো বাধা, তিনজন শত্ৰু, তবে ভাল দিন এল বলে।

অনেক সময় শোনা যায় হাত দেখে বা মুখ দেখে কোনও জ্যোতিষী নাকি জন্মসময় ও তারিখ বলে দিতে পারেন, এ ব্যাপারটি আমি কখনও যাচাই করে দেখিনি। তবে এই সূত্রে এক দক্ষিণ ভারতীয় অধ্যাপকের কথা মনে পড়ছে। এই চিরকুমার, তীক্ষ্ণধী বিজ্ঞানের অধ্যাপক তাঁর সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ দান করবেন সেই জ্যোতিষীকে যিনি দশটি অজ্ঞাত-পরিচয় ব্যক্তির ঠিকুজি দেখে বলে দিতে পারবেন কোনটি স্ত্রীলোকের ঠিকুজি আর কোনটি পুরুষের ঠিকুজি এবং এর মধ্যে কে কে মৃত। যতদূর জানি, এখনও কোনও দাবিদার মেলেনি।

জ্যোতিষের প্রতি দুর্বলতা লোকের মধ্যে কিন্তু ক্রমশ বেড়েই চলেছে। পুলিশের গোয়েন্দা, আধুনিক লেখক, ইঞ্জিনিয়র, ডাক্তার, এমনকী রাজনৈতিক নেতা, বিপ্লবী উগ্রপন্থীর হাতের আঙুলে পাথর বসানো আংটি দেখা যাচ্ছে। বিলেতে মনস্তত্ত্ববিদরা যে ভূমিকা পালন করেন এদেশে জ্যোতিষীরাও সম্ভবত তাই করছেন। দুর্বল মানুষ তাঁর ভয়, দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তার জীবনে একজন বিশেষজ্ঞ পরামর্শদাতার প্রয়োজন বোধ করেন, আমাদের দেশে জ্যোতিষীরা সেই প্রয়োজন মেটাচ্ছেন।

তা মেটান, আমি একটি প্রাচীন ও নিষ্ঠুর গল্প দিয়ে ভাগ্যফল শেষ করি। জ্যোতিষী রাজার হাত দেখে বললেন, ‘আয়ু আর বেশি নেই।’ রাজা আতঙ্কিত। পাশেই সেনাপতি ছিলেন, বললেন, ‘তাই নাকি? তা গণকঠাকুর, আপনার আয়ু কত?’ গণকঠাকুর বললেন, ‘তা আরো তিরিশ বছর।’ সেনাপতি সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতিষীর গলা তলোয়ার দিয়ে কেটে ফেললেন, তারপর রাজাকে বললেন, ‘ইয়ের একসেলেন্সি, দেখলেন তো তিরিশ বছর আয়ুর ব্যাপারটা, খামোকা এসব কথা বিশ্বাস করবেন না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *