অন্ধ তামস

অন্ধ তামস

জয়ন্ত চতুর্বেদী পরপর অনেকগুলো সিগারেট খেয়ে ফেলল। তারপর আর না পেরে বলেই ফেলল, ‘দ্যাখো দময়ন্তী, একটা কথা না বলে আর থাকতে পারছি না।’

দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘তোমার যে একটা কথা বলবার আছে, সেটা তো অনেকক্ষণ থেকেই বুঝতে পারছি। তা কথাটা কী? কোনো রহস্য নাকি?’

ঘাড় নেড়ে জয়ন্ত বলল, ‘হ্যাঁ। রহস্যই বটে। মানে, তোমাকে বলতে চাইছিলুম না আর কী। তোমরা ছুটি কাটাতে এসেছ, ক’টা দিন একটু রিল্যাক্স করবে। তার মধ্যে এইসব…’

দময়ন্তী হাত নেড়ে বলল, ‘দ্যাখ জয়ন্ত, পুলিশে চাকরি করে করে তোমার বুদ্ধি দেখছি কমেই যাচ্ছে, বাড়ার কোনো লক্ষণই নেই। তোমার কাছে একটা রহস্য রয়েছে আর তুমি সেটা বের না করে চেপে যাচ্ছ আমাদের ছুটির ব্যাঘাত ঘটবে বলে? কলেজে তো তুমি এতটা ইয়ে ছিলে না!’

জয়ন্ত একগাল হাসল। বলল, ‘গালাগাল কোরো না। চেপে কি আর যেতুম? বলতুম ঠিকই। কারণ আমি জানি, তুমি রহস্যটা ছুটির চেয়ে কম উপভোগ করবে না। এই একটু ভদ্রতা করছিলুম আর কি।’

দময়ন্তী বলল, ‘তা ভালো। কেউ ভদ্রতা টদ্রতা করলে ভালোই লাগে। এবার তবে খুলে বলো ব্যাপারটা কী? এখানে কীসের রহস্য?’

সমরেশ বলল, ‘একটু দাঁড়ান জয়ন্তবাবু। রহস্যের সঙ্গে একটু অনুপান না থাকলে কি জমে? বলে হাঁক মারল, ‘বৈজু, গোটা ছয়েক কাবাব এখানে দিয়ে যাও তো বাপধন। ভয়ানক সিরিয়াস ব্যাপার হতে যাচ্ছে, দেরি করে সব মাটি করে দিও না।’

.

জয়ন্ত বলল, ‘দ্যাখো, এই ফুলডিহি টাউনকে তোমরা, কলকাতার লোকেরা, জানো একটা স্বাস্থ্যকর জায়গা বলে। এটা যে স্বাস্থ্যকর জায়গা তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু এর আর একটা পরিচয়ও আছে। এটা একটা বহু পুরোনো খনি শহর। এর চারদিকে অনেকগুলো ভালো ভালো অভ্রের খনি আছে। আর তার ফলে বেশ কিছু পয়সাওয়ালা লোক এখানে বহুদিন ধরে বংশানুক্রমে বসবাস করে আসছেন। তাঁদের বাড়িগুলো এদিকে নয়, এখান থেকে মাইল খানেক দূরে। স্থানীয় লোকেরা সে জায়গাটাকে বলে লালকুঠিপাড়া।

‘এই পুলিশ লাইন, সরকারি অফিস, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের বাংলো ইত্যাদি একসময় ওই লালকুঠিপাড়াতেই ছিল। বছর দশেক হল নতুন কলোনি করে এদিকে উঠে এসেছে আর নতুন গড়ে ওঠার ফলে ফুলডিহি ব্যারেজ কাছে হওয়ার ফলে আজকাল এদিকটাই বেশি জনপ্রিয়।

‘তোমাকে এসব কথা বলার অবশ্য আমার একটা উদ্দেশ্য আছে। আমি বলতে চাইছি, তুমি মনে কোরো না যে এখানে কেবল সরকারি চাকুরে আর স্বাস্থ্যোদ্ধারকারীদের ভিড়। এখানে বহু পুরোনো বাসিন্দারা আছেন, তার মানেই আছে দলাদলি, ঈর্ষা এবং মাঝে মাঝে সংঘাত। খুনখারাপি এখানে নেহাত বিরল নয়। এরকম একটি খুনের কেসই তোমাকে বলছি। তবে মনে কোরো না যেন যে এই কেসটার জন্যেই তোমাদের জোরজার করে ছুটি কাটানোর নাম করে এখানে টেনে এনেছি।’

দময়ন্তী প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বলল, ‘ওরে বাবারে বাবা, আমি কিছু মনে করছি না! কলকাতায় লেখাপড়া করে আর বিহারে চাকরি করেও দেখছি, তোমার ইউ পি মার্কা চরিত্রের বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি।’

সমরেশ বলল, ‘আর দেরি করবেন না জয়ন্তবাবু, শুরু করে দিন। বেশি দেরি করলে আপনার বৈজু মহারাজ কাবাব সাপ্লাই করে কুল পাবে না।’

জয়ন্ত সহাস্যে বলল, ‘বৈজুর জন্য কোনো চিন্তা নেই। যাহোক, কেসটা বলি। তবে আগেই বলে রাখি, আমার বলাটা হয়তো সম্পূর্ণ অপক্ষপাত হবে না, কারণ এই কেসের সন্দেহভাজনদের মধ্যে একজন আমার শিক্ষাগুরু। আমি যখন আই-পি-এস ট্রেনিংয়ে ছিলুম, ইনি তখন ব্যালিস্টিক এক্সপার্ট হিসেবে আমাদের ক্লাস নিয়ে থাকতেন। এঁর নাম ক্যাপ্টেন রামনাথ সরফ। ঘটনাটা এঁর বাড়ির সামনেই ঘটে।

‘আজ থেকে মাস ছয়েক আগে, পনেরোই এপ্রিল, রাত ন-টার সময় ক্যাপ্টেন সরফের বাড়ির গেটের মুখে তেজপাল আগরওয়াল নামে এক ভদ্রলোক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তেজপাল রামনাথের দীর্ঘদিনের বন্ধু, উনি তাঁর সঙ্গে দেখা করতেই আসছিলেন।’

দময়ন্তী বলল, ‘প্রথম প্রশ্ন। রাত ন-টার সময় কি লোডশেডিং চলছিল? আমি তো এখানে এসে ইস্তক দেখছি, রোজই রাত আটটা থেকে দশটা পর্যন্ত লোডশেডিং চলে।’

জয়ন্ত বলল, ‘হ্যাঁ, তখন লোডশেডিং চলছিল। আজ থেকে ছ-মাস আগে অবস্থা বিশেষ ভালো ছিল না।’

‘তারপর?’

‘বুঝতেই পারছ, লোড শেডিংয়ের মধ্যে কে যে গুলি ছুড়েছে, কেউই দেখতে পায়নি। কিন্তু আওয়াজটা শুনেছে অনেকেই। সেই আওয়াজ শুনেই রামনাথের বাড়ির দিকে দৌড়ে আসছিল আনোয়ার আর নাসির বলে দুজন সাইকেল রিক্সাওয়ালা। উলটোদিক থেকে দৌড়ে আসছিল আর একজন। তিনজনের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হয় এবং আনোয়ার আর নাসির তৃতীয় লোকটিকে মাটিতে পেড়ে ফেলে। থানায় নিয়ে আসার পর দেখা যায় সেই তৃতীয় লোকটি কুখ্যাত দেওরাজ চৌধুরী, এখানকার সবচেয়ে বড়ো ব্যবসাদার নন্দকিশোর চৌধুরীর বখে যাওয়া একমাত্র ছেলে। ছেলেটি উকিল কিন্তু অত্যন্ত দুশ্চরিত্র।

‘এই রিক্সাওয়ালাদেরই একজন কি তেজপালকে ওখানে নিয়ে গিয়েছিল?’

‘না। তেজপাল লালকুঠিপাড়ার মুখে রিক্সা ছেড়ে দেন। সেখান থেকে হেঁটে রামনাথের বাড়ি যাচ্ছিলেন।’

‘বন্দুকটা পাওয়া গেছে?’

‘হ্যাঁ। রামনাথের বাগানের কুয়োর মধ্যে।’

‘কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট?’

‘পাওয়া যায়নি।’

‘বন্দুকটা কার?’

‘রামনাথের।’

‘দেওরাজ কী বলেছে? সে পালাচ্ছিল কেন?’

‘দেওরাজ বলেছে, সে মোটেই পালাচ্ছিল না। সেও দৌড়ে রামনাথের বাড়ির দিকেই যাচ্ছিল। আনোয়ার আর নাসিরের সঙ্গে অন্ধকারে ধাক্কা লাগতেই তারা ওকে মেরে মাটিতে ফেলে দেয়। কিন্তু আমার বিশ্বাস, দেওরাজ মিথ্যে কথা বলেছে। কারণ, আনোয়ার আর নাসির মোটেই বোকা ছেলে নয়, বরং দুজনেই যথেষ্ট বুদ্ধিমান। আর, দেওরাজের কপালে একটা আলু আর নাসিরের ঠোঁট কাটা যা মুখোমুখি সংঘর্ষেই হতে পারে। দেওরাজ অবশ্য অন্য কথা বলেছে।’

‘দেওরাজের সঙ্গে তেজপালের কোনো শত্রুতা ছিল:?’

‘থাকতেই পারে। তেজপালও বড়ো ব্যবসাদার। নন্দকিশোরের সঙ্গে ওপরে ওপরে না হলেও তলায় তলায় শত্রুতা থাকতে পারে। তা ছাড়া তেজপালের একটি নাতনি আছে। সে বছর খানেক হল দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাশ করে এখানে এসে আছে। নিঃসন্দেহে দেওরাজ তার পেছনে লেগেছিল।’

‘নিঃসন্দেহে কেন?’

‘কারণ দেওরাজ দুশ্চরিত্র এবং খারাপ ধরনের ছেলে, বিশেষ করে নারীঘটিত ব্যাপারে। সে যে গিরিজা আগরওয়ালের মতো সুন্দরী, শিক্ষিতা এবং ভয়ানক রকমের মডার্ন মেয়ের পেছনে লাগবে, তাতে সন্দেহ থাকতে পারে না।’

সমরেশ হাত নেড়ে বলল, ‘বাঃ, বাঃ, সুন্দরী শিক্ষিতা নারীচরিত্রও এসে গেছে। এইবার নাটক জমবে। বৈজু, আরও ছ-টা কাবাব!’

দময়ন্তী বলল, ‘গুলিটা কি সামনে থেকে ছোড়া হয়েছিল, না পেছন থেকে?’

জয়ন্ত বলল, ‘সামনে থেকে, ফুট দশেক দূরে নীচু হয়ে বসে নীচ থেকে ওপরের দিকে কেউ গুলিটা ছুড়েছিল। তার থেকে প্রমাণ হয় গুলিটা রামনাথের বাড়ির ভেতর থেকে ছোড়া হয়েছিল।’

‘কীভাবে?’

‘রামনাথের বাড়ির গেট থেকে দশ ফুট দূরে নীচু হয়ে বসে যদি তুমি কম্পাউন্ডের দিকে তাকাও, তুমি সামনে দোতলা বাড়িটা দেখতে পাবে, আর যদি কম্পাউন্ডের ভেতর থেকে বাইরে রাস্তার দিকে তাকাও তাহলে দুটো গাছের ফাঁক দিয়ে একটুকরো আকাশ দেখতে পাবে ঠিক গেটটার ওপরে। অর্থাৎ তুমি যদি কম্পাউন্ডের ভেতরে থাক, তাহলে লোডশেডিং হলেও তারাভরা আকাশের ব্যাকগ্রাউন্ডে গেটের সামনে দাঁড়ানো একটা মানুষের সিল্যুয়েট তুমি দেখতে পাবে, অথচ কম্পাউন্ডের বাইরে থেকে ভেতরের দিকে তাকালে তা তুমি পাবে না।’

‘বাঃ, ভারি চমৎকার চিন্তা করেছ তো! আচ্ছা, তার মানে তুমি বলতে চাইছ যে দেওরাজ যদি হত্যাকারী হয় তাহলে সে রামনাথের বাড়ির ভেতর থেকে রামনাথের বন্দুক দিয়ে তেজপালকে গুলি করে, তারপর বন্দুকটা কুয়োর মধ্যে ফেলে দিয়ে দৌড় দেয়। এই তো?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই থিয়োরিটা পুরোপুরি খাড়া করা যাচ্ছে না।’

‘কেন?’

‘কারণ গুলি ছোড়ার শব্দ আর রিক্সাওয়ালাদের সঙ্গে দেওরাজের ধাক্কা খাওয়ার মধ্যে যে সময়ের এবং দূরত্বের ব্যবধান, তার মধ্যে এ কাজ দেওরাজের করা সম্ভব নয়। যদি ধরেও নিই যে ঘটনাস্থলে দেওরাজের সঙ্গে অন্য আর একজনও ছিল, তাহলেও, আমি মাপজোপ করে দেখেছি, দেওরাজকে ছুটতে হয়েছিল ঘণ্টায় আশি কিলোমিটার স্পিডে। এটা একেবারেই অসম্ভব।’

‘তাহলে দ্বিতীয় সম্ভাবনাটা কী?’

‘দ্বিতীয় সম্ভাবনা হচ্ছে, দেওরাজ তেজপালের পেছন পেছন আসছিল। তেজপাল গেটটা খুলতে যাবেন বা খুলছেন, তখন দেওরাজ তাকে পেছন থেকে ডাকল। তেজপাল ঘুরে দাঁড়ালেন। দেওরাজ আন্দাজে গুলি চালাল। একটু নীচু হয়ে বসে চালাল যাতে গায়ে কোথাও না কোথাও লাগে। গুলি করেই বন্দুকটা ফেলে পেছন দিকে দৌড় দিল। তখন তার সাগরেদ বন্দুকটা উঠিয়ে গেটের কাছে গিয়ে তেজপালের মৃতদেহটা ঘুরিয়ে দিল যাতে মনে হয় যে গুলিটা ভেতর থেকে করা হয়েছে, তারপর বাগানের ভেতর গিয়ে কুয়োর মধ্যে বন্দুকটা ফেলে দিল।

‘কিন্তু এর মধ্যে একটা গোলমাল আছে। ব্যাপারটা হল, এই থিয়োরিটা দাঁড় করাতে গেলে একজন তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি একান্ত প্রয়োজন। কে এই তৃতীয় ব্যক্তি? দেওরাজের স্বভাব যতদূর জানা গেছে, তাতে মনে হয় সে একজন লোনার বা একক ব্যক্তিত্ব। তার মোসাহেব বা ইয়ারবকশি বন্ধুবান্ধব অনেক আছে, কিন্তু কোনো অন্তরঙ্গ বন্ধু নেই। তাহলে, এরকম একটা বিপজ্জনক কাজে, কাকে সে বিশ্বাস করে নিয়ে গেল? তার বন্ধুবান্ধবদের বাজিয়ে দেখেছি, তারা সবাই মেরুদণ্ডহীন বাজে লোক। কিন্তু এ কাজে দেওরাজকে যে সাহায্য করেছে সে স্থিরবুদ্ধিসম্পন্ন ওস্তাদ লোক। এরকম কাউকে আমরা বের করতে পারছি না।’

দময়ন্তী চিন্তিত মুখে বলল, ‘বুঝেছি। এবার তাহলে তৃতীয় সম্ভাবনা।’

‘তৃতীয় সম্ভাবনা হচ্ছে, দেওরাজ আর তেজপাল একসঙ্গেই আসছিলেন। তেজপাল গেট খুলতেই ভেতর থেকে কেউ গুলি করে। তেজপাল আর্তনাদ করে পড়ে যান। আর অমনি ভয় পেয়ে দেওরাজ পেছন ফিরে দৌড় মারে। কিন্তু সেখানে প্রশ্ন, সে কথা দেওরাজ বলছে না কেন?

‘আর যদি ধরে নিই যে সে কথা বলতে তার কোনো বিশেষ বাধা আছে, তাহলে গুলিটা ছুড়েছিল কে? এবং কেন?’

দময়ন্তী আস্তে করে প্রশ্ন করল, ‘রামনাথ?’

‘হ্যাঁ, রামনাথের নামটাই মনে আসে বটে। তিনি রগচটা টাইপের লোক, পুলিশে ছিলেন, একসময় রাইফেল শুটিংয়ে চ্যাম্পিয়ান ছিলেন, কাজেই তাঁর পক্ষে এ কাজ করা অসম্ভব নয়। কিন্তু আজ তাঁর আশি বছর বয়স। শক্তসমর্থ আছেন ঠিকই, কিন্তু তাই বলে একটা রাইফেল তুলে দশ ফুট দূর থেকে স্রেফ একটা সিল্যুয়েটে গুলি চালানো কি এই বয়সে সম্ভব? তা ছাড়া মোটিভটা কি? তেজপাল তাঁর বহুদিনের বন্ধু। তিনি রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার, তেজপাল ব্যবসাদার, কাজেই স্বার্থের দ্বন্দ্ব লাগার সম্ভাবনাও কম। তা ছাড়া উনি এখন কানে কম শোনেন। কাজেই দুই বন্ধু নীরবে সারাদিনে দাবা খেলতেন। এর মধ্যে খুন-টুন আসে কোত্থেকে? আর সবচেয়ে বড়ো কথা হল, রাত ন-টা তাঁর কাছে মধ্যরাত্রি। রিটায়ার করার পর থেকে আজ বিশ বছরের ওপর তিনি রাত আটটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন।’

জয়ন্ত হয়তো আরও অনেক কথা বলত, কিন্তু দময়ন্তী ওকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, ওনার লক্ষ্য হয়তো তেজপাল ছিলেনই না। হয়তো বদমাশ দেওরাজকেই গুলি করতে গিয়েছিলেন। অন্ধকারে ভুল করে…’

মাথা নেড়ে জয়ন্ত বলল, ‘বিরাট মোটা তেজপাল আর দরকচা মারা দেওরাজকে অন্ধকারে কেন, কোনো অবস্থাতেই একরকম বলে মনে হতে পারে না। আর দেওরাজ যে বদমাশ সেকথা রামনাথ মানতেই চান না।’

দময়ন্তী আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘সে কী কথা?’

‘হ্যাঁ। ওনার ধারণা, দেওরাজ মোটেই বদ ছেলে নয়, ওসব বাজে লোকের রটনা। আসলে নন্দকিশোরবাবুও ওঁর বহুদিনের বন্ধু আর দেওরাজকে তিনি দেখেছেন একেবারে জন্ম থেকে। দেওরাজ নন্দকিশোরের বুড়ো বয়সের ছেলে বলে কেবল বাপের নয়, তাঁর বন্ধুদের কাছ থেকেও অপর্যাপ্ত স্নেহ এবং প্রশ্রয় পেয়ে এসেছে এবং এখনও পাচ্ছে। আর লোকটার এমন একটা ভিজে বেড়াল ভিজে বেড়াল ভাব আছে যে তার আড়ালে সে দিব্যি তার আসল রূপটি বাপ-খুড়োদের কাছ থেকে আড়াল করে যেতে পেরেছে। তার ওপর রামনাথের তো নিজের ছেলে নেই, কাজেই দেওরাজকে উনি প্রায় নিজের ছেলের মতোই দেখেন।’

‘রামনাথের পরিবারে আর কে কে আছেন?’

‘রামনাথের স্ত্রী অনেক আগেই মারা গেছেন। এখন ওঁর সংসারে আছে বিধবা মেয়ে মণীষা, একটি অন্ধ নাতনি নম্রতা আর নাতি শুভকরণ।’

‘এঁরা কেউ আপনার সন্দেহভাজনদের লিস্টে নেই?’

‘না। মনীষা এত মোটা যে তাঁর পক্ষে হাঁটু গেড়ে বসে রাইফেল চালানো সম্পূর্ণ অসম্ভব। তিনি বসলে উঠতে পারেন না। শুভকরণ এখানেই নেই, সে বম্বে আই-আই-টিতে পড়ে। আর, নম্রতা অন্ধ। তা ছাড়া তাকে দেখলেই বুঝতে পারবেন সে সার্থকনামা। সারাদিন সে মা আর দাদুর সেবা করে যাচ্ছে।’

‘বেশ, তাহলে চতুর্থ সম্ভাবনা।’

‘হ্যাঁ। চতুর্থ সম্ভাবনা হচ্ছে অন্য কোনো লোক, মানে যার পরিচয় আমরা এখনও জানি না, রামনাথের বন্দুক চুরি করে পালাচ্ছিল, হঠাৎ সামনে একজনকে গেট খুলে ঢুকতে দেখে গুলি করে বসে এবং খুন হয়ে গেছে দেখে কুয়োর মধ্যে বন্দুকটা ফেলে পালায়। তাহলে প্রশ্ন, কে সেই চোর? তাকে খুঁজে পাওয়া কি সম্ভব?’

দময়ন্তী কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘এই হল তাহলে তোমার রহস্য।’

‘হ্যাঁ। কেমন মনে হল? ইন্টারেস্টিং? ভেবে দেখার উপযুক্ত?’

‘নিশ্চয়ই উপযুক্ত। আমি কি একবার জায়গাটা দেখতে পারি? আর যাদের নাম বললে, তাদের সঙ্গেও যদি একটা মোলাকাত করার ব্যবস্থা করা যায়।’

জয়ন্ত বলল, ‘সব হবে। তাহলে চলো, কালকেই বেরিয়ে পড়া যাক। ইতিমধ্যে আজ দুপুরে টেলিফোন করে আমি একটু ব্যাপারটা জানিয়ে রাখছি কয়েক জনকে। আশা করি, কোনো অসুবিধে হবে না।’

সমরেশ বলল। ‘ঠিক আছে। আজ বিকেলে তাহলে চলুন ব্যারেজের দিকটা ঘুরে আসা যাক।’

.

লালকুঠিপাড়ায় ঢুকলে সন্দেহ থাকে না যে সেটা একটা পয়সাওয়ালা লোকেদের জায়গা। রাস্তাগুলো খুব একটা চওড়া নয় বটে, কিন্তু তাদের দু-পাশে মস্ত মস্ত বাড়ি। বেশিরভাগই তিনতলা, কয়েকটা চারতলাও চোখে পড়ে। অনেকটা কলকাতার বড়োবাজারের মতোই। আর দুনিয়ার যত ক্যাটকেটে রং আছে— গোলাপি, গাঢ় সবুজ, গাঢ় হলুদ ইত্যাদি, সমস্তই এই বাড়িগুলোর বহিরাঙ্গের শোভাবর্ধন করছে। আরও আছে। মালা হাতে উড়ন্ত পরি, জলসেচরত হাতির মুণ্ডু, অদৃষ্টপূর্ব বাঘ, হরিণ, পাখি প্রভৃতি আর প্রকাণ্ড গুম্ফশোভিত দারোয়ান। শেষেরটি অবশ্য জীবন্ত।

জয়ন্ত কিন্তু এখানে গাড়ির গতি কমাল না। একসময় লালকুঠিপাড়া ছাড়িয়ে চলে এল বাইরে ফাঁকা মাঠের মধ্যে। আরও এক ফার্লংটাক যাবার পরে ডাইনে বাঁক নিল। এখানে একটা জঙ্গল মতো আছে, তার অন্য পাশে যেতেই দেখা দিল একটি অতি আধুনিক পাড়া। গোটা কুড়ি-বাইশ বাংলো টাইপের মস্ত মস্ত বাগানওয়ালা বাড়ি, ছবির মতো সাজানো।

জয়ন্ত বলল, ‘এটা হল নতুন লালকুঠিপাড়া। পুরোনো পাড়া ছেড়ে অনেকেই এখানে বাড়ি করেছেন আধুনিক রীতিতে। কেবল ব্যবসায়ী বা খনি মালিকরাই নন, কিছু রিটায়ার্ড অফিসারও এখানে বাড়ি করেছেন। যেমন, ক্যাপ্টেন সরফ। ওই যে লাল রং করা গেটটা দেখছেন যার দু-পাশে দুটো জারুল গাছ, ওটাই ওঁর বাড়ি।’

বাড়িটা ছোটো কিন্তু দোতলা। সামনে প্রশস্ত বাগান, গেট থেকে বড়ো বড়ো সাদা পাথর বসানো রাস্তা তার ভেতর দিয়ে বাড়ির গায়ে গিয়ে ঠেকেছে। বাগানে নানারকম ফুলের গাছ, ক্রোটন আর ক্যাকটাসের সমারোহ। তাদের সঙ্গে হালকা হলুদ রঙের অতি আধুনিক ডিজাইনের বাড়িটা দিব্যি মানানসই হয়েছে। বাড়িটার পেছনেও অনেকটা জমি, সেদিকে কিচেন গার্ডেন আর কিছু ফলের বড়ো বড়ো গাছ। মোটমাট সমস্ত পরিবেশটাই শান্ত আর শান্তিপূর্ণ। এখানে যে কিছুদিন আগে একটা ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড হয়ে গেছে— কল্পনাই করা যায় না!

লাল মাটির চওড়া রাস্তার ওপর গেটের সামনে গাড়ি দাঁড় করাল জয়ন্ত। গাড়ি থেকে দেখা গেল বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ে তাড়াতাড়ি ভেতর চলে গেল। মেয়েটি দীর্ঘাঙ্গী, স্বাস্থ্যবতী, হাঁটা চলায় আভিজাত্যের ছাপ আছে। একমাত্র বেমানান তার চোখের কালো চশমাজোড়া।

দময়ন্তী গাড়ি থেকে নেমে জিজ্ঞেস করল, ‘মেয়েটি কে জয়ন্ত?’

জয়ন্ত বলল, ‘ওই নম্রতা।’

‘অন্ধ?’

‘হ্যাঁ। হঠাৎ দেখলে বোঝা যায় না, না? চলাফেরা একেবারে স্বাভাবিক মানুষের মতো।’

দময়ন্তী মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ। তাই বটে। বয়েস কত?’

‘সাতাশ-আঠাশ হবে। সঠিক বলতে পারব না।’

‘বিবাহিতা?’

‘না।’

কথা বলতে বলতে জয়ন্ত এগিয়ে গিয়ে বুক সমান উঁচু গেটটা ঠেলা দিল। ঘড়ং ঘড়ং করতে করতে খুলে গেল গেটটা। গেট আর বাইরের রাস্তার মাঝখানে প্রায় ফুট ছয়েক চওড়া ঘাসের জমির দিকে নির্দেশ করে জয়ন্ত বলল, ‘এখানেই তেজপাল আগরওয়ালের মৃতদেহ পড়েছিল। পা দুটো ছিল বাড়ির দিকে আর মাথাটার একটুখানি এসে পড়েছিল রাস্তার ওপরে। বুলেটের ধাক্কায় বেশ কিছুটা ছিটকে গিয়েছিলেন পেছন দিকে। একটা পা থেকে চটিজুতো খুলে গিয়েছিল, ধুতিটা সামান্য ছিঁড়ে গিয়েছিল, সিল্কের পাঞ্জাবির বুকের কাছটা ছিল রক্তে লাল। বাঁ-হাতে মুঠো করে ধরা ছিল সুগন্ধী রুমাল, বোধ হয় মুখ মুছতে মুছতে ঢুকছিলেন। ডান হাতে ছিল কিছু খুচরো পয়সা, রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া দেবার পর চেঞ্জ, সেগুলো মাটিতে ছড়িয়ে পড়েছিল।’

দময়ন্তী মাথা নীচু করে শুনছিল। মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, ‘পকেটে আর কী ছিল?’

‘একটা মানিব্যাগে শ-পাঁচেক টাকা, একটা ধানবাদ থেকে কলকাতা যাবার ব্ল্যাক ডায়মণ্ডের এ.সি কোচের টিকিট, এক শিশি সরবিট্রেট আর গোটা পাঁচেক অন্য একটা ওষুধ— ট্র্যাংকুইলাইজার।’

‘টিকিটটা কার নামে ছিল:?’

‘ওঁর নিজের নামে। সতেরোই এপ্রিলের রিজার্ভশেন।’

‘হার্টের অসুখ ছিল?’

‘ছিল।’

‘গুলিটা কোথায় লেগেছিল?’

‘হার্টে। সঙ্গে-সঙ্গে মৃত্যু হয়েছিল।’

‘অব্যর্থ লক্ষ্য!’

‘হ্যাঁ। অব্যর্থ।’

‘আর কিছু লক্ষ করেছিলে যেটা অদ্ভুত মনে হয়েছে?’

‘হ্যাঁ। লোড শেডিংয়ের মধ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন, কিন্তু হাতে টর্চ ছিল না। অন্তত ওনার মৃতদেহের ধারেকাছে কোথাও টর্চ পাওয়া যায়নি। ছিটকে কোথাও পড়েছে ভেবে বেশ অনেকটা জায়গা নিয়েই খোঁজা হয়েছিল। ব্যাপারটা বেশ অস্বাভাবিক, তাই না?’

দময়ন্তী মুখ তুলে ফিকে হাসল। বলল, ‘হ্যাঁ, বেশ অস্বাভাবিক।’

ওর যখন কথা বলছে, তখন এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেটের কাছে চলে এসেছেন। ভদ্রলোক প্রায় ছ-ফুট লম্বা, যদিও বয়সের ভারে সামান্য সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন, কিন্তু স্বাস্থ্য বেশ ভালো, মাথার চুল সমস্ত সাদা, উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বপূর্ণ বলিরেখাঙ্কিত মুখে সাদা মোটা গোঁফ, পরনে সাদা পাজামা আর পাঞ্জাবি, হাতে একটা মোটা বেতের লাঠি।

ভদ্রলোককে দেখে জয়ন্ত দ্রুতপদে এগিয়ে গেল। গলাটা একটু তুলে বলল, ‘গুডমর্নিং স্যার, সকালবেলাতেই বিরক্ত করলুম। এই, এঁদের একটু আপনার সঙ্গে দেখা করাবো বলে নিয়ে এসেছি।’

ভদ্রলোক গম্ভীরমুখে লাঠিশুদ্ধ দু-হাত তুলে দময়ন্তী আর সমরেশের উদ্দেশে নমস্কার করলেন। বললেন, ‘জয়ন্ত কাল ফোন করে আপনাদের কথা আমাকে বলেছিল। ভেতরে আসুন।’ বলে পিছন ফিরে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলেন।

বারান্দায় উঠে ডান দিকে একটা মস্ত বড়ো ঘর। সেটাই বসবার ঘর। ঘরটা এত বড় যে একটা সোফা সেটে কুলিয়ে ওঠেনি, দুটো রাখা হয়েছে। বাকি জায়গাটুকুতে আছে একটা ডাইনিং টেবিল আর গোটা ছয়েক চেয়ার, একটা বড়ো কাচের শো কেস, তাতে নানারকম ট্রফি, কাপ, মেডেল প্রভৃতি, একটা বুক কেসে কিছু হিন্দি আর ইংরেজিতে বই আর দেওয়ালে নানা রকমের জন্তু জানোয়ারের স্টাফ করা মুণ্ডু।

ক্যাপ্টেন রামনাথ সরফ একটা সোফায় বসে অতিথিদের বাকিগুলো অধিকার করবার জন্য হাত নেড়ে ইঙ্গিত করলেন। তারপর দময়ন্তীর দিকে তাকিয়ে অতি পরিচ্ছন্ন ইংরিজিতে প্রশ্ন করলেন, ‘কে আপনাকে এই তদন্তের জন্য নিয়োগ করেছে?’

দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘কেউ না। আমি প্রফেশনাল ডিটেকটিভ নই। রহস্যভেদে আমি একটা বিশেষ আনন্দ পাই, যেমন অনেকে ক্রসওয়ার্ড পাজল সমাধানের মধ্যে পায়। জয়ন্ত আর আমি একসঙ্গে কলেজে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছর পড়েছি। কাজেই বন্ধু হিসেবে ও আমাকে মাঝে মাঝে কোনো কোনো রহস্যের সন্ধান দিয়ে সাহায্য করে। আমিও আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি দিয়ে ওকে সাহায্য করে থাকি।’

‘তার মানে, এই তদন্তে আপনার কোন স্বার্থ নেই?’

‘না।’

‘বিশ্বাস করা কঠিন। যাহোক, আপনি কী করতে চান?’

‘আমি জায়গাটা একটু বিশদভাবে ঘুরে দেখতে চাই, আর কয়েক জনের সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই।’

‘ব্যাস?’

‘ব্যাস।’

‘জয়ন্ত বলেছে আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। কী জানতে চান?’

‘আপনি তো পুলিশে কাজ করতেন। রিটায়ার করে এখানে বাড়ি করলেন কেন?’

‘রিটায়ার করার পর আমার সঞ্চিত কিছু টাকা নিয়ে আমি আমার এক ছোটোবেলাকার বন্ধুর সঙ্গে অভ্রের ব্যবসায় অংশীদার হই। আমি আসার পর ব্যবসায় খুব লাভ হয়। তখন এই অঞ্চলটাও নতুন গড়ে উঠছে। সব মিলিয়ে এখানে থাকাটাই বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি।’

‘আপনি কতদিন রিটায়ার করেছেন?’

‘কুড়ি বছর।’

‘শেষ কবে বন্দুক ছুড়েছেন?’

রামনাথ ব্যঙ্গাত্মক হাসি হাসলেন। বললেন, ‘পঁচিশ বছর আগে। এ প্রশ্ন কেন? আপনি কি সন্দেহ করেন যে তেজপালকে আমি হত্যা করেছি?’

‘হ্যাঁ, করি। আপনার বাড়ির গেটে আপনার বন্দুক দিয়ে হত্যা করা হয়েছে, আর আপনাকে সন্দেহ করব না? আপনি তো পুলিশে ছিলেন। আপনি হলে কী করতেন?’

‘করতুম না। কারণ ব্যাপারটা বড্ড বেশি সহজ, বড্ড বেশি স্বচ্ছ। কেউ যে আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকে না।’

‘থাকে। আপনি পুলিশের লোক হিসেবে জানেন যে অতিরিক্ত সারল্য এবং স্বচ্ছতা পুলিশকে ভুলপথে চালিত করতে পারে। আপনি যে তাই হত্যাকাণ্ডটা অত্যন্ত সরল এবং সোজা পথে করে, পুলিশকে ভুল পথে চালিত করছেন না সেরকম প্রমাণ আমি এখনও পাইনি।’

জয়ন্ত বিস্ফারিত চোখে বলল, ‘তুমি বলছ কী দময়ন্তী? স্যারের পক্ষে এ কাজ করা অসম্ভব!’

রামনাথ হাত নেড়ে বললেন, ‘তুমি চুপ করো জয়ন্ত। আপনি কী বলতে চাইছেন, আমি বুঝতে পেরেছি। পরের প্রশ্ন?’ তাঁর মুখের হাসিটি তখন আর নেই।

দময়ন্তী প্রশ্ন করল, ‘তেজপাল আগরওয়াল আপনার বহুদিনের বন্ধু। কতদিনের পরিচয়?’

‘আমাদের পরিচয় প্রায় ষাট বছরের। কলকাতায় আগরওয়াল পরিবার এবং আমাদের পরিবার অনেক বছর পাশাপাশি বড়োবাজার অঞ্চলে বাস করেছে।’

জয়ন্ত বলল, ‘কিন্তু স্যার, পোস্টমর্টেম রিপোর্টে মৃতের বয়স লেখা আছে বাষট্টি। সে ক্ষেত্রে…’

‘সে ক্ষেত্রে কী? আমি ওকে জন্মাতে দেখেছি। কিন্তু আজ আমরা দুজনেই বুড়ো। কাজেই আমাদের পরিচয় ষাট বছরের বলাটা কি অন্যায়?’

দময়ন্তী গম্ভীর মুখে বলল, ‘অন্যায় হয়তো নয়, একটু অস্বাভাবিক। উনি আপনাকে কী বলে সম্বোধন করতেন?’

‘রামদাদা বলে।’

‘আপনি যার সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেছিলেন, তিনিই কি ইনি?’

‘না। তার নাম দুর্গাদাস গোয়েঙ্কা। সে মারা গেছে। তার ছেলে বোম্বাইতে এখন ফিলমের ব্যবসা করছে।’

‘এই যে এতগুলো ট্রফি রয়েছে দেখছি শ্যুটিংয়ের ওপরে, এদের সব ক-টাই কি আপনার?’

‘না। আমার আছে, আমার স্ত্রীর আছে, আমার ছেলে-মেয়েরও আছে। আমাদের পুরো পরিবারটাই শ্যুটারের পরিবার।’

‘আপনার ছেলে এখন কোথায়?’

‘আমার ছেলে আর জামাই বড়াডিহির জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে জিপ উলটে খাদের মধ্যে পড়ে মারা যায়।’

দময়ন্তী ঠিক এরকম একটা উত্তর আশা করেনি। কিছুক্ষণ দুঃখিত মুখে চুপ করে থেকে বলল, ‘কত বছর আগে এ ঘটনা ঘটে?’

‘আজ থেকে বিশ বছর আগে।’ অকম্পিত গলায় রামনাথ বললেন।

‘তারপর?’

‘তারপর কী?’

‘তারপরেও কি আপনি শ্যুটিং চালিয়ে গেছেন?’

‘বলেছি তো, আমি তারও বছর পাঁচেক আগে শ্যুটিং বন্ধ করে দিই।’

‘বন্দুকগুলো রেখে দিয়েছিলেন কেন?’

‘মায়া পড়ে গিয়েছে ওদের ওপর। তা ছাড়া আমার নাতি ভালো রাইফেল চালায়।’

‘ও। আচ্ছা, আপনার ছেলের বিয়ে হয়নি?’

‘হয়েছিল। আমার ছেলের বউ এখানে থাকেন না, তিনি বোম্বাইতে থাকেন।’

‘কেন?’

‘এই পাণ্ডববর্জিত জায়গা তাঁর ভালো লাগে না, তাই। তিনি আনন্দ ফুর্তি করতে ভালোবাসেন। বিধবা বলে সর্বস্ব ত্যাগ করে ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে, তা তিনি বিশ্বাস করেন না।’

‘তিনি কি আবার বিবাহ করেছেন?’

‘না।’

‘তাঁর ছেলে-মেয়ে আছে?’

‘আছে। দুটি ছেলে। তারা কোথায় আছে, বলতে পারব না।’

‘তাদের বয়স?’

‘একজনের বাইশ, অপরজন চব্বিশ।’

‘আপনার নাতনি কি জন্মান্ধ?’

‘না। সে বিএসসি পাশ করে বম্বেতে একটা ওষুধের কারখানায় অ্যাপ্রেন্টিস থাকার সময় একটা অ্যাক্সিডেন্টে অন্ধ হয়ে যায়। একটা বিষাক্ত গ্যাসের সিলিন্ডার ফেটে ওর চোখে গ্যাস ঢুকে গিয়েছিল।’

‘কত বছর আগে?’

‘বছর তিনেক আগে। ওর তখন কুড়ি বছর বয়স ছিল।’

‘আপনার বন্দুক যে চুরি গেছে, আপনি জানতেন?’

‘না। মাসে একবার তেল দিই। এই ঘটনার মাত্র কয়েক দিন আগে পরিষ্কার করেছিলুম। কাজেই চুরি গেছে কিনা আমার জানা ছিল না।’

‘তেল কে দেয়?’

‘আমি।’

দময়ন্তী কিছুক্ষণ চুপ করে আছে দেখে রামনাথ মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর কোনো প্রশ্ন?’

‘আর একটি প্রশ্ন। তেজপাল আগরওয়াল মারা যাওয়ায় আপনি দুঃখিত হননি, তাই না?’

‘হ্যাঁ, তাই।’

‘কেন? তিনি কি আপনার বন্ধু ছিলেন না?’

‘ছিলেন হয়তো। কিন্তু আমি তাকে পছন্দ করতুম না। তার যে কোনো বিশেষ কারণ ছিল, তা নয়। কিন্তু আমার ওর সঙ্গ খুব পছন্দ হত না।’

‘যেদিন তিনি নিহত হন, সেদিন অত রাত্রে লোড শেডিংয়ের ভেতরে তিনি আপনার বাড়িতে কেন আসছিলেন আপনি জানেন? আপনি কি তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন?’

বাঁধানো দাঁত বের করে হাসলেন রামনাথ। পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি এ প্রশ্নের সত্যি উত্তর আশা করেন?’

‘দময়ন্তী মৃদু হেসে মাথা নাড়ল। বলল, ‘না।’

‘এবার আমি তাহলে আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করি?’

‘করুন।’

‘আমার জবাবগুলোয় আপনার কয়েকটা জায়গায় খটকা লেগেছে, নয়?’

‘হ্যাঁ।’

‘কোথায়?’

‘প্রথমত, তেজপালের সঙ্গে আপনার ষাট বছরের পরিচয় বলায়। দ্বিতীয়ত, আপনার নাতি দুটি কোথায় আছে সেকথা আপনি বলতে রাজি না হওয়ায়। তৃতীয়ত, তেজপালকে আপনি পছন্দ করতেন না সেকথা প্রকাশ করায়। এবং চতুর্থত, তেজপাল কেন সেদিন আপনার বাড়িতে আসছিলেন, সেকথা সোজাসুজি বলতে রাজি না হওয়ায়।’

‘আপনার কি ধারণা, আমি কোনো মিথ্যে বলেছি?’

‘হ্যাঁ, বলেছেন। কেন বলেছেন, সেটা বের করাই এখন আমার কাজ হবে। আমার বিশ্বাস, তখনই হয়তো আসল সত্যটা বেরিয়ে আসবে?’

ফিকে হাসলেন রামনাথ। বললেন, ‘হয়তো। হয়তো নয়। তবু আপনাকে আমার শুভকামনা জানাচ্ছি। গুড লাক।’

.

বারান্দায় বেরিয়ে এসে জয়ন্ত গোমড়া মুখ করে বলল, ‘তুমি যদি স্যারকে সন্দেহই করে থাক, তবে সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরের মতো কোথায় কোথায় তোমার খটকা লেগেছে, সেসব কথা গড়গড় করে বলে গেলে কেন?’

দময়ন্তী চিন্তিত, অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘ক্যাপ্টেন সরফ অত্যন্ত বুদ্ধিমান লোক। তাঁকে না বললেও তিনি বুঝতে পারতেন, কোথায় কোথায় তাঁর জবানবন্দি সন্দেহজনক বলে মনে হয়েছে। কাজেই, আমি বলে দেওয়াতে কোনোই ইতর বিশেষ হয়নি।’

জয়ন্ত পূর্ববৎ গোমড়া মুখে বলল, ‘কী জানি হল কিনা। তবে, এবার আমরা যাব তেজপালের বাড়ি? নম্রতা বা তার মার সঙ্গে কথা বলতে চাও না?’

‘এখনই নয়। হয়তো দু-দিন পরে।’

.

‘এখনই নয়’ বললেই তো আর হল না। নম্রতা গেটের কাছেই দাঁড়িয়েছিল। তিনজনের পায়ের শব্দ কাছে এগিয়ে আসতে নিঃশব্দে ঠোঁট দুটো ফাঁক করল। অর্থাৎ কিছু বলতে চায়।

দময়ন্তী একটু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কী কিছু বলবেন?’

সুন্দর ইংরেজিতে জবাব এল, ‘হ্যাঁ। তেজপাল আগরওয়ালের মৃত্যু রহস্যের কিনারা করতে আপনার কী স্বার্থ?’

দময়ন্তী নীচু গলায় বলল, ‘আপনার দাদু আমাকে একই প্রশ্ন করেছিলেন। আমি তার যা জবাব দিয়েছিলুম তা আপনি নিশ্চয়ই পাশের ঘর থেকে শুনেছেন।’

নম্রতার মুখে একটু লাল রঙের আভাস দেখা দিল। কালো চশমা জোড়া অকারণেই ঠিক করে নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, শুনেছি, কিন্তু বিশ্বাস করিনি। কে আপনাকে এই কাজে নিয়োগ করেছেন?’

দময়ন্তী ফিরে প্রশ্ন করল, ‘কে নিয়োগ করে থাকতে পারে বলে আপনার মনে হয়?’

লাল রং এবার আরও একটু বাড়ল। ক্রুদ্ধ গলায় জবাব এল, ‘আমি আপনাকে প্রশ্ন করছি।’

‘তা করছেন ঠিকই, কিন্তু এ প্রশ্নের কি জবাব আমি দেব, বলুন? আমি যদি বলি শ্রীবৃন্দাবন ব্যানার্জী বলে একজন আমাকে টাকা দিয়েছেন, আপনি কি বিশ্বাস করবেন? করবেন না। এবং সত্যি কথা বলার ইচ্ছে যদি আমার না থাকে, আমাকে মিথ্যে বলার হাত থেকে আটকাবেন কী করে? তার চেয়ে বলুন, আমি এই রহস্যের তদন্ত করি এটা কি আপনি বা আপনারা চান, না চান না?’

‘না, চাই না।’

‘কেন?’

‘তার জবাব দিতে আমি বাধ্য নই।’

‘না, তা নন। আচ্ছা, ঘটনার সময় আপনি কী করছিলেন?’

‘ঘুমোচ্ছিলুম। আমি কিচ্ছু শুনিনি, কিচ্ছু জানি না। আর কিছু?’

‘হ্যাঁ। যিনি আমাকে নিয়োগ করেছেন বলে আপনি মনে করেন, আমার মাধ্যমে আপনি কি তাঁকে কোনো মেসেজ পাঠাতে চান?’

একটু ইতস্তত করে নম্রতা বলল, ‘না। তারপর চাপা গলায় যোগ করল, ‘আপনাকে আমি যতটা কুটিল বলে মনে করেছিলুম, দেখছি আপনি তার চেয়েও বেশি।’ বলে পেছন ফিরে বাড়ির দিকে রওনা দিল।

.

গেট থেকে বেরিয়ে জয়ন্ত বেশ অনেকক্ষণ চুপ করে গাড়ির দরজাটা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘কী আশ্চর্য!’

দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘কী আশ্চর্য?’

‘আরে, নম্রতার মধ্যে যে এতটা উগ্রতা লুকিয়েছিল ধরতেই পারিনি। আর, হঠাৎ এ হেন বিস্ফোরণের কারণটাই বা কী? সরফ পরিবার সন্দেহ করছে যে কেউ তোমাকে নিয়োগ করে এই ঘটনার দায়িত্ব ওদের ঘাড়ে চাপিয়ে কোনো ফায়দা ওঠাতে চাইছে?’

দময়ন্তী ঘাড় নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ওদের কি সত্যিই কোনো দায়িত্ব নেই বা ছিল না?’

জয়ন্তর মুখ পুনরায় গোমড়া হয়ে গেল। বলল, ‘জানি না।’

দময়ন্তী চিন্তিত মুখে বলল, ‘আরও ভেতরে যেতে হবে জয়ন্ত। মনে হচ্ছে অনেক কাদা ঘাঁটতে হবে। তবে…’

‘তবে কী?’

‘হত্যাকারীর লক্ষ্য তেজপালই ছিলেন। তিনি কোনো দুর্ঘটনার শিকার নন।’

‘কী করে বুঝলে?’

‘পকেটে টর্চ ছিল না যে।’

.

তেজপাল আগরওয়ালের বাড়ি পুরোনো লালকুঠিপাড়ায়। তিনতলা প্রকাণ্ড বাড়ি। মাঝখানে উঠোন, তাকে তিন-থাক চওড়া বারান্দা পরপর উঠে গেছে তিনতলা পর্যন্ত। কিন্তু লোকজন খুব বেশি আছে বলে মনে হল না। যারা ঘোরাঘুরি করছে তারা কাজের লোক— বাড়ির লোক নয়।

জয়ন্ত পথ দেখিয়ে চওড়া সিঁড়ি দিয়ে ওপরে নিয়ে চলল। দেখা গেল একতলাটা মোটামুটি গুদোম। দোতলার যতটুকু দেখা গেল সেটুকু অফিস হিসেবেই ব্যবহার হয়। তিনতলায় ঢোকার মুখে লোহার গ্রিল লাগানো প্রকাণ্ড দরজা। পৃথিবীর যেকোনো চোরই এ হেন একটা দরজা দেখলে বিমর্ষ হয়ে পড়বে।

বেল বাজানোর দরকার হল না। দরজার মুখেই দাঁড়িয়েছিলেন এক অতিকায় পুরুষ। খুব যে লম্বা তা নয়, কিন্তু অসম্ভব চওড়া— চতুর্দিকেই চওড়া, ফলে মাথার ওপর আলো থাকলে এঁর পায়ের নিচে যে ছায়াটা পড়ে সেটা প্রায় একটা নিখুঁত বৃত্তই হয় বলে সকলের মনে হল।

সমরেশ ফিসফিস করে দময়ন্তীকে বলল, ‘দরজাটা যে কেন এত বড়ো এবার বুঝেছ?’

সমরেশ কথাটা শেষ করবার আগেই জয়ন্ত দরজাস্থিত বপুটিকে সম্বোধন করে বলল, ‘রাজেশবাবু, যাঁকে আনব বলেছিলুম, তাঁকে নিয়ে এসেছি।’

রাজেশবাবুর শরীরটি যত বড়োই হোক না কেন, কণ্ঠস্বরটি আশ্চর্য রকমের মিহি, একেবারে হিংটিংছটের যবন পণ্ডিতদের গুরুমারা চেলার উলটো। বিশুদ্ধ বাংলায় বললেন, ‘আসুন আসুন। ভেতরে আসুন।’

ভেতরটি যেরকম আশা করা গিয়েছিল, মোটেই সেরকম নয়। যে বাড়ির বাইরে গোলাপি পরি, সবুজ হাতি আর ঘোড়ামার্কা হরিণের অলংকরণ, তার ভেতরে যে এরকম একটি ড্রইংরুম থাকতে পারে, তা চিন্তাই করা যায় না। ইনটিরিয়ার ডেকরেশনের বিলিতি বইয়ে যেরকম সব ছবি দেওয়া থাকে, ঠিক সেরকম। কী নেই সে ঘরে! দু সেট সোফা, একটা বাইরের লোকেদের জন্য, অন্যটা অন্তরঙ্গদের জন্য, রেডিয়ো, স্টিরিয়ো, এমনকী একটা টিভি সেটও, ফায়ার প্লেস, দেওয়াল থেকে দেওয়াল কার্পেট, নানা রকমের মূর্তি, ছবি— সব মিলিয়ে একটা অত্যন্ত কেতাদুরস্ত ব্যাপার।

দময়ন্তীরা বসলে পরে ভদ্রলোক একাই একটা সোফা জুড়ে বসে বললেন, ‘বলুন জয়ন্তবাবু, আমি কীভাবে আপনাদের সাহায্য করতে পারি।’

জয়ন্ত মৃদু হেসে মাথা নেড়ে বলল, ‘আমাকে নয় রাজেশবাবু, এঁকে একটু সাহায্য করুন। আপনার বাবার মৃত্যুরহস্য নিয়ে ইনি তদন্ত করবেন। এঁর পরিচয়…’

রাজেশ হাত নেড়ে বললেন, ‘এঁর পরিচয়ের কোনো দরকার নেই। ইনি আমার কাছে যেরকম সাহায্য চাইবেন, তাই পাবেন। বলুন মিসেস দত্তগুপ্ত, আমি আপনার জন্যে কী করতে পারি?’

দময়ন্তী বলল, ‘আপনি তো ভারি চমৎকার বাংলা বলেন! কোত্থেকে শিখেছেন?’

রাজেশ দন্তবিকাশ করে বললেন, ‘বাঃ, আমি তো কলকাতার ছেলে। রিপন কলেজে পড়াশোনা করেছি। তার আগে হেয়ার স্কুল।’

‘তাই নাকি? এখানে কত বছর আছেন?’

‘তা প্রায় বিশ বছর হবে। পড়াশুনো করছিলুম, বাবা বিয়ে দিয়ে দিলেন, আর ব্যবসায় এনে লাগিয়ে দিলেন।’

‘আপনার মেয়ের বয়স কত?’

‘ওই রকমই। বিশ হবে।’

‘একই মেয়ে আপনার?’

‘হ্যাঁ। সে দিল্লিতে মামাবাড়ি থেকে পড়াশোনা করছিল। তা দিল্লির হালচাল তো জানেন। একদম সুবিধের নয়। তাই বছর খানেক হল এখানে এনে রেখেছি, বাড়িতেই পড়াশোনা করে প্রাইভেটে বিএ দেবে।’

‘এ ঘর কি তারই সাজানো?’

কিছুটা স্নেহ কিছুটা গর্ব মেশানো হাসি হাসলেন রাজেশ। বললেন, হ্যাঁ। ওই কী সব বিলিতি বইটই দেখে সাজিয়েছে। আর কোনো কাজ তো বিশেষ নেই, এইসব করে সময় কাটায়। আমি বাধা দিইনি। যা করে করুক। এই তো একটা টিভি সেট বসিয়েছে। চলে না, কিছু না। কিন্তু ওই যে বইয়ে দেখিয়েছে ওখানে একটা টিভি সেট বসানো দরকার। তাই বসিয়েছে।’

‘খুব সুন্দর লাগছে কিন্তু।’

বিগলিত হাসি হাসলেন রাজেশ। বললেন, ‘আপনারা প্রশংসা করলেই ভালো লাগে।’

‘আপনার আর সন্তান নেই?’

‘আছে। তিনটি ছেলে। তারা ছোটো। তারাও দিল্লিতে থেকে পড়াশুনো করছে।’

‘আচ্ছা, এবার কাজের কথায় আসা যাক। আপনার বাবা যেদিন মারা যান, সেদিনের কথা কিছু বলুন।’

দুঃখিত মুখে একটু চুপ করে থেকে রাজেশ বললেন, ‘কি আর বলব, বলুন। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও সারাদিন উনি একতলায় অফিস ঘরে বসে কাজকর্ম করেন। আমার অফিস দোতলায়। সাড়ে ছটায় যেমন রোজ যাই, তেমনি অফিস বন্ধ করে খাতাপত্র নিয়ে নীচে নামি। দুজনে একসঙ্গে খাতাপত্র মিলিয়ে আলমারিতে চাবি দিয়ে আমি তিনতলায় চলে আসি। ওঁর হার্টের অসুখ ছিল বলে উনি তিনতলায় আসতেন না। এক তলাতেই অফিস ঘরের পাশে ওনার শোবার ঘর ছিল। আটটার সময় আমাদের কুক গিরিধারী ওঁর খাবার নিয়ে নীচে যায়। উনি খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়লে, ও ওপরে চলে আসে।’

‘আপনার স্ত্রী কি জীবিত?’

‘হ্যাঁ। তবে তিনি অত্যন্ত অসুস্থ। শয্যাশায়ী।’

‘ও। তারপর?’

‘তারপর রাত দশটা থেকে শুরু হল গোলমাল। টেলিফোন, পুলিশ, লোকজন— উঃ, সে একটা রাত কেটেছে বটে! গিরিজা ছিল তাই, না হলে যে কী হত জানি না। ও তো একাই প্রায় সমস্ত ব্যাপারটা সামলালো। আমি এত হতভম্ব হয়ে পড়েছিলুম যে আমার মাথার ভেতরটা সব জট পাকিয়ে গিয়েছিল। কোনো কিছু ভাববার মতো ক্ষমতাই ছিল না।’

‘যখন টেলিফোন আসে, আপনি কী করছিলেন?’

‘ঘুমোচ্ছিলুম। আমি সাড়ে আটটা থেকে নটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ি।’

‘আচ্ছা, আপনার বাবাও নিশ্চয়ই ওই সময়েই শুয়ে পড়েন রোজ?’

‘হ্যাঁ। সেই রকমই তো জানতুম।’

‘তাহলে সেদিন ওই সময় তিনি রামনাথবাবুর বাড়িতে কেন যাচ্ছিলেন, সেটা আন্দাজ করতে পারেন কি?’

‘না।’ বলে ঘনঘন মাথা নাড়লেন রাজেশ।

‘কিন্তু উনি তো মাঝে মাঝেই রামনাথবাবুর বাড়িতে যেতেন। তাই না?’

‘হ্যাঁ, যেতেন। কিন্তু সে তো দিনের বেলায় আর দাবা খেলতে। অত রাতে কী জন্যে যাচ্ছিলেন, সেটা বোঝা বেশ কঠিন।’

‘উনি আগে কখনও অত রাতে গেছেন কি ও বাড়িতে?’

‘জানি না। তবে, মাঝে মাঝে উনি রাত্রিবেলা বেরোতেন রাস্তায় পায়চারি করবার জন্য। দারোয়ানকে বলে যেতেন, সে দরজা খুলে অপেক্ষা করত। ডাক্তারের বারণ সত্ত্বেও যখন উনি মাঝে মাঝে বেশি খেয়ে ফেলতেন, তখনই বেরোতেন। তা নয় তো উনিও নটার মধ্যে শুয়ে পড়তেন। তবে হ্যাঁ, বেড়াতে বেড়াতে কখনও ওবাড়ি গেছেন কিনা তা বলতে পারব না।’

‘সেদিন বেরোনোর সময় কি দারোয়ানকে কিছু বলে বেরিয়েছিলেন?’

‘না, তেমন কিছু নয়। যেমন বলেন, দরজা খোলা রাখতে, তেমনি আর কী!’

‘সেদিন আপনাদের কী কী ফোন এসেছিল, মনে পড়ে আপনার?’ মানে, আপনার বাবার বিশেষ করে?’

‘সে রাত্রে আমাকে দারোগাবাবুও এই প্রশ্ন করেছিলেন। আমার মনে আছে যে তেমন কিছু আসেনি, কয়েকটা অফিসের কাজের ছাড়া।’

‘রামনাথবাবুর পরিবারের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?’

‘খারাপ নয়। তবে আমার বাবার সঙ্গে যতটা ঘনিষ্ঠ আমার সঙ্গে ততটা নয়, কারণ রামনাথবাবুর সঙ্গে ওঁর বাল্যকালের পরিচয়। আমি যখন বড়ো হয়েছি, তখন দুটো পরিবার দু-জায়গায় আলাদা হয়ে গিয়েছে। তবে রামনাথবাবুর নাতনি নম্রতার সঙ্গে গিরিজার বেশ ভাব আছে।’

‘বিশ বছর আগে বিয়ের পর আপনি যখন ফুলডিহিতে আসেন, তখন কি রামনাথবাবুর ছেলে জীবিত ছিলেন?’

‘হ্যাঁ। ছিলেন। কিন্তু সে কথা কেন? সে তো বহুদিনের পুরোনো ব্যাপার।’ রাজেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন।

‘পুরোনো কথা বলেই কি তার আর দরকার আসে না, রাজেশবাবু? আচ্ছা, শুনেছি একই দিনে রামনাথবাবুর ছেলে আর জামাই নিহত হয়। ঘটনাটা কী ঘটেছিল?’

রাজেশ বেশ কিছু সময় চুপ করে থেকে বললেন, ‘আমার মনে নেই।’

‘মনে আপনার আছে রাজেশবাবু। কেন আপনি বলতে চাইছেন না?’

‘দেখুন, সেসব অন্য ঘরের ব্যাপার। অন্যের কেচ্ছা কেলেঙ্কারি নিয়ে আমি কোনো কথা বলা পছন্দ করি না। তবে সে ঘটনার সঙ্গে এ ব্যাপারের কোনো যোগ নেই বলেই মনে হয়।’

‘বিশ বছর আগে ঘটেছে বলেই তার কোনো রিফ্লেকশন এ ব্যাপারে থাকবে না— এটা মনে হওয়ার কি কোনো বিশেষ কারণ আছে? তা ছাড়া, সে ঘটনা অন্য ঘরের ব্যাপার বলে চাপা দেওয়াটা কি ঠিক? বিশেষত যেখানে আপনার বাবার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সেই পরিবার জড়িত হতে পারে?’

রাজেশ আবার চুপ করে থেকে বললেন, ‘দেখুন, সে ঘটনার কথা সত্যিই আমার তেমন কিছু মনে নেই। তখন নতুন ব্যবসা আর নতুন সংসার নিয়েই ব্যস্ত ছিলুম। তবে রামনাথবাবুর ছেলে আর জামাইয়ের মৃত্যুর পর ফুলডিহিতে একটা জোর গুজব উঠেছিল যে তাঁরা দুর্ঘটনায় মারা যাননি, নিহত হয়েছিলেন। রামনাথবাবু পুলিশেমহলে তাঁর প্রভাব খাটিয়ে পুরো ব্যাপারটা ধামাচাপা দিয়ে দেন। তা না হলে তাঁর আর তাঁর পরিবারের সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখা যেত না।’

‘কে তাঁদের খুন করেছিল বলে লোক সন্দেহ করেছিল?’

‘সেটা আমার সত্যিই মনে নেই।’

দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘রাজেশবাবু, আপনি সত্যিই একজন ভদ্রলোক। আপনার যদি বলতে সংকোচ হয় তো আমি বলছি। দুর্গাদাস গোয়েঙ্কার ছেলে, তাই না?’

বিস্মিত দৃষ্টি তুলে রাজেশ ওপরে নীচে মাথা নাড়লেন, বললেন, ‘হ্যাঁ। তবে তার কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ ছিল না। কাজেই সেটা নিতান্তই ভ্রান্ত একটা কুৎসা হতে পারে।’

‘সাক্ষ্যপ্রমাণ লুপ্ত করা হয়েছিল, তাও তো হতে পারে?’

‘তা হতে পারে অবশ্য। তা ছাড়া, ঘটনাটার কয়েক দিন পরেই দুর্গাদাসের ছেলে দ্বারকাদাস ফুলডিহি ছেড়ে চলে যাওয়ায় গুজবটা বহুদিন চালু ছিল।’

‘রামনাথের ছেলের বউ কি তার সঙ্গে একসঙ্গে গিয়েছিল, না আগে পরে?’

‘অত্যন্ত লজ্জিত মুখে মাথা নীচু করে রাজেশ বললেন, ‘একসঙ্গে।’

‘তাঁরা কি বিবাহ করেছিলেন?’

লজ্জায় প্রায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে যেতে রাজেশ বললেন, ‘না। তবে তাঁরা একসঙ্গে থাকতেন। দ্বারকাদাস কমলজিৎ সরফের দুই ছেলেকে নিজের ছেলের মতোই মানুষ করতেন।’

‘করতেন মানে? এখন করেন না?’

‘না। দ্বারকাদাস বছর পাঁচেক আগে মারা গেছেন।’

‘কমলজিতের স্ত্রী আর ছেলেরা কোথায়?’

‘বম্বেতেই থাকে।’

‘ছেলেরা কী করে?’

‘এদিক-ওদিক ব্যবসাপাতি করে। অবস্থা আর বিশেষ ভালো নেই।’

‘আপনি এত কথা জানলেন কী করে?’

‘বাবার কাছে শুনেছি। দ্বারকাদাস আর আমার বাবা বন্ধু ছিলেন। তাঁদের মধ্যে চিঠিপত্রের আদানপ্রদান ছিল।’

‘দ্বারকাদাস যা করেছিলেন তার পরেও?’

‘পুরুষমানুষের ওরকম একটু এদিক-ওদিক হতেই পারে। তাতে সামাজিক সম্পর্কে নিষেধ আসতে পারে, বন্ধুত্বে নয়।’

দময়ন্তী আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই খাবারের ট্রে হাতে যিনি ঘরে ঢুকলেন, তাঁকে দেখে সমরেশ একেবারে চমৎকৃত হয়ে পড়ল। ঘরটি তো এমনিতেই বম্বে ফিলম-এর সেটিং বলে মনে হচ্ছিল, এখন ইনি তো যেন একেবারে ফিলম-এর পর্দা থেকেই নেমে এলেন বলে মনে হল। পরমাসুন্দরী একটি মেয়ে, পোশাক-আশাক উগ্র অথচ মুখটি নিষ্কলুষ কোমল লাবণ্যে ভরা। এই নিষ্কলুষ কোমলতা কতটা স্বাভাবিক এবং কতটা প্রসাধনের মাধ্যমে তৈরি করা বলা শক্ত। মেয়েটি দু-হাতে দুটি সাদা গ্লাভস পরে ট্রেটি বহন করছিল।

রাজেশ মেয়েটিকে ঢুকতে দেখে স্নেহ-বিগলিত কণ্ঠে বলল, ‘এসো গিরিজা, এসো। এই দেখো, তোমার অতিথিরা সবাই উপস্থিত। তাদের কিছু দেখাশুনো করো।’

বীণানিন্দিত অথচ ন্যাকা ন্যাকা গলায় গিরিজা বলল, ‘আমি তো এসে গেছি ড্যাডি। আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে না?’ বলে পদ্মপলাশ লোচন দুটি চট করে একবার সমরেশের ওপর বুলিয়ে দিল। সমরেশ তাতে বড়ই কাতর হয়ে পড়ল।

পরিচয় পর্ব শেষ হলে রাজেশ বললেন, ‘হাতে ও দুটো পরেছ কেন?’

জলতরঙ্গের মতো হেসে উঠে গিরিজা বলল, ‘ও ড্যাডি, তুমি কিচ্ছু জানো না। এটা একটা হাইজিনিক ব্যাপার। ইউরোপে খাবার দেবার সময় সবাই হাতে গ্লাভস পরে নেয়, জানো না বুঝি?’

রাজেশ দন্তবিকাশ করে বললেন, ‘হবেও-বা। ও দুটো পেলে কোথায়? কিনেছ?’

‘না। কাল বিকেলে নম্রতার কাছ থেকে ধার করে এনেছি। ও যখন ল্যাবরেটরিতে কাজ করত তখন এগুলো ব্যবহার করত।’

রাজেশ বললেন, ‘তা ভালো। এবার তাহলে খাবারগুলো দিয়ে দাও, তারপর ও দুটো খুলে ফেল। আমার দেখতে কীরকম বিচ্ছিরি লাগছে।’

‘ও-কে ড্যাড।’ বলে গিরিজা সবাইকে প্লেট সরবরাহ করে গ্লাভস দুটো খুলে ফেলে ঝপ করে সমরেশের পাশে বসে পড়ে দময়ন্তীকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি আমাকে জেরা করবেন না? আপনি হয়তো জানেন না, আমিই আমার দাদুকে খুন করেছি।’ বলে খিলখিল করে জলতরঙ্গের মতো হেসে উঠল। সমরেশ তাতে আরও কাতর হয়ে কাষ্ঠ হাসিতে দাঁত বের করল।

দময়ন্তী কিন্তু সে হাসিতে যোগ দিল না। বিব্রত রাজেশকে বাধা দিয়ে বলল, ‘নিশ্চয়ই তোমাকে জেরা করব। আর যদি তুমি খুন করে থাকো, তোমাকে জেলেও ঢোকাব।’

গিরিজা এইবার একটু গম্ভীর হয়ে গেল। বোধ হয় এরকম জবাব সে প্রত্যাশা করেনি। বলল, ‘বেশ শুরু করুন।’

‘নম্রতা আর তুমি খুব বন্ধু, না?’

‘হ্যাঁ। খুব। অবশ্য নম্রতা আমার চেয়ে বয়সে কিছু বড়ো, তবুও আমরা খুব নিকট বন্ধু।’

‘রামনাথবাবুর সঙ্গে তোমার দাদুর বন্ধুত্বও কী খুব নিকট ছিল?’

‘ছিল বই কী!’

‘না, ছিল না। রামনাথবাবু তোমার দাদুকে পছন্দ করতেন না।’

‘একদম বাজে কথা! আপনাকে যদি কেউ একথা বলে থাকে তো সে মিথ্যে কথা বলেছে। দাদুকে পছন্দ করত না নম্রতা কিন্তু রামনাথবাবু আর দাদু খুবই বন্ধু ছিলেন, রোজ দাবা খেলতেন দুজনে।’

‘নম্রতা তোমার দাদুকে পছন্দ করত না কেন?’

‘তা জানি না। তবে দাদুর কথা উঠলে বা তাঁর গলা শুনলে গম্ভীর হয়ে যেত।’

‘কেন তার কোনো ধারণাই তোমার নেই?’

‘না। তবে দ্বারকাদাস গোয়েঙ্কা বলে কোনো একজন লোক এর মধ্যে আছে। কারণ, নম্রতাকে একদিন বলতে শুনেছিলুম, ওই এলেন তোর দাদু দ্বারকাদাসের হয়ে ওকালতি করতে। আমি তখন জিজ্ঞেস করেছিলুম, যে দ্বারকাদাস কে। তার উত্তরে নম্রতা বলেছিল সে একটা বাজে লোক। পরে দাদুকেও জিজ্ঞেস করেছিলুম। দাদুও কোনো জবাব দেয়নি, গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল।’

‘কতদিন আগে এসব কথাবার্তা হয়েছিল?’

‘তা বছর খানেক হবে। অক্টোবর কী নভেম্বর মাসে। আমার মনে আছে সেদিন বেশ কুয়াশা হয়েছিল। আমি আর নম্রতা সন্ধেবেলা ওদের বাড়ির বারান্দায় র‌্যাপার মুড়ি দিয়ে বসে গল্প করছিলুম। এমন সময় ঘড়াং ঘড়াং শব্দ করে গেটটা খুলে গেল। আমি উঠে দেখতে যাচ্ছিলুম কে এল, তখনই নম্রতা ওই কথাগুলো বলে। অন্ধ হয়ে ওর অন্যান্য অনুভূতিগুলো তো ভীষণ বেড়ে গেছে। অনেক সময় গেট খোলার আওয়াজ পেলেই ও বলে দিতে পারে যে কে আসছে।’

‘দেওরাজ চৌধুরী বলে কাউকে তুমি চেন?’

‘দেওরাজ? চিনি বই কী! ওহ, হি ইজ এ স্ক্রিম!’

‘স্ক্রিম? তার মানে?’

‘মানে? মানে ভীষণ বোকা, ভীষণ মজার একটা ছেলে। হি থিঙ্কস হি ইজ এ হিরো। কিন্তু আসলে ও একটা ইঁদুর।’ বলে হি হি করে হাসতে লাগল গিরিজা। ‘আপনারা যদি ওকে দাদুর হত্যাকারী বলে গ্রেপ্তার করেন, তাহলে যে ও কী খুশিই হবে, কী বলব। ওর অনেক দিনের স্বপ্ন সার্থক হবে। জয়ন্তবাবু কী সব হিসেব করে ওকে ছেড়ে দিয়ে ওকে খুব দুঃখ দিয়েছেন। পুয়োর সোল, কোথায় বস্টন স্ট্র্যাংগলার, জ্যাক দ্য রিপারদের সঙ্গে একসঙ্গে নাম লেখা হবে, তা নয়, সব ভেস্তে দিলেন আপনারা।’

‘তুমি ওকে ঘনিষ্ঠভাবে চেনো মনে হচ্ছে?’

গিরিজা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, আমাদের এখানে একটি অবিবাহিত মেয়ের পক্ষে একটি ভিন্ন পরিবারের অবিবাহিত ছেলেকে ঘনিষ্ঠভাবে চেনা অসম্ভব। তবে, নম্রতার সঙ্গে ওর পরিচয় খুবই ঘনিষ্ঠ, ওদের বাড়িতে ওর যাতায়াত খুব। আর যেহেতু আমি নম্রতার খুব বন্ধু, সেহেতু আমাদের মধ্যে একটা পরিচয় রয়েছে, কথাবার্তাও হয়েছে, নম্রতার কাছেও ওর সম্পর্কে কিছু কিছু কথা শুনেছি। আমি যেসব ধারণা করেছি, সেসব এই ভাবেই হয়েছে।’

দময়ন্তী রাজেশের দিকে ফিরে বলল, ‘দেওরাজ সম্পর্কে আপনার ধারণা কী? ছোটো জায়গা, এখানে আপনারা নিশ্চয়ই ভালো করেই ওকে চেনেন।’

রাজেশ বলল, ‘চিনি বই কী! ভালো করেই চিনি। ছেলেটা চোয়াড়ে কিন্তু বুদ্ধিমান। কাজকর্ম তেমন কিছুই করে না বটে, কিন্তু করলে উন্নতি করত। আর কাজকর্ম করার দরকারই বা কী? নন্দকিশোরবাবু এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ, চুটিয়ে ব্যবসা করছেন। দেওরাজ দু-চার বছর এখনও গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়াতে পারে। তারপর ব্যবসায় ঢুকলেই হল।’

দময়ন্তী চিন্তিত মুখে বলল, ‘তা বটে।’ তারপর আবার গিরিজার দিকে ফিরে বলল, ‘নম্রতার সঙ্গে তোমার খুব বন্ধুত্ব কী করে হল? তোমাদের বাড়ি তো কাছাকাছি নয়।’

গিরিজা বলল, ‘বাঃ, আমরা এক স্কুলে পড়েছি তো। একসঙ্গে গার্ল গাইড করেছি, ক্যাম্পে গেছি। ও অবশ্য আমার চেয়ে সিনিয়র।’

‘আচ্ছা, বেশ।’ বলে দময়ন্তী কিছুক্ষণ গম্ভীর অন্যমনস্কভাবে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, ‘রাজেশবাবু আমি কি একবার নীচে আপনার বাবার ঘরটা একটু দেখতে পারি?’

রাজেশ বললেন, ‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। গিরিজা, নীচে নিয়ে যাও, গিয়ে দরজাটা খোলার ব্যবস্থা কর। খোলা হলে নীচ থেকে টেলিফোন করো, তারপর ওঁদের নিয়ে যাবে।’

গিরিজা তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ও-কে ড্যাড।’ বলে তিন লাফে দরজা পার হয়ে নীচে চলে গেল।

রাজেশ সেদিকে তাকিয়ে সস্নেহ হেসে বললেন, ‘এখনও একেবারে ছেলেমানুষ।’

.

তেজপাল আগরওয়ালের ঘরটি মোটামুটি নিরাভরণ। একটা সিঙ্গল খাট, একটা প্রকাণ্ড সিন্দুক, একটা রাইটিং ডেস্ক, একটা আলমারি এবং একটা আলনা— এই হল আসবাব। ঘরের দেওয়ালে তিনটে ছবি, একটি সিদ্ধিদাতা গণেশের, একটি পুত্র রাজেশের যৌবনকালের এবং অপরটি সপরিবার রাজেশের।

দময়ন্তী চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করে গিরিজাকে প্রশ্ন করল, ‘তোমার ঠাকুমার কোনো ছবি নেই?’

গিরিজা একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘না নেই। বাবার ঘরে ওঁর একটি ছবি আছে অবশ্য। দেখবেন? নিয়ে আসব?’

দময়ন্তী মাথা নেড়ে বলল, ‘না। দরকার নেই। আচ্ছা, তোমার দাদু কি বেরোতে গেলেই সিল্কের পাঞ্জাবি পরে বেরোতেন?’

‘হ্যাঁ। সেই রকমই তো দেখেছি।’

‘উনি কি মাঝে মাঝে কলকাতা যেতেন?’

উত্তরটা দিলেন রাজেশ। বললেন ,’হ্যাঁ। ঘনঘন না হলেও মাঝে মাঝে যেতেন।’

‘উনি যেদিন নিহত হন, তার দু-দিন পরে কলকাতা যাবার টিকিট ওঁর পকেটে ছিল। উনি কি জন্য কলকাতা যাচ্ছিলেন, আপনি জানেন?’

‘না। উনি কেন কবে কলকাতা যাবেন, তা আমাকে আগে থেকে জানাতেন না বা জানানো প্রয়োজন মনে করতেন না। যাবার দিন বলতেন, আমি চললুম, দু-তিন পরে ফিরব।’

‘ওঁর হার্টের অসুখ ছিল। আপনারা একা যেতে দিতেন কেন?’

‘ওঁর সঙ্গে ওষুধ থাকত। তা ছাড়া তিনি একা যাওয়াই পছন্দ করতেন।’

‘আচ্ছা, গিরিজা এই ছবিতে দেখছি একটা স্কুল ইউনিফর্ম পরে রয়েছে। কোন স্কুল?’

গিরিজা বলল, ‘সেন্ট বার্নাবাস কনভেন্ট স্কুল। এটাও কি দাদুর হত্যারহস্যের একটা সূত্র নাকি? না, এমনি কৌতূহলের বশে প্রশ্নটা করলেন?’

দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘বলব কেন?’ তারপর রাজেশকে নমস্কার করে বলল, ‘আচ্ছা, তাহলে আজ চলি রাজেশবাবু। আজকের মতো আমার কাজ শেষ। যদি প্রয়োজন মনে করি, তাহলে হয়তো ভবিষ্যতে আবার আপনাকে বিরক্ত করতে আসব।’

.

দময়ন্তী চান-টান করে বসবার ঘরে ঢুকে দেখে জয়ন্ত অত্যন্ত ব্যাজার মুখ করে একটা চেয়ারে বসে আছে, আর সমরেশ এক মনে একটা স্পোর্টস জার্নাল পড়ে যাচ্ছে।

‘কী হল জয়ন্ত তোমার? অমন মুখ করে বসে আছ কেন?’ সহাস্যে জিজ্ঞেস করল দময়ন্তী।

‘মুখের আর দোষ কী বলো?’ জয়ন্ত বলল, ‘ভাবছি। আর, যতই ভাবছি, ততই সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে। আমি মাস্টার মশাইয়ের পরিবারকে যতটা ছেড়ে ছেড়ে তদন্ত করেছি, তুমি তো তা করোনি। কাজেই তোমার সঙ্গে থেকে অজস্র সূত্র এসে গেছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা ধরব, বুঝতে পারছি না।’

দময়ন্তী একটা ডিভানের ওপর বসে বলল, ‘কী কী সূত্র পেলে, শুনি?’

‘এই তো দেখ না, সম্ভাব্য হত্যাকারীর সংখ্যা হঠাৎ ভীষণ বেড়ে গেল।’

‘কীরকম?’

‘প্রথমে ধরো, রামনাথ সরফের কথা। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে তিনি তেজপালকে পছন্দ করতেন না। কেন করতেন না তা তিনি বলেননি বটে, কিন্তু আমরা জানি দ্বারকাদাস, যে তাঁর সংসার ছারখার করে দিয়েছে, আর তেজপালের বন্ধুত্ব তাঁর পক্ষে সহ্য করা কঠিন ছিল। এবং হয়তো তেজপাল তাঁকে চাপাচাপি করেছিলেন তাঁর দুই নাতিকে ফেরত নেবার জন্য। সেটা হয়তো তাঁর পক্ষে আরও অসহ্য বলে মনে হয়েছিল। তা ছাড়া তেজপাল কেন সে রাত্রে তাঁর বাড়িতে আসছিলেন তাও সম্ভবত তিনি জানেন, কিন্তু বলতে অস্বীকার করেছেন। নিশ্চয়ই সেকথা গোপন করলে তাঁর লাভ আছে।

‘দ্বিতীয়ত, নম্রতা। গিরিজার সাক্ষ্য অনুসারে সেও তেজপালকে পছন্দ করত না। সে বন্দুকবাজ পরিবারের মেয়ে। তার পক্ষে বন্দুক চালাতে জানা অসম্ভব নয়। রাত্রিবেলা গেটের শব্দ শুনে সে হয়তো শব্দভেদী গুলি ছুড়েছিল। হাতে গ্লাভস পরে নিয়েছিল বলে আঙুলের ছাপ পড়েনি বন্দুকে। সে অন্ধ। যদিও সে জানে তাকে কেউ সন্দেহ করবে না, তবু হয়তো সে উগ্রতা দেখিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইছে। মানে, যাকে বলে অফেন্স ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স।

‘তৃতীয়ত, রামনাথের দুই নাতি। এদের বয়স চব্বিশ আর বাইশ। খুব ছোটোবেলা থেকে কুৎসিত পরিবেশে মানুষ। এখন এদের অবস্থা পড়ে গেছে। এরা যদি এই খুনটা সাজিয়ে থাকে, তাহলে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। রামনাথ বা নম্রতা যে বারংবার বলছেন যে কেউ তোমাকে এই তদন্তে লাগিয়ে কোনো স্বার্থসিদ্ধি করতে চাইছে, তখন হয়তো এই দুজনকেই চিন্তা করছেন তাঁরা। রামনাথ বা নম্রতার যে কেউ ফেঁসে গেলে কাদের লাভ, বুঝতে তো কোনো অসুবিধে হয় না। রামনাথের সম্পত্তির প্রতি তাদের সংগত কারণেই লোভ থাকা স্বাভাবিক। আর পিতৃঘাতক বিপিতা দ্বারকাদাসের সঙ্গে তেজপালের বন্ধুত্ব থাকায় তাঁর ওপর ওদের প্রচণ্ড রাগ থাকাও অসম্ভব নয়। এই হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে তারা হয়তো এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চাইছে।

‘চতুর্থত, দেওরাজ…’

দময়ন্তী বাধা দিল। বলল, ‘উঁহু। দেওরাজ বলবে না। আগে তার সঙ্গে দেখা করি, তারপর তার সম্বন্ধে কথা। কিন্তু তুমি আরও দুজনকে ছেড়ে যাচ্ছ।’

জয়ন্ত আরও বিমর্ষ মুখ করে বলল, ‘আরও দুজন? তারা আবার কারা?’

‘আনোয়ার আর নাসির। সেই রিক্সাওয়ালা দুজন।’

জয়ন্ত সন্দিগ্ধভাবে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি ঠাট্টা করছ না তো?’

দময়ন্তী ফিকে হাসল। বলল, ‘মোটেই নয়। বাংলায় বলে জানো তো— যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পার…’

জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলল, ‘যাই বলো না তুমি, আনোয়ার আর নাসির কক্ষণও তোমার ওই অমূল্য রতন হতেই পারে না।’

দময়ন্তী এবার একটু জোরে হেসে উঠল। বলল, ‘সে তো তুমি রামনাথ সম্পর্কেও এই একই কথা বলেছিলে, মনে আছে? আর শুধু আনোয়ার আর নাসির কেন? রাজেশ আগরওয়ালকেও তুমি বাদ দিতে পারো না। লক্ষ করে দেখো, তেজপাল মারা যাওয়াতে সদ্য সদ্য লাভ হয়েছে কিন্তু তাঁর। তা ছাড়া, অন্য একটা কারণেও হয়তো তাঁর বাপের প্রতি অসন্তোষ ছিল।’

‘কী কারণ?’

‘আমার বিশ্বাস, তেজপাল দুশ্চরিত্র লোক ছিলেন।’

‘চমৎকার! তুমি বেশ সুচারুভাবে আমাকে আপাদমস্তক গুলিয়ে দিয়েছ। এখন চলো তাহলে, মাথার কাজটা সাময়িকভাবে বন্ধ রেখে খাওয়াটা সেরে নেওয়া যাক। তারপর বিকেলবেলা আবার বেরোনো যাবে।’

সমরেশ অবিলম্বে স্পোর্টস জার্নাল বন্ধ করে বলল, ‘উত্তম প্রস্তাব।’

.

নতুন লালকুঠিপাড়ার একেবারে মুখেই নন্দকিশোর চৌধুরীর অতি সুদৃশ্য বাংলো। আধুনিক আর্কিটেকচারের একটি সুন্দর নিদর্শন। সামনে প্রশস্ত লন বুক-সমান উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পেছনে ও দু-পাশে প্রচুর গাছপালা ও বাগান। গেটে একজন নেপালি ইউনিফর্ম পরিহিত দারোয়ান আর লনের চারদিকে পাথরে বাঁধানো রাস্তার ওপর সঞ্চরমান গোটা তিনেক ডোবারম্যান আর দুটো গ্রেট ডেন কুকুর। বাড়ির মালিক কেন যে পাঁচিলটা বেশি উঁচু করেননি, তা বেশ স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছিল।

দময়ন্তী গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। বলল, ‘আমি কিন্তু ভেতরে যাব না।’

জয়ন্ত আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘কেন?’

‘এমনি। তুমি দেওরাজকে বাইরে আসতে বলো। আমরা এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলব।’

একটি সম্পূর্ণ অপরিচিত মোটা গলা পেছন থেকে বলল, ‘আপনি কুকুরগুলোকে ভয় পাচ্ছেন, না? ভয় নেই। আমি ব্যবস্থা করছি।’

তিনজন পেছন ফিরে বক্তার দিকে তাকাল। ইনি ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত একজন অবাঙালি ভদ্রলোক, অত্যন্ত সুপুরুষ যদিও মুখে বয়সের ছাপ আর অপ্রকট নেই, চকচকে কালো চুল স্পষ্টতই কলপ লাগানো, তীক্ষ্ন চোখে রিমলেস সোনার ফ্রেমের চশমা।

জয়ন্ত বলল, ‘আরে নন্দকিশোরবাবু যে! আমরা এসে গেছি। আপনাকে তো আগেই বলে রেখেছিলুম।’

নন্দবাবু সোনা বাঁধানো দাঁত বের করে হাসলেন। ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। ঠিক আছে। দেওরাজকেও বলে রেখেছি, সে বাড়িতেই আছে। আপনারা একটু দাঁড়ান, আমি কুকুরগুলোকে বেঁধে রেখে আসছি।’ বলে ভদ্রলোক গেটের কাছে এগিয়ে গিয়ে জোরে ডেকে হিন্দিতে বললেন, ‘দেওরাজ। কুকুর বাঁধো।’

অমনি ঘরের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘ তীক্ষ্ন শিসের আওয়াজ ভেসে এল আর তৎক্ষণাৎ কুকুরগুলো একদৌড়ে ঘরের ভেতর চলে গেল।

নন্দবাবু হেসে বললেন, ‘আমার ছেলের গুণ দেখেছেন তো? কুকুর ট্রেনিং দিতে সে ওস্তাদ। আর কিছু না পারুক, এটা পারে। এবার ভেতরে চলুন, কোনো ভয় নেই।’

নন্দকিশোরের বাড়ির ভেতরটা বাইরের মতোই সুদৃশ্য বটে, তবু দময়ন্তী ভেতরে ঢুকতে চাইল না। নার্ভাস হাসি হেসে বলল, ‘আমরা এই লনেই বসি না? এই তো বেশ ভালো হাওয়া দিচ্ছে।’

নন্দকিশোরবাবু সহাস্যে বললেন, ‘এখনও ভয় গেল না? আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি দেওরাজকে এখানেই পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনারা ততক্ষণ এই বেতের চেয়ারগুলোতে বসুন।’ বলে ভেতরে চলে গেলেন।

দেওরাজ যখন বেরিয়ে এল, তখন সকলেই কিন্তু তাকে দেখে একটু আশ্চর্য হয়ে গেল। শোনা গিয়েছিল সে অত্যন্ত দুশ্চরিত্র, দরকচা মারা চেহারা, অতিশয় শয়তান ইত্যাদি, কিন্তু জলজ্যান্ত লোকটাকে কিন্তু অতটা ভয়ঙ্কর বলে মনে হল না। সে রোগা সন্দেহ নেই, বেশ লম্বা, মাথায় বড়ো বড়ো চুল কিন্তু মুখটা কেমন যেন বিষণ্ণ, অন্যমনস্ক। দুশ্চরিত্র লোকেদের সাধারণত চোখদুটি চঞ্চল আর সতর্ক হয়, কিন্তু এর চোখদুটি শান্ত, অনূগ্র।

মৃদু হেসে সবাইকে নমস্কার করে দেওরাজ একটি চেয়ার টেনে বসল। দময়ন্তীকে সম্বোধন করে বলল, ‘আমাদের পরিচিত হবার দরকার নেই, কারণ আমি আপনাদের চিনি, আপনারাও আমাকে চেনেন। শুনেছি, তেজপাল আগরওয়ালের হত্যারহস্যের আপনি তদন্ত করছেন এবং আমার কাছে কিছু সংবাদ আপনি চান বা জেরা করতে চান। তাহলে দেরি না করে শুরু করে দিন।’ কথাগুলো নীচু গলায় বলা হলেও তার মধ্যে যে একটা রূঢ় ঔদ্ধত্য ছিল সেটা সকলেরই কানে বাজল।

দময়ন্তী কিন্তু সেটাকে পাত্তা দিল না। বেশ সহজভাবে বলল, ‘আমি আপনাকে জেরা করতেই এসেছি। আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে, যে কজনকে হত্যাকারী বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, তার মধ্যে আপনি অন্যতম?’

‘জানি। তাহলে জেরা করুন। আপনার সব প্রশ্নেরই সাধ্যমতো জবাব দেব আমি।’

দময়ন্তীর প্রথম প্রশ্ন শুনে সকলেই হতবাক। ‘আপনি কী জানেন যে দুশ্চরিত্র বলে আপনার একটা ভয়ানক বদনাম আছে?’

রক্তিম মুখে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দেওরাজ বলল, ‘তেজপালের মৃত্যুর সঙ্গে আপনার এই প্রশ্নের কী সম্পর্ক আছে আমি জানি না। আর যদিও এটা একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন, তবু আমার বলতে বাধা নেই যে, হ্যাঁ, আমি জানি। তবে আমি কোনো পরিবারের মধ্যে হাত বাড়াই না, পেশাদার বাজারের মেয়েছেলের কাছে মাঝে মাঝে যাই বটে!’

‘আপনার যেতে ভালো লাগে?’

অনেকক্ষণ নতমস্তকে নীরব থেকে দেওরাজ মুখ তুলে বলল, ‘না। অত্যন্ত খারাপ লাগে।’

‘তবু যান কেন?’

‘মাঝে মাঝে ভেতরে একটা তীব্র আর্জ আসে। তখন যাই। কিন্তু, পরে মুখের ভেতরটা তেতো হয়ে থাকে। কিন্তু এসব জেনে আপনার লাভ কী?’

‘পরে বলব। আপনি আদৌ এ পথে পা বাড়িয়েছিলেন কেন?’

বিষণ্ণ মুখ আকাশের দিকে তুলে দেওরাজ বলল, ‘একটি মেয়ে আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। টাকার লোভে সে আমাকে অপমান করেছিল। তখন সমস্ত নারীজাতির ওপর আমার একটা প্রচণ্ড ঘৃণার সৃষ্টি হয়। একজনকে অপমান করে আমি গায়ের ঝাল মেটাতে চেয়েছিলুম। তাই গিয়েছিলুম। পয়সা দিয়ে যা খুশি অপমান করব, তাই।’

‘পরে সেটা কিছুটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়?’

‘হ্যাঁ।’

‘সে মেয়েটি কে?’

‘একটি বাঙালি মেয়ে। ফুলডিহি ব্যারাজের টাইম কিপারের মেয়ে, যার নাম ছিল রানি, কিন্তু তার মনোবৃত্তি ছিল ছোটোলোকের।’

‘আপনি যে বিরাট বড়োলোক, সেটা সে জানত না?’

‘না। আমি বলেছিলুম, আমি নন্দকিশোর চৌধুরীর একজন সরকার। সামান্য মাইনে পাই। আমার ধারণা ছিল, আমার অনেক টাকা আছে জানলে সে আর এগোবে না। আমার মস্ত ভুল হয়েছিল। হঠাৎ সে একদিন অদৃশ্য হয়ে যায়। যাবার আগে আমাকে একটা চিঠি লিখে রেখে যায়, তাইতে ব্যাপারটা বুঝতে পারি।’

‘আপনি যে বাজে জায়গায় যান, সেটা কি প্রকাশ্যে না গোপনে?’

‘আমাদের সমাজে প্রকাশ্যে যাওয়া কি সম্ভব?’

‘না, তা অবশ্য নয়। তাহলে, আপনার এই বদনামটা রটাল কে?’

‘কে আবার? যারা আমাকে ওখানে দেখেছে, তারাই। আমাদের সকলেই তো আর সাধুপুরুষ নয়।’

‘যারা আপনাকে ওখানে দেখেছে বলছেন, তাদের কাউকে কি আপনি চেনেন?’

‘কাউকে কাউকে চিনি।’

‘তেজপাল আগরওয়াল কি তাদের মধ্যে একজন?’

বেশ কিছুক্ষণ স্তম্ভিত মুখে দময়ন্তীর দিকে তাকিয়ে রইল দেওরাজ, তারপর আস্তে আস্তে একটা ব্যঙ্গাত্মক বাঁকা হাসিতে মুখটা বিকৃত হয়ে গেল। বলল, ‘ও, এতক্ষণ এতসব সহানুভূতিসূচক কথাবার্তার কারণটা এইবারে বুঝলুম। তেজপালকে খুন করার কি মোটিভ আমার থাকতে পারে সেটা বের করাই আপনার আসল উদ্দেশ্য। সে আমার নামে বদনাম রটিয়েছে আর তাই আমি তাকে খুন করেছি।’

দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘আপনি যা বুঝেছেন তা খানিকটা সত্য, সর্বাংশে সত্য নয়।’

‘সর্বাংশে সত্যটা কী?’

‘সেটা পরে বলব। তবে আপনাকে এটুকু বলতে পারি, আমার প্রশ্নের জবাব দিলে আপনি অকারণে বিপদে পড়বেন না।’

কাঁধ ঝাঁকিয়ে জোরে জোরে হেসে উঠল দেওরাজ। বলল, ‘সে কথা বিশ্বাস করা শক্ত। তা হোক, তবু আমি আপনার প্রশ্নের জবাব দেব। হ্যাঁ, তেজপাল আগরওয়াল আমাকে বেশ্যাপল্লিতে যাতায়াত করতে দেখেছেন, কারণ তিনিও সেখানে একদা নিয়মিত খরিদ্দার ছিলেন। তিনিই আমার নামে বদনাম রটান।’

‘যেদিন তেজপাল নিহত হন, সেদিন লোড শেডিংয়ের মধ্যে আপনি রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছিলেন কেন?’

‘এ পাড়ায় সকলেই জানে যে রাত্রি ন-টার পর আমি রাস্তায় নিয়মিত পায়চারি করি আমার কুকুরগুলোকে নিয়ে। এতে তাদের স্বাস্থ্যও ভালো থাকে, আমারও থাকে।’

‘সেদিন আপনার সঙ্গে কুকুরগুলো ছিল না কেন?’

‘ছিল। আমার সঙ্গে দুজন রিক্সাওয়ালার ধাক্কাধাক্কি লাগার পর আমি যখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই, তখন তারা বাড়ি চলে যায়।’

‘প্রভুভক্ত কুকুরের পক্ষে এটা একটা অত্যন্ত অস্বাভাবিক ব্যবহার নয় কি?’

দেওরাজ একটা ধাঁধা-লাগা হাসি হাসল। বলল, ‘অস্বাভাবিক কি? জানি না। কিন্তু ব্যাপারটা কী? আপনার উদ্দেশ্য তো রামনাথকে হত্যাকারী বলে প্রমাণিত করা। তা আমাকে এসব প্রশ্ন করে ফাঁসিয়ে দেবার ভয় দেখিয়ে বা ব্ল্যাকমেল করে আপনি কি আমাকে দিয়ে সাক্ষ্য দেওয়াতে চান যে আমি দেখেছি রামনাথই হত্যাকারী? যেহেতু আমি সেখানে নিজে উপস্থিত ছিলুম, অতএব আমার সাক্ষ্যই সবচেয়ে জোরদার হবে, এই ভেবেছেন আপনি? কিন্তু, আমি আপনাকে স্পষ্ট জানিয়ে রাখছি যে প্রয়োজন হলে আমি সমস্ত দোষ নিজের ঘাড়ে নেব, তবু অন্যের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেব না।’

দময়ন্তী তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে দেওরাজের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। মৃদু গলায় বলল, ‘আপনারা নিশ্চিত যে আমি রামনাথকে ফাঁসানোর জন্য এসেছি, তাই না?’

কোনো জবাব না দিয়ে দেওরাজ ওপরে নীচে ঘাড় নাড়ল।

দময়ন্তী বলে চলল, ‘আপনি এ বিষয়েও নিশ্চিত যে রামনাথ হত্যাকারী নন, তাই না?’

দেওরাজ এবারও জবাব দিল না। পূর্ববৎ ঘাড় নাড়ল।

‘কিন্তু, আপনি জানেন হত্যাকারী কে এ বিষয়েও আপনি নিশ্চিত, তাই না?’

এবার দেওরাজ বিরাট জোরে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে কোনোরকমে দম নিয়ে বলল, ‘মিসেস দত্তগুপ্ত, আপনার বুদ্ধির খুব সুনাম শুনেছি। কিন্তু আজ দেখছি, দূর থেকে যতটা শোনা যায়, কাছে এলে ততটা আর মনে হয় না। আমি দুঃখিত মিসেস দত্তগুপ্ত, কে হত্যাকারী হতে পারে এ বিষয়ে আমার সামান্যতম ধারণাও নেই।’

দময়ন্তী আগের মতোই মৃদু গলায় বলল, ‘মিস্টার চৌধুরী, আমার সামান্য বুদ্ধিতে আমি বুঝতে পারছি যে আপনি জানেন যে হত্যাকারী কে। আপনি তাকে স্বচক্ষে দেখেছেন এবং আপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাকে আড়াল করে রাখতে চাইছেন।’

দেওরাজ আর হাসছিল না, অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে দময়ন্তীর মুখের দিকে চেয়ে ছিল। দময়ন্তীর কথা শেষ হবার পরও অনেকক্ষণ গম্ভীর চিন্তিত মুখে চুপ করে রইল। তারপর বিড়বিড় করে বলল, ‘আমি কাউকে দেখিনি, আমি কিছু জানি না। আমার আপনাকে আর কিছু বলবার নেই।’ বলে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে বাড়িতে চলে গেল।

.

১০

দেওরাজ ভিতরে চলে যাওয়ার পরও তিনজনে বসে রইল। দেওরাজের সঙ্গে ইন্টারভিউটা এরকম দাঁড়াবে স্পষ্টতই কেউই তা অনুমান করেনি।

জয়ন্ত বলল, ‘আমি এটুকু বুঝতে পারছি যে তুমি তোমার সন্দেহভাজনদের লিস্ট থেকে দেওরাজের নামটা কেটে দিয়েছ, তাই না?’

দময়ন্তী মাথা নাড়ল। বলল, ‘না, তোমার অনুমান সম্পূর্ণ ভুল। আমার লিস্টে দেওরাজের নাম আগে যেখানে ছিল, এখন তার চেয়ে আরও ওপরে উঠে এসেছে।’

‘কী আশ্চর্য! আমি তো ভাবছিলুম তুমি কে হত্যাকারী তা ধরেও ফেলেছ বোধ হয়।’

‘না, জয়ন্ত। এখনও ধরতে পারিনি। তুমি যাদের সন্দেহ করছ, আমিও তাদেরই সন্দেহ করছি। তবে, মনে হচ্ছে অন্ধকার কেটে যাবে। তার কিছু কিছু লক্ষণও দেখতে পাচ্ছি।’

‘কি যে তুমি দেখতে পাচ্ছ তুমিই জানো। এখন আমরা তাহলে কী করব?’

‘তুমি একবার ভেতরে গিয়ে নন্দকিশোরবাবুকে ডেকে আনতে পারো? তার সঙ্গে কিছু কথা বলতে পারলে ভালো হত।’

ডাকার দরকার হল না। দময়ন্তীর কথার মধ্যেই ভদ্রলোক বারান্দায় বেরিয়ে এসেছিলেন। তিনজনে একসঙ্গে তাঁর দিকে তাকাতে, বারান্দা থেকে নেমে এসে একটা চেয়ার অধিকার করে বসে দময়ন্তীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি আমাকেও জেরা করতে চান?’

দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ। যদি আপনি কিছু মনে না করেন।’

‘না, না, মনে করব কেন? আপনি কি আমাকেও সন্দেহ করেন নাকি?’

‘করি। ব্যবসাসূত্রে আপনার আর তেজপালের মধ্যে শত্রুতা থাকা অসম্ভব নয়।’ দময়ন্তী তখনও হাসছে।

এবার নন্দকিশোরও হেসে উঠলেন। বললেন, ‘তা হয়তো নয়। তবে তা যদি হত, তাহলে কি আর আমি তেজপালকে নিজে খুন করতুম? গুন্ডা লাগিয়ে ধানবাদ বা কলকাতার যেসব কুৎসিত পল্লিতে ওর যাতায়াত, সেখানেই ওকে শেষ করিয়ে দিতুম। তাতে রিস্ক অনেক কম হত। তবে তার চেয়েও বড়ো কথা, ওর আর আমার ব্যবসার মধ্যে কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব নেই বা ছিল না।’

‘আচ্ছা, ওকথা বাদ দিন। আসলে, আপনাকে আমি যে প্রশ্নটা করতে চাই তা হল, দেওরাজ তেজপালকে খুন করেছে বলে পুলিশ যে সন্দেহ করছে, সে বিষয়ে আপনি কী বলেন?’

নন্দকিশোর হাত নেড়ে বললেন, ‘আমি আর কী বলব বলুন? আমি ওর বাপ, ওর সম্পর্কে আমার ধারণা তো পক্ষপাতশূন্য হতে পারে না। তবু আমার ধারণা, যদি জানতে চান তো বলি। আমার বিশ্বাস ও খুন করেনি, কারণ খুন ও করতে পারে না, যতই ওর বদনাম থাক না কেন। তবে, যদি করত তাহলে ওকে আমি আশীর্বাদ করতুম।’

‘তেজপাল কি এতই অসৎ লোক ছিলেন?’

‘তেজপালের মতো এরকম আদ্যন্ত শয়তান দুনিয়ায় খুব বেশি জন্মায় না।’

‘তাই যদি হবে, তাহলে আপনারা রামনাথকে সাবধান করে দেননি কেন?’

‘করে দিয়েছিলুম, কিন্তু তাতে খুব লাভ হয়নি। তার কারণ, প্রথমত তেজপাল আর রামনাথের দুই পরিবার দীর্ঘদিনের পরিচিত, আর দ্বিতীয়ত, বৃদ্ধ বয়সে রামনাথকে দাবার নেশায় পেয়েছিল আর তেজপাল ভালোই দাবা খেলত। কাজেই, রামনাথের বাড়ির দরজা তেজপালের জন্য খোলাই থাকত। আমরা বন্ধ করাতে পারিনি। তবে, একথা বলব, রামনাথ তেজপালের সঙ্গে দাবা খেলতেন ঠিকই, কিন্তু তাকে কখনই বিশ্বাস করতেন না বা পছন্দ করতেন না।’

‘একজন কিন্তু বলেছেন যে কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। রামনাথ আর তেজপালের মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল।’

‘কে বলেছে? রাজেশ তো? ও তো তা বলবেই। রামনাথ যদি ফেঁসে যান, মামলামোকদ্দমায় তাঁর টাকা পয়সা যদি লাটে ওঠে, তাহলে কমলজিতের দুই কুপুত্তুর ওর ঘাড়ে চড়তে পারে, এ ভয় তার আছে। কাজেই, সে রামনাথের বিরুদ্ধে কিছু তো বলবেই না এখন, এমনকী রামনাথের বিরুদ্ধে যেতে পারে এমন কোনো কথাও সে বলবে না।’

দময়ন্তীর চোখ দুটো ছোটো হয়ে এল। সংযত গলায় বলল, ‘আর একটু খোলসা করে বলুন।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে নন্দকিশোর বললেন, ‘খোলসা করে কী আর বলব। বড্ড নোংরা ব্যাপার। কমলজিতের স্ত্রী লতা তার স্বামীর মৃত্যুর পর দ্বারকাদাস গোয়েঙ্কা বলে একটা লোকের সঙ্গে দুই শিশুপুত্রকে নিয়ে ইলোপ করে। দ্বারকাদাসকে তার বাপ তৎক্ষণাৎ ত্যাজ্যপুত্র করেন এবং সে বোম্বাইতে গিয়ে সিনেমার ব্যবসা শুরু করে। এরকম লোকের সঙ্গে ভদ্রলোকেরা সাধারণত সংশ্রব রাখেন না, কিন্তু তেজপাল অন্য ধাতুর লোক ছিল। সে দ্বারকাদাসের সঙ্গে রীতিমতো সম্পর্ক বজায় রেখে চলল। দ্বারকাদাসও অত্যন্ত পাজি লোক ছিল, কিন্তু বোম্বাইতে গিয়ে সে বিশেষ কোনো সুবিধা করতে না পারায় একমাত্র বন্ধুরূপে পরিচিত তেজপালের জালে জড়িয়ে গেল। ফলে, লতার ওপর তার স্বত্বও ত্যাগ করতে হল। শুনেছি, তাকে সামনে শিখণ্ডী খাড়া করে তেজপাল লতার সঙ্গে অন্তরঙ্গতা চালিয়ে গেছে। এবং এটাই তার আসল উদ্দেশ্য ছিল।’

‘এ কথাটা আপনারা রামনাথকে জানিয়েছিলেন?’

‘না। তবে তিনি সম্ভবত জানতেন।’

‘এই কাহিনির বোধ হয় একটা অন্যরকম উপসংহার আছে, তাই না?’

‘ঠিক তাই। লতা ছিল পরমা সুন্দরী, সেই জন্যে তেজপাল বোধ হয় তাকে ছাড়তে পারছিল না। আজ তার বয়স চল্লিশের ওপর হবে, কিন্তু শুনেছি এখনও তার সৌন্দর্যের বিশেষ কোনো হানি হয়নি। সেই আগুনের চারদিকে দ্বারকাদাস ঘুরঘুর করেছে কিন্তু তেজপালের জাল কেটে এগোতে পারেনি। ফলে, মদ খেয়ে বছর পাঁচেক আগে সে নিজেকে শেষ করে। তারপর শুরু হয় একটা অপ্রত্যাশিত খেলা।

তেজপাল এতদিন লক্ষ করেনি যা, তা হল আজ এত বছরে কমলজিতের দুই ছেলে বড়ো হয়ে উঠেছে। তারা যে পরিবেশে মানুষ হয়েছে, তাতে তাদের মানুষ হয়ে ওঠা খুবই কঠিন ছিল, কিন্তু তারা দুজনে যা তৈরি হয়েছে তাকে অমানুষ বললে অত্যন্ত কম বলা হয়। শয়তানিতে তারা দুজনেই তেজপালকে টেক্কা দিতে পারে। দ্বারকাদাস মারা যেতেই তেজপাল যখন কেটে পড়তে চাইল, তখন এই দুই মূর্তিমান পথ রোধ করে দাঁড়াল।’

দময়ন্তী রুদ্ধনিশ্বাসে বলল, ‘ব্ল্যাকমেল?’

‘স্বাভাবিক। ব্ল্যাকমেল ছাড়া আর কীই-বা হতে পারে। তাদের কাছে তো কোনো কিছুই পবিত্র নয়, তাদের হারাবার কিছু নেই। কিন্তু, তেজপাল সমাজের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি, তার সংসার আছে, ব্যবসা আছে। কাজেই সে পড়ে পড়ে মার খেতে লাগল।’

সমরেশ বলল, ‘নিজের পুত্রবধূস্থানীয় একটি মেয়ের সঙ্গে অসভ্যতা করলে এই রকমই হয়।’

‘পুত্রবধূ! সমরেশবাবু, তেজপালের কাছে সম্পর্ক, বয়স, জাত, কোনো কিছুই বাধা ছিল না।’

জয়ন্ত প্রশ্ন করল, ‘তিনি রামনাথকে তাঁর দুই নাতিকে আশ্রয় দেবার জন্য চাপাচাপি করেন নি? তাদের তো কোনো দোষ ছিল না।’

‘তা জানি না। তবে চাপাচাপি করে কোনো লাভ হত না, কারণ আমরা সকলেই জানি যে আজ থেকে বহু বছর আগে রামনাথ তাঁর সমস্ত সম্পত্তি তাঁর মেয়ে মণীষাকে দানপত্র করে দিয়ে গেছেন। সে উইল অতি জোরদার জিনিস, আদালতে চ্যালেঞ্জ করে কোনো লাভ হবে না।’

‘সে উইলের একজন সাক্ষী কি আপনি?’ দময়ন্তী প্রশ্ন করল।

‘হ্যাঁ।’

‘দেওরাজ অন্যতম সাক্ষী নয়? সে তো উকিল।’

‘না। এই উইল যখন তৈরি হয়, দেওরাজ তখন ছেলেমানুষ।’

‘অর্থাৎ নম্রতা আজ একটা বিরাট সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী:?’

‘হ্যাঁ।’ মৃদু হেসে বললেন নন্দকিশোর।

‘আপনি দেওরাজের সঙ্গে নম্রতার বিয়ে দেন না কেন? দুটো বিরাট সম্পদ এক হতে পারে।’

নন্দকিশোর জোরে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘সেটা তো সম্ভব নয়। কারণ দেওরাজ আর নম্রতার মধ্যে একটা ভারি সুন্দর সম্পর্ক আছে। সেটা স্নেহের আর সহানুভূতির। দেওরাজ নম্রতাকে নিজের বোনের মতো ভালোবাসে। তার যত দুঃখের কথা সব নম্রতার কাছে বলা চাই আর নম্রতার সমস্ত অসুবিধের ভার তার নেওয়া চাই।’

দময়ন্তী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। বলল, ‘তেজপালের তো বুঝতে পারছি নিজের স্বার্থ ছাড়া দুনিয়ায় আর কিছুই পবিত্র নয়। সেক্ষেত্রে এত বড়ো সম্পত্তির মালিক, সুন্দরী অথচ অন্ধ, নম্রতাকে ফুসলাবার চেষ্টা তিনি করেছিলেন নিশ্চয়ই। তাই না?’

নন্দকিশোর অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। যখন মুখ তুললেন, তখন সে মুখ কোন অন্তর্গূঢ় যন্ত্রণায় কালো হয়ে গিয়েছে। ভগ্নকণ্ঠে বললেন, ‘আমার তা জানা নেই।’

.

১১

বাড়ি থেকে বেরিয়ে জয়ন্ত জিজ্ঞেস করল, ‘এবার কোথায় যাবে?’

দময়ন্তী বলল, ‘আমি এবার বাড়ি যাব। মাথার মধ্যে সমস্ত কেমন উলটোপালটা হয়ে যাচ্ছে। কোনো কিছুই ঠিক মতো ধরতে পারছি না। একটু নির্জনে চিন্তা করা দরকার। কিন্তু তুমি একটু আমায় দুটো কাজ করে দাও। প্রথম, সেন্ট বার্নাবাস কনভেন্ট স্কুলে গিয়ে খোঁজ নিয়ে এসো যে গিরিজা আর নম্রতা কতটা বন্ধু ছিল। দ্বিতীয়, রানির একটা খোঁজ করো। অনেকদিন আগেকার ব্যাপার তো নয়, হয়তো অনেকেই ঘটনাটা মনে রেখেছে।’

জয়ন্ত বলল, ‘বেশ। দুটো খবরই এনে দিচ্ছি।’

‘আর একটা কথা। পুরোনো লালকুঠিপাড়া থেকে নতুন লালকুঠি পাড়ায় আসাবার কোনো শর্টকার্ট রাস্তা আছে?’

‘আছে। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পায়ে চলা পথ আছে। খুব তাড়াতাড়ি আসা যায়। রাস্তাটা এসে নন্দকিশোরবাবুর বাড়ির পেছনেই শেষ হয়েছে। চাও তো দেখে নিতে পারো।’

দময়ন্তী মাথা নাড়ল। বলল, ‘দরকার নেই।’

১২

জয়ন্ত টুপিটা খুলে একটা সোফার ওপর ধপ করে বসে পড়ল। অন্য একটা সোফার ওপর উপবিষ্ট দময়ন্তীকে সম্বোধন করে বলল, ‘তোমার নির্জনে চিন্তা করা হল?’

মৃদু হেসে দময়ন্তী বলল, ‘হ্যাঁ, হল।’

‘কিছু পেলে?’

‘তেমন কিছু নয়। তুমি কিছু খবর এনেছ?’

‘হ্যাঁ। বেশ ইন্টারেস্টিং খবর। ব্যারাজের টাইম কিপার সুদর্শন সাহার মেয়ে রানি সাহা কলকাতার একটা ফার্মে একটা মোটা মাইনের চাকরি পায়, পরে সেই ফার্মের ম্যানেজার সুবল দত্তর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। কিন্তু হঠাৎ কিছুদিন বাদে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে বসে। কলকাতা পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী সেটা আত্মহত্যাই। এখন, ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে, রানি সাহাকে কলকাতায় চাকরিটা জোগাড় করে দিয়েছিলেন তেজপাল আগরওয়াল। সুদর্শনের সঙ্গে গায়ে পড়ে আলাপ জমিয়ে তিনি তাঁর পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন। তাঁদের মাঝে মাঝে টাকা পয়সা দিয়েও সাহায্য করতেন। এ সমস্ত ঘটনাটা ঘটে বছর দেড়েক আগে।’

দময়ন্তী বিষণ্ণ গম্ভীর মুখে জয়ন্তর কথা শুনছিল। বলল, ‘আমি এরকমই কিছু একটা অনুমান করেছিলুম বটে, তবে এতটা নয়। আর দ্বিতীয় খবরটা?’

‘দ্বিতীয় খবর হচ্ছে, সেন্ট বার্নাবাস কনভেন্ট স্কুলের প্রিন্সিপাল মিস্টার জোসেফের মতে নম্রতা এবং গিরিজা অত্যন্ত অন্তরঙ্গ এবং প্রায় ইনসেপারেবল বন্ধু ছিল, যদিও নম্রতা লেখাপড়ায় খুবই ভালো ছিল আর গিরিজা মোটেই ভালো ছিল না, প্রায়ই ফেল টেল করত। আচ্ছা, তুমি কি গিরিজাকেও সন্দেহ করো?’

‘নিশ্চয়ই। ভীষণভাবে করি।’

‘নাতনি তার দাদুকে খুন করবে? ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?’

‘তেমন তেমন নাতনি আর তেমন তেমন দাদু হলে ব্যাপারটা খুব অস্বাভাবিক থাকে কী?’

‘কি জানি। তুমি যে কি ভাবছ তুমিই জানো। একটু যদি বলতে তো সকলেরই বোধ হয় সুবিধে হত। কী বলেন সমরেশবাবু?’

সমরেশ প্রবলভাবে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘ঠিক, ঠিক। আমি আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত।’

দময়ন্তী হেসে ফেলল। বলল, ‘কী করে বলি? সব তো এখনও পরিষ্কার নয়। তবে, আমার অনুমান আমরা শিগগিরিই কয়েক জন অতিথির দর্শন পাব। তখনই বোধ হয় ব্যাপারটা কিছুটা বোধগম্য হবে।’

জয়ন্ত জিজ্ঞেস করল, ‘কে আসবে বলে মনে করো?’

‘হয়তো সবাই। হয়তো শুধুই দেওরাজ আর নম্রতা। বা হয়তো রামনাথ। ঠিক জানি না। তবে আমার ধারণা, এই হত্যাকাণ্ডের জন্যে অনেক ভেবেচিন্তে তৈরি যে জটিল ছবিটা আমার অনেক কষ্টে দেখা উচিত ছিল, সেটা চট করে দেখে ফেলায়, কেউ বোধ হয় অস্বস্তি বোধ করছে। তার বা তাদের এখানে আসা অস্বাভাবিক নয়।’

‘অর্থাৎ তুমি বলতে চাইছ, এই হত্যাকাণ্ডের মূল ষড়যন্ত্রকারী দেওরাজ?’

‘হতে পারে। আবার অন্য কেউও হতে পারে।’

‘অর্থাৎ তুমি এখনও ঝেড়ে কাশবে না, এই তো? আচ্ছা বাবা, তাই সই। তা, বৈজুকে কজনের খাবার বানাতে বলব?’

দময়ন্তী হাসতে হাসতে বলল, ‘যতজনের ইচ্ছে। বেশি হলে সমরেশ আছে। নষ্ট যাবে না কিছুই।’

.

১৩

দেওরাজ নয়, এল রাজেশ। অতিকায় দেহটা কোনোরকমে একটা সোফার মধ্যে গুঁজে ম্লান গলায় বললেন, ‘মিসেস দত্তগুপ্ত, আপনাকে একটা কথা বলতে এলুম। যদি কিছু মনে না করেন—’

দময়ন্তী বলল, ‘না, না, মনে করব কেন। বলুন।’

‘দেখুন মিসেস দত্তগুপ্ত, আমার বাবাকে কেউ একজন খুন করেছে। কেন করেছে তা আমি জানি না। তবে এটুকু জানি, আমার বাবার অনেক শত্রু ছিল। তিনি অনেক সময় অনেক কাজ করেছেন যাতে অন্যের ক্ষতি হয়েছে। এখন, আপনি যদি ব্যাপারটা নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করেন, তাহলে তাদের মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহা আরও বেড়ে যেতে পারে। কাজেই, আমার অনুরোধ আপনি তদন্তটা ছেড়ে দিন। পুলিশ যা করছে, করুক। কিন্তু প্রাইভেটলি আপনি যদি তদন্ত চালিয়ে যান, অনেকে সন্দেহ করতে পারে যে আমিই আপনাকে লাগিয়েছি। ফলে, আমার বা আমার পরিবারের ক্ষতি হওয়া আশ্চর্য নয়।’

‘আপনি কি এরকম কোনো সন্দেহের কথা শুনেছেন?’

‘না। তা শুনিনি বটে, তবে শুনলে অবাক হব না। তা ছাড়া আরও একটা কথা আছে। আমরা জৈন। অহিংসা আমাদের ধর্ম। যা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে। আর শত্রুতা বাড়িয়ে কাজ কী?’

দময়ন্তীর গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর বলল, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ যে আপনি আমার বিবেকটা পরিষ্কার করে দিলেন, কিন্তু আসল সত্যটা কি না জেনেই তদন্তটা ছেড়ে দেব?’

কাতর মুখে রাজেশ হাতজোড় করে বললেন, ‘প্লিজ!’

.

১৪

জয়ন্ত বলল, ‘সত্যি সত্যি ছেড়ে দেবেন নাকি?’

দময়ন্তী জানলার কাছে দাঁড়িয়ে রাজেশের অপসৃয়মান গাড়িটার দিকে তাকিয়ে ছিল। বলল, ‘ভাবছি। তবে তদন্তের বিশেষ তো আর বাকি নেই। ধাঁধার টুকরোগুলো প্রায় সবই জোড়া লেগে গেছে, কয়েকটা মাত্র বাকি। জয়ন্ত, আর একজন অতিথি আসছেন। ক্যাপ্টেন রামনাথ সরফ।’

জয়ন্ত তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে দিল। রামনাথ ঘরে ঢুকে ক্লান্ত ভঙ্গিতে একটা সোফার উপর বসে পড়লেন। দময়ন্তীকে পাশে বসতে ইশারা করে বললেন, ‘আমাকে কেন আসতে হল, আপনি তা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন?’

দময়ন্তী চুপ করে রইল। মাথা নেড়ে বলল, ‘না।’

‘মিসেস দত্তগুপ্ত, আপনার সঙ্গে নম্রতা, দেওরাজ, রাজেশ, গিরিজা এবং নন্দকিশোরের যে কথাবার্তা হয়েছে, তা আমি শুনেছি। আমার সঙ্গে কথাবার্তা তো আগেই হয়ে গিয়েছে। আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় এটুকু বুঝতে পেরেছি যে আপনার কাছে সত্য বেশিদিন চাপা থাকবে না। সেজন্যে আমি নিজেই ধরা দিতে এসেছি। আমি বলতে চাই যে আমি জেনেশুনে, ঠান্ডা মাথায় আমার বন্ধু তেজপালকে গুলি করে হত্যা করেছি। এর জন্য যা শাস্তি আমার প্রাপ্য তা আমি নিতে প্রস্তুত আছি।’

জয়ন্ত হাঁ করে সোফা থেকে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াচ্ছিল। দময়ন্তী হাতের ইশারায় ওকে বসিয়ে দিয়ে মৃদু হেসে বলল, ‘ক্যাপ্টেন সরফ, আপনি দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় কিন্তু একটি জিনিস ধরতে পারেন নি। আমাকে দেখলে যতটা গালিবল বা বোকাসোকা মনে হয়, ততটা বোধ করি আমি নই। আমাকে অত সহজে ধাপ্পা দেওয়া যায় না।’

‘আপনি বলতে চান আমি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নই?’

‘জড়িত কিনা জানি না, তবে একটা টেস্ট করে দেখতে পারি। জয়ন্ত, তোমার একটা বন্দুক ওঁকে দাও তো। আপনি হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে প্রায় পনেরো ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে বন্দুকটা উঁচু করে ধরে পনেরো সেকেণ্ড রাখুন তো? পারবেন?’

বিষণ্ণ, পরাজিত মুখে রামনাথ বললেন, ‘না, পারব না।’ ওঁর মাথাটা বুকের ওপর ঝুঁকে পড়ল।

দময়ন্তী বৃদ্ধের হাতের ওপর একটা হাত রেখে মৃদু চাপ দিয়ে বলল, ‘আপনি বাড়ি চলে যান, ক্যাপ্টেন। কিচ্ছু চিন্তা করবেন না। আমি আবার আপনাকে বলছি, আমার উদ্দেশ্য আসল সত্যটা জানা, প্রতিহিংসা নেওয়া নয়। আমি বলছি, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরাও আপনার বাড়ি যাব। নম্রতাকে বলবেন, আমাদের জন্য যেন সে চা করে রাখে।’

.

১৫

জয়ন্ত বলল, ‘বাঁচলুম। স্যারকে যে খুনি বলে গায়ে হাত দিতে হয়নি সেটাই যা বাঁচোয়া। তাহলে কাণ্ডটি করল কে? দেওরাজ? তার তো মোটিভের কোনো অন্ত নেই। তা ছাড়া টর্চের কথা কী বলছিলে যেন?’

দময়ন্তী মাথা নেড়ে বলল, ‘উঁহু! তোমার হিসাবেই তো দেখা যাচ্ছে যে তার পক্ষে হত্যাকারী হওয়া সম্ভবই না, টর্চ সম্বন্ধে যাই বলি না কেন।’

‘তাহলে নম্রতা? শব্দভেদী গুলি চালিয়ে থাকে যদি গ্লাভস পরে?’

‘শব্দভেদী গুলি চালানোর জন্য তার বারান্দা থেকে অতটা নেমে এসে ঝোপের ধারে হাঁটু গেঁড়ে বসে গুলি চালানোর দরকারটা কী ছিল? শব্দভেদী চালাতে হলে তো বারান্দা থেকেই চালাতে পারত। কুয়োটা বাড়ির পেছনে। বারান্দা থেকে সেখানে বরং বেশি তাড়াতাড়ি পৌঁছোনো যেত, তাই না? তা ছাড়া, দুটো গাছের ফাঁকে একফালি তিনকোণা তারাভরা আকাশটার কথা চিন্তা করে দ্যাখো। ওই পোজিশনটা একজন চক্ষুষ্মানের পক্ষে আদর্শ, একজন অন্ধের পক্ষে নয়। তাই না? অতএব যে গুলি চালিয়েছে, সে একজন চক্ষুষ্মান লোক।’

‘তাহলে রামনাথের দুই জগাই মাধাই নাতি?’

‘তারা তেজপালকে মারবে কেন? তারা তো তাঁকে ব্ল্যাকমেল করছিল।’

‘বেশ। চমৎকার। তোমার তদন্ত প্রায় শেষ অথচ হত্যাকারীর পাত্তা নেই। তুমি গিরিজাকে সন্দেহ করেছিলে, তার কী হল? আর সে বেচারিকে সন্দেহ করেছিলেই বা কেন?’

‘অত্যন্ত সংগত কারণে। ওদের বাড়িতে আমাদের সঙ্গে দেখা হওয়া মাত্র ও আমাদের গ্লাভস দেখাল এবং সেটা যে নম্রতার সেটা শুনিয়ে দিল। আর, গেটটা যে ভীষণ শব্দ করে সেটা আমাদের মনে করিয়ে দিল পাঁচ মিনিটের মধ্যে। আর এও বলে দিল যে নম্রতা তার দাদুকে পছন্দ করত না। এখন যে কেউ একটু খোঁজ খবর করবে, সেই জানতে পারবে যে নম্রতা অন্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত বন্দুক চালানোয় অভ্যস্ত ছিল। তার ওপর এই সংকেতগুলো পেলে নম্রতার ওপরে তার সন্দেহ গভীর হওয়া উচিত। অর্থাৎ গিরিজা তার বন্ধুকে আমাদের সন্দেহের সামনে তুলে ধরতে চাইছে। কেন?

‘তার দুটো কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, সে জানে যে নম্রতাই তার দাদুকে হত্যা করেছে। সে ক্ষেত্রে এত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ব্যাপারটা জানাবার কোনো দরকার ছিল না। সোজাসুজি জানানোই স্বাভাবিক ছিল।

‘দ্বিতীয় কারণ হতে পারে এই যে সে এইসব ইঙ্গিত করে সন্দেহটা নম্রতার ঘাড়ে চড়াতে চাইছে অন্য কাউকে আড়াল করবার জন্য। এখন, যেহেতু আমরা জানি যে নম্রতাকে হত্যাকারী বলে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়, অতএব এই সম্ভাবনাটা বেশ প্রবল। অর্থাৎ, সে কাউকে আড়াল করতে চাইছে। সে কে হতে পারে?’

‘এক হতে পারে দেওরাজ। দেওরাজ সম্পর্কে স্পষ্টতই সে মিথ্যে কথা বলেছে। যে দেওরাজ নম্রতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ তাকে তার বন্ধু গিরিজা ভালো করে চেনে না— এটা অবিশ্বাস্য। তার ওপর গিরিজা যা ফরোয়ার্ড মেয়ে! সমাজকে সে ভীষণ ভয় পায় বলে যে ধারণাটা সে সৃষ্টি করবার চেষ্টা করছিল সেটাও নিতান্ত মিথ্যা। হয়তো দেওরাজের সঙ্গে তার প্রেম আছে, গুপ্তই হোক বা ব্যক্তই হোক। কিন্তু দেওরাজ হত্যাকারী নয়, অতএব তাকে আড়াল করার প্রশ্নই ওঠে না।

‘দুই, হতে পারে জগাই মাধাই। তারা তেজপালের বাড়িতে আসত কিনা সে বিষয়ে আরও খোঁজ খবর না নিয়ে কিছু বলতে পারি না। যদি ধরে নিই আসত, তাহলে এও ধরে নিতে পারি যে গিরিজার সঙ্গে তাদের কোনো একজনের ভালোবাসা হয়েছে অতএব তার জন্যই এত মিথ্যে বাহানা। কিন্তু, জগাই মাধাইও হত্যাকারী হতে পারে না।

‘অতএব বাকি রইল সে নিজে।’

জয়ন্ত জিজ্ঞেস করল, ‘তার মোটিভ কী হতে পারে?’

‘ধরো, সে দেওরাজকে প্রেম নিবেদন করেছিল কিন্তু তেজপালের নাতনি বলে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যাত হয়। তখন পথের কাঁটা তেজপালকে সরিয়ে দিতে সে বদ্ধপরিকর হয়। এরকম হয়তো আরও অনেক কিছু হতে পারে!’

‘কীভাবে সে খুন করে থাকতে পারে?’

‘ধরো, কোনোরকমে সে জানতে পেরেছিল যে তেজপাল সেদিন নম্রতার বাড়ি যাবেন। উনি বেরিয়ে যেতেই সে একটা সাইকেল নিয়ে বনের শর্টকাটের মধ্যে দিয়ে নতুন লালকুঠিপাড়ায় গিয়ে উপস্থিত। রামনাথের বন্দুকটা হয়তো সে আগেই সরিয়ে লুকিয়ে রেখেছিল। এখন, নম্রতাদের বাগানে ঢুকে অপেক্ষা করে রইল যতক্ষণ না তেজপাল উদয় হন। তারপর গুলি, কুয়োয় বন্দুক নিক্ষেপ এবং সাইকেলে চড়ে প্রত্যাবর্তন।’

জয়ন্ত উজ্জ্বল মুখে বলল, ‘বাঃ বাঃ চমৎকার! এই তো, সুন্দর রাস্তা পাওয়া গেছে। দিব্যি পরিষ্কার।’

দময়ন্তী সজোরে মাথা নেড়ে বলল, ‘না। মোটেই পরিষ্কার নয়। দুটো প্রশ্নের জবাব এখনও পাওয়া যায়নি। প্রথমত, অত রাত্রে লোডশেডিংয়ের মধ্যে দারোয়ানের চোখ এড়িয়ে ওই দুর্গপ্রতিম বাড়িটা থেকে সে বেরোল কী করে? দ্বিতীয়ত, নম্রতাকে ফাঁসানোর চেষ্টা কেন? তার এই চেষ্টার কথা যখন দেওরাজ জানতে পারবে, তখন কি সেটা একটা আনন্দজনক ব্যাপার হবে?’

সমরেশ বলল, ‘আরও একটা প্রশ্ন আছে। গিরিজার বাবা কি বললেন শুনলে না? ওঁরা জৈন। অহিংসাই ওঁদের পরম ধর্ম।’

দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ। সেও একটা কথা বটে। গিরিজা যতই নম্রতার বন্ধু হোক না কেন, তাকে বন্দুক চালানো শেখাতে তার বাবা রাজি হবেন বলে তো মনে হয় না। আর যেমন তেমন শেখা তো নয়, এ তো একেবারে পাকা হাতের কাজ। এবার তাহলে তুমিই বলো জয়ন্ত, কি সিদ্ধান্ত আমি নিতে পারি?’

জয়ন্ত হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘প্রশ্নটা আমাকে না করে বরং পেছনের এই দেওয়ালটাকে করো। উত্তর পেলেও পেতে পারো হয়তো।’

জয়ন্তর কথার মধ্যেই একটি নারীকণ্ঠ দরজার কাছে প্রশ্ন করল, ‘আসতে পারি?’

তিনজন একসঙ্গে লাফিয়ে উঠল। দময়ন্তী হর্ষোৎফুল্ল গলায় বলে উঠল, ‘এসো, এসো, গিরিজা, ভেতরে এসো। আমরা এতক্ষণ তোমার কথাই আলোচনা করছিলুম।’

‘আমার কথা? ভুরু দুটো ওপরে তুলে জিজ্ঞেস করল গিরিজা। ‘আমার আবার কোন কথা আলোচনা করছিলেন আপনারা?’

দময়ন্তী বলল, ‘আমরা আলোচনা করছিলুম যে তোমার দাদুকে সম্ভবত তুমিই হত্যা করেছ।’ বলে মৃদু মৃদু হাসতে লাগল।

বিবর্ণ স্তম্ভিত মুখে সোফার ওপর বসে পড়ে গিরিজা একবার সকলের মুখের দিকে তাকাল। তারপর দময়ন্তীর দিকে তাকিয়ে সন্ত্রস্ত গলায় বলল, ‘আপনি ঠাট্টা করছেন? আমি কেন আমার দাদুকে খুন করতে যাব?’

‘সেটা আমরা পরে বিবেচনা করব। এখন বলো তো, তুমি কি দেওরাজকে বিয়ে করতে চাও?’

‘দেওরাজ কে? তাকে তো আমি ভালো করে চিনিই না?’

‘তাই নাকি? আচ্ছা, ঘটনাটা যখন ঘটে, তখন তুমি কোথায় ছিলে?’

‘বাড়িতেই ছিলুম।’

‘এটা কি সত্যি কথা?’

‘একদম সত্যি কথা। বিশ্বাস করুন। আপনি বাবাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। আমাদের দারোয়ান, কুক, চাকর সবাইকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।’

‘তুমি বন্দুক চালাতে জানো?’

‘না। নম্রতা আমাকে কয়েকবার শেখাবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আমার বড্ড ভয় করত তাই শিখতে পারিনি।’

‘তুমি নম্রতাকে ফাঁসাতে চাও— এটা দেখাতে চাইছ কেন? যাতে আমি তোমাকে সন্দেহ করি, সেই জন্য?’

কিছুক্ষণ নির্বাক বিস্ময়ে দময়ন্তীর মুখের দিকে চেয়ে রইল গিরিজা। বলল, ‘আপনি কী বলতে চাইছেন আমি বুঝতে পারছি না।’

‘তুমি ঠিকই বুঝতে পারছ। তুমি ভালো করেই জানো যে তোমাকে সন্দেহ করলে কিছুই প্রমাণ করা যাবে না। তুমি নিজেকে সামনে এগিয়ে দিয়ে আসল হত্যাকারীকে আড়াল করতে চাইছ। তাই না?’

গিরিজা চুপ। দময়ন্তী আবার বলল, ‘আচ্ছা, ওসব কথা বাদ দাও। এখন বলো তো, তুমি আমার কাছে এসেছ কেন?’

গিরিজা তার হ্যান্ডব্যাগের ভেতর থেকে একটুকরো কাগজ বের করে সসংকোচে বলল, ‘দাদুর টেবিলের ড্রয়ারের ভেতর এটা পেলুম। ভাবলুম, এটা হয়তো আপনার কাজে লাগবে।’

দময়ন্তী কাগজটা নিয়ে দেখল, তাতে দুটো নাম আর একটা ঠিকানা লেখা। নাম দুটো গোকুলচাঁদ আর অমরনাথ সরফের। ঠিকানাটা কলকাতার প্রফুল্ল ভট্টাচার্য লেনের। দময়ন্তী মৃদু হেসে কাগজটা জয়ন্তর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই নাও তোমার জগাই মাধাইয়ের ঠিকানা।’ তারপর গিরিজার দিকে ফিরে বলল, ‘আমরা এখন ক্যাপ্টেন সরফের বাড়িতে যাব। তুমিও আমাদের সঙ্গে চলো।’

.

১৬

নতুন লালকুঠিপাড়ার মুখে জয়ন্তকে গাড়ি দাঁড় করাতে বলল দময়ন্তী। তারপর গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। গিরিজাকে নেমে আসার ইঙ্গিত করে জয়ন্তকে বলল, ‘তোমরা এগিয়ে যাও। আমি আর গিরিজা হেঁটে আসছি।’

নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে নেমে এল গিরিজা। বলল, ‘হেঁটে যাবেন? অনেকটা পথ কিন্তু।’

‘তাতে কী আছে? আমি হাঁটতে খুব ভালোবাসি। আর তুমি তো বাচ্চা মেয়ে। হাঁটতে ভয় পাবে? তা ছাড়া রাস্তায় একটা কাজ আছে, সেটাও সেরে নেব।’

দময়ন্তীর কথার মধ্যেই জয়ন্ত সমরেশকে নিয়ে জিপ চালিয়ে এগিয়ে গেল। দময়ন্তী হাঁটা শুরু করল। গিরিজা পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী কাজ আছে আপনার?’

‘চলো না, দেখতেই পাবে।’

একটুখানি এগোতেই নন্দকিশোরের বাড়ি। গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল দময়ন্তী। গিরিজাকে বলল, ‘আমাদের সঙ্গে দেওরাজেরও যাওয়া দরকার। যাও তো, ওকে একটু ডেকে আনো।’

‘আচ্ছা।’ বলে গিরিজা গেট খুলে এগিয়ে গেল। সঙ্গেসঙ্গে দুটো প্রকাণ্ড কুকুর ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। গিরিজা তাতে কিছুমাত্র বিচলিত হল না। ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে এগিয়ে গেল। ঠিক তখনই দেওরাজ এসে বারান্দায় দাঁড়াল। সে একবার গিরিজার দিকে দেখল, একবার গেটের বাইরে দণ্ডায়মান দময়ন্তীকে দেখল, তারপর চাপা ক্রুদ্ধ গলায় গর্জন করে উঠল, ‘স্টুপিড গার্ল! তুমি কী করছ তার খেয়াল আছে?’

গেটের বাইরে থেকে দময়ন্তী সহাস্যে বলল, ‘গিরিজা কী করেছে তা আমি দেখিনি মিস্টার চৌধুরী। আমরা নম্রতাদের বাড়ি যাচ্ছি। আপনি কি আমাদের সঙ্গে যাবেন?’

দেওরাজ গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করল, ‘সেখানে গিয়ে কী হবে?’

‘কিছুই না। চা খাব সবাই মিলে।’

জ্বলন্ত দৃষ্টিতে একবার সংকুচিত গিরিজাকে ভস্ম করে দিয়ে দেওরাজ বলল, ‘বেশ। আসছি আমি।’

.

১৭

সেই বিশাল বসবার ঘরে তাঁর অভ্যস্ত চেয়ারে রামনাথ স্থির হয়ে বসে ছিলেন। আজ আর তাঁকে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছিল না। বরং একটু সন্ত্রস্ত, চিন্তাকুল। দময়ন্তীকে সম্বোধন করে বললেন, ‘আজ সকলে মিলে আমার বাড়িতে কী উদ্দেশ্যে মিসেস দত্তগুপ্ত?’

দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘উদ্দেশ্য তেমন কিছু নয়। আপনাদের জানাতে এলুম যে আমার তদন্তের আজ শেষ দিন।’

বিবর্ণ মুখ তুলে রামনাথ বললেন, ‘জয়ন্ত কি তাহলে এবার গ্রেপ্তারি পরোয়ানাগুলো জারি করতে শুরু করবে?’

‘না। কারণ কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নেই।’

‘কেন? আপনি কি হত্যাকারীর নাম পুলিশের কাছে এখনও প্রকাশ করেননি?’

‘না।’

‘কেন? আপনার উদ্দেশ্য বা কর্তব্য কি পুলিশকে হত্যাকারীকে ধরতে সাহায্য করা নয়?’

‘একেবারেই না। আমার উদ্দেশ্য বা কর্তব্য হচ্ছে রহস্যের সমাধান করা, আসল সত্যটা জানা। পুলিশকে সাহায্য করবার জন্য এই তদন্ত আমি শুরু করিনি।’

‘আসল সত্যটা কি তা জানতে পেরেছেন?’

‘আমার ধারণা পেরেছি।’

‘জয়ন্ত, তুমি জানো আসল ঘটনাটা কি ঘটেছিল?’

প্রবলভাবে মাথা নেড়ে জয়ন্ত বলল, ‘একদম না। দময়ন্তী যেভাবে চিন্তা করে আর আমরা যেভাবে চিন্তা করি, তার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। ও যে কী ভেবেছে, তা বুঝে ওঠা আমার কম্ম নয় স্যার।’

সবাই একসঙ্গে হেসে উঠল মনে হল, যেন অনেকদিন খাঁচায় বন্দি এক ঝাঁক পাখি হঠাৎ মুক্তি পেয়ে ডানা ঝটপটিয়ে আকাশে উড়ে গেল।

দেওরাজ হাসতে হাসতেই বলল, ‘জয়ন্তবাবুকে সরিয়ে দিয়ে আমাদের আসল সত্যটা বলতে পারেন না, মিসেস দত্তগুপ্ত।’

দময়ন্তী মৃদু হেসে বলল, ‘অত কৌতূহল ভালো নয় উকিল মশায়। তা ছাড়া আপনার তো অজানা থাকার কথা নয় যে সত্যের রূপটা সবসময় সুখপ্রদ হয় না।’

জয়ন্ত বলল, ‘না, না, দময়ন্তী, তুমি যদি ওদের কিছু আমার অনুপস্থিতিতে বলতে চাও, বলতে পারো। আমি না হয় একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসছি।’

দময়ন্তী মাথা নেড়ে বলল, ‘না জয়ন্ত। যা বলব, তোমার সামনেই বলব।’

দেওরাজ বলল, ‘তাহলে শুনিই না ব্যাপারটা কী।’

নম্রতার মুখ থেকে আগের দিনের দেখা কাঠিন্যের পর্দাটা সরে গিয়ে নম্রতা ফিরে এসেছিল এইমাত্র। আবার ওর মুখটা কঠিন হয়ে উঠল। বলল, ‘থাক-না।’

দময়ন্তী নীচু গলায় বলল, ‘আপনি বুঝতে পারছেন না কেন যে ওঁর ইগোতে লাগছে? আমি সত্যি বলছি না মিথ্যে বলছি, সেটা না জানলে যে রাত্রে ঘুম হবে না। ঠিক আছে মিস্টার চৌধুরী। আমি একটা গল্প বলি, শুনুন। যদি কোনো ভুলভ্রান্তি থাকে তো বলে দেবেন।

‘এক দেশে এক রাজা ছিল। তার ছিল এক রাজপুত্তুর। রাজার হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া কিন্তু রাজপুত্তুরের চিত্তে সুখ নেই। কারণ তার রাজত্বের বাইরে জঙ্গলের ভেতর এক দুর্গের মধ্যে থাকে এক ভয়ঙ্কর দৈত্য। তার অত্যাচারে রাজপুত্তুরের জীবন যৌবন ছারখার হয়ে গেল। সেই দৈত্য যেন তার জীবনের একটা দুষ্টগ্রহ, যেখানেই সে যায়, সেই দৈত্য তার পেছনে পেছনে এসে তার সর্বনাশের চেষ্টা করে। রাজপুত্র মনে মনে স্থির করে সেই দৈত্যকে সে মারবেই! কিন্তু মারতে চাইলেই তো আর মারা যায় না, দেশের আইনকানুন পুলিশ সব এড়িয়ে যা-কিছু করার করতে হবে নইলে নিজেরই ফেঁসে যাওয়ার সম্ভাবনা। কাজেই সাবধানে এগোয় রাজপুত্র। আইনের মধ্যেই আইন এড়াবার রাস্তা খোঁজে।

‘সেই দৈত্যপুরীতে ছিল এক রাজকন্যা। তার এমন একটা বয়স যখন সব মানুষেরই চোখে থাকে মানুষ হবার স্বপ্ন, অন্যায়কে ঘৃণা করার সংকল্প। সেই রাজকন্যার সঙ্গে একদিন দেখা হল রাজপুত্রের। দৈত্য ততদিনে তাকে নরকের ক্লেদোক্ত পঙ্কে ডুবিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কী তার চোখে ছিল কে জানে, রাজকন্যা তাকে ভালোবেসে ফেলল। তাকে সে টেনে তুলল সেই নরকের ভেতর থেকে। তাকে নিয়ে এল সুস্থ মুক্ত জীবনের মধ্যে। দৈত্যের তা মোটেই পছন্দ হল না। সে রাজকন্যার পথে পদে পদে বাধার সৃষ্টি করতে লাগল। ফলে সেই নৃশংস নিষ্ঠুর দৈত্যটার প্রতি রাজকন্যার মনে রাগ এবং ক্ষোভ আস্তে আস্তে জিঘাংসায় পরিণত হতে লাগল।

‘এই মিলিত দুই আগুন একদিন ফেটে বেরোল যেদিন দৈত্যটা তার জঘন্য থাবা বাড়াল তাদের উভয়ের বন্ধু আর এক রাজকন্যার দিকে। সে ছিল অন্ধ, তাদের দুজনেরই অসীম স্নেহ আর ভালোবাসার পাত্রী। তাদের সহ্যশক্তির সমস্ত সীমা এবার ছাড়িয়ে গেল। তারা স্থির করল এই নারকীয় বীভৎসতাকে চিরকালের মতো শেষ না করলে পৃথিবীটা আর মানুষের বাসের উপযোগী থাকবে না। এই সিদ্ধান্তটা ঠিক ছিল না ভুল ছিল তা বলতে পারব না, জানি না আইন এ বিষয়ে কী বলে, কিন্তু বলেছি তো, এ এমন একটা বয়স যখন মানুষের দুঃখ দেখলে অবিচলিত থাকতে পারে না, অদ্ভুত হয়তো বা অন্যায় সংকল্প করে বসে আর তা সফলও করে বসে। সেখানে আত্মীয় বা অন্য কোনো সম্পর্কই সেই সংকল্পসাধনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।

‘অতএব দৈত্য কর্তৃক লাঞ্ছিত তিন বন্ধু বসল পরামর্শ করতে যাকে বোধ হয় ষড়যন্ত্র বলা চলে। রাজপুত্র আইনজ্ঞ, অতএব সেই হল মুখ্য ষড়যন্ত্রকারী।

‘অনেক পরামর্শের পর স্থির হল যে যদি দু-নম্বর রাজকন্যাকে দিয়ে দৈত্যনিধন করানো যায়, তাহলে সে অন্ধ বলে কারুরই সন্দেহের উদ্রেক করবে না। সে একসময় এক্সপার্ট শ্যুটার ছিল, অতএব তার সেই স্কিলটা কাজে লাগানো যাবে। সেটা করতে হবে লোডশেডিংয়ের মধ্যে যাতে সে কারুর নজরে না পড়ে। আবার সে ক্ষেত্রে তার অন্ধত্বটাও কাজে লাগবে, কারণ ওই অন্ধকারেও সে নির্বিঘ্নে বাগানের মধ্যে দিয়ে বন্দুকটা কুয়োয় ফেলে দিয়ে আসতে পারবে। তার কাছে লোডশেডিং অর্থহীন।

‘কিন্তু প্ল্যানটা এখনও ফুলপ্রূফ হল না। অন্ধকারে শব্দভেদী গুলি ছোড়া দেখে কারুর মনে সন্দেহ হতে পারে। অতএব উকিল রাজপুত্র স্থির করলেন গুলিটা এমন জায়গা থেকে ছোড়া হবে যে জায়গাটা একজন চক্ষুষ্মান লোকের পক্ষেই বেছে নেওয়া স্বাভাবিক। আদালতে স্রেফ এই প্রশ্নটার ওপরেই দ্বিতীয় রাজকন্যার বেনিফিট অব ডাউট পেয়ে যাওয়া আটকানো যাবে না।

‘এখন এই প্ল্যানটা কাজে লাগাতে গেলে, দৈত্যকে লোডশেডিংয়ের মধ্যে দ্বিতীয় রাজকন্যার বাড়িতে আনতে হয়। দৈত্য অত্যন্ত ঘুঘু এবং তার শত্রুরও শেষ নেই। এইখানে প্রথম রাজকন্যাকে কাজে লাগানো হল। তাকে দৈত্য অবিশ্বাস করতে পারেই না। সে দৈত্যকে কী বলেছিল আমার জানা নেই, কিন্তু আমার স্থির বিশ্বাস সেই কোনরকমে অ্যালিওর করে তাকে এখানে নিয়ে আসে। খুব সম্ভব সে বলেছিল যে দ্বিতীয় রাজকন্যা দৈত্যকে ডাকছে কোনো গোপন কারণে। দৈত্য তাতে মহা পুলকিত হয়েছিল।

‘এবার রাজপুত্রর ভূমিকা। সে রোজ রাস্তায় পায়চারি করে সবাই জানে। সেদিনও সে রোজকার মতো অন্ধকারেই পায়চারি করতে করতে একসময় এসে টুক করে লুকিয়ে পড়ল দু-নম্বর রাজকন্যার বাড়ির সামনে। হয়তো তার হাতে ছিল একটা লোহার ডান্ডা বা অন্য কিছু যা যদি গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় তাহলে ব্যবহৃত হবে। কথা ছিল, গুলি করার পর দৈত্যটা পড়ে গেলে তারই টর্চ দিয়ে তার অবস্থাটা দেখে নিয়ে রাজপুত্র সেটা ছুড়ে দেবে ভেতরে। সেটাই সঙ্কেত। রাজকন্যা টর্চের শব্দ শুনে সেটা কোথায় পড়েছে বুঝে সেটা কুড়িয়ে নিয়ে বন্দুকটা কুয়োয় ফেলে ভেতরে চলে যাবে। আর রাজপুত্র এক দৌড়ে বাড়িতে চলে যাবে। ঘটনাটা নির্বিঘ্নে ঘটে গেলে সবার সন্দেহ গিয়ে পড়বে দ্বিতীয় রাজকন্যার দাদু বুড়ো রাজার ওপর। কিন্তু তিনি যে এ কাজ করতে পারেন না সেটা কোনো থার্ড ক্লাস উকিলও আদালতে স্বচ্ছন্দে প্রমাণ করে দিতে পারবে।

‘ঘটনাটা নির্বিঘ্নে ঘটে গিয়েছিল প্রায়, কেবল দুটো উটকো লোকের সঙ্গে ধাক্কা লেগে রাজপুত্র একটু ফ্যাসাদে পড়ে গিয়েছিল। তাতে অবশ্য অসুবিধে কিছু হয়নি। পুলিশ, যারা সাধারণত কোনো ঘটনার খুব গভীরে যায় না, তারাও বুঝতে পারল যে তার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব নয়। কাজেই তারা তাকে ছেড়ে দিল। আর তাদের সন্দেহ, যেমন ভাবা গিয়েছিল, বুড়ো রাজার ওপরেই গিয়ে পড়ল, কিন্তু সেটা যে প্রমাণ করা যাবে না— এটা বুঝে তারা তাঁকেও কিছু করতে পারল না। ফলে, রাজপুত্রের উকিলি বুদ্ধির জয় হল, রহস্যটা অন্ধকারেই রয়ে গেল।

‘তাহলে, মিস্টার দেওরাজ চৌধুরী, এবার বলুন এ পর্যন্ত গল্পটার মধ্যে কোনো ভুলভ্রান্তি কি পাওয়া গেল?’

সম্মোহিতের মতো মাথা নাড়ল দেওরাজ। বলল, ‘না। কিন্তু আপনি কী করে…’

‘বলছি, গল্পটা এখনও শেষ হয়নি। এইবার এই গল্পে প্রবেশ ঘটল এক ইতিহাসের অধ্যাপিকার, ছেঁড়াখোঁড়া পাণ্ডুলিপি জোড়া দিয়ে কিছু কিছু কল্পনার প্রলেপ লাগিয়ে একটা আস্ত ইতিহাস গড়ে তোলা যার কাজ।’

রামনাথ বললেন, ‘লেট’স কল হার দা সরসারেস বা জাদুকরী—’

দময়ন্তী মাথা নাড়ল। বলল, ‘না। জাদুকরী ভেলকি দেখায়, শূন্য থেকে নানারকম জিনিসপত্র বের করে। এর কাজ তো তা নয়। এর নেশা সত্য উদঘাটন— মিথ্যে ছায়াবাজীর ভেলকি দেখানো নয়। আমরা একে বরং বাইরের লোক বলব।

‘বাইরের লোকটির প্রথমেই সন্দেহ হয়, স্বভাবতই বুড়ো রাজাকে। তার মনে হল তিনি দুটো মিথ্যে কথা বলেছেন। এক, দৈত্যটা কেন তাঁর বাড়ি আসছিল তা তিনি জানেন না। দুই, তাঁর হারিয়ে যাওয়া দুই নাতি কোথায় আছে তা তিনি জানেন না। কিন্তু খটকা লাগল দু-জায়গায়। এক, তিনি যে দৈত্যকে অপছন্দ করতেন সেটা অসংকোচে বললেন, আর দুই, দৈত্যটার ওপর তাঁর এমন রাগ ছিল না বলে মনে হল যাতে তাঁর পক্ষে এ কাজ করা জরুরি হয়ে পড়ে। পরে দেখা গেল, যে দুটো কথা তিনি মিথ্যে বলেছেন বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল সেটা সত্যি বলে মেনে নেওয়াই সমীচীন।

‘এখন দেখা গেল বুড়ো রাজা বা দ্বিতীয় রাজকন্যা, দুজনেই নিঃসন্দেহ যে কোনো স্বার্থান্বেষী লোক বাইরের লোকটিকে নিয়োগ করেছে তাঁদের ফাঁসাবার জন্য। খোঁজখবর করে জানা গেল এরকম লোক একমাত্র হতে পারে রাজত্বের অংশ থেকে বঞ্চিত দুই নাতির। দৈত্যটার সঙ্গে তাদের একটা সম্পর্কও ছিল। অতএব তাদের সন্দেহের আওতার মধ্যে আনা হল। কিন্তু দেখা গেল, বুড়ো রাজা আর তার নাতনিকে ফাঁসানোর চেয়েও তাদের পক্ষে বেশি লাভজনক দৈত্যকে বাঁচিয়ে রাখা। অতএব তারা বাদ গেল, বাদ গেলেন বুড়ো রাজাও। কারণ বলাই বাহুল্য। তবে তীক্ষ্নধী বুড়ো রাজা ব্যাপারটা বোধ হয় গোড়া থেকেই জানতেন।

‘তাহলে বাকি রইল রাজপুত্র আর দুই রাজকন্যা। যদিও দু-নম্বর রাজকন্যার দিকেই এখন পাল্লটা ভারী, কিন্তু তাহলেও ছবিটা কিছুতেই সম্পূর্ণ হয় না। কী তার মোটিভ, কী করে সে একা সব কাজ সারল, কীভাবে সে এমন জায়গায় এল যেখানে তাকে কেউ সন্দেহ করতে না পারে? এইখানে একটা ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া গেল। দেখা গেল, দৈত্যটাকে মারার প্রবলতম বাসনা থাকার কথা রাজপুত্রের, সে উকিল, সমস্ত ঘটনাটার পেছনে আইন বাঁচাবার চেষ্টা, এসবই এই ষড়যন্ত্রে তার অংশগ্রহণের দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করে। এই দুজনকে ষড়যন্ত্রে নিলে ছবিটা কিঞ্চিৎ পরিষ্কার হয় কিন্তু পুরোটা হয় না। দৈত্যটা ওখানে এল কীভাবে? কে তাকে নিয়ে এল? রাজপুত্র হতে পারে না, দ্বিতীয় রাজকন্যাও হতে পারে না, কারণ সেখানে ধরা পড়ার একটা সম্ভাবনা আছে। এখানেই এল তৃতীয় ব্যক্তির প্রয়োজন। এবং এখানেই বোঝা গেল কী অসীম ঘৃণায় এবং গভীর যন্ত্রণায় এই ষড়যন্ত্রের জাল পাতা হয়েছিল।

‘এটা ধরা বেশ কঠিন হত যদি না রাজপুত্র প্রথম রাজকন্যাকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে তোলার জন্য তাকে দিয়ে তার বন্ধুকে ফাঁসানোর ভানটা না করাতো। দৈত্যের প্রতি তার ঘৃণাটা এ না হলে প্রকাশ পেত কিনা সন্দেহ। রাজপুত্র এখানেই ভুলটা করেছিলেন। এটা না করলে পুরো ছবিটা পরিষ্কার হত কিনা সন্দেহ।

‘কিন্তু কেবল ঘৃণাই দ্বিতীয় রাজকন্যাকে তার নিকটাত্মীয় দৈত্যটাকে শেষ করতে উদবুদ্ধ করতে পারে না। সেখানে একটা গভীরতর প্রাণের টান থাকতে বাধ্য। এইখানে কল্পনা দিয়ে শূন্য জায়গাটা ভরাট করতে হল। কিন্তু পরে দেখা গেল কল্পনাটা মিথ্যে নয়। প্রমাণিত হল দুই যুবক-যুবতী তাদের অন্ধকারের জাল ছিঁড়ে মুক্ত হবার পথ খুঁজছে। দ্বিতীয় রাজকন্যা, যার জীবনের একটা দিক চিরকালের জন্য অন্ধকার হয়ে গেছে, একটা কুৎসিত বীভৎস দৈত্যকে নিধন করে তার দুই বন্ধুর জীবনকে এক আলোকিত পথে উত্তরণ করতে সাহায্য করেছে। আইন বা সমাজ কী বলবে আমি জানি না, কিন্তু আমার বিবেক বলছে, অনেকগুলো প্রাণ গেছে, অনেক জীবন নষ্ট হয়ে নরকের আগুনে জ্বলছে, এবার এখানেই তার পরিসমাপ্তি হোক, এখানেই যবনিকা পড়ুক।’

দময়ন্তীর কথা শেষ হল। সবাই নীরবে স্তব্ধ বিষণ্ণ মুখে বসে রইল। অনেকক্ষণ পরে সমরেশ জয়ন্তকে প্রশ্ন করল, ‘কি জয়ন্তবাবু, দময়ন্তী যে গল্পটা বলল, তার পাত্র-পাত্রীদের চিনতে পারলেন নাকি?’

জয়ন্ত প্রবলবেগে মাথা নেড়ে বলল, ‘ক্ষেপেছেন? দময়ন্তীর যত সব আজেবাজে গপ্পো! তাদের পাত্র-পাত্রীদের পরিচয় খোঁজার চেষ্টা করাই পণ্ডশ্রম। চলো হে, দময়ন্তী, এবার বাড়ি যাওয়া যাক। তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়তে হবে। কাল ভোরে তোমাদের তোপচাঁচি লেকে পিকনিকে যাবার কথা, মনে আছে তো?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *