স্মৃতিচারণ

স্মৃতিচারণ

দাদামশায়ের অভিজ্ঞতা

গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে, মানে ১৯০২ কী ১৯০৩ সালে, আমার দাদামশায় জেলারের চাকরি নিয়ে আসামে গিয়েছিলেন। সে সময় আজকের মতো আসামের এত উন্নতি হয়নি। রাস্তাঘাট বেশি ছিল না। জঙ্গল খুব বেশি ছিল, এমনকী, ছোটো ছোটা শহরের চারদিকেও জঙ্গল ছিল। রেললাইন বেশি ছিল না, এক শহর থেকে আর এক শহরে যেতে হলে হয় ঘোড়ায় চড়ে যেতে হত নইলে গোরুর গাড়িতে।

এইসময় আমার দাদামশায়ের জীবনে অনেক অদ্ভুত আর রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটেছিল। অনেক মারাত্মক বিপদের মুখ থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছেন। তিনি কৃষ্ণভক্ত মানুষ ছিলেন, বিশ্বাস করতেন যে তাঁর উপাস্য দেবতা ভগবান শ্রীকৃষ্ণই তাঁকে সেইসব বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন, নইলে উদ্ধারের কোনো আশাই ছিল না। আমরা, মানে তাঁর নাতিরা, যখন দুষ্টুমি করতুম বা কোনো অন্যায় কাজ করতুম, তখন সেইসব গল্প বলে উনি আমাদের শোধরাবার চেষ্টা করতেন। আমরা হাঁ করে সেইসব গল্প শুনতুম, কিন্তু তাঁর আসল উদ্দেশ্য কতদূর সফল হত সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। আমাদের তো ভক্তিটক্তি ছিল না। আমরা সেই ঘটনাগুলোর অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যাখ্যা করতুম দাদামশায়কে ক্ষ্যাপানোর জন্য। খুব রাগী মানুষ ছিলেন, ক্ষেপেও যেতেন আমাদের মন্তব্যগুলো শুনে। তবে রাগটা বেশিক্ষণ থাকত না। নাতিদের সাতখুন মাপ হয়ে যেত।

চাকরির প্রথম দিকে একবার দাদামশায়কে ব্রহ্মপুত্র নদী পার হয়ে এক শহর থেকে অন্য এক শহরে যাবার সময় এক ভয়ংকর বিপদের মুখে পড়তে হয়েছিল। উনি যখন খেয়াঘাটে গিয়ে পৌঁছেছেন, তার একটু আগেই খেয়া ছেড়ে গেছে। ব্রহ্মপুত্র বিশাল নদী। খেয়া পারাপার করতে অনেক সময় লাগে। দাদামশাই আর কী করেন। ভাবলেন একটু এদিক-ওদিক ঘুরে দেখি। খেয়াঘাটের চারদিকেই ঘন জঙ্গল। দিনের বেলা, বাঘ-ভালুকের ভয় তো নেই। কাজেই দাদামশাই অন্যমনস্কভাবে ঘুরছিলেন। এসে দাঁড়িয়েছেন একটা মস্ত বটগাছের নীচে। বটগাছটা ভরতি একগাদা বাঁদর কিচিরমিচির করছে। পাহাড়ি জায়গা, গাছটার সামনে ছিল একটা পাথরের সমতল চাতাল মতো। শুকনো পাতা মচমচিয়ে দাদামশাই যেই এসে চাতালটার পাশে দাঁড়িয়েছেন, হঠাৎ অন্যপাশে ফোঁস করে ফণা তুলে খাড়া হয়ে উঠেছে এক শঙ্খচূড় সাপ। শঙ্খচূড় আমাদের দেশের সবচেয়ে বিষধর সাপেদের মধ্যে অন্যতম আর এত বড়ো, যে খাড়া হয়ে উঠলে প্রায় এক মানুষ সমান উঁচু হয়ে উঠতে পারে।

দাদামশাই দেখলেন সমূহ বিপদ। দৌড়ে পালাবেন তার উপায় নেই। শঙ্খচূড়া সাপের সঙ্গে দৌড়ে কখনোই পারা যাবে না। সামনের গাছে উঠে পড়বেন, সেও সম্ভব নয়। একমাত্র উপায় হল সাপের চোখে চোখ রেখে একটুও না-নড়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। তাহলে সাপ কামড়ায় না। ইতিমধ্যে যদি অন্য লোক এসে পড়ে তাহলে সাপটা চলে যেতে পারে। অতএব, দাদামশায় সেই নিষ্পলক নৃশংস দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে যথাসম্ভব নিষ্কম্প হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।

কোনো লোক কিন্তু এল না। আর কতক্ষণই বা একেবারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। দাদামশাই বেশ বুঝতে পারছেন যে তাঁর পা অল্প কাঁপতে শুরু করেছে, একটু বাদেই পড়ে যাবেন। এদিকে কিছু না-করতে পেরে সাপটাও ক্রমশ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে, একটু নড়লেই সঙ্গেসঙ্গে ছোবলাবে তাঁকে। মনে মনে ভাবছেন, হে ভগবান, এইরকম ভয়ংকর মৃত্যু তোমার ভক্তের কপালে লিখে রেখেছিলে তুমি।

ঠিক এইসময় একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। আগেই বলেছি, বটগাছটা ভরে ছিল একদঙ্গল বাঁদর। তারা এতক্ষণ ব্যাপারটা লক্ষ করছিল। দাদামশাই যখন আর পারছেন না, পড়ে যাবার মতো অবস্থা, আর সাপটাও রেগে টং, সেইসময়, হঠাৎ একটা বাঁদর লাফ দিয়ে পড়ল দাদামশায়ের পায়ের কাছে পাথরের চাতালটার ওপরে আর পরমুহূর্তেই চোখের নিমেষে একলাফে উলটোদিকের গাছটার ওপরে উঠে পড়ল। সঙ্গেসঙ্গে চমকে গিয়ে সাপটা চাবুকের মতো প্রচণ্ড জোরে ছোবল মারল বাঁদরটা যেখানে পড়েছিল সেইখানে। কিন্তু, বাঁদরটা তো তখন আর সেখানে নেই। ফলে, সাপটার মুখটা এসে হাতুড়ির মতো আছড়ে পড়ল পাথরের ওপর আর তৎক্ষণাৎ তার মুখটা ফেটে চৌচির হয়ে গেল। সঙ্গেসঙ্গে সাপটা ধড়ফড় করে মরে গেল। দাদামশাই তখন কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে বসে পড়ে তাঁর অদৃশ্য রক্ষাকর্তাকে অজস্র ধন্যবাদ জানালেন আর চোখের জলে প্রণাম করলেন তাঁর উপাস্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে।

গল্প শেষ করে দাদামশাই বলতেন, দেখলি তো। বিপদ যতই ভয়ংকর হোক না-কেন, ভক্ত— সে যতই না-কেন নগণ্য হোক, যদি সত্যিকার অন্তর দিয়ে তাঁকে ডাকে, তাহলে সেই ডাকে ভগবান ঠিক সাড়া দেন এবং ভক্তকে বিপদ থেকে মুক্ত করতে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন।

আমরা বলতুম, তাই বলে বাঁদর! দাদু! তোমার প্রার্থনার জন্য তাঁকে কিনা শেষপর্যন্ত বাঁদর হতে হল?

শুনে দাদামশায় রেগেমেগে তাঁর মেয়ের কাছে গিয়ে তাঁর ছেলেরা যে উচ্ছন্নে গেছে সে বিষয়ে নালিশ করতেন এবং ভবিষ্যতে আর কখনো তাদের গল্প বলবেন না সে কোথাও বেশ জোর দিয়ে জানিয়ে দিতেন। সেই প্রতিজ্ঞাটা অবশ্য বেশিদিন টিকত না।

.

আর একবার দাদামশাই এক শহর থেকে অন্য এক শহরে বদলি হয়েছেন। ততদিনে তাঁর বিয়ে হয়েছে, সংসার বেড়েছে। দিদিমা, তিন মেয়ে আর নিতান্ত শিশু আমাদের মামাকে নিয়ে মালপত্র গোরুর গাড়িতে চাপিয়ে রওনা দিয়েছেন। একটা গোরুর গাড়ি তো নয়, অনেকগুলো। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যেতে হবে, ডাকাতের ভয় আছে, হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের অভাব নেই। সেই জন্য সে সময় দলবদ্ধ হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। এই দল যখন চলতে শুরু করত, তখন কতগুলো পূর্বনির্ধারিত জায়গা ছাড়া কোনোমতেই অন্য কোথাও দাঁড়াত না। তা, সে যদি কেউ ভয়ানক অসুস্থ বা মরণাপন্ন হয়ে পড়ে তাহলেও না। অনেকটা আজকের ট্রেনের মতো। তবে, ট্রেন যদি-বা চেন টেনে থামানো যায়, এক্ষেত্রে তাও সম্ভব ছিল না। দু-একজনের জন্য তো সকলকে বিপদে ফেলা যায় না।

যেতে যেতে বিকেল নাগাদ হঠাৎ আমার মামার শরীর বেশ খারাপ হয়ে পড়ল। এত খারাপ যে তখুনি একটু দুধ খাওয়ানো বিশেষ দরকার নইলে অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে। অথচ সঙ্গে একফোঁটাও দুধ নেই। মামা আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়ছে দেখে দাদামশাই দিদিমাকে বললেন— আমাকে একটা পাত্র দাও, আমি পা চালিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখি কোনো গ্রাম আছে কি না। আমার জন্য চিন্তা কোরো না। আমার কোনো বিপদ হবে না। আর, হলে হবে। আমি এই দৃশ্য সহ্য করতে পারছি না।

দাদামশাই শ্লথগতি গোরুর গাড়ির কনভয় পেছনে ফেলে হনহন করে সামনে এগিয়ে গেলেন। যাচ্ছেন আর ভাবছেন, হে ভগবান, এতটুকু একটা শিশুকে কে এত কষ্ট দিচ্ছ। তার যন্ত্রণা যে চোখে দেখা যাচ্ছে না। ওকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করো।

ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পথ, কোথাও গ্রামের চিহ্নমাত্র নেই, লোকজন তো নেই-ই। দাদামশায়ের সব আশা যখন বিলীয়মান, হঠাৎ একটা স্থানীয় লোক জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল, তার হাতে একটা পাত্র। লোকটি দাদামশায়কে বলল— দুধ নেবেন, দুধ লাগবে আপনার?

দাদামশাই তো হাতে স্বর্গ পেলেন। বললেন— হ্যাঁ, হ্যাঁ, লাগবে বইকি। দাও, আমার এই পাত্রটার মধ্যে ঢেলে দাও।

তাই করল লোকটি। তখন দাদামশায় পকেটে হাত দিয়ে দেখেন পয়সা আনতে ভুলে গেছেন তাড়াহুড়োয়। লোকটিকে বললেন, এই দ্যাখো, আমি তো টাকা আনতে ভুলে গেছি। তুমি আমার পেছনে পেছনে এসো। ওই সামনেই আমার গাড়ি আসছে। ওখানে গিয়েই আমি তোমাকে দাম দিয়ে দেব। বলে পাত্র হাতে হনহন করে উলটোদিকে হাঁটা লাগলেন। গাড়িতে পৌঁছে দিদিমার হাতে পাত্রটা দিয়ে টাকা নিয়ে পেছন ফিরে দেখেন, কেউ নেই।

দাদামশাই বলতেন— এখন তোরাই বল, কে আমাকে দুধ এনে দিয়েছিল? ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া আর কেউ হতে পারে? ভক্তের করুণ প্রার্থনায় সাড়া না-দিয়ে পারেননি তিনি।

আমরা বলতুম— আর একজন হতে পারে দাদু। সে ব্যাটা দাগি চোর। জেল ভেঙে দুধ চুরি করে পালাচ্ছিল। ভেবেছিল, তোমাকে বিক্রি করে দু-পয়সা কামাবে। তুমি তো ইউনিফর্ম পরে ছিলে না, তাই প্রথমে তোমাকে চিনতে পারেনি। পরে দেখল, ও বাবা, এ যে জেলারসাহেব। একসময় না একসময় তো এঁর কাছে গিয়ে আবার পড়তেই হবে। এখন যদি পয়সা নিই তাহলে তখন কী আর রক্ষে থাকবে। মেরে পিঠের চামড়া তুলে নেবেন। তার চেয়ে কেটে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

শুনে দাদামশাই আমাদের লাঠি নিয়ে তাড়া করতেন, আমরা ঊর্ধ্বশ্বাসে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করতুম।

.

অন্য একবার, এক শহরের জেল থেকে আর এক শহরের জেলে একটা অত্যন্ত জরুরি খবর পরদিন ভোর বেলার মধ্যে পৌঁছে দেবার ভার পড়ল দাদামশায়ের ওপর। আদেশটা যখন এল, তখন বিকেল হয়ে গেছে। গাড়িঘোড়া জোগাড় করা তখন আর সম্ভব নয়। জঙ্গলের রাস্তা, বিপদ-আপদের কোনো শেষ নেই। একেবারে একা যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। দাদামশাই তখন স্থির করলেন যে সারারাত রানার বা ডাকহরকরার সঙ্গে দৌড়বেন। তাঁর দুর্দান্ত স্বাস্থ্য ছিল, বয়েসও কম। কাজেই, ব্যাপারটা অসম্ভব কিছু ছিল না। রানার সারারাত দৌড়য় যাতে সে পরদিন ভোররাত্রে অন্য শহরে পৌঁছে যেতে পারে। তার হাতে থাকে লন্ঠন আর কাঁধে ঝুমঝুমি লাগানো বর্শায় বাঁধা চিঠির থলি। সে যখন দৌড়য়, তখন তার ঝমঝুমির ধাতব ঝুমঝুম আওয়াজ আর লণ্ঠনের আলো বন্য জন্তু-জানোয়ারদের সহজে কাছে ঘেঁষতে দেয় না। কারণ এই দুটো জিনিসই তারা অত্যন্ত অপছন্দ করে। তা ছাড়া, তার আত্মরক্ষার জন্য বর্শাটা তো আছেই। সুতরাং, তার সঙ্গে দৌড়নোর, সুবিধে হল, একজন সঙ্গী তো পাওয়া যাবেই তার ওপর বাঘ-ভাল্লুকেরও ভয়ও কম হবে।

সেইরকমই হল। রানারের সঙ্গে সারারাত দৌড়লেন দাদামশায়। তখন ভোর হয়ে আসছে, শহরটা আর বেশি দূরে নেই, তখন দেখা গেল যে রাস্তাটা সামনে দুটো ভাগ হয়ে গেছে। শহরটা ছিল একটা নদীর অন্যপারে। মূল রাস্তাটা সেই নদীর ওপরে একটা ব্রিজ পেরিয়ে চলে গেছে শহরের দিকে আর অন্য একটা সরু কাঁচা রাস্তা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কিছুটা গিয়ে পড়েছে একটা খেয়াঘাটে।

দাদামশায় রানারকে বললেন— তুমি তো ব্রিজের রাস্তায় যাবে, তাতে শহরে পৌঁছুতে একটু দেরি হবে। আমি এই কাঁচা রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছি, খেয়াঘাটে গিয়ে মাঝিকে ঘুম থেকে তুলে নদী পেরিয়ে একবারে শহরের ভেতরে পৌঁছে যাব।

রানার বলল— ও রাস্তায় যাবেন না। শুনেছি এদিকে একটা মানুষখেকো বাঘ বেরিয়েছে। বিপদ হতে পারে।

দাদামশায় বললেন— দুত্তোর মানুষখেকো! ওই তো খেয়াঘাট দেখা যাচ্ছে। বাঘ যদি থাকেও, সে কিছু টের পাওয়ার আগেই একদৌড়ে পৌঁছে যাব। তুমি কিছু ভেব না, আসলে আমার হাতে সময় বড়ো কম। বলে, দাদামশায় কাঁচা রাস্তা দিয়ে দৌড়তে শুরু করলেন।

খেয়াঘাটের কাছাকাছি আসতেই দাদামশায়ের নজরে পড়ল একটা ঝোপের পাশে একটা বিরাট বাঘ শুয়ে আছে। সে ঘুমোচ্ছিল। দাদামশায়ের পায়ের শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেছে আর এক চোখ খুলে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে।

দাদামশায় দেখলেন বাঘটার সঙ্গে তাঁর যা দূরত্ব তাতে দৌড়ে পার পাওয়া যাবে না। গাছে উঠবেন, তারও উপায় নেই কারণ বেশি উপরে ওঠার আগেই সে লাফ দিয়ে তাঁকে ধরে ফেলবে। একটিমাত্র উপায় আছে। তা হল, প্রাণপণে দৌড়ে গিয়ে খেয়াঘাটের মাঝির ঘরে ঢুকে পড়া। অতএব, চিৎকার করে মাঝিকে ডাকতে ডাকতে বাঘের সামনে দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড় লাগালেন দাদামশায়। বাঘটাও খচমচ করে উঠে তাঁকে তাড়া করল।

এমনি কপাল, দাদামশায় দেখলেন খেয়াঘাটের মাঝির ঘরে বিরাট তালা ঝুলছে। কোনো কারণে সে বোধ হয় ছুটি নিয়েছিল সেদিন। এদিকে বাঘটাও প্রায় এসে পড়েছে। উপায়ান্তর না-দেখে ভগবানের নাম করতে করতে নদীর বরফ-ঠান্ডা জলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন দাদামশাই আর সঙ্গেসঙ্গে জ্ঞান হারালেন। তবে অজ্ঞান হবার আগে দেখলেন যে বাঘটা তাঁর পেছনে পেছনে জলে নামছে।

যখন জ্ঞান ফিরল, দাদামশাই দেখলেন যে তিনি একটা গোয়ালঘরে শুয়ে আছেন আর কয়েকটি মেয়ে তাঁর শুশ্রূষা করছে।

ঘটনাটা ঘটেছিল এইরকম। সেদিন ছিল ছট পুজো। গোয়ালিনীরা ভোররাত্রে উঠে কলসি নিয়ে গিয়েছিল নদীর ঘাটে জল আনতে। সে যুগে তো প্লাস্টিক ছিল না, কলসিগুলো ছিল কাঁসার। সেই কলসিতে জল ভরতে গিয়ে তারা দেখে, এক বাবু জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ঝাঁপ দিল নদীতে আর তার পেছনে একটা বাঘ। দেখেই তো তারা তাদের হাতের মোটা মোটা রুপোর বালা দিয়ে কলসির ওপর ঠংঠং করে মেরে মেরে মহা শোরগোল বাধিয়ে দিল। বাঘ আবার এই শব্দ সহ্য করতে পারে না। কাজেই সে জল থেকে উঠে ল্যাজ তুলে জঙ্গলের ভেতরে ভাগলবা। তখন গোয়ালিনীরা জ্ঞানহীন দাদামশায়কে তুলে তাদের বাড়িতে নিয়ে গেল।

গল্প শেষ করে দাদামশায় বলতেন, সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে সেদিন আমাকে বাঁচিয়েছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তাঁরই আদেশে বৃন্দাবনের গোপিনীরা গোয়ালিনী সেজে আমাকে উদ্ধার করেছিলেন।

আমরা বলতুম— একদম বাজে কথা দাদু। সারারাত দৌড়ে নিশ্চয়ই তোমার খিদে আর ঘুম দুটোই খুব পেয়েছিল। অফিসে যাওয়ার আগে গোয়ালাদের বাড়ি দুধ আর মিষ্টি প্রচুর পরিমাণে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলে। যখন ঘুম ভাঙল, দেখলে বেজায় দেরি হয়ে গেছে। তখন এই বাঘের গল্পটা বানালে।

আমাদের কথা শুনে দাদামশায় প্রথমে ভীষণ রেগে যেতেন তারপরেই হেসে ফেলতেন। বলতেন— নাঃ, তোদের দ্বারা কিচ্ছু হবে না।

তাঁর এই কথাটা অতন্ত নিরঙ্কুশ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

 ঠাকুরদাদার বিপদ

আমার ঠাকুরদাদার একটা অদ্ভুত আর বিস্ময়কর ক্ষমতা ছিল। তিনি কারোর মুখ হয়তো ভুলে যেতে পারতেন কিন্তু তার গলা কক্ষনো ভুলতেন না। কাজেই, কারোর মুখ দেখে তাকে চিনতে না পারলেও, গলা শুনে ঠিক চিনে ফেলতেন।

একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে।

একবার হাওড়া স্টেশনে নেমে মালপত্র নিয়ে বাইরে এসেছেন। অমনি একদল ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ান এসে তাঁকে নিজের নিজের গাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্যে টানাটানি শুরু করে দিল।

ঠাকুরদাদা বললেন— না, না, তোমাদের গাড়িতে যাব না। ওই তো ইসমাইল আছে, আমার চেনা লোক, আমি ওর গাড়িতে যাব।

বলতেই ভিড়ের ভেতর থেকে একজন বয়স্ক গাড়োয়ান হাসিমুখে এগিয়ে এসে ঠাকুরদাদার বাক্স-বিছানা তুলে তার গাড়ির দিকে রওনা হল। যেতে যেতে বলল— আপনি আমাকে চেনেন, বাবু? কী করে চিনলেন? আমি তো আপনাকে মনে করতে পারছি না।

ঠাকুরদাদা বললেন— তুমি একসময়ে ফেনি স্টেশনে গাড়োয়ানি করতে না? আমি তখন বেশ কয়েক বার ওখানে গেছি। প্রত্যেকবারই আমি তোমার গাড়ি নিয়েছি।

শুনে ইসমাইলের হাত থেকে ঠাকুরদাদার বাক্সটা ঠক করে মাটিতে পড়েই গেল। লোকটি বলল— বলেন কী বাবু? সে তো আজ পঁচিশ বছর আগেকার কথা! ফেনির কথা আমারই কিছু মনে নেই। আর আপনি আমাকে এখনও মনে রেখেছেন?

ঠাকুরদাদা বললেন— তোমাকে কি আর মনে রেখেছি? তোমার গলার স্বরটা শুধু মনে আছে।

এই ক্ষমতার জন্যে তাঁকে একবার ভীষণ বিপদে পড়তে হয়েছিল।

.

সেটা ১৯৩০ বা ওইরকম সময়ের কথা। আমার বাবা ঠাকুরদাদাকে নিয়ে এলাহাবাদে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন মা আর দাদা। দাদার তখন বছর দুয়েক বয়েস হবে। উদ্দেশ্য ছিল হাওয়া বদল আর তীর্থ করা।

সে যুগে, আজকের মতো সর্বত্র এত হোটেল, টুরিস্ট লজ বা ইয়ুথ হস্টেলের ছড়াছড়ি তো ছিল না। কেউ বেড়াতে গেলে মাসখানের মতো সময় হাতে করে যেতেন, একটা আস্ত বাড়ি বা কয়েকটা ঘরভাড়া করা হত, সঙ্গে যেত বিছানাপত্র, চাল, ডাল, স্পিরিট স্টোভ, থালা-বাটি-গেলাস, গ্রামোফোন, গুটি কয়েক রেকর্ড, কিছু গল্পের বই, পানের বাটা, এমনকী বঁটি পর্যন্ত।

আমার বাবাও সেইরকমভাবে এলাহাবাদে একটা মহল্লার একটি একতলা ছোটো বাড়ি ভাড়া করে একমাসের ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন। বাড়ির সামনে একটা বারান্দা ছিল। ঠাকুরদাদা রোজ ভোর বেলা আর সন্ধে বেলা সেখানে ইজিচেয়ার পেতে বসে সামনে রাস্তায় লোক চলাচল দেখতেন। তাঁর ধবধবে সাদা চুল-দাড়ি দেখে পাড়ার লোকেরা ওই পথে যাওয়ার সময় তাঁকে নমস্কার করত, দু-একজন এক-আধটা কথাও বলত। তাঁর আর একটা কাজ ছিল সাধুসন্ন্যাসী ও ভিখারিকে ভিক্ষা দেওয়া। সেইজন্যে থলে ভরতি খুচরো পয়সা তাঁর কোলের ওপর রাখা থাকত।

দিনগুলো বেশ ভালোই কেটেছিল। গোলমাল বাঁধালেন এক সন্ন্যাসী।

.

সেদিনও সন্ধে বেলা যথারীতি ঠাকুরদাদা বারান্দায় বসে ছিলেন। হঠাৎ এক বিশালাকৃতি জটাজুটধারী সন্ন্যাসী একহাতে কমণ্ডুলু আর অন্যহাতে একটা লম্বা ত্রিশূল নিয়ে বারান্দার পাশে এসে দাঁড়ালেন। বজ্রনির্ঘোষে হিন্দিতে বললেন— সন্ন্যাসীকে কিছু দান করা হোক।

ঠাকুরদাদা কিছুক্ষণ পিটপিট করে তাঁর দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন— তুমি সরোজিনীর জামাই না?

বলতেই, সাধুবাবা আঁতকে উঠলেন। প্রায় পড়েই যাচ্ছিলেন। ত্রিশূলটা দিয়ে কোনোরকমে সামলে নিয়ে ঠাকুরদাদাকে ভালো করে দেখে নিয়ে পরিষ্কার বাংলায় বললেন— আরে, সেনকাকা, আপনি এখানে?

বলে, সাধুবাবা বারান্দায় উঠে এসে ঠাকুরদাদাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে তাঁর পায়ের কাছে বসে পড়লেন। বললেন— ইশ কত বছর বাদে দেখা হল, তা বিশ বছর তো হবেই। আপনাকে শেষ দেখেছি আমার শাশুড়ির শ্রাদ্ধে। আপনার চেহারাটা কিন্তু একই আছে, কেবল আপনার দাড়িগোঁফ একেবারে পেকে গেছে।

এরপর কিছু পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ করবার পর ঠাকুরদাদা বললেন— তুমি না ফিলজফি অনার্স নিয়ে বিএ পাশ করেছিলে? তারপরে এসব কী?

সন্ন্যাসী বললেন— কী আর বলব, সেনকাকা। বিএ পাশ করে কোথাও একটা চাকরি পেলাম না। ব্যাবসা করব, তার মূলধনই বা কোথায়? শেষপর্যন্ত, সপরিবারে না খেয়ে মরবার অবস্থায় এসে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন, একজনের পরামর্শে এখানে এসে এই ভেক নিয়েছি।

—তাতে কোনো লাভ হয়েছে?

—হ্যাঁ, তা হয়েছে। এখন আমার বেশ ভালোই রোজগার হয়। মাসে মাসে বাড়িতে যে টাকা পাঠাই তাতে সংসার চলে যায়। ছেলেমেয়েরা স্কুলে পড়ছে, বাড়িটার আধখানা পাকা করে ফেলা গেছে, দুটো গোরুও কেনা হয়েছে। কী আর বলব, আপনাদের আশীর্বাদে এখন আর তেমন কষ্ট নেই।

শুনে ঠাকুরদাদা মহা খুশি হয়ে সন্ন্যাসীর মাথায় হাত রেখে বললেন— দীর্ঘায়ু হও, বাবা। আশীর্বাদ করি তোমার যেন লক্ষ্মী লাভ হয়।

.

তার পরদিন হুলুস্থুল কাণ্ড বেঁধে গেল।

ভোর না-হতেই দেখা গেল পাড়ার মহিলারা গঙ্গায় স্নান করে নতুন কাপড় পরে থালায় করে ফল-মিষ্টি ইত্যাদি নিয়ে ভজন গাইতে গাইতে ঠাকুরদাদার দিকেই আসছেন। তাঁরা বারান্দায় উঠে এসে ঠাকুরদাদার পায়ের কাছে থালাগুলো রেখে মেঝেতে বসে পড়ে তাঁকে ধর্মোপদেশ দিতে অনুরোধ করলেন। কয়েক জন আবার তাঁর গলায় গাঁদাফুলের মালাও পরিয়ে দিলেন।

ঠাকুরদাদা তো স্তম্ভিত। তিনি যতই বলেন যে তিনি দীর্ঘদিন অবসর নেওয়া সরকারি দপ্তরের কর্মচারী, তাঁর পক্ষে ধর্মোপদেশ দেওয়া একেবারে অসম্ভব ব্যাপার, কে শোনে কার কথা। পাড়াসুদ্ধ লোক দেখেছে যে এ তল্লাটের সবচেয়ে বড়ো সাধুমহারাজ তাঁকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছেন আর তিনি তাঁর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছেন। এর থেকে এ কথা বুঝতে কারোর আর বাকি নেই যে তিনি একজন ছদ্মবেশী মহাযোগী মহাপুরুষ। হিমালয় থেকে নেমে এসেছেন। তিনি অস্বীকার করলে কী হবে, তাঁর মতো মহাত্মার শ্রীমুখের উপদেশ না-শুনে তাঁরা কিছুতেই নড়বেন না। তাঁদের মতো পাপীতাপীকে তাঁকে উদ্ধার করতেই হবে।

গোলমাল শুনে বাবা আর মা বাইরে বেরিয়ে এসে শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে, উপদেশ-টুপদেশ পরে হবে বলে, কোনোরকমে ঠাকুরদাদাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন।

সকালটা তো কাটল। সন্ধে বেলা একেবারে তাণ্ডব লেগে গেল। দলে দলে লোক বাড়ির সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে খোলকর্তাল বাজিয়ে তারস্বরে নেচে নেচে কীর্তন গাইতে শুরু করে দিল। মাঝে মাঝে চলল মহাপুরুষের জয়ধ্বনি আর তাঁকে দর্শন দেওয়ার জন্য চিৎকার করে আহ্বান। কান পাতে কার সাধ্যি। গলিতে গাড়িঘোড়া বন্ধ হয়ে গেল। এইরকম চলল প্রায় মধ্যরাত্রি পর্যন্ত।

খবর পেয়ে বাড়িওয়ালা এসে গিয়েছিলেন। তিনি ব্যাপার দেখে বললেন— বাঁচতে চান তো আজ রাত্রেই পালান। স্টেশনে গিয়ে যে ট্রেন পাবেন তাতেই উঠে পড়বেন, সে ট্রেন কলকাতা, দিল্লি, বোম্বাই, মাদ্রাজ যেখানেই যাক না কেন। আপনারা মালপত্র বেঁধে ফেলুন। রাত তিনটের সময়, আমি দুটো ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে পেছনের গলিতে আসব। আমার লোকজন মাল গাড়িতে তুলে দেবে। টুঁ শব্দটি না-করে আপনারা চাদর মুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসবেন। এভাবে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর উপায় নেই। আজ যা হয়েছে, হয়েছে। কাল ব্যাপার আরও গুরুতর হবে। কেউ শুনবেই না যে আমাদের ওই সাধুটি আপনার মামাতো ভাই-এর জামাই। ভাববে, আপনি ওদের ঠেকানোর জন্য ভাঁওতা দিচ্ছেন। বরং, কাল সকালে আমি সবাইকে বলে দেব যে যোগীমহারাজ যোগবলে আকাশপথে হিমালয়ে ফিরে গেছেন। তাহলে, সবাই সন্তুষ্ট হবে।

বাবার সেবারের ছুটি এইভাবেই শেষ হয়েছিল।

 বাবার মুখে শোনা

১৯২৪ সালে আমার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে এমএসসি পাশ করে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল কেমিক্যালে চাকরি নিয়ে আসেন পূর্ব বাংলা থেকে। সে সময় বেঙ্গল কেমিক্যালের কর্ণধার ছিলেন রাজশেখর বসু, যিনি বাঙালি পাঠকের কাছে ‘পরশুরাম’ নামে পরিচিত।

এই বেঙ্গল কেমিক্যালের চাকরি সূত্রে আমার বাবা অনেক বিখ্যাত মানুষের সংস্পর্শে আসেন। তাঁর কাছে এইসব বড়ো মাপের মানুষদের যে সব গল্প শুনেছি, তার কয়েকটা এখানে বলছি। হয়তো এসব গল্প কারুর কাজে লেগে যেতে পারে।

রাজশেখর বসু

উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের শেষ কয়েক জন প্রতিভূর একজন ছিলেন রাজশেখর বসু। তাঁর পাণ্ডিত্যের পরিধিটা ছিল অবিশ্বাস্য রকমের বড়ো। ইংরেজি, বাংলা, হিন্দি বা সংস্কৃত সাহিত্যে তাঁর অগাধ জ্ঞান ছিল। একদিকে তিনি যেমন লিখেছেন হাসির গল্প, অন্যদিকে তেমনি অনুবাদ করেছেন রামায়ণ, মহাভারত, মেঘদূত ইত্যাদি মূল সংস্কৃত থেকে। রচনা করেছেন বাংলা অভিধান চলন্তিকা। লিখেছেন অসাধারণ সব প্রবন্ধ। বাংলা ভাষাকে দিয়েছেন নতুন নতুন প্রতিশব্দ। আবার ইনিই ছিলেন বেঙ্গল কেমিক্যালের একজন সার্থক পরিচালক, ভারতবর্ষের বিপণন শিল্পের একজন পথিকৃৎ।

রাজশেখর বসুর একটা বড়ো জিনিস ছিল— সময় জ্ঞান, যা বাঙালিদের মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না। শুনেছি, উনি যখন বকুলবাগানে থাকতেন, তখন ওঁর গতিবিধি দেখে পাড়ার লোক ঘড়ি মেলাত। সেইসঙ্গে ছিল পরিমিতি বোধ। উনি যে গল্প বা প্রবন্ধ লিখতেন, তার শেষে কম্পোজিটারকে বিশদভাবে নির্দেশ দিতেন যাতে তার গল্পটা কম্পোজ করতে এতটুকু অসুবিধে না-হয়।

একবার রাজশেখর বসু নিজের আবিষ্কৃত ফর্মূলায় একটি বেগুনি রঙের কালি তৈরি করেছিলেন। সেই কালি দিয়ে অনেকগুলো চেক সই করেছিলেন। সব কটা চেক ফেরত এল। রাজশেখরবাবু তো স্তম্ভিত; আর রেগেও গেলেন তেমনি। সেই চেকগুলো নিয়ে তিনি ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের ঘরে চলে গেলেন। ম্যানেজার চেকগুলো দেখে বললেন— এই চেকগুলো ফেরত পাঠিয়েছি কারণ আমরা রাবার স্ট্যাম্পে সই গ্রাহ্য করিনা। রাজশেখরবাবু তখন তাঁর বেগনি রঙের কালি ভরা কলম বের করে ম্যানেজারের সামনে অনেকগুলো সই করলেন। ম্যানেজার সব দেখে বললেন— আমার কী দোষ? বেগুনি রঙের কালি আর সব কটা সই যদি অবিকল একরকমের হয়, তাহলে সেগুলো রাবার স্ট্যাম্প ভাববো না তো কী করব?

অত্যন্ত গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন রাজশেখর বসু। নিজে হাসির গল্প লিখতেন কিন্তু তাঁকে কেউ বড়ো একটা হাসতে দেখেনি। তাঁর সঙ্গে ঠাট্টা ইয়ার্কি করার কথা কেউ চিন্তাও করতে পারত না।

শান্তিনিকেতনে একবার বিরিঞ্চিবাবা নাটকের অভিনয় হচ্ছে। নিমন্ত্রিত হয়ে রাজশেখরবাবু সেখানে গেছেন। দর্শকদের মধ্যে রয়েছেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরানি। ভীষণ মজার নাটক। সবাই খুব হাসছেন। নাটক যখন শেষ হল, তখন দর্শকদের একজন ইন্দিরাদেবীকে জিজ্ঞেস করলেন— নাটক কেমন দেখলেন?

ইন্দিরাদেবী বললেন— নাটক তো আমি দেখিনি।

প্রশ্নকর্তা ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে বললেন— নাটক দেখেননি? সে কী কথা?

ইন্দিরাদেবী বললেন— না। আমি আগাগোড়া তাকিয়ে ছিলুম রাজশেখরবাবুর মুখের দিকে। কী অদ্ভুত মানুষ। যেখানে সবাই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে, সেখানে তাঁর মুখে একটা রেখারও পরিবর্তন নেই!

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়

সময়জ্ঞান আর নিয়মানুবর্তীতায় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র ছিলেন অনমনীয়। আমার বাবাকে দেখেছি; তাঁর কাছে পাঁচটা বত্রিশ ছিল ঠিক পাঁচটা বত্রিশ-ই। তার এক মিনিট এদিক-ওদিক হবার জো ছিল না। শুনেছি, এই স্বভাবটি তিনি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের কাছ থেকে পেয়েছিলেন।

একবার ভারতবর্ষ তখন অবিভক্ত-ভারতীয় শিল্পপতি আর ব্যবসায়ীদের আমন্ত্রণে আচার্য গিয়েছিলেন লাহোরে একটা কনফারেন্সে বক্তৃতা দিতে। সঙ্গে করে আমার বাবাকেও নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর আমন্ত্রকদের মধ্যে মস্ত সব নাম-লালাশ্রীরাম, কস্তুরভাই লালভাই ইত্যাদি। কথা ছিল কনফারেন্স পাঁচটায় শুরু হবে এবং গাড়ি আসবে সাড়ে চারটের সময় আচার্যকে হোটেল থেকে নিয়ে যাবার জন্য।

আচার্য বাবাকে বললেন— তুই হোটেলেই থাকবি। কোথাও যাবি না। কনফারেন্স ঘণ্টাখানেকের বেশি হবে না। আমি সাড়ে ছ-টার মধ্যে ফিরে আসব। তারপর আমরা সিন্দুনদীর ধারে বেড়াতে যাব। সাড়ে চারটে বেজে গেল কিন্তু গাড়ি এল না।

অত্যন্ত উদবিগ্ন হয়ে আচার্য বললেন— আমার মনে হয় গাড়িটার নিশ্চয়ই কোনো বিপদ-আপদ হয়েছে। এদিকে কনফারেন্সে সবাই বসে থাকবেন, তাঁদের সময় নষ্ট হবে। আমি বরং একটা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে চলে যাচ্ছি। যদি গাড়ি আসে তুই সেটা ফেরত পাঠিয়ে দিস। বলে আচার্য সাদা কালো চৌখুপী খদ্দরের গলাবন্ধ কোট আর ধুতি পরে চলে গেলেন।

ঘণ্টাখানেক বাদে ফিরে এলেন। খুশি খুশি মুখ। বাবাকে বললেন— দারুণ ভালো চা খাওয়াল জানিস। আর তার সঙ্গে ভারি চমৎকার চানাচুর। নে এবার চল। আমরা সিন্ধুনদীর ধারে বেড়াতে যাব।

দু-জনে হোটেল থেকে বেরিয়েছেন, দেখেন একের পর এক গাড়ি এসে হোটেলের দরজায় দাঁড়াচ্ছে। আর তাদের ভেতর থেকে নামছেন মস্ত বড়ো শিল্পপতিরা।

আচার্যকে দেখে তাঁরা বললেন— আমাদের একটু দেরি হয়ে গেল, এবার তাহলে চলুন।

আচার্য মাথা নেড়ে বললেন— উঁহু। আমি তো আর যাব না। আপনারা আমাকে পাঁচটায় সময় দিয়েছিলেন। আমি ঠিক পাঁচটার সময় আপনাদের কনফারেন্স হলে পৌঁছেছি, সেখানে চা আর চানাচুর খেয়েছি। আমার কর্তব্য শেষ। দ্বিতীয় বার আমি আর ওখানে যাব না। আমি এই ছেলেটিকে কথা দিয়েছি যে এখন আমরা সিন্ধুনদীর ধারে বেড়াতে যাব, সে কথার নড়চড় হবে না।

শুনে সবাই স্তম্ভিত। অনেক কাকুতিমিনতি করেও বৃদ্ধ আচার্যকে টলানো গেল না। বাবাকে নিয়ে উনি বেড়াতে চলে গেলেন।

বাবা আচার্যকে পরে জিজ্ঞেস করেছিলেন— আপনি চা আর চানাচুর পেলেন কোথায়?

আচার্য যা বলেছিলেন সেটা এইরকম—

উনি ঠিক পাঁচটার সময় কনফারেন্সের জায়গায় পৌঁছেছিলেন। গিয়ে দেখেন, সেখানে তখন কেউ আসেনি। এমনকী কর্মকর্তারাও অনুপস্থিত। কেবল কয়েক জন বাবুর্চি বসে চা বানাচ্ছে। আচার্য গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। তাঁর খদ্দরের কোট, ধুতি, উশকোখুশকো চুল আর পাকা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি দেখে তারা মনে করল উনি ওদেরই কেউ হবেন। তারা তাঁকে চা আর চানাচুর খাওয়াল। আচার্যও সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে চলে এলেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রাজশেখরবাবু শান্তিনিকেতনে গিয়েছেন। সঙ্গে বাবা। খবর পেয়ে রবীন্দ্রনাথ দু-জনকে পরদিন দুপুরে খাওয়ার নিমন্ত্রণ করলেন।

পরদিন বেলা এগারোটার সময় রাজশেখরবাবু বাবাকে বললেন— চলুন। রবীন্দ্রনাথের কাছে যাওয়া যাক।

বাবা আশ্চর্য হয়ে বললেন— সেকী? এখন তো সবে এগারোটা। এই সময় নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাওয়াটা কি উচিত হবে?

রাজশেখর বললেন— চলুন-ই না। গেলেই দেখতে পাবেন কেন এখন যেতে বলছি।

সেইরকমই হল। দু-জনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছে গেলেন। রবীন্দ্রনাথ তখন গভীর মনোযোগের সঙ্গে কিছু লিখছিলেন। দু-জনকে দেখে চমকে উঠলেন। কিন্তু অসন্তুষ্ট না-হয়ে বরং সাদরে অভ্যর্থনা করলেন। ওঁদের বসতে বলে অল্প সময়ের জন্য বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। তারপর বেরিয়ে এসে গল্প শুরু করলেন।

রবীন্দ্রনাথের গল্প বলার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। তাঁর দুই শ্রোতা মুগ্ধ বিস্ময়ে তাঁর কথা শুনতে শুনতে কখন যে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল তা টের পেলেন না। এইসময় ভেতর থেকে খাবার ডাক এল।

রাজশেখরবাবু আর বাবা খেতে বসলেন। রবীন্দ্রনাথ একটা মোড়া পেতে তাঁদের খাওয়া তদারকি করবার জন্য বসলেন ওঁদের সামনে। দেখা গেল অত্যন্ত সাধারণ খাওয়া। মানে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ালে অন্তত দু-একটা পদ একটু বিশেষ রকমের হয়ে থাকে, কিন্তু এক্ষেত্রে সেরকম কিছু ছিল না।

খাবার দেখে রাজশেখরবাবুর মুখে বোধ হয় একটা অত্যন্ত ক্ষীণ হাসির রেখা দেখা গিয়েছিল। সেটা রবীন্দ্রনাথের নজর এড়ায়নি।

রবীন্দ্রনাথ বললেন— তুমি হাসছ কেন? তুমি বুঝতে পেরেছ যে আমি তোমাদের নিমন্ত্রণ করার কথা ভুলে গিয়েছিলুম, তাই না? তবে শোনো আমার দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ কী করেছিলেন।

দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন প্রচণ্ড পণ্ডিত, আত্মভোলা দার্শনিক। থাকতেন শান্তিনিকেতনে ‘নীচু বাংলা’ বলে একটা বাড়িতে। একবার কলকাতা থেকে আসা কয়েক জন দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপককে দুপুরে খাওয়ার নিমন্ত্রণ করেছিলেন। তাঁরা যথারীতি দুপুর বেলাতেই এলেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁদের একটা অত্যন্ত দুরূহ দার্শনিক তথ্যের ওপর ঘণ্টাখানেক বক্তৃতা দিয়ে বললেন— বেলা অনেক হল। এখন আমার স্নানাহারের সময়। তোমরা তাহলে এবার এসো।

গল্প শেষ করে রবীন্দ্রনাথ বললেন— আমার তো তোমাদের দেখে অন্তত নিমন্ত্রণ করার কথাটা মনে পড়ল। আমার দাদার কিন্তু তাও পড়েনি।

সে যুগে শান্তিনিকেতনের দুপুরের খাওয়ার মতো কোনো দোকান ছিল না। সেই কলকাতার অধ্যাপকদের যে কী দশা হয়েছিল সে কথা আর রবীন্দ্রনাথ কিছু বলেননি।

 তিন টুকরো হাসি

জাপানি জানার সুবিধে

 আমার বড়ো মেয়ে মউ জাপানি ভাষা শিখেছিল। বেশ ভালোই রপ্ত করেছিল। সেই ভাষায় বক্তৃতা-টক্তৃতা দিয়ে অনেক প্রাইজও পেয়েছিল।

একবার সে কালীঘাটে মেট্রো স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠেছে এসপ্ল্যানেডে যাবে বলে। ট্রেনে ভীষণ ভিড়। তিলধারণের জায়গা নেই। ঠেলেঠুলে উঠতে হয়েছে। যে কম্পার্টমেন্টে উঠেছে, দেখে তার একপাশে বেশ একটা উত্তেজনা। এক জাপানি মাঝবয়সি ভদ্রলোক হাত-পা নেড়ে সবাইকে কী যেন বোঝাতে চাইছেন কিন্তু কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। ভদ্রলোকের বোধ হয় ধারণা যে তিনি ইংরিজি বলছেন, কিন্তু তা বোঝে কার সাধ্যি। তাঁর সহযাত্রীরা তাঁর সমস্যাটা বোঝবার জন্য তাঁর সঙ্গে ইংরেজি, বাংলা এমনকী হিন্দিতেও কথা বলে যাচ্ছেন। সেসব আবার তাঁর একেবারেই বোধগম্য হচ্ছে না। এই নিয়ে বেশ একটা গোলমাল বেধে গেছে।

ব্যাপার দেখে মউ গলা বাড়িয়ে জাপানি ভদ্রলোককে বলল— কী হয়েছে আপনার, আমাকে একটু বলবেন?

নিজের মাতৃভাষা শোনামাত্র সেই ভদ্রলোক তো প্রায় কেঁদে ফেলেন আর কী। মেলার মধ্যে হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাছেলে তার মাকে দেখলে যেমন ব্যাকুল হয়ে দৌড়ে আসে, তেমনিভাবে ভিড়টিড় ঠেলে তিনি মউ-এর কাছে চলে এলেন। আসলে, তিনি জানতে চাইছিলেন যে, কোন স্টেশনে নামলে তাঁর পক্ষে ক্যামাক স্ট্রিট আর থিয়েটার রোডের মোড়ে যাওয়া সহজ হবে। সেটা তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়ার পর তিনি মউকে অনেক ধন্যবাদ দিলেন এবং তাঁর স্টেশন না-আসা পর্যন্ত ওর সঙ্গে অনেক কথাবার্তা বললেন। বাকি যাত্রীরা হাঁ করে ওদের আলোচনা শুনলেন। কী বুঝলেন কে জানে।

জাপানি ভদ্রলোক নেমে যেতেই সবাই মউকে ঘিরে ধরলেন। একের পর এক প্রশ্ন, দিদি, আপনি কী ভাষায় কথা বললেন, এটা কি চীনে না জাপানি, আপনি চীনে ভাষা কোত্থেকে শিখলেন, আপনি কি চীনে গিয়েছিলেন, কী বলছিলেন ওই লোকটি, উনি কি চিনদেশ থেকে আসছেন না ট্যাংরা থেকে… ইত্যাদি-ইত্যাদি।

মউ কোনো জবাব দেওয়ার আগেই, একজন যাত্রী সিটে বসে থাকা একটি অল্পবয়সি ছেলেকে লাগালেন এক ধমক— এই, তুই বসে আছিস যে বড়ো। দেখছিস না যে, দিদি দাঁড়িয়ে রয়েছেন? উনি চীনেভাষা জানেন, তুই জানিস? ওঠ, ওঁকে বসতে দে।

অন্ধ্রপ্রদেশে গণ্ডগোল

কর্মসূত্রে আমাকে একবার অন্ধ্রপ্রদেশের আদৌনি বলে একটা ছোটো শহরে যেতে হয়েছিল। সঙ্গে ছিলেন কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার (সেলস) মি. পি কে ঘোষ। আমাদের যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল ওই শহরের নামজাদা ব্যবসায়ী মি. বসন্তকুমারের সঙ্গে দেখা করা। বসন্তকুমার শুধু আদৌনিতেই নয়, সারা অন্ধ্রপ্রদেশেই খ্যাতনামা।

খুব ভোরে হায়দরবাদ থেকে গাড়ি নিয়ে বেরুলে বেলা দশটা নাগাদ আদৌনি পৌঁছনো যায়। আমরা সেইরকমই রওনা হয়েছিলুম। হায়দরাবাদ শহর থেকে বেরিয়ে রাস্তা গিয়েছে দিগন্তবিস্তৃত প্রান্তরের ভেতর দিয়ে। মাঝে মাঝে গ্রাম আর চাষের খেত। কখনো-বা দু-একটি ছোটো ছোটো শহর।

ঝিমঝিম করছে রোদ। মি. ঘোষ ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি চুপচাপ বসে বাইরের দৃশ্য উপভোগ করছি। আদৌনি আসতে যখন আর ঘণ্টাখানেক বাকি, হঠাৎ দেখি আমাদের উলটোদিক থেকে একটা সবুজ রঙের অ্যামবাসাডার গাড়ি প্রচণ্ড জোরে ছুটে আসছে। আর, শুধু আসছে নয়, মাতালের মতো এঁকেবেঁকে আসছে।

আমি ড্রাইভারকে বললুম— গাড়িটার হাবভাব মোটেই ভালো ঠেকছে না। আপনি আপনার গাড়ি রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে দিন।

ড্রাইভার আমার কথায় সায় দিয়ে সেইরকমই করল। সবুজ গাড়িটা যখন কাছে এসে গেল তখন মনে হল যেন তার ভেতরে একটা ধস্তাধস্তি চলেছে আর তার পেছনের ডানদিকের জানলা দিয়ে বেরিয়ে রয়েছে একটা বন্দুকের নল। ব্যাপার দেখে আমি তাড়াতাড়ি গাড়িটার নম্বরটা টুকে নিলুম।

গাড়িটা আমাদের পাশ দিয়ে উল্কার মতো বেরিয়ে গেল আর ঠিক তক্ষুনি ছ্যাক করে একটা শব্দ হল। সঙ্গেসঙ্গে দেখি আমাদের গাড়ির সামনের কাচে একটা ছোট্ট ফুটো। একমুহূর্ত পরেই পুরো কাচটা চড়চড় করে ফেটে চৌচির হয়ে গেল।

ব্যাপারটা কী হল? ড্রাইভার বলল যে, অন্য গাড়িটা থেকে কেউ গুলি চালিয়েছে। ঠিক যে আমাদের লক্ষ করেই চালিয়েছে তা বোধ হয় নয়। বন্দুকটা নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে হয়তো গুলি বেরিয়ে গেছে। আমাদের কপাল ভালো যে কারুর গায়ে লাগেনি সেটা। লাগলে আর দেখতে হত না।

কী আর করা যাবে? আমরা তো কাঁপতে কাঁপতে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলুম। রাস্তার ধারে বড়ো বড়ো পাতার ঝোপ ছিল। সেই পাতা দিয়ে ভাঙা কাচ পরিষ্কার করা হল। তারপর যখন রওনা হতে যাচ্ছি, তখন দেখা গেল এক বিশালাকায় সর্দারজি একটা মান্ধাতার আমলের স্কুটারে চড়ে ঝড়ঝড় করতে করতে আসছেন উলটোদিক থেকে। আমরা দৌড়ে গিয়ে তাঁকে থামালুম। সমস্ত ঘটনাটা তাঁকে বলা হল।

আমরা বললুম— ঘটনাটা যদি খেলাচ্ছলেও হয়ে থাকে, তবুও সেটা তো ভালো কথা নয়। এরকম নির্জন হাইওয়ের ওপরে কারুর যদি গায়ে গুলি লাগত, তবে তার ফল অত্যন্ত খারাপ হতে পারত। সেই কারণে, সামনেই যে থানা পাবেন সেখানে এই ব্যাপারটা দয়া করে জানিয়ে দেবেন আর বলে দেবেন যে অমুক নম্বরের গাড়ি এই নম্বরের গাড়িতে গুলি চালিয়েছে। বলে একটা কাগজে নম্বরদুটো লিখে ওঁকে দিয়ে দিলুম।

সর্দারজি সমস্ত ব্যাপারটা বুঝলেন। তারপর প্রবলভাবে সম্মতি জানিয়ে চলে গেলেন। আমরাও আদৌনির দিকে রওনা হলুম। সেখানে পৌঁছে গাড়িতে নতুন কাচ লাগিয়ে, বসন্তকুমারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা সেরে আমরা যখন হায়দরাবাদের দিকে রওনা হলুম তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এসেছে।

সন্ধের মুখে আমরা একটা ছোটো শহরে এসে পৌঁছলুম। থানার কাছাকাছি আসতেই একদল পুলিশ বন্দুক উঁচিয়ে আমাদের গাড়ি আটকে দিল। ব্যাপারটা কী জানবার জন্য আমরা গাড়ি থেকে নামামাত্র একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টর এগিয়ে এসে আমাদের আর আমাদের ড্রাইভারকে থানার ভেতরে নিয়ে গেলেন। বললেন— আপনাদের গ্রেপ্তার করা হল।

আমাদের তো আক্কেল গুড়ুম। সে কী কথা? কী আমাদের অপরাধ?

থানার ইনচার্জ, একজন সাব-ইন্সপেক্টর তাঁর টেবিল অলংকৃত করে বসেছিলেন। তিনি চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন— আপনারা এই নম্বরের গাড়িতে গুলি চালিয়েছেন। সেইজন্যে আপনাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। একজন সর্দারজি আমাদের এই অভিযোগ জানিয়ে গিয়েছেন।

আমরা যতই বলি ব্যাপারটা ঠিক উলটো ঘটেছে, কে কার কথা শোনে। তার ওপরে, আমরা কী বলি তিনি ভালো বোঝেন না, আমাদের অবস্থাও তথৈবচ। আমরা কার্ড দেখাতে গেলুম, অফিসারটি বললেন— অমন কার্ড পাঁচ টাকায় এক ডজন ছাপানো যায়। আমরা বললুম— কলকাতা থেকে আসছি কাজের সূত্রে। শুনে তো তিনি হাতকড়া লাগান আর কী। বললেন— কলকাতা থেকে? তবে তো আপনারা নিশ্চয়ই নকশালপন্থী। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসেছেন। শিগগির বলুন কাকে এবং কোথায় সেইসব অস্ত্র দিয়ে এসেছেন।

আমি প্রবলভাবে আপত্তি জানালুম। এইরকম তর্কাতর্কির মধ্যে হঠাৎ মি. ঘোষ খেপে গেলেন। হাত-পা ছুড়ে বললেন— দুত্তোর অস্ত্রশস্ত্র। আমরা মি. বসন্তকুমারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। বিশ্বাস না-হয়, তাঁকে ফোন করে দেখুন।

বসন্তকুমারের নাম শুনে অফিসারটির কানে জল ঢুকল। তিনি টেলিফোন তুলে নম্বর ডায়াল করলেন। কার সঙ্গে কী কথা বললেন তা তো বুঝতে পারলুম না। তবে আমাদের নাম বলতেই টেলিফোনের ভেতর থেকে কতগুলো রক্তজল করা ভয়ংকর গর্জন ভেসে এল। ফোন রেখে দিলেন। তারপর, হেঁ-হেঁ করে হেসে, আমাদের পিঠফিট চাপড়ে স্বয়ং থানা থেকে বেরিয়ে এসে আমাদর গাড়িতে তুলে দিলেন।

সেবার আমাদের হায়দরাবাদ পৌঁছতে মাঝরাত্তির হয়ে গিয়েছিল।

বে-আইনি ব্যাপার

পাঞ্জাবে রোপাড় বলে একটা জায়গায় এক থার্মাল পাওয়ার স্টেশনে তখন আমাদের কাজ চলছিল। আমাদের ক্যাম্পে ইঞ্জিনিয়ার, অ্যাকাউন্টেন্ট, স্টোরকিপার, মেকানিক সব মিলে প্রায় সাত-আটজন লোক। আমি সেবার কলকাতা থেকে সেখানে গিয়েছিলুম কাজ কতটা এগোল দেখবার জন্যে। তিন-চারদিন ছিলুম।

এরমধ্যে একদিন সকাল বেলায় কাজের সাইটে গিয়েছি, আমাদের এক ছোকরা ইঞ্জিনিয়ার এসে ফিসফিস করে আমাকে বলল— মনোজদা, হরিণের মাংস খাবেন?

বললুম— নিশ্চয়ই খাব। খাইনি তো কোনোদিন। কিন্তু তুমি এমন রহস্যময়ভাবে বলছ কেন? কোনো গণ্ডগোল আছে না কি?

সে বলল— একটু আছে। মানে, এখানে হরিণ মারা আইনত নিষেধ। একটা পোচার একটা হরিণ মেরেছে। স্থানীয় লোকেদের কাছে গেলে যদি তারা পুলিশকে বলেটলে দেয়, সেই ভয়ে আমাদের কাছে এসেছে।

আমি বললুম— চমৎকার। হরিণের মাংস খেতে গিয়ে শেষে পুলিশের হাতে পড়ব না কি?

—কিচ্ছু হবে না, মনোজদা। আপনি শুধু হ্যাঁ বলে দিন, বাকিটা আমরা ম্যানেজ করে নেব। সবাই কিন্তু লাফাচ্ছে।

কী আর করি। আমিও যে মনে মনে লাফাচ্ছিলুম না তা-নয়। বললাম— যা খুশি করো। আমি কিছু দেখিওনি, শুনিওনি। যদি বিপদ বোঝো, তাহলেই আমাকে ডেকো।

.

সারা সকাল কাজকর্ম করে দুপুর বেলা যখন আমাদের ক্যাম্প ফিরলুম, তখন আমরা সকলেই বিশ্বগ্রাসী খিদেয় কাতর। দেখি মাংস রান্নার গন্ধে চারদিক ম-ম করছে। আমাদের রান্না করত ভুবনমোহন পাত্র। সে সার্থকনামা লোক। তার রান্না ছিল সত্যিই ভুবনমোহন। তার ওপর, সেদিন স্পেশাল মাংস। পাত্র একেবারে মনপ্রাণ দিয়ে রান্না করেছিল। তার ফলে গন্ধটা যা বেরিয়েছিল সে আর কী বলব। আমি তো প্রায় অবশ হয়ে পড়লুম। বাকি সকলের অবস্থাও সেইরকমই।

স্নানটান সেরে সবাই মিলে অধীর আগ্রহে বসে আছি কখন খাবার ডাক আসবে, এমন সময় একটি ছেলে এসে বলল— একজন বনবিভাগের লোক আর একজন পুলিশের দারোগা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

সর্বনাশ করেছে। এ তো মহা বিপদ! আর ঠিক এই সময়েই? করবার তো কিচ্ছু নেই। বললুম— ওঁদের এখানেই নিয়ে এসো।

সরকারি অফিসার দু-জন ঘরে ঢুকেই কাজের কথা পাড়লেন। বললেন— আমরা খবর পেয়েছি যে আপনাদের ক্যাম্পের একজন লোক একজন পোচারের কাছ থেকে হরিণের মাংস কিনেছে। ব্যাপারটা ভয়ানক বে-আইনি। আমরা তাকে থানায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাই।

আমি প্রশ্ন করলুম— কে এই কাজ করেছে তার নাম জানেন?

দারোগা বললেন— নাম একটা পেয়েছি বটে কিন্তু তার কোনো মানেই হয় না। এমন বিদঘুটে সব নাম বাঙালিদের। কী যেন দাই পিয়োন হাজার বা ওইরকমের কিছু।

বুঝলুম, আমাদের ইলাক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার দ্বৈপায়ন হাজরা কর্মটি করেছে। সে আমার পাশেই মুখে একেবারে শিশুর সারল্য নিয়ে বসে ছিল। তাকে জিজ্ঞেস করলুম— এ কে রে? চিনিস?

প্রবলবেগে মাথা নেড়ে দ্বৈপায়ন বলল— না, মনোজদা। দাই পিওন হাজার বলে আমাদের এখানে তো কেউ নেই। আমাদের পাশেই কনশাস কন্সট্রাকশন কাজ করছে। তাদের একবার জিজ্ঞেস করে দেখলে হয় না?

দারোগা গম্ভীরমুখে বললেন— না, যে নিয়েছে সে আপনাদেরই লোক।

আমি বললুম— আমি তো একে ঠিক চিনতে পারছি না। একটু খোঁজখবর নিয়ে দেখি। যদি পেয়ে যাই তো সন্ধের মধ্যেই তাকে আপনাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দেব।

দুই অফিসার ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন। বললেন— ঠিক আছে, তাই হবে। আমরা তাহলে এবার চলি।

দ্বৈপায়ন বিনয়ের অবতার। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বলল— সে কি কথা! যাবেন মানে? এখন আমরা খেতে বসেছি, আপনাদেরও আমাদের সঙ্গে বসতে হবে। আমরা কোনো কথাই শুনব না। আপনারা না-খেয়ে চলে গেলে আমাদের যে অকল্যাণ হবে।

অফিসার দু-জন, না-না, তা হয় না, আপনাদের কম পড়ে যাবে, ইত্যাদি বলতে লাগলেন বটে কিন্তু খুব যে একটা জোরের সঙ্গে তা মনে হল না। দুপুর বেলা, ওঁদেরও নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছিল। তার ওপরে ভুবনমোহনের রান্নার গন্ধে যে ওঁরা অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়ছিলেন তাতে আর আশ্চর্য কী। কাজেই, যেন নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও ওঁদের রাজি হতে হল।

আমরা সবাই মিলে হইহই করে খেতে বসলুম। ভুবনমোহন যা রেঁধেছিল সেদিন, জন্মজন্মান্তরেও ভুলব না। আর দুই অফিসার যা খেলেন তা দেখে তো আমরা তাজ্জব। আমাদের কম পড়ে যাওয়ার কথাটা তখন আর তাঁদের মনে ছিল কি না, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ হতে লাগল।

খাওয়া শেষ করে দু-জনে যখন স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো ফিরে যাচ্ছেন, আমি বললুম— তাহলে আজ সন্ধে বেলায় দেখা হচ্ছে।

বনবিভাগের অফিসার ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন— তার আর দরকার হবে না। যে অপরাধের তদন্ত করতে এসেছিলুম, আমরা তো এখন সেই দুষ্কর্মেরই ভাগীদার। কাজেই তদন্তটা এখন নিশ্চয়ই নিষ্প্রয়োজন।

 মিথ্যেবাদী

বিনয় দাশগুপ্ত, আমাদের পাড়ার বিনুদা, একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইঞ্জিনিয়ার। বিভিন্ন দেশ থেকে তাঁর ডাক আসে নানা রকমের সমস্যার সমাধান করে দেওয়ার জন্য। এই কারণে তাঁকে মাঝে-মাঝেই বিদেশে উড়ে যেতে হয়। কতবার যে তিনি প্লেনে চড়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু হলে কী হবে, প্লেনে চড়তে তাঁর ভীষণ ভয়। যখনই প্লেনে ওঠেন, তাঁর সঙ্গে থাকে এক শিশি ট্র্যানকুইলাইজারের বড়ি। ঝোড়ো আবহাওয়ায় বা এয়ারপকেটে পড়ে প্লেন একটু লম্ফঝম্ফ করলেই তাঁর বুকের ঢিপঢিপানি শুরু হয়ে যায়। তখন চটপট একটা বড়ি মুখে ফেলে দেন। এতে মনটা কিঞ্চিত শান্ত হয়, স্নায়ুর উত্তেজনাও কমে আসে।

একবার বিনুদা কলকাতা থেকে ব্যাঙ্কক হয়ে কাম্বোডিয়া যাচ্ছিলেন। তাঁর সহযাত্রী ছিল হল্যান্ড থেকে আসা একদল পুরুষ ও মহিলা টুরিস্ট। প্লেনে পেছনের দিকে প্যাসেজের ধারে সিট পেলেন তিনি, জানলার ধারে তাঁর পাশে বসলেন ওই টুরিস্টদলের একজন মহিলা। সেই দলের বাকিরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মাঝামাঝি জায়গার সিটগুলোতে বসলেন।

সেদিন আকাশ পরিষ্কার, মেঘের চিহ্নমাত্র নেই, মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। বিনুদা ভাবলেন— যাক, বেশ নিশ্চিন্ত মনে যাওয়া যাবে।

কিন্তু, মানুষ ভাবে এক, হয় অন্যরকম।

প্লেন আকাশে ওঠার কিছুক্ষণ বাদে হঠাৎ মাঝামাঝি জায়গার সিটগুলোতে প্রচণ্ড গোলমাল শুরু হয়ে গেল। শোনা গেল, একজন টুরিস্ট বিজাতীয় ভাষায় ষাঁড়ের মতো চিৎকার করছেন আর বাকি সকলে তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। সে একটা হুলুস্থুল কাণ্ড।

ব্যাপার দেখে বিনুদার পাশে বসে থাকা মহিলা উঠে গিয়ে তাঁর দলের বাকি সকলের সঙ্গে যোগ দিলেন। কিছুক্ষণ বাদে দেখা গেল, একজন পাইলট বেরিয়ে এসেছেন আর তিনিও আর্তনাদরত ভদ্রলোককে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা। চিৎকার আর কিছুতেই থামে না।

কিছুক্ষণ বাদে বিরক্ত মুখে ভদ্রমহিলা ফিরে গেলেন। বিনুদা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন— কী হয়েছে? ওই লোকটি অমন চিৎকার করলেন কেন?

ভদ্রমহিলা বললেন— কী জানি কী হয়েছে। পাগল-টাগল হয়ে গেছে বোধ হয়। ‘প্লেন ফেরাও, প্লেন ফেরাও’ বলে চিৎকার করছে আর হাত-পা ছুড়ছে। পাইলট এসে বলে গেলেন যে প্লেনের সবকিছু ঠিকঠাক চলছে, কোথাও কোনো গণ্ডগোল নেই, তাও কিছুতেই শুনছে না। যত সব!

বিনুদা হেসে বললেন— ও কিছু নয়। প্রথম বার প্লেনে চড়লে অনেকে এরকম নার্ভাস হয়ে পড়ে। এই দুটো বড়ি দিচ্ছি, খাইয়ে দিন। দেখবেন, একটু বাদেই ঠিক হয়ে যাবে। বলে পকেট থেকে ট্র্যানকুইলাইজারের শিশিটা বের করলেন।

ভদ্রমহিলা অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে বললেন— প্রথম বার প্লেনে? কী বলছেন আপনি? আড্রিয়ান রয়েল ডাচ এয়ারলাইন্সের কর্মচারী, ওর জীবনের অর্ধেকটাই কেটেছে আকাশে। কখনো এরকম করে না। কিন্তু আজ ওর নাকি মনের ভেতরে ডাক এসেছে। যেকোনো কারণেই হোক, ওর ধারণা হয়েছে যে, এই প্লেনটা একটু বাদেই ভেঙে পড়বে, কিছুতেই ব্যাঙ্ককে পৌঁছাবে না। আর সেইজন্যে এমন পাগলামি করছে।

শুনে বিনুদার মুখের হাসি শুকিয়ে গেল। প্রবল ঢোঁক গিলে বললেন— বলেন কী? মনের ভেতরে ডাক এসেছে? প্লেনটা একটু বাদেই ভেঙে পড়বে? বলেই শিশির দুটো বড়ি বের করে মুখের ভেতরে চালান করে দিলেন। তারপর বললেন— এরকম ডাক কি ওই ভদ্রলোকের মাঝে-মাঝেই আসে নাকি?

—মোটেই না। এই প্রথম।

আবার দুটো বড়ি অদৃশ্য হল। বিনুদা চোখ বন্ধ করে সিটের ওপরে এলিয়ে পড়লেন।

তারপর থেকে যতবার আড্রিয়ান চিৎকার করে ওঠেন বা প্লেনটা একটু কেঁপে ওঠে, ততবারই একটা কী দুটো বড়ি বিনুদার মুখের ভেতরে চলে যায়। খাওয়া তো মাথায় উঠল, চা পর্যন্ত খেলেন না।

কিছুক্ষণ বাদে চিৎকারটা একেবারে উন্মত্ত হয়ে উঠল। বিনুদা আরও দুটো বড়ি খেয়ে মিনমিন করে বললেন— প্লেনটা যেন পড়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, না?

ভদ্রমহিলা বললেন— পড়ে যাবে কেন? প্লেনটা নীচে নামছে। ব্যাঙ্কক আসতে তো আর দেরি নেই।

—আপনার তাই মনে হয়? জানলা দিয়ে দেখবেন নীচে কী আছে?

—কী আবার থাকবে! পাহাড় জঙ্গল এইসব।

—পাহাড়? জঙ্গল? কোনোক্রমে কথাদুটো বলে শেষ তিনটে বড়ি মুখের ভেতরে চালান করে দিয়ে বিনুদা একেবারে নেতিয়ে পড়লেন। তাঁর আর তখন হাত-পা নাড়ারও ক্ষমতা নেই। গলা দিয়ে অত্যন্ত ক্ষীণ আওয়াজ বেরচ্ছে। একেবারে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগের অবস্থা।

ব্যাপার দেখে সহযাত্রিণীটি ভয় পেয়ে গেলেন। তাড়াতাড়ি এয়ারহোস্টেসকে ডেকে আনলেন। তিনিও চিন্তিত। বললেন— আমি ব্যাঙ্কক বিমানবন্দরকে খবর দিচ্ছি, তারা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করবে।

কিছুক্ষণ বাদেই প্লেন একেবারে নির্বিঘ্নে ব্যাঙ্কক বিমানবন্দরে নামল। যাত্রীরা একে-একে প্লেন থেকে নামতে শুরু করলেন। বিনুদা তাঁর চেয়ারে আচ্ছন্নের মতো পড়েই রইলেন অ্যাম্বুলেন্সের প্রতীক্ষায়।

প্রায় সবাই যখন নেমে গেছে, তখন তাঁর সহযাত্রিণী এক বিশালকায় ভদ্রলোককে রীতিমতো টানতে টানতে তাঁর কাছে গিয়ে এলেন। ক্রুদ্ধ গলায় বললেন— দ্যাখো আড্রিয়ান, তোমার নির্বোধ লম্ফঝম্ফ এই ভদ্রলোকের কী অবস্থা করেছে!

আড্রিয়ান অত্যন্ত লজ্জিত আর বিনীতভাবে বিনুদাকে বললেন— স্যার, আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?

বিনুদা কথা বলতে পারলেন না। খুব ধীরে-ধীরে ওপরে-নীচে মাথা নাড়লেন।

আড্রিয়ান বললেন— স্যার, আপনি তো জানেন যে আমাদের সকলেরই মনের ভেতরে একটি ভবিষ্যদদ্রষ্টা শক্তি লুকিয়ে থাকে। সে কখনো কখনো আমাদের বিপদ সম্পর্কে আগেভাগে সাবধান করে দেয়। একেই বোধ হয় অন্তর্যামী বলে। তা স্যার, আমার অন্তর্যামীটি যে একেবারে ডাহা মিথ্যেবাদী সেটা আমি মোটেই জানতুম না। তাই এরকম ব্যবহার করেছি। আমাকে মার্জনা করে দেবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *