২২. সেই আশ্চর্য পাখি

একটা ঘটনা চলাকালীন তার প্রকৃত গুরুত্ব অনুধাবন করা যায় না। সিমডেগা শহর আর রামরেখা পাহাড়ের জঙ্গলে থাকার সময়ে যে আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল তা যে কোনো মানুষের বুদ্ধিশুদ্ধি গুলিয়ে দেবার মত। কিন্তু তখন যেন একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে চলেছিলাম, ঘটনার প্রবাহ আমার ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে, শেকড় উপড়ে ফেলে দিতে পারেনি। তবে একেবারে ভেতর থেকে নাড়া দিয়ে গিয়েছে। এখন কোলকাতা ফিরে বুঝতে পারি কী অদ্ভুত অভিজ্ঞতাই না হল! এই যে এই খাতায় এসব কথা লিখে রেখে যাচ্ছি, ভবিষ্যতে এ বিবরণ পড়ে কেউ বিশ্বাস করবে কি? যা আমার কাজ আমি করি।

আমার এক বন্ধু বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনো করে, তার কাছে জঙ্গলের ভেতর তারানাথের আবির্ভাবের গল্পটা করেছিলাম—অবশ্য নাম না করে, বন্ধুটি গল্প শুনে একটু ভেবে বলল–তুমি নিশ্চিত যে, এই ভদ্রলোক তখন কোলকাতায় ছিলেন?

—আমি নিশ্চিত।

—কোনোমতেই তার পক্ষে বিহারের জঙ্গলে উপস্থিত হওয়া সম্ভব ছিল না?

–ন্যায়শাস্ত্রের তকমতে হয়ত অসম্ভব বলা যাবে না। কিন্তু কার্যত সম্ভব ছিল না।

বন্ধুটি বলল—তাহলে এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, তুমি ভুল দেখেছ। কারণ তোমার কথা বিশ্বাস করতে হলে বিজ্ঞানের একটা মূল সূত্রকে অগ্রাহ্য করতে হয়—

বললাম—কী সেটা?

—একই বস্তু একই সঙ্গে দু-জায়গায় থাকতে পারে না। থিওসফির ভাষায় একে বলে বাইলোকেশন। বিজ্ঞানে তা অসম্ভব।

—আমাদের দেশে অনেক মহাপুরুষকে কিন্তু একই সঙ্গে দু-জায়গায় দেখা গিয়েছে। অজস্র মানুষের সমানে যখন আশ্রমে বক্তৃতা করেছেন, একই সময়ে উপস্থিত রয়েছেন মৃত্যুশয্যাশায়ী গুরুভাইয়ের পাশে। এর বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যক্ষদর্শী রয়েছে।

বন্ধু বলল—ভাই, আমি তোমার কথার সমর্থন বা বিরোধীতা কিছুই করছি না। আমি শুধু বলছি—বিজ্ঞান এ কথা মানবে না।

বললাম—বিজ্ঞানের যুক্তিই কি সব? তার বাইরে কি কিছুই নেই?

—থাকতে পারে, কিন্তু আমার জানা নেই। কারণ সেক্ষেত্রে এ আলোচনা যুক্তির সীমা পার হয়ে বিশ্বাসের রাজ্যে পৌঁছবে। আমি বিজ্ঞানী, বিশ্বাস নিয়ে কথা বলার অধিকার আমার নেই। মোট কথা, আমার মতে বাইলোকেশন সম্ভব নয়।

তারানাথকেও এ বিষয়ে বেশ চেপে ধরেছিলাম। কিন্তু সে কায়দা করে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেল। কোলকাতায় ফিরে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম— রামরেখার জঙ্গলে ঐ দুর্যোগের রাত্তিরে আপনি কী করে হাজির হলেন বলুন তো?

তারানাথ উত্তর না দিয়ে সিগারেট ধরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

—আমার বৈজ্ঞানিক বন্ধু বলেছে বাইললাকেশন—মানে, একই বস্তু বা মানুষের একই সঙ্গে দু-জায়গায় অবস্থিতি সম্ভব নয়।

তারানাথ সিগারেটে টান দিয়ে নিস্পৃহ গলায় বলল—ও।

তারানাথের সামান্য ব্যঙ্গমিশ্রিত উপেক্ষার জন্য রাগ করতে পারলাম না। কারণ বিজ্ঞানী বন্ধু যাই বলুক না কেন, ঘটনাটা তো আমি নিজের চোখে দেখেছি।

দেখলাম তারানাথ ভেতরের কথা ভাঙবে না। বললাম—আজ একটু গল্প হবে না? অনেকদিন পরে এলাম—

তারানাথ বলল—আজ এসো আমরা এমনি কথাবার্তা বলি। কিশোরী আসেনি। আজ গল্প জমবে না।

কথাটা ঠিক। কিশোরী না থাকলে আমারও একা গল্প শুনতে ভালো লাগবে না। বললাম–ঠিক আছে, তাই হোক।

একটু বাদে তারানাথের মেয়ে চারি ভেতর থেকে আমাদের জন্য চা নিয়ে এল। তার ভাল নাম বোধহয় চারুলতা বা চারুপ্রভা ওইরকম কিছু। অনেক ছোটবেলা থেকে তাকে দেখছি। আমাদের সামনে সে লজ্জা করে না। চা নামিয়ে রেখে সে হেসে বলল—ভাল আছেন কাকাবাবু? অনেকদিন পরে আপনাকে দেখলাম–

—আমরা তো নিয়মিত তোর বাবার কাছে গল্প শুনতে আসি, তুই বিয়ে হয়ে অবধি আমাদের ভুলে গেলি—তার কি হবে?

দু-তিনবছর আগে চারির বিয়ে হয়েছে। জামাই মানুষটি ভাল, সেদিক দিয়ে তারানাথ সুখী। সম্প্রতি চারির একটি খোকাও হয়েছে, তাকে কোলে করে একবার দেখিয়ে নিয়ে গেল চারি। ভারি ফুটফুটে খোকা।

এটা ওটা গল্প করে চা খেয়ে সেদিন বিদায় নিলাম।

পরের রবিবার দুপুরে খেয়ে ওঠবার একটু পরেই কিশোরী সেন এসে হাজির।

—চল হে, আজ আর দেরি নয়, তারানাথকে চেপে ধরি গিয়ে।

একটা জামা গলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাইরে। বললাম—এটুকুর জন্য আর ট্রামে চেপে লাভ নেই, চল হেঁটেই মেরে দিই–

রামরেখা পাহাড়ের অভিজ্ঞতা ফিরে এসে কিশোরীকে বলেছি। এ ধরনের কাহিনী কারুকে বলার বিপদ হল বক্তার উপহাসের পাত্র হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু কিশোরী

এবং আমিও-প্রথম শ্রেণীর গল্পখোর। গল্প যদি ভাল হয় তাহলে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্নই ওঠে না। সমস্ত গল্পটা তাকে বলতে দু-দিন সময় লেগেছিল। শোনার পর সে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল—এ কাহিনী বিশ্বাস না করে উপায় নেই। কারণ যদিও তুমি ইদানিং তারানাথের কিছু গল্প লিখে পাঠকদের চমকাবার চেষ্টা করছ, তবুও এ রকম প্রথম শ্রেণীর গল্প বানাবার ক্ষমতা তোমার নেই। তাহলে তো একটা বড়মাপের লেখক হয়ে যেতে–

বাঁকা চোখে কিশোরীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে খুব সরল মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ভারি ইয়ে তোক কিশোরী।

মাসের প্রথম। কাজেই এক প্যাকেট পাসিং শশা, তেলেভাজা এবং একঠোঙা জিলিপি নিয়ে তারানাথের বাড়ি হাজির হলাম। আমাদের দেখে সে খুশি হয়ে বলল-আরে, এস, এস, তোমাদের কথাই ভাবছিলাম। তবে এত তাড়াতাড়ি আসবে বুঝতে পারিনি–

কিশোরী বলল—একটু অসময় হয়ে গেল, না? অনেকদিন গল্পের আসর তেমন করে জমেনি, আজ আর দেরি সইছিল না—

-না, অসময় আবার কী? এত সকাল সকাল তেলেভাজা পেলে কোথায়? বাঃ, এ যে দেখছি বেশ গরম রয়েছে! নাও, শুরু কর। ভেতরে চা বলে আসি–

মট্‌ লেনের মোড়ে উড়িয়া তেলেভাজাওয়ালা গরম ভাজার ওপরে ভারি সুগন্ধি একধরনের মশলা ছড়িয়ে দেয়। বোধহয় এই জন্যেই তার দোকানে অত ভিড়। লোকে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে কেনে। কড়াই থেকে নামতে না নামতে বিক্রি হয়ে যায়। তারনাথের,ভাষায় ভোলা থেকে নোলা। তেলেভাজা চিবোনো চলছে, এমন সময়ে বাড়ির ভেতরে যাবার দরজার কড়া নড়ে উঠল। তারানাথ হেসে বলল—ওই চা এসেছে।

সে উঠে গিয়ে পেতলের থালায় সাজানো তিনকাপ চা নিয়ে এল। আমাদের সামনে। খাটের ওপর নামিয়ে রেখে হেসে বলল–তোমাদের বউদিদি এখনও একেবারেই সেকেলে মানুষ। শেকল নেড়ে জানান দেয়।

বললাম—আপনি কষ্ট করলেন কেন? চারি নেই?

তারানাথের মুখে বিষণ্ণতার ছায়া পড়ল। সন্তান বড় মায়ার জিনিস। কন্যাকে বিবাহ দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে হয় এ তো চিরকালের সত্য। ভালো ঘরে চারির বিয়ে হয়েছে। সে সুখে আছে। তার খোকাটিও হয়েছে নাদুন-নুদুস, বড় বড় ঝকঝকে চোখ। তারানাথের তো এসব নিয়ে সুখেই থাকা উচিৎ। কিন্তু প্রতিবারই মেয়ে চলে গেলে সে বেশ কয়েকদিন মুখ গম্ভীর করে থাকে। বিশেষ করে নাতিটি হবার পর তার এই দশা।

তারানাথ বলল—না, চারি গতকাল শ্বশুরবাড়ি ফিরে গিয়েছে। জামাই এসেছিল নিতে।

আমি বললাম—মন খারাপ করবেন না, এই তো সামনেই পূজো, পূজোয় তো আবার তারা আসবে। এখন বরং জমিয়ে একটা গল্প বলুন আমাদের। মনের ভার কেটে যাবে।

তারানাথ বলল-জয়তলা গ্রামের দেবদর্শন মুখুজ্যের গল্পটা তখন শেষ করা হয়নি। সেটাই আজ বরং বলি। তারপর আবার নতুন পর্বে নতুন গল্প শুরু করা যাবে। শেষ হবে না, বুঝেছ? গল্পের প্রবাহ বইছে জীবনে–

সিগারেট ধরিয়ে তারানাথ বলতে শুরু করল।

–জয়তলা গ্রাম থেকে তো বিদায় নিয়ে চলে এলাম। বড় ভাল লেগেছিল মুখুজ্জেবাড়ির আতিথ্য, স্বয়ং মুখুজ্জেমশাইকে। বেশ কিছুদিন তাদের কথা প্রায়ই মনে পড়ত। তারপরে যা হয়, একটামাত্র জিনিস নিয়ে মানুষের মন ব্যাপৃত থাকতে পারে না। ধীরে ধীরে অন্য সাম্প্রতিক ঘটনা এসে সে জায়গা দখল করল। কত জায়গায় বেড়িয়ে বেড়ালাম, কত অদ্ভুত চরিত্র দেখলাম। বছর কেটে গেল অনেক।

একদিন ঘরের ভেতর বসে কোষ্ঠী তৈরি করছি, সময়টা সকাল দশটা মত হবে, বাইরে থেকে কে যেন ডাকল—ঠাকুরমশাই।

বারান্দায় বেরিয়ে এসে দেখলাম কেউ কোথাও নেই। সে আবার কী! স্পষ্ট ডাকটা শুনলাম, কী রকম হল ব্যাপারটা।

অবাক হয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘরের মধ্যে ফিরে এসে বসতে না বসতেই আবার সেই ডাক–ঠাকুরমশাই।

এবার আর বাইরে বেরোলাম না। আমি বুঝতে পেরে গিয়েছি বেরিয়ে কাউকে দেখতে পাবো না। তার চেয়ে বড় কথা, যে ডাকছে তার গলার স্বরটা আমার খুব চেনা, যদিও সে সময় কিছুতেই ঠিক করতে পারলাম না কার গলা সেটা।

সেদিন রাত্তিরে শুয়ে স্বপ্ন দেখলাম আমি যেন আবার জয়তলা গ্রামে গিয়েছি। রঘু ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করছে—আরে! ঠাকুরমশাই যে! আসুন, আসুন–

রঘুর চুল আর গোঁফ প্রায় সবই পেকে গিয়েছে। বাঁ গালে একটা লম্বা কাটা দাগ। এটা তো আগে দেখিনি।

আরো কী যেন সব বলতে লাগল রঘু। তার ঠোট নড়ছে, কিন্তু স্বপ্নের মধ্যে সে কী বলছে তা আমি বুঝতে পারছি না। সেকালের সাইলেন্ট ছবির মত। কথা বলতে বলতে রঘু একবার হাত তুলে চোখ মুছল। কী বলছে রঘু?

ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসলাম। ঝিমঝিম করছে নিশুতি রাত। ততক্ষণে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। আমি বুঝতে পেরেছি সেদিন কার গলা আমি শুনেছিলাম।

দেবদর্শন মুখুজ্জে আমাকে ডাকছেন। জয়তলা থেকে চলে আসবার সময় ওঁকে বলে এসেছিলাম কোন কারণে আমাকে দরকার হলে কী করে ডাকতে হবে। সে কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। এত বছর পরে আমাকে কেন ডাকছেন দেবদর্শন? যে কারণেই ডাকুন না কেন, তার মধ্যে একটা অসহায় আকুতি ফুটে উঠেছিল।

পরের দিন একটা ঝুলিতে দু-চারটে জামাকাপড় গুছিয়ে নিয়ে জয়তলায় রওনা হয়ে গেলাম। মাঝখানে অনেক সময় কেটেছে বটে, কিন্তু জয়তলা পৌঁছতে হলে এখনো শেষ চার মাইল মাঠের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হয়। সুন্দর রোদে ভরা এক বিকেলে ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তার ওপর বাস থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম। বেশ বেলা থাকতে থাকতে পৌঁছে গেলাম দেবদর্শনের গ্রামে। প্রায় বারো-তেরো বছর পরে এখানে এলাম, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন এই সেদিন গিয়েছি এখান থেকে। ভালোও লাগছিল, আবার আশঙ্কাও হচ্ছিল। কে জানে কেন ডেকেছেন দেবদর্শন। যাক, এখুনি তো জানতে পারবো।

মুখুজ্জে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। এ বাড়ি আগেও পুরনোই ছিল বটে, কিন্তু তার ভেতর একটা আভিজাত্যভরা গৌরব ছিল। সে জিনিষটা যেন একদম চলে গিয়েছে। রোয়াকে ওঠবার সিঁড়িগুলো বহু জায়গায় ভাঙা। যেখানে দেবদর্শনের সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়েছিল, সেই দালানের পঙ্খের কাজের চটা উঠে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, দালানের কড়িবরগার ফাঁক থেকে পায়রার দল উধাও হয়েছে। ফলে দালানে একধরনের বিচিত্র নীরবতা বিরাজ করছে। পায়রার দল চলে যাওয়া কোন গৃহের পক্ষে শুভ লক্ষণ নয়।

আর একটা কী যেন এ বাড়িতে ঘটেছে। খুব খারাপ কিছু।

দালানে ওঠবার সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছি কাকে ডাকা যায়, দেবদর্শনের ছেলেদের নামও ঠিকঠাক মনে পড়ছে না। এমন সময় ভেতর বাড়ি থেকে রঘু বেরিয়ে এসে আমাকে দেখে একেবারে আশ্চর্য হয়ে গেল।

–আরে! ঠাকুরমশাই যে! আসুন, আসুন—

একেবারে স্বপ্নের সেই সংলাপ হুবহু।

খুব বুড়ো হয়ে গিয়েছে রঘু। চুল, ভুরু, গোঁফসব পাকা। কপালে আর মুখে জরার কুঞ্চন। তার বাঁ-গালে স্বপ্নে যেমন দেখেছি ঠিক তেমন একটা কাটা দাগ। আসলে ভবিষ্যতের এই দৃশ্যটা স্বপ্নের মধ্যে আমার মনের পটে প্রতিফলিত হয়েছিল।

বললাম–কেমন আছ রঘু? এখানকার সব খবর ভালো তো?

রঘু বলল—না ঠাকুরমশাই, খবর ভালো না।

—কেন, কী হয়েছে?

রঘুর বিশ্বস্ত, প্রবীণ চোখে বেদনা ঘনিয়ে এল। সে বলল—কর্তার খুব অসুখ। আজ মাসখানেক বিছানা থেকেও উঠতে পারছেন না। গত বছরেও একবার শরীর অসুস্থ হয়েছিল। ব্রজমাধব কবিরাজের চিকিৎসায় সেরে উঠেছিলেন। কর্তা তো ইংরিজি ওষুধ খান না। কিন্তু এবারে অবস্থা খুবই কঠিন। সেবা করবার ভালো লোক না থাকলে রোগী সারে না—

—কেন, গিন্নীমা?

—তিনি নেই।

আমি মৃত্যু অনেক দেখেছি, অনেক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গিয়েছি, শব সাধনা করেছি—মন আমার শক্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মুখুজ্জেগিন্নীর মৃত্যুসংবাদ শুনে। বুকের ভিতরটা কষ্টে মুচড়ে উঠল। মনে পড়ে গেল খেতে বসে সেই মুখ তুলে হঠাৎ গিন্নীমাকে দেখে ফেলা। সেই পদ্মপলাশের মত চোখ, চওড়া লালপাড় শাড়ি, মন্দিরের দরজার সামনে সেই লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ। তিনি চলে গিয়েছেন, তাই বুঝি এ বাড়ির ঘরদোর, দেউড়িতে, সমস্ত পরিবেশে বিষণ্ণতার ছায়া।

বললাম—তুমি তো অনেক বুড়ো হয়ে গেছ রঘু। তোমার গালে ও কীসের কাটা দাগ?

রঘু বলল—তা তো বুড়ো হয়েছি ঠাকুরমশাই, বয়স তো কম হল না। ও দাগটা হল কী, দা দিয়ে একটা বাঁশ চেঁছে খুঁটি বানাচ্ছিলাম—হঠাৎ হাত ফসূকে বাঁশটা গালের ওপর এসে পড়েছিল। বেশি লাগেনি। কিন্তু দাগটা থেকে গেল। সে যাক ঠাকুরমশাই, আমার এখন ভগবানের কাছে শুধু এইটুকু কামনা কর্তা কষ্ট না পেয়ে তাড়াতাড়ি চলে যান। পেছন পেছন আমিও যাই। আমার আগে গেলে চলবে না ঠাকুরমশাই। কর্তাকে দেখার আর কেউ নেই।

কথা বলতে বলতে রঘু হাত তুলে চোখের জল মুছল। ঠিক স্বপ্নে যেমনটি দেখেছিলাম, সেই দৃশ্য। আমি জয়তলা ছেড়ে চলে যাওয়ার অনেক পরে রঘুর গালের ওই কাটা দাগ হয়েছে, অথচ তা আমি স্বপ্নে স্পষ্ট দেখেছি। তার এই হাত তুলে চোখ মোছর ছোট্ট ঘটনাটা।

বললাম—চল রঘু, মুখুজ্জেমশাইয়ের কাছে যাই।

রঘু আমাকে নিয়ে চলল ভেতরবাড়িতে। সেই দেউড়ি, সেই বারান্দা—যেখানে বসে আমরা খেতাম। দালান পার হয়ে ভেতর বাড়ি। এর আগে জয়তলা থাকার সময়েও একেবারে অন্দর মহলে কখনও ঢুকিনি। চওড়া বারান্দা পার হয়ে বাঁদিকের একটা বড়ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে অনুচ্চ গলায় রঘু ডাকল—কর্তা, কর্তা—

কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে ক্লান্ত, স্তিমিত গলায় কথা ভেসে এল—কে?

–কর্তা, ঠাকুরমশাই এসেছেন। সেই যে, সেই ঠাকুরমশাই–

–ভেতরে নিয়ে আয়।

ঘরে ঢুকলাম। প্রায় কোমর ছাড়িয়ে উঁচু বিশাল খাটে দেবদর্শন শুয়ে আছেন। কাছে এগিয়ে গিয়ে তার খাটের পাশে দাঁড়িয়ে বললাম—কী মুখুজ্জে মশাই, চিনতে পারেন?

—পারি। কেমন আছেন আপনি?

—আমি তো ভাল আছি। আপনি আবার অসুখ বাধিয়ে বসলেন কেন? সেরে উঠুন। দেখি চটপট করে।

দেবদর্শনের চেহারা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে। শরীর প্রায় অর্ধেক, বিছানার সঙ্গে মিশে আছে। গায়ের রঙ মলিন হয়ে গিয়েছে। অনেক বয়স হয়ে গিয়েছে তার। কিন্তু। একটি জিনিস মহাকাল হরণ করে নিতে পারেনি। সেটি হচ্ছে তার চোখ। বড় বড় উজ্জ্বল দুই চোখের দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ করে তিনি বললেন—সবই তো বুঝতে পারছেন। ঠাকুরমশাই। এবার সংসার গুটিয়ে নেবার সময় হল। আর সংসারই বা কোথায়? এ. বাড়ির গিন্নীমা চলে গিয়েছেন রঘু বলে দিয়েছে বোধহয়। ছেলেরাও নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। সেটাই স্বাভাবিক। বড় একা হয়ে গেছি ঠাকুরমশাই-একা থাকা বড় কষ্টের।

একটা জিনিস দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। দেবদর্শনের খাড়া বাঁশির মত নাক ঈষৎ বেঁকে আছে। অসুস্থ শয্যাশায়ী রোগীর নাক বেঁকে গেলে সে আর বেশিদিন বাঁচে না। তাছাড়া ঘরে ঢুকেই আমি মৃত্যুর গন্ধ পেয়েছি। তোমাদের তো আগেই বলেছি এটা আমি পাই, এবং আমার এই পূর্বধারণা আজ পর্যন্ত কখনও ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়নি।

ক্ষীণস্বরে দেবদর্শন আবার বললেন—বসুন ঠাকুরমশাই, আমার এই বিছানার পাশেই বসুন। রঘু, তুই যা-ঠাকুরমশাইয়ের জন্য জলখাবারের ব্যবস্থা কর।

রঘু ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে আমার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন—শুনতে পেয়েছেন তাহলে?

বললাম-তা পেয়েছি? নইলে এলাম কেন?

—আপনাকে কষ্ট দিলাম ঠাকুরমশাই, কিন্তু আমার কোন উপায় ছিল না। আপনাকে আর একবার না দেখে আমি শান্তিতে মরতে পারতাম না। কী যে সম্পর্ক আপনি তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিলেন! যেদিন নিশ্চিত করে বুঝতে পারলাম এবারে আর বিছানা ছেড়ে উঠবো না সেদিনই দুপুরবেলা শুয়ে শুয়েই মধুসুন্দরীদেবীর শ্লোক উচ্চারণ করে মনে মনে আপনাকে ডাকলাম।

—সঙ্গে সঙ্গেই আমি আপনার ডাক শুনতে পেয়েছি। প্রথমে ঠিক বুঝতে পারিনি। কিন্তু সেদিন রাত্তিরেই এই বাড়ি আর রঘুকে স্বপ্নে দেখলাম। সময় নষ্ট করিনি মুখুজ্জে মশাই, আমি বুঝতে পেরেছিলাম হাতে বেশি সময় নেই। তাই তাড়াতাড়ি রওনা হয়ে পড়েছি।

দেবদর্শন রোগা, শীর্ণ মুখে ক্লিষ্ট হাসি হাসলেন। তার চোখের দৃষ্টির মত হাসিটুকু এখনও অম্লান আছে। তিনি বললেন—খুব ভালো করেছেন। সময় যে আর নেই সে আমিও বুঝতে পেরেছি। আমি কবে যাবো ঠাকুরমশাই?

বললাম—এখনো কিছু দেরি আছে, সম্ভবত সামনের মাসের শুক্লপক্ষের কোনো দিন। অন্য কেউ হলে বলতাম না, কিন্তু এই ভবিষ্যদ্বাণী শোনবার যোগ্যতা আপনি লাভ করেছেন। মনকে মুক্ত করে দিন, নিয়ত ইষ্টচিন্তা করুন।

দেবদর্শন বললেন—মন আমার মুক্তই আছে। সেই কবে হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ মাতৃগর্ভ থেকে উলঙ্গ ভূমিষ্ঠ হয়েছিলাম, আবার অগ্নিশুদ্ধি করে নিজেকে ফিরিয়ে দেব ঈশ্বরের হাতে। এপারের যা কিছু সঞ্চয় তা এপারেই থেকে যাবে। বরং এখন তো ওপারটাই বেশি টানে। না, ধর্মকর্ম বা ওইরকম অর্থে বলছি না। মনে হয় এবাড়ির সেই মানুষটি অপেক্ষা। করে রয়েছেন ওপারে—আমার জন্য। তার কাছেই তো যাচ্ছি, তাহলে আর ভয় কী?

একটু থেমে আবার বললেন—অনেকদিন তাকে দেখিনি, কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই তিনি এসে সামনে দাঁড়ান। যাক, একটু জল খেয়ে আবার আসুন, আপনাকে একটা কথা বলবার আছে।

এবার আর অতিথিশালা নয়, পুরনো কাছারিবাড়ির একখানা ঘরে জায়গা পেলাম। রঘু বুড়ো হয়ে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার কর্মদক্ষতা একটুও কমেনি। পশমের আসন পেতে বসিয়ে মর্তমান কলা আর একথাবা সর দিয়ে সে আমাকে পরিতোষ করে জলখাবার খাওয়ালো। সবই ঠিক, কিন্তু আমার কেবলই মনে হচ্ছিল–কঃগতোত্তরকোশলা?

আবার দেবদর্শনের ঘরে এসে বসলাম। ভদ্রলোক খুব দুর্বল হয়ে পড়েছেন, বেশি ভূমিকা না করে বললেন–ঠাকুরমশাই, সে আবার এসেছিল—

বললাম—কে?

—সেই যে, সে। অমরজীবন। বলে গিয়েছিল আবার দেখা হবে। দেখা হল। এক আশ্চর্য জিনিস সে আমাকে দেখাল। সে কথা বলবার জন্যই আপনাকে ডেকেছি। আর কেউ তো ঠিক বুঝবে না, সময় থাকতে বলে যাই–

—আপনার কষ্ট হবে না? এত কথা বলছেন।

—কিছু হবে না। আপনি আসায় আমি নতুন শক্তি পেয়েছি মনে। শুনুন, গত শুক্রবারের আগের শুক্রবার, মানে দিনদশেক আগে হঠাৎ রঘু এসে উত্তেজিত গলায়। বলল—কর্তা, সেই পাগলমত লোকটাকে মনে আছে? সে কী যেন ছড়া বলে লটারির। টিকিটের নম্বরের হদিশ দিয়েছিল? সে এসেছে–

প্রথমটা খেয়াল করতে পারিনি, মানুষ এমনই অকৃতজ্ঞ জীব। এই কয়েকবছরের ব্যবধান ভুলিয়ে দিয়েছিল তার কথা। তারপর একসঙ্গে সব মনে পড়ে গেল।

বললাম—কোথায় সে?

–দালানে বসিয়ে রেখে এসেছি কর্তা। ডাকব?

—ডাক। নিয়ে আয় এখানে—

যেতে গিয়ে রঘু একটা ইতস্তত করে দাঁড়িয়ে গেল। বললাম কীরে, কিছু বলবি?

—হ্যাঁ কর্তা। একটা ব্যাপার একটু কেমন যেন লাগছে।

—কী ব্যাপার?

—এই লোকটা এর আগে যে এসেছিল, সে কতদিন আগেকার কথা?

একটু ভেবে বললাম—তা, বছর বারো-চোদ্দ হবে। কেন রে?

–কর্তা, এই সময়ের ভেতর আমরা তো সব বুড়ো হয়ে গেলাম, চুল-দাড়ি পেকে গেল, চামড়া কুঁচকে গেল। এই লোকটার চেহারা কিন্তু একদম বদলায় নি, একেবারে সেইরকম আছে। এ আবার কী ব্যাপার কর্তা?

বললাম—তাই? আচ্ছা, আগে নিয়ে তো আয় দেখি।

একটু পরেই রঘুর পেছন পেছন অমরজীবন এসে ঘরে ঢুকল।

আশ্চর্য! রঘু একটুও বাড়িয়ে বলেনি, এ তো অবিকল সেই বারো বছর আগে দেখা মানুষটা। বরং যেন আরো তরুণ আর সতেজ হয়েছে তার চেহারা। এ কী করে হয়!

সে এগিয়ে এসে খাটের ধারে দাঁড়িয়ে বলল—মুখুজ্জেমশাই বলেছিলাম আসব? এলাম।

আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সত্যিই একটুও চেহারা বদলায়নি তার। এমন কী করে হতে পারে আমি ভেবে পেলাম না।

সে বলল—বসি একটু আপনার পাশে?

আগের বার কী সম্বোধন করেছিলাম তা ঠিকঠাক মনে পড়ল না।

এখন আমার বয়েস অনেক বেড়ে গিয়েছে, কিন্তু কোন অলৌকিক উপায়ে অমরজীবন আটকে আছে চল্লিশের কোটাতেই। কাজেই কোন সঙ্কোচ না করে বললাম—বোস। তারপর এতদিন পরে হঠাৎ?

সে বলল–আসবার সময় হয়েছিল তাই এলাম! আপনার সঙ্গে আমার একটু দরকার আছে। কিংবা এইভাবেও বলা যেতে পারে—আপনারও দরকার আছে আমাকে। কিন্তু সে তো আজকে হবে না, কাল সকালে হবে।

কিছুই বুঝতে পারলাম না, তবু বললাম—কেন? আজ হবে না কেন?

—আজ রাত্তিরে আমি স্বপ্ন দেখব, কালকের দরকারটা একটু গুছিয়ে নেব কিনা। আপনার দরকারটা কী তা ভাল করে জেনে নিতে হবে।

গতবার যখন এসেছিল অমরজীবন, তখনও এইরকম নানা পাগলাটে কথা বলেছিল। কিন্তু তার কথা অনুযায়ী আমি তো লটারির প্রাইজ পেয়েছিলাম, তাই না? তার কথাবার্তা শুনতে অদ্ভুত লাগলেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বললাম— বেশ তো, থাকো।

–আমাকে কেবল রাত্তিরে শোবার জন্য একটু জায়গা দেবেন। খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে না, স্বপ্ন দেখার রাত্তিরে আমি কিছু খাই না।

যাই হোক, পরের দিন সকালে অমরজীবন আমার বিছানার পাশে এসে বসল। আমি কিছু বলবার আগেই বলল আপনার কী চাই সেটা স্বপ্নে জানতে পারলাম!

বললাম—কী সেটা?

—এমন কেউ আছে যাকে আপনার খুব দেখতে ইচ্ছা করে? অনেকদিন দেখেনি নি এমন কেউ?

আজ কয়েকদিন হল বাবাকে খুব মনে পড়ছে। সেই কবে মারা গিয়েছেন বাবা। আমার কৈশোরে। কী ভালই না বাসতেন আমাকে! তাঁর চরিত্রে উচ্ছ্বাসের বাড়াবাড়ি ছিল না, শুধু কাছে গিয়ে বসলে বুকের উষ্ণতাটুকু টের পেতাম। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে বলেছিলেন পশ্চিমের মাঠে কোথায় নাকি তেঁতুলগাছের ডালে কী এক অদ্ভুত পাখি বাসা করেছে। সবাই দেখতে যাচ্ছে, কিন্তু কেউই বুঝতে পারছে না কী পাখি। আমাকে দেখাতে নিয়ে যাবেন বলেছিলেন। যাওয়া হয়নি। তার আগেই বাবা অসুখে পড়লেন এবং সে অসুখ থেকে আর উঠলেন না। বয়স হলে মানুষের কেবলই পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে। কিন্তু সে কথা আমি অমরজীবনকে বললাম না। দেখি ও কী করে।

অমরজীবন বলল—মুখুজ্জেমশাই, আমি জানি। আচ্ছা, আপনি একবার একটু চোখ বুজুন তো। এক থেকে পাঁচ গুনতে যতক্ষণ সময় লাগে, তারপর আবার তাকান। বন্ধ করুন চোখ।

আমি চোখ বন্ধ করে মনে মনে এক থেকে ধীরে ধীরে পাঁচ অবধি গুনলাম। তারপর তাকালাম।

অমরজীবন যেখানে বসেছিল, বিছানার পাশে সেই জায়গাটায় আমার বাবা বসে আছেন!

এক মুহূর্তের জন্যে মনে হল আমার হৃদপিণ্ড বুঝি থেমে যাবে। মায়া নয়। মতিভ্রম নয়। সত্যি সত্যিই আমার সেই হারিয়ে যাওয়া বাবা। এমনকি তার কপালের বাঁদিকের রগটাও টিটি করতে দেখলাম, যেমনটি জীবদ্দশায় বাবার করত।

বাবা মৃদু হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।

আমি আকুল হয়ে বাবার হাত জড়িয়ে ধরলাম। একেবারে বাস্তব রক্তমাংসের দেহ, কোন ফাঁকি নেই। আঃ, কতদিন পরে বাবাকে দেখছি! আমার সমস্ত মনপ্রাণ জুড়িয়ে গেল। বাবা বললেন—দেবু, আমি তোকে সেই যেখানে যাবার কথা ছিল, সেইখানে বেড়াতে নিয়ে যাবো বলে এসেছি। চল, আমার সঙ্গে যাবি–

আমি বললাম—পাখি দেখতে বাবা? পশ্চিমের মাঠে?

—না, অন্য জায়গায়। আমার সঙ্গে যেতে ভয় করবে না তো?

আমি কেঁদে ফেলে বললাম—আমি যে আর চলতে পারি না বাবা, বিছানা থেকে উঠতে পারি না–

—তোকে উঠতেও হবে না। হাঁটতেও হবে না। আমি তোকে কোলে করে নিয়ে যাবো। তুই তার জন্য তৈরি হ—

তারপর আবার মিষ্টি হেসে বললেন—দেবু, সেই অদ্ভুত পাখিটা তোর তাহলে এখনো দেখতে ইচ্ছে করে?

আমি যেন আবার শিশু হয়ে গিয়েছি। বললাম—করে।

বাবা বললেন—বেশ, দেখাচ্ছি তোকে। জানালার দিকে তাকা।

বাবার হাত ধরে থেকেই ডানদিকের জানলাটার দিকে তাকালাম। ডানা ঝাপটানোর শব্দ করে জানালার ঠিক বাইরে বাতাবি লেবু গাছের ডালে আশ্চর্য এক পাখি কোথা থেকে উড়ে এসে বসল। কী অপূর্ব রং-এর বাহার তার! কেমন চুনির মত লাল চোখ! অমন পাখি কেউ কখনো দেখেনি ঠাকুরমশাই, স্বর্গের এই বিচিত্র পাখি বাবাই তো আমায় দেখালেন। আমি খুশি হয়ে বাবার দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম।

বাবা নেই। আমি অমরজীবনের হাত ধরে রয়েছি।

এই আমার কাহিনী ঠাকুরমশাই। এই কথা বলবার জন্যই আমি আপনাকে ডাক পাঠিয়েছিলাম। আমি বুঝতে পেরেছি আমার যাবার দিন কাছে এসে গিয়েছে। কিন্তু বাবা যখন নিয়ে যাবেন বলেছেন তখন আর ভয় কি?

আমি চুপ করে বসে রইলাম?

দেবদর্শন বললেন—আপনাকে আমি পুরো চিনতে পারিনি ঠাকুরমশাই। যেমন অমরজীবনকেও না। কিন্তু এই ঘটনা আপনাকে না বলে গেলে আমি শান্তি পেতাম না। অমরজীবন কে ঠাকুরমশাই? আপনিই বা কে?

বললাম—আমি খুব সাধারণ রক্তমাংসের মানুষ। সাধনা করে কিছু শক্তি পেয়েছিলাম, এইমাত্র। কিন্তু অমরজীবনের প্রকৃত পরিচয় আমিও জানি না। না জানাই বোধহয় ভালো। আমরা বুঝতে পারবো না, কেবলমাত্র বিভ্রান্ত হবো। যদি পরজন্ম বলে কিছু থাকে। তবে হয়ত আবার সঙ্গে দেখা হবে।

দেবদর্শন চুপ করে আছেন। জানালার বাইরে বাতাবিলেবুর গাছটা, যার ডালে সেই আশ্চর্য পাখি এসে বসেছিল। এই বাড়ি জীবনদেবতার আশীর্বাদপূত, বোধহয় তাই সে পাখি কেবল এখানেই আসে। লক্ষ্মীর বাস ছিল এ বাড়িতে, এর প্রতিটি অলিন্দে দেবীর অধিষ্ঠান। মৃত্যু আসছে, কিন্তু সে আসছে শিউলিঝরা স্নিগ্ধতায়।

বাকি দিনটা ঘুরে বেড়ালাম জয়তলা গ্রামের পথে পথে। আর হয়ত কোনদিন এখানে। আসা হবে না—বিদায় চাইলাম গ্রামের মাটির কাছে। রাত্তিরবেলা বারান্দায় খেতে বসলাম। একা, দেবদর্শন চলতে পারেন না বলে আজকাল তার খাবার ঘরেই দেওয়া হয়। থালায় তুলাইপাঞ্জি চালের ভাত, ছোট্ট বাটিতে বাড়ির তৈরি গাওয়া ঘি, মৃগেল মাছের ঝোল। আজ আর গিন্নিমা দাঁড়িয়ে তদারক করছেন না, বুড়ো রঘু যত্ন করে খাওয়াচ্ছে। শেষ পাতে ঘন দুধ আর সুপক মর্তমান কলা।

জয়তলা গ্রাম সুখে থাকো। সুখে থাকো বাঙালী।

পরের দিন খুব ভোরে জয়তলা ছেড়ে চলে এলাম। রঘু গ্রামের সীমানা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে বলল–কর্তার খাওয়া ইদানিং একেবারে কমে গিয়েছিল। আপনি এসেছিলেন বলে ওঁর মন খুব খুশি, কাল দুবেলাই পেট ভরে খেয়েছেন।

আলপথে হেঁটে অর্ধেক মাঠ পার হয়ে একবার পেছন ফিরে দেখি তখনও বিশ্বস্ত, বৃদ্ধ মানুষটি তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

* * *

গল্প শেষ করে তারানাথ বলল—এ কাহিনীর এখানেই ইতি।

কিশোরী বলল—যাঃ, গল্প শেষ হয়ে গেল।

তারানাথ হেসে বলল—না, এই গল্পটা শেষ হয়ে গেল। আমি রইলাম, পৃথিবী রইল তার বৈচিত্র্য নিয়ে, অমরজীবন রইল। সবচেয়ে বড় কথা—তোমরা রইলে আমাকে দিয়ে। গল্প বলিয়ে নেবার জন্য। অবিলম্বে আবার শুরু করব।

একটু চুপ করে থেকে আমাদের দিকে তার উজ্জ্বল দুই চোখ তুলে বলল—তারপর একসময় তো থামতেই হবে। যখন আমার জানালায় এসে বসবে সেই আশ্চর্য পাখি।

 

–সমাপ্ত–

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *