ইন্দ্রিয়ের ওপারে

ইন্দ্রিয়ের ওপারে

এককালের বিখ্যাত উকিল চিত্তপ্রসাদ রায় অসন্তুষ্ট মুখ তুলে তাকাতে আমরা কলরব করে বলে উঠলুম, ‘অনেকদিন পরে আবার আপনাকে বিরক্ত করতে আসছি কিন্তু। রাগ করতে পারবেন না। এমন বর্ষার রাতে যদি আপনার রোমাঞ্চকর জীবনের একটা গল্পই না-শুনতে পেলুম, তাহলে এই বাদলার কোনো অর্থই হয় না।’

রায়মশাই দাবার বোর্ড সরিয়ে রেখে বললেন, ‘ভালো ক্লাবের মেম্বার হয়েছিলুম। এই বুড়ো বয়সে যে একটু নিশ্চিন্ত মনে দাবা খেলব, তারও উপায় নেই। তা ঠিক আছে, গল্প শুনবেন আপনারা বলছেন যখন তখন শোনানো যাবে। কিন্তু কীসের গল্প? আমার এই সুদীর্ঘ জীবনে যে কতরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে, তার তো কোনো সীমা নেই। কী ধরনের অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চান, বলুন। সেরকম কিছু যদি আমার ভাণ্ডারে থাকে তো বলা যাবে।’

সমীর বলল, ‘আচ্ছা, রায়মশাই, আমরা জানি আপনার জীবনে অনেক ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে যার মধ্যে কতগুলোয় আপনি খুব ভয় পেয়েছেন, কখনো-বা পাননি। কিন্তু এমনকী কোনো কিছু আপনার স্মৃতিতে আছে যা অত্যন্ত সুন্দর কিন্তু আপনাকে আতঙ্কিত করে?’

রায়মশাই তাঁর বিরলকেশ মাথাটি আস্তে আস্তে ওপর-নীচে নাড়লেন। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আছে। কৌশিকী কানাড়া রাগের নাম শুনেছেন? রাত্রের রাগ, আমাদের মার্গ সংগীতের মধুরতম রাগগুলির একটি। এই রাগ আমি শুনতে পারিনে, শুনলে এখনও ভয়ে আমার সর্বাঙ্গ অবশ হয়ে আসে। অবশ্য তার জন্যে কৌশিকী কানাড়া রাগটি দায়ী, তা বলা যায় না। দায়ী সেই রাগের সঙ্গে জড়িত একটা ঘটনার স্মৃতি। সেই ঘটনার কথাই আজ আপনাদের বলব।—

আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে আমাকে একবার যেতে হয়েছিল অবিভক্ত বাংলার ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ সাবডিভিশনের থামল নামে একটা ছোট্ট শহরে। অবশ্য শহর না-বলে থামলকে একটা বড়ো বর্ধিষ্ণু গ্রামই বলা উচিত; কিন্তু শহর বলছি এজন্যে যে ওখানে পাকা বাড়ির সংখ্যা ছিল প্রচুর, পাকা রাস্তা ছিল, দুটো স্কুল ছিল— একটা ছেলেদের, অন্যটা মেয়েদের আর ছিল একটা কলেজ। থামল রাজকলেজ। এখানেই গিয়েছিলুম আমি।

আমি তখন উঠতি উকিল। থামলের জমিদার কুলভূষণ সিংহরায় আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন একটা ছোট্ট মামলার তদারকি করবার জন্যে। তাঁর কাছে আমাকে রেফার করেছিলেন আমার সিনিয়র মৃগেন্দ্র বোস। কুলভূষণ আমি গিয়ে পৌঁছনোমাত্র খুব যত্নআত্তি করলেন। তারপর আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন রাজকলেজের টিচারস মেসে। তার একটা কারণ তাঁর গেস্ট হাউসে তখন কিছু বাইরের লোক ছিলেন, আর অন্য কারণ তিনি স্বভাবতই অল্পবয়েস বলে আমাকে স্টেটের গেস্ট হাউসের উপযুক্ত বলে বিবেচনা করেননি। তবে যেখানে ব্যবস্থা করে দিলেন, সেটা যে খারাপ তা কখনোই বলব না; বরং আমার কাছে তখন অত্যন্ত ভালো বলেই মনে হয়েছিল।

মেসবাড়িটা ছিল শাস্ত্রমতে চারতলা। তবে তার মধ্যে প্রথম দুটো তলাতেই মেম্বাররা থাকতেন। তিনতলায় ছাদের ওপর একটা ঘর ছিল আর তার ঠিক ওপরেই আর-একটা ঘর ছিল। এই চারতলার ঘরটায় আবার একটা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হত। তিনতলার ঘরটায় আমার থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল।

আমি ঘর দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলুম। বেশ বড়ো ঘর, তিনদিকে জানলা, কেবল উত্তর দিকটা বন্ধ, কারণ সেই দিকেই ছিল চারতলায় ওঠার সিঁড়িটা। ঘরটার পূবদিকে প্রকাণ্ড ছাদ, পশ্চিমে দিগন্তবিস্তৃত ধান খেত, তার মাঝে মাঝে ঘন গাছপালায় ঢাকা কয়েকটি গ্রাম, আর দক্ষিণে রাজকলেজের খেলার মাঠ। মাঠের ওপারে শহর। এমন একটা ঘরের কথা আপনারা কলকাতার লোক চিন্তাই করতে পারবেন না। আমি তখন যদিও কলকাতায় থাকি, কিন্তু মূলত আমি গাঁয়ের ছেলে। কাজেই, আমি যে অত্যন্ত খুশি হয়ে উঠব তাতে আর আশ্চর্য কী। কলকাতায় হাঁপিয়ে উঠেছিলুম, এখানে এসে যেন নিশ্বাস ফেলে বাঁচলুম।

মেসের ম্যানেজার সন্তোষ ঘোষাল আমাকে খুব সমাদর করে ডেকে নিলেন। সন্তোষবাবু ছিলেন রাজকলেজের দর্শনের অধ্যাপক, মধ্যবয়স্ক হাসিখুশি মানুষ। আমাকে প্রথম আলাপেই তুমি সম্বোধন করলেন। এটা সে-যুগে খুব সাধারণ ব্যাপার ছিল না, অত্যন্ত স্নেহের সম্পর্ক না-হলে চট করে একজন নবপরিচিত ব্যক্তিকে কেউ তুমি বলে সম্বোধন করত না। আসলে সন্তোষবাবু সার্থকনামা লোক ছিলেন, সকলের প্রতিই তিনি ছিলেন সন্তুষ্ট ও স্নেহসম্পৃক্ত। এমন লোকের তত্ত্বাবধানে এসে পড়ে আমিও বেশ আরামবোধ করলুম।

সন্তোষবাবু প্রথমেই আমাকে মেসবাড়িটা ঘুরিয়ে দেখালেন। প্রকাণ্ড বাড়ি, পুব-পশ্চিমে লম্বা, মাঝখান দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে তিনতলা পর্যন্ত। প্রথম দুটো তলায় দক্ষিণ দিক বরাবর চওড়া বারান্দা সিঁড়ির দু-পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে, তার গায়ে পর পর ঘর। পুব দিকের উইঙের ঘরগুলো সিনিয়র প্রফেসরদের আর পশ্চিম দিকের উইংটা সদ্য পাশ করা ছোকরা লেকচারারদের। আর আমার ঘরটা কিন্তু সিঁড়ির ঘরের লাগোয়া ছিল না, ছিল ছাদের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে।

আমি সন্তোষবাবুকে জিগ্যেস করলুম, ‘ঘরটা এমনভাবে তৈরি কেন?’

সন্তোষবাবু মৃদু হাসলেন। বললেন, ‘জমিদারের খেয়াল। ওই যে চারতলার ঘরটা দেখছ, ওখানে থাকেন কুলভূষণবাবুর ছোটো ভাই রঙ্গলাল সিংহরায়। ভদ্রলোক গানপাগল মানুষ, জমিদারিতে মন নেই। রাজকলেজে শাস্ত্রীয় সংগীত শেখান আর ওই ঘরে বসে সাধনা করেন। মাথায় কিঞ্চিৎ ছিট আছে, তবে সে দেখতে গেলে তো ওঁদের সমস্ত পরিবারটিকেই ছিটগ্রস্থ বলতে হয়।’

আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, ‘আপনাদের কলেজে শাস্ত্রীয় সংগীত শেখার ছাত্র হয়? মানে, মফস্সল শহর বলে কথা।’

সন্তোষবাবু বললেন, ‘তা হয়। শাস্ত্রীয় সংগীতে পূববাংলায় ইন্টারেস্টের তো অভাব নেই। এদিক থেকে বেশ কিছু বড়ো বড়ো শিল্পীও তৈরি হয়েছেন। আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবই তো পূববাংলার লোক। কাজেই কিছু জেনুইন ছাত্র কখনো কখনো জুটে যায়। আর তা ছাড়া কিছু খয়ের খাঁ আছেন, জমিদারবাবুদের খুশি করার জন্যে ছেলেকে গান শেখাতে পাঠান। তাঁদের সংখ্যাই বেশি।’

আমি বললুম, ‘বাঃ ভালোই হল। রঙ্গলালবাবুর সঙ্গে আলাপ করা যাবে। শাস্ত্রীয় সংগীতে আমারও কিছু অনুরাগ আছে।’

সন্তোষবাবু হাত নেড়ে বললেন, ‘সে হওয়ার যো নেই। আলাপ করতে চাও তো কলেজে যেতে হবে। এখানে ওনার সাধনমন্দিরে কোনো বাইরের লোকের প্রবেশ নিষেধ। কনসেনট্রেশন নষ্ট হয়ে যাবে— এই ভয়। আরে, ওই জন্যেই তো চারতলার ওই কুঠরিটা তৈরি করালেন। প্রথমে তো ও ঘরটা ছিল না। উনি আগে তোমার এই ঘরেই থাকতেন। কিন্তু, মেসের লোকেরা ছাদে এসে গল্পগুজব করত, কেউ কেউ জানলা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারত, তাতে ওঁর খুব অসুবিধে হত। তাই এখন এমন কায়দায় ঘর করেছেন যে পাখি না-হলে কারুর পক্ষে জানলা দিয়ে উঁকি মারা সম্ভব নয় আর গভীর রাতে ওই সরু কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওঁর দরজায় টোকা দেওয়ার মতো মারাত্মক শখও কারুর নেই।’

‘গভীর রাতে কেন?’

‘উনি তো গভীর রাতে ঘরে অসেন। কলেজেই থাকেন রাত সাতটা-সাড়ে সাতটা পর্যন্ত। তারপর বাড়ি যান, মানে জমিদার বাড়ি। সেখান থেকে খাওয়া-দাওয়া করে এখানে শুতে আসেন যখন, তখন অনেক রাত। কিন্তু মজা কী জানো, উনি যে কখন শোন, সেটা আমরা আজ পর্যন্ত বের করতে পারলুম না।’

‘তার মানে?’

‘মানে, সারা রাতের মধ্যে যখনই ঘুম ভাঙে, শুনি ওঁর ঘর থেকে কোনো-না-কোনো যন্ত্রের মৃদু সুর ভেসে আসছে। সমস্ত দরজা জানলা বন্ধ করে বাজান, যাতে কারুর বিরক্তি না-ঘটে, তবু শোনা তো যায়। তাই বলছিলুম, মাথায় ছিট আছে। কোনো সুস্থ-মস্তিষ্কের লোক দিনের-পর-দিন না ঘুমিয়ে বেঁচে থাকতে পারে? আমার তো বাপু পাক্কা আট ঘণ্টা ঘুম না-হলে পরদিন কলেজে লেকচারের বদলে শুধু হাই।’

সন্তোষবাবুর কথায় একটা কথা বুঝতে পারলুম যে একটি বিচিত্র লোকের সান্নিধ্যে আমাকে এরপর কয়েক দিন কাটাতে হবে।

প্রথম দিন অত্যন্ত ক্লান্ত ছিলুম। কাজেই বিছানায় শুতে-না-শুতেই ঘুম। ঘুম যখন ভাঙল, তখন ভোর হতে খুব বাকি নেই। আকাশ অন্ধকার বটে, কিন্তু প্রথম আলোর চরণধ্বনি শোনবার প্রত্যাশায় নিদ্রিত পৃথিবী যে আস্তে আস্তে জেগে উঠছে সেটা অনুভব করা যায়। আর তখনই শুনলুম, রঙ্গলালবাবুর ঘর থেকে ভেসে-আসা এসরাজের মৃদু গুঞ্জন। পরিচিত রাগ আশাবরী। কিন্তু কী চমৎকার হাত! দেহমন যেন এক প্রশান্ত আনন্দে ভরে গেল।

আমি বিছানা ছেড়ে উঠে আস্তে-আস্তে ছাদে চলে এলুম। পুব দিকে তখন খুব সামান্য রঙের ছোঁয়া লেগেছে। দু-একটা পাখি ডাকতে আরম্ভ করেছে। সেই নির্জন নিশাবসানের মধ্যে আশাবরীর সুরে আপ্লুত হয়ে আমি স্তম্ভিতের মতো দাঁড়িয়ে রইলুম।

যখন সুর থেমে গেল তখনও তার রেশ কাটল না। আমি যেমন দাঁড়িয়ে ছিলুম, তেমন দাঁড়িয়েই রইলুম। চমক ভাঙল কাঠের সিঁড়িতে একটি পদশব্দে। আমি মুখ তুলে রঙ্গলালবাবুকে দেখলুম।

রঙ্গলাল সার্থকনামা ব্যক্তি। অমন টকটকে গায়ের রং বাঙালির মধ্যে এর আগে বা পরে আর কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। কিন্তু ভদ্রালোককে খুব একটা সুপুরুষ বলা চলে না। মোটামুটি রোগাই বলা চলে, মাথাজোড়া টাক, কেবল দু-কানের পাশে একগুচ্ছ করে চুল, গর্তে বসা ছোটো ছোটো চোখ, চাপা নাক আর লাল টুকটুকে মোটা মোটা ঠোঁট, দেখলে মনে হয় যেন লিপস্টিক লাগানো। এককথায় দেখলে খুশি হয়ে ওঠার মতো চেহারা নয়।

কিন্তু, সেদিন সেইসময়ে আমার ভদ্রলোকের চেহারার কথা একবারও মনে হয়নি। একটু আগেই যে অসাধারণ সুর শুনলুম, তার শিল্পীকে চোখের সামনে দেখে আমার মনে একটা গভীর শ্রদ্ধার ভাব এল। আমি দু-হাত তুলে তাঁকে নমস্কার করলুম।

কিন্তু রঙ্গলাল প্রতি-নমস্কার করা দূরস্থান, কেমন একটা অদ্ভুত ভ্রূকুটিতে আমাকে অভিষিক্ত করে তাড়াতাড়ি নীচে নেমে গেলেন। সেটা বিরক্তি না-ভয় বুঝতে পারলুম না।

একটু বেলা বাড়তে আমিও নীচে গেলুম চায়ের সন্ধানে। সেখানে সন্তোষবাবুর সঙ্গে দেখা। ওঁকে রঙ্গলালবাবুর কথা বলতেই বললেন, ‘তোমাকে তখনই বলিনি? ওঁর সঙ্গে এখানে আলাপ করার চেষ্টা বৃথা। ভদ্রলোক এমনিতেই একটু বেশি রকমের গম্ভীর। কলেজেও কথা বলেন খুব কম। কিন্তু, এ-বাড়িতে কথা একেবারেই বলেন না। তার অবশ্য কারণও আছে।’

আমি জিগ্যেস করলুম, ‘কী কারণ?’

‘কারণ দুটো। প্রথম, উনি এখানে আসেন সাধনা করতে। তখন কথা বলে নষ্ট করবার মতো সময় ওঁর থাকে না। দ্বিতীয়, এই মেসে যাঁরা আছেন, তাঁদের সংগীত সম্বন্ধে যা জ্ঞান সে সম্বন্ধে যত কম বলা যায় ততই ভালো। আর একটু বেলা বাড়ুক, সবাই যখন কুয়োতলায় স্নান করতে যাবেন, তখন তাঁদের সংগীতচর্চা একটু শুনো। মানে, শুনতে তোমাকে হবেই। আর তখনই বুঝতে পারবে, কেন রঙ্গলালবাবু এঁদের সঙ্গে কথা বলতে চান না বা কথা বলতে ভয় পান।’

পরের দিন রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি পশ্চিমের জানলায় দ্বাদশীর চাঁদ হেলে পড়েছে। আমার সমস্ত ঘর একটা উজ্জ্বল কিন্তু বিষণ্ণ আলোয় ভরে রয়েছে। আমার মনে হল, আমার মনটাও যেন কেমন বিষণ্ণ হয়ে রয়েছে, অনেকটা একটা করুণ অথচ মধুর স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুম ভেঙে গেলে যেরকম হয়। যদিও তখন চারদিক নিস্তব্ধ, তবু বুঝতে পারলুম কোনো এক অনির্বচনীয় সংগীতের মধ্যে এতক্ষণ ডুবে ছিলুম, যেটা বন্ধ হতেই আমার ঘুম ভেঙে গেছে। আমার অবচেতন মন তখন তার রেশ বহন করে চলেছে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করেছি, ঠিক তখনই ওপরতলার জানলার ভেতর দিয়ে একটি দিলরুবার চাপা অথচ মন্দ্র ঝংকার ভেসে এল। আমি উদগ্রীব হয়ে উঠলুম। আস্তে আস্তে সেই ঝংকার রূপ নিল যোগিয়ায়। আর সে কী অপরূপ রূপ! আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে লাগলুম। বাজনা যখন থামল, তখন পশ্চিম আকাশ অন্ধকার করে চাঁদ অস্ত গিয়েছে, পুবের আকাশ নতুন দিনের সংবর্ধনার জন্যে প্রস্তুত।

আমি রোমাঞ্চিত দেহে মাতালের মতো টলতে টলতে বিছানা ছেড়ে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদের ওপরে এসে দাঁড়ালুম। ভোরের ঠান্ডা হাওয়ায় আমার সমস্ত শরীর যেন জুড়িয়ে গেল। আমি পশ্চিম দিকের আলসের ওপর ভর দিয়ে দূরের ধান খেতের দিকে চেয়ে রইলুম যাতে আমার পেছনে যাঁর পায়ের শব্দ সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে, তাঁর ভ্রুভঙ্গি এই ভোরের বাতাস আর যোগিয়ার রেশটুকু নষ্ট করে দিতে না-পারে। পায়ের শব্দ ছাদের ওপর এক মুহূর্ত ইতস্তত করল, তারপর নীচে নেমে গেল। বুঝলুম, রঙ্গলাল আমাকে দেখেছেন এবং বোধ হয় কালকের মতো একটা বিনীত নমস্কার আশা করেছিলেন। শুধু বুঝলুম না, নমস্কারটি না-পেয়ে তিনি খুশি হলেন কি না।

সন্তোষবাবু আমাকে দেখেই হই চই করে উঠলেন। বললেন, ‘কী হে চিত্তপ্রসাদ, সারারাত ঘুমোওনি নাকি? চোখের তলায় কালি, মুখটা পাঁশুটে হয়ে রয়েছে। ওপরের বাজনায় ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে? তুমি বরং নীচে চলে এসো, আমার ঘরেই না-হয় একটা খাট পেতে দেওয়া যাবে। রাত্রে ঘুম না-হলে সারাদিন আদালতে কাজ করবে কী করে?’

আমি বললুম, ‘ঘুম যে কম হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই সন্তোষবাবু, কিন্তু তার বদলে যা পাচ্ছি, সেটার তো কোনো তুলনাই হয় না। কী অসাধারণ হাত আপনাদের রঙ্গলালবাবুর! এমন গুণী লোক এখানে পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছেন। কলকাতায় গেলে ওঁকে তো সকলে মাথায় করে রাখবে।’

সন্তোষবাবু মৃদু হেসে বললেন, ‘বটে বটে! তা, তোমার বাপু গানবাজনা সম্পর্কে দিব্যি জ্ঞান আছে দেখছি। তালিম টালিম নিয়েছ নাকি কোনো ওস্তাদের কাছে?’

আমি জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে বললুম, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। তারাদাস গোস্বামীর কাছে আমার প্রথম হাতেখড়ি, এখন মাঝে মাঝে ওস্তাদ ওয়াহিদুল্লা খানের কাছে যাই।’

সন্তোষবাবু বেশ আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘তুমি তারাদাস গোঁসাই-এর ছাত্র? বলো কী? আমি যে গানের গ-ও জানিনে, আমিও তো তাঁর নাম শুনেছি। তবে তো তুমি সত্যি-সত্যিই কিছু জানো। ভারি আশ্চর্য ব্যাপার!’

আমি কিঞ্চিৎ ক্ষুব্ধ হয়ে বললুম, ‘কেন? আশ্চর্য কীসের? আমার চেহারা দেখলে মনেই হয় না যে আমি গান সম্পর্কে কিছু জানতে পারি? কেন, আপনাদের ওই রঙ্গলালবাবুর মতো রঙ্গদার চেহারা না-হলে বুঝি সংগীতজ্ঞ হওয়া যায় না?’

সন্তোষবাবু প্রবলবেগে হাত নেড়ে সহাস্যে বললেন, ‘আরে না, না। তোমার কথা আমি বলছিই না। আমি আশ্চর্য হচ্ছি অন্য কথা ভেবে।’

‘কী কথা?’

সন্তোষবাবু একটু চিন্তা করে বললেন, ‘আজ থাক। তোমাকে আর একদিন বলব।’

আমার মনে কেমন একটা ধাঁধা লেগে গেল, বললুম, ‘দেখুন সন্তোষবাবু, আপনার মনের কথা এখন না-বলে যদি পরে বলতে চান, না-হয় তাই বলবেন। কিন্তু আপনাদের রঙ্গলালবাবু সম্পর্কে আর একটা প্রশ্ন আমার মনে জেগেছে। সেটার কিন্তু জবাব চাই। প্রশ্নটা হল— রঙ্গলালবাবু কি আপনাদের ভয় করেন? আপনাদের যে উনি এড়িয়ে চলেন, সেটা কী অহংকারে না কোনও একটা ভয়ে?’

আমার প্রশ্ন শুনে সন্তোষবাবু ভয়ানক গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, ‘এরকম একটা ধারণা তোমার হল কী করে?’

‘গতকাল সকালে উনি যখন আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালেন, তখন আমার কেমন যেন মনে হয়েছিল ওনার দৃষ্টিতে বিরক্তির চেয়েও ত্রাসটাই বেশি। পরে আবার আপনি বললেন, উনি আপনার মেসের বোর্ডারদের সঙ্গে কথা বলতে ভয় পান। তাইতেই আমার মনে প্রশ্নটা এল। সত্যিই কী উনি ভয় পান না কি? কীসের ভয়?’

সন্তোষবাবুর মুখে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ হাসিটা ফিরে এল না। উনি পূর্ববৎ গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘কিছু মনে করো না চিত্তপ্রসাদ, তোমার এ প্রশ্নের জবাবও আমি দিতে পারলুম না। পরে হয়তো কোনোদিন দিতে পারব।’

‘আচ্ছা, এ প্রশ্নটার জবাব দিতে তো আপত্তি নেই? ওঁর ঘরটা পরিষ্কার করে কে?’

‘ওঃ, সে জমিদারবাড়িতে পূর্ণ বলে একটা কালা-বোবা চাকর আছে। সে দুপুর বেলা এসে ঝাঁটপাট দিয়ে যায়।’

‘কালা-বোবা?’ উত্তরটা শুনে আমি হতাশ হয়ে চুপ করে গেলুম।

সেদিন সারাদিনই কাছারিতে চিন্তিত হয়ে রইলুম। রঙ্গলালবাবুর ভেতরে কোথাও একটা রহস্য আছে। সন্তোষবাবু সেটা জানেন, কিন্তু চেপে যাচ্ছেন। কেন? রঙ্গলালাবাবুর পরিবারের কাছে চাকরি পাওয়ার কৃতজ্ঞতা বশত, না অন্য কোনো ব্যাপার? আর রহস্যটাই বা কী? জমিদারের ছেলে, গানবাজনা নিয়ে আছেন, কোনো অন্যায় বা অসামাজিক কাজ নয়, তারমধ্যে গোলমাল কী হতে পারে?

কৌতূহল বড়ো বিশ্রী জিনিস। একবার চেপে ধরলে, তার নিবৃত্তি না-হওয়া পর্যন্ত, চাপ বেড়েই চলে। স্বস্তি দেয় না কিছুতেই। কাজেই স্থির করে ফেললুম, এ রহস্যের সমাধান করতে হবে। তার আগে কলকাতায় ফেরা নেই।

এই স্থির করতে-করতেই চারটে বেজে গেল। কাছারি বন্ধ হওয়ার সময় হয়ে গেল। ভাবলুম, একবার রাজকলেজে যাই। সেখানে গিয়ে সোজাসুজি রঙ্গলালবাবুর সঙ্গে আলাপ জমাব। ভদ্রলোক যদি ভাগিয়ে দিতেও চান, ছাড়ব না। আমি উকিল, নাছোড়বান্দা হওয়া আমার পেশার একটা অঙ্গ।

এই ভেবে রাস্তায় বেরোতেই দেখি সন্তোষবাবু আর একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে একটা গাছলতায় দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে দু-জনেই এগিয়ে এলেন। অপরিচিত ভদ্রলোকটির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে সন্তোষবাবু বললেন, ‘চিত্তপ্রসাদ, ইনি আমাদের রাজকলেজের অধ্যাপক নৃপেন্দ্রনাথ ঘোষ। এঁকে তোমার কাছে নিয়ে এলুম একটা কথা আলোচনা করব বলে। আজ সকালে তোমাকে যে কথাটা বলব বলব করেও বলতে পারিনি, সেটাই আর কী।’

আমি বললুম, ‘বেশ তো। সে তো খুব ভালো কথা। তাহলে চলুন, ওই বেঞ্চিটাতে গিয়ে বসি।’

বেঞ্চিতে বসে আলাপচারি শুরু হল। সন্তোষবাবু বললেন, ‘দ্যাখো চিত্তপ্রসাদ, নৃপেন্দ্রবাবুকে কেন এনেছি সে কথা আগে বলি। আমাদের এই থামলে সিংহরায় পরিবার ছাড়া শস্ত্রীয় সংগীতে এক্সপার্ট বলতে যদি কেউ থাকেন তো তিনি এই ভদ্রলোক।’

বলতেই নৃপেনবাবু প্রবলবেগে হাত নেড়ে প্রতিবাদ করে উঠলেন। বললেন, ‘আরে না, না। শাস্ত্রীয় সংগীতের আমি কিছুই জানি না। আমার বাড়িতে একটা ফোনোগ্রাম আছে আর কিছু কে সি দে, ইন্দিমতী, কে মল্লিকের রেকর্ড আছে। তাতেই সকলের ধারণা হয়েছে যে আমি বুঝি মস্তবড়ো বোদ্ধা। ব্যাপারটা তা নয়। এক্সপার্ট হওয়াটা আসল কথা নয়, আসলে গান সম্পর্কে আমার কিছু ধারণা আছে আর সেই সূত্রেই আমাদের আপনার কাছে আসা।’

আমি ভীত হয়ে বললুম, ‘কী সর্বনাশ! আমাকে গানটান গাইতে বলবেন না-তো?’

নৃপেনবাবু সহাস্যে বললেন, ‘আপনি তারাদাস গোঁসাইজির ছাত্র। আপনাকে গাইতে বলব না, একথা তো জোর করে বলতে পারছি না। তবে, এখন নয়, এখন আমরা এসেছি রঙ্গলালবাবুকে নিয়ে কিছু কথা বলবার জন্যে। আচ্ছা, আপনি কি সন্তোষবাবুকে বলেছেন যে রঙ্গলালের অসাধারণ হাত, তার বাজনা অপূর্ব?’

আমি বললুম, ‘হ্যাঁ বলেছি।’

‘ঠাট্টা করে বলেছেন, না সত্যি-সত্যি?’

আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, ‘ঠাট্টা হতে যাবে কেন? আমি তো ওঁর বাজনা শুনেছি। সত্যি, অসাধারণ বাজানোর হাত ওঁর!’

‘কী শুনেছেন?’

‘প্রথম দিন এসরাজে আশাবরী আর দ্বিতীয় দিন দিলরুবায় যোগিয়া।’

নৃপেনবাবুর মুখে এবার হাসি ফুটল। বললেন, ‘ও, এই? আর দুটোই ভোররাতে ঘুম চোখে শুনেছেন তো? তাহলে ঠিকই আছে। আসলে, কথা কী জানেন? রঙ্গলাল ইদানীং কেমন একটু রহস্যময় হয়ে পড়েছে। তাই…’

আমি বললুম, ‘আর-একটু খোলসা করে বলুন। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। গানবাজনার মধ্যে রহস্য আসে কোত্থেকে?’

‘আচ্ছা, বেশ। আমি তাহলে যথাসাধ্য খোলসা করে বলছি। দেখুন, আমি আর রঙ্গলাল খুব ছোটোবেলাকার বন্ধু। আমরা এক পাঠশালায় পড়াশুনো করি, শেষ করি একসঙ্গে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। এই সন্তোষ ঘোষাল আমাদের চেয়ে দু-বছরের জুনিয়ার, পরিচয় এই ঢাকাতেই। সন্তোষের সাবজেক্ট ছিল দর্শনশাস্ত্র, আমার ইংরেজি সাহিত্য আর রঙ্গলালের ইতিহাস। ঢাকার জগন্নাথ হলে একসময় আমরা তিনজনে বড়োই আনন্দে সময় কাটিয়েছি।

আমরা যখন পাশ করি, তখন কুলভূষণবাবু কলেজ খুলেছেন। কাজেই আমরা যে সবাই সদলবলে এসে সেই কলেজেই যোগ দেব, তাতে আর আশ্চর্য কী?

এ পর্যন্ত সবই ঠিকঠাক চলছিল। গোলমাল বাধল আজ থেকে বছরআষ্টেক আগে। তখন কুলভূষণবাবুর মেয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যে বেনারস আর লখনউ-এর কিছু ওস্তাদ এসেছিলেন আমাদের এখানে। তাঁদের মধ্যে বুড়ো বীণাবাদক, ওস্তাদ ওরম অল-মালিক আর দুই বাইজি তামিমবানু আর হাফমাবানুর গানবজানা শুনে রঙ্গলাল হঠাৎ খেপে উঠল। এর আগে পর্যন্ত রঙ্গলালের সংগীতের প্রতি অতিরিক্ত রকমের কোনো অনুরাগ আমরা কখনোই দেখিনি, বরঞ্চ সুরজ্ঞানের অভাবই দেখেছি। সেই লোক এখন শাস্ত্রীয় সংগীত শেখবার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠল। কুলভূষণ স্বভাবতই মনে করলেন যে সুরের চেয়েও দুই বাইজির সুরতই রঙ্গলালকে আকৃষ্ট করেছে বেশি। অতএব, ছোটো ভাই শাস্ত্রীয় সংগীত শেখার প্রস্তাব করামাত্র কুলভূষণ তাকে আচ্ছা করে বকে দিলেন।

কিন্তু বকে কি আর সব সমস্যার সমাধান হয়? মহাসাংসারিক অশান্তি লেগে গেল। শেষপর্যন্ত কুলভূষণ ভাইয়ের প্রস্তাবে রাজি হলেন, কিন্তু এই শর্তে যে সে এখানে থেকেই গান শিখবে, ওই লখনউ-টখনউ যাওয়া চলবে না। অতঃপর রঙ্গলালের গুরু এলেন এখানে, ভগবান জানেন তাঁকে এখানে আনতে কুলভূষণের কত টাকা খরচ হয়েছিল। সেই গুরু আর কেউ নন, বুড়ো ওস্তাদ ওরম অল-মালিক।

ওস্তাদজি তাঁর শিষ্যকে প্রথমেই বীণা শেখালেন না কিন্তু। শুরু করলেন, এসরাজ আর দিলরুবা দিয়ে। আর শিষ্যও প্রবল উৎসাহে শিখতে আরম্ভ করে দিল। কুলভূষণবাবু কলেজের একটি ঘর ছেড়ে দিলেন ওঁদের। কিন্তু এই শেখানোটা বেশিদিন আর সুখপ্রদ রইল না। আমরা প্রায়ই শুনতুম, ওস্তাদজি চিৎকার করছেন, বকাবকি করছেন। যেন উনি যা দিতে চাইছেন, শিষ্য তা নিতে পারছে না।

এইভাবে দু-বছর কাটল। এর মধ্যে রঙ্গলাল চারটে রাগ শিখল— ইমন, জয়জয়ন্তী, যোগিয়া আর আশাবরী। তারপরেই ওস্তাদজি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সেই অসুখ থেকে আর উঠলেন না। সারা থামলের লোক মিলে সেবা করেও কোনো লাভ হল না। তবে, সেই অসুখের মধ্যেও ওস্তাদজি শুনতুম বারংবার রঙ্গলালকে বলতেন, আমার দুঃখ রয়ে গেল, আমি তোমাকে তৈরি করে দিয়ে যেতে পারলুম না। আমি তোমাকে শেখাতে পারলুম না কীভাবে প্রাণ ঢেলে বাজাতে হয়। তুমি খুবই মন দিয়ে বাজাও, তাতে তোমার সুরটা শুদ্ধ হয়, কিন্তু প্রাণ দিয়ে বাজাও না, তাই সেটা সুন্দর হয় না। সংগীতের উদ্দেশ্য— ব্যাকরণ মেনে কতগুলো সুরকে ঠিকমতো পর পর সাজানো নয়, তার উদ্দেশ্য— শ্রোতাকে একটা অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতায় দিয়ে যাওয়া। সেটা করতে হলে তোমার ভেতরের সবটুকু মাধুর্য ঢেলে দিতে হবে যে!

ওস্তাদজির মৃত্যুর পর রঙ্গলাল একদম পালটে গেল। সে গম্ভীর হয়ে গেল, তার ইতিহাসচর্চা, জমিদারি দেখাশুনো, সব বন্ধ হয়ে গেল। সবসময় সে ওই চারটে রাগের রেওয়াজ করে চলল। আমাদের বলত, আমি যেভাবে হোক মনপ্রাণ ঢেলে বাজাবই, গুরুজির সুর আমার কানে লেগে রয়েছে, সেই সুর তুলবই তুলব।

কিন্তু প্রতিজ্ঞা করা এককথা আর সেটা পালন করা অন্য ব্যাপার। শত চেষ্টা করেও কিন্তু রঙ্গলালের বাজনার কোনো উন্নতি হল না। সেই একঘেয়ে বিরক্তিকর ঘ্যানঘ্যানানি বাজনা। আমি যে সামান্য গান বুঝি, আমার পক্ষেও বলা সম্ভব, যে ওর বাজনা কেবল খারাপ নয়, রীতিমতো অসহ্য।’

আমি নৃপেনবাবুকে এইখানে বাধা দিয়ে জিগ্যেস করলুম, ‘তাই যদি হবে, তাহলে উনি শেখান কী করে?’

নৃপেনবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আর কী করে! তিন বছর আগে কুলভূষণবাবু ওই একটা মিউজিক ডিপার্টমেন্ট খুলেছেন মূলত বোধ হয় ভাইকে কিছুটা কাজেকর্মে রাখার জন্যে। নইলে, ভাইটা পাগল হয়ে যাবে, এই ভয় ছিল বোধ হয়। আর ভাইও সেরকমই শেখাচ্ছেন। কোনো ছাত্রই তো দেখলুম পাঁচ-ছয় মাসের বেশি টিকছে না। তবে কী জানেন, রঙ্গলাল ভালো বাজান কী খারাপ বাজান তাতে আমাদের কিছু যায়-আসে না। কিন্তু, মানুষটা যদি পালটে যায়, তবে বন্ধু হিসেবে অবশ্যই যায়-আসে। সেইজন্যেই সন্তোষের কাছে আপনার মন্তব্য শুনে আমি এখানে দৌড়ে এসেছি। তবে কি, রঙ্গলালের সাধনা এতদিনে সফল হল? আমি তো কিছুদিন আগেই শুনেছি, তখন তো কোনো পরিবর্তন লক্ষ করিনি। তবু হয়তো হতেও পারে। তাহলে, এইবার ওকে স্বাভাবিক জীবনে টেনে আনা যেতে পারে। কিন্তু, আপনার কথা শুনে বুঝলুম, আমাদের আশা অমূলক। আধ ঘুমের মধ্যে আপনি যা শুনেছেন সেটা বেশিরভাগই আপনার কল্পনা।

তবে সব রহস্যের যে সমাধান হল, তা নয়। প্রথমত, বছরদুয়েক আগে যবে থেকে রঙ্গলাল ওই চারতলার ঘরটায় আশ্রয় নিয়েছে, তবে থেকে ও কেমন একটা সন্ত্রস্ত হয়ে রয়েছে। কীসের যেন ভয়। প্রশ্ন করেও জবাব পাইনি। আর আজকাল তো আমাদের সঙ্গে কথাবলাই বন্ধ করে দিয়েছে।

দ্বিতীয়ত, সন্তোষের কাছে শুনেছেন নিশ্চয়ই সারারাত ওই ঘর থেকে বাজনার শব্দ আসে। তবে কি ও একদম উন্মাদ হয়ে গেছে? অথচ কথা যখন বলে তখন তো বেশ স্বাভাবিক মনে হয়।

তৃতীয়ত, আপনি আসার বছরখানেক আগে ওই ঘরে কিছুদিন থেকে গিয়েছেন কুলভূষণবাবুর এক বন্ধু হরিনাথ চাটুয্যে। হরিনাথবাবুর নাম আপনি শুনে থাকবেন, এককালে উনি বেশ ভালো হারমোনিয়াম বাদক বলে পরিচিত ছিলেন। উনি যাওয়ার সময় কুলভূষণকে যা বলে গেছেন, তা প্রায় আপনি যা বলেছেন তাই, কেবল অতিরিক্তের মধ্যে রয়েছে ওই যে চারটে রাগের নাম বললুম, সেগুলো ছাড়াও আরও কিছু দুষ্প্রাপ্য এবং দুরূহ রাগও নাকি তাঁর কানে এসেছিল। তা, হরিনাথ চাটুয্যে তো আবার নেশাটেশা করার ব্যাপারেও কিছু কম যান না। কাজেই অতিরিক্তটুকু বাদ দিলে যা থাকে, তাতে বোঝা যাচ্ছে, তিনিও আপনারই মতো কল্পনার শিকার হয়েছিলেন।’

নৃপেনবাবু যত সহজে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝে গেলেন, আমার পক্ষে কিন্তু সেটা সম্ভব হল না। যে সুর আমি শুনেছি, সেটা অর্ধঘুমন্ত মস্তিষ্কের কল্পনা বা হরিনাথ চাটুয্যে শুনেছিলেন সেটা আফিমের নেশা থেকে উদ্ভূত— এটা চট করে মেনে নেওয়া কঠিন। তাহলে, সমস্ত ঘটনাটার একটা যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা থাকা দরকার।

এক হতে পারে রঙ্গলালের খারাপ বাজানোটা একটা বাইরের ধোঁকার টাটি। তিনি একলব্যের মতো নিভৃতে সাধনা করে চলেছেন এবং যতদিন না পারফেকশনে পৌঁছবেন ততদিন তিনি আত্মগোপন করেই থাকবেন। কিন্তু, সেখানে প্রশ্ন থাকে, তাহলে তাঁর এত ভয় কীসের? তিনি যদি ধরা পড়েও যান যে তিনি সত্যি-সত্যি খারাপ বাজান না, তাহলে কি তাঁর কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা আছে? কী ধরনের ক্ষতি? সারারাত ধরে বাজানোই বা কেন? লোকজনের কাছ থেকে এত দূরে-দূরে থাকাই বা কেন?

আর-এক হতে পারে, হয়তো রাত্রের বাজনাটা রঙ্গলাল বাজানই না। বাজায় অন্য কেউ। গানপাগল রঙ্গলাল হয়তো কাউকে এনে আটকে রেখেছেন ওই ঘরে। সে-ই সারারাত বাজায় আর রঙ্গলালের সুরের পিপাশা মেটায়। ব্যাপারটা বেআইনি, তাই রঙ্গলালের এত ভয়। কিন্তু, দু-বছর ধরে একজন লোককে এভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে রাখা কি সম্ভব?

এইসব ভাবতে ভাবতে মেসে ফিরছিলুম। আগেই বলেছি, মেসে আসতে গেলে রাজকলেজের মাঠের পাশ দিয়ে আসতে হয়। সেখানে আসতে একটি ছেলে আমাকে ডাকল। বলল, ‘আপনিই তো চিত্তপ্রসাদ রায়? মাস্টারমশাই আপনাকে একবার ডাকছেন।’

‘কোন মাস্টারমশাই?’

‘আমাদের গানের মাস্টারমশাই। তিনি ওই দোতলার কোণের ঘরটায় আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।’

অর্থাৎ রঙ্গলাল। ভালোই হল। আমিই গিয়ে আলাপ করব ভাবছিলুম, এখন তো দেখছি তিনিই স্বয়ং ডেকে পাঠিয়েছেন। অতএব, তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে দিলুম দোতলার কোণের ঘরের উদ্দেশে।

সেটাই মিউজিক ডিপার্টমেন্ট। সারা ঘর জুড়ে গালিচা পাতা, তার ওপর ইতস্তত কিছু সেতার, এসরাজ, হারমোনিয়াম ইত্যাদি পড়ে রয়েছে। একধারে কয়েকটা আলমারি ভরতি কিছু বই আর খাতাপত্র। তাদের সামনে একটা তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে গালচের ওপর আড় হয়ে শুয়েছিলেন গতকাল ভোরে মেসের ছাদে দেখা সেই ভদ্রলোক। আমাকে দেখে তিনি সোজা হয়ে বসলেন। একটা হাত অলসভাবে সামনে মেলে দিয়ে বললেন, ‘বসুন।’

আমি একটা নমস্কার করে তাঁর সামনে বসে পড়লুম। রঙ্গলাল তার কোনো প্রত্যাভিবাদন না-করে কিছুক্ষণ বিষণ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে দেখে বললেন, ‘আপনি গান কিছু বোঝেন?’

আমি মৃদু হেসে বললুম, ‘খুবই সামান্য।’

এবারে রঙ্গলালের দৃষ্টিটা কিছু কঠিন হল। বললেন, ‘তাহলে যা বোঝেন না, তার ওপরে মন্তব্য করেন কেন?’

‘কোন মন্তব্য?’

‘আপনি নৃপেনকে বলেছেন যে রাত্রে আপনি যে বাজনা শুনেছেন, তা অপূর্ব এবং অতুলনীয়? কে আপনাকে এসব বিশেষণ প্রয়োগ করতে বলেছে? যা জানেন না বা যা বোঝেন না, তা নিয়ে আমাদের জমিদারিতে দয়া করে কোনো কথা বলবেন না। আমি কোনোরকম বাচালতা সহ্য করতে রাজি নই।’

অর্থাৎ রঙ্গলাল ভয় দেখিয়ে আমাকে চুপ করাতে চাইছেন। কিন্তু অত সহজে ভয় আমি কোনোদিনই পাইনে। তাই সহজভাবেই বললুম, ‘রঙ্গলালবাবু, আপনার বয়েস আমার চেয়ে অনেক বেশি সন্দেহ নেই, কিন্তু যে শাস্ত্রে আপনার শিক্ষা মাত্র দু-বছরের আর সাধনা আট বছরের, সেখানে আমার জমার দিকে পাল্লা কিন্তু অনেক ভারী। আমি তারাদাস গোস্বামীর কাছে ধ্রুপদ আর ধামার শিখেছি আট বছর আর ওস্তাদ ওয়াহিদুল্লার কাছে খেয়াল, তারানা আর ঠুংরির শিক্ষা চলেছে তা-ও কেননা বছর চারেক হবে। সেক্ষেত্রে কোন বাজনার ব্যাপারে আমি কী বিশেষণ প্রয়োগ করব, তার বিচার আপনি বোধ হয় করতে পারেন না, তাই না? আপনি বাচলতা সহ্য করতে পারুন বা না-পারুন, যে সুর আমি গত দু-রাত আপনার ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে শুনেছি, তা যে অপূর্ব এবং অতুলনীয়, তা আমি বলবই। আর সে সুরের সৃষ্টিকর্তা যদি আপনি হন, তাহলে চিরকাল আপনার পায়ে সশ্রদ্ধ নমস্কার জানাব।’

আমি আশঙ্কা করেছিলুম, আমার উকিলি বক্তৃতা শুনে রঙ্গলাল তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠবেন। কিন্তু তা হল না। ভদ্রলোক আবার তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে আড় হয়ে পড়লেন। বিষণ্ণ হেসে বললেন, ‘আচ্ছা, মেনে নিলুম আপনি পণ্ডিত ব্যক্তি। কিন্তু, তাহলে বলুন তো, মাত্র দু-বছরের শিক্ষা যার, সে কি অপূর্ব বা অতুলনীয় সুর সৃষ্টিতে সক্ষম?’

আমি আবার হেসে বললুম, ‘আপনার আট বছরের নিরলস সাধনার কথাও আমি জানি রঙ্গলালবাবু।’

‘সবই তো জানেন, দেখছি। শুধু এই কথাটাই জানেন না যে এ ব্যাপারে আমি কোনোরকম কথাবার্তা বা আলোচনা পছন্দ করি না। যা আমার একান্ত ব্যক্তিগত, তা আমারই থাক না।’

এবার কিন্তু আমার হাসি বন্ধ হল। রঙ্গলালের বলার মধ্যে এমন একটা অসহায় আর্ত অনুরোধ ছিল যে, আমি কিছুটা অভিভূত না-হয়ে পারলুম না। বললুম, ‘বেশ। আপনি যদি এ ব্যাপারে কোনো আলোচনা পছন্দ না-করেন, না-হয় তা না-ই করা যাবে। কিন্তু এভাবে নিজেকে লুকিয়ে রাখছেন কেন? তাতে আপনার লাভ কী?’

রঙ্গলাল এ প্রশ্নের জবাব দিলেন না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পালটা প্রশ্ন করলেন, ‘আমার বাজনা আপনার ভালো লেগেছে, নয়? কতটা ভালো?’

আমি একটু আশ্চর্য হয়ে বললুম, ‘অত্যন্ত ভালো— অসাধারণ! কিন্তু এ প্রশ্ন কেন?’

রঙ্গলাল আবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আপনার কৌতূহল নিবারণ করার ক্ষমতা আমার নেই, চিত্তপ্রসাদবাবু। করতে পারলে হয়তো ভালোই হত। কিন্তু তা হওয়ার নয়। যা চলছে, তাই চলাই ভালো। হয়তো তাতে আপনার ঔৎসুক্য কমবে না, কিন্তু আপনার মঙ্গলই হবে।’

এরপর আর কোনো প্রশ্নেরই জবাব পাইনি সেদিন। কেন তিনি আমার কৌতূহল মেটাতে পারবেন না এবং না-মিটলে কেনই বা আমার মঙ্গল, তা আর তখন জানা হল না। যদি জানতুম যে রঙ্গলাল যা বলছে, তা অসত্য বা কোনো কিছু চেপে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নয়, তাহলে হয়তো আর এগোতুম না কিন্তু তা তো হল না। ওঁর গোপনীয়তা, অনাবশ্যক ভয়, কোনো কিছু আশঙ্কা এবং সকলকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা— সবকিছু মিলে আমার মনের মধ্যে একটা অদম্য কৌতূহল জাগিয়ে তুলল। তার ওপর আমার উকিলি সত্ত্বা বারংবার বলতে লাগল, এতসবের পেছনে নিশ্চয়ই কোনো অসামাজিক বা অনৈসর্গিক পাপ লুকিয়ে আছে। আজ ভাবি, আমার উকিল আমিটাকে যদি তখন দমিয়ে রাখতে পারতুম, হয়তো তাহলে ভালোই হত।

সে রাত্রে স্বভাবতই ঘুমোব না বলে স্থির করে ফেললুম। মাথার কাছে একটা হ্যারিকেন লণ্ঠন জ্বেলে সখারাম গণেশ দেউস্করের দেশের কথা পড়তে শুরু করে দিলুম।

রঙ্গলাল যে কখন ওপরে গেলেন, টেরই পাইনি। হঠাৎ সেতারের ঝংকারে চমক ভাঙল। নৃপেনবাবুর কথা মনে পড়ল, সেতার বাজার তো কথা নয়। আর তারপর সেই ঝংকারের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে রূপ নিল মারোয়া। আমি নেশাগ্রস্তের মতো শুয়ে শুয়ে সেই অপূর্ব সুরের তরঙ্গে ডুবে যেতে লাগলুম। আবার নৃপেনবাবুর কথা মনে পড়ল, যে চারটে রাগের তিনি নাম করেছিলেন— এটি তো তাদের একটিও নয়!

কিন্তু আশ্চর্য হওয়ার সেদিন আরও বাকি ছিল। কখন যেন মারোয়া শেষ হয়ে গেল। গভীর রাত্রে ওপরের ঘর থেকে গুঞ্জরিত হয়ে এল এক অশ্রুতপূর্ব সুর। আমার মনে হল, কানাড়ার কোনো একটা বিশেষ রূপ, কিন্তু কী রূপ তা বুঝতে পারলুম না। কৌশিকী কানাড়া নামটির সঙ্গে আমার পরিচয় হয় বহু বছর পরে, কলকাতায়।

তবে, নাম না-জানা থাকলেই বা কী? অমন আশ্চর্য সমস্ত অনুভূতি অবশ করা সুর যে হতে পারে, তা আমার আগে জানা ছিল না। আমি আচ্ছন্ন হয়ে সেই সুরের মাধুর্যে ডুবে যেতে লাগলুম।

তারপর সারারাত ধরে চলল আরও কত সুরের বিস্তার। তাদের একটিও নৃপেনবাবুর দেওয়া লিস্টের অন্তর্ভুক্ত নয়। রাত শেষ হল ললিতের মধ্য দিয়ে। আমি তৃপ্ত মুগ্ধ মনে বাইরে এসে দাঁড়ালুম। জীবনে খুব কম সময়ই নিজেকে অমন সমৃদ্ধ ও পরিপূর্ণ বলে মনে হয়েছে।

ভেবেছিলুম, রঙ্গলাল রোজকার মতো সেদিনও আমার সঙ্গে বাক্যালাপ না-করে নীচে চলে যাবেন। তাই আলসের ওপর ভর দিয়ে পুবের আকাশে অপসৃয়মাণ অন্ধকারের দিকে তাকিয়েছিলুম। কিন্তু রঙ্গলালের পায়ের শব্দ নীচে যাওয়ার সিঁড়ির দিকে না-গিয়ে আমার পেছনে এসে থামল। আমি ঘুরে দাঁড়ালুম।

রঙ্গলাল একটু কুণ্ঠিত হাসি হাসলেন। বললেন, ‘আজ কীরকম শুনলেন?’

আমি বললুম, ‘এটা নিতান্তই অবান্তর প্রশ্ন রঙ্গলালবাবু। যা শুনেছি, তা অতুলনীয়। এ এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।’

রঙ্গলাল লোভার্ত অথচ কাতর দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘আমার বাজনা আপনার কাছে অতুলনীয়, অবিস্মরণীয় বলে মনে হয়েছে?’

‘হ্যাঁ, রঙ্গলালবাবু। আপনি বিশ্বাস করুন, আপনার মতো ধনী আজ আমাদের দেশে বড়ো বেশি নেই। আপনি এই পরিবেশের বাইরে এসে দাঁড়ান, দেখবেন সমস্ত দেশ আপনাকে কতখানি সম্মান দেয়।’

রঙ্গলাল করুণ হাসলেন। বললেন, ‘না তা হয় না চিত্তপ্রসাদবাবু।’

আমি অধৈর্য হয়ে বললুম, ‘কেন হয় না?’

রঙ্গলালের মুখে আবার সেই ভীত, সন্ত্রস্ত ভাবটা ফিরে এল। বললেন, ‘কারণ এই সুরের স্রষ্টা আমি নই, চিত্তপ্রসাদবাবু। এই সুর আমার ভেতরে আসে। কোত্থেকে আসে জানি না। আমাকে দিয়ে কেউ বাজায়। আমার যন্ত্রটার মতো আমিও তখন একটা যন্ত্র হয়ে যাই।’

আমি মৃদু হেসে বললুম, ‘সব স্রষ্টাই এই কথাই বলেন, রঙ্গলালবাবু। শিল্পে-সাহিত্যে-সংগীতে সব সৃষ্টির মূলেই নাকি থাকে কোনো অতীন্দ্রিয় অলৌকিক অনুপ্রেরণা। অনেক বিখ্যাত গায়কই তাঁদের অনন্যসাধারণ সংগীত সৃষ্টির পর বলেছেন যে, তাঁরা যে কী গেয়েছেন, তা তাঁদের মনে নেই। যেন অন্য কেউ তাঁদের ওপর ভর করে এই সংগীতের জন্ম দিয়েছেন— এটা খুবই স্বাভাবিক রঙ্গলালবাবু।’

আমার কথায় রঙ্গলাল খুব একটা সান্ত্বনা পেলেন বলে মনে হল না। কিছুক্ষণ বিষণ্ণ মুখে চুপ করে রইলেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘কী যে স্বাভাবিক, আর কী অস্বাভাবিক, তা বোঝবার মতো ক্ষমতা আমার নেই। কীসের ঘোরে চলেছি, কোথায় এর শেষ, জানি না। তবু আপনার কাছে প্রশংসা পেলুম, এটাই লাভ। আমার হাত দিয়ে কখনো-কখনো সুন্দর সুশ্রাব্য বাজনা বেরোয়, সেটা জানতে পারাই তো মস্তবড়ো পুরস্কার।’

বুঝতে পারলুম, রঙ্গলালের কাছে প্রকৃত সমঝদারের প্রশংসা মোটেই সুলভ নয়। এই শহরে তেমন সমঝদারও আসেন না, আর তাঁর বন্ধুবান্ধবের মনে তাঁর খারাপ বাজনার যে স্মৃতি আছে, সেটাও যাবার নয়। কাজেই প্রশংসা-প্রত্যাশী তাঁর শিল্পীমন অতৃপ্তই থেকে যায়। ভাবলুম, সেই প্রত্যাশাটাই বাড়িয়ে তোলা যাক, দেখা যাক ওঁর সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ওঁর সামনে বসে বাজনা শোনার অনুমতি আদায় করা যায় কি না। তাতে দুটো লাভ। এক, একজন গুণী শিল্পীর সামনে বসে বাজনা শোনার অভিজ্ঞতা। দুই, রহস্য যদি কিছু থাকে, তবে তার উৎঘাটন ।

কাজেই রঙ্গলালকে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললুম, ‘কী যে বলেন, তার ঠিক নেই। আমি কলকাতার লোক, সারা ভারতের হেন বড়ো শিল্পী নেই যাঁর সংগীত আমি শুনিনি। সেই অভিজ্ঞতার জোরেই বলছি, আপনার বাজনা অত্যন্ত সুন্দর। তবে একটা কথা…’

রঙ্গলাল ব্যগ্রভাবে প্রশ্ন করলেন, ‘কী কথা?’

‘মানে, আপনার বাজনা তো শুনেছি, বন্ধ জানলার ভেতর দিয়ে, খাটে শুয়ে শুয়ে। এতে তো ঠিক রস পাওয়া যায় না, যার ফলে বাজনাটা কতদূর ভালো হল, তারও সঠিক মান বের করা যায় না। যদি সামনে বসে শুনতে পেতুম তাহলে…’

রঙ্গলাল প্রবলবেগে মাথা নেড়ে বললেন, ‘না, না, তা হয় না।’

আমি মৃদু হেসে বললুম, ‘আমি আপনাকে একটুকুও বিরক্ত করতুম না। আমি অনেক ঘরোয়া আসরে একেবারে সামনে বসে ওস্তাদ মাহফুজ খান, ওস্তাদ ইমরাৎ হুসেন, পণ্ডিত শংকরলাল— এঁদের বাজনা শুনেছি। এতে আমার অভিজ্ঞতা আছে। আপনার কোনো অসুবিধে হত না।’

রঙ্গলালের দুই চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। বললেন, ‘এঁদের গান আপনি একদম সামনে বসে শুনেছেন? নিশ্চয়ই সে-অভিজ্ঞতার কথা আপনার চিরকাল মনে থাকবে?’

‘অবশ্যই থাকবে এবং সেইসব অভিজ্ঞতার সঙ্গে আপনার সামনে বসে গান শোনাটাও যোগ দিয়ে নিতে চাই রঙ্গলালবাবু।’

উত্তেজনাসংহত গলায় রঙ্গলাল বললেন, ‘এঁদের সঙ্গে আপনি আমার তুলনা করছেন চিত্তপ্রসাদবাবু?’

‘হ্যাঁ, এবং আমার এতটুকুও ভুল হয়নি, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।’

হঠাৎ সব সংযমের বাঁধ ভেঙে গেল। রঙ্গলাল দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘বেশ, তাই হবে। আমি আজ রাত্রি বেলা ঘরে ফেরার সময় আপনাকে ডেকে নেব। আপনি যেন ঘর ছেড়ে কোথাও যাবেন না।’

রঙ্গলালের ঘরে ঢুকতেই মনে হল, এ ঘরের জানলা বোধ হয় কোনোদিন খোলা হয় না। একটা স্যাঁতসেঁতে, বাসি গন্ধ সারা ঘরাটাকে একটা অন্ধকূপের মতো করে রেখেছে। ঘরটার একপাশে একটা খাট, তার ওপর সাদা চাদরে ঢাকা বিছানা। খাটের সামনে মোটা কার্পেট বাকি মেঝেটাকে ঢেকে রেখেছে; কার্পেটের ওপর নানা রকমের বাদ্যযন্ত্র, সেতার, সরোদ, দিলরুবা, বেহালা আরও কত কী। আর এপাশে-ওপাশে ছড়ানো কিছু তাকিয়া।

আমি সন্তর্পণে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলুম। ঘরে অন্য কোনো লোকের অস্তিত্ব টের পেলুম না।

রঙ্গলাল একটা বড়ো ল্যাম্প জ্বালালেন, তারপর দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। আমি বললুম, ‘জানলাগুলো খুলে দিই?’

বিদ্যুৎবেগে ঘুরে দাঁড়ালেন রঙ্গলাল। চাপা গলায় বললেন, ‘না। চুপ করে এখানে বসুন।’

জানলা খুলতে বলায় ভদ্রলোক এতটা খেপে উঠবেন বুঝিনি। ভাবলুম, তীরে এসে তরী ডোবে বুঝি। তাই তাড়াতাড়ি বললুম, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে রঙ্গলালবাবু। এই বসছি।’

রঙ্গলাল আমার সামনে কার্পেটের ওপর বসলেন। একটা এসরাজ টেনে নিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বোধ হয় স্বর্গস্থ গুরুকে নমস্কার জানালেন। তারপর ছড় দিয়ে তারের ওপর লাগালেন টান।

যে সুরটা বের হল, সেটা একেবারেই আনন্দবর্ধক নয়। রাগটা যে জয়জয়ন্তী সেটা বুঝলুম, কিন্তু সেটা যতই এগোতে লাগল, ততই আমি বিমর্ষ হয়ে পড়তে লাগলুম। একেবারে শিক্ষানবীশ হাত, যেকোনো গানের ইশকুলের প্রথম শ্রেণির ঘরের পাশ দিয়ে গেলে এরকম শব্দ শোনা যায়।

কিন্তু বাজনা যতই নিম্নমানের হোক না-কেন, আমার কীরকম মনে হতে লাগল, এটা ধোঁকার টাটি, আসল বস্তু ক্রমশ প্রকাশিতব্য। ধৈর্যং, রহু, ধৈর্যং। সবুরে নিশ্চয়ই মেওয়া ফলবে।

বেশিক্ষণ সবুর করতে হল না। রঙ্গলাল বাজাতে বাজাতে মাঝে মাঝে উজ্জ্বল চোখ তুলে আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন। বোধ হয় আমার মুখের ভাব দেখে, আমার মনের কথা বোঝবার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে ওঁর চোখের পাতা ভারী হয়ে এল, মাথাটা একটু সামনের দিকে নুয়ে পড়ল। আর সেইসঙ্গে ওঁর শিক্ষানবীশ হাত থেকে জয়জয়ন্তী একটা অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যময় পরিণতির দিকে এগিয়ে চলল। এই পরিবর্তনটা আসতে যে কত সময় লেগেছিল তা বলতে পারব না, কিন্তু হঠাৎ আমি অনুভব করলুম আমি সুরের মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি।

সেইসঙ্গে আরও একটা অনুভূতি আমায় অধিকার করে ফেলল। সেটা কিন্তু আনন্দের নয়, বরং সম্পূর্ণ বিপরীত। বদ্ধ ঘরের হাওয়াটা যেন ভারী হতে হতে জগদ্দল পাথরের মতো আমার বুকের ওপর চেপে বসল। আমার মনে হতে লাগল যেন আমি একটা আলো-বাতাসহীন অন্ধকার কুয়োর মধ্যে পড়ে গেছি, সেখানে জলের বদলে রয়েছে সুর— আমি তার মধ্যে ডুবে যাচ্ছি। একটু আলো, একটু মুক্ত বাতাসের জন্য আমার সমস্ত সত্ত্বা আকুলিবিকুলি করতে লাগল। মনে হল, এখুনি কিছু না-করতে পারলে আমি বোধ হয় মরে যাব।

প্রাণের দায়ে আমি উঠে দাঁড়ালুম। আমার এই অস্বস্তির মধ্যেই কখন যেন রঙ্গলাল জয়জয়ন্তী শেষ করে কৌশিকী কানাড়া ধরেছেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখি তাঁর বিরলকেশ মাথাটা আরও সামনে ঝুঁকে পড়েছে, মুদিতচক্ষে বাহ্যজ্ঞানলুপ্ত হয়ে তিনি বাজিয়ে চলেছেন। ভাবলুম জানলাগুলো খুলে দিই, উনি টেরও পাবেন না। আজ পূর্ণিমা, বাইরের পৃথিবীটা চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। সেই প্রকৃতিকে বাইরে আটকে রেখে এই বদ্ধ ঘরের ক্লেদাক্ত বাতাসে দমবন্ধ হয়ে কষ্ট পাওয়ার কোনো মানেই হয় না।

তাই যথাসাধ্য নিঃশব্দে গিয়ে আমি পশ্চিমের জানলাটা খুলে দিলুম। জ্যোৎস্নাপ্লাবিত দিগন্তবিস্তৃত মাঠ দেখব এই আশায়। কিন্তু কী দেখলুম? কোথায় তারাভরা আকাশ, কোথায় আদিগন্ত মাঠ, কোথায় জ্যোৎস্না? এ আমি কোথায়? সামনে ও কী?

আসলে, আমি যে কী দেখছিলুম তা আমি নিজেই ভালো করে বর্ণনা করতে পারব কি না জানি না। কিন্তু আজও চোখ বুজলে সেই ভয়ংকর দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভাসে।

কীরকম জানেন? আমার মনে হল যেন জানলার বাইরে একটা নীলাভ ধূসর ম্লান দ্যুতিময় কুয়াশার স্তর, সেটা নড়ছে-চড়ছে, তালগোল পাকাচ্ছে, কখনো উজ্জ্বলতায় বাড়ছে, কখনো কমছে। আর সেই স্তরের পেছনে কতগুলো আবছায়া শরীর। কী তাদের অবয়ব, কী তাদের রূপ, কিছুই বোঝা যায় না; কিন্তু তারা যে আছে তাতে কোনো সন্দেহ থাকে না। অনেকটা বড়ো স্টেজের ভেতরে বসে সামনে দর্শকদের দিকে তাকালে যেরকম মনে হয়। চোখের ওপর ফুটলাইনের একটা পর্দা মতন পড়ে, তার ওপারে দর্শকদের মুখ দেখা যায় না কিন্তু তাদের অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। কিন্তু থিয়েটারের স্টেজের সঙ্গে সেদিনের জানলার বাইরেটা একটা তফাত ছিল। স্টেজের দর্শকরা মানুষ, অভিনয় শুরু হলে তাঁদের অস্তিত্বের সঙ্গে অভিনেতার একটা মানসিক যোগাযোগ শুরু হয়। কিন্তু সেই জানলার বাইরে সেদিন যারা দর্শক বা শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত ছিল, তারা যে রক্তমাংসের মানুষ নয়, সেটা একমুহূর্তেই প্রতীয়মান হল আমার কাছে। শুধু তাই নয়, তারা যে কেবল অপার্থিব তাই নয়, আমি অনুভব করলুম তারা কুৎসিত, অশুভ দূষিত কোনো সত্ত্বা। কুষ্ঠরোগাক্রান্ত কদর্য মনোবৃত্তিসম্পন্ন কোনো মালি যেমন বাগানে অসাধারণ ফুল ফুটিয়ে তার সৌন্দর্য উপভোগ করে, তেমনই এরাও রঙ্গলালের হাত দিয়ে সুরসৃষ্টি করে তার রসাস্বাদন করছে। কিন্তু তাই বলে রঙ্গলালের প্রতি তাদের কিছুমাত্র মমতা নেই। শুধু রঙ্গলাল কেন, কোনো কিছুর প্রতিই এদের মমতা নেই। এদের সমগ্র অস্তিত্বটাই অমঙ্গলজনক, ক্লেদাক্ত, ভয়ংকর। সেইসঙ্গে কুয়াশার মধ্যে তাদের সরীসৃপের মতো নড়াচড়া আমি অনুভব করলুম, জানলাটা খুলে দেওয়ায় তাদের মধ্যে বীভৎস উল্লাসও যেন দেখতে পেলুম। আর সেই মনে হল, সেই স্পন্দমান কুয়াশার স্তরটা যেন দুলতে দুলতে ঘরের ভেতরে ঢুকে আসছে।

আমি ভীষণ আতঙ্কে জানলা থেকে ছিটকে এলুম। তখন মনে একটাই চিন্তা এ-ঘর থেকে পালাতে হবে। পেছনে তখন রঙ্গলাল প্রবল জলদে সুর ধরেছেন। আমি দৌড়ে গিয়ে তাঁর কাঁধ ধরে ঝাঁকানি দিয়ে বললুম, ‘রঙ্গলালবাবু, শিগগির চলুন, এখান থেকে পালাই।’ আর তার পরমুহূর্তেই আর্তনাদ করে আমি দরজাটার ওপর আছড়ে পড়লুম। রঙ্গলালের গায়ে হাত দিয়েই আমি বুঝতে পেরেছিলুম তিনি মৃত। বরফশীতল তাঁর শরীর কাঠের মতো শক্ত। তাতে জীবনের চিহ্নমাত্র নেই। একটা যন্ত্রের মতো তাঁর প্রাণহীন প্রকোষ্ঠ বাজিয়ে চলেছে কৌশিকী কানাড়া।

কী করে যে দরজার খিল খুলেছিলুম জানি না। শুধু মনে আছে দরজাটা খুলতেই চোখের ওপর এসে পড়ল জ্যোৎস্নার আলো আর আমি জ্ঞান হারিয়ে সিঁড়ির ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ে গেলুম।

জ্ঞান ফিরল পরদিন সকালে সদর হাসপাতালে। আমার পাশে তখন নৃপেনবাবু আর সন্তোষবাবু বসে। জানতে পারলুম, আমার সিঁড়ির ওপর থেকে পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে কয়েক জন বোর্ডার দৌড়ে ওপরে আসেন। তাঁরা দেখেন রঙ্গলালের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, বাজনা চলছে আর সিঁড়ির নীচে অজ্ঞান আমি। ওঁরা রঙ্গলালকে ডাকাডাকি করে কোনো সাড়া না-পেয়ে আমাকে নামিয়ে এনে হাসপাতালে পৌঁছে দেন আর সেইসঙ্গে কুলভূষণবাবুকে খবর দেন। কুলভূষণ হাসাপাতালে আমাকে দেখে যখন টিচার্স মেসে গিয়ে পৌঁছোন, তখনও রঙ্গলালের ঘরের দরজা বন্ধ কিন্তু বাজনা বন্ধ হয়ে গেছে। পুনরায় ডাকাডাকিতে কোনো সাড়া না-পেয়ে কুলভূষণের আদেশে দরজা ভেঙে ফেলা হয় এবং দেখা যায় ঘর শূন্য।

কুলভূষণ সন্দেহ করেছিলেন রঙ্গলাল হয়তো জালনা দিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে, কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজেও তাঁর মৃতদেহ কোথাও পাওয়া যায়নি। তবে শুনেছি, পুলিশ নাকি আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চেয়েছিল, কিন্তু কুলভূষণ তাঁর প্রভাব বিস্তার করে তাদের নিরস্ত করেন এবং শুধু তাই নয়, তিনি নিজেও আমাকে কোনোদিন কোনো প্রশ্ন করেননি।

তিনি কি কিছু জানতেন? জানি না। আর আপনাদের মতো সে যুগে অন্য ডাইমেনশান সম্পর্কেও আমাদের কোনো জ্ঞান ছিল না। আমাদের জগতের সঙ্গে অন্য জগৎও যে সম্পৃক্ত হয়ে থাকতে পারে, আমাদের অনুভূতির বাইরেও যে জীবন থাকতে পারে, এসব থিয়োরি আমরা কখনো কল্পনাও করিনি। কাজেই রঙ্গলালের হারিয়ে যাওয়া, প্রতি রাত্রে তাঁর প্রাণহীন শরীরের সুরসৃষ্টি, সেই ক্লেদাক্ত ভয়ংকর কুয়াশার পিণ্ডের দৃশ্য, সেই কুয়াশার পেছনে কদর্য উল্লাস— সবই আমার কাছে একটা ভয়াবহ আতঙ্কের স্মৃতি। আর, তাই যখনই আমি কৌশিকী কানাড়া শুনি, সেই স্মৃতিগুলো আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে, আমি ভয়ে অবশ হয়ে পড়ি। আমার মনে পড়ে যায়, আমাদের ইন্দ্রিয়ের ওপারে অথচ আমাদের অত্যন্ত কাছে অন্তত একটা এমন জগৎ আছে যা নির্মম, কুৎসিত আর অমঙ্গলজনক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *