পিন্টুচরণ ও নগেন্দ্রবালা

পিন্টুচরণ ও নগেন্দ্রবালা

সকাল বেলা খবরের কাগজ পড়ে পাঁচুগোপালবাবু রেগে কাঁই। এসব কী হচ্ছে কী? গভর্নমেন্ট বলে কি দেশে আর কোনো পদার্থ নেই? যে যা খুশি তাই করবে? যতই ভাবেন, ততই রেগে যান পাঁচুগোপাল। তাঁর মুখ বেগনি হয়ে ওঠে, চোখ লাল হয়, আপন মনেই গজগজ করতে থাকেন।

এমন সময় হাফপ্যান্ট, স্পোর্টস শার্ট আর ক্যানভাসের জুতো পরিহিত নৃত্যগোপাল ঘর্মাক্ত কলেবরে বাড়ি ফেরে। নৃত্যগোপাল পাঁচুগোপালের ছেলে, বয়েস কুড়ি। কিন্তু ছেলে বলেই যে তার প্রতি অতিশয় স্নেহ পোষণ করতে হবে, সে কথা মোটেই মানেন না পাঁচুগোপাল। কেমন যেন ছোকরার হাবভাব। বাপের ব্যবসায় মন নেই, কেবল লেখাপড়া করে আর সাতসকালে উঠে না-হোক কিছুটা বনবন করে দৌড়ে আসে। এর নাম নাকি জগিং না কী যেন। কেমন একটা বাউন্ডুলে ভাব, শেষপর্যন্ত সন্নিসি-টন্নিসি হয়ে যাবে না তো? বালতি আর বিড়ির ব্যাবসা করে পাঁচুগোপাল আজ কোটিপতি, কলকাতায় সাতটা, বালিতে দুটো আর হাওড়ায় চারটে করে বাড়ি, তিনটে গাড়ি, সাতটা কুকুর, সে সব কি ভেসে যাবে? তার ওপর হারামজাদা শুয়োর বাপ-চোদ্দোপুরুষের নামটা পর্যন্ত এফিডেভিট করে পালটে দিলে গা! নেত্যগোপাল নামটা না-হয় পছন্দ হয়নি, তাই বলে কুলোপাধী— কাঁড়াদাস নামটা কী দোষ করেছিল? উনি নাকি এখন আর নেত্যগোপাল কাঁড়াদাস নন, ও নামটা শুনলে সবাই নাকি হাসে, বিজনেসে অসুবিধে হয়, তাই উনি এখন দ্যুতিমান রায়! মতিচ্ছন্ন আর কাকে বলে! পাঁচুগোপাল কাঁড়াদাসের ছেলে দ্যুতিমান রায়! সারা পৃথিবী হাসছে না? এসব ভেবে আরও রেগে যান পাঁচুগোপাল। একমাত্র ছেলে, নইলে কবেই ত্যাজ্যপুত্র করে দিতেন।

বারান্দায় উঠে বাড়ির ভেতরে যেতে গিয়েও খবরের কাগজ পাঠরত বাপের রুদ্রমূর্তি দেখে নৃত্যগোপাল থমকে দাঁড়িয়ে গেল। মুচকি হেসে বলল, ‘কী হল, আজকে আবার কী খবর বেরোল? খাটালে খুন না ছোটোনাগপুরে ছিনতাই? আজকেও খুব রেগে গেছ দেখছি? রোজ রোজ এমন রেগে গেলে, শরীর ভেঙে পড়বে যে! তার চেয়ে বরং রোজ সকালে আমার সঙ্গে…’

পাঁচুগোপাল দাত কিড়মিড় করে বললেন, ‘থাক, তোমাকে আর আমার শরীরের কথা চিন্তা করতে হবে না। দুনিয়ার খবর তো আর রাখো না। খবরের কাগজ পড়লে যার মাথা ঠান্ডা থাকে, সে একটা… সে একটা গাড়ল!’

নৃত্যগোপাল দন্তবিকাশ করে বলল, ‘বেশ, তা না-হয় হল। কিন্তু খবরটা কী?’

পাঁচুগোপাল কাগজের একটা অংশ দেখিয়ে বললেন, ‘এই দ্যাখো, পড়ে দ্যাখো।’

খবরটা পড়ে নৃত্যগোপাল ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘এতে এত রেগে যাবার কী হয়েছে? দু-জন ভারতীয় বৈমানিক মহাকাশযানে চড়ে মহাশূন্যে যাবার জন্যে নির্বাচিত হয়েছে। তাতে তুমি রেগে যাচ্ছ কেন?’

পাঁচুগোপাল গলা সপ্তমে তুলে বললেন, ‘রেগে যাব না? কে এই চ্যাংড়া দুটোকে নির্বাচিত করলে, শুনি। কত টাকা দিতে পারবে এরা? টাটা বিড়লার ছেলে হলেও বা বুঝতুম।’

নৃত্যগোপাল এবার ধপাস করে বাপের পাশে তক্তপোশের ওপর বসে পড়ল। বলল, ‘এরা টাকা দেবে কোন দুঃখে? এদের নির্বাচিত করা হয়েছে এদের বয়েস দেখে। এদের ফিজিক্যাল ফিটনেস…’

পাঁচুগোপাল হাউমাউ করে উঠলেন, ‘ওই, ওই, তোমার ফিজিক্যাল ফিটনেস এসে গেছে! মহাশূন্যে যাবে তো ফিজিক্যাল ফিটনেস দিয়ে হবে কী, শুনি? ওখানে গিয়ে তোমার মতো হাফপ্যান্ট পরে জগিং করবে, না হাতের নড়া বেঁধিয়ে মহাশূন্যশ্রী হবে? টাকা দেবে না তো, মাগনা যাবে নাকি?’

‘মহাশূন্যে যেতে হলে টাকা দিতে হয়, এরকম কথা তুমি ভাবলে কী করে?’ নৃত্যগোপাল হাসবে না কাঁদবে ঠিক করতে পারল না।

‘এই তোমার বুদ্ধি? এই তোমার লেখাপড়া? মহাশূন্যে যেতে পয়সা লাগে না? গভর্নমেন্ট কোটি কোটি টাকা খরচা করে চাঁদে রকেট পাঠাবার বন্দোবস্ত করছে, এমনি এমনি লোক নিয়ে যাবার জন্যে? গভর্নমেন্টের বাস, গভর্নমেন্টের ট্রাম, গভর্নমেন্টের ট্রেন সব তাতে পয়সা দিয়ে চড়তে হয়, আর সবচেয়ে বেশি খরচের রকেটে যেতে দিতে হয় না? এত জ্ঞান নিয়ে এই শিখেছ?’

নৃত্যগোপাল বলতে গেল, ‘আহা, বিজ্ঞানের অগ্রগতি…’ কিন্তু কথাটা শেষ করতে পারল না। পাঁচুগোপাল হাত নেড়ে বললেন, ‘বটেই তো। বিজ্ঞানের অগ্রগতি মানেই পয়সা খরচ। আগে যখন বিজ্ঞান ছিল না, আমার বাবা, ঠাকুরদা দেশের বাড়ি থেকে হেঁটে কলকাতায় এসে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বালতি বিক্রি করতেন। কোনো খরচাই ছিল না। আর এখন? অগ্রগতি হয়েছে, বাস হয়েছে, ট্রেন হয়েছে, লরি-টেম্পো হয়েছে, আর পদে পদে পয়সা গুণতে হচ্ছে। তবে পয়সা খরচটা তো কোনো একটা ব্যাপারই নয়। আমি জানতে চাই, এই দুই ছোকরার মহাশূন্যে যেতে কত টাকা লাগছে। আমি যা দর দিয়েছি, তার থেকে তো বেশি কোনো মতেই হতে পারে না। থুম্বার লোকেরা তাহলে কী করে, কোন আইন মোতাবেক…’

নৃত্যগোপাল খাবি খেতে খেতে বলল, ‘দর দিয়েছ? দর দিয়েছ মানে? কাকে কীসের দর দিয়েছ তুমি?’

পাঁচুগোপাল গোমড়া মুখ করে ছাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ও, তোমাকে বলা হয়নি। আমি ওই থুম্বার ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র না কী যেন নাম, তার ডিরেক্টরকে চিঠি লিখে বলেছি যে মহাকাশে যখন লোক যাবে, তখন যেন আমাকে নেওয়া হয়। তার জন্যে যত টাকা লাগে, আমি দেব। ঠিকানাটা যদিও ধর্মদাস জোগাড় করে দিয়েছিল, কিন্তু ঠিকই ছিল সেটা। অ্যাকনলেজমেন্ট ডিউ-এর কার্ড স্ট্যাম্প সুদ্ধ ফেরত এসেছে। অথচ তার পরেও…’

নৃত্যগোপাল দু-হাতে নিজের মাথাটা টিপে ধরে বলল, ‘দাঁড়াও, দাঁড়াও। ব্যাপারটা আগে আমাকে বুঝতে দাও। তুমি মহাকাশে যাবে, আর সে জন্যে থুম্বায় দর পাঠিয়েছ?’

‘হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ।’

বলতে না-বলতে নৃত্যগোপাল হঠাৎ হাসতে শুরু করল। হাসতে হাসতে শুয়েই পড়ল তক্তপোশের ওপর। কখনো মাথা চাপড়ায় আর বলে, ‘ও বাবা গো, আর পারছি না!’ কখনো দু-হাতে পেট খিমচে ধরে চ্যাঁচায়, ‘মরে গেলুম, মরে গেলুম!’ আর পাঁচুগোপাল ছেলের কাণ্ড দেখে রাগের চোটে একবারে জড়ভরতের মতো হয়ে গেলেন।

‘এত হাসি কীসের?’— বলতে বলতে বাড়িতে ঢুকলেন ধর্মদাস কারফর্মা। শুকনো চিমসে-মারা চার ফুট দশ, এই সাতসকালেই চোখদুটি দিব্যি রক্তবর্ণ ধারণ করেছে; কিন্তু ফিটফাট ফুলবাবুটি— বয়েস যদিও পাঁচুগোপালের চেয়ে বছর কয়েক বেশিই হবে।

ধর্মদাসের গলা কানে যেতেই নৃত্যগোপাল হাসি থামিয়ে উঠে বসল। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই পাঁচুগোপাল বললেন, ‘এসো হে ধর্মদাস, এসো। সেই যে আমরা থুম্বায় চিঠি লিখেছিলুম, তোমার মনে আছে? সেই কথা শুনেই আমার শ্রীমান হাসতে শুরু করে দিয়েছেন। যেন, এটা একটা মহাহাসির ব্যাপার! একেবারে উচ্ছন্নে গেছে হে। ওর গর্ভধারিণী মারা গিয়ে ইস্তক, কেমন যেন…’

ধর্মদাস তাঁর ফিনফিনে ধুতিটি গুছিয়ে জুত হয়ে তক্তপোশে বসলেন। একটা গ্রাম্ভারি হাসি হেসে বললেন, ‘অল্পবয়েস তো, এখন হাসবে না তো হাসবে কবে? এতে তোমার রাগ করা উচিত নয়, পাঁচু। তবে হ্যাঁ, বুদ্ধিমান ছেলে, আমাদের পরামর্শ ছাড়াই তোমার ব্যাবসা চালিয়ে তো নিচ্ছে। কাজেই সে যখন হাসছে, তখন তার কারণ অনুসন্ধান করা দরকার। আমাদের ধুতিমান…’

নৃত্যগোপাল বাধা দিয়ে বলল, ‘ধুতিমান নয়, দ্যুতিমান।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, দ্যুতিমান। তবে যাই বলো, নৃত্যগোপাল নামটা অনেক সহজ ছিল হে। তা সে যাই হোক, এবার তোমার হাসির কারণটা শুনি। তোমার বাবা না-হয় অল্পবয়েসে ব্যাবসা ছেড়ে অবসর জীবনযাপন করতে শুরু করেছেন, তবুও তাঁর কাজে বা কথায় হাসির একটা কারণ থাকা উচিত—’

নৃত্যগোপাল গম্ভীর মুখে বলল, ‘কারণ একটা আছে অবশ্যই। তবে সেটা আপনাদের, বিশেষত আপনাকে বোঝাতে পারব কি না সন্দেহ আছে। কিন্তু তার আগে আমার জানা দরকার, ওই মহাকাশে বেড়াতে যাবার আইডিয়াটা বাবার মাথায় ঢোকাল কে?’

পাঁচুগোপাল বললেন, ‘ঢোকাবে আবার কে? আমি কি কোনো খবর রাখি নে? যতদিন ব্যাবসা নিয়ে ছিলুম, ততদিন কাগজ-টাগজ বেশি পড়তুম না ঠিকই, কিন্তু এখন আমার চেয়ে বেশি ওয়াকিবহাল লোক কলকাতায় একটা খুঁজে বের করো দেখি। আমি সব জানি, সব লক্ষ করি। যতদিন মার্কিনি আর রাশিয়ানরা মহাকাশে যাচ্ছিল, চাঁদে-টাদে নামছিল, আমি তো কোনো কথা বলিনি। কিন্তু আমাদের গভর্নমেন্ট যখন মহাকাশে যাবার চেষ্টা চরিত্তির শুরু করল, তখনই আমি থুম্বায় চিঠি লিখলুম। মহাকাশে যাবার জন্যে অন্য কোনো তরিকা তোমার জানা থাকে তো বলো, সে চেষ্টাও করা যাবে।’

নৃত্যগোপাল কাতরভাবে জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু মহাকাশে কেন? পৃথিবীতে কি তোমার যাবার কোনো জায়গা নেই?’

‘না, নেই। পৃথিবীতে আমার কোথাও যাবার জায়গা নেই!’

‘সে কী? এই মোটে দু-মাস হল ভারতদর্শন করে ফিরলে। তোমার পাসপোর্টও তৈরি। আগামী বছর ইউরোপ ভ্রমণে যাবার ব্যবস্থা করেছিলুম। এমনকী, যদি বলো তো ওয়ার্ল্ড ট্যুরেরও একটা চেষ্টা করতে পারি। ওই তো আমাদের কংসকাকুর মতো…’

‘চুপ করো! কংসকাকুর মতো! বলতে লজ্জা করল না তোমার? পাঁচুগোপাল কাঁড়াদাস ওই ভুঁইফোড় বোম্বেটে কংসনাশন চৌধুরির মতো কাজ করবে? আর তোমাকেও বলি, ওই হাড়হাবাতে কংসব্যাটার সঙ্গে তোমার এত পিরিত কীসের, হ্যাঁ? সারাজীবন যে তোমার বাপকে বংশ দিয়ে এল…’

‘কিন্তু কী করছেন তিনি?’

‘করবে আবার কী? কিছু করার হিম্মত আছে? বাঁশের ব্যাবসা করে আবার ফুটানি! কোথায় বাঁশ আর কোথায় বালতি! আমরা হলুম জাত ব্যাবসাদার, এইসব আজেবাজে কারবারির কাজকর্ম দেখে আমাদের চালচলন ঠিক করতে হয় না, বুঝেছ?’

‘যাই বলো বাবা, কংসকাকু মোটেই আজেবাজে কারবারি নন।’

‘আজেবাজে নয় তো কী? বাঁশের ব্যাবসা করে দুটো পয়সা করেছে। তো হয়েছে কী? বাঁশ বাঁশই, তা কখনো বালতি হয়? তা পয়সাই করুক আর ওর ওই চিমড়ে মারা হাড়জিরজিরে মেয়েটাকে নিয়ে বিলেতই ঘুরে আসুক…’

নৃত্যগোপাল তড়াক করে তক্তপোশ থেকে খাড়া হয়ে উঠে দাঁড়াল। হাহাকার করে বলল, ‘বাবা! কী বলছ তুমি? রাজহংসী হাড়জিরজিরে? রাজহংসী চিমড়ে?’

‘চিমড়ে না তো কী? বাঁশের ব্যাবসা করে কংস ব্যাটাচ্ছেলে মেয়েটাকেও বাঁশের মতো তৈরি করেছে। হ্যাঁ, চেহারা ছিল বটে তোমার মার। ঠিক একটা ওলটানো বালতির মতো। হাতলওলা চেয়ারে বসতে পারত না, গলত না কিনা। চোখ ফেরানো যেত না।’— বলে সশব্দে একটা প্রকাণ্ড দীর্ঘশ্বাস ফেললেন পাঁচুগোপাল।

নৃত্যগোপাল জেদি গলায় বলল, ‘তোমার কথা আমি মানতে পারলুম না, বাবা। কিন্তু কংসকাকু যেমন ওয়ার্ল্ড ট্যুর করে এলেন, তোমারও সেরকম করতে বাধা কোথায়? পৃথিবীতে কোথাও তোমার যাবার জায়গা নেই— একথা বলছ কেন?’

ধর্মদাস হাত নেড়ে বললেন, ‘আমি বলছি। বাধা আছে। তোমার বাবা একজন সম্মানিত ব্যক্তি, সমাজে তাঁর একটা প্রতিষ্ঠা আছে, প্রতিপত্তি আছে। সাধারণ লোক যা করে, তা তো আর তিনি করতে পারেন না। মানে, করলে ভালো দেখায় না, আর কী। মানে, তাঁর এমন কাজ করা কর্তব্য যা দেখে লোকে বলবে, হ্যাঁ, এই তো পাঁচুগোপালের উপযুক্ত কাজ, পাঁচুগোপাল ছাড়া একাজ আর কে করতে পারে?’

নৃত্যগোপাল মাথা নেড়ে বলল, ‘হুঁ, এতক্ষণে বুঝলুম। কংসকাকু ওয়ার্ল্ড ট্যুর করেছেন, তাই তাঁকে টেক্কা মারার জন্য বাবার মহাকাশ ভ্রমণ করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, এই তো?’

‘হ্যাঁ, কতকটা তাই বটে। তবে তোমার ওই টেক্কা মারা কথাটায় আমার একটু আপত্তি আছে। পাঁচুগোপাল টক্কর দিতে হলে যাবে তার চেয়ে বড়ো কারোর কাছে, কংসনাশনের মতো একজন…’

‘ব্যাস, ব্যাস। কংসকাকুর সম্পর্কে বাবা যা খুশি তাই বলতে পারেন, কারণ দু-জনে বাল্যবন্ধু, একসঙ্গে পড়াশুনো করেছেন, যদিও আজ দু-জনে দু-দিকে চলে গেছেন, কিন্তু আপনি পারেন না। তবে একটা কথা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না যে, বাবা মহাকাশ ভ্রমণে গেলে আপনার কী সুবিধে হবে? যতদিন উনি মহাকাশে থাকবেন, ততদিন সকাল বেলা এখানে লুচি-মোহনভোগটাও যে বাদ পড়বে।’

পাঁচুগোপাল চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘চোপ! ধর্মদাসের সব কাজে স্বার্থ খোঁজা তোমার একটা বদভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। আমি মহাকাশ ট্যুরে গেলে যখন দেশসুদ্ধ লোক ধন্যি ধন্যি করবে, তখনও কি তুমি তার মধ্যে ধর্মদাসের স্বার্থ খুঁজবে? আমি স্থির করেছি যখন, তখন আমি মহাকাশে যাবই। দেখি, তুমি আমায় কী করে ঠেকাও।’

নৃত্যগোপাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমি তোমাকে ঠেকাতে যাব কোন দুঃখে? তবে যাই করো, আমাকে একটু জানিয়ে রেখো। এখন তবে অফিসে চললুম। আজ ম্যাদাগাস্কার থেকে একটা ট্রেড ডেলিগেশন আসছে, পঞ্চাশ হাজার অ্যালুমিনিয়াম আর তিরিশ হাজার প্লাস্টিকের বালতির জন্যে নিগোশিয়েট করতে। এর পরেরটাই হয়তো মঙ্গলগ্রহের ডেলিগেশন হবে। তখন তোমাকে আবার অফিসে নিয়ে যাব, এক্সপার্ট হিসেবে।’

সন্ধে বেলা বাড়ি ফিরে মিস্টার দ্যুতিমান রায় ওরফে নৃত্যগোপাল নিজের ঘরে না-গিয়ে প্রথমেই তার বাবার ঘরে চলে গেল। দু-হাত ঘষতে ঘষতে বলল, ‘বাবা, জোর খবর! তিরিশ লাখ টাকার এক্সপোর্ট অর্ডার ফাইনালাইজড হয়ে গেল। প্রথম শিপমেন্ট— ছ-মাস বাদে।’— কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখল যে শ্রোতার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠা তো দূরস্থান, কোনো রেখারও পরিবর্তন হল না সেখানে।

ভাবলেশহীন মুখে পাঁচুগোপাল বললেন, ‘বাঃ, ভালো কথা। কিন্তু শোনো, একটা জরুরি কাজ আছে। এই বিজ্ঞাপনটা দিচ্ছি, আগামী রোববারের দুটো ইংরেজি আর দুটো বাংলা কাগজে বেরোনো চাই।’

ক্ষুণ্ণমুখে নৃত্যগোপাল কাগজটা নিল। বলল, ‘পড়ে দেখতে পারি?’

‘নিশ্চয়ই।’

মনোযোগ দিয়ে বিজ্ঞাপনটা পড়ে নৃত্যগোপাল বলল, ‘ওঃ, এই ব্যাপার!’

‘তার মানে?’

‘মানে অত্যন্ত পরিষ্কার। থুম্বা তোমার অনুরোধে কান দিল না বলে তুমি এখন নিজেই মহাকাশযান বানিয়ে বেড়াতে যেতে চাও। তার জন্যে যত টাকা লাগে, তাও তুমি দিতে প্রস্তুত। সেই জন্যে কাগজে বিজ্ঞাপন দিচ্ছ। বয়ানটা অবশ্য লিখে দিয়েছেন ধর্মদাস। ভালো কথা। কিন্তু কোনো ঠগজোচ্চোর যে এক্সপার্ট সেজে এসে তোমার টাকাগুলো হাতিয়ে নিয়ে চম্পট দেবে না, সেটা স্থির করবে কী করে? কে এক্সপার্ট আর কে এক্সপার্ট নয়, সেটা বুঝবে কী করে? এ ব্যাপারে তুমি তো কিছুই জানো না, ধর্মদাসও তথৈবচ। আর, কোনো জানাশুনো বিখ্যাত পণ্ডিতকে কনসালট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ করবে, সে আশারও গুড়ে বালি। এ ব্যাপারে কেউ নাক গলাতে রাজি হবেন না, সে কথা আমি বাজি ফেলে বলতে পারি।’

‘হুঁ, কথাটা তুমি নেহাত মন্দ বলোনি। ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনাটা একদম উড়িয়ে দিতে পারছি না। পাঁচুগোপাল কাঁড়াদাসকে আজ পর্যন্ত কেউ ঠকাতে পারেনি সেটা ঠিকই, কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে, সত্যিই আমি তো এ ব্যাপারে কিছুই জানি না।’

‘শুধু তুমি কেন, আমাদের চেনাশুনোদের মধ্যেও কেউই কিসসু জানে না।’

‘তুমি তবে কী করতে বলো? বিজ্ঞাপনটা দেব না?’— হতাশ, বিমর্ষ মুখে প্রশ্ন করলেন পাঁচুগোপাল।

বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে নৃত্যগোপাল সত্যি কথাটা আর বলে উঠতে পারল না। বলল, ‘না, না, দেবে না কেন? বিজ্ঞাপনটা দিয়েই দাও।’— বলে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, ‘তবে ওটার সঙ্গে আরও কয়েকটা কথা জুড়ে দাও।’

‘কী কথা?

‘এক, যিনি মহাকাশযান বানাবেন, তাঁকে তাঁর ফি ছাড়া অন্যকোনো টাকাপয়সা দেওয়া হবে না। তাঁর যা যা দরকার হবে, তিনি লিস্টি করে দেবেন, আমাদের কোম্পানির পারচেস ডিপার্টমেন্ট থেকে তা খরিদ করে দেওয়া হবে। বিদেশি জিনিসের দরকার হলেও কোনো অসুবিধে নেই। আমাদের এক্সপোর্ট এজেন্টকে দিয়ে আনিয়ে দেওয়া হবে। কারণ এক্সচেঞ্জের বোধ হয় কোনো অসুবিধে হবে না।

দুই, আমাদের বালির দু-নম্বর বাড়িতে থেকে কাজ করতে হবে। পেছনের বড়ো মাঠটায় দরকার হলে শেড তুলে দেওয়া হবে। আমাদের কারখানাটাও ওখান থেকে কাছে। কাজেই, ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রইংয়ের দরকার হলে ওখান থেকেই করানো যাবে। আর শুনেছি, প্লেনই বলো আর রকেটই বলো, যেসব যন্ত্র ওড়ে, তাদের তৈরি করতে অ্যালুমিনিয়াম আর প্লাস্টিকই বেশি দরকার হয়। তাহলে, ড্রইং পেলে সেইমতো মাল তৈরি করবার জন্যে আমাদের কারখানাই যথেষ্ট হবে। বালতি তৈরি করতে পারি, আর রকেট বানাতে পারব না?

তিন, যতদিন কাজ চলবে, ততদিন যিনি তৈরি করবেন আর তাঁর লোকজনের বাড়ির বাইরে যাওয়া চলবে না। যে ফি উনি চাইবেন তার শতকরা দশভাগ অ্যাডভান্স হিসেবে দেওয়া হবে, ষাট ভাগ চারটে ইক্যুয়াল ইনস্টলমেন্টে দেওয়া হবে, পনেরো ভাগ কাজ শেষ হলে আর বাকি পনেরো ভাগ মহাকাশ থেকে ফিরে আসার পর।’

ছেলের কথা শুনে পাঁচুগোপালের বিমর্ষ মুখ আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, ‘বাঃ, বাঃ, এই তো বেশ ভালো হয়েছে! তাহলে কাগজটা তুমি রাখো। তোমার শর্তগুলো জুড়ে দিয়ে বিজ্ঞাপনটা যাতে রোববারেই বেরোয়, সেটা একটু দেখো।’

ধর্মদাস কাটলেট চিবুতে চিবুতে বললেন, ‘কীহে পাঁচু, আর কতদিন অপেক্ষা করে থাকবে? দশ দিনের ওপর তো হয়ে গেল, কেউ এল? না, কোনো চিঠি বা টেলিগ্রাম পেলে? তখনই বলেছিলুম, কিসসু হবে না। নেত্যগোপালের বিজ্ঞাপন তো নয়, যেন আদালতের সমন। ও দেখলে কোনো ভালো লোক এগোতে সাহস পাবে? তোমাকে বলি শোনো, নেত্য ছেলেমানুষ, ও যা বলে বলুক, তুমি আগামী রবিবারে আমাদের বানানো মুসাবিদটা কাগজে পাঠাও। নইলে এমন হাঁ করে বসে থাকাই সার হবে।’

পাঁচুগোপাল মাথা নেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে হে। ভাবছি, আজকের মধ্যে যদি কিছু না-হয়, তাহলে অন্যরকম করেই বিজ্ঞাপনটা দিতে হবে।’

বলতে বলতেই সদর দরজায় কলিংবেল বাজল। আর সঙ্গেসঙ্গে পাঁচুগোপালের সাতটা অ্যালসেশিয়ান কুকুর তারস্বরে চিৎকার করতে শুরু করল।

পাঁচুগোপাল ব্যসসমস্ত হয়ে ডাকলেন, ‘দামোদর, ওরে এই হারামজাদা দামোদর! কুকুরগুলোকে ভালো করে বাঁধ, নইলে কে এসেছে তাকে ছিঁড়ে না-ফ্যালে।’

দরজার পর্দা সরিয়ে দামোদর দন্তবিকাশ করল। বলল, ‘ভয় নেই গো বড়োবাবু। তেনারা সব খাটের নীচে সেঁইধেছেন, আর সেখান থেকেই চিৎকার পাড়তেছেন।’

পাঁচুগোপাল আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘খাটের নীচে সেঁইধেছেন? বলিস কী রে? যাই হোক, ওদের ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দে, আর দ্যাখ কে এল।’

একটু পরেই ঘরে যে ঢুকল, তাকে দেখে পাঁচুগোপাল আর ধর্মদাস দু-জনেই খুব হতাশ হলেন। দু-জনেই আশা করেছিলেন, একজন স্যুট-ট্যুট পরা লোক এসে কড়মড় করে ইংরেজিতে কথা বলবে। নিজেদেরও সেইভাবে প্রস্তুত রেখেছিলেন। তার বদলে এ কে? নেহাত গোবেচারা চেহারার পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি লম্বা একটা লোক, ডিগডিগে শরীরের ওপর একটা মস্তবড়ো মাথা, তাতে আবার শুয়োরের কুচির মতো ছোটো ছোটো চুল, ড্যাবডেবে চোখ, থ্যাবড়া নাক। বয়েস তিরিশ থেকে বত্রিশের ভেতর। পরনে একটা সদ্য কেনা খদ্দরের পাঞ্জাবি আর একটা আধময়লা চুড়িদার পাজামা। বাঙালি না হিন্দুস্থানি বোঝা দায়। দেখলে হাসিও পায়, কান্নাও আসে।

ধর্মদাস কড়া গলায় বললেন, ‘কে হে তুমি? এখানে কী দরকার?’

লোকটা খুব মিহি গলায় বিনীতভাবে বলল, ‘আজ্ঞে, আমি আপনাদের বিজ্ঞাপন দেখে আসছি। আমি চমৎকার মহাকাশযান বানাতে পারি কিনা।’

শুনে প্রথমে ধর্মদাস, তারপর পাঁচুগোপাল খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে শুরু করলেন। ধর্মদাস হাসতে হাসতেই বললেন, ‘তুমি মহাকাযান বানাতে পারো? বলো কী হে? তা, এখানে এলে কী করে? মহাকাশযানে করে নাকি?’

লোকটা বলল, ‘আজ্ঞে না, হেঁটে এসেছি। হাওড়া স্টেশনে আমার ব্যাগ-ট্যাগ সব চুরি হয়ে গেল কিনা। টাকাপয়সা সব তার মধ্যেই ছিল। তাই…’

‘হাওড়া স্টেশনে কেন? রাঁচি থেকে এলে বুঝি?’

‘আজ্ঞে না, বম্বে থেকে। প্রায় সাতদিন আগে রওনা হয়েছিলুম। হিউস্টন থেকে নিউইয়র্ক, সেখানে থেকে লন্ডন, সেখান থেকে বম্বে, তারপর কলকাতা।’

ধর্মদাসের হাসি এবার বন্ধ হল। বললেন, ‘নিউইয়র্ক? তার মানে আমেরিকা? তুমি আমেরিকা থেকে আসছ? তা, আমাদের বিজ্ঞাপনটা তোমার নজরে পড়ল কোথায়? আমেরিকায় না লন্ডনে?’

‘আজ্ঞে, লিলুয়ায়। ওখানে ট্রেনটা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল তো। তখন ট্রেন থেকে নেমে এক ঠোঙা জিলিপি কিনেছিলুম। তখনই তো আমার ব্যাগটা খোয়া গেল! তা, সেই ঠোঙাতেই আপনাদের বিজ্ঞাপনটা নজরে পড়ল।’

‘অ, ঠোঙা! বেশ, এবার বলো তো বাপু, তুমি আমেরিকাতে কী করছিলে?’

‘আজ্ঞে, ওই আমেরিকার টেকসাসে হিউস্টন শহরে নাসা বলে একটা প্রতিষ্ঠান আছে, যার নামের বাংলা করলে দাঁড়ায়— জাতীয় উড্ডয়ন বিজ্ঞান এবং মহাশূন্য পরিচালন সংস্থা। আমি সেই সংস্থার মহাকাশযান সংক্রান্ত গবেষণাগারের মহাকাশযানের গঠনতত্ত্ব বিভাগের প্রধান পরিচালক ছিলুম।’

ইতিমধ্যে কখন যেন পেছনে এসে নৃত্যগোপাল দাঁড়িয়েছে। সে এবার সামনে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘অর্থাৎ আপনি নাসার স্পেস রিসার্চ সেন্টারের একজন ডিরেক্টার ছিলেন?’

লোকটা ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলল, ‘আজ্ঞে, ঠিক ধরেছেন। আমি ওখানে স্পেস ক্রাফটের স্ট্রাকচারাল অ্যানালিসিস করতুম।’

পাঁচুগোপাল এতক্ষণ অবাক হয়ে এই কথোপকথন শুনছিলেন। এখন প্রশ্ন করলেন, ‘একজন বাঙালিকে আমেরিকানরা ডিরেক্টারের চাকরি দিলে?’

লোকটা ফিক করে হেসে বলল, ‘দেবে না কেন? ওরা তো আর বাঙালি কী জাপানি দেখে চাকরি দেয় না। দেয় বিদ্যেবুদ্ধি দেখে। কত বাঙালি ওখানে আমার চেয়েও উঁচু পদে চাকরি করছেন।’

ধর্মদাস বাঁকা হাসি হেসে বললেন, ‘তা, তোমার বিদ্যে কতদূর?’

‘আজ্ঞে, আমি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ স্নাতক। তারপর আমেরিকায় গিয়ে হাতে-কলমে কাজ শিখে খানিকটা ভাগ্য আর বাকিটা পরিশ্রমের জোরে ওপরে উঠি। খুব ভারী ডিগ্রি আমার নেই, ওদেশে তার বড়ো দরকারও হয় না। তবে, পৃথিবীর বড়ো বড়ো সব বিশ্ববিদ্যালয়েই রচনা পাঠ করবার এবং বক্তৃতা দেবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।’

নৃত্যগোপাল বলল, ‘আপনি যা বললেন, তা প্রমাণ করতে পারবেন?’

লোকটা মাথা নাড়ল। বলল, ‘না। পারব না। প্রথমত, আমার কাছে কাগজপত্র যা ছিল, তা সে সবই খোয়া গেছে। আর সেসব থাকলেও বিশেষ কিছু প্রমাণ করা যেত না, কারণ আমি যে পদে চাকরি করতুম, সেটা একটা খুবই গোপনীয় ব্যাপার। সে বিষয়ে আমি কখনো মুখ খুলব না, বা বিশদভাবে কিছু জানাব না, এই প্রতিজ্ঞাপত্রে সই করে তবে ছাড়া পেয়েছি।’

‘ছাড়া পাওয়ার দরকার কী ছিল?’

‘মানে, দেশের জন্যে বড্ড মন কেমন করছিল। বহু বছর দেশ ছাড়া। মনে হল, নম নম নম, সুন্দরী মম…’

ধর্মদাস হাত নেড়ে বললেন, ‘থাক, থাক। আসল কথা হল, তোমার বিদ্যেবুদ্ধির কোনোই প্রমাণ নেই। তা, তোমার নিজের নামটা মনে আছে তো? নাকি সেটা লিলুয়ায় খোয়া গেছে?’

লোকটা আবার ফিক করে হেসে বলল, ‘না, না, কী যে বলেন! আমার নাম পিন।’

‘পিন!’

‘হ্যাঁ, মানে ইয়ে, আমার পুরো নামটা হল, পিন্টুচরণ রায়। আমার বন্ধুরা আমায় আদর করে পিন বলেই ডাকে।’

ধর্মদাস ভয়ানক ভ্রূকুটি করে বললেন, ‘ডাকুক। আমরা তো আর তোমার বন্ধু নই। আমরা তোমাকে পিন্টুচরণ বলেই ডাকব। পিন্টুচরণ! এঁঃ, কী অদ্ভুত নাম!’

নৃত্যগোপাল ধমক দিয়ে বলল, ‘আঃ, আপনি চুপ করুন তো! পিন্টুবাবু, আপনি আমার সঙ্গে আসুন। আমি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।’— বলে লোকটাকে নিয়ে নৃত্যগোপাল তার লাইব্রেরি ঘরে চলে গেল।

নৃত্যগোপাল বলল, ‘লোকটার মাথায় একটু গোলমাল আছে, কিন্তু প্রচণ্ড পণ্ডিত। অবিশ্যি, সব প্রতিভাবান লোকেরাই অল্পবিস্তর ছিটগ্রস্ত হয়।’

ধর্মদাস বললেন, ‘লোকটা পণ্ডিত, তুমি বুঝলে কী করে?’

‘দেখুন, এমএসসি পাশ করেছি, প্লাস্টিক টেকনোলজিতে স্পেশাল ট্রেনিং নিয়েছি— অতএব একজন পণ্ডিত কী পণ্ডিত নয়, সেটুকু বোঝবার মতো ক্ষমতা আমার আছে। আর সেই ক্ষমতার জোরেই বলছি, লোকটা প্রচণ্ড পণ্ডিত। তা ছাড়া অনেকগুলো ইউনিভার্সিটির ফটোগ্রাফ দেখালুম, দেখেই নাম বলে দিল। হাইডেলবার্গ, ইয়েল, লুমুম্বা, জওহরলাল নেহেরু— সব ক-টা। প্ল্যাঙ্ক, ফার্শি, হয়েল, হার্শেল— প্রত্যেকের ছবি দেখে চিনতে পারল। অদ্ভুত!’

‘এতই যদি জ্ঞান তো আমেরিকায় চাকরি ছেড়ে এখানে মরতে ফিরে এল কেন?’

‘বোধ হয় ছিটগ্রস্ত বলেই। আমাকে তো বলল যে বিদেশে আর ভালো লাগছিল না বলেই এদেশে চলে এসেছে। পয়সাকড়ি যা এনেছে, তাতে বাকি জীবনটা নিশ্চিন্তে কাটবে। এখন, আমাদের বিজ্ঞাপনটা নজরে পড়ায় আবার রক্ত চনমন করে উঠেছে। লোকটার নাকি অনেকদিন যাবৎ একটা ছোট্ট মহাকাশযান বানাবার ইচ্ছে, যেটা মোটরগাড়ির মতো চালিয়ে মঙ্গলগ্রহ কী চাঁদে চট করে বেড়িয়ে আসা যাবে। এর একটা ডিজাইনও নাকি ওর আছে। মার্কিন সরকারকে ও এই কাজে ওকে টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করতে অনুরোধ করেছিল, তারা কোনো পাত্তাই দেয়নি। এখন আমরা যদি সাহায্য করি, তাহলে আখেরে আমাদেরও লাভ হয়, লোকটারও থিয়োরি সত্য বলে প্রমাণিত হয়।’

পাঁচুগোপাল বলে উঠলেন, ‘তবে আর দেরি কেন? লোকটাকে কাজ শুরু করতে বলো! পুজোর আগেই যদি শেষ করতে পারে, তাহলে বড়ো ভালোই হয়। পুজোটা মহাশূন্যে কাটিয়ে এলুম, ভাবতেই রোমাঞ্চ হচ্ছে।’

নৃত্যগোপাল মাথা নেড়ে বলল, ‘একটা জায়গায় আটকাচ্ছে।’

‘আটকাচ্ছে? আটকাচ্ছে কেন?’

‘পিন্টুচরণ তার বিমানের সত্ব ছাড়তে রাজি নয়।’

‘তার মানে? বিমানই তৈরি হল না, তার আবার সত্ব কী?’

‘আহা, ধরো যদি সত্যি তৈরি হয়, তখন? তার পেটেন্ট নিতে পারলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়, বুঝতে পারছ? একটা ছোটো মহাকাশযান, বাড়ির ছাদেই হয়তো পার্ক করে রাখা যাবে, যখন খুশি পৃথিবীর বাইরে বেড়িয়ে এলেই হল, তার কী ডিমান্ড হবে ভাবতে পারছ? এখন সেই বিমানের প্রথমটা যদি আমাদের টাকাতেই হয়, তাহলে তার পেটেন্ট নেওয়ার অধিকারও আমাদের।’

‘কেন?’

‘তার কারণ, যদি তৈরি না-হয়, তাহলে আমাদের সমস্ত টাকাটাই তো জলে যাবে। কত বড়ো একটা রিস্ক নিতে যাচ্ছি, অন্ধকারের মধ্যে পা বাড়াচ্ছি, তার যদি কোনো সুফল ফলে সেটা আমরা ভোগ করতে পারব না, এ কখনো হয়?’

‘কিন্তু যে লোকটা মাথা খাটিয়ে জিনিসটা বানাল, সে কিছু পাবে না?’

‘নিশ্চয়ই পাবে! সে মোটা রয়্যালটি পাবে, লভ্যাংশ পেতে পারে, কিন্তু পেটেন্ট রাইট আমাদের থাকতেই হবে।’

ধর্মদাস মুখ বেঁকিয়ে বললেন, ‘গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেল! তুমিও যে এমন ক্ষ্যাপা, তা আগে জানতুম না বাপু। তোমার ওই পিন্টুচরণ বানাবে মিনি মহাকাশযান আর তার থেকে তুমি পয়সা পিটবে— ওই আনন্দেই থাকো।’

পাঁচুগোপাল ধমকে উঠলেন। বললেন, ‘আঃ, ধর্মদাস, থামো তো! তা, তুমি কি লোকটাকে ভাগিয়েই দিলে নাকি?’

নৃত্যগোপাল বলল, ‘না, না, তা কখনো পারি। ওকে আমার গাড়িটা দিয়ে পাঠিয়েছি হোটেল সুভদ্রায়। ড্রাইভারকে বলে দিয়েছি, এক সেট ভালো জামাকাপড় কিনে দিতে আর হোটেলের ম্যানেজারকে বলতে যে সে যেন বিলটা আমার অফিসে পাঠিয়ে দেয়। আর লোকটাকে বলে দিয়েছি, আজ সারা রাত চিন্তা করে কাল সকালে আসতে। ন-টার সময় হোটেলে গাড়ি পাঠাব বলে দিয়েছি।’

‘হোটেলে কেন, লোকটার বাড়িঘর নেই নাকি?’

‘বলল তো আছে, তবে কলকাতায় নয়। বাঁকুড়ায়। অজ পাড়াগাঁয়ে।’

নৃত্যগোপালের কথা শুনে ধর্মদাস আবার মুখ বাঁকালেন। বললেন, ‘বাঃ, চমৎকার! আমেরিকানরা যাকে পাত্তা দিল না, সেই আধপাগলা পাড়াগেঁয়েটার পেছনে পয়সা ঢালবে তুমি!’

নৃত্যগোপাল সহাস্যে বলল, ‘ব্যাপারটা আপনাদের কাছে যতটা অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে, আসলে তা অতটা একেবারেই নয়। আমেরিকান গভর্নমেন্টের কাছে দিনে গড়ে হয়তো কয়েক লক্ষ উদ্ভট প্রস্তাব আসে। তাদের মধ্যে ক-টা পাগলে পাঠায়, আর ক-টা সত্যিকারের প্রতিভাশালী লোক পাঠায়, তার বিচার করবার সময় কোথায় তাদের? কাজেই সব ক-টাই নাকচ হয়ে যায়। আমাদের তো তা নয়। আমরা দেখেশুনে বিচার করে তারপর কাজে হাত দেব। অর্ধেক কাজ করার পর যদি দেখি পিন্টুচরণ আসলে পাগলই, তাহলে তাকে তৎক্ষণাৎ ভাগিয়ে দিলেই হবে। ইতিমধ্যে আপনি যদি পারেন তো না-হয় একজন আসল ভালো লোক জোগাড় করে আনবেন!’

পরদিন সকালে পিন্টুচরণের নতুন পোশাক দেখে ধর্মদাস আর পাঁচুগোপাল নৃত্যগোপালের ভ্রূকুটি উপেক্ষা করেই আবার খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে শুরু করলেন। গাঢ় নীল রঙের জামা তার ওপর সোনালি রঙের বড়ো বড়ো বুটি আর কালো ডোরাকাটা ক্যাটকেটে কমলা রঙের ট্রাউজার্স।’

ধর্মদাস হাসতে হাসতে বললেন, ‘এঁঃ, এমন জামাকাপড় কে কিনে দিলে হে তোমায়? গুণনিধি বুঝি? ব্যাটার গুণের ঘাট নেই দেখছি!’

পিন্টুচরণ লাজুক হেসে বলল, ‘না, আপনাদের ড্রাইভার নয়, আমি নিজেই কিনেছি। কেন, বেশ ভালো হয়েছে, না?’

নৃত্যগোপাল হাত নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব ভালো হয়েছে। এবার কাজের কথায় আসা যাক। কী স্থির করলেন?’

পিন্টুচরণ মাথা চুলকে বলল, ‘দেখুন, আমার আবিষ্কারের সত্ব আমি ছাড়তে পারব না। তবে তা দিয়ে টাকা বানানোর ইচ্ছেও আমার নেই, কারণ টাকার কোনো প্রয়োজন আমার নেই। আমার উদ্দেশ্য, যন্ত্রটা বানানো এবং প্রমাণ করা যে আমার থিয়োরি সঠিক। এখন আপনারা টাকা দিচ্ছেন এবং তার থেকে স্বভাবতই আপনারা একটা রিটার্ন আশা করবেন। এ ব্যাপারে আমার প্রস্তাব হচ্ছে যে আপনাদের সঙ্গে আমার একটা চুক্তি হবে যার দ্বারা, যদিও আমিই পেটেন্ট নেব, আমার যন্ত্রের উৎপাদন এবং বিক্রির সমস্ত অধিকার থাকবে আপনাদের। আমি লভ্যাংশের শতকরা চল্লিশ ভাগ নেব এবং এই চুক্তি প্রতি তিন বছর অন্তর রিনিউ করতে হবে।’

নৃত্যগোপাল মাথা নেড়ে বলল, ‘শতকরা চল্লিশ ভাগ অত্যন্ত বেশি। আজকালকার বাজারে যাই আপনি তৈরি করুন না-কেন, তাতে কখনো বেশি লাভ রাখা সম্ভব নয়। আর সেই লাভের চল্লিশ ভাগই যদি আমাদের ছেড়ে দিতে হয়, তাহলে ব্যাবসা চলে কী করে?’

‘বেশ, আপনারা কত দিতে প্রস্তুত?’

‘দশ।’

‘দশ? বড্ড কম হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা বেশ, আপনার কথাও থাক, আমার কথাও থাক। শতকরা পঁচিশ। রাজি?’

নৃত্যগোপাল একটু ভেবে বলল, ‘রাজি। আসুন, হাত মেলান।’

হাত-টাত মেলানো হয়ে গেলে পর পাঁচুগোপাল লজ্জা লজ্জা মুখ করে বললেন, ‘ইয়ে হয়েছে যে রকেটটা তৈরি হবে, তার নাম কিছু ঠিক করেছ নাকি?’

নৃত্যগোপাল বলল, ‘হ্যাঁ, করেছি। বিমান তো, তাই তার নাম দেব রাজহংসী।’

পাঁচুগোপাল ব্যাজার মুখ করে বললেন, ‘দূর, দূর, এটা একটা নাম হল! আমি বলি, নাম দাও নগেন্দ্রবালা— তোমার মায়ের ওই নাম ছিল কিনা।’

মাস দুয়েক পরের কথা।

ধর্মদাস মুখ বেঁকিয়ে বললেন, ‘একটা আধপাগলা গেঁইয়া যে তোমাদের এরকম বুদ্ধু বানাবে, আমি একদম আশা করতে পারিনি। এক লাখ টাকা ফি চাইল, তাইতেই তোমরা রাজি হলে। এককথায় তার টেন পার্সেন্ট দশ হাজার টাকা দিয়ে দিলে! এখন দ্যাখো, কোথাকার জল কোথায় গড়ায়।’

নৃত্যগোপাল চিন্তিত মুখে চা খাচ্ছিল। বলল, ‘লোকটাকে রকেট বানাতে দিয়ে বুদ্ধু বনেছি, এটা আমি স্বীকার করতে রাজি নই। তবে লোকটাকে যতটা বোকাসোকা ভেবেছিলুম, ততটা সে মোটেই নয়। বরং অত্যন্ত ধড়িবাজ।’

পাঁচুগোপাল জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী করে বুঝলে? টাকা নিয়ে কেটে পড়ার ধান্দা করছে নাকি?’

‘না, তা নয়। কাজ শুরু করে দিয়েছে। তবে যে সব ড্রইং বানাচ্ছে, সেগুলো এমন একটা মোটা তেলতেলে কাগজে করছে যে, তার থেকে না-উঠছে কোনো প্রিন্ট, না-করা যাচ্ছে সেগুলো ট্রেস। অথচ ওয়ার্কিং ড্রইং হিসেবে ব্যবহার করতে কোনো অসুবিধে নেই।’

‘তাতে তোমার আপত্তি কোথায়?’

‘আপত্তি ঠিক নেই। মানে, ভেবেছিলুম ড্রইংগুলো কপি করে একটা সেট নিজেদের কাছে রেখে দেব, যাতে পরে যদি ব্যাটা কখনো চুক্তিভঙ্গ করে তাহলে নিজেরাই বিমানটা যেন তৈরি করে নিতে পারি। এই আর কী!’

‘হুঁ! সেটা যখন সম্ভব হল না, তখন আর ভেবে লাভ কী? তা, কাজ কদ্দূর এগোল?’

‘এগিয়েছে কিছুটা। বেশ কিছু কম্পোনেন্টের কাস্টিং হচ্ছে, অনেকগুলো মালেরও অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে। তবে যা বুঝতে পারছি, বিদেশি কোনো মালের দরকার হবে না আর যে যন্ত্রটা তৈরি হতে যাচ্ছে সেটার চেহারাটা রকেটের মতো হবে না, হবে পিরিচের মতো। মানে, যাকে বলে ফ্লাইং সসার।’

শুনে ধর্মদাস খ্যা খ্যা খ্যা খ্যা করে হেসে, বিষম খেয়ে, কেশে একাকার।

আরও প্রায় চারমাস বাদে।

ধর্মদাস বললেন, ‘কীহে পাঁচু, এই সাতসকালে সিল্কের পাঞ্জাবি পরে চললে কোথায়? ছেলের বউ দেখতে নাকি?’

পাঁচুগোপাল রুমালে মুখ মুছে বললেন, ‘আরে, না, না। যাচ্ছি অন্য একটা জায়গায়। তুমিও যাচ্ছ আমাদের সঙ্গে। এতক্ষণ তোমার অপেক্ষাতেই ছিলুম।’

‘বেশ, তা না-হয় যাওয়া হবে। কিন্তু কোথায় যাচ্ছ, জানাতে আপত্তি আছে কি?’

‘না, না, আপত্তি কীসের? যাচ্ছি বালি। নগেন্দ্রবালাকে দেখতে।’

‘নগেন্দ্রবালা? ওহো, তোমার সেই মহাকাশযান! তার কদ্দূর হল? রেডি?’

‘হ্যাঁ, রেডি।’

‘অ্যাঁ, বলো কী হে! ছ-মাসের মধ্যে একটা মহাকাশযান রেডি? তোমার ওই পিন্টুচরণ না কী যেন নাম, তার কি আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ-টদীপ আছে নাকি? আমেরিকা, রাশিয়ার মতো দেশে এক-একটা রকেট বানাতে বছরের পর বছর লেগে যায়, আর বলা নেই কওয়া নেই, ছ-মাসের মধ্যে তোমার মহাকাশযান রেডি! তাও বালির মতো জায়গায়!’

‘দ্যাখো, ব্যাপারটা আমারও একটু কেমন কেমন লাগছে। চলো, গিয়ে দেখেই আসি। পিন্টুচরণ ছোকরা খেটেছে খুব, নেত্যও লেগেছিল পেছনে, কাজেই মনে হয় কিছু একটা হয়েছে।’

‘ছাই হয়েছে! যত তাড়াতাড়ি কিছু একটা খাড়া করতে পারবে, তত তাড়াতাড়ি ইনস্টলমেন্টের পয়সা হাতাতে পারবে তো। শেষটা টুক করে কেটে পড়বে। তখন তুমি আর তোমার ছেলে ওই ফ্লাইং সসারে ঢেলে ঢেলে চা খাবে। এই আমি বলে দিলুম।’

ধর্মদাসের কথার মধ্যে নৃত্যগোপাল ঘরে ঢুকেছিল, কিন্তু তার কথা শুনেও চটে উঠল না। নার্ভাস, কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘আপনার কথা সত্যি হলেও আজ অখুশি হব না, কাকাবাবু। আজ মনে হচ্ছে, এর মধ্যে না-গেলেও হত।’

পাঁচুগোপাল চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘তার মানে?’

‘মানে, কাজটায় যখন হাত দিয়েছিলুম, তখন কখনো অন্তর থেকে বিশ্বাস করিনি যে পিন্টুচরণ সত্যি সত্যি কিছু একটা বানাতে পারে। ভেবেছিলুম, এটা একটা খেলা। কিছুটা টাকার শ্রাদ্ধ হবে বটে, কিন্তু বাবার ছেলেমানুষি…’

পাঁচুগোপাল তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন, ‘ছেলেমানুষি! কী বলতে চাও তুমি? আমি মহাশূন্যে বেড়াতে যাব, সেটা ছেলেমানুষি? জানো, এটা আমার একটা প্রেস্টিজের ব্যাপার? আর আমার প্রেস্টিজ হল সবার ওপরে। সম্মান খোয়াতে রাজি নই কিছুতেই।’

‘আহা, তুমি বুঝতে পারছ না। পিন্টুচরণ যেটা বানিয়েছে সেটা প্রথম বার যদি ঠিকমতো ওড়েও, দ্বিতীয় বার বিগড়োতে পারে। তখন কী হবে?’

‘কী আবার হবে? আটাশ বছর বয়সে পিতৃহীন হবে। তাতে ভারি বয়েই গেল। একটু ভালো করে শ্রাদ্ধ করলেই সব গোল চুকে যায়। দ্যাখো বাপু, জীবনের পরোয়া আমি করি না। বললুম তো, আমার কাছে প্রেস্টিজ হল গে সবার ওপরে।’

ধর্মদাস সহাস্যে বললেন, ‘আঃ, ঘাবড়াও কেন, ধুতিমান? আমি লিখে দিতে পারি, তোমার মহাকাশযানও উঠবে না, তোমার বাবারও বিপদ-আপদ কিছু হবে না।’

নৃত্যগোপাল বলল, ‘আপনার কথাই যেন সত্যি হয়।’

পাঁচুগোপাল আবার গর্জন করলেন, ‘চোপ! কক্ষনো সত্যি হবে না। ওই পিন্টুচরণের মহাকাশযান উড়বে আর আমিও বেড়িয়ে আসব। দেখি, তোমরা আমাকে ঠেকাতে পারো কি না। আর হ্যাঁ, পিন্টুচরণের যন্ত্র যদি তৈরি হয়ে গিয়েই থাকে তো সেটা ওড়েনি কেনো এখনও?’

‘তার কারণ তিন-শো কুইন্টাল পারা এখনও এসে পৌঁছয়নি। ওই যন্ত্রের ফুয়েল নাকি পারা!’

শুনে ধর্মদাস আবার হাসতে শুরু করলেন। বললেন, ‘পারা? পারা দিয়ে প্লেন চলবে? পেট্রোল নয়, ডিজেল নয়, নিদেন কেরোসিনও নয়— পারা? এমন অদ্ভুত কথা জীবনে শুনিনি কখনো। তোমার ওই পিন্টুচরণের হাবভাব আমার কিন্তু ভালো লাগছে না বাপু। লোকটার উদ্দেশ্য কী?’

পাঁচুগোপাল দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, ‘উদ্দেশ্য যদি আজও না বুঝতে পেরে থাকো ধর্মদাস, তবে আর কোনোদিনও বুঝতে পারবে না। এখন চলো তো, নগেন্দ্রবালাকে দেখে আসি।’

‘তা তোমার পেয়ারের কুকুরগুলোকে নিয়ে যাবে না?’

‘নাঃ, কী যেন হয়েছে বাটাচ্ছেলেদের। কেমন যেন ম্যাদামারা হয়ে গেছে ইদানীং। বেড়ালের মতো ম্যাও ম্যাও করছে আর কাক দেখলে পর্যন্ত চমকে উঠে দৌড়ে ঘরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। ভাবছি, কালই ওদের ডাক্তার দেখাব। নেত্য, তুমি কালই ডাক্তারকে ফোন করবে তো। ও, ভালো কথা মনে পড়ল। তোমার কংসকাকুকেও ফোন করে সে হতভাগাকে বালিতে আসতে বলো এখন। ব্যাটা দেখুক আমার মহাকাশযান। আর যেদিন উড়ব, সেদিনও আসতে বলবে। সে সময় আমি ওর মুখটা দেখতে চাই। হিংসেয় আবার হার্টফেল না-করে।’

নৃত্যগোপাল বিড়বিড় করে বলল, ‘সে তুমি বলার আগেই ফোন করে দিয়েছি।’— ভাগ্যিস কথাগুলো পাঁচুগোপালের কানে যায়নি।

বালির বাড়িটা বাইরে থেকে দেখলে, নেহাতই একটা সাদামাটা দোতলা বাড়ি বলে মনে হয়। তার পেছনে যে প্রকাণ্ড মাঠ, আমবাগান, কলাবাগান ইত্যাদি রয়েছে বোঝাই যায় না। দশ ফুট উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা এই বাড়িটার একমাত্র বাসিন্দা রামঅবতার সিং আর তার গিন্নি লছমি। তারাই বাগানটার দেখাশুনো করে আর বাবুর বাড়ি ভেট পাঠায়। এখন অবশ্য একজন অতিথি আছে, তর নাম পিন্টুচরণ রায়।

নৃত্যগোপালের গাড়ির হর্ন শুনে গেট খুলে দিল রামঅবতার। তারপর গাড়ি থেকে বড়োবাবুকে নামতে দেখে বিশাল শরীরটা বিনয়ে বেঁকিয়ে সভক্তি নমস্কার করল। খুব কষ্ট হল, সন্দেহ নেই।

প্রাথমিক কুশল প্রশ্নাদির পর পাঁচুগোপাল সদলবলে পেছনের মাঠের দিকে রওনা হলেন। সামনের বড়ো ঘরটা পেরিয়ে উঠোনে পা দিয়ে সামনে তাকিয়েই বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। ধর্মদাসও হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।

মাঠের ঠিক মাঝখানে একটা বিচিত্রদর্শন যন্ত্র রাখা আছে। যন্ত্রটা অনেকটা একটা আঠেরো থেকে বিশ ফুট ব্যাসের অ্যালুমিনিয়ামের ডিসের ওপর আর একটা ওই মাপের ডিস চাপা দিলে যেমন দেখতে হয়, তেমনই দেখতে। তিনটে সরু লম্বা পায়ার ওপর এই ডিসজোড়া রাখা, মাটি থেকে প্রায় ফুট দুয়েক ওপরে। ডিসদুটো যেখানে জোড়া লেগেছে, সেখানে কতগুলো গোল গোল জানলা, আর ওপরের উপুড় করা ডিসের ওপর একটা স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ডোম। সেটাই যন্ত্রটার ভেতরে ঢোকার রাস্তা, কারণ সেখান থেকে একটা অ্যালুমিনিয়ামের মই মাটি পর্যন্ত নামানো আছে। ডোমটা ফুট চারেক উঁচু আর মাটি থেকে ডোমের শীর্ষ আবার উনিশ ফুট হবে।

প্রথম কথা বললেন ধর্মদাস। বললেন, ‘পিন্টুচরণ, পিন্টুচরণ কোথায়?’

সরু মিনমিনে গলায় পেছন থেকে উত্তর এল, ‘আজ্ঞে, এই যে আমি।’

সবাই পেছন ফিরে দেখলেন, কখন যেন পিন্টুচরণ তাঁদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার মুখে একটা বিনয়, গর্ব আর অহংকার মিশ্রিত হাসি। বলল, ‘এই আপনাদের নগেন্দ্রবালা। কেমন দেখছেন, স্যার?’

পাঁচুগোপাল বললেন, ‘অপূর্ব! এই যন্ত্রটা তুমি একা হাতে বানিয়েছ? কী করে পারলে?’

পিন্টুচরণ দু-হাত ঘষতে ঘষতে বলল, ‘না, না, আমি একা হাতে করব কেন? তা কি কখনো সম্ভব? আমি ড্রইং করে দিয়েছি, দ্যুতিমানবাবু তাই দেখে মাল তৈরি করিয়ে দিয়েছেন, তাঁর কারখানার লোকজন দিয়ে সব ফিট করিয়ে দিয়েছেন। এমনকী ইলেকট্রিক ওয়্যারিংয়ের কাজও আমাকে পুরোটা করতে হয়নি, ওঁর ইলেকট্রিশিয়ান অনেকটাই করে দিয়েছেন। মানে, কৃতিত্ব যদি কিছু থাকে, তবে দ্যুতিমানবাবু তার সমান অংশীদার।’

পাঁচুগোপাল ঘন ঘন মাথা নেড়ে বললেন, ‘না, না, সব কৃতিত্ব তোমার। তোমার মাথা থেকেই তো সব বেরিয়েছে। আর আমরা ভেবেছিলুম কিনা যে তুমি একটা…’

পাঁচুগোপাল কথাটা শেষ না-করেই কটমট করে ধর্মদাসের দিকে তাকালেন।

ধর্মদাস বিশেষ ঘাবড়ালেন বলে মনে হল না। বললেন, ‘সব প্রশংসাটা এখনই খরচ করে ফেলো না হে পাঁচু। যন্ত্রটা আগে উড়ুক, তার পরে না-হয় বাকিটা খরচা কোরো।’

এমন সময় গেটের কাছে গাড়ির হর্ন বাজল। একটু বাদেই উঠোনে এসে উপস্থিত হলেন কংসনাশন চৌধুরি। তাঁর পেছনে তাঁর মেয়ে রাজহংসী। কংসনাশন চেহারায়, চালচলনে একেবারে পাঁচুগোপালের বিপরীত। ইনি রোগা, লম্বা, বুশশার্ট আর ট্রাউজার্স পরা, চঞ্চল চলাফেরা, মৃদুভাষী, কেবল মাথার চুলগুলো তাঁর বন্ধুর মতোই সব পেকে গেছে। আর রাজংসী তার বাবার মতোই রোগাটে লম্বা গড়নের, চোখে স্টিল ফ্রেমের চৌকো চশমা তাঁর তরুণ সুকৌমার্যকে চাপা দিয়ে রাখতে পারেনি।

কংসনাশন এসেই কোনো দিকে দৃকপাত না-করে নীচু গলায় বললেন, ‘এই যে পাঁচু! এ সব কী আরম্ভ করেছিস, শুনি? মহাশূন্যে বেড়াতে যাবি নাকি? তার জন্যে যন্তরপাতির দরকার কী? গলায় দড়ি দিলেই তো পারিস। সস্তায় তাড়াতাড়ি হবে।’

পাঁচুগোপাল তাঁর স্বভাবসিদ্ধ গলায় চিৎকার করে বললেন, ‘তা আর বলবি না? বাঁশের কারবার করলে এমনই হয়। যন্তরটা আগে দ্যাখ, তার পরে কথা বলিস।’

কংসনাশন কিছু বলার আগেই রাজহংসীর বিস্মিত কণ্ঠ শোনা গেল, ‘ওমা! এই তোমার মিনি স্পেস শিপ! দ্যুতি, ইটস ফ্যান্টাস্টিক! ইটস মার্ভেলাস!’

পাঁচুগোপাল এতক্ষণে রাজহংসীকে দেখতে পেলেন। বললেন, ‘আরে, নেংটি তুইও এসেছিস। বেশ করেছিস। কেমন দেখছিস এটা?’

রাজহংসী লাজুক হেসে বলল, ‘দুর্দান্ত, মেসোমশাই। কিন্তু আপনি আমাকে এখনও নেংটি বলে ডাকবেন?’

‘তো কী বলতে হবে? কুইন ভিক্টোরিয়া? বলি, কোন ক্লাস হল?’

‘ক্লাস কী মেসোমশাই, আমি এখন এমএ পড়ি।’

পাঁচুগোপাল কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই আবার গেটের কাছে হর্ন বাজল। ট্রাকের হর্ন। সেই আওয়াজ শুনেই পিন্টুচরণ হন্তদন্ত করে বেরিয়ে গেল।

পাঁচুগোপাল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকালেন। নৃত্যগোপাল কম্পিত কণ্ঠে বললেন, ‘পারা এল বোধ হয়।’ তার মুখ ছাইয়ের মতো সাদা।

ধর্মদাস বললেন, ‘ঘাবড়াও কেন? পারা দিয়ে কোনো কিছু চলে, শুনেছ কখনো?’

এইসব কথার মধ্যেই, একটা ছোটো ঠ্যালাগাড়িতে একটা মাঝারি সাইজের ড্রাম ঠেলতে ঠেলতে এল পিন্টুচরণ। একগাল হেসে নৃত্যগোপালকে বলল, ‘ব্যাস, লাস্ট আইটেমও এসে গেল।’— বলে ঠ্যালাগাড়িটা মাঠের ওপর দিয়ে তার যন্ত্রটার দিকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যেতে যেতে সবাইকে ডেকে বলল, ‘আসুন আপনারা। নগেন্দ্রবালাকে দেখে যান।’

রাজহংসী আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘নগেন্দ্রবালা?’— পরমুহূর্তেই সামলে নিয়ে বলল, ‘ওঃ মাসিমা।’— বলেই সকলের আগে দৌড়ে বেরিয়ে গেল।

পিন্টুচরণ ততক্ষণে নগেন্দ্রবালার কাছে পৌঁছে গেছে। রাজহংসী তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আমরা ভেতরে যেতে পারি?’

পিন্টুচরণ বলল, ‘নিশ্চয়ই।’

আর বলতে না-বলতেই রাজহংসী তরতর করে মই বেয়ে ওপরে উঠে প্লাস্টিকের ঢাকাটা সরিয়ে ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল।

সেই দৃশ্য দেখে কংসনাশন কিছু বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন বটে, কিন্তু একটু বাদেই ওলটানো ডিসের ওপর দিয়ে রাজহংসীর মুণ্ডুটা দেখা গেল। উত্তেজনায় প্রায় লাফাচ্ছিল রাজহংসী। চেঁচিয়ে বলল, ‘বাবা, শিগগির উঠে এসো! ইটস ফ্যাবিউলাস ইন হিয়ার। য়ু’ভ নেভার সিন এনিথিং লাইক দিস বিফোর।’

ভেতরটা সত্যিই দেখবার মতো। আসলে সমস্তটাই একটা গোল ঘর, মাঝখানে খানিকটা ফুট সাতেক উঁচু, তারপর চারিদিক থেকে ঢালু হয়ে নেমে এসেছে জানালাগুলো পর্যন্ত। ঘরের মাঝখানে একটা প্ল্যাটফর্ম মতো, তার ওপর দুটো দারুণ আরামপ্রদ নরম গদিমোড়া চেয়ার। বোঝা যায়, সেটা হল অবজার্ভেশন প্ল্যাটফর্ম, কারণ সেখানে বসলে স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ভেতর দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখা যায়। যন্ত্রটাকে চালাবার আসল জায়গা কিন্তু তার নীচে। জানলাগুলোর ওপরে ঘরটায় চারিদিকের দেওয়ালে অসংখ্য যন্ত্রপাতি আর তারের জাল আটকানো। আর জানলাগুলোর নীচে সারা ঘরটার চারিদিকে গোল করে লাগানো সানমাইকা বসানো টেবিল। সেই টেবিলের ওপরেও আছে নানা রকমের যন্ত্রপাতি। আর ঘরের মেঝেয়, প্ল্যাটফর্মের দু-পাশে দুটো খাট।

কংসনাশন একটা খাটের ওপর বসে বললেন, ‘পাঁচু, তোর এই পিন্টুচরণ লোকটার দেখছি সব দিকে নজর। মহাশূন্যে বেড়াতে গেলে যদি ওভার নাইট জার্নি করতে হয়, তার জন্যেও ব্যবস্থা রেখেছে। আর কী আরামের খাট। এমন খাট কোত্থেকে পেলে হে, নেত্য?’

নৃত্যগোপাল করুণ চোখে তাকিয়ে বলল, ‘কাকাবাবু!’

কংসনাশন চমকে উঠলেন। বললেন, ‘ওঃ হো! ভুলেই গিয়েছিলুম। অ্যাই পাঁচু, তোর পাগলামি আর গেল না। এসব বন্ধ কর তো।’

পাঁচুগোপাল তেড়েফুঁড়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই ভেতরে নেমে এল পিন্টুচরণ। লাজুক হেসে নৃত্যগোপালকে বললে, ‘ফুয়েল ভরে নিয়েছি। এবার আপনারা বাইরে যান, আমি টেস্ট ফ্লাইটের ব্যবস্থা করি!’

পাঁচুগোপাল হাত নেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোমরা সব বাইরে যাও তো।’

নৃত্যগোপাল বলল, ‘আর তুমি?’

পাঁচুগোপাল মাথা নেড়ে বললেন, ‘আমি যাচ্ছি না।’

‘সে কী! এখন তো টেস্ট ফ্লাইট হবে। তোমার তো এতে যাবার কথা নয়।’

পাঁচুগোপাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছেলেকে বললেন, ‘এদিকে এসো তো একবার। তোমাকে দুটো কথা বলি’— বলে তাকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘তোমার ব্যাবসা-বুদ্ধি হবে কবে? লোকটা যদি এখন নগেন্দ্রবালাকে নিয়ে কেটে পড়ে? তখন? তোমার সঙ্গে তো মোটে তিন বছরের চুক্তি। এই তিন বছর কোথাও গা ঢাকা দিয়ে থেকে তারপর যদি বেরিয়ে আসে, তখন তোমার চুক্তির কোনো মূল্য থাকবে? তোমার টাকাকে টাকা তো যাবেই, ঘরে যা তুলবে ভাবছিলে, তার এক কানাকড়িও পাবে না। কিন্তু আমি যদি সঙ্গে থাকি তো, সে তো আর সম্ভব হবে না।’

নৃত্যগোপাল কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, ‘তোমার কথা ঠিক। কিন্তু লোকটা তো তোমাকেও গুম করে দিতে পারে।’

পাঁচুগোপাল দুঃখের হাসি হাসলেন। বললেন, নিজের বাপকে এখনও চিনতে পারলে না, নেত্য! তাকে গুম করতে পারে, এমন মানুষ এখনও পৃথিবীতে জন্মায়নি।’

নৃত্যগোপাল মাথা নেড়ে বলল, ‘তা না-হয় হল। কিন্তু উড়তে গিয়ে যদি যন্ত্রটা ভেঙে পড়ে, যদি কোনো অ্যাক্সিডেন্ট হয়?’— বলতে বলতে গলা ধরে এল।

‘হলে হবে। এমনিতে অ্যাক্সিডেন্ট হচ্ছে না? যারা গাড়িতে চড়ে, তারা অ্যাক্সিডেন্টে মরে না? প্লেন, ট্রেন বাসের কথা না-হয় বাদই দিলুম। আর তা ছাড়া আমার তো বাপু পিন্টুচরণের যন্ত্রটা দেখে বেশ শক্তপোক্তই বলে মনে আছে। আমার মন বলছে, কিচ্ছু হবে না। তোমরা যাও, নিশ্চিন্ত মনে যাও।’

নৃত্যগোপাল চোখ মুছে বলল, ‘ঠিক আছে, তোমার কথা কোনোদিন অমান্য করিনি, আজও করব না। চলুন, কাকাবাবু আমরা নীচে যাই। বাবা এখানেই থাকবেন।’

কংসনাশন গভীর ভর্ৎসনাপূর্ণ দৃষ্টিতে পাঁচুগোপালের দিকে তাকিয়ে রওনা হলেন। তাঁর মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোচ্ছিল না। এমন সময় পাঁচুগোপাল পেছন থেকে তাঁর জামার হাতা ধরে টানলেন। বললেন, ‘দ্যাখ কংস, যদি সত্যি সত্যি আমার কিছু হয়, তুই নেত্যকে দেখিস। আমি জানি, তুই একটা বুদ্ধু, তাও বলছি…’

কথাটা পিন্টুচরণের কানে গেল। একগাল হেসে বলল, ‘আপনার কিচ্ছু হবে না পাঁচুগোপালবাবু। আমি বলছি, আপনি এঁদের সকলের চেয়ে বেশি দিন বাঁচবেন, অনেক বেশি দিন বাঁচবেন।’

পাঁচুগোপাল সহাস্যে বললেন, ‘তুমি থামো তো, ডেঁপো ছোকরা।’

সবাই নেমে এসে কিছু দূরে একসঙ্গে দাঁড়ালেন। ধর্মদাসের মুখে বিদ্রূপের হাসি, নৃত্যগোপালের চোখে জল। অ্যালুমিনিয়ামের ঝোলানো সিঁড়িটা আস্তে আস্তে ওপরে উঠে গেল। প্লাস্টিকের ডোমটা একটা পাক খেয়ে বন্ধ হয়ে গেল। জানলাগুলোর মধ্যে দিয়ে দেখা গেল, পিন্টুচরণ শান্ত অবিচলিতভাবে এদিক-ওদিক ঘুরে কলকব্জা নাড়াচাড়া করছে। একটু পরে সে ভেতরে চলে গেল। আর তাকে দেখা গেল না। তারপর নগেন্দ্রবালার ভেতর থেকে একটা ক্ষীণ মৌমাছির গুঞ্জনের মতো শব্দ শোনা গেল। আর প্রায় সঙ্গেসঙ্গে তার শরীরটা কাঁপতে শুরু করল। কাঁপুনিটা অবশ্য চোখে দেখা গেল না, কিন্তু পায়ের নীচে মাটির স্পন্দনে টের পাওয়া গেল।

হঠাৎ স্পন্দনটা বন্ধ হয়ে গেল। উপস্থিত দর্শকরা বিস্ফারিত চোখে দেখলেন, নগেন্দ্রবালার পায়া তিনটে আস্তে আস্তে গুটিয়ে তার পেটের মধ্যে ঢুকে গেল, অথচ তার শরীরটা যেখানে ছিল সেখানেই নিরলম্ব অবস্থায় রয়ে গেল। বোধ হয় কয়েক মুহূর্ত। তারপরেই হঠাৎ সেই আঠেরো ফুট ব্যাসের ঝকঝকে গোলাকার বস্তুটি চক্ষের নিমেষে উল্কার মতো ওপরে উঠে গেল, আর দেখতে না-দেখতে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে হতে একটা বিন্দুর মতো হয়ে আকাশে মিলিয়ে গেল।

পাঁচুগোপালবাবুর ঘোর কাটতে পাঁচ মিনিটটাক সময় লাগল। যখন পুরো সম্বিত ফিরে পেলেন, দেখলেন উনি অবজার্ভেশন প্ল্যাটফর্মের ওপর চেয়ারে সেফটি ব্লেট বাঁধা অবস্থাতেই বসে আছেন, মানে যে অবস্থায় উনি রওনা হয়েছিলেন আর কী। বাইরে তাকিয়ে দেখলেন, আকাশটা আর নীল নেই, ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ। সেই আকাশের একদিকে একটা নীলাভ সবুজ রঙের গোলাকার জিনিস ঘুরতে ঘুরতে দূরে সরে যাচ্ছে। উনি বিস্মিত হয়ে জিনিসটা দেখছিলেন, এমন সময় পিন্টুচরণের গলা শুনতে পেলেন।

পিন্টুচরণ বলছিল, ‘পাঁচুগোপালবাবু, বলুন তো ওটা কী?’

পাঁচুগোপাল মাথা নেড়ে বললেন, ‘বুঝতে পারছি না তো, ওটা কী!’

‘ওই হল পৃথিবী। ওই দেখুন ভারতমহাসাগর আর ভারতবর্ষের উপকূল। চিনতে পারছেন? দেখুন, দেখুন কেমন সাদা সাদা মেঘ ভেসে যাচ্ছে।’

পাঁচুগোপালবাবু ভালো করে দেখে বললেন, ‘আরে, তাই তো! ভূগোলের ম্যাপে অমনই দেখায় বটে। ও পিন্টুচরণ, আমি স্বপ্ন দেখছি না তো? আমরা সত্যি সত্যি মহাশূন্যে এসে গেছি?’

পিন্টুচরণ হাসল। বলল, ‘মহাশূন্য আপনি কাকে বলেন, জানি না। তবে, পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে চলে এসেছি বটে। ওই দেখুন, চাঁদ। কেমন রুক্ষ্ম, এবড়োখেবড়ো।’

‘সত্যি তো। আমরা তাহলে সুন্দর মুখকে চাঁদপানা বলি কেন?’— বলে পাঁচুগোপাল মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন।

আরও প্রায় দশ মিনিট বাদে পাঁচুগোপাল চেঁচিয়ে বললেন, ‘দ্যাখো, দ্যাখো পিন্টুচরণ, একটা লাল মতন গ্রহ আসছে। ওটা কী?’

পিন্টুচরণ বলল, ‘ওটা মঙ্গলগ্রহ। ওটাতেও জনপ্রাণী নেই। রুক্ষ মরুভূমি। তবে ওটার বাতাসে সামান্য জল আছে। হয়তো শ্যাওলা জাতীয় কোনো কিছু থাকলেও থাকতে পারে। এবার ওই দূরের গ্রহটাকে দেখুন। কি বিশাল দেখেছেন? এর ব্যাস আপনার পৃথিবীর ব্যাসের দশ গুণের চেয়েও বেশি। ইনিই বৃহস্পতি। আর মিনিট পনেরোর মধ্যে আমরা ওঁর কাছে পৌঁছে যাব। তবে বেশি কাছে যাব না অবশ্য, গেলে উনি আবার আমাদের আদর করে টেনে নিতে পারেন। তাহলে কিন্তু বিপদ।’

পাঁচুগোপাল ছেলেমানুষের মতো বিস্ময়ে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে ছিলেন, পিন্টুচরণের সব কথা তাঁর কানে ঢুকল কি না সন্দেহ। বললেন, ‘কী অদ্ভুত রং বৃহস্পতির। আর ওটা কী? ওই যে লাল রঙের একটা মস্ত বড়ো কী এদিক থেকে ওদিকে যাচ্ছে?’

ওটা বৃহস্পতির গ্যাসের আবরণের ওপর ভাসমান কঠিন পদার্থের একটা জমাট স্তর। ওটা পৃথিবী থেকেও দূরবিন দিয়ে দেখা যায়। ওটার নাম বৃহস্পতির রেড স্পট বা লাল দাগ। বেশি নয়, লম্বায় ওই দাগটা হল গে মাত্র তিরিশ হাজার মাইল আর চওড়ায় মাত্র সাত হাজার মাইল।’

শুনে পাঁচুগোপালের চোখ আরও গোলপানা হয়ে গেল। খানিকটা চুপ করে থেকে বললেন, ‘এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এত বড়ো? আর আমরা? ছোটোর থেকে ছোটো, আর দ্যাখো, আমাদের বড়াইয়ের অন্ত নেই, অহংকারের অন্ত নেই, নিজেদের মধ্যে মারামারি কাটাকাটিরও অন্ত নেই। নাঃ, তুমি আমার চোখ খুলে দিলে হে পিন্টুচরণ! ভাবছি, এত দিন কী বোকাই না ছিলুম! নিজেকে কত বড়োই না ভাবতুম!’

পিন্টুচরণ বলল, ‘কেবল সৌরজগতের বৃহস্পতিকে দেখেই যদি এ কথা বলেন, এরপর যখন আপনাকে দেখাব মহাকায় কোয়াসার, যার কাছে এই গ্রহটি একটি ছোটো তিলের চেয়েও ছোটো, বা দেখাব দৈত্যাকৃতি যমজ তারা যারা পরস্পরকে ঘিরে ঘুরছে, তখন যে আপনি কী ভাববেন, কে জানে।’

‘কী আর ভাবব? আমার ভাবনা করার ক্ষমতা চলে গেছে। আমি চুপ করে বসে শুধু দেখব। এত সৌন্দর্য, এত বিরাটত্বের কতটা নিজের ভেতরে নিতে পারব জানি না— আমি তো তোমার মতো লেখাপড়া বেশি করিনি। তা, এত সব দেখাবে কখন? আমাদের বাড়ি ফিরতে হবে না?’

পিন্টুচরণ হাসল। বলল, ‘বাড়িই তো ফিরছি পাঁচুগোপালবাবু। ফেরার পথেই সব দেখাব আপনাকে।’

‘বাড়ি ফিরছি কী হে? আমার তো মনে হচ্ছে, আমরা পৃথিবী থেকে দূরে চলে যাচ্ছি। তাই না?’

‘হ্যাঁ, ঠিক তাই। বাড়ি আমরা ফিরছি বটে— তবে আপনার বাড়ি নয়, আমার বাড়ি।’

‘তোমার বাড়ি? কোথায় তোমার বাড়ি? তুমি কে?’

‘আমার বাড়ি আপনাদের ছায়াপথ নীহারিকার বাইরে অন্য এক নীহারিকায়। আপনারা তাকে বলেন অনুরাধা, আমরা বলি অ্যামিকি। সেই অ্যামিকি নীহারিকায় আপনাদেরই মতো এক সৌরজগৎ আছে। সেইখানে এক গ্রহে আমার বাড়ি। আমাদের গ্রহের নামের বাংলা করলে দাঁড়ায় শান্তি। আমি সেই শান্তি গ্রহের রাজকুমার পিন।’

‘ও, তাই বলো। তাই তো বলি, পিন্টুচরণ কখনো কারও নাম হয়? তুমি নাম জিজ্ঞেস করাতে প্রথমে পিন বলে ফেলে তার পরে সামাল দিতে পিন্টুচরণ বানিয়েছিলে, তাই না?’

পিন্টুচরণ লাজুক হাসল। বলল, ‘হ্যাঁ। ব্যাপারটা সেরকমই বটে।’

‘তা, বাপু পিন। তুমি আমাদের পৃথিবীতে কী করছিলে?’

আমাকে আমাদের বৈজ্ঞানিক সংঘ পৃথিবীতে পাঠিয়েছিল বুদ্ধিমান প্রাণীর নমুনা সংগ্রহ করতে। আমার মতে আরও অনেকেই নানা দিকে গেছে। কিন্তু আমার বেলা একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। আমার মহাকাশযানটা পৃথিবীতে নামতে গিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর হঠাৎ বিকল হয়ে পড়ে ডুবে গেল। আমি অবশ্য নিরাপদেই বেরিয়ে এসেছিলুম, কিন্তু পড়ে গেলুম বিপদে। এখন দেশে ফিরি কী করে? একবস্ত্রে বেরিয়ে এসেছি— প্রায় অসহায়ই বলা চলে। তখন মনকে চালিয়ে টের পেলুম আমেরিকা আর রাশিয়া মহাকাশযান তৈরি করার তোড়জোড় করছে। রাশিয়াতে ভেড়া কঠিন, তাই আমেরিকার মহাকাশযানের কেন্দ্রে গিয়ে ভিড়ে গেলুম। তারা আমার জ্ঞান দেখে মুগ্ধ। আসলে, সেটা কিছুই নয়। দেখলুম, আমাদের দেশের ইশকুলের বাচ্চা ছেলেদের যা জ্ঞান, আপনাদের তাবড় তাবড় পণ্ডিতদের জ্ঞান তার চেয়েও ঢের ঢের কম।

ভিড়ে তো গেলুম, কিন্তু কিছুতেই সুবিধে করতে পারছিলুম না। যে সব ঢাউস ঢাউস মহাকাশযান তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে, তাতে কিসসু হবে না। সৌরজগতের বাইরে যেতেই আপনাদের বহু প্রজন্ম কেটে যাবে। তা আমার কথা কেউ কানেই তোলে না। তাই চুপচাপ কাজ করি আর এদিক-ওদিক মনকে চালাই। এই সময়ে মনের মধ্যে হঠাৎ টের পেলুম, আপনার বিজ্ঞাপনটার কথা। সঙ্গেসঙ্গে কলকাতায় রওনা দিলুম।

পাঁচুগোপাল বললেন, ‘বেশ করলে। তারপর আমার ঘাড়ে বন্দুকটি রেখে একটি মহাকাশযান বানিয়ে ফেললে। তাতে অবশ্য ক্ষতি বিশেষ কিছু হয়েছে, তা বলতে পারছি না। কারণ, যে অভিজ্ঞতা হল, তা আমি জীবনে কখনো স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি। কিছু দিয়েই এর মূল্য ঠিক করা যায় না।’

পিন্টুচরণ হাত নেড়ে বলল, ‘এ কিছুই নয়, পাঁচুগোপালবাবু। আমি বলছি, আপনার জন্যে আরও বিস্ময়, আরও সৌন্দর্য অপেক্ষা করে আছে! যাওয়ার পথে আমরা প্রথমে যেখানে থামব, সেই গ্রহটি স্ফটিকের। তার আকাশে সাতটি সূর্য, সেখানে আপনি যা রং দেখতে পাবেন, তা আপনি কখনো দেখেননি। তারপরে যেখানে থামব…’

পাঁচুগোপাল বাধা দিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। এখন আমায় বলো দেখি, তুমি কি আমাকে ওই নমুনা না কী বললে, সেই বলে নিয়ে যাচ্ছ নাকি?’

পিন্টুচরণ ঘাড় নাড়ল। বলল, ‘হ্যাঁ, পাঁচুগোপালবাবু। কিন্তু আপনার কোনোরকম অসম্মান করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তা ছাড়া আপনার চেয়ে ভালো নমুনা পাবই বা কোথায়? মানুষের যতরকম ইমোশান আছে, মানে রাগ, অভিমান, স্নেহ, ঈর্ষা, অনুরাগ সবই আপনার মধ্যে বেশি পরিমাণে আছে, অথচ আপনি সরল বলে সেসব মনের মধ্যে চেপে না-রেখে প্রকাশ করে ফেলেন। কাজেই আমাদের বৈজ্ঞানিকদের কাছে আপনি একটি অত্যন্ত মূল্যবান নমুনা হবেন, সে বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই। আপনি যদি স্বেচ্ছায় আজ আমার সঙ্গে না-আসতেন, তাহলে আমাকে শূন্য হাতেই ফিরতে হত সন্দেহ নেই, কিন্তু আপনাকে না-নিতে পারার দুঃখটা সারাজীবন রয়ে যেত।’

পাঁচুগোপাল বললেন, ‘থাক, থাক, বুঝতে পেরেছি। তা তোমার গ্রহে যেতে কতদিন লাগবে?’

‘আপনার ঘড়ি মতে ছ-মাস। মাঝে অবশ্য কয়েক জায়গায় থাকব। রসদ জোগাড় করতে হবে।’

‘তারপর, তোমাদের বৈজ্ঞানিকরা কতদিন নেবেন?’

‘বছর খানেক।’

‘বেশ। তারপর দেশে, মানে পৃথিবীতে ফিরতে পারব তো?’

‘হ্যাঁ, তা পারবেন। কিন্তু ফিরতে চাইবেন কি?’

‘নিশ্চয়ই চাইব। তোমরা আমাকে যতই আরামে রাখো না-কেন, আমার নিজের বাড়ির আরামের মতো আরাম আমার কাছে আর কিচ্ছু নেই।’

‘তা তো বটেই, তা তো বটেই। তবে কিনা, আপনি যখন পৃথিবীতে ফিরবেন, তখন দেখবেন আপনার বাড়িটা আর নেই।’

‘কেন? নেই কেন? যাবে কোথায় বাড়িটা? জানো, এমন বাড়ি বানিয়েছি যে এক-শো এক-শো বছরেও তার কিছু হবে না?’

‘জানি। কিন্তু এক-শো হাজার মানে এক লক্ষ বছরে কি হবে?’

‘সে আবার কী?’

‘আপনি যখন পৃথিবীতে ফিরবেন পাঁচুগোপালবাবু, তখন পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ বছর পার হয়ে গেছে। আমরা এখন যে গতিতে চলেছি, তাতে আপনার ঘড়ির তুলনায়, পৃথিবীর ঘড়ি অনেক বেশি জোরে বনবন করে ঘুরে চলেছে। আপনি জানেন কি না জানি না, মহাজাগতিক সময় আর পার্থিব সময় এক নয়। আপনাদের শাস্ত্রকাররা কিন্তু এটা জানতেন। সেইজন্যে মহাভারতে আছে যে, ব্রহ্মালোকের এক অহোরাত্র পৃথিবীর বহু কল্পান্তের সমান।’

‘বলো কী হে? এই যে আমরা মাত্র ঘণ্টাখানেক হল চলেছি, তার মধ্যেই পৃথিবীর অনেক সময় কেটে গেছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘নেত্য যে কী করছে, কে জানে। ছেলেমানুষ।’

পিন্টুচরণ হাসল। বলল, ‘দাঁড়ান, বলে দিচ্ছি’— বলে কিছুক্ষণ ধ্যানস্থ হয়ে বসে রইল। তারপর বলল, ‘এই মুহূর্তে আপনাদের বাড়িতে বিরাট উৎসব হচ্ছে। শ্রীযুক্ত দ্যুতিমান রায়ের বড়ো ছেলে জমদগ্নি রায়ের নাতির আজ মুখে ভাত।’

পাঁচুগোপাল বিস্ময়কম্পিত কণ্ঠে বললেন, ‘সে কী! একেবারে ছেলের ঘরে নাতি?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। বললুম যে, ওদের ঘড়ি আমাদের তুলনায় অনেক বেশি জোরে চলছে।’

‘কেমন আছে নেত্য?’

‘ভালোই আছেন। বয়সের তুলনায় বেশ শক্তপোক্তই আছেন। কিন্তু ওঁর স্ত্রী ভয়ানক মোটা হয়ে পড়েছেন। যে রাজহংসীকে আপনি কাঠির মতো রোগা দেখে এসেছিলেন, তিনি আজ অসম্ভব স্থূলকায়া হয়ে বাতে প্রায় পঙ্গু হয়ে শয্যাশায়ী! অবশ্য সেখান থেকেই তিনি গোটা সংসারটা চালাচ্ছেন। ছেলের বউরা সবাই তটস্থ হয়ে আছেন।’

পিন্টুচরণের কথা শুনতে শুনতে পাঁচুগোপাল তাঁর চেয়ারের ওপর আয়েস করে বসলেন। তাঁর মুখে একটা বিস্ময়মিশ্রিত তৃপ্তির হাসি। বললেন, ‘এতক্ষণে বুঝলুম, কেন তুমি বলেছিলে আমি সকলের চেয়ে বেশি দিন বাঁচব। পিন, তুমি রাজপুত্তুর হতে পারো, কিন্তু একনম্বরের ডেঁপো।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *