২০. সকাল হল বটে

সকাল হল বটে, কিন্তু আলো তেমন করে ফুটল না। সমস্ত অরণ্যে একটা ভিজে অন্ধকার ব্যাপ্ত হয়ে রইল। ওয়ার্কিং টেন্টে বসে বাসিমুখে চা খাচ্ছি, এমন সময় বিশুয়া গম্ভীর মুখে সামনে এসে দাঁড়াল।

মেজকর্তা বললেন কী ব্যাপার বিশুয়া? মুখ অমন শুকনো কেন?

বিশুয়া বলল—বাবু, জিপ স্টার্ট নিচ্ছে না–

—তাতে মুখ শুকনো করার কী আছে? দেখ গিয়ে ভাল করে, কোনো তার-টার খুলে গিয়েছে হয়ত। ব্যাটারির টার্মিনাল আলগা হয়ে যায়নি তো?

—না বাবু। ওসব আমি দেখে নিয়েছি। একবার ভাবলাম বুঝি কোনোভাবে ডিস্ট্রিবিউটারে বৃষ্টির জল ঢুকেছে। ডিস্ট্রিবিউটার ক্যাপ খুলে শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে কাগজের নুড়ো জ্বেলে গরম করে ফের লাগিয়েছি

—তাতে হল না?

—না বাবু। অথচ ট্যাঙ্কে তেল ভর্তি, তাজা ব্যাটারি—

মেজকর্তা একটু ভেবে বললেন—বিশুয়া, এ বিষয়ে আর আমি কী বলব? আমি তো আর যন্ত্রপাতির ব্যাপার কিছু বুঝি না। দেখ আর একটু চেষ্টা করে, স্টার্ট নেবে এখন—

অপ্রসন্নমুখে বিশুয়া আবার গাড়ির দিকে গেল।

নির্মল কাঞ্জিলাল বললেন—আকাশের ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে আবার বৃষ্টি নামবে।

অসিতবাবু বললেন—আমার ভাল লাগছে না।

সবাই তার দিকে তাকাল। মেজকর্তা বললেন—কী ভাল লাগছে না?

—কিছুই না। দেখুন, নিজেদের মধ্যে আর লুকোচুরি না করে সত্যি কথা স্বীকার করবার সময় এসেছে। কী হচ্ছে এসব? একশো মণ ওজনের পাথর সরে গেল আপনা আপনি, হাওয়ায় উবে গেল একটা বিশাল গাছ, পাসাং মারার গান শুনে কুলিরা ফিরে গেল, সবাই মিলে রাত্তিরে একই স্বপ্ন দেখছি—এখন আবার শুনছি গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না। আমি খারাপ কিছু ঘনিয়ে এলে আগে থেকে মনের ভেতরে তার আগাম ঘণ্টা শুনতে পাই। জলধরকে আমাদের ছেড়ে দেওয়া উচিত হয়নি, গাড়ি খারাপ হলে আমরা তো এই দুর্যোগে অসহায়ের মত আটকে পড়ব। অবশ্য আমার এ নিয়ে কথা বলা উচিত নয়, এটা আপনাদের ব্যাপার। আমি সবার নিরাপত্তার কথাই বলছি–

মেজকর্তা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন—যেখানে সকলের ভালমন্দ একসূত্রে জড়িত, সেখানে কারো কথা বলা অন্যায় নয়। তাছাড়া আমিও বুঝতে পেরেছি এখানে আমরা কাজ করতে পারব না। জলধর কুলি নিয়ে ফিরতে পারবে বলে আমি মনে করি না। সে ফেরা পর্যন্ত অন্তত অপেক্ষা করা যাক—

মাথার ওপরে গাছের পাতা থেকে টুপ টুপ করে জল ঝরে পড়ছে। চেয়ার একটু টেনে সরিয়ে বসলাম। জলধর যদি খুব তাড়াতাড়িও ফেরে, তাহলেও কাল বিকেলের আগে নয়। আর একটা রাত্তির এই নির্জনতার মধ্যে আমরা কয়েকটি প্রাণী কাটাব। অন্য সময় হলে ভাল লাগত, কিন্তু মনে আশঙ্কা নিয়ে কোনও উপভোগই সুখের নয়।

কিন্তু পরের দিন অবধি আমাদের অপেক্ষা করতে হল না। বেলা বারোটা নাগাদ সাম পাহাড়টোলির দিকের রাস্তায় গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ পাওয়া গেল। বড়, ভারী গাড়ির। ইঞ্জিন, চড়াই দিয়ে ওঠার পথে গোঁ গোঁ শব্দ করছে। এ শব্দ আমাদের পরিচিত, তবু থেকে আমরা বাইরে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম। রান্নার তাবু থেকে বিশুয়াও বেরিয়ে এল। সে বলল—আমাদের লরি আসছে।

মেজকর্তা বললেন–কী করে বুঝলে?

–আমি আওয়াজ চিনি কর্তা। এক এক গাড়ির এক এক রকম আওয়াজ–

একমিনিটের মধ্যেই বিশুয়ার কথা সত্য প্রমাণিত করে আমাদের চেনা ট্রাক উঠে এল চড়াই বেয়ে। বিশুয়া একগাল হেসে বলল—বলেছিলাম না আমাদের গাড়ি!

মেজকর্তা বললেন—ওটা কিছু নয়। এই জঙ্গলে আর অন্য কোন গাড়ি আসবে? ও তো আমিও বলতে পারতাম–

মেজকর্তা অবশ্য কথাটা মজা করে বললেন। কিন্তু বিশুয়া আহত অভিমানের সুরে বলল—বলেন কী কর্তা! আমার চোখ বেঁধে সামনে একে একে পঞ্চাশটা গাড়ি স্টার্ট দিন, আমি বলে দেব কোন্টা কোন্ গাড়ি–

লরি এসে ব্রেক কষল সামনে। চড়াই ভেঙে ওঠার জন্য রেডিয়েটরের জল ফুটছে। জলধর পণ্ডা নেমে এসে দাঁড়াল, সে কুলি পায়নি—এ কথা তার আর মুখে বলবার দরকার হল না। বিশ্বস্ত কাজের লোক কোনো কাজে ব্যর্থ হলে তার চেহারায় একটা গ্লানির ছাপ ফুটে ওঠে, জলধরেরও তাই হয়েছে। সে বলল—কী করে এত তাড়াতাড়ি এরা খবর ছড়ায় জানি না কর্তা, নাকি এদের মাথার মধ্যে সত্যি সত্যি টনক আছে, তাই বা কে জানে! চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর সিমডেগা, কোলেবিরা, সীসা আর জঙ্গলের ভেতরকার বস্তি—সবজায়গার লোকেরা বেঁকে বসেছে। জিজ্ঞাসা করলেও কিছু বলে না। ডবল মজুরি অবধি কবুল করেছি কর্তা—যেমন আপনি বলে দিয়েছিলেন, তাতেও কিছু হয়নি।

এইসব কথা হচ্ছে, হঠাৎ লরীর থেকে পেছনের খোলা ডালার দিক দিয়ে একজনকে। নামতে দেখলাম। এ আবার কে? একে তো আমাদের দলে আগে দেখিনি। আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে অন্যরাও তাকাল। মেজকর্তা জিজ্ঞাসা করলেন—এ লোকটি কে জলধর?

জলধর একটু ইতস্তত করে বলল—আজ্ঞে, আমিও ঠিক চিনি না–

—চেন না মানে? তোমার সঙ্গে এল, আর তুমি চেন না?

—না কর্তা। মাঝপথে হঠাৎ জঙ্গলের মধ্যে থেকে উঠে এসে রাস্তার ওপর দাঁড়াল। সেখানে কোথায় ফেলে আসব, তাই সঙ্গে নিয়ে এলাম–

লোকটি কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। বছর চল্লিশ কী বেয়াল্লিশ বয়েস হবে, বেশ ভদ্র আর সৌম্য চেহারা। জামাকাপড় অত্যন্ত সাধারণ হলেও লোকটিকে ঠিক ভবঘুরে শ্রেণীতে। ফেলা যায় না। তার হাতে একটা সরু, লম্বা গাছের ডাল। জঙ্গলের ভেতরে কোথাও থেকে কুড়িয়ে নিয়েছে বোধহয়। গাছের ডালটা দেখে আমার মনের ভেতর একটা ঘণ্টা বেজে উঠল। কিছু মনে পড়ে যাওয়ার পূর্বাভাস।

লোকটি সাধারণভাবে আমাদের সকলকে উদ্দেশ করে বলল-নমস্কার।

শিক্ষিত মানুষের বাচনভঙ্গি। মোটেও ভবঘুরেদের মত নয়। মজার ব্যাপার তো!

মেজকর্তা বললেন—নমস্কার। তুমি কে?

লোকটি মুচকি হেসে বলল—পথিক। আপাতত আপনাদের অতিথি।

—নাম কী তোমার? এখানে কোথা থেকে এলে?

লোকটা একটু চিন্তা করল।

—নাম? নাম ধরুন মৃত্যুঞ্জয়। আমি এমনি পথে পথে ঘুরে বেড়াই, বাড়ি-টাড়ি কিছুই নেই। যেখানে থাকতে পাই থাকি, যেখানে খেতে পাই খাই। এখন বনের ভেতর দিয়ে। হাঁটছিলাম, আপনাদের গাড়ি দেখতে পেয়ে তাতে উঠে বসেছি। ব্যস, চলে এলাম।

কিন্তু ব্যাখ্যাটা অত সহজ নয়। জনমানবহীন অরণ্যে, যাকে ইংরেজিতে বলে In the middle of nowhere, সে একা কী করছিল? যেখান থেকে সে লরীতে উঠেছে সেটা সবচেয়ে কাছের লোকালয় থেকে অন্তত দেড়দিনের হাঁটাপথ। খাবার বা জল না নিয়ে। এই দেড়দিন সে কীভাবে কাটিয়েছে জঙ্গলের ভেতর? পরিষ্কার বাংলায় কথা বলছে, তার। মানে সে বাঙালী। বিহার-উড়িষ্যার সীমান্তবর্তী দুর্গম অরণ্যে একজন ভবঘুরে বাঙালী কীসের আশায় ঘুরে বেড়াচ্ছে? একে আমি চিনি এমন কথাই বা আমার মনে হচ্ছে কেন?

মৃত্যুঞ্জয় বেশ সহজ ভঙ্গিতে একবার চারদিকে তাকাল, তারপর বললবেশ জায়গা, কিন্তু এখানে তো আপনারা কারখানা বানাতে পারবেন না কর্তা–

মেজকর্তা ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে বললেন—আমরা এখানে কারখানা করতে চাই একথা তোমাকে কে বলল?

–ওটার মধ্যে কোনো যাদু নেই। আসবার সময় আপনার লোকেদের কাছেই শুনেছি।

—কেন, কারখানা করতে পারব না কেন?

মৃত্যুঞ্জয় হেসে বলল—কর্তা, কিছু কিছু কেন-র কোনও উত্তর হয় না। মেনে নিতে। হয়। এই তো দেখুন না, এখনও তো বর্ষা নামেনি, তবু ক’দিন তেমন আকাশ মেঘে ঢাকা আর বৃষ্টি হয়ে চলেছে। যদি প্রশ্ন করেন কেন হচ্ছে, কেউ কী তার উত্তর দিতে পারবে? কেবল দু’একজন বিশেষ মানুষ ছাড়া?

নির্মলবাবু এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন, এবার বললেন—বিশেষ মানুষ আবার কে? কী বলছ হে তুমি?

মৃত্যুঞ্জয় বলল—বিশেষ লোক বলতে যারা এসব ব্যাপার ঠিকঠাক জানে আর কী। এই যেমন আমি

নির্মলবাবু বললেন—তুমি ধাঁধায় কথা বলছ কেন? কি জান তুমি?

মৃত্যুঞ্জয় বলল—এই যেমন বলে দিলাম এখানে আপনারা কাজ করতে পারবেন না। কারণ কী জানেন? কারণ হল পৃথিবীতে কিছু কিছু জায়গা মানুষের, কিছু কিছু জায়গা। মানুষের নয়। নিজের অধিকারের গণ্ডি পার হয়ে ওদিকে পা দিলে তাতে সব গোলমাল হয়ে যায়।

মেজকর্তা বললেন—এত সব কথা তুমি শিখলে কোথায়? এ তো টোলের পণ্ডিতমশাই-এর মত কথা।

মৃত্যুঞ্জয় বলল—আজ্ঞে, আমি জানতে পারি। স্বপ্ন দেখি কী না। তার পরে ধরুন। মাপজোক আছে, মাটি শোঁকা আছে। এসব মিলিয়ে আমি টের পেয়ে যাই–

আমি চমকে তার দিকে তাকালাম। মনে হল আমি তাকে চিনতে পেরেছ। তারানাথের মুখে শোনা সেই বাহিরগাছি গ্রামের গল্প। রামজয়পুরে সরসী চাটুজ্জের বৈঠকখানা। কিন্তু যার কথা তারানাথ বলেছিল তার নাম তো মৃত্যুঞ্জয় নয়। কী যেন নামটা! আবছা আবছা মনে পড়লো। সে নামের অর্থও মৃত্যুঞ্জয় গোছের কিছু। অবশ্য মেজকর্তা বা নির্মলবাবুর সামনে এসব প্রসঙ্গ উত্থাপন করা সঙ্গত মনে করলাম না।

মেজকর্তা বললেন তুমি ভারি অদ্ভুত কথা বলে তো! মাপজোক কীসের? মাটি শোকাই বা কাকে বলে?

—আজ্ঞে, সব বুঝতে পারবেন। আজকেই সব দেখিয়ে দেব। বেলা হয়েছে। একটু খাওয়াদাওয়া করে নিই, কেমন? তারপরে কাজ শুরু করা যাবে। আপনাদের আজকে মাছ-মাংস কিছু রান্না হয়নি তো? স্বপ্ন দেখতে আর মাটি শুকতে হলে সেদিন মাছ-মাংসটা

খাওয়াই ভাল। তাতে হিসেবের গোলমাল হয়ে যায়।

মৃত্যুঞ্জয়কে কেউ তখনও খাবার নিমন্ত্রণ করেনি। কিন্তু নিজে থেকেই সে এমনভাবে প্রসঙ্গটা তুললো যে, মনে হল এটা তার অত্যন্ত স্বাভাবিক অধিকার। এ মেজকর্তা বললেন—নিরামিষ খাবারই পাবে।

জলধর পণ্ডা সার্ভেয়ার সাহেব আর মেজকর্তার সঙ্গে জরুরি কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। অসিতবাবু তাঁবুতে ফিরে গেলেন বোধকরি ভুলে যাওয়ার আগে সকাল থেকে এখন পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে ঠিকঠাক লিখে রাখার জন্য। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলাম। যেখানে সেই বিরাট বৃদ্ধ নারিকেল গাছকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম, সেখানে মৃত্যুঞ্জয় চিন্তিত মুখে মাটির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাটিতে বিশাল পাথরটা হড়কে যাওয়ার চওড়া গভীর দাগ। যেন একটা রাজপথ তৈরি হতে আরম্ভ করে থেমে গিয়েছিলো। আমার পায়ের আওয়াজে মুখ তুলে তাকিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল—এই যে!

আমি তার চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলাম—তুমি বাহিরগাছি গ্রাম চেনো?

তার মুখে বিশেষ কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। সে বলল-ওঃ, আপনি বুঝতে পেরেছেন তাহলে!

–বাহিরগাছিতে চক্রবর্তী পরিবারের সঙ্গে তোমার পরিচয় আছে, তাই না? আদিনাথ চক্রবর্তীকে মনে পড়ে?

–পড়ে। কিন্তু সে তখন নিতান্তই বালক। তার পরে তাকে আর কখনও দেখিনি।

—সেই বালক আদিনাথ চক্রবর্তী বুড়ো হয়ে মারা গেছে আজ বহুদিন। শুনেছি তখন নাকি তোমার বয়স পঁয়ত্রিশ কী চল্লিশ ছিল। এখনও তোমার সেই বয়েস থাকে কী করে? হিসেবমত তোমার বয়েস তো একশ ছাড়িয়ে যাওয়া উচিত–

এ কথার কোন উত্তর না দিয়ে মৃত্যুঞ্জয় একটু হাসল।

বললাম—আদিনাথ চক্রবর্তীর ছেলের সঙ্গেও তো তোমার দেখা হয়েছিল, তাই না? দেখা হয়েছিল না বলে আলাপ হয়েছিল বলাই ভাল। অন্ধকার রাত্তিরে মন্দিরের চাতালে শুয়ে কেউ কারো মুখ যখন দেখতে পায়নি–

মৃত্যুঞ্জয় মিষ্টি করে হেসে বলল—আপনি তো সব জানেন দেখছি। অবশ্য জানবেনই তো, আদিনাথ চক্রবর্তীর ছেলে তারানাথ চক্রবর্তী আপনাকে জানিয়ে দিয়েছেন আজ আমি আসব, ঠিক তো?

এখনও ভাবলে অবাক লাগে, কী করে সেদিন মৃত্যুঞ্জয়ের সঙ্গে দেখা হওয়াটা আমি এত সহজ ভাবে নিয়েছিলাম। অলৌকিক ঘটনার কথা আমরা শুনি বটে, কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সীমানায় খুব বেশি একটা পাই না। কে জানে কী করে সেদিন মাথা ঠাণ্ডা রেখেছিলাম।

হঠাৎ ঝুঁকে পড়ে মৃত্যুঞ্জয় যেখানে পাথরটা সরে যাওয়ার দাগ হয়ে রয়েছে সেখান থেকে একমুঠো মাটি হাতে তুলে নিয়ে গভীরভাবে শুকতে লাগলো। তার মুখচোখ গম্ভীর, মগ্নতায় আবিষ্ট।

বললাম—ও কী হচ্ছে?

—মাটি শুঁকছি।

—সে তো দেখতেই পাচ্ছি। মাটি শুঁকে কী হবে?

আমার দিকে তাকিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল—মাটিই তো সব। মাটিতে সৃষ্টি, এই মাটিতে প্রতিষ্ঠা, মাটিতে মৃত্যু। মাটিতে মহাকাল মিশে থাকে। বৈদ্য যেমন রোগীর নাড়ি থেকে শরীরের গতিক বুঝতে পারে, তেমনি মাটি খুঁকে সবকিছু বলে দেওয়া যায়–

—এখন কী বুঝতে পারলে?

–বুঝলাম এ জায়গা অন্যের অধিকারে।

এখানে কিছু না করাই ভাল। —অন্যের অধিকারে মানে? কার অধিকারে? মৃত্যুঞ্জয় প্রথমে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর বলল কী বলি বলুন তো, নাম তো কিছু নেই। শুধু বলতে পারি এ শক্তি জীবন আর স্থিতির বিরোধী–

–তার মানে অশুভ শক্তি?

—মোটেই নয়। আমাদের পক্ষে অসুবিধেজনক বলে অশুভ হতে যাবে কেন? যে কোনো একজন শান্ত, ভদ্র গৃহস্থ কি অশুভ শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে? কিন্তু তার বাড়ির উঠোনে নিজের প্রয়োজনে আপনি যদি গিয়ে মাটি খুঁড়তে থাকেন, তাহলে সে নিশ্চয় লাঠি নিয়ে হৈ হৈ করে তেড়ে আসবে, যতরকম ভাবে বাধা দেওয়া যায় তার চেষ্টা করবে। তার জন্য তাকে কি খুব পাজি বা দুষ্টু লোক বলা উচিত হবে? নিজের স্বাভাবিক অধিকারে হাত পড়লে সবাই রেগে যায়—

বন থেকে বেরিয়ে আসা মানুষটি ভারি আশ্চর্য কথা বলে। পণ্ডিতের মত কথা। বললাম—কিন্তু এ শক্তির রূপ কী? পরিচয় কী?

—কিছু না। সৃষ্টির সময় থেকেই আলো আর অন্ধকারের মত বিরোধীশক্তি আর মিত্রশক্তির উদ্ভব। জাতি, ভাষা, ধর্ম অনুযায়ী এক এক জায়গায় এক এক নামে মানুষ ডাকে। পরিচয় আর কী থাকবে?

বললাম—তুমি তাহলে এখন কী করবে? এর থেকে রক্ষা পাবার উপায় কী?

মৃত্যুঞ্জয় বলল—যাতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কেটে যায়, কারো প্রাণহানি না হয় সেজন্য আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি, মিত্রশক্তির দেবতার আশ্রয় নিচ্ছি। কিন্তু এ জায়গা থেকে আপনাদের। চলে যেতে হবে। কিছু জায়গায় কিছু কাজ করা যায় না।

—মিত্রশক্তির দেবতা কে?

—জানি না। দেবতার আবার নাম-গোত্র কী? তবে তার আশ্রয় গ্রহণ করলে ভয় কেটে যায়। শাস্ত্রে বলেছে—

ভূতপ্রেতপিশাচশ্চ রাক্ষসা দুষ্টচেতসঃ।
সর্বেতে প্রলয়ং যান্তি বিশ্বমিত্রস্য প্রসাদতঃ ॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *