গঙ্গাধরের সাংবাদিকতা

গঙ্গাধরের সাংবাদিকতা

জীবনবল্লভ কুণ্ডু কিছু না-হোক বিশবছর ধরে বাড়ির দালালি করছেন। খদ্দেরের মুখ দেখলেই বুঝতে পারেন যে বাড়ি তাঁর পছন্দ হয়েছে কিনা। কিন্তু জয়ন্ত সরকার এতই বিমুগ্ধ-নয়নে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে ছিল যে তার মনের অবস্থা বোঝার জন্য বিশবছর তো দূরস্থান, কোনো অভিজ্ঞতারই দরকার হয় না।

অনেকক্ষণ বাড়িটা দেখে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে যেন অনেক কষ্টে চোখ ফিরিয়ে জয়ন্ত সরকার জীবনবল্লভকে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা জীবনবাবু, বাড়িটা হানাবাড়ি, তাই না?’

এরকম একটা প্রশ্নের জন্য জীবনবল্লভ একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। হ্যাঁ-না কিছুই না-বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে হাতের প্রাগৈতিহাসিক পোর্টফোলিয়ো ব্যাগটা দোলাতে লাগলেন।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে জয়ন্ত আবার জিগ্যেস করল,’ কী হল? কিছু একটা বলুন?’

জীবনবল্লভ কাষ্ঠ হেসে বললেন, ‘কী আর বলব স্যার? আপনি সাংবাদিক, সব খোঁজখবরই নিয়েই তো এসেছেন। আপনার কাছে মিথ্যা বলে আমার তো কোনো সুবিধে হবে না। সব-ই যখন জানেন, তখন আর আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন কেন?’

‘না-না, আমি কিছুই জানি না, আর কোনোরকম খোঁজখবর নিয়েও আসিনি। বাড়িটা দেখে আমার কীরকম মনে হল যে বাড়িটাতে ভূত আছে। সেটা কি সত্যি?’

‘সত্যি-মিথ্যে তো জানি না, স্যার। তবে লোকে নানান কথা বলে। বাড়িটা এর আগে যতবার ভাড়া নিয়েছে, ভাড়াটে সাতদিনের মধ্যে তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালিয়েছে। কেন পালিয়েছে, কোথায় পালিয়েছে সেসব কেউ জানে না। অ্যাডভান্সের টাকা পর্যন্ত ফেরত নিতে আসেনি।’

পুলকিত-মুখ জয়ন্ত বলল, ‘বলেন কী?’

জীবনবল্লভ অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলেন, জয়ন্তর মুখের দিকে লক্ষ করেননি। বিমর্ষভাবে বললেন, ‘হ্যাঁ, স্যার। সত্যিই বলছি। চলুন তাহলে, লেক স্কোয়ারের বাড়িটাই দেখতে যাই।’

জয়ন্ত বলল, ‘সে কী কথা? এমন বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে যাব কেন?’

‘এ-বাড়ি আপনি নেবেন স্যার? তার আগে আপনার স্ত্রীর সঙ্গে একবার কথা বলে নিলে হত না?’

‘কথা বলব বই কী। সে যখন জানবে যে শেষপর্যন্ত একটা সত্যিকারের হানাবাড়ি পাওয়া গিয়েছে, তখন সে এত খুশি হবে যে সে আর বলার নয়।’

ব্যাগ দোলানো বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়ালেন জীবনবল্লভ। বললেন,’ব্যাপারটা কী বলুন তো? লোকে ভূতের বাড়ি শুনলে রাম রাম করতে করতে পালায় আর আপনারা খুশি হয়ে উঠছেন! এটা তো ভারি আশ্চর্য ব্যাপার!’

‘এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। আমার স্ত্রী প্যারাসাইকোলজি আর অকাল্ট মানে ভূতপ্রেত, মন্ত্রতন্ত্র এইসব ব্যাপার নিয়ে রিসার্চ করছে। আমিও এসব ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড। আসলে প্ল্যানচেটের আসরেই ওর সঙ্গে আমার আলাপ হয়। সেদিন সেখানে আমরা সম্রাট ধর্মপালকে ডেকেছিলুম। তিনিই আমাদের বিয়ে করতে বলেন। তা সম্রাট বলে কথা। তাঁর কথা তো আর অমান্য করা যায় না। তার থেকেই বিয়ে হল আমাদের।’

জীবনবল্লভ একটা মস্তবড়ো হাঁ করে জয়ন্তর কথা শুনছিলেন। বললেন, ‘সম্রাট ধর্মপাল আপনাদের বিয়ের ঘটকালি করেছিলেন? মানে সেই পালরাজাদের ধর্মপাল? বলেন কী মশাই?’

‘হ্যাঁ, সেই সম্রাট ধর্মপাল। এতে এত আশ্চর্য হবার কী আছে? সম্রাটরা কি আর মানুষ নয়? তারাও খায়দায়, চান করে, ঘুময়। ঘটকালি করতে পারবে না কেন?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। পারবে বই কী। নিশ্চয়ই পারবে। কেন পারবে না? আমি তাহলে এই বাড়িটাই ঠিক করে ফেলছি কী, বলেন?’ বলে ঊর্ধ্বশ্বাসে হাঁটা লাগালেন জীবনবল্লভ।

জায়গাটা বেশ ভালোই। যাদবপুর রেলস্টেশন থেকে পনেরো মিনিটের হাঁটাপথ, চারদিকে ফাঁকা-ফাঁকা। বাড়িটার দক্ষিণে রাস্তা, তারপরে একটা পুকুর। পেছনে আর দু-পাশে অনেকটা জমিজমা নিয়ে বাংলো-টাইপের বাড়ি। ফলে বেশ একটা নির্জন নির্জন ভাব। ট্রেনের শব্দ বা সুকান্ত সেতু থেকে আসা বাসের হর্নের আওয়াজ পাওয়া যায় বটে, কিন্তু সেটা কর্ণবিদারী কিছু নয়।

বাড়িটা একতলা। রঙিন কাচ-বসানো খিলেন করা চকচকে দরজা-জানলা। বাইরের দেওয়ালে হলদেটে আর টেরাকোটায় কম্বিনেশন করা সিমেন্ট পেন্ট, বাইরের বারান্দার দেওয়ালে ঝকঝকে সাদা ডিসটেম্পার। কিন্তু এসব সত্ত্বেও বাড়িটা কেমন যেন বিষণ্ণ, প্রাণহীন। হানাবাড়ি বললেই যেমন মনে হয়— ভাঙাচোরা দেওয়াল, ফাটলে অশ্বত্থগাছ, খসে-পড়া পলেস্তারা খুলে পড়া দরজা-জানলা, সেরকম কিন্তু এ-বাড়িটা একেবারেই নয়। তবুও এর বারান্দায় পা রাখলে গা ছমছম করে।

জয়ন্ত আর পারমিতা মহাখুশি। পারমিতা বলল, ‘দারুণ বাড়ি। ঢুকতেই যেন শরীরটা কেমন কেমন করছে।’

জয়ন্ত বলল, ‘যা বলেছ। এই তো দ্যাখো না, আমার গায়ের লোম সব খাড়া হয়ে উঠছে, বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ করছে। বেশ জমবে, কী বলো?’

‘তা আর বলতে! শুধু যারা আমাদের মালপত্র নিয়ে এল, তাদের কথা ভেবে আমার একটু দুঃখ হচ্ছে। যা পয়সা দিলুম, তাই নিয়েই ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাল। বখশিশ চাওয়া তো দূরস্থান, গুনে দেখল না পর্যন্ত। আবার যাবার সময় বলে গেল, এ-বাড়িতে থাকবেন না মেমসাহেব, পালান!’

মাসখানেক কেটে গেছে। পরমানন্দে দিন কাটছে জয়ন্ত-পারমিতার। এর মধ্যে অবশ্য অনেক কিছুই ঘটে গেছে। প্রায় প্রত্যেক রাত্রেই তাদের প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে খাটের থেকে ছিটকে মেঝেয় পড়তে হয়েছে। রান্নাকরা মুসুরির ডালের রং কখনো লাল, কখনো বা সবুজ হয়ে গিয়েছে। টেবিল-চেয়ার মেঝে থেকে উঠে শূন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দরজা-জানলা কখনো খুলছে, কখনো বন্ধ হচ্ছে। সেই সঙ্গে ক্যাঁচকোঁচ শব্দ। জানলার নীচে দুটো বেড়াল রাত বারোট বাজলেই বিকট সুরে ঝগড়া করছে।

এর ফলে পারমিতার আনন্দ আর উত্তেজনার শেষ নেই। তার নোটবই-এর পাতার-পর-পাতা ভরতি হয়ে উঠছে। সে এ-ঘর থেকে ও-ঘরে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে, কোথায় কী ঘটছে সে-ব্যাপারে লিখে ফেলবার জন্য। আর জয়ন্তর কাজ হচ্ছে বাড়িটার অদৃশ্য বাসিন্দা বা বাসিন্দাদের সঙ্গে একটা যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। কখনো চিৎকার করে ডেকে, কখনো বা ধ্যানস্থ হয়ে সে একটা কথাবার্তা শুরু করার চেষ্টা করে যাচ্ছে, যদিও তাতে কোনো ফল এখনও পাওয়া যায়নি।

অবশেষে বাড়িটার আদি-বাসিন্দার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল।

সেদিন রবিবার। পারমিতা গেছে বাজার। জয়ন্ত সন্ধে বেলা বসবার ঘরে বসে টেলিভিশনে মনোসন্নিবেশ করার চেষ্টা করছিল। এত আজেবাজে সব প্রোগ্রাম যে কিছুতেই তার চেষ্টা সফল হচ্ছিল না।

হঠাৎ দপ করে বাড়ির সব আলো নিভে গেল। জয়ন্ত গলা বাড়িয়ে দেখল আশেপাশে সর্বত্র আলো জ্বলছে, অর্থাৎ লোডশেডিং নয়। তার মানে এখনই ভৌতিক কার্যকলাপ শুরু হবে। টেলিভিশনের জঘন্য প্রোগ্রামের চেয়ে সেটা শতগুণে ভালো।

ঠিক তাই হল। হঠাৎ ঘরের মাঝখানে মেঝে থেকে ফুট তিনেক ওপরে একটা নীলাভ আলোর বিন্দু দপ করে জ্বলে উঠল। সেটা বোঁ করে একবার সারাঘরে ঘুরে এসে জয়ন্তর নাকের ঠিক সামনে দুলতে লাগল। সেই আলোর বিন্দুটার ভেতর থেকে একটা ক্ষীণ কিন্তু স্পষ্ট গলা শোনা গেল, ‘কীরকম লোক মশাই আপনারা? মানুষ না-আর কিছু?’ গলাটা মোটা আর চেরা চেরা।

জয়ন্ত হাত নেড়ে বলল, ‘কেন? দিব্যি সুস্থ-সবল দু-জন মানুষ। হাত আছে, দুটো পা আছে।’

‘ছাই আছে। দুটো হাত-পা থাকলেই মানুষ হওয়া যায় না, বুঝলেন? বুদ্ধি! বুদ্ধি থাকা চাই। সেই বস্তুটিই তো আপনাদের ঘটে নেই। আপনারা যে কী ভয়ানক বিপদের মধ্যে রয়েছেন সেটা আপনারা বুঝতে পারছেন না।’

‘বিপদ? কীসের বিপদ?’

‘ভূতের। আবার কীসের? বুদ্ধিমান লোকমাত্রেই ভূতের ভয় পায়, তা জানেন?’

‘আজ্ঞে না তো।’

‘সেই জন্যই তো বলছি, ঘটে কিসসু নেই। এই যে আমি আপনাদের ঘাড় মটকে দিতে পারি, তা জানেন?’

‘আজ্ঞে না, এত সোজা নয়। আমরা দু-জনেই ক্যারাটে ব্ল্যাকবেল্ট। আমাদের ঘাড় মটকাতে এসে আপনারাই মুণ্ডু ঘুরে যেতে পারে।’

আলোর বিন্দুটা চট করে একটু পেছিয়ে গেল। গলা শোনা গেল, ‘দু-জনেই ব্ল্যাকবেল্ট? ওরে বাবা! আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে। ঘাড় মটকানো-ফটকানো পরে দেখা যাবে। এখন বলুন, আমারই বাড়ি থেকে আমাকে কেন আপনারা বিতাড়িত করতে চান?’

‘আপনাকে বিতাড়িত করতে যাব কোন দুঃখে? উলটে আমরা তো একসঙ্গেই থাকতে চাই। আপনি আপনার মতো থাকবেন, আমরা আমাদের মতো থাকব। যখন সময় পাব বেশ জমিয়ে আড্ডা মারব।’

‘দূর! কী যে বলেন তার ঠিক নেই। ভূত আর মানুষ কখনো একসঙ্গে থাকতে পারে?’

‘কেন পারবে না? আপনি হলেন অতীতের মানুষ, বর্তমানের ভূত। আমরা হলুম বর্তমানের মানুষ, ভবিষ্যতের ভূত। এই তো তফাত। তাহলে না-পারার কী আছে?’

‘হেঁ-হেঁ। না, মানে আপনার প্রস্তাবটি খুবই লোভনীয়। একা-একা থাকি তো। সবাই ভয় পায় বলে আমিও ভয় দেখাই। নইলে আমি কিন্তু আড্ডাবাজ লোক। তা ছাড়া ইয়ে, আপনার স্ত্রী রাজি হবেন তো?’

‘হবেন মানে? হয়েই আছেন বলতে পারেন। তাহলে এবার বলুন, জীবন্তদশায় আপনি কে ছিলেন, মানে আপনার পরিচয় কী ছিল?’

‘কলকাতায় ঊষার আলো বলে একটা খবরের কাগজ ছিল। নাম শুনেছেন?’

জয়ন্ত চিন্তিত-মুখে বলল, ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ। শুনেছি বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু সে তো বহুকাল আগেকার কথা। বোধহয় আমার জন্মেরও আগে কাগজটা বন্ধ হয়ে যায়।’

‘তাই হবে। উনিশ-শো সাঁইত্রিশ সালে আমি মারা যাবার পরের বছর আমার গুণধর পুত্র সেটা বন্ধ করে দেয়। যাই হোক, আমি ছিলুম সেই পত্রিকার মালিক এবং সম্পাদক। আমার নাম ছিল গঙ্গাধর নন্দী। এ-বাড়িটা বানাই ছত্রিশে, মারা যাবার আগের বছর।’

উল্লসিত হয়ে জয়ন্ত বলল, ‘আপনিও সাংবাদিক? মানে ছিলেন? তবে আর কী। আমাদের আড্ডা তো তাহলে দারুণ জমবে।’

দুদিন পরের কথা।

পারমিতা পড়ায় মহামায়া কলেজে। বাড়ি থেকে ন-টায় বেরিয়ে যায়। জয়ন্ত বের হয় বেলা বারোটায়। সেদিন দশটা বাজতে-না-বাজতে জয়ন্তর কাঁপ দিয়ে জ্বর এল। গায়ে অসহ্য যন্ত্রণা। সে খাটে শুয়ে পড়ে চিঁ-চিঁ করে, ‘জ্যাঠামশাই! ও জ্যাঠামশাই!’ বলে ডাকাডাকি শুরু করল।

একটু পরেই খাটের পাশে দপ করে নীল আলোর বিন্দুটা জ্বলে উঠল। কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘কী হল? ডাকছ কেন? ও বাবা, জ্বর হয়েছে দেখছি।’

জয়ন্ত বলল, ‘হ্যাঁ, ভাইরাল ফিভার। কলকাতায় কিছুদিন হল এসেছে। সকলের হচ্ছে। আমাদের অফিসসুদ্ধু সবাই বিছানায় শুয়ে পড়েছে। আমার যা স্বাস্থ্য, তাতে আমারও যে হবে ভাবিনি। দু-দিন খুব ভোগাবে।

‘তা আমাকে ডাকছ কেন বললে না তো?’

‘আমি ভয়ানক বিপদে পড়ে গেছি জ্যাঠামশাই। এখন এই বিপদ থেকে একমাত্র আপনিই উদ্ধার করতে পারেন।’

‘কীসের বিপদ?’

‘আপনি কি জানেন যে আজ ইস্ট পুটিয়ারী আর কালীগঞ্জ অগ্রগামীর ফুটবল খেলা? ভয়ানক ইম্পর্ট্যান্ট খেলা। এর ওপর লিগ চ্যাম্পিয়নশিপ নির্ভর করছে। আমার খেলাটা কভার করার কথা ছিল। অথচ এই তো অবস্থা। অফিসে যে খবর দেব, তার উপায় নেই। দিলেই বা কী হবে? কেউ নেইও যে আমার জায়গায় যাবে। আপনি যদি দয়া করে খেলাটা দেখে একটা রিপোর্ট বানিয়ে দেন তাহলে আমি বাঁচি। আপনি অভিজ্ঞ সাংবাদিক। কী করতে হবে তার সবই তো আপনি জানেন। আমি আজ সন্ধে বেলায় পারমিতাকে দিয়ে রিপোর্টটা অফিসে পাঠিয়ে দেব।’

‘টেলিভিশনে দেখে নাও না।’

‘ওটার দিকে তাকাতে পারছি না। তাকালেই মাথা ছিঁড়ে পড়ছে। যান-না জ্যাঠামশাই! বেশি দূর তো নয়।’

‘যাচ্ছি রে বাবা যাচ্ছি, আজ সন্ধে বেলা রিপোর্ট পেয়ে যাবে।’

সন্ধে বেলা নীল আলোর বিন্দুটার ভেতর থেকে একটা পাকানো কাগজ ফুড়ুৎ করে বেরিয়ে এসে জয়ন্তর বুকের ওপর পড়ল। গঙ্গাধরের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘এই নাও তোমার রিপোর্ট।’

জয়ন্ত প্রচুর ধন্যবাদ জানিয়ে রিপোর্টটা পড়তে শুরু করল। পড়তে পড়তে ওর চোখদুটো বিস্ফারিত হয়ে উঠল, ঘন-ঘন নিশ্বাস পড়তে লাগল। তারপর পড়া শেষ করে অনেকক্ষণ স্তম্ভিত-দৃষ্টিতে কাগজটার দিকে তাকিয়ে রইল। অবশেষে পারমিতার হাতে দিয়ে জয়ন্ত বলল, ‘এই এতদিনে আমার চাকরিটা গেল।’ বলে ধপাস করে চোখ বুজে শুয়ে পড়ল।

পারমিতা রিপোর্টটা পড়তে শুরু করল।

প্রথমে হেডলাইন— লিগ ম্যাচে তাণ্ডব। খেলা অর্ধপথে পরিত্যক্ত। রেফারি গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভরতি।

আজ ছিল ময়দানে ইস্ট পুটিয়ারী আর কালীগঞ্জ অগ্রগামীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খেলা। উভয় পক্ষই যে এই ম্যাচে প্রাণ দিয়ে লড়বে তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না। এটা ছিল দুই দলেরই কেবল বাঁচার লড়াই নয়, সম্মানেরও প্রশ্ন।

ফলে দর্শক-গ্যালারিতে তিলধারণেরও জায়গা ছিল না। র‌্যামপার্টও ভরতি হয়ে গিয়েছিল। কলকাতা ফুটবলের অনেক দিকপাল তারকাই খেলা দেখতে উপস্থিত ছিলেন। পূর্বদিকের পাঁচিলের ওপর পা ঝুলিয়ে বসেছিলেন সুন্দরকাননের স্বনামধন্য ফুলব্যাক গোপীকৃষ্ণ দত্ত, যাঁকে একসময় কলকাতার মাঠের ম্যাজিনো লাইন বলা হত। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁরই ক্লাবের গুরুদাস ভাদুড়ি আর বিজয় শুক্লা। স্বাধীনতার আগে মিলিটারি টিমের সঙ্গে সমানে সমানে পাল্লা দিয়ে খেলে এঁরা নিজেদের বাংলার তথা ভারতের আত্মসম্মানের প্রতীক করে তুলেছিলেন। উত্তরদিকের গোলপোস্টের ওপর বসেছিলেন ইস্ট পুটিয়ারীর অরুণ সোম, চিত্ত দাশগুপ্ত, রণেন গুহ এবং আরও অনেক বিখ্যাত খেলোয়াড়। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, দক্ষিণদিকের গোলপোস্টের ওপর বসেছিলেন বিংশ শতাব্দীর গোড়োর দিকের বেশ কিছু মিলিটারি টিমের নামজাদা খেলোয়াড়, যথা প্ল্যাংকটন, ডোডো, রকি প্রভৃতি।

খেলা প্রথম থেকেই খুব জমে ওঠে। পাঁচ মিনিটের মাথায় কালীগঞ্জ অগ্রগামীর ইতালিয়ান স্ট্রাইকার আন্তেগিয়েও আনিনি মাঝমাঠ থেকে একক প্রচেষ্টায় বল টেনে নিয়ে গিয়ে গোলে যে প্রচণ্ড শটটি করেন, সেটি ইস্ট পুটিয়ারীর সাউথ কোরিয়ান গোলরক্ষক কিম নো ভ্যাক অনেক কষ্টে আটকান। এর তিন মিনিটের মধ্যেই ইস্ট পুটিয়ারীর নাইজেরিয় ফরোয়ার্ড কিমা তর্কারি এবং কালীগঞ্জ অগ্রগামীর ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডার জোসে মারিও-র মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। ফলে দু-জনকেই কিছুক্ষণের জন্য মাঠের বাইরে যেতে হয়। রেফারি প্রশান্ত ভদ্র ইস্ট পুটিয়ারীর পক্ষে ফ্রি-কিক দিলে দর্শকদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাধতে থাকে। ফ্রি-কিক নিতে যাচ্ছিলেন ইস্ট পুটিয়ারীর ইউক্রেনীয় রাইট ফুলব্যাক কিকরিস্কি। এই সময় হঠাৎ দেখা গেল, উত্তরের গোলপোস্ট থেকে অরুণ সোম হুপ করে নেমে এসে কিকরিস্কির ঘাড়ে চড়ে বসলেন। তখন দক্ষিণের গোলপোস্ট আর পূর্বদিকের পাঁচিল থেকে সমস্বরে শেম-শেম আওয়াজ উঠল। তাতে লাভ কিছু হল না। কিকরিস্কির ফ্রি-কিক কামানের গোলার মতো প্রচণ্ডবেগে বিপক্ষের গোলে ঢুকে গেল।

এবার গোলমাল বাড়তে শুরু করল। কুড়ি মিনিটের মাথায় গোলপোস্ট থেকে লাফ দিয়ে এসে ডোডো কালীগঞ্জের জাপানি স্টপার টাকামাটি মাটিটাকার ঘাড়ে চড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে অবিশ্বাস্য ক্ষীপ্রতায় বিপক্ষের সমস্ত বাধা লঙ্ঘন করে তিনি গোলে বল ঢুকিয়ে দিলেন। তারপরেই কিকরিস্কি আর টাকামাটির মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়ে গেল। তাই দেখে যত প্রাক্তন খেলোয়াড়দের প্রেতাত্মা দু-দলের প্লেয়ারদের ঘাড়ে চড়ে প্রচণ্ড মারামারি শুরু করে দিলেন। এরপরই গ্যালারির তলা থেকে উভয়দলের মৃত সমর্থকরা বেরিয়ে এসে দর্শকদের কাঁধে বসে মাঠে নেমে পড়লেন। মাঠের মধ্যে ভূতের নৃত্য শুরু হয়ে গেল। রেফারি ভদ্র খেলা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলেন।

তাতে কিন্তু মারামারি বন্ধ হল না। নিরুপায় হয়ে রেফারি ভদ্র হাতজোড় করে সকলকে শান্ত হবার জন্য অনুরোধ করতে গেলেন। তৎক্ষণাৎ উভয়পক্ষই পরস্পর বিদ্বেষ ভুলে তাঁকে ধরে আপাদমস্তক পেটাতে শুরু করল। ফলে গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে ভরতি হতে হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *