স্বভাব

স্বভাব

ব্যানার্জীহাটের নবগোপাল সামন্ত হাড়কিপটে লোক। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, অথচ কখনো একটা পয়সা উবুড়হস্ত করেন না। মহেশডাঙায় তিনপুরুষের কাপড়ের দোকান, নুঙ্গী বাজারে ফুলের দোকান, বাঁশতলার মোটর সারাই-এর গ্যারেজ অথচ এমনভাবে থাকেন যেন দিন চলে না। ছেঁড়া জামাকাপড়, তিন দিন অন্তর দাড়ি কামান, পায়ে সেফটিপিন দিয়ে আটকানো হাওয়াই চপ্পল। বাড়িতে কোনো আত্মীয়স্বজন আসে না, পুজোপার্বণের তো বালাই-ই নেই। স্ত্রী মারা গেছেন অনেক দিন। একমাত্র ছেলে সুনীলকে নিয়ে বিরাট পোড়ো বাড়িটাতে ভূতের মতো থাকেন।

সুনীল অবশ্য ভালো ছেলে। মুখুজ্জেদের অবৈতনিক স্কুলে ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়ে প্রাইভেটে মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করেছে। তার নাকি ডাক্তার হবার ইচ্ছে ছিল। তা আর হওয়া যায়নি। সে-এখন বাঁশতলার গ্যারেজটা দেখাশোনা করে।

স্বভাবতই, নবগোপালের সঙ্গে পাড়ার ছেলেদের সম্পর্ক ভালো নয়। দুর্গাপুজো, কালীপুজো তো দূরস্থান, পুকুরসংস্কার বা দরিদ্রনারায়ণ সেবার মতো সৎকাজেও অনেক চেষ্টা করেও তাঁর কাছ থেকে একটা আধলাও চাঁদা আদায় করতে পারেনি ছেলেরা। ‘উদয়ের পথে’ ক্লাবের সেক্রেটারি উজ্জ্বল হাজরার জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেবার যতই ক্ষমতা থাক, নবগোপাল সামন্তকে সে একচুলও টলাতে পারেনি। অনুরোধ, উপরোধ, ভয় দেখানো, আপনি-কি-মানুষ-না-অন্যকিছু জাতীয় গালমন্দ— কোনো কিছুতেই কোনো ফল হয়নি। এর বেশি কিছু করাও যায় না। শত হলেও নবগোপাল সুনীলের বাবা। সুনীল তো শুধু বন্ধু নয়, ‘উদয়ের পথে’ অ্যাথলেটিক ক্লাবের গোলকিপারও বটে।

সুতরাং, নবগোপাল সামন্তের সঙ্গে ‘উদয়ের পথে’ ক্লাবের, বিশেষত উজ্জ্বলের একটা অঘোষিত যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। মারামারি নয়, অন্যরকম লড়াই। শত্রুকে আঘাত করাই আসল উদ্দেশ্য।

ব্যাপারটা হল, নবগোপাল তাঁর বাড়ির পেছনে প্রায় পাঁচ বিঘে পরিমাণ জমিতে ফুলের চাষ করেন আর সেই ফুল যায় তাঁর নুঙ্গী বাজারের দোকানে। যেখানে পাঁচটা মালি রাখার কথা সেখানে রেখেছেন একজন। বাকি কাজ নিজেই করেন। শীত নেই, গ্রীষ্ম নেই, সারাবছর খালি গায়ে আধময়লা ধুতি হাঁটুর ওপর তুলে বাগানের পরিচর্যা করে যান। সেটা করেন, ফুল ভালোবাসেন বলে নয়, পয়সা রোজগারের জন্য। হাড় বের করা শরীর যে রোদে পুড়ে, জলে ভিজে, কাঠকয়লার মতো হয়ে গেছে, সে দিকে খেয়াল নেই।

অদ্ভুত প্রতিভা নবগোপালের। প্রত্যেকটি ফুল তাঁর হিসাবের মধ্যে থাকে। পাশের বাড়ির হাঁদুর ঠাকুমা খুনখুনে বুড়ি। রোজ সকালে গঙ্গাস্নান করতে যান। ফেরার পথে যদি একটা ফুলও তোলেন তো নবগোপাল চিৎকার শুরু করে দেন। হাঁদুর ঠাকুমাও ছেড়ে কথা কইবার লোক নন। ফলে ঝগড়ার চোটে পাড়ায় সেদিন আর কাকচিল বসতে পারে না।

এই বাগানই উজ্জ্বল রণক্ষেত্র রূপে বেছে নিল।

কালীপুজোর তিন-চার দিন পর অ্যাকশন শুরু হল। কাকভোরে উঠে পাশের বাড়ির চন্দনকে সঙ্গে নিয়ে উজ্জ্বল সামন্ত বাড়ির বাগানে গিয়ে একটা লাল আর একটা ড্যাফোডিল জবাগাছ প্রায় সাফ করে দিয়ে চলে এল। সেদিন সন্ধে বেলা ক্লাবঘরে সেই ফুল সাজিয়ে একটা ছোটোখাটো বিজয়-উৎসব পালিত হল। সদস্যরা সকলেই একমত হল যে এটা চুরি বা ডাকাতি নয়, এ হল বকেয়া চাঁদা আদায়।

তার আগে অবশ্য পাড়ার লোকেরা সারাসকাল ধরে নবগোপালের একতরফা চিৎকার শুনে গেছে। পাড়ার হেন লোক নেই যাকে ভদ্রলোক সন্দেহ করে গাল পাড়েননি। বাড়ির সামনে ভিড় জমে গিয়েছিল। তবে, জনতা মোটেই উত্তেজিত হয়নি, উলটে ব্যাপারটা সবাই বেশ উপভোগ করছে বলেই মনে হচ্ছিল। অন্তত তাদের দন্তবিকশিত সে রকমই ইঙ্গিত দিচ্ছিল।

বিজয়-উৎসবের পর সুনীল উজ্জ্বলকে বলল, ‘যা করেছিস, করেছিস। এরপর সাবধানে থাকবি।’

উজ্জ্বল বলল, ‘কেন? তোর বাবা কি দরওয়ান বসাবেন নাকি?’

‘ক্ষেপেছিস? দরওয়ানকে মাইনে দিতে হবে না?’

‘তবে কি কুকুর পুষবেন?’

‘নাঃ। কুকুরকে খেতে দিতে হবে। ওসব নয়। বাবা বাগানের পাশে দক্ষিণের ঘরটায় বিছানা সরিয়ে নিয়ে গেছে। ঠাকুরদার আলমারি থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আমলের একটা বন্দুক বেরিয়েছে। কিছু কার্তুজও রয়েছে দেখলুম। সেগুলো চলবে কি না জানি না, তবে সাবধানের মার নেই। আর আমি জানি, বাবার ঘুম অসম্ভব পাতলা। তাই বলছি, যা করবি, ভেবেচিন্তে করবি।’

সুনীলের কথা শুনে চন্দন পেছিয়ে গেল। দুষ্টুমি করতে তার আপত্তি নেই কিন্তু গুলি খেতে সে একেবারেই রাজী নয়। উজ্জ্বল কিন্তু পেছোল না। তার কেমন যেন একটা রোখ চেপে গিয়েছিল। চাপারই কথা। নবগোপাল তাকে যে সব কথা বলেছেন তাতে নিজেকে শান্ত রাখতে তাকে যথেষ্ট কষ্ট করতে হয়েছে। নেহাত সুনীলের বাবা তাই। অন্য কেউ উজ্জ্বলকে গুণ্ডা, সমাজবিরোধী, অশিক্ষিত বাঁদর ইত্যাদি বললে ওপর থেকে তাকে ছ-ইঞ্চি ছোটো হয়ে যেতে হত। কাজেই তার অভিযান অব্যাহত রইল।

দুঃখের বিষয়, উজ্জ্বলের বেশিরভাগ অভিযানই ব্যর্থ হতে লাগল। রাত্তির বারোটাই হোক আর সাড়ে তিনটেই হোক, সে বাগানে ঢুকলেই পেছনের বারান্দায় খুট করে আলো জ্বলে উঠত। শেষ রাতের ঘন কুয়াশার মধ্যেও নবগোপাল যে কী করে টের পেতেন যে বাগানে কেউ ঢুকছে সেটা একটা রহস্যময় ব্যাপার।

ডিসেম্বরের মাঝামাঝি প্রচণ্ড শীত পড়ল। সেদিন রাত আড়াইটে নাগাদ উজ্জ্বল একটা কালো র‌্যাপার মুড়ি দিয়ে নবগোপালের বাড়ির দিকে রওনা হল খিড়কির দরজা খুলে। ঝকঝকে তারাভরা অমাবস্যার আকাশ, গঙ্গার দিক থেকে তখন একটা কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। এই শীতে কি আর নবগোপাল বেরুবেন? মনে হয় না। উজ্জ্বলের মনে হল, আজ তার অভিযান সফল হবেই।

সমস্ত বাড়ির পেছনের পাঁচিলের একটা ভাঙা অংশ টপকিয়ে বাগানে ঢুকল উজ্জ্বল। ওর একপাশে ন্যাসটারশিয়াম আর অন্যপাশে গাঁদাফুলের বেড। তবে, এগুলো নয়, ওর আসল লক্ষ্য গোলাপ বাগানটা। দুপুর বেলা দেখে গেছে যে বাগান ফুলে ভরে রয়েছে।

চুপিসাড়ে অনেকটাই এগিয়ে গেল উজ্জ্বল। গোলাপ বাগানটা যখন আর মাত্র কয়েক হাতের মধ্যে, হঠাৎ ওর পা লেগে একটা কালো লোহার বালতি সশব্দে পড়ে গেল। নিস্তব্ধ রাত্রে সেই সামান্য আওয়াজটাই বোমা ফাটার শব্দ বলে মনে হল।

সঙ্গেসঙ্গে বারান্দার আলোটা জ্বলে উঠল। উজ্জ্বল দেখল সাদা শাল মুড়ি দেওয়া নবগোপাল তারই দিকে বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। উজ্জ্বল তৎক্ষণাৎ র‌্যাপারে মুখ-মাথা ঢেকে পেছন ফিরে দৌড় মারতে যাচ্ছিল, তার আগেই নবগোপাল তাঁর স্বভাবসিদ্ধ খনখনে গলায় বললেন, ‘দাঁড়াও উজ্জ্বল! একটুও নড়বে না। পালাবার চেষ্টা করলেই গুলি চালাব।’

নিরুপায় উজ্জ্বল স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। বারান্দা থেকে বেশ একটা গর্বিত ভঙ্গিতে নেমে এলেন নবগোপাল। উজ্জ্বলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘র‌্যাপারে মুখ ঢেকে কোনো লাভ নেই উজ্জ্বল। আমি জানি এসব হল গে তোমার কীর্তি। তুমি জানো, আমি তোমাকে এখনই গুলি করে মারতে পারি? আর সে জন্যে পুলিশ আমাকে কিচ্ছু বলবে না।’

উজ্জ্বল দেখল যে বাঁচার একমাত্র উপায় হল নবগোপালের হাত থেকে বন্দুকটা কেড়ে নেওয়া। সে স্বাস্থ্যবান ছেলে, স্কুলের ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন। তার পক্ষে হাড়-জিরজিরে নবগোপালকে কাবু করাটা কঠিন হবে না। কিন্তু তার আগে তাঁকে অন্যমনস্ক করে ফেলতে হবে। নইলে, বিপদের সমূহ সম্ভাবনা। সে জন্য একটু সময়ের দরকার।

কাজেই, উজ্জ্বল বলল, ‘আপনার ওই মান্ধাতার আমলের বন্দুক দিয়ে কি গুলি বোরোয় মেসোমশাই? চেষ্টা করে দেখেছেন কখনো?’

নবগোপাল দাঁত বের করে হাসলেন। বললেন, ‘এটা হল উইনচেস্টার রাইফেল, বুঝেছ? এটা খারাপ হবার জিনিস নয়। আর তুমি যে ভাবছ আমাকে চটিয়ে দিয়ে অন্যমনস্ক করে ফেলে আমার হাত থেকে এটা কেড়ে নেবে, সে আশার গুড়ে বালি। তবে, তোমাকে গুলি করে মারলে আমার একটা কার্তুজের বাজে খরচ হবে, এটাই যা চিন্তা।’

প্রবলবেগে মাথা নেড়ে উজ্জ্বল বলল, ‘ঠিক কথা! একটা কার্তুজের কি দাম কম?’

‘সে কথা তোমাকে ভাবতে হবে না হে, ছোকরা! সমস্যা হচ্ছে, তোমাকে গুলি করে মারব, না জেলে দেব। তবে হ্যাঁ, একটা শর্তে আমি তোমাকে ছেড়ে দিতে পারি।’

উজ্জ্বল যথাসাধ্য বিনীত কণ্ঠে বলল, ‘কী শর্ত, মেসোমশাই?’

‘শর্তটা হল, কাল সকাল বেলা তুমি সুনীলের সঙ্গে দেখা করবে। কাল তার কিছু সাদা ফুলের দরকার। তাকে বলবে যে সেই ফুল যেন সে এই বাগান থেকে নেয়। তবে, বেশি নয়, অল্প করে। সে হয়তো রজনীগন্ধা চাইবে। সে ফুলটা এখানে নেই আর তার কোনো দরকারও নেই। তাকে বলবে যে আমি বলেছি একথা। বাজার থেকে যেন পয়সা খরচা করে না-কেনে।’

‘একথা তো আপনিই তাকে বলতে পারেন, মেসোমশাই!’

‘না, একটা বিশেষ কারণে আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তুমি বলতে পারবে কি না তাই বলো।’

‘নিশ্চয়ই বলতে পারব। এ আর এমন বেশি কথা কী?’

‘ঠিক আছে। তবে যাও। কথাটা ভুলো না কিন্তু। আর মনে রেখো, ফের যদি কোনোদিন এই বাগানে পা রেখেছ, তো তোমার কপালে অনেক দুঃখ আছে।’

‘মনে থাকবে, মেসোমশাই।’ বলে উজ্জ্বল এক দৌড়ে ভাঙা পাঁচিলের দিকে চলে গেল।

পরদিন সকাল বেলা উজ্জ্বল সামন্ত বাড়িতে গিয়ে দেখে বাড়ির সামনে কিছু লোকের জটলা। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ভেতর থেকে সুনীল বেরিয়ে এল। তার মাথার চুল উসকোখুশকো, চোখের দৃষ্টি উদভ্রান্ত।

উজ্জ্বলকে দেখে এগিয়ে এসে বলল, ‘কাল মাঝরাতে বাবা মারা গেছেন। আমি ঘুমিয়েছিলাম। টের পাইনি। আজ সকালে জানতে পেরেছি।’

শুনে আঁ আঁ করতে করতে উজ্জ্বল অজ্ঞান হয়ে ধপাস করে রাস্তার ওপর পড়ে গেল।

সব শুনে হাঁদুর ঠাকুমা বললেন, ‘এ আর এমন বেশি কথা কী? আমাদের শাস্তরে তো কবেই বলে গেছে যে স্বভাব যায় না মলে আর ইল্লুত যায় না ধুলে। সে কথা তো আর মিথ্যে হতে পারে না!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *