প্রভাময়ীর প্রত্যুপকার

প্রভাময়ীর প্রত্যুপকার

ট্যাক্সি থেকে অরিজিতের হাত ধরে নামতে নামতে প্রভাময়ী বললেন, ‘জায়গাটা কী নির্জন! চারদিকে বাড়িঘর নেই নাকি রে? কোনো লোকজনের আওয়াজ পাইনে কেন?’

অরিজিৎ ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘বাড়িঘর আছে মা। শোনো তোমাকে বলি। এই আমরা এখন আট নম্বর জয়চন্দ্র গার্ডেন লেনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। বাড়িটা পুবমুখো। উত্তর আর পশ্চিম দিক ঘিরে রয়েছে নববিদ্যাবীথি হাই স্কুলের প্রকাণ্ড বাড়ি আর খেলার মাঠের পাঁচিল। এখন বাজে পাঁচটা, ইশকুল ছুটি হয়ে গেছে। কাল সকাল হলে শুনতে পাবে একটা বিশাল মৌচাকের ভনভন শব্দের মতো ছেলেমেয়েদের কলরব। দক্ষিণ দিকে মহারাজা নবীনকিশোর রায়চৌধুরির বাড়ির বিশাল উঁচু পাঁচিল, গলিটা শেষ হয়েছে তার গায়ে। ও বাড়ির এখন ভগ্নদশা, কেউই প্রায় থাকে না। আর পুব দিকে গলির ওপারে রাজা বিজয়কৃষ্ণ সিংহের বাড়ির পেছন দিক। ও বাড়িটা এখন সরকারি অফিস, বিকেল হলেই শুনশান।’

প্রভাময়ী বললেন, ‘এ কোন পাড়ায় বাড়ি নিলি রে, খোকা? চারদিকে যে রাজা-মহারাজাদের বাড়ি।’

অরিজিৎ হাসল। বলল, ‘যা বলেছ। একটা সময় ছিল ঠিকই যখন এ পাড়ায় ঢুকতে গেলে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত লোকের হাঁটু বেঁকে যেত। আজ আর সেদিন নেই মা। আজ যেখানে নববিদ্যাবীথি হাই স্কুল, সেটা ছিল রাজা জয়চন্দ্র রায়ের বাগানবাড়ি। আর আমাদের বাড়িটা ছিল সেই বাগানবাড়ির কেয়ারটেকার আশুতোষ ধরের কোয়ার্টার। বংশানুক্রমে ধরেরা এই কাজ করেছেন এই বাড়িতে থেকে। রাজা জয়চন্দ্রের বর্তমান বংশধর যখন অর্থাভাবে তাঁর বাগানবাড়ি বিদ্যাবীথি এডুকেশন ট্রাস্টকে বিক্রি করেন তখন জমিসমেত এই বাড়িটা লিখে দেন হরিপদবাবুকে। হরিপদবাবু আশুতোষ ধরের বংশধর। তাঁরও এখন খুবই দুরবস্থা। তিনি আমাকে সম্পত্তিটা বিক্রি করে দিলেন।’

প্রভাময়ী বললেন, ‘বুঝলুম। এবার বাড়িটার কথা বল।’

খড়খড় করে একটা লোহার গেট খুলে অরিজিৎ বলল, ‘বাড়ির সামনেও এক মানুষ সমান উঁচু পাঁচিল, পুব-উত্তর কোণে এই লোহার গেট খুলে আমরা ভেতরে ঢুকছি। বাড়ির সামনে একটা ছোট্ট ঘাসের জমি আছে। বাড়িটা একতলা, তবে মেঝেটা রাস্তা থেকে বেশ ওপরে। মনে রেখো, দশটা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে হবে। সামনে টানা বারান্দা। তার একপাশে তিনটে খিলেন-করা থাম আর অন্যপাশে দুটো শোবার ঘর, একটা রান্নাঘর, একটা ভাঁড়ার ঘর, একটা বাথরুম আর একটা ছোটো পুজোর ঘর। আমাদের পক্ষে এই যথেষ্ট, না কি বলো মা? তার ওপর, বারান্দার সামনের দিকে আগাগোড়া চারটে কোলাপসিবল গেট লাগানো আছে। জানলায় লোহার গ্রিল, দেওয়ালগুলো পঁচিশ থেকে তিরিশ ইঞ্চি চওড়া। গেটগুলো বন্ধ থাকলে কারুর সাধ্যি নেই যে বাড়ির ভেতরে ঢোকে।’

প্রভাময়ী লাঠিতে ভর দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে উঠতে বললেন, ‘এ তো চমৎকার! এমন একটা বাড়ি তুই এত সস্তায় পেলি— এ তো ভাবাই যায় না।’

‘সবই তোমার আশীর্বাদ, মা।’ অরিজিৎ বলল, ‘তার ওপর আরও দ্যাখো, হরিপদবাবু এমন একজন সজ্জন লোক যে বাড়িটা সারিয়ে-সুরিয়ে রংটং পর্যন্ত করে দিয়েছেন। আমার আর এখন কোনো খরচা করবার দরকার নেই।’

প্রভাময়ী পুত্রবধূ সুনন্দার এগিয়ে দেওয়া একটা মোড়ার ওপর বসে বললেন, ‘আমার কিন্তু কোথায় যেন একটা খটকা লাগছে, জানিস! তুই দলিলপত্র সব ভালো করে দেখে নিয়েছিস তো খোকা? কোথাও কোনো গোলমাল নেই তো?’

প্রভাময়ীর প্রশ্নটা শুনে চমকে উঠেছিল অরিজিৎ। সামলে নিয়ে বলল, ‘সব ভালো করে দেখে নিয়েছি মা। তোমার খটকা লাগার কোনো কারণ নেই।’

‘তবুও লাগছে। আসলে কী জানিস, আমাদের মতো লোকের কপালে এরকম শিকে ছেঁড়বার তো কথা নয়। সারাজীবন তো শুধু বঞ্চনাই পেয়ে এলুম।’

‘সেসব কথা ভুলে যাও, মা। এত কষ্ট করে আমাদের লেখাপড়া শিখিয়েছ সে তো এরকম একটা দিনের আশায়, তাই না? এখন সেদিন আসবার সময় হয়েছে। পুরোনো দিনের কথা আর ভেবো না তো।’

মাথা নাড়লেন প্রভময়ী। বললেন, ‘না, আর ভাববো না। শোন, একটা গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠান করবি না? একটা পুজো বা ওইরকম?’

‘এখনই না, মা। দিদি-জামাইবাবু বলেছে, পুজোর সময় ওরা যখন আসবে, তখন গৃহপ্রবেশের ব্যবস্থা করতে। তা ছাড়া, টাকাপয়সাও তেমন নেই। প্রথম কিস্তির টাকা দিতেই ফতুর হয়ে গেছি। এরপর লোনের টাকা যখন কাটতে শুরু করবে তখন আর বড়ো রকমের কোনো অনুষ্ঠান করবার মতো অবস্থা থাকবে না।’

‘সে আমি জানি। ঠিক আছে, এসব ব্যাপার পরে করলেও হবে।’

মাকে সারা বাড়ি ঘুরিয়ে, তাঁকে তাঁর ঘরে রেখে, চারটে কোলাপসিবল গেট বন্ধ করে, রান্নাঘরে এসে বসল অরিজিৎ। সুনন্দাকে বলল, ‘মার বাড়িটা খুব পছন্দ হয়েছে। সারাজীবন কষ্ট করেছে, বাড়িওলি মাসির মুখঝামটা সহ্য করেছে, এবার অন্তত সেই অত্যাচার থেকে মুক্তি। দুঃখ করছিল যে বাবা দেখে যেতে পারল না। সে দুঃখ যে আমারও নেই তা নয়। তবে, আমি বিশ্বাস করি যে ওপর থেকে নিশ্চয়ই তাঁর আশীর্বাদ পেয়েছি, নইলে আজ যে আমি নিজের বাড়িতে বসে আছি সেটা কখনোই সম্ভব হত না।’

সুনন্দা হাঁড়িকুড়ি গোছাতে গোছাতে বলল, ‘একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করব?’

‘কী প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে?’

‘মা যখন বললেন যে তাঁর কোথাও একটা খটকা লাগছে, তখন তুমি ভয়ানক চমকে উঠলে কেন? কোথাও একটা গোলমাল আছে, তাই না?’

কাষ্ঠহেসে অরিজিৎ বলল, ‘আরে না, না। গোলমাল আবার কী? গোলমাল কিছু নেই। আসলে, আমার ভয় হয়েছিল যে মার বোধ হয় বাড়িটা পছন্দ হল না। কপালজোরে পেয়ে গেছি, মার পছন্দ না-হলে তো আবার নতুন বাড়ির খোঁজে বেরুতে হবে।’

কথাটা কিন্তু সত্যি নয়। প্রভাময়ী সারাজীবন দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে করতে আজ একেবারে ভগ্নস্বাস্থ্য, অকালবার্ধক্যে নুয়ে পড়েছেন। গত তিন বছর যাবৎ অতিরিক্ত ডায়াবেটিসে সম্পূর্ণ অন্ধ, তবু তাঁর স্বাভাবিক তীক্ষ্নবুদ্ধির ধার একটুও কমেনি। বরং, দৃষ্টিশক্তি চলে যাবার পর তাঁর বাকি ইন্দ্রিয়গুলো যেন আরও বেশি সজাগ আর সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাঁর কথা শুনে অরিজিতের মনে হয়েছিল বাড়িটাতে যে সত্যিই কোনো গোলমাল আছে বলে ও শুনেছে, সেটা চেপে যাওয়া সত্ত্বেও প্রভাময়ী বোধ হয় ধরে ফেলেছেন।

আসলে গোলমাল তেমন কিছুই নয়। যত সব বাজে কুসংস্কার। হরিপদ ধরের ধারণা যে এই বাড়িটাতে ভূত আছে, এ-কথা সবাই জানে আর সেইজন্যেই তাঁর বাড়ির কোনো খরিদ্দার জুটছে না। বাড়িটা জলের দরে বেচে দেবার কারণটা হল এই। একথা অরিজিৎকে বলতেও দ্বিধা করেননি হরিপদবাবু। ভদ্রলোক সরল প্রকৃতির মানুষ, হয়তো নিজেকে ভবিষ্যৎ বিবেকদংশনের হাত থেকেও মুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন। তবে একথা তিনি ভেবে দেখেননি যে উত্তর কলকাতার একটেরে, একটা কানাগলির শেষপ্রান্তে, পাঁচকাঠা জমির ওপরে একটা দেড়শো বছরের পুরোনো বাড়ি কিনতে বিশেষ কারুর দায় পড়েনি। তা ছাড়া, এসব কথা লোক ডেকে বলাও তো যায় না। না-কিনলে সবাই বলবে, ‘তুই একটা গাধা’, কিনলে বলবে, ‘জেনেশুনে এই কাণ্ডটা করলি?’

সুনন্দ অরিজিতের মুখের দিকে চেয়েছিল। বলল, ‘কী ভাবছ?’

অরিজিৎ বলল, ‘ভাবছি যে আজ সারাদিন তোমার খুব ধকল গেছে, এখন এক কাপ চা চাওয়াটা খুব অন্যায় হবে কি?’

‘না। কিছুমাত্র না। আমি তো ভাবছিলুম, তুমি খেলে, আমিও এক কাপ খেতুম। মাকেও ডাকো না। তিনজনেই খাই।’

ডাকার দরকার হল না। প্রভাময়ী নিজেই লাঠি ঠকঠক করতে করতে রান্নাঘরে এসে উপস্থিত হলেন। তাঁর মুখ গম্ভীর, কী যেন চিন্তা করছেন।

সুনন্দা একটু উদবিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করল, ‘কী হয়েছে মা? শরীর খারাপ লাগছে?’

প্রভাময়ী মাথা নাড়লেন। বললেন, ‘কই, না তো। আমার শরীর বেশ ভালোই আছে।’ তারপর, একটু থেমে বললেন, ‘আচ্ছা বউমা, তুমি কি একটু আগে আমার ঘরে গিয়েছিলে?’

‘না তো।’

‘সে তো বটেই। তুমি কী করে হবে? তুমি তো গয়না পরো না।’

অরিজিৎ বলল, ‘কী বলছ বলো তো? গয়না-টয়না আবার কী? ওর কি আছে নাকি কিছু যে পরবে?’

প্রভাময়ী পুনর্বার মাথা নাড়লেন। বললেন, ‘তাইতো ভাবছি। মনে হল কে যেন ঘরের ভেতর ঢুকল, তার চুড়ি-বালার টুংটাং শব্দ পেলুম।’

সশব্দে হেসে উঠল অরিজিৎ। বলল, ‘এই ভর সন্ধে বেলা ভূতের ভয় পেলে নাকি মা? ওই শোনো, পাঁচিলের ওপাশে টিউবওয়েলের জল তোলার শব্দ। নিশ্চয়ই ইশকুলের দরওয়ানের বউ চুড়ি-বালা ঠংঠঙিয়ে জল আনতে এসেছে। তুমি তারই আওয়াজ পেয়েছ। এটা নতুন জায়গা, চারদিক ফাঁকা, নিস্তব্ধ। খুব ছোটো ছোটো শব্দও প্রতিধ্বনি হয়ে কানে আসবে। তাতে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।’

প্রভাময়ী বললেন, ‘দ্যাখ খোকা, আমার ছোলেবেলাটা কেটেছে গাঁয়ে। সেখানে সন্ধ্যে হলেই ঘন অন্ধকার, তালগাছের ওপর একানড়ে, বেলগাছে বেম্মদত্যি, নদীর পাড়ে শাঁকচুন্নি, পুকুরপাড়ে পেত্নি— এদের মধ্যে বড়ো হয়েছি, তাই এদের আমি ভয় পাইনে। ভয় পাবি তোরা। তবে, মনে হচ্ছে তোর কথাই ঠিক। আমার ভুলই হয়েছিল।’

হাসতে হাসতে অরিজিৎ বলল, ‘ভয় আমারও নেই, মা। আমি একমাত্র ভয় পাই মানুষকে। বিশেষ করে যে মানুষকে চেনা যায় না। তবে চারটে কোলাপসিবল গেটই বন্ধ আছে, কোনো মানুষের সাধ্যি নেই যে ভেতরে ঢুকতে পারে। অবশ্য সুনন্দার কথা জানি না, ও হয়তো ভূতের ভয় পায়।’

সুনন্দ হাত নেড়ে বলল, ‘পাই, পাই। ভূত, পুলিশ, পাগল, মাতাল, সব্বাইকে ভয় পাই।’

অনেক রাত্রে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল প্রভাময়ীর। স্পষ্ট টের পেলেন ঘরের ভেতরে কেউ আছে। চারদিক একেবারে নিস্তব্ধ, মোটা কাপড়ের খসখস শব্দ শুনতে পেলেন পরিষ্কার। খোলা জানলার পাশে একটা চেয়ারে বসে আছে সে। তবে তার কোনোরকম বদ মতলব আছে বলে মনে হল না প্রভাময়ীর। শুয়ে শুয়েই প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কে?’ কোনো সাড়া পেলেন না। আবার প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কথা বলতে পারো না?’ তারও কোনো সাড়া পেলেন না। এবার কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ‘তুমি কি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাও? যদি এর উত্তর হ্যাঁ হয়, তবে দরজাটার পাশে গিয়ে দাঁড়াও।’ এবার খসখস শব্দটা চেয়ার থেকে সরে দরজার কাছে চলে গেল।

চমৎকার! প্রভাময়ী বলেন, ‘বাঃ! তাহলে, এখন তো আমরা আলাপ করতে পারি। আমি তোমাকে প্রশ্ন করব, তার উত্তর হ্যাঁ হলে তুমি দরজার কাছে যাবে আর না-হলে চেয়ারে বসে থাকবে। তোমার হয়তো তাতে একটু কষ্ট হবে, তবে কথা তো বলা যাবে। এ ছাড়া আর উপাই বা কী!’ পরে অবশ্য তাঁর মনে হল, যার শরীর নেই তার শারীরিক কষ্ট হবার তো কথা নয়।

এইভাবে একতরফা প্রশ্ন আর হ্যাঁ-না উত্তরের মধ্য দিয়ে আলাপচারি শুরু হল। ভোরের প্রথম কাক ডাকার সঙ্গেসঙ্গে শব্দটা বন্ধ হওযার আগে পর্যন্ত অনেক সংবাদ সংগ্রহ করলেন প্রভাময়ী। ঘরের ভেতরে যিনি আছেন, তিনি একজন মহিলা। বহুবছর ধরে আছেন এই বাড়িতে। চলে যেতে চান, কিন্তু যেতে পারছেন না। তাঁকে আর তাঁর স্বামীকে গুলি করে মেরেছিল তাঁরই কোনো আত্মীয়। মারা যাওয়ার সময় তাঁর বয়স ছিল তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশের ভেতর। সবচেয়ে বড়ো কথা হল, প্রভাময়ীকে তাঁর ভালো লেগেছে কারণ তিনি জানেন যে প্রভাময়ী ভয় পাবেন না এবং তাঁর সঙ্গে কথা বলা যাবে। অনেক কথাই বলবার আছে তাঁর, কিন্তু যার সঙ্গেই কথা বলতে যান, সেই ভয় পায়।

এবার প্রভাময়ীর সামনে দুটো সমস্যা। ব্যাপারটা অরিজিৎকে বলা উচিত কি উচিত নয়? অনেক ভেবে, না বলাই স্থির করলেন প্রভাময়ী। বেচারি অনেক কষ্টে অনেক আশা নিয়ে বাড়িটা কিনেছে। এই ঘটনার কথা জানলে সে ভেঙে পড়তে পারে। এই মহিলার যখন কাউকে ভয় দেখানোর বা কারুর ক্ষতি করার কোনো বাসনা নেই, তখন আর অরিজিৎকে মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলার কী দরকার?

দিন দশেক বাদে, সকাল বেলায় সুনন্দা অরিজিৎকে বলল, ‘জানো, মার কিছু একটা হয়েছে। তুমি তো সারারাত মোষের মতো ঘুমোও, কিছুই টের পাও না। মাঝে মাঝে যখন অনেক রাতে ঘুম ভেঙে যায়, আমি শুনেছি মা বিড়বিড় করে কথা বলছেন। এরকম তো আগে কখনো শুনিনি। তা ছাড়া, আজকাল যে মা পুজো করেন, দেখছি ধূপ জ্বালেন না, জোরে জোরে মন্ত্র পড়েন না। কী ব্যাপার, বুঝতে পারছি না।’

অরিজিৎ চিন্তিত হয়ে বলল, ‘দ্যাখো, ধূপ না-জ্বালানো বা জোরে জোরে মন্ত্র না-পড়াটা কোনো ব্যাপার নয়। মা যেভাবে ইচ্ছে সেভাবেই পুজো করবে। কিন্তু মাঝরাতে আপন মনে বিড়বিড় করাটা তো ভালো কথা নয়। দাঁড়াও, এখনই মাকে জিজ্ঞেস করছি।’

প্রভাময়ী বারান্দায় মোড়ায় বসে চা খাচ্ছিলেন। অরিজিৎ গিয়ে তাঁর পাশে বসে পড়ল। বলল, ‘মা, শুনছি তুমি নাকি আজকাল রাতবিরেতে আপনমনে বিড়বিড় করে কথা বলো। ব্যাপার কী? তোমার কি ঘুম হচ্ছে না? প্রেশার বাড়ল নাকি?’

প্রভাময়ী হেসে উঠলেন। বললেন, ‘দূর। প্রেশার-ট্রেশার কিছু নয়। দ্যাখ খোকা, পঁয়ত্রিশ বছর কাটালুম যেন একটা বাজারের মধ্যে। দিনরাত হইচই, ট্রামবাসের আওয়াজ, অন্য ভাড়াটেদের চ্যাঁচামেচি, ঝগড়াঝাঁটি, বাচ্চাদের চিৎকার, এতেই তো অভ্যস্ত ছিলুম। তোর এই বাড়িটা এত নিস্তব্ধ যে সত্যি সত্যি ঘুম আসতে চায় না, এলেও মাঝে মাঝে ভেঙে যায়। তখন আর কী করব, জোরে জোরে কৃষ্ণনাম করি। তাতে কি তোদের অসুবিধে হয়? তাহলে না-হয় না-ই করব।’

লজ্জা পেয়ে অরিজিৎ বলল, ‘তুমি কৃষ্ণনাম করবে আর তাতে আমাদের অসুবিধে হবে? কী যে তুমি বলো, তার ঠিক নেই!’

‘তবে যা, আর দেরি না-করে বাজারটা করে আন।’

অরিজিৎ বাজার থেকে ফিরল, সঙ্গে এক বছর পঞ্চাশেক বয়েসের ট্রাউজার্স আর সোয়েট-শার্ট পরিহিত বিরলকেশ লম্বা-চওড়া ভদ্রলোক। হাঁক দিয়ে বলল, ‘শুনছ, দ্যাখো কাকে নিয়ে এসেছি।’

আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল সুনন্দা। বলল, ‘আরে, এ যে বুড়োকাকা। আপনি কোত্থেকে? মা, ইনি আমার ছোটো পিসেমশায়ের ভাই, খুব নামকরা লোক। শ্রী পরিমল ঘোষ ওরফে চপলকুমার, থিয়েটারে নায়ক সাজেন।’

ইতিমধ্যে প্রভাময়ীও রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। পরিমল তাঁকে প্রণাম করে গাম্ভারি হাসি হেসে বললেন, ‘সাজেন নয়, বলো সাজতেন। আমি আজকাল আর অভিনয় করি না, আমি এখন প্রোডিউসার, মানে প্রযোজক। বেগম থিয়েটারে এখন আমার নাটক চলছে, নাম শুনেছ নিশ্চয়— ”উগ্র প্রেমের তীব্র জ্বালা”? পাবলিক খুব নিয়েছে।’

উগ্র প্রেমের তীব্র জ্বালা শুনে বাকি তিনজন কেমন যেন ভড়কে গেল। অরিজিৎ বলল, ‘সিনেমা-থিয়েটারের খোঁজ আমরা বড়ো একটা রাখি না, বুড়োকাকা। তৈল-তণ্ডুল-লবন-ইন্ধনের সন্ধানে সারাদিন কাটে, এসব ব্যাপারে আমাদের আদার ব্যাপারী হওয়া ছাড়া উপায় কী বলুন?’

বুড়োকাকা বললেন, ‘উপায় নেই, একথা আমি মানিনে। বুঝলে সুনন্দা, শখ করে যদি গরিব থাকতে চাও, তো সে আলাদা কথা। নইলে, কলকাতার অলিতে-গলিতে টাকা উড়ছে, কেবল তুলে নেওয়ার ওয়াস্তা। তবে হ্যাঁ, তার জন্যে চাই সাহস আর দূরদৃষ্টি। এই আমাকেই দ্যাখো না। বি এ, এম এ পাশ করিনি ঠিকই, অথচ আজ আমার লাখ লাখ টাকা খাটছে থিয়েটার প্রোডাকশনে। এরপর, আমি আর আমার পার্টনার সূরযলাল সিং তো সিনেমা প্রোডিউস করতে যাচ্ছি। গল্পও বাছা হয়ে গেছে, ভবেন সাউ-এর লেখা ”ক্যাবারের নটী কঙ্কাবতী”। আসলে কী জানো, সাহস করে হাত বাড়াতে হবে, দেখবে দু-হাত উপচে পড়ছে।’

উপচে পড়ার কথায় শ্রোতারা কেউই খুব উৎসাহিত হল বলে মনে হল না। সুনন্দা যেন কথাটা ঘোরাবার জন্য বলল, ‘ওর তো আপনাকে চেনবার কথা নয়, আপনিই বোধ হয় ওকে চিনেছেন, তাই না বুড়োকাকা? কী করে চিনলেন?’

‘হ্যাঁ, বাজারের মধ্যে আমিই ওকে চিনেছি। আরে, মানুষের মুখ নিয়েই যে আমার কারবার। যে মুখ আমি একবার দেখি তা কখনো ভুলি না।’

অরিজিৎ বলল, ‘এবার আমাকে উঠতে হবে, নইলে অফিসে দেরি হয়ে যাবে।’ সুনন্দাও উঠে পড়ল। তখন কিছুটা যেন মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে এবং অযাচিতভাবে আবার আসবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিলেন পরিমল ঘোষ।

সে রাত্রে প্রভাময়ীর নির্বাক সহবাসিনীর কাপড়ের খসখস শব্দ খুব উত্তেজিতভাবে ঘরের এক কোণ থেকে অন্য কোণে ঘুরে বেড়াল। হ্যাঁ আর না উত্তরের সাহায্যে প্রভাময়ী যা জানতে পারলেন তা হল, পরিমল ঘোষের মতলব মোটেই ভালো নয়। সে একটি অত্যন্ত অসৎ, মিথ্যেবাদী, জোচ্চর আর দুশ্চরিত্র লোক। তাকে এ বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া একেবারেই উচিত নয়।

এই কথাগুলো অবশ্যই বলবার অপেক্ষা রাখে না। পরিমল ঘোষ যে কী পদার্থ, তা বুঝতে প্রভাময়ীর একটুও অসুবিধে হয়নি। কিন্তু কী করা যেতে পারে? স্রেফ সন্দেহের ওপরে তো একজন আত্মীয়কে বাড়িতে ঢুকতে বাধা দেওয়া যায় না। তাতে সুনন্দার পরিবারে তার শ্বশুরবাড়ির বদনাম হয়ে যাবে। লোকে বলবে, দুটো পয়সা হয়েছে বলে অরিজিতের মাটিতে পা পড়ছে না। প্রভাময়ীর শ্বশুরবাড়িও অসন্তুষ্ট হতে পারে। আসলে অরিজিতের অবস্থা তো যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই আছে। সবাইকে চটিয়ে, বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানোর মতো সামর্থ্য বা মানসিকতা কোনোটাই ওর নেই। তা ছাড়া, পরিমল ঘোষ যথেষ্ট প্রভাবশালী লোক বলে মনে হল। ইচ্ছে করলে অরিজিতের চাকরির ক্ষতিও করতে পারেন। তবে তো ও পথে বসবে। অথচ, একটা কথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে পরিমল আঘাত করবেই, এবং ওর লক্ষ্য সুনন্দা। এই ব্যাপারটা নিয়ে সুনন্দার সঙ্গে যে কথা বলবেন তাও সম্ভব নয়। একে বুড়োকাকা তার আত্মীয়, তার ওপরে সে সরল সিধে মানুষ, হয়তো সে কিছু বুঝতেই পারেনি। তাকে এসব কথা বললে তার মানসিক অবস্থা কী দাঁড়াবে বলা কঠিন। এ অবস্থায় তাহলে কী করণীয়? কী করে সুনন্দা আর তার ছোট্ট সুখী সংসারটাকে বাঁচানো যায়? ক্ষমতাশালীর কদর্য লোভের হাত থেকে বাঁচাবার কি কোনো উপায় নেই?

‘তুমি কি আমাকে সাহায্য করতে পারবে?’ প্রশ্ন করলেন প্রভাময়ী।

উত্তর এল, ‘হ্যাঁ।’

এইবার বড়ো ভরসা পেলেন প্রভাময়ী। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাহলে কি পরিমল কোনো কুকর্ম করার চেষ্টা করা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করব?’

আবার উত্তর এল, হ্যাঁ।’

হঠাৎ কী মনে হওয়ায় প্রভাময়ী জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, এই যে তুমি আমাকে সাহায্য করবে বলছ, তার বদলে আমাকে কিছু দিতে হবে, তাই না?’

এবারেও উত্তর এল, ‘হ্যাঁ।’

‘তা তো বটেই। বিনা স্বার্থে কি কেউ কারও উপকার করে? দেবতারাই করেন না। বর যা দেন তা সুদে-আসলে আদায় করে নেন। কিন্তু আমি তোমাকে কী দিতে পারি? তোমার তো টাকাপয়সা বা গয়নাগাঁটির কোনো দরকার নেই। তোমার শ্রাদ্ধ করব তার উপায় নেই। তোমার নামধাম কিছুই জানিনে। তুমি আমার পরিবারের ইজ্জৎ বাঁচাবে, এত বড়ো উপকারের কী প্রতিদান দেব বলো তো?’

এই প্রশ্নের কোনো উত্তর এল না। আসতে পারেও না, কারণ এর জবাব তো হ্যাঁ বা না দিয়ে হয় না।

কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন প্রভাময়ী। হঠাৎ বিদ্যুতচমকের মতো প্রশ্নের উত্তরটা তাঁর মনে এসে গেল। সহাস্যে বললেন, ‘বুঝেছি তুমি কী চাও। তাই পাবে তুমি।’

পরিমল ঘোষ দু-দিন পরেই উদয় হলেন। সকাল বেলা তিনজনে বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিল, এইসময় পরিমল এসে একটা বড়ো গয়নার বাক্স দিলেন সুনন্দার হাতে। বললেন, ‘তোমার বিয়েতে দিতে পারিনি, লোকেশন শুটিং থেকে সোজা বিয়েবাড়িতে গিয়েছিলুম। একটু দেরি হল অবশ্য, তবু ভাবলুম, উপহারটা দিয়েই যাই। যাবার পথে বাজারটাও করে নিয়ে যাব।’

বাক্স খুলে চেঁচামেচি করে উঠল সুনন্দা। বলল, ‘ওমা, এ তো ভীষণ দামি গয়না! এ আপনি আমাকে দিলেন কেন? এই হার পরে কোথাও যেতে পারব আমি? তা ছাড়া, আমি তো গয়নাই পরি না।’

‘কেন পরো না? তোমার মতো সুন্দরীরা যদি গয়না না-পরে তো পরবে কে?’

‘আমি আবার সুন্দরী কোথায়? আমি তো কালো।’

‘গায়ের রঙে কী যায় আসে? সিনেমায় যেসব নায়িকাদের ধবধবে ফর্সা দেখো, তারা কেউই সেরকম নয়। তাদের ওইরকম বানানো হয়। তোমার যা ফিগার আর যাকে বলে ফেস-কাটিং, তাতে তুমি সেইসব অনেক নায়িকারই কান কেটে নিতে পারো।’

অরিজিৎ জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কোথায় থাকেন?’

পরিমল বললেন, ‘আমি থাকি কেয়াতলায়। জানো সুনন্দা ওখান থেকে টালিগঞ্জ কাছে হয় তো, তাই ওখানেই ফ্ল্যাট নিয়েছি।’

অরিজিৎ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কেয়াতলায়? বলেন কী? সে তো ঢাকুরিয়া লেকের কাছে! সেখান থেকে আপনি রোজ কাশীনাথ কোলের বাজারে আসেন বাজার করতে?’

একটু থতমত খেয়ে গেলেন পরিমল। তবে সামলাতে বেশি সময় লাগল না। বললেন, ‘আগে তো এ পাড়াতেই থাকতুম। ওটা অভ্যেসের ব্যাপার। বুঝলে সুনন্দা, বাঙালরা যেমন বলে— কোলের মাছ না-হইলে আবার আমি খাইতে পারি না।’ বলে নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে অস্থির হলেন।

অরিজিৎও হাসল বটে কিন্তু কথাটা যে তার কাছে যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য হয়েছে তা মোটেই মনে হল না।

সেদিন কথাবার্তা আর খুব একটা এগোল না। চটপট উঠে পড়লেন পরিমল। কিন্তু তাঁর আসা বন্ধ হল না। সপ্তাহে অন্তত একবার তাঁর পদধূলি পড়তেই থাকল। তিনি আসেন, কেবল সুনন্দার সঙ্গে কথা বলেন, অন্য কেউ কোনো প্রশ্ন করলে তার জবাব দেন সুনন্দাকে। আর তাঁর সব বক্তব্যেরই বিষয়বস্তু একটাই— টাকা। পৃথিবী টাকার বশ, এই তত্ত্বটি যে তিনি সার বুঝেছেন, এ বিষয়ে তাঁর শ্রোতাদের মনে কোনোরকম সন্দেহই থাকে না। সচ্ছলতায় তাঁর বিশ্বাস নেই। অতিরিক্ত মাত্রায় টাকা না-থাকলে যে জীবন বৃথা সে কথা সবাইকে বোঝাবার ক্ষান্তিহীন প্রয়াস চালিয়ে যান।

এর ওপর আছে উপহার। কোনো উপলক্ষ্য থাক বা না-থাক, সুনন্দার প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও মাঝে মাঝেই দামি শাড়ি বা গয়না নিয়ে এসে উপস্থিত হন। সুনন্দা চেঁচামেচি করে, রাগারাগি করে কিন্তু কোনো লাভ হয় না। একবার তো বলেই দিল যে, হাতে করে কিছু আনলে বুড়োকাকার আসার দরকার নেই। তাতে অবশ্য বুড়োকাকা কিঞ্চিৎ ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। তাঁর এত আছে, তার থেকে এই সামান্য কিছু জিনিস যদি তিনি তাঁর স্নেহের পাত্রীটিকে দেন, তাহলে অসুবিধে কী আছে। এরপর থেকে সুনন্দা আর প্রতিবাদ করত না। বুড়োকাকা মনে মনে অবশ্যই এর একটা নিজের পছন্দমতো ব্যাখ্যা করে নিয়েছিলেন।

নিয়েছিলেন যে, তার প্রমাণ পাওয়া গেল তাঁর ক্রমবর্ধমান সাহস দেখে। সুনন্দার গা ঘেঁষে বসতে শুরু করলেন, পিঠে হাত রাখাও আরম্ভ হল। আর তাঁর আসবার সময়টাও ক্রমশ পিছিয়ে সকাল থেকে দুপুরের দিকে যেতে লাগল, যাতে অরিজিৎ তখন অফিসে চলে যায়। সবই বুঝতে পারছিলেন প্রভাময়ী অথচ কিছুই করতে পারছিলেন না। সাঁতার না-জানা লোকের সামনে কুমির যখন তার প্রিয়জনকে জলের মধ্যে টেনে নিয়ে যায়, তখন তার যে-রকম মনের অবস্থা হয়, তেমনই অসহায় অবস্থা তখন তাঁর।

‘আমার তো মনে হচ্ছে পরিমল যা করবার দিনের বেলাতেই করবে। সে সময় তুমি কিছু করতে পারবে তো?’

উত্তর এল, ‘হ্যাঁ।’

‘আমি কি কিছু না-করে এখন চুপ করেই থাকব?’

পুনরায়, ‘হ্যাঁ।’

বেড়াল এবার আস্তে আস্তে থলির ভেতর থেকে বের হতে শুরু করল। কিছুদিন বাদে পরিমল বললেন, ‘সুনন্দা, আমি দেখছি যে তুমি চব্বিশ ঘণ্টা রান্নাঘরে কাটাও। এটা ঠিক নয়। চলো না, আমার গাড়ি চড়ে বেড়িয়ে আসবে। এই গলিতে তো আমার গাড়ি ঢোকে না, তাই সেটা বড়োরাস্তায় রেখে এসেছি। বেশি নয়, ধরো ঘণ্টাখানেক।’

সুনন্দা বলল, ‘পাগল হয়েছেন! মাকে একা রেখে কোথায় যাব? অন্ধ মানুষ। তা ছাড়া, কে বললে আপনাকে যে আমি চব্বিশ ঘণ্টা রান্নাঘরে কাটাই? প্রত্যেক শনি-রবিবার সন্ধে বেলা আমরা তিনজনে ঘুরতে বের হই। আর বেশি ঘোরবার আমার কোনো দরকার নেই।’

প্রথম প্রচেষ্টা এই পর্যন্ত। এর কিছুদিন পরে, বেড়ালটা অনেকটাই আত্মপ্রকাশ করল। পরিমল বললেন, ‘তোমার এই দুরবস্থা চোখে দেখা যায় না, সুনন্দা। তুমি আমার সঙ্গে চলো, আমি তোমাকে সিনেমায় নায়িকার পার্ট দেব। আমার প্রোডাকশন, আমার ডিরেকশন। আমি তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব, সঙ্গে করে পৌঁছে দিয়ে যাব, কাজেই তোমার ভয় বা চিন্তার কোনো কারণই নেই। আমি এ লাইনে গত প্রায় পঁচিশ বছর আছি। আমি বলছি, তুমি সাকসেসফুল হবেই। দেশে-বিদেশে তোমার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে, প্রোডিউসাররা টাকার থলি নিয়ে তোমার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবে।’

সশব্দে হেসে উঠল সুনন্দা। মাথা নেড়ে বলল, ‘এ হয় না বুড়োকাকা, আমার জন্যে এত চিন্তা করবেন না, আমি খুব ভালো আছি। এরচেয়ে ভালো আমি থাকতে চাই না।’

অনেক চাপাচাপি করলেন পরিমল। দেবীকারানী, সাধনা বোস, সুচিত্রা সেন, শর্মিলা ঠাকুর প্রমুখ বড়ো বড়ো পরিবার থেকে আসা সিনেমার নায়িকাদের কথা বললেন, কিন্তু কোনো লাভ হল না। অনড় হয়ে রইল সুনন্দা। তার নিরর্থক নির্বুদ্ধিতায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ আর কিছুটা ক্রুদ্ধ হয়েই বিদায় নিলেন বুড়োকাকা।

সন্ধে বেলা সব শুনল অরিজিৎ। বলল, ‘এতদিন তোমাকে বলিনি, কিন্তু আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, আমার ধারণা ভদ্রলোক সুবিধের নন। উনি তোমার আত্মীয়, তার ওপরে গুরুজন, কাজেই একথা তোমাকে বলা হয়তো আমার পক্ষে শোভন নয়। তবুও না-বলে পারছি না।’

চিন্তিত, গম্ভীর মুখে প্রভাময়ী বললেন, ‘শোভন নয় যখন বুঝতেই পারছিস, তখন এ সব কথা বলে কেন বউমার মনে কষ্ট দিচ্ছিস? তবে আজ বউমার কথায় যেরকম রেগেমেগে চলে গেছেন তাতে মনে হয় না যে শিগগিরি আর এদিকে আসবেন।’

হেসে উঠল সুনন্দা। বলল, ‘আপনি বুঝতে পেরেছেন, না? যে-রকম হাঁড়িপানা মুখ করে গেছেন, তাতে মনে হয় এখন বেশ কিছুদিন ওঁর ভালোবাসার অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।’

ওদের ভুল হয়েছিল।

পরদিন দুপুর বেলা খাওয়ার পর প্রভাময়ী নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন আর সুনন্দা অরিজিতের কয়েকটা জামা নিয়ে বারান্দায় বসল বোতাম লাগাতে। এইসময় পরিমল এসে হাজির হলেন। বললেন, ‘সুনন্দা, তোমার ঘরে চলো, কয়েকটা সিরিয়াস কথা আছে তোমার সঙ্গে।’

‘এখানে বসে কথাটা বলা যায় না, বুড়োকাকা?’ সুনন্দা জিজ্ঞেস করল।

দৃঢ় গলায় পরিমল বললেন, ‘না, নিরিবিলিতে বলা দরকার।’

সুনন্দা বলল, ‘ঠিক আছে, চলুন।’ বলে জামাগুলো কোল থেকে নামিয়ে রেখে ওর ঘরে গিয়ে ঢুকল। পেছনে পেছনে এলেন পরিমল। ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে মোটা কাঠের খিলটা তুলে দিলেন।

উদবিগ্ন সুনন্দা প্রশ্ন করল, ‘একী, দরজা বন্ধ করছেন কেন, বুড়োকাকা?’

‘দরজা বন্ধ করছি এই জন্য যাতে তোমার শাশুড়ি এসে ডিস্টার্ব না করতে পারেন। এখন, বসো তো খাটের ওপর আর আমার কথা মন দিয়ে শোনো। ব্যাপার হল, আমার পার্টনার সূরযলাল সিং আজ থেকে বছর দুয়েক আগে মেজদা, মানে তোমার ছোটো পিসেমশায়ের শ্রাদ্ধে তোমাকে দেখেন। তখনই তাঁর মনে হয়েছিল যে তোমার মধ্যে অভিনয় করার একটা প্রকাণ্ড প্রতিভা লুকিয়ে রয়েছে। তখন তোমার বিয়ে হয়নি। সূরযলালের প্রস্তাব নিয়ে আমি তখন তোমার বাবার কাছে গিয়েছিলুম। অত্যন্ত ভালো প্রস্তাব ছিল সেটা, তা সত্ত্বেও তোমার বাবা আর দুই দাদা আমাকে অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। অন্য কোনো প্রদেশের লোক হলে এহেন একটা প্রস্তাব লুফে নিত, কিন্তু স্টুপিড বাঙালিদের মোটা মাথায় কোনো ভালো জিনিস ঢোকায় কার বাবার সাধ্যি! আরে এটা যদি বিহার হত, তাহলে তো সূরযলাল প্রস্তাব-ট্রস্তাবের ধারই ধারত না, স্রেফ লোক পাঠিয়ে তোমাকে তুলে নিয়ে যেত। আনফর্চুনেটলি, ওয়েস্ট বেঙ্গলে এসব করায় ঝুঁকি আছে। তারপর তোমার বিয়ে হয়ে গেল। দেড় কামরার যে বস্তির মধ্যে থাকতে, বাপরে, সেখানে তো আমার ঢুকতেই সাহস হত না।’

‘এখন আমাকে কী করতে হবে?’

‘তেমন কিছু নয়। তোমাকে আমার সঙ্গে সূরযলালের কাছে যেতে হবে। এখনই। তোমার হাজব্যান্ড অফিস থেকে ফেরবার আগেই ফিরে আসবে তুমি। তোমার উপহারগুলোর জন্য অনেক টাকা খরচ করেছে সূরযলাল। সে আর অপেক্ষা করতে রাজি নয়। আজ তুমি না-গেলে সূরযলাল আমাকে জ্যান্ত কবর দেবে।’

‘আমি তো স্বেচ্ছায় যাব না। পারেন তো জোর করে ধরে নিয়ে যান।’ কম্পিত গলায় বলল সুনন্দা।

এইবার পরতে পরতে ভদ্রতার মুখোশটা খসে পড়ল পরিমলের। তাঁর হিংস্র পশুর মতো চেহারাটা বেরিয়ে এল।

ছটফট করছিলেন প্রভাময়ী। লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে প্রায় কেঁদে উঠে বললেন, ‘কোথায় তুমি? তুমি যে বলেছিলে আমাকে সাহয্য করবে? ওদিকে যে সুনন্দার সর্বনাশ হতে বসেছে! তোমাকে তো বলেছি, তুমি যা চাও তাই পাবে। তবে তুমি কিছু করছ না কেন?’

এবারে শাড়ির খসখস নয়, একজোড়া ভারী পায়ের আওয়াজ পেলেন প্রভাময়ী। পরক্ষণেই তাঁর সমস্ত চিন্তাশক্তি বিলুপ্ত হয়ে গেল।

‘জোর করে নিয়ে যাব? এসব ঝামেলা করবার কোনো দরকারই হবে না, সুনন্দা। যদি ভালোয় ভালোয় না-যাও তাহলে আমি এখনই তোমাকে রেপ করব, বাংলায় যাকে বলে ধর্ষণ। তুমি চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করলেও কেউ তোমাকে এখানে বাঁচাতে আসবে না। তোমার কানা শাশুড়িকে তো ধর্তব্যের মধ্যেই আনি না। আর একবার ধর্ষিতা হলে, তোমার স্বামী আর শাশুড়ি তোমাকে লাথি মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেবে। তখন তো সুড়সুড় করে আমার কাছেই আসতে হবে। কাজেই ভেবে দ্যাখো, কী করবে।’

গুটিশুটি মেরে খাটের এককোণায় সরে যেতে যেতে কেঁদে উঠল সুনন্দা, ‘আমি যাব না, কিছুতেই যাব না। আমাকে ছেড়ে দিন বুড়োকাকা। আপনার পায়ে পড়ি। আপনাকে গুরুজন বলে শ্রদ্ধা করি। আমাকে ছেড়ে দিন।’

শেয়ালের মতো দাঁত বের করে হাসলেন বুড়োকাকা। খাটের ধারে বসে জুতো-মোজা খুলতে খুলতে বললেন, ‘ওসব ছেঁদো কথায় আমার মন ভেজে না, সুনন্দা। ভেবেছিলুম, সূরযলালের পর প্রসাদ পাব। এখন দেখছি নৈবেদ্যটা প্রথমে আমার কপালেই নাচছে। ভালোই হল।’

বলতে বলতেই দড়াম করে বোমা ফাটার মতো শব্দ করে ঘরের দরজাটা খুলে গেল। মোটা কাঠের খিলটা ভেঙে দু-টুকরো হয়ে দু-পাশে ছিটকে পড়ল। চমকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন পরিমল। দেখলেন কুব্জপৃষ্ঠ ন্যুব্জদেহ প্রভময়ী দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন। কোনোরকমে সামলে নিয়ে পরিমল বললেন, ‘ইস, কী পচা কাঠ! এই বুড়ি, এখানে কী চাই? যা ভাগ বলছি! ফূর্তির সময় যতসব ঝামেলা। ভাগ, নইলে গলা টিপে মেরে ফেলব।’

প্রভাময়ী কেটে কেটে বললেন, ‘তুমি এই মুহূর্তে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাও, আর কখনো এসো না।’

পরিমল প্রভাময়ীর মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল, ‘তোর কথায় যেতে হবে? কী করবি যদি না-যাই?’

বলামাত্র একটা বিরাশি সিক্কার চড় খেয়ে মেঝের ওপর বসে পড়লেন পরিমল। গালে হাত দিয়ে চোয়ালটা ঠিক করতে করতে বললেন, ‘ওব্বাবা, বুড়ি বেধবার গায়ে দেখছি খুব জোর! চালকলা খেয়ে তো এরকম হয় না বাওয়া! লুকিয়ে লুকিয়ে ষাঁড়ের ডালনা খাস বুঝি? তবে, আমার সঙ্গে টক্কর দিয়ে পারবিনে, কানি। এখন আগে তোকে মারব তারপর তোর ছেলের বউটার বারোটা বাজাব।’

এই গোলমালের ভেতরে সুনন্দা খাট থেকে নেমে দরজার দিকে পালাচ্ছিল। তড়বড় করে উঠে দাঁড়ালেন পরিমল। চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচকা টানে ওকে আবার খাটের ওপর ছুড়ে ফেলে দিলেন। গর্জন করে বললেন, ‘পালাচ্ছিস কোথায় হারামজাদি? মনে রাখিস, পরিমল ঘোষের হাত থেকে পালানো যায় না—’

কথাটা শেষ করেছেন কী করেননি, প্রভাময়ীর হাতের লাঠিটা হাতুড়ির মতো এসে পড়ল পরিমলের পাঁজরার ঠিক নীচে। উফফ করে আর্তনাদ করে দু-ভাঁজ হয়ে গেলেন। কোনোরকমে সোজা হয়ে উঠতে উঠতে পরিমল পকেট থেকে একটা বড়ো ভাঁজ করা ছুরি বের করে ফেললেন। সেটা খুলে একটা অশ্লীল অশ্রাব্য গালাগালি দিয়ে বললেন, ‘ভেবেছিলুম খুনখারাপির মধ্যে আর থাকব না। কিন্তু বুড়িটাকে না-মারলে তো দেখছি চলছে না—’

এবারেও কথাটা শেষ করতে পারলেন না, আবার লাঠিটা বিদ্যুদ্বেগে এসে পড়ল পরিমলের কব্জির ওপরে। ছুরিটা ছিটকে বেরিয়ে গেল। এইবার লাঠিটা ফেলে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন প্রভাময়ী। এগিয়ে গিয়ে জামার কলার আর কোমরের কাছে ট্রাউজারের বেল্টটা ধরে স্তম্ভিত সুনন্দার চোখের সামনে পরিমলের শরীরটা শূন্যে তুলে ঘরের এককোণে আছড়ে ফেলে দিলেন।

হাউমাউ করে উঠলেন পরিমল, ‘ওরে বাবারে, মরে গেলে গেলুম রে, আমার হাড়গুলো সব ভেঙে গেল রে!’ বলে প্রভাময়ীকে আবার এগিয়ে আসতে দেখে একটু আগে সুনন্দা যেমন করছিল, তেমনি গুটিশুটি মেরে ঘরের এককোণায় সরে যেতে যেতে কেঁদে উঠলেন, ‘আর না বেয়ান, ঢের হয়েছে।’ বলে প্রভাময়ীর চোখে চোখ পড়তেই তাঁর বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। দেখলেন, মণিহীন দু-টি সাদা চোখ এক অপার্থিব হিংস্র জিঘাংসায় জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।

ব্যাপারটা চট করে হৃদয়ঙ্গম করলেন পরিমল। দু-হাত জোড় করে বললেন, ‘আ-আমি এক্ষুনি চলে যাচ্ছি। ভুল করে ভয়ানক অন্যায় করে ফেলেছি। আর কক্ষনো এরকম হবে না, বিশ্বাস করুন। আর কোনোদিন এ বাড়ির ছায়া মাড়াব না, আপনার পরিবারের তো নয়-ই। মাইরি বলছি, মা কালীর দিব্যি।’

আর এগোলেন না প্রভাময়ী। এক হাত তুলে দরজাটা দেখিয়ে দিলেন। দু-হাতে কোমর ধরে বেঁকতে বেঁকতে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালালেন পরিমল।

প্রভাময়ীর যখন জ্ঞান ফিরল, দেখলেন উনি খাটের ওপর বসে আছেন আর সুনন্দা ওঁর কোলে মাথা রেখে হাউমাউ করে কাঁদছে। অনেক সান্ত্বনা, অনেক আদরের পর একটু স্থির হল সুনন্দা। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘আমি কি অপবিত্র হয়ে গেলুম, মা?’

প্রভাময়ী হাসলেন। বললেন, ‘দূর, পাগলি! ভগবানের সৃষ্টিকে অপবিত্র করা কী অতই সোজা? কিচ্ছু হয়নি তোর। আজকের ঘটনাটা মন থেকে একেবারে মুছে ফেল তো। যা, এখন স্নান করে নে। তোর সব গ্লানি ধুয়ে ফেল। চটপট যা। অরিজিতের আসবার তো আর বেশি দেরি নেই। আর, আমার লাঠিটা কোথায় পড়ল, একটু এনে দে তো। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। এখন গিয়ে একটু শুয়ে নিই।’

সুনন্দা মেঝের ওপর পড়ে থাকা লাঠিটা তুলে এনে প্রভাময়ীর হাতে ধরিয়ে দিল। কী যেন একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, শেষপর্যন্ত সেটা আর করে উঠতে পারল না।

অরিজিৎ সব শুনে বলল, ‘তোমার একটা কথাও আমি বিশ্বাস করি না। ফাজলামো করছ নাকি আমার সঙ্গে? মা ভালো করে হাঁটতে পারে না, চোখে দেখতে পায় না। সে কি না ওই বিরাট লাশটাকে মেরে একেবারে চচ্চড়ি বানিয়ে দিল! এ কী ইয়ার্কি নাকি? এসো আমার সঙ্গে, আমি মার মুখ থেকে সব কথা শুনতে চাই।’

দু-জনে ঘরে ঢুকে দেখল প্রসন্ন সমাহিত মুখে প্রভাময়ী শুয়ে রয়েছেন। তাঁর ঠোঁটের কোণে একটা তৃপ্ত সুখের হাসি। সেদিকে তাকিয়ে অরিজিতের ওঁর ঘুমটা ভাঙাতে মন চাইল না। যথাসম্ভব নিঃশব্দে বেরিয়ে আসার সময় ওর নজরে পড়ল খাটের পাশে ছোটো টেবিলটার ওপরে একটা চিঠি রয়েছে। প্রভাময়ীর হাতের লেখা। ওদের দু-জনকে সম্বোধন করা।

একটু উদবিগ্নচিত্তে চিঠিটা হাতে করে বারান্দায় এসে বসল অরিজিৎ। সুনন্দাকে বলল, ‘মা মুখে না-বলে হঠাৎ আমাদের চিঠি লিখতে গেলেন কেন? অন্ধ হয়ে যাবার পর থেকে মাকে তো কখনো কিছু লিখতে দেখিনি। অথচ এত বছর বাদেও চোখে না-দেখে কী পরিচ্ছন্নভাবে লিখেছেন, দেখেছ!’ তারপর চিঠিটা পড়তে শুরু করল—

স্নেহের খোকা ও বউমা। আমার দুই পরম বন্ধুর কোনো অকল্পনীয় এবং অপ্রত্যাশিতপূর্ব উপকারের প্রত্যুপকার করিবার আশায় ইহজগৎ হইতে বিদায় লইলাম। আমি এখন যেখানে আছি তাহা অনন্ত সুখের স্থান, তাই আমার জন্য শোক করিও না। করিলে অকারণে আমাকে কষ্ট পাইতে হইবে। আমার শেষকৃত্যাদি যা ভালো বুঝিবে তাহা করিবে, তবে আর একটি কাজ তোমাদের অতি অবশ্যই করিতে হইবে। ইহা আমার শেষ অনুরোধ এবং আদেশ বলিয়া জানিবে। এই ঘরের উত্তর-পশ্চিম কোণে যে স্তম্ভটি আছে তাহা ভাঙিলে তাহার অভ্যন্তরে দুইটি নরকঙ্কাল পাইবে। পুলিশকে দেখাইয়া সেই অস্থি গঙ্গায় বিসর্জন দিবে এবং যথাবিধি শ্রাদ্ধ করিবে। জীবিতাবস্থায় ইঁহাদের নাম ছিল শিবচন্দ্র ধর ও নন্দরানী ধর। ইঁহারা স্বামী-স্ত্রী। শিবচন্দ্রের পিতার নাম আশুতোষ, পিতামহ হরকালী, প্রপিতামহ বৃন্দাবন। মধ্যবয়সে শিবচন্দ্র ও নন্দরানী বিষয়কর্মে বীতরাগ হইয়া গভীরভাবে ধর্মকার্যে লিপ্ত হন। এই সুযোগে সম্পত্তির লোভে শিবচন্দ্রের ভ্রাতা রামচন্দ্র দুইজনকে নিষ্ঠরভাবে হত্যা করে ও তাঁহাদের দেহ ওই স্তম্ভের ভিতরে গাঁথিয়া দেয়। হত্যা করিবার পূর্বে সে তাহার মাতৃসমা ভ্রাতৃবধূর উপর পাশবিক অত্যাচার পর্যন্ত করিয়াছিল। পরে সে রটনা করিয়া দেয় যে শিবচন্দ্র সস্ত্রীক সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়া রাত্রের অন্ধকারে সকলের অগোচরে গৃহত্যাগ করিয়াছেন। কালক্রমে লোকে ইঁহাদের কথা বিস্মৃত হয়। এখন শিবচন্দ্রের বর্তমান বংশধর যদি শ্রাদ্ধ করিতে অস্বীকার করেন, তাহা হইলে খোকা নিজে যেন তাঁহাদের শ্রাদ্ধ করে। ইঁহারা আমাদের পরিবারকে রাহুমুক্ত করিয়াছেন, নিশ্চিত সর্বনাশ হইতে উদ্ধার করিয়াছেন, অতএব খোকার তাঁহাদের শ্রাদ্ধ করিবার অধিকার আছে। দীর্ঘকাল তাঁহারা অসীম যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছেন, এইবার তাহা হইতে তাঁহাদের মুক্ত করা খোকার অবশ্যকর্তব্য বলিয়া জানিবে। তোমরা পুত্রপৌত্রাদিক্রমে সুখে থাকিও, ইহাই আমার আশীর্বাদ রহিল।

ডাক্তার নির্মল মৈত্র বললেন, ‘এটা স্বাভাবিক মৃত্যু, সুইসাইডের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। স্পষ্ট সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস, সঙ্গেসঙ্গে মৃত্যু হয়েছে। দেখছেন না, মুখে যন্ত্রণার লেশমাত্র নেই? এই বয়সে, এত দুর্বল শরীরে এইরকমই হয়।’

অরিজিৎ অবশ্য ডাক্তার মৈত্রকে চিঠিটার কথা কিছু জানায়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *