বাসুদেবের নতুন বাসা

বাসুদেবের নতুন বাসা

সন্ধের ম্লান আলোয় মুগ্ধ চোখে বাড়িটা দেখছিলেন বাসুদেব সরকার। ঠিক এইরকমই একটা বাড়ি খুঁজছিলেন কিছু দিন ধরে। শ্যাওড়াফুলি থেকে যে রাস্তাটা চন্দননগরের দিকে গেছে, তার মাঝামাঝি একটা সরু রাস্তা বেরিয়ে দু-পাশে কলাবাগানের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে কয়েকটা গ্রাম ঘুরে দিয়াড়ার দিকে চলে গেছে। তারই ওপরে একটা গ্রাম গোবিন্দনগর। তার একপ্রান্তে পেছন দিকে চারদিকে ধান খেতের মধ্যিখানে বাড়িটা অসহায় নিঃসঙ্গ বৃদ্ধের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে।

বাড়িটার বয়েস এক-শো বছর তো হবেই আর কতদিন যে পরিত্যক্ত তা বোধ হয় কেউ জানে না। একটা মস্ত চৌকো উঠোনের চারদিক ঘিরে প্রকাণ্ড দোতলা ইমারত। বাইরের পলেস্তারা কবেই খসে পড়ে গেছে, জানলাগুলোর চিহ্নমাত্র নেই, উঠোন ভরতি বড়ো বড়ো ঘাস, উঠোনের মাঝখানে শ্বেতপাথরের স্নানরতা নগ্ন ভেনাসের মূর্তি, তবে তাঁর আর সংকোচের কোনো কারণ আপাতত নেই; কারণ বুনো লতায় তাঁকে প্রায় আগাপাস্তলা ঢেকে ফেলেছে। ভেতরে ঢোকার উঁচু খিলেন করা দেউড়ির দরজা অদৃশ্য আর তার চুড়োয় রাখা গোটাতিনেক পরির সকলেই আজ ধরাশায়ী।

খুবই পুলকিত চিত্তে এক হাতে বেহালার বাক্স আর অন্য হাতে একটা বড়ো সুটকেশ নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন বাসুদেব। ভেবেছিলেন, হিংস্র আর পরশ্রীকাতর প্রতিবেশীদের অসভ্যতা আর চারদিকের টেলি-ভীষণের সশব্দ অত্যাচারে তাঁর শিল্পসাধনায় তিনি বোধ হয় আর কোনদিনই সফল হতে পারবেন না। এইবার এইখানে তিনি মুক্ত, তাঁর সাধনায় কেউ বাধা দিতে আসবে না। স্টেশনে শুনে এসেছেন যে, লোকে এই বাড়িটাকে রাজবাড়ি বলে আর সন্ধের পর ভয়ে কোনো লোক এর ধারেকাছে আসে না। শুনে যে কী খুশি হয়েছিলেন! সারাদিন ঘুমোবেন, সন্ধের পরেই শুরু করবেন তাঁর সাধনা। সেটাই তো প্রকৃষ্ট সময়।

বাসুদেব একজন শিল্পী। এতদিন মগ্ন ছিলেন ছবি আঁকা নিয়ে, যদিও এজন্য তাঁর পরিবারের লোক আর গর্দভ সমালোচকদের নানারকম কটুকথা তাঁকে শুনতে হয়েছে। তিনি অবশ্য তাতে মোটেই বিচলিত হননি। আর্টের ব্যাপারে এদের যা জ্ঞানগম্যি তাতে এর চেয়ে অন্যরকম কিছু তিনি আশাও করেননি। কিন্তু ঘটনাটা গুরুতর হয়ে উঠল যখন তিনি বেহালা বাজানো শুরু করলেন। এবার তাঁর পরিবারের লোকেদের সঙ্গে প্রতিবেশীরাও যোগ দিল। রীতিমতো অত্যাচার শুরু হয়ে গেল। তাঁর চিলেকোঠার ঘরে রাত্রি বেলা যেই তিনি বেহালায় ছড় টানতেন, অমনি জানালার ওপর ঠকাস ঠকাস করে ঢিল পড়তে শুরু করত। দু-একটা ভেতরেও যে চলে আসত না তা নয়। ভীমের সঙ্গে হনুমানের মোলাকাতের একটা অসাধারণ বিমূর্ত ছবি এঁকেছিলেন, সেটা তো ছিঁড়েই গেল। আর সেইসঙ্গে নীচের তলা আর চারপাশ থেকে গালাগালির ঝড়। এহেন অসহ্য অবস্থায় সাধনা করা কি কারুর পক্ষে সম্ভব?

এখন আর ভয় নেই। এখানে কেউ তাঁকে বিরক্ত করতে আসবে না। এই নীরব শান্ত নিষ্কলুষ নির্জনতায় তিনি নিশ্চিন্তে তাঁর সাধনা চালিয়ে যেতে পারবেন।

এইবার বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখতে শুরু করলেন বাসুদেব।

একতলার ঘরগুলো বাস করার পক্ষে যথেষ্ট উপযুক্ত বলে মনে হল না। মেঝে ফাটিয়ে ঘাস গজিয়েছে, জানালা দিয়ে ঢুকে এসেছে জংলি লতা। একটা ঘরই কিছুটা পরিষ্কার আছে, বোধ হয় বছর দশেক আগে এখানে কিছু অসামাজিক লোক আশ্রয় নিয়েছিল। আজও মাকড়শার ঝুলে ঢাকা একটা তোলা উনুন আর একটা কুঁজো তাদের স্মৃতি বহন করছে।

দোতলায় যেতে গিয়ে কিছুটা বাধা পেলেন বাসুদেব। ওপরে ওঠার চওড়া কাঠের সিঁড়িটা ভেঙে নীচে পড়ে আছে। তবে, কে বা কারা, হয়তো বা সেই অসামাজিক লোকগুলোই হবে, তার জায়গায় একটা বাঁশের মই লাগিয়ে রেখে গেছে। পাকা বাঁশ এখনও প্রায় অক্ষতই আছে। ভালোই হল। ওপরে গিয়ে মই তুলে নিলে আর কেউ আচমকা উঠে আসতে পারবে না।

দোতলার ঘরগুলোর অবস্থা অনেক ভালো। দেওয়ালে মেঝেতে বড়ো বড়ো ফাটল আছে বটে, তবে তা একেবারে বসবাসের অনুপযুক্ত, সেরকম নয়। বাসুদেব একটা বড়ো ঘর দেখতে পেলেন যার ভেতরে একটা প্রকাণ্ড কালো কাঠের টেবিল তিনটে তাকওলা কারুকার্য করা একটা আলমারিও আছে। প্রায় অক্ষত। চমৎকার ব্যবস্থা। টেবিলটার ওপর শোওয়া যাবে। সুটকেসের জিনিসপত্রগুলো আরামসে আলমারিতে ধরে যাবে।

তিনতলায় ছাদে যাবার সিঁড়িটাও ভাঙা। মইটা লাগিয়ে উঠে চারদিকের দৃশ্য দেখে একেবারে বিমোহিত হয়ে গেল বাসুদেব। বাড়িটার ঠিক পেছনেই একটা আধবিঘে পরিমাণ ডোবা বা পুকুর, কচুরিপানায় ঢাকা, তবে জল আছে। আর, চারদিকে ধান খেত। দূরে কয়েকটা গ্রাম আসন্ন সন্ধ্যায় গাঢ় কমলারঙের ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর কালো কালো স্তূপের বিমূর্ত ছবির মতো দেখাচ্ছে। এই তো শিল্পীর শিল্পসাধনার প্রকৃষ্ট জায়গা।

বড়ো সুখে দিন কাটছিল বাসুদেবের। তিনি আসবার পর ভাগ্যক্রমে বাড়িটার বদনাম আরও বেড়েছে। আগে চাষিরা দুপুর বেলা বাড়িটার ছায়ায় বসে ভাত খেত, খুব সাহসীদের কেউ কেউ ভেতরে ঢুকে ঘাসও কাটত, এখন সেসব বন্ধ। কিছুদিন আগে গোবিন্দনগর গিয়েছিলেন বাসুদেব। সেখানে মুদির দোকানে শোনেন খুব উত্তেজিত আলোচনা চলছে। দু-দিন আগে কার্তিক সাঁতরার বড়ো ছেলে ব্রজগোপাল চন্দননগরে কলেজ সেরে ফিরছিল। রাত হয়ে গিয়েছিল বলে মাঠের ভেতর দিয়ে শটকার্ট মারছিল। ডাকাবুকো ছেলে ভয়ডর কম। রাজবাড়ির কাছাকাছি আসতে সে শোনে ভেতর থেকে একটি মেয়ের কান্নার আওয়াজ আসছে। তখন তার মধ্যে বীরত্ব জেগে ওঠে। সে ওদিকে ছুটে যায়। কিন্তু কাছাকাছি যেতেই সে স্পষ্ট শোনে দেউড়ির পেছনে একটা ক্রুদ্ধ ঘোড়ার চিঁহি চিঁহি ডাক। তখন তার সব সাহস উবে যায়, সে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়ে চলে আসে। তার কারণ গোবিন্দনগর কেন, আশেপাশে পাঁচটা গাঁয়ের লোক এই তল্লাটে ঘোড়া তো দূরস্থান, গাধাই দেখেনি কোনোদিন।

শুনে বাসুদেব মনে মনে হেসে অস্থির। হিসাব করে দেখলেন, ঘটনাটি যে রাত্রের এবং যে সময়ের কথা হচ্ছে, তখন তিনি পুরিয়া ধানেশ্রী বাজাচ্ছিলেন। তাঁর সূক্ষ্ম মীড় আর ঝালার কাজ শুনে যতসব হিজিবিজি কথা ভেবেছে ব্রজগোপাল। তবে তারই বা দোষ কী? গাঁয়ের ছেলে, সে কি আর কোনোদিন বেহালায় ক্লাসিক্যাল রাগরাগিণী শুনেছে!

দুর্ভাগ্য এই যে, সুখ কখনোই নিরবচ্ছিন্ন হয় না। তা না-হলে ছ-টা মাস কাটতে না-কাটতেই খামোখা একজোড়া ঘরপালানো প্রেমিক-প্রেমিকা এ বাড়িতে উপস্থিত হবে কেন।

সেদিন বিকেল বেলা ছাদে বসে ছবি আঁকছিলেন বাসুদেব। বিষয়বস্তুটা অত্যন্ত জটিল। বালক শ্রীকৃষ্ণ গিরিগোবর্ধন ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছেন আর তাঁকে সে অবস্থায় দেখে নিজেকে কিছুতেই সামলাতে না-পেরে একটি অত্যন্ত দুষ্ট গোপবালক তাঁকে কাতুকুতু দিতে এগিয়ে আসছে। এই দৃশ্যে সমবেত গোপমণ্ডলীর প্রত্যেকটি লোকের মুখে যে বিভিন্ন রকমের ভাবোদয় হচ্ছে সেটা আলাদা আলাদা করে ফুটিয়ে তোলা তো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। কাজেই, গভীর মনোযোগ সহকারে সেই কর্মে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন তিনি। এইসময় তাঁর কানে এল নীচের উঠোন থেকে একটি নারী ও একটি পুরুষের কণ্ঠস্বর। পুরুষ কণ্ঠ বলছিল, ‘দ্যাখো রূপা, লুকিয়ে থাকার এরচেয়ে ভালো জায়গা আর পাবে না। তোমার বাবা দুঁদে দারোগা, কলকাতা আর চন্দননগর চষে ফেলে দেবেন কালকেই। কিন্তু এ জায়গার খবর ডায়েরিতে লেখা নেই। আজ থেকে বছর বারো আগে, আমি তখন স্কুলে পড়ি, এই বাড়িতে এসে লুকিয়েছিলুম প্রায় একমাস পাড়ার পলিটিকাল পার্টির দাদাদের সঙ্গে। কোনোদিন একটা পুলিশেরও টিকি দেখিনি। দিনদশেক যেতে দাও, দেখবে তোমার মার মন দিব্যি নরম হয়ে এসেছে। তোমার মা-ই ঘ্যানঘ্যান ঘ্যানঘ্যান করে সে-ই কাজটি করবেন। আমি একদিন গোপনে চন্দননগরে গিয়ে খবর নিয়ে আসব, তারপর ড্যাংড্যাং করতে করতে ফিরে যাব।

রূপা বলল, ‘কিন্তু আমার যে বড্ডো গা-ছমছম করছে, মন্টুদা।’ মন্টুদা বলল, ‘তা তো একটু করবেই। এরকম একটা পোড়ো-বাড়িতে সেটাই স্বাভাবিক। তবে ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমি তো ছিলুম এখানে। এখন শীতকাল, সাপখোপের ভয় নেই। আর, ভূতপ্রেত? ওসবে আমি বিশ্বাসও করি না, ভয়ও পাই না।’

দু-জনে দিনদশেক থাকবে শুনে বাসুদেব প্রায় ভির্মি যাচ্ছিলেন। এ তো মহাবিপদ। এতদিন তো নিজেকে লুকিয়ে রাখা যাবে না। আর, একবার উপস্থিতি টের পেলে দু-জনে যদি মেসোমশাই, মেসোমশাই করতে করতে ঘাড়ে এসে পড়ে তবে তো তাঁর সাধনার দফা, গয়া। তার ওপর আবার থানা-পুলিশের ব্যাপার আছে। নাঃ এদের পত্রপাঠ না-তাড়াতে পারলে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা।

ছবি আঁকা মাথায় উঠল। অত্যন্ত চিন্তাকুল চিত্তে রং, তুলি, কাগজ বগলদাবা করে মই বেয়ে দোতলায় নেমে এলেন বাসুদেব। একটুও সময় নষ্ট করা চলবে না, আজ রাত্রের মধ্যেই তাড়াতে হবে। মেরে তাড়ানো সম্ভব নয়। একমাত্র উপায় ভয় দেখিয়ে কাজ হাসিল করা। এমন ভয় দেখাতে হবে যাতে জীবনে আর দু-জনে এমুখো না-হয়। ভূতের ভয়ই দেখাতে হবে। অন্য অনেক কিছুই হয়তো করা যেত, কিন্তু সেসব করবার সময় নেই। মেয়েটা তো এখনি ভয় পেয়েই গেছে। সেটা বাড়াতে হবে আর ছেলেটাকেও তদানুরূপ ভয় পাওয়াতে হবে। তিনি নাকি আবার ভূতে বিশ্বাস করেন না! দেখা যাক সে ব্যাপারে কিছু করা যায় কিনা।

প্ল্যান-প্রোগ্রাম ঠিক করে সবকিছু তৈরি করতে করতে সন্ধে গাড়িয়ে রাত হয়ে গেল। ইতিমধ্যে ছেলেমেয়ে দুটো বাজার থেকে কিনে আনা ডালপুরি আলুর দম খেয়ে, গায়ে ওডোসম মেখে, তোলা উনুনওলা ঘরটায় গিয়ে শুয়ে পড়েছে। মেয়েটির চিত্তে কিন্তু একটুও সুখ নেই। না থাকারই কথা। কোথায় দারোগার কোয়ার্টার্স-এর শোবার ঘর আর কোথায় এই ভূতুড়ে পোড়ো বাড়ির ভাঙা ঘরে মাটিতে বিছানা। মন্টুদা একটু ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু প্রচণ্ড মুখঝামটা খেয়ে বিষণ্ণ মনে নাক ডাকানোই স্থির করেছেন।

রূপার প্রবল ঠেলা খেয়ে ‘কে কে, কী কী’ করতে করতে উঠে বসল মন্টু। কাঁপা কাঁপা গলায় রূপা বলল, ‘শুনছ? ওপরতলায় কে যেন বেহালা বাজাচ্ছে।’

‘কোথায়?’ বলে কান পেতে শুনে মন্টু বলল, ‘এঃ, কী জঘন্য হাত! এ কি বাজনা হচ্ছে? মনে হচ্ছে, বাগেশ্রী বাজাবার চেষ্টা করছে। বাগেশ্রী তো নয়, হচ্ছে বাঘের শ্রী। কিংবা বিশ্রীও বলতে পারো।

কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিলেন বাসুদেব। ভীষণ চটে গেলেন। যতসব অশিক্ষিত পাষণ্ড। রেগেমেগে একটা দারুণ মীড়ের কাজ লাগালেন। এইবার বোঝ।

মন্টু বলল, ‘ইসস! মার্ডার, মার্ডার! নাঃ, এর দ্বারা জীবনেও বেহালা বাজানো হবে না।’

রূপা চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘উফ, মন্টুদা! আমি কি তোমাকে বাজনার সমালোচনা করতে বলেছি? দোতলায় তো যাবার কোনো পথ নেই। সেখানে বসে কে এইসময় বেহালা বাজাচ্ছে, সেটা ভেবে দেখছ কি?’

‘যেই বাজাক, তার বাজানো কিন্তু একেবারেই উচিত হচ্ছে না। আর, তুমি কি ভাবছ কোনো অশরীরী ওপরে বসে এহেন বেসুরো বেহালা বাজাচ্ছে? আমার তা মোটেই মনে হচ্ছে না। অশরীরীদের কি আর খেয়েদেয়ে কোনো কাজ নেই? দ্যাখো গিয়ে, গোবিন্দনগরের কোনো ছেলে যাত্রাদলে নাম লেখানোর জন্য ধান খেতে বসে বাজনা প্র্যাকটিস করছে। পাড়ার মধ্যে করলে তো মার খেয়ে চিরকালের জন্য খোঁড়া হয়ে যাবে, সেইজন্য। আর সেই আওয়াজ প্রতিধ্বনি হয়ে মনে হচ্ছে দোতলা থেকে আসছে। তবে, প্র্যাকটিসটা বৃথা যাচ্ছে। দুনিয়ায় কোনো যাত্রা পার্টি নেই যারা এই বেহালাবাদককে দলে নেবে— এটা আমি লিখে দিতে পারি। বলে মন্টুদা আবার নাক ডাকতে শুরু করে দিল।

একটু বাদেই আবার প্রবল ঠেলা খেয়ে উঠে বসল মন্টু। ঘুমজড়িত গলায় বলল, ‘আবার কী হল?’

কাঁদোকাঁদো গলায় রূপা বলল, ‘ওই শোনো, ওপরে কী যেন গড়াচ্ছে।’

‘ও কিছু নয়। ইঁদুর-টিদুর হবে। গড়াচ্ছে তো গড়াতে দাও না।’

‘ইঁদুর কি কখনো অনবরত একটা ভারী জিনিস ঘরের এককোণ থেকে অন্যকোণে ঠেলে নিয়ে যায় আর নিয়ে আসে?’

‘দ্যাখো রূপা, কবি বলেছেন, ইঁদুরের কেন বলো হেন ব্যবহার, যাহা পায় কেটেকুটে করে ছারখার? তা, সত্যদ্রষ্টা কবিরাই যখন ইঁদুরের ব্যবহারের রহস্য ভেদ করতে পারেননি, সেখানে চুনোপুঁটি আমি কোত্থেকে পারব বলো দেখি?’

রূপা চেঁচিয়ে বলল, ‘এই কি তোমার পদ্য আওড়ানোর সময় হল? ওপরে ভূত বল খেলছে আর তুমি পদ্য আওড়াচ্ছ!’

‘বল খেলছে? নাঃ আর খেলছে না। ভূত এখন পায়চারি করছে।’

ভারী সুটকেসটা ঠেলাঠেলি করে বাসুদেব ক্লান্তবোধ করছিলেন। এখন লেদার-সোলের পাম্পশু জোড়া পরে খটাস খটাস করে ঘর থেকে বারান্দা আর বারান্দা থেকে ঘর পায়চারি করতে শুরু করে দিয়েছেন।

রূপা প্রায় কেঁদে ফেলল। বলল, ‘অ মন্টুদা, কিছু একটা করো!’

মন্টুদা একটু যেন নার্ভাস হয়েছে বলে মনে হল। বলল, ‘দাঁড়াও, একটু চিন্তা করতে দাও। ওপরে নিশ্চয়ই কেউ আছে। সে আমাদের ভয় দেখাতে চাইছে। তার মানে সে খুব একটা সুবিধের লোক নয়। যদি গুণ্ডা-ফুন্ডা হয়, তবে তো চিত্তির। আমি আবার মারামারিটা তেমন পছন্দ করি না।’

‘তা তো জানিই। ওই তো হাড়জিরজিরে স্বাস্থ্য, সারা বছর জিয়ারডিয়ায় ভোগো। তুমি আবার মারামারি করবে কি! তার চেয়ে চলো পালাই।’

‘ব্যস্ত হয়ো না। পালাই বললেই তো আর হল না। এই রাতবিরেতে কোথায় পালাবে? তার চেয়ে আগে ওপরের ওই লোকটার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে দেখি। দেখি যদি ভজাতে পারি।’

ফিক করে হেসে রূপা বলল, ‘তা তুমি পারবে। দারোগার মেয়েকে যখন ভজাতে পেরেছ, একেও পারবে।’

‘সেই ভালো।’ বলে মন্টু উঠে দাঁড়াল। বাইরের উঠোনে ত্রয়োদশীর চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। তাই দেখে মন্টুর সাহস কিছুটা বাড়ল। দু-হাত ঘষতে ঘষতে যথাসাধ্য বীরত্ব দেখিয়ে উঠোনে নেমে ওপরের দিকে তাকিয়ে হাঁকল, ‘এই যে দোতলার দাদা! একটু বাইরে বারান্দায় আসবেন, কথা….’

এই পর্যন্ত বলেই মন্টু হঠাৎ যেন পাথর হয়ে গেল। মুখটা হাঁ হয়েই রইল, চোখদুটো বিস্ফারিত হয়ে গেল, হাত-পা একেবারে নট নড়নচড়ন।

রূপা দৌড়ে এসে পাশে দাঁড়াল। ব্যাকুল হয়ে বলল, ‘মন্টুদা কী হয়েছে তোমার?’

মন্টুদা সম্বিৎ ফিরে পেতেই ওর মুখ বন্ধ হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। দাঁতে দাঁতে লেগে ঠকাঠক ঠকাঠক করে বাদ্যবৃন্দ হয়ে গেল। তার ফাঁকে কোনোরকমে বলতে পারল, ‘বার বার বার বার।’

‘বার বার? কী বার বার, মন্টুদা?’

প্রবলবেগে মাথা নেড়ে মন্টুদা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘বার বার না। বারান্দায় একটা কং কং কং কং।’

‘কংকং। সে আবার কী?’

আবার মাথা নেড়ে মন্টুদা পূর্ববৎ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘কংকং না। বারান্দায় একটা কঙ্কাল!’

‘হিইঁইঁইঁইঁইঁ!’

‘আমাকে হাত নেড়ে ডাকল, তারপর চলে গেল।’

‘হিইঁইঁইঁইঁইঁইঁ! আর আর এক মুহূর্তও এখানে থাকব না। থাকতে হয় তুমি থাকো।’

রূপার সান্নিধ্যে মন্টুর বোধ হয় সাহস কিঞ্চিৎ বেড়েছিল। বলল, ‘একটু দাঁড়াও। চাঁদের আলোয় ভুল দেখলুম কি?’

কথাটা শেষ করতে পারল না মন্টু, তার আগেই ঝপাস করে এক বালতি পানাপুকুরের বরফঠান্ডা দুর্গন্ধ পচা জল এসে পড়ল দু-জনের মাথায়। সেইসঙ্গে বারান্দার ওপরে একটা সাদাকালো ছায়ামূর্তিও দেখা গেল।

তৎক্ষণাৎ হাঁটুর ওপর শাড়ি তুলে, ‘আঁমি মাঁ-র কাঁছে যাঁব’ বলে যে গতিতে রূপা দেউড়ির দিকে ছুট লাগাল তা উইলমা রুডলফ দেখলে দৌড়নো ছেড়ে যে লুডো খেলার সাধনায় আত্মনিয়োগ করতেন তাতে কোনো সন্দেহই থাকে না। মন্টুদাও চোখের জল মুছে, ‘ও রূপা আমিও যাব, আমাকে ফেলে যেও না গো,’ বলে ঊর্ধ্বশ্বাসে পেছনে দৌড়ল।

হাসতে হাসতে বাসুদেব সরকার প্রায় শুয়েই পড়েছিলেন। কোনোরকমে ধুতির ওপর কালো রং দিয়ে আঁকা কঙ্কালের পোশাকটা খুলে ফেলে লাফাতে লাফাতে নীচে নেমে এলেন। এতদিনে তাঁর বহুকালের বাসনা চরিতার্থ হল। বলে কিনা বাগেশ্রী না-হয় বাঘের শ্রী হচ্ছে? জঘন্য হাত? এতবড়ো আস্পর্ধা। এইরকম সব সমালোচকদের মুখে নুড়ো জ্বেলে দিতে পারলে আরও খুশি হতেন। তবে যা দিয়েছেন তা যথেষ্টরও বেশি। মন ভরে গিয়েছে। পেট চেপে হাসতে হাসতে দেউড়িতে দাঁড়িয়ে চাঁদের আলোয় ধান খেতের ওপর দিয়ে বিদ্যুদ্বেগে অপস্রিয়মাণ মূর্তি দুটোকে যতক্ষণ পারলেন দেখলেন বাসুদেব। তারপর, আনন্দের আতিশয্যে একটা প্রকাণ্ড লাফ মেরে দোতলার একটা ছোট্ট ঘুলঘুলির ভেতর দিয়ে সুড়ুৎ করে গলে নিজের ঘরে চলে গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *