টেটবালের কুকুর

টেটবালের কুকুর

বেশ কিছুদিন ধরে দু’তরফই নিজেদের ঘাঁটিতে গেঁড়ে বসে। দিনের মধ্যে দশ-বারোবার এদিক বা ওদিক থেকে ফায়ারিং হয়। কিন্তু কোনো মানুষের আর্তনাদ শোনা যায় না।

চারিদিক তখন আনন্দে ভরপুর। হাওয়ায় জংলি ফুলের সুগন্ধ। যুদ্ধ ভুলে পাহাড়ের চূড়ায় আর ঢালে প্রকৃতি রূপটানে ব্যস্ত। পাখিরা কোলাহল করছে। ফুল আপন মনে ফুটছে। মৌমাছির দল মধুর লোভে ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

পাহাড়ে কোনো বন্দুকের আওয়াজ হলেই পাখিদের কোলাহল হঠাৎ করে থেমে যেত। চমকে উঠে তারা এদিক ওদিক দিশেহারা হয়ে উড়তে শুরু করত। মনে হত যেন বেসুরো তান ধরে কেউ রসভঙ্গ করেছে।

সেপ্টেম্বর তখন অক্টোবরকে আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরেছে; যেন শীত আর গ্রীষ্মের মধ্যে আপোস চলছে। নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, যেন সাদা বজরায় বেড়াতে বেরিয়েছে।

দুদিকের পাহাড়ি মোর্চার সেপাইরাই কিছুদিন ধরে বসে থেকে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছিল। কোনোদিক থেকেই কোনো নির্ধারণী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছিল না। যখন অসহ্য হয়ে উঠত, উপুড় বা চিৎ হয়ে পাথুরে মাটিতে শুয়ে একজন আরেকজনকে কবিতা শোনাত, গুনগুন করে গান গাইত, আর আদেশ এলে একটা দুটো ফায়ার করত।

দু’তরফের সৈন্যই সুরক্ষিত ছিল। ছুটে আসা গুলি পাথরের গায়ে ধাক্কা খেয়ে শান্ত হয়ে যেত। দুটো পাহাড়ই কাছাকাছি উচ্চতার। ফলে উপর থেকে গুলি চলারও ভয় ছিল না। পাহাড় দুটোর মাঝখানে সবুজ উপত্যকা। তার মধ্যে দিয়ে একটা নদী সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে।

হাওয়াই জাহাজ বা কামানের ভয়ও ছিল না। কারণ, কোনো পক্ষের কাছেই সেসব ছিল না। তাই নিশ্চিন্তে যে যেখানে পারত আগুন জ্বালিয়ে দিত। ধোঁয়া ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ধীরে ধীরে শূন্যে মিলিয়ে যেত। রাত তখন নিস্তব্ধ। একপক্ষ মাঝে-মাঝেই ওই পাহাড় থেকে অন্য পক্ষের হাসির আওয়াজ শুনতে পেত। কেউ হঠাৎ গান ধরলে রাতের অন্ধকার চিরে সেই গান পাহাড়ে পাহাড়ে ধ্বনিত হত।

চায়ের সময় শেষ। পাথরের চুলায় চাপানো ডালপালা জ্বলে জ্বলে নিভে এসেছে। চারদিকে হালকা শীত। হাওয়ায় আর ফুলের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না। যেন ফুলেরা অভিমানে রাতে নিজেদের আতরদানির মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। শুধুই পোড়া কাঠের গন্ধ।

কম্বল চাপিয়ে সবাই সজাগ হয়ে শুয়ে। মৃদু ইশারাতেই তারা উঠে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত।

জমাদার হরনাম সিং পাহারা দিচ্ছিল। ঘড়িতে দুটো বাজতেই গণ্ডা সিংকে তুলে সে পাহারায় বসিয়ে দিল। ঘুমোবে ভাবল, কিন্তু কিছুতেই ঘুম এল না। চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে তারা দেখতে দেখতে গুনগুন করতে লাগল।

‘এনে দে তারার জুতো,

এনে দে তারার জুতো…

ও হরনাম সিং! প্রিয় আমার!

এনে দে তারার জুতো…

তাতে বেচতে হলে বেচিস না-হয়

তোর ওই মহিষ দুটো!’

আকাশ জুড়ে সে ঝলমলে তারার জুতো দেখতে পাচ্ছিল।

‘দেব রে তারার জুতো,

দেব তোকে তারার জুতো…

ও হরনাম কৌর! প্রিয়া আমার!

দেব তোকে তারার জুতো…

তাতে বেচতে হলে বেচেই দেব

আমার মহিষ দুটো!’

নিজের গানে নিজেই উত্তর দিতে দিতে হরনাম সিং হেসে ফেলল। প্রিয়ার কথা মাথায় আসতেই আরো নানানরকম চিন্তাভাবনা আসতে লাগল। ঘুম আসবে না বুঝতে পেরে সে বাকিদেরকেও তুলে দিল। ভাবল, তাদের সঙ্গে কোনো এক কাল্পনিক হরনাম কৌরকে নিয়ে আবোলতাবোল বকে যদি শুকনো জীবনে একটু রস পাওয়া যায়, ক্ষতি কী!!

আবোলতাবোল গল্প শুরু হয়ে গেল। কিন্তু বিশেষ জমল না। ওদের মধ্যে সবচেয়ে অল্প বয়স বন্তা সিংয়ের। সে একটু তফাতে বসে নিজের মনে কী যেন ভাবতে শুরু করল! আর বাকিরা হাই তুলতে তুলতে বিক্ষিপ্তভাবে আদিরসাত্মক আলোচনা করতে লাগল।

বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎই বন্তা সিং গান শুরু করল। তার দরদি গলার ‘হীর’-এর কথায় আকাশ-বাতাস ভরে উঠল।

‘হীর কাঁদে, ”যোগী, মিছে কেন মিঠে কথায় মন ভোলাও?

কাছে ফিরে আর আসে না প্রেম হারালে কভু কোথাও।

যে পাখি খুয়েছে দল, সে কি আজ চুপ? নাকি চোখে জল?

একাকী যে জন তারে কেন আর সুখের গান শোনাও”!!’

হীরের শোকালাপের উত্তরে বন্তা সিং এবার রাঁঝার তরফে গেয়ে উঠল,

‘যে পাখিরে ভাবো দলহারা সে যে আসলে মুক্ত আজ,

ধন-মান খুয়ে নিজেরে যে পায়, সে-ই তো রাজাধিরাজ!

সঁপি ঈশ্বরে তনু-মন-ধন, আলোর দিশায় হোক উত্তরণ!

দুঃখ-দৈন্য বুকে নিয়ে পরো ওয়ারিস শাহের তাজ!…’

যেমন হঠাৎ শুরু করেছিল, কিছুক্ষণ বাদে তেমনি হঠাৎ সে চুপ করে গেল। ধূসর পাহাড় আবার নিস্তব্ধতায় ঢেকে গেল।

জমাদার হরনাম সিং শূন্যে একটা গালি দিয়ে শুয়ে পড়ল।

হঠাৎই রাতের উদাস হাওয়ায় একটা কুকুরের ডাক ভেসে এল। সবাই চমকে উঠে এ ওর দিকে তাকাতে লাগল। আবার আওয়াজ ভেসে এল, ভৌ-ভৌ…। এবার আরেকটু কাছ থেকে। হরনাম সিং উঠে বসে বলল, ‘যাঃ বাবা! কুকুর কোত্থেকে এল!’

কুকুরটা আবার ডেকে উঠল। এবার আরো কাছে। একটু পরে ঝোপের পিছনে তাকে দেখা গেল।

বন্তা সিং উঠে ঝোপের কাছে গেল। যখন ফিরে এল, তার সঙ্গে একটা নেড়ি কুকুর। লেজ দোলাচ্ছে।

বন্তা সিং হাসল, ‘জমাদার সাহেব, ওকে জিগ্যেস করলাম। বলল ওর নাম নাকি চপড় ঝুনঝুন।’

বাকিরাও হেসে উঠল। জমাদার কুকুরটাকে চুকচুক করে ডাকল, ‘চপড় ঝুনঝুন! এদিকে আয় তো!’

কুকুরটা লেজ নাড়াতে নাড়াতে জমাদারের কাছে গেল। খাবার-টাবার থাকতে পারে ভেবে পাথুরে মাটিতে নাক ঘষে ঘষে শুঁকতে লাগল।

হরনাম সিং একটা থলে থেকে বিস্কুট বের করে তার দিকে ছুঁড়ল। কুকুরটা বিস্কুট শুঁকে খেতে যাবে এমন সময় হরনাম সিং লাফিয়ে বিস্কুটটা তুলে নিল।

‘দাঁড়াও! এ পাকিস্তানি না তো?’

সবাই আবার হেসে উঠল। বন্তা সিং এগিয়ে চপড় ঝুনঝুনের পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, ‘না না সাহেব, চপড় ঝুনঝুন এক্কেবারে খাঁটি হিন্দুস্তানি।’

জমাদার হেসে কুকুরটাকে বলল, ‘প্রমাণ দেখা দেখি!’

সে লেজ নাড়াল।

হরনাম সিং আরো জোরে হেসে উঠল, ‘ওটা আবার একটা প্রমাণ হল! সব কুকুরই তো লেজ নাড়ায়!’

বন্তা সিং লেজটা ধরে বলল, ‘আশ্রয় চাইছে বেচারা।’

জমাদার আবার হেসে বিস্কুটটা আবার ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটা লাফিয়ে সেটাকে মুখে পুরে নিল।

এক সেপাই বুট দিয়ে মাটিতে গর্ত করতে করতে বলল, ‘এখন কুকুরকেও হয় হিন্দুস্তানি নয় পাকিস্তানি হতে হবে!’

হরনাম সিং আরেকটা বিস্কুট ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘আর পাকিস্তানি কুকুরকেও পাকিস্তানি লোকজনের মতোই বন্দুকের গুলিতে উড়িয়ে দেওয়া হবে।’

একজন চিৎকার করে স্লোগান দিল, ‘হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ!’ কুকুরটা বিস্কুট খেতে গিয়ে আওয়াজে চমকে উঠে পিছিয়ে গেল। লেজখানা দু’পায়ের মধ্যে গুটিয়ে গেল।

হরনাম সিং উচ্চস্বরে হেসে উঠল, ‘কী রে চপড় ঝুনঝুন? নিজের দেশের স্লোগান শুনে ভয় পেতে হয় নাকি!!!…নে, আরেকটা বিস্কুট খা।’ বলে আরেকটা বিস্কুট তার দিকে এগিয়ে দিল।

কথায় কথায় ভোর হয়ে গেল।

সূর্য উঠতে না উঠতেই চারিদিক আলোয় ভরপুর। টেটবালের পাহাড়, উপত্যকা, নদী, গাছপালা ঝলমল করে উঠেছে, ঠিক যেন কেউ বোতাম টিপে চারদিকের বাতি জ্বালিয়ে দিয়েছে।

টেটবাল এলাকায় বেশ অনেকদিন ধরেই যুদ্ধ চলছিল। একটা পাহাড় দখল করতে গিয়ে অন্তত এক ডজন সেনা মারা পড়ত। তাও কোথাও কারোর স্থায়ী দখল ছিল না। একটা পাহাড় আজ এই দলের কব্জায় তো কাল অন্য দলের কব্জায়, পরশু আবার এই দল দখল করল তো তার পরের দিন অন্য দলের হাতে চলে গেল।

জমাদার হরনাম সিং দূরবীন দিয়ে চারপাশের অবস্থা জরিপ করল। সামনের পাহাড় থেকে ধোঁয়া উঠছে। অর্থাৎ ওদিকে চা-জলখাবারের প্রস্তুতি চলছে। ওরাও নিশ্চয়ই এদিক থেকে ধোঁয়া ওঠা দেখতে পাচ্ছে!

সব সেপাইরাই নিজেদের জলখাবার থেকে কুকুরটাকে একটু-একটু দিতে লাগল। চপড় ঝুনঝুন পেট ভরে খেয়ে লেজ নাড়াতে শুরু করল। সে আসায় সেপাইদের নিস্তরঙ্গ জীবনে যেন একটু আনন্দ ফিরে এসেছিল। সবাই তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে উৎসুক হয়ে উঠল। মাঝে-মাঝেই এক-একজন চপড় ঝুনঝুনকে কাছে ডেকে তাকে আদর করতে লাগল।

সন্ধে হয়ে এসেছে। পাকিস্তানি মোর্চার সুবেদার হিম্মত খাঁ তার চওড়া গোঁফে তা দিতে দিতে টেটবালের ম্যাপ মন দিয়ে দেখছিল। পাশে ওয়ারলেস অপারেটর বসে প্লাটুন কমান্ডারের থেকে নির্দেশ নিচ্ছিল। একটু দূরে পাথরের হেলান দিয়ে বশীর বন্দুক কোলে গুনগুন করছিল, ‘প্রিয়, কোথায় কাটিয়ে এলে রাত, বল!…প্রিয়, কোথায় কাটিয়ে এলে!’

গাইতে গাইতে গলা একটু চড়েছে, এমন সময় বশীর শুনতে পেল হিম্মত খাঁ জোরে কাকে একটা বলছে, ‘কী রে! সারারাত কোথায় ছিলি?’

বশীর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে হিম্মত খাঁর দিকে তাকাল। হিম্মত খাঁ অন্য কাউকে একটা উদ্দেশ্য করে বলছে, ‘বল! কী রে?’

বশীর অন্যদিকে তাকাল।

একটু দূরে সেই নেড়ি কুকুরটা বসে। কুকুরটা বেশ কিছুদিন আগে আচমকা তাদের মোর্চায় এসে পড়েছিল। তারপর থেকে এখানেই রয়ে গেছে।

বশীর হেসে কুকুরটার দিকে তাকিয়ে গাইল, ‘প্রিয়, কোথায় কাটিয়ে এলে রাত, বল!’

কুকুরটা জোরে জোরে লেজ নাড়তে লাগল। যেন পাথুরে মাটি ঝাঁট দিচ্ছে!

সুবেদার হিম্মত খাঁ একটা নুড়ি ছুঁড়ে মেরে বলল, ‘শালা শুধুই লেজ নাড়তে জানে!’

বশীর মন দিয়ে দেখতে দেখতে বলল, ‘এর গলায় ওটা কী?’

তার ওঠার আগেই আরেকজন সেপাই কুকুরটার গলায় বাঁধা দড়িটা খুলে নিল। দড়িতে পিচবোর্ডের মতো একটা শক্ত জিনিস গাঁথা। তার উপর কিছু একটা লেখা।

বশীর এগিয়ে গিয়ে টুকরোটা নিল, ‘চপড় ঝুনঝুন…অ হ্যাঁ!!! এটা কী!!!’

সুবেদার গোঁফে একটা মোক্ষম তা দিয়ে জিগ্যেস করল, ‘হবে কিছু একটা শব্দ।…বশীর, আর কিছু লেখা আছে?’

বশীর উত্তর দিল, ‘হুম। লেখা আছে,…এ হিন্দুস্তানি কুকুর।’

সুবাদার ভাবতে শুরু করল, ‘সেটা আবার কী?! কী লেখা ছিল তার আগে? চপড় কী?…’

‘চপড় ঝুনঝুন!’

একজন সেপাই অনেক ভেবে বলে উঠল, ‘কিছু একটা মানে নিশ্চয়ই লুকিয়ে আছে।’

কথাটা সুবাদারের মনে ধরল, ‘হুম, বোধহয় ঠিকই বলছ।’

বশীর আবার পড়ল, ‘চপড় ঝুনঝুন এ হিন্দুস্তানি কুকুর।’

সুবেদার হিম্মত খাঁ ওয়ারলেস সেট নিয়ে হেডফোন কানে গুঁজে প্লাটুন কমান্ডারকে পুরো বৃত্তান্ত জানাল—কীভাবে কুকুরটা সেখানে এসেছিল, কেমন কয়েকদিন তাদের কাছে ছিল, তারপর হঠাৎ কেমন করে এক রাতে উধাও হয়ে গেল, ফিরে আসার পর তার গলায় পিচবোর্ডে কী লেখা…’চপড় ঝুনঝুন! এ হিন্দুস্তানি কুকুর।’

কিন্তু কেউই এর কোনো অর্থ খুঁজে পেল না।

বশীর কুকুরটার কাছে বসে আদর করে, বকে, ভয় দেখিয়ে বিভিন্নভাবে জিগ্যেস করতে লাগল যে সে কোথায় ছিল, গলায় ওটা কে বেঁধেছিল ইত্যাদি। কিন্তু ঠিকঠাক উত্তর পাওয়া গেল না। যাই জিগ্যেস করা হয়, কুকুর শুধু লেজ নাড়ায়। শেষে অধৈর্য হয়ে বশীর তাকে এক লাথি মারল। কুত্তা ব্যথায় কাঁউকাঁউ করে উঠল।

ওয়ারলেস সেটে কথা শেষ করে হিম্মত খাঁ কিছুক্ষণ টেটবালের ম্যাপটা দেখতে থাকল। তারপর সিগারেটের ডিব্বার ঢাকনা খুলে সেটা বশীরকে দিয়ে নিষ্পত্তিসূচক গলায় বলল, ‘বশীর, এতে লেখো…।’

বশীর ঢাকনাটা নিয়ে জিগ্যেস করল, ‘কী লিখব, সুবেদার সাহেব?’

হিম্মত খাঁ গোঁফে চাড়া দিতে দিতে চিন্তান্বিত স্বরে বলল, ‘লিখে দাও… কিছু একটা লিখে দাও…কী লেখা উচিত বল তো?’

পেন্সিল ঠোঁটে লাগিয়ে বশীর ভাবতে বসে গেল। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘সপড় সুনসুন!…হাঁ ঠিক। চপড় ঝুনঝুনের উত্তর সপড় সুনসুনই হবে। এটাই লিখব। শালা বেজন্মাগুলো মনে রাখবে!’

বশীর ডিব্বার ঢাকনায় লিখল, ‘সপড় সুনসুন।’

হিম্মত খাঁ উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘শাবাশ! একদম ঠিক। এটাই লিখে দাও। আর লেখো, সপড় সুনসুন—এ পাকিস্তানি কুকুর!’

বশীরের হাত থেকে ঢাকনাটা নিয়ে সে পেনসিল দিয়ে তাতে ফুটো করে দড়ির মধ্যে পরিয়ে দিল।

‘নিয়ে যা তোর ইয়ের ওখানে!’

সবাই হো হো করে হেসে উঠল।

সুবেদার হিম্মত খাঁ কুকুরের গলায় দড়িটা পরিয়ে দিল। কুকুরটা তখনো লেজ নাড়িয়েই যাচ্ছে। তাকে কিছু খাবার দিয়ে সুবেদার উপদেশের ভঙ্গিতে বলল, ‘বন্ধু, গদ্দারি কোরো না। গদ্দারির শাস্তি কিন্তু মৃত্যু।’

কুকুর লেজ নাড়াতে নাড়াতে খাওয়া শেষ করলে সুবেদার তার দড়ি ধরে তাকে পাহাড়ের পাকদন্ডীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘যাও। আমাদের চিঠি শত্রুর কাছে পৌঁছে দিয়ে এসো।…কিন্তু ফিরে এসো…অফিসারের হুকুম! বুঝেছ?’

কুকুর লেজ নাড়াতে নাড়াতে পাকদণ্ডী দিয়ে নামতে লাগল।

হঠাৎ ওদিক থেকে ফায়ারিং-এর আওয়াজ শুনে হিন্দুস্তানি মোর্চার সেপাইরা চমকে উঠল। কারণ কিছু বুঝতে পারল না।

জমাদার হরনাম সিং কোনো কারণে বিরক্ত ছিল। আওয়াজ শুনে আরো বিরক্ত হয়ে গেল। জোরে জোরে দাড়িতে চিরুনি চালাতে চালাতে কিছুক্ষণ পর জালের মধ্যে কোনওক্রমে দাড়ি ঠিকঠাক করে বন্তা সিংকে জিগ্যেস করল, ‘সাধে বলে, কুকুরের পেটে ঘি সহ্য হয় না!!…চপড় ঝুনঝুন শালা গেল কোথায়?’

বন্তা সিং প্রবাদের মানে বুঝতে পারল না, ‘আমরা তো ওকে ঘি খাওয়াইনি!’

হরনাম সিং হা-হা করে হেসে উঠল, ‘মূর্খ! তোর সঙ্গে কথা বলাই মুশকিল!’

একজন সেপাই দূরবীন দিয়ে এদিক-ওদিক উপরে নীচে দেখছিল। সে হঠাৎ চেঁচাল, ‘ওই তো আসছে…!’

সবাই চমকে উঠল।

জমাদার জিগ্যেস করল, ‘কে আসছে?’

‘চপড় ঝুনঝুন…আর কে!’

‘চপড় ঝুনঝুন? আসছে?’

‘হ্যাঁ! ওই তো!’

জমাদার হরনাম সিং সেপাইয়ের হাত থেকে দূরবীন নিয়ে চোখ লাগাল।

‘হ্যাঁ, এদিকেই তো আসছে!…গলায় দড়ি বাঁধা।…কিন্তু…কিন্তু এ তো শত্রু মোর্চার ওদিক থেকে আসছে!’ কুকুরের মা-কে একটা চোখা গালি দিয়ে হরনাম সিং বন্দুক তুলে ফায়ার করল।

কিন্তু গুলি নিশানায় লাগল না। কুকুরটার থেকে একটু দূরে একটা পাথরে লেগে মাটিতে ঢুকে গেল। কুকুরটা চমকে থেমে গেল।

অন্যদিকে সুবেদার হিম্মত খাঁ দূরবীন দিয়ে দেখতে পেল, কুকুর পাকদণ্ডিতে দাঁড়িয়ে। ওদিক থেকে আরেকটা ফায়ার হতেই সে লেজ উল্টে সুবেদারের মোর্চার দিকে দৌড় মারল।

হিম্মত খাঁ চিৎকার করে বলল, ‘বাহাদুর না তুই!! ভয় পেতে নেই!…যা ওদিকে!…’

বলে কুকুরটার দিকে লক্ষ্য করে সেও ফায়ার করল।

কুকুরটা আবার থেমে গেল।

জমাদার হরনাম সিং আবার বন্দুক চালাল। গুলি এবার কুকুরের কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। ভয়ে সে লাফাতে লাফাতে দুটো কান নাচাতে শুরু করল।

সুবেদার ওদিক থেকে দ্বিতীয়বার ফায়ার করল। কুকুরটার ঠিক পাশে একটা পাথরে গিয়ে গুলিটা গেঁথে গেল।

ঘাবড়ে গিয়ে কুকুর একবার এদিকে দৌড়ায়, একবার ওদিকে!

তার দিশেহারা অবস্থা দেখে হিম্মত খাঁ আর হরনাম সিং নিজের নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে হা হা করে হাসতে লাগল।

কুকুর এবার জমাদারের মোর্চার দিকে এগোতেই জমাদার আবার বন্দুক চালাল। এবার গুলি লাগল তার পায়ে। সে গগনভেদী আর্তনাদ করে উঠল।

উল্টোদিকে ঘুরে সুবেদারের মোর্চার দিকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যেতে চেষ্টা করতেই ওদিক থেকে হিম্মত খাঁ আবার গুলি চালাল, ‘শাবাশ!! বাহাদুর! চোটের পরোয়া করতে নেই!…যা ওদিকে!’

কুকুর ভয়ে আবার অন্যদিকে ঘুরল। তার একটা পা কাজ করছিল না। তিন পায়ে ঘষে ঘষে কোনওরকমে একটু এগোতেই হরনাম সিং নিশানা করে গুলি চালাল। কুকুরটা পড়ে গেল।

আর কোনো আওয়াজ নেই।

সুবেদার হিম্মত খাঁ আফসোস করে বলল, ‘ইশ! বেচারা শহীদ হয়ে গেল।’

জমাদার হরনাম সিং বন্দুকের গরম নল হাতের উপর ঘষে বলল, ‘শালা কুকুরের মতোই মরেছে!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *