টোবা টেক সিং

টোবা টেক সিং

দেশভাগের দু-তিন বছর পর পাকিস্তান আর হিন্দুস্তানের শাসনকর্তাদের হঠাৎ মনে হল, সাধারণ কয়েদীদের সঙ্গে সঙ্গে পাগলদেরও অদলবদল হওয়া উচিত। অর্থাৎ হিন্দুস্তানের পাগলাগারদে যে মুসলমান পাগলেরা রয়েছে তাদের পাকিস্তান আর পাকিস্তানের পাগলাগারদে যে হিন্দু ও শিখ পাগলেরা আছে তাদের হিন্দুস্তানে পৌঁছে দেওয়া উচিত।

সেই ভাবনা ঠিক কি ভুল জানি না, কিন্তু হোমরা-চোমরাদের ইচ্ছায় এদিকে-ওদিকে অনেক কনফারেন্স হল, মিটিং হল আর তারপর একদিন পাগলদের বদলির বিল পাস হয়ে গেল। দিনক্ষণও ঠিক হয়ে গেল।

তত্ত্বতালাশে কোনো খামতি ছিল না। যে মুসলমান পাগলদের আত্মীয়-স্বজন হিন্দুস্তানে ছিল, তারা হিন্দুস্তানেই থেকে গেল। বাকিদের সীমানা পার করিয়ে পাকিস্তান পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা হল। পাকিস্তান থেকে প্রায় সব হিন্দু-শিখই পালিয়ে গেছিল। ফলে সেখানে হিন্দু বা শিখ পাগলদের রাখার কোনো মানে ছিল না। তাদের পুলিশি হেফাজতে বর্ডারে নিয়ে যাওয়া হল।

ওদিকের কথা জানি না, তবে লাহোরের পাগলাগারদে যখন এই বদলির খবর এল, জোর গল্পগুজব শুরু হয়ে গেল।

সেখানে এক মুসলমান পাগল ছিল যে বিগত বারো বছর ধরে প্রতিদিন নিয়ম করে ”জমিদার”* পড়ত। আরেকজন পাগল তাকে জিগ্যেস করল, ‘মৌলবি সাহেব, এই পাকিস্তান কী জিনিস?’

মৌলবি খুব চিন্তিত মুখে উত্তর দিল, ‘পাকিস্তান হল হিন্দুস্তানের এমন একটা জায়গা যেখানে ক্ষুর তৈরি হয়।’

অন্যজন এই শুনে শান্ত হয়ে ভাবতে বসে গেল।

এরকমই এক শিখ পাগল আরেক শিখ পাগলকে জিগ্যেস করল, ‘সর্দারজি, আমাদের হিন্দুস্তান কেন পাঠানো হচ্ছে!? আমি তো ওখানকার ভাষাও জানি না।’

প্রথমজন হাসল, ‘আমি তো জানি ওখানকার ভাষা।’ বলে সুরে সুরে বলতে লাগল, ‘হিন্দুস্তান খুব শয়তান, গুমোর নিয়ে থাকে।’

একদিন স্নান করতে করতে এক মুসলমান পাগল জোরে জোরে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ চিৎকার করতে করতে পিছলে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল।

এদের মধ্যে কিছু লোক ছিল যারা আসলে পাগল না। তারা বেশিরভাগই খুনের আসামী। তাদের বাড়ির লোকেরা ফাঁসির হাত থেকে বাঁচাতে পুলিশকে ঘুষ-টুষ দিয়ে তাদের পাগল সাজিয়ে পাগলাগারদে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এরা তবু একটু-আধটু বুঝত হিন্দুস্তান-পাকিস্তান কেন আলাদা হয়েছে। কিন্তু বিশদে কিছুই জানত না। খবরের কাগজ থেকে যেটুকু জানা যেত, তাই ছিল এদের জ্ঞানের পরিধি। পুলিশ বা পাহারাদারদের জিগ্যেস করে কোনো লাভ হত না। কারণ তারা বেশিরভাগই অশিক্ষিত আর মূর্খ। কাগজ পড়ে, এর-ওর-তার কথা শুনে এটুকুই জেনে গেছিল যে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ বলে একজন আছেন যাঁকে কায়েদ-এ-আজম বলা হয়। তিনি মুসলমানদের জন্য একটা আলাদা দেশ করেছেন। নাম পাকিস্তান। কিন্তু পাকিস্তান কোথায়, এর ভৌগোলিক সীমা কী, এসব কিছু কেউই জানত না। ফলত যেসব পাগলের তখনো একটুও বোধশক্তি বাকি ছিল, তারা এই দ্বন্দ্ব থেকে বেরোতে পারছিল না যে তারা হিন্দুস্তানে আছে, না পাকিস্তানে আছে! হিন্দুস্তানে থাকলে পাকিস্তানটা কোনদিকে? আর যদি পাকিস্তানে থাকে, তাহলে…তাহলে সেটা কী করে সম্ভব? এই ক’দিন আগেই তো তারা হিন্দুস্তানে ছিল!

এক পাগল এই হিন্দুস্তান-পাকিস্তান, পাকিস্তান-হিন্দুস্তানের গন্ডগোলে এমন ফাঁসল যে আরো খানিকটা পাগল হয়ে গেল। ঝাঁট দিতে দিতে একদিন সে গাছে চড়ে বসল আর টানা দু’ঘণ্টা ধরে দেশভাগ নিয়ে ভাষণ দিয়ে গেল। সেপাইরা তাকে নামতে বলতেই সে আরো উঁচু একটা ডালে চড়ে ঘোষণা করল, ‘আমি হিন্দুস্তানেও যাব না, পাকিস্তানেও যাব না। আমি এই গাছেই থাকব।’

অনেক কষ্টে তাকে ঠান্ডা করা হল। ঠান্ডা হতেই সে গাছ থেকে নেমে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল। হিন্দু-শিখ বন্ধুদের জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল, ‘তোমরা হিন্দুস্তান চলে যাবে ভাই! তোমরা আমায় ছেড়ে চলে যাবে…?’

এক এম.এস.সি. পাস মুসলমান রেডিও ইঞ্জিনিয়ার ছিল যে বাকি পাগলদের থেকে আলাদা থাকত। সারাদিন সে বাগানে নিজের মনে চুপচাপ চলে ফিরে বেড়াত। এই বদলির গল্প শুনতে পেয়ে সে সব জামাকাপড় খুলে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়ে উলঙ্গ হয়ে বাগানে ঘুরে বেড়াতে লাগল।

চিনিয়োটের এক মোটামতো পাগল আগে মুসলিম লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিল। সে পাগলাগারদে আসা ইস্তক দিনে পনেরো-ষোলোবার স্নান করত। খবর শুনে সে স্নান-টান করা বন্ধ করে দিল। তার নাম মুহম্মদ আলী। সে ঘোষণা করল যে সে-ই কায়েদ-এ-আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ। সেই দেখে এক শিখ পাগল নিজেকে মাস্টার তারা সিং বলে ঘোষণা করে দিল। খুনখারাপির যথেষ্ট সম্ভাবনা উপস্থিত হতে দুজনকেই বিপজ্জনক পাগলের তকমা লাগিয়ে আলাদা আলাদা জায়গায় বন্ধ করে দেওয়া হল।

লাহোরের এক তরুণ হিন্দু উকিল প্রেমে ব্যর্থ হয়ে পাগল হয়ে গেছিল। অমৃতসর হিন্দুস্তানে চলে গেছে শুনে তার আর দুঃখের শেষ থাকল না। তার প্রেমিকা অমৃতসরে থাকত। হিন্দু। যদিও মেয়েটি তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, কিন্তু সে তাকে ভুলতে পারেনি।

সে তামাম হিন্দু-মুসলমান নেতাদের উদ্দেশ্যে অশ্রাব্য গালিগালাজ শুরু করল যে তাদের জন্যই হিন্দুস্তান দু’ভাগ হয়েছে। তার প্রেমিকা এখন হিন্দুস্তানী আর সে পাকিস্তানী! বদলির কথা শুরু হতে অন্য সব পাগলে মিলে উকিলকে বোঝাতে লাগল যে তার চিন্তার কিছু নেই; তাকে অমৃতসর পাঠিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু সে আবার লাহোর ছাড়তেও নারাজ। তার ধারণা অমৃতসরে তার প্র্যাক্টিস চলবে না।

ইউরোপিয়ান ওয়ার্ড-এ দুই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পাগল ছিল। ইংরেজ ভারত ছেড়ে চলে গেছে শুনে তারা ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল। দুজন চুপিচুপি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগল যে এবার পাগলাগারদে তাদের অবস্থায় কোনো পরিবর্তন আসবে কিনা! ইউরোপিয়ান ওয়ার্ডটা কি আদৌ থাকবে? ব্রেকফাস্ট পাওয়া যাবে, নাকি ডাবল ব্রেডের বদলে তাদের ব্লাডি ইন্ডিয়ান চাপাটি গিলতে হবে?!

এক শিখ পাগল ছিল যে বছর পনেরো আগে সেখানে ভর্তি হয়েছিল। সে শুধু বিড়বিড় করত, ‘ওপড় দি গড়গড় দি অ্যানেক্স দি বে-ধিয়ানা দি মুঙ্গ দি দাল অফ দি লালটেন…।’ *

পাহারাদারেরা বলত, সে নাকি পনেরো বছরে একমুহূর্তের জন্যও ঘুমোয়নি, এমনকি শোয়নি পর্যন্ত। মাঝে মাঝে দেওয়ালে শুধু একটু হেলান দিয়ে নিত। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার পা ফুলে ঢোল হয়ে গেছিল। তবু সে বিশ্রাম নিত না।

দেশভাগ, অদলবদল এসবের কথা আলোচনা হলে সে খুব মন দিয়ে শুনত। রায় জিগ্যেস করলে সে গম্ভীর মুখে জবাব দিত, ‘ওপড় দি গড়গড় দি অ্যানেক্স দি বে-ধিয়ানা দি মুঙ্গ দি দাল অফ দি পাকিস্তান গভর্নমেন্ট।’

কয়েকদিন পর ‘পাকিস্তান গভর্নমেন্ট’ টা বদলে হয়ে গেল ‘টোবা টেক সিং গভর্নমেন্ট”। অন্যান্য পাগলদেরকে সে প্রায়শই প্রশ্ন করতে লাগল টোবা টেক সিংটা কোথায়। কিন্তু কেউই স্থির করে বলতে পারল না সেটা তৎকালীন হিন্দুস্তানে না পাকিস্তানে। লোকের এমনিতেই ধন্দের শেষ ছিল না।…সিয়ালকোট তো ছিল হিন্দুস্তানে। সেটা কী করে পাকিস্তানে চলে গেল!…কে জানে কবে শুনবে লাহোর হিন্দুস্তানের মধ্যে ঢুকে গেছে!… বা কোনোদিন শুনবে পুরো হিন্দুস্তানই পাকিস্তান হয়ে গেছে!…বা একদিন হয়তো শোনা যাবে, হিন্দুস্তান-পাকিস্তান কোনোটাই আর নেই!…

ভয়াবহ লাগত শিখ পাগলটাকে দেখে। চুল অযত্নে লুপ্তপ্রায়। স্নান করত না বলে দাড়ি আর চুলে জট পাকিয়ে গেছিল। কিন্তু সে আদপেই ভয়ঙ্কর ছিল না। সবাই জানত যে সে খুবই নিরীহ আর শান্তশিষ্ট। পনেরো বছরে কারোর সঙ্গে কোনো ঝামেলা করেনি।

পাগলাগারদের পুরোনো কর্মচারীরা জানত যে টোবা টেক সিং বলে একটা জায়গার সে জমিদার। প্রচুর জমিজায়গা, পয়সাকড়ি ছিল তার। হঠাৎই একদিন তার মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ায় বাড়ির লোক লোহার মোটা শিকলে বেঁধে তাকে এনে পাগলাগারদে রেখে দিয়ে গেছিল।

মাসে একবার তার সঙ্গে দেখা করতে বাড়ি থেকে লোকজন আসত। দেশভাগের দাঙ্গাহাঙ্গামায় তাও বন্ধ হয়ে গেল।

তার নাম বিষণ সিং। লোকে তাকে টোবা টেক সিং ডাকত। দিনক্ষণ-মাস -বছর কিছুই তার খেয়াল থাকত না। তবু প্রত্যেক মাসে আত্মীয়দের আসার দিনটা কীভাবে যেন সে আগেভাগেই বুঝে যেত! নিজেই পুলিশকে গিয়ে খবর দিত যে লোকজনের দেখা করতে আসার সময় হয়ে গেছে। সেই একটা দিন সে সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে স্নান করত, চুলে ভালো করে তেল মেখে চুল আঁচড়াত আর তুলে রাখা পরিষ্কার জামাকাপড় বার করিয়ে পরে তবে দেখা করতে যেত। কিন্তু বাড়ির লোক কিছু প্রশ্ন করলেই শুধু বিড়বিড় করত, ‘ওপড় দি গড়গড় দি অ্যানেক্স দি বে-ধিয়ানা দি মুঙ্গ দি দাল অফ দি লালটেন।’

তার এক মেয়ে ছিল। প্রত্যেক মাসে আঙুল সমান বাড়তে বাড়তে পনেরো বছরে সে রীতিমতো যুবতী হয়ে উঠেছিল। বিষণ সিং তাকে চিনত না। মেয়ে ছোটবেলায় এসে বাবাকে দেখেই কাঁদতে শুরু করে দিত। বড় হয়েও তার সেই চোখের জল থামেনি।

পাকিস্তান-হিন্দুস্তান গোলমাল শুরু হতেই বিষণ সিং আর সব পাগলকে ধরে ধরে জিজ্ঞেস করতে লাগল, ‘টোবা টেক সিং কোথায়?’

কারোর কাছ থেকেই কোনো সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া গেল না। ততদিনে আত্মীয়দের আসাও বন্ধ হয়ে গেছিল। আগে অন্তত তার মন বলত কবে দেখা করার দিন আসবে। ধীরে ধীরে মনও চুপচাপ হয়ে গেল।

ভালোবেসে আগে ফল-মিষ্টি নিয়ে যারা আসত, সে তাদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল। সে নিশ্চিত ছিল তারা টোবা টেক সিং থেকেই আসে। তারা নিশ্চয়ই বলে দিতে পারবে টোবা টেক সিং কোথায়!

পাগলাগারদে একজন পাগল ছিল যে নিজেকে ঈশ্বর বলত। বিষণ সিং একদিন তাকে গিয়ে জিগ্যেস করল, ‘টোবা টেক সিং এখন কোথায়? হিন্দুস্তানে না পাকিস্তানে?’

সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল, ‘কোথাও না। কারণ আমি এখনো হুকুম দিইনি।’

বিষণ সিং সেই ঈশ্বরের কাছে অনেক কাকুতি মিনতি করল যাতে সে তাড়াতাড়ি হুকুম দিয়ে ঝামেলা মিটিয়ে দেয়; কিন্তু ঈশ্বর অটল। তার নাকি তখনো আরো অনেক হুকুম দেওয়ার আছে। শেষে বিরক্ত হয়ে বিষণ সিং তার উপর চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওপড় দি গড়গড় দি অ্যানেক্স দি বে-ধিয়ানা দি মুঙ্গ দি দাল অফ ওয়াহে গুরু জি দা খালসা অ্যান্ড ওয়াহে গুরু জি দি ফতেহ…!’

বোধহয় বলতে চাইল, ‘তুমি মুসলমানদের ঈশ্বর, তাই এরকম করছ। শিখদের ঈশ্বর হলে নিশ্চয়ই আমার কথা শুনতে।’

বদলির কিছুদিন আগে বিষণ সিংয়ের এক পুরোনো মুসলমান বন্ধু দেখা করতে এল। সে টোবা টেক সিংয়ে থাকত। আগে কখনো আসেনি। বিষণ সিং লোক এসেছে শুনে গিয়ে যখন তাকে দেখল, পিছনে সরে গেল। ফিরে যেতে পা বাড়াতেই সেপাইরা তাকে বোঝাল, ‘তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে…তোমার বন্ধু ফজলদীন।… দেখা করে নাও। চলে যেও না।’

বিষণ সিং ফজলদীনের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করতে লাগল।

ফজলদীন তার কাছে এসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘অনেকদিন ধরে তোমার কাছে আসব ভাবছি। কিন্তু সময়ই হয়ে উঠছিল না।…তোমার বাড়ির লোকেরা ভালোভাবে হিন্দুস্তান চলে গেছে।…আমার পক্ষে যতটা সম্ভব সাহায্য করেছি।…তোমার মেয়ে রূপ কৌর…’ বলতে বলতে সে থেমে গেল।

বিষণ সিং যেন কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করতে লাগল, ‘মেয়ে রূপ কৌর…’

ফজলদীন থেমে থেমে বলল, ‘হ্যাঁ…সে…মানে…হ্যাঁ সেও ভালো আছে… ওদের সঙ্গেই চলে গেছে…।’

বিষণ সিং চুপ করে রইল।

ফজলদীন আবার বলতে শুরু করল, ‘আমায় ওরা বলে গেছিল তোমার খোঁজ-খবর নিতে। আমি এই শুনলাম যে তুমিও হিন্দুস্তান যাচ্ছ।…ভাই বলবীর সিং আর ভাই বধাবা সিংকে আমার সালাম দিও…বোন অমৃত কৌরকেও… ভাই বলবীরকে বোলো যে ফজলদীন ভালো আছে…যে দুটো বাদামি মোষ দিয়ে গেছিল, একটার বাছুর হয়েছে। আরেকটারও হয়েছিল, কিন্তু জন্মের ছদিন বাদেই মরে গেছে।…আর…আর…বোলো যদি ওদের কখনো কিছু লাগে, আমি সাধ্যমত করব। এই নাও, তোমার জন্য একটু মিষ্টি এনেছি।’

বিষণ সিং মিষ্টির বাক্স নিয়ে পাশে দাঁড়ানো সেপাইয়ের হাতে দিয়ে দিল। তারপর ফজলদীনের দিকে তাকিয়ে তাকে জিগ্যেস করল, ‘টোবা টেক সিং কোথায়?’

ফজলদীন অবাক হয়ে উত্তর দিল, ‘কোথায়!…কোথায় মানে?…যেখানে ছিল সেখানেই!’

‘হিন্দুস্তানে না পাকিস্তানে?’

‘হিন্দুস্তানে…না না, বোধহয় পাকিস্তানে…’ ফজলদীন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল।

বিরক্তমুখে বিষণ সিং উল্টোদিকে হাঁটা দিল, ‘ওপড় দি গড়গড় দি অ্যানেক্স দি বে-ধিয়ানা দি মুঙ্গ দি দাল অফ পাকিস্তান অ্যান্ড হিন্দুস্তান অফ দি দূর ফিটে মুহ!’…

অদলবদলের সমস্ত প্রস্তুতি শেষ। দুদিকের পাগলদের নামের ফিরিস্তি পুলিশের কাছে পৌঁছনোর পর দিনক্ষণও স্থির হয়ে গেল।

শীতকাল। লাহোর থেকে হিন্দু আর শিখ পাগলদের লরিতে তুলে পুলিশ ও কিছু অফিসার বর্ডারের দিকে রওনা দিল। ওয়াগা বর্ডারে দু’তরফের সুপারিনটেনডেন্টের দেখা হল। প্রাথমিক নিয়মকানুন সারার পর আসল কাজ শুরু হল। আর তা চলল সারারাত ধরে।

পাগলদের লরি থেকে নামিয়ে অন্যদিকের অফিসারদের হেফাজত অবধি পৌঁছে দেওয়া আদৌ সহজ ছিল না। অনেকে নামতেই চাইছিল না। কোনওক্রমে তাদের যদি নামানোও হত, তারা এদিকে ওদিকে দৌড় লাগাত। তাদের সামলানো সে এক ঝক্কি! যারা উলঙ্গ, তাদের জামাকাপড় পরালেই খুলে-ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছিল। কেউ গালাগাল করছিল, কেউ গান গাইছিল, কেউ বা ডাক ছেড়ে কাঁদছিল, আবার কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে মারপিট শুরু করে দিয়েছিল। কান পাতা দায়! আরেকদিকে মেয়ে পাগলদের আরেকরকম চিৎকার। কারোর আবার শীতের চোটে দাঁতে দাঁত লেগে গিয়ে তারা ঠকঠক করে কাঁপছিল।

বেশিরভাগ পাগলই এই বদলিতে অসম্মত ছিল। তাদের মাথায় ঢোকেনি, নিজের জায়গা থেকে উৎখাত করে তাদেরকে অন্য জায়গায় কেন ফেলা হচ্ছে! যারা একটু -আধটু বুঝছিল, তাদের কেউ ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, কেউ ‘পাকিস্তান মুর্দাবাদ’—বিভিন্নরকম স্লোগান দিচ্ছিল। স্লোগানের চোটে কিছু মুসলমান আর শিখ এমন রেগে গেল যে প্রায় দাঙ্গার উপক্রম! বহুকষ্টে তাদের শান্ত করা হল।

বিষণ সিংয়ের নম্বর আসতে সে ওপারে গিয়ে অফিসারকে জিগ্যেস করল, ‘টোবা টেক সিং কোথায়? পাকিস্তানে না হিন্দুস্তানে?’

অফিসার একটা রেজিস্টারে নামধাম লিখছিল। সে প্রশ্ন শুনে হাসল, ‘পাকিস্তানে।’

শুনেই বিষণ সিং লাফ দিয়ে পালিয়ে ফিরে এপারে তার বন্ধুদের কাছে চলে এল। পাকিস্তানী সেপাইরা ধরে ওদিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে সে জোরে জোরে মাথা নাড়তে শুরু করল, ‘টোবা টেক সিং এখানে…ওপড় দি গড়গড় দি অ্যানেক্স দি বে-ধিয়ানা দি মুঙ্গ দি দাল অফ টোবা টেক সিং অ্যান্ড পাকিস্তান….’

তাকে অনেক বোঝানো হল, টোবা টেক সিং হিন্দুস্তান চলে গেছে। আর কোনো কারণে না গেলে তাকে তক্ষুনি পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

সে একচুল নড়ল না।

আরেকটু জোর করতেই সে ছিটকে গিয়ে দুদিকের মাঝামাঝি একটা জায়গায় ফোলা পা নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। কোনো শক্তিই যেন তাকে সেখান থেকে টলাতে পারবে না!

নিরীহ মানুষ বলে তাকে খুব একটা জোরজবরদস্তি করা হল না। বাকি কাজ চলতে থাকল।

বিষণ সিং স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে রইল।

ভোর হয়ে এসেছে। সূর্য উঠতে আর অল্প দেরি। হঠাৎ বিষণ সিংয়ের গলা চিরে একটা আকাশভেদী আর্তনাদ বেরোল।

সঙ্গে সঙ্গে দুদিকের অফিসাররা দৌড়ে এল।…

যে গত পনেরো বছরে এক মুহূর্তও শোয়নি, সেই বিষণ সিং উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে!

একদিকে কাঁটাতারের ওপাশে হিন্দুস্তান। আরেকদিকে তেমনি একটা কাঁটাতারের এপাশে পাকিস্তান।

মাঝখানের একফালি জমিতে টোবা টেক সিং পড়ে রইল।

______

* এক উর্দু খবরের কাগজ ।

* বে-ধিয়ানা =বেখেয়াল /অমনোযোগ । লালটেন =লন্ঠন ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *