০৬. হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রণধ্বণি

ছয়

আনন্দমঠকে যদি কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর সঙ্গে তুলনা করা হয়, কৃষ্ণচরিতের তুলনা করতে হবে ডাস ক্যাপিটালের সঙ্গে। আনন্দমঠে বঙ্কিম যে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রণধ্বণিটি উচ্চারণ করেছেন এবং কৃষ্ণচরিতে সেই হিন্দু রাষ্ট্রের একটা তাত্বিক ভিত্তি দাঁড় করিয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণকে তিনি এমন একজন আদর্শ রাষ্ট্রগুরু হিসেবে এঁকেছেন যাঁর দৃষ্টান্ত নিষ্ঠার সঙ্গে অনুসরণ করলে ভারতের হিন্দুরা জগতের বুকে একটি শক্তিমান জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। সমগ্র ভারতের হিন্দু জনসমাজে দুজন মানুষের প্রভাব এতো গভীরতরো এবং সুদূরপ্রসারী হতে পেরেছে, হাজার হাজার বছরের পরে আবাল বৃদ্ধ হিন্দু নরনারী এই দু’জন মানুষের স্মৃতি অন্তরে অনুরাগ ভরে লালন করেছে। বিপদে তাঁদের কাছে বরাভয়, শোকে সান্ত্বনা, এবং নশ্বর জীবনের অন্তে পরপারের সদগতি প্রার্থনা করেছে। তাঁদের একজন অযোধ্যার রাজা রামচন্দ্র এবং অন্যজন শ্রীকৃষ্ণ। দু’জনেই বিচারশীল নরপতি, ক্ষত্রিয় বীর, সাহসী যোদ্ধা এবং আদর্শ মানুষ। বঙ্কিমচন্দ্র শ্রীকৃষ্ণকেই তাঁর অভিনিবিশের বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তার কারণও আছে। রামচন্দ্রের তুলনায় শ্রীকৃষ্ণ অপেক্ষাকৃত পরবর্তী যুগের মানুষ। তাঁর পবিত্র মুখ থেকেই গীতার পবিত্র শ্লোকসমূহ নির্গত হয়েছে। প্রতিটি ধর্মপ্রাণ হিন্দু নরনারী দৈনন্দিন জীবন ধারণের একটি দিক নির্দেশকের ভূমিকা গীতা থেকে পেয়ে থাকে। যাঁর মুখ থেকে গীতার পবিত্র শ্লোকসমূহ নির্গত হয়েছে, সেই শ্রীকৃষ্ণকে আদর্শ হিন্দু রাষ্ট্রের ধারক বাহক করে দেখাতে পারলে হিন্দু সমাজে খুব সহজে বঙ্কিমের মনের কথাটি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে, তিনি একথা চিন্তা করেছিলেন। বঙ্কিম ভুল চিন্তা করেননি। এই ভারত ভূমিতে যুগে যুগে কৃষ্ণের মহিমা নানাভাবেই কীর্তিত হয়েছে। যদিও কৃষ্ণ প্রকৃত আর্য বংশদ্ভূত ছিলেন কিনা অদ্যাবধি সেই বিতর্কের অবসান হয়নি। ঋগেদে কৃষ্ণের নাম উদ্ধৃত হয়েছে কয়েক বার। বৌদ্ধ শাস্ত্রসমূহেও কৃষ্ণকে নিয়ে পর্যালোচনা হয়েছে অনেক। মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের যে প্রত্যক্ষ উপস্থিতি এবং তাঁর যে ভূমিকা সেই জিনিশটিই ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় শাসনের ইতিহাসে অদ্যাবধি দৃষ্টান্ত হিসাবে বিরাজমান রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের অন্যবিধ কীর্তি, যোগ্যতা এবং গুণাগুণের কথা বাদ দিলেও শ্রীমদ্ভাগবদগীতাই একমাত্র গ্রন্থ যা আধুনিক ভারতের নানা মতের হিন্দুর সংযোগের হেতু হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।

শ্রীকৃষ্ণ মানুষ একজন হলেও তাঁর অনেকগুলো পরিচয়। তিনি রাখালবেশী গোপ বালক। বৃন্দাবনের গোট বিহারী অপূর্ব লীলাময় বংশীধারী, গোপ ললনাকুলের কামনার ধন। মথুরায় তিনি দণ্ডধারী মহারাজ। কুরুক্ষেত্রে কুরু-পাণ্ডবের সম্মুখ সমরে অর্জুনের সারথী। নতুন নতুন রণকৌশলের উদ্যোক্তা, শ্রীমদ্ভাগবদগীতার প্রবক্তা, শান্তির সময়ে দক্ষ কুটনৈতিক, যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞের সময়ে যুদ্ধ শান্তির নীতি নির্ধারক, আদর্শ স্বামী, আদর্শ পিতা, আদর্শ রাজা, পরাক্রান্ত অজেয় বীরযোদ্ধা এই এতোগুলো বৈশিষ্ট্যের অধিকারী তাঁকে পুরুষ বলে ভাবা হলেও তিনি পরম পুরুষ না হয়ে যান না। আকৃতিতে তিনি নর হলেও আসলে তিনি নারায়ণেরই অংশ– একজন অবতার। পৃথিবীতে দুষ্টরা যখন রাজ্যপীঠ বিস্তার করে সৎ মানুষদের জীবনযাত্রা যখন অসম্ভব করে তোলে, পরিত্রাণের আশায় ধরণী ত্রাহি ত্রাহি চিৎকার করে সেই সময়ে একজন অবতার পৃথিবীতে আবির্ভূত হন। আসলে নারায়ণই নরবেশে নরকুলের উদ্ধার মানসে ধরাধামে অবতীর্ণ হন। শ্রীকৃষ্ণ একজন অবতার নারায়ণের অংশ। তাঁর পূর্ববর্তী অবতার ছিলেন অযোধ্যার রাজা শ্রীরামচন্দ্র।

শ্রীকৃষ্ণ যুগে যুগে অবতার হিসেবেই পূজিত হয়ে আসছেন। তথাপি সময়ের বিবর্তনে লোক সমাজে তাঁর আরেকটি পরিচয় বিস্তার লাভ করতে পেরেছে। শ্রীকৃষ্ণ প্রেমের দেবতাও বটে এই প্রেম দু’ভাগে ব্যাখ্যা করা যায়, দেহবাদী প্রেম এবং দেহাতীত প্রেম। অন্য অর্থে নরনারীর প্রেম এবং জীবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যবর্তী প্রেম। প্রেমের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা যাই হোক না কেননা, দেহবাদী প্রেমেরও আলাদা একটি মহিমা রয়েছে। প্রেমের সেই একান্ত ভোগবাদী আদর্শটি শ্রীকৃষ্ণের স্মৃতিকে ঘিরেই পল্লবিত হয়েছে। গ্রীক পুরাণে পান এবং রোমানদের বাক্কাসকে যেভাবে সম্ভোগের দেবতা হিসেবে দেখা হতো শ্রীকৃষ্ণের এ সম্ভোগ সমৃদ্ধ ভাবমূর্তি লোকসমাজের মধ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। আসলে এ শ্রীকৃষ্ণের প্রেমলীলাকে উপলক্ষ করে নানান ভারতীয় ভাষায় যে অজস্র গান রচিত হয়েছে, দুনিয়ার কোনো একক মানুষের স্মৃতিকে অবলম্বন করে অতো গান রচিত হয়নি। এই গান রচনার ধারাটি আমাদের সময়েও সক্রিয়।

হিন্দু সমাজে শ্রীকৃষ্ণের পুজো প্রচলিত হওয়ার পর থেকে সময়ের চাপে তার অন্যবিধ পরিচয়সমূহ ক্ষয়ে ক্ষয়ে তাঁর প্রেমিক পরিচয়টিই ব্যাপ্তি এবং বিস্তৃতি লাভ করেছে। অপেক্ষাকৃত আধুনিককালে নদীয়ার মহাপ্রভূ করুণাবতার শ্রীচৈতন্যদেব শ্রীকৃষ্ণের নতুন ধরনের পূজার প্রচলন করেছেন। শ্রীচৈতন্যদেব শ্রীকৃষ্ণের ভাবমূর্তি যে আঙ্গিকে স্থাপন করলেন তাঁর সঙ্গে ইতিহাসসম্মত কৃষ্ণচরিতের তুলনা করে বিশেষ ফল লাভ হবে না। শ্রীচৈতন্য দেবকে হিন্দু সমাজের বিশেষ একটা আপদকালে নতুন করে কৃষ্ণপুজোর প্রচলন করতে হয়েছে। এই নতুন কৃষ্ণ ভজনার রূপ এবং স্বাদ একেবারে আলাদা। মুসলমান শাসন দৃঢ়ভাবে চেপে বসায়, হিন্দু সমাজ আতঙ্কে তটস্থ। রাজশক্তির প্রতাপ এবং সুফি দরবেশের প্রভাবে দলে দলে মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে লেগেছে। এই মারমুখী প্রভাব ঠেকাবার কোনো কার্যকর পন্থা উদ্ভাবন করতে ব্যর্থ হয়ে ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায় নতুন আচারের জাল বিস্তার করে কোনো রকমে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছিলো। এই আচার যতো কড়াকড়ি আকার ধারণ করেছিলো, ধ্বসটা ততো বেশি করে নামছিলো। এই পরিস্থিতিতে চৈতন্যদেব এসে জানালেন, আচণ্ডাল সকলকে কোল দিতে হবে এবং এটাই ধর্ম। মেথর হোক, মুচি হোক, চাই কি হোক মুসলমান যে একবার কৃষ্ণনাম উচ্চারণ করবে, উদ্ধার পেয়ে যাবে। কৃষ্ণনামের ভজনাই এ যুগের শ্রেষ্ঠ উপাসনা। হাটে, মাঠে, বাটে সঙ্গী-সাথী নিয়ে সর্বত্র কৃষ্ণনাম কীর্তন করতে থাকলেন। নামগানের রসে আকৃষ্ট হয়ে যে এলো জাতপাত বিচার না করে শ্রীচৈতন্য। সকলকেই আলিঙ্গন করলেন এবং সকলকেই কোল দিলেন। প্রেমাবতার শ্রীচৈতন্য ছিলেন সেই আশ্চর্য পুরুষ, আপন হাতে একটি বাক্যও রচনা না করে একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব তিনি সম্পন্ন করেছিলেন। শ্রীচৈতন্য কৃষ্ণনামের যে মন্ত্র প্রচার করলেন, তা হিন্দু। সমাজে মন্ত্রশক্তিই বিস্তার করলো এবং হিন্দু সমাজের ধ্বস নামা বন্ধ হলো এবং নতুন একটি আত্মিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে হিন্দু সমাজ আপন অস্তিত্বের জয়ধ্বনি করলো।

ইংরেজ রাজত্বের একটা বিশেষ পর্বে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে আরো একবার শ্রীকৃষ্ণের শরণ নিতে হলো। শ্রীচৈতন্য যে পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের ভাবমূর্তি স্থাপন করেছিলেন, বঙ্কিমের পরিপ্রেক্ষিতটা তার চাইতে সম্পূর্ণ আলাদা। শ্রীচৈতন্য হিন্দু সমাজের আত্মরক্ষার প্রয়োজনে শ্রীকৃষ্ণের স্মৃতি নতুন করে জাগিয়ে তুলেছিলেন। কিন্তু বঙ্কিমের লক্ষ্য হিন্দু সমাজের আত্মরক্ষা নয়, হিন্দু জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠা। হিন্দুদের নিজেদের একটা রাষ্ট্র চাই। একটি নতুন হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য একজন রাষ্ট্রগুরু চাই, যাঁর উপদেশ, শিক্ষা এবং দৃষ্টান্ত যথাযথভাবে অনুসরণ করলে একটি হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ অনেকখানি প্রশস্ত হয়। সুতরাং বঙ্কিমের শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীচৈতন্যর শ্রীকৃষ্ণ এক নয়। শ্রীচৈতন্যের কৃষ্ণ পাপি-তাপির ত্রাণকর্তা, একবার মাত্র নাম উচ্চারণ করলে উদ্ধার পেয়ে যায়। বঙ্কিমের শ্রীকৃষ্ণ সম্পূর্ণ রূপে ভিন্ন মানুষ। তিনি রাজা, কিন্তু এই। পরিচয় শ্রীকৃষ্ণের ব্যক্তিত্বের ভগ্নাংশও প্রকাশ করে না। তার আসল পরিচয় হলো তিনি রাষ্ট্রগুরু এবং ধর্ম ব্যাখ্যাতা। যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ একজন রাষ্ট্রগুরু, তাই তিনি যুদ্ধশান্তির নিয়ম নীতি সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত, দক্ষ, সাম, দান, দণ্ড ইত্যাদি প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার সবগুলো ফন্দি ফিকির তাঁর নখদর্পনে। যুদ্ধ এবং শান্তির বিষয়ে উৎকৃষ্ট পরামর্শ দিতে পারেন। যেহেতু তিনি অবতার ধর্মব্যাখ্যা এবং সংস্থাপন করা তাঁর আরেকটি প্রধান কর্তব্য। মানব জীবনের সর্বোচ্চ কর্তব্য তিনি স্থির করে দিতে পারেন, সামাজিক শ্রেণীগুলো কার কোথায় স্থান, কার কি দায়িত্ব নির্ধারণ করে দিতে পারেন। তাছাড়া মানুষের ঐহিক এবং পারলৌকিক লক্ষ্যসমূহ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারেন। প্লেটো যে ধরনের প্রাজ্ঞ শাসককে দার্শনিক নরনাথ বলে আখ্যায়িত করেছেন, আর ভারতবর্ষে যারা রাজর্ষি বলে স্বীকৃতি লাভ করতেন, বঙ্কিমচের শ্রীকৃষ্ণকে কিছুতে যে পর্যায়ভুক্ত করার উপায় নেই। মিশর থেকে ইহুদী সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দিয়ে জেরুজালেমে ফিরে আসার সময় মুসা নবীর যে ভূমিকা ছিলো, সমস্ত প্রতিকূল বাধা চূর্ণ করে হযরত মুহম্মদ যেভাবে মুসলমানদের ইহকাল পরকালের অবিসংবাদিত অপ্রতিদ্বন্দী ধর্মগুরু হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্রের শ্রীকৃষ্ণের অবস্থান অবিকল সে রকম।

জার্মান দার্শনিক শোপেনহাওয়ারের একটি উদ্ধৃতি খুবই প্রনিধাণযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, হিন্দু চিন্তার গভীরতা সমুদ্রের মতো, তল পাওয়ার কোনো উপায় নেই, কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, এই যে তাঁর কোনো নির্দিষ্ট আকার নেই। আবার। রাশিয়ানদের চিন্তার নির্দিষ্ট আকার আছে, কিন্তু গভীরতা নেই। প্রাচীন হিন্দুরা যে চিন্তার ভাণ্ডার রেখে গেছে, হিন্দু সমাজের সঙ্কটকালে সেই চিন্তার ভেতর থেকে নতুন প্রাণশক্তি বিকিরিত হয়ে সমাজে নতুন ভাবের পাবন বইয়ে দিতে পারে। এই পুরাতন চিন্তা, মীথ, ব্যক্তিত্ব, নতুন হয়ে ওঠার বেলায় পুরাতনের কিছু যেমন থাকে, তেমনি যে পরিস্থিতির চাপ এবং প্রয়োজনে সে চিন্তা, মীথ ব্যক্তিরা প্রাসঙ্গিকতা অর্জন করে সেই পরিস্থিতিও অনেকখানি আত্মসাৎ করে ফেলে।

বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণচৈতন্যদেব বর্ণিত কৃষ্ণ নন, বৌদ্ধ শাস্ত্রে যে কৃষ্ণের কথা আলোচিত হয়েছে তিনিও নন। মহাভারত, হরিবংশ এবং পুরাণসমূহে যে অবতার কৃষ্ণের কীর্তি গাঁথা রসসমৃদ্ধ ভাষায় বর্ণিত হয়েছে, বঙ্কিমচন্দ্রের শ্রীকৃষ্ণ তার চাইতে আলাদা। নরনারী কিংবা জীবাত্মা পরমাত্মার গহন সম্পর্কের দেবতা শ্রীকৃষ্ণও বঙ্কিমের কৃষ্ণচরিত অনুধ্যানের উপজীব্য বিষয় নয়। উনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজি শিক্ষিত, ইংরেজের। ডেপুটিবাবু বঙ্কিমচন্দ্র একটি হিন্দু রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রয়োজনে একজন রাষ্ট্রগুরুর সন্ধান করেছিলেন এরং শ্রীকৃষ্ণের জীবন চরিত তাঁর সে প্রয়োজনটা মিটিয়েছিলো। সুতরাং বঙ্কিমের কৃষ্ণচরিতের সঙ্গে অন্যবিধ কৃষ্ণচরিতের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। বঙ্কিমের কৃষ্ণচরিতে অন্যবিধ পরিচয় ছাপিয়ে শ্রীকৃষ্ণের রাষ্ট্রগুরু পরিচয়টাই প্রধান হয়ে উঠেছে। যেহেতু তিনি অবতার, তাই তার ধর্মগুরুর দিকটি ও উপেক্ষিত হয়নি। কিন্তু ধর্মরাষ্ট্রে রাজনীতি এবং ধর্মচর্চা দু’য়ের মধ্যবর্তী ভেদরেখা থাকতে পারে না। একটা আরেকটার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মেশামেশি করে থাকে।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শ্রীকৃষ্ণের একটি অভিনব জীবন চরিত রচনা করতে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে ঘিরে যে সকল অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ রয়েছে তার অনেকগুলোকেই একেবারে ছেটে বাদ দিয়েছেন। কৃষ্ণের জীবন কথা এমনভাবে স্তরে স্তরে সাজিয়ে গেঁথে তুলেছেন, আগাগোড়া শ্রীকৃষ্ণের জীবন কথাটাই যেনো তার উদ্দেশ্যানুগ রূপ লাভ করে। কৃষ্ণপুরাণসমূহে তাঁর অবতার সত্তাকে প্রধান করে দেখানোর প্রয়োজনে পুরাণকারেরা যে সব অবাস্তব কল্পকাহিনী জুড়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের চেনা জানার। বাইরে শ্রীকৃষ্ণের ব্যক্তিত্ব স্থাপন করেছেন, বঙ্কিম সে সব যথাসম্ভব বাদ দিয়ে, যেখানে বাদ দিলে কৃষ্ণের জীবন কথা চেনা যাবে না; সে সমস্ত জায়গায় নিজস্ব ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে একজন অসাধারণ মানুষ হিসেবে উপস্থিত করেছেন। অথচ পুরাণকারদের মতো বঙ্কিমও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন শ্রীকৃষ্ণ একজন অবতার। বঙ্কিমের অবতার একজন মানুষের শিক্ষাদাতা। যদিও তাঁর ঐশী অংশটা অত্যন্ত প্রবল। একজন অবতারকেও মানবিক বোধবুদ্ধি প্রয়োগ করেই দুঃসাধ্য কর্ম সম্পাদন করতে হয়। মানুষ অবতারদের এই সকল ক্রিয়াকলাপ থেকে অনেক কিছু শিক্ষা করে থাকে। যদিও একজন সাধারণ মানুষ কখনো অবতারের স্তরে উঠতে পারবে না, তথাপি। অবতারের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে তার শক্তি এবং ক্ষমতার চূড়ান্ত বিকাশ ঘটাতে পারে। এই কারণেই অবতারেরা মানব জাতির অনুসরণীয় শিক্ষক। বঙ্কিমচন্দ্রে শ্রীকৃষ্ণ রাষ্ট্রগুরুর চেহারায় ধরা পড়েছেন। তাঁর সমস্ত কর্মের ভালো মন্দ রাজনৈতিক মাণদণ্ডে বিশ্লেষণ করেছেন এবং সেটাকেই তিনি ধর্মসম্মত বলে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর কংস বধ, শিশুপাল নিধন এবং জরাসন্ধ হত্যা এই সকল অক্ষত্রিয়োচিত অন্যায় কর্মকে এভাবেই যুক্তিসিদ্ধ করেছেন, এই রাজারা সকলেই ছিলেন পাপিষ্ঠ এবং অন্যায় কর্মের সমর্থক। সুতরাং তাঁদের ছলে বলে কলে কৌশলে নিরস্তিত্ব করে ফেলা নিতান্তই ধর্মসম্মত কর্ম।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যে সকল কলাকৌশল অবলম্বন করে ভীষ্ম, দ্রোণাচার্যকে নিহত করার কারণ হয়েছেন, কর্ণার্জুনের যুদ্ধে কাদায় দেবে যাওয়া রথের চাকা উত্তোলনরত নিরস্ত্র কর্ণকে যেভাবে অর্জুনকে প্ররোচিত করে হত্যা করালেন, স্বয়ং মহাভারত রচয়িতা বেদব্যাসও এই সমস্ত কর্ম নীতিসম্মত বলে মেনে নিতে পেরেছিলেন কিনা সন্দেহ। গদাযুদ্ধে ভীমকে দিয়ে যেভাবে দুর্যোধনের উরু ভঙ্গ করালেন, সেই অপরাধের জন্য দুর্যোধন-মাতা গান্ধারী শ্ৰীকৃষ্ণকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণকেও ছত্রিশ বছর পর নিতান্ত করুণভাবে নিচ জাতির মানুষের হাতে প্রাণ হারাতে হবে। শ্রীকৃষ্ণ একটার পর একটা অন্যায় কর্ম সম্পাদন করেছেন, কিন্তু এগুলো শ্রীকৃষ্ণ মনে করেছেন, ধর্মসম্মত। শ্রীকৃষ্ণের ধর্মটাই আসল ধর্ম। এখানে রাজনীতিটাই ধর্মের ভূমিকা গ্রহণ করেছে। অবশ্য শ্রীকৃষ্ণের একটা রাজনীতি ছিলো। তৎকালীন ভারতের কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থাকে দৃঢ় অবস্থানে দাঁড় করানো এবং বৰ্গকরণ, স্তর বিন্যাস পরস্পরের ওপর স্থায়ীভাবে দাঁড় করিয়ে প্রতিটি বর্ণকে আলাদা করে গোটা সামাজিক কাঠামোকে একটা অচল স্থিতাবস্থার ওপর স্থাপন করাই হলো তাঁর ধর্ম। শ্রীমদ্ভাগবদগীতার আধ্যাত্মিক অর্থ যাই হোক না কেননা, ব্যবহারিক অর্থ এই দাঁড়ায় যে জন্মগতভাবে কিছু মানুষ উৎকৃষ্ট, কিছু মানুষ অপকৃষ্ট এবং অপকৃষ্টের কর্তব্য হলো উৎকৃষ্ট মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করা। কৃষ্ণের সমাজনীতি এবং রাজনীতি দু’টোই ভারতীয় সমাজে ধর্মের মর্যাদা লাভ করেছে। এই ব্যবস্থাটিকে দীর্ঘস্থায়িত্ব দেয়ার জন্যই তিনি গীতা গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। গীতাকে কি কাব্য বলা যায়? নাকি নীতিশাস্ত্র? নাকি দর্শন? নাকি সংখ্যাধিক মানুষকে হাজার বছর ধরে বোধবুদ্ধির দিক দিয়ে বামুন করে রাখার সব চাইতে উৎকৃষ্ট মগজ ধোলাইয়ের মনস্তাত্বিক যন্ত্র? একথা অল্প বিস্তর সব ধর্ম পুস্তক সম্পর্কে বলা চলে।

বঙ্কিম কংস, জরাসন্ধ, শিশুপাল এই সব রাজাদের দুবৃত্ত এবং পাপিষ্ঠ বলে হননযোগ্য ধরে নিয়েছিলেন, তাঁদের পাপ এবং দুবৃত্তপনার মুখ্য প্রমাণ হলো, তাঁরা সকলেই ছিলেন আঞ্চলিক স্বাধীন রাজা। কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনতা মেনে নিতে রাজি না হওয়াই ছিলো তাঁদের মস্ত অপরাধ। কেন্দ্রীয় শাসন দৃঢ়, সবল এবং নিষ্কন্টক করাই ছিলো শ্রীকৃষ্ণের রাজনীতি। এই রাজনীতিই রাজন্যবর্গের জন্য নিয়তির ভূমিকা পালন করেছিলো।

প্রসঙ্গত আমি দীনেশচন্দ্র সেনের বিষয়টি উত্থাপন করতে চাই। দীনেশ এবং বঙ্কিমের মধ্যে বয়সের বিরাট ফারাক। বঙ্কিম যখন প্রৌঢ়, মৃত্যুর দিন গুণছেন, দীনেশ তখনও তরুণ। দীনেশচন্দ্র ছিলেন পূর্ব বঙ্গীয় বৈদ্য সম্প্রদায়ের লোক। সারা জীবন চেষ্টা করেও ঘটি উচ্চারণ পদ্ধতি রপ্ত করতে পারেননি। তাঁকে নিয়ে অনেকেই ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ করতেন। যদিও দুজনের মধ্যে বেশি দেখা সাক্ষাত ঘটেনি, তথাপি এই পূর্ব বঙ্গীয় বৈদ্য বঙ্কিমের রাগ, উন্মা এবং বিরক্তির কারণ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তার কারণ অবশ্যই আছে। বঙ্কিমবাবু কংশ, জরাসন্ধ, শিশুপাল এই রাজাদের ধর্মের প্রয়োজনে হত্যা করা হয়েছিলো বলে দাবি করেছেন। দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর দু’খণ্ডে সমাপ্ত ‘বৃহৎ বঙ্গ’ গ্রন্থে এই বঙ্কিমবাবুর ধর্মের আসল স্বরূপটি ফাঁস করে দিয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ এক কেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনেই এই সব রাজাদের হত্যা করেছেন। দীনেশ সেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে সেই জিনিশটি দেখিয়ে দিয়েছিলেন। এই রাজারা সকলেই আঞ্চলিক স্বাধীন নৃপতি। শ্রীকৃষ্ণের সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে বিচার করলে অবশ্যই তাঁদের অপরাধী বলতে হবে। তাঁদের আপন স্বজনদের কাছে ছিলেন স্বাধীনতার শহীদ। দীনেশচন্দ্র সেন এই বিষয়টা যুক্তি প্রমাণ সহকারে প্রতিপন্ন করেছিলেন। দীনেশবাবুর আরো একটা অপরাধ ছিলো, সেটাও কম গুরুতর নয়। বঙ্কিমবাবু বাংলা ভাষার স্বাতন্ত্র মেনে নিয়েও সংস্কৃতের কাঠামোর মধ্যে সীমিত রাখতে চাইতেন। আর বাংলা সাহিত্যকে সংস্কৃত সাহিত্যের অনুবর্তী করার একটা মনোগত অভিপ্রায় বঙ্কিমের ছিলো। সংস্কৃতের অনুবর্তী মানে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির পরিমণ্ডলটাই বোঝানো হচ্ছে। অন্যদিকে দীনেশবাবু লোক সাহিত্য চর্চা এবং সংগ্রহ করে সারস্বত সাহিত্যের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের আরেকটা উজ্জ্বল প্রোজ্জ্বল ঐতিহ্যের রুদ্ধদুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং প্রমাণ করেছিলেন সারস্বত সাহিত্যের সমান্তরালে একেবারে সাধারণ মানুষেরা যে সাহিত্য রচনা করেছেন, তার নন্দনতাত্বিক মান কিছুতেই তুচ্ছ কিংবা ফেলনা নয়। আরো একটা বিষয় স্পষ্ট করে তুলে ধরে অভিজাত্যাভিমানী শ্রেণীর অহঙ্কারের গোড়া ঘেষে কোপ বসিয়েছিলেন। সাহিত্যে কোনো একটা বিশেষ শ্রেণীর অধিকার নেই। বাংলা সাহিত্যে আসলে বাংলার হিন্দু এবং মুসলমান উভয়েরই সাহিত্য। উভয়ে মিলে নির্মাণ করেছে সাহিত্যের শরীর, উভয়ের অবদানে সমৃদ্ধ হয়েছে প্রাণ। অবদান কারো কম, কারো বেশি।

বঙ্কিমবাবু দীনেশসেনের ওপর কি রকম চটে গিয়েছিলেন, দীনেশবাবু গল্পচ্ছলে সে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। একবার দীনেশসেন মহাশয় বঙ্কিমবাবুর সঙ্গে সাহিত্য আলোচনা করতে গিয়েছিলেন। বঙ্কিমবাবু তাঁর সঙ্গে সাহিত্য বিষয়ে একটি বাক্যও আলাপ করেননি। তিনি জানতে চেয়েছিলেন দীনেশবাবুদের ওখানে তাজা তরি তরকারি পাওয়া যায় কিনা। সোনামুগ কি বাজারে বিক্রয় হয়, কচি লাউ এবং পাঠার মাংস নিয়মিত আসে কিনা। আনাজ তরকারির দাম জানতে চেয়ে বঙ্কিমবাবু দীনেশসেনকে প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তোমার সঙ্গে তরিতরকারি ছাড়া আর কোনো বিষয়ে আলাপ করতে পারি। সাহিত্য উচ্চমার্গীয় ব্যাপার। সেসব তুমি বুঝবে কেননা? যদি বুঝবে তো তুমি শ্রীকৃষ্ণের পূতপবিত্র চরিত্রে কোন্ সাহসে কলঙ্ক কালিমা লেপন করো? বঙ্কিমচন্দ্র এবং দীনেশসেনের আলাদা সাহিত্য রুচি এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটা বিরোধ লুকিয়েছিলো। দৃষ্টিভঙ্গির এই বিষয়টা শুধু দু’জন মানুষের নয়, তাবত বঙ্গীয় সংস্কৃতির এবং রাজনীতির। এই বিরোধের একটা নিরাকরণ অবশ্যই করতে হবে। নইলে বাঙালি তার পূর্ণ সত্তা ফিরে পাবে না।

শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন বঙ্কিমের দৃষ্টিতে একজন অবতার। এই অবতারের মূল কাজ ছিলো ধর্ম সংস্থাপন এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। রাজ্যে যখন বিপ্লব ঘটে, বিদ্রোহ যখন রাজসিংহাসন টালমাটাল করে ফেলে কিংবা পর রাজ্যের আক্রমণে ধন প্রাণ বিপন্ন হয় অথবা অত্যাচারী রাজপুরুষদের নির্যাতনের কারণে প্রজাসাধারণের জীবনে ভোগান্তির অন্ত থাকে না, তখনই শান্তি বিঘ্নিত হয়। শ্রীকৃষ্ণের গীতোক্ত কাঠামো কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখলে সমাজে আর শান্তিভঙ্গের অবকাশ থাকে না। শ্রীকৃষ্ণ প্রচারিত ধর্ম এবং শান্তি উভয়ের অর্থই রাজনৈতিক প্রেক্ষিত থেকে বিচার করতে হবে। কোনো কারণে শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার লক্ষণ দেখা দিলে বার বার শান্তি সংস্থাপনের প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে। তার পরও যদি শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব না হয়, যে বা যারা শান্তি ভঙ্গকারী তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রহাতে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। যুদ্ধ ক্ষত্রিয়ের পবিত্র কর্তব্য। কোনো ক্ষত্রিয় যদি ন্যায়যুদ্ধে পরাঙ্মুখ হয়, তাহলে সেই ব্যক্তি ইহলোকে নিন্দিত হবে এবং পরলোকে থাকবে তার ভাগ্যে অনন্ত নরকবাস।

কৌতূহলী পাঠক, এইখানে অবতার শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে পরবর্তীকালের আরেকজন মানব শিক্ষকের একটা তুলনা করার অবকাশ পাবেন। তিনি অপেক্ষাকৃত আধুনিককালের মানুষ। আমি আরবের নবী হযরত মুহম্মদের কথা বলছি। তিনিও তাঁর প্রচারিত ধর্মের নাম রেখেছিলেন ইসলাম তথা শান্তি। তিনি নিজেকে রাহমাতুল্লিল আল-আমিন, মানে বিশ্বজগতের প্রতি আশির্বাদ বলে পরিচয় দিতেন। যুদ্ধ বিগ্রহের বিষয়টা শ্রীকৃষ্ণ যে দৃষ্টিতে বিচার করতেন, তার সঙ্গে হযরত মুহম্মদের মতামতের আশ্চর্য সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। ইসলামের দৃষ্টিতে অকারণে যুদ্ধ করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। একমাত্র আক্রান্ত হলেই তোমার প্রতিরোধ করার অধিকার আছে। আক্রান্ত না হলে খবরদার আক্রমণ করবে না। যুদ্ধ শুরু করার আগে শান্তি বজায় রাখার সব রকমের চেষ্টা এবং যত্ন করবে। কিন্তু যুদ্ধ যদি তোমার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়, সে যুদ্ধ করা তোমার পক্ষে ফরজ অবশ্য কর্তব্য। শান্তি প্রচারের প্রয়োজনে যে যুদ্ধ তোমার জন্য এসে পড়েছে, তাতে অবশ্যই শামিল হবে। তুমি পালিয়ে যেতে পারবে না। পৃষ্ঠ প্রদর্শন কিংবা কর্তব্যে অবহেলা করলে পরকালে তোমাকে নরকবাসী হতে হবে। মনে রাখবে ধর্মযুদ্ধ তোমার ঈমানের তথা অঙ্গীকারের অংশ।

বঙ্কিমচন্দ্র শ্রীকৃষ্ণের একটি আধুনিক চরিত কথা, উনবিংশ শতাব্দীর সমাজের দিকে লক্ষ্য রেখে রচনা করার প্রাক্কালে খুব সম্ভবতো হযরত মুহম্মদের জীবনী খুব মনোযোগ দিয়ে পাঠ করেছিলেন। এখানে জার্মান দার্শনিক শোপেনহাওয়ারের উদ্ধৃতি আবার নতুন করে উল্লেখ করবে। হিন্দু চিন্তার গভীরতা আছে, আকার নেই। খুব সম্ভবত কৃষ্ণচরিত রূপায়ণে হযরত মুহম্মদের জীবন চরিত বঙ্কিমচন্দ্রকে অনেকখানি সহায়তা করেছে। বঙ্কিম যে হযরত মুহম্মদ সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান রাখতেন তাঁর ধর্মতত্বের একটি বাক্যের মধ্যে তার প্রমাণ মেলে। বঙ্কিম তাঁর পর্যালোচনার এক জায়গায় বলেছেন, হিন্দুরা যদি আমার কথাগুলো মনোযোগ সহকার শুনে এবং অনুশীলন করে মুহম্মদের সময় আরব জাতি এবং ক্রমওয়েলের সময় ইংরেজ জাতি যে শক্তির অধিকারী হয়েছিলো, হিন্দুরাও জাতি হিসেবে সেরকম শক্তির অধিকারী হয়ে উঠবে। বঙ্কিমের কথাগুলো নিজের জবানীতেই প্রকাশ করলাম।

কৃষ্ণচরিত এবং ধর্মতত্ব একে অপরের পরিপূরক গ্রন্থ। কৃষ্ণচরিতে যা ব্যক্তি বিশেষের মতবাদ আকারে প্রকাশ পেয়েছে, ধর্মতত্ত্ব সেই মতামতসমূহের নির্বিশেষ রূপ। আমার। বর্ণনার যা মূলকথা বঙ্কিমচন্দ্র হযরত মুহম্মদের জীবনী সম্পর্কে নিশ্চিতভাবেই অবগত ছিলেন। যুগপ্রবর্তক ধর্মগুরু হযরত মুহম্মদ একটি শক্তিশালী জাতির স্রষ্টাও বটেন। তাঁর তিরোধানের একশো বছরের মধ্যেই তাঁর অনুসারিরা চীন সাম্রাজ্য ছাড়া তৎকালীন পৃথিবীর সবগুলো সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁরা যুদ্ধকে শান্তিধর্ম প্রচারের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের কাছে দীন এবং দুনিয়া এক হয়ে গিয়েছিলো। এটা তো শ্রীকৃষ্ণেও ঘটেছিলো। যুদ্ধে জয়ী না হলে শান্তি ধর্মের প্রচার কিভাবে সম্ভব। আর যুদ্ধের সবচাইতে বড়ো নীতি জয় লাভ। রাজ্য বিস্তারের জন্য হোক আর মতবাদের জন্য হোক। হযরত মুহম্মদ এবং শ্রীকৃষ্ণের তুলনা করা হলো, তার প্রাসঙ্গিকতা তুচ্ছ করার মতো নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *