০১. বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কিত এই রচনা

এক

বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কিত এই রচনাটি আমার নিজের জীবনকথা দিয়ে শুরু করতে হবে। স্কুলে থাকার সময়ে আমাদের ইংরেজি গ্রামার, ট্রানসেন এবং বাংলা গদ্য পদ্য পড়ানোর শিক্ষক শিববাবুর নেক নজরে পড়ে গিয়েছিলাম। তাঁর পুরো নাম শ্রীশিবপ্রসাদ সেন। সোজা হয়ে হাঁটতেন। মাথার সবগুলো চুল পাকনা, তবে মাঝে মাঝে কালোর আভাস পাওয়া যেতো। শীত গ্রীষ্ম সব ঋতুতেই কাঁধের ওপর একটা ভাজ করা সুতীর চাদর ঝুলিয়ে রাখতেন। সামনের দিকের দুটো ছাড়া সবগুলো দাঁত পড়ে গিয়েছিলো। দেখলে মনে হতো ঈষৎ লালচে দাঁত দুটো চোয়াল ঠেলে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে।

শিববাবুর সম্পর্কে নানা রকম কাহিনী চালু ছিলো। সেগুলো একেকটা একেক রকম। আমার ত্রিশ বছর আগে যাঁরা এই স্কুলে পড়েছেন, তাঁদের কাছে শুনেছি, তাঁরাও ছাত্র থাকার সময়ে শিববাবুকে এই একই রকম কাঁচা পাকা দেখতে পেয়েছিলেন। এখন। সাদার আভাস বেশি, তখন কাঁচার প্রতাপ ছিলো অধিক। এটুকু ছাড়া আদলে অবয়বে শিববাবুর মধ্যে উল্লেখ করার মতো কোনো পরিবর্তন খুঁজে পেতেন না। এই রকম মানুষের বয়স কত হবে জানতে চাওয়া অবান্তর। যাঁদের সম্পর্কে বলা যায়- বয়সের কোনো গাছ পাথর নেই, সত্যিকার অর্থে শিববাবু ছিলেন সে ধরনের মানুষ।

শিববাবুর বিরাগভাজন অথবা প্রিয় হওয়া কোনোটাই ক্লাশের ছাত্রদের কাছে সুখকর ব্যাপার ছিলো না। যে সমস্ত ছাত্র টেন্স, ভার্ব এবং ইংলিশ শব্দের বানান উচ্চারণ ঠিকমতো করতে পারতো না, তাদের লিকলিকে বেত দিয়ে হাতের সুখ মিটিয়ে তিনি পেটাতেন। আর অঘা মার্কা ছাত্রদের হাই বেঞ্চিতে দাঁড় করিয়ে দিয়ে সমস্ত ক্লাশের দর্শনীয় বস্তুতে পরিণত করতেন। শিববাবু এদের বলতেন ইণ্ডিয়া কোম্পানির পিলার। যে সমস্ত ছাত্র শিববাবুর প্রশ্নের ঠিক ঠিক জবাব দিতে পারতো, তাদের জন্যও ভিন্ন রকমের শাস্তি অপেক্ষা করে থাকতো। শিববাবু তাদের কানের গোড়া আস্তে আস্তে মলে দিতেন এবং আদর করে সম্বোধন করতেন শ্যালক। আমার মুখস্ত করার অনেক ক্ষমতা ছিলো। সুতরাং অনায়াসে শিববাবুর শ্যালক শ্রেণীর মধ্যে গণ্য হতে পেরেছিলাম। শিববাবুর শ্যালক হওয়া যেমন তেমন ব্যাপার ছিলো না। তাঁর দাবির পরিমাণ ছিলো অসম্ভব রকম চড়া। মেটাতে গিয়ে জান কাবার হওয়ার দশা।

শিববাবু আমার কাছে স্কুল লাইব্রেরির সমস্ত চাবি গছিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, যদি হারাস এক কিলে আস্ত মাথা পেটের ভেতর ঢুকিয়ে দেবো। আমার এই নতুন দায়িত্ব প্রাপ্তিতে সতীর্থ ছাত্ররা ঈর্ষা করতো। কিন্তু আমাকে মস্তকটা স্কন্ধদেশের ওপর খাড়া রাখার জন্য বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সর্বক্ষণ তটস্থ হয়ে থাকতে হতো। চাবি রক্ষক পদ গৌরবের মর্যাদা রক্ষা করার জন্য আমার নাকের পানি চোখের পানি এক হওয়ার জোগাড়। শিববাবু স্কুল লাইব্রেরির আলমারির গহ্বর থেকে মোটা মোটা শক্ত মলাটের বই বের করে আমার হাতে তুলে দিয়ে বলতেন, পনেরো দিনের মধ্যে সবটা পড়ে ফেলবি। নইলে কিলিয়ে হাড্ডি গুড়ো করে ফেলবো। এই শক্ত মলাটের বইগুলোর কোনোটা ছিলো মাইকেল মধুসূদন দত্তের, কোনোটা নবীনচন্দ্র সেনের, কোনোটা হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের গ্রন্থাবলী। ওই এতোটুকু বয়সে আমাকে কায়কোবাদের মহাশ্মশান, অশুমালা, অমিয়ধারা, শিবমঙ্গল এই সকল কাব্যগ্রন্থে দাঁত বসাতে হয়েছিলো। ভূদেব। মুখোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র দত্ত এরকম কতো লেখকের বই যে আমাকে চাবি রক্ষকের পদগৌরবের ইজ্জত রক্ষার জন্য পাঠ করতে হয়েছিলো, তার অনেকগুলোর নামও এখন উলেখ করতে পারবো না। এই সমস্ত অপাচ্য এবং দুম্পাচ্য জিনিশ ভক্ষণ করার কারণে আমার মানসিক হজম শক্তির প্রক্রিয়া গড়বড় হয়ে পড়েছিলো এবং আমি এক রকম এচড়ে পেকে গিয়েছিলাম। এই সমস্ত মহাজনের মহত প্রভাবে আমার মনের বায়ুমণ্ডল এতোটা কুপিত হয়ে উঠেছিলো, একান্ত সরল প্রশ্নের সরল জবাবও আমার পক্ষে এক রকম দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিলো। অনেক লৰা কাহিনী। সে সমস্ত কথা থাকুক।

এক সময় শিববাবু বসুমতী সাহিত্য মন্দির কর্তৃক প্রকাশিত বঙ্কিম রচনাবলী আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এইবার পড়বি সাহিত্য সম্রাটের রচনা। বঙ্কিম রচনাবলী পাঠ করতে গিয়ে আমি যে প্রাথমিক হোঁচটটি খাই সেই অভিজ্ঞতার বয়ানটুকু দিয়ে আমার বঙ্কিমচন্দ্রের পুনঃমূল্যায়ন সম্পর্কিত রচনাটির সূত্রপাত ঘটাচ্ছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *