৩০. আশ্চর্য রাত্রি আসছে রাধিকার

৩০

এমনি করেই আশ্চর্য রাত্রি আসছে রাধিকার। সমস্ত দিন কথা হয় না। চোখে চোখেও না। দেখা হলেই মুখ নিচু করে পালিয়ে যায় সে। কেন? একজন মানুষ অন্য এক মানুষকে চায়। এর চেয়ে নিষ্পাপ ও সরল আর কী হতে পারে যদি সেই চাওয়ায় কোনও দায়বদ্ধতা না থাকে? শর্ত না থাকে? যেমন একটি নক্ষত্রের গায়ে খসে পড়ে অন্য এক তারা আর প্রজ্জ্বলন হয়—যেমন একটি ফুল অন্য ফুলের গায়ে মুখ রাখে আর পুলকে কাঁপে—তেমনই নারী ও পুরুষ। যদি দায়হীন হয় তারা পরস্পর, যদি শর্তহীন হয়! যদি শুধু কাছে আসাটুকুই সব চাওয়া জুড়ে থাকে! তা হলে ভয় কেন আর? দ্বিধা কেন?

কত দিন চলে গেল। সেই এক হঠাৎ আসা আশ্চর্য সন্ধ্যা, আগুন জ্বলল রাধিকার। আগুন এমন স্বাদের হয়, এমন অপূর্ব অনুভব দিতে পারে—জানল রাধিকা। আর একবার চায় সে। একটিবার চায়। সে তাকিয়ে থাকে। চেয়ে থাকে। বেহায়া মেয়ে। সে তার বালককে ভাত বেড়ে দেয় আর দিতে দিতে বালক ভুলে পুরুষকে কামনা করে। সে শিশুকে স্তন দিতে থাকে আর আশ্চর্য অনন্য অনুভবে ডুবতে ডুবতে মরে যায়। বারবার মরে। বারবার বাঁচে। শিশুটি যখন অন্তহীন পানই করতে থাকে, যখন নরম ঠোঁট—কোমল ও দৃঢ় মুখগহ্বর দিয়ে শুষে নিতে থাকে রাধিকাকে, রাধিকা তখন চোখ বন্ধ করে আরও গভীর শোষণ, আরও কঠিন চাপ প্রার্থনা করে। এতদিন সে পায়নি এমন স্বর্গীয় আনন্দ। যদি না পেত কোনওদিন, সে একরকম ছিল। এখন সে যেন এক অন্য রাধিকা। যেন পাগলিনী সে। যেন বাঁশি শোনে কার আর অসামান্য পুরুষ পায়। এখন আশ্চর্যের সন্ধান সে পেয়ে গিয়েছে, আরও একটু পাবার জন্য, সম্পূর্ণ হবার জন্য সমস্ত অস্তিত্ব তেষ্টায় কাতর হয়ে আছে।

কতদিনে ঘুচব ইহ হাহাকার।

কতদিনে ঘুচব গুরুআ দুখভার॥

কতদিনে চাঁদ কুমুদে হব মেলি।

কতদিনে ভ্রমরা কমলে করু কেলি॥

কতদিনে পিয়া মোরে পুছব বাত।

কবহুঁ পয়োধরে দেওব হাত॥

কিন্তু সে তো চোখ তোলে না। কথা বলে না আর। কেউ জানে না কী হয়েছে সেদিন। কেউ টের পায়নি। রাধিকা নিজের বুকের তলায় মন্দির করে রেখে দিয়েছে সব। সমস্ত দিন তার কানে সাইকেলের ঘন্টি বাজে। আর সমস্ত রাত আশ্চর্য স্পর্শেরা শরীরময় ঘুরে বেড়ায়। আগুন-আগুন লাগে। রাধিকা পাগলির মতো টান মেরে আঁচল নামিয়ে দেয়। দু’খানি হাত সামনে মেলে ধরে। দু’খানি হাত পাতার মতো হয়। আস্তে আস্তে নামিয়ে আনে নরম গভীর উদ্ভাসে। চাপ দেয়। শরীর জুড়ে আবেশ, কত আবেশ, সে ঘুমিয়ে পড়তে চায়। হাত দু’টিতে পুরুষ জেগে ওঠে। সমস্ত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা নামে, নেমে যায়। ক্রমশ নাভি, ক্রমশ ঊরু, ক্রমশ যোনি প্রত্যঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। রাধিকা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। নিজস্ব শরীরে পুরুষপ্রকৃতি নিয়ে খেলে। ঘুমকে জাগিয়ে দেয়, জাগরণীকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে। তার চারপাশে ঘন বর্ষা আসে। যেন, বর্ষার পূর্ণধারা প্রসবিতা গাঢ় মেঘ। মেঘ ছিঁড়ে চাঁদ আসতে চায়। চাঁদের মতোই মুখ, মেঘ ভর্তি মুখ, কোমল কোমল দাড়ি ভর্তি মুখ—রাধিকাকে নিয়ে অস্থির অস্থির খেলে, একটুও বিশ্রাম দেয় না, একটুও দম ফেলবার অবকাশ নেই, রাধিকা কতবার, কতবার মরতে মরতে বাঁচে, বাঁচতে বাঁচতে পরিপূর্ণ হয় এবং আবার মরে যায়। কে তার স্তন মুঠোয় টানছে। কে তার পেটের ওপর উঠিয়ে দিচ্ছে পা। রাধিকা, জানে না কিছু, জানতে চায় না। সে তার স্তনের মধ্যে, নাভির মধ্যে, যোনির গভীরে নিজেকে আরোপ করতে চায় এবং কাঁদে। কাঁদে কারণ রাতের শেষে নিজেকে তার ছিন্নভিন্ন লাগে, পূর্বাপর ব্যর্থ মনে হয়। যখন সে চেতনাতলে আসে আর খুঁজে পায় না কারওকে, তখন গভীর অভিমানভরে ভাবে। চলে গেল সে, বলে গেল না কেন? একটুখানি জড়িয়ে নিতাম যাবার আগে। একটুখানি মুখ ঘষতাম। কোথায় কোথায় কোথায়? বুকে। ওর বুকে। যেখানে মুখ রাখলে দমবন্ধ হয়ে যায়। সব আলো নিভে যায়। প্রত্যাশিত অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকে পৃথিবী আর শান্তি নামে, ক্রমশ শান্তি নামে। আর কোলাহল থাকে না। তখন চেতনা এসে গলা জাপ্টে ধরে। রাধিকা বিপর্যস্ত হয়। কে ছোঁয় কাকে? কার জন্য জাগিস? সমস্ত দিন যে-মুখ সে প্রত্যাশা করে রাত্রে তাকে দেখতে পায় না কেন? যে-মুখ ফেলে এসেছে কত বছর আগে কত দূরে শিবমন্দিরে আশ্চর্য বর্ষণে, তার সঙ্গে দেখা হবে না আর, তবু তাকেই কেন জড়িয়ে থাকে রাতে? দিশেহারা লাগে তার। কী করে সে, কোথায় যায়, কোথায় পায়, একটা সম্পূর্ণ লোক! এরকম খণ্ড খণ্ড গ্রহণ আর ভাল লাগে না। আর পারছে না সে। এ মুখ থাকে, ও মুখ দেখে, সে মুখ চায়। কার্তিকের বউ, কার্তিকের দু’টি সন্তানের স্নেহসিক্ত জননী, কে একজন ছুঁয়ে ফেলল তাকে, কে একজন স্বপ্নে দেখা দিল। পায় না? সম্পূর্ণ পায় না? এই জীবনেই একটি গোটা পুরুষ?

এখন তখন করি দিবস গোঁয়ায়লুঁ

দিবস দিবস করি মাসা।

মাস মাস করি বরস গোঁয়ায়লুঁ

ছোড়লুঁ জীবনক আসা॥

এমনই এক বিভ্রান্ত সন্ধ্যায় কার্তিক এল একদিন। বলল, কাল চলে যাব। পরশু আসব। সব গুছিয়ে বেঁধে-ছেঁদে তৈরি থাকবে। নিয়ে যাব।

কালই শেষ? কালই? রাধিকা ভাবে। সেই কাল তবে এল। ছিঁড়ে ফেলবার কাল। উপড়ে নেবার কাল। ক্রমশ দূরে দূরে ছুঁড়ে ফেলবার কাল, এল, তবে এল। সে বিবশ হয়ে থাকে। কার্তিক শুয়েছে আজ পাশে। সে সন্ত্রস্ত। আজ আর স্বপ্ন আসবে না। আজ আর নিজের সঙ্গে নিজের খেলা বন্ধ থাকবে। আজ সব মেঘ দুয়ার দেবে ঘরে আর চাঁদ গিয়ে শুয়ে থাকবে কার চাতালে, ফুটপাথে, জলের তলায়। রাধিকা তখন নীরবে সেই অনিবার্য কালের জন্য জাগে। শিশুটি কাঁদে। তার গায়ের ওপর বালক পলাশ হাত ছড়িয়ে ছুঁয়ে রেখেছে মাকে। তার জায়গায় বাবা শুয়েছে। সে চলে গেছে দূরে। আর ছুঁতে চাইছে। শিশুটি কাঁদছে। পলাশের ভারে জ্যোৎস্না কাঁদছে। কার্তিক ধমকাচ্ছে, ‘মাই দিচ্ছ না কেন?’

রাধিকা উঠে বসছে। ছেলে কোলে নিয়ে দোল দিচ্ছে। কান্না থামছে না। সে এখন ব্লাউজের হুক খুলছে। হুক ছিঁড়ে পড়ে গিয়েছে কবে। বরং ব্লাউজের দোর সেফটিপিনে আঁটা। সে সেফটিপিন সাবধানে বিঁধিয়ে রাখছে। যেন ক্ষত না দেয় সন্তানকে। বাম স্তন খুঁজে দিচ্ছে শিশুর ঠোঁটে। শিশু ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পান করছে। চোখ বন্ধ করে পান করছে। তখন কার্তিক সর্পিল হয়ে উঠছে। লকলকে জিভ বাড়িয়ে দিচ্ছে দক্ষিণের স্তনে। একটি হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে গভীরে। রাধিকার ঘেন্না করছে। উঃ মাগো, কী এল গায়ে, কী লাগছে! কেন্নো, নাকি জোঁক, নাকি শুঁয়োপোকা, টিকটিকি। সে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে, সহজ নয়। সহজ নয় ফেলা। দাবির সঙ্গে শরীর টানছে কার্তিক। অনেক দিন পর অন্য রকম স্বাদ। তার চাই। সে নেবে। রাধিকা ধাক্কা দিয়ে ঠেলে দিচ্ছে কার্তিককে। কার্তিক ভাবতে পারছে না, বুঝতে পারছে না এ প্রত্যাখ্যান। প্রতিরোধ তৈরি হয়েছে রাধিকার মধ্যে? না বলার ক্ষমতা এসেছে? কবে এল! কেমন করে সম্ভব হল! রাধিকা শান্তভাবে ঘুমন্ত ছেলেকে শুইয়ে দিচ্ছে কাঁথায়। কার্তিক ভাবছে, ও এইজন্যই, এইজন্যই সরিয়ে দিল হাত। সে অপেক্ষা করছে। ছেলে শোয়ানো হলেই আবার টানবে। আবার ঘাঁটবে। রাধিকা বলছে—খবরদার! অ্যাক্কেরে ধরবা না আমারে।

কার্তিক লাফিয়ে উঠছে। কী বললি? কী? শালী! হারামজাদি। খুব তেজ বেড়েছে কেমন? আমার খাবি, আমার পরবি, আমাকেই কলা বেচবি?

রাধিকা লড়াই করছে। আপ্রাণ লড়াই করছে। আঁচড়ে দিচ্ছে, কামড়ে দিচ্ছে কার্তিককে। কার্তিক চড় মারছে। শাড়ি টানছে রাধিকার। রাধিকা আর পারছে না। পালাতে চাইছে। পালাচ্ছে। কোথায় পালাবে? ছোট্ট এই ঘর। এই ছোট্ট পৃথিবী। এই ছোট্ট সমাজ। স্বামীর থাবার তলায় চেপে রেখেছে তাকে। কোথায় পালাবে? সে আছড়ে পড়ল দেওয়ালে আর ঠোঁট কেটে গেল। আর আলোয় আলো হয়ে উঠল ঘর। হাত লেগে গেছে সুইচে। আর আলো জ্বলে গেছে। কার্তিক বিমূঢ় হয়ে গেছে। হঠাৎ আলো সইতে পারছে না। দু’ হাতে চোখ আড়াল দিচ্ছে। তার ঊর্ধ্বাঙ্গে হলদে গেঞ্জি। নিম্নাঙ্গ থেকে লুঙ্গি খসে গেছে। রাধিকা ডাকছে, পাগল হয়ে ডাকছে— উঠ্, পলাশ, উঠ্, বাবা, সোনা, উঠ্।

পলাশ উঠে বসেছে। চোখে ঘুম। তবু—তবু—বাবা এসেছে আজ। সে উঠে বসেছে—কী হইছে মা? কী?

—উঠ্ বাবা। তর বাবায় আমারে মারে। আমারে কিলায়। রাধিকা বিছানার কাছে বসে পলাশের কোলে মাথা গুঁজে দিচ্ছে। পালাচ্ছে সে। এক পুরুষ থেকে আর এক পুরুষে পালাচ্ছে। বালক পলাশ পুরুষ হয়ে যাচ্ছে। দেখছে বাবাকে। কার্তিক লুঙ্গি পরছে। কীরকম নির্বোধ লাগছে তাকে। কীরকম অশক্ত লাগছে। যেন ধাক্কা দিলে পড়ে যাবে। পলাশ ভাবছে—এই লোকটাকে ভয় পায় মা? এই লোকটাকে? তার ভয় করছে না। কিন্তু সে স্তব্ধ হয়ে আছে। তার ভেতর থেকে কী যেন চলে যাচ্ছে আর কী যেন জায়গা নিয়ে নিল। হ্যাঁ, হতে পারে, কার্তিকের প্রতি ভয় চলে যাচ্ছে, নির্ভরতা চলে যাচ্ছে, ভালবাসা যতটুকু ছিল তাও—কিন্তু তার বদলে কী এল? এ সবের জায়গা নেয় কী? রাগ? ঘৃণা? প্রতিহিংসা? আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ছে কার্তিক। শোবার আগে দেখে নিচ্ছে রাধিকাকে। মাথা জ্বলছে তার। রাগে। অপমানে। প্রত্যাখ্যানে। ছেলে জেগে গেছে। এই জাগরণ তাঁকে আরও ক্রোধী, নিষ্ঠুর ও দাবিদার হওয়া থেকে অক্ষম করেছে। পলাশ ঘুমন্ত গলায় বলছে—মাটিতে শুইবা মা? মাটিতে? পাটিখান পাইত্যা দেই?

রাধিকা উঠে বসছে। কী হচ্ছিল এতক্ষণ? বাজে-কবুতরে লড়াই? বাঘে-হরিণে লড়াই? সে আঁচল সামলাচ্ছে। সারা শরীর কাঁপছে তার। কতক্ষণ যুদ্ধ করেছে সে? বলছে—হ। পাটিখান পাত পলাশ। শুই।

পলাশ পাটি পাতছে। হাত দিয়ে মুড়ে মুড়ে সোজা করছে গুটিয়ে যাওয়া প্রান্ত। রাধিকা খোঁপা আঁটছে। জানলা দিয়ে রাত্রির নিজস্ব আলো ঢুকে পড়ছে ঘরে। রাধিকার মনে পড়ছে, এই সেই আলো, যা বাবা দেখতে পেত, দেখাতে চাইত রাধিকাকে, সে বোঝেনি তখন, আজ বুঝতে পারছে, কত কিছুই যে বোঝা হয় না আগে আর শেষ পর্যন্ত যখন উপলব্ধি হয় কত কিছুই হারিয়ে যায়।

পলাশ কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। বলছে—আমি তোমার লগে শুই মা?

ছেলের মাথায় হাত রাখছে রাধিকা। বলছে—শোও।

বাড়তি বালিশ নেই। নিজের বালিশ দিয়ে, পলাশের বালিশ দিয়ে জোছনের পাশে বাঁধ দিচ্ছে রাধিকা। পড়ে না যায়। ভাবছে। বলছে—যাবি আমার লগে?

—কই যাইবা?

—কলে যামু।

কলঘরের দিকে যাচ্ছে রাধিকা। একবারও পরমেশের কথা মনে পড়ছে না তার, আজ শুধু খিলপাটনি গাঁয়ে ফেলে আসা মুখ উঁকি দিচ্ছে। বারবার উঁকি দিচ্ছে। সে মুখে-চোখে জলের ঝাপটা দিচ্ছে। চোখ ফেটে জল আসছে। সে আঁচলে চোখ মুছছে। মুখ মুছছে। পলাশ প্যান্টের বোতাম খুলে হিসি করছে আর বলছে—কান্দো ক্যান মা?

রাধিকা চমকে উঠল। ও কী করে জানল? কেমন করে জানল? সন্তানকে জন্ম দেয় মা। সন্তানও কি জন্ম দেয় মাকে? রাধিকা হাসার চেষ্টা করছে। ছেলেকে জড়িয়ে ফিরে যাচ্ছে ঘরে। আজ আর ঘুম হবে না। পলাশ মায়ের বাহুতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ছে। একটি পা তুলে দিয়েছে পেটে। রাধিকা বাইরে চেয়ে আছে। জানালা দিয়ে একটুখানি আকাশ। একটি দু’টি তারা। সে ভাবছে, সত্যি তা হলে প্রতিরোধ করতে পারল সে? সত্যি পারল? কতদিন ইচ্ছে করেছে তার, পারেনি। ছেলেকে জড়িয়ে ধরল সে। ছেলের পিঠে মুখ গুঁজে দিল। ভীষণ কান্না পেল এবার। মনে মনে বলতে লাগল সে—আমাকে বাঁচাবি না পলাশ? বাবা? বাঁচাবি না আমাকে? তার মনে রইল না, পলাশ এখনও এক বালকই বটে।

সকালে খুব গম্ভীর থাকল কার্তিক। চারটে রুটি আর বেগুনভাজা খেয়ে হৃদয়পুর ফেরার তাড়া করল। যাবার আগে আবার বলল—সব গুছিয়ে রাখবে, কাল বেলাবেলি এসে নিয়ে যাব। একবার শেফালির মা’র কাছে গেল সে। রাধিকাকে নিয়ে যাবে সে সংবাদ দিল।

বলবে না বলবে না করেও বলে ফেলল শেফালির মা—অরে নাকি ফটিক বিলের বস্তিতে লইয়া যাইবা?

কার্তিক মাথা চুলকোচ্ছে। পরাক্রম খসে যাচ্ছে মুখ থেকে। এদিকে ওদিকে চোখ ঠারছে। বলল—আয় কমে গেছে মাসি। আর চালাতে পারি না।

—চালাইতে পারো না? দুইখান পোলা লইয়া মাইয়াডা এইখানে আঁকড়া-আঁকড়ি করে। হেইখানে তুমি আলাদা বাসা লইসো। আর একখান সংসার করসো শুনি। হেইডা কি একখান ধম্মের কাম হইল? মাইয়াডারে ভাসাইয়া দিলা?

—কে বলে? কে বলেছে এ সব? রাধিকা?

—হ্যায় কইব ক্যান? শুনছি। হ্যায় জানব ক্যামনে? এক পাও বাইরে রাখে?

—মিথ্যে কথা। সব মিথ্যে কথা। হৃদয়পুরে এক বন্ধুর বাড়িতে আছি। একটু মাথা গুঁজে থাকা।

—হেইখানে লইয়া যাও মাইয়াডারে। বস্তিতে রাখতেয়াসো ক্যান?

দু’বার কাশে কার্তিক। শেফালির মা তার কাশির মধ্যে ষড়যন্ত্র খুঁজে পায়, যেন-বা সে ওই কাশির সময়টুকুতে কোনও পরিকল্পনা ফেঁদে নিচ্ছে। কার্তিক বলে—সে মেয়েমানুষের থাকার মতো নয়। আর বড় ঘর নিলে যা লাগবে তা আমি দিতে পারব না। চারটে মানুষের খাঁই মেটানো আপনি আর কী বুঝবেন মাসিমা? আপনার তো চার ইঞ্জিন চলে। লোকে বলল, বামফ্রন্ট এলেই বাজার নামতে শুরু করবে। কোথায় কী!

শেফালির মা আর কথা বাড়ায় না। দুরাত্মার কত ছল! বিয়ে না করলেও কার্তিক যে আর একটা মেয়েছেলে নিয়ে থাকে তা সবাই জানে। রাগে ও ঘেন্নায় গা গুলিয়ে ওঠে শেফালির মা’র। কোনও কোনও পুরুষ মানুষের কিছুতেই খাঁই মেটে না। এমুন ডাগর মাইয়া ফালাইয়া আধবুড়িরে লইয়া থাকতেয়াসে। কয় না—পুরুষের ভালবাসা মুসলমানের মুরগি পোষা…ভাবতে ভাবতে এক ঝলক সন্দিহান হয়ে পড়ে শেফালির মা। এ বাক্য সব পুরুষে যায় কি? যায় না। যেমন পোষা মুরগি জবাই করতে দুঃখ পায় অনেক মুসলমান। আসলে হইল কপাল। ভাইগ্য। যার যেমুন ভাইগ্য। মাইয়ামাইনষের কও আর মুরগির। রাধিকার কপালে কী আছে কে জানে! পোড়া কপালে মেয়ে। একটু সুখের মুখ দেখল না কোনওদিন। শেফালির মা উনুনে হাঁড়ি চাপাতে চাপাতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সেই শ্বাসে আঁচ উসকে যায়। হাঁড়িতে ভাত ফুটছে টগবগ-বগবগ, হাঁড়ির মুখে ঢাকনাটা নাচছে। সংঘর্ষে শব্দ তুলছে টাং টাং টাং। শেফালির মা ঢুকে যাচ্ছে হাঁড়ির মধ্যে। ফুটছে, ফুটছে, ফুটছে। অক্ষম রোগে নিরুপায়ভাবে আঁচে আঁচে সেদ্ধ হচ্ছে সে। আর দেখতে পাচ্ছে এইরকম হাঁড়িতে পাশাপাশি উনুনে সেদ্ধ হচ্ছে রাধিকা নিজে। এবারে শেফালির মা’র চোখে জল এসে যাচ্ছে। মা মঙ্গলচণ্ডীর প্রতি গাঢ় অভিমানে বুক ভেঙে যাচ্ছে। এত ডাকলাম তোমাকে, এত পূজা করলাম, এ কী হল! আমি পাপ বুঝি না। প্রায়শ্চিত্ত বুঝি না। এইটুকু মেয়ের আর পাপ কী? প্রায়শ্চিত্ত কী? আমি বুঝি কপাল। বিধির লিখন খণ্ডানো যায় না! যায়ই না যদি, তবে আর তোমাকে ডাকব কেন মা, পূজা করব কেন? যা হবে তা এমনি হবে। যা যাবার তা ওমনি যাবে। আমি কী পাপ করেছিলাম যে আমার শেফালি চলে গেল!

রাধিকা সকাল থেকে একবারও আসেনি। শেফালির মা তার স্বভাব জানে। খুব কষ্ট পেলে, খুব রাগ হলে, রাধিকা নিজেকে বন্ধ করে ফেলে। পালিয়ে যেতে চায়। শ্যাফালি, শ্যাফালি— অ্যাক্কেরে শ্যাফালির লাখান। সেই যে অভিমান করে সে চলে গিয়েছিল জামরুলতলায় আর সাঁঝসন্ধ্যায় কেমন হারিয়ে গিয়েছিল। তারপর প্রবল অসুখ করল তার। কত কী হতে পারত সে-দিন। শেফালিকে সাপে কাটতে পারত। সে পুকুরে পড়ে ডুবে যেতে পারত, সুশীলার পেত্নি ঘাড়টা মটকে দিতে পারত। কোনও কোনও সময় মনে হয় দিলেই বোধহয় ভাল হত। অন্তত জানা যেত কী গতি হল মেয়েটার। শেফালির মার এক এক বারে ইচ্ছে করে কলকাতা শহরের ওই আকাশছোঁয়া বাড়িগুলোর ওপর দাঁড়ায় আর চিৎকার করে ডাকে—‘শ্যাফালি লো-ও-ও-ও,’ যদি শুনতে পায় সে কোনওদিন আর সাড়া দেয়—‘মা-আ-আ-আ। আইতাছি—ই-ই-ই।’ যেমন দিত ছোটবেলায়, যেমন ডাকত শেফালির মা তখন তাকে!

হাতে মাছের থলে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন অমরেশ। সকালে দাড়ি কাটেননি। সাদা বাসি দাড়িতে মুখ ভরে আছে। রোগা শরীর। সারা জীবন লড়াই করতে করতে ন্যূব্জ। এই প্রাক্ শীতের পর্বেও তাঁর গায়ে ঘাম ফুটছে। শেফালির মা থলে নিয়ে গামছা এগিয়ে দিচ্ছে স্বামীর দিকে। জল দিচ্ছে। অমরেশ জল পান করতে করতে স্ত্রীর দিকে দেখছেন। শেফালির মা’র চোখ ফোলা। গালে জলের দাগ। ফরসা শরীরের টিকলো নাকটি আজও কষ্ট পেলে লাল হয়ে যায়। অমরেশের বুকের মধ্যে মায়া জমে উঠল। অপূর্ব ভালবাসায় ব্যথিয়ে উঠল ভেতরটা। কী সুন্দর এই রমণী! কত বড়, কত নির্ভরযোগ্য তার মন। অমরেশ সারা জীবন কষ্ট ছাড়া কিছুই দিতে পারেননি স্ত্রীকে। বহু চেষ্টা করার পরও ঈশ্বর সে ক্ষমতা দেননি। উল্টে শেফালির মাকেই চাকরি নিতে হয়েছে। ওই সামান্য আয়ই কাজে লেগেছে সংসারের। দেশে থাকতে অমরেশ কি স্বপ্নেও ভেবেছিলেন, ঘরের লক্ষ্মী বাইরে কাজ করতে যাবে? সেখানেও অভাব ছিল। সুখ-দুঃখ ছিল। কিন্তু ইচ্ছের জোরও ছিল। তিনি জানেন, শেফালির মা এক দুঃখী মহিলা! কিন্তু তার কোনও অভিযোগ-অনুযোগ নেই। সে ভারী আশ্চর্য করে ভাবে। আশ্চর্য করে বোঝে। তার বোঝা সকলকে শক্তি দেয়। সংসারের চাকা যখন একেবারে বসে যাবার উপক্রম তখন এক রাত্রে স্ত্রীর বুকে মাথা দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন অমরেশ। গোটা সংসার নিয়ে আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন তিনি। তখন, অমরেশের যুবক চুলে পাক ধরছে, তাতে আঙুল চালাতে চালাতে শেফালির মা বলেছিল—শুধু দুঃখের দিকে তাকিয়ো না। সারাক্ষণ যদি নিজের দুঃখ তুলে দেখো, তবে চারপাশের একটুখানি সুখও আর ধরা দেবে না জীবনে। কিন্তু সেই একটুখানি সুখ কী বুঝতে পারেননি অমরেশ। শেফালির মা বলেছিল—এই বেঁচে থাকা। এই এক সঙ্গে থাকা। সুস্থ থাকা। যদি শেফালির মতো আমরা সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতাম! যদি আর আমাদের দেখা না হত! যদি এই দুই সুস্থ সন্তান না পেতাম আমরা! যদি তুমি অক্ষম হয়ে যেতে আর আমি পাগল হয়ে যেতাম! এ সব হয়নি। এই সুস্থতা এই কর্মক্ষমতা এই একসঙ্গে থাকা, এ-ও কি সুখ নয়? চারপাশে দেখোনি, কত লোক একলা হয়ে গেল, কত লোক হারিয়ে গেল, মরে গেল।

স্ত্রীকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন অমরেশ। তাঁর মনে হয়েছিল স্ত্রীই শক্তি, স্ত্রীই সহায়িকা, স্ত্রীই দৃষ্টি। আর ভেঙে পড়েননি তিনি। খুব লড়াই করেছেন। শূন্য হাতে লড়েছেন। শখ করে জামাকাপড় বানানো শিখেছিলেন, সেই শখই তাঁর পুঁজি ছিল। সেটুকু দিয়ে শুধু কষ্ট করে বেঁচে থাকতে পেরেছেন তিনি, স্ত্রী-পুত্র নিয়ে বেঁচেছেন। এর বেশি কিছু দিতে পারেননি শেফালির মাকে। কিন্তু ভালবেসেছেন। গভীরভাবে ভালবেসেছেন। যত বয়স বেড়েছে, যত পরিণতি এসেছে ভাবনায়, যত লড়াই করতে করতে ক্লান্ত হয়েছেন, তত ভালবেসেছেন।

চারপাশে একবার দেখে নিলেন অমরেশ। তারপর তর্জনী দিয়ে শেফালির মা’র নাকটি ঠেলে দিয়ে বললেন—কান্দো ক্যান?

শেফালির মা চুপ। নাক টানল দু’বার। অকারণে খোঁপা খুলে আবার খোঁপা করল। অমরেশ বলল—থইলাখান খুইলা দ্যাখসো?

—না। শেফালির মা’র গলা ভারী।

—কী আনছি কও?

—ক্যামনে কমু?

—চিতল মাছের গাদা আনছি। কোল আনুম মনে লইসিল, এমুন দাম! হাত দ্যাওনের উফায় নাই!

—হ। গাদার দাম য্যান কিসু কম। আর গাদা খাইয়া চিতলের কোল খাওনের আনন্দ পাইবা? হেই যে কয় না—

স্বপন দেখি লুচি খাই

জাইগ্যা দেখি ক্যাথা চিবাই

তোমার হইল গিয়া হেই দশা।

অমরেশ হাসছেন। বলছেন—ক্যান? ক্যাথা ক্যান? তুমি মুইঠা রানবা। কতদিন হয় তোমার হাতের মুইঠা খাই না কও দেহি।

শেফালির মা’র মুখখানা কোমল হয়ে আসে। কী সামান্য সাধ! মুইঠা খাবেন। কী সাধারণ বেঁচে থাকা! কত ছোট ছোট ইচ্ছে আর স্বপ্ন। স্বামীর ভাঙাচোরা মুখের দিকে তাকিয়ে তবু শেফালির মা’র মনে হয়—এ জীবন সুন্দর। এই বেঁচে থাকা সুন্দর। পরস্পরকে জড়িয়ে এই শ্বাস নেওয়া, এই অন্নগ্রহণ, এর কি কোনও তুলনা হয়?

অমরেশ বলেন—অগো আইজ খাইতে কও শ্যাফালির মা।

শেফালির মা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বামীর দিকে তাকায়। সেও আজ চেয়েছিল রাধিকাকে, পলাশকে খেতে বলবে। একসঙ্গে পাত পেড়ে খাবে দু’জনে! অমরেশ সেই ইচ্ছাটি বুঝে নিয়েছেন। নিজের সাধ্যের মধ্যে সেরা মাছ কিনেছেন বাজার থেকে। শেফালির মা’র চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে যায়। ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতায় কানায় কানায় মন ভরে ওঠে। সে একটু ঘন হয়ে আসে।

অমরেশ কাঠের চেয়ারে শরীর এলিয়ে দেন। সে বলে—কমু। আমারও সাধ লইসিল। শুনছ?

—কও।

—তুমি ক্যামনে জানলা?

—কী?

—অগো খাইতে কমু ভাবসিলাম।

—জানুম না? হগ্গলৈ জানি। তোমারে না জাইন্যা যামু কই। পার পামু?

তাঁর মুখে ছায়া নেমে আসে। বহু কথা উপছে আসে। বলা হয় না। অনেক দুঃখের কথা। বুকের মধ্যে মাথা খুঁড়ে মরে সেইসব। বলতে ইচ্ছে করে—তোমার সব ইচ্ছের কথাই তো টের পেয়েছি আমি। টের পাই। কতটুকুই-বা পুরোতে পারলাম।

শেফালির মা থালা নিয়ে চামচ নিয়ে স্বামীর পায়ের কাছে বসে। ছোট ছোট দু’খানি খুপরি ঘর। একটিতে ছেলেরা থাকে। অন্যটিতে রান্না-বান্না হয়। এ ঘরেই একখানি চৌকিতে শুয়ে পড়েন দু’জনে। আগে এই ঘরটিই ছিল। একটাই ঘর। দিনের পর দিন অমরেশ মেঝেতে শুয়েছেন। চৌকিতে দুই ছেলে নিয়ে শেফালির মা। রাত্রে এক এক দিন নেমে এসেছেন। পা টিপে টিপে এসে স্বামীর বুকে মাথা রেখেছেন। কত ভয়ে ভয়ে, কত সন্তর্পণে। ছেলেরা যাতে টের না পায়। জায়গার অত অভাব ছিল, তবু চৌকির তলায় কিছু রাখতে দিতেন না অমরেশ। স্ত্রীকে বুকে নিয়ে এটিই ছিল তাঁর একমাত্র আড়াল। একমাত্র স্বর্গ! কত কিছু মনে পড়ে। কত আশ্চর্য দিন। কত অদ্ভুত, বিচিত্র সময়।

শেফালির মা চামচ দিয়ে মাছের সারবস্তু খুঁড়ে নিচ্ছে এখন। অমরেশ দেখছেন। কী অদ্ভুত কায়দা। চামচের ডগায় মাছের মাস উঠে আসছে। কাঁটাগুলি খোঁচা খোঁচা হয়ে গেল। অমরেশ শুধালেন—প্যাঁজ আসে নি?

—হ। আসে। ক্যান?

—চাম চচ্চড়ি রানবা না?

—হ। রান্দুম।

—ঝাল ঝাল কষা কষা কইরো।

—হ। করুম। শুনছ। একখান কতা কমু?

—কও।

—রাইতে শুটকি খাইবা? লইট্যা শুটকি?

—আসে?

—না। আইন্যা দিবা। মাইয়াডারে রাইতেও খাইতে কমু। শুটকি আর ভাত। আর কিসু না। হ্যায় বড় ভালবাসে।

মাথা নাড়েন অমরেশ। বলেন—হ’ দিমু অনে। আর কী লাগবো কইয়ো। রসুন, প্যাঁজ… তরকারি করবা, না ভর্তা।

—দুয়ৈ করুম। ভর্তায় তো এতগুলা প্যাটের কুলাইব না। তরকারিও করুম আর অল্প কইরা ভর্তা।

স্কুল খুলে যাবে ক’দিন পর। তখন আর এ সব হবে না। শেফালির মা নিখাদ গৃহিণীর মতো মুইঠা রান্নার সময় পাবে না আর। এই শান্ত গৃহস্থালি, এই প্রাণ ছুঁইয়ে রান্নাবাড়া এই সময়টায় করে নেয় শেফালির মা। দেশে কত কাজ ছিল। ঢেঁকিতে পাট দেওয়া, বড়ি দেওয়া, ডাল বাটা, সর্ষে কোটা। এখানে সে-সব নেই। এখানকার গেরস্থালি যেন শুধু রান্নায় সীমাবদ্ধ। শুধু কাপড় কেচে শুকোতে দেওয়া আর ভাঁজ করায় সীমাবদ্ধ। স্কুল খোলা থাকলে সেটুকুতেও টান পড়ে।

মাছের মাস ছাড়িয়ে, কথা বলতে বলতেই, তাতে নুন-হলুদ মাখছিল শেফালির মা। চটকাচ্ছিল বেশ করে। হাতে তেল মেখে আঠাল তলতলে মাস দলা পাকাচ্ছে এখন। মুঠো করছে। অমরেশ বলছেন—আইজ আর দোকানে যামু না। বুঝলা।

শেফালির মা সতর্ক হয়। স্বামীর মুখের রেখা পড়ার চেষ্টা করে। মানুষটা কাজে ফাঁকি দেন না একদম। প্রশ্ন করে—ক্যান? শরীলডা খারাপ লাগে?

—না। শরীলে কিসু না। আইজ মনডা বড় উতলা আসে।

—ক্যান? মাইয়াডার লিগা মন কান্দে?

—হ। আসিল লগে লগে। পোলাড়ায় আইয়া গল্প কইত। দাদু-দাদু ডাকত। বুকডা য্যান খালি খালি লাগে।

দু’জনেই চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। রাধিকার জন্য এভাবে আগে স্নেহ প্রকাশ করেননি অমরেশ। হয়তো এই যাবার কালে তিনি নতুন করে নতুন স্নেহাবেশ টের পাচ্ছেন। হয়তো তাঁরও রাধিকা দেখতে দেখতে বারবার মনে পড়েছে তাঁর শেফালির মুখ। কিন্তু ভুলেও সে-কথা তিনি উচ্চারণ করেননি। পিতৃহৃদয়ের সব তোলপাড় পাঁজরের আড়ালেই থামিয়ে রেখেছেন। তাঁদের জীবনে দুঃখ অধিক কিন্তু বিশ্বাস, ভালবাসা ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতার অপরিসীম সুখ। অমরেশ দেখেছেন—সুখ-দুঃখময় এই জীবনে এক এক জন আসে। মায়ায় বাঁধে। তারপর হারিয়ে যায়। শেফালির মাও তখন ভাবতে থাকছিল ক্রমাগত। রাধিকা এল। মায়ায় বাঁধল। এবার হয়তো হারিয়ে যাবে। শেফালির মা জানে, সে বস্তিতে যাবে না। যেতে পারবে না। রাধিকার সঙ্গে তার সম্পর্কের প্রবাহের মাঝে বস্তি একটি বৃহৎ দেওয়াল হয়ে যাবে। একযোগে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দু’জনে। অমরেশ বললেন—আইজ বাজার থিকা মল্লিদাদার বাড়ি গেসিলাম। বিজয়ার প্রণাম করা হয় নাই।

—কেমুন দ্যাখলা?

—ভাল আর কই? দুঃখের কথা কইলেন। হ্যায়রে তো দুঃখের কথা কইতে শুনি নাই। এখন শুইন্যা বড় মন খারাপ লাগতেয়াসে। কয়, পোলায় লিখসে, মায় যদ্দিন তোমার লগে আসিল তুমি মায়রে পাগল বানাইয়া রাখসিলা। অহন মায় সুস্থ আসে। মায়রে আর পাঠামু না আমি।

—এমুন হয়? কী কও? হয় এমুন? পাগল-ছাগল হইলেও বউ কাসে আসিল। বিশাল বাসাডায় অখন অ্যাকলা মানুষ কেমুন কইরা থাকব?

—হ্যায় কোলাকুলি করসে না।

—ক্যান?

—কইল ছুঁমু না। সব অশুদ্ধ। কাদায় ময়লায় অ্যাকাকার। সব অশুচি। সব কয়লা। ব্যাজাতে কুজাতে দুনিয়া ভইরা গ্যাসে। ছুঁমু না। কাউরে ছুঁমু না। হ্যায় এমুন আসিল না। আমার ডর লাগতেয়াসে।

—কীসের ডর?

—ডাক্তারি করে না। খালি পূজা লইয়া আসে। কয় হ্যায় আইসিল। শুচিয়ে পূজা না করলে হগ্গলরে মাইরা ফালাইব।

—কার কথা কয়? হেই রূপচান্দ দাদুর প্যাচাল?

—হ।

—তাইনরে দ্যাখসো তুমি?

—দ্যাখসি। ছুডো আসিলাম তো। তাও ভুলি নাই। তাইনরে ভুলন যায় না।

শেফালির মা রান্নার জোগাড় করে। অমরেশ রূপচাঁদ দাদুর গল্প শোনায়। অদ্ভুত দেখতে ছিল লোকটাকে। গাট্টাগোট্টা, খুব ফরসা। ছোট ছোট করে চুল ছাঁটতেন। শীতে গ্রীষ্মে কোরা ধুতি ছাড়া কিছু পরতেন না। নানারকম যোগাভ্যাস করতেন আর কালীপূজা। লোকে নাকি তাঁকে করোটি নিয়েও পূজায় বসতে দেখেছে। প্রতি অমাবস্যায় শাস্ত্রকথা শোনাতেন রূপচাঁদ। মল্লিনাথদের আঙিনায় লোকে ভিড় করে শুনত। সারা গ্রাম বিশ্বাস করত রূপচাঁদের পাওয়া স্বপ্নাদিষ্ট আসন মন্ত্রপূত। রূপচাঁদের কালী জাগ্রত। রূপচাঁদ বলতেন—শুদ্ধভাবে পূজা না করলে ধ্বংস হবে। সব ধ্বংস হবে। মুসলমান সহ্য করতে পারতেন না তিনি। খ্রিস্টান সহ্য করতে পারতেন না। অসম্ভব পর-ধর্মদ্বেষী ছিলেন। মানুষের মধ্যে তা চারিয়ে দিতেন। বলতেন—‘সমস্ত মুসলমান, সমস্ত খ্রিস্টান, সব পাপী। ওদের জন্য পৃথিবী ধ্বংস হবে।’ গাঁয়ের লোক শুনত। ভুলেও যেত। ধর্ম-বিভেদ তখন খুব দৃঢ় হয়নি তাদের মধ্যে। কিন্তু বীজ গজিয়েছিল। অত বছর পর দাঙ্গার সময় তার প্রকাশ ঘটে। এসব বিষের ক্রিয়া অতি ধীর এবং অনিবার্য। বংশে বংশে, যুগে যুগে তা চারিয়ে যায়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া যা থাকে, তা ওই ভয়। অশুদ্ধতার ভয়। কালীর কোপে পড়ার ভয়।

অদ্ভুত নিষ্ঠুরতাও ছিল মানুষটার মধ্যে। অমরেশের মনে আছে, ঠাকুরঘর থেকে বাতাসা চুরি করেছিলেন মল্লিনাথ। তখন তাঁর আট বছর। অমরেশের ছয়। রূপচাঁদদাদু জানতে পেরে গিয়েছিলেন। দুপুর বারোটার রোদ্দুরে দু’হাতে দু’খানা ইট চাপিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন মল্লিনাথকে আর দু’পয়সার বাতাসা কিনে ক্রমাগত মুখে পুরে দিচ্ছিলেন তার। মল্লিনাথ খেতে পারছিলেন না। জল চাইলেই আর একটা বাতাসা পুরে দিচ্ছিলেন। গলায় বাতাসা আটকে ভয়ে অপমানে কষ্টে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন মল্লিনাথ। রূপচাঁদের ভয়ে কেউ তাঁকে বাঁচাতে আসেনি। শুধু ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে নলিনীবালা ছুটে এসেছিলেন। নাতির মাথা কোলে করে গলায় আঙুল দিয়ে বমি ও শ্লেষ্মা মাখানো বাতাসা টেনে বার করেছিলেন। সেই বাতাসার সঙ্গে রক্ত মাখানো ছিল। এরপর অনেকদিন ভালভাবে কথা বলতে পারেননি মল্লিনাথ। গলা বসে গিয়েছিল।

শেফালির মা কথা বলতে পারছে না। পায়ে পায়ে পলাশ এসে দাঁড়িয়েছে, দরজার কাছে। শেফালির মা বলছে—ব। মায় কী করে? তার গলা কাঁপছে। সে প্রশ্ন করছে—হায় হায় এমুন নিষ্ঠুর! খুন হইয়া যাইত পোলাভায়। আইচ্ছা, তোমার কি মনে হয় হ্যায় আসে? সইত্য আসে?

অমরেশ চুপ করে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর ব্যাখ্যা করতে চান। কে জানে, কী হয়! এই দুনিয়ায় যা-কিছু ঘটে সবের ব্যাখ্যা নেই। মল্লিনাথের বাবার অপঘাতে মৃত্যু হল তো! সেই কোন সুদূর বাংলাদেশের গ্রাম থেকে ওই সিংহাসন ভেসে এসে ঠেকল তো দক্ষিণেশ্বরের ঘাটে! আর সে-দিনই মল্লিনাথ তো উপস্থিত হলেন দক্ষিণেশ্বরে! এ সবের ব্যাখ্যা কে দেবে? কে বলবে তিনি আসেন কি না! ঈশ্বরকে যদি ভয় পেতেই হয় তবে তাঁকে পূজা করা সম্ভব নয়। ভালবেসে যে-ভক্তি আসে, যে-পূজা আসে তাই অভ্রান্ত। যে অভয় দেবে তাকে ভয় করলে চলবে কেন! রূপচাঁদ ঈশ্বর ছিলেন না। যতই পূজা করুন, অত ঘৃণা ও নিষ্ঠুরতা সমেত তাঁর পক্ষে পুণ্যাত্মা হওয়া সম্ভব ছিল না। তিনি দুরাত্মা ছিলেন। দুরাত্মা অমর। অজর। যুগে যুগে তার জন্ম হয়। সে বারবার মরে আর বারবার জন্মায় মানুষের চিন্তায়, জীবন-যাপনে, বিশ্বাসে আর দুঃস্বপ্নে।

অবশেষে, আজ এ ঘরে রাধিকার শেষ রাত্রি। এর দেওয়ালে দেওয়ালে তার সমস্ত ভাবনা লেখা আছে। তার ইচ্ছে ও স্বপ্নের কথা, তার কষ্ট ও অবহেলার কথা। এ ঘরেই আঁকা আছে সেই অসামান্য সময় যখন একবারের জন্য রাধিকা জেগে উঠেছিল। এই পরিবেশ, জানলা দিয়ে দেখতে পাওয়া এক টুকরো আকাশ, মাছ হয়ে ঘুরে বেড়ানো দুষ্ট আত্মাভর্তি পুকুর ও সজনে গাছ, যার পাতা ভেজে খেয়ে অনেক দুপুর কেটে গিয়েছে রাধিকার—এ সব আর কাল থেকে থাকবে না। শেফালির মা থাকবে না। আর থাকবে না শমসেরকে চাইতে চাইতে পরমেশকে আঁকড়ে ধরা। আজ সে একবারও কাঁদেনি। কটাই বা জিনিস! বাঁধা-ছাদা করা হয়ে গেছে। শুধু একটা কাজ বাকি। পরমেশকে দেখতে পায়নি সারা দিন। শুধু সাইকেলের শব্দ পেয়েছে। সে তো জানে রাধিকা চলে যাবে কাল। তবু কেন একবার এল না। কতদিন চোখে চোখ পড়েনি। কতদিন কথা হয়নি। পরমেশ তাঁকে এড়িয়ে যাচ্ছে। হয়তো ভাবছে এ যাওয়া তো সম্পূর্ণ যাওয়া নয়। রাধিকা আবার আসবে। দেখা হবে। পরমেশের কাছে এ যাওয়ার তেমন কোনও মূল্যই নেই। কিন্তু রাধিকা বুঝতে পারছে, এ যাওয়া তার কতখানি। এই দূরত্ব কত অনতিক্রম্য। সে ক্রমশ অন্ধকারের আভাস পাচ্ছে। আরও গভীর, আরও ঘন অন্ধকার। ধীরে ধীরে উঠে বসল সে। নিঃশব্দ নেমে এল বিছানা থেকে। আলো জ্বালল। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে সন্তান দু’টি তার। সে ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে পরমেশের ঘরের দিকে। মৃদু টোকা মারছে দরজায়। একবার, দু’বার। পরমেশ কি বুঝতে পেরে গেছে? সে কি জানত রাধিকা চলেও আসতে পারে এই ঘোর রাত্তিরে? সে কি প্রতীক্ষা করছিল? নিঃশব্দে দরজা খুলে দিল সে। দেখল এক পলক। মৃদু স্বরে বলল—বউদি!… রাধিকা ভেবেছিল, আর একবার, মাত্র একবার পরমেশের বুকে মুখ রাখবে সে। ধবল শরীরে, মুথা ঘাসের মতো রোমের আড়ালে দু’খানি রক্তাভ চুনীতে মুখ রাখবে আর আগুন হতে চাইবে।

জৈসন রজনি উজোরল চন্দ।

ঐসন বেস ভূসন করু বন্ধ॥

এ ধনি ভাবিনি কি কহব তোয়।

নিচয় সো নাগর তুয়া বস হোয়॥

তুহু রস নাগরি নাগর রসবন্ত।

তুরিতে চলহ ধনি কুঞ্জক অন্ত ॥

কিন্তু সে এখন শীতল হয়ে আছে। পরমেশ দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে আছে রাধিকার পায়ের কাছে। ফিস ফিস করে বলছে—ক্ষমা করুন বউদি। যাবার আগে আমাকে ক্ষমা করে দিয়ে যান। আমি সে-দিন পাপ করেছিলাম!

৩১

ঘ্রাণ পেয়েছে অন্ধ। বস্তিতে নতুন সংসার আসার ঘ্রাণ। সংসার হয় বটে ফটিক বিল বস্তিতে। জিনিসপত্র নেই। পয়সাকড়ি নেই। ছেঁড়া কাঁথা আর ফুটো চাল—তবু গলায় রক্ত তুলে খাটুনি আর জীবন-যাপন। সংসার করা। সংসার। কথায় বলে—ঢাল নেই, তরোয়াল নেই, নিধিরাম সর্দার।

তা যাই হোক না কেন। বাঁচার টান তীব্র। যেমন করে হোক বাঁচতে হবে। এই অমূল্য জীবন টিঁকিয়ে রাখা চাই। এই টিঁকিয়ে রাখা এক এক জনের এক-এক রকম। বাঁচার গন্ধও তাই এক এক জনের এক এক রকম। প্রত্যেক পরিবারের গায়ে সে-গন্ধ আলাদা করে লেগে থাকে। আর অন্ধ সেইসব আলাদা গন্ধের সন্ধান পায়। এ বস্তিতে যত রকম গন্ধ আছে, সে চেনে। এখানে পঁয়ত্রিশটা বাসা আর সবার নিজের নিজের গন্ধ। সে যখন হেঁটে যায়, বড় পাথরটায় ঠোক্কর খায়, বুঝতে পারে যে মুন্নাদার বাড়ির কাছে এল। বাড়ি তো নয়। ঘর। এখানে সব ঘর। মুন্নাদার ঘরের গন্ধও তার চেনা।

মুন্নাদা সকালবেলায় মাথুরের গড়ের মোড়ে মাটিতে বস্তা পেতে বসে খুচরো ফুল আর বেলপাতা বিক্রি করে আর দুপুর থেকে সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক করতে যায় জয়শ্রী সিনেমায়। যত ফিল্ম আসে, সব মুন্নাদার মুখস্থ। এক একটা ফিল্ম ও চার-পাঁচবার দেখে। রাজেশ খান্নার ছবি হলে আট-দশবার। সেইসব ফিল্মের গল্প অন্ধকে করে মুন্নাদা। অন্ধ তো কোনওদিন সিনেমা দেখতে পাবে না, তাই। মুন্নাদার কাছে শুনে শুনে অন্ধ সব হিরোর নাম জেনে গেছে। ভিলেনদের নামও। মুন্নাদা ওকে হিরোইনদের বর্ণনাও শুনিয়েছে কিন্তু অন্ধর বেশি আকর্ষণ হিরো আর ভিলেনে।

মুন্নাদা এ পর্যন্ত যত গল্প করেছে অন্ধকে সব তার মুখস্থ। সব কিছুই খুব ভাল মনে রাখতে পারে অন্ধ। গন্ধ, পায়ের শব্দ, বাতাসে উষ্ণতার তারতম্য—সব। সে বলে দিতে পারে, সোমবার বাতাসে জলের পরিমাণ বেশি ছিল কিন্তু মঙ্গলবারের হাওয়া শুকনো। তার মাথাটা খুবই পরিষ্কার। এ কথা অবশ্য জানা ছিল না। কিন্তু মাস্টারকাকা এ কথা তাকে বলেছে। মাস্টারকাকা যা বলে তার এক বর্ণও অন্ধ অবিশ্বাস করে না। মাস্টারকাকা তাকে ভাবতে শেখায়, বুঝতে শেখায়। কথা পর্যন্ত বলতে শেখায়। আজকাল অন্ধ ওর মা-বাবার মতো করে কথা বলে না। শুদ্ধ করে বলে। মুন্নাদার বাড়ি ছাড়িয়ে মাস্টারকাকার বাড়ি। এই বস্তিতে একমাত্র মাস্টারকাকার বাড়ির সামনেই ফুলগাছ আছে। অন্ধ সহজেই এ ঘর চিনতে পারে। সারা বছর ধরে মরসুম বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে এখানকার গন্ধ বদলায়। আর অন্ধ তার মধ্যে দিয়ে বছরটাকে ছোঁয়। এক পুজো গেল—আবার আসবে। এক বসন্ত গেল—আসবে আবার। সে তো ক্যালেন্ডার দেখতে পায় না। ডায়রিও না। মাস্টারকাকার এই গাছগুলোই তার সালতামামি। মুন্নাদা যেমন অন্ধকে ফিল্মের গল্প বলে তেমনই মাস্টারকাকাও অন্ধকে গল্প বলে। কিন্তু সে-সব গল্পের চরিত্র আলাদা। মাস্টার বলে সারা পৃথিবীর গল্প। দেশ-বিদেশের উপকথা আর ইতিহাসের গল্প।

মাস্টার যে ঠিক ঠিক মাস্টারমশাই একজন—তা বলা যাবে না। বস্তির লোক তার নাম দিয়েছিল মাস্টার। অন্ধ জানে, মাস্টারকাকার আসল নাম সত্যব্রত দাস। আর এখানে আসার আগে মাস্টারকাকা বীরভূমে থাকত। অন্ধ বলে—তা, বীরভূমে কি তোমার ঘরবাড়ি ছিল না?

—ছিল।

—তা হলে চলে এলে কেন?

—খুঁজতে রে অন্ধ।

—কাকে? কী?

—কী জানি! এখন আর তা মনে পড়ে না। হয়তো ভাই খুঁজতে এসেছিলাম বা বন্ধু খুঁজতে। নাকি আমি পড়তে এসেছিলাম রে অন্ধ, বা কাজ করতে। এখন আর তা মনে পড়ে না।

—আমার মনে হয় তুমি এখানে থাকবে আর আমাকে গল্প বলবে বলেই এখানে এসেছিলে।

—তা বেশ বলেছিস। আমাকে তুই-ই বুঝতে পারিস রে অন্ধ। তোর জন্যই আমি গ্রাম ছেড়ে এসেছিলাম। এক অন্ধ বালকের জন্য। আমি বুঝেছিলাম, শহর ছেড়ে লেখানো পড়ানোর জন্য শুধু গ্রামেই নয়, যেতে হবে শহরের বস্তিগুলোতেও। কারণ এখানে বাস করে অন্ধ। অনেক অন্ধ। তাই এসে থাকতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু কিছুই করতে পারিনি। অনেক কথা বলার ছিল আমার। বলা হল না। তোকেই সব বলব রে অন্ধ।

—তোমার গল্পগুলো আর কেউ শোনেনি বুঝি?

—নাঃ। শুনল আর কোথায়! কিংবা আমিই হয়তো বলতে পারিনি শোনাবার মতো করে। আমারই ব্যর্থতা সব।

—আমাকে বলো, কী তুমি অন্যদের বলতে চেয়েছিলে?

—ধর্, তোর বাড়িটা হঠাৎ আজ অন্য কেউ নিয়ে নিল আর তোকে শুতে হল রাস্তায়—

—হুঁ!

—তোর ভাতের থালা কেড়ে নিল আর বলল, আজ থেকে তুমি শুকনো মুড়ি খাবে আর ভাত খাব আমরা—

—কেন?

—এটাই তো কথা। কেন! ধর্ তোকে নিয়ে কাজ করিয়ে নিল সারা দিন আর দিল মোটে এক টাকা—

—তখন?

—সেই টাকায় তুই খেতে পেলি না, তোর ঘরের চাল ফুটো, সারাতে পারলি না, তোর মা’র অসুখ, তুই ডাক্তার ডাকতে পারলি না—

—আমার বাবার অসুখ।

—তুই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিস, তোর ছেঁড়া পোশাক, পেটে খিদে, মাথার চুলে দুশ্চিন্তার জট পাকিয়ে গেছে, তুই ধার নিয়ে গেলি, অন্ধ, তুই লেখাপড়া জানিস না, ধার পেলিও যদি, তোকে দিয়ে লিখিয়ে নিল দেড় গুণ, আর তুই বিকিয়ে গেলি—

—আমার মা মাঝে মাঝে আলিচাচার কাছে ধার নেয়।

—তোর কিছুই নেই। ঘর দিলি। মাটিতে শুয়ে থাকিস, কাঁথা চিবিয়ে খাস—

—মাঝে মাঝে খুব খিদে পেলে আমার দুনিয়াটাকে চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করে।

—তোর মা, না হোক বাবা, যন্ত্রণায় ধুঁকছে। তুই জানিস, খিদেয় এবং পরিশ্রমে ওদের অসুখ করেছে। এবার তুই হিসেব কষছিস। যদি এক টাকার বিনিময়ে ওরা তোকে পাঁচ টাকা পারিশ্রমিক দিত তোর ঘর সারত, মা সারত, বাবা সারত, তুই একটু একটু বিদ্যাভ্যাস করতে পারতিস। একটা পরিষ্কার জামা পরে হেঁটে যেতিস রাস্তা দিয়ে আর ভাবতে পারতিস এই পৃথিবী কত সুন্দর—

—সুন্দর নয় বুঝি? আমি তো কত ভাল ভাল গন্ধ পাই!

—এইটাই মুশকিল। তুই যে খারাপ আছিস, তোর যে এরকম সব-হারানো, সব-খোয়ানো জীবন হওয়ার কথা নয় এটা তুই বুঝতেই পারছিস না—

—কেন? বুঝি তো! মা কত বড় বড় বাড়িতে কাজ করতে যায়। তাদের বাড়ি সব ধুয়ে-পুছে আসে। ওখানে পাঁজা পাঁজা বাসন মাজে মা আর এঁটো-কাঁটা দেখে বুঝতে পারে আজ কী কী রান্না হল! সে সব খাবার আমরা জন্মেও খাইনি৷ তাতে কী? মা যখন কুঁচোমাছের চচ্চড়ি করে আর পটলের খোসা বেটে ভাত খেতে দেয়, আমার দারুণ লাগে। মা মাঝে মাঝে কাঁচকলার খোসাও বাটে। একটু কষ কষ গন্ধ বটে কিন্তু খেতে দারুণ।

—কিন্তু তোর বাবা? তুই তো বললি, তার অসুখ সারছে না—

—হ্যাঁ। মা সন্তোষী মা’র পুজো করছে। এবার ইতুও করবে বলছে। সন্তোষী মা’র পুজো করলে, বুঝলে, যা চাওয়া যায়, পাওয়া যায়।

—আর ইতু করলে—

—সেও।

—মঙ্গলচণ্ডী করলে? পুরীর ধামে গেলে? তারকেশ্বরে হত্যে দিলে? কামারহাটিতে সেই কদমগাছ আর নিমগাছওয়ালা পীরবাবার কাছে ঢিল বাঁধলে? মা কালী মা দুগ্গা বলে ঢাক-ঢোল পেটালে? কী হয়—

—ওই যা চাওয়া যায় পাওয়া যায়।

—তবে পাচ্ছে না কেন লোকে? ভিখিরি বাড়ছে কেন? লোকে কাজ না পেয়ে ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরছে আর গলায় দড়ি দিচ্ছে কেন? তোরা আধপেটা খেয়ে মরছিস কেন? ডাক্তার দেখাবার পয়সা নেই কেন? তোর চোখটা অপারেশন করে সারানো যায়। সেটা করা যাচ্ছে না কেন—

—সে-সব গতজন্মের পাপ। মা বলে, ঠাকুমা বলে, পাপী হলে এরকম গরিব হয়ে জন্ম হয়। এক জন্ম ধরে গরিবের ঋণ শুধতে হয় ভগবানকে।

—এই ঋণ আমিও শুধছি রে। জন্মের ঋণ। তোর বাবা যেভাবে দুঃখে কাঁদে, ওমনি কান্না আর কোথাও শুনিস—

—হ্যাঁ, ছোট্টুর মা কাঁদে। জনার পিসি কাঁদে। কুদ্দুসের বউ কাঁদে। নয়নার দিদি কাঁদে।

—ওই এক টাকার জায়গায় পাঁচ টাকা হলে এই কান্নাগুলো থাকত না—

—কিন্তু এক টাকাই দেবার কথা থাকলে পাঁচ টাকা দেবে কেন?

—শোন বুদ্ধু, আসলে দেবার কথা পাঁচ টাকাই। ওরা এক টাকা দেয়। লোককে ভাতে মারে। মনে মারে। মারতে মারতে ভুলিয়ে দেয় তার বাঁচার কথা ছিল—এবং কীভাবে বাঁচার কথা ছিল।

এখন অন্ধ জানে, সব মানুষের বড় বাড়িতে থাকার কথা ছিল। সব মানুষের গাড়ি চাপার কথা ছিল। সবার পেট ভরে সুস্বাদু খাবার খাওয়ার কথা ছিল কিন্তু তা তো হয় না। স্বয়ং মাস্টারই তা খায় না। তবু বলে—যাদের যাদের কান্না শুনতে পাস তারা যদি এক জোট হয়ে পাঁচ টাকা আদায় করতে শেখে তবে ঠিক হয়।

—তাহলে সে কথাটা তুমি কেন সবাইকে বলে দিচ্ছ না?

—বলিনি কি আর? বলেছিলাম। কিন্তু কারও শোনার সময় হয়নি। সারা দিন পরিশ্রমের পর কেউ আর কেমন আছে, কেমন হলে ভাল থাকা যায়, ভাবতে চায় না। তখন তারা চুল্লু খেতে চায়। বেশ্যাবাড়ি ছোটে। গুলতানি করে। ঘুমোয়। সারা দিন মার খায়। যতটুকু সময় মারের হাত থেকে বেরিয়ে আসে ততটুকু ওই মার ভুলে থাকার চেষ্টাতেই কাটিয়ে দেয়। কেন মার খেল, মার খাবারই কথা তার ছিল কিনা ভাবে না। ভাবে এইটাই ওদের প্রাপ্য।

—তুমি কী ভাব?

—আমি আর কী ভাবব? আমি গেঞ্জিকলে কাজ করতে করতে দম ফুরিয়ে ফেলেছি। আমার ফুসফুসে রোগ হয়েছে, বুঝলি? এ রোগ এ বস্তিতে প্রায় সবার আছে। তোরও হবে। বুঝলি? একটা কথা আমি বুঝে গেছি, আমি গান্ধিজি নই। নেতাজিও না। আমি ইন্দিরা গান্ধি নই। জ্যোতি বসুও না। আমি চারু মজুমদার, কানু স্যানাল কিছু না। আমি আসলে যা বলব বলে ভাবি, বলতে পারি না। যা করব বলে স্বপ্ন দেখি, করতে পারি না। আমি তাই শুধু দেখি। ইতিহাস দেখি।

—সেটা কী?

—ঘটনা দেখি। চুপচাপ। আর ভাবি, বিশ্লেষণ করি, এটা হল না বলে ওটা হল। এটা আর একটু অন্যভাবে দেখলে পরিণতি এরকম হত না। বলতে পারিস আমি নিজেই ইতিহাস। কিছুই বদলাবার সাধ্য নেই আমার। শুধু যা ঘটছে তা দেখে যাওয়া ছাড়া। ধারণ করা ছাড়া।

মাস্টারের সব কথা অন্ধ বুঝতে পারে তা নয়। কিন্তু কথাগুলো শুষে নেয়। মুন্নাদা যাই বলুক, অন্ধ শোনে, বোঝে। মাস্টারের কথাও অন্ধ শোনে, কিছু বোঝে, বেশিটাই বোঝে না, এবং সবটা মনে রাখে। অন্ধকে মাস্টার শিখিয়েছেন কাকে বলে ইতিহাস। অন্ধ জানে, এই আজ যা ঘটছে কাল তা ইতিহাস হয়ে গেল। তাই বলে এই জবাফুলটা আজ ফুটছে, আর কাল ঝরে গেল, সেটা কিন্তু ইতিহাস হল না। সেটা অতীত। আজ ছিল। কাল নেই। কাল ছিল। আজ নেই। কিন্তু ইতিহাস আজ নেই। কাল থাকবে। থেকে যাবে। অতীত হয়েও মানুষের সঙ্গে সঙ্গে যাবে। যদি জবায় জবায় ব্যাপক হানাহানি হয় আর সমস্ত জবার বুক চিরে ঝরঝর রক্ত ঝরে তবে ইতিহাস হয়ে যাবে। ইতিহাস মানে নির্মাণ হওয়া চাই, ইতিহাস মানে সংঘর্ষ হওয়া চাই। ইতিহাস ধ্বংসে লালিত হয়। প্রতিপালনে লালিত হয়। ইতিহাস হল কীর্তি। কাণ্ড। ইতিহাস হয়ে উঠতে পারার ঘটনাগুলো সময়ের অভিমুখ পাল্টে দেয় এবং লালিত হতে থাকে মানুষের চেতনায়।

সুতরাং, অন্ধ বুঝতে পারে না, গোটা একটা মানুষ, যে বেঁচে আছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে-কথা কইছে, সে কী করে ইতিহাস হবে। মাস্টার বলে—এ বেঁচে থাকাকে কি বাঁচা বলে রে অন্ধ? যে-বাঁচা অন্যকে বাঁচতে উদ্দীপিত করে না, তা আবার বাঁচা কী? যে-কথা বলি, তাও কি আর কথা? এ তো কারও কাছে পৌঁছয় না। কেউ শোনে না। এই বস্তির একজনকেও কি আমি কথা বলে, বুঝিয়ে, বাঁচতে শেখাতে পারলাম? আমি তাই শুধু ধরে রাখি। ইতিহাস ধরে রাখি। প্রতিদিন যা-কিছু ঘটে, আমি টুকে রাখি ডায়রিতে। এটাই তো ইতিহাস হল।

ডায়রি কী, এখন অন্ধ জানে। আর আজকাল অন্ধর মনে হয়, মাস্টার যা জানে, তার সবটাই অন্ধ জানে। যেন তাদের জানায় কোনও পার্থক্য নেই। যেন এ পাত্রের জল ও পাত্রে ঢেলে দিলেই হল। তাতে জলেরও আপত্তি নেই, পাত্রেরও না। তাই অন্ধ যতটুকু জানে না, জেনে নিচ্ছে ক্রমশ। অন্ধ শুধু রঙ কেমন জানে না। রোদ্দুর কেমন, আকাশ কেমন, চাঁদ, তারা, জ্যোৎস্না আর অভিব্যক্তি জানে না যদি তা নিঃশব্দ হয়। রঙ, রোদ্দুর, আকাশ, চাঁদ, তারা, জ্যোৎস্নায় তো শব্দ নেই। কিন্তু গন্ধ আছে। আর সে গন্ধটা একা টের পায় অন্ধই। সে বোঝে, রাস্তা পুড়ছে, মাটি পুড়ছে, ঘরের চালে রোদ ঠিকরোচ্ছে। সে গন্ধ পায়। এক একদিন, সন্ধ্যায় যখন চুপ করে বিল ঘেঁষে দাঁড়ায় তখন আস্তে আস্তে বুঝতে পারে চাঁদ এসে মাথার ওপর দাঁড়িয়েছে, জ্যোৎস্না নেমে আসছে, মাঝে মাঝে একটু গুলিয়ে যায়, কুয়াশাকেও সে মনে করে জ্যোৎস্না, সে টের পায় জলে তারা পড়ছে, জল নড়লে, সব নক্ষত্র নড়ে গেল। বাতাস ছুঁয়ে গেলে সে টের পায় এখন চন্দ্রপক্ষ নয়। সে সব গন্ধ দিয়ে বোঝে এমন নয়। স্পর্শেও বোঝে। কিন্তু ইতিহাস সে স্পর্শে বুঝতে পারেনি। মাস্টারের ঘরে এলে সে ডায়রির গন্ধ শোঁকে আর বিশ্বাস করে এটাই ইতিহাসের গন্ধ।

মাস্টারের আর অন্ধের একটি প্রিয় খেলা আছে। রাত্রে মাস্টার লণ্ঠন জ্বেলে কাগজ-বই খুলে বসে। আর অন্ধ তার কথা শোনে। নানা কথা, নানা কাহিনী, নানা বর্ণনা। এক সময় অন্ধ বলে, ‘আজ কী শোনাবে?’

মাস্টার বলে— খোল।

অন্ধ ডায়রি হাতে নিয়ে এক-দুই-তিন বলে যে কোনও একটি পাতা খোলে। মাস্টার সে পাতা থেকে পড়ে শোনায়। এক-এক পাতা কতবার পড়া হল, অন্ধর মুখস্থ হয়ে গেল, তবু পড়া হয়। কাল রাত্রে অন্ধ খুলেছিল—

অদ্ভুত সুযোগ নিয়েছে কংগ্রেস সরকার। সেন্টারে, স্টেটে একেবারে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পেয়ে গেছে। এটাকে কি সংবিধান সংশোধন বলে? এটা সংশোধন নয়। এটা বানানো। সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে চমৎকারভাবে ছেঁটে ফেলা হয়েছে আইনের জুডিশিয়াল রিভিউ-এর সম্ভাবনা। ফান্ডামেন্টাল রাইটস্ নিয়ে ছেলেখেলা খেলছে। একটা শোষিত, নিপীড়িত, গরিব দেশ, যেখানে অধিকাংশ মানুষ জীবনের প্রাথমিক অধিকার পায় না, সেখানেও আমাদের মাননীয় জনপ্রতিনিধিরা মৌলিক অধিকার খর্ব করে দিতে উদ্যত হন। ট্রাইবুনালের ক্ষেত্রে সমস্ত জুডিশিয়ারি কন্ট্রোল ছেঁটে ফেলেছে। এমনকী নতুন আইনের ক্ষেত্রেও জুডিশিয়ারি কন্ট্রোল প্রায় নেই বললেই চলে। এভাবে চলে না। এভাবে চলতে পারে না। একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়েও সমস্ত মানুষের গলা টিপে দেওয়া যায় না। জরুরি অবস্থা নিয়ে যে-ছেলেখেলা গত বছর থেকে চলছে, তা যদি এ দেশের চেতনাসম্পন্ন মানুষকে প্রতিবাদ না জোগায় তাহলে, হে ভারতবর্ষ, তোমার আবার পরাধীন হয়ে যাওয়াই উচিত।

খুবই উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল মাস্টার পড়তে পড়তে। অন্ধ কিছুই বুঝতে পারছিল না। তবে, সে যেহেতু ইতিহাসের গন্ধ চেনে সেহেতু অনুমান করছিল, এমন কোনও ইতিহাস এখন পাঠ করা হচ্ছে, যা আপত্তিকর, যার পরিবর্তন দরকার। অন্ধ বোঝে না মাস্টার এত কঠিন করে লেখে কেন! যে-ভাষায় সে অন্ধকে বোঝায়, সে-ভাষায় তো লিখতেও পারে। সে কেবল বলতে গেছে—তারপর?

তখনই খুব চেঁচামেচি উঠেছিল পাশে। মাস্টার ডায়রি বন্ধ করে বলেছিল—কী হল, দেখে আসি চল্।…মাস্টারের হাত ধরে অন্ধ গিয়েছিল গোলমালের জায়গায়। আরও সব লোক ছুটে এসেছিল। টেপির বাবা মদ খেয়ে পেটাচ্ছিল টেপির মাকে। টেপির মা চেঁচিয়ে কাঁদছিল। প্রায়ই হয় এমন আর প্রায়ই তার কান্না শোনা যায়। অন্ধ জানে, সকাল হলেই টেপির বাবা পাথরের বাক্স নিয়ে বেচতে যাবে। ছোট্ট বাক্স নিয়ে আংটির পাথর বেচে টেপির বাবা। সেগুলো নাকি খুবই সুন্দর। টেপি বলেছে। লাল, নীল, হলুদ রঙ। আলো পড়লে ঝকঝক করে। টেপির বাবা বাক্সে তুলো দিয়ে যত্নে পাথরগুলো সাজিয়ে রাখে। যদিও মাস্টার বলেছে, ওগুলো পাথর নয়, সব কাচ, টেপির বাবা লোক ঠকিয়ে কাচের দামের জিনিস কিনে পাথরের দামে বেচে। সেই থেকে অন্ধ জানে, পাথর কখনও কখনও কাচের চেয়ে দামি এবং রাস্তার লোকেরা খুব বোকা আর টেপির বাবা একটা বাজে লোক। বস্তিতে আরও অনেকেই মদ খেয়ে বউকে ধরে পেটায়। কিন্তু তারা কেউ লোক ঠকায় না। তারা পরিশ্রম করে। রিকশা চালায়। জুতো সারায়। রাস্তার পাথর ভাঙে। কাঠের দোকানে, হোটেলে কাজকর্ম করে।

টেপির মা বা অন্যরা রোজ রোজ কেন মার খায় মাস্টারের কাছে জানতে চেয়েছিল অন্ধ। জিজ্ঞেস করেছিল— কেন ওরা কিছু বলে না? পাল্টা মার দেয় না কেন?

মাস্টার বলেছিল— ওরা শেখেনি।

—কেন? শেখেনি কেন? আমাকে সে-দিন পেঁচো ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল তার পরদিন পেঁচোকে পেয়ে আমি খিমচে রক্ত বের করে দিইনি? আমাকে কে শিখিয়েছিল?

মাস্টার চুপ করে ছিল। তারপর বলেছিল— পেঁচো তোর কেউ না। কিন্তু ওরা সব বর।

—বর তো কী?

—বর মানে মালিক। ওরা সব বউদের মালিক।

—মালিক তো কিনলে হয়।

—বিয়েটাও একরকম কেনা হল। আর তাই ওরা যা-খুশি করে। বউগুলো সয়। মারলে ভাবে— মারবেই তো, ও আমার বর! ভালবাসলে ভাবে, বাসবেই তো, ও আমার বর! দু’টোই ওরা ভাবে প্রাপ্য। দু’টোতেই ওদের অধিকার। আমি এখানে যখন প্রথম এসেছিলাম তখন থামাবার চেষ্টা করতাম। ওই টেপির মা আমাকে একদিন কী বলেছিল জানিস?

—কী?

—বলেছিল— আমার সোয়ামি আমারে মারুক কাটুক আপনের কী? আপনে আমার ভাতার হইবেন?

—হি হি হি…

অন্ধ হেসেছিল। ভাতার মানে সে জানে। বোঝে। বাঁশের চাঁচের চৌখুপ্পি ঘরের মধ্যে, উঃ আঃ, মাইটা মুখে দিয়া দে, তোমারে করুম… আরও করুম… এইসব হয় আর সে দিব্যি বুঝতে পারে এ সব মাগ-ভাতারে হয়। টেপি কতবার অন্ধকে বলেছে— আয়, মাগ-ভাতার খেলবি? টেপি শুয়ে পড়েছে। আর অন্ধর হাত এনে নিজের মাইতে, মুতুনিতে ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে বলেছে, ধর্, ধর্ টেপ। কী যে টেপে অন্ধ, কী যে করে, মুতুনি ধরে হাতে কী বিশ্রী গন্ধ! অন্ধর ঘেন্নাও লাগে, আবার ভালও লাগে। বেশ খেলা।

আজ কিন্তু টেপির মা মার খেতে খেতে উল্টে মার দিয়েছে টেপির বাবাকে। একেবারে বাঁ কাঁধে আঁশবঁটির বিশাল কোপ। অন্য দিন টেপির মা কাঁদে, আজ বাবা কাঁদছে। কীরকম অদ্ভুত শোনাচ্ছে তার কান্না। যেন ফাটা বাঁশ হঠাৎ কথা বলতে লেগেছে। অন্ধর হাসি পাচ্ছে। মনে মনে বলছে—‘বেশ হয়েছে!’ সব মেয়েরা টেপির মাকে ঘিরে ধরেছে। ছি ছি, ভাতারের গায়ে হাত তোলে কেউ। টেপির মা’রও খুব অনুশোচনা হয়েছে। সে কেঁদে কেঁদে বলছে— আর কত সইতে পারি কও। রোজ আইব, পয়সা লইয়া মদ গিল্যা আমারে মারব। আইজ ব্যাতন পাইসি। সব নিসে। উড়াইসে। আইয়া আমারে কয় হারামজাদি, আরও ট্যাকা আসে। দে আমারে। যত কই, নাই। সব উড়াইসো, সারা মাস প্যাটে কিল দিয়া থুবা, কয়, দিতই হইব, দিতই হইব। হ্যায় জুয়া ধরসে, সব উড়াইতাসে, কয়, গতর ভাইঙ্গা দিবি, খানকি, হটেলে তুই শুইশ না? আমি শুই? কোন পুঙ্গির পুত কইব আমি শুই? দিসি দুইখান…।

মাস্টার আলো ফেলে দেখছিল ক্ষত কতখানি গভীর। তারপর নলি, পাকু আর তাপুকে বলেছিল— নিয়ে যা শিবতোষ ডাক্তারের কাছে। সেলাই দেবে।

মল্লিনাথ ডাক্তার আর রোগী দেখেন না। লোকে শিবতোষ ডাক্তারের কাছে যায়। যেতেই হয়। কিন্তু তাদের যেতে ইচ্ছে করে না। শিবতোষ গরিব-বড়লোক মানেন না। সবার কাছে তাঁর পয়সা চাই। পুরো পয়সা। মল্লিনাথ গরিব-বড়লোক সবার ডাক্তার ছিলেন। শিবতোষ শুধু বড়লোকের ডাক্তার।

ফেরার সময় মাস্টার বলেছিল— রোজই তো মারামারি হয়, আজ কেন এত গোল বাঁধল বল তো?

অন্ধ বলেছিল— দা দিয়ে কেটেছে বলে?

—না। তুই তো দেখিসনি। কাটেনি খুব বেশি।

—কিন্তু আমি রক্তের গন্ধ পাচ্ছিলাম।

—রক্ত পড়ছিল। তবে ও নিজেরাও পটি বেঁধে সারিয়ে নেওয়া যায়। আসলে রোজ মেয়েছেলের কান্না শোনে তো লোকে, আজ বেটাছেলের কান্না শুনেছে। আর তাও সবটা নয়। আসলে মানুষ যাকে সহনশীল দেখতে অভ্যস্ত সে যদি কোনও দিন ভুল করেও প্রতিবাদ করে বসে, যদি একদিনও নিজের অবস্থান ও অধিকার সম্বন্ধে সচেতন চিৎকার করে, তাহলে যারা রোজ চেঁচায় তাদের চেয়ে সেই নীরবতা-ভাঙা চিৎকার কানে আসে দ্বিগুণ তীক্ষ্ণতাসম্পন্ন হয়ে। অন্যদের তা শ্রুতিকটু লাগে। বিসদৃশ লাগে। তাই অসহ্যও লাগে।

অন্ধ জানে মাস্টার খুব বোঝে। এই বস্তিতে মাস্টারের মতো করে আর কেউ বোঝে না। বুঝবেই বা কী করে, মাস্টারের মতো পড়তেই তো পারে না কেউ। অন্ধর খুব মাস্টার হতে ইচ্ছে করে। ইতিহাসও হতে ইচ্ছে করে, ঠিক মাস্টারের মতো। কিন্তু অন্ধ, খুব অসহায়ের মতো, এটুকু বোঝে, শুনে আর গন্ধ শুঁকে আর ছুঁয়ে মাস্টার হওয়া যায় না। ইতিহাস হওয়া যায় না। ইতিহাস হতে গেলে চোখ থাকতেই হয়। দেখতেই হয়। ইতিহাস হতে গেলে দৃষ্টি চাই। গোলমাল থেকে ফিরে এসে ডায়রির বাকিটুকু পড়েছিল মাস্টার—

ঘাড়ের ওপর পাকিস্তান শত্রুতা করছে বলে ১৯৭১ সালে জরুরি অবস্থা জারি করা হল। চমৎকার। এ নিয়ে কোনও সন্দেহই থাকতে পারে না যে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে জরুরি অবস্থা বলবৎ থাকবে। কিন্তু গত বছর যে-কারণে জরুরি অবস্থা আবার ঘোষণা করা হল তার কি সত্যিই প্রয়োজন ছিল? কিছু লোক পুলিশ ও সশস্ত্রবাহিনীকে তাদের কর্তব্যপালন ও স্বাভাবিক কাজকর্ম না করতে প্ররোচিত করছে। পুলিশের স্বাভাবিক কর্ম কী? সশস্ত্রবাহিনীর কর্তব্য কী? ময়দানে তাজা তরুণ ছেলেদের ছুটিয়ে পিছন থেকে গুলি করে মারা?

অন্ধ আর সহ্য করতে পারছে না। সে যেন দেখতে পাচ্ছে, ছুটে যাচ্ছে একটা ছেলে। কত বয়স? কে? ছুটে যাচ্ছে। শব্দ হল। গুলির শব্দ হল, বুম বুম বুম র‍্যাট ট্যাট ট্যাট! লুটিয়ে পড়ছে ছেলেটা। একটু আগেও ভেবেছিল বেঁচে যাচ্ছে কিন্তু আসলে এখন মরছে। মরে যাচ্ছে। অন্ধ জানে। এ সব গল্প জানে। মাস্টার তাকে পড়ে শোনায়। অজস্র খুনের গল্প। অজস্র মারণের ইতিহাস। অন্ধর মা যে যে বাড়িতে কাজ করে তার একটা বাড়ির ছেলেও মরে গিয়েছিল এভাবে।

মাস্টার পড়ে চলেছিল—

পুলিশকে কর্তব্য না করতে প্ররোচিত করা! হায়! অভ্যন্তরীণ গোলযোগের জন্য ভারতের নিরাপত্তা বিপন্ন! আমাদের গেঞ্জিকলের ছোট কেরানিবাবু বলছিলেন— হ্যাঁ, ঠিকই করেছে বটে ইন্দিরা! কার মেয়ে দেখতে হবে তো! ট্রেনগুলো এখন কেমন রাইট টাইমে চলছে? কোনও ট্রেন তুমি এক মিনিট লেট পাবে না। ড্রাইভাররা সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকবে, কখন দেরি হয়ে যায় আর তাদের চাকরিটি শেষ হয়। এই আমাদের দেশ। এই আমাদের নাগরিক। এরা প্ররোচিত করছে পুলিশকে কর্তব্য না করার জন্য!

এক পাতা পড়া হয়ে গেছে। এক পাতার বেশি পড়ে না মাস্টার। বলে, ‘তোর মগজে ঢুকবে না।’ যে-পাতাটা কাল পড়েছিল, সেটাই কি মগজে ঢুকেছিল অন্ধর? ইন্দিরা গাঁধীকে সে জানে। এই বস্তির কে-ই বা জানে না। ইন্দিরা আছেন বলেই এ দেশে মানুষে বেঁচে-বর্তে আছে এমন ধারণা ছিল সকলের। কিন্তু মাস্টার বলেছে, এখন আর ইন্দিরার জমানা নেই। সাধারণ মানুষ ঠিকই বুঝেছে, গণতন্ত্র ক্ষমতার অপব্যবহার ক্ষমা করে না। এত কিছু বোঝেনি অন্ধ। সে শুধু এটুকু বুঝেছে, ইন্দিরা থাকতেও তারা যেমন আধপেটা খেয়েছে, ভাঙা ঘরে থেকেছে এখন ইন্দিরা না থাকলেও অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি।

মাস্টারের বাড়ি ছাড়িয়ে আজ খানিকটা এগিয়ে গেল অন্ধ। ওপাশে একটা গুলমোহর গাছ আছে। সেটা পেরোলেই বেলিদিদের বাড়ি। ওদিক থেকে একটা নতুন গন্ধ আসছে। নতুন লোকের গন্ধ। নতুন জিনিসের গন্ধ। ওই বাড়িটায় আগে কমলমণি থাকত। সে নাকি বাবু ধরে কোথায় চলে গেছে। এখানে অনেক মেয়েই বাবু ধরে চলে যায়। বাবুদের কোথায় ধরা যায় অন্ধ জানে না। তবে কেউ বাবু ধরলে মা-মাসিরা খুব গল্প করে তাঁকে নিয়ে। বাবু ধরা খারাপ না ভাল অন্ধ জানে না। একদিন মাস্টারকে জিজ্ঞেস করেছিল। মাস্টার বলেছিল— ভাল না খারাপ আমিও জানি না। তবে বাবু না ধরে আরও অন্যান্য কাজ করার সুযোগ তাদের নিশ্চয়ই ছিল না। বেঁচে থাকার তাগিদটা অনেকটা পেটের খিদের মতো, বুঝলি রে অন্ধ। কিছু মানে না। স্থান-কাল মানে না। বাসি-পচা মানে না। বুভুক্ষু মানুষ খাবার পেলেই খেয়ে নিতে চায় হালুম-হুলুম। জীবনের জন্যও মানুষের এমনই কাঙালিপনা। অথচ, কী বলব রে অন্ধ, কাঙাল তুই হতে পারিস, একমাত্র ভালবাসার জন্য। অন্য সব কাঙালিপনা মানুষকে আর মানুষ রাখে না। শরীর করে দেয়। শরীর নামের যন্ত্র। দেহ নামের প্রাণী।

সেই থেকে অন্ধ ঠিক করেছে সে কাঙাল হবে না। দেহ-প্রাণী, শরীর-যন্ত্র হবে না। তা হলে সে কী হবে? সে জানে না। গন্ধ শুঁকে অতীত, গন্ধ শুঁকে ভবিষ্য—এই অন্ধর কীর্তি। এই অন্ধর বর্তমান। তবুও সে জানে না সে কী হবে! কী হওয়া যায় এই চক্ষু দু’টি বিনা! তাই, ঘ্রাণশক্তির জোরে দিনযাপন করতে করতে সে বেলিদির বাড়ির দিকে হাঁটে।

কমলমণির ওই ঘরটাও বেলিদিদের। এখানে অনেক ঘরই বেলিদিদের। আজ সেখান থেকে নতুন গন্ধ আসছে। অন্ধ সেদিকে চলেছে। কার গন্ধ? কীসের গন্ধ? জানা চাই। বেলিদি ডাকছে— ও অন্ধ। যাস কই?

অন্ধ দাঁড়াচ্ছে। কোমল চিকন মুখ। রোগা লম্বাটে চেহারা। মুখের মধ্যে সাদা গোলকের ওপর ঘোলাটে দু’টি মণি। অন্ধর চোখ। সেই চোখ বেলিদির দিকে নিবদ্ধ করেছে সে। নতুন শাড়ির গন্ধ লাগল নাকে। অন্ধ বলল—নতুন শাড়ি পরেছ, বেলিদি?

—হ্যাঁ। পরছি। বাবা আনছে। ভাল না?

—ভাল। তোমাদের ফাঁকা ঘরটায় কে এল বেলিদি?

বেলি অন্ধর কাছাকাছি এসেছে। এক হাতে অন্ধর কাঁধ চেপে ধরে মুখটা নিজের বুক বরাবর টেনে নিয়ে বলছে— কে আসছে জানিস? জানিস?

অন্ধর ঘ্রাণের পৃথিবী টলে যাচ্ছে। বেলিদির বুকের গন্ধ কী ঝাঁঝাল। সে সহ্য করতে পারছে না। বলছে— ছাড়ো। বেলিদি। লাগে।

বেলিদি ছাড়ছে না। অন্ধকে শক্ত করে ধরে আছে তো আছেই। আর তার কানের কাছে মুখ এনে বলছে— বস্তিতে ভদ্দরলোক আসল রে অন্ধ। ভদ্দরলোক আসল।

৩২

এটুকু করতে পেরেছে মাস্টার। এই সামান্য পরিচ্ছন্নতাবোধ এনে দিতে পেরেছে এখানে। কিন্তু সহজ সভ্য মানুষ-জীবন যাপনের পক্ষে তা যথেষ্ট নয়। যদিও বস্তির মানুষেরা মানুষই যে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ থাকতে পারে না। কারণ মানবতার পরিচয় তাদের হৃদয়বিকাশে জৈবিক বোধের চেয়ে একটু ওপরে।

বাচ্চারা আগে যেখানে-সেখানে বসে বাহ্যি করত, সেটা বন্ধ হয়েছে। অন্ধর নিজেরই মনে আছে সে কতদিন ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তার ধারে বাহ্যি বসত। তার দেখাদেখি বেলি বা টেপি বা কেউ চলে আসত আর বসে পড়ত পাশে। উঁকি মারত—‘দেখি তর কতখানি হইল।’

বেশির ভাগই বস্তা দিয়ে ঘেরা, চারখানা বাঁশের ওপর টিনের টুকরো গুঁজে, কাঠের পাটাতন গুঁজে, কোনওমতে কাজ চালানো। তবু, রাস্তার ধারে, এর-ওর ঘরের খাঁজে বাহ্যি করতে নেই, এটুকু বোধ জাগ্রত হওয়ায় বস্তিটিকে আর ততখানি বস্তি লাগে না, বদলে তা কয়েকশো গরিব লোকের বসতি হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু ফটিক বিলের তলা থেকে মাঝে মাঝে বিদ্রোহী গন্ধ ভেসে আসে। এত লোকের এত ময়লা, এত গরল জমে জমে জল পচে যায়। কোনওদিন হয়তো-বা ঘন হতে হতে, ভারী হতে হতে, বাতাস বইবে যখন, জলে আর একটুও ঢেউ খেলবে না। ফটিক বিলের সব জল থকথকে কাদা হয়ে যাবে। এখনও এই জলেই কাপড়জামা কাচে সবাই। শুধু খাবার জল মিউনিসিপ্যালিটির রাস্তার কল থেকে ভরে আনে। বস্তিতে দু’টো-তিনটে কলের জন্য, টিউকল হলেও আপত্তি ছিল না, এ মর্মে আবেদন জানাতে লোকজনকে একমত করিয়েছিল মাস্টার। আর মাথুরের গড় নাগরিক কমিটির কাছে আবেদন পেশ করেছিল যাতে তাঁরা মিউনিসিপ্যালিটিকে চাপ দেন। এসব কাজে মাস্টার কখনও নিজে সামনে আসেনি। মাস্টার সম্পর্কে দু’চার কথা মাথুরের গড়ের মানুষ শুনেছে বটে, যে, বস্তিতে আছে একজন মানুষ— যার প্যাটে বিদ্যা আসে— কিন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো কিছু ঘটেনি। অন্ধ ছাড়া তেমন ভাল করে কেউ জানেই না যে মাস্টারের আশ্চর্য সমস্ত ডায়রি আছে। আর মাস্টার নিজে একজন মাস্টার নয়, সে ক্রমশ ইতিহাস হয়ে উঠছে, ধারণ করছে সমস্ত ঘটনার ক্রম। এবং মাস্টারও, কোনও কিছু বোঝাবার কালে, বস্তিবাসীর কাছে কোনও নেতৃত্বসুলভ স্বর এগিয়ে আনে না, সম্ভবত সে-ক্ষমতাও তার নেই, সে শুধু কখনও কখনও চণ্ডীর বাংলার ঠেকে বসে। খায়ও দু’-এক গেলাস। আর খায় বলেই নিতাই, হেমন্ত, মাধব, স্বপন, আজিজুল, মুন্না, কামেশ কোনও সমস্যা উত্থাপন করলে সাড়া দেয় এবং তার সমাধানে সম্মতি জ্ঞাপন করে। মাস্টার যদি গলা কাঁপিয়ে চেঁচাত— ‘বন্ধুগণ, আমার প্রিয় ভাইবোনেরা, আমাদের এই বঞ্চিত জীবন, যাতে একটা পানীয় জলের কল পর্যন্ত নেই, নোংরা জলে জামাকাপড় কেচে আমাদের শরীর খোশ-পাঁচরায় ভরে যাচ্ছে, আর এই সরকার, যারা ভোটর আগে অসংখ্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং পালন করেনি, এই অকর্মণ্য মিথ্যাচারী সরকার, যারা আমাদের এই দারিদ্র ও বঞ্চিত জীবনযাপনের জন্য দায়ী… …’ তাহলে কেউ তার কথা শুনত না। সে বরং দু’গেলাস ধেনো খায় আর উবু হয়ে চার-পাঁচজনের মধ্যে বসে। সে যে লিখতে-পড়তে পারে এবং ইতিহাস হয়ে যায় সে-সম্পর্কে কোনও অভিমান মনে রাখে না এবং বলতে শুরু করে— ‘তা হলে, আমাদের যদি বস্তিতেই দুই-তিনটা কল হয় তো ভাল।’

অনিবার্য উত্তর আসে— বস্তিতে? কল? হবে না। আমাদের কিসসু হবে না।

মাস্টারকে বলতে হয়— চেষ্টা করতে হবে।

—কেউ চেষ্টা করবে না।

—হুঁ, মলিনাথ ডাক্তারকে বলো তোমরা। স্বপন, তোমার মা ডাক্তারের বাড়ি রান্না করে তো।

—হ।

—সে বলুক ডাক্তারকে। পারলে দু’-চারজন যাও। নাগরিক কমিটিকে বলো।

এটুকুই করে মাস্টার। রোজই করে। এটুকুই। করতে করতে একদিন কারও মুখে শোনা যায়— আজ বলছিলাম। ডাক্তার বলে, আমি তো আর ওর মধ্যে নাই। বিকাশ রে বলো।

—গেছিলা বিকাশের কাসে?

—গ্যালাম। বলে কল বসানো মিউনিসিপ্যালিটির কাজ। পার্টি ধরো।

—কোন পার্টি?

মাস্টার দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। এখন মাথুরের গড়ে পার্টি ধরা শক্ত। এই এলাকায় কংগ্রেস সক্রিয়। কিন্তু রাজ্য স্তরে বাম জোট এসে যাওয়ায় বামেরাও এখানে শক্তিশালী হয়ে উঠছে। হঠাৎ তার মনে হয়, শুধু শুধুই ভাবছে। বস্তির জনসংখ্যা কম নয়। মিউনিসিপ্যালিটির ভোটে সংখ্যাটা বেশ গুরুত্ব পাবে। কংগ্রেস ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চাইবে আর সি পি এম ক্ষমতা পেতে চাইবে। যে দলকেই বলা যাক, কাজটা করার চেষ্টা হবে।

মাস্টার ঠেলে, বস্তির লোক একটু এগোয়। মাস্টার আবার ঠেলে। বস্তির লোক ঠেলা নেয় কারণ মাস্টার পড়ে, লেখে। মাস্টারের তো এখানে থাকার কথা না। কেন থাকে তবু? জিজ্ঞাসা করলে বলে— ‘থাকি, থাকতে হবে তো কোথাও।’

দু’-একজন নিজে থেকে আরও একটু ভাল জায়গায় আরও একটু ভাল বাসা খুঁজে দিতে চেয়েছে মাস্টারকে। মাথুরের গড়ে না হোক, অন্তত উদ্বাস্তু কলোনিতে! মাস্টার বলেছে— কোনও দরকার নেই। আমার জন্য ভাল বাসা খুঁজো না। তোমাদের জন্য খোঁজো। কবে তোমরা বুঝবে যে এই বস্তিতে তোমাদেরও থাকার কথা নয়?’

এখন মাস্টার সবার একজন হয়ে গেছে। তিন-চার বছর আগেও যখন খুব খুন-খারাবি হচ্ছিল, পটাপট গুলি-গোলা চলছিল, লাশ পড়ছিল তখন অনেকেই ভেবেছিল মাস্টারও ওই নকশাল দলের কেউ। কিন্তু মাস্টার কোনওদিন ও সবে যায়নি। মাস্টার যেন খানিকটা হাওয়ার মতো। সবেতেই আছে। আবার কোনও কিছুতে নেই।

ইতিহাসের মতোও। আছেও, আবার নেইও।

মাস্টার শুনেছে ফণীমিস্ত্রির বাড়িতে নতুন ভাড়াটে এসেছে। অন্ধ বলছিল— তারা সব ভদ্দরনোক।

—‘নোক না, লোক।’ শুধরে দিয়েছিল মাস্টার। অন্ধ গড় গড় করে বলে যাচ্ছিল, ‘চারজন বুঝলে? বাবা-মা দুটো ছেলে। ছোটটা দুধের শিশু। বড়টা বেশ। বুঝলে? ইস্কুলে যায়।’

এ পর্যন্ত বলে চুপ করে ছিল কিছুক্ষণ। মাস্টার তখন শার্ট গলাচ্ছিল। চুল আঁচড়াচ্ছিল। রাস্তার কলে স্নান করে এসেছে কিছুক্ষণ আগে।

স্নানের প্রসঙ্গে এসে মাস্টার বস্তিজীবনের সঙ্গে নিজেকে সম্পূর্ণ মেলাতে পারেনি। এখানে সবাই, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে, স্নান করে নেয় ফটিকবিলের জলে। মাস্টার পারে না। কিছুতেই পারে না। সে কলের পাড়ে যায়। অপেক্ষা করে। অনেক সময় স্নান করার আগেই জল চলে যায়। মাস্টার তখন হাঁটতে থাকে। মরণব্রিজের তলা দিয়ে ঘুরপথে কামারহাটির দিকে যায়। বি টি রোড দিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে গেলে একটা টিউকল পড়ে। সেইখানে স্নান সেরে আসে। অন্ধও মাঝে মাঝে তার সঙ্গে যায়। মাস্টারের সঙ্গে থেকে অন্ধর কথা বদলে গেছে। ভাবনা আলাদা হয়ে গেছে। মাস্টার জানে অন্ধর খুব স্কুলে পড়ার ইচ্ছা।

অন্ধ চুপ করে আছে দেখে মাস্টার বলেছিল— ‘ভাল তো। ও স্কুলে যা-যা পড়ে সেগুলো তুই শুনে শুনে শিখে নিবি।’

তবু কথা বলছিল না অন্ধ। মাস্টার তাড়া দিয়েছিল— কি রে? যা বলবি বলে ফেল। আমাকে যেতে হবে। মালিকের বড় অর্ডার এসেছে। প্রচুর কাজ। তাড়াতাড়ি যেতে হবে।

অন্ধ বলেছিল— ওর নাম পলাশ। ওর বাবাটা খারাপ মাস্টারকাকা, খুব খারাপ।

—কী করে বুঝলি?

—আমি ওর বাবার গায়ে শয়তানির গন্ধ পেয়েছি।

মাস্টার জানে, অন্ধ সব রকম গন্ধ পায়। সেইসব গন্ধ কখনও মিথ্যে বলে না। হতে পারে লোকটা খারাপ। অন্ধকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল মাস্টার। ঘরে তালা দিল। এ যা ঘর, বাঁশ কেটে যে-কেউই সব চুরি করে নিয়ে যেতে পারে। তবু লোকে তালা দেয়। সামলে রাখতে চায় সামান্য জিনিসপত্র।

অন্ধ মাস্টারের সঙ্গে এগোতে এগোতে বলল— রাতে পলাশকে তোমার কাছে নিয়ে আসব কেমন? গল্প শোনাবে, কেমন?

মাস্টার এক মুহূর্ত দাঁড়াল। তারপর বলল— হ্যাঁ, গল্প বলব। কিন্তু ডায়রির খেলাটা আর কারও সামনে খেলব না অন্ধ। ওটাতে শুধু তুই আর আমি।

আনন্দে উজ্জ্বল দেখাল অন্ধর মুখ। সে তো জানে মাস্টার লেখা-পড়া কত ভালবাসে! তার একটু ভয় ভয় করছিল সকাল থেকে। এখানে অন্য সব ছেলেরা অন্ধের মতোই। ইস্কুলে যায় না। ঘুরে বেড়ায়। ইস্কুলে ভর্তি করে দিলেও যায় না। কিন্তু পলাশ আলাদা। সে নিয়মিত ইস্কুলে যায়। পড়ে। অন্ধ দু’-একটা কথা বলে বুঝে গেছে পলাশের গন্ধ আলাদা। ও ভদ্দরলোক। অনেকটা মাস্টারের মতোই কি নয়? পলাশকে পেলে মাস্টার কি অন্ধকে ভুলে যাবে? না, আর সে ভয় নেই। পলাশ তো মাত্র এসেছে। নতুন। আর অন্ধ তো মাস্টারের সেই কবেকার বন্ধু! কতদিন আগেকার!

অন্ধর মুখের রং নজরে পড়ল মাস্টারের। সে হাসল। গরিব, অসংস্কৃত, অশিক্ষিত, অন্ধ— তবু কত গভীর অনুভূতি ছেলেটার! অন্ধের মাথাটা নেড়ে দিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেল সে। অন্ধ পায়ে পায়ে চলল পলাশের বাড়ির দিকে। কিন্তু বাড়ির কাছে এসে আর ঢুকতে সাহস পেল না। ভদ্দর লোক। যদি তাড়িয়ে দেয়? পলাশই দেখতে পেল অন্ধকে। বেরিয়ে এসে বলল— তোমাগো এইখানে স্নান করে কুনখানে গো?

বিড়ির গন্ধ পেল অন্ধ। শয়তানির গন্ধও পেল। পলাশের বাবা নিশ্চয়ই এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। শিশুর কান্না শোনা যাচ্ছে। পলাশের ভাই। শুধু পলাশের মায়ের কোনও সাড়াশব্দ নেই। অন্ধ বলল— ওই তো, ওই বিলেই স্নান করে সবাই।

—বিলে?

পলাশ চুপ করে যায়। কালো জল। মাঝে মাঝে ভ্যাপসা গন্ধ উঠছে। সার সার খাটা পায়খানা জলের ওপর। পলাশের গা ঘিনঘিন করছে। এই জলে তাকে স্নান করতে হবে? সে দেখার চেষ্টা করছে, স্নানের ঘাট বস্তি থেকে অল্প দূরে। ও দিকে কোনও পায়খানা নেই বটে। বেশ ক’জন স্নানও করছে। কাপড়ও কাচছে। কিন্তু একই তো জল। পলাশ কথা বলছে না দেখে ফের নিজেই কথা বলে অন্ধ— আমি বিলে করি না।

সে ভাবছে বিলে স্নান করে বলে কি পলাশ ওকে পছন্দ করবে না?

অন্ধ মনে মনে পলাশকে পছন্দ করে বসে আছে কারণ সে স্কুলে যায়।

পলাশ বলছে— কুনখানে করো?

অন্ধ মাস্টার হয়ে যাচ্ছে। পলাশের ভাষা শুধরে দেবার অদম্য ইচ্ছে জাগছে তার। বলছে— বলো, কোথায় করো?

পলাশ হাসছে। বলছে— কোথায় করো?

—ওই জলে, হাত দিয়ে দেখাচ্ছে অন্ধ। রাস্তার দিকে দেখাচ্ছে।

পলাশ বলছে— আমারে নিয়া যাইবা?

—নিয়ে যাবে?

—নিয়ে যাবে? আমাকে?

কে কাকে স্নান করিয়ে দেবে তা নির্ধারিত থাকে না। কে কাকে ডাক দেবে, বলবে, চলো নেয়ে আসি আর নাওয়া হলে কে যে বলবে— নাও, দু’টি খেয়ে নাও, বেলা হল… এ সব কোথাও নির্দিষ্ট নেই। মানুষে মানুষে এইসব ঘটে। চেনা-জানা না হলেও চলে। অন্ধে-বধিরে আটকায় না। শুধু ঘটে। স্নান করো। ভাত খাও। জিরিয়ে নাও দুপুরটায়।

চক্ষুষ্মান পলাশকে স্নান করাতে নিয়ে যাচ্ছে অন্ধ। রাস্তার কলে। তারা কথা বলছে। অন্ধ পলাশকে মাস্টারের কথা শোনাচ্ছে। মাস্টার কত আশ্চর্য মানুষ তা বোঝাচ্ছে। কিন্তু বলে দিচ্ছে না যে মাস্টার একজন ইতিহাস আর সেও ইতিহাস হতে চায়। সে মাস্টারের পরিচ্ছন্নতার কথা বলছে, গল্পের ভাণ্ডারের কথা বলছে। আর জানাচ্ছে, মিউনিসিপ্যালিটি টিউকল করে দিলে আর ভাবনা নেই। তখন আর ফটিকের বিলে কারওকে জামাকাপড় কাচতে হবে না। স্নান করতে হবে না। মাস্টারকেও হেঁটে হেঁটে কামারহাটি যেতে হবে না।

কলে তখনও সরু হয়ে জল পড়ছিল। মাখামাখি করে স্নান করে নিল দু’জনে। পলাশ ইস্কুলে যাবে। অন্ধ আরও ঘুরে বেড়াবে খানিক। তারপর ঘরে ঢুকে পড়বে। ঠাকমা আজ কী রান্না করেছে কে জানে। মা দুপুরে আসতে পারবে না। মা যেখানে কাজ করে সেখানে বিয়ে লেগেছে। সারা দিন মাকে থাকতে হবে। বাতাসে বিয়ের গন্ধ পাচ্ছিল অন্ধ। হঠাৎ জমা রক্তের বদ গন্ধ ছুটে এল। সে ঘরের দিকে পা চালাল। এ গন্ধ সে চেনে। এ হল বাবার বমির গন্ধ। মাঝে মাঝে কাশতে কাশতে রক্তবমি করে বাবা। অন্ধ জানে ডাক্তার বলে দিয়েছে এটা টিবি না। বাবার পেটে ঘা হয়েছে। আর সারবে না। খুব কষ্ট পাচ্ছে বাবা। মরে যাবে যে-কোনওদিন। অন্ধর মা সন্তোষী মা’র পুজো করছে। ভগবানই একমাত্র অন্ধর বাবাকে সারিয়ে তুলতে পারে। আর কেউ নয়।

সন্ধেবেলা অন্ধর মা, কালীতারা, বেলি, বেলির মা অঞ্জলি, টেপির মা, ময়না সব দল বেঁধে এল রাধিকাকে দেখতে। আজকেই উপযুক্ত সময় কারণ কাল থেকে একেবারে বিবাহের দিন পড়ে যাচ্ছে। যাদের মূল বাড়িতে বিবাহ তাদের তো ক’দিন ধরেই ব্যস্ততা চলছে। কাল থেকে আর কথা কওয়ার সময় থাকবে না। যাদের মূল বাড়িতে বিবাহ নেই তারাও চার-পাঁচদিনের জন্য বিয়েবাড়িতে ঠিকে কাজ নেবে। বেশ কয়েকটা বিয়ে লেগে গেল মাথুরের গড়ে। এর ছেলে, ওর ভাই, তার দেবর। আর শুধু মাথুরের গড় কেন, সারা কলকাতাতেই বিয়ে-বিয়ে ভাব জেগেছে। ফটিকবিল বস্তিতে এবারে কেউ বিয়ে করছে না অবশ্য তবে বরের গাড়ি চলেছে তো চলেছেই রাস্তা দিয়ে। ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িতে টোপর পরা বর। আজ একা যাচ্ছে। কাল বউ নিয়ে ফিরছে। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় উঁকি দিচ্ছে মানুষ— দেখি তো, কনে-বউকে কেমন দেখতে! কাজ করার কথা নয়, তবু অন্ধর বাবা চাইছে, মালিকের কাছ থেকে রিকশা নিয়ে যদি একটু চালিয়ে নেওয়া যেত, দু’পয়সা হত। এই বিয়ের মরসুমে, যাদের গাড়ি সাজাবার পয়সা নেই তারা রিকশা সাজিয়ে বিয়ে করতে যায়। অন্ধর মা তাঁকে যেতে দেয়নি। বলেছে— ‘আগে সারো।’ আর সারা! দীর্ঘশ্বাস পড়েছে অন্ধর বাবার। এই তো ক’দিন আগেও দিব্যি রিকশা চালিয়েছে। হঠাৎ শরীরটা বসে গেল। একা অন্ধর মা’র ওপর চারটি পেট। বেচারি কি পারে? বাড়ির পর বাড়ি বাড়াচ্ছে। ভোরবেলা ছুটে যায়। সারা দিন পাঁচবাড়ির বাসন মেজে, কাপড় কেচে, ঘর মুছে সন্ধ্যাবেলা হা-ক্লান্ত হয়ে ফেরে। অন্ধর বাবা জানে, ও-ও অসুখে পড়বে কোনওদিন, তখন সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে। অদ্ভুত একচোখোমি ঈশ্বরের। তিন-তিনটে মেয়ের পর ছেলে দিলেন তো দিলেন অন্ধ করে। অন্ধ ছেলে, সে আর বাপ-মায়ের কী কাজে লাগবে! অন্ধর মা বলে— ‘হউক অন্ধ। পোলা তো।’ মায়ের প্রাণ একেই বলে। সারা দিন টই-টই করে ঘোরে ছেলেটা। আর মাস্টারের কাছে পড়ে থাকে। মাস্টারের তো চালচুলো নেই। অন্ধর বাবার গভীর বিশ্বাস, মাস্টার শেষ পর্যন্ত অন্ধর জন্য একটা কিছু করে দেবে। অন্ধর বাবা শুয়ে থাকে সারা দিন। প্যাটে বড় জ্বালা-যন্তন্না। যন্ত্রণা সয়। আর ভাবে। ভাবার অসুখ ছোটবেলা থেকে বয়ে আসছে সে। রিকশা স্ট্যান্ডে যখন কোনও যাত্রী নেই, অন্যরা গুলতানি করছে, আর অন্ধর বাবা ভাবছে। এই পুজো গেল, তখনও অন্ধর বাবা ভেবেছিল। তার ধারণা ছিল কমিনিস্ট পাট্টি এলে পুজো-টুজো উঠে যাবে কলকাতা থেকে। সে তো হল না। কোনও পরিবর্তনই চোখে পড়ল না। শুধু ভোটের দিন কতই না মারামারি হল আর তারা গিয়ে দেখল সব ভোট শেষ। সে ঠিক করেছিল ভোটটা এবার কমিনিস্ট পাট্টিকে দেবে। অন্ধর মাকেও তেমনি শিখিয়েছিল। কিন্তু দিতে পারল না। এই ভোটের তিন মাস আগে আর একটা ভোট হল। সে-দিনও একই হাল। কী দাপাদাপি! কী দৌড়াদৌড়ি! এ ওকে তাড়া করে, সে তার টুঁটি কামড়ায়। ভোট দেবার আগেই ভোট খতম। যদিও কমিনিস্ট রাজ এসেই গেল তবু কোথাও কোনও পরিবর্তন নেই দেশে। অন্ধর বাবা হতাশ। অন্ধর বাবা তো অন্ধ নয়। সে দেখেছে অনেক। একজনকে তাড়া করছে পাঁচজন, গলি থেকে উঠে আসছে চিৎকার, লাশ পড়ে আছে গঙ্গার ধারে, বড় নর্দমায়, পুলিশের গাড়ি ঘুরছে, খুঁজছে, চক্রাকারে, ধীরে, যেন বাজ নামছে বিরাট আকাশ থেকে মুরগিছানা ছোঁ মারবে বলে। সে ঘরে ঘরে মায়েদের কান্না শুনেছে। বাবাকে ভাইকে জড়াজড়ি করে গুমরাতে দেখেছে। দেখেছে আর ভেবেছে। গুণ্ডামি মোটেও ভাল নয়। তা সে যেই করুক। তার গুলিয়ে গেছে। কে গুণ্ডা দমন করছে আর কে গুণ্ডা হিসেবে মাথা তুলছে! ফলত, সে একটা পরিবর্তন চেয়েছিল। আর কিচ্ছু নয়। পরিবর্তন একটাই, তেমন করে, সকালে ঝিঙেফুলের মতো আর টুপটাপ লাশ পড়ছে না। পড়লেও চোরাগোপ্তা। জানছে না অন্ধর বাবা। এখন, এই বিবাহের মরসুমে তার মনে হচ্ছে, যত বাঁশি বাজার কথা ছিল, যতগুলি বরের গাড়ি যাওয়ার কথা ছিল তা আর হল কোথায়? এ বছর বিবাহযোগ্য হয়ে উঠত যে-সব তরুণরা, তারা তো বেশির ভাগই মরে গেল।

তবু, ঝরে পড়ে যা থাকে, কম কি? কাল থেকে বস্তি ঝেঁটিয়ে সব বিয়ের কাজে নামবে। তার আগে রাধিকার সঙ্গে কথা বলতে আসা। কার্তিক মেয়ের দল দেখে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। সবার আগে বেলির মা অঞ্জলি, পিছনে আর সব উঁকি দিচ্ছে। অন্ধর মা ফিসফিস করে বলছে— শুনছি ভদ্দরলোক।

অঞ্জলি বলছে— থো। এইখানে আসছে। আমরা যা, অরাও তাই। তারা ফিসফিস করছে। রাধিকা বিছানার ওপর ছেলেকে ঘুম পাড়াচ্ছে। পলাশও মার গা ঘেঁষে বসে আছে। এইখানে লাইট জ্বলে না। আগের দিনই তারা জেনে গেছে। লণ্ঠন জ্বলছে ঘরে। ঘরময় শুধু বিছানা। আলনাটা কোনও মতে ঢোকানো গেছে। ইট দিয়ে উঁচু করা হয়েছে চৌকিখানা। তার তলায় মেঝে ঢুকে গেছে। বাঁশের বেড়া দিয়ে ঝিল থেকে উঠে আসছে তীব্র হাওয়া। ঠাণ্ডা। কটু গন্ধে ভারী। রাধিকা ভাবছে, এটাকে তো দেওয়াল বলে না। তাদের খিলপাটনি গাঁয়ে মাটির দেওয়াল ছিল। তবু সে দেওয়ালই ছিল। এখানে শুধু বেড়া। ছোট ছোট অজস্র ফুটো। আবরু নেই। আড়াল নেই। রাধিকা ভাবছে, তার আর চার দেওয়াল রইল না। চার দেওয়ালের ঘেরাটোপ কী দেয় মানুষকে, শুধুই নিরাপত্তা, নাকি আরও কিছু? একটা স্বপ্নের ঘোর, একটা একাকী পৃথিবী এবং অন্যদের পৃথিবী থেকে নিজেকে আগলে আবডালে রাখা। কারণ, কখন বেরিয়ে আসবে নিহিত আবেগমঞ্জরী আর অন্যদের দ্বারা উপহসিত হবে—সে বড় লজ্জার, সে বড় কষ্টের। নিজের আবেগকে-অভিমানকে অন্যের হাতে নিপীড়িত হতে দেখা বড় যন্ত্রণার।

শুন লো রাজার ঝি।

লোকে না বলিবে কী?

লোকে বলে। শুধু বলে। নানা কথা। বোঝে না—কোন দুঃখ ওর। জানতে চায় না—কোন ইচ্ছা ওর। লোক, সব সময়ই, প্রত্যেকটি ব্যক্তিমানুষের বিরুদ্ধে এক একটি প্রতিষ্ঠান। এবং রাধিকা, আড়াল হারানো মেয়ে। তার চোখ চলে যাচ্ছে বাইরের দিকে। সে দেখতে পাচ্ছে দুয়ারে অন্ধকার জুড়ে আরও অন্ধকার ভাসা ভাসা মুখ। অঞ্জলি বলছে— আমরা সব আসলাম, তোমার সঙ্গে দুইটা কথা কইতে।

রাধিকা নড়েচড়ে বসছে— আসেন। বসেন।

সে বলছে না— ‘আহেন। বয়েন।’ বলছে, আসেন, বসেন। তারও ভাষা মিশ্রিত হচ্ছে। সে জানে না। সে দেখছে। ক্ষয়া ক্ষয়া চেহারা, আধময়লা শাড়ি, উলুঝুলু চুল— একদল মেয়েমানুষ। বিছানা ছাড়া বসতে দেবার জায়গা নেই অথচ তারা বসবে এ যেন রাধিকা মানতে পারছে না। সে তাড়াতাড়ি, যাতে বিছানার শুচি রক্ষা হয়, পলাশকে বলতে চাইছে— পলাশ পাটি পাত… পলাশ তাড়াতাড়ি ঘরের কোণ থেকে পাটি আনছে। তাকে বিছানার নীচে নামতে হচ্ছে না। বিছানার প্রান্তে গিয়ে হাত বাড়ালেই সব পেয়ে যাচ্ছে। সে পাটি পেতে টান টান করছে। সমান করছে। ভাবছে, এটাই তাহলে এখন তাদের মেঝে। এই বিছানাটা। কারণ, এতকাল মাটিতে পাটি পাতা হত! মেয়ের দল পাটিতে জাঁকিয়ে বসছে। রাধিকা কী বলবে বুঝে পারছে না। তার অল্প অল্প অভিমান হচ্ছে। সে ভেবেছিল, বিকেলে শেফালির মা ছুটে আসবে, আসেনি। যদিও শেফালির মা বলেছিল, ‘দিদিমণির বাড়ি বিয়া, না মিটাইলে তর কাসে যাইতে পারুম না।’ তবু রাধিকার মনে হয়েছিল, এরকম বললেও, শেফালির মা ঠিকই আসবে। রাধিকাকে দেখার জন্য, জোছনকে ছোঁওয়ার জন্য তার মন কেমন করবে। এখন শেফালির মা’র বদলে এরা এসেছে। সে কী করে! কী বলে! তাঁকে কিছু বলতে হল না। প্রশ্ন নামছে একের পর এক। সে উত্তর করছে। কোথায় গাঁ, কোথায় ঘর। কী জাত। একজন বলছে— ‘বর তো বুড়া। এমুন সোন্দর মাইয়ার লগে এমন বুড়া বরের বিয়া দিল ক্যান বাপ-মায়?’

রাধিকার গলা ভার হয়ে আসছে। চোখে জল আসছে। সে চুপ করে আছে। কাল রাত্রে বস্তিতে খুব চিৎকার হুজ্জোতি হয়েছে। সে ভেবেছিল এ এক মায়া-মমতাহীন নির্দয় নোংরা জায়গা। এখন এদের সঙ্গে কথা বলে তার খারাপ লাগছে না। শুধু একটু গা ঘিন ঘিন ভাব। একটু নোংরা। অপরিচ্ছন্ন।

অন্ধর মা এবার মোক্ষম প্রশ্ন করছে— শ্যাফালির মায়রে চেন নি? তুমি তাগো লগেই আসিলা না? অ্যাক বাড়িতৈ না থাকতা?

রাধিকা চমকে তাকাচ্ছে। এই বউটা শেফালির মাকে চেনে! তার মন আনন্দে ভরে যাচ্ছে। যেন দূরদেশ থেকে বাপের বাড়ির সংবাদ এনেছে এক পরিচিত ফেরিওয়ালা। সে ভেবেছিল, শেফালির মা এখন বহু দূরদেশের হয়ে গিয়েছে। যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু এই বউটা শেফালির মাকে চেনে। তার মনে হচ্ছে, এই বস্তি ততটা অজানা নয়। ততটা বিদেশ নয়। সে বলছে— আপনে চিনেন?

—হ। চিনুম না? হ্যায় ইশকুলের কামডা করে। আমি ইশকুলের দিদিমণির ঘরের কামডা করি। চিনুম না ক্যান?

ভাব হচ্ছে ক্রমশ। ওলো সই-ওলো সই হচ্ছে। রাধিকা আড় ভাঙছে। আর বাইরে অন্ধর গলা পাওয়া যাচ্ছে— পলাশ! পলাশ!

পলাশ চুপ করে শুনছিল সব কথা। বুড়ার লগে বিয়া দিসে। তার বাবা বুড়া। মা বুড়া না। এক যৌবনবতীর সঙ্গে প্রায় বৃদ্ধের অপমিশ্রণের সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া সে জানে না। তবু ভাবছে। এবং ভাবনা অন্য দিকে চলে যাচ্ছে। অন্ধর দিকে। সে এবার অন্ধর গলা পাচ্ছে। অন্ধ বলেছিল ওর মাস্টারের কাছে নিয়ে যাবে। সে মা’র মুখের দিকে দেখছে— যামু? মা?

—অখন? এই রাইতে কই যাবা?

—অন্ধ ডাকতেয়াসে।

—এমুন অন্ধকার। ঠাণ্ডা। অখন কই যাবা পলাশ?

অন্ধর মা বলছে— হ। আমার অন্ধর লগে মাস্টারের কাসে যাইব। যাউক। ছাইড়া দ্যাও। মাস্টারের কাসে গ্যালে তোমার পোলার ক্ষতি হইব না।

রাধিকা কথা বলছে না। পলাশ বিছানা থেকে লাফিয়ে নামছে— যাই-ই-ই।

রাধিকা চুপ করে আছে। এটা-সেটা কথা চলছে মাঝে মধ্যে। আর অন্ধ পলাশকে নিয়ে যাচ্ছে মাস্টারের কাছে। পলাশ বলছে— বেশিক্ষণ না। ফিরা পড়তে হইব। নাইলে মায় রাগ করব।

—ঠিক আছে।

অন্ধ পলাশের হাত ধরে মাস্টারের ঘরে ঢুকছে। পলাশ দেখছে অন্ধর মাস্টারকে। মাস্টার দেখছে পলাশকে। গোলগাল নরম বালক। বড় বড় চোখ। ফরসা রঙ। মাস্টার সে রোগা, কালো মুখ ভর্তি দাড়ি। লম্বা লম্বা কাঁধ ছোঁয়া চুল, চোখ দু’টি গর্তে। বলছে— এসো। আজ তোমাদের একটা চমৎকার গল্প শোনাব।

তারা দু’জন বিছানায় সার বেঁধে বসে পড়ছে। পলাশের গা ছম ছম করছে। শীতও করছে। এখানে শীত অনেক বেশি। সে চুপ করে বসে আছে। মাস্টার বলছে— রানি জোছনাকুমারীর ছিল সাত ছেলে আর সাত মেয়ে। তারা সব রূপে-গুণে অসামান্য। বলা যেতে পারে, তারা ফুলের মতো। আবার বিদ্যুতের মতো। তারা যখন গান গাইবে তখন পাখির মধুরতম স্বরও হার মেনে যাবে। আবার তারা যখন শিকার করার জন্য তির ছুঁড়বে, সেই তির, হরিণের হৃৎপিণ্ড এফোঁড় ওফোঁড় করে চলে যাবে। ছেলে-মেয়েদের নিয়ে রানির মনে গর্বের সীমা ছিল না। সে-দেশের রাজা সাত বছরের জন্য সাতটি দেশে বৈদেশিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে গিয়েছিলেন। রানির ওপর দেশ শাসনের ভার ছিল। রানি সে-ভার গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু পালন করেননি। রাজা চলে যাবার পর থেকে দেশে দস্যু-তস্কর বেড়ে গেল। অরাজকতা দেখা দিল। গরিব চাষিরা কোনও রাজসহায়তা পেল না। মন্ত্রী-আমলা সব লুটে-পুটে খেতে লাগল। সাধারণ মানুষ দাঁতে দাঁত চেপে সাত বছর পর রাজা ফিরে আসবেন এই প্রতীক্ষা করতে লাগল। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে জনজীবনের চাকা ঘুরতে লাগল। আর রানি প্রতিদিন গোলাপজলে স্নান করে, সবচেয়ে দামি গাড়িতে চেপে ছেলে-মেয়ে নিয়ে হেসে-খেলে হাওয়া খেয়ে সুন্দর পোশাক পরে শিকার করে দিন কাটাতে লাগলেন আর রাজ্যে ঘোষণা করলেন— আমি রানি জোছনাকুমারী। আমাকে দেখেই সমস্ত প্রজাকে হাঁটু মুড়ে বসে অভিবাদন জানাতে হবে। লোকেরা তাই করতে লাগল। কিন্তু এই অযোগ্য মহিলাকে বিয়ে করার জন্য রাজার কষ্টের কথা ভেবে খুব দুঃখ পেল তারা। আর তাদের নিজের দুঃখ ঘোচাবার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে লাগল যাতে রাজা তাড়াতাড়ি ফিরে আসেন। সে-দেশে সবাই চন্দ্রিমাদেবীর পুজো করত। প্রতি বছরের মতো এবারও চন্দ্রিমাদেবীর পূজার উৎসব এল। মন্দির সেজে উঠল। মেয়ে-পুরুষ সব যে যার ভাল পোশাক পরে চন্দ্রিমাদেবী আর তাঁর দুই ছেলে-মেয়ে নিশিকান্ত ও নিশিনন্দিনীর জন্য ফলমূল উপহার ধূপকাঠি নিয়ে মন্দিরে যেতে লাগল। দেবী চন্দ্রিমা শান্ত কল্যাণী প্রসন্ন সুন্দর। পাহাড়ের ওপর থেকে, পাথর ও গাছের আড়ালে লুকিয়ে বসে তিনি নিজের পুজো দেখতে লাগলেন। তাঁর মন আনন্দে পূর্ণ হল। ঠিক তখনই— বিশাল সুসজ্জিত দামি গাড়ি চেপে রানি জোছনাকুমারী সাত পুত্র, সাত কন্যা নিয়ে মন্দিরে এলেন৷ সব ভক্ত দেবীর মন্ত্র উচ্চারণ করতে যাবে, বলতে যাবে— যশো দেহি, ধনং দেহি, রূপং দেহি… …তখনই রানি বললেন— ‘খামোশ।’ তাঁর চড়া আওয়াজ, চড়া শব্দ শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। তিনি বললেন, আজ থেকে দেবী চন্দ্রিমার পূজা বন্ধ। আজ থেকে তোমরা আমার পূজা করবে। আমার মূর্তি গড়ে রাখবে বেদীতে আর আমাকে আরাধনা করবে।

প্রজারা হাঁটু মুড়ে বসে মাথা নিচু করে কাঁপতে লাগল— মালিক, দীনদুনিয়ার মালিক, তা কি হয়?

—হয়। আলবাৎ হয়।

রানির মণিমানিক বসানো চাবুক ঝলসে উঠল। তিনি চিৎকার করলেন— না হলে আমি অভ্যন্তরীণ গোলযোগ ও দেশদ্রোহের উন্মেষ দেখে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করব।

জরুরি অবস্থা! জরুরি অবস্থা! কী সাংঘাতিক। এর আগে এ দেশে দু’বার জরুরি অবস্থা চালু হয়েছিল। সবার মনে আছে সেই ভয়ঙ্কর সময়ের কথা। কতরকম কারণে মানুষকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তখন আর তাদের প্রাণদণ্ড হয়েছিল তার শেষ নেই। তখন অবিশ্বাসের হাওয়া বয়ে গিয়েছিল চারপাশে। গুপ্তচরে ছেয়ে গিয়েছিল। স্বামী স্ত্রীকে বিশ্বাস করত না। বোন ভাইকে বিশ্বাস করত না। শিশু কাঁদতে ভয় পেত। সুতরাং জনগণ মনে মনে চন্দ্রিমাদেবীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তাঁর মূর্তি সরিয়ে রানি জোছনাকুমারীর মূর্তি বসানো সাব্যস্ত করল। মনে মনে আশা রাখল রাজা ফিরলে এর একটা বিহিত হবে।

দেবী চন্দ্রিমা প্রজাদের মনোবেদনা বুঝলেন। তাঁর কষ্ট হল। নিজের জন্য। প্রজাদের জন্যও। তাঁর উৎসব সম্পূর্ণ হল না। তাঁর পদ্মের মতো চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। তিনি নিশিকান্ত ও নিশিনন্দিনীকে কেঁদে কেঁদে সব কথা কইলেন। তারা রেগে টং হয়ে গেল। সূর্যাস্তের লাল আভায় ভয়ঙ্কর হল চোখ-মুখ। রানির দিকে দৈববাণী ছুঁড়ে দিল তারা। বলল— মূর্খ। তুমি কেন মনে করছ তুমি ঈশ্বরের চেয়ে বড়?

রানি সমান তেজে জবাব দিলেন— কারণ আমি শক্তিমান। আমার সাত পুত্র ও সাত কন্যা আছে যারা যে-কোনও দেবপুত্র বা দেবকন্যার চেয়ে রূপবান ও শক্তিশালী। আমার বিশাল রাজ্য। বিরাট সেনাবাহিনী। আমার তুলনায় দেবী চন্দ্রিমা তো ভিখারিণী। এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে কোথায় থাকেন কেউ জানে না। কেউ তাকে আজ পর্যন্ত চোখে দেখেনি। কিন্তু তাঁর পূজা করে। এর চেয়ে বড় মূর্খামি আর কী হতে পারে?

আবার দৈববাণী হল। বিদ্যুতের রেখায় কথাগুলি আঁকা হল আকাশে— তুমি মূর্খ শুধু নও, উদ্ধত, শয়তান, গর্বে অন্ধ। সাধারণ মানবী, তুমি নিজেকে দেবী মনে করছ, তবে দেখো, তুমি কত সামান্য!

নিশিকান্ত এক ভয়ঙ্কর তির ছুঁড়লেন। জোছনাকুমারীর সাতটি ছেলে মরে গেল। জোছনাকুমারী হায় হায় করতে লাগলেন। তবু তাঁর অহঙ্কার গেল না। বলতে লাগলেন— এখনও আমার সাতটি মেয়ে আছে। এখনও আমি তোমার চেয়ে বড়, চন্দ্রিমা!

এবার নিশিনন্দিনী একটি একটি করে তির ছুঁড়তে লাগলেন আর রানির বড়, মেজ, সেজ… সব মেয়ে একে একে মরতে লাগল। পঞ্চম কন্যার বেলায় সবচেয়ে ছোটটি ছুটে আসতে লাগল। ভয়ে, মৃত্যুভয়ে, মায়ের বুকে লুকোবে বলে। তখন ষষ্ঠ কন্যাও মারা পড়ল। রানি চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। বললেন, দেবী, ক্ষমা করো। আমি ভুল করেছি, অন্যায় করেছি। এই ছোট সন্তানটিকে কেড়ে নিও না। আমাকে একটি নিয়ে বাঁচতে দাও। কিন্তু এইসব কথা নিশিনন্দিনীর কানে যাবার আগেই তাঁর তির ছোড়া হয়ে গিয়েছিল। রানির কথা কানে যাবার পর তাঁর দয়া হল বটে, কিন্তু তির ফিরিয়ে নেবার আর উপায় রইল না। সেটি এসে রানির ছোট মেয়েটিকে বিদ্ধ করল। রক্তাক্ত অবস্থায় সে লুটিয়ে পড়ল মায়ের বুকে।

রানি এক মুহূর্তে ভিখারিণী হয়ে গেলেন। তাঁর রূপ, শক্তি, সম্পদ আর গর্বের কোনও মানে রইল না। চোদ্দোটি সন্তান ছিল তাঁর। এই গর্বে নিজেকে তিনি ঈশ্বরের চেয়ে বড় বলে ঘোষণা করেছিলেন। আজ তাঁর একটিও সন্তান নেই। তিনি ধীরে ধীরে মাটিতে বসে পড়লেন। কেউ তাঁকে সেখান থেকে ওঠাতে পারল না। কেউ একটি কথা কওয়াতে পারল না। শোকে, দুঃখে বেদনায় তিনি ক্রমশ শক্ত হতে থাকলেন। তাঁর চোখমুখের রঙ উধাও হয়ে গেল। তিনি পাথরে পরিণত হলেন। দিনের পর দিন ওভাবেই রইলেন রানি। অনড় পাথর হয়ে। এক দিন বিষম ঝড় এল। সব কিছু চুরমার হয়ে গেল। আর হাওয়ার সেই দাপট পাথরের রানিকে উড়িয়ে নিয়ে ঝুলিয়ে দিল একটা পাহাড়ের চূড়ায়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত সমস্ত পাহাড়ের চূড়ায় গাঁথা থাকে একটি রমণীর অবয়ব। দুঃখিত। ব্যথিত। সন্তান হারা, একাকী। এবং ক্ষমাহীন শক্তির অকরুণ দম্ভের ফল।

অন্ধ বলল— ভগবান তা হলে মানুষের মতোই মানুষকে মারে?

মাস্টার বলল— হ্যাঁ। ঈশ্বরও হিংস্র। প্রতিহিংসাপরায়ণ। পূজালোভী। ক্ষমাশীলতা জানে না। ঈশ্বর মানুষের ছায়া মাত্র। মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের কোথাও তফাত নেই।

অন্ধ বুঝতে পারল না, তা হলে ঈশ্বরের পুজো করে লাভ আছে না নেই।

পলাশ ভাঙা ভাঙা গলায় বলল— কিন্তু ঠাকুরকে মন দিয়ে পূজা করলে তো ঠাকুর খুশি হয়ে যা চাওয়া যায় দিয়ে দেয়। না?

মাস্টার চুপ করে রইল। সে নিজেও বুঝতে পারছে না যে সে ঈশ্বরকে স্বীকার করল না অস্বীকার করল। হয়তো স্বীকারই করল। পৃথিবীতে দেশে দেশে সবসময়ই কোনও না কোনও ঈশ্বর-ঈশ্বরী বিরাজ করেন। তাঁকে কে অস্বীকার করবে!

৩৩

অনেকদিন পর দেবার্চনের বিছানা ব্যবহৃত হচ্ছে। বিকাশ নিজেই বেছে নিয়েছেন এই শয্যা। একটি সম্পূর্ণ ঘর দেবাশিসকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে-ঘরে লক্ষ্মী আর বিকাশ শুতেন, এতকাল সেখানে ছেলেকে নিয়ে শুয়েছেন লক্ষ্মী। আজ তিনি একা। বহু দিন আগে স্ত্রীর সঙ্গে শোবার অভ্যেস চলে গেছে। নিজের মতো করে রাত্রিটাকে পাবার জন্য বিকাশ ছোট ছেলের ঘরটিকেই বেছে নিয়েছেন। বাড়িতে যখন থাকেন, এ ঘরেই তাঁর বেশি সময় কাটে। তার টেবিল। তার বই। তার ডায়রি। বিকাশই এগুলো ঝাড়েন পোছেন। লক্ষ্মী হাত দেন না। বলেন— ‘যে নেই, তার জিনিস ঘেঁটে কী হবে!’ বিকাশের মনে হয়— তবু তো পাওয়া যায়! ও একদিন ছুঁয়েছিল এইসব। একদিন লিখেছিল। নানান ভাবনা ছড়িয়ে দিয়েছিল পাতায় পাতায় এ সবের মধ্যে তো ও আছে।

দু’জনের ভাবনা দু’রকম, তাই ঘরও দু’রকম। তবে আজ বিকাশের ভাল লাগছে। ছেলের ছবির দিকে তাকিয়েছিলেন তিনি। মনে হল দেবার্চন হাসছে। যেন সংসারের এই পরিবর্তন, দেবাশিসের বধূ নিয়ে আসা, এই আয়োজন-উৎসব—এ সব দেবার্চনের মধ্যে সহজ আনন্দ সঞ্চার করেছে।

মেয়েটি বেশ। জিনি। আসলে শিঞ্জিনী। সারাক্ষণ হেসে বেড়ায়। কে যে তার নাম দিয়েছিল শিঞ্জিনী! একেবারে ঠিকঠাক নাম। কেউ তাকে গাইতে বললে সে একটুও লজ্জা না পেয়ে গাইতে বসে যায়। দু’বার-চারবার হারমোনিয়ামের রিড এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত টিপে ধরে ফেলে— ‘প্রিয় যাই যাই বলো না।’ কিংবা ‘পরদেশী মেঘ যাওরে ফিরে’— হারমোনিয়াম সে সঙ্গে এনেছে। যেমন এনেছে সুন্দর সুন্দর আসবাব, টেলিভিশন, স্টিরিওফোনিক রেকর্ডপ্লেয়ার। এ বাড়িতে সে ঝলমল করে এসেছে। হেসে হেসে এসেছে। বিকাশের মনে হচ্ছে, একজন চলে গিয়েছিল, একজন এল। যেন দীর্ঘদিনের জমে থাকা অন্ধকার গেল। বাতি জ্বলল। কারও অভাব তো পূরণ করা যায় না। কিন্তু নতুন মানুষ দিয়ে আবার নতুন করে ঘর পূর্ণ করা যায়। বিকাশের কাছে এখন জিনি সেই পূর্ণতা। বেশ দেখতে মেয়ে। পাতলা পাতলা গড়ন। সরু নাক। বড় বড় সমুদ্র রঙের চোখ। বউভাত অনুষ্ঠানের দিন বিকাশের অফিসের সহকর্মীরা এসেছিলেন। কথায় কথায় দেখা গেল বিজন দেব জিনির বাবাকে চিনতেন। জিনিকে দু’-একটি প্রশ্ন করতে লাগলেন তিনি। জিনি তাঁর সঙ্গে গল্প করতে লাগল। বাবা নেই। বাবা মারা গেছেন দু’বছর। জিনি যেন এই অল্প পরিচিত মানুষটির মধ্যেও ঢুকে পড়ে বাবাকে দেখতে চায়। বিকাশের হৃদয় মমতায় ছলছল করে উঠেছিল। তিনি পুত্র হারিয়েছেন পাঁচ বছর পেরোয়নি। এই মেয়েটি তার পিতাকে হারিয়েছে দু’বছর পেরোয়নি। বিকাশ নিজের সঙ্গে মেয়েটির শোক একাকার করে দেখলেন। তখন লক্ষ্মী এসে হাত টেনেছিলেন বিকাশের— শোনো।

—কী?

—এ সব কী কাণ্ড?

—কী হল?

—চারপাশে এত লোকজন, নতুন বউ এত কথা বলে নাকি?

—তাতে কী হল? আজকাল এ সব কেউ মানে না লক্ষ্মী। কলেজে-ইউনিভার্সিটিতে পড়া মেয়ে—

—বাজে বোকো না। আমি কলেজে পড়িনি?

বিকাশ কোনও দোষ পাননি জিনির মধ্যে। চার ভাইয়ের একটা বোন। খুব আদরে মানুষ হয়েছে মেয়েটা। সরল। অনভিজ্ঞ। সদ্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পার করা মেয়েরা যেমন হয়। তাত্ত্বিক জ্ঞান লাভ করে কিন্তু বাস্তবিক শিশু থাকে খুব। মনে করে, এই তো দেখা হয়ে গেল জীবন, কিন্তু, ক্রমে বুঝতে পারে, জীবন আরও বহু রূপে ধরা দেয়। সেই রূপে মিশে থাকে চুন-কালি, অশ্রু, গর্জন এবং কিছু স্নিগ্ধ সূর্যোদয়।

বিকাশ ঘরের পর্দা টেনে দিলেন। অনেকদিন পর আবার রবীন্দ্রনাথ পড়তে শুরু করেছেন তিনি। ছোটগল্প ধরেছেন। আশ্চর্য জীবনের আশ্চর্যতর স্পন্দন ধরা আছে গল্পগুলিতে। সমস্ত রস আছে। কী অপূর্ব পরিমিতি! কী অসামান্য বিস্তার! কখনও মনে হয় না এ অংশটুকু বাড়তি। বিকাশ পড়ছেন—

…উপার্জনে মন দেওয়া গেল। গবর্মেন্ট-আপিসে চাকরি করিবার বয়স গেছে, অন্য আপিসে প্রবেশ করিবারও ক্ষমতা নাই। অনেক ভাবিয়া বই লিখিতে লাগিলাম।

বাঁশের নল ফুটা করিলে তাহাতে তেল রাখা যায় না, জল রাখা যায় না, তাহার ধারণশক্তি মূলেই থাকে না; তাহাতে সংসারের কোনও কাজই হয় না, কিন্তু ফুঁ দিলে বিনা খরচে বাঁশি বাজে ভালো। আমি স্থির জানিতাম, সংসারের কোনও কাজেই যে হতভাগ্যের বুদ্ধি খেলে না, সে নিশ্চয়ই ভালো বই লিখিবে। সেই সাহসে একখানা প্রহসন লিখিলাম, লোকে ভালো বলিল এবং রঙ্গভূমিতে অভিনয় হইয়া গেল।

সহসা যশের আস্বাদ পাইয়া এমনি বিপদ হইল, প্রহসন আর কিছুতেই ছাড়িতে পারি না। সমস্ত দিন ব্যাকুল চিন্তান্বিত মুখে প্রহসন লিখিতে লাগিলাম।…

অন্য দিকের ঘরে আলো নিবিয়ে দিয়েছিল দেবাশিস। পর পর তিন রাত্রি সে ব্যর্থ হয়েছে। প্রথম রাত্রে সে হাত দিয়ে হতাশ হয়েছিল। এত ছোট! অত অল্প! তার হাত মুখ সমস্ত শরীর পুরু ভরাট রাত্রির জন্য কতখানি প্রত্যাশী ছিল সে-সম্পর্কে তার নিজের কোনও ধারণাই ছিল না। দরজা বন্ধ করা মাত্রই সে তীব্র হয়ে ওঠে আর সমস্ত হুক এক টানে ছিঁড়ে জিনিকে বিদীর্ণ করতে চায়। এই তিনদিন ধরে জিনি একেবারে শক্ত হয়ে আছে। একেবারে কাঠ। দেবাশিস প্রথমে ভেবেছে লজ্জা। ভেবেছে ভয়। পূর্বাপর ব্যর্থ হয়ে উন্মত্ত অবস্থায় ছুটে গেছে বাথরুমে। সেই হাতের প্রশ্রয়। তার রাগ হচ্ছে। কিন্তু সে শান্ত আছে। মাত্র তো তিনদিন। আস্তে আস্তে হবে। অফিসের শঙ্করদা বলেছিল— তাড়াহুড়ো করিস না যেন।

জানালার পর্দা একটু তুলে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল জিনি। দেবাশিসের সঙ্গে ভাল করে কথা হয়নি তার। দেবাশিস কোনও কথা জানতে চায়নি। অথচ জিনি ভেবেছিল, অনেক কথা বলবে বরের সঙ্গে, কথা শুনবে। ছোটবেলার কথা। বড় হয়ে ওঠার গল্প। তার বাবার কথা বলবে। তার প্রিয় কবিতাগুলি শোনাবে দেবাশিসকে। দেবাশিস তার কোলে মাথা রাখবে। কবিতা শুনতে শুনতে খুব ভালবাসবে তাকে। কবিতার মতো করে ভালবাসবে। এখনও হয়নি এমন। দেবাশিস সারা দিন দূরে দূরে থাকে। এই ক’দিন বেশিটাই এ ঘরেই কেটে গিয়েছে জিনির। আত্মীয় যাঁরা এসেছিলেন চলে গেলেন আজ। এর মধ্যে দেবাশিস যতবার এসেছে এ ঘরে ততবার ডাক পড়েছে তার। লক্ষ্মী ডেকে নিয়েছেন ছেলেকে— ‘বাবু—’। ‘যাই মা’ বলে সেও চলে গেছে তৎক্ষণাৎ। জিনি গুনছে, আর মাত্র চারদিন। তারপর আগরতলা যাত্রা। ভাবলেই ভাল লাগছে তার। সব দেখাবে সে দেবাশিসকে। ছোটবেলার স্কুল। খেলার মাঠ। পুরস্কার পাওয়া বইগুলি। বাবার ছবি। সব দেখাবে। আর অনেক গল্প করবে। তার বিয়ের পরের পরদিনই সবাই ফিরে গেছেন আগরতলায়। গিঁট খুলতে জিনি আর দেবাশিস সেখানে যাবে।

শব্দ করে দরজা বন্ধ করল দেবাশিস। জিনি চমকে উঠল। দেবাশিসের হাত আলোর সুইচে। হিমেল স্রোত জিনির মেরুদণ্ড বেয়ে নামতে থাকল ক্রমশ। সে জানে এখুনি দেবাশিস তাকে হিঁচড়ে শুইয়ে দেবে। পটাপট খুলে ফেলবে হুক। আর জিনি শক্ত হয়ে যাবে। তিনদিন ধরে এই চলছে, এই হচ্ছে ক্রমশ। জিনি বুঝতে পারছে না, এইভাবে কেন আসছে ও! একটুও কথা না বলে! চোখে না তাকিয়ে! ভাল না বেসে! বিয়ে হওয়া মাত্রই কি দুই নারী ও পুরুষ পরস্পরের শরীরের সম্পূর্ণ দখল পেয়ে যায়? সে আস্তে বলল— আলো নিবিয়ো না।

—কেন? ঘুরে দাঁড়াল দেবাশিস। তার ভ্রূ কুঁচকে গেছে। নাক কাঁপছে। হালকা সবুজ চাদরে ঢাকা সুন্দর শরীর। সে আদেশের ভঙ্গিতে বলছে— জানালা বন্ধ করো। ঠাণ্ডায় সব খুলে রেখেছ কেন?… জিনি জানালা বন্ধ করছে। তার মনে হচ্ছে, যেন সে নিরাপদ নয়। বিচ্ছিন্ন। সমস্ত জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন। এবং তাকে যেন চিৎকার করতে হবে, যাকে বলে আর্তনাদ, এমনই পরিস্থিতি। আর জানালা খোলা থাকলে সে, আর্তস্বরসমূহ পৌঁছে দেবে। কোথায় পৌঁছে দেবে? কার কাছে? আপনজনদের কাছে। প্রিয়জনদের কাছে। মা, দাদা, বউদি, পিসি… ভাবছে জিনি, ঠোঁট কামড়াচ্ছে। মা, দাদা, বউদি, পিসি তার প্রিয়জন। দেবাশিস নয়? সে ভাবত, বিয়ে হওয়া মানেই বর এক প্রিয়জন। এই প্রিয়ত্ব, তিন রাত্রি পেরিয়েও সে স্পর্শ করতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে ভরাট চার দেওয়ালের মধ্যে আবার সে একা। সে খাট থেকে নেমে আসছে। দেবাশিস শক্ত করে হাত ধরছে তার।

—কোথায় যাচ্ছ?

হঠাৎ প্রশ্ন করছে জিনি। আচম্বিতে প্রশ্ন করছে— তুমি কবিতা পড়ো না?

—কবিতা? কী বললে? কবিতা?

—হ্যাঁ। পড়ো না?

দেবাশিস হাসে। এবং হাসির মধ্যে ব্যঙ্গ পুরে দেয়। কিংবা তাচ্ছিল্য। কিংবা বিরক্তি। জিনি, বোঝে অথবা বোঝে না। কিন্তু উত্তরের প্রতীক্ষা করে। দেবাশিস বলে—

—না। তুমি পড়ো? হ্যাঁ, তুমি তো পড়বেই। সাহিত্যের ছাত্রী। গান গাও। কবিতা পড়ো। নাচতেও নাকি?

দেবাশিসের একটি হাতে জিনির হাত শক্ত করে ধরা। অন্য হাত ঘুরছিল। শরীরময় ঘুরছিল। জিনি হয়তো ভাঙত আজ। হয়তো গলত। বড় সুন্দর দেখাচ্ছিল যে দেবাশিসকে! কিন্তু সে শক্ত হয়ে গেল ফের। নাচতেও নাকি— শুনে শক্ত হয়ে গেল। নাচত না সে। যদি-বা নাচতও তাতে কী? সে বলল— ছাড়ো।

—কেন? ছাড়ব কেন?

— কবিতা শুনবে?

—কবিতা? আচ্ছা বেশ।

হতাশ হয়ে শুয়ে পড়ল সে। বলতে থাকল— ভাইয়ের এ সব ছিল। কবিতা, রবীন্দ্রনাথ, শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, শেষ পর্যন্ত কার্ল মার্কস আর চারু মজুমদার। বাপরে!

—বাপরে কেন?…থমকে গেছে জিনি। দেওয়ালের র‍্যাকে কয়েকটি কবিতার বই সাজিয়েছিল, তার সর্বক্ষণের সঙ্গী, সে দিকে যেতে পারছে না।

—ওর জন্যে কী হ্যারাসমেন্ট গেছে জানো! আমাকে কতদিন পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে! বাবার কী অপমান! কী দরকার ছিল এ সবের!

—ও, অপমান কেন?

—সে তুমি বুঝবে না। তাড়াতাড়ি এসো।

জিনি র‍্যাকে হাত বাড়াচ্ছে। জীবনানন্দ টানছে। এখন আর কবিতা শোনাতে ইচ্ছে করছে না। সে বেশ বুঝতে পারছে দেবাশিস কবিতা শুনবে না। যদি এ ঘর থেকে একটু বেরোতে পারত। যদি একটু একা একা দু’পাতা পড়ে আসতে পারত! বাথরুমে চলে যাবে? বই নিয়ে? দেবাশিস প্রশ্ন করবে। সে আনমনে পাতা ওল্টাল।

…রাত ঢের, —বাড়িবে আরো কি

এই রাত! —বেড়ে যায়, —তবু চোখাচোখি

হয় নাই দেখা।

আমাদের দুজনার! দুইজন, —একা!—

বার-বার চোখ তবু কেন ওর ভ’রে আসে জলে!

কেন বা এমন ক’রে বলে,

কাল সাঁঝরাতে

আবার তোমার সাথে

দেখা হবে? —আসিবে তো? তুমি আসিবে তো!—

ডুবে যাচ্ছে। কবিতায়। কোনও মুখ মনে নেই। কাছে নেই। কে বলবে একদিন? আসিবে তো?

—হল? কবিতা খোঁজা? তাড়াতাড়ি করো।

জিনি তাকাচ্ছে। এগোচ্ছে বিছানার দিকে। শোনাবে। শোনানো তো উপলক্ষ। আসলে নিজেই পড়বে। দেবাশিস চাদর ছুড়ে ফেলছে। কম্বল চাপাচ্ছে গায়ে। হাসছে। জিনির হাতে জীবনানন্দ। সে শুনছে— আজ শিবতোষদা দারুণ জিনিস দিয়েছে একটা।

—কী?

মনে আছে শিবতোষদাকে?

—ঠিক মনে পড়ছে না।

—ওই যে, বলেছিল, তোর বউয়ের বুকের অসুখ করলে আমার কাছে নিয়ে আসিস।

—ওঃ।

—ও কি! শিবতোষদা ডাক্তার। বুঝলে? যা জিনিস দিয়েছে না!

জিনি দেখছে। দেবাশিসের চোখমুখে উচ্ছলতা চকচক করছে। কিন্তু এর নাম আনন্দ নয়।

দেবাশিস দু’ আঙুলে তুলে ধরছে ছোট চকচকে রঙিন প্যাকেট।

—খুব দামি। বিদেশি। দারুণ!

জিনির চোখের সামনে হামাগুড়ি মেয়ে। ঠোঁট ফাক। নগ্ন। বিপুল স্তন মাচা থেকে ঝোলানো কুমড়োর মতো দুলে আছে। জিনি দেখছে। জীবনানন্দ হাতে দেখছে। দেবাশিস দেখছে। হাতে কন্ডোমের প্যাকেট। স্বামী-স্ত্রী তারা। নারী-পুরুষ তারা। মিলিত হবে। বর্ষে বর্ষে মিলিত হবে, যুগে যুগে মিলিত হবে। সারল্যে সৃষ্টি করবে অপূর্ব সন্তান। সারল্যে দেহ সরব করে চলে যাবে দেহাতীত সেই পর্বে যার নাম প্রেম। এমনই জানত জিনি। আজ সব তার মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে। সব ভুল। শরীরের জন্য তো রইলই আরও একটি শরীর। তবে কেন এত তিক্ত ছবির উল্লাস! কেন এই নির্লজ্জ প্রকাশ যা প্রেমকে ছুড়ে দেয় নর্দমায় এবং অস্বীকার করে? দু’হাতে মুখ ঢাকছে জিনি। বিকৃত গলায় বলছে— ছিঃ! সরাও ওটা সরাও!

দেবাশিস শুইয়ে ফেলছে জিনিকে। ঘড়ঘড়ে গলায় বলছে— লজ্জা করছে? উঁ? লজ্জা করছে? ওইরকম করব আমি। তোমাকেও ওইরকম করব।

জীবনানন্দ ছিটকে গেছে হাত থেকে। মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে মেঝেয়। জিনি শক্ত হয়ে আছে। আর তার পরিত্রাণ নেই। দেবাশিস চড়ে বসেছে ওপরে। জিনি ছটফট করছে। বোবা নিরুত্তর গাভীর মতো ছটফট করছে। কী যন্ত্রণা! মাগো! চোখ উপছে জল পড়ছে তার। আলো নেবানো নেই। তার ঠোঁট কামড়ে আছে অন্য লোক। সে চোখ খুলল একবার। দেওয়ালে চোখ পড়ল। একটা ছোট্ট সোনালি মথকে কামড়ে ধরেছে টিকটিকি। মাথা নেড়ে-নেড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে।

পাতা ওল্টাচ্ছেন বিকাশ। পড়ছেন, বহুপাঠিত ‘ল্যাবরেটরি’—

…মন যে লোভী, মাংসমজ্জার নীচে লোভের চাপা আগুন সে লুকিয়ে রেখে দেয়, খোঁচা পেলে জ্বলে ওঠে। আমি তো গোড়াতেই নাম ডুবিয়েছি, সত্যি কথা বলতে আমার বাধে না। আজন্ম তপস্বিনী নই আমরা। ভড়ং করতে করতে প্রাণ বেরিয়ে গেল মেয়েদের। দ্রৌপদী-কুন্তীদের সেজে বসতে হয় সীতাসাবিত্রী।…

পর্দাটা নড়ে উঠল। বিকাশ তাকালেন। ঘরে ঢুকছেন লক্ষ্মী। দুই চোখ সম্মোহিত। এগিয়ে আসছেন। বিকাশের শরীর ঘেঁষে বসে পড়লেন বিছানায়। বললেন— এখনও পড়ছ?

বিকাশ অবাক হয়ে দেখছেন। লক্ষ্মীর এ কী পোশাক! এই শীতেও গায়ে কোনও চাদর নেই। গোলাপি রঙের পাতলা রাতপোশাক, যা লক্ষ্মী আগে কখনও পরেননি। চিরকাল শাড়িতেই দেখতে অভ্যস্ত স্ত্রীকে এরকম পোশাকে দেখে হাঁ হয়ে গেলেন বিকাশ। এসময় এ ঘরে লক্ষ্মীর আসা, এই পোশাক সব দেখে বিকাশের বোধবুদ্ধি গুলিয়ে গেল। কম্বলে নিজেকে ভাল করে ঢেকেঢুকে তিনি প্রশ্ন করলেন— এ সব কী?

লক্ষ্মীর ভাবভঙ্গি, স্বর প্রায় সেইরকম যখন বিকাশ সদ্য বিবাহ করেছেন। তেমনি গলা-গলা, তেমনি গা-ঘেঁষা। তিনি বলছেন— দেখি না, কী পড়ছ!

হাত থেকে কেড়ে নিলেন বইখানা। সেই আগেরই মতো। পড়তে লাগলেন, সেই আগেরই মতো। কিন্তু পড়তে পারলেন না। চশমা নেই চোখে। ‘দুচ্ছাই, কিছুই দেখি না’— বলে বইখানা সরিয়ে রাখলেন পাশে। একটু ঝুঁকে পড়ে, কনুইয়ে শরীরের ভর রেখে, হাতে চিবুক রেখে শুধোলেন— আমায় কেমন দেখাচ্ছে গো?

বিকাশ চোখ থেকে চশমা খুলে পাশ ফিরতে ফিরতে বললেন— চাদর-টাদর গায়ে দাওনি, ঠাণ্ডা লাগবে যে।

লক্ষ্মী নাকে শব্দ করলেন— উঁ উঁ উঁ উঁ।

শব্দটা ঘুরে ঘুরে ঢেউ খেলে গেল। বিকাশকে টেনে নিজের দিকে ফেরাতে ফেরাতে বললেন—আমার শীত লাগছে না।…উচ্চারণ সানুনাসিক হল। আধো আধো হল। টেনে টেনে তিনি কইলেন— দ্যাঁ-কো-না-আ!

বিকাশ পিটপিট করে চাইলেন। লক্ষ্মী হঠাৎ নববিবাহিত বধুটির মতো আচরণ করছেন। তাঁর মগজ শূন্য হয়ে গেল। গল্পগুচ্ছের গল্প উধাও। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প বিছানার কোনায় পড়ে কাঁদছে। আর বিকাশ নির্বোধের মতো কম্বলের তলায় আঁকুপাকু করছেন। তাঁর সামনে একজন অচেনা মহিলা। যিনি বলছেন— আজ আমি এখানে শোব।

লাফিয়ে উঠে বসেছেন বিকাশ। কম্বল-টম্বল ফেলে দিয়েছেন। বলছেন—এখানে? মানে এ ঘরে? মানে এই বিছানায়?

—কেন?

বিকাশ বলতে যাচ্ছিলেন— ছি ছি, ছোট খোকার সামনে একসঙ্গে…বলা হল না। কথাটা গিলে ফেললেন। লক্ষ্মীর নিজের যখন মনে পড়েনি, এ ঘরে ছোটখোকা সর্বক্ষণ জেগে আছে, তখন আর বলে কী হবে! তিনি ছেলের ছবির দিকে তাকালেন। বড় বড় নির্মল দু’টি চোখ ছোটখোকার। দেখলেই মনে হয়, এই স্নান করে, জামায় বোতাম লাগাতে লাগাতে ঘরে ঢুকবে, বলবে— বাবা, এ সংখ্যায় ‘গড়ের মাঠে’ দারুণ একটা ছবি দিয়েছে পতৌদির।…কিংবা বলবে— তুমি কি ‘ম্যাকবেথ’ পড়েছ বাবা?

বিকাশ বলবেন— পড়েছিলাম। বহু আগে। তুই পড়ছিস?

—হ্যাঁ। কিছু মনে নেই তোমার? অনেক জায়গায় বুঝতে পারছি না। বিকাশ মনে করছেন। কতদিন আগেকার পড়া। ছোট ছেলের মুখ দেখছেন। বড়খোকা কখনও এমন প্রশ্ন করে না। বিকাশের খুব কাছাকাছি আসে না সে। তার সব কথা, সব দাবি মায়ের সঙ্গে। খাবারের স্বাদ মনোমতো না হলে চিৎকার করে। কোনও কিছু মনোমতো না হলেই সে চিৎকার করে। তার প্রকাশ খুব জোরাল। কিন্তু ছোটখোকা অন্য রকম। সে শান্ত। সে নীরব। ভাবুকও বলা যায়। সে যাই পড়ে, যাই দেখে, তাই নিয়ে ভাবে। বিকাশের মনে পড়ে যাচ্ছে একটি-দু’টি লাইন—

Whence is that knocking?

How is’t with me, when every noise appals me?

What hands are here? Ha : they pluck out mine eyes :

Will all great Neptune’s ocean wash this blood

Clean from my hand? No : this my hand will rather

Making the green one red.

ছোটখোকা শুনছে। চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তার। বিকাশ বলছেন— বুঝিয়ে দেব তোকে। বলিস কোথায় আটকাচ্ছে!

আর বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন হবে না। কোথায় চলে গেছে ছোটখোকা! নিজের মতো করে বুঝে, নিজের মতো করে ভাল-মন্দ স্থির করে পৃথিবীর বাইরে চলে গেছে। বিকাশের দীর্ঘশ্বাস পড়ে। ছোটখোকা যদি বড়খোকার মতো হত, তা হলে হয়তো বেঁচে থাকত। এ কথা বহুবারই তাঁর মনে হয়েছে। কিন্তু শান্তি পাননি ভেবে। ছোটখোকা তার নিজের মতো ছিল। সেই থাকাটাই তাকে মানায়। এর থেকে একটুও অন্য রকম হলে সে তাঁর ছোটখোকা হত না যেন! ঠিক ঠিক তেমন করে স্বপ্নের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ত না! বিকাশের ইচ্ছে করে পৃথিবীসুদ্ধু লোক ছোটখোকাকে মনে রাখুক। কিন্তু তার মা-ই তাকে ভুলে গেছে কত দ্রুত। গোলাপি ম্যাক্সি পরে আধো আধো কথা বলছে।

বিকাশ ভাবার চেষ্টা করেন— ভুলতে কি আর পারে! মা তো! সব কিছু নিয়ে মেতে আছে। ভোলার চেষ্টা করছে। দুঃখ ভোলার চেষ্টা করাটাই তো জীবন।

বিকাশ জানতে চান— এ ঘরে শুতে চাইছ কেন?

লক্ষ্মী বিকাশের কাঁধে মাথা রাখেন। বলেন— একা একা ভাল লাগছে না।

লক্ষ্মীর মাথা ঠেলে দেন বিকাশ। কম্বল দলা করে হাতে নিয়ে ঘষে ঘষে বিছানা থেকে নামেন। বলেন— এ খাট তো ছোট। অসুবিধে হবে। চলো তোমার ঘরে।

ঘরের আলো নিবিয়ে এগোতে থাকেন দু’জনে। ছেলের বন্ধ দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন লক্ষ্মী। বিকাশ পেছন ফিরে অবাক হয়ে বলেন— কী হল?

—না। কিছু না।

লক্ষ্মী মাথা নিচু করে এগোতে থাকেন। ঘরে এসে স্বামীকে বলেন— কেমন দেখাচ্ছে আমাকে, বললে না?

ঘাড় হেলিয়ে দীর্ঘ মোটা বিনুনি দুই বুকের মাঝখানে এনে ফেলেন তিনি। একসময় এ দৃশ্য বিকাশকে পাগল করে তুলত। কিন্তু আজ বিকাশের চোখে এতটুকু আগুন জ্বলল না। স্ত্রীকে দেখতে দেখতে নিরুত্তেজ গলায় তিনি বললেন— বেশ যুবতী-যুবতী লাগছে।

—আমি এখনও যথেষ্ট যুবতী আছি। সবাই বলে।

বিকাশ কম্বলে শরীর ঢাকেন। তাঁর যথেষ্ট শীত করছে। লক্ষ্মীর কেন করছে না কে জানে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে ক্রিম ঘষছেন এখন। গায়ে সরাসরি আলো পড়েছে। বিকাশ দেখছেন পাতলা ম্যাক্সির নীচে লক্ষ্মীর আবছা শরীর। এ শরীর বিকাশের ছিল। এখন নেই। কবে থেকে নেই? এখন মনেও পড়ে না। পর পর দুটো বাচ্চা সিজার করে হওয়ার পর লক্ষ্মীর কীরকম ধারণা হয়েছিল আরও বাচ্চা এলে তিনি বাঁচবেন না। ডাক্তার যদিও খুব স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে বলেছিলেন তবু আজও লক্ষ্মী কাপড় কাচেন না, ঘর মোছেন না, জলের বালতি তোলেন না। তাঁর পেট, যেখানে তিনি দু’টি শিশুকে অন্তঃস্থ রেখেছিলেন, এখনও এমনভাবে আগলে বেড়ান যেন তাতে আঙুল লাগলেই ফুটো হয়ে ঝরঝর করে জল গড়াতে শুরু করবে মাটির কুঁজোর মতো। বিকাশের প্রথম প্রথম কষ্ট হত। অনেক বুঝিয়েছিলেন লক্ষ্মীকে। কথা দিয়েছিলেন, কন্ডোম ছাড়া চাইবেন না। কিন্তু লক্ষ্মী রাজি হননি। গত বছর থেকে তাঁর ঋতুচক্র স্তব্ধ হয়ে গেছে। বিকাশেরও কোনও কিছুতেই কিছু এসে যায় না। ছোটখোকার মৃত্যু তাঁকে আরও শীতল, আরও নিরুত্তেজ করে দিয়ে গেছে। এতদিন পর, আজ, লক্ষ্মীকে স্বাভাবিক লাগছে না। ক্রিম ঘষা শেষ করে তিনি আলো নিবিয়ে দিচ্ছেন। বিকাশের গা ঘেঁষে শুয়ে পড়েছেন বিছানায়। বিকাশ সরে যাচ্ছেন। অনেকদিন স্ত্রীর সঙ্গে শোওয়া অভ্যাস নেই। অস্বস্তি লাগছে। লক্ষ্মী বিকাশের কম্বলের নীচে ঢুকে পড়েছেন। হাত দিয়ে পা দিয়ে পেঁচিয়ে ধরছেন বিকাশকে। বিকাশের একটি হাত তুলে এনে স্থাপন করছেন স্তনে। বিকাশ পালাতে চাইছেন। সরে যেতে চাইছেন। পারছেন না। বলছেন— কী চাও লক্ষ্মী? কী করছ? ক্লান্ত বিপন্ন তাঁর স্বর।

লক্ষ্মী বলছেন—হয় না? আমাদের? আবার হয় না?

বিকাশের শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে। বলছেন— এতদিন পর…আমার আর হবে না লক্ষ্মী। ছাড়ো। তা ছাড়া ছেলের বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। আর কি এ সব মানায়? আর হয় না।

—কেন হবে না? লক্ষ্মী ফুঁসে উঠছেন।—হবে না কেন? ছেলের বিয়ে দিয়েছি বলে আমাদের কোনও সাধ-আহ্লাদ ইচ্ছে-অনিচ্ছে থাকতে নেই?…তিনি হাতের প্রক্রিয়ায় ভাঙাতে চাইছেন বছর বছর ধরে একটানা জড়িয়ে থাকা শীতঘুম। বালি খুঁড়ছেন। অগাধ বালি খুঁড়ছেন। যথার্থ পাথরটিকে এতকাল পর খুঁজে পাওয়া খুবই শক্ত। কিন্তু লক্ষ্মী উন্মাদ হয়েছেন। নেমে আসছেন ক্রমে। বিকাশের শরীরের ভুলে যাওয়া ঘরে পৌঁছে মর্চে ধরা তালা খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন তিনি। বিকাশ নড়তে পারছেন না। নিজস্ব অসাড়তার সপক্ষে অসম্ভব আত্মবিশ্বাস নিয়ে শুয়ে আছেন। বাধাও দিতে পারছেন। নিজের গোচরে যায় না এমন সেই মানস অন্ধকার হাতড়াচ্ছেন তিনি। লক্ষ্মীর ইচ্ছার কাছে কি তিনি আত্মসমর্পণ করছেন না? ইচ্ছের কাছে আত্মসমর্পণ তখনই ঘটে যখন নিজের ইচ্ছেকে অস্বীকার করেও আসলে স্বীকারই করা হয়। বিকাশ লক্ষ্মীর ঠোঁট ও দাঁতের চাপ অনুভব করলেন। বহুকালের পুরনো প্রক্রিয়াকালীন অভ্যস্ত হাত তুলে লক্ষ্মীর চুল খামচে ধরলেন। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মৃদু কাঁপন অনুভব করলেন। লক্ষ্মী নিজেকে ঘষে ঘষে তুলে আনতে লাগলেন ওপরে। বিকাশ দু’খানি ছড়িয়ে দেওয়া পায়ের মধ্যে প্রবেশ করতে চেয়েও ব্যর্থ হতে লাগলেন বারবার। শুকনো খটখটে ঢালভূমিতে তাঁর সমস্ত প্রয়াস ব্যাহত হতে লাগল। লক্ষ্মী, তীব্রভাবে হিস হিস করে বলতে লাগলেন— যাও। যাও। ড্রেসিংটেবলে ক্রিমের টিউব আছে।

বিকাশ কম্বল ছুঁড়ে ফেলে নেমে দাঁড়ালেন খাট থেকে। নামতে গিয়ে মশারিতে শরীর জড়িয়ে গেল। যত ছাড়াতে চান, জড়িয়ে যায় তত। আঁকড়ে ধরে। ঊর্ধ্বাঙ্গে একখানি গেঞ্জি, নিম্নাঙ্গ খোলা। নকশাল আন্দোলনে মৃত এক পুত্রের কেরানি থেকে আমলা হয়ে ওঠা পিতা বিছানা থেকে নেমে হেঁটে যাচ্ছেন ড্রেসিংটেবিলের দিকে। দীর্ঘকাল পর এক অনাবৃত পদক্ষেপ— একটি ক্রিমের টিউব সংগ্রহের জন্য। একটিও শিশিবোতল না উল্টে তিনি সহজেই সংগ্রহ করেছেন সেই বস্তু। ফিরে আসছেন। উঠে পড়েছেন বিছানায়। ভয়ে ভয়ে আছেন, তাঁর এই এতদিন পরের উত্থান হারিয়ে না যায়। আঙুলে ক্রিম নিয়ে চালনা করতে করতে তাঁর মনে পড়ে যাচ্ছে, বছর দুয়েক হল লক্ষ্মীর নীচের পাটির সব দাঁত তুলে বাঁধানো হয়েছে। শোয়ার সময় লক্ষ্মী সেটি খুলে রাখত। কিন্তু আজ পরে আছে। বিকাশ মনে করতে পারলেন না লক্ষ্মীর আসল দাঁতের চাপও ঠিক এই রকমই ছিল কিনা।

৩৪

ঘুম থেকে উঠে পা ফেলতে কষ্ট হচ্ছে জিনির। সে কি কোনও নতুন জীবন কাল লাভ করল? কাল কি সে প্রথম বধূ হল? প্রথম নারী হল সম্পূর্ণতার অর্থে? পা ফেলতে থাকা এবং প্রত্যেক পদক্ষেপে বেদনা বোধ করতে থাকা তাকে এইসব প্রশ্নের সমাগমে রাখছিল। রেওয়াজ মতো প্রথম দশদিন সকালে শ্বশুরকে প্রণাম করবে সে৷ শাশুড়িকে প্রণাম করবে। কিন্তু সে রক্তাক্ত হয়েছে। নিচু হতে পারছে না। তলপেটে তীব্র ব্যথা। কারওকে বলতে পারছে না। এরকমই কি হয়? এটাই কি স্বাভাবিক? সে জানে না। সে চায়ের কাপ নিয়ে স্বামীকে পৌঁছে দিচ্ছে। দেবাশিস খাটে বসে দু’চুমুক দিয়ে হাতে কাপ নিয়ে পায়ে পায়ে চলে আসছে খাবার টেবিলের দিকে। এবং একবার থমকে দাঁড়িয়েছে লক্ষ্মীর ঘরের কাছে। তার ঘুমমাখা চোখ-মুখ কুঁচকে গেছে। টি-পট থেকে চা ঢালছেন লক্ষ্মী। দেবাশিস প্রশ্ন করছে—বাবা কি কাল তোমার ঘরে ঘুমিয়েছিল?

লক্ষ্মী জবাব দিচ্ছেন—হ্যাঁ, মানে, আমার একলা শুতে ভয়-ভয় করে বাপু। তোর তো এখন বউ এসে গেছে।

জিনির মাথা নিচু হয়ে আছে। সে মুখ তুলতে পারছে না। চায়ের কাপ মুখের কাছে আনতে পারছে না। ভাবছে, এ সব বলা যায়? হয়তো যায়। হয়তো এটাই মহানাগরিক জীবনযাত্রার পদ্ধতি। তার তবু কান গরম হয়ে যাচ্ছে। ভেতরে বাজছে—‘তোর তো বউ এসে গেছে।’ দু’খানি সরল চোখ তুলে সে প্রশ্ন করছে— তুমি মা’র কাছে ঘুমোতে বুঝি এতদিন?

লক্ষ্মী জবাব দিচ্ছেন— আমাকে ছাড়া ঘুমই হত না বড়খোকার।

বড়খোকা পেছন দিক থেকে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরছে। গালে গাল রাখছে। লক্ষ্মী মুখ ঘুরিয়ে চুমু খাচ্ছেন ছেলেকে। বলছেন— যাও। বাথরুমে যাও।

জিনি দেখছে। তাকে শেখানো হয়েছিল, ছেলে বড় হলে মা’র আর তাকে জড়িয়ে ধরতে নেই। মেয়ে বড় হলে বাবার কোলে বসতে নেই। ভাই বড় হলে বোনের সঙ্গে শুতে নেই। তার মনে পড়ে না সে শেষ কবে বাবার গলা জড়িয়ে ধরেছিল। তার কোনও দাদার যখন মাথা ব্যথা করে তখন মা তাকে কোলের কাছে শুইয়ে কপালে পুরনো ঘি মালিশ করে দেন। বড়দা মাঝে মাঝে জিনিকে দিয়ে চুল ঘাঁটিয়ে নিতেন বটে! জিনি বড়দার চুলগুলো মুঠোয় ধরে খুব করে টেনে দিত। কিন্তু ওই পর্যন্ত। বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন মায়ের সঙ্গে একঘরে এক বিছানাতেই শুতেন। বড়দাদা, বড়বউদি, মেজদাদা মেজবউদি, সকলেই জিনিদের বাড়িতে এমনই করে থাকেন। এ নিয়ে যে কোনও কথা তৈরি হতে পারে, এর যে কোনও ব্যতিক্রম হতে পারে, তার কোনও ধারণাই জিনির ছিল না।

—চা শেষ হল? লক্ষ্মী জিজ্ঞেস করছেন জিনিকে।

—হ্যাঁ, এই শেষ হল মা। জিনি উত্তর দিচ্ছে। মনে মনে একটু দিশেহারা। সে জানে না ঠিক কীভাবে শ্বশুরবাড়ির দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাদের বাড়িতে তার মায়ের সঙ্গে বউদিদের দ্বন্দ্ব নেই। কারণ মা, তাঁর ছেলেমেয়েদের মতোই, বউমাদের ত্রুটিগুলিকে বুক দিয়ে আড়াল করে বেড়ান। জিনিকে, বিবাহের জন্য, আগরতলা থেকে কলকাতায় পাঠানো হচ্ছিল যখন, সারা পরিবার নানা জিনিসপত্র গোছগাছ করছিল, কারণ এ পক্ষে বলা হয়েছিল ত্রিপুরা গিয়ে বিবাহ করে আসা সম্ভব নয়। জিনির মা সারাক্ষণ জিনিকে শিখিয়েছিলেন, তাকে বলা হয়েছিল, যেন, শ্বশুরগৃহে থাকায় সময় কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে পড়া জীবনযাপন মনে না রাখা হয়। যেন-বা, শ্বশুরবাড়ি নিজেরই বাড়ি, এমনই ভাবে সে প্রথমদিন থেকে। শ্বশুর বা শাশুড়ির কথা, যদি তা শাসন হয় যেন, আলাদা করে না দেখে মা-বাবার থেকে। প্রথম প্রথম সহ্য করতে হয়। সে যেন সয়। সইলেই সে একমাত্র রয়ে যেতে পারে সর্বাঙ্গীণ। এবং সে যেন তার ব্যবহারে আচারে এমনই সৌজন্যনিষ্ঠ থাকে যাতে তার বিরুদ্ধে কারও কিছু বলার বিষয় না জন্মায়।

জিনি তার এই কলকাতায় কলেজে পড়া জীবন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন সম্পাদন করত দূরসম্পর্কীয়া এক পিসির বাড়িতে থেকে, যিনি খুবই কড়া ধাঁচের ছিলেন, বিশেষ করে জিনির ক্ষেত্রে। এ কারণেই যে জিনি খুব সরল সাদাসিধে মেয়েটা, এই বিপুল কলকাতা শহরে এসেছে, সে কোনও ভুল করে ফেলতে পারে। আর তিনি নিজে একাই মেয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন, এ সম্পর্কে তাঁর সাবধানতা ও সতর্কতার শেষ ছিল না। জিনির দ্বারা কোনও ভুল করা সম্ভব ছিল কিনা এ কথা পিসি ভেবে দেখেছেন বহুবার এবং এই প্রত্যয় পেয়েছেন যে নয়, সম্ভব নয়, তবু ভুলেও ভুল করার কোনও অবকাশ তিনি রাখতে চাননি। জিনি শিখেছে, মানতে হয়, বাবা যা বলেন, মা যা বলেন, দাদারা যা বলেন। জিনি স্কুলে মাস্টারমশাইদের মেনেছে। কলেজে অধ্যাপকদের মেনেছে। পিসিকেও মেনেছে। পিসি তাঁর একলা অধ্যাপিকা জীবনে জিনিকে নিয়ে নিশ্চিন্তই ছিলেন আবার নিশ্চিন্ত ছিলেন বলেই তাঁর ভাবনারও শেষ ছিল না। কেন-না নিশ্চিন্ত জীবন বজায় রাখা খুবই অনিশ্চিত। ভাবনা ছিল, জিনির এই ভাল থাকা, শিষ্ট থাকা যদি বজায় না থাকে! কিন্তু জিনিকে খারাপ হতে হয়নি। অশিষ্ট হতে হয়নি। অমান্য করতে হয়নি কারওকে। তার মেনে নেবার শিক্ষা থেকে কোনও আঘাত নেমে আসেনি তার জীবনে, ফলে এই শিক্ষা সে সহজভাবে নিয়েছে। কিন্তু এখানে এসে তার এতদিনের শিক্ষা থেকে জন্ম নেওয়া ভাবনা রুচিবোধ যখনই এতটুকু অমিল পাচ্ছে তখনই সংঘর্ষের ভয়ে তার ভেতরটা কেঁপে উঠছে। ‘চা শেষ হল?’ শাশুড়ির এই প্রশ্নে, প্রশ্নের চেয়ে বড় কিছু যেন আছে। যেন কোনও অনুযোগ। যেন সকালে এই চা-পানে এতখানি সময় নেওয়া ঠিক নয়। সে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠছে। ‘হ্যাঁ। এই শেষ হল বলে।’

লক্ষ্মী বলছেন—কাল যা ঠাণ্ডা পড়েছিল!

জিনি চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে বলল— হুঁ!

লক্ষ্মী বললেন— আমি তো তোমার শ্বশুরের কম্বলের তলায় ঢুকে গুটিসুটি হয়ে পড়েছিলাম।

জিনি কোনওমতে ঢোঁক গিলে বলল— ওঃ!

সে মনে মনেও ভাবতে সাহস করল না, তার শাশুড়ি গুটিসুটি মেরে শ্বশুরের কম্বলের তলায় ঢুকছেন। বরং সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। লক্ষ্মী বললেন—তুমি এক কাজ করো। স্নান করে পূজার ঘরটা পরিষ্কার করো তো যাও।

জিনি মাথা নিচু করছে। কী বলবে বুঝতে পারছে না। কোনও ভাবে বলার চেষ্টা করছে— আমার… আমার….

—শরীর খারাপ হয়ে গেছে?

লক্ষ্মী বাক্য যুগিয়ে দিচ্ছেন। তাঁর স্বর চড়ছে। নববিবাহিতা বধূটিকে ধমকাচ্ছেন তিনি— আগে বলেনি কেন? অ্যাঁ? আমার চায়ের পট ছুঁয়ে দিলে? আজ বৃহস্পতিবার, লক্ষ্মীর পূজা করব আমি। কাল সন্তোষী মা’র ঘট বসাব। পরশু যাব শনিমন্দিরের পুজো দিতে। রবিবারে, হ্যাঁ, রবিবারে ইতুর ঘট বসবে। তুমি সব ছুঁয়ে দিলে? ছি ছি ছি।

জিনির মাথা বুকের ওপর নেমে এসেছে। নখ খুঁটছে সে। চোখে জল আসছে তার। সে কেমন করে জানবে ঘুম থেকে উঠেই তাঁকে ঋতু হওয়ার কথা জানাতে হবে! কেমন করেই বা জানাবে সে? এ কি বলা যায়? তার এ সব অভ্যেস নেই। ওই ছিছিক্কার তার পিঠে একশো চাবুক হয়ে পড়ছে এখন। তার কান্না পাচ্ছে। এত জোরে কেন বলছেন শাশুড়ি? ইস্! কী লজ্জা! পাশের ঘর থেকে শ্বশুর শুনতে পেয়েছেন নিশ্চয়ই। এ সবের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। তার দু’চোখ থেকে গাল বেয়ে জল পড়ছে। লক্ষ্মী দেখতে পাচ্ছেন। বলছেন—কান্নার কী হল? তোমাকে এমন কিছু বলিনি যাতে কাঁদতে হবে! তখনই জানতাম বাপু। তিন ছেলের পর এক মেয়ে আদুরে হবে। তখনই বলেছিলাম।

জিনি চলে যাচ্ছে ঘরে। মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতির মুখোমুখি কেমন করে হতে হয় তাকে কেউ শিখিয়ে দেয়নি। সে তাই কাঁদছে। নিরুপায় হয়ে কাঁদছে। শুনতে পাচ্ছে, লক্ষ্মী বলছেন—কী মেয়েরে বাবা, দু’টো কথা বললাম কি না বললাম, কাঁদতে শুরু করল!

তিনি জিনির ঘরের দিকে আসছেন। পেছন পেছন দেবাশিস। জিনি জানালাগুলো খুলে দিচ্ছে, পর্দা টেনেটুনে ঠিক করছে। আর চোখ মুছছে। পাশের বাড়ি থেকে সেতারের শব্দ আসছে। সে নিজেকে অন্যমনস্ক রাখার চেষ্টা করছে। ভাবছে, তার স্টিরিওতে একটা রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড চাপিয়ে দেবে কি না। এই সকালে, এই মন খারাপের মধ্যে একটু রবীন্দ্রসংগীত শুনতে তার খুবই ইচ্ছা করছে। তা হয়তো তার গ্লানি ধুয়ে দিতে পারে। সে হয়তো শান্তভাবে জেনে নিতে পারে আর কোন কোন কাজ তার করা উচিত নয়। কতখানি ছোঁয়া তাকে বাঁচিয়ে চলতে হবে! তখন লক্ষ্মী প্রবেশ করছেন ঘরে। দেখছেন। বলছেন— এই ক’দিন জামাকাপড় আলাদা তারে শুকোতে দেবে। পাঁচদিন হয়ে গেলে যা যা ব্যবহার করেছ তার সব সাবান-কাচা করবে। বালিশের ওয়াড়, বিছানার চাদর, মশারি— সব। আর পাঁচদিন তো থাকছই না। তাহলে তিনদিন পেরুলেই সব করে নেবে। নিজে কাচতে যেয়ো না। লোকে বলবে, নতুন বউকে খাটিয়ে নিচ্ছি। অন্ধর মাকে বোলো, কেচে দেবে। সেইদিন আর আমাদের কিছু দেব না।

জিনি শুনছে। কোনও উত্তর করছে না। কীই-বা বলবে। সে ঘাড় কাত করছে। লক্ষ্মী গজ গজ করতে করতে বেরুচ্ছেন—বড় দেমাকি বাপু!…বিকাশ দেখছেন, শুনছেন, কোনও কথা বলছেন না। খুব অলস লাগছে তাঁর। ছেলের বিয়ের জন্য ছুটি নিয়েছিলেন। আজ যোগ দেবার কথা ছিল। কিন্তু সে-ভাবনা ছেড়ে দিয়েছেন। এতদিন পর কাল শরীর জেগে উঠেছিল। বিকাশকে ক্লান্ত করে দিয়েছে। বিকাশ ভাবছেন, কথায় বলে, অনভ্যাসে কপালে চন্দন চটচট করে। তাঁর সেই অবস্থা।

লক্ষ্মীরও আজ স্কুলে যাবার কথা। এই ক’দিন তিনি যাননি। মালতীদির ওপর স্কুল চালাবার ভার আছে। কিন্তু বিকাশ অফিসে যাবেন না শুনে লক্ষ্মীরও আর যেতে মন লাগছে না। ভাবছেন, বহুদিন পরে শীতের দুপুরটা স্বামীর সঙ্গে শুয়ে কাটাবেন।

দেবাশিস জিনিকে বলছে—কী এমন বলেছে মা তোমাকে যে তুমি কেঁদে-কেটে ভাসিয়ে দিলে?

জিনি কথা বলছে না। স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। এই তবে নিয়ম! এই তবে শ্বশুরবাড়ি! ঋতুচক্রকে এখানে তবে এমনই অশুচি ধরা হয়! তাদের বাড়িতে দুই বউদি আর সে তিনজনে পালা করে হত। সারা মাসে কেউ না কেউ ঋতুতে আছে। কিন্তু সেখানে এত অশুচি ছিল না। সে ভাবছে, সে হেঁটে-চলে বেড়াবে এই গৃহে। তাতে চেয়ার-টেবিল আলমারি অশুচি হবে না? যে-মেঝেতে ঠাকুরের আসন সেই মেঝেতে সেও দাঁড়িয়ে, তাতে আসন অশুদ্ধ হবে না? অন্যান্য ঘরের পর্দাগুলো যে তার গায়ে লাগবে, আর দেবাশিস যে তাকে ছুঁয়ে সেই শরীরে মা’র গলা জড়িয়ে ধরবে তাতে অশৌচ ঘটবে না? ওই যে অন্ধর মা, ওরও তো হয়, মহিলা যখন, ও কি এসে বলে—মা আমি কিন্তু হইসি!

রাগ হতে থাকে জিনির। অপমানিত লাগতে থাকে। নিজেকে শান্ত করার জন্য চোখ বন্ধ করে সে। আর বন্ধ চোখের তলায় মায়ের মুখ দেখতে পায়। এই প্রথম, মায়ের বাক্য অমান্য করছে জিনি। এই প্রথম তার শিক্ষাপ্রাপ্ত সত্যের সঙ্গে উপলব্ধিগত সত্য মিলছে না। সে মনে মনে বলছে—আমি ওঁকে মা বলে ভাবতে পারব না। কিছুতেই পারব না। আমায় তুমি ভাবতে বোলো না মা। আবার তার কান্না পাচ্ছে। দেবাশিস পাশে খবরের কাগজের ওপর উপুড় হয়ে পড়েছে। সে দেখছে। ছ’মাসে বামফ্রন্ট সরকার কিছুই করে উঠতে পারেনি এই রাজ্যের ভালর জন্য—এ কথা বিস্তরভাবে লিখেছে কাগজটি। জিনির খবরের কাগজ পড়ার অভ্যাস আছে। কিন্তু এখন পড়তে ইচ্ছে করছে না। তখন, অন্ধর মা জিনিকে ডাকছে—বউদি, আসেন, মায় সানে গ্যাসেন। আমি ময়দা মাখসি। বেইলা দেই। আপনে লুচিগুলা ভাজেন।

কাজ পেয়ে বেঁচে যাচ্ছে জিনি৷ বলছে—যাও। যাচ্ছি। সে বিছানা থেকে নামছে। দেবাশিস আঁচল টেনে ধরছে। আঙুল দিয়ে গাল দেখিয়ে ইশারা করছে। জিনি পারছে না। তার ইচ্ছে করছে না। সে জোর করে আঁচল ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে রান্নাঘরের দিকে।

দেবাশিস জিনির চলে যাওয়া দেখছে। নিজেকে অবান্তর লাগছে তার। অক্ষম লাগছে। জিনি, তার বউ, তাকে যেন ধরা যাচ্ছে না কিছুতেই। কিংবা, ধরা দিচ্ছে না মেয়েটা। দেবাশিস অফিসে শঙ্করদাদের কাছে নতুন দাম্পত্য বিষয়ে যেমন শুনেছে তার সঙ্গে মিলছে না কিছুই। তার দিশেহারা লাগছে, বা অসহায়। এবং এইসব রাগ, ক্ষোভ ও ক্ষীণ সন্দেহ জন্ম দিচ্ছে। ও কি ভালবাসত আর কারওকে? ভালবাসে? যে-মনে খারাপ ভাবনা আসে সে-মন আপন কষ্ট পায়। দেবাশিসও কষ্ট পেতে থাকছে।

সাড়ে ন’টার সময় স্কুল থেকে ছুটতে ছুটতে এল শেফালির মা। লক্ষ্মী স্নান করে পুজো-পার্বণ সেরে সবে দু’টো লুচি মুখে পুরেছেন তখন। বিকাশ গল্পগুচ্ছ নিয়ে চলে গিয়েছেন তাঁর নিজের ঘরে, যেটা আসলে দেবার্চনের ঘর। দেবাশিস টিভিতে খেলা ধরার চেষ্টা করছে। টিভিটা বিয়েতে যৌতুক পেয়েছে সে। শেফালির মা হাঁফাতে হাঁফাতে বলছে—আর ট্যাকন যায় না। পোলাপান লইয়া গার্জিয়ান সব যাইতাসে গিয়া। আপনে একবার চলেন।

শেফালির মাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন লক্ষ্মী। বৃত্তান্ত বোঝার চেষ্টা করছেন। তখন স্কুল থেকে ছায়াদি এলেন ঘরে। দশটায় স্কুল শুরু হয়। টিচাররা আধঘণ্টা-পনেরো মিনিট আগে এসে পড়েন। শেফালির মাকে থামিয়ে দিয়ে ঘটনাটি বলার চেষ্টা করছেন ছায়াদি। দু’দিন ধরেই গন্ধটা টের পাওয়া যাচ্ছিল। থেকে থেকে উঠছিল, আবার হারিয়ে যাচ্ছিল। কাছাকাছি কুকুর বেড়াল মরে পড়ে থাকলে যেমন হয়। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কোনও কুকুর-বেড়াল কেন, একটা মরা ইঁদুরও পাওয়া যায়নি। প্রচুর ফিনাইল ছড়ানো হয়েছে চারপাশে। তবু গন্ধ উঠছিল। আজ গন্ধে আর টেকা যাচ্ছে না। মালতীদি, স্বপ্নাদি এসেই একবার করে বমি করেছেন। গার্জিয়ানরা বাচ্চাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এমন অস্বস্তিকর গন্ধ যে সত্যিই আর কিছুতেই স্কুলে থাকা যাচ্ছে না। আশেপাশের বাড়িগুলিতেও একই অবস্থা। তারা সকলেই স্কুলের দিকে আঙুল তুলছে। কী হল! কী হল! ছায়াদির উত্তেজিত স্বর শুনে বিকাশ আর দেবাশিস এসেছেন ঘর ছেড়ে। লক্ষ্মী কোনওমতে তিনখানা লুচি শেষ করেছেন। উঠছেন। তাঁকে যেতেই হবে এবার। তিনি বলছেন—আগে জানাওনি কেন? ছায়াদি মাথা নাড়ছেন। বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম দূর থেকে গন্ধ আসছে। চলে যাবে।

লক্ষ্মী কাপড় বদলাচ্ছেন। বিকাশ ও দেবাশিস সঙ্গে যাবে কিনা প্রশ্ন করছেন। লক্ষ্মী বলছেন—দরকার নেই। প্রয়োজন হলে ডেকে পাঠাব।

সকলে মিলে চলে যাচ্ছেন স্কুলের দিকে। স্কুল পর্যন্ত যেতে হল না, তার আগেই গন্ধ পেলেন লক্ষ্মী, সদ্য পুজো করে খেয়েছেন। ধূপ-ধুনোর গন্ধের পর, লুচি তরকারির গন্ধের পর এই গন্ধে তাঁরও গা ঘুলিয়ে উঠছে। তীব্র পচা গন্ধ। স্কুলে না ঢুকে আশেপাশে ঘুরে দেখছেন তিনি। এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে নানা মুখ উঁকি দিচ্ছে, যেন এই গন্ধ তৈরি হওয়ার জন্য এই স্কুলই দায়ী। স্কুলটা যখন হয় তখন অনেকের যেমন সমর্থন ছিল, অনেকের আপত্তিও ছিল। আপত্তি যাদের ছিল তারা এখনও মুখিয়ে আছে।

কোথাও কিছু খুঁজে পেলেন না লক্ষ্মী নিজেও। তিনি স্কুলে ঢুকলেন। কয়েকজন অভিভাবক তখনও বাচ্চা নিয়ে বসে আছেন। এত খারাপ গন্ধ সত্যি সহ্য করা যায় না। তিনি নিজের চেয়ারে বসে কপালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগলেন। কী হতে পারে! কোথা থেকে এ গন্ধ আসতে পারে! হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো দীপনের কথা মনে পড়ল তাঁর। ইস্! এতক্ষণ এ কথা মনে হয়নি! দিদিমণিদের ডেকে খুব উত্তেজিতভাবে লক্ষ্মী বললেন—চলো তো, একবার ওপরে চলো তো!

খুব শান্ত মুখে দরজা খুলে দিল দীপন। সে মাছ কুটছিল। হাতে মাছের আঁশ লেগে আছে। তার পেছন থেকে ভলকে ভলকে আছড়ে পড়ছে পচা বিকৃত জটিল গন্ধ। দিদিমণিরা নাকে আঁচল-চাপা দিচ্ছেন। দু’-চারজন অভিভাবকও এসে দাঁড়িয়েছেন পিছনে। লক্ষ্মী ভাবছেন, দীপন ঠিক আছে। তাহলে গন্ধ কীসের! মাসিমা কোথায়? তিনি জিজ্ঞেস করছেন—মাসিমা কোথায়?

দীপন বলছে—মা ঘুমোচ্ছ। শরীরটা ভাল নেই তো!

—ঘরে এ গন্ধ কীসের?

—গন্ধ! কী গন্ধ!

আশ্চর্য! লোকটা গন্ধ পাচ্ছে না? এই তীব্র গন্ধ পাচ্ছে না? লক্ষ্মীর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সতর্ক হল। কিছু একটা ঘটেছে। খারাপ কিছু। তিনি বললেন—মাসিমা কোথায়? দেখতে যাব।

দীপন দরজা ছেড়ে সরে যাচ্ছে। সহজ স্বাভাবিক মুখ—যান। ও ঘরে।

মাসিমার ঘর চেনা আছে লক্ষ্মীর। কতদিনই তো এসেছেন ওপরে। তিনি সটান চলে যাচ্ছেন সে-ঘরে। সঙ্গে অন্য দিদিমণিরা। অভিভাবকরা এগোতে সাহস করছেন না এখনও। সকলের নাকে রুমাল চাপা। রুমাল না হলেও হাত চাপা। মাসিমার ঘরের দরজা ভেজানো। গন্ধের উৎস যে ও ঘরেই, এ সম্পর্কে কারও আর কোনও সন্দেহ নেই। লক্ষ্মী দরজা ঠেলছেন। জানালাগুলো বন্ধ। পর্দা ফেলা। ঘরে আলো নেই। আধো আলো আধো অন্ধকারে বিছানার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠছেন লক্ষ্মী—ও মা গো! ও মা!…নিজের অজান্তে সুইচবোর্ডের দিকে হাত চলে গেছে তাঁর। দরজার পাশেই সুইচবোর্ডের সব সুইচ জ্বেলে দিচ্ছেন তিনি। চিড়িক চিড়িক শব্দ করে দু’বারের চেষ্টায় জ্বলে উঠছে টিউব। লক্ষ্মী দেখছেন। অন্যরা দেখছেন—বিছানায় চিৎ হয়ে আছে মাসিমার দেহ। গায়ে কম্বল চাপা দেওয়া। সারা শরীর পচে ফুলে উঠেছে। সবচেয়ে বেশি ফুলে উঠেছে স্তন দু’টি। ফোলা উঁচু হয়ে থাকা পেটকেও ছাপিয়ে গেছে। অমন টকটকে রঙের মাসিমা ছাইবর্ণ হয়ে গেছেন। চোখ দু’টি খেয়ে নিয়েছে পিঁপড়েরা। দু’খানি গর্তের মধ্যে জেগে আছে কালচে মাংস। উৎকট গন্ধে ঘরের বাতাস ভারী। তারই মধ্যে চোখে পড়ছে মাসিমার মাথার কাছে টেবিলে সারসার খাবার ভর্তি প্লেট। কোনওটায় রুটি, কোনওটায় ভাত, সঙ্গে তরকারি, মাছ। গ্লাস ভর্তি জল। ইঁদুরে আরশোলায় সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। একটি প্লেটে তাজা দু’টি টোস্ট, সকালবেলায় দীপন খেতে দিয়েছিল মাকে। রোজই দিয়েছে এই ক’দিন। যদি মা’র খিদে পায়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *