২৫. গণেশকন্যা সন্তোষী

২৫

গণেশকন্যা সন্তোষী। পিতারই মতো তিনিও সিদ্ধিদাত্রী। করুণাময়ী। যোগাসনে বসে দুঃখজর্জর মানুষের প্রার্থনা পূরণের চেষ্টা করছেন অহরহ। চার হাতে আর কত সামলানো যায়! তবু একহাতে তরবারি ধরে অমঙ্গল ধ্বংস করছেন তিনি। অন্য হাতে ত্রিশূল নিয়ে অশুভকে বধ করছেন। তৃতীয় হাতে অকাতরে বিলোচ্ছেন অন্ন-পানীয়। চতুর্থ হাতে বরাভয়। হে কাতর মানুষ, হে কষ্টজর্জর মানুষ, হে বেদনাভারে ক্লান্ত ক্লিষ্ট মানুষ— তোমরা ভয় পেয়ো না। আমি আছি। আমাকে দেখো। চোখ মেলো। আমার দিকে তাকাও। আমিই ভবানী। আমিই অন্নপূর্ণা। আমিই পরমাপ্রকৃতি আদ্যাশক্তি, আমিই লক্ষ্মী-সরস্বতী দুর্গা, কালী, আমিই নারায়ণী, ব্রাহ্মণী, শিবানী। আমাকে ভক্তিভরে ভালবাসো। নিষ্ঠাভরে আমাকে পূজা কর। আমি তোমাদের কল্যাণ সরবরাহ করব।

আজ এই মহাশুক্রবার। মহাপুণ্যের দিন। ঘরে ঘরে মেয়েরা সন্তোষী মা’র পূজা অয়োজন করেছে। মঙ্গলচণ্ডী পূজার মতো, ইতু পুজার মতো, সন্তোষী মা’র পূজাতেও কোনও ঘটা নেই। স্নান করে শুদ্ধ কাপড় পরে মেয়েরা ধূপ-দীপ জ্বেলে দিয়েছেন। ঘটের ওপরে দেবীর চন্দন ও সিঁদুরচৰ্চিত ফটোগ্রাফ। যে যে নারী পূজার আয়োজন করেছে তারা বসেছে ঘটের কাছাকাছি। অন্যরা একপাশে চোখে-মুখে ভক্তি ও বিশ্বাস মেখে বসে আছে। তুলসীর ঘরে হরিচরণ ও তার পাঁচ ছেলে হাতে ছোলা-গুড় নিয়ে বসে আছে। বিকাশের বাড়িতে লক্ষ্মী একা। ছেলে স্নান সেরে এসে একবার বসবে। কিন্তু নকশাল পুত্রের পিতা বিকাশ কোন মুখে সন্তোষী মা’র কাছে প্রণত হবেন? মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকলেও প্রকাশ করার সাধ্য নেই। যদিও ওই প্রসাদ তিনি গ্রহণ করবেন এবং সারাদিন একটুও টক যাতে না খেয়ে ফেলেন তার জন্য সতর্ক থাকবেন।

প্রচুর ফল প্রসাদ দিয়েছেন লক্ষ্মী। এত ফল তুলসী বা অন্ধর মা’র আয়োজনে নেই। তবু তুলসী একটি পাকা পেঁপে ডুমো ডুমো করে কেটে দিয়েছে। নারকোল কুরিয়ে থালায় ভর্তি করে দিয়েছে। কিন্তু অন্ধর মা’র আয়োজনে শুধু গুড় আর ছোলা। ফুল, গুড়, ছোলা আর ধূপকাঠি কিনতেই তাকে সাতবার ভাবতে হয়েছে কোন খরচ তাকে কমাতে হবে। সামান্য এই পূজার আয়োজনটুকু ঘিরে হাতে ছোলা-গুড় নিয়ে বসে আছে অন্ধ আর তার ঠাকুরমা। মা সন্তোষী মা’র পূজা করছে খবর পেয়ে মেজ মেয়ে মালতী ঘোষপাড়া থেকে চলে এসেছে। এসে অবধি অন্ধর মা’র কাছে ঘ্যান ঘ্যান করছে—একটাও ভাল শাড়ি নেই আমার। তোমাকে বাবুদের বাড়ি থেকে নববর্ষে কিছু দেয়নি মা?

অন্ধর মা’র একটা নিজস্ব নাম আছে, সুমিত্রা, অন্ধ জন্মাবার পর সে-নাম সবাই ভুলে গেছে। এমনকী তার নিজেরও আজকাল মনে পড়ে না। শুধু যখন সে বাবুদের দেওয়া নতুন শাড়ি, জামা পরে তখনই তার মনে হয় তার নাম সুমিত্রা। নিজেকে ভাল লাগে তখন। এই বাঁশের চাঁচের ঘরে, এই ফুটো হয়ে যাওয়া টিন, রুগ্ন স্বামী ও অভাবের সংসারে থেকেও তখন খুব যত্নে গোল করে একটি সিঁদুরের টিপ পরে সে। কিন্তু এমনটি খুব বেশি ঘটতে পায় না। পালা-পার্বণে নতুন শাড়ি পাবার সম্ভাবনা থাকলেই কোনও না কোনও মেয়ে এসে হাজির হয় এবং অন্ধর মা’র নতুন শাড়িটি না নিয়ে ছাড়ে না। কখনও তার শাশুড়ি আপত্তি করে—তগো লুভের শ্যাষ নাই? অ্যাঁ? মায় মুখে রক্ত তুইল্যা খাটে। খাইয়া না-খাইয়া তগো বিয়া দিসে। অহনও তগো মায় কী পাইল হাতান লাগে?

মেয়েরা দাঁত খিঁচিয়ে চ্যাঁচায়— চুপ কর বুড়ি। আধুনিক শহুরে ভাষা ও সাজগোজে তারা বেশ চৌখস। বুড়ির এই অনুযোগকে তারা উড়িয়ে দিতে চায় কিন্তু পারেও না সব সময়। না পারার ঝাল মিটিয়ে নেওয়ার জন্য মায়ের নতুন শাড়ি পরে সিনেমা দেখে আসে। বাজার ঘোরে। দু’-চারদিন এমনই চলতে থাকে। নতুন শাড়ির জৌলুস কমে গেলে তারা যে যার বাড়ি ফিরে যায়।

স্বামীর জন্য এবং পূজার জন্য অন্ধর মা আজ উদাসী হয়ে আছে। মেয়ের প্রশ্নের জবাব দেয়নি তেমন। একখানা ছাপা শাড়ি সে সত্যিই পেয়েছে পালবাবুর গিন্নির কাছ থেকে। কিন্তু মেয়েকে তা জানাচ্ছে না। জানালে নিয়ে নেবে। ভাবলে এর মধ্যেও একটু মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে অন্ধর মা’র। তারপরই নিরাসক্ত হয়ে ভাবছে—‘নিক গিয়া। আমারৈ তো মাইয়া।’ এ সব ভেবে সে ব্রতকথা শুরু করছে। তার পুরোহিত ডাকার ক্ষমতা নেই। পড়তেও সে জানে না। শুনে শুনে ব্রতকথা মুখস্থ করেছে। যেমন করেছে তুলসী। কিন্তু হেড দিদিমণি লক্ষ্মী পুরোহিত ডেকেছেন। তিনি পূজা, জল, আসন, ফুল সব শুদ্ধ করছেন। তুলসী আর অন্ধর মা এই শুদ্ধাচার জানে না। তারা ব্রতকথা বলছে। অন্যরা শুনছে।

… … মা হলে কি হয়, দেখো, ছোট ছেলেটা আর সব ছেলের মতো রোজগেরে নয় বলে পাতকুড়নো খাবার দিচ্ছে। আহা! বউটারও কত কষ্ট! রোজগার করবে বলে স্বামী বিদেশে চলে গেল। আর শাশুড়ি ও অন্য জায়েরা মিলে তাকে দিয়ে সব কাজ করাতে লাগল। সে বনে যায়। কাঠ আনে। রাঁধে। বাসন মাজে। ঘর গুছোয়। অন্য সকলের সেবা করে। তার শরীর শুকিয়ে গেল। হাড় কালি হল। চোখ গর্তে বসে গেল। সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী সাবিত্রী এক কঙ্কালরমণী হয়ে গেল৷ সন্তোষী মা এই সব প্রত্যক্ষ করলেন। দুঃখীর ত্রাতা, অসহায়ের উদ্ধার, সাবিত্রীকে এমন পথে চালিত করে দিলেন যে সে একটি মন্দিরের সন্ধান পেল। সেখানে সন্তোষী মা অধিষ্ঠান করছিলেন। সাবিত্রী জিজ্ঞেস করল— তোমরা এ কার আরাধনা করছ?

—সন্তোষী মাতার। এটা সন্তোষী মাতার মন্দির। প্রতি শুক্রবারে সন্তোষী মাতার পূজা দিতে হয়।

—এই দেবীর পূজা করলে কী হয়?

—অপুত্রের পুত্র হয়। অজ্ঞানের জ্ঞান হয়। নির্ধনের ধন হয়। আর যার যা মনস্কামনা—সব পূর্ণ হয়।

—দেবীকে কী দিয়ে পূজা করতে হয়?

—শুধু ভালবাসা আর ভক্তি দিয়ে।

—আমি কি এই ব্রত পালন করতে পারি না?

—কেন নয়? তুমি কি উপবাসে আছ?

—হ্যাঁ।

—বেশ। তুমি তাহলে হাতে ছোলা গুড় নিয়ে বসে ভক্তিভরে দেবীকে প্রণাম করো। তাঁর কথা মন দিয়ে শোনো। প্রতি শুক্রবার এমনি করে পূজা করতে থাকো। মা তোমার মনোবাসনা পূর্ণ করবেন। যে-দিন তোমার প্রার্থনা পূর্ণ হবে সেদিন সাধ্যমতো দেবীকে নিরামিষ ভোগ দেবে। ব্রাহ্মণ ও বালকভোজন করে ব্রত উদযাপন করবে। সধবাদের তেল-সিঁদুর, পান-সুপুরি আর বাতাসা দিয়ে নমস্কার করবে। কিন্তু মনে রেখো, টক খাবে না। কারওকে খাওয়াবে না।

হ্যাঁ। সাবিত্রী ভক্তিভরে সমস্ত ব্রতপালন করেছিল। তার স্বামীর ধনলাভ ঘটেছিল। তাদের মিলনও সম্পন্ন হয়েছিল দেবীর আশীর্বাদে। এই আশীর্বাদ ছিনিয়ে নেবার জন্য চক্রান্ত কম হল না। জায়েরা তাদের ছেলেদের শিখিয়ে দিল— খাবার সময় টক চাইবি। না দিলে চিৎকার করবি। পয়সা চাইবি। ওই পয়সা দিয়ে পরে টক কিনে খাবি। বুঝলি?

জায়েদের ষড়যন্ত্রে সাবিত্রী আবার দুর্বিপাকে পড়ল। কিন্তু ভক্তির চেয়ে বিশ্বাসের চেয়ে বড় কিছু নেই। সাবিত্রীর অটল ভক্তি ও বিশ্বাস সব ষড়যন্ত্র অতিক্রম করে গেল। সে স্বামী পুত্র নিয়ে ধনে-জনে শান্তিতে সুখে ঘর করতে লাগল।

ব্রতকথা শেষ হল। স্থির বিশ্বাস ও সহায়তার বাণীতে সকলে আপ্লুত হয়ে রইল। মনে মনে সকলেই সংকল্প করল, হ্যাঁ, সন্তোষী মাতা দেবতার মতো দেবতা বটেন। তিনি নির্ধনকে ধন দেন। অপুত্রককে পুত্র দেন। দুঃখীর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন, অতএব তাঁর পূজা করতে হবে। সে পূজায় নিষ্ঠা থাকতে হবে। হরিচরণের ছেলেরা প্রসাদের পাকা পেঁপে খেতে খেতে পরস্পর বলাবলি করল, আজ, সারাদিন, কিছুতেই টক খাবে না তারা। সমস্ত প্রলোভন এড়িয়ে যাবে। গোপাল আর সুরেশকে নিয়েই ভয়। তারা এখনও যথেষ্ট ছোট আছে। কিছুতেই বোঝে না। কোনওভাবে টক জাতীয় কিছু খেয়ে ফেলতে পারে তারা। ডমরু, ঝমরু আর ছেদী তখন সংকল্প করে, সারাদিন দু’ভাইকে তারা চোখে চোখে রাখবে। আজ আর পাড়ার বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে যাবে না। তখন হরিচরণ মুখ ভর্তি পাকা পেঁপের রস নিয়ে ঘন চোখে তুলসীর দিকে তাকায়। তুলসী মিষ্টি হেসে চোখ সরিয়ে নেয়। ডমরুকে বলে— ‘যা, এই ছোলা আর গুড় গরুকে খাইয়ে আনবি, যা।’

বিকাশ জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে চামচ দিয়ে প্রসাদের ফলমিষ্টি মুখে দিচ্ছেন তখন আর লক্ষ্মীর সাবধানবাণী শুনছেন। দ্যাখো, যেন টক খেয়ে ফেলো না।

বিকাশ বিরক্ত হচ্ছেন— আচ্ছা, অফিসে কোথায় আমি টক খাব বলো তো?

লক্ষ্মী ঝাঁঝিয়ে ওঠেন— কেন? টিফিনে কোনওদিন ধোসা ইডলি খাও না মনে হচ্ছে।

বিকাশ চুপ করে গেলেন৷ দেবাশিস এসে পেছন থেকে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল। লক্ষ্মীর গালে গাল রেখে বলল—কী চাইলে মা?

—চাইলাম, তোমার বাবার যেন একটু মতিগতি দেন।

অবাক হয়ে তাকালেন বিকাশ— কীসের মতিগতি?

—বালিগঞ্জে একটা বাড়ি করতে পারতে তুমি। পারতে না? সল্ট লেকে এখনও কত জমি আছে। কিনতে পারো না? কলকাতায় লোকের বাড়িতে টেলিভিশন এসে পুরনো হয়ে গেল। আমাদের জন্য একটা কেনার নাম করো তুমি?

—টেলিভিশন? সে তো কেনাই যায়। এর জন্য সন্তোষী মা’র পূজা করতে হবে কেন?

—কেন নয়? বড় খোকার বিয়ে দেব না আমি? তোমাকে আর কিনতে হবে না। বড় খোকার বিয়েতে টেলিভিশন যৌতুক নেব আমি।

—যৌতুক নেবে? ছেলের বিয়েতে যৌতুক নেবে তুমি?

—কেন নেব না, ছেলে কি আমার ফেলনা?

দেবাশিস তখনও মাকে জড়িয়ে আছে। লক্ষ্মী তার মাথাটা টেনে চুমো খেলেন। যৌতুক নেওয়া সম্পর্কে দেবাশিস কোনও মত প্রকাশ করল না। বিকাশ উঠে দাঁড়ালেন। এখনও তাঁর গাড়ি আসেনি। দু’-একবার এ দিক ও দিক দেখে আবার খবরের কাগজটা নিয়ে বসলেন। দেবাশিস বেরিয়ে গেল। পুজোয় বসেছিলেন বলে লক্ষ্মী এখন একবস্ত্রা। হলুদ সিল্ক শাড়ি জড়িয়ে জড়িয়ে পরে আছেন। সে অবস্থাতেই হঠাৎ বিকাশের গা ঘেঁষে বসে পড়লেন তিনি৷ বিকাশ, যেন অন্য কোনও নারী তাঁর গা ঘেঁষে বসছেন এমনই অনুভবে একটু সরে বসলেন। লক্ষ্মী দু’দিকে মাথা নেড়ে হতাশভাবে দুটো হাত ছড়িয়ে দিয়ে বললেন— ছি ছি ছি। কী লজ্জার কথা!

—কী হল? বিকাশ জানতে চাইলেন।

—ওর আজকাল হয়।

—কী হয়? কার?

—বড় খোকার।

—কী হয়?

—ওই সব পড়ে। বেশ কয়েকদিন বিছানা তুলতে গিয়ে দেখেছি। ছি ছি ছি!

—এতে ছি ছি করার কী হল? বড় হয়েছে। এরকম তো হতেই পারে।

—তা বলে এখনই? এত আগলে আগলে রাখি। এত আড়াল করার চেষ্টা করি।

বিকাশের কথা বলতে ইচ্ছে করল না। মনে করিয়ে দিতে ইচ্ছে করল না যে বড় খোকার বয়সে তিনি দেবার্চনের পিতা হতে যাচ্ছিলেন। অন্তর্নিহিত পরিবর্তন ও অনিবার্য উন্মেষ কি ঠেকিয়ে রাখা যায়, আগলে রাখা যায়? পৃথিবীর কোনও মায়ের পক্ষেই কি তা সম্ভব? লক্ষ্মী বলে চললেন— সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকি, এই বুঝি কোনও মেয়ের পাল্লায় পড়ল। বড় খোকা আমার সে-রকম না যদিও। আমি তো বলি, সবসময় বলি, কারও দিকে এগোবি না। তুই ভাল চাকরি করিস, এত সুন্দর চেহারা তোর, মেয়েরা এসে তোর পায়ে লুটোবে।

বিকাশ সোফায় ঘাড় এলিয়ে বসে আছেন। গাড়ি আসতে এত দেরি করছে কেন? ওপরে ফ্যান ঘুরছে। ফ্যানে বিস্তর ময়লা। তিনি ভাবছেন, পাশে বসে থাকা এই নারী মাত্র পাঁচ বছর আগে পুত্রশোক পেয়েছেন! আশ্চর্য! তাঁর এক প্যাচের শাড়ির আঁচল সরে গেছে। ভারী স্তন বেরিয়ে পড়ছে হাতের নড়ার সঙ্গে। বিকাশের চোখ চলে যাচ্ছে। কিন্তু কোনও অনুভূতি হচ্ছে না। বিকাশ ভাবছেন, কতদিন তাঁদের শারীরিক মিলন হয়নি। ভাবছেন, তাঁর মধ্যেকার পুরুষটা মরে গেছে সম্ভবতঃ। যাক। এখন আর পৌরুষ দিয়ে কী হবে! যখন ইচ্ছে করত, ভেতরটা আছড়াত, লক্ষ্মীর শরীরটা পিষে ফেলার জন্য সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উন্মাদ হত, তখন লক্ষ্মী ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে দরজা বন্ধ করে শুতেন। এখন বিকাশের উন্মাদনা শেষ। কিন্তু অন্যভাবে জেগে উঠছে। পুত্রের মধ্যে জেগে উঠছে। ঘুমের মধ্যে কথা বলছে শরীর। এ বার দেবাশিসের বিয়ে দিতে হবে। বেশ হবে। দেবাশিসের বিয়ের কথা ভাবতে বিকাশের ভাল লাগল।

তখন ফটিক বিলের বস্তিতে অন্ধর মা’র ব্রতকথা বলা শেষ হলে অন্ধ হাতের গুড় চাটতে চাটতে বলল— মা।

—কী কইস?

—সন্তোষী মা’র দাঁতগুলান কি পোকায় খাইসে?

—কী মাথা খাওনের কতা কইস? অ্যাঁ?

—কও না! মা! পোকায় ধরসে না? নাইলে সন্তোষী মায় টক খাইব না ক্যান কও! আমাগো তো টক পাইলৈ জিব্বা আলুস-উলুস করে!

২৬

একাডেমিতে আজ নাটক দেখতে গিয়েছিলাম। ফুটবল। গোটা মাঠটা গ্যালারি ট্যালারি সমেত, চিৎকার-চেঁচামেচি সমেত মঞ্চে নেমে এসেছিল। সব সংলাপ, অভিনয়, দর্শন— আমি কিন্তু ভুলে গেছি। না, ভুলিনি। আমি আসলে কিছু দেখিওনি, শুনিওনি। না না, শুনেছি। একটামাত্র গান। গান নাকি? হ্যাঁ। সুর করে গাইছিল যখন তখন গানই হবে। অমোঘ লাইন একেবারে। লাইন। বাবা কে তোর, বাবা কে তোর, বাবা কে তোর রেফারি? বেজন্মা তুই, বেজন্মা তুই, বেজন্মা তুই রেফারি! অসাধারণ! একেবারে গণসঙ্গীত যাকে বলে।

গণসঙ্গীত! এরকম কুৎসিত নোংরা কথার গান গণসঙ্গীত? কেন নয়? নোংরা আবার কী? জনগণের মুখ দিয়ে বেরিয়েছে। অনুভূতি দিয়ে তৈরি হয়েছে। ঘৃণার সৃষ্টি। গণসঙ্গীত নয় কেন? জন হেনরি, পল রবসন আর হেই সামালো ধান হো না বললে গণসঙ্গীত হবে না? শুধু খাদ্য, স্বাধীনতা, সমৃদ্ধি— এ সবই মৌলিক প্রশ্ন? বাবা কে তোর— এটা কি মৌলিক গণপ্রশ্ন নয়?

হ্যাঁ, ফিরে এসে থেকে আমার মাথায় এই ঘুরছে। বাবা কে তোর, বাবা কে তোর, বেজন্মা তুই, বেজন্মা তুই!

বাবা কে আমার? অ্যাঁ? কে বাবা? পরেশ বোস! শালা! একটা বাচ্চাও বলবে না পরেশ বোসের সঙ্গে আমার এতটুকু মিল আছে! আমার তো মনে হয় আমাকে অনেকটা অরুণ সেনের মতো দেখতে। অরুণ সেন। আমার প্রকৃত পিতা। জন্মদাতা। ধুস! এই পৃথিবীতে কে কাকে জন্ম দেয়।

দাদাটা মাইরি লাকি। ওকে একেবারে খাঁটি পরেশ বোসের মতো দেখতে। কোথাও ভেজাল নেই। এমনকী আমি জানি, আর দশ বছর পর ওর মাথাটাও পরেশ বোসের মতো চকচকে হয়ে যাবে। প্রাজ্ঞতার সূর্য উঠবে মাথা জুড়ে রোদ্দুর ঘোষণায়।

অরুণ সেনের সঙ্গে আমার প্রায়ই দেখা হয়। দেখা হলেই আমি ভাবি, এই লোকটা আমার বাবা! বা-আ বা-আ! বাঃ বাঃ! ব্যা ব্যা! আমার এ সবই বলতে ইচ্ছে করে কারণ লোকটাকে কিছুতেই খাঁটি বাবা মনে করা যায় না। বরং বলা যেতে পারে ও আমার মায়ের নাগর।

লাগর মোরে খাইল রে

বাঁশি কে বজাইল রে

সখী মোরে বাইন্দা রাখ

আমার মন পলাইল রে

যখন ছোট ছিলাম। একটা ভিখিরি হেঁড়ে গলায় গানটা গেয়ে ভিক্ষে করত।

তো, অরুণ সেন আমার মায়ের নাগরা না। এটাও ঠিক হল না। নাগর শব্দটা এখন আর চলে না। এখন বলে কেপ্ট। রক্ষিতা। ইংরিজিতে বললে বেশ একটা করুণ মর্যাদা পায় বিষয়টা। হিন্দি ফিলিমে বলে রাখেল। রা-খে-ই-ল। মানে যাকে রাখা হয়েছে। আমার মা অরুণ সেনের রাখেল। অরুণ সেন আমাদের ভর্তা। ওই ঢ্যামনা পরেশ বোসের প্রভু।

এই পরেশ বোস লোকটাকে আমি বাবা বলে ডাকি। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয় ওর পেছনে একটা লাথি মেরে রেললাইনে ফেলে দিলে কেমন হয়? ওর মাথাটা রেলের চাকায় পিষে চ্যাপ্টা হয়ে যাবে। আর মাথা দিয়ে রক্তের বদলে বেরুবে মদ। তাতে কী? আমার মা বিধবা হবে না। ব্যাসদেব পঞ্চ পাণ্ডবের একজনকেও কুরুক্ষেত্রে মারেননি কেন? কারণ এই হিসেব উনি কিছুতেই ঠাহর করতে পারেননি যে কে মরলে দ্রৌপদী কতখানি বিধবা হবে! তার চেয়ে বেঁচে থাক বাছারা।

পরেশ বোস লোকটাকে কিন্তু আমি ভালইবাসি। হারুদার দোকানের সামনে তিনটি রোঁয়া ওঠা নেড়িকুত্তা আছে আমি তাদেরও ভালবাসি। আরে পৃথিবীতে তো এই শব্দটাই সবচেয়ে সুলভ আর অর্থহীন। বলে দিলেই হল। কঠিন কাজ হল ঘৃণা করা। কারণ ঘৃণা কখনও আপাতভাবে হয় না। কৃত্রিমও হয় না। ঘৃণা সবসময় বিদেশি পণ্যের মতো খাঁটি। পরেশ বোসকে আমি ঘৃণা করি। করুণাও করি। ঘৃণা আমি কাকেই-বা করি না? কারওকে ভালবাসতে পারি না আমি। কারওকে বিশ্বাস করতে পারি না। তাই আমার বাঁচতেও ইচ্ছে করে না। এখন আমি মরব বলে পরিকল্পনা করি। রেললাইনে যাই আর মন্ত্রমুগ্ধের মতো ভাবি কীভাবে মরব! আমিও শালা ঢ্যামনা কম না। মরার জন্য আবার পরিকল্পনা লাগে নাকি? পরিকল্পনা লাগে বাঁচার জন্য। মরতে ইচ্ছে করলেই মরা যায়। বাঁচার পরিকল্পনা খুবই অনিশ্চিত। ঠিক থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। আমাদের টাইমপিসটার মতো। অ্যালার্মের ব্যাপারে চিরকাল অনিশ্চিত থেকে গেল। কোনওদিন বাজে, কোনওদিন বাজে না। আমরা তাই নিয়েই এত বছর চালিয়ে দিলাম। জীবন অনিশ্চিত। কিন্তু মৃত্যু অমোঘ। শুধু মরলেই হয়। কিন্তু তার আগে, তার আগে………

কী? তার আগে কী?

তার আগে যথেষ্ট ঘৃণা দরকার। আমার ঘেন্নার ষোলোকলা এখনও পূর্ণ হয়নি। এখনও মাঝে মাঝে আমার মধ্যে অঢেল করুণাধারা নেমে আসে। আমি বলি বেচারা অরুণ সেন! বেচারা পরেশ বোস! শবরী বোসের চোখের জলও আমার মাঝে মাঝে মুছিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। সবার জীবনের বঞ্চনা নিয়ে আমি গভীর গবেষণা করি তখন আর গাই— এ-ক বেচারা— আ-আ— আহাঃ।

অরুণ সেন— সম্পদশালী মান্যবর, গুণী, কর্তব্যনিষ্ঠ, মামলাবাজ, ফিকিরবাজ কিন্তু পুরুষ। নিজে পুরুষ বলে বুঝি পৌরুষ আসলে কী ভয়ঙ্কর! কী ছটফটায়! কী কেলেঙ্কারি করে! বিয়ে করার উপায় ছিল না লোকটার। বোন ভেসে যাবে। বোনের ছেলেরা ভেসে যাবে। কিন্তু কোথাও ঢালতে তো হবে। অরুণ সেনের ঢালতে হবে তাই পরেশ বোস শবরী বোসকে বিয়ে করে আনল। আচ্ছা, বাবা কি বিয়ের আগে মাকে শর্ত দিয়েছিল— শোনো, আমিও খাব, অরুণদাও খাবে, তুমি রাজি? না হলে মার কোনও প্রতিবাদ নেই কেন?

অদ্ভুত পরেশ বোস লোকটা। নিজেকে সারাজীবন মান্না দে-র চেয়ে বেশি প্রতিভাবান মনে করে কষ্ট পেয়ে গেল! কবে দু’-চারখানা ছায়াছবির প্লে-ব্যাক করেছিল, তারপর থেকে ভাবতে লাগল, এমন প্রতিভা— লোকে বুঝলই না। পরেশ বোস অবশ্য গানও লেখে। সুরও দেয়। সে-সব গায়ও কেউ কেউ। লোকটা মনে করে সে-সব গানের সুর অসাধারণ। কথা অনবদ্য। কিন্তু আর কারও তা মনে হয় না। লোকটা যদি ঠিক ঠিক নিজের প্রতিভার সীমা-পরিসীমা বুঝত তা হলে হয়তো আরও কিছু দূর যেতে পারত। অরুণ সেন না থাকলে পরেশ বোসকে ভিক্ষেই করতে হত এখন।

পরেশ বোসের সঙ্গে দীপনদার খুব মিল আছে। পাড়ার ঠিক মাঝখানটায় দীপনদার বাড়ি। দোতলায় দীপনদারা থাকে আর একতলায় দেবাশিসের মা, লক্ষ্মীকাকিমা একটা স্কুল করেছে।

ছোটবেলায় দীপনদাকে হাঁ করে দেখতাম। কী সুন্দর দেখতে ছিল ওকে। বিরাট চাকরি করতেন দীপনদার বাবা। কী চাকরি জানি না তবে গাড়িতে যাওয়া-আসা করতেন আর দীপনদা খুব ভাল ভাল জামা-কাপড় পরে নায়ক-নায়ক ভাব করে পাড়ায় ঘুরে বেড়াত। আমি আর দাদা বলাবলি করতাম, বাবা বড়লোক হলে কী মজা না?

দেখো আমার কপাল। আমার বাবাও বড়লোক। কিন্তু ছেলে বলে আমাকে মানতেই চায় না। অতএব আমি নিজে বড়লোক, কিন্তু বড়লোক নই, প্রভু কিন্তু পোষ্য, দাতা কিন্তু ভিক্ষুক। মাঝে মাঝে হাসি পায়— হা হা হো হো হি হি…। আবার কান্নাও পায়— উঃ উঃ ফিচ্‌ ওঃ হো হো। ধুস্‌। আমার তো বড়লোক বাবা চাই না। আমার দরকার ছিল একটা খাঁটি বাবা।

দীপনদাকে সবাই বলত সিনেমা করো। নায়ক হিসেবে দারুণ মানাবে। এমনকী উত্তমকুমারের জায়গাটাও তুমি অধিকার করতে পারো। দীপনদা বিশ্বাস করল। আর অরুণ সেনকে গিয়ে ধরল। কাজলের ছোট পিসি, বুড়িপিসি বলতাম আমরা, প্রেম করত দীপনদার সঙ্গে। সবাই জানত পাড়ায়। দীপনদা সিনেমায় নামবে-নামবে করতেই বুড়িপিসিরও চাল-চলন বদলে গেল। বেশ একটা নায়িকা-নায়িকা ভাব। সুচিত্রা সেনের মতো তাকানো। সন্ধ্যা রায়ের মতো হাসি।

অরুণ সেন দীপনদার বাবাকে চেনেন। দীপনদাও সুন্দর, স্মার্ট। পয়সার অভাব নেই। ফ্যালনাও নয় আমাদের মতো। অতএব চান্স করে দিলেন একটা ছবিতে। উত্তমকুমার নায়ক। দীপনদার পার্শ্বচরিত্র। তাতেই মোটামুটি পাড়ার উত্তমকুমার হয়ে গেল দীপনদা। এরপর দীপনদার দ্বিতীয় ছবি, কার সঙ্গে মনে নেই, ছবিটা মুক্তি পেল না।

চলচ্চিত্রের সঙ্গে মানুষের জীবনের এই একটা ভয়ঙ্কর মিল। দু’টোই মুক্তির প্রতীক্ষা করে। কী থেকে মুক্তি তা নির্দিষ্ট নয়। শুধু মৃত্যুরই মধ্যে তা অমোঘ হয়ে থেকে যায় মৃত্যু-পরবর্তী অস্তিত্বের জন্য। দীপনদার দু’টি সুদৃশ্য অক্ষত ডানা তখনও অক্ষত। এবার তৃতীয় ছবি। তাতে দীপনদা নায়ক। দীপনদা উড়ল। ছবি ফ্লপ করল। এত বড় ধরনের ফ্লপ যে ওর ফর্সা রঙ তামাটে হয়ে গেল। চোখের তলায় পাখির নখের আঁচড়। একটু কুঁজোও কি হয়ে গেল না দীপনদা?

প্রথম প্রথম ঠাঁট বজায় রেখেই অরুণ সেনের কাছে যাওয়া-আসা করত। নায়ক হওয়ার জন্য নাকি দীপনদা অনেক টাকা ঢেলেছিল। মানে ছেলের আব্দারে বাবা ঢেলেছিলেন। ছবি ফ্লপ করায় দ্বিতীয়বার আর তিনি টাকা দিতে রাজি হলেন না। দীপনদা খুব চেঁচামেচি করল। বাড়ি ছেড়ে যাবে, আত্মহত্যা করবে বলে ভয় দেখাল। পিতৃহৃদয় গলল না। দীপনদা অরুণ সেনের পায়ে পড়ে আরেকটা সুযোগ চাইল।

অরুণ সেন অন্তঃসারশূন্য পরেশ বোসকে পুষেছিলেন। হয়তো প্রথমে অতখানি ফাঁপা না ভেবেই পুষেছিলেন। কারণ পরেশ বোস যখন চোখ বন্ধ করে, থেমে থেমে, ভাল ভাল কথা বলে তখনই ওকে একদম পৃথিবীর তিন নম্বর প্রতিভাবান মনে হয়। প্রত্যাশা ও নির্ভরতা জাগিয়ে তোলা আত্মপ্রত্যয়ী মুখ। পরে যখন সে-মুখ ফাঁপা বেরুল তখনও অরুণ সেনের হাতে দু’খানা তাস। পরেশ বোসের বউ আর বিশ্বস্ত, অনুগত, পোষা কুকুরের মতো পরেশ বোস নিজে। এতদিনে গায়ক, গীতিকার, সুরকার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অরুণ সেনের মদ্যপানের সঙ্গী ও পার্শ্বচর। লোকটা এত নখদন্তহীন যে অরুণ সেনের সামান্য ক্ষতি করার ক্ষমতাও ওর নেই। লোকটা নিজেকে এতখানি বিকিয়েছিল যে আগ্রায় বেড়াতে গিয়ে অরুণ সেনের থাবায় বউকে ফেলে আমাদের দু’ভাইকে নিয়ে গিয়েছিল তাজমহল দেখতে। সারাদিন ঘুরল। তারপর বিকেলে বাড়ি ফিরে শুরু করল নাটক। বাড়ি কি বলছি, হোটেল। আমাদের তো সবটাই হোটেল। এখন যেখানে থাকি, সেটাও হোটেল। দেখতে অবশ্য বাড়ি। আমার মায়ের নামে বাড়ি। অরুণ সেনেরই দেওয়া নিশ্চয়ই। না হলে পরেশ বোসের ক্ষমতা ছিল নাকি মাথুরের গড়ের মতো জায়গায় দোতলা বাড়ি হাঁকায়? এক কেজি চাল কেনার ক্ষমতা আছে লোকটার? আমার তো মনে হয়, আমি আর দাদা যখন থেকে ট্যুইশন করতে শিখলাম তখনই প্রথম এ বাড়িতে সততার পয়সা এল। নিজের পরিশ্রমের পয়সা।

দাদাটা বেশ আছে। চাকরি আর গান নিয়ে থাকে। প্রেমও করছে একটা। এই যে এত কিছু— বাবার মদ খাওয়া, বদমায়েশি, মা’র বঞ্চিত সখী সখী ভাব আর অরুণ সেনের প্রকাশ্য লাম্পট্য—এ সব নিয়ে ও ভাবে না। হয়তো একারণেই যে আমার মতো ওর পিতৃপরিচয় নিয়ে সংশয় নেই। ধুস্‌। কী যা তা বকছি! পিতৃপরিচয় নিয়ে আমারই কি সংশয় আছে নাকি? বিরাট পিতার নগণ্য সন্তান আমি! আমিও শালা ঢ্যামনা আছি। মা’র মতো বঞ্চিত সখী সখী ভাবটা আমার মধ্যেও ঢুকে পড়েছে। দু’-একদিনের মধ্যেই বোধহয় গাইতে শুরু করব— কেন বঞ্চিত তব চরণে! সবসময় নিজেকে দুঃখের মোড়কে রেখে দেওয়াই আমার চরিত্র হয়ে গেছে এখন। অথচ খাও পিয়ো জিয়ো করতে পারলে দিব্যি ল্যাঠা চুকে যেত। কিন্তু আমার দ্বারা কিছুই সম্ভব হল না। একটা প্রেম পর্যন্ত করতে পারিনি এখনও। অথচ আমারই চোখের সামনে অরূপ তুলছে আর ছাড়ছে।

প্রেম নাকি জন্মান্তর ঘটাতে পারে। আমার আর বোঝা হল না। জ্ঞান হতে না হতেই অরুণ সেন, পরেশ বোস আর শবরী বোস আমার অস্থি মজ্জা চিন্তা চেতনা শরীর প্রেম সব শুষে নিয়েছে।

না। ভুল বললাম। শরীর নিতে পারেনি। আমার মধ্যে স্বাধীনভাবে, ওই তিনব্যক্তি নিরপেক্ষভাবে যে বোধ জন্মায় তা শরীরী বোধ। সে-জন্যই আমি আজকাল ছন্দা বউদির কাছে যাই। এক ঢ্যামনার ছেলে আরেক ঢ্যামনার বউয়ের কাছে যাই। এক খানকির ছেলে আরেক খানকির কাছে যাই। নিত্যদা কি বোঝে না, মৌচাক ক্লাবের যেসব ছেলে ছন্দা বউদির কাছে কাছে ঘুর ঘুর করে তাদের সঙ্গে বউদির কি সম্পর্ক? নিশ্চয়ই বোঝে এবং দেখি না দেখি না করে থাকে। আসলে এখানেই হিসেব আছে। নিত্যদা ব্যাঙ্কে চাকরি করে তো। একেবারে পাকা হিসেবি। মৌচাক ক্লাবের প্রচুর কাজকর্ম আছে। অনেক টাকার ব্যাপার। নিত্যদার তাই এ ক্লাবের সেক্রেটারিশিপ বজায় রাখা খুবই দরকার। সুতরাং ছন্দা বউদিকে দিয়ে ছেলেগুলোকে হাতে রাখে।

আমি অবশ্য মৌচাকের কেউ না। কিন্তু ছন্দা বউদিদের পাড়ায় আমি সোনালিকে পড়াতে যাই। সোনালি খুব ভাল মেয়ে। বইয়ের ভাঁজে ভাঁজে ফুলের পাপড়ি রেখে দেয় আর লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা লেখে। একদিন বাংলা খাতার পেছনে একটা কবিতা লিখে রেখেছিল। আমি খুব বকাবকি করেছিলাম— এ সব কী? লেখাপড়ার খাতায় এ সব লেখা কেন? —যেন রাগ করে ছিঁড়ে ফেলছি এমন ভাব করে পাতাটা ছিঁড়ে ভাঁজ করে পকেটে পুরেছিলাম। আসলে কবিতাটা ভাল লেগেছিল আমার। আর মনে হয়েছিল ওটা আমার জন্যই। প্রথম দিকটা এরকম—

তুমি কি পুকুর দেখো? সমস্ত পুকুর?

নাকি জল—

তোমার ও দু’টি চোখ আশ্চর্য, অপার অতল

যখন সন্ধ্যা হয়, যখন চিৎকার করে পাড়া

কেউ-বা বন্ধু খোঁজে, কেউ বই খোলে, কেউ ফেরে

অফিসের থেকে

আমি একা অপেক্ষায় থাকি। দেখি কে ফিরেছে

তখনও ফিরল না কারা কারা

যেদিন তোমার জন্য বারান্দায় লুকিয়ে দাঁড়াই

জল স্থির, তারাগুলি স্থির, এমনকী বাতাসও কাঁপে না

তুমি ভুল জানালার কাছে যাও। ভুল আগুনের কাছে

আমাকে দেখেও না দেখার ভান করো

গলা ছিঁড়ে কতটা চেঁচাই কত বলি— যেয়ো না ওখানে

পুড়ে যাবে, ছাই হয়ে যাবে

ছাইভস্ম বাতাসের আগে আগে উড়ে

পুকুরের জলে মিশে যাবে!

এরপর আরও অনেক আছে। সে-সব লিখে ডায়রির পাতা নষ্ট। কিন্তু শেষটুকু লিখতেই হয়—

আমি ভেসে যাচ্ছি জলে

ডুবে যাচ্ছি এপাড়ার শ্যাওলাপুকুরের নীচে

কলসিতে দড়ি গেঁথে জন্ম জন্ম ধরে!

ছিন্নভিন্ন হয়ে আছি রাস্তায় রাস্তায়

একা একা বারান্দায় বসে আছি

গোপন অপেক্ষা নিয়ে

কে এল, কে গেল সব মুখস্থ আমার

সন্ধ্যাবেলা ঘরে ঘরে বউদি হয়ে আছি

ঘরে ঘরে মগ্ন বইপোকা

পড়ুয়া বিনুনি বেঁধে

ঘরে ঘরে শান্ত বউ বরকে জিজ্ঞেস করে

কী খাবে গো তুমি? কখন কী খাবে?

ওই বউদি ওই বউ পড়ুয়া মেয়েটা—

আমি সব হয়ে আছি।

মাস্টারমশাই! আমাকে এড়িয়ে তুমি কোথায় পালাবে?

কবিতাটা আমি অনেকবার পড়েছিলাম। বহুদিন ওকে পড়াতে এসে আমি দূর থেকে দেখেছি বারান্দার আলো নিভিয়ে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে সোনালি। ওদের বাড়ির আগেই ছন্দা বউদির বাড়ি পড়ে। ছন্দাবউদিও আমাকে ঠিক জানালা দিয়ে দেখতে পায়। ডাকে। আমিও জানালার কাছে দাঁড়াই। গ্রিলের এপারে আমি। ওপারে ছন্দা বউদি। ছন্দাবউদি ইচ্ছে করেই গ্রিলে শরীর চেপে ধরে। আর আমি আঙুল রাখি। খুঁটে দিই। উত্তেজিত হই। তখন সোনালি ঘরে চলে যায়। আমি জানি ও বারান্দা থেকে আমাদের কথা বলাটা বুঝতে পারে কিন্তু আর কিছু দেখতে পায় না। মাঝে মাঝে ও বিষণ্ণ হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে তন্ময়। একদিন শেলি প্রসঙ্গে ওকে বিস্তারিতভাবে ‘অ্যাডৌনিস’ পড়াচ্ছিলাম। ও শুনছিল। দেখলাম ওর পলক পড়ছে না। বললাম—বলো তো, কী বলছিলাম!

ও চমকে উঠল। মুখ নামিয়ে নিল। স্পষ্ট দেখলাম, লাল হয়ে যাচ্ছে। এটা কি প্রেম? আমার প্রতি সোনালির প্রেম? বেচারা! ওর জন্য মায়া হয় আমার। এই বয়সে মেয়েরা খুব মাস্টারমশাইয়ের প্রেমে পড়ে। কিন্তু ও তো জানে না, আমার প্রেম-ট্রেম নেই। পৃথিবীর সব মহিলাই আমার কাছে শবরী বোস বা ছন্দা মিত্র। সোনালিদের দেবার মতো কোনও জায়গাই আমার নেই। সোনালিও কি একদিন শবরী বোস বা ছন্দা মিত্র হয়ে যাবে? আজকের পবিত্র, মিষ্টি, লাল হয়ে যাওয়া সোনালি! হয়তো হবে। সবাই তো প্রথমে সোনালিই থাকে। তারপর রঙ চটকে যায়। আজ না হোক কাল। আজ সোনালি আমার জন্য কবিতা লিখছে, কাল কলেজের কোনও রোম্যান্টিক অধ্যাপককে নিয়ে লিখবে। মেয়েরা জাতটাই এরকম।

নাঃ। কথাটা বলা ঠিক হল না। ছেলেরাই বা কী এমন গঙ্গাজল? ক’জন মহৎ পুরুষ আমি দেখেছি জীবনে? অরুণ সেন, পরেশ বোস, দীপনদা— ধূর্ত, বিকৃত, লোভী, হতাশাজর্জর। কিলবিল করছে সবসময়। সর্পজাত সন্তান সব। আমি বলছি, আমিই বা কম কী? অন্যের বউ ধরে টানি না? পাপ পাপ। পাপে ভরে গেছে সব। পৃথিবীটা আর পৃথিবী নেই। শনি হয়ে গেছে। খচ্চরে ভরে গেছে। রুইও নয়। কাৎলাও নয়। সব শালা সিলভার কার্প।

কী লিখছিলাম, আর কোথায় এসে পড়লাম। কথা হচ্ছিল দীপনদা আর পরেশ বোস নিয়ে, শুরু করে দিলাম ধান ভানা।

হ্যাঁ, পরেশ বোসকে পোষা প্রয়োজন ছিল অরুণ সেনের। বিশ্বস্ত বুড়ো কুকুর বা নুলো ঘোড়াকেও তো লোকে আজীবন পোষে। সুতরাং পরেশ বোস পার পেয়ে গেল। কিন্তু দীপনদা পেল না। অরুণ সেন ওর জন্য আর কিছুই করতে চাইলেন না। দীপনদাটা কীরকম এলেবেলে হয়ে গেল। সবাইকেই বলতে লাগল—‘আর একটা সুযোগ যদি পাই, দেখিয়ে দেব।’ সেই দেখিয়ে দেবার সুযোগ আর এল না।

দীপনদার অভিনয় প্রতিভা ছিল না। চর্চা ছিল না। শিক্ষা, প্রশিক্ষা, অধ্যবসায় কিছুই ছিল না। শুধু লোকে দীপনদাকে তুলে দিয়েছিল। ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দিয়েছিল। মনে মনে নায়ক হতে হতে ও উত্তমকুমারকেই ওর প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করল একদিন। কী আশ্চর্য ইলিউশন! আচ্ছা, ইলিউশনের বাংলা কী হবে? মায়াজালিকা? নাঃ! চলে না কথাটা। স্বপ্নমায়া?

যাই হোক, আমি বেশ বুঝতে পারি, আমার চারপাশে সবাই কোনও না কোনও ইলিউশনে ভুগছে। শুধু আমি ভুগছি না। এ পাড়ার ঘুঁটেকুড়ুনি ফুলরেণু, তারও কিছু কিছু ইলিউশন আছে। আমি ইলিউশনে ভুগছি না কারণ আমি মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছি। খোলা আকাশের নীচে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকলেই আমি দেখতে পাই ছোট ছোট কালো কালো বিন্দু অনেক ওপরে ঘুরছে। ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাকসাট মারছে। ওরা মৃত্যু। অসংখ্য, অগুনতি মৃত্যু। এই পৃথিবীতে এই একটিই বস্তু যা চাইলেই পাওয়া যায় কিন্তু কেউই চায় না। যারা চায়, পেয়েও যায়। বাকিরা তাদের ভিতু বলে। বোকা বলে। বলে জীবন থেকে পালাল। আমি জানি, আমি নিশ্চিত জানি যে ওরা সবাই ওই ভীরুতা চায়। ওই পলায়ন। জীবনে কোনও না কোনও দিন ওরা ওই বোকামিই প্রার্থনা করে। হয়তো আমার মতো প্রতিদিন করে না।

সব সতীর বাচ্চাই স্বীকার করবে যে চলে-ফিরে বেড়ালেও তারা আসলে মরে রয়েছে। না, না । গীতার বাণী না। এ তো অভিজ্ঞতা। দীপনদার কথাই ধরা যাক। ও যে ফ্লপ নায়ক তা প্রমাণিত হওয়ার কিছুদিন পরই দীপনদার বাবা মারা গেলেন। ইতিমধ্যেই দীপনদার ঝকঝকে উপস্থিতি হারিয়ে গিয়েছিল। শেষ আশ্রয়ের মতো বুড়িপিসিকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল বোধহয়, বুড়িপিসি ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে। ঝাড় খাওয়া নায়ককে কে আর বুকে টানবে! মেয়েরা যা সেয়ানা! প্রেম করার সময় একেবারে এমন ভাব দেখাবে যেন তোমা বিনা প্রাণ উড়ি যায় হে! কিন্তু ফ্লপ লোককে কিছুতেই বিয়ে করবে না। এ সব কথা এখানে সবাই জানে। সব কথাই সবাই জানে। পরেশ বোসের কথাই কি জানে না? যাকগে, পরেশ বোসের কথা পরে। আগে দীপনদার কথা বলি। বাবা মারা যাবার পর আর বুড়িপিসির বিয়ে হয়ে যাবার পর দীপনদা একেবারে ন্যালাক্যাবলা হয়ে গেল। আস্তে আস্তে লোকের সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করে দিল। ঘরকুনো হয়ে গেল। জেঠিমা যতদিন চলতে ফিরতে পেরেছেন, ঘরে-বাইরে সামলেছেন। এখন আর দোতলা থেকে নামতে পারেন না। দীপনদা মাঝে মাঝে বাজার করতে বেরোয় আর ব্যাঙ্কে যায়। বিধ্বস্ত সভ্যতার মতো লাগে ওকে এখন। কুঁজো। বিশ্রী। ময়লা। চুল-দাড়ি কাটে না ঠিকমতো। স্নান? বোধহয় করে না রোজ। কিন্তু খাওয়া-দাওয়ায় দীপনদার খুব পরিপাটি। নিজেই রাঁধে। লোকে এখন বলে পাগলা দীপু। কেন এরকম হল? ও নিজেকে বোঝেনি। চেনেনি। ও দীপন হতেই চায়নি। দীপনকে যে দীপনই হতে হয় তা শেখেওনি হয়তো। ও উত্তমকুমার হতে চেয়েছিল বলে কিছুই হল না শেষ পর্যন্ত। ক’জন মানুষই বা স্বয়ং হয়ে উঠতে চায়? ক’জনই-বা জানে সে কী, সে কেন, সে কতখানি?

আমার অবশ্য দীপনদাকে পাগল মনে হয় না। ও যেন খানিকটা স্বেচ্ছানির্বাসিত মানুষ। কারণ দীপনদার সব চেতনা আছে। ঠিক ঠিক বাজার করে। রাঁধে, খায়—এ সব তো আছেই। কিন্তু নিয়মিত ব্যাঙ্কে যায়। হিসেব করে খরচ করে। গুণে গুণে মাসের ঠিক চার তারিখে লক্ষ্মীকাকিমার কাছে ভাড়া আনতে যায়।

পাগল নয়। দীপনদা আসলে একটা গুটিয়ে-যাওয়া মানুষ বা ফুরিয়ে যাওয়া। আমি বলি, মৃত। এই পৃথিবীকে যাদের কিছুই দেবার নেই, তারা মৃত ছাড়া কী? যেমন আমি। যেমন পরেশ বোস। পরেশ বোস—এতগুলো বছর ধরে এই লোকটা একটা কলের পুতুলের মতো হাসছে, কাঁদছে। একইভাবে গান গাইবার চেষ্টা করছে আর ধুন বাজাচ্ছে আর মদ্যপান করে বলছে— এ দেশে প্রতিভার দাম কেউ বুঝল না। প্রতিভার কোনও মূল্য নেই। দীপনদার মতো এই লোকটাও নিজেকে মান্না দে-র প্রতিদ্বন্দ্বি মনে করে এল। কিংবা সঠিকভাবে বলতে গেলে মান্না দে-কে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী। হ্যাঁ, চেহারায় পরেশ বোসকে কিছুটা মান্না দে-র মতো দেখায়। আর এ বিষয়ে লোকটা বেশ সতর্ক। কিন্তু দেখায় যেন সতর্ক নয়। ঠিক মান্না দে-র মতোই একটা টুপি পরে মাথায়। গানের ভঙ্গি নকল করে। এমনকী গোঁফটাও অবিকল মান্না দে-র মতো না রেখে পারে না। কী আশ্চর্য! মনে মনে মান্না দের প্রতিভা, কণ্ঠ, যশ, খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে করতে এই লোকটা মান্না দে-র অহং পেয়ে গেছে এবং নিজে মরে গেছে। আমাদের চারপাশে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে একজন মৃত মানুষ।… ….

আজ পরেশ বোস তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছেন। এবং মদ খাননি। মুখে স্বীকার করুন বা না করুন, পরেশ বোস নিজের মধ্যে জানেন অনুপমের জন্যই তাঁর বুকের তলায় একটি স্নেহসঞ্চারী নদ লুকিয়ে আছে। বড় ছেলেকে স্পর্শ করলে তাঁর শান্তি লাগে। তিনি বোঝেন, বড়পমের কণ্ঠ অতি সম্ভাবনাময়। তাঁর নিজের চেয়েও মধুর ও স্থিত। এতে তাঁর আনন্দ হয়। ঈর্ষাও হয়। কিন্তু এ ঈর্ষা বিবর্জিত। এ ঈর্ষা আসলে একজন শিল্পীর অসহায় ব্যর্থতা ও অন্য শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধানুভব। এক ধরনের তারিফ। ও পেরেছে। বাঃ ও পারল। সঙ্গে সঙ্গে মনে কষ্ট খেলে যায়—আমি পারিনি। আমি পারলাম না।

সমস্ত গায়ক ও সুরস্রষ্টা পৃথিবীর সমস্ত সার্থক সুরের সঙ্গে একাত্ম বোধ করেন। সমস্ত চিত্রকর—যাবতীয় ছবির মধ্যে বিলিয়ে দেন নিজেকে। পৃথিবীর যে-কোনও কবি-লিখিত কবিতাই অন্য কবিদের নিজস্ব হয়ে যায়। সমস্ত অসামান্য স্থাপত্য দেখে সব স্থপতি মনে মনে সেটি নির্মাণ করেন। পৃথিবীর সব শিল্পীই—দেশকাল নিরপেক্ষভাবে যার যার আরাধ্য শিল্পের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় কোনও না কোনও দিন। এই তার ধর্ম। যখন সে সৃষ্টি দেখে এবং উপলব্ধি করে তখন সেও স্রষ্টার সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন আনন্দে ভরপুর। যখন সে সেই সৃষ্টির বাইরে এসে নিজের দিকে তাকায়, নিজেকে দেখে, তখন সে বিরাট-বিশাল নয়, সমস্ত শিল্পের সঙ্গে একাত্ম নয়, তখন সে একা। অসামান্য রচনার ইচ্ছা তখন তাকে তাড়া করে বেড়ায়। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই সে-ইচ্ছা পূর্ণ হয় না। প্রেরণা কখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় না। শিল্পীর অজস্র প্রতিবন্ধকতার ভিতর অসম্পূর্ণ অসমাপ্ত শিল্প দিনে দিনে গুমরে মরে এবং কোনওদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। নিজের মধ্যে নিরন্তর সৃষ্টিকে জাগিয়ে রাখতে পারে যে, সে যুগন্ধর। সে যুগে যুগে সম্ভব হয়। যুগে যুগে আসে।

অনুপমের গান শুনলে পরেশের মনে হয়—এ তাঁরই গান। তাঁরই স্বর। এই সবই সে তাঁর থেকেই পেয়েছে। কিন্তু নিজের গভীরে তিনি জানেন, বড়পমকে তিনি কিছুই দেননি। যেভাবে পিতার থেকে পুত্রে চরিত্র প্রবাহিত হয় সেভাবেই অনুপম পরেশের থেকে সংগীত আহরণ করেছে। পরেশের বীর্যবাহিত হয়ে শবরীর শরীর মাধ্যমে অনুপমের মস্তিষ্কে। ব্যস্‌, ওটুকুই। আর কোনও একদিন, অনুপমের ছোটবেলায়, তাকে কাছে বসিয়ে হারমোনিয়মে সা রে গা মা চিনিয়েছিলেন। ওই একদিনই।

দেবশিশুর মতো দেখতে ছিল অনুপম ছোটবেলায়। সময় সময় পরেশ ওকে গানের চেয়েও বেশি ভালবেসে ফেলতেন।

গানের চেয়ে বেশি? তাঁর সন্দেহ হয়। সংশয় জাগে। নানাবিধ সংশয়। গানের চেয়ে বেশি করে কোনওদিন কিছু ভালবাসতে পারেন তিনি? না। হয়তো-বা গানকেও তিনি ভালবাসেননি কোনওদিন। ভালবাসলে তা সুন্দর হয়। সফল হয়। ভালবাসার নামে তিনি ঈর্ষা করেছেন মাত্র আর গ্রাস করতে চেয়েছেন। বরাবর ভাল গান, ভাল কণ্ঠ, ভাল স্বরায়ত্ত প্রয়োগ ঈর্ষা করেছেন তিনি। যাকে ঈর্ষা করেছেন তাকে ছাড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেননি। প্রতিষ্ঠা ও সাফল্যের বাসনায় ধৈর্য ধরার বদলে, সাধনার বদলে নিজেকে টুকরো টুকরো করে ফেলেছেন। কবে থেকে এরকম স্বপ্নগ্রাসী হয়ে উঠলেন, এখন আর মনেও পড়ে না। গুরুজির কাছে যতদিন ছিলেন ততদিন সাধনা ছাড়া আর স্বপ্ন ছিল না। একদিন অরুণ সেন এলেন। প্রায়ই আসতেন তখন গুরুজির কাছে, নতুন প্রতিভার খোঁজে। একদিন পরেশকে বললেন—চমৎকার গলা তোমার। আমার ছবিতে প্লে-ব্যাক করে। মাঝে মাঝে একেবারে মান্না দে-র মতো লাগছে।

মান্না দে-র মতো! সত্যি? মান্না দে-র মতো! পরেশ কি জানতেন না? জানতেন। এর আগেও অনেকের কাছে শুনেছেন—একেবারে মান্না দে-র মতো। মান্না দে তখন ক্রমশ উদ্ভাসিত হচ্ছেন। তাই যত শুনেছেন তত বেশি করে পরেশ বোস না হয়ে মান্না দে হওয়ার চেষ্টা করে গেছেন তিনি। মনে হয়েছিল, একটিমাত্র সুযোগ পেলেই মান্না দে-কে ছাড়িয়ে যাবেন। তখন জনমানসে মেরুকরণ শুরু হয়েছে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, না মান্না দে? তিনি স্বপ্ন দেখলেন—হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, না পরেশ বোস?

অরুণ সেনের প্রস্তাবে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। গুরুর অনুমতি ছিল না। কিন্তু গুরুর কাছে যাওয়া বন্ধ করলেন। বয়সে মান্না দে-র সঙ্গে খুব পার্থক্য ছিল না। সেটিও আরও বেশি করে ঈর্ষা জাগাল। গাইলেন জীবনের প্রথম প্লে-ব্যাক। চারখানা গান। ছবিটি চলল না। গানগুলো নিয়েও কোনও হৈ চৈ হল না। শুধু পরেশ বোসের কানে ওই গানের কথা ও সুর, কণ্ঠ ও গায়কী এত মধুর লাগল যে সেই মধুরিমায় তিনি বধির হয়ে গেলেন। জানলেন না, তাঁর কণ্ঠে এখনও পূর্ণ নৈপুণ্য আসেনি, সুরসমৃদ্ধ হয়নি, মায়া জাগেনি। বুঝলেন না যে প্রতিভা নিয়ে মান্না দে জন্মেছিলেন সে প্রতিভা তাঁর নেই। তাঁর সব অপূর্ণতা যন্ত্রে ধরা পড়ল, সমঝদারের কানে ধরা পড়ল এবং সাধারণ শ্রোতার বুকে কোনও প্রত্যাশা জাগাল না। তিনি নিজেকে মহান করে মান্না দে-কে দুষলেন, দুর্ভাগ্যকে দুষলেন এবং টিকে থাকার জন্য অরুণ সেনের পিঠ কামড়ে ঝুলে পড়লেন।

অনেক দিয়েছেন অরুণ সেন পরেশকে। তিনি ছিলেন তাই পরেশ ভাত পেয়েছেন। তিনি ছিলেন তাই পরেশ যেটুকু হোক স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাঁর জন্যই পরেশ বোসকে সারা জীবনে এক বোতল মদও কিনতে হয়নি। বউ ছেলে নিয়ে পরেশ বোস একজন সফল সংসারী। মাথুরের গড়ে তাঁর দোতলা বাড়ি। তাঁর ছেলেরা শিক্ষিত এবং প্রায় প্রতিষ্ঠিত। স্ত্রী এখনও সুন্দরী। এ সমস্ত সাফল্যই ঘটিয়েছেন অরুণ সেন। পরেশ বোসের জীবনে তিনিই একমাত্র দরাজ ঈশ্বর। এ জন্য তাঁর কোনও ক্ষুদ্রতাবোধ নেই। তিনি আজও বিশ্বাস করেন, তাঁর দুরন্ত প্রতিভা ছিল। আর প্রতিভাকে লালন-পালন করতে হয়। প্রতিভাহীন কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে সফল মানুষেরা যুগে যুগেই প্রতিভাধরদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।

এ পর্যন্ত সবই ঠিক আছে। শুধু ছোটপমের দিকে তাকালে পরেশের জ্বালা ধরে যায়। সব প্রাপ্তি অর্থহীন লাগে। দেবোপম শান্ত। গম্ভীর। কথাবার্তা যা-কিছু সে অনুপমের সঙ্গেই বলে। আর মাঝে মাঝে শবরী ও পরেশের দিকে তীব্র চোখে তাকায়। সেই দৃষ্টি দেখলে পরেশের মাঝে মাঝে ওর টুঁটি ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।

সন্ধে থেকে লোডশেডিং চলছে আজ। আকাশ মেঘে ছেয়ে আছে। শহরে বর্ষা এসে গেছে। অন্যান্যবারের মতোই খাল উপছে ভাসছে ফটিক বিল বস্তি। বাজারে আনাজের দাম চড়া। এই বৃষ্টিতেও লোকে নির্বাচনের মিছিল করছে। কেউ পরিবর্তন চায়। আর তারা মুঠো শক্ত করে প্রকাশ করছে রাগ, রোষ, আকাঙ্ক্ষা। কেউ পরিবর্তন চাইছে না। বহুবিধ নতুন সুবিধার প্রতিশ্রুতি সমেত তারা বোঝাতে চাইছে স্থিতাবস্থাই কাম্য। একই দেশ, একই নগর, একই ভূমি কিন্তু স্বার্থগুলি একাকার হতে পারছে না কিছুতেই। কোনওমতেই বলা যাচ্ছে না এতে আমাদের সবার ভাল। কীসে কতখানি ভাল বুঝতে না বুঝতেই দু’টি মিছিল মুখোমুখি হবে। লড়াই বাঁধবে। ভাল চাওয়ার আগে সব শেষ হয়ে যাবে। কেউ কেউ ভাল-মন্দ ঠিক-ভুল বোঝার আগেই মরে যাবে। যারা বেঁচে থাকবে, আহত বা সুস্থ, তারা বাড়ি ফিরে যাবে, ঘুমোবে, খাবে, বিয়ে করবে এবং পাশের বাড়ির বাচ্চার সঙ্গে মারামারি খুনোখুনি করার জন্য এ বাড়িতে একটা বাচ্চার জন্ম দেবে।

এ সবই অতি স্বাভাবিক গতি ও ছন্দ। কোথাও না-কোথাও তা বজায় থাকে। এ পাড়ার জন্য ও পাড়া স্তব্ধ হয় না। এ গাঁয়ের জন্য ওই গাঁ কাঁদে না। একটা দেশ ধ্বংস হলে অন্য দেশ রাত্রি জেগে উৎসব জমায়। এই ভোটের মরসুমেও এই পারস্পরিক লড়াই এবং অস্থিরতা, বহুপক্ষীয় অনিশ্চয়তাও বটে, যখন কারও কারও মনে পড়ছে সেইসব তরুণদের কথা যারা পরিবর্তন চেয়েছিল আর মরেছিল গুলি খেয়ে, ছুরিতে বিদ্ধ হয়ে। জেলের মধ্যেকার নিজস্ব নিপীড়ন প্রক্রিয়ায় তারা কেউ মরেছিল, কেউ মরেনি, হারিয়ে গেছে, পঙ্গু হয়ে গেছে, পাগলও অনেক— এ সবের জন্য কে দায়ী, কে নয়, কারওকে ঘৃণা করা হবে কি না, কেউ অভিযুক্ত হবে কি না ঠিক হতে না হতে মার-মার কাট-কাট ভোট এসে গেল। রাষ্ট্রযন্ত্র থেমে থাকল না। ভাবতে ভাবতে প্রত্যেকেই নিজেকে প্রস্তুত করল ভোটাভুটির জন্য। হয়তো-বা কয়েকজন মা ছাড়া—যাদের ছেলে মরে গেছে, কয়েকজন ভাই ছাড়া—যাদের ভাই মরে গেছে, কয়েকজন পিতা ছাড়া— যাদের কন্যা নৃশংস ও নোংরাভাবে নির্যাতিত—তেমনি কয়েকজন, যাঁরা সংকল্প করেছেন, ভোট দেবেন না, বাকিরা প্রস্তুত। কে গেল কে এল কিছু যায় আসে না। তাঁরা বেঁচে আছেন—এ পর্যন্তই। এর চেয়ে ভাল থাকার কথা সবাই ভুলে গেছে। এর থেকে মন্দ থাকা যায় কি না তারা জানে না। এমন সব নির্বিকার ও নির্বিরোধী মানুষ। এই নিয়ে পৃথিবী ঘুরছে। মানুষ নিজের অজ্ঞাতে জন্মায়, বিবাহ করে, মরে যায়। ভোট দেয়। অজ্ঞাতে ভবিষ্যৎ প্রবাহ নির্বাচন করে। কেউ মরল। কেউ বাঁচল। কারও গায়ে আঁচড়টিও লাগল না।

যেমন পরেশ বোস। যেমন তাঁর পরের ঘাড় কামড়ে জীবন অতিবাহিত করা। কোনও রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়ে তাঁর কিছু এসে যায় না। আজ তিনি তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছেন কারণ সকালে অনুপম বলেছিল, জরুরি কথা আছে। বলেছে যখন, আছে নিশ্চয়ই। কারণ এ বাড়িতে নোটিস দিয়ে ঘটে এমন ঘটনা বিরল। বছরে এক-আধ দিন, এক-আধ বার, এ পরিবার এক আদর্শ পরিবার হয়ে উঠতে চায়। চারজন একসঙ্গে খেতে বসে। কোনও তর্ক-বিতর্ক ঝগড়া-ঝাটি করে না। সুস্থ ও প্রশান্ত মস্তিষ্কে কোনও একটি সমস্যা নিয়ে ভাবে, মতামত দেয় এবং সিদ্ধান্ত নেয়। আজ সেরকমই একটি দিন। শবরী আজ পাঞ্জাবি পরোটা করেছেন সবার জন্য। সঙ্গে কষা মাংস। পরোটা ও মাংসের সুগন্ধে সারা পরিবারে সুখী পারিবারিক বাতাবরণ।

পরেশ সন্ধেবেলা স্নান করে সাদা পাঞ্জাবি চাপিয়ে ঘাড়ে-গলায় পাউডার মেখেছেন। শবরী আজ সাদাসিধে। পরোটা ও মাংস রান্না করতে গিয়ে পরিপাটি চুল বাঁধেননি। চোখে কাজল পরেননি। অনুপম হারমোনিয়ম নিয়ে বসেছে। এ হারমোনিয়ম তার নিজের। পরেশের মনে পড়ছে। তাকে না বলে হারমোনিয়মে হাত দিয়েছিল বলে অনুপমকে তিনি বেল্ট দিয়ে মেরেছিলেন। সারা গায়ে দাগ পড়ে গিয়েছিল। কয়েকদিন পর অনুপমকে একটি ছোট হারমোনিয়ম উপহার দিয়েছিলেন অরুণ সেন। পরেশের হারমোনিয়মে অনুপম আর কখনও হাত দেয়নি। ওই ছোট হারমোনিয়মেই গান গেয়েছে এতকাল। চাকরি পেয়ে সম্প্রতি এই হারমোনিয়মটি কিনেছে। বেশ ভাল জিনিস। বেশ কয়েকবার এটি বাজিয়ে গাইতে ইচ্ছে করেছে পরেশের। পারেননি। পিতা-পুত্র একই সঙ্গে গান গাইছেন এ দৃশ্য এ পরিবারে বিরল। কিন্তু গাওয়া হলে পরেশ নিজের হারমোনিয়মে বসেন, অনুপম তারটিতে। অনুপমও কোনওদিন তার হারমোনিয়ম পরেশকে বাজাতে বলেনি। সে রোজ ভোরে সংগীত অভ্যাস করে। তখন তানপুরা নেয়। তানপুরায় সুর সাধতে এখনও তার স্বর কাঁপে কারণ এক বছর আগেও এ বাড়িতে তানপুরা ছিল না। পরেশ শুনেছেন, প্রথম তিন মাস অনুপম ভোরে শুধু সা বলা অভ্যাস করেছিল। পরেশের মনে পড়েছে, গুরুজি বলতেন—সা বোল বেটা। পহলে সা লাগা। যো ঠিকসে সা বোলতা হ্যায় ও ঠিকসে সব বোলেগা।

সা বলা শেষ হল না। পরেশ রে গা মা পা গাইতে লাগলেন। আজকাল অনুপমের সুর শুনে নিজের সমস্ত দম্ভ ফাটিয়ে একটা আত্মকরুণা জন্ম নেয় পরেশের। সা বলা হল না। যথাযথ অভ্যাস করা হল না। কিছুই হল না তেমন।

অনুপম গাইছিল না। আপন মনে সুর বাজাচ্ছিল। সে কিছুটা অন্যমনস্ক। কিছুটা উদ্বিগ্ন। আজ সে সকাল থেকে বলে রেখেছে বলেই বাড়িতে একটি শান্ত আবহ আছে। তার কপাল ভাল। থাকবেই যে তার কোনও নিশ্চয়তা ছিল না। কিন্তু আছে বলে তার ভাল লাগছে। যেন-বা তারা একটা অন্য বাড়িতে এসে পড়েছে। এ বাড়ির চরিত্রগুলো তাদেরই মতো দেখতে কিন্তু ভিতরে ভিতরে পাল্টে গেছে আমূল। সে মনে মনে তার কথা সাজিয়ে নিচ্ছে। কেমন করে বলা যায়। দেবোপম জানে, কী বলা হবে। তার কোনও উদ্বেগ নেই। সে এখন একটি বই পড়ছে। বই না বলে একটি ছোট পুস্তিকা বলা যায়। ইসলামি তত্ত্বের সঙ্গে হিন্দুবাদ ও খ্রিস্টধর্মের মিল খোঁজা হয়েছে এতে। পুস্তিকাটি আনিসুজ্জামানের লেখা। দেবোপম মাঝে মাঝে আনিসুজ্জামানের কাছে যায়। বই পড়ে। নানা রকম আলোচনা করে। তার ভাল লাগে মানুষটিকে। কিন্তু অনুপম তাঁকে পছন্দ করে না। তার মনে হয় আনিসুজ্জামান বড্ড বেশি ভারসাম্য রেখে চলেন, বড় বেশি ভদ্র ও যথাযথ। কোনও কথা অকারণে বলেন না। বাড়তি বলেন না। কারও কাছে বিনা প্রয়োজনে যান না। তাঁর কোনও কিছু সম্পর্কেই কোনও অভিযোগ তোলা চলে না। সে একদিন দেবোপমকে জিজ্ঞেস করেছিল—ওখানে যে যাস, ভাল লাগে লোকটাকে? দেবোপম বলেছিল—অনেকক্ষণ কথা বলা যায়।

অনুপম অবাক হয়েছিল। তার এতদিন ধারণা ছিল তার ও অরূপের সঙ্গে ছাড়া দেবোপম কারও সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলে না। অরূপও বোধ হয় এ দলে পড়ছে না আজকাল। কিন্তু আনিসুজ্জামান কখন ঢুকে গেলেন! অনুপমের মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। গলা জড়িয়ে শিবের গাজন গাইবার অন্তরঙ্গতা হারিয়ে যাচ্ছে তাদের মধ্যে। কে কখন মাঝখানে ঢুকে পড়ছে কেউ জানে না। ইতিমধ্যেই পুপু ঢুকেছে। আনিসুজ্জামান ঢুকেছেন। ছন্দা বউদিও ঢুকেছে। আরও কেউ ঢুকেছে কি না কে জানে! অনুপম নিজেও এর জন্য কম দায়ী নয়। আর, হয়তো এরকমই হওয়ার কথা। এই-ই জীবনের নিয়ম। ভ্রাতৃত্বের মধ্যে ঢুকে পড়ে বহু অজানিত সম্পর্ক, আর সেগুলি কাঙ্খিত ছিল কি না বোঝার আগেই স্থায়ী ছাপ রেখে যায়। দু’টি চেনা মানুষকে ক্রমে অচেনা করে দিতে থাকে।

বাড়ির দায়িত্বশীল কর্তার মতো মুখ করে বিছানায় উঠে দুই ছেলের মাঝামাঝি বসলেন পরেশ। তাঁর সংসারে আসবাবপত্র কম। একতলায় একটি খাট ও ছড়ানো চেয়ার-টেবিল। একটি বাথরুম। সে-অর্থে একতলায় একটিই ঘর বলতে হবে। মাঝে মাঝে বড় ধরনের আড্ডা বা আসর সেখানে বসানো হয়। কোনও কোনও লোকের ক্ষেত্রে অরুণ সেন নিজের বাড়িতে আড্ডা জমাতে চান না। তখন পরেশের একতলা ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এ-ও ঠিক যে পরেশের একতলায় অরুণ সেন কখনও পানের আসর বসাননি। এ বিষয়ে শবরীর কোনও নিষেধ বা আপত্তি থাকলেও থাকতে পারে যদিও তিনি মাঝে মধ্যে পান করতে আসক্ত।

পরেশ লক্ষ করেছেন, বিশেষত সুরকার তিমির সেনগুপ্তকে অরুণ সেন স্বগৃহে নিতে চান না। পরেশের কানে এসেছে, অরুণ সেনের বিধবা বোন অন্নপূর্ণার প্রেমে পড়েছিলেন তিমির। বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। অন্নপূর্ণার কী মত ছিল জানা যায়নি। কিন্তু অরুণ সেন তা ঘটতে দেননি। পাঁচ বছর আগে তিমির সেনগুপ্তর ছেলে পুলিশের গুলিতে মারা যায়। পুলিশ না গুণ্ডা না অন্য পার্টির লোক তা জানা যায়নি। বাড়ির দরজায় তার গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ এনে ফেলে রেখেছিল কেউ। ছেলেটি নকশাল করত। তিমিরের স্ত্রীই প্রথম ছেলেকে ওভাবে শায়িত দেখতে পান। প্রথমে বাকরোধ হয়ে গিয়েছিল তাঁর। তারপর কথা ফিরে পান কিন্তু মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তিমির সুরকে আশ্রয় করেছিলেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রীর আর অন্য অবলম্বন ছিল না। ইতিমধ্যে তিনবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন তিনি। এখনও নাকি সারাদিন পরিকল্পনা করেন— কীভাবে মরা যায়। মাঝে মাঝে খুব শান্ত ও স্বাভাবিকভাবে বলেন— বুঝলে, ভাবছিলাম ফ্যান বা কড়িকাঠ থেকে হবে না। ভেঙে পড়তে পারে। পার্কের কৃষ্ণচূড়া গাছটা কেমন হয়?

তিমির কোনওদিন বেশি দেরি করে ফিরলে বলেন—আর একটু দেরি করলে না কেন, প্রায় ঠিক করে ফেলছিলাম।

সুর ছিল না। কথা ছিল না। শুধু ছেলে ছিল। স্বামীকে সুরের কাছে যেতে দিয়ে জীবনধারণের জন্য আপ্রাণ জড়িয়েছিলেন ছেলেকে। সেই ছেলে অনেক বড় জীবনের জন্য, আরও অমোঘ মায়ের জন্য সব ছেড়ে চলে গেল। আর তিমিরের স্ত্রী মৃত্যু আঁকড়ালেন।

আর তিমির সেনগুপ্ত হারমোনিয়াম বাজাতে বাজাতে, সুর তৈরি করতে করতে মাঝে মাঝে বলে ফেলেন—‘জল আসছে, চোখে জল আসছে। কোনও নতুন সুর বাজলেই ছেলের মুখ মনে পড়ে যায় আমার। তোমরা কিছু মনে কোরো না ভাই।’ কেউ কিছু মনে করে না। কেন করবে? ঘরে ঘরে এইরকম উন্মাদ, অর্ধ-উন্মাদ, শোকসন্তপ্ত বাবা-মা প্রত্যেকেই দেখছে কমবেশি। ঝকঝকে তাজা সব ছেলেদের মৃত মুখ। রক্তাক্ত শরীর। মসৃণ ও উদ্ভাসিত মেয়েদের ধর্ষিত মুহূর্তে কণ্ঠছেঁড়া চিৎকার, পোড়া দাগ গায়ে—সকলেই সহ্য করে যাচ্ছে, কতকাল, কতদিন। হয়তো তিমির সেনগুপ্ত একা বহুজনেরই হয়ে কাঁদছেন। কাঁদেন দিনের পর দিন। আর সেই চিঠিটার কথা বলে যান।

—জানো, সে কী লিখেছিল জানো? লিখেছিল—ভেবো না আমার জন্য। আমি ঠিক আছি। কোথায় কোথায় ঘুরত। ঠিকমতো খেতো না, ঘুমত না—তবু বলত, ভেবো না, ভাল আছি। ঠিক আছি।

—‘চিঠি দিয়েছিল বুঝি?’ জিজ্ঞাসা করে কেউ।

—কোথা থেকে দিয়েছিল? বাড়িতে কী একেবারে থাকত না?

তিমির সেনগুপ্ত তখন ব্যথিত দুই চোখ তোলেন। বলেন— না। সে চলে গিয়েছিল। জানত তো, মরে যাবে। মেরে ফেলা হবে ওকে। আজ নয় কাল। ওর বন্ধুদের মতো। কিংবা সহ যোদ্ধাদের মতো। ও তো বিশ্বাস করতে চেয়েছিল, যুদ্ধ করছে সবাই। তাই লিখেছিল—ভেবো না আমার জন্য। ভেবে কোনও লাভ নেই। বরং দুঃখ যদি একটু কমাতে চাও মাগো, তবে ওদের জন্যও ভালো। যাদের কিছুই নেই। জীবন না। সম্মান না। ঘর না। বাড়ি না। শুধু কষ্ট। শুধু একজন মানুষের মতো বেঁচে থাকার জন্য খালি গায়ে, খালি পায়ে থেকে ওরা শেষে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। না হলে অস্ত্র তুলতে আর কে চায় মা? সবাই শান্তিই তো চায়। সুস্থ জীবন চায়। মা, ভাবো, আমার মতো আরও শত শত ছেলেদের কথা—যারা জানে—মানুষের জন্য, দগ্ধ, পিষ্ট, অবহেলিত ওই মানুষগুলির জন্য তাদেরও অস্ত্র ধরতেই হবে। যুদ্ধ করতেই হবে। এবং হয়তো মরতে হবে। মা— আমাকে একা ভেবো না। আমি ওদেরই একজন। ওই সব সাহসী যোদ্ধাদের একজন। দেখবে তোমার আর কষ্ট নেই। জানবে, আমাদের সবার তোমার বুকে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে মা আমার। এরকম ভেবো, দেখবে, তুমিও একজন যোদ্ধা হয়ে গেছ। বীর যোদ্ধা। আমার বীরাঙ্গনা মা—আমার হাতেই অস্ত্র দিয়ে বলছ—যা খোকা, যুদ্ধ কর। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত যেন না থামে এ লড়াই।

মা, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গিয়েছে এই অপূর্ব যুদ্ধের গান। দেখো, আর কষ্ট থাকবে না মানুষের। এই অন্ধকার অবসিত হবে। আসবে নতুন যুগ। মানুষ নতুন করে ভাবতে শিখবে। নতুন জীবনযাপন করতে শিখবে। সমস্ত দেশের প্রতিটি শোষিত অবহেলিত ঘুমন্ত মানুষই আজ জেগে উঠেছে। এই এশিয়াকে দেখো, আফ্রিকাকে দেখো, লাতিন আমেরিকার দিকে তাকাও, মা, দেখতে পাচ্ছ না? সমস্ত শান্ত অচেতন মানুষের জাগরণ ঘটেছে মা। এতদিন যারা মুখ বুজে শুধু পরিশ্রম করে গেছে, শুধু রক্ত, ঘাম আর শ্রম দিয়ে গেছে, প্রাণ দিয়েছে দিনের পর দিন—বিনিময়ে কিছু চায়নি, এমনকী জানতেও চায়নি তাদের মানুষ বলা হল কি না—তারা আজ হাতে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করেছে। শক্ত মুঠি তুলে ধরেছে আকাশে। সবাই তো যুদ্ধ করছে মাগো! এ দেশের সমস্ত নিরন্ন মানুষ আজ যুদ্ধে গেছে। দেখো শ্রীকাকুলাম, দেখো গোপিবল্লভপুর, দেখো বহরাগোড়া। একটু, সামান্য আগুন, মা—দেখো নকশালবাড়ির ওই স্ফুলিঙ্গ সারা দেশে ধু ধু আগুন জ্বেলে দিল। ওই আগুনে আমরা সমস্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি পুড়িয়ে দেব। সমস্ত কুটিল জোতদার আর অর্থলোলুপ ওই মালিককে, যারা এতদিন গরিবের রক্ত শোষণ করেছে আর নিজেরা ঐশ্বর্যে বসে এই দুনিয়াকে ভোগ করছে, আমরা তাদের বেঁচে থাকতে দেব না। চাকা ঘুরে গেছে। পৃথিবী ঘুরছে। পরিবর্তনের দামাল হাওয়া লেগেছে পালে। এই পরিবর্তনকে আমরা আরও দ্রুত ও অবশ্যম্ভাবী করে তুলবই। আমি খুবই গর্বিত মা, আমিও এ পৃথিবীর অন্যতম যোদ্ধাদের একজন। একটা সুন্দর পৃথিবী গড়ব বলে, মা, প্রিয় মা আমার, চলে এসেছি তোমার কোল ছেড়ে। কিন্তু তুমি যেন কেঁদো না আমার জন্য। সোনা মা আমার। লক্ষ্মী মা। আমি আজ বেঁচে আছি। হয়তো কাল বেঁচে থাকব। পরশুও। হয়তো বেঁচেই থাকব মা, যতদিন না যুদ্ধের শেষটা দেখতে পাই।

ইতি—তোমার মানব

মানব, তিমির সেনগুপ্তর ছেলে, যে-দিন চিঠিটা লিখেছিল তার তিনদিন পর সে মারা যায়। তার মৃত্যুর পর চিঠিখানা হাতে পেয়েছিলেন তিমির। যুদ্ধের শেষ দেখা পর্যন্ত বাঁচেনি মানব। হয়তো তা সম্ভবও ছিল না। কারণ কেউই বলতে পারে না যুদ্ধ আদৌ থেমেছে কি না। আপাত শীতল পরিস্থিতির তলায় তলায় আগুন ঘনিয়ে উঠছে কি না। কারণ সত্যিই কেউ শান্তিতে নেই। সুখে নেই। সকলেই কি আর দুধে-ভাতে আছে গো? সুখে-দুখে শিক্ষায় সংগীতে আছে? সকলেরই কি কণ্ঠ ছেঁড়ে স্বাধীন চিৎকারে? ওই যে অন্ধর মা, পাঁচবাড়ি ঠিকে কাজ করে খায়— বস্তিতে উপচে ওঠা কাদাজলে থেকে থেকে হাতেপায়ে ঘা ধরে গেল, তবু কাজের বিরাম নেই, ও ভাল আছে? ওরা?

তিমির শোনান। মানবের চিঠি তিনি বার বার শোনান। আর সুর দেন। প্রেমের সংগীতে। বিরহ মিলনের গানে। বেশির ভাগ গানই তো ওই। কী মধুর ছোঁয়া! চোখে চোখে চাওয়া। কী মধুর হাসি। কত ভালবাসি। ভালবাসার ছেঁদো কথায় সুর মেলানো শস্তা শিল্পের শস্তা বিনোদন।

পরেশ দেখেন, তিমিরের ফর্সা মুখে চোখের তলার অংশে অন্ধকার। পুত্রশোক কালি লেপে দিয়ে গেছে। পরেশের মাঝে মাঝে মনে হয় পুত্রশোক না পাওয়া কত আনন্দের! ছেলে বেঁচে আছে, সুস্থ আছে, এটুকু দেখা কত আনন্দের! তাঁর ইচ্ছে করে, বাকি জীবন যদি শুধু ছেলের টাটকা সতেজ মুখের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যেত। মদে নয়, ঈর্ষায় নয়, হতাশায় নয়— শুধু ছেলে নিয়ে বাঁচা! ইচ্ছে করে তাঁর— বড়পমের গালদু’টি ছুঁয়ে থাকবেন, ওর বুকের পুরুষালি রোম ঢাকবার জন্য রঙিন পাঞ্জাবি কিনে আনবেন। তখনই ছোটপমের দিকে চোখ যায়। আর সব এলোমেলো হয়ে যায়। সমস্ত স্বপ্ন পতিত হয়। সমস্ত ইচ্ছের মৃত্যু ঘটে। পরেশ তখন আবার মদ খান। আবার ঈর্ষা করেন, আবার যন্ত্রণায় বিদ্ধ হতে হতে অরুণ সেনের সঙ্গে জীবনে অংশ গ্রহণ করেন।

আজ পরেশ চমৎকার আছেন। অনুপমকে বলছেন—শোনা, সেই গানটা শোনা।

—কোনটা?

—সেই যে—দেয়া ডাকে গুরু গুরু কী কথা বলে!

—আজ হবে না বাবা।

—কেন! হবে না কেন! লাগা। সুর লাগা।

অবিকল গুরুজির ভঙ্গিতে বলছেন পরেশ। লাগা। সুর লাগা। সা লাগা। সা বোল বেটা। সা বোল। কিন্তু অনুপম পারছে না। সুর লাগছে না গলায়। শুধু দেবোপম জানে। দাদার গলায় আজ কথা আটকে গেছে। সে হাসছে। তার বিরল হাসি সে হেসে নিচ্ছে মুখে বই চাপা দিয়ে। শবরী এসে দাঁড়িয়েছেন। হাত মুছছেন আঁচলে। বলছেন— বড়পম, বাবা বলছে, গা না।

ঘন ঘন মেঘ ডাকল বাইরে। তুমুল বিদ্যুৎ চমক মারল। কেউ বুঝি কোথাও বলল ধান মেপে দেবে আর তাই ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। দেবোপম উঠে বসল। অনুপমের কাছ থেকে টেনে নিল হারমোনিয়ম। ধরল—

সঘন ঘন ছাইল গগন ঘনাইয়া,

স্তিমিত দশ দিশি

স্তম্ভিত কানন

সব চরাচর আকুল—

কী হবে কে জানে।

প্রাণ দিয়েছে গানে আজ দেবোপম। যেন বৃষ্টি মেঘ বর্ষা ছিটকে ছিটকে উঠছে ঘরে। পরেশ তবলা পাড়ছেন। খাঁটি শিল্পীর মতো ভাল গানের কদর দিতে ঠেকা দিচ্ছেন। তাল পড়ছে। বর্ষায় একটু বসে আছে তবলা কিন্তু হাতুড়ি পেটার সময় নেই। শবরী পাউডার এগিয়ে দিচ্ছেন পরেশের হাতে। দেবোপম কি আজ ভাল আছে? কেন আছে? ভাবছে অনুপম। কবে ও ভাল থাকে? কীসে থাকে? যদি জানা যেত। ভাবতে ভাবতে গলা মেলাচ্ছে সে…

শবরী দেওয়ালে টাঙানো রবিঠাকুরের ছবির দিকে তাকাচ্ছেন। কী আসামান্য সৃষ্টি মানুষটার! ভাবছেন তিনি। সুর জড়িয়েছে তাঁকেও। তিনি ধরছেন—

ঘোরা রজনী

দিকললনা ভয় বিভলা।

চমকে চমকে সহসা দিক উজলি

চকিতে চকিতে মাতি ছুটিল বিজলী

পরেশের গাঢ় গম্ভীর গলা জুড়ছে এবার। বাদল বাতাস ঝাপট মারছে ঘরে। মোমের আলো কাঁপছে। কাঁপুক। আজ ল্যাম্প জ্বালা আছে। কাঁপে কাঁপুক। নেভে নিভুক। পরেশ সম স্বর ধরছেন—

…সহসা উঠিল জেগে প্রচণ্ড সমীরণ,

কড় কড় বাজ ॥

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেবতার মতো আলো দিয়েছেন, ঈশ্বরের মতো আনন্দ। প্রকৃতিকে গানে ধরেছেন আর গান প্রাণ ভরিয়ে সুন্দর করেছে পরেশ বোসের পরিবারকে। কয়েক মুহূর্তের জন্য গোটা পরিবার পৃথিবীর সেরা সুখী ও আদর্শ পরিবার হয়ে ঝলমল করছে। আজকের দিন যেন অন্য বই থেকে ছিঁড়ে আনা পাতা জুড়ে দেওয়া। কিংবা আজ প্রত্যেকে যথার্থ ভূমিকা পালন করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বৃষ্টি ছাপিয়ে সমবেত সংগীত পৌঁছে যাচ্ছে পাড়ায় পাড়ায়। লোকে অবাক হয়ে শুনছে। গালাগালি নয়, চিৎকার নয়, মদে জড়ানো কণ্ঠ ও দোষারোপ নয়—পরেশবাবুর বাড়ি থেকে ভেসে আসছে গান। যৌথ সংগীত। পাড়ার লোকে বলাবলি করছে—ওরা নিজেরা গাইছে। নিজেরা। ওরা গায়। ওরা সবাই গায়।

শবরী বসে পড়েছেন খাটের একধারে। বলছেন—ছোটপম! কী সুন্দর গাস তুই! কত বললাম, দাদার সঙ্গে গিয়ে তুইও শেখ। কিছুতেই কথা শুনলি না।

দেবোপম বলছে—ভাগ্যিস শিখিনি! দাদা কি তা হলে পাত্তা পেত?

সকলে হাসছে। একসঙ্গে হাসছে। আজ যেন খাট, বিছানা, দেওয়াল, আলমারি—সব হাসছে। শবরী বলছেন—গা ধুয়ে আসি। তারপর খেতে দেব।

পরেশ বলছেন—কী বই পড়ছিলিস রে ছোটপম!

অনুপমকে কেউ বলছে না, কী বলবি বল, কথা শুরু কর। এ বাড়িতে সবাই এমন। জিজ্ঞেস করবে না যতক্ষণ যে-যার কথা নিজে থেকে না বলে। অনুপম বলেছে তার কথা আছে, সেই শুরু করবে। দেবোপম হারমোনিয়ম ছেড়ে আবার বই তুলেছে। অল্প আলোয় পড়তে কষ্ট হচ্ছে। তবু পড়ছে। অনুপম তবলা তুলে রাখছে। এ বার হারমোনিয়ম তুলবে। পরেশ আবার বলছেন—কী বই রে ছোটপম?

দেবোপম বলছে—অদ্ভুত বই। অদ্ভুত সব কথা লেখা।

—কী লেখা?

—লেখা— সব প্রাণীই জন্মেছে জল থেকে।

—আর?

—মানুষের সঙ্গে মানুষের কোনও ভেদাভেদ নেই।

—ওরে ব্বাবা! কোনওটার সঙ্গে কোনওটার মিল নেই।

পরেশ হাসছেন। অনুপম গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে।

দেবোপম বলছে—মিল বুঝতে গেলে তোমাদের বইটা পড়তে হবে। এক লাইন শুনেই গোটাটা বুঝতে চাও নাকি?

অনুপম দুপুরে বইটি নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। বলল—আনিসুজ্জামানদা কিন্তু প্রচুর পড়েছেন। বইটা দেখলেই বোঝা যায়।

বইটি সম্পর্কে আলোচনায় মাতে দু’জন। আনিসুজ্জামানের নানা ভাবনা চিন্তা নিয়ে কথা বলে। আনিসুজ্জামানের গবেষণার বিষয়ে অনুপুঙ্খ জেনেছে দেবোপম। তার ভাল লেগেছে। এই ভাল লাগার কথা সে জানাচ্ছে অনুপমকে। আর ছেলেদের আলোচনা অচেনা লাগছে পরেশের। কত গভীর, কত বিস্তৃত আলোচনা করছে ওরা। পরেশ নিজে কি কোনওদিন ভেবে দেখেছেন এভাবে? এতখানি করে? অথচ তাঁরই চোখের সামনে এই ছেলে দু’টি কত বিচিত্র বিষয় নিয়ে ভাবতে শিখে গেল! তাঁর মনে হচ্ছে, তিনি যুগ যুগ ধরে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে আছেন। ওদের বড় হওয়ার পেছনে তাঁর কোনও ভূমিকা নেই। ওরা আপনা-আপনি বড় হয়েছে। আপনজালা গাছের মতো। তবু ওরা যেন অনেক বেশি সম্পূর্ণ। অনুপম আজ কী বলবে পরেশ স্পষ্ট করে জানেন না। কিন্তু অনুমান করতে পারেন—এই বয়সে, এই সময়ে, গোটা পরিবারের কাছে কী বলা যায়। তিনি বুঝতে পারছেন, সংসার বাঁক নিচ্ছে। তবে কি সত্যিই তাঁর একটা সংসার ছিল? আছে? এ সংসার তাঁর? তাঁর গলা শুকিয়ে যায়। এ প্রশ্নের উত্তর তিনি কোনওদিন পাবেন না। এ সংসারের জন্য তাঁর মায়া আছে। বিতৃষ্ণাও আছে। দেবোপমের দিকে তাঁর চোখ চলে যায়। বুকের মধ্যে ভয় গুড় গুড় করে। এই ছেলেটা চাকরি খোঁজে না। স্থিত হওয়ার চেষ্টা করে না। একলা একলা থাকে। বই পড়ে। ট্যুইশন করে নিজের খরচ চালায়। এই ছেলেটা স্পষ্ট বলে, সহজে রেগে যায়, সবসময় নিজেকে দূরতম বিন্দু করে রাখে। ও এরকম কেন? সঙ্গে সঙ্গে কাঁপন লাগে গায়ে। দেবোপমের কণ্ঠ পরিষ্কার কানে বাজে—কেন, তুমি জানো না? আমার কোথায় যন্ত্রণা, তুমি জানো না? মাই গুড ওল্ড বিলাভেড ফাদার—…।

তখন শবরী খেতে ডাকেন। আজ মাটিতে খাওয়া হবে। পরেশের সেই অর্থে কোনও খাবার টেবিল নেই। একটি টেবিল ও দুটি চেয়ার আছে বটে। তাতে সবাই মিলে বসে খাওয়া যায় না। পায়ে পায়ে খাবারের দিকে নেমে আসেন পরেশ ও তাঁর ছেলেরা। খাবারের পাত্র ঘিরে শূন্য চারখানি প্লেটের পাশে পাশে বসে পড়েন চারজন। একটি পাত্রে পরোটা অন্যটিতে মাংস। যার যতখানি লাগবে, তুলে নেবে। এভাবেই খাওয়া হয় এ বাড়িতে। তাতে কারওই কম-বেশি হয়নি। কেউই খিদে মেটেনি বলে অভিযোগ করেনি। চারজন নীরবে পরোটা ছিঁড়ে মাংসের ঝোল লাগিয়ে মুখে নেয়। দেবোপম বলে—তুই বলবি, না আমি শুরু করে দেব?

অনুপম চমকে ওঠে। বলে—কী?

—তুই যা বলতে চাস তা বলা শুরু না করলে আজ আর আলোচনাটা শেষ হবে না।

আলো এল। সমস্বরে আহ্ শব্দ ধ্বনিত হল একবার। দেবোপম উঠে বিছানা থেকে আনিসুজ্জামানের বইটা নিয়ে এল। পাতা খুলতে না খুলতেই আলো চলে গেল আবার। দেবোপম বু পাতা ওলটাচ্ছে। পরেশ একটি ল্যাম্প ওর দিকে এগিয়ে দিলেন। ঘরে এখন দু’খানি ল্যাম্প জ্বলছে। শবরী একটি রান্নার কাজে ব্যবহার করছিলেন। সেটি আনা হয়েছে। দু’টি ল্যাম্প মিলে বেশ আলো হয়েছে ঘরে। পরেশ আজ নিজের হাতে চিমনি পরিষ্কার করেছেন।

গোল করে ফিতে কেটেছেন। একেক দিন সংসারের খুঁটিনাটি কাজে মন লেগে যায় তাঁর। মনে হয়, এই তো, এই সেই দিন। আজ থেকেই মন লাগিয়ে নিখুঁতভাবে সংসার করা যায়।

শবরী পরোটা চিবোচ্ছেন। চোখে কাজল পরেছেন স্নান করে এসে। চুল খোলা। ল্যাম্পের আলোয় চোখ দু’টি তীব্র লাগছে। বলছেন—বইটা কার? ওই যে কলেজে পড়ায়? মুসলমান?

দেবোপম বলল—মা, তুমি মান্তুদাকে চেনো তো?

—হ্যাঁ, চিনব না কেন? ওই তো, কলেজে পড়ায়। বউয়ের সঙ্গে বোধহয় ডিভোর্স চলছে।

—বাঃ চমৎকার! আচ্ছা, মান্তুদার ক্ষেত্রে তো তুমি বললে না—ওই যে হিন্দু… কলেজে পড়ায়?

শবরীর মুখে অল্প অল্প আলো আঁধারি। রেখাগুলি কঠিন হতে থাকছে। পরিস্থিতি অনুধাবন করতে না পারলে তাঁর মুখ থেকে কঠোর ভাব বেরিয়ে আসে।

একটি হাড় থেকে মাংস ছিঁড়তে-ছিঁড়তে তিনি বললেন—এর মধ্যে এত জটিলতার কী আছে? এখানে আমরা সংখ্যায় বেশি, তাই ও ভাবে বললাম। এটা যদি একটা মুসলিম কান্ট্রি হত আর এক পাড়া মুসলমানের মধ্যে আমরা একঘর হিন্দু হতাম তবে ওরাও আমাদের দেখিয়ে বলত—ওই যে হিন্দু ভদ্রলোক তো, গান করেন—!

কয়েক মুহূর্ত সকলেই চুপ করে গেল। নতুন করে বৃষ্টি নামল। এতক্ষণ যে বৃষ্টি ছিল না তা বোঝা গেল নতুন করে নামা বৃষ্টির শব্দে। সে যে ছিল না, সে যে এল, তারই ঘোষণা হল যেন। অনুপম দেবোপমের দিকে তাকাল। বলল—তবে আমি এ বার বলি?

—বলো।

দেবোপম বই বন্ধ করছে। ল্যাম্পের আলোতেও অনুপমের মুখ লালচে দেখাচ্ছে। সে পরোটাগুলো টুকরো টুকরো করছে। কথা শুরু করার চেষ্টা করছে, তাই অন্যমনস্ক। নানাভাবে ভেবে রেখেছিল। কিন্তু এখন আর কোনও কাজে লাগছে না সে-সব। এ পরিবারে প্রত্যেকেই যে-কোনও বিষয়ে পরিষ্কার কথা বলতে পারে। হয়তো পরেশ ও শবরীর পারস্পরিক দোষারোপ ও কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির ইতিহাস এই খোলা পরিবেশ রচনা করেছে। তবু অনুপম আজ খানিকটা দ্বিধাবোধ করছে। অবশেষে শুরু করতে পারছে এভাবে—মা, তুমি তো আমাদের গানের স্কুলের অনুষ্ঠানে পুপুকে দেখেছ।

শবরী খাওয়া থামিয়ে নীরবে চেয়ে আছেন ছেলের দিকে। তাঁর সমস্ত স্নায়ু সতর্ক। কী বলবে ও! কী বলবে! পরেশ চোখ বন্ধ করে হাড় চিবোচ্ছেন। সবকিছু তাঁর ভাবনা অনুযায়ী এগোচ্ছে। একমাত্র দেবোপমই স্বাভাবিক। তার কোনও প্রতিক্রিয়া নেই।

অনুপম বলছে—মা, মানে, পুপুকে আমি…,পুপুকে আমার…,মানে পুপুর বাড়ি থেকে খুব চাপ। আসছে মা।

—কীসের চাপ।

পরেশ বলছেন—এত দেরি হয় কেন বুঝতে? এ সব সময় একটাই চাপ হয়। বিয়ের চাপ? নারে বড়পম?

পরেশকে খুশি দেখাচ্ছে। কিন্তু শবরী ভ্ৰূ কুঁচকেছেন। বলছেন—এখনই? ওর বয়স কত? দেখে তো পনেরো-যোলোর বেশি মনে হয় না।

—যোলো মা। ওদের বাড়িতে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেবার রেওয়াজ আছে।

শবরী ভাবছেন। অনুষ্ঠানের দিন পুপু ও অনুপমকে দেখে তাঁর সন্দেহ হয়েছিল। ছেলে কারওকে বিয়ে করবে, করতে চাইবে এ তো খুব স্বাভাবিক কিন্তু তাঁর ভাল লাগছে না কেন তিনি ভেবে পেলেন না। পরেশ বললেন— কী করেন পুপুর বাবা?

—সোনার ব্যবসা।

—ওরে বাবা! সে তো প্রচুর পয়সাওয়ালা!

অনুপম চুপ করে আছে। পরবর্তী প্রশ্নগুলো অনুমান করছে সে। পরেশ বললেন—অত বড়লোকের মেয়ে আমাদের এই সাধারণ ঘরে মানাতে পারবে নাকি?

অনুপম বলল—ও অন্যরকম।

পরেশ বললেন—কীরকম?

—ঘরোয়া।

শবরী বললেন—কিন্তু ও তো নাচ শেখে।

—তা হলেও। ঘরোয়াই। তা ছাড়া বিয়ের পর নাচ শেখা ছেড়ে দেবে বলেছে।

—কেন? ছাড়বে কেন? তুই বলেছিস?

অনুপম মাথা নাড়ে। না। সে বলেনি। এটা পুপুর নিজস্ব সিদ্ধান্ত। কারণ নাচ সে খুব আগ্রহে ভালবেসে শেখে না। তাকে জোর করে শেখানো হয়। পড়াশুনায়ও সে ভাল নয়। পাশও করে না প্রতি বছর। এই ষোলো বছর বয়সেও সে অষ্টম শ্রেণী পেরুতে পারেনি। গানের গলাও নেই যে গান শিখবে। তার চেহারা দেখলে রূপসী বলতে ইচ্ছে যায় তা নিশ্চিত কিন্তু সে-চেহারায় মেদবাহুল্যের প্রবণতা। তাই রূপের সঙ্গে গুণ জুড়তে এবং মেদ ঝরাতে সে নাচের স্কুলে যায়।

পরেশ শবরীর দিকে পর্যবেক্ষণের চোখে তাকান। শবরীর মুখ কঠিন। পরেশের হাসি পেয়ে যায় হঠাৎ। শবরী খুশি হতে পারছেন না। কেন? শবরী কি শাশুড়ি হতে চান না? বুড়ি হয়ে যাবেন? মনের মধ্যে আর্তনাদ ওঠে তাঁর। শরীর শরীর শরীর। শরীর ছাড়া কিছু বুঝলেন না শবরী। কোনওদিনই বুঝলেন না। প্রথম থেকে, যখন তাঁদের বিয়ে হয়েছে, যখন শবরী কুড়িও পেরোননি, তখন থেকে শরীরের টান ভাসিয়ে নিল শবরীকে। তাঁর শরীরের জন্য, কিংবা কে জানে হয়তো পরেশের নিজের শরীরের জন্যও, পরজীবী হয়ে থাকতে হল তাঁকে। দু’মুঠো ভাত, শবরী ও সন্তানের জন্য, যোগাতে কি সত্যি অক্ষম ছিলেন তিনি? ছিলেন না। তবু নানাবিধ শরীরী চাহিদার কাছে বিক্রিত হয়ে গেলেন। মানবজন্মের সবচেয়ে বড় অভিশাপ বোধহয় এই যে শরীরের নানাবিধ খিদের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া তার আর কোনও উপায় থাকে না। পরেশ শবরীর প্রতি বৈরিতা অনুভব করতে থাকেন। চকিতে সিদ্ধান্ত নেন বড়পমের বিয়েটা তাড়াতাড়ি ঘটিয়ে ফেলতে হবে। শবরীর আপত্তির বিরুদ্ধে যাবার সিদ্ধান্ত নিতে পেরে উল্লসিত লাগে তাঁর। বলেন—তা বেশ। তুমি যদি মনে করো এ বাড়িতে তার কোনও অসুবিধে হবে না তবে আর আপত্তির কী আছে? তুমি চাকরি করছ। বড় হয়েছ। আমাদের কোনও আপত্তি নেই।

শবরী খড়কুটো আঁকড়াবার মতো বলেন—কিন্তু অত ছোট! বড়পমের চেয়ে প্রায় বারো বছরের ছোট।

পরেশ বলেন—তাতে যে খুব আটকায় না এ আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। মনের মিল থাকলে আর বয়স কী?

শবরী বলেন—হুট করে একটা বিয়ে লাগিয়ে দেবে! বাড়িতে একটা ভাল ফার্নিচার নেই। ভাল বিছানা নেই। ছোটপম এখনও কিছু করে না—

পরেশ শবরীর কথা কাড়েন—ফার্নিচার? সে বানিয়ে নিতে ক’দিন! আর ছোটপম চাকরি করে না কিন্তু আমাদের কাছে হাত পাতে কি? ওর খরচ তো ও চালিয়েই নিচ্ছে। সেটাই তো যথেষ্ট। সত্যি বলতে কি শবরী, আমার ছেলেরা আমার গর্ব। আমি আর কী করেছি ওদের জন্য! ওরা তো নিজেরাই বড় হয়ে উঠেছে। আজ যে বড়পম ওর জীবনের সিদ্ধান্তের জন্য আমাদের অনুমতি চেয়েছে এই তো অনেক।

শবরী তবু গম্ভীর হয়ে আছেন। অনুপম ও দেবোপম পরেশকে দেখছে। লোকটা মাঝে মাঝে চমৎকার দর্শন রচনা করে! অনুপম ভাবছে—আসলে মানুষটা মহান। আসলে ভাল। মনে মনে সুন্দর। একজন শিল্পী তো। শিল্পীর মধ্যে একটি সুন্দর মন না থেকে কি পারে? জীবনটাকে ভুলে ভরে রেখেছেন। তাই মাঝে মাঝে খারাপ লাগে।

দেবোপম ভাবছে—এঃ! একেবারে বেড়াল তপস্বী! চমৎকার অভিনয় জানে লোকটা! কী অবলীলায় মহান হয়ে গেল! জাতে মাতাল, তালে ঠিক। কীরকম টনটনে জ্ঞান! অবলীলায় বলে গেল আমি তো ওদের জন্য কিছু করিনি! কেন করোনি? আমরা বারণ করেছিলাম? দাদা হারমোনিয়ম ধরেছিল বলে দাদাকে বেল্ট দিয়ে মেরেছিল। মনে নেই নাকি? শয়তানের বাচ্চা! আজ মহত্ব দেখাচ্ছে! বড়পম! ছোটপম!…

ডায়রিতে তারিখ লেখে না দেবোপম। সালও লেখে না। কোনও কোনও রাত্রিতে, গভীর ও স্তব্ধ সময়ের সঙ্গে নিজেরই মুখোমুখি বসবার মতো ডায়রির রুলটানা সাল তারিখ তিথির হিসেব ভর্তি পাতায় পর পর লিখে চলে যা মনে আসে। আজ সে শুরু করেছে এভাবে—

দাদা বিয়ে করছে শেষ পর্যন্ত। বলেছিলাম, এ বাড়িতে এই পরিবেশে পুপুকে আনতে তোর লজ্জা করবে না? ও বলল—কেন? লজ্জা কীসের? পুপুর কাছে কীসের লজ্জা? ও সব জানে। আমি জিজ্ঞেস করলাম—সব জানে? মানে সবই জানে? দাদা স্থির হয়ে আমার দিকে তাকাল। বলল—পুপুর বয়স মাত্র ষোলো। তা ছাড়াও ওর বয়সি মেয়েদের তুলনায় ও অনেক সরল। ওকে কেন ভালবেসে ফেললাম জানিস? ও নিষ্পাপ বলে।

আমি বললাম না যে যোলো বছর বয়সে সব মেয়েই নিষ্পাপ থাকে। সব মেয়েই এ বয়সে পবিত্র ও অনুগত হয়ে ভালবাসে। সব মেয়েই প্রেম দিয়ে পূজা দিয়ে এ বয়সে মরতে প্রস্তুত থাকে। আসল খেলা শুরু হয় তার পর।

বললাম না মানে বলতে পারলাম না। পুপুর যে-নিষ্পাপ সত্তাকে দাদা ভালবেসেছে তা বাসতে গেলে নিষ্পাপ হতে হয়। দাদাটা অন্যরকম। এ পর্যন্ত অনেক মেয়ে এসেছে ওর জীবনে। তারা কীভাবে এসেছে আমি জানি। মেয়েরা দাদাকে সহজেই পছন্দ করে ফেলে। ও কিন্তু কারওকে বেশি কাছে টানেনি। কারও সঙ্গে জড়ায়ওনি, কারওকে পরিকল্পিতভাবে দুঃখও দেয়নি। নিজের মধ্যে ও বেশ একটা শুচিতা বজায় রেখেছে। ও এখনও নিষ্পাপ, পবিত্রতা, পুণ্য, কল্যাণ, শুচিতা—এ সবে বিশ্বাস করে। করুক। ওর তো আমার মতো সংকট নেই। থাকলে ও- ও আমার মতো হয়ে যেত। ছন্দাবউদিতে গমন করত আর নীরবে প্রত্যাখ্যান করত সোনালির নিবেদন। মানে আমি যা করি আর কি! কিংবা কে জানে, ও হয়তো, আমার মতো সংকট নিয়েও এরকমই থাকত। সবার প্রতিক্রিয়া সমান হয় না। বিশেষ করে ওর দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই আলাদা। কিন্তু কতদিন এরকম থাকে, সেটাই প্রশ্ন। আমি ওকে বলেছিলাম—পুপু নিষ্পাপ হলেই তোর সমস্যার সমাধান হয় না। ও বলল—কেন? এরপর আমার সঙ্গে ওর দীর্ঘ কথা বিনিময় হল। সেই অমলেন্দু মারা যাবার পর আমাদের অনেক কথা হয়েছিল, তারপর আবার এই হল। আগে আমি আর ও রাতের পর রাত জেগে কথা বলতাম। কত কথা! রাস্তায় কে কী দেখলাম তাও বাদ যেত না। আস্তে আস্তে সবই বদলায়। আমরাও বদলেছি। যাই হোক, আমি ওকে বলেছিলাম—বাবার এই মাতলামো, মা’র এই অদ্ভুত বিষণ্ণতা, ন্যাকামি, যাই বল, আমাদের আশ্চর্য ইতিহাস, পাড়ায় আমাদের অবস্থান—এ সব ও যখন জানবে, খুব আঘাত পাবে না কি? ওর নিষ্পাপ মনে সে-সব দাগ কাটবে না? মা-বাবার একদিনের ঝগড়া শুনলেই তো ওর পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করবে। এ সব ওর বাড়িতে জানবে। ওর বাবা-মা তোকে দোষারোপ করবেন তখন।

দাদা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল—শোন্, পম, পুপুকে এ সব বলেছি আমি।

আমি—এ সব মানে?

দাদা—মা’র বিষণ্ণতা। বাবার মাতলামো। তোর গাম্ভীর্য।

আমি—আমি কেমন তাতে পুপুর কী যায় আসে?

দাদা—তেমন কিছু না। কিন্তু তোর কথানুযায়ী পরিবারের সার্বিক চিত্ৰই তো ওকে দেবার কথা। ও শুনে বলেছে, আমি যেমন আছি, তেমন থাকলেই ওর চলে যাবে। অন্যদের ও বেশ মানিয়ে নিতে পারবে। বাবার মদ্যপান আর মায়ের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া ও নিজের বাড়িতেও দেখেছে। ওর বাবা নাকি মদ খেয়ে ঝগড়া করেন আর ওর মাকে বাড়ি থেকে বার করে দেন। ওর মা পাশেই ওর মাসির বাড়িতে চলে যান। সেরকমই বন্দোবস্ত আছে। পরদিন ওর বাবা আবার সাধাসাধি করে মাকে নিয়ে আসেন।

আমি — বাঃ! চমৎকার! কিন্তু আমাদের ইতিহাস? আমাদের পরিবার? অরুণ সেন? এ সব? এ সব ও শুনবে না?

দাদা — ইতিহাসের কী আছে? ও সব আমাদের ছোটবেলাকার। যা দেখেছিস, ভুলে যা। আমরা তো কোনও অন্যায় করিনি। মানুষই তো হয়েছি। অনেক কষ্ট করে বড় হয়েছি। কিন্তু ভেসে যে যাইনি সেটাই তো সবচেয়ে বড় জোরের কথা।

আমি — কিছুই হইনি আমরা। কিছুই না। চোরাবালির ওপর দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের শুরুতেই গোলমাল। সেইসব ভাবতে আমার ঘেন্না লাগে। মরে যেতে ইচ্ছে করে। শুধু যে বেঁচে আছি কেন এটাই বুঝতে পারছি না।

দাদা — ছোটপম, আমরা কোথা থেকে এলাম, কীভাবে এলাম, কেন জন্মালাম, আমাদের বাবা-মা যথাযথ দায়িত্ব আমাদের প্রতি পালন করলেন কি না, তাঁরা নিজেদের কাছে যথেষ্ট সৎ ছিলেন কি না, আমাদের মধ্যে কার জিন, কার রক্ত—এ সব ভেবে কী লাভ? ভেবে দেখ— কোনও পুরুষ কোনওদিন নির্ভুলভাবে বলতে পারবে না—হ্যাঁ, আমিই এই সন্তানের পিতা। একমাত্র কোনও নারীই তা বলতে পারে। আবার নাও পারে। এর চেয়ে ভয়ঙ্কর কিছু নেই আবার এর চেয়ে সুন্দরও কিছু নেই। একটা মানুষ, সে মানুষ হয়ে জন্মেছে, তার স্বর আছে, মেধা আছে, বুদ্ধি আছে, অনুভূতি ও অভিব্যক্তি আছে। এই সুন্দর পৃথিবীকে সে ছুঁতে পায়, দেখতে পায়, পৃথিবীর ঐশ্বর্য ভোগ করতে পারে, সে গায়, কবিতা রচনা করে, আঁকে—নিজেকে সে বহুত্ব দিতে পারে, প্রকাশ করতে পারে নিজের ইচ্ছায়। এই কি যথেষ্ট নয়? একটা মানবজন্ম মানে এক বিশাল প্রাপ্তি। আমি তা পেয়েছি। আমি আর কিছু চাই না। কীভাবে পেয়েছি জানতে চাই এই মানুষজন্মই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কথা। ঈশ্বরকে তুই মনে কর তোর পিতা। তাঁর কাছ থেকে এসেছি। তাঁর কাছে চলে যাব। ঈশ্বর না হলে তুই একটা সময়কে কল্পনা কর। একটা সময় থেকে এসেছিস একটা সময়ের জন্য। আবার চলে যাবি। তোর সত্তাই আসল কথা। অন্য সব গৌণ।

আমি — এগুলো বানানো ভাষা। বানানো চিন্তা। বাস্তবকে অস্বীকার করে কল্পিত ভাবরাজ্যে ঘুরে বেড়ান। এ হল নিজের কাছে নিজের ফাঁকি। এভাবে ভেবে জোর করে ভাল থাকা যায় না।

দাদা — বানানোই তো। সবটাই বানানো। তোর জগৎটা তো তোকেই নির্মাণ করতে হবে। জগৎ তোর নিয়মে চলবে না। সূর্য সূর্যের মতো ওঠে। তোকেই ঠিক করতে হয় তুই ক’টায় অ্যালার্ম দিবি। তোকে সবাই খারাপ রাখার চেষ্টা করবে। কারণ নিজেকে ভাল রাখার জন্য প্রায় সব মানুষেরই অন্যকে খারাপ রাখার প্রয়োজন হয়। কিন্তু তুই আত্মসমর্পণ করবি কেন? তোকে ভাল থাকতে হবে। তোর নিজের জন্য। এর নাম প্রয়াস। এই ভাল থাকতে চাওয়া, ভাল হয়ে উঠতে চাওয়া—এরই নাম জীবন। এই প্রয়াসই বেঁচে থাকা এবং বেঁচে থাকার প্রেরণা। ওপরওয়ালার ওপর ভরসা করে নেমে পড়ো। যা হবার হবে। বেঁচে থাকার জন্য আরও ভাল থাকার ইচ্ছেটা চাই। ও কেন এমন করল। সে কেন ওমনি হল না! এ সব করে কেঁদে লাভ নেই। তুমি নিজেকে প্রস্তুত করো, যা তুমি হতে চাও।

আমি — ও সব ওপরওয়ালা-ফোয়ালায় আমার বিশ্বাস নেই। ঈশ্বরের অস্তিত্ব থাকলেও সে একটা একচোখো ভুলভাল লোক ছাড়া কিছু নয়। ঈশ্বর হল দুর্বলের অবলম্বন। ওই যে ফটিক বিলের লোকগুলো—যাদের ঘরবাড়ি জলে ভেসে আছে, খেতে পরতে পায় না—পচতে পচতে প্রাণধারণ করছে—ওরা কি ঈশ্বরকে রাতদিন ডাকছে না? কী লাভ হচ্ছে ওদের?

দাদা — এ প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই। আমি শুধু আমার কথা বলতে পারি। আমি তত্ত্ব জানি না। আমি মহাজ্ঞানী নই। গান ভালবাসি, গাই। এই পৃথিবীকে ভালবাসি তাই আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো বাঁচি। পেটের জন্য চাকরি করি। সময় হলে খোল কর্তাল বাজাতে বাজাতে হরিবোল বলে চলে যাব। তার আগে এই জীবনকে দেখে নিই। মৃত্যু তো আসবেই। জীবন মানে কী, সেটুকু বোঝার জন্যও তো বেঁচে থাকা দরকার। শেষ দিন উপলব্ধি করব—এই তবে জীবনের স্বাদ আর এই মৃত্যুর!

আমি — তুই তা হলে দারুণভাবে ঈশ্বর-টিশ্বর মানছিস। মাঝে মাঝে তো দক্ষিণেশ্বরেও যাস।

দাদা — হ্যাঁ। যাই। রামকৃষ্ণদেবের ঘরটায় গিয়ে চুপ করে বসি। চিন্তা করি। সব চঞ্চলতা চলে যায়। দেখিস একদিন গিয়ে।

আমি — ঈশ্বর যে আছে তার কোনও প্রমাণ যদি সত্যি কেউ দিতে পারত।

দাদা —

…who profess Him?

Saying : I believe in Him!

Who feeling, seeing,

Deny His being.

Saying: I believe Him not!

এর পরেরটা আমারও জানা। আমার অতি প্রিয় পিস। তবে ঈশ্বরের জন্য নয়। সাহিত্যের গুণে। তাই দাদার সুরে গলা লেগে গেল আমার। রবীন্দ্রনাথের গান যেমন কেউ গাইলে গলা লেগে যায়, তেমনি আমিও গ্যেটে বলতে লাগলাম—

Arches there not the sky above us?

Lies not beneath us firm the earth?…

দাদা —

…Vast as it is, fill with what

force thy heart,

And when thou in the feeling wholly blessed art,

Call it then, what thou wilt, —

Call it bliss! Heart! Love! God!

আমি — I have no name to give it!

Feeling is all in all,

দাদা — ভাব, এই লাইনগুলো ভাব ছোটপম। কী চমৎকার, ভাব। কল ইট ব্লিস! হার্ট! লাভ! গড! আই হ্যাভ নো নেম টু গিভ ইট! ফিলিং ইজ অল ইন অল। এরপরও তোর ইচ্ছে করে এইসব বিশ্রী স্মৃতির মধ্যে নিজেকে ফেলে রাখতে? ছেড়ে দে। ও সব ছেড়ে দে। প্রাণ আর অনুভূতির চেয়ে বড় কিছু নেই। তোর দেখার জগৎটাকে আরও বাড়িয়ে দে না। নিজেকে মহাবিশ্বের একটা অংশ বলে ভাব। অন্য সব তুচ্ছ মনে হবে। তোর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে নিজের জন্য একটা সুন্দর জগৎ তৈরি করে নেওয়া খুবই সম্ভব। পরেশ এবং শবরী বোসের অপসম্পর্ক ওঁদের ব্যর্থতা। আমাদের নয়!

দাদা পারে। আমি পারি না। আমি কিছুতেই পারি না। আমি কারওকে বিশ্বাস করিনি। ভালবাসিনি। নির্ভর করিনি। ছন্দাবউদির শরীর ধরলে আমার যন্ত্রণা হয়। না ধরলেও হয়। আমি কোথাও শান্তি পাই না। সোনালিকে আমি অকারণে বকাবকি করি। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি জোরে ধমকাই। ওর চোখে জল ভরে আসে। আমার ভাল লাগে না। তবু এরকম করি। মনে হয় এটাই ঠিক। এগুলোই আমার করার কথা। কীসের ভাল থাকা! কীসের প্রয়াস! আমি তো মরবই। মরে যাব। মৃত অবস্থাতেই আমার জন্ম। যার বাপের ঠিক নেই তার আবার প্রয়াস কী! মূল্যবোধ কী! আমি জানি আমার জীবনে কোনও প্রেম-ফ্রেম আসবে না। বউদিবাজি করতে করতেই আমি ফুটুস হয়ে যাব। মাঝে মাঝে যখন রেললাইন ধরে হাঁটি, অথবা শুয়ে থাকি লাইনে মাথা দিয়ে, রেল আসার আগে কাঁপন লাগে, যেন-বা ধাতব প্রবাহের শব্দও বয়ে যায়। আমার মনে হয় মৃত্যুর শব্দ। মৃত্যু আসছে। ভারী, গর্জনশীল, ধাতব ও কঠিন মৃত্যু। আর তখনই কোথা থেকে ফুলরেণু উপস্থিত হয়। কুঁজো, নড়বড়ে, হামাগুড়ি দেওয়া ঘুঁটেকুড়ানি ফুলরেণু! গায়ে গোবরের গন্ধ! আমাকে তাড়া দেয়— ওঠো, ওঠো। ট্রেন আসছে। বুঝতে পারছ না নাকি!

স্পষ্ট আদেশ করে সে। আমি উঠে পড়ি। তার বুকের দিকে তাকাই। ওই রোগা শরীরে কী বিশাল বুক! আমি যে কতখানি নোংরা, জন্মসূত্রে যে কতখানি লাম্পট্য আমি অধিকার করেছি, তা বুঝতে পারি। একটা লটপটে কুঁজো খুঁটেকুড়ানির শরীরের দিকেও আমি তাকাতে ভুলি না।

সে-দিন দাদার সঙ্গে কথা বলার পর থেকে দেবার্চনের কথা আমার মনে পড়ছে। খুব সুন্দর কথা বলত দেবার্চন। ওর মধ্যে গভীর দৃষ্টি ছিল। ও সঙ্গে থাকলে, কেন জানি না, আমার অশান্তিগুলো প্রশমিত হয়ে আসত। তবু ও যে-পথে গেল শেষ পর্যন্ত, আমি যেতে পারলাম না। একদিন বলেছিলাম— কারওকে পুরোপুরি বিশ্বাস করা ঠিক নয়। দেবার্চন সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল— সে কী! বিশ্বাসের আবার কম বেশি কী! বিশ্বাস মানেই অন্ধ বিশ্বাস। পুরো বিশ্বাস। বিশ্বাস থাকলে সম্পূর্ণ থাকে। না হলে থাকে না।

পরে ভেবে দেখেছি, সত্যি তো, বিশ্বাসের আবার সন্দেহ কী, যুক্তি কী। বিশ্বাস মানেই তো অন্ধ। সন্দেহ রেখে যুক্তি দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করলে বিশ্বাসে পৌঁছানো যায় না। যুক্তি বিশ্লেষণের রাস্তায় খানাখন্দের শেষ নেই, জিজ্ঞাসা, প্রতিযুক্তি, বৈরোধিত্যেরও শেষ নেই।

দাদাও দেবার্চনের মতোই বিশ্বাস করে জীবনকে, ভাল থাকার প্রয়াসকে। দেবাৰ্চনকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। ও ওর সমস্ত উপলব্ধিগুলি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করত। ওর কথায় রামকৃষ্ণের প্রভাব খুব স্পষ্ট ছিল। আবার পরে ও কীরকম মার্কসিস্ট হয়ে গেল। নকশাল হয়ে গেল। মরেও গেল। আমি শালা একটা ফালতু। ওই ফুলরেণুর চেয়েও নগণ্য। একটা কীটের বাচ্চা কীট। কিছুই হতে পারলাম না। কিছুই ধরতে পারলাম না। না ভক্ত হলাম না বিপ্লবী। না কংগ্রেসি হলাম না নকশাল। ভক্ত হলে ঈশ্বরে ভিজতাম, প্রেমে পড়তাম, কবিতা লিখতাম, নারীতে স্বর্গ দেখতাম। নকশাল হলে গুলি খেয়ে মরতাম বা জেলখানায়— পুলিশের গুঁতো খেতে খেতে পাগল বা পঙ্গু।

এখন গোটা একটা শরীর নিয়ে আমার মতো পঙ্গু আর কেউই নেই।

২৭

পলাশ বোন চেয়েছিল কিন্তু একটি ফুটফুটে ভাই হয়েছে তার। শেফালির মা অবাক মেনে গেছে। যে-দিন ব্যথা উঠল রাধিকার আর শ্যামল, কমল, পরমেশ সব মিলে শেফালির মা’র সঙ্গে সঙ্গে তাকে মাতৃসদনে নিয়ে গিয়েছিল, সে-দিন ঝড়জলের অন্ত ছিল না। যেন পানাপুকুরের পেত্নিরা পোয়াতি-শরীর খেতে না পেরে, শিকার হাতছাড়া হয়ে যায়-যায় দেখে আক্রোশে তুফান ডেকেছিল। আর মন্ত্র চড়িয়ে দিয়েছিল রাধিকার পেটে। ব্যথায় পাগল পাগল হয়ে গিয়েছিল রাধিকা। শেফালির মা’র কেবলই মনে হচ্ছিল ওর যমজ হবে। এখন অবাক মেনে গেছে সে। একটাই বাচ্চা আর তার কীরকম আশ্চর্য স্বাস্থ্য! কেমন করে হল? এই মেয়েটা নিয়ম করে খেতে পায়নি। একটু শান্তি পায়নি। শেফালির মা নিজেও তেমন আদরযত্ন করতে পারল কই! তবু রাধিকা একটি সুন্দর স্বাস্থ্যবান শিশুর জন্ম দিয়েছে। শেফালির মা মনে মনে মা মঙ্গলচণ্ডীকে স্মরণ করছে। সে যতবার বিপদে পড়েছে ততবার মঙ্গলচণ্ডী তাকে উদ্ধার করেছেন। শুধু শেফালিকেই আর পাওয়া গেল না। ব্রত, হত্যে, ঢিল বাঁধা, মানতসব বিফলে গেল। হবেও-বা মঙ্গলচণ্ডী তাকে কাছে টেনে নিয়েছেন। হবেও-বা তাকে ভাল রেখেছেন। তাই হবে। তাই হওয়াই সম্ভব। সে মঙ্গলচণ্ডীর ঘট প্রতিষ্ঠা করেছে। ফলফুল সংগ্রহ করছে। রাধিকা অদূরে বাচ্চা নিয়ে বসে আছে। তার দুই বুক দুধে টল টল করছে। পলাশ মাঝে মাঝে ভাইয়ের মুখ দেখছে। মাঝে মাঝে মায়ের মুখ। সে তার নিজের কথা ভাবছে। কবে মায়ের দুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল এখন আর মনে পড়ছে না। এখন ভাইকে দেখে তারও আবার একটু একটু পান করতে সাধ যাচ্ছে। বোন হয়নি বলে তার আর দুঃখ নেই। বেশ চমৎকার একটা ভাই হয়েছে। ক’দিন পরেই ভাই বড় হয়ে যাবে। সে খেলবে। হাত ধরে ইস্কুলে নিয়ে যাবে ভাইকে। মাঝখানে কার্তিক এসেছিল। ছেলে হওয়ার খবর পেয়ে এসে দেখে গিয়েছিল রাধিকাকে। কিছু টাকাপয়সা দিয়ে গিয়েছিল। শেফালির মা খুশি। কিন্তু রাধিকার ইচ্ছে করে না কার্তিক আসুক। যদি সে কোনওভাবে উপার্জন করতে পারত, যদি সে কোনওভাবে তার ও বাচ্চা দু’টোর পেট চালাতে পারত তা হলে কার্তিকের মুখও দেখত না।

শেফালির মা পূজার আয়োজন করছে আর ভক্তির কথা বলছে। রাধিকা কিছু শুনছে, কিছু শুনছে না। এখন সে ছোট ছেলের মুখ দেখছে। পলাশ কী সুন্দর, সে রাধিকার মতো হয়েছে। রাধিকা ভাবছে এই ছেলেটা কার মতো হল? কার মতো? কার্তিকের মতো? না না। কখনও নয়। পরমেশের মতো? যাঃ! তাই কখনও হয়? তা হলে কি শমসেরের মতো? যদি হয়! যদি হয়! তখন, ঠিক তখন, পলাশ বলল— মা, ভাইরে ঠিক জ্যোৎস্নার লাখান দ্যাখতে।

— কার লাখান কইলি? কার লাখান?

— জ্যোৎস্নার লাখান।

শেফালির মা হাসছে। রাধিকা হাসছে। শ্যামল কমল আর তাদের বাবা হাসছেন। কথা দেখো। জ্যোৎস্নার মতো মুখ! পলাশ লজ্জা পেয়ে গেছে। শ্যামল বলছে— বেশ তো, বউদি, ওর নাম রাখো জোছন। ভাল না?

ভাল, ভাল। সবাই ভাল বলছে। কী চমৎকার নাম! জোছন! পলাশের ভাই জোছন। এ কি মেলে? পলাশের ভাই বিকাশ বা প্রকাশ হলে কি ভাল হত না? না না। এই ভাল। বেশ মিলছে। পলাশের ভাই জোছন। জ্যোছনায় পলাশ ফুটে আছে। ভাবো। ভেবে দেখো কী চমৎকার! শেফালির মা পাঁচালি পড়ছে। আজ সবাই দেরি করে কাজে যাবে। পুজো হবে। ফলপ্রসাদ খাবে। তারপর যাবে। এমনকী পরমেশ পর্যন্ত। শেফালির মা’র স্কুল ছুটি। তবু বেলার দিকে তাকে একবার হেডদিদিমণির বাড়ি যেতে হবে। সেখানে কারা কারা আসবে। শেফালির মা হেডদিদিমণিকে সাহায্য করতে যাবে। অন্ধর মাও আছে। কিন্তু তাকে দিয়ে সবটা হবে না। সে তেমন ভদ্রসভ্য নয়। বস্তির মহিলা। ওই কাপড় কাচা, বাসন মাজার বাইরে কী-ই বা সে পারবে! শেফালির মা তেমন নয়। গরিব কিন্তু বস্তির নয়। অভাবগ্রস্ত কিন্তু অসংস্কৃত নয়। তার পোশাকে, আচরণে আর্থিক স্বল্পতা প্রকাশ পায় কিন্তু হাঘরেপনা নয়। তাকে আদেশ করা যায় কিন্তু সেই আদেশে কিছু বা সম্ভ্রম মেশাতেই হবে যেন। শেফালির মা দ্বারা হেডদিদিমণিরও রুচি অভিব্যক্ত হয়। এবং শেফালির মা নিজেও বস্তিবাসী শ্রেণীকে অসহ চক্ষে দেখে। সে নিজে দশঘরের মধ্যে থেকেও স্বাতন্ত্রের আত্মসম্মান বোধ করে। এমনকী, হেডদিদিমণি তাকে এমন দিনে ডেকে থাকেন যে-দিন অন্ধর মাকে ডাকা যায় না— এই উপলব্ধি তাকে উদ্দীপ্ত করে।

মঙ্গলচণ্ডীর পুজো সেরে, রান্নাবান্না করে যাবে শেফালির মা। এখন সে পড়ছে। মা মঙ্গলচণ্ডীর মহিমাকীর্তন করছে। পয়ারে পড়ে যাচ্ছে উপাখ্যান।

চণ্ডিকা দেবীর বরে লুপ্ত ধন জন।

দেখিতে দেখিতে তরী ভাসে সেইক্ষণ ॥

আনন্দে উৎফুল্ল হল সাধু ধনপতি।

বহু দ্রব্য লয়ে দেশে যাইল ঝটিতি ॥

ঘাটে রাখি তরী যত দূত পাঠাইল।

সাধুর গৃহেতে বার্তা তখনই জানাল ॥

বার্তা পেয়ে দ্রুতগতি খুল্লনা যুবতী।

পুরাঙ্গনা সাথে লয়ে আসে শীঘ্রগতি ॥

আনন্দে উৎসবে তবে ধনজন লয়ে।

নিজ গৃহে গিয়ে তথা পূজে চণ্ডী মায়ে ॥

পরম আনন্দে যাপে সাধু ধনপতি।

সুরপতি যথা করে স্বর্গেতে বসতি ॥

এবং খুল্লনার সুখ দেখে সমৃদ্ধি দেখে দেশে দেশে যুগে যুগে সমস্ত নারীই মঙ্গলচণ্ডীকে পূজা করতে থাকল। তারাও সুখে-সমৃদ্ধিতে ভরে উঠল। আর কোথাও কোনও দুঃখকষ্ট রইল না। আর এত কিছু শুনেও একটুও পূজায় মতি হল না রাধিকার। সে প্রণাম করল বটে, প্রসাদ খেল বটে, কিন্তু ছেলে কোলে নিয়ে পরমেশকে দেখল। দু’চোখ ভরে দেখল। আর শমসেরকে ভাবতে লাগল। এই পরমেশ তার কেউ-ই নয়। এক বাড়ির ভাড়াটে বই কেউ-ই নয়। তবু, খিলপাটনি থেকে এসে, শমসেরকে, বাবাকে, গ্রাম ও রূপসী নদীকে ছেড়ে এসে তার যখন ভীষণ কষ্ট হত আর কষ্টে দম আটকে আসত তখন এই দশ ঘর ভাড়াটের মধ্যে, কার্তিকের কঠিন পেষণের মধ্যে পরমেশ আস্তে আস্তে স্বপ্ন হয়ে গেল। শমসেরের মধ্যে মিলিয়ে গেল সে। অথবা শমসের পরমেশ হয়ে গেল। রাধিকা ইচ্ছে করলে তাদের মিলিয়ে দিতে পারে, ইচ্ছে করলে জুড়ে দিতেও পারে। আবার আলাদাও করতে পারে। তার যখন যেমন ইচ্ছা। আজ পরমেশকে দেখে তার আশ মেটেনি। আজ তাকে শমসেরে পেয়েছে। কেমন আছে শমসের? কোথায় আছে? কেমন দেখতে হয়েছে তাকে? ঢাকা থেকে তিন-চারটে পাস দিয়ে এসে সে কি তার বাবার মতো জমিজমা দেখাশুনা করছে? সে কি বিয়ে করেছে এতদিনে? সে কি সুখী? বউকে নিয়ে সুখী? এই বউকে কি বলেছে সে— তরে বিয়া করুম। বিয়া করুম তরে?

ছেলে বুকে করে আনমনা হয়ে আছে রাধিকা। সে যখন কার্তিকের সঙ্গে এ পারে চলে এসেছিল তখন শমসের খিলপাটনিতে ছিল না। অনেকদিন ধরেই ছিল না। ঢাকায় গিয়ে সে খুবই শহুরে হয়ে উঠেছিল। খুব দ্রুত সে ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। তারপর আগুনের মতো ছড়িয়ে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। রাধিকা এ সব জানে না। আন্দোলন জানে না। মুক্তিযুদ্ধ জানে না। তাদের খিলপাটনি গ্রামে এ সবের আঁচ আসতে না-আসতে রূপসীর জলে ভেসে যেত। চার-পাঁচ মাস বর্ষার সঙ্গে, রোগ-বালাই, অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে কেই-বা বাড়তি ভাবনাচিন্তায় ঢুকবে? সে আলগা আলগা যতটুকু বুঝেছিল তাতে ধারণা হয়ে গিয়েছিল যে শমসের কোনও সাংঘাতিক কাজ করছে, কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যার জন্য বুঝি-বা তার প্রাণও চলে যেতে পারে এবং সে বুঝে গিয়েছিল শমসের বিয়া করার কথা ভুলে গেছে। রাধিকাকে ভুলে গেছে। ভাঙা শিবমন্দিরে শমসের আর রাধিকা যে একাঙ্গী হয়ে গিয়েছিল একদিন আর পরস্পর প্রতীক্ষা করার জন্য প্রতিজ্ঞা করেছিল সেইসব আর মনে নেই। শমসের রাধিকাকে প্রতারণা করেছিল। ছি ছি! এ সব কী ভাবছে সে! দু’হাতে মুখ চাপা দেয় রাধিকা। ঢাকায় চলে গিয়েছিল বলে, অনেকদিন আসেনি বলে, কিংবা সে যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ কাজে জড়িয়ে গিয়েছিল সেহেতু সে যে আর ফিরে আসত না কখনও, রাধিকাকে বিয়ে করতে চাইত না, তা কে বলতে পারে? সে হয়তো নিশ্চিন্ত ছিল। জানত রাধিকা আছে। প্রতীক্ষা করছে তার জন্য। সারা জীবন। সে ভেবে থাকবে, সমস্ত যুদ্ধের পর সে ফিরে আসবে। রাধিকাকে বলবে—‘কোল পেতে দাও। আমি ঘুমুব। আমি ক্লান্ত, বড় ক্লান্ত!’ আর রাধিকা কোল পেতে দেবে তখন। সারা শরীরে সুগন্ধ মেখে রাখবে। চুলে সাজিমাটি ঘষে রাখবে। শমসেরের জন্য নিজেকে সাজিয়ে রাখবে রাধিকা। একটা লাল… না না একটা হলুদ রঙের ঢাকাই শাড়ি পরবে, সেটা শমসের ওর জন্য নিয়ে এসেছে—

পিয়া যব আওব এ মঝু গেহে।

মঙ্গল যতহুঁ করব নিজ দেহে ॥

কনয়া কুম্ভ করি কুচযুগ রাখি।

দরপণ ধরব কাজর দেই আঁখি ॥

বেদী বনাওব হাম অপন অঙ্গণে।।

ঝাড়ু করব তাহে চিকুর বিছানে ॥

কিছুই ঘটেনি এ সব কিছুই হয়নি। তার আগেই রাধিকা কার্তিকের সঙ্গে চলে এসেছে। শমসেরকে কিছুই না বলে, কারওকেই কিছু না বলে ওই গ্রাম, ওই নদী, বাবা সব ফেলে চলে এসেছে। পথের কথা কিছুই মনে নেই তার। কীভাবে এসেছিল এতখানি? কোন পথে? শুধু মনে আছে একটা জায়গা। তাদের গায়ের মতোই জায়গাটা। শুধু তার নাম বর্ডার। বর্ডার কাকে বলে সে জানত না। পরে বুঝেছিল ওটা সীমান্ত। এ পাশে পাকিস্তান, ও পাশে ভারত। দু’টি আলাদা দেশ। তারা পাকিস্তান থেকে ভারতে আসছিল। কার্তিক দু’টি লোককে টাকা দিয়েছিল। তারা নিরাপদে সীমান্ত পার করে দিয়েছিল কার্তিক ও রাধিকাকে। ওরা কার্তিকের চেনা লোক। আগে এ পার থেকে চাল নিয়ে ও পারে চালান করত কার্তিক। সেই চাল সব রেল-ওয়াগন থেকে বার করা। লুঠ করা চাল। কার্তিক সরাসরি ওয়াগন ভাঙত না। কিন্তু লুঠ করা চাল যেখানে বিক্রি হত তার একটা ঘাঁটি ছিল বনগায়। সে সেখানে কাজ করত। চাল পৌঁছে দিত ও পারে। এ কাজ করতে গিয়েই একজনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়ে যায়, যে সত্যবন্ধুকে চিনত আর জানত সত্যবন্ধুর একটি গলগ্রহ ভাইঝি আছে। সোমত্ত। বিবাহযোগ্যা। কার্তিক জুটে গিয়েছিল। কাকা জেনেছিল, বাবা জেনেছিল ব্যবসা করে। ভাল ব্যবসা। সেই লোকটি বলেছিল। কেউ ভাল করে খোঁজ নেয়নি। নেবার প্রয়োজনও ছিল না হয়তো। খোঁজ নিয়ে বিয়ে দিলেই তো অনেক টাকা লাগত। কে দিত সে টাকা? সত্যসাধন পঙ্গু হয়ে পড়েছিল তখন। মা হারিয়ে গিয়েছিল। একেবারে একা হয়ে গিয়েছিল রাধিকা। একেবারে বোঝা হয়ে গিয়েছিল। দিনরাত কাকির মুখনাড়া খেতে আর ভাল লাগত না। যখন কার্তিক এল আর বিবাহের কথা হয়ে গেল, সে একটুও আপত্তি করেনি। সে শুধু দু’টো দিন সময় চেয়েছিল। সেই দু’দিনে সে সারাদিন রূপসীর পাড়ে ওই ঝাঁকড়া জামরুল গাছের তলায় দাড়িয়েছিল। কিংবা চলে গিয়েছিল মন্দিরতলায়। তাকে দেখে শিবলিঙ্গের মাথায় চাপানো বেলপাতা খসে পড়ছিল। মন্দিরের ঠাণ্ডা মেঝে আর সোঁদা গন্ধ— অলস নির্জনতা— রাধিকার মনে হয়েছিল বুঝি-বা এ সময় দেবতার দেখা পাওয়া যায়। সে বুঝি বিভ্রান্ত হয়েছিল কাকে দেবতা মনে করে ভালবাসবে। দেবতাকে সেরা ভালবাসা নিবেদন করতে হয়। সে, তার সুন্দরতম প্রেম, শমসের ছাড়া এমনকী দেবতাকেও দিতে প্রস্তুত ছিল না। সেইসব নির্জন সময়, যখন সে ভেবেছিল দেবতা আবির্ভূত হলেও হতে পারেন, তখন প্রকৃতপক্ষে শমসের প্রার্থনা করেছিল। সে আজও বিশ্বাস করে থাকে— সেদিন শমসের থাকলে আমৃত্যুই রাধিকা তার খিলপাটনি গ্রাম ও রূপসী নদীর অঙ্গাঙ্গী থাকতে পারত। তেমন আর সম্ভব ছিল না। তেমন ঘটেনি। তার চোখ জ্বালা করছিল। সে বলেছিল— হয়তো আর আসব না কোনওদিন। আর কখনও দেখা হবে না। সে জামরুল গাছের গায়ে কাঠি দিয়ে লিখেছিল— ‘চলে যাচ্ছি।’ কে চলে যাচ্ছে? কাকেই-বা সংবাদ দিয়েছিল জানল না কেউ। শুধু জামরুল গাছের কাণ্ডে শিহরণ জাগল। ছাতারেরা কিচিমিচি করল আর রূপসী বয়ে গেল চুপচাপ। শমসেরদা কি জানবে না এ লেখা তার? কিংবা, কে জানে, শমসের ফিরে আসার আগেই হয়তো ছাল গজিয়ে যাবে। লেখাটুকু হারিয়ে যাবে। রাধিকা দেখেছিল এতটুকু জল জমে নেই, এতটুকু কাদা নেই কোথাও। হেমন্তের গন্ধ ছড়িয়ে গিয়েছিল চারপাশে। একলা শিবলিঙ্গ পাথর হয়ে ছিল। দ্বিতীয় দিন সে সারাদিন বাবার কাছে ছিল। আর সে-দিনই বলেছিল সেই লুকনো কথাটা।

— বাবা।

সত্যসাধন কথা বলতে পারে না তখন, কিন্তু চোখ কথা বলে। মুখে জান্তব শব্দ হয়। তার বাঁ দিক অসাড় হয়ে গেছে এই ছ’মাস হল। শরীর শুকিয়ে গেছে। মরে যাবে যে কোনওদিন। ওই অবস্থাতেও চলে আসার আগের দিন রাধিকা জানিয়ে দিয়েছিল সব। কেন জানিয়েছিল সে জানে না। শুধু মনে হয়েছিল, বলা দরকার। শমসের থাকলে হয়তো বলত। কিন্তু সে আর এল কই! এখন, কথা বলবার জন্য সাকুল্যে বাকি বাবা। তাকে ছাড়া আর কাকেই-বা বলবে। সে ডেকেছিল— বাবা।

সত্যসাধন চোখ মেলেছিল। সে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বলেছিল, একখান কথা আসিল বাবা। গুহ্য কথা।

সত্যসাধনের নাকের দু’পাশ কাঁপছে। চোখের নীচেকার শিথিল ও কালশিটে পেশি কাঁপছে। এই তার প্রশ্ন। এটুকুই অভিব্যক্তি। রাধিকা বড় বেদনায় বলেছিল— বাবা, মায় ডুবেনাই গ। মায় ভাইসা গেসিল। যেই সালতিখান চুরি হইসে বইলা তোমরা ভাবসিলা, সেইখান মায় লইয়া গেসিল।

সত্যসাধনের নাকের দু’পাশের কাঁপন বাড়ছে। চোখের তলাকার কাঁপন বাড়ছে। প্রশ্ন, প্রশ্ন, আরও প্রশ্ন। অনেক প্রশ্ন। যেন-বা বলতে চায়, কীভাবে জানলি রাধিকা? রাধিকা বলেছিল— আমি মায়রে দ্যাখসিলাম বাবা।

সত্যসাধনের চোখগুলো প্রথমে বিস্ফারিত হয়েছিল। তারপর ঠোঁট কুঁচকে গিয়েছিল। তার স্থবির অথর্ব ঘোলা ও নিরভিব্যক্তিক চোখে জল ভরে এসেছিল। যেন-বা অভিযোগ। যেন-বা হাহাকার। যেন-বা অক্ষমতার তীব্র যন্ত্রণা। যেন তার আকুল প্রশ্ন নিঃশব্দে উচ্চারিত হয়—কইস নাই ক্যান? তখন কইলি না ক্যান?

রাধিকা শুকনো তখন। যেন-বা মরুবালুরাশি। যেন তার কান্না নেই। যেন তার চলে যাবার প্রাকলগ্নে এতটুকু বেদনা নেই। জীবনের অনিবার্য পরিণতি সম্পর্কে যেন সে মহাপুরুষের মতো ত্যাগী ও ধৈর্যশীল। স্বগতোক্তির মতো বলেছিল সে— বুঝিনি গো বাবা। কিছুই বুঝিনি। মন্দিরতলা থেকে অন্য এক রাধিকা হয়ে ভেসে এসেছিলাম তখন। আমার চোখ ছিল কিন্তু দৃষ্টি বন্ধ ছিল। আমার মাথা ছিল কিন্তু মস্তিষ্ক অসাড়। বাবা গো, আমি যে সে-দিন প্রাণ পেয়েছিলাম। বুঝিনি, আমার প্রাণপ্রদায়ী মানুষের সন্ধান পেয়েছি এমন দিনেই আমার জন্মদায়িনী মা হারিয়ে যাচ্ছে। একজনের বুকের মধ্যে গভীর আশ্রয় পেয়েছিলাম বলে আরেকজন নিজের বুক উপড়ে চলে যাচ্ছে! যেন ওই দিনটুকু পর্যন্তই তার থাকার কথা ছিল। যেন আমারই জন্য তার থাকার কথা ছিল। বাবা। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল তখন। আমি যেন দেখলাম, ওই বাদল পেরিয়ে কার সালতি ভেসে যায়! কার সালতি জল ডিঙিয়ে মেঘে মেঘে মেশে। তার আঁচলখানি ওড়ে। তার চুল বুঝি বাহিত হয় জলধারায়। বাবা। আমি বুঝি নাই গ। জানি নাই গ। মায় ভাইসা যায়।

তার পর থেকে আজও জলের কাছে একলা দাঁড়ালেই তার মনে পড়ে সালতি বেয়ে ভেসে যাচ্ছে কে! মা-ই কি ছিল? যেন সে-দিন স্পষ্ট করে দেখেনি বলে আজও প্রত্যয় হয় না। তখন, নদী দু’কূল ছাপালে যেন তাকে গুণ করত কেউ। অনেকক্ষণ ধরে উথাল-পাথাল জল দেখত সে আর শব্দ শুনত। এমনকী বিছানায় রাত্রে শুয়েও—যতক্ষণ ঘুম না আসে। এই শব্দের সঙ্গে বকুলফুলের সম্পর্ক পাতাবার ইচ্ছাও তার হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জলের শব্দকে সে কিছুতেই মেয়েমানুষ ভাবতে পারেনি। জলের শব্দ মানেই যেন বেটাছেলে— যে উন্মত্ত টানে কিন্তু যাকে লজ্জা পেতে হয়। শান্ত পুরুষের মতো, উদ্দাম পুরুষের মতো, জলশব্দেরও যে কত ধারা! সারাক্ষণ এই নিয়েই সে থাকে। এই সবই ভাবে। এই আকাশ-পাতাল ভাবনা ছাড়া কিছুতেই মন লাগে না রাধিকার। সবসময় চুপ করে বসে থাকতে ইচ্ছে করে। শুধু পরমেশ এলে ভাল লাগে। অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করে। আবার মাঝে মাঝে তাও করে না। ইদানীং সকালটা শরতের মতো লাগে। পুজো এসে গেল। রাধিকা আকাশের দিকে তাকায়। বর্ষা ফুরিয়ে গেলে তার মন খারাপ করে। বর্ষায় মানুষের কত কষ্ট! তবু তার মন খারাপ করে। বর্ষায় শমসেরকে সে যতখানি করে পায় তেমন আর কখনও পায় না। সে ভাল করে ঘরখানি দেখে। এ ঘরে থাকতে থাকতে, এ ঘরের পরিচিত দৃশ্যে পরমেশকে দেখতে দেখতে, এ ঘরেই যেন শমসের পরমেশ একাকার হয়ে গেছে। এই ঘরও তাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে। কার্তিক শেষ যে-দিন এসেছিল, বলে গেছে। অনেকদিন হল চালের কারবার ছেড়ে দিয়েছে কার্তিক। ও সব আর ভাল লাগে না। হৃদয়পুরে কাঠের কারবারে জুটেছে। কত কি আয় করে রাধিকা জানে না। সত্যিই কি ওখানে আর একটা সংসার করেছে কার্তিক? করেছে নিশ্চয়ই। নয়তো আসে না কেন? থাকে না কেন? আগে যার একটা দিন শরীর ছাড়া চলত না সে এখন ঘরমুখোও হয় না কেন? সে বরং এক পক্ষে রাধিকার ভাল। না আসুক কার্তিক। সে এভাবেই কাটিয়ে দিতে চায়। কিন্তু টাকা? সে কোথায় পাবে? তার মন আরও ভার হয়ে যায়। মুক্তি নেই। কোথাও মুক্তি নেই। কার্তিক বলে গেছে, ফটিক বিলের ধারে একখানা ঘর নিয়েছে রাধিকার জন্য। দক্ষিণেশ্বরে যেতে ফটিক বিলের ধার দেখেছে রাধিকা। দুরে রেললাইন চলে গেছে। মাঝখানে ফটিকবিল। তার ধারে অসংখ্য ছোট ছোট ঘর। বাঁশের বেড়া। মাটির বেড়া। টালির চাল। পাশাপাশি ঘেঁষাঘেষি নিচু নিচু ঘর। বিলের ওপর উঁচু বাঁশে চট টাঙিয়ে পায়খানা। ফটিক বিলের বস্তি। বস্তি কেমন হয় রাধিকা জানে না। হয়তো এরকমই হবে। বা এর চেয়ে খারাপ। সে বস্তি ভালবাসতে পারবে কি? পছন্দ করতে পারবে কি? সে জানে না। কীসে আনন্দ তার, কীসে দুঃখ সে জানে না। শমসের বিনা জীবনের এইসব বোধগুলি সম্পর্কে চিরবিভ্রান্ত বুঝি সে। এখানে এই দশ ঘর ভাড়াটের মধ্যে শেফালির মা ছাড়া, পরমেশ ছাড়া কাকেই বা ভালবাসতে পারল রাধিকা। কারওকে নয়! প্রায়ই ঝগড়া লাগে এখানে। শাশুড়ি-বউতে লাগে। ননদে-ভাজে লাগে। স্বামী-স্ত্রীতে তো সব ঘরেই লাগে। মা বাচ্চাদের কিলোয়। এ বাড়ির বউ ও বাড়ির বউয়ের সঙ্গে গলা খুলে ঝগড়া করে আর এ ওর সুসম্পর্ককালে বলা গোপন কথা ফাঁস করে দেয়। রাধিকার বোধ হয় বস্তিও এমনই সংস্করণ। শুধু সেখানে ভাষায় অকথ্য শব্দ জুটে যায় হয়তো চিৎকারে। আরও উন্মাদনা।

শেফালির মা যদি না থাকত, পরমেশ যদি না থাকত, তাহলে রাধিকা মনের মধ্যে আগলে রাখা পদাবলীর সব কথা এতদিনে ভুলে যেত। ফটিকের বিলে গিয়ে কি ভুলে যাবে? কে জানে! রাধিকা এখনও চলে যাবার কথা শেফালির মাকে জানায়নি। কষ্ট পাবে মানুষটা। রাধিকা জানে। কিন্তু বলতেই হবে তাকে। আজ না হোক, কাল। যা-কিছু ঘটে মানুষের, এড়িয়ে যাওয়া যায় না এমনই সব কর্মসমূহ, বেশির ভাগ সময়ই তা জটিল পরিণতি টানে অথবা যন্ত্রণার পরিণতি, আর যদি জানা থাকে এইসব ভবিষ্য, তাহলেও, জানা থাকা সত্ত্বেও মানুষ তা ঠেকিয়ে রাখতে চায়, যেন দেরি করলেই তার তীব্রতা কিছু কম পড়বে। যেন কষ্ট লাঘব হবে কিছু। রাধিকাও এমনই সাধারণী প্রক্রিয়ায়, আড়াল রাখতে চায় শেফালির মা’র যন্ত্রণাদায়ক মুহূর্ত। যেন-বা আত্মজাতুল্য মমতা তার শেফালির মায়ের জন্য, আর তাই হওয়া উচিত, এমনই সে বোধ করে। রাধিকার জন্য কী করেছে শেফালির মা! নিজের খাবার ভাগ করে খেয়েছে। ছেলেকে খাইয়েছে। মনে সাহস দিয়েছে। স্নেহ দিয়ে শাসন করেছে। রোজ এসে রাধিকার ছেলেকে তেল মাখিয়ে দিয়ে যায়, আদর করে— জোছন জোছন জোছন। রাধিকার কল্যাণে মঙ্গলচণ্ডীর পুজো করছে এখন। এমন কেউ হয়? কেউ করে? মা ছাড়া? শেফালির মাকেও ছেড়ে যেতে হবে ভেবে চোখে জল এসে গেল রাধিকার। সে যেন দ্বিতীয়বার বাপের বাড়ি ফেলে যাচ্ছে। তবু, এ একরকম, সে ইচ্ছে করলে বা শেফালির মা যদি ইচ্ছে করে, যাওয়া-আসা করতে পারবে। এত দূর নয় যে বাবার মৃত্যুসংবাদ পেতেই হারিয়ে যাবে তি, মাস। এমন নয় যে কান্না পেলে কাঁদবার জন্য ছুটে আসতে আসতেই পথে পথে কামা ফুরিয়ে যাবে। তবু, সারাদিনের এই দেখা, এই সঙ্গ, এই নির্ভরতা, শিশু নিয়ে, বালক নিয়ে, স্মৃতি নিয়ে, মেঘমেদুর এই মন নিয়ে একটা মানুষ, একটা শূন্য মানুষ, তার এই আঁকড়ে ধরা আর একটা শূন্য কিন্তু অসামান্য মানুষকে, এ সব তো থাকবে না! সে যখন জটাচুলে ঘুরে বেড়াবে, কেউ তো বলবে না— ‘কাইট্যা ফালামু। সব চুল কাইট্যা ভাসাইয়া দিমু গঙ্গায়। ক্যান একটু আঁচড়ান্ যায় না? বান্দন যায় না? মাইয়া মাইনষের এ কেমুন ধারা ক দেহি। অলক্ষ্মী হইয়া ঘুরস্— !’ রাধিকা তার চুল আর এলিয়ে দেবে না। বলবে না— ‘আহা! লক্ষ্মী য্যান চুল ধইরা ঘরে আইব।’ তখন, শেফালির মা চুলগুলো মুঠোয় ধরে স্নেহে রাগে কষ্টে চিরুনি চালাতে চালাতে আর বলবে না— ‘হ। থো ফালাইয়া। আর কথা কইস না। কামে অ্যাড়া, বুজনে দ্যাড়া!’ রাধিকা আর বলবে না— ‘আর অ্যাকখান কও, মাসি, আর অ্যাকখান কও।’ শেফালির মা, যেন বলতে চায় না এমনই ভান করবে আর বলতে চাইবে, তার ঠোঁটে হাসি থাকবে যেন বলতে চায়, ভ্রূ কুঁচকে থাকবে যেন বলতে চায় না, তখন তাকে অপরূপা লাগবে, এমন ঘটবে না, সে বলবে না— ‘হ, কি কমু, তরে লইয়াই কওন যায় তুই য্যামন রান্দস্‌! দ্যাশে-গাঁয়ে হইলে কী কইত ক’?’

— কী কইত?

— আরান্দুনির হাতে পইড়া পুটিমাছে কান্দে

না জানি রান্দুনি আমার কেমুন ধারা রান্দে।

— হা হা হা। হি হি হি।

রাধিকা হাসছে। গড়িয়ে পড়ছে। পেট চেপে ধরছে। চোখে জল এসে গেল। তবু শোনা চাই। তবু বলবে— আর অ্যাকখান। অ মাসি, আর অ্যাকখান—।

এমন কিছুই আর হবে না গো, হবে না। শেফালির মা রাধিকার বিনুনি বাঁধতে বাঁধতে, মাথায় বিনুনির বেড়া দিতে দিতে বলবে না আর— বামনি আর বামুনে মহাঝগড়া। বুজলি নি?

— হ৷ হেইডা আবার বুজুম না!

— ঘরে কাক চিল বসে না। পোলাপান ঝগড়া দেইখ্যা পলায়। পাড়াপড়শিয়ে কানে আঙ্গুল দ্যায়। তো ঝগড়াঝাটি কইরা বুড়ির প্যাটে টান লাগসে, বুড়ি কলমি তুলতেয়াসে। একজনে আইয়া কইল, অ বুড়ি, তোমার বুড়া মরসে। বুড়ি কয়—

— কী কয়? বুড়ি কী কয়?

— বুড়ি কয়—

বুড়ায় মরসে ভাল হইসে।

দুইখান ক্যাঁথা আমার হইসে ॥

আর হবে না, এ সব আর হবে না। রাধিকা ভাবছে। কেমন করে হবে? তখন তো শুধু দেখা করতে আসা। শুধু দু’চারটি দুঃখের কথা বলে— হ্যাঁ শুধুই দুঃখের কথা— কারণ রাধিকার আর সুখ কোথায়— সেইসবই বলে চলে যেতে হবে। সে কাঁদছে। খুব কাঁদছে। অ মাসি, মাসি গো, তোমাকে ছাইড়া থাকুম ক্যামনে? ছোট্ট শিশুটি কেঁদে উঠল। কাঁথা ভিজে গেল বুঝি! এ কাঁথাও বানিয়ে দিয়েছে শেফালির মা। রাধিকা কাঁথা পালটে দিল। স্তন্য দিচ্ছে শিশুকে। ছোট শিশু পান করছে— চক চক। শব্দ হচ্ছে চক চক। মাঝে মাঝে তার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সে শ্বাস নেবার জন্য ছোট নাকটি সরিয়ে নিচ্ছে। কেমন করে সরাচ্ছে? সে কি জানে, বোঝে, সরাতে হয়? এমনি করে সরাতে হয়? কেমন করে জানে? রাধিকা শিশুর গালে আঙুল রাখে। দুধের উৎস মুখের মধ্যে যত্ন করে পুরে দেয়। এবং তার চোখ থেকে জল পড়ে। শিশুর গালে পড়ে। গাল থেকে তা ঠোঁটের দিকে গড়িয়ে যায়। দুধপানরত ঠোঁটের দিকে গড়াতে গড়াতে দুধের সঙ্গে মেশে। শিশু দুধের সঙ্গে মায়ের অশ্রু পান করে। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, কত যুগ, কত মহাবর্ষ শিশুরা পান করে আসছে এমনই দুধ মায়ের, এমনই চোখের জলে মেশা। রাধিকা জানে না। জানেনি কোনওদিন। আজ মাসির জন্য কষ্টে তার মায়ের জন্যও কষ্ট হচ্ছে। আজ সমস্ত কষ্ট ছাপিয়ে উঠছে। মা কি পাগল ছিল? ওমনি পাগল ছিল যখন সে জন্মায়? মা-ও কি কাঁদত এরকমই, আর তার চোখ থেকে জল পড়ে দুধের সঙ্গে মিশে যেত যখন পান করত রাধিকা! তার গলা থেকে কান্না ছিটকে আসে। শব্দ হয়। নামহীন, গোত্রহীন, উচ্চারণের অনেক তলায় অপার্থিব শব্দ হয়। চলে যাওয়া। ছেড়ে যাওয়া। কতবার ঘটবে তার? কতবার? সালতি নিয়ে মা ভেসে যায়। চলে যায়। ভাইস্যা যায় গো যায় হাড়মাংসের জিয়ন্ত পিতিমা। আর সমস্ত বর্ষা ও বাদলের ঘন স্বপ্ন বুকে করে, ঠোঁটে করে, যেন খড়-কুটো, যেন পাখির বাসা বোনার তীব্র ইচ্ছার মতো সত্য, বুকে করে, অপেক্ষার আবেদন রেখে চলে যাচ্ছে শমসের। চলে যাওয়া। ভেসে যাওয়া। ছেড়ে যাওয়া। কতবার? কতবার? এবং মানুষ সান্ত্বনা পেতে চায়। বলে, যাচ্ছি বটে, চোখের আড়ালে থাকব, কিন্তু আমি রইলাম, আমরা রইলাম, রইলাম। রইলাম— বলা হয় কিন্তু থাকা হয় না। একসঙ্গে থাকা, গায়ে গা লাগিয়ে, পাশাপাশি, যেন চোখের জল মুছিয়ে দেওয়া যায়, যেন হাসিতে ভেঙে পড়া যায় পরস্পরের কাঁধে, যেন অসুখ করলে শীর্ণ ঠোঁট ভিজিয়ে দেবার সুযোগ পাই ঠাকুর— এ সব আর রইল কই!

শিশুটি ঘুমিয়ে পড়ছে তখন। বিকেল হচ্ছে। ছায়া নামছে পুকুরে। শিঙ মাছ, মাগুর মাছ মুখ তুলে দেখে নিচ্ছে আকাশ। সজনে পাতা খসে পড়ছে জলে, জল কাঁপছে। মৃদু। অতি মৃদু। এমনকী জলও তা টের পাচ্ছে না। যতসব অপআত্মারা কোথায় কী সন্ধান করছে! হয়তো নতুন কোনও পোয়াতি! নতুন কোনও ভরন্ত শরীর। সন্তানের সম্ভাবনাময় রসালো পাকা আম্রফলের মতো উপচে ওঠা তাদের শরীর। শিশুর জন্ম দেওয়া হয়ে গেল তবু রাধিকা এখন নিজের অগোচরেই উপচে উঠছে। উপছে উঠছে। ভাসবে বুঝি। ভেসেই যাবে এ বার। পিঠে ছড়ানো চুল। স্তন ফিরিয়ে নিচ্ছে জামার নীচে। তখন ঘরে ঢুকছে পরমেশ— বউদি—

— কে?

চমকে উঠছে রাধিকা। দুর্বোধ্য চোখ দেখছে সামনে। কাকে দেখছে? ঘর আবছা। সে-দিনের মতো যেন। কোন দিন? কোন দিনের মতো? শমসেরকে জড়িয়ে থাকা? ঘন বর্ষায়? একলা বিকেল কিংবা ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যায়— শিবমন্দিরে, শিবলিঙ্গের কাছে—

— আজ জল রাখিনি। একটুও খাবার জল নেই। বউদি। একটু জল দেবেন?

রাধিকা উঠতে পারছে না। কথা বলছে না। কী সে বলতে চায় আর বলতে গিয়ে গলার থেকে কান্না ছিটকে আসে। পরমেশ এগিয়ে আসছে। শমসের এগিয়ে আসছে। অনেক অনেক আশ্বাস নিয়ে স্বপ্ন নিয়ে যুবক পুরুষ এগিয়ে আসছে।

— কাঁদছেন কেন? কী হয়েছে? বউদি?

সে হাত রাখছে। কাঁধে। হাত রাখছে। পিঠে। পিঠময় চুল। চুলে হাত ডুবে যায়। ডুবে যাচ্ছে। সে টানছে। কাছে টানছে। নারী কাঁদলে পুরুষ ডুবে যায়। নারী যতখানি কাঁদে, তার কতক বুঝি পুরুষের তরে। তবু, পুরুষ তার কোমল হৃদয়ে জানে, নারীর কান্না পুরুষের সহনীয় হয় না। তারা দ্রব হয়। ঠোঁট দিয়ে প্রিয় নারীর চোখের জল মুছিয়ে দেবার ব্রত তাদের। তবে কষ্ট দাও কেন? অ্যাঁ? কেন কষ্ট দাও? কান্না নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নারী। ঝরনা হল, খাল, বিল, পুকুর হল। নদীও হল বুঝি। পরমেশ সে পুরুষ এক, কোনওদিন নারীকে এমন নারীর মতো ছোঁয়নি। সে জল ভুলে যাচ্ছে। তৃষ্ণা ভুলে যাচ্ছে। তার মধ্যে এখন অন্য তৃষ্ণা। সে ন্যায় ভুলছে। স্থান ভুলছে। পাত্র ভুলে গেল। আমি কে, তুমি কে জানতে পারল না। কোথায় ডুবি, কেন, আমি কোন নদীতে ডুবি? কোথায় সে? ওগো সে কি নদীতে ডুবল, না পুকুরে, না কুঁয়োয়? সে কি সমুদ্র পেল? ওগো কে মানুষকে এমন ডোবায়! এমন ডোবায় যে আমি ডুবে যায়, তুমি ডুবে যায়— ডুব ডুব ডুব ডুব…

রাধিকা তার মুখ ডুবিয়ে আছে। গলায় মুখ ডুবিয়ে আছে। এই তো সেই কণ্ঠ— যাতে চুঁইয়ে পড়ে স্নানের ধারাজল। এই তো সেই বুক, যাতে ঘন ঘাসের মতো রোম, যাতে অন্ধকার, মুখ লুকনো, কষ্ট লুকনো, চোখ মুছনো অন্ধকার। পরমেশের সরু কোমর, মেদহীন, ঋজু কোমর জড়িয়ে আছে সে। মুখ ঘষছে বুকে। কোন বুক এ। কে এ। তুমি কে গো? কেমন করে এলে? তোমাকেই তো ফেলে এসেছি আমি? শিবের কাছে ফেলে এসেছি। জামরুল গাছের গায়ে, রূপসী নদীর পাড়ে। এখানে তুমি কেমন করে এলে? তুমিই কি, তুমিই কি, তুমিই কি সমস্ত কাঙিক্ষত হয়ে ঘুরে বেড়াও জগৎ চরাচরে?

পরমেশের পেট অথবা পেটের নীচে রাধিকার বুক সাপটে যায়। দুধ নামছে। এখনও দুধ নামছে কত। পরমেশ ভিজে যাচ্ছে। সে কী করবে এখন? তার হাত ক্রমশ খুঁজছে। খুঁজে যাচ্ছে। সে জানে না কী খুঁজতে হয়। কেমন করে খোঁজে। নারী পেয়ে এমনি দিশেহারা। নিচু হচ্ছে সে। শুইয়ে দিচ্ছে। তার গলা শুকিয়ে কাঠ। তবু ঠোঁট নেমে যাচ্ছে ঠোঁটে আর ভিজে যাচ্ছে। হাত নেমে যাচ্ছে বুকে আর ভিজে যাচ্ছে। তখন মেঘ নামছে। ঢেকে দিচ্ছে আকাশ। আর দ্রুত রাত্রি নামছে। না জেনে না বুঝে পরমেশ উপুড় হতে গেল, যেমন মেঘ উপুড় হয়, উপুড় হওয়ার জন্য যেমন মাটি খোঁজে, আর পরমেশও তেমনি, উপুড় হতে গেল আর জাগিয়ে দিল বাচ্চা। রাধিকার সদ্য ঘুম পাড়ানো শিশু। শিশু কাঁদল। জোরে। আরও জোরে। হাত ছুঁড়ল। পা-ও ছুঁড়ছে। পরমেশ উঠে দাঁড়াচ্ছে। ফিরে পাচ্ছে হাত। ফিরে পাচ্ছে পা। শুধু, নারীকে যখন ছোঁয়নি, তখনকার স্পর্শটুকু নেই, তার কী যেন হারিয়ে গেছে, কী যেন সে পেয়েছে— সে চলে যাচ্ছে, স্বপ্নে, অথবা ঘুমে, অথবা মন্ত্রে, সে চলে যাচ্ছে, গলা শুকিয়ে কাঠ, ভুলে গিয়েছে, জল চাইতে এসেছিল। আর আশ্চর্য আগুনে ঝলসে যাচ্ছে রাধিকা। এত আগুন থাকে? শরীরে এত আগুন থাকে? সে তো কোনওদিন এমনি করে টের পায়নি। সে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ছে। জড়িয়ে নিচ্ছে শিশুকে। সন্তানে শীতল হতে চাইছে। তার মনে পড়ছে, মনে না পড়ে উপায় নেই কোনও—

পিঙ্গলবরণ  বসনখানি

মুখানি আমার মুছে।

শিথান হইতে       মাথাটি বাহুতে

রাখিয়া শুতল কাছে॥

মুখে মুখ দিয়া       সমান হইয়া

বঁধুয়া করল কোলে।

চরণ উপরে চরণ পসারি

পরাণ পাইনু বোলে॥

শেফালির মা ডাকছে। এখনও উঠিসনি? রাধিকা? রাধু? বেলা গেল। সন্ধে হল। কত কাজ করে এলাম আমি। দিদিমণির বাড়িতে কত লোক। এবার বুঝি ছেলের বিয়ে দেবেন বড়দিদিমণি। বেশ হবে। এক ছেলে তো গেল। আর এক ছেলে জড়িয়ে কত স্বপ্ন, কত সুখ। আমার ছেলেও তো কত বড়টি হল। বিয়ের যোগ্য হল। কিন্তু কেমন করে বিবাহ দিই? কোন মুখে বলি? রাধিকা? ঘর নেই। বাড়ি নেই। একই ঘরে খাওন, শোওন, বসন। আমারও ওই ওমনিই ছেলের বউয়ের মুখ দেখতে বড় সাধ যায় রে রাধিকা।

রাধিকা উঠল। আলো জ্বলছে। পলাশ কই, পলাশ? তার কথা মনে হয়নি এতক্ষণ! সে কি প্রেমী হয়ে মাতৃত্ব ভুলল? সে কি এক প্রিয়ত্বে ডুবে ভুলতে থাকল অন্য প্রিয়জন? পলাশের কথা মনে হল না? ভাবল না, কেনই-বা এখনও সে ঘরে এল না?

শেফালির মা’র চোখ কুঁচকে আছে— মুখখান এমুন লাগে ক্যান?

— কী লাগে?

—এমুন ফুইল্যা ঢোল হইল ক্যান? কয়টার থিক্যা ঘুমাইতেয়াসস্?

—হ। ঘুমাইসি অখন। পলাশরে দ্যাখলা নাকি হেইডা কও।

— হ। পোলারে মনে পড়সে এতক্ষণে। হারুর দোকানে পাঠাইসেন দিদিমণি, ময়দা আর ঘি কিনুম, দেহি তর পোলায় খাড়াইয়া আসে। মাঠে যাইব। আমি কই, অ্যাতখানি আইসস্, মায় জানে? হ্যায় কয়, হ, আমি খ্যালা করতে যাই। কয় বলে, মায় তো ঘুমায়, তাই, ডাকি নাই। আমারে জিগায়, কী ন্যাও দিদা? কই, যাবি আমার লগে? কয়—কই যামু? মুখ দেইখ্যা কষ্ট হইল। পোলাপান। ভাল-মন্দ কিসুই তো খায় না। দিদিমণির ঘরে কত কী হইতাসে। যাইব আমার লগে। খাইয়া আইব।

— খাইসে?

—হ। খাইসে। প্যাট ভইরা খাইসে।

—অখন কই?।

— শ্যামলের লগে কতা কয়। তুই শুইয়া আছস দেইখ্যা আর ডাকে নাই।

রাধিকার বুক টনটন করে। নিজের জন্য এমন কাঙালপনা কখনও কি করতে পারত শেফালির মা? পারত না। নিজের জন্য মুখ ফুটে কিছু চাইতে পারে না সে। কিছু বলতে পারে না। ক্লান্ত থাকে, তবু দাঁতে দাঁত চেপে কাজ করে আসে। ঘরে ডাল তরকারি ফুটিয়ে ছুটে যায়। দিদিমণি বাসি সিন্নি দেয়। কাটা ফল দেয়। খেয়ে নেয় নির্বিবাদে। হজম করতে পারে না। তবু বলে না, খাব না। পারব না। না বলতে শেখেনি সে। রাধিকা গাঢ় গলায় বলে— বও না, মাসি। বইসা যাও।

— হ। বমু অনে। বইলে চলব? কাম আসে না?

— কাম কইরো। অখন বও। কত কাম তো কইরা আইলা।

শেফালির মা বসে। রাধিকার একটু সহানুভূতিতে তার ক্লান্তি আরও দ্বিগুণ হয়ে যায়। ছোট ছেলের পাশে বসে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকে খানিক। আদর করে ডাকে জোছন, জোছন। জোছন চাঁদের মুখে ঘুমোয়। শেফালির মা ডাকে। তার ঘরে কি আসবে কখনও, এমন শিশু, নাতির মুখ কি দেখতে পাবে সে?

মুখেচোখে জল দিয়ে এসে শেফালির মা’র কোলের কাছে বসে পড়ল রাধিকা। আজ তার ঘরের বাইরে যেতে লজ্জা করছিল। যদি কারও মুখোমুখি হয়ে যায়! কী হল আজ! এ কী হল! সে কি আজ দুপুরেও জানত, এমন হবে? হতে যাচ্ছে? ছি ছি! সে পরমেশকে মুখ দেখাবে কী করে? সে কি কার্তিককে ঠকাল? সে কি শমসেরকে ঠকাল? না। কার্তিকের জন্য তার কোনও অনুভব নেই। বরং কার্তিককে লুকিয়ে, এই প্রথম, কিছু করতে পেরে, নিতে পেরে বেশ লাগছে। যেন মনে হচ্ছে তার নিজের কিছু আছে, একেবারে নিজের কিছু। যেন সে কোথাও একটুখানি স্বাধীন, একটুখানি মানুষ, যার সন্ধান সে বিনা জানে না অন্য আর কেউ। কিন্তু সে কি পরমেশকে চেয়েছে? সে জানে না। সে কি শমসেরকে চেয়েছে? সে জানে না। ওই সময়, ওই অন্ধকারে, ওই কান্নায় সে কাকে পেয়েছে, কাকে? সে জানে না, বলতে পারে না, বুঝতে পারে না কিচ্ছু। শুধু এটুকু জানে, শরীরের ওই সুখ, ওইরকম আনন্দ, ওই বিচ্ছুরিত আগুন হয় যে, থাকে যে, সে জানত না। তার আগে কখনও হয়নি। এমন হয়নি।

— উঠ। বইয়া পড়লি ক্যান?

—উইঠ্যা কী করুম?

—ভাত বসা। প্যাটে দিবি কী?

— হ। মুড়ি খাইয়া থাকুম। পলাশের আর রাইতে খাওন লাগব না। আইজ আর রান্দুম না কিসু।

— আমিও কিসু খামু না আইজ। লুচি খাইয়া প্যাটডা আইঢাই করতেয়াসে।

রাধিকা ডাকে— মাসি।

— কী কইস?

—তোমার লগে কথা আসে।

— ক। কইয়া ফ্যালা।

—মাসি। হ্যায় আমারে লইয়া যাইব কইসে।

শেফালির মা নড়ে বসে। কে নিয়ে যাবে? কোথায়?

রাধিকা বলে যাচ্ছে। সে নিয়ে যাবে মাসি, সে।

— কে নিয়ে যাবে? কার্তিক? কোথায়? কই আগে তো বলিসনি তুই? এতদিন বলিসনি তো?

— বলিনি। বলতে পারিনি মাসি। আজ আর পারছি না। আজ দুপুর থেকে কী সব ঘটে যাচ্ছে! কী সব হয়ে যাচ্ছে! আর পারছি না গো। আর পারি না।

— কী হয়েছে রে? কী হল?

— মাসি গো, আমি মাকে পাইনি জানো। আমার মা, পাগল মা না একদিন, ভরা বর্ষায়, সালতি নিয়ে ভেসে গিয়েছিল জলে, আমি মাকে দেখেও চিনতে পারিনি মাসি। বুঝতে পারিনি মা যাচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে। আমিও যে ভাসছিলাম তখন।

— তারপর? তারপর কী?

— মা মরে গেল। নাকি ভেসে গেল। কোথাও আর পাওয়া গেল না মাকে। এমনকী মাছে ঠোকরানো, চোখ উপড়ানো শরীরটাও না। ওই বর্ষাতেও হারুকাকা, মতিকাকা, বাবা জাল ফেলেছিল জলে। নেই, কোথাও নেই। তারপর বাবাও যেন কেমন হয়ে গেল। আর কোথাও গেল না। তবলা বাজাতে গেল না। যাত্রাপালায় গেল না। আর একদিনও পদাবলী পড়তে চাইল না। শুধু ঘাটলায় বসে থাকত সারাক্ষণ আর দূরের দিকে চেয়ে থাকত। মা যখন ছিল বাবা ছুঁয়েও দেখেনি মাকে। পাগল ছিল তো। কিন্তু মাকে বাবা ভালবাসত খুব। আমি টের পেতাম। মাসি। মা ছাড়া বাবার মধ্যে কেউই আর ছিল না। আমিও না। তাই বাবা পদাবলী পড়ত। চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি পড়ত। আমি শুনতাম, বাবা শোনাত, আসলে বাবা আমাকে শোনাত না। বাবা পড়ত আর বাবার মনের মধ্যে বসে, বুকের মধ্যে বসে শুনত মা, শুনে শুনে পাগল হয়ে যেত, বাবাকে পাগল করে দিত, বাবা-মায়ের মিলন হত জানেনা, পদাবলীতে মিলন হত।

— চুপ কর তুই চুপ কর। মা-বাবার কথা বলতে নেই। এ ভাবে বলে না।

— কেন বলে না মাসি? তুমি জানো না, আমার বাবা আমার পাগলী মাকে নতুন শাড়িতে দেখে কত খুশি হত। কীরকম বালকের মতো তাকিয়ে থাকত মায়ের দিকে। আমি বুঝতাম। সব বুঝতাম। মা চলে গেলে বাবা কেমন হয়ে গেল। আমি বললাম, বাবা পদাবলী পড়ো, শুনব। বাবা পড়ল না। আমি হাতে বই ধরিয়ে দিলাম। হলুদ হলুদ বই। বাবা সরিয়ে রাখল। একদিন ঘাটলাতেই বসে থাকতে থাকতে অজ্ঞান হয়ে গেল। কখন হয়েছিল কে জানে। জ্ঞান যখন ফিরল, বিছানায় শুয়ে, দেখল, ঠোঁট নাড়ল, আর কথা বলতে পারল না।

শেফালির মা কাঁদছে। নিঃশব্দে কাঁদছে। রাধিকাকে টেনে নিয়েছে কাছে। রাধিকা চলে গিয়েছে কোথায়! সেই খিলপাটনি গ্রাম, যেখানে মা ভেসে গেল, বাবা মরে গেল, হারিয়ে গেল শমসের। রাধিকা কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয়ে গেলেও আর ফিরে পাবে কি কারওকে? একজনকেও? সে বলে চলল— বিয়ে দিল কাকা। আমার সব গেল। কাকির কাছেও সুখ ছিল না। শান্তি ছিল না। তবু ওরা নিজের ছিল। ওই গ্রাম, ওই নদী, ওই পাড়া-পড়শি। ওই তাজিয়া নিয়ে মহরমের মিছিল, ওই শিবমন্দিরে পুজো, আরও কত সব ছিল তো, বিয়ে হয়ে আর কিছুই রইল না। আমি একেবারে শূন্য হয়ে গেলাম। না। ভগবান শূন্য হতে দেন না কিছু। কিছু রাখেন। একটু রাখেন। তেমনি রইলে। তুমি রইলে। আমার ছেলে রইল। তুমি আমাকে স্নেহে ভিজিয়ে দিলে। কত ভালবাসলে মাসি। এতখানি কেউ কখনও বাসেনি। আমি তোমার মধ্যে মাকে পেলাম। মা তো যন্ত্র হয়ে ছিল, পাগল হয়ে ছিল, ভালবাসতে জানত না। অথবা জানত, আমরা বুঝিনি বলে, দেখিনি বলে, দুঃখে অমন পাগল হয়ে ছিল। মাসি, তোমার কোলে আমি মায়ের কোল পেয়েছিলাম। ভগবান সেইটুকুও কেড়ে নিলেন। ও মাসি, মাসি গো, আমি তোমায় ছেড়ে কেমন করে থাকব?

শেফালির মা পাথর হয়ে যাচ্ছে। পাথর চাপা বুক তার। বইতে-বইতে অভ্যাস হয়ে গেছে। সে প্রশ্ন করছে— কোথায় নিয়ে যাবে কিছু বলেছে? কইসে কিসু?

— হ। কইসে। বলেছে। ঘর নিয়েছে ফটিক বিলের বস্তিতে।

ফটিক বিল!? শেফালির মা’র দীর্ঘশ্বাস পড়ছে। হায় মা মঙ্গলচণ্ডী। এত ডাকলাম তোমাকে। এত করে পুজো দিলাম। আমার কি কোনও অপরাধ হল? মেয়েটাকে শেষে বস্তিতে নিয়ে ফেললে?

যত কষ্টই পাক, যত দারিদ্র, অনাহার সইতে হোক শেফালির মাকে, বস্তিজীবন তাকে পোহাতে হয়নি কখনও। যখন তারা দেশ-গাঁ ছেড়ে চলে আসে তখন গ্রাম সম্পর্কে চেনা ছিল বলে খুব সাহায্য করেছিলেন মল্লিনাথ ডাক্তার। তখন তাঁর বয়স অল্প। সাহায্য করার বিশেষ কিছু ক্ষমতা ছিল না। তবু, ওই মাথুরের গড়ে যাঁরা বসবাস করতেন সে সময়, সবাই মোটামুটি সমৃদ্ধ ও সচ্ছল পরিবার, তাঁদের অনেকের মধ্যেই পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা মানুষদের প্রতি সহানুভূতি ছিল, কারণ, সেইসব পরিবারের অনেকেই, তখন থেকে দশ বা পনেরো বা হতে পারে তারও বেশি সময় আগে পূর্ব বাংলা ছেড়ে এ পারে এসে বসতি করেছিলেন। ধীরে ধীরে গুছিয়ে সামলিয়ে এসেছিলেন বলে এ দেশেও পাকাপাকিভাবে বসতে তাঁদের অসুবিধে হয়নি। তাঁরা দীর্ঘকাল দুই বাংলাতেই সম্পত্তি ও যাওয়া-আসা বজায় রেখেছিলেন। কিন্তু শেফালির মায়েদের মতো মানুষরা, যাদের সম্পত্তি বেশি ছিল না, ভিটেমাটি আর সামান্য জমিজমা, তারা সেটুকু শেষ দিন পর্যন্ত ছাড়তে চায়নি। আমাগো কিস্যু হইব না। দ্যাশ ছাইড়া কুনখানে যামু— এমনই তারা ভেবেছিল জীবন নিয়ে টানাটানি হওয়ার দিনটি পর্যন্ত। তারপর শুধু প্রাণ হাতে করে, পরস্পরের কাঁধে ভর দিয়ে, একটি-দু’টি পুঁটুলি আর সামান্য গয়না-গাঁটি সম্বল করে সব ফেলে তাদের চলে আসতে হয়। সেই ঘর— কত স্বপ্ন, কত স্মৃতি মাখা, জীবনের পরম আশ্বাসের মতো সেই রোদ্দুর-পড়া উঠোন, কাক-শালিক-চড়ুই-বুলবুল-দোয়েল জড়ানো মোহময় দুপুর, সেই কুলুঙ্গি— যেখানে লক্ষ্মী বসেছিলেন, সেই আচারের বয়াম, ফুলছাপ দেওয়া সেই বিয়ের তোরঙ্গখানা আর সবরি কলার ঝাঁকড়া ওই গাছ— সব ফেলে, মাটি ফেলে, জীবন ফেলে, শুধু প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটে আসা— সে কতকাল আগে! তবু সব মনে পড়ে যায়। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত মনে থাকবে সব। ওই আলোছায়া, ওই গন্ধ, ওই পুকুর এ সব কোনওদিন ভোলা যাবে না। আর শেফালির মা, যার শেফালিটাই হারিয়ে গেছে, তবু সে বেঁচে আছে, তুমুলভাবে বেঁচে আছে শুধু শেফালির মা হয়েই, সে এখন বুঝি-বা আরও এক শেফালিকে হারাতে চলেছে, এমনই বেদনায়, বিড় বিড় করছে, ঠোঁটে জিভে উচ্চারণ করছে, বোঝাতে চাইছে, রাধিকা নামের একটা দুঃখী, বিপর্যস্ত, সহায়সম্বলহীন মেয়েকে বোঝাতে চাইছে, এ কিছু নয়, এই ছেড়ে যাওয়া, এ কিছু নয়, এর চেয়ে অনেক বড় ছাড় সারা জীবন ছাড়তে হয় মানুষকে। সে বলে যাচ্ছে, শুনে চলেছে রাধিকা, সইত্য, এক আন্দারে, ঘর ফালাইয়া, দুয়ার থুইয়া, সব ফালাইয়া, চক্ষের জলে বক্ষ ভাসাইয়া, আমাগো পলাইতে হইল। পালিয়ে গেলাম। আমরা পালিয়ে গেলাম। আর এ পালানোয় ফেরার কোনও পথ রইল না। এ এক চিরপলায়ন। পিছনে চাইবার অবকাশ নেই, সামনেও তাকানো যায় না। অন্ধকার। শুধু অন্ধকার। হাঁটছি, হাঁটছি, হাঁটছি। দলে দলে লোক হাঁটছে। একেকটি পরিবার জড়াজড়ি করে হাঁটছে, যেন ছেড়ে না যায় কেউ, যেন হাত ফসকে না যায়, যেন মিশে না যায় ভিড়ে আর পথ হারিয়ে ফেলে। এত ভালবাসা! এত টান! পথ চলেছে লোক। পড়তে পড়তে, উঠতে উঠতে চলেছে। বাবা মেয়ের হাত ধরে আছে। মা ছেলেকে বুকে চেপে আছে। ভাই ভাইকে সাপ্টে জড়িয়ে আছে। শেফালি আমার কোলে। আমি আর হাঁটতে পারছি না। বসে পড়ছি। ক্লান্ত। অবসন্ন। সে বলছে, চলো, যেতে হবে। সবাই সবাইকে বলছে, চলো, যেতে হবে, থেমো না, দাঁড়িয়ো না, যেতে হবে। কোথায় যাব? কোথায়? কেন যাব? কী পাপ করেছি? কী অন্যায় করেছি! আর পারব না, আর যাব না, এই বসলাম, বসে পড়লাম। কী ক্লান্তি, কী ভয়! কীসের ভয়? সবই তো ছেড়ে এসেছি, ভয় কীসের! তবু ভয়। প্রাণটা তো আছে। দেহটা তো আছে। যদি হারায়! যদি না থাকে। যদি মরি! মৃত্যুভয়! মৃত্যুভয়ে কালো হয়ে আছে মানুষগুলি। যত মৃত্যু তত প্রাণ আঁকড়ে ধরা। বাবার হাত থেকে মেয়ে ফসকে গেল। স্বামীর হাত ছাড়িয়ে স্ত্রী পড়ে গেল। জল চাই জল। ভাইকে ছেড়ে ভাই ছুটল জলের সন্ধানে। নদী শুকিয়ে ডোবা। ডোবা শুকিয়ে পুকুর। পুকুর শুকিয়ে কাদাজল। সেই জলই পান করতে ছুটল। আঃ বড় ক্লান্তি, বড় তেষ্টা, জল খাবে, উপুড় হয়ে পড়ল আর জলে জিভ ঠেকাবার আগেই তার প্রাণ উড়ে গেল। সে আর বেঁচে রইল না। তার পথ মাঝপথেই শেষ হয়ে গেল। কেউ ফিরে তাকাল না। তার ভাই, সব পলায়নপর ভাই, তার পিতামাতা, তার বোন, সবাই ওই কাদাজল খেল, ঢেকুর তুলল, এবং পথ চলতে লাগল। শোক করল না। শোক ভুলে গেছে। কিংবা এই চলতে থাকা, এই তো এক শোকপালন, এর চেয়ে বড় শোক আর হয় না। তোমাকে পথে রেখে গেলাম। তুমি শুয়ে থাকো। শেয়াল কুকুরে তোমার দেহ ছিঁড়ে খাক। চিল শকুনে তোমাকে ভোজন করুক। আমি দেখব না। ও আমার ভাই, আমার ছেলে, আমার মেয়ে, সোনা বোনটি আমার, তোমাকে ফেলে চলে যাচ্ছি শুধু বেঁচে থাকব বলে আর বেঁচে থাকলে কাঁদব বলে আর চিরকাল শোকগ্রস্ত থাকব বলে। এখন আর শোক করলাম না। আমিও আর শোক করলাম না। আমার শেফালি হারিয়ে গেল। শোক করলাম না। ভীষণ ভয়, ভীষণ তাড়া। দারুণ ইচ্ছা বেঁচে থাকবার। দুর্নিবার ইচ্ছায় আমরা ছুটতে লাগলাম। ছুটতে ছুটতে ছুটতে যখন বুঝলাম, হ্যাঁ, বেঁচে আছি তো! হ্যাঁ, এই তো দম নিচ্ছি। এই তো আমার হাত পা মুখ চোখ! এই যে আমি! সত্যি সত্যি আমি! আর ওই আমার আকাশ। ওই আমার মাটি। আঃ! ওই পরিষ্কার ঠাণ্ডা জল! আঃ! বেঁচে থাকা কী সুন্দর! বেঁচে থাকা— তখন আবার মনে পড়ল— বেঁচে আছি, কিন্তু শেফালি কই? সব হারিয়েও সব আছে, কিন্তু আমার শেফালি কই! এই আকাশ এই মাটি এই জল হাওয়া রোদ্দুর—সব আছে। শুধু আমার শেফালি আর কোথাও নেই। হে ভগবান! এই কি তোমার বিচার? এই কি তোমার ন্যায়? নির্দেশ? কৃপা করুণা? গোটা একটা জীবন দিয়ে দাও আর বিনিময়ে কেড়ে নাও একটি-দু’টি শেফালিকা?

রাধিকা কাঁদছে কিন্তু শব্দ করছে না। শেফালির মা কাঁদছে কিন্তু শব্দ করছে না। মানুষ তা হলে শেষ পর্যন্ত শুধু বেঁচে থাকে। শুধু বেঁচে থাকতে চায়, আর কাঁদে! কাঁদতে চায় না কিন্তু কাঁদতেই হয়। তাদের কান্না মিলেমিশে যেতে যেতে জন্ম হয় নতুন সব কান্নার। এবং তখন, একজন আর একজনকে ছুঁয়ে থাকে। ছুঁতে চায়। মানুষের জন্যই কাঁদে মানুষ আর কান্নায় ডুবতে ডুবতে শেষ পর্যন্ত আর একজন মানুষকেই চায়। তাই, তাই, তাই একসঙ্গে থাকতে চাওয়া, একসঙ্গে বসবাস করতে চাওয়া, মতভেদ, ইচ্ছেভেদ, অভিমান-অভিযোগ সব-সমেত একসঙ্গে জড়িয়ে থাকার ইচ্ছে। গভীর ইচ্ছে। আর তা সম্ভব না হলে, বিচ্ছিন্ন হতে থাকলে, অসম্ভব-অসম্ভব কষ্ট— যেন কোনও বিরক্ত দানব দু’হাতে নিষ্ঠুর ছিঁড়ে নিচ্ছে ধড় থেকে মুণ্ডু থেকে নখ চুল হৃৎপিণ্ড।

২৮

দুর্গামণ্ডপের সামনে মূর্তির দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আনিসুজ্জামান। দুর্গার এই বিশালতা, সৌন্দর্য, সমৃদ্ধি ও পুত্রকন্যা সমেত অধিষ্ঠানের আড়ালে একটা পারিবারিকতা আছে, আনিসুজ্জামানের মনে হয়, এটিই প্রকৃতপক্ষে হিন্দু বাঙালির আরাধনার বিষয়। এই পারিবারিকতা। সুখী-সুবন্ধন পরিবারের চেয়ে সুন্দর আর কী হতে পারে এই মানব সভ্যতায়!

মূর্তির কাছে যেতে ইচ্ছে করে আনিসুজ্জামানের। কিন্তু উপায় নেই। ভাবতে আশ্চর্য লাগে। অনেক আগে, কত আগে তা নিজেও জানেন না তিনি, তাঁদের পূর্বপুরুষ, হিন্দু ছিলেন। তখন তাঁদের দুর্গাপূজায় অধিকার ছিল। এখন নেই। ঈশ্বর নন, কোনওদিনই নন, আসলে মানুষই মানুষের অধিকার রচনা করে এবং খণ্ডায়। অবশ্য এও বিচার্য যে হিন্দু থাকাকালীন তাঁরা কী ছিলেন! হাঁড়ি, ডোম— অস্পৃশ্য অন্ত্যজ! নাকি সদ্বংশ প্রণম্য! এ বিষয়ে পরিবারে কথাই চলে না তেমন, কথা উঠলেও এড়িয়ে যাওয়া হয়, যেন কোনওকালে হিন্দু থাকার লজ্জা তাঁদের আজও স্পর্শ করে ফেলবে। তবু, কানাঘুষোয় যতটুকু শুনেছেন তাতে জেনেছেন যে অন্য অনেকের মতো অত্যাচারিত হয়ে নয়, মুসলমানের মেয়েকে ভালবেসে গৃহ ও ধর্মত্যাগ করেছিলেন তাঁদের কোনও একজন পিতামহ। সামাজিক মর্যাদায় তিনি ছিলেন উঁচু বংশীয় কায়স্থ। এইটুকু জানার মধ্যেই সুখের বিষয় এই যে, সেই ধর্মান্তরীকরণের মধ্যে কোনও ঘৃণা ছিল না। প্রেম ছিল।

দুর্গা-সম্পর্কিত যে-গবেষণামূলক গ্রন্থটি লিখছেন আনিসুজ্জামান, তার কাজ অনেক এগিয়ে গেছে। এর আগে তিনি একটিই বই লিখেছেন, যাকে পূর্ণাঙ্গ বই না বলে পুস্তিকাও বলা যায়। তার বিষয় ছিল সাধারণ জনজীবন ও সর্বধর্ম সমন্বয়। কিংবা প্রকৃতপক্ষে এই বক্তব্যই প্রতিষ্ঠা করা যে, কোনও ধর্মের সঙ্গেই কোনও ধর্মের বিরোধ নেই। সব ধর্মই প্রকৃতপক্ষে মানুষের কল্যাণের কথা বলে। কিন্তু তাঁর ওই ছোট পুস্তিকার সামান্য প্রবন্ধে এ সব কিছুই যুক্তি ও বিশ্লেষণ সমেত প্রকাশ করা সহজ ও সম্ভব ছিল না। এবং, ওইটুকু লিখতে গিয়েই আনিসুজ্জামান অনুভব করেছিলেন তুলনামূলক ধর্মীয় বিষয়ে লিখতে গেলে গভীর অধ্যয়ন এবং পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন যা খুব অল্প সময়ে করা সম্ভব নয়। অতএব, তাঁর সিদ্ধান্ত এই যে, যে-প্রবন্ধ বা পুস্তিকাটি দিয়ে তাঁর রচনা শুরু হয়েছিল, সেই প্রবন্ধই তাঁকে সারাজীবন লিখে যেতে হবে ধর্মের অন্তর্নিহিত সত্যটি প্রতিষ্ঠার জন্য। বিবাহ নয়, সংসার পালন নয়, সন্তান উৎপাদনের প্রয়াস নয়— আনিসুজ্জামান লিখে যেতে চান মাত্র কয়েকটি গ্রন্থ।

ওই পুস্তিকাটি যখন লেখেন আনিসুজ্জামান তখন দুই বাংলায় রাজনৈতিক আগুন জ্বলছে। আনিসুজ্জামানের প্রিয় ছাত্ররা, ছাত্রের বন্ধুরা তখন মরছে, পালিয়ে বেড়াচ্ছে আর দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইয়ের সংকল্প নিচ্ছে। দুই বাংলায় দু’রকম মুক্তির প্রার্থনা।

নকশাল আন্দোলন সম্পর্কে আনিসুজ্জামানের স্থির কোনও সিদ্ধান্ত ছিল না। ওদের অনেক মত ও পদ্ধতি সমর্থনও করতে পারেননি সবসময়। আবার ওদের দূরেও রাখতে পারেননি। ওদের ইচ্ছাটিকে তিনি শ্রদ্ধা করেছিলেন। তাই সাহায্যও করেছিলেন সাধ্যমতো। ছাত্রদের মধ্যে যারা মাকর্সবাদী ছিল না তারা আনিসুজ্জামানকে সন্দেহ করেছিল। কিন্তু তিনি সেইসব সন্দেহাকুলদের সঙ্গেও সহজ ছিলেন। সমান বন্ধুত্বপূর্ণ ও স্নেহশীল। সেটুকুর জন্যই হোক বা অন্য কোনও কারণ— যাকে ভাগ্যের জোর বলা যায়— আনিসুজ্জামানকে কেউ বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়নি বা পুলিশকে ফোন করেনি এই বলে যে, তিনি নকশালদের আশ্রয় দিচ্ছেন। অন্যান্য অধ্যাপকরা চতুরভাবে আবহাওয়া বুঝে চলতেন। এবং এড়িয়ে চলতেন ছাত্রদের। কোনটা আন্দোলন কোনটা নয়, কোনটা যথার্থ কোনটা ধ্বংস এই বিচারবোধ গুলিয়ে গিয়েছিল তাঁদের। আনিসুজ্জামান স্বীকার করেন, সে-দলে তিনিও পড়েন, কোনও ব্যতিক্রম তিনিও নন। তাঁর শুধু বাড়তি ছিল একটিই বস্তু, তা ওই ছাত্রদের প্রতি ভালবাসা, যারা স্বপ্ন ও আগুন সমেত স্ফুলিঙ্গ ছিল এক এক জন। অন্যদের থেকে ব্যতিক্রম ছিলেন না বলেই, সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি বলেই, ওই বারুদ ও মিরণের গন্ধের মধ্যেও মানুষের চিরন্তন বোধ ও সমস্যা সম্পর্কে ভাবা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল।

দেবী দুর্গা যে তাঁর কোনও গ্রন্থের বিষয় হয়ে উঠবেন তা তখনও ভাবেননি আনিসুজ্জামান। কিন্তু ধর্মবিষয়ক পড়াশুনো করতে গিয়ে তিনি দেখলেন যে, হিন্দুধর্মের শাখা-উপশাখা এত বিস্তৃত ও জটিল যে গভীর অধ্যয়ন না করলে এ ধর্ম সম্পর্কে কোনও যথার্থ জ্ঞান অধিগত করা সম্ভব নয়। নিজে মুসলমান হওয়ায় এবং মনিরুলের ব্যাপক ধর্মাচরণানুগত্যের কারণে ইসলামের তত্ত্বগুলি তিনি অবহিত ছিলেন। ফলে ইসলামি তত্ত্ব সরিয়ে রেখে হিন্দুধর্ম, দেবদেবী বিশ্বাস ও পৌত্তলিকতা নিয়েই তাঁর পাঠ শুরু হয় এবং ক্রমশ ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে থেকে দেবী দুর্গা খুবই আকর্ষণীয় বিষয় প্রতিভাত হন তাঁর চোখে। তিনি উপলব্ধি করেন, বাঙালি হিন্দুর অস্তিত্বের মধ্যে দুর্গার প্রভাব অপরিসীম। শুধু ধর্মে নন, তিনি গার্হস্থ্যে আছেন— আবার মহাকাব্যেও। সংস্কৃতিতে আছেন— আবার সমাজেও। এমনকী তিনি স্বয়ং হয়ে উঠেছেন এক বিশাল অর্থনীতি। সুতরাং তিনি দুর্গা সম্পর্কে পাঠ জারি করলেন এবং লিখে চললেন একের পর এক প্রাবন্ধিক অধ্যায়। তৃণাঙ্কুর আনিসুজ্জামানের সঙ্গে আলোচনা করে এবং প্রবন্ধগুলি পাঠ করে খুবই উৎসাহী হয়েছেন এবং নিজেরই ইচ্ছায় সু. ভা. প্র. প্রকাশনীর সঙ্গে আনিসুজ্জামানের যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়েছেন যারা এ ধরনের গবেষণামূলক গ্রন্থ ছেপে থাকে।

তৃণাঙ্কুর এ বাড়িতে ফের বসবাস করতে শুরু করায় লাভবান হয়েছেন আনিসুজ্জামান। কারণ দু’জনেই একই পেশার মানুষ তাই নন— পারস্পরিক আগ্রহ, দর্শন ও মানসিকতার মধ্যে কোনও সঙ্কট নেই। সে-ভাবে বলতে গেলে তৃণাঙ্কুরই আনিসুজ্জামানের একমাত্র সমবয়সী বন্ধু। অন্য অন্তরঙ্গ বন্ধুদের মধ্যে কেউ তাঁর অধ্যাপকের বয়সী প্রায়, আর কেউ ছাত্রের বয়সী— বা ছাত্ররাই।

কিছুদিন আগে তৃণাঙ্কুর একটি ভাল পরামর্শ দিয়েছেন আনিসুজ্জামানকে। ধর্মতত্ত্ব নিয়ে গবেষণায় আগ্রহী এরকম কয়েকজনকে তৃণাঙ্কুর চেনেন যাঁরা বাংলাদেশে বসবাসকারী ছাত্র বা অধ্যাপক। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এগোলে কেমন হয়! কথাটি ভেবে দেখেছেন আনিসুজ্জামান। এ খুবই ভাল প্রস্তাব। সামাজিক দৃষ্টিকোণ সম্পর্কে আলোচনার আদান-প্রদান খুবই কার্যকরী হবে নিশ্চয়ই। ধর্ম ইতিহাস নিয়ন্ত্রণ করে, বর্তমান নিয়ন্ত্রণ করে, গভীরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে মানব প্রগতি— যার প্রভাব কোনও বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে কম সুদূরপ্রসারী নয়।

সারা জীবনের প্রচেষ্টায় যে-গ্রন্থটি আনিসুজ্জামান লিখবেন বলে স্থির করেছেন তার আন্তর্জাতিক গুরুত্ব আছে এবং এ কাজের জন্য চিন্তা বিনিময়ে তাঁর এতটুকু কুণ্ঠা নেই। তৃণাঙ্কুরকে নিজের মত জানিয়ে দিয়েছেন আনিসুজ্জামান। তিনি যোগাযোগ করতে চান। তৃণাঙ্কুর পুজো মিটে গেলে যোগাযোগের কাজ শুরু করবেন। স্নায়ুদৌর্বল্য হওয়ায় আজকাল ভাল লিখতে পারেন না তৃণাঙ্কুর। আনিসুজ্জামান জানেন না, সত্যিই শর্মি তৃণাঙ্কুরকে স্লো-পয়জনিং করে শেষ করে দিতে চেয়েছিল কিনা! ভাবতে কষ্ট হয়, আবার ভাবা যায় না এমনও নয়। যদিও আনিসুজ্জামান যত দূর জানেন, স্নায়ুজনিত সমস্যা তৃণাঙ্কুরের বাবার ছিল এবং তৃণাঙ্কুর নিজে সে-সমস্যা নিয়েই জন্মেছিলেন। অবশ্য এটা নির্দিষ্ট নয় যে তৃণাঙ্কুরের পিতা স্নায়বিক অসুখেই ভুগতেন, তাঁর রোগ মানসিকও হতে পারে। কারণ যাই হোক, শেষ পর্যন্ত সবই স্নায়ুতেই বর্তায়। তবে তৃণাঙ্কুরের মতো গভীর ও বইপ্রেমী, কবিতাপ্রিয়, আপন জগৎ ও পড়াশুনোয় ডুবে থাকা মানুষ— নির্বিরোধী ও নির্ভরশীল মানুষকেও যে কারও ধীর-বিষক্রিয়া করার প্রয়োজন হতে পারে তা ভাবতেও আনিসুজ্জামানের কষ্ট হয়। অজাতশত্রু হওয়ার থেকে অতিরিক্ত অসম্ভব আর কিছু হয় না পৃথিবীতে। যে-কোনও মানুষই তার নিজের অগোচরে অন্যের শত্রু হয়ে উঠতে পারে। আনিসুজ্জামান দেখেছেন অপরের বিঘ্ন হয়ে উঠতে সব সময় সক্রিয় হওয়ার প্রয়োজন হয় না।

মাথুরের গড়ের দুর্গাপূজায় এবার ঔজ্জ্বল্য কম। তার কারণ, আনিসুজ্জামানের ধারণা, পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের ঐতিহাসিক পরাজয়। যদিও কয়েকটি জায়গায় কংগ্রেসের আসন রক্ষিত আছে, কিন্তু এ হল শক্তিহীনের শক্তি। বুড়ো সিংহের মতো। সিংহ— কিন্তু দাঁত-নখ ক্ষয়ে যাওয়া। এমনকী এই এলাকাতেও কংগ্রেসের প্রভাব অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও এবং পুজোর কর্মকর্তারা কংগ্রেসি হওয়া সত্ত্বেও শোক পালনের মতো নিরানন্দ এ পূজা। এতদিন এ পাড়ায় মাকর্সবাদীদের কোনও আড্ডা পর্যন্ত ছিল না। কিন্তু এখন হয়েছে। আনিসুজ্জামান ও নীলিমার বাড়ির একতলার গ্যারেজঘরে পার্টি অফিস খুলেছে সি পি এম। কিন্তু মাকর্সবাদীরা পূজায় আগ্রহী নয় সুতরাং পার্টি অফিস হওয়াতে মা দুগ্গার মুখ উজ্জ্বল হয়নি। সে-দিক থেকে দেখতে গেলে, আনিসুজ্জামানের মনে হয়, সারা কলকাতাতেই পূজার বর্ণ কম থাকার কথা। তা হলে কি মা দুর্গাকে খানিকটা রাজনৈতিকও বলা যায় না? যায় নিশ্চয়ই। রামচন্দ্রের অকালবোধন, অর্থাৎ শারদীয়া পূজার সূচনার পিছনেই কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বর্তমান ছিল না? তবে আনিসুজ্জামান এ তথ্য পেয়েছেন যে অকালবোধন সম্পর্কে মতবিরোধ আছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণের বর্ণনা অনুযায়ী রাবণের সঙ্গে যুদ্ধের সময় রামচন্দ্র অকালবোধন করে দেবীর পূজার প্রচলন করেছিলেন। সারা বাংলায় তাই মানা হয়। যে-সব পট, কাঠখোদাই বা পোড়ামাটির শিল্পে দুর্গার অকালবোধন উৎসৃষ্ট আছে তাতে রামায়ণের কথনই মানা হয়েছে। কিন্তু পুরাণে আছে— ব্রহ্মা স্বয়ং দেবী দুর্গার অকালবোধন করেছিলেন। পুরাণে যাই থাক, আনিসুজ্জামান মনে করেন, যে-সত্য মহাকাব্যে লিখিত তার কোনও তুলনা হয় না, কারণ মহাকাব্য মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি। দর্শনের ব্যঞ্জনা। অনুভবে রঞ্জিত সেই সত্য— যা ধ্রুব থাকে সহস্র বৎসর পরেও।

পূজার ঘণ্টা বাজছে। আনিসুজ্জামান দেখছেন— কত আয়োজন। সারা কলকাতা শহরের কোন্ কোন্ পূজা দেখতে যাবেন তার একটি তালিকা আনিসুজ্জামান প্রস্তুত করেছেন কাল রাত্রে। এর মধ্যে কয়েকটি পারিবারিক পূজাও আছে। গত পাঁচ বছর ধরে এ কাজ তিনি করে আসছেন। মুসলমান বলে তাঁর অসুবিধে অনেক। বারোয়ারি মণ্ডপের বাইরে দাঁড়িয়ে চুপচাপ দেখা ছাড়া কিছু করার নেই। মুসলমান বলে পূজাস্থলে যেতে পারবেন না— এমন কোনও সংস্কার বারোয়ারিতে বজায় নেই। তেমনই নিয়মের প্রতি আনুগত্য ও আচারে নিষ্ঠাও নেই। ঘট যথার্থ শুদ্ধ হল কিনা তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব পায় মণ্ডপসজ্জার চাকচিক্য, কেন-না বারোয়ারিতে মা আর ধর্মে নেই, আছেন শিল্পে, সংস্কৃতিতে, অর্থনীতিতে এবং সৌন্দর্যচর্চায়। গভীর নিরিখ করতে হলে পারিবারিক পূজায় যাওয়া চাই। পারিবারিক পূজাগুলির এক একটি ইতিহাস থাকে। এবং এই পূজাগুলি খুব নিয়ম-নিষ্ঠা মেনে সম্পন্ন হয়। নানা পরিচয়ের সূত্র ধরে এরকম কয়েকটি পূজা দেখতে গিয়েছিলেন আনিসুজ্জামান, কিন্তু বিশেষ সুবিধা হয়নি। কোনও পরিবারই তাঁকে পূজাস্থলে বসে আচার-বিধি দেখার আমন্ত্রণ জানায়নি। যথাযথ ভদ্রতার সঙ্গে সব জায়গাতেই তাঁকে প্লেট সাজিয়ে প্রসাদ খেতে দেওয়া হয়েছে এবং তাঁর সমস্ত প্রশ্নের উত্তরও প্রত্যেকেই খুব আগ্রহের সঙ্গে দিয়েছেন। কিন্তু তাতে তাঁর প্রয়োজন সবটা মেটেনি।

গৃহের পূজামণ্ডপে যে কেউই তাঁকে বসতে বলেননি এ নিয়ে তাঁর কোথাও কোনও অভিযোগ নেই। নিজের বাড়িতে তিনি হিন্দুদের সম্পর্কে উন্নাসিকতা দেখেছেন। তিনি মেনেছেন— যেহেতু ধর্মচর্যার বিধি-নিষেধ মানুষের আদিমতম সংস্কারে মিশে আছে সেহেতু এ আচরণই প্রত্যাশিত। তাঁকে পূজাস্থলে না ডাকার পিছনে কোনও অপমানের উদ্দেশ্য নেই, আছে হয়তো-বা পাপের ভয় যা ছোঁয়াজনিত দেবতার রোষ থেকে উৎপন্ন হতে পারে। এবং এই সমস্ত প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণও আনিসুজ্জামানের গবেষণার বিষয়।

তাঁর অভিজ্ঞতার কথা শুনে গত বছর পূজায় নীলিমা আনিসুজ্জামানকে দত্তপুকুরে তাঁর বাপের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। নীলিমার বাপের বাড়িতে দুর্গাপূজা প্রচলিত আছে আর তা খুবই প্রাচীন। নীলিমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তাঁর শিক্ষিত ও প্রগতিশীল ভাইবোনেরা আনিসুজ্জামানকে মণ্ডপে প্রবেশ করতে ও কাছ থেকে পূজা দেখতে দেবেন। আনিসুজ্জামানের মহৎ উদ্দেশ্য তাঁদের প্রাণিত করবে এ কথাও তাঁর মনে হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। নীলোফাকে রিপন স্ট্রিটের বাড়িতে রেখে আনিসুজ্জামান যখন নীলিমার সঙ্গে দত্তপুকুরে পৌঁছলেন তখন তাঁর নিজেকে খুবই অনাহূত লাগল। তাঁকে দেখে প্রায় সকলের মুখেই এই ভাব প্রকাশ পেল যে, বড়দির যেমন চিরকেলে অনাছিষ্টি! আনিসুজ্জামান নিজেই শুনলেন একজন বলছেন— বড়দির যদি কোনওদিন একটু জ্ঞানগম্যি হত! নিজে তো জাতধর্ম কিছু মানেই না! বিধবা হয়েছে, এখনও মাছ-মাংস খেয়ে যাচ্ছে— লজ্জা নেই। আমাদেরও নষ্ট করে ছাড়বে।

অন্যজন বললেন— সে তুই নিজে যা করিস কর, আমরা দেখতেও যাব না। তা বলে পুজোবাড়িতে যাকে-তাকে টেনে আনবি!—ওকে যখন ফ্ল্যাটটা দিল তখনই আমি আপত্তি করেছিলাম। অত শস্তায় একটা মুসলমানকে বেচে দিল! তোর জামাইবাবু কেনার কথা ভেবেছিল জানিস! পাত্তাই দিল না। বলে মুসলমান তো কী! জানিস কলেজে পড়ায়!

ইচ্ছে করেই কি আনিসুজ্জামানকে শুনিয়ে এ সব বলা হয়েছিল। তিনি বুঝতে পারেননি। বরং কথাগুলো শুনে ফেলে, যেন-বা চৌর্যকর্মের অপরাধবোধ জাগছিল তাঁর। সংকোচে গুটিয়ে যাচ্ছিলেন অন্তরে কিন্তু ভেবেছিলেন— হ্যাঁ, মনে রাখা উচিত, আমি মুসলমান, মনে রাখা উচিত। তুমি হিন্দু, মনে রাখা উচিত। আমার কেন তা মনে থাকে না? আরও অনেক মানুষেরই কেন মনে থাকে না? কোনটা ভাল? মনে রাখা, নাকি না রাখা…

নীলিমার ভাইরা খুবই আপ্যায়ন করেছিলেন আনিসুজ্জামানকে। তাঁদের প্রায় প্রত্যেকের সঙ্গেই তাঁর পরিচয় ছিল। সে-দিন তখনও তৃণাঙ্কুর এসে পৌঁছননি। সপ্তমীর ঝকঝকে সকাল। ঢাকবাদ্যি বাজছিল। দুর্গার গলায় বিশাল বেলপাতার মালা। নীলিমা বড়ভাইয়ের কাছে আনিসুজ্জামানের আসার উদ্দেশ্য প্রকাশ করলেন। বড়ভাই বললেন—তা বেশ। দেখবে। মা’র কাছে সব সন্তানই সমান।

মেজভাই বললেন—হ্যাঁ। বড়দা যখন বলেছেন তখন আর অন্যথা কী!

ছোটভাই বললেন—হ্যাঁ। দাদাদের যখন আপত্তি নেই তখন আমি আর কে! তবে কি-না বাড়ির মেয়েরা আপত্তি করছেন। আসলে মেয়েদের সংস্কার তো! তবে আমি বলেছি। কত বড় কাজ করছেন উনি। মুসলমান হয়ে হিন্দু দেবদেবী নিয়ে লেখা!

কিন্তু আনিসুজ্জামান যখন প্রবেশ করলেন পূজাস্থলে তখন নীলিমার বর্ষীয়ান মামা, মূল মণ্ডপে একজন মুসলমান প্রবেশ করেছেন জেনে রাগে বা পাপভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন।

ওই শেষ। আনিসুজ্জামান আর কোনও পারিবারিক পূজামণ্ডপে ঢোকার চেষ্টা করবেন না। যা দেখবেন, দূর থেকেই। বাকিটা শুনে আর পড়ে মিটিয়ে নেবেন। হয়তো তাঁর কাজে কোনও অপূর্ণতা থেকে যাবে। কোনও হিন্দু বিদগ্ধ পণ্ডিত তা ধরিয়ে দেবেন। আনিসুজ্জামান সংস্কার করে নেবেন তখন।

সে-দিন কি খুব অপমানিত লেগেছিল তাঁর? তিনি জানেন না। ব্যাপারটি এত হঠাৎ ঘটেছিল যে তিনি অন্য কিছু উপলব্ধি করার আগেই অপরাধবোধে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। মামা সুস্থ হলে, দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর নীলিমা আনিসুজ্জামানের সঙ্গেই কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন। যদিও তাঁর থেকে যাবারই কথা ছিল, কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত পাল্টেছিলেন। আনিসুজ্জামান আপত্তি করেছিলেন। নীলিমা শোনেননি। পথে কেউ এ প্রসঙ্গে কথা বলেননি। এমনকী পরেও কথা ওঠেনি এ নিয়ে। এ বছর আনিসুজ্জামান জেনেছেন নীলিমা দত্তপুকুর যাবেন না। অনেকদিন হল এই মহিলাকে কাছ থেকে দেখছেন আনিসুজ্জামান। তাঁর সবসময় মনে হয়েছে নীলিমা অতুলনীয়। নীলিমা আলাদা। তিনি ঠিক সে-যুগের নন যে-যুগে জন্মেছিলেন। তিনি ভাবীকালের। আর, এ কথা নানাভাবে প্রমাণিত, মানুষের সমাজকে এক বর্তমান থেকে সম্মুখবর্তী অন্য বর্তমানে পৌঁছে দেয় মাত্র গুটিকয় মানুষই। অন্যরা তা অনুসরণ করে অতি ধীর প্রক্রিয়ায়। ফলে কখনও সমান সারি তৈরি হয় না। সমান অবস্থিতি পাওয়া যায় না। সাধারণ একটি প্রগতিকে যখন ছোঁয়, তখন অসাধারণ নির্ণয় করে ফেলে আরও এক প্রগতির মাত্রা।

কালও ছিল এমনই এক সপ্তমীর সকাল। আনিসুজ্জামানকে ডেকে লুচি, আলুর দম, আর নাড়ু দিয়েছিলেন নীলিমা। তৃণাঙ্কুর আর আনিসুজ্জামানকে একসঙ্গেই। নীলোফা নীলিমাকে লুচি বেলে সাহায্য করছিল। আনিসুজ্জামান বলেছিলেন—দত্তপুকুর কবে যাচ্ছেন, মাসিমা?

—যাব না এবার।

নীলিমার সংক্ষিপ্ত উত্তর।

আনিসুজ্জামান বললেন—কেন মাসিমা? গতবার সেই যে আমার সঙ্গে চলে এলেন, আর গেলেন না। এবার পূজাতেও গেলেন না। আমার জন্যই কি এ সব হল?

নীলোফা লুচি বেলা থামিয়ে স্থির হয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। তার মুখ যেহেতু ঢাকা সেহেতু বোঝার উপায় নেই সে কী বলতে চায় বা ভাবে। কিন্তু আনিসুজ্জামান অনুমান করেছিলেন নীলোফা কষ্ট পাচ্ছে। আনিসুজ্জামান সে-দিনের সমস্ত অপমানের কথা নীলোফাকে বলেছিলেন। মাঝে মাঝে বলে ফেলেন সবই। মল্লিনাথের ওই অদ্ভুত আচরণের কথা ছাড়া প্রায় সবই নীলোফার জানা। সুতরাং আনিসুজ্জামানের স্বরের নিহিত প্রকাশ নীলোফার শ্রবণে অনিবার্যভাবে ধরা পড়ে। তাঁর কথায় উৎকণ্ঠা ও বেদনা ছিল যা নীলোফাকে স্পর্শ করছে।

সম্পূর্ণ ভিন্ন দু’টি কারণে পরিবার থেকে নির্বাসিত দু’টি মানুষের এই দিনযাপন ভাগ করে নেবার মধ্যে পারস্পরিক অলিখিত নির্ভরশীলতা আছে কিন্তু কোনও দায়বদ্ধতা নেই। নির্বাসনের কথা হয়তো-বা তাঁরা মনে রাখেননি কারণ এইই তাঁদের কাম্যও ছিল। তবু যা তাঁদের চাইতে হয়েছে তার পিছনের ইতিহাস বেদনাতুর, যা তাঁদের দু’জনকে একাকিত্বে নিশ্চয়ই বিষণ্ণ করে। কোনওরকম বোঝাপড়া ছাড়াই নীলোফা নিজের যন্ত্রণা সম্পর্কে নীরব। আর আনিসুজ্জামান নিজের অজান্তেই বাইরেকার যন্ত্রণা ও অপমানের কথা, অনিশ্চয়তা বা কাঠিন্যের কথা, এমনকী নিজের লেখার পরিকল্পনার কথাও নীলোফাকে বলতে অভ্যস্ত হয়েছেন, যার মধ্যে নীলোফা কখনও মন্তব্য রাখে, কখনও নীরবে নেয়, কিন্তু আনিসুজ্জামানের সমস্ত ব্যথায় একান্তে ব্যথিত থাকার অবধারণ রচনা করে বসে।

অতএব সে স্থির ও সতর্ক হয় নীলিমার জবাব শোনার জন্য। নীলিমা বলেন—তোমার জন্য নয় অনি, ওদের জন্যই। দেখো, যারা ঘৃণা করতে শেখে, অবহেলা করতে শেখে, সংস্কারের পট্টি বেঁধে দৃষ্টিকে স্বেচ্ছানির্বাসন দেয়, মানুষ হিসেবে তাদের সমস্যা অনেক বেশি। তোমার মেসোমশাই মারা যাবার পরও আমি মাছ-মাংস খাই বলে ওরা আমায় অপমান করে। আমার সমস্ত চালচলন, বক্তব্য, জীবনযাপনের পদ্ধতি ওদের কাছে নিন্দার বিষয়। এমনকী মান্তুর বিয়ে ভেঙে যাবার জন্যও নাকি আমিই দায়ী। আমার মান্তুকে মানুষ করাটা যথাযথ হয়নি। দেখো, আমার জীবন যাই হোক তার জন্য আমি কারও মুখাপেক্ষী হইনি। নানা সমস্যার মধ্যে আমি জীবনকে চিনেছি। কষ্ট করেছি কিন্তু নিজের মতামতকে অবহেলা করিনি। ওদের বিশ্বাস নিয়ে ওরা আছে, আমার বিশ্বাসে আমি। এ নিয়ে আমার কোনও ক্ষোভ বা নালিশ ছিল না। কিন্তু আমাকে যা বলে বলুক, তুমি আমার ছেলের সমান, তোমাকে আমিই নিয়ে গিয়েছিলাম ও বাড়িতে, ওরা তোমাকেও অপমান করল, আমাকেও করল। সবচেয়ে বড় কথা আমার চোখে এই প্রথম খুব ছোট হয়ে গেল ওরা। যারা মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখে না তাদের আমিই বা মানুষ বলি কী করে!

আনিসুজ্জামান বলেছিলেন—মাসিমা, আমি ও সব মনে রাখিনি। এরকমই তো হয়। সেভাবে দেখতে গেলে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হবে। আপনি কতজনকে জীবন থেকে বাদ দেবেন? সমস্যাটা কোনও ব্যক্তিমানুষের না। কোনও পরিবারেরও না। সমস্যাটা ঐতিহাসিক। কোনও-না-কোনও কারণে মানুষ মানুষকে ঘৃণা করেছে চিরকাল। জাতিতে, বর্ণে বা ধর্মের বিরোধিতায়। আর কিছু না হলে এক মানুষ অন্যজনকে ঘৃণা করছে পেশার পার্থক্যের জন্যও। এই তো হয়। হচ্ছে। আপনি কাকে বাদ দেবেন। ক’জনকে বাদ দেবেন, মাসিমা?

নীলিমা বলেছিলেন—এই তো বাদ দেবার সময়, বলো? বাহুল্য আর ভাল লাগে না। জটিলতা, কৃত্রিমতা কিছুই আর ভাল লাগে না। জীবনের বোঝা টানতে টানতে এমনিতেই মন্থর হয়ে আছি। এ বার ছাড়ার পালা। এ বার যে-ক’দিন যতটুকু বাঁচব, সে নিজের মতো।

আনিসুজ্জামান আর কথা বলেননি।

সন্ধেবেলা নীলোফা কাছে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল। তিনি তখন গবেষণার কাগজপত্র দেখছিলেন। বলেছিলেন—কিছু বলবি?

—হ্যাঁ।

—বল্।

—আমাকে কাল খিদিরপুরে পীরবাবার মাজারে নিয়ে যাবেন?

চমকে উঠেছিলেন আনিসুজ্জামান। মাজারে! কেন? কিন্তু মুখে কিছু বলেননি। নীলোফার কোনও দাবি নেই। প্রত্যাশা নেই। এ বাড়িতে সে তার গাছেদের মতোই নিরুচ্চার। সে শুধু বেঁচে থাকতে থাকতে খেয়াল রাখে, আনিসুজ্জামানের কোনও অসুবিধা যাতে না হয়! আনিসুজ্জামান তার জন্য যতটুকু করেন সেটুকুই তার প্রাপ্তির জগৎ। যেমন কিছু পড়িয়ে দেওয়া, বুঝিয়ে দেওয়া বা সেতার শেখার আয়োজন। যেমন নীলোফা নিজের খেয়ালে কিছু করতে চাইলে বাধা না দেওয়া। এই ফ্ল্যাট সে মনের মতো করেই সাজায় নানা রকম পর্দায় আর চাদরে। মনের মতো গাছ করে। ছবি টাঙায়, বইয়ের স্তূপ গোছায় যেন এ তার নিজের সত্যিকার সংসার। এ সবে কোনও বাধা নেই কারণ আনিসুজ্জামান উদাসীন ও নির্বিকার। নীলোফাকে নীলোফার মতো ছেড়ে দিয়েই তাঁর নিশ্চিন্তি। এই প্রথম, বা বলা যেতে পারে, রিপন স্ট্রিটের বাড়ি থেকে চলে আসার প্রস্তাবের পর এই প্রথম নীলোফা মুখ ফুটে কিছু চাইছে তা মনে পড়ল আনিসুজ্জামানের। ভাগ্যিস পড়ল। না পড়লে হয়তো তাঁর নিজের কাজের তাগিদে এ আবেদন খারিজও করে দিতে পারতেন। এবং নীলোফা তাতে প্রতিবাদও করত না। আনিসুজ্জামান নীলোফার দিকে তাকিয়েছিলেন। তার বোরখা-ঢাকা মুখ মাটির দিকে নামানো। তিনি বলেছিলেন—নিয়ে যাব। কাল বিকেলে। কেমন?

আজ সেই নিয়ে যাবার দিন। বড় ভিড় রাস্তায়। অষ্টমীর কলকাতা। আনিসুজ্জামান জানেন পথ অচল হয়ে থাকবে। হাঁটা যাবে না। গাড়ি নড়বে না। তবু মানুষ চলবে। একটু একটু করে এগোবে। চলা থেমে থাকবে না। না চলে উপায় নেই। আনিসুজ্জামানের মাঝে মাঝে মনে হয়, এই যে চারপাশে এত হানাহানি, ঈর্ষা, ঘৃণা, বিদ্বেষ— এ সব যেন করতে হয়, তাই মানুষ করে, না করে কোনও উপায় নেই বলে করা। প্রাতঃকৃত্যের মতো। রেতঃস্খলনের মতো। এইসব মানুষেরা প্রত্যেকে এখান থেকে বেরোতে চায়, মুক্ত হতে চায়, কিন্তু পারে না। না পেরে নিরুপায়ভাবে আবার এ সবে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মানুষ নিজেকে সৎ ও সুন্দর দেখতে চায়।

মণ্ডপ থেকে বেরিয়ে আনিসুজ্জামান হাঁটছেন— পাশ দিয়ে একটা রিকশা চলে গেল। রিকশায় দুই মহিলা বসে আছেন। একজন আর একজনকে বলছেন— ‘হাসপাতালটাই আমাদের একমাত্র বেড়াবার জায়গা।’ ইস্! কী কঠিন! কী কষ্ট! আনিসুজ্জামান ভাবেন, এই তো মানুষ। এরা বেড়াতে যেতে চায়। মুক্ত বাতাস, খোলা আকাশ, কুলুকুলু নদী আর সবুজ নরম মাঠে গড়িয়ে দৌড়ে খেলতে চায়। মানুষ প্রকৃতিকে কাছে চায়। না চেয়ে কী করবে! প্রকৃতিই উৎস। প্রকৃতিই মা। মাকে না পেলে সন্তান যেমন পাগল-পাগল হয়, অস্বাভাবিক হয়, তেমনই, প্রকৃতিকে না পেলে মানুষের মধ্যেও অস্বাভাবিকতা আসে। সে উন্মত্ত হয়। ক্ষিপ্ত হয়। কাম ক্রোধ লোভ মাৎসর্যে ধ্বংস করে পরস্পরকে।

ভাল থাকতে চায়, ভাল হতে চায় মানুষ—এ বিশ্বাস আনিসুজ্জামানের মধ্যে খুবই গভীর। শুধু দুঃখ হয় যে মানুষ বুঝতেই পারে না আসলে সে কী চায়! কিন্তু এভাবেই, আজীবন ভাল হতে চায় মানুষ। যেন ছোট্ট বালক বা বালিকা, খুব দুষ্টুমি করছে, শুনছে না কোনও উপদেশ, শাসন আদেশ মানছে না, তাঁকে ভাল বলা হোক—তুই কী ভাল রে—বলা হোক—তুমি কী লক্ষ্মী, সোনা, তোমার মতো ভাল আর দু’টি নেই—সে ভাল হতে থাকবে। শুনতে শুনতে সে নিজেকে বলবে ভাল। যেন এক বৃষ্টিওয়ালা এসে মন্ত্র দিয়ে যাবেন—বলো, আমি সুন্দর। বলো, আমি ভালবাসি।

দু’টি ছেলে সাইকেল চালিয়ে চলে গেল। একজন চালাচ্ছে, একজন সামনের রডে বসা। যে চালাচ্ছে, বলল—মাধবী দাঁড়াতে বলেছে তোকে।

সামনের ছেলেটি কী বলল শোনার আগেই তারা চলে গেল। কে মাধবী? সে ছেলেটিকে দাঁড়াতে বলল কেন? কোথায় দাঁড়াতে বলল? কখন? একটি বিচ্ছিন্ন বাক্য আনিসুজ্জামানের মধ্যে জীবনের নিগূঢ় দর্শন সঞ্চার করে। ভাল হতে চাওয়ায় মতো, ভাল থাকতে চাওয়ায় মতো, এও এক চাওয়া। থেকো আমার জন্য। দাঁড়িয়ো। অপেক্ষা কোরো। কেউ কারওকে দাঁড়াতে বলে। কেউ দাঁড়ায়। কেউ দাঁড়ায় না। আসবে বলে কথা দেয় কেউ। আসে। আবার আসেও না। অথবা আসে, কিন্তু ঘটনাক্রমে সে আসা অর্থহীন হয়ে যায়। কেউ হয়তো দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে, অপেক্ষা করতে করতে কাটিয়ে দেয় সারা জীবন। এক সময়, কার জন্য অপেক্ষা, কার জন্য দাঁড়ানো, সেটুকু ভাববারও প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। তখন শুধু অপেক্ষাই জীবন। অপেক্ষাই ধর্ম। মৃত্যুরই মতো অনিবার্য ও অর্থহীন।

আনিসুজ্জামান নিজে কখনও কারও জন্য দাঁড়িয়ে থাকেননি। কোনও মাধবী তাঁকে কোথাও কখনও অপেক্ষা করতে বলেনি। তিনিও প্রত্যাশা করেননি তাঁর জীবনে কোনও মাধবীর ফুটে ওঠা। তাঁর মধ্যে, এমনকী, যৌন তাড়নাও অতি নিভৃত এবং বিরল। এক লুকনো ভীতি বা বিতৃষ্ণায় ওই বোধ থেকে তিনি পালিয়ে বেড়াতে চান।

বেড়াবার জায়গা হিসেবে, মুক্তির জায়গা হিসেবে, আনিসুজ্জামানকে কখনও হাসপাতালে যেতে হয়নি। সে-দিক থেকে ভাবতে গেলে আনিসুজ্জামানের জীবন খুবই ঘটনাবিহীন এবং নিস্তরঙ্গ। বলা যেতে পারে, জীবনকে তিনি পরোক্ষভাবে যতখানি চিনেছেন, প্রত্যক্ষভাবে তেমন নয়। মাঝে মাঝে গভীর রাত্রে একা বেরিয়ে পড়েন বাইরে। আপনভোলা পাগলের মতো হেঁটে যান রাস্তায়, গলিতে, কিংবা ফটিক বিল বস্তিতে। অন্তর্গত জীবন নানাভাবে তাঁর কাছে ধরা দেয় তখন। কবে থেকে এ অভ্যাস হল? মনে আছে, কাশীপুরের ওই বীভৎস পাশবিক হত্যাকাণ্ডের পর, মনে হত রক্তের গন্ধ পাচ্ছেন, মনে হত কারা চিৎকার করছে, বাঁচাও— মেরো না— মা গো, পায়ের শব্দ পেতেন, কারা পালাচ্ছে। অজস্র পায়ের শব্দ। ছুটছে। কোথায় ছুটছে? কোন পথে? ওইসব মৃতদের মধ্যে আনিসুজ্জামানের কলেজের ছাত্র ছিল। স্কুল পড়ুয়া ছিল। নিরীহ, জীবন কী তার কোনও সম্যক ধারণাহীন তরুণও ছিল। পৃথিবীর সমস্ত তরুণের প্রতি আনিসুজ্জামানের ছাত্রবৎ স্নেহ বহমান। ওইসব মৃত্যু তাঁকে তাড়িয়ে ফিরত। দম বন্ধ হয়ে আসত। ঘরে মন টিকত না। ওইসব পায়ের শব্দের সঙ্গে পা মেলাবার ইচ্ছায় পথে নেমে আসতেন তিনি। তখন গভীর রাতে বেরুনোয় ঝুঁকি ছিল। রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক কোনও মানুষেরই নিষ্কৃতি ছিল না। পুলিশ ও গুণ্ডা, বিপ্লবী বা সাধারণ পাটিকর্মী— প্রত্যেকেই খুন করতে পারত, খুন হতেও পারত। আনিসুজ্জামান তবু বেরোতেন। বেরিয়ে পড়তেন। সেই অভ্যেস হল। এখনও তা বজায় আছে। মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়েন। দু’-এক পাক এ দিক-ও দিক ঘুরে দেখেন। আর দেখেন গভীরতর নিহিত জীবন।

একদিন রাত্রে নিয়োগীপাড়া দিয়ে চলেছেন। ঘুমন্ত পাড়া। একটি কান্না বাজছে। একটি পুরুষকণ্ঠ সাড়া দিচ্ছে।

—কাঁদছ কেন? বাসন্তী? কেঁদো না। ও জেলে আছে। তবু তো আছে। আসবে কোনওদিন।

—ও কি সত্যি মেরেছে, বলো? ও তো একটা শুঁয়োপোকাও মারত না। ও কি ওর মাস্টারমশাইকে মারতে পারে? ওই নিরীহ লোকটাকে?

—মারতে পারে। আবার নাও পারে। যদি মারে, অবাক হয়ো না। ওরা বিপ্লব করছে। ওরা স্বপ্নে আছে। খুন শব্দটা ওরা জানে না। ওরা শ্রেণীশত্রু খতম করে। আমাদের স্বাধীনতার আগে সশস্ত্র বিপ্লবীরা যেমন করতেন, তেমনই। সে-সব কি খুন বলবে তুমি?

—হ্যাঁ গো, আমি কিছু জানি না, বুঝি না। কিন্তু এভাবে কি শত্রু নিকেশ করা যায়? অন্যকে মেরে, নিজেরা মরে? একজনকে মারলে দশজন কি ফের জন্মাবে না? যে-প্রাণ একবিন্দু দিতে পারব না কারওকে, সে-প্রাণ নেব কেন? অন্য পথে বিপ্লব হয় না? হ্যাঁ গো, না মেরে, না মরে বিপ্লব হয় না? আনিসুজ্জামান চলে এসেছিলেন। পুরুষ কণ্ঠটি কী উত্তর দিয়েছিল, আর শোনেননি। তাঁর মন ভার হয়ে গিয়েছিল। যে-বিপ্লবে মা ছেলেকে সমর্থন করতে পারছে না তা কীভাবে সফল হওয়া সম্ভব? সে-বিপ্লব কখনও যথার্থ নয়। কিংবা, হতে পারে তিনি পিছিয়ে আছেন। ওদের গতি ধরতে পারছেন না। বুঝতে পারছেন না সত্যিই এই খুনোখুনির প্রয়োজনীয়তা কতখানি! কষ্ট পাওয়া ছাড়া তাঁর আর কিছুই করার ছিল না। যতই তা উপলব্ধি করছিলেন, ততই একটা পাগলামি কিংবা নেশা তাঁকে টেনে ঘরের বাইরে আনছিল।

শুধু হত্যা, শুধু ধ্বংস। সমস্ত অনুভূতিসম্পন্ন বাঙালিই বোধহয় পাগল হয়ে উঠেছিল সেই সময়। আর বারবার খবর হচ্ছিল এই বরানগর। সত্তর সালের শেষের দিকে হঠাৎ একদিন বারাসত আমডাঙা অঞ্চলে অনেকগুলো মৃতদেহ পাওয়া গেল। কারও হাত-পা বাঁধা। কারও চোখ বাঁধা। প্রত্যেকের গায়ে চার-পাঁচটা করে গুলির দাগ। দেহগুলো শনাক্ত হল। বেলঘরিয়া-বরানগর-দক্ষিণেশ্বর অঞ্চলের সব ছেলে। স্কুল-কলেজের ছাত্র। নকশাল করত। তাদের মধ্যে একজন ছিল বেলঘরিয়া থানার এক অফিসারের ছেলে। দিল্লিতে রাজ্যপাল সম্মেলন চলছিল তখন। সম্মেলন উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিলেন। আইন-শৃঙ্খলা প্রসঙ্গে এসে বললেন— যেভাবেই হোক ভারতবর্ষ থেকে হিংসার রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। খুনের রাজনীতি দ্বারা সমস্যার সমাধান হয় না। বরং তা বেড়েই চলে।… …

ওই সম্মেলনেই নকশাল আন্দোলনকে সর্বভারতীয় সমস্যা হিসেবে তুলে ধরা হল। পশ্চিমবঙ্গের একজন বিদগ্ধ নেতা বললেন— নকশালরা, পুলিশেরই সৃষ্টি। এবং শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগসাজসেই নকশালদের তৈরি করা হয়েছে।… …

বিবৃতি চলতে লাগল। আক্রমণ-প্রতি আক্রমণও চলতে লাগল। স্কুল, কলেজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সম্পত্তির ওপর আঘাত এল। কিন্তু ক্রমশ, ওই আঘাত ব্যক্তি আক্রমণের কাছাকাছি চলে এল। চারু মজুমদার বললেন— মনীষীদের মূর্তি ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে যুব সমাজের তাঁদের প্রতি তীব্র ঘৃণা, বিদ্বেষ প্রকাশ পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর এঁরা তো ইম্পিরিয়ালিজম্-এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে আদৌ উৎসাহী ছিলেন না। মূর্তি ভাঙার মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আসবাব কিংবা ল্যাবরেটরি ধ্বংসের মধ্যেও ছাত্রদের কোনও অন্যায় নেই। বরং আমি খুব আনন্দিত হতাম, যদি ছেলেরা গোটা বিশ্ববিদ্যালয়টা একটা ডিনামাইটের সাহায্যে উড়িয়ে দিত।

বিভিন্ন বিবৃতিতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত। তার সঙ্গে যুক্ত হল মনীষীদের অপমান করার কারণে নকশালদের প্রতি সহানুভূতিহীনতা। গুণ্ডামির সঙ্গে বৈপ্লবিক ক্রিয়া-কর্মের আর তফাত পেল না তারা। আন্দোলন ক্রমশ সার্বিক আবেদন থেকে সরতে সরতে কুক্ষিগত হয়ে গেল। আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতে লাগল পার্টি কর্মীদের মধ্যেই। ভাঙন ধরল। কারণ বিপ্লবীদের নেতারা প্রশ্ন পছন্দ করলেন না। যে-কায়দায় জরুরি অবস্থার নামে জনকণ্ঠ রোধ করার চেষ্টা হয়েছিল, সেই একই কায়দায় পার্টির প্রতি আনুগত্যের নামে বিপ্লবের নেতারা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকতে চাইলেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠল। উঠলই। কারণ মানুষের চেতনায় প্রশ্ন সূর্যোদয়ের মতো অমোঘ, অনিবার্য সত্য। প্রশ্নকে ঠেকানো যায় না, থামানো যায় না, হত্যা-করা যায় না। আর তাই-ই মানুষ প্রশ্নকেই এড়িয়ে চলতে চায়। তাই, প্রশ্নের উন্মেষ হতেই তখন শুরু হল পারস্পরিক খুন ও সন্ত্রাস৷ একবারও ভেবে দেখা হল না, বিশ্ববিদ্যালয় গুঁড়িয়ে দিলেও গড়ে উঠবে আবার কোনও বাড়ি যা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে থাকবে কারণ বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতিরেকে নতুন ও বিকল্প কোনও চেতনা দেওয়া হয়নি।

ভাবলে এখনও দমবন্ধ হয়ে আসে। পূজার সকালে মানুষের এই নির্বিকার মুখ, মা দুর্গার আরতি, মেয়েদের নতুন শাড়ি পরে ঘুরে বেড়ানো দেখলে মনে করতে ইচ্ছে করে না যে দু’বছর আগেও গলিতে গলিতে যখন-তখন বারুদের গন্ধ উঠেছে।

হাঁটতে হাঁটতে উদ্বাস্তু কলোনিতে পৌঁছলেন আনিসুজ্জামান। সত্যর বাড়িতে এসেছেন তিনি। সত্যর একটা গাড়ি আছে। ভাড়া দেয়। পুরনো সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কিনে ব্যবসা করছে সত্য। আনিসুজ্জামান এসেছেন গাড়িটি ভাড়া নিতে।

সত্য বাড়ির বারান্দায় বসে নারকোল ছুলছিল। এ কাজে একটি সাঁড়াশি ব্যবহার করছিল সে। সাঁড়াশি দিয়ে নারকোল ছোলা যায় তা প্রথম দেখলেন আনিসুজ্জামান। সত্য তাঁকে দেখে এগিয়ে এল। বলল— স্যার, আপনি?

সত্য আনিসুজ্জামানের প্রাক্তন ছাত্র। ওর বোন এখন এ কলেজে পড়ছে। আনিসুজ্জামান হাসলেন। বললেন— তোমার গাড়িটা কি আজ পাওয়া যাবে সত্য?

সত্যও হাসছে। বলল— হ্যাঁ, স্যার! পাওয়া যাবে না! আপনি বললেই পাওয়া যাবে। কোথায় যাবেন স্যার?

—খিদিরপুর যাব। তারপর ওখান থেকে আরও কয়েকটা জায়গায়। একটু তাড়াতাড়িই বেরুতে চাই। রাত যত বাড়বে তত জ্যাম বাড়বে রাস্তায়।

—ক’টায় বেরুবেন স্যার? আমি নিজে গাড়ি নিয়ে আপনার বাসায় চলে যাব।

—আড়াইটেয় এসো।

সত্যর বোন এসে দাঁড়াল বাইরে। সবুজ রঙের তাঁতের শাড়ি পরেছে। টিপ দিয়েছে কপালে। চুল খোলা। কিছুই দেখতে নয় মেয়েটিকে। কোনওভাবেই চোখে পড়ার মতো নয়। কিন্তু আজ ভারী চমৎকার দেখাচ্ছে। লাবণ্য ঢলঢল করছে। পুজোর দিনে, উৎসবের দিনে খুবই সুন্দরী হয়ে ওঠে মেয়েরা। আপনা-আপনিই। যেন উৎসবের আনন্দের ছটা লাগে চোখেমুখে।

সত্যর বোন আনিসুজ্জামানের বিভাগের নয়। মেয়েটির নাম ভুলে গেছেন তিনি। তাতে কী! ছাত্র-ছাত্রীরা এতে অভ্যস্ত। স্যার নাম ভুলে যাবেন আর তারা লাজুক মুখে বলবে— ‘আমি অমুক স্যার। চিনতে পারছেন না? ওই ইয়ার স্যার! সেই সেবার—… …’ সে কোনও ঘটনার কথা বলবে। আর অধ্যাপকের তা মনে পড়ে যাবে।

সত্যর বোন এগিয়ে আসছে। প্রণাম করছে আনিসুজ্জামানকে। আনিসুজ্জামান পিছিয়ে যাচ্ছেন— কী করছ? আচ্ছা— আচ্ছা— থাক্…

সে হাসছে। বলছে— আমার নাম শিউলি স্যার। ভিতরে আসুন না। মা ডাকছেন। পুজোর দিন এলেন।

আনিসুজ্জামানের ভয় করছে। পুজোর দিনে ছুঁয়ে ফেলার ভয়। অপমানের ভয়। কিন্তু তিনি না বলতে পারছেন না। সত্য আর শিউলি দু’জনেই বলছে, আসুন না স্যার।

আনিসুজ্জামান ঘরে ঢুকছেন। ঘরে চালবাটার আলপনা। জিজ্ঞেস করছেন— পুজো হয়েছে বুঝি?

—না, না। আজ অষ্টমী বলে শিউলি আলপনা দিয়েছে। বসুন স্যার।

ছোট ছোট দু’টি ঘর সত্যদের। ঘরজোড়া বিছানা, বসার অন্য কোনও জায়গা নেই। একফালি মেঝে আলপনায় ভরে আছে। ঘরের চার দেওয়াল পাকা হলেও দু’ঘরের মাঝখানের দেওয়ালটি বাঁশের। একপাশে একটি আলনা, তাতে পরিপাটি করে শাড়ি গুছনো। পাশের ঘরটি এত অন্ধকার যে সেখানে আর একটি বিছানার আভাস ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। দেওয়ালে একটি কাঠের তাক ঝোলানো, তাতে বই। সব কিছুই গোছানো। যথাস্থানিক। এত ছোট ঘর। এত সামান্য আসবাব, তবু ভাল লেগে যায়।

আনিসুজ্জামান বিছানায় বসতে সংকোচ করছিলেন। শিউলি হাত দিয়ে ঝেড়ে দিল সামনের দিকটা। দেখিয়ে দিল, বসুন স্যার। আনিসুজ্জামান বসলেন। প্লেট ভরে নাড়ু, সন্দেশ আর খেজুর নিয়ে এল শিউলি। আনিসুজ্জামান খেতে আপত্তি করছিলেন। তখন পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সত্যর মা। মোটাসোটা। স্নিগ্ধ। মায়াময়। অনেকটা যেন আমিনার মতো লাগে। বললেন— খান। খাইয়া লন। সক্কালে সক্কালে পূজা দিসিলাম। প্রসাদে না কইতে নাই।

সত্যর মায়ের কথায় বাঙাল ভাষার টান। সত্য বা শিউলির কথা শুনে বোঝা যায় না ওরা বাঙাল। অবশ্য উদ্বাস্তু কলোনির বেশির ভাগ লোকই বাঙাল। পূর্ববাংলা থেকে উচ্ছিন্ন উৎপাটিত মানুষ। কোনওক্রমে বাঁচতে চেয়েছিলেন এপারে এসে। জীবনের তাগিদ বড় তাগিদ। কত সম্পন্ন গৃহস্থ যে নিঃস্ব হয়ে নতুন করে বাঁচার চেষ্টা করেছেন তার হিসেব নেই। সারা কলকাতায় এরকম অসংখ্য উদ্বাস্তু কলোনি।

হঠাৎ আনিসুজ্জামানের মনে হল, ওই যে হলুদ পাড় সাদা শাড়ি পরা মহিলা, মায়ের মতো মায়াচ্ছন্ন মুখ, যিনি সত্য ও শিউলি নামের দু’টি চমৎকার ছেলেমেয়ের মা, অষ্টমী পুজোর সকালে শুদ্ধভাবে গৃহদেবতার পুজোর প্রসাদ তুলে দিয়েছেন অতিথির হাতে, তিনি কি জানেন, আনিসুজ্জামান একজন মুসলমান? তাঁর মাথায় টুপি নেই। তিনি গোঁফও কাটেন না। নিখুঁত দাড়ি, সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি কিংবা সাধারণ শার্ট-প্যান্ট কখনও বলে দেয় না তিনি কোন ধর্মের মানুষ! যদি সত্যর মা না জেনে আপ্যায়ন করে থাকেন, যদি জানার পর তাঁর মনে হয়, অষ্টমী পূজার সকালটায় একজন মুসলমান ঘরে ঢুকে ছুঁয়ে-ছেনে সব অপবিত্র করে দিল— তা হলে? আনিসুজ্জামানের বুকের মধ্যে সিরসির করে। আর হাতে দু’খানি ফুলবেলপাতা সমেত এগিয়ে আসেন সত্যর মা। বলেন— দাঁড়ান। মাথায় একটু নিরমালি ঠ্যাকাইয়া দেই।

তাঁর হাত উঠল। সত্য আর শিউলি কোনও কথা বলল না। আনিসুজ্জামান প্রায় আর্তনাদের মতো বলে ফেললেন— দাঁড়ান মা, আপনি বোধহয় জানেন না আমি মুসলমান।

একটু চুপ করে থাকলেন সত্যর মা। তারপর বললেন— আপনের আপত্তি থাকলে দিমু না। ন্যান্, খাইয়া লন্।

সত্য কথা বলে ওঠে এবার। কারণ সে আনিসুজ্জামান স্যারকে চেনে। মাকেও। সে বলে— স্যারের কোনও আপত্তি নেই মা। তোমার আপত্তি হতে পারে ভেবে উনি বললেন।

আনিসুজ্জামান বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছেন। প্রসাদের প্লেট পাশে রাখা। তাঁর মাথা নিচু। বারবার এরকম হয়। বারবার। তুমি হিন্দু, না মুসলমান! ছোঁব, না ছোঁব না! যদি না ছোঁয়— তবে কষ্ট, অপমান। ছুঁল না আমাকে! কেন, কেন?… … যদি ছোঁয়— তবেও কষ্ট। না, অপমান নেই। শুধুই কষ্ট। বেশ করুণা করছে। কারণ যে স্পর্শ করছে সে এ মনে করে করবে না যে আমার জাতি-গোত্র নেই, ধর্ম-বর্ণ নেই, দেশ-বিদেশ নেই, আমি একটা মানুষ, একজন মানুষ আর একজন মানুষের কল্যাণ কামনা করছে। না, এরকম নয়। বরং সব মনে রেখে জেনে রেখে ঔদার্য প্রমাণ। আবার মনিরুলের মতো ধর্মাচারপরায়ণ—তিনি কোনও হিন্দুর পরিবারে মাংসাদি গ্রহণ করবেন না কোনও দিন কারণ হিন্দুরা প্রাণীগুলিকে জবাই করে না। হালাল করে না। এই রকমই চলছে। চলে যাচ্ছে। এ ওর কাছে অস্পৃশ্য। ও এর কাছে অন্যায্য। ঈশ্বরকে ভজনা করছে দু’দলই কিন্তু সাকারে নিরাকারে বৈরিতা বেঁধে যাচ্ছে। পশু-পক্ষীও বধ করছে দু’দল কিন্তু বধ করার পদ্ধতি নিয়ে কলহ বাঁধিয়ে পশুবধের ছুরিগুলিই পরস্পর বসিয়ে দিচ্ছে বুকে। অপমান দিতে দিতে নিতে নিতে যুগ গেল, যুগান্তরে পৌঁছে গেল বিরোধ—তবু ফুরল না।

সত্যর মা আনিসুজ্জামানের মাথায় ফুল ছোঁয়াচ্ছেন। নির্মাল্য ছোঁয়াচ্ছেন। বলছেন— দ্যাশে আমার এক ভাই আসিলেন। মোসলমান। ভাই ডাকসিলাম তাইনরে। তাইতে কী? আপনে আমার পোলা-মাইয়ারে শিক্ষা দেন। আপনের আর জাইত-ধর্ম কী! শিক্ষকের জাইত নাই। জীবনে কি কম দ্যাখলাম? কতবার দাঙ্গা হইল, হিন্দু মোসলমানরে কাটল, মোসলমান হিন্দুরে। কত রক্ত দ্যাখলাম। রক্ত দেইখা তো বুজি নাই কুনডা মোসলমানের কুনডা হিন্দুর।

আনিসুজ্জামান মুখ তুলছেন। এ করে কথা? অল্প শিক্ষিত বা আতিশয্যহীন অশিক্ষিত সত্যর মায়ের? নাকি ইনি এক প্রাজ্ঞ দার্শনিক! সত্যর মায়ের পায়ে হাত রাখতে ইচ্ছে করে তাঁর। কিন্তু লজ্জায় স্থির ও নিষ্ক্রিয় থাকেন। পায়ে হাত রেখে বা মাথা রেখে প্রণামে তাঁর মোহ ছিল না। নিজে এটি পালন করেছেন কখনও বা গ্রহণও করে থাকেন ছাত্রছাত্রীর কাছে। কিন্তু আজ এ যেন কোন্ অন্তরের ইচ্ছা! আজ তাঁর মনে হচ্ছে, কোনও কোনও মুহূর্ত আসে যখন নিজেকে নীচে দেখতে, ছোট দেখতে ভাল লাগে। বড় মনের কাছে, বড় স্নেহের কাছে, বড় বিশ্বাস ও কল্যাণের কাছে ছোট হয়ে, শিশু হয়ে দু’হাত বাড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে। যেন মায়ের কাছে বলা— আমাকে নাও। আমাকে তুলে নাও। আমাকে বড় করো। তোমার মতো করো। তোমার মতো বড়।

আনিসুজ্জামান আনন্দে নারকোল নাড়ু মুখে পুরলেন। শিউলির দিকে তাকিয়ে বললেন— তোমার নিশ্চয়ই শরতে জন্ম?

—হ্যাঁ।

মাথা নাড়ল শিউলি। সত্য বলল— আজই ওর জন্মদিন স্যার! ভূ-ভারতে দেখেছেন কেউ নিজের জন্মদিনে নিজে আলপনা দেয়! শিউলি দিয়েছে।

শিউলি ছেলেমানুষের মতো ঝাঁপায়। রাগ করে। প্রতিবাদের চেষ্টায় বলে— মোটেই না। ভাল হবে না দাদা। উল্টো-পাল্টা বলবি না। আমি অষ্টমী বলে আলপনা দিয়েছি। মোটেই আমার জন্মদিন বলে নয়।

আনিসুজ্জামান শিউলি ও সত্যর সরল শুভ্রতায় স্নিগ্ধ হলেন। বললেন— তাহলে পায়েস কোথায় মা? জন্মদিনের পায়েস?

সত্যর মা বললেন— এখনও করি নাই বাবা মাস্টার। সইত্যরে কইতেয়াছি দুধ আইন্যা দিব। অ সইত্য! এমুন ব্যালা করলি! আর দুধ পাবি না। মাইয়াটারে আইজ পায়েস দিমু না?

সত্য বলে— পাব মা। মরণ ব্রিজের ওপাশে খাটাল থেকে এনে দেবে।

আনিসুজ্জামান খেতে থাকেন আর চারপাশের গৃহস্থীতে চোখ বোলান। এ ঘরে কী আছে, যা অন্য সব ঘরেই থাকে না? তাঁর মনে হল, এ ঘরে জীবন আছে। বেঁচে থাকার প্রতি সম্ভ্রম আছে। বেশির ভাগ ঘরে শুধুই থাকা। শুধুই দিনযাপন। যতটুকু আছে তারই মধ্যে ভাল না থেকে যা নেই তারই জন্য খারাপ থাকা! তিনি সত্যর মায়ের দিকে তাকালেন। মাথার চুল প্রায় সব পাকা। কপালে বড় সিঁদুরের টিপ। চুলের তলায় গিঁট দেওয়া। কানে দু’খানি সোনার কানপাশা লতি কেটে ঝুলে আছে। হাতে শাঁখা, পলা, নোয়া। কী সাধারণ! কী অনাড়ম্বর! কী রিক্ত অথচ কী সুন্দর! এখনও বিশ্বাস হয় না এই মানুষটির দর্শন কী আশ্চর্য গভীর ও মূল্যবান! সারা জীবন গবেষণা করে যে-তত্ত্ব আনিসুজ্জামান পুস্তকে বা গ্রন্থে প্রতিষ্ঠা করতে চান, তা প্রতিষ্ঠিত ও নিহিত আছে সাধারণ মানুষের মনোজগতেই। সব সময় তার স্ফূরণ হয় না। প্রকাশ হয় না। আর এটাও ঠিক যে সব মানুষের মধ্যে সেই অবিচল নিজস্ব দর্শন গড়ে ওঠার অবকাশ পায়নি।

পুজোর জন্য নীলোফাকে একটি তাঁতের শাড়ি উপহার দিয়েছেন নীলিমা। আনিসুজ্জামান জানেন, নীলোফার সঙ্গে নীলিমার এইসব সুন্দর আদান-প্রদান হয়। কেউ কোথাও একটি মনের মতো গাছ পেলে সংগ্রহ করে আনেন এবং দু’জনের বাগানেই তা লাগানো হয়ে যায়। খাবার দেওয়া-নেওয়া নৈমিত্তিক ঘটনা। দু’জনে বাজারে যান একসঙ্গে এবং যে-যার সংসারের বস্তু কিনে আনেন। নীলিমা নীলোফার পছন্দের ওপর ভরসা করেন। নীলোফা নীলিমার নির্দেশনার ওপর। এই দুই মহিলার সখ্য দেখে অবাক লাগে আনিসুজ্জামানের। বয়সে সমান নয়। ধর্মবোধ আলাদা। একজন শিক্ষিত, অভিজ্ঞ, মুক্ত—বাইরের পৃথিবীকে দেখতে পাওয়া মানুষ। অন্যজন শিক্ষা পাবার অবকাশ পায়নি। স্কুলের সীমা পেরিয়ে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার অবকাশ পায়নি। রিপন স্ট্রিটের বাড়ি আর মাথুরের গড়ের এই পরিবেশ ছাড়া বৃহত্তর জগৎ সম্পর্কে যার কোনও ধারণা নেই। সেও ঈদের দিনে, হালকা চাঁপাফুল রঙের ওপর সবুজ কল্কাপাড় তাঁতের শাড়ি নীলিমাকে উপহার দেয়। কতদিন আনিসুজ্জামান বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে এসে দেখেছেন নীলিমার বারান্দায় পাশাপাশি চেয়ার পেতে বসে রয়েছেন দু’জন। একজন বোরখায় ঢাকা। আড়াল থেকে আকাশ দেখছে বা কশিদা করছে চুপচাপ— অন্যজন কাঁচাপাকা চুল ছড়িয়ে দিয়েছেন পিঠময়। হাতে ‘গীতবিতান’। পড়ছেন—

ওগো বিদায়, ওগো ক্ষতি,  ওগো দিনশেষের পতি,
ভাঙা বাসার লহো নমস্কার॥

আনিসুজ্জামান নড়তে পারছেন না। চা চাই। খিদে পেয়েছে। কিন্তু এই বৈকালিক ধ্যান ভাঙিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে না। বরং তিনি নিজেও ঢুকে পড়েছেন ধ্যানের জগতে। এ কী আশ্চর্য কথা! এ কোন শক্তি! এ কী অপূর্ব প্রেম আর নির্ভরতা! নিঃশেষ নিবেদনের কী অমোঘ উচ্চারণ! বিদায়কে ব্যক্তিত্বদান। কী সুন্দর! তুমি সব নেবে তবে? হে বিদায়— সব ভেঙে দিলে তুমি। নষ্ট করে দিলে। সব সাজানো স্বপ্নের ধন তোমার হাতে তছনছ হল। তাতে কী! তুমি তো এলে। তোমাকে তো আসতে হল। আমার ক্ষতির বেশে। আমার দিন ফুরনোর বেশে। তবুও। আমার ভাঙা আমি, রইল তোমার জন্য।

আনিসুজ্জামান ভেবেছেন বহুবার। নীলোফা কি বোঝে? এ সব বোঝে? নীলোফা পড়ে। পড়তে ভালবাসে। অনেক সময় অনেক কিছুর মানে বুঝতে পারে না। ছেলেমানুষের মতো প্রশ্ন করে তখন। এসে ডাকে— ভাইজান—!

নীলিমা ‘রাজকাহিনী’ দিয়েছে নীলোফাকে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। পড়ছে নীলোফা। ধরতে পারছে না। যখন যেটা পাচ্ছিল, পড়ছিল। আনিসুজ্জামান বুঝিয়ে দিয়েছিলেন— এ বই অন্য গল্প বইয়ের মতো নয়। এটি পড়তে হয় ধারাবাহিকতা মেনে। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত।

নীলোকা পড়ছে। পড়তে পড়তে ‘বাপ্পাদিত্য’তে ঠেকল। বলল— এ কেমন করে হয় ভাইজান? যেখানে শরীর ছিল সেখানে রইল গোলাপ আর পদ্ম। কেমন করে হল?

আনিসুজ্জামান তখন সেই দুর্গাবিষয়ক প্রবন্ধ লিখছেন। গভীরভাবে নিরিখ করছেন পোড়ামাটির ভাস্কর্যের ছবি। তাঁর মাথায় বাপ্পাদিত্য ঢুকছে না। তিনি দেখছেন, দুর্গার পায়ের তলায় সিংহকে অনেকটা ঘোড়ার মতো লাগছে। যে-নিখুঁত নির্মাণ তাতে মনে হচ্ছে— এই ঘোড়ার মতো সিংহ অর্থাৎ সিংহে খানিক অশ্বত্ব প্রদানই শিল্প। এই অশ্বগ্রীব সিংহ শিল্পীর নিজের সৃষ্টি। এ শিব গড়তে শিবা নয়। এ অর্থবহ। তিনি ভাবছেন— কেন এমন হয়, কেন এমন আসে! সিংহের সম্পূর্ণ পশুবিক্রমের সঙ্গে অশ্বের তীব্র বেগ ও যৌনতাকামী ভঙ্গি কেন জুড়ে যেতে চায়? মানুষ কি চিরকালই সমস্ত প্রার্থনীয় এক আধারে সমবেত দেখতে চায়? কেন এমন হয়? কেন?

নীলোফাও প্রশ্ন করছে তখন— ‘ভাইজান। কেন এমন হয়! কেন? একটি পাতায় আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে সে—

‘একশত বৎসর বয়সে বাপ্পার মৃত্যু হল। পূর্বদিকে হিন্দুস্থানে তাঁর হিন্দু মহিষী, হিন্দু প্রজারা; পশ্চিমে ইরানীস্থানে তাঁর মুসলমানী বেগম আর পাঠানের দল, হিন্দুরা তাদের মহারাজকে চিতায় তুলে দিতে চাইলে, আর নৌসেরা পাঠানের দল তাঁকে মুসলমানের কবর দিতে ব্যস্ত হল। শেষে যখন একপিঠে সূর্যের স্তব আর একপিঠে আল্লার দোয়া-লেখা প্রকাণ্ড কিংখাবের চাদর বাপ্পার উপর থেকে খুলে নেওয়া হল, তখন কিছুই দেখা গেল না— কেবল রাশি-রাশি পদ্মফুল আর গোলাপফুল। চিতোরের মহারানী সেই পদ্মফুল বাণমাতাজীর মন্দিরে মানস সরোবরের জলে রেখে দিলেন! ইরানী বেগম একটি গোলাপ ফুল শখের গুলবাগে খাসমহলের মাঝে গোলাপ জলের ফোয়ারার ধারে পুঁতে দিলেন; আর সেইদিন হিন্দুস্থান ও ইরানীস্থানের মধ্যস্থলে হিন্দুকুশ পর্বতের শিখরে হীরে-জহরতে মোড়া এক রাজার শরীর চিতার উপরে তুলে দিয়ে এক সন্ন্যাসিনী বললেন—“সখী, তোরা সেই গান গা৷”…’

আনিসুজ্জামান বুঝিয়ে দিচ্ছেন— যিনি বড়, যিনি রাজা, যিনি সার্থক ও মহান তিনি সব ধর্মকে ধারণ করেন, সব মানুষকে গ্রহণ করেন। তাঁর কাছে চিতোরের মহারানি আর ইরানি বেগম, দুই-ই সমান, দুই-ই বড়। দু’জনকেই ভালবাসেন তিনি। মনের মধ্যে বালকবেলার সেই শোলাঙ্কি রাজকুমারীকে রেখেও ভালবেসেছেন অন্যদের। ব্যক্তিগত জীবনে বলো, প্রজা বাৎসল্যে বলো, কে হিন্দু কে মুসলমান— এ তাঁর কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়নি। তাঁর নিজের মনে এ নিয়ে কোনও বিরোধ ছিল না। কিন্তু তাঁকে নিয়ে বিরোধ মিটল না। এক হৃদয়ে জায়গা পেয়েও মানুষের জন্ম জন্ম বয়ে চলা ধর্মসংস্কার ও স্বজাত্যভিমান বাপ্পাদিত্যকে চিরকালের মতো খণ্ডিত করে দিল। তাদের বিরোধ বন্ধ করার জন্য বুদ্ধিমতী, প্রেমপূর্ণা, শোলাঙ্কি রাজকুমারী, নীরবে রেখে গেলেন গোলাপ আর পদ্মফুল। বলতে চাইলেন— থাকো। স্বতন্ত্র থাকতে চাও, থাকো। নিজেদের মধ্যে হানাহানি কোরো না। একই কিংখাবের নীচে, দেখো, পাশাপাশি শুয়ে আছে গোলাপ আর পদ্ম। একই দেহের নির্যাস।… আর রাজকুমারী দেহটি নিয়ে গেলেন। এক শত বৎসর বয়স্ক গলিত লোল দেহ। কিন্তু তা বাপ্পার দেহ। রাজকুমারী যে দেহ সারা জীবন খুঁজেছেন এবং পেলেন যখন তা চিতায় তোলার সময় হল—।

নীলোফা কাঁদছে। গালের ওপর দুলিয়ে দেওয়া বোরখার ঢাকনা ভিজে যাচ্ছে। আনিসুজ্জামান মৃদু হেসে বলছেন— ‘বাপ্পাদিত্য’ প্রথমবার পড়ে কাঁদেনি এরকম লোক কমই আছে।

এ সবই সম্ভব। এ সবই ঘটে। নীলোফা ও নীলিমার মধ্যে এই আশ্চর্য সম্পর্ক ঘটে যায়। পাশাপাশি দু’টি গৃহ দুই বোন বা বান্ধবীর মতো কণ্ঠলগ্না হয়ে একই সাজে সাজ পরে। আনিসুজ্জামানের মনে হয়, নারী বলেই এমন অসম সম্পর্ক সম্ভব। পুরুষ পারবে না। এত বৈপরীত্য, এত প্রান্তিক অবস্থান সত্ত্বেও এমন সম্পর্ক গড়তে পারবে না।

ঠিক আড়াইটের সময় আনিসুজ্জামানের ফ্ল্যাটের নীচে হর্ন বাজাল সত্য। আনিসুজ্জামান পাঞ্জাবিটা গলিয়ে নিলেন। নীলোফা নীলিমার দেওয়া ডুরে শাড়িটি পরেছে। ওপরে বোরখা চাপিয়ে নীলিমাকে দেখাতে গেছে। আনিসুজ্জামানের বুকের মধ্যে অদ্ভুত ব্যথা টনটনিয়ে উঠল। কী দেখাবে ও? মুখ নয়, বাহু নয়, সম্পূর্ণ অবয়ব নয়। যেটুকু বোরখার তলা দিয়ে দেখতে পাওয়া যায়, সেটুকুই। নিজেকে দেখাবার ইচ্ছা এত প্রবল হয় মানুষের? এত তীব্র হয়?

নীলোফার আসার অপেক্ষা করছেন আনিসুজ্জামান। ল্যাম্প পোস্টের রডে দু’টি শালিখ এসে বসল। যে যার নিজের বুক খোঁচাচ্ছে ঠোঁট দিয়ে। ডানা দু’টি ঝাপটে পরিপাটি করে নিচ্ছে। গলা ছেড়ে ডেকে নিল দু’-একবার। কথা কয়ে নিল দু’জনে। দু’টি অপরূপ পক্ষীবিভঙ্গ। অপরূপ দাম্পত্যবিভঙ্গও কি নয়? সাহিত্য থেকে কল্পনা ও চিন্তা অর্জন করে, বাস্তবে অসার্থক দাম্পত্য প্রত্যক্ষ করে সার্থক দাম্পত্য সম্পর্কে যে ধারণা আনিসুজ্জামানের মনে তৈরি হয়েছে তার সঙ্গে মিলে যায় একমাত্র পাখিদাম্পত্য। চারপাশের মানুষের মধ্যে কোথাও তা নেই। আনিসুজ্জামান জানেন না, সে-ই সার্থক দাম্পত্য কিনা যা তিনি একদিন, মাত্র একদিন, চোদ্দো বছর বয়সে, দেখে ফেলেছিলেন। জেনেছিলেন সেই অমোঘ সত্যকে আর পালিয়ে গিয়েছিলেন সেই সত্যের কাছ থেকে তীব্র আকর্ষণে ও তীব্র বৈরাগ্যে; কঠিন টানে এবং কঠিন অপমানেও— কারণ তাঁর শ্বেতরোগ তাঁর সুস্থতা ও স্বপ্ন হরণ করেছে। দাম্পত্য ও নারী সংসর্গের ইচ্ছা হরণ করেছে। আপন শরীরে আপনি অভিমানী হয়ে উঠেছেন তিনি। আর পালাচ্ছেন সেই চোদ্দো বছর বয়সের পালিয়ে যাওয়া।

বড় চাচির এক আত্মীয়ের বিয়েতে বেথুয়াডহরি গিয়েছিলেন আনিসুজ্জামান। শহরও নয় সে, বর্ধিষ্ণু গ্রাম। আর গ্রামের প্রান্তে এক ঘন বন।

তখন ওই বয়স। সব কিছুর প্রতি লজ্জা, আবার দারুণ টান ও অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণের বয়স। গোপনে অসামান্য ঔৎসুক্য আর মুখে ও আচার-আচরণে, যেন কোনও ঔৎসুক্য নেই, এমন ভাব বজায় রাখা।

আনিসুজ্জামান প্রথম দু’দিন চাচির পিছন পিছন ছিলেন। কম কথা বলতেন আর শান্ত ধরনের ছিলেন বলে সব সমবয়সীদের সঙ্গে তাঁর ভাব হত না চট করে। কিন্তু একজনের সঙ্গে ভাব হয়ে গেল। সে এক আশ্চর্য স্বপ্নিল ছেলে। খুব আশ্চর্য-আশ্চর্য কথা বলত আনিসুজ্জামানকে। তার নাম ছিল কামাল। কামাল বলত, সে বাতাসে বারুদের গন্ধ পায়। আর সেইসব গন্ধ নাকি পলাশির মাঠ থেকে উঠে আসে। একদিন কামাল তার বাবার সঙ্গে সিরাজের কবর দেখতে গিয়েছিল। ওখানে, সিরাজ ও তার পরিবারবর্গের কবরগুলি দেখে তার চোখে জল এসে গিয়েছিল। সে বাবার কাছ থেকে চোখের জল লুকোবার জন্য সিরাজের কবরের কাছে উবু হয়ে বসে পড়েছিল। আর তখন, ঠিক তখনই, সে শুনতে পায়, ধক্ ধক্ করছে। ভেতরে ধক্ ধক্ করছে।

আনিসুজ্জামান কামালের হাত চেপে ধরেছিলেন। কামাল বলেছিল— বিশ্বাস কর। বিশ্বাস কর। আমি স্পষ্ট শুনেছি। ধক্ ধক্ ধক্ স্পষ্ট শুনেছি। কবরের নীচে সিরাজের বুকের শব্দ। কারওকে বলিনি। কারওকে না। তোকে বললাম। তোর বিশ্বাস হয় না? তুই বিশ্বাস করবি না?

এতখানি বিশ্বাস নিয়ে যে কথা বলে তার কথা বিশ্বাস না করে উপায় থাকে না। কামালের চোখে-মুখে কষ্ট ফুটে উঠেছিল। যেন অদ্যাবধি সে শুনতে পাচ্ছে বারুদের গন্ধ বা সিরাজের বুকের ধক্ ধক্। আর কামালকে দেখতে দেখতে ভয় করছিল আনিসুজ্জামানের। পলাশির মাঠ, সিরাজের কবর, কিছুই দেখা হয়নি, কিন্তু কামালের চোখের মধ্যেই ছিল গোটা যুদ্ধটা। আর, এই কামালই তাঁকে দেখিয়েছিল জীবনের আশ্চর্য জানালা।

একদিন, তখন বিকেল গড়িয়েছে। কামাল ডাকছে— মেঠা। মেঠা।

আনিসুজ্জামান বেরিয়ে এসেছেন। কামাল ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ থাকতে ইশারা করছে। চোখে ডাকছে। চলে আয়। আয়। তার মুখ লালচে। ঘাম-ঘাম। আনিসুজ্জামানের শরীর শির শির করছে। কেন ডাকছে ও! কোথায় নিয়ে যেতে চাইছে চুপি চুপি? যেন-বা কোনও নিষেধ পেরিয়ে অন্য এক নিষেধের কাছে যাওয়া। আনিসুজ্জামান যাচ্ছেন। কামাল তাঁর হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে, ক্ষিপ্র পায়ে, বনের কাছাকাছি। দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে একটি ছোট্ট কুঁড়ের পাশে। বাঁশের চাঁচের বেড়া আর খড়ো চালের কুঁড়ে। বেড়ার ফোঁকরে চোখ রাখলেন দু’জনে।

ঘরের মধ্যে অন্ধকার। তারই মধ্যে আরও তীব্র দু’টি অন্ধকার খণ্ড। সক্রিয় কিন্তু গতিশীল নয়। একটি কণ্ঠস্বর অতল থেকে উঠে আসছে— আমারে করো। জোরে করো। জোরে—

তার উচ্চারণ যথাযথ হচ্ছে না। খসে যাচ্ছে। আনিসুজ্জামান কামালের হাত চেপে ধরেছেন। অন্য একটি কণ্ঠ জোরের সঙ্গে, জেদের সঙ্গে বলছে— জোরে রে মাগী? জোরে? কত জোরে? কত? এই নে। এই নে। এই নে।

প্রত্যেক ‘এই নে’র পর উচ্চারিত হচ্ছে বা ছিটকে উঠছে এক একটি ‘আঃ’ ধ্বনি, যা শুধু শব্দের মধ্যে বন্ধ রেখেছে প্রার্থিত সুখ ও যন্ত্রণার প্রহার। এত নিবেদিত যেন তা থামলে পৃথিবীর ঘূর্ণন থেমে যাবে আর ধ্বংস হবে সব সৃষ্টি, সব ভারসাম্যজাল।

—বউ। অ বউ।

—কও না কও। কও। আঃ কইতাছ না ক্যান?

গর্জন নয়। নাদ নয়। শুধু কয়েকটি সমাহিত শব্দ ওঠে দু’খানি মিলিত আঁধার খণ্ড থেকে। যেন-বা, শরীরে শরীর রেখে মন খুঁজে ফেরে সেই প্রার্থিত মহাবস্তু যা দেহ ডিঙিয়ে আত্মার মন্ত্র রচনা করে।

—তুই আমারে ভাবো?

—ভাবি গো। ভাবি গো। ভাবি। সারাদিন কাম করি। ঘুঁইটা দেই। উঠান ঝাড়ি। কাঠ কুড়াই—আর ভাবি।

—কী ভাবো? কও! কও না বউ। কী ভাবো?

—আমি কমু না। কমু না।

—আমি যদি মরি? বউ? তখন কারে বলবা?

—না না না—

—আমারে যদি সাপে কাটে? তখন কারে দিবা সব?

—না না না—

—যদি বাজ পড়ে মাথায়, বউ? যখন মাঠে কাজ করি? তখন কারে ভাইবা চুল বানবা?

—না। হয় না। এমুন হয় না। আমার কেউ নাই গো। কিছু নাই তুমি ছাড়া…

একটি আঁধার খণ্ড কাঁদে। অন্য খণ্ড তাঁকে জড়ায়। পেষে। মিষ্ট সম্ভাষণ করে। দু’টি বালক শুনতে পায়— কান্দে না। অ বউ। কান্দে না। তরে ফেইলা আমার মইরা সুখ কই? আমার সব সুখ তর গতরে। অখন ক’। ক’ না। অ বউ! কও—

সমস্ত উত্থান-পতন থেমে আছে। এক ঝলক বৃষ্টির পর আরও বড় বৃষ্টির জন্য থেমে থাকা মুহূর্তের মতো। মেঘ ভারী হতে হতে, ভারী হতে হতে ফেটে যাবে হঠাৎ আর ঝরঝর চরবর শব্দে বৃষ্টি হতে থাকবে। আবিশ্রাম। অবিরত। যতক্ষণ না শান্ত হয় ভূমি। যতক্ষণ না ভেজে। যতক্ষণ না গলে পিছলে কাদা হয়ে যায়।

আহা! কী কষ্ট পুরুষটার! কাতর গলায় বলছে— কও, কও!

আহা! কী কষ্ট মেয়েটার! কাতর গলার বলছে— কমু না। আমি কমু না। আমার শরম লাগে।

—কও। কও না। আমারে ভাবো তুমি? কী ভাবো?

—ভাবি, ভাবি, ভাবি। তুমি আসবা। আইসা নিবা আমারে। করবা। নিবা না? কও? নিবা না? ন্যাও, ন্যাও, ন্যাও—

আগুন লেগে গেছে দুনিয়ায়। অভ্রান্ত, অনিবার্য আগুন। বৃষ্টি নামার আগেকার এক নিষ্ঠুর দহনে জ্বলে যাচ্ছে বুক। জ্বলে যাচ্ছে চেতনা। যেন-বা অসহ গ্রীষ্মে আকণ্ঠ অপেক্ষা সেই আরাধ্য অনিবার্য পরিপূর্ণ বর্ষার। অসহ্য কষ্ট হচ্ছে। আনিসুজ্জামান কামালের হাত ছেড়ে পালাচ্ছেন। ছুটছেন। কামালও দৌড়চ্ছে পিছনে— এই। পালাচ্ছিস কোথায়? যাস না। বনের কাছে যাস না।

আনিসুজ্জামান থমকে দাঁড়াচ্ছেন। দেখছেন কামালকে। অথবা দেখছেনও না। কারণ, বোবা চোখে তাকিয়ে আছেন তিনি। প্যান্টে চাপ পড়ছে। অসহনীয় চাপ আর কষ্ট! তাঁর ভয় করছে। খুব ভয় করছে। এ সব কী! কেন এমন হল! কামাল বুঝতে পারছে। সাহস দিচ্ছে আনিসুজ্জামানকে— ভয় পাস না। দেখ। এই দেখ। আমারও—

সে নিজের প্যান্ট খুলে ফেলছে। অন্ধকারে। বনের সীমানায়, দু’টি বালক, অসহায় আগুনে পুড়তে থাকছে আর তাদের মধ্যে দাপাদাপি করছে উন্মাদনা। একজন পুড়েছে আগেই। সে জানে। সে প্রাজ্ঞ। সে তার আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে অন্যজনে, যেমন করে স্বপ্নের পর স্বপ্ন ছড়িয়ে যায়। অন্যজনের প্রথম। তার কী যে লাগছে! মা গো! সে কি পাপ করছে! খারাপ হয়ে যাচ্ছে! বাজে!

কামাল বলছে— খোল্। সবটা।

সে খুলছে।

কামাল বলছে— ধর্। এইভাবে। এ রকম ধর্।

সে ধরছে। যথাযথ। যেমন ধরছে কামাল। যেমন বলছে। আনিসুজ্জামান এখন এক যন্ত্রবৎ। লাভামুখ খুলে যাচ্ছে আপন সঞ্চালনে। আগুনের সঙ্গে সঙ্গে আশ্চর্য উদিগরণ! এ কী! এ সব কী! প্রথমে কাঁপন এবং এক ঝলক হাওয়ার মতো নির্যাস। তারপর ভিজে গেল হাত। আবার পালালেন আনিসুজ্জামান। কামালের ডাক উপেক্ষা করে, হাত ভিজে যাবার হাত থেকে পালাতে থাকলেন। ওই সব সন্ধ্যার থেকে, ওই কুঁড়েঘরের দৃশ্য আর শব্দ থেকে, ওই নির্গমন থেকে কেবলই পালাচ্ছেন তিনি। পালাতে পালাতে আজ এতগুলি বছর। প্রথম ক’দিন নিজেকে খারাপ লেগেছিল। পাপী লেগেছিল। রাত্রে ভাল ঘুম হত না। খেতেও ইচ্ছে করত না। অনেকদিন এরকম হয়েছিল। আজ আর পাপবোধ নেই। শরীরে কিছু আসে, তা ফেলে দিতে হয়। রেচনক্রিয়ার মতো। কিন্তু এতে পাপবোধ না থাকলেও ক্লান্তি আছে। অপরিসীম ক্লান্তি আর তৃপ্তিবিহীনতা।

তৃপ্তিবিহীনতা? এর খবর কি তিনি জেনেছেন এতদিন? জানতেন? না। জানতেন না। বাথরুমের দরজা বন্ধ করে অন্যান্য রেচনক্রিয়ার মতোই যখন স্বহস্তে নিজেকে মুক্ত করতেন তখন টের পাননি তাঁর নিজের মধ্যে এই ক্ষুধা কত বিশাল! কী ভয়াবহ! এ কি কোনও দানবীয় ক্ষুধা, না প্রকৃতপক্ষে এ-ই মানবিক? আনিসুজ্জামান জানেন না। শুধু যে-দিন এই ক্ষুধা নির্মম হয়েছিল, সে-দিনের সেই রাত্রির জন্য, সেই জেগে ওঠা ও নির্বাপণের জন্য, নিজের প্রতি ক্ষমা নেই। কিছুমাত্র ক্ষমা নেই তাঁর।

নীলোফা ডাকছে— ভাইজান আমার হয়ে গেছে।

সে নামছে সিঁড়ি বেয়ে। পিছনে আনিসুজ্জামান। নীলিমা এসে দাঁড়িয়েছেন সিঁড়ির মুখে। বলছেন— আমার জন্যও একটা ঢিল বাঁধিস তবে।

—বাঁধব। কিন্তু তোমাকেই গিয়ে খুলে আসতে হবে মাসি।

—যাব একদিন।

আনিসুজ্জামান বলছেন— হ্যাঁ রে, ঢিলে কি সব নাম লেখা থাকবে?

নীলিমা আর নীলোফা হাসছেন। সম্মিলিত শব্দে সিঁড়ির আবদ্ধতার ধাক্কায় প্রতিধ্বনি উঠছে। তৃণাঙ্কুরও এসে দাঁড়ালেন নীলিমার পাশে। নীলিমা হেসে বলছেন— ছেলেটার কথা শোন। ঢিলে নাকি নাম লেখা থাকে।

আর এক দফা হাসির শব্দ উঠছে।

আনিসুজ্জামান সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে অবাক গলায় বলছেন— ও। থাকে না? তাহলে খোলার সময় কেমন করে বোঝা যাবে কোনটা কার ঢিল?

নীলোফা বলছে—যে-কোনও একটা খুলে এলেই হবে ভাইজান।

নীলিমা বলছেন— একেই বলে পুঁথি-পড়া বিদ্যা। লৌকিকতা, আচার, ধর্ম নিয়ে বই পড়ে পাতার পর পাতা লিখে ফেলল, ঢিল বাঁধার নিয়ম শিখল না।

তৃণাঙ্কুর সরব হলেন এবার। বললেন—

আমাদের ছাত্রদের ভাষায় বলি?

—হ্যাঁ, হ্যাঁ মান্তুদা…

—ছাত্রদের ভাষায় আমার বক্তব্য হল ঢিল বাঁধার বিষয়ে আমারও কোনও ফাণ্ডা নেই।

তুমুল হাসি বাজল। কারণ এ হাসির সৃষ্টি সমন্বয়ে।

হাসির দমকে ভাসতে ভাসতে সিঁড়ি টপকাচ্ছেন দু’জনে। আনিসুজ্জামান নীলিমার কথা ভাবছেন। সত্যিই আশ্চর্য সংস্কারমুক্ত এই মহিলা। আজ অষ্টমী পূজার দিনে তিনি পীরবাবার থানে ঢিল বেঁধে আসার সংকল্প করছেন। এ নিয়ে কোনও দ্বিধা নেই। সংকোচ নেই। সকালবেলায় দেখা সত্যর মাকে মনে পড়ল আনিসুজ্জামানের। এই উপলব্ধি আবার জাগ্রত হল যে, সাধারণ মানুষ সর্বক্ষণ নিজের মধ্যে ধর্মভেদ জারি রাখে না। রাখে মাত্র কয়েকজন। আর তারাই অন্যদের মধ্যে এই ভেদ চারিয়ে দেয়। স্বার্থে বা অন্ধ সংস্কারে।

গাড়ির পিছনের দরজা খুলে দিয়েছিল সত্য। কিন্তু আনিসুজ্জামান নীলোফাকে পিছনে বসিয়ে সামনে সত্যর পাশে চলে এলেন। খুব ভাল লাগল সত্যর। গাড়ির ব্যবসা করছে বলে, ড্রাইভার না রেখে নিজেই গাড়ি চালাচ্ছে বলে অনেকেই তাঁকে অপাঙ্‌ক্তেয় জ্ঞান করে থাকে। অনেক বন্ধু বা পরিচিত জনই তাকে এড়িয়ে গেছে যখন সে যাত্রী নিয়ে পুরোপুরি কার-ড্রাইভার। এ জন্য সে কষ্ট পেয়েছে কিন্তু ভেঙে পড়েনি। শুধুমাত্র ভদ্রভাবে আত্মনির্ভর থাকার জন্য এ পর্যন্ত অনেক কষ্ট করে এসেছে তারা। এখন, তার মধ্যে এই চেতনার উন্মেষ ঘটেছে যে কোনও কাজেই কোনও অপমান নেই যদি তা সৎ হয়ে থাকে। যদি তা কোনও মানুষকে নিজের দু’টি পায়ের ওপর দাঁড়াবার অধিকার দেয়।

আনিসুজ্জামান গাড়ি বিষয়ে কথা বলতে লাগলেন সত্যর সঙ্গে। ব্যবসা করে লাভ থাকে কি না। ট্রেড লাইসেন্স আছে কি না। নীলোফা জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। তার হাতে ছোট একটি ব্যাগ। বাগবাজার পেরিয়ে গাড়ি ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। সারা রাস্তা খোঁড়া। গর্ত। জল জমে আছে। গর্তের পাশেই তার মাটি স্তূপ করে রাখা। খুঁড়ে তৈরি করা গর্তের ধাক্কা ছাড়াও রাস্তায় অসংখ্য খোঁদল। ছাল-চামড়া উঠে যাওয়া অমসৃণতা। রাস্তা না বলে একে রাস্তার ইতিহাস বলা ভাল। গাড়ি ঝাঁকুনি খাচ্ছিল। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ ছেড়ে বাঁদিকে বাঁক নিল সত্য। ট্রাম লাইন আছে বলে বিধান সরণিতে অন্তত খোঁড়াখুড়ি নেই। কিন্তু এখানে হকার আছে। পুজোর দ্বিতীয় দিনেও পুজোর বাজার চলছে পুরোদমেই। কেনাকাটা এখনও শেষ হয়নি। হকার বাজার ক্রেতা দর্শক আর পুজো প্যাণ্ডেল। রাস্তা অনেকখানি নিয়ে পুজো প্যাণ্ডেল করা হয়েছে। এক একটি প্যাণ্ডেলের অন্তত আধ কিলোমিটার এধার-ওধার দূরত্বে আলোকসজ্জার কারিকুরি। তার জন্যও বেশ জায়গা লাগে বইকি। আলোকসজ্জার সঙ্গে সঙ্গে মাইকের বাজনা। এত জোর সে-শব্দ যে গাড়িগুলি পরস্পরের হর্ন শুনতে পাচ্ছে না। এক প্যাণ্ডেলে বাজছে— পুরানো সেই দিনের কথা— হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মধুর কণ্ঠ— তার রেশ ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে —হাম কালে হ্যায় তো কেয়া হুয়া দিলবালে হ্যায়— মেহমুদ রাস্তা জুড়ে নেচে বেড়াচ্ছেন। ছেলেদের বড় বড় চুল আর লম্বা জুলফি। চাপা ফুলছাপ শার্ট। প্যান্টের মাথা হঠাৎ পায়ের কাছে চওড়া হয়ে পতপত করছে। তারা সব শরীর দোলাচ্ছে, কোমর দোলাচ্ছে। হ্যাঁ, বড় সুখে আছে তারা। তাই নাচছে। না গো। বড় দুঃখে আছে। কিছু তো নেই জীবনে, তাই নাচছে। সুখে নাচুক বা দুঃখে নাচুক— সে-নাচ সকলের সহনীয় নয়। শুধু মেয়েরা খুব রঙিন আর ঝলমলে সেজে এ নাচ উপভোগ করছে। বুঝি-বা এরাই সেই স্বপ্নের নায়ক, যারা পথে পথে নৃত্যপর দৃশ্যমান হয়। সব সাজুগুজু মেয়েরা নেমে এসেছে রাস্তায়। আর রুক্ষ জটাজীর্ণ চুলের এক আদুল বালিকার নাক দিয়ে শিকনি গড়াচ্ছে, সারা গায়ে মাটি, ন্যাংটো ভাইয়ের হাত ধরে রাস্তা পারাপার করছে। হাঁ করে দেখছে নাচ, সাজ, আলোকবিভা। আজ খেতে পায়নি, তবু কী আনন্দ কী আনন্দ, শহর উৎসবে মেতে আছে।

নীলোফা দেখছে— তার মতো— নতুন শাড়ির ওপর বোরখা পরা একজনও নেই।

ধর্মতলার কাছাকাছি আসতেই এক যুবক প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল সত্যর গাড়ির ওপর— দাদা, দয়া করে সাহায্য করুন।

—কী হয়েছে? কেউ অসুস্থ? দুর্ঘটনা? হাসপাতালে যেতে হবে?

—না দাদা। এ বিয়ে করবে। ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাছে যাবে। একটাও ট্যাক্সি পাচ্ছি না।

সত্য আনিসুজ্জামানের দিকে তাকাচ্ছে। ছেলেটিকে বিশ্বাস করবে কী করবে না! মিথ্যে বলছে না তো? কোনও মতলব নেই তো?

আরও কয়েকজন ঘিরে ধরল গাড়িটাকে। আনিসুজ্জামান বললেন— কিন্তু আপনাদের এতজনকে নেওয়া তো সম্ভব নয়।

একজন বলল— এতজন না। স্যার। আপনি মাত্র তিনজনকে নিন। বর-কনে আর অন্য একজনকে। আমরা যে-ভাবে হোক আসছি।

—কোথায় যেতে চান সেটাই তো বলেননি। আপনাদের রুটে যদি না যাই?

ছেলেগুলো চুপ। পিছনের সার সার গাড়ি হর্ন দিচ্ছে। একজন বলল— বেহালা যাব সার।

এ বার সত্য কথা বলল— শুনুন। আমরা খিদিরপুর যাব। আপনারা সব ওখানে নেমে যাবেন।

রাজি হয়ে গেল দলটি। একটি লাজুক-লাজুক মেয়েকে নিয়ে নীলোফার পাশে উঠে বসল এক যুবক। মেয়েটি এরই মধ্যে সিঁদুর দিয়েছে কপালে। অন্য একজন সামনে এসে আনিসুজ্জামানের পাশে বসল। বেশ চাপাচাপি হল। গুছিয়ে বসতে না-বসতেই সে বলল— আমি স্যার আপনার কলেজেরই ছাত্র। চিনতে পারছেন না তো স্যার?

সে আনিসুজ্জামানের পায়ের খোঁজে ঝুঁকল। আনিসুজ্জামান তার হাত ধরে ফেললেন। সে বলল— চিনবেন আর কী করে স্যার! সবটা তো পড়িনি, ব্যবসায় ঢুকে গেলাম।

আনিসুজ্জামান মুখ খোলেন— কেন? পড়লে না কেন?

—ওই যে স্যার, বোমা বানাতে গিয়ে এই আঙুলটা উড়ে গেল। বাবা বলল, ওসব নকশালবাজি অনেক হয়েছে। অত বড় দোকান স্যার বড়বাজারে। আমি ছাড়া কে দেখে! একমাত্র সন্তান তো স্যার। খুব ঝামেলা। পড়াশুনা তো আগেই গেছিল। এবার পার্টি পলিটিক্স ছেড়ে ঢুকে গেলাম দোকানে। এই যে বিয়ে করছে স্যার —ও বিজয়। অ্যাই বিজয়, নেমে স্যারকে প্রণাম করবি। আমি তো আপনাকে দেখেই বললাম স্যার— ঝাঁপিয়ে পড়্— গাড়িতে এ এস এম— কোনও ভয় নেই। ঠিক তাই হল।

—তুমি তো জানতে না আমি কোথায় যাব।

—না জানলেই কি স্যার? আপনাকে তো জানি। আমি পরিচয় দিলে আপনি কি আর না করতে পারতেন? যেখানে বলতাম সেখানেই নামিয়ে দিতেন।

—আজ কিন্তু আমি তোমাদের খিদিরপুরেই নামিয়ে দেব— মানে ইয়ে— তোমার নাম মনে নেই।

—স্বপন স্যার। স্বপন বসাক।

—হ্যাঁ স্বপন। আজ বেহালা পৌঁছনোর কোনও উপায় নেই আমাদের, কেমন?

—সে কোনও ব্যাপার নাকি, স্যার? এতটাই কি কেউ করে? কী ঝামেলায় যে পড়েছি স্যার। বিজয়ের শ্বশুরটা এক নম্বরের ঢ্যামনা, বুঝলেন। কিছুতেই রাজি হয় না। বলে বানিয়াকে মেয়ে দেব না। বানিয়ারা মানুষ নাকি! নে, এবার ঠ্যালা বোঝ্… মালতী। স্যরি মাইরি। কিছু মনে কোরো না।

একটি ক্ষীণ শব্দ উঠল— না না, এতে মনে করার কী আছে? আনিসুজ্জামানের ইচ্ছে করল ঢ্যামনা বাপের মেয়ের গদগদ মুখখানা একবার দেখেন। কিন্তু নিতান্তই তা অসম্ভব। তিনি একবার সত্যর গাড়ির আয়নায় দেখার চেষ্টা করলেন। হল না। তখন সত্য হঠাৎ জিজ্ঞেস করল— সজলদের ব্যাচ? সুজিত, হীরক ওদের সঙ্গে থাকতেন?

ছেলেটি চমকে উঠল। বলল— হ্যাঁ। ঠিক। কী করে জানলেন!

সত্য বলল— ওই আঙুল উড়ে যাওয়ার গল্প করলেন, তাতে বুঝলাম। আপনার তো আঙুল। হীরকের দু’টো পাঞ্জা উড়ে গিয়েছিল না?

—হ্যাঁ। আপনি জানেন? চেনেন হীরককে।

—চিনি। ও কী করে এখন জানেন?

—না। জানি না। যোগাযোগ নেই তো৷ কী করে?

—কাশীপুর শ্মশানঘাটে বসে গাঁজা খায়। কোনও কাজ তো করতে পারে না। দুই কব্জিতে কল্কেটা ধরে। শুনেছি বোমা বানানোর ট্রেনিং দিচ্ছে আজকাল।

—অ্যাঁ! কোথায়? কাদের?

—নকশালদের নয়। নকশালরা তো নিরামিষ হয়ে গেছে এখন। এই ভোটে তো সি পি এমের হয়ে খাটলও অনেকে।

খিদিরপুরে নেমে গেল ওরা। নামার সময় আবার আনিসুজ্জামানকে প্রণামের ভঙ্গি করেছিল আর আনিসুজ্জামান ‘থাক—থাক’ করাতে অব্যাহতিও পেয়েছিল।

বিকেল গড়িয়ে গেছে। আলোকসজ্জা উজ্জ্বল হচ্ছে ক্রমশ। মাজারে ভিড় নেই। নীলোফা ভিতরে চলে গেল। আনিসুজ্জামান বাইরে দাড়িয়ে রইলেন। পুজোর ঝঙ্কারে দামাল বাতাস। তিনি একবার মুখ ফিরিয়ে দেখলেন। ঝলমলে কাপড়ে ঢাকা পবিত্র জায়গার কাছে স্থির হয়ে বসে আছে নীলোফা। বাইরে থেকে তাকে দেখা যাচ্ছে। অন্ধকার নামছে। আলোর কারুকৃতি, সাজসজ্জা, রোশনাই স্পষ্ট হচ্ছে ক্রমশ। আনিসুজ্জামান আবার মাজারের দিকে তাকালেন। নীলোফা তেমনই বসে আছে। স্থির। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আলোকসজ্জা দেখা ছাড়া কিছু করার নেই। তাঁর মনে হচ্ছে— এই উৎসবের আলোও বয়ে যাওয়া সময়ের মতো নিষ্ঠুর। কারও দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণার পরোয়া করে না। ঠিক জ্বলে। কোথাও-না-কোথাও। অথবা, অন্যভাবে দেখলে, এই রোশনাই আসলে জীবনের মতো। কিছুতেই নেবানো যায় না। যাই ঘটুক, জীবনপ্রবাহ থামে না।

খুব বেশিক্ষণ সময় নিল না নীলোফা। আনিসুজ্জামানের ধৈর্য সচেতন হওয়ার আগেই চলে এল সে। আনিসুজ্জামানের মনে হল নীলোফাকে তিনি কোথাও কোনওদিন নিয়ে যাননি। বেড়াতে, সিনেমা বা নাটক দেখতে, কেনাকাটা করতে— কোনও জায়গাতেই নয়। তাঁরও ইচ্ছে করেনি। নীলোফাও বলেনি কখনও। তার কিছু প্রয়োজনীয়তা সে নীলিমার সঙ্গে গিয়ে মিটিয়ে নেয়। টাকার অভাব নেই। মনিরুল নীলোফাকে অর্থে বঞ্চিত করেননি। প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আসার সুব্যবস্থা তিনি করেছেন। আনিসুজ্জামান তাঁর ব্যাঙ্কেই অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছেন নীলোফাকে। কিন্তু কোনওদিন জানতে চাননি সে কত পায়, কী খরচ করে। তাঁর নিজের উপার্জনেরও পুরোটাই তিনি দিয়ে দেন নীলোফাকে। দরকারমতো চেয়ে নেন। নীলোফা সব সামলায়। সংসারের খুঁটিনাটি, আনিসুজ্জামানের দরকারি জিনিসপত্র এবং নিজেরও সব। আজ প্রথম আনিসুজ্জামান নীলোফার জন্য সময়টি দীর্ঘায়িত করতে চাইলেন। যা যা তিনি করেননি, যা যা তিনি করতে পারতেন, তার সামান্য একটু করার ইচ্ছে পুজোর রোশনাইয়ের মতো জ্বলে উঠল। তিনি বললেন— ফ্যান্সি মার্কেট যাবি?

মাথা নাড়ল নীলোফা। যাবে। আনিসুজ্জামান বললেন— সত্যর বোন শিউলির আজ জন্মদিন। ওর জন্য কিছু কিনে দিবি নীলু?

—দেব। বলল নীলোফা।

সত্য মাজার থেকে একটু দূরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। আনিসুজ্জামান তাকেও ফ্যান্সি মার্কেট যাবার আমন্ত্রণ জানালেন। সে রাজি হল না। পুজোর সময়। গাড়ি ফেলে যেতে পারল না। বলল— আপনারা ঘুরে আসুন। আমি এখানে আছি।

আনিসুজ্জামান নীলোফাকে নিয়ে ফ্যান্সি মার্কেটের দিকে এগোলেন। শিউলির কথা আবার মনে পড়ল। কী দেওয়া যায় মেয়েটাকে? ঘড়ি? ওর কি ঘড়ি আছে? হঠাৎ তাঁর মনে হল, আচ্ছা, শিউলিকে কী দেবেন ভেবে মাথা খারাপ করছেন—নীলোফাকে কিছু দেবার কথা মনে হচ্ছে না কেন? নিজের কাছে নিজে লজ্জিত হন আনিসুজ্জামান। সংকল্প করেন, কিছু দেবেন নীলোফাকেও। কিন্তু কী দেবেন? কী পেলে ও খুশি হবে? মনে মনে অসহায় বোধ করেন তিনি। কষ্টও হয়। এই মেয়েটা—এই দগ্ধ, বিশ্রী, বাতিল, বোরখা-ঢাকা মেয়েটা আজন্মকাল আনিসুজ্জামানের সঙ্গে একই বাড়িতে বসবাস করছে, অথচ তিনি জানেন না সে কী পেলে খুশি হয়! কী চায়! নীলোফাকে হঠাৎ আনিসুজ্জামানের অচেনা গ্রহান্তরীর মতো লাগে। যে স্বীকার করলে আছে। না করলে নেই। তা নিয়ে মাথা ঘামাবারও দরকার নেই। কিন্তু সে যে আছে, সে যে রইল, তা যেন অতি আশ্চর্য এবং বাড়তি। বাড়তি তার অস্তিত্বটাই যা শুধু আছে এই স্বীকৃতির মধ্যেই পূর্ণ। এটাই তার সবচেয়ে বড় পাওয়া। এর চেয়ে বেশি তাকে চাইতে নেই। চাইলে মানুষ তার দিকে অবাক হয়ে তাকাবে—এই পোড়া মেয়েটা চাইছে— দেখো চাইছে! তাহলে চাইতে পারে ও? চাইতে জানে?

ট্রাম রাস্তা পেরোতে পেরোতে আনিসুজ্জামান খুব হালকা চালে, যা তাঁর মধ্যে প্রায় বিরল, জিজ্ঞাসা করলেন— সব ছেড়ে এই মাজারে এলি কেন রে?

নীলোফা বলল— এখানে ঢিল বাঁধলে সব ইচ্ছা পূর্ণ হয়।

আনিসুজ্জামান নির্ভারে চাপল্যে আর তজ্জনিত নিষ্ঠুরতায় বলে ফেললেন— তোরও ইচ্ছে? কী চাইলি তুই? অ্যাঁ?

মাথা নিচু করে এগোচ্ছে নীলোফা। এগোচ্ছে। উত্তর করছে না। আনিসুজ্জামান আবার বলছেন— কি রে? তোর কী চাই?

নীলোফা দাঁড়িয়ে পড়ল। বোরখা-আবৃত মুখ তুলল। বলল— হাসছেন, না? আরও তো হাসি পাবে শুনলে, কী চাইলাম!

করুণ হাওয়া এসে এক নিমেষে উড়িয়ে দিল আনিসুজ্জামানের চপল ধুলোবালি। তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। তাঁর স্নায়ু তীব্র হল৷ তাঁর ভয় করতে লাগল। পিঠ সিরসির করা ভয়। অনেকটা যেন কামালের সঙ্গে বেথুয়াডহরির বনের প্রান্তে চলতে থাকার ভয়। তাঁর পালাতে ইচ্ছে করল। নীলোফার উত্তর শোনার আগে এই ট্রাম রাস্তা ধরে উন্মাদের প্রায় দে-ছুট দে-ছুট। কেন? কেন এরকম ইচ্ছে হল? সে-দিন যে তিনি পালিয়েছিলেন, ওই বেথুয়াডহরির গ্রামে, সে কি ওই দৃশ্যের থেকে? কুঁড়েঘর থেকে? কামালের থেকে? না তো। না তো। তবে? তাঁর নিজের থেকেই কি নয়? নিজেকে চিনতে গিয়ে নিজেকে অস্বীকার করতেই কি নয়? নিজের কোনও অনভিপ্রেত, অপ্রত্যাশিত ধর্মকেই কি বেথুয়াডহরির বনের উপান্তে ফেলে পালাতে চাননি তিনি?

পালাতে চান। কিন্তু উপায় নেই। সত্যিই ট্রাম রাস্তা ধরে ছুট লাগানো যায় না। তিনি প্রতীক্ষা করছেন। দোষ দিচ্ছেন নিজেকে। কেন জানতে চাইলাম! কেন এই কৌতূহল! যেন-বা এক অমোঘ প্রশ্ন করে বসে আছেন, শুনবেন অমোঘ উত্তর।

ট্রাম লাইনের ওপর নীলোফার মুখোমুখি বা মুখোমুখি নন এমনই দাঁড়ানো তাঁর। মুখোমুখি নন কারণ এ একতরফা তাকানো। নীলোফার মুখ ঢাকা। নিচু। সে বলছে— আমি চাইলাম… আমি চাইলাম… এমন একজন মানুষকে, যে আমাকে দেখে ঘেন্নায় পালিয়ে যেতে চাইবে না। বেসিন ভরে বমি করবে না।…

লোডশেডিং হল। চারপাশ ডুবে গেল অন্ধকারে। গাড়িগুলি তীব্র হর্ন দিতে থাকল। লাউড স্পিকার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সমস্ত হর্নের শব্দ অন্ধকারের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে ছিন্নভিন্ন করে দিতে থাকল আনিসুজ্জামানের শ্রুতিকে!

২৯

অনেকদিন পর ব্রজগোপালের ওষুধের দোকানের আড্ডায় এলেন আনিসুজ্জামান। দুর্গাপূজা শেষ হয়েছে। দেবী ভাসানে গেছেন। বহু মেয়ে-পুরুষ, বালক-বালিকা, প্রেমিক-প্রেমিকা হাত ধরাধরি করে সঙ্গে সঙ্গে গেছে। কিশোর-যুবকরা নাচতে নাচতে গেল। গঙ্গায় ভাসান জমবে। অনেকেই আজ মদ্যপান করেছে। কিংবা সিদ্ধির সরবত। ভাসানকালে একটু গাঁজা টানাটানি হবে। জল ছোঁড়াছুঁড়ি। এ ওকে চুবনো।

মাথুরের গড়ের মা দুগ্গা গেলেন একটি বিশাল ট্রাকে, সে ট্রাক সুধীর পালের। কাজল, হয়তো তার বাবার ট্রাক বলেই, দু’পাশে সুজন আর অমিতাভকে নিয়ে হুডে চেপে বসেছে। শরীর দুলিয়ে নাচছে। পুজোয় জৌলুস কম থাক, অনিল সামন্তর ডান হাত বাসুদেব পোদ্দার নিজে এসেছেন ভাসান রওনা করিয়ে দিতে। এ সব দেখে সুধীর পালের ট্রাকে চেপে মা দুগ্গার চোখ ছল ছল করছে। সুধীর পাল যে-বার প্রথম ট্রাক কিনেছেন সে-বার থেকেই মাথুরের গড়ের মা দুগ্গা তাঁর ট্রাকে চেপেই প্রতিবার ভাসান যাচ্ছেন। কত ট্রাক এল সুধীর পালের, কত গেল, কত ট্রাক উল্টে পড়ল হাইওয়ের পাশে আর চোরাই কাঠ পাচারের দায়ে ধরা পড়ল—তার হিসেব স্বয়ং মা দুগ্গাও জানেন না। যত কাজ, যত ব্যস্ততাই থাকুক, দশমীর দিন একটি ট্রাক মা দুগ্গার জন্য ঠিকই মজুত রাখেন সুধীর পাল। মা ভাসানে যাচ্ছেন। কম কথা নয়। এ সুযোগে বাসুদেব পোদ্দারের সঙ্গেও একটু কথা বলা যায়। দরকারে-অদরকারে অনিল সামন্ত বরাবর পাশে আছেন। তবে এখন পাড়ার যা ভাবগতিক, পরবর্তী ভোটাভুটির আগে শ্যামাকান্তর সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলতে হবে। কিছুদিন আগেও এলাকায় সি পি এমের অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু এখন পাড়ায় পাড়ায় পার্টি অফিস হচ্ছে। এ পাড়ায় নীলিমার বাড়ির তলায় গ্যারেজে পার্টি অফিস করেছেন শ্যামাকান্ত। সেখানে বেশ আড্ডাও জমেছে। এতদিন যা হাল-চাল ছিল তাতে শ্যামাকান্ত কমিউনিস্ট বলে তাঁকে করুণাই করত লোকজন। আর শুধু কমিউনিস্ট হওয়াই নয়, শ্যামাকান্ত এই সম্পন্ন মাথুরের গড়ে অসম্পন্ন গৃহস্থ। সেই হিসেবে উদ্বাস্তু কলোনিতে তাঁকে মানাত ভাল। যদিও, এখন শ্যামাকান্ত পার্টির কাজের সঙ্গে সঙ্গে নিজের উন্নতি করে নিচ্ছেন ধীর প্রক্রিয়ায়, তবু, পুরোদস্তুর নেতা হবার পরও একটি দারিদ্রের ইতিহাসের জন্য তিনি এ পাড়ার নির্মম অন্তরে অবহেলিতই থেকে যাবেন।

পাড়া শ্মশান করে মা চলে গেলেন। যে-ক’জন আছেন, ভাসানে যাননি, বিজয়ার সাক্ষাৎপর্বে আড্ডায় জমা হচ্ছেন এইবেলা। আনিসুজ্জামান আসতেই বিকাশ ও সমরেন্দ্র একসঙ্গে বললেন—এসো, অধ্যাপক, এসো। তাঁরা কোলাকুলি করলেন। আনিসুজ্জামানের সঙ্গেও করলেন একে একে ব্রজগোপাল, বিকাশ, রণেন, সমরেন্দ্র। ভাসান দিয়ে ফেরার আগে এই পর্ব শুরু হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আড্ডায় নিয়ম নাস্তি। ব্যস্ত মানুষ সব। এ বেলা সুযোগ পেয়ে করণীয় সেরে ফেলতে চান।

আনিসুজ্জামান আসার একটু পরেই প্রণবেশ এলেন। আবার একদফা প্রণাম ও কোলাকুলি হল। ব্রজগোপাল এটুকুর জন্যই দোকান খোলা রেখেছেন আজ। তাঁর উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। আড্ডার সব সদস্যই আছেন। শুধু মল্লিনাথ নেই। সবচেয়ে বর্ষীয়ান, সবচেয়ে প্রিয় সদস্য এই আড্ডার। আনিসুজ্জামানের মনে হল, কতদিন মল্লিনাথের কাছে যাওয়া হয়নি! মল্লিনাথের মধ্যে জেগে ওঠা ছোঁয়াছুঁয়ি-জনিত সংস্কারকে মনে মনে ক্ষমা করতে সক্ষম হয়েছেন আনিসুজ্জামান। কিন্তু ভিতরকার উদ্বেগ যায়নি। আবার যদি ঘটে কিছু! আবার! আবার!

তবু কষ্ট হয়। মানুষটির জন্য কষ্ট হয়। সেই মেলামেশা করা মানুষ, একলা হয়ে গেলেন। সেই খ্যাতিমান ডাক্তার, চিকিৎসা ভুলে গেলেন। আর চেম্বারে যান না। প্র্যাকটিস করেন না। রোগীরা জেনে গেছে ডাক্তারবাবু আর চিকিৎসা করতে সক্ষম নন। সারা দিন একা একা গৃহে কাটান। পূজা করেন। ওষুধের আলমারির কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন মাঝে মাঝে। মানুষ কখনও কখনও তার পেশা দ্বারা নির্ণীত হয়। পেশার মধ্যে সম্পৃক্ত হয়ে যায় সত্তা। বিশেষত, যে-পেশার মধ্যে ঢুকে পড়ে নির্মাণ, সৃষ্টি, সাফল্য, ব্যর্থতা—যে-পেশার মূল্যমান কোনওদিন অর্থ দ্বারা তুল্য হয় না, তার থেকে নিজের সত্তা বিয়োগ করলে ফলাফল শূন্যে ঠেকে। এমনই পেশা, যা কারও গুণ ও প্রতিভা, জীবনযাপন ও রক্ত চলাচল—তা যদি ছেড়ে যায় সেই মানুষকে তবে তার নিজস্বতার আর কোনও অর্থ থাকে না। তার, এমনকী, ক্ষয়ও স্তব্ধ থাকে।

মল্লিনাথের আলমারির ওষুধ আর বাড়েনি। কমেওনি। তিনি স্বাভাবিক ভাষা ভুলে গেছেন। স্বাভাবিক কথাও। যে-কোনও কারও সঙ্গে কথা বলতে গেলেই রূপচাঁদ এসে পড়েন সে-প্রসঙ্গে। রূপচাঁদ, যাঁর কথা এতদিন গোপন রেখেছিলেন মল্লিনাথ, সেই সর্পখোদিত কাঠামো, যার ভেসে আসার কাহিনীও তিনি কারওকে বলেননি, তা এখন মল্লিনাথের ঘনিষ্ঠজনবিদিত। যে-ই যখন গেছেন, তাঁকে দেখতে, তাঁর খোঁজ নিতে, তিনি শুনিয়েছেন সব কথা। কিন্তু আনিসুজ্জামান যা জানেন, যত দূর জানেন, তা কি জানেন আর কেউ! সম্ভবত নয়, কারণ আড্ডায় এ নিয়ে আলোচনা হয়নি। এখানে সকলেই এমন নন যে গোপন কথা এই আড্ডাতেও লুকিয়ে রাখবেন, বিশেষত তা অন্য কারও সম্বন্ধীয়, এমনই দৃঢ়চেতা হয়ে থাকেন। আনিসুজ্জামান ভাবেন, আজ এমন দিনে, সকলে মিলে মল্লিনাথের বাড়ি গেলে কেমন হয়! সে-কথা বলার আগেই বিকাশ বলেন—একটা ভাল খবর তোমাদের দিই।

—কী খবর? কী খবর?

—ছেলের বিয়ে ঠিক হল।

—বাঃ! খুব ভাল। খুব ভাল। কবে? কোথায়? কোন মাসে?

সমস্বরে প্রশ্ন উঠল। বিকাশ বললেন—মেয়েটি ত্রিপুরার। আগরতলায় বাড়ি। তবে কলকাতায় থেকে এম-এ পড়েছে। আমাদের অধ্যাপকের বিষয়।

—বাংলা? বাঃ!

—আমিও মেয়েটিকে গল্প করেছি, অধ্যাপকের কথা। বুঝলে অধ্যাপক, সে তোমার নাম জানে। বোধহয় কোনও এক পত্রিকায় কোনও ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখেছিলে তুমি!

আনিসুজ্জামান সংকোচ বোধ করেন। বলেন—হ্যাঁ। ঠিকই। আধুনিক কবিতার বিবর্তন নিয়ে লিখেছিলাম বটে। সেটা উনি পড়েছেন!

বিকাশের ছেলের বিয়ে নিয়ে আরও কথা চলতে লাগল। ডিসেম্বরে বিয়ে। বিকাশ খুশি। ব্রজগোপাল বললেন—অনুপমেরও বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনলাম। ওই সময়েই।

—তাই নাকি! অনুপম! মানে পরেশবাবুর ছেলে!

সমরেন্দ্র চোখ মটকালেন—পরেশ ছেলের বিয়ে দিচ্ছে!

বিকাশ বললেন—তা কেন দেবে না? নিজে যাই হোক, ছেলে দু’টো ভাল।

রণেন হাসছেন। বলছেন—হবে না কেন? টু সনস্ অফ এ গ্রেট ফাদার।

সকলে হাসছেন। সে-হাসি আনন্দের নয়, বরং উল্লাসপ্রতিম, যে-উল্লাস মানুষ বোধ করত আদিম অবস্থায় ঝলসাতে থাকা শুয়োর দেখে এই প্রত্যয়ে যে, কিছুক্ষণ পর তারা সুস্বাদু পশুমাংস ভোজন করবে। কিন্তু, আনিসুজ্জামান, বুঝি-বা এমন মানুষ, যাঁর মানুষ এ কাল পেরিয়ে চলে গেছে কোনও এক অনির্বচনীয় সুন্দরের ভবিয্যে যেখানে মানুষ পরস্পরের জন্য কাতর ও প্রেমী। তাই আনিসুজ্জামানের মনে পড়ছে দেবোপমের মুখ। ছেলেটি প্রায়ই আসে। বইপত্র নিয়ে যায়। গম্ভীর, আত্মস্থ, কিন্তু বিষণ্ণ। কত কবিতা পড়ে! কত মনে রাখে! কিন্তু এখন কারও সে-কথা মনে আসছে না। সমরেন্দ্র হাসতে হাসতে বলছেন—একটু ভুল হল, রণেন, টু সনস্ অফ এ লেডি হ্যাভিং টু হাজব্যান্ডস্।

আনিসুজ্জামান অন্য কথা শুনতে চাইছেন। অন্য কথা বলতে চাইছেন। কী বলা যায়! বলা দরকার, খুব দরকার, কেউ আনিসুজ্জামানের ভেতরে বলে যাচ্ছে, এমন স্থানে যেয়ো না যেখানে থাকা তোমার নিজের কাছে অবমানকর। এমন কথা শুনো না যার ধ্বনি তোমার অন্তর্গত শান্তি ভেঙে দেয়। তুমি জানো, শান্তি, বড় দুর্বল। অতি ক্ষণস্থায়ী। এবং বোলো না এমন কথা যা তোমাকে চিহ্নিত করে দেবে এক বিন্দুও অমানবিকতায়।

প্রণবেশ বললেন—কী করে জানলেন, অনুপমের বিয়ে?

ব্রজগোপাল হাসছেন। তাঁর টাক পড়া মাথায় আলো চক চক করছে। বলছেন—আমাদের হিরণ! ওর কাছে সব ঘোড়ার মুখের খবর পাবে। সে-দিন এল। একেবারে মদ-টদ খেয়েছে। বলতে লাগল, পরেশ বোস ছেলের বিয়ে দিচ্ছে, বুঝলে! শালা, যা বাগিয়েছে না, একেবারে বানিয়ার মেয়ে ধরেছে। লোকটার কপাল বটে! সারা জীবন নিজের বউ ভাঙিয়ে খেয়েছে এবার ছেলের বউ ভাঙিয়ে খাবে। হ্যা হ্যা হ্যা।

—হ্যা হ্যা হ্যা! হ্যা হ্যা হ্যা!

হিরণের হাসি ব্রজগোপালে, ব্রজগোপালের হাসি আড্ডার অন্যান্য কণ্ঠস্বরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। আনিসুজ্জামানের মাথায় এই রাত্রেও মধ্যাহ্নের গ্রীষ্ম রোদ্দুর ঝাঁ ঝাঁ করছে। তিনি রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছেন। সমরেন্দ্র তাঁকে ঠেলছেন। শুনলে অধ্যাপক, শুনলে! তাঁর কান বন্ধ। মুখ বন্ধ। কু-বাক্য শুনিয়ো না। কু-কথা বলিয়ো না। চোখও কি বন্ধ থাকার কথা নয়? হ্যাঁ। সে-ও তো হওয়ার কথা! কারণ কু-দৃশ্য না দেখিবার কথাও বলা আছে হিতোপদেশে। কিন্তু কান আর মুখ বন্ধ রেখে কু-বাক্য থেকে দূরে থাকা যদি সম্ভব, আর চোখ খোলা রাখলে যদি কোনও মনোরম দৃশ্য দেখা সম্ভব তবে আনিসুজ্জামান তাই দেখছেন। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে হরিচরণ। চমৎকার সাদা ধুতি আর শার্ট পরেছে। কোলে একটি শিশু। হাতে আর একটি। পাশে হরিচরণের বউ। কমলা রঙের সামনে ফেরতা শাড়ি পরেছে। হাতে লাল কাচের চুড়ি। নাকে নাকছাবি চিক চিক করছে। পায়ের গোছে মল বাজছে। কোমর থেকে আঁচল ঘুরিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনেছে সে। তারও কোলে শিশু। তারও হাতে শিশু। সবচেয়ে বড়টি, মা-বাবার হাত ধরে থাকা দু’ ভাইয়ের মাঝখানে থেকে ধরে আছে তাদের অন্য দু’টি হাত। তাদের সকলের গায়ে হলুদ রঙের পাঞ্জাবি আর সাদা চুড়িদার। সক্কলে পায়ে জুতো দিয়েছে আর তাদের কী চমৎকার স্বাস্থ্য। একটি সুখী ও স্বাস্থ্যবান পরিবার হাতে হাত রেখে চলেছে। আত্মগত কিন্তু উদাসী নয়। সকলের চোখে-মুখে খুশি ঝলকাচ্ছে। এক জন বলছে জিলাবি-জিলাবি। অন্য জন বলল—বেলুন-বেলুন। দশমীর দিনে তারা বুঝি শোভাযাত্রা দেখতে বেরিয়েছে। এখানে দশেরা হয় না। হয়তো তাদের দেশ-গাঁয়ে হয়ে থাকবে! এখানে তারা নিজের ইচ্ছায়, বাঙালির মতো দশমীর শোভাযাত্রা দেখছে। আর এই বিজয়ার রাতে দুই ভাই অনুপম-দেবোপম কোথায়? কী করছে? তারা বুঝি গান গাইছে! বুঝি কবিতা পড়ছে! বুঝি আলিঙ্গন করছে পরস্পরকে। আর তারা আলোচিত হচ্ছে। রাস্তায়-রাস্তায়। ঘরে-ঘরে।

আনিসুজ্জামান বললেন—চলুন সবাই মিলে ডাক্তারদার বাড়ি যাওয়া যাক।

অনেকে সায় দিলেন। হ্যাঁ। যাওয়া যাক। যাওয়া উচিত। আমরাও ভাবছিলাম। রোজকার চাপে মানুষটার খবর নেওয়া হয়নি কতদিন! চোখের সামনে তিনি কীরকম বদলে গেলেন! ক’দিনেই কীরকম বেভুল হয়ে গেলেন! আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! হবে নাই-বা কেন! অত বড় শোক! সারা জীবন পাগল স্ত্রী নিয়ে কাটানো। চলো, চলো, যাওয়া যাক।

প্রণবেশ যেতে রাজি হলেন না। ব্রজগোপালকে দোকানের ঝাঁপ ফেলতে হবে। তিনিও থেকে গেলেন। সমরেন্দ্র, রণেন, বিকাশ আর আনিসুজ্জামান রওনা দিলেন। আনিসুজ্জামান, তিনিই এই যাবার প্রস্তাব দিয়েছেন অথচ তাঁরই যেতে ইচ্ছে করছে না এখন। বুঝি-বা তিনি কোনও অপমানে লিপ্ত হতে যাচ্ছেন। বুঝি-বা কোনও অপ্রিয় দৃশ্য দেখে ফেলতে যাচ্ছেন যা-নিয়ে পরে আড্ডা সরগরম হয়ে উঠতে পারে। এইসব আড্ডা, যাতে মাঝে মাঝে চমৎকার আলোচনা হয় রাজনীতি বা সাহিত্য বিষয়ে, ধর্ম বা সংস্কৃতি বিষয়ে তখন এই মানুষগুলিকে ভাল লাগে। ভাবতে ভাল লাগে, এই, এ কিন্তু কারও ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে এসে পড়লে আর সংস্কৃতি থাকে না। সাহিত্য ভেসে যায়। শিক্ষা ও রুচিবোধ দাঁতকপাটি দিয়ে ভিরমি খায়। সব চলে যায়। সব ভেসে যায়। শিক্ষিত, ভদ্র, মার্জিত মানুষগুলির মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে জান্তব মুখ। জান্তব নখ-দাঁত। যাকে যা মানায়। ওই মুখ, ওই নখ, ওই দাঁত ও গর্জন মানুষকে মানায় না মোটে। আনিসুজ্জামানের মন খারাপ হয়ে যায়। তিনি জানেন, কোথাও এর ব্যতিক্রম নেই। কলেজে সুন্দরী ছাত্রীকে নিয়ে রসালো মন্তব্য করলেন অধ্যাপকরা। কোনও কোনও ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে ঘনিষ্ঠতা হল আর তারা হাত ধরাধরি করে চলে গেল বিলের ধারে আর হাঁস হয়ে গেল ঘনিষ্ঠতম ভঙ্গিতে—এ নিয়ে অধ্যাপক-কক্ষে আলোচনা চলল। আনিসুজ্জামানের দিকে প্রশ্ন ছোঁড়া হল—যেহেতু তিনি অবিবাহিত—যেহেতু ছাত্রছাত্রী কয়েকজন তাঁর সম্পর্কে জটিল কিছু মন্তব্য হেনেছে—কি? রাত্রে ঘুম হয় এ সব দেখে গেলে?

জানেন, সব জানেন আনিসুজ্জামান। তবু মন খারাপ হয়। এখনও হচ্ছে। এই ক’মাসে মল্লিনাথের বাড়ির শ্রী একেবারে চলে গেছে। বাগানের যত্ন নেই। দেওয়ালে শ্যাওলা ধরেছে। স্কুলটা জীর্ণ। মাঝে মাঝে মল্লিনাথ নিজের খরচে স্কুলবাড়িটা সারাতেন। সেই কতকাল আগে উদ্যোগ করে বসানো হয়েছিল এই স্কুল। এখন সব ময়লা। সব জঙ্গল। বুঝি-বা বাড়িও বোঝে তার অবস্থিতির অর্থহীনতা। এবং দুঃখ পায় আর কাঁদে। ক্রমশ জরাজীর্ণ হতে থাকে ক্লেশপ্রাপ্ত মানুষের মতো।

বিকাশ বহুক্ষণ চুপ করে আছেন। আনিসুজ্জামান বললেন—কী হয়েছে, বিকাশদা?

বিকাশ বললেন—মল্লিদাকে এভাবে কোনওদিন দেখতে হবে ভাবতেও পারিনি।

আনিসুজ্জামানের নিজের অজান্তেই ভ্রূ-কুঞ্চিত হল। শ্বেতীচিত্রিত বহুবর্ণ মুখে খেলা করল অদ্ভুত আলোছায়া। তিনি নিজের ঠোঁটের মধ্যে শব্দ ধরে রেখে উচ্চারণ করলেন—কে জানে কাকে কখন কীরকম অবস্থায় দেখতে হবে! মানুষ নিজে যেমন জানে না সে কখন কী করে বসে, তেমনই জীবন যে তাকে কোথায় টেনে নেয় আর আছড়ে থেতলে গুঁড়িয়ে ছুড়ে ফেলে দেয় কোথায় তাই-বা কে বলতে পারে!

বেল দেওয়া হয়েছিল। দরজা খোলার শব্দ হল। সকলেই নীরব। উদ্বিগ্ন। শেষ কে কবে মল্লিনাথকে দেখেছেন তাই মনে করার চেষ্টা করছেন প্রত্যেকে। পাল্লা দু’টি ফাঁক হল। দরজায় দীর্ঘদেহী মল্লিনাথ। কিন্তু মল্লিনাথ নয় বলে ভ্রম হয়। চুল বড় হয়ে কাঁধ ছুঁয়েছে। কাঁচা-পাকা দাড়ি অযত্নে ঝুলছে গাল ছাড়িয়ে, চিবুক ছাড়িয়ে গলার কাছ বরাবর। পেশি শিথিল হয়েছে। মুখ জুড়ে অজস্র জরাচিহ্ন। সকলে নীরব হয়ে দেখছেন। আর এই নীরব মুহূর্ত ভাঙা দরকার। সমরেন্দ্র বললেন—আমরা সব এলাম মল্লিদা। আপনি আজ ব্রজদার দোকানে গেলেন না। আজ বিজয়া দশমী!

শুধু একটি মাত্র শব্দ বেরুলো মল্লিনাথের মুখ দিয়ে—ওঃ! সরে দাঁড়ালেন দরজা থেকে। ঘরে কোনও আবর্জনা নেই, যেমন থাকার সম্ভাবনা আছে বাইরেটা দেখলে মনে হয়। কালীতারা রোজ আসে। ঘরদোর গুছিয়ে যায়। আগে রান্নাও করত। এখন মল্লিনাথ স্বপাক খাচ্ছেন।

বিকাশ এগিয়ে গেলেন মল্লিনাথের দিকে। বললেন—মল্লিদা, আসুন। কোলাকুলি সারি।

না। না। না। মল্লিনাথ পিছিয়ে যাচ্ছেন। ভ্রূ কোঁচকানো।

বলছেন—ছুঁয়ো না। ছুঁয়ে দিয়ো না আমাকে। আমার পূজা আছে। আমাকে সংযত থাকতে হবে। শুদ্ধ থাকতে হবে। ছুঁতে পারব না। কারওকে ছুঁতে পারব না আমি।

সকলে মাথা হেঁট করছেন। কষ্ট পাচ্ছেন। মল্লিদা—এ সব কী বলছেন তিনি!

ততো মামেব শরণং দেহবন্ধ-বিমুক্তয়ে।

যাহি সংযতচেতাস্ত্বং মামেষ্যসি ন সংশয়ঃ॥

—দেহবন্ধ বিমুক্তির নিমিত্ত সংযতচিত্ত হয়ে আমাকে স্মরণ করো। তুমি আমাকে লাভ করবে।

কেউ কোনও কথা বলছেন না। বোঝা এবং না-বোঝার মধ্যবর্তী অবস্থানে নীরবতাই শ্রেয়। মল্লিনাথ কি তবে সত্যিই আর প্রকৃতিস্থ নেই? নাকি তাঁর কোনও আধ্যাত্মিক উপলব্ধি হয়েছে! আর আনিসুজ্জামানের মাথায় ঝিম ঝিম তর্জমা বাজছে। তাঁকে দেখতে হবে। বুঝতে হবে। মল্লিনাথ প্রকৃতিস্থ নেই। তা ছাড়া মহাভাগবতের যেটুকু শ্লোক মল্লিনাথ পড়েছেন তা সম্পূর্ণ ছিল না। শ্রীপার্বতী-হিমালয়-সংবাদের মূল জায়গাই মল্লিনাথ বলেননি। হয়তো বলতেও চাননি। আনিসুজ্জামান অনুভব করেন, মল্লিনাথ এখন সেই পর্যায়ে আছেন যেখান থেকে মানুষ শাস্ত্রের অপব্যাখ্যা করে এবং ধর্মকে স্বেচ্ছাচারের কাজে লাগায়। তাঁর মধ্যে এই বোধ জন্মায় যে এখনই সেই প্রধান অংশটি বলা দরকার। মল্লিনাথের দিকে তাকিয়ে, ধীরে ধীরে, সেই শ্লোক তিনি বলতে লাগলেন। অন্যরা নিষ্ক্রিয় কুশীলবের মতো শুনতে থাকলেন আনিসুজ্জামানের স্বর—

যেহপ্যণ্যদেবতা ভক্ত্যা যজন্তে শ্রদ্ধয়ান্বিতাঃ।

তেহপি মামেব রাজেন্দ্র যজন্তে নাত্র সংশয়ঃ॥

অহং সৰ্ব্বময়ী যস্মাৎ সৰ্ব্বযজ্ঞফলপ্রদা।

কিন্তু তাস্মেব যে ভক্তা-স্তেষাং মুক্তিঃ সুদুর্লভা॥

মল্লিনাথ আনিসুজ্জামানের পায়ের কাছে বসলেন। দূরত্ব রইল, যেন ছোঁয়া না লাগে। বললেন—এর মানে কী?

আনিসুজ্জামান বললেন—ডাক্তারদা, উঠে বসুন। ওখানে বসবেন না।

মল্লিনাথ বলছেন—বলো। মানে বলো। এটা তো তিনি আমাকে বলেননি!

আনিসুজ্জামান বলেন—শ্রদ্ধার সঙ্গে যারা অন্য দেবতাকে ভজনা করে, তারাও আমাকেই ভজনা করে কারণ আমিই সর্বময়ী, আমিই সর্বযজ্ঞ-ফলপ্রদা। এ জগতে আমার থেকে স্বতন্ত্র কোনও পদার্থ নেই। সকল দেবতা আমারই বিভূতি। সে, যে-যজ্ঞই করুক, সে-যজ্ঞের আরাধ্য হিসেবে আমিই তার ফল বিধান করি। কিন্তু যারা নিজের দেবতাকেই একমাত্র বলে জানে, অন্য দেবতাকে স্বতন্ত্র জ্ঞান করে উদাসীন হয়, বিরক্ত হয় বা অভক্ত থাকে, তাদের মুক্তি দুর্লভ।

মল্লিনাথ আরও একটু এগিয়ে এসে বলেন—তুমি জানো? সব জানো? অধ্যাপক?

তাঁর ব্যক্তিত্ব উধাও হয়। জেদি, অবুঝ কিন্তু কৌতূহলী ও সুমন বালকের মতো লাগে তাঁর ভঙ্গি।

আনিসুজ্জামান বলেন—এটা জানি কারণ এ সব নিয়েই আমাকে পড়াশুনো করতে হচ্ছে কিন্তু আমি এ সব কিছুই মানি না। দেব-দেবী পূজা-পার্বণ নমাজ-কলমা প্রার্থনা—গির্জাঘরে পাপকবুল—এ সবের কোনও অর্থ নেই আমার কাছে। আমি এ সব নিয়ে গবেষণা করছি মাত্র। ডাক্তারদা, যে-শ্লোক আপনি বললেন, আমি তার আগেরটুকুই বললাম। আপনি জানেন না?

মল্লিনাথ অসহায়ভাবে মাথা নাড়েন। বলেন—না। জানি না। আমি তো পড়িনি কখনও। তিনি বলতেন। আমি শুনতাম। আমার মনে ছিল। আবার মনে যে ছিল তাও জানতাম না। এখন তিনি ঘুমের মধ্যে এলেন আর আমাকে সব বলতে লাগলেন। শাসন করলেন আমাকে। ভয় দেখালেন। ঠিকমতো পূজা না করলে সব কেড়ে নেব! বুঝলে, বুঝলে তোমরা, আমাকে পূজা চালিয়ে যেতে হবে। একনিষ্ঠভাবে। শুদ্ধভাবে। আমি কী বোকা, অ্যাঁ কী বোকা! বুঝিনি! কিছু বুঝিনি তিনি কী চান! কী বোকা, অ্যাঁ, কী বোকা আমি—

মল্লিনাথ নিজের দু’ গালে চড় মারতে থাকেন। তাঁর মাথা ঝাঁঝিয়ে যায়। তাঁকে পাগল-সদৃশ লাগে। অনর্গল বলে যান—বোকা বোকা বোকা। হঠাৎ কাঁদেন। মাটিতে উপুড় হয়ে ফুলে ফুলে কাঁদেন শোকাকুল বৈধব্যের মতো। তাঁর খেয়াল থাকে না যে ওই মেঝেয় পা রেখেছিলেন আনিসুজ্জামান আর তাঁর পায়ের ধুলো এখানে জমা ছিল।

অনেকক্ষণ পর মল্লিনাথের কান্না থামে। রণেনের চোখে জল এসে গেছে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে তিনি জল মোছেন। রাস্তা দিয়ে বিসর্জনের বাজনা চলে যায়। কারা বুঝি ভাসান দিয়ে ফিরল। ছোট কোনও পূজা। বড় পূজার দল হলে অনেক বেশি কলরব হত। অনেক চিৎকার!

মল্লিনাথ আস্তে আস্তে উঠে বসেন। বলেন—তোমরা যাও ভাই। আমাকে পূজায় বসতে হবে। আমার ছেলে চিঠি লিখেছে, তারা সব ভাল আছে। তার মা ভাল আছেন। ওখানে গিয়ে তাঁর আর পাগলামি নেই। কমলেন্দু মাকে আর এখানে ফিরতে দেবে না। না ফেরাক। আমি তো কারওকে ছাড়তে পারব না। পূজা আমাকে করতেই হবে। উপায় নেই। কোনও উপায় নেই।

একে একে উঠে পড়েন সকলেই। সকলের মন ভার হয়ে যায়। মাথুরের গড়ে মল্লিনাথ ডাক্তার বিশাল পুরুষ হয়ে ছিলেন। ভাল চিকিৎসক বলেই শুধু নন। তাঁর ব্যক্তিত্ব, ঔদার্য, বিপদে পাশে দাঁড়ানোর অভ্যাস, তাঁর বন্ধুত্ব, তাঁকে নির্ভরযোগ্য বৃক্ষের মতো করে তুলেছিল। এই বৃক্ষ এখন অতীত হতে থাকছেন। তাঁর পাতা খসে পড়ছে। ডাল-পালা ভেঙে পড়ছে। ভারী কাণ্ড মাটি থেকে কবে উপড়ে নেবে ঝড়ো সময়। এ সবই ভাবতে ভাবতে পথ চলেন সকলে। ভাবতে ইচ্ছে করে, এই মহাবৃক্ষের পতনের পর, কে আছেন মাথুরের গড়ের সম্ভাব্য মহীরুহ? যেমন ঈশ্বরের পর গুরু, যেমন রাজার পর রাজতনয়, যেমন নেতার পর দলপতির পর সমস্ত সম্ভাব্য নেতৃত্ব, তেমনই কোনও লোকালয়ে থাকেন এমন মনুষ্য, যেমন মল্লিনাথ, তাঁর পতন হলে, অনুপস্থিতি ঘটলে, আরও এক সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করতে ইচ্ছে হয়। তাঁরা এমনই কোনও ভবিষ্যৎ মুখ ভাবতে চেষ্টা করেন। এবং ভাবতে ভাবতে ভুলে যান। চলতে চলতে এক কথা থেকে অন্য কথা পাড়েন। মল্লিনাথ তাঁর নিজেরই নিষ্ক্রিয় মস্তিষ্ক এবং দুঃস্বপ্নের স্নায়ুব্যবস্থার মতো স্মরণ হারিয়ে ক্রমশ আর স্মর্তব্য থাকেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *