২০. একা ছিলেন নীলিমা

২০

চার বছর। চার বছর একা ছিলেন নীলিমা। এই চার বছরে অনেক কিছু দেখলেন তিনি। কে জানে, আর কত কী দেখবেন। আজ মান্তু আসবেন, চার বছর পর আবার এ বাড়িতে পাকাপাকিভাবে থাকতে আসছেন মান্তু। আজ সকাল থেকে নীলিমা ঘর ঝাড়গোছ করছেন। যদিও এ সবের প্রয়োজন ছিল না। নীলিমার বাড়ি এমনিতেই পরিষ্কার। ঝুল কালি ময়লা অগোছালো ঘর-দোর নীলিমা দেখতে পারেন না। এ বাড়ির প্রতিটি ঘরে অনেক আলো-হাওয়া। এই যে চার বছর নীলিমা একা ছিলেন সেই সময়েও প্রতিদিন, নিয়মিত ঘর পরিষ্কার রেখেছেন তিনি। ঋতুর সঙ্গে মিলিয়ে পর্দা বদলেছেন। বিছানার চাদর বদলেছেন। ফটিক বিলের ধারে ওই বস্তি থেকে ময়না রোজ এসে নীলিমাকে সাহায্য করে যায়। রান্না নীলিমা নিজেই করেন। আর সব কাজ ময়নার। ময়না মানুষ ভাল। তার কাজও ভাল। কিন্তু তাড়াহুড়ো করা স্বভাব। অন্য বাড়িতে কাজ করতে যাবার তাড়ায় মাঝে মাঝে তার কাজে অবহেলা পাওয়া যায়। আর বড্ড চাইবার স্বভাব। নীলিমা মাঝে মাঝে খুবই বিরক্ত হন ময়নার ওপর। একটা কাপের ডাঁটি ভেঙে গেল, ওমনি ময়না বলবে— ‘মাসিমা, এই ডান্টি ভাঙ্গা কাপ দিয়া আপনে কি করবেন? আমি লইয়া যাই?’ গোলাপের কাঁটায় লেগে সেদিন শাড়ির আঁচলটা ছিঁড়ে গেল। ময়না বলল— ‘আপনি কি ছিঁড়া পরবেন? আমারে দিয়া দ্যান।’

নীলিমা মাঝে মাঝে বলেন—তোমাকে তো না চাইতেই দিই, দিই না ময়না?

—দ্যান। আমি তো কই, আপনে না থাকলে আমার কী না জানি হইত।

—তা হলে এত চাও কেন? চাইবে না।

ময়না হাসে। সলজ্জ হাসি। ঝাঁটা ঠুকে ঠুকে দু’বার ঝেড়ে নেয়। তর্ক করে না। কিন্তু আবার চায়।

গত বছর একখানা ফ্রিজ কিনেছেন নীলিমা। রোজ বাজার করার অনেক হাঙ্গামা। বৈধব্য সত্ত্বেও তিনি মাছ-মাংস সবই খান। এ বিষয়ে তাঁর কোনও সংস্কার নেই। এ নিয়ে আত্মীয়স্বজন পাড়া-প্রতিবেশীর মধ্যে নিন্দে কম হয়নি। সে-সব শুনে নীলিমা দুঃখ পেয়েছেন ঠিকই কিন্তু বিচলিত হননি। সমরেশ যখন মারা যান তখন তৃণাঙ্কুর কলেজে পড়ছেন। নীলিমার অনেকদিন চাকরি বাকি। বৈধব্য সম্পর্কে অনেক ভেবেছেন তিনি। বৈধব্যের বিধান কেন? এ নিয়ে কথাও বলেছেন অনেকের সঙ্গে। নীলিমার মেজবোন প্রতিমা বলেছিলেন—যে চলে গেছে তার শোক পালনের জন্য। প্রিয়তম মানুষের অনুপস্থিতির যে অসামান্য কষ্ট তার প্রতীকী পালনীয় বিধি।

—তা হলে কি নারী কখনও পুরুষের প্রিয় নয়? সে চলে গেলে পুরুষরা তো কোনও নিয়ম পালন করে না? সারা জীবন কোনও শোকচিহ্ন ধারণ করে না!

—পুরুষদের অনেক রাস্তা খোলা আছে। তারা আবার বিবাহ করতে পারে।

—মেয়েরা পারে না কেন?

—তুমি করবে? আইনত কোনও বাধা নেই।

—করব না। তবে সম্ভব হলে হয়তো করতাম। আমাদের সমাজে এই নিয়ম এখনও গ্রহণযোগ্য হয়নি। তাই—। আমার ছেলের জন্য আমাকে ভাবতে হচ্ছে। আর আইনের কথা তুলিস না। কল্যাণকারী আইন তৈরি করেন কয়েকজন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সচেতন প্রগতিশীল মানুষ। সেই প্রগতি উপলব্ধি করতে সাধারণ মানুষের কয়েক শতক কেটে যায়। বিধবা হওয়ার পর আবার বিয়ে করছে শুনলে মানুষ এখনও ট্যারা চোখে তাকায় না?

—তা হলে তো সমাজ তুমি মানছই। মানলে পুরোটা মানবে না কেন?

—পুরোটা? সমাজের কোন নিয়মটা সম্পূর্ণ তা কী করে নির্ধারিত হবে? সমাজ প্রতিনিয়ত বদলায়। এই পরিবর্তনটা অদৃশ্য। সবসময়ই সমাজের কেউ কেউ কিছু নিয়ম মানে, কেউ কেউ মানে না। এই মানা আর না-মানার মধ্যে থেকেই একটা নতুন রীতি বেরিয়ে আসে। এটাই সমাজের নিয়ম। অনেক কিছু আপনিই বদলায়। কিন্তু অনেক নিয়ম বদলাতে হয় জোর করে। যেমন সতীদাহ বন্ধ করা হয়েছিল। যেমন বিধবাবিবাহ প্রচলন। কিন্তু সমাজের কোনও কোনও পাথর এত ভারী, এত জগদ্দল যে সেই প্রচলন আজও টলছে না। তোদের কথাই ধর না। আজ থেকে একশো বছর আগে হলে তোরা কি এরকম স্লিভলেস ব্লাউজ পরে, ববছাঁট চুল নিয়ে, ঠোঁটে রং মেখে বেড়াতে পারতিস?

নীলিমার ছোট বোন চন্দ্রিমা নিজের ফিতেকাট ব্লাউজ পরা কাঁধ ঢাকতে ঢাকতে বলেছিলেন—শোক বলেও তো কিছু আছে। জাঁইবাবুর জন্য তোমার কি সেটাও নেই?

—সত্যি বলব? নেই। তোর জামাইবাবুর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কী ছিল জানিস? পোষা টিয়াপাখির মতো। ছোলা আর লংকা দেওয়া ছাড়া, মাঝে মাঝে দু’-একটা হরেকৃষ্ণ বোল দেওয়া ছাড়া যার সঙ্গে আসলেই কোনও সংযোগ ছিল না। আর শোকের কথাই যদি বলিস তা হলে তো বলতে হয় সন্তানশোকের চেয়ে বেশি কিছু নেই। তার জন্য তো সমাজ সারাজীবন বহমান কোনও চিহ্ন নির্ণয় করেনি, আসলে ভোগ্যবস্তু ছাড়া আর কোনওভাবে তো দেখা হয়নি মেয়েদের। তোমার বর মরে গেছে মানে—তোমার স্বামী মরে গেছে মানে—তোমার জমি এখন ধু-ধু নিষ্ফলা পড়ে থাকবে। আর কেউ এসে সে-জমি দখল নিলে অন্যায় হয়ে যাবে। মালিক একজনই। বিক্রি না-করা পর্যন্ত তো মালিক বদলায় না। সন্তানের জন্যও তাই কোনও শোকচিহ্ন নেই। কারণ স্বামী থাকলে আবার সন্তান উৎপাদন সম্ভব। কিন্তু স্বামী না থাকলে আর একজন স্বামী—তওবা তওবা। হিন্দু বিধবাদের মতো নির্যাতিত অবহেলিত ও দলিত জাত পৃথিবীর আর কোথাও নেই।

ভ্রূ কুঁচকে গিয়েছিল প্রতিমার। রুমাল দিয়ে চেপে চেপে ঠোঁটের চারপাশ থেকে অতি সাবধানতার সঙ্গে ঘাম মুছে, যেন তাঁর লিপস্টিক টসকে না যায়, প্রতিমা বলেছিলেন—বৈধব্য কিন্তু সংযমের জন্যও। আমিষ আহার বা রঙিন পোশাক, সাজগোজ, মানুষের সেক্স বাড়ায়, ভোগলিপ্সা বাড়ায়। একজন বিধবার পক্ষে…সেইসব…

—অর্থাৎ একজন স্বাভাবিক মানুষের হাত পা দুমড়ে ভেঙে দাও। নাক-মুখ থেঁতলে দাও।

—কেন?

—কেউ বিধবা মানেই তার স্বাভাবিক বোধ হত্যা করতে হবে কেন? শোক কারও চিরস্থায়ী হয় না। কিন্তু সামাজিক নিয়ম স্বামীশোক চিরন্তন করে তুলতে চায়। সতীদাহর চেয়ে বৈধব্য যাপন কোনও অংশে কম নিষ্ঠুর নয়! প্রত্যেক বিধবার উচিত, অন্যদের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করা।

—সে তুমি তোমার যা খুশি করবে। আমরা তো কিছু বলতে যাব না। সব নিয়ম মেয়েদের জন্য কেন! পুরুষদের কোনও কষ্ট নেই কেন! এ সব খুব উঠেছে আজকাল। ওরা যে দিনরাত খেটেখুটে আমাদের মুখে অন্ন জোগায়, তার বেলা?

নীলিমা হেসেছিলেন। খুব কঠিন সত্য হলেও তাঁকে বলতে হয়েছিল—ও। অন্ন জোগালেই সাতখুন মাফ? তা হলে আর আমার দোষ কী?

—তার মানে?

—মানে আমিও তো তোমাদের জামাইবাবুর মুখে অন্ন জুগিয়েছি এতকাল।

—সে তোমার কপাল।

—মানলাম। আমার কপাল। কিন্তু নিয়মটা যদি এরকম হয় যে আমাদের অন্ন জোগায় বলেই সমস্ত ইচ্ছে অনিচ্ছে, চাহিদা, ভাল-মন্দ লাগাকে পূর্ণ মূল্যে বিকিয়ে দিতে হবে তা হলে আমি বলব, তোমাদের হাতগুলোকে শুধু নখরঞ্জনী আর চুড়ি পরার কাজে না লাগিয়ে অন্নসংস্থানের কাজে ব্যবহার করো।

চন্দ্রিমা আর প্রতিমা প্রায় একসঙ্গে বলেছিলেন—সে তুমি চাকরি করে বলে তোমার বরাবর গর্ব। তুমি মনে করো তুমি যা ভাবো সেটাই ঠিক। তুমিই সবচেয়ে বেশি প্রগতিশীল। আধুনিক।

নীলিমা হেসে বলেছিলেন—সত্যি কথা বলতে কি, আমি তাই। আর চাকরি তোমরাই বা করো না কেন? বাবা তো তোমাদেরও সমান লেখাপড়া শিখিয়েছেন।

—আমাদের দরকার নেই।

—বেশ। তা হলে আমার ব্যাপারে কোনও কথা বলতে এসো না। তোমার জামাইবাবুর জন্য আমার কোনও শোক নেই। কোনও প্রতিবিধানও আমি মানব না। আমাকে চাকরি করতে হবে। শরীর ঠিক রাখতে হবে। ব্যালান্সড ফুড আমার দরকার। একাদশী করে বাস ঠেঙিয়ে তোমাদের জামাইবাবুকে স্মরণ করার নাটক করতে করতে আমি দিন কাটাতে পারব না।

প্রতিমা বলেছিলেন—আমাদের অনেকেই কিন্তু তা হলে তোমার বাড়ি আসবেন না বড়দি!

—তাঁরা কারা?

—যেমন আমার শাশুড়ি। শ্বশুর।

—যেমন আমার ননদ। জা।

—নাই-বা এলেন। কী যায় আসে? আমার যখন অফিস যাবার জন্য মাত্র দু’টি শাড়ি ছিল, মান্তুর পড়ার খরচের জন্য আমি যখন দিনের পর দিন দই আর চিঁড়ে খেয়েছি, অন্তত ছ’টা বর্ষা আমি কাটিয়েছি বিনা ছাতায়, তখন তোমাদের শাশুড়ি ননদরা আমাকে দেখতে আসেননি। তোমাদের সঙ্কোচের কোনও কারণ নেই। তোমাদের যদি নিজস্ব ভাবনা কিছু থাকে আমাকে জানিয়ে দিয়ো।

তারপর সেই চমৎকার ঘটনাটা ঘটেছিল। কতদিন হয়েছে তখন, সমরেশ মারা গেছেন? এই বছর দেড়েক হবে হয়তো। এতদিন অশৌচ থাকার কারণে প্রতিমা বা চন্দ্রিমা কেউ তাদের পূজা-পার্বণে নীলিমাকে ডাকেননি। নীলিমাও যাননি তাঁদের বাড়ি। সমরেশ মারা যাবার পরই পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি গড়ার সংকল্প করেছিলেন নীলিমা। পরিকল্পনা আগেই ছিল। কিন্তু পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি করতে যে-হাঙ্গামা পোহাতে হয় তা সইতে রাজি ছিলেন না সমরেশ। অদ্ভুত অলস ছিলেন তিনি। অদ্ভুত অকর্মণ্য। অসততা আছে বলে চাকরিটা হঠাৎ একদিন ছেড়ে দিয়ে চলে এলেন। বেশ তো, অন্য কিছু করো। অন্য চাকরি দেখো। হ্যাঁ দেখব। হ্যাঁ দেখছি। ঘরে চাল নেই। মান্তুর স্কুলের পড়া। সঞ্চয় খরচ হতে হতে তলানিতে ঠেকে গেছে। সমরেশের কোনও তাড়া নেই। মাঝে মাঝে নীলিমার কথায় বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে যান। কোথায় যান নীলিমা জানেন না। কিন্তু কোনও কাজ জুটিয়ে ফেরেননি। সমরেশের বন্ধু ছিলেন অর্ঘ্য দত্ত। শেয়ালদায় বিশাল ছাপাখানা আছে তাঁর। প্রায়ই আসতেন। বকাবকি করতেন সমরেশকে— বিয়ে করেছিস, বউ বাচ্চা আছে, কিছু একটা তো করতেই হবে তোকে।

—ভাল লাগে না।

একই উত্তর ছিল সমরেশের— ভাল লাগে না। কিছু ভাল লাগে না।

এক-একদিন রাগ করতেন অর্ঘ্য। তুই খাস না? ঘুমোস না? সে-সব ভাল লাগে? অত ভাল কাজটা ছেড়ে দিলি। তুই কি বলতে চাস ওখানে সবাই ঘুষ নেয়? সৎ কেউ নেই? তা তুইই থাকতিস। অসতের মাঝে সততার একমাত্র নিদর্শন হয়ে। ঠিক আছে, কাজটা ছাড়লি, ছাড়লি— অন্য কিছু জুটিয়ে নে।

সমরেশ চুপ। মাঝে মাঝে নিজেকে পাথর করে ফেলার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল লোকটার। অর্ঘ্য বলতেন—জানলেন বউঠান, কলেজ থেকে আমরা কতবার মিছিল করেছি। মাইলের পর মাইল হেঁটেছি। এই সমরেশ কিন্তু কোনওদিন যায়নি। বলত ভাল লাগে না। আরে এরকম কথা কেউ ভূভারতে শুনেছে? স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন, আমাদের তখন রক্ত কথা বলে, সুভাষ বোসের বক্তৃতা শুনলে মনে হত, আজই, এখুনি, দু’-দশটা ব্রিটিশ না মারতে পারলে জন্ম বৃথা। তখন এই হতভাগা বলত, আমার ভাল লাগে না। একটাই কাজ ও খুব ভাল জানে। পড়তে।

নীলিমা কাঁদেন। রাগ করেন। অনুযোগ করেন। কখনও ভালবেসেও বোঝাতে যান। সমরেশ ঘুমোন।

ঘুম থেকে জেগে পাশ ফেরেন। আবার ঘুমোন। কোনও কথা বললেই—আমার ভাল লাগে না। জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকেন। নীলিমা বোঝার চেষ্টা করেছেন। বলেছেন—কিছু কী হয়েছে, যাতে তুমি চঞ্চল আছ, অস্থির আছ, আমাকে কি বলা যায়!

—কিছু হয়নি।

—তবে?

—আমার ভাল লাগে না।

—আমরা কোথায় যাব? কী করব? কে আমাদের দেখবে? তুমি মান্তুর কথা ভাববে না?

সমরেশ নিরুত্তর। দেওয়াল হয়ে যান। ক্রমশ দেওয়ালের পরিধি বাড়ে। বিস্তার বাড়ে। দেওয়ালের সঙ্গে নীলিমারও ব্যবধান বাড়ে। নীলিমার প্রথমে ভয় করেছিল। তারপর অভিমান হয়েছিল। তারপর আর ভয় করল না। অভিমান ধুয়ে গেল। শুধু রাগ হল। তীব্র রাগে বাথরুমের কল জোরে খুলে দিয়ে হু হু করে কাঁদতেন নীলিমা। চিৎকার করে জান্তব শব্দের মধ্যে নিজের ক্রোধ প্রশমিত করতে চাইতেন। একদিন আর রাগও হল না। ঘেন্না হল। লোকটাকে ঘৃণা করতে শুরু করলেন। তখনই ওই অর্ঘ্য দত্তই একদিন বললেন—এ জি বেঙ্গলে লোক নেবে। আমার চেনা আছে। আপনি কি চাকরি করবেন বউঠান?

নীলিমা সম্মতি দিয়েছিলেন। করবেন। আশ্চর্য হয়েছিলেন। কারণ তাঁর চাকরির খবরে নিরুত্তর ছিলেন সমরেশ। এতটুকু প্রতিবাদ করেননি। একবারও বলেননি, না, ওকে বাইরে বেরুতে হবে না। মানুষটাকে অভিশপ্ত লাগত নীলিমার। এক মাসের মধ্যে কাজটা হয়ে গিয়েছিল। প্রথম প্রথম মান্তু খুব কান্নাকাটি করত। বাবা তাকে ছোঁয় না। আদর করে না। বাবাকে একটা অচেনা নক্ষত্রের মতো লাগত তার। মা অফিস যাচ্ছেন, এ নিয়ে তার অভিমান ও উদ্বেগের শেষ ছিল না। আস্তে আস্তে মান্তুও মেনে নিতে শুরু করল। বড় হচ্ছিল। বুঝতে শিখল। নীলিমা পড়ি-মরি করে অফিস থেকে ফিরতেন। রান্না করতেন। ছেলেকে পড়াতেন। সমরেশ আরও সুবিধে পেয়ে গেলেন। বাড়ি ছেড়ে বেরুনোই বন্ধ করে দিলেন একেবারে। অর্ঘ্য মাঝে মাঝে আসেন, জোর করে একতাড়া প্রুফ গছিয়ে যান। বলেন—বউয়ের পয়সায় খাওয়া এখনও চালু হয়নি। অন্তত নিজের ভাতের খরচাটা প্রুফ দেখে জুটিয়ে নে।

সেটাও ঠিকমতো করেননি সমরেশ, শুধু ঘুমোতেন। সিগারেট খেতেন। জানলা দিয়ে চেয়ে থাকতেন। আর বই পড়তেন। মান্তু স্কুল থেকে ফিরলে দরজা খুলে দিতেও নাকি বিরক্ত বোধ করতেন। মান্তু মার কাছে অনুযোগ করত।

সমরেশের মৃত্যুর তিন-চার মাসের মাথায় বাড়ির কাজ শুরু করেছিলেন নীলিমা। তাঁর শরীর বরাবর সুস্থ ছিল, এও ভগবানের একরকম আশীর্বাদ বলেই মনে করেন তিনি। টানা দেড় মাসের ছুটি নিলেন। সেই সময় মল্লিনাথ খুব সাহায্য করেছিলেন নীলিমাকে। নিজের একতলাটা ছেড়ে দিয়েছিলেন জিনিসপত্র রাখবার জন্য। তৃণাঙ্কুর তখন অমল-কমলকে পড়াতেন। দু’জনেই খুব ভাল ছাত্র ছিল। তৃণাঙ্কুর খুব প্রশংসা করতেন। দেড় মাসে বাড়ি উঠে গেল। মল্লিনাথই বলেছিলেন—নীচটা দোকান করুন। একটা গ্যারেজ বানান। ছেলে কোনওদিন গাড়ি কিনতে পারে। এখানে মশার যা উপদ্রব। দোতলায় থাকুন।

বাড়ি করতে অনেক খরচ হয়ে গিয়েছিল নীলিমার। সঞ্চয় ফুরিয়ে এসেছিল। মল্লিনাথ বলেছিলেন—আজকাল তো খুব ফ্ল্যাট চলছে। আপনার ছোট সংসার। ওপরটা ফ্ল্যাটের মতো করে একটা পাশ বিক্রি করে দিন।

ভাল পরামর্শই বলতে হবে। অনেক দেখেশুনে আনিসুজ্জামানকে ফ্ল্যাটটা বিক্রি করেছিলেন নীলিমা, তাঁর সঙ্গে কথা বলে খুব ভাল লেগেছিল নীলিমার। বয়সে প্রায় তৃণাঙ্কুরের মতোই। দু’জনেরই পেশা অধ্যাপনা। নীলিমার গভীর বিশ্বাস ছিল, অধ্যাপকদের কখনওই বিশ্বাস করে ঠকতে হয় না। নীলিমা ঠকেননি। প্রতিবেশী হিসেবে আনিসুজ্জামানের তুলনা নেই। ভাই-বোন থাকেন। নীলোফাও অতি চমৎকার মেয়ে। দু’জনেরই দুর্ভাগ্য। ঈশ্বর একই সঙ্গে ভাইবোন দু’জনকে বিকৃত করে তুলেছেন, এমন শোনা যায়নি। আনিসুজ্জামানের শ্বেতী। নীলোফা দগ্ধ।

আনিসুজ্জামানকে ফ্ল্যাট দেবার জন্যও অভিযুক্ত হয়েছেন নীলিমা। মুসলমানের সঙ্গে এক বাড়িতে থাকা নিয়েও তাঁর বৈধব্যের পর মাছ-মাংস খাওয়ার মতো ঝড় উঠেছিল। তবে তার তীব্রতা ততখানি ছিল না এ জন্যই যে মানুষের মধ্যে নীলিমা সম্পর্কে এই সহনশীলতা তৈরি হয়েছিল যে, নীলিমা, বিধবা হয়েও আমিষ আহার করতে পারেন যখন তখন মুসলমানের সঙ্গে থাকবেন, এ আর বিচিত্র কি। বরং নীলিমাকেই একরকম সৃষ্টিছাড়া বলা যায়। আর এ সব নিয়ে ভাবনা ঘটিয়েছিলেন নীলিমার বোন ও ভ্রাতৃবধূরাই। এই মাথুরের গড় পাড়ায় কোনও আলোচনা বা সমালোচনা হয়নি।

মাছ-মাংস খাওয়া নিয়ে ছেলের সঙ্গে কথা বলেছিলেন নীলিমা। তৃণাঙ্কুর বলেছিলেন— আমার কোনও সংস্কার নেই। তুমি খাবে।

—অনেকে অনেক কথা বলছে। সেগুলো তোকেও শুনতে হবে মান্তু। তখন মনে হবে না তো, মা এগুলো না করলেও পারত।

—না। হবে না। কারণ মেয়েদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এইসব নিয়ম আমি মানি না মা।

নীলিমা নির্দ্বিধ ছিলেন। এবার নিঃশঙ্ক হলেন। মান্তুর কথা তাঁর ভাল লেগেছিল। বাড়ি করার ব্যাপারেও মান্তুর পূর্ণ সমর্থন পেয়েছিলেন নীলিমা। বোনেরা বলেছিলেন—কালাশৌচে কোনও শুভ কাজ করতে নেই। নীলিমা বলেছিলেন—তা হলে তো মান্তুর ফাইনাল পরীক্ষাটা এবার স্থগিত রাখতে হয়। ওর জীবনে এর চেয়ে শুভ আর এখন কী হতে পারে।

নীলিমা শোনেননি। তাঁরাও আড়ালে বহু সমালোচনা করে কাল যাপন করেছেন। বাড়ি শেষ হবার পর ঘটা করে গৃহপ্রবেশও করেননি নীলিমা। দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে পূজা দিয়েছিলেন। বোনেরা তাঁদের বাড়ির পূজা-পার্বণে একবারও নীলিমাকে ডাকেননি কিন্তু নীলিমার বাড়ি করা হয়ে গেলে দেখতে এসেছিলেন।

চন্দ্রিমা বলেছিলেন—তোমার বাড়িতে সবসময় কীরকম আঁশটে গন্ধ লাগে দিদি। একটু পুজোটুজো করাও।

তৃণাঙ্কুর ছিলেন সামনে। বলেছিলেন—তাই নাকি? আঁশটে গন্ধ? আসলে গন্ধটা শুধু ঘরেই না, মা’র মুখেও তুমি পাবে। গায়েও পেতে পারো ছোটমাসি।

চন্দ্রিমা চোখ গোল গোল করে বলেছিলেন—তাই নাকি? কেন?

তৃণাঙ্কুর হেসে বলেছিলেন—বাঃ! মা বিধবা হয়েও মাছ-মাংস খায়, না? মা’র গায়ে একটু বেশি গন্ধ লাগে তাই।

একেবারে নিবে গিয়েছিলেন চন্দ্রিমা। বলেছিলেন—তোর বড় কটাস কটাস কথা মান্তু। একেবারে দিদির মতো।

সেই চন্দ্রিমার বাড়িতেই একবার নিমন্ত্রণের ডাক এল নীলিমার কাছে। সমরেশ মারা যাবার দেড় বছর পর। মানসিক সত্যনারায়ণ করেছিলেন চন্দ্রিমা। তাঁর ছেলের টায়ফয়েড হয়েছিল। সে সেরে উঠেছে। এখন তার মহিমায় পূজা। সন্ধেবেলায় চন্দ্রিমার মানিকতলার বাড়িতে গেলেন নীলিমা ও তৃণাঙ্কুর। প্রচুর আত্মীয় এসেছেন চন্দ্রিমার। ছাদে পূজা হচ্ছে। প্রতিমাও এসেছেন। সঙ্গে প্রতিমার শাশুড়ি। কত যে লোক! পুরুষ মহিলা মিলিয়ে একশোজনের কম নয়। নীলিমারা যখন পৌঁছলেন তখন পূজা প্রায় শেষ। পুরোহিত ঘোষণা করছেন—‘শান্তির জল।’ সকলে হুড়োহুড়ি করে কাছে বসছেন। শান্তির জল ফসকে গেলেই অশান্তি! মেয়েরা ফ্রক দিয়ে পা ঢাকছে। বউরা কাপড় দিয়ে। পুরুষরা পাঞ্জাবি আর পাজামা পরেছে। অনেকে ধুতি। ছোটরা ছাড়া প্যান্ট-শার্ট পরা নেই কেউ। মেয়েদের পরিধানে তাঁতের শাড়ি বা সিল্ক। পোশাকে-আশাকে, ধূপের গন্ধে বেশ একটা পুজোর পরিমণ্ডল তৈরি হয়েছে। সত্যনারায়ণের কাছে মেয়ে-পুরুষ সব গড় করছেন। মনে মনে কী বলছেন কে জানে! নীলিমা গড় করলেন না। দু’হাত জোড় করে কপালে ঠেকালেন। পুজো শেষ হয়ে যাওয়ায় এ ধারে-ও ধারে নানা রকম জটলা তৈরি হয়েছে। নীলিমার কানে এল একজন বলছে—অ! লাউঘন্ট! তাতে কেউ কালোজিরে ফোড়ন দেয় নাকি!

কেউ তার জবাবে বলছে—তা আর বলছি কী? দেখি লাউ রাঁধে কালোজিরে ফোড়ন দিয়ে। বললুম, রান্না না হয় করোনি বউমা। কিন্তু লাউঘণ্ট কি খাওনি কখনও?

—তা সে কী বললে?

—সে ন্যাকাপানা কথা শুনলে তোমার গা জ্বলে যাবে। বলে কিনা, কোনটাকে কী বলে আমি জানি না মা।

—ন্যাকা! জানো না! বলি আমাদের কি কেউ কিছু শিখিয়ে দিয়েছিল? ইচ্ছে থাকলে আপনি হয়।

—তা তাকে দেখতে কেমন?

—ভাল। রংটা একটু চাপা।

—নাক চোখ?

—বেশ টানা টানা। গড়নটা একটু মোটার দিকে।

—গানটান জানে?

—হ্যাঁ। নাচও জানত। আমি বাপু বলে দিয়েছি। আগে যা করতে, করতে। এখন ও সব ধিঙ্গিপনা চলবে না। নাচ আর করে না। গায়। সেও এক ঝামেলা বাপু। সময়-অসময় নেই। হারমোনিয়াম নিয়ে বসে পড়বে।

—থাক থাক। একবারে বেশি কিছু বোলো না। একটা হলেটলে আপনিই সব বন্ধ হয়ে যাবে।

—হ্যাঁ। আর কাজই বা কি? আর বড় নির্লজ্জ বুঝলে। কতবার বলেছি, বউমা শব্দ করে হেসো না। কানেই তোলে না। বর ঘরে এলেই গুজ গুজ আর হা হা হি হি।

—আজকাল বাপু সবই ওই। তা দিলে থুলে কেমন?

—সে আর কি! যা দিয়েছে সে তো মেয়েকেই। আমরা তো সঙ্গে নিয়ে সগ্গে যাব না।

—কিন্তু সে যাই দিক, বউকে দিয়ে একটু কাজটাজ করাবে। আর কিছু না হোক রোজ অন্তত শ্বশুরের মশারিটা টাঙিয়ে দিতে বলবে। প্রথম থেকে লাগাম না টানলে পরে আর সামলাতে পারবে না। তা আনলে না কেন বউকে?

—শরীর খারাপ।

—হবে নাকি? এত তাড়াতাড়ি?

—না। না। সেই শরীর খারাপ না।

—অ। বুঝলুম।

নীলিমার বেশ লাগছিল শুনতে। কথা ফুরিয়ে গেল ও দিকে। কিংবা হয়তো ফুরোয়নি। নীলিমা জানেন দুই শাশুড়িতে বউয়ের নিন্দা শুরু করলে কখনও ফুরোয় না। দুই বউতে শাশুড়ির নিন্দা করলেও তা অফুরন্ত। তবু তিনি খানিকটা এগিয়ে গেলেন। একপাশে পুরুষরা দাঁড়িয়ে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে কথা বলছেন। নির্বাচন, নাকি তা কংগ্রেস নেতৃত্বের খেয়ালখুশি বা স্বার্থসাধন, তা নিয়েও তর্ক হচ্ছে। একজন বলছেন—কংগ্রেস শেষ। ওরকম একটা জাতীয় দল! গান্ধি একেবারে শেষ করে দিয়ে গেল।

আরেকজন, সে বুঝি গান্ধিভক্ত, গলা তুলে বলল—শোনো, গান্ধি কী করে গেলেন এখন বুঝতে পারবে না। সে কথা বলবে ইতিহাস।

—সব কথাই ইতিহাস বলে।

—যাই বলো ভারতবর্ষে কংগ্রেস এখনও অবিসংবাদী দল। এক কথায় যার একটা সর্বভারতীয় গ্রহণযোগ্যতা আছে।

—সে তুমি যাই বলো। পশ্চিম বাংলায় কংগ্রেস শেষ। কোয়ালিশনও হবে না। এ বার কমিউনিস্ট পার্টি আসবে।

—ধুর! কমিউনিস্ট পার্টি আবার একটা পার্টি নাকি। একটা দল কতবার ভাঙল। দলটার কোনও নির্দিষ্ট নেতৃত্ব আছে? যে-দলের সাংগঠনিক স্থিতি নেই, তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের শেষ নেই, সে-দল কী করে ক্ষমতায় আসবে?

—শোনো, অত হেলাফেলা কোরো না। দলীয় মতভেদ কোথায় নেই। কংগ্রেসে নেই? পাঁচ বছরের মধ্যে কংগ্রেসে ভাঙন ধরবে, দেখে নিয়ো।

—আরে দুর! কিছুই হবে না। এ দেশের মানুষ কংগ্রেস ছাড়া কিছু বোঝে নাকি? কংগ্রেস শব্দটাই এখনও মন্ত্রের মতো কাজ করে। কমিউনিজম বুঝতে গেলে শিক্ষা দরকার। সে-শিক্ষা এ দেশে ক’জনের আছে? এ দেশে সবসময় যা কাজ করে তা হল নাম-মাহাত্ম্য। একটা ইমেজ। তা ছাড়া কোনও পার্টি কখনও জনগণের জন্য ভাঙে না। ভাঙে নেতৃত্বের বিরোধে।

—তুমি কি বলতে চাও রাশিয়ায় আগে গণশিক্ষা দেওয়া হয়েছিল, তারপর বিপ্লব এসেছে?

—না। তা নয়। তবে রাশিয়ায় লেনিন ছিলেন। সে-রকম নেতৃত্ব এ দেশে কোথায়? এ দেশে ওরকম গণ-অভ্যুত্থান কোনওদিন হবে না।

—কেন হবে না? এদেশে তেভাগা আন্দোলন হয়নি? তেলেঙ্গানা বিপ্লব হয়নি? প্রত্যেকটি অভ্যুত্থানেই কিন্তু নেতৃত্ব দিয়েছিল নিরক্ষর নিপীড়িত মানুষ। শোনো, প্রতিবাদের জন্য কেতাবি শিক্ষা প্রথম শর্ত নয়। প্রতিবাদ আসে ধারাবাহিক শোষণ, বঞ্চনা ও অপমান থেকে।

—তা হলে শিক্ষার প্রসার না হলেও চলে বলছ?

—না। তা কেন? শিক্ষা চেতনার দ্রুত স্ফূরণ ঘটায়। আবার শিক্ষা চেতনার হত্যাকারী হিসেবেও কাজ করে।

—সে আবার কী!

—হ্যাঁ। কারণ শিক্ষা মানুষের কাজের পরিণতি অনুধাবন করতে সাহায্য করে। ফলে মানুষ স্বার্থপর হতে থাকে। তেভাগা আন্দোলনের শেষের দিকটা ভাব। সম্পূর্ণ ব্যর্থতার মধ্যে কি যায়নি? শেষের দিকে কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা ওই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিল।

—কি? কেমন আছ?

চমকে উঠলেন নীলিমা। ভাবতে ভাবতে খুবই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন তিনি। প্রতিমার শাশুড়ি সামনে দাঁড়ানো। সঙ্গে চন্দ্রিমার ননদ। নীলিমা হাসলেন। বললেন—ভাল।

প্রতিমার শাশুড়ি কপট উদ্বেগে মুখ ভরিয়ে ফেললেন—না। মোটে ভাল দেখাচ্ছে না তোমাকে। আর তা তো হবেই। এই বয়সে অত বড় শোক। তার মধ্যে এত খাটুনি। খাওয়া-দাওয়াও তো ভালভাবে হয় না।

—খাওয়া-দাওয়া হয় না কেন?

—না মানে, বিধবা মানুষ, কষ্ট তো হয়। তার ওপর চাকরি-বাকরি করো।

নীলিমা হেসে বলেছিলেন—আমার কষ্ট হয় না। আমি তো সবই খাই।

সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল ভদ্রমহিলার মুখ। বলেছিলেন—অ। তা হলে সত্যিই তুমি মাছ-মাংস খাও? কথাটা শুনে বিশ্বাস করিনি। আচ্ছা, নিজের মুখে কথাটা বলতে তোমার লজ্জা করল না?

চন্দ্রিমার ননদ বললেন—সবার তো লজ্জা সমান হয় না। কারও কারও লজ্জা থাকেও না।

নীলিমা বলেছিলেন—নিজের মুখে খেতে লজ্জা পাই না, বলতে কেন লজ্জা পাব মাসিমা?

—ছি ছি। তোমাকে দেখে ঘেন্নায় আমার গা কেমন করছে। হিন্দু বিধবায় মাংস খায় এ আমি ভাবতেও পারি না।

নীলিমা সহজ গলায় বলেছিলেন—আমাকে দেখতে আপনাকে কে বলল মাসিমা? আমি তো ডাকিনি। আমাকে দেখে শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছেন কেন আপনি? আপনি এখানে খেতে এসেছেন। খেয়ে চলে যান।

—কি? এত বড় কথা? এত বড় অপমান?

প্রতিমা আর চন্দ্রিমা দৌড়ে এসেছিলেন এ দিকে। কী হয়েছে? কী হয়েছে? চারপাশে আরও কিছু কৌতূহলী মুখ। প্রতিমার শাশুড়ি বলছেন—বউমা। এরকম অপমান হব বলেই কি আমায় এনেছিলে? ছি ছি, এক্ষুনি আমি চলে যাব।

চন্দ্রিমা অপ্রস্তুত—কী হয়েছে মাসিমা? কী হয়েছে?

চন্দ্রিমার ননদ প্রতিমার শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরলেন। প্রতিমার শাশুড়ি আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন।

চন্দ্রিমার ননদ বলছেন—তোমাকে তখনই বলেছিলাম বউদি। যাকে-তাকে বোলো না। যারা নিয়মকানুন ধর্মাধর্ম মানে না…

নীলিমার কান ঝাঁ ঝাঁ করছিল। গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠেছিল অপরিসীম ক্ষোভ। আশ্চর্য! তিনি তো কারও ক্ষতি করেননি। কারও নিজের ব্যাপারে নাক গলাননি। তা হলে? তবু নীলিমা স্থিত হয়েছিলেন। চন্দ্রিমা বলেছিলেন—তুমি কি একটু সইতে শেখোনি দিদি? বয়স্ক মানুষটা একটু কি বলল না বলল অমনি দশ কথা বলে বসলে। ছি ছি। আমার বাড়িতে নিমন্ত্রিত মানুষটা!

নীলিমা বলেছিলেন—আসলে আমাকেই তোর ডাকা উচিত হয়নি রে চাঁদু। তোর ননদ ঠিকই বলেছে।

এর পরও আর সবার মতো পাত পেড়ে সত্যনারায়ণের সিন্নি খেয়ে এসেছিলেন নীলিমা। ইচ্ছে করছিল না। তবু মনে হয়েছিল, না খেলে, চন্দ্রিমার অপমান হয়। কিন্তু সারাক্ষণ মন ভার হয়ে ছিল। রাত্রে বাড়ি ফিরে আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন। না। তাঁর কোনও পাপবোধ ছিল না। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, বিধি-বিধানের মধ্যে নয়, পুণ্য ও কল্যাণের সবটাই নিহিত থাকে ভালবাসার মধ্যে। সততার মধ্যে। সমরেশ বেঁচে থাকতেই নীলিমার তাঁর প্রতি টানের মৃত্যু ঘটেছিল। শোকপালন নীলিমা সারা জীবন ধরেই করছেন। আর কত? দাম্পত্য বলতে যা বোঝায় তা বোধহয় সাকুল্যে বছরখানেক যাপন করেছেন নীলিমা। আজ আর সে-সব নিয়ে ক্ষোভ নেই। ক্ষোভ হয় মানুষের অর্থহীন সংস্কার নিয়ে। সমরেশের প্রতি একটুও প্রেম না থাকা সত্ত্বেও যদি তিনি বৈধব্য পালন করতেন তবে ওই বৈধব্যই প্রেমের ধ্বজা হয়ে থাকত। মানুষের তাতেই শান্তি। ধ্বজা উড়িয়ে। প্রতীক চিহ্নিত করে। আসলের চেয়ে নকলের ফাঁদেই মানুষ তুষ্ট রইল চিরকাল।

২১

—তোমার কি কোনও ছোট নাম নেই?

কয়েকদিন পাশাপাশি বাস করার পর বলেছিলেন নীলিমা। আনিসুজ্জামান হেসেছিলেন। তাঁর হাসিটি চমৎকার। এই রোগচৰ্চিত মুখেও তার হাসিটি সুন্দর নয়ন-সুখকর হয়ে ওঠে। বলেছিলেন— মেঠা। আমার নাম মেঠা। তবে ও নামে ডাকলে আমার খুব অস্বস্তি হবে মাসিমা।

—কেন?

—সবসময় আব্বাজানের কথা মনে পড়ে যাবে আর নিজেকে খুব ছেলেমানুষ লাগবে।

—তুমি তো ছেলেমানুষই।

—না মাসিমা। অধ্যাপকদের ছেলেমানুষ একদম হতে নেই।

—বেশ। আমি তোমাকে ডাকব অনি বলে। আপত্তি নেই তো?

—না না। আপত্তি থাকবে কেন?

আনিসুজ্জামানকে বেশ লাগে নীলিমার। প্রচুর পড়াশুনো ছেলেটির। যে-কোনও প্রসঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগে। এতদিন পাশাপাশি বাস করছেন কিন্তু আজ পর্যন্ত কখনও ওঁদের সঙ্গে অসুবিধে হয়নি। নীলোফা মাঝে মাঝে চলে আসে এ দিকে। নানা রকম গল্প করে নীলিমার সঙ্গে। এক জায়গায় দু’জনেরই বেশ মিলে গেছে— গাছ করায়। নীলিমা তাঁর চওড়া ব্যালকনিতে অনেক গাছ করেছেন। নীলোফাও প্রচুর গাছ করেছে তার বারান্দায়। বাগান করা সম্পর্কে বেশ ভাল ধারণা তার। ইদানীং বনসাই সম্পর্কে নানা রকম পড়াশুনোও করছে নীলোফা। বনসাই বাগান নীলিমারও ভাল লাগে, কিন্তু বড্ড খাটুনি। এখন আর অত খাটতে ইচ্ছে করে না।

অন্যান্য ঘর গোছগাছ শেষ করে নীলিমা ছেলের ঘরে এলেন। যাবার সময় ওঁরা সমস্ত আসবাব নিয়ে গিয়েছিলেন। নীলিমা বাধা দেননি কারণ সে সবই শর্মির বাবার দেওয়া ছিল। নীলিমার পুরনো খাটটা, শর্মি আসার পর লবিতে রাখা ছিল। মিষ্টুর খেলার জায়গা ছিল সেটা। সেই খাটটাই আবার ছেলের ঘরে দিয়েছেন নীলিমা। পুরনো চেয়ার-টেবিলটা ছাতের ঘরে তোলা ছিল। বিয়ের আগে পর্যন্ত তৃণাঙ্কুর ওটাতেই লেখাপড়া করতেন। নতুন বাড়ি করলেও আসবাবগুলি একই রেখেছিলেন নীলিমা। সে-সব আবার কাজে লাগছে। তৃণাঙ্কুরের বইয়ের টান দেখে তার ঘরের দেওয়াল জুড়ে বই রাখার তাক করে দিয়েছিলেন নীলিমা। তৃণাঙ্কুর, বি এন আর যাবার সময় বইগুলোই শুধু রেখে গিয়েছিলেন মায়ের জিম্মায়। অবশ্য, বই ছাড়া আর কীই-বা ছিল তাঁর।

আবার সেই পুরনো বাড়ি, পুরনো ঘর, পুরনো আসবাব। কিন্তু তৃণাঙ্কুর? তিনি কি সেই পুরনো মান্তু হয়ে ফিরে আসতে পারছেন! নীলিমা বি এন আর যাননি। কারণ শর্মি একবারের জন্যও তাঁকে যেতে বলেনি। ওখানে মিষ্টুর জন্মদিন পালিত হয়েছে। তৃণাঙ্কুর অবশ্য তার আগে এসেছেন। বলেছেন— মা, তুমি যাবে তো? নীলিমা মিষ্টুর জন্য কিনে রাখা উপহারগুলি তৃণাঙ্কুরকে দিয়ে বলেছেন— মিষ্টুকে দিস। আমি আবার এতদূর যাব! শরীর দেয় না।

তৃণাঙ্কুর কথা বাড়াননি। তাঁর চোখমুখে তৃপ্তি ছিল না। সুখ ছিল না। তিনিও যেন তেমন করে চাননি নীলিমা বি এন আর যান। নীলিমার দুঃখ হয়েছিল। ভেবেছিলেন— মান্তুটাও এমন! এত স্বার্থপর! দূরে গেলেই কি মায়ের সঙ্গেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মানুষ!

নীলিমা জানেন, শর্মিকে খুব ভালবাসেন তৃণাঙ্কুর। এবং, সেই ভালবাসা, অন্ধ। তৃণাঙ্কুরের কাছে, শর্মি যদি-বা কোনও অন্যায় করে, না বুঝে করে। শর্মি ছেলেমানুষ। শর্মি অপরিণত। কিন্তু নীলিমা নিজে, হয়তো একজন নারী বলেও, কিংবা হয়তো তৃণাঙ্কুরের মা বলেও টের পেতেন শর্মির জগতে তৃণাঙ্কুরের জায়গা একেবারে একটুখানি। ভালবাসা পাননি বলে, ভালবাসা চেনার একটা তীব্র ইচ্ছে আছে নীলিমার। তাঁর চারপাশের মানুষের মুখে, দম্পতির মুখে তিনি সেই ভালবাসার সন্ধান করেন এবং তাঁর বিশ্বাস, যা ওই দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ থেকে জন্ম নিয়েছে, তা হল, মানুষ মানুষের সঙ্গে সহবাস করে মাত্র। ভালবাসে না। অসংখ্য শর্ত ও পরস্পরনির্ভরশীল সহবাস। অপরিমেয় দাবি ও স্বার্থসাধনের সহবাস। চোখ বন্ধ করলেই তিনি দেখতে পান দীর্ঘ দূরতম প্রান্ত পর্যন্ত অসংখ্য প্রেমহীনতার মিছিল। তিনি নিজেও তার মধ্যে আছেন বলে তাঁর কষ্ট। কিন্তু তৃণাঙ্কুরও আছেন বলে তাঁর যন্ত্রণা।

তৃণাঙ্কুর, হয়তো-বা, যেমন বইয়ের পাতায় নিজেকে নিবদ্ধ রাখেন, যেমন একতরফা আনন্দরস বই থেকে সংগ্রহ করে নেন, তাতে ওই নিস্পৃহ বই, সে কিছু অসাধারণ অক্ষরসংবলিত অবস্থায় পাঠক নিরপেক্ষ নিস্পৃহ ও উদাসীন থাকে, তৃণাঙ্কুরের রসপ্রাপ্তিতে বা অপ্রাপ্তিতে তার কিছু যায় আসে না, তেমনই শর্মি সম্পর্কেও ওই একতরফা প্রেম তাঁর মধ্যে জাগিয়ে রাখেন।

এখানে, এই বাড়িতে, নীলিমা একজন প্রকৃষ্ট তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। শর্মি সম্পর্কে তৃণাঙ্কুরের যতটুকু কম লাগত, ততটুকু নীলিমার কারণেই ঘটছে বলে তিনি মনে করতেন।

—মা, আজ শর্মি আমার জন্য খাবার আগে অপেক্ষা করেছিল। তুমি ওকে জোর করে খাইয়ে দিয়েছ কেন?

—জোর তো করিনি। আমি বললুম, মান্তুর আসতে দেরি হচ্ছে। তোমার কি খিদে পেয়েছে শর্মি? খেয়ে নেবে? সে তো আপত্তি করেনি।

—তোমার বোঝা উচিত ছিল মা। ও আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তুমি নিজে না খেয়ে ওকে খাইয়ে দিলে। মা, আমি তো জানিই তুমি আমাকে ভালবাসো। তার জন্য তোমার খাবার টেবিলে অপেক্ষা না করলেও চলত।

—কিন্তু শর্মিকে, তোমার প্রতি ভালবাসা প্রদর্শনের জন্য অপেক্ষা করতে হত, এটাই কি তুমি বলতে চাইছ?

—ঠিক তা নয়। তুমি যখন খেলে না, ও-ও না খেতে পারত। তা ছাড়া অপেক্ষার মধ্যে একরকম আনন্দ আছে মা।

—সে তো বললেই পারত, এখন খাবে না, খেল কেন?

—তা হলে তুমি ওকে জোর করতে। তুমি যা ভাল বোঝো সেই মতোই তুমি এ বাড়ির সকলকে চালাতে চাও।

দু’দিন আগে নীলোফাকে সঙ্গে নিয়ে সুপার মার্কেট থেকে পর্দা কিনে এনেছেন নীলিমা, মান্তুর ঘরে এখন ঝকঝকে পর্দা থাকা দরকার। দু’টি গাছ রেখেছেন জানালায়। এই জানালার পেছনেই একটি আমগাছের মাথা। কোনও বৃক্ষকে ওপর থেকে দেখতে বেশ লাগে নীলিমার। যেন সেইসব বৃক্ষের সমস্ত রহস্য একবারে উন্মোচিত হয়ে যায়। তার কোনও ডালে পাখির বাসা, কোনও ডাল মঞ্জরিত হচ্ছে, কোনও ডালে বাসা বেঁধেছে ডেঁও পিঁপড়ের দল— সব বলা যেতে পারে। দীর্ঘ উন্নত, ব্যক্তিত্বশালী বৃক্ষকে তখন ছেলেমানুষ ও নির্ভরশীল দেখায়।

দরজার শব্দ হল। নীলিমা তাকালেন। ময়না ঢুকছে। ময়না তার সরল যুযুধান মুখ নিয়ে প্রশ্ন করল— আইজ দাদায় আইব?

—হ্যাঁ।

নীলিমা, অনেক সময়ই ময়নার সঙ্গে নানাবিধ গল্প করে থাকেন। ময়নার সঙ্গে তাঁর বিশেষ সখ্য গড়ে উঠেছে বলা যায়। ময়না, এত দিনের পুরনো লোক, কিছুটা সরল কিছুটা লোভী কিন্তু মনের গভীরে সে সাদাসিধে সংসারী মানুষ। নীলিমার সঙ্গে তার সখ্য হওয়া স্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু ময়নার দীর্ঘ সময়ের নানাবিধ সততা ও আনুগত্য নীলিমার মধ্যে একটি হালকা শ্রদ্ধার স্তর ও মায়া জাগিয়ে তুলেছিল। এই মাথুরের গড় ও ফটিক বিল বস্তির পাশাপাশি সহাবস্থানের মতো, পারস্পরিক অনিবার্য নির্ভরশীলতার মতো, নীলিমা ও ময়নাও এক বিশেষ সখ্য গড়ে তুলেছেন। নীলিমার কর্তৃভাব, ময়নার দাস্যভাব। তবু এই পৃথিবীতে এও এক সম্পর্ক!

ময়না চারদিক দেখতে দেখতে ঝাঁটা হাতে নিয়ে কাজ শুরু করে এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলে— কত কইরা পোলার বিয়া দিলেন। নাতনির স্যাবা করলেন। কিন্তু দ্যাখেন কপাল। বউদি আর আইবই না?

—না। কাল ওরা মিউচুয়াল ডাইভোর্সের জন্য আবেদন করেছে।

ময়না হাঁ করে আছে। কিছুই বুঝতে পারছে না। মাসিমায় খটমট ইংরাজি কয়। ময়না জানে, এ পাড়ায় মাসিমাই একমাত্র মহিলা যিনি পুরুষদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে আপিস যেতেন। ময়নারা যে-কাজ করে, সে তো আলাদা। সে-কাজ তো পেটের দায়ে, বাধ্য হয়ে করা। ময়নার বর কুঁড়ে, অলস, মদ্যপ। ময়না কাজ না করলে ছেলেমেয়েগুলোকে কে খাওয়াবে! নীলিমা একদিন হেসে বলেছিলেন— তোর সঙ্গে আমার কোনও পার্থক্য নেই রে ময়না।

ময়না হেসে গড়িয়ে পড়েছিল। বলেছিল— কী যে কন। আপনের কত ল্যাখাপড়া!

তবে ময়না দেখেছে মাসিমা মানুষটার কপাল খারাপ। মেসোমশাইকে দেখেছে। খুব খিটখিটে ছিল লোকটা। রোগ-বালাই নেই, তবু সারাদিন শুয়ে থাকত আর কারণে-অকারণে খিটমিট করত। এক-একদিন ভয়-ভয়ও করত ময়নার। একদিন মাসিমা আপিসে। দাদা কলেজে। ময়না ঘরে কাজ করছে। তখন ঘরবাড়ি এরকম ছিল না। মাসিমাদের পুরনো বাড়ি। ময়না বালতি এনে ঘর মুছছে। সমরেশ ডাকলেন— ময়না। শোন।

ময়না শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে সামনে গেল। সমরেশ কিছুক্ষণ ময়নার দিকে চেয়ে বললেন— তোর স্বামী কী করে?

—ছুতারের কাজ।

—বাঃ সে তো ভাল কাজ। ভাল পয়সাই তো পায়।

—পাইলে কী হইব। মদ খাইয়া সব উড়াইয়া দ্যায়। সংসারে কিসু দ্যায় নাকি?

—তোর ভাল শাড়ি-ব্লাউজ নেই, না?

ময়নার মুখ নিচু। কাপড় খুঁটছে। বালিশের তলা থেকে তিনটে দশ টাকার নোট বের করেন তিনি। বাড়িয়ে ধরে বলেন— তোর ব্লাউজ ছেঁড়া। হুক নেই। তুই যখন ঘর মুছিস, আমি সব দেখতে পাই। চারটে ভাল ব্লাউজ কিনে নিস্‌, কেমন?

সারা শরীর কেঁপে উঠেছিল ময়নার। ভয়ে না লজ্জায় সে জানে না। টাকা নেবার জন্য সে হাত বাড়াতে পারেনি। সমরেশ ময়নার হাত টেনে টাকা গুঁজে দিয়ে বলেছিলেন —যা। চলে যা। ওইসব দেখলে আমার কষ্ট হয়।

তিনদিন স্বস্তি পায়নি ময়না। বাড়ি ফিরে কেবলই মনে হচ্ছিল সে যেন কাকে ঠকাচ্ছে। এই টাকার কথা সে কারওকে বলতে পারেনি। কালীকে না। মনোকে না। পরদিন সে কাজে গেল না। তার পরদিনও না। অথচ, সে জানে, কাজে না গেলে খুব অসুবিধা হয় মাসিমার। কিন্তু সে, অদ্ভুত অসততার দংশনে জ্বলছিল। দু’দিন ক্রমাগত ভাববার পর সে সিদ্ধান্তে পৌঁছোয়— টাকাটা ওইখানেই ফেলে রেখে আসা উচিত ছিল তার। সমরেশ যদি-বা সহানুভূতিবশেই কিছু দিয়ে থাকেন, তবে মাসিমার সামনেই তা দিতে পারতেন। সে, এই ত্রিশ টাকার ভার বইতে পারেনি। তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় মাসিমাকে সব খুলে বলেছিল। সে-দিন, অনেকক্ষণ চুপ করে ছিলেন নীলিমা। ময়না বলেছিল— আপনে বিশ্বাস করেন। আমার কুনো দোষ নাই।

নীলিমা বলেছিলেন— আমি জানি, ময়না, শোন, কাল থেকে মান্তু কলেজে চলে গেলে তোর কাজ শেষ হোক বা না হোক তুই চলে যাবি। আবার বিকেলে ছ’টায় আসবি। পারবি না?

ময়না ঘাড় নেড়েছিল— পারুম।

সে ত্রিশ টাকা ফিরিয়ে দিয়েছিল নীলিমাকে। নীলিমা টাকাটা স্পর্শ করেননি। ময়না দেখেছে, সে যেমন রেখে গিয়েছিল তেমনই দু’দিন পড়েছিল সেটা, টেবিলের ওপর ধূপদানি চাপা দেওয়া। পরে আর দেখেনি।

আনিসুজ্জামানের দরজায় বেল দিলেন নীলিমা। ভেতরে মশলা বাটার শব্দ হচ্ছিল। নীলোফা বাড়িতে কাজের লোক রাখে না। সব কাজ একাই করে। আনিসুজ্জামান দরজা খুলে দিলেন। হাসলেন নীলিমাকে দেখে। দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়িয়ে বললেন— আসুন মাসিমা। আজ তো মান্তুদা আসছেন।

নীলিমা বসতে বসতে বললেন— হ্যাঁ। তাই এলাম। তোমার কলেজ ক’টায় শেষ আজ?

—আপনার কখন লাগবে বলুন, আমি হাজির থাকব।

—আসলে, মান্তু তো আজকাল ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না।

—হাঁটতে পারছে না! সে কি!

—হ্যাঁ। ছোটবেলায় ওর পা দু’টো কমজোরি ছিল। অনেক চিকিৎসা করে ওকে হাঁটতে শেখানো হয়েছিল। বোধহয়, আবার কিছু সমস্যা হয়েছে।

—ওঃ। এ তো খুব খারাপ হল।

নীলিমা হাসলেন। আনিসুজ্জামান দেখছেন— হাসি দিয়ে দুঃখ ঢাকছেন মাসিমা। বললেন— ভাল আর কোন দিকে হল বলো তো! কাল ওরা ডিভোর্স আপিল করল।

—ওঃ। হয়ে গেল?

—হ্যাঁ। অন্তত হয়ে যাবার কথা ছিল।

আনিসুজ্জামান বলেন— মান্তুদার হাঁটার সমস্যাটা কত দূর!

—হাঁটতে পারছে। কিন্তু পা তুলতে পা ফেলতে অসুবিধে হচ্ছে। একটু ঘষে ঘষে, ধীরে ধীরে হাঁটছে ও এখন। ও তো বিকেলে আসবে, তুমি যদি তখন থাকো। ওকে তো আমি একা সিঁড়ি ভাঙতে সাহায্য করতে পারব না।

—হ্যাঁ, মান্তুদা খুব মোটাও হয়ে গেছেন কিন্তু। ঠিক আছে মাসিমা। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি এসে যাব।

প্রায় সাতটা নাগাদ ট্যাক্সি চেপে তৃণাঙ্কুর মাথুরের গড়ে পৌঁছলেন। একটি মাত্র স্যুটকেস তাঁর সঙ্গে আর ডিকি ভর্তি বই। কেবল বই। এই ক’বছরে তিনি বি এন আর-এর বাড়িতে আরও কিছু বই-ই মাত্র সংগ্রহ করেছেন। কোনওমতে দড়ি দিয়ে বেঁধে বইগুলি এনেছেন তিনি। ট্যাক্সি দাঁড়াতে দেখে ওপর থেকে নেমে এলেন নীলিমা। ময়নাও এল পিছু পিছু। দাদা আসবে বলে সে অপেক্ষা করছিল। ওদের পেছনে আনিসুজ্জামান আর নীলোফা। ট্যাক্সির দরজা খুলে বেরোলেন তৃণাঙ্কুর। তাঁর মুখে অপ্রতিভ হাসি। বললেন— বইগুলো…

নীলোফা এগিয়ে এল। বলল— আমি আর ময়নাদি সব নিয়ে যাচ্ছি। আপনি ঘরে যান মান্তুদা।

তৃণাঙ্কুর বললেন— ভাল আছিস নীলু? অনি, তুমি ভাল আছ?

নীলোফা বলল—ভাল।

তার মুখ দেখা যায় না। কিন্তু অতি মিষ্টি ও সুরেলা কণ্ঠ হওয়ায় সব সময় মনে হয় সে অতি প্রসন্ন। সব সময় হাসছে। তৃণাঙ্কুর পা ঘষে ঘষে সিঁড়ির দিকে এগোন। নীলিমা আর আনিসুজ্জামান তাঁর দু’পাশে দাড়ান। তৃণাঙ্কুরকে সিঁড়ি দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

ছেলের ঘরে আলো নিবিয়ে বসেছিলেন নীলিমা। তৃণাঙ্কুর বাথরুমে। নীলিমা দু’টি শোবার ঘরের সঙ্গেই লাগোয়া বাথরুম করেছিলেন। ভাগ্যিস করেছিলেন, এখন মান্তুর কত সুবিধে হচ্ছে! এ ঘরের ও পাশেই আনিসুজ্জামানের ঘর। তারও বাথরুম এ বাথরুমের উল্টোদিকেই। দু’টি ফ্ল্যাট একেবারে প্রতিবিম্বের মতো করেই তৈরি করা হয়েছিল তখন। তৃণাঙ্কুর বাথরুমের দরজা খুললেন। ভেতরকার হালকা আলোয় তাঁকে অতি বিষণ্ণ দেখাচ্ছে এখন। এ ঘরে কোনও আয়না নেই। বাথরুমের ভেতরেই একটি ছোট্ট আয়না লাগানো আছে। পাশে দেওয়াল-বাক্সে দাড়ি কাটার সরঞ্জাম, চিরুনি, পাউডার— সব রেখে দিয়েছেন নীলিমা। তৃণাঙ্কুর চুল আঁচড়ে, গায়ে পাউডার দিয়ে বাথরুমের আলো নিবিয়ে এলেন। নীলিমার মনে হল, কবে, কোন যুগ আগে, এরকমই কোনও স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন। আজ যেন, সেই স্বপ্নটাই টুকরো করে বসিয়ে দিয়ে গেল সময়। হয়তো তা নয়, হয়তো, যখন তৃণাঙ্কুরের বিয়ে হয়নি, এমনি করে ছুটির সন্ধ্যাগুলোয় দু’জনে বসে গল্প করতেন। তৃণাঙ্কুর কবিতা পড়তেন। তাঁর খুব প্রিয় কবি ইয়েটস। নীলিমার মনে আছে, একটি কবিতা শুনিয়েছিলেন তৃণাঙ্কুর, সেই কবিতার বিষয় ছিল একটি বেড়াল, যে, খোলা মাঠে পড়ে থাকা অপরূপ জ্যোৎস্না গায়ে মাখছে। সে চাঁদ দেখছে। সে জানে না তার নিজস্ব চোখ চাঁদের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে। শেষ লাইনগুলো মনে আছে নীলিমার—

Does Minnaloushe know that his pupils

Will pass from change to change,

And that from round to crescent,

From crescent to round they range?

Minnaloushe creeps through the grass

Alone, important and wise,

And lifts to the changing moon

His changing eyes.

এই কবিতাটি শোনার পর থেকে বেড়ালকে আর তুচ্ছ করতে পারেননি নীলিমা। তাঁর সত্যিই মনে হয়েছে, বেড়ালেরা জ্যোৎস্নায় লুটোপুটি খায়, চাঁদ দেখে। এবং এখন, এতদিন পর তাঁর আবার মনে হচ্ছে চাঁদের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাওয়া চোখ, সে কি শুধু বেড়ালের? মানুষের নয়? মানুষ নিজেই কি জানে, নিজের অজ্ঞাতসারে তার চোখ কত বদলে যায়!

তৃণাঙ্কুর পা ঘষে ঘষে বিছানা পর্যন্ত এসে শুয়েছেন। জানালার পর্দা তোলা। বাইরের হালকা আলো ঘরে এসেছে। তৃণাঙ্কুর হাত দু’টি মাথার নীচে দিলেন। খুব অবসন্ন লাগছে। অথবা খুব শান্তিও। যেন কত বছর অক্লান্ত যুদ্ধ করার পর তিনি আজ বিশ্রাম পেয়েছেন। নীলিমার শাড়ির প্রান্ত তাঁকে স্পর্শ করছে। তৃণাঙ্কুরের বালকবেলার মতো লাগছে। তিনি বলছেন— আমার পা দু’টো ভাল হবে না মা?

—হবে।

—মা, ওরা আমাকে স্লো পয়জন করেছে জানো।

—আগেও বলেছিস তুই মান্তু। এটা কি সত্যি?

—হ্যাঁ মা। মাঝে মাঝে ঘুম হত না আমার। মাঝে মাঝে পাগুলো কমজোরি লাগত। তখন রঞ্জন ওষুধ দিত আমাকে।

—আর কোনও ডাক্তার দেখাসনি?

—না। শর্মি বলত রঞ্জন খুব ভাল ডাক্তার। ওর ওষুধ খেলেই চলবে।

—এরকম সন্দেহ কোরো না। তোমার তো পায়ে অসুবিধে ছিলই। রঞ্জনের প্রেসক্রিপশান এনেছ তো?

—না! ও তো কোনও প্রেসক্রিপশান দিত না। নিজে ওষুধ দিয়ে যেত। কখনও শর্মি আনত। মা এর চেয়ে তো ওরা আমাকে মেরে ফেলতে পারত।

—ওরা চাইলে তা করতেই পারত। আমি বুড়ো মানুষ, তোমার জন্য কিছুই করতে পারতাম না। কিন্তু ওরা তা করেনি। আমার মনে হয় তুই যা ভাবছিস তা ঠিক নয়। তোর সঙ্গে শর্মির মেলেনি অন্য কারণে। সেটা তুই বোঝার চেষ্টা কর। তোর পক্ষের দোষ নিশ্চয়ই কিছু আছে।

—মা। তুমি শর্মির হয়ে কথা বলছ!

—না! আমি নিরপেক্ষভাবে বলছি। এগারো বছর হল তোদের বিয়ে হয়েছে। এতদিন পর কেন এরকম হল?

—সময়টা কোনও কথা নয় মা। তুমি আর বাবা তো একুশ বছর পাশাপাশি ছিলে। তোমাদের সম্পর্কটাই কি কোনও দাম্পত্য ছিল?

—না। ছিল না। তখন উপায় ছিল না বলে আমি ডিভোর্স করিনি। এখনকার মেয়েরা সইবে কেন?

—তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।

—তোর মধ্যে তোর বাবার মতো কিছু ব্যাপার আছে মান্তু। তুই বড় ঘরকুনো। বইমুখী। হইহুল্লোড় করিস না। তোর মধ্যে একটা আলগা আলগা ব্যাপার আছে।

—এটুকুই মা? এটুকুই আমার স্ত্রীর আমাকে ছেড়ে চলে যাবার পক্ষে যথেষ্ট?

—না।

এতক্ষণ সমস্তই যথাযথ ছিল। এতক্ষণ নীলিমা একজন আধুনিক মানুষ, নিজস্ব বিচারবোধ বিচ্যুত করেননি, এমনকী ছেলের কথাতেও। এতক্ষণ, সমস্ত সংলাপ দু’টি মানুষের মৌলিকতা নিয়ে বিরোধ ঘটায়নি। ঘটাবে না কখনও। সচেতন নীলিমা সুচিন্তক তৃণাঙ্কুর গড়েছেন। সাম্প্রতিক পৃথিবীর চূড়ান্ত আধুনিক দু’টি মানুষ। নীলিমা যুদ্ধে ছিলেন। তৃণাঙ্কুর নীরব বিশ্লেষক সঞ্জয়, বিদুর। কিন্তু তারপরও প্রচ্ছায়ার মতো ইতিহাস লেগে থাকে। থাকে সন্দেহ সংস্কার বোধ ও অর্থহীন বিশ্বাসের আবর্জনা। একজনও তা থেকে মুক্ত নয়। তাই, মধ্যবর্তী নীরবতায় ঢুকে পড়ে কত বস্তু। ভাঙা বেড়া দিয়ে শেয়ালের ঢুকে পড়ার মতো। কিছুক্ষণ নীরবতার পর তৃণাঙ্কুর নৈঃশব্দ্য ভাঙেন। দূরত্ব ভাঙেন। কোন দূরত্ব? কার দূরত্ব? মা ও ছেলের। ছেলের ও মা’র। এ দূরত্ব সত্যিই কি থাকে কখনও? তৈরি হয়?

—তুমি জানো না মা। তোমাকে বলিনি। ও যখন এখানে ছিল তখন প্রবীরের সঙ্গে ওর একটা সম্পর্ক হয়।

—কোন প্রবীর? ওর নাচের স্কুলের সেই ছেলেটি?

—হ্যাঁ

—ইস! কী রুচি! ছেলেটি একেবারে মেয়েদের মতো ছিল। দাড়িগোঁফ না থাকলে ওকে তো ছেলে বলে ভাবাই যেত না।

—শর্মি বলত, পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে শিল্পচর্চা করলে নাকি একরকম অপ্রতিরোধ্য রোম্যান্টিক সম্পর্ক তৈরি হয়। জীবনের পক্ষে সেটা খারাপ নয়।

—ও। একই হাসপাতালে কাজ করতে গিয়েই বুঝি আবার রঞ্জনের সঙ্গে রোম্যান্টিক সম্পর্ক হল শর্মির? কিন্তু হাসপাতালের পরিবেশ কি খুব রোম্যান্টিক? খুব শিল্পসুলভ?

—প্রবীর— জানো মা, নাচ ছেড়ে দিয়েছে। শর্মির জন্য। রঞ্জন আসার পর শর্মি একদিন আর প্রবীরকে পাত্তা দিল না। আমি বুঝতে পারিনি। আমাকে বলল, প্রবীরের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় আমার প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে, এই উপলব্ধি ওর হয়েছে। একদিন বিছানায়, মা, খুব কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো আমাকে বলল। আমি বিশ্বাস করলাম। ভাবলাম বয়স বাড়ছে। বদলাচ্ছে শর্মি। প্রবীর ক’দিন খুব পাগলের মতো এল বি এন আর-এ। আমি যে ক’দিন ছিলাম, বসে থাকত, শর্মি কখন আসবে তার জন্য। শর্মি তখন স্কুলে যাচ্ছে না। একদিন প্রবীর বলে ফেলল, শর্মি আমার শ্বাসপ্রশ্বাসের মতো হয়ে গিয়েছে তৃণাঙ্কুরদা। ও পাশে না থাকলে আমার নাচ হয় না।…বেচারা প্রবীর। আমি বুঝতে পারছিলাম মা, ওর আর কোনও বোধ কাজ করছে না। আমি যে শর্মির স্বামী, আমার কাছে যে এ কথাটা বলতে নেই, তা ও ভুলে গেছে। ওর জন্য আমার করুণা হল। কিন্তু তখন একটা দারুণ প্রতিশোধস্পৃহা কাজ করছে আমার মধ্যে। এর জন্য, এই প্রবীরের জন্য কতবার আমি আহত বোধ করেছি। কত রাত্রি ঘুমোতে পারিনি। এখন ও একটু পুড়ুক। কী বোকা ছিলাম মা আমি! বুঝতে পারিনি। একটুও বুঝতে পারিনি যে আসলে তখন আমি আর প্রবীর এক সঙ্গে রয়েছি। একই সঙ্গে পুড়ছি। আমি পুড়ছি দ্বিতীয়বার। শুধু প্রবীর বুঝতে পারছে। আমি পারছি না। আমার সর্বস্ব চলে যাচ্ছে।

নীলিমা স্তব্ধ হয়ে আছেন। এত কথা, এত কষ্ট বুকের মধ্যে ধরে রেখেছিল মান্তু! নীলিমা বললেন— রঞ্জনের কথা? সে-কথা কখন জানলি?

—সন্দেহ হচ্ছিল আমার। রঞ্জন প্রায় রোজ আসত। আর ওকে দেখলেই শর্মি বদলে যেত একেবারে। একেবারে নরম, আদুরে, মিষ্টি হয়ে যেত। ওকে দেখলে তখন কে বলবে যে এই শর্মি রেগে গিয়ে থালা-বাসন ছোড়ে, গালাগালি দেয়, দেওয়ালে মাথা ঠোকে! যে-দিন রঞ্জন আসত সে-দিনগুলোয় যেন আমাকেও একটু বেশি দয়া করত শর্মি। প্রেমের কিছু সাধারণ লক্ষণ আছে মা। এপিডেমিকের মতো। সব মানুষের মধ্যেই সেগুলি ফুটে ওঠে। শর্মি যতবারই নতুন করে প্রেমে পড়ত, ততবার ওর মধ্যে ওই লক্ষণগুলি ফুটে উঠত।

একদিন ওকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম। খুব কাঁদল। বলল, তুমি আমাকে সন্দেহ করো? প্রবীরের কথা তো আমিই তোমাকে বলেছিলাম। তা কি আমি তোমার কাছে যথেষ্ট সৎ থাকতে চেয়েছিলাম বলেই নয়! আজ যখন আমি সব ফেলে তোমার কাছে থাকতে চাইছি তখন তুমি আমাকে সন্দেহ করছ। আমার পায়ে মাথা রেখে উপুড় হয়ে পড়ল। তুমি তো জানো মা, ওর কী সুন্দর চুল…। সে-দিন, খোলা চুলে, আমার পায়ে মুখ রেখে ও কাঁদছে, ওর চুলে আমার পা ঢেকে যাচ্ছে। আমি নিশ্চিন্ত হয়ে গেলাম। ক’দিন নিজেকে খুব সুখী ও সফল লাগল। কলেজ থেকে ফিরে কোথাও যেতে আমার ভাল লাগত না। একদিন তবু শর্মি আর মিষ্টুকে নিয়ে অ্যাকাডেমিতে নাটক দেখলাম। চিড়িয়াখানায় গেলাম। শর্মি সারাক্ষণ তোমার নিন্দে করত। আমি শুনতাম। প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে করত। কিন্তু ভয় করত। প্রতিবাদ করলে যদি ও আবার বদলে যায়। আমার সুখের জন্য তোমাকে আমি তখন প্রতিদিন বলি দিয়েছি মা।

নীলিমার চোখে জল আসছে। কিন্তু সেই জল তিনি ছেলের কাছে লুকোতে চাইছেন। কেন এই কান্না? ছেলের সংসার ভেঙেছে সে তো কষ্টেরই। কিন্তু অল্প অল্প করে শুনতে শুনতে মনকে তিনি বেঁধে ফেলেছিলেন। তবু আজ খুব কান্না পাচ্ছে। তৃণাঙ্কুর বলছেন— একদিন কলেজ থেকে ফিরে দেখি শর্মি নেই। সাধারণত ওই সময় ও ফিরে আসত। মিষ্টু ওর টিচারের কাছে পড়ছিল। বলল— মা তো রঞ্জনকাকুর বাড়ি গেছে।

শর্মি মাঝে মাঝে রঞ্জনের বাড়ি যেত। আমি আপত্তি করলে বলত— তোমরা বড্ড সেকেলে। টিপিক্যাল উত্তর কলকাতার মানসিকতা। ছেলেটা একা থাকে। মাঝে মাঝে গিয়ে একটু সাহায্য করলে কী হয়!…আমাকে কিন্তু কোনও দিন যেতে বলেনি ওরা। আমিও ভদ্রতাবশত কথাটা কোনওদিন তুলিনি। সে-দিন আমি আসার পর পরই মিষ্টুর টিচার চলে গেল। তার পড়ানো হয়ে গিয়েছিল। মিষ্টুকে একা রেখে যেতে পারছিল না। টিচার চলে যেতে মিষ্টু এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলল— ‘জানো বাবা, আজ না একটা জিনিস দেখে ফেলেছি।’ কী দেখেছিস— আমি জানতে চাইলাম। খুব ছোট তো নয় এখন। বলল, ‘তুমি মাকে বলে দেবে না তো?’ বলব না। আমি বললাম। মিষ্টু বলল— ‘রঞ্জনকাকু আজ মাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছিল।’ আমি ঘামছিলাম মা আমার গলা শুকিয়ে গেছিল। তবু, মিষ্টুকে বললাম, তাতে কী হয়েছে মিষ্টু! আমিও তো তোমাকে চুমু খাই। ও বলল, ‘বা রে। তুমি কি লুকিয়ে খাও? রঞ্জনকাকু তো লুকিয়ে খাচ্ছিল। আমি স্পষ্ট শুনেছি কাকু বলছে— ‘আর পারছি না এ বার তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাব।’ মা বলল—‘চুপ মিষ্টু আছে।’ কাকু বলল— ‘মিষ্টু ঘুমোচ্ছে। তা ছাড়া ওরও জানা দরকার।’ কী জানা দরকার? কী? ওরা কি বিয়ে করতে চায়? তখন আমার পায়ে সমস্যাটা দেখা দিয়েছে। আমার ভয় করল। ওরা কি আমাকে মেরে ফেলবে? আমি মরে গেলে আর ওদের সামনে কোনও বাধা নেই। মিষ্টুর কথা আমি রাখতে পারিনি। সরাসরি শর্মিকে বলেছিলাম। না হলে ও হয়তো আবার আমার পায়ে পড়ে যেত। আবার আমি ওর ঘন কালো চুল দেখে বা বড় বড় চোখ ভর্তি জল দেখে ভুলে যেতাম। শর্মি অস্বীকার করেনি। বলেছিল রঞ্জন ওকে বিয়ে করতে চায়। তখন ডিভোর্সের প্রস্তাব আমিই ওকে দিই।

—শর্মি এক কথায় মেনে নিল?

—না। কাঁদল। বলল, ‘রঞ্জনকে ছেড়ে দেব। তুমি ডিভোর্স কোরো না।’ কিন্তু আর আমি বিশ্বাস করিনি মা। বিয়ের আগেও ওর প্রতাপদা বলে একজন ছিল। প্রতাপ। প্রবীর। রঞ্জন। আমি কি হাতের পাঁচ? বোধহয় একাধিক পুরুষ ছাড়া ও থাকতে পারে না। হ্যাঁ। আমি চুপচাপ। ঘরকুনো। কিন্তু আমি তো পাগল নই। অক্ষম নই। বাবার সঙ্গে আমার তুলনা কোরো না তুমি।

বিছানা ছেড়ে নামলেন নীলিমা। খাবারগুলো গরম করতে হবে। শারীরিক অসুস্থতার জন্য ছুটি নিয়েছেন তৃণাঙ্কুর। নীলিমা হিসেব করলেন। তিন মাস সময় আছে। কাল একবার মল্লিনাথের কাছে গিয়ে পরামর্শ করে মান্তুকে ডাক্তার দেখিয়ে নেবেন।

২২

মল্লিনাথের দিকে চিঠি এগিয়ে দিচ্ছে কমলেন্দু। মল্লিনাথ পড়ছেন।

ভাই।

আজকাল একটা লোক আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। যখন-তখন আমি তাকে দেখতে পাই রাস্তায়। মাঠে। ছাদের কোনায়। বেঁটে আর গোল গোল চেহারা। ছোট ছোট করে ছাঁটা মাথার চুল। খোলা গায়ে ঝকঝকে পৈতে। হাঁটু পর্যন্ত ধুতি পরা। সে-লোকটা আমার দিকে কখনও সোজাসুজি তাকায় না। আমি জানি। লোকটার নাম রূপচাঁদ। আমাকে কেউ বলে দেয়নি। কিন্তু ও এলেই আমি বুঝতে পারি এ রূপচাঁদ।

অনেকদিন আগে আমার এক ক্লাশমেট অভিষেক আমাকে একজন জ্যোতিষের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। জ্যোতিষে আমার বিশ্বাস ছিল না। কিন্তু অভিষেক বলেছিল, ওই জ্যোতিষ, ক্ষতিমোহন, যিনি একদা ভূগোলের শিক্ষক ছিলেন, কোনও ভ্রান্ত গণনা করেন না। আমি দেখতে গিয়েছিলাম তিনি কতখানি অভ্রান্ত। আমি অবাক হয়েছিলাম। আর তার কারণ আমার জন্ম সময় গুণে ছবিচার করে তিনি প্রথমেই বলেছিলেন—তোমার মাতৃস্থান কুদৃষ্টিপূর্ণ। তাঁর মস্তিষ্কবিকৃতি আছে।’

সে-দিন ছক বিচার করতে করতে কিছুদূর গিয়ে বিচার বন্ধ করে দিয়েছিলেন উনি। শুধু বলেছিলেন—তোমাকে বলি, চার বছর পর শনি তোমার কাছে নেমে আসছেন।

আমি হাসছিলাম। শনি নেমে এলে মহাকর্ষ ওলোট-পালোট হয়ে যাবে যে!

উনি ধমকে বলেছিলেন—হেসো না। যা বলছি তা শোনো। শনি তোমার কাছে নেমে আসবেন। কোনও পূর্বপুরুষকে স্বপ্নে পাবে তুমি। বার বার পাবে। জেনো, সে-তোমার কঠিন সময়। তোমাকে অতি সাবধানে থাকতে হবে। তুমি এখন থেকেই শনিবার উপবাস করো। যে কোনও শনি মন্দিরে পুজো দাও। আর একটি কাজ অবশ্যই কোরো। কোনও শনিবার একটি লোহার কড়াই কিনে সেটি কোনও সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণকে দান কোরো। আর মনে রেখো, ঊনিশশো সাতাত্তর সালের দশই মার্চ—সে-পর্যন্ত তোমার কঠিন সময়।

আমি তখনকার মতো ভুলে গিয়েছিলাম। উপোসও করিনি, পুজোও দিইনি। হ্যাঁ, মায়ের কথা উনি ঠিকই বলেছিলেন বটে। কিন্তু তাতে কিছু প্রমাণ হয় না, পরে আমার এমনই মনে হয়েছিল। কিন্তু আজকাল রূপচাঁদকে আমি দেখতে পাচ্ছি। অর্থাৎ এই আমার কঠিন সময়। আমি জানি, দশই মার্চ, ঊনিশশো সাতাত্তর, আমি মারা যাব। কীভাবে জানলাম? কে জানে? আমার মনে হয়। আমার আয়ুরেখা ফুরিয়ে গেছে। এ জন্য জ্যোতিষের দরকার হয় না। ডাক্তারিশাস্ত্র আমি যতটুকু পড়েছি, তাতে বুঝতে পারি, আমার নেশা করা বিকল কলকব্জাগুলো আমায় আর বইতে পারছে না। আমায় যেতে হবে।

আমার বাঁচতে ইচ্ছেও করে না। আমি পড়া ছেড়ে দিয়েছি তার কারণ আমি দেখতে পাচ্ছিলাম বাবার জীবনটা আমার জীবনে ঢুকে পড়ছে। আমি ক্রমশ বাবা হয়ে যাচ্ছি। শুধু আমাদের শরীরটা আলাদা। আমিও ডাক্তার হতে চলেছি। বাড়ির বড় ছেলে হিসেবে ওই পূজা আমার ওপর বর্তাবে। আমিও সারাদিন রোগী দেখে, সারারাত কালীর আরাধনা করব। আমি সংযম পালন করব আর আমার স্ত্রী, কষ্ট পেতে পেতে, যন্ত্রণা পেতে পেতে ভুলে যাবে কেন তার জন্ম হয়েছিল। হ্যাঁ, আমার জ্যেষ্ঠ সন্তান থাকতেই হবে, তাকে পুত্রই হতে হবে, না হলে এই পূজার দায়িত্ব আমি কাকে দিয়ে যাব।

তুই জানিস না, কিন্তু আমি জানি, কারণ, আমার তখন বোঝার বুদ্ধি ছিল না কিন্তু দেখার বুদ্ধি ছিল। আর যা-কিছুই আমি দেখতাম, শুনতাম, তুই জানিস, আমি ভুলিনি। মেমোরি নিয়ে খেলতে খেলতে তুই বরাবর হেরে গেছিস আমার কাছে। ভাই, আমি জানি, আমাদের মায়ের মস্তিষ্কবিকৃতির কারণ আমাদের বাবা। আমাদের মা তাঁর কাছে পুরুষ প্রার্থনা করলে রাতের পর রাত তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। আমার মনে আছে, মা কাঁদছেন, বাবা বলছেন—মাগী, না ঢোকালে ঘুম আসে না, না? লোহার শিক গরম করে… আমার রাগ হত। মা যা চাইছেন বাবা কেন তা দিয়ে দিচ্ছেন না। আমি যা চাই, তাই তো তিনি দিয়েছেন। পরে, যে-দিন বুঝতে শিখলাম, কী চাইতেন মা, আর বাবা দিতেন না। বলতেন—মাসি… বলতেন—বুঝতে পারছ না, পূজার জন্য আমাকে সংযত থাকতে হবে। স্ত্রীসঙ্গ ছাড়তে হবে…আমার বাবার ওপর ঘেন্না হল। আমার ভয় করতে শুরু করল। ওই পূজা আমার ওপর চেপে বসবে। আমি সারাদিন পরিশীলিত মুখে রোগী দেখব বাবার মতো, সারা পাড়ার লোককে উপদেশ-নির্দেশ দেব, গরিবকে সাহায্য করব আর ভালমানুষ সাজব আর রাত্রে সমস্ত রুচি ও শিক্ষা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে আমার আদি অন্ধ মানুষ, বাবার মতো, আমিও আমার বউকে বলব…।

আমি বাবাকে ঘেন্না করি। রূপচাঁদকে ঘেন্না করি। আমি কালীর ওই মূর্তিকে ঘেন্না করি। ওর ওই মুণ্ডমালায় আমি রূপচাঁদকে দেখি, বাবাকে দেখি, এমনকী… এমনকী… আমাকেও দেখতে পাই। সব সময় মনে হয় ও কাঁচা মাংস এইমাত্র চিবিয়ে খেয়েছে আর মুখে সেই রক্ত লেগে আছে।

আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। আমি চলে যাব। যেখানে যাব সেখানে কোন কালী আমায় গ্রাস করবে আমি জানি না। তোকে সাবধান করে গেলাম, এই পূজার ভার কিছুতেই নিস না তুই। মরে যাবি।

ইতি

দাদা

২৮শে ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭

মাথুরের গড় অ্যাথলেটিক ক্লাবের

হেরোইন আড্ডা থেকে

আঠাশে ফেব্রুয়ারি। অমলেন্দুর চুড়ান্ত অসুস্থতার ঠিক আগের দিন লেখা চিঠি। মল্লিনাথের মাথার চুল খসে পড়ছে। রক্ত-মাংস-ত্বক গলে পড়ছে। তিনি স্তব্ধ ও নিঃশেষিত হয়ে আছেন। অজস্র ছবি ও প্রশ্ন। অজস্র আত্মধিক্কার। হ্যাঁ, এটা সত্যি তিনি মাধবীকে নোংরা কুৎসিত ভাষায় গালাগালি করেছেন। মেরেছেন। একাধিক দিন। তাঁর সংযম অনিবার্য ছিল। রূপচাঁদ স্বপ্নে শাসন করতেন। কিন্তু মাধবী শুনতেন না। তিনি প্রবল ছিলেন। বারণ করা সত্ত্বেও তাঁর চাহিদা প্রবল হয়ে উঠত। কিন্তু মল্লিনাথের লিঙ্গোত্থান হতো না। ওই কাঠামো পাবার পর যতদিন স্ত্রী-সঙ্গম করেছেন ততদিন কঠিন মুখে এসেছেন ওই পুরুষ। হেঁটো ধুতি পরা, খালি গা, গায়ে ঝকঝকে পৈতে। মাথায় ছোট ছোট করে ছাঁটা চুল। কোনও কথা বলেন না। শুধু স্থির চোখে চেয়ে থাকেন। ওই পুরুষকে মল্লিনাথ চেনেন। তিনি রূপচাঁদ। তিনিই পরিবারে পূজার প্রচলন করেছিলেন। স্বপ্নে এই কালীকাঠামোর সন্ধান তিনি পান। ব্রহ্মচারী ছিলেন তিনি। যোগী ছিলেন। তেজী ও নিয়মনিষ্ঠ, তাঁর কোনও ছবি এ বাড়িতে নেই। অমলেন্দু তাঁকে কেমন করে চিনতে পারল! হয়তো মল্লিনাথ কখনও রূপচাঁদের গল্প তাকে করেছিলেন আর সে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তাঁকে প্রত্যক্ষ করেছে। কিংবা, কে জানে, রূপচাঁদ সত্যিই এই উত্তরপুরুষকে দেখা দিয়েছেন কি না।

কমলেন্দু বাবার মুখোমুখি বসে আছে। শান্ত। নীরব। অমলেন্দু রাত্রি তিনটে নাগাদ মারা গিয়েছিল। আর সে-দিনই রাত তিনটেয় কমলেন্দুর বন্ধ দরজায় ধাক্কা মেরেছিল কেউ। কিন্তু কমলেন্দু দরজা খুলে কারওকে দেখতে পায়নি। সে-দিন, তার মনে আছে, সে ঘুমোয়নি, কারণ পরদিন তার পরীক্ষা শুরু হতে চলেছিল। আর সে রাত্রি জেগে নোট দেখছিল। সত্যিই কি অমলেন্দুর আত্মা এসে করাঘাত করে গিয়েছিল দরজায়?

ঈশ্বর বা আত্মা সম্পর্কে কোনও নির্দিষ্ট ধারণা নেই কমলেন্দুর। জ্ঞান হওয়া অবধি সে দেখেছে তার বাবা প্রত্যেক অমাবস্যায় নিয়মনিষ্ঠ ও গম্ভীর হয়ে যান। শ্রীকান্ত কাকা এসে পুজো করেন এবং বাবা সেই পুজোর সামনে টান টান হয়ে বসে থাকেন যতক্ষণ না তা শেষ হয়। এ সব দেখতে দেখতে, কমলেন্দু, সুখে-দুঃখে মা কালীকেই স্মরণ করেছে এতকাল। সে জানে, যদি সে মুসলমান হত বা খ্রিস্টান তবে আল্লা বা যিশুর নামে প্রার্থনা করত। মানুষ নিজের বোঝা বইবার শক্তি চেয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে। ঈশ্বর থাকুন আর নাই থাকুন, এর একটা শুভ দিক আছে। ঈশ্বর নির্ভরতা মানুষকে খানিকটা ঘটনা নিরপেক্ষ করে। উদ্বেগ প্রশমিত করে। কিন্তু এখন কমলেন্দু বিভ্রান্ত বোধ করছে। দাদার মৃত্যু, দাদার অভিজ্ঞতা, মৃত্যুর সময় সম্পর্কে, বাবার আচরণ সম্পর্কে এবং রূপচাঁদ সম্পর্কেও তার ধারণা এক ধরণের অতিপ্রাকৃতিকতার মুখোমুখি তাকে টেনে এনেছে যা সে বিশ্বাস করতে চাইছে না। অথচ এই অদ্ভুত ঘটনা প্রবাহে সে, দাদার জন্য যথাযথ শোক পালনও করতে পারছে না। সে জানতে চায়। বুঝতে চায়। মল্লিনাথের কাছে তার বহু প্রশ্ন আছে। দাদা যাঁকে যেখানে সেখানে দেখতে পেত সেই লোকটি সত্যি যদি রূপচাঁদ হয়ে থাকেন তাহলে কোন স্বার্থে তিনি বংশানুক্রমিক তাড়া করে বেড়াচ্ছেন? একজন মেডিক্যাল স্টুডেন্ট হয়েও অমলেন্দু এ চাপ সহ্য করতে পারেনি। কমলেন্দু প্রযুক্তিবিদ হয়েও এ চাপ নিতে পারছে না। তার চোখের সামনে তার চির-চেনা বাবা কীরকম বদলে যাচ্ছেন। কমলেন্দুর মনে হয় মল্লিনাথের মুখ হঠাৎ ছুঁচলো হয়ে উঠল। ক্রমে দুটি শাণিত কুটিল চোখ বেরিয়ে এল। বড় বড় কান। তীক্ষ্ম দাঁত। রোমশ হিংস্র শরীর। মল্লিনাথ নেকড়ে হয়ে গেলেন৷ কৃষ্ণবিদ্যাঅধিত লাইকানথ্রপির মতো পশু হয়ে গেলেন তিনি। কমলেন্দু অসুস্থ বোধ করে। সে মল্লিনাথকে বলে—তুমি কি কালও পুজো করবে?

মল্লিনাথ বলেন—হ্যাঁ। করব। শশাকের সঙ্গে পূজার কোনও বিরোধ নেই।

—দাদার চিঠির কথাগুলো কি সত্যি?

—কোন কথা?

—মাকে মারতে তুমি? খারাপ গালাগালি দিয়েছ? তোমার জন্যই মা…

মল্লিনাথের মুখচোখ কঠিন দেখায়। বুঝি-বা রূপচাঁদের মতোই লাগে তাঁকে। আকারে-প্রকারে নয়, কিন্তু অভিব্যক্তিতে লাগে। তিনি বলেন—তোমার মা সংযম বুঝতেন না। তোমরা দু’সন্তান আসার পরও তার প্রবল কামবোধ ছিল। আমি তাঁকে সংযম অভ্যাস করতে বলেছিলাম। মেয়েরা মা হয়ে গেলে সংযমই তাঁদের মানায়। তিনি কোনও দিন সংযম বিষয়ে চেষ্টা করেননি। কিন্তু পূজার জন্য আমাকে তা পালন করতে হতো। তাঁর শারীরিক আকর্ষণ বেশি ছিল। জীবনকে তিনি শরীরে চিনেছিলেন।

তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই কমলেন্দু বলে—আর তুমি জীবনকে অক্ষর ধরে জেনেছ! মা যা চাইতেন সেটাই স্বাভাবিক ছিল বাবা। সেটাই সংসার ধর্ম। আমাকে তুমি রূপচাঁদের গল্প শুনিয়ো না। একটা কথা স্পষ্ট বলে দিই তোমাকে, ওই পুজোর ভার আমার ওপর চাপিয়ো না। যে-পুজো মানুষের কল্যাণ করে না সে-পুজো করে লাভ কী?

মল্লিনাথের সন্ত্রস্ত কণ্ঠ শোনা যায়। তিনি বলতে থাকেন— শোনো, ওরকম বলতে নেই।

—কী বলতে নেই? কেন?

—সে শুনতে পায়। রাগ করে। সে সর্বনাশ করতে পারে।

—কে শুনতে পায়? কে? সর্বনাশের আর কী বাকি আছে বাবা?

—রূপচাঁদ শুনতে পায়। স্বপ্নে ভয় দেখায় আমাকে।

—পুজোটা কাকে করো তুমি বাবা? কালীকে, না রূপচাঁদকে?

—শোন, কমল, সে-পূজার ঐতিহ্য শোন। রূপচাঁদদাদু স্বপ্নে দেবীকে পান।

—আমি জানি, উত্তরের ভিটে খুঁড়ে দেবীর কীসব পেয়েছিলেন তিনি!

—হ্যাঁ। দেবী তিনদিন স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলেন রূপচাঁদদাদুকে। ভিটে খুঁড়ে পাওয়া গিয়েছিল এই কাঠামো। এর চারপাশে তামার শঙ্খলাগা সাপ জড়ানো কাঠের টুকরো। তার কাঠ পচে গিয়েছিল। নতুন কাঠের ওপর ওই তামার সাপ লাগিয়ে আবার কাঠামো প্রস্তুত হয়। দক্ষিণেশ্বরে, তোদের জন্মেরও আগে, ওই কাঠামোই আমি ভেসে আসতে দেখেছিলাম। দেখেই চিনতে পেরেছিলাম আমি আবার তুলে এনেছিলাম কারণ ওই কাঠামোর সঙ্গে অভিশাপ লেগে ছিল।

—অভিশাপ লেগে ছিল তো তুলে আনলে কেন? ভাসিয়ে দিলেই পারতে!

—দেশ ছেড়ে আমরা যখন কলকাতায় আসি তখন রূপচাঁদদাদুর বয়স আশী। ভিটে ছেড়ে তিনি আসতে চাননি কিন্তু বাবাকে বলেছিলেন ওই কাঠামো সঙ্গে নিতে। পূজার ভার গ্রহণ করতে। বাবা রাজি হননি। রূপচাঁদদাদু বলেছিলেন—নিলি না তো! ছ’মাসের মধ্যে মা তোকে টেনে নেবে। ছ’মাসের মধ্যে, রূপচাঁদদাদুরও মৃত্যুর আগে চলে গিয়েছিলেন বাবা, গঙ্গায় নাইতে নেবেছিলেন, আর ওঠেননি।

কমলেন্দুর হাত-পা শিরশির করে। অজানিত ভয়ে মন আচ্ছন্ন হয়ে যায়। তবু, একটি প্রতিরোধ নিজের ওপর জারি রাখে সে। বলে—আমি এ সব মানি না বাবা। দাদা কোনও অপরাধ করেনি। ওকে কেন মরে যেতে হল? ওই কাঠামো যে তোমারই তা তুমি কেমন করে জানলে?

—ও জিনিস আর হয় না। ওটা স্বপ্নে পাওয়া ছিল।

—কেন হয় না? স্বপ্নে তো আর কেউ পেতে পারেন। স্বপ্ন ছাড়াই কেউ বানাতে পারেন ওরকম কিছু। ওই কাঠামো যে রূপচাঁদদাদুই বানিয়ে ঢিবির নীচে পুঁতে রাখেননি তা কে বলতে পারে! প্রাচীন কাঠামো হলে ওই কাঠের অস্তিত্বই থাকত না। বাবা, যথেষ্ট হয়েছে এ সব। আজ আর পুজো-টুজো বন্ধ করো। দাদার জন্য কষ্ট হয় না তোমার? দুঃখ হয় না? ঈশ্বর যদি জিতক্রোধ না হবেন, পরম আশীর্বাদক না হবেন তবে তাঁর অস্তিত্ব রেখে কী লাভ! তুমি শেখাতে—এটা কোরো না, ওটা কোরো না—ঠাকুর পাপ নেবেন। কেন নেবেন বাবা? কেন আমাদের ভয় দেখাতে তুমি? যদি বলতে—ঠাকুর কষ্ট পাবেন, তাহলেও বুঝতাম। যে-দিন তুমি পুজো করতে সারা বাড়ি থমথম করত। যেন কী এক কঠিন কাজ চলছে! এই কাঠিন্য কেন! উদ্বেগ কেন?

—শক্তির স্বীকৃতি। সারা বিশ্ব-জগৎ যে নিয়ন্ত্রণ করছে, তার কাছে প্রণত থাকা।

চমৎকার। যাঁর কাজ এই মহাসৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ, যিনি এতখানিই শক্তিধর, তিনিই অসহায়, অক্ষম মানুষের ওপর হিংসা ও ক্রোধ ছড়াচ্ছেন। তা হলে আর একটা সুদখোর, জোতদার, পুলিশ বা হিটলারের সঙ্গে ভগবানের পার্থক্য কী? ভয় পাবার এত কিছু মানুষের জন্য মজুত আছে যে ঈশ্বর স্বয়ং, ত্রাতার ভূমিকা নিরপেক্ষভাবে পালন না করলে একদিন এই পৃথিবী থেকে উধাও হয়ে যাবেন।

—চুপ! একদম চুপ করো! তুমি নাস্তিকের মতো কথা বলছ। এই পরিবারের ছেলে হয়ে তুমি ঈশ্বর সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করছ।

—ঈশ্বর সম্পর্কে সন্দেহ প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে আছে। তোমারও আছে। কেবল তুমি তা স্বীকার করো না। বলতে পারবে তুমি, দেখাতে পারবে, ঈশ্বর সংশয়াতীত? ঈশ্বর দর্শনের ঊর্ধ্বে, কারণ তিনি কল্পিত। মানুষ স্বীকার করলে তিনি আছেন, নইলে নেই।

—ছি ছি। মূর্খের মতো কথা বোলো না। পুরাণ পড়ো। বেদ, উপনিষদ পড়ো। ও সবের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ পড়ো।

—সেগুলোও মানুষের তৈরি বাবা। সেগুলোও তর্কাতীত নয়।

—তুমি হিন্দুত্ববিরোধী কথা বলছ। ওইসব পার্টিবাজদের মতো কথা বলছ।

—বলছি, কারণ আমার মনেই থাকে না আমি হিন্দু। মনে পড়ে যখন কোনও ফর্ম ফিল আপ করি, আর আমাকে রিলিজিয়ন লিখতে হয়, তখন। কিন্তু সে অর্থে, আমি মনে করি, মনুষ্যত্ব ছাড়া আমার কোনও ধর্ম নেই। একজন স্বাধীন, সজ্ঞান মানুষ জন্মগতভাবে ধর্ম বহন করবে কেন! জন্মের পর থেকেই আমাদের ওপর ধর্মীয় আচার-আচরণ প্রয়োগ করা হয়। কিছু না বুঝেই আমরা সব পালন করতে শিখি। এটা একধরনের জবরদস্তি। চাপিয়ে দেওয়া বিশ্বাস। অর্থাৎ শুরুতেই একজনের স্বতঃস্ফুর্ত বিকাশের ডানাগুলো ছেঁটে ফেলা হল। আমি জানি না আমি হিন্দু কি না। কিন্তু আমি হিন্দু হয়ে গেলাম।

—তোমার সঙ্গে কথা বলার আর কোনও অধিকার নেই আমার। প্রবৃত্তিও নেই। সম্ভবত, তোমার নাম কমলেন্দুই হবে কি না বা আমি মল্লিনাথ, আমার পরিচয় তুমি গ্রহণ করবে কি না, এটা জানার জন্যও আমার, তোমার বড় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত ছিল। যে-কথা তুমি আজ আমাকে বললে সে-কথা আমি অন্তত আমার পিতাকে বলতে পারতাম না।

—যথেষ্ট হয়েছে। আমি বুঝতে পারছি। দাদার প্রত্যেকটি উপলব্ধি কত যথাযথ ছিল। দাদা যখন মারা যাচ্ছে, বাবা, তুমি তখন ডাক্তার হয়ে তা বুঝতে পারোনি, এ আমি বিশ্বাস করি না। অথচ তুমি ওর পাশে না থেকে, ডাক্তার হিসেবে বা বাবা হিসেবেও না থেকে, তুমি কালী সাধনা করতে বসেছিলে। তুমি উন্মাদ। নিষ্ঠুর। এখনও এক মাস হল না ও গেছে। তুমি কিছুমাত্র শোকসন্তপ্ত নও। ভালবাসার ক্ষমতাই তোমার নেই। কিন্তু… কিন্তু… বাবা, তুমি কি এরকমই ছিলে? এরকমই? যখন আমাদের হাঁদা-ভোঁদার গল্প পড়ে শোনাতে? অ্যালিস ইন ওয়াণ্ডারল্যান্ড বাংলা করে বলতে? বাবা—তুমি এরকম কেন হয়ে গেলে?

কমলেন্দু দু’হাতে মুখ ঢাকছে। দাদার জন্য যে-বেদনা, বাবার জন্য যে-কষ্ট, যে-আবেগ সে ধরে রেখেছিল, তার স্ফুরণ ঘটছে। কিন্তু মল্লিনাথ গম্ভীর। হয়তো সত্যি কোনও কষ্ট, কোনও আবেগ তাঁকে স্পর্শ করছে না। কারণ তিনি মুখের রেখাগুলি কঠিন রাখতে সক্ষম হয়েছেন। হয়তো তিনি বিপন্নও কারণ তাঁর স্মৃতি কাজ করছে না। তিনি বুঝতে পারছেন না তাঁকে অ্যামনেসিয়া আক্রমণ করেছে কি না। অনেকদিন পর আজ তিনি চেম্বারে বসেছিলেন। রোগীর ভিড় ছিল। কিন্তু নিদান দিতে গিয়ে ওষুধের নামগুলো ঠিক মনে করতে পারছিলেন না। আগে তাঁর কখনও এরকম হয়নি। মল্লিনাথ একই সঙ্গে কমলেন্দুর কথা, অমলেন্দুর কথা, মাধবীর কথা, রূপচাঁদ ও পূজার কথা এবং রোগী ও ওষুধের কথা ভাবতে লাগলেন। বললেন— তোমাকে আমি কিছুই জোর করে দিতে চাইব না। অমলকেও দিতাম না। হ্যাঁ, পরিবারের ইতিহাস তোমরা গল্পে গল্পে শুনেছ। এই কাঠামো ভেসে আসার কথা বললাম। আমার মনে হয়েছে, আমি পূজা নিয়েছি। বলি দিই না। কিন্তু অন্য সব অনুষঙ্গ পালন করি। রূপচাঁদদাদুরও এমনই বিধান ছিল। তোমার ধারাবাহিকতা রাখতে ইচ্ছে করে ভাল, না হলে, আমার সঙ্গেই সব শেষ হয়ে যাবে।

—না। শেষ হবে না। কারণ আমার পেছনে রূপচাঁদদাদুর দুঃস্বপ্ন রেখে যাবে তুমি। আমি কোনও দায়িত্ব নেব না। এ পুজো তুমি নিয়েছ, তোমাকেই বন্ধ করতে হবে। কাল তুমি পুজো করবে না।

—না। আমাকে বাধা দিয়ো না। পূজা আমাকে করতেই হবে।

—হ্যাঁ, আমারই ভুল। তুমি তো পুজোই করবে। আর বাড়ির লোকগুলো মরে যাবে, পাগল হয়ে যাবে, পালিয়ে যাবে। তোমার তাতে কিছুই যায় আসে না। মাকে সারানোর জন্য তুমি কখনও ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছ? কোনও সাকিয়াট্রিস্ট বা নিউরোলজিস্টের কাছে? ভেবেছ যে মাকে স্বাভাবিক করে তোলা যায়?

—তোমার মায়ের এ পাগলামি সারবার নয়। ডাক্তারিটা আমার পেশা। আমি জানি।

—আমি মাকে চিকিৎসা করাতে চাই বাবা।

—কোথায়?

—কানপুরে। আমি মাকে কানপুরে নিয়ে যাব।

—মাকে রাখবে কোথায়? হস্টেলে?

—না। ফ্ল্যাটে। আমাদের ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ হয়েছিল। ইন্ডা পেট্রল আমাকে একটা অফার দিয়েছে। ভেবেছিলাম এখুনি চাকরিতে ঢুকব না। কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্ত বদলাচ্ছি। আমি মাকে নিয়ে যাব। ওরা আমাকে থাকার জন্য একটা ফ্ল্যাট দেবে।

—বেশ। তোমার মা যদি যেতে চান, যাবেন।

—মা যাবেন।

—কথা হয়ে গেছে?

—হ্যাঁ।

—তোমার মা যাবেন বললেন?

—হ্যাঁ।

—কিন্তু তিনি তো গত আটাশ বছরে এ বাড়ি ছাড়া কোথাও কাটাননি।

—সেটা তো তোমার ভাববার কথা ছিল।

মল্লিনাথ আর কথা বাড়ান না। টান টান হয়ে সোফায় শুয়ে পড়েন। মল্লিনাথের বাড়ির জন্যই রাত্রি নিজেকে আরও গভীর, নিশ্ছিদ্র ও প্রলম্বিত করে। দেওয়ালের সব টিকটিকি নিজেদের অনিশ্চিত প্রাণ সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করে এবং খিদের তাড়নায় লক্ষ্য রাখে পতঙ্গদের উড়ানে। কমলেন্দু, অমলেন্দুর ঘরে যায়। এ ঘরেই অমলেন্দু মারা গিয়েছিল। শূন্য খাট পড়ে আছে এখন। অমলেন্দুকে তার তোশকও দিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে নগ্ন হয়ে আছে খাট। নিষ্প্রাণ। ধূলিমলিন। দেওয়ালের আলমারিতে অমলেন্দুর বই। স্কুলে পেত আর সাজিয়ে রাখত এখানে। কমলেন্দু বইগুলোর দিকে চাইল। চিঠির কথা তার মনে পড়ল। জ্যোতিষ ক্ষিতীন্দ্রমোহন কি সত্যিই বুঝেছিলেন দাদার আয়ু নেই? সত্যি কি রূপচাঁদকে দেখতে পেত দাদা? নাকি বহুবার শোনা গল্প ও নেশাগ্রস্ত মস্তিষ্কে ঢুকে পড়া ভয় ও ঘৃণা মিলেমিশে দাদার সামনে তৈরি করত একটি জটিল ভ্রান্তি! কেউ কি বিশ্বাস করবে, এ সব হয়? কমলেন্দু দেওয়ালের দিকে তাকায়। দু’জনের ছোটবেলার ফটোগ্রাফ। বাঁধানো। অমলেন্দু হাসছে। কমলেন্দুর পিঠে হাত। কবে তোলা হয়েছিল ছবিটা? মনে করার চেষ্টা করল কমলেন্দু। এবং টের পেল, পিঠে আলতো করে হাত রেখেছে কেউ। আস্তে আস্তে স্নেহের চাপড় মারছে। কাঠ হয়ে গেল সে। সারা শরীর শির শির করতে লাগল। অদ্ভুত ভয় কিংবা কোনও অজানিত অনুভূতিতে ঘুরে দেখার শক্তিও হারিয়ে ফেলল সে। এক ঝলক হাওয়া পর্দা উড়িয়ে দিল। মাধবী ডাকলেন—কমল। এতক্ষণে মুখ ঘোরাতে পারল কমলেন্দু। মাধবী দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। কমলেন্দু ভেবে পেল না, মা-ই তার পিঠে হাত ছুঁইয়ে আবার দূরে চলে গেছেন কি না। সে এগিয়ে এল। মাধবী ফিস ফিস করে বললেন—আলো নিবিয়ে চলে আয়।

আলো নিবিয়ে বেরিয়ে এল কমলেন্দু। মায়ের পাশে দাঁড়াল। মাধবী বললেন—আলো সইতে পারে না। কষ্ট পায়।

—কে, মা? কার কথা বলছ?

—সে। সে আসে তো।

—কার কথা বলছ, মা? কে?

—অমল আসে রে। অমল রোজ আসে।

—মা, দাদা কেমন করে আসবে?

কমলেন্দু মাধবীকে জড়িয়ে ধরে। দেখে, কীরকম স্বাভাবিক লাগছে মায়ের চোখ-মুখ। একটু চিকিৎসা করালে সেরে উঠবেন মা—দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে কমলেন্দু। মাধবী বলেন—ও আসে। সত্যি। বিশ্বাস কর। আমার সঙ্গে কথা বলে। আসবে না, বল? ওর তো যাবার ইচ্ছে ছিল না। ওই রূপচাঁদ ওকে জোর করে নিয়ে গেছে।

—মা, দাদা আমাকে একটা চিঠি লিখেছিল। তুমি পড়বে?

—না, আমি জানি ও কী লিখেছে।

—কী?

—রূপচাঁদের কথা।

—কী করে জানলে মা?

—অমল বলেছে।

—কবে? মা, কবে?

—কবে যেন বলল, কবে…, ও তো আসে, অনেক কথা বলে, সব মনে থাকে না। কমল—

—বলো মা।

—আমাকে নিয়ে চল।

—কোথায় মা?

—তোর সঙ্গে! তুই যে বললি, আমাকে নিয়ে যাবি!

—একটা মাস সময় দাও মা। আমি জয়েন করি। ফ্ল্যাটটা পাই। তোমাকে নিয়ে যাব।

—কমল, কমল, এক মাস আমাকে ফেলে রাখিস না বাবা। আমাকে মেরে ফেলবে।

—কে তোমাকে মেরে ফেলবে মা?

—তোর বাবা। ওই রূপচাঁদের সঙ্গে ষড় করে আমাকে মেরে ফেলবে।

—কেউ তোমাকে মারবে না মা। কেন মারবে? হঠাৎ কাঁদতে শুরু করেন মাধবী। আকুল, অসহায় কান্না। সেই কান্নার প্রলম্বিত টান বাতাসে কাঁপন লাগায়। কমলেন্দু দিশেহারা বোধ করে। মাকে ধরে বিছানায় বসিয়ে দেয়। তখন মল্লিনাথ ছুটে আসেন এ ঘরে। ধাক্কা মারেন মাধবীকে। তাঁর মুখে হাত চাপা দেন। বলেন—চুপ। একদম কাঁদবে না। চুপ।

কমলেন্দু মাথা নিচু করে। বাবার মুখে সেই নেকড়েটাকে দেখতে পায় আবার। মনে মনে স্থির করে, একমাস পরে নয়, এবারই নিয়ে যাবে মাকে, যা তোক কিছু ব্যবস্থা করবে। কিন্তু করবেই।

আজ অমাবস্যা। মল্লিনাথের পূজা এবং উপোস। সকালে চেম্বার খুললেন তিনি! নিজেরই একতলায় তাঁর বহুকালের চেম্বার। হাসপাতাল আর চেম্বার ছাড়া অন্য কোথাও তিনি বসেননি। হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়েছেন। চেম্বারে কিছু সময় রোগী দেখে বাকি সময়টা পূজা করবেন এই তাঁর ইচ্ছা।

অনেকদিন পর নীলিমা এলেন চেম্বারে। তৃণাঙ্কুরের কথা সবিস্তারে বললেন। খুব মন দিয়ে শুনলেন মল্লিনাথ। নীলিমার সাহায্য দরকার। তাঁর মনে হচ্ছে তৃণাঙ্কুরের অসুবিধাগুলি স্নায়ুজনিত। কিন্তু কিছুতেই যথার্থ শব্দটি তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। তাঁর মনে পড়ছে নিউ—নিউ… নিউ…রো মনে পড়ছে না, ল মনে পড়ছে না। বন্ধ দরজায় আটকে থাকা এক টুকরো পর্দার কোনার মতো হয়ে আছে চিন্তাশক্তি। খানিকটা বেরিয়ে আছে কিন্তু পুরোটাই বন্ধ দরজার ও পারে। কোনও ডাক্তারবন্ধুর নাম পর্যন্ত মনে করতে পারছেন না মল্লিনাথ। তাঁর মুখ-চোখ ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছে। কপালে ঘাম ফুটছে। নীলিমা জিজ্ঞেস করছেন—শরীর খারাপ লাগছে?

—না। আজ উপোস তো। ওই একটু… …

নিজেকে আড়াল করতে চাইছেন মল্লিনাথ। এবং ড্রয়ার খুলে বার করে আনছেন পুরনো ডায়রি। পাতা ওল্টালেন কয়েকটি এবং লিখলেন—ডাঃ পি কে মজুমদার। নিউরোলজিস্ট। ১৮, ডি এল রায় স্ট্রিট…

রাত্রি দশটায় অমাবস্যা পড়েছে। সন্ধ্যা থেকে পূজার আয়োজন করছেন মল্লিনাথ। ভাবছেন। তিনি কি ভুল করছেন? সত্যি কি এ পূজা সাধারণ সংস্কার ছাড়া কিছু নয়? কিন্তু এ পূজা ছাড়াও তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। এত বছর ধরে, অমলেন্দুর জন্মেরও আগে থেকে এ পূজা করতে করতে সবটাই বেঁচে থাকার অঙ্গ হয়ে গেছে। তবুও মাঝে মাঝে ক্লান্ত লাগে কেন? কেন এইসব আয়োজন করতে করতে মনে হয়, কী যেন নেই, কী যেন হওয়ার কথা ছিল না! কেন ইচ্ছে করে—যদি সম্ভব হত, যদি হত, যদি এ পূজা বন্ধ করা যেত—তখন দৈববাণীর মতো অমোঘ কণ্ঠস্বর ভেসে আসে কানে। তিনি শুনতে পান—

হে মানবজাতি, হে সামান্য শক্তিধর, দর্পিত উদ্ধত মানবজাতি, তোমাদের জানাই, আমিই ব্ৰহ্ম, আমিই জগতের উপাদানরূপা প্রকৃতি, আধার রূপ পুরুষ এবং অভিব্যঞ্জক কাল।

ভূমিরাপোহনলো বায়ুঃ খং মনো বুদ্ধিরেব চ।

অহঙ্কার ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা॥

ভূমি, জল, অনল, বায়ু, আকাশ, মন, বুদ্ধি এবং অহঙ্কার—এই অষ্ট প্রকারে আমার প্রকৃতি বিভাজিত হয়েছে। এই অষ্টধা বিন্যাস অপরা। আমার চৈতন্য প্রকৃতিকে তোমরা পরা বলে জানো। এই পরাশক্তিই জীবন। আর আমিই জীব। আমিই বিশ্ব। আমিই জড় আমিই চৈতন্য।… …

মল্লিনাথ অমলেন্দুর অভিযোগ ভুলে যান। মৃত্যু ভুলে যান। স্ত্রীর অপ্রকৃতিস্থতা, কমলেন্দুর শ্লেষ ভুলে যান। তাঁর মনে পড়ে না যে তাঁর অধীত চিকিৎসাবিদ্যা তাঁকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তিনি বিদ্যার চেয়েও বড় বিদ্যা, অধ্যয়নের চেয়েও আরও বড় অধ্যয়নে নিমজ্জিত হন। তাঁর শ্রবণে আসে—

এই পরমা আদ্যাশক্তি শ্রুতি পথে বিদ্যা, সর্বান্তর্যামিনী, সংসার-বন্ধ-বিনাশিনী। আপন ত্ৰিল্বশ্চণা শক্তি দ্বারা তিনি সৃষ্টি করেছেন এই জড় ও চৈতন্য, সৎ ও অসৎ, তিনিই প্রতিপালন করছেন। আবার সংহারও করছেন তিনিই… …

আশ্চর্য সৃষ্টিতত্ত্বের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে মনে মনে স্তব করেন তিনি। ক্রমশ দশ মহাশক্তির প্রতি তাঁর আনুগত্য রচিত হয়। ক্রমশ ঘড়ির কাঁটা দশটার দিকে এগিয়ে যায়। তিনি মনে মনে পরম ঈশ্বরীর স্মরণ নিয়ে বলতে থাকেন—

কালী তারা মহাবিদ্যা যোড়শী ভুবনেশ্বরী।

ভৈরবী ছিন্নমস্তা চ বিদ্যা ধূমাবতী তথা॥

বগলা সিদ্ধবিদ্যা চ মাতঙ্গী কমলাত্মিকা।

এতা দশ মহাবিদ্যাঃ সিদ্ধবিদ্যাঃ প্রকীৰ্ত্তিতাঃ॥

শান্তিতে ডুবতে ডুবতেও দম-ফুরনো মাছের মতো ভেসে ওঠেন মল্লিনাথ। তাঁর হঠাৎ কমলেন্দুকে দেখতে ইচ্ছে করে। কেন যে করে তাও তিনি জানেন না। রাস্তায় ধাবমান গাড়ির শব্দ হয়। কিন্তু মল্লিনাথের চারপাশ অতল নৈঃশব্দে পাক খেতে থাকে। আর মল্লিনাথ শক্তিতত্ত্বের যাবতীয় প্রজ্ঞা স্মরণ করে পূজার উদ্দেশে নিজেকে ঠেলে দেন। তাঁর মনে পড়ে সেইসব বাক্য, সেইসব শ্লোক, মনে পড়ে সেই বিশ্লেষণ। ঠাকুরঘরের দাওয়ায় বসে রূপচাঁদ বলছেন আর অন্যরা শুনছেন। কে কে ছিলেন তার মধ্যে? মল্লিনাথ নিজেকে ছাড়া আর কারওকে দেখতে পান না ওই ভিড়ে। ঘড়িতে দশটা বাজার নির্দেশ পাওয়া যায়। মন্ত্র সহকারে মল্লিনাথ আচমন সমাপন করেন। সূর্যার্ঘ্যের পর আত্মপ্রাণ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তুত হন। বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ও মধ্যমা হৃদয়ে স্পর্শ করে উচ্চারণ করেন—ওঁ আং হ্রীং ক্রোং যং রং লং বং শং যং সং হীং হং সঃ শ্রীমৎ শ্মশান কালিকায়াঃ প্রাণা ইহ প্রাণাঃ… হঠাৎ তাঁর চোখ বন্ধ করা শরীর কেঁপে ওঠে। তিনি স্পষ্ট শুনতে পান নারীকণ্ঠে তাঁর আত্মপ্রাণ প্রতিষ্ঠার মন্ত্র উচ্চারিত হচ্ছে। শ্রীমৎ শ্মশান কালিকায়াঃ সর্বেন্দ্রিয়াণি ইহ স্থিতানি… তিনি চোখ খোলেন এবং উন্মাদপ্রায় হয়ে যান। তাঁর সামনে দেবী কালীর মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে আছেন মাধবী। তাঁর চুল খোলা। চোখ লাল। বলছেন—মুখস্থ। আমার সব মুখস্থ। এতদিন ধরে শুনছি কি-না! মল্লিনাথ স্থির গম্ভীর কণ্ঠে বললেন—মাধবী, তুমি কেন এখানে এসেছ? যাও। ঘরে যাও।

তাঁর হাত কাঁপছে। পৈতেগাছা মুঠো করে ধরে তিনি নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করছেন। মাধবী বলছেন—আমাকে পুজো করবে? অ্যাঁ? দেখো, আমিও কালী হতে পারি দেখো।…তিনি শাড়ি খুলে ফেলছেন। শাড়ির প্রান্ত এসে ফুলের ওপর পড়ছে। তিনি ব্লাউজ খুলে ফেলছেন। ব্লাউজ মায়ের খড়্গে আটকে নমিত পতাকার মতো দুলছে। মল্লিনাথ বলে চলেছেন—মাধবী? কী করছ, মাধবী!

মাধবী বলছেন—আমায় পুজো করো। দেখো। আমাকে দেখো। আমি কালী হলাম কি না।

শায়া খুলে ফেলছেন তিনি। খোলা চুলে বিবস্ত্রা পাগলিনী মাধবীকে উলঙ্গিনী শ্যামার মতোই লাগছে। কিন্তু মাধবী শ্যামদেহী নন। তাঁর গৌরাঙ্গে বিজলী ও প্রদীপের আলো পিছলাচ্ছে। মল্লিনাথ দেখছেন। মাধবী কালীর খড়্গ তুলে নিচ্ছেন হাতে। খড়্গ থেকে ব্লাউজ খসে পড়ল ঘটের ওপর। পূজার আসনে বসেও মল্লিনাথ কেঁপে উঠলেন। আশ্চর্য অটুট দু’টি স্তন মেলে, উলঙ্গ হয়ে, হাতে খড়্গ ধরে, জিভ বের করে দাঁড়িয়ে আছেন মাধবী। স্থির। অপলক। তাঁর কোমরে শায়া বন্ধনের গাঢ় দাগ। তলপেটের ভারী খাঁজে সন্তান ধারণের অজস্র ফাটল। স্তব্ধ যোনি। শ্লথ ঊরুতে সামান্য রোম। নিটোল পা। মল্লিনাথের রাগ প্রশমিত হয়ে কষ্ট উঠতে লাগল। তাঁর মনে পড়ল, মাধবী, তাঁর চেয়ে অন্তত আঠার বছরের ছোট। দেড় যুগ যাকে বলে। ফুঁ দিয়ে প্রদীপ নিবিয়ে দিলেন মল্লিনাথ। মাধবীর শাড়ির একটি প্রান্ত জ্বলন্ত ধূপকাঠির ওপর পড়েছিল। গোল গোল ফুটো হয়ে গেছে। মল্লিনাথ উঠে দাঁড়ালেন। মাধবীর হাত থেকে খড়্গ নিয়ে ফিরিয়ে দিলেন মায়ের হাতে। মাটি থেকে শাড়িখানি কুড়িয়ে নিয়ে উড়িয়ে দিলেন মাধবীর গায়ে। মাধবী বাধা দিলেন না। অনেক—অনেক—অনেকদিন পর, সেই প্রথম যৌবনকালের মতো গাঢ় স্বরে স্ত্রীকে ডাকলেন মল্লিনাথ—মাধু, মাধু, জিভ ভেতরে নাও।

মাধবী লক্ষ্মী মেয়ের মতো জিভ তুলে নিলেন। মল্লিনাথ মাধবীর শায়া ও ব্লাউজ হাতে করে মাধবীর হাত ধরে বাইরে নিয়ে এসে বললেন —পরো।

মাধবী, যেন ঘরে কেউ নেই, যেন আয়নার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন এমনই ভঙ্গিতে মল্লিনাথের জড়িয়ে দেওয়া শাড়ি খুলে শায়া ও ব্লাউজ সমেত যথাযথ প্রক্রিয়ায় শাড়ি পরতে লাগলেন আবার। আঁচল বাঁদিকে দিলেন, কুঁচি করলেন, পা দিয়ে চেপে-চুপে ঠিক রাখলেন কোণ আঁচল। আর এতক্ষণ, মল্লিনাথ, এই বয়সেও, পাগলিনী স্ত্রী ও পুত্রশোক সমেত ভাবতে লাগলেন— যদি কমলেন্দু চলে আসে! যদি দেখে ফেলে!

আর কমলেন্দু, এ দিকেই আসতে গিয়ে, শাড়ি পরিধানরতা মাকে দেখে, বাবাকে দেখে, অনুমান করেছিল, পাগলিনী মা কোনও গোলমাল ঘটিয়ে থাকবেন, বাবা কোনও অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে থাকবেন— সে পাশের ঘরে চলে গিয়েছিল। এ বার ফিরে এসে বলল—তুমি ধুনো আনতে বলেছিলে। আমি ভুলে গেছি। লাগবে কি? পঞ্চাদার দোকান এখনও খোলা আছে।

—আনবি? দ্যাখ তা হলে।

মাধবী অন্য ঘরে চলে যান। কমলেন্দু ধুনো আনতে যায়। মল্লিনাথ একলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ল্যাম্পপোস্টের পেছন দিকে জমে থাকা অন্ধকার দেখেন। এ দিক থেকে স্ট্যাটিসটিকাল ইন্সটিটিউটের বড় বড় বাড়িগুলি নজরে আসে। তিনি ভাবতে থাকেন, কমলেন্দু যদি পূজা পছন্দই করে না তবে নিজে থেকে ধুনো আনতে গেল কেন! উঁচু পাঁচিলের অন্য ধার থেকে একটুখানি আশা উকি মারতে চায়। কিন্তু মল্লিনাথ নিজেকে শাসন করেন। আর নয়। আর কিছুতেই নয়। তাঁর নিজের সঙ্গেই এ পূজা শেষ করে যাবেন তিনি। কিন্তু কী করে শেষ করবেন, কী করে শেষ করতে হয়, তাঁর মাথায় আসে না। তখন কমলেন্দু ধুনো নিয়ে ফেরে। গুঁড়ো পাওয়া যায়নি। সে চাকা নিয়ে এসেছে। কাগজের মোড়ক মল্লিনাথকে ধরিয়ে দিয়ে সে চলে যায়। মল্লিনাথ পুজোর ঘরে ফিরে যান। মাধবীর শাড়ি জামা লেগে সব ছড়িয়ে গেছে। সবই কি অপবিত্র হয়ে গেল? বোতল থেকে গঙ্গাজল নিয়ে সব কিছুতে ছেটাতে থাকেন তিনি। হঠাৎ তাঁর অবাক লাগে। পূজার উপচার সাজাতে ইতিমধ্যে তাঁর কোনও ভুল হয়নি। আর আজ তিনি ধুনো ছাড়াই পূজা শুরু করেছেন, এ কথা মনে ছিল না। আবার ভয় করে তাঁর। তিনি কি তবে ভুলে যাচ্ছেন? সবই ভুলে যাচ্ছেন?

ধুনো গুঁড়ো করার জন্য প্যাকেট সমেত মাটিতে রেখে চন্দনের পাটা দিয়ে আঘাত করেন তিনি। শব্দ হয়। ঘর কাঁপে। ধুনো গুঁড়িয়ে যায়। এবং একটি শব্দে তাঁর চোখ আটকে যায়। পুরনো খবরের কাগজের ঠোঙা চোখের সামনে ধরে তিনি পড়েন সেই শব্দ। ঠোঙার ভাঁজে কিছু হারিয়ে গেছে। কিন্তু ঘষায় ঘষায় উঠে গেছে। মল্লিনাথ তারই মধ্যে ঢুকে পড়েন—

…entered a house in Taltola, forced their way into an inner apartment and came upon three allegedly Naxalite youths who were sleeping there. According to the people of the neighbourhood, the officer… …raiding party, presumably a spy, ‘Isn’t it Biplab Bhattacharya?’ The spy replied, ‘Yes’. Biplab was immediately shot dead and the other two… …paper published a police version… …

কাগজটি হাতে নিয়ে চুপ করে বসে থাকেন মল্লিনাথ। বিপ্লব ভট্টাচার্য, সেই বিপ্লব ভট্টাচার্য। সে ছাড়া আর কে হবে? বিপ্লব ভট্টাচার্য নকশাল। বিপ্লব ভট্টাচার্য শট ডেড। সেই তখনকার কাগজ এটা। কী কাগজ, বোঝার আর উপায় নেই। কিন্তু এ কাগজ স্পর্শ করে মন্ত্রের আগে, প্রতারক স্মৃতিকে পাশ কাটিয়ে মল্লিনাথের মনে পড়ে যাচ্ছে, হরিপাল থেকে ও এসেছিল। হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে কলকাতায় পড়তে এসেছিল। নিষ্পাপ মুখ ছিল ছেলেটার। গাল থেকে যেন শৈশব মোছেনি। অনেকটা মালার মতোই। মালার হাত থেকে এসে একাত্তরের স্বপ্নে ডুবে গেল ছেলেটা এবং মরে গেল। মালার মুখ মনে পড়ল মল্লিনাথের। অনঙ্গ মারা যাবার পর অনেক কষ্টে হরিপাল গার্লস হাইস্কুলের চাকরিটা পেয়েছিলেন মালা। মল্লিনাথই সাহায্য করেছিলেন। সেও কতদিন হল? পুজোর আসনে বসে মল্লিনাথ মালার কথা ভাবেন। সেই একাত্তর সাল। কিংবা বাহাত্তর। কিংবা তিয়াত্তর। ঘরে-বাইরে আগুনে আগুনে একাকার ছিল তখন। একাত্তরের শেষে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল ভারত। জরুরি অবস্থা ঘোষিত হল। এ দেশের প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিলেন—

…আজ বাংলাদেশের যুদ্ধ ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। …আমার এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে ভারতের জনগণের ঐক্যবদ্ধ ইচ্ছাশক্তিই পাকিস্তানের এই বেপরোয়া ও বিনা প্ররোচনায় আক্রমণ নিশ্চিতরূপে ও চূড়ান্তভাবে প্রতিহত করতে পারবে।… …

অজস্র বুলেট ছুটল। আর কয়েকদিনের যুদ্ধে মুক্ত হল বাংলাদেশ। তাঁদের এতদিনের ধৈর্য বা প্রতিবাদ, এতদিনের সহনশীলতা বা অন্তর্গত যুদ্ধ বিরাট ও ব্যাপক হয়ে থেমে গেল একদিন। কিন্তু বুলেট থামল না। পাড়ায় পাড়ায় গলিতে গলিতে মাঠেঘাটে তা বিদ্ধ করতে লাগল বালককে তরুণকে যুবককে। ধরা পড়তে লাগলেন যুবতীরা এবং জেলের মধ্যে অত্যাচারিত হতে লাগলেন। আর এইসব ঘটতে লাগল পশ্চিমবাংলায়। বিহারে। ওড়িশায়। পঞ্জাবে। দক্ষিণ ভারতে। মুক্ত বাংলাদেশ যখন প্রতিদিন আবিষ্কার করছে পাকিস্তানিদের ধ্বংস করে দেওয়া বাড়ির তলায় স্তূপ স্তূপ মৃতদেহ, আর নদীর পাড়ে পাকিস্তানির নিষ্ঠুর গুলিতে বিদ্ধ দেহ খুবলে খাচ্ছে কাক, তখন এখানে, এই পশ্চিমবাংলায় বা ওড়িশায় বা বিহারে বা পঞ্জাবে চলছে নিরন্তর হত্যালীলা। নকশাল মারা হচ্ছে। নকশাল পোড়ানো হচ্ছে। নকশাল দমন করা হচ্ছে পিটিয়ে, অত্যাচার করে। উল্টো করে ঝুলিয়ে। আর বিপ্লব ভট্টাচার্যের মৃত্যুতে, এ পাড়ার দেবার্চন, এ পাড়ার নীলাদ্রি, ও পাড়ার সত্যজিতের মৃত্যুতে, বা প্রত্যেকটি মৃত্যুসংবাদে মল্লিনাথ ঈশ্বরকে বারবার প্রণাম জানিয়েছেন তাঁর দু’টি পুত্র নকশাল হয়ে যায়নি বলে। তারা পুলিশের গুলিতে মারা যায়নি বলে। কিন্তু তাতে কী লাভ হল? বিপ্লবের মৃত্যুর পর মালার কাছে গিয়েছিলেন মল্লিনাথ। হরিপালে। মালা কাঁদেননি। শুধু বলেছিলেন— ওরা সব চলে গেল, মল্লিদা! আমাকে একা ফেলে চলে গেল। কেন গেল বলুন? একা থেকে আর কী করব আমি…

আজ মল্লিনাথও একা। ওরা সব চলে গেল। চলে যাচ্ছে। তিনি কালীমূর্তির দিকে তাকান। সে-মুখ কেমন নিষ্প্রভ। আবার প্রদীপ জ্বালেন তিনি। কালীর মুখ উজ্জ্বল হয়। মল্লিনাথ আত্মপ্রাণ প্রতিষ্ঠায় মন দেন।

২৩

মাকে নিয়ে চলে গেল কমলেন্দু। মাধবীও যন্ত্রের মতো চলে গেলেন। মল্লিনাথকে কিছুই না বলে, পিছন ফিরে একটিবার বাড়ির দিকে না তাকিয়ে চলে গেলেন। মনে মনে হিসেব করছিলেন মল্লিনাথ। কত বছর পর বেরুলেন মাধবী? পনেরো বছর? কুড়ি বছর? তবু এই চলে যাওয়া, এই বেরুনো অতি নিষ্প্রাণ, আবেগকম্পনহীন। শুধু কালীতারা একা, বহুদিন ধরে এ বাড়িতে রাঁধে বলে, কাজ করে বলে, বা বস্তুত সে-ই প্রতিদিন ফটিক বিল বস্তি থেকে এসে মল্লিনাথের পরিবারের দায়ভার নেয় বলে, এই শূন্য বাড়ি সম্পর্কে বেদনাবোধ করতে থাকে এবং চোখে আঁচল চাপা দিয়ে বলে—মাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে এসো ছোড়দাবাবু।

মল্লিনাথ দেখলেন। চলে যাওয়া দেখলেন। কালীতারার কান্না দেখলেন এবং তাঁর চোখে পড়ল তাঁর বাগানে আগাছা জমেছে। বাগানে হাত দিচ্ছেন না কতদিন! যত্ন করছেন না। যত্ন না করলে আগাছা তো জমবেই। মল্লিনাথ আপনমনে মাথা নাড়েন। যত্ন না করলে মেঝেতেও শ্যাওলা ধরে, দেওয়ালে নোনা লেগে যায়, বাগানে আগাছা। যত্ন না করলে সমস্ত সম্পর্ক অভ্যাসে পরিণত হয়, বা অভিযোগে। পারম্পরিক আকাঙ্ক্ষিত বসবাস সহবাস হয়ে ওঠে, কখনও কখনও অসহ-বাস। যত্ন, যত্ন, সর্বত্র যত্ন চাই। ক’দিন যা কিছুই অবহেলায় রাখা যাক— সে ম্লান হতে থাকবে।

বাগানের প্রান্তে কর্পোরেশনের প্রাইমারি স্কুল—গুটি কয়েক ছাত্র আর দু’জন মাস্টারনি— মল্লিনাথই এই স্কুলের দেওয়াল রং করিয়ে দেন—সেও হয়নি কতদিন! সব কাজ পড়ে থাকছে। সব জায়গায় আগাছা ভরে যাচ্ছে। তিনি চেম্বারে যান। এবং আজও তাঁর ওষুধের নাম মনে পড়তে চায় না। আরও বেশি রোগী এসে পড়ার আগেই তিনি উঠে পড়েন। চেম্বারের দরজা বন্ধ করে ঘুরতেই দেখেন জুঁই দাঁড়িয়ে আছেন। বাপ্পার জ্বর এসেছে। মল্লিনাথকে ডাকতে এসেছিলেন জুঁই। মল্লিনাথ বিপন্ন গলায় বললেন—আমাকে আর ডেকো না বউমা। আমি আর রোগী দেখব না।

—কী হয়েছে, জ্যেঠামশাই?

—আমার কীরকম সব হচ্ছে! ওষুধের নাম মনে করতে পারি না। মাথার মধ্যেটায় যন্ত্রণা হয়। খুব যন্ত্রণা। তুমি বরং শিবতোষকে ডেকে নাও।

ফিরে যাচ্ছিলেন জুঁই। পথে আনিসুজ্জামানের সঙ্গে দেখা হল। আনিসুজ্জামান কলেজ যাচ্ছেন। জুঁইকে দেখে হেসে বললেন—কি? ভাল তো?

জুঁই বললেন,—আমি ভাল। কিন্তু বাপ্পার জ্বর এসেছে। জ্যেঠামশাইকে ডাকতে এসেছিলাম। কিন্তু উনি অদ্ভুত কথা বললেন। মানুষটা শোকে প্রায় পাগল হয়ে গেছেন। বাইরে থেকে তো বোঝা যায় না।

—কী বললেন, ডাক্তারদা?

জুঁই মল্লিনাথের কথাগুলি বলতে থাকেন আনিসুজ্জামানকে। আনিসুজ্জামানের কপাল কুঁচকে যায়। মল্লিনাথ কি অসুস্থ? জুঁই চলে গেলেন। আনিসুজ্জামানের অপরাধী লাগল। অমলেন্দু মারা যাবার পর আর একদিনও যাননি মল্লিনাথের বাড়ি। যাওয়া উচিত ছিল। শোকের সময় মানুষ মানুষকে আঁকড়ে নিতে চায়। একা ঘর অসহ্য লাগে তখন। ওই এক পাগল স্ত্রী নিয়ে মল্লিনাথের সন্তাপ আরও বেড়ে থাকবে বলে ধারণা হয় আনিসুজ্জামানের। কথা নয়, সান্ত্বনা নয়, শুধু একজনের সুস্থ সঙ্গ যদি পেতেন মল্লিনাথ তবে এ মুহূর্তে তাঁর পক্ষে নিশ্চয়ই তা মহামূল্যবান হয়ে উঠত।

আনিসুজ্জামান ঘড়ির দিকে তাকান। এখন ঢুকলে কলেজে দেরি হয়ে যাবে। তিনি স্থির করেন, ফেরার পথে বা একটু রাত্রের দিকে আজ একবার আসবেন। পাড়া থেকে বেরিয়ে পি ডব্লু ডি রোডের ধার দিয়ে বি টি রোডের দিকে হাঁটেন তিনি। তাঁর পাশ দিয়ে একটি সাদা অ্যাম্বাসেডার যেতে যেতে থেমে যায়। আনিসুজ্জামান দেখতে পান বিকাশ গাড়ির জানালা দিয়ে তাঁকে ডাকছেন। তিনি এগিয়ে যান। বিকাশ বলেন—কলেজ যাবে তো? উঠে পড়ো।

আনিসুজ্জামান বলেন—আমি গেলে আপনাকে তো ঘুরতে হবে।

—ঘুরব একটু।

আনিসুজ্জামান গাড়িতে উঠে বিকাশের পাশে বসেন। বিকাশ ড্রাইভারকে বি পি সি কলেজের রাস্তা বলে দেন। আনিসুজ্জামানকে বলেন—তারপর? খবর বলো।

আনিসুজ্জামান বলেন—ডাক্তারদার শরীরটা ভাল নেই।

বিকাশ বলেন—সে তো হবেই। অত বড় আঘাত।

—হ্যাঁ। উনি নাকি ওষুধের নাম ভুলে যাচ্ছেন।

—সে কি!

—হ্যাঁ। ভাবছি রাত্রে একবার যাব। আসবেন নাকি?

—দেখি, যদি তাড়াতাড়ি ফিরি। না হলে কাল সকালে একবার যাব।

—আপনার সঙ্গে আমারও একটু দরকার ছিল।

—কী?

—দুর্গা সম্পর্কে কিছু প্রবন্ধ আপনাকে পড়তে দেব।

—দিয়ো। তোমার সেই বইটি কী হল? সাধারণ জনজীবন ও সর্বধর্মসমন্বয় নিয়ে যেটা লিখছিলে! প্রকাশক পেলে ওটার জন্য?

—না। আমি ছোট একটা পুস্তিকা করেছি। কিন্তু সেটা কিছু নয়। কাজটা আমি বড় মাপে করতে চাই।

সুপার মার্কেটের পাশ দিয়ে এগিয়ে গুরুদ্বারের সামনে গাড়িটা বাঁ দিকে বাঁক নিল। এবারে ডান দিকে অল্প গেলেই আনিসুজ্জামানের কলেজ। আনিসুজ্জামান কলেজের কাছে নামলেন। বিকাশ গাড়ি নিয়ে এগোলেন।

কলেজের পরিবেশটি ভাল লাগে আনিসুজ্জামানের। বি টি রোড থেকে একটু দূরে। বসতি অল্পই আশে-পাশে। বেশ শান্ত ও নির্জন। সামনেই একটি বিশাল ঝিল। প্রেমিক ছাত্র-ছাত্রীরা হাত ধরাধরি করে ঝিলের পাড়ে বসে গল্প করে। আনিসুজ্জামানের মনে হয়, এরকম একটি ঝিল, যাতে মাছ খেলা করে, পরিযায়ী পাখিরা উড়ে আসে, শুভ্র হাঁস পালক ভিজিয়ে নেয়— এরকম একটি ঝিল যার গায়ে রোদ্দুর পড়ে আর যার পাড় ঘেঁষে গাছেদের সারি ঘন ছায়া নামিয়ে দেয়— এই ঝিল থাকলে চঞ্চলমতি ছাত্র-ছাত্রীরা তো প্রেম করতে চাইবেই। সেই সঙ্গে প্রাজ্ঞ বিদগ্ধ, এমনকী আনিসুজ্জামানের মতো বাতিলপ্রণয়ী মানুষেরাও ঝিলের ধারে বসে গুনগুনিয়ে দু’টি মনের কথা বলতে চাইবেন।

কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকলেন আনিসুজ্জামান। পোড়া বিল্ডিং-এর সামনে কিছু ছেলে জটলা করেছে। বাহাত্তরে কলেজটায় আগুন লাগানো হয়েছিল। খুব বেশি ক্ষতি হওয়ার আগেই তা নেভানো সম্ভব হয়। সামান্য মেরামত করে ক্লাশও নেওয়া হয় ওই বিল্ডিং-এ। কিন্তু পোড়া দাগ এখনও সারেনি। সকলে নকশালদের দোষ দিয়েছিল তখন। কয়েকদিন খুব হামলা হয়েছিল তাদের ওপর। বোমাবাজি আর গুলি ছোঁড়াছুড়ির জন্য কলেজ চত্বরে চারদিন ঢোকা যায়নি। মনোজ আর সৌমিত্র দু’দিন লুকিয়ে ছিল আনিসুজ্জামানের বাড়িতে। ভাল ছাত্র ছিল ওরা। নকশাল করত। ওদের বাড়িতে রাখার ঝুঁকি কম ছিল না। পুলিশ বা পার্টিগুণ্ডা—যে-কোনও দিক থেকেই তিনি আক্রান্ত হতে পারতেন। তবু, যেহেতু, সব স্তরের ছাত্রদের সঙ্গেই তাঁর ভাল যোগাযোগ ছিল এবং এখনও সেইসব সম্পর্কগুলি বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে আর তা এমন পর্যায়েও যায় যে তেমন-তেমন ঘনিষ্ঠরা তাদের প্রেমে পড়ার খবরও বলে যায় আনিসুজ্জামানকে—ফলত তিনি তাঁর গোপন ভাবনার জায়গায় নকশাল ওইসব ছেলেদের জন্য আলাদা স্নেহ আগলে রেখেছিলেন এবং যদিও তারা এইসব শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল না তবু তিনি তাদের জন্য নিজের দরজা খোলা রাখতেন এ কারণেই যে তাদের ঔজ্জ্বল্য চোখে পড়ার মতোই ছিল। ছোটখাট সামান্য সাহায্যই তিনি করতে পেরেছেন। আর তা করতে গিয়েই পেয়েছিলেন জামাল কৌশিককে, যে সরাসরিভাবে এই কলেজের ছাত্র ছিল না কিন্তু প্রায়ই আসত, এমনকী মাঝে মাঝে সে আনিসুজ্জামানের ক্লাশে গিয়েও বসে থেকেছে। সেও বেশিদিন নয়। কারণ ওরা ছিল ক্লাশভাঙার দল। অভিযোগ আর আন্দোলন, ঘেরাও আর বয়কট, বাস-ট্রাম পোড়ানো, স্কুলে-কলেজে আগুন দেওয়া ও জ্ঞানীগুণীজনের মূর্তি ভাঙার দামাল ও বিস্তৃত ইতিহাস তারা দেওয়ালে দেওয়ালে রচনা করে গেছে। যত অভিযোগ তারা উত্থাপন করেছিল সেগুলি অমূলক ছিল না কিন্তু সেইসব উত্থাপনের প্রতিকারের জন্য যে সময়, পদ্ধতি ও অস্থির ব্যগ্রতা তারা মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে নিয়েছিল তার মধ্যে সামঞ্জস্য তৈরি হয়নি। যদিও তাদের চাওয়ার মধ্যে কোনও খাদ ছিল না। শ্রমিক নেতৃত্বের মধ্যে দিয়ে শ্রমিক-কৃষক সংগঠনকে দৃঢ় ও বৈপ্লবিক করে তুলতে চেয়েছিল তারা। সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে শহরমুখী ও অসম অর্থবণ্টনকে রুখতে চেয়েছিল। এককথায় যাকে বিপ্লব বলা যায়। আর আনিসুজ্জামানের বিশ্বাস, বিপ্লব কখনও পরিকল্পিত ভাবে, অঙ্ক কষে, ছক বেঁধে হয় না। বহু দিনের বহু বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে জ্বলে ওঠা বিন্দু বিন্দু আগুন একদিন হু হু করে বাড়তে থাকে আর উছলে ওঠে আর তৈরি করে দাবানল যেমন করে ধিকি ধিকি জ্বলা তৃণভূমি থেকে আগুন লাফিয়ে ওঠে গাছে আর পোড়াতে থাকে সমূহ বৃহৎ বৃক্ষ, লতা।

সেই সময় মনোজ আর সৌমিত্র আনিসুজ্জামানের খাবার টেবিলে বসে ফিসফিস করে বলেছিল—বিশ্বাস করুন স্যর, আমরা আগুন দিইনি।

আনিসুজ্জামান বিশ্বাস করেছিলেন এবং ভেবেছিলেন হয়তো-বা এই বিপ্লবের প্রয়াস বিফল হবে কারণ এর শুদ্ধ আগুনে ঢুকে গেছে উদ্দেশ্যমূলক প্ররোচনার আগুন। আর এই আগুন আগুনকে খায়। ধ্বংস আরও বড় ধ্বংসের দিকে প্ররোচিত করে মানুষকে। আর তখন সবাই সবাইকে সন্দেহ করে। অবিশ্বাস ও ঘৃণার লোহিত তপ্ত ধারায় মুখ পুড়ে যায় মাটির।

আনিসুজ্জামান এখনও মনোজদের জন্য কষ্ট পান। মনোজ নেই। সৌমিত্র বহুদিন লুকিয়ে বেড়াবার পর প্রভাবশালী পিতার প্রভাবে চলে গিয়েছে বিদেশ, লাভ করবে কোনও একটি ডিগ্রি এবং এ দেশে কোনওদিন ফিরে স্বাভাবিক জীবনযাপন করবে। কিংবা, কে জানে, হয়তো ফিরবেই না। সুখী থাকবে, বিদেশিনী শ্বেতাঙ্গী স্ত্রীতে এবং তৃপ্ত থাকবে বৈদেশিক নিশ্চিন্ত মুদ্রায়। আর কৌশিক, আনিসুজ্জামানের প্রিয় জামাল কৌশিকের কোনও খবর নেই। আর তারা সব, ওই আগুন নিয়ে খেলা করার তরুণরা সব, এমনই ছিল যে নিজের থেকে খবর না দিলে তাদের খবর পাওয়া সম্ভব ছিল না কোনও উপায়েই।

আনিসুজ্জামানকে দেখে ছাত্রদের জটলা এগিয়ে এল। তারা একটি জলসা করতে চায় এবং তাতে আনিসুজ্জামানের সাহায্য প্রত্যাশা করে। আনিসুজ্জামান একবার পোড়া বিল্ডিংটার দিকে তাকান, একবার এইসব ছাত্রছাত্রীদের দিকে। না, এরা কেউ বিপ্লব করার কথা ভাবে না। কারণ বিপ্লবের পিঠে প্রচণ্ড মার তারা জেনেছে। দেখেছে, শুনেছে যে তার কোনওই সারবত্তা নেই শুধু আবেগে, অক্ষম আবেগে, জ্বলে মরা ছাড়া, এভাবেই নকশাল আন্দোলনকে উপস্থাপিত করা হচ্ছে যে অপরিকল্পিত উন্মাদনা ছাড়া এ আর কিছুই নয়, একেবারে পাশেই বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ, এমনকী সইদুল নামের এক দশ বছর বর্ষীয় বালক, হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল আর তার বিনিময়ে, প্রচুর গোলা-বারুদ, প্রাণ ও রক্তের বিনিময়ে লাভ করেছিল মুক্তি, চিরন্তন রাষ্ট্রীয় মুক্তি, যা ঐতিহাসিক উৎসাহ ও উদ্দীপনার কারণ হয়ে ওঠে, কিন্তু তেমন কোনও প্রত্যক্ষ ফলাফল নকশাল আন্দোলন দিতে পারেনি। অতএব তা ব্যর্থ বলে গণ্য হয় বা উপস্থাপিত হয় যাতে সমস্ত স্ফুলিঙ্গের সম্ভাবনা নির্বাপিত করা যায়। আর তা যে সম্ভব, তা যে খুব সহজ প্রক্রিয়ায় করে ফেলা যায় তা আনিসুজ্জামান অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে কিন্তু আপাত নির্লিপ্ত অবস্থানে প্রত্যক্ষ করেন প্রতিদিন। অনুভব করেন। সেইসব বারুদের গন্ধ তাঁর নাকে আজও লেগে আছে যা তারুণ্যের স্বপ্ন ও তেজ হয়ে দেখা দেয়। যা পৃথিবীতে ঘটিয়ে ফেলতে পারে চূড়ান্ত বিপ্লব ও অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তন। যার কাঁপনে ও ধাক্কায় নোনা ইটের নীচে চাপা পড়ে মৃতের সভ্যতা। তবুও, কোথাও, অমর শয়তান হয়ে উঠে আসে মৃত্যুকামী শাসন ও মেধা। অস্ত্রে-অস্ত্রে ছিন্নভিন্ন, রক্তাক্ত, পোড়া ছাই সমস্ত স্বপ্ন ও কল্যাণ কামনায় ছুট ও আত্মোৎসর্গ।

তাই, এখনকার যত তরুণ মুখ, তারা রাজেশ খান্না বা অমিতাভ বচ্চনের মতো চুল রাখে কিন্তু তাঁর অধ্যবসায় ও সৎ সংগ্রামের দিকে তাকায় না, তারা চুল রাখে এবং নাচে এবং প্রত্যাশা করে কোনও মিঠুন চক্রবর্তী হওয়ার কিন্তু এই হয়ে ওঠার আগেকার দীর্ঘ পথ অতিক্রমণ ও পরিশ্রম সম্পর্কে অন্ধ ও বধির হয়ে থাকে। আগে যারা এসেছিল তারা ফলাফল দিতে পারেনি বলে বা হাতে পায়নি বলে, বা বলা উচিত প্রত্যাশিত সাফল্য ছিল না বলে, এরা এখন দেখছে শুধুই সাফল্য, শুধুই উজ্জ্বল ফলাফল যার কাছাকাছি পৌঁছনোর ইতিহাস সম্পর্কে তারা অন্ধকারে থাকছে এবং আনিসুজ্জামান টের পাচ্ছেন, পড়াতে গেলে, সব শূন্য মুখ। বাংলা অনার্স নিয়েছে তারা এবং জানে না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের বই কি-না, তারা ধারণা করে, ‘শেষের কবিতা’ বুঝি-বা কোনও কবিতারই বই যা হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষবার লিখেছিলেন। ‘গোরা’ উপন্যাসের বিষয়বস্তু কী তারা জানে না এবং আনিসুজ্জামান এই পুস্তকটি এক ছাত্রীকে পড়তে দিয়ে বুঝেছিলেন সে কয়েকপাতা উল্টেছে মাত্র এবং ফেরত দিয়েছে। তিনি হতাশ হতে হতেও ভেবেছেন, এত সত্ত্বেও তিনি ক্লাশে মীর মশাররফ হোসেনের নাম করবেন বা বলবেন সেই আশ্চর্য ‘লাল শালু’ উপন্যাসের কথা যার লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। অতএব তিনি এদের প্রত্যাশিত নোট দিতে থাকলেন এবং তারই ফাঁকে বৈষ্ণব পদাবলী পড়ানোর কালে বললেন—‘এই পরিষ্কার ভাষা, প্রেম এবং প্রেমজাত শরীরী বোধের চূড়ান্ত প্রকাশ যা আমরা বিদ্যাপতিতে দেখতে পাই, তা আছে শেলিতে, আছে ইয়েটসে। আমি প্রত্যাশা করব যে তোমরা, ইয়েটস পড়েছ, অন্তত পড়েছ ‘ক্রেজি জেন’ যা তাঁর সুবিখ্যাত রচনা। পড়েছ কি কেউ? কেউই? বাংলা অনার্স পড়ো বলে কি শুধু বাংলাই পড়ো তোমরা? ইংরিজি পড়ো না!’

একটি মেয়ে সামনের বেঞ্চে বসে আছে। রোজই বসে। লাল সাললায়ার কামিজ পরা। কলেজে মেয়েরা শাড়ি কমই পরছে আজকাল। মেয়েটির চোখে তন্ময়তা ছিল আর তার কামিজের কাট এমনই যে বুকের অনেকখানি উন্মুক্ত। আনিসুজ্জামানের চোখ বার বার গিয়ে পড়ছিল ওইখানে এবং সেটা এ কারণে নয় যে ওই চেরা সঁড়িপথ যা কোনও অজ্ঞাত গভীরে পৌঁছে যায়, আনিসুজ্জামানকে নিয়ে যাচ্ছিল যৌন উত্তেজনার মুখোমুখি। তাঁর তাকানোর কারণ ছিল এই যে তিনি ভাবছিলেন এতখানি মুক্তি তিনি সইতে পারবেন কি না বা এ দেশের পুরুষরা তা সইবার জন্য প্রস্তুত আছেন কি না। সেই সঙ্গে একথাও তিনি না ভেবে পারেননি যে মেয়েটি ভাগ্যবান যে তাকে কিছু লুকিয়ে বেড়াতে হয় না। অনিবার্যভাবে তাঁর মনে পড়েছিল নীলোফার কথা যে সারাক্ষণ বোরখা ব্যবহার করে এ কারণে যে তার পুড়ে যাওয়া মুখ সে দেখাতে পারে না।

আনিসুজ্জামান মেয়েটির তন্ময়তা লক্ষ করেন এবং প্রায়ই জানতে চান সে শেলি পড়েছে কি না। কিটস, ইয়েটস বা বায়রন পড়েছে কি না। মেয়েটি জানায় যে সামান্য পাঠ করার সৌভাগ্য তার হয়েছে এবং এতে আনিসুজ্জামান কিছুটা অন্তত উৎসাহ বোধ করেন এবং পড়াতে থাকেন—‘ক্রেজি জেন টকস উইথ দ্য বিশপ’। দেখো। কবিতাটা দেখো। উপলব্ধি দেখো,

I met the Bishop on the road

And much said he and I.

‘Those breasts are flat and fallen now,

Those veins must soon be dry;

Live in a heavenly mansion,

Not in some foul sty.’

‘Fast and foul are near of kin,

And fair needs foul,’ I cried.

‘My friends are gone, but that’s a truth

Nor grave, nor bed denied,

Learned in bodily lowliness

And in the heart’s pride.

বুঝেছ? বুঝতে পারছ? জীবনকে কতটা ভালবাসলে এরকম বলা যায়?

আনিসুজ্জামানের সামনে দিনের পর দিন সব শূন্য মুখ। শুধু একজনের চোখগুলি বাঙ্ময়। তার ডিপ কাট কামিজ, সে-দিকে চোখ চলে যায়। অন্য সব মুখগুলি, অমিতাভ বচ্চনের চুল পরা বা নীল, হলুদ, ফুল ফুল সালোয়ার কামিজ—তারা চেয়ে থাকে। নিঃসাড়। ভাষাহীন। কারা আগুন দিয়েছিল কলেজে আর কারা চিৎকার করে বলেছিল—বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থা মানি না। তাদের আগুনের আভা এখনও দেওয়ালে লেগে আছে। তাদের গর্জন এখনও শোনা যায় কান পাতলে কারণ বাতাস তা এখনও বিস্মৃত হয়নি। আনিসুজ্জামান অতীত এবং বর্তমানের মধ্যবর্তী পর্যায়ে অবস্থান করেন এবং বলার নেশায় বলে যান—

‘A woman can be proud and stiff

When on love intent;

But Love has pitched his mansion in

The place of excrement;

For nothing can be sole or whole

That has not been rent.’

তোমরা জাননা, ভালবাসা শরীর দিয়ে প্রকাশিত হয়। শরীরে তার চরম আস্বাদন। আমরা তা উচ্চারণ করতে ভয় পাই কারণ আমরা নিজেরা নিজেদের প্রবঞ্চনা করি।

তাঁর চোখ বার বারই লাল সালোয়ার পরা মেয়েকে দেখে। তিনি বলেন—শরীর, ভালবাসার চূড়ান্ত উদযাপনের ক্ষেত্র; Love has pitched his mansion in the place of excrement— বিদ্যাপতিতে আছে, কিংবা হতে পারে যে-পদ এখন তোমাদের বলব তা গোবিন্দদাস ঝা-র, এখন আর তা আলাদা করে বলা যাবে না। কোনও কোনও পদে দু’টি নাম একাকার। কিন্তু এই ভাষালক্ষণ দেখো, এই ললিত বর্ণনা দেখো। এটা বিদ্যাপতিরই সম্পদ। এ নিয়ে আর সন্দেহই থাকে না। রাধাবিরহে কাতর কৃষ্ণ, সুবল তাঁকে সঙ্গ দিচ্ছেন। কৃষ্ণ বলছেন—

বেলজ সঞো যব বসন উতারল

লাজে লজওলি গোরী।

করে কুচ ঝাঁপইতে বিহুসি বয়নি ধনী

অঙ্গ কয়ল কত মোরি ॥

মাধব নির্লজ্জের মতো রাধার বসন খুলেছেন, রাধা লজ্জায় নীরব। তিনি হাত বাড়িয়েছেন কুচ দু’টির দিকে, রাধা শরীর মুড়ে বাধা দিচ্ছেন।

নীবিবদ্ধ খসইতে করে কর ধরু ধনী

পুণু বেকতে কুচ জোর।

দুহু সমধানে বিকল ভেল শশিমুখী

তব হম কোরে অগোর ॥

এত কহি বিষাদ ভাবি রহু মাধব

রাহিক প্রেমে ভেল ভোর।

দেখো, এখানে শরীরী মিলনের সব কথা বলা আছে কিন্তু এখানেই কবির জয়। মানবিক প্রেমেরও জয় এখানেই। এখানেই নারী ও পুরুষের সম্পর্কের স্বর্গীয় উদ্ভাস। শরীর পূর্ণ হলেও এই অতৃপ্তি থাকে। পরম মিলনের পরও মানুষ বিষাদে আক্রান্ত হয়।এরই নাম প্রেম। দৈহিক হলেও যা দেহাতীত। যা বিশুদ্ধ। যা সুন্দর।

আস্তে আস্তে রটনা হতে থাকছিল কলেজে। আনিসুজ্জামান স্যর মেয়েদের দিকে তাকিয়ে অশ্লীল কবিতা পড়েন। কেউ কেউ তা আমল দেয়নি কিন্তু কেউ কেউ দিয়েছিল। কোনও কোনও ছাত্র, যারা আনিসুজ্জামান সম্পর্কে খুবই সশ্রদ্ধ এবং অনুরাগী তারা মনস্থ করেছিল এ কথা জানানো হবে স্যরকে যাতে তিনি সতর্ক হতে পারেন। যারা আনিসুজ্জামান সম্পর্কে বিরূপ ছিল, এমনকী এর মধ্যে কয়েকজন অধ্যাপকও বর্তমান যাঁরা তাঁর সম্পর্কে কটূক্তি করতে রাজি ছিলেন, অতএব এই কানাঘুষো, যা মেয়েদের ঘিরে শুরু হল আর তার কেন্দ্রবিন্দুতে ডিপকাট লাল সালোয়ার কামিজ মেয়ে থাকল, যা আনিসুজ্জামানের এতদিনের অধ্যাপনা জীবনে আসেনি, এসে গেল এবার এবং সেইসব ছাত্র যারা আনিসুজ্জামানকে ভালবাসত তারা তাঁকে এ সব বলতে লাগল, আর সেইসব অধ্যাপক যাঁরা আনিসুজ্জামান সম্পর্কে কটুক্তি করতে চান তাঁরা সহ-অধ্যক্ষ দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়কে এ সব বলতে লাগলেন।

শুধু কিছু কবিতার পক্ষেই এমন আলোড়ন তোলা সম্ভব বা এমন কিছু ভ্রান্ত ধারণাও, যদি সেই কবিতার পাঠক যথার্থ শিক্ষিত না হয়ে থাকেন এমনই মতামত গ্রহণ করলেন দীপঙ্কর এবং আনিসুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলতে প্রবৃত্ত হলেন। আনিসুজ্জামান বললেন—অশালীন কবিতা? সে আবার কী? আমি তো বৈষ্ণব পদাবলীর ক্লাশ নিয়েছি ক’দিন। দীপঙ্কর জানান, একটি মেয়ে, সে বুঝি-বা আনিসুজ্জামানের মনোযোগ আকর্ষণ করে থাকবে এবং আনিসুজ্জামানও খুব সততার সঙ্গে একথা স্বীকার করেন যে একটি বিশেষ মুখ তাঁকে টানে কারণ সে-মুখে কিছু ভাষা থাকে আর কোন অধ্যাপকই বা অস্বীকার করবেন যে তাঁদের অধ্যাপনার কালে ছাত্র-ছাত্রীদের মুখে একটুখানি ভাষা তাঁরা কতখানি প্রত্যাশা করেন এবং তা পেলে শুধু আনন্দিত নন, কৃতজ্ঞও বোধ করেন তাঁরা ছাত্রছাত্রীদের প্রতি, অতএব এর মধ্যে কোনও অশালীনতা ছিল না যখন তিনি সেই মেয়েটির দিকে তাকিয়েছিলেন এবং এতটুকু যৌনতাবোধও জন্ম দিতে পারেনি ওই ডিপকাট কামিজ, যতই-না তিনি প্রেমের শরীরী অনুষঙ্গ সম্পর্কে নোট দিয়ে থাকুন। শরীরী ইচ্ছা সংযত রাখার বিপুল ক্ষমতা আনিসুজ্জামানের যা তিনি প্রয়োগ করে আসছেন সেই কাল থেকেই প্রায় যখন তাঁকে যুবক বলা যেত না এবং এই সংযম নিয়েই তিনি পড়ান কবিতা, যা রচনা করেছিলেন কবিকুলশিরোমণিরা দেশে দেশে, যুগে যুগে অথচ যাঁদের চিন্তাধারায় কোনও পার্থক্য ছিল না। আনিসুজ্জামান বলেন—‘ক্রেজি জেন টকস্ উইথ দ্য বিশপ’ বলেছিলাম বটে বিদ্যাপতি বলতে গিয়ে।

দীপঙ্কর উৎসাহিত হন। তাঁকে তন্ময় হতে দেখা যায় এবং তিনি বলতে থাকেন—ক্রেজি জেন? তুমি ক্রেজি জেন বলেছিলে?

That lover of a night

Came when he would,

Went in the dawning light

Whether I would or no;

Men Come, men go;

All things remain in God.

মনে আছে, মনে আছে তোমার? কী অসাধারণ লাইন! বলো! মেন কাম, মেন গো, অল থিংস রিমেইন ইন গড্‌। আর এরপরে আছে একটা অমোঘ লাইন। যা মানুষের প্রতি বা এই নগরায়নের প্রতি ধিক্কারও বটে আবার সাবধানবাণীও বটে। এর পরের লাইনটা। মনে আছে?

আনিসুজ্জামান বলেন—ব্যানারস চোক দ্য স্কাই/মেন-অ্যাট-আর্মস ট্রড…

দীপঙ্কর বলেন—ইয়েস! দোজ আর দ্য ওয়ার্ডস! ব্যানারস চোক দ্য স্কাই…জানো, কলকাতার দিকে তাকালেই আমার এ কথা মনে পড়ে আজকাল। ব্যানারস অ্যান্ড ব্যানারস। হোর্ডিংস অ্যান্ড হোর্ডিংস। সত্যিই আকাশটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দেখো। আর আজকাল হয়েছে, ওই অ্যান্‌টেনা, একটার পর একটা ছাদ ফুঁড়ে উঠছে, ম্যাজিশিয়ানের শূন্যে ভাসমান কঙ্কালের মতো…

আনিসুজ্জামান চারপাশে অসংখ্য কঙ্কাল দেখতে পান। নির্বোধ, হাড়সর্বস্ব কঙ্কাল। তবু, দীপঙ্করের সঙ্গে কথা বলার আনন্দ সান্ত্বনার মতো মনে লেগে থাকে। সেটুকু সম্বল করে আবার পড়াতে যান ক্লাশে এবং তাঁর মনে হতে থাকে, সারা ক্লাশ, বুঝি-বা তাঁর চোখের ওপর নজরদারি করছে, বুঝি-বা মুখ টিপে হাসছে এই ভেবে যে আনিসুজ্জামান স্যর কিছু সুযোগ নিচ্ছেন নিজস্ব ইচ্ছা প্রকাশের জন্য। তাঁর বিপন্ন লাগে। তবু তিনি এক কবিতা থেকে অন্য কবিতায় যান। কে জানে, কখন কার মধ্যে এতটুকু আলো জেগে উঠবে আর সে বুঝতে পারবে এইসব আশ্চর্য রচনার সার্থকতা, আর সে তখন সাগ্রহে পড়বে ‘ক্রেজি জেন অন গড’ এবং ‘ব্যানারস চোক দ্য স্কাই’! পড়ে আকাশের জন্য কষ্ট বোধ করবে।

আনিসুজ্জামান নিজের মতো করে পড়ান এবং নিজের কাজটি নিজের মতো করে করাই ভাল, এও তিনি বিশ্বাস করেন। তাঁর সময়সীমা পেরুলে তিনি চলে যান অধ্যাপকদের কক্ষে এবং সেখানে, কয়েকজন, তাঁকে—আর কতদিন ব্যাচেলর থাকবে, এ বার বিয়ে করো— গোছের উপদেশ দিতে শুরু করেন।

কলেজ থেকে ফেরার পথে আর মল্লিনাথের বাড়ি গেলেন না আনিসুজ্জামান। বেশ খিদে পেয়েছিল। সরাসরি বাড়ি চলে এলেন তিনি। নীলোফা গরম গরম সুজির পোলাও বানিয়ে দিল।আনিসুজ্জামান খেতে খেতে বললেন—ভাল রান্না করেছিস তো নীলু! কে শেখাল?

—মাসিমা

একটিও বাড়তি কথা বলে না নীলোফা। কিছু চায়ও না। মাঝে মাঝে রিপন স্ট্রিটের বাড়িতে যাওয়া ছাড়া তার আর যাবার জায়গাও নেই। ইদানীং সেখানেও আর যেতে চায় না সে। প্রত্যেকটি উৎসবে-অনুষ্ঠানে ও বাড়িতে যাবার আমন্ত্রণ পান তাঁরা। মাঝে মাঝে নীলোফাকে নেবার জন্য গাড়িও পাঠানো হয়। কিন্তু আনিসুজ্জামানের বাড়িতে আসার কোনও আগ্রহ ও বাড়ির লোকের নেই। তিনি কোনও উৎসব অনুষ্ঠানও করেন না যে ওঁদের আমন্ত্রণ করা যাবে। ইতিমধ্যে দুই চাচি গত হয়েছেন। মনিরুল তরুণী স্ত্রী নিয়ে সুখেই জীবন-যাপন করছেন দেখা যায়। কনিষ্ঠা স্ত্রীর গর্ভে, এই বয়সেও তিনটি বাচ্চা আনয়ন করেছেন তিনি। মায়ের মৃত্যুতে শোক পেয়েছিল নীলোফা, কিন্তু সামলে নিয়েছে। বড় চাচিকেই মা বলে জেনেছিলেন আনিসুজ্জামান। তাঁর মৃত্যুতে খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন তিনিও। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শোক প্রশমিত হয়েছে। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আনিসুজ্জামানও মনে মনে নীলোফার সে-দিনের সিদ্ধান্তের প্রশংসা না করে পারেননি। এটা ঠিক যে নীলোফা নিজে পালাতে চেয়েছিল। কিন্তু আনিসুজ্জামান নীলোফার কর্তৃত্ব ও দায়িত্ববোধের ওপর নিশ্চিন্তে নির্ভর করে ভাল আছেন এ নিয়েও কোনও সংশয় নেই।

নীলোফা এখানে কেমন আছে? আনিসুজ্জামান কখনও তা জানতে চাননি। কিন্তু এটুকু বলা যেতে পারে যে এখানে তার স্বাধীনতা আছে। এখানে পাড়ার লোক, গল্প শুনতে খুবই উৎসুক কিন্তু নিস্পৃহও। কখনও কোনও জমায়েত হলে কূট-কচাল, নিন্দে-মন্দ, আলোচনা-সমালোচনা চলে, কিন্তু ওই পর্যন্তই। যে যার ব্যক্তিগত জীবনপ্রবাহে স্বচ্ছন্দই থাকতে পারে। আনিসুজ্জামান ও নীলোফার জীবনযাত্রায় এ পাড়ার পরিবেশ সহায়কই হয়েছে। নীলোফা সেতার শেখে, গান করে, বাজারে যায়। নীলোফা সেলাই করে। বাংলা বই পড়ে। নীলিমার সঙ্গে কথা বলে আর মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে কেনাকাটাও করতে যায়। নীলিমার কাছে সে বুঝি কিছু স্নেহ ও প্রশ্রয়ও পায়। নীলিমা নানারকম রান্না নীলোফাকে শেখান এবং বই পড়ে তা নিয়ে কথা বলতে প্রবৃত্ত থাকেন। নীলোফা নিজের ইচ্ছেমতো রান্নাঘর গোছায়, ঘর সাজায় এবং কোনও কাজের লোক না রেখে সারা দিনমানের কাজ একাই সম্পন্ন করে। আনিসুজ্জামানের কোনও ছাত্র যখন এসেছে তখন রাত্রিবাস করুক বা না করুক নীলোফা তাদের যথাযথ আপ্যায়ন ও যত্ন করেছে। নীলোফা না থাকলে কী হত সে-সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই আনিসুজ্জামানের। হয়তো-বা ছাত্রদের এতখানি আপ্যায়ন করা সম্ভব হত না। হয়তো-বা ঘরের এই পরিচ্ছন্নতা, সুদৃশ্য পর্দা বা ফুলের টব, বাথরুমের গাছ বা ঝকঝকে রান্নাঘর থাকত না। আনিসুজ্জামান একা থাকা ও ঘরোয়া কাজ করা সম্পর্কে যে-কোনও ভারতীয় পুরুষের মতোই যোগ্যতা রাখতে অসমর্থ। নীলোফা যে-নিশ্চিন্তি ও সহায়তা তাঁকে দেয় তা গবেষণাধর্মী বই লেখার পরিকল্পনায় সাহায্য করে। কিন্তু সে সম্পর্কে আনিসুজ্জামান ওয়াকিবহাল নন। নীলোফা যখন দু’একদিনের জন্য রিপন স্ট্রিটে যায় তখন আনিসুজ্জামান একটু বিপন্ন বোধ করেন এই ভেবে যে হয়তো তাঁকে চা বানিয়ে খেতে হবে, যদিও তা কোনওদিন ঘটেনি কারণ নীলোফা না থাকলে নীলিমা খুব খুশির সঙ্গে আনিসুজ্জামানের দায়িত্ব গ্রহণ করে থাকেন। নীলোফার কোনও নিজস্ব প্রার্থনা বা চাহিদা আছে কিনা এ নিয়ে আনিসুজ্জামান কখনও ভাবেননি।

সুজির পোলাও খেয়ে আনিসুজ্জামান তাঁর প্রবন্ধের কাছে গেলেন। ঘুরে-ফিরে কলেজের কথা তাঁর মনে পড়তে লাগল। প্রবন্ধে মনোনিবেশ করতে না পেরে তিনি মল্লিনাথের বাড়ি যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন।

মাঝে মাঝে নিশুতি রাতে বেরিয়ে পড়েন আনিসুজ্জামান। হয়তো ঘুম আসে না তাঁর। কিংবা নিশুতি রাত, যা চেনা পৃথিবীটাকে অচেনা করে দেয়, কিংবা দিনের বেলায় বা প্রথম রাত্রে যা উচ্চারণ করতে পারে না মানুষ এবং যে-আবেগ অন্তঃস্থ রাখে সেগুলি প্রকাশ করতে থাকে, আর তার কানাকড়ি আনিসুজ্জামান সংগ্রহ করতে সক্ষম হন এ সময়েই। ফলে তিনি মধ্যরাত্রে ঘুরে বেড়ান কোনও কোনও দিন এবং দেখতে পান ওই পাঞ্জাবি পরিবারের জানালায় উঁকি মারে দুই যুবক বা যৌবনসমৃদ্ধ দম্পতির ঘরে উঁকি মারে এবং এই ইচ্ছে প্রকাশ করে যে তারা অন্তত একদিন কোনও পাঞ্জাবি মেয়ের সঙ্গে শুতে চায়। আনিসুজ্জামানের মনে হয়, ইচ্ছেটা অতি সামান্য বটে, তবে অতি নীচ। তিনি পথে চলতে চলতে দুঃখবোধ করলেন যখন ওই যুবকদ্বয় চমৎকার পোশাক পরে, শিক্ষিত মুখ নিয়ে হেঁটে গেল।

মল্লিনাথ তখন কোনও ঘরের আলো জ্বালেননি। সমস্ত নীরব এবং অপ্রীতিকর সন্ধ্যা, যা তিনি এতকাল কাটিয়ে এসেছেন, অদৃশ্য রূপচাঁদের সন্তোষবিধানের নিমিত্ত এতকাল যে আধা-সংসারী জীবন-যাপন তাঁর ছিল, আজ তার সমাপ্তি ঘটেছে। দেওয়ালে অমল-কমলের ছবি, দেওয়ালে মাধবী ও মল্লিনাথের ছবি। কিন্তু সবই পুরনো, হলদেটে। যখন মল্লিনাথ রূপচাঁদকে সর্বস্ব অর্পণ করেননি তখনকার আবছা সংসারচিত্র। আজ মল্লিনাথ থেকে থেকে এইসব দেখছেন। এই ছেলেকে দাহ করে এসেছেন, যে এক আশ্চর্য চিঠি তার ভাইকে লিখেছে। যে তার পিতাকে সমস্ত ঘটনানুক্রমের জন্য দায়ী করে, ঘৃণা করে চলে গেছে। সে কি সত্যি জেনেছিল, মারা যাবে? মল্লিনাথ চিকিৎসাশাস্ত্রজ্ঞান থেকে ভ্রষ্ট হতে থাকেন। যন্ত্রচালিতের মতো ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় এসে দাঁড়ান ওষুধভর্তি আলমারির সামনে। আলমারির কাঁচে তাঁর প্রতিবিম্ব। হালকা প্রতিবিম্বকে ভেদ করে যাচ্ছে ওষুধের বিচিত্র নাম। তিনি পড়ছেন— …জেসিক। …সায়ানিন। …প্লক্স। …সিলিন। স্মরণ করার চেষ্টা করছেন বিভিন্ন কম্পোজিশন। বাইক্লোমেথাসোন ডাইপ্রোপায়নেট। ডাইক্লোফেনাক ডাইয়েথাইলামাইন। মেট্রোনিডাজোল। বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিচ্ছে মল্লিনাথের কপালে। পূর্ণ ঘূর্ণায়মান পাখার নীচে দাঁড়িয়েও তাঁর পিঠ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। তাঁকে একলা রেখে দুই ছেলে চলে গেল। একজন কথাটিও বলল না। একজন মুখ ঘুরিয়ে রইল। বলল না, বাবা, তুমিও চলো। বাবা, একলা, এত বড় বাড়িতে তুমি কেমন করে থাকবে!’

আর মাধবী? মল্লিনাথের আজ এত বছর পর মনে হচ্ছে, মাধবী, পাগলিনী হয়ে, অর্থহীন হয়েও, সারা ঘর জুড়ে ছিল। সেও কি ছেড়ে গেল না মল্লিনাথকে? রেখে গেল না, একা? এবং ওই ঔষধসমূহ। প্রেসক্রিপশন লিখতে বসলে যারা ধরা দেয় না মল্লিনাথকে, হতে পারে তা মানসিক চাপে, হতে পারে পুত্রশোকে, হতে পারে ধারাবাহিক ও প্রলম্বিত, অতিভারনুব্জ্য ওই কালীপূজার ধারণে, কিন্তু তারা এতদিন মল্লিনাথে অধিষ্ঠিত ছিল আপন শ্বস-প্রশ্বাসের মতোই এবং আজ নেই! মল্লিনাথ শঙ্কিত হয়ে আছেন। ওষুধের রাসায়নিক মনে আছে তাঁর, হায়, নাম মনে নেই। অপরিপূর্ণ স্বামীর মতো, অপরিপূর্ণ পিতার মতো, অপরিপূর্ণ সংসারীর মতো, অপরিপূর্ণ ডাক্তার হয়ে যাবার ভয়ে তিনি শ্রান্তি বোধ করেন এবং ওই শ্রান্তি তাঁকে আরও একলা করে দিতে দিতে উপলব্ধি করিয়ে নেয়, এই ভার দুর্বহ, এই একাকিত্ব অসহনীয়। ঘড়ির একটানা টিক টিক শব্দ তাঁর মাথা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয় নিষ্ঠুর হত্যাকারীর অভিপ্রায়ে এবং তিনি দু’হাতে মাথা আঁকড়ে কাঁপেন। এবং বিন বিন করে নেমে আসতে থাকা ঘামের অনুভবের সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পান দরজার বেল বাজছে। তিনি ছোটেন। কেউ এসেছে। হ্যাঁ। কেউ এসেছে নিশ্চয়ই। কোনও মানুষ। কোনও দানব। কোনও আত্মা বা প্রেতাত্মা। রূপচাঁদ—যিনি স্বপ্নে দেখা দেন ; অমলেন্দু—যে আগে থেকে মৃত্যুর দিন নির্ধারণ করে রাখে। মলিনাথ দরজা খুললেন। আনিসুজ্জামান দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞেস করছেন—ডাক্তারদা, আপনি অসুস্থ?

মল্লিনাথ হারিয়ে গিয়েছেন। এ কে? রূপচাঁদ নন। মাধবী নন। অমলেন্দু—কমলেন্দু নয়। ঘামে ভেজা মুখে, শূন্য দৃষ্টি মেলে আনিসুজ্জামানের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। আনিসুজ্জামান আবার জিজ্ঞাসা করছেন—ডাক্তারদা, কী হয়েছে? আপনি কেমন আছেন?

মল্লিনাথ ক্রমশ দুষ্ট আত্মাদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে থাকেন। পরিত্রাণ পেয়ে ফিরে আসেন এবং ধীরে ধীরে তাঁর দৃষ্টি অভিব্যক্তি ফিরে পায়। বেদনার মতো এক হাসি ফুটে ওঠে তাঁর ঠোঁটে। তাঁকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত এবং ক্লান্ত লাগছে এখন। তিনি বলছেন—এসো। অধ্যাপক। ওরা সবাই আজ চলে গেল।

আনিসুজ্জামান ঘরে পা রাখেন। জুতো খুলে খোলা পায়ে মেঝে স্পর্শ করেন তিনি। তাঁর চোখে প্রশ্ন ও বিস্ময়। তিনি জিজ্ঞাসা রাখেন—কারা চলে গেল, ডাক্তারদা?

—মাধবী। কমল। কমল ওর মাকে নিয়ে চলে গেল।

—চলে গেল? কেন?

—মায়ের চিকিৎসা করাতে চায়। আমি যে-দায়িত্ব পালন করিনি তাই করতে চায় সে। অধ্যাপক, তুমি কি জানো, মানুষ আগে থেকে তার মৃত্যুর সময় ঘোষণা করতে পারে? ধরো তা আত্মহত্যা নয়, অসুস্থতা, তবু?

আনিসুজ্জামান মল্লিনাথের অবস্থা অনুমান করেন। তাঁর কপাল কুঁচকে যায়। সাদা-কালো শ্বেতিচিহ্নিত কপালে কয়েকটি বাঁকাচোরা দাগ পড়ে। তিনি চিন্তিত মুখে বলেন—মৃত্যুর সময় বুঝতে পারা? এরকম শুনেছি কয়েকবার। কিন্তু এর কি কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে?

—শ্রীরামকৃষ্ণদেব গিরীশ ঘোষের রোগ গ্রহণ করেছিলেন, এর কি কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে? সবাই বিজ্ঞান খোঁজে। প্রমাণ খোঁজে। অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দেয়। আমি কেন পারি না? কেন জেগে শান্তি পাচ্ছি না আমি? কেন ঘুমিয়ে শান্তি পাই না? সব ছাড়লাম, সব দিলাম, নিয়ম-নিষ্ঠা মেনে পূজা করে যাচ্ছি। তবু সে আমার পিছু ছাড়ে না কেন?

—কে? কার কথা বলছেন, ডাক্তারদা?

—রূপচাঁদ। রূপচাঁদ…

মল্লিনাথ অসংলগ্নভাবে রূপচাঁদের বৃত্তান্ত বলেন। স্বপ্নের কাহিনী শোনান। একে একে বলেন গঙ্গায় কাঠামো ভেসে আসার ইতিবৃত্ত। আনিসুজ্জামান স্তব্ধ হয়ে শোনেন। এতদিন কিছুই জানতেন না, কিছুই বলেননি মল্লিনাথ। এত ভার নিয়ে দিনযাপন করেছিলেন বোঝাও যায়নি কখনও। আনিসুজ্জামানের অস্থির লাগে। চেনা মুখের মধ্যেও, হঠাৎ, অজানিত, অপরিজ্ঞাত জীবন দেখতে পেয়ে তিনি দিশেহারা বোধ করেন। মল্লিনাথ বলে যান—তোমার বউদি কালীবেশে আমার কাছে এসেছিলেন।

—সেকি?

—হ্যাঁ, কালীবেশ ধরে আমার কাছে পূজা চাইছিলেন তিনি। এ কি কালীরই কোনও নির্দেশ? এ কি মায়েরই ইচ্ছা? নাকি স্বামী হিসেবে আজীবন যে পূজা আমার তাকে দেবার কথা ছিল, তা দিইনি বলে, যাবার আগে আমার কাছে পেতে চেয়েছিল! তার কাছে কি পুত্রশোকের চেয়েও বড় ছিল সেই শোক যা তার যৌবনকে লাঞ্ছিত করেছে? কিন্তু আমি তো সব ভুলে গিয়েছি। সব হারিয়ে ফেলেছি। মায়ের পূজা ছাড়া আমার যে আর কিছুই করার উপায় নেই।

খুবই ব্যক্তিগত কথা বলছেন মল্লিনাথ। আনিসুজ্জামান বাধা দেন না। মল্লিনাথকে তাঁর অপ্রকৃতিস্থ লাগে। হয়তো জমে থাকা শোক, কষ্ট, যন্ত্রণা তাকে এ মতো মানসিক অবস্থায় নিয়ে গেছে যা অফুরন্ত কথা বললে প্রশমিত হতে পারে। মানুষ কথা বলতে চায়। প্রকাশ করতে চায়। কিন্তু পারে না। আত্মপ্রকাশের উপযুক্ত ক্ষেত্র কই! কিন্তু অনেক সময় স্থান-কাল-পাত্রের জ্ঞান থাকে না। তখন শুধু কথা বলতে ইচ্ছে করে স্বগতোক্তির মতো। সে-সব আর কারওকে শোনানোর জন্য নয়। নিজের জন্য। নিজের ভেতরকার বিশ্লেষণের জন্য। এ সব যে শোনে সে উপলক্ষ্য মাত্র। তাকে অলিখিত, অনুচ্চারিত প্রতিশ্রুতি দিতে হয় ভুলে যাবার। আর তেমনই প্রতিশ্রুতি সমেত আনিসুজ্জামান শুনে যান মল্লিনাথের কথা—আমি ওষুধের নাম ভুলে যাচ্ছি, অধ্যাপক। আমি ডাক্তারি পড়তে গিয়ে গোল্ড মেডেল পেয়েছিলাম। আমি ওষুধের নাম ভুলে যাচ্ছি। এ সবই কি তাঁরই নির্দেশে? মা কি চান আমি সব ভুলে তাঁরই ভজনা করি? এ জন্যই কি তিনি সবাইকে, সবকিছুকে আমার থেকে দূরে নিয়ে গেলেন? আমি তো দুই-ই চেয়েছিলাম! জানো, অমল যখন ছোট ছিল, খেজুর খেতে ভালবাসত। পুজোর দিন বলত—বাবা, খেজুরগুলো আমার তো? ওর জন্য প্রসাদে অনেকটা খেজুর দিতাম আমি। সেই অমল আমাকে ঘৃণা করে চলে গেল। আমার জন্য ও মৃত্যুর কাছে গেল। তা হলে কি আমি আমার পুত্র-হন্তারক হলাম? তোমার বউদির জন্য, অমল-কমলের মায়ের জন্যও কি আমিই দায়ী রইলাম?

আনিসুজ্জামান বিপন্ন বোধ করেন। কী বলবেন, কী বলতে হয় ভেবে পান না। বলেন— আপনার বিশ্রাম প্রয়োজন। আপনি তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ুন। ঘুমিয়ে নিন।

—ঘুম? আসে না। এলেও স্বপ্নে তিনি আসবেন, আমার ভয় করে। ঘুমোতে ভয় করে।

—একটা ওষুধ-টষুধ খান বরং। ঘুম গাঢ় না হলে আমরা নানা রকম স্বপ্ন দেখি। আপনাকে আমি আর কী বলব?

—ওষুধ? হ্যাঁ…ওষুধ…কিন্তু কী খাই বলো তো? আমাকে কি তুমি কিছু দিতে পারো, অধ্যাপক? কোনও ওষুধ? আমার মাথার ভেতরটায় যন্ত্রণা হয়। কবে থেকে যে হচ্ছে তাও মনে করতে পারি না। কিন্তু থামে না। ওষুধ খেয়েও কিছু হয় না।

—অন্য কোনও ডাক্তার দেখিয়ে নেবেন একবার?

—নাঃ। অন্য ডাক্তার আমাকে কী করে সারাবে! আমার এ যন্ত্রণা সারবার নয়। তুমি বরং আলমারিটা খোলো। আমাকে একটা ওষুধ দাও। যদি ঘুমোতে পারি!

আনিসুজ্জামান ইতস্তত করেন। ওষুধ দেবার তিনি কেউই নন। বলেন—আমি বরং যাই একবার। শিবতোষকে ডেকে আনি।

—নাঃ। থাক। আমার ওষুধ দরকার নেই।

আনিসুজ্জামানের কষ্ট হয়। তিনি প্রসঙ্গান্তরে যাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু অন্য কোনও প্রসঙ্গেরই অবতারণা সম্ভব হয় না। কৌতূহল, অকারণ অসভ্য কৌতুহল তাঁকে গোপনে প্ররোচিত করে। ক্ষয়ে যাওয়া মানুষটিকে খুঁচিয়ে তোলেন তিনি। তাঁর কষ্ট হচ্ছে, তবু, অপরাধী লাগছে, তবু। প্রশ্ন করেন—ওরা আপনাকে দায়ী করছে কেন?

মল্লিনাথ বলেন—পূজা করেছি তো! শুদ্ধভাবে পারিবারিক প্রথা মেনে পূজা করেছি। যাবতীয় সাংসারিক অকল্যাণের কারণ হিসেবে ওই পূজাকেই দেখেছে ওরা। আমি তো চাইনি। দায়িত্ব নিতে চাইনি। কিন্তু মা যদি যেচে আসেন…অধ্যাপক…একটা ওষুধ আমাকে দিয়ে যাও। মাথাটা আমার বড্ড যন্ত্রণা করছে।

আনিসুজ্জামান ওষুধের আলমারির কাছে যান। আলমারিতে চাবি দেওয়া নেই। তাঁর স্নায়ু দুর্বল হয়। কখনও কি ভেবেছেন, একজন ডাক্তারকে ওষুধ দেবেন? কারওকেই দেবেন? ওষুধের স্ট্রিপ ঘাঁটেন তিনি। হাল্‌কা পরিমাণ কিছু ওষুধ পেয়েও যান হাতে। আলমারি ভর্তি পরিচিত-অপরিচিত ওষুধ। মল্লিনাথ এগুলো বিলিয়ে দেন তাদের যারা ওষুধ কিনতে পারে না।

আনিসুজ্জামান জিজ্ঞেস করেন—ক’টি দেব?

—দু’খানা দাও।

জাগ থেকে গ্লাসে জল ঢালেন আনিসুজ্জামান। দু’খানা ওষুধ আর এক গ্লাস জল বাড়িয়ে দেন মল্লিনাথের দিকে। মল্লিনাথ ওষুধ দু’টি নেন কিন্তু জল গ্রহণ করেন না। হঠাৎ হাসেন। সশব্দ, দীর্ঘায়িত। আনিসুজ্জামানের কাছে তা ভৌতিক বা অস্বাভাবিক মনে হয়। তাঁর এই প্রত্যয় হতে থাকে যে মল্লিনাথ তীব্র মানসিক চাপে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। কিন্তু হঠাৎই, ঝোড়ো উদ্‌ভ্রান্ত বৃষ্টি যেমন সবকিছু ভিজিয়ে দাপিয়ে থেমে যায়, তেমনি চুপ করে যান তিনি।

আনিসুজ্জামান, আহত, অপমানিত অবস্থান সম্পর্কে অবহিত হতে থাকেন। জলের গ্লাস নামিয়ে রাখেন টেবিলে। তাঁর মনে ছিল না। তাঁর মনে থাকে না। ধর্মীয় পরিচয় তিনি কাঁধে করে বেড়ান না পেশাদার শববাহকের মতো। কিন্তু তাঁকে মনে পড়িয়ে দেয় সমস্ত মানুষ। যাঁরা মুসলমান তাঁরা বলেন তুমি হিন্দুঘেঁষা, সাবধান হও, আমাদের থেকে দূরে থাকো। যাঁরা হিন্দু তাঁরা বলেন তুমি হিন্দু নও, তফাৎ যাও। জল ছুঁয়ো না। আনিসুজ্জামান বলেন—আমি দুঃখিত, ডাক্তারদা। আমার বোঝা উচিত ছিল।

মল্লিনাথ আনিসুজ্জামানের কথায় কান দেন না। আপনমনে বলে চলেন—আমি হিন্দু। ব্রাহ্মণ। শ্মশান-কালিকা পূজা করি। ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য কারও ছোঁয়া জল আমার চলবে না। অধ্যাপক দেখো। আমি কীরকম নীচ, ঘৃণ্য। হতে পারি আমি পুত্রহন্তা। হতে পারি স্ত্রীকে পাগল করে দেবার মতো ক্ষমতাবান। তুমি আমার খবর নিতে এসেছিলে। আমার শুশ্রূষা করতে চেয়েছিলে। তবু, তোমাকে আমি অপমান করছি। কিন্তু বিশ্বাস করো। আমার কোনও উপায় নেই।

আনিসুজ্জামান বেরিয়ে আসছেন। মল্লিনাথ কি ওষুধটা খেলেন? না, আর ভাববেন না তিনি। কী যায় আসে এ সবে? তাঁর ক্রোধ জাগে না। সহস্র বৎসরের সংস্কার। প্রতিনিয়ত মানুষকে অবনমিত করে। এই বিংশ শতকের শেষেও জন্মদাগের মতো লেগে আছে কোনও কোনও মানুষের চেতনায়। আনিসুজ্জামান বাড়ির দিকে এগিয়ে যান। হারুর দোকানের সামনে ছেলেরা আড্ডা মারছে। নানা বয়স, নানা পার্টি, নানা সামাজিক অবস্থান ও শিক্ষার মানুষ। পরস্পর তর্কাতর্কি করছে। বিষয় জ্যোতি বসুর সাম্প্রতিক বক্তৃতা। বিষয় ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা ঘোষণাজনিত অভিসন্ধি। আনিসুজ্জামান জানেন না এরা পরস্পর বন্ধু কি না। শত্রু হওয়াও সম্ভব। অথবা কোনও কিছুই নয়। বন্ধু বা শত্রু। হঠাৎ কোনও ঘটনা ঘটবে আর তার নিরিখে যে যার মতো নিজস্ব অবস্থান ও পরিচয় ঘাঁটতে ঘাঁটতে পাশের জনের বন্ধু বা শত্রু হওয়া নির্ণয় করবে। যেমন মল্লিনাথ, এতদিনের পরিচয়ের পর ইদানীং তাঁর সত্যদর্শন হচ্ছে যে ব্রাহ্মণ ছাড়া আর কারও হাতের জল তাঁর চলবে না। কিছুদিন হল কালীতারার রান্নাও ত্যাগ করেছেন তিনি। স্বপাক খাচ্ছেন। ডাক্তার মল্লিনাথ, যিনি সারা জীবনে নানা শরীর স্পর্শ করেছেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ না মেনেই, যিনি এতকাল সমস্ত কর্তব্য সম্পাদনও করেছেন কোনও কিছু প্রাধান্য না দিয়েই, তিনি আনিসুজ্জামানকে প্রত্যাখ্যান করছেন, আর আনিসুজ্জামানের পক্ষে তা মেনে নেওয়া কষ্টকর কারণ এ পাড়ায় প্রথম এসে মল্লিনাথের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয় বয়সের পার্থক্য সত্ত্বেও এবং মল্লিনাথই তাঁকে নিয়ে যান ব্রজগোপালের দোকানের আড্ডায় এবং তিনি ক্রমে পাড়ার একজন হয়ে পড়েন। এখন, এ সমস্ত ঘটনানুক্রমে আনিসুজ্জামানের দৃষ্টি বিকশিত হয় এবং তাঁর গলা বেয়ে নেমে আসে তেতো স্বাদ আর তা নাভি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এই অপমান। কিন্তু এ অপমান এমনই মানুষের দেওয়া যাঁর কথা আনিসুজ্জামান কারওকে বলতে পারবেন না। নিজের বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকেন তিনি। সারা জগতের প্রতি তাঁর অভিমান জন্ম নেয়। এবং আবারও এক আশ্চর্য উপলব্ধি যা তাঁকে, বরাবর, মানবচরিত্র খুঁড়তে প্ররোচিত করেছে। কিংবা অনুপ্রাণিত। প্ররোচনা বা অনুপ্রেরণা যাই হোক, আনিসুজ্জামান যন্ত্রণা টের পান। সেই যন্ত্রণা যা মানুষই মানুষকে দিয়ে থাকে।

মল্লিনাথের পরিবার মল্লিনাথকে পরিত্যাগ করেছেন কারণ তিনি পূজাপালন করেছিলেন। আনিসুজ্জামান তাঁর পরিবার দ্বারা অর্ধপরিত্যক্ত কারণ তিনি যথাযথভাবে ধর্মাদেশ মানেননি। প্রত্যেকেই মানুষ। এ দেশের। এ যুগের। তাঁর মনে পড়ে সারি সারি মুখ। জামাল কৌশিক। মনোজ। সৌমিত্র। দেবাৰ্চন। নীলাদ্রি। তাদের স্বপ্ন হারিয়ে গেছে। তারা কি জেনেছিল এই দেশকে? মাটিকে? শুধু ধান-গম নয়, এ মাটিতে জন্মেছে শোষণ ও হত্যা। শুধু প্রেম-ভক্তি নয়, এ মাটিতে আছে তীব্র কুসংস্কার, কঠিন ধর্মসংকট এবং ঘৃণা। আদিগন্তবিস্তৃত ঘৃণা। এ সব কি জানেনি তারা? বোঝেনি? রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যাওয়া এই ঘৃণার বিষ থেকে কী করে রক্ষা পাবে এ দেশ! কারা রক্ষা করবে? তাঁর মনে পড়ে লাল ডিপকাট আঁটো কামিজ, মনে পড়ে ক্লাশরুমের সমস্ত শূন্য মুখ—কোথাও এতটুকু আলো জ্বলে না। আনিসুজ্জামান দরজার বেল বাজান। নীলিমার ঘর থেকে মধুকণ্ঠের রবীন্দ্রসঙ্গীত ভেসে আসে—…যে সুধারস পানে ত্রিভুবন মাতে তাহা মোরে দাও, হৃদয় ভরে দাও… আনিসুজ্জামানের বলতে ইচ্ছে করে—হৃদয় ভরে দাও— কিন্তু কাকে বলবেন? হৃদয়ভরণ কারওকেই তিনি খোঁজেননি কোনওদিন। বিনা খোঁজে কাটিয়ে দিলেন অর্ধ জীবনকাল।

নীলোফা দরজা খুলে দেয়। হাতের আঙুলে মেরজাপ। সেতার বাজাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল সে। আনিসুজ্জামানের মুখ তার নজরে আসে এবং সে জিজ্ঞাসা রাখে—কিছু হয়েছে? ভাইজান?

আনিসুজ্জামান মাথা নাড়েন। কিছু হয়নি। তিনি পাঞ্জাবি খোলেন। তাঁর শ্বেতরোগাক্রান্ত ছোপ ছোপ শরীর দৃশ্যমান হয়। তিনি বলেন—একটু বাজিয়ে শোনাবি? নীলু?

—হ্যাঁ ভাইজান।

নীলোফা নিজের ঘর থেকে সেতার আনতে যায়। আনিসুজ্জামান ঘরের চড়া আলো নিবিয়ে মৃদু আলোটি জ্বেলে দেন। নীলোফা তার সামান্য আয়ত্তে আসা রাগ বাজাতে শুরু করে। মাঝে মাঝে আনিসুজ্জামান শুনতে চান বটে, বিশেষ করে যে দিনগুলোয় তিনি অস্থির থাকেন, নীলোফা শোনায়, কিন্তু শোনাতে লজ্জাও বোধ করে কারণ যেটুকু সে শিখেছে, সেটুকু, কখনও কারওকে শোনাবার মতো নয়। তবু, আনিসুজ্জামানের কথা সে ফেলতে পারে না বলে হাত লাগায়।

প্রয়োজনের বাইরে নীলোফা ও আনিসুজ্জামানের মধ্যে কোনও কথা হয় না। কিন্তু প্রয়োজন হলে কথা না হবারও কোনও কারণ ঘটে না। হয়তো-বা, সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে, নীলোফা পুড়ে না গেলে, আনিসুজ্জামান রোগাক্রান্ত না হলে, তাঁদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়া সম্ভব ছিল। যদিও এ পরিবারে, খুল্লতাত ভাই-বোনে বিবাহরীতি নেই কিন্তু তা হওয়ার মধ্যে কোনও নিষেধও নেই। বহু আগে এ পরিবার হিন্দু ছিল এবং পরে ধর্মান্তরিত হয় ফলে কিছু কিছু পারিবারিক রীতি বজায় থেকেই যায়। তাদের বংশে এ এক অনুচ্চারিত নিয়ম এবং তা থাকা সত্ত্বেও ভাই-বোনের মধ্যে দুস্তর শীতল দেওয়াল থাকে যা অতিক্রম করা কঠিন। যেমন নীলোফা আনিসুজ্জামানের ঘরে বসে সেতার বাজাচ্ছে এখন এবং মনে মনে কুণ্ঠিত হয়ে আছে কারণ আনিসুজ্জামানের উপস্থিতিতে সে সাধারণত এ ঘরে আসে না এবং তিনিও যান না নীলোফার ঘরে। তাঁদের মধ্যে কোনও ছিটকিনি দেওয়া দরজা নেই, আবার দরজা ডিঙোনোও নেই। এই ঘর নীলোফাই পরিষ্কার করে। গোছায়। এ ঘরের সব ঝুল, সব ধূলিকণা তারই হাতে বিদূরিত হয়। বিছানার চাদর ও বালিশঢাকনা সে-ই কাচে এবং বই গুছিয়ে রাখে। কিন্তু, আনিসুজ্জামানের উপস্থিতিতে এ ঘর তার কাছে অচেনা থাকে। সকালে ঘুম থেকে উঠে আনিসুজ্জামান লবিতে আসেন এবং খাবার টেবিলে বসে লেখাপড়ার কাজটি সম্পন্ন করতে থাকেন। নীলোফার সঙ্গে তাঁর যাবতীয় কথা এখানেই হয়। এখন সে বসে আছে এ ঘরের মেঝেয় এবং এ ঘরের মৃদু আলোর মতো মৃদুভাবে রাগ বিস্তার করছে। সামান্য যে ক’টি রাগ সে কিছু কিছু আয়ত্ত করেছে, তারই থেকে বেছে নিয়ে বিস্তার করছে। মাঝখানে ধৈবত রেখে দু’পাশের কোমল ও শুদ্ধ নিষাদ নিয়ে সুর খেলাতে খেলাতে ধৈবত টপকে নেমে আসছে মধ্যমে, গান্ধারে। আর মধ্যম-গান্ধার গায়ে গায়ে আন্দোলিত হচ্ছে। মন্দ্র থেকে মধ্য সপ্তকে এসেছে তার বিস্তার। সে মিয়ামল্লার বাজাচ্ছে। এখন বর্ষা নয়, মধ্য রাত্রি নয়, তবু বাজাচ্ছে। আনিসুজ্জামানের মনে হচ্ছে চারপাশ স্নিগ্ধ হল। তাপিত হৃদয় স্নিগ্ধ হল। তিনি জানালার পর্দা তুলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে স্থির শুয়ে রইলেন। কিন্তু চিন্তায় অস্থিরতা গেল না। কলেজের কথা মনে পড়ছে। মল্লিনাথের আচরণ মনে পড়ছে। বড় চাচি, ছোট চাচি, মনিরুলের কথা। তাঁরা, নীলোফাকে আনিসুজ্জামানের সঙ্গে দিয়ে দিয়েছেন। নিজের সুবিধার জন্য জীবন্মৃতকে পার করেছেন। আপদ আপনি বিদেয় হতে চাইল যখন তখন আর সুযোগ হাতছাড়া করেননি। এক আপদকে অন্য আপদের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন। একটি বিকৃত মুখকে পাঠিয়েছেন অন্য এক বিকৃত মুখ দর্শনের জন্য। তাঁদের খেয়াল রাখতে ইচ্ছে করেনি যে আনিসুজ্জামান যুবক একজন আর শ্বেতীচিহ্নিত হলেও সে পুরুষ। আর নীলোফা যৌবনকন্যা পোড়া ও বীভৎস হলেও সে নারী। যে কোনও মুহূর্তে এই দু’টি পরিচয় অন্য সবকিছুকে ছাপিয়ে যেতে পারে কারণ তাঁদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক সম্ভব। তাঁদের পরিবারে যদিও খুল্লতাত ভাইবোনে বিবাহের রীতি নেই, তবু! নাকি এও এক কূটচাল। যে কূটচাল দিতে মানুষের ভুল হয় না। তাঁদের দু’জনকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে যদি কোনওভাবে আনিসুজ্জামানের দ্বারা নীলোফার গতি হয়… …।

আনিসুজ্জামান এক হাতে নিজের গলা টিপে ধরেন। নিজের ওপর ঘেন্না হয় তাঁর। নিজের মধ্যেকার জটিল ভাবনার রাক্ষস মুখ দেখে ক্লান্ত বোধ করেন তিনি। নীলোকার মগ্ন নির্ভরশীলতা ও বিশ্বাসের বিপরীতে এই ভাবনার জন্য তিনি নিজেকে ক্ষমা করতে পারেন না। তাঁর চোখ খুলতে ভয় করে, বুঝি, চোখ খুললেই নীলোফা সব পড়ে ফেলবে আর ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেবে। নীলোফার জন্য মায়া জাগে তার। ভাবতে থাকেন তিনি, আহা মেয়েটা, আহা! সমস্ত সৌন্দর্যবিহীনতাকে সারাদিন আড়াল করে বেড়ায় সে। আর তাঁর লাল কামিজের মেয়েকে মনে পড়ে। সমস্ত সৌন্দর্যকে যে উগরে দেয়। আর এই ওগরানোর মধ্যে নিহিত থাকে এমন তীব্রতা যা সৌন্দর্য পোড়ায়। আনিসুজ্জামানের পক্ষে তা কষ্টকর এবং দুঃসহ হয়ে থাকে যা তাঁর কাছে প্রায় সৌন্দর্যহীনতারই সমার্থক।

নীলোফা একমনে বিস্তার করে। শুধুই বিস্তার করে। বুঝি-বা বিস্তৃত সুরে সে আকাশকে ছুঁয়ে ফেলতে চায়। ব্যানারে, হোর্ডিং-এ, বিজ্ঞাপনে লাঞ্ছিত হয়ে যাওয়া আকাশে সুর পৌঁছে দিয়ে মেঘ ডেকে আনতে চায়। আর মেঘেরা সব, ব্যানারের ফাঁক-ফোকর গলে, নীলোফার সুর ধরে একসময় কখন যেন ঢুকে পড়বে মাথুরের গড়ে আর বৃষ্টি ঝরিয়ে দেবে, এই তাপিত ফ্ল্যাটবাড়ির দেওয়ালগুলো ভিজে যাবে তখন আর ঠাণ্ডা হবে। আনিসুজ্জামান ঘুমোবেন। সব ভুলে ঘুমোবেন। ঘুমিয়ে পড়বেন। ঘুম… ঘুম…।

সমস্ত কুটিল মুখের থেকে দূরে সরে যান আনিসুজ্জামান। ঘুমে ডুবে যান। শুক্লপক্ষের রাত্রে আকাশে চুপিসাড়ে মেঘ ঘনায়। নীলোফা, বিস্তারের মধ্যেই থামিয়ে দেয় বাজনা এবং সেতার তুলে রাখে। আনিসুজ্জামানের জানালার কাছে এসে দাঁড়ায় সে একবার। পেছনদিককার ঝাঁকড়া ঝুপসি আমগাছটি দেখে। মৃদু বিদ্যুৎ কাঁপে আকাশে। বুঝি বৃষ্টি হবে! বুঝি দিগন্তের মেঘ ছেয়ে যাবে সমস্ত আকাশ। আনিসুজ্জামানের খাওয়া হয়নি। তবু, নীলোফা, তাঁর ঘুম না ভাঙানোর সিদ্ধান্তই নেয় এবং নিজের খাবারের থালা নিয়ে ব্যালকনিতে তার গাছেদের কাছে দাঁড়ায়। সে ভাবতে থাকে, ডাইনিং টেবিলের চেয়ারটি টেনে নেবে এবং বসবে এখানে। সে-মতোই সে করে এবং দেখতে পায় আকাশে বেড়ে চলেছে বিদ্যুতের পরিমাণ। তার আনন্দ হয়। ওই মেঘের সঙ্গে নিজের সংযোগ স্থাপন করে মন ভরে তুলতে থাকে। বুঝি-বা সে মিঞামল্লার বাজিয়েছিল বলেই গ্রীষ্মের ছুঁটে এসে গিয়েছে বর্ষা। সে ভাবতে থাকে, সত্যিই কি তেমন করে চাইলে আল্লা সব দেন যা কাম্য?

অন্যান্য দিন আনিসুজ্জামানের সঙ্গেই নীলোফা আহার করে থাকে। প্রথম-প্রথম, এখানে আসার পর, রিপন স্ট্রিটের বাড়ির রীতি অনুযায়ী আগে আনিসুজ্জামানকে, পুরুষমানুষের অগ্রাধিকার ও বিশেষত্বে খেতে দিত সে, পরে নিজে খেত। আনিসুজ্জামান নিজেই তা রদ করেছেন এবং এ সত্য প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে এক সঙ্গে খাবার মধ্যে যে পারিবারিক পরিমণ্ডল রচিত হয়, অন্য কিছুতেই তা হয় না। আজ একা একা খেতে নীলোফার ফাঁকা লাগছে। সে প্রত্যাশা করছে, যদি আনিসুজ্জামানের ঘুম আপনা থেকেই ভেঙে যায় তাহলে তাঁকে খাবার সাজিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তেমনটি ঘটে না। সেও অতৃপ্তির খাবার নিঃশেষ না করে রেখে দেয় এবং তার গাছদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে বলতে থাকে, তৈরি হও, তোমরা তৈরি হও, আজ বৃষ্টি আসবে।’ গাছেরা মাথা নাড়ে। ব্যালকনির গ্রিল গলে কিছু বৃষ্টির ভাগ জুটে যাবে তাদের নিশ্চয়ই। ফোঁটা না পাক ছাঁট পাবে। তাই নিয়ে খুশি থাকবে রাত্রিভর।

নীলোফা ব্যালকনির দরজাটি বন্ধ করে এবং নিজের ঘরে চলে যায়। পর্দা তুলে দেয় সে এবং শুয়ে শুয়ে দেখে দ্রুত ধাবমান মেঘ। যাকে মোটেই অন্ধকারে ঠাহর করা যায় না, শুধু জেগে থাকে, ঝলসে থাকে তার বিদ্যুতের চমক। আর সেই চমক দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে সে।

বৃষ্টির ছাঁটে ঘুম ভাঙল আনিসুজ্জামানের। ঘোর লাগা চোখে উঠে বসলেন তিনি। এখন কি মাঝরাত? কিছুই ঠাহর হল না। কখন বৃষ্টি নামল আর মেঘই-বা করেছিল কখন! বৃষ্টির ছাঁটে বিছানা ভিজে যায়। আনিসুজ্জামান জানালা বন্ধ করতে করতে পাকস্থলীতে খিদের যন্ত্রণা টের পান। তাঁর কি আজ খাওয়া হয়নি? মনে পড়ল মল্লিনাথের মুখ। মনে পড়ল, সেতার বাজাচ্ছিল নীলোফা আর তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। শীত-শীত করছে। পাঞ্জাবি টেনে গায়ে চাপালেন তিনি। তখনই মনে পড়ল, এই হঠাৎ বৃষ্টির কথা নীলোফা কি জানে? সে কি জানালা বন্ধ করেছে? যদি ভুলে যায়, যদি টের না পায় তার সেতার ও অন্যান্য বস্তু ভিজে যাবে। আনিসুজ্জামান, নীলোফার ঘরের পর্দা সরিয়ে ঢোকেন। না। জানালা বন্ধ করেনি নীলোফা। ছাঁট ঢুকছে ঘরে। বৃষ্টিতে সে জাগেনি। অন্ধকারের নিজস্ব আলোয় দেখা যাচ্ছে তার শয়ান।

নারী-অবয়বের প্রান্তে আবছায়া মুখ। আনিসুজ্জামানের কল্পনায় তা মাধুর্যে মণ্ডিত হয়। কবে একদিন দেখে ফেলা কোন বাঁশের বেড়ায় ঘেরা ঘরের মধ্যেকার দৃশ্যাবলী ছিঁড়ে-ফেলা চিঠির মতো ভেসে বেড়ায়। ওই দৃশ্যই তাঁকে কামবোধে প্ররোচিত করেছিল এবং ওই দৃশ্য থেকেই তিনি পালিয়ে বেড়িয়েছেন এবং সংযত থেকেছেন প্রত্যয়ী ব্রহ্মচারীর মতো। আজ, আনিসুজ্জামান বিদ্যুৎ দ্বারা, মানসিক অস্থিরতা দ্বারা, শরীর কল্পনা-স্মৃতি দ্বারা প্ররোচিত হন আবার এবং তাঁর, এতদিন আগলানো সংযমের ঘাড়ে থাবা বসায় উদগ্র অনুভূতি। বিশ্বাসঘাতক রক্ত পুংস্থলীতে ধাবমান হয়, ধমনীতে চলাচল করে। অন্ধকারে রাত্রে, সমস্ত অন্ধকার পুরুষের মতো তাঁরও অভিসন্ধি সক্রিয় হয়। ভুলে যেতে থাকেন তিনি, আনিসুজ্জামান, সংযত, অবিচলিতচিত্ত, চিরকৌমার্যের সংকল্প তাঁর। ভুলে যান, শুয়ে থাকা মেয়েটি কত বিশ্বাসে শয়নকক্ষে আগল তোলে না। তিনি, এক চিরাচরিত আদিম পুরুষ, অভুক্ত অপমানিত মস্তিষ্কে ভেসে ওঠেন। তাঁর সামনে চরাচর জুড়ে থাকে ছাব্বিশ বছরের পরিপূর্ণ নারী। ঠাণ্ডা হাওয়ায় ঘরে ভিজে ভিজে ভাব। তবু কী আশ্চর্য উত্তাপ! পায়ে পায়ে এগোচ্ছেন অধ্যাপক। মহান, দেহাতীত প্রেম সম্পর্কিত অভিভাষণ দেওয়া অধ্যাপক। কোন দিকে— অনিবার্য রিপু তাড়নায়? কীসের জন্য— এই প্রেমহীন দৃষ্টি নিক্ষেপ? নেই প্রণয় কই প্রণয় প্রণয়বিহীন—দুই হাত এগিয়ে আসে আর তখন এক ঝলক তুমুল বিদ্যুৎ ঢুকে পড়ে জানালা দিয়ে আর আছড়ে পড়ে নীলোফার মুখে— সে মুখে, এখন বোরখা ঢাকা নেই, খোলা আছে দগ্ধ, কুশ্রী, বীভৎস অভিব্যক্তি, বিদ্যুতের মৌহুর্তিক ঝলকে যা আরও আরও ভয়ঙ্কর, কদাকার!

আনিসুজ্জামান বাড়িয়ে দেওয়া হাত গুটিয়ে চোখ চাপা দিলেন। তীব্র শব্দ উঠল তাঁর গলায়— আ আ আঃ! ঘোমটা নেই কেন, বোরখা নেই কেন নীলোফার? দগ্ধ গলিত কদর্য মুখ। নাকের অন্ধকার ফুটো। সম্পূর্ণ বন্ধ না হওয়া চোখে বিবমিষা সাদা। এক ঝলক আলোয় গলিত সমাধিস্থ শবের মতো কুৎসিত।

আনিসুজ্জামান পালাতে থাকেন। দ্রুত, অতি দ্রুত, ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চান। দরজায় ধাক্কা লেগে দুর্ঘটনার শব্দ হয়। দুই হাতে পেট চেপে ধরে অজস্র অম্লজান বমি করে উগরে দেন হাতধোয়ার বেসিন-গর্তে। এবং বেসিনের নালি আটকে যায়। কল থেকে বেরিয়ে আসা জলের সঙ্গে মিশতে না পেরে জলে ক্রমশ আবর্ত তৈরি করতে থাকে অপাচ্য বস্তু, অম্ল, পিত্ত, থুথু, কফ। যেন-বা তমসা নির্গত হয়। আনিসুজ্জামান আবার, বহুদিন আগেকার মতো বমনব্যক্তি হয়ে ওঠেন।

সমস্ত সুরহীন ধাক্কার শব্দে, সমস্ত উগ্র নিষ্ঠুর অভিব্যক্তির দ্যোতনায় ঘুম ভেঙে ছুটে এল নীলোফা— ভাইজান! তার মনে পড়ছে ভাইজান আজ অস্থির ছিলেন। অসুস্থ হলেন কি? আকস্মিকতায় তার মুখে ঢাকা দেওয়া নেই। বিনুনি লেপ্টে আছে কাঁধে। উদ্বেগে সে বুঝি ভুলে গেছে তার কদর্য মুখ। পুড়ে যাওয়া কর্কশ হাতে সে আনিসুজ্জামানের কাঁধে শুশ্রূষা চাপড় মারছে। আনিসুজ্জামান দেখছেন না। তুলছেন না মুখ। অম্লগন্ধে ঘর ভরে যাচ্ছে। তাঁর মুখে ঠোঁটে জড়িয়ে আছে বমি-রস-নাল। তিনি বলছেন— চলে যা… ওক্‌… চলে যা তুই… আহ্‌… তাকাতে পারছি না, দেখতে পারছি না। ওক্‌-ওক্‌-ওয়াক্‌… ঘরে চলে যা তুই… নীলু—

নীলোফা চলে যাচ্ছে। মুখ নিচু করে। ধীরে ধীরে। বুঝি-বা নিভৃত ছায়ার মতো চলে যাচ্ছে। অস্তিত্বে বিপন্নতা দেখতে দেখতে সে অনুমান করে নিচ্ছে আনুপূর্বিক ঘটনানুক্রম। সে, রিপন স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে আসার পর, এই প্রথম, এ ঘরের আগল তুলছে। বিছানায় চলে যাচ্ছে। কান্না যদি কোনও সঙ্গী হয় মানুষের, কোনও প্রতিষেধক, কোনও উপশম, তবে, এই মুহূর্তে নীলোফা তার নাগাল পাচ্ছে না। আর আনিসুজ্জামান তাঁর অবসন্ন শরীর বিছানায় মেলে দিয়ে ভাবছেন, এ কেমন মার? যে-মার অন্যকে রক্তাক্ত করে এবং নিজেকেও ছিঁড়ে-খুঁড়ে দেয়— এ কেমন মার! নিজের মধ্যেকার অসংখ্য অচেনা মুখ তাঁকে ঘিরে ধড়হীন মুণ্ডের মতো নাচে। রক্তাক্ত বীভৎস লাগে সেই সব। আনিসুজ্জামান বিভ্রান্ত হয়ে যান। নিজেকে তাঁর সম্পূর্ণ অচেনা লাগে। অশ্লীল লাগে। মানুষ মানুষকে অপমানে দাহ করে তিনি জানতেন। ভরসা ছিল, নিজে তা করেন না। আজ সে ভরসা গেল। এবং সেই অতুলনীয় ঘৃণ্য কাজ তিনি করলেন যা নীলোফাকে সর্বার্থে অস্তিত্বহীন করে দিল। আনিসুজ্জামান নীলোফার মুখের জন্য নিজের কাছে সহনশীলতা প্রার্থনা করেন। সেই প্রেম প্রার্থনা করেন যার স্বরূপ জানা তাঁর থাকে না কিন্তু যা রূপাতীত সত্যকে আশ্রয় করে। এবং নিজের প্রতি ধিক্কারে, নিজেরও রূপহীন বিকৃতচর্ম শরীরকে চিহ্নিত করতে বিছানা থেকে নেমে দরজায় খিল তোলেন তিনি। পূর্ণ দৈর্ঘ্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একে একে খুলে ফেলেন সমস্ত পোশাক। মৃত কুকুরের জলে ডোবা শবের মতো সাদা-কালো ছোপ ছোপ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেখে ঘৃণা পেতে ইচ্ছা করেন তিনি। কিন্তু ঘৃণা জাগে না। বরং পরম মায়ায় আপন দেহে হাত খেলে যায় নিবিড় স্নেহ সম্পর্কের মতো। তখন, অন্য অন্তরালে, অন্যজনও ধীরে ধীরে চলে গিয়েছিল আয়নার কাছে। একে একে খুলে ফেলতে চেয়েছিল সব— সব— সব পোশাক। শাড়ি খুলে ফেলার পর, ব্লাউজ খুলে ফেলার পর, নীবিবন্ধে হাত রেখে থমকে গেল সে। মাথা থেকে পেট অবধি নিরাবরণ, ঝলসানো বা দগ্ধ ও কুঞ্চিত, দলা পাকানো ত্বক দেখল কিছুক্ষণ। চোখ বন্ধ করল। এবং বন্ধ চোখের তলায় নিজেকে কল্পনা করল সে— সুস্থ। সুন্দর। হাত রাখল। নিজের গালে, ঠোঁটে, স্তনে ও গলায়। আয়নার আরও কাছাকাছি গিয়ে চোখ খুলল। নিজের দগ্ধ প্রতিবিম্বকে চুমু খেল। প্রত্যেকটি পোড়া স্থান গভীর নিরিখ করল ছুঁয়ে ছুঁয়ে। আর তার প্রত্যেকটি বিতাড়ন, প্রত্যাখান ও ঘৃণার উপকরণগুলি সম্পর্কে অপার মায়ায় ডুবতে লাগল। একবারও দেখল না যোনিদেশ, ঊরু, অবতল জানুসন্ধি— কারণ সেগুলি সম্পর্কে তার কোনও মায়া নেই। কারণ সেগুলি অটুট আছে।

২৪

মেঝেয় গোল হয়ে বসেছে ডমরু, ঝমরু, ছেদি, গোপাল আর সুরেশ। মাঝখানে হরিচরণ। খাচ্ছে। তুলসী খাবার পরিবেশন করছে। আজ মুসুরির ডাল বেঁধেছে তুলসী। আর সেটি কেমন চমৎকার খেতে হয়েছে! সঙ্গে উচ্ছে বেগুন আলু আর কুমড়োর তরকারি। সেটিও কেমন চমৎকার! তুলসী যা রাঁধে তা-ই সুস্বাদু। মেথি ফোঁড়ন দিয়ে, চাক চাক করে কাটা করলা ও রুইমাছের ঝোল তার মতো আর কেউ-ই রাঁধতে পারে না এই মহল্লায়। পেঁয়াজ ও সরষেবাটা দিয়ে সাটিমাছের ঝোলেও তুলসীর হাতের অপূর্ব গুণ ঢালা থাকে। আজকের মুসুর ডাল আর তরকারিটিও এই কৃপা থেকে বঞ্চিত হয়নি। ছেলেরা তার সুস্বাদের তৃপ্তিতে মন দিয়ে খাচ্ছে। হরিচরণও বড় আরাম পাচ্ছে খেয়ে। কালু সাহার ওখানে আজ বড় খাটুনি গেছে। দু’গাড়ি সিমেন্ট এসেছিল। সেগুলো খালি করতে হয়েছে। সিমেন্টের বস্তায় মাঝে মাঝে অন্য কীরকম একটি গন্ধ পাচ্ছিল হরিচরণ। যেন-বা সেইসব সিমেন্টের রংও কিছুটা হলদেটে। আর সেই গন্ধে তার নাক জ্বালা করছে। আতিতুল, মোহন আরও যারা বস্তা বইছিল, তাদেরও নাকি অমনিই লেগেছে। হরিচরণ ভেবেছে। এ কিছু অন্যরকম সিমেন্ট হবে হয়তো। আরও ভাল, আরও মসৃণ। অনেক বেশি বড়লোকদের বাড়ি হবে তাই দিয়ে। কিন্তু অনেক বস্তা বয়ে তার পিঠ টনটন করছে। সে ভাবছে, তুলসীকে বলবে, পিঠটা যাতে একটু দলাই-মলাই করে দেয়। এ বিষয়ে তুলসী খুবই নিপুণ। ওর বাবা ছিল চমৎকার মালিশওয়ালা। উত্তরপাড়ার ঘাটে গিয়ে বসত আর লোকজনকে মালিশ করে দিয়ে পয়সা পেত। সকালে এই কাজ শেষ হলে সে ছাতু, লেবু, লংকা আর নুন নিয়ে, পুদিনা পাতা আর ডাব্বা ভর্তি জল নিয়ে বেরিয়ে পড়ত রাস্তায়। তার ঠেলাগাড়িখানি ঠেলে ঠেলে ঘুরত। ছোট্ট তুলসী তার সঙ্গে থাকত। তার পিঠে রুক্ষ বিনুনি দুলত। নাকে শিকনি গড়াত। হাতে রঙিন কাচের চুড়ি পরে, বিবর্ণ হলুদ জামা পরে সে বাবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরত আর লোকেদের খেয়ে যাওয়া, ছাতুর লিট্টি খেয়ে যাওয়া বা শরবৎ, থালা আর গ্লাসগুলি ধুয়ে দিত। তার বাবা তাকে কিনে দিত আমের সময় কাচা আম, পেয়ারার সময় পেয়ারা বা জাম৷ হরিচরণ তাদের অনেকদিন ধরে চেনে। জন্ম থেকেই চেনে। তার বাবাও মিউনিসিপ্যালিটির সাফাইওয়ালা ছিল এবং একই পাড়ায়, তুলসীর বাবার সঙ্গে বসবাস করত। তুলসী যখন একটু বড় হল, যখন তার নাক দিয়ে শিকনি গড়াবার আগেই সে ধুয়ে ফেলল আর তার ফ্রকের তলায় উঁকি দিল দু’খানি আশ্চর্য দুনিয়া, তখন হরিচরণ অবাক মেনে গিয়েছিল। তুলসীর গা দিয়ে যেন গর্ব ঝরে পড়তে শুরু করল তখন। সে যদি খুশি হয়েও ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাত, মনে হত, রাগ করছে তলায় তলায়। তার বাবা তখন তাকে বেশি করে কাচের চুড়ি কিনে দিত। আর নানারকম ঝিকিমিকি বিন্দি। সেই সঙ্গে হঠাৎই যেন তুলসীর মালিশদার বাপু কেমন বুড়োটে আর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। মেয়েকে নিয়ে বিক্কিরির জন্য বেরুলে বেশ ভিড় জমত তার। ব্যবসায়ী হিসেবে এতে তার খুশি হওয়াই উচিত ছিল কিন্তু পিতা হিসেবে তার দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। পাজি পাজি ধাড়ি ছোকরাগুলো তো এক গ্লাসের জায়গায় তিন গ্লাস শরবৎ কিনত আর আড়ে আড়ে তুলসীকে দেখত। হরিচরণ অনেকদিনই দক্ষিণেশ্বর মন্দির গেটের কাছাকাছি এইসব লক্ষ করেছে। সেই সময়গুলো তার মনে হত সারা দুনিয়া জুড়ে ছায়া নামছে। উদ্দাম রোদ্দুরে, লোকে হাঁসফাস করতে করতে যখন ছাতুর শরবং খাচ্ছে, তখনও খৈনির তামাকপাতা বিক্রি করতে করতে হরিচরণের মনে হত রোদ্দুরের মধ্যে একটুকরো ছায়া ঢুকে পড়েছে আর চারপাশ ঝাঁ ঝাঁ করা সত্ত্বেও এখনই যেন ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসবে। শুধু তুলসী নিজে তখন একটুকরো মেঘ হয়ে থাকত। তার চুলে আর জট পড়ে না তখন। রেশমি চুলে রঙিন ফিতে বাঁধা। একমনে গ্লাস ধুয়ে যেত সে। আর মাঝে মাঝে হরিচরণের বস্তায় বসে পা ছড়িয়ে দিত। একদিন ফ্রক ছেড়ে শাড়ি পরল তুলসী। হরিচরণের মনে আছে, শাড়িটায় অজস্র আশ্চর্য ফুল ফুটেছিল। আর ফুল জড়িয়ে জড়িয়ে তুলসীও যেন এক অসামান্য ফুল। সে-দিন হরিচরণ অনেকবার খদ্দেরের কাছে পয়সা নিতে ভুলে যাচ্ছিল। আর তুলসী যখন ওর বস্তার ধারে পা মেলে বসল তখন, ওই প্রথম হরিচরণ দেখতে পেল তুলসীর পায়ে মন্দিরের দেবীর পায়ের মতো জড়িয়ে আছে রুপোর মল। কী সুন্দর দেখাচ্ছিল তার ধুলোমাখা পা। তুলসীর বাবা তুলসীকে রুপোর নথ গড়িয়ে দিয়েছে। কানের দুল হার চুড়ি কিছুই বাদ রাখেনি। সে-সব প্রতিদিন তুলসীর অঙ্গে থাকে। কিন্তু তার যে একজোড়া মলও আছে তা হরিচরণ জানতই না।

এখন, ছেলেপুলের জন্ম দিয়ে তুলসী আর আগের সেই কাঁচা তুলসী নেই। মোটাসোটা গিন্নিবান্নি হয়েছে। হরিচরণও তুলসীকে আরও মোটা মোটা দু’খানা মল গড়িয়ে দিয়েছে যাকে মল না বলে খাড়ু বলা যায়। আগে ওর কোমল পায়ে ওই হালকা মল যেমন মানাত, এখন ওই পুরুষ্টু পায়ের গোছে খাড়ু দেখলেও হরিচরণের মন ভাল হয়ে যায়। পাঁচ ছেলেকে স্তন্য দান করে, এবং হরিচরণকেও নিশ্চয়ই, তুলসী এখন গুরুস্তনী হয়েছে। তার ভারী কোমরে হলুদের ওপর লাল গোল গোল ছাপা শাড়ি বা হাত ধরাধরি করে নাচতে থাকা মেয়েদের ছবিওয়ালা পাড় হরিচরণকে এখন আশ্চর্য শান্তি, সম্মান ও নির্ভরতা দেয়। সে যখন ভোরবেলা ময়লা পরিষ্কার করে তখন যেন-বা এর মধ্যে কোনও মালিন্য নেই, দুর্গন্ধ নেই এমনই সে ভাবতে চায়। তরকারির পচনশীল খোসা, মাছের আঁশ, মেয়েদের উচ্ছৃঙ্খল মাসিকের কাপড়ের মধ্যেও সে গাছ থেকে ঝরে পড়া শুকনো ফুলেরই মতো বৈভব সন্ধান করে। এ সবের কোনওটাই সম্ভব হত না যদি তুলসী না থাকত। তুলসী ও পাঁচ ছেলে সমেত বরাহনগর মিউনিসিপ্যাল ভবনের কাছাকাছি হরিচরণ খুবই শান্তিতে জীবনযাপন করে যার গৃহস্থালিতে পরিশ্রম আছে কিন্তু অসততা নেই, মিথ্যাচার নেই, অভাববোধ নেই। তুলসী খুবই গুছিয়ে ধর্মকর্ম সমেত সংসার করতে সমর্থ। আর হরিচরণ তার প্রতিবিন্দু শ্রম সংসারের কল্যাণে দিয়ে তৃপ্ত থাকে। তাদের মধ্যে একটিমাত্র চাওয়া মাঝে মাঝে ঝলসে ওঠে। সেও খুব অভিযোগক্লিষ্ট বা দুঃখজড়িত নয়।

তুলসী বলে—ইস্‌, একটা যদি মেয়ে হত।

হরিচরণ এ বিষয়ে তার নিজের প্রত্যাশাকে আলাদা করে নেড়েচেড়ে দেখেনি। তুলসীর ইচ্ছেকেই নিজের ইচ্ছে ভেবে প্রত্যেকবার তুলসীর কথায় সায় দিয়েছে—হ্যাঁ। রামজি তোমার আশা নিশ্চয়ই পূর্ণ করবেন।

তুলসী মুখ লাল করে, চোখে লজ্জারুণ উন্মাদনা এঁকে হরিচরণকে ঠেলে দিয়ে বলেছে— যাও!

এরকম অবস্থায় প্রতিবারই হরিচরণ উদ্বুদ্ধ হয় এবং তুলসীর নরম পেটে মুখ ডুবিয়ে দেয়। কখনও তার বিশাল স্তনে চওড়া গোঁফ ঘষে দিতে থাকে। দেওয়ালে তখন খুবই পরিতোষের সঙ্গে গৃহস্থ টিকটিকি সাড়া দেয়।

হরিচরণের মন সাদা। কোনও কিছু সম্পর্কেই তার কোনও পাপবোধ নেই। পরিশ্রম, উপার্জন, দাম্পত্য ও সন্তান পালনের যে সরল গার্হস্থ্য সে যাপন করে তার মধ্যে পাপের অবকাশও নেই। হরিচরণ যদি অবহিত হত যে পাপবিহীন কোনও যাপনচিত্র প্রায় অবাস্তব, তা হলে হয়তো সে পাপ সন্ধান করত। পাপের প্ররোচনা খুঁজত। সে খোঁজে না। কারণ তার লোভ নেই। লোভ নেই তার কারণ সে নিজস্ব বাঁচবার পদ্ধতি ও দর্শন থেকে জানে সে নিজে ভাল আছে। তার পরিবার ভাল আছে। এটুকুই তার সুন্দর পবিত্র আত্মকেন্দ্রিকতা। শুধু মাঝেমধ্যে সে খুব স্বার্থপরতার সঙ্গে তুলসী সম্পর্কে দু’একটি কথা না ভেবে পারে না। তুলসীর নাকে যখন রুপোর ফুল চকচক করে আর পায়ের গোছে মোটা খাড়ু আলো ছিটকোয়, তখন তার মনে হয়, ওই ঘটনাটা যদি না হত, যদি তুলসীর বাবা ট্রাকের ধাক্কায় হঠাৎ এই দুনিয়া ছেড়ে চলে না যেত তা হলে হরিচরণ কখনওই তুলসীকে লাভ করত না। তুলসীর বাবা বেঁচে থাকলে তুলসীকে নিশ্চয়ই কোনও পাম্পম্যান বা মিলের কর্মচারীর সঙ্গে বিয়ে দিত। খৈনির তামাক পাতা বেচনেওয়ালা, ঝাড়ুদারের পো ঝাড়ুদারের সঙ্গে কখনওই তুলসীর বিয়ে হত না। এ বিয়ে যে তা হলে তুলসীর পক্ষে কোনও দুর্ভাগ্যই তা হরিচরণের মাথায় আসেনি। কিন্তু সে যে পরম সৌভাগ্যবান এ নিয়ে তার কোনও সংশয় নেই।

কিন্তু তাদের জীবনে সেদিনের সে দুর্ঘটনা করুণভাবে মুদ্রিত আছে। কেমনভাবে হয়েছিল সে-দুর্ঘটনা, পরে কেঁদে কেঁদে শুনিয়েছিল তুলসী হরিচরণকে। বেলার দিকে মন্দিরের সামনে থেকে বেরিয়ে জুটমিলের দিকে যাচ্ছিল তারা। রোজকার মতোই। বালি ব্রিজে ওঠার মুখে ভ্যানের একটা চাকা হঠাৎ খুলে যায়। তুলসীর বাবা মহাভারতের কর্ণের মতোই, পথের ধার ঘেঁষে জিনিসপত্র সমেত ভ্যানটাকে আগলে চাকা সারাবার চেষ্টা করছিল। তুলসী বড় একখণ্ড পাথর বা ইঁটের সন্ধানে, যেমন বিপদগ্রস্তরা খুঁজে ফেরে কোনও ওষুধ বা অবলম্বন, তেমনি খুঁজে ফিরছিল। তখনই দু’টি ব্যস্ত ট্রাক দু’দিক থেকে এসে পড়ে এবং পরস্পরকে জায়গা দিতে বুঝি-বা অনেকটাই ধার ঘেঁষে চাকা চালিয়ে দেয় এবং তুলসীর বাবা সেই ধাক্কায় ছিটকে পড়ে রক্তাক্ত ও প্রাণহীন অবস্থায়। বালি ব্রিজের ওইখানটায় দু’পাশে খাড়া ঢাল আর মনুষ্য বিরলতা। শুধু তুলসী তীক্ষ্ণ চিৎকার করছিল তখন— বাপুরে-এ-এ, ও বাপু-উ-উ—আর সেই দেহ ঘিরে অবাক হয়ে দেখেছিল, মৃত ও চূর্ণ শরীর থেকে কীরকম দ্রুত বেগে রক্ত প্রবাহিত হয় আর সেই রক্তে কীরকম শরীর ওগলানো গন্ধ! সে জানত মানুষ মরে গেলে তৎক্ষণাৎ বন্ধ হয়ে যায় সমস্ত রক্তপাত। যাবতীয় তরল ও উষ্ণ রক্ত ডেলা পাকিয়ে যায়। সেই মুহূর্তে একই গোত্রের দু’টি সত্য উপলব্ধি করেছিল তুলসী আর বিহ্বল হয়ে গিয়েছিল। রক্তপাত সংক্রান্ত সত্য ছাড়া অন্যটি হল, এই দুনিয়ায় সে একা ও অরক্ষিত। সেইদিন তাকে আর তার বাপুকে ঘিরে যে জটলা হয়েছিল তার মধ্যে থেকে কয়েকজন তুলসীকে বাহু ধরে তুলতে চেয়েছিল বা তার পিঠে হাত রেখে নির্ভরতা দেবার চেষ্টা করেছিল। তুলসী তার নারীসুলভ কোনও অনুভবে সেইসব প্রতিহত করেছিল বটে কিন্তু পরে সে হরিচরণকে বলে যে মানষের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আকাশ থেকে যে অত দ্রুত শকুন নেমে আসতে পারে, বা জঙ্গলে ঘাপটি মেরে থাকা শেয়াল নির্গত হয় তা তার ধারণায় ছিল না। তার এত ভয় করেছিল যে শেষ পর্যন্ত খবর শুনে হরিচরণ যদি ওখানে না পৌঁছুত তবে সেও শেয়াল শকুনের হাতে বাপুকে ছেড়ে পালিয়ে আসত। কারণ একটা জায়গায় সে নিশ্চিত ছিল, এরা তার বাবার মাংস খেতে আসেনি। বস্তুত, বাপুর ওই করুণ মৃত্যুর শোক থেকে ঝটিতি বেরিয়ে আসতে হয়েছিল তুলসীকে সুরক্ষার কারণেই। দুঃখ নিংড়ানো কান্নার অবকাশও তাকে দেয়নি হাড় হারামজাদারা।

এখন ভাবলে হরিচরণ তাজ্জব বনে যায়। ওইটুকু বয়সেই তুলসী কত বুঝদার হয়ে উঠেছিল। হয়তো বাপের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে লোকচরিত্র সম্পর্কে কোনও গভীর জ্ঞান তার জন্মেছে। সেই সময় সে থেকে থেকে বাপুউ-উ-উ বলে কেঁদেছে আর হরিচরণের বাপ বলেছে, হরির মা, যাও মেয়েটাকে শান্ত করো। হায় রাম, ওর বাপুর সঙ্গে কালকে রাত্রেও তাস খেলতে খেলতে কত গল্প করেছি। মেয়ের বিয়ে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল মানুষটার। বলত—পারমিন্ট চাকরি করা ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেব। আমার মতো এমন ঘুরে বেড়ানো লোকের সঙ্গে নয়।

হরিচরণের মা-ই আগলে রেখেছিল তুলসীকে। তুলসীর নিজের মায়েরই মতো, কারণ তারাও, পাশাপাশি বসবাসের কারণে, খুবই সখ্য বোধ করত পরস্পরের প্রতি এবং একে অন্যের ছেলেমেয়েকে আপনার করে ভাবত। তুলসীর মা শেষ অবধি সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে বহু রক্তপাতে মারা যায়। আর তুলসী তার বাপের খালি বুক ভরতে ভরতে, অন্ধকার মন আলো করতে করতে বড় হয়ে উঠল। সেই সময় হরিচরণকে কেউ বলে দেয়নি কিন্তু সে আপনা-আপনি কেমন করে বুঝে গিয়েছিল তুলসীর কাছাকাছি তার বেশি যাওয়াটা ঠিক হবে না। তুলসী তার মায়ের জিম্মায় আছে এই এক নিশ্চিন্ত বোধে সে নিজের কাজ করতে বেরুত। পরে তুলসী তাকে বলেছিল, সেই সময় সে নাকি সারাদিন প্রতীক্ষা করত হরিচরণ কখন ফিরবে আর তার ইচ্ছে করত হরিচরণের তামাকপাতায় লাল হয়ে যাওয়া আঙুলগুলি ধুয়ে মুছে দেয়।

এখনও তুলসী তাকে সমান যত্নই করে বটে। পাখা দিয়ে বাতাস করে দেয়। গরমে কাজ থেকে তেতে-পুড়ে ফিরলে ঠাণ্ডা শরবৎ দেয়। এখন তো হরিচরণেরও বাপু নেই, মা নেই। জগতের ধর্মে সব স্বর্গে চলে গেছে। তাদের সমস্ত স্নেহ মমতা যেন একাই টেনে নিয়েছে তুলসী। এই স্নেহ সে হরিচরণে বিলোয়, সন্তানে বিলোয়, এবং আরও বিলোবার জন্য আরও একটি সন্তানের প্রতীক্ষা করে। বস্তুত, হরিচরণের ক্ষেত্রে তুলসী পত্নী বটে আবার মাতাও। তুলসী এক বিস্ময় বটে, আবার স্নিগ্ধ আশ্রয়। যার তরে হরিচরণ এই নটের ভবে জন্ম জন্ম ধরে ফিরে আসতে পারে।

এখন তারা সকলে মিলে একটি পারিবারিক আহার পর্ব সমাপন করছে। ঝমরু থালা চাটছে। হাতের চেটোয় থালা থেকে তুলে নিচ্ছে থালায় লেগে থাকা সুস্বাদু ডাল আর তরকারির রেশ। ছেদীর পাতে ভাতের চেয়ে ডালই বেশি। সে দু’হাতে থালা ধরে সুরুৎ সুরুৎ টানছে। তার নাকে এক ফোঁটা ডাল লেগে গেল। ডমরু, ঝমরু, সুরেশ আর গোপাল তাই দেখে হাসছে। এ ওর গায়ে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। হরিচরণ আর তুলসীও হাসছে কিন্তু তারা পরস্পরের গায়ে গড়িয়ে পড়ছে না। তারা হাসছে। স্নিগ্ধ স্নেহচর্চিত হাসি। গোপালের পিঁড়ির তলায় হঠাৎ একটা আরশোলা চলে এল। পিঁড়ির নীচেকার অন্ধকারে গা ঢেকে শুধু শুঁড়দু’টি বার করে পরিস্থিতি বুঝে নিচ্ছে সেটি। গোপাল দেখেছে আরশোলা তার পিঁড়ির তলায় ঢুকল। তার খাওয়া থেমে আছে। সে হাত নামাতে পারছে না। তার ভয় করছে। বুঝি-বা আরশোলাটি হাত কামড়ে দেবে। তার ঘেন্নাও করছে, যদি উঠে আসে থালায়, যদি তার প্রিয় অন্নে জিভ দেয়। সে অসহায় কেঁদে উঠছে, মাঈ, মাঈ। পৃথিবীর সমস্ত ভীত ও শঙ্কিত মানুষের স্বর তার কণ্ঠে। ঠোঁটে অসহায় আর্তি। মাঈ। মাঈ। তুলসী তখন দেবী ভগবতী হয়ে গেল। পরিত্রাতা হয়ে গেল। স্বয়ং মা বিপত্তারিণী। পিঁড়ি থাবড়াচ্ছে যাঃ। যাঃ। আরশোলা পিঁড়ির কম্পনে অস্থির। বেরিয়ে আসছে তলা থেকে। দিশেহারা হয়ে পালাচ্ছে। ডমরু, ঝমরু, ছেদী আর সুরেশ প্রত্যেকেই নিজের নিজের পিঁড়ি থাবড়াচ্ছে এখন, যেমন হয়, যেমন অন্যের বিপদ দেখলে যে-যার বাস সামলায়, মুখ দিয়ে হুসহাস শব্দ করছে। আরশোলাটি কোথায় পালিয়ে গেল, কোথায় সেঁধিয়ে গেল। না, আর তাকে দেখা যাচ্ছে না। সে বুঝি গিয়ে খবর দিয়ে দিয়েছে তার মহল্লায়। অন্য কোনও আরশোলাকে আর দেখা যাচ্ছে না। গোপালের জলভরা চোখ, তবু খুশি ও স্বস্তির হাসি ঠোঁটে। সে ফের খাবারে মনোযোগী হল এখন। এবার তুলসী চাপাটি বিতরণ করছে। ভাত আর চাপাটি মিশিয়ে খাওয়া, তাতে চাল সাশ্রয় হয়। এ বার বোতল থেকে আচার বার করা হল। হরিচরণ, ডমরু, ঝমরু দু’টি করে আমের টুকরো পাচ্ছে। সুরেশ, ছেদি আর গোপাল একটি করে পেল। তাই নিয়ে কেউ খেদ করছে না। অভিযোগ করছে না। বড়রা জানে তারা বড় বলে, আর একটু বেশি খাবে বলে বেশি পেল। ছোটরা কম খাবে, তাই কম পাওনা। ওরা বড় হবে যখন, আর কয়েক বছর গেলেই, আর একটু বেশি খেতে শিখবে, তখন তুলসী ওদেরও দু’টি করে আমের টুকরো দেবে। সেটুকু ধৈর্য ওরা ধরতে জানে। যখন ডমরু ঝমরু ছোট ছিল, তখন দু’ টুকরো আম হরিচরণই পেত একমাত্র, ওরা তার জন্য কখনও লোভী হয়নি। ওরা জেনেছে, বুঝে গেছে, যতটুকু ওদের কাছে আসে, যতটুকু ওরা পায় তার মধ্যেই ওদের প্রাপ্য ফুরোয়। সেটুকুতেই ওরা তুষ্ট থাকে। ওদের উঠোনে এই গ্রীষ্মেও চমৎকার শান্তিময় ছায়া পড়ে। সেখানে পাটি বিছিয়ে তুলসী কাপড়চোপড় আলগা দিয়ে ছেলেদের নিয়ে বসে আর ঈশ্বরের পাঠানো কৃপণ বাতাসে হাতপাখার আন্দোলন তুলতে তুলতে একটি ছোট মেয়ের জন্য কাতর হয়। যে থাকলে গোলাপি রঙের ফিতে দিয়ে দু’টি বিনুনী বেঁধে দিতে সে। মোটা করে কাজল পরিয়ে দিত, ফাঁকে ফাঁকে মেয়ের বিয়ের জন্য গয়না গড়াত! মেয়ের ভিক্ষায়ই কি না কে জানে, হতে পারে সারা সংসারেরই মঙ্গল কামনায় কাল থেকে তুলসী শ্রীশ্রীসন্তোষীমাতার পূজা শুরু করেছে। যোলোটি শুক্রবার এই পূজা তাকে করতে হবে। একটানা প্রতি শুক্রবার করা নিশ্চয়ই সম্ভব হবে না। এর মধ্যে কোনও শুক্রবার তার মাসিক হয়ে যেতে পারে। মাসিক অবস্থায় দেবতারা পূজা নেন না। দেবতারা নেন না সে এক রকম। দেবীরাও যে কেন নেন না, সে এক বিস্ময়। তুলসী এ সব ভেবে দেখেছে। গণেশকন্যা সন্তোষী অতি সরলমতী দেবী। অল্পে তুষ্ট আবার অল্পে রেগে আগুন। তার মধ্যে কেন কে জানে টকস্বাদের সঙ্গে তাঁর ভয়ানক বিবাদ। টক সংক্রান্ত নানা বিধিনিষেধ তুলসী পই পই করে ছেলেদের বুঝিয়ে রেখেছে। আজ সকলকে আচার দেওয়া হলে আর নিজেরও নেওয়া হলে আচারের বয়াম তুলসী পাকঘরের কুলুঙ্গিতে তুলে রাখবে। কাল এ বয়াম নামবে না। তুলসী যখন ছেলেদের নিয়ম কানুন বুঝিয়েছে তখন ছেলেরা চমৎকার বুঝদার সন্তানের মতোই মাথা নেড়েছে। পরে নিজেদের মধ্যে এ বিষয়ে তারা আলোচনাও করেছে। মাত্র তো একটি দিন। একদিনের জন্য টকের লোভ ত্যাগ করা আর এমন কী। পরিবর্তে বাড়িতে পুজো হলে সারাদিন কেমন আনন্দের গন্ধ! তাই, হরিচরণের শান্ত পরিবারের সকলেই আজ সন্তোষে আছে। কাল সন্তোষী মা’র পূজা।

সকলকে সব দিয়ে নিজে খেতে বসল তুলসী। ছেলেদের খাওয়া হয়ে গেলে ডমরু, ঝমরু আর ভাইদের থালা নিয়ে উঠে পড়ল। উঠোনের একধারে টিনের পাত্রে জল রাখা। জলপাত্রের কাছে ইঁট বাঁধিয়ে বাসন ধোয়ার জায়গা করেছে হরিচরণ। এখানে ঘরে ঘরে কল নেই। কিছু দূর দূর মিউনিসিপ্যালিটির জলের পাইপ আছে। কল লাগালে কে যেন খুলে নিয়ে যায়। জলের সময় এলে ওই পাইপ থেকে এক ধারায় জল পড়তে থাকে আর আশেপাশের মানুষ নিজের প্রয়োজন মতো জল তুলে নেয়। কুলিয়ে যায় সবারই। তবে জল টানা আর ধরে রাখা এক কষ্ট। কে আগে জল নেবে তাই নিয়ে মহল্লায় মারামারি, ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকে।

ডমরু, ঝমরু তাদের আর ভাইদের বাসন ধুতে থাকল। হরিচরণ আর তুলসী সংসারের টুকিটাকি কথা সেরে নিল। সকালে হরিচরণ কাজে বেরিয়ে যাবে। তুলসীর ইচ্ছা পূজার সময়, ব্রতকথার সময় হরিচরণ থাকুক। হরিচরণেরও এমনই ইচ্ছা। কিন্তু কাজ সেরে পরিচ্ছন্ন হয়ে আসতে আসতে বেলা দেড়টা-দু’টো বাজে। অতক্ষণ পূজার দেরি হলে তুলসীকে না খেয়ে থাকতে হবে। হরিচরণ তার জন্য দুঃখ বোধ করছে। যেন তুলসী, ওইটুকু উপোস দিলে, ক্ষয়ে যেতে পারে, দুর্বল হতে পারে। হরিচরণ, যাই খাওয়াতে সমর্থ থাকুক, খাবার সে ভরপেট পরিমাণ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। ঈশ্বরের কাছে তার প্রার্থনা, যেন পেট ভরে খেতে দিতে পারে সন্তানদের এবং স্ত্রীকে। হরিচরণ কষ্ট পাবার কথা তুলসীর কাছে প্রকাশ করছে এখন। তুলসী হাসছে। বোঝাচ্ছে হরিচরণকে— এমনি এমনি না খেয়ে থাকলে কষ্ট হবে। পুজোর উপোস করলে কষ্ট নেই। তুমি ভেবো না।

তখন মুচকি হেসে পৃথিবী পরিক্রমণ করছে চাঁদ আর গরমে হাসফাঁস করা রাত্তির স্নিগ্ধ ভোরের জন্য প্রার্থনা করছে। চার পুত্র পাশে। শুধু গোপাল তুলসীর পেটের কাছে সেঁধিয়ে আছে। তাকে বাঁচিয়ে তুলসীর গায়ে একটি পা তুলে দিয়েছে হরিচরণ। তুলসী আঁচল সরিয়ে দিয়েছে। নিভৃত থেকে উঠে আসা গন্ধ নিতে নিতে ঘুমিয়ে পড়ছে ডমরু, ঝমরু, ছেদি, সুরেশ আর গোপাল। ঘুমিয়ে পড়ছে হরিচরণ। আর তুলসী, সকলকে ঘুম দিতে দিতে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ল কখন। জানতেও পারল না। তাদের অজ্ঞাতসারে ঘুমের দেবতা এসে মিলিত হলেন রাত্রির সঙ্গে। তাঁর কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে নিলেন। ঘুম দেবার শক্তি অমোঘ। কিন্তু তা কি রাত্রির চেয়ে বেশি? সে-কথা কেউ জানে না। কোনও দিন কেউ তা তৌল করতেও পারবে না। প্রমাণ করতেও না। যখন পরস্পর পরস্পরে সম্পৃক্ত থাকা, যখন একে অন্যের জন্য সততার সঙ্গে কামনা করে এবং মিলিত হলে পারস্পরিক ঘনত্বে এমন মিশে যায় যে ঘুম ও রাত্রির নিজস্ব অন্ধকার নিরবচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন ঘুম নিজের সত্তা নিয়ে, রাত্রি নিজের অবস্থান নিয়ে আর সতর্ক নন। তাঁদের আশ্চর্য মিলনে, যা মহামিলনও বলা যায়, অসামান্য শক্তি পুঞ্জীভূত হয়! পুকুরের জল চাঁদ ও নক্ষত্রসমেত আকাশকে নিজের বুকে টেনে নেয়। নদীর সঙ্গে পাথরের ঘষা লেগে জন্ম নেয় মসৃণতা। সমস্ত পশু-পাখি নিজের নিজের ধর্ম পালন করে। মাটির তলায় অঙ্কুরোদগমের প্রস্তুতি হতে থাকে। মানুষেরা তখন ন্যায়-অন্যায়-নিরপেক্ষ, হিংসা-দ্বেষ ব্যতিরেকী; কোথাও কোনও হীনবৃত্তি নেই। এমনই চলতে চলতে রাস্তার ধারে আলো জ্বলে উঠল আর শুরু হল চৌর্যবৃত্তি। যদিও এমনই কথিত আছে যে ঘনায়মান আঁধারই চৌর্য প্ররোচিত করে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অন্ধকার চৌর্যবৃত্তিকে কখনও সহায়তা করেনি। বরং তাদের সহায়তা করেছে নিদ্রাভিভূত রাত্রি এবং তা আলোকোজ্জ্বল হলেও! যে-কোনও সার্থক বৃত্তির জন্য আলোর প্রয়োজন এই বোধ হল যখন তখন জেগে উঠল অনুসরণ। পাহারাদারেরা তা শুরু করল। চৌর্য নিবৃত্ত করার জন্য ধাবমান থাকতে থাকতে তারা বিস্মৃত হয়ে গেল ধাবনের প্রকৃত ধর্মকে। অস্ত্র শাণিয়ে তারা ছুটে গেল তাদের দিকেও যারা রাত্রি জেগে ভোরবেলার জন্য কোনও কল্যাণী নির্মাণ শেষ করতে চায়। এবং আলোই পাহারাদারের পক্ষে সহায়ক হয়ে ওঠে। এই মহাবিশ্বে তবু শান্তি আছে কোথাও। তা বজায় রাখা নিশ্চয়ই সম্ভব হয়েছে। আলো ও অন্ধকার, ঘুম ও রাত্রি সম্পর্কে ভাবিত হয় না এমন সব প্রাণীদের মধ্যে থেকে মহাবিশ্বের অংশ হয়ে জেগে উঠছে হরিচরণ। তখন ঘুমদেবতা জড়িয়ে আছেন রাত্রিদেবীকে। তখনও আকাশ শুধু অসামান্য নীল হয়েছে মাত্র আর তারই মধ্যে তারা জ্বলছে। পৃথিবীর সমস্ত মোরগ যোগী হয়ে যোগিয়া ধরল বুঝি। হরিচরণ ঘুমন্ত স্ত্রী-পুত্রকে রেখে, দরজা খুলে বেরিয়ে এল। আবার আব্জে দিল শব্দ না হয় এমন সন্তর্পণে। নরম উঠোনের প্রান্তে প্রাকৃতিক নিঃসরণ ঘটাল। ধুয়ে নিল মুখ চোখ আলিস্যি। এ বার সে বেরিয়ে আসছে। হাতে ঠেলছে জঞ্জাল যান। হাঁটছে। আজ পূজা। আজ অন্ধকার থাকতেই সে বেরিয়েছে। তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে হবে। তার কাজ তো কম নয়। দায়িত্ব কম নয়। গোটা মাথুরের গড় তাকে পরিষ্কার রাখতে হয়। সমস্ত সমৃদ্ধ বসবাসকে সে পরিচ্ছন্ন রাখে। ঈশ্বর আপন ইচ্ছায় তাকে এই মহান কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন। সে তার ধর্ম বিস্মৃত হতে পারে না। যানের চাকা ঠেলে ঠেলে পায়ে পায়ে এগোয়।

রাস্তা পারাপার করতে করতে ভেবে নিচ্ছে সে এখন। মাথুরের গড়ে ঢোকার বেশ কয়েকটি গলিমুখ। আজ সে সাতকন্যা দিয়ে ঢুকবে। সাতকন্যা। অদ্ভুত নাম বাড়িটার। মাথুরের গড়ে সাতকন্যাই সবচেয়ে নতুন বাড়ি। নতুন হলেও তা প্রায় তিন বছর হল। ওখানে আগে জমি ফাঁকা ছিল। ওই মানুষটি, যাঁর ওই সাতকন্যা বাড়ি, একদিন তা কিনে নিলেন এবং মাটিতে ভিত করে, শূন্য আঁকড়ে তৈরি করলেন একটি চমৎকার তেতলা বাড়ি। হরিচরণ গুণে দেখেছে, বাড়িটা, ম্যাজিকের মতো তৃতীয় মাসে দিব্যি খাড়া হয়ে গেল। আর চতুর্থ মাসে রঙে, আসবাবে সেজে ঝলমলে হয়ে গেল। বাড়ির মালিক স্ত্রী ও সাতকন্যাকে নিয়ে গৃহপ্রবেশ করলেন। বাড়ির নামও দিয়ে দিলেন, সাতকন্যা। তাঁদের ঘরে পা দেবার সময়ও হরিচরণ ছিল। রাস্তাই পরিষ্কার করছিল সে। বুঝি-বা, তাঁরা আসবেন, এই প্রচার হয়ে যাওয়ায়, অনেকেই ঘোরাফেরা করছিল। হরিচরণও একটু কৌতূহলে, একটু ইচ্ছায় দেরি করে সাফাই চালিয়ে যাচ্ছিল। যদি তাঁদের দেখা মেলে। যদি জানা যায় তাঁরা কোথায় ছিলেন এতকাল। এক জীবনযাত্রা ছেড়ে আর এক জীবনযাত্রায় কেনই-বা তাঁরা এলেন! যেমন গাছের শেকড় চাড়িয়ে যায়, হরিচরণের মনে হয়, মানুষেরও এক জায়গায় থাকতে থাকতে ওইরকম শেকড় ঢুকে যায়। সেখানকার মাটি, জল, হাওয়া, আকাশ ও বৃষ্টির সঙ্গে। আশেপাশের লোকের সঙ্গে। সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত তখন চেনা ও মায়াময় লাগে। জানা হয়ে যায়, ওই, ঝল্লুদাদা চানার ঝাকা নিয়ে বেরুল। এখন নবীন চাচা সাজিতে ঠাকুর বসিয়ে দোকানে দোকানে মন্ত্র পড়তে যাবে। দুর্গা চাচি এখুনি রান্নার আয়োজন করবে। তার সুস্বাদু রান্নায় ফোড়নের গন্ধ সারা বস্তিকে মাতিয়ে তুলবে। মোতিনানির ঘরের পাশে যে-কাকগুলো ঘোরে, যে-শালিকগুলো হীরাভাবির ভাতের হাঁড়ি ঠুকরে দেয়, যে-চড়াই আর পায়রাগুলো গৃহস্থ মানুষের মতোই কিচিরমিচির বকম বকম করে— মানুষের শেকড় সেইখানেও চারিয়ে যায় আর অত অত সম্ভাবনাময় মুহূর্ত জড়িয়ে গিয়ে এক মহাকাণ্ড বাঁধিয়ে বসে। অতসব ছাড়িয়ে, কেটে, উপড়ে নতুন জায়গায় বসবাস—তা কি চাট্টিখানি কথা? হরিচরণ যখন দক্ষিণেশ্বরের বস্তি ছেড়ে এই মিউনিসিপ্যালিটির পাশে চলে এল তখন ওইসব শেকড় ছেঁড়ার কষ্ট সে টের পেয়েছে। আর এটাও সে মনে মনে স্বীকার না করে পারে না যে এখানে এসে ততখানি শেকড় চারিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। তুলসী আর ছেলেপুলে নিয়ে এক ঠাসবুনোট গভীরচারী বৃক্ষ তৈরি আছে বটে কিন্তু তা নেহাৎ পারিবারিক। ওই ঘরের বাইরে কোনও মোরগের ডাক, কোনও পালন করা শুয়োরের পদচারণের হিসেব হরিচরণের জানা নেই। সে বোঝে, তার নিজস্ব বৃক্ষটি শেকড়-বাকড় সমেত উপড়ে প্রয়োজনমতো আবার অন্য জায়গায় বসতি করে যদি তবে আর কোনও কষ্টই হবে না যেমন দক্ষিণেশ্বর থেকে আসতে তার হয়েছিল। এখনও চোখ বন্ধ করলে তার মনে হয়, ওইখানে, ওই বস্তিতে এক হরিচরণ, তুলসী আর তাদের বাপু-মা জীবনযাপন করছে। যে-জীবন সে চিনত ওখানে তা একেবারে পরিপূর্ণভাবে অক্ষত রেখেছে নিজেকে। ওইখানে, হরিচরণের ওই জীবনযাত্রাকে কেউই আর সরাতে পারবে না কক্ষনো। সে দু’বার গোঁফ মুচড়োয়। আকাশ লাল হয়ে আসছে। একটু পরেই গরমের ছাঁট লাগবে। ভোরের আলোয় সাতকন্যার হলুদ হলুদ রঙ জেগে উঠছে। হরিচরণ দেখেছে, এ বাড়ির সামনে কখনও ময়লা জমে থাকে না। আবর্জনা থাকে না। বাড়ির বাঁদিক ঘেঁষে একটি লতানে বেলফুলের গাছ। এই এলাকায় এমন গাছ আর একটিও দেখেনি হরিচরণ। সারা গ্রীষ্মে থোকা থোকা সাদা ফুল ফোটে গাছটায় আর গন্ধ ছড়িয়ে দেয়। এই গাছের নীচে প্যাকেট প্যাকেট করে সব আবর্জনা রেখে দেন এ বাড়ির মা। সেই প্রথম আসার পর একদিন ডেকে বলে দিয়েছিলেন হরিচরণকে। এরকম থাকবে। এরকমভাবে রেখে দেব। নিয়ে নিয়ো। হরিচরণ দেখেছিল তাঁকে। কী সুন্দর! দেবীপ্রতিমার মত মুখ। আর তার মেয়েরাও কী সুন্দর! বড়টাকে হুবহু হেমামালিনীর মতো লাগে। মেজটা যেন তনুজা। এ বাড়িতে আসার পরই তাদের বিয়ে হয়ে গেল। সেজটার সাজগোজ অনেকটা রীণা রায়ের মতো। ওই রকমই উঁচু গাল। চোখে কাজল। সুন্দর। কিন্তু হরিচরণের ভাল লাগে না। কেন, সে নিজেও জানে না। ওরা মেয়ে। সম্পূর্ণ মেয়ে। কিন্তু যেন মেয়ে নয়। ও বাড়ির বড় মেয়ে মেজ মেয়ের সঙ্গে বাকিদের মিল নেই। বাকিরা টাইট প্যান্ট পরে। ছোট ছোট শার্ট পরে। একেবারে ছেলেদের মতো হাঁটাচলা। কিন্তু ঠোঁট রাঙায়। কাজলও পরে চোখে। যদি অন্য পথ দিয়ে এ পাড়ায় ঢোকে হরিচরণ তবে এ পথে বেরোয়। তখন, ওইসব মেয়েরা নানা জায়গায় যেতে থাকে। তাদের শরীরে সূর্যের আলো ঠিকরোয়। সমস্ত পৃথিবীকে তুচ্ছ করে পা ফেলে ফেলে এগিয়ে যায় তারা। হরিচরণ তখনই তাদের দেখে নেয়। দেখে নেয় আশেপাশের সব বয়সের সব পুরুষ। এখানে এরকম পোশাক এই সাতকন্যার মেয়েরা ছাড়া আর কেউই পরে না। তাদের দেখতে দেখতে পানওয়ালা পান বানানো থামিয়ে দেয়। মালবাহী ট্রাকগুলো গতি কমিয়ে কাঁপতে কাঁপতে পেরিয়ে যায় তাদের। সমস্ত যুবক একবার নড়েচড়ে বসে। আর হরিচরণের মন খারাপ হয়ে যায়। কেন যে হয় সে তা বুঝতেও পারে না। ওই মন খারাপ দিয়েই সে ঠেলে নিয়ে যায় ভ্যানটিকে। অনেকক্ষণ।

আজও বেলফুলগাছের তলায় আবর্জনার প্যাকেট রাখা আছে। হরিচরণ নিজের ভ্যানে তুলে নিল প্যাকেটটা। তার প্রথম আবর্জনা সংগ্রহ। একটা বাসি বেলফুল খসে পড়ল তার গায়ে। যেন তলা থেকে আবর্জনা সরিয়ে নেওয়ার জন্য একটুখানি আশীর্বাদ ফেলে দিল গাছ। হরিচরণ ওপরে তাকাল। এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল সে। বেঁধে দেওয়া দড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে যেখানে শেষ হয়েছে বেলফুলের ঝাড়, সেইখানে, ছাদের আলসেয় হাত রেখে, আর সেই হাতে মুখ রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সাতকন্যার সেজ মেয়ে। সেজ মেয়েই তো! হরিচরণ ঠাহর করল। মেয়েটি তাকে নজর করছে না। মুখ নামিয়ে নিল সে। ভ্যান ঠেলে এগোতে থাকল। এখন আর পথ বা পথের আবর্জনা তার চোখে পড়ছে না। তার বুক জুড়ে দুঃখ উঠে আসছে। চোখের সামনে সেজ মেয়ের মুখ ছাড়া অন্য কিছু নেই। হরিচরণ বুঝতে পারছে না, কী ছিল মেয়েটির মুখে, যা তাকে এমনই দুঃখজর্জর করে ফেলছে। তাকে যেমন কাজলে, যেমন রঙে, যেমন বেপরোয়া ভঙ্গিতে দেখতে সে অভ্যস্ত তার কিছুই এই ভোরবেলায় নেই। যেন-বা তার দিদিদের মতোই হয়ে উঠেছে সে কিংবা তার চেয়েও বেশি কিছু। যেন আকাশের কাছে নিবিড় করে প্রার্থনা করছে। হঠাৎই তার সমস্ত বেপরোয়া ভাব মিলিয়ে গিয়ে সে হয়ে উঠেছে করুণ ও ক্লিষ্ট। এ কি তাকে মানায়? হয় তো মানায়। আবার মানায়ও না। এই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা, কীরকম দুঃখী করে দেয় সমস্ত ভোরবেলা। বুকের ওপর থেকে, গলা আর মুখ আর বিনুনি ঝোলানো মাথাটি ওপরের দিকে তুলে রাখা— এর বেশি কিছুই দেখতে পায়নি হরিচরণ। কিন্তু এখন, যেন অল্প অল্প করে তার মনে পড়ছে, অনেকদিন, অনেকদিন এই মেয়েটিকে সে রাস্তায় দেখতে পায়নি। এ বিষয়টি তাকে ভাবায়ওনি তেমন। দিনের পর দিন রাস্তা কাঁপিয়ে তাদের আসা-যাওয়া দেখতে দেখতে, ওই দর্শন প্রতিদিনের জন্যই এমন সত্য হয়ে ছিল যে মনে হত আজও হয়েছে। এমনই হয়েছে। চোখে না দেখলেও।

এক জায়গায় ভাঙা ঝুড়ি পড়ে আছে। চলতে চলতে কুড়িয়ে নিল হরিচরণ। ভ্যানের গায়ে বেঁধে রাখা ঝাড়ু এবার খুলে নিচ্ছে সে। পথ ঝাঁট দিচ্ছে। টেনে টেনে জড়ো করছে এক দিনের আবর্জনা। মাঝে মাঝে তার মনে হয়, সে যদি না ঝাঁট দিত এমন, দিনের পর দিন এইসব আবর্জনা জমে পাহাড়ের মতো হয়ে যেত, আর ঢেকে যেত এইসব পথ মাটি গাছপালা, এইসব অট্টালিকাপ্রতিম বাড়িঘর। তখন আর মানুষ দেখা যেত না। এই ‘সাতকন্যা’র মেয়েও এরকম উদাস ও বিষণ্ণ চোখে আকাশের দিকে চেয়ে ভোরবেলাকে দুঃখী করে দিত না। হরিচরণের বাপুও এরকমই সাফাইওয়ালা ছিল। বলতে গেলে, হরিচরণের মনে হয়, আবহমানকাল ধরে তারা বংশ পরম্পরায় এমনই সাফাই করে চলেছে আর পৃথিবীকে পরিচ্ছন্ন রাখছে।

পাড়ার অর্ধেক পরিষ্কার হতে না হতে রোদ উঠে গেল বেশ। হরিচরণের গেঞ্জি ঘামে ভিজে গেছে। এখানে ওখানে ধুলো-ময়লা লাগছে। সাফাইয়ের কাজ করতে এলেও হরিচরণ প্রতিদিন তুলসীর কেচে দেওয়া ধুতি আর গেঞ্জি পরে আসে। যে-কোনও কাজই খুব পরিচ্ছন্নভাবে ও সততার সঙ্গে শুরু করা উচিত বলে তুলসী মনে করে। হরিচরণও এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে না। বস্তুত তুলসীর সঙ্গে তার এ পর্যন্ত কোনও বিষয়েই মতের অমিল হয়নি।

কাজ করতে করতে ‘সাতকন্যা’র মেয়েটি কখন মন থেকে হারিয়ে গেল টের পেল না হরিচরণ। সে এখন পরেশবাবুর বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঝাড়ু আর বেলচা নিয়ে তৈরি হচ্ছে সে। প্রতিদিনের মতো মাছের আঁশ, তরকারির কাটা অংশ ও উচ্ছিষ্ট খাবারের স্তূপ পড়ে আছে গেটের কাছে। হরিচরণ ভাবতে ভাবতে এগোচ্ছে— থাকবে কি থাকবে না। পরেশবাবুর স্ত্রীর রক্তমাখা কাপড় পড়ে থাকে এখানে। প্রতিমাসে। পরিষ্কার করতে করতে হরিচরণ জেনে গেছে, এই সেই সময়। সে তাই নিজের মধ্যে নিজেকে প্রস্তুত করছে। কিন্তু তেমন কিছু পড়ে নেই। হরিচরণ খানিক স্বস্তি বোধ করছে। ধীরে ধীরে ঝাড়ু আর বেলচা দিয়ে আবর্জনা তুলছে। বাঁদিকে জানালা দিয়ে সুর ভেসে আসছে। হরিচরণ জানে, পরেশবাবুর বড় ছেলে এখন গান গাইছে। গম্ভীর মিঠে স্বর রোদ্দুরে মিশে যাচ্ছে। কিন্তু শব্দগুলি ছড়িয়ে যাচ্ছে। ঘুরে পড়ছে। কিছুতেই আকার নিচ্ছে না। হরিচরণ গান থেকে বাক্য পাবার চেষ্টা করছে। পাচ্ছে না। সে জানে না এ কীরকম গান। কিন্তু বেশ গান! এ বাড়ির সামনেটা পরিষ্কার হয়ে গেল। ঘরে ঘরে মানুষের ঘুম ভাঙছে। পথে কুকুর-বেড়াল ঘোরাঘুরি করছে। জলের ভারীরা বাঁক কাঁধে ব্রিজের তলার কলে জল আনতে ছুটছে। মাথুরের গড়ে ডিপ টিউবওয়েল থেকে পাম্প করে যে-জল ওঠে ও ঘরে ঘরে চলে যায় তা পানযোগ্য নয়। এমনকী স্নানযোগ্যও নয়। ওই জল চুলে পড়লে চুল চিট চিট করে। এখানে জলের ভারীর খুব চাহিদা। ড্রামে জল ভরে ঠেলায় করে তারা বাড়ি বাড়ি জল পৌঁছে দেয়। বেশ কাজ। হরিচরণের বেশ ভাল লাগে। সকালে বিকেলে দু’বার বাড়ি বাড়ি জল দিয়ে যাও। সারা দিনভর অন্য কাজ করো। আয়ও হল। জল দেবার পুণ্যও হল। সে যদি মিউনিসিপ্যালিটির সাফাইওয়ালা না হয়ে অন্য কিছু হত, তবে কালু সাহার ইট-সিমেন্টের গুদামে কাজ করে বাড়তি আয়ের সন্ধান না করে এই জল বণ্টন করত। সে জানে, সাফাইওয়ালার আনা জল কেউ খাবে না। কেউ তা দিয়ে স্নান করবে না। তার জন্য তার কোনও গ্লানি নেই। প্রতিবাদও নেই। সাফাইওয়ালার হাতে জল আর কে কবে খেয়েছে! এই সবই তার অমোঘ সত্য মনে হয়। সে দেখেছে, শহরে ধর্মাধর্ম নেই, জাতি বর্ণ নেই, হিন্দু-মুসলমান এক টেবিলে খাবার খায়, ব্রাহ্মণে কায়স্থে দিব্যি বিয়ে-সাদি ঘর-সংসার হচ্ছে। কিন্তু প্রফেশন সম্পর্কে উন্নাসিকতা যেমন ছিল তেমনি আছে। হরিচরণ জানে, বামুনের ছেলে এখন জুতো সারাতে পারে। দেশকাল এমনই হল সে তাও সম্ভব। স্বাভাবিকও। আর সেই ব্রাহ্মণতনয় তখন মুচি হয়ে গেল। জুতো সারায় বলেই। সে ক্রমে তুচ্ছ হতে থাকবে। যদি পৌরোহিত্য তার অন্যতম কাজ হয় তা হলেও কেউই তাকে পূজায় নেবে না। সে ক্ৰমে ব্রাত্য হতে থাকবে। হরিচরণ জানে, বুঝতে পারে, মানুষে মানুষে ভেদ বর্ণে আছে, ধর্মে আছে, জাতিতে আছে— সেইসঙ্গে পেশায় আছে। অন্যগুলো টপকানো যায়। জাতবৃত্তি বা পেশা টপকানো যায় না।

পথ পরিষ্কার করতে করতে সেতারের বাজনা শুনতে পেল হরিচরণ। গ্রীষ্মের এই সকাল, হঠাৎ শারদীয় হয়ে উঠল যেন। কে বাজায় এমন বাজনা? হরিচরণ ওপরের দিকে তাকাল। সে জানে এটা চাকরি করা মাসিমার বাড়ি। এ বাড়ির সামনেও কখনও জঞ্জাল পায় না সে। মাসিমার বলা আছে, নীচে দাঁড়িয়ে হরিচরণ ভ্যানের গায়ে কয়েকটি ধাতব শব্দ তুলবে, তখন ওপর থেকে জঞ্জালের প্যাকেট তিনি ফেলে দেবেন নীচে। সে শব্দ করতে করতে ওপরের দিকে তাকাল। ক’দিন হল এ ধারের জানালাগুলো সকাল সকাল খোলে না। মাসিমার ছেলে এসেছে। সে বোধ হয় অনেকক্ষণ ঘুমোয়। জানালা বন্ধ থাকলেও মাসিমা ঠিকই শুনতে পেয়েছেন শব্দটা। প্যাকেট নিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়াচ্ছেন। ফেলব? রোজকার মতো জিজ্ঞেস করছেন তিনি, হরিচরণ মাথা দোলাচ্ছে। হ্যাঁ। ফেলুন। তাদের কথোপকথনেই বুঝি, কিংবা সেই ধাতব শব্দে বাজনার শব্দটি থেমে গেল। জানালার পর্দা তুলে উঁকি দিল বোরখা ঢাকা একটি মুখ। হরিচরণ দেখল, মুসলমান মাস্টারের বোন ওপর থেকে উঁকি মারছে। মাসিমার জন্য শব্দ করলে সেও হরিচরণের আগমনবার্তা টের পায় এবং জঞ্জালের প্যাকেট নিয়ে নীচে নেমে আসে। আজ বুঝি তার নামার ইচ্ছে নেই। প্যাকেট নিয়ে সেও এসে দাঁড়াল বারান্দায়। কথা বলছে না। ইশারা করছে— ছুড়ব? হরিচরণ ভ্যান ঠেলে এসে দাঁড়াল ওই ব্যালকনির নীচে। নীলোফা দু’টি প্যাকেট ছুড়ে দিল ওপর থেকে। একটি ভ্যানে পড়ল। একটি পড়ল না। মাথায় হাত দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল সে— ‘হে আল্লা!’ হরিচরণ হাসল। অভয়দানের হাসি। বেলচা দিয়ে কুড়িয়ে নিল প্যাকেট। নীলোফা কি হাসল একটু? কৃতজ্ঞতার হাসি কি একটুখানি দিয়ে গেল? হরিচরণ জানে না। মুসলমান মাস্টারের বোনের মুখ কোনওদিনই দেখেনি সে। হয়তো কেউই দেখেনি। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ভ্যানটিকে এ দিক-ও দিক করতে থাকছে সে এখন। নীলিমা ওপর থেকে ডাকলেন— হরিচরণ।

—‘হ্যাঁ, মাসিমা।’

উত্তর দিল হরিচরণ।

—অনেকটা রুটি আর ছানার ডালনা আছে। যাবার সময় নিয়ে যাবে?

হরিচরণ হাসল। এই মাসিমা প্রায়ই তাকে কিছু না কিছু দেন। নানারকম খাবার। খুবই সুস্বাদু হয় সেইসব। আজও ছানার ডালনা আর রুটির কথা শুনে হরিচরণের জিভে জল ভরে এল। নীলিমা তাকে অন্যমনস্ক দেখে বললেন— রাত্রে বানিয়েছিলাম। তোমার দাদার শরীরটা খারাপ হল… এত ভুগছে আমার ছেলেটা… কিছুই খেল না। আমি যা পেরেছি সামান্য খেয়ে বাকিটা তুলে রেখেছি। ভাবলাম তুমি নিয়ে যাবে। তোমার ছেলেমেয়েরা খাবে আনন্দ করে।

হরিচরণ ফের হাসল। ভ্যানের গায়ে ঝাঁটা বেলচা ঠেকিয়ে রেখে উবু হয়ে রাস্তার ধারে বসে পড়ে বলল— মাসিমা, ছানার তরকারি তো আজ নিতে পারব না।

হরিচরণের মুখে রোদ্দুর পড়ছে। ঘামে ভেজা মুখ সে রোদ থেকে আড়াল করছে ঘামে ভেজা হাত দিয়ে। নীলিমা বলছেন—কেন? কারও শরীর খারাপ হল বাড়িতে?

—না। তুলসী আজ সন্তোষীমা’র পূজা রেখেছে বাড়িতে। টক কিছু ঘরে তোলা যাবে না। ছানাতে লেবু আছে তো। ছুঁতেও পারব না আজকে।

নীলিমা হাসছেন। বলছেন— হ্যাঁ। সন্তোষী মা’র পূজা বেশ হচ্ছে বটে ঘরে ঘরে। কিন্তু টক ছোঁবে না বলছ কেন, এই জঞ্জালের মধ্যে কত লেবুর খোসা আর ফলের খোসা লুকিয়ে আছে তা তো তুমি বুঝতেই পারছ না। সেগুলো তো ছুঁয়ে ফেলছ।

—কী জানি মাসিমা। তুলসী বলেছে, ছুঁতে নেই। আমি তো দেখে-শুনে কিছু করিনি। ভগবান আমাকে পাপ দেবেন হয়তো। আমি সামান্য মানুষ, কি আর বুঝি!

নীলিমা ভেতরে চলে গেলেন। হরিচরণ উঠে ভ্যান ঠেলে ঠেলে পাশের গলিতে গেল। মিথিলেশবাবুর বাড়ির সামনে গুচ্ছের নোংরা। ভাত-তরকারি। ছেঁড়া কাপড়। প্লাস্টিক। বোতল। খবরের কাগজের দলা। তরকারির খোসা। মাছের আঁশ। অনেকক্ষণ লাগবে এ জায়গাটা পরিষ্কার করতে। হরিচরণ কপালের ঘাম মুছল। একটু চা খেতে ইচ্ছে করছে। বেলচা নামিয়ে ময়লা তুলছে সে। মিথিলেশবাবুর বাড়ি থেকে বাজনা ভেসে আসছে। ঠিক এমন বাজনাই সে একটু আগে মুসলমান মাস্টারের বাড়ির সামনে থেকে শুনে এসেছে। বড় মধুর এই শব্দ। ওখান থেকেও, এখানে। মিথিলেশবাবুর বাড়ির সামনে যেন আরও মধুর হয়ে বাজছে। হরিচরণ মিথিলেশবাবুর বাড়ির সামনে এ বাজনা প্রায়ই শোনে। কিন্তু আজ যেন তার কানে সব কিছুই আরও স্পষ্ট শোনাচ্ছে। আলাদা করে বাজনা শোনার ইচ্ছে এর আগে কখনও হয়নি। এখানকার ময়লাগুলি একটু ধীরে ধীরেই সাফাই করল সে। একটু বেশিক্ষণ ধরে বাজনা শুনল। ভ্যান ঠেলে এগিয়ে চলল আবার। বিকাশবাবুর বাড়ির কাছাকাছি আসতেই চা খাবার ইচ্ছেটা দ্বিগুণ হয়ে উঠল হরিচরণের। বিকাশবাবুর বউ, ছোটদের ইস্কুলের বড় দিদিমণি মাঝে মাঝে সকালবেলায় চা খেতে দেন হরিচরণকে। বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে গিয়ে কুয়োতলায় বসে চা খায় হরিচরণ। দিদিমণি তাকে ভাঁড়ে চা দেন। এ সব ভাঁড় চায়ের জন্য নয়। হয়তো দই এসেছে বা মিষ্টি এসেছে। আর দিদিমণি মনে করে হরিচরণের জন্য সে-সব রেখে দিয়েছেন। হরিচরণ খেলে বা ছুঁলে পাত্রগুলি আর ব্যবহার করার যোগ্য থাকবে না। সে তাই এই ভাঁড়ের চায়েই তৃপ্তি সীমিত রাখে এবং খাওয়া হলে নিজের ভ্যানে ভাঁড়টা ফেলে দেয়। সেইসব চা পানের দিন দিদিমণির বাড়িতে নিশ্চিতভাবে ইঁদুর বা বেড়াল মরে থাকে। কিংবা বাইরের দিকের পায়খানার গর্তে পাঁচিল টপকে বল বা ঢিল এসে গর্তের মুখ আটকে দেয়। চা খাওয়া হলেই দিদিমণি হরিচরণকে সেইসব মরা ইঁদুর-বেড়াল পরিষ্কার করে দিতে বলেন কিংবা পায়খানার গর্ত থেকে আবর্জনা তুলে সেটি যথাযথ করে দিতে বলেন। হরিচরণ তা করে দেয়। পরিষ্কারকরণই তার ধর্ম। তার সঙ্গে জড়িয়ে যায় চা খাবার কৃতজ্ঞতা। মাঝে মাঝে দিদিমণিও নানা রকম খাবারের প্যাকেট ধরিয়ে দেন হরিচরণকে। তার মধ্যে হোটেলের খাবারের প্যাকেটও থাকে। আর বেশির ভাগ দিনই সেইসব প্যাকেটের খাবার পচে যায়। হরিচরণ কতদিন বাড়ি নিয়ে যাবার আগেই সেসব ভ্যানের জঞ্জালে ফেলে দিয়েছে। কখনও-বা সে বুঝতে পারেনি। বাড়ি নিয়ে যাবার পর তুলসী ছি ছি করে ফেলে দিয়েছে। রাগ করে বলেছে—এ সব নাও কেন? আনো কেন? আমরা কি খেতে পাই না?

—এ সব ভাল খাবার। হোটেলের খাবার।

জবাব দিয়েছে হরিচরণ।

—আমাদের হোটেলের খাবার দরকার নেই।

—ভালবেসে দেয় আমাকে। না বলি কেমন করে, বলো?

—ভালবেসে? তুমি কি সত্যি ভাবো ওরা তোমাকে এ সব ভালবেসে দেয়?

—না হলে আর দেবে কেন বলো? দানের মধ্যে ঈশ্বরের করুণা থাকে তুলসী। কেউ কিছু দিতে চাইলে না বলতে নেই।

এ সব বলে তুলসীর কাছে নিজেকে, নিজের দুঃখকে একটু একটু আড়াল করে হরিচরণ। এইসব পচে যাওয়া, ফেলে দেওয়া খাবার দিলে সেও কষ্ট পায়। গরিব মানুষ সে। দু’বেলা দু’মুঠো খাওয়া জুটে যায়। বউকে সামান্য গয়না গড়িয়ে দেওয়া, পরিবার নিয়ে খেলা দেখতে বেরুনো কিংবা দক্ষিণেশ্বরের পঞ্চবটিতে গিয়ে হনুমানকে বাদাম খাইয়ে আসার মজাও সে করতে পারে। মাঝে মাঝে ‘সোনালী’ সিনেমায় নতুন নতুন হিন্দি ছবিও দেখাতে নিয়ে যায় তুলসীকে। তাদের কোনও অভাববোেধ নেই। তবু স্বীকার করতেই হবে তারা গরিব। বিকাশবাবু যেমনি গাড়ি হাঁকিয়ে আপিস যান আর হেডদিদিমণি যেমনি সিল্কের শাড়ি পরে লাল ছাতা নিয়ে ইস্কুলে যান তেমন তো কিছুই নেই তাদের। তাই, বিকাশবাবু আর হেডদিদিমণির যতখানিতে পচা লাগে, যতখানিতে কোনওকিছু আর খাবার যোগ্য বলে মনে হয় না, তার চেয়ে অনেক বেশি পচা খাবার হরিচরণদের খেয়ে হজম করে ফেলাই উচিত। কারণ গরিব লোহা খেয়েও হজম করে। আরও বেশি গরিব রাস্তার জঞ্জাল থেকেও খাবার কুড়িয়ে খায়। অতএব, হরিচরণ মনে করে, সকল দেওয়ার মধ্যেই মহত্ত্ব লুকিয়ে আছে। যদিও তুলসী তা শেষ পর্যন্ত মেনে নেয়নি। অন্ধর মাও না। ইদানীং বাড়িতে খাবার নিয়ে ফিরলে তুলসী জানতে চায়, খাবার কোন বাড়ির। বিকাশবাবুর বাড়ির শুনলে সে ওই খাবার ছুঁড়ে ফেলে দেয়। পরখ করেও দেখে না সে খাবার গ্রহণযোগ্য ছিল কি না। বাচ্চারাও এ নিয়ে বায়না করে না। অন্যদের দেওয়া খাবার তারা আগ্রহ ও তৃপ্তির সঙ্গেই খায়। অন্যরকম স্বাদ ও গন্ধ। কিন্তু সে খাবার না-খেলেও তাদের মন খারাপ নেই। বাড়ির সাধারণ রান্নাও তারা সমান তৃপ্তিতে গ্রহণ করে।

অন্ধর মা একেবারে খাবার নিতে চায় না হেড দিদিমনির কাছ থেকে। বলে— আমি নিজের চক্ষে দ্যাখসি৷ পোলায় খাইয়া গেল। লাউ করসিলেন। পোলায় খায় নাই। আইঠা পাতের থিকা দিদিমণি বাটিতে লাউ তুইল্যা রাখতেয়াসেন। আমারে কয়— অন্ধরা মা। লাউ রাখসি। খাও। আমি কই— আইজ শরীলডা ভাল নাই। কিসু খামু না। কয়— লাউ খাও। লাউ তো ঠাণ্ডা— সাইরা যাইব গিয়া। আমি আর কি কই না। লাউ লইয়া থো ফ্যালাইয়া কইরা দিসি নালায় ফেইল্যা। ছুডোলোকের বেটি ছুডোলোক। গতর খাটাইয়া খাই। ভিক্ষা তো করি নাই। পাতের আইঠা খাইতে দিব ক্যান?

অন্ধর মা’র ভাবনা মিলিয়ে যেতে না যেতেই তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল হরিচরণের। গোঁফের তলায় হেসে সে জিজ্ঞেস করল— কি? আজ যে বড় তাড়াতাড়ি?

অন্ধর মাকে চিন্তাকুল দেখাল। সে বলল— হ। অন্ধর বাপরে লইয়া বড় ভয়ে ভয়ে আসি।

হরিচরণ বলল— কী হয়েছে অন্ধর বাপের?

—সারা দিনে কয় মাথা ঘুরায়। হজম হয় না। পাতলা কইরা কাঁচকলার ঝুল আর ভাত দিসি। তাও কয় প্যাটে ব্যাদনা। উঠনের নাম নাই। কুনো কামও করতে পারে না। আমি একা কুনদিগে করুম! টাকা পয়সা নাই। পাঁচখান কাম নিসি। সকাল সকাল না আইলে সারুম কি কইর‍্যা?

অন্ধর মায়ের জন্য হরিচরণের চোখ নরম হয়ে আসছে। কী সুন্দর গড়ন-পেটন অন্ধর মায়ের! কী সুন্দর কথা! চারটি মেয়ে ও একটি অন্ধ পুত্রের জন্ম দিয়েও, এই বাড়ি বাড়ি এত খাটাখাটুনি করে আর সংসার সামলেও সকালের রোদ্দুরে অন্ধর মাকে খুব সজীব লাগছে। তুলসী বলে, একে বলে মনের আলো। যার মন যত সাচ্চা থাকে, তার মুখ তত সজীব থাকে— সে তুমি যতই পরিশ্রম করো! কত কিছু যে জানে সে। বোঝে। হরিচরণ যখন তার সমস্ত দিনের দেখার গল্প, শোনার গল্প সন্ধ্যায় তুলসীর কাছে বলতে থাকে আর জানতে চায়— কেন এরকম হয়, বলো তো কেন হয়! তখন তুলসী খুব নিশ্চিতভাবে উত্তর দেয়। যেমন অন্ধর মা’র বিষয়ে সে বলেছিল বা ‘সাতকন্যা’র গৃহিণীর বিষয়ে। বলেছিল— মনে যদি অন্ধকার না থাকে, হাহাকার না থাকে, কষ্ট পেলে, কেন কষ্ট পাচ্ছি, এরকম না ভেবে যদি মনে করা যায়, সুখ-দুঃখ সবারই জীবনে আছে, তা পেরিয়ে যাওয়াই কাজ, যদি অন্যের আনন্দ দেখে ঈর্ষায় পুড়ে না যায় কেউ, তবে পরিশ্রম, কষ্ট, অভাব— কিছুই তার মনকে মারতে পারে না। মনের সেই আলো তাকে উজ্জ্বল করে রাখে। ভাল রাখে।

অন্ধর মা যাই-যাই করছিল। হরিচরণ বলল— ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছ না কেন?

—হ। ডাক্তার। মল্লিনাথ ডাক্তার তো আর রুগীই দ্যাখেন না। কালীতারা দিদি আমারে তার ঘরেও লইয়া গেসে। ডাক্তারে কয়, মায় নিষেধ করসে। আর আমি রুগী দেখুম না কালী। কত কইলাম কত সাধলাম। না, দ্যাখবেন না। গলায় রুদ্রাক্ষ পইরা, ফোঁটা কাইটা রাতদিন ঠাকুর ঘরে মন্ত্র পড়তেয়াসেন। কয়, শিবতোষ ডাক্তার আসে, তার কাসে যাও।

হরিচরণ বলে—বড় ডাক্তারবাবুকে দোষ দিয়ো না গো অন্ধর মা। মানুষটার কি দুঃখের শেষ আছে? অত ভাল ছেলেটা কীরকম হয়ে গেল। মরেই গেল শেষে। বউটা পাগল হয়ে গেল। সবাই মানুষটাকে ছেড়ে, একলা ফেলে কত দূরে চলে গেল। তার কি আর কাজে মন লাগে রে! তুমি বরং শিব ডাক্তারের কাছেই অন্ধর বাপকে নিয়ে যাও।

—যাই নাই? গেসিলাম। শোনেন, শিব ডাক্তারের কাছে গিয়া, ওষুধে ইঞ্জেকশানে আমার পঞ্চাশ ট্যাকা কর্জ হইয়া গেল। কিন্তু কিস্যু হয় নাই। ভগবান জানে কী আসে কপালে। ভাল-মন্দ হইলে কপাল তো একখান পুড়ব না। পুড়ব দুইখান।

—দুইখান কেন?

—বাংলাদ্যাশে আর একখান সংসার রাইখা আসছে না?

—আরও সংসার মানে?

—অন্ধর বাপের আর একখান বিয়া আসে না? তারে বাংলাদ্যাশে রাইখ্যা আইসে। দুইখান পোলাও আসে হেইখানে। এইখান থিকা কাজ কাম করে, দুই-চাইর পয়সা জমাইয়া গিয়া হ্যায়রে দিয়া আসে।

হরিচরণের মুখে কথা জোগায় না। আপনমনে ভ্যানের হাতল ধরে টানাটানি করে সে। বিকাশবাবুর বাড়ির নিমগাছ থেকে পাতা খসে পড়ে পথ ভরিয়েছে। সেগুলোই তুলবে বলে ঝ্যাঁটা হাতে নিতে থাকে এখন। অন্ধর মা বলে চলে— সন্তোষীমায়ের কাসে মানত করসি। আইজ থিকা আসন নামামু।

হরিচরণ অন্ধর মা’র দিকে তাকায়। অন্ধর মা’র মুখে দুঃখের ছায়া। কী আশ্চর্য মেয়েমানুষ।

সে বলে— পূজা করো ক্ষতি নেই। কিন্তু ভগবান তো বলেনি অসুখ করলে দাওয়াই না খাওয়ালেও সেরে উঠবে। ঈশ্বর অসুখ দিয়েছেন তো তার দাওয়াইও দিয়েছেন।

অন্ধর মা বলে— হ। কামারহাটিতে এক গুণিনের সন্ধান পাইসি। মিঞাবাবার থান। এ্যাক্কেরে বইলা-বইলা সারাইয়া দিব। আর শুদু কি রোগ সারান? কি হারাইলে চুর ধইর‍্যা দিব। মাথা খারাপ হইলে সারাইয়া দিব। বর ছাইড়্যা গ্যালে ধইর‍্যা আনব। হেইখানে লইয়া যামু অন্ধর বাপেরে।

হরিচরণ হাঁ করে শোনে। সত্যিই এমন কেউ আছে? এমন মুশকিল আসান? আর তা কামারহাটিতেই? তার একবার যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সে যাবে কী নিয়ে? তার তো পরিবারে কারও অসুখ করেনি। মাথা খারাপ হয়নি। তুলসী এবং তার মধ্যে ভালবাসার এতটুকু অভাব ঘটেনি। তা হলে? কোনও দুঃখ বিনা কষ্ট বিনা কেমন করে সে গুণিনের কাছে যায়। তখনই তার মনে পড়ে তুলসীর ইচ্ছের কথা। তাই তো! এ কথা কেন এতক্ষণ মনে পড়েনি? পাঁচটাই ছেলে বলে, মেয়ে নেই বলে, তুলসীর কি দুঃখ নেই? অভাববোধ নেই? হরিচরণ কি জানে না, আজ থেকে তুলসী যে সন্তোষী মা’র ব্রত পালন করবে তা ওই মেয়ে প্রার্থনা করেই? তবে কি সে তুলসীকে নিয়ে একবার যেতে পারে না, গুণিনের কাছে? পরক্ষণেই তার মনে হয়, মিঞাবাবার থান, তার মানে গুণিন মুসলমান নিশ্চয়ই। হরিচরণ জানে, তুলসী কোনওভাবেই কোনও মুসলমানের দেওয়া ওষুধ খাবে না। সে জিজ্ঞেস করে— লোকটা কি মুসলমান?

—না। হিন্দু। সন্ন্যাসী।

—তুমি যে বললে মিঞাবাবার থান?

—হ। ওইখানে আগে এক মুসলমান গুণিন আসিল। হ্যায় মরলে গিয়া তার দ্যাহ পাওয়া যায় নাই। যেইখানে বইসা তেনি নামাজ পড়তেন, হেইখানে এক রাত্রর মইধ্যে দুইখান গাছ সাঁই সাঁই কইরা বাইড়া উঠল। একখান কদম গাছ। আর একখান নিম। মাইনষে কয়, মিঞাবাবার আত্মা হইল নিম গাছ আর দ্যাহ হইল কদম।

হরিচরণের চোখ গোল গোল হয়ে যায়। সে যেন স্পষ্ট দেখতে পায় সেই মুসলমান পুণ্যাত্মাকে যার শরীর মৃত্যুর সঙ্গে কদমগাছ হয়ে উঠছে আর ফুলে ফুলে ভরে উঠছে আশ্চর্য পুলকে। যাঁর আত্মা আশীর্বাদের মতো, ঔষধের মতো দাঁড়িয়ে আছে নিমগাছ হয়ে তার তলায় একদিন এসে দাঁড়াচ্ছেন একজন হিন্দু সন্ন্যাসী। মুসলমান ফকিরের কাজ কাঁধে তুলে নিচ্ছেন। সুশ্রূষা বিলিয়ে দিচ্ছেন দিগ্বিদিক। অন্ধর মায়ের মতো কত মানুষ তাতে উপকৃত হচ্ছে। হিন্দু-মুসলমান সব তো বাইরের কথা। আচরণের কথা। পুণ্যে পূজায় মানুষের কল্যাণে কী-বা হিন্দু কী-বা মুসলমান! হরিচরণের হৃদয় প্রসন্ন হয়ে যায়। সে স্থির করে কন্যার কামনায় তুলসীকে নিয়ে সে কামারহাটি চলে যাবে একদিন। দরকার হলে অন্ধর মাকেও সঙ্গে নেবে। সে কৃতজ্ঞ চোখে অন্ধর মা’র দিকে তাকায়। বলে— তুলসীও আজ থেকে সন্তোষী মা’র পূজা বসাবে অন্ধর মা। তুমি ভেবো না। ঈশ্বরের ওপর ভরসা রাখো। সব ঠিক হয়ে যাবে।

সে ঝাড়ু দিয়ে নিমপাতা জড়ো করতে থাকে। অন্ধর মা বিকাশবাবুর বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতে লক্ষ্মী ছুটে আসেন— দাঁড়াও। দাঁড়াও। ঢুকো না।

অন্ধর মা থমকে দাঁড়ায়। লক্ষ্মী বলেন— অতক্ষণ লোকটার সঙ্গে কথা বলছিলে, ছুঁয়ে-টুয়ে দাওনি তো? ছুঁলে বাপু চান-টান করে আমার বাসন-কোসন ঘর-দুয়ারে হাত দেবে।

অন্ধর মা বোকার মতো হাসে। বলে— ছুমু ক্যান? এইডা আপনে কী কন? পথে খাড়াইয়া দুইখান কথা কইসি। তারে আমি ছুঁইতে যামু ক্যান?

লক্ষ্মী বললেন— দু’টো কথা তো বলোনি বাপু। সন্তোষী মা’র পুজো করব বলে আজ আমি ভোরে ভোরেই উঠেছি। সবই দেখলাম। কাজ করতে এসেছ। করে চলে যাও। ওই গু-ঘাঁটা লোকের সঙ্গে অত গুজগুজ কি!

অন্ধর মা’র কোনও কথা শোনা যায় না এবার। অন্তত হরিচরণের কানে অন্ধর মা’র কোনও উত্তরই পৌঁছয়নি। কিন্তু লক্ষ্মীর প্রতিটি কথাই সে শুনতে পাচ্ছিল। আর শুনতে শুনতে সমস্ত ঝরে পড়া নিমপাতা, কাগজের ঠোঙা, চুলের দলা, ছেঁড়া ব্লাউজ বা জাঙিয়া জড়ো করে বেলচায় তুলে তার ভ্যান ভরে ফেলছিল। একটি দীর্ঘশ্বাস পড়ল তার। চায়ের নেশা কখন হারিয়ে গেছে! গোঁফের ডগায় ঘামের বিন্দু জমেছে। সকালের পরিচ্ছন্ন পোশাক এখন ময়লা প্রায়। মুখ নামিয়ে সেই পোশাকেই মুখের ঘাম মুছে নিচ্ছে হরিচরণ। ভাবছে— আজ সন্তোষী মা’র কাছে তুলসী হয়তো মেয়ে চাইবে। এতদিন সে ভাবত, তুলসী যা চাইবে, সেই তার চাওয়া। এখন, এই মুহূর্তে তার মনে পড়ছে, আজ তার চাওয়া অন্যরকম। সে মেয়ে চাইবে না। বরং প্রার্থনা করবে, তার পুত্রেরা, কেউ যেন, ঝাড়ুদার হয়ে না ওঠে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *