১৫. যন্ত্রচালিতের মতো ট্রেন থেকে

১৫

যন্ত্রচালিতের মতো ট্রেন থেকে নামলেন প্রণবেশ। ফাঁকা স্টেশন। স্বাভাবিক সমতল থেকে অনেক উঁচুতে বলে, বি টি রোডের শরীর থেকে অনেক সিঁড়ি উঠে গিয়ে স্টেশনে উঁকি মেরেছে বলে একটু অন্য ধরনের এই অবতরণক্ষেত্র। চওড়া কাঠের স্লিপার ফেলা প্ল্যাটফর্ম। মাঝে মাঝে বড় বড় ফাঁক। একটু মন দিয়ে না হাঁটলে পা ঢুকে যেতে পারে। প্রণবেশ হোঁচট খেতে খেতে এগোচ্ছেন। হঠাৎ তাঁর মনে হল অফিসে কিছুই জানানো হয়নি। বাপ্পা যদি কোনওভাবে আবার ফারাক্কা চলে যায়। কিছুক্ষণ দ্রুত হাঁটলেন প্ল্যাটফর্মের ওপর দিয়ে। তারপরই মনে হল, এভাবে সবাইকে বলে কোনও লাভ নেই। গভীর অবসন্নতায় স্টেশন থেকে বি টি রোড পর্যন্ত ওই অসংখ্য সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে প্রণবেশের মনে হল রাস্তা পেরিয়ে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছনো আর সম্ভব নয়। নিজেকে নিয়ে মাঝে মাঝে অসহায় বোধ করেন প্রণবেশ। নিজেকে খুব একা ও নিঃসম্বল লাগে। এক গম্ভীর আত্মকরুণায় মন বিকল হয়ে যায়। বাবা যত দিন ছিলেন, দূরের মানুষ হয়েছিলেন। গম্ভীর। আত্মমগ্ন। পড়াশুনো নিয়েই থাকতেন। বিদ্যাসাগর কলেজের রাশভারী অধ্যাপক ছিলেন তিনি। মা ছিলেন চিররুগ্‌ণ। প্রতি দিন কোনও না কোনও অসুখ তাঁকে কাবু করে রাখত। প্রণবেশের অনেক দিন পর নীলাদ্রি এসেছিল পৃথিবীতে। প্রায় দশ বছর পর। প্রণবেশ এখন বুঝতে পারেন, রুগ্‌ণ মায়ের গর্ভে আরও একবার সন্তান আসা তাঁর শরীরের পক্ষে শুভ হয়নি। নীলুর বয়স যখন বারো, মা চলে গেলেন। প্রণবেশের মনে আছে, মায়ের দু’টি রক্তশুন্য পা। কারা যেন বলছিল—কী ভাগ্যি ! সধবা গেল।

কারা যেন আলতা পরিয়ে দিয়েছিল পায়ে। কপালে বড় করে সিদুঁর দিয়েছিল। মায়ের সেই মুখ এখন আর প্রণবেশের মনে পড়ে না। শুধু মনে হয়, দু’টি পা—সাদা। নীল শিরা-উপশিরা সমেত। লাল আলতায় ঘেরা। সেই থেকে খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল ভাই। হয়তো চারজন মানুষই নিজের মতো করে একা হয়ে গিয়েছিল। রুগ্‌ণ হলেও পারস্পরিক সম্পর্কের সরু সুতোটা বেঁধে রেখেছিলেন মা—প্রণবেশ তখনই সেটা উপলব্ধি করতেন। প্রণবেশের বাবা সচ্চিদানন্দকে দেখে বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায়নি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনিও নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন। মা রুগ্‌ণ হওয়ায় প্রণবেশের ছোটবেলা থেকেই বাড়ির রান্নাবান্না সংসার সামলানোর ভার ছিল সন্ধ্যামাসির ওপর। একটা পা খোঁড়া ছিল বলে সন্ধ্যামাসির বিয়ে হয়নি। সংসারে কোথাও তাঁর সমাদরের জায়গা ছিল না। সচ্চিদানন্দ আর ইলা, প্রণবেশ ও নীলাদ্রির বাবা ও মা তাঁকে সেই জায়গাটি দিয়েছিলেন। অনেক বড় হয়েও প্রণবেশ জানতেন সন্ধ্যামাসি তাঁর মায়ের সহোদরা। পরে জেনেছেন, সন্ধ্যামাসি মায়ের পাড়ার মেয়ে। ছোটবেলার বকুলফুল।

সন্ধ্যামাসির সঙ্গে মায়ের কোনও দিন ঝগড়া হয়নি। মায়ের মৃত্যুর পর ভাইকে মায়ের জায়গা দেবার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। তাঁরা দু’ ভাই-ই সন্ধ্যামাসিকে ভালবাসতেন। কিন্তু তাঁকে কোনওভাবে মা বলে ভাবা যেত না। কোথায় কম ছিল প্রণবেশ জানেন না। হয়তো সন্ধ্যামাসির প্রতি বাবার আচরণের সসম্ভ্রম দূরত্ব তাঁকে বাবার ছেলেদের চোখেও কিছুটা দূরে ঠেলে রেখেছিল। কিংবা, সন্ধ্যামাসির নিজের ক্ষেত্রেও বলা যায়। মা বেঁচে থাকতে, সংসারের সমস্ত কাজ সম্পর্কে মাকে জিজ্ঞাসা না করে তাঁকে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায়নি। পরম ভদ্রতায়, পরম বিনয়ে আশ্রয়দাত্রীর কাছে স্বঘোষিত অধীনতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন তিনি। মায়ের মধ্যেও সেই পরিমিতিবোধ ছিল। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ছিল বলেই কেউই কারও সীমা ভাঙার জন্য ব্যস্ত হননি। তাই ছোট ছেলে দু’টির চোখেও তিনি সন্ধ্যামাসিই হয়ে রইলেন আজীবন। প্রকৃতপক্ষে, মায়ের ছায়ার মতো কাটিয়েছিলেন পঁচিশ বছর। মাঝে মাঝে ভাইয়ের বাড়ি যেতেন। তখন মাকে খুব অস্থির দেখাত। বলতেন, সন্ধ্যা নেই। বাড়িটা ফাঁকা লাগে।

সন্ধ্যামাসির হাতখরচ ইত্যাদিও নিশ্চয়ই তিনিই জোগাতেন। কিন্তু সেই সম্পর্কে কারওকে কোনও কথা উচ্চারণ করতে শোনা যায়নি। হয়তো মা ও সন্ধ্যামাসির এত সুন্দর সম্পর্কের জন্য, কিংবা প্রত্যেকেরই অতুলনীয় ভদ্রতাবোধের জন্য কোথাও কোনও গোলমাল ছিল না। গোলমাল লাগল, জুঁই আসার পর।

স্টেশন থেকে নামার সিঁড়ির প্রান্তে এসে মল্লিনাথের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল প্রণবেশের। ওপর দিয়ে একটা ট্রেন চলে যাচ্ছিল তখন। সেই শব্দে প্রণবেশের হঠাৎ মনে হল মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। আশ্চর্য ! এতক্ষণ মনে হয়নি তো ! প্রণবেশের কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। মল্লিনাথও অন্যমনস্ক পা ফেলে আসছিলেন। স্টেশনের সিঁড়ি দিয়ে একজন নেমে আসছেন, আর একজন উঠছেন, দুই পুত্রশোকাতুর পিতা। মল্লিনাথ ষাট। প্রণবেশ পঁয়ত্রিশ। মল্লিনাথও মাথায় হাত রাখছেন। হয়তো তাঁরও মাথার যন্ত্রণা করছে। একটি বিচ্ছিন্ন ছবির মতো এই সিঁড়ি, ওই বি টি রোড, মাথার ওপরকার আকাশ এবং কিছু দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য ভ্রাম্যমাণ চিল এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছে। পঁচিশ বছরের ব্যবধান সমেত দু’টি মানুষ পরস্পরের মুখোমুখি হচ্ছেন এবং কথা বলার অনিচ্ছায় বা অন্যমনস্কতায় মাথার যন্ত্রণা নিয়ে পরস্পরকে কুশল বিনিময় না করে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু কুশল বিনিময় না করলেও তাঁদের মধ্যবর্তী ব্যবধানকে এক মুহূর্তে মুছে দিচ্ছে পুত্রশোকের ভারী পাথর।

প্রণবেশ রাস্তা পার হলেন। একটা ওষুধ খাওয়া দরকার। তিনি ব্রজগোপালের দোকানে গেলেন। দিব্যেন্দুও আজ দোকানে আছে। ওষুধটা দিতে দিতে দিব্যেন্দু বলল, ছেলের কোনও খবর হল প্রণবদা ?

প্রণবেশ মাথা নাড়লেন। বললেন, এক গ্লাস জল হবে ?

এক গ্লাস জল দিয়ে দিব্যেন্দু বলল, দরকার হলে বলবেন প্রণবদা। কোথাও যেতেটেতে হয় যদি !

কোথায় যেতে হবে ? কোথায় যাওয়া যায় ? এরা কোন জায়গার সঙ্গী হতে চাইছে ? ভাবতে মাথা ঝিমঝিম করে। চকিতে, ইথার তরঙ্গের মতো অধরা কম্পমান অবয়বে ফুটে ওঠে মল্লিনাথের মুখ। ধ্বস্ত। ভাঙাচোরা। শোকের মুখ। পিতার মুখ। যা বুঝি-বা কখনও কখনও সমার্থক। পিতৃত্বের সেই অসহ শোক ক্রমে প্রণবেশেও ছড়িয়ে যায়। টালমাটাল পায়ে তিনি বাড়ির দিকে হাঁটেন।

হারুর দোকান পেরিয়ে যেতে যেতেই হারু ডাক দেয়, ও প্রণবদা, ছেলের খবর পেলেন ?

প্রণবেশ ক্লান্ত মুখ তুলে হাসেন। মৃদু, এক চিলতে হাসি ঠোঁটের তলায় বিপজ্জনকভাবে ঝুলতে থাকে। যেন ছাদের কার্নিশ ধরে ঝুলতে থাকা মস্তিষ্কবিকৃত যুবক, যে পড়ে গেলে বাঁচানো একেবারেই অসম্ভব। মনে মনে প্রণবেশের ধাঁধা লেগে যায়। সবাই জেনে গেছে তা হলে ? এখন তাঁকে অজস্র প্রশ্নের জবাব দেবার জন্য তৈরি হতে হবে। তিনি এগিয়ে যান। লক্ষ্মীর স্কুল পেরুতে না-পেরুতেই পেছনে গাড়ির তীব্র শব্দে চমকে ওঠেন তিনি। তাকিয়ে দেখেন—পুলিশ ! সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সমস্ত অবসন্নতা কেটে যায়। প্রত্যেকটি স্নায়ুতন্ত্র টান টান হয়ে ওঠে। পথের একপাশে সরে দাঁড়ান তিনি। পুলিশের গাড়ি তাঁর প্রায় গা ঘেঁষে এগিয়ে যায় কারণ পাড়ার ভিতরকার এই রাস্তাগুলি গলির চেয়ে চওড়া হলেও এখানে কোনও ফুটপাথ নেই। রাস্তা তৈরি হওয়ার সময় কেউ মনে রাখেনি একদিন প্রণবেশ পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকবেন, হারিয়ে যাওয়া ছেলের জন্য শোকে বা দুশ্চিন্তায় তাঁর মাথা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাবে, ডাক্তারিশাস্ত্রে এটিকে মাইগ্রেনও আখ্যা দেওয়া যেতে পারে হয়তো, কিংবা নিউরোসিস, আর এমনই অবস্থায় কোনও পুলিশের গাড়ি তাঁর প্রায় গা ঘেঁষে চলে যাবে। এবং তখনই প্রণবেশ লক্ষ করবেন, একা জিপ নয়, পেছনে ইঁদুরকলের মতো কালো বড় খাঁচাটা। এবার প্রণবেশকে লক্ষ্মীর স্কুলের সিঁড়িতে উঠে দাঁড়াতে হল নইলে ওই ইঁদুরকল গাড়ি তাঁকে চাপা দিয়ে দিতে পারে এবং তখনই লক্ষ্মী ও আর দু’জন শিক্ষিকা স্কুলের বারান্দায় এলেন—প্রত্যেকের চোখে মুখে জিহ্বায় একটাই প্রশ্ন—পুলিশের গাড়ি কেন ? অ্যাঁ ? পুলিশের গাড়ি কেন ?

এ পাড়ায় পুলিশের গাড়ি আসত বটে নিয়মিত, খাঁচা ছাড়া কিংবা খাঁচা সমেত তিন-চার বছর আগেও, নকশাল ধরতে আসত, বাছবিচার না করে, খোঁজখবর করে, সমস্ত যুবক বা তরুণকে বা বালকদেরও যাদের সদ্য তরুণ বলা যায়—ওই খাঁচায় পুরে নিয়ে যেতে চাইত। কেন-না নকশাল কে বা কে নয় তা বাইরে থেকে চিহ্নিত করা সম্ভব ছিল না। নকশাল হওয়ার প্রাথমিক শর্তই ছিল তরুণ হওয়া, পুলিশ এরকমই ধরে নিতে চেয়েছিল এবং ভীষণই ভয় পেয়েছিল নিশ্চয়ই ওই সমস্ত পুলিশ বা পুলিশের চালক বা চালকদল। কারণ তারা সমস্ত তরুণকেই ঝাড়ে-বংশে নিঃশেষ করতে চেয়েছিল, যেন ছোঁয়াচে রোগের মতো আন্দোলনের স্বপ্ন একজন তরুণের থেকে অন্যজনে না যায়। ওরা খুব তাড়াতাড়ি মরে যেতে পারে। আর তীব্র ভাইরাসের মতো সংক্রামক ওই স্বপ্নের ধাক্কায় সারা পৃথিবীর ইতিহাস পাল্টে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। তাই, তখন ওই ইঁদুরধরা গাড়ি সমেত যখন তখন পুলিশ এসেছে এ পাড়ায়, অনেকটা বুঝি করপোরেশনের কুকুরধরা গাড়ির মতো আচরণ—হবে নাই-বা কেন ? কুকুর না-ভাবলে, ইঁদুর না-ভাবলে, একেবারে খোদ মানুষ ভাবলে ওদের খাঁচায় তোলা এবং মাঠে-ময়দানে-রাস্তায়-গলিতে গুলি করে মারা সম্ভব হত না, কিছুতেই সম্ভব হত না তাদের পক্ষে।

তখন প্রণবেশের মনে আছে, বিকাশদার বড় ছেলে দেবাশিসকে বম্বে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর সবাই কোথায় গিয়েছিল ? প্রণবেশের একবার মনে হয়, তাঁর ছেলের খোঁজে পুলিশের এই আগমন বুঝি-বা। না, তখনই এই ভাবনাকে তিনি খারিজ করে দেন, কারণ, বাপ্পার সঙ্গে ওই কালো খাঁচাগাড়ির কোনও সম্পর্ক আদপেই থাকতে পারে না। আর তাঁর এই ভাবনা-চিন্তার মুহূর্তেই পুলিশের গাড়ি পাড়ার নিজস্ব চৌমাথায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। ভেতর থেকে সুসভ্য চেহারার একজন, হয়তো, এস আই, বেরিয়ে লক্ষ্মীর স্কুলের দিকে আসেন। প্রণবেশ এবং লক্ষ্মীসহ তিন জন স্থাণুবৎ তাঁর প্রতীক্ষা করেন। পুলিশের আগমন অমোঘ ও অবিচল মনে হয়। সাধারণ ও স্বাভাবিক পদক্ষেপগুলি ক্রমশ বৃহৎ হতে থাকে এবং বৃহত্তর। প্রত্যেকেই, স্বভাবগত ভাবে, যে-স্বভাব আয়ত্তে এসেছে বিগত কয়েক বছরের পুলিশচর্চায়, উদ্বেগ বোধ করেন এমন কোনও প্রশ্নের কথা কল্পনা করেন যার উত্তর কারও জানা নেই। ছেলেমেয়েরা স্কুলে-কলেজে যাওয়ায়, পুরুষেরা অফিসে যাওয়ায়, সারা পাড়ায় নিঃসাড় জনশূন্যতা, তারই ফাঁকে সুসভ্য পুলিশটি এসে দাঁড়ান। তাঁর চোখেমুখে এখনও ঘরের ছেলের ছাপ লেগে আছে। পুলিশি ক্রূরতার ছায়া পড়েনি। সে কি সদ্য পুলিশে যোগ দিয়েছে ? হতে পারে বটে। গত কয়েক বছরে অনেক তরুণের সঙ্গে গুটিকয় পুলিশের মৃত্যুর কথাও শোনা গেছে। সেই সব শূন্য জায়গা ভরাট করতে কিছু নতুনকে সংগ্রহ করা হতেও পারে। প্রণবেশ অনুমান করার চেষ্টা করেন। কত হবে বয়স ? পঁচিশ, ছাব্বিশ ? নীলাদ্রির মতোই প্রায়। তিনি বড় করে বায়ু টানেন—যাক, ওই বয়সের মানুষরা এখনও আছে তা হলে ! কিছু অন্তত জিইয়ে রাখা হয়েছে যাতে নিজেদেরই যন্ত্রাংশের হাতল টানার জন্য তাঁদের ব্যবহার করা যায়।

—মাথুরের গড় স্পোর্টিং ক্লাব কোন দিকে ?

পুলিশ প্রণবেশের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। কিন্তু উত্তর দিচ্ছেন লক্ষ্মী—অনেকটা রেডিয়োতে সম্প্রচারিত ফুটবলের ধারা-বিবরণীর মতো শোনায় তাঁর কথা। তিনি বলে চলেন, হ্যাঁ, গাড়ি নিয়ে চলে যান, ডান দিকে, সেখানে অন্য একটি রাস্তা ধরে সোজা বাঁ দিকে, কিছুটা গেলে একটা মাঠ, মাঠের গা ঘেঁষে রেললাইন। লাইনের ধারে ওই…ওই…

তাঁর স্বর ক্রমে উৎসাহী ও প্রাণবন্ত হতে থাকে। এবং দায়িত্বশীল। যেন চিন্তার গহনে উপলব্ধি হয়েছে যে মাথুরের গড় স্পোর্টিং ক্লাবের সঙ্গে তাঁদের কারও কোনও স্বার্থসম্পর্ক থাকতে নেই।

পুলিশ জিপ গতিশীল করে। ততক্ষণে কয়েকজন কৌতূহলী মানুষ ভিড় করেছেন। অনেকদিন এ পাড়ায় পুলিশ আসে না। সকলেই চোখে-মুখে প্রশ্ন এঁকে এগোন। পুলিশের লক্ষ্য তবে পুরনো ক্লাব ! প্রণবেশ দেখেন, বেশির ভাগই দোকানের লোক, কিংবা হিরণের মতো কিছু কর্মহীন পুরুষ। গোটা দল এগিয়ে যায়, প্রণবেশও যান তাঁদের সঙ্গে, এমনকী লক্ষ্মীও যান, সঙ্গে থাকেন ‘আদর্শ শিশুপাঠ’ অর্থাৎ লক্ষ্মীর স্কুলের সহপ্রধানা মালতীদি। মাঠের ওপর দাঁড়িয়ে তাঁরা অদ্ভুত একটি দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন। পুলিশের নীরব বন্দুকের সামনে একে একে বেরিয়ে আসছে এ পাড়ার গোপাল কুণ্ডুর ছেলে সুজন, সুধীর পালের ছেলে কাজল, ঘোষবাবুর ছেলে অমিতাভ, মিথিলেশ ব্যানার্জির ছেলে মৃণ্ময়। তারপর আরও একজন, আরও একজন, ওই দেখো, আরও একজন। ওরা কে ? কেউ ওদের চেনে না। কিন্তু কেউ কেউ চিনেও ফেলে। ওরা দক্ষিণেশ্বরের নাম করা মস্তান গোপলা, চেরি আর কালু। ওরা এখানে ! এই ক্লাবে ? ওরা তো… ওরা তো… শোনা যায় কারও পেটে ছুরি বসাতে হাত কাঁপে না গোপলার …. আর চেরি, যে-কোনওদিন, শুধু হাত ধুয়ে এসে বলে—এই একটাকে ফেলে এলাম তো—

হাত উঁচু করে হেঁটে আসছে সব। হাতগুলি যেন ওদের স্ববশে নেই। শূন্যে ঝুলছে। লটপট করছে। এমনকী ওরাও যেন হাঁটতে গিয়ে টলে যাচ্ছে বারবার। চোখ খুলতে পারছে না। দুলতে দুলতে, অসুস্থ প্রত্যঙ্গ সমেত, একজন একজন করে উঠে আসছে ইঁদুরের খাঁচায়। ওরা নেশা করছিল তা হলে ! কী যেন খাচ্ছিল ! নতুন নাকি এসেছে বাজারে। হিরোইন—একজন বলল। তখন কে যেন শুধরে দিল—না ব্রাউন সুগার। না না ট্যাবলেট—ম্যানড্রেক্স খাচ্ছিল—বলল আরেকজন। না। ওটাকে বলে—হেরোইন। খুবই প্রত্যয়ের সঙ্গে বলল আরেকজন। তার প্রত্যয় বুঝি অন্য সবাইকে থামিয়ে দিল।

তখন উঁচু-নিচু হতে থাকা কুঁজ নিয়ে নড়বড় করতে করতে এখানে এসে দাঁড়াল ফুলরেণু। তার হাত দু’টি গোবর ভরা। দু’চোখে বিস্ময় ! পুলিশ এসেছে তা হলো পুলিশ ! কিন্তু কী করেছে ওরা ! নেশাই তো করছিল ! ওরা তো কোনও ক্ষতি করেনি। মাতলামো করেনি। বস্তিতে তো কতই নেশা করে মানুষ। এমনকী রেলব্রিজের পাশে ওই ক’টা ঝোপড়ি, তার মধ্যেও চোলাইয়ের ঠেক আছে। কই, পুলিশ তো কখনও কারওকে ধরে না। সে আর কৌতূহল ধরে রাখতে পারে না। সরাসরি প্রশ্ন করে, অ পুলিশবাবু, দাদাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছ কেন গো ?

নবনিযুক্ত পুলিশের গম্ভীর মুখের রেখা টান টান হয়ে থাকে। তিনি ক্লাবে তাঁর অনুসন্ধান শেষ করেছেন। ঝলমলে রোদ মেখে একটি সুদীর্ঘ মালগাড়ি ক্রমে পার হয়ে যায়। ততক্ষণ এই জনতা, পুলিশ ও নেশাখোরদের চিত্রটি স্থির হয়ে থাকে। এরই মধ্যে কোনওভাবে খবর রটে যায়। বিশ্বম্ভর ঘোষ ও গোপাল কুণ্ডুকে প্রায় ছুটে আসতে দেখা যায়। জনতা তাঁদের দিকে ফেরে। লক্ষ্মী স্কুলের দিকে ফেরেন। বিশ্বম্ভর লক্ষ্মীকে বলেন, কী হল বলুন দেখি ! পুলিশ কেন !

লক্ষ্মী কিছু বলার আগেই তরুণ পুলিশকর্মী বাধা দেন, এক মিনিট। আপনারা যাবেন না।

তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই বিশ্বম্ভর ঘোষ ও গোপাল কুণ্ডু তাঁকে ঘিরে ধরেন। জনতা আরও এগিয়ে আসে। কুণ্ডু ও ঘোষের কাতর প্রার্থনা শোনা যায়, স্যর ! কী হল স্যর ! কেন ধরে নিয়ে যাচ্ছেন স্যর!

তাঁদের হাত দু’টি জোড় হয়ে যায়। ঘাড় কুঁজো হয়ে আসে। মেরুদণ্ড তদবধি সোজা। পুলিশের ভারপ্রাপ্ত তরুণটি বলেন, আপনারা কে ? কুণ্ডু ও ঘোষ সমস্বরে তাঁদের পিতৃত্ব ঘোষণা করেন। তরুণ বলেন, থানায় আসুন। এখানে কোনও কথা হবে না।

অতঃপর তাঁদের মেরুদণ্ড বেঁকে যেতে থাকে। ভারপ্রাপ্ত তরুণ পুলিশ এবার ঘোষণা করেন, এখানে এই ক্লাবে আমি কিছু জিনিস পেয়েছি যেগুলো সর্বসমক্ষে আমি সিজ করে নিচ্ছি। আপনাদের মধ্যে থেকে যে-কোনও পাঁচজন আসুন। সাক্ষী দিন। আমি সিজার লিস্ট তৈরি করছি।

ভিড়ে একটি চাঞ্চল্য তৈরি হয়। কুণ্ডু ও ঘোষ ক্রমশ দূরে চলে যেতে থাকেন। পুলিশের লিস্ট ! তাতে সই ! পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা—কেই-বা তা না জানে ! পুলিশের কণ্ঠ আবার শোনা যায়—আপনারা কেউ চলে যাবেন না।

তিনি প্রণবেশকে বেছে নেন। এই মুখ, একটু আগে, দেখা ছিল। প্রণবেশ এগিয়ে যান। তাঁর হাত-পা কাঁপতে থাকে। পুলিশের নিকটবর্তী হওয়া সম্পর্কে স্নায়ুগুলি শিথিল হয়ে যায়। তবু তিনি এগোন এবং সিজার লিস্টে সই করেন। একে একে সই করেন হিরণ, হারু, দিব্যেন্দু। তখন হাঁক-ডাক করে সেখানে পৌঁছে যান কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্কসবাদী)-র আঞ্চলিক নেতা শ্যামাকান্ত। কয়েকজন সাঙ্গপাঙ্গ সমেত ‘কী হয়েছে—কী হয়েছে’ বলতে বলতে উপস্থিত হন তিনি এবং বৃত্তান্ত শুনতে শুনতে সিজার লিস্টে হাত বাড়ান। পড়তে থাকেন। ছুরি-ছোরা-বন্দুকের তালিকা দেখে কপাল কুঁচকে যায় তাঁর। বলেন, খুব জোরের সঙ্গে, জনতাকে শুনিয়ে— কী ? এইসব রাখত ? ক্লাবটাকে শয়তানির জায়গা করে ছেড়েছিল ? আমি এবং আমার ছেলেরা আপনার সঙ্গে আছে। আমাদের কর্তব্য যে-কোনও অন্যায়ে অবিচারে পুলিশ ও প্রশাসনকে সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে সাহায্য করা। আপনি আজ যা করলেন তাতে মাথুরের গড় উপকৃত হল। এরপর এর যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় আমরা দেখব।

প্রণবেশের মনে হল, শ্যামাকান্ত বক্তৃতা অভ্যাস করছেন। ভোট এসে গেছে। শ্যামাকান্ত উত্তেজিত। এ পাড়ায় তিনিই প্রথম সি পি এম নেতা।

পুলিশ ক্লাব সিল করে গাড়িতে গতিশীলতা দেয়। মাঠের বুকে চাকার দাগ রেখে ধীরে ধীরে বেরুতে থাকে ইঁদুরভ্যান ও জিপগাড়িটি। তখন কংগ্রেসের অনিল সামন্তকে দু’-তিনজন সমেত ছুটে আসতে দেখা যায়। ভোট এসে গেল বলে অনিল সামন্ত ব্যস্ত ও তৎপর। এ পাড়ায় শ্যামাকান্তর চেয়ে তাঁর প্রভাব অনেক বেশি। খানিকটা অভ্যাসে, খানিকটা ঐতিহ্যগত সংস্কারে এ পাড়ার বেশিরভাগ মানুষ কংগ্রেসে আস্থাবান। যে-কোনও ভুল ও স্বার্থপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত তাঁদের পীড়িত করে না এমন নয় কিন্তু ত্রাস, নিরাপত্তাহীনতা ও অস্থিরতা কাটাতে তাঁরা এই ঐতিহাসিক দলের প্রত্যেক মত ও বাক্যের পেছনে শান্তি ও কল্যাণ আজও অনুসন্ধান করেন। ব্যক্তি হিসেবে অনিল সামন্তর পরিচয়ে কালি লাগেনি। সফল নেতার মতোই সারাক্ষণ মুখে সামন্তপ্রভুজনোচিত নির্বিকার কর্তৃত্ব তিনি জারি রাখতে জানেন। দেরিতে এসেও এতটুকু অপ্রতিভ না হয়ে অনিল সামন্ত হাত দেখান। পুলিশের জিপ থেমে যায়। তিনি বাসুদেব পোদ্দারকে নিয়ে জিপে উঠে বসেন। শ্যামাকান্তর মুখ ঝুলে যায়। ভোটের মাত্র তিনদিন আগে পুলিশের জিপে অনিল সামন্তর এই অনায়াস উত্তরণ জনগণের কাছে তাঁকে প্রকৃতই গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। আর এইসব দেখতে দেখতে প্রণবেশের স্নায়ুগুলি ক্রমশ কর্মক্ষমতা হারায়। তাঁর চারপাশে অন্ধকার নেমে আসে। তিনি ধীরে ধীরে পড়ে যেতে থাকেন। তাঁর মনে হয়, অসীম অনন্ত অন্ধকারে তাঁর পতন হচ্ছে। কোনও কিছু আঁকড়ে ধরতে চাইছেন তিনি। থামতে চাইছেন—কিন্তু পারছেন না।

১৬

কোনও এক গাঢ় স্বপ্নের মধ্যে কিংবা হয়তো অন্য পৃথিবীর কোথাও ভাসতে ভাসতে প্রণবেশের মনে হল সচ্চিদানন্দ এসেছেন। ও বাবা ! বাবার পাশে কে ! সন্ধ্যামাসি ! সন্ধ্যামাসি কী বলছ ?

তোর মাকে দেখতে পাচ্ছিস না পুনু ? ওই তো মা।

মা ! মাগো ! তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন ?

কপালে একটি শীতল স্পর্শ পান প্রণবেশ। আঃ ! মা তুমি, না ? তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন ?

—এই তো আমি। পুনু ! সন্ধ্যা আছে আর আমি থাকব না ?

—মা ! বাবা ! সন্ধ্যামাসি !…

প্রণবেশের কণ্ঠ চেপে যায়। ভীষণ কান্না পায় তাঁর। কত কিছু বলার আছে। কত ভার জমে আছে। কত দুর্বহ কষ্ট ! কোনওক্রমে তিনি উচ্চারণ করেন—ও চলে গেছে মা।

—কে ? কে চলে গেছে ?

—নীলু চলে গেছে মা। নীল নীলু নীল…

তখন সচ্চিদানন্দের ভারী কণ্ঠ শোনা যায়—পুনু। পুনু তোর ছেলে হাসছে দেখ। তোর ছেলে কেমন সুন্দর হয়ে উঠেছে। পুনু—

প্রণবেশ চোখ মেলতে চান। কই আমার ছেলে কোথায় ? বাবা। তুমি জুঁইকে একটু বুঝিয়ে বলবে ? আমার ছেলেকে আমি ভালবাসি। ওর দিকে যে তাকাতে পারতাম না সেটা ওকে ঘৃণা করে নয়। সেটা কষ্ট হত বলে। খুব কষ্ট হত বলে। ক্লেফ্‌ট প্যালেট অ্যান্ড হেয়ার লিপ্‌স। বাবা—

—দেখ, পুনু, চোখ খোল। তোর ছেলে। পুনু—

একরাশ আলোয় প্রণবেশের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। ক্রমে সচ্চিদানন্দের মুখ মিলিয়ে যায়। সন্ধ্যামাসির মুখও নেই। শুধু এক শীতল প্রশান্তির রেশ সারা কপাল জুড়ে। প্রণবেশ ডাকেন— মা—

জুঁই মুখ ঝোঁকান।

—শুনছ ! শুনতে পাচ্ছ ! ও ফিরে এসেছে ! বাপ্পা ফিরে এসেছে ! ওঠো ! চোখ খোলো। দেখো। ও ফিরে এসেছে।

প্রণবেশের মধ্যে তড়িৎ খেলে যায়। তিনি ধড়ফড় করে উঠে বসতে চান। ডাক্তার শিবতোষ তাঁর কাঁধ ধরে শুইয়ে দেন। মাথার কাছ থেকে বাপ্পা সরু কণ্ঠে ডাকে, বাবা ! আমি। বাবা—

তার শীতল হয়ে যাওয়া হাতে সে প্রণবেশের ললাট স্পর্শ করে। প্রণবেশ বুঝতে পারেন না এখন সময় কত। বুঝতে পারেন না ঘরে কত লোক জমে আছে ! বাপ্পার হাত টেনে তাকে বুকে সাপটে নেন তিনি। তারপর বাঁধ ভেঙে কাঁদেন। তাঁর কান্নার ওঃ ওঃ শব্দে হো হো শব্দে বাপ্পাও ফুঁপিয়ে ওঠে। সমবেত মেয়েরা চোখে আঁচল চাপা দেয়। সমবেত পুরুষেরা সাদা দেওয়ালের দিকে চেয়ে আবেগ সংবরণ করে। দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ওঠেন জুঁই—ওঃ ভগবান ! তাঁর মন অনুতাপে পুড়ে যেতে থাকে। মনে পড়ে সকালে তিনি কত বিষাক্ত কথা প্রণবেশকে বলেছেন !

আবেগপর্ব কিছুটা প্রশমিত হলে লোকেরা যে-যার বাড়ি যায়। এতক্ষণ, যা-কিছু ঘটছিল, তার মধ্যে অন্যান্য পরিবারও জুড়ে গিয়েছিল। এখন তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে আবার। আবার ঢুকে পড়ছে নিজের বৃত্তে। যদি, এই ঘটনাক্রম বিয়োগান্তে পৌঁছত, তার রেশ দীর্ঘকাল লেগে থাকত প্রতিটি বৃত্তে। সুখের গল্প ক্রমশ সংক্ষিপ্ত হয়। দুঃখের গল্প বাড়তে থাকে।

—সম্পূর্ণ বিশ্রাম।

ডাক্তার শিবতোষ পালস্‌ পরীক্ষা করতে করতে বলেন, সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকো ক’দিন পুনুদা।

প্রণবেশ হাসেন, বিশ্রাম আর কি ? সাতদিনের ছুটি নিয়েছিলাম। এখনও ছ’দিন বাড়িতে আছি।

—না, বিশ্রাম মানে বেড রেস্ট। প্রেশারটা খুবই নেমে গেছে। আমি কোনও ওষুধ দিচ্ছি না। শুধু ট্র্যাঙ্কুইলাইজার দিলাম। একটা চাপ গেছে তো। বিশ্রামে সেরে যাবে। আর বাজারটাজারও করতে যাবে না একদম। ভাল করে খাও আর ঘুমোও।

জুঁই শিবতোষের হাতে ভিজিটের টাকা দিতে যান।

শিবতোষ টাকা নিয়ে চলে যেতে যেতে বলেন, সন্ধ্যাবেলা আসব আবার।

প্রণবেশ দেখেন, জুঁই হাসছেন। বাইরে বাপ্পার গান শোনা যাচ্ছে—তুউমি ধন্য ধন্য হে। তোওমারি গেএহে পাআলিছ স্নেহে—তুমি ধন্য ধন্য হে—সবকিছু কত স্বাভাবিক। অথচ কালই এসময়…। প্রণবেশ আর ভাবতে পারেন না। চোখ বন্ধ করেন। জুঁই কপালে হাত রাখেন। জিজ্ঞেস করেন, কী খাবে ? সকালে ?

ধীরে ধীরে চোখ খোলেন প্রণবেশ। বলেন, ওকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিলে ?

—না।

জুঁইয়ের মুখে অন্ধকার নেমে আসে।

—কে দিয়ে গেল ? নিজে এসেছে ?

—একটা লোক।

—সে কোথায় ?

—চলে গেছে।

—কেন ?

—বলল, স্টেশনে দোকান আছে। খুলতে হবে। ভোরবেলা চলে গেল। ও নাকি কালনায় নেমে গিয়েছিল। জানো ?

জুঁইয়ের গলা ধরে আসে। দু’চোখে জল। প্রণবেশ অবাক হন।

—কালনায় ! আমরা অতক্ষণ টের পাইনি !

—ওই লোকটা না দিয়ে গেলে কী হত বলো তো ?

—আমাদের বাড়ি খুঁজে পেল কী করে ? ও ঠিক ঠিক ঠিকানা বলতে পেরেছিল ?

—ও নাকি ফাঁকা স্টেশনে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আর লোকটা—কী যেন নাম বলল—

পাঁচু—পাঁচুগোপাল স্টেশনে ওর দোকানের সামনে বেঞ্চে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। ও নাকি ডেকে বলে—কাকু আমাকে একটু জল দেবে ?

—বোধহয় ভয় পেয়েছিল, না ?

—হ্যাঁ। পাঁচুও তাই বলল। ওর ভয় পাওয়া মুখ দেখে আর কোনও ট্রেন স্টেশনে নেই দেখে পাঁচুর সন্দেহ হয়। সে তখন বাপ্পাকে নানা রকম প্রশ্ন করে। বাপ্পা ওকে অদ্ভুত গল্প বলেছে জানো ?

—কী বলেছে ?

জুঁই চারপাশ দেখে নেন। তারপর বলেন, বলেছে, আমার মা আমাকে ভালবাসে না, তাই আমি চলে এসেছি।

—সে কি !

—আচ্ছা বলো, আমি কি ওকে ভালবাসি না ? এই কথা ও বলতে পারল ?

—তারপর ?

—আর বলেছে, আমার একটা দাদা ছিল। মা তাকেও ভালবাসত না। একদিন দাদাকে খুব মেরেছিল তাই ও মরে গেছে। আমি যদি বাড়িতে থাকি, আমাকেও মেরে ফেলবে।

—সে কি ? তারপর ?

—পাঁচুগোপালের সন্দেহ হয়েছিল। ও এরকম আরও দেখেছে। অনেক বাচ্চা পালিয়ে পালিয়ে স্টেশনে আসে, আর তারা এরকম বানিয়ে অনেক কথা বলে। আচ্ছা, বাপ্পা কেন এরকম বলবে ? বলো ? কেন বলবে ?

জুঁই দু’হাতে মুখ ঢাকেন। ছেলে শুনে ফেলতে পারে ভেবে জোরে কাঁদতে পারছেন না। কিন্তু কান্নার দমকে তার সাঁরা শরীর ফুলে ফুলে ওঠে। প্রণবেশের মনে হয়, নীলাদ্রি ছোটবেলায় এরকম বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলত। কিন্তু সেগুলো শুনতে ভাল লাগত— দু’-একটা প্রণবেশের মনে আছে। একদিন বলেছিল—আমি ঘুড়ি ওড়াচ্ছি। আর একটা এরোপ্লেন যাচ্ছিল ! পাইলটটা কী করল জানো ? হাত বাড়িয়ে আমার ঘুড়ি নিয়ে দৌড়।

প্রণবেশ খুব হেসেছিলেন সে-দিন। গল্পটা সকলকে করেছিলেন। তাতে খুব অভিমান হয়েছিল নীলুর। বলেছিল, তুমি সবাইকে বলে দিলে কেন ? তোমাকে আর কিছু বলব না।

প্রণবেশ ভাইকে বুঝিয়েছিলেন, আচ্ছা, পাইলট তোমার ঘুড়ি নিয়ে গেল আর সে-খবর তুমি মাকে বলবে না ?

তখন হেসেছিল সে। বলেছিল, আরেকদিন কী হয়েছিল শুনবে ?

—কী ?

—দেবার্চনদের ন্যাড়াছাদে উঠেছিলাম। তখন একটা ভূত আমাদের তাড়া করেছিল।

—হুঁ ! ভূত ! কেমন দেখতে ?

—ওই ছায়ার মতো। দাদা। দেবার্চন বলছিল নিমগাছে নাকি ভূত থাকে।

কী শিশু ছিল নীলুটা ! কী সুন্দর ছিল ! প্রণবেশ জানেন—অনেক শিশুই কল্পনাপ্রবণ হয়। কিন্তু বাপ্পা এ সব কী বলেছে ? তিনি জুঁইকে প্রশ্ন করেন, এর মধ্যে ওকে মেরেছিলে নাকি ?

জুঁই মুখ তোলেন। বলেন, কখনও কখনও চড়-চাপড় মারি। কিন্তু সে কে না মারে বলো ? ওই পাঁচু কিছুতে বিশ্বাস করবে না আমার কোনও ছেলে আর ছিল না। কী ভাবল লোকটা !

—ও কী ভাববে ? তারপর ? ও কি করল ?

—ও নাকি বাপ্পাকে বলেছিল, আচ্ছা মা তো তোমাকে ভালবাসে না, কিন্তু বাবা ! বাবা ভালবাসে ?

—কী বলেছে বাপ্পা ?

—বলেছে—বাবা ? হ্যাঁ। ভালবাসে। কিন্তু আমার কাছে তো থাকেই না। তোমাকে কতবার বলেছি কলকাতায় ট্রান্সফারের চেষ্টা করো, বাপ্পার তোমাকে দরকার। এখানে, এই একা বাড়িতে ও আবোলতাবোল কল্পনা করছে।

প্রণবেশ চুপ করে যান। তাঁর মনে পড়ে, জুঁইয়ের সমস্ত সংলাপ সমস্ত আচরণ—সন্ধ্যামাসির সঙ্গে। নীলাদ্রির সঙ্গে। তাঁর বলতে ইচ্ছে করে—একা তো ওকে থাকতে হত না। জুঁই। তুমিই একা হতে চেয়েছিলে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই বলা হয় না। খুব অবসন্ন লাগে প্রণবেশের। তিনি সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গ টানেন—লোকটিকে আসা-যাওয়ার ভাড়াটা দিয়েছিলে ?

—দিতে চেয়েছিলাম। নেয়নি। বলল, ছেলেকে মা-বাবার কাছে ফিরিয়ে দিলাম, এই তো কত ! বলল, ওকে মারধর করবেন না মা।

প্রণবেশ স্থির করেন, পরে ছেলের সঙ্গে কথা বলবেন। ভাবতে ভাবতে তাঁর চোখ জড়িয়ে আসে। তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে যান তিনি। তাঁর মনে পড়ে স্বপ্নে বাবাকে দেখেছেন। সন্ধ্যামাসিকে দেখেছেন। বাবা বাপ্পাকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন ! কী আশ্চর্য ! তখন বাপ্পা সত্যি এসে গেছে। স্বপ্নের কথা জুঁইকে বলবেন বলে চোখ খুললেন প্রণবেশ। জুঁই নেই। প্রণবেশ আবার চোখ বন্ধ করলেন। তাঁর মনে পড়ল, স্বপ্নে মাও ছিল। কিন্তু মার মুখ দেখা যায়নি। কেন যায়নি ? আস্তে আস্তে অনেক পুরনো কথা মনে পড়ে প্রণবেশের। জুঁই যখন এল এ বাড়িতে, তখনকার কথা।

যেমন সাধারণত বলা হয়, নতুন বউ বাড়িতে এলে, শোনো, এ তোমার অমুক, একে তমুকভাবে দেখবে, তেমনি করে সন্ধ্যামাসি সম্পর্কে কেউ জুঁইকে বলে দেয়নি, শোনো, ও সন্ধ্যা, ও আমাদের সবার আপন, তুমিও ওকে নিজের বলে ভাববে। বলেনি, কারণ বলার লোক ছিল না। ইলা অর্থাৎ প্রণবেশের মা থাকলে হয়তো বলতেন। কিন্তু সচ্চিদানন্দের পক্ষে, এত কথা, এত সাধারণ সাংসারিক কথা বলা সম্ভব ছিল না। ইলার মৃত্যুর পর সচ্চিদানন্দ আরও গুটিয়ে গিয়েছিলেন। আরও গম্ভীর হয়েছিলেন। বেলুড়ে বা দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে বসে থাকা বেড়ে গিয়েছিল। প্রণবেশের বিয়ের ব্যাপারটায় সন্ধ্যামাসিই জোর করেছিলেন ! বলতেন, ঘরে বউ না থাকলে লক্ষ্মীছাড়া লাগে।

কেউ প্রতিবাদ করেননি। প্রণবেশও না। প্রণবেশ তখন সদ্য শিবপুর থেকে বেরিয়েছেন। কলেজের গন্ধ যায়নি গা থেকে। পাত্রী খুঁজতে খুঁজতে প্রায় দেড় বছর কেটে গেল। ফারাক্কা ব্যারেজে প্রণবেশের চাকরি আর জুঁইয়ের আসা প্রায় একই সঙ্গে।

সন্ধ্যামাসিকে প্রথম থেকেই গ্রহণ করতে পারেননি জুঁই। শাশুড়ি নন কিন্তু শাশুড়ির মতো সংসার আগলে থাকা মানুষটাকে তাঁর খুব বাড়তি মনে হত। কিংবা অন্য সকলের তাঁর প্রতি সম্মান, তিনি যে ইলার সহোদরার চেয়েও বেশি ছিলেন জুঁই তা বুঝতে চাননি। একটি হৃদয়, কাকে কতখানি জায়গা দেবে, কাকে প্রকৃতপক্ষে আত্মীয় ভাববে, কাকে নয় তার সন্ধান শুধু সে-ই জানে। অন্যরা তার নাগাল পায় না। কাছাকাছি থাকলে অন্তরঙ্গতা সম্পর্কে একটি অনুমানমাত্র সম্ভব।

শুরুতেই জুঁইকে রান্নাবান্নার মতো ভারী কাজ দেওয়া হয়নি। জুঁই একদিন বলে বসলেন, আমি কিন্তু সবই পারি মাসিমা।

সন্ধ্যা বলেছিলেন, পারবে বৈকি মা। আমাদের দেশে মেয়েরা বারোতেই সব শিখে নেয়। করবার দিন তো তোমার পড়েই আছে। যতদিন পারি, করে দিই।

জুঁই হঠাৎ বলেছিলেন, যতদিন পারার কী আছে ? আসলে আপনি দখল ছাড়তে চান না, তাই বলুন।

সন্ধ্যা দুঃখ পেয়েছিলেন। বলেছিলেন, দখল ছাড়তে চাই না ? সে কি গো ? এ সব কি আমার নিজের ? সব তো তোমারই। বেশ তো। তোমার যখন রান্নার ইচ্ছা, কাল থেকে তুমি রেঁধো।

আর রান্নাঘরে ঢোকেননি সন্ধ্যা। রান্না ছাড়াও সংসারের বিস্তার কাজ পড়ে থাকে। খুঁজে খুঁজে সে-সবই তিনি করতেন। কাজ ছাড়া শুধু শুধু বসে থাকার স্বভাবও ছিল না তাঁর। আর কিছু না হলেও সচ্চিদানন্দের ঘরে বইয়ের তাক থেকে বই পেড়ে ধুলো ঝাড়তেন। লেখাপড়া জানতেন সন্ধ্যামাসি। পড়াশুনোয় আগ্রহও ছিল। সচ্চিদানন্দের বই ধরার অনুমতি পেতে তাঁর অসুবিধে হয়নি। শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ—সবই তাঁকে পড়তে দেখেছেন প্রণবেশ। কোনও কোনও দুপুরে মাকেও পড়ে শুনিয়েছেন সন্ধ্যামাসি৷

—শোন ইলা। এই জায়গাটা পড়ে দেখবি একবার ?

ইলা পড়তে ভালবাসতেন না। বলতেন, তুই পড় সন্ধ্যা। আমি শুনি।

সন্ধ্যামাসি পড়ছেন। ইলা শুনছেন। শরৎচন্দ্রের উপন্যাস—

“… বৃদ্ধের সনির্বন্ধ আবেদন ও নিবেদন এবং পুনঃ পুনঃ উত্তেজনা অচলাকে যেন আচ্ছন্ন করিয়া ধরিল। যে মিথ্যা সম্মান, প্রীতি ও শ্রদ্ধা সে তাহার এই নিত্য শুভাকাঙ্ক্ষী পিতৃব্যসম বৃদ্ধের নিকট হইতে এতকাল শুধু প্রতারণার দ্বারাই পাইয়া আসিয়াছে, সেই লোভেই এই তাহার একান্ত দুঃসময়ে কণ্ঠরোধ করিয়া অপ্রতিহত বলে সুরেশের নির্জন শয়নমন্দিরের দিকে ঠেলিতে লাগিল। তাহার মনে পড়িল, এমনি এক ঝড়-জল-দুর্দিনের রাত্রিই একদিন তাহাকে স্বামীহারা করিয়াছিল, আজ আবার তেমনি এক দুর্দিনের দুরতিক্রম্য অভিশাপ তাহাকে চিরদিনের মত সীমাহীন অন্ধকারে ডুবাইতে উদ্যত হইয়াছে। কাল অসহ্য অপমানে, লজ্জার গভীরতর পঙ্কে তাহার আকণ্ঠ মগ্ন হইয়া যাইবে, ইহা সে চোখের উপর স্পষ্ট দেখিতে লাগিল, কিন্তু তবুও আজিকার মত ওই মিথ্যাটাই জয়মাল্য পরিয়া তাহাকে কোনমতেই সত্য প্রকাশ করিতে দিল না। আজ জীবনের এই চরম মুহূর্তে অভিমান ও মোহই তাহার চিরজয়ী হইয়া রহিল। সে বাধা দিল না, কথা কহিল না, একবার পিছনে চাহিয়াও দেখিল না—নিঃশব্দে ধীরে ধীরে সুরেশের শয়ন-কক্ষে গিয়া উপস্থিত হইল।…”

সেইসব পাঠ চয়নের মুহূর্তে দু’টি মানুষের কাছাকাছি চলে যাওয়া—একজন পড়েন, একজন শ্রোতা—পরস্পরের মধ্যে কত নিবিড় আনুগত্য থাকলে তা সম্ভব হয়, জুঁই কোনওদিন তা বুঝবেন না। আশ্রিত ও আশ্রয়দাতার নিজস্ব সীমা নির্ণয় করে দেওয়া এবং সেই সীমার মধ্যেই পরস্পরের সসম্মান অবস্থান কত বিশাল হৃদয় থাকলে সম্ভব হয়, তাও জুঁই কোনওদিন জানবেন না। প্রণবেশ জানেন, পৃথিবীর বেশির ভাগ মেয়ের মতোই জুঁই মাতৃত্ব জানেন শুধু আপন সন্তানের জন্য, প্রেম জানেন শুধু স্বামীরই জন্য, তাঁর জগৎ ও পরিবারে তফাত এটুকুই যে জগৎ-বোধের মধ্যে ঈশ্বরবিশ্বাস সমাসীন। অর্থাৎ জুঁই অতি সাধারণ, একেবারে গড়পড়তা মেয়ে। এই সাধারণ উপলব্ধির বাইরে তাঁর আর কোনও অনুভব নেই। এর বাইরে অন্য কোনও সম্পর্ক, কোনও সংযোগের গভীরে যাওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব। প্রণবেশ মোটামুটিভাবে তা মেনেও নিয়েছেন। কিন্তু মাঝে মাঝে কীরকম শূন্য লাগে তাঁর জুঁইকে। সাধারণকে সাধারণ বলে গ্রহণ করার মধ্যে স্বস্তি আছে কিন্তু তৃপ্তি নেই। যদি কেউ বিশালে ও ব্যতিক্রমে অভ্যস্ত থাকে, তবে সেই তার সাধারণ্য। তার বাইরেকার যা-কিছু বা তার চেয়ে ক্ষুদ্রতর কিছু গ্রহণে বড় কষ্ট। চিন্তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যেতে থাকে সমালোচনা। পারস্পরিক প্রিয়ত্ব ঘুচে যায়। আপনজনকে কিছুতেই ভাবা যায় না যথার্থ আপনজন বলে। তখন নিজেকে একাও লাগে। মনে হয়, কোথাও কিছু নেই। সচ্চিদানন্দ নেই। ইলা নেই। সন্ধ্যামাসি নেই। নীলু নেই। নেই। নেই। নেই। নেই। সারাক্ষণ দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়। সচ্চিদানন্দের বইগুলো কীটে দংশন করে। ধুলোর আস্তরণ পড়ে যায়। অথচ ওখানকার চেনা বইগুলি, সন্ধ্যামাসি যেগুলি বেশি করে পড়তেন— দেখলেই প্রণবেশ তাঁর কণ্ঠস্বর শুনতে পান। বিভূতিভূষণের ‘অপরাজিত’ পাঠ করছেন তিনি

“…ছাদে কেহ নাই, দূরের নদীর দিক হইতে একটা ঝিরঝিরে হাওয়া বহিতেছে। দুদিন যে কি ঘটিয়াছে তাহা যেন সে ভাল করিয়া বুঝিতেই পারে নাই—আজ বুঝিয়াছে। কয়েকদিন পূর্বেও সে ছিল সহায়শূন্য, বন্ধুশূন্য, গৃহশূন্য, আত্মীয়শূন্য জগতে সম্পূর্ণ একাকী, মুখের দিকে চাহিবার ছিল না কেহই। কিন্তু আজ তো তাহা নয়, আজ ওই মেয়েটি যে কোথা হইতে আসিয়া পাশে দাঁড়াইয়াছে, মনে হইতেছে যেন ও জীবনের পরম বন্ধু।…”

প্রণবেশের বন্ধু নেই। সবাই তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন। শুধু একটুখানি টান। জুঁইয়ের জন্য অতি অল্প। সামাজিক দায়বদ্ধতা। বাকিটুকু, যা জীবনের জন্য দরকার, তার সবটাই বাপ্পার জন্য। ছেলেকে চুম্বন করার, ছেলেকে ছুঁয়ে থাকবার আশ্চর্য সুখ ! প্রণবেশ মাঝে মাঝে ফারাক্কার বিস্তৃত জলরাশির দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবেন—এটুকুই কোনও মানুষকে দীর্ঘ দিন বাঁচিয়ে রাখতে পারে।

সন্ধ্যামাসি মাঝে মাঝে সচ্চিদানন্দের ইংরাজি বইয়ের সংগ্রহগুলোর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন। দুঃখ করে বলতেন, ওই ভাষা যদি জানতাম !

প্রণবেশ একদিন বলেছিলেন, জানোই তো।

সন্ধ্যামাসি হেসেছিলেন। বড় বিষণ্ণ হাসি। বলেছিলেন, ধুর। ওকে কি জানা বলে ? ওটা অক্ষর চেনা। আমি অক্ষরটাই চিনি রে। শব্দের মানে করতে পারি না।

প্রণবেশ কথাটার মানে করতে পারতেন না। পরে বুঝেছিলেন, জীবনের অনেক উপলব্ধিই একটি নির্দিষ্ট বয়সের জন্য অপেক্ষা করে। প্রথম বর্ণপরিচয়ের পর, আ-কার ই-কার যখন শেখা হয়ে গেল তখন মনে হত, এই তো কেমন সব পড়তে পারছি। তারপর যুক্তাক্ষরের দেওয়াল ডিঙিয়ে হাতের কাছে যা পাওয়া যেত তাই পড়ে ফেলার আশ্চর্য আস্বাদ আর নেশায় মন ভরে যেত। কত কিছুই তো বোঝা যেত না তখন। যেত না যে তা নিয়ে কোনও দুঃখ ছিল না কারণ সেই জ্ঞানটুকুও তখন হয়নি। তারপর যখন যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ শেখা হয়ে গেল, তখন মনে হল, এই তো, এর বাইরে অঙ্ক কী হতে পারে ! কিন্তু আস্তে আস্তে জ্যামিতির গোপন নকশায় প্রবেশ করতে হল। ত্রিকোণমিতির আশ্চর্য ছন্দ জানা গেল। আর জাদু সমাধানের মতো বীজগণিত। প্রণবেশের মনে হল আলাদিনের সেই আশ্চর্য প্রদীপটা হাতে এসে গেছে। যে-কোনও সমস্যা কী আশ্চর্যভাবে সমাধান করে দেয় এই বীজগণিত। প্রথম যে-দিন অঙ্ক স্যার স্কুলে বীজগণিত শেখালেন—ধরো x। কেন ধরব ? কেন y নয় ? z নয় ? হ্যাঁ, ধরতেই পারো। y, z, a, b, c যা খুশি। এমনকী ক, খ, গ-ও ধরতে পারো। আসলে x মানে সমাধান। x মানে উত্তর। x মানে যে-কোনও সংখ্যা। x হল বীজ। ধরো বটগাছের দশটা বীজ তুমি রোপণ করে দিলে। কী হবে বলো ? কী গাছ হবে ? কেন ? বটগাছই হবে। হ্যাঁ। তা হলে দেখ। এই x হল ওই বটফলের বীজের মতো। x-এ সংখ্যা পুরে যে-কোনও নিয়মেই তাকে ফেলে দাও না কেন, সে দিব্যি একটা মানানসই গাছ তৈরি করে ফেলবে। প্রণবেশ, সেইদিন x মানে বীজ, মানে এক আশ্চর্য প্রদীপ শিখে, রাস্তার ওই প্রান্ত থেকে চিৎকার করতে করতে এসেছিলেন, মা মা মা ….

—কীরে ?

সন্ধ্যামাসি আর মা উদ্বিগ্ন মুখে বারান্দায় এসেছিলেন।

—কী হয়েছে রে ? ওমনি ছুটছিস কেন ? চেঁচাচ্ছিস কেন ?

প্রণবেশ উত্তেজনায় হাঁফাচ্ছেন। আনন্দে হাঁফাচ্ছেন।

—মা, হাবুল স্যার আজ আমাদের হ্যালজাবরা শিখিয়েছে মা। আমি আজ হ্যালজাবরা শিখেছি।

সন্ধ্যামাসি অবাক হয়েছিলেন। বলেছিলেন, জাবরা টাবরা কি বলিস পুনু ? তোদের কি জঙ্গল-জাবরাও পড়ায় ?

—হ্যালজাবরা মা। x দিয়ে অঙ্ক।

খুব হতাশ হয়েছিলেন সন্ধ্যামাসি। অঙ্ক শিখে কেউ এরকম লাফায় ! কিন্তু সচ্চিদানন্দ, সেই প্রথম, গাম্ভীর্যের মুখোশ ফেলে হেসে প্রণবেশকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। প্রণবেশ ছটফট করছিলেন নামার জন্য। সচ্চিদানন্দ কেন যে সে-দিন সে-সময় বাড়িতে ছিলেন আজ আর তা মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে, তিনি শুধরে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, হ্যালজাবরা নয় পুনু, অ্যালজেব্রা, বীজগণিত।

তখনও মনে হয়েছিল, এই তো, এরপর আর কী থাকতে পারে ? কিছু নেই। কিন্তু ভুল ভেঙেছিল যখন ক্যালকুলাস শিখেছিলেন। মনে হয়েছিল, গণিত এত সুন্দর হয় ! এমন ছন্দোময় হয় ! বুঝেছিলেন, শেষ নেই। কোনও শেষ নেই এর। নতুন উপলব্ধি হয়েছিল। মনে পড়েছিল সন্ধ্যামাসির কথা। বর্ণ জানি। শব্দ জানি না তো ! সারাজীবনকেই এমনই মনে হয় প্রণবেশের। বর্ণ জানা। শব্দ জানা নেই। প্রতিবারই নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সময় মনে হয় এটাই শেষ, এটাই জীবনের চরম প্রাপ্তি। কিন্তু তারপর আবার কিছু ঘটে। আবার কিছু আসে। নতুন উপলব্ধি। নতুন কোনও বোধ। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তা বদলায়। গানের মতো। ছবির মতো। কবিতার মতো। “আলো আমার, আলো ওগো, আলো ভুবন-ভরা, …” প্রণবেশের মনে পড়ে—ছোটবেলায় এই গানটি শুনলেই তাঁর কল্পনায় অসংখ্য প্রজাপতি উড়ত। তাদের সূর্যমুখীর পাপড়ির মতো হলুদ-হলুদ ডানা। আজ আর ওই গানের সঙ্গে ওইসব প্রজাপতির অনুষঙ্গ নেই। আজ অন্য এক আলোর জন্য হৃদয় খানখান। বর্ণ জানি। শব্দ জানি না। শব্দ জানি, কিন্তু কই, শব্দ-বর্ণ-গন্ধের ব্যঞ্জনাকে ছুঁতে পারলাম কোথায় ! সময় আসে। থামে। বিচিত্র চিন্তন দিয়ে ভেসে যায়। জীবনের বিচিত্র গাণিতিক অধ্যায় পরতে পরতে খুলে যেতে থাকে। সন্ধ্যামাসি কত দূর বুঝে বলেছিলেন কথাগুলো ? কে জানে ? অনেক পড়তেন তো, অনেক জানতেন, বুঝতেন। সেই পড়া নিয়ে বলতেও ছাড়েননি জুঁই। একদিন বললেন, কোনও কাজের নাম নেই। শুধু বই পড়া। কারও আশ্রয়ে আছেন, একটু কৃতজ্ঞতাও তো থাকে মানুষের।

বেচারা সন্ধ্যামাসি। ক্রমশ পুরনো মুড়ির মতো মিইয়ে যেতে থাকলেন সংসারে। জুঁইকে খুশি রাখতে গিয়ে সর্বস্ব হারালেন। আসলে জুঁইকে খুশি করা সম্ভব ছিল না তাঁর পক্ষে। যে খুশি হতে চায় না, তাকে নিয়ে কী করা যাবে ?

সচ্চিদানন্দের ভাত খাওয়ার সময় সন্ধ্যা বসে থাকেন। বিজলি পাখা আছে। তবু হাতে তাল পাতার পাখা নিয়ে মাছি তাড়ান। জুঁইয়ের আপত্তি—ওনার বসার কী আছে ? আমিই তো থাকি।

প্রণবেশ বলেছিলেন, ওটা মাসির অভ্যাস।

—অভ্যাস ? বরাবর কি উনিই এটা করতেন, মা করেননি ?

জুঁইয়ের স্বরে অন্ধকার ছিল। প্রণবেশ স্পষ্ট তা টের পেয়েছিলেন। বলেছিলেন, মা যতদিন পেরেছে করেছে। মাসিও করত। মা নেই, তাও তো কতদিন হল !

—যত সব।

জুঁই গজ গজ করেছিলেন। তেতো গলায় বলেছিলেন, তা মায়ের জায়গাটাই উনি নেবার চেষ্টা করেছিলেন নাকি ? আবার ঢং করে ভাল ভাল বই পড়া হয়।

—জুঁই !

প্রণবেশ অধৈর্য হয়েছিলেন। তুমি কী বলছ ?

—কেন ? বলব না কেন ? বুঝতাম যদি নিজের মাসি হতেন। তাও তো নন।

—উনি নিজের মাসির চেয়ে কম কিছু নন জুঁই। ওঁকে এভাবে বোলো না।

—কেন বলব না ? তোমাদের বাড়ির সবই অদ্ভুত।

—কী অদ্ভুত ?

—উনি কেন তোমার বাবার জামাকাপড় কাচেন ?

কাচতেই পারেন। তাতে কী ?

—কেন ? ফুলি আসে, সবার জামা কাচে, ওকে দেওয়া যায় না ?

—বাবা সাদা জামাকাপড় পরেন। ফুলির কাচা নিশ্চয়ই পরিষ্কার হয় না। তাই—

—তাই—

জুঁই উত্তেজিত হয়েছিলেন। হাত নেড়ে বলেছিলেন, তাই আন্ডারওয়ারটাও কেচে দিতে হয়, না ?

প্রণবেশ চোখ বন্ধ করেছিলেন। দু’কানে গরম গলিত লোহা ঢেলে দিচ্ছিল কেউ। এ কোন আশ্চর্য বিষ ! জুঁই এসব কী ভাবছেন ? আন্ডারওয়ার ? সেভাবে কখনও আলাদা করে দেখা হয়নি পোশাকটাকে। গেঞ্জি পাজামা ধুতির সঙ্গে ওটাও চলে গেছে চিরকাল। প্রণবেশ নীরব। স্তব্ধ। কিন্তু জুঁইয়ের মধ্যে ফেনিয়ে উঠছিল বিষ। তিনি বলে চলেছিলেন, জীবনে শুনিনি পরপুরুষের ভেতরের জামা কেউ এভাবে কাচে। যত সব সেক্স-স্টার্ভড পারভার্টেড উওম্যান।

প্রণবেশের মনে পড়েছিল, জুঁইয়ের একটি বিষয় ছিল সাইকোলজি। মনস্তত্ত্ব। জুঁই তো তাঁর জ্ঞান ফলাবেনই। জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা। এই পৃথিবীকে যে যেমন দেখে।

কিন্তু সে-দিন, জুঁইয়ের বিষ, দরজা গলে দেওয়ালের ফুটো দিয়ে সন্ধ্যার কানে পৌঁছেছিল। আজ প্রণবেশের মনে হয়, জুঁই ইচ্ছে করেই, জেনেশুনেই— যে সন্ধ্যা ওখানে আছেন, কথাগুলো বলেছিলেন। পরদিন সন্ধ্যামাসি—সহজ, সুন্দর, ব্যক্তিত্বপূর্ণ সন্ধ্যামাসি—রাত্রের খাবার টেবিলে সচ্চিদানন্দের সামনে, নীলাদ্রির সামনে, প্রণবেশ ও জুঁইয়ের সামনে বলেছিলেন, নীলু। সবাইকে বলি তবে ?

—বলো মাসি।

নীলাদ্রি ভাত মাখছিল। তার মুখ নিচু। সচ্চিদানন্দ তাকিয়েছিলেন। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। শুধু বোঝা যাচ্ছিল, এমন কোনও বিষয়, যা নীলাদ্রি আর সন্ধ্যামাসির মধ্যে আলোচিত হয়েছে, যা এখন প্রত্যেককে অবহিত করা হবে।

সন্ধ্যামাসি ধীরে ধীরে বলেছিলেন, সেক্স-স্টার্ভড পারভার্টেড উওম্যান—

সচ্চিদানন্দের হাত থেমে গিয়েছিল। প্রণবেশ ও জুঁই একই সঙ্গে চমকে উঠেছিলেন। সন্ধ্যা ধীরে ধীরে বলেছিলেন, কথাটার মানে আমি নীলুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। নীলু বলেছে।

জুঁইয়ের জিভ শুকিয়ে গিয়েছিল। কোনওমতে বলেছিলেন, তার মানে…তার মানে…আপনি কাল…লুকিয়ে…সন্ধ্যামাসি থামিয়ে দিয়েছিলেন জুঁইকে। বলেছিলেন, লুকিয়ে নয়। বাধ্য হয়ে। বাধ্য হয়ে আমি কাল সব শুনেছি। বিশ্বাস না হয় নীলুকে জিজ্ঞেস করে দেখো। ও তো আমার কাছেই ঘুমোয়। আমরা চেষ্টা করেও না শুনে থাকতে পারিনি। আর তো কোনও ঘর ছিল না যে পালিয়ে বাঁচব। একমাত্র বড়বাবুর ঘর ছাড়া।

সকলের খাওয়া থেমে গিয়েছিল। সচ্চিদানন্দ গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিলেন, কে ? কে বলেছে এ কথা ?

প্রণবেশ মাথা নিচু করে আছেন। জুঁই স্থির। সন্ধ্যামাসির চোখ থেকে জল পড়ছে। কিন্তু স্বর নিস্তরঙ্গ। তাঁর কোনও আবেগ নেই। শুধু অতল অপার কষ্টে তিনি ডুবে যাচ্ছিলেন। বলেছিলেন, পুনুর বউ এ কথা বলেছে বড়বাবু। আমার সম্পর্কে বলেছে। আমি তো ইংরাজি জানি না, তাই নীলুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম।

সচ্চিদানন্দ কাঁপছেন।—আর কী ? আর কী বলেছে পুনুর বউ ?

—বলেছে, আমি জোর করে ইলার জায়গা দখল করেছি। ওর শাশুড়ির জায়গা। বলেছে আমি আপনার জামাকাপড় কাচি কেন—। শোনো বউমা। তুমি অনেক লেখাপড়া করেছ। অনেক জানো। আমি তোমার মতো জানি না। কিন্তু আমি যা জানি তাও তোমাকে জানতে হবে। বড়বাবু আমার কাছে দেবতার মতো। তাঁকে আমি কখনও মানুষ জ্ঞান করিনি। তোমার শাশুড়িকে আমি সহোদরার মতো ভালবাসতাম। নীলু আর পুনু আমার পুত্ৰাধিক। আমার তো কেউ নেই। যারা আপন ছিল তারা পরের মতো ব্যবহার করত বলে ইলা আমাকে তার সংসারে নিয়ে এসেছিল। এই পরিবারকে আমি আজও নিজের বলে জানি। আমি বুঝেছি তুমি আমাকে পছন্দ করো না। তা বেশ। পুনু সুখে থাক। তোমরা সুখে থাকো। আমি এ সংসারে আর থাকব না।

সচ্চিদানন্দ খাওয়া ফেলে উঠে পড়েছিলেন। একে একে সন্ধ্যা প্রণবেশ আর নীলাদ্রিও। শুধু এঁটো হাতে একা একা বহুক্ষণ বসেছিলেন জুঁই। কেঁদেছিলেন। প্রণবেশ একটি কথাও বলেননি। সেটাও ছিল জুঁইয়ের রাগ। বলেছিলেন, তুমি একটি কথাও বললে না।

—কী বলব ? প্রণবেশ প্রশ্ন করেছিলেন।

—উনি চুপি চুপি সব শুনলেন। এত কথা বললেন। তুমি কিছু বললে না।

প্রণবেশ বলেছিলেন, আমি তো অমানুষ নই। অকৃতজ্ঞও না। বরং তোমাকে বলছি, জুঁই, যাও, মাসির কাছে ক্ষমা চাও।

না। জুঁই ক্ষমা চাননি। সকাল থেকে মাসিকেও আর পাওয়া যায়নি। কিছুই না নিয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন। তাঁর বিছানায় শরৎচন্দ্র ছিল। বিভূতিভূষণ ছিল। তাঁর আলনায় শাড়িগুলি তেমনই ভাঁজ করা ছিল। তাঁর চিরুনিতে তেলের গন্ধমাখা দু’-একখানি চুল তখনও লেগে আছে। ঘরময় তাঁর উপস্থিতির টাটকা চিহ্ন, যেন ডাকলেই সাড়া দেবেন। শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে-মুছতে বলবেন, কী বলছিস, পুনু ?

প্রণবেশ খুঁজতে চেয়েছিলেন। সচ্চিদানন্দ দেননি। বলেছিলেন, সে তো হারিয়ে যায়নি। হারিয়ে পড়েছে। তাকে আর খোঁজা কেন ?

তিনি জুঁইকে ডেকেও কিছু বলেননি। জুঁই তখন বাপ্পাকে নিজের মধ্যে বহন করছেন। একদিন নিজেই তিনি বাপের বাড়ি যেতে চাইলেন। কেউই বাধা দেয়নি। প্রণবেশও না। সন্ধ্যামাসিকে তাড়িয়ে জুঁই যেন একেবারে অনাকাঙ্ক্ষিত হয়ে পড়েছিলেন সংসারে। প্রণবেশের সঙ্গেও তাঁর স্বাভাবিক সম্পর্ক আলগা হয়ে গিয়েছিল। তিনি চলে গেলেন। এরপর ছিল প্রণবেশের পালা। বাবার কী হবে ? নীলাদ্রির ? প্রণবেশকে চলে যেতে হবে ফারাক্কায়। আশ্চর্য জটিল পরিস্থিতি। প্রণবেশের মনে হয়েছিল, ইলা ছিলেন সংসারের বন্ধন। তাঁর চলে যাওয়ায় সবই একটু আলগা আলগা হয়ে পড়েছিল বটে কিন্তু মূলত গড়নটি ছিল নিটুট। সন্ধ্যা চলে যেতে সব ভেঙে পড়ল। তিনি ছিলেন খুঁটির মতো। তাঁর অনুপস্থিতিতে সবই খসে পড়ল। প্রণবেশ বাবা আর ভাইকে ফেলে যেতে রাজি ছিলেন না। তখন সচ্চিনানন্দই পরিস্থিতি সামলেছিলেন। সেচ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন তাঁর বন্ধু। তাঁকে বলে, জুঁইয়ের শরীর খারাপের কারণ দেখিয়ে তিন বছরের জন্য কলকাতায় বদলি করিয়ে দেওয়া হয়েছিল প্রণবেশকে। তিন বছর। প্রণবেশের জীবনের ষড়যন্ত্রময় তিন বছর। সব খোয়ানোর তিন বছর। ওই তিন বছরে প্রণবেশ সন্ধ্যামাসিকে হারালেন। সচ্চিদানন্দকে হারালেন। নীলাদ্রিকে হারালেন। আশ্চর্য ! এরকমও কি হয় ? তখন ঘরে খুটখাট শব্দ পেলেন প্রণবেশ। চোখ খুললেন। দেখলেন বাপ্পা ওর টিনের গাড়ির কলকব্জা খুলে ফেলেছে। আর আগের মতো জুড়তে পারছে না। মগ্ন হয়ে জোড়া দেবার চেষ্টা করছে। প্রণবেশের, ছেলেকে দেখে, অর্ধেক ক্লান্তি চলে গেল। মনে হল, ওই তিন বছরে শুধুই হারাননি। পেয়েওছেন।

মগ্ন থাকলেও, অন্যমনস্ক থাকলেও, কেউ তাকিয়ে আছে বুঝতে পারা যায়। প্রণবেশ বাপ্পাকে দেখছিলেন। বাপ্পাও মুখ তুলে বাবাকে দেখে নিল একবার। শান্ত নরম চোখ। একটু যেন বেশি গভীর। যেন ঘুম জড়ানো। হাফ প্যান্টের নীচে বেরিয়ে আছে মসৃণ দুটি পা। খোলা গায়ে নরম নরম আদুরে আস্তরণ। ঠোঁটের ওপর বিস্তৃত সেলাই। তার জন্য ঠোঁট একটু বাঁকা লাগে। একটু চাপা লাগে। ক্লেফ্‌ট প্যালেট অ্যান্ড হেয়ার লিপস মেরামত করা বাপ্পা। আপনমনে নিজের গাড়ি মেরামত করছে এখন। প্রণবেশ ডাকলেন, বাপ্পা—শোন্‌।

বাপ্পা উঠে কাছে এল। তার হাতে যন্ত্রাংশ। দেখছে।

প্রণবেশ বললেন, কী ভাবছিস্‌।

বাপ্পা হাত মেলে দেয়।—এটা লাগিয়ে দেবে ?

প্রণবেশ হাসেন। বলেন, ওটা আর লাগানো যাবে না। আর একটা এনে দেব বিকেলবেলায়।

—বাঃ রে ! কেমন করে আনবে ?

—কেন রে ?

—তোমাকে বুঝি ডাক্তারকাকু শুয়ে থাকতে বলেনি ?

আলজিভ ছিল না বাপ্পার। পরে অপারেশন করে সেই আলজিভ তৈরি হয়। বাপ্পা এখন কী চমৎকার কথা বলে।

প্রণবেশ বলেন, আচ্ছা, আমি নয়, মা এনে দেবে।

—মা দেবে না।

—কেন?

বাপ্পা চুপ করে থাকে। প্রণবেশ এক হাতে ছেলেকে স্পর্শ করেন। ছেলেও বাবার গা ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। বেলা বাড়ছে। শুয়ে থাকতে খুব ভাল লাগছে তা নয়। তবু, আলস্যও আর কাটিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। প্রণবেশ বলেন, বড় হয়ে তুই কী হবি, বাপ্পা ?

—কি জানি।

—কী ইচ্ছে করে ?

—ওই, অনেক দূরটা দেখতে ইচ্ছে করে।

—অনেক দূরটা মানে কি ?

—ওই যে ধানক্ষেত। তারপর অনেক দূরে দূরে গাছ। বাড়ি। তারপর কোথায় শেষ হয়ে গেল। ধানক্ষেত কোথায় শেষ হয় বাবা ?

—যেখানে রাস্তা থাকে।

—সব ধানক্ষেতের পরই রাস্তা ?

—হ্যাঁ, বাপ্পা, তুই ট্রেন থেকে নেমে গেলি কেন রে ? তোকে কেউ ডেকেছিল ?

—না তো।

—নেমে গেলি কেন ?

—এমনি। মনে হল।

—তোর ভয় করল না ? অন্ধকারে। একা একা ?

—করল তো, যখন ট্রেনটা চলে গেল।

—তুই যদি হারিয়ে যেতিস বাপ্পা ? তোকে যদি আর খুঁজে না পেতাম ?

—আমাকে ফারাক্কা নিয়ে যাবে, বাবা ?

—এই যে ফারাক্কা থেকে ঘুরে এলে !

—আমি ফারাক্কায় থাকব বাবা। কত বড় নদী আছে ওখানে ! আর কত দূর আছে।

প্রণবেশ চুপ করে ভাবেন। ও দূরের কথা বলে কেন ? দূর ওকে টানে কেন ? ও তো শিশু। এই ইঁটের শহরে ওর জন্ম। ও কী করে নদীর জন্য কাঁদে ? তিনি বলেন, ওখানে ভাল স্কুল নেই বাপ্পা। তুই কোথায় পড়বি ?

বাপ্পা চুপ করে থাকে। তারপর কী মনে করে একটি পা বাবার গায়ে তুলে দেয়। এক হাতে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলে, মাকে বলে দেবে না তো ? বাবা ?

প্রণবেশ সন্ত্রস্ত হন। কী বলবে বাপ্পা ? যা ওর মাকেও বলা যাবে না ? তিনি ছেলেকে জড়িয়ে নিয়ে বলেন—বলব না।

বাপ্পা বলে, মা আমাকে ভালবাসে না।

—ছি ছি! এ কথা বলতে নেই। মা তোমাকে খুব ভালবাসে।

—তা হলে মা আমাকে খেলতে দেয় না কেন? ক্লাবের মাঠে বুকুন যায়। পিন্টু যায়। আরও কত সব আসে। মা আমাকে যেতে দেয় না কেন? আমাকে একটা ঘুড়ি-লাটাইও দেয় না। ছাতে যেতেও দেয় না। বুকুনের মা বুকুনকে অ্যাত্তো বড় একটা লাটাই আর দস্যুঘুড়ি-লণ্ঠনঘুড়ি কিনে দিয়েছে।

বাপ্পার চোখ দিয়ে জল গড়ায়।

প্রণবেশ ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ভাবেন, জুঁই এরকম করে কেন? ওইটুকু ছেলে, ওকে খেলতে দেয় না কেন? বাপ্পার পড়াশুনো নিয়ে খুব চিন্তা জুঁইয়ের। এখনই কী? আর বাপ্পা খুব চঞ্চলও নয়। রামকৃষ্ণ মিশনে পড়ছে সে। জুঁই কি একটু বাড়াবাড়ি করছে না?

পরে কথাটা তুলেছিলেন প্রণবেশ। জুঁই বলেছিলেন, তুমি তো ফারাক্কায় বসে থাকো। ছেলের ঝক্কি এখানে একা আমাকে পোয়াতে হয়। এখন থেকে নজর না দিলে ছেলে বয়ে যাবে। তোমার ভাইকে তো দেখলে।

প্রণবেশ চুপ করে যান। তাঁর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করে না। মনে মনে ভাবেন—নীলাদ্রি কি বয়ে গিয়েছিল? তুমি কী এটা ঠিক বললে জুঁই? সমাজটাকে নতুন করে, সুন্দর করে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখাটা কি ভুল? বয়ে যাওয়া? এতগুলো ব্রিলিয়ান্ট ছেলে—সবাই তা হলে বয়ে গিয়েছিল? নীলাদ্রির জন্য প্রণবেশের কষ্ট হয়। তখন, জুঁই বলেন, বাপ্পাকে নিয়ে বিকেলে একবার ভবানীপুর যাব আমি।

—কেন?

—ওখানে মল্লিকার চেনা এক জ্যোতিষী আছেন। তাঁকে দিয়ে বাপ্পার ছকটা করিয়ে নেব। তুমি যেতে পারবে তো?

প্রণবেশ বললেন, ছক! জ্যোতিষী! এ সব তুমি কী করছ জুঁই! বাবা এ সবের ভীষণ বিরোধী ছিলেন জানো!

—ছিলেন কারণ বাবার জীবনে কোনও সমস্যা ছিল না।

—ছিল না! তুমি বাবার স্ট্রাগলটা জানো?

—আমার জানার দরকার নেই। তুমি যাবে কি না বলো! আর যেতে তোমাকে হবেই। কারণ, মল্লিকা বলে দিয়েছে, উনি বাবা-মায়ের হাতও দেখতে চাইবেন।

প্রণবেশ কথা বাড়ান না। বিরোধিতাও করেন না। নিজের মনে ভাবেন, কোনও কি মানে আছে এ সবের? সত্যি? মানুষ যদি জন্মের সঙ্গেই তার ভাগ্য নিয়ে আসে, যদি তা প্রাকনির্ধারিত বিষয় হয় তবে জ্যোতিষশাস্ত্রের কী প্রয়োজন? ভবিষ্যতে অনিবার্যভাবে কী ঘটে যাবে তা আগে থেকে জেনে উদ্বিগ্ন হয়ে লাভ কি? যদি তা পাল্টানোই না যায়!

কথাগুলি জ্যোতিষকে না বলে পারেন না প্রণবেশ। জ্যোতিষ, ক্ষিতীন্দ্রমোহন, বয়স্ক মানুষ, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে চন্দন, পান খেতে খেতে বলেন, না। ভবিতব্য নিয়ে কেউ জন্মায় না। মানুষ জন্মায় ভাগ্যচক্র নিয়ে। অর্থাৎ গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব নিয়ে। সেই প্রভাব এবং পুরুষকার অর্থাৎ জন্মগত গ্রহনক্ষত্র এবং ইচ্ছাশক্তি দ্বারা ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

—আপনি বিশ্বাস করেন?

ক্ষিতীন্দ্রমোহন হাসেন। বাপ্পার হাত দু’টি নিরিখ করতে করতে বলেন, আমি বিশ বছর ধরে এ সবের চর্চা করি। বিশ্বাস না করলে করব কেন? আর তুমি ভেবো না এটা আমার প্রফেশন। প্রফেশনালি আই ওয়াজ এ টিচার। ভূগোল বিষয়ে আমি পড়াতাম। অঙ্কেও আমার আকর্ষণ আছে। আর অ্যাস্ট্রোলজি অ্যান্ড পামিস্ট্রিও আমার নেশা। এই মহাকাশ এক আশ্চর্য শক্তির সূত্রে গাঁথা। তার সব রহস্যের কিনারা হয়নি। অ্যাস্ট্রোলজি সেই রহস্যের একটা অংশমাত্র।

প্রণবেশ বলেন, কিন্তু সকলের সব কথা ফলে না। আপনি যে এত লোকের হাত দেখেছেন, তাদের সব বিধান কি যথাযথ হয়েছে?

ক্ষিতীন্দ্রমোহন হাসেন। বলেন, আমি তর্ক করব না। তোমার যদি ভাল না লাগে তুমি হাত দেখিও না। তোমরা তো বিজ্ঞান-পড়া ইঞ্জিনিয়ার। তোমাদের বানানো ব্রিজ কি কখনও ভেঙে পড়েনি?

জুঁই প্রণবেশকে থামাতে চান। প্রণবেশ চুপ করে যান। ছোট্ট বাপ্পা দু’হাত মেলে স্থির বসে থাকে তার ভবিষ্যৎ গণনার প্রতীক্ষায়। ক্ষিতীন্দ্রমোহন ছক কষেন। নানা রকম যোগ-বিয়োগে পাতা ভরে যায়। শেষে একসময় বলতে শুরু করেন, মঘা নক্ষত্রে জন্ম। সিংহ রাশি। রাক্ষসগণ। অধিযোগ। গ্রহাধিপতি রবি নীচস্থ। তাকে দৃষ্টি দিচ্ছে কে? রাহু। আর মনস্থিরকারক গ্রহ কে? চন্দ্র। সে বসে আছে কোথায়? না শনির ঘরে। তাকে দৃষ্টি দিচ্ছে মঙ্গল…

তিনি গণনা করে যান। জুঁই পাংশু মুখে শোনেন। প্রণবেশ নির্বিকার। তাঁর মনে হয়, এও কি ভাগ্যে লেখা থাকে? এই জ্যোতিষের কাছে আসা?

১৭

চাল তো কবেই ফুরিয়ে গিয়েছিল। শেফালির মার কাছে আর চাইতে পারে না রাধিকা। একজনের কাছ থেকে আর কত সাহায্য নেওয়া যায়! রাধিকা আরও চার দিন চার ঘর থেকে চাল ধার করেছে। এখানে সবারই দিনটানা সংসার। কে আর বাড়তি কারওকে দেবার সঙ্গতি রাখে! তবু রাধিকা পোয়াতি বলে, তার স্বামী আসছে না বলে, ঘরে তার ছোট ছেলেটি—সে খানিকটা সহানুভূতি পায়। হয়তো-বা কোনও গিন্নি নিজের বরাদ্দ থেকেই দু’মুঠো চাল দিয়েছিল তাকে। সে বড়ই বিনয়ের সঙ্গে বলেছে, তেনি ফিরা আইলে দিয়া যামু দিদি।

কিন্তু এভাবে আর কতদিন! কার্তিক আসছে না। কেনই-বা আসছে না সে! না হয় মারতই তাকে কার্তিক। না হয় এমন ভরা মাসেও যতখানি সম্ভব শরীর দিত সে কার্তিককে। কিন্তু এই তীব্র খিদে আর সহ্য হয় না। নাড়ি পাক দেয়। মুখে নোনা জল উঠে আসে। সন্তানের পেট ভরাতে পারে না। কম-কম রান্না করে। একজনের খাবার দু’জনে খায়। একবেলার খাবারে চালিয়ে নেয় দু’বেলা। খানিকটা ভাত শেফালির মা রোজই দিয়ে যায় তাকে। তাতেও কুলোয় না। মানুষের এতটুকু পেটের থলি। কিন্তু তাতে সময়ের সমান খিদে। কত যে খিদে তার তল মেলা ভার!

শেফালির মা স্কুলে চলে গেলে রাধিকা চুপি চুপি পিছনের পুকুরে চলে যায়। একটি সজনে গাছ, জলের ওপর বাঁকা হয়ে ঝুঁকে পড়েছে, তার থেকে পাতা তুলে আনে। ডাঁটা পেড়ে নেয়। ডাঁটার খোঁজে অনেকেই তক্কে-তক্কে থাকে। তাই একটি-দু’টি মহাভাগ্যে মিলে যায় কখনও। নইলে শুধুই পাতা।

তেল ফুরিয়ে এসেছে। কাচের বোতলে তলানি। সবই ফুরিয়ে আসে কোনও না কোনও দিন। নিয়মমতো জুগিয়ে না গেলে রাজভাণ্ডারও খালি হয়ে যায়।

ওই তলানি থেকে একটুখানি তেল নিয়ে কড়াইতে মাখিয়ে নেয় রাধিকা। সজনে পাতা ভাজে। ভাত প্রায় পুরোটাই পলাশের জন্য রেখে নিজে সামান্য ভাতে অনেকটা সজনে পাতা ভাজা মেখে খায়। গলা দিয়ে নামতে চায় না। কিন্তু খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। এক এক সময় রাধিকার ইচ্ছে করে গলায় দড়ি দেয়। কিংবা ওই পুকুরে ডুবে মরে। মরেই যেত হয়তো পলাশ না থাকলে! অথবা কখনও মৃত্যুর অদম্য ইচ্ছের মুহূর্তে উঠোনে ঠুন ঠুন সাইকেল বেজে ওঠে। ওমনি আর মরতে ইচ্ছে করে না। মরার ইচ্ছে পালিয়ে গিয়ে আশ্চর্য আকাঙ্ক্ষায় তার অভুক্ত ক্লিষ্ট শরীর সজাগ হয়ে ওঠে। দরজা ফাঁক করে দেখে সে। সাইকেল তুলছে পরমেশ। নিজের ঘরে যাচ্ছে। নিচু উঠোন থেকে উঁচু দাওয়ায় সাইকেল তুলতে সে মনোযোগী হয়েছে। পরমেশ—কী সুন্দর! কী আশ্চর্য দীপ্তি ওর! রাধিকা মুগ্ধ হয়ে যায়। আর কিছু নয়। একটু কথা যদি বলত রাধিকার সঙ্গে! যদি তার দুঃখে একটু দুঃখ পেত! আধপোড়া আধভাজা সজনে পাতা চিবিয়ে রাধিকা শুয়ে শুয়ে একটি আশ্চর্য আকাশ প্রার্থনা করে যেখানে কালো গম্ভীর মেঘ উড়ে এসে এলোমেলো করে দিচ্ছে কদমের পাতা। যমুনার জল মুহূর্তে কালো হয়ে গেল মেঘের ছায়ায়। সেই কালো জলের মতো বা মেঘেরই মতো শ্রীকৃষ্ণ আকাশ-বাতাস মাতিয়ে বাঁশি বাজাল বনে। আহা! বাঁশি শুনে রাধা রইতে পারে না ঘরে। ছুটে যায়। কোনও দিকে খেয়াল নেই গো তার। আঁচল লুটিয়ে পড়ছে। পায়ে কাদা লাগছে। ওই বুঝি দু’টি কাঁটাও ফুটে গেল সুকোমল শ্রীচরণে! রাধা কিছু দেখছে না, কিছু বুঝছে না, শুধু ছুটে যাচ্ছে। একবার তাকে দেখার জন্য। একবার তার অসামান্য বুকে ঝাঁপ দেবার জন্য।

রাধিকা পরমেশে কৃষ্ণ দেখে। নাকি পরমেশে শমসের দেখে। নিজে সে শ্রীরাধিকা স্বয়ং। তখন কার্তিক বুঝি-বা আয়ান ঘোষের জায়গা নেয়। এক ঝলক হাওয়া এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল ঘরে। ধুলোর গন্ধে ঘর ভরে গেল। বাইরে উঁকি দিচ্ছে রাধিকা। ও মা গো! কালো মেঘে ছেয়ে গিয়েছে আকাশ! কখন এত মেঘ করল! বুঝি কালবৈশাখী আসছে! রাধিকা অসহায়ভাবে তাকায়। এখন পলাশের ঘরে ফেরার সময়। সে কি ঝড়ের মধ্যে পড়ল? সে কি ভিজে যাবে? দিশেহারা হয়ে দৌড়বে রাস্তা দিয়ে? গাড়িগুলি উন্মাদ পার হবে পথ আর লক্ষও করবে না পলাশ ছেলেটি কেমন অন্ধ ও ব্যাকুল হল ঝড়ে! রাধিকার মাতৃবুকে নানা ভয় টালমাটাল। কাল পলাশ বলছিল—মা, বাবা আসে না কেন?

রাধিকা কী বলবে! কেন আসে না! তার মন নানা শঙ্কায় আচ্ছন্ন। কোনও বিপদে পড়েনি তো মানুষটা! কোনও অসুখ-বিসুখ করেনি তো? তেমন হলে নিশ্চয়ই খবর দিত কোনওভাবে?

তখন বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামে। দু’-একটি রাধিকার কপালে এসে পড়ে। চড়বড় করে শব্দ হয়। পলাশ ভিজতে ভিজতে, হাসতে হাসতে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে মাকে। রাধিকা একটু পিছিয়ে যায়। বলে, ধাক্কাইস না। ধাক্কাইস না।

পলাশ অভিমানী হয়। ঠোঁট ফুলিয়ে বলে, ধাক্কাইলাম কই!

তার হাসি মিলিয়ে গেছে। চোখ ম্লান। রাধিকা ছেলের মুখ চুম্বন করে। বলে, হ। তর ভাই আইতাসে না?

পলাশ এবার হাসে। তার মুখের মেঘ কেটে যায়। বলে, না। বুইন আইব মা। আমার বুইন ভাল্লাগে। মা, কাইল আমাগো ইসকুল ছুটি দিসে।

রাধিকা আঁচল দিয়ে পলাশের মাথা মুছে দিতে দিতে বলে, ক্যান?

পলাশ বলে, মুসলাগো য্যান কী আসে?

—আরে! এমুন কৈতে হয় না। হগ্গলরে মান দিয়া কথা কইতে শিখো।

—ক্যান! আমি কী কইলাম মা?

—মুসলা কয় না, কয় মুসলমান।

—আমাগো ইসকুলে হগ্গলেই মুসলা কয় মা। গো-খেকো, নেড়ে, আগা-কাটা হেই-ও কয়।

—কউক! তুমি কইবা না। খারাপগুলা নিবা ক্যান! কাউরে অপমান করতে নাই। তাইলে তাগো অপমান আমাগো গায়ৈ ফিরা আইব।

—হ মা! কমু না!

—অখন মুসলমানগো কী?

—মহরম আসে কয়।

—অ। হইব। যা জামা খুল। ঠাণ্ডা লাগব।

পলাশ জামা খোলে। সদ্য মোছা চুলগুলি খাড়া খাড়া হয়ে আছে। রাধিকা ছেলের দিকে সস্নেহে তাকায়। কী সুন্দর তার ছেলে! কী গভীর আর স্নিগ্ধ! একটু যত্ন করার সামর্থ নেই। কেন নেই? ভাবে রাধিকা। এবং আবারও আনমনা হতে থাকে। কাল মহরম। হয়তো-বা। রাধিকা জানে না। কিছুই জানে না এখন। কোনও কিছুরই খোঁজ রাখে না। আগে তাদের গাঁয়ে মহরমের দিন শমসেরদারা কত কী করত! সাতদিন আগে থেকে তরোয়াল খেলা, লাঠিখেলার মহড়া। কী সুন্দর তাজিয়া বানাত ওরা! অত সুন্দর জরি আর রাংতার ঝালর কোথায় যে পেত! আর মহরমের দিন কী তাদের আস্ফালন! হায় হাসান-হায় হোসেন করতে করতে বুকে চাপড় মারা! পরস্পরের সঙ্গে লাঠিতে-তরোয়ালে লড়াই। দেখে মনে হত যেন সত্যি সত্যি লড়ছে! অথচ কেউ কারওকে এতটুকু আঘাত করত না। গাঁয়ের পথে পথে ঘোরা হয়ে গেলে বিকেলবেলা ইষ্টিকুটুমের মাঠে দশগাঁয়ের তাজিয়া জড়ো হত। ওখানেও আর এক প্রস্থ যুদ্ধ যুদ্ধ রব। শেষে সন্ধ্যাবেলায় সবাই ঘরে ফিরত। তাদের গাঁয়ের তাজিয়া শমসেরদাদের উঠোনে রেখে দিয়ে যেত কয়েকজন।

সেই সময় সেই তাজিয়ার সঙ্গে সঙ্গে তরোয়াল ও লাঠি নিয়ে লড়াই করতে করতে যাবার সময় শমসেরকে যেন চেনা যেত না। শমসেরও যেন চিনতে পারত না রাধিকাকে। অথচ অন্য সময় শমসের কড়া নজর রাখত রাধিকার বাড়ির দিকে। কখন রাধিকা একটু একা হয়! কখন একটু বেরিয়ে আসে। সে-বার খুব রাগ করেছিল রাধিকা—ক্যান? আমারে ডাকো ক্যান? শমসেরের স্বর কাতর। আকুল। বলেছিল—আর কারে ডাকুম ক’!

—ক্যান! হেইদিন যেমুন চিনতৈ পারলা না!

—কুনদিন তরে চিনি নাই! রাধু! আল্লার কিরা। তরে চিনুম না হেই আবার হয় নাকি!

—সইত্য কও?

—সইত্য! সইত্য!

রাধিকা মাথা দোলায়। ঠোঁট টিপে হাসে। এই কাতর প্রার্থনা, এই ব্যাকুলতা ভাল লাগে তার। কেন যে লাগে সে বোঝে না। একেবারে সম্প্রতি, খুব গোপনে এই ভাল লাগার শুরু। কাকিকে লুকিয়ে শমসেরের সঙ্গে এই কথা বলা—এর চেয়ে বেশি সুখ আর কিছুতে নেই। সামান্য দু’টি-একটি কথা হয় কিন্তু সারাদিন মনের মধ্যে তার রেশ গুন গুন করে। শমসেরকে দেখলেই মনে মনে গলে যায় রাধিকা। ভাল লাগায় ভেসে যায়। শমসেরের দাড়ি ঘনিয়ে ওঠা গালে কৃষ্ণমেঘের সন্ধান পায় সে। বর্ষা তার প্রিয়। এত কষ্ট বর্ষায়—তবু বর্ষা প্রিয়। কৃষ্ণমেঘ প্রিয়। আর মেঘের মতো শমসের। তার পাগল পাগল লাগে। তবু, সব গোপন রেখে, নিভৃত রেখে সে বলে, হেইদিন তাজিয়ার লগে লগে যাইতেয়াসিলা। আমি কাকির লগে খাড়াইয়াসিলাম। ক—ত দ্যাখলাম তোমারে। ক—ত চাইয়া রইলাম। তুমি নি অ্যাকবারও দ্যাখলা!

শমসের বিষণ্ণ হাসে। বলে, হেইদিন চাইতে নাই। ওই সময় চাইতে নাই। শুন রাধু, যেই কাম যখন করন লাগে তখন নিষ্ঠা ভইরা মন লাগাইয়া করন লাগে।

গভীর ভাবনায় ডুবে গিয়েছিল শমসের। তার মুখে বেদনার ছায়া পড়েছিল। রাধিকা তার কারণ বুঝতে পারছিল না। কিন্তু তখন তার বাবার কথা মনে পড়েছিল। পদাবলী পড়তে পড়তে বাবার মুখও ঠিক ওইরকম হয়ে যেত। বিষণ্ণ। গম্ভীর। যেন-বা চিন্তাচ্ছন্ন। সে-দিন অসহ্য কষ্টে—কেন তার উৎস, কোথায় তার বাস রাধিকা জানত না—শুধু কষ্ট বুঝেছিল, বুঝি-বা সে প্রথম সুখাবেশের কষ্ট, সোজা সে তাকিয়েছিল শমসেরের দিকে। অসহ বেদনায় হাত পা কাঁপছিল তার। কষ্ট সে তো কম পায়নি জন্মাবধি। পাগল মাকে নিয়ে, আধপাগল ভবঘুরে বাবাকে নিয়ে মুখরা কাকির হাতের নীচে থাকতে থাকতে কষ্টই কি তার জীবনের একমাত্র অবলম্বন ছিল না? তবু, সে-দিনের কষ্টের কোনও তুলনা নেই রাধিকার জীবনে। সারা জীবনে গোপন সম্পদের মতো আগলে রাখার কষ্ট সেটি। ওইসব কষ্টের তলায় লুকনো থাকে এক অসহ্য সুখানুভূতির স্তর যা কষ্টের থেকে আলাদা করার কোনও উপায় নেই। সেদিন তাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে শমসের মন্দ্রিত স্বরে বলেছিল, ফ্যালফ্যালাইয়া কী দ্যাখস?

চোখ নামিয়ে নিয়েছিল রাধিকা, না। কিসু না।

শমসের এগিয়ে এসেছিল। রূপসীর পাড়ে ওই ঝাঁকড়া জামরুল গাছের তলায় সে আর শমসের ছাড়া কেউ ছিল না। ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে অলস মানুষেরা ঘুমিয়ে পড়েছিল। কর্মব্যস্ত লোকেরা কেউ শমসের আর রাধিকার খোজ করেনি। শমসের তার আবেগ-গম্ভীর কণ্ঠে রাধিকাকে ডেকেছিল। তার মসৃণ হাত রেখেছিল রাধিকার কাজ করা, অযত্নের খসখসে হাতে। রাধিকা প্রায় মরে যাচ্ছিল তখন। অথবা অসহ্য ভাল লাগায় ক্রমশ লঘু থেকে লঘুতর হয়ে উড়ে যাচ্ছিল হাওয়ায়। পুরুষের হাত এত নরম হয়? এত মসৃণ? ওদের চওড়া হাড় দেখে, চওড়া বুক-পিঠ-কাঁধ দেখে, ওদের মোটা ভারী স্বর শুনে মনে হয় ওদের মধ্যে একটুও কোমলতা নেই। কিন্তু সে-দিন রাধিকা বুঝেছিল, পুরুষের করতলও কখনও কখনও খুব আশ্চর্য কোমল ও মসৃণ! কখনও স্বপ্নময়! অসহ্য সুখাস্বাদনের কণায় ভরপুর! শমসের স্পর্শ না করলে, রাধিকার বুকের তলায় তা এতখানি করে লুকিয়ে না থাকলে সে কোনওদিন এসব বুঝতে পারত না। কার্তিক তেমন পুরুষ নয়। কার্তিক প্রেমহীন। স্বপ্নহীন। অতি সাধারণ।

সে-দিন, অসহ্য সুখের কষ্ট দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে করতে সে বলেছিল, কী কও!

শমসেরের চোখগুলি আশ্চর্য ভালবাসায় লাল তখন। গালের হাড়গুলি দৃঢ়তায় ভরপুর। সে বলেছিল, রাধু, তরে বিয়া করুম আমি।

রাধিকা চমকে উঠেছিল। এ কী বলছে শমসেরদা! সে হাত ছাড়িয়ে নেবার জন্য ছটফট করেছিল। শমসের ছাড়েনি। যেন বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিল, কতখানি করে সে রাধিকাকে ধরে রাখতে চায়। যেন ছাড়তে না হয় কোনওদিন। যেন কোনওদিন যেতে দিতে না হয়। বলেছিল, কথা কইস না ক্যান? রাধু? বিয়া করবি না আমারে? ক’! ক’ না!

রাধিকা জবাব দেয়নি। কোনও জবাব জানা ছিল না তার। কোনওক্রমে বলেছিল, কে কুনখানে দেইখা ফালাইব। আমারে ছাড়ো শমসেরদা।

—ছাড়ুম। তুই ক’। আমারে বিয়া করবি ক’।

—আমি কইতে পারি না। আমি কী জানি কও! ছাড়ো। আমারে ছাইড়া দাও শমসেরদা। কাকিয়ে দ্যাখলে আমারে কাইট্টা ফালাইব।

শমসের হাত ছেড়ে দিয়েছিল। তার চোখ দু’টি সজল হয়ে উঠেছিল। বলেছিল, তর কাকি তরে ব্যাবাক কষ্ট দ্যায়, না?

হঠাৎ রাধিকার কাছে শমসের সমস্ত কষ্টের নির্বাপণ প্রতিভাত হয়েছিল। তার কষ্টের কথা এভাবে আলাদা করে কেউ ভাবেনি এর আগে। সে তার নিজের কষ্ট নতুন করে শমসেরের চোখে প্রতিফলিত হতে দেখেছিল। ব্যথায় উপছে বলে ফেলেছিল, আমি মইরা যামু শমসেরদা। রূপসীর জলে দড়ি-কলসি লইয়া ডুব দিমু। আমার আর সইহ্য হয় না!

শমসেরের চোখ জ্বলে উঠেছিল। বলেছিল, ক্যান? আমি থাকতে মরবি কুন্‌ দুঃখে? রাধু, তুই মুসলমান হইলে তরে আইজৈ লইয়া ঘরে তুলতাম। আইজৈ বিয়া করতাম তরে। বাবায় তরে আদরৈ করত। তর আর কষ্ট হইত না।

রাধিকা নিজস্ব সরল বুকে মুখ নামিয়ে এনেছিল। যেন-বা আবেগে, যেন-বা লজ্জায়, যেন-বা সুখ-দুঃখ আলাদা করতে না পারার অনুভূতিতে নিজের মুখ লুকোতে লুকোতে বলেছিল— আর কইয়ো না। আর কিসু কইয়ো না গ। আমার ডর করে।

দামাল হয়ে উঠেছিল শমসের। ক্রোধী ও তুমুল। বলেছিল—কীসের ডর তর? কারে ডর? রাধু, আমার কী মনে লয় জানস?

রাধিকা তার নরম, দুর্বল স্বর আত্মসমর্পণে মেশাতে মেশাতে বলেছিল—কী? কী মনে লয়?

—তরে যারা কষ্ট দিতাসে, ব্যাদনা দিতাসে, তাগো কাইট্টা ফালাই!

—না, না। এমুন কতা কইয়া না। আমার কষ্ট নাই গ। কুনো কষ্ট নাই।

মাঝখানে কষ্ট রেখে তারা পরস্পরের দিকে গভীর তাকিয়েছিল।

হঠাৎ জামরুলের ডালে ঝটপট শব্দ হয় তখন। তারা দু’জনেই চোখ তোলে। দু’টি ছাতারে মারামারি করতে করতে মাটিতে নেমে এসে ধুলো ওড়ায়। রাধিকা ও শমসেরের উপস্থিতি তারা গ্রাহ্য করে না। রাধিকা চোখ বড় বড় করে বলে, দ্যাখসোনি কাইণ্ড! অ মা, অ্যারেরে মাইরা ফালানের লাখান করে!

তার একটু আগেকার কষ্ট আর নেই গলায়। বরং বিস্ময়! বরং বালিকাসুলভ চাপল্যে সে শমসেরের কাছ ঘেঁষে আসে। রূপসী নদীতে রোদ্দুর ভেসে যায়। ঝক ঝক করে। চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। শমসের মৃদু হেসে বলে, অরা মারামারি করে নাই।

—তাইলে?

রাধিকা পূর্ণ চোখে প্রশ্ন করেছিল শমসেরকে। শমসের জামরুল গাছে ঠেস দিয়ে, বুকের ওপর হাত দু’টি মুড়ে দাঁড়িয়েছিল। যেন কোনও অমোঘ কথা এখুনি সে উচ্চারণ করবে। রাধিকার প্রশ্নের উত্তর তৈরি হওয়ার আগেই ছাতারে দু’টি আবার ঝটপট করে উড়ে গিয়েছিল গাছে। শমসের বলেছিল, চাইয়া দ্যাখ। অরা ভালবাসতেয়াছে। একখান মাইয়া, একখান ব্যাটাছেইলা।

খুব লজ্জা পেয়েছিল রাধিকা সে-দিন। এক ছুটে জামরুলতলা থেকে পালিয়ে এসেছিল। শমসের বাধা দেয়নি। তেমনই বুকের ওপর হাত রেখে, জামরুল গাছে হেলান দিয়ে রাধিকার হরিণী পালিয়ে যাওয়া দেখেছিল সে। আর রাধিকা বাড়ি ফিরে দেখেছিল, তার পাগলিনী মা উঠোনে বসে দুলছে। মাটিতে কাঠি দিয়ে আঁক কাটছে। মায়ের পাশে বাটিতে ডালবাটা। তেল মাখানো টিনের পাত। রাধিকা বুঝেছিল, ডাল ফ্যাটানোর কাঠি দিয়েই আঁক কাটছে মা। বড়ি দেবার আগে আবার উদাস হয়ে গেছে। সেই ফাঁকে শালিক চড়ুই ডালবাটা ভোজ দিচ্ছে। রাধিকা এ দিক-ও দিক তাকিয়েছিল। এ দৃশ্য কাকি দেখলে অনর্থ করবে। রাগের মাথায় মেরেও বসতে পারে মাকে। কাকির হাতে প্রায়ই মার খায় মা। অথচ সারাদিন মাকে দিয়ে সমস্ত কাজ করিয়ে নেয় কাকি। রাধিকা যা করে তার বাইরে সমস্ত গৃহস্থালি। শুধু মা’র ওপর ভরসা করে রান্নার ভার দেওয়া যায় না। কিন্তু বাকি সমস্ত কাজ মা নির্বিবাদে করে। কিন্তু এক-এক দিন বিকল বিগড়ানো যন্ত্রের মতো হয়ে যায়। কিছুতেই উঠতে চায় না। সব কাজ ফেলে রাখে। কোনও গোপন দুঃখে বা রাগে ঘাড় গুঁজে জিদ্দি মেয়ের মতো বসে থাকে। সেইসব দিন কাকির মাথায় আগুন জ্বলে যায়। রাধিকাকে যা-তা করে বকাবকি শুরু করে। মাকে মারে। মা’র চুলের রাশি ধরে মাটিতে মাথা ঠুকে দেয়। মা কাঁদে—আঃ! আঃ! তবু কাজ করে না। যেন যুদ্ধ ছুড়ে দেয় কাকির সামনে। কোনও কোনও দিন হাল ছেড়ে দিয়ে কাকিও কাঁদতে বসে। উনুনে জল ঢেলে দিয়ে রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে ফোঁপায়। রাধিকাই তখন ফের আগুন জ্বালে। অনেকগুলি পেটের জন্য খাবার ব্যবস্থা রাখতে হয়। উনুন নিবলে চলবে কেন? কাকা খাবে। কাকার তিন ছেলে। কাকি। মা। রাধিকা। কোনও কোনও দিন সত্যসাধন।

সেইদিন হাঁফাতে হাঁফাতে মা’র কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল রাধিকা। পিঠময় ছড়ানো চুল সাপটে খোঁপা করে দিতে গিয়েছিল। মা মাথাটা ঘুরিয়ে নিল একটু। রাধিকা এক হাতে তার মাথা চেপে ধরে খোঁপা করে দিল একরকম। মা দুলতে থাকল। রাধিকা মায়ের গা ঘেঁষে বসে হাত দিয়ে ডাল ফ্যাটাতে থাকল। বড়িগুলো দিয়ে ফেলতে হবে। নইলে কাকি চেঁচাবে।

পলাশ ধাক্কা মারে রাধিকাকে। মা! মা! অমা!

—হ

রাধিকা কোনও এক অদ্ভুত জগৎ থেকে ফিরে আসে। পলাশ বলে, মা। খিদা লাগে।

—হ, বাবা! এই দেই খাইতে।

শেফালির মা’র দেওয়া ডাল ভাত তরকারি সে ছেলের পাতে তুলে দেয়। ছেলের চোখে তৃপ্তি দেখতে পায় সে। খাবার দেখে পলাশ সত্যি খুশি। সে বলে, হ মা! অ্যাত! অ্যাত ভাত আমি খামু কী কৈরা!

সে মায়ের মুখ দেখে। যেন-বা শুকনো ঠেকে। সে বলে, আমার লগে তুমিও দুইটা খাও মা।

—আমি খাইসি। তুই খা বাবা।

—আমার লগে দুইটা খাও। অ মা! আমারে ভাতটা মাইখ্যা দিবা?

রাধিকার মুখ জলে ভরে যায়। এতক্ষণ সে সামান্য ভাত ও সজনেপাতা ভাজা খেয়ে আছে। ডাল ভাতের গন্ধে এখন তার মুখ স্বাদু জলে ভরে যাচ্ছে। সে আর কথা বাড়ায় না। ডাল দিয়ে ভাত মেখে ছেলের মুখে তুলে দেয়। বড় গ্রাসে মুখ ভর্তি হয়ে যায় ছেলের। সে তার ছোট হাতখানি মায়ের ঠোঁটে রেখে মাথা নাড়ে। এবারে নিজের মুখে গ্রাস তোলে রাধিকা। তাড়াতাড়ি চিবিয়ে পেটে চালান করে দেয়। ছেলের মুখের ভাত ফুরোবার আগে আরও এক গ্রাস নিজের মুখে তোলে। হঠাৎ তার মনে হয়, এ কী করছে সে! এ ভাত সে তো ছেলের জন্য রেখেছিল। এখন নিজেই গোগ্রাসে খেয়ে ফেলছে কেন! তখনই পেটের মধ্যে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে। সে। কিন্তু আমল দেয় না। ছেলের মুখে ভাত তুলে দেয় ফের। খাওয়া শেষ হলে এঁটো তুলে কলতলায় পা বাড়ায়। তখন ভেজা কাপড়ে হাঁসফাঁস করতে করতে উঠোনে ঢোকে শেফালির মা। রাধিকাকে বলে, অ রাধু। আমারে ঘর থিকা একখান শুকনা কাপড় আইন্যা দে।

তার কথা ফুরোতে না ফুরোতে হড় হড় করে বমি তোলে রাধিকা। শেফালির মা তাড়াতাড়ি এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। বমির গন্ধে তার গা গুলিয়ে ওঠে। পলাশ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে এই দৃশ্যের দিকে। এত প্রিয় ভাত, এত আশার ভাত, বমিতে তুলে দিতে হল মাকে— তার কষ্ট হয়! আর শেফালির মা দেখতে পায়, জলের সঙ্গে, ভাতের সঙ্গে উঠে আসছে অনেক কালো-কালো সবুজ-সবুজ কণা। ভেজা আঁচল দিয়ে রাধিকার মুখ মুছে দিতে দিতে সে প্রশ্ন করে, কী খাইসিলি? তরে যে ভাত দিসিলাম খাইস নাই?

রাধিকা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। শেফালির মা বমিতে জল ঢালতে ঢালতে বলে, ওইগুলা কী?

রাধিকা হাঁফাতে হাঁফাতে দাওয়ায় ঠেসান দিয়ে দাঁড়ায়। জবাব দেয় না। অবশেষে শেফালির মা’র জিজ্ঞাসা ঘোরানোর জন্য বলে, খাড়াও। তোমার কাপড়খান আইন্যা দেই।

শেফালির মা’র মুখ শক্ত হয়। বলে, র। আনিস অনে। অহন ক দেহি। কী খাইসিলি!

—কী আর। সইজনা পাতা ভাজা!

—আবার ওই পুখুরে গেসিলি তুই? হারামজাদী মাইয়া। তরে কই নাই প্যাট লইয়া পুখুরে যাবি না? বাইর হ। যা। আমার সামনের থিকা যা। আমার কাছে আর আওন লাগব না তর। যা।

দু’হাতে মুখ চেপে কেঁদে ফেলে রাধিকা। বলে, হ। যামু। যমের বাড়িই যামু অ্যাক্কেরে।

তখন পরমেশ ক’টি বাসন নিয়ে কলতলায় আসে। রাধিকা তাকে দেখেনি। সে বলে যায়, কেউ কি দ্যাখসে চোখ তুইল্যা? হ্যায় গ্যাসে তো গ্যাসেই। আর আওনের নাম নাই। দড়ি-কলসি লইয়া ডুইব্যা মরুম পুখুরে।

পরমেশ অবাক হয়ে যায়। ইশারায় শেফালির মা’র কাছে বৃত্তান্ত জানতে চায় সে। শেফালির মা বিরক্ত হয়ে বলে, কী আর কমু! অর যেমুন কপাল। যত আইসা জুটব আমার লগে।

সে ভেজা কাপড় সাপটে ঘরে চলে যায়। পরমেশ বাসন নামিয়ে রাখতে রাখতে বলে, কী হয়েছে বউদি? ও বউদি? কাঁদছেন কেন?

এই প্রথম পরমেশ কথা বলছে রাধিকার সঙ্গে। মুখ থেকে হাত সরায় রাধিকা। প্রায় অবিশ্বাসে তাকায়। এবং সামনে সত্যি পরমেশকে প্রত্যক্ষ করে দু’হাতে মুখ আগলে আবার কাঁদতে শুরু করে।

বৃষ্টি কমেছিল কিছুক্ষণ। আবার ঝমঝমিয়ে শুরু হয়। যেন রাধিকার সঙ্গে বর্ষার তুমুল প্রতিযোগিতা।

পরমেশ তাড়াতাড়ি বারান্দায় উঠে যায়। রাধিকাও চোখ মুছতে মুছতে ঘরে আসে। পরমেশ তাকিয়ে থাকে রাধিকার দিকে। মা হতে চলেছে এমন মেয়েকে এভাবে কাঁদতে দেখে তার কষ্ট হয়। কার্তিকের খবরাখবর সে জানে। অনেকদিন বাড়ি আসেনি কার্তিক। রাধিকা এ অবস্থায় নিশ্চয়ই অসহায় বোধ করছে তার জন্য। এবং কাঁদছে। স্বাভাবিক, খুবই স্বাভাবিক।

সন্ধ্যায় পরমেশকে ডেকে পাঠাল শেফালির মা। শ্যামল আর কমলও মায়ের সঙ্গে বসল। শেফালির মা পেঁয়াজ, আদা, ধনেপাতা, তেল ও নুন দিয়ে মুড়ি মেখে দিয়েছে তিনজনকে। কমল বলল, বাবায় কই মা?

শেফালির মা বড় গামলায় মাখা মুড়ির খানিকটা একটা ছোট বাটিতে তুলতে তুলতে বলল, তর বাবায় রোজ কই যায় জানস না?

—শীতলা মন্দিরে?

—হ। একবার তাস না পিটাইলে তেনির ঘুম আহে না।

শ্যামল আরও এক বাটি মুড়ি মাকে আলাদা করতে দেখে বুঝেছিল, বাবা যখন তাস খেলতে গেছে তখন এ মুড়ি কার। তবু, মাকে রাগানোর জন্য সে বলল, বাবায় নাই। মুড়ি কার লিগ্যা তুলো তুমি মা? তুমি তো গামলা লইয়া বইবা।

শেফালির মা বলে, হ। বমু।

—তাইলে মুড়ি দ্যাও কারে?

পরমেশ মুখে একগাল মুড়ি ফেলে কী বলতে যাচ্ছিল। শ্যামল তাকে ইশারা করে। পরমেশ থেমে যায়। শ্যামল আবার বলে, অ মা!

এ বার শেফালির মা ঝাঁঝিয়ে ওঠে, সব খোঁজে তগো কাম কি? খাইতে দিসি, খা।

মাকে চটানোই শ্যামলের উদ্দেশ্য। কমল বুঝতে পারছে। সে হাসছে। শ্যামল বলল, মায় পরাণের মাইয়ার লিগ্যা লইয়া যাইব বুঝলা পরমেশ।

শেফালির মা রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে যেন-বা ধরা পড়ার ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়। হাতে মুড়ির বাটি নিয়ে বারান্দায় যায় সে। নিজেরা পেট পুরে মুড়ি খাচ্ছে আর পোয়াতি মেয়েটা খিদে চেপে শুয়ে থাকছে—এ শেফালির মা’র সহ্য হবে না। সে ঘর ছেড়ে বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে লোডশেডিং হল। আকাশে এখনও মেঘ আছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ধীরে ধীরে। রাধিকার দরজায় মৃদু ঠেলা মারল শেফালির মা। পলাশের সাড়া পাওয়া গেল।

শেফালির মা বলল, পলাশ। বাবা। মুড়িগুলা থো দেহি লইয়া। তর মায় কই?

রাধিকা সাড়া দিচ্ছে না। দুপুরে গালমন্দ করেছিল শেফালির মা। রাধিকা পুকুরের পাড়ে গিয়েছিল বলে রাগ করেছিল। পুকুরে অপদ্যাবতা থাকে। শিঙ-মাগুর-কৈ হয়ে ঘুরে বেড়ায়। পোয়াতি দেখলেই অদৃশ্য জাদুবলে জলের দিকে টানে আর তার পা হড়কে যায়। তখন সে ডুবে যেতে পারে। না ডুবলেও বিষাক্ত অসুখ তার শরীর ছেয়ে ফেলতে পারে। এ সবই অপদ্যাবতার লোভী নিশ্বাসের কারণে। রাধিকা মানছে না। এই জীবনের প্রতি, সন্তানের জন্ম দেবার প্রতি সে বীতশ্রদ্ধ। বীতস্পৃহ। কিন্তু শেফালির মা’র উদ্বেগ কমে না।

রাধিকা দুপুরের কথা মনে রেখে চুপ করে আছে বলে শেফালির মা কষ্ট পায়। তখন মেজাজ ভাল ছিল না। কী বলেছে না বলেছে! তাই বলে সব মনে রাখবে মেয়েটা! একটু বুঝবে না? নিজে যে কথা শুনছে না, নিয়ম মানছে না! নিজের বিপদ নিজে ডাকছে—সেটা কিছু নয়! তার মনে পড়ছে, একবার একটা সবুজ ফিতের জন্য বায়না ধরেছিল শেফালি। তখন সব কিছু কত অন্য রকম ছিল। ছায়াস্নিগ্ধ পুকুরঘাটে জীবনের সমস্ত খুশি বিছিয়ে থাকত। স্নান করার সময় ডুব-ডুব খেলা। কে কতবার ডুব দিতে পারে। জলে চোখ লাল হয়ে যেত। নাক দিয়ে ঘন রস গড়াত। তবু খেলা থামত না। ওইসব পুকুরে সব কিছু ভাসিয়ে দিতে চাইত মানুষ। ডুবিয়েও দিতে চাইত। সমস্ত দুঃখ, ক্লেদ, অপমান। নিজেরাও ডুবত, যখন আর জীবনের ভার বইতে পারত না। শেফালির মার মনে আছে, সুশীলাদি একদিন ডুবে মরল পুকুরটায়। লোকে তাকে নিয়ে নানা কথা কইল। গাঁয়ের সবচেয়ে পুরনো ধাই রটাল—প্যাট হইসিল। আমার কাসে আইসিল খালাস করনের লিগ্যা। আমি কইসি, পারুম না। খালাস করন আমার কাম না।

পুকুরের জলে ডুবে নিজেই নিজেকে জীবন থেকে খালাস করে ফেলেছিল সুশীলাদি। কে এই সর্বনাশ করেছিল তার? নাকি সেই, অমোঘ টানে সর্বনাশে ঢুকেছিল তা কে বলতে পারে! ছোটবেলায় বিধবা হয়েছিল সুশীলাদি। বৈধব্যের কঠোর নিয়ম সে পালন করে চলেছে—এমনই জানত লোকে। কোন রন্ধ্রে ঢুকে গিয়েছিল অসংযম! তার মৃত্যুর পর সন্ধ্যায় রাত্রে ঘাটের পাশ দিয়ে যেতে পারত না কেউ। সুশীলাদি নাকি জাম্বুরা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকে। হয়তো-বা মরণোত্তরে জাম্বুরাফুলের গন্ধ বুক ভরে টেনে নিত সে। সেইটুকুই সুখ ছিল হয়তো! সেইদিন শেফালির ওরকম বায়নায় খুব বিরক্ত হয়ে উঠেছিল শেফালির মা। শেফালির মুখে ঠোনা মেরে বলেছিল—খাড়া! তর সবুজ ফিতা দিতাসি! সক্কাল থিকা ঘ্যানর ঘ্যানর। থুইয়া আমু তরে জাম্বুরা গাছের তলে। পেত্নিয়ৈ ধরব।

কী বুঝেছিল শেফালি কে জানে! হয়তো গভীর অভিমান হয়েছিল তার। সন্ধ্যাবেলা নিজেই সে জাম্বুরাতলায় চলে গিয়েছিল। যখন ভাল করে বেলা পড়েনি, তখনই সাহসে ভর করে রাগের মাথায় সে চলে যায় সেইখানে। কিন্তু যখন অন্ধকার হল, যখন জাম্বুরার পাতাগুলিকে আলাদা করে আর চেনা গেল না, তখন খুব ভয় পেয়েছিল শেফালি। দারুণ ভয়ে সে কাঁপছিল। কাঁদছিল। গাঁয়ের আসমাদ চাচা ফিরছিল পুকুরের পাশের রাস্তা দিয়ে। সাহসের জন্য খ্যাতি ছিল তার। ভূত-পেত্নির পরোয়া করেনি কখনও। হঠাৎ অদ্ভুত ইঁ ইঁ ইঁ ইঁ কান্না শুনে তারও প্রথমে ভয় ধরে যায়। তবু সুশীলার পেত্নিকে দেখার আগ্রহে সে চলে এসেছিল জাম্বুরাতলায়। বন-বাদাড়ে সে কম ঘোরেনি। কিন্তু ভুতের কান্না শোনেনি কখনও। কোনও গোলমাল আছে বলে তার সন্দেহ হয়েছিল এবং সত্যি শেফালিকে আবিষ্কার করেছিল সেখানে। সে-ই তাকে কোলে করে বাড়ি পৌঁছে দেয়। জ্বর এসে গিয়েছিল শেফালির। আর মরমে মরে গিয়েছিল শেফালির মা। কেন সে একটু ধৈর্য ধরেনি? কেন একটু বোঝায়নি?

যদি বেঁচে থাকে শেফালি, যদি ভাল থাকে, তবে আজ তার বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গেছে। তার কি মনে পড়ে সেইসব কথা? সুশীলার ভূতের গল্প? ভয় পাওয়ানো জাম্বুরা গাছ, শেফালির মা’র চোখে জল আসে। সে নীরবে বাটি নামিয়ে রেখে ঘরে যাবার জন্য ফেরে। রাধিকা ডাকে তখন, মাসি!

শেফালির মা দাঁড়ায়। রাধিকা বলে, মাথায় ব্যাদনা হইতাসে মাসি।

তার কথায়, ওই দু’খানি কথায়, শেফালির মার বিষণ্ণতা চলে যায়। সে স্নেহসিক্ত গলায় বলে, শুইয়া থাক। দুইগাল মুড়ি খা। আমি পরে আমুঅনে।

সে ঘরে যায়। কমল বলে, মা, তোমার মুড়িগুলান শুকইয়া চিমড়া মাইরা গেল। চিবাইবা ক্যামনে? আমারে দুগা দিয়া দাও।

শেফালির মা হাসিমুখে দু’মুঠো তুলে দেয় ছেলের বাটিতে। তারপর নিজের মুখে এক মুঠো ফেলে বলে, মাইয়াডার কষ্ট আর দ্যাখন যায় না। তরা কিসু কর।

তখন আলোচনা করে তারা। কার্তিকের কাণ্ডজ্ঞানহীনতায় অবাক হয়। সত্যি তো! একটা পয়সা নেই ঘরে, বাচ্চা নিয়ে, পোয়াতি অবস্থায় কী করে চলে মেয়েটার! সবার কাছে ধারকর্জ করছে। সজনেপাতা ভাজা খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এভাবে আর কতদিন? সে-দিন উত্তরের ঘরের মুখরা রামিবুড়ি বলছিল, এখন মেগে খাচ্ছে। ক’দিন পর শরীর বিকোবে। মিনসেকে বাঁধতে শেখেনি। এ বয়সেই যদি মিনসের টান আলগা হয় তবে আর বলি কি! বাঙালের মেয়েগুলো বাপু কেমন ধারা। বড় ঢিলেঢালা। গা আলগা সংসারে।

কার্তিকের কাণ্ডজ্ঞানহীনতা ও নিষ্ঠুরতার পাশাপাশি উদ্বিগ্নও হয় তারা। যদি কিছু হয় মানুষটার! কোনও অসুখ-বিসুখ কিংবা দুর্ঘটনা। অনেক আলোচনা করে কার্তিকের কর্মস্থলে গিয়ে খোঁজ নেওয়া স্থির করে তারা। শ্যামল যত দূর জানে, হৃদয়পুর স্টেশনের কাছে একটা কাঠগোলায় কাজ করে কার্তিক। কাঠগোলাটির নাম জানে না অবশ্য। আর ওখানে ওরকম গোলা অনেকই রয়েছে। তবু খোঁজ করলে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে তাকে। পরমেশ মাধব পালের সাহায্য নেবার পরামর্শ দেয়। মাধব পাল রামিবুড়ির ছেলে। পরমেশ অনেকদিন তাকে কার্তিকের সঙ্গে আসা যাওয়া করতে দেখেছে।

আলোচনা ফুরোবার আগেই আলো ফিরে এল। শেফালির মা বিড় বিড় করে দু’হাত মাথায় ঠেকায়। শ্যামল শুনতে পায় মা মঙ্গলচণ্ডীর কাছে মানত করছে। পূজা দেবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। তার আবার সত্যজিতের কথা মনে পড়ে। ঈশ্বরচিন্তা মানুষকে দুর্বল করে দেয়। সে বলত। শ্যামল আজও এ বিষয়ে কোনও স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি। সে তার মাকে দেখছে। চারপাশে অন্যদের দেখছে। ঈশ্বর আছেন, তিনি পরম করুণাময়, মঙ্গলময়—এই বিশ্বাসে এই ভরসায় মানুষ তার কর্তব্যও করছে। হয়তো সাধ্যাতীত কাজের ঝুঁকি নিচ্ছে কখনও। আসমুদ্র শোক সাঁতরে পেরিয়ে যাচ্ছে। কেউ একজন আছে, কেউ একজন আমার কথা ভাবছে, আমার সমস্ত সুখ-দুঃখের ভার নিয়ে আমাকে শান্তি দেবার জন্য অতন্দ্র জাগরণে আছে—এই ভরসায় কি গিরি লঙ্ঘন করছে না মানুষ? তবু ঈশ্বরের অঙ্ক সবসময় সুফল দেয় না। ঈশ্বরের কাছে পূজা-প্রার্থনার পরও, উপোস-ব্রত-নিয়ম পালনের পরও চরম সর্বনাশ ঘটে মানুষের। সেটাও পরম করুণাময় ঈশ্বরের গূঢ় ইচ্ছা, লক্ষ্য বা অভীপ্সা ধরে নেওয়া হয়। কিংবা নিজের কোনও পাপের প্রায়শ্চিত্ত—এমনই ব্যাখ্যা। মাঝে মাঝে শ্যামলের মনে হয়, কেউই ভুল নয়। যে অখণ্ড আত্মায় বিশ্বাস করে সে নয়, যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে না সেও নয়। যার যার বিশ্বাস তার নিজের মতো। আসল কথা, মানুষ নিজেকে কীভাবে পরিচালিত করবে, কীভাবে নির্ধারণ করবে ন্যায়-নীতি, কীভাবে সে শক্তি ও আত্মবিশ্বাস অর্জন করবে সেই পথ নির্মাণ করা। শ্যামল মায়ের দিকে তাকায়। রাতের রান্নার আয়োজন করছে মা। এত পরিশ্রম করে মা, এমনই তার দুঃখ ও সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস—তবু কীরকম আলো করে রাখে ঘর। মার গায়ে আলো দেখে সে। বিশ্বাস করে—এ আলো স্নেহের। নৈঃস্বার্থের। এই দারিদ্রের মধ্যেও মা নিজের খাবার বণ্টন করে খায়। এর চেয়ে বড় আর কী হতে পারে!

১৮

সুধা ছানিয়া কেবা  ও সুধা ঢেলেছে গো
তেমতি শ্যামের চিকণ দেহা।

অঞ্জন গঞ্জিয়া কেবা খঞ্জন আনিল রে

চাঁদ নিঙাড়ি কৈল থেহা ॥

সে থেহা নিঙ্গাড়ি কেবা     মুখ বনাইল রে

জবা ছানিয়া কৈল গণ্ড।

বিম্বফল জিনি কেবা ওষ্ঠ গড়িল রে

ভুজ জিনিয়া করি-শুণ্ড ॥

মগ্ন হয়ে পাঠ করছে সত্যসাধন। যেন-বা তার পাঠ শুধু পাঠ নয়। সুরও আছে। মৃদু সুর। যা ঠিক গানের মতো নয়। কিন্তু সঙ্গীতই বুঝি। যেন স্থির জলকে একটু ছুঁয়ে দিলে যে কাঁপন, তাকে ঢেউ বলা যাবে না কোনওমতে, তবু ঢেউ-ই তো।

লণ্ঠনের চিমনিতে কালি পড়েছে। আলো কম লাগছে ঘরে। সেই লালচে আলোতেই পাঠ করছে সত্যসাধন। রাধিকা পাশে বসে আছে। একটি কাঁথা সেলাই করছে সে। নিত্যকার ব্যবহার্য কাঁথা। শিল্প-নকশার প্রয়োজন নেই। তবু মাছ করছে, ফুল করছে। এ গাঁয়ে বিদ্যুৎ আসেনি এখনও। সকলে লণ্ঠনে অভ্যস্ত। সত্যসাধন পড়া থামিয়ে চশমা মুছে নিল একবার। রাধিকা বলল, আলো কম লাগতেয়াসে, না বাবা?

—হ। আইজ লণ্ঠনগুলা মুছস নাই?

—না।

—দুফরে বৈয়া বৈয়া কী করস্‌?

—আইজ বড়ি দিসি।

সত্যসাধনের চোখে স্নেহ ঝরে। মৃদু হেসে বলেন, বড়ি দিত পারস তুই?

—হ। পারুম না ক্যান? সংসারে কুন কামড়া না পারি কও?

রাধিকার গলায় প্রত্যয়। নাকি আসলে এর নাম ক্ষোভ! রাধিকা স্কুল ছাড়তে চায়নি। কিন্তু গাঁয়ের যেমন রীতি। কাকি কিছুতেই আর স্কুলে যেতে দিল না। কী হত গেলে? শহরে আজকাল সব মেয়ে স্কুলে যায়। সত্যসাধনের একটু মন খারাপ লাগে। মেয়ের খোঁপাটা একটু নেড়ে দিয়ে বলে, পারস বুজি? তাইলে আর কি? তরে বিয়া দিয়া দেই রাধু?

—বিয়া!

রাধিকা চমকে ওঠে। বিয়া! বিয়া! আজকেই একজন বলেছে তাকে—তরে বিয়া করুম। বিয়া! বিয়া! কী সুন্দর শব্দটা! কিন্তু কী ভয় যে লাগে! তার হাত পা হিম হয়ে যায়। বুকে সির-সিরানি ধরে। এই শব্দটা ক্রমশ ঘিরে ধরছে তাকে। তার হঠাৎ মনে হয়, পৃথিবীর সবাই সব কিছু জেনে গেছে। শমসেরের কথাগুলি শুধু জামরুল গাছ নয়, ছাতারে পাখিরা নয়, রূপসী নদী আর রাধিকা নয়—শুনে ফেলেছে সারা গ্রাম! সে কী করবে ভেবে পায় না। এক ফুঁয়ে লণ্ঠন নেবাতে চায়। লণ্ঠন দপ্‌ করে ঝলসে ওঠে। নেবে না। সত্যসাধন হা হা আর্তনাদ করে, করস কী! করস কী! আগুন-মাগুন লাগাইয়া এক কাণ্ড হইব অখন।

রাধিকা আমল দেয় না। আঁচল দিয়ে লণ্ঠনের মাথা টেনে আলগা করে জোরে ফুঁ দেয়। বলে, চিমনিডারে সাফ কইরা আনি। তুমি বও।

আঁচল দিয়ে গরম চিমনি চেপে ঝরেছে সে। কাপড় ভেদ করে ভাপ লাগছে হাতে। বুক দুর দুর করছে। পাশের ঘর থেকে ভাইদের পড়াশুনোর শব্দ উঠছে। মা কোথায়? রাধিকা একবার রান্নাঘরে উঁকি দেয়। মা দু’হাঁটুর ভাঁজে ঘাড় গুঁজে বসে আছে। রাধিকা একটু স্বস্তি বোধ করে। মা তা হলে কাজ করছে এ বেলা! বাবা এসেছে। বাবার সামনেই যদি মাকে মারে কাকি! রাধিকা জানে বাবা তা হলে ভীষণ কষ্ট পায়। পদাবলী পড়তে পড়তে চোখের জল মোছে।

চিমনি মুছে ফিরে এল রাধিকা। সত্যসাধন অন্ধকারে বসে আছে। দেশলাই জ্বেলে লণ্ঠন ধরিয়ে চিমনি বসিয়ে দিতেই উজ্জ্বল হল ঘর। সত্যসাধন বলল, রাধু—

—কও।

—আন্দারেরও য্যান আপন আলো জ্বলে এমুন লাগে না তর?

—আন্দারে আলো তুমি কই পাও বাবা?

—হ। পাই। তুই আলো নিবাইয়া গেলি গিয়া। আমার য্যান সব ডুইবা গেল। আবার সবৈ য্যান ফিরা আইল একটুস একটুস কইরা।

বাবার কথার কোনও মানে বোঝেনি রাধিকা। অন্ধকারে চোখ সয়ে গেলে মানুষ তো দেখতে পাবেই। এ আর নতুন কি? সত্যসাধন একটা বড় শ্বাস ছাড়ে। আবার নিজের দিকে বই টেনে নেয়। আবার আগের সুরের রেশ ধরে সে। রাধিকার ভাল লাগছে সেই সুর। কেন ভাল লাগছে সে জানে না। বলে, বাবা। আমারে বুজাইয়া দিবা?

—কী?

—ওই যে পড়তেয়াসিলা?

সত্যসাধনের মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়। সে বলে, সুধাময় শ্যাম যেন অন্ধকার লাঞ্ছিত নীলকণ্ঠ পাখিটি। যেন চাঁদ নিংড়ে বের করে আনা একখণ্ড স্থির স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না।

সুধা ছানিয়া কেবা  ও সুধা ঢেলেছে গো
তেমতি শ্যামের চিকণ দেহা।
অঞ্জন গঞ্জিয়া কেবা   খঞ্জন আনিল রে
চাঁদ নিঙ্গাড়ি কৈল থেহা॥

—কী সুন্দর লিখে বাবা! কী সুন্দর কয়?

—সেই স্থির স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না দিয়ে মুখ তৈরি হল তার। জবার আভা লাগল গালে। পাকা পুষ্ট বিম্বফলের দানা দিয়ে গড়ে উঠল ঠোঁট। হাতির শুঁড়ের সুগোল মসৃণতায় হাত তৈরি হল—

সে থেহা নিঙাড়ি    কেবা মুখ বনাইল রে
জবা ছানিয়া কৈল গণ্ড।
বিষফল জিনি কেবা   ওষ্ঠ গড়িল রে
ভুজ জিনিয়া করি-শুণ্ড ॥

রাত গড়িয়ে গেছে। কেউ কোথাও জেগে নেই। রাধিকার পাশে পাগলি মা। দূরে রূপসীর অবিশ্রাম ভেসে যাবার টান। মা কি ঘুমিয়ে পড়েছে? রাধিকা টের পাচ্ছে না। সে ভাবছে। জমাট জ্যোৎস্নার মতো মুখ। স্নিগ্ধ। নিষ্পাপ। সে মুখ শমসেরের। কালো চকচকে গাল। যেন ঘোর রক্তবর্ণ জবার পাপড়ি। পাকা বিম্বফল ঠোঁট। শমসেরের ঠোঁট কেমন? হাত কেমন? গলা কেমন? বুক? হ্যাঁ। বুকেরও বর্ণনা আছে ওখানে। রাধিকার মনে পড়ছে—পাষাণ কেটে রত্ন বসিয়ে দিয়েছে কেউ। রত্ন কোথায়? ঢালা হাড় সঞ্জাত বুকে রত্ন বলবে কাকে?

বিস্তারি পাষাণে কেবা       রতন বসাইল রে
এমতি লাগয়ে বুকের শোভা
দাম-কুসুমে কেবা     সুষমা করেছে রে
এমতি তনুর দেখি আভা॥

রাধিকার বুকের মধ্যে সিরসির করে। শমসেরের সেই স্পর্শ— আশ্চর্য নরম, উষ্ণ, ভেজা স্পর্শ তাকে আচ্ছন্ন করে দেয়। একা একা, প্রায় ঘুমন্ত মানুষের মতো স্থির হয়ে জেগে রাধিকা ক্রমশ মরে যাচ্ছে তখন। নানা রকম স্বপ্নে মরে যাচ্ছে। তার কানে বাজছে—‘তরে বিয়া করুম রাধু। বিয়া করুম তরে।’ বিয়া বিয়া বিয়া—আশ্চর্য শব্দ বুকে করে ঘুমিয়ে পড়ে রাধিকা। জীবন ও মরণের সীমানা চুকিয়ে সমস্ত কিছুর চূড়ান্ত স্বাদ নিতে ইচ্ছে করে তার। আর ঘুমের মধ্যে ইচ্ছাগুলি স্বপ্ন হয়ে যায়। সেই স্বপ্নে ছাতারে পাখিরা। সেই স্বপ্নে শমসের। আর শমসেরকে ঘিরে কেষ্টঠাকুরের অঙ্গ বর্ণন! রাধিকার চোখের পাতাগুলি কাঁপে। শিথিল হাত মুঠো হয় একবার। ঘুমের মধ্যে নড়াচড়া করে সে। পাশ ফিরে জড়িয়ে ধরে পাগলি মায়ের গলা। রাধিকার ঘুম গাঢ় হয়।

পরপর অনেকদিন শমসেরকে দেখতে পেল না রাধিকা। নদীর ঘাটে অকারণে বসে থেকে কাকির বকুনি খেল কতদিন। কতদিন জামরুল গাছের নীচে বসে ছাতারের ডাক শুনল, হুটোপাটি দেখল, কিন্তু শমসের এল না। সে কি টের পায়নি, গন্ধ পায়নি, রাধিকা অপেক্ষা করছে? শমসের রাধিকাকে প্রায়ই বলত—যখন আরও ছোট ছিল তারা—খেলে বেড়াত মাঠে-ঘাটে—লুকোচুরি খেলার সময় শমসের ঠিক রাধিকাকে খুঁজে পেয়ে যেত। রাধিকা বলত—তোমার লগে পারি না! শমসেরদা! লুক্কাইলেই খুইজা বাইর কইরা ফালাও। শমসের বলত—কেমুন কইরা তরে পাই, ক?

—ক্যামনে পাও?

—গন্ধ শুইক্যা পাই। তর চুলের গন্ধ। শরীলের গন্ধ। এমুন মিঠা লাগে—

—অ্যাক্কের হারাইয়া যামু তখন আমারে কই পাইবা? গন্ধও পাইবা না।

—কই যাবি? অ্যাঁ? কই যাবি? যেইখানৈ যা, তরে গন্ধ শুইক্যা বাইর করুম।

একদিন আর থাকতে না পেরে ফন্দি করল রাধিকা। চারটি কাঁচা আম পেড়ে শমসেরের বাড়ি চলে গেল তার বোন লায়লিকে ডাকতে।

শমসেরের মা সিমুই রোদ্দুরে দিচ্ছিল উঠোনে। রাধিকাকে বলল, যা, লায়লি ঘরে আসে।

রাধিকা ঘরে গেল। শাকিনা মেহেন্দি পরিয়ে দিচ্ছিল লায়লিকে। রাধিকা বলল, কাচা আম খাবি লায়লি?

লায়লি মুখ তুলছে না। শাকিনার নকশার দিকে তাকিয়ে আছে। পাছে নড়ে যায়। তা হলেই শাকিনা খেঁকিয়ে উঠবে। মুখ না তুলেই সে বলে, কুনখান থিকা আনলি?

—আমাগো গাসের।

—তগো গাসের আম খাইতে মিঠা। পরে খামু। তুই রাইখা যা রাধু।

শাকিনা বলে, সইত্যকাকারে য্যান দ্যাখলাম কাইল!

রাধিকা বলে, হ। বাবায় আইসে দুইদিন হয়।

কথা থেমে গেল। কেউ কিছু বলছে না। রাধিকা উশখুস করছে। শেষে বলেই ফেলল, শমসেরদারে দেখি না?

শাকিনা বাঁকা চোখে তাকায়। বলে, ক্যান? শমসেররে দিয়া তর কুন কামডা?

রাধিকা অপ্রস্তুত বোধ করছে। ভয় পাচ্ছে। শাকিনা কি সব বুঝে ফেলল? জেনে ফেলল? সে যে শমসেরকেই খুঁজছে কি জানে সবাই? ইস—কেন যে শমসেরের নাম করল! সে তাড়াতাড়ি বলে, না। আমার আর কুন কামডা? বাবায় কইল, যা রাধু, শমসেররে ডাইকা আন। পোলাডা কয়, কাকা আমারে টুন তবলা বাজান শিখাও। তাই জিগাইতেয়াসিলাম।

শমসের তবলা বাজানো শিখতে চায়, এ খবর সত্যি। সে আর কথা বাড়ায় না। লায়লি বলে, দাদা ঢাকায় গ্যাসে গিয়া।

—ক্যান?

—কলেজে ভর্তি হইব। বাবায় কইসে জমিজমা আমি দ্যাখতেয়াসি। তুই ঢাকায় যা গিয়া। পড়। দুই চাইরখান পাস কইরা জমিজমা ধরবি।

রাধিকা উঠে পড়ল। বিরস গলায় বলল, যাই তাইলে। বাবারে গিয়া কই।

মন খারাপ হয়ে গেল তার। ঢাকায় যাবে, শমসেরদা তাকে একবারও বলে গেল না কেন? শুধু শুধু একগাদা মিথ্যে বলল সে। শাকিনাটা কেমন যেন। শুধু ট্যাঁরা-ব্যাঁকা কথা। তার একবার ইচ্ছে হল ফিরে গিয়ে জিজ্ঞেস করে শমসের কবে ফিরবে। কিন্তু পারল না। একা একা রূপসীর দিকে হাঁটতে লাগল সে। ক’দিন বৃষ্টি হয়েছে। তাতেই রূপসীর জল বেড়ে গেছে। জামরুল গাছের তল ছুঁই-ছুঁই করছে। সালতিগুলো বের করার সময় হয়ে এল। ক’দিন পর পুরোপুরি বর্ষা নেমে গেলে অনেকদিন আর মাটি দেখা যাবে না। খাল বিল নদী পুকুর উপচে একাকার করে দেবে জমি পথ উঠোন বাগান। সারা গ্রাম জলে ভাসবে। সালতি নিয়ে এ দিক-ও দিক করবে সবাই। খাওয়ার কষ্ট। জলের কষ্ট। উনুন জ্বলতে চাইবে না। প্রচুর মাছ পাবে সকলে কিন্তু সেই মাছ ফেলে দিতে হবে কারণ মাছ ভাজার মতো তেলও পাওয়া যাবে না। সকলের ভাঁড়ারই প্রায় শূন্যে ঠেকবে তখন। গোরু-বাছুরের ক্ষুরে ঘা হবে। গলা ফুলবে। নানা রকম অসুখ। মানুষেরও রোগ-বালাই বেড়ে যাবে। রূপসী ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে তখন।

খিলপাটনি গ্রাম থেকে সরাসরি মাথুরের গড়ের এই উদ্বাস্তু কলোনিতে ফিরে এল রাধিকা। স্মৃতির ভেতরই যেন সে জেগে ছিল। ঘুমিয়ে পড়ল এখন। যখন সে বাস্তবে এল। বর্তমানে ফিরল। এই কঠিন বর্তমান সম্পর্কে নিদ্রিত না থাকলে সে বাঁচবেই বা কী করে!

কার্তিকের খবর পাওয়া গেছে। সরাসরি তারই সঙ্গে কথা বলে এসেছে মাধব পাল। কার্তিক দায়িত্ব অস্বীকার করেনি। এখন আসতে পারার অক্ষমতা জানিয়েছে। না। কোনও কারণ দর্শায়নি সে। কাজের দোহাই দিয়েছে। মাধব পালের সন্দেহ, হৃদয়পুরে আর একটা বিয়ে করেছে কার্তিক। নাকি সে কোনও মেয়েছেলের সঙ্গে থাকছে আজকাল। যে কাঠগোলায় কাজ করে কার্তিক তারই একজন সেরকমই ইঙ্গিত দিয়েছে মাধবকে। কিন্তু কার্তিক নিজে কিছু বলেনি। সে মাধবের হাতে পঞ্চাশ টাকা দিয়েছে রাধিকাকে দেবার জন্য। রাধিকা টাকা নিয়ে চুপ করে বসে আছে। শ্যামলদের ঘরে শ্যামল, কমল ও পরমেশের মুখ রাগে টান টান। আশ্চর্য! আবার বিয়ে করেছে লোকটা! বুড়ো ভাম। বউটাকে এ অবস্থায় ফেলে রেখে ওখানে মজা লুটছে! একটা কচি মেয়ের সর্বনাশ করে আর এক জনকে জুটিয়েছে। শেফালির মা এক কোণে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বসেছে। কাঁদছে। শব্দ নেই। ভরা গঙ্গার মতো অফুরন্ত জল। মানুষের কান্না ফুরোবার নয় বলেই বোধহয় অশ্রুর উৎস কোনওদিন শুকোয় না।

নির্বাক হয়ে আছে শেফালির মা। ভাবছে। যেমনই হোক কার্তিক—বুড়ো-ঝুরো-নিষ্ঠুর— এতদিন রাধিকার গতি কী হবে তাই নিয়ে ভাবতে হয়নি। কিন্তু এখন সামনে শুধুই অন্ধকার। কার্তিক যদি ফিরে না আসে ছেলেপুলে নিয়ে কী করবে মেয়েটা!

আর সকলের রাগ ক্ষোভ দুঃখ প্রত্যক্ষ করে রাধিকা নিজের ঘরে বসে ভাবছে—এটা কি খুবই দুঃখের কথা, শোকের কথা যে কার্তিক হৃদয়পুরে আলাদা বিয়ে করেছে? আপাতত পঞ্চাশ টাকা পেয়ে তার আর যেন দুঃখ নেই। কিংবা কার্তিক সম্পর্কে, প্রকৃতপক্ষে, সুখ-দুঃখের কোনও বোধই নেই তার। তার কপাল খারাপ—শেফালির মা বারবার বলে এ কথা। কিন্তু খিলপাটনি গাঁয়ে এমন কপাল কি আর দেখেনি সে? শ্যামলীদির ছেলে-পুলে হচ্ছিল না বলে তাকে বাপের বাড়িতে রেখে গেল তার বর। আবার বিয়ে করল। শাকিনার কথাই ধরা যাক। সেও ছিল তালাক-পাওয়া দুঃখী মেয়ে। সেইসব তালাক পাওয়া বা স্বামীতে ফিরিয়ে দেওয়া মেয়েদের কান্না অনেকদিন ধ্বনিত হয়েছে খিলপাটনি গাঁয়ে। হিন্দু আর ক’ঘর ছিল খিলপাটনিতে! বেশির ভাগই মুসলমান! তাদের প্রায় ঘরেই মেয়েরা তালাক পেয়ে ফিরে আসে। কখনও আবার তাদের বিয়ে হয়। কখনও হয় না। অনেক সময় সন্তান সমেত ফেরত আসে তারা। রাধিকা দেখেছে, হিন্দু মেয়েরা একবার সন্তান দিতে পারলে বেশ থিতু হয়ে যায় শ্বশুরবাড়িতে। সম্পর্ক যতই কোদালে-কুড়ুলে হোক, যতই অবহেলার হোক, শ্বশুরবাড়ির স্থান পাকা। বুঝি সন্তানের মাধ্যমে তারা দৃঢ় শেকড় চারিয়ে দেয় ওই পরিবারে। মুসলমান মেয়ের সেই জোর নেই। কোথাও স্থিতি নেই তাদের। হঠাৎ হাসি পায় তার। নিজের কতটুকু স্থিতি সে দেখতে পাচ্ছে এখন? হিন্দু মেয়ে সে, সন্তানবতী এবং সন্তানসম্ভবা— এমতাবস্থায় কার্তিক অন্য মহিলা নিয়ে সহবাস করছে। খোঁজ রাখছে না রাধিকা আর পলাশ মরল না বাঁচল। পাড়া-প্রতিবেশী তার খবর খুঁজে আনছে। দয়াভিক্ষা চাইবার মতো বা প্রাণভিক্ষা চাইবার মতো তারা এনে দিচ্ছে রাধিকার রাহা খরচ। সুতরাং তার ও শাকিনার স্থিতিহীনতার কোনও তফাত নেই। সে অনিবার্য পরিণামে ভাবে—সে যদি শমসেরের বউ হত, এ অবস্থায় শমসের কি তাকে ছেড়ে চলে যেত? তালাক দিত তাকে? না না। দিত না। শমসের কখনও এরকম করতে পারত না। সে অন্যরকম ছিল। সে তো ভালবাসত রাধিকাকে। অতল গভীরতায় ভালবাসত। তেমন ভালবাসা আর কেউই দেবে কি রাধিকাকে? কোনওদিন? ভালবাসা। ভালবাসা। ভালবাসা। সংসারের মূল কথা এটাই। এটি থাকলে হিন্দু বলো আর মুসলমান, বৌদ্ধ বলো, জৈন বলো আর খ্রিস্টান—যে-কোনও সংসারই ফুলে-ফলে বিকশিত হয়ে পৃথিবী অলঙ্কৃত করে। ভালবাসা না থাকলে সব শেষ। সবই অস্থায়ী ও ভঙ্গুর।

কার্তিকের তো ভালবাসা নেই। মায়া নেই। শুধু শরীরকে দলে পিষে আশ মিটিয়ে সে ক্লান্ত অজগর হয়ে যায়। সে-ই এ সব পারে। যে কখনও দুয়ার ঠেলে ঘরে এল না সে কেমন করে বুঝবে আঙিনার কী টান! কার্তিক রাধিকার বাইরেটাই দেখল শুধু। শরীরটাই দেখল। কিন্তু চিনল বলা যাবে না। কার্তিকের হাতের তলায় রাধিকা কোনওদিন জাগেনি যেমন জাগার কথা ছিল তার বসন্ত-শরীরের। তার মনে আছে, খিলপাটনি গাঁয়ে তাদের গাভীগুলিকে এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছিল যাতে একটি গাভীন হয়ে দুধ বন্ধ করলে অন্যটির বাচ্চা দিয়ে দুধেল হওয়ার সময় আসত। মনে মনে তুলনা করে ফেলে রাধিকা। কার্তিকের হিসেবটাও অনেকটা সেইরকম। হঠাৎই আহত অপমানে দগ্ধে যায় সে। নিজেকে ওই গোয়ালের গাভীগুলির চেয়েও অসহায় ও নিষ্প্রোয়জন লাগে। এই ছেলে নিয়ে, গর্ভস্থ সন্তান নিয়ে কীভাবে দিন চলবে তার? শেফালির মায়ের মতোই দুঃখী হয় সে। নিজের পোড়াকপালকে করুণা করে। হাতের পঞ্চাশ টাকা পেষণ করে অনেকক্ষণ। দোমড়ায়। অসহ্য গরমে হাঁস-ফাঁস করে। ভারী শরীর দ্বিগুণ গরম হয়ে যায়। অসহায়তায়, অপমানে, যন্ত্রণায় পাগল-পাগল লাগে রাধিকার। ঘরের ছোট জানালাটি দিয়ে বাইরে উঁকি মারে সে। অন্ধকার জমে আছে পুকুরে। ওখানে অপদেবতার বাস। সে মনে মনে অপদেবতার কাছে গর্ভস্থ সন্তানের মৃত্যুকামনা করে। সে যদি ভূমিষ্ঠ হয়, আর রাধিকা তাকে খাওয়াতে ও প্রতিপালন করতে না পারে, তবে সে এমনিতেই মারা যাবে। সেই মৃত্যু দেখার চেয়ে সে আগেই ধ্বংস হয়ে যাক। অসম্ভব অসংহত ভাবনায় তার চোখে জল আসে। পলাতকার মতো খিলপাটনি গাঁয়ে ফিরতে চায় সে। শমসেরের কাছে ফিরতে চায়। স্বপ্ন দেখে—শমসেরের হাত ধরে পালিয়ে যাচ্ছে। কোথায়? জানে না কেউ। শমসের বলছে — ‘তরে বিয়া করুম রাধু।’ শমসের ঢাকায় চলে যাচ্ছে। রাধিকা কাঁদছে।

তখন, সারা আকাশ, শমসেরময় হয়ে আছে রাধিকার। সে শমসেরে জাগে, শমসেরে ঘুমোয়। শমসেরে মরে আবার বাঁচে শমসেরের জন্যই। সে যখন গোয়াল পরিষ্কার করছে, মনে হচ্ছে, ওই তো ওই কোণে শমসের। সে রূপসীর পাড়ে যাচ্ছে, জামরুলতলায় বসছে, যেন এই পায়ের শব্দ পেল শমসের আসছে। আকাশ ভেঙে বর্ষা নামল। রূপসীর গর্ভ উপচায়। উঠোনে জল। জমিতে জল। পথে জল। পানি, পানি, পানি—সর্বত্র। জলে জলময় ভুবন। শমসেরদা, তুমি কেমন করে এই পানিপথ পেরিয়ে আসবে? শমসেরদা, আমার কথা ভাবো না তুমি? শমসেরদা, শমসেরদা, ও শমসেরদা—

যে দিন হইতে      তোমার সহিতে।
পহিলে হয়েছে দেখা।
সে সব বচন   রয়েছে ঘোষণ
যেমত শেলেরই রেখা॥
শপথি করিয়া  পীরিতি করিলে
তাহা বা রাখিলে কই।
কে আছে ব্যথিত      কাহারে কহিব
যে দুখে আমরা রই ॥

রাধিকা দিবারাত্রি শমসেরকে ভাবছে আর চোখের সামনে দেখছে শমসেরকে। পরমেশের মধ্যে দেখছে। সকালবেলায় স্নান করছে পরমেশ। রাধিকা দেখছে। খোলা গায়ে জল পড়েছে। আলো ঠিকরোচ্ছে। প্রতিটি নড়াচড়ার সঙ্গে সঙ্গে পেশিগুলি ফুলে উঠছে। রাধিকা ভাবছে—

বিস্তারি পাষাণে কেবা       রতন বসাইল রে
এমতি লাগয়ে বুকের শোভা।
দাম-কুসুমে কেবা     সুষমা করেছে রে
এমতি তনুর দেখি আভা॥
আদলি উপরে কেবা   কদলী রোপিল রে
ঐছন দেখি উরুযুগ।

পরমেশ কী সুন্দর! কিন্তু পরমেশ কালা নয়। তাকে দেখে নীলকণ্ঠ পাখির কথা মনে পড়ে না। সে বুঝি শ্রীগৌরাঙ্গরূপ এখন। তার সাদা বুকে পরিণত থানকুনি পাতার মতো রোম। নিপুণ হাতে বুকে দু’খানি চুনি বসিয়ে দিয়েছে কেউ। গলা উঁচু করে জল ঢালছে সে গায়ে। কম্বু জিনিয়া কেবা কণ্ঠ বনাইল রে—পরমেশ ভিজছে। রাধিকাও ভিজছে মনে মনে। ভিজে একসা হয়ে শঙ্খের মতো কণ্ঠে ঠোঁট ডুবিয়ে দিচ্ছে। ওই কন্ঠে ওই উঁচু হয়ে থাকা হাড় পান করার কথা ভাবতে ভাবতে হাতুড়ি দিয়ে কয়লা ভাঙছে রাধিকা। ঠং ঠং ঠং। এ সব কাজে কষ্ট হয় এখন। ভারী শরীর। পেটের মধ্যে সন্তান খলবল করে। পেটের বাইরে সমস্ত অপদেবতার কূট-কচালি। মনের মধ্যে টল টল করে স্বপ্ন, স্মৃতি এবং স্বপ্ন মাখানো স্মৃতিকোরক। আজ রাধিকার ভাল লাগছে। কষ্ট করতে ভাল লাগছে। অনেকদিন পরে আজ কারও কাছে কিছু চাইতে হবে না। করুণার দান, দয়ার খাবার খেতে হবে না। উনুনে আঁচ দিয়ে বাটি হাতে ঘরে ঘরে যায় রাধিকা। চাল শোধ করে। কার্তিকের অবহেলা ও অপমান থেকে সম্মান সংগ্রহ করে সম্মান নিয়ে বাঁচতে চায়। বাজার করে দিয়ে গেছে শ্যামল। চাল, ডাল, তেল, নুন, চিঁড়ে, চিনি পুঁইডাঁটা, কুমড়ো, আলু আর ঝিঙে। আজ পুঁইডাঁটার চচ্চড়ি আর ভাত। শেফালির মাকে পুঁইডাঁটা রান্না করে দেবে রাধিকা। তার মনে হচ্ছে একটু কুচো চিংড়ি যদি আনাত। একটি দিন সুস্বাদু রান্না করে বাটিভর্তি পুঁইচচ্চড়ি দিত শেফালির মাকে। ভাত না। ডাল না। তার স্নেহ, করুণা, দয়া ও প্রতিদিনের ভালবাসার ভাতের বিনিময়ে রাধিকা শুধু এটুকুই দেবার সংকল্পে অসীম তৃপ্তি পাচ্ছে এখন। আজ হাঁড়িতে বেশি করে চাল দেবে। পলাশের জন্য একটা আলুসেদ্ধ। তারপর? এই চাল ফুরিয়ে যাবে একদিন। আলু ফুরোবে। পুঁইডাঁটা, ঝিঙে, কুমড়োর পরিবর্তে সবজির ঝুড়িতে পড়ে থাকবে কয়েকটি শুকনো লঙ্কা। রাধিকা যত্ন করে সেগুলির বোঁটা ছাড়িয়ে রেখেছে। তাই সহজে পচন ধরবে না। কিন্তু সবই যে ফুরিয়ে যাবে—তার উদ্বেগ সে কী করে অস্বীকার করবে! যেমন মুগ্ধ উন্মাদ যৌবন থেকে দ্রুত ফুরিয়ে যায় আয়ু এবং পৌঁছে দেয় অনিচ্ছার অনাকাঙ্ক্ষিতর বার্ধক্যে! তেমনই, সাময়িক সম্পন্নতার ভাঁড়ার থেকে চাল শোধ করে এসে রাধিকা আবার কয়লা ভাঙতে বসল। অন্যমনস্কতায় নখে হাতুড়ির বাড়ি পড়ল। ব্যথায় কাতর হল সে। উঃ শব্দ হল মুখে। একটি হাত দিয়ে অন্য হাত চেপে ধরল। পরমেশ গা মুছে সূর্যস্তব করছিল। প্রণাম শেষ করে বলল, কী হয়েছে বউদি?

—হাতে বাড়ি দিসি।

—আহা! জল দাও। জল দাও বউদি। রক্ত পড়ছে? রাধিকা হাত মেলে ধরল। না। রক্ত পড়ছে না। তবে টন টন করছে। জলের ধারা দেবে বলে কলের কাছে এগিয়ে এল সে। পরমেশ পাশে দাঁড়াল। বড় পেছল জায়গাটা। রাধিকার পক্ষে বিপজ্জনক। সে বলল, সাবধানে বউদি!

সে কিছু না করে চুপ আছে। থেমে আছে। যেন রাধিকা যত্নে হাত ধুলো কিনা, যথাযথ আরাম পেল কিনা দেখার দায়িত্ব তার। এমনকী রাধিকা ঠিকমতো উঠোন পেরুল কিনা সে দেখার দায়ও তার ওপর বর্তায়। রাধিকা আড়াল থেকে পরমেশকে দেখেছে কতবার, কতদিন। অথচ এখন, পরমেশ তার পাশে, সে লজ্জায় গুটিয়ে যাচ্ছে। পরমেশের দিকে তাকাতে পারছে না। কিন্তু তাকাতে ইচ্ছে করছে। ইস্‌! তার আঙুলটা কেন ছেঁচে গেল না! কেন দরদর ধারায় রক্ত বইল না! পরমেশ হয়তো ছুটে আসত তাহলে। একটু ছুঁত রাধিকাকে। রাধিকার হাত নিজের হাতে ধরে থাকত।

রাধিকা মুখ তুলতে পারছে না। রাধিকা যেতেও পারছে না। তার ইচ্ছে করছে পরমেশের ওই চেয়ে থাকার সামনে অনন্তকাল স্থির থাকতে। যেন-বা, সত্যসাধনের পঠন-পাঠন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নেমে এসেছে সেই কবেকার আকুল ইচ্ছার ধ্বনি—

কানু সে জীবন      জাতি প্রাণ ধন
এ দুটি নয়ান-তারা।
হিয়ার মাঝারে পরাণ-পুতলি
নিমিখে নিমিখ হারা॥
তোরা কুলবতী ভজ নিজপতি
যার মনে যেবা লয়।
ভাবিয়া দেখিলাম      শ্যাম বঁধু বিনে
আর কেহ মোর নয়॥

এই অংশ পড়তে পড়তে সত্যসাধন ভাবাবিষ্ট হয়ে যেত। তার চোখে জল আসত। আহা! কেমন সব ভুলে, সব তুচ্ছ করে, ভয়-ভাবনা জলাঞ্জলি দিয়ে ভালবেসেছিল মেয়েটা। রাধা— সে তো স্বয়ং লক্ষ্মী। কৃষ্ণ— সে তো বিষ্ণু স্বয়ং। নারায়ণ। নারায়ণের পাশে লক্ষ্মীর বাঁধা জায়গা। রাধিকা ভাবত, ও, রাধার বেলায় সব মাপা। মোটেই ভাল চরিত্রের মেয়ে নয় সে। স্বামী থাকতে আনজনে পিরিতি করে। তারে ক্যামনে ভাল কই! কিন্তু স্বীকার করতেই হবে। সাহস ছিল শ্রীরাধার। এসব ভাবতে ভাবতে রাধিকার চোখে আসলে অসামান্য হয়ে উঠেছে শ্রীরাধা। কী সাহস! কী আশ্চর্য প্রত্যয়! সরাসরি বলছে— আমি ভালবাসি ওকে। আর কিছু নয়। লোকভয় নেই। নিন্দার পরোয়া নেই। কারওকে অস্বীকার করেনি। বলছে— হ্যাঁ, স্বামী আছেন আমার। শ্বশুরকুলে বাস আমার। ননদিনী প্রহরারত। তবু আমি কালা বিনা অন্ধ। কানু বিনা মৃত। কৃষ্ণ বিনা আমার জীবন যেন-বা অর্থহীন। তোমরা কুল মানো। নিয়ম মানো। শাসন মানো। আমি মানব না কিছুই। যে শাস্তিই আমাকে দাও— আমার ওকে চাই। ওকে। শ্রীরাধাকে ভালবেসে ফেলেছে রাধিকা। কী সাহস! কী প্রত্যয়! কই সে তো পারছে না! কাকির ভয়ে সিঁটিয়ে আছে সর্বক্ষণ। অথচ সে তো চায় শমসেরের জন্য কুল ছাড়তে, গ্রাম ছাড়তে, এমনকী ধর্ম ছাড়তেও। কিন্তু বলতে পারল কই!

রাধিকা আবার ডুবেছে। খিলপাটনি গাঁয়ের স্মৃতিতে ডুবেছে। সে-গাঁয়ের উঠোনে জল ভরে গেছে। সালতিগুলি বাঁধা আছে দাওয়ার খুঁটির সঙ্গে। পেয়ারা গাছের সঙ্গে। সত্যসাধনকে খেতে দিয়েছে কাকি। খেতে বসিয়ে বলছে— পোলা দ্যাহেন। মাইয়া ডাগর হইসে। অর ভাব-চলন আমার মনে ভাল লয় না। কুনদিন কী কইরা বসব। মুখ দ্যাখাইতে পারুম না কারুরে।

সত্যসাধন বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। কী করেছে রাধিকা! খারাপ কিছু? ওকে যে বোঝাবার কেউ নেই। মা সব বোঝাবুঝির বাইরে। কাকি স্নেহ জানে না। শাসন করে শুধু। কাকা উদাসীন। নিস্পৃহ৷ মাসি-পিসি নেই। সত্যসাধন নিজে ঘুরে বেড়ায় আপনভোলা। চাল-চলন ঠিক না থাকলে পাড়া-পড়শি নিন্দে-মন্দ করবে। নালিশ-সমালোচনা করবে। কাকি বলছে, শমসের ছোকরাডা অর আগে-পিসে ঘুর ঘুর করে। কী করতেয়াসে ক্যাডা জানে!

রাধিকার বুক দুর দুর করছে। কাকি বাবাকে খেতে দিয়ে এইসব বলছে। রূপসীর ওপর দিয়ে কোনও বড় নৌকা গেল বুঝি! জল দুলছে। ছপ ছপ শব্দ হচ্ছে। রাধিকা পিছনের বারান্দায় আড়ি পেতেছে। তার খুড়তুতো ছোটভাই শঙ্কর তাকে ডাকছে, দিদি। অই দিদি। শমসের দাদায় তরে যাইতে কয়।

নিজের অজান্তে মুখে আঙুল উঠে আসে রাধিকার, চুপ। চুপ যা। কাকি শুনব।

শঙ্কর হাসছে, হি হি হি। শমসেরদায় তরে ভাঙা মন্দিরে যাইতে কইসে। বিকালে চাইরটার সময়। দিদি। গাছে দুইখান প্যায়রা ডাসা হইসে। আমারে পাইড়া দে।

কী কথা হয়ে গেল কাকিতে-বাবাতে! সব কথা খসে খসে পালিয়ে যাচ্ছে। শঙ্করের বকবকানিতে শোনা যাচ্ছে না। সে বিরক্ত হয়ে বলছে, হ। দিমু অনে। অখন যা।

—না। আমারে অখনৈ দিত হইব।

—আঃ। জ্বালাইয়া মারে দ্যাখো।

—অ। দিবি না? তখন দিবি না? দাড়া। মায়রে কইয়া দিমু। সব কইয়া দিমু।

সন্ত্রস্ত হচ্ছে রাধিকা। কী বলে দেবে ও? মন্দিরতলায় যাবার কথা? আড়ি পেতে কথা শোনার খবর? সে তাড়াতাড়ি শঙ্করকে কাছে টানছে। মিষ্টি করে বলছে, রাগ করস ক্যান? আমার মাথা খা। দিমু কইসি না?

শঙ্করের চোখ ছল ছল করে, হ। তুই কইস পরে দিবি। দাদায় দেইখা ফালাইলে আমার খাওনের লিগা থুইব?

রাধিকা বিপদে পড়ে। এই ভেজা গাছ— চড়ার উপায় নেই। এই বর্ষায় কোথাও একটা ডাং পাবার উপায় নেই। সে বলে, কী দিয়া পাডুম ক’।

—চালে উঠ।

—উইঠা হাত পামু?

—হ। পাবি। নাইলে আমারে চালে তুইল্যা দে। আমি পাইড়া নিমু।

রাধিকা সম্মত হয় না। এই ভেজা চালে শঙ্করকে তোলা উচিত হবে না। সে বলে, হ। তর আর উইঠ্যা কাম নাই। আমিই উঠতেয়াসি। দ্যাখা।

শঙ্কর রাধিকার হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে। পেয়ারা দেখাচ্ছে। এই গাছটা অদ্ভুত। সারা বছর ফল দেয়। ঝাঁকড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেওয়াল ঘেঁষে। তার ডালপালা সব চালে বিছিয়ে দিয়েছে। রাধিকার নানা ভয়ে বুক সিরসির করছে। সে আবার জিজ্ঞেস করছে, আর কী কইল শমসেরদায়?

—কইল, তর দিদিরে ক গিয়া চাইরটায় মন্দিরতলায় আইব। আমি কই— কুন মন্দির? শমসের দাদায় কয় ভাঙা মন্দিরে ক’।

—হ। আর কী কইল?

—আমারে লজেনছ্‌ দিয়া কইল, ঢাকার থিকা আনছি। খাইয়া দ্যাখ।

—খাইলি?

—হ। কী মিষ্টি যে লাগে! তরেও দিবে কইসে। যাইস।

রাধিকার হাসি পাচ্ছে। ভয়ও করছে। শমসের কেন শঙ্করকে দিয়ে ডাকতে গেল? শঙ্কর যদি বলে দেয় কাকিকে? সে আর পারছে না। যা হবার হবে। আঁচলটা শক্ত করে বেঁধে নিল সে কোমরে। একটা পা জানালায়, একটা খুঁটিতে। চালের কাঠ ধরে সে শরীরটা শূন্যে ভাসিয়ে দিল। শুধু হাতে ভর দিয়ে চালে উঠছে। হাত কাঁপছে। ভেজা চাল। ভেজা কাঠ। বাঁ হাঁটু ভাঁজ করে চালে রাখছে রাধিকা। ডান পাও টেনে নিল। এখন চালের ওপর সে উবু। শিকার পর্যবেক্ষণরত বেড়ালীর ভঙ্গি। টলে টলে উঠে দাঁড়াচ্ছে এখন। দু’হাত দু’পাশে ছড়িয়ে ভারসাম্য বজায় রাখছে। পেয়ারা গাছের ডালে ধাক্কা লাগল। জল পড়ছে। রাধিকা ভিজে গেল। কোথায় পেয়ারা? কোথায়? হ্যাঁ। চোখ আছে বটে ছেলেটার। দু’টি ডাঁসা পেয়ারা ডালপাতার আড়ালে ঝুলছে। পাতাসুদ্ধ ছিঁড়ে নিল সে। কী সুন্দর গোল মসৃণ পেয়ারা! একটি খেতে লোভ হচ্ছে তার। বলছে, আমি অ্যাকখান লই?

—না, না-আ-আ। শঙ্কর উবু হয়ে বসে পড়েছে। গলা তুলে আপত্তি করছে। না-আ-আ। আমি দিমু না।

রাধিকা তবু বলছে, অ্যাকখান দিবি না? শঙ্কর?

—না। দিমু না। আমি দ্যাখসি। অই দুইখানৈ আমার। দে আমারে দে। অ মা।…সে বুঝি আছাড়ি-পিছাড়ি খেতে চায়। রাধিকা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সে চালে উঠেছে দেখলে কাকি চিল্লাবে। তার আর দু’টি ভাই সালতি নিয়ে মাছ ধরতে বেরিয়ে পড়েছে। সেও যেতে চেয়েছিল। গিয়েওছে গত বছরে। কিন্তু এ বার কাকির মানা। ধিঙ্গি হইছস। অখন ড্যাং ড্যাং কইরা মাছ ধরতে যাওন। সে অতএব শঙ্করকে থামাতে চায়, লমু না। লইতাছি না। তর প্যায়রা তুই খা। ধর।

সে শঙ্করের দিকে পেয়ারা ছুঁড়ে দিল। শঙ্কর লুফে নিল ঠিকঠাক। হঠাৎ কী মনে হল তার, বলল, আইচ্ছা। অ্যাকখান তুই খা।

—না। লাগব না।

কাকির চিৎকার শোনা গেল তখন। শঙ্কু— অ শঙ্কু—!

যাইতাছি—। শঙ্কর ছুট লাগাল। পেয়ারার ডালপালা থেকে মুখ তুলল রাধিকা। আঃ! চোখ জুড়িয়ে গেল তার। জল জল জল। দিগন্তবিস্তৃত পানি। ঘরবাড়ি জেগে আছে শুধু। রূপসীর পাড় দিয়ে দূরে দূরে বড় বড় বাঁশ পোঁতা। নদীর সীমাচিহ্ন। নইলে নদীর সঙ্গে পারের কোনও তফাত নেই এখন। এইসব বাড়িঘর যেন জলেই নির্মিত হয়েছিল কোনওদিন। আকাশে মেঘ আছে। কিন্তু ভারী বর্ষণ হবার মতো নয়। মেঘের ছায়ায় জলকে যেন শান্ত গম্ভীর আর বিষণ্ণ লাগছে। কী এক দুঃখ যেন ছড়িয়ে আছে চারপাশে। রাধিকা মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। জন্মাবধি প্রতি বর্ষায়ই এ দৃশ্য সে দেখে আসছে। কিন্তু এ যেন প্রথম দেখা। দূরে জামরুল গাছ ঝাঁকড়া মাথা নিয়ে জেগে আছে। তার তলায় বিষণ্ণ শ্রীরাধাকে দেখতে পাচ্ছে সে। কৃষ্ণ আসেনি বলে একা নিরানন্দ হয়ে আছে বুঝি। শমসেরদা তুমি আমারে আইজ মন্দিরতলায় ডাকলা ক্যান? এই বর্ষায় এই জলে তুমি আইলা কেমুন কইরা? শমসের এসেছে। শমসের ডেকেছে। রাধিকার আনন্দে ছুটে যাবার কথা ছিল। কিন্তু কোনও আনন্দ হচ্ছে না কেন তার? নাকি কাকির ওইসব কথায় অজানিত ভবিষ্যের সম্ভাবনায় তার মন ভার হয়ে গেছে। তার মনে পড়ে—

এ ঘোর রজনী      মেঘের ঘটা
কেমনে আইল বাটে।
আঙ্গিনার কোণে       তিতিছে বঁধুয়া
দেখিয়া পরাণ ফাটে॥
সই, কি আর বলিব তোরে।
বহু পুণ্যফলে  সে হেন বঁধুয়া
আসিয়া মিলিল মোরে॥

শমসেরদা। আইজ তুমি আমারে মন্দিরতলায় যাইতে কইলা ক্যান?

সত্যবন্ধু ফিরছে। বাঁশের লগি ঠেলেঠেলে এগিয়ে আসছে সালতি নিয়ে। ডাকছে— রাধু। অ রাধু। দড়িখান কই? অ রাধু—। রাধিকা নামছে। দ্রুত লাফ মারতে চাইছে। না, লাফানো যাবে না।

শরীরটা ঝুলিয়ে দিয়ে জানালায় পা রাখল সে। শরীর মুচড়োচ্ছে। পেরেকে লেগে শাড়িটা ছিঁড়ে গেল খানিক। খোঁপা খুলে গেল। সে ছুটছে। কাকা ডাকছে। সে ছুটছে। সালতি বাঁধবার দড়িটা কোথায়! কাকি গম্ভীর মুখে দেখছে রাধিকাকে। চোখ পাকাচ্ছে।

—চালে উঠসিলি?

—হ।

রাধিকা দড়ি এগিয়ে দিয়েছে। সালতি বাঁধছে সত্যবন্ধু।

—তরে কি কইসি! ধিঙ্গি হইছস। অজায়গায় কুজায়গায় যাবি না!

রাধিকা ঝাঁঝিয়ে উঠছে।

—কুনখানে গেসি? কুনখানে যাইতে দ্যাখসো আমারে? সক্কাল থিকা খালি মুখ নাড়া দ্যাও!

কাকির চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে। নাকের পাটা ফুলছে। দাঁতে দাঁত পিষছে সে। হিস হিস করছে— কী-ই। আমার খাবি। আমার পরবি। আমারেই চাইরখান কতা কবি! হাড়জ্বালাইন্যা শত্রু সব। তগো লিগা গতর সাইরা ফ্যাললাম আর তরা—! কয় না

মাইয়ার উঠে স্তন
মায় পায় না মন
পোলার উঠে দাড়ি
ঘুরে বাড়ি বাড়ি

তোমার হইল ওই দশা। খাড়াও। তোমার কুড়কুড়ানি বাইর করুম।

কুড়কুড়ানি। কাকির প্রিয় শব্দ এটা। রাগ হলেই বলবে, কুড়কুড়ায়? কী কাম করস সক্কাল থিকা? আটি বানছ?

ঘরে মা তখন দুলে দুলে কাঁদছে। আজ আবার মা’র অকর্মণ্যতা এসেছে। কাকির মেজাজ চড়ে আছে তাই। এই জলে মা অকর্মণ্য বসে থাকলে কাকির রাগ হওয়ারই কথা। রাধিকা মা’র দিকে দেখল। কী দুঃখিনী মুখ! রাধিকার মনে হল, কৃষ্ণ যখন শ্রীরাধাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, চিরদিনের জন্য, এমনই কি হয়ে যায়নি তখন রাধিকা? এমনই ক্লিষ্ট? বিধুর? ক্রন্দসী? অকর্মণ্য?

ওহে বড়াই তাহার বিষম জ্বরা।
কিছু নাহি খায় সে তেজয়ে কায়
পাঁজ হৈয়াছে সারা॥
শুনি কি না শুনি       যেন সরু বাণী
যেন রুধিরের ধারা।
কনক বদন    হৈয়াছে মলিন
চকিত লোচন তার॥
শ্রবণ নয়ন     করে অনুক্ষণ
যেনক শায়ণ ধার।
নেতের বসনে  মুছিবে কেমনে
এত বল আছে কার॥

মন্দিরতলায় ঝুপসি বটগাছের নীচে সালতি ভিড়িয়েছে দু’জনে। রাধিকা বলছে, আমারে মন্দিরতলায় ডাকলা ক্যান?

—তর লগে কথা কমু রাধু। তরে দেখুম।

ক্রমশ মেঘ নেমে আসছে। অন্ধকার ক্রমশ ঢুকে পড়ছে বটগাছের তলায়। সালতির নীচে পাক খাচ্ছে স্বাধীন সাবলীল মাছ। মন্দিরের শিবলিঙ্গ আগলাতে আগলাতে ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে বেলপাতার গুচ্ছ। আর রাধিকা, যত সময় সে শমসেরের জন্য প্রতীক্ষা করেছে, যত সময় সে শমসেরকে চেয়েছে, যত সময় শমসেরের জন্য মিথ্যাচার করেছে সেইসব সময়ের সমষ্টিগত অভিঘাতে, সেইসব না পাওয়ার মুহূর্তের ক্ষোভে যন্ত্রণায়, বুঝি-বা কিছু অভিমান জমিয়ে রেখে ক্রমশ উত্তাল হয়ে উঠছে। তার বুকের তলায় কোনও প্রাণ যদি থাকে, কোনও চোখ যদি থাকে তার সে যেন দেখতে পাচ্ছে উপছানো রূপসীর সঙ্গে, এই মুহূর্তে রাধিকার কোনও পার্থক্য নেই। তবু আপাতভাবে তাকে শান্ত দেখায়। নিস্পৃহও কিছুটা। শমসেরের প্রতি, এখন, নিরাসক্তি ফুটিয়ে তুলতে, বালিকা থেকে তারুণ্যের উন্মোচনে পৌঁছনো ওই মেয়ে সম্পূর্ণভাবে সফল। তার সালতি দুলছে। মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। বটের ঝুড়ি ধরে তারা দু’জন যে-যার সালতি সামলাচ্ছে। রাধিকা দেখছে। শমসের, কেমন অন্যরকম দেখায় তাকে। ঢাকায় গিয়ে, কলেজে ভর্তি হয়ে তাকে কেমন পরিপাটি লাগছে। তার গালের দাড়ি আরও গাঢ়। আরও পৌরুষেয়। তার পাঁজরের গড়ন বিকশিত হচ্ছে। শমসের, সাঁপুড়ে যেমন বিণ দ্বারা সাপিনীকে বশীভূত রাখে, মুগ্ধ রাখে, তেমনি যে-বাঁশি এখনও বাজেনি, তারই দ্বারা রাধিকাকে বশীভূত রাখছে। আর রাধিকা তাকিয়ে আছে। শমসেরকে দেখছে। শমসের তাকিয়ে আছে। রাধিকার উড়ো চুল, নিপুণ ঠোঁট আর চাপা নাকের সমন্বয়ে চোখ দু’টি দেখছে। রাধিকা তুই কেন কাজল দিসনি চোখে? শীর্ণ কণ্ঠ তার নিরাভরণ। রাধিকা কেন এক ছড়া হার, হয়তো গিলটিরই হল, হয়তো পুতির, গলায় দিসনি তুই! শীর্ণ, রিক্ত হাত দু’খানি তার, ক’খানি কাচের চুড়ি কিনে দেয়নি কেউ তোকে? হলুদ ব্লাউজে কাঁধ ঢেকে আছে। লাবণ্য এত! সৌন্দর্য এত! শমসের দেখছে। রাধিকা, থেমে থাকা মুহূর্তের তল থেকে বলল—ঢাকায় গ্যালা, কইয়া গ্যালা না ক্যান?

জল পড়ছে। বট পাতার থেকে ঝরে পড়ছে। না। ওই আবার বৃষ্টি নামল।

—রাধিকা, তুই কি চেয়েছিলিস্‌ আমাকে? খুঁজেছিলিস্‌?

—হ্যাঁ। খুঁজেছিলাম।

—কোথায়?

—রূপসীর পারে।

—আর কোথায়?

—জামরুল গাছের তলায়।

—আর কোথায়?

—তোমাদের আঙিনায়।

—আর কোথায়?

—অন্ধকারে। একলা। স্বপ্নে।

—আর কোথায়? বুকের ভেতর? সেখানে খুঁজিসনি? আমি যেমন তোর গন্ধ পাই। রাধিকা। তুই তেমন গন্ধ পাস না আমার?

বৃষ্টি পড়ছে। দু’-এক ফোঁটা। এবার চড়বড় করে। এবার জোর ধারায়। রাধিকা ছটফট করছে। সে যদি ভিজে যায়, ভিজে বাড়ি ফেরে, কী হবে? সে শমসেরকে আহ্বান করে, চল, সালতি বাইন্ধা মন্দিরে যাই।

শমসেরের কানে বাজে— চল যাই… চল যাই… যেন-বা রাধিকা তাকে জীবনের মহাযাত্রায় যাবার ডাক দিচ্ছে। যেন, এই বর্ষণ, এই টই-টম্বুর পানি, এই ঝুপসি বটতলা আর ভাঙা মন্দির— মহাবিশ্ব ও মহাকালের মতোই অমোঘ ও পূর্বনির্দিষ্ট। শমসের ও রাধিকার জীবনে এর বাইরে আর কিছু ঘটার কোনও উপায় নেই। এক নিরুপায় উপলব্ধি শমসেরকে আচ্ছন্ন করে। সেই নিরুপায় অবস্থা এক নারীর প্রতি এক পুরুষের উন্মাদ অবিচ্ছেদ্য টান— যা থেকে— শমসের টের পায় সে আর নিজেকে পৃথক স্বীকার করতে পারবে না। রাধিকা বাদ দিয়ে সে এক অসম্ভব। বুকের ভেতরকার নিটোল মহাধমনীর মতো।

ফের রাধিকার স্বর ছিটকোয়— চুপ কইরা কী দ্যাহো? অ শমসেরদা! আস, আস। আস-অ-অ-অ।— আমু-উ-উ। আইতাসি—ই-ই-ই।

বুকের ভেতর থেকে এই স্বীকৃতি ঠেলে উঠতে চায়। কিন্তু বাইরে দ্বিধা আসে।

শমসের ইতস্তত করে, যামু না। আমি যামু না।

—ক্যান? আইসো। ভিজ্যা যাইবা।

মন্দিরের গায়ে সালতি ভিড়িয়ে বারান্দায় উঠে পড়ে রাধিকা। মন্দিরের খুঁটির সঙ্গে সালতি বেঁধে নেয়।

—আস। আইস্যা পড়ো।

তাড়া দেয় সে। শমসের ভিজে যাচ্ছে। সেও লাফিয়ে উঠে আসছে মন্দিরে। দড়ি বাঁধছে রাধিকার দড়ির সঙ্গে। আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে যাচ্ছে বিদ্যুতের ঝাড়। মেঘ ডাকছে, শমসের ভাবছে। এত বেলায় এখানে রাধিকাকে আনা ঠিক হয়নি। এই বৃষ্টি কখন থামবে কে জানে! রাধিকা ভাবছে শঙ্কর যদি বলে দেয়? যদি তার ফেরার দেরি দেখে কাকি চেঁচামেচি করে আর শঙ্কর বলে দেয়—দিদি মন্দিরতলায় আছে। শমসেরদার সঙ্গে আছে!

প্রবল হাওয়া উঠছে। বৃষ্টির ছাঁট এসে ভরিয়ে দিচ্ছে মন্দিরের বারান্দা। হাওয়ায় শিবলিঙ্গের চারপাশের বেলপাতা ছড়িয়ে যাচ্ছে। রাধিকার শাড়ি উড়ছে। শমসের রাধিকার হাত ধরছে। আঃ। রাধিকা ডুবতে শুরু করল। কাকি নেই। শঙ্কর নেই। এই বাদলবাতাস আর রাধিকা। এই বৃষ্টির শব্দ আর শমসের। রাধিকা শমসেরের হাত আঁকড়ে ধরছে। শমসের ভুলে যাচ্ছে সে কোথায়, ভুলে যাচ্ছে এই মন্দিরে তার আসার কথা নয়। তার জ্বর আসছে। সে তার ডান হাত তুলে দিচ্ছে রাধিকার কাঁধে। রাধিকা শক্ত। আড়ষ্ট। তার মুখ শমসেরের বুকের কাছে। তার মুখ এমন জায়গায় যার একটু নীচে পাথর কুঁদে বসানো আছে দু’খানি আশ্চর্য চুনীরত্ন। সে শমসেরের গায়ের গন্ধ পাচ্ছে। কেমন এ গন্ধ? ধুতরো ফুলের মতো বুঝি। না না, জারুল ফুলের মতো। না। তার গন্ধ বুঝি-বা কোনও আশ্চর্য স্বপ্নের। এখন আর কোনও ব্যবধান নেই। শমসেরের শরীরের সঙ্গে মিশে আছে রাধিকা। এত শান্তি! এত শান্তি! তার ঘুম পাচ্ছে। শমসেরের সারা শরীরে রক্ত চলাচলে পাগলা ঘোড়ার খুরের শব্দ। সে, তবু, বেহিসেবী হচ্ছে না, ধীরে ধীরে মুখ নামিয়ে আনছে। রাধিকার ঘাড়ের কাছে ছোট চুর্ণ চুলের গুচ্ছে ঠোঁট ডুবিয়ে দিচ্ছে। আঃ। রাধিকার সারা শরীর সিরসির করছে। সে বুঝি তা প্রতিহত করতে চায়। সে শমসেরকে শক্ত করে ধরছে। সারা শরীর টানটান করছে। তার স্তন তীক্ষ্ণ হয়ে ঢুকে যাচ্ছে শমসেরের পাঁজরে। সে বলছে—ছাড়ো। ছাইড়া দ্যাও। শমসের তার দাড়ি ঘষে দিচ্ছে রাধিকার গালে। ঠোঁট নেমে আসছে রাধিকার শুকনো উদ্বিগ্ন ঠোঁটে। আদিম স্বপ্নরা জেগে উঠছে তখন। শমসের নিজের ভেতরকার পুরুষ সম্পর্কে অবহিত হচ্ছে। তার পুরুষাঙ্গে অদম্য রক্তচলাচল। রাধিকাকে বুকে সাপটে, সমস্ত সুখ, সমস্ত আনন্দ উপলব্ধি করতে করতে অন্ধকারে ক্রমশ ডুবে যেতে থাকা শিবলিঙ্গের দিকে চোখ রেখে শমসের, এই প্রথম লিঙ্গপুজা সম্পর্কে একটি ব্যাখ্যা তৈরি করছে। সমস্ত প্রতীকের আড়ালে, আয়োজনের আড়ালে, অপার আনন্দের উৎসার লুকিয়ে থাকা মানবদেহকে মনে মনে, শ্রদ্ধা করছে শমসের। উপলব্ধিকে শ্রদ্ধা করছে। প্রেমকে শ্রদ্ধা করছে। অন্য ভাষায়। অন্য প্রক্রিয়ায়। তবু, এই প্রথম তার মনে হচ্ছে, সব মানুষই আসলে একটিই বস্তুর জন্য আরাধনা করে। তার নাম আনন্দ। সে ধীরে ধীরে রাধিকাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে দিল। শরীরী আহ্বান উপলব্ধি করতে করতে সে ভাবছে—এই অপার আনন্দ—যা সে পেয়েছে এই প্রথমবার—তার জন্য বেহিসেবী হওয়া চলে না।

বৃষ্টি ধরে এসেছে। রাধিকা বিহ্বল চোখে দেখছে। কী হল! যেন এতদিন, যা কিছু ঘটেছে সব, সত্য ছিল না। আজ এই বর্ষায়, জলমগ্ন সময়ে, এই সন্ধ্যায়, কোনও নতুন সত্যে তারা পা রাখছে। শমসের বলছে, তরে বিয়া করুম রাধু। কাইলৈ ঢাকায় যামু গিয়া আমি, তুই পথ চাইয়া থাকবি না? রাধু?

রাধিকা ফিসফিস করে বলছে, হ। বইয়া থাকুম। তোমার লিগ্যা। হ। অপ্যাক্ষা করুম তোমার লিগ্যা। হ—

শমসের পরম যত্নে হাত ধরে রাধিকাকে নামিয়ে দিচ্ছে সালতিতে। যেন, এই মুহূর্ত থেকে, রাধিকার, শমসেরের যত্ন একান্ত প্রয়োজন। দু’টি সালতি ভাগ হয়ে যাচ্ছে। দূরে চলে যাচ্ছে। দূরে, আবছা অন্ধকারে বাঁশের সীমানা দেওয়া রূপসী। রাধিকা দেখছে—একখানি সালতি ভেসে যায়। কে যায়! তার বুঝি লগি নেই। তার বুঝি আঁচল উড়ছে রাধিকার নজর যায়। মন যায় না। বৃষ্টি এখনও পড়ছে। ঝির ঝির পড়ছে। রাধিকাকে স্পর্শ না করে শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে তারা। বাষ্প হয়ে যাচ্ছে। রাধিকা ভাবছে। ভাবছে। ভাবছে।

আঁখি ঢুলু ঢুলু       ঘুমেতে আকুল
জাগিয়াছ বুঝি নিশি।
রসের ভরেতে  অঙ্গ নাহি ধরে
বসন পড়িছে খসি॥
এক কহিতে   আন কহিতেছ
বচন হইয়া হারা
রসিয়ার সমে  কিবা রস রঙ্গে
সঙ্গ হয়েছে পারা॥

১৯

আমার নাম তৃণাঙ্কুর কেন রেখেছিল, মা?

—সত্য বলে।

—কী সত্য?

—তৃণাঙ্কুর জন্মায়। দলিত হয়। কিন্তু ধ্বংস হয় না।

—আর?

—তৃণাঙ্কুর বিদ্ধ করে। মানুষদের বিদ্ধ করে।

—তুমি কোন সত্যের জন্য ব্যগ্র ছিলে মা? বিদ্ধ করার জন্য, নাকি জন্মে, দলিত হয়ে, ধ্বংস না হবার জন্য?

—দুই-ই।

—কিন্তু আমি তো একটা আলাদা মানুষ মা। আমার একটা পৃথক সত্তা আছে। তৃণাঙ্কুর। এই নাম রেখে তুমি আমাকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছ। আমি কোনওদিন, কারও সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে পারিনি। ঘনিষ্ঠ হতে পারিনি। এই নামটার মধ্যে একটা হলুদ বিবর্ণ জ্বলে যাওয়া, খা-খা হয়ে যাওয়া একলা তৃণভূমি আছে। আমাকে তুমি একলা করে দিলে কেন মা?

যিনি মা তিনি কিছুটা নিরাসক্ত, কিছু-বা ডুবে থাকা কোনও প্রাচীন যন্ত্রণায়। যে-যন্ত্রণাকে কোনও প্রশ্ন বিদ্ধ করে তুলে আনে না কোনও যথার্থ উত্তর। ঘরের দেওয়াল থেকে বিক্ষিপ্ত আলোর কণা অনিবার্য রচনা করে মা ও ছেলের মুখের প্রথাসিদ্ধ অন্ধকার। একদা একই রক্তমাংস হয়ে থাকা দু’টি বিচ্ছিন্ন মানুষ। বিচ্ছিন্ন কিন্তু নিকট। পরস্পর শোনেন পরস্পর নিকটজনকথা।

—তুই আমার প্রতিবাদ ছিলি তখন।

—কীসের বিরুদ্ধে?

—মৃত্যুর বিরুদ্ধে; তুই আমার সত্যের প্রতিষ্ঠা ছিলি।

—কোন সত্য?

—জীবনসত্য। জীবনের চেয়ে বড় কিছু নেই, এই সত্য।

—কিন্তু কেন তুমি বুঝতে পারোনি মা, তুমি আমাকে, তোমার বোধের জন্য, উপলব্ধির জন্য, এই আমাকে, তুমি, ব্যবহার করেছ। তৈরি করেছ। আমাকে স্বীকার করোনি। আমার নিজস্বতা স্বীকার করোনি।

—না। তোমাকে ব্যবহার করিনি আমি। আমি বিশ্বাস করেছি, তুমি আমার সত্তার অংশ। যখন আমার মৃত্যুর ইচ্ছে জাগত তখন জীবনের কাছে আমি তোকে প্রার্থনা করতাম। আমার জীবন শেষ হয়ে গিয়েছিল, তবু জীবনের টানে, তোকে সৃষ্টি করে, তোর ভিতর, আমার জীবনকে আমি চারিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। আমার লালিত জীবনবোধ যখন মিথ্যে হয়ে যাচ্ছিল, তখন ওই বোধের প্রতি অসীম মায়ায়, তোর মধ্যে আবার আমি তা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম।

—তার মানে, নিজের স্বার্থে তুমি আমাকে ব্যবহার করেছ।

—স্বার্থ! এর নাম স্বার্থ? এর নাম মাতৃত্ব। যুগ যুগ ধরে নারী যাকে অবলম্বন করে বেঁচে আছে। যুগ যুগ ধরে, এই একটি মাত্র উপলব্ধি, যা কেউ নারীর থেকে কেড়ে নিতে পারেনি। আমি আমার সন্তানের মধ্যে নতুন করে জন্ম নিয়েছি। এ তো স্বার্থ নয়! এ তো অধিকার। আমার সৃষ্টির প্রতি আমার অধিকার!

—সৃষ্টির প্রতি মানুষের ততদিনই অধিকার, যতদিন সে নির্মিত হচ্ছে। নির্মাণ হয়ে গেলে, সৃষ্টি তার নিজের।

—এটা কবিতার ক্ষেত্রে সত্য। শিল্পের ক্ষেত্রে সত্য। জীবনের ক্ষেত্রে সত্য নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সত্য নয়। তুই আমার ছেলে। আমার সন্তান। এই পৃথিবীতে তুই যেখানেই থাক, তোর এই আমার হয়ে থাকা কে কেড়ে নেবে? এমনকী তুই নিজেও তা কেড়ে নিতে পারিস না। অপত্য সম্পর্কের কাছে, সব দাবি ছাপিয়ে শেষ পর্যন্ত এই বোধটুকুই বেঁচে থাকে। এই অধিকারবোধ। এই অধিকারের সীমাবদ্ধতা মানুষের ক্ষেত্রে কখনও সত্য নয়।

—মানুষের ক্ষেত্রেও সত্য। মা। তুমি চিরকাল আমাকে তোমার সম্পত্তি হিসেবে ভেবেছ। আর আমিও, শুধুমাত্র, তোমাকে আঘাত দেব না বলে, তোমাকে অমান্য করব না বলে তোমার সম্পত্তি হয়ে থেকেছি, কিন্তু এখন আমি ক্লান্ত। আমার মনে হয়েছে, আমি একজন অসম্পূর্ণ মানুষ।

—তোমার ধারণা ঠিক নয়। তুমি একজন সৎ, শিক্ষিত, দায়িত্বশীল নাগরিক। তুমি একজন সম্পূর্ণ মানুষ। আমি তোমাকে তৈরি করেছি।

—আমি তোমার হাতে তৈরি হয়েছি মা। গড়ে উঠিনি। আমি কারও সঙ্গে কথা বলতে গেলে, দু’টি কথা বলার পর আমার কথা ফুরিয়ে যায়। আমি তখন বইয়ের মধ্যে ডুবে যাই। বই। বই ছাড়া আর কোথাও ঢুকতে পারি না কেন আমি? কিছু ভেদ করতে পারি না কেন? ছোটবেলায় তুমি যখন আমাকে খেলতে বারণ করতে, আমি মাঠের দিকে চেয়ে থাকতাম। আমার খেলতে ইচ্ছে করত। সবাই খেলত। শুধু একা আমি পুরনো বাড়ির বারান্দায়। আমি বই পড়তাম।

—তোমার যে কথা ফুরিয়ে যায় সে-দোষ তোমার নয়। তুমি গভীর এবং পরিণতমনস্ক বলেই সমান গভীরতার মানুষ সন্ধান করো। আর না পেলেই তোমার কথা ফুরিয়ে যায়। এমন কারওকে যখন পাবি মান্তু, যার মধ্যে তোর মনোবৃত্তির কম্পাঙ্ক খুঁজে পাবি, দেখবি তোর কথা ফুরোচ্ছে না।

—কাকে পাব মা? কবে পাব?

—সে আমিও বলতে পারি না। তবে পাবে সেই ভরসা রাখো। আমার মনে আছে মান্তু, বন্ধু তোমার কোনওকালেই বেশি নেই। অনেকদিন পর্যন্ত আমাকেই তুমি বন্ধু জেনেছিলে।

—পড়ার বন্ধু মা। তুমি আমার মধ্যে পড়া ঢুকিয়ে দিয়েছিলে!

—অনেক বই কিনে দিয়েছি আমি তোমাকে। কত কষ্ট করে সংসার চালাতাম তখন। এ জি-র পে স্কেল ভাল ছিল না। তোমার বাবা কোনও কাজকর্ম করতেন না। তারই মধ্যে তোমার জন্য আমি সব করেছি।

—হ্যাঁ। কিন্তু তুমি আমাকে খেলতে দাওনি।

—দিইনি কেন তুই জানিস না? জন্মের সময় তোর পা দু’টো কমজোরি ছিল। প্রথমে বোঝা যায়নি। কিন্তু সময় পেরিয়ে গেলেও তুই যখন হামা দিলি না, আমার ভাবনা হল। অনেকে বলল, কেউ কেউ একেবারে দাঁড়ায়। কিন্তু তোর দাঁড়ানোর সময়ও পেরিয়ে গেল। তুই বসিস। কথা বলিস। হাসিস। কিন্তু দাঁড়াস না। তোর বাবাকে বলে বলে রাজি করাতে পারিনি। শেষে আমিই তোকে নিয়ে একদিন মেডিক্যাল কলেজে চলে গেলাম। তখনও আমাকে চাকরিতে যেতে হয়নি। তার বাবা চাকরিটা তখনও করতেন। ডাক্তার তোকে দেখে বললেন, একটি বিশেষ ধরনের জুতো পরিয়ে তোকে হাঁটাতে হবে। রোজ। বিশেষ ধরনের মালিশ করতে হবে। সেই আমার কাজ হল। স্প্যাসটিক এইড। তখন, তুই যখন ছোট ছিলিস, ভাল চিকিৎসা ছিল না এ সবের। রোজ সংসারের কাজ করে তোকে নিয়ে বেরোতাম। রোজ মেডিক্যাল কলেজ। ডাক্তার আমায় বলেছিলেন, দুর্বল পা। খুব চাপ যেন না পড়ে। স্বাভাবিক হাঁটাচলার বাইরে বেশি খেলাধুলা দৌড়ঝাঁপ যেন না হয়।

—ভুল ছিল। ভুল ছিল মা। আমি একটি মেডিক্যাল জার্নালে পড়েছি। এরকম হলে বাচ্চাকে স্বাভাবিক জীবন দিতে হয়। তাকে মাঠে ছেড়ে দিতে হয়। অন্য বাচ্চাদের মধ্যে খেলতে দিতে হয়। তাতে সে মানসিক বল পায়। আত্মবিশ্বাস পায়। সেই সঙ্গে পেশির প্রচুর সঞ্চালনে পেশি তার স্বাভাবিক জোর অর্জন করে।

—চিকিৎসার ধরন বদলেছে মান্তু। দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে। কত রোগই তো আগে জানতুম সারে না। এখন শুনি সারে। কত রোগের তো নামই শুনিনি। এখন শুনতে পাই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুই বদলায়। তখন আমি যা করেছি, ডাক্তারের পরামর্শে তোর ভালর জন্যই করেছি।

—কিন্তু আমার কী হবে মা? আমি যে বই ছাড়া আর কিছুই জানি না? তোমার মনে আছে, মা, সেই কোন ছোটবেলায় খেলতে যেতে পারি না বলে আমি কান্নাকাটি করেছিলাম। তুমি আমায় অবনঠাকুরের ‘রাজকাহিনী’ কিনে এনে দিলে। সেই সময় কতবার করে সে বই পড়েছি! ভাল লাগার জায়গাগুলো আজও আমার মনে আছে। সেই, তোমার মনে আছে মা, বাপ্পার আত্মপরিচয় পাবার জায়গাটা? কী সুন্দর! কী করুণ!

‘… …বাপ্পা বড় হয়ে উঠেছিলেন কিন্তু সুতোয় বাঁধা তামার কবচটি তাঁর গলায় যেমন, তেমনই ছিল—অনেকদিনের অভ্যাসে মনেই পড়ত না যে, গলায় একটা কিছু আছে। আজ যখন হীরামোতির কুড়িগাছা হারের নীচে থেকে সেই পুরোনো কবচখানি পায়ের তলায় ছিঁড়ে পড়ল, তখন বাপ্পা চমকে উঠে ভাবলেন এ কি! এতদিন আমার মনেই ছিল না যে এতে লেখা আছে আমি কে, কোথায় ছিলুম! আজ সব সন্ধান পাওয়া যাবে! বাপ্পা প্রফুল্ল-মুখে সেই তামার কবচ মহারানীর হাতে এনে দিয়ে বললেন— “পড় তো শুনি।” বাপ্পা নিজে এক অক্ষরও পড়তে জানতেন না। মহারানী বাপ্পার পায়ের কাছে বসে পড়তে লাগলেন। কবচের এক পিঠে লেখা রয়েছে— “বাসস্থান ত্রিকূট পর্বত, নগেন্দ্রনগর, পরাশর-অরণ্য।” বাপ্পা হাসি মুখে রানীর কাঁধে হাত রেখে বললেন— “এই আমার ছেলেবেলার দেশ, এইখানে কত খেলা খেলেছি!”… …’

—কী আশ্চর্য মান্তু। কী সুন্দর মনে আছে তোর!

—মা, তখন ‘বাপ্পাদিত্য’ পড়তে পড়তে আমি মনে মনে বাপ্পা হয়ে উঠতাম। ‘গোহ’ পড়তে পড়তে গোহ।

মা দেখছেন ছেলেকে। মনে মনে বলছেন—‘এখনও তুই বাপ্পাদিত্য হয়ে আছিস মান্তু। তোর মুখে সেই পরাশর-অরণ্যের মায়া।’ কিন্তু মুখে কিছুই উচ্চারণ করছেন না। তাঁর বুকের তলায় আছে এক কঠিন স্তর, যা জীবনকে বাঁচাবার জন্য যুদ্ধ করতে করতে রচিত হয়েছে। পায়ের তলাকার শক্ত অনিবার্য কড়ার মতো। কিন্তু সেই কাঠিন্যের আড়ালে এক টলটলে পুকুর আছে। গাঁয়ের ঠাণ্ডা ছায়া-ছায়া তালপুকুরটির মতোই। সেইখানে জীবনেরই জন্য ভালবাসা রাখা। সেইখানে মা ভাবছেন— তোকে কে বুঝবে, আমি ছাড়া? বলছেন—

—আর ‘আলোর ফুলকি’? তোর ‘আলোর ফুলকি’র কথা মনে নেই? আমার খুব ইচ্ছে করে তোর মেয়েকেও ওই বই দিই একখানা। ওই বই পড়ে তুই কীরকম মোরগ পোষার বায়না করেছিলি?

—হ্যাঁ মা। ওই বইটা পড়ার পর থেকে আজও যেন মনে হয় পাখিদের সব কথা আমি বুঝতে পারি। সব সংলাপ। সোনালিয়া আর কুঁকড়োর জায়গাগুলো মনে আছে মা?

‘… … ছোটো কোণটিতে চুপচাপ বসে থেকেও যে সবই খুব বড় করে দেখা যায় আজ সোনালি সেটি বুঝে অবাক হল।

কুঁকড়ো বললেন, “সব জিনিসকে যদি তেমন করে দেখতে পার তবে সুখদুঃখের বোঝা সহজ হবে; অজানা আর কিছু থাকবে না। ছোটো একটি পোকার জন্ম মরণের মধ্যে পৃথিবীর জীবন আর মৃত্যু ধরা রয়েছে দেখো, একটুখানি নীল আকাশ ওরি মধ্যে কত কত পৃথিবী জ্বলছে নিভছে।”… …’

তোমার মনে হত না মা, ওই মুরগিদের মধ্যে সত্যি ওরকম কথা হয়? ওমনিই ওদের রাগ অভিমান ঈর্ষা ও চক্রান্ত? ওই পাখিরা যখন মারামারি করে, এ পাড়ার কাক—ও পাড়ার কাক দেখলে ঠোকরায়, এই মোরগ ওই মোরগের ঝুঁটি চেপে ধরে, তখন আমার ওদের একেবারে মানুষের মতো লাগে। এই পাড়ায় পাড়ায় দ্বন্দ্ব, এই দখল, এই কামড়া-কামড়ি—একেবারে কি মানুষের মতো নয় মা?

—কী সুন্দর করে ভাবিস তুই মান্তু। বোধহয় ছোটবেলা অত ভাল ভাল বই পড়েছিলিস বলেই এমনটা সম্ভব হয়েছে। তোর মেয়েকে আমি অবনঠাকুরের সব বই কিনে দেব।

—কিন্তু শর্মির যে বই পছন্দ নয় মা।

—তাতে কী? মান্তু। তোর তো পছন্দ। তোর মেয়ে তোর পছন্দের কিছু শিখবে না?

—জানি না, মা। আমার মনে হয় আমি যা যা জানি, যা যা পছন্দ করি, চাই, আমি যা হয়ে উঠেছি—তার সবটাই ভুল।

—এরকম কেন ভাবছিস? মান্তু, তোর কী হয়েছে?

—সকালে শর্মিকে তুমি কী বলেছ, মা?

—কই, কিছু না তো!

—শাড়ি নিয়ে কি কিছু বলেছিলে?

—শাড়ি নিয়ে? ও! হ্যাঁ! শর্মি নাচের স্কুল থেকে ফিরে শাড়ি ছেড়ে দলা করে আলমারিতে রাখছিল। তা আলমারির পাল্লা টানতেই ওমনি আরও চার-পাঁচটা দলাপাকানো শাড়ি গড়িয়ে পড়ল মেঝেয়। আমি শর্মিকে বললাম, এভাবে শাড়িগুলো রাখছ কেন? একটু ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখলেই তো পারো।

—শাড়িগুলো কার মা? তোমার, না শর্মির?

—আমার কেন হবে? এভাবে কথা বলছিস কেন মান্তু? আমি কি রঙিন শাড়ি পরি?

—তাহলে শর্মির শাড়ি সে যেমন খুশি রাখুক, তোমার কী?

—ও! এটাও কি ব্যক্তিস্বাধীনতার গল্প নাকি?

—নিশ্চয়ই।

—কিন্তু তুই তো জানিস, গুছিয়ে না রাখলে আমার ভাল লাগে না। আমি অফিস থেকে ফিরেও সব কিছু ঠিকঠাক গুছিয়ে রাখতাম।

—সবাই তো একরকম হয় না মা। শর্মি শর্মির মতো, তুমি তোমার মতো।

—ও, এ বেলা কোনও ব্যক্তিস্বাধীনতা নেই?

—কেন?

—যেমন ও ওর মতো থাকবে, এলোমেলো, অগোছালো। শাড়ি দলা পাকিয়ে আলমারিতে ঠেলে দেবে। সারা দিনে খাবার টেবিল থেকে এঁটো থালাবাটি তুলবে না। আমার জুঁইলতার ওপর ব্রেসিয়ার মেলে রাখবে আর তার জল পড়ে আমার জুঁইফুল থেঁতলে যাবে, আর আমি, এ সমস্তই ওর ব্যক্তিস্বাধীনতা বলে চুপ করে থাকব। কোনও কথা বলব না!

—কেন বলবে? এ তো ওরও বাড়ি মা। ওরও এখানে নিজের মতো থাকার অধিকার আছে।

—শোনো, আমি কথা বলব কারণ আমার নান্দনিকবোধ, পরিচ্ছন্নতাবোধ বিঘ্নিত হলে প্রতিবাদ করাটা আমারও ব্যক্তিস্বাধীনতা। আর এটা ওর বাড়ি নিশ্চয়ই। কিন্তু আমারও কি বাড়ি নয়, মান্তু, আজ থেকে আটত্রিশ বছর আগে, এই মাটিতে তোমাদের পুরনো বাড়িতে আমি পা দিয়েছিলাম।

—তুমি পৃথিবীতে আগে এসেছ, তাই ঘটনাক্রমে তুমি এ বাড়িতেও আগে এসেছ। তার জন্য তোমার অধিকার কিছু বেড়ে যায় না মা। এই পৃথিবীর ওপর একটি বৃদ্ধের যা অধিকার, একটি শিশুরও তাই।

—সব কিছু জেনারেলাইজ করে ফেলিস তুই মান্তু। কিন্তু জীবন এরকম নয়। মানুষের চাওয়া-পাওয়ার বোধ এরকম নিয়ম মেনে, যুক্তি মেনে চলে না। ওই পুরনো বাড়িতে কত কষ্ট করেছি আমি! এ বাড়ি নতুন করে করতেও কি কম কষ্ট হয়েছে? তুমি জানো সব কিছু ম্যাজিকে হয়ে যায়নি। এর পিছনে আমার যথেষ্ট পরিশ্রম ছিল। এর প্রত্যেকটি ইট, প্রতি কণা সিমেন্ট, প্রতিটি গ্রিল, আমার নিজের পরিশ্রম জড়িয়ে তৈরি। এ বাড়ির পরিকল্পনা, মেঝের নকশা, জানালার মুখ—সব আমার করা। সুতরাং, এ বাড়ির প্রতি, আমার অধিকার কিছু বেশি আছে বটে। সেই অধিকার সম্পর্কের নয়। সময়ের নয়। মায়ার। ও একদিন রাগ করে কাচের গ্লাস ছুঁড়ল। আমার জানালার কাচ ভেঙে গেল। ও একদিন তোমার সঙ্গে ঝগড়া করে তালা ছুঁড়ে দিল, আমার মেঝের স্ল্যাবে চিড় ধরে গেল। তুমি বলবে, রাগ করার অধিকার প্রত্যেকের আছে। এবং প্রকাশভঙ্গিও যার যার নিজস্ব। ঠিক। তবে এও ঠিক ব্যক্তিস্বাধীনতাই মানুষের সেই শেষ ভয়ঙ্কর শব্দ যা পরস্পরকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। যা পরস্পরকে শ্রদ্ধা করায় না। উপলব্ধি করায় না। ব্যক্তিস্বাধীনতা নিষ্ঠুর আত্মকেন্দ্রিকতা ছাড়া কিছু নয় যদি তুমি এর সঠিক ব্যবহার না করো। তোমাকে বুঝতে হবে, কোথায় মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রয়োজন। বুঝতে হবে, তোমার স্বাধীনতার ইচ্ছা যেন অন্যের ইচ্ছাকে ব্যাহত না করে। কারণ ওই দাবি তারও আছে। শর্মি যখন খুব সহজেই খুব খারাপ ভাষায় চিৎকার করে তোমার কাছে ক্ষোভ জানায়, তখন, এই পরিবশকে দূষিত লাগে আমার। কিন্তু আমি কিছু বলিনি। বলা উচিত ছিল কারণ এখানে তার শিক্ষার অপূর্ণতা রয়েছে। মানুষ পরস্পরকে বিভিন্ন সময় বাধা দেবে, যখন প্রয়োজন। বাধা দেবে না যখন প্রয়োজন নেই—যেমন, সৎ ইচ্ছায়। সৎ অভিপ্রায়ে। সৎ কাজে। শর্মি নাচের স্কুল করতে চেয়েছে। আমি স্কুলে আপত্তি করিনি। আমি জানি, এ পাড়ায়, আমার পুত্রবধু নাচে বলে, নাচের ক্লাসে যায় বলে, কানাকানি হয়। কিন্তু আমি ওইসব অর্থহীন কানাকানিতে গুরুত্ব দিই না। শর্মি চমৎকার নাচে। ও তো স্কুল করতেই পারে। আমার এই সমর্থনগুলো তোমাদের চোখে পড়ে না।

—কিন্তু তুমি ওকে চাকরি করতে বাধা দিয়েছিলে।

—না। ভুল উপস্থাপনা কোরো না, এটাও মিথ্যাচার। সত্যের বিকৃতি। আমি বলেছিলাম দেড় বছরের বাচ্চা রেখে এখন তোমার কাজে যাওয়ার দরকার নেই। অর্থের তো অভাব নেই আমাদের। মেয়ে একটু বড় হলে চাকরি কোরো। আমি নিজে যেখানে চাকরি করছি, সেখানে শর্মিকে বাধা দেব কেন? শর্মি চাকরিটা নেওয়ায় মিষ্টুর কি অসুবিধে হয়নি? বারবার কি অসুখে পড়েনি সে? সে বছরই, ছ’মাসের মাথায়, আমি যদি রিটায়ার না করতাম, মিষ্টুর কি ক্ষতি হত না? তোমরা জানো, মিষ্টুর জন্যই আমি এক বছর আগে রিটায়ার করেছি। তাতে আমার আর্থিক ক্ষতি কিছু কম হয়নি।

—এতদিন পর তুমি টাকার কথা তুলছ মা?

—না। টাকার কথা নয়। কথা হল, শর্মি মেয়েকে ফেলে রেখে যে-টাকা উপার্জন করতে গেল তার চেয়ে বেশি টাকা আমি ওই মেয়েরই জন্য ছেড়ে এলাম। লাভ কী হল?

—কিন্তু প্রায়ই তুমি শর্মিকে অভিযোগ করো। ও সংসার দেখে না। শুধুই চাকরি করে। শুধুই নাচ করে। মা। ওর তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়েছে বলে। না হলে এখন ওর বয়সী মেয়েরা বিয়েই করে না। সেভাবে দেখলে ও তো ছেলেমানুষ।

—দেখো। সে-দিন যখন আমি বলছিলাম, মেয়েকে এখুনি প্রাইভেট টিউটরের হাতে দিয়ো না, তুই বললি, মা, আমরা বড় হয়েছি, আমাদের সিদ্ধান্ত আমাদের নিতে দাও। কোনটা তাহলে তোর যথার্থ উপলব্ধি? আধুনিক জীবনদর্শন একটি নতুন ভাবনার জন্ম দিয়েছে। আসলে নতুন নয়। কিন্তু সব পুরনো ভাবনাই তো নতুন করে আসে। তো, এই দর্শনের নাম আইডেনটিটি ক্রাইসিস। যথার্থ অত্মোপলব্ধি না হলে মানুষ এ রোগে ভোগে। আমি ভুগতাম ছোটবেলায়। যখন এক্কাদোক্কা খেলতাম, মা বলত—বড় হয়েছ। অত লাফিয়ো না। যখন মা-রা গল্প করত, আমি শুনতে বসতাম। মা তাড়া দিত, তুমি এখানে কেন? যথেষ্ট ছোট আছ এখনও। বড়দের মধ্যে কী করছ? আমি চলে যেতাম। কষ্টও পেতাম। তার চেয়ে যেটা বেশি হত, আমি হতবুদ্ধি হয়ে যেতাম। আমি আসলে ঠিক কী! বড়, না ছোট! আমার কোনটা করণীয়, কোনটা নয়! আমি তখন আইডেনটিটি ক্রাইসিসে ভুগছিলাম। কথাটা যদিও তখন জানতাম না। জেনেছি অনেক পরে। যখন জীবন বারবার এই সঙ্কটের সামনে আমাকে নিয়ে ফেলেছে যে আমি আসলে কী? আমি কে? আমি কেন? আমি কি ওটা? নাকি, আমি অন্যটা? আজ আবার আমার সেই সঙ্কট। সেই আইডেনটিটি ক্রাইসিস। আমি বুঝতে পারছি না আমি তোমাদের কাছে কতটা কাঙ্ক্ষিত, কতখানি কল্যাণকর।

—তুমি ব্যাপারটাকে এত জটিল এত তাত্ত্বিক করে ফেলো না। আসলে তোমার অভিযোগগুলো শর্মিকে বিঁধছে। তুমি বলেছ ও সংসার দেখে না। সংসার তো তুমিই দেখছ। ও যদি চাল ডালের হিসেব নাই করে তবে আপত্তি কি?

—তোরা ভুলে যাস যে আমার বয়স বাড়ছে। আমি দীর্ঘদিন চাকরি করেছি, সংসার সামলেছি, তোর এবং তোর বাবার দেখাশুননা করেছি। নিজের দিকে তাকাইনি। নিজের সাধ-আহ্লাদের কথা ভাবিনি। হতে পারে আমার অনেক ভুল হয়েছে। কিন্তু ভগবান জানেন, আমি জেনেশুনে কখনও তোদের কষ্ট দিতে চাইনি। তখন আমাকে চালের হিসেব রাখতে হয়েছে। টিফিন কিনে খাবার সামর্থ্য ছিল না। বোতলে দই পেতে চিঁড়ের পুঁটুলি নিয়ে অফিসে গিয়েছি। এখন, এই বয়সে তোমাদের মেয়েকেও আমি কম আগলাচ্ছি না। এখনও মিষ্টু তোমাদের ছেড়ে আমাকেই বেশি চেনে। আমারও তো বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে করে! নিজের মতো করে সময় কাটাতে ইচ্ছে করে! বাকি জীবনটা শেক্সপিয়র পড়ে, রবীন্দ্রনাথ, গ্যেটে, টলস্টয় পড়ে আর দেবব্রত বিশ্বাসের গানে বইয়ে দিতে ইচ্ছে করে।

—বেশ। তোমার কথা মনে রাখব। শর্মিকেও বলব।

—আমার কথা বোধহয় তোরা একটু বেশিই বলাবলি করছিস মান্তু! আর মনেও রাখছিস। এতটা প্রয়োজন নেই।

—ঠিক আছে। কিন্তু তুমি শর্মির সাজপোশাক নিয়েও আর কিছু বলতে যেয়ো না।

—না। আমি তো সেরকম কিছু বলিনি! একদিন বলেছিলাম রং মেখো না। ঠোঁটে গালে রং মাখা মানে তো নিজেকে অপমান করা। পরকে ভোলানো। নিজেকে ভোলানো।

—ও যদি নিজেকে সাজাতে ভালবাসে তোমার তাতে কী?

—না। আমার কি? কী সুন্দর দেখতে শর্মিকে। ও তো নিজেকে সাজাবেই। কিন্তু সাজ আর মেক আপ কি এক হল? সাজ তো কৃত্রিমতা নয়। সাজ হল শিল্প। আর মেকআপ হল কৃত্রিম।

—তোমার এই বিশ্বাস তোমারই থাক না মা। ওকে ওর মতো থাকতে দাও।

—আমি কি তা দিচ্ছি না?

—না, তুমি মনে করো, তুমি যা ভাবছ তাই ঠিক। তুমি যেভাবে যা-কিছু দেখো সেটাই চূড়ান্তভাবে সফিস্টিকেটেড। কিন্তু সবসময় সেটা ঠিক নয়। তোমাকে একটা কথা বলার আছে। শর্মি বি আর সিং থেকে বি এন আর হাসপাতালে ট্রান্সফার হচ্ছে। ওখানে ও কোয়ার্টারও পাবে।

—ও

—এখান থেকে বি এন আর যাওয়া তো সম্ভব নয়। বুঝতেই পারছ—

—যাবার দিন ঠিক করেছিস?

—হ্যাঁ। মানে, না। মানে আমরা বলছিলাম তুমিও আমাদের সঙ্গে যাবে তো?

—না। তোরাও জানিস আমি যাব না। তোরা যা। তবে মান্তু। বউয়ের কোয়ার্টারে থাকা। আমাদের সমাজে এতে কেউ তেমন অভ্যস্ত নয়। তোর অসুবিধে হবে না তো?

—এ সব তুমি কী বলছ মা? আমি কোয়ার্টার পেলে শর্মি কি যেত না? এখানে তফাত কোথায়?

দেওয়াল থেকে পিছলে পড়া, ছিটকে আসা আলো ফুরিয়ে গেছে তখন। মা এবং ছেলের মুখ অন্ধকার। মায়ের মুখের মৃদু বলিরেখার ওপর সেইসব অন্ধকার জমে কালোর প্রলেপ একটু বেশি গাঢ় করেছে। এখন আর আলোর ফুলকি নেই। গোহ, বাপ্পাদিত্য, পরাশর অরণ্য নেই। পাহাড়তলির মোরগ কোথাও দাঁড়িয়ে পরম বিশ্বাসের কথা শোনাচ্ছেন না বনের সোনালিয়াকে। বলছেন না— “পাছে ভুল হয়, সেই ভয়েই আমি জেগে উঠি।” বলছেন না—“… … সুর বেসুর সব এক হয়ে ডাক দিলে যা চাই তা পেতে বেশি দেরি হয় না,… …” এখন সংসার— কূট ও জটিল টানের মধ্যে। এখন সম্পর্ক— পরস্পরকে না বোঝায়।

বহুক্ষণ চুপ করে থেকে মা বললেন—

—না। শর্মি তো কথায় কথায় বলে, আমি যা খুশি তাই করব, তোমার খাই না পরি! এই মন নিজের কোয়ার্টারে গেলে আরও দুর্বার হয়ে উঠবে না তো?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *