১০. আমি নীলোফা

১০

খুবই কুণ্ঠার সঙ্গে ভীতভাবে সে বলেছিল, আমি নীলোফা। হতে পারে এই কুণ্ঠা বা ভীতি সে ক্রমে অর্জন করেছিল, কিংবা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার ওপর, কারণ এটা ঠিক যে তার জিয়ন কারও অভিপ্রেত ছিল না। সে ছিল এক বাড়তি বা ফালতু, যার বাঁচার চেয়ে বড় অপকর্ম আর কিছুই ঘটতে পারত না।

কোনও ব্যক্তি নয়, কোনও বিধান নয়, সামগ্রিক পরিস্থিতি তাকে ওইরকম করে তুলেছিল।

আনিসুজ্জামানের মনে আছে, ছোটবেলায় ফরসা ও ফুটফুটে ছিল নীলোফা। পুড়ে গেল একদিন৷ খেলতে খেলতে। না বুঝে। সব সৌন্দর্য পুড়ে গেল। পৃথিবীর সব মানুষই প্রায়, না বুঝে, খেলতে খেলতে পুড়ে যায়। ঝলসে যায়। সে হল অন্তরে পোড়া। নীলোফা বাইরে পুড়েছিল, তাই অন্তরেও। সে-দিন পুড়তে পুড়তে যে তীব্র চিৎকার সে করেছিল, আর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল, সে-চিৎকার, তার জ্ঞান হওয়া ও বাড়তে থাকা পর্যন্ত আর থামেনি।

ঘটনাটি যখন ঘটেছিল তখন আনিসুজ্জামান স্কুলের শেষের দিকে। ইলেভেনের শেষ প্রান্ত। পুরুষ হয়ে ওঠেননি। মানুষ হয়ে ওঠেননি। দায়িত্বশীলও নয়। শুধু কৈশোরের উপান্তে পৌঁছে মনে মনে অশান্ত চিৎকার। আর নীলোফা যখন পুড়েছিল তখনও গৃহে কোনও পুরুষ ছিল না। আব্বাজান নয়, মনিরুল নয়, ফিরোজ, মকবুল—কেউই নয়। সম্পূর্ণ পুরুষবিহীন অবস্থায়, বলা যেতে পারে অভিভাবকহীন অবস্থায় পুড়ে যাবার অপরাধে নীলোফাকে অন্তত তিন ঘণ্টা ছেঁচা আলুর তত্ত্বাবধানে শুয়ে থাকতে হয়েছিল। আর তাতে তার চামড়াগুলি গুটিয়ে দলা পাকাবার যথেষ্ট সময় পায় এবং তাকে বিকৃত করে তোলে অতি সহজেই।

ওইটুকু মেয়ে তখন নীলোফা, হয়তো পাঁচ, কষ্টের বোধ তার লুপ্ত হয়েছিল। কারণ ওই যন্ত্রণা সহ্য করা কোনও মানুষের কর্ম নয়। আর নীলোফা হয়তো-বা মানুষই ছিল না। দলা পাকানো ত্বক-মাংসের পিণ্ডের তলে হয়তো-বা দানবশিশু তখন। সঞ্জিদা তাঁর ছোট শিশুটির কাছে নীলোফাকে বসিয়ে রেখে বুঝি-বা কোনও কাজে গিয়েছিলেন। আর বোনের কাছে বসে থাকতে থাকতে নীলোফার মনে হয়েছিল, বোনের যত্ন সেও দিব্যি নিতে পারে। কারণ সে অনুপুঙ্খ নজর করতে থাকে কীভাবে দুধ গোলা হয় আর বোতলে পুরে ধরা হয় শিশুটির মুখের কাছে। সঞ্জিদা অসুস্থ ও ক্ষীণ। যথেষ্ট দুধ নেই শরীরে। তাই বোতলে দুধ নিয়ে শিশুটির মুখে ধরা। সে দুষ্টুমি করে মাঝে মাঝে মুখ সরিয়ে নেবে আর তখন বোতলের শোষণপ্রান্ত তার পাতলা লাল দুটি ঠোঁটে পুরে দিতে হবে। এ হেন শিশু কেঁদে উঠেছিল আর নীলোফার মনে হয়েছিল, এই তো খিদে পেল ওর, আর দুধ গোলার সময় হল। মাঝরাত্রে দুধের ব্যবস্থা করার জন্য ঘরেই স্টোভের ব্যবস্থা রেখেছিলেন সঞ্জিদা। আর নীলোফা খুবই পরিণত বুদ্ধি সমেত তাতে জল বসাবার নিমিত্ত আগুন দিয়েছিল। এরপর কী হয়েছিল কেউ জানে না৷ নীলোফাও বলতে পারেনি। হয়তো তেল চুইয়ে থাকবে, হয়তো স্টোভ যথাযথ পরিকৃত ছিল না বা ফিতেগুলি অসমান ছিল। কারণ যাই হোক, দাউ দাউ জ্বলেছিল সেটি আর নীলোফার পরিধানে কৃত্রিম গোলাপি পশমের জামা স্পর্শ করেছিল। তার বুক বরাবর আগুন লাগে আর নিমেষেই তা অস্থির ও আগ্রাসী হয়ে যায়। ভয়ে যন্ত্রণায় দিশেহারা নীলোফা জ্বলন্ত অবস্থায় ছুটে যেতে থাকে বারান্দা বরাবর। কেই-বা তাকে দেখতে পেয়েছিল আর কেই-বা তার আগুন নিভিয়েছিল আজ আর কারও মনে নেই। সকলেই আশ্বস্ত হয়েছিল এ কারণে যে সে-দিন স্টোভ থেকে সারা বাড়িতে আগুন লাগতে পারত বা ছোট শিশুটিও মারা যেতে পারত, কিন্তু তা হয়নি। নীলোফা একা পুড়েছিল। পুড়ে গেল আর ঝলসে গেল। তার পেট থেকে গলা পর্যন্ত কৃত্রিম গোলাপি রেশমের জামা গলে আটকে রইল। সারা মুখ আগুনে গলিত মণ্ড হল। নাকের সঙ্গে ঠোঁট আটকে গেল, গালের সঙ্গে কান। স্ফীত মাংসে চোখের তলায় টান পড়ল। চোখ অক্ষত এবং কপাল পুড়ল না এবং নীলোফাও বেঁচে রইল। বেঁচে থাকল। কিছুতেই মরে গেল না।

ছ’মাস হাসপাতালে কাটিয়ে যখন সে ফিরে এল তখন আর মানুষ নেই। মানুষ রইল না। দানবশিশু সেই, বা দানবশিশুও নয়। প্রাগৈতিহাসিক কোনও প্রাণীর মতো তার চিবুকের থেকে গলা পর্যন্ত মাংসপিণ্ড ঝুলে রইল। বুকের মাংস-ত্বক দুমড়ে মুচড়ে স্বাভাবিক সংকোচন প্রসারণের উপায় রাখল না। দৃষ্টিশক্তি রাখলেন খোদা। কপাল রাখলেন। চুল। শ্বাস-প্রশ্বাস। শুধু চোখের তলায় টান—তাই চোখের পাতা পুরোপুরি বন্ধ হয় না। জলে চোখ ভরলে জমার উপায় নেই। গালে পড়লে সে-পথ আঁকাবাঁকা। ঊষর ভূমির মতো উঁচু-নিচু। বাহুগুলি ঝলসেছে বটে আর ত্বকও কুঁচকেছে, কিন্তু সেগুলি কর্মক্ষম আছে। বুকের চামড়া গুটিয়ে গুটলি পাকিয়ে যাওয়ায় চলনে শিম্পাঞ্জি সদৃশ দোদুল্যমানতা, কিন্তু উদর ও তারও নিম্নবর্তী দেহভাগ অটুট। আর প্রত্যেকেরই খোঁজ তেমনই যেমন বাসাবাড়ি পুড়ে গেলে ছাই ঘেঁটে দেখা—কিছু অবশিষ্ট রইল কি না। নিটোল-নিটুট রইল কি না।

হাসপাতালে বড়রা তাকে দেখতে যেত এবং শিশুদের নিয়ে যাওয়া হয়নি। প্রত্যেকেই সারাক্ষণ তার মৃত্যু কামনাই করেছিল। তবু নীলোফা ফিরে এল এবং ছোটরা তাকে দেখে ভয়ে চিৎকার করে লুকিয়ে পড়তে লাগল। নীলোফার গায়ে বোরখা উঠল আর আনিসুজ্জামান নীলোফা-দর্শনে বাথরুমে গিয়ে দরজা দিলেন। বমি করলেন। বমি করতে লাগলেন আর বেসিনের ফুটো বন্ধ হয়ে গেল। তিনি, কারওকে কিছু জানবার অবকাশ দেবেন না এই সংকল্পে একটি কাঠি দিয়ে খোঁচাতে লাগলেন যাবতীয় উগরে দেওয়া বস্তু। যেন নিজের ভেতরকার সমস্ত অপরিচ্ছন্ন দ্রব্য তাঁর সামনে এসে গেল এমনই বোধ করছিলেন তিনি তখন। আর খোদা, হয়তো ওই ক্ষমাহীন বমনের অপরাধে শ্বেতরোগে কুৎসিত করে তুললেন আনিসুজ্জামানকে। তবু, মনে মনে স্বীকার করেন তিনি, আনিসুজ্জামানের চেয়ে সুখী সে-মুহূর্তে আর কেউই নেই, কারণ, তাঁকে নীলোফার মতো মুখ ঢাকতে হয় না। নড়াচড়া হাসিকান্নায় তার কোনও অসুবিধে নেই।

—নীলোফা! নীলোফা তুই কেমন আছিস?

আনিসুজ্জামানের মনে পড়ল দীর্ঘদিন নীলোফার খোঁজ নেওয়া হয়নি! সে কী করে বড় হল আর কী করে এখন এসে দাঁড়াল দরজায়। সে কত বছর— দশ-এগারো—নীলোফা সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য কোনও মুহূর্ত মনে আসছে না, আর আনিসুজ্জামান অপরাধী হয়ে উঠছেন নিজের কাছে। হ্যাঁ, এ খবর তাঁর কাছে আছে যে এই দশ-এগারো বছর নীলোফা বছরে দু’বার হাসপাতালে গেছে আর অল্প অল্প করে তার বিকৃতি অপনোদনের চেষ্টা হয়েছে। প্রথমে বুকের চামড়া কেটে-কুটে তার চলনকে স্বাভাবিক প্রকরণ দেওয়া হয়েছিল। তারপর নাকের নীচ থেকে ঠোঁটের ওপর ঝুলন্ত মাংসপিণ্ডটা বাদ দেওয়া হয়। কানের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া হয় গাল এবং নীলোফা এত বছরে, সাধনার মতো বেঁচে থেকে লাভ করতে থাকে— স্বাভাবিক উচ্চারণ, স্বাভাবিক গতিতে সোজা মানবিক হেঁটে যাওয়া। তবু, আজও তাকে অসহরূপাই বলা যায়, যা সে সারাক্ষণ আবৃত রাখে। অন্দরেও সে বোরখা তোলে না এবং এই দুর্ভাগ্যকে স্থৈর্যের সঙ্গে মেনে নিতে নিতে সে দেখেছে আগুন তার অঙ্গে কিছু বাড়তি জীবন দিয়ে থাকবে যাতে সে কখনও রোগাক্রান্ত হয় না এবং প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে তারও মধ্যে রোমেলি বসন্ত আসে।

আনিসুজ্জামান গভীর প্রশ্নের সন্ধান করেছিলেন। নীলোফা! কী নিয়ে আছে ও! কী নিয়ে থাকে! অন্য মেয়েদের মতো ওর বিয়ের স্বপ্ন থাকতে নেই, পুরুষের প্রতি আকর্ষণ থাকতে নেই। সবাই পুতুলখেলা খেলতে খেলতে সংসার গুছোনোর হাতেখড়ি সম্পন্ন করে। নীলোফা কী করে!

বিছানায় বইয়ের স্তূপ হয়েছিল। সে-সব এ দিকে ও দিকে সরিয়ে নীলোফাকে বসার জায়গা দিয়েছিলেন আনিসুজ্জমান। নীলোফা খুব সংকোচের সঙ্গে বসেছিল। বোরখায় মুখ ঢাকা ছিল বলে আনিসুজ্জামান অভিব্যক্তি বুঝতে পারেননি। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সে বলেছিল, আপনি তবে সত্যি যাচ্ছেন, ভাইজান?

আনিসুজ্জামান বই গুছোতে গুছোতে বলেছিলেন, হ্যাঁ রে। যাচ্ছি।

নীলোফা নীরবে বসেছিল। তিনি ভেবেছিলেন এটাই স্বাভাবিক যে একে একে সবাই এসে দেখা করে যাবে আর একই প্রশ্ন করবে, সত্যিই তিনি যাচ্ছেন কি না। যেন-বা এ দিনই সবার মনে পড়বে তাঁর চলে যাওয়ার খবর সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার কথা। যদিও এ বাড়িতে তিনি আসতেই পারবেন যখন তখন কিন্তু একত্র বসবাস না করলে আর পরিবারের অন্তর্ভুক্ত থাকা হয় না। পরিবার থেকে বিদায় নেবার অন্তিম পর্ব আজ সমাধা হতে চলল। এই বইগুলি ছাড়া আর বিশেষ কিছু নেবার নেই তাঁর। আখতারুজ্জামানের গাড়িখানা মনিরুল তাঁকে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি নেননি। কারণ তাঁর মনে হয়েছিল গাড়ির ব্যবহার ও প্রয়োজনীয়তা সাপেক্ষে সেটি মনিরুলেই বর্তায়। গাড়ি নিয়ে কী করতেন আর তিনি! সম্পত্তির বিনিময়ে যে-অর্থ তিনি পেয়েছেন তার দৌলতেই মাথুরের গড়ের এই ফ্ল্যাট। এখান থেকে কলেজ পনেরো-কুড়ি মিনিটের হাঁটা পথ। রিকশায় ছ’ মিনিট। গাড়ি রাখার ঝামেলাও বিস্তর। আনিসুজ্জামান মূলত পড়ুয়া ও চিন্তাবিদ। পড়া বা লেখার বিষয়ে প্রয়োজন এমন কিছু ছাড়া অন্য কাজে তাঁর উৎসাহ জন্মায় না। যদিও ওই গাড়িই তাঁকে এবং তাঁর বইগুলিকে মাথুরের গড়ে পৌঁছে দেবে। একবারে তা সম্ভব কি না এ কথাই ভাবছিলেন আনিসুজ্জামান।

নীলোফা বলল, ওখানে কে থাকবে আপনার সঙ্গে ভাইজান?

—আমি একা থাকব নীলোফা।

—আপনার রান্না করে দেবে কে, আর কাপড়জামা কে কাচবে, অন্যান্য কাজ?

—হুঁ। সে এক সমস্যা। লোক-টোক রাখব। কিন্তু তুই বেশ অনেক দূর ভেবেছিস নীলু! পাকা গিন্নি একেবারে। চাচিরা এইসব আলোচনা করেছেন আর তুমি সব শুনেছ, তাই তো?

নীলোফা মাথা নিচু করেছিল। তারপর খুব আস্তে, প্রায় একলা উচ্চারণের মতো বলেছিল, আপনি কখনও কিছুই করেননি ভাইজান। আমার মনে হয়, আপনি এ-ও জানেন না কী করে উনুন ধরাতে হয়। কী করে স্টোভ জ্বালে। কাজের লোকের ওপর নির্ভর করে আপনি বাঁচবেন কী করে ভাইজান? তার চেয়ে আমাকে আপনার সঙ্গে নিয়ে যাবেন? ভাইজান? আমি আপনার রান্না করে দেব। কাপড় কেচে দেব। বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার— মোট কথা একটা লোক যা যা করে…

আনিসুজ্জামান তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, পাগল!

কিন্তু নীলোফা সে-কথা শুনতে পায়নি। সে উত্তরের অপেক্ষা করছিল আর আনিসুজ্জামান ভাবছিলেন— কী বলে মেয়েটা? মজা করছে? এ পরিবারে আনিসুজ্জামান সমস্ত ফাজলামো ইয়ার্কি ও মজার বাইরে। তা ছাড়া নীলোফার সঙ্গেও তাঁর কোনও মেলামেশা ছিল না। তাঁদের বয়সও অদূর নয় যে নীলোফা দু’টি হালকা বেচাল কথার ঝুঁকি নিতে পারে। সুতরাং, আনিসুজ্জামান, তাঁর পক্ষে এক গম্ভীর পরিস্থিতিতে, যেহেতু তা দুর্বোধ্য, বললেন, নীলোফা আমি ব্যস্ত। এ সব ফালতু কথা শোনার সময় এটা নয়। তুমি চলে যাও।

নীলোফা, হয়তো-বা এই গাম্ভীর্যে, হয়তো দীর্ঘলালিত অসহায়বোধের তাড়নায় প্রায় কান্নায় প্রায় যন্ত্রণায় বলেছিল, আপনি না বলবেন না ভাইজান। না বলবেন না। আমাকে আপনার সঙ্গে নিয়ে চলুন।

আনিসুজ্জামান সব কাজ ছেড়ে চেয়ার টেনে নীলোফার মুখোমুখি বসেছিলেন। কোনও কোনও সময় মানুষের স্বর, উচ্চারণের চেয়েও অনেক বেশি কথা বলে দেয়। প্রক্ষেপে ধরতে পারা যায় অবরুদ্ধ বাষ্পের ঘনত্ব। নীলোফার স্বর আনিসুজ্জামানকে একটি অসহায় বিষাদগ্রস্ত অনুভবে ঠেলে দিয়েছিল। কী বলা উচিত, করা উচিত, কিছুই তাঁর বোধগম্য হয়নি। তবু বলেছিলেন, এরকম বলতে নেই, নীলু।

—কেন?

—তুই আমার সব কাজ করে দিবি কেন? নিজের জন্য একজন লোক রেখে নেব আমি, কেমন?

নীলোফা বোরখার আড়ালে গলার ভেতর ফোঁপাচ্ছিল তখন। বলেছিল, আমি করে দিলে কী হয়! ভাইজান! এ বাড়িতেও তো সব করি আমি। করি না?

—আচ্ছা বেশ। তা করিস। কিন্তু কাজের জন্য আমার সঙ্গে যাবি, তা কী করে হয়?

—কাজের জন্য নয়।

—তা হলে? কীসের জন্য? কেন আমার সঙ্গে যেতে চাস নীলু?

একটা কান্নার শব্দ ছিটকে বেরিয়েছিল তখন। কিন্তু সামান্য সময়ের জন্য। নীলোফা কিছুটা ধরা গলায়, কিন্তু খুব শান্তভাবে, যেন-বা সে আগে সব ভেবে রেখেছে, বলেছিল, এ বাড়িতে আর থাকতে ইচ্ছে করে না, ভাইজান। আমাকে কেউ ভালবাসে না। আম্মি, আব্বু, চাচি, ভাইরা, ভাবিরা— কেউ না। এমনকী বাচ্চাগুলোও আমার কোলে আসে না। আমি কুচ্ছিৎ। আমি পোড়া। আমি এ বাড়ির বোঝা, না ভাইজান? কিন্তু আমি কী করব! আমি যে পুড়ে মরে যাইনি, বেঁচে ফিরে এসেছি, সে কি আমার দোষ?

আনিসুজ্জামান নীলোফার জন্য সহমর্মিতা বোধ করেছিলেন। এবং, সান্ত্বনা দেবার যা সহজতম উপায়, তাই অবলম্বন করে বলেছিলেন, না। তোমার দোষ কেন হবে? কিন্তু কেউ তোমাকে ভালবাসে না এ কথা কেন বলছ? তুমি যাতে একটু সুস্থ-স্বাভাবিক হয়ে ওঠো তার জন্য তো বাড়ির লোক কম চেষ্টা করেননি, বলো?

—হ্যাঁ। করেছেন।

—তবে? কেউ ভালবাসে না, এ কথা বলতে নেই।

—কেন বলব না, ভাইজান? আম্মি সবসময় বলে, মরে গেলি না কেন? পুড়লি যদি তো মরলি না কেন? পাপ, পাপ, জন্মপাপ। হে খোদা,কী গুনাহ্‌ করেছিলাম যে আমার মেয়ে এরকম হল! আব্বাজান আমাকে দেখলেই চটে ওঠেন। আমি সামনে গেলেই বলেন, এই পোড়া কয়লাটাকে এখানে পাঠিও না। বড় আম্মা আমাকে দিয়ে সব কাজ করিয়ে নেয়। একটু পড়তে বসি যদি, একটু বইয়ের পাতা ওল্টাই, বলবে, রাখ, অনেক হয়েছে। পড়লেও কিছু বেহেস্তে যাবি না । এমন কপাল পুড়িয়ে এসেছিস যে কুষ্ঠরোগীও তোকে ছোঁবে না। গতর না খাটালে আমরা যখন চোখ বুজব ভাবিরা লাথ মেরে বার করে দেবে। যে যা বলে, যে কোনও কাজ, আমি করে দিই ভাইজান। আমাদের বাড়িতে কাজ করতে যে-মেয়েটা আসে, হামিদা, ওর যা বলার সাহস আছে, আমার তা নেই। আমি লঙ্কা পর্যন্ত বেটে দিই জানেন। ভাবীরা আমাকে দিয়ে বাচ্চার নোংরা কাঁথা কাচায়। কেন, ভাইজান, কেন? কই, আর কেউ তো করে না? আম্মিকে বললে বলে, কাজ করে জন্মের ঋণ শোধ তো করতে হবে! ভাইজান, কোনও উৎসবে অনুষ্ঠানে যখন যাই, আমার সঙ্গে কথা বলতে চায় না কেউ। এই সে-দিন, ফরিদাদিদির বিয়ে হল, আমরা গেলাম, সক্কলে ফরিদাদিদিকে ঘিরে বসে আছে, আমিও বসলাম, ওমনি আসর ভেঙে যেতে লাগল। বড় আম্মা বলল, তুই এখানে কেন, নীলু? তুই যা। যেখানে-সেখানে হুট করে চলে যাবি না। মনে রাখবি তুই অপয়া। সবার সামনে বলল, ভাইজান, আর আমার মরে যেতে ইচ্ছে করল। কিন্তু আমি সত্যি সত্যি মরতে চাই না। আমাকে মেরে ফেলাই যদি খোদার ইচ্ছে হয় তবে আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে কেন?

আনিসুজ্জামানের চোখে জল আসছিল। নীলোফা, সে ধনীর দুলালী, যার খাওয়া-পরা-আশ্রয়ের অভাব নেই, সে প্রকৃত অর্থে কতখানি নিঃসহায় তা তিনি বুঝতে পারছিলেন। হয়তো-বা, যে-কারণে আনিসুজ্জামান নিজে পালাতে চান সে-কারণে নীলোফাও পালাতে চায়। কিন্তু সে এক অসম্ভব প্রস্তাব করেছে। এ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবার তিনি কেউই নন। নিজেকে তাঁর নীলোফার মতোই অসহায় লাগছিল, কিন্তু তিনি এমনও ভেবেছিলেন যে নীলোফা, ষোলো-সতেরো বছরের মেয়েটি, কী সুন্দর করে ভাবতে শিখেছে, বুঝতে শিখেছে। হয়তো সমস্ত সৌন্দর্যগরিমা ও আনন্দ থেকে বঞ্চিত বলে তার অনুভবগুলি এত তীব্র। এই দশ বছরে, এমন কঠিন ব্যবহারে সে অভ্যস্ত হয়ে যেতে পারত, ভোঁতা হয়ে যেতে পারত, ভাবতে পারত এ সবই তার পাওনা, কিন্তু ভাবেনি। মনে মনে একটি অবাধ উদার মুক্তির প্রতীক্ষা করেছে। সে মুক্তি অনিশ্চিত জেনেও নির্মম অন্ধকার মৃত্যুর কাছে তা প্রার্থনা করেনি। এত বঞ্চনা সত্ত্বেও নীলোফা জীবনকে ভালবেসেছে—এ বড় কম কথা নয়! ওই দুই পোড়া দৃষ্টিতে আনিসুজ্জামানের কাছে নতুন উদ্ভাস এসেছিল। সেই উদ্ভাসে আমিনা আর সঞ্জিদার মুখ। আমিনা যখন আনিসুজ্জামানকে —মেঠা— বলে বুকে আঁকড়ে রাখেন তখন তাঁর মাতৃত্বে কোথাও সন্দেহ জাগে না। এই মাতৃত্ব আনিসুজ্জামানে বর্ষিত হল, নীলাফাতে হল না কেন? নীলোফা মেয়ে বলে! তার কোনও গতি নেই বলে! সঞ্জিদার ওই মৃত্যু-কামনা— তার মধ্যেও কি নিকৃষ্ট স্বার্থপরতা নেই! অথবা, নীলোফার প্রতি আমিনা ও সঞ্জিদার এই ব্যবহার হয়তো বিপন্নতারই অন্য প্রকাশ। নীলোফার অসহায়তা ঘোচাবার কোনও উপায় তাঁদের নেই বলে তাঁরা নিজেদেরও সমান অসহায় ও অভিশপ্ত জ্ঞান করেন যা ওই কঠিনভাবে বর্ষিত হয়।

আনিসুজ্জামানকে চুপ করে থাকতে দেখে নীলোফা বলেছিল, আম্মিকে আমি দোষ দিই না ভাইজান। আম্মির তো এমনিতেই কত কষ্ট! বড়আম্মা সবসময় ধমকায়। আব্বাজান বকে। আমার জন্য আম্মির কষ্ট আরও বেড়ে গেছে। কিন্তু আম্মিরও তো কোনও দোষ নেই। আম্মি তো এভাবে আমাকে জন্ম দেয়নি। সত্যিই, আমিই অপয়া, আমার মুখ আম্মিকেও দেখাই না আজকাল।

বোধহয় সে-দিন কথায় পেয়েছিল মুখচোরা, অবহেলিত নীলোফাকে। বদ্ধ স্রোতের মুখ একবার খুলে দিলে যা হয়।

আনিসুজ্জামান আবার বলেছিলেন, আমার সঙ্গেই যাবার কথা তুই ভাবলি কেন? আর কোথাও নয় কেন?

নীলোফা বলেছিল, আর কোথায় যাব? আর তো যাবার জায়গা নেই। আপনি যদি এ বাড়ি ছেড়ে অন্য বাড়ি না করতেন তা হলে অন্য জায়গায় যাবার কথা আমি ভাবতেও পারতাম না। অন্য কোথাও চলে গেলে এ বাড়ির বোঝা হালকা হবে। আমার কথা আর কেউ ভাববে না। কাজ তো আমি এখানেও করি, ওখানেও করব। আর আপনার ঘর সামলাবার জন্য একজন তো সত্যি দরকার। আপনি তো নিজে কিছুই করতে পারেন না ভাইজান। খাবার না দিলে খান না। রাত্রে বই খোলা রেখে আলো জ্বেলে ঘুমিয়ে পড়েন। পেন হারিয়ে ফেলেন। ঘড়ি নিতে, পার্স নিতে ভুলে যান। আপনাকে দেখাশুনা করার জন্যও একজন দরকার।

আনিসুজ্জামান একটু থমকে গিয়েছিলেন। এতখানি জানল কী করে নীলোফা! হয়তো আসতে যেতে লক্ষ করেছে। আকস্মিক ভাবনা ও অপ্রত্যাশিত প্রস্তাবে মাথায় চাপ অনুভব করছিলেন তিনি। প্রসঙ্গান্তরে যাবার জন্য বা আজন্মলালিত বোধের প্রেরণায় নিষ্ঠুরের মতো বলে ফেলেছিলেন, ধর, তুই গেলি আমার সঙ্গে নীলু, বেশ ঘর-সংসার সামলালি, আর আমি একখানা বিয়ে করে তোর ভাবি নিয়ে এলাম। আর তোর ভাবি তোকে সহ্য করতে পারল না। তখন কী হবে, তখন!

নীলোফা চুপ করে ছিল। তারপর বিষণ্ণ গলায় বলেছিল, ভাইজান, আপনি বিয়ে করলে তা সবারই কাছে সুখের বিষয় হবে। আমার কাছেও। তবে ভাবি আমাকে তাড়িয়েও দিতে পারেন। কিন্তু এখানেও যে আম্মি আর আব্বু না থাকলে আমার একই দশা হবে না তা কে বলতে পারে? আসলে আমি যেখানেই যাব আমার একই ফল হবে। আমি না-হয় তখন ভাবির পা আঁকড়ে থাকব। কিন্তু ছোট থেকে যাদের দেখছি, যে-বাড়িতে বড় হলাম, যে-বাড়িতে আমার অন্য বোনেদের মতোই যত্নে ও আদরে প্রতিপালিত হওয়ার কথা, সেখানেই থাকার জন্য কারও পায়ে পড়তে আমার অনেক বেশি কষ্ট হবে।

আনিসুজ্জামানের মনে হয়েছিল, বোরখার আড়ালে যোলো বছরের নয়, ছত্রিশ বছরের মহিলা বসে আছে। খুবই সচেতন নীলোফা, খুবই স্বচ্ছ তার চিন্তাধারা। এই বাড়ি, এই পরিবার তার অধিকারের জায়গা। এখানে নিজের স্থান প্রতিষ্ঠার জন্য সে মাথা নিচু করতে চায় না। সেখানে তার দারুণ অপমান, কারণ সে-অপমানে অভিমান আছে। নীলোফার প্রতিটি বেদনা ও আবেদন মনে মনে স্পর্শ করেন আনিসুজ্জামান কিন্তু এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার তিনি কেউই নন এ কথা তাঁর মনে হয়। নীলোফার অনুরোধ খুব বড় নয় কিন্তু খুবই জটিল। নীলোফা বড় হয়েছে। শুধুমাত্র এই অনুভবেই সমাজ, পরিবার ও বক্রকুটিল দুনিয়াদারির দুর্বহ ভার তাঁর ওপর চেপে বসে। ফলে তাঁর এই বোধ লোপ পেল, কী বলা উচিত বা উচিত নয়। মুখ পিছলে বেরুল, কিন্তু আমি রাজি হলে কিছু হবে না। চাচুজান আছেন। আর লোকজন নানা কথা বলাবলি…

নীলোফা মৃদু শব্দ করে হেসেছিল। সে-হাসি এত তীক্ষ্ণ বিঁধছিল যে আনিসুজ্জামান থেমে গিয়েছিলেন। নীলোফা বলেছিল, আমি কিছুরই যোগ্য নই, ভাইজান। আমাকে নিয়ে কেউ কিছু বলবে না। আমি নিন্দারও বাইরে। আনিসুজ্জামান দু’হাতে মাথা চেপে ধরেছিলেন। কী বলছে মেয়েটা! আমি সমস্ত নিন্দার বাইরে— হায়! মানুষ কোথায় পৌঁছলে এ কথা বলতে পারে! যন্ত্রণার কোন গভীরতম জায়গায়!

খুক খুক— শোনা গেল তখন। বাইরে। কাশির মৃদু শব্দ। সঞ্জিদা এসে দাঁড়ালেন। আনিসুজ্জামান হালে পানি পাবার মতো স্বস্তি বোধ করেছিলেন তাঁর উপস্থিতিতে। যদিও সঞ্জিদা আমিনার মতো নন, আনিসুজ্জামানের কাছে একটু দূরের মানুষ, তবু, নীলোফার সঙ্গে এতগুলো আশ্চর্য সংলাপের পর সঞ্জিদা আশীর্বাদের মতো প্রতিভাত হন তাঁর কাছে। তিনি চেয়ার এগিয়ে দেন। সঞ্জিদা হাঁফাতে হাঁফাতে বসেন। সেই মুহূর্তে তাঁর বোরখা পরা ছিল না। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল জীবনের সমস্ত ভার বইতে বইতে রক্তশূন্যতা এসে গেছে। শীর্ণ আঙুলে দু’বার মুখ মুছলেন তিনি। দু’টি নিষ্প্রভ চোখ মেলে চাইলেন আনিসুজ্জামানের দিকে। কিছুক্ষণ, যেন কী বলবেন জানেন না, এমনই ভঙ্গি, যেন গুছিয়ে নিচ্ছেন মনে মনে। বললেন, আজই তবে সব নিয়ে যাবে, মেঠা?

ঘুমন্ত বীণার মতো শুনিয়েছিল তাঁর স্বর। আনিসুজ্জামান বইয়ের স্তূপের ওপর বসতে বসতে বলেছিলেন, হ্যাঁ। আপনার শরীর ভাল তো, চাচি?

নিজের ঘরখানিকে অচেনা লাগছিল আনিসুজ্জামানের। এমন আড্ডা তাঁর ঘরে কখনও বসেনি।

সঞ্জিদার উত্তর দীর্ঘশ্বাস সমেত পাওয়া গিয়েছিল—আর শরীর! এ নিয়ে আর ভাবি না। যে ক’দিন টানতে পারি, থাকব।

আনিসুজ্জামান চুপ করে ছিলেন। নীলোফাও। এমনকী সঞ্জিদা ও নীলোফার মধ্যেও কোনও কথা বিনিময় হয়নি।

সঞ্জিদা বরাবরই কৃশ ও দুর্বল। মৃদু গলায় কথা বলেন। সবসময়ই সকলের কাছে সন্ত্রস্ত ভাব। তাঁকে দেখে মনে হয় কোনও বধ্যভূমিতে বুঝি এসে পড়েছেন। তাঁর নিজস্ব ভীত-সন্ত্রস্ত ভার বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল মানরুলের সান্নিধ্যে এসে। বা, বলা যেতে পারে, তিনি সেই নিরীহ প্রাণীটি যাকে নিরন্তর দুটি জাঁদরেল বাঘের কাছে বসে থাকতে হয়। আমিনা, খুব স্বাভাবিক অধিকার বোধে সঞ্জিদার প্রতি স্নেহশীলা নন এবং অসহিষ্ণুও অনেকটা। বিশালদেহী, স্পষ্টভাষী ও ব্যক্তিত্বময়ী আমিনা এবং ক্ষীণ, দুর্বল, মুখচোরা সঞ্জিদা সম্ভবত খোদার দুই পরীক্ষামূলক সৃষ্টি যাঁদের একই সঙ্গে ধর্মপ্রাণ মনিরুলের জীবনে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আর মনিরুল, যিনি আমিনাকে যথার্থ ভয় পান এবং এ জন্য মনে মনে কোনও হীনম্মন্যতা তাঁর থেকে থাকবে, যা থেকে মুক্তি পেতে সম্পূর্ণ প্রভুত্ব সঞ্জিদার ওপরই তিনি আরোপ করেন। তিনি কত বড়, তাঁর গুরুত্ব ও জোর কতখানি তা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সঞ্জিদার সঙ্গে স্বাভাবিক কথা বলাই ভুলে বসেছেন। স্বাভাবিক ভাবে তিনি যদি বলতে চান— এক গ্লাস জল আমাকে দাও— তবে, সঞ্জিদার ক্ষেত্রে তা এভাবে অনুদিত হয়ে বেরিয়ে আসে যে— হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছ কেন নিষ্কর্মার বেটি? আমাকে যে এক গ্লাস জল দিতে হয় তাও শিখে আসোনি?

সঞ্জিদা কেঁপে ওঠেন। জল আনতে গ্লাস পড়ে যায় হাত ফসকে আর আমিনা বলেন, আদরের বেটি, শুধু ভাঙতেই জানে। খেটে খাবে সে-কপাল নাকি ওর! আর সঞ্জিদা নিজেকে ধিক্কার দেন। এই জন্মকে তাঁর অপজন্ম মনে হয়। সন্তানদের প্রতি স্নেহবশত তিনি জীবিত থাকার রসদ সংগ্রহ করতে চান এই বাড়ির চার দেওয়ালে, জানালায়, বাইরেকার ঘিঞ্জি রিপন স্ট্রিট, ফেরিওয়ালার ফেরি করে যাওয়া, ফলওয়ালার নানা রঙের ফল ও অচেনা-অজানা পথচলতি মানুষের মুখে। এই সমস্ত সত্তা ও দৃশ্যাবলিকে সঞ্জিদা ভালবাসেন আপন দেহত্বকের মতোই যাতে ছ্যাঁকা লাগলে জ্বলে। বিনোদন বলতে সিনেমা, সে-দেখতে মাঝে মাঝে যাওয়া হয়। আমিনার নেতৃত্বে এবং কর্তাদের ইচ্ছায় স্থির হয় যে, কোন ছবি কোন প্রেক্ষাগৃহে দেখা হবে। তাঁরাই টিকিট কাটিয়ে আনার ব্যবস্থা রাখেন এবং বাড়ির মেয়েরা বোরখায় নিজেদের আড়াল করে গাড়ি চেপে সিনেমা দেখতে যায়। এ নিয়ে কারও কোনও অভিমান অভিযোগ নেই। কড়া অনুশাসন থাকলে বরং সকলের মধ্যে একটা নিরাপত্তার বোধ জাগে। মনে হয়, হ্যাঁ, এই তো জীবন। কিছু হারাবার ভয় নেই। কোথাও অনভিপ্রেত কিছু ঘটছে না।

সঞ্জিদা যাই হোন, যতই ক্ষীণ আর দুর্বল, আনিসুজ্জামান তাঁকে, নীলোফার মা হিসেবে, সব কথা বলার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছিলেন। বলেছিলেন, নীলু, চাচিকে তবে বলি?

নীলোফা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিল। আনিসুজ্জামান বলেছিলেন, নীলোফা একটি পাগলের প্রস্তাব করেছে চাচি। আমার দেখভাল করার জন্য ও আমার সঙ্গে যেতে চায়।

সঞ্জিদার চোখ দু’টি আরও ম্লান হয়েছিল। বলেছিলেন, আমি জানি। বাপজান!

—জানেন!

—হ্যাঁ। নীলু ক’দিন ধরেই আমাকে বলেছে। আমি ভাবলাম, সেই ভাল। ও চলেই যাক। মেঠা, আমি আর বাঁচব না বেশিদিন। তোমার বড়চাচিও যে-কোনও দিন চলে যাবেন। তোমার চাচা আবার নিকাহ্‌ করছেন। নীলু এখানে থাকতে পারবে না। তোমাকে বলার জন্য বলেছিল আমাকে ও। আমি ভাবলাম নিজেই বলুক। ওর কষ্ট আমরা তো সবটা বুঝি না।

তখন উঠে পড়েছিল নীলোফা। আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। যেন তার আর কিছু বলার নেই। শোনার নেই। আনিসুজ্জামানের ভেতরটা ব্যথায় টাটিয়ে উঠেছিল। একটা মানুষ, একটা নির্দোষ মানুষ, কী আশ্চর্য অসহায়, নিরাশ্রয়, নির্বান্ধব। আনিসুজ্জামান মনে মনে আব্বাজানের মুখ স্মরণ করেছিলেন। মনে হয়েছিল সে-মুখে প্রসন্নতা। কিন্তু আনিসুজ্জামান নিজে দ্বিধা কাটাতে পারেননি। সঞ্জিদাকে বলেছিলেন, কিন্তু, ও বড় হয়েছে চাচি। বাড়িতে সব কী বলবে! চাচা, বড়চাচি, অন্যেরা?

সঞ্জিদা বহু দূর থেকে বলেন, ও আমার মেয়ে। আমি ওকে জন্ম দিয়েছি। ওর কীসে ভাল হবে তা আমার চেয়ে বেশি আর কে জানবে! আমি তোমাকে বিশ্বাস করি মেঠা। তুমি ওর ক্ষতি করবে না। তুমি আর সবার মতো তো নও। ওকে নিয়ে যাও সঙ্গে। কেউ কিছু বলবে না। সবাই ওকে ভুলতেই চায়। আমি আপার সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি কিন্তু রাজি আছেন।

—বড়চাচি রাজি? আপনারা এটা নিয়ে কথাও বলেছেন?

—হ্যাঁ, আমি ছাড়া ওই একজনই যার নীলুকে নিয়ে ভাবনার শেষ নেই।

—চাচা? তাঁকে বলেছেন? তাঁর মতই তো প্রধান।

—তোমার কথা বলো মেঠা। তোমার তো কোনও আপত্তি নেই ওর দায়িত্ব নিতে?

—দায়িত্ব?

—তোমার সঙ্গে থাকলে ওর ভাল-মন্দ তো তোমাকেই বুঝতে হবে বাপজান!

—হ্যাঁ, তা বটে। না, আপত্তি কী? একা থাকার চেয়ে তো ভাল! কিন্তু চাচাকে আগে বলুন। তাঁর মত নেওয়া দরকার।

—তাঁকে তুমি বলো মেঠা। আমার নাম করেই বলো।

—আমি? আমি কী বলব! চাচা তো আমাকে বিশ্বাসও করেন না আমি হিন্দু-ঘেঁষা বলে—

—উনি কবে কী বলেছেন তা মনে রেখো না। তোমাকে এ পরিবারে সকলেই বিশ্বাস করেন। আমি থাকব। তুমি কথা তোলো। এ বাড়িতে একমাত্র তুমিই পারো তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে।

শুধুমাত্র এই কথাটুকুর জন্য তিনি রাজি হয়েছিলেন। এই স্বীকৃতিটুকুর জন্য যে মনিরুলের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার ক্ষমতা তাঁর আছে বলে কখনও কখনও কেউ কেউ তাঁর ওপর নির্ভর করে থাকে। ফলে প্রসঙ্গটি মনিরুলের কাছে উত্থাপন করা কঠিন হওয়া সত্ত্বেও তিনি তা করেছিলেন।

সে-দিন বইগুলো ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়ে আবার ফিরে এসেছিলেন আনিসুজ্জামান। রাত্রে তাঁকে দেখে মনিরুল বলেছিলেন, ও, তুমি আজও যাওনি?

আনিসুজ্জামানের মনে হয়েছিল, তাঁর যাওয়াটি বুঝি খুবই কাম্য সকলের। এবং এই উপস্থিতিটুকুও প্রত্যাশিত নয়। সঞ্জিদা যেমন বলেছিলেন সকালে, নীলোফাকে সবাই ভুলতে চায়, তেমনই আনিসুজ্জামানের মনে হয়েছিল তাঁকেও সকলে ভুলতেই চান। কিন্তু কেন? তিনি তো গলগ্রহ নন! নির্ভরশীল নন! পারিবারিক অনুশাসন মানেন না বলেই কি তাঁকে একটি অবাঞ্ছিত টিউমারের মতো ছেঁটে ফেলে দেওয়া হচ্ছে?

মনিরুলের কথার প্রেক্ষিতে আনিসুজ্জামান সরাসরি নীলোফার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করার আর্জি পেশ করেছিলেন। ভাবখানা এমন ছিল যে মনিরুলই যেহেতু নীলোফার জন্মদাতা সেহেতু তাঁর যে-কোনও প্রস্তাবের জন্য তিনিই দায়ী থাকেন! তখন অন্যান্য ভাইদের কথা থেমে গিয়েছিল এবং তারা উৎসুক চোখে চেয়ে ছিল শুধু জানতে যে মনিরুল কী বলেন এবং মনিরুল তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন এই বলে যে— তোমাদের কি মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেল?

খুব বড় আশ্চর্যের ঘটনা সে-দিন মনিরুলের পরিবারে ঘটেছিল। বাড়ির দুই বউয়ের ওপর ভার রেখে নিজেকে হিঁচড়ে আমিনা সবার মাঝখানে নিজেকে এনে ফেলেছিলেন। তাঁর পাশে ছিলেন বোরখায় ঢেকে সঞ্জিদা। তাঁরা দু’জনে মিলে নীলোফার যাবার সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছিলেন। রাগে হোক বা বিস্ময়ে মনিরুল নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন তখন। কোনও সিদ্ধান্ত বাড়ির মেয়েরা তাঁকে টপকে খোলা গলায় ঘোষণা করছেন, এ তাঁর কল্পনাতীত ছিল। কল্পনাতীত অন্যান্য ভাইদের পক্ষেও। তারা তাদের স্ত্রীদের বোরখা-ঢাকা মুখ দেখতে পাচ্ছিল না। কিন্তু এ কথা ভেবেছিল যে পরিবারের হাওয়া পালটাচ্ছে। ফলে তাদেরও নির্বাক থেকে ঘটনার শেষ দেখতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত মনিরুল বলেছিলেন, তোমরা সবাই যদি চাও, তবে যাবে।

আপত্তি করেছিলেন এবং আপত্তি খণ্ডনও করেছিলেন সহজেই। কারণ নতুন বিবির জন্য নীলোফার মতো চিরস্থায়ী যন্ত্রণাকে তিনিও ঘরে রাখতে চাননি। সে-দিনই মধ্যরাতে সঞ্জিদার সঙ্গে কিছু গূঢ় আলোচনা তাঁর হয়েছিল যা নীলোফা শুনে ফেলেছিল এবং কোনওদিন ভোলেনি।

১১

গাছের চারাগুলো হাতে নিয়ে বেরোবার উদ্যোগ করলেন বিকাশ। আজ রবিবার। অফিস ছুটি। কাল সন্ধ্যায় গিয়ে পাড়ার রেললাইনের দিকটি তিনি বেছে এসেছেন। ওই দিকেই পুরনো ক্লাব। ক্লাবের আশেপাশে গাছ লাগিয়ে দিলে বেশ হয়। ক্লাবের ছেলেগুলোকে ডেকে নিলে এই কাজে সাহায্য করতে পারবে ভেবে তিনি বাগানের কোণ থেকে শাবলটা হাতে তুলে নিলেন। তাঁর নিজের বাগান একফালি। তারই মধ্যে জবা, বোগেনভেলিয়া ও টগর গাছ। কোণে একখানি নিম। তাকে জড়িয়ে উঠেছে মাধবীলতা। টগর গাছের গায়ে জড়িয়ে আছে জুঁইলতা। দেবার্চন খুব গাছ ভালবাসত। ওই মাধবীলতা দেবার্চনের লাগানো। টগরটাও। মল্লিনাথের বাড়ি থেকে সংগ্রহ করে এনে লাগিয়েছিল সে। স্পষ্ট মনে আছে বিকাশের। স্বাভাবিকভাবে যেগুলো মনে থাকার কথা নয়, সে-দিনের বিষয়ে সেগুলোও তাঁর মনে পড়ে যায়। আশ্চর্য সুন্দর স্বাস্থ্য নিয়ে লতিয়ে উঠছে মাধবীলতাটি। বসন্ত প্রায় শেষ হয়ে এল। এখনই দু’-একগুচ্ছ ফুল দিয়েছে। বেল, জুঁই, মাধবী ফোটার এই প্রকৃষ্ট সময়। এই শেষ বসন্ত।

দেবার্চন গাছ ভালবাসত বলেই সারা পাড়া গাছে ভরিয়ে দেবার কথা ভেবেছেন বিকাশ। ও থাকলে নিশ্চয়ই খুশি হত। তিনি আকাশের দিকে তাকান। এখনও তেমন বেলা হয়নি। তবু রোদের তেজ এসে গেছে। তাঁর মনে হল, ওইখানে কি আছে দেবার্চন? ওই নক্ষত্রলোকের কোনও একটিতে?

ছেলেবেলায় এরকমই বিশ্বাস করতেন তিনি। কেউ মরে গেলে, আকাশের তারা হয়ে যায়। আজও, এই পঞ্চান্ন উত্তীর্ণ বয়সে, বিশ্বাস করতে বড় ইচ্ছে হয়।

স্নান করে একবস্ত্রা হয়ে এতক্ষণ গীতা পড়ছিলেন লক্ষ্মী। এতক্ষণে তাঁর খেয়াল হল বিকাশ বেরিয়ে যাচ্ছেন। এক ছুটে জানালায় চলে এলেন তিনি। বললেন, কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি?

বিকাশ কোনও কথা বলছেন না। মাটিতে ঠুকে ঠুকে শাবল থেকে মাটি ঝাড়ছেন। লক্ষ্মী এ বার অসহিষ্ণু হলেন। বলতে থাকলেন, সক্কালবেলায় কাজ নেই, কর্ম নেই, উনি চললেন সবুজ গড়তে। আশ্চর্য! এরকম লোকও হয়! সারাজীবন জ্বালিয়ে মারল আমাকে। সারাজীবন!

বিকাশ মাথা তোলেন এ বার, কী চাই, বলো!

—বড় খোকা,আজ বাড়ি আছে। ওকে একটু লুচি করে দেব না? ময়দা এনে দাও। ডালডাও লাগবে খানিকটা। তা ছাড়া বাজার-টাজারও তো করতে হবে।

—ময়দাটা এনে দিয়ে যাচ্ছি। গাছগুলো লাগিয়ে এসে বাজার করব।

—না। ওই অত বেলায় আমি রাঁধতে পারব না। আগে বাজার করে দিয়ে তুমি যা ইচ্ছে করো। তা ছাড়া শেফালির মাকে আসতে বলেছি। স্কুলটা একটু ঝাঁটপাট দেবে। পুরনো কাগজ জড়ো করে বেচে দেবে। তুমি দাঁড়াবে ওখানে।

সাংসারিক নানা বিষয় চিরকালই তাঁর ইচ্ছের অভিমুখ বদলে দিয়েছে। মাঝে মাঝে তাঁর এই জীবন-যাপনকে বাধ্যতামূলক মনে হয়। মাঝে মাঝে অর্থহীন লাগে। যদি তাঁর জীবন এরকম না হয়ে অন্যরকম কিছু হত, ধরা যাক তিনি বিবাহ করেননি, চাকরি করেননি, ঘুরে বেড়াচ্ছেন যেমন খুশি…তা হলে যা পেয়েছেন তার চেয়ে কি কিছু কম পাওয়া হত? এই গতানুগতিক পথেই কি জীবন সবচেয়ে বেশি দেয়? বিকাশ জানেন না। লক্ষ্মীর নানা আচরণ আজকাল অসহ লাগে। তবু বিকাশ কথা বাড়ান না। চারাগুলো ছায়ায় রেখে শাবল নামিয়ে হাত পাতেন, টাকা দাও।

লক্ষ্মী টাকা নিয়ে ফেরেন। বাজারের দিকে চলে যান বিকাশ। পথে প্রণবেশের সঙ্গে দেখা হয়। খুব অন্যমনস্ক হয়ে আসছিলেন প্রণবেশ। দু’বার পাথরে হোঁচট খেলেন। কাছাকাছি হতেই বললেন, বিকাশদা, আমার ছেলেটাকে পাচ্ছি না।

—পাচ্ছ না! তার মানে?

বিকাশ প্রণবেশের কথার মানে ধরতে পারেন না, প্রণবেশের ছেলে খুবই ছোট। বছর সাতেক বয়স। কী হল তার?

প্রণবেশের চোখে জল আসে। বাঁ হাতে জল মুছে বলেন, ফারাক্কা থেকে আসছিলাম। জুঁই এক সপ্তাহ আগে ছেলেকে নিয়ে আমার ওখানে গিয়েছিল। কয়েকদিনের ছুটি নিয়েছিলাম ওদের নিয়ে পুরী যাব বলে। কালই যাবার কথা। ভোরবেলা আমি আর জুঁই উঠে দেখি বাপ্পা নেই।

—কোথায় ছিল ও?

—আমার পাশেই ছিল। জুঁই একটা বার্থে ছিল। অন্যটায় আমি আর বাপ্পা। কী করি বিকাশদা? কোথায় খুঁজি?

—বউমা কোথায়?

—ও খুব কান্নাকাটি করছিল। ওকে ভবানীপুরে ওর বোনের বাড়ি রেখে এলাম।

বিকাশ কী বলবেন ভেবে পান না। প্রণবেশ দ্রুত চলে যান। বিকাশের ইচ্ছে হয় বলেন— কোথায় খুঁজবে ছেলেকে? থানায় যাবে? আমি কি তোমার সঙ্গে থাকব প্রণবেশ? কিন্তু বলা হয় না। ময়দা আর ডালডা নিয়ে ফিরতে হবে। নইলে লক্ষ্মী অনর্থ করবেন। ময়দা আর ডালড়া? বিকাশের নিজের ওপর রাগ হয়। ময়দা, ডালডা, আলু, চাল, বিজয়া দশমী আর নববর্য করেই জীবন কেটে গেল। এতগুলো বছর পৃথিবীর কোনও যুদ্ধে, কোনও উত্থানে-পতনে নিজেকে শামিল করেননি তিনি। শুধু নিজেরটা গুছিয়েছেন। তাঁরই ছেলে হয়ে দেবার্চন কেমন করে অত বড় কাণ্ডে জড়িয়ে পড়ল? কেমন করে ওইরকম অসাধারণ স্বপ্নের জন্য বিলিয়ে দিল নিজেকে? দেবাশিস কিন্তু ও পথে পা বাড়ায়নি। সে বিকাশের মতোই হয়েছে। স্বার্থপর। বিলাসী। বড়লোক হওয়ার স্বপ্নে মশগুল।

পঞ্চার মুদি-দোকানের দিকে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর আবার মনে পড়ে প্রণবেশের কথা। পাশে দাঁড়াবার মতো কেউই নেই প্রণবেশের। একটা মাত্র ভাই ছিল। দেবার্চনের মতোই অসম্ভব স্বপ্ন দেখতে দেখতে সে হারিয়ে যায়। প্রণবেশ সবে বিয়ে করেছেন তখন। ছেলে হয়েছে। ভাই যে একটা গোপন কিছুতে জড়িয়ে পড়ছে বুঝতে পারেননি তখন। বিকাশ নিজেই কি বুঝেছিলেন? একই কলেজে পড়ত দেবার্চন আর নীলাদ্রি। বিকাশের ছোট ছেলে আর প্রণবেশের ছোট ভাই। সিটিতে। একসঙ্গেই কলেজ যেত তারা। আরও অসংখ্য তরুণের সঙ্গে একই মুহূর্তে তারা স্বপ্নের বীজ বুনতে শুরু করে। কারওকে জানতে না দিয়ে। বুঝতে না দিয়ে। সেই স্বপ্নের খবর রাখত মাত্র কয়েকজন। পার্টি। পুলিশ আর ওরা। ওই স্বপ্নদ্রষ্টারা।

ভাইকে হারিয়েছেন প্রণবেশ। আজ ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছেন না। পঞ্চাকে এক কেজি ময়দা ও এক প্যাকেট ডালডার কথা বলে বিকাশ ভাবতে থাকেন। প্রণবেশ নিশ্চয়ই এখন নিজের মধ্যে নেই। কোথায় যাবে, কী করবে কে জানে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন চারাগুলো আজ আর লাগানো হবে না। বরং ময়দা-টয়দা বাড়িতে দিয়ে প্রণবেশের সঙ্গে থাকবেন। যেখানে যেখানে সে যেতে চায়, নিয়ে যাবেন। জিনিস নিয়ে দাম মিটিয়ে দ্রুত হাঁটেন তিনি। একবার পকেটে হাত দিয়ে টাকা কত আছে দেখে নেন। এতে হবে না। কিছু নিতে হবে আরও। টাকাপয়সা সবই লক্ষ্মীর কাছে থাকে। চাইতে হবে। বিকাশ জানেন, খুবই চেঁচামেচি করবেন লক্ষ্মী। তব চাইতেই হবে। কে জানে, প্রণবেশ কতটা তৈরি হয়ে বেরুবেন!

সকাল প্রায় ন’টা। দেবাশিস তখনও ঘুমোচ্ছিল। লক্ষ্মী তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিলেন। তাঁর দীর্ঘ ভেজা চুল বিছানা ছাড়িয়ে মাটিতে এসে পড়েছে। পূজাপর্ব শেষ করে, স্বামীকে সাংসারিক কাজে প্রবৃত্ত করে তিনি সন্তানসুখ গ্রহণ করছেন। একটা পা তিনি ছেলের গায়ে তুলে দিয়েছেন। দেবাশিস মায়ের বুকে মুখ দিয়ে শুয়ে আছে। লক্ষ্মী তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।

বিকাশ ঘরে এসে বললেন, লক্ষ্মী, কুড়িটা টাকা দাও।

লক্ষ্মী মুখ ফেরালেন। দেবাশিসও মুখ তুলে একটু আড়মোড়া ভাঙল। বিকাশ বললেন, তাড়াতাড়ি দাও লক্ষ্মী।

লক্ষ্মী উঠে বসে বললেন, কেন?

—প্রণবেশের ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না। ওর সঙ্গে যেতে হবে।

—পাওয়া যাচ্ছে না। সে কী! ওইটুকু ছেলে কোথায় যাবে?

—সেটাই তো কথা।

—কী করে হারাল?

—সে অনেক কথা। পরে শুনো। আগে টাকাটা দাও।

—কিন্তু তুমি কোথায় যাবে?

বিকাশ বিরক্ত হন। বড় প্রশ্ন করেন লক্ষ্মী। সময় অসময় বোঝেন না। বিকাশের প্রতিটি পদক্ষেপ তিনি নিজের মুঠোয় পুরে রাখতে চান। একটু অসহিষ্ণু হয়ে বলেন, সে তো আমিও জানি না। ওর সঙ্গে থাকতে হবে। ব্যস।

লক্ষ্মী বিছানা থেকে নামতে নামতে বলেন, তুমি ছাড়া আর লোক নেই? পৃথিবীর সবার সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব কি তুমি একা নিয়েছ? কার ছেলে মরল, উনি শ্মশানে চললেন। কার ছেলে হারাল, উনি খুঁজতে চললেন। আশ্চর্য!

বিকাশ বললেন, কার ছেলে মরার কথা তুমি বলছ লক্ষ্মী? মল্লিনাথদার? সে-দিন আমি শ্মশানে যাইনি কিন্তু!

লক্ষ্মী আলমারির দিকে যেতে যেতে বলেন, আজই-বা তোমাকেই যেতে হবে কেন? পাড়ায় আর লোক নেই! খেলে না-দেলে না। বাজার-হাট নেই। উনি চললেন।

—বাজার-হাট তো একটি দিন বড় খোকাও করতে পারে।

—ওর একটা দিন ছুটি। সেও তুমি বাজার-হাট করতেই পাঠিয়ে দাও! ও তো ছেলেমানুষ এখনও! ওর তো একটু শুয়ে-বসে আরাম করতে ইচ্ছে করে। সবাই তো তোমার মতো পায়ের তলায় চাকা লাগিয়ে টো-টো ঘুরে বেড়ায় না!

বিকাশ কথা বাড়ান না। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে প্রণবেশের বাড়ির দিকে হাঁটেন। পাড়ার দক্ষিণপ্রান্তে প্রণবেশের বাড়ি। চলতে চলতে মনে মনে লক্ষ্মীর কথার জবাব দিতে থাকেন তিনি—হ্যাঁ, বড় খোকা এখনও ছেলেমানুষ। সাতাশ বছর বয়স হল, এখনও ছেলেমানুষি গেল না। ওর বয়সে আমি কত দায়দায়িত্ব নিয়েছিলাম তোমার জানা নেই।

মনটা তেতো হয়ে যায় বিকাশের। লক্ষ্মী এখনও বড় খোকাকে বাচ্চা করে রেখেছেন। ছোট ছেলের মতো ওকে জড়িয়ে ধরেন। চুমু খান। এখনও বড় খোকা পাশে না থাকলে লক্ষ্মীর ঘুম হয় না। বিকাশের কষ্ট হয়, একটু ঈর্ষাও হয়। লক্ষ্মী কবেই বিকাশকে বিছানা থেকে আলাদা করে দিয়েছেন! পরক্ষণেই লজ্জা পান তিনি! ছি ছি! এ সব কী ভাবছেন! কিন্তু ছেলের প্রতি এখনও এত আদর অতিরিক্ত মনে হয় বিকাশের। লক্ষ্মী যাই ভাবুন, বিয়ের বয়সই তো হয়ে এল ছেলের।

প্রণবেশ আসছিলেন। বিকাশ বললেন, কোথায় যাবে বলে ঠিক করলে?

—জানি না। বিকাশদা। ভবানীপুরে যাই। সুব্রত আছে ওখানে। ভায়রাভাই। ওর সঙ্গে কথা বলে যা হোক ঠিক করা যাবে।

—আমি ভাবলাম তোমার যদি প্রয়োজন হয়। সঙ্গে যাব বলে তৈরি হয়ে বেরোলাম। পাড়ায় আরও কয়েকজনকে বলে দেখবে? কেউ যদি কোনও সাহায্য করে?

প্রণবেশ চুপ করে থাকেন। ধীরে ধীরে পাশাপাশি হাঁটতে থাকেন তাঁরা। একসময় প্রণবেশ বলেন, এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সাহায্য করতে পারে পুলিশ। একটা মিসিং ডায়রি তো করতেই হবে আমাকে। বাপ্পার একটা ছবি নিতেই এসেছিলাম।

দু’জনেই চুপ করে যান এবার। দু’জনেই দু’জনের মনের কথা টের পান। পুলিশ। পুলিশের কাছে যেতে হবে। দু’জনেরই মনে হয়—পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণ্যতম জীব কী?

—পুলিশ।

সবচেয়ে নোংরা জায়গা কোনটা?

—থানা।

সবচেয়ে বিবর্ণ কী?

—পুলিশের চোখ।

সবচেয়ে কঠিন কী?

—পুলিশের অস্ত্র।

সবচেয়ে অসহনীয় কোনটা?

—ওদের মৃত্যুদণ্ড। ওদের মার। যা দিয়ে ওরা আমাদের ভাইকে কেড়ে নিয়েছে। আমাদের ছেলেকে কেড়ে নিয়েছে।

দু’জনের চোখের সামনেই সারা পৃথিবীর রং খাকি হয়ে যায়। এবং খাকি রঙের কেন্দ্রে থাকে সাদা উর্দি। তাঁদের দৃষ্টিশক্তির সমস্ত অনুভূতিতে এইসব উর্দিপরা মানুষেরা কঠিন চোয়ালে ঘোরাফেরা করতে থাকে। আর-সব রং মুছে যায়। সমস্ত শব্দ জিপের শব্দের মতো লাগে। বাতাসে শুধু পেট্রল আর বারুদের গন্ধ। ওরা যখন রেইড করত, হঠাৎ আসত, জিপের স্টার্ট বন্ধ করত না। ভীষণ যন্ত্রণায় একটানা কোঁ কোঁ কোঁ করে চলত গাড়িটা।

এখন সবকিছুই স্বাভাবিক। শুধু কয়েকটা দেওয়ালে বুলেটের দাগ থেকে যাবে। রং করলেও যাবে না। কয়েকটা রাস্তায় আর ময়দানে, কয়েকটা গলিতে আর কয়েকজনের হৃদয়ে টকটকে লাল তাজা রক্ত ছড়িয়ে থাকবে। কোনওদিন মুছবে না। শুকোবে না।

—তবু, আমাদের পুলিশের কাছেই যেতে হবে।

—তবু, আমাকে পুলিশের সাহায্যই নিতে হবে।

দু’জনে একটা রিকশা নিলেন। বিকাশ স্থির জানেন না যে যেখান থেকে বাপ্পা হারিয়েছে সেখানেই ডায়ারি করতে হবে নাকি স্থানীয় থানাতেই সাহায্য পাওয়া যাবে। তাঁর নির্দেশে রিকশা থানার দিকে চলল। মাথুরের গড় থেকে বরানগর থানা বেশ দূরে। গঙ্গার গায়ে। বাজারের কাছটায় এসে প্রণবেশ বিকাশের হাত আঁকড়ে ধরলেন, বিকাশদা, ওই থানাটা …ওখানে আমাকে তিনদিন আটকে রেখেছিল…!

বিকাশ দেখলেন প্রণবেশের কপালে বড় বড় ঘামের ফোঁটা জমেছে। চোখ দু’টি লাল হয়ে উঠেছে। তিনি বলছেন, তিনদিন, বিকাশদা, আমাকে একটা নোংরা ঘরে আটকে রেখেছিল…ঘরটায় কোনও জানালা ছিল না।

উঁচু-নিচু পাথর ওঠা রাস্তা দিয়ে এগোচ্ছিল রিকশাটা। খুবই ঝাঁকুনি হচ্ছে। বরানগরের এ দিকটা প্রাচীন। ঘরবাড়িতে ঠাসা। ছোট ছোট ইঁটের বাড়ি। দেওয়াল ফেটে গাছ গজিয়ে গেছে। ঘরের মধ্যে আশ্চর্য অন্ধকার। জানালার পর্দা না দিলেও কিছুই দেখা যাবে না বাইরের থেকে। প্রণবেশ আরও জোরে বিকাশের হাত আঁকড়ে ধরছেন। যেন বিকাশের রক্তমাংসে তাঁর নখ ডুবে যাবে। বিকাশ কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। প্রণবেশ বলছেন, তখন বিকাশদা, তিনদিন আমি কিছু খাইনি। একবিন্দু জল পর্যন্ত না। ওরা শুধু প্রশ্ন করত।… হাজার হাজার প্রশ্ন.… আমার ডিহাইড্রেশন হয়ে গিয়েছিল.… আমার ছেলে তখন ছোট, দেড় বছরের, বিকাশদা আমি মরেও যেতে পারতাম, কিন্তু তবু আমার ভাইকে আমি পুলিশের হাতে দিইনি…।

বিকাশের ঠোঁট কেঁপে যায়। রিকশার হাতলটা জোরে আঁকড়ে ধরেন তিনি। তাঁর নাকে কূট গন্ধ লাগে। এ কি বারুদের গন্ধ! হ্যাঁ, বারুদেরই হবে কারণ থানা নিকটতর হচ্ছে। এ কি রক্তের গন্ধ! হ্যাঁ, রক্তেরই গন্ধ! কারণ থানা আর একটু এগোলেই। থানা থেকে রক্তের গন্ধ আসবে, বারুদের গন্ধ আসবে— এটাই স্বাভাবিক। থানা মানে পুলিশ, মানে আরক্ষা, মানে শক্তি। রক্ষা আর শক্তির সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে। হয়তো বর্তমানের মতোই পরবর্তীকাল এই সম্পর্ক বহন করে নিয়ে যাবে কোনও মহাজাগতিক পরিণতির কাছে!

রিকশা এ বার গঙ্গার পাড় দিয়ে চলতে শুরু করেছে। আর একটুখানি, মাত্র একটুখানি এগোলেই থানা। বিকাশ চিৎকার করেন, থামাও, থামাও তো ভাই।

রিকশা পরোয়া করে না। বলে, থানায় যাবেন বললেন! থানা তো সামনেই বাবু।

বিকাশ দারুণ অসহিষ্ণু হয়ে বলেন, আঃ, তোমাকে থামাতে বলছি না!

রিকশাওয়ালা দাঁড়িয়ে পড়ে। বিকাশের মনে হয় রিকশাওয়ালা পুলিশের লোক। জোর করে তাঁদের পুলিশের কাছে নিয়ে যেতে চায়। তখন যেমন হয়েছিল, একজন প্রতিবেশী এলেও, একটি ভিখিরি বা পাগল এলেও মনে হত পুলিশের লোক। ছদ্মবেশে এসেছে। দেবার্চনকে খুঁজছে। সন্দেহ কুটিল হয়ে উঠত!

নিশ্চল রিকশা থেকে দু’জনেই থানাটিকে দেখতে থাকেন। প্রণবেশ বিড়বিড় করেন, বিকাশদা… ওই তিনদিন… আমার মনে হত, একটু একটু করে ওই ঘরের চারটে দেওয়াল ছোট হয়ে আসছে। ক্রমশ নিচু হয়ে আসছে ছাদ…। যে-কোনও সময় আমার ওপর চেপে বসতে পারে। আমাকে পিষে মেরে ফেলতে পারে। ওরা আমাকে মারেনি। অন্ধকার ঘরে ঢুকিয়ে প্রশ্ন করেছে… প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেছে…

বিকাশ খসখসে গলায় প্রশ্ন করেন, নীলাদ্রিকে কি পুলিশ মেরেছিল, প্রণবেশ?

—হ্যাঁ। পুলিশই মেরেছিল। নিশ্চয়ই। ওরা তো খুঁজছিল নীলাদ্রিকে। তাই না? আর দেবার্চনকে! বিকাশদা? দেবার্চনকে কারা…

—আমি জানি না। হয়তো পুলিশ মেরেছিল। হয়তো অন্য পার্টির লোক। হয়তো গুণ্ডা। শুধু জানি, মানুষ ওদের মেরেছিল। স্বার্থে, লোভে, জিঘাংসায়। আমাকে তোমার মতো থানায় কাটাতে হয়নি। কেন জানো? আমি সরকারি চাকরি করি বলেই নয়। সে তো তুমিও করতে। আমার চেয়ারে আমি বিশ্বস্ত প্রভুভক্ত কুকুরের মতো কেঁউ কেঁউ করেছিলাম বলে। আমার প্রভুভক্তি দিয়ে আমি নিজেকে রক্ষা করেছি। শুধু নিজেকে। আর আমার পুত্রকে হত্যা করেছি।

প্রণবেশ বলেন, আমি যাব না, বিকাশদা।

—কোথায়?

—থানায় যাব না।

—তা হলে? কীভাবে খুঁজবে প্রণবেশ?

—আমি জানি না। কাগজে বিজ্ঞাপন দেব। ঘুরব। সমস্ত হাসপাতালে। মর্গে।

—হাসপাতালে যাবে কেন? মর্গে যাবে কেন?

—ও বিকাশদা। এভাবেই খুঁজতে হয়। এক দিন রাত্রে কৌশিক… কৌশিককে মনে আছে আপনার? জামাল? জামাল কৌশিক… প্রায়ই আসত ওদের সঙ্গে? অসাধারণ সুন্দর ছিল! কী ব্রিলিয়ান্ট…

—কে ব্রিলিয়ান্ট ছিল না? প্রণবেশ? দেবার্চন ছিল না? নীলাদ্রি ছিল না?

—হ্যাঁ। ওরা সবাই ব্রিলিয়ান্ট ছিল। বোধহয় এও এক আশ্চর্য ভাইরাস। বিকাশদা। স্বপ্নের ভাইরাস। যা শুধু মেধাবী ছেলেদের মধ্যে ঢুকে যেত। স্বপ্নে বুঁদ করে দিত। স্বপ্নের জন্য ওরা সব ভুলে গিয়েছিল। বাবা-মা, ভাই, বোন। ওই কৌশিক জানেন বিকাশদা, একটাই ছেলে ছিল বাবা-মায়ের। একদিন, অনেক রাতে, কড়া নাড়ল। দরজা খুলতে ভয় করত তখন। কে যে আসে! পুলিশ না নীলুটা! দু’জনকেই সমান ভয় পেতাম আমি, জানেন বিকাশদা। নীলকে খুব ভালবাসতাম। কিন্তু নিজের স্ত্রী-পুত্রের কাছেও আমার দায়বদ্ধতা ছিল। আমি…আমি…সত্যি বলতে কী, চাইনি বিকাশদা যে নীলুর জন্য জুঁই আর বাপ্পার কোনও ক্ষতি হোক। ওদের নিরাপত্তা ভেঙে যাক! আমি চাইনি। আমি নিজে নীলুর জন্য সমস্ত কষ্ট করতে পারতাম, কিন্তু ওদের কথা…ওদের কথা…আমি না ভেবে পারিনি…!

—তোমার বউদি বলেন, দেবার্চনের মৃত্যুর জন্য, পরিণতির জন্য, আমিই দায়ী। ও যখন সময়মতো বাড়ি ফিরত না, পড়তে বসত না, কী যেন ভাবত, তোমার বউদি বলেন, রাত জেগে চুপিচুপি কী সব লেখাপড়া করত, আমি ওকে শাসন করিনি। কেন করিনি? সে কি ও মরে যাবে বলে? ওর মৃত্যু চাই বলে? বলো? আমরাও তো দেবাশিসকে বাঁচাবার জন্য কলকাতার বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু দেবাৰ্চনকে পাঠাতে পারিনি। যদি পারতাম, তা হলে কে জানে, হয়তো ও বেঁচে থাকত! কিন্তু পারিনি যে, সে কি ইচ্ছে করে? বিপদ এলে পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভাবা স্বাভাবিক কর্তব্য, প্রণবেশ..।

প্রণবেশ ও বিকাশ দু’টি ভিন্নতর স্মৃতিতে ডুবে যান। দু’জনে দু’জনের কথা বলতে থাকেন। শোনাতে থাকেন পরস্পরকে। রিকশাওয়ালা ওঁদের তাড়া দেয় না। গলায় গামছা দিয়ে সে নিজের বুক পিঠ মোছে। বসার সিটটা ঝেড়ে নেয়। রিকশাটিকে টেনে একটি কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় দাঁড় করায়, পাশে নীরবে গঙ্গা বয়ে যায়। এত জল তবু এতটুকু শব্দ নেই। রিকশাওয়ালা বিকাশ ও প্রণবেশকে দেখে। সে চেনে এঁদের। তার স্ত্রী, অন্ধর মা, বিকাশের বাড়ি বাসন মাজতে যায়। দু’জনের মুখের দিকে তাকিয়ে তার দীর্ঘশ্বাস পড়ে। তাঁদের কথাবার্তার মধ্যে থেকে সে অনুধাবন করতে পারে সব। মাত্র পাঁচ বছর আগেও অলিতে-গলিতে গঙ্গার পাড়ে লাশ পড়ে থাকার ইতিহাস সে বিস্মৃত হয়নি। এখন এই দু’জনকে দেখে তার মনে হয়, পয়সা থাকলেও, বাড়িঘর থাকলেও মানুষের দুঃখ ঘোচে না। সে শোকতপ্ত মানুষ দু’টিকে কথা বলার সুযোগ দেয়। একবারও তাড়া না দিয়ে, ভাড়া না মিটিয়ে সে ছায়ায় বসে বিড়ি ধরায়। থানার কাছে, গঙ্গার পাড়ে, রক্তচিহ্নবিধৌত কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় একটি রিকশা ছায়া-সুনিবিড় কুটির হয়ে যেতে থাকে। যেন প্রণবেশ আর বিকাশ নামের দু’টি শ্রান্ত মানুষ তার দাওয়ায় বসে খানিক জিরিয়ে নিচ্ছেন।

প্রণবেশ বলে চলেন, দরজা খুলে দেখলাম কৌশিক দাঁড়িয়ে আছে। রোগা হয়ে গেছে। গালে একমুখ দাড়ি। চুলে জট। চোখ দু’টি উদ্‌ভ্রান্ত। বলল, ওরা নীলাদ্রিকে খুন করেছে, দাদা। আমাকেও করবে। আমাদের সবাইকে করবে। নীলাদ্রিকে খুঁজুন।… কিছু বোঝার আগেই ও অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছিল। আমি ভয়ে ওকে ডাকতে পারিনি। হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলাম। একটি কথাও ওকে জিজ্ঞাসা করতে পারিনি। প্রথমে ওর কথার মানেই বুঝতে পারিনি আমরা। শোক করতেও ভুলে গিয়েছিলাম। কিংবা ভয় পেয়েছিলাম। পুলিশ যদি জানতে পারে, আমি ওর মৃত্যুর খবর জেনেছি। আমাকে যদি আবার ওই অন্ধকার ঘরে… আর নীলাদ্রি যে মারা যাবে, যাবেই, তা তো জানতামই। সারারাত ঘুমোতে পারিনি। কার কাছে যাব! কী করব! ভোরবেলা বেরিয়ে পড়েছিলাম। প্রথমেই গিয়েছিলাম আর জি কর হাসপাতালে। মেডিক্যাল কলেজে। শিয়ালদার মর্গে। বিকাশদা, ওভাবে কারওকে খোঁজা যায় না। ওভাবে পৃথিবীর কেউ কারওকে কোনওদিন খোঁজেনি। আমার মতো অসহায়, অপদার্থ ও দুর্ভাগা ভাইও পৃথিবীর কোথাও জন্মায়নি। আমি আমার প্রিয়তম ভাইটির মৃত্যুর প্রহর গুনেছি দিনের পর দিন। সেই গুনে যাবার মধ্যে কি মৃত্যুকামনাও ছিল, বিকাশদা? যা ভাবতাম, তাই ঘটল কী করে? আর ঘটে যাবার পর আমি মর্গে ছুটে গেলাম কী করে? সেই সময় আমি কোনও জীবিত মানুষের দিকে তাকাইনি। সমস্ত মৃত মুখের মধ্যে আমি শুধু আমার ভাইকে খুঁজেছিলাম।

প্রণবেশ কান্নায় ভেঙে পড়েন। দু’ হাতে মুখ চেপে অসহায়ভাবে শব্দ করেন তিনি। বলেন, এবার আমি আমার ছেলেকে খুঁজব। বিকাশদা। কিন্তু মৃত খুঁজব, না জীবিত, আমি জানি না।

বিকাশ প্রণবেশকে জড়িয়ে ধরেন। এক জন পরিণত মানুষকে দু’ হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে দেখে লোক জমে যায়। পাঁচ বছর আগে, এ অঞ্চলের হাজার হাজার পরিণত মানুষ এরকম মুখ ঢেকে কেঁদেছিল। তখন তা স্বাভাবিকই ছিল। কারণ ওই সব হত্যাকাণ্ড, যেমন নৃশংস কাশীপুর হত্যার রক্তাক্ত ইতিহাস, প্রাত্যহিক ছিল তখন। মৃত্যু নৈমিত্তিক ছিল। আর হাহাকার। এখন আর নয়। এখন শুধুই শান্তি। অপার অনাবিল শান্তি। তাহলে এখন মানুষ কঁদে কেন?

বিকাশ রিকশাওয়ালাকে ইশারা করেন। সে রিকশার মুখ ঘোরায়। প্রণবেশ ভবানীপুরের দিকে যেতে চান। দরকার মতো বিকাশের কাছে আসবেন বলে বাস ধরেন তিনি। বিকাশ বাড়ি ফেরেন। লক্ষ্মী বিকাশকে দেখে এগিয়ে আসেন, কী গো, খবর পেলে?

—না, ও ভবানীপুর গেল। শ্যালিকার বাড়ি।

লক্ষ্মী দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। ছলো ছলো চোখে বলেন, পেটের ছেলে হারানোর জ্বালা যে কী!

লক্ষ্মীর ভাবান্তরে অবাক লাগে বিকাশের। হয়তো পুত্রশোক এমনই বস্তু। লক্ষ্মীর মতো শক্ত মানুষকেও মাঝে মাঝে টলিয়ে দেয়। বিকাশ ভাবতে থাকেন, তাঁর নিজের শোকটি কেমন? লক্ষ্মী মাঝে মাঝে এমন ক্রন্দসী হয়ে ওঠেন দেবার্চন প্রসঙ্গে। এই তাঁর শোক। কিন্তু তাঁর জীবন-যাপনে আর কোথাও শোকের প্রকাশ নেই। বিকাশের শোক কেমন? বিকাশ শোক আলাদা করে টের পান না। তাঁর চোখে জলও আসে না সহজে। তাঁর সারাক্ষণে দেবার্চনের না-থাকা মস্ত হয়ে ওঠে। এই না-থাকা, এই শূন্যতা কি বিকাশের শোক? তিনি ভাবতে ভাবতে বেরুবার উদ্যোগ নেন। লক্ষ্মী বলেন, আবার কোথায় যাচ্ছ?

—বড় খোকা বাজার করেছে?

—হ্যাঁ। কিন্তু তুমি কোথায় যাচ্ছ?

—যাই। গাছগুলো লাগিয়ে আসি।

—সত্যি! তোমার কি এক মুহূর্ত বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করে না?

বিকাশ জবাব দেন না। মনে মনে বলেন— করে না লক্ষ্মী! এ বাড়িতে সব সময় ছোট খোকাকে দেখতে পাই আমি। বারান্দার কোণটা ওর খুব প্রিয় ছিল। চুপ করে বসে থাকত। কতদিন জিজ্ঞেস করেছি— কী ভাবিস ছোট খোকা? বলত, কিছু না বাবা। দেখি।

—কী দেখিস?

—কী দেখি? জানি না তো! হ্যাঁ! গাছ ফুল পাখি আকাশ দেখি। বাবা?

—বল্‌।

—ফুল কখন পাপড়ি মেলে?

—ফুল? রঙিন ফুলেরা দিনের আলোয় মেলে। আর সাদা ফুলেরা রাত্রে।

অসহিষ্ণু মাথা নাড়ত সে। বড় বড় চোখ তুলে বলত, ও সব আমি জানি। আমি বলছিলাম, আমি কতদিন কুঁড়ির দিকে তাকিয়ে বসে থেকেছি, ওর পাপড়ি মেলা দেখব, কতক্ষণ বসে থেকেছি, দেখতে পাইনি। যেই একটু খেলতে গেছি, এ দিক ও দিক গেছি, ওমনি ফিরে এসে দেখেছি, ফুটে গেছে। কেন এরকম হয় বাবা?

আশ্চর্য ছিল ছোট খোকা। ওরা সবাই আশ্চর্য ছিল। যোদ্ধা ছিল বটে। কিন্তু নিষ্পাপ ছিল। তাই বুঝি টিকে থাকতে পারল না।

লক্ষ্মী বললেন, খেয়ে যাও অন্তত।

বিকাশ মাথা নাড়েন। খাবেন না। বলেন, প্রণবেশের ছেলেটা হারিয়ে গেল। মনটা ভাল লাগছে না।

—ওর ছেলে না এলে কি না খেয়ে শুকিয়ে মরবে? নিজের ছেলের বেলায়…

বিকাশ আর শোনেন না। স্বেচ্ছায় শ্রুতি বিনষ্ট করেন। গলার কাছে জান্তব চিৎকার ঘুরপাক খায়— চুপ করো লক্ষ্মী। চুপ করো। এত নিষ্ঠুর হোয়ো না। ঈশ্বর তোমাকে কী দিয়ে তৈরি করেছিলেন? হ্যাঁ। ছেলের মৃত্যুর পরও আমি খেয়েছি। খেতে হয়েছে। কাজে গিয়েছি। জীবনযাপন করছি। তোমাদেরও খাইয়েছি। লক্ষ্মী। তুমিও কি খাওনি? বাঁচোনি? তোমার গর্ভজাত সন্তানের মৃত্যুর পরও! আসলে না বেঁচে উপায় থাকে না মানুষের। ঈশ্বর এভাবেই আমাদের সৃষ্টি করেছেন। বেঁচে থাকার অপরিমিত আকাঙ্ক্ষা সমেত। ঈশ্বর… ঈশ্বর…

ছোট খোকা ঈশ্বরে বিশ্বাস করত না। কেন করত না? ছোট থেকে রামকৃষ্ণ মিশনে পড়া ছেলে। ধ্যান, ভজন সবই তাকে করতে হত। ও যখন ইলেভেনে উঠল তখন বিজ্ঞান নিল না। বলল, দর্শন পড়ব। ফিলজফি।

বরাবর ভাল রেজাল্ট করে আসা ছেলেটা বিজ্ঞান পড়বে এটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু বিকাশ জোর করেননি। শান্ত, অল্পভাষী ছোট খোকার ওপর খুব আস্থা ছিল তাঁর। যেন ও কোনও অন্যায় করতে পারে না। ভুল করতে পারে না। হয়তো এই আস্থার জন্য, নির্ভরশীলতার জন্য লক্ষ্মী আজও বিকাশকে দোষ দেন— তোমার জন্যই এরকম হল। তুমি কোনওদিন ওকে শাসন করোনি।

বিকাশ বোঝাতে পারেননি, ছোট খোকা, দেবার্চন, শাসনের ছেলে ছিল না। ওর মধ্যে একটা ব্যক্তিত্ব ছিল। ছেলেবেলা থেকে তা উজ্জ্বল ছিল ওর অভিব্যক্তিতে। বেশি কথা সহ্য করতে পারত না। অলসতা দেখতে পারত না। কোনও ভুল-ত্রুটির জন্য অন্যের ওপর দোষারোপ করা পছন্দ করত না। লক্ষ্মীর সঙ্গে লেগে যেত। মাঝে মাঝেই লেগে যেত। লক্ষ্মী বলতেন, ছোট খোকা বড় রূঢ়। দুর্বিনীত।

বিকাশ তর্ক করেননি। কিন্তু তিনি ছোট খোকাকে বুঝতেন। বিনয়ের অভাব নয়, ওটা ছিল স্পষ্টবাদিতা। বড় খোকার সঙ্গেও তার খুব অন্তরঙ্গতা ছিল না। দেবার্চন হয়তো একটু একা একাই ছিল সংসারে। বিকাশের মতোই। বিকাশ লক্ষ্মীকে স্পর্শ করতে পারেন না। বড় খোকাকে স্পর্শ করতে পারেন না। অথচ ওরা ছাড়া বিকাশের আর কিছুই নেই। তিনি শুধু ছোট খোকাকে বুঝতেন। দু’জনের মধ্যে একটা নিবিড় নিভৃত অনুচ্চারিত বোঝাপড়া ছিল।

তেরো বছর বয়সে দেবার্চন প্রথম রামকৃষ্ণ কথামৃত পড়েছিল। স্কুলের জন্য রামকৃষ্ণের নানান বাণী তাকে মনে রাখতে হত। একদিন নিজের ইচ্ছায় সে কথামৃত টেনে নেয়। বিকাশ জানতে চেয়েছিলেন, পুরো পড়েছিস?

মাথা নেড়েছিল সে। তারপর খুব স্মিত মুখে বলেছিল, কী সুন্দর সব গল্প বাবা।

বিকাশ হেসেছিলেন। কিন্তু লক্ষ্মীর এগুলো পছন্দ হয়নি। দেবার্চনের সামনেই বলেছিলেন, আশ্চর্য! এইটুকু ছেলেটা কথামৃত পড়ছে, তুমি কিছু বলছ না! এত ডেঁপোমি কেন ওর! সবটাতে বাড়াবাড়ি!

দেবার্চন, ওইটুকু দেবার্চন মায়ের দিকে সোজা চোখ তুলে বলেছিল, তুমি পড়েছ মা? কথামৃত?

লক্ষ্মী অপ্রস্তুত হয়েছিলেন। কোনওমতে বলেছিলেন, না। পড়িনি।

দেবার্চন বলে ফেলেছিল, তুমি তো স্কুলে পড়াও মা। তোমার কি এখনও ডেঁপোমির বয়স হয়নি?

লক্ষ্মী খুব জোরে চড় কষিয়েছিলেন ছেলের গালে। দেবার্চনের চোখে জল এসে গিয়েছিল। মাথা নিচু করে পাশের ঘরে চলে গিয়েছিল সে। বিকাশ ভেবেছিলেন ও একা থাকতে চায়। কিন্তু তাঁর ধারণা ঠিক হয়নি। একটু পরেই সে একখণ্ড ‘ঘরোয়া’ এনে লক্ষ্মীর সামনে ফেলেছিল। তার চোখ লাল। লক্ষ্মীও ফুঁসছেন। সে বলেছিল, এই বইটা সামলে রেখো। আমি বাংলা ভালই পড়তে পারি মা। দাদাও পারে। মিলারের অনুবাদটার কিছুটা আমি পড়ে ফেলেছিলাম।

সে চলে গিয়েছিল। লক্ষ্মী খুব আস্ফালন করেছিলেন সেদিন— দেখেছ-দেখেছ। কীরকম চড় মেরে গেল গালে! কী অসম্ভব পেকে গেছে ছেলেটা! এ সব বড়দের বই দেখলে তুই পড়বি কেন শুনি? উঃ! ও মানুষ হবে না! কিছুতেই মানুষ হবে না! শোনো, তুমি এখনও ওকে শাসন করবে না?

বিকাশ বলেছিলেন, আমি ওকে শাসন করার মতো কিছু পাইনি। সারা দুপুর ও বাড়িতে একা থাকে। নানা রকম বইপত্র পড়ে। হাতের কাছে কিছু পেলে খুলে দেখার বয়স ওর হয়েছে লক্ষ্মী।

—তোমার জন্য ও নষ্ট হয়ে গেল।

সে-দিনও লক্ষ্মী এ কথা বলেছিলেন। আজও বলেন। পরে ছেলেকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন বিকাশ —হ্যাঁ রে। তুই বলছিলিস অনেক মজার গল্প আছে কথামৃততে। সেগুলো কী বল তো? সে উজ্জ্বল মুখে বলেছিল, কেন, ওই যে মথুরবাবুর ভাব সমাধি! কী কাণ্ড বাবা! লোকটা সমাধি সমাধি করে পাগল হয়ে গেল! এখন কেন কেউ ওরকম হয় না?

দেবার্চন বই এনেছিল। উৎসাহের গলায় বলেছিল, পড়ো, বাবা, পড়ো।

পড়েছিলেন বিকাশ।

ভাবসমাধির জন্য আবেদন করেছিলেন মথুরবাবু। রাজি হননি রামকৃষ্ণ। বলেছিলেন— ওরে কালে হবে, কালে হবে। একটা বিচি পুঁততে পুঁততেই কি গাছ হয়? আর গাছ হয়েই কি ফল পাওয়া যায়?

কিন্তু মথুরবাবু নাছোড়। রামকৃষ্ণ সাবধান করলেন— ভাব হলে অথৈ জলে পড়বি। সংসার থেকে মন উঠে যাবে। তখন তোর বিষয়-আশয় কে দেখবে-শুনবে?

তাতেও দমেননি মথুরবাবু। কালীর কাছে ভাবসমাধি প্রার্থনা করেছেন। তিন দিন বাদে তাঁর ভাব উপস্থিত। আর ভাব নিয়ে মথুরবাবুর পাগলের দশা। বিষয়ে মন না দিলে তেত্রিশ ভূত লুটে খায়। চোখের সামনে দেখছেন কিন্তু মন লাগাতে পারছেন না। বিষয়ে ইচ্ছা যায় কিন্তু ঈশ্বর নামের প্রবলতর টান তাঁকে সংসারের কর্মে বিমুখ করে। শেষে আবার ভাবসমাধি ফিরিয়ে নেবার বায়না করলেন মথুরবাবু। স্বীকার করলেন তাঁর কাজ পদসেবা। পরসেবা। সমাধির আনন্দ তাঁর জন্য নয়। রামকৃষ্ণ তুলসীদাস স্মরণ করিয়ে শিক্ষা দিলেন। বলেছিলেন—

তুলসী, য়্যাসা ধেয়ান ধর,
য্যাসা বিয়ানকা গাই।
মু মে তৃণ চানা টুটে।
চেৎ রাখয়ে বাছাই।

প্রসূতি গাই দেখিসনি? মুখভর্তি ঘাসপাতা চিবোচ্ছে। কিন্তু মন পড়ে আছে বাছুরে। তেমনি করেই ডাকতে হয় ঈশ্বরকে। সংসারধর্মে কর্ম রাখো। মন রাখো ঈশ্বরে।

ছেলের মাথায় হাত রেখেছিলেন বিকাশ। মথুরবাবুর টানাপোড়েনটি ঠিক ধরতে পেরেছিল দেবার্চনা বিকাশের ভাল লেগেছিল। সব কিছু গভীরভাবে অনুধাবন করার প্রবণতা ছিল দেবার্চনের। বিকাশ বলেছিলেন, এই মথুরবাবুর নামেই আমাদের এ জায়গার নাম মাথুরের গড়, জানিস?

—তাই নাকি?

—হ্যাঁ। লোকে বলে। এ জায়গা নাকি মথুরবাবুর ছিল এক সময়। যদিও এই জনশ্রুতির পেছনে কোনও প্রামাণ্য নেই।

ছোট ছেলেকে অনেকদিন অনেক ইতিহাস শুনিয়েছেন বিকাশ। বিদেশি উপকথা শুনিয়েছেন। দেবার্চন মন দিয়ে সব শুনত। কিন্তু দেবাশিস শুনত না। এ সব শোনার পরিবর্তে সে অনেক বেশি পছন্দ করত ঘুমোতে। বিকাশ দেবাশিসকে কোনওদিন পাঠ্য বইয়ের বাইরে কিছু পড়তে দেখেননি।

অনেক দিন পর, দেবার্চনের যখন ইলেভেন, তখন আবার ওকে কথামৃত পড়তে দেখলেন বিকাশ। ততদিনে অনেকখানি গাম্ভীর্য ও ব্যক্তিত্ব অর্জন করেছিল সে। বিকাশও তাকে প্রশ্ন করা কমিয়ে দিয়েছিলেন। যোগাযোগও কমই হত ছেলের সঙ্গে কারণ বিকাশের কাজের দায়িত্ব বাড়ছিল। ঊর্ধ্বতন অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হচ্ছিল তাঁকে। তাঁদের নানা রকম ব্যক্তিগত কাজের দায়িত্ব তিনি স্বেচ্ছায় কাঁধে নিচ্ছিলেন। নিজের উন্নতির সিঁড়ি প্রশস্ত ও পোক্ত না করে তাঁর উপায় ছিল না কারণ লক্ষ্মী নিরন্তর বিকাশকে উচ্চপদের পেছনে তাড়িয়ে ফিরতেন। বিকাশের তা রোধ করার ক্ষমতা ছিল না। হয়তো তাঁরও মনের কোণে ওইসব পদলিপ্সা ছিল। দেবাশিস বরাবরই দূরের ছিল। দেবার্চনও দূরতর হয়ে উঠছিল তখন। সে-সময় একদিন আবার তাকে কথামৃত পড়তে দেখে ঔৎসুক্য বোধ করেছিলেন বিকাশ। দেবার্চনের অগোচরে বইগুলির পাতা উলটোছিলেন। প্রায় প্রতিটি খণ্ডেই পেন্সিলের দাগ। দিয়েছিল সে। রামকৃষ্ণের নানা উক্তি ও ব্যাখ্যা সে আত্মস্থ করেছিল। রন্তিদেবের প্রসঙ্গে এসে মার্জিনে পেন্সিল দিয়ে লিখেছিল— বোগাস। একটু আগেই জীবের ক্ষুধা-তৃষ্ণা দূর করতে চাইছিল। এখন আবার বিগতস্পৃহ হতে চাইছে। বিগতস্পৃহা কি কর্মবিমুখতাও নয়? ঈশ্বর ছাড়া অন্য কোনও আকাঙ্ক্ষা যদি নাই থাকবে মানুষের তবে আর বেঁচে থাকার জন্য এত সংগ্রাম কেন?

১২

মাথুরের গড়ে ছ’টা পুকুর ছিল, এখন দু’টি আছে। চারটি পুকুর বুজিয়ে চারটি বাড়ি হয়েছে। মাঠ ছিল তিনটি। একটিতে লোকনাথবাবার মন্দির হয়েছে। আর একটির ওপর শিগগির ফ্ল্যাট উঠবে। সেনদের জমি ছিল ওটা, বিক্রি হয়ে গেছে। বিশাল ব্যবসাদার ছিল সেনরা এক সময়। বিকাশের মনে আছে, ছোটবেলায় সেনদের দোতলা বাস দেখেছেন তিনি। জাহাজও ছিল ওঁদের। এই এলাকায় সেনদের বাড়িটাই সবচেয়ে বড়। প্রায় জাহাজের মতো। বাড়িটার দখল নিয়েছেন অরুণ সেন। সেনদের ব্যবসা যিনি বিশালতর করে তুলেছিলেন, তাঁর নাম ছিল বিশ্বেশ্বর সেন। একটি ছেলে ছিল তাঁর। দেবেশ্বর সেন। দেবেশ্বরের তিন ছেলে, দুই মেয়ে। অরুণ, বরুণ, হিরণ এবং অন্নপূর্ণা আর মহামায়া। ব্যবসা ধরে রাখা বলতে যা বোঝায়, এ পর্যন্ত অরুণ সেনই তা পেরেছেন। অত বড় করে না হলেও কম কিছু নেই। মাথুরের গড়ে একটাই মাত্র থাকবার মতো সুদৃশ্য হোটেল, রাজেশ্বরী, অরুণ সেনের। ইদানীং রাজেশ্বরীতে নানা রকম উৎসব হয়। উৎসব বলতে, বিয়ে-অন্নপ্রাশন। নিজেদের বাড়িতে এ সবের ঝামেলা আজকাল অনেকেই পোহাতে চায় না। বিশেষত যাদের ঘরবাড়ি ছোট। আগে বাড়ি ছোট হলে সামনের রাস্তায় প্যান্ডেল হত। অথবা সংলগ্ন মাঠ থাকলে মাঠে। এখনও হয় না তা নয়। কিন্তু কমে এসেছে। প্যান্ডেলের তলা দিয়েই তখন গাড়ি যাতায়াত করে। পথচলতি মানুষ সানাইয়ের ধ্বনি শুনতে পায়। উলুধ্বনি হাঁকডাক শুনতে পায়।

এই এলাকায় বিয়ের জন্য রাজেশ্বরী ভাড়া দিচ্ছেন অরুণ সেন। রোজকার ভাত খাওয়া হোটেল রাজেশ্বরী নয়। বিভিন্ন জায়গা থেকে লোক এসে এখানে থাকতেই পারে শুধু। বৃদ্ধ বিনয় ধাড়া বহুদিন ধরে হোটেলের দেখাশুনো করেন। ছেলে মোহনই হোটেলের বয়ের কাজ করে দেয়। মেদিনীপুরের লোক বিনয় কবে এখানে এসেছিলেন বিকাশের খেয়াল নেই। হোটেলেরই একতলায় ওঁরা থাকেন। কখনও মাথুরের গড়ের জনজীবনে বা সংস্কৃতিতে ওঁদের সম্পৃক্ত হতে দেখা যায়নি। রাজেশ্বরীর সামনে ফাঁকা জায়গাটিতেই এ পাড়ার বারোয়ারি দুর্গোৎসব হয়। ভোগ রান্না ইত্যাদির ব্যবস্থা রাজেশ্বরীতেই। বিনয় ধাড়া তখন ঘর খুলে দেওয়া, ঘর পরিষ্কার করানো ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করেছেন ঠিকই, কিন্তু ওই পর্যন্তই। সরাসরি অংশ নেননি কখনও।

কত রকম মানুষ এই মাথুরের গড়ে। অদ্ভুত। অন্যরকম। অরুণ সেন নিজেই কি কম অদ্ভুত! হোটেল চালিয়ে, গেঞ্জির কারখানা, বড়বাজারের কাপড়ের দোকান সামলিয়েও তাঁর অদ্ভুত খেয়াল সিনেমার প্রযোজনা। তাঁর প্রযোজিত বেশ কয়েকটি ছবির নাম একডাকে বলে দেওয়া যায়। এ জন্য তাঁকে ছেঁকে রাখবার লোকের অভাব নেই। নানা রকম স্বার্থে কিংবা কোনও স্বার্থের সন্ধান করা যায় কি না এমনই চিন্তায় বহু লোক তাঁকে ছেঁকে ধরে। দীর্ঘদিন ধরে, প্রায় ত্রিশ বছর ধরে অরুণ সেনের গায়ে যিনি চিরস্থায়ী হয়ে লেগে আছেন, তাঁর নাম পরেশ বোস। বিকাশ এই মানুষটিকে দেখেও কম আশ্চর্য হন না। মাথুরের গড়ে পরেশ ছোটবেলা থেকে ছিলেন না। ওই বছর ত্রিশেক আগে অরুণ সেনের হাত ধরেই তাঁর আগমন। প্রথমে ওই বিশাল বাড়িতেই তাঁরা থাকতেন। লোকে মনে করেছিল অরুণ সেনের কোনও দুঃস্থ আত্মীয় হয়তো। কিন্তু অরুণ সেন যত সহজে কোনও চাটুকারকে আশ্রয় দিতেন, তত সহজে কোনও আত্মীয়কে নয়। ইতিমধ্যেই দুই ভাইকে তিনি পথে বসিয়েছিলেন। কিংবা তাঁরা নিজেরাও শখ করে পথে বসতে পারেন। পরস্পরের মধ্যে নানান মামলা ঝুলছে এখন। বিষয়-সম্পত্তিজনিত মামলায় কেউ দোষী বা নির্দোষ হয় না। যে যেমন পারে লুটে নেয়। অন্য কেউ হলে লোকে বলত, দেখেছিস, অমুকের সমস্ত সম্পত্তি কেমন আত্মসাৎ করল। কিন্তু এ হল তিন ভাইয়ের মামলা। বরুণ আর হিরণ সম্পর্কে এখানকার মানুষের কোনও সহানুভূতিও নেই। বরুণ অতি উন্নাসিক। ধনবান পিতার পুত্র হিসেবে তাঁর গর্বের সীমা নেই। সাধারণ যে-কোনও মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তাঁর মাথাটা পেছন দিকে হেলে যায়, মুখভর্তি পানের রস সামলাতে সামলাতে তর্জনী তুলে কথা বলেন তিনি। পানের রস ভরা মুখের অপূর্ণ উচ্চারণে সব কিছু নস্যাৎ করে দিতে চান। ধরা যাক, ছোটরা তাঁর কাছে চাঁদার জন্য গেল। বলল—কাকু চাঁদা।

বরুণ তখনই, মুখ তুলে ফেলবেন, একটু চুন ছোঁয়াবেন জিভে, চাঁদ দেখলে কুকুর যে-ভাবে টেনে টেনে ডাকে, সে-ভাবে বলবেন, হ্যাঁ? চাঁআ? কী হয়ে চাঁআ ডিয়ে?

—কাকু সরস্বতী পুজো।…কিংবা জলসা।… কিংবা কালীপুজো।

—অ। টাকা কি খোলামকুই? চাইলেই পাওয়া আয়? হয়ে না হয়ে না। যাও যাও।

বরুণ গজগজ করেন, কতবার বলেছি, আমি চাঁদা দিই না। কতবার বলেছি। তবু চাই চাই।

এরকম হয়। প্রতিবার হয়। কিন্তু ছোটরা তবু যায়। প্রত্যাশা করে। কোনওদিন মত ফিরতেও পারে। কিংবা তাদের কাছে এটাও একটা খেলা। মাথুরের গড়ে খুব সাধারণ গৃহস্থের অবস্থাও বরুণের চেয়ে ভাল। কিন্তু বরুণ তা মনে করেন না। কারণ মোকদ্দমা মিটে গেলেই তিনি যখন প্রচুর টাকা পাবেন তখন তাঁর হৃত গৌরব ফিরে আসবে— স্বপ্ন দেখেন বরুণ। দাদার মতো অ্যাম্বাসেডারে চাপছেন, ঠাকুরদার মতো জাহাজ কিনছেন। এবং… এবং… সিনেমায় বিনিয়োগ করছেন। হ্যাঁ, অবশ্যই, আর কিছু না হোক, অ্যাম্বাসেডার না হোক, সিনেমায় বিনিয়োগ তাঁকে করতেই হবে। তাঁর মুখে পানের রসের সঙ্গে তুমুল ঈর্ষা জড়িয়ে যায়। ঘৃণা জড়িয়ে যায়। দাদা একা সব ভোগ করবে কেন? কোন অধিকারে?

কবে এইসব মামলা শুরু হয়েছিল? বোধহয় পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে। তখন ছোট ছিলেন বিকাশ। সম্পত্তি বিষয়-আশয় নিয়ে ভাবার মানসিকতা ছিল না। কিন্তু সেইসব মামলার নিষ্পত্তি আজও হয়নি। যৌবনের প্রাকলগ্ন থেকে ঈর্ষা করতে করতে, প্রত্যাশা করতে করতে, স্বপ্ন দেখতে দেখতে আজ কেউ ষাটোর্ধ্ব কেউ পঞ্চাশোর্ধ্ব। কোনওদিন কি এ মামলা মিটবে?

বরুণের একেবারে বিপরীত চরিত্র হিরণ। বড়দা অরুণ সেন সম্পর্কে তিনি খুবই শ্রদ্ধাশীল। হিরণকে সুস্থ অবস্থায় কখনও দেখা যায় না। লোকে বলে, সেই যে ছোটবেলায় বোতল ধরেছিল, সে-নেশা আর গেল না। শুধু দুধের বদলে এখন বোতলে মদ থাকে। বিকাশের মাঝে মাঝে মনে হয়, ধুস, সে-সময় কি দুধের বোতল ছিল নাকি! যখন হিরণ ছোট ছিলেন? কিংবা বিকাশ? ওই পঞ্চাশ-বাহান্ন বছর আগে শিশুদের ঝিনুকেই নিশ্চয়ই দুধ খাওয়ানো হত। কিন্তু মানুষ মজা করার সময় অত কিছু খেয়াল রাখে না। আর হিরণের চলাফেরার মধ্যেই একটি মজা লুকিয়ে থাকে সব সময়। অরুণ সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করলে হিরণ বলেন, দাদা? দাদার মতো লোক হয়? অন্নকে দাদা রাখছে না? তার দুই ছেলে হিরে আর মণিকে মানুষ করছে না? বোনটার জন্য বিয়েই করল না সারা জীবন।

হ্যাঁ। এটা একটা কথা বটে। অন্নপূর্ণার বড় ঘরে বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও তাঁর যখন বৈধব্য এল তখন শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাঁকে মারধরও করে। ভাতারখাকি, রাক্ষসী, ডাইনি, এইসব বলে নিত্য গালাগালি করা হত তাঁকে। তাঁর ছোট ছোট দুই ছেলে হিরে আর মণিকে কেড়ে তাঁকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। অরুণ সেন সমস্ত প্রভাব খাটিয়ে তাঁর ভাগ্নেদ্বয়কে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। বোনের হাতে নিজের সংসারের ভার তুলে দেন। বোনের নিরাপত্তার অভাব হবে বলে, বোন সংসারে আশ্রিতাবৎ হয়ে যাবে বলেই কি তিনি বিয়ে করেননি? এ কথা নিজের মুখে কারওকেই বলেননি তিনি। কিন্তু লোকে এভাবেই নিতে পছন্দ করেছে। নইলে, সফল, ধনী, সুপুরুষ অরুণ সেন বিবাহ করবেন না কেন?

লোকে হিরণকে অন্যভাবে খোঁচায়। বলে, কিন্তু ধরো, তোমাদের বোনকে আশ্রয় দিলেও তোমাদের দু’ভাইকে তো ঘরছাড়া করল অরুণ? সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করল তো?

—কোন শালা বলে?

জড়ানো, স্খলিত জিভে প্রতিবাদ করেন হিরণ। হারুর স্টেশনারি দোকানের সামনে, কিংবা ব্রজগোপালের ওষুধের দোকানে আড্ডা হয়। হিরণ বলেন, আমার দাদা তো আমাদের ঘর থেকে বের করেনি। বলেছে, তোরা নিয়ম মেনে থাক। সংসারের একটা লক্ষ্মী-অলক্ষ্মী আছে। আমার অত বড় দাদা কত মদ খায় কিন্তু কোনওদিন এক ফোঁটা মাতলামি করেছে? কিন্তু আমি করেছি। আরে অত সফিস্টিকেশন আমার ভাল লাগে না। শালা, মদ খেয়ে যদি না চেল্লাব, মেয়েছেলে ধরে নাই স্ফুর্তি করব, তা হলে মদ খাবার কী মানে? তাই নিজেই ও বাড়ি ছেড়ে দিলুম! ধুস। আর মেজদাটা একটা ঢ্যামনা। ওর কী করে চলে জানেন? ওই আমার বড়দার টাকায়।

—তোমার কী করে চলে হিরণ?

—ওই আমার বড়দার টাকায়!

লালন-পালন করছেন বটে অরুণ সেন! কিন্তু লোকের খোঁচানোর স্বভাব যায় না। তারা বলে, কিন্তু, সম্পত্তি? অত বড় সম্পত্তি থেকেই তো এইসব খরচ জোগায় অরুণ? এতে তো তোমাদেরই ভাগ।

—কোন শালা বলে?

আবার প্রতিবাদ করেন হিরণ।

—আমাদের সম্পত্তি এখন আদালতে টুসটুস করে ঝুলছে। পাকা আমের মতো! আমরা হাঁ করে আছি। আমটা দুলছে দুলছে। এই বুঝি পড়ল। কার দিকে পড়ে! কার দিকে? দাদার যা ইনকাম সব ওর নিজের করা। আমি সাক্ষী আছি। আমি। আমার দেবতার মতো দাদার গায়ে তোমরা কলঙ্ক লেপন কোরো না।

কইমাছ কিনে বাড়ি ফিরছেন হিরণ। থলে থেকে লাফ দিয়ে কইমাছ বড় নর্দমায় পড়ল। হারুর দোকান থেকে এক টুকরো কাগজ আর পেন চেয়ে কাগজে খস খস করে লিখে নর্দমায় ফেলে দিলেন হিরণ।

—কী করলেন হিরণদা? হারু প্রশ্ন করেছিল।

হিরণ বলেছিলেন, আমার বাড়ির ঠিকানাটা মাছটাকে দিয়ে দিলাম। ড্রেনটা আমার বাড়ির সামনে দিয়েই গেছে তো।

কথা নেই, বার্তা নেই, মানোদা ঝিকে ঘরে তুললেন হিরণ। পাড়ায় গেল-গেল রব। ছি ছি! কী ঘেন্না! শেষ পর্যন্ত ঝি-চাকর? ছি ছি! এ পাড়ায় আর বাস করা যাবে না। মুখ টেপাটেপি। হাসাহাসি। পাড়ায় জোট হল— ওকে পাড়াছাড়া করো।

কিন্তু কার পাড়া? কে ছাড়া করে? হারুর দোকানে লোকজন জমা হয়ে হিরণকে ডাকল, হিরণ। এ তুমি কী করছ? মদ খাচ্ছ খাও। কিন্তু এটা একটা ভদ্র পাড়া। এখানে তুমি ঝি-চাকর ঘরে তুলছ?

হিরণ প্রথমে অবাক হন। তারপর বলেন, অ। মানাদা? তাতে কী হয়েছে? মানোদা ঝি বলে কি মানুষ নয়? ওর কি মন নেই?

মানোদা যাচ্ছিল পথ দিয়ে। লোকে দেখল, হ্যাঁ, মন তো আছেই, মানুষ যখন, শরীরও আছে মানোদার। হিরণ ডাকলেন, অ্যাই। অ্যাই মানো। শোন এ দিকে?

মানোদা মুখ ঝামড়াল।

—অ্যাকোন ডেকোনি তো। কাজে যাচ্চি বলে।

—অ্যাই হারামজাদি। শোন।

হিরণের বাঘের গর্জন। মানোদা পায়ে পায়ে আসে।

—কী বলছি। বলো। আমার দ্যার হইয়ে যাইচ্ছে।

—অ্যাই দ্যাখ। অ্যাই এনাদের দ্যাখ। এঁদের চিনিস?

—চিনবনি কেন গো? এনাদের বাড়িতি তো কাজ করে খাই।

জনতা ভাঙতে শুরু করেছে তখন। পঞ্চায়েতি জোট থেকে যে-যার মতো মুখ রক্ষা করতে ব্যস্ত। সত্যি! হিরণকে নিয়ে পারা যায় না। দু’কান কাটা। নির্লজ্জ। ওকে নিয়ে মাথা ঘামানোটাই ভুল হয়েছে।

ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেও কেউই চলে গেল না ওখান থেকে। চাক ভাঙতে গেলেও মৌমাছিরা যেমন ভাঙা চাক ঘিরে গুনগুন করে, তেমনই করতে লাগলেন ভদ্দরনোকেরা। হিরণ বললেন, শোন। এইসব বাবুদের পাড়ায় তুই উঠেছিস। তুই এখন ভদ্রলোক, বুঝেছিস? তুই আর ঝি-কাজ করতে যাবি না।

—ইঃ! কাজ করতে যাবনি! আমি জন্ম-ঝি বুয়েছ? আমার মা ঝি ছিল। আমিও ঝি। হাজার সাবানজলে ধুলেও আমার গা থেকে ঘামের গন্ধ যাবেনিকো। বলে না—দু’ দিনের রানি।/ তার কত ফড়ফড়ানি। বলি, আজ তুমি আমারে ঘরে রেইখেচ। কাল যে নাতি মেরে বার করে দেবেনি তা কে বলতি পারে? তখন আমি কোথায় ভাতার খুঁজতি যাব শুনি?

গর্জে উঠেছিল হিরণ, কী এত বড় কথা? আমি তোকে লাথি মেরে বের করে দেব? মানো? এত বড় কথা বলতে পারলি তুই? চল। তোকে আজই বিয়ে করব আমি। এখুনি করব।

মানোদাও গর্জে ওঠে, ও কথা বোলোনিকো। আমায় বিয়ে করা ভাতার আছে। তাকে কি ফেলে দিয়ে যাব? আর আমারে বে করলি আর এ পাড়ায় থাকতি হবে না। ভদ্দরনোকেরা তোমারে ছিঁড়ে খাবে। শোনো, অ্যাই পরিষ্কার কইলুম, তোমার ঘরে আমি আর থাকবনি। আমি ঝি মানুষ, আমারে তেমনি থাকতি দাও। বাবারে বাবা। সব ভদ্দরনোক গো…

মানোদা মিলিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভদ্রলোকের পাড়ায় ক’দিন হিরণ আর মানোদা ছাড়া কোনও কথা ছিল না। লোকে বলে, ক’দিন নাকি হিরণকে বেশ উদাস-উদাস লাগত। এ পাড়ায় হিরণের গল্পের শেষ নেই। একদিন একটা ছোট ভিখিরির ছেলে হারুর দোকানে এসে হাত পাতল। অনেকেই ছিল, কেউ পাত্তা দিল না। হিরণ পকেট থেকে দশ টাকার নোট বের করে সন্ন্যাসীর মতো মুখ করে ছেলেটির হাতে দিলেন। ছেলেটি নোট নিয়ে ভোঁ-দৌড়। পাছে বাবু ভুল করে দিয়ে থাকেন। পাছে ফেরত চান! হারু বলেছিল, সে কী হিরণদা! একেবারে দশটা টাকা দিয়ে দিলেন!

—দিলুম।

হিরণের মুখে মায়াবী আলো, দাদার পয়সায় প্রতিপালিত মদ্যপ মানুষ। বললেন, বুঝলি হারু ছেলেটাকে দেখে বড় মায়া জাগল রে। কত জায়গায় কত মেয়ের সঙ্গে শুই। ভিখিরি-টিখিরিও বাদ যায় না। আমার কত সন্তান এভাবে ভিক্ষে করে খাচ্ছে কে জানে!

হারু চুপ। এভাবে কেউ নিজের সম্পর্কে বলতে পারে? হিরণ পারেন। হিরণ মদ্যপ। হিরণ বেপরোয়া। হিরণ পারেন। তিনি যে-কোনও মানুষকে ক্ষমা করতে পারেন। যে-কোনও লোকের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। শুধু পরেশকে সহ্য করতে পারেন না। বড়দা, মেজদা নয়। মানোদার ভাতার নয়। কোনও ভিখারিণী নয়— হিরণের একমাত্র শত্রু পরেশ বোস। বিকাশের মনে হয়, হিরণের নেশাগ্রস্ত সত্তার আড়ালে একজন শুদ্ধ সুন্দর মানুষ আছেন। তাঁর যত্রতত্র গতিবিধি, যেমন-তেমন জীবন-যাপন— সেখানে কোনও ছাপ ফেলতে পারেনি।

মৌখিক আলাপ ছাড়া পরেশ বোসের সঙ্গে কোনও ঘনিষ্ঠতা হয়নি বিকাশ বা রণেনদের। বিনয় ধাড়ার মতো পরেশও এ পাড়ায় চিরদিন আলগা হয়ে রইলেন। এ পাড়াতেই জীবন-যাপন, অথচ ভাব এমন, যেন দু’দিনের জন্য বেড়াতে আসা! এ দিক থেকে অতুলনীয় বলা যায় আনিসুজ্জামানকে। বছর আট-দশ হল এই মাথুরের গড়ে এসেছেন আনিসুজ্জামান। ইতিমধ্যেই তিনি এ পাড়ার একজন হয়ে উঠেছেন। বিকাশ দেখেছেন বয়স নির্বিশেষে মিশে যাওয়ার গুণ আছে আনিসুজ্জামানের মধ্যে। বছর তিনেক আগে পর্যন্ত সেই আগুন হয়ে যাওয়া সময়ে অনেক ছাত্রকে সাহায্য করেছিলেন আনিসুজ্জামান। নিজের বিপদের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তাদের আশ্রয় দিয়েছেন ফ্ল্যাটে। অধ্যাপকদের নিজেদের জীবনেরও কোনও নিরাপত্তা ছিল না তখন। কোথাওই কোনও নিরাপত্তা ছিল না। ষাটের দশকের শেষ থেকে যে-অস্থিরতা পশ্চিমবঙ্গকে গ্রাস করেছিল তার জন্য সাধারণ মানুষ একেবারে প্রস্তুত ছিল না। ১৯৬৯ সালে মধ্যবর্তী নির্বাচন হল। যুক্তফ্রন্ট সরকার এল। বিভিন্ন দলগুলির পারস্পরিক দ্বন্দ্বের মধ্যে প্রশ্ন উঠল কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার প্রকৃতি ও যুক্তফ্রন্টের ঐক্য নিয়ে। মাত্র তেরো মাস কোনওক্রমে টিকে থাকার পর যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন হল ১৯৭০ সালের মার্চ মাসে। পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হল। এক বছর পর ১৯৭১ সালে এল আবার এক নির্বাচনের সময়। সেও এক মার্চ মাস। ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছিল শ্রমিকদের মার্কসবাদী ট্রেড ইউনিয়ন সি আই টি ইউ। গড়ে উঠেছিল ছাত্র সংগঠন এস এফ আই। সে-সময়েই কংগ্রেসেও দেখা দিয়েছিল ভাঙন। সংগঠন কংগ্রেস এবং শাসক কংগ্রেস। সেই সময়ই শুরু হয়েছিল গুপ্ত হত্যার রাজনীতি এই বাংলায়। ওই বাংলায় মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। এবং সেই সময়ই নেওয়া হয়েছিল ভারতের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি পদক্ষেপ—এক, রাজন্যভাতা বিলোপের সিদ্ধান্ত, দুই, চোদ্দোটি দেশীয় ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ করা। কিন্তু এ সময়ই শুরু হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে সন্ত্রাস ও হত্যা। নির্বিচার হত্যা। যারা পরিবর্তন আনবে বলে বিপ্লব করতে চেয়েছিল তারাও নিয়েছিল খতম নীতি, যারা দমন করতে চেয়েছিল তারাও নিয়েছিল অসংখ্য মৃত্যুর পরোয়ানা। তারই মধ্যে ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হল। বরানগরে বাংলা কংগ্রেস হেরে গেল। কিন্তু কংগ্রেসের সমর্থনে বাংলা কংগ্রেসের নেতৃত্বে আবার তৈরি হল কোয়ালিশন সরকার। আবার নতুন করে আগুনের হল্‌কা এসে লাগল। উত্তাপ ছড়াতে লাগল প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে। আগস্ট মাসে কাশীপুরে ঘটে গেল এক বীভৎস গণহত্যা। টানা চব্বিশ ঘণ্টা ধরে কাশীপুরে একটি নারকীয় উন্মাদনা ও তাণ্ডব চলেছিল সে-সময়। পারস্পরিক খুন নিয়ে— খুনের বদলা খুন— জপতে জপতে কংগ্রেস কর্মীর হত্যাকারী নকশালদের ওপর বদলা নিতে গিয়ে সে-দিন মারা হয়েছিল প্রচুর অরাজনৈতিক, সাধারণ, নিরীহ মানুষকেও। তাদের মধ্যে কিশোর ও স্কুল পড়ুয়ারাও বাদ ছিল না। যারা এ সব হত্যা করে চলেছিল তারা কি জানত না, এইসব বালক, কিশোর বা সাধারণ নিরীহ মানুষেরা কংগ্রেসকর্মী হত্যাকাণ্ডে জড়িত নয়? নিশ্চয়ই জানত। তবু তারা তা করেছিল কারণ ধ্বংস ধ্বংসের জন্ম দেয়। হত্যা, হত্যার। আর এইসব প্রতিধ্বংস বা প্রতিহত্যায় শুধু শোধ নেবার বাসনাই লুকিয়ে থাকে না। থাকে আপন শক্তির নিশ্চিততর বহিঃপ্রকাশের ইচ্ছা। যেন আগুন খেতে খেতে বলা— তুই কী পারিস? দ্যাখ— তোর চেয়ে আমি অনেক বেশি পারি! ১৯৭২ সালে আবার পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের দাবি উঠল। আবার আরও একটি মার্চ মাস। ইতিহাসের পাতায় আবার নতুনতম সংযোজন। এ বারে ক্ষমতায় এল কংগ্রেস। কেন্দ্রে ও রাজ্যে একই শাসকদল কায়েম হল। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে জরুরি অবস্থা জারি করা হল দেশ জুড়ে। আর এই কয়েক বছরে নির্যাতিত হল, নিপীড়িত হল, মৃত্যুর মুখে চলে যেতে লাগল হাজার হাজার মানুষ। কেউ যুবক, কেউ তরুণ, কেউ শিল্পী, কেউ অধ্যাপক বা সাংবাদিক। সংবাদপত্রের বিবৃতির অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হল। মার্কস, লেনিন বা এঙ্গেলসের উদ্ধৃতি ব্যবহার নিষিদ্ধ হল। রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত নিষেধের আওতায় পড়লেন। ভারত স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে ভুলে গেল। এরই মধ্যে এ বছর জানুয়ারিতে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে নির্বাচনি লড়াই ঘোষণা করেছে সংগঠন কংগ্রেস, ভারতীয় লোকদল, সোস্যালিস্ট পার্টি ও জনসঙ্ঘ দল। তৈরি হয়েছে জনতা পার্টি। জ—অ—ন—ও—তা—আ পার্টি।

সেই নির্বাচন সমাগত। জরুরি অবস্থা এখনও জারি আছে। কিন্তু কিছুটা শিথিল করা হয়েছে নির্বাচনের জন্য। মিছিল ও প্রচারের হাওয়া বন্ধ। বিকাশ প্রস্তুত। তাঁকে নির্বাচনি কেন্দ্রে দায়িত্ব নিয়ে যেতে হবে। কেমন হবে এ বারের নির্বাচন? কী হবে এই নতুন ইতিহাস? সাধারণ লোকের কোনও নিশ্চিত ধারণা নেই। তারা শুধু এটুকু অনুভব করতে পারে যে বিগত আট বছরের জের এখনও কাটেনি। লোকসভা নির্বাচন হলে জুন মাস নাগাদ বিধানসভা। আপাতদৃষ্টিতে জনজীবন স্বাভাবিক। স্থির। উত্তেজনাহীন। কিন্তু বিকাশ নিজের জীবন দিয়ে দেখেছেন, রাজনৈতিক ঝড় হঠাৎ আসে, তার উত্থান অতি ধীর। গোপনীয়। হৃদস্পন্দনের চেয়েও অগোচর তার পদধ্বনি। কিন্তু তা হঠাৎ উত্থিত হয়। তীব্র শক্তিতে ভেঙে-চুরে দেয় প্রতিষ্ঠিত নিয়ম। জনজীবন বিপর্যস্ত হয়। যেমন বিকাশ হয়েছিলেন৷ যেমন প্রণবেশ হয়েছিলেন। বিকাশ আকাশের দিকে তাকান। কালচে দু’ খণ্ড মেঘ ভেসে যাচ্ছে। বৈশাখ চলে এল প্রায়। যে-কোনওদিন কালবৈশাখী হবে। বাজারে কাঁচা আম উঠেছে। আকাশে মেঘ ভাসছে। ভেসে যাচ্ছে সময়ের মতো। জীবনের মতো। ইতিহাসের মতো।

লক্ষ্মীর স্কুল এসে গেল সামনে। দরজা খোলা। তার মানে শেফালির মা কাজ করছে। বিকাশ উঁকি দিলেন ভেতরে। সমস্ত বইপত্রের স্তূপ নামিয়ে ঝাঁট দিচ্ছে শেফালির মা। বিকাশকে দেখেই ঘোমটা টেনে ছুটে এল সে। একটা চেয়ার ঝেড়েমুছে বলল, বসেন। দাদা।

বিকাশ বসলেন। তাঁর খুব জলতেষ্টা পেল। বললেন, এক গ্লাস জল দিতে পারো?

—এই আনি।

ছুটে গেল শেফালির মা। বাথরুম থেকে হাত ধুয়ে এল। কুঁজো থেকে ঠাণ্ডা জল ঢেলে গ্লাস এগিয়ে দিল বিকাশের দিকে। বিকাশ হাতে জল নিয়ে ঘাড়ে মুখে ছিটিয়ে দিলেন। তারপর একটানা সবটুকু জল খেয়ে বললেন, আর একটু দেবে?

আরও এক গ্লাস জল দিল শেফালির মা। বিকাশ দেখলেন, বয়সের ছাপ পড়েছে শেফালির মা’র মুখে। দারিদ্র্য, পরিশ্রম, ক্লান্তি সব মিশে আছে। বেশ সুশ্রী ছিল শেফালির মা তখন। যখন প্রথম এসেছিল। একটা নম্র, ভীরু, লজ্জারুণ ভাব থাকত মুখে আর ব্যবহারে। তাতে আরও সুন্দর লাগত তাকে। এখনও মাথায় একটা বিশাল খোঁপা। জীবন মানুষকে কোথা থেকে কোথায় এনে ফেলে। দেশভাগের সময় পূর্ব বাংলা থেকে এসে উদ্বাস্তু কলোনিতে মুখ গুঁজেছিল শেফালির মা-রা। মল্লিনাথ ডাক্তারের গ্রাম সম্পর্কে চেনা ছিল তারা। মল্লিনাথই উদ্বাস্তু কলোনির ওই ঘরটা জুটিয়ে দেন। বহুদিন ওদের খরচপত্রও জুটিয়েছিলেন। তখন মল্লিনাথের সবে ডাক্তারি পড়া শেষ হয়েছে, ভাল করে পসার জমেনি। বিকাশ কলেজের দোরগোড়ায়। চল্লিশের দশকে, সেই সময়ের কথা, যারা দেখেছে, কেউই ভুলতে পারবে না। কত মানুষ যে বিষয়-সম্পত্তি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে তখন! সমস্ত হারিয়ে, শুধুমাত্র বাঁচার জন্য, দু’মুঠো ভাতের জন্য যা পেয়েছে তাই করেছে। স্কুল মাস্টার গামছা বিক্রি করেছে। ঘরের বউ পরের বাড়িতে ঝিগিরি করেছে। কত ভাল মেয়ে বিক্রি হয়ে গেছে। কত মেধাবী ছাত্রের পড়া হয়নি।

যারা আগে-ভাগে হাওয়া দেখে পাততাড়ি গুটিয়ে নিচ্ছিল তারাই একমাত্র মানমর্যাদা বাঁচিয়ে চলতে পেরেছিল তখন। সেই ঝড় থামতে না-থামতেই কতবার যুদ্ধ হল। কতবার রায়ট লাগল। কত রকম আন্দোলন হল দেশটায়। বিকাশ ভাবেন, মানুষের জীবন চিরকালই কি এরকম অস্থির?

দ্বিতীয় গ্লাসের পুরো জলটা খেলেন না বিকাশ। খানিকটা দেওয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখা চারাগুলোতে ছিটিয়ে দিলেন। শেফালির মাকে বললেন, পুরনো কাগজ জমিয়েছ?

—হ। প্রায় শ্যাষ হইল বইলা।

—আমি দেখি নিতাইকে যদি পাই তো পাঠিয়ে দেব।

—নিতাইরে আমি কইসি। সক্কাল সক্কাল আমার লগে দ্যাখা হইসিল। হ্যায় আইয়া লইয়া যাইব।

বিকাশ উঠে দাঁড়ান। তাঁকে গাছগুলো লাগাতে হবে। তাঁর এই গাছ লাগানোর বাতিক নিয়ে অনেকে হাসাহাসি করে। কিন্তু বিকাশ চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পান— মাথুরের গড়ে আর একটিও বড় গাছ নেই। সব গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। সব পুকুর বুজে যাচ্ছে। সব মাঠ ইটে ভর্তি। শুধু গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ি। অনেক অনেক প্রাণহীন বাড়ি।

আর একটু এগোলেই ডান হাতে ক্লাব। নীলোফা একটা বিশাল মানিপ্ল্যান্টের ডাল হাতে নিয়ে ফিরছিল। এখন বেশ গরম। নীলোফা একটা ছাই রঙের বোরখায় নিজেকে ঢেকে রেখেছে। কারওকেই মুখ দেখায় না মেয়েটি। বিকাশ শুনেছেন ছোটবেলায় বিশ্রীভাবে পুড়ে গিয়েছিল নীলোফা, মুখটা নষ্ট হয়ে গেছে, তাই আর বিয়ে দেওয়া যায়নি। বিকাশের অদ্ভুত লাগে। শ্বেতীতে আনিসুজ্জামানের মুখটাও ক্রমশ বীভৎস হয়ে উঠেছে। নীলোফা কতখানি পোড়া বিকাশ জানেন না, কিন্তু অনেকটাই হবে তা অনুমান করেন। কাছাকাছি আসতেই নীলোফা বলল, ওগুলো কী গাছ কাকু?

বিকাশ মজা পান। তাঁকে আনিসুজ্জামান ডাকেন দাদা। বিকাশদা। আর নীলোফা ডাকে কাকু। পাড়াতুতো সম্বোধনগুলোয় সত্যিই কোনও মাথামুণ্ডু নেই। বিকাশ তাকালেন, খুব মিষ্টি কণ্ঠ মেয়েটির। গান গাইলে বেশ লাগবে শুনতে। কিন্তু ও তো কখনওই মুখ খুলে গাইতে পারবে না। আনিসুজ্জামান একটি সেতার কিনে দিয়েছেন বোনকে। নীলোফা প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত মিথিলেশ ব্যানার্জির কাছে সেতার শিখতে যায়। বিকাশের ঠিক পাশের বাড়িতেই থাকেন মিথিলেশ। সেতারি হিসেবে মিথিলেশের নাম আছে। আকাশবাণীতে প্রায়ই অনুষ্ঠান করেন। দেশ-বিদেশে ডাক পান। কোনও অহংকার নেই মানুষটার। একটু আপনভোলা গোছের। একটা মাত্র ছেলে ওঁদের। মৃণ্ময়। মানুষ হল না ছেলেটা। এত বড় মানুষের ছেলে, এখন নাকি নেশা করে বেড়ায়। কে নাকি তাকে খারাপ পাড়াতেও দেখেছে। আশ্চর্য! এ খবরটা কে রটায়? খারাপ পাড়ায় অন্যকে যে দেখতে পায় সে তো নিজেও সেখানে গিয়েছিল বলে বোঝা যায়।

বিকাশ গাছগুলো সোজা করে ধরলেন। বললেন, সব দেবদারু, আকাশমণি আর কৃষ্ণচূড়া।

নীলোফা মিষ্টি করে বলে, একটা কৃষ্ণচূড়া আমায় দেবেন?

—কোথায় লাগাবে?

আমাদের ব্যালকনিতে অনেক ক’টা টব করেছি আমি। একদিন আসবেন কাকু, দেখাব।

বিকাশ বলেন, তুমি টবে কৃষ্ণচূড়া লাগাতে চাও? হবে না তো।

—হবে কাকু। আমি একটা বনসাই-এর বই আনিয়েছি। গাছটা আমি বনসাই করব।

বিকাশ, প্রায় শিশুর মতো, হাতটি নিজের পেছনে লুকোন। তাঁর ভ্রূ কুঁচকে যায়। সন্ত্রস্ত ও অসন্তুষ্ট গলায় বলেন, বনসাই? না না। বনসাই আমি পছন্দ করি না।

—কেন কাকু?

—না। একটা গাছের স্বাভাবিক বাড় বৃদ্ধি বন্ধ করে বামন করে রাখা, এ আমি সহ্য করতে পারি না।

—কেন কাকু? ছোট্ট ছোট্ট গাছে লেবু ঝুলবে, পেয়ারা ঝুলবে—ভাল লাগে না?

রণেন কয়েকটা বই হাতে করে আসছিলেন। বিকাশকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন। নীলোফার কথা শুনতে শুনতে বললেন, কী নিয়ে এত কথা?

নীলোফা জেদি মেয়ের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে বোরখা নাড়িয়ে বলে, আপনি বলুন কাকু, বনসাই কি খারাপ?

রণেন কিছু বলার আগেই বিকাশ হঠাৎ চটে ওঠেন। এত তর্ক করছে কেন মেয়েটা? একটা স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে দাবিয়ে থামিয়ে রাখার প্রচেষ্টা কখনও ভাল হতে পারে না। সুন্দর হতে পারে না। তিনি গলা চড়িয়ে বলেন, খারাপ। অবশ্যই খারাপ। রণু কী বলবে? অ্যাঁ? আমি বলছি? একটা বড় গাছের বনসাই করে রাখা রীতিমতো অপরাধ। একেবারে অপরাধ। তোমাকে যদি কেউ শিশু হয়ে থাকবার জন্য হাঁড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে রাখত?

নীলোফা মরিয়ার মতো বলে, মানুষ আর গাছ?

—হ্যাঁ। মানুষ আর গাছ।

বিকাশ চেঁচান। তাঁর গলা সীমা ছাড়িয়ে যায়, এখনও গাছকে ভালবাসতে শেখোনি, বাগান করছ!

রণেন বিকাশের হাত ধরে টানেন। আজকাল বিকাশ মাঝে মাঝেই এরকম চটে ওঠেন। রণেন বোঝেন— শান্তি নেই বিকাশের। তিনি নীলোফার দিকে তাকিয়ে বলেন, কিছু মনে কোরো না মা। তুমি বাড়ি যাও।

নীলোফা নিঃশব্দে চলে যায়। রণেন বিকাশকে জিজ্ঞেস করেন, কোনদিকে যাবি?

—ওই ক্লাবের দিকে।

—চল।

দু’জনে কিছুক্ষণ নীরবে হাঁটেন। বিকাশের হাতের শাবলে ঠং ঠং শব্দ হয়। বিকাশ সেটিকে লাঠির মতো ব্যবহার করছেন এখন। রণেন বলেন, ওইটুকু মেয়েটাকে ওভাবে বললি কেন? বেচারা।

বিকাশ চুপ করে থাকেন। সত্যি কাজটা ঠিক হয়নি। জাপানি বনসাই এখন অনেকেই করে। বিকাশ কি তা বন্ধ করতে পারছেন? আসলে সকাল থেকেই বিকাশ অস্থির হয়ে আছেন। প্রণবেশের ছেলেটাকে পাওয়া যাচ্ছে না। দারুণ মনে পড়ছে ছোট খোকাকে। সকালে খাওয়া হয়নি। বিকাশকে চুপ করে থাকতে দেখে রণেন বললেন, আমি যাই রে। ভারত-অস্ট্রেলিয়ার রিলেটা শুনব।

—বই কোথা থেকে পেলি?

—লাইব্রেরি থেকে।

—রবিবার লাইব্রেরি?

—নান্টুকে বলেছিলাম। ও নিজের বাড়িতে নিয়ে রেখেছিল কাল। আমার তো সময় হয় না।

মাঠের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন দু’জনে। এ দিকটায় দুঃখদার বাড়ি। দুঃখদার ছেলে রঞ্জন গান গাইছে। ভাল গায় রঞ্জন। খুব নিষ্ঠার সঙ্গে সে চর্চা করে। এ পাড়ায় আরও একটি ছেলেও ভাল গায়। পরেশের ছেলে অনুপম। অনুপম ভাল গাইলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। পরেশ নিজেও খুব ভাল গাইতেন আগে। কিন্তু রঞ্জন এই সুর কোথায় পেল? দুঃখদা কোনওদিন গান গাইতেন বলে শোনা যায়নি।

রণেনকে পেয়ে বিকাশের ভাল লাগছিল। আরও একটু কথা বলার জন্য তিনি বললেন, প্রণবেশের ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না, শুনেছিস।

—সে কী? শুনিনি তো! কবে থেকে।

—আজ সকাল থেকে। ফারাক্কা থেকে আসছিল। প্রণবেশ আর ওর বউ বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ দেখে ছেলে নেই।

—প্রণবেশ কোথায়?

—ভায়রার বাড়ি গেল। ভবানীপুরে।

—আমাদের ছেলেগুলোকে তো জানানো দরকার। সাহায্য করতে পারত। আর কাকেই-বা জানাবে, ভাল ছেলেগুলোই চলে গেল। এখন সব স্বার্থপর। স্বার্থপর আর নেশাখোর। মল্লিদার ছেলেটা তো মরেই গেল।

হঠাৎ, আশ্চর্য আলোয় মন ভরে গেল বিকাশের, রণেন কি দেবার্চনের কথাই বলল না? ভাল ছেলে। হ্যাঁ। ভাল ছেলে তো ছিলই দেবার্চন। সে চলে গেছে। আশ্চর্য স্বপ্ন দেখে চলে গেছে। মানুষের জন্য ভাবতে গিয়ে, মানুষের গুলিতে মরে গেছে। কিন্তু যারা চিনত-জানত তারা আজও ভালবাসে তাকে। বাসবেই তো। সে তো নেশা করে মরেনি! অন্যায় করে মরেনি!

অন্যায় নয়? বিকাশের মধ্যে কেউ ফুঁসে ওঠে। যে-পথ ওরা নির্বাচন করেছিল, অহিংস ভারতের ঐতিহ্য ধুলোয় মাড়িয়ে যেভাবে ঘোষণা করেছিল—বন্দুকের নলই প্রকৃত ক্ষমতার উৎস, সে-পথ অন্যায় নয়?

রণেন চলে গেছেন। বিকাশ মাঠ পেরুতে পেরুতে ভাবেন—না। অন্যায় নয়। ভুল হতে পারে কিন্তু অন্যায় নয়। তা হলে রাশিয়ার সশস্ত্র অভ্যুত্থানও অন্যায়। স্বাধীনতার আগে সশস্ত্র বিপ্লব অন্যায়। সুভাষ বোসের পথ অন্যায়। না। অন্যায় করেনি দেবার্চন। কারণ ওরা মানুষের জন্য ভেবেছিল। দেশের জন্য ভেবেছিল। ক্ষণিক হলেও প্রিয়তম স্বপ্নের জন্য ওরা প্রাণ দিয়েছে।

রেললাইনের পাড়ে গোবর কুড়োচ্ছিল ফুলরেণু। ক্লাবের ছায়ায় বসে সে জিরোতে লাগল। ক্লাবের দরজা বন্ধ। অর্থাৎ ভিতরে লোক আছে। বিকাশ ক্লাবের পাশ দিয়ে গাছ পুঁততে গেলেন। এত রোদে গাছগুলো শুকিয়ে না যায়। আরও সকালে লাগালে ভাল হত। মকবুলকে বলা আছে বিকাশের। বিকেলে ও এসে বাঁশের ঘের দিয়ে যাবে এখানে। কিন্তু এগুলোতে জল দেওয়া দরকার। জল আনতে গেলে যেতে হবে সেই দুঃখদার বাড়ি। এই রোদে আবার পুরো মাঠ পেরুতে হবে। বিকাশের মনে হল ক্লাবে জল পাওয়া যেতে পারে। কিংবা ছেলেগুলো যদি দুঃখদার বাড়ি থেকে জল বয়ে দেয়। তিনি বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়ালেন। ফুলরেণু প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এসে বলল, কী করো বাবু? কী করো?

—এই একটু জল নেব। ভেতরে ওরা আছে না?

—আছে তো। গাছে জল দেবে নাকি?

—হ্যাঁ।

—ও দরজা খুলো না বাবু গো।

—কেন বলো তো?

—ওখানে দাদাবাবুরা নেশা করছে যে। তোমার মতন বড়মানুষ ওখানে যেয়ো না। তারা তো নিজের মধ্যে নেই। মান রাখবে নাকো আপনার।

বিকাশ থমকে যান। ক্লাবঘরটা নেশার জায়গা হয়ে উঠেছে শুনেছিলেন বটে তিনি। এবং আর সবার মতো এড়িয়েও গিয়েছিলেন। হঠাৎ অদম্য ইচ্ছে হল তাঁর। কী নেশা করে দেখবেন। ফুলরেণুকে বললেন, ওরা কী নেশা করে বলো তো?

—জানো না বুঝি? আই অ্যামনি করে ধরে আর আগুন জ্বেলে ফুঁ দেয়। দেখতে চাও?

বিকাশ মাথা নাড়েন। ফুলরেণু ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে চুপ করতে বলে রেললাইনের ঢালের দিকে এগিয়ে যায়। বিকাশ তার পেছনে এগিয়ে যান। চলনের অভিঘাতে ফুলরেণুর কুঁজটি ওঠে-নামে। বিকাশ দেখেন, রেললাইনের ওপারে ধু ধু জলাজমি। শেষ দেখা যায় না। ডানদিকে তাকালে রেলের সিগনাল চোখে পড়ে। বাঁদিকে মাঠ পেরিয়ে রেললাইনের সমান্তরালে আরও কিছু বাড়ি। এই এলাকাকেও আগে মাথুরের গড় বলা হত। এখন নতুন নাম হয়েছে আশ্রমপাড়া। ও দিকে লোকনাথবাবার মন্দির ও আশ্রম। ও দিকে রেল লাইনের তলা দিয়ে আড়াআড়িভাবে একটা রাস্তা গেছে। পি ডাব্লু ডি রোড় আর বি টি রোডের যোগাযোগ। রাস্তা থাকায় রেলের ছোট ব্রিজ হয়েছে ওখানে। লোকে বলে মরণ ব্রিজ। গোরু বাছুর মানুষ—অনেক কাটা পড়েছে ওইখানটায়। ওই রাস্তা পেরোলে ফটিক বিল। বিস্তৃত ওই বিলের ধার ঘেঁষে বস্তি। ঘন। নোংরা। জনবহুল বস্তি। আর অন্য পাশে খাটাল।

আশেপাশে মানুষ নেই। মাঠের অন্য পাড়ে লাইব্রেরি। সারাদিন নান্টু আর সুলেখাদি ওখানে নিজের কাজ করে। বিকাশের মনে হল, নেশা করার পক্ষে এর চেয়ে উপযুক্ত জায়গা আর হয় না।

ক্লাবের পেছন দিকে ঘুরে একটা ছোট জানালার কাছে এসে থামল ফুলরেণু। তারপর রেললাইনের ঢাল বেয়ে একটা জায়গায় বসে পড়ল। মাঠের তুলনায় রেললাইন অনেক উঁচুতে। বিকাশ ফুলরেণুর ইশারা অনুযায়ী ঢালে উঠে পড়লেন। ফুলরেণু ইশারা করে হাত নেড়ে বলল, বোসো। বসে পড়ো।

তার মুখে শিশুর আনন্দ। খুব গোপনে পরমাত্মীয়কে প্রিয় জিনিস দেখালে শিশুদের যেমনি খুশিতে আলোকময় লাগে তেমনি দেখাচ্ছিল ফুলরেণুকে। সে ফিসফিস করল, ওই দ্যাখো বাবু।

কে কে ওরা? বিকাশ রোদ্দুর থেকে চোখ আড়াল করলেন। চারজনকে চিনতে পারলেন। মিথিলেশের ছেলে মৃণ্ময়। সুধীর পালের ছেলে কাজল। গোপাল কুণ্ডুর ছেলে সুজন আর ঘোষবাড়ির অমিতাভ। বাকিদের চিনতে পারলেন না। মোট ন’জন ছেলে গোল হয়ে বসে নেশা করছে। মাঝে মাঝে দেশলাই বা লাইটার জ্বলে উঠছে। কেউ কোনও কথা বলছে না। কোনও দিকে তাদের মন নেই। প্রচণ্ড রোদ্দুরে বিকাশের চোখে ধাঁধা লেগে যাচ্ছিল। তিনি উঠে পড়লেন। ফুলরেণুও মাথায় কাপড় চাপা দিয়ে গোবর কুড়োতে গেল। বিকাশ আশ্চর্য হয়ে ফুলরেণুর দিকে চেয়ে রইলেন। রোগা, কুঁজো, নড়বড়ে ফুলরেণু। সারাদিন রোদে ঘুরে ঘুরে গোবর কুড়োয় আর ঘুঁটে দিয়ে, গুল দিয়ে বিক্রি করে। দারিদ্র সত্ত্বেও সে চমৎকার হাসে। প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সে কাজ করে। তার সাধ্যমতো, এই সমাজে, ফুলরেণু প্রয়োজনীয়তা সরবরাহ করে। কিন্তু ওদের অবস্থা? মিথিলেশ সেতারি। গোপাল কুণ্ডুর বিরাট কাপড়ের দোকান বাজারে। সুধীর পাল ও ঘোষদের বড় বড় ব্যবসা। ট্রাক, বাস, জমি-বাড়ি। পয়সা গুনতে গুনতে দিন-রাত কেটে যায়। খাওয়া-পরার চিন্তা নেই। নিরাপত্তার ভাবনা নেই। ওদের ছেলেরা নেশা করে হাজার হাজার টাকা উড়িয়ে দিচ্ছে। বিকাশ ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করেন। তাঁকে গাছে জল দিতে হবে। মাঠ পেরোতে পেরোতে তাঁর মনে হয়—মানুষ আসলে কী চায়? শুধু উপভোগ? জৈবিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে শুধু শরীরের সুখ বিহার? তা হলে মানুষ কাজ করে কেন? শুধু খাবার জন্য? শুধু ভরণ-পোষণের জন্য? কোনও রিপু কি তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়? নাকি কিছু পেতে চায় সে? নাকি কাজ করা মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই আবশ্যিক স্বাভাবিকতা? ওই যে ফুলরেণু? ও তো ভিক্ষে করেও খেতে পারত। কিন্তু ও সারাদিন এত পরিশ্রম করে কেন?

ছোট খোকা বলেছিল, আমরা কাজ করছি বাবা। অনেক বড় কাজ। কী ছিল সেই কাজ? এই চলতি নিয়মকে উল্টে দেওয়া? শোষণবিহীন, স্বার্থবিহীন সমাজ গড়ে তোলা? যেখানে ফুলরেণুর মতো মানুষও পরিশ্রমের যথাযোগ্য মূল্য পাবে? কই, দেবার্চনের বাবা হয়ে তাঁর তো একবারও ইচ্ছে হয় না কিছু করি? বঞ্চিতদের জন্য? শোষিতদের জন্য? হয়তো বয়স হলে উত্তেজনা থিতিয়ে আসে। কর্মচাঞ্চল্য কমে যায়। দেখার বা বোঝার ইচ্ছেও কি কমে যায়? এতদিন ধরে শুনেছেন ক্লাবে নেশা করা হয়—কখনও আসেননি কেন? এই বেশ আছি গোছের স্থাণুবৎ প্রক্রিয়ায় তিনিও কি জন্তুর মতো প্রাণধারণই করছেন না শুধু? তা হলে তাঁকে এক প্রকার জড়ই বলা যায় কারণ স্থবিরতা ও নিষ্প্রাণতার মধ্যে মূল তফাত কিছুই নেই। মানুষের জিজ্ঞাসার উৎসও কি তবে কোনও রাসায়নিক প্রক্রিয়া? যৌন ইচ্ছার মতো বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সে হ্রাস পায়? অদ্ভুত কিছু কথা মনে পড়ে বিকাশের। কে বলেছিল এই কথাগুলো? নাকি পড়েছিলেন? কথাগুলো আশ্চর্য। এবং সত্যি। কিন্তু সহজবোধ্য নয়। তিনি ভাবতে থাকেন— তুমি কি সাধারণ? তবে তোমার কর্তব্য শুধু পরিবারের প্রতি। তুমি কি আরও একটু বেশি? তোমার কর্তব্য তবে সমাজের প্রতি। তারও বেশি কি তুমি? তা হলে তুমি দেশের। আর যদি তার চেয়েও বড় হও তবে পৃথিবীর প্রতি তোমার কর্তব্য। আর তুমি যদি সব ছাড়িয়ে যাও, সবার চেয়ে বৃহৎ আর মহান হয়ে ওঠো তবে তোমার কর্তব্য তোমার নিজের প্রতি।…

—তুমি কী?

—আমি কী?

—তুমি কে?

—আমি কে?

—কী তোমার কর্তব্য?

বিকাশ মনে মনে স্থির করেন, পুলিশে জানাবেন তিনি। ওরা সমাজবিরোধী কাজ করছে। খারাপ নেশা করছে। ওই নেশার জন্য মল্লিদার ছেলে চলে গেল। হঠাৎ চমকে উঠলেন বিকাশ। পুলিশ! আবার তিনি পুলিশের কথা ভাবছেন!

১৩

সকাল সাতটায় প্রণবেশ বিকাশের দরজায় বেল বাজালেন। বিকাশ তখন সবে প্রথমবারের চা শেষ করেছেন। সকালে একবারে দু’কাপ চা খাওয়া বিকাশ ও লক্ষ্মীর বহুকালের অভ্যাস। বেলের শব্দে অবাকই হলেন দু’জনে। অন্ধর মা কাজে আসে আটটায়। তার আগে আর বেল দেবার মতো কেউ নেই। লক্ষ্মী চা ঢালছিলেন। বিকাশ উঠে দরজা খুললেন। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রণবেশ। পেছনে জুঁই। প্রণবেশের চুল এলোমেলো, চোখের নীচে গভীর কালি। জুঁইয়ের মুখ-চোখ ফোলা। কাল থেকে বোধহয় তারও চুলে চিরুনি পড়েনি। ঘুমও যে হয়নি তা বলে দেবার দরকার হয় না। দেবার্চনের সময় কতদিন ঘুমোননি বিকাশ ও লক্ষ্মী? কতদিন?

বিকাশ বললেন, খোঁজ পেলে কিছু?

—না, বিকাশদা।

লক্ষ্মী ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছেন দরজার কাছে। বললেন, ভেতরে এসো প্রণবেশ। কী যেন নাম তোমার বউয়ের?

—জুঁই।

—হ্যাঁ, জুঁই, এসো।

প্রণবেশ ও জুঁই ঘরে এলেন। বসার ঘরে সোফার ওপর একগাদা কাপড়-জামা ডাঁই করা। সব অন্ধর মা এসে গোছাবে। শুধুমাত্র রান্না করা ছাড়া ঘরের কোনও কাজই লক্ষ্মী করেন না। রান্নার জন্যও লোক রাখা হয়েছে অনেকবার। কিন্তু দেবাশিস বাইরের লোকের হাতে খেতে ঘেন্না পায়। বিশেষ করে কারও গায়ের রং যদি কালো হয় তবে ওর নাকি মনে হয় তরকারি বা মাছের ঝোলের রংও কালো হয়ে গেছে। বিকাশ জিজ্ঞাসা করেছিলেন—হোটেলে কেমন করে খাস? সে বলেছিল—হোটেলে তো দেখতে যাচ্ছি না কে রাঁধছে! লক্ষ্মীর গায়ের রং খুব ফরসা নয়। কালোও নয়। মাজা মাজা। বরং বিকাশকে ফরসা বলা যায়। ছোটবেলায় নাকি দুগ্ধধবল ছিলেন তিনি। নামও ছিল ধলু। রংটা এখন পুড়ে গেছে। পৃথিবীতে রঙের মূল্য এতটুকু ফুরোয়নি এখনও।

প্রণবেশ আর জুঁইকে কোথায় বসতে বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না বিকাশ। লক্ষ্মীই বললেন, ওদের খাবার টেবিলে নিয়ে এসো।

লক্ষ্মীর জাতপাতের মানামানি আছে। সবাইকে খাবার টেবিলে বসানো পছন্দ করেন না। বিকাশকে তাই খুবই সতর্ক থাকতে হয়।

প্রণবেশ আর জুঁই বসলেন। বিকাশও বসলেন। জুঁই বসেই দু’হাতে মুখ ঢাকলেন। বিকাশ কী বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। চুপচাপ কিছুক্ষণ কেটে গেল। লক্ষ্মী ট্রেতে চায়ের পট, কাপ আর এক প্লেট বিস্কিট নিয়ে এলেন। কাপে চা ঢেলে সবার দিকে এগিয়ে দিলেন তিনি। বিকাশ দেখলেন, অনেকদিন পর এ বাড়ির খাবার টেবিলে চারটে চেয়ার ভরা।

বিকাশের আত্মীয়স্বজন খুবই কম। এ বাড়িতে তাঁরা কালেভদ্রে আসেন। শেষ এ বাড়িতে কবে কোন আত্মীয় এসে বাস করে গেছেন বিকাশ মনে করতে পারেন না। কোনও আত্মীয় এলে খুব অসন্তুষ্ট হন লক্ষ্মী। হয়তো আত্মীয়রা তা টের পেয়েছেন। এ ছাড়া সবাই এখন ব্যস্ত। দেবার্চনের খবর শুনে বিকাশের দাদারা ছুটে এসেছিলেন। নিজের দাদা নন কেউ। জ্যেঠতুতো-খুড়তুতো। লক্ষ্মী পাশের ঘর থেকে চিৎকার করেছিলেন—“মজা দেখতে এসেছে সব! মজা! ছেলে মরেছে! দেখি কেমন নাটক হচ্ছে!” শোকে পাগল হয়ে আছেন মনে করে দাদারা কোনও কথা বলেননি। কিন্তু বিকাশ বোঝেন, শোকের মধ্যেও ওভাবে কারওকে বলা যায় না। অত শোকের মধ্যেও লক্ষ্মীর সে-দিনের আচরণ বিকাশ ক্ষমা করতে পারেননি। লক্ষ্মী সাধারণতই একটু রূঢ়, কটুভাষী।

প্রণবেশ অন্যমনস্কভাবে চায়ে চুমুক দিলেন। জুঁই মুখ থেকে হাত নামিয়ে অপলক তাকিয়ে আছেন চায়ের দিকে। যেন চায়ের কাপটা ঠিক দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। তলিয়ে গেছেন কোনও অজানা দেশে। লক্ষ্মী বললেন, এই যে, কী যেন নাম তোমার, জুঁই, চা খেয়ে নাও।

জুঁই মুখ তুললেন না। লক্ষ্মী বললেন, খাও, খাও, চা-টা খাও। যা হয়েছে সে তো বোঝাই যাবে আজ নয়, কাল।

এতক্ষণে মুখ তোলেন জুঁই। অবরুদ্ধ স্বরে প্রশ্ন করেন, তার মানে?

বিকাশ এ বার খুব কাছ থেকে তাঁর দিকে তাকান। জুঁইয়ের গাল দু’টিতে জল মুছতে থাকার লালচে দাগ। চোখ দুটি রিক্ত। অসম্ভব বেদনার্ত এক মায়ের ছবি বিকাশের সামনে। লক্ষ্মীর কথায় বিকাশের ভয় করে। ও কি ইচ্ছে করে এভাবে বলছে? ইচ্ছে করে? ও এত নিষ্ঠুর? তাড়াতাড়ি, এ প্রসঙ্গ সামাল দিতে বিকাশ বলেন, কোথায় কোথায় খুঁজলে প্রণবেশ?

—অনেক জায়গায় খুঁজেছি বিকাশদা।

তাঁর কথা শেষ না হতেই লক্ষ্মী বলে ওঠেন, মর্গটা দেখেছ? শিয়ালদা মর্গ? রেলে কিছু হলে ওখানেই আনবে।

বিকাশ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবার। অসহিষ্ণু হয়ে বলেন, তুমি থামবে?

লক্ষ্মী ভুরু কুঁচকোন। তারপর বলেন, কেন? কিছু ভুল বললাম?

বিকাশ বলেন, মর্গে খোঁজার কী আছে? ছোট ছেলে কোনও খেয়ালে কোথাও নেমে পড়েছে। কেউ ঠিক পৌঁছে দেবে দেখো। তোমার ছেলে ঠিকানা বলতে পারে, প্রণবেশ?

প্রণবেশ মাথা নাড়েন। তাঁর গলায় স্বর ফোটে না। একটুখানি কেশে গলা পরিষ্কার করে বলেন, বউদি ঠিকই বলছেন। মর্গে দেখা উচিত।

বিকাশ তীব্র প্রতিবাদ করেন, না। মর্গে যেতে হবে না। আমি বলছি।

প্রণবেশ ফের বলেন, না বিকাশদা। আমি তো সে-কথা বলতেই এসেছিলাম। হাসপাতালগুলো কাল আমরা খোঁজ নিয়েছি। আমার ভায়রা শেয়ালদায় এসে ওর এক রেলওয়ে অফিসার বন্ধুকে ধরে কাছাকাছি স্টেশনগুলোতে খবর নেবার চেষ্টা করেছে। শুধু মর্গটাই বাকি আছে। আপনার অফিস যাবার পথে একবার যাবেন আমার সঙ্গে?

বিকাশ নিরুপায় ও শান্তভাবে বলেন, যাব।

প্রণবেশ ক্লান্ত গলায় বলেন, আমরা সকালে উঠেই চলে এলাম এই ভেবে যে ও যদি ফেরে, যদি দরজার তালা দেখে কাঁদে; অন্য কোথাও চলে যায়—

তাঁর স্বর রুদ্ধ হয়ে আসে। তখন জুঁই কান্নায় ভেঙে পড়তে পড়তে বলেন, ও আসবে না। ও আসবে না। তোমার জন্য এরকম হল। তুমি ওকে চাওনি।

তাঁর সজল চোখও ক্রমে জ্বলন্ত হয়ে ওঠে। চিৎকার করে তিনি বলতে থাকেন, জানেন বউদি, জন্মের সময় ওর ক্লেফট প্যালেট ছিল। আলজিভও ছিল না। ক্লেফট প্যালেট অ্যান্ড হেয়ার লিপ্‌স। ওই অবস্থায় আমি ওকে দুধ খাইয়েছি। বারবার ওর অপারেশন হয়েছে। রাতের পর রাত জেগে কত কষ্ট সহ্য করেছি। ওর আর কী? ও বাপ্পাকে সহ্য করতে পারত না তখন। বাপের বাড়িতে ওর আসার কথা থাকলে বাচ্চাকে আমি অন্য পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে রাখতাম।

প্রণবেশ মুখ ঢাকেন। কোনও প্রতিবাদ করেন না। বিকাশ যেন বুঝতে পারেন প্রণবেশ বলতে চান, আমাকে ভুল বুঝো না। সন্তানের ওই বিকৃতি আমি সহ্য করতে পারতাম না। কিন্তু আমি ওকে ভালবাসি।

বিকাশ চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন। আটটা বাজে। ন’টায় বিকাশের গাড়ি আসে। তিনি ধীরে ধীরে তৈরি হয়ে দশটায় বেরোন। কিন্তু আজ তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে। শেয়ালদায় নামলে সময় তো একটু লাগবেই।

প্রণবেশও উঠে দাঁড়ান। লক্ষ্মীর দিকে তাকিয়ে বলেন, তবে আমরাও উঠি। ন’টা নাগাদ চলে আসব বিকাশদা।

লক্ষ্মী বলেন, হ্যাঁ। আর কী বলব ভাই। কার যে কী কপাল! ভগবানকে ডাকো। মনকে শক্ত করো।

বিকাশ বাথরুমের দিকে যেতে যেতে ভাবলেন লক্ষ্মী এভাবে কথা বলছে কেন? ও কি কোনও মজা পাচ্ছে? অন্যকে কষ্ট পেতে দেখার নিষ্ঠুর আনন্দ? আশ্চর্য, একজনের বঞ্চনা অন্যকে এভাবেই সমৃদ্ধ করে! একজনের দুঃখ অন্যকে সুখ দেয়! মানুষ দুঃখের আগুনে পুড়ে পুড়ে সোনা হয় না সবসময়ই। কয়লাও হয়। যেমন লক্ষ্মী।

বিকাশ শাওয়ার খোলেন ও নীচে মাথা পেতে দেন।

১৪

সব ড্রয়ার মড়া ভর্তি। বাড়তি দেহগুলি খোলা মেঝেয়। যথেষ্ট আলো নেই ঘরটায়। পচনশীল শরীরের দুর্গন্ধে গা গুলিয়ে যায়। এখানে ওখানে জড়ো করা মানুষের শব। কোথাও একা একজন। কোথাও একসঙ্গে পাঁচটি-ছ’টি। বরফের চাঁই দেওয়া অনিশ্চিত দেহ। একটি শরীর থেকে চামড়া খসে আসছে। অন্যটির খুলির ওপরটায় ছালচামড়া নেই। অসহ্য সাদা মস্তক। মোটা মোটা ইঁদুর দৌড়ে বেড়াচ্ছে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। ওরা কি শব খায় ? মানুষের শব খেয়ে এরকম চমৎকার স্বাস্থ্য কি ওরা অর্জন করেছে ? কয়েকটি ফুলে ওঠা দেহ। মুখ দেখে আর বোঝা যাবে না ইনি কে ছিলেন ! আশ্চর্য ! এইসব দেহগুলির খোঁজে কেউই আসেননি ? কোনও আত্মীয়স্বজন ? এমন মানুষও কি হয় যার কেউ থাকে না ? একজনও না ?

প্রণবেশের চোখে জল আসছে। তাঁর ভায়রার বন্ধু রেলওয়ে অফিসার সঙ্গে আছেন। প্রণবেশকে বোঝাচ্ছেন, শুধু শুধু ঘুরছেন। আমি খোঁজ নিয়েছি। ওরকম কেউ নেই।

প্রণবেশ চোখ মুছছেন। ভূতগ্রস্তের মতো খুঁজছেন মৃত মানুষদের মুখ। তাঁর শুধু মনে হচ্ছে, এখানে কোথাও কি নীলাদ্রি শুয়ে আছে ? নীলাদ্রির পাশে বাপ্পা ? এইরকম ছালচামড়া উঠে গেছে ওদের ? খুলি ফেটে গেছে ? কিন্তু নীলু বা বাপ্পা পরস্পরকে কেমন করে চিনবে ? কী করে পাশাপাশি শোবে তারা ? বাপ্পার যখন দেড় বছর, তখনই তো নীলু…।

বিকাশ প্রণবেশের কাঁধ জড়িয়ে ধরেন, চলো। আর এখানে নয়।

প্রণবেশ যেন গাঢ় ঘুম ভেঙে জেগে উঠতে চান। আপন মনে বলেন, ও নেই। ও নেই তবে।

বিকাশের মনে হল, ওকে খুঁজে পাওয়াই কি একমাত্র ব্রত ছিল প্রণবেশের ? যেখানে হোক, যে অবস্থায় হোক, এমনকী এই মর্গেও ? ঝকঝকে রোদে এসে দাঁড়ালেন তিনজনে। বিকাশের মনে হল, শরীরে রোদ্দুর পড়ার অনুভূতিতে এত ঝরঝরে কখনও লাগেনি। ওইটুকু সময় মর্গের ভেতরে থাকতে থাকতে সমস্ত শরীর রৌদ্রস্নাত হবার জন্য আকুলিবিকুলি করছিল।

প্রণবেশ পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখ মুছলেন। বিকাশের দিকে ফিরে বললেন, অনেক কষ্ট দিলাম বিকাশদা।

—কষ্টের কথা নয়। কিন্তু তুমি কি একা যেতে পারবে ?

—চলে যাব। ট্রেন ধরে বরানগরে নেমে যাব।

বিকাশ মাথা নাড়েন। অফিস যেতে আর ইচ্ছে করছে না। কিন্তু সোমবার, অনেককে আসতে বলেছেন। আস্তে আস্তে গাড়ির দিকে এগিয়ে চললেন তিনি। সরকারি গাড়ি বলে অনেকটা আনা গেছে। অন্য গাড়ি হলে সেই কার পার্কিং-এ রাখতে হত। একটি ছেলে কাগজ বিক্রি করছিল। বিকাশের মনে পড়ল আজ কাগজ পড়া হয়নি। তিনি ছেলেটিকে ডাকলেন। একটি স্টেটসম্যান নিলেন। গাড়িতে যেতে যেতে পড়া যাবে। নিজের চারপাশে মর্গের গন্ধ পাচ্ছিলেন বিকাশ। কবজি নাকের কাছে এনে শুঁকলেন একবার। মনে হল শার্টে গন্ধ হয়ে গেছে। অল্প দূরে শেয়ালদা চত্বরের সবজি বাজার। একপাশে জমে থাকা সবজি ও ফল-পাতার পচনশীল স্তূপ। তার থেকেও দারুণ দুর্গন্ধ আসছে। চারপাশে শ’য়ে-শ’য়ে মানুষ। কারও কোনও বিচলন নেই। কারও নাকে রুমাল নেই। বিকাশ নাকে রুমাল চাপলেন। রুমালেও পচনশীল শবের দুর্গন্ধ লাগল। তিনি বড় বড় পা ফেলে এগোলেন। এই পরিবেশ থেকে চলে না গেলে এই গন্ধ তাঁকে ছাড়বে না। বিকাশের হঠাৎ মনে হল মৃত ও জীবিত শরীরের মধ্যে মাত্র একটি শব্দের ব্যবধান— প্রাণ ! প্রাণ কী ? জানেন না বিকাশ। কিন্তু তাঁর মধ্যে প্রিয় সন্তানের প্রাণহীনতার হাহাকার নতুন শব্দে বয়ে যায়। সেই শব্দ অনেকটা যান্ত্রিক শকটের তীক্ষ্ণ বাঁশির মতো এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিতে থাকে। সবসুদ্ধ বিকাশ গাড়ির দিকে এগোন।

বিকাশের ড্রাইভার ভানু প্রায় চার বছর হল এ গাড়ি চালাচ্ছে। এর আগে বিকাশ জিপ পেতেন। আরও কয়েকজনের সঙ্গে তাঁকে জিপে বসে অফিস যেতে হত। চার বছর হল তিনি গাড়ি পাচ্ছেন। বিকাশের মনে হয়, এ গাড়ি অনেকটা তাঁর পুত্রশোকের ক্ষতিপূরণ। অথবা সব কিছুকে দেবার্চনের মৃত্যুর নিরিখে দেখা তাঁর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু তাঁর শেষ পদোন্নতির সঙ্গে সত্যিই জড়িয়ে আছে ছোট খোকা। বিকাশের মনে আছে, সেই সময় প্রায়ই অফিসে আসতেন না তিনি। কাজ করতে ইচ্ছে করত না। নকশাল ছেলের জন্য প্রকাশ্যে শোক করার সাহসও ছিল না তাঁর। কিন্তু সবসময় রক্তের গন্ধ পেতেন। কোনও না কোনও জায়গা থেকে বাতাস সেই গন্ধ বয়ে আনত। মাঝে মাঝে মনে হত, বেঁচে থেকে কী লাভ ! যে-দেশের প্রশাসন ঘরে ঘরে গুলি ছোড়ে সে-দেশে বেঁচে থেকে কী লাভ ! বিকাশ তখন একা একা রাস্তা দিয়ে হাঁটতেন। একা একা। দিকভ্রান্তের মতো। হঠাৎ চোখে জল আসত। হঠাৎ মনে হত, ওই তো ছোট খোকা। একদিন মানিকতলায় নেমে পড়েছিলেন। সঙ্গে সেন আর ত্রিপাঠী ছিলেন। সেই সময় বিকাশের কোনও আচরণের জন্য কেউ প্রশ্ন করতেন না। মানিকতলা আসতেই বিকাশ বলেছিলেন, এই, জিপটা থামাও তো। নামব।

জিপ থেমে গিয়েছিল। তিনিও নেমে বলেছিলেন, আজ আর যাচ্ছি না সেন।

সেন সামান্য মাথা নেড়েছিলেন। জিপ চলে গিয়েছিল। জিপ চলে যাবার পরে বিকাশের মনে হয়েছিল—কেন এলাম এখানে ?

অনেকক্ষণ তিনি কিছুই ভেবে পাননি। শেষে বিবেকানন্দ রোড ধরে হাঁটতে শুরু করেছিলেন। হেদুয়া পার্কে গিয়ে চুপচাপ বসেছিলেন দু’ঘণ্টা। চুপচাপই কি ? না। সঙ্গে একটা ছোট্ট নোটবই ছিল। পুলিশ যে-দিন বাড়ি সার্চ করতে আসে সে-দিন ওরা আসার আগেই ছোট খোকার টেবিল থেকে ছোট ছোট কয়েকটা ডায়রি সরিয়ে ফেলেছিলেন বিকাশ। তাড়াতাড়িতে লক্ষ্মীর স্কুলের বইপত্রে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। পুলিশ খুব একটা তছনছ করেনি। শুধু ছোট খোকার টেবিলটাই দেখেছিল। যাবার আগে বরানগর থানার বড়বাবু বলেছিলেন—সব কাজ সবসময় করতে ভাল লাগে না মশাই। আপনিও সরকারি চাকরি করেন। আমিও করি। বোঝেনই তো !

বড়বাবু চলে যেতে লক্ষ্মী ঠাকুর প্রণাম করেছিলেন। দেবাশিসকে বম্বেতে মামার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কোনও সন্দেহজনক কাগজপত্র পাওয়া যায়নি। কিন্তু তাতেও ছোট খোকার মৃত্যু ঠেকানো যায়নি। সে-দিন, গভীর রাত্রে নোটবইগুলো বার করে উল্টে-পাল্টে দেখেছিলেন বিকাশ। কিছুই ছিল না তেমন। বেশির ভাগই কবিতা। কয়েকটি কোটেশন। বিকাশের মনে আছে, একটি কবিতা ছিল—

আজ রাত্রে না গেলেও
আগামী কাল রাত্রে
আমি জেলে যাব।…
অন্তরের একটি পাতাও নড়ছে না
অচৈতন্য ঘুমের মতো আমার মন
শান্ত
নির্বিকার।
আমার মন
শান্ত
নির্বিকার ;
কারণ, নবজাত শিশুর মত
নীল আকাশ আমি দেখছি।
কাল
শহরের ময়দানে আমি হেঁটে গিয়েছিলাম।
হেঁকে বলেছিলাম ;
‘আমাদের ভাইবন্ধুদের আমরা যেন না মারি,
যেন শয়তানের জন্যে
না মরি।’

পরের পাতাতেই লেখা ছিল আরও একটি কবিতা।

প্রিয়তমা আমার,
তোমার শেষ চিঠিতে
তুমি লিখেছো :
মাথা আমার ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে
দিশেহারা আমার হৃদয়।
তুমি লিখেছো :
যদি ওরা তোমাকে ফাঁসি দেয়
তোমাকে যদি হারাই
আমি বাঁচব না।
তুমি বেঁচে থাকবে, প্রিয়তমা বধূ আমার,
আমার স্মৃতি কালো ধোঁয়ার মত হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে
তুমি বেঁচে থাকবে, আমার হৃদয়ের রক্তকেশী ভগিনী,
বিংশ শতাব্দীতে
খুব বেশি হলে এক বছর
মানুষের শোকের আয়ু।

কবির নাম কোথাও লেখা ছিল না। কবিতার নামও নয়। কিন্তু বিকাশের মনে হয়েছিল দেবার্চন সত্যদ্রষ্টা ছিল। এক বছরের মধ্যেই কি বিকাশ, লক্ষ্মী, দেবাশিস স্বাভাবিক হননি ? সেই সময় বিকাশের অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল সময় পেলেই নোটবইগুলো পড়া। না, নোটবইগুলো নয়। একটি মাত্র নোটবই। যাতে সে কয়েকটি কবিতা আর কোটেশন তুলে রেখেছিল। সে-দিন, হেদুয়ার পার্কে বসে ওই নোটবইটাই তিনি পড়ছিলেন। তাতে লেখা ছিল—কমরেড চারু মজুমদার লাল সেলাম।

লেখা ছিল—কমরেড কৃষ্ণভক্ত শর্মা লাল সেলাম।
লেখা ছিল—এই ভুয়ো শাসনব্যবস্থা মানি না।
এই ভুয়ো শিক্ষাব্যবস্থা মানি না।
এই ভুয়ো সমাজব্যবস্থা মানি না।
ভারতবর্ষে চাই সার্বিক জনগণতান্ত্রিক আন্দোলন।
এই আন্দোলনকে যারা ব্যর্থ করতে চায় তারা জনগণের শত্রু।
শ্রেণীশত্রু।
শ্রেণীশত্রু খতম কর।
লেখা ছিল—অকংগ্রেসি গণতান্ত্রিক সরকারের ভুয়া আওয়াজে যেন আমরা বিভ্রান্ত না হই। আমাদের জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের রাজনীতি অর্থাৎ শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক ঐক্য, সশস্ত্র সংগ্রাম এবং পার্টি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার রাজনীতি জনসাধারণের মধ্যে বলিষ্ঠভাবে নিয়ে যেতে হবে।

এই সমস্ত কথাই বিকাশ আজও পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে করতে পারেন। কারণ দেবার্চন, বিকাশের ছোট সন্তান, কী ভাবত, কোন স্বপ্নে মশগুল হয়ে নিজের জীবন দিতেও সে প্রস্তুত ছিল, তা বোঝার নিরন্তর চেষ্টায় ওই নোটবুকগুলি পড়তে পড়তে বিকাশের মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। চারু মজুমদার—বহুবার গ্রেপ্তার ও অন্তরীণ হওয়া চারু মজুমদার—কোনওদিন বিকাশের মনে কোনও গাঢ় ছায়া ফেলতে সক্ষম হননি। তিনি কেমন করে দেবার্চনকে দীক্ষিত করে ফেললেন ! হয়তো দেবার্চনই, হয়তো নীলাদ্রি, কেউ কিংবা কয়েকজন বিদ্যাভারতী স্কুলের গায়ে লাল রঙে লিখে দিয়েছিল— চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান।

লিখেছিল—বন্দুকের নল সমস্ত ক্ষমতার উৎস।

দেবার্চনই কি লেখেনি ওইসব ? একজন লিখলেই কি হাজারজনের লেখা হয়ে যেত না ওই সময় ? সেই রাতগুলোয় যখন দেবার্চন ফিরত না, সেই বিকাশের জেগে থাকার রাত, লক্ষ্মীর দোষারোপ শুনতে শুনতে অপরাধীর মতো, কিংবা কুকুরের মতো, কিংবা ভাবলেশহীন পাগলের মতো নিদ্রাহীনতা—তখনই কি এইসব লেখেনি ওই ছেলে ? কারণ তার নোটবইতে লেখা ছিল—

চারু মজুমদারের নির্দেশ : চেয়ারম্যান মাও আমাদের শিখিয়েছেন বিপ্লবী পার্টি চাই ; মার্কসবাদী কায়দায় তৈরি একটি বিপ্লবী তত্ত্বের ভিত্তিতে এবং মার্কসবাদী-লেনিনবাদী কায়দায় তৈরি একটি বিপ্লবী পার্টি ছাড়া শ্রমিকশ্রেণী ও ব্যাপক জনগণকে নেতৃত্ব দিয়ে সাম্রাজ্যবাদ ও তার শিকারী কুকুরদের পরাজিত করা অসম্ভব।

কিন্তু তারপর কী ছিল ? কয়েকটি পাতা বাদ দিয়ে লেখা ছিল—কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের ঐক্যবদ্ধ করা এবং বিপ্লবী সংগ্রামগুলি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সারা ভারত কো-অর্ডিনেশন কমিটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু এই স্তর পার হয়ে যাবার পরও যদি পার্টি প্রতিষ্ঠায় দ্বিধা থাকে, তা হলে নিশ্চয়ই সে-দ্বিধা আসছে ভাববাদী চিন্তা থেকে। এই ভাববাদের প্রভাববশেই জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে আমরা চাইছি এমন একটি পার্টি প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম চালাতে, যা সুবিধাবাদ ও সংশোধনবাদ থেকে মুক্ত। এ হল সম্পূর্ণ ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গি যার সঙ্গে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের কোনও সম্পর্ক নেই।

এরপর আর কোথাও কিছু লেখা ছিল না। শুধু ছিল একটি বিরাট প্রশ্নচিহ্ন। নোটবই-এর বাকি পাতা জুড়ে। কেন ছিল ? কোথাও কি কোনও দ্বিধা ছিল ছোট খোকার ? অনেকক্ষণ জলের দিকে তাকিয়ে থেকে কোনও সমাধান পাননি বিকাশ। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন একসময়। ফের বিবেকানন্দ রোড ধরে আমহার্স্ট স্ট্রিটের দিকে হেঁটেছিলেন। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বিকাশের আগে আগে হেঁটে যাচ্ছিল একটি মেয়ে। বিকাশ প্রথমে তাকে খেয়াল করেননি। রামমোহনের বাড়ির কাছাকাছি আসতেই মনে হল হঠাৎ চারপাশটা কেমন চঞ্চল হয়ে উঠেছে। কারা যেন দৌড়ে পালাচ্ছে। কারা যেন লুকিয়ে পড়ছে। হঠাৎই একটি ছেলে হাঁফাতে হাঁফাতে মেয়েটির পাশে এসে বলল, আমি আদিত্য। একটু হাঁটব আপনার সঙ্গে, কেমন ! আপনার নামটা বলুন। তাড়াতাড়ি।

বিকাশ অবাক। এ সব কী হচ্ছে ? কিন্তু ছেলেটিকে দেখে মনে হচ্ছে না ও মেয়েটিকে অসুবিধেয় ফেলতে চায়। মেয়েটির মুখ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু বিকাশ শুনতে পেলেন— শিপ্রা। শিপ্রা নাথ। আপনার কী ? আদিত্য কী ?

—সেনগুপ্ত। সেনগুপ্ত। কোন ইয়ার ? কলেজ তো ?

—হ্যাঁ। সেকেন্ড ইয়ার। বটানি। স্কটিশ। আপনি ?

—সিটি। সিটি। সেকেন্ড ইয়ার। ইংলিশ। শুনুন আমি স্কটিশে গিয়েছিলাম। সেইখান থেকে আপনার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছি, কেমন ? একটু আগে গলিতে বোমাবাজি হয়েছে। বোধহয় লাশও পড়েছে।

আদিত্যর কথা শেষ হল না। বেশ ক’জন পুলিশকে ছুটে আসতে দেখা গেল। একজন এদিকে তাকিয়ে বলল— ও দিকে যাবেন না। এই যে দাদা, এই যে ভাই দিদিকে নিয়ে সরে পড়ুন। তিনটে পড়েছে হারাধন বোস লেনে।

পরে অনেক ভেবেছিলেন বিকাশ। আদিত্যও কি নকশাল ? তখন, মাত্র পাঁচ বছর আগেও পুলিশের রোষে পড়ার জন্য নকশাল হবার কোনও দরকার ছিল না। শুধু যুবক হলেই চলত। কিংবা তরুণ। কিংবা বালক। বালকরাও কি খুন হয়নি তখন ? চোদ্দো-পনেরো বছরের, ষোলো বছরের বালকরা ?

আরও একটি ঘুমহারা রাতে বিকাশ অনেকক্ষণ শিপ্রা আর আদিত্যর কথা ভেবেছিলেন। ওরা তো কেউ অপ্রস্তুত হল না ! কত সহজে, কত দ্রুত যা যা জানার জেনে নিল। তার মানে ওরা অভ্যস্ত ! শিপ্রা নামের মেয়েটি, আদিত্য নামের ছেলেটিকে এক মুহূর্ত আগেও চিনত না। অথচ কীরকম আড়াল করে দিল, আগলে নিল ! ওর একটা সম্মতি বা অসম্মতির ওপরই কি আদিত্যর সবটাই নির্ভর করছিল না ! সে-দিন বিকাশ নতুন করে পৃথিবীকে দেখেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, ওই মেয়েটি, শিপ্রা, সরাসরি পার্টি না করেও যার মনের মধ্যে ওইসব ছেলেদের জন্য দুকূল প্লাবন সহানুভূতি ছিল, সে, এই বিকাশ, লুকিয়ে ছেলের নোটবই পড়ে তার কলেজের দিকে হেঁটে যাওয়া বিকাশ, সে, এঁরাই কি জনগণ নয় ? জনগণের সহানুভূতি তো সত্যিই ছিল তা হলে ওই দুনিয়া উল্টে দিতে প্রয়াসী ছেলেগুলোর ওপর ! তবু কেন মরে গেল দেবার্চন ? কেন মরে গেল !

লক্ষ্মী বরং অনেক শক্ত ছিলেন সেই সময়। বলেছিলেন, ভাবো, ও একা গেছে। ভাবো, সময়মতো বড় খোকাকে আগলাতে পেরেছি আমরা। তোমাকে প্রণবেশের মতো, উদ্বাস্তু কলোনির বিনয় মাস্টারের মতো ছেলের জন্য দিনের পর দিন থানায় থাকতে হয়নি। ভাবো।

হ্যাঁ। ভেবেছিলেন বিকাশ। বোধহয় এ ভাবেই দেখতে হয় জীবনকে। এ ভাবেই ভাবতে হয়। নইলে বাঁচা যায় না।

এর ক’দিন পরপরই অ্যাসিসট্যান্ট ডায়রেক্টর সান্যাল ডেকে পাঠিয়েছিলেন বিকাশকে। বলেছিলেন, ভাল খবর আছে আপনার জন্য।

বিকাশ নীরবে চেয়েছিলেন। এই মুহূর্তে ভাল খবর আর কীই-বা হতে পারে তাঁর ?

সান্যাল খুব সহানুভূতির সঙ্গে বলেছিলেন, আপনার অবস্থা আমরা বুঝি বিকাশবাবু। সবারই তো ঘরে ছেলে-পুলে আছে। বাবা-মায়ের বশে আজকাল আর কেউ থাকতে চায় না। কিন্তু আমি আপনার চেয়ে বয়সে বড়। অভিজ্ঞতাও আমার বেশি। আরে আমার বাবা সারাজীবন স্বদেশি করতে গিয়ে জেল খাটলেন। আমরা প্রায় খেতে পেতুম না। মা গয়না বিক্রি করে করে আমাদের খাওয়াতেন। একদিন কী হল জানেন ? শাড়ি ছিঁড়তে ছিঁড়তে মায়ের আর পরনের শাড়ি নেই। শেষে বিয়ের বেনারসি বার করে পরলেন মা। আমার এখনও মনে আছে। মায়ের হাতে শুধু লোহা আর শাঁখা। আমাদের জন্য চিচিঙ্গের তরকারি আর ভাত রাঁধছেন মা। দু’চোখ দিয়ে জল পড়ছে। মায়ের পরনে বেনারসি শাড়ি। আমার তখন মনে হয়েছিল, মাকে ভারতবর্ষের মতো লাগছে। ক্লিষ্ট। ক্রন্দসী। কিন্তু সুন্দর। সম্পূর্ণ রিক্ত কিন্তু আসলে যেন রিক্ত নয়।

বিকাশ চুপ করে ছিলেন। কিছু বলার ছিল না তাঁর। সান্যাল বলেছিলেন, এখনকার ছেলেরা এ সব বুঝবে না। স্বাধীনতা পাবার কষ্টটা বুঝবে না। আরে এতদিনের শোষিত দেশটাকে তৈরি করতে সময় লাগবে না ? তার আগেই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিল। যাই হোক, আপনার দুঃখ আমি বুঝি।

বিকাশ কাচের পেপার ওয়েট ঘুরিয়ে যাচ্ছেন। তখনও একটা কথাও বলেননি। ভাবছেন। না। জনগণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে পারেনি ছোট খোকা। ওই তো, বিকাশের সামনে বসে আছে যে-লোকটা, সে দেবার্চনের জনগণের বাইরের লোক। স্বাধীনতা আন্দোলনে বাবার জেল খাটার কথা আজ সে সগর্বে বলতে পারছে। এ সৌভাগ্য বিকাশের কোনওদিন হবে না। কোনওদিন তিনি গর্বের সঙ্গে চেয়ারের উল্টোদিকে বসা কোনও লোককে বলতে পারবেন না— আমার ছেলে নকশাল ছিল। দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, সর্বহারা কৃষক ও শ্রমিকের জন্য প্রাণ দিয়েছিল।

সান্যাল তখন বলেছিলেন, হ্যাঁ যা বলছিলাম, আমার পরামর্শ শুনুন। কাজের থেকে পালিয়ে বেড়াবেন না। ওতে কোনও লাভ হয় না। বরং কাজে ডুব দিন। দেখবেন আস্তে আস্তে সব সয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া আপনার আরও একটি ছেলে আছে। স্ত্রীও আছেন। তাঁদের জন্যও তো ভাবতে হবে। আপনার স্ত্রী যেন কী করেন ?

এই প্রথম কথা বলেছিলেন বিকাশ, হ্যাঁ, একটি স্কুল চালান।

—বাঃ। নিজের স্কুল ?

—হ্যাঁ।

—কিন্তু এরকম স্কুল কেন ? কোন ক্লাস পর্যন্ত ?

—আমাদের পাড়াটায় ছোটদের ভাল কোনও স্কুল নেই। একটা মাত্র প্রাইমারি স্কুল, তাতে পড়াশুনো হয় না। বাচ্চাদের সেই নরেন্দ্রনাথ বা রামকৃষ্ণ মিশনে দিতে হয়। অথবা বিদ্যাভবন। সবগুলোই পাড়া থেকে বেশ দূরে। এটা হওয়াতে সুবিধে হল যে থ্রি-ফোর পর্যন্ত এখানে পড়ে সব বড় স্কুলে যায়।

—বাঃ বেশ। কতদিন ধরে করছেন ?

—প্রায় দশ বছর।

সান্যাল আর কথা বাড়াননি। সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে গিয়ে বলেছিলেন, শুনুন, মন্ত্রী আপনার ফাইল চেয়ে পাঠিয়েছেন।

—কেন ?

প্রশ্নটা ছিটকে বেরিয়েছিল বিকাশের মুখ থেকে। কিছু ভয় ও দুশ্চিন্তাও কি মিশেছিল সেই প্রশ্নে ? বিকাশ বাইরের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করেছিলেন। আজ বিকাশের মনে হয়, যত দুঃখই থাকুক না মানুষের—নিরাপত্তা এতটুকু বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা মানুষকে তীক্ষ্ণভাবে সচকিত করে দেয়। নিরাপত্তার বোধই সম্ভবত মানুষের আদিতম প্রবৃত্তি ! সে-দিন বিকাশের মুখে সেই প্রবৃত্তি ফুটে উঠেছিল নিশ্চয়ই ! কারণ সান্যাল হেসেছিলেন। বলেছিলেন, ভয় নেই, ভাল খবরই পাবেন।

তারপরই দ্রুত ঘটে গিয়েছিল সেইসব। মন্ত্রী নিজের ঘরে ডেকে পাঠিয়েছিলেন বিকাশকে। দেবার্চনের প্রসঙ্গে কোনও কথা তোলেননি। শুধু বলেছিলেন— গলদার চাষ করার জন্য কয়েকটি প্রজেক্ট পেয়েছি আমরা মাহেশ্বরী গ্রুপের সঙ্গে কোলাবোরেশনে। এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নতুন একটি শাখা খোলা হচ্ছে। সান্যাল তার ডায়রেক্টর হবেন। আপনাকে আমরা অ্যাসিসট্যান্ট ডায়রেক্টরের পদে নিতে চাই। সান্যালের খুবই ভাল রেকমেন্ডেশন আপনার পক্ষে। পিসি কালচারের ওপর ট্রেনিংও তো নেওয়া আছে আপনার ? আপনি কি রাজি আছেন ?

হাঁ হয়ে গিয়েছিলেন বিকাশ। মন্ত্রী স্বয়ং ঘরে ডেকে বলছেন, আসুন, এই চেয়ার দিলাম, আপনি বসতে চান ! বিকাশ মাথা নেড়েছিলেন। রাজি। তারপর দ্রুত, অতি দ্রুত অনেক কিছু ঘটে গিয়েছিল। দমদমে মাছ চাষের গবেষণার জন্য নতুন কেন্দ্র তৈরি হচ্ছিল। সেখানেই দপ্তর বদলাল বিকাশের। তিনি গাড়ি পেলেন। মাইনে বেড়ে গেল। লক্ষ্মী খুশি। পরপর অনেক জিনিস এল বাড়িতে। পুরনো চৌকি বদলে নতুন খাট হল। একটা টেপ রেকর্ডার কেনা হল। পর্দাগুলো ঝকঝকে, ভারী, শৌখিন হয়ে গেল। শুধু একা, দেবার্চন, শ্রমিক কৃষক জোট আন্দোলনের স্বপ্ন নিয়ে জেগে রইল সারারাত। ছবির মধ্যে। ক্রমশ ধুলো জমতে থাকা কাচের তলায়। কোনও কোনও রাতে, যখন বিকাশ এসে ছেলের ছবির সামনে দাঁড়ান, মাধবী অথবা জুঁই ফুলের গন্ধ লাগে নাকে, কিংবা নিম ফুলের, তাঁর মনে পড়ে—

তুমি বেঁচে থাকবে, প্রিয়তমা বধূ আমার,
আমার স্মৃতি কালো ধোঁয়ার মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে।
তুমি বেঁচে থাকবে, আমার হৃদয়ের রক্তকেশী ভগিনী,
বিংশ শতাব্দীতে
খুব বেশি হলে এক বছর
মানুষের শোকের আয়ু

মধ্যরাত্রে, বিকাশ নামের এক পিতা, দেবার্চনের চোখে যাঁর অবস্থান— আমলাতন্ত্রের বাহক— একা একা বিড়বিড় করে উচ্চারণ করেন

বিংশ শতাব্দীতে
খুব বেশি হলে এক বছর
মানুষের শোকের আয়ু

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *