০৫. শ্মশান থেকে ফিরতে ফিরতে

শ্মশান থেকে ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে গেল। খুব খিদে পেয়েছিল অনুপমের। বন্ধুকে দাহ করতে যাবার বেদনা উধাও হয়ে এখন একরাশ বিরক্তি। শ্মশানে আজ মৃতদেহের লাইন পড়েছিল। অমলেন্দুর আগে আরও চারজন পুড়ল।

সারাক্ষণ পোড়ানোর জন্য অপেক্ষা করে থাকা, শ্মশানের কটু গন্ধে গুলিয়ে ওঠা শরীর, অনুপম ভাবছিল, যে যায় সে তো যায়, যে থাকে তার শাস্তির সীমা নেই। হয়তো, এ কারণেই মৃত্যুকে ধরা হয় শান্তি পারাবার। তবু, জীবনের এমনই টান যে শ্মশানের গন্ধের মধ্যেও খিদে পায়। তৃষ্ণা জাগে। গভীর নেশায় দুঃখাতুর সময়কে অস্বীকার করতে ইচ্ছে হয়। মৃত্যু, সর্বজনবিদিত শান্তির। কিন্তু মৃত্যু জীবিতের আশ্রয় নয় কখনও। মৃত্যু একমাত্র মৃতকেই তৃপ্ত করে।

কাজল, সুজন, মৃণ্ময় আর অমিতাভ এরই ফাঁকে গাঁজা টেনে এল। দিব্যেন্দু দু’ টান মারার ফিকির করছিল। অনুপম বাধা দিয়েছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সারাদিন শ্মশানে কাটাতে গেলে মদ-গাঁজা চমৎকার উপশম হতে পারে।

দেবাশিস অনেকক্ষণ উদাস হয়ে বসেছিল আজ। ওকে বড় একটা উদাস বা উন্মনা হতে দেখা যায় না। বরাবরই ও কিছুটা আত্মকেন্দ্রিক ও সুখপ্রিয়। একটু মোটা দাগের বলা যায়। অমলেন্দুর দাহ আজ ওকেও উদাসী করেছিল। ও বলছিল, অমলেন্দু আর অমলেন্দু নেই, না? শ্মশানে এসেই বডি হয়ে গেছে। স্রেফ বডি একটা।

দিব্যেন্দু বলেছিল, শুধু শ্মশান কেন? হাসপাতালে? হাসপাতালে গেলেই তুই বেঁচে থাকলে হবি বেড, মরে গেলে বডি।

দেবাশিস কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিল, শ্মশানে-টশানে এলে মনে হয় বেঁচে থাকার জন্য এত যুদ্ধ করে কী লাভ! সেই তো পুড়তে আসবই একদিন!

অনুপম বলেছিল, ব্যাপারটা অন্যভাবে ভাব। মনে কর, আমরা আজও কত ভাগ্যবান। শ্মশানে এসেছি কিন্তু পড়তে আসিনি।

আসলে সমস্ত ঔদাসীন্য ও দার্শনিক হয়ে ওঠার কারণ এই শ্মশান। শ্মশান কিংবা গোরস্থানগুলি মানুষকে মৃত্যুর দিকে ফিরিয়ে দেয়। এ মৃত্যু স্বার্থকে প্ররোচিত করে না। বরং তৈরি করে ক্ষমাপ্রসন্নতা, শান্তিমোহ, যদিও অত্যন্ত অল্প সময়ের জন্যই।

কোনও কথারই আসলে কোনও শেষ নেই। উত্তর নেই। মল্লিনাথ অমলেন্দুর দেহ ছুঁয়ে বসেছিলেন। নির্বাক শূন্য চোখ প্রবাহিত গঙ্গায় নিবদ্ধ ছিল। অমলেন্দুর আগে লাইনে এক বলিরেখাময় বৃদ্ধার শরীর। আজ, অমলেন্দু ছাড়া, অন্য যারা পুড়তে এসেছিল, তারা প্রত্যেকেই সারা জীবন পুড়ে পুড়ে কয়লা। মহাপ্রস্থানের পথে লম্বা কিউ দিয়ে দাঁড়াতে তাদের কারও কোনও ক্ষোভ, কোনও আপত্তি নেই। শুধু অমলেন্দু আলাদা। তার হাড়সর্বস্ব দেহে যৌবনের এতটুকু উজ্জ্বলতা নেই। তবু শ্মশানের ডোম থেকে শুরু করে প্রতিটি শ্মশানযাত্রীর কাছে খবর গেল—অকালে চলে গিয়েছে একজন। ডোমেরা ডাক্তারবাবুকে চেনে। তারা দেখছে, আহা, কী শোকার্ত মুখ মানুষটার! এমন মুখে তাঁকে কেউ কখনও দেখেনি। শ্মশানযাত্রীদেরও কেউ কেউ ডাক্তারবাবুকে চেনে, কেউ চেনে না। যারা চেনে না তারা দেখতে থাকছে একজন অকালমৃত পুত্রের পিতাকে। মানুষটার দীর্ঘ পরিপূর্ণ দেহ। সুখী ও সফল অবয়ব। এখন কাঁচাপাকা চুলগুলি বিন্যস্ত নেই। চোখ দু’টি গঙ্গাজলের মতো ঘোলা ও গৈরিক।

অনুপম মল্লিনাথকে ছোটবেলা থেকে দেখছে। যে-কোনও সময় যে-কোনও পরিস্থিতিতে তাঁকে কখনও উত্তেজিত হতে দেখা যায়নি। এই পৃথিবীতে যা-কিছুই ঘটুক—খরা, বন্যা, খুনোখুনি, দাঙ্গা, রোগ, মড়ক—মল্লিনাথ অবিচল থেকেছেন। চিকিৎসা চালিয়ে গেছেন। পাড়া-প্রতিবেশীর খোঁজখবর নিয়েছেন। মল্লিনাথ যেন আগুনের মধ্যে দিয়েও সোজা হেঁটে যাবেন এমনই মনে হত। ডাক্তার হয়েও তাঁর কালীপূজা করা নিয়ে নানান কথা চালু আছে। মাধবী নাকি এই পূজার জন্যই পাগল হয়ে গেছেন। শ্মশানকালী নাকি খুবই আগ্রাসী। ভক্তের ভাগ-বাঁটোয়ারা সইতে পারেন না। আজ শ্মশানে বসে বসে অনেক ভেবেছে অনুপম। মল্লিনাথের জীবনের এই দু’টি দুর্ঘটনার দিকে তাকালে প্রচলিত বিশ্বাস চেপে বসতে চায়। কিন্তু ঈশ্বর তো সর্বশক্তিমান। তিনি সৃষ্টি, ক্ষমা, কল্যাণের দ্যোতক। ইতরজনের মতো তাঁরও কেন ঈর্ষা, দ্বেষ, ক্রোধ ও দাবি থাকবে? অনুপম উপলব্ধি করে, মল্লিনাথকে দেখে এ পাড়ার মানুষ শ্মশানকালীর প্রতি আরও ভীতি ও ভক্তি অর্জন করবে।

মুখাগ্নির সময় অনুপম জলের কাছে দাঁড়িয়েছিল। চিতার সামনে যায়নি। চিতায় তোলার আগে একেবারে নগ্ন করে ফেলা হয়েছিল অমলেন্দুকে। নিয়ম অনুযায়ী শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল। কোনও কোনও সম্প্রদায়ের কথা জানে অনুপম যারা মৃত পুরুষকে চিতায় শোওয়ায় উপুড় করে। নারীকে চিত করে। তাদের মতে ছেলে নাকি গর্ভদেশ থেকে এভাবেই আসে। মেয়ে আসে চিত হয়ে। তাই যাবার সময়ও এরকমই নিয়ম। এমনকী মৃতদেহ জলে ভাসালেও জল এ নিয়ম পালন করে যায় বলে মনে করে তারা। নারী ভাসে চিত হয়ে। পুরুষ উপুড়। চিতা যেন অন্য এক মাতৃগর্ভ যা মানবদেহকে পৌঁছে দেবে অন্য কোনও দুনিয়ায়। তাই যথাযথ নিয়ম পালন করা। আর মানুষ, জীবনে যতখানি নিয়ম ভাঙতে পারে মৃত্যুতে ততখানি নয়। আজ শ্মশানের ধারে বহমান গঙ্গার দিকে তাকিয়ে অনুপমের মনে হয়েছে, শুধু জন্মকাল নয়, এই উপুড় হওয়া পুরুষ, এই চিত হওয়া নারী, এ যেন যৌন-মুহূর্তেরও প্রতীক। এই ভঙ্গিতে সৃষ্টির মহিমাও নির্দেশিত। নারী-পুরুষের চুড়ান্ত মিলনের এটাই কি স্বাভাবিক ভঙ্গি নয়? এভাবেই একম্‌ অদ্বিতীয়ম্‌ হয়ে যায় না দু’টো মানুষ?

অনুপম ভয় পায়। তার মধ্যে কি যৌনবিকার জন্ম নিচ্ছে? এরকম ঘোর মৃত্যু আর শোকের অবস্থানে এ সব মনে পড়ছে কেন তার? সে চিন্তাক্লিষ্ট ও ক্লান্ত হাতে দরজার বেল বাজায়। প্রলম্বিত যান্ত্রিক শব্দ নেচে নেচে বেড়ায় ভিতরে। কিছুক্ষণ পর শবরী এসে দরজা খোলেন।

মায়ের মুখ দেখেই অনুপম টের পেল কিছু একটা হয়েছে। কিছু হওয়া তাদের বাড়িতে নতুন নয়। ছোটবেলা থেকে মা-বাবার বিষাক্ত দাম্পত্য দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে আর তার ভাই। মা-বাবার ঝগড়া হবে। মাকে বাবা গালাগালি করে চলে যাবেন। আগে মারতেনও। এখন, অনুপমরা বড় হওয়ার পর সেটি বন্ধ হয়েছে। এখন পরেশ শুধু গালাগালি করে চলে যান। এরপর তিনি সারাদিন ফিরবেন না। শবরী রাঁধবেন না। খাবেন না। অনুপম-দেবোপম কিছু খাবে কি না দেখবেন না। তাঁর শোকপালন চলতে থাকবে। রাত্রে পরেশ মদ খেয়ে ফিরবেন। আর এক প্রস্থ তুমুল গালাগালি করবেন শবরীকে। শবরীও মৃদু অনুচ্চ শব্দে তাতে ইন্ধন যোগাবেন। দু’-একটা জিনিসপত্র ভাঙচুর হবে। তারপর আশ্চর্য সমঝোতায় দু’জনে এক বিছানায় শুতে যাবেন। কেমন করে পারেন? অনুপম আজও এ রহস্যের কিনারা পায়নি। এই বিষাক্ত সম্পর্ক নিয়েই এতগুলো বছর এঁরা পাশাপাশি আছেন। পাশাপাশি ঘুমোন। হাসেন। গল্পও করেন। শবরী রূপটান দেন। পরেশ সংগীতচর্চা করেন। এরই মধ্যে তাঁরা অনুপম ও দেবোপমের জন্ম দিয়েছেন এবং বিনা আয়াসে বড়ও করে ফেলেছেন।

অনুপমের মনে আছে, কতদিন স্কুল থেকে ফিরে দু’ ভাই দেখেছে খাবার নেই। খিদেয় মুখ শুকিয়ে গেছে। ফলত ছোটবেলা থেকেই উপায় খুঁজতে হয়েছিল তাদের। আর পেয়েও গিয়েছিল তারা। মাটির ভাঁড়ে খুচরো পয়সা জমাতেন শবরী। এখনও জমান। দু’ ভাই মিলে সেই ভাঁড় সরিয়ে আনত। চামচের পেছন দিয়ে পয়সা ফেলার ফুটোয় আস্তে আস্তে ঠেলা দিত অনুপম। আর খুচরো গড়িয়ে পড়ত। দেবোপম কুড়িয়ে দিত। দু’জনের খাবার পয়সা উঠে এলেই আবার ভাঁড়টি রেখে আসত যথাস্থানে। একদিন ফুটোটার কাছে ভেঙে গিয়েছিল। শবরী সন্দেহ করেছিলেন। কিন্তু ধরতে পারেননি। তারা ভাঙা অংশটা আলতো করে চেপে রেখেছিল। শবরী আজও জানেন না এ সব। আজ আর পয়সা নেবার দরকার নেই কিন্তু তাদের পারিবারিক চিত্র বদলায়নি। বাইরে গিয়ে খাবার খেয়ে আসার প্রয়োজন আজও পড়ে।

শবরী কোনও কথা বললেন না। অনুপমও কিছু জিজ্ঞেস করেনি। আগুন আর লোহা সে ফেরার পথে মল্লিনাথের বাড়িতে ছুঁয়ে এসেছে। সোজা স্নানঘরে গিয়ে অনেকটা স্নান করে নিল এখন। আর স্নান শেষ হতেই দানবীয় খিদে দাঁত বসাল পাকস্থলীতে। কোথাও খাবার নেই। রাত থেকে এঁটো বাসনের পাঁজা পড়ে আছে। আঁশটে গন্ধ উঠছে। ঠিকে ঝি এসেছিল। শবরী তাকে কোনও কাজ করতে না দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। মশারি বালিশ চাদর স্তূপ হয়ে আছে বিছানায়। মাঝখানে হারমোনিয়াম। সোফায় চোখ বন্ধ করে পড়ে আছেন শবরী। অনুপম বুঝল, বেশ বড়ই হয়েছে। কী নিয়ে হয়েছে কে জানে! শবরীকে এখন খিদের কথা বলে কোনও লাভ নেই। দেবোপমকেও দেখা যাচ্ছে না। অমলেন্দু দেবোপমেরও বন্ধু ছিল। অনুপম-দেবোপমের বয়সের পার্থক্য কম বলে দু’জনের বান্ধবজগৎও প্রায় এক। অমলেন্দু মারা গেছে শুনেও দেবোপম দেখতে যেতে চায়নি। বলেছিল, ও হেরোইন ধরেছিল। এটাই এখন আধুনিকতম নেশা বুঝলি। লেটেস্ট আমদানি। খুব টান বুঝলি। তোকে দু’দিনে নেশাড়ু করে দেবে। খরচও অনেক।

অনুপম বলেছিল, দেখতে যাবি না?

—না।

—কেন?

—পড়ানো আছে।

—আজ নাই-বা গেলি।

—ওর যখন তৃতীয় দিন, হেরোইন টানছে, সে-দিনই ও মরে গিয়েছিল বুঝলি। ওর অন্য সঙ্গীরা যত টানে, একদিনে ও টানত তার তিনগুণ। ওর জন্য আমি আগেই শোক পালন করে ফেলেছি।

দেবোপম এরকমই। কঠিন, জেদি, খাপছাড়া। কেউ ওকে বুঝতে পারে না। হয়তো-বা অনুপমই একমাত্র যে ওকে ছুঁতে পারে। কিন্তু সেও হয়তো সবটা নয়। তারা সহোদর এবং আবাল্য সহচরও। শৈশব থেকে যাবতীয় তিক্ততা ও যন্ত্রণা ভাগাভাগি করে নিতে নিতে তাদের মূল টান ও ভালবাসা তারা বাড়িয়ে দিয়েছে পরস্পরের প্রতিই, যা আসলে তাদের বাবা-মায়ের পাবার কথা ছিল। পরস্পরের কাছে তাদের কোনও আবডাল নেই কিন্তু সহমর্মী হয়েও তাদের দু’জনের দৃষ্টিভঙ্গি একরকম নয়। যে-কোনও ঘটনা সম্পর্কে দেবোপম বড় বেশি প্রতিক্রিয়াশীল। কিন্তু অনুপম উদাসীন হতে জানে। তার মনে হয়, অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দুনিয়া পাল্টায় না, শুধু নিজের ক্ষতি করে প্রচুর। অনুপম সংগীত আঁকড়েছে জীবনে। দেবোপমও গায়। কিন্তু বড্ডই ফেলে-ছড়িয়ে। পরেশের কাছ থেকে সংগীতটুকু পেয়ে অনুপমের কৃতজ্ঞতার সীমা নেই। গানের মধ্যে সে সব ভুলতে এবং ধুয়ে ফেলতে সক্ষম হয়। নিয়মিত সংগীতচর্চা করে সে। দেবোপমের এ সব কিছুই নেই। কোনও কিছু নিয়মিত করা তার সয় না। ইংরাজি সাহিত্যে এম এ করে সে ট্যুইশন করছে। চাকরি করবে না। তার নাকি চাকরির দরকার নেই। অনুপম দেখেছে, দেবোপমের আজও যা নিরবচ্ছিন্নভাবে বজায় আছে তা ওর পাঠাভ্যাস।

দেবোপম শেষ পর্যন্ত কী করবে অনুপম জানে না। আজকাল তার ভাবনার সময় কমে গেছে। কথারও। হেদোয় একটি গানের স্কুলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সে। অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা সেখানে চলে যায়। ফিরতে ফিরতে রাত্রি এগারোটা-সাড়ে এগারোটা। তখন আর কথা জমে না কিছু। দেবোপম অনেক রাত পর্যন্ত আলো জ্বেলে কীসব লেখে। অনুপম জানতে চেয়েছিল একদিন। দেবোপম বলেছিল—ডায়েরি লিখি। আমি মরে গেলে ওগুলো তুই নিয়ে নিস্। বুঝলি?

বাইরে থেকে কিছু খেয়ে আসা দরকার। পাঞ্জাবিটা গায়ে চাপিয়ে অনুপম বেরোচ্ছিল। দরজার কাছেই দেবোপমের সঙ্গে দেখা হল। দেবোপম বলল, কখন এলি?

—এই তো। এসে স্নান করলাম।

—কোথায় যাচ্ছিস আবার?

—ঘরে খাবার-দাবার নেই। খুব খিদে পেয়েছে।

—তুই যা। আমি আনছি।

—পয়সা আছে?

দেবোপম পকেট থেকে টাকা বের করে গুনল। বলল, হয়ে যাবে।

খাবার আনতে চলে গেল সে। অনুপম ঘরে ফিরল। দেবোপম এসে যাওয়াতে ভালই হল তার। এত ক্লান্ত লাগছিল যে বেরোতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু ঘরের অগোছালো অবস্থায় তার ক্লান্তি আরও বেড়ে গেল। এলোমেলো অপরিচ্ছন্ন ঘর সে সইতে পারে না। এক হিসেবে তার কিছু নিজস্ব খুঁতখুঁতেমি আছে। তার পোশাক ঝকঝকে থাকা চাই। সে শুলে যদি বিছানার চাদর গুটিয়ে যায় তবে সে-চাদর টান না করা পর্যন্ত তার ঘুম আসে না। গ্লাসে আঁশটে গন্ধ থাকলে সেই জল সে পান করতে পারে না কিছুতেই। ঘরের হাল ফেরাতে টুকটাক জিনিসপত্র গোছাতে লাগল সে। মশারি ভঁজ করল। ছড়ানো জামাকাপড় হ্যাঙারে ঝোলাল। শবরী সোফা ছেড়ে ব্যালকনিতে গিয়ে বসেছেন। তাঁর মুখ এখন বাইরের দিকে ফেরানো। এখনও শবরীকে কত তরুণী দেখায়। না বললে কেউ ভাববে না শবরীর এত বড় বড় দু’টি ছেলে আছে। সেই তুলনায় বরং পরেশ অনেক বুড়োটে মেরে গেছেন। মাথায় চকচকে টাক। গোল ভুঁড়ি। পুরু গোঁফ। মদ খেয়ে খেয়ে চোখের তলায় জলস্থলী। চিরকাল ভেবে গেলেন মান্না দে-র চেয়ে তাঁর প্রতিভা কম ছিল না। শুধু কপালজোরে বিখ্যাত হয়ে গেলেন মান্না দে আর পরেশ বোস মাথুরের গড়ে পড়ে রইলেন। পরেশের জন্য মাঝে মাঝে কষ্ট হয় অনুপমের। এ যেন ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা। কী ব্যর্থ জীবন মানুষটার! শবরীর জন্যও অনুপমের কষ্ট হয়। অদ্ভুত জীবন শবরীরও। চোদ্দো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল শবরীর। সেই থেকে এই মাথুরের গড়ে। কোথাও কোনও বন্ধু নেই। মাথুরের গড়ের কোনও বাড়িতে তিনি যান না। পরেশ বোসের ইচ্ছে ও খেয়ালে পা ফেলে চলতে চলতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছেন মহিলাটি। এতদিনের সংসারজীবনে একবার মাত্র সপরিবারে বাইরে গিয়েছিলেন পরেশ। আগ্রায়। সেই স্মৃতি, সেই ভয়ংকর স্মৃতি কোনও দিন ভুলতে পারবে না অনুপম-দেবোপম। তখন অনুপমের বয়স দশ। দেবোপমের নয়। ততদিনে অনেক জেনে ফেলেছে তারা। অনেক দেখে ফেলেছে। কিন্তু সে-দিন তারা এক ঝটকায় শয়তানের মতো বড় হয়ে গিয়েছিল। দু’জনেই।

অনুপম মায়ের পাশে দাঁড়াল। এ পাশ থেকে রেললাইন দেখা যায়। শবরী সে-দিকেই দেখছিলেন। অনুপম ভাবল, মাকে কিছু বলবে। কিন্তু কী বলবে ভেবে পেল না। তার মনে হল, সে কি মাকে ভালবাসে? বাবাকে? হঠাৎ এ প্রশ্ন মনে আসায় সে নিজেও কম অবাক হল না। সহসা উত্তরও পেল না কিছু। তখনই দেবোপম ঘরে ঢুকে ডাকল, দাদা!

অনুপম ঘরে এল। ডিম আর পাঁউরুটি এনেছে দেবোপম। সঙ্গে একবাক্স মিষ্টি। বলল, সন্দেশগুলো খা। আমি ততক্ষণে ফ্রেঞ্চটোস্ট করে দিচ্ছি।

শবরীও ঘরে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। দেবোপমের হাত থেকে প্যাকেটগুলো নিতে নিতে বললেন, তোমরা বোসো। আমি করে দিচ্ছি।

কোনও কথা না বলে প্যাকেটগুলো বাড়িয়ে দিল দেবোপম। অনুপম বলল, দুপুরে কী খেয়েছিস?

—ভাত খেয়েছি। হোটেলে।

মাদুর নিয়ে এল দেবোপম। ব্যালকনিতে বিছাল। এ তাদের পুরনো অভ্যাস। সন্ধেবেলা এক জায়গায় হলে ব্যালকনিতে বসে কথা বলা। অনুপম ব্যালকনির আলো নিবিয়ে দিল। হাতে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল মাদুরে। টান টান হয়ে শুতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু ব্যালকনির ছোট পরিসরে শরীর টান করা সম্ভব নয়। দেবোপম শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে গান ধরল—ইয়ে যো মহব্বত হ্যায়…

অনুপম বলল, ওঃ! পারিস তুই।

—কেন?

—এটা ছাড়া আজ আর গান পাচ্ছিস না?

—কেন? এটা বসন্ত। একটু ব্যর্থ প্রেমের গান গাইব না?

—তা নয়। আজ এরকম একটা দিন।

—অ। তা হলে ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’ গাই? দেবব্রত বিশ্বাসের মতো কেঁদে কেঁদে গাইব তো?

অনুপম জবাব দিল না। দেবোপম আরও কিছুক্ষণ ইয়ে যো মহব্বত হ্যায়… গুনগুন করল। অনুপমের মনে হল ও জোর করে অমলেন্দুর মৃত্যুজনিত বিষণ্ণতা অস্বীকার করতে চাইছে।

অনুপমের মুখোমুখি বসল দেবোপম। বলল, তুই অমলেন্দু মারা গেছে বলে বলছিস তো?

—তাই তো মনে হয়।

—আর অমলেন্দু। তোকে বললাম না ও দু’বছর আগেই মারা গেছে? ফোর্থ ইয়ার পেরুনোর আগেই অমলেন্দু ওর মেডিক্যালের বই বেচতে শুরু করেছিল। হেরোইন কি ও আজ থেকে খায়?

—সে কী!

—এতেই অবাক হোস না। আরও আছে। যদি ধরে নেওয়া যায় যে দেশের সেরা ও মেধাবী ছাত্ররাই ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যায় তবে এ কথাও মানতে হবে যে সেরা মেধাবীরাই সবচেয়ে বড় নেশাড়ু। সবচেয়ে বেশি উচ্ছৃঙ্খল ও নিষ্ঠুর।

—কেন?

—মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হস্টেলগুলোতে কী পরিমাণ নেশা চলে তোর কোনও ধারণা নেই। মেয়েদের নিয়েও ওরাই সবচেয়ে বেশি খেলে। আর নিষ্ঠুরের মতো র‍্যাগিং-এ ওদের জুড়ি নেই।

—অমলেন্দুও এরকম ছিল বলতে চাস!

—কেন নয়? তুই কি জানিস ও নিয়মিত সোনাগাছি যেত?

—সে কী! সে তো কাজল-সুজনরা যায়।

—অমলেন্দুও যেত। আর ডাক্তারজেঠু বোধহয় এখনও জানেন না যে তাঁর বউয়ের গয়নাগুলোর প্রায় সব হাপিস।

—বলিস কী? কী করে?

—শোন, হেরোইন খেতে প্রচুর পয়সা লাগে। বলছিলাম না, দামি নেশা। হয় টাকা ঢালো, না হলে বেচো। পেডলার হও। শেষ পর্যন্ত সবাই অবশ্য পেডলিং করে। কিন্তু মাঝখানে নিজের জিনিস বা বাড়ির জিনিসপত্র বিক্রি করার দীর্ঘ পথ পেরুতে হয়।

—কীরকম?

—যেমন প্রথমে বই। তারপর ঘড়ি। তারপর জামা-প্যান্ট। নিজের যখন আর কিছুই থাকে না তখন বাড়ির বাসন-কোসন। ঠাকুরপুজোর ছোট ছোট পেতল বা রুপোর রেকাবি থেকে শুরু করে বড় বড় হাঁড়ি-কড়া পর্যন্ত। বাসন নেওয়া একটু অসুবিধে। তার থেকে অনেক বেশি সুবিধে গয়না নেওয়া। সরলমতি মায়েরা ছেলেদের একটুও সন্দেহ করে না। তারাও একটি-দুটি করে গয়না সরায়।

—তুই এত সব জানলি কী করে?

—অমলেন্দুই বলেছে। সরাসরি। ওদের সঙ্গে ক্লাবে হেরোইন খেতে খেতেই শুনেছি।

—তুই খেয়েছিস নাকি?

—দু’টান। টান মানে কী! এ তো সিগারেট বা গাঁজা টানা নয়। এটায় নাক দিয়ে ধোঁয়া টানতে হয়।

—সে কী রে! বলিসনি তো?

—তোর সময় কোথায়?

—কীসের?

—শোনার।

—হুঁ। তারপর?

—অমল বলছিল, প্রথম দিন যখন ও মায়ের গয়না সরায় ওর ঘুম হয়নি। সারা রাত মনে হয়েছিল ও পাপ করেছে। এমনকী প্রথম যে-দিন হেরোইন খায় সে-দিনও এরকম লাগেনি। ও ভেবেছিল আর এ সব খাবে না। সকালবেলায় বইটই খুলে পড়তে বসেছিল। কিন্তু বই খুললে ওর নাকি বমি পেত।

—উঃ! অমলেন্দুর মতো ছেলে! ভাবা যায়! স্কুলে বোধহয় এখনও ওর রেকর্ড আছে।

—ও বলত, ডাক্তারি বই দেখলেই ওর মনে হয় পাস করে বেরুলেই বাবা ওকে শ্মশানকালীর পুজোর ভার দেবে। ওদের বংশের নিয়ম অনুযায়ী বংশের বড় ছেলে হিসেবে এ দায়িত্ব নাকি নিতেই হবে।

শবরী খাবারের প্লেট নিয়ে এলেন। ডিমভাজার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। অনুপম বলল, তোমার কোথায় মা?

শবরী বললেন, আছে। তোরা নে।

প্লেট দিয়ে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বললেন, তোর ইয়েটসটা কোথায় রে?

দেবোপম উঠে গেল। তার টেবিলে বা বইয়ের র‍্যাকে কারও হাত দেবার অধিকার নেই। শবরী বই পড়তে ভালবাসেন। তাঁকে খানিকটা স্বশিক্ষিতই বলা যায়। তাঁর সমস্ত জীবন-যাপনের ফাঁকে ফাঁকে মাথুরের গড় লাইব্রেরি থেকে আনিয়ে অজস্র বই তিনি পড়েছেন। ছেলেরাই তাঁকে বই এনে দেয় এবং শবরী ইংরাজি বাংলা দুই-ই পড়েন। দেবোপম যখন ইংলিশ অনার্স নেয় তখন খুশি হয়েছিলেন শবরী। বলেছিলেন, তোর পড়াগুলো আমাকে পড়াবি ছোটপম?

সব পড়ানো সম্ভব হয়নি। সাহিত্যের ইতিহাস বা ভাষাতত্ত্ব পড়েননি শবরী। কিন্তু উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ ও কবিতাগুলো পড়েছেন। অনেক কবিতা শবরীর মুখস্থ। ছেলেরা সে-খবর রাখে। কিন্তু স্বয়ং পরেশই হয়তো তা জানেন না।

বই নিয়ে ফিরে এল দেবোপম। শবরী বললেন, তোমরা রাত্রে রুটি খাবে না ভাত?

অনুপম বলল, ভাতই করো।

শবরী চলে গেলেন। দেবোপম খেতে খেতে বলল, দেবীর রাগ পড়ছে।

অনুপম বলল, এখনই সিদ্ধান্ত নিস না। দেবা ফিরুক। সে-পর্বটা বাকি আছে এখনও।

—যা বলেছিস।

অনুপম প্রসঙ্গ ফেরায়। বলে, হ্যাঁ। তারপর? যা বলছিলিস!

—হ্যাঁ। কী বলছিলাম! ও! কালীপুজো করতে হবে এই ভয়ে ও চেয়েছিল কোনওদিন যেন ডাক্তারিটা পাস করতে না হয়।

—কী বোকার মতো কথা। ডাক্তারি পাস না করলেও ওকে পুজো করতে হত।

—সেটা তো সঠিক যুক্তি হয়ে গেল। অমলেন্দুর তো সঠিক যুক্তির প্রয়োজন ছিল না। ওর প্রয়োজন ছিল নেশা করা বা যাবতীয় উচ্ছৃঙ্খলতার উদ্দেশে কিছু খাড়া করা।

—এবং, আরও কথা আছে। পুজোও ওকে করতেই হবে তার মানে কী? পরিবারের প্রত্যেক রীতিনীতি মানতে এখন আর কেউই বাধ্য থাকে না। পুজোপাঠ, ধর্মাচরণ, বিয়ে—এই সবই এখন ব্যক্তিগত ব্যাপার নয় কি?

—ব্যক্তিগত। ঠিক। এই কথাটা তুই কতদিন ধরে শিখেছিস?

অনুপম গরম টোস্টে কামড় দিয়ে চিবোয়। ভাবে। তারপর বলে, তা বলতে পারব না।

দেবোপম বলে, আমাদের পরিবার দেখে বিচার করিস না। আমাদের কোনও শিকড় নেই। কিন্তু সাধারণ ভাবে এখনও আমাদের সমাজে শ্রেণী, সমাজ, পরিবার, আভিজাত্য শব্দগুলি খুবই প্রবল। এর বাইরে আমরা ভাবতেই পারি না। ব্যক্তিগত ব্যাপারটা খুবই সাম্প্রতিক এবং তুচ্ছ।

অনুপম ভাবে, ঠিকই বলেছে ছোটপম। এ সমাজে প্রত্যেকেরই ইচ্ছে অনিচ্ছে কোনও পরিস্থিতি বা পরিবেশের নিরিখে নিবেদিত। একা ‘আমি’ কোনও গুরুত্ব পায় না। যারা ‘আমি’কে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, বলতে চায়—এই পৃথিবী আমার, এই জীবন আমার, এই ধর্ম, দর্শন, রাজনৈতিক মতামত আমার—তাদের ধ্বংস বা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হয়। কিংবা ধ্বংসের ভয়ে পালাতে পালাতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তাদের। এ এক অদ্ভুত অসম হাডুডু খেলা যেখানে একজনের প্রতিপক্ষ হাজার হাজার নিয়ম ও সংস্কার।

দেবোপম আবার অমলেন্দুর প্রসঙ্গে আসে। বলে, অমলেন্দু একবার একটা আশ্চর্য ঘটনার কথা বলেছিল।

—কী?

—ওর মায়ের গয়নাগুলো নিতে নিতে যখন প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে সে-সময় একদিন দুপুরে আলমারি খুলে ও কোনটা নেবে ভাবছে, তখন পিছনে জেঠিমা এসে দাঁড়ালেন।

—সে কী। তারপর?

—অমল বলেছিল, আমি প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। চুরি ধরা পড়লে যা হয় আর কী! মা তো এ সময় ঘুমিয়ে থাকে। তা হলে কি বাবা আজ মাকে ঘুমের ওষুধ দেয়নি? তাড়াতাড়ি গয়নাগুলো লুকোতে গেছি। মা বলল, নিবি? নিবি? আয়। আমি বেছে দিচ্ছি। মাধবী জ্যেঠিমার নাকি খুব সুন্দর দু’টো কাঁকন ছিল। পান্না বসানো। সে দু’টো নিয়ে উনি বলেছিলেন— এগুলো ছাড়া সব নিয়ে যা। কাকে দিবি রে? পুজো দিবি না তো? কালীর পুজো দিবি না তো? ওই মেয়েছেলেটা খুব খারাপ। উলঙ্গ হয়ে থাকে আর পুরুষ ভোলায়। এগুলো নিয়ে যা-খুশি কর কিন্তু সাবধান, ওর ফাঁদে পড়িস না। আর দেখ, এ দু’টো দেখ, এগুলো তোর বউ আর কমলের বউয়ের জন্য, বুঝলি।

লোডশেডিং হল। শবরী বিরক্ত হয়ে গজ গজ করতে করতে উঠে এলেন। এই শুরু হল। কতক্ষণ থাকবে না কে জানে! খুব গতি নিয়ে সশব্দে পার হয়ে গেল একটা ট্রেন। বোধহয় দার্জিলিং মেল। কড়া নাড়ার শব্দ হল। শবরী দরজা খুলতে গেলেন। দেবোপম উঠে দেশলাই জ্বালল। কোথায় মোমবাতি, কোথায় লণ্ঠন কে জানে! প্রায় প্রত্যেকদিন লোডশেডিং হয় অথচ কোনওদিন কোনও নির্দিষ্ট জায়গায় এগুলো পাওয়া যায় না। দরজা খোলার শব্দ হল। হইচই করে ভিতরে এল অরূপ। কলকাতা পুলিশে চাকরির আবেদন করেছিল। পেয়ে গেছে। শবরীকে একরকম জড়িয়ে নিয়েই ভিতরে এসেছে সে। ঘরে কয়েক পাক ঘুরে অন্ধকারেই নাচগান জুড়ে দিল—ইয়া ইয়া হিপি হিপি ইয়া ইয়া হিপি। তখনই, অবিশ্বাস্য কম সময়ে আলো ফিরে এল।

চমৎকার দেখাচ্ছে অরূপকে। হলুদ রঙের শার্ট আর সাদা প্যান্ট পরেছে। দেবোপমের মনে পড়ল, অমিতাভ বচ্চনের যে নতুন ছবিটা এসেছে, কী যেন নাম, তাতে এরকমই একটা পোশাক পরেছেন বচ্চন। হঠাৎ খুবই বিরক্তি লাগল দেবোপমের। অরূপ দেবোপমেরই বন্ধু। কিন্তু অরূপের এই অমিতাভকে নকল করার ব্যাপারটা সে একেবারে সহ্য করতে পারে না। এটা ঠিক যে বচ্চনের সঙ্গে অরূপের চেহারার মিল আছে। আর অরূপ তা এক মুহূর্তের জন্যও ভোলে না। সে চুলও ছাঁটে বচ্চন কাটিং-এ। অনেকটা পরেশের মান্না দে হওয়ার মতো।

অরূপ চাকরির খবর পরিবেশন করছে। অনুপম বলছে, শ্যাম্পেন কোথায়? শ্যাম্পেন?

অরূপের দিকে দেখতে দেখতে দেবোপমের চোখ পড়ে গেল শবরীর দিকে। শবরীর মুখ অপূর্ব উজ্জ্বল। সকাল থেকে জমে থাকা বিষণ্ণতা ও গাম্ভীর্যের মেঘ উড়িয়ে কেউ যেন আনন্দের মগ্ন আবেশ পরিয়ে দিয়েছে তাঁকে। এটা দেবোপম আগেও লক্ষ করেছে। অরূপ এলে শবরী বদলে যান। অরূপের উপস্থিতিটাও এমনই। হঠাৎ হাওয়ার মতো বা হাড়কাঁপানো হিমে একরাশ ঝলমলে রোদ্দুরের মতো।

শবরী অরূপের দিকে অপলক চেয়ে বললেন, আজ রাত্রে খেয়ে ফিরছ তো? আমার কিন্তু এখনও রান্না হয়নি!

দেবোপম ভাবে, কে বলবে এই মহিলা আজ সারাদিন রান্না করেননি বরের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে বলে!

দরাজ গলা অরূপের। দরাজ উন্নত শরীরের মতোই। এবং অমিতাভ বচ্চনের মতোও। সে দু’হাত তুলে বলে—

সম্পূর্ণ ক্ষুধার নীচে বালি আর সোরা আর গন্ধকের গৃহ…
অক্ষরে করুণ ঘণ্টা আরও ক্ষিপ্র করে তুলে কিরণক্ষমতা
ভরে নিতে প্রক্ষেপণে, তুমি কি সমস্ত শেষে আমাকে সমীহ
করাই মনস্থ করলে শ্যামল ধনুক-তীর?…

শবরী ভ্রূ কুঁচকে বললেন, উঃ! এ তো প্রায় মধুসূদনের ভাষা বলছ। যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব না দিয়ে কীসব বলছ বলো তো!

অরূপ চোখ বন্ধ করে হাসে। বলে, হে ইয়েটস্‌-এলিয়ট পড়া রমণী! ইহা আবোল-তাবোল নহে। মধুসূদনও নহে। ইহা জয় গোস্বামী। সাম্প্রতিকতম আধুনিক কবি।

পকেট থেকে একটি পাতলা বই বের করে সে। অনেকটা স্বপনকুমারের গোয়েন্দা গল্পের বইয়ের মতো। বইখানা রোল করে পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছিল অরূপ। হাত দিয়ে সেটি সোজা করার চেষ্টা করতে করতে দেবোপমের দিকে তাকিয়ে সে বলে, প্রভাসকে মনে আছে তো?

—কোন প্রভাস?

—আরে বাংলার প্রভাস। কবিতা লিখত! আমাদের ক্লাসের সন্ধ্যাশ্রীকে কবিতায় প্রেম নিবেদন করেছিল। সন্ধ্যাশ্রী খিচাইন করে ছেড়েছিল, মনে নেই?

—হ্যাঁ মনে পড়েছে। পাগলা-প্রভাস।

—আজ ওর সঙ্গে দেখা। কলেজ স্ট্রিটে। সেই একইরকম আছে মাইরি! আমাকে জোর করে ধরিয়ে দিল বইটা। বলল—পড়ে দেখ। অসাধারণ! কলেজ স্ট্রিট থেকে এখানে আসার জন্য সেভেন্টি এইট বাই ওয়ান ধরলাম। শালা এমন জ্যাম বি টি রোডে, বাসই নড়ে না। কী আর করব, বইটা পড়তে শুরু করলাম। পড়তে পড়তে মুখস্থ হয়ে গেল।

দেবোপম বইটা নিল। শবরী বললেন, তুমি কিন্তু কী খাবে বলোনি।

অরূপ গমগমে স্বরে শবরীর স্বর ঢেকে দিল, খাব কী? খাওয়াব। বড়োপম, চলো, চিকেন নিয়ে আসি।

অনুপম মাথা নাড়ল। বলল, আমি যাব না অরূপ৷ তুই ছোটপমকে নিয়ে যা। আজকে পাড়ায় একটা বাজে ব্যাপার হয়েছে। সারাদিন শ্মশানে ছিলাম। এখন ভাল লাগছে না।

—শ্মশানে? কেন? কেউ মারাটারা গেছে?

—হ্যাঁ। আমাদেরই বন্ধু।

—ওঃ। তা হলে আজ চিকেন থাক, নাকি! তোদের বন্ধু মানে তো…কীভাবে মারা গেল রে?

এবার দেবোপম অরূপকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘ক্রীসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ’পড়ে কি তুই শীত হয়ে গেলি? অমলেন্দু হেরোইন খেয়ে ফিনিশ হয়ে গেছে। তার জন্য আমাদের চিকেন না খাবার কোনও মানে হয়?

অরূপকে নিয়ে দেবোপম চলে যায়। কী করা যেতে পারে বুঝতে পারছিল না অনুপম। সারা মুখ বিস্বাদ হয়ে আছে। আজকাল বাড়িতে থাকতে ভাল লাগে না। কোনওদিনই কি লাগত? গানের স্কুলে চলে গেলে বরং ভাল হত। অনুপম ছাড়া কেউই গানের স্কুলে প্রতিদিন যায় না। সে যায়, কারণ গিয়ে ভাল থাকে। আদর্শ পরিবার বা সুন্দর পারিবারিক পরিবেশ কেমন হতে পারে সে-সম্পর্কে অনুপমের কোনও ধারণা নেই। একসময় প্রত্যেক সহপাঠীর মুখের দিকে তাকিয়ে অনুপম ভাবত—ওদের খুব আনন্দ! ওদের কোনও দুঃখ নেই। কিন্তু পরে কোনওদিন কোনওভাবে অনেকেরই যন্ত্রণার কথা জেনেছে সে। সবারই আলাদা আলাদা যন্ত্রণা। তার মনে হয়েছে, জীবন এরকমই। আপাত উজ্জ্বল। আজ মনে হচ্ছে জীবন অস্বচ্ছ। অসার। হঠাৎ হাসি পেল তার। এ সব কী ভাবছে সে! সন্ন্যাসী হয়ে গেল নাকি? আজ সারাদিন শ্মশানে থাকার ফলাফল। এর আগেও অনেক বার শ্মশানে গেছে অনুপম কিন্তু সেইসব মৃত্যুর কোথাও কোনও শোক ছিল না। জরাজীর্ণ মৃতদেহ পোড়ানোর মধ্যে বেশ একটা জঞ্জাল পরিষ্কার করার তৃপ্তি পাওয়া যায়। পৃথিবীর বোঝা যেন হালকা হল একটু। কিন্তু আজ অমলেন্দুকে পোড়ানোর ব্যাপারটা অন্যরকম।

পারিবারিক নিয়ম মানতে চায়নি বলেই এরকম উচ্ছৃঙ্খল হয়ে গিয়েছিল অমলেন্দু, এ কথা মানতে পারেনি অনুপম। হ্যাঁ, সমাজ ও পরিবারের অনুশাসন লঙ্ঘন করা সোজা নয় কিন্তু অসম্ভবও নয়। তার জন্য হয়তো একা হয়ে যেতে হয়। ক্ষতবিক্ষত হতে হয়। কিন্তু অনুশাসন ভাঙা যায়। তার জন্য আত্মধ্বংসের কোনও প্রয়োজন হয় না। আসলে এটা আত্মপ্ররোচনা। নিজের দুর্বলতার সপক্ষে দুর্বলতর যুক্তি। ধ্বংসকে কখনও সমর্থন করতে পারেনি অনুপম। পলায়নপরায়ণতাকেও নয়। অমলেন্দু পরিবার ছেড়ে চলে যেতে পারত। মল্লিনাথকে অস্বীকার করতে পারত। আসলে নিজের দুর্বল চরিত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল সে। তবু কোথাও একটা কষ্ট হতে থাকে অনুপমের। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। বহু ছোট ছোট স্মৃতি। আশ্রমের পুকুরে একবার এ পার-ও পার সাঁতার প্রতিযোগিতা করেছিল তারা। মাঝ-পুকুরে মৃণ্ময়ের পেশিতে টান লেগে গিয়েছিল। অমলেন্দু আর দেবোপম আস্তে আস্তে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে আসে। না হলে, কে জানে, মৃণ্ময় মরেও যেতে পারত। অমলেন্দু মাঝখানে নকশালে ঝুঁকেছিল। খুব লেনিন-মার্কস পড়ত। সত্যজিৎ নামে একটি ছেলে আসত অমলেন্দুর কাছে। সত্যজিৎ আর অমলেন্দুর সঙ্গে দু’-একবার উদ্বাস্তু কলোনিতে শ্যামল নামে একটি ছেলের বাড়িতে গিয়েছে অনুপম। শ্যামলের সঙ্গে এখনও মাঝে মাঝে দেখা হয়। হাসে। মাথা নাড়ে। কিন্তু ওটুকুই। সত্যজিৎ তুমুলভাবে নকশাল করত। অনুপম কখনও রাজনীতি করতে পছন্দ করেনি। কিন্তু সত্যজিতের কথা শুনতে ভাল লাগত তার। হঠাৎ অমলেন্দু সত্যজিৎকে ওদের বাড়িতে আসতে বারণ করে দিল। বলল, ও পুলিশের কোপে পড়তে চায় না। সত্যজিৎ আসা বন্ধ করে দিল। অমলেন্দুরও মার্কসচর্চার ইতি।

তখন রেললাইনের ধারে ক্লাবটা সদ্য তৈরি হয়েছে। নেহাতই তাস, ক্যারাম আর দাবাখেলার ক্লাব। শীতে ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট। কিন্তু পুলিশের নজর ছিল ক্লাবটার ওপর। কোথায়ই-বা ছিল না। কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ তখন বাজপাখির মতো নিষ্ঠুর, তীক্ষ্ণচক্ষু ও ঝানু শিকারি হয়ে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিল সত্যজিৎ আর অমলেন্দু ঠাণ্ডা মাথায় ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিল। তখন এইসব পারিবারিক দায়বদ্ধতা ও অঙ্গীকার কোথায় ছিল কে জানে! আসলে নেশার প্রতি ওর বরাবরের টান। স্কুল পালিয়ে শ্মশানঘাটে গিয়ে গাঁজা খাবার সন্ধান অমলেন্দুই প্রথম দিয়েছিল।

ভাবতে ভাবতে হাঁফিয়ে ওঠে অনুপম। সব ভাবনা ঝেড়ে ফেলে নিজের হারমোনিয়াম বার করে। এ বাড়িতে তার ও পরেশের হারমোনিয়াম আলাদা। হারমোনিয়ামের গায়ে খুশিমতো আঙুল খেলায় সে। যেন ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রমাণ করে। সে নিজেও জানে না এ মুহূর্তে কোন সুর কোন রাগ তার ভাল লাগবে। অস্থির পতঙ্গের মতো ঘুরে বেড়ায় তার আঙুল। বাসন মাজতে মাজতে শবরী বলেন, মারোয়া ধরলি?

মারোয়া? তাই তো! অনুপম লক্ষ করে, দ্রুত আঙুল চালালেও সে বারবার নিষাদ, ধৈবত, কড়িমধ্যম পেরিয়ে, গান্ধার ছুঁয়ে কোমল ঋষভে চলে আসছে। সে কোনও শব্দ করে না। গায় না। শুধু আনমনে বাজিয়ে যায়। শবরী মাজা বাসনে জল ঢালেন। গুনগুন করে সুর ধরেন— আকাশে ছাইল ঘন বাদল মেঘলা/একা চলে যাও/ভাবো না বসে রয়েছি একেলা…

গানের কথা ও সুর পরেশের। গানটি মারোয়ায়।

তখন ডোরবেল বাজে। অনুপম উঠছে দেখে শবরী বলেন, তুই বোস। আমি যাচ্ছি।

শবরী নীচে যান। আর একটু পরেই হইহই করতে করতে অরূপ ঢোকে। পেছনে প্যাকেট হাতে দেবোপম৷

রান্না হয়ে গেল, কিন্তু কেউ খেতে বসতে পারছে না। পরেশ ফেরেননি এখনও। রাত্রি সাড়ে দশটা বেজে গেছে। এত দেরি হল দেখে আজ আর ফিরবে না ঠিক করল অরূপ। তাকে লেকটাউন যেতে হবে। একটু চিন্তিত গলায় সে বলল, কোনও জায়গা থেকে ফোন করা যাবে দেবোপম?

দেবোপম ঘাড় নাড়ল। বলল, দেবাশিসের বাড়িতে চল। ওদের ফোন আছে।

—মাকে একটা ফোন করে দিই। ভাববে না হলে।

—তোরা ফোন নিয়েছিস?

—না। পাশের বাড়িতে। মায়ারা নিয়েছে।

দেবোপম হাসল। বলল, ও! তোর সেই মায়া?

দেবোপমের কথা ফুরোতেই লোডশেডিং হল আবার। এক মুহূর্ত কেউ কোনও কথা বলল না। বিছানায় সবাই যে-যার মতো ছড়িয়ে আছে। শবরী আস্তে আস্তে নামলেন। সন্ধ্যায় একবার লোডশেডিং হয়েছিল। মোমবাতি হাতের কাছেই আছে। দেশলাইও। জ্বালাতে গিয়ে দু’টো কাঠি নষ্ট করলেন শবরী। তৃতীয় কাঠিটায় মোম জ্বলল। শবরীর খোঁপা ভেঙে চুল এলিয়ে পড়ল পিঠে। মোমের আলোয় কাঁপতে থাকা অন্ধকারে প্রেতসদৃশ লাগল তাঁকে। সেটি হাতে নিয়েই গাম্ভীর্যে ও অপলকে খাটের কাছে এগিয়ে গেলেন তিনি। বললেন, মায়া কে?

লোডশেডিং-এর আকস্মিকতায় মোম জ্বালবার দু’টি বিফল প্রচেষ্টা লক্ষ করতে করতে মায়ার প্রসঙ্গ সবাই ভুলে গিয়েছিল। শবরীর প্রশ্নের কী জবাব দেবে কেউ বুঝতে পারছে না। দু’-এক মুহূর্ত, তারপরই স্বভাবসুলভ হা হা হাসিতে ফাটল অরূপ৷ সদ্য পড়া ‘ক্রীসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ’ থেকে আওড়াল—

ভেবে দ্যাখো, এ-পর্যন্ত একথা জানে না। রাত্রে বালুতীর ধরে
হেঁটে গেছে আর তাঁবু নেমে এল চারিদিকে অবনত, মোটা…
বালির উপরে উঠে অজ্ঞান ঘুমের খাস থেমে থেমে দোরে
ধাক্কা দিল, তারপর স্বপ্নে এসে দেখা দিতে তুমি চমকে ওঠা

অরূপকে থামাবার জন্য তার পিঠে চাপড় মারল দেবোপম। শবরীকে বলল, মা, মোম গলে হাতে পড়বে। কোথাও বসাও।

শবরী একটা পেতলের শূন্য ফুলদানি উল্টো করে মোমের ফোঁটা ফেলতে থাকলেন। অরূপ উঠে বসল। বলল, চল, ফোনটা করে আসি।

কড়া নাড়ার শব্দ হল। অনুপম বলল, বাবা এল বোধহয়।

শবরীর মুখ কঠিন হতে থাকল। মোমের আলোয় গালের শক্ত পেশির প্রকট হওয়া ফুটে উঠল না। কিন্তু শবরী দরজা খোলার তাগিদ দেখালেন না। তখন নীচ থেকে গলা ভেসে এল— দেবোপমদা, অনুপমদা, একবার শোনো।

দু’জনেই দ্রুত নামল বিছানা থেকে। এত রাতে কে ডাকছে! অরূপ দরজার দিকে তাকিয়েছিল। সরাসরি দৃষ্টিপাত না করেও চোখের কোণ দিয়ে সে বুঝতে পারল শবরী তাকে দেখছেন। সে এবার শবরীর দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শরীর সিরসির করে উঠল তার। তীব্র চোখ শবরীর। মোমের আলোয় বুঝি-বা স্ফুলিঙ্গ উপচে উঠছে। শবরী অতি নিচু স্বরে, প্রায় ফিসফিসিয়ে বললেন, মায়ার কথা আগে তো বলোনি!

দেবোপম দরজা খোলার জন্য নীচে গেল। পেছন পেছন অনুপম। দরজা খুলে দেখা গেল সি পি এম নেতা শ্যামাকান্তর ভাই তপন দাঁড়িয়ে আছে। বলল, দেবোপমদা, কাকু অরুণ সেনের বাড়িতে আছেন।

এ কোনও নতুন কথা নয়। এর পরও আরও কিছু আছে। দু’ভাই অপেক্ষা করল। তপন একটু থামল। একটু কাশল। অরূপও নেমে এসেছে নীচে। একা শবরীর কোনও কৌতুহল নেই। তিনি চিত হয়ে শুয়ে আছেন বিছানায়। অনুপম-দেবোপম কোনও প্রশ্ন করছে না। তারা জানে, অনুমান করতে পারছে, পরবর্তী সংবাদ। তপন একটু থেমে, একটু কেশে, হোঁচট খেতে খেতে বলল, মানে…কাকু একটু বেশি অসুস্থ। মানে… ওই … হেঁটে আসতে পারছেন না এ পর্যন্ত। মনাদা বলল একটু খবর দিতে।

দেবোপম কথা বলল না। অনুপম বলল, ঠিক আছে তপন, তুই যা, আমরা আসছি।

তপন চলে গেল। অরূপ কোনও প্রশ্ন করল না। তিনজনে উপরে এল আবার। দেবোপম বলল, আমি যাব না। তুই যা।

অনুপমের কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। কোনও উদ্বেগ বা উত্তেজনাও নয়। শান্তভাবে গায়ে পাঞ্জাবি চাপাতে চাপাতে সে বলল, এত রাতে রিকশা পাব না। আমি একা আনতে পারব নাকি?

দেবোপম চুপ করে আছে। অরূপ বলল, আমি যাচ্ছি, চল।

রুক্ষ গলায় দেবোপম বলল, না। আমিই যাব।

বেরিয়ে গেল দু’জন। অরূপ একা একা ঘরের এ দিক-ও দিক ঘুরে বিছানায় এসে বসল। ব্যালকনি দিয়ে হাওয়া আসছে। মোমটা নিবু-নিবু হয়ে আবার জ্বলে উঠছে। একটা ট্রেন চলে গেল। নীচে কোথাও বেড়াল ডাকছে। একটানা। একঘেয়ে। চুপ করে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছে অরূপের। সে বলল, অরুণ সেনের বাড়ি কত দূর? মানে, রাস্তায় ওই যে বড় বাড়িটা পড়ে তো?

হঠাৎ, দু’ হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠলেন শবরী। আর পারছি না… আর পারছি না…। অরূপ ঝুঁকে পড়ল শবরীর ওপর। স্বর মন্দ্রিত করে বলল, কী হল? কী হয়েছে?

খচ করে শব্দ হল একবার। দু’বার চমক দিয়ে জ্বলে উঠল টিউবলাইট। ফ্যান ঘুরতে শুরু করল। আলোয় চমকে সোজা হয়ে বসল অরূপ, যেন লোডশেডিং বিনা এরকম ঝুঁকে পড়া ঠিক নয়। শবরী এক হাতে চোখ ঢেকে শুয়ে আছেন। নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরা। পেট থেকে আঁচল সরে গেছে। সামান্য মেদমার্জিত পেটে একটি উদ্বেলিত নাভি। অরূপ বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। ফ্যানের হাওয়ায় মোম দপ দপ করছিল কিন্তু নিবছে না। ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে দিল অরূপ। তারপর ব্যালকনিতে গেল। একটা সিগারেট ধরাল সে। মায়ার মুখ মনে পড়ল। কীরকম অপরাধী লাগছে তার। কী অপরাধ? প্রত্যক্ষ কোনও অপরাধের সন্ধান পেল না সে। তবু সারা মুখ বিস্বাদ হয়ে গেল। প্রত্যাশিত চাকরি পাবার যে আনন্দ আজ সারাদিন মনে তির তির করছিল তা কোথাও খুঁজে পেল না। মায়ের জন্য ভাবনা হল তার। মাকে খবর দেওয়া হল না। দুশ্চিন্তায় থাকবেন। যদিও মাকে সে বলে এসেছিল আজ মাথুরের গড়ে আসবে। আর দেবোপমের বাড়িতে সে মাঝে মাঝেই থেকে যায়। তবু, মায়ের বয়স বাড়ছে। আজকাল খুবই বিচলিত হয়ে পড়েন।

একবার পিছন ফিরে তাকাল অরূপ। শবরী বিছানায় নেই। কিন্তু তাঁর শুয়ে থাকা জায়গাটায় চোখ পড়তেই অরূপ শরীরে সিরসিরানি টেল পেল। তার চোখে ভেসে এল আঁচল সরে যাওয়া পেট। উদ্বেলিত নাভি। সিগারেটে জোরে টান দিল সে। মনে মনে বলল—মায়া, আমাকে ক্ষমা কোরো। আমার কোনও উপায় নেই।

সিগারেটের টুকরো অন্ধকারে ছুড়ে ফেলে শবরীর খোঁজে ঘরে এল সে। তার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। তখন নীচে পরেশের কণ্ঠ বাজল। স্খলিত জড়ানো উচ্চারণ। পরেশ মাতাল হয়েছেন। দরজায় ছিটকিনি দেওয়া ছিল না। দু’ভাই পরেশকে দু’দিক থেকে ধরে সিঁড়ি দিয়ে তুলতে লাগল। আর পরেশ শবরী সম্পর্কে একরাশ ঘৃণা, কিংবা রাগ, কিংবা গাঢ় প্রেমের তীব্র রস ঢালতে ঢালতে উপরে উঠতে লাগলেন। সারাদিন পান করে সন্ধ্যায় বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিলেন। অরুণ সেন বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিলেন। সেই ঘোর এখনও কাটেনি। তাঁর শিথিল শরীর অনুপম ও দেবোপম আর টানতে পারছে না। অরূপ কয়েক ধাপ নেমে পরেশের কোমর জড়িয়ে ধরল। পরেশ বললেন, কে? অরূপ? এত রাত্রে? এত রাত্রে আমাদের বাড়িতে কেউ থাকে না। আমি থাকি, আমাদের ছেলেরা থাকে আর লোলাপাঙ্গী। তুমি কি লোলাপাঙ্গীর নতুন প্রেমিক? অ্যাঁ?

কেউ কিছু বোঝার আগেই পরেশকে ছেড়ে দিল দেবোপম। পরেশ পড়ে যাচ্ছিলেন। অরূপ তাঁকে জড়িয়ে ধরল। পরেশের চেয়ে অনেক বেশি লম্বা হওয়ায় সে ভারসাম্য রাখতে পারছিল না। দেবোপম সজোরে এক চড় মারল পরেশের গালে। অনুপমের হাত ছিটকে গেল। পরেশ ঝুঁকে পড়লেন। অরূপ তাঁকে ধরে রাখতে পারল না। তিনি মেঝেয় গড়িয়ে গেলেন। উপুড় হয়ে একটুক্ষণ পড়ে থেকে উল্টে যেতে যেতে কান্না জুড়ে দিলেন তিনি— মার। মার। আমাকে মেরে ফেল। আমি তো ক্লীব। ক্লীব একটা। শুধু চড় কেন? লাথি মার আমাকে…

একজন চিরকালীন মাতালের মতোই বিলাপ চলতে লাগল তাঁর। সেই কোন কাল থেকে এমনই অভিব্যক্তি সমস্ত মাতালের। অসফল গায়ক, অসফল পিতা এবং সার্থকতাশূন্য মানবজীবনে, পরেশ বোস একজন সফল মাতাল—যা পুঞ্জীভূত হল একটি সশব্দ থাপ্পড়ে।

সশব্দ চড় পৃথিবীকে স্তব্ধ রাখে কিছুক্ষণ—তারপর কাঁপন ধরায়। আলোড়ন হতে থাকে তারও পর। পৃথিবী একটি নড়াচড়া প্রাপ্ত হয়। যেমন এখন, এক মাতালের বিলাপের পাশে প্রাথমিক স্তব্ধ কয়েকজন। তারপর নড়াচড়া শুরু হলে শবরী নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালেন দেবোপমের সামনে। এবং একইরকম সশব্দ চড় মারলেন তার গালে। দেবোপম ছিটকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে লাগল। অরূপ অনুসরণ করল তাকে। অনুপমের ইশারায়।

একটুও চাল নেই রাধিকার ঘরে। দু’টোর সময় স্কুল থেকে ফিরে আসবে পলাশ। ভাত চাইবে। রাধিকার মুখ শুকিয়ে গেল। শরীর ভাল নেই তার। সাত মাস চলছে। এখনও গা গুলোয়। সারাদিন ঘুম পায়। আজ নিয়ে পাঁচদিন হল কার্তিক বাড়ি ফেরেনি। প্রায়ই ফেরে না। ফিরলেও রাধিকার কী! রাধিকার কাছে কার্তিকের একটিই প্রয়োজন, শরীর। বিয়ে হওয়ার পর থেকে এক রাত্রি বাদ দেয়নি সে। পলাশ হওয়ার সময় তিনদিন মাতৃসদনে ছিল আর তারপর শেফালির মায়ের সঙ্গে শুয়েছিল এক হপ্তা। ব্যস। ওই দশদিন মাত্তর ছোঁয়াছুঁয়ি বন্ধ ছিল। ভরা মাসে যখন আর কোনও কিছু সম্ভব নয় তখন রাত্রে বাড়িই ফেরেনি কার্তিক। কোথায় থাকত কে জানে! যাবার আগে পুবের ঘরে শেফালির মাকে বলে যেত—‘মাসি, একটু দেখবেন।’

খুব ভয় করত রাধিকার। যদি কিছু হয়, যদি ব্যথা ওঠে। ওঃ! কী সাংঘাতিক ব্যথা হয়। সে তো দেখেছে তাদের গাঁয়ে। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে একেকজন মাটি কামড়াত। নখে খিমচে নিজের গায়ের ছাল তুলে ফেলত। মুখে গ্যাঁজলা তুলে অজ্ঞান হয়ে যেতেও সে দেখেছে। ভাবতেই হাত-পা হিম হয়ে আসত তার। একদিন বলেই ফেলেছিল কার্তিককে। কার্তিক তখন অলস ও তৃপ্ত অজগরের মতো ঘুমোবার চেষ্টা করছিল। রোগা লম্বা শরীরটাকে দুমড়ে অদ্ভুত দ করে ঘুমোয় কার্তিক। নীচের পুরু ঠোঁট ঝুলে পড়ে আর নাল গড়ায়। গা ঘিনঘিন করে রাধিকার। তবুও, ছাদে বিছানায় কার্নিশে অহরহ উঁকি মারতে থাকা ভয় নিয়ে সে কার্তিকের কাছেই আশ্রয় খুঁজেছিল। আস্তে আস্তে ঠেলা দিয়ে ডেকেছিল কার্তিককে— শুনছেন! শুনছেননি! ঘুমাইয়া পড়সেন?

ঘড়ঘড়ে গলায় জবাব দিয়েছিল কার্তিক, কী বলিস? অ্যাঁ? কী?

রাধিকা কিছু বলতে পারেনি প্রথমে। তখনও সংকোচ যায়নি তার। আপনি থেকে তুমি হয়নি কার্তিক।

ডাকা পর্যন্ত একরকম। কিন্তু বলতে গিয়ে সে টের পেয়েছিল, ভয় পাবার কথা কার্তিককে বলা কত কঠিন! এক ভয়ের কথা বলতে গিয়ে অন্য এক ভয়ের দুস্তর পথ পেরুতে হয়েছিল তাকে। হাত-পা ঘেমে, গলা শুকিয়ে, কোনওক্রমে বলেছিল, আমার ডর করে।

কার্তিকের খর স্বর প্রশ্ন রেখেছিল, কেন? ভয় করে কেন?

রাধিকা অসহায় মরিয়া। বলেছিল, আপনে আমারে ফালাইয়া যান গিয়া। যদি ব্যাতা-ব্যাদ্‌না উঠে— আমি কী করুম!

বলতে বলতে রাধিকার কোমল কণ্ঠ বেয়ে কান্না নেমে এসেছিল। সে জানে কার্তিক কান্নাকাটিতে ভিজে যাবার লোক নয়। তবু, অজানিত ভয়ে, অসহায় একাকিত্বে, আর এই পূর্ণ সন্তানসম্ভাবিত অবস্থায় স্বামীর তাকে একা ফেলে চলে যাবার অভিমানে সে চাপা কান্নায় ডুকরে উঠেছিল। কার্তিক তেমনই ঘুম জড়ানো গলায় বলেছিল, তোর ব্যথা উঠলে কি তোকে কোলে করে বসে থাকব আমি? ব্যথা উঠলে মাতৃসদনে যাবি। নাম তো লেখানোই আছে। দুনিয়ায় কোনও মেয়েছেলের আব বাচ্চা হয় না!

হঠাৎই অসম সাহসে ফুঁসে উঠেছিল রাধিকা। কান্নার দমকে বলেছিল, আমার একলা ঘরে য্যান্‌ দম ঠেইলা উঠে। চাইরদিকে থমথমায়। আমারে কইসে, প্যাট কাচাইল্যা মাইয়া মাইনষের লিগা পেত্নি ঘুর ঘুর করে।

এক থাবড়া মেরেছিল কার্তিক রাধিকার মুখে। তার শক্ত হাত ভারী, কর্কশ থাবার মতো এসে পড়েছিল রাধিকার ঠোঁটের ওপর। মার খেয়েছিল রাধিকা। কার্তিকের হাতে ওই প্রথম। এমনিতে হেসে সোহাগ করে কখনওই কথা বলত না কার্তিক। কিন্তু সে-দিনের মতো অত কর্কশ থাবায় আর মারেনি এর আগে। সে, হয়তো-বা থামাতে চেয়েছিল রাধিকার গাঁইয়া কুসংস্কারের বুকনি। এবং থামাতে পেরেওছিল। রাধিকা তার পরে আর শব্দ করেনি। তার হুক খোলা ব্লাউজ থেকে ফুসে ওঠা স্তন ঠিকরে পড়েছিল। আর স্ফীত উদরে খুব জোরে নড়েচড়ে উঠেছিল নাড়ি জড়ানো পিণ্ডটি। হয়তো ওই সর্বনাশা থাবা— যা সমস্ত কাতর আবেদন গুঁড়িয়ে দিয়ে যায়—তার অসহ্য লেগেছিল! রাধিকা আর কখনও কিছু বলতে চায়নি। অর সমূহ ভয়ের জন্য, ইচ্ছের জন্য, কষ্টের জন্য, সে সঞ্জীবনীর মতো সূর্য থেকে বায়ু থেকে শক্তি সংগ্রহ করতে শিখেছিল। সে যখন বাপের কাছছাড়া হয়েছিল তখন গাঁয়ের আলো-বাতাসে, নদী আর ধানের সৌষাম্যে, পোয়াতি অবস্থায় আচরণীয় বিধি বা বিবাহিত মেয়ের কামকলাসক্রিয়তা সম্পর্কে কিছু জানবার অবকাশ পায়নি। সে-পর্যন্ত তার দিনগুলি কোমল রঙিন ঝিঙেলতার মতো ছিল। বাতাসের ঝাপটা খেত, বৃষ্টিতে নেতিয়ে পড়ত, কিন্তু আবার উঠত। মাচায় বাইত। হলুদ হলুদ ঝিঙে ফুল ফুটিয়ে সন্ধ্যা সাজাত।

তার কাকা-কাকি তাকে মূল থেকে উপড়ে রাস্তায় ফেলেছে। এবং কাকা-কাকির পিছু পিছু তাঁদের ইচ্ছেয় চলতে চলতে, কাঁকর বিছানো জীবন তাকে কার্তিকের কর্কশ হাতে মুখ থুবড়ে ফেলেছে। আশ্চর্য এই মানুষ যে শরীর ছাড়া আর কিছু বোঝে না। রুক্ষ উত্তপ্ত হাতে সে পোয়াতি নারীর মুখে থাবা বসিয়ে দেয়। আশ্চর্য এই শহর— যেখানে মানুষে মানুষে ঠাসাঠাসি। পাশাপাশি বসবাস কিন্তু স্বার্থে দীর্ণ। ঝগড়াপ্রবণ। পথে দাঁড়ালে অকারণে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। এমনই শহরে, এমনই মানুষে পিষ্ট রাধিকা ঈশ্বরের কল্যাণের মতো পেয়ে গেছে শান্ত, স্নিগ্ধ, দীঘিজল—শেফালির মাকে। স্বামী-পুত্র-সংসার আর ইস্কুলের আয়াগিরি করতে যাওয়া মানুষটা এই দশ ঘর ভাড়াটের মধ্যেও উজ্জ্বল সিঁদুরটিপ পরে মধুর হেসে রাধিকার খবর নিয়ে যেতে একদিনও ভোলে না।

পলাশ হওয়ার সময়, প্রথম পোয়াতি হওয়ার ভয় ও আড়ষ্টতায় দিশেহারা রাধিকাকে মাথায় তেল দিয়ে কতদিন চুল বেঁধে দিয়েছে শেফালির মা। কার্তিক না থাকলে, রাতের সমস্ত কাজের শেষে, ভেজা হাত দু’খানি মুছতে মুছতে রাধিকার দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। আশ্চর্য আলোর মতো মনে হয়েছে রাধিকার।

শেফালির মা’র কাছে সে কাঁদে। সুখ-দুঃখের কথা বলে। তার পরামর্শ নেয়। শেফালির মা থাকলে রাধিকার মন ভাল হয়ে যায়। সে তখন বাস্তবাতীত স্বপ্নের মতো খিলপাটনি গাঁয়ে চলে যায়— যেখানে শমসের আছে। না। শুধু মনসুখে যায় না। দুঃখেও যায়। তার মনে মনে ওড়ার জায়গা একটাই। খিলপাটনি গ্রাম। আর স্বপ্নেরও লোক একজনই। শমসের। তার মনে পড়ে, রূপসী নদীর তীরে ওই মাটির বাড়িখানিকে। কুঁড়েঘর নয় কিন্তু। দিব্যি কোঠাবাড়ি। ইটের গাঁথনিতে মাটির মেঝে, আর ওপরে টিনের চাল। যাত্রার দলের সঙ্গে এ গ্রাম ও গ্রাম ঘুরে যখন ফিরে আসত তার বাবা, আর ঠাকুমার জন্য, কাকির জন্য শাড়ি আনত, রাধিকার জন্য রঙিন ফ্রক আর নানা রঙের ফিতে, আর মায়ের জন্যও নতুন শাড়ি, কিন্তু কোন লজ্জায় কিংবা ভয়ে নিজের হাতে মাকে দিতে পারত না। রাধিকার হাতে দিয়ে ফিসফিস করে বলত— তর মায়রে পরাইস।

ঠাকুমা চলে গিয়েছে কবে! মা-বাবাও চলে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাধিকা। তার খুব একা লাগে। রাধিকা একটু-একটু বুঝছে যখন, বুঝি ন’-দশ বছর বয়স হল তার, স্কুলে যায় না আর, গাঁয়ে-ঘরে মেয়েদের বুকে গুটি উঠলেই স্কুলে যাওয়া মানা, তবু আপনা-আপনি নর-নারীর সম্পর্ক, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বা পিতা-মাতার মধ্যবর্তী এক ফাল্গুনী টান তার গোচরে এসেছিল। সে, মায়ের প্রতি বাবার বুকের মধ্যে জমে থাকা ব্যথাদীর্ণ অসহায় টান অনুভব করত সারাক্ষণ। বাবাকে বলত— তুমি দ্যাও না ক্যান বাবা? মায়ের লগে কথা কও না ক্যান?

রাধিকার বাবা, সত্যসাধনের ঠোঁটের দু’পাশে অনিবার্য ভাঁজ পড়ত তখন। চোখ দু’টি উদাস হয়ে যেত। কাঁচা-পাকা চুলে অস্থির আঙুল চালাত, যে-আঙুলে তবলা বাজিয়ে বিস্তর কড়া পড়ে গেছে। হয়তো-বা রাধিকাকেই, হয়তো-বা কোনও অনির্দিষ্ট শূন্যতাকে উদ্দেশ্য করে আপন মনে মানুষটা উচ্চারণ করত— তর মায় আমারে চিনে না রাধু। আমি কথা কইতে যামু কই, ফ্যালফ্যালাইয়া চাইয়া থাহে, নাইলে কান্দে। কথা কয় না।

রাধিকা বাপের কাছে সরে আসত তখন। বলত— মায় কারুরেই চিনে না বাবা। কারুর লগেই কথা কয় না।

তার কথায় বুঝি-বা কোনও কান্না লুকিয়ে থাকত, কোনও অভিযোগ বা প্রশ্ন। কেন চেনে না মা? কেন তোমাকেও চেনে না? মাকে এক নিঃশব্দ যন্ত্রের মতো লাগে কিংবা কোনও শাপগ্রস্ত স্বর্গবালিকা। নীরব। বেভুল। কথা বলে না! চুল বাঁধে না। সারা পিঠে ছড়িয়ে থাকা চুলের রাশির মধ্যে নির্বাক রক্তহীন মুখে প্রত্নসম্পদের মতো সৌন্দর্যের আভাস পাওয়া যায়। মাকে নিয়ে প্রশ্নের শেষ ছিল না রাধিকার। বস্তুত তার সঙ্গে সত্যসাধনের কথার বিষয়ই ছিল মা। সত্যসাধনের না-থাকার সময়গুলোয় মায়ের সমস্ত ইতিহাস রাধিকা বর্ণনা করত তাকে। সত্যসাধন শুনত। চুপ করে ভাবত। তার নেশা ছিল পদাবলী পড়া। সুখে-দুঃখে পদাবলী খুলে বসত যখন তখন। ভাল লাগত না রাধিকার। তবু শুনতেই হত। বাবাকে খুশি করার জন্য, সঙ্গ দেবার জন্য, অনিচ্ছায় অজ্ঞাতে কত যে পদ মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল তার। কী যে ভাষা! সত্যসাধন মাঝে মাঝে বুঝিয়ে বলে দিত। শুনত সে। আর ঘুমিয়ে পড়ত। বাবার গা ঘেঁষে, কোল ঘেঁষে। কতদিন কাকি আড়ালে ঠাসিয়ে চড় মেরেছে তার জন্য— লজ্জা শরমের মাথা খাইছস, ধিঙ্গি মাইয়া! বাপের কাসে ঠ্যাং উচাইয়া শোওন তর বাইর করুম।

সিঁটিয়ে যেত রাধিকা। ভয়ে, শঙ্কায় বা অপরাধবোধে। লজ্জা না-পাবার লজ্জা ক্ষণিকের জন্য বিষণ্ণ করে দিত তাকে। কিন্তু লজ্জা কেন পেতে হবে এ হিসেব তার মিলত না। বাবার কাছে তার কখনওই তেমন লজ্জা করে না যেমন করে শমসেরের সামনে বা হরিধনদার সামনে। কেন করে না? এ প্রশ্ন সে কোনওদিন কারওকে করেনি। সে বুঝেছিল কাকির চোখে অনেক কিছুই অপরাধ। যেমন মুড়ি খেতে দেরি হওয়া বা গোয়াল পরিষ্কার করতে সময় লেগে যাওয়া। যদিও এর জন্য পৃথিবীর কোথাও কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম নেই, সময়ও বেঁধে দেওয়া নেই। তবু, রাধিকার কাকি সারাদিন অসংখ্য অন্যায্য সময়যাপন খুঁজে পেত এবং ঈশ্বরের বিরুদ্ধে অগণন অভিযোগ করত এই বলে যে সত্যসাধন এক স্বার্থপর মানুষ— সে তার ভালমানুষ ছোটভাই সত্যবন্ধুর ওপর পাগল স্ত্রী ও জন্মকুটিল মেয়ের দায় চাপিয়ে নিশ্চিন্তে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাকে কোনও ভোগান্তি পোহাতে হয়নি, অতএব ঈশ্বরের একচোখোমি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সংশয় থাকে না তার। সেইসঙ্গে ভালমানুষ স্বামীর জন্য হা-হুতাশ অপরিসীম। স্বামী সে, সত্যবন্ধু, মুদিদোকান চালায় এবং দিনান্তে পরিশ্রমের অন্ন অপরের মুখে তুলে দেবার সময় রা কাড়ে না, হায়, তাকে ঘিরে আছে সব দাঁতাল নখনিবিড় রাক্ষস—তাকে ছিঁড়ে খাচ্ছে যেন-বা—কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কিছু বললেই পাড়াপড়শি— অন্য সব রাক্ষস দায়ি করতে পারে সত্যবন্ধুকে। বলতে পারে— সত্যবন্ধু অন্যায়ভাবে পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বড় ভাইকে বঞ্চিত করল— কারণ, কে না জানে যে ওই মুদিদোকান, ওই ভিটে সবই সত্যসাধন ও সত্যবন্ধুর পিতা সত্যসিন্ধুর হাতে তৈরি। কিন্তু সংসারে ক’পয়সা দেয় সত্যসাধন আর তার পরিবারের জন্য ক’পয়সা ব্যয়— সে হিসাব কে রাখে! তখন, এইসব ভাবনা ও বাস্তবদর্শনের বিনিময়ে, রাধিকার কাকি স্বামীর ভালমানুষির প্রতি ছড়া কেটে ক্ষোভ প্রদর্শন করে—

হাক করে না রাউয়ার ডরে।
হগ্গল রাউয়ায় বেইরা ধরে ॥

আজ, এমতাবস্থায় যখন রাধিকা দ্বিতীয়বার অন্তঃসত্ত্বা, যখন কার্তিক খুবই অনিয়মিতভাবে আসে এবং অবহেলা করে তাকে, তার মনে পড়ে সব। এই একটুও চাল না থাকা এবং শিশুটি শুকনো মুখে ঘরে ফিরলে তাকে কী-ই বা খেতে দেয় এমনই দুশ্চিন্তার পাশাপাশি সমস্ত অন্নসংস্থানের প্রতি তার ভীতি বাড়ে। কাকি তাকে যত ভাত বেড়ে দিত, তার সমস্ত কাঁকর তার মুখনিঃসৃত ছিল এবং এখন কার্তিক তার চাল কিনে আনে যে-টাকা দিয়ে যায় মাঝে মাঝে এবং যার দ্বারা সে অন্নসংস্থান করে, সে-অন্নেও প্রচুর পাথর। তার চোয়াল ব্যথা করে, নাভিতে দংশায়। রাধিকার তখন স্নিগ্ধ হেমন্তবেলার মতো বাবাকে মনে পড়ে। বাবার কথা। বাবার পাঠ। বাবার চাহনি। মাকে মনে পড়ে। পাগলি দুঃখী মা। ভেসে যাওয়া মা। আর মনে পড়ে ওই সমস্ত বাক্যবিন্যাস, পদাবলীর আশ্চর্য বয়ন। কেন মনে আসে? কেন অর্থ হয়ে যায়? কেন ভাল লাগে? তস্করের মতো বা ভিক্ষুকের মতো অশেষ কাঙালপনায় সে ভাবে, ভেবে যায়—

প্রেম-আকুল        গোপ গোকুল
লজ-কামিনী-কন্ত।
কুসুমরঞ্জন     মঞ্জু মঞ্জুল
কুঞ্জমন্দির সন্ত ॥

তার নিজস্ব মানসসিন্দুকে উঁকি মেরে যায় একটি মুখ— পরমেশ— কী সুন্দর! নরম মুখ, দীঘল চোখ, ঝকঝকে রৌদ্রের মতো শরীর। শরীরে এঁটে থাকা শার্ট পরে কাজে যায় সে আর অমন শার্ট খুলে অমন শরীর একখানি ধুতি জড়িয়ে স্নান করাতে নিয়ে আসে উঠোনের খোলা কলে। দীর্ঘ সময়ের পুরু শ্যাওলার ওপর অতি যত্নে গা ঘষে। রাধিকা, দরজার ফাঁক দিয়ে তাকে অপলক দেখে, গোপনে। সে ছাড়া অন্য কেউ জানে না এই দর্শনের কথা। মাঝে মাঝে মনে হয়, জানে, সে জানে, যার দিকে তাকায়, না হলে সেও তাকায় কেন? আসতে-যেতে দেখে কেন দু’চোখের কোণে? আর রাধিকার কেবলই মনে হয়— কার্তিক নয়, পরমেশ, বা পরমেশও নয়, পরমেশের মধ্যে সে আসলে অন্য একজন মানুষকে দেখতে পায়। তার সঙ্গে পরমেশের বরণে না হলেও গড়নে মিল, বয়সে মিল, চাহনিতে মিল— সেই মানুষকেই সে চেয়েছিল অন্য কোনও জন্মের পার থেকে। তাকে আর দেখবে না কোনওদিন, তাই সে অন্য পুরুষে তার মুখ খোঁজে। আর পরমেশ, দশ ঘরের এক ঘর ভাড়াটে পরমেশ, অন্য একজনের মতো হয়ে রাধিকার বেঁচে থাকা সঞ্জীবিত করে যায়। রাধিকার মনে পড়ে—

নিজ পরিজন        সে নহে আপন
বচনে বিশ্বাস করি।
চাহিতে তা পানে       পশিল পরাণে
বুক বিদারিয়া মরি॥

রাধিকা, ছেলের মুখে দেবার জন্য ভারী শরীরে শেফালির মা’র কাছে দুটি চাল আনতে ছোটে। যেন-বা মাতৃমুখ— শেফালির মা তার কাছে এমনই প্রতিভাত হয়। তবু কুণ্ঠায় হাত পাতে সে। এই প্রথম। ছেলে খাবে, কী খেতে দেয়? ঘরে একটু চাল নেই। স্নেহকাঙাল সে, শেফালির মায়ের মাতৃত্বকাঙাল। প্রেমেরও কাঙাল— কোনও এক শমসের সদৃশ পরমেশ পুরুষের। সে এখন দু’টি হাত পেতে ছেলের জন্য কাঙালপনা করে। শেফালির মা, তারও টানাটানির সংসারে চালের পাত্র ঠনঠন করে— নুন আনতে পান্তা ফুরায়/ প্যাটের আগুন বক্ষ পুড়ায়— তবু সে দু’টি চাল তোলে এবং জিজ্ঞাসা করে— আইজও আসে নাই?

রাধিকার মুখ নিচু। হাতে চালভর্তি পাত্রখানি সমেত সে টের পায় তার চোখে জল চলে আসছে। তখন উঠোনে সাইকেল ঢোকানোর ঠুনঠুন শব্দ হয়। রাধিকার বুকের তল ধক করে ওঠে। পরমেশ! অফিস যায়নি কি আজ? চালভর্তি বাটি আড়াল করতে চায় রাধিকা। কাকির বকুনি খাওয়া নির্লজ্জ মেয়েটি হঠাৎ চাল ধার চাওয়া লুকোবার প্রয়াসে শেফালির মা’র ঘরে সেঁধিয়ে যেতে চায়। তার আগেই পরমেশ একমুখ হাসে। রাধিকাকে দেখে নয়। তার চোখ শেফালির মা’র দিকে। যেন-বা রাধিকাকে দেখতেই পায়নি সে। হাসি বিনিময় করে অনায়াসে নিজের ঘরের দিকে যায়। রাধিকাও পা বাড়ায় নিজের ঘরের দিকে। হঠাৎই রাগ হয় তার। ক্ষোভ জাগে। পরমেশ তাকাল না কেন? যেন কথা ছিল চোখে চোখে কথা হবে। রাধিকার কানে বাজে—

কে হেন কালিয়া    নিঠুর হইল
কি শেল লাগিল যেন।
দরশন আসে  যে জন ফিরয়ে
সে এত নিঠুর কেন ॥

এবং সে আনমনা হয়ে যায়। সন্তানের ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য চেয়ে আনা চালের বাটি হাতে ধরে সে ভাবতে থাকে আশ্চর্য প্রাঞ্জল এইসব আখরের কথা। বাবা কেমন সুর করে পড়ত! তখন তো বোঝেনি কিছু! এখন কেমন করে বুঝে যায়! ভাবতে ভাবতে ভূতগ্রস্তর মতো সে হেঁটে যায়। তখন শেফালির মা ডাকে— খাড়া।

রাধিকা বহু দূর থেকে শুনতে পায় সে ডাক। এবং ফেরে। ধীরে পাকখাওয়া লাট্টুর মতো লাগে তার চলা। শেফালির মা বলে— আইজ আমার শরীলডা ভাল নাই। প্যাটে ব্যাদনা হইতাসে।

রাধিকা তার আকাশচারণ থেকে এতক্ষণে মাটিতে নেমে আসে। বলে, ক্যান? এমুন হইল ক্যান?

শেফালির মা পেটে হাত রেখে বলে, কাইল দিদিমণি নারায়ণ পূজার প্রসাদ দিসিল। কুন সকালে মাখা ছিন্নি আমারে দিসে ব্যালা চাইরটায়। কেমুন য্যান গন্ধ লাগতেয়াসিল।

রাধিকা বলে, খাইলা ক্যান?

—খাইলাম। প্রসাদ ফেইলা দিমু?

রাধিকা ঝেঁঝে ওঠে। বলে, হ। প্রসাদ কইয়া পচা-ধচা সবৈ খাওন লাগব। অখন বুজো। খাইয়া প্যাট ছাড়সে। তাও কইব প্রসাদ। থোও ফ্যালাইয়া।

শেফালি মা পালটা ঝাঁঝায়, হ। তগো তো সবৈ ফ্যালন। কয় বলে— ধাইরা বাছুর উইড়া যায়/ চামচিকায় কটকটায়—তগো হইল ওই দশা। কিসু মানামানি নাই। হাজারবার কইসি, পোয়াতি মাইয়্যা চুল খুইল্যা ঘুরবি না। প্যাট খালি রাইখ্যা থাকবি না। শুনস?

—ক্যান? অহন কি আমার চুল খুলা দ্যাখায়?

রাধিকা তার প্রকাণ্ড খোঁপা শেফালির মার নাকের ডগায় এগিয়ে দেয়। শেফালির মা তার গালে একটি ঠোনা মেরে বলে, সকাল থিক্যা কী খাইছস?

—শুকনা মুড়ি আসিল দুগা, খাইসি।

—হ। ওই খাইয়াই থাক। কপাল পুড়াইয়া আইসা জুটসো। জিগাই যে চাইল দিসি যা তর পোলারৈ হইব। তুই খাবি কী?

রাধিকা হঠাৎ বিরক্ত বোধ করে। কিংবা আসলে হয়তো ধরা পড়ে যাওয়ায় বিব্রতও। কেন এসব প্রশ্ন! এমনকী, মায়েরই স্নেহতুমুল শেফালির মায়ের কাছেও সে তেতো কণ্ঠ উদ্‌গীরণ করে ফেলে, কিসু খামু না। প্যাটে কিল মাইরা পইড়া থাকুম।

—হ। তাই থাক গিয়া। কয় না?

ভাতারে দ্যায় কিল।
তাই খাইয়া শুই,
মায় দিসে ভাতের থালা
গজ গজাইয়া থুই।

রাধিকা হেসে ফেলে এ বার। বাটির চাল দু’বার নেড়েচেড়ে বলে, কী করুম কও? ভাতারে তো কিলাইতেও আইতাসে না!

শেফালির মা কোমল হয়ে যায়। বুঝি-বা শেফালির কথা তার মনে পড়ে। চোখে জল ভরে আসে। কত কিছুই তো হল জীবনে। পঁয়ত্রিশ বছর আগে ধনধান্য গ্রাম ছেড়ে নিঃসম্বল অবস্থায় স্বামী-কন্যা-শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে পাড়ি দিয়েছিল দীর্ঘ উদভ্রান্ত পথ। শাশুড়ি রাস্তাতেই প্রাণত্যাগ করেছিলেন। অমন সুলক্ষণা সংসার ফেলে, ঢেঁকিঘরের গন্ধ, তাজা কলমি ও শাপলা-ভরা পুকুর, ঝিঙে ফুল ফোটা বিকেল আর দোয়েল-শ্যামা ভোরের স্নিগ্ধ যাপন ফেলে পোঁটলা-পুঁটলি আঁকড়ে ওই পথ চলা তাঁর সয়নি। রাস্তার ধারে স্ত্রীকে ওভাবে মরে যেতে দেখে শোকে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন শ্বশুর। স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূর জন্য কিছু করতে না পারার অক্ষমতা বোধ সম্ভবত তাঁর আত্মসম্মান সম্পূর্ণ হরণ করেছিল। তিনি প্রায় ছেলেমানুষ হয়ে গিয়েছিলেন। যে কয়েক বছর বেঁচে ছিলেন, ওভাবেই। এমনকী, শেফালির শোক পর্যন্ত স্পর্শ করেনি তাঁকে। তখন শেফালির মা’র সতেরো বছর বয়স। এই এমনই— এই রাধিকা যেমন এসেছিল প্রথম। তার পর থেকে ঘষে ঘষে চলা। দিন গুজরানো। সেইসব দিন, কোনও দিনই ভুলবে না শেফালির মা। আর ভুলবে না শেফালিকে। রাধিকাকে দেখে তার শেফালি স্মরণ হয়। বুকে স্নেহ উপচে আসে। ইস্কুলে আয়াগিরি করে উপার্জন করা যে-অর্থ সে সংসারকে দেয় সেই অন্নর ভাগ আসন্নপ্রসবা রাধিকাকে দিয়ে তৃপ্ত হতে চায় সে। বলে, যা গিয়া। পোলার লিগা ভাত বসা। কয়লা আসেনি?

—আসে।

—যা গিয়া। আমি আইতাসি।

রাধিকা চলে যায়। শেফালির মা একটি থালায় অতি যত্নে ভাত বাড়ে। শ্যামল, শেফালির মা’র বড় ছেলে, দোকান থেকে নাইতে খেতে এসেছিল। প্রশ্ন করে—কার লিগা ভাত বাড়ো মা? আমার সান হয় নাই।

শেফালির মা প্রত্যয়ের সঙ্গে বলে, শুইন্যা তর কুন কামডা হইব? খাড়াইয়া না থাইকা তর কাম তুই কর গা যা।

শ্যামল বোঝে। কথা বাড়ায় না। সে জানে, তার মা ‘না’ বলতে জানে না। স্বার্থপর হতে পারে না। নিজেকে বিলিয়ে দেবার জন্য তার জন্ম। যে-ইস্কুলে শেফালির মা আয়াগিরি করে সেই ইস্কুলের বড় দিদিমণি যখন তখন খাটিয়ে নেয় তাকে।…আজ ঝি আসেনি, শেফালির মা, আমার বাসনটা মেজে দিয়ে যেও।… আজ কাপড় কাচার বউটা এল না। সকালে এক গাদা কাপড় ভিজিয়েছিলাম। জানো তো, তোমার দাদার রোজ পাটভাঙা শার্ট না হলে চলে না। ছেলেও হয়েছে তেমনি— তুমি একটু কেচে দিয়ে যেও যাবার আগে… এই রবিবারে একটু এসো শেফালির মা। মশলার শিশি-বোতলগুলো ধুতে হবে।…

আপন সংসারে, ছুটির দিনেও, কড়ায় পুঁইডাঁটা চাপিয়ে শেফালির মা বড় দিদিমণির বাড়ি ছোটে। শ্যামল, কমল এবং তাদের বাবা আপত্তি করার চেষ্টা করেছে। বলতে চেয়েছে— তুমি যাইবা ক্যান? তুমি কি তাগো বাড়ির ঝি?

শেফালির মা জিভ কেটেছে। বলেছে, ছি ছি! কী কও! এই ইস্কুলের কামডা ছাড়া আমাগো চলত? দেইখো, অকিতজ্ঞ হইও না।

মায়ের জন্য শ্যামলের কষ্ট হয়। অকারণে গলার কাছে ব্যথা করে ওঠে। মাথায় তেল ঘষতে ঘষতে কলতলার দিকে যেতে যেতে সে ভাবে— মা এত ভাল, তবু মা’র এত কষ্ট কেন? ঈশ্বর ভালমানুষদের প্রতি কবে সদয় হতে শিখবেন? হঠাৎ সত্যজিতের কথা মনে পড়ে গেল শ্যামলের। সে বলত— অত ভগবান-ভগবান কোরো না। ভগবান-নির্ভরতা মানুষের নিজস্ব শক্তির প্রতিবন্ধক। ভগবান-ভগবান করে মানুষকে ভাগ্যনির্ভর এবং অক্ষম করে দেওয়া একটা বুর্জোয়া পরিকল্পনা।

শ্যামল বলেছিল, পৃথিবীর সব প্রশ্নের উত্তর কি জানো তুমি? সমস্ত সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের ব্যাখ্যা? ঈশ্বর না মেনে আমাদের উপায় কোথায়?

সত্যজিৎ বলেছিল, প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হয়। নিউটনস ল তো তুমি ক্লাস সেভেনেই পড়ে ফেলেছিলে। কিন্তু তাঁর আগে ওই ব্যাখ্যা কেউ দিতে পেরেছিল কি? ততদিন ওইটুকু ভগবানের নামে ছিল। তাই না?

শ্যামল বলেছিল, মানুষ যতটা জানে, ততটাই জানে না, সত্যজিৎ।

দেবার্চন ছিল সঙ্গে। বলেছিল, ঈশ্বরে নয়, বিজ্ঞানে বিশ্বাস কর। সমস্ত ঘটনার বুক পেট কেটে সত্যটা জেনে নাও। সত্য জানার কোনও শেষ নেই।

—তার মানে কী দাঁড়াল? শুধুই বিজ্ঞান? না, ঈশ্বর ও বিজ্ঞান?

—সেটা বলা খুব শক্ত। নিটশে যেমন, ঈশ্বরকেও অস্বীকার করেছিলেন, বিজ্ঞানকেও। এক জায়গায় বলেছিলেন— বিজ্ঞানও এক ধরনের আত্মসম্মোহনের উপায়, যার সাহায্যে মানুষ নিজের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করতে পারে; যেখানে প্রশ্নভীরু, জীবনবিমুখ, ক্ষুদ্রদৃষ্টি বুদ্ধি আশ্রয় খোঁজে, যা ধর্মের মতো প্রশ্নোর্ধ্ব প্রাধিকার দাবি করে নির্বোধ জনসাধারণকে স্তোক দেয়; প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার সঙ্গে রফা করে যা পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রসার লাভ করে; যা প্রয়োগের ফলাফলের জন্য ব্যক্তিগত দায়িত্ব স্বীকারে পরাঙ্মুখ।… আসল কথা হল তুমি কী বিশ্বাস করবে সেটা তোমার ব্যাপার। কাজ করাটাই মূল কথা।

বেলুড় মঠের প্রাঙ্গণে বসেছিল তারা। সত্যজিৎ বহুক্ষণ গঙ্গার দিকে তাকিয়ে চুপ করে ছিল। সে প্রেসিডেন্সিতে পড়ত তখন। শ্যামল পয়সার অভাবে, হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে বাবার দোকানেই দর্জির কাজ শিখত। তবু তারা একসঙ্গে বসত। কথা বলত। সে-দিন সত্যজিৎ বলেছিল, বেশ। তুমি তো বিবেকানন্দকে মানো। মানো না?

—মানি।

—ঈশ্বর সম্পর্কে ওঁর মতটা শোনো—

অসীম এক, বহু নয়; একই অসীম আত্মা হাজার হাজার দর্পণে নিজেকে প্রতিবিম্বিত করিয়া ভিন্ন ভিন্ন আত্মা-রূপে প্রতিভাত হইতেছে। এই বিশ্বের অধিষ্ঠান-স্বরূপ অসীম আত্মাকেই আমরা বলি ঈশ্বর।’ মানব মনের অধিষ্ঠান সেই এক অসীম আত্মাকেই আমরা বলি ‘মানবাত্মা’।

দেবার্চন চুপ করে ছিল। একটু ভেবে বলেছিল, সেই তো, সেই কথাই তো ভাবতে হবে। মানবাত্মার কথা। শুধু তত্ত্ব দিয়ে তাকে কখনও ধরা যাবে না সত্যজিৎ। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়েছে ভারতের মূল চিন্তার জায়গাটা আমরা ধরতে পারিনি। আমাদের এ কাজ সফল হবে না।

ফুঁসে উঠেছিল সত্যজিৎ। বলেছিল, কেন? হবে না কেন?

—কারণ আমরা আমাদের দেশের মানবাত্মার সন্ধান রাখিনি। যুগ যুগ ধরে যে-বিশ্বাস ও নির্ভরতা তাদের মধ্যে জমে রয়েছে তার একটা মূল্য আছে। আমাদের তত্ত্বের সঙ্গে যদি তা না মেশে তবে সাধারণ মানুষ কোনওদিন তত্ত্বটাকে মেনে নেবে না। বিশ্বাসকেই নেবে।

—সেটাই তো আমাদের কাজ। ওদের বোঝাতে হবে যে তত্ত্বটা আসলে ওদের ভালর জন্য, ওদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য।

—হ্যাঁ। এখানেই আমার আপত্তি। তত্ত্বের জন্যও বিশ্বাস দরকার। বিশ্বাস ছাড়া তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না। আবার তত্ত্ব বোঝানোর জন্য শিক্ষাও দরকার। শিক্ষা না থাকলে তুমি কী করে তত্ত্বজ্ঞান ঢোকাবে। ভাববার ক্ষমতাই যদি না জন্মায় তবে পেনিসিলিন ইঞ্জেকশনের মতো তত্ত্বজ্ঞান ফুটিয়ে কোনও লাভ নেই। একটা আনপড় লোককে তুমি কী করে কেন্দ্রের বৈদেশিক নীতি বোঝাবে? কী করে বোঝাবে মুদ্রাস্ফীতি আর ঘাটতি ব্যয়ের অন্তর্নিহিত রাজনীতি?

—ঋণের কথা বলছ? এটা বোঝানোই তো সবচেয়ে সহজ। আমাদের দেশের সমস্ত ছোট চাষি বা শ্রমিক কীভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে থাকে, তুমি কি জানো না?

—জানি। সেটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে। জাতীয় স্তরের সমস্যাগুলো তুমি বোঝাতে পারবে না।

—বোঝাবার দরকার নেই দেবার্চন। রাশিয়া বা চিনে কি সমস্ত মানুষ রাষ্ট্রবিজ্ঞান জানে? অর্থনীতি বোঝে? ওখানে কি সমাজ এগোয়নি? বিপ্লব হয়নি?

দেবার্চন বলেছিল, রাশিয়া বা চিন নয়। আমি আমাদের দেশের কথা ভাবতে চাই। প্রত্যেক দেশের অন্তর্কাঠামো আলাদা আলাদা। আমাদের সবই ভাবতে হবে আমাদের দেশের ধর্ম, সংস্কার, বিশ্বাসের নিরিখে। আমি তত্ত্ব জানি কিন্তু যাদের সঙ্গে কাজ করব তারা জানে না। সুতরাং আমার লক্ষ্য হওয়া উচিত ওদের বোধগম্য উপায়ে তত্ত্ব প্রয়োগের কথা চিন্তা করা।

—সেটা কী করে করবে? তুমি কি দাস ক্যাপিটালকে বলবে ধর্মগ্রন্থ আর তার ওপর গীতার মতো ভক্তি জাগিয়ে তুলবে?

—ঠিক তা নয়। হয়তো আমি তোমাকে বোঝাতে পারছি না। ধরো গম সেদ্ধ করে কেউ থুকপা বানিয়ে খায়। কেউ রুটি ভাজে।

সত্যজিৎ বলেছিল, তোমার মধ্যে সংশয় ঢুকে গেছে দেবার্চন। এটা বিপ্লবের পথ নয়। বিপ্লব বিশ্বাস থেকে আসে। বিপ্লবের জন্য একটা নিঃসংশয় স্বপ্ন দেখতে হয়।

শব্দ করে হেসে উঠেছিল দেবার্চন। বলেছিল, সেই আমার কথাতেই কিন্তু ফিরে এলে তুমি। সেই বিশ্বাসে ফিরে এলে। দেখো, আমরা পড়াশুনো জানা, বিশ্লেষণবাদী, তত্ত্ব জানা কর্মী। তবু আমাদের বিশ্বস্ত স্বপ্নদ্রষ্টা হতে হয়। তা হলে যারা আগেই অন্য কোনও বিশ্বাস আঁকড়ে ফেলেছে তারা সেটা ছাড়বে কোন যুক্তিতে?

দেবার্চন ও সত্যজিতের সব কথা বুঝতে পারত না শ্যামল। কিন্তু বোঝার চেষ্টা করত। ওদের মধ্যে গনগনে আগুনের আঁচ পেত সে। দেবার্চন ও সত্যজিৎ দু’জনের কেউই আর বেঁচে নেই।

রাধিকাকে পাশে নিয়ে শুয়েছিল শেফালির মা। বোঝাচ্ছিল পোয়াতির আচরণীয় বিধি। দুপুরের উচ্ছ্বসিত আলোর ক্লান্তি চারপাশে। মালাইবরফওয়ালা ডাক দিয়ে যায়। সরু গলায় বাসনওয়ালি হাঁকছে—লাগে—এ-এ-এ স্টিলের বাসু-উ-উ-ন। কার ঘরে কচি ছেলে কেঁদে উঠল। কেউ-বা ভারী গলায় শিশুটিকে ধমকায়। কোথাও একটানা ডেকে যাচ্ছে কুবো পাখি। কোথায় বসে ডাকে সে! এই শহরে আড়াল কোথায় পায়! পলাশ মায়ের পাশে শুয়ে আছে। আজ ইস্কুলে একক দশক শতক চিনেছে সে। তাই আপনমনে বিড় বিড় করছে একক দশক শতক—এ দ শ হা অ ল নি কো, এদ শহা অল নিকো। এদশহা অলনিকো—খেলা পেয়ে গেছে সে। পড়া পড়া খেলা। এক এক রকম উচ্চারণে এক এক রকম ছন্দ। আবার চুপ করছে। কুবো পাখির ডাক শুনছে কুব-কুব-কুব। ভাবছে—কেমন দেখতে পাখিটা? কতবার ডাকছে! না থেমে? দম না নিয়ে? ঘড়ির কাঁটার মতো। একটুও আগে পরে নয়। একটুও কাছে দূরে নয়। কেমন করে পারে? একক-দশক-শতক—আবার তার মনে পড়ে যায়। এক সংখ্যা, দু’ সংখ্যা, তিন সংখ্যা—লক্ষ কোটি— কত কত সংখ্যায়! আবার তার মনে পড়ছে—শিখেছিল— বনে থাকে বাঘ। গাছে থাকে পাখি। এখন শিখছে, অদ্য বধ্য কল্য হাস্য দাস্য। ডাক্তারবাবুর বাগানে টিনের চালাঘরে কর্পোরেশনের ইস্কুল। সেখানে বিদ্যাভ্যাস করছে সে। আজ দিদিমণি অনেকটা পড়িয়েছেন। মাঝপথে ছুটি দিয়ে ইস্কুলে তালা মেরে চলে যাননি। দিদিমণির মন খারাপ কারণ ডাক্তারবাবুর বড় ছেলে মারা গেছে। আর তাই বুঝি দিদিমণির পক্ষে এমন পড়ানো সম্ভব হল। কেউ মারা গেলে, কেউ দুঃখ-কষ্ট পেলে সমস্ত হালকা বস্তু ওপরে উঠে যায় আর ভারী বস্তু—যেমন মনঃসংযোগে, যেমন কর্তব্যসচেতনতা, যেমন পরপার চিন্তা—এইসব নেমে আসে। মানুষ ক্ষণকালের জন্য হলেও যথাযথ হয়ে ওঠে।

ডাক্তারবাবুর ছেলের মৃত্যুর ফলেই বুঝি আজ পলাশ একক দশক শতক শিখেছে। এখন সে ঘুমিয়ে পড়ছে। মালাইবরফওয়ালার বরফের প্রতি একটু লোভ, কুবো পাখি কেমন দেখতে—এই ঔৎসুক্য এবং মা কেন একদিনও বাসনওয়ালির থেকে বাসন কেনে না—এমনই প্রশ্ন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে। বাবা নেই বেশ ক’দিন। সে ভাল আছে। বেশ আছে। বাবাকে একটুও ভাল লাগে না তার।

অন্ধকার খুপরি এই ঘর। তাতে মশা। তাতে পোকা। তাতে উই। দক্ষিণে এঁদো পুকুরের ধারে মানকচুর ঝোপে পোকামাকড়ের সংসার। শেফালির মা আঁচল দিয়ে মশা তাড়ায়। সন্ধ্যায় পুরনো ন্যাকড়া পোড়া দেয়, ধোঁয়া দিয়ে মশা তাড়াতে। রাধিকা মশার কামড় টের পায় না। তার পা ফুলেছে। শেফালির মা এই কথাই তাকে বোঝাতে চাইছে যে কথা শুনে না চললে পোয়াতির এমনই দশা হবে। পলাশ হওয়ার আগেও এইসব শিক্ষা সে দিয়েছিল। তখন আরও ছোটটি ছিল রাধিকা। তাই আরও অনুগত ছিল। এবারে তার বুদ্ধি পেকেছে। গা-ছাড়া ভাব এসেছে। সবেতে তর্ক। সবেতে প্রশ্ন। কিছুই মানছে না। তাই পা ফুলেছে। চোখ-মুখ ফুলেছে। আর ছেলের সঙ্গে তারও ঘুমে চোখ ভার। শেফালির মা তাকে ঘুমোতে দেবে না—ঘুমাইস না দুফ্‌রে। হ্যাদাইয়া যাবি।

রাধিকার আদুরে গলা শোনা যায়, কী করুম! ঘুম পাইতেয়াসে!

—কথা ক।

—তুমি কও। শুনতেয়াসি।

—তর যেমুন প্যাট হইসে রাধু আমার য্যান মনে লয় যমজ হইব।

রাধিকা ভয় পায়। উত্তেজিতও হয় কিছুটা। দ্রুত মাথা নেড়ে বলে, ক্যান হইব মাসি? আমি কুনোদিনে ঝোড়া ফল খাই নাই।

শেফালির মা সন্দেহ প্রকাশ করে, খাইস নাই? তর কিসু বিচার আসে? কুনখানে কুন অখাইদ্য-কুখাইদ্য খাইছস্! কুনো কথা শুনস্‌ তুই?

—ক্যান? কুনডা শুনি নাই কও।

—শুনছস্‌ না আরও কিসু!

—ক্যান তুমি কইস চুল খুইল্যা না ঘুরতে। ঘুরসি?

—হ। কয় না?

শুচি শুচি বামনি, নিরামিষ্যি খায়
শোল মাসের মাথা লইয়া, উগুরতলে যায়!

—হি হি হি হি—

রাধিকার হাসি শোনা যায়। হেসে ঝলমল করতে তাকে বড় একটা দেখেনি শেফালির মা। মেয়েটা কথা বলে কম। এতদিনেও শেফালির মা ওর বাপের বাড়ির বৃত্তান্ত তেমন জানে না। তার নিজেরও কোনও বাড়তি কৌতুহল নেই। এমুন সুন্দর মাইয়া—কার্তিকের মতো রুক্ষ, অভাবী, বয়স্ক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন লোকের সঙ্গে তার বিবাহ হয়েছে। শেফালির মা জানে, এর আড়ালে দুঃখের ইতিহাস। তার নিজের জীবনের অশেষ সংগ্রাম ও দুঃখের পর আরও-আরও দুঃখের বৃত্তান্ত শুনতে তার ইচ্ছে করে না। দুঃখের প্রতি তার আর কোনও কৌতুহল নেই। রাধিকার জন্য শুধু মায়া হয়। কে জানে, তার শেফালিরও এমনই হয়েছে কিনা। সম্ভব হলে শেফালির মা তাকে সারা পৃথিবীতে খুঁজত। কোথায় আছে সে? যেখানেই থাক, ভাল থাকুক। কিন্তু কিন্তু কিন্তু… সন্দেহ এসে শেফালির মা’র হৃদয় ফালা ফালা করে দেয়। যদি কোনও আশ্রয় না জোটে তার! যদি সে ভাল না থাকে! যদি মরে যায়! না। আর ভাববে না। শেফালির মা হৃদয়ে গামছাবাঁধন দেয়। এ সব সে অনেক ভেবেছে। অনেক কেঁদেছে এজন্য। শেষে আর কান্নাও পেত না। কিন্তু রাধিকা আসার পর, রাধিকার কষ্ট দেখার পর শেফালিকে আবার নতুন করে মনে পড়ছে শেফালির মা’র! এমন নয় যে সে সব মেয়ের প্রতিই কন্যাসুলভ স্নেহ অনুভব করে। কিন্তু রাধিকা যেন কেমন করে স্নেহ ছুঁয়েছে! সে এক ভাল মেয়ে, আত্মসম্মানবোধের মেয়ে, কিন্তু কেমন স্বপ্ন-স্বপ্ন সে, আর দুঃখী, একা—শেফালির মা এই মেয়ের মুখের হাসি ভালবেসেছে। কপট গাম্ভীর্যে সে বলছে, এমুন হাসনের কী হইল?

রাধিকা সামান্য কাত হয়ে শেফালির মা’র গায়ে হাত রাখে। বলে, মাসি, এমুন আর কত জানো তুমি?

শেফালির মাও হাসে। বলে, জানি, জানি। দ্যাশে-ঘরে এমুন হগ্গলৈ জানত।

রাধিকা বলে, হ। আমিও তো দ্যাশে আসিলাম। আমি তো একখানও কৈতে পারি না। কাকি কৈত—হাক করে না রাউয়ার ডরে/ হগ্গল রাউয়ায় বেইরা ধরে। এমুন সব কইত। অখন আর মনে নাই। আর কয়খান কও না!

—হ। কই। আর তুমি হাইসা প্যাটে ব্যাদ্‌না তুলো!

—কও, কও! হাসুম না। কও মাসি।

—আইচ্ছা! এমুন হইলে হইব না। অবস্থা বুইজ্যা কওন লাগব। আইচ্ছা—এইডা কই—

খাইয়া দাইয়া পান্তা ভাত।
গল্প করে দই।
মাইট্টা হুক্কায় তামুক খায়
গুড়গুড়িটা কই!

ফের হাসে রাধিকা। হাসির দমকে শরীর দুলে ওঠে। শেফালির মাও ওই হাসিতে সংক্রামিত হয়। তার মধ্যে শোলোক বলার উৎসাহ জেগে ওঠে। সে বলে—আর একখান কই—

গেরস্ত পায় না ঘোলের পানি
চাকরে কয় ক্ষীর দাওখানি

রাধিকার চোখে এইসব ছবি জীবন্ত হয়ে যায়। যেন-বা কেউ লুকিয়ে, দোর দিয়ে পান্তাভাত খেয়েছে, সঙ্গে একখানি পেঁয়াজপোড়া ছিল কি ছিল না! তারপর জমিয়ে বসেছে আড্ডা দিতে। সাতকাহন করে বলছে—আইজ দইখান যা অসিল না—এক্কেরে মাখনের লাখান। খাইয়া প্যাড্ডা আইডাই করে। দাও গো। তামুক আসেনি? দুই টান মাইরা যাই।

তার ঘরে বুঝি তামাক নেই। তাই এই ছলাকলার চাল। রাজা-উজির মারা। যে শুনছে তার মুখ ব্যাজার। গামছা দিয়ে মুখ পিঠ গলা মুছে সে মাটির হুঁকোয় আগুন আনল। সেও আজ পান্তা খেয়েছে দুপুরে। তাই চুপ করে আছে। দুঃখে আছে। দরিদ্রের মধ্যে সে বুঝি দরিদ্রতম। প্রথমজনের রাজা-উজির মারার উৎসাহে পাখা লেগেছে তখন। মাটির হুঁকোয় চারখানি সুখটান দিয়ে সে বলছে—তা তামুক দিলা আর গুড়গুড়িটা দিলা না?

রাধিকা হাসছে আর দু’হাতে পেট চেপে ধরেছে। শেফালির মা বলেছে, আর কমু?

—না, না। কইয়ো না। অ মাসি! প্যাটে খিল ধরছে আমার।

রাধিকার মুখে হাসি মিলিয়ে গিয়ে বিবর্ণতা এসেছে। হাসির দমকে পেটে খিল ধরে গেছে তার। ভিতরকার সমস্ত পেশি দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। শেফালির মা তার পা টান করে দিচ্ছে। তাকে চিত করে শুইয়ে তার পেটে মালিশ করে দিচ্ছে। আস্তে আস্তে জড়ানো, পাক খাওয়া তন্তুগুলি শিথিল হতে থাকছে। আস্তে আস্তে সহজ বোধ করছে রাধিকা। স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে এলিয়ে পড়ছে। এই ক্ষণিক পেশি-সংঘর্ষে ক্লান্ত বোধ করছে সে। হঠাৎই, সে জানে না কেন, তার চোখে জল আসছে। হয়তো-বা যন্ত্রণায়, হয়তো-বা শেফালির মার প্রতি পরম কৃতজ্ঞতায়, অথবা কার্তিক নামে লোকটার অসম্ভব অবহেলায়। হঠাৎই অসহায় লাগছে রাধিকার। তার আকাশ নেই। তার মাটি নেই। শূন্য শূন্য শূন্য। ভাসছে সে। ভেসে যাচ্ছে। কোথাও কোনও শাখাপ্রশাখা নেই যে! সারা পৃথিবী জুড়ে ন্যাড়ামুণ্ডি গাছের কঙ্কাল। কোথায় বসবে সে? জিরোবে কোথায়? কার কাছে একটু আশ্রয় চাইবে? সে পলাশের গায়ে হাত রাখে। শেফালির মা’র নির্দেশ না মেনে অপরাধ করেছে, এমনই মনে হয়। অপরাধবোধে ভারী হয়ে যায় মন। ভাল-মন্দ যা-কিছু এ মানুষটাই দেখে। সন্তানসম্ভবা নারীর পালনীয় বিধিগুলি কতবার বলেছে সে! চুল খুলে চৌকাঠ পেরিয়ো না। কুবাতাসে শরীর নষ্ট হবে। সন্তান কানা-খোঁড়া হতে পারে তাতে। পেটের মধ্যেই মরেও যেতে পারে। দেখো, এই মহাশূন্যে দুষ্ট আত্মারা ঘুরে বেড়ায়। ডাকিনী-যোগিনী নাচে। ভূত-পেত্নি-দত্যি-দানোয়, পিশাচে-পিশাচিনীতে বায়ুমণ্ডল ঠাসাঠাসি। ঘরের পেছনে ওই যে পুকুর, ওখানে শয়তানী আছে। মাছের বাচ্চা আর ডিমলো মাগুরের পেট খেয়ে খেয়ে লালচ বেড়েছে তার। ডিমলো ইলিশ আমাদের কেমন প্রিয় বলো! ডিমলো ট্যাংরা দেখলে তোমার জিভে জল আসবে কি না বলো! আমরা মাইনষের ছাওয়াল, আমাদেরই যদি ওই দশা হয় তো ভূত পেত্নির দশা কী হয় ভাবো। পোয়াতি মেয়ে দেখলেই তাদেরও জিভ লক লক করবেই। তাদের নরম-সরম রক্তমাংস চিবিয়ে খাওয়ার জন্য, তাদের বুকের দুধ শুষে খাওয়ার জন্য তারা উঁকি-ঝুঁকি মেরে সুযোগের সুলুক-সন্ধান করবেই। সব নোংরা স্থানে, অজায়গায়-কুজায়গায় তাদের আসা-যাওয়া। তাই, যখন তুমি বাহ্যি যাবে, আঁচল দিয়ে আঁট করে, শক্ত করে তোমার দুধগুলি বেঁধে রাখবে। যাতে ওরা কোনও ফাঁক-ফোকর দিয়ে, ছিদ্র দিয়ে ঢুকতে না পারে। হ্যাঁ, ভিক্ষা দিয়ো না কারওকে। ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে শয়তান আসার কাহিনী তো যুগে যুগেই রচিত হয়েছে।

শুনতে থাকে রাধিকা। মায়ের পাশে পলাশ নিশ্চিন্তে ঘুমোয়। শেফালির মা’র দুই চোখে কথা বলে চলার ঢুলুনি নামে। আপনমনে মাতৃত্বের বৃত্তান্ত কইতে কইতে তার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। কথা জড়িয়ে গেল। কী যে বলছে বোঝা যাচ্ছে না। সে বুঝি একই লাইন বারবার বলছে। রাধিকার কানে কিছু পৌঁছচ্ছে না। তার ঘুম চটে গেছে। সে ভাবছে, কার্তিক কতদিন হল আসছে না। কী করবে সে? চেয়ে-চিন্তে কতদিন চালাবে? কার্তিক কেন ওই রকম হল না? ওই রকম? পরমেশের মতো, বা শমসেরের মতো? কার মতো চাইবে—পরমেশ না শমসের—স্থির করতে পারে না রাধিকা। চোখ বন্ধ করে বোঝার চেষ্টা করে সে। কার্তিক কার মতো হলে ভাল লাগত তার? লাল নীল হলুদ আলো, অন্ধকার গহ্বর, জলন্ত অগ্নিপিণ্ড, পাথর, নদী, মাটি—সব পেরিয়ে তার চোখের সামনে নেমে আসে একখানি শান্ত গ্রাম। বর্ষার ভরন্ত গ্রাম। আর সেই গ্রামেরই মতো শ্যামল, সজল, সবল, শান্ত মুখ একজনের। এ বার রাধিকা সুস্থির হয়। ফের ভাবে, কার্তিক কেন তার মতো হল না? কার মতো রে, কার মতো? শমসের-শমসের-শমসেরের মতো!

আখতারুজ্জামানের ইচ্ছে ছিল ডানাকাটা পরি বউ আনবেন ছেলের জন্য। কিন্তু সেটি সম্ভব করার আগেই তাঁর ইন্তেকাল হয়ে যায়। এটা সত্যি যে ভালমানুষদের আল্লা তাড়াতাড়িই ডেকে নেন, আর আখতারুজ্জামান যে অতি সহৃদয়, বিচক্ষণ ও শুদ্ধচিত্ত ছিলেন তা তাঁর শত্রুরাও স্বীকার করবে।

এ প্রশ্ন উঠতেই পারে যে আখতারুজ্জামানের মতো মানুষের শত্রু থাকবেই বা কেন, আর যা যা কিছু তাঁর মিত্রপক্ষের স্বীকার করার কথা—সে-ভার তাঁরা নেবেনই-বা কেন! এক্ষেত্রে, বলা যেতে পারে যে নিঃশত্রু লোক কেমন করেই-বা থাকা সম্ভব যেখানে এই পৃথিবীতে ঈর্ষা বিরাজমান!

আখতারুজ্জামান ছিলেন সফল ব্যবসায়ী ও সুনাগরিক। বলা যেতে পারে, তাঁর আব্বাজান বা তাঁরও আব্বাজানের সাধারণ ব্যবসাকে আখতারুজ্জামানই বৃহৎ ও ঈর্ষণীয় করেছেন যা তাঁর বড়ভাই এবং ছোটভাই সমেত গোটা পরিবারের ভরণ-পোষণ, আভিজাত্য ও ভবিষ্যৎ বজায় রাখছে।

বড়ভাই বেঁচে নেই দীর্ঘদিন, আর সেই শোকে বড়ভাবিও অল্প বয়সে গত। কিন্তু তাঁদের ছেলে-পুলেরা আছে, যাদের ভার আখতারুজ্জামান গ্রহণ করেছিলেন এবং প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রত্যেককেই। ব্যবসার কাজে তারা সকলেই নিবেদিত এবং দুই চাচা আখতারুজ্জামান ও মনিরুলে অনুগত—ব্যতিক্রম আনিসুজ্জামান। আনিসুজ্জামানের ব্যবসায়ে আনুগত্য বা আকর্ষণ নেই, মনিরুলেও না। পিতাকে তিনি খুবই ভালবাসতেন কিন্তু বিদ্রোহও করতেন। নানা পারিবারিক আচরণ ও ধর্মীয় নিয়ম অনুসরণে তাঁর আপত্তি ছিল। মসজিদে যাওয়া, ধর্মের বাণী শ্রবণ করা ও পাঁচ ওয়ক্ত নমাজ পড়ার কোনও নিয়মই তিনি মানতেন না। মনিরুলের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন একটি পারিবারিক পাপ যা সহ্য করলেও পাতকী হতে হয়, আর আখতারুজ্জামানের ছিল ধৈর্যের শরীর যা দিয়ে তিনি মৃত্যুর দিন পর্যন্ত ছেলেকে এতটুকু জোর না করে তার স্বতঃস্ফূর্ত উপলব্ধির জন্য প্রতীক্ষা করেছেন।

আখতারুজ্জামান নিজে ধর্মাচরণে কোনও ফাঁক রাখেননি। এবং ছেলের প্রতি তাঁর স্নেহ এত গভীর ছিল যে স্ত্রী গত হলেও তিনি আর নিকাহ্‌ করেননি এই ভেবে যে, ছেলের স্নেহপ্রাপ্তিতে কিছু ঘাটতি তা হলে দেখা দিতে পারে।

আনিসুজ্জামান তাঁর শৈশব থেকেই ঘোর পড়ুয়া এবং একা একা কোণবন্দি থাকায় তাঁর উৎসাহ। খেলাধূলায় তাঁর টান তেমন ছিল না, যেমন ছিল বইয়ের পর বই শেষ করার নেশা। কী ধরনের পড়াশুনো করলে তাঁর ভবিষ্য সুগম হতে পারে তা নিয়ে যেমন আনিসুজ্জামান নিজেও ভাবিত ছিলেন না তেমন চিন্তিত ছিলেন না আখতারুজ্জামান বা মনিরুল। আনিসুজ্জামান নিজের খেয়ালে পড়েছেন, ভাল ফল করেছেন এবং নিজেই আবিষ্কার করেছেন যে সাহিত্যেই তাঁর গতি। এ ক্ষেত্রে মনিরুলের কাছে উর্দু বা ইংরাজি ভাষা নিয়ে পড়াই বাঞ্ছনীয় ছিল সত্ত্বেও আনিসুজ্জামান বাংলা ভাষাই বেছে নিলেন এবং এম এ পাস করে শেয়ালদার আদর্শ বোধ বিদ্যালয়ে পড়াতে শুরু করলেন যখন তখনও আখতারুজ্জামান সুস্থভাবে বর্তমান এবং ডানাকাটা পরিতে সন্ধান করেন। কিন্তু আনিসুজ্জামান—গৃহে যাঁকে সম্বোধন করা হয় মেঠা বলে—নিশ্চিত বিবাহবিমুখ। পৃথিবীর সমস্ত ডানাকাটা পরিকে তিনি বিদায় জানিয়ে বসে আছেন এ জন্য যে ছোটবেলাতেই তাঁর পায়ে যে-শ্বেতচিহ্নটি জন্ম নিয়েছিল, তা ক্রমে বিস্তৃত হচ্ছে এবং তিনি কলেজে ক্লাস করতে করতেই টের পেয়েছেন যে গোঁফদাড়ির নীচে, ঠোঁট এবং ঠোঁটের তলাকার অল্প ভাঁজে শ্বেত রং লাগছে। এখন তা চোখের তলায় ছড়িয়েছে, কানেও, যা তাঁকে স্পষ্টত চিহ্নিত করে শ্বেতরোগী হিসেবে।

চিকিৎসা হয়নি তা নয় কিন্তু ফল পাওয়া যায়নি আর এই মাথুরের গড়ে স্থিতি হওয়ার আগেই, সে আজ প্রায় দশ বছরের কথা, আনিসুজ্জামান তাঁর জ্যেঠতুতো ভাইয়ের স্ত্রীদের আচরণে ঘৃণা দেখেছেন এবং পরিবারের সমস্ত দেবদূতের ন্যায় শিশুদের চুম্বন করা বা কোলের কাছে নেবার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বাচ্চারা তাঁর কাছে এলেই মায়েরা তাদের ডেকে পাঠায় বা টেনে নিয়ে যায় ছল-ছুতোয়, মারধরও করেছে। এবং মেঠা কখনও তাদের বোঝাবার চেষ্টা করেননি যে শ্বেতরোগ তেমন করে ছোঁয়াচে নয় মোটেই।

অতএব শ্বেতবর্ণ যত প্রকট হতে থাকল, তত আনিসুজ্জামান একা হতে লাগলেন এবং তাঁর ধর্মাচরণে বীতস্পৃহা তাঁকে ঠেলে দিল সকলের থেকে দূরে, আরও দূরে এবং আব্বাজান— দয়ালু, বিচক্ষণ, ধর্মপরায়ণ—আখতারুজ্জামানের মৃত্যুতে তিনি হয়ে পড়লেন বিচ্ছিন্ন, অস্পৃশ্য, অনাকাঙ্ক্ষিত ও একাকী, যা তাঁকে এই রিপন স্ট্রিটের বাড়ি থেকে বেরিয়ে অন্য কোথাও থাকবার সিদ্ধান্তকে প্ররোচিত করতে লাগল। যারা আপন বলে চিহ্নিত হয়ে থাকে তাদের মাঝখানে থাকার পরও যে-একাকিত্ব তাকে সহ্য করা মুশকিল। কারণ মনের মধ্যে সারাক্ষণ এই প্রত্যাশার স্ফুরণ হতে থাকে যে প্রিয়জনদের দ্বারা এই একাকিত্ব দূর হওয়ার কথা ছিল। প্রত্যাশার পূর্তি হয় না। তাই ক্ষোভ জাত হয়। ক্ষোভের জন্ম দ্রুত দূরে ঠেলে দিতে থাকে অন্যদের। এর চেয়ে বরং ভাল স্বেচ্ছায় দূরে চলে যাওয়া। আনিসুজ্জামানের পক্ষে অন্যকে দোষারোপ করা এমনই যন্ত্রণার যে তার চেয়ে স্বেচ্ছা নির্বাসন তাঁর পক্ষে উপশম হয়ে ওঠে।

আখতারুজ্জামানের মৃত্যুর দিনকয়েক পরেই তাঁর এই বি পি সি কলেজের চাকরিটা হয়ে যায় এবং অধ্যাপক দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের সাহায্যে তিনি মাথুরের গড়ে থাকবার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়ে ওঠেন। মাথুরের গড় থেকে এই কলেজের দূরত্ব অতি সুবিধেজনক এবং রিপন স্ট্রিটের বাড়ি ছাড়ার পক্ষে তা অতি জোরালো যুক্তি। অতএব আত্মীয়দের থেকে দূরে গিয়ে একাকী জীবন কাটিয়ে দেবার সর্বাঙ্গীণ প্রস্তুতি নিলেন যখন আনিসুজ্জামান তখন নীলোফা এসে তাঁর দরজায় দাঁড়িয়েছিল।

আখতারুজ্জামানের কথা মনে করে আনিসুজ্জামানের অবাক লাগে যে অত বড় ব্যবসা চালিয়ে, অত বড় পরিবার সামলে এবং যেখানে তাঁর স্ত্রী ছিল না যে শান্তি দেবে বরং ছিলেন গোঁড়া মনিরুল যিনি প্রতি পদক্ষেপে দাদার ঔদার্যের প্রতি কটাক্ষ করতেন এবং তিনি যদি পরিবারের মাথা হতেন তবে কী কী হত বা হত না তা প্রকাশ্যে ঘোষণা করতেন, তখন এতটুকু বিরক্ত না হয়ে, ধৈর্য না হারিয়ে নিজের সিদ্ধান্তে ও বক্তব্যে স্থির থাকতেন আখতারুজ্জামান। প্রকৃত ধর্মপ্রাণ বলতে তাঁকেই বোঝায় কারণ জীবনের কোনও পর্বে, সুখে বা দুঃখে, আনন্দে বা বেদনায় তিনি খোদাকে স্মরণ করতে ভোলেননি। বরং আল্লার ইচ্ছায়ই সমস্ত চলছে এমনই মত তিনি প্রকাশ করেছেন বারবার এবং অন্য যে-কোনও ধর্মমতের ওপর গভীর শ্রদ্ধা রেখেছেন। তাঁর হৃদয়ে ছিল আশ্চর্য ধৈর্য আর ক্ষমা।

আনিসুজ্জামান প্রশ্ন করেছিলেন, আব্বাজান, শুনলাম নাজনীন আর স্কুলে যাবে না!

আখতারুজ্জামান কোনও উত্তর করেননি। তাঁর গোঁফ-দাড়ির আড়ালে একজন চিন্তাগ্রস্ত বিপন্ন মানুষের মুখ ফুটে উঠেছিল। সেই মুহূর্তে আনিসুজ্জামানের চোখে তা ধরা পড়েনি। কিন্তু আব্বাজানের ওই মুখ, আশ্চর্যভাবে আজও ধরা আছে স্মৃতিতে, তার স্মরণক্ষণে উঠে আসে বিপন্নতাও। মস্তিষ্ক, আপনাআপনি, মানুষের সজ্ঞান ইচ্ছার অগোচরে অনেক কাজ সম্পন্ন করে রাখে। যেন-বা, একজন মানুষের মধ্যে বসে আছে অন্য এক মানুষ, যে প্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ, বোধ, উপলব্ধি গ্রহণ করছে, সংঘটিত করছে। নিজের মধ্যে এক অন্যতম আপনজন, যে সতর্ক, বুদ্ধিমান ও বলশালী।

পরে যতবারই সে-দিনের কথা ভেবেছেন, অনেকবারই তাঁকে ভাবতে হয়েছিল, কারণ, বলা যেতে পারে, ওইদিনই রিপন স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে আসার বীজ রোপিত হয়েছিল হয়তো, আর সেইসব পথ ধরে ওই ভাবনায় তিনি দেখেছেন, আখতারুজ্জামানের সৌম্যমুখ উধাও এক বিপন্নতা। এক ক্লিষ্ট মুখ। কেন ওরকম হয়েছিল? আব্বাজান কি মনে মনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন? তার নানা রকম ব্যাখ্যা হতে পারে। কিন্তু আনিসুজ্জামান জানেন, সব ব্যাখ্যাই হবে তাঁর একান্ত নিজস্ব ধ্যানধারণার উৎসার যা প্রকৃত সত্যের অনুষঙ্গে নাও যেতে পারে।

আখতারুজ্জামান চুপ করে ছিলেন কিন্তু মনিরুল ভ্রূ কুঁচকে বলেছিলেন, হ্যাঁ। তাতে তোমার কী?

আনিসুজ্জামান, যা কি না প্রায় বিরল ঘটনা যে তিনি চাচার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেছেন, তেমনটাই ঘটিয়ে, মনিরুলের চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ও পড়াশুনোয় খুবই ভাল। আমি জানি কারণ আমি ওকে পড়িয়েছি। ওর স্কুল বন্ধ করে দেবার কী মানে হয়!

আখতারুজ্জামান বলেছিলেন, ওর এগারো হল। তুমি জানো এ পরিবারে দশের পর মেয়েরা বাইরে যায় না। এটাই এ পরিবারের দস্তুর।

আনিসুজ্জামান অবুঝের মতো বলেছিলেন, কীসের দস্তুর? কেন দস্তুর? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু বদলায়। আমাদের পারিবারিক নিয়মও কেন বদলাবে না? কেন ওদের এভাবে আটকে দেওয়া হয়?

মনিরুল বলেছিলেন, দেওয়া হয় কারণ মেয়েদের একটা আবরু ও নিরাপত্তার ব্যাপার আছে। নীতি-নৈতিকতার ব্যাপার আছে। প্রথম থেকে ওদের তা না শেখালে, সংযম না শেখালে, সংসার উজাড় হয়ে যায়।

আনিসুজ্জামান টের পাচ্ছিলেন, তাঁর দুটি মুঠি শক্ত হচ্ছে। তিনি ক্রোধী হচ্ছেন। তবু কণ্ঠ সংযত করে বলেছিলেন, মেয়েরা মেয়েদের স্কুলে পড়তে পারে। এখানে অনেক মেয়েদের স্কুল আছে। আমাদের ফুফুর মেয়েরাও ওখানে পড়ে।

মনিরুল গর্জে উঠেছিলেন, চুপ করো। বোকার মতো কথা বোলো না। ফুফুরা তাঁদের পরিবারের নিয়মে চলেন। আমরা আমাদের নিয়মে চলি।

তর্কের শব্দে সব জানালায় শিশুরা আর মেয়েরা কান পেতেছিল। এ শব্দে সকলেই উত্তেজিত হয়েছে। বিষয়বস্তুটি সম্পর্কে প্রত্যেকেই মনে মনে নিজস্ব মতামত পোষণ করে। শিশুদের মধ্যে পুরুষ যারা, তারা ক্রমশ আসরের কাছাকাছি এসে আসরটিকে ঘিরে বসছে, সম্ভবত নিজেদের ভবিষ্যৎ অবস্থান তারা পছন্দ করে নিচ্ছে মনে মনে। প্রত্যেকের মাথায় জরিদার টুপি ও গায়ে ঝকঝকে পোশাক। তাদের কেউ বলে দেয়নি, হ্যাঁ, তোমরা ওই আসরে যেতে পারো। কিন্তু তারা বুঝে গেছে। আরও অনেক কিছুরই মতো তারা জেনে ফেলেছে যে যা-কিছুর প্রতি এগিয়ে যাবার অধিকার তাদের আছে। অন্য দিকে মেয়েরা মায়ের, চাচির, ভাবির কোল ঘেঁষে অন্তরালে দাঁড়িয়ে। তাদেরও কেউ বলেনি—না, ওখানে যেয়ো না—তবু তারাও জেনে গেছে, ওখানে যেতে নেই। আর নাজনীন দাঁতে ঠোঁট কামড়ে আছে। ইস্কুল তার খুব পছন্দ ছিল। আর যেতে পারবে না শুনে কষ্ট হচ্ছে। এই কষ্ট সে মেঠা ভাইজানের কাছে প্রকাশ করেছিল। এখন তার লজ্জা করছে। ইস্‌—ভাইজান কেন এ সব নিয়ে ঝগড়া করতে গেলেন!

আনিসুজ্জামান বলেছিলেন, ফুফুর মেয়েরা যদি বড় হয়েও স্কুলে যেতে পারে, আর তাতে যদি তাদের আবরু, নিরাপত্তা, নীতি-নৈতিকতা নষ্ট না হয়, তবে আমাদের বাড়ির মেয়েদেরই-বা হবে কেন?

মনিরুল বলেছিলেন, তুমি অনেক কথা বলেছ। আর একটি কথাও না বলে চলে যাও। পরিবারের কর্তা হিসেবে আমরা এখনও বেঁচে আছি। সমস্ত নিয়ম-কানুন আমাদের মতেই চলবে। ভাইজান, আপনাকে বলেছিলাম ওকে কলেজে-ইউনিভার্সিটিতে পাঠাবার দরকার নেই। জোর করে ব্যবসায় ঢুকিয়ে দিন! আপনি শোনেননি। দেখুন, ওর অধঃপতন দেখুন। আধুনিকতার হাওয়া লেগেছে ওর গায়ে। চরম কিছু ও করে বসবে এবার। আমার সন্দেহ হয়, বাইরে হিন্দুদের সঙ্গে ও অখাদ্য খায় কি না। চোখের সামনে হিন্দুর মেয়েগুলোকে নেচে বেড়াতে দেখে ওর বিকার হয়েছে…

আখতারুজ্জামান দু’হাতে কান চাপা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, থামো, থামো তোমরা। মেঠা। নাজনীন আর ইস্কুলে যাবে না। তবে সে যদি পড়তে চায়, ঘরেও পড়তে পারে। তুমিও ওকে পড়াতে পারো। বাইরে গিয়ে একবার পরীক্ষা দিয়ে আসুক না হয়। এমনকী নীলোফাও এটা করতে পারে কারণ ওর পড়ার আগ্রহ আছে। তবে, এ বাড়ির মেয়েরা কখনও পড়াশুনোয় কোনও আগ্রহ দেখায়নি। তাই নিয়মটাও বদলানো হয়নি। পারিবারিক স্থিতি, কল্যাণ ও শৃঙ্খলার জন্যই নিয়ম তৈরি হয়। কিন্তু এমন নয় যে তা বদলাবে না বা শিথিল হবে না। বরং দরকারমতো নিয়ম-কানুন একটু বদলে নিলেই কাজে লাগে ভাল। নিয়মের জন্য তো মানুষ নয়, মানুষের জন্য নিয়ম। পড়াশুনা যত দূর সম্ভব প্রত্যেকের করা উচিত। এ বাড়ির মেয়েরাও তার ব্যতিক্রম নয়। যদি কেউ সত্যি সত্যি সে বিষয়ে আগ্রহী হয় তবে কোনও রাস্তা আমাদের ভাবতে হবে।

মনিরুল বলেছিলেন, এ সব আপনি কী বলছেন ভাইজান? আপনি কি অন্ধ হয়ে গেলেন? পারিবারিক প্রথা বলে কিছু থাকবে না? মেয়েরা পড়াশুনো শিখে করবেই বা কী! সেই তো বাচ্চা পয়দা করবে আর বিরিয়ানি রাঁধবে!

আখতারুজ্জামান ঠাণ্ডাভাবে বলেছিলেন, কিন্তু কারও সদিচ্ছায় আমরা বাধা দিতে পারি না। নাজনীন পড়ায় আগ্রহ প্রকাশ করলে তা সে করুক।

মনিরুল চরম আঘাত হেনেছিলেন। বলেছিলেন, কিন্তু নাজনীনকে পড়াবার ভার আমি মেঠার ওপর দিতে পারি না।

—কেন?

—আমি ওকে বিশ্বাস করি না। যে ধর্ম মানে না তার ওপর আমার বিশ্বাস নেই।

আনিসুজ্জামানের কান ঝাঁ ঝাঁ করেছিল। দু’ হাঁটুতে মুখ রেখে তিনি ধ্বস্ত অস্তিত্ব সামাল দেবার চেষ্টা করছিলেন। আখতারুজ্জামান নীরবে উঠে পড়েছিলেন। শিশুরাও পালিয়ে গিয়েছিল। আর নাজনীন কোন অন্ধকারে মুখ লুকিয়েছিল কেউ জানে না। তখন আমিনা আনিসুজ্জামানের কাছে এসেছিলেন। মনিরুলের প্রথম স্ত্রী আমিনা। মুর্শিদাবাদের মেয়ে। খুবই দাপুটে। কিন্তু স্নেহপ্রবণ। অন্দরের হাল তিনিই শক্ত করে ধরে আছেন। তাঁর বয়স হয়েছে। বছর বছর তিনি অতি পৃথুলা হয়েছেন। ভারী শরীর নিয়ে হাঁসফাঁস করে তাঁকে চলতে হয়। নিতান্ত বাইরের লোক না থাকলে তিনি বোরখা পরেন না। আনিসুজ্জামানের কাছে তিনিই মাতৃস্থানীয় এবং নির্ভরস্থল। আনিসুজ্জামান, তাঁর স্নেহকণ্ঠ শুনতে পান, বাপজান, তোমার জন্য আজ কী রান্না করেছি বলো দেখি!

গলে গিয়েছিলেন আনিসুজ্জামান। ভিজে গিয়েছিলেন। তাঁর বিদীর্ণ পঞ্জরাস্থি থেকে ছিটকে বেরিয়েছিল আহত অপমানিত হৃদয়। কান্নার দমকে কেঁপে উঠেছিল পিঠ। আমিনা তাঁকে কোলের কাছে টেনে নিয়েছিলেন সেইমতো, যেন এ তাঁর মাতৃহারা শৈশব এবং এই নরম কোল অতীব প্রয়োজনীয়। আমিনার কাছে, পৃথিবীর সমস্ত মায়েরই মতো, কোনও সন্তানই বয়ঃপ্রাপ্ত নন। আর এমনই বাৎসল্যে তিনি নিজের বিপুল বুকে টেনে রাখেন আনিসুজ্জামানের মাথা এবং তাপিত মস্তক শান্ত করতে চান। মকবুলের ছোট ছেলে ইয়াসিন—এত বড়, মেজাজি, তার্কিক চাচুকে, ভেঙে পড়তে দেখে, প্রবল মজায় হাসে, হেসে গড়ায়—হি হি হি হি— চাচু ওঁয়া ওঁয়া…চাচু বাচ্চা বাচ্চা…। আমিনা তাকে ধমকাচ্ছেন, তাড়াচ্ছেন, আর ধীরে ধীরে আনিসুজ্জামানের মাথার চুল ঘাঁটতে ঘাঁটতে বলছেন—

মাতৃদত্ত শিক্ষাবীজ এতই অতুল
অন্য কোনও শিক্ষা নহে তার সমতুল
পট্টবস্ত্রে গুজাফল মূল্য নাহি হয়
ছিন্নবস্ত্রে মতির মূল্য কখনও না যায়

তোকে কি আমি কখনও বলেছি মেঠা, তোকে বিশ্বাস করি না?

—না চাচি।

—কখনও কি বলেছি তোকে, পড়িস না ইস্কুলে, কলেজে?

—না, চাচি।

—তুই যখন পাস করে আসতিস আর আমাকে জড়িয়ে জড়িয়ে বলতিস এইবার নাইনে উঠলাম চাচি…এইবার ইলেভেন…আমি কি খুশি হইনি? আর আদর করিনি তোকে?

—হ্যাঁ চাচি।

—তা হলে? তা হলে? এত দুঃখ কেন পাস বাপ আমার। ওরা বোঝে না। কিছু বোঝে না। যে-দিন বুঝবে সে-বড় কল্যাণের দিন। তুই কাদিস কেন মিছিমিছি? তোর জ্ঞান হয়েছে। বুদ্ধি হয়েছে। যা ভাল বুঝেছ, বলেছ। তবে কথা কী, সব কথা সবখানে বলতে যেয়ো না। তোমাকে বুঝতে হবে, কোথায় কী কথা চলে। পাহাড় অটল। তাকে টলাবে তোমার সাধ্য কী? তাই পাহাড় ঠেলে কেন মিছে শক্তিক্ষয় করছ? বরং পথ দেখো। পথ খোঁজো। কী করে ওই বিশাল পাহাড় টপকে যাওয়া যায়। মাইয়ামাইনষেরে পায়ের তলায় না রাখলে, বন্ধ না করলে ওদের প্রভুত্ব কার ওপর জারি থাকবে! সবাই রাজত্ব চায়। দেশ না হোক, শহর না হোক, গ্রাম না হোক—অন্তত নিজের ঘরে, নিজের পরিবারে!

আশ্চর্য লাগে। আজ ভাবতে খুবই আশ্চর্য লাগে আনিসুজ্জামানের। ওই স্বচ্ছ সুন্দর মানসিকতা কোথায় পেয়েছিলেন আমিনা? স্কুলে যাননি, বাড়িতে বিদ্যাভ্যাস করেননি, আধুনিকদের বক্তৃতা শোনার ইচ্ছেও তাঁর ছিল না। কিংবা, ইচ্ছে থাকলেও, কোনও সুযোগই আসেনি জীবনে। তা হলে কে-ই বা তাঁকে এমন শেখাল! জীবন—জীবন। জীবনের চেয়ে বড় গুরু আর কে হতে পারে! এ সবেরই নাম স্বশিক্ষা। এ সবেরই নাম জীবনদর্শন। প্রতিদিনের সুখ-দুঃখ সংঘর্ষ থেকে জন্ম নেওয়া আশ্চর্য উপলব্ধির অধ্যায়।

নাজনীনের মতো বড় হওয়ার অনেক আগেই বোরখার আড়ালে যেতে হয়েছিল নীলোফাকে। নির্ধারিত আড়াল বা অন্ধকারের চেয়েও বেশি আড়াল ও অতিরিক্ত অন্ধকার জারি ছিল তার জন্য। শৈশবের গন্ধ মুছতে না-মুছতেই তারা সবাই ছিল দূরে চলে যাওয়া, দিগন্তের আবছা বৃক্ষসারির মতো। গতিবিধি দেখে কখনও বোঝা যেত না ও নীলোফা, ও তহমিনা, ও নাজনীন। আনিসুজ্জামান নজরও দেননি তেমন। সে-দিন, মনিরুলের কথার পর অন্দরের সঙ্গে তাঁর সামান্য যোগাযোগও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। দক্ষিণের যে-ঘরে তিনি পড়াশুনো করতেন, সে-ঘরই তার সম্পূর্ণ জগৎ ছিল। যার খবর খুব কমই যেত বাইরে।

আজ আনিসুজ্জামান স্বীকার করেন যে মনিরুলের রাগ হওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। তাঁর বেশির ভাগ হিন্দু বন্ধুবান্ধব এবং তাঁদের বাড়িতেও যাওয়া-আসাকালে কোনও দিন বাধা অনুভব করেননি আনিসুজ্জামান। তিনিও অন্য ছাত্রদের মতোই অধ্যাপকদের পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছেন। আজ, যখন ছাত্ররা তাঁর পা ছোঁয়, প্রণামে নমিত হয়, তখনও মনের মধ্যে কোনও বাধা অনুভব করেন না তিনি। কিন্তু এটুকুই সব নয়। ছাত্রাবস্থায় দৃষ্টি আলোকরেখার মতো। প্রেম শ্রদ্ধা ভালবাসার কোনও জাত-মান থাকে না তখন। কিন্তু সে-দৃষ্টি বদলায়। জট পাকায়। শক্ত ফাঁদের মতো জড়িয়ে ফেলে মানুষের অন্তরাত্মা। মনিরুল তার শিকার। চারপাশের বেশির ভাগ মানুষই তার শিকার। এই মাথুরের গড়ে এসে আনিসুজ্জামান তা দেখেছেন। মনিরুলের মতোই বিপরীত স্পর্শকাতরতা এখানে ছড়ানো। কিন্তু এ নিয়ে তাঁর নিজের কোনও বিদ্বেষ বা অভিযোগ নেই। তিনি নিজেকে নিরপেক্ষ দেখার চেষ্টা করেন। নির্বিকারভাবে তিনি দেখে যান এই দুনিয়ার আশ্চর্য খেলা। যেন তিনি পৃথিবীতে এসেছেন এই বিস্ময়কর মানুষ দেখার জন্যই। অতএব তিনি পর্যবেক্ষণ করে যান, মানুষ মানুষকে ছোট করছে, অপমান করছে, ঈশ্বরের নামে হানাহানি করছে পরস্পর। আনিসুজ্জামান নিজে কোরান পড়েছেন, গীতা পড়েছেন, বাইবেল পড়েছেন। বুদ্ধ বা মহাবীর জৈন-এর বাণীগুলি সম্পর্কেও অবহিত আছেন তিনি। তাঁর মনে হয়েছে—মূলত সবই এক। আচরণীয় বিধি-নিষেধের কিছু পার্থক্য ছাড়া সব ধর্মই প্রেম দেবার কথা বলে। ঈর্ষা না করার কথা বলে। দয়া ও সংযম প্রদর্শনের কথা বলে। কিন্তু যে-সহনশীলতা ধর্মাচরণের মূল বিধেয় তাকে বিস্মৃত হয় মানুষ আর ধর্মকে অভিযুক্ত করে। দোষ ধর্মে নেই। দোষ মানুষে। মানুষ সত্যকে বিকৃত করে। বোধকে বিকৃত করে। বিকৃত ব্যাখ্যা দ্বারা কলুষিত করে উপদেশ এবং যথার্থ শিক্ষা না পাওয়া মানুষেরা ভুলভাবে পরিচালিত হয়। এর নাম অজ্ঞানতা। আনিসুজ্জামান, একজন সৎ ও শিক্ষিত নাগরিক হিসেবে, একজন অধ্যাপক ও ভারতপ্রেমী হিসেবে জানেন, উপলব্ধি করেন যে অজ্ঞানতাই এ দেশের বৃহত্তম অভিশাপ যা থেকে মুক্ত নয় এমনকী শিক্ষিত নাগরিকরাও। সতর্ক ও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ হিসেবে, আনিসুজ্জামান মনে মনে ক্ষমা জারি রাখেন সর্বক্ষণ। অজ্ঞানের প্রতি, অবুঝের প্রতি। অধৈর্যের প্রতি।

আজ বড় বেশি করে মনে পড়ছে সে-দিনের কথা যে-দিন রিপন স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন আনিসুজ্জামান। দিনের কর্মব্যস্ততা শুরু হয়ে গিয়েছিল তখন। তিনিও তাঁর বইয়ের সংগ্রহগুলি গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। একটি বোরখা পরা ছোট মূর্তি দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল। আনিসুজ্জামান মুখ তুলে বলেছিলেন—কে?

তাঁর হাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গল্পগুচ্ছ’ ধরা ছিল। ক্লাস নাইনে স্কুলে সেরা রেজাল্ট করে পাওয়া। সমস্ত বইপত্র গুছিয়ে নিতে নিতে তাঁর এই বাড়ি, এই ঘর, এই বই-জড়ানো অসংখ্য স্মৃতি মনে পড়ছিল। ছোটবড় কত কথা। গোটা বাড়িটাই যেন আব্বাজানের মতোই স্থির, গভীর, ক্ষমাশীল। আনিসুজ্জামান এ বাড়ির সমস্ত ইট চিনে ফেলেছিলেন। এ বাড়িতে কখন কোথায় ছায়া পড়ে, কখন বাইরের কোলাহল সবচেয়ে বেশি ঢুকে পড়ে ঘরের আনাচে-কানাচে, কোন জায়গায় দাঁড়ালে আজও আখতারুজ্জমানের চলাফেরা স্পষ্ট বোঝা যায়—তাঁর জানা হয়ে গিয়েছিল। নিজের ঘরে বসেই তিনি বলে দিতে পারতেন—কোনও পায়ের শব্দ মনিরুলের কি না, আমিনার কি না। এ বাড়ি ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে কত রাত্রে দেওয়ালে হাত বুলিয়েছেন তিনি। একা একা বলেছেন—আমি চলে যাচ্ছি। শুনতে পাচ্ছ? আমি চলে যাচ্ছি! আব্বা নেই। বড় চাচি অসুস্থ, চলে যাবেন যে-কোনও দিন। এ বাড়িতে আমাকে আর কেউ চায় না! ওরা ভুলে যাবে আমাকে। কিন্তু তোমরা ভুলো না।

কোথাও কোনও শব্দ হয়নি। কিন্তু আনিসুজ্জামানের স্থির বিশ্বাস, এইসব দেওয়াল, কড়িকাঠ, জানালা-দরজা যদি কথা বলতে পারত, তবে বলত—যেয়ো না, যেয়ো না, থাকো। যেমন আমিনা বলেছিলেন।

আব্বাজান চলে যাবার পর এমনও হয়েছে, পর পর সাতদিন, শুধু খাবার সময় ছাড়া পরিবারের আর কারও সঙ্গে তাঁর কোনও কথা হয়নি। সে-সময়ও যেন তাঁর উপস্থিতি অন্য সবাইকে জড় রেখেছে, আড়ষ্ট রেখেছে। হতে পারে তাঁর গাম্ভীর্য বা তার্কিক স্বভাব এর জন্য দায়ী। অথবা পরিবার সম্পর্কে তাঁর নিস্পৃহতা, ঔদাসীন্য কিংবা তাঁর বিবাহ না করার সিদ্ধান্ত, যা সকলে অন্যায় সাব্যস্ত করেছে।

আখতারুজ্জামানের মৃত্যুর পর, আনিসুজ্জামানের পিতৃ-মাতৃহীন হয়ে পড়ার কারণে বুঝি মনিরুল তাঁর সম্পর্কে কিছু দুর্বলতা বোধ করেছিলেন। কিংবা এই দুর্বলতা আসলে কোরানের বাণীর প্রতি আনুগত্য যেখানে এতীমকে অভিভাবকত্ব দেবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আনিসুজ্জামান যেহেতু কোনওদিন ধর্মাচরণে অনুরাগী নন, এবং হিন্দু-মানুষের প্রতি তাঁর টান বা ওঠা-বসায় আগ্রহ, সুতরাং তাঁকে শুরু থেকে এভাবেই সাব্যস্ত করা হয় যে তিনি নিজস্ব ভালমন্দ বোধহীন, অতএব বুদ্ধিহীন, অর্থাৎ তাঁর বয়স হলেও, জীবন সম্পর্কে স্বচ্ছ সুন্দর ধারণা থাকলেও, তাঁকে এতীম হিসেবে পরিগণিত করা হয় এবং মনিরুল, একজন ধার্মিক পুরুষ, আনিসুজ্জামানের দায়দায়িত্ব স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেন। অতএব মনিরুল অভিভাবক হয়ে থাকেন এবং আনিসুজ্জামানের নিজস্ব জীবনযাপন সম্পর্কেও মতামত দেবার অধিকার অর্জন করেন৷ বহুবার তাঁদের মধ্যে নানাবিধ বাক্যবিনিময় ও তর্ক উত্থাপিত হয় যার কবে কোনটি হয়েছিল, কোনটির পর কোনটি এসেছিল আজ আর আনিসুজ্জামান ধারাবাহিকভাবে মনে করতে পারেন না কিন্তু এটা তাঁর ঠিকই মনে আছে যে আখতারুজ্জামানের ইন্তেকাল হলে মনিরুল আরও ব্যক্তিত্বশালী হয়ে ওঠেন এবং ধর্মে আনুগত্য প্রদর্শন নিমিত্ত তাঁর ধর্মচর্চার বন্ধন আরও কড়া ও কঠিন হয়। ধর্ম সংক্রান্ত কোনও উপদেশ তিনি আনিসুজ্জামানকে দিতে আসেননি বটে কিন্তু কঠোর কর্তব্যবোধে একদিন বলেছিলেন—মেঠা, তোমার বয়স হল। আল্লার ইচ্ছায় ব্যবসা না করেও তুমি সংসার পালনে সক্ষম। ভাইজান বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই তোমার শাদি ইত্যাদি সম্পন্ন করতেন। আমি তাঁর অবর্তমানে, তাঁরই আন্তরিক ইচ্ছায় তোমার জন্য কয়েকটি পাত্রী খোঁজ করেছি। আমার এবং তোমার অন্যান্য ভাইদের ইচ্ছা তুমি পাত্রী নির্বাচনে সহায়তা করো।

আনিসুজ্জামান স্বাভাবিক বিনয় ও দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, চাচুজান, আব্বাজানের অবর্তমানে আপনিই আমার পিতৃসম। আপনি জানেন রোগগ্রস্ত হওয়ার কারণে আমি শাদি করে সংসার পালন করব না স্থির করেছি। আগে রোগ অল্প ছিল। পোশাকের আড়ালে ঢাকা থাকত। কিন্তু এখন ক্রমশ তা প্রকাশিত হচ্ছে। ক্রমশ এই প্রকাশ আমার সর্বাঙ্গে ছেয়ে যাবে। আমি এখনই যথেষ্ট কুৎসিত। ক্রমশ আমার চেহারায় আরও বিকৃতি আসবে। আমার স্ত্রী, যদি কেউ হয়— আমার সন্তানেরা, যদি কেউ জন্মায়— আমাকে স্পর্শ করতে ঘৃণা বোধ করবে। আমার তা সহ্য হবে না। তাদের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্কও গড়ে উঠবে না। অতএব, চাচু, এই রোগ সমেত, আমার পক্ষে কারওকে শাদি না করাই শ্রেয়।

মনিরুল খুবই ধৈর্যের সঙ্গে প্রতিটি কথা শুনেছিলেন এবং শান্তভাবে বলেছিলেন, এ সব বিষয়ে আমি ভেবেছি। পৃথিবীতে তুমি একা এ রোগের শিকার নও। এ রোগ তোমাকে এমন কিছু বিকৃতদর্শন বা কুৎসিত করেনি। করবেও না। বহু লোকেরই এই রোগ হয়ে থাকে এবং তৎসত্ত্বেও তাঁরা সংসার প্রতিপালন করেন। আমি কয়েকটি ভাল বংশের পাত্রী সন্ধান করেছি। আমাদের পরিবারে যেহেতু স্ববংশ বিবাহ চলে না সেহেতু ভাল মেয়ের জন্য বাইরে অনুসন্ধান না করে উপায় নেই। বংশ ভাল হলেও পরিবারগুলি দরিদ্র। তোমার রোগ থাকা সত্ত্বেও তাঁদের আগ্রহ কম নেই কারণ এই দরিদ্র অবস্থায় আমাদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন একপ্রকার বড় সহায়। যে তোমার স্ত্রী হবে সে আজীবন তোমার কাছে কৃতজ্ঞই থাকবে।

—এ প্রস্তাবে আমি রাজি হতে পারি না কারণ আমাদের পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য আসলে মেয়েটিকে বিক্রয় করা হবে। এবং আমিও, আমার রোগলজ্জার কারণে বিক্রীত হব এমন যেন আমাকে দয়া করা হল! বোঝা যাবে না কে কাকে দয়া করল এবং তা অতি জটিল অবস্থা। সবটাই ভ্রান্তি এবং সারাজীবন তার অপমানিত মন আমাকে তাড়া করবে। আমি তা ঠিকই টের পেয়ে যাব আর তাতে আমার সুখ-শান্তি বিঘ্নিত হবে। চাচুজান, প্রেমহীন সম্পর্কে আমি বিশ্বাস করি না। আর এরকম হিসেবের বিবাহে প্রেম কখনও জন্মাতে পারে না।

—তুমি আবার আমার মতের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিচ্ছ। আমি তা সমর্থন করছি না। তুমি কি কিছুতেই বুঝবে না মেঠা, চিরকৌমার্য আমি কোনওদিন মেনে নেব না।

—আমি কোনও ভুল সিদ্ধান্ত নিইনি। আপনার বিধান এ পরিবারে শিরোধার্য কিন্তু তা সাধারণ-স্বাভাবিক মানুষের জন্য। আমি রোগগ্রস্ত। কোনও সুস্থ মানুষকে সুখী করার ক্ষমতা আমার নেই। আপনারাই তো বলেন কারওকে কষ্ট দিয়ো না। অসুখী কোরো না।

—তুমি কি আমাকে অসুখী করছ না? কোনও রীতিনিয়মই কি মানছ তুমি?

আনিসুজ্জামান চুপ করেছিলেন। সে-দিনও সমস্ত চোখ তাঁদের ওপর নিবদ্ধ ছিল। শিশুরা কিছু বুঝতে পারেনি। অন্যান্য ভাইরাও নিঃশব্দ ছিল—অধিক শিক্ষিত হওয়ার কারণে এবং বেখাপ্পা আচার-আচরণের জন্য আনিসুজ্জামান তাদের কাছে দূরতম নক্ষত্র প্রতিভাত হতেন। তারা আনিসুজ্জামানকে মানতে পারত না কারণ মনিরুলকে মানা, মনিরুলের বিধান অনুসরণ করা তাদের কাছে অনেক সহজ ছিল। সেই সবই তারা চারপাশে পালিত হতে দেখে এবং স্বাভাবিক বলে জানে। যা-কিছুই, একবার স্বাভাবিক বলে ধরে নিতে পারলে আর কষ্ট নেই। সঠিক কিংবা সঠিক নয় বোঝার পরিশ্রমও নেই। ফলে আনিসুজ্জামানের ভাষ্য তাদের দুর্বোধ্য মনে হয়। একদিন তিনি বলেছিলেন, সমস্ত ক্ষীণজীবী, অদৃঢ়চিত্ত ও দুর্বল মানুষের জন্মের কারণ প্রেমহীন পৃথিবী। নারী ও পুরুষের অশ্রদ্ধার মিলন।

এ সবের কীই-বা মানে হয়! আনিসুজ্জামানের ভাইরা তা বুঝতে পারে না। সারাদিনের পরিশ্রমের পর বাড়ি ফেরায় সুখ এবং নারী সেই সুখের অনুষঙ্গ। হ্যাঁ, প্রেম সেখানে থাকতে পারে বটে তবে তা জরুরি নয়। তবু—তবু—তবু আনিসুজ্জামানের শব্দোচ্চারণের গুরুভারে ভাইরা নিশ্চুপ থাকে। ভাবে, তাদের মত ও আচরণের সঙ্গে না মিললেও আনিসুজ্জামানের কথাগুলি ওজনদার। এবং, কোনও সত্যও হয়তো-বা আছেই যা দুর্গম। দুর্ভেদ্য।

কিন্তু ভাইরা নীরব হলেও মনিরুল নীরব থাকলেন না। রাত্রে পরিবারের পুরুষরা একসঙ্গে বসে আহার করবেন—এ নিয়মের ব্যত্যয় করলেন তিনি। বললেন, যে নিয়ম মানে না, ধর্মাচরণ করে না তার সঙ্গে খাওয়ার রুচি নেই আমার।

আনিসুজ্জামান দুঃখ পেলেন। আমিনাকে বললেন, বেশ, আমার খাবার আমার ঘরে পাঠাবার ব্যবস্থা করো। আমার জন্য চাচু কেন অন্যদের সঙ্গে খাবার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবেন!

ব্যবস্থা হল। আর আনিসুজ্জামান টের পেলেন এই পরিবারের মাটি থেকে তাঁর শিকড় আলগা হল আরও। হয়তো তাঁর আচরণ তা আহ্বান করেছে। বোধ তাকে ত্বরান্বিত করেছে। কিংবা, মা ছিল না বলে, কোনওদিন গভীর সম্পর্ক প্রোথিতই হল না এই পরিবারে, এমন হওয়াও সম্ভব। অতএব আনিসুজ্জামান চলে যাওয়াই মনস্থ করলেন। উপলব্ধি করলেন, আব্বাজানের অনুপস্থিতি তাঁকে কতখানি অসহায় করেছে। তিনি থাকতে, নিজের অস্তিত্ব ও সম্পর্কগুলি নিয়ে এত জটিল করে ভাবতে হয়নি। আনিসুজ্জামানের সত্তার গভীর থেকে ক্লান্তি ঠিকরে বেরিয়েছিল। আখতারুজ্জামানের ইন্তেকাল এই সত্তার পক্ষে একটি বড় ধাক্কা, আর তার পরপরই আমিনার পক্ষাঘাত, যা, অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুকে দেওয়ালে টাঙিয়ে দেয়, এবং যা ঝুলতে থাকে, ঝুলতেই থাকে সবার বিকট প্রতীক্ষার মতো।

নড়াচড়া করতে পারেন না তখন আমিনা, জড়িয়ে জড়িয়ে কথাটুকুই বলতে পারেন। অথচ ওই বাড়ি জুড়ে তাঁর পায়ের শব্দ ছড়ানো ছিল তখনও। আনিসুজ্জামান, তাই চেয়েছিলেন, আমিনার জীবিতকালেই তাঁকে জানাতে যে তিনি গৃহ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন অন্য কোথাও। হয়তো কলেজের কাছাকাছি কোথাও। যদিও এই বলার কাজটি করে ফেলা খুব সহজ ছিল না তাঁর পক্ষে। কিন্তু বললেন যখন, কোনও জোরালো প্রতিক্রিয়া পরিবারে দেখা গেল না। এবং তিনি আরও একবার আহত হলেন। ভাবলেন, তা হলে তাঁর বিদায়ই অভিপ্রেত এবং তা প্রস্তুত হয়েই ছিল এই পরিবারের জীবনচর্যায়। তিনি অন্তত এটুকু আশা করেছিলেন যে ভাইরা বলবে— কোথায় যাবে! থাকো! এ পর্যন্ত আমরা কেউ পৃথক হইনি। তুমিই-বা হবে কেন! থাকো!

শুধু আমিনা বলেছিলেন, চলে যাবি? হ্যাঁ? চলে যাবি? এখন যাস না মেঠা। অন্তত যে-ক’ দিন আমি আছি, থাক এই বাড়িতে। আমার কাছে থাক তুই।

চলে যাবার কথা শুনে প্রাথমিক বিহ্বলতায় এ সবই বলেছিলেন বটে, আর তাঁর চোখে জল এসেছিল, ঠোঁট কেঁপেছিল। কিন্তু দ্রুতই তিনি এইসব আবেগবিহ্বল কথা ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, না। আমার জন্য থাকতে হবে না। আমি তো থেকেও নেই। চলে যা। কে আর তোকে দেখবে! কে আর বুঝবে! এ সংসারের হাওয়া বদলে যাচ্ছে রে মেঠা। সংসার আর একসঙ্গে রাখা যাবে না বেশিদিন।

আনিসুজ্জামান অবাক মেনেছিলেন। সংসারে কি গূঢ় কিছু ঘটেছে? তিনি টের পাননি। কিন্তু আমিনা যা বলেন তা ফেলনা নয়। এ সংসারে তিনিই ছিলেন মূল চালিকাশক্তি। তাঁর উপলব্ধিতে সংসারের বাঁকগুলি ধরা পড়ারই কথা। আনিসুজ্জামানকে নীরব রেখে আমিনা ফের বলেছিলেন, একটা কথা তোকে বলি, একটা অনুরোধ, রাখবি, তুই রাখবি, এ সংসারে তোর চেয়ে বেশি ভরসা আর কারওকে করি না।

এ-ও আনিসুজ্জামানের কাছে এক বিস্ময় যে চিরকাল সংসার থেকে আলগা হয়ে থেকেও কী করে তিনি এমন এক ভরসাস্থল হয়ে উঠলেন! হয়তো এতে তাঁর কোনও কৃতিত্ব ছিল না। আমিনা তাঁকে গভীর স্নেহ করতেন বলেই হয়তো গভীর ভাবে বিশ্বাসও করতেন। তখন এত কিছু বোঝর অবকাশ ছিল না। এক বিষণ্ণতার মধ্যে থেকে তিনি বলেছিলেন—হ্যাঁ, বলো, তোমার কথা নিশ্চয়ই রাখব।

সে-দিন আর বলেননি আমিনা। পরে বলেছিলেন। আনিসুজ্জামান রিপন স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে আসার এক বছরের মাথায় তাঁর ইন্তেকাল হয়। আর তার এক বছরের মাথায় মনিরুল ও তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্ররা পরস্পরের মধ্যে ব্যবসা ও সম্পত্তি ভাগাভাগি করে আলাদা হয়ে যান।

সেই সময় মনিরুল একদিন ডাকলেন আনিসুজ্জামানকে। বললেন, তুমি নাকি বাড়ি ছেড়ে যাবে শুনলাম।

আনিসুজ্জামান সম্মতি জানালেন। সেই সঙ্গে তাঁর চোখ এড়াল না যে খুবই পরিশীলিত দেখাচ্ছে মনিরুলকে। দাড়িতে মেহেন্দি করেছেন। জামায় সোনার বোতাম। টুপির চাকচিক্য বেড়েছে। নিপুণ করে গোঁফ কামিয়েছেন। গায়ে বিদেশি সুগন্ধী আর চোখের তলায় পুরু সুরমা।

মজা পেয়েছিলেন আনিসুজ্জামান। মনিরুলের বার্ধক্য সমাগত। অনেক পুরুষই এ সময় বেশবাসে মন দেন। যৌবনের ক্ষয় চাকচিক্যে ঢেকে রাখা উদ্দেশ্য। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সে-মজা আর থাকে না যখন মনিরুল বলেন, শুনেছ বোধহয়, আমি আবার নিকাহ্‌ করব।

—আপনি!

আনিসুজ্জামানের বিস্ময় ও তীব্র রাগ! গোপন করতে পারছেন না তিনি। সংযত হতে পারছেন না। বলছেন, আপনি! হঠাৎ! এই বয়সে!

তাঁর শ্লেষ প্রকাশিত। মনিরুল তার প্রতি বিন্দু ধরতে পেরেছিলেন। কিন্তু তাঁর উত্তর অতি সহজ ছিল, যা আনিসুজ্জামানের কানে এসেছিল অতি নির্লজ্জ প্রবাহে।

—নিকাহ্‌ করার কোনও বয়স আছে বলে তুমি মনে করো নাকি? আর বাহান্ন বছর কী এমন! তোমার বড় চাচিকে যখন আমি এনেছিলাম তখন আমার বয়স বাইশ। বত্রিশে তোমার ছোট চাচি আসেন। এর মধ্যে আরও কয়েকটি নিকাহ্‌ করতে পারতাম আমি। কারণ তোমার দুই চাচিই দু’রকমভাবে অসুস্থ। কিন্তু করতে পারিনি। এখন আর আমার কোনও সংশয় নেই!

আনিসুজ্জামান মনে মনে আর্তনাদ করেছিলেন, হায় চাচু! হায় তোমার ইচ্ছা! কী আশ্চর্য! ত্রিশ বছর ধরে দাম্পত্য পালন করেও তোমার কামনা নির্বাপিত হয়নি! দু’জন নারীকে নিঃশেষে ভোগ করেও তৃষ্ণা মেটেনি! হায় চাচু! হায় হায়!

কিন্তু তখনও বাকি ছিল। মনিরুল বলেছিলেন, হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে আমি নিজে থেকে এ প্রস্তাব উত্থাপন করিনি। খানিকটা তোমার জন্যই, কথা রাখতে আমাকে মত দিতে হয়েছে।

—কীরকম!

—তোমার জন্য একজনকে আমি প্রায় নির্বাচন করে ফেলেছিলাম। এখন, সেই মেয়েটির পিতা, দরিদ্র দুর্ভাগা মানুষ, আর কিছুতেই সম্পর্কের সম্ভাবনা হারাতে রাজি নন। তা, তোমার অন্য সব ভাই, যারা বয়ঃপ্রাপ্ত, সবার শাদি হয়ে গেছে। তাদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম। কালের হাওয়া। তারা কেউই দ্বিতীয়বার নিকাহ্ করতে রাজি নয়। আরে, তোরা দুটো-তিনটে নিকাহ্‌ না করলে মেয়েরা যে বিপদে পড়ে তা ভাব। তাই, শেষ পর্যন্ত আমাকেই …।

—বাঃ চমৎকার। গল্পে-উপন্যাসে আছে বটে— বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ পুত্রের জন্য পাত্রী দেখিতে গেলেন। তাঁহার আর পলক পড়ে না। শেষ পর্যন্ত আপনি দার পরিগ্রহ করিয়া… মনিরুলের স্বর বিকৃত হয়। তাঁর ভ্রূ কোঁচকায়। বলেন, তুমি আমাকে হিন্দুর সঙ্গে তুলনা দিচ্ছ। জানো ওদের এক-একজন একশোটাও বিবাহ করত! গ্রামে গ্রামে স্ত্রী! খাতা রাখত ঠিকানা মনে রাখবার জন্য।

—হ্যাঁ । জানি। কৌলীন্যধর্ম পালন করে পুণ্য করতেন তাঁরা।

মনিরুল লাল দাড়িতে হাত বুলিয়েছিলেন। তাঁর মুখ থেকে তৃপ্তি গড়িয়ে পড়ছিল।

আনিসুজ্জামান, গভীর ও তিক্ত স্বরে বলেছিলেন, আপনি কি এ সব বলবেন বলেই আমাকে ডেকেছিলেন?

মনিরুল বলেছিলেন, কিছুটা তাই। কিন্তু আমার অন্য কথাও ছিল।

—সেটা কী?

—শুনলাম তুমি চলে যাবে। যদিও তুমি ব্যবসাপত্র দেখো না তবু তোমার এই ব্যবসায় অন্য সবার মতো হক আছে। কারণ এই সবই ভাইজানের হাতে গড়া। তোমার অনেক প্রাপ্য আছে। আমি বুঝতে পারছি ব্যবসা আর একসঙ্গে রাখা যাবে না। ভাগাভাগি হবে।

আনিসুজ্জামান চমকে গিয়েছিলেন। একই কথা বড়চাচিও বলছিলেন সে-দিন। আশ্চর্য! তিনি নিজে ভাঙনের কোনও শব্দই পাননি!

মনিরুল বলেছিলেন, তোমার ভাগ তোমাকে দিয়ে দিতে চাই। আমি মুখার্জিবাবুকে বলেছি। তিনি আমাদের সমস্ত সম্পত্তির হিসেব তোমাকে বুঝিয়ে দেবেন। তুমি তোমার অংশ বিক্রি করে টাকা নিতে পারো অথবা নিজের মতো ব্যবসা করতে পারো। যা ভাল বুঝবে।

আনিসুজ্জামান এ সবের জন্য তৈরি ছিলেন না। ভাঙনের কথায় তাঁর কষ্ট হচ্ছিল। আব্বাজানের হাতে গড়া আর কিছুই রইল না। কথা না বলে তিনি মুখ নিচু করে বসেছিলেন। মনিরুল বলেছিলেন, তুমি খুবই আবেগপ্রবণ এবং তোমার বিষয়বুদ্ধি নেই। বোকার মতো বলে বোসো না যে তোমার কিছু চাই না। মাস্টারি করে ক’পয়সা পাওয়া যায় সে-খোঁজ আমি নিয়েছি। একটা বড় অসুখ করলে ওষুধ কেনার সামর্থ্য থাকবে না তোমার। তাই সম্পত্তির অংশ তুমি নিতে না চাইলেও আমি জোর করে দেব। এক্ষেত্রে মেঠা, তোমার কোনও কথাই আমি শুনব না।

সেই প্রথম, অতি সামান্য সময়ের জন্য হলেও মনিরুলকে অন্য চোখে দেখেছিলেন আনিসুজ্জামান। কী করতে পারতেন তিনি যদি একটি পয়সাও তাঁকে না দেওয়া হত। এবং হয়তো সেই মুহূর্তে সম্পত্তির ভাগ না নেবার কথা সত্যি তিনি ভেবেছিলেন। মনিরুল তা টের পেলেন কেমন করে! তাঁর মধ্যে কি সত্যি সেই দৃষ্টি আছে যা মানুষের অন্তঃস্তলে পৌঁছয়! আনিসুজ্জামান বলেছিলেন, খানিক বিহ্বল হয়েই, আমি সম্পত্তির কিছু বুঝি না।

মনিরুল সস্নেহ হেসে বলেছিলেন, সে আমি জানি!

—আমি কাগজপত্র, হিসেব কিছুই বুঝতে চাই না।

—বেশ। তোমার তবে কী বক্তব্য?

—আমি জানি না। ব্যবসা আমি কোনওদিনই করব না। এক্ষেত্রে আপনি যা ভাল বুঝবেন, যা করবেন, আমি তাই মেনে নেব।

—এই প্রথম, মেঠা, এই প্রথম তুমি কোনও বিষয়ে আমার শুভবুদ্ধির প্রতি নির্ভরশীল হলে! আজ আমার খুবই আনন্দের দিন। তুমি চলে যাচ্ছ। একে একে হয়তো আরও অনেকে চলে যাবে। আমি তার গন্ধ পাচ্ছি। তোমার বড়চাচি পঞ্চাশ পেরুতে না পেরুতেই পক্ষাঘাতগ্রস্ত। তোমার ছোটচাচি এত রুগ্‌ণ, এত দুর্বল যে সংসারের হাল ধরার সাধ্যই তাঁর নেই। ভাঙনও তাই অনিবার্য। অন্তরে ভাঙন লাগলে বাইরেটা কেমন করে ঠেকাব! তুমি যেতে চাইছ, যাও। আমি আটকাব না। শুধু জেনো, তোমাকে আমি নিজের সন্তানদের থেকে একটুও আলাদা করে দেখিনি। তোমার কোনও প্রয়োজনে আমার কাছে আসতে দ্বিধা কোরো না।

আনিসুজ্জামান দেখেছিলেন মনিরুল কাঁদছেন। এক সংক্রামক ব্যাধির মতো আনিসুজ্জামানেরও কণ্ঠ ভারী হয়ে এসেছিল সে-দিন। মনিরুল বলেছিলেন, ভাইজানের কথা খুবই মনে পড়ে সবসময়। আব্বাজানকে ভুলে গেছি। ভাইজানই আমার সব ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার মতে মেলেনি। কত ছেলেমানুষি করেছি। বোকামি করেছি। তিনি সব ক্ষমা করেছেন। আজ মনে হয়, তিনিই ঠিক ছিলেন। আমি বুঝতে পারিনি। তাঁর স্নেহ, ধৈর্য, ক্ষমা—এতদিন সব ধরে রেখেছিল। নইলে এতদিন কিছু হল না, আজ সব ভাঙতে চায় কেন?

অস্থির কান্নায়, তাঁর পক্ষে খুবই অস্বাভাবিকভাবে, ভেঙে পড়েছিলেন মনিরুল। আনিসুজ্জামান তাঁকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। আব্বাজানের প্রসঙ্গে ও প্রশস্তিতে তাঁরও কান্না পাচ্ছিল। পরিবারের সকলে অবাক হয়ে দেখেছিল সে-দিন। যে-দৃশ্য আখতারুজ্জামানের ইন্তেকালেও ঘটানো যায়নি, সে-দৃশ্যই রচিত হয়েছিল তাঁর স্মরণে। আর সারা পরিবার, এমনকী মনিরুল ও আনিসুজ্জামানও ভেবেছিলেন এই শেষ। আর কোনওদিন তাঁদের মধ্যে তর্ক হবে না। তিক্ততা জন্মাবে না। কিন্তু আবার সব ফিরে এসেছিল। বাৎসরিক কালবৈশাখীর মতো কিংবা বসন্তরোগের মতো। ফিরে এসেছিল নীলোফাকে নিয়েই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *