০১. অরুণ সেনের বাড়ির ছাদে

বসুধারা – তিলোত্তমা মজুমদার / প্রথম সংস্করণ ডিসেম্বর ২০০২

জয় গোস্বামী
শ্রদ্ধাস্পদেষু

ঋণ
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, হর্ষ দত্ত, শিল্পী রায়চৌধুরী, অভিজিকুমার মণ্ডল

অরুণ সেনের বাড়ির ছাদে প্রতিদিন লাফিয়ে নামেন সূর্য এবং সারা মাথুরের গড়ে আলো ছড়িয়ে দেন। অরুণ সেন এই মাথুরের গড়ে একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি সন্দেহ নেই, আবার তাঁকে নগণ্যও বলা চলে, কারণ বৈভব-সাফল্য ছাড়া তাঁর অস্তিত্বে এমন কোনও মন্দির নেই যা তাঁকে তাঁর পরবর্তী ভবিষ্যতে পৌঁছে দেবে। এবং অন্য কারণ—তাঁর চলাফেরায়, জীবনযাপনে, কর্মকাণ্ডে কোথাও এতটুকু গোপনীয়তা নেই। লোকে তাঁকে নিয়ে আর কীই-বা আলোচনা করবে। যে-তোরঙ্গ একবার খুলে গেছে তা নিয়ে আর মানুষের ঔৎসুক্য থাকে না। তবু, সূর্য প্রতিদিন অরুণ সেনের ছাদে অবতরণ করেন এবং চতুর্দিকে আলো দেন। কোনও অজ্ঞাত কারণে, লাফিয়ে নামার জায়গা হিসেবে ওই ছাদই তাঁর পছন্দ। প্রশ্ন উঠতে পারে যে অরুণ সেনের ছাদ না থাকলে তিনি কী করতেন! সে-ক্ষেত্রে উত্তরটি সরল। ছাদ না থাকলে সূর্যের কাজ আরও সহজ হয়ে যেত। ও বাড়ির ছাদ এই এলাকায় সবচেয়ে উঁচু ও প্রাচীন। সূর্য মাটি ছেড়ে ঠিক যেখানটায় উল্লম্ফন শুরু করেন সেই জায়গাটিই আড়াল করে দাঁড়ানো। সুতরাং বাড়িটি না থাকলে, ছাদই না থাকলে, সূর্য মাটিতে উঁকি দিয়েই সহজে সব দিকে আলো ছড়াতেন— এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

লোকে বলে রানি রাসমণির জামাই মথুর এ অঞ্চলের মালিকানাপ্রাপ্ত ছিলেন। তার কোনও প্রামাণ্য তথ্য নেই শুধু জায়গার নামটি ছাড়া। আর লোকের তো নাম দিতে জুড়ি নেই, গল্প ছড়াতেও না। সুতরাং এ নামের পেছনে কোনও ঐতিহাসিক সত্য প্রতিষ্ঠিত নয়। এ পাড়ার আদি বাসিন্দারাও এখানকার ইতিহাস বলতে পারেননি। কারণ হয়তো-বা, বংশপরম্পরায় আঞ্চলিক ইতিহাস মনে রাখার দায় বা গুরুত্ব তাঁরা বোধ করেননি। ইতিহাস কখন কোথায় প্রয়োজন হবে, কেই-বা আগে থেকে বোঝে! সে-দিক থেকে দেখতে গেলে এই মাথুরের গড়ের এতদিন কোনও ঐতিহাসিক গুরুত্বই ছিল না। বরানগর অঞ্চলের আর পাঁচটা সাধারণ পাড়ার মতো সে পড়ে ছিল এবং আপনা ধর্মে জীবন বইয়ে দিচ্ছিল। সত্তরের গোড়া থেকে নকশাল আন্দোলনের সময় বরানগর-কাশীপুর যখন আবার প্রাত্যহিক খবর হতে থাকল তখন তারই মধ্যে মাথুরের গড় নামটিও বেশ জানাজানি হল।

অবশ্য ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য পেয়েও অনেক জায়গা ইতিহাস হয়েছে, এরকম দেখা যায়। মাথুরের গড়ও সে-রকম হতে পারে। এ কথা ঠিক যে এই পাড়াটি বেশ উঁচু। আর বরানগরের অন্তর্ভুক্ত এই অঞ্চল বরানগরের গর্ব হয়ে ওঠে এ কারণে যে, এই অঞ্চলের চারপাশ নদীবেষ্টিত এবং এই মাথুরের গড় ভূখণ্ড নদীতলের চেয়ে উঁচু হয়ে কূর্মপৃষ্ঠের মতো জেগে আছে, তেমনই উচ্চতম হয়ে, যেখানে বর্ষায় জল দাঁড়ায় না।

নামে কী যায় আসে! ইতিহাসেই বা কী! জনজীবন যেমন চলার তেমনই চলে। তবে ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য যে-কোনও অঞ্চলই কিছু সুবিধা-অসুবিধা পায় বটে। আর সে-দিক থেকে বলতে গেলে মাথুরের গড়ের উত্তরে রেললাইন ও ফটিক বিল। ফটিক বিলের ধারে যে জনবসতি তা দরিদ্রের বাসস্থান বলে ফটিক বিলের বস্তি নাম পায়। এই ভূখণ্ডের পশ্চিমে গঙ্গা ও দক্ষিণেশ্বর। উত্তর-দক্ষিণে প্রসারিত সদা ব্যস্ত বি টি রোড এবং বি টি রোড় থেকে একটি শাখার মতো বেরিয়ে এসেছে পি ডব্লু ডি রোড, যা দক্ষিণেশ্বর অভিমুখে গেছে। অর্থাৎ ফটিক বিলের অবস্থান বলা যায় উত্তরপশ্চিম কোণে এবং মাথুরের গড়ের সূর্য সেখানে প্রথম আলো কখনওই ফেলেন না। প্রথমে তিনি লাফিয়ে নামেন অরুণ সেনের ছাদে এবং আলসেয় জোড় আসন করে বসে দরিদ্র জনগণকে আলো বিতরণ করেন।

এ নিয়ে কখনও কোনও প্রশ্ন ওঠেনি কারণ এমনটাই হয়ে আসছে চিরকাল। আর যা চিরকাল ধরে হয়ে আসে তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা খুবই অস্বাভাবিক ঠেকে মানুষের কাছে। এতটাই অস্বাভাবিক যে যুগে যুগে যে-ইতিহাস রচিত হয়েছে তাতে দেখা গেছে এই মহাজগৎ সম্পর্কিত প্রতিটি মূল প্রশ্ন ও যথাযথ উত্তরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হত্যা ও রক্তপাতের কাহিনী। তার কারণই এই যে যুগ যুগ ধরে স্বীকৃত কোনও সত্য ভেঙে ওইসব প্রশ্ন উঠে এসেছিল। কোনও কালেই তার ব্যতিক্রম হয়নি। অর্থাৎ, কোনও সত্য, যা মানুষ ধ্রুব বলে ভাবতে শেখে এবং নিজস্ব সুবিধার জন্যও ধ্রুব রাখতে প্রয়াস পায়—তাতে ভাঙন ধরে কোনও না কোনও দিন। সেইসব ভাঙনের কাল। উন্মাদের কাল। এমনকী এ কালেও মানুষের সমস্ত অধিকার সম্পর্কিত কিছু সত্য ও মৌলিক প্রশ্ন তুলেছিল কেউ কেউ এবং হত্যালীলা সম্পাদিত হয়েছিল। এখন সে-প্রসঙ্গ চাপা আছে বটে, তবে কখন কার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হবে আবার এবং সেইসব উচ্চারণের বিনাশকল্পে তৈরি হবে অস্ত্রের কারখানা এবং নতুন নতুন অস্ত্রের নীচে বুক-পেট ফুটো হয়ে কখন গড়াতে গড়াতে নেমে যাবে মানুষের লাল গরম রক্ত তা কেউ বলতে পারে না। যেমন এই মাথুরের গড়, কোনও বর্ষায় এখানে জল জমেনি, কিন্তু হঠাৎ কোন বর্ষায় তা ভাসতে শুরু করবে কে বলতে পারে!

গঙ্গায় বান এসে বানের জল পি ডব্লু ডি রোড ধরে তেঁতুলতলা অবধি এসে হামলে পড়েছে ফটিক বিলে আর বিলের জলে অশুদ্ধি সংশোধন ঘটিয়েছে। কিন্তু মাথুরের গড়ের টিকি ছুঁতে পারেনি কোনও দিন। অন্য দিক থেকে দেখতে গেলে বরানগর বা মাথুরের গড় বা ফটিক বিলের জন্য কলকাতা মহানগরী ও তার খালবিলের মানচিত্র স্মরণ করতেই হয়। কারণ মহানগরীর হাল-হকিকত এসে আছড়ে পড়বেই তার উপকণ্ঠে এবং জল থাকলে জল সমেত বইয়ে দেবে চারপাশে। কলকাতা যাদের ওপর নির্ভরশীল সেই নোয়াই, বিদ্যাধরী ও বাগজোলা খাল কুলটি নদীতে সব পরস্পর সংযুক্ত। নোয়াই খালের বহমানতা বরানগর এলাকা থেকে দূরে নয়। আবার বাগজোলা খালও এই এলাকা ছুঁয়ে গিয়ে এমন হয়েছে যে নোয়াই ও বাগজোলা উপচালে এসব অঞ্চলের নিচু অংশ একেবারে ভেসে যায়।

কলকাতার ওপর বিদ্যাধরীর প্রভাবও কম নয়। এই বিদ্যাধরী নদীই ছিল একসময় এবং স্কুলের ভূগোল বইতে তা এখনও নদী হয়ে বেঁচে আছে বটে তবে বাস্তবে তার অস্তিত্ব নদীমাতৃসুলভ নেই। সে এখন মজে যাওয়া, হেজে যাওয়া, জঞ্জাল ও কচুরিপানা ভর্তি খাল, যার জলধারণ ক্ষমতা শূন্যে ঠেকেছে।

নোয়াই খালের অবস্থাও তাই। বাগজোলা খালেরও। প্রায় বারো বছর আগে একবার নোয়াই খাল সংস্কারের প্রস্তাবনা হয়েছিল কিন্তু ঠিকঠাক পরিকল্পনার অভাবে সেই সংস্কারে নোয়াই-এর ভাঙন ঠেকানো যায়নি। ফলত প্রতি বছর বর্ষায় যা হয় তাতে এভাবে সংবাদপত্রগুলি জানায় যে—

টালা থেকে বিরাটি পর্যন্ত উত্তর কলকাতা ও শহরতলির জলনিকাশি ব্যবস্থা গুরুতর সংকটে। আষাঢ়ের ঘন বর্ষায়, এমনকী ভারী বর্ষণের আগে স্বল্প বৃষ্টিপাতেও জল জমে যাচ্ছে সিঁথি-কাশীপুর-বরানগর-নিমতা-কামারহাটি-বিরাটি প্রভৃতি অঞ্চলে …।

এরকমই হয়। প্রতি বছর। প্রতি বর্ষায়। বৃষ্টির জল জমে। খালের জল, নদীর জল উপচে এসে বিল ভরিয়ে দেয়। বিলের জল উপচে উঠে আছড়ে পড়ে ঘরে-উঠোনে। প্রথমে তাই ফটিক বিল বস্তির সব দুয়ারে পায়ের পাতা ডোবে। তারপর, দিন গেলে, জল পায়ের গোছ ছাড়ায়। চৌকাঠ গলে যায়। ওই জলে ময়লা ভাসে। আবর্জনা ভাসে। আর সব সমেত ঘরে ঢুকে যায়। ক’টা দিন একটু কষ্ট। তাতে বস্তির কোনও কাজ আটকায় না। বাচ্চার জন্ম পর্যন্ত হয়। কাজের মানুষেরা জলে হাঁটু অবধি কাপড় তুলে কাজে বেরোয়। ক’দিনেই পা কুটকুট করে। হাজা ধরে। বাবুবাড়ির গিন্নিদের কাছ থেকে তখন মেয়ে-বউরা, যারা বস্তি থেকে কাজ করতে আসে, চেয়ে নেয় হাজার মলম বা বোরোলীন। খানিক নিজে মাখে। খানিক দোক্তা বা পানের কৌটোয় পুরে বাড়ি নিয়ে যায় বরের জন্য, লাগিয়ে দেবে পায়ে।

এরকমই হয়ে আসছে চিরকাল আর চিরকালের মতো শুকনো ডাঙা হয়ে ভেসে থাকছে মাথুরের গড়। কোনও দিন, কোনও কালে এখানে জল দাঁড়ায়নি। কে জানে, যদি সত্যি এ জায়গা রানি রাসমণির জামাই মথুরবাবুর হয়ে থাকে তবে হয়তো একারণেই যে এই জমি, দিনের পর দিন, এমনকী বর্ষায়ও, মাথা তুলে জেগে থাকে যেমন পলাতক পুত্রের জন্য জাগে মা। সে-ইতিহাস কোথাও লেখা নেই। শুধু নামটুকু আছে।

পাড়া বলতে খুব ছোট বলা যাবে না মাথুরের গড়কে। দরিদ্রও বলা যাবে না। সমৃদ্ধ, সচ্ছল ও ধনী পরিবারগুলির বাস এখানে। পশ্চিম বাংলার স্থায়ী বাসিন্দাদের পাশাপাশি বাস নিয়েছেন পূর্ব বাংলা থেকে চলে আসা পরিবারগুলি। তাঁদের মধ্যে যাঁরা প্রতিষ্ঠিত, অর্থবান, তাঁরা আছেন এ পাড়ায়। আর যাঁরা নড়বড়ে, তাঁদের বাস পি ডব্লু ডি রোড পেরিয়ে ওপারের উদ্বাস্তু কলোনিতে।

এই মাথুরের গড়ের এক প্রান্তে বি টি রোডের ধার ঘেঁষে ব্রজগোপালের ওষুধের দোকান। সেখানে আড্ডা বসেছিল। সমরেন্দ্র বলছিলেন, তবে তুমিই-বা শ্মশানকালীর পুজো না করে দক্ষিণাকালীর পুজো করো না কেন? ওই ভয়াল রূপেই তোমার ভক্তি? দক্ষিণাকালীর শান্ত শ্রীময়ী রূপ দেখে ভক্তি আসে না?

মল্লিনাথ মুচকি হেসে চুপ করে আছেন। সে-দিনের কাঠামো ভেসে আসার কথা তিনি আজ পর্যন্ত কাউকে বলেননি। মাধবী আর লিলি ছাড়া কেউ কিছু জানেন না। তাঁর দুই ছেলে অমলেন্দু, কমলেন্দুও নয়।

মল্লিনাথকে চুপ করে থাকতে দেখে বিতর্ক উসকে দিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। এই আড্ডায় তিনিই সবচেয়ে কমবয়সি সদস্য। বনহুগলি বি পি সি কলেজে বাংলা পড়ান। বললেন, কালী শব্দের উৎস কী, ডাক্তারদা?

মল্লিনাথ বললেন, কাল শব্দের উত্তরে স্ত্রী লিঙ্গে ঈ প্রত্যয় যোগে কালীর সৃষ্টি। কালী মহাকালের অংশ। দশ মহাবিদ্যার প্রথম মহাবিদ্যা। অন্যরা হলেন তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী, রাজরাজেশ্বরী বা কমলা। আদ্যাশক্তি দুর্গার এই দশ মূর্তি। অনন্তকালের শক্তিরূপিণী পরমা প্রকৃতি। কালীকে ভয়াল বলছ কেন? প্রকৃতি তো মা। আর ওই ভয়দশনা রূপ তো আমাদেরই গড়া। আমরা যখন যেমন রূপের কাছে শক্তি চেয়েছি, তেমনই গড়েছি।

এত কথা একসঙ্গে বলে কিছুক্ষণ চুপ করেছিলেন মল্লিনাথ। তাঁর করোটির তলায়, মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে তীক্ষ্ণমুখের কয়েকটি প্রশ্ন উঠে আসছিল। সত্যি বললে? সত্যি? ভয় করো না তুমি? কালীকে? অভিশাপকে? রূপচাঁদের আত্মাকে?

কিন্তু এ সব কথা কারওকে বলার উপায় নেই তাঁর। ভয় পাওয়া প্রকাশ করারও উপায় নেই। নিজের সমস্ত অনুভব নিজেরই মধ্যে গোপন করতে করতে মুখের রেখাগুলি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টায় ছিলেন তিনি। আনিসুজ্জামান তাঁর কথার পৃষ্ঠে প্রসঙ্গ গেঁথে নীরবতা ভেঙেছিলেন। বলেছিলেন, কাল শব্দের আর একটি অর্থ যে মৃত্যু তা তো আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না ডাক্তারদা।

মল্লিনাথ বলেছিলেন, না, তা পারব না। তবে কালীর আরাধনা মানে মৃত্যুর আরাধনা নয়। বরং রোগ, শোক, ভয় ও দুঃখনাশিনী হিসেবেই আমরা কালীকে ডাকি।

আনিসুজ্জামান একটু হেসে চোখ বন্ধ করে গাঢ় গলায় বলেছিলেন—

ওঁ ত্ৰহ্যেহি ভগবত্যম্ব ভক্তানুগ্রহবিগ্রহে।
যোগিনীভিঃ সমং দেবি রক্ষার্থং মম সর্বদা॥
ওঁ মহাপদ্মবনান্তস্থে কারণানন্দবিগ্রহে।
সর্বভূতহিতে মাতরেহ্যেহি পরমেশ্বরি॥

মল্লিনাথ ও সমরেন্দ্র একসঙ্গে হাততালি দিয়েছিলেন— চমৎকার! চমৎকার!

সমরেন্দ্র বলেছিলেন, এত চমৎকার স্তোত্র পড়ো তুমি জানতাম না তো। কোথায় শিখলে?

আনিসুজ্জামান বললেন, অবাক হলেন তো! আপনাদেরই মন্ত্র। কিন্তু বলতে পারবেন এ কোন মন্ত্র?

সমরেন্দ্র মাথা নাড়লেন। পারবেন না। পূজা-পার্বণ সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেই তাঁর। আনিসুজ্জামান বললেন, এটি দেবী কালিকার আবাহন মন্ত্র। ঠিক বললাম ডাক্তারদা?

মল্লিনাথ সায় দিলেন। ঠিকই বলেছেন আনিসুজ্জামান। এর পরই পঞ্চমুদ্রা দ্বারা দেবীকে আবাহন করতে হয়। তারপর ষড়ঙ্গন্যাস। হৃদয়, শির, শিখা, কবচ ও ত্রিনেত্র এবং অন্ত্র। কারও কারও মতে অবশ্য ষড়ঙ্গ মানে মস্তক, হস্তদ্বয়, কোমর, চরণদ্বয়।

সমরেন্দ্র লাজুক লাজুক মুখে বললেন, কিছু মনে কোরো না অধ্যাপক, না জানলে আজ কিছুতেই মনে করতাম না তুমি হিন্দু নও।

আনিসুজ্জামান হেসে বলেছিলেন, ইলেভেন পর্যন্ত সংস্কৃত পড়েছি সমরেন্দ্রদা। আর সাহিত্য পড়তে গেলে একটা ভাষার সঙ্গে সঙ্গে আরও দু’-একটা ভাষার চর্চা হয়েই থাকে, জানেন তো! সংস্কৃত জানা আছে বলে অনেক বই আমি মূল থেকে পড়তে পাই।

মল্লিনাথ গুনগুন করছিলেন। ব্রজগোপাল বললেন, জোরে হোক না মল্লিদা। শ্যামাসংগীত গাইছিলো তো? নজরুলের সেই গানটা, না?

সমরেন্দ্র অবাক গলায় বললেন, নজরুলের শ্যামাসংগীত? আছে নাকি?

মল্লিনাথ বললেন, জানো না তুমি? তবে শোনো। দু’হাত ছড়িয়ে দরাজ গলায় তিনি গান ধরলেন—

মহাবিদ্যা আদ্যাশক্তি পরমেশ্বরী কালিকা।
পরমাপ্রকৃতি জগদম্বিকা ভবানী ত্রিলোক পালিকা॥

অসাধারণ কণ্ঠ মল্লিনাথের। ভারী এবং সুরঋদ্ধ। খুব বেশি গান তিনি জানেন না যে-গুটিকয় গাইতে শুরু করেন তাতেই এতখানি প্রাণের ছোঁয়া থাকে যে কান পেতে শুনতে ইচ্ছে হয়।

ফুটপাথ দিয়ে লোক চলাচল করছিল। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হল। সাড়ে আটটা বাজতে যায়। ব্রজগোপালের দোকানের সামনের ফুটপাথের পাশে বি টি রোডের অংশ দখল করে তৈরি হয়েছে ছোট রিকশা স্ট্যান্ড। ব্যস্ত, ক্লেদাক্ত বি টি রোড থেকে সারাক্ষণ ব্রজগোপালের দোকানে উঠে আসে ধোঁয়া, ধুলো আর শব্দ। এর মধ্যেই আড্ডা জমে। আড্ডায় বয়সের কোনও মাপ নেই। তবে যুগের একটি সূক্ষ্ম বিভাজন এ পাড়ার তিনটি-চারটি আড্ডাখানায় পাওয়া যায়। হারুর স্টেশনারি দোকানে বসে যুবকদের আড্ডা। সমরেন্দ্রর বাড়ির সামনেকার রকে বসে বয়ঃসন্ধিকালের তরুণরা। ব্রজগোপালের দোকানের এই আড্ডাটি প্রধানত অভিভাবকস্থানীয়ের। মাঝে মাঝে প্রণবেশকেও এই আড্ডায় দেখা যায়। আর আনিসুজ্জামান নিয়মিত আসেন। তাঁকে মাঝে মাঝে হারুর স্টেশনারি দোকানে দেখা গেলেও এ আড্ডাতেই তাঁর টান বেশি। এ পাড়ায় বেড়ে ওঠেননি বলে, এ পাড়ার সঙ্গে তাঁর শৈশব-কৈশোরের যোগ নেই বলে, কোনও বয়ঃজ্যেষ্ঠকেই তাঁর অভিভাবকের সম্মান দেবার দরকার পড়েনি। এখানে সব বয়সের মানুষের সঙ্গেই তিনি সহজভাবে মেশেন। এ কথাও বলা যেতে পারে যে মিশে যাবার প্রবণতা তাঁর সহজাত। যদিও নিজের বাড়িতে, অনেক ভাইবোনের মধ্যেও তিনি একা বোধ করতেন।

ফুটপাথ দিয়ে যেতে যেতে চেনা-অচেনা প্রত্যেকেই ব্রজগোপাল ফার্মেসির দিকে তাকাচ্ছিল। মল্লিনাথ গেয়ে চলেছিলেন। কেউই তাঁকে থামায়নি কিন্তু মল্লিনাথ নিজেই হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠেছিলেন। লোকজন দেখছে। গান থামিয়ে বলেছিলেন, আহা! ধীরেন মিত্তিরের গলায় এ গান শুনেছ?

ছোটখাটো চেহারার ব্রজগোপাল বললেন, শুনেছি। তবে ওই গানটাও ওঁর গলায় আমার ভাল লাগে— শ্মশানে জাগিছে শ্যামা—

সমরেন্দ্র বলেছিলেন, এ সবই কি নজরুলের গান?

আনিসুজ্জামান বললেন, আরও কত শ্যামাসংগীত আছে নজরুলের! দুর্গাগীতি আছে। লক্ষ্মী-সরস্বতীর বন্দনা আছে!

প্রসঙ্গের পরিবর্তন হয়ে চলেছে। যে-কোনও আড্ডারই যা স্বাভাবিক চরিত্র! রাজনীতি দিয়ে শুরু হয়, শেষ হয় সিনেমায়। মাঝখানে সমাজ, সাহিত্য, শিল্প, ক্রীড়া এবং অর্থনীতির পথপরিক্রমা থাকে অবশ্য। কারও কারও এই প্রসঙ্গভেদ পছন্দ নাও হতে পারে। তেমন কারণেই সমরেন্দ্র অসহিষ্ণু গলায় পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে বললেন, সে তুমি যাই বলো, শ্মশানকালীর পুজো করা যে ভাল নয় এ কিন্তু আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি। তা ছাড়া মল্লিদা তুমি আবার বলিবিবর্জিত পুজো করো। অথচ শ্মশানকালীর পুজো বলি ছাড়া হয় বলে শুনিনি। লোকে বলে এ পুজোয় বিঘ্ন হলে বংশ নির্বংশ হয়।

মল্লিনাথ খানিকটা উত্তেজিত গলায় বলেছিলেন, শোনো, এ আমাদের পারিবারিক পূজা। যখন শুরু হয়েছিল, এরকমভাবেই শুরু হয়েছিল। আসলে পূজার নিয়মটা প্রধান নয়। শুদ্ধ ইচ্ছেটাই প্রধান।

আজ সারা দিন সমরেন্দ্রর কথাগুলো মনে পড়েছে মল্লিনাথের। বারবার নিজেকে বুঝিয়েছেন তিনি— দুর্বল হয়ো না। তুমি কোনও অন্যায় করোনি। পাপ করোনি। সারাজীবন মানুষকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছ। মানুষ তোমাকে অভিশাপ দেবে না। যে-দিন থেকে পূজা করছ, সে-দিন থেকে অন্তরাত্মা দিয়েই আরাধনা করার চেষ্টা করেছ। ঈশ্বরও তোমায় অভিশাপ দেবেন না। তবে?

মল্লিনাথ ভয় পান। কার কাছে তিনি অপরাধী হয়ে আছেন? মন মানে না। সামগ্রিকভাবে অস্থির বোধ করেন। কিছুক্ষণ আগেও অমলেন্দুকে দেখে এসেছেন তিনি। অস্থিচর্মসার শরীর নিয়ে বিছানায় মিশে আছে। কমলেন্দু এখানে নেই। কানপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং-এর শেষ বর্ষের পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করছে। মল্লিনাথ অমলেন্দুর বিষয়ে কিছুই জানাননি তাকে। কী করবে জেনে। বরং পরীক্ষাটা দিক। অমলেন্দুকে দিয়ে কোনও আশা মিটল না। কোন অজ্ঞাত যন্ত্রণায় মেডিক্যাল ফোর্থ ইয়ার পড়তে পড়তে সে নেশা ধরল। গাঁজা, চরস, হেরোইন। মল্লিনাথ যখন জানলেন তখন দেরি হয়ে গেছে। এই দেরি হওয়ার জন্য, নিজের ছেলেকে বুঝতে না পারার জন্য মল্লিনাথ নিজেকে দায়ী করে চলেছেন সর্বক্ষণ। আগাগোড়া ভাববার চেষ্টা করেছেন। তাঁর সঙ্গে মাধবীর যে-সম্পর্কই থাক, দুই ছেলেকে তিনি কখনও অবহেলা করেননি। মাধবীকেও করেননি। কিন্তু মাধবী ভুল বুঝে ক্রমশ সরে গেলেন। শরীরটা যেমন তেমনই রইল কিন্তু মন নিয়ে হারিয়ে গেলেন তিনি। তাঁর ক্ষোভ ছিল। হয়তো অমলেন্দুরও ছিল। বড় হতে হতে সেও গুটিয়ে গিয়েছিল। মল্লিনাথের থেকে সরে যাচ্ছিল। তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন এ বয়ঃসন্ধিকালীন অন্তর্মুখিনতা। তাই ঘাঁটাননি। আজ বুঝছেন, এই গুটিয়ে যাওয়া আসলে পলায়ন বা গোপন জীবনবিমুখতা। সে যে-পথে যাচ্ছে সেখান থেকে আর ফেরা যাবে না তা বোঝার মতো শিক্ষা ও বুদ্ধি অমলেন্দুর ছিল। তবু সে গিয়েছে। তা হলে মরে যেতেই কি চেয়েছিল সে? এর উত্তর পাবার আর কোনও উপায় রাখেনি অমলেন্দু।

আর হয়তো আধঘণ্টা আয়ু আছে তার। কিংবা একঘণ্টা। মল্লিনাথ জানেন কিন্তু কারওকে বলেননি। অসুস্থ অমলেন্দুর কাছে থাকার জন্য লিলিকে ডেকে এনেছেন তিনি। অমলেন্দুকে খুব ভালবাসতেন লিলি। বিয়ের আগে খুব কোলেপিঠে করেছেন। এ বারে আসার পর অমলেন্দুর পাশ থেকে একটুও নড়েননি। মাধবী নির্বাক হয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছেন। মল্লিনাথের ইচ্ছে করছিল মাধবীকে ধরে জোরে জোরে ঝাঁকাবেন। বলবেন— দেখো, আমাদের বড় ছেলে চলে যাচ্ছে। ওকে জিজ্ঞেস করো, কেন ও এরকম করল! কেন!

শেষ পর্যন্ত কিছুই বলা হয়নি। শুধু একা একা সহ্য করছেন—আর আধঘণ্টা বা একঘণ্টা পর পৃথিবীতে অমলেন্দু বলে কেউ থাকবে না। মাধবী সমস্ত বলা-কওয়ার বাইরে চলে গেছেন। কিন্তু লিলিকেও বলতে পারলেন না মল্লিনাথ। বরং শান্ত থাকার চেষ্টা করতে করতে বললেন, তুই থাক এখানে। আমি পুজোটা সারি।

লিলি মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন। মল্লিনাথ ঘৃণা দেখলেন তাঁর চোখে। কিন্তু মল্লিনাথের কিছুই করার ছিল না। এক্ষুনি পূজায় বসতে না পারলে পুত্রাশৌচ এসে যাবে। পূজার আয়োজন সত্ত্বেও পূজা না করার অপরাধে পাতকী হবেন তিনি। তার চেয়ে এই ভাল। না জানা ভাল। মৃত্যু কখন আসে দেখবেন না মল্লিনাথ। জানবেন না। যতক্ষণ না জানছেন ততক্ষণ মৃত্যু নেই। গৃহদেবতার পূজার কোনও শৌচাশৌচ নেই এমনই তিনি জেনেছিলেন রূপচাঁদদাদুর কাছে। কিন্তু পুত্রের মৃত্যু হয়েছে জেনেও নিজেকে পূজার আসনে বসানোর মতো মানসিক জোর তাঁর নেই। তাই তিনি পালিয়েছেন। মৃত্যুশয্যার পাশ থেকে পালিয়েছেন।

পূজার সমস্ত আয়োজনই শেষ। প্রতিটি অমাবস্যার মতো আজও মল্লিনাথ সারা দিন উপোস করে সমস্ত সংগ্রহ করেছেন। নিখুঁতভাবে পূজার উপকরণ সাজিয়েছেন। আজ আটাশ বছর হল প্রতি অমাবস্যায় তাঁর বাড়িতে শ্মশানকালীর পূজা হয়ে আসছে। ভাল-মন্দ বোঝেননি, সুখাসুখ বোঝেননি। কাঠামো পাবার পর থেকে পূজা করেছেন কেবল। যে-দিন, গঙ্গার ঘাটে, ওই কাঠামোটি ভাসতে ভাসতে এসে ঠেকে গেল, সে-দিনই, আকস্মিকভাবে ওখানে উপস্থিত থাকা মল্লিনাথ পূজা সম্পর্কে দায়বদ্ধ হয়ে গেলেন।

তখন সবে বিবাহ করেছেন তিনি। একটু বেশি বয়সেই করেছেন। মাধবী অন্তঃসত্ত্বা। তাঁদের প্রথম সন্তান আসছে। মাধবীই বলেছিলেন—চলো, দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিয়ে আসি।

পাঁচ মাস চলছে তখন তাঁর। বরাবরই গোলগাল দেখতে বলে এক নজরে বোঝা যেত না। মিষ্টি মুখখানিকে সবসময় খুব ছেলেমানুষ লাগত। একটু বেশি বয়সে বিবাহ করেছিলেন বলে নিজের চেয়ে অন্তত আঠারো বছরের ছোট মাধবীর প্রতি গভীর স্নেহ বোধ করতেন মল্লিনাথ। লিলিকে যেমন করতেন তেমনই স্ত্রীকেও মাঝে মাঝে শাসনও করে ফেলতেন। আবার কোনও অনুরোধ ঠেলে ফেলতেও পারতেন না। সে-দিন তাঁর খুবই কাজের চাপ ছিল, তবু দক্ষিণেশ্বর যাবার অনুরোধ রেখেছিলেন। না রাখলে হয়তো জীবন অন্যরকম হত। আর রেখেছিলেন বলেই, এখন এই অবস্থায় বড় বিপন্ন বোধ করছেন তিনি। কবে থেকে এই বিপন্নতা ঘাপটি মেরেছিল? সে-দিনের জন্যই কি আজ নিজেকে সবার থেকে দূরে সরে যাওয়া একলা একজন মানুষ মনে হয় না? মল্লিনাথ প্রতিমার দিকে তাকান। হাসছে কি ও? কিছু বলবে কি? ভঙ্গিটা দেখো! উদ্ধত। রুষ্ট। যেন দাবির কোনও শেষ নেই। দু’টি হাত আড়াআড়ি করে নিজের দুই কাঁধ খামচে ধরছেন মল্লিনাথ। দাঁতে ঠোঁটে চেপে ধরছেন। নিজের কাছে অতি দ্রুততার সঙ্গে স্বীকার করছেন তিনি—আজ তাঁর পূজা করতে ইচ্ছে করছে না। তিনি ফিসফিস করছেন। দাঁতে দাঁত পিষে বলছেন— তোর জন্য। তোর জন্য। সব নে। সব নিয়ে যা!

মল্লিনাথ ক্লান্ত বোধ করেন। এ সব কথা কার জন্য? এ সব নিয়ম কার জন্য? কাকে আসলে ভয় করছেন তিনি? কালী না রূপচাঁদ? কাঠামো পাবার দিন থেকে প্রায়ই স্বপ্নে ধরা দেন রূপচাঁদদাদু। মাধবীর সঙ্গে, সেই সময় শারীরিক মিলিত হলেই তিনি দেখা দিয়েছেন। নীরব কিন্তু তীব্র চোখ মেলে চেয়ে থেকেছেন মল্লিনাথের দিকে। যেন, মল্লিনাথ, সংযম পালন না করলে তুমুল শাস্তি নেমে আসবে মাথায়। ওই স্বপ্ন দেখলেই, অনেকদিন তাঁর লিঙ্গোত্থান হত না। কারওকে মুখ ফুটে বলতে পারেননি এ কথা। মাধবীকেও না। শুধু নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে, ভয়ে, ক্রমশ যৌনজীবন স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন।

সময় যাচ্ছে। ক্রমশ বাসি হতে থাকা ফুলের গন্ধ নাকে লাগছে তাঁর। ধূপ ও চন্দনের গন্ধ লাগছে। বাসি হতে থাকা ফুলের গন্ধ বড় দুঃখময়। সমস্ত আয়োজন ও সামাজিকতার পর নববিবাহিতরা যখন ফুলশয্যার ঘরে যাবার অবকাশ পায়, তখন এরকম গন্ধ। ক্লান্তির। কেন-না, সন্ধেবেলা কারও সাজিয়ে রেখে যাওয়া খাট এবং মালাগুলি তখন ক্লান্ত। প্রাণ শেষ হতে থাকা। এবং প্রাণ ফুরিয়ে গেলে মৃতদেহের চারপাশে রেখে যাওয়া ফুলেরাও ধীরে ধীরে সৌগন্ধ হত্যা করতে করতে ঝিমিয়ে পড়ে। পূজার আয়োজনেও তার ব্যতিক্রম নেই। মল্লিনাথ তাঁর পূজার ঘরে রাত-ফুরনো অসার্থক ফুলশয্যার গন্ধ পান। প্রাণ শেষ হয়ে যাওয়া মৃতদেহের গন্ধ পান। তাঁর অস্থির অস্থির লাগছে এখন। তিনি জোরে শ্বাস নিচ্ছেন। তাঁর উদর ফুলে উঠছে। আর সেই শ্বাসের সঙ্গে ঢুকে পড়ছে চন্দন ও ধূপের উদার গন্ধের মিশেল। আত্মস্থ হওয়ার চেষ্টা করলেন মল্লিনাথ। সমস্ত আয়োজন পূর্ণ। পূজা তাঁকে করতেই হবে। আজ স্বহস্তে তাঁর তৃতীয় পূজা। এতদিন পুরোহিত শ্রীকান্ত চক্রবর্তী দায় মেনেছিলেন। তিনি মারা যাবার পর মল্লিনাথ স্বয়ং পূজার ভার নিয়েছেন। হাসপাতাল থেকে অবসর নিয়েছেন। শুধু চেম্বার করেও অনেকটা সময় পান। নিত্যকার ফুলজল আগেও দিতেন, এখন অমাবস্যায় পূজার ভার নিলেন। অনেকে বারণ করেছিল। কিন্তু পূজা না করে মল্লিনাথেরও আর উপায় ছিল না।

ধীরে হাত জোড় করলেন তিনি। তাঁর চোয়াল দৃঢ় হল। প্রণাম সেরে ডান হাতটি গোকর্ণের আকারে নিলেন। মাষমাগ্ন পরিমাণ জল গ্রহণ করে জোরে জোরে, হয়তো-বা, অন্যান্য পূজার দিনের চেয়ে অনেক বেশি জোরে উচ্চারণ করলেন—

ঐং হ্রীং শ্রীং ক্লীং কালিকে
ক্লীং শ্রীং হ্রীং ঐং আত্মতত্ত্বায় স্বাহা।…

ক্রমশ ওষ্ঠ, মুখ, দক্ষিণ ও বাম নাসা, চোখ, কান, নাভি, বুক শুদ্ধ করে চলেন তিনি। একাগ্রে উচ্চারণ করে যান কপালিনৈঃ, কুরুকুল্লায়ৈ, বিরোধিন্যৈ, বিপ্রচিত্তায়ৈ… আচমন ক্রিয়া সম্পন্ন হয়, পূজা শুরু হয় এবং আস্তে আস্তে পূজায় ডুবে যান মল্লিনাথ, আর পাশের ঘরে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রের প্রয়াণ হতে থাকে। একা, অসহায়ের মতো, অজ্ঞান অচৈতন্য অবস্থায় সে কালের গর্ভে ঢুকে যায়।

পূজা শেষ করে বেরিয়ে এলেন মল্লিনাথ। কোথাও কোনও শব্দ নেই। সম্ভবত তাঁরই মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ এতক্ষণ জেগে ছিল। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। কী যেন হয়েছিল, কী যেন করার কথা তাঁর— সহসা মনে পড়ল না। মাথায় হোমের শিখা জ্বলজ্বল করছে। বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ একটা টিকটিকি ওপর থেকে খসে একেবারে জলন্ত স্থণ্ডিলের মধ্যে পড়েছিল। মল্লিনাথ তখন চোখ বন্ধ করে মন্ত্র পড়ছিলেন। টিকটিকিটাকে দেখতে পাননি তিনি। কিন্তু মাংস পোড়ার কটু গন্ধে পূজার পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল। দু’ চামচ পরিমাণ ঘি ঢালতে ঢালতে মল্লিনাথ কারণ বিশ্লেষণ করেছিলেন যে, যেহেতু এ ঘরে তিনি ছাড়া দ্বিতীয় মাংসসর্বস্ব প্রাণী টিকটিকিই, সেহেতু এই প্রাণীটির পক্ষেই পুড়তে থাকা সম্ভব। হোমাগ্নিতে অবাঞ্ছিত বস্তু পড়লে কোনও ক্রিয়াবিধান আছে কিনা মল্লিনাথ জানেন না। হয়তো আছে। হয়তো নেই। সব কিছুই ঈশ্বরের ইচ্ছায় ঘটে থাকে ধরে নিলে এই পতনও তাঁরই অভিপ্রায় এ কথা মনে আনার চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু আজ যুক্তিবোধ স্ববশে নেই। তাঁর হঠাৎ মনে হতে লাগল এ কোনও ইঙ্গিত। কীসের ইঙ্গিত!

ছোটবেলায় মল্লিনাথ টিকটিকি ভয় পেতেন৷ দেখতে পেলেই ছুটে গিয়ে ঠাকুরমা’র কোলে মুখ লুকোতেন। ওরা উড়তে পারে এবং যে-কোনও সময় গঙ্গাফড়িংয়ের মতো গায়ে এসে বসতে পারে এ বিশ্বাস দৃঢ় ছিল তাঁর। একদিন ঠাকুরমা একটি মজার গল্প শোনালেন তাঁকে। বললেন—ঈশ্বরের সমস্ত সৃষ্টির পেছনেই একটি কার্যকারণ সম্পর্ক আছে। তিনি যখন সব প্রাণী গড়লেন, তাঁর বিশাল বাগানে আর জায়গা নেই, সব প্রাণহীন মূর্তি হয়ে আছে…

মল্লিনাথ বলেছিলেন—প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়নি তখনও ঠাকুমা?

প্রাণ প্রতিষ্ঠা জানতেন মল্লিনাথ। রূপচাদদাদু প্রতি বছর নতুন প্রতিমায় প্রাণ দিতেন। এই কাঠামোতেই সে-প্রতিমা বসাতেন। প্রাণ দেবার আগে পর্যন্ত প্রতিমার হাত, চুল, গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতেন মল্লিনাথ কিন্তু প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হবার পর আর সাহস হত না। মনে হত, হাত দিলেই ওই প্রতিমার গা মানুষের শরীরের মতো নরম ও উষ্ণ লাগবে। তাঁর ভয় করত।

ঠাকুরমা মল্লিনাথ থর প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন—

সেইটাই তো গল্প। সব মূর্তি তৈরি। একটা বিশাল পিপেয় প্রাণ রাখা আছে। যার যতটুকু জায়গা, ভরে দেওয়া হবে। ভরা শুরু হল। যার জন্য যেমন প্রাণ তেমনই জায়গাও তৈরি। গোরু, ভেড়া, কুকুর, ছাগল, বাঘ, সিংহ, বেড়াল, ইঁদুর, পাখি, ফড়িং, বোলতা, উচ্চিংড়ে, মৌমাছি, কেঁচো, জোঁক, উকুন, ছারপোকা সব প্রাণ পেতে লাগল আর টুপটাপ পৃথিবীতে পড়তে লাগল। কোনও ঝামেলা হল না। কিন্তু গোল বাধল মানুষকে নিয়ে।

দেওয়ালের কোণ থেকে অমনি একটা টিকটিকি ডেকে উঠেছিল— টিক টিক টিক টিক। মল্লিনাথ ঠাকুরমার আরও কাছ ঘেঁষে বসেছিলেন। ঠাকুরমা বলেছিলেন—ঠিক ঠিক ঠিক। আমার গল্প পুরোটা শুনলে আর একটুও ভয় করবে না।

মল্লিনাথ ঠাকুরমার নরম শাড়ির প্রান্ত মুঠোয় নিয়ে বলেছিলেন— বলো, ঠাকুমা বলো।

নলিনীবালা, মল্লিনাথের ঠাকুরমা বলেছিলেন—সব পশু পাখি পতঙ্গ কীট চলে যাবার পর ঈশ্বর মানুষের প্রাণ দিতে গিয়ে দেখেন প্রাণ রাখার জায়গাই তার নেই। ইস্‌ স্‌ স্‌৷ ঈশ্বর বলতে থাকলেন। কী ভুল হল! কী ভুল করলাম! সবচেয়ে বেশি বুদ্ধি দিয়ে, সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা দিয়ে, শেষ পর্যন্ত কি-না প্রাণ দেবার জায়গা নেই! কী করা যায়! স্বর্গের নাপিত এসেছিল ভগবানের গোঁপ কাটতে। সে বললে— এত চিন্তার কী আছে মহারাজ! মহাঠাকুর! মহাস্রষ্টা! ওই যা মালপত্র পড়ে আছে তা দিয়ে মানুষের প্রাণ ধরার মতো ছোট কিছু তৈরি করে তাতে মানুষের প্রাণ পুরে দিন। ওটাও রইল, মানুষও রইল। ভগবান খুব খুশি হলেন। তাঁর নাপিতেরও কত বুদ্ধি। বললেন—বাঃ। বেড়ে বুদ্ধি তো তোর! যাঃ! আমার গোঁপটা কামিয়ে তৃতীয় স্তরে চলে যা। নাপিতের পদোন্নতি হল। আভিজাত্য বাড়ল। সে একেবারে নিখুঁত করে ভগবানের গোঁপ চাঁছতে লাগল আর সেই ফাঁকে ভগবান দু’ আঙুলে একটা টিকটিকি গড়ে ফেললেন আর তাকে দেওয়ালে চলার উপযুক্ত করে দিলেন কারণ নইলে মানুষই ওকে মাড়িয়ে দেবে আর তাতে ওর নিজেরই বিপত্তি হবে। এ সব হল, তারপর তিনি টিকটিকির মধ্যে পুরে দিলেন মানুষের প্রাণ।

মল্লিনাথ বিশ্বাসে ও বিস্ময়ে বলেছিলেন—ও ঠাকুমা! তাই! সত্যি ঠাকুমা!

দেখিস না, বুদ্ধি অত হলে কী হয়, মানুষের প্রাণটা সেই এতটুকুনি। দিব্যি টিকটিকির মধ্যে ধরে গেল তা। সেই থেকে ওরা সব মানুষের প্রাণ বয়ে বেড়ায় আর মানুষের ঘরে ঘরে থাকে। কামড়ায় না। কাঁদে না। চেঁচায় না। তো ওকে অত ভয় করার কী আছে? কোথাও কোনও টিকটিকির মৃত্যু হল তো জানবে কোথাও কোনও মানুষ মারা গেছে।

মল্লিনাথ বলেছিলেন—আর টিকটিকির নিজের প্রাণটা কোথায় রইল ঠাকুমা? ভগবান সেটা কোথায় রাখলেন?

জোরে জোরে হেসেছিলেন নলিনীবালা। মল্লিনাথের ঝুঁটি ধরে বলেছিলেন— আচ্ছা বাপু, তোমার সঙ্গে কথায় পারা ভার। টিকটিকির প্রাণ ভগবান নিজের পকেটে রেখে দিলেন। ওরা দেখতে একটু খারাপ বটে। লেজ খসিয়ে ফেলে আর পোকা ধরে খায় তাও ঠিক। ছোট ছোট নখও তুমি ওদের আঙুলের ডগায় দেখতে পাবে, কিন্তু জেনো ওরা খুবই পবিত্র প্রাণী।

তীব্র হর্ন বাজল। পি ডব্লু ডি রোড দিয়ে কোনও ট্রাক গেল হয়তো। ওই রাস্তায় সারা দিনরাত ট্রাক যাবার বিরাম নেই। দিনের বেলা অন্যান্য আওয়াজে মিশে হর্নের শব্দ এত তীব্র লাগে না। কিন্তু শেষরাত্রের স্তব্ধ পরিমণ্ডলে মল্লিনাথ ওই শব্দে কেঁপে উঠলেন। যেন কেউ তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে তাঁকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনল। তাঁর মনে পড়ল অমলেন্দুর কথা। মনে হল ও কি চলে গেল? তখনই? যখন খসে পড়ল টিকটিকিটা? মল্লিনাথের বিজ্ঞান পড়া, চিকিৎসক মস্তিষ্কে ভয় উঁকি দিল। তিনি অমলেন্দুর বিছানার কাছে এই প্রত্যাশা নিয়ে ছুটে গেলেন যে এখনও তার বুকের ওঠাপড়া দেখতে পাওয়া যাবে। অক্সিজেনের নল এখনও সক্রিয় থাকবে। স্যালাইনের বোতল থেকে ওষুধ সমেত ফোঁটা ফোঁটা জল ঢুকতে দেখা যাবে তার শরীরে। আর তাকে বাঁচিয়ে রাখবে! কিন্তু এত কিছু দেখার আগে মাধবীকে দেখে চমকে গেলেন মল্লিনাথ। দু’হাতে অমলেন্দুর মুখ ধরে কপালের কাছে নিজের মুখ ঝুঁকিয়ে এনেছেন মাধবী। লিলি নিঃশব্দে অমলেন্দুর পায়ের কাছে বসে আছেন। মল্লিনাথকে দেখেই তিনি বললেন, পা দু’টো বরফ হয়ে আছে দাদা।

মল্লিনাথের বুক কাঁপল। তিনি ছেলের পায়ে হাত দিলেন। হলুদ মৃদু বিষণ্ণ আলোয় তিনি মৃত্যুর অভ্রান্ত খবর পেলেন। তবু অসীম প্রত্যাশায় বা ডাক্তারি অভ্যাসবশে ছেলের হাত টেনে নাড়ি দেখতে গেলেন। আর মাধবী এক ঝটকায় হাতখানি টেনে নিয়ে বলতে লাগলেন, চুপ। ধোরো না। অনেকক্ষণ চেষ্টা করে ঘুম পাড়ালাম। মল্লিনাথ দেখলেন মাধবীর দু’হাতের মধ্যে থাকা অমলেন্দুর মৃত মুখ মুক্তি পেয়ে একপাশে কাত হয়ে গেল। তিনি লিলির দিকে তাকালেন। তাঁর ঠোঁটের দু’পাশে গভীর ভাঁজ। কপাল কুঁচকে গেছে। দুই ভ্রূর মাঝ বরাবর জীবনের নিষ্ঠুর রসকলি। লিলি বুঝলেন। তাঁর চোখ জলে ভরে গেল। মল্লিনাথের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে রইলেন তিনি। কষ্টের সঙ্গে, বেদনার সঙ্গে, ভয়ের আভাস লাগল সে চাওয়ায়। মাধবী অনেকদিন এত কথা বলেননি। আজ বলছেন কেন? অমলেন্দুর মৃত্যু কি তাঁরও স্থবির স্নায়ুগুলি নাড়িয়ে দিচ্ছে? আশ্চর্য আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে দু’জনের মাঝে। মল্লিনাথের দীর্ঘ ঋজু ও সবল শরীর ভেঙে নুয়ে পড়তে চাইছে। টালমাটাল পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন। পূজার পোশাক ছেড়ে আসছেন। একখানি পাজামা ও পরিষ্কার পাটভাঙা পাঞ্জাবি পরছেন। শীত করছে তাঁর। দূরে কোকিল ডাকছে। তা হলে কি বসন্ত এল? মল্লিনাথ সোফায় শুয়ে পড়েন। তাঁর দু’চোখ থেকে জল গড়ায়। তবু তিনি নির্মমভাবে নিঃশব্দে থাকেন। মনে মনে বলেন— অমল, চলে গেলি কেন? এভাবে গেলি কেন? আমাকে এত দূরে ঠেলে দিলি কেন?…তাঁর হৃদয় স্তব্ধ হয়। একবারও ঈশ্বরের কথা মনে পড়ে না। অমলেন্দুর নিটোল বালকবেলা বা কৈশোরের কথা মনে পড়ে না। শুধু ধ্বংস হতে থাকা, ক্ষয় হতে থাকা অমলেন্দু ঘুরেফিরে আসে। মল্লিনাথ সব কিছুরই জন্য নিজেকে দোষী করেন। নিজেকেই দায়ী করেন। ছেলের ক্ষয় চোখে পড়েনি বলে, ধ্বংসের খবর রাখেননি বলে নিজের মধ্যেকার বহু নিরাসক্তি ও ঔদাসীন্যের প্রতি আঙুল তোলেন তিনি। অন্ধকারে একটি টিকটিকি শব্দ করে ডেকে ওঠে। মল্লিনাথ শুনলেন এবং নিঃশব্দে উচ্চারণ করলেন ঠিক ঠিক। তখন মাধবীর গলা পাওয়া গেল। ধমকাচ্ছেন লিলিকে— আঃ। কেঁদো না তো৷ ওর ঘুম ভেঙে যাবে!

লিলি ছুটে এলেন মল্লিনাথের ঘরে। মল্লিনাথের বুকের ওপর পড়ে কান্নার দমকে দমকে বলতে লাগলেন, ও দাদা গো! দাদা! আর পারি না!

মল্লিনাথ, লিলির মাথা আঁকড়ে ধরলেন বুকের ওপর।

পাড়ার উত্তর কোণ থেকে রাস্তা ঝাঁট দিতে দিতে ফিরছিল হরিচরণ। তার পাশ দিয়ে ব্যস্ত পায়ে ছুটে যাচ্ছিল অন্ধর মা। হরিচরণকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, হরিদা, শুনছেন নাকি?

অন্ধর মা’র কথায় বিশেষ খবরের গন্ধ পেয়ে ঝাঁটা বেলচা সরিয়ে রেখে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে এগিয়ে এল হরিচরণ। গোঁফের প্রান্তগুলি দু’-চারবার মুচড়ে বলল, কী হল আবার?

অন্ধর মা গলা খাটো করে বলল, শুনেন নাই? কাইল রাইতে ডাক্তারবাবুর বড় পোলাডা মইরা গ্যাসে। আমার অন্ধ কাইলৈ কইসে, মা, আমি য্যান সারাদিনৈ হরিবোল-হরিবোল শুনি…

হরিচরণ কিছুক্ষণ হাঁ করে থাকে। তার গোল ফুলকো গাল ও খুদে চোখ দু’টি আরও ঝুলে পড়তে থাকে। গোঁফের প্রান্ত নেমে যায়। সে প্রশ্ন করে, ডাক্তারবাবুর ছেলে? কোন ছেলে?

অন্ধর মা তেমনই ফিসফিসিয়ে বলে, কইলাম না, বড় পোলা? ডাক্তারি পড়তেয়াসিল।…

সে আক্ষেপ করে চলে—বদসঙ্গে পড়ল ছেলেটা। জানেন তো! অমন সোনার টুকরো ছেলে একেবারে জলে চলে গেল। ডাক্তারবাবুর জন্য যে কী খারাপই লাগে! ওইরকম মানুষ— লোকের বিপদে-আপদে সবসময় পাশে। আমার মলিনার বিয়ের সময় গিয়ে বলতেই এক কথায় একশো টাকা দিয়ে দিলেন। বললেন— ভাল করে বিয়ে দিস। ছেলে-মেয়ের অসুখে-বিসুখে যখনই যাই, একটা পয়সা নেন না। ঠাকুর দেবতায় কত ভক্তি! এই মানুষের কী কপাল! বউটা পাগল! ছেলেটার মরণ হল! ভগবানের কি সত্যি চোখ নেই গো!

সে চোখের জল মুছতে আঁচল চাপা দেয়। বলতে থাকে— আমার অন্ধয় কয়, মা, ভগবানের চোখ নাই। আমার লাখান অন্ধ, অন্ধ। আমি কই, কানও কি নাই তোমার ঠাকুর?

হরিচরণের মুখও দুঃখে ম্লান হয়ে আসে। ডাক্তারবাবু সত্যিই মানুষ ভাল। এই এলাকায় গরিবের ডাক্তার বলতে তিনিই। পুরনো ডাক্তার আর ক’জন? নতুন যাঁরা বসছেন, গরিব-গুর্বো মানেন না। যতই অসুবিধা থাক পুরো ভিজিট চাই। আশেপাশের বস্তির মানুষ শিবতোষ বা সুবীরব্রত ডাক্তারের কাছে তাই যেতে চায় না। ও দিকে শীতল ডাক্তার আছেন বটে। তবে তাঁর চোখ এখন কম দেখে। কানও কম শোনে। ওষুধের চিঠি লিখতে হাত কেঁপে যায়।

হরিচরণ অকারণে হাত ঝাড়ে দু’বার। অকারণে গোঁপ পাকায়। বলে, জয় শ্রীরাম! জয় হনুমান! দেখো ভগবানের কী ইচ্ছে সে আর আমরা কী বুঝব! তুমি কেঁদো না অন্ধর মা।

অন্ধর মা চোখ মোছে। ধরা গলায় বলে, হ। এই আমাগো দ্যাহেন। ভগবানের পুষ্যি। কী পাপ করছিলাম ক্যাডা জানে! সুখ-শান্তি ট্যার পাই না। আধা প্যাটে খাইয়া, লাত্থি কিল গুতা খাইয়া, বাঁইচা আসি।…

সে চলে যায়। হরিচরণও ঝাঁটা-বেলচা গুটিয়ে ভ্যানে তোলে। আজ আর পরিষ্কার হবে না। অন্য দিকটা ওসমান পরিষ্কার করছিল। সেও হয়তো এ খবর শুনে কাজ ফেলে চলে আসবে। আর আসবেই-বা না কেন! ডাক্তারবাবুকে এ পাড়ায়, এ অঞ্চলে কে না চেনে! সে ভ্যান ঠেলে ডাক্তারবাবুর বাড়ি অভিমুখে যায়। পথে যেতে যেতে দেখে এ বাড়ি ও বাড়ির বাবুরা, ছেলেরা, শিশুরা সব বেরিয়ে পড়েছেন। সবারই চোখে-মুখে ঘুম লেগে আছে। এখনও দৃষ্টিতে সকাল ফোটেনি। গৃহিণীরা জানালার পর্দা তুলে আছেন। কে আসে কে যায় দেখছেন বুঝি! মাধবীর তো কোনও বন্ধু নেই, দুপুরের-বিকেলের কেনাকাটার সঙ্গিনীও নেই। এ সবে আর প্রয়োজন নেই তাঁর। কিন্তু পাগল মানুষটির জন্য সব গৃহিণীর বুকেই একঘর সমবেদনা। কিন্তু তা হলেও, এই সাতসকালে একটু সংসার না গুছিয়ে কেমন করেই বা তাঁরা বেরোন! শুধু গেলেই তো হল না। মড়ার বাড়ি। আবার রাতে মারা গেছে মানে বাসি মড়া। ফিরে এসে স্নান করা, ধোয়া, কাচা সব করতে হবে। সে-সব না করে সংসারে কিছুটি করার জো থাকবে না। রবিবার হলেও নয় কথা ছিল। কিন্তু আজ অফিস-কাছারি প্রত্যেকেরই আছে। ডাক্তারবাবুর ছেলে মারা গেছে খুবই দুঃখের কথা। কিন্তু তার জন্য তো অফিস কামাই হবে না। জনজীবন দাঁড়িয়েও থাকবে না এতটুকু!

হরিচরণ ভ্যান ঠেলতে ঠেলতে চলল। বাঁধানো রাস্তার খোয়া উঠে গেছে এখানে সেখানে। লোহার চাকায় ঘটাং ঘটাং শব্দ উঠছে। হরিচরণ চলতে চলতে মল্লিনাথ ডাক্তারের কথা ভাবছে। সত্যি কী কপাল! রামজির কী ইচ্ছা কে জানে! সে দু’হাত দিয়ে ভ্যান ধরে আছে, তাই কপালে হাত ঠেকাতে পারছে না। মনে মনে রামজির পায়ে মাথা রাখছে। হরিচরণ জানে ডাক্তারবাবুর ছেলে খারাপ নেশাটি করত। এ পাড়ার অনেক ছেলেই করে। কাজল, সুজন, মৃণ্ময়, অমিতাভ। কত ভাল পরিবারের ছেলে সব! কত বড়লোক বাপ-মায়ের ছেলে! হরিচরণ অনেকদিন ওদের ওই ক্লাবটিতে দেখেছে। দরজা বন্ধ করে নেশা করে সব। কিন্তু রেললাইনের উঁচু অবস্থান থেকে জানালা দিয়ে সব দেখা যায়। পুরিয়া খুলে সিগারেটের রাংতায় সাদামতো গুঁড়ো ঢালে। নীচ থেকে দেশলাই বা লাইটার জ্বেলে আস্তে আস্তে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাপ দেয়। সাদা গুঁড়োগুলো পুড়তে থাকে। ওরা শার্ট খুলে মাথার ওপর দিয়ে নেয়। প্রায় অদৃশ্য ধোঁয়া বুক ভরে নিজের মধ্যে শুষে নেয়। একসঙ্গে বেশ কয়েকটি প্রসন্ন প্রশ্বাস নিতে থাকে সবাই। আস্তে আস্তে ওদের চোখ দু’টি নিঝুম হয়ে আসে। অদ্ভুত মোহশূন্য অভিব্যক্তির তলায় ওরা ডুবে যায়।

হরিচরণ জানে না এ নেশার কী নাম। জানার আগ্রহও বোধ করেনি কখনও। তার নিজের কোনও নেশা নেই। আগে বিড়ি খেত। এখন ছেড়ে দিয়েছে। তুলসী একদিন বলল, কত পয়সা বিড়িতে দাও?

হরিচরণ বলেছিল, তা হবে, পনেরো টাকা-কুড়ি টাকা মাসে।

তুলসী বলেছিল, সে-পয়সায় ফল এনো বরং বাচ্চাদের জন্য। আর নেশা কোরো না।

সুতরাং হরিচরণ বিড়ি ছেড়ে দিয়েছে। পালায়-পার্বণে একটু চুল্লু খায় বটে কিন্তু তাতে তুলসী রাগ করে না। সুতরাং হরিচরণ, এই সব গুঁড়ো নেশা, যাতে বাবুদের ছেলেরা ডুবে থাকে, তার নাম জানে না আর জানতেও চায় না। কারণ সে বুঝেছে, এ নেশার নাম অভিসম্পাত। যারা এ নেশা করে, হরিচরণ দেখেছে, তারা সরু ও দুর্বল হয়ে যায়। এবং অবশেষে বুঝি মরেও যায়। যেমন মরে গেল অমলেন্দু।

যেতে যেতে পরেশবাবুর বাড়ির সামনে একবার নাক কোঁচকাল হরিচরণ। সারা পাড়ার মধ্যে এই বাড়িটির সামনে সবচেয়ে বেশি ময়লা জমে থাকে। এ বাড়ির সামনে একফালি বাগানের রিক্ততা ঢাকতে একটি মাত্র নাম-না-জানা হলুদ ফুলের গাছ, যা এই প্রাক্‌ বসন্তে ফুটে আলো হয়ে আছে। তারই তলায়, প্রায় ঢোকার মুখেই জঞ্জাল। তরকারির খোসা ও মাছের আঁশ, ভাত, আধ-পোড়া রুটি, ছাই, এমনকী মেয়েদের রক্তকাপড়। হরিচরণ আনমনে ভাবে, একটু ঢাকতে পারে না? একটু কাগজে মুড়ে ফেলতে পারে না? সবাই কি চোখে পড়লেই, নিশ্চিত বোঝে না, এ কাপড় কার?

জঞ্জাল না তুলে চলে যেতে যেতেও থমকে দাঁড়াল হরিচরণ! পরেশবাবুর স্ত্রী শবরী ডাকছেন। একতলার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। পলাশফুল রঙের শাড়ি পরা। খোলা চুল। চুলের রাশির নীচে তলিয়ে আছে মসৃণ অনাবৃত কাঁধ। কিছু ভারী, কিছু রুক্ষস্বরে তিনি বলছেন, হরিচরণ! কী হল! আমার বাড়ির সামনেটা আজ পরিষ্কার করলে না?

হরিচরণ কথা বলতে পারে না। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আগুনের মতো নারী এবং তাঁরই ব্যবহৃত রক্তচিহ্নিত খোলামেলা কাপড়ের টুকরোগুলি তাকে বাকরহিত করে দেয়। সে যত দূর সম্ভব শবরীর দিকে পেছন ফিরে ঝাঁটা-বেলচা হাতে নেয়। তখন ঘরের ভেতরে হারমোনিয়ামের শব্দ ওঠে। কোনও নির্দিষ্ট সুরে নয়, যেন কিছুটা অন্যমনস্ক, চিন্তামগ্ন কিছুটা, এমনই ভাবে হারমোনিয়ামের গায়ে আঙুল চালায় কেউ। শবরীর ভ্রূ কুঁচকে যায়। তিনি দু’বাহু তুলে খোলা চুলের রাশে খোঁপা আঁটেন। তাঁর হাতের নীচ থেকে উঁকি মারে জটিল অন্ধকার। হরিচরণের কানে আসে, শবরী বলছেন, ছি! থামাও এ সব। তুমি কি মানুষ! পাশে এত বড় একটা ঘটনা হল আর তুমি হারমোনিয়াম নিয়ে—ছি!

একটি ভরা পুরুষ কণ্ঠ চড়া শব্দে হেসে বাজে। হরিচরণ বোঝে, এ কণ্ঠ পরেশবাবুরই। তিনি বলেন, বাঃ! বা বা! সকালবেলায় তুমি স্নান করে, ক্রিম মেখে লোলাপাঙ্গী হয়ে বসে আছ যে! সেখানে তো কোনও শোকের চিহ্ন নেই। আমি শালা গান গাইলেই দোষ?

শবরীর তীক্ষ্ণ ও খসখসে স্বর শোনা যায়, বাজে বোকো না। তুমি কি চেয়েছিলে, শোক বোঝাবার জন্য আমি রাস্তায় গিয়ে ধুলো মাখব?

—না না। তুমি ধুলো মাখতে পারো? তুমি শালি পাফ্‌ফিউম মেখে মল্লিনাথ ডাক্তারকে চুমু খেয়ে এসো। উম্‌ম্‌ম্‌। তোমার চুমু খেলে ডাক্তার ছেলের শোকও ভুলে যাবে।

কোনও কিছু আছড়ে পড়ার শব্দ হয়। হয়তো বহুধাবিভক্ত হয় কোনও মূল্যবান বস্তু। ভেঙে ফেলার তীব্র উল্লাসে মাতে আগুন ছুঁয়ে আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলা সম্পর্ক। এ সব শুনতে শুনতে হরিচরণ শেষ বিন্দু ময়লা তুলে নেয় তার ভ্যানে। পরেশবাবু ও শবরীর জন্য মনে মনে শ্রীরামের কাছে প্রার্থনা জানায় সে। এবং ধন্যবাদও জানায় যেহেতু ঈশ্বরের বাগান এই পৃথিবী এবং পৃথিবীর সামান্য ভূখণ্ড পরিষ্কার করার কাজ সে পেয়েছে। সামান্য আবর্জনা দূর করারও অধিকার পেয়েছে।

ভ্যান নিয়ে সে সামনের দিকে চলে যায়। অট্টালিকার ফাঁক-ফোকর দিয়ে তার গায়ে রোদ্দুর পড়ে। আবার সে অমলেন্দুর কথা ভাবে। একদিন নতুন একশো টাকার নোটে ওই গুঁড়ো ঢেলে নোট পুড়িয়ে নেশা করছিল অমলেন্দু। রেললাইনের উঁচু পারে বসে দেখছিল হরিচরণ। তার বাড়িতে সে-দিন একটিও পয়সা ছিল না। ভোরবেলা কাজে বেরুবার আগে তুলসী সে-কথা মনে করে দিয়েছিল। সুরেশকে দুধ খাওয়াচ্ছিল সে। আঁচল দিয়ে দুধ পান করতে থাকা শিশুকে আড়াল করে বলেছিল, মাইনে কবে হবে? ঘরে চাল নেই। আটা যা আছে আজ এ বেলাতেই ফুরিয়ে যাবে।

হরিচরণ বলেছিল, তুমি দুপুরটা চালিয়ে নাও। আমি সাহাবাবুর কাছে দুপুরে কিছু ধার চেয়ে নেব।

এরকম প্রায়ই হয়। হয়ে থাকে। তার জন্য হরিচরণের কোনও ক্ষোভ ছিল না। ভগবান যাকে যেমন দেন। কিন্তু অমলেন্দুকে, সিগারেটের রাংতার পরিবর্তে একশো টাকার নোটে আগুন ধরিয়ে নেশা করতে দেখে, হরিচরণের চোখ জ্বালা করছিল। কালু সাহার ওখানে, দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত অত বস্তা টেনেও সে এ টাকা পায় না। সেই দিন, জীবনে প্রথম, ভগবানের করুণা ও কৃপার প্রতি সন্দিহান হয়েছিল সে। আর তখনই তার পাশ দিয়ে ময়লা, ছেঁড়া শাড়ি পরা, রোগা, প্যাকাটি কিন্তু আশ্চর্য বড় বড় স্তনওয়ালা ফুলরেণু পিঠকুঁজো শরীর নিয়ে, চার হাত-পায়ে ভর করে, হাঁফাতে হাঁফাতে চলে গেল। তার হাতে একটি বাঁশের ঝুড়ি, তাতে গোবর। কুঁজো বলে, ঝুড়ি বইতে হয় বলে, সে যখন হাঁটে তখন তার ঝুঁকে থাকা চলন প্রায় হামাগুড়ির মতো দেখায়। সারাদিন এভাবেই সে চলে। এভাবেই মাঠ, ঘাট ও রেললাইনের ঢিবির ঢালে ঘুঁটে দেয় সে। গুল দেয়। আর এইসব বিক্রি করে আয় করে। হরিচরণ তাকে কখনও অভিযোগ করতে শোনেনি। ভিক্ষে চাইতেও দেখেনি।

ফুলরেণুকে দেখে হরিচরণ সে-দিন ঈশ্বরের ওপর থেকে সব অভিযোগ তুলে নিয়েছিল। যে-শক্তি নিয়ে একা পিঠকুঁজো ফুলরেণু লড়ে যাচ্ছে, সেও তো ঈশ্বরেরই দান। অতএব, এই নানা বৈষম্যের মধ্যেও ঈশ্বরের কোনও কল্যাণের ইচ্ছা থেকে থাকবে, এমনই বিশ্বাস করেছিল সে।

মল্লিনাথের বাড়ির কাছে পৌঁছল হরিচরণ। ঘরে বাইরে ভিড়। তার তো ভেতরে যাবার কোনও উপায় নেই। এক পাশে ভ্যান রেখে উবু হয়ে পথের ধারে বসে পড়ল সে। দেখতে থাকল। লোক আসছে আর যাচ্ছে। সবারই কপাল কুঁচকে আছে। মুখে বিষাদ। এই পাড়া ও তার আশেপাশে প্রায় সবাইকে চেনে হরিচরণ। সে দেখতে থাকে। একধারে চোখে জল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শেফালির মা। সঙ্গে অমরেশ, শ্যামল, কমল। তাঁরা বুঝি-বা শ্মশানে যাবেন। সকলেই কোমরে গামছা বেঁধে আছেন। হরিচরণ ভাবছে, যদি অন্য কোনও অসুখে মারা যেত অমলেন্দু বা কোনও দুর্ঘটনায়, তবে যেন ডাক্তারবাবু কিছু সান্ত্বনা পেতেন। অথবা, কে জানে, এই নেশা, এও হয়তো এক গুরুতর অসুখ এবং যে-কোনও ছেলে-মেয়ের জীবনেই এও এক বিশাল দুর্ঘটনা!

অবশেষে সমরেন্দ্র ও আনিসুজ্জামান কাজে যাবার পরিকল্পনা ত্যাগ করলেন। মল্লিনাথের সঙ্গে সারাদিন থেকে যাওয়াই সাব্যস্ত করলেন তাঁরা। বিকাশ আর রণেনও অনেকক্ষণ রইলেন। কিন্তু তাঁদের পক্ষে অফিস কামাই করা সম্ভব হল না। দিব্যেন্দু, ব্রজগোপালের ছেলে, অমলেন্দুর বন্ধু হিসেবে শ্মশান যাবার জন্য তৈরি হয়েছিল। ব্রজগোপাল তাই দোকান সামলাবার জন্য থেকে গেলেন। মল্লিনাথ এবং তাঁর সঙ্গীদের ছেলেরা, একই পাড়ায়, পরস্পরের বন্ধু হয়েছে, এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। যদিও এইসব ছেলেদের শিক্ষার মান, রুচি, পেশা ও জীবনযাপনে পরস্পরের মধ্যে অমিল রয়েছে। একসঙ্গে বেড়ে ওঠার টান তবু থেকেই যায় একরকম। প্রায় আজীবন।

পরেশ বোসের ছেলে অনুপম, দেবোপম; বিকাশের ছেলে দেবাশিস, রণেন সেনের ছেলে নিখিলেশ— প্রত্যেকেই অমলেন্দুর বন্ধুই। কিন্তু তাদের কারওকে কোনওদিন ক্লাবের নেশার আসরে দেখা যায়নি। কলেজের পড়া শেষ করে অনুপম এল আই সি-তে ঢুকেছে। দেবাশিস ব্যাঙ্কে। দেবোপম চাকরি পায়নি। ট্যুইশন করছে। নিখিলেশ কয়লার দোকান দিয়েছে পাড়ায়। কেরোসিন তেলের ডিলারশিপও পেয়েছে। নেশার জন্যই হোক বা ডাক্তারি পড়তে গিয়ে পাড়াছাড়া হয়েছিল বলেই হোক, শেষের দিকে অমলেন্দুর সঙ্গে অনুপম-দেবাশিসদের আর তেমন যোগাযোগ ছিল না। অথচ একাত্তর-বাহাত্তরের সেই তুমুল সময়ে সমস্ত অকারণ অভিযোগ ও নির্মম হত্যার হাত থেকে একসঙ্গে পালিয়ে বেড়িয়েছে তারা। নকশাল আন্দোলনের সমর্থনে বা অসমর্থনে নিজেদের মধ্যে তর্ক করেছে। সমর্থন করা বা না-করা বিষয়ে তারা খুবই সংশয়ে ছিল তখন। শঙ্কিত হয়েছিল দেবার্চন আর নীলাদ্রিকে নিয়ে। তাদের চেয়ে ছোট ছিল ওরা কিন্তু তবু, নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল। তবু, সেই সময়কার সমস্ত নির্ধারিত বর্তমানের অশান্ত উত্তাল তীব্রতার পর ধীর অবতরণ প্রক্রিয়ার কালে ছিটকে গিয়েছিল অমলেন্দু, আর ঢুকে পড়েছিল কাজল, সুজন, মৃণ্ময় আর অমিতাভর দলে। গভীর নেশায় অতিপৃক্ত হয়ে গিয়েছিল। ওরা কেউই কলেজ পেরুল না। মৃণ্ময় ছাড়া অন্য সকলেই পৈতৃক ট্রাক বা বাসের ব্যবসা চালাবার প্রস্তুতি নিল। মৃণ্ময়ের সে-সুযোগ ছিল না কারণ তার বাবা সেতারি মিথিলেশ ব্যানার্জি, উত্তরাধিকার সূত্রে ছেলেকে সেতার ছাড়া আর কিছুই দেবার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। মৃণ্ময় সেতারে আগ্রহী না হয়ে ম্যান্ডোলিন তুলে নিল আর নিউ মার্কেটের রেস্তোরাঁয় একটি ব্যান্ড বাজিয়ের দলে সঙ্গত করতে লাগল। প্রত্যেকেই হাতে পেল কিছু কাঁচা পয়সা আর তাই নিয়ে সতেরো-আঠারো বছর বয়সেই মদ নিয়ে চলে গেল সোনাগাছির দেহপসারিণীদের পাড়ায়। নিখিলেশ, দেবাশিস, অনুপমরা তখন বাড়ির অনুমতি ছাড়াই সিনেমা যাচ্ছিল বটে কিন্তু মদ ছুঁতে পারেনি। অন্য পাড়ায় যাবার তাগিদ বোধ করেনি। চারবার ‘কাটিপতঙ্গ’ দেখে পাগল হয়েছে এক-একজন আর ওইসব বন্ধুদের মদ ও মহিলাজনিত অভিযান বিষয়ে দমবন্ধ করা গল্প শুনেছে। বয়ঃসন্ধিকাল পেরুলে এতে আর তাদের রুচি ছিল না, তখন যেন একটু গভীর হওয়ার ইচ্ছে জাগল তাদের মধ্যে আর দেখা বা শোনার বিষয়েও তারা ছাঁকনি ব্যবহার করতে চাইল। ফলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঠাকুরদা-ঠাকুরমাকে পোড়াতে গেলেও একটি অনিবার্য মেরুকরণে অভ্যস্ত হয়েছিল তারা। দিব্যেন্দু, অনুপম, দেবোপম, নিখিলেশ ও দেবাশিস ক্রমশ সুন্দর হয়েছে। যৌবনোজ্জ্বল ও স্বাস্থ্যবান হয়েছে, কিন্তু কাজল, সুজন, মৃণ্ময় ও অমিতাভ ক্ষয়িষ্ণু হতে থেকেছে কেবল। বিলিতি মদ আর চুল্লু, গাঁজা আর চরসের থেকে ক্রমে গিয়ে পড়েছে হেরোইনের গর্তে। আর এই দুই মেরুর ঠিক মাঝখানে বহুদিন থেকে গিয়েছে অমলেন্দু। সে পড়ে ভাল ফল করেছে আবার গাঁজাও টেনেছে। নকশাল আন্দোলন সম্পর্কে বা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গভীর মতামত দিয়েছে দিব্যেন্দু-দেবাশিসের কাছে, আবার কাজলদের সঙ্গে সোনাগাছিতেও হামলা করেছে।

তার জন্য এখন খাটে ফুল লাগাচ্ছে দু’প্রান্তের বন্ধুরাই। আর ভাবছে ছোট ছোট স্মৃতি। কবে গুলি নিয়ে ঝগড়া করেছিল কোন ছোটবেলায়। কবে খেলতে গিয়ে ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে মেরে অমলেন্দুর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল সুমন। অঙ্ক পরীক্ষায় কাজলকে খাতা দেখাতে গিয়ে ভূগোল স্যারের কাছে ধরা পড়ে মার খেয়েছিল অমলেন্দু। সেই অমলেন্দু এখন ঘুমন্ত, কৃশ, মলিন। দেবাশিস তার পোশাক বদলে তাকে ধুতি ও পাঞ্জাবি পরাচ্ছে। যদি ঠিক ঠিক চলত অমলেন্দুর জীবন তবে আর দু’-এক বছরের মধ্যেই এই পোশাক তার পরার কথা ছিল। দেবাশিস জানে, শৈশব থেকে সব ছেলেরই ওই পোশাক সম্পর্কে একটি স্বপ্ন তৈরি হয়। ওই পোশাক পরার জন্য তারা আকুল হতে থাকে। সেই আকুলতা পাছে প্রকাশ হয়ে পড়ে তাই এই পোশাকের বিরুদ্ধে সোচ্চারও হয় কেউ কেউ। কিন্তু অপূর্ব লজ্জামেশানো ইচ্ছে ক্রমশ রক্তে-মাংসে বাড়তে থাকে সব পুরুষের মধ্যেই।

আয়োজন শেষ হয়েছে। ঘরে কান্নাকাটির কোনও শব্দ নেই। প্রত্যেকেই নিচু গলায় কথা বলছেন। কিছুই যায় আসে না আর এমন মুখ করে দুই চোখ তুলসীপাতায় ঢেকে শুয়ে আছে অমলেন্দু। গতরাতে মল্লিনাথ যে-পূজা করেছিলেন তার প্রসাদ পড়ে আছে যেমনকার তেমন। কারও সে-কথা মনেও নেই।।

শ্মশান যাবার জন্য খুব বেশি লোক আর রইলেন না। মল্লিনাথের আত্মীয় বলতে লিলি ও তাঁর স্বামী সত্যেন। ওঁদের ছেলেমেয়েরা। তারা, মিতা ও সন্দীপ, চুপ করে কোণে বসে আছে। মাধবীর কোনওকালেই কেউ ছিলেন না। যে-মামার কাছে তিনি ছিলেন তাঁকে মল্লিনাথ মুক্তি দিয়েছেন মাধবীকে বিবাহ করেই। অমরেশ, শ্যামল ও কমলকে নিয়ে বসে আছেন। তাঁদের সঙ্গে রইলেন সত্যেন, সমরেন্দ্র, আনিসুজ্জামান ও অমলেন্দুর বন্ধুরা। সকলেই শ্মশান যাবার জন্য তৈরি। কিন্তু মাধবীকে দেখা যাচ্ছে না। তিনি চিলেকোঠার ঘরে চলে গিয়েছেন। তাঁকে শেষ দেখা দেখাবার জন্য নিয়ে এলেন লিলি। মল্লিনাথ চুপ করে আছেন। বড় বেশি সাদা লাগছে তাঁর চুল। গালের মাংস ঝুলে পড়েছে। ষাট পেরোলেও এতদিন বার্ধক্য স্পর্শ করেনি তাঁকে। কাল রাত্রে আশ্চর্য মহাকাল সে-কাজ সম্পন্ন করে গেছে।

দিব্যেন্দু অনুমতি চাইল, ওকে খাটে নিই জ্যেঠামশাই?

মল্লিনাথ নিজের মনে হারিয়ে গিয়েছিলেন। দিব্যেন্দুর কথা শুনতে পাননি। তাঁর কপালে এখনও রক্তচন্দনের টিপ শুকিয়ে আছে। সকলেই বিস্মিত। বিরক্তও। নতুন চোখে দেখছেন এতদিনের পরিচিত লোকটিকে। কী কঠিন মানুষ! নিষ্ঠুরও কি নন! ছেলে মৃত্যুশয্যায় জেনেও পূজা সম্পাদন করেছেন নিজে। মল্লিনাথ সুদূর থেকে চোখ তুলে আনেন, যদি কমল দাদাকে দেখতে চায়, কী বলব? যদি মাধবী বলে আমার ছেলে কোথায় গেল, কী বলব? যে যার প্রাপ্য সব আমার কাছে বুঝতে চাইবে। আমি কেমন করে দেব!…

কথাগুলি নিস্তরঙ্গ বলে যান মল্লিনাথ আর শুনতে শুনতে আনিসুজ্জামানের চোখে জল এসে যায়। পকেট থেকে রুমাল বার করে চোখ মোছেন তিনি।

মল্লিনাথের হয়ে সমরেন্দ্র সম্মতি দেন দিব্যেন্দুকে। তোশক, বালিশ, গায়ের চাদর সমেত ধুতি-পাঞ্জাবি পরা চিরঘুমন্ত বন্ধুকে তুলে নেয় আটজন। এক খাট থেকে শুইয়ে দেয় অন্য খাটে। তাদের নির্ভার লাগে। যেন যা-কিছু ওজন ওই তোশক আর বালিশের। আটজনের ভারসাম্যে তোশকের দোলনায় মহাপ্রস্থানের পথে প্রথম পা রাখে অমলেন্দু। সুমনের গলা ধরে আসে। তার মনে পড়ে যায় মাস দু’য়েক আগেকার কথা। অমলেন্দু বলেছিল— আমি ফুট্টুস হয়ে গেলে—বুঝলি, সুমু, সঙ্গে কিছু পুরিয়া দিয়ে দিস। না হলে শালা ভগবানের কাছে গিয়ে নেশা করব কী করে!

সুমনের কাছে টাকা ছিল না সে-দিন। বলেছিল, পঞ্চাশ ছাড় তো গুরু। ধার রইল। তোর চিতায় পুরিয়া দিয়ে শোধ দেব।

অমলেন্দু পকেট থেকে টাকা বার করছিল যখন, আর দিচ্ছিল সুমনকে, সুমন দেখেছিল অস্বাভাবিক হাত কাঁপছে তার। আজ অমলেন্দু সত্যি ফুট্টুস হয়ে গেল! সুমন ওকে পুরিয়া দিতে পারছে না তো! অমলেন্দু কি বুঝেছিল সে চলে যাবে! কেন বলেছিল ওরকম! সুমনের মাথায় যন্ত্রণা হয়। খাটের কোনায় মাথা রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। ভারী ও বিকৃত গলায় কী যে বলে বোঝা যায় না। বোঝার চেষ্টাও করে না কেউ। অমলেন্দুর মৃত মুখে রোদ্দুর পড়েছে। প্রায় মিশে যাওয়া শরীরে গরদের পাঞ্জাবি চকচক করছে। মিতা একটি সোনালি কলম এনে অমলেন্দুর পকেটে গুঁজে দেয়। এবং কান্নায় কাঁপতে থাকে। সন্দীপ দিদিকে জড়িয়ে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দিতে চায়। তখন, মাধবীকে নিয়ে বারান্দার দরজায় এসে দাঁড়ান লিলি। দোতলার ড্রইংরুম সংলগ্ন বারান্দাতেই রাখা হয়েছে অমলেন্দুর খাট। মল্লিনাথ মাধবীকে দেখে সচকিত হন। তাঁর সঙ্গে অন্যরাও ভয়ংকর কিছু ঘটার সম্ভাবনায় ত্রস্ত হয়ে ওঠেন। রণেন ও বিকাশের স্ত্রী নিভা ও লক্ষ্মী স্বামীদের অফিসে রওনা করে দিয়ে উপস্থিত হন তখন। লিলিকে নিভা বলেন, ওকে বলো লিলি, ছেলে চলে যাচ্ছে। শেষবারের মতো ছুঁতে বলো।

আমি পারব না, কিছুতেই পারব না, বলতে বলতে নতুন করে শোকগ্রস্ত কান্নায় ভাঙেন লিলি। কয়েকটি চড়ুই বারান্দার দিকে উড়ে এসেই আবার পালিয়ে যায়। এই পূর্বাহ্ণে ময়দানের দিকে হেঁটে চলেছে একটি আসন্ন ভোটের মিছিল। প্রিয় নেতা ও নেত্রীর কাট আউট নিয়ে, দলীয় পতাকা উড়িয়ে যেতে যেতে ভোট পাবার দাবি জানায় তারা। রোজ। এক-একটি মিছিলের এক এক রকম দাবি। মাধবী নিশ্চল হয়ে বাইরের দিকে দেখেন। মিছিলের জন্য পি ডব্লু ডি রোডে যানবাহন থেমে যাচ্ছে। তাদের হর্ন ও ধোঁয়ায় বাতাস কলুষিত হল। লক্ষ্মী আঁচলে নিজের চোখ মুছে বলেন, দিদি, পুত্রশোক কী শোক, আমি বুঝি। ছেলে চলে যাবে তোমার। কিন্তু এখনও ও আছে। ওকে আশীর্বাদ করো।

লক্ষ্মী নিজের হাতের চাপ দিলেন মাধবীর হাতে। আর মাধবী সে-হাত ছাড়িয়ে এ পিঠ ও পিঠ দেখে ঘরে চলে গেলেন। লক্ষ্মী আর নিভাও গেলেন তাঁর সঙ্গে। মাধবী রান্নাঘরের সিঙ্কে হাত ধুয়ে এ কৌটো সে কৌটো খুঁজে একমুঠো চিনি নিয়ে ফিরে চললেন বারান্দায়। ধীরে ধীরে পা মুড়ে ছেলের মাথার কাছে বসলেন। গভীর ও অপলক চোখে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। সকলে নীরবে সভয়ে দেখতে লাগলেন মাধবীকে। মাধবী বললেন, যাচ্ছিস? যা। তবে খালি মুখে যেতে নেই বাবা। একটু চিনি মুখে দিয়ে যাও।

হাতের চিনি তিনি গুঁজে দেন অমলেন্দুর ঠোঁটে। ঠোঁট ফাঁক হয় না। শক্ত হিম মুখে চিনির দানা ছড়িয়ে যায়। গড়িয়ে পড়ে গলায়, বালিশে, কানের গর্তে। চিনিতে ঢুকে-পড়া দু’টি-তিনটি পিঁপড়ে অমলেন্দুর মৃত মুখে ঘুরে বেড়ায়। নিভা ও লক্ষ্মী মাধবীকে তুলে নেন। নিয়ে যান ঘরের দিকে। মল্লিনাথ আনিসুজ্জামানের দিকে তাকিয়ে বলেন, জীবদ্দশায় সবচেয়ে বড় শাস্তি কী জানো অধ্যাপক? নিজের হাতে ছেলের মুখাগ্নি করা।

চার বন্ধু খাট তুলতে তুলতে আওয়াজ দেয়। একজন হাঁকে— বলহরি—

সকলে পালটি দেয়— হরিবোল।

আনিসুজ্জামান, একা, স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন৷ মল্লিনাথের বেদনা তাঁকে স্থবির করে দেয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *