২. ঝুমুর ঝুমুর

ঝুমুর ঝুমুর

‘দিদিইইই, এই দিদিইইই।’

‘হ্যাঁ। যাই।’

‘আসবি না নাকি? বাবা স্নানে চলে গেল। খেতে দিবি না? শুধু ভাইকে দেখলে হবে? বোনটাকেও তো দেখতে হবে।’

‘যাই। যাচ্ছি। এখুনি যাচ্ছি। টোপর, টোপর, হাত ছাড়। ডাকাডাকি করছে। যাই। ওরা বেরিয়ে গেলে আবার আসব তখন? সোনা আমার!’

‘ঠিক আসবে তো? আজ আমার এক মুহূর্ত তোমায় ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।’

‘ঠিক আসব।’

ঝুমু ও টোপর ও সুহাসিনী ভোর

প্রতিমা কাজ করছে। বাসনমাজায় হাত দিয়েছে সবে। বলেছিল দশটায় আসবে, এসেছে সাড়ে এগারোটায়। এখানে আসার আগে যে বাড়িতে যায়, তাদের বাড়িতে আজ অতিথি আসবে। অনেক বেশি কাজ করতে হয়েছে প্রতিমাকে। এখানে সেরে আরও একবার যাবে। প্রতিমা গজগজ করছে, ‘বাড়িতে লোক লেগেই আছে, বেশি বেশি কাজ করাবে, কিন্তু একটা টাকাও বেশি ছোঁয়ায় না। এমন হাড়কেপ্পন আর দেখিনি বাপু। ভগবান তোমাদের ঢেলে দিয়েছেন, তোমরাও একটু হাত খোলো। বুঝলে ঝুমু, এত টাকা ওদের তবু পুরনো কাপড়-জামা একটা দেবে না। সব গুছিয়ে রাখবে। ফিরিওয়ালা এলে একটা ইস্টিলের থালার জন্য দর কষাকষি। আচ্ছা, কী দাম বলো একটা থালার? ভাল ভাল সব কাপড়, তাই দিয়ে থালাবাসন না কিনে আমাদের দিলে তো পারে।’

মুখ চলছে, মুখের সঙ্গে হাত। ঝুমু বলল, ‘তা তুমি বাসন মাজছ কেন? সরসী আসবে তো বিকেলে। তোমার আজ সময় কম, রান্নার জোগাড় করো। আমি একটু হাতে হাতে এগিয়ে দিই।’

‘রাস্তায় দেখা হল সরসীর সঙ্গে। ওই যে ডাক্তারের বাড়ি কাজ করে, যাচ্ছে সেখানে, বলে শরীরটা মোটে ভাল নেই। আবার হবে তো। চার মাস।’

‘আবার হবে! সরসীর! দেখে বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু। চার মাস মানে পেট বেশ বড় হয়ে যায় না? ওর আরও দুটো আছে তো! খাওয়াবে কী? বরটা তো মাতাল।’

‘তবে আর বলছি কী। শরীরে কিছু নেই, পেট বাড়বে কী! ওর প্যাকাটি চেহারা দেখলে লোকে রাখতেও চায় না। ভাবে রোগ আছে। এখন কাহিল দশা। অন্তত বাসনটা ধুয়ে রাখি। পেটভরা খাওয়া নেই, রক্ত শূন্য। বরটা মানুষ নাকি? লাইগেশন করতে চেয়েছিল সরসী, দেয়নি জানো। বলে নাকি মজা নেই। ও করলে মেয়েমানুষ পুরুষমানুষের সমান।’

‘আহা রে! আমি রোজ একটু মাছভাত রেখে দেব ’খন ওর জন্য। একটু পেটভরে খাক ক’দিন।’

‘দিয়ো ঝুমু। ভগবানের আশীর্বাদে ভাল ঘর-বর পাবে। কাজ তো বন্ধ দিতে পারবে না সরসী, খাবে কী! ভরা পোয়াতি নিয়েই নড়তে চড়তে হবে!’

‘তুমি কি জামাকাপড় মেশিনে দিয়েছ?’

‘না গো, সময় পাইনি। বিছানা তুমিই গুছিয়ে গিয়েছ টোপর বলল। কী রান্না হবে বলো তো?’

‘পাঁকাল মাছ আছে দেখো। টোপর ভালবাসে। বেগুন-বড়ি দিয়ে পাতলা ঝোল করে দিই। ও তো খেয়ে বেরোবে আবার। তুমি মাছটা ধোয়ার ব্যবস্থা করো। নুন দিয়ে চটকে ধোবে। গায়ে খুব শ্যাওলা। আমি মেশিনে জামাকাপড় দিই। বাড়িতেও কেচে এলাম।’

‘এখানে রাঁধবে? আবার বাড়ি গিয়েও তো কাজ আছে না? তোমার বাবাকে বলো কাচার মেশিন কিনে দিতে। হাতে কেউ কাচে আজকাল? আমাদের ভগবান উপায় দেয়নি, তাই। তা, তোমার বিয়ে-থা হয়নি, ক্ষারে হাতের চামড়া খসখসে হয়ে গেলে জামাই বলবে কী।’

‘আমার আর কাজ কী বলো, ঘরে বসে খাই। গোপালীমাসি আর পারে না। তবু তো পরদা, বিছানার চাদর, যত বড় জিনিস, মাসিই কাচে। বাড়িতে এখন আর রান্না নেই আমার। বাবা আর ঝিরি তো বেরোল। দুপুরে আমি টোপরের সঙ্গেই দু’গাল খেয়ে নেব এখন। বিকেলে গোপালীমাসি এলে রাতের জন্য যা হোক করা যাবে।’

প্রতিমা দ্রুত কাজ সারছে। ঝুমু টোপরের আলমারি খুলে সামনে দাঁড়াল। প্রত্যেকটি পোশাক সুন্দর সাজানা। ঝুমুই গুছিয়ে রাখে। শুধু প্রবীরের আলমারি বা অন্যান্য ব্যক্তি গত জিনিসে সে হাত দেয় না। অনেকসময় প্রবীর নিজেই তাকে চাবি দিয়ে এটা-ওটা করিয়ে নেন।

টোপরের আলমারিতে মাঝের তাকটায় একটা নতুন প্যাকেট। কী আছে? খুলবে? এত কৌতূহল কি ভাল? ধুৎ! টোপরের জিনিস সে দেখতেই পারে। এ কী! শাড়ি! টোপরের আলমারিতে শাড়ি! গাঢ় লাল ঢাকাই জামদানি, হালকা সোনালি সুতোর কাজ। সুন্দর। খুব চেনা লাগছিল তার। রুপু কাকিমার চারটে ঢাকাই আছে। একটি ভাঁজে ভাঁজে কেটে গিয়েছে। শাড়িগুলো পরলে ভাল থাকত। কিন্তু প্রবীর কোনও দিন ঝুমুকে ওসব ব্যবহার করার কথা বলেননি। শাড়িগুলোর জন্য ভারী দুঃখ হয় তার। কত সব দামি সিল্ক, জর্জেট, তাঁত! এত বছরেও দিব্যি ব্যবহারযোগ্য আছে। চলে যাবার সময় শাড়ি-টারি নিয়ে যাননি রুপু। শুধু গয়না নিয়েছিলেন। তাঁর জিনিস তিনি নিয়েছেন। গহনা হল স্ত্রীধন। পরম্পরা অনুযায়ী মেয়েরা তার অধিকারিণী! এই অধিকার নিয়ে কোনও প্রশ্ন চলতে পারে না। পুরুষের জন্য হিরে-পান্না, সোনার বাট, ঘড়া ঘড়া মোহর। মেয়েদের জন্য শুধু গয়না, গয়না, গয়না। স্ত্রীধন মেয়ের জীবনের পাথেয়। প্রবীর আজও রুপুকে ভালবাসেন বলেই ঝুমু-র মনে হয়। সমঝোতাভিত্তিক বিচ্ছেদ হয়েছিল তাঁদের। রুপুকাকিমার পক্ষে কী শর্ত ছিল ঝুমু জানে না। হয়তো নির্বিঘ্ন বিচ্ছেদই ছিল একমাত্র পারস্পরিক শর্ত!

শাড়িটা ভাল করে দেখে যেমন ছিল রেখে দিল ঝুমু। গাঢ় নীলের ওপর সাদা চেক দেওয়া শার্ট আর ঘিয়ে রং ট্রাউজার্স নিল টোপরের জন্য। রুমাল গেঞ্জি জাঙিয়া গুছিয়ে রাখল। ওয়ালেট খুলে দেখে নিল যথেষ্ট টাকা আছে কিনা। টোপরের কাছে সবসময় টাকা থাকা দরকার। কখন কী প্রয়োজন হয়। তার টাকা তোলার কার্ড আছে। কিন্তু ব্যবহার করার বড় ঝক্কি। গাড়ি থেকে নেমে টাকার যন্ত্র পর্যন্ত পৌঁছতে এত কিছু তাকে সামলাতে হবে যে সে বিপর্যস্ত বোধ করে। গাড়িতে ওঠা এবং অবতরণ করা-দুইই তার পক্ষে নিত্য সংগ্রাম। সে গাড়ি থামায়, পলাশ তার তালবেতাল লাঠি দুটি দেয়। দরজা খুলে একটু কোনাকুনি অবস্থানে গড়গড়িটি রাখে। টোপর ডানহাতের ভরে শরীরটি ঘষটে নিয়ে আসে আসনের প্রান্তে। ঘুরে বসে। দু’হাতের দুই লাঠি ভূমিতে ভালরকম স্থাপন করে কয়েক পলের জন্য শরীরটাকে দণ্ডায়মান অবস্থায় নিয়ে যায় এবং গড়গড়ির আসনে বসে পড়ে। গড়গড়ি ঝাঁকুনি খায়। পলাশ শক্ত করে ধরে তাকে। বাঁদিকে কেৎরে লটকে থাকা অশক্ত দুই পা হাত দিয়ে ধরে একটা একটা করে পাদানিতে রাখে টোপর। সচল হয়। সিঁড়ি এলে আবার সে লাঠি পরায় হাতে, আস্তে আস্তে সবল দুই বাহুর ওপর নিজেকে সঁপে দেয়। পলাশ তার গড়গড়িখানা সিঁড়ি দিয়ে সমতলে নিয়ে যায়। টোপর অতি সন্তর্পণে লাঠি রাখে ধাপে। প্রথম ধাপ। দ্বিতীয় ধাপ। তৃতীয় ধাপ। তার পা দুটি ছেঁচড়ে উঠতে থাকে। ঠোক্কর খেতে খেতে। ধুলো মাখতে মাখতে। টোপর ঘেমে ওঠে। নিজের অসাড় অঙ্গ বয়ে চলা কী ভীষণ কঠিন!

পলাশ তার পাশে পাশে চলে। টোপরের চেয়ে মাত্র তিন বছরের ছোট। কানাই সামন্ত সরু গলির অধিবাসী নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে পলাশ তার সম্পূর্ণ সুস্থ কলেবর ও অঙ্গসমূহের জন্য বারংবার ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেয় আর প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থাকে— যেন পড়ে না যায় টোপর।

বাইরে বেরোলে এই স্বাদু পৃথিবী টোপরের জন্য যুদ্ধভূমি হয়ে যায়। তার জ্ঞান ও মেধা, বুদ্ধি ও হৃদয়— সমস্তই সুস্থ, স্বাভাবিক, সুন্দর। মেধা ও বুদ্ধির নিরিখে সে বিশিষ্ট একজন, হৃদয়খানি উদার ও বিশাল বটে। তবু, যারা অবিকলাঙ্গ, তারা বিকলাঙ্গের প্রতিবন্ধকতা তার সর্বত্র দেখতে শুরু করে। ব্যাখ্যাতীত ত্রাসে তার মনের নিকটে আসে না। টোপরকে, সর্বত্র, স্বাভাবিক মানুষের প্রতিবন্ধী চিন্তার সঙ্গেও রণে অবতীর্ণ হতে হয়।

ঝুমু ও বড়পিসি ও নিশি দিশি দিশি

শার্টে একবার হাত বুলিয়ে দিল ঝুমু। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ভেতর থেকে। কে করবে এসব, যখন সে থাকবে না? লোক রাখা যেতে পারে। যত বেশি লোক রাখবে টোপর নিজের জন্য, তত বেশি করে বিচ্ছিন্নতা বোধ করবে। ঝুমু বিয়ে করে কলকাতা শহরের বাইরে যেতে চায় না। নিজের জন্য নয়, টোপরের জন্য আর বাবার কথা ভেবে সে শুধু বলেছিল, ‘বড়পিসি, কলকাতার বাইরে আমার সম্বন্ধ দেখো না।’

‘কেন রে?’

‘বাবাকে দেখাশোনা করবে কে বলো?’

‘শুধু বাবার জন্য দরদ? নাকি ওই ল্যাংড়া অপয়াটার জন্যও ভাবছিস? যা করিস ওর জন্য, নিজের ভাইয়ের জন্যও কেউ করে না।’

‘ওর জন্য কিছুই করার নেই গো। ও সব নিজে পারে। আমার জন্য ওর কিছু আটকাবে না। ওভাবে বোলো না ওকে। ও অপয়া হল কীসে?’

‘ছেলেটাকে ভাল লাগে না আমার। বড্ড যেন ডেঁপো। অল্প বয়সেই গেরেম্ভারী ভাব। কী জানি বাপু, যে ছেলে মায়ের স্নেহ টেনে রাখতে পারে না, তার নিশ্চয়ই কিছু দোষ আছে।’

‘ওসব কথা থাক পিসি।’

‘শোন ঝুমু, এ জগতে কারও জন্য কিছু আটকে থাকে না। এই যে তোর মা সংসার ভাসিয়ে, কচি মেয়ে ফেলে, সিঁথেয় সিঁদুর নিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেল, কিছু আটকেছে? ভাল ঘর-বর যেখানে পাবি, যাবি। আমার তো এ শহরেই বাড়ি, নিজের সংসার ফেলে আমি কি আসতে পেরেছি ঝিরিকে আগলাবার জন্য? তখন ঘরে বুড়ো শ্বশুর-শাশুড়ি, তোর দীপদাদার বয়স মাত্র বারো, আসার ইচ্ছে থাকলেও উপায় ছিল না। নিজের সংসার হোক, তখন বুঝবি, মেয়েদের পায়ের বেড়ি আমরণ থাকে। সংসার যেমন চালাবে, মেয়েরা তেমনই চলবে। সে তুমি ডাক্তারই হও আর মোক্তারই হও।’

অবশ্য ঝুমু জানে, বাবার সঙ্গে বড়পিসির এ বিষয়ে মতে মেলেনি। জ্যোতির্ময় ঝুমুকে দূরে বিয়ে দিতে চান না।

সে বলেছিল, ‘বাবা, বিয়ে করার প্রয়োজন কী! এই তো ভাল আছি।’

‘বিয়ে তো দিতেই হবে। ওপরে গিয়ে তোর মাকে কী জবাব দেব। লোকে কী বলবে? তোরও একটা জীবন আছে।’

‘এ জীবনেই বেশ আছি আমি। এটাও তো আমারই জীবন! ভাল থাকাটাই তো আসল-না, বাবা? আমি তো পরমানন্দে আছি। বিয়ে করে কি আমার আনন্দ বাড়বে? কোনও নিশ্চয়তা আছে বাবা, বিয়ের পর ভাল থাকব? সেটাই হবে আমার আকাঙ্ক্ষিত জীবন? যা হচ্ছে চারিদিকে, বউ পুড়িয়ে মারছে, ফাঁসিতে লটকে দিচ্ছে। আমি গেলে কে তোমাদের দেখবে? ঝিরি যা ছেলেমানুষ। আমার আর বিয়ে করে কাজ নেই। কেউ কিছু বললে বলবে, ঝুমু আইবুড়ি থাকতে চায়।’

‘তুই বুঝবি না মা। বাপের কর্তব্য করতেই হবে। আমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। তোদের নিরাপত্তা দেখতে হবে না?’

‘বাড়ি করে রেখেছ। টাকাকড়িও করেছ। লেখাপড়া শিখেছি। আর কী লাগে?’

‘তুই বড় সরলসোজা। তোর জন্যই তো চিন্তা।’

টোপর ও ঝুমু ও স্বপ্ন নিঝুম

ঝুমু রান্নাঘরে গেল। গ্যাসের উনুন জ্বেলে কড়া চাপাল। মাছ আর বেগুন আলাদা পাত্রে রেখে গিয়েছে প্রতিমা। সে কড়ায় তেল ঢালল।

‘কতদিন বলেছি তোমাকে, ওড়ানাটা রান্নার সময় খুলে রাখবে।’

‘কিছু হবে না রে টোপর।’

‘খুলে রাখবে কিনা।’

‘রাখছি।’

‘আমি সামনে থাকি আর না থাকি, আর যেন ভুল না হয়।’

‘আচ্ছা আচ্ছা।’

‘দাঁড়াও ঝুমুদি, আজ ফিরে এসে তোমার জন্য একটা দারুণ জিনিস আনতে দেব।’

‘কী রে?’

‘একেবারে আধুনিক চুল্লি। আগুনের শিখা নেই। শুধু তাপ। একে বলে ইনডাকশন কুকার।’

‘হিটার বুঝি?’

‘অনেকটা হিটারের মতো। কিন্তু বাইরে থেকে তার ইত্যাদি দেখা যায় না। তোমার মতো দুষ্টু আর বেখেয়ালি মেয়ের জন্য খুব দরকার।’

‘আমি মোটেই দুষ্টু না। বেখেয়ালিও না। বড্ড বাজে বকিস তুই টোপর!’

‘কতক্ষণ লাগবে তোমার রান্নায়?’

‘এই তো। বেগুন ক’টা ভেজে তুলি। তারপর বড়ি ভেজে মাছ সাঁতলে ঝোল চাপিয়ে দেব।’

‘লম্বা প্রক্রিয়া। থাক ওসব। আমার সঙ্গে কথা বলবে চলো।’

‘তুই থাক না এখানে, রান্না করতে করতে কথা বলা যায়।’

‘নুনপোড়া খাওয়াবে?’

‘না না’

‘আলুনি?’

‘মারব এক চাঁটা! বড়িভাজা খাবি? দেব করে?’

‘দাও। একটু কফি করবে? তুমিও খাও।’

‘করছি। তোর শার্ট বেছে রেখে এসেছি।’

‘জানি। শাড়িটা কেমন?’

‘খুব সুন্দর।’

‘কার জন্য জানতে চাইলে না? কে কিনল। কোত্থেকে। কোনও কৌতূহল নেই?’

‘তুই তো এমনিই সব বলিস রে।’

‘আচ্ছা আন্দাজ করো কার জন্য।’

‘প্রেমে পড়েছিস? না। তা হলে আমাকেই প্রথম বলবি তুই। আর তোর প্রেমিকা মানে তো একফোঁটা মেয়ে। শাড়ি-টাড়ি পরবেই না। ওরা পরে স্কার্ট, জিন্স।’

‘কেন?’

‘তোরই তেইশ। তোর প্রেমিকার বয়স হওয়া উচিত উনিশ-কুড়ি। সে পরবে শাড়ি? অসম্ভব! ঝিরিই পরতে শিখল না। এখনও শাড়ি পরলে ছ’টা সেফটিপিন লাগায়।’

‘এবার পুজোয় কী করেছিল জানো?’

‘কী?’

‘অষ্টমীর দিন। তুমি বড়পিসিকে নিয়ে চেতলা গেলে?’

‘হ্যাঁ। বড়পিসির গুরুমা এসেছিলেন কাশী থেকে।’

‘ঝিরি শাড়ি পরে বেরোবে, কারণ বিবস্বান বলেছে। আমার কাছে চলে এসেছে। দিদি বাড়ি নেই, শাড়ির কুচি ধরে দে টোপর।’

‘যাঃ!’

‘হ্যাঁ গো। শায়া আর ব্লাউজ পরে দিব্যি আমার সামনে। দু’বার ভুল দিকে শুরু করল। আমায় বলে, হাঁ করে দেখিস না। প্রেম করলে অনেক কঠিন কাজ করতে হয়। শাড়ি পরা তার মধ্যে একটা।’

‘তারপর?’

‘কী তারপর? আমি মুখ ফিরিয়ে রইলাম। ঝাড়ু নমিতার বুক দেখতে পারি, কিন্তু ঝিরির যৌবনের ঝাউবন দেখতে আমার ইচ্ছা করে না। ও যখন বলল, ধর এবার। প্রত্যেকটা কুচি যেন সমান হয়, আমি তাকালাম। ও শাড়ি-টাড়ি দলা পাকিয়ে টপাৎ করে খাটে উঠে পড়ল যাতে আমি হাত পাই।’

‘তুই ওর কুচি ধরে দিলি?’

‘সোজা কাজ।’

‘কী আশ্চর্য! আমাকে বলেনি তো!’

‘আমিও আগে বলিনি। ও-ই বলল, দিদিকে বলিস না। বকুনি দেবে।’

‘কেন? ও যদি তোকে নিরাপদ মনে করে, আমার কী।’

‘মানে? কী বলতে চাইছ? আমি নিরাপদ নই?’

‘ধুৎ! আমি কি তাই বললাম? ও তোর কাছে লজ্জা পায় না। এটাই তো স্বাভাবিক। তুই কি আমার কাছে লজ্জা পাস?’

‘এমনি এমনি লজ্জা পাব কেন? লজ্জা পাবার মতো কাজ করলে পেতে হবে।’

‘না রে বাবা! শরীরের স্বাভাবিক লজ্জা বলে একটা ব্যাপার আছে না?’

‘আসলে তুমি প্রথমে ঠিক বলেছিলে। নিরাপদ। ঝিরি বা অন্য মেয়ের কাছে আমি নিরাপদ। তার মানে এই নয় যে মেয়েরা আমাকে ভালমানুষ সন্ন্যিসিঠাকুর মনে করে। মেয়েরা বা ছেলেরাও মনে করে আমি যৌনভাবেও প্রতিবন্ধী।’

ঝুমু চামচে কফি তুলল। কাপে দিল। চিনি। গুঁড়ো দুধ। কড়া থেকে বেগুন তুলে বড়ি দিল। বড়ি নিঃশব্দে ভাজা হয়ে যায়। সে-ও নীরবেই ছ’খানা বড়িভাজা তুলে নিল রেকাবে। টোপরের হাতে দিল। মাছ ছাড়ল কড়ায়। ছাঁইই, ছ্যাক, ফর্‌র্‌ ফট্, ঠপ। খুন্তি দিয়ে মাছ এপিঠ ওপিঠ করে আঁচ কমিয়ে কফিতে জল ঢালল। নাড়ছে। ভারী মিঠে শব্দ উঠছে। টুংটাং। চিনেমাটির পেয়ালা ও স্টিলচামচের বাজনা। সঙ্গে রিন রিন ঠিন ঠিন। ঝুমুর হাতে দু’গাছি সোনার চুড়ি।

‘দারুণ হয়েছে কফি, ঝুমুদি। এবার বলো।’

‘কী?’

‘প্রেমিকা শুধু ছোটই হয়? বড় হতে পারে না?’

‘আজ তোকে নতুন লাগছে রে টোপর। তুই যেন অন্য কেউ।’

‘আমি বড় হয়ে গিয়েছি ঝুমুদি। আমি এখন অনেক দায়িত্ব নিতে পারি।’

‘কী দায়িত্ব?’

‘আমার কাছে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব কী জানো? সমস্ত প্রিয় সম্পর্কগুলো সযত্নে পালন করা। আমি তোমার সব কথার উত্তর দিচ্ছি। তুমিও দাও।’

‘কী?’

‘প্রেমিকারা শুধু ছোটই হয়?’

‘তাই তো হয়। বউ হোক আর প্রেমিকা— ছোট হবে, এমনটাই নিয়ম।’

‘কে ঠিক করেছে এই নিয়ম?’

‘প্রকৃতি।’

‘না। অন্য প্রাণীরা বয়স দেখে সঙ্গী বাছে না। তুমি কি প্রথম দর্শনের প্রেমে বিশ্বাস করো? লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট? সেইসব ভালবাসা বয়সের ঠিকুজি নিয়ে জন্মায় না! ভালবাসা আর বাস্তবের চাহিদা পূরণ একাকার করে দেওয়া ঠিক নয়।’

‘মেয়েরা কুড়িতেই বুড়ি, বলে না? কুড়ি না হোক, মেয়েদের বয়স তাড়াতাড়ি বাড়ে।’

‘সমাজ মেয়েদের তাড়াতাড়ি বুড়ি করে দেয়। কারণ এখনও মেয়েদের শরীরসর্বস্ব বস্তু বলে মনে করা হয়। টাটকা মুলো গাজর ধনেপাতা নটেশাক। দুঃখের কথা, মেয়েরাও তাই মনে করে নিজেদের।’

‘সে তুই যাই বল, একটা ত্রিশ বছরের ছেলে আর ত্রিশ বছরের মেয়ের তফাত আছে রে টোপর। মেয়েদের মা হওয়ার বয়স ভাবতে হয়।’

‘সেটাও তো শারীরবৃত্তীয় বিষয় না ঝুমুদি? টান টান মেদহীন পেট, নারকেল মালার মতো উঁচু শক্ত বুক, মসৃণ সাদা ত্বক-না হলে মাতৃত্ব-একজন মেয়ের গ্রহণযোগ্যতা এখানেই শেষ? তার মেধা, বুদ্ধি, প্রতিভা, প্রেম আর কিছুই থাকে না?’

‘মেধা, বুদ্ধি, প্রতিভা কি স্বীকৃতি পায় না? মেয়েরা কত জ্ঞানী-গুণী! কত প্রতিষ্ঠিত এখন! মুশকিল আমার মতো মেয়েদের। সমাজে প্রচলিত নিয়মের ব্যতিক্রম হয়ে আমাদের চলে না। আমরা যে অতি সাধারণ।’

‘সাধারণ আর অসাধারণের পার্থক্য ক্ষীণ। দুর্বল।’

‘কীরকম?’

‘বিনা প্রশ্নে, বিনা বিশ্লেষণে গতানুগতিক নিয়ম এবং অপরের ইচ্ছার স্রোতে নিজেকে মিশিয়ে দেওয়া হল সাধারণীবৃত্তি। নিজের জীবন নিজের শর্তে গড়ে তোলার ইচ্ছাই মানুষকে অসাধারণত্বে নিয়ে যায়।’

‘সমাজের বিধি অস্বীকার করা কি অতই সহজ? বাড়ির লোকের কথাও তো ভাবতে হবে। তারা কী চায়, না চায়।’

‘কোন বিধি? কোন ভাবনা? শ্রীরাধা কৃষ্ণের চেয়ে বড় ছিলেন।’

‘সে তো চিরকালের বিয়োগান্তক প্রেম টোপর।’

‘খেলোয়াড় শচিনের স্ত্রী বয়সে বড়, তাঁরা তো সুখে আছেন।’

‘ওটা ব্যতিক্রম। তুই ‘লমহে’ ফিল্মটা দেখেছিস। ওটাই বাস্তব।’

‘‘লমহে’? একটা ফিল্ম। ভাল গল্প। কিন্তু কী ভীষণ রক্ষণশীল!’

‘আচ্ছা বাবা! তোর সঙ্গে কথায় পারি না। তোর কোনও প্রেমিকা নেই আমি নিশ্চিত। তা হলে শাড়িটা কার জন্য? কাউকে উপহার দিবি? কেউ নিমন্ত্রণ করেছে?’

‘নদীর নিমন্ত্রণে নৌকা ভাসাই। চঞ্চলা তরলিতা নদী ঢেউয়ের দোলায় উলটে পালটে দেখে। ভেঙে দেয় আমার তরণী। তারপর আমাকে আছড়ে ফেলে নরম ফেণিল জলদেহে। আমি তার বুক খুঁজি। স্তন খুঁজি। গাঢ় খাঁজে মুখ দিতে চেয়ে ক্রমশ গভীরে গহনে ডুবে যাই। কবে জল দেবে তুমি হে আকাশ। কবে তরলিত হবে যুগ যুগ ধরে বিশুষ্ক বিবাগী যোনি! কবে তুমি আমারই একান্ত হবে হে প্রিয় রমণী?’

‘আমার জন্য কিনেছিস, না? শাড়িটা?’

‘পরবে তো?’

‘পরব। এ তো অনেক দাম। এত দামি শাড়ি আমি কখনও পরিনি তো। একটু ইয়ে, মানে…পরব। পরব তো।’

‘জ্যোতিকাকা বড় কৃপণ ঝুমুদি।’

‘না না। আসলে আমরা দুটো বোন ঘাড়ের ওপর।’

‘ছিঃ! এভাবে আর কক্ষনো বোলো না। ভেবোও না। মা-বাবা নিজের সুখের জন্য সন্তান পৃথিবীতে আনে। সন্তানকে বোঝা মনে করার অধিকার কারও নেই। তোমাকে একটা ভাল শাড়ি কিনে দেয় না! একটা ভাল সালোয়ার-কামিজ! একটু সাজায় না তোমাদের!’

‘টোপর! এটা ঠিক নয়! সবাই সমান হয় না। আমার বাবাকে খারাপ বললে আমি রেগে যাই।’

‘মাপ করো ঝুমুদি। কথাগুলো সত্যি, তবু এভাবে বলা ঠিক হয়নি।’

‘এত দাম দিয়ে শাড়ি কিনলি, টাকা পেলি কোথায়?’

‘বাবার কাছ থেকে ধার নিলাম। চাকরি পেলে শোধ দেব।’

‘শাড়ির জন্য ধার? আর চাকরির জন্য শাড়ি?’

‘হুঁ।’

‘শাড়িটা আমার এত চেনা চেনা লাগছে কেন বল তো?’

‘মাকে আমরা শেষ যেদিন দেখেছি, মা’র চলে যাবার দিন, ঠিক এরকম একটা শাড়ি মা পরে ছিল।’

‘হ্যাঁ। লাল শাড়ি। হ্যাঁ। তোর মনে আছে? ঢাকাই জামদানি! কী করে জানলি ওটা ঢাকাই জামদানি ছিল? ওই বয়সে তুই শাড়ি চিনতি? এখনও কি চিনিস?’

‘না। শাড়িটা মনে ছিল। চটিটা। ব্যাগ। মায়ের গায়ের গয়নার নকশা-সব মনে আছে আমার। দোকানে শাড়ি সাজিয়ে রাখে, আমি সারাক্ষণ খুঁজতাম। খুঁজে যাচ্ছিলাম।’

‘কবে থেকে?’

‘জানি না। বোধহয় মা চলে যাবার পর থেকেই। দোকানে শাড়ি দেখলেই চোখ চলে যায়। দেখি। দেখতে দেখতে দেখাটা খোঁজায় রূপান্তরিত হয়ে গেল। আমাদের শিশু থেকে তরুণ হয়ে যাওয়ার মতো।’

‘আমাকে ওই লাল মানাবে না।’

‘মানাবে।’

‘ধুৎ! আমি তো কালো।’

‘তাতে কিছু যায় আসে না শ্রীময়ী।’

‘কাকিমা খুব সুন্দর ছিল। রুপু। রূপাঞ্জলি। সার্থক নাম। কাকিমাকে যা মানায়, আমাকে তা মানাবে কেন?’

‘তুমিও যে খুব সুন্দরী, ঝুমুদি।’

‘ওরে পাগল, উন্মাদ, তুই স্নানে যা। খেয়ে একটু বিশ্রাম নে। পলাশ কখন আসবে?’

‘শাড়িটা পরবে না তুমি?’

‘আমি কি তাই বললাম। তোর দেওয়া প্রথম শাড়ি। তোর প্রথম চাকরির প্রথম উপহার। আমি না পরে পারি? শাড়ি পরতে আমার ভাল লাগে রে টোপর।’

‘খুব সুন্দর লাগবে তোমাকে। লাল ব্লাউজ পোরো, লাল টিপ। চুল খোলা রেখো। গলায় একটু চওড়া সোনার হার, দু’হাতে দুটি কঙ্কণ। নখে রং লাগিয়ো না। চোখে কাজল দিয়ো না। একটুও রং মেখো না ঠোঁটেও। পায়ে রুপোর নূপুর যেন থাকে। কিন্তু তাতে শব্দ নেই। আমার টাকা খানিক জমলে তোমাকে সোনার নূপুর গড়িয়ে দেব।’

‘বেশ।’

‘আসবে তো! আমার কাছে?’

‘আসব। তোর ওই সাজের বায়না মেটাবার জন্য আসল সোনার বদলে গড়িয়াহাটের ফুটপাথ থেকে কেনা সিটিগোল্ড হলে চলবে তো? গয়না সব ব্যাঙ্কে। বাবার হেফাজতে।’

‘নকল? তোমার যে এতটুকুও কৃত্রিমতা নেই ঝুমুদি! নকল গয়না তোমার বিশুদ্ধতায় গলে খসে পড়বে। আমি তোমার জন্য অনেক গয়না কিনব। ততদিন তুমি বিনা অলংকারে এসো।’

‘পাগলামো সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এবার বল তো, তুই নিজে দোকানে গেলি? শাড়ি কিনলি? এ যে অবিশ্বাস্য।’

‘ডোভার লেনের মুখে একটা নতুন ঝকঝকে দোকান। একদিন দেখি নানান নীলের বাহার। বিশাল কাচের দেওয়ালের ওপারে নীল শাড়ি উড়ছে। রঙের তারতম্য খুবই অল্প, কিন্তু পাশাপাশি মেলা বলে প্রত্যেকটির বৈশিষ্ট্য বোঝা যাচ্ছে। শুধু নীল কেন? ভাবলাম গিয়ে জিজ্ঞেস করি। তারপর মনে হল, না, অপেক্ষা করি। আবার আসব। দেখব কী রং। কী সুন্দর না? তুমি রঙের প্রত্যাশায় প্রহর গুনছ! রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছ-কাল কী রং থাকবে! সবুজ? হলুদ? গোলাপি? বেগুনি? কমলা? তুমি ভাবছ হলুদ থাকবে আজ। থাকবেই। কলেজে ক্লাস করছ, ভাবছ, বোধহয় গোলাপি! তোমার মনের মধ্যে একটা পিঙ্ক ঝরনা। গোলাপি আকাশ। গোলাপি মেঘ। গোলাপি প্রতীক্ষা। অনেকগুলি শর্ত ও চলরাশি সাপেক্ষে তোমাকে কম্পিউটারের জটিল নকশা তৈরি করতে হচ্ছে। অলঙ্ঘ্য যুক্তি বোধে, আঙ্কিক বিশ্লেষণে, নিখুঁত প্রোগ্রামিং। তার মধ্যেও তুমি মাখিয়ে দিতে পারো তোমার অপেক্ষার গোলাপি রং। এবং, শেষ পর্যন্ত, প্রায়ই আমার কল্পনার রং মিলত না। গোলাপির পরিবর্তে কমলা, হলুদের পরিবর্তে সাদা। শুধু লালের জন্য আমি কখনও অপেক্ষা করিনি। আর সব রং না মিললেও কিছু না। আমি নতুন করে অপেক্ষা আর কল্পনা নিয়ে খেলা করেছি। লাল আমার খেলনার রং নয় ঝুমুদি। সে আসতই। জানা ছিল আমার। লাল শাড়ি না থাকলে চলে নাকি? আমি তো রোজ বেরই না। হয়তো যেদিন লাল আছে, আমি নেই। পরশু দেখা হল। লালে লাল হয়ে আছে বিশাল কাচের আড়ালে দৃশ্যপট। আমি চিহ্নিত করলাম।’

‘নাম! শাড়ির নাম জানলি কী করে?’

‘ওইসব হলুদ নীল কমলা গোলাপি দেখতে দেখতে। ঝুমুদি, আমার হাতের মুঠোয় নেট দুনিয়া। আমাকে বিশ্বরূপ সে-ই দেখায়। যখন তুমি আমার কাছে থাকো না, সে-ই আমার সঙ্গী। সে-ই হবে আমার অন্নপূর্ণা, আমার রুজি রোজগারের বিশ্বস্ত মাধ্যম। তাকে বললাম শাড়ি চেনাও। সে সারা দেশ থেকে শাড়ি এনে ধরল। যেন আলাদীনের দৈত্য। বললাম, বাংলার শাড়ি। সে দিল দুই বাংলাকে মিলিয়ে। সত্যি বলব? শাড়ি আমাকে মুগ্ধ করেছে। কী সৌন্দর্য! কী বৈচিত্র্য! তখন জ্যোতিকাকার কৃপণতায় দারুণ রাগ করলাম। আমি যদি জ্যোতিকাকা হতাম, সাধ মিটিয়ে মেয়েদের শাড়ি কিনে দিতাম। সঙ্গে মানানসই গয়না। ওই যেমন দেয় মেয়েদের পত্রিকায়, এই শাড়ির সঙ্গে পরুন ব্ল্যাক মেটাল, এর সঙ্গে মানাবে এথনিক, মাটির গয়না আপনার যে কোনও সাজের সঙ্গী। তেমনই গোল্ড। রুপোর ওপর কস্টিউম জুয়েলারি আপনাকে দেবে ফ্যাশানেবল অথচ দৃঢ় ব্যক্তিত্বের ভাব।’

‘কোথায় দেখিস এই বই?’

‘তোমার চোখে।’

‘যত বাজে কথা।’

‘আমি তোমাকে সব দেব। ধুত্তোর। দেব-দেব কেন করছি। তুমি আমার ধনলক্ষ্মী। তোমাকে সব টাকা সমর্পণ করব। নতজানু তো হতে পারব না। জানুর সঙ্গে সন্ধি আর হল কোথায় যে জানুসন্ধি ভূমিস্পর্শ মুদ্রা দ্বারা মাটি ছুঁইয়ে হাত পাতব-আমি তোমার কাছে দু’হাত প্রসারিত করে বলব দাও। তুমি তখন কার্পণ্য কোরো না।’

‘বাজে কথা রাখ। আমার মাছের ঝোল হয়ে গেছে। ভাত আছে। শুক্তো আর ওলকপির ডালনা। স্নানে যা।’

‘যাব তো। কবে পরবে বলো শাড়িটা।’

‘পরে চমকে দেব তোকে। আচ্ছা প্রবীরকাকাকে তুই কী বললি?’

‘আগে দোকানে কী বললাম শোনো।’

‘তুই নিজে গেলি?’

‘না। পলাশ গেল। আমাকে ফোনে ধরল। আমি অনুরোধ করলাম শাড়িটা সরিয়ে রাখতে। দাম জানতে চাইলাম।’

‘কত?’

‘এগারো হাজার টাকা।’

‘কী সর্বনাশ! ও শাড়ি পরে তো ঘরে বসে থাকতে হবে রে টোপর। বাসে-ট্রামে অটোয় তো চাপতে পারব না। একেবারে সোনা-সোনা যত্ন করতে হবে।’

‘ও! এগারো হাজার টাকা দাম বলে যত্ন করবে। এটা যদি সাড়ে চারশো টাকার শাড়ি হত, তবে তুমি ফেলে-ছড়িয়ে পরতে, কেমন? টোপরের দেওয়া শাড়ি বলে যত্ন করতে না!

‘টোপরের দেওয়া প্রথম শাড়ি, না রে? যত্ন করতাম। আমি তো সব কিছুরই যত্ন করি। কিন্তু দামি জিনিসের একটা আলাদা যত্ন প্রাপ্য হয় না?’

‘এই না হলে তুমি? এবার শোনো না। রাতে বাবাকে বললাম এগারো হাজার টাকা চাই। বাবা বলল, ‘কবে?’ ‘কালই।’ কুড়ি পেরোনর পর বাবা আমাকে আর জিজ্ঞেস করে না টাকা কীসের জন্য চাই। আমিই বলি। বললাম। বাবা খানিক চুপ করে রইল। অবাক হয়েছে। এতদিন আমি তোমার আর ঝিরির জন্য বই, সিডি, পারফিউম কিনেছি, শাড়ি এই প্রথম।’

‘জিজ্ঞেস করল না, শাড়ি কেন?’

‘না।’

‘আমি বাড়িতে কী বলব? এত দামি শাড়ি!’

‘আজই তার সমাধান। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে তোমাদের নৈশভোজ দেব আমি। চমক ভোজন। কী খাবে বলো? চৈনিক, না মোগলীয়? তুমি যা বলবে। পদ ভেবে রাখো, আমি ফোন করব তোমায়।’

‘আমি তো মোগলাই খাব। খানাতল্লাসি নয় পরে করছি। তুই আমায় তখন শাড়িটা দিবি তো?’

‘ঠিক।’

‘না। ঠিক নয়। তোর এত বুদ্ধি, তবু মাঝে মাঝে বোকার মতো করিস কেন?’

‘কী করলাম?’

‘আমাকে দিবি, ঝিরিকে কিছু দিবি না টোপর?’

‘আমার ভাবনায় ঝিরি ছিল না। স্বীকার করছি। বাবা মনে করিয়ে দিয়েছে। ওর জন্য কী আনা যায় বলো তো!’

‘কত খরচ করবি? মানে ঝিরির জন্য বরাদ্দ বাজেট কত?’

‘উঁ? হাজার বারোশো।’

‘লেদার ব্যাগ আনিস। চেরি রং। বড় দেখে। একটা লাগবে বলছিল।’

‘তুমিই নিয়ে এসো এক ফাঁকে।’

‘আচ্ছা। টাকা রেখে যাস। বাবা সংসারের টাকা গুনে দিয়ে যায় তো। আমাকে হিসেব রাখতে হয়।’

‘হুঁ! জানি! দেখছি তো ছোট থেকে।’

ঝুমু ও ঝিরি ও বায়ু থিরি থিরি

কী সুবিধা হয়েছে এখন! বললেই বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেয়। টোপরের আয়োজিত নৈশভোজ সেরে, যথেষ্ট গল্পগাছা করে, রাত বারোটায় বাড়ি ফিরল ঝিরি আর ঝুমু। জ্যোতির্ময় ও প্রবীর মাত্র এক হাত দাবা খেলার অবকাশ পেয়েছেন আজ।

ঝিরি এসে ঝুমু-র বিছানায় বসল। বলল, ‘টোপরকে এত খুশি কোনও দিন দেখিনি। এত প্রাণবন্ত। এমন আড্ডাবাজ। কী ব্যাপার রে?’

‘কী আবার! চাকরি পেয়েছে, প্রথম, আনন্দ হবে না?’

‘উঁহু! ও তো ব্রিলিয়ান্ট! ভাল চাকরি পাবে জানাই ছিল।’

‘ভেবে দ্যাখ ঝিরি, মাত্র তেইশ ওর, পাশ করে বেরোতে না বেরোতেই প্রতিষ্ঠা পেল। সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতায়। প্রতিবন্ধী কোটায় নয়। কারও সুপারিশে নয়। শুধু মেধা আর বুদ্ধি দিয়ে সব হয় না। ওর অদম্য মানসিক শক্তি। কী জেদ! কী আত্মবিশ্বাস! কত কষ্ট ওর! কত প্রতিকূলতা! সব জয় করেছে! আজ তো ও আনন্দ করবেই।’

‘শাপমুক্ত রাজকুমার।’

‘কেন?’

‘ছিল ব্যাঙ, হয়ে গেল রাজপুত্তুর।’

‘বাজে বকছিস কেন?’

‘চাকরিটার জন্য বিবস্বানও আবেদন করেছিল। তোর লাডলা ওর মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছে।’

‘তাই বল। ঈর্ষানল পোড়ায় তোমায়। বিবস্বান বসে থাকবে নাকি? অত ভাল ছেলে।’

‘তা থাকবে না। কিন্তু টোপরের পক্ষপাতিত্ব নজর করার মতো। তোর শাড়িটার দাম অন্তত হাজার দশেক টাকা। আমার ব্যাগটা তো শিশু ভুলোন। সান্ত্বনা পুরস্কার। তুই-ই এনে দিয়েছিস বোধহয়। ঠিক আমি যেমনটি চাইছিলাম। চেরি কালার। মাল্টিপকেটস। ঢাউস লেদার ব্যাগ।’

‘হ্যাঁ। আমি তো নিয়ে এলাম লেদার ওয়ার্ল্ড থেকে। টোপর বলল এনে দিতে। টাকা দিয়েছিল।’

‘না দিলে তুই কিনবি কোত্থেকে! আমাদের চিপ্পু বাপ তো পারলে মোজা সেলাই করে পরে। নেহাৎ গোপালীমাসি আমায় বাঁচিয়েছিল, তাই চক্ষুলজ্জায় মাসিকে ফুটিয়ে দিতে পারে না। না হলে দেখতি কী করে।’

‘আমাদের কোনও কিছুর অভাব তো রাখেনি বাবা। একটু হিসেব করে চলে।’

‘হ্যাঁ। শুধু একটু হিসেব করে চলে। তাই মাকে মেরে ফেলল।’

‘ঝিরি! আবার!’

‘চুপ কর। ভালমানুষ সাজতে আমার ভাল লাগে না। মামাবাড়ির সঙ্গে আমাদের সেরকম সম্পর্ক নেই কেন? দিদা আমাকে সব বলেছে। মাকে ঠিকমতো চিকিৎসা করায়নি।’

‘আমরা কি মামাবাড়ি যাই না? আজকাল এর বেশি সম্পর্ক কে রাখে? দিদা যদি জানতই বাবা ঠিক কাজ করছে না, মাকে নিজের কাছে নিয়ে গেল না কেন?’

‘কেন আবার! দাদু অসুস্থ ছিল! সম্পর্ক তো ছিলই না কতদিন। তুই ভাল করেই জানিস।’

‘পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে কী লাভ। বাবা আমাদের তো কোনও অযত্ন করেনি! দিদাই বা তোকে ওসব বলতে যায় কেন?’

‘বাবা ভয় পায়। টাকা না থাকলে যদি আমরা না দেখি। বুড়ো বয়সে বউ থাকলে চিন্তা নেই। আচ্ছা, বাবা আরেকটা বিয়ে করলেই পারত। কেন করল না? নিশ্চয়ই টাকা খরচের ভয়ে।’

‘ঝিরি থামবি?’

‘থামলাম। তোর শাড়িটা কোত্থেকে কিনলি রে? একাই গেলি? ‘ঢাকেশ্বরী’ না ‘প্রিয়ংবদা?’’

‘আমার শাড়ি আমি কিনিনি।’

‘কে কিনল? লেংড়ু? হাসাস না দিদি। লেংড়ু গড়গড়ি নিয়ে শাড়ির দোকানে গিয়েছিল? হি হি হি!’

‘সেটা তুই টোপরকেই জিজ্ঞেস কর ঝিরি।’

‘দরকার কী! শাড়িটা দারুণ কিন্তু। একঘর দেখতে। রবিবার পরিস। শাড়ির গুণে পরীক্ষায় পাশ করে যাবি।’

‘তুই নিবি? নে না।’

‘না বাবা। তোর টোপর তোকে দিয়েছে, তুই পর। আমি পরলে হয়তো গড়গড়ি চেপে তাড়া করবে।’

‘ঝিরি ঘরে যা। আমার ঘুম পাচ্ছে।’

‘টোপর এখনও জেগে আছে দ্যাখ।’

‘আমাকে ঘুমোতে দে ঝিরি। সেই ভোরবেলা উঠি। ক্লান্ত লাগে না?’

ঝুমুর ঝুমুর

বলল ঠিকই, সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমোতে পারল না ঝুমু। সে নানা কথা ভাবতে লাগল। আজকের দিনটা খুব অদ্ভুত। খুব সুন্দর। জীবন হঠাৎ এমন সব ঝলমলে দিন উপহার দেয়!

টোপর একটা পাগল। কত কী বলল আজ! ঝিরিটা একটু হিংসুটে আছে। খুব জোরও আছে। বাবা ওর সঙ্গে পেরে ওঠে না। প্রত্যেককেই অল্পবিস্তর সন্দেহের চোখে দেখে ঝিরি। সমালোচনা করে। আর টোপর দ্বন্দ্ব হাঁকিয়ে বসে। সবকিছুই অন্যভাবে দেখতে চায়। ভাগ্য ওকে নিরন্তর যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে বাধ্য করেছে। ওরও পৃথিবীর দিকে দ্বন্দ্ব নিক্ষেপ করার স্বভাব। কেমন বলছিল? প্রেমিকাকে ছোট হতেই হবে কেন! পাগল! একদম পাগল! না হলে অত দাম দিয়ে ঝুমু-র জন্য শাড়ি কেনে? ঝুমু-র জন্য? যার রূপ নেই, গুণ নেই, বিদ্যাবুদ্ধি অতি সাধারণ, একটা চাকরি পর্যন্ত করে না, কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই, যে কিনা বসে আছে কবে কেউ তাকে পছন্দ করে মন্ত্র পড়ে সম্বন্ধ পাতিয়ে নিয়ে যাবে! বাবা চিন্তিত— মেয়ের বিয়ের যা খরচা আজকাল! বড়পিসি উদ্বিগ্ন। সময়মতো বিয়ে দিতে না পারলে মেয়ে গলার কাঁটা, বুকের পাথর। ঘাড়ের বোঝা। ঝুমুকেই বলে। খুব লজ্জা করে ঝুমু-র। বাবাই হোক আর পিসিই হোক, কারও গলার কাঁটা হয়ে বেঁচে থাকা গ্লানিকারক। টোপর রেগে ওঠে। উঠবেই। যা স্বভাব! না। সেজন্য রাগে না। আশ্চর্য! ঝুমু ভেবে দেখেনি কেন এতদিন? ও-ও ছিল ওর মায়ের বুকের পাথর!

ঝুমু-র ইচ্ছে করল, আবার টোপরের কাছে চলে যায়। আজ সারাদিনই প্রায় একসঙ্গে ছিল। থাকেও তো। টোপর বাড়িতে থাকলে কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে তো যায়ই বারংবার। হয়তো কথা হল কিছু, হলও না, হয়তো ছোটখাটো কাজ সেরে নিল চুপচাপ, প্রতিমা বা সরসীর সঙ্গে কথা বলল, কম্পিউটার বা বইতে নিমগ্ন টোপরকে দেখল খানিক।

ঘুমন্ত টোপর, ব্যস্ত টোপর, ব্যথিত, চিন্তিত, উৎসাহী, তার্কিক টোপর চেনা হয়ে গিয়েছিল। টোপরের আবেগ উচ্ছ্বাসের সমস্ত সরুগলিও ঝুমু-র চেনা। তবু এখন অসময়ে অকারণে কাছে যেতে কেন ইচ্ছা করে! ধ্যুৎ! ঝুমু টোপরের কাছে যাবে, তার আবার সময়-অসময়, কারণ-অকারণ কী!

একটা সাঁকো থাকলে ভাল হত না? ঝুমুর প্রিয় কল্পনা। টোপরদের বারান্দা থেকে তাদের এইদিকের ঝুলবারান্দা পর্যন্ত, কানাই সামন্ত সরু গলির উপর ঝুলন্ত সাঁকো!

রুপুকাকিমা ছিল যখন, ঝুমু-ঝিরি-টোপর বালক-বালিকারা রাবারের বল ছুড়ে হিন্দুস্থান-পাকিস্তান খেলত। টোপর চেয়ারে বসে, ঝাড়ু নমিতা আর তার ভাই পলাশ টোপরের কুড়োনদার। তখন নমিতার নাম ছিল ফেলি। জন্মের পর, স্ত্রীলিঙ্গ দেখে ঠাকুমা তাকে ফেলে এসেছিল ছাইগাদায়। নমিতার মায়ের কাছে সে গল্প বহুবার শুনেছে ঝুমু।

‘আমাদের গেরাম, বুঝলে ঝুমু, সেই যাকে বলে মরিচঝাঁপি, তার নিকটে। সোনাচি। দ্বীপের মতন। একন আর নেইকো। ডুবে গেছে। সেবার সেই ঝড় হল নি কো? সেই যে কী নাম? আয়েশা! টুকুন জমিজমা যা ছিল, ডুবে গেসল নোনা জলে। আর আগে না, আমি ছেলতাম শ্বশুরের ভিটেয়। ঘরের বউ। স্বামী থাকেন কলকাতায়। শাউড়ি বলে— যা বউ, জল থে’ মীন ধর যেয়ে। কামটের ভয়ে মরি। মুয়ে রা নেই। পোয়াতি হলে বলে কী, লাতি হবে, ঘরকে থাক। আমি তো বাঁচলাম। কিন্তু ভয়ে ভয়ে নাই খাই। লাতি না হয়ে লাতিন তো হতে পারে। বুড়ি বলে— চাই না লাতিন। মুখে নুন ঠেসে মেরে ফেলাব। ওর বাপ রে বলি, শহরে সাথে নে চলো, বলে— ফাসসকালে কাজে যাই, এইটুকচাস বস্তিঘরে ডেরা, তোমারে দেকেশুনে রাখবে কে! বলি— পাড়ায় মেয়েছেলে নাইকো? বিয়োয় না তারা? বলতে তো পারি না, তোমার মা লাতিন হলে নুন ঠেসে মারবে! শেষে, কী হল, ব্যথা তো উঠল, বুইলে ঝুমু, সে যে কী ব্যথা, মা গো, মেয়েছেলে মানুষ, টের পাবে, সইতে না পেরে কখন জ্ঞান হারানু। জেগে বলি, আমার ধন কই? শাউড়ি বলে,’ চুপ যাও, মরা মেয়ে বিইয়েছ! আমার পোড়া কপাল! বলি, মরলে নাতি আমার ছাতি দেবে, কোথায় কী!’ দাই ছিল আমার সইমা। সে দেকি মুক টেনে রাকে। চোখে চোক ডালে না। সন্দ হল। বলি, মরা মেয়েকে দর্শাও। শাউড়ি বলে, ও ছাইগাদায় ফেলি রেখিচি। পারিস তো নেয়ায়!

আমি ধড়ফড় করি। কেঁদে বলি, মাসি, মেয়ে আমার বুকে দাও। পশ্য করি। শুনি যেন মেয়ে কাঁদে। টাঁই টাঁই। জোর না। জানুরি মাসের শীত গো ঝুমু, বলে— বাঘেও কাঁতা গায়ে দেয়— মাসি আমার মেয়ে নে এল। কোলে নিনু। শীতে নীল। কেঁদে বলি, মাসিগো, এ তো বাঁচবেনি! মাসে বলে— বাবা তাওকনাতের নামে দিব্যি কর, তাওকেশরের পুখরে বিসজ্জন দিবি, নাম রাক ফেলি, এপ্পর বাবার দয়া।

বলি, মাসি গো, তুমি তো ছিলে, তবু!

মাসি বলে, লাতনি দেখে তোর শাউড়ির মাতা খারাপ। বলে— দে। গেলে দে পেটটা।

আমি বলি— ও-কতা বোলোনি, জনম দেওয়ানো আমার কাজ, খুন কর্তে পার্বোনি। তোমার লাতিন, তুমি যা হোক করো। ত’ন ছাইগাদায় ফেলি এল। নিজ হাতে মার্তে কি পারে? বলে মরুক ছাই খেয়ে। ঠাণ্ডায়।

ত’ন তো কিছু বলি না। মেয়েকে সেঁক দিই। ওম দিই। গা মুছি। কাঁতা চাপা দিই। গায়ে একটুস বল পেয়ে একেবারে তেড়েফুঁড়ে উঠে শুরু দিলাম শাসানি। পেটে যত গালাগালি ছিল, গায়ে যত ঝাল ছিল, সব এক্কেবারে ঢেলে দিলুম। মাগী তো হতবাক। বলে, যে মেয়ে রা কাড়ত না তার এ কী মুত্তি! বলি, পুলিশে দেব আপনেকে, জেলের ঘানি টানাব, খবদ্দার যদি মেয়ের গায়ে হাত দিইছেন।’

একেকটি ক্ষণ কী আশ্চর্য নিখুঁত। যদি আর আধঘণ্টা পরে নমিতার মায়ের জ্ঞান আসত, পৃথিবীতে নমিতা থাকত না।

তারকেশ্বরের পুকুরে ফেলিকে বিসর্জন দিয়ে শিবঠাকুরের কাছে প্রতিজ্ঞা রেখেছিল নমিতার মা। নতুন নামে মেয়েকে ফিরিয়ে এনেছিল! নমিতা আপন জন্মবৃত্তান্ত শোনে আর মিটিমিটি হাসে।

বড়পিসি প্রায়ই বলে, ‘জ্যোতের একটা ছেলেও যদি থাকত।’

লোকে পুংলিঙ্গ চায়। জগৎ পুংলিঙ্গময়। কিন্তু কী লাভ, যদি ছেলের কোনও অক্ষমতা থাকে? টোপরের মতো? প্রতিবন্ধী পুত্রও ফেলির মতো অনাকাঙ্ক্ষিত দায়। ঝুমু-র মতো মেয়ে প্রতিবন্ধী পুত্রের মতো বোঝা। ঝুমু যদি ছেলে হত, বাবার বিষাদ কিছু কম হত কি? ছেলে আছে— এই ভরসায় কৃপণতা কম হত? কিংবা টোপর একটি প্রতিবন্ধী মেয়ে হত যদি? প্রবীরকাকার ওই সাময়িক মনোবৈকল্য কি সার্বক্ষণিক হয়ে উঠত মেয়ের নিরাপত্তার চিন্তায়, আপন ভবিষ্যতের সুরক্ষার স্বার্থে!

আচ্ছা, অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে যদি অত চিন্তা বাবার, তা হলে ঝুমুকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করল কেন?

বাধ্য করেছে বলা যাবে না। বুঝিয়েছে। ঝুমুও দিল ছেড়ে। বাবা চাইছে, কী করবে? তার জন্য কেউ দুঃখ পেলে, অসুবিধায় পড়লে, মনে মনে ভারী অস্থির হয়ে পড়ে সে। সবাইকে খুশি রাখাই তার অভিপ্রায়। সবার সুবিধা করে দিতে চাওয়ার মধ্যে তৃপ্তি আছে। এই যে প্রবীরকাকা, কত নিশ্চিন্ত, ঝুমু আছে, প্রবীরকাকার অনেক ভাবনা সে ভেবে দেয়। রান্নাঘরের জন্য ছোট্ট চিরকুট বই কিনেছে। যা যা ফুরোয়, লিখে রাখে তারিখ সমেত। কেনা হলে ছিঁড়ে ফেলে দাও। এই যাঃ ভুলে গেলাম— কোনও দরকার নেই। সকলের সুবিধার্থে সদা সতর্ক বলেই বাবা চাইল না সে ঘরের বাইরে যাক? টোপরের ধারণা। খানিকটা সঠিক হলেও হতে পারে। তবু প্রশ্ন আছে। সে যদি কাজটায় লেগে থাকত, এতদিনে দস্তুরমতো চাকুরিজীবী, প্রশিক্ষণ শেষে সে উপার্জন করত, তার বিবাহের বিপুল ব্যয় আংশিক হলেও বহন করতে পারত সে।

নিদ্রাহীন রাতের অবারিত চিন্তায় ঝুমু তার বাবা জ্যোতির্ময়ের একটি অঘোষিত চারিত্র্য উপলব্ধি করতে পারল অনায়াসে। অত্যন্ত রক্ষণশীল তিনি। যে প্রাচীনতা মনে করে মেয়েরা অভিনেত্রী হলে বেশ্যা বনে যায়, খেলাধূলা করলে মাতৃত্ব হারায়, বেসরকারি আপিসে কাজ করলে উচ্চপদাসীনের হাতে বলাৎকৃত হয়! জ্যোতির্ময় এর বাইরে বেরোতে পারেননি!

টোপর, নানারকম প্রশ্ন তুলে তাকে দিয়ে ভাবিয়ে নেয়। টোপর তার বোধের বিশ্লেষণের অবলম্বন। সে টোপরের শ্রোতা। টোপরের সহায়। কথাপুষ্পের পাত্র, সে টোপরের আকাশ। আকাশে আকাশে বড় ভালবাসাবাসি। কে আগে ধুলো চাটে, কোন মেয়ে আদি জন্ম নেয়, কোন তারা আগেভাগে সাঁঝের আকাশ থেকে নেমে আসে অনন্ত নয়ন তারায়।

ঝুমুর শরীর জুড়ে ঘুম আসে। কী শিথিল করে দেয় ঘুম! আজকের দিনটা কী সুন্দর! টোপর কি জেগে আছে? বাড়িটা অন্ধকার। নারীবিবর্জিত বসবাস। একেবারে নারী নেই? মেয়ে নেই, মেয়ে? ঝুমু মেয়ে? আজকের দিনটা… কিন্তু রবিবার!

আবার প্রদর্শনী! আবার হাসি-হাসি মুখ করে চায়ের থালিকা মেয়ে মিষ্টি দেয় ব্যর্থতার আগে। ঝুমু বড় সাধারণ। মূল্যহীন। নিজেকে বিকোতে চেয়ে বিবাহের হাটে, সে কেবল বাসি হতে থাকে। অবিক্রীত পসরার মতো, আত্মবিশ্বস্ততাহীন, ফ্যাকাশে, মলিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *