সং অফ দ্য সানি স্পট

সং অফ দ্য সানি স্পট

চোখ খোলার পর আবিষ্কার করলাম আমি একটা স্ল্যাবের উপর শুয়ে আছি। উঠে বসে আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে পেলাম একটা বড় রুমের ভেতর আছি, যার ভেতর একগাদা অদ্ভুত দেখতে জিনিস জমা করে রাখা। উল্টো দিকে দেয়ালের কাছে একজন লোককে চেয়ারে বসে থাকতে দেখলাম। তাকে দেখে মনে হল গভীর কোন চিন্তায় ডুবে আছে, কিন্তু আমাকে ঠিকই লক্ষ্য করল। তার মুখে একটা হাসি ফুটে উঠল।

“গুড মর্নিং,” চেয়ারে বসেই সে বলল। তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত পরনের সব কিছুরই রঙ সাদা।

“তুমি কে?” আমি জানতে চাইলাম। উত্তর দেয়ার আগে সে উঠে দাঁড়াল আর হেঁটে কাছের একটা লকারের দিকে গেল। লকার খুলে কিছু পোশাক আর জুতো বের করল।

“আমি সেই ব্যক্তি যে তোমাকে সৃষ্টি করেছে, সে আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল। সিলিং থেকে আসা সাদা আলো আমাদের দুজনকে ভাসিয়ে দিচ্ছিল। সে কাছাকাছি এলে আমি বুঝতে পারলাম তার ত্বক কতটা ফ্যাকাসে ছিল। সাদা ত্বকের বিপরীতে তার চুলগুলো ছিল গাঢ় কালো। সে আমার কোলের উপর কাপড়গুলো রেখে বলল পরে নিতে। আমি শার্ট আর ট্রাউজারটার দিকে তাকালাম; ওগুলো দেখতে ঠিক তার পরা পোশাকগুলোর মতই ছিল, একই রকম সাদা রঙের। আমি নগ্ন ছিলাম।

“হ্যাপি বার্থডে,” সে বলল। রুমের উপর আবার চোখ বুলিয়ে আমি দেখতে পেলাম আমাদের চারপাশে অনেক রকমের যন্ত্রপাতি আর বানানোর সামগ্রী রাখা। আমি যেখানে বসেছিলাম তার পাশে একটা প্ল্যাটফর্মের উপর একটা মোটা বই দেখতে পেলাম। দেখে মনে হচ্ছিল বইটা অসংখ্যবার পড়া হয়েছে, একগাদা সাজানো নোট রাখা।

আমি পোশাকগুলো পরে তার পিছুপিছু রুম থেকে বের হলাম। অনেকগুলো দরজা আর শাটারসহ একটা লম্বা হলওয়ে ধরে হেঁটে গেলাম। তারপর একটা সিঁড়ি সামনে পড়ল, যেটা উপর দিকে গিয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার পর আরেকটা দরজা পড়ল। দরজাটা সে খুলতেই উজ্জ্বল আলো আমার মুখের উপর এসে পড়ল আর কিছুক্ষণের জন্য অন্ধ হয়ে গেলাম। সেই মুহূর্তে আমি প্রথম উপলদ্ধি করলাম, যেই রুমে আমি প্রথম চোখ খুলেছিলাম, সেটা ছিল ভূগর্ভস্থ। আমার ত্বক দ্রুত উষ্ণ সূর্যালোক শুষে নিতে লাগল।

দরজা দিয়ে বের হওয়ার পর আমি দেখতে পেলাম আমরা একটা ঘাসে ঘেরা পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছি। উপরের এই চওড়া সবুজ ঢালু জায়গা থেকে সামনের পুরোটা এলাকা সুন্দরভাবে চোখে পড়ছিল। আমাদের ভূগর্ভস্থ চেম্বারের দরজাটা একদম চুড়োর কাছে অবস্থিত। কাঠামোটা একদম সাধারণ ধরণের ছিল। কংক্রিটের তৈরি আয়তক্ষেত্র, লম্বায় আমার চেয়ে বেশি নয়। একটাই দরজা ঢোকার কিংবা বের হওয়ার জন্য। ছাদটা। কংক্রিটের একটা সমতল জায়গা, যেটার কিছু অংশ ঘাসে ঢেকে ছিল। একটা পাখি সেখানে বাসা বেঁধেছে।

আমি চারপাশের এলাকার উপর চোখ বোলালাম তথ্য সংগ্রহের জন্য। আমাদের ছোট পাহাড়টার চারিদিকে উঁচু পর্বতমালা। পাহাড়টার আকৃতি ছিল কোন গোলকের উপরের এক তৃতীয়াংশের মত। ব্যাস এক কিলোমিটার। পর্বতগুলো গাছে ছেয়ে ছিল। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেটার মত আর কোন ঘাসভূমি চোখে পড়ল না। আমি সিদ্ধান্তে এলাম যে পাহাড়টা অবশ্য

“নিচের ঐ বনের ভেতরে আমাদের বাড়ি, লোকটা হাত তুলে দেখিয়ে বলল। পাহাড়ের নিচে একটা বেড়া দেয়া জায়গা দেখা যাচ্ছে। সেখান থেকে পর্বতমালা পর্যন্ত গাছ ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছিল না। এর ভেতরে একটা ফাঁক দিয়ে আমি একটা বাড়ির ছাদের কিছু অংশ দেখতে পেলাম।

“ঐ বাড়িতে তুমি আমার দেখাশোনা করবে,” সে বলল। তারপর আমরা পাহাড় বেয়ে নামতে লাগলাম।

বনের কাছাকাছি একটা জায়গায় দুটো সাদা রঙের কাঠের তক্তা একত্র করে ক্রস বানানো হয়েছে। এমনিতে জায়গাটা একদম সমতল, খালি ঐ জায়গাটায় মাটি একটু উঁচু।

“কবর,” সে বলল।

কাছে যাওয়ার পর আমি দেখতে পেলাম বাড়িটা বেশ বড় আর পুরোনো। বিষয়টা আমার কাছে পরিস্কার যে, বাড়িটাকে প্রকৃতির ইচ্ছের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। দেয়ালের বিভিন্ন অংশে গাছ গজিয়েছে। ছাদের টাইলস থেকে সবুজ পাতা উঁকি দিচ্ছিল। বাড়ির সামনে বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে একটা ঘেসো উঠোন, একটা কুয়া আর একটা জং ধরা পুরাতন ট্রাক।

কাঠের দরজাটা থেকে সাদা রঙের চলটা উঠে গিয়েছে। আমি তার পেছন পেছন ভেতরে গেলাম। মেঝের কাঠের বোর্ডগুলো আমাদের ভারে কাঁচকোঁচ করে উঠল।

বাড়িটায় দুটো তলা আর একটা চিলেকোঠা ছিল। আমাকে নিচ তলায় কিচেনের পাশের রুমটা দেয়া হয়েছিল। ছোট একটা রুম। একটা বিছানা, আর একটা জানালা ছিল শুধ।

সে আমাকে কিচেনে ডাকল।

“প্রথমে আমি চাই তুমি কফি বানাও।”

“আমি জানি কফি কি, কিন্তু কিভাবে বানাতে হয় তা জানি না।”

“সেটা ঠিক আছে।”

সে শেলফ থেকে কফি বিন ভর্তি একটা ছোট কৌটা নামাল আর পানি জ্বাল দিল। দু কাপ কফি বানাল, আমি দেখলাম। তারপর এক কাপ আমার দিকে বাড়িয়ে দিল।

“ধন্যবাদ,” আমি বললাম। গাঢ় তরলে ঠোঁট লাগিয়ে চুমুক দিলাম। “আমি দেখেছি তুমি কিভাবে কফি বানালে। পরেরবার আমি বানাব।” কাপে টোকা দিয়ে আমি তরলটা মখের ভেতর দিয়ে নেমে যেতে দিলাম।

“তবে,” আমি বললাম, “এর স্বাদটা আমার পছন্দ হল না।”

“হ্যাঁ,” সে মাথা ঝাঁকাল। “তোমার মনে হয় কিছুটা চিনি দিয়ে নেয়া উচিত।”

আমি তার কথা মত কাজ করলাম আর নতুন মিষ্টি করা কফিতে চুমুক দিলাম। জেগে উঠার পর এটাই ছিল প্রথম খাবার যা আমার শরীর পরিচিত হয়েছিল। পাকস্থলীর কলকজাগুলো সব পুষ্টি ঠিকমত শুষে নিল।

হাঁটার পর খানিকটা ক্লান্ত বোধ করায় আমি একটু বসলাম আর কাপটা কিচেনের টেবিলের উপর রাখলাম। জানালা থেকে একটা ধাতব ডেকোরেশন ঝুলছে। ধাতুর তৈরি বিভিন্ন সাইজের রড বাতাসের প্রবাহের সাথে দুলছে আর চমৎকার একটা শব্দ হচ্ছে। আমরা চুপচাপ বসে সেই অনিয়মিত শব্দ শুনলাম।

দেয়ালে একটা ছোট আয়না লাগানো ছিল। আমি সেটার সামনে গিয়ে বসে আমার চেহারাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। মানুষ দেখতে কি রকম হয় তা আমি আগে থেকেই জানতাম, তাই আমাকে একজন নারীর আদলে তৈরি করা হয়েছে দেখে অবাক হলাম না। আমি জানতাম যে আমার শরীরের প্রতিটা খুঁটিনাটি-আমার সাদা ত্বক, লাল চুল, সবকিছু মানুষের সাথে মিলিয়ে ডিজাইন করা।

কিচেনের কাপ বোর্ডে কিছু পুরোনো ছবি খুঁজে পেলাম। ওগুলোতে বাড়িটার সামনে দুজন মানুষকে দেখা যাচ্ছিল। সে আর একজন সাদা চুলের বুড়ো মানুষ। “তোমার সাথের জন কোথায়?” আমি জানতে চাইলাম।

সে একটা চেয়ারে বসে ছিল, আমি শুধু তার পিঠ দেখতে পাচ্ছিলাম। সে আমার দিকে না ঘুরে উত্তর দিল, “কোথাও না।”

“কোথাও না কথাটা দিয়ে কি বোঝাতে চাইছ?”

সে আমাকে জানালো পৃথিবীর মানুষেরা প্রায় বিলুপ্তির মুখে। সে ব্যাখ্যা করল যে পৃথিবীর আকাশে জীবাণু ছড়িয়ে পড়েছিল, আর দুই মাসের মধ্যে প্রায় পুরো গ্রহের জনসংখ্যা মুছে যায়। ব্যতিক্রম না হলেও ও ভাগ্যবান। ছিল। আক্রান্ত হওয়ার আগে সে গ্রামের দিকে তার চাচার বাড়িতে চলে আসতে সক্ষম হয়। ওর চাচা এক সময় মৃত্যুবরণ করে আর তাকে পাহাড়ের পাদদেশে কবর দেয় ও। এখানে আসার সময় আমরা যে ক্রসটা দেখেছিলাম।

“দুদিন আগে আমি নিজেকে পরীক্ষা করেছি,” সে বলল। “জানতে পারলাম আমি জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি।”

“তারমানে তুমিও মারা যাবে।”

“হ্যাঁ, কিন্তু আমি সৌভাগ্যবান ছিলাম। কয়েক দশক ধরে জীবাণুগুলো আমাকে খুঁজে পায়নি।”

আমি ওকে ওর বয়স জিজ্ঞেস করলাম। প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি, সে বলল।

“তোমাকে দেখে মনে হয় না। আমি যা বুঝি তাতে তোমাকে দেখে বিশের কাছাকাছি মনে হয়।”

“আমি ব্যবস্থা নিয়েছি।”

যা বোঝা গেল তা হল কিছু সার্জারির মাধ্যমে মানুষ এখন ১২০ বছরের মত বেঁচে থাকতে পারে।

“কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি জীবাণুর হাত থেকে বাঁচতে পারলাম না।”

আমি উঠে গিয়ে কিচেনের বিভিন্ন যন্ত্রপাতিগুলো পরীক্ষা করে দেখলাম। রেফ্রিজারেটরে বিভিন্ন সবজি, সিজনিং, অন্যান্য খাবার রাখা ছিল যা গরম করে খাওয়া যাবে। ইলেকট্রিক জিনিসগুলোর মধ্যে একটা না থোয়া ফায়িং প্যান ছিল। আমি সুইচ অন করলে স্টোভের কয়েল ধীরে ধীরে গরম হয়ে উঠল।

“আমাকে একটা নাম দাও, প্লিজ,” আমি বললাম।

সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে লনের উপর কয়েকটা প্রজাপতির ওড়াউড়ি দেখছে। বোঝা যাচ্ছে অন্যমনস্ক।

“লাভ কি?”

জানালা দিয়ে বাইরের ঝিরঝিরে বাতাস ঘরে ঢুকছে। বাতাসের সোতে রিমঝিম শব্দ তুলছে ধাতুর তৈরি চাইমটা।

“আমি যখন মারা যাব,” সে বলল, “আমি চাই তুমি আমাকে ঐ পাহাড়ের পাদদেশে নিয়ে গিয়ে কবর দেবে। আমি আমার চাচার পাশে বিশ্রাম নিতে চাই। সেজন্যেই তোমাকে তৈরি করেছি।”

সে আমার মুখের দিকে তাকাল।

“বুঝতে পেরেছি। আমাকে তৈরি করা হয়েছে গৃহস্থালি কাজ করার জন্য আর তোমাকে কবর দেয়ার জন্য।”

সে মাথা ঝাঁকাল।

“এগুলোই তোমার অস্তিত্বের মুল কারন।”

আমি ঘর পরিস্কার করা শুরু করলাম। একটা ঝাড়ু নিয়ে মেঝে ঝাঁট দিলাম আর এক টুকরো ত্যানা দিয়ে জানালাগুলো মুছলাম। আমি যখন আমার কাজ করছিলাম তখন সে চেয়ারে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল।

জানালার ধুলো পরিস্কারের সময় আমি খেয়াল করলাম একটা ছোট পাখি স্থির হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। আমার মনে হল ওটা মৃত, তাই বাইরে গেলাম ওটা তুলে দেখতে। পাখির দেহটা একদম ঠাণ্ডা হয়ে ছিল, আমার সন্দেহ সঠিক প্রমানিত হল।

সে এর মধ্যে কোন এক সময় জানালায় এসে দাঁড়িয়েছি। আমার হাতে মরা পাখিটা দেখে বলল, “তুমি এটা দিয়ে কি করবে এখন?”

উত্তরে আমি পাখিটাকে বনের দিকে ছুঁড়ে মারলাম। আমার পেশীগুলো সাধারণ একজন প্রাপ্তবয়স্কা নারীর মতই, তবুও অনেকদূর পর্যন্ত উড়ে গিয়ে গাছের ডালে পড়ে হারিয়ে গেল।

“এরকম করলে কেন?” সে মাথা কাত করে আমাকে জিজ্ঞেস করল।

“কারন ওটা পঁচে গেলে সারে পরিণত হতে পারবে।” আমি উত্তর দিলাম। সে মাথা ঝাঁকাল।

“যখন সময় আসবে, তুমি আমাকে ঠিকমত কবর দেবে। তোমাকে মৃত্যু সম্পর্কে কিছু জিনিস জানতে হবে,” সে বলল।

সে ঠিকই বলেছিল। আমি মৃত্যু কি তা বুঝতে পারছিলাম না। হতবুদ্ধি হয়ে ছিলাম।

এভাবে একসাথে আমাদের জীবন শুরু হল।

সকালে উঠে আমি কিচেন থেকে বালতিটা নিয়ে পানি তুলতে কুয়ার দিকে যাই।

এই কুয়ার পানি আমরা রান্না-বান্না আর ধোয়াধুয়ির কাজে ব্যবহার করি। সেলারে একটা ছোট ইলেক্ট্রিক জেনারেটর ছিল, কিন্তু পানি তোলার জন্য কোন পাম্প ছিল না।

পাথর বসানো একটা বাঁকানো পথ দিয়ে বাড়ি থেকে কুয়া পর্যন্ত যেতে হত। প্রতিদিন সকালে আমি ঐ বাঁকানো পথটা বাদ দিয়ে সোজাসুজি কুয়ার দিকে যেতাম। শুধু যে পথটা উপেক্ষা করতাম, তাই নয়। যাওয়া আসার সময় ফুলের গাছগুলোকেও মাড়িয়ে যেতাম।

কুয়াতে দড়ি দিয়ে বাঁধা একটা বালতি লাগানো ছিল। আমি সেটা ছেড়ে দিতাম কুয়ার গভীরে পানিতে পড়ার জন্য। পানিতে পড়ে ছলাৎ করে শব্দ উঠলে বুঝতে পারতাম নিচে পৌঁছেছে। বালতিটা টেনে তোলার সময় পানির ওজন টের পেয়ে অবাক লাগত।

পানি আনার পর দাঁত ব্রাশ করতাম। প্রত্যেকদিন সকালে আমার মুখের ভেতর কেমন বিচ্ছিরি একটা স্তর জমা হত। ঘুমের মধ্যে লালার হজমশক্তি আটকা পড়ত, আর আমি টুথব্রাশ দিয়ে সেটা পরিস্কার করতাম।

জরুরি জিনিস আর খাবার দাবার সব একসাথে ভূগর্ভস্থ গুদাম ঘরে রাখা হত। আমি খেয়াল করলাম যে এই রুমের পাশের রুমেই আমার জন্ম হয়েছিল। আমি ওখানে যেতাম প্রতিদিনের খাবার আনার জন্য। তার সাথে বাগানে চাষ করা শাকসজি দিয়ে ইলেকট্রিক চুলায় ফাইপ্যানে রান্না করতাম। আমি যখন রান্না করতাম তখন সে তার দোতালার রুম থেকে নেমে এসে টেবিলে বসততা। খাবারের সাথে সবসময় কফি খেত।

“তোমার কাছে অতীতের কোন ছবি বা রেকর্ড করা কিছু নেই?” একদিন আমি ব্রেকফাস্টের সময় জিজ্ঞেস করলাম। খাওয়া শেষে আমি সব পরিস্কার করার পর সে আমাকে কিছু ছবি দেখাল। পুরাতন ছবি যেরকম হয়, রঙ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ছবিতে একটা শহর দেখা যাচ্ছে যেখানে অনেক মানুষ বসবাস করত। আমি লম্বা বিল্ডিংগুলো, গাড়িগুলো আর মানুষগুলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম।

একটা ছবিতে তাকে একটা বিল্ডিঙের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম ওটা কি ছিল, সে জানাল ওখানে সে একসময় কাজ করত।

আরেকটা ছবিতে একজন নারী ছিল। তার চেহারা আর চুল হুবহু আমার মত দেখতে ছিল।

“তুমি অনেক জনপ্রিয় ছিলে,” সে বলল।

পর্বতমালা আর পাহাড়টা যেখানে মিলিত হয়েছে, সেখানে আমাদের বাড়িটা ছিল। বাড়ির পেছন দিয়ে পর্বতমালার পাদদেশ পর্যন্ত চলে গেছে একটা রাস্তা। আগাছা জন্মে রাস্তাটা প্রায় ঢেকে গেছে। কেউ সেটা ব্যবহার করে এরকম কোন চিহ্ন ছিল না। রাস্তাটা বাড়ি পর্যন্ত-বলা যায় অন্ধ গলির মত শেষ হয়েছে এখানে এসে।

“তুমি যদি এই রাস্তা ধরে পর্বতমালা পর্যন্ত যাও, সেখানে কি আছে?” আরেকদিন আমি ব্রেকফাস্টের সময় জানতে চাইলাম।

“ওখান থেকে ধ্বংসস্তূপের শুরু, কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে সে উত্তর দিয়েছিল। উঠোনের গাছপালাগুলোর ভেতর দিয়ে পর্বতমালার পাদদেশটা ভাল মত দেখা যেত। সে যেরকম বলেছিল, দেখে মনে হচ্ছিল এক সময় সেখানে কোন শহর ছিল। আমি পরিত্যক্ত বাড়িঘর আর গাছপালা দেখতে পেলাম। কিন্তু কোন মানুষজন থাকার কোন চিহ্ন দেখতে পেলাম না।

আরেকদিন ব্রেকফাস্টের সময় সে কাঁটাচামচ দিয়ে তার সালাদের একটা অংশ আমার সামনে তুলে ধরল। একটা লেটুস পাতার কোনার দিকে ছোট ছোট দাঁতের দাগ। যেন কেউ চাবিয়ে রেখেছে। লেটুসটা আমাদের বাগানের থেকে তোলা।

“খরগোশ,” সে বলল। আমরা অবশ্য রোগ বালাইয়ের ধার না ধেরে খরগোশের চাবানো লেটুস খেয়ে ফেললাম। বেছে নিতে বললে আমি অবশ্য দাঁতের দাগ ছাড়া লেটুস খেতেই আগ্রহ বোধ করতাম।

ব্রেকফাস্টের পর আমি বাড়ির মধ্যে একটু হাঁটাহাঁটি করলাম আর কিছু চিন্তা করলাম। ভাবছিলাম ওর জীবন শেষ হওয়ার পর কি হবে। এক সময় আমিও তো আর নড়াচড়া করতে পারব না। আমার মত অস্তিত্বরও একটা কর্মক্ষম পর্যায় আছে, যা প্রথম থেকেই ঠিক করা থাকে। সেই সময়টা আসতে এখনো অনেক দেরি কিন্তু আমি জানতাম আমার জীবনের আর কতটুকু বাকি। হাতগুলো তুলে কান চাপলাম। ভেতরে ছোট ছোট মোটর ঘোরার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। এগুলোই একদিন বন্ধ হয়ে যাবে, নিজেকে নিজে বললাম।

ভূগর্ভস্থ গুদাম ঘরে গিয়ে নিশ্চিত হলাম যে সেখানে একটা কোদাল রাখা আছে। সে যেহেতু চায় তাকে পাহাড়ের পাদদেশে কবর দিতে, আমার উচিত মাটি খোঁড়াটা একটু অনুশীলন করা।

আমি এখনো কল্পনা করতে পারছি না মৃত্যু ব্যাপারটা কি রকম হতে পারে। সে কারণে হয়ত বা, অনেক গর্ত খোঁড়ার পরেও আমি শুধু চিন্তা করছিলাম, কি হবে?

***

বাড়ির সমস্ত জানালার পাশে একটা করে চেয়ার রাখা ছিল। আর দিনের বেলায় সে ওগুলোর কোন একটা বেছে নিয়ে তাতে বসে থাকত। চেয়ারগুলোর বেশিরভাগই ছিল একজনের বসার মত কাঠের চেয়ার। তবে যে জানালাটা থেকে কুয়া দেখা যেত, সেটার পাশে একটা লম্বা বেঞ্চ ছিল।

আমি তার দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমার করণীয় কিছু আছে কিনা। সে শুধু হাসল, আর বলল “না।” মাঝে মাঝে আমি তার জন্য এক কাপ কফি নিয়ে এলে সে বলত, “ধন্যবাদ।” তারপর আবার জানালার দিকে ঘুরে যেত। চোখগুলো এমনভাবে কুঁচকে থাকত যেন অতি উজ্জ্বল কোন কিছু দেখছে।

অনেকবার এমন হয়েছে যে আমি তাকে বাড়ির কোথাও খুঁজে পেতাম না। শেষে দেখতাম বাইরে, তার চাচার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ক্রসের সাদা রঙের সাথে ওর পোশাকের সাদা রঙটা চমৎকার মিলে যেত।

কবর সম্পর্কে আমার কিছু ধারণা ছিল। ঐ জায়গায় মৃতদেহ মাটি চাপা দেয়া হয়। কিন্তু এই নির্দিষ্ট কবরটার সাথে ওর সম্পর্কটা আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এতদিনে নিশ্চয়ই ওর চাচার দেহ গলে মাটির সাথে মিশে গিয়ে গাছদের খাবারে পরিণত হয়েছে।

আমার জন্মের পর থেকেই উঠোনের সবজির বাগানটা দেখে আসছি। সে ওখানে চাষ করত। এখন আমি ওগুলোর দেখাশোনা করি।

মাঝেমাঝে খরগোশ এসে সবজিগুলো চিবিয়ে রেখে যায়। পুরো বনের সব গাছপালা রেখে তাদের মনে হয় আমাদের বাগানটাই বেশি পছন্দ।

মাঝেমাঝে যখন আমার কিছু করার থাকে না তখন ঝোঁপের কাছে দাঁড়িয়ে থাকি। যখন ছোট মত সাদা কোন কিছুকে সবজির দিকে এগুতে দেখি তখন দৌড়ে গিয়ে ধরার চেষ্টা করি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমার শারীরিক ক্ষমতা কোন প্রাপ্তবয়স্কা নারীর চেয়ে বেশি নয়। তাই কখনোই কোন খরগোশ ধরতে পারিনি। তারা আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে দৌড়ে বনের মধ্যে হারিয়ে যায়।

খরগোশের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে মাঝে মধ্যে আমি কোন কিছুতে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাই। তখন পেছনের জানালা থেকে মুখ টিপে হাসার শব্দ ভেসে আসে। বাড়ির দিকে ঘুরে তাকিয়ে দেখতে পাই সে হাসছে। পরাজয় মেনে নিয়ে মাথা নিচু করে উঠে দাঁড়িয়ে আমি আমার সাদা পোশাক থেকে ধুলো কাদা ঝাড়তে থাকি।

“যত দিন যাচ্ছে তুমি তত মানবীয় হয়ে উঠছ, বাড়িতে ফেরার পর সে হাসিমুখে আমাকে বলল। তার কথার অর্থ বুঝতে আমার সমস্যা হচ্ছিল। সে যখন আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিল, আমার অনেক মেজাজ খারাপ হচ্ছিল। আমার শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেল, কিভাবে প্রতিক্রিয়া

জানাবো বুঝতে পারছিলাম না। কিছু না পেয়ে আমার মাথা চুলকালাম আর বলে উঠলাম, “আহা!” বিব্রতকর পরিস্থিতিতে কি এরকম অনুভূতি হয়? আমার জানা নেই। আমি শুধু জানতাম যে আমার উপর হাসার কারনে তার উপর বিরক্ত লাগছিল আমার।

লাঞ্চের সময় সে টেবিলে দুবার চাপড় দিল আমার মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য। আমি এক বাটি সুপ খাচ্ছি আর সে সালাদ খাচ্ছে। লেটুসে বরাবরের মত খরগোশের দাঁতের চিহ্ন লেগে আছে।

“আমার সালাদের সজিতে খরগোশের দাঁতের দাগ আছে অথচ তোমার সুপেরগুলোতে নেই কেন?”

“বিষয়টা পুরোপুরি কাকতালীয়,” আমি বললাম আর খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম।

***

দোতালায় একটা রুম ছিল যেটায় কোন বইয়ের শেলফ, ডেস্ক বা চেয়ার কিছুই ছিল না। শুধু প্লাস্টিকের তৈরি কিছু খেলনা ব্লক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, ছোট বাচ্চাদের খেলনার মত। আমি কখনো সত্যিকারের বাচ্চা দেখিনি কিন্তু ওরা কেমন হতে পারে সে সম্পর্কে আমার কিছু ধারণা আছে।

প্রথম যখন আমি ঐ রুমে উঁকি দিয়েছিলাম, পুরো রুমটা বিকেলের সূর্যের আলোয় লালচে হয়ে ছিল। তীব্র লাল আলোতে ব্লকগুলোকে আরও গাঢ় লাল লাগছিল।

ব্লকগুলোর কয়েকটা একসাথে জুড়ে অসমাপ্ত একটা জাহাজের মত বানানো হয়েছিল। পুরোটা শেষ করলে এত বড় হবে যে দু হাত লাগবে জড়িয়ে ধরতে। জাহাজের বো টা ছিল না। ভোলা ব্লকগুলো মেঝের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।

“আমি একবার ওটায় লাখি দিয়েছিলাম, তখন ওগুলো ভেঙে খুলে পড়েছিল।” সে আমার পেছন থেকে বলল। সে আমাকে ওগুলো নিয়ে খেলার অনুমতি দিলেও আমি বুঝতে পারছিলাম না কোত্থেকে শুরু করা উচিত। আমার মনে হচ্ছিল হঠাৎ যেন আমার ব্রেনটা জমে গিয়েছিল।

“তোমার জন্য কিছু বানাতে যাওয়াটা কঠিন মনে হতে পারে, সে বলল। খুঁটিনাটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বলে দেয়া হলেই শুধু আমি কাজে লাগতে পারি। সে বলল আমি নাকি কখনো শিল্পকর্ম সৃষ্টি বা সঙ্গীত রচনা করতে পারব না। তাই চুপচাপ সেখানে বসে থাকলাম, কিছু করতে পারলাম না।

সূর্য ডুবে যাওয়ার পর বাইরে অন্ধকার নেমে এল। উঠোনের আলোগুলো নিজে নিজে জ্বলে উঠল। সাদা আলোগুলো জানালার কাঁচে প্রতিফলিত হচ্ছে।

সে ঐ রুমে বসে একটা ব্লক আরেকটার উপর সাজাতে লাগল। একটা জাহাজ বানাচ্ছিল। লাল জাহাজটা বানানো শেষে সে সবদিক থেকে ঘুরিয়ে সেটা দেখল। আমারও ইচ্ছা হচ্ছিল যদি তার মত করে ব্লকগুলো নিয়ে খেলতে পারতাম।

ল্যাম্পগুলোর চারপাশে সবসময় মথ উড়াউড়ি করত। আমরা যখন রাতে আমাদের দাঁত ব্রাশ করতাম তখন মাটির উপর মথের উড়ার ছায়া পড়ত। আমরা আমাদের মুখ ধুয়ে পানি নর্দমাতে ফেলতাম। নর্দমাটা বনের কোল ঘেসে পর্বতমালার কাছে একটা নদী পর্যন্ত লম্বা ছিল।

দাঁত ব্রাশ করার পর থেকে বিছানায় যাওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে আমরা লিভিং রুমে বসে মিউজিক শুনতাম। আমাদের দুজনের কেউই তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যাওয়ার ব্যাপারটা পছন্দ করতাম না। মাঝে মাঝে আমরা হালকা মিউজিক চালিয়ে দাবা খেলতাম। একবার ও জিতলে একবার আমি জিততাম। আমার মানসিক ক্ষমতা একজন সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি দেয়া হয়নি।

জানালাগুলোতে পর্দা টেনে দেয়া হত যাতে পোকা ঢুকতে না পারে। কিচেনের জানালা দিয়ে রাতে যখন বাতাস ভেসে আসত, ধাতুর চাইমটা নড়ে উঠে পরিচিত শব্দ সৃষ্টি করত। শব্দটা পরিস্কার এবং সুমধুর।

“জানালার ঐ চাইমের শব্দটা হল বাতাসের মিউজিক। আমার এটা পছন্দ…এই শব্দটা,” আমি ওকে বলেছিলাম। সে তখন দাবার পরবর্তী চাল কি হতে পারে তা নিয়ে চিন্তা করছিল। আমার কথা শুনে প্রথমে ভুরু কুঁচকে তাকাল, তারপর মাথা ঝাঁকাল।

আমি নিশ্চিন্তবোধ করছিলাম। প্রথম যখন আমি এই বাড়িতে এসেছিলাম তখন উইন্ড চাইমের শব্দটা অনিয়মিত ঝনঝন আওয়াজের মত মনে হত। এক সময় আমি অনুভব করলাম সেটা অন্যকিছুতে পরিণত হয়েছে। এরপর পুরো একটা মাস পার হয়ে গিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে আমার অজান্তেই আমার হৃদয় বদলে গিয়েছে।

সে রাতে সে তার বেডরুমে যাওয়ার পর, আমি একা বাইরে হাঁটতে গেলাম। কালির মত ঘন অন্ধকার রাত ছিল, কিন্তু একটা ল্যাম্পের নিচে দাঁড়ানোর কারনে আমার চারপাশে আলো ভেসে যাচ্ছিল। আমি ওখানে দাঁড়িয়ে চিন্তা করলাম, আমার মধ্যে কী কী পরিবর্তন এসেছে।

কোন একদিন, আমার মনে নেই সেটা কবে, আমি কিচেন থেকে কুয়াতে সরাসরি যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। আমি এখন ঐ পাথর বসানো বাঁকানো পথ দিয়ে ঘুরে যাই আর খেয়াল রাখি যেন কোন ফুলের গাছ মাড়িয়ে না ফেলি। আগে আমার মনে হত এটা সময় আর শক্তির অপচয়। আর এখন আমি হাঁটার সময় চারদিক উপভোগ করি।

যখন আমি প্রথম ঐ ভূগর্ভস্থ কামরা থেকে বের হয়েছিলাম তখন সূর্যের আলো পছন্দ করেছিলাম শুধু এর উজ্জ্বল আলো আর ত্বকের উপর উষ্ণ অনুভুতির জন্য। আর এখন আমি এটাকে আরো ব্যক্তিগতভাবে উপলদ্ধি করতে পারি-যেটা হয়ত শুধুমাত্র কোন কাব্যিক ভঙ্গিতে প্রকাশ করা সম্ভব। এখন মনে হয় সূর্যের সাথে আমার হৃদয়ের কোথাও কোন গভীর সম্পর্ক আছে।

অনেক কিছুই এখন আমার কাছে মূল্যবান মনে হয়: বাড়িটা, এর দেয়ালে বেড়ে ওঠা গাছগুলোসহ। পাহাড়ের ধারের ঘাসভূমি। ভূগর্ভস্থ গুদামঘরে যাওয়ার দরজা, সেটার মাথার উপরে পাখির বাসাটা। মাথার উপরের নীল আকাশ আর ভেসে যাওয়া তুলোর মত মেঘগুলোও ভাল লাগে। তেতো কফি আমার ভাল লাগে না, অনেক চিনি দিয়ে খেলে ভাল লাগত। গরম গরম অবস্থায় মিষ্টি তরলটা জিহ্বাতে ছড়িয়ে যাওয়ার অনভুতিটা আমাকে আনন্দিত করে তোলে। “ আমি খাবার রান্না করা আর ঘরবাড়ি পরিস্কার রাখা চালিয়ে যেতে লাগলাম। সাদা পোশাকগুলো ধুয়ে দিতাম। কোথাও ছিঁড়ে ফেটে গেলে সুই সুতো দিয়ে সেলাই করি। একটা প্রজাপতি জানালা দিয়ে উড়ে এসে রেকর্ড প্লেয়ারের উপর বসল। বাতাসের শব্দ শুনতে শুনতে আমি চোখ বন্ধ করলাম।

রাতের আকাশে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকি। বাতাসে গাছগুলো এদিক ওদিক দোলে আর পাতাগুলো ঝিরঝির শব্দ তোলে। আমি এর সবকিছু ভালবাসি, তাকেসহ।

গাছের ফাঁক দিয়ে আমি দূরে শহরের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেতাম। কোথাও কোন আলো ছিল না। পুরো অন্ধকার।

“আর এক সপ্তাহের মধ্যে আমি মারা যাব,” পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সে বলল। একটা মেডিক্যাল টেস্ট ওকে জানিয়েছিল ঠিক কখন সে মারা যাবে। আমি তখনো পুরোপুরি ‘মৃত্যু মানে কি তা বুঝতে পারিনি। কিন্তু আমি তাকে বললাম যে আমি বুঝেছি।

ওর শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছে। সকালে উঠে নিচে আসতে দেরি হয় এখন। আমরা ঠিক করেছি সে এখন থেকে এক তলায় আমার রুমে ঘুমাবে। এর বদলে আমি দোতালায় গিয়ে ঘুমাবো।

আমি তাকে বিছানা থেকে উঠে জানালার পাশে চেয়ারে গিয়ে বসতে সাহায্য করি। সে অবশ্য বলে যে তার কোন সাহায্যের দরকার নেই আর আমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখে। আমি যা করি তার কোনটাকেই নার্সিং বলা যাবে না। সে কখনো জ্বর কিংবা শরীরে ব্যথা নিয়ে কোন অভিযোগ করেনি। তার বক্তব্য হল জীবাণুগুলো নাকি ওভাবে কাজ করে না। ওগুলো কোন ব্যথা সৃষ্টি করে না, শুধু মৃত্যু।

ওর নড়াচড়ার ঝামেলা কমানোর জন্য, সে যেখানে বসে থাকে সেখানেই খাওয়ার অভ্যাস করলাম আমরা। সে যদি বেঞ্চে বসে থাকত তাহলে আমি ট্রেতে করে আমাদের খাবার সেখানে নিয়ে আসি। সে যদি অন্য কোন চেয়ারে বসে থাকে, তাহলে তার পায়ের কাছে বসে রুটি-টুটি কিছু একটা খাই।

সে তার চাচার কথা বলত। কিভাবে তারা ট্রাকে চড়ে ধ্বংসস্তূপের দিকে যেত। সেখানে দরকারি কিছু পাওয়া যায় কিনা ঘাঁটাঘাঁটি করত। আর দিন শেষে বাড়ি ফিরে আসত। যে ট্রাকটা তারা ব্যবহার করত সেটা এখন মরচে ধরে পড়ে আছে, চালানোর জন্য কোন ফুয়েল নেই বলে।

“তোমার কি কখনো মানুষ হওয়ার ইচ্ছা হয়?” সে একদিন হঠাৎ কথার মাঝখানে জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ হয়,” আমি বললাম। “যখনই আমি কিচেনের জানালায় ঝুলানো উইন্ড চাইমের আওয়াজ শুনি, আমার মনে হয় মানুষ হতে পারলে চমৎকার

এমনকি বাতাসেরও ক্ষমতা আছে সঙ্গীত সৃষ্টি করার, আমি নিজের মনে ভাবতাম। আমার কোন কিছু সৃষ্টি করার কোন ক্ষমতা নেই। ব্যাপারটা আমাকে বিষাদগ্রস্থ করে তুলত। কথাবার্তার সময় আমি কাব্যিক ভঙ্গি ব্যবহার করতে পারতাম, এমনকি মিথ্যা বলতেও। আমার শৈল্পিকতার দৌড় ঐ পর্যন্তই।

“হুম…” সে বলল। তারপর আবার তার চাচার গল্পে ফিরে গেল। তারা দুজন মিলে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে শহরের ধ্বংসাবশেষ ঘুরে বেরিয়েছিল।

আমি বুঝতে পারি যে সে তার চাচাকে গভীরভাবে ভালবাসত। সেকারনে চাইত চাচার পাশে সমাহিত হতে। সেজন্যই আমাকে সৃষ্টি করা হয়েছিল-তার অসুস্থতার সময় তার সেবা করার জন্য, যতক্ষণ না মৃত্যু এসে হাজির হয়।

আমি যেখানে বসেছিলাম তার পাশের মেঝেতে একটা আধ খাওয়া রুটি ধপ করে পড়ল। সে ফেলেছে। ধপ শব্দটা খুবই ক্ষীণ ছিল, বাতাসের মৃদু একটা ঝাপ্টার মত।

ওর ডান হাত হালকা কাঁপছিল। সে সেটা নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। কাঁপতে থাকা হাতটার দিকে শান্তভাবে তাকিয়ে থেকে সে আমাকে প্রশ্ন করল, “তাহলে, এখন কি তুমি বুঝতে পারছ মৃত্যু কিরকম?”

“এখনো না। কি রকম?”

“ভীতিকর।”

আমি রুটিটা তুলে নিয়ে ট্রেতে রাখলাম। সঙ্গত কারনে সেটা না খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি এখনো ভালমত মৃত্যুকে বুঝতে পারছি না। জানি কোন এক সময় আমি নিজেও মারা যাব। কিন্তু আমি ভীত নই। হঠাৎ করে থেমে যাওয়ার মধ্যে কি ভয়ের কিছু আছে? এই বিরাম এবং ভীতির মধ্যে কোথাও কিছু একটা আছে যা আমি দেখতে পাচ্ছি না। আর সেটাই আমাকে জানতে হবে।

আমি মাথা কাত করে তার দিকে তাকালাম। সে হয়ত খেয়াল করছিল যে তার হাতগুলো তখনও কাঁপছে। তার চোখগুলো জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। আমিও বাইরে তাকালাম।

উঠোনটা আলোকিত হয়ে ছিল, উজ্জ্বলতা এতটাই বেশি ছিল যে আমাকে চোখ সরু করতে হল। বাড়িটা ঘিরে থাকা বনের দিকে তাকালাম, পাশেই থাকা জরাজীর্ণ ডাকবাক্স, পরিত্যাক্ত ট্রাক আর বাগান। সবজির সারির উপর ঘোট ঘোট প্রজাপতি উড়াউড়ি করছে।

একটা ছোট সাদা তুলোর বল সবুজ পাতার ছায়ার ভেতর অর্ধেক লুকানো অবস্থায় বসে ছিল। একটা খরগোশ। আমি উঠে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। আমি জানি এটা সঠিক আচরণ হল না কিন্তু যে মুহূর্তে আমি খরগোশটাকে দেখেছি আমার মনে হয়েছে এটা আমাকে শিকার করতে কিছুটা সুবিধা দেবে।

***

তার মৃত্যুর পাঁচ দিন আগের দিনটাতে আকাশ ছিল মেঘলা। আমি বনে গিয়েছিলাম বন্য সবজি জোগাড় করতে। গুদাম ঘরে প্রচুর খাবার জমা করা থাকলেও সে মনে করত বাগানের টাটকা সবজি আর প্রাকৃতিক খাদ্য খাওয়াই ভাল।

হঠাৎ হঠাৎ কোন খবর না দিয়েই ওর হাত পা কাঁপতে শুরু করত। এই পর্বগুলো বেশিক্ষণ চলত না ঠিকই কিন্তু নিয়মিত ঘটতে লাগল। সে তার মোটর ফাংশন এর নিয়ন্ত্রন হারাতে শুরু করেছিল। যেমন, সে হয়ত এক কাপ কফির জন্য হাত বাড়াল কিন্তু কফিটা টেবিলের উপর ছড়িয়ে ফেলল। এই ক্রমশ খারাপ হতে থাকা শারীরিক অবস্থার মধ্যেও সে তার ধৈর্য ধরে রাখার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করত। সে কখনো বিরক্ত হত না, শরীর সাড়া না দিলে সে শুধু ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে থাকত।

বনের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি একটা গিরিখাতের কাছে চলে গিয়েছিলাম। সে আমাকে গিরিখাতটার ব্যাপারে সাবধান করেছিল। ওখান থেকে দূরে থাকতে বলেছিল। জায়গাটা বিপদজনক, আমি পড়ে যেতে পারি। কিন্তু গিরিখাতের কোণায় অসংখ্য বন্য সবজি দেখা যাচ্ছে। কাছে না গিয়ে পারলাম না।

আমার কাছে মনে হল হঠাৎ যেন মাটি শেষ হয়ে আকাশে পরিণত হয়েছে। সবজি তুলে তুলে আমার হাতের ঝুড়িতে রাখছিলাম। সেই সাথে গিরিখাতের পর পর্বতমালার সারির দিকে তাকাচ্ছিলাম। পর্বতগুলো আকাশের মেঘের সাথে গিয়ে মিশে গিয়েছিল যেন। ওগুলো দানবাকৃতির ধূসর ছায়ার মত দেখাচ্ছে।

কিনারার এক জায়গায় আমার দৃষ্টি পড়ল। জায়গাটা দুমড়ে মুচড়ে আছে যেন কেউ ওখানে লাথি মেরেছে।

কিনারা থেকে মাথা বের করে নিচে তাকালাম। ত্রিশ মিটারের মত নিচে একটা পানির ধারার মত বয়ে যাচ্ছে যেটাকে দড়ির মত দেখাচ্ছে। বিশ মিটার নিচে একটা টেবিলের সমান পাথর ঝুলে ছিল। উপরে পরিত্যক্ত ঘাসের চাপড় দেখা যাচ্ছে।

সাদা রঙের কিছু একটা দেখতে পাচ্ছিলাম। একটা খরগোশ। ওটা নিশ্চয়ই চলার সময় খাদ থেকে পা ফসকে নিচে পড়ে গিয়েছিল। আর উপরে উঠতে পারেনি।

দূর থেকে বজ্রপাতের গর্জন ভেসে এল। এক ফোঁটা বৃষ্টি আমার হাতের উপর এসে পড়ল।

ঝুড়িটা মাটিতে রেখে আমি খাদের কিনারা দু হাত দিয়ে ধরে আস্তে আস্তে এক পা এক পা করে বেয়ে বেয়ে পাথরটার দিকে নামাতে লাগলাম।

ঠাণ্ডা এক ঝাপ্টা বাতাস এসে আমার চুলের ভেতর দিয়ে বয়ে গেল। এতদিন পর্যন্ত আমি খরগোেশ নিয়ে বিরক্ত হয়ে এসেছি, কিন্তু এখন এটাকে অসহায় অবস্থায় দেখে আমার মনে হয়েছে একে রক্ষা করতে হবে।

আমি খরগোশের দিকে হাত বাড়ালে প্রথমে সেটা প্রতিরক্ষামূলক ভঙ্গিতে ছিল। কিন্তু পরে তুলতুলে সাদা প্রাণীটা আমাকে ওকে তুলে নিতে দিল। আমি এর ক্ষুদ্রতা, এর উষ্ণতা অনুভব করতে পারছিলাম। মনে হচ্ছিল উষ্ণ একটা ছোট বল।

বৃষ্টি শুরু হল। আর পর মুহূর্তেই আমি কিছু একটা নড়াচড়ার শব্দ শুনতে পেলাম। একটা ঝাঁকি আমার পুরো শরীর নাড়িয়ে দিল। খাদটা হঠাৎ উপরে উঠে গেল। পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাওয়ায় এক মুহূর্তের জন্য মনে হল আমি বাতাসে ভাসছি। খাদের যেখানে আমার সবজির ঝুড়ি রেখে এসেছিলাম সেটা অনেক দুরে সরে গেল, অনেক ছোট দেখাল। আমি খরগোশটাকে নিরাপদে রাখার জন্য বকের সাথে চেপে ধরে রাখলাম।

একটা শক্ত ধাক্কা অনুভব করলাম। ধুলোর একটা মেঘ ছড়িয়ে পড়ল মুহূর্তখানেকের জন্য। কিন্তু তারপরই বৃষ্টি সেটাকে ধুয়ে ফেলল। গিরিখাতের গোড়ায় পানির ধারার পাশে এক জায়গায় আমরা গিয়ে পড়েছিলাম।

আমার অর্ধেক শরীর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। একটা পা ঝুলছিল, কোন কাজ করছিল না। তলপেট থেকে বুক পর্যন্ত একটা গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল। আমার ভেতরের যন্ত্রপাতি সব বেরিয়ে আসতে চাইছিল কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম নিজের শক্তিতে বাড়ি ফিরে যেতে পারব।

বুকে ধরে থাকা খরগোশের দিকে তাকিয়ে দেখি সাদা পশম লাল হয়ে আছে। আমি বুঝতে পারলাম সেটা ওর রক্তের দাগ। খরগোশের শরীরটা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হচ্ছিল আমি অনুভব করতে পারছিলাম যে এর শরীরের সব উষ্ণতা আমার হাত দিয়ে বয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।

বাড়ি ফেরার সময় পুরোটা পথ আমি দুহাত দিয়ে খরগোশটা ধরে ছিলাম। আমি এক পায়ে লাফাতে লাফাতে এগুচ্ছিলাম আর আমার শরীর থেকে নাটবল্ট খুলে খুলে মাটিতে পড়ছিল। থামানোর জন্য আমার কিছু করার ছিল না। পিঠে বৃষ্টির ঝাপ্টা লাগছিল।

বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে আমি তাকে খুঁজতে লাগলাম।

আমার শরীর থেকে পানি ঝরে মেঝে ভেসে গিয়েছে। চুলগুলো ত্বকের সাথে লেপ্টে আছে। আমার সিনথেটিক ত্বকের বেশিরভাগই ঝড়ে খসে গিয়েছিল। সে জানালার পাশে বসে ছিল, যেখান থেকে বাগানটা দেখা যায়। আমার অবস্থা দেখে সে ধাক্কা খেল।

“আমাকে ঠিক কর, প্লিজ,” আমি বললাম। কি ঘটেছে তা খুলে বললাম।

“ঠিক আছে,” সে বলল। “চল গুদাম ঘরে যাই।”

“আর তুমি কি একেও ঠিক করত পারবে?” আমি মিনতির সুরে বললাম, দুহাতে খরগোশটাকে ওর দিকে বাড়িয়ে দিলাম।

সে মাথা নাড়ল। খরগোশটা ইতিমধ্যে মরে গিয়েছে। সে আমাকে বলল। খরগোশটা পতনের ধাক্কা হজম করতে পারেনি। ওটা আমার কোলের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে।

আমার মনে পড়ছিল খরগোশটা যখন বাগানের ভেতর দিয়ে ছুটোছুটি করত, কত চটপটে ছিল সেটা। আর আমি আমার কোলে থাকা মৃত প্রাণীটার দিকে তাকালাম। এর সাদা পশমে লাল রক্তের দাগ, আর চোখগুলো আজীবনের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ও যখন আমাকে গুদাম ঘরের দিকে যেতে তাড়া দিল তখন ওর কণ্ঠ অদ্ভুত কোন কারনে মনে হচ্ছিল দূর থেকে ভেসে আসছে। সে আমাকে দ্রুত পরীক্ষা করে মেরামত করতে চাইছিল।

“আঃ…আঃ।” আমি মুখ হাঁ করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু কোন শব্দ বের হল না। বুকের গভীরে চাপা একটা কষ্ট অনুভব করছিলাম। যদিও সেটার সাথে আমার শারীরিক কষ্টের কোন সম্পর্ক ছিল বলে মনে হচ্ছে না, তবু অন্য কোন শব্দ আমার মাথায় এল না। আমার দেহ শক্তি হারিয়ে ফেলল আর আমি হাঁটু ভেঙে পড়ে গেলাম।

“আ-আমি…” আমি আবিষ্কার করলাম আমার অশ্রু নির্গত করার ক্ষমতা আছে। “আমি এই ছোট প্রাণীটার সাথে অনেক বেশি জড়িয়ে গিয়েছি।”

সে আমার দিকে তাকাল, তার চোখে সমবেদনার চিহ্ন। “এরই নাম মৃত্যু,” সে বলল, আমার মাথার উপর হাত রাখল। তখন আমি বুঝতে পারলাম। মৃত্যু অর্থ হারানোর উপলদ্ধি।

ও আর আমি একসাথে হেঁটে হেঁটে ভূগর্ভস্থ গুদাম ঘরে গেলাম। প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে, ঝড়ের ভেতর প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আমি তখন এক পায়ে লাফাচ্ছিলাম, খরগোশটা বুকের কাছে ধরে রাখা। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় সে বলেছিল খরগোশটা বাড়িতে রেখে যেতে কিন্তু আমি সেটা করতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত অপারেটিং টেবিলে যখন আমার উপর ইমারজেন্সি প্রক্রিয়া চলছিল তখন খরগোশটা আমার পাশের ডেস্কে রাখা ছিল।

আমি সিলিঙের লাইটের ঠিক নিচে চিত হয়ে পড়ে ছিলাম। প্রায় দুই মাস আগে এখানে এভাবেই শুয়ে ছিলাম আমি। চোখ খুলে তাকানোর পর সে আমাকে “গুড মর্নিং” জানিয়েছিল। এটাই আমার প্রথম স্মৃতি।

সে আমার দেহের ভেতরটা পরীক্ষা করল। কিন্তু বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। বিরতি নিয়ে নিয়ে কাজ করছিল। ক্লান্ত হয়ে পড়লে চেয়ারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে।

পরীক্ষা করার সময় আমি আমার মাথাটা একদিকে ঘুরিয়ে রেখেছিলাম যাতে খরগোশটাকে দেখতে পাই। খুব শিগগিরি সেও খরগোশটার মত নিশ্চল হয়ে পড়বে। শুধু সেই নয়, এক পর্যায়ে সবকিছুরই মৃত্যু ঘটবে, আমারও। এখন আমি তা জানি। আগে কখনো এই জানাটার সাথে ভয় যুক্ত ছিল না, যেটা এখন আছে।

আমি আমার মৃত্যুর কথা চিন্তা করলাম। এর অর্থ একসময় শুধু থেমে যাওয়া নয়। এর অর্থ পৃথিবীর সবকিছু থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া, এমনকি নিজের থেকেও। আর এই কথাটা সবসময় সত্যিই থাকবে যতই আমি কোন কিছু ভালবাসি না কেন। এই ব্যাপারটাই মৃত্যুকে ভয়ানক রকমের বিষাদগ্রস্থ করে তোলে।

একজন যত বেশি ভালবাসে, মৃত্যুর অর্থ ততটাই ভারি হয়, হারানোর অর্থ ততটাই গম্ভীর হয়। ভালবাসা আর মৃত্যু কোন আলাদা বিষয় নয়, একই জিনিসের সামনের আর পেছনের দিক।

সে যখন আমার শরীরের জিনিসপত্র ঠিক করছিল, পুরোটা সময় আমি নীরবে ফোঁপাচ্ছিলাম। অর্ধেকের মত মেরামত হলে সে বিশ্রাম নেয়ার জন্য বসল।

“ইমারজেন্সি কাজটুকু কালকের মধ্যে শেষ হবে। তবে পুরো কাজ শেষ। করতে আমার আরো তিনদিন সময় লাগবে।

ওর শরীর তার শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। এর মানে হল মূল কাজ শেষ হওয়ার পর বাকি কাজ আমাকেই করতে হবে। আমার শরীরের সাধারণ কাজ কিভাবে হয় তা আমার জানা ছিল। যদিও আমার কোন অভিজ্ঞতা ছিল না কিন্তু যদি চেষ্টা করি তাহলে আমি নিশ্চিত, প্রয়োজনীয় সব কাজ নিজেই সারতে পারব।

“বুঝতে পেরেছি,” আমি বললাম, কান্নার কারনে আমার কণ্ঠ থেমে যাচ্ছিল। “তোমার জন্য খারাপ লাগছে।”

সে কেন আমাকে তৈরি করেছিল? এই দুনিয়ায় যদি আমার জন্ম না হত তাহলে আমাকে কোন কিছু ভালবাসতে হত না কিংবা কোন আবেগ অনুভব করতে হত না। মৃত্যু ভয়ও পেতে হত না আমাকে।

অপারেটিং টেবিলে শোয়া অবস্থায় আমি ফোঁপাতে ফোঁপাতে এই কথাগুলো মুখ দিয়ে বের করে আনতে সক্ষম হলাম।

“আমি তোমাকে ভালবাসি। তোমাকে কবর দিতে হবে ভাবতে আমার কষ্ট হচ্ছে। আমার হৃদয়ে প্রচণ্ড কষ্ট অনুভুত হচ্ছে। ভাল হত যদি আমার কোন হৃদয় না থাকত। এরকম হৃদয় দেয়ার জন্য আমি তোমাকে ঘৃণা করি।”

তার মুখটা বিষাদপূর্ণ হয়ে ছিল।

***

আমার পুরো শরীর ব্যান্ডেজে মোড়ানো অবস্থায় আমি ঠাণ্ডা শক্ত হয়ে যাওয়া খরগোশটাকে তুলে নিয়ে ভূগর্ভস্থ গুদাম ঘর থেকে বের হলাম। বাইরে তখন বৃষ্টি থেমে গিয়েছে, ঘাস ভূমির উপর ভ্যাপসা রকমের বাতাস ঝুলে ছিল। বাইরে তখন অন্ধকার, কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম যে কোন মুহূর্তে ভোর হবে। মেঘগুলো আকাশ জুড়ে সরে যাচ্ছে। আমার পেছনে সে দরজা খুলে বেরিয়ে এল।

ইমারজেন্সি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর আমি স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারছিলাম। অবশ্য মেরামতের সব কাজ শেষ হয়নি। হঠাৎ কোন নড়াচড়া করা আমার জন্য নিষেধ ছিল। আপাতত নিজে নিজে কোন মেরামতির কাজ করার কোন ইচ্ছা আমার নেই। আমাকে এখনো বাড়ির কাজ করতে হবে আর তার জন্য খাবার তৈরি করতে হবে।

আস্তে আস্তে আমরা বাড়ির দিকে হেঁটে গেলাম। সূর্য তখন পুব আকাশে আলো ছড়াতে শুরু করেছে। আমরা ওর চাচার কবরের ক্রসের সামনে থামলাম।

“আর চার দিন,” সে বলল।

ঐ সকালে আমি খরগোশটাকে কবর দিলাম। সবুজ উঠোনটার এক কোণায়, যেখানে অনেক পাখির আগমন ঘটে। আমার মনে হয়েছিল পাখিগুলো হয়ত খরগোশটাকে সঙ্গ দিতে পারবে। আমি যখন মাটি দিয়ে কবরটা ভরাট করছিলাম আমার মনে হচ্ছিল বুকের উপর ভারি একটা বোঝা আমাকে নিচের দিকে টানছে। একই জিনিস আমার ওর জন্যও করতে হবে। এই কথা চিন্তা করে আমার সন্দেহ হল আমার সেই শক্তি আছে কিনা।

এরপর সে একতলার বিছানায় গিয়ে শুল এবং আর উঠল না। সে শুধু বিছানার কিনারায় শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকত, আমি ব্রেকফাস্ট বানিয়ে তার জন্য নিয়ে আসতাম। আমি আর হাসতে পারছিলাম না। ওর পাশে থাকা আমার জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

একসময় আমি বুঝতে পারলাম কেন সে সবসময় জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে পছন্দ করত। আমার মত, সেও এই পৃথিবীকে ভালবাসত। তাই মৃত্যু এসে তাকে নিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সে চেয়েছিল ভাল করে সব দেখে মনে গেঁথে নিতে। এরকম একটা মানুষের সাথে আমি যতটা সম্ভব সময় কাটাতে চাইছিলাম। একসময় আমি অনুভব করতে পারছিলাম যে তার মৃত্যু নিকটে চলে এসেছে। বাড়ির যে কোন স্থানেই আমি তা অনুভব করতে পারছিলাম।

সেই ঝড়ের পর থেকে আকাশ এখনো মেঘলা। কোন বাতাস নেই, কিচেনের জানালার উইন্ড চাইমটাও তাই নীরব। রেকর্ডগুলো বাজানোর কোন শক্তি আমাদের ছিল না। পুরো বাড়িটা নিস্তব্ধ হয়ে ছিল। একমাত্র শব্দ যা হচ্ছে, তা হল আমার পায়ের নিচে আলগা কাঠের তক্তার কাঁচকোঁচ শব্দ।

“লাইট বাল্বটা নষ্ট হওয়ার সময় হয়ে এসেছে,” এক সন্ধ্যায় সে বলল, বরাবরের মত জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। উঠোনের বাগুলোর একটা ম্লান হয়ে মিটমিট করছিল। এভাবে কিছুক্ষণ থেকে একবার চমকে উঠে অন্ধকার হয়ে গেল।

“কাল দুপুরের মধ্যেই আমি মারা যাব,” নিভে যাওয়া বাটার দিকে তাকিয়ে সে বলল।

সে যখন ঘুমিয়ে পড়ল, আমি তখন সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় গেলাম। ঐ রুমটায় গেলাম লাল রঙের জাহাজটাকে আবার দেখতে। ওটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি চিন্তায় ডুবে দিয়েছিলাম।

আমি ওকে ভালবেসেছিলাম। কিন্তু একই সাথে কিছু একটা আমার হৃদয়ে গেঁথে ছিল। আমাকে এই পৃথিবীতে আনার জন্য তার প্রতি অসন্তুষ্টি অনুভব করছিলাম। একটা কালো মেঘ আমার হৃদয়টাকে ছেয়ে ফেলল।

ওর সাথে আমার সম্পর্কটার সংজ্ঞা ছিল এরকম বিভিন্ন ধরনের জটিল আবেগের সংমিশ্রন। শ্রদ্ধা আর অসন্তোষের সংমিশ্রণ। কিন্তু এর কিছুই আমি বাইরে প্রকাশ করিনি।

আমার ভেতরে যে ঝড় যাচ্ছিল সেটা তার জানার কোন প্রয়োজন নেই। কাল দুপুরে আমি শুধু তাকে আমাকে সৃষ্টি করার জন্য ধন্যবাদ জানাবো। কোন সন্দেহ নেই যে সেটাই ওর মৃত্যুর জন্য সেরা উপায় হবে, কোনরকম কোন অনুশোচনা ছাড়া।

আমি ব্লক জোড়া দিয়ে বানানো লাল রঙের জাহাজটা হাতে নিলাম। ঠিক করেছি আমি আমার সমস্ত অসন্তোষ আর অন্ধকার আবেগগুলোকে আমার হৃদয়ের গভীরে চাপা দেব। কিন্তু যতবারই আমি এসব নিয়ে চিন্তা করছিলাম ততবারই নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। আমি ভীত ছিলাম। আর আমার মনে হচ্ছিল আমি তাকে মিথ্যা বলছি।

হঠাৎ জাহাজের যে জায়গাটায় ধরেছিলাম সে জায়গাটা খুলে এল। জাহাজের হালটা ভেঙে মেঝেতে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। আমি সবগুলো টুকরো এক জায়গায় জড়ো করে ভাবছিলাম কি করব এখন। আমার মত কেউ একজন, যে কিনা মানুষ নয়, যে কিনা কখনো ছবি আঁকতে পারবে না, মূর্তি গর্তে পারবে না কিংবা সঙ্গীত রচনা করতে পারবে বা। সে মারা যাওয়ার পর এই ব্লকগুলো আজীবনের জন্য এরকম খোলাই থেকে যাবে।

ঐ মুহূর্তে আমি উপলদ্ধি করলাম যে ব্লকগুলো দিয়ে করার মত একটা জিনিস আমার জানা আছে। আমার মনে আছে কিভাবে জাহাজ বানাতে হয়। আমি ওকে জাহাজটা বানাতে দেখেছিলাম, সেটা আমার মনে আছে। ও যেভাবে করেছিল সেভাবে আমি একটা একটা করে ব্লক জোড়া দিয়ে জাহাজটাকে আবারও বানালাম।

বানানো শেষ হওয়ার পর আমি কেঁদে ফেললাম। হয়তো, হয়তো। হৃদয়ের গভীরে আমি এই জিনিসটাই চিন্তা করেছিলাম, বার বার, অসংখ্যবার।

***

পরদিন সকালে পুরো আকাশ একদম নীল হয়ে ছিল। শুধুই নীল, আর কিছুই না। এই মাথা থেকে ঐ মাথা পর্যন্ত নীল, কোন মেঘ ছিল না। সে তখনো ঘুমাচ্ছিল। আমি কুয়ার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করলাম, মুখ ধুলাম। কুয়া থেকে পানি তুলে বালতিতে ভরলাম। কিছু পানি কাছের ফুল গাছগুলোতে ঢালোম। ফুলগুলোর পাপড়ি পানির ফোঁটার ভারে একদিকে কাত হয়ে ছিল। পানির ফোঁটাগুলো মাটিতে পড়ে সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় চকমক করে উঠলে আমি তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম।

এতদিন মেঘলা থাকায় একগাদা জামা কাপড় জমে গিয়েছিল। আমি ঠিক করলাম সব ধুয়ে ফেলা যাক। ভেজা কাপড়গুলো বাইরে শুকোতে দেয়ার সময় আমার শরীরের ব্যান্ডেজ ঢিলে হয়ে গেল। আমাকে থেমে আবার সব ঠিক করে বেঁধে নিতে হল।

লন্ড্রির কাজ শেষ হওয়ার পর আমার খেয়াল হল সে জানালা দিয়ে আমাকে দেখছে। ওর বেডরুমের জানালা নয়, হলওয়ের যে বসার জায়গাতে সূর্যের আলো পড়ে সেখান থেকে। আমি দৌড়ে ওর কাছে গেলাম।

“তুমি কি ঠিক আছ, এভাবে উঠে পড়লে যে?”

“আমি এই জায়গায় বসে মরতে চাই।” মনে হল সে তার শেষ শক্তিটুকু খরচ করে এই জায়গায় এসে বসেছে।

আমি বাড়ির ভেতর গিয়ে তার পাশে বসলাম। মাত্র শুকোতে দেয়া কাপড়গুলো দেখতে পাচ্ছিলাম। সাদা রঙটা যেন একদম ঠিকরে বের হচ্ছিল। চমত্যার একটা সকাল, মৃত্যুর কোন চিহ্ন কোথাও নেই।

“আর কয় ঘন্টা বাকি?” বাইরে তাকিয়ে আমি জানতে চাইলাম। সে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল, তারপর জানাল আর কতক্ষন বাকি, সেকেন্ডে।

“এই যে মৃত্যুটা ঐ জীবাণুগুলো বয়ে আনে, তাদের সময়জ্ঞান কি খুবই নিখুঁত?”

“কি জানি।”

ওর কণ্ঠ ভেঙে যাচ্ছিল। আমি প্রশ্ন করলাম, “তুমি কি আমাকে একটা নাম দিতে পারোনি, একইভাবে আমি যেরকম ছবি আঁকতে বা মিউজিক করতে পারি না?”

অবশেষে সে জানালা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমার দিকে তাকাল।

“আমি আমার মৃত্যুর নির্দিষ্ট সেকেন্ডটা জানি, আমার মত কারোর জন্য জীবনের শর্তাবলী পূর্বনির্ধারিত। আর তোমার জন্যও…”

সত্যি কথা হল, জীবাণুগুলো ওকে কখনোই সংক্রমিত করেনি। ও একজন মানুষকে ব্লকগুলো দিয়ে জাহাজটা বানাতে দেখেছিল। যে কারনে ও নিজেও জাহাজটা বানাতে পারত। ও এমন একটা পৃথিবীর একমাত্র উত্তরসুরী ছিল যেখানের সব মানুষ মারা গিয়েছিল। সে আমার মুখের দিকে এক মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে থাকল, তারপর মাথা নিচু করল। ফ্যাকাসে মুখটার উপর ছায়া জমল।

“আমি দুঃখিত, তোমাকে মিথ্যে বলেছি…”

আমি ওকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে আমার মাথা রাখলাম। ছোট ছোট মোটর চলার ক্ষীণ শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।

“কেন তুমি মানুষ সাজার ভান করেছ?”

নিচু কণ্ঠে সে ব্যাখ্যা করল যে সে তার মন থেকে তার চাচার মত হতে চেয়েছিল। চাচাই ওকে তৈরি করেছিলেন। মাঝে মাঝে আমার মনে হত মানুষ হলে ভাল হত। এখন মনে হচ্ছে ওরও একইরকম মনে হত।

“প্রথমে আমি ভেবেছিলাম তুমি বোধহয় ওভাবে কিছু দেখতে পাবে না।”

ও ভেবেছিল আমাকে যদি বলা হয় যে একজন মানুষ আমাকে তৈরি করেছে, আমার মত কেউ তৈরি করেনি, তাহলে আমার কষ্ট কম হবে।

“তুমি একটা বোকা।”

“এখন সেটা বুঝতে পারছি।” কথাটা বলতে বলতে সে আলতো করে আমার মাথায় হাত রাখল। অন্তত আমার কাছে ও একজন মানুষ কি মানুষ

তাতে কিছু আসে যায় না। আমি ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকলাম। অবশিষ্ট সময়টা আর অল্পই বাকি ছিল।

“আমি চাইছিলাম আমার চাচার পাশে সমাহিত হত। আমার দরকার ছিল এমন কাউকে, যে কিনা কোদাল দিয়ে আমার উপর মাটি ঢেলে দিতে পারে। আর এই স্বার্থপর কারনে আমি তোমাকে তৈরি করেছি।”

“কত বছর ধরে তুমি এই বাড়িতে একা ছিলে?”

“চাচা মারা যাওয়ার পর দুইশ বছর পার হয়ে গিয়েছে।”

যে আবেগগুলো আমাকে তৈরি করার পেছনে ওকে তাড়না দিয়েছে সেগুলো আমি ভাল করেই বুঝতে পারছিলাম।

যে মুহূর্তে মৃত্যু ডাকতে হাজির হয়, সে মুহূর্তে কেউ একজন যদি হাত ধরে বসে থাকে তাহলে কত ভালই না হয়। আর তাই যে মুহূর্তে মৃত্যু ওকে নিয়ে যাবে সে মুহূর্ত পর্যন্ত আমি ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকতে চাইছিলাম। তাহলেই সে বুঝতে পারবে যে সে একা নেই।

একটা সময় আসবে যখন হয়ত আমাকেও মৃত্যুবরণ করতে হবে, তখন ও যা যা করেছে আমিও একই কাজ করব। যা যা যন্ত্রপাতি, প্ল্যান আর পার্টস প্রয়োজন, সবই গুদামঘরে রাখা আছে। যখন আমি আর নিজের একাকীত্ব সহ্য করতে পারব না তখন হয়ত আমি আমাকে কাছ থেকে ধরে রাখার জন্য নতুন একটা জীবন তৈরি করে নেব। আর তাই আমি ওকে ক্ষমা করে দিলাম।

আমরা দুজন একত্রে ঐ বেঞ্চে বসে চুপচাপ একটা সকাল কাটালাম। পুরোটা সময় আমি ওর বুকে আমার কান চেপে রেখেছিলাম। সে কিছুই বলছিল না, শুধু জানালা দিয়ে বাইরে শুকোতে দেয়া কাপড়গুলো বাতাসে নড়তে দেখছিল।

ইমারজেন্সি ব্যবস্থার পর থেকে আমার শরীর ব্যান্ডেজ দিয়ে মোড়ানো ছিল। সে আমার ঘাড়ের কাছের ব্যান্ডেজ ঠিক করে দিল। জানালা দিয়ে সূর্যের উষ্ণ আলো এসে আমার কোলের উপর পড়ছিল। সবকিছুই উষ্ণ ছিল। দয়াল আর নরম। এগুলো যখন আমি অনুভব করছিলাম তখন টের পেলাম হৃদয়ের সব বিয়োগাত্মক অনুভূতিগুলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে।

“আমাকে সৃষ্টি করার জন্য তোমার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ,” কথাগুলো নিজে নিজেই আমার ঠোঁটগুলো থেকে বেরিয়ে এল। “কিন্তু আমি আবার তোমাকে ঘৃণাও করি।”

বুকের উপরে মাথা রাখার কারনে আমি ওর মুখ দেখতে পারছিলাম না, তবে বুঝতে পারছিলাম যে সে মাথা উপর নিচ করল।

“তুমি যদি আমাকে তোমার কবর দেয়ার জন্য সৃষ্টি না করতে, তোমার অসুস্থতার পরিচর্যা করতে না দিতে, তাহলে আমি মৃত্যুভয় কি বা কারো মৃত্যু হলে হারানোর যে অনুভূতি হয় তা কখনোই জানতে পারতাম না।”

ওর দুর্বল আঙুলগুলো আমার চুল স্পর্শ করল।

“আমি যত বেশি কিছু একটাকে ভালবাসব, সেটাকে হারানোর পর ততই বেশি আমার হৃদয় কেঁদে উঠবে। আর বাকি যতটা সময় আমি বেঁচে থাকব, বার বার আমাকে এই কষ্টটা ভোগ করে যেতে হবে। ব্যাপারটা খুবই নিষ্ঠুর। এরকমই যদি হয় তাহলে আমি কখনোই আর ভালবাসতে চাই না। আমি একজন হৃদয়হীন ব্যক্তি হতে চাই…”

বাইরে কোথাও একটা পাখি ডাকছিল। আমি চোখ বন্ধ করে কল্পনা করলাম আকাশে এক সাথে অনেক পাখি উড়ে যাচ্ছে। আমার গাল বেয়ে অণু গড়িয়ে পড়ল।

“এখন অবশ্য আমি কৃতজ্ঞ। আমি যদি এই পৃথিবীতে কখনো জন্ম না নিতাম তাহলে এই ঘেসো পাহাড়টাকে কখনোই দেখা হত না। যদি আমার হৃদয় না থাকত তাহলে একটা পাখির বাসা দেখার মধ্যে কখনোই আনন্দ খুঁজে পেতাম না, তেতো কফিতে চুমুক দিয়ে মুখ বাঁকাতে পারতাম না। এই উজ্জ্বল রত্নের মত মূল্যবান বিষয়গুলো অনুভব করতে পেরে আমার নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। সেভাবে যদি চিন্তা করা হয়, তাহলে আমার হৃদয় থেকে যতই রক্তপাত হোক না কেন, এসবই আসলে আমার বেঁচে থাকার পক্ষে প্রমাণ।”

অদ্ভুত একটা ব্যাপার, তাই না? একই সাথে কৃতজ্ঞতা আর অসন্তোষ দুটোই অনুভব করা? কিন্তু আমার এরকমই মনে হচ্ছিল। আসলে আমার মনে হয় সবাইই এভাবে চিন্তা করবে। এমনকি যে মানুষের সন্তানেরা অনেক বছর আগে মারা গিয়েছে, তারাও তাদের পিতা-মাতা সম্পর্কে এরকমই পরস্পরবিরোধী চিন্তাই করত। ওদেরকে ভালবাসা আর মৃত্যু সম্পর্কে শিক্ষা দিয়ে বড় করা হত। আর তারা তাদের জীবন পার করত এই দুনিয়ার আলোকোজ্জল অংশ থেকে অন্ধকার অংশে ভ্রমনের মধ্য দিয়ে।

আর সেই সন্তানেরা বড় হয়ে একইভাবে দুনিয়াতে নতুন জীবন আনার ভার গ্রহণ করত।

আমি পাহাড়ের পাদদেশে, তোমার চাচা যেখানে ঘুমিয়ে আছে তার পাশে তোমার জন্য কবর খুঁড়ব। সেখানে তোমাকে শুইয়ে চাদরের মত মাটি দিয়ে ঢেকে দেব। একটা ক্রুশ দাঁড় করাব আর কুয়ার কাছ থেকে বুনো ফুলের চারা এনে লাগিয়ে দেব। প্রতিদিন সকালে আমি তোমাকে অভিবাদন জানাবো। আর সারাদিন কি হল তা প্রতি সন্ধ্যায় এসে রিপোর্ট করব।

এরপর ঐ বেঞ্চে আমরা চুপচাপ একজন আরেকজনকে ধরে বসে থাকলাম। দুপুর প্রায় হয়ে এসেছিল। ওর শরীরে মোটরগুলোর শব্দ আরো ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যাচ্ছিল। এক পর্যায়ে আমি আর কোন শব্দ শুনতে পেলাম না। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ফিস ফিস করে বললাম, “গুড বাই।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *