ফাইন্ড দ্য ব্লাড!

ফাইন্ড দ্য ব্লাড!

অ্যালার্ম ক্লক যখন বাজল, আমি (চৌষট্টি বছর বয়স) আমার চোখ খুললাম। ঘড়িটাকে চুপ করালাম, তারপর একই হাত দিয়ে ঘুম তাড়ানোর জন্য চোখ ডলতে লাগলাম। ভোর পাঁচটা বাজছি। বিছানার পাশের পর্দাবিহীন জানালা দিয়ে সূর্যের আলো আসছে। জানালাগুলো এত বাজেভাবে ফিট করা ছিল যে লক তো হয়ই না তার উপর যত চাপাচাপি টানাটানি করা হোক না কেন তিন সেন্টিমিটারের বেশি ফাঁক হয় না। রুম থেকে বের হওয়ার একমাত্র উপায় ছিল দরজাটা।

নিজের হাতের দিকে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠলাম। ওগুলো গাঢ় লাল। কোন লাল জিনিস শুকিয়ে মাখামাখি হয়ে আছে। ভয়ে আমি চিৎকার করে উঠলাম। অতীতে আমার একটা বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছিল আর মনে হচ্ছিল (সম্ভবত) সেটা আবারও হতে যাচ্ছে।

“কি হয়েছে বাবা? আমাকে ভেতরে আসতে দিন!” দরজা ধাক্কানোর শব্দ। আমার মেঝো ছেলে, সুগুয়ে (বয়স সাতাশ বছর) এর গলা। মনে হল, দরজাটা ভেতর থেকে লক করা, তাই সে ভেতরে আসতে পারছে না। আমি বিছানা থেকে উঠে বোঝার চেষ্টা করলাম আমার শরীরের কোন অংশ থেকে রক্তপাত হচ্ছে।

“কো…কো…কো…কোত্থেকে? রক্ত কোত্থেকে বের হচ্ছে?”

আমি থরথর করে কাঁপছিলাম, কিন্তু কোনভাবেই বের করতে পারলাম না কোথায় আঘাত পেয়েছি। আমার চোখে রক্ত থাকায় সবকিছু ঘোলাটে দেখছিলাম। যে মুহূর্তে ভাবছিলাম কোত্থেকে রক্তপাত হচ্ছে সেটা বের করার আশা ছেড়ে দেব আর (কোনভাবে) তখন উঠে দরজার কাছে গিয়ে লকটা খুলতে পারলাম।

“বাবা!”

সুগুয়ে দরজা খুলে হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকল। তারপর আমার অবস্থা দেখে চিৎকার করে উঠল, “অ্যাঁ!”

“কো…কো…কো…কোত্থেকে আমার রক্ত বের হচ্ছে? তাড়াতাড়ি দেখ সুগুয়োয় খুঁজে বের কর!”

সুগুয়োকে সবসময় কাপুরুষ মনে করে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখতাম, আর এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হয়েছিল সে হয়ত দেখেই দৌড়ে পালিয়ে যাবে। কিন্তু ও (আশ্চর্যজনকভাবে) আমার আকুতি শুনল আর আমার পেছন দিকটা পরীক্ষা করল। আমি ওর মুখ থেকে বের হওয়া ছোট ছোট শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম-আউঃ ইক!

“অ্যাঁ! এই যে পেয়েছি!” ও বলল। “আপনার একপাশে কেটে গিয়েছে বাবা!” আমি হাত দিয়ে জায়গাটা স্পর্শ করার চেষ্টা করলাম আর অনুভব করলাম শক্ত কিছু একটা আমার শরীরে গেঁথে আছে।

সেই সময় আমার দ্বিতীয় স্ত্রী সুমাকো (বয়স পঁচিশ বছর) আর বড় ছেলে নাগায়ো (বয়স চৌত্রিশ বছর) এসে হাজির হল। চোখে রক্ত লেগে থাকার কারনে আমি পরিস্কার করে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু এটুকু দেখতে পাচ্ছিলাম যে ওরা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করছে কি হচ্ছে এখানে।

আমি ওদের চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম :

“আয় হায়!”

“এ কি..!”

“সুগুয়ো, আমাকে বল, আমার পিঠে এই শক্ত জিনিসটা কি লেগে আছে?”

“উম…” ও এমন একটা সুরে বলল যার অর্থ অনিচ্ছা আর বুঝতে সময় লাগা দুটোই হতে পারে।

“যত দূর যা মনে হচ্ছে…উম…তোমার পিঠের পাশে যে জিনিসটা লেগে আছে সেটা…একটা কিচেন নাইফ।”

আমার মনে হচ্ছিল জ্ঞান হারিয়ে ফেলব। আমার ডান দিক দিয়ে রক্ত বেয়ে পড়তে থাকল, আর কার্পেটের উপর একটা দাগ হয়ে আস্তে আস্তে বাইরের দিকে যেতে লাগল। ছুরি দিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার কোন স্মৃতি আমার মনে নেই।

দশ বছর আগে আমার কারনে একটা ভয়াবহ ট্রাফিক দুর্ঘটনা ঘটেছিল। যে গাড়িটা আমি চালাচ্ছিলাম সেটা ছিল বুলেটপ্রুফ, সেই সাথে স্পিঙ্কলারস দিয়েও সজ্জিত ছিল। এটা ছিল আমার “টাকা কথা বলে” ধরনের গাড়ি যা একটা ট্যাংকের মত করে তৈরি করা হয়েছিল। আমার প্রথম স্ত্রী সে সময় প্যাসেঞ্জার সিটে বসে ছিল।

দুর্ঘটনাটা ছিল ভয়াবহ। আমার গাড়ি, যেটা নিয়ে আমার অনেক গর্ব ছিল, একদলা ভাঙাচোরা ধাতব বস্তুতে পরিণত হয়েছিল। যাইহোক, সৌভাগ্যজনক (অনভিজ্ঞ) অভিজ্ঞতা বলা যায় যে আমি সে যাত্রা বেঁচে গিয়েছিলাম।

হাসপাতালের বিছানায় জ্ঞান ফেরে আমার। আমার পুরো শরীর ব্যান্ডেজ দিয়ে মোড়ানো থাকলেও কোথাও কোন ব্যথা বোধ করছিলাম না। আমি উঠে দাঁড়িয়ে হাসপাতালের ভেতর ঘোরাফেরা করতে লাগলাম, জানার চেষ্টা করলাম আমার স্ত্রীর কি হল।

আমাকে দেখে একজন পুরুষ নার্স চিৎকার করে উঠেছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম যে আমার শরীরে কিছু একটা অন্যরকম লাগছিল, আর তারপর দেখি আমার একটা পা জোড়া দেয়া। আমাকে বলা হল যে আমার অনেক হাড় ভেঙে গিয়েছে তাই আমার উচিত চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকা।

কথাটা গ্রহণ করতে আমার কষ্ট হচ্ছিল। কোন ব্যথা হচ্ছে না, কেন আমাকে শুয়ে বিশ্রাম নিতে হবে?

পরদিন ডাক্তার এসে পরিস্থিতিটা আমার কাছে ব্যাখ্যা করলেন। দুর্ঘটনায় আমার মাথা বেশ ভালভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। এতে ব্রেনের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। দুর্ঘটনার প্রভাবে তখনও ভুগছিলাম। ব্যথা অনুভব করার ক্ষমতা (সম্পূর্ণভাবে) হারিয়ে ফেলেছিলাম।

তখন থেকে, আমি যেকোন ধরনের ক্ষত নিয়ে আতংকে ভুগি। ধরা যাক, হয়ত খবরের কাগজে কমিক্স পড়ছি, আর হোমোবোমো-কুন এর চতুর্থ ফেম লালে ঢেকে আছে। ব্যাপারটা আমাকে বিরক্ত করে তুলল। কে এভাবে আসল অংশটার বারোটা বাজাল? এটা কি ধরনের কার্টুন রে বাবা? কে জানে কার্টুনটার আসল কোন অংশ ছিল নাকি ছিল না? আর সেই মুহূর্তে আমি উপলদ্ধি করলাম আমার আঙুল কেটে যাওয়ায় রক্তপাত হচ্ছিল, আমার নিজের রক্তের দাগ পড়েছিল খবরের কাগজে। হয়ত আমার কুত্তাটা (একটা তোসা প্রজাতির কুকুর) কামড়ে আঙুলের মাংস তুলে নিয়েছে কারন আমি ওকে সকালে খেতে দিতে ভুলে গিয়েছি। নিশ্চিত হওয়ার কোন উপায় আমার কাছে নেই।

কিংবা হয়ত আমি গোসলের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, এন্টার রুমে আন্ডারওয়্যার ছাড়া সব খুলে ফেলেছি, তারপর আমার কাপড়ে লাল লাল বিন্দুর মত চোখে পড়ল। মেজাজটা খিঁচড়ে গেল। চিন্তা করতে লাগলাম কে

এরকম বিদঘুঁটে ধরনের আন্ডারওয়্যার কিনেছে আমার জন্য। তারপর উপলদ্ধি করলাম বিন্দুগুলো আমার নিজের রক্ত। ঘুমানোর সময় একটা পেরেক আমার পিঠের দুই তিন জায়গায় ফুটো করে দিয়েছে। আমি এমনই গভীর ঘুম ঘুমাই (তাই তো মনে হচ্ছে) যে নড়াচড়ার কারনে আরও কয়েক জায়গায় ফুটো হয়ে গিয়েছে।

এই হল আমার অবস্থা। মাঝে মাঝে আমার স্রেফ চোখে পড়ে যে রক্তপাত হচ্ছে। মাঝে মাঝে এরকম পেরেকে গেঁথে যাই আর খেয়ালও করি না। একবার ড্রেসারের কোনায় কড়ে আঙুলে এত জোরে বাড়ি খেয়েছিলাম যে হাড়ই ভেঙে গিয়েছিল। পুরো দুটো দিন আমার চোখে কোন অসঙ্গতি ধরা পড়েনি।

আমি আমার নিজের নিরাপত্তা নিয়ে অত্যন্ত ভীত ছিলাম। ঠিক করলাম প্রতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে পারিবারিক ডাক্তার, ডঃ ওমোজি (বয়স পঁচানব্বই বছর) আমাকে পরীক্ষা করে দেখবেন। আমি নিশ্চিত হতে চাই যে কোথাও আহত হইনি।

দুর্ঘটনার পরবর্তী বছরে আমি বেঁচে থাকার সমস্ত উৎসাহ হারিয়ে ফেললাম। স্ত্রীকে হারিয়ে, আকাইম্মা ছেলেপেলের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে, আমার আনন্দ বলতে একমাত্র জিনিস যা ছিল তা হল নিজের কোম্পানিকে বড় থেকে আরো বড় হতে দেখা।

তবে এই উন্নতি আসলে ছিল দুদিকে ধারওয়ালা তলোয়ারের মত। কোম্পানির সম্পদের কারনে আমি ধনী থেকে আরো ধনী হতে লাগলাম। কিন্তু যেহেতু আমার ছেলেদেরকে দায়িত্ব নেয়ার যোগ্য মনে করতে পারছিলাম না তাই কখনো অবসর নেয়ার কথাও কল্পনা করতে পারছিলাম না। হাসি কমে গেল। ব্যথাহীন এক পৃথিবীতে আমি আহত হওয়ার ভয় নিয়ে বসবাস করতে লাগলাম।

আমার জানালা থেকে সকালের নতুন সূর্যের আলোতে পর্বতমালা দেখতে পাচ্ছিলাম। অসাধারণ দৃশ্য। অবশ্য জানালার বাইরে পাখিদের কিচিরমিচির বেশ বিরক্তিকর ছিল। সুগুয়ো আর সমাকে বিছানার পাশের টেবিলে বসল।

“তোমার অনেক রক্তপাত হচ্ছে। ফোয়ারার মত,” সুমাকো বলল। হাত দিয়ে মুখ চেপে রেখেছে। নাগায়ো ফোন শেষ করে টেবিলে ফিরে এল।

“বাবা, এ্যাম্বুলেন্স ডেকেছি। পর্বতমালার গোড়া থেকে এখানে আসতে ওদের আধঘন্টার মত সময় লাগবে। তুমি কি করতে চাও?”

আধঘণ্টা অপেক্ষা করা নিয়ে আমি গজগজ করলাম। তারপর দেহে নিষ্ঠুরভাবে গেঁথে থাকা ছুরিটার দিকে তাকালাম। দেহটাকে একটু ঘুরাতে হচ্ছে ছুরিটার দিকে তাকানোর জন্য। নয়ত চর্বির জন্য দেখা যাচ্ছিল না। কেউ আমাকে ছুরি মেরেছে, এতে কোন সন্দেহ নেই।

“ওরকম করো না, বাবা! তুমি আরো রক্ত চিপে বের করছ, কাপড় মুচড়ে পানি নিংড়ানোর মত!”

“ওহ, ঠিক বলেছ, তুমি ঠিক বলেছ।” সুগুয়োর দরদ মাখা কণ্ঠ শুনে আমি আমার ক্ষতের দিকে তাকানো বাদ দিলাম। এভাবে যদি রক্তপাত হতে থাকে তাহলে আমি কোনভাবেই ত্রিশ মিনিট টিকব না। এখানে আমাদের মাউন্টেইন লজের একদম কাছাকাছি কোন হাসপাতাল নেই।

“সুমাকো…” নাগায়ো আমার স্ত্রীকে নাম ধরে ডাকে কারন সে ওর চেয়ে বয়সে ছোট। “তুমি হাত দিয়ে মুখ চেপে আছ কেন? অসুস্থ বোধ। করছ?”

সুমাকো মাথা নাড়ল। “না তা নয়। আমি আসলে আমার হাসি চাপার চেষ্টা করছি। আমি অনেক আনন্দিত। অবশেষে আমার এই বুড়ো স্বামী আসলেই মরতে বসেছে।”

আমার কমবয়সি সুন্দরি স্ত্রী আমাকে বিয়ে করেছে শুধু আমার টাকার জন্য।

“কি বলছ এসব?” নাগায়ো আমার দিকে ঘুরল, মুখে তোষামুদে হাসি ধরে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা। আমার সবসময়ই মনে হয়েছে আমার বড় ছেলে এক নাম্বারের একটা ভণ্ড। “বাবা, তুমি নিশ্চয়ই আশা করছ না তোমার সম্পত্তি আমরা এই নারীর সাথে ভাগাভাগি করব? কোম্পানি আমার উপর ছেড়ে দিয়ে তুমি নিশ্চিন্তে মরতে পার।”

“কি বলে দেখ। তুমি এতটাই ঋণে ডুবে আছ যে ওই টাকায় হাত দেয়ার জন্য তর সইছে না।”

“আমি এই দুজনকে বিশ্বাস করতে পারছি না,” সুগুয়ে, আমার কাপুরুষ সন্তান বলল। নিজের চেয়ার ওদের থেকে আরেকটু দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল।

“কি বলছ, নিজেদের কথাগুলো শুনেছ? তোমরা সবাই আজেবাজে কথা বলছ আর আমি এদিকে মরতে বসেছি।”

“এসব হচ্ছেই কারন তুমি মরতে বসেছ,” সুমাকো ছোট একটা নিশ্বাস ছেড়ে হালকাভাবে বলল।

হারামজাদি, ওকে উইল থেকে বাদ দিব আমি।

“বাবা, তোমার রেগে যাওয়া উচিত হচ্ছে না। রক্তচাপ বেড়ে গেলে রক্তপাতের অবস্থা আরো খারাপ হবে।” সুগুয়োর কষ্ট আমাকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনল। আমি জোরে নিশ্বাস নিয়ে রাগ সংবরণ করার চেষ্টা করলাম। তারপর হঠাৎ খেয়াল হল যে সকাল হওয়ার পর থেকে একজন ব্যক্তিকে আমি এখনো দেখিনি।

“ভাল কথা, ডাঃ ওমোজি কোথায়?” তাকে ছাড়া আমি কোথাও ভ্রমণ করি না, এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আমরা পাঁচজন একসাথে ছুটি কাটাতে কেবিনে এসেছি।

ডাঃ ওমোজি রীতিমত একজন প্রাগৈতিহাসিক ফসিল। আপনাদেরকে তার বয়সের ধারণা দেয়ার জন্য বলছি, বেশিরভাগ মানুষ তাকে দেখে সাধারণত বলে, “এই বুড়ো কুটের (এক ধরনের হাঁস) এখনো মেডিক্যাল লাইসেন্স আছে? আমি আমার জীবন এরকম কোন বুড়ো ভামের হাতে দিতে চাই না যে কিনা শোগানের (১১৮৫-১৮৬৮ সাল পর্যন্ত জাপানে চলা সামরিক স্বৈরতন্ত্রের নেতৃবৃন্দ) সময় ঘোরাফেরা করেছে। যে কারনে ডাঃ ওমোজির ক্যালেন্ডার সবসময়ই ফাঁকা থাকত। আর আমি আমার সাথে কোন যাত্রায় যেতে বললে তিনি সবসময় দ্রুত উত্তর দিতেন, “আনন্দের সাথেই যাব।” যাওয়ার জন্য তার কোন রিজার্ভেশন ছিল না যে বাদ দিতে হবে (কিচ্ছু না)।

“আমার মনে হয় তিনি এখনো তার রুমে ঘুমাচ্ছেন,” সুগুয়ো মাথা নাড়তে নাড়তে বলল। “আমি গিয়ে তাকে ঘুম থেকে উঠাচ্ছি।”

ডাঃ ওমোজির রুম এক তলাতেই ঠিক আমার পাশের রুমটায়। এইসব চিল্লাচিল্লিতে তারই সবার আগে লাফিয়ে ওঠার কথা। কিন্তু কানে বিশাল সমস্যা থাকায় তিনি সম্ভবত টের পাননি। হয়ত তিনি রাতেই বিছানায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। সব কিছুই সম্ভব। তার বেডরুমের দরজাটা লিভিং রুমের দিক থেকে খুলে, যে কারনে আমি পরিস্কার দেখতে পারলাম নাগায়ো দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাক্তারকে ডাকল।

কিছুক্ষণ পর তিনি মাথার পেছনটা চুলকাতে চুলকাতে বেরিয়ে এলেন। উনি আর নাগায়ো এগিয়ে এল আমরা যে টেবিলে বসে ছিলাম সেদিকে। এই পুরোটা সময় আমার শরীর থেকে রক্ত বেয়ে পড়তেই থাকল, কারপেট ভিজে চুপচুপ।

“ডাঃ ওমোজি, আপনার ঘুমে বাধা দেয়ার জন্য দুঃখিত। আপনি একটু দয়া করে দেখবেন? কেউ একজন আমার পিঠে ছুরি মেরেছে মনে হচ্ছে?”

নাগায়ো ডানে বামে মাথা নাড়ল।

“না, বাবা, তুমি ভুল করছ। ডাক্তারসাহেব জেগেই ছিলেন।”

আপাদমস্তক সাদা পোশাক পড়া ডাঃ ওমোজি আমার দিকে এগিয়ে এলেন। কোথাও যাওয়ার সময় তিনি প্রায় সবসময়ই পুরো সাদা পোশাক পড়েন।

“আ…আমি খুবই দুঃখিত। আমি আপনাকে চিল্লাচিল্লি করতে শুনেছি। কিন্তু প্রতিদিন ভোর সোয়া পাঁচটায় একটা ট্রাভেল শো হয় যেটা আমার খুব পছন্দ। আমার কাছে মনে হয়েছে আপনার সমস্যা যাই হয়ে থাকুক না কেন তার চেয়ে এই প্রোগ্রামটা বেশি গুরুত্বপুর্ণ।”

“বুড়ো হাঁস কোথাকার!” সুমাকো ফেটে পড়ল।

“আচ্ছা যাই হোক, এখন এখানে এসে দেখুন তো আমাকে,” আমি বললাম। ওমোজি কাত হয়ে আমার ক্ষত পরীক্ষা করলেন।

“আহা!” তিনি বললেন। “একটা কিচেন নাইফ গেঁথে আছে আপনার শরীর! এ ব্যাপারে আমার কিছুই করার নেই।”

“ওয়াও! নিজের চোখে একটা শবচ্ছেদ দেখার সুযোগ পাচ্ছি। কখনো ভাবিনি এরকম সুযোগ হবে।” নাগায়ো বলল।

শবচ্ছেদ? কি বলতে চাইছে সে? আমি এখনো মারা যাইনি। “আপনি কি কোনভাবেই কোন সাহায্য করতে পারবেন না ডাক্তারসাহেব?” আমি বললাম, আমার নির্বোধ সন্তানকে উপেক্ষা করার যথাসাধ্য চেষ্টা চালালাম।

“দাঁড়ান, আমাকে একটু চিন্তা করতে দিন। ওরকম একটা ক্ষত নিয়ে আপনি টিভির সকালের খবর পর্যন্তও টিকবেন না। খুব খারাপ অবস্থা।”

টেবিলের অপর পাশে সুমাকোর চোখগুলো যেন বেরিয়ে আসছিল, হাতের তালু দিয়ে মাথা চাপড়াচ্ছিল ও।

“কি হচ্ছেটা কি এখানে? তাহলে আমাদের সাথে একজন ডাক্তার রেখে লাভটা কি হল যদি…।”

এক হাতের আঙুল ওর দিকে তাক করে অন্য হাত দিয়ে ডাঃ ওমোজির হাত আঁকড়ে ধরলাম।

“আমার স্ত্রী আতংকিত। এ থেকে বেঁচে যাই এরকম উপায়ই কি নেই?”

ডাক্তারের ভাঁজপড়া মুখ থেকে একটা হাসি বেরিয়ে এল।

“চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। এরকম কোন কিছু কোন একদিন হতে পারে তা আমি আগেই আন্দাজ করেছিলাম। যে কারনে আমরা কোন টিপে গেলে আমি সবসময় সাথে করে ট্রান্সফিউসনের জন্য প্রয়োজনীয় রক্ত বহন করি।”

এই কথাগুলো শুনে আমি হাঁটু ভেঙে বসে পড়লাম। মাঝে মাঝেই সে আমার বাহুতে সুই ঢুকিয়ে কিছু রক্ত বের করে নিত। এত ঘন ঘন করত যে আমার সন্দেহ পর্যন্ত হয়েছিল বুড়ো আমার রক্ত নিয়ে কোথাও বিক্রি করে কিনা। এখন বুঝতে পারলাম সে আসলে এরকম কোন পরিস্থিতির জন্য রক্ত সংরক্ষণ করছিল। ওর মাথার উপর স্বর্গদূতদের মত পবিত্র আলোর রিং দেখতে পাচ্ছিলাম বলে মনে হল।

আমরা যদি এখন ট্রান্সফিউশন শুরু করি তাহলে আপনি এ্যাম্বুলেন্স আসা পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারবেন। কেউ একজন এ্যাম্বুলেন্স ডেকেছে বলে ধরে নিয়েছি আমি।”

আমরা তাকে ব্যাখ্যা করলাম যে লজ পর্যন্ত এ্যাম্বুলেন্স আসতে আধা ঘন্টার মত লাগবে।

“তাহলে তো একদম ক্লোজ কল। যাই হোক, আপনার রক্তের একটা বড় সাপ্লাই আমার রুমে রাখা আছে। আমি গিয়ে সেটা নিয়ে আসছি।”

ডাঃ ওমোজি তার রুমের দিকে ছুটলেন।

“যাক, বেঁচে থাকার প্রতি তোমার যথেষ্ট আগ্রহ দেখে আমি আনন্দিত, বাবা।”

“হ্যাঁ, আমিও তাই বলব। সবচেয়ে আনন্দজনক হবে যদি তুমি বেঁচে থাকো আর আমাদের সাথে নিয়ে লম্বা একটা জীবন পার কর।”

নাগায়ো আর সুমাকোর এইসব ভাবা কথা আমার কাছে খুবই ক্লান্তিকর লাগল। কেউ একজন জিব্বা দিয়ে ইস! ধরনের শব্দ করল।

“বাবা, তুমি যদি মারা যাও, আমাকে তাহলে এই দুজনের সাথে থাকতে হবে? তাহলে অনেক ভয়ের ব্যাপার,” সুগুয়ো বলল, কেঁদে ফেলবে মনে হচ্ছিল। ও আমার কাঁধে হাত রেখে নিজের কথার উপর জোর বাড়াতে চাইল।

হাত সরাও, আমি নিজে নিজে ভাবলাম, তুমি শুধু রক্তপাতটাকেই বাজে অবস্থায় নেবে। ওর হাত সরে গেল (অবশেষে) যখন ডাঃ ওমোজি ফিরে এলেন। তার হাসি এক কান থেকে আরেক কানে গিয়ে ঠেকেছে।

“প্লিজ, ডাক্তারসাহেব, আমাকে রক্ত দিন। আমার মনে হচ্ছে জ্ঞান হারিয়ে ফেলব।”

“আমার মনে হয় সেটা সম্ভব হচ্ছে না।”

মানে?

“আমি দুঃখিত, কিন্তু মনে হচ্ছে আমি আপনার রক্ত রাখা ব্যাগটা কোথাও ফেলে এসেছি।”

পঁচানব্বই বছর বয়সি এক বুড়োকে লজ্জায় লাল হতে দেখাটা অবশ্যই একটা দুর্লভ দৃশ্য।

কোথাও ফেলে এসেছে মানে?

“আমি বুঝতে পারছি না কিভাবে এমনটা হল, কিন্তু জিনিসটা আমার রুমে নেই।’

নাগায়ো আর সুমাকোকে আনন্দিত দেখাল।

“আমরা যখন বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম তখন তো ব্যাগটা আপনার সাথে ছিল, নাকি? কোন জায়গায় আপনি ফেলে গিয়ে থাকতে পারেন?”

“কোন ধারণা নেই,” ডাঃ ওমোজি মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন। “আমার এমনকি স্পষ্ট মনে নেই, আমরা যখন এখানে এসেছি তখন সেটা আমার কাছে ছিল কিনা। আমি হয়ত সেটা আগের ট্রেনেই ফেলে এসেছি। হতে পারে অন্য কারো লাগেজের সাথে উল্টোপাল্টা হয়ে গিয়েছে।”

আমি আমার স্ত্রী আর ছেলেকে নির্দেশ দিলাম গিয়ে ওদের ব্যাগ পরীক্ষা করে দেখতে।

“সুমাকো আর নাগায়ো যদি তোমার রক্তসহ ব্যাগ খুঁজেও পায় তাহলেও হয়ত ওরা সেটা লুকিয়ে ফেলবে,” সুগুয়ো বলল। ঠিকই বলেছে অবশ্য।

“ঠিক আছে তাহলে একটা কাজ করা যাক: যেই ব্যক্তি আমার রক্তওয়ালা ব্যাগ খুঁজে পাবে, তাকে আমি আমার সব সম্পদ দিয়ে দেব-কোম্পানি, সম্পত্তি, সব। তোমরা যদি টাকাই চাও, তাহলে যাও, গিয়ে রক্ত খোঁজো!”

নাগায়ো আর সুমাকো আমার দিকে তাকিয়ে থাকল, বিস্মিত।

“কোন চিন্তা কোরনা প্রিয়! আমি এখনই খুঁজে বের করছি!”

“আমিও!”

ওরা দুজন উঠে রুম থেকে বেরিয়ে দোতালায় ওদের রুমের দিকে ছুটে গেল। সগুয়োও একই কাজ করল। ডাঃ ওমোজি তার সাদা কোটের হাতা গুঁটিয়ে নিলেন, মনে হচ্ছিল তিনিও তাদের সাথে যোগ দেবেন।

“আপনি না, ডাঃ ওমোজি, আপনি রক্ত খুঁজে পেলে আমি আপনাকে আমার কিছুই দিচ্ছি না।”

“আমিও তাই ভেবেছি।”

“এই বাড়ির অন্য কারো শরীর থেকে কি আমি রক্ত গ্রহণ করতে পারব?।”

“আপনি তো ‘টাইপ ও তাই না? বাকি সবাই এ, বি কিংবা এবি। দুঃখিত সেটা সম্ভব নয়।”

উপরের তলা থেকে ভেসে আসা শব্দে বুঝতে পারছিলাম তিনজন মানুষ তাদের লাগেজ তছনছ করছে। পুরোটা সময় আমার শরীর থেকে রক্ত বেরিয়ে যেতেই থাকল।

“আপনি কি অন্তত কিছু একটা করতে পারেন না যাতে অন্তত রক্তপাতটা বন্ধ হয়?”

তিনি মাথা ঝাঁকালেন। “আমার সাথে আমার প্রিয় স্কালপেল আর সেলাই দেয়ার সুতো আছে। আমি একটা ছোট অপারেশন করতে পারি। সৌভাগ্যজনকভাবে আমাদের অ্যানাস্থাসিয়ার প্রয়োজন নেই।”

“আপনার কাছে হাত জোর করছি। আমাকে আরো খানিকটা সময় বাঁচতে হবে। এই তিনজনের উপর কে নির্ভর করতে পারবে বলুন? বছরের পর বছর শ্রম দিয়ে আমি এই কোম্পানি দাঁড় করিয়েছি। আপনার কি ধারণা আমি সেটা ধ্বংস করার জন্য ওদের হাতে তুলে দিতে পারব?”

“চিন্তা করবেন না। আপনি এখনই মরছেন না।”

ডাক্তারসাহেব তার পকেট থেকে একটা মরচে ধরা স্কালপেল বের করলেন।

“এক মিনিট দাঁড়ান। এই স্কালপেল দিয়ে অপারেশন চালাবেন? এটাতে তো মরিচা লেগে আছে!”

“খানিকটা মরিচা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন কেন? এখন তো জীবন-মরণের প্রশ্ন। প্রত্যেকটা সেকেন্ড এখন মূল্যবান!” তার স্কালপেল ধরা হাতটা পাতার মত কাঁপছিল।

“ডাক্তারসাহেব, শেষ কবে আপনি কারো অপারেশন করেছেন?”

“ওহ, সম্ভবত আপনার জন্মের আগে।”

এক ঝটকায় (বিস্ময়করভাবে) আমি ডাক্তারের হাত থেকে স্কালপেলটা ফেলে দিলাম।

“শুনুন ডাক্তারসাহেব, আমার মনে হচ্ছে আপনার জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে ভাল হয় যদি মনে করতে পারেন রক্তের ব্যাগটা কোথায় রেখেছেন। ওইটা ছাড়া আমি একদম শেষ।”

আগেরদিন বাসা ছেড়ে বের হওয়ার পর কি কি ঘটেছে তার খুঁটিনাটি মনে করার চেষ্টা করলাম আমি।

***

দুটো ট্যাক্সিতে করে সকাল দশটায় বাসা ছেড়েছিলাম। বাকি সবার মধ্যে একমাত্র আমারই ডাইভিং লাইসেন্স আছে, কিন্তু দুর্ঘটনাটার পর থেকে স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে আর বসা হয়নি।

“আপনি কি নিশ্চিত যে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় রক্তের ব্যাগটা আপনার কাছে ছিল?”

“কোন সন্দেহ নেই, আমার কোলের উপরই ছিল।”

দুটো ট্যাক্সিই স্টেশনে পৌঁছলে আমরা ট্রেনে চড়েছিলাম। আমার মনে পড়ল ট্রেনের দোলায় ডাঃ ওমোজিকে কেমন দেখাচ্ছিল। দুই হাত দিয়ে নিজের লাঞ্চ বক্স চেপে ধরে রেখেছিলেন।

“ট্রেনের ভেতর আপনি দুই হাত দিয়ে আপনার লাঞ্চ বক্স ধরে রেখেছিলেন।”

“ঠিক বলেছেন, একদম ঠিক। আমারও সেটা স্পষ্ট মনে আচ্ছে। লাঞ্চটা ভাল ছিল।”

“কিন্তু রক্তের ব্যাগটা কোথায় ছিল তখন?”

“ধুর! আমি কি বোকা! আমি নিশ্চয়ই সেটা ট্রেনের প্ল্যাটফর্মে ফেলে এসেছিলাম।”

ভুলো মনের বুড়ো ভাম কোথাকার! আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছিল, কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার পেছনে একটা কণ্ঠ বলে উঠল।

“সেটা হয়নি। আমরা ডাক্তারসাহেবের লাগেজ প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেনে তুলেছিলাম। আমি নিজে রক্তের কালো ব্যাগটা টেনে তুলেছিলাম।”

কণ্ঠটা সুগুয়োর। এর মধ্যে কোন এক সময় নিশ্চয়ই সে নিচতলায় ফিরে এসেছে।

“তাহলে সুগুয়ো, ব্যাগটা কি তুমি তোমার রুমে নিয়ে গিয়েছিলে?”

“না আমার রুমে সেটা নেই,” সে মাথা নাড়ল। আমি অনুভব করলাম আমার কাঁধগুলো অসন্তুষ্টির ভারে দেবে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল শরীরের তাপমাত্রা পড়ে যাচ্ছে, হাত-পায়ের আঙুলগুলো ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।

“বাবা তোমাকে ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে।”

“অবাক হওয়ার কিছু নেই, যে পরিমাণ রক্ত হারিয়েছি। সুগুয়ো, আমি ধূমপান করতে চাই। একটা সিগারেট দাও।”

“সিগারেট তোমার জন্য ক্ষতিকর, জানো না?”

“এখন কি এইসব কথাবার্তা বলার আর সময় আছে?”

ট্রেন থেকে নামার পর আমরা আবার ট্যাক্সি নিয়েছিলাম। তারপর চল্লিশ মিনিটের মত ডাইভের পর এই মাউন্টেইন লজে এসে পৌঁছাই। তবে আমরা প্রথমে স্টেশনের কাছে একটা মুদির দোকানে গিয়েছিলাম। এটা আমাদের সাধারণ রুটিন। গাট্টিবোঁচকা নিয়ে কেনাকাটা করতে যাওয়া বেশ ঝামেলাদায়ক। তাই সুগুয়ো আর ডাঃ ওমোজি আমাদের সবার ব্যাগ নিয়ে কেবিনে চলে গিয়েছিল।

আর নাগায়ো, সুমাকো, আমি গাট্টি বোঁচকাহীন অবস্থায় বাজার করতে গেলাম। বেকারির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সুমাকো বলল, সে মিষ্টি কিছু কিনতে চায়।

“কিছু কেক কিনে নেয়া যাক নাকি? আর আমাদের একটা ছুরিও কিনতে হবে। আমার স্পষ্ট মনে আছে কেবিনে একটাও ছুরি নেই।”

আমার মনে আছে ওর বাম হাতে একটা কালো ব্যাগ ঝুলছিল। আমি নিশ্চিত, ওটা ডাঃ ওমোজির রক্তের ব্যাগটাই ছিল।

“আমি কি একটা প্রশ্ন করতে পারি? প্রথম ট্যাক্সি যেটা কেবিনে ব্যাগট্যাগ নিয়ে গিয়েছিল, সেটায় কি রক্তের ব্যাগটা ছিল?”

“আমার তা মনে হয় না,” সুগুয়ো বলল, কিন্তু ওকে দেখে তেমন একটা আত্মবিশ্বাসী মনে হল না।

“যখন সুগুয়ো আর ডাঃ ওমোজি গাড়িতে উঠলেন তখন রাস্তার উপর একটা কালো ব্যাগ পড়েছিল,” সুমাকো আমার পেছন থেকে বলল। আমি ঘুরে তাকালাম। ও দুইতলা থেকে নেমে এসেছে, এখন চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। “ওটা যে ডাঃ ওমোজির ব্যাগ তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম, সেকারনে আমাদের কেনাকাটার সময় সেটা আমি বহন করেছিলাম।”

আমি হাতের মুঠি পাকিয়ে ডাক্তারের দিকে তাকালাম।

“এরকম গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস আপনি কি করে রাস্তায় ফেলে গেলেন?”

“আমাকে কেন মুঠি তুলে শাসাচ্ছেন? মারবেন নাকি? আমি সেফ একজন বুড়ো মানুষ যার খুব একটা ভবিষ্যৎ বাকি নেই আর!”

আমার নিজেরও কোন ভবিষ্যৎ বাকি নেই!

“ঠিক আছে, ডিয়ার, শান্ত হও। বুড়ো হাঁসটা এমনিতেই সবকিছু আধা মনে রাখতে পারে, তাই সে যদি উলটাপালটা কিছু করে ফেলে তাহলে মাফ করে দেয়াই ভাল।”

তোমার কি কোন রক্ত নেই? কোন অ নেই? “তারমানে তোমার কাছে রক্তের ব্যাগটা ছিল। ব্যাগটা কি রুমে ছিল?”

সে ওর মাথা নাড়ল। “আমি নিশ্চিত যে আমরা যখন এখানে এলাম তখন পর্যন্ত সেটা আমার সাথেই ছিল, আমি নিশ্চয়ই সেটা কোথাও নামিয়ে রেখেছিলাম…।”

কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। আমার দৃষ্টিশক্তি ঘোলাটে হতে শুরু করল, ঘুম পাচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম এগুলো খারাপ লক্ষণ। বালিঘড়ির মত নিয়মিতভাবে আমার ক্ষত থেকে রক্ত বেয়ে পড়তে থাকল। প্রতি সেকেন্ডে আমার আয়ুও কমতে থাকল।

“কিন্তু তুমি নিশ্চিত তো ব্যাগটা এই কেবিনেই আছে?”

“হ্যাঁ, যেমনটা সুগুয়ো বলল।”

“কিন্তু কেবিনের কোথায় থাকতে পারে সেটা?”

সবাই চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। নাগায়ো (ভণ্ডটা) লিভিং রুমের মুখ থেকে বলে উঠল।

“গত রাতে আমি ব্যাগটা দেখেছিলাম।”

কথাটা সবার মনোযোগ আকর্ষণ করল।

“কি? আসলেই?”

“হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত যে ব্যাগটা দেখেছি। এই দরজার কাছেই সেটা পড়ে ছিল।”

“তারমানে, নাগায়ো, তুমি রক্ত খুঁজে পেয়েছ?”

“না, পাইনি। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে গত রাতে, যখন আমি প্লাটিপ্লাসের অঙ্গভঙ্গি করছিলাম তখন সেটা এখানে একদিকে কাত হয়ে পড়েছিল।”

গত রাতের ডিনারের কথা মনে পড়ল। সুমাকোর রান্না করা খাবার খেয়েছিলাম আমরা সবাই। তারপর আমার স্ত্রী আর দুই ছেলে কিছু অভিনয় করে দেখিয়েছিল। নাগায়োর প্লাটিপ্লাসের অঙ্গভঙ্গি অভিনয় করে দেখানোটা ছিল সবচেয়ে (এখন পর্যন্ত) খারাপ।

সুগুয়ো বলল, “নাগায়ো, বাবা তোমাকে গতরাতে একদম গাধা বানিয়ে ছেড়েছিল।”

সুমাকো সাথে যোগ করল : “সবচেয়ে বেকুবি ব্যাপার হল, একটা প্লটিপ্লাস নিজে কখনো বলতে পারে না, সে একটা স্তন্যপায়ী নাকি একটা হাঁস, আর তুমি আমার সৎ ছেলে হলেও কিছু আসে যায় না, তুমি আসলেই একটা রাম গাধা।”

“এহ, বকবকানি বন্ধ কর। প্লাটিপ্লাসের মধ্যে কোন ভুল নেই। আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। প্লাটিপাস অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় স্তন্যপায়ী প্রাণী। ওদের পাগুলো ছোট আর পায়ে হিল আছে! আসলে গতরাতে, সুমাকো তুমি নিজেই সবকিছু গুব্রট পাকিয়েছিল তোমার ফালতু ‘আপেল ডামপ্লিং গ্যাং’ গান নিয়ে। ঐটার জন্যই বাবা ক্ষেপে গিয়েছিল। তা না হলে তিনি আমার পরিবেশনা ঠিকই পছন্দ করতেন। তুমি জানো না তিনি ডামপ্লিং দুচোখে দেখতে পারেন না?”

“আমার কোন ধারনাই ছিল না। আমি কিভাবে জানব যে ওর প্রথম স্ত্রী। দশ বছর আগে ডামপ্লিং গলায় আটকে মারা গিয়েছিল? আমি তো এতদিন ভেবেছি সে ওই ট্রাফিক এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছিল।”

আমি চোখ বন্ধ করে গত রাতের সবকিছু মনে করার চেষ্টা করলাম। ঘুরন্ত লণ্ঠনের মত, দৃশ্যগুলো আমার চোখের পর্দার উপর প্রতিফলিত হল।

****

গত রাতে, খাওয়া দাওয়া শেষ হওয়ার পর আমরা এই তিনজনের পরিবেশনা দেখেছিলাম-সুমাকো, নাগায়ো, সুগুয়ো-এই ক্রম অনুসারে। আমার মেজাজ খারাপ চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছেছিল নাগায়োর পরিবেশনা শেষ হওয়ার পর। কিন্তু তারপর সুগুয়ো কার্ডের কিছু খেলা দেখাল যেগুলো খারাপ ছিল না। হতে পারে ও একটা কাপুরুষ, আকাইম্মা, বখে যাওয়া একটা ছেলে, কিন্তু জাদু পরিবেশনায় ওর খানিকটা দক্ষতা আছে। ওর রুমের বুকশেলফ রহস্যোপন্যাস দিয়ে ভর্তি।

আমার মনে পড়ল ও যখন ছোট ছিল তখন একবার ওকে তারার দিকে হ্যাঁ করে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় ধরে ফেলেছিলাম।

“কি ভাবছিলে?” আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ওকে।

“আমি একটা জাদুর কথা ভাবছি যা দিয়ে মানুষ মারা যাবে, সে চোখ টিপে বলেছিল। আমি হাসিতে ফেটে পড়েছিলাম।

“তুমি যে কাপুরুষ, এরকম একটা জাদুর কথা তুমি কেন ভাববে? আর যদি এরকম কিছু একটা বের করেও ফেলতে পার, এরপর কি করবে? এই নিয়ে গল্প লিখবে? নাকি কাউকে খুন করতে ব্যবহার করবে? তুমি যে কাপুরুষ তাতে এর কোনটাই করা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি যাবে কলেজে আর ভাল গ্রেড অর্জন করবে তারপর তোমার দিন কাটবে কুকুর হাঁটাতে নিয়ে বেরিয়ে।”

ও স্রেফ শুনে গেল, হাসল আর মাথা চুলকাতে থাকল। আমি ওকে যত আজেবাজে কথাই বলি না কেন ও খালি হাসবে, বেচারা।

গত রাতে ও যখন কার্ডের জাদু দেখানো শেষ করল তখন আমি খেয়াল করলাম ঘড়িতে ইতিমধ্যে দশটা বেজে গিয়েছে। ডাঃ ওমোজি বলা শুরু করলেন যে তিনি হিকারু উদার একটা গান গাইতে চান, কিন্তু কোন সুযোগ দিলাম না তাকে। অন্যদের চেয়ে আগেই আমি ঘুমুতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ছুটিতে ঘুরতে গেলেও আমি আমার নিয়মমত চলার চেষ্টা করি, রাত দশটায় শুয়ে পড়ি আর ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠি।

ঘুমুতে যাওয়ার আগে ডাঃ ওমোজি আমার রুমে এলেন কোথাও কেটে টেটে গিয়েছে কিনা পরীক্ষা করে দেখার জন্য। আমি শুয়ে পড়ে জানালার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। জানালার ফেমটা ছোট আর একদম চারকোনা, দরজার উল্টোপাশের দেয়ালে লাগানো। বিছানার ঠিক পাশেই। যে কারনে জানালা দিয়ে বাইরের তারাভরা আকাশ দেখা যায়। খালি জানালাটা বাজেভাবে লাগানোর কারনে কয়েক সেন্টিমিটারের বেশি খোলা যায় না। রুমের ভেন্টিলেসনের অবস্থা তাই (খুবই) খারাপ। কেউ আমার সাথে রুম বদলাতে রাজি না হওয়ায় প্রতিবার কেবিনে এলে এই রুমটাতেই আমাকে ঘুমাতে হয়।

রুমের দরজা খোলা ছিল। লিভিং রুমে বসে আমার স্ত্রী আর দুই পুত্রর হাহাহিহি পরিস্কার শুনতে পাচ্ছিলাম। ওরা (মনে হল) কেক খাওয়ার মুডে ছিল।

যেহেতু আমার ত্বক কোনো স্পর্শ অনুভব করতে পারে না তাই ডাক্তার তার হাত দিয়ে কি করছিলেন তা বলা মুশকিল। আমার চিন্তা হচ্ছিল যে তিনি আসলে আমাকে পরীক্ষা না করে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন কিনা। বিছানার নিচ থেকে আসা থপথপ শব্দ শুনে নিশ্চিত হলাম তিনি এখনো ঘুমিয়ে পড়েননি। কিন্তু যখন আমি ঘুরে তাকালাম তখন দেখি তিনি শুধু বিছানার পাশের চেয়ারে বসে আছেন। বোঝাই যাচ্ছে ঝিমাচ্ছেন।

খোলা দরজাটা দিয়ে আমি লিভিং রুমের টেবিল দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি দেখলাম সুমাকো কিচেন নাইফ দিয়ে কেক কাটছে।

“ডাক্তারসাহেব! ওরা সবাই ওই রুমে কেক খেয়ে শেষ করে ফেলছে,” আমি বিড়বিড় করে বললাম। তিনি চেয়ার থেকে উঠে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন, চিৎকার করে বলতে বলতে, “উপরের চকলেট বারটা কিন্তু আমার।”

আমি বিরক্তির সাথে মাথা নেড়ে বিছানা ছেড়ে উঠলাম আর দরজার দিকে এগুলাম। ওদের চারজনকে কেক ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে চাইছিলাম।

একটু পর দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ছিটকিনি লাগালাম, আর রুমের ভেতর একা হয়ে পড়লাম। বাতি নিভিয়ে হাই তুলে ঘুমিয়ে পড়লাম।

***

“তুমি যখন রুমে ফিরে গেলে আমরা তখন কেক খাচ্ছিলাম। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে রক্ত ভর্তি ব্যাগটা তখন লিভিং রুমে আর ছিল না।”

নাগায়োর কণ্ঠ শুনে আমি চোখ খুললাম আর বর্তমান আলোচনায় ফিরে এলাম। টেবিলে চারজন বসে আছে, আর আগের মতই আমার শরীর থেকে রক্ত (এখনো) বেরিয়ে যাচ্ছে, আমি তখনো দেখতে পাচ্ছিলাম ছুরিটা শরীরে বিঁধে আছে। এক সময় মনে হল, প্লাটিপ্লাসের অনুকরণ নিয়ে আলোচনা শেষ হলে রুমের ভেতর নীরবতা নেমে এল।

“নাগায়ো, যদি তোমাকে আমার বিশ্বাস করতে হয়, তাহলে রাত দশটায় আমি যখন রুমে ঢুকেছিলাম তার আগেই ব্যাগটা ঢোকার মুখ থেকে। নাই হয়ে গিয়েছিল।”

সুমাকো কথা বলে উঠল। ওর মুখে অদ্ভুত এক অভিব্যক্তি। “সম্ভবত এগারোটা কিংবা তারও পরে, আমরা সবাই আমাদের যার যার রুমে ফিরে গিয়েছিলাম…এই কথায় আরেকটা কথা মনে পড়ল, এই কেবিনে শুধু একটাই ছুরি আছে।”

মানে কি? “আহ হা! আমি বুঝতে পেরেছি?” সুগুয়ে বলল, সুমোকোর কথার মূল বক্তব্য ধরতে পেরে। তার মানে বাবার শরীরের ছুরিটা অবশ্যই….”

“হ্যাঁ, ভাল করে দেখ, ব্লেডের শেষ মাথায়, হাতলের কাছে, একটু খানি হুইপড ক্রিম লেগে আছে।”

সেই মুহূর্তে, ডাঃ ওমোজি রক্তাক্ত ছুরিটা টেবিলের উপর রাখলেন। দেখে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছিল এই একই ছুরি দিয়ে কেকটা কাটা হয়েছিল।

“অ্যাঁই, এক মিনিট দাঁড়াও! ছুরি! কেউ একজন সেটা আমার শরীর থেকে টেনে বের করেছে!”

আমি হাত দিয়ে স্পর্শ করে টের পেলাম ছুরিটা আর আমার শরীরে গেঁথে নেই।

“হেঃ হেঃ হেঃ এবার কে বোকা হল? আমি আপনার শরীর থেকে ছুরিটা টেনে বের করে ফেলছি আর আপনি একদমই টের পাননি!”

“আপনি! আপনি কি আসলেই কোন ডাক্তার?”

নাগায়ো ওর হাত দুটো ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে ছিল। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়ানো কোন সেলসম্যানের মত, যারা কিনা সরল গৃহিণীদের পটানোর ধান্দায় থাকে।

“হ্যাঁ, বাবা রুমে ফিরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা কেক কাটিনি।”

আমি মাথা ঝাঁকালাম। দরজা বন্ধ করার আগ মুহূর্তে আমি যা দেখেছিলাম তা ছিল সুমাকো ছুরি দিয়ে এক পিস কেক কেটে প্লেটের উপর রাখছে।

“এরপরই তুমি দরজা লাগিয়ে দিলে,” নাগায়ো বলল। “তাহলে এই হুইপড ক্রিম মাখানো ছুরিটা তোমার রুমের ভেতর গেল কি করে। আমি নিশ্চিত তুমিও এই প্রশ্নর উত্তর জানতে চাও, এমনকি সেটা অন্য দুনিয়াতে যাওয়ার পর হলেও…”

আমি এখনো মারা যাইনি..

রক্তশুন্যতার কারনে আমার মাথা ঘোরাচ্ছিল। আমি আমার স্ত্রী আর দুই পুত্রকে আবারও ঝাড়লাম রক্তের ব্যাগটা কোন কিছুর নিচে আড়াল হয়ে পড়ে আছে কিনা ভাল করে দেখতে। আমার জিহ্বা ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল, শব্দগুলো উচ্চারণের সময় ঠিকমত বের হচ্ছিল না।

নাগায়ো, সুগুয়ো আর সুমাকো প্রত্যেকটা জিনিস সরিয়ে সরিয়ে ভাল করে খুঁজে দেখছিল। আমি বিশ্বাস করতে আরম্ভ করছিলাম যে আমি (বিশেষ করে) অনিচ্ছা সত্ত্বেও মরতে যাচ্ছি। এই মানুষগুলো সবাই অকাট নির্বোধ। আমি শান্তিতে মরতে পারতাম যদি শুধু জানতাম যে আমার উত্তরাধিকারদের মধ্যে কেউ একজন আমার কোম্পানির বারোটা বাজাবে না।

ডাঃ ওমোজির সাহায্য নিয়ে আমি লিভিং রুমের সোফা পর্যন্ত গেলাম। সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। নিজে নিজে হাঁটাচলা করার ক্ষমতা আর ছিল না। পাগুলো থরথর করে কাঁপছিল।

“আহ! তাই তো!” সুমাকো বলে উঠল, ও কিচেনের ভেতর ব্যাগটা খুঁজতে গিয়েছিল। আমার সোফার দিকে এগিয়ে এল। ওর গলা শুনে নাগায়ো আর সগায়েও লিভিং রুমে এসে হাজির হল। “আমি যখন কেক বেড়ে দিচ্ছিলাম, তখন লিভিং রুমের দরজার কাছে কিছু একটায় পা পড়েছিল বলে মনে পড়ল। কি বোকা আমি, সেটা কি রক্তের ব্যাগটা ছিল?”

“কি বলতে চাও? ওটা নিয়ে পরে কি করেছিলে?” শরীর থেকে শক্তিও বেরিয়ে যাচ্ছিল, আমার কণ্ঠও নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিল।

“ওটা আমার মেজাজ খারাপ করে দিয়েছিল। তাই কষিয়ে একটা লাথি দিয়েছিলাম।”

“আমার রক্ত..!”

“কিন্তু ব্যাগটা, ওটা তাহলে কোথায় এখন?”

সুগুয়ো মাথা বাঁকাল। ওটা যদি ওর রুম কিংবা সুমাকোর, নাগায়োর, ডাঃ ওমোজির রুমে না থাকে তাহলে কোথায় থাকতে পারে?

আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আমি মরতে যাচ্ছি। ঐ পর্যায়ে, আমার জঘন্য স্ত্রী আর পুত্রদের প্রতি এক রকমের মমতা বোধ জেগে উঠছিল। আমি তাদেরকে শেষবারের মত একবার ভাল করে তাকিয়ে (মমতা পূর্ণ?) দেখলাম।

তখনই মুডটা নষ্ট করে আধমরা ডাক্তারটা চেয়ার টেনে একদম আমার সামনে এসে বসলেন। খবরের কাগজ থেকে খেলার পাতাটা বেছে নিয়ে জোরে জোরে পড়তে লাগলেন। গতকালকের সুমো ম্যাচের একটা বড় ছবি আমার পুরো দৃষ্টি জুড়ে ভেসে উঠল। এরকম কোন দৃশ্য আমার শেষ মুহূর্তে অবশ্যই দেখতে চাইনিঃ এক দল সুমো রেসলার একজন আরেকজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। কিন্তু আমি অন্য কিছু লক্ষ্য করলাম।

“ডাঃ ওমোজি! আপনি আপনার পা দিয়ে ঠকঠক করছেন না!”

খবরের কাগজের তলা দিয়ে মেঝের উপর তার পা দেখতে পাচ্ছিলাম। তিনি আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন আমার মাথায় কোন সমস্যা আছে। “গত কয়েক বছর ধরে আমি আমার অনবরত পা ঠক ঠক করার অভ্যাসের সুইচ বন্ধ করে রেখেছি,” বলে তিনি খবরের কাগজের পাতা উল্টালেন।

আমি একটা সম্ভাবনা নিয়ে ভাবলাম, আর আমার মাথার উপর একটা ছোট বাল্ব জ্বলে উঠল। “সুগুয়ো, আমার রুমে গিয়ে খুঁজে দেখ তো!”

আমার কণ্ঠস্বর ভীষণ দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। সুগুয়ো আমার আর ডাঃ ওমোজির মাঝখান দিয়ে রুমের দিকে তাকাল।

“অ্যাঁ? অসম্ভব! আমি এটা কল্পনাও করতে চাই না। ব্যাপারটা খুবই ভীতিকর। পুরো রুমটা রক্তে থৈ থৈ করছে!”

“ঠিক আছে তাহলে, নাগায়োয় আমার ঘরে গিয়ে ভাল করে খুঁজে দেখ, বিশেষ করে বিছানার তলে!”

আমার বড় পুত্র আমার কথা শুনল আর আমার রুমে গেল। সোফার যেখানে আমি শুয়ে ছিলাম সেখান থেকে খোলা দরজা দিয়ে ওর পিঠ দেখা যাচ্ছিল। বিছানার নিচে খোঁজাখুঁজি করছে। অবশেষে ও বলল, “পেয়েছি!” যখন লিভিং রুমে ফিরে এল তখন ওর হাতে কালো ব্যাগটা দেখা গেল।

একদম সময় মত…।

আমার মনে হল বুকের উপর থেকে বিশাল একটা বোঝা নেমে গেল। ততক্ষণে আমি প্রায় অর্ধেক অচেতন, কিন্তু আমার আত্মবিশ্বাস ছিল যে আরো কিছুক্ষণ টিকে থাকতে পারব।

“কিন্তু ব্যাগটা ওখানে গেল কি করে?” সুমাকো মাথা কাত করে প্রশ্ন করল।

“ডাঃ ওমোজি যখন আমাকে পরীক্ষা করছিলেন তখন তুমি ব্যাগটায় লাথি মেরেছিলে। এখান থেকে দরজার ঠিক পাশেই বিছানাটা হওয়ায় সেটা সোজা বিছানার নিচে চলে যায়।”

ডাঃ ওমোজি যখন আমাকে পরীক্ষা করে দেখছিলেন তখন একটা শব্দ (আসলেই) আমার কানে এসেছিল। আমি ভেবেছিলাম সেটা ডাঃ ওমোজির পা দিয়ে ঠকঠক করার শব্দ। আসলে সেটা ছিল ব্যাগটা পিছলে বিছানার নিচে ঢুকে যাওয়ার শব্দ।

নাগায়ো আর সুমাকো ব্যাগটার দিকে তাকাল। ওদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল বড়ই অসন্তুষ্ট। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম ডাঃ ওমোজি কখন আমার বাহুতে আইভি নিডল পুশ করবেন।

“ডাক্তারসাহেব, দয়া করে তাড়াতাড়ি করুন। আমি আমার সীমায় প্রায় পৌঁছে গিয়েছি।”

“সম্ভব হচ্ছে না,” তিনি বললেন। মুখে আফসোসের ছায়া। ব্যাগটা খুলে ভেতরে দেখালেন। “ব্যাগের ভেতরে কিছু নেই।”

“বুড়ো ভাম কোথাকার, আপনি ব্যাগে রক্ত ভরতে ভুলে গিয়েছিলেন, শেষ চেতনাটুকু আঁকড়ে ধরে আমি বললাম। আমার এক পা ততক্ষণে (নিশ্চিতভাবে) অন্য জগতে। কিন্তু আমার কণ্ঠ শুনে মনে হল কোন ঘোট মেয়ে নাকি কান্না কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ছে। আমি বুঝতে পারছিলাম মৃত্যুর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, একদম হতভম্ব। আমার জীবন তার শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছে।

পুরো শরীর নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে, বিন্দুমাত্র শক্তি নেই। বাঁচার আর কোন পথ খোলা নেই মনে হচ্ছে। একমাত্র পথ ছিল চোখ দুটো বন্ধ করে ঘুমের গভীর সাগরে ডুব দেয়া, যেখান থেকে আর কখনো মাথা তোলা হবে না।

আমার দৃষ্টি যখন ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছিল, তখন দেখতে পাচ্ছিলাম ডাঃ ওমোজি তার হাত বাম থেকে ডানে নাড়াচ্ছেন। তিনি নিশ্চয়ই আমার একদম সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, কিন্তু মনে হচ্ছিল অনেক দূরে দাঁড়ানো।

“না তা সত্যি নয়, একদম সত্যি নয়। আমি ওগুলো ব্যাগে ভরেছিলাম। সত্যি সত্যি ভরেছিলাম। হতে পারে কেউ সেগুলো সরিয়ে ফেলেছে। যাতে আমি আপনাকে রক্ত ট্রান্সফিউজ করতে না পারি। যাতে আপনার মৃত্যু নিশ্চিত করা যায়। আমি সত্যি সত্যি ব্যাগে রক্ত ভরেছিলাম। সত্যি বলছি। আমি এত বুড়ো হইনি। হতে পারে আমাকে এখন এডাল্ট ডায়াপার পড়তে হয়, কিন্তু তাই বলে এত ভুলো মন হইনি। ও টাইপের রক্ত। আইভি টিউবিং। সব আমি ব্যাগে ভরেছিলাম।”

“অ্যাঁ? কি বললেন, আপনি ডায়াপার পড়েন?” সুগুয়ো হাঁ হয়ে জিজ্ঞেস করল।

“আরে সেটা মজা করার জন্য বললাম। সেফ একটা কৌতুক।” ডাঃ ওমোজ মুখ টিপে হাসলেন।

এটা হাসার কোন সময় হল? এক মুহূর্তের জন্য আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু টিউবিং শব্দটা আমাকে আবার চিন্তায় ফেলে দিল। আমার মাথার ভেতরে সবকিছু সাদা রূপ ধারন করতে শুরু করে দিয়েছিল, কিন্তু তার মধ্যেও সেই ছোট বাল্বটা আরেকবারের জন্য জ্বলে উঠল।

কিন্তু আমি তা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। একবার চিন্তা করেছিলাম যে এরকম কিছু আমার সাথে হতে পারে কিন্তু বিশ্বাস করতে পারিনি যে তা আসলেই সত্যি হবে।

“আমি আনন্দিত যে তোমার জন্য বেশ বড় একটা ইনস্যুরেন্স পলিসি নিয়ে রেখেছিলাম, বাবা,” চেহারায় স্বস্তি নিয়ে নাগায়ো বলল। আমার মেজাজ খারাপ ছিল কিন্তু কিই বা করার ছিল। ক্ষত দিয়ে রক্তের সাথে সব শক্তিও বেরিয়ে গিয়েছে। কথা বলার মত কোন শক্তিও আর অবশিষ্ট নেই। কিন্তু আমার চোখগুলো তখনও খোলা ছিল। কোনরকমে আমার বড় পুত্রের দিকে সেগুলো ঘোরাতে সক্ষম হলাম।

“তুমি নিশ্চয়ই একটা ঠিকঠাকভাবে করা উইল রেখে যাচ্ছ, নাকি?” অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে কোনরকমে মাথাটা একটু নাড়িয়ে নড় করতে পারলাম। এটা সত্যি যে বেশ কয়েক বছর আগেই আমি আমার লইয়ারের সাথে বসে আমার সম্পত্তি ভাগাভাগির ব্যাপারটা সেরে ফেলেছিলাম। আমার সবকিছু আমার দুই পুত্র আর স্ত্রীর মধ্যে সমান ভাগে বন্টন করে দিয়েছি।

মৃত্যু আস্তে আস্তে আমার চোখের পাতাগুলোকে গ্রাস করে নিতে শুরু করল। অবশেষে, আমি ভাবলাম। আমার মৃত্যুর মুহূর্ত উপস্থিত টের পেয়ে সবাই সোফাকে ঘিরে ধরে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। নাগায়ো আর সুমাকোর চোখে আশা আর প্রতীক্ষার চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল। ডাঃ ওমোজির অভিব্যক্তি বেশ জটিল মনে হচ্ছিল। তবে সুগুয়ো রুমের অন্য মাথা থেকে আমার কাছে এল, আর চোখ টিপল। সেটা দেখা মাত্র সব প্রশ্নের উত্তর পরিস্কার হয়ে গেল আমার কাছে।

সুগুয়ো কিভাবে আমাকে খুনের পরিকল্পনা করেছিল তা আমি আর কখনোই জানতে পারব না। ওর ছোটবেলার কথা আমার মনে পড়ল, জড়সড় অবস্থায় আমাকে কার্ডের জাদু দেখিয়েছিল। আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম, ওর প্রশংসা করেছিলাম, ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে সুখি মানুষ। সেটাই হয়ত ছিল বাবা-পুত্রের সম্পর্কের শেষ অভিব্যক্তি।

আমার জেনে শান্তি লাগল যে ওর মাথার ভেতর অন্তত এই বুড়োকে খুন করার মত মগজ আছে। আমি সবসময় ওকে দুর্বল আর কাপুরুষ ভেবেছি, কিন্তু এখন আমার মনে হল ওর হাতে কোম্পানিটা নিরাপদেই থাকবে।

আমার ধারণা ও এই ট্রিপ শুরুর আগেই এই পরিকল্পনা সেরে রেখেছিল। লজে আসার সময় পথেই কোথাও ডাঃ ওমোজির ব্যাগ খালি করে ফেলেছিল-সম্ভবত আমরা যখন ট্রেনে উঠছিলাম, তখনই।

পরদিন ভোরে পাঁচটার সময় বরাবরের মত ঘুম থেকে উঠলাম আমি। পরিবারের প্রত্যেকটা সদস্য আমার এই অভ্যাসের কথা জানে। কিন্তু তার আগেই সুগুয়ো আমাকে খুনের সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল।

আইভি টিউব আর সংরক্ষিত রক্ত নিয়ে ও বাড়ির বাইরে গিয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে আমার ঘুমন্ত শরীরে আমারই ও-টাইপ রক্ত ছিটিয়ে দিয়েছিল। সবাই জানত আমার রুমের জানালা কয়েক সেন্টিমিটারের বেশি খোলা যায় না, আমি সবসময় এটা নিয়ে চিল্লাচিল্লি করতাম।

তারপর ও টিউবিং আর রক্তের বোতল সরিয়ে ফেলে লিভিং রুমে ফিরে আসে আর অ্যালার্ম ক্লক বাজার জন্য অপেক্ষা করে। আমি কখনোই জানতে পারব না ও কেন একটা হুইপ ক্রিম লাগানো ছুরি ব্যবহার করল, কিংবা সুমাকো যদি সেটা না কিনতে চাইত তাহলে ও কি করত। যাই হোক, পাঁচটার সময় আমি জেগে উঠলাম।

জানালার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো যখন ঢুকল তখন আমি খেয়াল করলাম রক্তে মাখামাখি হয়ে আছি। আমাকে চিৎকার করতে প্রথম শুনেছিল সুগুয়োই, আর ও ওর স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী খেলতে থাকল। দরজা ধাক্কাতে লাগল, আমাকে লক খুলতে বলল। আমার শরীরে ক্ষত কোথায় হয়েছে তা পরীক্ষা করার নাম করে পেছন থেকে ছুরি বসিয়ে দিল। যেহেতু আমি কোন ব্যথা অনুভব করতে পারি না তাই অদ্ভুত হলেও আমি ব্যাপারটা খেয়াল করিনি।

সোফায় শুয়ে আমি আমার দিকে নিচু হয়ে তাকিয়ে থাকা চার জনের মুখের দিকে তাকালাম। ওদের মাথা ছাড়িয়ে ফুরোসেন্ট বাতির আলোটাকে অনেক বেশি উজ্জ্বল মনে হচ্ছিল। আমি হাসলাম, আর অন্যদের থেকে একটু আলাদা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুগুয়ের দিকে মুখ করে একটা শব্দহীন ইঙ্গিতের মাধ্যমে জানিয়ে দিলাম, “আমি জানি।”

“কেন, কেন সে হাসছে এভাবে?” সুমাকোর হতবুদ্ধি গলা আমার কানে এল। বুক ভর্তি শান্তি নিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করলাম আমি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *