৬. কণ্ঠ

কণ্ঠ

প্রস্তাবনা

ইদানিং আমার বোন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়েই কুকুর নিয়ে হাঁটতে বেরিয়ে যায়। নভেম্বরের শেষ, তাই বেশ ঠান্ডা পড়েছে। দরজা খুললে সকালের ঠান্ডা বাতাস ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে।

সেদিন সকালে সে বরাবরের মত বাইরে যাওয়ার জন্য ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে দরজার দিকে যাচ্ছিল। আমি টেবিলে বসে নাস্তা খেতে খেতে খবরের কাগজের ‘শোক সংবাদ’ পড়ছি।

মা একটু আগেই ঘরের কোনায় একটা কেরোসিন হিটার জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। যে কারনে তেলের গন্ধে সারা ঘর ভাসছে। গন্ধে মনে হচ্ছিল মাথার ব্রেইনসেল মরে যাচ্ছে। আর সেই মুহূর্তেই একটা আর্টিকেল পড়ল আমার চোখে। হিটার থেকে বের হওয়া কার্বন মনোক্সাইড বিষক্রিয়ায় এক শিশুর মৃত্যু।

জানালাটা খুলে দিয়ে ঘরের ভেতরে ঠান্ডা বাতাস ঢুকতে দিলাম, গন্ধটা বেরিয়ে যাক। জানালা ঠান্ডায় ঘেমে ঘোলাটে হয়ে ছিল, বাগানের ভেতর কুয়াশা।

জানালার বাইরে দেখলাম আমার বোন দাঁড়িয়ে আছে। সোয়েটার আর স্কার্ফ দিয়ে নিজেকে পুরো মুড়িয়ে ফেলেছে।

জানালা খোলার সময় আমাদের চোখাচোখি হলে ও হাত নাড়াল। কুকুরটা ওর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। ওটার কলারের সাথে লাগানো একটা রশির আরেক মাথা আমার বোনের হাতে ধরা।

“আমি ওকে বের করতে পারছি না। উঠোনের উপর কিছু একটা ওর পুরো মনোযোগ টেনে ধরে রেখেছে, কুকুরটাকে দেখিয়ে বলল সে। কুকুরটা আমাদের উঠোনের দেয়াল আর পাশের বাসার দরজার মাঝের মাটি শুঁকতে শুঁকতে থাবা মারছিল। যেন খুঁড়ে দেখতে চায়।

“আহহা আমাদের হাতে সময় নেই! চল বের হই!” ও রশি ধরে টানতে লাগল কুকুরটাকে। হেঁটে আসার পর স্কুলের জন্য তৈরি হতে হবে ওকে। কুকুরটা মনে হলো ওর কথা বুঝতে পেরেছে। ওর পিছু পিছু গেল। বাতাসে ওদের নিঃশ্বাস ধোঁয়ার মত দেখাচ্ছিল।

মা আমাকে বলল জানালাটা বন্ধ করতে। আমি জানালাটা লাগিয়ে বাগানে গেলাম। বাগানের সীমানায় একটা বড় পাথর ছিল, সেটা টেনে এনে কুকুরটা যে জায়গাটা খোঁড়ার চেষ্টা করছিল সেখানে রাখলাম। আশা করা যায় এরপর আর চেষ্টা করবে না। আমি চাই না ও সেখানে খোঁড়াখুঁড়ি করুক। আর কয়েক মিনিট খুঁড়লেই একগাদা কাটা হাত বেরিয়ে পড়ত আমার বোনের সামনে। এই বছরের শুরুতে আমি সেগুলো ওখানে পুঁতে রেখেছিলাম। ওগুলো নিয়ে বাসায় ফেরার পর নিরাপদ কোথাও লুকিয়ে রাখা দরকার ছিল। আর আমার বোনের তো এসব অস্বাভাবিক জিনিস খুঁজে পাওয়ার বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে, আবারো সেই প্রমাণ পাওয়া গেল।

ভেতরে গিয়ে খবরের কাগজের বাকিটা পড়লাম। মা জানতে চাইল ইন্টারেস্টিং কোন খবর আছে কিনা, আমি মাথা নাড়লাম। কিটাযাওয়া হিরোকো সম্পর্কে নতুন কিছু নেই খবরে।

সাত সপ্তাহ আগে আমাদের এলাকার কাছেই একটা পরিত্যক্ত বিল্ডিঙে কিটাযাওয়া হিরোকোর লাশ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। পরিত্যক্ত বিল্ডিংটা এককালে একটা হাসপাতাল ছিল। জায়গাটা শহরের সীমানার মধ্যে হলেও আশেপাশে কোন কিছু ছিল না। জায়গাটা ছিল সিটি সেন্টারের পরে পাহাড়ি এলাকার দিকে একটা নুড়ি বিছানো পথের শেষ মাথায়। মরচে ধরা চেইন লিঙ্ক বেড়া দিয়ে পুরো জায়গাটা ঘেরা ছিল। বিল্ডিংটা ভেঙে না ফেলে কেন ফেলে রাখা হয়েছিল কে জানে। বছরের পর বছর পরিত্যক্ত থাকায় বিল্ডিঙের আশেপাশে মরা ঘাস ছাড়া আর কিছু ছিল না।

এলিমেন্টারি স্কুলের তিনটা বাচ্চা বিল্ডিংটা ঘুরে দেখতে গিয়ে কিটাযাওয়া হিরোকোর লাশ খুঁজে পায়। তিনজনকেই এখন কাউন্সেলিং নিতে হচ্ছে।

লাশটা খুঁজে পাওয়ার পর সমস্ত টিভি চ্যানেল আর খবরের কাগজ কেসটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরে। কিন্তু এখন তাদের আগ্রহে ভাটা পড়েছে। খবর কমতে কমতে প্রায় নাই হয়ে যাচ্ছে। ফলে তদন্তের অগ্রগতি কতদুর তা জানার এখন আর উপায় নেই।

খবরের আর্টিকেলগুলোতে মেয়েটার একটা ছবি আর কিভাবে তার লাশ পাওয়া গিয়েছিল সেই গল্প ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আমি আর্টিকেলগুলো পত্রিকা থেকে কেটে জমিয়ে রেখেছি।

ছবিটা তোলা হয়েছিল যখন সে জীবিত ছিল তখন। হাসিখুশি একটা মেয়ে, সাদা দাঁতগুলো ঝলমল করছে, কালো লম্বা চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমে গিয়েছে। এই ছবিটা ছাড়া আর কোন ছবি দেখানো হয়নি কোথাও।

পুলিশ কি জানতে পেরেছে কে মেয়েটাকে খুন করেছে?

সেদিন সন্ধ্যায় যখন ক্লাস শেষ হলো, ততক্ষণে বাইরে অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। ফুরোসেন্ট লাইটগুলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, জানালায় আলো

প্রতিফলিত হয়ে আয়নার মত দেখাচ্ছে। ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীরা সবাই দৌড়ে রুম থেকে বের হলো। জানালার দিকে তাকিয়ে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, ছেলেমেয়েদের স্রোতের মধ্যে একটা অবয়ব অনড় বসে আছে। মেয়েটার কালো চুলগুলো লম্বা আর সোজা। ত্বকের রঙ এতটাই ফ্যাকাসে যে দেখে মনে হয় বরফের তৈরি। মেয়েটার নাম মোরিনো ইয়োরু।

ক্লাসে শুধু আমরা দু-জন রয়ে গেলাম।

“তুমি কি কিছু বলতে চাও?” আমি জানতে চাইলাম। লাঞ্চের পর আমার কানে ফিসফিস করে বলেছিল ক্লাসের পরে থাকতে।

“লাশের একটা ছবি পেয়েছি।”

সবার জীবন যার যার মত করে চলে। আপনি যদি একশজন মানুষকে বেছে নেন, তাহলে এক ধরনের জীবনধারা পাবেন। আর সবাই নিজেদেরটা বাদে অন্যদের জীবনধারা বুঝে উঠতে সমস্যায় পড়ে।

মোরিনো আর আমার জীবনধারাও অন্যরকম। সাধারণের চেয়ে আলাদা। মৃতদেহের ছবি আদান-প্রদান করা এই জীবনধারার সাধারণ একটা অংশ।

ও ওর ব্যাগের থেকে লেটার সাইজের একটা কাগজ বের করল। কাগজটার উপর চকচকে একটা ব্যাপার ছিল। বোঝাই যাচ্ছিল সাধারণ কোন কাগজ নয়, ছবি প্রিন্টের জন্য এই কাগজ ব্যবহার করা হয়।

ছবিতে একটা খোলা কংক্রিট রুম দেখা যাচ্ছে। প্রথম যা আমার চোখে পড়ল তা হলো সবকিছু কেমন যেন লাল হয়ে আছে।

ছবির মাঝামাঝি একটা টেবিল রাখা, ওটার উপরের অংশও লাল। আশেপাশের মেঝেও লাল। সিলিং এবং দেয়ালও…উজ্জ্বল লাল নয়, একটু গাঢ় ধরনের লাল, আলো জ্বালালে রুমের কোনায় যেরকম অন্ধকার হয় অনেকটা সেরকম।

মেয়েটাকে টেবিলের উপর রাখা ছিল।

“কিটাওয়া হিরোকো?” আমি জানতে চাইলাম।

মোরিনোর ভ্রূ কিছুটা উঁচু হলো। না খেয়াল করলে বোঝা যেত না। এভাবে সে অবাক হওয়া প্রকাশ করে।

“তুমি ধরতে পেরেছ তাহলে!”

“ইন্টারনেটে পেয়েছে এটা?।”

“একজন দিয়েছে আমাকে। পাবলিক লাইব্রেরিতে বসে মেয়েটার খবরের আর্টিকেলগুলো কাটছিলাম তখন একজন এসে দিয়েছে। হ্যাঁ ঐ মেয়েটারই ছবি এটা, কিন্তু তোমার জায়গায় আমি হলে অনুমান করতে পারতাম না।”

মোরিনো ইয়োরু দেখতে সুন্দরি। তাই অন্য স্কুলের ছেলেরাও এসে গায়ে পড়ে ওর সাথে খাতির জমানোর চেষ্টা করে। আমাদের স্কুলের কেউ ওর ধারে কাছে যায় না, সবাই ভালো করেই জানে এসবে ওর কোন আগ্রহ নেই।

যাই হোক, কেউ একজন ওকে লাইব্রেরিতে বসে এইসব অস্বাভাবিক খবর সংগ্রহ করতে দেখেছে আর সেটাকে সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে।

সে আমার হাত থেকে ছবিটা নিয়ে চোখের কাছে নিয়ে ভালো করে দেখল। “তুমি কি করে এক দেখাতেই বুঝলে এটা ওর ছবি?”

“ছবিতে মেয়েটাকে…মানুষ হিসেবে বুঝতে পারার অবস্থা নেই।” মোরিনো বিড়বিড় করে এরকম কিছু বলল, আমি অনুমান করে নিলাম।

“ছবিতে কিটাযাওয়া হিরোকোর মাথাটা টেবিলের উপর রাখা। চুলের স্টাইল আর গঠন দেখে আমি অনুমান করে নিয়েছি ছবিটা ওর।”

“ওহ্, আচ্ছা,” সে বলল।

ছবিটা যে দিয়েছে তার সম্পর্কে জানতে চাইলাম, কিন্তু মোরিনো কোন উত্তর দিল না।

বাসায় গেলে ইন্টারনেটে সার্চ করে দেখতে হবে।

জানালার দিকে তাকালাম, অন্ধকার ছাড়া বাইরে কিছু দেখা যাচ্ছে না। অনন্ত গভীর আঁধার। ক্লাসরুমের ভেতরটা সাদা আলোয় উজ্জ্বল হয়েছিল। জানালার প্রতিফলনে বেঞ্চগুলোকে বাইরের আঁধারে ভাসমান মনে হচ্ছিল।

“পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ আছে-যারা খুন করে আর যারা খুনের শিকার হয়।”

“হঠাৎ এই কথা? কি বলতে চাইছ?”

ব্যাপারটা পরিস্কার যে কিছু মানুষ অন্য মানুষদের খুন করে কোনরকম কোন কারণ ছাড়াই। আমি জানি না এর পেছনে তাদের বেড়ে ওঠার কোন কারণ কাছে কিনা, নাকি তারা জন্ম থেকেই এরকম। সমস্যা হলো, এই লোকগুলো তাদের আসল চেহারা লুকিয়ে রাখে, সাধারণ মানুষের ভেতর সাধারন মানুষের মতই বসবাস করে। তারা এমনভাবে লুকিয়ে থাকে যে অন্য মানুষের সাথে তাদের কোন পার্থক্য চোখে পড়ে না।

কিন্তু একদিন, তাদের সামনে খুন করা ছাড়া আর কোন পথ খোলা থাকে না। সাধারণ জীবন থেকে বেরিয়ে শিকার ধরতে যেতে হয়।

আমি নিজেও এরকম একজন মানুষ।

আমি অনেক খুনির চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেছি। ঐ চোখগুলোকে মাঝেমাঝে মানুষের চোখ বলে মনে হয় না, অন্য কিছু মনে হয়। পার্থক্যটা খুবই সামান্য, চোখে না পড়ার মতই, কিন্তু তাদের চোখের ভেতরে কোথাও থেকে অপার্থিব কিছু একটা বিচ্ছুরিত হয়।

যেমন বলা যায়, যখন কোন সাধারন মানুষ আমার সাথে কথা বলে তখন তারা বিশ্বাস করে যে আমি একজন মানুষ আর একজন মানুষের মতই আচরণ করে।

কিন্তু খুনিদের সাথে আমার সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা ভিন্ন রকমের। আমি যখন তাদের চোখের দিকে তাকিয়েছি, আমার মনে হয়েছে তারা যেন আমাকে একটা বস্তু হিসেবে দেখছে, একজন জীবিত মানুষ হিসেবে নয়।

“তো…”

আমি মোরিনোর প্রতিফলনের দিকে তাকালাম।

“তুমি নিশ্চয়ই ওকে খুন করনি, নাকি করেছ..?” ছবির মেয়েটার চুল রঙ করা আর কোঁকড়ানো-খবরের কাগজের ছবিটার সাথে কোন মিল নেই। তাহলে তুমি কিভাবে জানলে এটা কিটাযাওয়া হিরোকোর ছবি?”

মোরিনোর কথা শুনতে শুনতে আমার মনে হলো ওর মাথা আজকে ভালোই কাজ করছে।

ওর চোখে খুনিদের চোখে দেখা অপার্থিব বিচ্ছুরণের কোন চিহ্ন নেই। ও মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখে। মনে হয় না ও কখনো কোন মানুষকে খুন করতে পারবে। অন্য মানুষের তুলনায় ওর আগ্রহ হয়তো একটু অন্যরকম, কিন্তু তারপরেও ও একজন স্বাভাবিক মানুষ।

মোরিনো আর আমার মধ্যে অনেক কিছুতে মিল থাকলেও এই ব্যাপারটায় পার্থক্য আছে। খুবই মৌলিক পার্থক্য, মনুষ্যত্ব আর…অন্য কিছুর পার্থক্য।

সে একজন মানুষ, যেই পক্ষ সবসময় শিকার হয়। আমি ঐ পক্ষের নই।

“আরেকটা ছবি আছে, ওর চুলের স্টাইল বদলানোর পর তোলা। মেয়েটার পরিবারের অনুমতি ছাড়া ছবিটা ছাড়া হয়েছিল, যে কারনে খুব বেশি লোক দেখেনি। ঐ ছবিটা দেখে আমি মিলটা ধরতে পেরেছি।”

“ও আচ্ছা, সে আমার অজুহাত গ্রহণ করল।

আমি বাসায় গিয়ে আমার রুমের কম্পিউটার অন করলাম। কিটাযাওয়া হিরোকোর লাশের ছবি ইন্টারনেটের সবখানে খুঁজলাম। রুমের বাতাস বাসি

আর ভারি হয়ে উঠল। আমি কিছুই খুঁজে পেলাম না।

বুককেসের পেছনে লুকানো ছুরিগুলো বের করলাম। ব্লেডের উপর আমার চেহারার প্রতিফলন দেখছি। বাইরের বাতাসের শব্দ কানে আসছে। শুনে মনে হচ্ছিল ছুরিগুলো দিয়ে খুন করা মানুষগুলোর আর্তনাদের শব্দ।

কেন জানি মনে হয় ছুরিগুলোর নিজস্ব কোন শক্তি রয়েছে আর তার আমাকে ডাকছে। কিংবা হতে পারে আমার মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা গোপন বাসনা ছুরির চকচকে ব্লেডে প্রতিফলিত হচ্ছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে অন্ধকারে ফুটে থাকা শহরের আলো দেখা গেল। উপরে ফ্যাকাসে রঙা আকাশ।

আমার হাতে ধরা ছুরি থেকে একটা শব্দ ভেসে এল যা ছুরি হওয়ার কথা নয়। মনে হচ্ছিল যেন ছুরিটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠার শব্দ পাচ্ছিলাম।

মোরিনোকে মিথ্যে বলেছি আমি। কিটাওয়া হিরোকোর নতুন হেয়ারস্টাইলের কোন ছবি কোথাও ছাড়া হয়নি।

মাঝেমাঝে আমার পরিবারের লোকজন কিছুদিনের জন্য বাসায় থাকে না। বাবা হয়তো কোন বিজনেস ট্রিপে যায়। কিংবা মা তার কোন বন্ধুর সাথে কোথাও ঘুরতে যায়। এরকম সময়ে বাসাটাকে অদ্ভুত রকমের খালি খালি লাগে। চারজন যখন বাসায় একসাথে থাকি তখন কিন্তু এরকম লাগে না। আমি যখন ফিল্ড ট্রিপে বাইরে গিয়েছিলাম তখন আমার বাবা-মা, বোনেরও এরকম অনুভূতি হয়েছিল। কেমন যেন কি জানি একটা নেই ধরনের অনুভূতি। যখন পরিবারের সদস্য আবার বাসায় ফিরে আসে তখন সবকিছু আবার ঠিক হয়ে যায়। বাসার সাইজটা আমাদের জন্য ঠিক ছিল, আরামদায়ক কিন্তু ছোট। যে কারনে প্রতিবার টিভির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আপর ছড়িয়ে রাখা পায়ের সাথে হোঁচট খেতে হতো।

আমরা চারজন ছিলাম…কিন্তু এখন যখন আপু আর কখনো ফিরে আসছে না, টেবিলে সবাই একসাথে বসলে সবসময় একটা অতিরিক্ত চেয়ার রাখা হয়।

কেউ জানে না কেন আমার বোন খুন হয়েছে। আমার বড় বোন, কিটীযাওয়া হিরোকো, সাত সপ্তাহ আগে খুন হয়েছে। ওর সাথে আমাদের শেষ দেখা হওয়ার বারো ঘন্টা পর ওকে খুন করা হয়েছিল। আর লাশটা পাওয়া গিয়েছিল শহরের শেষ মাথার এক পরিত্যক্ত হাসপাতালে।

ঐ হাসপাতালের ভেতরে আমার কখনো যাওয়া হয়নি। কিন্তু একবার বাইরে থেকে দেখেছিলাম, আপুর লাশ পাওয়া যাওয়ার পর। শীতল একটা জায়গা, মরা ঘাস ছাড়া আর কিছু নেই। মাটিতে নুড়ি বেছানো, বাতাসে বালি উড়ে আমার জুতো সাদা হয়ে গিয়েছিল। হাসপাতালটা বিশাল ছিল, পরিত্যাক্ত একটা কংক্রিটের দালান, যেন একটা গুবরে পোকা। জানালার সব কাঁচ ভাঙা, ভেতরটা অন্ধকার।

আমার বোনের লাশ পাওয়ার পর সেখানে গিয়েছিলাম। যে কারনে প্রবেশপথ আটকানো ছিল টেপ দিয়ে। ভেতরে যাওয়া আসা করছিল।

কিছু বাচ্চাকাচ্চা সেখানে লাশটা খুঁজে পেয়েছিল। পুলিশ কাউকে কোন তথ্য দেয়নি, তবে যে রুমে ওকে পাওয়া যায় সেটা ছিল একটা অপারেটিং চেম্বার।

লাশের দেহ এতটাই ক্ষগ্রিস্ত হয়েছিল যে পরিচয় জানার কোন উপায় ছিল না। ব্যাগটা কাছাকাছি পাওয়া যাওয়ার পর পুলিশ আমাদের সাথে যোগাযোগ করে। আমার মা ফোনটা ধরেছিল।

সময়টা ছিল দুপুরের কাছাকাছি, আপুকে শেষ দেখার পর একদিনও পার হয়নি তখনও। যে কারনে আমার মা প্রথমে ভেবে নিয়েছিলেন কেউ ফোনে তার সাথে শয়তানি করছে।

কিন্তু লাশটা নিশ্চিতভাবে আমার বোনেরই ছিল। আমরা যারা ওর কাছাকাছি মানুষ-বাবা, মা, আমি, আমার বোনের বয়ফ্রেন্ড আকাগি, আমরা ওকে সনাক্ত করিনি। মেডিক্যাল চার্ট আর জটিল ফরেনসিক টেস্ট থেকে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে।

ও কিভাবে খুন হয়েছিল কিংবা কি অবস্থায় ওকে পাওয়া গিয়েছিল সে ব্যাপারে পুলিশ তেমন কোন তথ্য প্রকাশ করেনি। সবাই শুধু এটুকুই জানত যে ওকে গলায় ফাঁস দিয়ে খুন করা হয়েছিল তারপর কোন ধরনের চুরি দিয়ে কাটা হয়েছিল। এইটুকু তথ্যই হৈচৈ ফেলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল, কিন্তু আসল ঘটনা এরচেয়ে অনেক বিভৎস ছিল।

পুলিশের ধারণা সত্য প্রকাশ পেলে সমাজের উপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে, যে কারনে তারা সবকিছু গোপন রেখেছিল। এমন কি যেসব বাচ্চাকাচ্চা লাশটা খুঁজে পেয়েছিল তাদেরকেও মুখ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছিল।

আমার বাবা-মা দাবি করেছিলেন তাদেরকে লাশ দেখাতে হবে। পুলিশ তা চায়নি। লাশের যে অবস্থা ছিল তা কাউকে দেখানো সম্ভব ছিল না। তারা বলেছিল না দেখলেই বরং আমাদের জন্য ভালো হবে।

যখন আমার বোন জীবিত ছিল আমার বাবা-মা তখন তাকে খুব ভালোবাসত বলে আমার মনে হয়নি। ওদের ভেতর সম্পর্কটা ছিল খুবই সাধারণ ধরনের-টিভি কমার্শিয়াল নিয়ে কথা বলা, খবরের কাগজ কোথায় গেল সেই নিয়ে কথা চালাচালি…ইত্যাদি। আমরা এরকম ধরনের পরিবার। তারা কখনো বাইরের লোকের কাছে মেয়েকে নিয়ে বড়াই করেনি, তারা ওকে কতখানি ভালবাসত তা আমি জানতামও না। অন্তত মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর তাদের কান্না না দেখা পর্যন্ত।

“দয়া করে ওকে দেখতে দিন!” আমার বাবা মরিয়া হয়ে অনুনয় করলেন। তার মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল, ক্ষিপ্ততার লক্ষণ। যখন পুলিশ আর ডাক্তার বুঝতে পারল কোনভাবেই আমার বাবা-মা কে আটকানো যাবে না, তখন লাশ যেখানে রাখা ছিল সেখানে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাদের ঢুকতে দিতে বাধ্য হলো।

তাদেরকে হলের ডাবল দরজা দি য়ে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখলাম। আমি নিজে প্রচণ্ড আতংকিত হয়ে পড়েছিলাম, বুঝতে পারছিলাম না কিভাবে কেউ সাহস করে লাশটা দেখতে চাইতে পারে।

একজন ডাক্তার আর ডিটেক্টিভের কথাবার্তা শুনে ফেলেছিলাম। তারা টের পায়নি যে আমি সিঁড়ির ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছি।

ডিটেক্টিভটা বলছিল সবগুলো টুকরো সংগ্রহ করতে তাদের কত সময় লেগেছিল।

মেঝেতে আমার জুতো লেগে শব্দ হওয়ায় সে ঘুরে দাঁড়ায় আর আমাকে দেখে ফেলে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে ঠোঁট কামড়ে ধরে।

টুকরো। আমার বোনের শরীরের টুকরো। আমি দাঁড়িয়ে থেকে তথ্যগুলো হজম করার চেষ্টা করছিলাম।

বাবা-মা যখন মর্গ থেকে বেরিয়ে এলেন আমি লাশের ব্যাপারে তাদের কাছে জানতে চাই, কিন্তু তারা পুরোপুরি বাবা হয়ে গিয়েছিলেন। অথচ একটু আগেও তারা অঝোরে কাঁদছিলেন। কিন্তু রুম থেকে বের হওয়ার পর তারা আর একবারের জন্য কাঁদেননি। মনে হচ্ছিল তারা যেন তাদের সকল অনুভূতি ঐ রুমটায় রেখে এসেছেন। তাদের চেহারাগুলো অদ্ভুত রকমের হলদেটে দেখাচ্ছিল, যেন অনুভূতিশূন্য কোন মুখোশ পড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

পুলিশ মৃতদেহ সম্পর্কে কিছু জানায়নি যে, কারনে তথ্যের অভাবে খবরের কাগজের আগ্রহও শিগগিরি নিচের দিকে পড়তে শুরু করে। খুনের সাত সপ্তাহ পর পুলিশ এবং প্রেস উভয়ই আমাদের বাসায় আসা থামিয়ে দেয়।

***

আমার বোন ছিল আমার চেয়ে দু-বছরের বড়। যখন খুন হয় তখন বয়স ছিল মাত্র বিশ।

ফিফথ গ্রেডে পড়ার সময় আপু জুনিয়র হাই শুরু করেছে মাত্র। নতুন ইউনিফর্ম পরা শুরু করেছে। আমি যখন এইটথ গ্রেডে উঠলাম, সে তখন হাই-স্কুলে তার সামনে উন্মুক্ত নতুন পৃথিবী নিয়ে কথা বলছে। আমি সবসময় দেখতে পাচ্ছিলাম দু-বছর পর আমার সামনে কি অপেক্ষা করছে। আমার বোন ছিল একটা জাহাজের মত, যা কিনা গভীর সমুদ্রে আগে আগে পথ দেখিয়ে যেত।

যদিও আমাদের বয়সের পার্থক্য ছিল দুই বছরের কিন্তু আমাদের উচ্চতা ছিল প্রায় একই রকম, আর লোকজন বলত আমরা দুজন দেখতে নাকি একই রকম। যখন আমরা দুজনেই ছোট বাচ্চা ছিলাম, একবার নিউ ইয়ার্সে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম, তখন যাদের সাথে দেখা হয়েছিল সবাই একই কথা বলেছিল আমাদের।

“মোটেও কোন মিল নেই!” আপু বলল। ওকে আমার মতই হতবুদ্ধি দেখাচ্ছিল।

আমরা যতদূর জানতাম, আমাদের দুজনের চেহারা ছিল একদম আলাদা। তাহলে মিলটা কোথায়? এই চিন্তা সবসময় আমাকে ধাঁধাঁয় ফেলত। কিন্তু তারপরেও সেই ট্রিপে, আমি যখন বাড়ির এক পাশে অন্য বাচ্চাকাচ্চাদের সাথে খেলছিলাম, একজন আন্টি পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দারুন অবাক হয়েছিলেন। বলছিলেন আমাকে নাকি মাত্র অন্য জায়গায় খেলতে দেখে এসেছেন!

যখন আমরা ছোট ছিলাম, আমার আর আপুর মধ্যে অনেক খাতির ছিল। আমরা সবসময় একসাথে খেলাধুলা করতাম। সে আমার হাত ধরে আমাকে তার বন্ধুদের বাসায় নিয়ে যেত।

সেই ব্যাপারগুলো কিভাবে বদলে গেল? আমি কবে আমার বোনের সাথে শেষ কথা বলেছি কিংবা হাসাহাসি করেছি তা মনেও করতে পারি না আর।

কয়েক বছর আগে আমাদের মধ্যে ছোট একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়। স্পষ্ট কিছু ছিল না, তাই আমাদের আশেপাশের কেউ ব্যাপারটা খেয়াল করেনি। এমনকি দূরত্ব বলার মত বড় কিছুও ছিল না। কিন্তু আপু যখন আমার সাথে কথা বলত, ওকে দেখে মনে হত কিছুটা বিরক্ত।

একবার, আমি লিভিং রুমের সোফায় বসে ছিলাম। আঙুল তুলে যে ম্যাগাজিনটা পড়ছিলাম সেটা দেখিয়ে মাত্র পড়া ইন্টারেস্টিং একটা আর্টিকেলের কথা বলছিলাম। এইটুকুই করেছিলাম শুধু। কিন্তু আপু ম্যাগাজিনের দিকে তাকাল, তারপর ওর মুখ শুকিয়ে গেল। কি জানি অস্পষ্ট কিছু বলল তারপর রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আমার মনে হলো ও আমার উপর বিরক্ত আর সেটা লুকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম না।

হয়তো আমি না বুঝে কিছু একটা করেছিলাম যে কারনে সে বিরক্ত হয়েছিল, কিংবা সে হয়তো অন্য কিছুতে মগ্ন ছিল আর আমি কথা বলে বাধা সৃষ্টি করেছিলাম। এসব বুঝ দিয়ে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম যে, এসবের পেছনে আসল কোন কারণ নেই। ওর বিরক্তি হয়তো আমার কল্পনা হয়ে থাকতে পারে কিন্তু শুধু সে সময়ই এরকম ব্যাপার ঘটেনি।

যেমন, আরেকদিন, স্কুল থেকে বাসায় আসার পর। আপু ওর এক বন্ধুর সাথে ফোনে কথা বলছিল। কর্ডলেস রিসিভারে হাসাহাসি করছিল। আমি সোফায় বসে চুপচাপ টিভি দেখছিলাম, ওর কথাবার্তায় কোন ঝামেলা সৃষ্টি করিনি।

এক সময় ওর কথা শেষ হলো। রুম হঠাৎ করে একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আমরা দুজন মুখোমুখি আলাদা আলাদা সোফায় বসে নিরবে টিভি দেখছিলাম। আমি ওকে কিছু একটা বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ওর চেহারায় এমন কিছু একটা ছিল, যে কারনে ইতস্তত করছিলাম। এক মুহূর্তে আগেও সে ফোনে অনেক মজা করছিল, আর এখন আমার সাথে একা এক রুমে মুখ গোমড়া করে আছে। সেই উষ্ণতা ওর মধ্যে থেকে উধাও হয়ে গেছে, আর আমাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে অদৃশ্য একটা দেয়াল।

আমি যদি নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করতাম তাহলে সে আমাকে থামিয়ে দিত। ওকে ক্ষিপ্ত দেখাত। আমাদের মধ্যে কোন কথা হলে ওর উত্তর হত চাঁছাছোলা ধরনের। যেন যত দ্রুত সম্ভব কথাবার্তা শেষ করার চেষ্টায় আছে। মায়ের সাথে কথাবার্তার চেয়েও দ্রুত।

আমার কোন ধারণা ছিল না কারণটা কী, যে কারনে আরো ভীত ছিলাম আমি। কিছু না বললেও আমার শরীর কিভাবে যেন আপুর মেজাজ টের পেত। আমি ওর আশেপাশে থাকতে সাহস করতাম না। ধীরে ধীরে ওর সামনে থাকা বা এক রুমে থাকা আমার উপর অনেক চাপ সৃষ্টি করত। সারাক্ষণ টেনশনে থাকতাম।

“নাটসুমি, তোমার এইটা আর পড়া ঠিক হচ্ছে না,” ছয় মাস আগে হঠাৎ আপু আমাকে বলল, যখন আমি বুকস্টোরে যাচ্ছিলাম কিছু গাইড বই কিনতে। সে আমার সাদা উলের কার্ডিগানের দিকে ইঙ্গিত করে কথাটা বলেছিল। ভালো করে দেখলে কিছু উল উঠে থাকা দেখা যায়। অনেক ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে গিয়েছিল কার্ডিগানটা।

“কিন্তু এটা আমার পছন্দ,” আমি বললাম।

“খুব ভাল,” ও মুখ ঝামটা দিয়ে আমার দিক থেকে ঘুরে বসল, যেন ওর কিছু আসে যায় না। আমার মনে হচ্ছিল দুনিয়া যেন অন্ধকার হয়ে আসছে আমার চারপাশে।

আমরা দুই বোনের হয়তো, লোকজন যেমন বলে, চেহারায় মিল থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের পছন্দ-অপছন্দ আর ব্যক্তিতু একদম দুই মেরুতে।

আমার বোন ছিল মিশুক। সারাক্ষণ হাসিখুশি। বয়ফ্রেন্ড ছিল। ওর বন্ধুরাও ওকে পছন্দ করত। বাসায় ফোন আসলে ওর ছাড়া আর কারো হওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল। অস্থির ধরনের, অনেক রকম কাজের সাথে যুক্ত, বাসায় অলস বসে থাকা ওর জন্য দুর্লভ একটা ব্যাপার। এমনকি আমার চোখে মনে হত ওর থেকে উজ্জ্বল দ্যুতি বের হচ্ছে সবসময়।

অন্যদিকে, আমি আমার পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করছি। সারাদিন কেটে যায় ডেস্কে বসে। মনে হয় যেন কত বছর আমি আমার পেন্সিলের টোকার শব্দ ছাড়া কিছু শুনিনি। কোনভাবে ফ্রি টাইম বের করতে পারলে ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়ি।

জুনিয়র হাই শুরু করার পর থেকে আপু বাসার বাইরে বেশি সময় কাটাতে লাগল। এমন সব জায়গায় যেতে লাগল যেখানে আমি কখনো যাইনি। এমন সব মানুষের সাথে সময় কাটাতে লাগল যাদের কখনো দেখিনি। ঘন্টার পর ঘন্টা আমি একা বাসায় থাকতে লাগলাম পড়াশোনা করে। শুধুমাত্র আমাকে সে টেনে বের না করলে বাসা থেকে বের হতাম না। কিন্তু এই বদলটা ছিল স্বাভাবিক, আর যতদূর মনে হয় আমি তখনো আমার সুন্দরি, হাসিখুশি, মিশুক বোনটাকে ভালোবাসতাম।

আমি প্রায়ই আপুর বাইরে ঘুরে বেরোনোর সাথে আমার বাসায় পাথরের মত বসে থাকার তুলনা করতাম। তার মানে এই না যে, আমি হীনমন্যতায় ভুগতাম, আমার বোনের জন্য আমি গর্ব বোধ করতাম আসলে।

যাইহোক, সে সম্ভবত আমাকে নিয়ে বিব্রতবোধ করত। আমি উপলদ্ধি না করলেও আমার জীবনধারা নিয়ে ওর হয়তো কোন সমস্যা ছিল।

ও ভালো মানুষ ছিল। যদিও ও আমার উপর ওর অসন্তুষ্টি সরাসরি কখনো প্রকাশ করেনি কিন্তু আমি নিশ্চিত ও সবসময় চেষ্টা করত যাতে সেটা প্রকাশ না পায়। ও কখনো আমাকে বলেনি, ও আমাকে অপছন্দ করে, ও শুধু ওর বিরক্তি ঢেকে রাখার চেষ্টা করত। যে কারনে আমার ব্যাপারটা বুঝতে অনেক সময় লেগেছিল।

হয়তো আমি যেরকম ভাবতাম সেরকমভাবে আমার বোন কখনোই আমাকে ভালবাসত না..

আমার ধারণা সত্য কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার কোন উপায় ছিল না আমার কাছে, কিন্তু এই একটা মাত্র ব্যাখ্যাই ছিল যা আমি কল্পনা করতে পারি।

কেন? এই একটা প্রশ্ন করলেই হতো, কিন্তু এখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। ও যখন জীবিত ছিল তখন কেন আমি সাহস করে প্রশ্নটা করতে পারিনি? হয়তো উত্তরটা জানলে কষ্ট হতে পারত কিন্তু তারপরেও তো সেটা এখনের এই অবস্থার চেয়ে ভালো হত?

আমার বোনের এখন উত্তর দেয়ার সব ক্ষমতা হারিয়ে গেছে আর আমি আমার প্রশ্ন নিয়ে পড়ে আছি। প্রতিবার যখন ওর কথা ভাবি, প্রশ্নটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

আপু না থাকায়, বাসাও স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। যেন রাতের পর ভোর কখন আসবে সেই অপেক্ষা চলছে, কিন্তু আসছে না। ব্যাপারটা এতটাই অন্যরকম যে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় একই জায়গা মাত্র দু-মাস আগেই একদম অন্যরকম ছিল।

বাবা-মাও বোনের মৃতদেহ দেখার পর থেকে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছেন। তাদের চেহারা অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়েছে। বেশিরভাগ সময়ই তারা সেফ চুপচাপ বসে টিভি দেখেন। টিভিতে যদি কোন কমেডি শো চলে তাহলেও তারা এক বিন্দু হাসেন না। শুধুই তাকিয়ে থাকেন। প্রতিবার তাদের দিকে তাকালে আমার মনে হয় তারা হয়তো তাদের বাকি জীবন এরকমই থেকে যাবেন।

তাদের চেহারা মনে হত সেইসব মানুষের চেহারার মত যারা বোঝার চাপে অন্য কিছু অনুভব করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।

আমার মা এখনো রান্না করেন। অভ্যাস থেকে করেন, রোবটের মত দৈনন্দিন কাজ করে যান।

কিন্তু যখন ঘরের কোনায় ধুলোবালি চোখে পড়ে তখন কান্না পায় আমার। তাদের জন্য কষ্ট হয়। আপু যখন বেঁচে ছিল তখন মা সবকিছু ঝেড়ে মুছে পরিস্কার রাখতেন। আর এখন সবকিছুর উপর ধুলোর স্তর জমে গিয়েছে। তাদের চোখেও পরছে না কিছু। তারা সম্ভবত চিন্তা করছেন তাদের মেয়ে ছোটবেলায় কিভাবে হাসত, কিভাবে তাকে প্রথম কোলে নিয়েছিল। সেই ওজনটা অনুভব করার চেষ্টা করছেন।

আর সেই নিস্তব্ধ বাড়িতে আমার উপস্থিতি কারো চোখে পড়ে না। বাবাকে যদি কিছু বলি তাহলে উনি অস্পষ্টভাবে মাথা নাড়ান খালি। অন্যদের চোখে হয়তো আমাকেও আমার বাবা-মায়ের মতই দেখায়। আমার বন্ধুরা বলেছে আমিও নাকি আর আগের মত হাসি না।

রাতের বেলা মাঝেমাঝে আপুর রুমে গিয়ে ওর চেয়ারে বসে থাকি আর নানান কিছু ভাবি। আমার রুমের পাশেই ওর রুম। ও বেঁচে থাকার সময়ে যদি আমি না বলে ওর রুমে ঢুকতাম তাহলে ও ভীষণ ক্ষেপে যেত।

এখন কেউ রুমটা ব্যবহার করে না বোঝা যায়। ডেস্কে হাত রাখলে ধুলো হাতে লাগে।

ও যখন বেঁচে ছিল আর এই চেয়ারে বসত, তখন কি নিয়ে ভাবত? আমি ওর চেয়ারে বুকের সাথে হাঁটু ভাঁজ করে বসে, আশেপাশের ফার্নিচারগুলোর দিকে তাকালাম। পর্দাগুলো সরানো ছিল, জানালার বাইরে রাতের অন্ধকার।

জানালায় আমি আমার মুখের প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছিলাম, এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হয়েছিল চেহারাটা আমার না, আপুর। পরে বুঝলাম প্রতিফলন দেখছি। আমরা হয়তো একইরকম দেখতে, নইলে এরকম ভুল মনে হবে কেন।

সেলফের উপর একটা আয়না ছিল। ওটার দিকে হাত বাড়ালাম নিজের চেহারাটা খুঁটিয়ে দেখার জন্য। আয়নার পাশে ছোট একটা সিলিন্ডারের মত জিনিস ছিল, দেখতে লিপস্টিকের মত। আয়না না নিয়ে ওটা হাতে নিলাম।

জিনিসটা ছিল লাল। রক্তের মত লাল। বিভিন্ন ধরনের পিঙ্ক কালারের আরো লিপস্টিক ছিল সেখানে। কিন্তু লালটাই আমাকে আকর্ষণ করছিল।

আয়নার দিকে তাকানোর প্রয়োজন নেই। নিজের একটা লিপস্টিক থাকাটাই আমাদের মধ্যে বড় পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। লিপস্টিকটা মুঠোয় শক্ত করে চেপে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম।

আমি জানি না বাকি জীবন আমি কী করে বেঁচে থাকব। আর সেই সময়েই, নভেম্বরের শেষের দিকে এক সন্ধ্যায় আমি আবার আমার বোনের কণ্ঠ শুনতে পেলাম।

দিনটা ছিল নভেম্বরের ৩০ তারিখ। স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে আমি একটা বড় বুকস্টোরে গিয়েছিলাম। কলেজ ভর্তি পরীক্ষার উপর একটা বই কেনা দরকার ছিল। যদিও কলেজে যাওয়ার কোন ইচ্ছাই আমার আর নেই। আপু যখন বেঁচে ছিল তখন অনেক কিছু ছিল যা আমার জানতে, শিখতে ইচ্ছা করত। এখন আর ইচ্ছা করে না। পড়াশোনা করি শুধুমাত্র আর কিছু করার নেই সেজন্য।

আমার যে বই দরকার ছিল সেগুলো ছিল দোকানের পেছনের দিকের সেলফে। সেখানে গিয়ে একদম উপরের সেলফের বাম পাশ থেকে বইয়ের নামগুলো দেখছিলাম। সেলফের ডান পাশে এসে পরের সেলফটায় খুঁজতে লাগলাম বইটা।

পাওয়া গেল না। নিচু হয়ে নিচের সেলফটায় খুঁজতে লাগলাম ডান থেকে বামে। হঠাৎ এক জোড়া কালো জুতো সরে যেতে দেখলাম। সেলফের সারিতে হারিয়ে গেল।

আমার মনে হল কেউ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নার্ভাস লাগছিল আমার। আবার সেলফের বই দেখতে লাগলাম।

এমন সময় কেউ একজন আমার পিছে এসে দাঁড়াল। ফ্লুরোসেন্ট লাইটের আলোয় আমার যে অস্পষ্ট ছায়া সেলফটার উপর পড়ছিল, সেটা বেড়ে গেল।

কোন পায়ের শব্দ আমার কানে আসেনি, অথচ তারপরেও কেউ একজন আমার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। যথেষ্ট কাছে। চাইলেই ছুঁতে পারবে এতটা কাছে। আমি তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।

আমি জানতাম সে আমাকে জাপটে ধরবে। এই দোকানে এইরকম কাহিনী আগে হয়েছে শুনেছিলাম। কিন্তু আমার গলা থেকে কোন শব্দ বের হচ্ছিল না। আমার পা দুটোও বেঈমানি করছিল। আমি এতটাই ভয় পেয়েছিলাম যে ঘুরে দেখার সাহসও পাচ্ছিলাম না। আমার পুরো শরীর পাথরের মথ শক্ত হয়ে গিয়েছিল।

“কিছু মনে করবেন না, এমন সময় কেউ একজন আমার ডানদিক থেকে বলে উঠল। একটা অল্প বয়স্ক ছেলের গলা। “আপনি মনে হয় মেয়েদের গায়ে হাত দেয়া ধরনের লোক। ঐ যে সিলিঙের সাথে লাগানো আয়নাটা দেখতে পাচ্ছেন? ঐ আয়নাতে আপনাকে খেয়াল করেছি। ভালো,ভালো, খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। কিন্তু আমাকে একটু এদিক দিয়ে ওদিকে যেতে হবে। কিছু মনে না করলে একটু সরে দাঁড়াবেন?”

তৃতীয় কেউ একজন এসেছে এই ব্যাপারটা জাদুর মত কাজ করল, আমি আবার নড়াচড়া করতে সক্ষম হলাম। আমি ঘুরে দেখি কালো ইউনিফর্ম পরাএকটা ছেলে দুটো সেলফের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে।

আমার পেছনে দাঁড়ানো লোকটা দ্রুত সরে গেল। ছেলেটার থেকে দৌড়ে পালাল। আমি খালি তার পেছন দিকটা দেখতে পেলাম। দেখে মনে হল স্যুট জ্যাকেট পরাসাধারণ একজন লোকের মত। সে এত আজবভাবে দৌড়ে পালিয়ে গেল যে আমার ভয় সাথে সাথে উবে গেল।

“ধন্যবাদ,” ছেলেটাকে বললাম।

ছেলেটা আমার চেয়ে লম্বা ছিল, আর শুকনো। কিন্তু ওর মধ্যে কিছু একটা ছিল যে কারনে ওকে দেখে দূর্বল মনে হচ্ছিল না। কালো ইউনিফর্মটা চিনতে পারলাম আমি, ঐ স্কুলের একটা ছেলেকে আমি চিনতাম।

“ধন্যবাদের কোন প্রয়োজন নেই, আমি আসলে আপনাকে সাহায্য করতে আসিনি,” সে সাদামাটাভাবে বলল, অভিব্যক্তির কোন চিহ্ন নেই চেহারায়।

“তুমি বলতে চাইছ তুমি শুধুই এদিক দিয়ে যেতে চাইছিলে?”

“আসলে তোমার সাথে কথা বলতে এসেছিলাম। তুমি কিটাযাওয়া নাটসুমি, তাইনা? তুমি দেখতে অনেকটাই তোমার বোনের মত। এক দেখাতেই চিনে ফেলেছি।”

এ ধরনের কথার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম, কি বলব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কিছু বলার আগেই ছেলেটা আবার কথা বলে উঠল।

‘হিরোকো মারা যাওয়ার আগে ওর সাথে আমার দেখা হয়েছিল। তোমার কথা সে আমাকে বলেছিল…।”

“এক মিনিট দাঁড়াও…কে তুমি?” এইটুকুই খালি আমি বলতে পেরেছিলাম।

ছেলেটা যদিও আমার প্রশ্নের উত্তর দিল না। এর বদলে ইউনিফর্মের পকেট থেকে সে একটা সাধারণ বাদামি রঙের খাম বের করল। যেরকম খাম সবজায়গায় পাওয়া যায়। খামের ভেতরে কিছু একটা ছিল, ফুলে ছিল।

“এটা তোমার জন্য,” খামটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল সে। হতভম্ব অবস্থায় খামটা হাতে নিলাম। খুলে ভেতরে দেখলাম। একটা স্বচ্ছ খাপের ভেতর ক্যাসেট টেপ দেখা গেল।

“দুঃখিত, কিন্তু তুমি ভেতরের জিনিসটা নিয়ে খামটা কি আমাকে ফেরত দিতে পারবে?” তার কথা মত আমি তাই করলাম। টেপটা বের করে খালি খামটা ফেরত দিয়ে দিলাম। সে সেটা ভাঁজ করে পকেটে ঢুকিয়ে রাখল।

সাধারণ একটা ক্যাসেট টেপ। যে কোন দোকানে কিনতে পাওয়া যায়। উপরে একটা স্টিকার লাগানো। “কণ্ঠ ১: কিটাযাওয়া হিরোকো।” লেখাটা হাতে লেখা না, প্রিন্ট করা।

“এটা কি? এখানে আমার বোনের নাম লেখা কেন?”

“সেটা শুনলে বুঝতে পারবে। কিটাযাওয়া হিরোকো যখন বেঁচে ছিল তখন এটা আমাকে দিয়েছিল। আমি চাইছিলাম জিনিসটা তোমাকে শোনাতে, তাই রেখে দিয়েছিলাম। আরো দুটো টেপ আছে। পরে দেব। অবশ্য যদি তুমি কাউকে আমার কথা বল তাহলে সেটা আর কখনো হবে না।”

ছেলেটা চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াল।

“দাঁড়াও..” আমি বললাম, ওর পেছন পেছন যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। আমার পাগুলো নড়ছিল না। একদম জমে গিয়েছিল। ঐ লোকটা যখন পিছে এসে দাঁড়িয়েছিল তখনের মত। আমি জানি না কেন আমার এরকম হয়েছিল, ছেলেটা তো আমাকে হুমকিও দেয়নি…উল্টো আমাকে উদ্ধার করেছে। কিন্তু তারপরেও আমার সারা শরীর ভেঙে পড়েছিল। আমি পুরো ঘেমে গিয়েছিলাম।

এক মুহূর্ত পর ছেলেটা সেলফের কোনা থেকে ঘুরে আমার দৃষ্টি থেকে হারিয়ে গেল। আমি ক্যাসেটটা হাতে নিয়ে একা দাঁড়িয়ে থাকলাম।

ট্রেনে চড়ে বাসায় ফেরার সময়, সিটে বসে টেপটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ততক্ষণে সূর্য ডুবে গিয়েছিল, বাইরেটা অন্ধকারে ঢাকা। জানালাগুলোতে গাঢ় অন্ধকার, যেন কয়লা ঘষা হয়েছে। বাইরের কিছু দেখা যাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল যেন ট্রেন নড়ছে না। শীতের কারনে সূর্য তখন তাড়াতাড়ি অস্ত যাচ্ছিল। আপু যখন খুন হয়েছিল তখন হয়তো বাইরে একটু আলো ছিল।

কে ছিল ছেলেটা? হাই স্কুল ইউনিফর্ম পড়া, তার মানে আমার বয়সি হবে। কিংবা আমার চেয়ে এক-দুই বছরের ছোট। সে দাবি করছিল সে আমার বোনকে চেনে। কিন্তু আপু কখনো এরকম কারো কথা আমাকে বলেনি।

যদি মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে তাদের দেখা হয়ে থাকে তাহলে সে সময় পায়নি ছেলেটার কথা বলার।

ছেলেটা বলেছে আপু ওকে টেপটা দিয়েছে। সে কি বলতে চেয়েছে আমার বোন চেয়েছিল আমি টেপটা শুনি? আর কষ্ঠ ১ : কিটাযাওয়া হিরোকো’ লেখাটার মানে কি?

ট্রেনের গতি কমে এলে অভ্যাসবশত আমার শরীর নড়ে উঠল। আমি উঠে দাঁড়িয়ে ট্রেন থেকে নেমে গেলাম।

স্টেশনের কাছে লোকজনের ভিড় থাকলেও যে মুহূর্তে আবাসিক এলাকায় পা রাখলাম, কোন জন-প্রাণী দেখা গেল না। খালি পিচঢালা রাস্তা এগিয়ে গিয়ে অন্ধকারে মিশে গিয়েছে। ঠাণ্ডা বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে আমি বাসার দিকে হেঁটে চললাম। রাস্তার ধারের বাড়িগুলো থেকেই যা একমাত্র আলো আসছিল। ওগুলোর প্রত্যেকটায় একটা করে পরিবার আছে, ডিনার টেবিলে বসা, নিজেদের মত জীবন চলে যাচ্ছে তাদের-এই তথ্যটা হঠাৎ করে আমার কাছে চমকপ্রদ মনে হলো।

আমাদের বাড়ির জানালাগুলো অবশ্য অন্ধকার ছিল। এর মানে এই না যে কেউ বাসায় ছিল না। সামনের দরজা খুলে আমি লিভিং রুমে ঢুকলাম, বাবা-মাকে জানালাম আমি বাসায় ফিরেছি।

তারা সোফায় বসে টিভি দেখছিল। কোন কথা নেই। বাতি জ্বালানোর ইচ্ছাও হয়নি তাদের। টিভির স্ক্রিন ছিল রুমের আলোর একমাত্র উৎস। আমি সুইচ টিপে আলো জ্বালালে তারা আমার দিকে ঘুরে প্রাণহীন সুরে আমাকে স্বাগতম জানালেন।

“তোমরা আবারো দরজা লক করতে ভুলে গিয়েছ,” আমি বললাম। উত্তরে আমার মা টিভির দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকালেন খালি। তার মধ্যে জীবনের কোন চিহ্ন নেই। কোন কিছুতে তার যেন আর কিছু আসে যায় না।

তারা আসলে টিভির কিছুই দেখছিলেন না। টিভিতে দেখানো কোন কিছুই তাদের চোখ পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছিল না। আমি তাদের পিঠের ভাঁজ পড়া পোশাকের দিকে একবার তাকিয়ে উপর তলায় আমার রুমে গেলাম।

ব্যাগটা বিছানার উপর ফেলে, ইউনিফর্ম না বদলেই টেপটা আমার স্টেরিওতে ঢোকালাম। স্টেরিওটা ছোট ধরনের ছিল, নীলচে রুপালি রঙের, সেলফের দ্বিতীয় তাকে রাখা ছিল। আমি ওটার সামনে দাঁড়িয়ে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম।

আপুর চেহারা আমার চোখে ভাসল-খুনের আগে সে যেভাবে আমার দিকে বিরক্ত চেহারায় তাকাত, সেই চেহারা নয়। যখন আমরা আরো ছোট ছিলাম, হাত ধরে একসাথে হাঁটতাম তখন সে যেভাবে আমার দিকে তাকাত সেই চেহারা।

প্লে বাটনে চাপ দিলাম। যান্ত্রিক শব্দ করে মোটরগুলো ঘুরতে লাগল। আমি স্পিকারগুলোর দিয়ে তাকিয়ে থাকলাম।

প্রথম কয়েক সেকেন্ড কিছুই ছিল না, সেফ নিরবতা। তার পর একটা হিস ধরনের শব্দ, বাতাসের মত। আমার হৃদপিণ্ড দ্রুত চলছিল, নার্ভাস লাগছিল।

আমি যেটাকে বাতাসের শব্দ ভেবেছিলাম সেটা তা নয়, কেউ একজন মাইক্রোফোনের সামনে নিঃশ্বাস ফেলছিল আসলে।

নাটসুমি…

হঠাৎ আমি আপুর কণ্ঠ শুনতে পেলাম। ওর গলা দূর্বল শোনাচ্ছিল। ক্লান্ত। কিন্তু নিশ্চিতভাবে কণ্ঠটা ওরই। ছেলেটা মিথ্যে বলেনি। আমার বোন সত্যি সত্যি আমার জন্য একটা টেপ রেখে গিয়েছে।

‘নাটসুমি, জানি না তুমি কখনো এটা শুনতে পারবে কিনা? এই মুহূর্তে আমি আমার সামনে রাখা একটা মাইক্রোফোনে কথা বলছি। কিন্তু জানি না এই মেসেজ কোনদিন তোমার কাছে পৌঁছাবে কিনা…’

কখন, কোথায় সে এটা রেকর্ড করেছিল? ওর গলা এত পাতলা শোনাচ্ছিল যে প্রায় হারিয়েই যাচ্ছিল। সে আস্তে আস্তে কথা বলছিল, থেমে থেমে, যেন কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। শব্দগুলোর মধ্যে দীর্ঘ বিরতি, আর কেমন যেন মরিয়া ভাব। কিন্তু এসব কিছুর কারনে ব্যাপারটা আরো সত্যি মনে হচ্ছিল। কোন স্ক্রিপ্ট করা বক্তব্য না, বরং নিজের চিন্তাকে শব্দে পরিণত করার চেষ্টা করা হয়েছে।

‘শোন, তোমাকে একটা মেসেজ দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে আমাকে বলা হয়েছে মাইক্রোফোনে আমি যা খুশি বলতে পারব, যা খুশি…কিন্তু শুধুমাত্র একজন মানুষকে। আর আমি সাথে সাথে তোমার কথা চিন্তা করেছি-আমি উপলদ্ধি করেছি তোমাকে কিছু কথা বলা আমার জন্য কতখানি জরুরি। জানি অদ্ভুত শোনাচ্ছে কিন্তু তোমার সাথে আমার কথা বলা দরকার, আকাগির সাথে নয়…’

সে মাইক্রোফোনটা আমার মুখের দিকে ধরে রেখেছে…ওর সম্পর্কে আমি কিছু বলতে পারব না, সে দেবে না বলতে। আমি দুঃখিত। সে কথা দিয়েছে মেসেজটা তোমাকে পাঠাবে। সে দেখতে চায় আমার কথাগুলো

শুনে তোমার প্রতিক্রিয়া কি হয়। আমার কাছে ব্যাপারটা আনন্দ লাভের জন্য জঘন্য উপায় মনে হলেও আমার কথাগুলো যদি তোমার কাছে পৌঁছায় তাহলে বাকি কোন কিছুতেই আমার কিছু আসে যায় না…

আমি নড়তে পারছিলাম না। একটা ভয়াবহ সন্দেহ আমার মধ্যে উঁকি দিচ্ছিল। একটা কণ্ঠ আমার মাথার ভেতর প্রতিধ্বনি তুলছিল, আমাকে সাবধান করছিল টেপের বাকিটা যেন না শুনি। দুঃস্বপ্ন অপেক্ষা করছিল আমার জন্য, আর আমি যদি মেসেজটা শুনি তাহলে ফিরে যাওয়ার আর কোন রাস্তা খোলা থাকবে না আমার সামনে। এই ব্যাপারে আমি এতটাই নিশ্চিত ছিলাম যে এর মুখোমুখি হতে পারছিলাম না, নিঃশ্বাস ফোপানির মত করে বেরিয়ে এল আমার বুক থেকে।

টেপটা বন্ধ করতে পারব না আমি। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আপুর কণ্ঠ শুনতে লাগলাম।

‘নাটসুমি, আমি এখন একটা অন্ধকার রুমে। নড়াচড়া করতে পারছি না। চারদিকে কংক্রিট…আর অনেক ঠান্ডা…একটা টেবিলের উপর আমি…’

আমি হাত তুলে আমার মুখ চাপা দিলাম, বেরিয়ে আসতে চাওয়া চিৎকারটা ঠেকাতে চাইছিলাম। আমি জানি সে কোথায় ছিল, কোথায় সে

মাইক্রোফোনে কথা বলছিল।

আপু কাঁদছিল কথা বলার সময়।

‘এই জায়গাটা…পুরনো কোন বাতিল বিল্ডিং…’

ওর মলিন কণ্ঠের কষ্টপূর্ণ একটা প্রতিধ্বনি শীতল, অন্ধকার কংক্রিটের দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলল। ওর কষ্ট আমার বুক ছিদ্র করে ফেলছিল।

অবচেতন মনে আমি টেপ ডেক স্পিকারগুলোর উপর কাঁপা কাঁপা হাতে আঙুল বোলালাম, যেন আপুর কণ্ঠ স্পর্শ করতে চাইছিলাম।

‘আমি দুঃখিত, নাটসুমি।

ওর কথাগুলো আমার আঙুলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে মিশে গেল। আঙুলে স্পিকার থেকে বের হওয়া কম্পন টের পেলাম, মনে হলো যেন ওর কণ্ঠের একটা অংশ ছিল সেটা। আপুর নিঃশ্বাসের শব্দও হারিয়ে গেল। টেপটা শেষ।

আমি টেপটা ঘুরিয়ে অন্য পাশটা চালালাম কিন্তু সে অংশটা খালি ছিল।

কোন সন্দেহ নেই, টেপটা আপু খুন হওয়ার আগের মুহূর্তে রেকর্ড করা হয়েছিল। বুক স্টোরে টেপটা নেয়ার কথা মনে পড়ল আমার। ছেলেটা একটা খামে টেপটা আমাকে দিয়েছিল, আর খামটা ফেরত নিয়ে নিয়েছিল।

সে টেপটা স্পর্শ করেনি। টেপে ওর কোন ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেই। সেইকি আপুর সামনে মাইক্রোফোন ধরে ছিল? সেইকি আপুকে খুন করেছে?

আমার উচিত টেপটা পুলিশের হাতে তুলে দেয়া। কিন্তু সেটা করার কোন ইচ্ছা আমার নেই। ছেলেটা যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিল পুলিশকে জানালে বাকি টেপগুলো আর পাওয়া যাবে না।

মেসেজে আরো কথা ছিল। আর সেই কথাগুলো আমি শুনতে চাই।

***

টেপটা শোনার পরপরই আমি আমার স্কুল ফাঁকি দিয়ে ম**** হাই স্কুলের সামনে গেলাম।

ম**** হাই স্কুল ছিল একটা সরকারি স্কুল। আমার স্কুল থেকে দুই স্টেশন পরে। স্কুলের গেটটা ব্যস্ত রাস্তার দিকে মুখ করা আর চারপাশ সুন্দর করে ছাঁটা গাঢ় সবুজ ঝোঁপের বেড়া দিয়ে ঘেরা। দেখে মনে হচ্ছে সবুজ দেয়াল। বেড়ার উপর দিয়ে স্কুলের সাদা ছাদ চোখে পড়ছে।

স্কুলের গেটের কাছাকাছি রাস্তার অপর পাশে একটা দোকান, সেখানে ম্যাগাজিন র‍্যাকের কাছে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে স্কুলের উপর নজর রাখছিলাম আমি। প্রায় এক ঘন্টার মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ার ভান করলাম। স্কুল ছুটি হলে শিক্ষার্থীরা বের হতে শুরু করল। সূর্য তখন প্রায় অস্ত যাচ্ছে।

শিক্ষার্থীরা প্রায় সবাই গেট থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হয়ে আমার সামনে দিয়েই যাচ্ছে। কারণ স্টেশন এই পাড়ে ছিল। ফুটপাথও চওড়া। আমি সবার চেহারা দেখছিলাম একজন একজন করে।

ওদের দেখতে দেখতে আমার বোনের কথাগুলো মনে পড়ছিল।

আমি অনেকবার, বার বার টেপটা বাজিয়ে শুনেছি, প্রতিবারই একইভাবে ধাক্কা খেয়েছি। ঘুম নষ্ট হয়ে গেছে আমার। বিছানায় শুয়ে খালি সিলিঙের দিকে তাকিয়ে থাকি, চিন্তা করি। কিন্তু চিন্তাগুলো কোথাও গিয়ে পৌঁছাতে পারে না।

আমার কেমন যেন হতবিহ্বল লাগছে, না ঘুমাতে পারার কারনে হয়তো? ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাতে ওলটাতে আড়চোখে ক্লার্কের দিকে তাকালাম। এতক্ষন এখানে দাঁড়িয়ে আছি সে জন্য রেগে যাচ্ছি কিনা। হয়তো সন্দেহ করছে। আমার ভয় হচ্ছিল সে আমাকে কিছু বলে কিনা।

জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে পেলাম পাঁচটা ছেলের একটা দল যাচ্ছে, হাসতে হাসতে কথা বলছে। ওদের একজনের সাথে আমার চোখাচোখি হলো।

সে দাঁড়িয়ে গেল, অবাক হয়েছে, তারপর সাথে বন্ধুদের কিছু একটা বলল। কাঁচের ভেতর দিয়ে আমি কথাগুলো শুনতে পাইনি, সম্ভবত বলল ওকে ছাড়া এগিয়ে যেতে ধরনের কিছু। তারা ছেলেটাকে রেখে চলে গেল।

আমি ওকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম।

ছেলেটা দোকানের দরজা খুলে ছুটে আমার দিকে এল। “কিটাযাওয়া? তুমি এখানে কি করছ?”

ওর নাম কামিয়ামা ইটসুকি। জুনিয়র হাই থেকে আমি ওকে চিনি। ও স্কুলের বাস্কেট বল টিমের মেম্বার ছিল, আমি ছিলাম টিমের ম্যানেজার। কুকুরছানার মত কিউট চেহারা করে রাখত ও সবসময়। সদা হাস্যজ্জল। ও আমার চেয়ে অনেক লম্বা হলেও যেভাবে আমার দিকে দৌড়ে এল তাতে ছোট কুকুর ছানার মতই লাগল আমার কাছে।

“বোল না যে তুমি আমাকে ভুলে গিয়েছ?”

ওকে আসতে দেখে আমি এতটাই নিশ্চিন্তবোধ করছিলাম যে প্রায় কেঁদেই ফেলছিলাম। হঠাৎ উপলদ্ধি করলাম কতখানি আতংকে ছিলাম আমি।

“ফালতু কথা বোল না, ভুলব কেন? অনেকদিন হয়েছে অবশ্য..”

আমার বোনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কথা ভাবলাম আমি। চারদিকে আত্মীয়স্বজন আর আপুর কলেজের বন্ধুরা। ইটসুকি আমার দিকে ছুটে এসেছিল। আমরা দু-জন আমাদের হাই স্কুল ইউনিফর্ম পড়ে ছিলাম। ও পুরোটা সময় আমাকে সঙ্গ দিয়েছিল, মন ভালো করার চেষ্টা করছিল, আমার পাশে ছিল। ব্যাপারটা আমার কাছে অনেক ছিল।

ওর ইউনিফর্মর ক্রেস্টটা আমার মাথায় ঢুকে গিয়েছিল। সেজন্য আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে ছেলেটা আমাকে টেপ টা দিয়েছিল সে যে ম*** হাই স্কুলের ছাত্র। ছেলেটার নাম যেহেতু আমার জানা নেই সুতরাং একমাত্র স্কুল দিয়েই আমি ওকে খুঁজে পেতে পারি।

“তোমাকে এখানে দেখে খানিকটা অবাক হয়েছি। কারো জন্য অপেক্ষা করছ নাকি?”

আমি ওকে বলতে চেয়েও বলতে পারলাম না যে আমি গেটের দিকে তাকিয়ে আছি, আমার বোনের সম্ভাব্য খুনি কখন বের হবে সেজন্য অপেক্ষা করছি। সুতরাং মাথা নাড়লাম। আমি জানি না আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছিল কিন্তু ও সিরিয়াস হয়ে গেল।

“কোন সমস্যা হয়েছে?” ইটসুকি প্রশ্ন করল, ওকে চিন্তিত শোনাল। “নাকি এখনো তোমার বোনের ব্যাপারে,.” ও আমার আর আপুর মধ্যের সমস্যার কথা জানত। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানে আমি ওকে সব জানিয়েছিলাম।

অন্তেস্টিক্রিয়ায়ায় রাখা আপুর ছবিটা মারা যাওয়ার অল্প কিছুদিন আগেই তোলা হয়েছিল। কিন্তু তার আগেই আমাদের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে

ছিল। আপুকে খুব সুন্দর লাগছিল ছবিটায়। সেটা দেখে আমার কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছিল।

“না আপুর ব্যাপারে না।”

“কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত তুমি? তুমি বলেছিলে আপুর সাথে কথা বলতে চেয়েছিলে,.”

“হ্যাঁ, কিন্তু…বাদ দাও ব্যাপারটা। আমি দুঃখিত তোমাকে ঐদিন এসব কথা জোর করে শুনিয়েছি।”

ইটসুকি সমবেদনার চোখে আমার দিকে তাকাল। “পুলিশ কি কিছু জানতে পেরেছে কে খুন করেছে?”

আমি ওর দিকে তাকালাম।

“তোমাকে অন্যরকম লাগছে।”

ওর সহজাত প্রবৃত্তি বেশ ভালো দেখা যাচ্ছে। আমি মাথা নারলাম। “পুলিশ এখনো কিছু..”

“হুম,” ও জোরে শ্বাস ফেলল।

সেই মূহর্তে যার জন্য অপেক্ষা করছিলাম তাকে দেখা গেল। ইটসকির সাথে কথা বলার সময় সূর্য ডুবছিল, যে কারনে বাইরে অন্ধকার হতে শুরু করেছে। কিন্তু তারপরেও ছেলেটা যখন রাস্তা পার হচ্ছিল তখন জানালা থেকে আমি ওর চেহারা পরিস্কার দেখতে পেলাম।

যদিও আমি নিশ্চিত না ছেলেটা আসলেই আপুকে খুন করেছে কিনা, কিন্তু যে মুহূর্তে ওকে দেখলাম সাথে সাথে একরাশ ভয় এসে আমাকে গ্রাস করল। মনে হল যেন হঠাৎ আমি এক দলা অন্ধকারের মধ্যে ডুবে গিয়েছি।

তারা ম্যাগাজিন র‍্যাকের সামনের জানালা দিয়ে হেঁটে গেল। ইটসুকি আমার দৃষ্টি লক্ষ্য করে বাইরে তাকাল, কি কারনে আমি হঠাৎ চুপ করে গেলাম বুঝতে চাইল।

“মোরিনো,” সে বলল।

“ছেলেটার নাম মোরিনো?”

“না, মেয়েটার নাম। সবাই চেনে ওকে। একজন টিচার ওর গায়ে হাত দিতে গিয়েছিল। ও পিটিয়ে লোকটার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল।”

ইটসুকির মত ওরাও সেকেন্ড ইয়ারের শিক্ষার্থী।

“তুমি কি ছেলেটার নাম জান?” আমি ব্যগ্রভাবে জানতে চাইলাম।

ইটসুকি একটু ভাবল। “উমম, হ্যাঁ, ছেলেটার নাম হল..”

ও একটা নাম বলল, আমি আমার মগজে ভালোমত গেঁথে নিলাম যেন কখনো ভুলে না যাই।

হাতের ম্যাগাজিনটা নামিয়ে রেখে দোকান থেকে বের হলাম। ঠান্ডা বাতাস আমাকে ঘিরে ফেলল।

দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আমি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ওদের পেছন দিকটা দেখতে পাচ্ছিলাম। স্টেশনের দিকে এগোচ্ছিল ওরা।

মেয়েটা মনে হয় টের পেয়েছিল কেউ ওদের দেখছে, কারন সে ঘুরে আমার দিকে তাকাল। আমাকে কয়েক মুহূর্ত দেখে আবার সামনে ঘুরে গেল।

দোকানের দরজা খুলে ইটসুকি বেরিয়ে এল। “ছেলেটার সাথে আমি গত বছর একসাথে ক্লাস করেছিলাম।”

“কেমন ধরনের ছেলে?”

ইটসুকি এক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল। “জানি না…সাধারণ ধরনের?”

আমি ইতস্তত করছিলাম। আমি কি ছেলেটার পিছু পিছু যাব? কিন্তু আমার সাথে ইটসুকি আছে, আর ছেলেটার সাথে মোরিনো মেয়েটা আছে। এরকম সময়ে আপুর টেপ নিয়ে কিছু জানতে চাওয়া ঠিক হবে বলে মনে হচ্ছে না। সুতরাং আইডিয়াটা বাদ দিলাম।

“কোন সমস্যা?”

আমি মাথা নাড়লাম। দুজনে একসাথে হাঁটতে লাগলাম স্টেশনের দিকে। যেদিকে ওরা গিয়েছে। ওদেরকে অবশ্য তখন আর দেখা যাচ্ছে না।

রাস্তার ধারের দোকানগুলোর নিয়ন সাইন আর সারি সারি করে রাখা ভেন্ডিং মেশিনগুলো থেকে আসা উজ্জ্বল আলো চোখে পড়ছিল। সূর্য ডুবে যাওয়ার পর শীতকালের অন্ধকার যেন অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ঘন মনে হচ্ছে। ভেন্ডিং মেশিনের আলোরই শুধু কোন পরিবর্তন নেই।

হাঁটতে হাঁটতে ইটসুকি আর আমি আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ করলাম। আমি শুধু ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে প্যাচাল পাড়লাম, কারন একমাত্র এই বিষয় নিয়ে কথা বলাই নিরাপদ মনে হলো আমার কাছে। ও অবশ্য ওর স্কুল, বন্ধু-বান্ধবি, বেড়াতে যাওয়া সবকিছু নিয়েই মজার মজার গল্প শোনাল।

সেরকম আহামরি কোন গল্প না, একজন হাই স্কুলের ছাত্র অহরহ যে ধরনের গল্প করে থাকে সেসব আর কি। কিন্তু গল্পগুলো আমাকে শান্ত করতে সাহায্য করল। হয়তো ইটসুকি আমার টেনশন বুঝতে পেরে মন ভালো করানোর চেষ্টা করছে।

গাড়িগুলো সাঁ সাঁ করে আমাদের পাশ কাটিয়ে গেল। ওগুলোর জ্বালানো হেডলাইট আমাদের মুখের উপর আলো ফেলছে। “ওখানে বসে কথা বলতে চাও?” ইটসুকি স্টেশনের সামনের একটা ফ্যামিলি রেস্টুরেন্ট দেখিয়ে বলল।

রেস্টুরেন্টের ভেতর ডিনার করতে আসা লোকজনের হাউকাউ। একজন ওয়েট্রেস আমাদেরকে পেছন দিকের একটা বুথে নিয়ে গেল। দেয়াল আর পার্টিশনগুলোতে রুপালি আল্পনা করা, আলো পড়ে ঝকমক করছে।

“তোমার বাবা-মা কেমন আছেন?” ইটসুকি জানতে চাইল।

“ভালো না, তারা বাসা ছেড়ে কোথাও যায় না।”

আমি ওকে বললাম আপু মারা যাওয়ার পর বাসার কি অবস্থা। ঘরের কোনায় ধুলো, টিভি চালানো কিন্তু লাইট নেভানো, কিভাবে তারা দরজা লক করতে ভুলে যায়।

“তার মানে তারা এখনো শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি…?”

“হ্যাঁ, বিশেষ করে আপুর লাশ দেখার পর..”

সে মাথা দোলাল। আমি ওকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় বলেছিলাম, আপুর লাশের অবস্থা আসলে পত্রিকায় যা বলা হয়েছে তারচেয়ে অনেক খারাপ অবস্থায় ছিল।

“জানি না তাদের কোন উন্নতি হবে কিনা?” বিড়বিড় করে বললাম, বাবা-মায়ের শূন্য চেহারার কথা চিন্তা করে। তাদের দেখে মনে হয় জীবনের স্ফুলিঙ্গ তাদের ভেতর থেকে আজীবনের জন্য হারিয়ে গিয়েছে।

“আকাগির কি অবস্থা?”

“অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর সে কয়েকবার এসেছিল, কিন্তু ইদানিং…”

আকাগি, আমার বোনের বয়ফ্রেন্ড…আপুর খুনের ঘটনায় বিধ্বস্তদের একজন সে। আপুর সাথে এক কলেজেই পড়ত। যদিও আমি নিশ্চিত ছিলাম না, আমি ভেবেছিলাম ওখানেই ওদের দেখা হয়েছে। আপু ওকে সাথে করে বাসায় নিয়ে আসত, আমার সাথে কয়েকবার কথা হয়েছিল। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় ও আমার বাবা-মায়ের পাশে ছিল, সান্ত্বনা দিচ্ছিল।

“হয়তো হিরোকোর খুনের জন্য আমিই দায়ি, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর ও বলেছিল। “ওর খুনের আগেরদিন আমাদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছিল, আমার রুম থেকে ছুটে বের হয়ে গিয়েছিল, তারপর,.”

পরের দিন, আপুর লাশ ঐ পরিত্যক্ত হাসপাতালে পাওয়া যায়।

আকাগিই শেষ ব্যক্তি যে আপুকে জীবিত দেখেছে।

ওরা যদি ঝগড়া না করত, তাহলে আপুর সাথে খুনির হয়তো দেখা হত না। খুনও হতে হত না আপু। আকাগি নিজের মুখ ঢেকে এরকম কিছু কথা আমাকে বলেছিল।

“আমাকে এখন যেতে হবে,” ইটসুকি বলল। ওর ট্রেনের সময় হয়ে গিয়েছে।

“আমি আরো কিছুক্ষণ থাকব।”

“ঠিক আছে, কিন্তু..” সে এক পা গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। “তোমার যদি কোন কিছু নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করে, তাহলে অবশ্যই আমাকে ফোন দিও।”

ওকে ধন্যবাদ জানালাম। ও চলে গেলে, একা বসে কফি খেতে খেতে পাশের টেবিলের পরিবারকে দেখতে লাগলাম। সরাসরি তাকাইনি, আড়চোখে দেখছিলাম।

অল্পবয়সি স্বামী-স্ত্রী, সাথে দুটো মেয়ে বাচ্চা।

আমাদের পরিবারের মত মনে হলো আমার কাছে। ছোট বাচ্চাটা বেশি ছোট, কথা বলতে শেখেনি। মুখের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে রেখেছে। চারপাশের সবকিছু বড় বড় চোখ করে দেখছে। আড়চোখে তাকানোর সময় পিচ্চিটার সাথে আমার চোখাচোখি হলো।

আপুর কথা মনে পড়তে লাগল।

আমরা যখন ছোট ছিলাম, দু-জনে একসাথে হাঁটতে গিয়েছিলাম। সম্ভবত বসন্তের কোন উষ্ণ দিন ছিল। আমি তখন মাত্রই এলিমেন্টারি স্কুল শুরু করেছি।

আমরা দুজন একসাথে পাহাড়-টিলায় চড়তাম, বাড়ির পর বাড়ি পেরিয়ে যেতাম। পাহাড়ের চূড়ায় একটা বন ছিল। সেখান থেকে আমরা নিচে পাহাড়ের ছায়ায় থাকা শহর দেখতাম-যতদূর চোখ যায় ঘোট ঘোট বাড়িঘর।

উপরে তাকালে আকাশে একটা লম্বা সাদা ডানাওয়ালা একটা পাখি দেখা যেত। একটা বড় নদী শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে গিয়েছিল। আমার অনুমান ছিল পাখিটা ওখানেই কোথাও থাকে। পাখিটা প্রায় নড়াচড়া করছিলই না। স্রেফ বাতাসে ভর দিয়ে ভেসে ছিল। বিরক্ত না হয়ে আমি ঘন্টার পর ঘন্টা পাখিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারতাম।

আপু আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, ওর দাঁতগুলো ঝকমক করে উঠল। হাসলে ওর শ্বদন্তগুলো বেরিয়ে থাকত। এমন কি বড় দাঁত উঠার পরেও। আমরা অনেক সময় ভ্যাম্পায়ার ভ্যাম্পায়ার খেলতাম। কতদিন আমি আপুকে হাসতে দেখিনি! কতদিন আমি ওর শ্বদন্তগুলো দেখিনি! কতদিন!

ও যখন চুল রঙ করালো, আমি ভাবছিলাম আমিও করাবো কিনা।

“তুমি কোরনা, তোমাকে বাজে দেখাবে,” আপু বলেছিল। আমি এরকম পরামর্শ মেনে নিতে পারছিলাম না। ওর কথার সুরে কেমন জানি। একটা ধার ছিল। আমার গায়ে বিধেছিল।

প্রতিবার সে ওরকম কিছু করলে, আমার মনে হত সে আমাকে চায় না বা কিছু। কেন ও খুন হল? যে ওকে খুন করার মত ঘৃণা করতে পারে কেউ তা আমার কোনভাবে বিশ্বাস হয় না। আর খুন হওয়ার আগে সে আমাকে কি বলতে চেয়েছিল?

আমার টেবিলের উপর একটা ছায়া পড়ল। মুখ তুলে দেখি কালো ইউনিফর্ম পরাএকটা ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দোকানের সামনে দিয়ে মোরিনোর সাথে যে ছেলেটা হেঁটে যাচ্ছিল।

“কিটাযাওয়া, তুমি আমার স্কুল থেকে বের হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলে।”

যতটা অবাক হওয়া উচিত ততটা অবাক হতে পারলাম না আমি। আমার মনে হয়েছিল এরকম পরিস্থিতিতে এরকম কিছু হওয়াটাই স্বাভাবিক। উঠে দাঁড়ালাম না। আমি শুধু ওর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম, “তুমি আমার বোনকে খুন করেছ?”

এক মুহূর্তের জন্য ও চুপ করে থাকল। তারপর ওর ঠোঁট আস্তে করা খুলে গেল আর শব্দগুলো বেরিয়ে এল : “হ্যাঁ, আমি ওকে খুন করেছি।”

ওর মৃদু কণ্ঠে বলা কথাগুলো মিলিয়ে গেল আমার কানে, রেস্টুরেন্টের ভেতরের হাউকাউয়ে মিলিয়ে গেল সেটা।

আমার সামনে বসল ছেলেটা, যেখানে এতক্ষন ইটসকি বসে ছিল। আমি নড়তে পারছিলামনা, মনে হচ্ছিল সারা শরীর অসাড় হয়ে গিয়েছে। আমি শুধু ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। অবশ্য যদি নড়াচড়া করতেও পারতাম তাহলেও ছেলেটাকে বসতে বাধা দিতাম না। কিংবা উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতাম না।

“আমি ওকে খুন করেছি।” ছেলেটার কথাগুলো আমার মনে প্রতিধ্বনি তুলছে। আমি জানতাম এই সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু আমার মন আমার কান যা শুনেছে তার সাথে একমত হতে চাইছে না। ব্যাপারটা অনেকটা টবের গাছে, অতিরিক্ত পানি ঢালার মত-ছেলেটার কথাগুলো আমার খুলি আর মগজের মধ্যে আটকা পড়ে গিয়েছিল, কিন্তু এর বেশিরভাগই মেনে নিতে অক্ষম ছিলাম।

ও আমার দিকে তাকিয়ে মাথা খানিকটা সামনে বাড়িয়ে দিল, মুখ নড়ছে। মনে হচ্ছিল জানতে চাইছে আমি ঠিক আছি কিনা। আমি কথাগুলো

ওর ঠোঁটে নড়তে দেখছিলাম কিন্তু কিছু শুনতে পারছিলাম না। ও টেবিল ঘুরে এসে আমার কাঁধ স্পর্শ করার চেষ্টা করল। ওর স্পর্শ পেয়ে আমার অসাড়তা ভাঙল।

“আমাকে ছোঁবে না?”

আমি বুথের মধ্যে পিছিয়ে গেলাম, ওর থেকে যতটা সম্ভব দূরে সরে যেতে চাইছিলাম। ইচ্ছাকৃত ক্রিয়া ছিল না, বরং সহজাত প্রবৃত্তি থেকে দেয়ালের দিকে সরে গেলাম।

রেস্টুরেন্টের আলো আর শব্দ হঠাৎ করে আমার কাছে ফিরে এল। মিউজিক কিংবা কাস্টমারদের হাউকাউ কখনোই বন্ধ হয়নি, সে আমার চোখে কানে ওগুলো পৌঁছাচ্ছিল না। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল সময় যেন থেমে গিয়ে আবার শুরু হলো।

আমি বুঝতে পারিনি যে কথাগুলো জোরে বলে উঠেছিলাম। পাশের টেবিলের পরিবারটা শুনতে পেয়েছিল। পুরুষ এবং নারী দু-জনেই আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে চোখ পড়তেই তারা বিব্রত বোধ করে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজেদের আলাপে ফিরে গেল।

“তুমি ঠিক আছ, নাটসুমি?” ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, ওর হাত ফিরিয়ে নিয়েছে। সিটে হেলান দিয়ে প্রশ্নটা করেছে সে। আমি আমার আগের জায়গায় ফিরে গিয়ে মাথা নাড়লাম।

“না।” আমার বুক ব্যথা করছিল। কাঁদছিলাম না, কিন্তু কথার মধ্যে কান্নার সুর ছিল। “কিছুই ঠিক নেই..”

আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে যেন। বুঝতে পারছিলাম না ছেলেটাকে আমার ভয় পাওয়া উচিত নাকি ওর উপর রাগ করা উচিত। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারছিলাম আমার বিপরীতে বসে থাকা ছেলেটাকে কিছু করা আমার ক্ষমতার বাইরে।

আমি নিজের উপর যতই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি না কেন, সে ছিল পুরোপুরি শান্ত। আর সে ওখানে বসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাকে লক্ষ্য করছে। মনে হচ্ছে আমি কোন মানুষ নই, অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে রাখা কোন পোকামাকড়।

“নাটসুমি, আমি চাই না তুমি চিৎকার কর,” অনুভূতিহীন সুরে ছেলেটা বলল, যেন ওর হৃদয় বলতে কিছু নেই। টেবিলের এপাশ থেকে আমি বুঝতে পারছিলাম সে খুবই ভয়ঙ্কর একজন মানুষ।

“কেন তুমি ওকে খুন করলে..?”

এই ছেলে ইটসুকির মত কখনো হাসে না, কিংবা অপ্রত্যাশিত কিছু সামনে পড়লে অবাক হয় না। ও ছিল ডালপালা কেটে ফেলা, পাতা বিহীন একটা গাছের মত, ননতম জিনিসগুলো ছাড়া আর কিছুর অস্তিত্ব নেই। জানি শুনতে অদ্ভুত লাগছে কিন্তু আমার কাছে ওকে এরকমই মনে হয়েছিল।

“আমি জানি না কেন হিরোকোকে খুন করেছি, সত্যি জানি না, সে আস্তে আস্তে বলল। “কিন্তু কোন কারন ছিল না। ওর মৃত্যুই আমার সাথে কোনভাবে যুক্ত ছিল।”

“তোমার সাথে?”

কয়েক মুহূর্ত সে কিছু বলল না, মনে হলো কোন চিন্তায় ডুবে গিয়েছে। কিন্তু আমার থেকে চোখ সরায়নি একবারের জন্যও। অবশেষে কিছু না বলে মুখ দিয়ে ইশারা করে পাশের টেবিলে পরিবারটিকে দেখাল।

“কিছুক্ষণ আগে তুমি ওদের দেখছিলে তাই না?” বাচ্চা মেয়ে দুটো একজন আরেকজনের সাথে খুনসুটি করছে।

“তুমি তোমার অতীত দেখতে পাচ্ছিলে তাই না? ভাবছিলে তোমার আর হিরোকোর সাথে ঐ মেয়ে দুটোর কত মিল? ওদের দেখে তোমার নিজের ছোটবেলার সুখ স্মৃতিগুলো মনে পড়ছিল, আর তুমি এমনভাবে ওদের দিকে তাকিয়ে ছিলে যেন মূল্যবান কোন সম্পদের দিকে তাকিয়ে আছ।”

“চুপ কর…”

আমি দুহাতে কান চাপা দিতে চাইলাম যেন ওর গলা শুনতে না হয়। মনে হচ্ছে যেন সে আমার মনের পাহাড়ে নোংরা জুতো পড়ে হাঁটাহাঁটি করছে।

“আমার নিজেরও বোন আছে। অনেক বছর আগে আমরাও নিশ্চয়ই এভাবে ডিনারে যেতাম, ঐ পরিবারটার মত। যদিও আমার এরকম কোন স্মৃতি নেই কিন্তু নিশ্চয়ই এরকম কিছু হয়েছিল। শুনে অবাক লাগছে না তোমার কাছে?”

ওর প্রত্যেকটা শব্দ উচ্চারণের সাথে পাল্লা দিয়ে আমার হৃদস্পন্দন বাড়তে লাগল। মনে হচ্ছে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছি, প্রতি মুহূর্তে গড়িয়ে পড়ার গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

“ছোট মেয়েটাকে দেখ-মনোযোগ দিয়ে দেখ। সাবধানে, তুমি যে দেখছ সেটা যেন খেয়াল না করে,” ছেলেটা নিচু গলায় বলল।

আমি ওর দিক থেকে চোখ সরিয়ে কাছের সিটে বসা ছোট মেয়েটার দিকে তাকালাম। বুথে বসে সে নিষ্পাপ চোখগুলো দিয়ে দূরে কোথাও তাকিয়ে আছে। ওর হাতগুলো শক্ত করে মায়ের পোশাক ধরে আছে। আমি মেয়েটাকে না চিনলেও, নাম না জানলেও, ভালবেসে ফেললাম।

“নাটসুমি, তোমার কি মনে হয় আজ থেকে দশ বছর পরে ঐ মেয়েটা কাউকে খুন করতে পারবে?”

আমার বুকটা মনে হলো জমে গেল। বাধা দিয়ে কিছু একটা বলতে ছেলেটার দিকে ফিরলাম কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না। সে তার মত বলে চলল।

“মেয়েটা হয়তো ওর বাবা-মাকে খুন করবে। কিংবা ওর বোনকে। অসম্ভব কিছুই নয়। সে হয়তো এখনই এই নিয়ে পরিকল্পনা শুরু করে দিয়েছে। হয়তো সে শুধু ছেলেমানুষির অভিনয় করছে। হয়তো সে আসলে চাইছে হ্যামবার্গারের প্লেটে রাখা ছুরিটা তুলে নিয়ে ওর মায়ের গলায় পোচ দিতে।”

“প্লিজ…আর না, থামো। তুমি একজন অসুস্থ মানুষ।” আমি মাথা নিচু করলাম। হাত দিয়ে শক্ত করে কান চেপে আছি। ওর বলা কথাগুলোর সাথে যুদ্ধ করছিলাম। ওর প্রত্যেকটা শব্দ আমাকে আঘাত করছে, নিদারুন কষ্ট সৃষ্টি করছে। মনে হচ্ছে আমার গালে কষে চড় বসাচ্ছে।

“নাটসুমি, আমার দিকে তাকাও…আমি মজা করছি। বাচ্চাটা খুব সম্ভব কাউকে কখনো খুন করবে না। এতক্ষন আমি যা বললাম, তা স্রেফ আমার নিজের বর্ণনা।”

আমি চোখ তুলে ওর দিকে তাকালাম। ওকে ঘোলা দেখাচ্ছিল-আমার চোখ ভর্তি পানির জন্য।

“জন্ম থেকেই আমি এমন। আমি যখন ঐ মেয়েটার মত ছোট ছিলাম তখন ব্যাপারটা বুঝতাম না, কিন্তু এলিমেন্টারি স্কুলে উঠার পর বুঝতে পারলাম আমি অন্যদের থেকে আলাদা।”

“কি…কি বলছ ত-তুমি?” আমি তোতলাচ্ছিলাম।

ওকে একটুও বিরক্ত দেখাল না, ব্যাখ্যা করে শোনাল। “বলছি যে আমার নিয়তিতে লেখা ছিল একদিন খুন করতে হবে। আমার অন্তত তাই মনে হয় আর কি। যেমন ধর একজন ভ্যাম্পায়ারের সামনে মানুষের রক্ত পান করা ছাড়া কোন উপায় খোলা নেই। আমারও খুন করা ছাড়া কোন উপায় নেই। জনের সাথে সাথেই আমার নিয়তি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমার বাবা-মা আমার উপর কোন অত্যাচার করেননি কিংবা কোন মানসিক নির্যাতনও করেননি। আমার পূর্বপুরুষদের মধ্যে কোন খুনিও নেই। আমি একদম সাধারণ একটা পরিবারে বড় হয়েছি। কিন্তু যেখানে অন্য সাধারণ ছেলেমেয়েরা তাদের কল্পিত বন্ধু আর প্রাণীর সাথে খেলাধুলা করে সেখানে আমি সময় কাটাতাম কল্পিত মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে থেকে।”

“তুমি আসলে কি?!” আমি ওকে আর একজন মানুষ হিসেবে দেখতে পারছিলাম না। ও আরো ভয়ঙ্কর কিছু, অনেক অনেক ভয়ঙ্কর।

এক মুহূর্তের জন্য ও চুপ ছিল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, “আমি জানি না। আমি অনেকবার নিজেকে প্রশ্ন করেছি কেন আমার কাউকে খুন করতে হবে, কিন্তু কোন উত্তর খুঁজে পাইনি। আর আমাকে এটা গোপনও রাখতে হয়েছে, অভিনয় করতে হয়েছে যে আমি একদম সাধারণ গোছের কেউ। খুব সাবধানে ছিলাম যাতে কেউ আমার ভেতরের সত্যি রূপটা দেখতে না পায়।

“তোমার পরিবারও টের পায়নি?”

সে মাথা নাড়ল। “আমার পরিবার আমাকে জানে একজন সাধারণ, নরমাল ছেলে হিসেবে। আমি খুবই সাবধানতার সাথে নিজের এই অবস্থান সৃষ্টি করেছি।”

“ত্‌-তোমার পুরো জীবন…তাহলে একদম মূ-মিথ্যে?”

“কিংবা বলা যায় আমার কাছে বাকি সবকিছু মিথ্যে।” ওর কথার অর্থ বুঝিনি।

সে আরো ব্যাখ্যা করল, “আমি বিশ্বাস করতে পারিনি, আমার পরিবারের সাথে যেসব কথা হয় কিংবা অন্য লোকদের যে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ দেখি তার সব সত্যি। আমার ধারণা ছিল কোথাও কোন স্ক্রিপ্ট থাকে, যেটা দেখে সবাই কথা বলে-এমনকি আমি যখন ছোট ছিলাম তখন একবার পুরো বাড়ি এরকম স্ক্রিপ্টের জন্য খুঁজে দেখেছিলাম। আমি অন্যদের মত একই কথাগুলো পড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু কোথাও কোন স্ক্রিপ্ট ছিল না। একমাত্র যেটা আমার কাছে সত্যি মনে হয়েছিল তা হলো মৃত্যু।”

“সে কারনে আমি মানুষের মৃত্যু দেখতে চাই।” আমি ওর মুখ থেকে কথাগুলো বের হতে দেখলাম।

“সেজন্য আমার বোনকে..?”

“সেই রাতে, আমি বাইরে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। তোমার বোনকে একটা ভেন্ডিং মেশিনের সামনে বসে থাকতে দেখি। কাঁদছিল। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম সে ঠিক আছে কিনা। ও একটু হেসে ধন্যবাদ জানাল।

ওর শ্বদন্তগুলো ঝকমক করে উঠেছিল।”

ছেলেটা জানাল ও খুনটা করেছিল কারন শ্বদন্তগুলো ওর ভালো লেগেছিল। ওর মতে ব্যাপারটা ছিল একটু অন্যরকম ভালবাসার মত।

ওর কথা শুনতে শুনতে আমার মনে হলো আমাকে রেস্টুরেন্টের বুথের ভেতর বেঁধে রাখা হয়েছে। টেবিলের উপর রাখা ওর হাতগুলোর দিকে তাকালাম আমি-সাদা হাতগুলো কালো ইউনিফরমের স্লিভগুলো থেকে বেরিয়ে এসেছে, আঙুলগুলো সরু ধরনের। কিন্তু সাত সপ্তাহ আগে ঐ একই হাতগুলো আমার বোনকে খুন করেছিল।

“কারন তোমার ওর শ্বদন্তগুলো ভালো লেগেছিল?”

ছেলেটা মাথা ঝাঁকাল। তারপর ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করল।

“আমি ওগুলো রেজিনে ঢুকিয়ে রেখেছি, ভাবলাম তুমি হয়তো দেখতে চাইবে।”

সে বস্তুটা টেবিলের উপর রাখল। একটা স্বচ্ছ চারকোনা ব্লক। ভেতরে বিশটা ছোট ছোট সাদা জিনিস সারি করে রাখা। দুটো বাঁকানো সারি, একটা আরেকটার উপর রাখা।

“ওগুলো পুরো রুমে ছড়িয়ে ছিল, সবগুলো খুঁজে বের করতে বেশ সময় লেগেছে।”

রেজিনে রাখা দাঁতগুলো দেখে মনে হচ্ছে ওগুলো শূন্যে ঝুলে আছে। অদৃশ্য কোন মানুষের দাঁত, প্রত্যেকটা তার ঠিক জায়গায় অবস্থান করছে।

আমি শ্বাদস্তগুলো দেখতে পেলাম।

বাচ্চাদের হাসির শব্দ আমার কানে এল। চকমকে আল্পনাগুলো রেস্টুরেন্টের আলোয় ঝলমল করে উঠল।

অদ্ভুত ব্যাপার যে আমি ভয় পেলাম না, সেফ দুঃখ বোধ করছি। কেউ আমাকে বলেনি যে ওর দাঁতগুলো পাওয়া যায়নি।

ব্লকটা তুলে আবার ব্যাগে ভরে একটা খাম বের করল সে।

“ওগুলোর কথা বাদ দাও, এই নাও দ্বিতীয় টেপট।” খামটা খুলে উপুড় করল, একটা ক্যাসেট বের হয়ে টেবিলের উপর পড়ল।

“কণ্ঠ ২: কিটাযাওয়া হিরোকো, ক্যাসেটের লেবেলে লেখা।

“আর একটা টেপ আছে।”

“আমাকে শুনতে দাও।”

“দ্বিতীয়টা শেষ কর আগে, তারপর দেখা যাবে।”

সে চলে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ আমি উঠার শক্তি পেলাম না। টেপটা টেবিলের উপর রেখে আমি রেজিনে রাখা আপুর দাঁতগুলোর কথা ভাবছিলাম।

কফিতে চুমুক দিয়ে দেখি ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। পাশের টেবিলের মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে কেচাপ লেগে আছে। সুন্দর চোখগুলো দিয়ে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার কাঁপতে থাকা হাতের কারনে কফির কাপে যে শব্দ হচ্ছিল তা নিশ্চয়ই ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।

রেস্টুরেন্ট থেকে ট্রেনে বাড়ি ফেরার সময় আমি গুটিসুটি মেরে সিটের উপর শুয়ে পড়লাম। আমাকে নিশ্চয়ই দেখতে ভয়াবহ লাগছিল, একজন মধ্যবয়স্ক নোক বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল তুচ্ছ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। আমার ভয় হচ্ছিল অন্য যাত্রিরা কিংবা কন্ডাক্টর হয়তো আমার পকেটে রাখা টেপটার কথা টের পেয়ে যাবে, ছেলেটার সাথে আমার কথোপকথন জেনে যাবে, আমাকে এসব নিয়ে প্রশ্ন করবে।

ট্রেন থেকে নামার পর আমি অন্ধকার আবাসিক এলাকার রাস্তায় দৌড়াতে লাগলাম। বাসায় পৌঁছে দেখি ভেতরে বাতি জ্বলছে। এখন তো আমার বাবা-মা বলতেও পারবেন না কখন সূর্য ডোবে আর কখন আলো জ্বালাতে হবে।

মাত্র দরজাটা খুলতে যাব এমন সময় সেটা ভেতর থেকে খুলে গেল আর কেউ একজন বেরিয়ে এল। আকাগি। সে আমাকে দরজার বাইরে দেখে চমকে লাফিয়ে উঠল।

“ওহ! নাটসুমি, দূর্বল একটা হাসি দিল আকাগি।

“তোমার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগল।”

“বাসায় যাচ্ছি এখন, দুশ্চিন্তা হচ্ছিল তাই..”

মাঝেমাঝে ক্লাসের পর বাসার সামনে এলে আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে গল্প করি। আকাগি বেশ লম্বা একটা ছেলে। এই দূরত্ব থেকে ওর মুখের দিকে তাকালে ঘাড় কাত করে উপরে তাকাতে হবে।– ও প্রচুর বই পড়ে। বইয়ের ভারে ওর বাসার দ্বিতীয়তলা যেকোন সময় ভেঙে পড়ার মত অবস্থায় আছে। আমরা সবসময় বই নিয়ে আলাপ করতাম। কিন্তু আজকে আমার মুড নেই, তাই একজন আরেকজনকে শুভেচ্ছা জানালাম খালি। ওকে ধন্যবাদ দিলাম আপুর কথা মনে রাখার জন্য।

আমরা যখন কথা বলছিলাম তখনো আমার মাথায় খালি টেপটা ঘুরছিল। আমার উচিত ওকে আপুর কথাগুলো শোনানো, কিন্তু কিছু বললাম না।

“তাহলে, নাটসুমি, পরে দেখা হবে…বাই।”

আকাগি হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে চলে গেল। আমি চুপচাপ ওর চলে যাওয়া দেখলাম, নিজের পরিবর্তন দেখে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি।

আগে যখন আমরা কথা বলতাম তখন এক মুহূর্ত শান্ত হয়ে থাকতে পারতাম না। বুক ধুকপুক করত, বিশ্রাম দিত না। প্রতিবার সে যখন আপুর দিকে তাকাত আমার মন বিমর্ষ হয়ে যেত।

ওর অনেক কিছুই আমি পছন্দ করতাম, কিন্তু আমার হৃদয় এখন নিস্তব্ধ, শীতল কোন পাথরের টুকরোর মত।

ঘাড় ডলতে ডলতে আমি উপলদ্ধি করলাম আকাগিকে এমনকি বিদায়ও জানাইনি। অথচ আগে নিজে থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে হাত নেড়ে আবার দেখা হবে!” বলতাম।

আমাদের মধ্যেকার সংযোগ ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছিল। আপুর মৃত্যুর পর ও আবার একজন অপরিচিত মানুষে পরিণত হচ্ছে। আপু না থাকলে ওর সাথে আমার কখনো হয়তো পরিচয় হত না, সেজন্য ব্যাপারটা হয়তো স্বাভাবিক।

আকাগি হয়তো চাইছেনা সম্পর্কটা হারিয়ে যাক। সেটা চাইলে সে কখনো এখানে আর আসত না।

ভেতরে গেলাম। লিভিং রুম ঠান্ডায় জমে আছে মনে হলো। বাবা-মা কোটাটসু (ভারি কম্বল, ভেতরে কাঠের টেবিল থাকে) এর ভেতর ঢুকে আছে। আমি ওদের বললাম আকাগির সাথে দরজায় দেখা হয়েছে। তারা কোন উত্তর দিল না। আমি টের পেলাম আমার মুড আরো খারাপ হচ্ছে।

উপরে গিয়ে রুমে ঢুকে দরজা লক করলাম। পকেট থেকে টেপটা বের করে স্টেরিওতে ঢুকিয়ে আগের টেপটা বের করে তেবিলে রাখলাম। তারপর প্লে বাটনে চাপ দিলাম আমি।

টেপ ঘোরার শব্দ কানে এল। চেয়ারে বসে স্টেরিওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

টের পেলাম, পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ছে, যখন আমরা দুজনেই এলিমেন্টারি স্কুলে পড়তাম। আমরা নিজেদের কণ্ঠ রেকর্ড করতাম। টেপে নিজের কণ্ঠ কিরকম অদ্ভুত শোনায় সেটা আবিস্কার করে অবাক হতাম। তারপর বাবা-মা এলে সবাই একসাথে গান গেয়ে রেকর্ড করতাম। ছেলেমানুষি সব গান কিন্তু আমাদের খুব মজা লাগত। বাইরে ড্রাইভিংয়ে গেলে বাবা ঐ টেপটা চালাত। আপু জুনিয়র হাইতে ওঠার পর বাবা টেপটা চালালে ও না না করে চিৎকার করত। মা ওর কান্ড দেখে সব সময় জোরে জোরে হাসত।

কী সুন্দর দিন ছিল তখন…

নাটসুমি…

‘বাবা-মাকে বোল, আর আকাগিকেও…সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ। এত সব ঝামেলা করার জন্য আমি দুঃখিত…নাকি তারা তোমার সাথে বসে এই টেপ শুনছে? আমার পক্ষে সেটা জানা সম্ভব না আর…

ও…ও এর পর আমাকে খুন করবে, প্রথমে ভেবেছিলাম ও মজা করছে..

নাটসুমি…আমি একা অন্ধকারে পড়েছিলাম এতক্ষন, চোখ-মুখ বাধা ছিল,..এক মিনিট আগেও..

যখন এটা বুঝতে পারলাম যে…কান্নাকাটি আর চিৎকার করা অর্থহীন…তখন…তখন আমার অনুশোচনা হচ্ছিল..

আমি ক্ষমা চাই…সেজন্য তোমাকে এই মেসেজ দিয়ে যাচ্ছি। উপলদ্ধি করার জন্য আমার এরকম অবস্থায় পড়তে হলো ভেবে নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে …

আমি অনেকবার অনেক কিছু বলেছি তোমাকে আঘাত করার জন্য, কিংবা হতভম্ব করার জন্য…তোমাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাত সেজন্য…

আমি দুঃখিত…তোমার কোন দোষ ছিল না। আমি স্রেফ নিজের উপর রেগে ছিলাম…কারনটা জানলে তুমিও আমাকে ঘৃণা করবে…

কিন্তু কথাটা যদি না বলেই মারা যাই তাহলে সত্যিটা তুমি আর কখনই জানতে পারবে না…কথাটা আমাকে বলতেই হবে।’

টেপটা নিরব হয়ে গেল।

আর তারপর…আপুর কণ্ঠ না, ছেলেটার পরিচিত কণ্ঠ শোনা গেল..

কিটাযাওয়া নাটসুমি। ডিসেম্বরের ৩ তারিখ। রাত এগারোটায়। একা ঐ পরিত্যাক্ত হাসপাতালটায় আসবে। যেখানে হিরোকো মারা গিয়েছিল। জায়গাটা তো চেনো, নাকি? যে রুমে ওর মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল সে রুমে আসবে। সেখানে আমি তোমাকে শেষ টেপটা দেব।

ওর কথাগুলোর পরে টেপটায় আর কিছু ছিল না।

***

টেপটা যেদিন শুনলাম, তার দুইদিন পর ডিসেম্বরের ৩ তারিখ ছিল। এর মধ্যে আমি পুলিশের কাছে যাইনি। তার বদলে প্রতিদিন যা যা করি তাই করলাম–স্কুলে গেলাম, পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করলাম।

ক্লাসের পর হলে এক বন্ধু আমাকে থামাল।

“নাটসুমি, আগামি রবিবার চল কোথাও ঘুরতে যাই।”

আপুর মৃত্যুর পর আমি একবারও হাসিনি দেখে ও সম্ভবত দুশ্চিন্তা করছিল। মাঝে মাঝেই সে আমার মন ভালো করার চেষ্টা করে।

“ঠিক আছে…কিন্তু শেষে যদি যেতে না পারি তাহলে সেজন্য সরি।”

“তোমার আর কোন প্ল্যান আছে নাকি?” সে জানতে চাইল।

কোন প্ল্যান ছিল না। কিন্তু সে রাতে জীবিত বাসায় ফিরে আসতে পারার সম্ভাবনাও কম। আমি ঠিক করেছি ছেলেটার বলা কথামতই কাজ করব। মেসেজটা শোনার পরপরই আমি সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলি।

যদি ঐ পরিত্যাক্ত হাসপাতালটায় যাই, তাহলে আপুর মেসেজের বাকি অংশটা শুনতে পারব। এর বিনিময়ে হয়তো আমার জীবনটা যাবে। জানি না সে কেন আমাকে খুন করতে চায়, কিন্তু খুন না করে ছেড়ে দেয়ার কোন সুযোগ নেই বললেই চলে।

“না কোন প্ল্যান নেই কিন্তু..” আমি বললাম, হঠাৎ ইচ্ছা হচ্ছিল ওকে জড়িয়ে ধরি। ওর জীবনটা কি রকম হবে? কিছুদিন আগেও তো আমরা স্রেফ সাধারণ মানুষ ছিলাম। হাই তুলতে তুলতে সকালে স্কুলে আসতাম। সারাদিন ব্ল্যাকবোর্ড থেকে লেখা নোটবুকে কপি করতাম। প্রতিদিন একই জিনিস ঘটত। দিনগুলো ছিল সাধারণ, কিন্তু জীবন ছিল আনন্দের।

কিন্তু এখন আমার সামনে যে জীবন রয়েছে সেটা আমি আর বিশ্বাস করতে পারি না। সুখি জীবন পেতে গিয়ে মৃত্যু নিয়ে অনেকটা সময় ব্যয় করা হয়ে গিয়েছে। আমার বন্ধুর জীবনে এখনো ভবিষ্যৎ আছে। আর যখন আমি চিন্তা করি যে ওকে আর দেখতে পাব না…খুব পছন্দ করি ওকে।

“কাল দেখা হবে,” হাত নাড়তে নাড়তে বললাম।

স্কুল থেকে বের হতেই ডিসেম্বরের ঠান্ডা বাতাস এসে মুখে ঝাপ্টা মারল।

সূর্য পুরোপুরি ডুবে না গেলেও আকাশ মেঘলা ছিল, যে কারনে ভালোই অন্ধকার। গায়ের কোট ভালো টেনে চেকে হাঁটা শুরু করলাম।

স্কুল গেটের কাছে আসতে ফোন বাজল। ইটসুকি।

“এখন? স্কুল মাত্র শেষ হলো। গেট দিয়ে বের হচ্ছি এখন।”

গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ওর সাথে কথা বলছিলাম। শো শো করে গাড়ি যাচ্ছিল। ট্রাফিক আর বাতাসের শব্দে কথা বুঝতে সমস্যা হচ্ছিল।

“কী বললে? শুনতে পাচ্ছি না,” আমি জোরে বললাম। “ও আচ্ছা, ধন্যবাদ…না আমি ঠিক আছি…”

এটাই হয়তো ওর সাথে আমার হওয়া শেষ কথা। চিন্তাটা মাথায় আসতেই আমার কান্না পেল। ইটসুকিকে সেই জুনিয়র হাই থেকে চিনি। সে আমার কাছে ছোট ভাইয়ের মত।

“আরেকটু জোরে বলতে পারবে?” আমি চোখ বন্ধ করলাম, যেন তাহলে ওর কথাগুলো ভালভাবে শোনা যাবে। আমি বলছি যে আমি ঠিক আছে…দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। কি? না, আমি কাঁদছি না…” এক মুহূর্ত পর আমাদের কথাবার্তা থেমে গেল।

হাত ঘড়িতে সময় দেখলাম ট্রেনের জন্য। পাঁচটার বেশি বাজে। স্টেশনের দিকের রাস্তায় সূর্য ডুবতে শুরু করে দিয়েছে। বাইরে অন্ধকার। ছেলেটার সাথে দেখা করার আগে আমার হাতে আর ছয় ঘন্টা সময় আছে।

জানি না কেন, কিন্তু আমি ভয়ে কাঁপছিলাম না। আমার মন শান্ত ছিল। চোখ বন্ধ করে বসে ট্রেনের চলাচল অনুভব করলাম। আসন্ন বিপর্যয়ের কথা চিন্তা করে আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় যেন থেমে গিয়েছিল। রেস্টুরেন্টে আপুর দাঁতগুলো দেখার পর সব চেতনা যেন বিনাশ হয়ে গিয়েছে। কোন কিছু আর সত্যি মনে হচ্ছে না, সবকিছু কেমন অবাস্তব লাগছে। “ ছেলেটার সাথে হাতাহাতি করার কথা আমি কখনো চিন্তাও করিনি। কোন অস্ত্রপাতি ছাড়াই, কাউকে জানানো ছাড়াই আমি হাসপাতালে যাব। আমার আগ্রহ শুধু আমার বোনের কণ্ঠস্বর শোনা নিয়ে। আর কোন কিছুর আমার প্রয়োজন নেই। ছেলেটা যদি আমার কোন ক্ষতি করে, করুক।

আমার বাবা-মা আবারো ঘর লক করতে ভুলে গিয়েছিল। আমি ভেতরে ঢুকে জানালাম যে বাসায় ফিরেছি।

মা তাতামি রুমে ছিল, জামাকাপড় ভাঁজ করে রাখছিল। আমি যখন কথা বললাম তার সাথে তখন দূর্বলভাবে হাসল। দেখে মনে হচ্ছিল হালকা ধাক্কা দিলেই ডিগবাজি খেয়ে পড়বে।

বাবা ছিল লিভিং রুমে। কোটাটসুর নিচে। মুখ দেখা যাচ্ছে না। আমরা যখন ছোট ছিলাম, আমি আর আপু বাবার হাত ধরে ঝুলতাম। কত বছর আগের ঘটনা সেটা?

“বাবা, আমি বাসায় ফিরেছি,” হাঁটু গেড়ে তার পাশে বসলাম। তিনি কোন উত্তর দিলেন না। ভাবলাম ঘুমাচ্ছেন, উঠে দাঁড়ালাম চলে যাওয়ার জন্য।

“নাটসুমি,” তিনি বললেন। “আমি দুঃখিত…আমরা তোমার দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছি।”

“কি বলছ এসব?” একই কথা আজকে বন্ধুদেরও বলেছি।

“লোকজন সবসময় বলে তুমি দেখতে হিরোকোর মত। কিন্তু আমি কখনো বুঝতে পারিনি সেটা কতখানি। হিরোকো যখন বেঁচে ছিল তখন কখনো খেয়াল করিনি, কিন্তু এখন…এখন মনে হয় তারা ঠিকই বলত।”

বাবা মাথা উঁচু করে আমার দিকে তাকালেন। মাঝে মাঝে নাকি তিনি আপুর সাথে আমাকে গুলিয়ে ফেলেন। উনার চোখগুলো অর্ধেকটা মায়া আর অর্ধেকটা শোকে ডুবে ছিল।

“কিন্তু, নাটসুমি…তুমি কি মাত্র স্কুল থেকে এলে?”

আমি মাথা ঝাঁকালাম। বাবাকে অবাক দেখাল।

“আমার মনে হল কারো উপর তলায় যাওয়ার শব্দ শুনলাম…”

“মা হয়তো?”

“সে তো আমার সাথে এখানে ছিল।”

ডোরবেল না বাজিয়ে পায়ের শব্দ পাওয়ায় তারা ধরে নিয়েছিলেন আমি এসেছি।

আমি উপরে গেলাম। টেপগুলো নেই।

ছেলেটা মনে হয় এসেছিল ওগুলো নিতে। কাজটা ওর জন্য একদমই কঠিন হয়নি।

আমি যদি সে রাতে বাসায় না ফিরি, পুলিশ টেপগুলো আমার রুমে পেলে ওকে ধরে ফেলত। ছেলেটা সেরকম কিছু ঘটার সুযোগ রাখেনি।

এর অর্থ হল সে আমাকে ছেড়ে দেয়ার কোন পরিকল্পনা রাখছে না।

আমার মনে হলো শরীর থেকে সমস্ত শক্তি গলে বেরিয়ে যাচ্ছে। ধুপ করে চেয়ারের উপর বসে পড়লাম।

গত দুই দিন ভেবেছি আমাকে খুন করা হতে পারে। এখন আমি নিশ্চিত।

আমি যদি টেপে বলা কথাগুলো অনুযায়ি হাসপাতালে যাই, আমাকে খুন করা হবে।

মৃত্যু কি? ছেলেটা বলেছিল মৃত্যুই একমাত্র সত্যি ব্যাপার। ও মানুষের মৃত্যুর অভিজ্ঞতা পেতে চায়, যেভাবে ভ্যাম্পায়ার রক্তের স্বাদ গ্রহণ করে।

জানি না কতক্ষন চেয়ারে অনড় হয়ে বসে ছিলাম। নিরবতা আমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছিল। আমি কল্পনা করছিলাম ছেলেটা আপুকে কিভাবে খুন করছে। একসময় আপুর জায়গায় আমার চেহারা চলে এল। কিন্তু যতটা ভেবেছিলাম ততটা ধাক্কা খেলাম না।

জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য দেখেছি আমি আগে। আমি ছিলাম জীবিত। আমার বোন, বাবা-মা, সবাই জীবিত ছিল। ব্যাপারটা স্পষ্ট ছিল। এখন সেই পার্থক্যটা ঘোলাটে হয়ে এসেছে। যেন সাদা আর কালো মিশে গিয়ে ধূসর একটা রঙ সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে আমি দাঁড়িয়ে আছি। আপুর লাশ দেখার পর থেকে বাবা-মা একইরকম হয়ে গিয়েছে, এক পা মৃতদের এলাকায়, জমে আছে।

কিন্তু আমার বোন…আপু নিশ্চিতভাবে মৃত। আমার কাছে তার কণ্ঠ তখনো জীবিত। ঐ টেপগুলোর মধ্যে সে বেঁচে আছে, এখনো নিঃশ্বাস নিচ্ছে, এখনো চিন্তা করছে, এখনো কথা বলার চেষ্টা করছে…এখনো আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

আমি আর জানি না জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে কী। কিন্তু এটুকু জানি, আমি তার উপর দাঁড়িয়ে আছি।

“নাটসুমি,” মা নিচ থেকে ডাকল। “ডিনার তৈরি!”

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বলতে চাইলাম, “আসছি!” যদি না যাই তাহলে শুধু তারা রয়ে যাবে।

আপুর মৃত্যুর পর আমরা সবাই কেমন তালগোল পাকিয়ে গিয়েছি। কিন্তু তারপরেও আমরা চেষ্টা করি একসাথে খাওয়া দাওয়া করার। অতিরিক্ত একটা চেয়ার রাখা থাকে যদিও। কিন্তু ডিনার হলো একমাত্র জিনিস যেটা কিনা এখনো আমাদেরকে পরিবার হিসেবে একসাথে আটকে রেখেছে।

আজকে, অবশ্য আমি উঠতে গিয়ে থেমে গেলাম।

“নাটসুমি?” মা আবার ডাকল। উত্তর দেইনি দেখে অবাক। আপার মনে পড়ল বাবা কিভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমার মনে হচ্ছিল যদি তাদের সাথে খেতে যাই তাহলে আর হাসপাতালে যাওয়া সম্ভব হবে না। আমি যদি ফিরে না আসি তাহলে তারা কিভাবে বেঁচে থাকবে? ভালোবাসা, কিংবা বলা উচিত করুণা-আমাকে এখানে আটকে রাখবে।

“ডিনার তৈরি!” মা আবার ডাকল।

 ডেস্কের উপরে সিলিন্ডারটায় চোখ পড়ল। চোখ সরাতে পারছিলাম না।

জিনিসটা একটা রক্তলাল লিপস্টিক, আপুর রুম থেকে এনেছিলাম।

চোখ বন্ধ করে মনস্থির করলাম। চেয়ারে বসা অবস্থায় বললাম “আমার খিদে নেই।”

দরজা লাগানো ছিল। মায়ের চেহারা দেখতে পাইনি, কিন্তু উপস্থিতি টের পাচ্ছিলাম। সিঁড়ির নিচ থেকে দাঁড়িয়ে আমার দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন।

অপরাধবোধ এসে আমার হৃদয়ে বিদ্ধ করল। বুক ব্যথা করতে লাগল। মা যখন দেখল তার মেয়ে নিচে আসছে না, তার কাঁধ ঝুলে পড়ল, নিরবে সিঁড়ির কাছ থেকে সরে গেলেন। আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম যেন দৃশ্যটা।

চেয়ারে বসে আমি তাদের কাছে বার বার ক্ষমা চাইতে লাগলাম। কিন্তু তারপরেও সিদ্ধান্ত বদলালাম না। আমি একজন জঘন্য সন্তান। আমাকে হাসপাতালটায় যেতেই হবে, তাদেরকে এখানে একা ফেলে।

সে রাতে পরে আমি কোট পড়ে তৈরি হলাম। খেলনা খরগোেশটা হাতে নিলাম। যখন ছোট ছিলাম তখন খরগোশটাকে অনেক ভালবাসতাম। নরম তুলতুলে ভাবটা ভালো লাগত, আদর করে চুল আঁচড়ে দিতাম। আমার একদম ছোটবেলা থেকে খরগোশটা আমার রুমে ছিল। এখন এটাকে বিদায় জানানোর পালা। আপুর লিপস্টিকটা কোটের পকেটে নিলাম। সাথে নিয়ে যাচ্ছি যাতে আমার মন বদল না হয়।

একটা ফ্ল্যাশলাইট নিলাম সাথে। তারপর চুপ করে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম যাতে বাবা-মা টের না পায়। তারা ডাক দিলে আমি আর বের হতে পারব না। কেউ ডাকল না।

পরিত্যক্ত হাসপাতালটায় যেতে সাইকেলে বিশ মিনিটের মত লাগবে। ছোট একটা রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে গেলাম, কোন স্ট্রিট ল্যাম্প ছিল না। চারপাশে অন্ধকার। শুধু আমার লাল সাইকেলের আলো অন্ধকার ভেঙে এগিয়ে যাচ্ছে।

আপু আর আমি দু-জনেই সাইকেলটা ভাগাভাগি করে চালাতাম। আমাদের মধ্যেই কেউ একজন পড়ে গিয়ে বাস্কেটটা বাঁকিয়ে ফেলেছিল। আমার যেহেতু মনে নেই, সুতরাং দোষটা সম্ভবত আপুরই ছিল। লাল সাইকেলটা দেখে আমার লিটল রেড রাইডিং হুডের কথা মনে হতো। মনে হত আমি সেই ছোট মেয়েটা, নানির বাড়িতে যাচ্ছি যেখানে একটা নেকড়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

আকাশটা বরং আশেপাশের সবকিছুর চেয়ে কম অন্ধকার ছিল। মাটি আর আকাশের মধ্যের পার্থক্য স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। পাকা রাস্তাটা সোজা পর্বতমালার দিকে চলে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পরেই নুড়ি বিছানো পথটা শুরু হলো। সেখানে সাইকেল থেকে নেমে হাঁটতে লাগলাম। যতক্ষণ না বেড়া দেয়া জায়গাটা চোখে পড়ল। বাইরে সাইনবোর্ড লাগানো “বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ।”

বেড়া পেরিয়ে অনেকটা ভেতরে হাসপাতালটা। ফ্ল্যাশলাইটের আলো এতদুর যাচ্ছিল না।

লাইট নিভিয়ে দিতেই অন্ধকার এসে সবকিছু গ্রাস করল। আশেপাশে কোন বাড়ি কিংবা দোকান নেই। দুরেও কোন আলো দেখা যাচ্ছে না। চারপাশে খালি শুকনো ঘাস। বাতাস না থাকায় ঘাস দুলছে না, কোন শব্দও হচ্ছে না। অস্বাভাবিক রকমের নিস্তব্ধতা।

বেড়ার সাথে সাইকেলটা রেখে শুধু ফ্ল্যাশ-লাইটটা নিয়ে সামনে এগুলাম। পায়ের নিচে নুড়ির চমচ শব্দ হচ্ছিল। নিঃশ্বাস বেরিয়ে ঠাণ্ডায় সাদা ধোঁয়া তৈরি করে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। বেড়ার সাথেই রাস্তামুখি একটা দরজা আছে, ধাক্কা দিতে সহজেই খুলে গেল ওটা। ভেতরে পা ফেললাম আমি।

যে রাতে আপু খুন হলো, কিভাবে সে এখানে এসেছিল? আমার মত হেঁটে হেঁটে গেট দিয়ে ঢুকেছিল? হয়তো ছেলেটা ছুরি ঠেকিয়ে জোর করে ওকে এখানে এনেছিল। নাকি ও অজ্ঞান ছিল তখন? ঘাড়ে করে বয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল? হাসপাতালে ঢাকার রাস্তাটা ওর জন্য একমুখী পথ ছিল, ওর চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার পথ।

এই জায়গাটা কি একসময় পার্কিং লট ছিল? যথেষ্ট বড় একটা জায়গা। ফ্ল্যাশলাইটের লম্বা আলো শুকনো মাটি আর নুড়ি বেছানো পথের উপর পড়ছে। দূরে সাদা একটা বিশাল কংক্রিটের বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে। দোতলা। রাতের আকাশে মাথা উঁচু করে রেখেছে। বিল্ডিংটা একসময় একটা হাসপাতাল থাকলেও এখন শুধু কাঠামোটাই পড়ে আছে। ডাইনোসরের ফসিলের মত। শুধু হাড়গুলো।

প্রবেশ পথ দিয়ে ভেতরে গেলাম। আগে এখানে হয়তো কাঁচের দরজা ছিল। এখন চারকোনা হা করা একটা মুখ। লবিতে আলো ফেললাম। বেঞ্চগুলোকে আর চেনা যায় না। এখানে সেখানে কংক্রিটের টুকরো পড়ে আছে। গোলাকার আলো দেয়ালের উপর পড়লে সেখানে স্প্রে পেইন্ট দিয়ে আঁকা গ্রাফিতি দেখা গেল।

আমি ছোট ছোট নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম। দম হারিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সিলিংটা নেমে এসে চাপা দেবে আমাকে। লাইট লাগানোর অংশগুলো দেখা যাচ্ছে। নিচে ভাঙা ফ্লুরোসেন্ট লাইট পড়ে আছে। খেয়াল না করে একটার উপর পাড়া দিয়ে ফেলেছিলাম। কাঁচের গুড়ো কুড়মুড় শব্দ করে উঠল।

হলওয়েটা অন্ধকারে দিয়ে মিলিয়ে গিয়েছে। আপুকে যেখানে পাওয়া গিয়েছিল সেদিকে যাচ্ছি। রুমটা ঠিক কোথায় তা জানি না কিন্তু একটা সাধারণ ধারণা আছে আমার। নিচালার পেছন দিকে কোথাও হবে।

রুমটা একসময় অপারেটিং চেম্বার ছিল। সাইন দেয়া ছিল কোনদিকে যেতে হবে। আমার পায়ের শব্দ দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলছে। বাতাসে কম্পন সৃষ্টি করছে শীতের ঠাণ্ডা।

হলের শেষ মাথায় গিয়ে রুমটা খুঁজে পেলাম এক সময়। দরজা বলে কিছু নেই। চারকোনা একটা গর্ত দাঁড়িয়ে আছে দরজার জায়গায়। ভেতরে

আরেকটা খালি দরজার মত গর্ত। তারপর একটা খোলা জায়গা।

রুমের মধ্যে আলো বোলালাম। জায়গাটা এত ঠাণ্ডা আর নিঃসঙ্গ যে বুকে কাঁপুনি ওঠে। এত নিরব যে একটা পাথর গড়ালেও প্রতিধ্বনি শোনা যাবে। আমার মনে হচ্ছে যেন কোন নিঃসঙ্গ আত্মার নিচু গলায় কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি।

হাত দেওয়ার জন্য লম্বা সরু কিছু সিঙ্ক ছিল রুমের এক কোনায়। আরো কিছু ছোট দরজা ছিল পাশের ছোট রুমগুলোতে যাওয়ার জন্য। সেগুলোর পর অপারেটিং চেম্বার। ছোট রুম। সব মিলিয়ে তিনটা। প্রত্যেকটায় ঢুকে দেখলাম।

কেউ নেই সেখানে। ছোট রুমগুলো পনের ফিটের মত চওড়া। প্রথম দুটো একদম ফাঁকা। কিন্তু তৃতীয়টায়, সবচেয়ে দূরেরটায়, দরজা খুলে ঢুকতেই জমে গেলাম। অশুভ কিছু একটা সেখানে অনুভব করছি আমি।

এই রুমটা অন্যগুলোর চেয়ে অন্ধকার। অনেক বেশি অন্ধকার। দেয়াল আর সিলিং কালো রঙের। যেন আগুনে পুড়ে গিয়েছে।

রুমে ঢুকে নিশ্চিত হলাম কেউ সেখানে নেই। দরজাটায় সুইং লাগানো আছে, ছেড়ে দিলে নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে যায়। দেয়ালের সাথে এক সারি সিলিন্ডার রাখা, ওগুলো শিকল দিয়ে বাধা যাতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রুমের মাঝখানে একটা জং পড়া ধাতব বিছানা-একটা অপারেটিং টেবিল।

তখন আমি খেয়াল করলাম সিলিং আর দেয়ালগুলো পোড়া নয়। কালো দাগটা শুরু হয়েছে টেবিল থেকে, পায়ের নিচের মেঝে ছাড়িয়ে রুমের দেয়াল হয়ে দরজার নিচ পর্যন্ত।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমি গিয়ে দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালাম। খালি হাতটা দিয়ে মুখ চেপে চিৎকার আটকানোর চেষ্টা করলাম। কালো দাগটা আমার বোনের রক্তের।

অন্ধকারে আমি যেন প্রায় ওকে দেখতে পাচ্ছি। আমার বোনের শরীরের অংশ, মৃতদেহের টুকরোগুলো। পুলিশ সেগুলো পরিস্কার করছে।

‘নাটসুমি…

জানি না তুমি কখনো এটা শুনতে পাবে কিনা?

হঠাৎ আমি আপুর কন্ঠ শুনতে পেলাম। পাশ থেকে আসছে। প্রথম টেপটায় কথাগুলো ছিল। আমি দরজার দিকে আলো ফেললাম। গোল আলোয় দরজাটা বন্ধ হতে দেখলাম, যেন মাত্রই কেউ ভেতরে ঢুকেছে।

“কিটাওয়া নাটসুমি।” ছেলেটার গলা ভেসে এল অপারেটিং টেবিলের অন্য পাশ থেকে। পুরো জায়গাটা হঠাৎ যেন জ্বলে উঠল, আমি অন্ধ হয়ে গেলাম।

আলোতে ছেলেটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, ইউনিফর্ম পরা নেই। কিন্তু পা থেকে মাথা পর্যন্ত কালো পোশাক। ওর হাতের লাইটটা আমার ফ্ল্যাশলাইটের চেয়ে অনেক শক্তিশালী ছিল। অন্য হাতে একটা ছোট টেপ প্লেয়ার ধরে রেখেছে। সেখান থেকে আসছে আপুর গলার শব্দ।

‘সে কথা দিয়েছে মেসেজটা তোমাকে পাঠাবে সে। সে দেখতে চায় আমার কথাগুলো শুনে তোমার প্রতিক্রিয়া কি হয়…’।

আমার বোন বলে চলল। ওর নিঃশ্বাসের শব্দ কংক্রিটের দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলল। আমি অপারেটিং টেবিলটার দিকে তাকালাম, যেখানে রক্তের দাগ সবচেয়ে গাঢ়। পুরো রুম জুড়ে কালো ছায়া ফেলেছে।

“হিরোকো এই টেবিলে শুয়ে টেপটা রেকর্ড করেছিল।”

ছেলেটা লাইট আর টেপ প্লেয়ারটা এক কোনায় রেখে টেবিলের দিকে এগোল। কালো দাগটার উপর হাত বোলাল সে, যেন আদর করছে।

“কেন আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে?” প্রশ্ন করলাম আমি। আমার গলা কাঁপছে।

অপারেটিং টেবিলটা একসময় কালো লেদারে মোড়া ছিল। কিন্তু এখন সেটার অল্পই অবশিষ্ট রয়েছে। লেদার ছিঁড়ে ধাতব অংশ বেরিয়ে এসেছে। কালো দাগ পুরোটা ঢেকে ফেলেছে। ছেলেটা হালকাভাবে সেখানে আঙুল বুলিয়ে গেল। আঙুলের স্পর্শে শুকনো রক্তে সৃষ্টি হওয়া মৃদু শব্দ শুনে আমার লোম দাঁড়িয়ে গেল। মনে হচ্ছে যেন ছেলেটা আমাকেই স্পর্শ করছে।

“হিরোকো যেমন বলল, আমার কৌতূহল হচ্ছে টেপটা শুনে তোমার প্রতিক্রিয়া কেমন হয়।”

আমার দিকে তাকিয়ে থেকেই ছেলেটা অপারেটিং টেবিলের উপর দুবার টোকা দিল। ওর দৃষ্টি পরিস্কার বলছিল সে আমাকে কি করতে দেখতে চাইছে।

দেয়ালে ঠেস দিয়ে আমি আস্তে করে মাথা নাড়লাম। যদি ছেলেটার দিকে এগোই তাহলে মরতে হবে। আমার বোনের মত আমাকেও খুন করা হবে। কিন্তু ভয়ের কারনে মাথা নাড়িনি আমি।

অপারেটিং টেবিলের পাশে চুপচাপ দাঁড়ানো ছেলেটার উপর আলো পড়ায় মনে হচ্ছিল যেন অন্ধকারে ভাসছে সে। ওর পেছন থেকে আলো এমনভাবে ওর কাঠামোটা আলোকিত করে তুলেছিল যেন স্বর্গীয় কিছু দাঁড়িয়ে আছে। আমার ভয় কমে গেছে, মনে হচ্ছে যেন মৃত্যুর সাথে বোঝাপড়া করা অর্থহীন, অযৌক্তিক আর হাস্যকর।

‘আমি অনেকবার অনেক কিছু বলেছি তোমাকে আঘাত করার জন্য, কিংবা হতভম্ব করার জন্য…’

“নাটসুমি, এদিকে আস, ছেলেটা বলল।

সে আমাকে বলছিল অপারেটিং টেবিলে এসে উঠতে। মাত্র তিন হাত দূরে দাঁড়িয়ে ছিল ও।

যদি দ্রুত নড়াচড়া করে তাহলে সহজেই আমাকে ধরে ফেলতে পারবে। জোর করে শোয়াতে পারবে। কিন্তু সে নড়ল না। অপেক্ষা করছিল। তার কাছে যাওয়ার জন্য।

তার কথা অনুযায়ি আমার পাগুলো চলল। আমার ভেতরে অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে-যেন ওর কথা আমাকে শুনতেই হবে। যখন আমি সেটা বুঝলাম, শরীর কেঁপে উঠল আমার।

নিজের ইচ্ছায় আমি ওর কাছে যাচ্ছি? জোর করে দেয়ালের সাথে লেগে থাকলাম। ছেলেটার দিকে তাকালাম।

সে বুঝিয়ে বলল, “নাটসুমি, তুমি ইতিমধ্যে জানো কিন্তু।”

“কি জানি?” আমি না বুঝতে পেরে প্রশ্ন করলাম।

“এই যে, আমি তোমাকে খুন করতে যাচ্ছি। তুমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছ আমাকে খুন করতে দেবে।”

আমার বোনের কণ্ঠ কাঁপছে। আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে ছেলেটা, পলক পড়ছে না ওর চোখে। ওর দৃষ্টি এত সূচালো যেন আমার মাথা ভেদ করে সব দেখতে পাচ্ছে।

“তুমি মৃত্যুর প্রতি আকর্ষিত…নিজের ইচ্ছায় তুমি এখানে এসেছ।”

“কথাটা মোটেও সত্যি নয়,” আমি জোর গলায় বললাম।

ছেলেটা চোখ সরু করে আস্তে আস্তে বলল, “আমার বিশ্বাস মৃত্যু হলো, ধ্বংস’। মৃত্যুর সময় দুনিয়ার সাথে সব সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। প্রিয়জনের সাথে যত সম্পর্ক সব ধ্বংস হয়ে যায়। তারা কখনো আর সূর্য দেখতে পাবে না, বাতাস অনুভব করতে পারবে না, আঁধার কিংবা নিরবতা টের পাবে না। আনন্দ, দুঃখ-সবকিছুর সাথে সব রকম সংযোগ নষ্ট হয়ে যাবে। নাটসুমি, আমি জানি তুমি কিসের ভেতর দিয়ে গেছ, যখন তুমি এখানে এসেছিলে।”

দু-হাতে আমার মাথা চেপে ধরলাম আমি। ফ্ল্যাশলাইটটা মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগল। বাবা-মায়ের কথা মনে হলো আমার। ইটসুকি, আমার বন্ধুরা, আকাগি।

“এখানে আসা নিশ্চয়ই তোমার জন্য কঠিন ছিল কিন্তু তুমি মন শক্ত করেই এখানে এসেছ। তুমি জানো তুমি না ফিরলে তোমার বাবা-মা কত কষ্ট পাবেন, তারপরেও তুমি এসেছ। সব সম্পর্ক ধ্বংস করে, নিরবে সবাইকে বিদায় জানিয়ে, এখানে এসেছ একজন মৃত ব্যক্তির কণ্ঠ শুনতে।”

ছেলেটার কথাগুলো একদম জায়গামত গিয়ে আমাকে আঘাত করল। শব্দহীন কিছু একটা আমার ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এল। চিৎকার আর গোঙানির মাঝামাঝি কোন কিছু। হাত দুটো দিয়ে শক্ত করে মাথা চেপে রাখলাম।

‘নাটসুমি, যে কারনে আমি তোমার উপর কঠোর হয়েছিলাম তার আসলে কোন গুরুত্ব ছিল না। ব্যাপারটা ছিল আকাগির কারনে।’

এমন এক বাবা-মাকে আমি ফেলে এসেছি যারা কিনা ইতিমধ্যে তাদের এক মেয়েকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছে। অপরাধবোধ আমাকে দাবানলের মত ঘিরে ধরল।

“দ্বিতীয় টেপটা পাওয়ার পর তোমার হাতে দু-দিন সময় ছিল। সে সময়ের মধ্যে তুমি যার যার সাথে দেখা হয়েছে সবাইকে বিদায় জানিয়েছ-তোমার জীবনের সাথে জড়িত সবাইকে এবং সবকিছুকে বিদায় জানিয়েছ। সোজা মৃত্যুর দিকে হেঁটে গিয়েছ।”

অবশেষে আমি উপলদ্ধি করলাম-এই ছেলের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে আমি যা যা করেছি তা হল স্লো-মোশন সুইসাইড। বাবা-মাকে না জানিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে এসেছি, ফিরে যাওয়ার শেষ সুযোগটাও ছুঁড়ে ফেলেছি। এই দুনিয়ার সাথে আমার সম্পর্কের সবচেয়ে ভারি বন্ধনটাকে ভেঙে এখানে এসেছি..

‘আকাগির সাথে কিভাবে আমার পরিচয় হয়েছে তা তোমাকে কখনো বলিনি…’

“আমি..”

আমি আমার হাত নামিয়ে নিলাম, আশেপাশে তাকালাম। ঠান্ডা কংক্রিটের রুমটা শূন্য অন্ধকারে ডুবে আছে। আর কিছুই এখানে নেই একমাত্র রক্ত মাখা অপারেটিং টেবিল আর ছেলেটা ছাড়া…একটা খুবই নিঃসঙ্গ স্থান।

আমার পা নড়ল। দেয়াল থেকে সরে এসে অপারেটিং টেবিলের দিকে এগুলাম।

নিজের ইচ্ছায় জীবনের সবকিছু থেকে আমি সরে এসেছি। আপুর কণ্ঠ ছাড়া আর কিছুই আমার কাছে কোন মূল্য বহন করে না। নিজেকে কি আমি আসলে এই মুহূর্তে জীবিত দাবি করতে পারি? আমার দেহ হয়তো কাজ করছে কিন্তু ইতিমধ্যে তো আমি মৃত্যুর দেশের অর্ধেক পথ পেরিয়ে গিয়েছি।

‘সে রাস্তায় এসে আমার সাথে কথা বলেছিল। পরে আমি জানতে পেরেছি আমরা একই কলেজে পড়ি।

টেবিলের অন্যপাশে ছেলেটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি এখন। সে একটা পেশিও নড়ায়নি এখনো, শুধু কথা দিয়ে আমার সব দ্বিধা বের করে নিচ্ছে।

সে এখন আমার অনেক কাছে দাঁড়িয়ে, আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লম্বা হওয়ার কারনে দৃষ্টি খানিকটা নিচের দিকে।

“হিরোকো এই টেপটা যখন রেকর্ড করছিল তখন আমি তোমার কথা জানতে পারি। তারপর থেকেই আমি অপেক্ষা করছিলাম তোমার সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য, সে ফিসফিস করে বলল। “তুমি আসলেই দেখতে ওর মত।”

আমার বোনের কণ্ঠ রুমের মধ্যে প্রতিধ্বনি তুলে নিস্তব্ধ বিল্ডিঙের মধ্যে হারিয়ে গেল। “আমি জানি তুমি কেন আমাকে টেপটা দিয়েছিলে, কেন তুমি এখানে এনেছ,” আমি বললাম।

ছেলেটাকে দেখতে কুচক্রীর মত লাগল।

“মজা করার জন্য তুমি এসব করছ না, তাই না? সস্তা ধূলের আশায় নয়। রেস্টুরেন্টে একটা কথা বলেছিলে তুমি। সব মানুষের সবকিছু তোমার কাছে স্ক্রিপ্ট করা মনে হয়, নকল মনে হয়…শুধু মৃত্যুকে মনে হয় আসল।”

‘আমরা ডেট করা শুরু করলে আকাগি বলেছিল সে আমাকে প্রায়ই বুকস্টোরে দেখত। আর তখন সে আমার প্রতি আগ্রহি হয়ে ওঠে। আমাকে সবসময় সাদা উলের জ্যাকেট পড়তে দেখত সে, ঐতিহাসিক উপন্যাসের সেলফের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে…’

এই ছেলেটা মানুষ খুন করেছে। অথচ এই নিয়ে ওর কোন অপরাধবোধ নেই। আমি জানি ওর প্রতি আমার কোন সমবেদনা অনুভব করা ঠিক নয়, কিন্তু তারপরেও…ছেলেটার জন্য আমার খানিকটা খারাপ লাগছিল।

“তুমি দেখতে চেয়েছিলে আমি আমার বোনের সাথে সম্পর্ক ঠিক করতে চাই কিনা, সেটা তার মৃত্যুর পরে হলেও। ব্যাপারটা তুমি বুঝতে চাইছিলে কারন এই অনুভূতিগুলো বোঝার ক্ষমতা তোমার নেই।”

বেশ একটা লম্বা সময় সে অনুভূতিহীন দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। কোন কথা বলল না। শুধু আপুর কণ্ঠ রুমের মধ্যে প্রতিধ্বনি তুলছিল। আমি জানি না সে কী ভাবছিল, জানার ক্ষমতা আমার নেই।

‘বুঝতে পেরেছ ব্যাপারটা? আকাগি আসলে প্রথমে তোমাকে দেখেছিল।

অবশেষে ছেলেটা ওর হাত দুটো অপারেটিং টেবিলের উপর রাখল। “নাটসুমি, এখানে বস।”

কোন ভয় অনুভূত হলো না আমার। ছেলেটার দিকে পিঠ দিয়ে আপুর রক্তে মাখা টেবিলটার উপর বসলাম। ছেলেটার উপস্থিতি টের পাচ্ছি আমার পেছনে।

শীতল টেবিলটা থেকে ঠান্ডা আমার জিন্সের প্যান্ট দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল। আর একটু পরেই মরে যাব কিন্তু তারপরেও অদ্ভুত এক শাস্তি বোধ করছি, শান্ত সাগরের মত।

টেবিলের কোনা ধরে ছিলাম। আপুর শুকনো রক্তের স্পর্শ পাচ্ছিলাম। নড়তে পারছিলাম না। কিংবা বলা যায় নড়াচড়া করার কোন ইচ্ছা আমার ছিল না, তাই নড়তে পারিনি। আঙুলের তলে সবকিছু কেমন ঠান্ডা আর শক্ত হয়ে ছিল।

লাইটটা আমার পেছনে থাকায় সামনে দেয়ালে আমাদের ছায়া দেখতে পাচ্ছিলাম। ছেলেটার শরীরের ছায়া আমার ছায়া অর্ধেক ঢেকে দিয়েছিল, একটু এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সে।

‘আমরা সবসময় একইরকম পোশাক পরতাম, যে কারনে সবাই বলত আমরা দেখতে একইরকম,..আকাগি ভুল করে আমাকে প্রস্তাব দিয়ে ফেলেছিল, ভেবেছিল তুমি…

ছেলেটার ছায়া নড়ে উঠল। হাত তুলল, ছায়া আমার ছায়ার উপর বেড়ে গেল।

ওর হাত দিয়ে আমার দৃষ্টি ঢেকে দিল, কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না আর। অন্ধকারে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম আমি। পেছন থেকে আসা হাত দুটোর একটা আমার ঘাড় পেঁচিয়ে ছিল, আরেকটা আমার মুখ। সে যদি জোরে চাপ দেয় তাহলে মুহূর্তের মধ্যে আমার ঘাড় ভেঙে যাবে। আমি নিজের নিঃশ্বাসের উষ্ণতা টের পাচ্ছি। ছেলেটার বুক আমার পিঠে লেগে ছিল। কাপড়ের ভেতর দিয়ে ওর উষ্ণতা ভেদ করে আসছে।

“প্লিজ…ওর মেসেজের বাকিটা আমাকে শুনতে দাও।”

আপুর কন্ঠ শুনতে পাচ্ছিলাম আমি, যদিও ছেলেটার হাতগুলো আমার কান ঢেকে রেখেছিল। আকাগির ব্যাপারে এসব জানতাম না আমি। আপুর অদ্ভুত ব্যবহারের রহস্যের গিট খুলতে শুরু হয়েছে।

ওর হাতের সন্ধিগুলো আমার গলার পাশে আঁট হয়ে আবার আলগা হচ্ছিল। যেন ভেতরের হাড় পরীক্ষা করে দেখছে। ঘাড় ভাঙার জন্য হাতগুলো পুরোপুরি তৈরি ছিল, মনে হচ্ছিল যেন একজন অ্যাথলেট স্বল্প পাল্লার দৌড়ের জন্য ওয়ার্ম আপ করছে।

আমার ঘাড়টা মনে হচ্ছিল সুন্দর একটা ফুলের ডাঁটির মত, না ভেঙে ফুলটা আলাদা করা যাবে না।

‘সত্যি কথাটা জানার পরও আমাদের মধ্যে কোন সমস্যা ছিল না। শুরু সেভাবে হলেও সত্যিকারের ভালবাসা আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল। আমাকে ভালোবেসেছিল সে, আমার ভেতরে যা আছে সেটাকে…’

কিন্তু আমি নার্ভাস ছিলাম।

আমার বুক ব্যথা করছিল ওর কথাগুলো শুনতে শুনতে।

“তুমি হয়তো ঠিকই বলেছ,” ছেলেটা ফিসফিস করে বলল। ওর কণ্ঠ আমার ডান দিক থেকে এল। আমি ওর বুকের উঠানামা টের পাচ্ছিলাম। আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে।

“আমার দ্বিতীয় শিকারের জন্য দু-জনকে বাছাই করেছিলাম। একজন হল কিটাযাওয়া নাটসুমি, আরেকজন আমার স্কুলের একটা মেয়ে।”

“মোরিনো? তোমাকে ওর সাথে হাঁটতে দেখেছি..”

ওর হাতের কারনে আমার কণ্ঠ চাপা পড়ে যাচ্ছে। বুক ধুকপুক করছে, শিরার মধ্যে দিয়ে রক্ত জোরে ছুটছে। গলার উপর হালকা চাপ, শিরার স্পন্দন-আমার মাথা গরম হয়ে উঠতে লাগল।

“কামিয়ামা ইটসুকি তোমাকে ওর নাম বলেছে, তাইনা? শেষে অবশ্য আমি তোমাকে বেছে নিয়েছি, কারনটা হয়তো তুমি যেটা বললে সে কারনেই।”

আমার মনে হলো, কথাগুলো ও আমাকে না বলে নিজেকেই শোনাচ্ছে। হয়তো ও নিজের কর্মকাণ্ড নিজেই বুঝতে পারছে না। অদ্ভুত হলেও, আমার কাছে মনে হল আমরা বন্ধুর মত।

‘আমিও আকাগিকে কখনো জানাইনি…যে সে তোমাকে দেখেছিল, আমাকে নয়। আমি ওকে বলতে পারিনি আসলে…’

আমি এতটা অন্ধ ছিলাম কি করে? আপুর ব্যাপারে কিছুই জানতাম না। ছেলেটার হাতের বন্ধনে আটকা পড়ে, আপুর কণ্ঠ শুনতে শুনতে নিজের প্রতি লজ্জা হতে লাগল আমার।

আমার ধারণা ছিল আপুর মধ্যে আত্মবিশ্বাস আছে, যেটা আমার নেই। ভেবেছিলাম সে অনেক মেধাবী, মিশুক-একজন শক্ত নারী, যাকে সবাই ভালবাসে। অথচ সত্য ছিল একদমই অন্যরকম…।

‘আমি তোমার মুখের দিকেও তাকাতে পারছিলাম না…আমরা অনেকটাই একইরকম ছিলাম। আমি আমার সব বিরক্তি তোমার উপর ঝেড়েছি। চুলের রঙ বদলেছি, তোমার থেকে ভিন্ন রকমের পোশাক পরাশুরু করেছি, যাতে তোমার সাথে মিল না থাকে…কারন আমি জানি আকাগির প্রতি তোমার অনুভূতি কিরকম…’

আমার বোন তার নিজের ভয় আর দুচিন্তার মধ্যে আটকা পড়ে নিরন্তর যুদ্ধ করে চলছিল। আমাকে আকাগির ব্যাপারে কিছু বলতে পারছিল না। এই গোপন ব্যাপারটা তার হৃদয়ের উপর বোঝার মত চেপে বসেছিল। আমার পকেটের লিপস্টিকটা…সে সেটা ব্যবহার করত আশেপাশের দুনিয়া থেকে নিজের ভয়কে আড়াল করার জন্য।

আফসোস! সে বেঁচে থাকা অবস্থায় যদি আমি সেটা লক্ষ্য করতাম। আমি যদি ব্যাপারটা জানতে পারতাম তাহলে তাকে বুকে জড়িয়ে জানাতাম নার্ভাস হওয়ার কিছু নেই, ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

ছেলেটার হাতের চাপ বাড়ল। ওয়ার্ম আপ করা শেষ। শক্ত করে আমার মাথা ধরে আছে এখন। তার হাতের চাপে আমার মনে হচ্ছিল ভালবাসার বন্ধনে মৃত্যু ঘটতে চলছে যেন আমার।

আপুর কণ্ঠ যখন থামবে, জোরে চাপ দিয়ে আমার ঘাড়ে মোচড় দেয়া হবে। মাথা আর ঘাড়ে বিপরীত চাপ পড়ে আলাদা হয়ে যাবে। মৃত্যুর মুহূর্তটা নিয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম।

‘যদিও আমি আমার শেষ কথাগুলো এভাবে রেকর্ড করছি, আমার ইচ্ছা হচ্ছে…ইচ্ছা হচ্ছে যদি কথাগুলো তোমাকে আরো আগে বলা যেত…’

আমি টের পাচ্ছি আমার হৃদপিন্ড জোরে জোরে লাফাচ্ছে। সারা শরীরের রক্ত পাম্প করার শব্দ যেন আপুর কণ্ঠের মতই পরিস্কার শুনতে পাচ্ছি। ছেলেটার হৃদস্পন্দনও টের পাচ্ছি আমি।

বুকে কেমন যেন চাপ বোধ হচ্ছে, ইচ্ছা করছে চিৎকার করে কাঁদি। ছেলেটার প্রতি আমার কোন রাগ বা ঘৃণা নেই, মৃত্যুর মত অনিবার্য কিছু মনে হচ্ছে ওকে।

আপুর স্বীকারোক্তি প্রায় শেষ। ছেলেটার হাতের চাপ আর আপুর কণ্ঠ থেকে সেটা বুঝতে পারছি আমি।

আমি খুশি যে টেপটা শুনতে পেরেছি।

“তুমি জানতে তুমি আমাকে খুন করবে…সেজন্য তুমি বাসায় এসেছিলে টেপগুলো নিতে, যাতে আমি আর না ফিরলে পুলিশ সেগুলো খুঁজে না পায়,” আমি বললাম। সাবধানে বললাম যাতে আপুর কন্ঠ মিস না হয়। খুন হওয়ার আগে আপু এই কথাগুলো আমাকে বলে গিয়েছে। আমার দায়িত্ব সবটুকু শোনা।

‘কিন্তু পেছনে ফিরে যাওয়ার কোন উপায় তো নেই। নাটসুমি…আমি তোমাকে আসলেই ভালোবাসতাম।

“নাটসুমি,” ছেলেটা বলল, গলার উপর চাপ সরে গেল। আমি এটা আশা করিনি, একটু অবাক হলাম। “আমি কখনো তোমার বাসায় যাইনি।”

ওর কথাগুলো প্রথমে বুঝতে পারলাম না। সে বলতে চাইছে সে টেপগুলো নেয়নি? প্রশ্নটা করার আগেই অপারেটিং চেম্বারে কারো ঢোকার শব্দ পেলাম।

ছেলেটার হাত শিথিল হলেও, তখনও সেগুলো আমাকে পেঁচিয়ে আছে, কিছু দেখতে পাচ্ছি না। তৃতীয় ব্যক্তিটা কে? ওর হাত যথেষ্ট জোরালো থাকায় নড়তেও পাচ্ছি না। শুধু নতুন এক জোড়া পায়ের শব্দ পাচ্ছি।

“কে..?” আমি ঢোক গিলোম।

পায়ের শব্দটা দরজার কাছ থেকে এসে অপারেটিং টেবিলের কাছে থামল।

ছেলেটা আস্তে করে আমার মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিল। আবার দেখতে পাচ্ছিলাম, সামনের দেয়ালে তিনটা ছায়া তখন।

‘আমি তোমাকে আঘাত করার জন্য অনেক কিছু বলেছি…কিন্তু তোমার কোন দোষ ছিল না…’

আমি না, ছেলেটাও না, তৃতীয় ছায়াটা নড়ে উঠল। স্টপ বাটনে চাপ দিতে শুনলাম, আপুর কণ্ঠ থেমে গেল। রুমের ভেতর আবার নিরবতা নেমে এল।

টেবিল বসেই আমি মাথা ঘুরালাম। ছেলেটা আমার পিছে দাঁড়িয়ে, ওর পিঠ আমার দিকে ফেরানো, রুমের অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। ওর পেছনে, দেয়ালের কাছে ইটসুকি দাঁড়ানো।

ইটসুকি টেপ ডেক থেকে আঙুল সরিয়ে বলল, “আমি টেপগুলো নিয়েছি, নাটসুমি।”

আমি ভেবেছিলাম আর কখনো ওর কণ্ঠ শুনতে পাব না। সে এখানে কেন? নাকি পুরোটা আমার কল্পনায় ঘটছে? না, সে বাস্তবেই সেখানে আছে। আলোতে ছায়া পড়ছিল ওর। কোন কল্পনা নয়।

“হাসপাতালটা অনেক বড় হওয়ার কারনে, খুঁজে পেতে সমস্যায় পড়েছিলাম। হিরোকোর কণ্ঠ শুনতে না পেলে হয়তো তোমাদের খুঁজে পেতাম না।”

সেদিন সন্ধ্যায় ওর ফোন মনে পড়ল আমার। আমি ওকে বলেছিলাম আমি স্কুলের বাইরে। সে হয়তো তখন আমার রুমে ছিল আর নিশ্চিত হচ্ছিল যে আমি হঠাৎ এসে হাজির হব না সেখানে।

রেস্টুরেন্টে বসা অবস্থায় আমি ওকে বলেছিলাম যে বাবা-মা দরজা লক করতে ভুলে যায়।

সেকারনে ও সহজেই বাসায় ঢুকতে পেরেছিল। তারপর আপুর নাম লেখা টেপগুলো দেখতে পেয়ে অবাক হয়। ওর এখানে আসার ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। দ্বিতীয় টেপে এই জায়গার কথা আর সময় দেয়া ছিল।

“কামিয়ামা যে! অনেকদিন দেখা হয়নি আমাদের,” ছেলেটা বলল, ওর এক হাত আমার বাম কাঁধে রাখা। হাতের তালু গরম। তারপর অপারেটিং টেবিল থেকে সরে গেল। ইটসুকির মুখোমুখি হলো। আমি নড়তে পারছি না। নিথর বসে ইটসুকির দিকে চেয়ে রইলাম।

“হ্যালো,” ইটসুকি বলল। ছেলেটার নাম ধরে ডাকল, একবারের জন্যও চোখ সরাল না। ওকে দেখে মনে হচ্ছে আমি যে এখানে আছে সেটা ইটসুকি ভুলে গিয়েছে।

তারা চুপচাপ একজন আরেকজনের দিকে চেয়ে থাকল, রুমের দুই মাথায় দু-জন দাঁড়িয়ে থেকে। অপারেটিং চেম্বারের ভেতর শব্দহীন টানটান উত্তেজনা। নিরবতা যেন আমার কানে আঘাত করছিল।

আপুর কণ্ঠ শুনতে ইচ্ছা করছিল আমার। টেবিলে বসে থেকে আমি ইটসুকির পায়ের দিকে তাকালাম।

প্লেয়ারে তখনো টেপটা ঢোকানো ছিল।

আমি টেবিলের কোণা চেপে আমার আঙুলে সংকেত পাঠালাম, যেন তারা নড়াচড়া করে। কিন্তু সেগুলো অবশ হয়ে ছিল।

“তুমি ওকে উদ্ধার করতে এসেছ?” ছেলেটা জানতে চাইল। ওর কণ্ঠস্বরে নিরবতা ভেঙে গেল। কিন্তু তাতে উত্তেজনা মনে হলো আরো বেড়ে গেল।

আমি আবার আমার পেশিগুলোকে বললাম নড়াচড়া করতে, কিন্তু আমার হাত-পা আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেল। বুক দ্রুত লাফালেও শরীরের বাকি অংশ মনে হচ্ছিল ড্রাগ দিয়ে অবশ করে রাখা হয়েছে।

চোখ বন্ধ করে জোরে নিঃশ্বাস নিলাম আর প্রার্থনা করলাম।

প্লিজ, নড়াচড়া কর, টেপ প্লেয়ারটার কাছে হেঁটে যেতে দাও আমাকে…আমার আঙুলগুলো কাঁপতে লাগল।

“আমি কি কোন কিছুতে বাধা দিলাম?” ইটসুকির কণ্ঠ।

এখন যেহেতু আমার আঙুল কাঁপছে, সেটা একটা চেইন রিয়্যাকশনের মত সৃষ্টি করল। হাত আর পাও জেগে উঠল। কিন্তু পেশিগুলো টানটান হয়ে ছিল। নড়ছিল কিন্তু জোর পাচ্ছিলাম না। তারপরেও আমি টেবিল থেকে নিচে গড়িয়ে পড়ে যেতে পারলাম। যে টেবিলে আপু খুন হয়েছিল সেখান থেকে সরতে পেরে আমার নিজেকে জীবিত মনে হতে লাগল।

আমার পা এমনভাবে কাঁপছে যে উঠে দাঁড়ানো সম্ভব না। আমি হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে লাগলাম। ফ্লোরের ধুলোয় মাখামাখি হয়ে গেলাম। অপারেটিং টেবিলে ঘুরে ইটসুকির পায়ের কাছে টেপ ডেকটা রাখা। ইটসুকি আর ছেলেটা তখনো কথা বলছিল, কিন্তু সেসব আমার কানে ঢুকছিল না। পোকার মত ঘষে ঘষে আমি এগুতে লাগলাম, টেপ ছাড়া আর কোন কিছুর চিন্তা আমার মাথায় নেই।

এক টুকরো কংক্রিটের উপর হাতের চাপ পড়ে সেটা হাতে ঢুকে গেল, কিন্তু পাত্তা দিলাম না। ছেলেটা বলেছিল মৃত্যু হল ধ্বংস। সে বলেছিল

আমি সবকিছু পেছনে ফেলে এসেছি, বেছে নিয়েছি মৃত্যু।

কিন্তু আমি এখনও মারা যাইনি। এখনো জীবন পুরোপুরি ছুঁড়ে ফেলিনি। এই পরিত্যাক্ত বিল্ডিঙে আমি এসেছি কিছু পাওয়ার জন্য। জীবনের বদলে যা চেয়েছি।

টেপ ডেকটার কাছাকাছি যেতে আপুর কথা মনে হচ্ছে।

টেপ ডেকের পাশে রাখা আলো আমাকে অন্ধ করে দিচ্ছে যেন। ইটসুকির পা নড়ল, আলোর সামনে এল। ওর ছায়া আমাকে পাশ কাটিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেল। আমি মাথা ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম না।

অবশেষে একসময় টেপ ডেকটা স্পর্শ করতে পারার মত কাছে পৌঁছাতে পারলাম। হাত দিয়ে বুকের কাছে টেনে নিয়ে প্লে বাটনে চাপ দিলাম। আঙুল কাঁপছেল আমার।

প্লেয়ারটা যেন জ্যান্ত হয়ে উঠল, ক্যাসেটের টেপ আবার ঘুরতে শুরু করল। স্পিকার দিয়ে আপুর কণ্ঠ আবার বেরিয়ে এল। বাতাসে নয়, আমার হাতের নিচ থেকে ওর গলার কাঁপুনি বেরিয়ে এল।

‘নাটসুমি, আমি সবসময় তোমাকে নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। প্রতিবার যখন তোমাকে উদ্দেশ্য করে খারাপ কিছু বলে ফেলেছি, সে নিয়ে আফসোস করেছি…তোমাকে বার বার কষ্ট দেয়ার জন্য আমি দুঃখিত…’

গত কয়েকবছর আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আর ছিল না। আমরা ছিলাম দু-জন অপরিচিত মানুষ যারা কিনা এক ছাদের তলায় বাস করছিল। আমি ভেবেছিলাম আপু আমাকে ঘৃণা করত।

“হয়তো এরকম মেসেজ দেয়াটা পুরো ব্যাপারটাকে আরো খারাপ করে তুলবে…আমি জানি এরকমই হবে। কিন্তু তারপরেও আমি খুশি এই ভেবে যে আমি ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ পেয়েছি…মারা যাওয়ার আগে হলেও…আমি বলতে চাইছি, আমার কথা চিন্তা করে তোমার মুখে যদি হাসি না আসে, তাহলে তার চেয়ে খারাপ কিছু আর হতে পারে না আমার জন্য…’

আমি টেপ ডেকটা জড়িয়ে গুটিসুটি মেরে ফ্লোরে শুয়ে থাকলাম। মাির প্রিয় বোনের কষ্ঠ শুনছি। মনে হচ্ছে আমার প্রিয় বোনটা আমার কাছে ফিরে এসেছে।

‘এখানে শুয়ে আমার মনে পড়ছে, ছোট থাকতে আমরা একসাথে কি কি করতাম…’

আমি চোখ বন্ধ করে শুনছি।

‘পাহাড়ের উপর একটা বড় বন ছিল…’

আমার মনে আছে, যখন ছোট ছিলাম তখন আমরা কি কি দেখেছিলাম।

অন্ধকার, ঠান্ডা কংক্রিটের দেয়াল…সব কোথায় মিলিয়ে গেল, আমি দাঁড়িয়ে আছি নুড়ি বেছান পথের উপর, মাথার উপর সূর্য।

গার্ডরেইল, পোস্টগুলো-সব অনেক বড় বড় ছিল। আমি বাচ্চাদের ছোট জুতো পরে ছিলাম। পাহাড়টা অনেক খাড়া দেখাচ্ছিল। একদিকে ঘরবাড়ি, আরেকদিকে গার্ড রেইল। নিচে শহরের সুন্দর দৃশ্য।

‘তোমার মনে আছে আমরা হাত ধরাধরি করে হেঁটেছিলাম?

আমি পরিচিত একটা বাচ্চার কণ্ঠ শুনতে পেরে ঘুরে দাঁড়ালাম। আপু দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।

ও আমার চেয়ে বেশি লম্বা ছিল না, আর সবাই বলত আমাদের দেখতে একইরকম লাগত।

আপু এসে আমার হাত ধরল। পাহাড়ের চূড়ার দিকে আঙুল তুলে প্রস্তাব করল সেখানে যাওয়ার জন্য।

আমি খুবই উত্তেজিত ছিলাম। আমি ওর হাত ধরে দৌড়াচ্ছিলাম। উষ্ণ সূর্যালোক আমাদের পেছনে ছোট ছায়া ফেলেছিল। সেগুলোও আমাদের সাথে ছুটছিল। পাহাড়ের চূড়ার লম্বা গাছগুলোর দিকে দৌড়ে যাওয়ার সময় কংক্রিটের উপর আমাদের স্নিকারগুলো ক্যাচকোচ শব্দ করছিল।

পাহাড়ের উপরে গিয়ে আমরা বনের ভেতর ঢুকেছিলাম। ঠান্ডা বাতাসে আমাদের ঘাম শুকিয়ে গেল। বনের ভেতর দিয়ে আমরা হেঁটে গেলাম। একসময় একটা খোলা জায়গা পাওয়া গেল যেখান থেকে নিচে দূরের শহরের চমৎকার দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল। আমরা হাত ধরে সেদিকে তাকিয়ে ছিলাম।

ওর নরম উষ্ণ হাতের স্পর্শ পাচ্ছিলাম। ও আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল। আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, সুন্দর শ্বান্তগুলো চকচক করে উঠল হাসির সাথে।

শহরের উপরে অনেক উঁচুতে একটা পাখি উড়ে যাচ্ছিল।

একটা সাদা পাখি, ডানাগুলো ছড়িয়ে উড়ছিল। আমি ভেবেছিলাম পাখিটা নিশ্চয়ই বড় নদীটার কোথাও থাকে। যেই নদীটা শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে গিয়েছে। পাখিটার ডানাগুলো একদমই নড়ছিল না। অসীম নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছিল শুধু।

‘নাটসুমি, আমি মরতে যাচ্ছি, কিন্তু তুমি তো এখনো জীবিত। তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। আমাকে কথা দাও, তুমি আবার হাসবে-না হাসলে তোমাকে আমি ক্ষমা করব না। গুডবাই

ওর কণ্ঠ মিলিয়ে গেল, আর শোনা গেল না। ওর নিঃশ্বাসের শব্দও টেপ থেকে হারিয়ে গেল। স্পিকারগুলো থেমে গেল। আপুর স্বীকারোক্তি সমাপ্ত হয়েছে। স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ভেতর দিয়ে আমি তখনো ক্যাসেটটাকে নিরবে ঘুরতে দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার গাল বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু ডেকটার উপর গিয়ে পড়ল।

নিরবে আমি ফিস ফিস করে বললাম, “আমি দুঃখিত…কিন্তু তোমাকে ধন্যবাদ।”

জায়গাটা অন্ধকার আর খুবই নিরব। পরিত্যাক্ত হাসপাতালের ভেতর ফিরে এসেছি আমি। এক মুহূর্ত আগেও আমি আপুর সাথে ঐ পাহাড়টার উপরে ছিলাম।

কতক্ষন ধরে আমি এখানে পড়ে পড়ে কাঁদছি?

রুমের ভেতর শুধু আমি, টেবিল আর লাইটটা। ছেলেদের কাউকে দেখা গেল না।

ফ্লোরের উপর আলোটা একটা অংশ আলোকিত করে রেখেছে। চোখ পিটপিট করে আমি টের পেলাম ফ্লোরটা ভেজা। ফ্লোরে এক পুকুর রক্ত জমে আছে। শুকনো রক্ত না, টাটকা রক্ত। আমি মনে মনে প্রার্থনা করলাম রক্তটা যেন ইটসুকির না হয়।

উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম, টেপ ডেকটা তখনো বুকের সাথে চেপে ধরে রেখেছি। প্রথমে পাগুলো অত্যন্ত দূর্বল লাগছিল। অনেক সময় নিয়ে কোন রকম পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে সক্ষম হলাম।

রুম থেকে বেরিয়ে অসংলগ্নভাবে হাঁটছিলাম। ইটসুকির নাম ধরে ডাকলাম। আমার কণ্ঠ দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

হাসপাতালের প্রবেশ পথের কাছে দাঁড়িয়ে ইটসুকির জন্য অপেক্ষা করলাম। ঠান্ডা বাতাস কাপড় ভেদ করে ঢুকছে। আমি কাঁপতে কাঁপতে অন্ধকারে বসে ছিলাম। একসময় সূর্য উঠল। ইটসুকি কিংবা অন্য ছেলেটার কোন চিহ্ন দেখা গেল না।

উপসংহার

“আরে তেমন কোন ব্যাপার না, কুকুরের সাথে খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম,” সিঁড়ি থেকে নামার সময় মোরিনোকে বললাম। এক হাতে ব্যাগ ধরে আছি।

ডিসেম্বরের ৪ তারিখ। স্কুলের পর কথা বলতে বলতে ক্লাস থেকে বের হচ্ছিলাম আমরা। মোরিনো আমার গলার লাল দাগটার দিকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইল।

“তাই? কোন সন্দেহ নেই যে সে তোমাকে খুন করতে চাইছিল।”

“কুকুরটা?”

“আমি পুরোপুরি নিশ্চিত।” সে মাথা ঝাঁকিয়ে ঘোষণা দিল।

সত্যি বলতে আগের রাতে পরিত্যাক্ত হাসপাতালে আমি আহত হয়েছিলাম।

শরীরের কয়েক জায়গায় রক্ত জমে কালো দাগ পড়েছে কিন্তু ইউনিফর্মের নিচে ঢাকা পড়ায় সেগুলো দেখা যাচ্ছে না।

“যাই হোক, গতকালকে কিটাওয়া হিরোকোর খুনের তথ্য নিয়ে আমি একটা স্ট্র্যাপবুক বানাচ্ছিলাম..”

লাইব্রেরিতে দেখা হওয়া লোকটার কাছ থেকে মোরিনো বেশ ভালো পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করেছে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম লোকটা কে, মোরিনো উত্তর দেয়নি। আমি ঠিক করলাম ওকে ফলো করে নিজেই জেনে। নেব, কিন্তু এখন আর দরকার আছে মনে হয় না।

“শেষ করেছ?”

“প্রায় শেষ। এখন খালি দরকার খুনির একটা ইন্টারভিউ নেয়া। তাহলেই কাজ শেষ।”

বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে স্কুলের গেটের দিকে যাওয়ার সময় মোরিনো বলছিল পুলিশ যতটুকু জানিয়েছে কেসটা তারচেয়ে কত বেশি বিভৎস ছিল।

সময় হয়ে গেছে সূর্য অস্ত যাওয়ার, ঠান্ডা বাতাস বইছে। স্কুল বিল্ডিং থেকে গেট পর্যন্ত চওড়া রাস্তা, দু-পাশে গাছের সারি। অল্প কিছু শিক্ষার্থী আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করছে। বাতাসে একটা সাদা প্লাস্টিক ব্যাগ উড়ে গেল।

আমরা গেট থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হলাম। রাস্তার সাথের দোকানটায় কিটাযাওয়া নাটসুমি দাঁড়িয়ে ছিল। ম্যাগাজিন র‍্যাকের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সে। আমাদের মধ্যে চোখাচোখি হলো।

আমি দোকানের সামনে থামলাম। মোরিনোও আমার সাথে থামল।

দোকানের ভেতর কিটাযাওয়া নাটসুমি হাতের বইটা নামিয়ে রাখল। এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরায়নি আমার থেকে। তারপর দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল।

দোকানের সামনে একটা পার্কিং লট, অল্প কয়েকটা গাড়ি রাখার মত বড়।

নাটসুমি এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়াল। দোকানের ফ্লুরোসেন্ট লাইটের স্নান আলো আমাদের উপর এসে পড়ছে।

গত রাতে আমি একজনকে খুন করেছি, যখন নাটসুমি টেপ রেকর্ডার নিয়ে মাটিতে পড়ে ছিল।

ছুরিটা শরীরের ঢোকার সময় ভোঁতা একটা শব্দ হয়েছিল, তারপর সে নিথর হয়ে গেল।

এরপর নাটসুমির সাথে আর দেখা না করেই আমি বাসায় ফিরে গিয়েছিলাম। ইচ্ছা করছিল না ওর সামনে পড়তে। আমাদের লড়াই ওর চোখে পড়েনি। সেজন্য ফ্লোরের রক্তটা কার ছিল সেটা জানার ওর কোন উপায় ছিল না, অন্তত স্কুলের সামনে এসে দেখা ছাড়া।

আমি ওকে কিছু বলার আগেই মোরিনো কথা বলে উঠল। সে এতক্ষন নাটসুমির দিকে তাকিয়ে ছিল।

“তুমি কি…কিটাযাওয়া নাটসুমি?”

“হ্যাঁ,”

“আমিও তাই ভেবেছি। তুমি দেখতে খবরের কাগজে ছাপা হওয়া তোমার বোনের মতই।

“ওর চুল রঙ করে বদলে ফেলার আগের ছবিটার কথা বলছ?”

“হ্যাঁ, খুনের তদন্ত করা আমার শখ। তাই তোমার বোনের ছবি দেখা হয়েছে। তোমার কোন ছবি খুঁজে পাইনি অবশ্য। কিছুদিন আগে যখন তোমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম তখনই মনে হয়েছিল কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছিলাম না।”

“তুমি ওর খুনের তদন্ত করছিলে?” নাটসুমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল। আমার দিকে তাকাল সাহায্যের জন্য।

“ওর মনে হয় তথ্য সংগ্রহের একটা উৎস আছে, আমাকে বলেনি সেটা কে।” আমি বুঝিয়ে বললাম। নাটসুমি বুঝতে পারল না ওর কি বলা উচিত।

মোরিনো আমার দিকে তাকাল। ওর চেহারা বরাবরের মতই অভিব্যক্তিহীন। কিন্তু গলা শুনে উৎসাহ টের পাওয়া যাচ্ছিল। “তুমি কি করে কিটাওয়াকে চেন?”

উত্তর না দিয়ে আমি পকেট থেকে কিছু খুচরা কয়েন বের করলাম আর মোরিনোর হাতে দিলাম। সে এক মুহূর্ত কয়েনগুলোর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল কি করবে সেগুলো দিয়ে। আমি দ্রভাবে বললাম যে আধ মাইলের মত সামনে একটা ভেন্ডিং মেশিন আছে, সেখান থেকে আমাদের জন্য ডিঙ্ক কিনে আনতে।

“আমি জানি আমাদের সামনেই একটা দোকান আছে কিন্তু ভেন্ডিং মেশিন থেকে কিনে আনলেই ভালো হয়। তুমি যাতে আমার কথা শুনতে না পাও সেজন্য অবশ্য এই পদ্ধতি অবলম্বন করছি না।”

মোরিনো একবার আমার দিকে আরেকবার নাটসুমির দিকে তাকাল। ইতস্তত করছে। তারপর মনস্থির করে ঘুরে দাঁড়িয়ে ভেন্ডিং মেশিনের দিকে এগিয়ে গেল।

“মেয়েটা কিছু জানে না, তাই না? খুনি যে ওকে টার্গেট করেছিল?” কিটাযাওয়া বিড়বিড় করল।

আমি মাথা ঝাঁকালাম।

এক মুহূর্তের জন্য আমরা দুজনেই মোরিনোর হেঁটে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কালো পোশাকের কারনে ও অন্ধকারে প্রায় অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।

“সেদিন সে আমাকে হিরোকোর ছবি দেখিয়েছিল।”

“ওর মৃতদেহের?”

“হ্যাঁ। কেউ একজন ওকে ছবিটা দিয়েছিল। যে ছবি কোখাও ছাড়া হয়নি। নিশ্চিতভাবে মুখটা হিরোকোর ছিল। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যে ছবিটা রাখা হয়েছিল সেটার মত হেয়ারস্টাইল,

“তারপর, তুমি যখন দেখলে..”

“আমি বুঝতে পেরেছিলাম, জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে যে খুনি নিজে ছবিটা তুলেছে। ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল আমার…কিন্তু যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে হিরোকোর খুনি ওর আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে আর ও হয়তো তার পরবর্তি শিকার।”

“তুমি অর্ধেক সঠিক ছিলে, কিন্তু খুনি ওর বদলে আমাকে বেছে নিল।”

“আমি যখন তোমাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম তখন বুঝলাম সে তখনো নিজের শেষ চাল চালেনি। তুমি খুবই অদ্ভুত আচরণ করছিলে। যে কারনে আমি ভাবছিলাম সে তোমার দিকে হাত বাড়িয়েছে কিনা।”

“হ্যাঁ…সে সেটাই করেছিল। যে কারনে তুমি আমার রুমে ঢুকেছিলে…সূত্র খুঁজতে।”

“তুমি আমাকে কখনোই সত্যিটা বলনি।”

দোকান থেকে আসা আলো নুড়ি পাথরের উপর আমাদের লম্বা ছায়া ফেলেছে। মনে হচ্ছে ছায়ার পুতুল। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে মাথা দোলাচ্ছে নাটসুমি।

“কিন্তু, ইটসুকি, আমি কখনো ভাবতেও পারিনি তোমার অনুভূতি এত কম।”

“তোমার মতই কম।”

“আমি দুশ্চিন্তা করছিলাম গত রাতে…তুমি সেফ উধাও হয়ে গেলে। সকালে তোমাকে ফোন করলাম, ফোন যাচ্ছিল না।”

“ও আমার ফোনটা ভেঙে ফেলেছিল।”

কিটাযাওয়া হিরোকোর খুনি আর আমি এক ক্লাসে ছিলাম এক সময়। ওকে ভালো করে চিনতাম না। যদি কখনো একসাথে একটুও সময় কাটাতাম তাহলে নিশ্চয়ই ওর মধ্যের অস্বাভাবিক ব্যাপার আমার চোখে পড়ত।

“কী করেছ…ওকে নিয়ে পরে?”

আমি ছেলেটার লাশ হাসপাতালের পেছনের ঘাসের নিচে চাপা দিয়েছি। ওর সব নিষ্ঠুরতা কেড়ে নিয়েছে আমার রুপালি ছুরি। অন্তত এভাবেই আমি পুরো ব্যাপারটা দেখি। ছুরিটা যখন ওর শরীরের গভীরে ঢুকে গিয়েছিল, ও গুঙিয়ে উঠেছিল। মুখ থেকে রক্ত ছিটকে বেরিয়েছিল। ছুরি ধরা হাতটা মনে হচ্ছিল অনেকদিনের পিপাসা মিটিয়ে নিচ্ছে।

“ও দৌড়ে পালায়। আমি পিছু নিয়েছিলাম, কিন্তু ধরতে পারিনি…”

সে নিজের রক্তের পুকুরের দিকে তাকিয়ে থাকে যেন কোন অর্থ ধরতে পেরেছে, যেন এটা সম্ভাব্য আরেকটা উত্তর ছিল।

হাঁটু গেড়ে বসে ও সহজভাবে নিজের মৃত্যু গ্রহন করে নেয়, যেভাবে কিটাযাওয়া হিরোকোর মৃত্যু গ্রহণ করেছিল। আমার দিকে তাকিয়ে ছুরিটার প্রশংসা করে, তারপর নিথর হয়ে যায়।

“ওহ, আমাদের কি পুলিশকে জানানো উচিত তাহলে?”

“তুমি যদি চাও। আমি কোন ঝামেলা চাই না। সুতরাং তুমি জানালে আমার কথা বাদ দিয়ে জানিও। হাজার হোক তোমার ঘরে চুরি করে ঢুকেছিলাম।”

রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি দূরে কিছু একটা নড়ছে। মোরিনো। ফিরে আসছে।

“সকালে বাসায় পৌঁছানোর পর দেখি বাবা পাগলের মত করছে।” নাটসুমি পার্কিং এর বাম্পারে লাথি দিতে দিতে বলল। হাসছে। সে সাইকেল চালিয়ে বাসায় ফিরে গিয়েছিল। বাসায় ফেরার আগেই ওর বাবা মা টের পেয়ে গিয়েছিলেন যে ও বাসায় নেই। তারা আতংকিত হয়ে পড়েন। সে যখন ক্লান্ত চেহারা নিয়ে দরজা খুলে ঢুকল, তারা ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরেন।

“মা আমাকে দেখে কান্নায় ফেটে পড়েন। আপুর ঘটনার পর এটা হওয়াই স্বাভাবিক। বাসায় ফিরে আমার মনে হচ্ছিল আমি বেঁচে আছি, আমার বাবা-মাও বেঁচে আছেন। আমরা চিন্তা করছি আগামি বছর অন্য কোথাও বাসা নেব। এখান থেকে দূরে কোথাও চলে যাব।”

সে মাথা তুলে রাস্তার দিকে তাকাল। দোকান থেকে আসা আলোতে ওর কাঠামো উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।

“তোমার সাথে আর দেখা হবে না।”

ড্রিঙ্কস হাতে নিয়ে মোরিনো একটু দূরে একটা টেলিফোনের খাম্বায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদেরকে দেখছিল। রাস্তা দিয়ে ছুটে যাওয়া গাড়ির বাতাসে ওর চুল দুলছে। দেখতে ছোট ম্যাচ গার্লের মত লাগছে ওকে।

“শেষ হয়নি?” মোরিনো জিজ্ঞেস করল। “আর একটু,” আমি বললাম। বিড়বিড় করে কী জানি বলে অন্যদিকে ঘুরে তাকাল সে। ওখান থেকে আমাদের কথা শুনতে পাবে না। আমি ওর শুকনো কাঁধের দিকে তাকালাম।

“মোরিনো কি…” কিটাওয়া নাটসুমি বলা শুরু করল, আমার দৃষ্টি খেয়াল করে।

“কি?”

“কিছু না, ভুলে যাও…সে হয়তো আমাদের নিয়ে ভুল ভাবছে। তুমি কি ওকে জানাবে কি ঘটেছে?”

“দরকার না পড়লে না। আমার কোন ইচ্ছা নেই।”

“তাহলে সে জানতে পারছে না, তুমি ওকে রক্ষা করেছ। ইটসুকি, তুমি কি ওখানে গিয়েছিলে আমাকে রক্ষা করতে? নাকি ওর কাছে পৌঁছানোর আগেই আগুন থামাতে গিয়েছিলে?” নাটসুমি সোজাসুজি আমার চোখের দিকে তাকাল।

“ঠিক বলেছি তাই না? তুমি ওকে ভালোবাসো?”

প্রেম-ভালবাসার মত কিছু নয়…এক ধরনের ঘোর বলা যেতে পারে। কিন্তু সেটা আমি মুখে উচ্চারণ করলাম না।

কিটাযাওয়া নাটসুমি অন্যদিকে তাকাল, ডান হাত দিয়ে বাম কাঁধ ধরে আছে।

“কাঁধ ব্যথা করছে?”

সে মলিনভাবে হেসে সায় দিল।

“ঘোরার আগে ও এখানে হাত রেখেছিল।”

“ও?”

“বাদ দাও। আর কতক্ষন মোরিনোকে দাঁড় করিয়ে রাখবে?”

মোরিনো তখনো টেলিফোনের খাম্বার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওকে ডাক দিয়ে জানালাম যে আমাদের কথা শেষ।

মোরিনো আস্তে ধীরে আমাদের কাছে এল। ওর হাতে একটা ট্রিাসের ক্যান। আমি ইশারায় দেখালাম আমরা তো মানুষ তিনজন এখানে। সে বলল অপেক্ষা করতে করতে দুই ক্যান সে খেয়ে ফেলেছে। চেহারা দেখে অবশ্য বরাবরের মত বোঝার উপায় নেই ওর মেজাজ কতখানি খিঁচড়ে আছে।

আমরা তিনজন একসাথে গল্প করতে করতে হেঁটে স্টেশনের দিকে গেলাম। পড়াশোনা, কলেজ ভর্তি পরীক্ষা-এগুলো নিয়ে কথা হচ্ছিল, গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। আমি আমার অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিটাওয়াকেও হাসিখুশিই দেখাচ্ছিল। বেশ কয়েকবার হাসল।

মোরিনো কয়েক কদম পেছনে ছিল। আমি মাঝে মাঝে ফিরে ওকে দেখছিলাম। ওর এক হাতে ব্যাগ, আরেক হাতে সোডা ক্যান ধরে। যেন বুঝতে পারছে না ক্যানটা নিয়ে কী করবে। পায়ের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে। সে। লম্বা চুলগুলো সামনে ঝুলে মুখ ঢেকে রেখেছে। কোন কথা বলছে না। আমাদের গল্পের মধ্যে ঢোকার কোন চেষ্টাও করল না। ওর দিকে তাকালেও আমি ভান করলাম কিছু খেয়াল করিনি, সব স্বাভাবিক আছে।

স্টেশনের সামনে খালি জায়গাটায় যখন আমরা পৌঁছলাম, ততক্ষণে পুরোপুরি সন্ধ্যা নেমে গিয়েছে। কিন্তু আশেপাশে প্রচুর দোকান থাকায়, আর সেগুলো থেকে উজ্জ্বল আলো আসার কারনে অন্ধকার তেমন একটা ছিল না।

স্কুল-অফিস ছুটি হয়ে যাওয়ায় স্টেশন ভর্তি মানুষ ছিল, সবাই বাসায় ফিরছে। বিশাল স্টেশনটার প্রথম তলায় চারকোনা একটা প্রবেশ পথ ছিল, অনেকটা টানেলের মত। লোকজন এমনভাবে ঢুকছে আর বের হচ্ছে। সেখান থেকে, মনে হচ্ছে স্টেশনটা নিঃশ্বাস টেনে ভেতর নিচ্ছে আবার ছাড়ছে।

প্রবেশ পথের কাছে কিটাযাওয়া নাটসুমিকে আমি বিদায় জানালাম। সে হাত নেড়ে তারপর টিকেট মেশিনগুলোর দিকে চলে গেল। এমনভাবে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে গেল যেরকম সাইন্স ফিকশন মুভিতে স্পেসশিপ শত্রু বহরে সাঁ করে ঢুকে যায়।

মোরিনো আর আমি দেয়াল ঘেঁসে দাঁড়ালাম যাতে লোকজনের চলাচলে বাধা না হয়। আমাদের দুজনের কারোরই ভিড়, চেঁচামেচি পছন্দ না। এসব জায়গায় বেশিক্ষণ থাকলে মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়।

“কিটাযাওয়া নাটসুমির সাথে ওর বোনের মিল দেখে অবাক হয়েছ না?” আমি বললাম।

তারচেয়েও যেটা জরুরি সেটা হলো, মানুষ বুঝে তোমার কথা বলার ভঙ্গি বদলে যাওয়া। সমস্যা হয় না?” মোরিনো তার হাত দুটো ভাঁজ করে আছে। ডান হাতে ধরা সোডা ক্যানটা বাম হাতের নিচ থেকে উঁকি দিচ্ছিল। আমি নিশ্চিত ওর শরীরের তাপে সোড়া এখন গরম হয়ে গিয়েছে।

মোরিনো লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা কিটাযাওয়া নাটসুমির দিকে তাকাল। “তুমি কি করে এত স্বাভাবিকভাবে হাসতে পারো আমি বুঝি না।”

“আনন্দিত হওয়ার কারনে আমি হাসি না।”

কথাবার্তা যাই হোক না কেন তা থেকে আমার কোন আনন্দ হয় না। সবসময় মনে হয় আমি যেন কোন গভীর অন্ধকার গর্তের তলায় দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু সাথে সাথে অবচেতনভাবে অভিনয় চালিয়ে যাই, সাবধান থাকি যেন কেউ সেটা ধরতে না পারে।

“আর সেও খুব একটা হাসে না, আমার সাথে কথা বলার সময় খালি একটু হাসল, কিন্তু ইদানিং কিছুদিন ওর অবস্থা এরকম ছিল না।”

মোরিনো ভুরু কুচকাল। “মেয়েটা হাসে না? আমার কাছে তো ওকে বেশ হাসিখুশি মনে হলো।”

আমি মোরিনোকে কিটাযাওয়া নাটসুমির সাথে ওর বোনের সম্পর্কের একটা সাধারণ বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করলাম। দুই বোনের মধ্যে চেহারায় মিল থাকলেও, ওদের মধ্যে বেশ লম্বা সময় ধরে একটা অপ্রীতিকর অবস্থা চলছিল। নাটসুমির ধারণা ছিল ওর বোন ওকে ঘৃণা করে, যে কারনে ও হাসতে ভুলে গিয়েছিল।

মোরিনো চুপচাপ শুনল, কিছু বলল না।

“আমি কিটাওয়া হিরোকোর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে গিয়েছিলাম, বুঝতেই পারছ কি কারনে। ও আমাকে ওদের এই সমস্যা সম্পর্কে আমাকে তখন বলেছিল। কিন্তু এরপর একদিন ও একটা টেপ পেল যেটায় হিরোকোর কণ্ঠ রেকর্ড করা ছিল..”

বোনের মুখোমুখি হওয়ার একটা সুযোগ ওর সামনে এল যদিও ও ভেবেছিল আবার ওদের দেখা হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।

আমি ওকে গত রাতের ঘটনা, কিংবা খুনির কথা কিছুই বললাম না। বললে ঝামেলা বাড়তে পারে। আমি শুধু ওকে সংক্ষেপে জানালাম টেপের কথাগুলো শুনে কিভাবে কিটাযাওয়া নাটসুমির মধ্যে পরিবর্তন এসেছে।

আমার মনে পড়ল ও কিভাবে টেপ রেকর্ডারটা জড়িয়ে ধরে ফ্লোরে গুটিসুটি মেরে শুয়ে ছিল।

আমি তখন ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে ছেলেটার কাপড়ে রক্ত মুছছিলাম। টেপের বর্ণনা থেকে ছোটবেলায় ওরা কিভাবে একসাথে খেলাধুলা করত তা কল্পনা করতে আমার কোন কষ্টই হয়নি।

আমি যখন এগুলো মোরিনোকে বলে শেষ করলাম, ও তখনো দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। হাত দুটো তখনো ভাঁজ করা। দৃষ্টি নিচের দিকে। মনে হচ্ছে গভীর কোন চিন্তায় ডুবে গিয়েছে। চোখগুলো আধ বোজা। মাথার উপর থেকে উজ্জ্বল আলো চোখের পাতার উপর পড়ায় চোখের নিচে ছায়া পড়েছে।

“এসবের কোন কিছুই আমার স্ট্র্যাপবুকে নেই,” সে বলল, এতটা আস্তে যে আমি প্রায় শুনতেই পারিনি। সে মাথা তুলে টিকেট মেশিনের লাইনে দাঁড়ানো কিটাযাওয়া নাটসুমির দিকে তাকাল।

লাইন সামনে এগুলে নাটসুমি মেশিনে কয়েন ফেলল। একটা বাটনে চাপ দিয়ে কাছাকাছি এক স্টেশনের টিকেট নিল। তারপর ভিড়ের দিকে এগিয়ে গেল। মানুষের স্রোতের মধ্যে মাঝে মাঝে এক ঝলক দেখা যাচ্ছে।

মোরিনো হাতে ধরা ক্যানটার দিকে তাকাল। তারপর দেয়াল থেকে সোজা হয়ে দাঁড়াল। এক মুহূর্ত পর ওর লম্বা কালো চুলও ওকে ফলো করল। ওর হাঁটা দেখে মনে হচ্ছিল শান্ত নদীর পানির মত, হঠাৎ নিস্তব্ধে আবার বইতে শুরু করেছে।

আমার বুঝতে মুহূর্তখানেক লাগল যে ও হাঁটতে শুরু করেছে। কি করতে চাইছে বুঝতে না পেরে আমি খালি তাকিয়ে থাকলাম। ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হওয়ার আগ পর্যন্ত ওকে ফলো করিনি।

মোরিনোর দৃষ্টি কিটাযাওয়া নাটসুমির উপর বিদ্ধ হয়ে ছিল, যে ইতিমধ্যে টিকেট কিনে প্লাটফর্ম গেটের দিকে এগুচ্ছে।

মোরিনো ইয়োরু নিশিতে পাওয়া মানুষের মত ওর পিছু পিছু যেতে লাগল। ভিড়ের মধ্যে হাঁটার অভ্যাস না থাকায় এদিক ওদিক লোকজনের ধাক্কা খাচ্ছিল। স্যুট পরা নারীপুরুষের ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে এসে আবার জোর সামনে এগুচ্ছে। এর আগে আমি কখনো কাউকে ভিড়ের মধ্যে এত যুদ্ধ করতে দেখিনি। ওর কাছে পৌঁছে যেতে আমার কোন সমস্যাই হলো না।

অন্যদিকে কিটাযাওয়া নাটসুমি ঘিঞ্জি গেটগুলো পার হয়ে গিয়েছে। অল্প কিছু গেটের সামনে বিশাল একদল লোক জমা হয়ে তাদের সময় আসার জন্য অপেক্ষা করছিল। তাদের মাথা আর পিঠের জন্য আমরা কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। নাটসুমিকে চোখে পরছিল না। সে মোরিনোকে খেয়াল না করে স্টেশনের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল।

মোরিনো আবার একজনের সাথে ধাক্কা খেল, মধ্যবয়স্ক বিশালদেহী এক লোক। মনে হল যেন কোন ভারি ট্রাকের সাথে একটা ট্রাইসাইকেলের সংঘর্ষ হলো। ও ধাক্কা খেয়ে আমার উপর এসে পড়ল। ওর মাথা আমার চোয়ালে লেগে চোখে অন্ধকার দেখলাম। গত কয়েক মাসে এত কিছু হলেও এরকম ক্ষতি আমার আর হয়নি। মোরিনো অবশ্য সেটা খেয়াল করেছে মনে হল না। ওর মনোযোগ ছিল কিটাযাওয়া নাটসুমি যেদিকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল সেদিকে। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জোরে চিৎকার করে ডাকল,

“নাটসুমি!”

এর আগে কখনো আমি ওকে জোরে কথা বলতে শুনিনি। এত জোরে তো প্রশ্নই আসে না। ওর শুকনো শরীরের ভেতর কোথাও মনে হলো একটা অ্যাম্পলিফায়ার বসানো আছে। আশেপাশের ভিড়ের শব্দ মুহূর্তের জন্য নিরব হয়ে গেল। কিছু লোকজন থেমে গিয়ে ওর দিকে তাকাচ্ছিল।

মোরিনো আবার হাঁটা শুরু করল। যারা যারা ওর চিৎকার শুনেছে তারা স্বরে গিয়ে ওকে জায়গা করে দিল। আমিও পিছে পিছে গেলাম।

“মোরিনো?” কিটাযাওয়া নাটসুমির গলা শোনা গেল। মানুষের ভিড় থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল ওকে। গেটের অন্য পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে নিশ্চয়ই মোরিনোর গলা শুনে ফিরে এসেছে। অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। আমাদের মাঝে একটা বন্ধ গেট। মোরিনো একটা গেট আটকে রাখায় দ্রুত আমাদের আশেপাশে ভিড় জমে গেল। যদিও মারিনো সেটা খেয়াল করল বলে মনে হলো না।

“নাটসুমি, এটা তোমার জন্য,” মোরিনো ক্যানটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল।

“ধ-ধন্যবাদ,” কিটাযাওয়া নাটসুমি ইতস্তত করে ক্যানটা নিল।

“একটু আগের বাজে মেজাজের কারনে আমি দুঃখিত। তোমার সাথে আমার আরো কথা বলা উচিত ছিল। আমি শুনেছি তোমার বোনের সাথে তোমার সম্পর্ক ঠিক হয়ে গিয়েছে।”

গেট দিয়ে যেতে না পেরে অনেক লোকজন আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। স্টেশন অ্যাটেন্ডেন্টরা সমস্যা বুঝতে পেরে ভিড় ঠেলে আমাদের দিকে আসার চেষ্টা করছিল। আমি মোরিনোর হাত ধরে টানলাম। ওকে ওখান থেকে সরিয়ে আনতে চাইলাম, কিন্তু ও বাধা দিল, সেখান থেকে নড়ল না।

“আমার সাথেও আমার বোনের সমস্যা ছিল, যখন…কিন্তু ফলাফল ভালো হয়নি…যাই হোক আমি শুধু তোমাকে অভিনন্দন জানাতে চাইছিলাম, এই আরকি।”

এরপর আমি ওকে সেখান থেকে টেনে বের করে আনতে পারলাম। ওর শরীর একদম হালকা ছিল, যেন কোন ওজনই নেই। লোকজনের সোত আমাদের পাশ কাটিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেল, কিটাযাওয়া নাটসুমি সেই সোতে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার আগে আমি ওকে হাসতে দেখলাম, মোরিনোকে ধন্যবাদ জানিয়ে।

মোরিনো আমার পিছু পিছু আসতে লাগল, ক্লান্ত মনে হচ্ছে। ওর ব্যাগটা কোথাও হারিয়ে ফেলেছে।

আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে ব্যাগটা খুঁজে পেলাম। একটু আগে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা সেখানে দেয়ালে ঠেশ দিয়ে রাখা।

আমি ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে বিদেশী নারীর ছবির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভিড়ের মধ্যে ওকে টেনে আনা কষ্টকর ছিল অবশ্য। শক্ত করে হাত ধরে ছিলাম যেন আলাদা না হয়ে যাই। ও মাটির দিকে তাকিয়ে আছে, কোনদিকে যাচ্ছে তা নিয়ে ওর কোন হুঁশ নেই। ওর ঠোঁটগুলো কাঁপছে, যেন কিছু বিড়বিড় করছে সে। ভিড়ের শব্দের কারনে শুনতে পাচ্ছি না আমি।

ভিড় ঠেলে ওর ব্যাগ রাখা জায়গাটায় পৌঁছানোর পর শুনলাম ও বলছে, “আমার মনে হয় তুমি আমার ঠিক বিপরীত, কামিয়ামা,” সে এক কথাই বার বার ফিসফিস করে বলছিল। আমাকে বাসায় যাওয়ার জন্য ট্রেন নিতে হবে। আর ওকে এখান থেকে একা একা হেঁটে বাসায় যেতে হবে। ওর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল না সেটা পারবে।

“প্রথমে আমি ভেবেছিলাম তুমি আমার মতই। তোমাকে দেখে আমার বোনের কথা মনে পড়ত। কিন্তু তুমি তা নও। আমাদের মধ্যে কোন মিল নেই।”

মোরিনোর ব্যাগটা ছিল একটা সাধারণ ধরনের কালো ব্যাগ। আমি ওটা তুলে ওর হাতে দিলাম। এক সেকেন্ড পরে সেটা আবার নিচে পড়ে গেল।

ব্যাগটা আবার তুলে ওর হাতে পেঁচিয়ে দিলাম। কিন্তু কোন কাজ হল, মনে হচ্ছিল ও ব্যাগ বহন করার জন্য খুব বেশি ক্লান্ত। ওর আঙুলগুলো ব্যাগের ওজন বহন করতে পারছে না। আঙুলের ফাঁক গলে ব্যাগটা খসে পড়ল।

“মাঝে মাঝে আমার মনে হয় তুমি উপরে উপরে হাসছ কিন্তু তোমার ভেতরটা শূন্য। শুনতে খারাপ লাগলে আমি দুঃখিত, কামিয়ামা। কিন্তু আমার তাই মনে হয় যখন তোমাকে অন্যদের সামনে হাসিখুশি অবস্থায় দেখি। আর মাঝে মাঝে তোমার জন্য আমার সত্যি সত্যি দুঃখ হয়।”

আমার দিকে না তাকিয়ে মোরিনো কথাগুলো বলে যাচ্ছে। ওর গলা কাঁপছে, মনে হচ্ছে যেন একটা ছোট বাচ্চা যেকোন মুহূর্তে কান্নায় ভেঙে পড়বে।

“কিন্তু আমি একদম উল্টো ধরনের।”

মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল, চোখে চোখ রাখল। আমি ওর চেয়ে লম্বা হওয়ার কারনে এটুকু দূরত্বের মধ্যেও ওকে উপরের দিকে তাকাতে হলো। ওর অভিব্যক্তি বরাবরের মতই শূন্য ছিল। কিন্তু চোখগুলো ঈষৎ লাল হয়ে ছিল, ভেজা দেখাচ্ছিল।

“আমি জানি,” আমি বললাম।

একটা দীর্ঘ মুহূর্ত ও নড়াচড়া না করে চুপ করে থাকল। তারপর মাথা নামিয়ে নড় করে বলল, “তাহলে ঠিক আছে। এভাবে বকবক করার জন্য আমি দুঃখিত।”

আমি ওর ব্যাগটা এগিয়ে দিলাম, ও সেটা এমনভাবে হাতে নিল যেন কিছুই হয়নি। এবার আর সেটা খসে পড়ল না।

আমাদের ডান-বাম দিয়ে যাওয়া আসা করা লোকজনের দিকে তাকাল। আমি বুঝতে পারছিলাম না ও কী দেখছে, কারন লোকজনের ভিড় ছাড়া আর কিছু ছিল না।

তারপর আস্তে করে বলল, “আমি আসলেই নাটসুমির জন্য আনন্দিত। খানিকটা হিংসাও হচ্ছে।”

মোরিনো আবার আগের মোরিনোতে ফিরে এসেছে, আমার সাহায্যের আর ওর দরকার নেই।

এরপর আমরা দুজন দুজনার থেকে বিপরীত দিকে হেঁটে চলে গেলাম, একজন আরেকজনকে কোন রকম কোন বিদায় না জানিয়েই।

1 Comment
Collapse Comments
দারাশিকো ডট কম September 1, 2022 at 9:59 pm

অৎসুইশির সাথে পরিচিত হয়ে খুশী হলাম। কৌশিক জামানের অনুবাদ খুব ঝরঝরে। পড়তে গিয়ে মনেই হয়নি যে অনুবাদ পড়ছি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *