৫. সমাধি

সমাধি

কৌসুকি ডাকছিল সেইকিকে। বাচ্চা ছেলেটা সবসময়ই নিষ্পাপ আর হাসিখুশি ধরনের। কিন্তু আজকে ওর গলা বিষণ্ণ শোনাল। কৌসুকি হলো পাশের বাসার ছোট ছেলেটা, যে কিনা সবেমাত্র কিন্ডারগার্টেনে ঢুকেছে।

“কি হয়েছে?”

সেইকি ওর বাগানে ছিল, মর্নিং গ্লোরির চারাতে নিড়ানি দিচ্ছিল। গ্রীষ্মের সময়, ভোরবেলা। বাগানের ভেতর হালকা একটা কুয়াশার মত ভেসে বেড়াচ্ছে, যে কারনে সবকিছু চকচক করছে। গ্রপ এক্সারসাইজের জন্য ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে ওর বাগানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। দেয়ালের কারনে সেইকি ওদের দেখতে পাচ্ছে না। দেয়ালটা ওর বুক পর্যন্ত উঁচু। কিন্তু ওদের পায়ের শব্দ আর হৈচৈ ওর কানে আসছে।

“আব্বু কি এখনো রেগে আছে?” কৌসুকি গত রাতে সেইকির বাসায় এসে হাজির হয়েছিল। কাঁদছিল ছেলেটা। এরপর আর বাসায় ফিরে যায়নি।

সেইকি যখন ওকে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে, কৌসুকি কাঁদতে কাঁদতে বলল ওর বাবার পুরস্কার জেতা একটা অ্যান্টিক ওর ধাক্কা লেগে ভেঙে গেল। কৌসুকিকে হাজারবার সাবধান করা হয়েছে যেন কোন অ্যান্টিকে হাত না দেয়, কিন্তু ও নিজের কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারেনি।

“না, আমার মনে হয় না সে আর তোমার উপর রেগে আছে।”

সেইকি ছেলেটাকে বলল কিভাবে ওর বাবা-মা গতরাতে ওকে খুঁজতে এসেছিল। সেইকি ওর দরজায় তাদের সাথে দেখা করে। তারা জানতে চায় সে কৌসুকিকে দেখেছে কিনা। ওদেরকে অনেক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছিল। সেইকি মাথা নাড়ল, এমন ভান করল যেন কিছু জানে না। তারপর সেইকিকে খুঁজতে ওদেরকে সাহায্য করল।

“সত্যি রেগে নেই তো?”

“সত্যি।”

সেইকির সামনে মাটিতে গেঁথে রাখা বাঁশের খুঁটির সাথে মর্নিং গ্লোরির চারা পেঁচিয়ে ছিল। বাঁশের খুঁটিটা শুকিয়ে বাদামি রঙের হয়ে গিয়েছিল।

সেইকি থাকত একটা পুরনো বাড়িতে। বাড়ির সাথে একটা বড় বাগান। বাগানটা আশেপাশের সবার বাড়ির চেয়ে বড়। জমিটা দেখতে প্রায় বর্গাকৃতির। বাড়ি আর গ্যারেজটা পুব দিকে। বাকি জমিটা পুরো খালি ছিল। সেইকি খালি জায়গাটা গাছ লাগিয়ে ভর্তি করে ফেলেছে। গ্রীষ্মে মাঝে মাঝে, যেমন আজকে, মাটি পাতা দিয়ে ঢেকে রাখা আছে।

বাগান করতে সেইকির সবসময়ই ভালো লাগে। ছোট থেকেই ভালো লাগত। বাগানের পুরো দেয়াল সে মর্নিং গ্লোরি লাগিয়ে ঢেকে ফেলেছে।

সেদিন আকাশ ছিল পরিস্কার। মেঘশূন্য আকাশে বরাবরের মত সূর্য উঠল। দেয়াল আর গাছগুলোর ভেতর দিয়ে পিছলে ঢুকে গেছে সূর্যালোক। বাঁশের খুঁটিগুলো আর মর্নিং গ্লোরি মাটিতে লম্বা ছায়া ফেলেছে।

ও শুনতে পাচ্ছিল কৌসুকি কাঁদছে।

আগের রাতে কৌসুকি যখন ওর দরজায় এসে নক করে সেইকিকে অনুরোধ করল ওকে কোথাও লুকিয়ে রাখতে। সেইকি ওকে বাসার ভেতর ঢুকতে দিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ দেখছে কিনা।

“তুমি নিশ্চিত কাউকে বলনি যে এখানে এসেছ?” সেইকি আবার জিজ্ঞেস করল। ছেলেটা চোখ মুছতে মুছতে মাথা ঝাঁকাল। একটা বাচ্চা ছেলের কথায় কতখানি ভরসা করা যায়? অবশ্য ব্যাপারটা নিয়ে এখন আর কোন চিন্তা করার কোন মানে হয় না বলে সেইকির কাছে মনে হলো।

আগে যখন ও কৌসুকির সাথে ঝিঁঝি পোকা ধরত কিংবা ওকে কার্ড বোর্ড বক্স নিয়ে খেলতে দেখত, তখন সেইকির মাথায় একটা চিন্তা উঁকি দিতে শুরু করেছিল। একটা ফ্যান্টাসি যেটাকে প্রশ্রয় দেয়া সম্ভব নয়। এরকম ভয়াবহ কিছু চিন্তা করার জন্য সে নিজেকে ধিক্কার দিয়েছিল। কিন্তু গতকাল তার মাথা ঘোলাটে হয়ে গিয়েছিল, ঠিক মত কাজ করছিল না…

“তোমার কি মনে হয় আমার ক্ষমা চাওয়া উচিত?”

ওর জন্য বুকের ভেতর কষ্ট হতে লাগল সেইকির। সে একাই বাস করে। অনেক আগেই মারা গেছে ওর পরিবারের সবাই, তাই ও কৌসুকিকে সবসময় নিজের ছোট ভাইয়ের মতই দেখত। কৌসুকির পরিবার যখন বাইরে কোথাও গিয়েছে তখন সে ওর জন্য বেবিসিট করেছে। দু-জনে একসাথে ঘোরাঘুরি করেছে। সেইকি নিশ্চিত ছিল যে ও কৌসুকিকে ওর বাবা-মায়ের মতই ভালোবাসত। তাহলে কেন সে এরকম কিছু করতে গেল? এখন অবশ্য ফিরে আসার আর কোন উপায় নেই।

“তুমি আর বাসায় ফিরে যেতে পারবে না, কৌ,” বলতে গিয়ে সেইকির গলা কাঁপছিল। ওর বাগানের মর্নিং গ্লোরিগুলো একটা বাঁশের খুঁটি জড়িয়ে বেড়ে উঠেছে। দুটো বাঁশের খুঁটি অন্য খুঁটিগুলোর চেয়ে খানিকটা লম্বা।

কৌসুকির গলাও কাঁপছে। সে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। বাসায় ফিরতে পারব না কেন?”

মাটিতে পুঁতে রাখা বাঁশের খুঁটি থেকে ওর গলা ভেসে এল। খুঁটিটার ভেতরটা ফাঁপা। যে কারনে মাটির নিচে পুঁতে রাখা কফিন থেকে শব্দ খুঁটির ভেতর দিয়ে এসে সেইকির কানে পৌঁছাতে পারছে। কৌসুকি জানত না যে ওকে জ্যান্ত কবর দেয়া হয়েছে। কি দুঃখজনক ব্যাপার!

আগেরদিন যখন কৌসুকি ওর বাসায় এল, সেইকি তখন মনস্থির করে ফেলেছিল। সে ছেলেটাকে পেছনের একটা রুমে নিয়ে গিয়ে একটা বাক্স দেখিয়ে বলল, “বাক্সটার মধ্যে গিয়ে লুকিয়ে থাক।” রুমের মাঝামাঝি একটা বাক্স রাখা ছিল। কৌসুকির জন্য যথেষ্ট বড়, সহজেই ওটার ভেতর ঢুকে শুয়ে থাকতে পারবে।

কৌসুকি প্রায় সবসমই সেইকি যেরকম বলে সেরকমই করার চেষ্টা করে। তাছাড়া সে ওর বাবার ক্রোধ নিয়ে ভীত ছিল, সুতরাং কোন সন্দেহ না করেই বাক্সের ভেতর ঢুকে গেল।

সেইকি বাক্সের ঢাকনা বসিয়ে পেরেক মেরে আটকে দিল। কফিনে বাতাস চলাচলের জন্য দুটো ফুটো ছিল। একটা কৌসুকির মাথার কাছে আরেকটা পায়ের কাছে। যে কারনে ঢাকনা লাগিয়ে দিলেও ছেলেটা নিঃশ্বাস নিতে পারছিল।

কৌসুকির কফিন রুমে রেখে ও বাইরে বাগানে গেল। পোর্চের বিপরীতে দেয়ালের সামনে একটা গর্ত খোঁড়া ছিল। কৌসুকির কফিনটাকে মাটি চাপা দেয়ার জন্য ওকে শুধু গর্তটা একটু বড় করতে হবে।

গর্ত করা হলে সে রুমে ফিরে গিয়ে কফিনটা বয়ে নিয়ে এল। কৌসুকিকে বলল সে ওকে এমন এক জায়গায় লুকিয়ে রাখছে যেখানে ওর বাবা কখনো খুঁজে পাবে না। কফিনটাকে পোর্চ থেকে বাগানে নিয়ে যেতে ঘাম ছুটে গেলেও কাজটা হলো। আস্তে করে সেইকি কফিনটাকে গর্তে নামিয়ে দিল।

ফাঁপা বাঁশের খুঁটিগুলোকে সে কফিনের গর্তে ঢুকিয়ে দিল। তারপর মাটি ঢেলে কৌসুকিকে পুরোপুরি কবর দিয়ে দিল।

খালি জায়গার মধ্যে দুটো বাঁশ দাঁড়িয়ে আছে দেখতে অদ্ভুত আর সন্দেহজনক লাগতে পারে ভেবে সেইকি অন্য জায়গা থেকে কয়েকটা মর্নিং গ্লোরির চারা তুলে এনে ওখানে লাগালো। মর্নিং গ্লোরিগুলো সাবধানে খুঁটির সাথে পেঁচিয়ে দিল যেন দেখে মনে হয় বাঁশগুলো ঐ চারাগুলোর জন্যই ওখানে পোঁতা হয়েছে।

“কী বলছ এসব? আমি বাসায় যেতে চাই!” বাঁশের খুঁটি কেঁদে উঠল।

বেচারী কৌসকি, জীবন্ত কবর দেয়া হয়েছে ওকে, সেইকি ভাবল। বাঁশের খুঁটির চারপাশে মাটি দিয়ে শক্ত করে দিল যেন সোজা হয়ে থাকে।

ওর সমস্যাটা কি? এই বাচ্চা ছেলেটাকে তো ও ভালবাসত। ও একবার দেখেছিল কৌসুকি একটা গাড়ির নিচে প্রায় চাপা পড়তে যাচ্ছিল। ছেলেটা একটা বলের পেছনে দৌড়াচ্ছিল, গাড়িটাকে আসতে দেখেনি। গাড়িটা শেষ মুহূর্তে ব্রেক কষায় ও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। উত্তেজনায় ওর পা কাঁপছিল তখন। আর এখন সেই ছেলেকে ও কিভাবে জ্যান্ত কবর দিতে পারল?

সেইকি এই বাড়িতেই বড় হয়েছে। প্রথমে ওর বাবা-মা আর দাদি এ বাড়িতে বাস করত। বেশিরভাগ সময়ই ওর বাবা-মা কাজের জন্য বাইরে থাকত, যে কারনে ওর পুরো সময় কাটত ওর দাদির সাথে। অন্য ছেলেমেয়েরা যখন বাস্কেটবল খেলা নিয়ে ব্যস্ত কিংবা মডেল বানাচ্ছে, সেখানে সেইকি দাদির সাথে বাগান করায় ব্যস্ত থাকত। টবগুলো কালো মাটি দিয়ে ভরাট করা, তার ভেতরে ফুলের বীজ বপন করা। সেইকির ক্লাসমেটরা এই নিয়ে প্রায়ই হাসাহাসি করত, ওকে মেয়ে বলে ক্ষ্যাপাত। সেইকি ছিল দূর্বল, শুকনো ধরনের। অপরিচিত লোকজন ওকে দেখে মেয়ে ভেবে ভুল করত। অবশ্যই সেটা ওর গায়ে লাগত। কিন্তু যখন ও ওর দাদির সাথে থাকত, ফুলগাছে পানি দিত, তিনি সবসময় ওকে লক্ষ্মী ছেলে বলতেন। কখনো মন খারাপ হলে ও ওর দাদির বলা কথাগুলো মনে করত, আর নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করত যে ওকে অবশ্যই একটা সুন্দর জীবন যাপন করতে হবে, দাদির সম্মান ধরে রাখতে হবে। কিন্তু এরপর কোনভাবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই কাউকে জ্যান্ত কবর দেয়ার ফ্যান্টাসি ওকে দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছে।

বাগানে পানি দিতে ওর ভালো লাগত, উজ্জ্বল পরিস্কার দিনগুলোতে এক হাতে হোস পাইপ নিয়ে আরেক হাতের আঙুল মুখে ঢুকিয়ে বাগানে পানি দিত। হাতের চাপে পানি ছিটকে যেত বহুদুর। গাছের উপর গিয়ে পড়া পানি সূর্যের আলোয় চিকচিক করত। সেটা যখন ওর চোখে পড়ত কিংবা যখন ওর দাদি হাসতেন, তখন ওর অনেক আনন্দ হতো, মনে হত যেন চারপাশের আলোর উজ্জলতা আরো বেড়ে গিয়েছে।

আবার একই সাথে, ওর ভেতরে কোথাও একটা অন্ধকার জায়গা লুকিয়ে ছিল, যেখানে সেই আলো পৌঁছাতে পারত না। ওর দাদিকে বাক্সে ভরে মাটিতে কবর দেয়ার চিন্তা ওর মাথায় আসত। প্রতিবার চিন্তাটা মাথায় আসতেই ও আতঙ্কে কেঁপে উঠত।

কিভাবে এরকম জঘন্য কোন কিছু ও চিন্তা করতে পারল? এমন সময়ও ছিল যখন ও ওর দাদির দিকে তাকাতেও পারত না। মনে হত তিনি হয়তো ওর চিন্তা ধরে ফেলবেন।

এমন কি হতে পারে যে ওর ভেতরে কোথাও কোন গভীর ক্ষত লুকিয়ে ছিল যা ওকে এরকম বানিয়েছে? সেরকম কিছু ও চিন্তা করে পেল না, কিংবা থাকলেও হয়তো ভুলে গিয়েছে। কিংবা-যেটা ওর সবচেয়ে বড় ভয় হচ্ছে ভাবতে-হয়তো ও জন্ম থেকেই এরকম।

বড় হওয়ার কয়েকবছর পর সেইকির বাবা-মা আর দাদি রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। ও তখন অফিসে ছিল।

এর আগ পর্যন্ত ওর বাসাকে ঘিরেই ওর পরিবার ছিল, তাদের সাথে ওর যোগাযোগ সবসময় ওকে সমাজে ওর অবস্থানের কথা মনে করিয়ে দিত। কিন্তু এক্সিডেন্টের পর পুরো বাড়িতে ও একা হয়ে পড়ল, ওর ফ্যান্টাসি আটকিয়ে রাখার মত কোন কিছুই আর অবশিষ্ট ছিল না। প্রতিদিন সে কাজে যেত, কাজ থেকে বাসায় ফিরত; বাসায় কথা বলার কেউ ছিল না, একই জিনিস নিয়ে ও বার বার চিন্তা করত, সেই ছোট বেলা থেকে যে জিনিসগুলো ওর মাথায় ঢুকে আছে। ও সেগুলো ঝেড়ে ফেলার চেষ্টাও করেছে, নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে এসব ক্ষমার অতীত। তারপর নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য বাগানের পেছনে বেশি বেশি সময় দিতে শুরু করেছে।

যখন ওর পরিবার বেঁচে ছিল তখন ও শুধু কিছু চারা রোপন আর আগাছা পরিস্কার ছাড়া আর কিছুই করেনি। কিন্তু এখন ও উর্বর মাটি কিনে এনে বাগানে ফেলল, নিত্য নতুন গাছ লাগাতে লাগল।

একটা পুরো বছর সেইকি দেয়ালের পাশে গর্ত করে গাছ লাগালো। ওর অফিসের কাজের বাইরের পুরো সময় এই কাজে খরচ করল। ওর বয়সি অন্যদের মত কোন কিছুতে ওর কোন আগ্রহ ছিল না।

একসময় দেয়ালের ভেতর বাড়ির চারপাশ দিয়ে গাছ লাগানো হয়ে গেল। এক ইঞ্চি জমিও খালি ছিল না। কেউ যদি দেয়ালের ওপার থেকে উঁকি দেয় তাহলে গাছপালার ভেতর দিয়ে বাড়ি প্রায় চোখেই পড়বে না। পুরো বাগানের খালি একটা অংশে কোন গাছ ছিল না, যে অংশটা সে পোর্চ থেকে দেখতে পেত। দেয়াল থেকে ঐ পুরো অংশটা খালি ছিল। সেখানে সেইকি ফুলের চারা লাগাত, যেগুলোতে সারা বছর ফুল ফুটত।

প্রথমে সেইকির ধারণা ছিল ও শুধু গাছ লাগানোর জন্যই গর্ত খুঁড়ত। কিন্তু পরে ও অনুভব করল গর্তগুলোর উপযুক্ত ব্যবহারের জন্যই আসলে গাছ লাগাত। একসময় ও খালি গর্ত খুঁড়ত আর সেগুলো আবার ভরাট করত। বাগানের গাছগুলো এত কাছাকাছি ঘেঁসে বেড়ে উঠেছিল যে ওগুলো ডালপালা বিস্তারের জায়গা পর্যন্ত ছিল না, নতুন করে গর্ত খুঁড়ে গাছ লাগানো ছিল অসম্ভব। তারপরেও সেইকি গর্ত খুঁড়ে যেতে লাগল কারণ এই একটা কাজই ওকে ওর ফ্যান্টাসি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সক্ষম ছিল তখন, কাউকে কবর দেয়ার ফ্যান্টাসি থেকে। গর্ত খোঁড়ার সময় সেইকি বাকি সবকিছু ভুলে যেত। কিন্তু সেটা গর্ত খোঁড়ার যন্ত্রপাতি নামিয়ে রাখার আগ পর্যন্তই।

গর্ত খুঁড়ে আবার ভরাট করার ব্যাপারটাও একসময় অর্থহীন আর শূন্য লাগতে লাগল। গর্ত খোঁড়ার সময় ওর মনের ঘোলাটে ভাবটা দূরে সরে যেত ঠিকই কিন্তু কাজ শেষ হওয়া মাত্র সেটা আবার ফিরে আসত। ফিরে আসত আগের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে, কিন্তু সেইকি ওর গর্ত খোঁড়াখুঁড়ি চালিয়েই যেত, যে কারনে সে রাতে কৌসুকি আসার পরে একটা গর্ত তৈরিই ছিল।

ওর প্রতিবেশিদের কাছে ওর কর্মকাণ্ড কেন জানি অদ্ভুত কিংবা অস্বাভাবিক লাগেনি। এমনকি ও যখন রাতেও খোঁড়াখুঁড়ি করত, তখনো। ওর সাথে দেখা হলে সবাই প্রথমে মাথা নিচু করে বো করত, তারপর নিজেদের বাগানের জন্য ওর থেকে পরামর্শ নিত। সবাই জানত যে ও বাগান করতে পছন্দ করে, এর মধ্যে অস্বাভাবিক কোন কিছু তারা দেখতে পায়নি। সবাই ওর প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল, হাজার হোক বেচারা রোড এক্সিডেন্টে পরিবারের সবাইকে হারিয়েছে, বাগান করার শখটা ছাড়া ওর আর কী বাকি আছে।

একবছর আগে, ওর পরিবারের সবাই মারা যাওয়ার দু-বছর পর, কৌসুকির সাথে ওর খাতির হয়। ছেলেটা সেইকির বাগানে হারিয়ে গিয়েছিল। এরপর তারা বন্ধু হয়ে ওঠে। সেইকি অনেকবার কৌসুকির পরিবারের সাথে পিকনিকে বাইরে গিয়েছে।

কৌসুকির সাথে সম্পর্ক যখন নয়-দশ মাসের মত হলো, সেইকি তখন ওর গ্যারেজে কিছু কাঠ খুঁজে পেল যেগুলো কৌসুকির উচ্চতার মত হবে। সাথে সাথে ওর মাথায় এল যে এগুলো দিয়ে কৌসুকির জন্য চমৎকার একটা কফিন বানানো যেতে পারে।

চিন্তাটা আসার পরেই ও আতঙ্কের সাথে চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল। কিন্তু পরদিন থেকে সে কফিনের কাজ শুরু করল। কাজ করতে করতে নিজের বোকামির জন্য নিজেকে ধমক লাগালো। কফিন বানাচ্ছে ঠিকই কিন্তু কখনো এটা ব্যবহার করা হবে না, নিজেকে সে নিজে বলল। কিন্তু তারপরেও ওর হাতগুলো নিজে থেকে পেরেকে হাতুড়ি ঠুকে গেল কোন রকম চিন্তা ভাবনা ছাড়াই, স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে কাঠগুলো দিয়ে একটা কফিন তৈরি করে ফেলল।

“আমি বাসায় যেতে চাই। আমাকে এখান থেকে বের কর!” কৌসুকি কাঁদছিল। সেইকি ওর ফোঁপানোর শব্দ শুনতে পাচ্ছিল বাঁশের খুঁটির ভেতর থেকে। গর্তের ভেতরটা অন্ধকার। বাচ্চার গলার স্বর এর ভেতর প্রতিধ্বনি তুলছিল, কেমন চাপা শোনাচ্ছিল।

কৌসুকিকে কি বলবে সেইকি বুঝতে পারছিল না। ছেলেটার জন্য ওর অনেক খারাপ লাগছিল। অনেক খারাপ। ছেলেটার প্রতি ওর অনেক মায়া হলেও বলার কিছু ছিল না।

সেইকি একটা হোস পাইপ ধরে আছে। পাইপের আরেক মাথা বাড়ির পাশের একটা কলের সাথে লাগানো।

গ্রীষ্মের গরম বাড়ছিল, চারপাশ থেকে পোকামাকড়ের শব্দ ভেসে আসছিল। সেইকির পিঠ থেকে তাপ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে।

এক ঝলক পানি এসে সেইকির স্যান্ডেলের মুখে পড়ল, কৌসুকির কবর থেকে একটা বাঁশের খুঁটি দিয়ে বেরিয়ে এসে মাটিতে পড়ছে। মর্নিং গ্লোরিগুলোকে ভিজিয়ে মাটিতে ছোটখাট পুকুরের মত সৃষ্টি করেছে। যেই বাঁশের খুঁটিটা নিঃশ্বাস চলাচলের জন্য ছিল সেটা থেকে পানি বের হচ্ছিল। আরেকটা খুঁটিতে হোস পাইপটা ঢুকানো ছিল। সেখানে সেইকির চোখ পড়তেই হঠাৎ খেয়াল হলো ও কি অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছে। যদিও পুরো ব্যাপারটা অন্যমনস্কভাবে ঘটিয়েছে তা বলা যাবে না।

ও সজ্ঞানেই কলের চাবি খুলে হোস পাইপ দিয়ে পানি ঢুকতে দিয়েছে, মাটির নিচে চাপা দেয়া বাক্সটা পানি দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে। পুরোটা সময় ওর মনে হচ্ছিল যেন কোন স্বপ্ন দেখছে। যে সজ্ঞান অন্য কাউকে বাঁধা দিত তা ওর ক্ষেত্রে তখন কাজ করছিল না।

কফিনটা ভরে আর কোথাও যাওয়ার জায়গা না পেয়ে অন্য বাঁশের খুঁটিটা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। খুঁটি থেকে ফোয়ারার মত ছিটকে পড়া পানি সূর্যের আলো পরে চকচক করে উঠল। সেইকির কাছে দৃশ্যটা অসাধারণ সুন্দর মনে হলো। সেই সাথে যুক্ত হয়েছিল পোকামাকড়ের গান আর এক্সারসাইজ করে ফেরা ছেলেমেয়ের দলের কোলাহল। তারা এবার অন্যদিক থেকে আসছিল। ওর দেয়ালকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। কৌসুকির কাছ থেকে আর কোন সাড়া-শব্দ শোনা যাচ্ছে না। আর মর্নিং গ্লোরিগুলো মলিন হয়ে কুঁচকে যেতে শুরু করেছে।

***

কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিন বছর পার হয়ে গেল।

ওকে গ্রেফতার করার জন্য কোন পুলিশ আসেনি। কৌসুকির বাবা-মা এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেল। যাওয়ার সময় তাদেরকে অনেক দুঃখি দেখাচ্ছিল। সেইকি ছাড়া আর কেউ তাদেরকে যাওয়ার সময় দেখেনি। কেউ কল্পনাও করেনি কৌসুকিকে সে খুন করেছে, বরং সবাই ভেবেছে ছেলেটার নিখোঁজ সংবাদ ওকে কষ্টে ফেলে দিয়েছে।

সেইকি কোন অভিনয় করেনি, ওর সত্যি সত্যি ছেলেটার জন্য কষ্ট লাগছিল। কিন্তু ও চোখ তুলে সরাসরি ছেলেটার বাবা-মায়ের দিকে তাকাতে সাহস পায়নি। তাদের চোখের অশ্রু ওকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল কি ভয়াবহ জঘন্য একটা কাজ সে করেছে।

এই তিন বছর সেইকি সারাক্ষণ আতংকে ছিল যে কেউ একজন বের করে ফেলবে ও কি করেছে। এই পুরো সময় একবারের জন্য সেইকি ওর বাগানের সেই অংশে যায়নি, যেখানে কৌসুকিকে সে জ্যান্ত কবর দিয়েছিল। জায়গাটা এখন আগাছা ঝোপে ঢেকে আছে। কৌসুকিরা যে বাসায় থাকত সে বাসায় এখন নতুন একটা পরিবার এসে উঠেছে।

গ্রীষ্মের শুরুতে, প্রতিবেশি এক গৃহিণী এসে সেইকির বাড়িতে একটা নিউজলেটার দিয়ে গেল। দরজায় দাঁড়িয়ে মহিলাটা এক সিরিয়াল কিলারের কথা জানাল ওকে যে কিনা মেয়েদেরকে শিকার হিসেবে বেছে নিচ্ছে, সব টক শো-গুলোর আলোচনার বিষয়বস্তু এখন এই সিরিয়াল কিলিং। স্বাভাবিকভাবেই কথাবার্তা একসময় কৌসুকিতে গড়াল।

“কৌসুকি নিখোঁজ হওয়ার পর তিন বছর হয়ে গেল…ওর সাথে তো তোমার খুব খাতির ছিল, তুমি নিশ্চয়ই অনেক মিস কর ওকে?”

সেইকির টেনশন হতে লাগল, কৌসুকির হাস্যরত ছোট মুখটার কথা ওর মনে পড়ল। এক রাশ দুঃখ এসে গ্রাস করল ওকে। নিজ হাতে মাটি চাপা দিয়ে ছেলেটাকে ও পানিতে ডুবিয়ে মেরেছে, কিন্তু তারপরেও ওর গোলমেলে মাথা এখনো ব্যাপারটা নিয়ে দুঃখবোধ করতে সক্ষম। কি ভয়াবহ জঘন্য একটা ব্যাপার।

সেইকি দুঃখের সাথে মাথা ঝাঁকাল। কিন্তু এরপর মুখ তুলে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে ও অবাক হলো। অদ্ভুত একটা ব্যাপার সে খেয়াল করল। মহিলাটিকে মোটেও দুঃখিত দেখাচ্ছিল না। সে এরই মধ্যে প্রসঙ্গ বদলে ফেলেছে। গরম বাড়ার কারনে পোকামাকড়ের আওয়াজ অনেক বেড়ে গিয়েছে এই নিয়ে সেইকির কাছে অভিযোগ করছিল। পৃথিবী ইতিমধ্যে কৌসুকির মৃত্যুশোক পার করে ফেলেছে।

কিছুদিন পর সেইকি টের পেল সে নতুন করে আবার কাঠ আর পেরেক কিনছে। আরেকটা কফিন তৈরি করার জন্য। কফিনটা ঘরের মধ্যে বসে বানালে কেউ দেখবে না। তক্তাগুলোকে করাত দিয়ে কেটে মাপমত করতে গিয়ে কাঠের সুক্ষ্ম খুঁড়োগুলো তাতামি ফ্লোরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল।

গ্রীষ্মকাল বয়ে চলছে। সেইকি টের পাচ্ছে ওর ভেতর শুভ আর অশুভের লড়াই চলছে। শুভ অংশটা চাইছে আবার কোন ভয়াবহ ঘটনা ঘটানোর থেকে ওকে বিরত রাখতে, আর অশুভ অংশটা নতুন শিকার খুঁজছে। কিন্তু ওর ভেতরের এই যুদ্ধ কখনো বাইরে তার চেহারা দেখায়নি। যে কারনে ওর আশেপাশের দুনিয়া ওকে আগের মতই দেখছে। স্বয়ংক্রিয় কোন যন্ত্রের মত ও কোন সমস্যা ছাড়াই দৈনন্দিন কাজগুলো করে যেতে লাগল।

তারপর একদিন, অক্টোবরের শেষের এক শুক্রবারে, সেইকি কাজ থেকে বেরিয়ে গাড়ি বের করতে পার্কিং লটে গেল। তারপর বাসার দিকে ড্রাইভ করতে লাগল। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। হেডলাইট জ্বালানো গাড়ির সারি পার হতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই ওর চোখ পড়ল রাস্তার পাশের দিকে। এক মুহূর্ত পর ও উপলদ্ধি করে কেঁপে উঠল যে ওর চোখ আসলে একজন মানুষকে লক্ষ্য করছিল, পরীক্ষা করছিল। রিয়ার ভিউ মিররে রিফ্লেক্সন দেখতে গিয়ে ওর মুখের অভিব্যক্তি সব যেন কোথাও হারিয়ে গেল, মনে হচ্ছিল চোখের কালো অংশগুলো যেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গভীর গর্তে পরিণত হয়েছে।

অফিসে সবাই ওকে চুপচাপ মানুষ হিসেবেই ধরে নিয়েছে। ও বাসা থেকে ফুল নিয়ে যেত অফিসে সাজিয়ে রাখার জন্য, যা কাজ দেয়া হত কোন অভিযোগ ছাড়াই সম্পন্ন করত। সবাই ওকে ভালো মানুষ হিসেবেই জানত, পছন্দ করত, বিশ্বাস করত। তাদের কেউ ঘুণাক্ষরে কল্পনাও করতে পারবে না যে সেইকি একটা বাচ্চা ছেলেকে খুন করেছে।

বাসার কাছাকাছি গিয়ে ও বামে মোড় নিল। এই রাস্তায় ট্রাফিক কম।

আর সেখানে সেইকি মেয়েটাকে দেখল।

রাস্তার পাশ দিয়ে মেয়েটা হেঁটে যাচ্ছে। হেডলাইটের আলোয় সেইকি ওর শরীরের পেছন অংশটা দেখতে পাচ্ছিল। মেয়েটার পরনে কালো রঙের ইউনিফর্ম। লম্বা চুলগুলো কাঁধ বেয়ে নিচ পর্যন্ত নেমে গিয়েছে।

মেয়েটাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় সেইকি কোন কিছু না ভেবেই গাড়ির গতি কমিয়ে আনল। মেয়েটার চুল যেন ওর চোখগুলোকে জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল ওকে আহবান জানাচ্ছে।

সেইকি উইন্ডসিল্ড দিয়ে উপরে তাকিয়ে দেখল রাতের আকাশে পূর্ণ চাঁদ ঝুলে আছে। কোথাও কোন মেঘের ছিটে ফোঁটাও নেই। পুরো এলাকা চাঁদের আলোয় মলিনভাবে আলোকিত হয়ে আছে। জায়গাটা একটা আবাসিক এলাকা, এলাকার সামনেই একটা পার্ক। আশেপাশের গাছগুলো ইতিমধ্যেই তাদের অর্ধেক পাতা হারিয়েছে।

সেইকি সামনের চৌরাস্তায় গিয়ে ডানে মোড় ঘুরে গাড়ি থামাল। হেডলাইট নিভিয়ে মিররের দিকে তাকিয়ে থাকল। মেয়েটার আসার জন্য অপেক্ষা করছে।

মেয়েটা যদি সোজা কিংবা বাম দিকে যায় তাহলে সেইকি গাড়ি চালিয়ে বাসায় চলে যাবে। কালকে অফিস ছুটি। সারাদিন বাসায় বসে আরাম করা যাবে।

কিন্তু মেয়েটা যদি এদিকে আসে…

একটা শুকনো পাতা খসে জানালার উপর টোকা দিয়ে পেভমেন্টের উপর পড়ল। আগেরদিন পড়া প্রতিবেশির নিউজলেটারটার কথা মনে পড়ল ওর। রাস্তায় পড়ে থাকা পাতা পরিস্কার করা নিয়ে একটা আর্টিকেল ছিল। সেখানে। আজকে বিকেলেই পরিস্কার করা হয়েছে। যে কারনে রাস্তায় পড়া পাতার সংখ্যা কম ছিল। সকালে পাতায় ঢেকে ছিল জায়গাটা। তার মানে তাদের পাতা পরিস্কারের কাজ আজকের মত শেষ। আরেকটা শুকনো পাতা খসে পড়ে ওর গাড়ির উইন্ডসিন্ডের ওয়াইপারের মধ্যে জায়গা করে নিল।

কোথাও কোন শব্দ নেই। সেইকি গাড়ির ভেতর বসে ছিল। ওর হাত দুটো শক্ত করে স্টীয়ারিং হুইল চেপে ধরে আছে। মিররে এইমাত্র পার হয়ে আসা মোড়টা দেখা যাচ্ছে। অবশেষে চাঁদের ফ্যাকাসে আলোর মধ্যে মেয়েটাকে দেখা গেল।

গ্যারেজে গাড়ি পার্ক করে সেইকি তাড়াতাড়ি বিশাল ধাতব দরজাটা লাগিয়ে দিল, ক্যাঁচকোঁচ শব্দ আশেপাশে নিস্তব্ধ এলাকার মধ্যে প্রতিধ্বনি তুলল। গ্যারেজের বাইরে দাঁড়িয়ে ও পড়ে থাকা শুকনো পাতার দিকে চাইল।

গ্যারেজের পাশে লাগ্লো গাছগুলো বড় হয়ে উঠেছে। ওগুলো থেকে শুকনো পাতা পড়ে ওর গ্যারেজ প্রায় ঢেকে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি ওগুলো ঝাঁট দিয়ে পরিস্কার করা দরকার।

ওর বাবা-মা আর দাদি মারা যাওয়ার পর থেকেই সেইকি বাসায় একা। সব পরিস্কার করা, লন্ড্রি সব কাজ ও একাই করে। আর প্রতিবার করতে গিয়ে ওর উপলদ্ধি হয় ও কতটা নিঃসঙ্গ।

ওর সদ্য বিবাহিত একজন কলিগ মাড় দেয়া শার্ট পড়ে আসে এখন, আর সেইকির বস টেবিলের উপর নিজের বাচ্চাদের ছবি সাজিয়ে রেখেছেন।

“তোমার কি কোনদিন বিয়ে-টিয়ে করার কোন ইচ্ছা আছে, সেইকি?” ওর এক নারী কলিগ একবার প্রশ্ন করেছিল।

কোন সম্ভাবনা নেই, সেইকি ভাবল। প্রেমিকা, বন্ধু, পরিবার,..এসব কিছু ওর কাছে দূরের কোন বস্তু মনে হয়। অফিসের কাজের পরিবেশের সাথে সেইকি খাপ খেয়ে নিতে পারলেও এরচেয়ে গভীর কোন সম্পর্কের ক্ষেত্রে ওর কেমন জানি অস্বস্তি বোধ হয়।

যেসব গোপন ব্যাপার আর সমস্যা ও নিজের ভেতর তলে তলে গড়ে তুলেছে তা ওর আর অন্যদের মাঝে এক দুর্ভেদ্য দেয়াল সৃষ্টি করেছে। এমন কেউ নেই যার কাছে ও নিজের ভয়াবহ কার্যকলাপ নিয়ে স্বীকারোক্তি করতে পারে।

একটা ঠান্ডা বাতাস ওর ঘাড়ের কাছ দিয়ে বয়ে গেল। আগেরদিনের চেয়ে আজকে একটু বেশি ঠান্ডা পড়েছে। উঠোনের পাতা উড়ে যেতে দেখে সেইকি একটু কেঁপে উঠল। কিন্তু আসন্ন শীতের পূর্বাভাস ওর কাঁপুনির জন্য পুরোপুরি দায়ি নয়। সেইকি টের পেল ওর স্যুট জ্যাকেট পরা নেই। ওর সাদা শার্টের অসংখ্য ভাঁজ ওকে মনে করিয়ে দিল ওর সদ্য বিবাহিত কলিগের সুখি জীবনের কথা। লোকটার শার্ট সবসময় ইস্ত্রি করা থাকে।

সেইকি ওর মাথা ঝাঁকাল। অন্যদের ব্যাপারে চিন্তা করার সময় এখন নয়। ও আবার গ্যারেজের ভেতর গিয়ে ঢুকল। গ্যারেজের এক দিকে একটা দরজা ছিল, সেটা দিয়ে ঢুকে ও গাড়ির পেছনের দরজা খুলল। স্যুট জ্যাকেট তুলতে গিয়ে দেখলে পেছনে দাগ লেগে আছে। রক্তের দাগ হবে সম্ভবত। ব্যাকসিটে শুয়ে থাকা মেয়েটার দিকে তাকাল ও। মুখ আর নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে। সেইকি চায়নি বাড়ি ফেরার সময় কেউ গাড়িতে মেয়েটাকে দেখে ফেলুক। তাই জ্যাকেট দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল ওকে।

মেয়েটা তখনও জ্ঞানহীন হয়ে পড়েছিল। নড়াচড়া করছিল না। গুটিসুটি মেরে পড়ে ছিল, লম্বা চুলগুলো পর্দার মত মুখের উপর পড়েছিল। মেয়েটা যদি বাধা না দিত তাহলে সেইকি ওকে আঘাত করত না, হাত ডলতে ডলতে ভাবল। মেয়েটার নখের আঁচড়ে লাল দাগ হয়ে আছে ওর তুকে।

মেয়েটাকে ধরার সময় চিৎকার করেছিল, নিস্তব্ধ রাতে সেই কম্পন তোলা চিত্তার নিশ্চয়ই সবাই শুনতে পেয়েছিল।

এরপর কি হলো তা সেইকির ঠিকমত মনে নেই। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ও মেয়েটার মুখে কয়েকবার আঘাত করে। মেয়েটা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল, নড়ছিল না। কিন্তু তারপরেও সেইকির হাত মেয়েটার মুখের উপর চলছিল। সে মেয়েটাকে নিয়ে ব্যাকসিটে ঢুকালো, জ্যাকেট দিয়ে ঢেকে দিল। গাড়ি চালু করে উড়ে চলে এল।

সেইকি ওর জীবনে কখনো হিংস্র কোন কিছু করেনি, ছোট থাকতেও। টিভিতে শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত কোন খবর দেখলে বিতৃষ্ণায় ওর মাথা ঘুরাত। আর এখন কিনা সে একটা মেয়েকে মুখে ঘুষি মেরেছে। ও ওর হাতে এর প্রতিক্রিয়া টের পাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল যেন কোন পোকা নড়াচড়া করছে হাতের উপর দিয়ে। আতংকিত হয়ে ও হাত ঝাড়ল, পোকাগুলোকে ঝেড়ে ফেলতে চাইল, কিন্তু অনুভুতিটা রয়েই গেল।

ও মেয়েটাকে তুলল। ঘরের পেছনের রুমটায় বয়ে নিয়ে গেল। আলো নিভিয়ে রেখেছিল যেন ওদের ছায়া পর্দা কিংবা জানালায় না দেখা যায়। চাঁদের আলোতে মেয়েটার হাতগুলো আর চুল নিচে ঝুলে থাকল, হাঁটার সময় দুলছিল। কাজের রুমে নিয়ে গিয়ে ও মেয়েটাকে নতুন বানানো কফিনের ভেতর শুইয়ে দিল।

সুন্দর ফিট হলো, যেন মেয়েটার কথা ভেবেই কফিনটা বানানো হয়েছিল। কিন্তু সেইকি মেয়েটার চেহারার দিকে তাকাতে পারছিল না। কিভাবে তাকাবে? নাক আর ঠোঁট থেকে রক্ত ঝরছে, ঘুষি খাওয়া জায়গাগুলো ফুলে রঙ বদলে গেছে। সেইকির ভেতর থেকে উঠে আসা অন্ধকার অশুভ ব্যাপার যে ছাপ রেখে গিয়েছিল সেগুলোর মুখোমুখি হওয়ার সাহস সেইকির নেই। সে তাড়াতাড়ি কফিনের ঢাকনা লাগিয়ে পেরেক মেরে বন্ধ করতে লাগল। ঢাকনায় দুটো ফুটো ছিল বাতাস যাওয়া আসা করার জন্য।

কৌসুকির কবরের পাশে একটা গর্ত করা ছিল। গর্তটা হয়তো টের পেয়েছিল যে কিছু একটা হবে, তাই চাঁদের আলোয় অধীরভাবে অপেক্ষা করছিল। গর্ত থেকে তোলা মাটিতে একপাশে ছোটখাট একটা টিবি হয়ে আছে।

সেইকি টেনে কফিনটা ঘর থেকে বের করে সোজা গর্তের দিকে নিয়ে গেল। মেয়েসহ কফিনটা বেশ ভারি হয়ে আছে।

কফিনটা গর্তে ফেলে এক জোড়া বাঁশের খুঁটি কফিনের গর্তগুলোতে বসাল। তারপর মাটি ঢেলে গর্তটা ভরাট করে ফেলল। প্রথম দিকে শুকনো মাটি কফিনের কাঠের উপর পড়ে থপ থপ শব্দ সৃষ্টি করছিল, পরে কফিন ঢেকে গেলে শব্দ থেমে গেল। যতটা অনুমান করেছিল তার চেয়ে অনেক সময় লাগল গর্তটা ভরাট করতে। সেইকি ঘেমে পুরো গোসল হয়ে গিয়েছে। আর বাসায় ফেরার পর ও পোশাকও বদলায়নি, ওর ওয়ার্ক সুটের পা মাটি লেগে নোংরা হয়ে গেছে। কবরটা ভর্তি হয়ে যেতেই ও কোদাল দিয়ে মাটি সমান করে দিল।

কৌসুকিকে কবর দিয়েছিল গ্রীষ্মে, বাঁশের খুঁটিতে মর্নিং গ্লোরি ছড়িয়ে দিয়ে। কিন্তু বছরের এই সময়ে সেটা করা সম্ভব নয়। মর্নিং গ্লোরি মূলত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফুল, শীত সহ্য করতে পারে না। দেয়ালের পাশের আগাছার মধ্যে খালি বাঁশ যেগুলো ছিল সেগুলো নিয়ে কারো কোন সন্দেহ হবে না, হলেও সে বলতে পারবে গ্রীষ্মের সময় মর্নিং গ্লোরির জন্য সেগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল।

কিন্তু নতুন ভরাট করা মাটির ক্ষেত্রে এই অজুহাত দেয়া যাবে না। তাই সে ফ্লাওয়ার বেড থেকে কিছু খড়কুটো তুলে এনে সেখানে বিছিয়ে দিল। কাজ শেষ করার পর জায়গাটা দেখে মনে হচ্ছিল না যে এখানে কোন গর্ত খোঁড়া হয়েছিল।

সেইকি কোদাল সরিয়ে রেখে পোর্চে গিয়ে বসল। অনেকক্ষণ বাঁশের খুঁটিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকল। মেয়েটাকে ওখানে জ্যান্ত কবর দেয়া হয়েছে।

পোর্চ আর দেয়ালের মাঝখানের জায়গাটাতেই শুধু কোন গাছ লাগানো ছিল না। শুধু কিছু ফ্লাওয়ার বেড, কিছু বাঁশের খুঁটি আর কাপড় শুকানোর জন্য দড়ি টাঙানো ছিল। কিন্তু পোর্চের অন্য পাশগুলোতে গাছগুলো ঘন হয়ে ছিল। রাতের অন্ধকারে কালো দেয়ালের মত লাগছিল দেখতে। যখন বাতাস বইছিল তখন ছায়াগুলো এদিক ওদিক সরে যাচ্ছিল। মেয়েটার আঁচড় লাগা জায়গাটা ডলতে লাগল সেইকি। ঘুষি মারার পর হাতের অবশ অবস্থাটা প্রায় নেই আর। নিজের মুখে হাত বোলাতে গিয়ে টের পেল ও হাসছে।

বাড়ির ভেতর গিয়ে সে মেয়েটার ব্যাগ চেক করে দেখল, ভেতরে এক ক্যান মরিচ পানির স্প্রে আর একটা স্টুডেন্ট আইডি আছে। আইডিতে সুন্দর চেহারার একটা মেয়ের ছবি।

ছবির নিচে গ্রেড, ক্লাস, সিট নাম্বার, আর নাম লেখা। মোরিনো ইয়োরু। সেইকি আবার পোর্চে গিয়ে দাঁড়াল, বাঁশের খুঁটিগুলোর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে নামটা উচ্চারণ করল সে।

যেই মানুষটাকে ও মাত্র কবর দিয়ে এসেছে তার একটা নাম ছিল-সাধারণ একটা ব্যাপার, ও উপলদ্ধি করল। মাটির নিচে পড়ে থাকা মেয়েটার বাবা-মা ছিল, তারা তাকে এই নাম দিয়েছিল আর আদর-যত্নে বড় করে তুলেছিল। আর সেইকি কিনা সেই ভালবাসার মানুষটিকে জ্যান্ত কবর দিয়ে ফেলল।

একটা অদ্ভুত উন্মাদনা সেইকির মন ভরে তুলল, যেভাবে চিনি দেয়া পানি ধীরে ধীরে তুলোর বলের ভেতর প্রবেশ করে। মাটির উপরে থাকতে যে মেয়েটাকে ও ঘুষি মেরেছিল, সে ছিল আতঙ্কজনক। কিন্তু মাটির নিচে, চোখের আড়াল হতে সেইকি টের পেল ওর আতংক বদলে গিয়ে আনন্দে রূপ নিচ্ছে।

সে মুহূর্তে সেইকির কানে একটা আওয়াজ ভেসে এল, দূর্বল-বাতাস ভাসিয়ে নিয়ে এসেছে কোনমতে।

সেইকি আবার বাঁশের খুঁটিগুলোর দিকে তাকাল। চাঁদের ফ্যাকাসে আলোয় সেগুলোর ছায়া লম্বা হয়ে বাগান থেকে পোর্চ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, যেখানে সেইকি বসে আছে। চারটা খুঁটি অন্যগুলোর চেয়ে বেশি মোটা।

মোটা খুঁটিগুলোর দুটো থেকে ক্ষীণ শব্দটা আসছে। সেইকি উঠে দাঁড়িয়ে জুতো পরে সোজা সেদিকে গেল। হাঁটতে গিয়ে ওর মনে হচ্ছে ও বোধহয় কোন নড়াচড়া করছে না। ঘুমের ভেতর হাঁটার মত এক অবাস্তব দুনিয়ার ভেতর দিয়ে চলছে যেন। চাঁদের আলোয় বাগানে গাছগুলোর ছায়া যেন ওর দিকে চেয়ে আছে।

সে খড়কুটো পার হয়ে খুঁটিগুলোর কাছে পৌঁছাল, খুঁটিগুলো ওর বুক পর্যন্ত উঁচু। বুড়ো আঙুলের সমান চওড়া ফুটো দিয়ে ভেতরে তাকাল। ভেতরে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না, ওর শূন্য হৃদয়ের মত গহিন অন্ধকার। ভেতর থেকে মেয়েটার দূর্বল কাঁপাকাপা গলার শব্দ ভেসে আসছে। খুঁটি বেয়ে মাটির নিচে থেকে মাটির উপরে উঠে আসছে আর মাথায় পৌঁছাতেই বাতাস ছিনিয়ে নিচ্ছে, ধোঁয়ার মত।

একটা খুঁটিতে শব্দ অন্যটার চেয়ে বেশি ছিল। কফিনে দুটো খুঁটি লাগানো। একটা মুখের কাছে আরেকটা পায়ের দিকে। মুখের কাছেরটার খুঁটি দিয়ে অন্যটার চেয়ে ভালো শব্দ আসছে।

“হ্যালো?” দূর্বল গলায় মেয়েটা বলল। কেটে যাওয়া ঠোঁটের জন্য নিশ্চয়ই কথা উচ্চারণ করতে কষ্ট হচ্ছে। আমাকে বের হতে দাও…”

সেইকি হাঁটু গেড়ে বসল, হাতের তালু বাঁশের খুঁটির কাছের মাটিতে রাখা। কিছুক্ষণ আগে কবর দেয়া, যে কারনে মাটি নরম হয়ে আছে।

মেয়েটার গলা ওর হাতের নিচ থেকে ভেসে আসছে। ও বুঝতে পারছিল ওর কল্পনা কিন্তু তারপরেও ওর কাছে মাটিটা উষ্ণ মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কবর দেয়া মেয়েটার শরীরের উষ্ণতা ও টের পাচ্ছে উপর থেকে।

বেচারি। কি অসহায় হয়ে পড়ে আছে, বাঁশের খুঁটির ভেতর দিয়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। সেইকির খারাপ লাগতে লাগল মেয়েটার জন্য। জ্যান্ত কবর হয়ে আছে অথচ কিছু করার নেই। সেইকির নিজেকে অনেক ক্ষমতাশীল মনে হতে লাগল। কোন কুকুর কিংবা বিড়াল ছানার দিকে তাকালেও ওর এরকম লাগে।

“আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?” সেইকি দাঁড়িয়ে বলল। ওর কথাগুলো খুঁটির অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়ে মেয়েটার কাছে পৌঁছাল।

“কে…কে ওখানে?” সেইকি ওকে বলতে শুনল, কোন উত্তর দিল না। মেয়েটার গলা আরেকটু জোরে শোনা গেল। “তুমি আমাকে এখানে বন্দি করেছ তাই না? তারপর মাটির নিচে চাপা দিয়েছ।”

“তুমি জানো তোমাকে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে?” সেইকি অবাক হয়ে প্রশ্ন করল। মেয়েটা যদি মাত্র কফিনের মধ্যে জ্ঞান ফিরে পেয়ে থাকে তাহলে শুধু অন্ধকার, ছোট, বদ্ধ, একটা জায়গায় আটকে আছে ছাড়া তার কোনোভাবেই সেটা জানার কথা নয়।

মেয়েটা কয়েক মুহূর্ত কিছু বলল না। তারপর বলল, “আমি ঢাকনার উপর মাটি পড়ার শব্দ শুনেছি।”

“তুমি অজ্ঞান হয়ে থাকার ভান করেছিলে?”

সেইকি ভেবেছিল ঘুষি মারার পর থেকে মেয়েটা অজ্ঞান। জ্ঞান ফিরল কখন? ও মেয়েটাকে বাঁধার চেষ্টা করেনি। বাক্সে ঢোকানোর আগে যদি জ্ঞান ফিরে থাকত তাহলে নিশ্চয়ই পালানোর চেষ্টা করত?

“তোমার কি পা আহত হয়েছে? সে কারনে পালাওনি?” সেইকি জিজ্ঞেস করল। মেয়েটা কোন উত্তর দিল না। তার মানে ওর অনুমান সঠিক।

“আমাকে বের হতে দাও।” মেয়েটা রাগতস্বরে বলল।

ওর এই হঠাৎ রেগে যাওয়ায় সেইকি অবাক হলো। মেয়েটা কাঁদেনি কিংবা অনুনয় করেনি-সোজা আদেশ দিচ্ছে, মাটির নিচে সে মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু অনুভব করতে পারছে মেয়েটার মনোবল কতখানি শক্ত। কিন্তু যতই শক্ত থাক, আসলে সে অসহায়।

“না। আমি দুঃখিত যে সেটা সম্ভব হচ্ছে না, সেইকি মাথা নেড়ে বলল। “তোমাকে বের হতে দিলে তুমি সবাইকে বলে দেবে আমি তোমাকে নিয়ে কি করেছি। আমি সেটা হতে দিতে পারি না।”

“ক্-কে তুমি? কেন এসব করছ?” মেয়েটার প্রশ্নগুলো সেইকির বুকে এসে প্রতিধ্বনি তুলল।

কেন সে মেয়েটাকে কবর দিল? এই প্রশ্ন থেকে পালাবার কোন উপায় ও খুঁজে পেল না। প্রশ্নটা যেন ওকে কোন এক কানাগলির সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। কিন্তু দেয়ার মত কোন কারণ খুঁজে না পেয়ে ও ব্যাপারটা নিয়ে বেশি চিন্তা করতে গেল না,

“তাতে কিছু আসে যায় না।”

“আমি কোথায়? পার্বত্য এলাকায়?”

“না। তুমি আছ আমার বাগানে, তোমার কবরে শুয়ে আছ।”

মেয়েটা চুপ করে গেল। সেইকি অন্ধকারে তার চেহারা কিরকম হতে পারে তা কল্পনা করার চেষ্টা করল।

“কবর? মজা করছ নাকি? আমি এখনো জীবিত আছি।”

“মৃত মানুষদের কবর দেয়ার মধ্যে কোন মজা নেই, সেইকি বলল, যেন এরচেয়ে কঠিন কোন সত্য থাকতে পারে না।

শুনে মনে হলো মেয়েটা কিছুক্ষনের জন্য কথা হারিয়ে ফেলল। তারপর গরগর করে উঠল, “আমাকে বের হতে না দিলে তুমি বিপদে পড়বে।”

“তোমার ধারণা কেউ তোমাকে উদ্ধার করতে আসবে?”

“আমি জানি একজন আমার খোঁজে আসবেই!” সে হঠাৎ গর্জে উঠল। তারপর ব্যথায় কাতরে উঠে আবার চুপ করে গেল। সেইকি ওর জোরে জোরে দম নেয়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। হয়তো ওর বুকের রিবস এ ইঞ্জুরি হয়েছে, প্রতিবার কথা বলার সময় ব্যথা হচ্ছে। সেইকির মনে হলো মেয়েটার কথা-বার্তার মধ্যে অন্যরকম একটা বিশ্বাসের জোর রয়েছে।

“তুমি তোমার এই বন্ধুটিকে অনেক বিশ্বাস কর মনে হচ্ছে…কোন ছেলে নাকি?”

“হ্যাঁ,” সে বলল, কিন্তু আত্মবিশ্বাসের সুর থেকে পরিস্কার বোঝা ছিল ছেলেটি ওর বয়ফ্রেন্ড হবে।

“ছেলেটার নাম জানতে পারি?”

“নাম দিয়ে কি করবে?”

“সেফ কৌতূহল।”

এরপর খানিকক্ষণ নিরবতা। তারপর মেয়েটা ওকে ছেলেটার নাম বলল। সেইকি নামটা ওর স্মৃতিতে গেঁথে নিল, কিন্তু ওর সন্দেহ হতে লাগল মেয়েটা আসলেই সত্যি বলছে কিনা। ছেলেটার হয়তো কোন অস্তিত্বই নেই, কিন্তু সেটা পরীক্ষা করে দেখার কোন উপায় সেইকির হাতে নেই।

“একটা বাইনোকুলার কিনতে হবে।”

আকাশে ছোট ছোট মেঘ চাঁদের সামনে দিয়ে দ্রুত উড়ে যাচ্ছিল। কাল পরশু ঝড় বৃষ্টি হতে পারে।

“কেন কিনব জানো?” সেইকি প্রশ্ন করল। মেয়েটা চুপ করে থাকল। “দূর থেকে দেখব তোমাকে হারিয়ে সে কিভাবে বিলাপ করে।”

ও নিশ্চিত কথাগুলো মেয়েটার কানে ঠিকই পৌঁছেছে, তারপরেও সে কোন উত্তর দিল না। সেইকি আরও কিছু কথা বলল, মেয়েটার কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া পাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুই হল না। সে শুধু সেখানে অন্ধকারে চুপচাপ শুয়ে রইল।

মেয়েটাকে ও খেপিয়ে দিয়েছে ধরে নিয়ে সেইকি বাগান ছেড়ে চলে এল। সকালে হয়তো মেয়েটার মুড বদলাবে।

সে গ্যারেজে গিয়ে গাড়ির পেছনের সিট পরিস্কার করল। মেয়েটার উপস্থিতির কোন চিহ্ন রাখা যাবে না। গাড়িতে ও সবসময় একটা ছোট বালিশ রাখে, মেয়েটাকে শোয়ানোর সময় বালিশটা মাথার নিচে দিয়েছিল। সেটা রক্ত সব শুষে নিয়েছিল যে কারনে সিটের উপর কোন দাগ পড়েনি। সেইকি বালিশটা বের করে নিল আর মেঝে থেকে সব লম্বা কালো চুল তুলে জড় করল।

পরিস্কার করা শেষ হয়ে গেলে ও বাইরে গিয়ে দেয়ালে ঝুলানো ঘড়িতে সময় দেখল। দুটোর বেশি বেজে গিয়েছে। সেইকি ওর রুমে গিয়ে মেঝেতে ফুটোন বিছিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল। চোখ বন্ধ করে স্বপ্নের রাজ্যের প্রবেশ পথ খুঁজতে লাগল, মেয়েটাকে নিয়ে ওর চিন্তা আলাদা একটা ছোট অন্ধকার অংশে আটকে রাখল।

***

পরদিন যখন সেইকির ঘুম ভাঙল তখন প্রায় দুপুর হয়ে গিয়েছে। দিনটা ছিল শনিবার। ও যেখানে কাজ করে সেখানে ছুটির দিন বলে আলাদা কিছু নেই যে কারনে ওকে প্রায়ই শনি-রবিবারে অফিস যেতে হয়। কিন্তু এই সপ্তাহে ভাগ্য ভালো বলা যেতে পারে, শনিবার ছুটি ছিল ওর।

জানালা খুলে বাইরে তাকাল। যখন ও ঘোট ছিল তখন এখান থেকে শহর পর্যন্ত দেখা যেত। কিন্তু এখন গাছের জন্য কিছু দেখা যায় না আর। গাছের উপর দিয়ে ধূসর আকাশ দেখা যাচ্ছে। একটা ঠান্ডা বাতাসের ঝাপ্টা এসে গাছগুলোকে নাড়িয়ে সেইকির গাল ছুঁয়ে অন্যদিকে চলে গেল।

মেয়েটার ব্যাপারটা কি আসল নাকি স্বপ্ন ছিল সেটা ভাবতে ভাবতে সেইকি নিচ তলায় গিয়ে পোর্চে দাঁড়াল। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ও নিশ্চিত হল ঘটনাটা আসলেই ঘটেছে।

সোজা দাঁড়িয়ে থাকা চিকন বাঁশের খুঁটিগুলোর মাঝে চারটা মোটা খুঁটি দাঁড়িয়েছিল। চারটা মানে দুটো কফিন। গত রাতে সে একটা মেয়েকে কবর দিয়েছে, কৌসুকির কবরের পাশে। নিশ্চিত হতে পেরে ওর দুশ্চিন্তা দূর। হলো।

পার্কের ওখানে কি হয়েছিল, যেখানে ও মেয়েটাকে গাড়ির ভেতর ঢোকানোর চেষ্টা করছিল?

মেয়েটা চিৎকার করেছিল। কেউ কি সেটার রিপোর্ট করেছে নাকি? মেয়েটার বাবা-মা কি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পুলিশকে খবর দিয়েছে? পুলিশ হয়তো এই দুই তথ্য একসাথে করে আন্দাজ করতে পারবে যে মেয়েটা পার্কের পাশের রাস্তা থেকে কিডন্যাপড় হয়েছে।

সেইকি স্যান্ডেলে পা গলিয়ে বাগানে নামল। ওর খিদে পেয়েছে, কিন্তু কিছু খাওয়ার আগে মেয়েটার সাথে একটু গল্প করে নিতে চায়। এরকম অস্বাভাবিক ঘটনায় সে সাধারনত কিছু মুখে তুলতে পারে না। কিন্তু কোন বিচিত্র কারনে ওর প্রচন্ড ক্ষুধা বোধ হচ্ছিল আর নিজেকে জীবিত মনে হচ্ছিল।

বাঁশের খুঁটির কাছে দাঁড়িয়ে ও প্রথমে কথা না বলে কিছু শোনা যায় কিনা সেটা খেয়াল করল। কোন শব্দ কানে এল না। সুতরাং সেইকি বলল, “সকাল হয়েছে, তুমি কি জেগে আছ?”

আগের রাতে মেয়েটা কোন উত্তর দেয়নি। সকালেও উত্তর দেবে কিনা সেই নিয়ে সেইকির দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। কিন্তু পর মুহূর্তেই ও উত্তর পেল।

“আমি জানি এখন সকাল। ভেতরে অন্ধকার হলেও..”

বাঁশের খুঁটির ভেতর থেকে গলার শব্দ খানিকটা কেঁপে কেঁপে আসছিল। বাঁশের গোঁড়ার মাটি নড়ে গিয়েছিল। নিশ্চয়ই মেয়েটা খুঁটির ঐ মাথা নাড়াচাড়া করেছে, যে কারনে হয়তো কফিনের গর্ত থেকে খুঁটিটা সরে গিয়েছে বা কিছু।

“আমার মুখের কাছে একটা খুঁটি লেগে আছে। আমি নড়তে গিয়ে টের পেলাম। এটা দিয়েই কি নিঃশ্বাস নিচ্ছি? ভেতর দিয়ে তাকিয়ে দূরে সাদা আলো দেখতে পেলোম-তার মানে তাহলে সকাল?”

খুঁটিগুলো জোড়া লাগানো ছিল না, সেফ কফিনের গর্ত দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেইকি যদি সেগুলো তুলে ফেলতে চায় তাহলে সহজেই তুলে ফেলতে পারবে। আবার মেয়েটা যদি অন্য অংশটা নাড়ায় তাহলে বাইরেও খুঁটিটা নড়তে থাকবে।

“খুঁটিটা ছেড়ে দাও। ওগুলো নড়ার কথা না। কেউ দেখলে সন্দেহ করতে পারে। তুমি যদি ওগুলো আরেকবার নড়াও তাহলে আমি ওগুলো উঠিয়ে ফেলব। দম নিতে পারবে না তখন।”

খুঁটিগুলো নড়াচড়া বন্ধ করে দিল।

“তোমার নাম কি?” মেয়েটা জিজ্ঞেস করল।

“সেইকি। আর তোমার নাম তো মোরিনো তাইনা?”

অনেকক্ষণ কোন উত্তর এল না। তারপর মেয়েটা ফিসফিস করে বলল, কথায় মনে হচ্ছিল ঘৃণা ঝরে পড়ছে। “সেইকি, আমি জানি না কেন তুমি আমাকে এখানে আটকে রেখেছ, কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না। আমাকে বের হতে দাও নাহলে কালো পাখির দুর্ভাগ্য ভোমার ঘাড়ে চড়ে বসবে।”

মেয়েটা তো ওকে কোন ভয় পাচ্ছেই না বরং উল্টো ওর উপর অভিশাপ দিচ্ছে। সে কি তার অবস্থান ঠিকমত বুঝতে পারছে? সেইকি অনুভব করল ও রেগে যাচ্ছে।

“মাটির নিচ থেকে তুমি কি করবে আমার? আমি তোমাকে যেকোন মুহূর্তে পানিতে চুবিয়ে মারতে পারি।”

“চুবিয়ে..?”

সেইকি যথাসম্ভব বিস্তারিতভাবে মেয়েটাকে জানানোর চেষ্টা করল কিভাবে কফিনে পানি ঢুকিয়ে মেয়েটাকে সে মেরে ফেলতে পারে। মেয়েটাকে পরিস্কারভাবে বুঝিয়ে দিতে চাইল যে ওর বাঁচার কোন আশা নেই। মেয়েটার মনোবল ভেঙে ফেলতে চাইল।

মেয়েটা তার দুর্ভাগ্যর কালো বাক্স থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারছিল। কিংবা হয়তো রাগ কন্ট্রোল করতে পারছিল না। যেটাই হোক না কেন ওর গলা কাঁপছিল। “তুমি আমাকে খুন করার আগে আমি নিজেই আমার জীবন শেষ করে দেব। তুমি আমার পকেট চেক করতে ভুলে গিয়েছ-বিশাল ভুল করেছ। আমি নিশ্চিত তুমি জানো না তুমি কতখানি উদাসীন। আমার পকেটে একটা মেকানিক্যাল পেন্সিল আছে। আমি সেটা আমার জগুলার ভেইনে ঢুকিয়ে দিব।”

“তুমি হয়তো ভাবছ খুন হওয়ার আগে আত্মহত্যা করলে তোমার সম্মান বাঁচবে, কিন্তু সেটা সত্যি নয়। সবই আসলে এক। তুমি আত্মহত্যা করলেও তোমার শরীর এখানেই পচে গলে মাটির সাথে মিশে যাবে। কেউ জানতেও পারবে না। তুমি একাই থেকে যাবে, মাটির নিচে চাপা থাকবে অনন্তকালে জন্য।”

“না থাকব না। আমাকে অনন্তকালের জন্য লুকানো যাবে না। কেউ না কেউ আমাকে খুঁজে বের করবেই। আর পুলিশ এত গাধা না, তোমাকে তারা একদিন ঠিকই ধরে ফেলবে। আজকে তোক আর কয়েক বছর পরে হোক, ধরা তোমাকে পড়তেই হবে। এটা আমি নিশ্চিত জানি। আর আরেকটা ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত-আমি একা মরব না।”

“একা মরবে না?”

“আমি একা পচে মরব না!”

“তুমি বলতে চাইছ, তোমার সাথে অন্য কেউও মরবে? যে ছেলের কথা কালকে বললে সে?”

“সে আমাকে একা মরতে দেবে না।”

মেয়েটা ওর কবরে শুয়ে কাঁদছে? ওর গলা একটু ভেজা ভেজা শোনাল। কিন্তু তারপরেও সেখানে একটা প্রতিজ্ঞার সুর ছিল।

সেইকি ওর বয়ফ্রেন্ড সম্পর্কে জানতে চাইল, সেফ উপহাস করার জন্য। হাই স্কুলে পড়া বাচ্চা ছেলেমেয়ে, তাদের প্রেম হলো দুই দিনের প্রেম। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ওর নার্ভাস লাগছিল। ওর মাথার উপর একটা বড় কালো মেঘ ভেসে যাচ্ছে, যেকোন সময় বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ার অপেক্ষায়।

“আমি বুঝতে পারছি না…তুমি এই অবস্থায় এমনভাবে কিভাবে কথা বলতে পারছ। মোরিনো…তুমি এখানে মাটির নিচে একা পচে মরবে…একা। আর কোন কিছু তোমার কপালে নেই।” সেইকি এ কথা বলে ওখান থেকে চলে এল।

মেয়েটার কথাগুলো শোনার সময় ওর মনে পড়ছিল অফিসে ওর অল্পবয়স্কা কলিগ ওকে যে প্রশ্ন করেছিল-ও কখনো বিয়ে করবে কিনা।

যেকোন গভীর সম্পর্ক থেকে ওকে কেটে আলাদা করে ফেলা হয়েছে, যেরকম গভীর সম্পর্ক পরিবার কিংবা বন্ধুদের মধ্যে থেকে থাকে।

বেচে থাকার জন্য এছাড়া ওর সামনে আর কোন পথ খোলা ছিল না। অন্য মানুষদের দিকে ও হাসত আর ফালতু আলোচনায় যোগ দিত ঠিকই, কিন্তু ওর মন কখনো কারো সাথে যুক্ত হত না। মেয়েটার কথাগুলো ওকে নাড়িয়ে দিয়েছে।

সেইকি ঠিক করল কিছু একটা পেটে দিয়ে নিজেকে শান্ত করবে। যদিও ওর ক্ষুধা নষ্ট হয়ে গিয়েছে কিন্তু কিছু খেলে হয়তো ভালো লাগবে।

সে ঠিক করল বাইরে খেতে যাবে। স্যুটের পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে জ্যাকেটের পকেটে পুল। তারপর জুতা পরে দরজার দিকে যেতে গিয়ে একটা খটকা লাগল।

সেইকি সব সময় ওর অফিসের ব্যাজ সাথে রাখে। ব্যাজসহ আইডি কার্ডটা একটা বাদামি রঙের চামড়ার কেইসে রাখা ছিল। আর সেটা ওয়ালেটের সাথে একই পকেটে থাকত সবসময়। কিন্তু গত রাতের পর সেটা ওর চোখে পড়েনি আর।

সেইকি আবার জুতো খুলে রুমে ফিরে গেল, যেখানে স্যুটটা ঝুলছিল। যে পকেটে ওয়ালেটটা রাখা ছিল সেটায় হাত ঢুকাল। কিছু নেই ভেতরে। অন্য পকেটগুলোও চেক করল। আইডি কার্ডের কোন চিহ্ন নেই কোথাও। আশেপাশে তাকাল, ফ্লোরের কোথাও পড়েছে কিনা। ম্যাগাজিনগুলো তুলে টেবিলের উপর রাখল, ফুটোন তুলে নিচে দেখল। কোথাও নেই।

জিনিসটা ও শেষ কখন দেখেছিল? অফিসে ওর সাথে ছিল, পরিস্কার মনে আছে। অন্য কোথাও কি পড়েছে?

দ্রুতই সেইকি একটা উত্তর খুঁজে পেল, আর উত্তরটা পেয়ে ওর মাথা ঘোরাতে লাগল। যতই ও ব্যাপারটা উপেক্ষা করতে চাইল ততই আরো সন্দেহ বাড়তে লাগল।

আইডি কার্ডটা যদি কোথাও পড়ে গিয়ে থাকে তাহলে সেটা মেয়েটার সাথে মারামারি করার সময়ই পড়েছে…গত রাতে, পার্কটার কাছে। মেয়েটা যখন চিৎকার দিয়েছিল তখন ওর কনুই এর গুতা লেগেছিল সেইকির বুকে। তখন নিশ্চয়ই ধাক্কা লেগে পকেট থেকে পড়ে গিয়েছিল আইডি কার্ডটা।

বাগান থেকে পাখিদের ডানা ঝাঁপটানোর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ওর বাসার চারপাশের গাছগুলোতে অনেক পাখির বাসা। সকালে বাগানে হাঁটার সময় সে পাখির গান শুনতে পায়। কিন্তু আজকে পাখির গান ওর কানে অশুভ শোনাচ্ছিল, যেন আসন্ন কোন দুর্যোগের সংবাদ দিচ্ছে তারা।

আগেরদিন রাস্তার ঝরা পাতাগুলো পরিস্কার করা হয়েছিল। তখনও আইডি কার্ডটা সেখানে ছিল না। কিন্তু আজকে যদি সেটা সেখানে পাওয়া যায় তাহলে…লোকগুলো জানবে যে আইডি কার্ডটার মালিক গত রাতে কি ভোরে এদিক দিয়ে গিয়েছিল।

আইডি কার্ডটা কার তা জানা কোন সমস্যাই না, সেইকির নাম পরিস্কার করেই লেখা আছে। বলা মুশকিল কতজন লোক দুটো ব্যাপারকে একসাথে মিলিয়ে দেখবে মেয়েটার চিৎকার আর নিখোঁজ হওয়ার সাথে ওর আইডি কার্ডটা সেখানে পড়ে থাকার কোন সংযোগ আছে। ভালো হয় যদি কেউ পাওয়ার আগেই সেটা খুঁজে পাওয়া যায়।

সেইকি দ্রুত ওর জুতো পড়ে বাইরে গেল। পার্কটা খুবই কাছে, গাড়ি বের করার কোন মানে হয় না, দৌড়েই চলে যাওয়া যাবে।

কিন্তু বাইরে যাওয়ার আগে সে ঠিক করলে মেয়েটাকে কিছু কথা বলবে। গাছগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে পোর্চের সামনের অংশটায় গেল। দেয়ালের কাছে বাঁশের খুঁটিগুলোর সামনে গিয়ে থেমে গেল।

বাঁশের খুঁটিগুলোর ভেতর থেকে মেয়েটার হাসির শব্দ ভেসে আসছিল। ভাঙা রেকর্ডের মত সে অবিরাম হেসে চলছে।

ওদের সমস্ত আলোচনায় মেয়েটা কখনো নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করেনি। কখনো চিৎকার করেনি, বরং শান্তভাবে কথা বলেছে সেইকির সাথে, নিজের অনুভুতির উপর পুরোপুরি দখল বজায় রেখেছে, ভেঙে পড়েনি।

মাটির নিচের বাক্সের মধ্যে কি ভয় মেয়েটাকে পাগল করে ফেলল?

সে এতটা সময় এত চুপচাপ ছিল যে এখন এই হাসি ওর স্বভাবের সাথে মিলছে না। সেইকি কিছু বলার সাহস না পেয়ে সেখান থেকে সরে এল।

সেইকি যখন পার্কে পৌঁছাল ততক্ষণে দুপুর হয়ে গিয়েছে। পরিস্কার দিন হলে সূর্য এসময় মাথার উপর থাকত। কিন্তু আজকে ঘন মেঘগুলো সূর্য পুরোপুরি ঢেকে ফেলেছে, সেই সাথে ঠান্ডা হাওয়া বইছে।

পার্কটা ছোট, ছিমছাম। আবাসিক এলাকাটার একদম মাঝখানে অবস্থিত।

পুরো জায়গাটা চেইন লিঙ্ক বেড়া দিয়ে ঘেরা যাতে বাচ্চা ছেলে পেলে দৌড়ে রাস্তায় গিয়ে না পড়ে। সেইকি সাইডওয়াক দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় পার্কের ভেতরে তাকাল। ভেতরে একটা ভোলা জায়গায় প্লে গ্রাউন্ড।

কেউ একজন দোলনায় বসে আছে। অন্যদিকে মুখ করে আছে বলে সেইকি ওর কালো পোশাকের পেছন দিক ছাড়া কিছু দেখতে পাচ্ছে না।

আশেপাশে আর কোন জন মানুষ দেখতে না পাওয়ায় সেইকি স্বস্তি বোধ করল। ওর দুশ্চিন্তা হচ্ছিল যে পুলিশ হয়তো সেখানে হাজির হয়ে ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু সেরকম কিছু দেখা গেল না। ওর আসল ভয় ছিল ওর আগে অন্য কেউ ওর আইডি কার্ডটা খুঁজে পাবে।

সাইডওয়াকের মাঝে মাঝে কিছুদূর পর পর গাছ লাগানো। রাস্তায় কোন গাড়ি ছিল না। একদম সুনসান, খালি রাস্তা।

বাতাস বইলেই শুকনো পাতাগুলো ঝরে পড়ছিল। উড়ে কোথাও যাচ্ছে, সেফ বৃষ্টির মত সোজা খসে পড়ছে। আগেরদিন পাতা পরিস্কার করা হলেও আজকেই সাইডওয়াকের প্রায় পুরোটা আবার ঝরা পাতায় ঢেকে গিয়েছে। রাস্তার উপর পাতা কম ছিল, কারণ গাড়ি গেলে পাতাগুলো বাতাসে উড়ে যায়। অবশ্য একখানে শুকনো পাতাগুলো স্তূপ করে রাখা ছিল।

গতরাতে যেখানে গাড়ি থামিয়েছিল সেখানে সেইকি খুঁজে দেখল। পাওয়া গেল না। হত পাতার নিচে কোথাও অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। প্রচুর পাতা পড়ে ছিল সেখানে।

সেইকি হাঁটু গেড়ে বসে পাতা সরিয়ে খুঁজতে লাগল। পুরো সাইডওয়াক খোঁজার দরকার নেই, যেখানে ওর সাথে মেয়েটার ধস্তাধস্তি হয়েছিল সেটুকু জায়গা দেখলেই হবে। ওর মনে হচ্ছিল শিগগিরি আইডি কার্ডটা পাওয়া যাবে।

পাতাগুলো সরানোর সময় বাতাস এসে সেগুলোকে দূরে উড়িয়ে নিয়ে গেল। সেইকি সেদিকে চেয়ে মেয়েটার কথা ভাবতে লাগল।

বাক্সের ভেতরটা অন্ধকার। মেয়েটা যদি খুঁটির ফুটো দিয়ে তাকায় তাহলে একটা বিন্দুর মত আলো দেখতে পাবে। আর কোন আলো প্রবেশ করবে না। ঐ ছোট অন্ধকার বাক্সের ভেতর মেয়েটার শুয়ে শুয়ে নিজের মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন পথ নেই। অথচ সে দাবি করছে তার বয়ফ্রেন্ড তাকে একা মরতে দেবে না।

সেটা জেনে অবশ্য সেইকি কেঁপে উঠেছিল। ব্যাপারটা ওর মাথায় ঢুকছিল না, যে কারনে দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে যাচ্ছে। মাটির নিচে একটা বাক্সে আটকা পড়ে থেকে কি করে তুমি কারো উপরে ভরসা করতে পার? কি করে আশা করতে পার কেউ তোমার সাথে অনন্তকাল সঙ্গ দেয়ার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করবে?

গতকাল রাত পুরোটা সময় ওর মাথার ভেতর ঘোলাটে হয়ে ছিল। মাটির নিচে চাপা পড়া মেয়েটা কতখানি অসহায় হয়ে পড়ে আছে সেটা ভাবতেই ওর মনে আনন্দের ঢেউ জাগছিল। অনেকটা জিহ্বার উপর মধু ঢালার মত অনুভূতি। কিন্তু তারপর যখন এই কথাগুলো শুনল তখন মনে হল কেউ যেন এসে ওর গালে কষে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছে।

মাথা ঘোরাচ্ছে, সেইকি হাঁটু গেড়ে শুকনো পাতাগুলোর উপর বসে পড়ল। দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসছে, শুকনো পাতার স্তরগুলো দেখে ওর মনে হচ্ছিল যেন সাগরের বুকে জাগা ঢেউ। নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না, ফুসফুস যেন বাতাসের জন্য আকুলিবিকুলি করছে।

কবে থেকে সে এরকম জঘন্য সব কাজ করা শুরু করল যেন এগুলো ছেলের হাতের মোয়া?

একসময় তো সে একজন ভালো মানুষ, একজন সুনাগরিক ছিল। কঠোর পরিশ্রম করত, সবার সাথে ভালো ব্যবহার করত, দেখা হলে সবাইকে শুভেচ্ছা জানাত, হাঁটতে গিয়ে কারো সাথে দেখা হলে থেমে কিছুক্ষণ আলাপ করত।

প্রতিবার কাউকে মাটিচাপা দেয়ার চিন্তা মাথায় এলেই সে যুদ্ধ করে চিন্তাটাকে তাড়িয়ে দিত। নিজেকে বলত, এরকম অন্যায় কাজ কারোরই করা উচিত নয়। আর ওর শুধু বাগানে গর্ত খুঁড়েই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। ও একজন মানুষ। কাউকে জ্যান্ত কবর দেয়ার মত জঘন্য নারকিয় কোন কিছু ও কখনো করতে পারে না…

কিন্তু যখন সে কৌসুকিকে জ্যান্ত কবর দিল আর পরে পানিতে ডুবিয়ে মেরে ফেলল, তখন যেন ওর ভেতরের কলকজাগুলোর কোন গুরুত্বপূর্ণ একটা নষ্ট হয়ে গেল। ভয়াবহ হলেও, অসহায় মেয়েটার উপর কর্তৃত্ব ফলানোয় ওকে নতুন এক অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। এতদিন পর ওর নিজেকে জীবিত একজন মানুষ মনে হতে লাগল…কিন্তু এখনো কি ও নিজেকে মানুষ বলে দাবি করতে পারে?

মাখা ঘোরালেও সেইকি এক মুহূর্তের জন্যও পাতাগুলো সরিয়ে দেখার কাজে ক্ষান্ত দেয়নি, আইডি কার্ডটা খুঁজেই যাচ্ছিল। ওর মুখ থেকে ঘাম নাক বেয়ে টপ টপ করে শুকনো পাতাগুলোর উপর ঝরে পড়ছে।

হাজার খুঁজেও আইডি কার্ডটা কোথাও পাওয়া গেল না। মেয়েটার সাথে ধস্তাধস্তির জায়গাসহ আশেপাশে সব জায়গা খুঁজল, কোথাও নেই। সেইকি আবার প্যানিক করতে লাগল।

বাতাসে একটা খবরের কাগজ উড়ে এসে ওর পায়ে লাগল। ও উঠে দাঁড়িয়ে পা ঝাঁকিয়ে সেটা সরাল পা থেকে। সেই মুহূর্তে ওর খেয়াল হল কেউ একজন বেড়ায় মুখ লাগিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ও আইডি কার্ডটা খোঁজায় এতটাই ব্যস্ত ছিল যে আগন্তুকের আগমন খেয়াল করেনি।

দূরের দোলনাটা খালি। ওখানে যে বসে ছিল সেই নিশ্চয়ই উঠে এসেছে।

বেড়ার ওপাশে যে ছেলেটা দাঁড়িয়ে ছিল তাকে দেখে মনে হল হাইস্কুলের ছাত্র হবে। কালো ইউনিফর্ম পড়া, দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে সেইকির দিকে চেয়ে আছে। সেইকি অনুমান করল আজকে বোধহয় অর্ধদিবস স্কুল ছিল। স্কুলের পর ছেলেটা সম্ভবত এখানে এসেছে।

সেইকির সাথে ছেলেটার চোখাচোখি হলো, অস্বস্তিকর একটা নিরবতা। ছেলেটাই প্রথম কথা বলল, মাথা নিচে করে বো করে। “দুঃখিত, আমি শুধু,..ভাবছিলাম আপনি কি করছেন।”

সে নিশ্চয়ই দূর থেকে খেয়াল করেছে সেইকিকে।

“কিছু হারিয়েছেন বুঝি?” ছেলেটা প্রশ্ন করল।

“উমম,” সেইকি বিড়বিড় করল, কি উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারছে না। ও চাইছে ছেলেটা চলে যাক কিন্তু সেটা বললে অদ্ভুত দেখাবে। হয়তো ও উত্তর না দিয়ে নিজের কাজ করলে দেখবে ছেলেটা চলে গিয়েছে।

“আপনি কি আশেপাশেই থাকেন?” সেইকি উত্তর না দেয়ায় ছেলেটা প্রশ্ন করল।

“হ্যাঁ,”

“আপনার নামটা জানতে পারি কি?”

কোন চিন্তা না করেই ও ছেলেটাকে সত্যি নাম বলে দিল।

“সেইকি? কিছু না মনে করলে একটা প্রশ্ন করতে পারি? প্রশ্নটা একটু অদ্ভুত, তবে..”

“অদ্ভুত প্রশ্ন?”

“আমি আপনার বেশি সময় নেব না। কালকে রাতের চিৎকারটার ব্যাপারে,..আপনি কি কিছু জানেন?”

সেইকির মনে হলো কেউ খপ করে ওর হৃদপিণ্ড চেপে ধরেছে।

“চিৎকার..? কিসের চিৎকার..?”

“গতকাল রাত্রে নয়টার দিকে কাউকে এখানে চিৎকার দিতে শোনা গিয়েছে। আশেপাশে থাকে এমন একজন আমাকে জানাল। কিন্তু মনে হচ্ছে আপনার বাসা এখান থেকে দূরে, বোধহয় শুনতে পাননি সেজন্য।” সেইকির প্রতিক্রিয়া দেখে ছেলেটা বলল।

সেইকি মাথা ঝাঁকাল, ছেলেটার বক্তব্যর সাথে একমত পোষণ করে।

“আসলে হয়েছে কি, আমার একজন ক্লাসমেট গতরাতে বাড়ি ফেরেনি। আজকে অর্ধদিবস স্কুল ছিল অথচ সে স্কুলেও আসেনি।”

সেইকি চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকানো থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারল না। ছেলেটা ওর চেয়ে অন্তত দশ বছরের ছোট হবে, কিন্তু ওর চোখগুলো ভীতিকর লাগছিল সেইকির কাছে। সে টের পেল পোশাকের নিচে প্রচুর ঘামছে। ছেলেটা মেয়েটার কথা বলছে..

“আমার ক্লাসমেট এই রাস্তা দিয়ে স্কুলে যাওয়া-আসা করে প্রতিদিন, তাই আমি ভাবছিলাম গত রাতের চিল্কারের সাথে ওর কোন সম্পর্ক আছে কিনা..”

অবশ্যই আছে। সেইকি মেয়েটাকে জ্যান্ত কবর দিয়েছে। মেয়েটা কি তোমার ভালো বন্ধু?”

“আমার তো তাই ধারণা,” ছেলেটা একই সুরে উত্তর দিল। এই ছেলের কথাই কি মেয়েটা বলেছিল?

যেভাবে ছেলেটা উত্তর দিল তাতে তো মনে হচ্ছে, না। ছেলেটার ভাবসাব খুবই শান্ত, এমনভাবে মেয়েটার কথা বলছে যেন অপরিচিত কোন মানুষ। বিশ্বাস করা কঠিন যে তাদের মধ্যে গভীর কোন সম্পর্ক আছে।

“তো তোমার নিখোঁজ ক্লাসমেটের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা হচ্ছে বলে এখানে এসেছ?”

“আরে নাহ। ঘুরতে এসেছি বলতে পারেন।”

“ঘুরতে মানে..?”

“পুলিশ স্টেশনে শহরের একটা ম্যাপ টাঙ্গানো থাকে, লাল দাগ দেয়া।”

“যেসব জায়গায় ভয়াবহ এক্সিডেন্ট হয়?”

“হ্যাঁ, আপনি জানেন সেটার কথা? আমি ভেবেছি আমি ছাড়া কেউ জিনিসটা কখনো খেয়াল করেনি। আমার শখ হলো লাল দাগ দেয়া জায়গাগুলোর প্রত্যেকটায় ঘুরতে যাওয়া। যেখানে মানুষগুলো মারা গিয়েছিল, যেখানে ওদের জীবনের ইতি ঘটেছিল সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা, পায়ের নিচে রাস্তার পিচ অনুভব করা…এখানে আসার কারণও একই। সেই শখ। ভয়াবহ ঘটনা ঘটা জায়গাগুলো দেখতে যেতে আমার ভালো লাগে। আর আমার এমনও মনে হয়, যদি ভাগ্য ভালো থাকে তাহলে হয়তো সেই জায়গায় ঘটনাটা ঘটার দৃশ্য আবার দেখতে পাব।”

ছেলেটা পকেট থেকে হাত বের করে চেইন লিঙ্ক বেড়াটা ধরল। বেড়াটা কেঁপে উঠল, ধাতব ঝাঁকির শব্দ হলো। ছেলেটা সোজাসুজি সেইকির চোখে তাকিয়ে আছে।

কথাগুলো সেইকির হৃদস্পন্দন প্রায় থামিয়ে দিচ্ছিল। সে কি এই কারনে ওকে এসব কথা বলল কারণ ও মেয়েটাকে কিডন্যাপ করেছে তা জানে বলে? সেইকি চিন্তাটা বাতল করে দিল। প্রশ্নই আসে না।

কিন্তু ওর বুক ধুকপুকানি কমলো না, দুশ্চিন্তা দূর হলো না।

পাখির চিৎকারের শব্দে সেইকি উপরের দিকে তাকাল। একটা নিঃসঙ্গ কাক উড়ে যাচ্ছে ঠান্ডা ধূসর আকাশের ভেতর দিয়ে। কালো ঠেটিটা সোজা সেইকির দিকে তাক করা।

দাঁড়াও দাঁড়াও। সেইকির মাথায় একটা চিন্তা এল।

হতে পারে ছেলেটা ওর আইডি কার্ডটা খুঁজে পেয়েছে–আর মেয়েটার চিৎকারের সাথে সেটার সম্পর্ক অনুমান করে নিয়েছে। আর ধরে নিয়েছে কালপ্রিটটা আইডিটার জন্য এখানে আসবেই…

আর এখন সেটা লুকিয়ে রেখে ছেলেটা ওকে পরীক্ষা করছে। আসলেই কি এরকম কিছু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে?

“তো আমার এই নিখোঁজ ক্লাসমেট…আপনার কি ধারণা সে কোথায় থাকতে পারে?” ছেলেটা প্রশ্ন করল। আবারো সে ঠান্ডা চোখে সেইকির প্রতিক্রিয়ার উপর নজর রাখছে।

সেইকির ইচ্ছে করছিল ছুটে দৌড় দিতে। ছেলেটা বেড়ার ওপাশে আছে। ওকে ধরতে হলে, পার্কের ঢোকার গেট পর্যন্ত পুরোটা ঘুরে আসতে হবে ওকে। ততক্ষণে ও পালিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে…ছেলেটা যদি সত্যি ওর আইডি কার্ড হাতে পেয়ে থাকে তাহলে পুলিশের কাছে গিয়ে সেইকির সন্দেহজনক ব্যবহার খুলে বললেই..

“আপনি কি কিছু জানেন নাকি এ ব্যাপারে?”

“না কিছু জানি না আমি।”

“ওহ আচ্ছা, আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো কিছু জানবেন।”

“কেন এরকম মনে হলো?…”

“হয়তো একটু বেশিই চিন্তা করছিলাম। কারণ আপনি বললেন আপনি চিৎকার শুনতে পাননি।”

“তো কি হয়েছে..?”

“ব্যাপারটা মিলল না। আমি শুধু চিল্কারের কথা বলেছি। কিন্তু যখন নিখোঁজ ক্লাসমেটের কথা বললাম, আপনি জানতে চাইলেন মেয়েটা আমার ভালো বন্ধু কিনা। মেয়েটা’, আমি একবারও বলিনি আমার ক্লাসমেট মেয়ে নাকি ছেলে। আপনি কী করে জানলেন, সে একজন মেয়ে?”

‘কারণ আছে। প্রতিদিন সকালে আমি এখান দিয়ে হাইস্কুলে পরে একটা মেয়েকে যেতে দেখি। আজকে দেখিনি। সেজন্য বললাম। আমি ধরেই নিয়েছিলাম তুমি তার কথা বলছ।”

ছেলেটা মাথা ঝাঁকাল। “একটা শুকনা মেয়ে, লম্বা চুল?”

“হ্যাঁ-ফ্যাকাসে ত্বক, বাম চোখের নিচে একটা তিল আছে, সেইকি মেয়েটার আইডি কার্ডে দেখা ছবিটা মনে করার চেষ্টা করল। কিন্তু আর কতক্ষন ওর এই কথাবার্তা চালিয়ে যেতে হবে? বোঝাই যাচ্ছে ছেলেটা ওকে সন্দেহ করেছে। সেইকির অস্বস্তিবোধ আরও বেড়ে গেল। মনে হচ্ছিল কেউ একজন হাত দিয়ে ওর গলা পেঁচিয়ে ধরে ধীরে ধীরে চাপ বাড়াচ্ছে।

“আপনি ঠিক আছেন? আপনাকে অসুস্থ দেখাচ্ছে।”

“গরমে কাহিল হয়ে পড়েছি।”

“দাঁড়ান, আমি আসছি।”

ছেলেটা বেড়া ছেড়ে হেঁটে পার্কের গেটের দিকে গেল। দোলনার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওর স্কুল ব্যাগ তুলে নিল কাঁধে। পার্ক থেকে বেরিয়ে সেইকির দিকে আসতে লাগল, চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ওর অসুস্থতা নিয়ে চিন্তিত।

সেইকি ওর দুশ্চিন্তা থেকে সৃষ্ট ঘাম ফ্র থেকে মুছে ফেলল।

“গতকাল থেকে…শরীরটা একটু খারাপ যাচ্ছে।”

“এরকম অবস্থায় আমার সাথে কথা বলার জন্য জোর করায় আমি ক্ষমা চাইছি। বলেছিলাম আপনার বেশি সময় নেব না, কিন্তু নিয়ে ফেলেছি…হয়তো আপনার কোথাও গিয়ে একটু বিশ্রাম নেয়া উচিত।”

“হ্যাঁ…” সেইকি এক মুহূর্ত চিন্তা করার ভান করল, তারপর জানা উত্তরটাই বলল। “আমার বাসাই মনে হয় সবচেয়ে কাছে হবে।”

সেইকি পরিকল্পনা করল কয়েক কদম হেঁটে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাওয়ার ভান করবে। ছেলেটা দৌড়ে আসবে ওকে ধরতে। সেইকি সেই সুযোগ নিয়ে ছেলেটাকে বলবে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিতে সাহায্য করতে। তারপর ছেলেটাকে খুন করে আস্তে ধীরে পকেট-টকেট চেক করে দেখা যাবে। কিন্তু অভিনয় করার কোন প্রয়োজন পড়ল না।

“আপনাকে সুস্থ দেখাচ্ছে না-আমি কি আপনাকে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিব?” ভ্রু কুঁচকে বলল ছেলেটা। তাহলে তো ভালোই হলো।

“ধন্যবাদ, খুব ভালো হয়। ওদিকে যেতে হবে…”

তারা একসাথে হাঁটতে লাগল। সেইকি মাঝে মাঝে কেঁপে উঠল। ওর আসলেই খারাপ লাগছিল তাই অসুস্থ অভিনয় করতে একটুও সমস্যা হল না।

হাঁটতে হাঁটতে সেইকি অনুমান করার চেষ্টা করল ছেলেটা কে হতে পারে। হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসেছে, আর এখন একসাথে হাঁটছে। বাসায় পৌঁছানোর পর সেইকি কি করবে? কিভাবে ছেলেটাকে খুন করবে?

সেইকির আবারো মাথা ঘোরাতে লাগল। সেই সাথে কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে ছেলেটাকে অন্য শিকারগুলোর মত খুন করার পরিকল্পনা করতে শুরু করল।

ওর মনের ভেতরের একটা অংশ অনুনয় করতে লাগল এরকম ভয়ঙ্কর কাজ না করার জন্য। কিন্তু ছেলেটা যদি ওর আইডি কার্ডটা পেয়ে থাকে আর ওর সাথে মেয়েটার সম্পর্ক অনুমান করে থাকে তাহলে সেইকির সামনে আর কোন পথ খোলা নেই ওকে খুন করা ছাড়া। অন্যথায় সারা দুনিয়া ওর কৃতকর্মের কথা জেনে যাবে।

ওর অফিসের লোকজন যখন জানবে আসল সেইকি একজন পশু, তখন কি ভাববে? যেই লোক নিজের বাগান থেকে ফুল নিয়ে আসত অফিস সাজানোর জন্য সেই মানুষ তলে তলে একজন খুনি? একজন পশু যে কিনা থুথুরও যোগ্য নয়? এই খবর পেয়ে কি তাদের মন খারাপ হবে? তারা কি রাগান্বিত হবে? ওদের কথাবার্তা যেন সেইকির কানে ভোলো করতে লাগল, লজ্জায় সেইকি মুখ তুলে তাকাতে পারছিল না, লজ্জার শিখাগুলো যেন জ্বলে উঠে ওকে গ্রাস করে নিতে চাইছিল।

এরকম কোন কিছু সে কিছুতেই হতে দিতে পারে না। ছেলেটাকে মরতেই হবে। সেইকি চোখগুলো চেপে বন্ধ করে রাখল, নিজেকে বার বার এই কথাটা বলতে লাগল, কান্না আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করল।

অল্প সময়েই ওরা বাড়ির কাছে পৌঁছে গেল। রাস্তায় আসতে আসতে ওরা কি কথা বলেছিল তা সেইকির মনে নেই, জরুরি কিছু ছিল না মনে

“সুন্দর বাড়ি,” ছেলেটা সামনে তাকিয়ে বলল।

“হ্যাঁ কিন্তু পুরোনো। আসো ভেতরে আসো।”

গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল ওরা। গাড়ি আসা যাওয়ার সুবিধার্থে গেটটা সবসময় ভোলাই থাকে। ছেলেটা ড্রাইভওয়েতে থেমে গেল, বাড়ির পাশের গ্যারেজটার দিকে চেয়ে আছে। গ্যারেজের দরজাগুলোও খোলা, আর একটা কালো গাড়ি ওদের দিকে মুখ করে আছে। সেইকি গাড়িটার পেছনের সিট থেকে মেয়েটার সব চিহ্ন পরিস্কার করে ফেলেছিল। কোথাও কোন রক্ত নেই, কোন চুল নেই, একদম কিছু নেই। তারপর গ্যারেজের দরজা খোেলা রেখে গিয়েছিল।

“আপনার কি একটাই গাড়ি? আপনি কি পুরো বাড়িতে একাই থাকেন নাকি?”

“হ্যাঁ।”

ছেলেটা বাগানের উপর চোখ বুলাল।

“অনেক গাছ তো?”

“গাছ লাগানো আমার শখ। এটা আমার ব্যক্তিগত ছোট বন।”

তারপর ওর অনুমতি নিয়ে ছেলেটা বাগানের দিকে গেল। সেইকিও পেছন পেছন গেল।

মেঘলা আকাশের নিচে সেইকির জন্মানো সবকিছু গাঢ় সবুজ দেখাচ্ছিল। ছেলেটা এক সারি চিরহরিৎ গাছ পার হলো, মনে হলো মুগ্ধ। “বাগানটা বেশ বড়।”

চিরহরিৎ গাছের সারির পর বাগানের খোলা জায়গা যেটা বাড়ির দক্ষিণ দিকের অংশ, পোর্চ আর দেয়ালের মাঝামাঝি অবস্থিত। অনেকগুলো ফ্লাওয়ার বেড পাথর দিয়ে ফ্রেম করা ছিল, কিন্তু ভেতরে খালি। চারা নেই, শুধু শুকনো মাটি।

দেয়ালের কাছে কিছু বাঁশের খুঁটি পোঁতা, যেখানে মর্নিং গ্লোরি লাগানো হয়েছিল, এখন খালি খড়কুটো পরে আছে। আর সেগুলোর নিচে…

“এখানে কোন গাছ নেই?”

“পোর্চ থেকে দেখার জন্য খালি রাখা,”

…সেগুলোর নিচে আছে মেয়েটা…আর কৌসুকির অবশিষ্টাংশ যদি কিছু থেকে থাকে।

বাঁশের খুঁটিগুলো দেয়ালের সাথে সারি ধরে দাঁড়িয়ে আছে, নড়ছে না। ছেলেটা ওগুলোর দিকে তেমন একটা মনোযোগও দেয়নি, ভেবেছে বাগানেরই অংশ। কিন্তু মেয়েটা যদি নিচ থেকে খুঁটি ধরে নাড়ায়? ছেলেটা হয়তো অবাক হয়ে কি হচ্ছে তা দেখতে যাবে।

তার আগেই সেইকির ব্যাপারটা থামাতে হবে। সে ছেলেটাকে বলল পোর্চে বসতে।

“আমি চা বানিয়ে আনি,” বলে সেইকি পোর্চে উঠে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল।

“কে জানে মোরিনো কোথায় উধাও হল..” ছেলেটা বিড়বিড় করে বলছে ও শুনতে পেল। সেইকি জমে গিয়ে ছেলেটার দিকে পেছন থেকে তাকাল।

“আমি বোঝাতে পারব না ব্যাপারটা, কিন্তু ওর ভেতর কি যেন একটা আছে…কিভাবে যেন সবসময় অদ্ভুত মানুষদের আকর্ষণ করে,” ছেলেটা সেইকির দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল। ব্যাপারটা নিশ্চিত যে কথাগুলো বিড়বিড়িয়ে বললেও ছেলেটা চাইছিল সে শুনতে পাক। ওর ঐ চারপাশের ‘কি যেন’ এর কারনে অস্বাভাবিক লোকজন ওর পিছু নেয়।”

“এক মিনিট-আমি চা নিয়ে আসছি,” সেইকি ছেলেটাকে বলে চলে এল। ও নিশ্চিত না ছেলেটা ইচ্ছা করেই বিষয়টা তুলে আনল কিনা, তবে ওর কথার সুরে নিশ্চিত একটা অশুভ ব্যাপার লুকিয়ে ছিল।

কিচেনে গিয়ে চায়ের জন্য পানি গরম করতে করতে সেইকি ড্রয়ারে রাখা কিচেন নাইফগুলোর দিকে তাকাল। খুন করার জন্য আর কোন অস্ত্র ওর মাথায় আসছে না।

গ্যাস স্টোভের নীলচে আগুনে কেটলির পানি গরম হতে শুরু করল। একটা ট্রে তে কাপ আর টিপট নিল। ছুরিটা সেগুলোর পাশে রাখল। ছুরিটার ব্লেডের ধাতব উজ্জ্বলতায় ও কল্পনা করার চেষ্টা করল যে ছুরিটা ও পোর্চে বসে থাকা ছেলেটার পিঠে বসিয়ে দিচ্ছে।

সিঙ্কের কোনায় ভর দিয়ে সেইকি ভারসাম্য ঠিক রাখল, নাহলে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবে মনে হচ্ছিল। মেয়েটাকে কবর দেয়ার পর যে আনন্দ হয়েছিল তার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই ওর মনে। বরং ওর মনে হচ্ছিল যেন কোন ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখছে। যা কিছু সে দেখছে, যা কিছু স্পর্শ করছে সবকিছু পচে দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে জঘন্য ব্যাপার আসলে সে নিজেই। কৌসুকিকে খুন করেছে ও, মেয়েটাকেও জ্যান্ত কবর দিয়েছে। এখন এই ছেলেটাকেও কুপিয়ে হত্যা করতে চলেছে। মেয়েটার তার বয়ফ্রেন্ডের উপর বিশ্বাসের সাথে তুলনা করলে ওর নিজের হৃদয়ের অবস্থা করুণ। ওর দুঃস্বপ্নের শুরু হয়েছে আসলে কৌসুকিকে খুন করার পর থেকেই।

কিংবা হয়তো ও এই দুঃস্বপ্নে জড়িয়ে গিয়েছে জন্ম নেয়ার পর থেকেই। যে মুহূর্তে ও ওর জীবন পেয়েছে, তখনই হয়তো ওর আত্মা কোনভাবে খুন করার লিপ্সায় আবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

পানি ফুটে গিয়েছে, কেটলির মুখ দিয়ে বাষ্প বের হচ্ছে। সেইকি চুলা বন্ধ করতে গিয়ে উপলদ্ধি করল..

কৌসুকি…

বাস্প বেড়ে গেল, কেটলির ভেতর উন্মত্ত হয়ে পানি ফুটছে।

কৌসুকির চেহারা কেমন ছিল দেখতে..?

সেইকি কিছুতেই ওর চেহারা মনে করতে পারছিল না। বাচ্চা ছেলেটাকে ও খুন করেছে। ওর সাথে কতবার পার্কে খেলেছে, কিন্তু কিছু মনে পড়ছে না। যেন লাশ মাটির সাথে মিশে যাওয়ায় ওর স্মৃতিও হারিয়ে গিয়েছে সাথে সাথে।

সেইকির সমস্যাটা কোথায় আসলে? উত্তরটা ওর জানা নেই। ওর কিছু অংশ ছিল একজন ভালো মানুষের, যে কিনা সবার সাথে ভালো ব্যবহার করে। আর কিছু অংশ ছিল দানবের, যে জীবন্ত মানুষ কবর দিয়ে মজা পায়। এই দুই অংশ নিজদের মধ্যে যুদ্ধ করে মাল্টিপল পারসোনালিটির মত। অথচ তারা ভিন্ন ভিন্ন মানুষ নয়-তারা একসাথে যুক্ত, একই মানুষ।

কিন্তু সে ক্ষেত্রে ও আসলে কোন মানুষটা। কোন মানুষটা ও ভাবত ও ছিল? ও আর নিজেকে বিশ্বাস করতে পারে না এখন। তাহলে ও কিসে বিশ্বাস করবে?

ট্রে থেকে ছুরিটা হাতে নিল সেইকি। হাত কাঁপছে ওর…

স্টোভটা নিভিয়ে পটটা ভরল ও। তারপর পোর্চে বসে থাকা ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেল।

সেইকি নিঃশব্দে হাটে। কোনায় পৌঁছুতে ও পোর্চে বসা ছেলেটার পিঠ দেখতে পেল, বাগানের দিকে মুখ দিয়ে বসে আছে। ছেলেটার কানে সেল ফোন ধরা। সে কি পুলিশকে ফোন করছে? এক মুহূর্তের জন্য সেইকি আতংকিত হয়ে পড়ল।

নিঃশব্দে সামনে এগুলো ও।

ছেলেটার ফোনে কথা বলা ওর কানে আসছিল। কথা বলার ভঙ্গি থেকে ও বুঝতে পারল, পুলিশ নয় কোন বন্ধুর সাথে কথা বলছে সে।

ছেলেটার পেছনে গিয়ে দাঁড়াতে পায়ের নিচের তক্তা ক্যাচকোচ করে উঠল।

ছেলেটা ঘুরে তাকিয়ে ফোন কেটে দিল। “সেইকি, এত সময় লাগল যে! আপনাকে আরো অসুস্থ দেখাচ্ছে এখন..”

সেইকি ছেলেটার পাশে ট্রেটা নামিয়ে রাখল। “হ্যাঁ, আসলে…আমার বেশ মাথা ঘোরাচ্ছে..” কাপে চা ঢালল।

মনের ভেতরে বাস করা দানবটাকে দমিয়ে রাখতে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। কাপটা ছেলেটার হাতে দিয়ে ও মনস্থির করতে লাগল।

ছুরিটা সে কিচেনে রেখে এসেছে। কৌসুকির চেহারা যখন ও আর মনে করতে পারল না তখন বুঝল ওর আর কিছু করার নেই। দুঃস্বপ্ন থেকে পালিয়ে যাওয়ার এটাই একমাত্র উপায় ওর সামনে।

কাপটার ফ্যাকাসে সবুজ তরল থেকে সাদা ধোঁয়া উঠছিল। ছেলেটা সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল, তারপর চুমুক না দিয়ে কাপটা নামিয়ে রাখল।

“সেইকি, সুখবর আছে,” ছেলেটা জোরে শ্বাস ফেলল, ওকে দেখে মনে হলো স্বস্তি বোধ করছে। “মোরিনো কালকে নিখোঁজ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু একটু আগে সে বাড়ি ফিরে এসেছে।”

দেয়ালের ঘড়ি মাঝরাতের জানান দিল যখন, সেইকি তখন নিজের রুমে আলো নিভিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে ছিল। ওর সারা শরীর কাঁপছিল। সূর্যাস্তের আগে থেকেই এরকম অবস্থা। এখন আর ও বলতে পারবে না গরম লাগছে নাকি ঠান্ডা লাগছে…অথবা জীবিত আছে নাকি মরে গেছে।

ঘড়ির বড় কাটা শব্দ করে আরেক ঘর এগুলো। সেই মুহূর্তে জানালা দিয়ে চাঁদের আলো ঠিক জায়গায় গিয়ে পড়ল। সাদা আলোয় সবকিছু চকচক করছে। আলো চোখে পড়তেই অবশেষে মনস্থির করে উঠে পড়ল সেইকি। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গ্যারেজে ঢুকে কোদাল নিল। আর একটা ক্রোবার, কফিনের ঢাকনা খোলার জন্য। তারপর বাগানে গেল।

পৃথিবী আঁধারে পুরোপুরি নিমজ্জিত না হওয়া পর্যন্ত ও অপেক্ষা করছিল। দিনের বেলা হলে ওর ভয় ছিল কেউ হয়তো দেয়ালের ওপাশ থেকে দেখে ফেলবে ও কি করছে। কিন্তু যতই ও অপেক্ষা করছিল রাতের জন্য ততই ওর কল্পনা ওকে কাবু করে ফেলেছে, পাগল বানিয়ে ফেলেছে ওকে। ভয়ে কাবু হয়ে ও প্রায় জ্ঞান হারাতে বসেছে, কিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই ছয় ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছিল।

চিরহরিৎ গাছগুলো পার হয়ে ও খোলা জায়গাটায় হাজির হলো। দেয়ালের সাথে বাঁশের খুঁটিগুলোর দিকে তাকিয়ে পা বাড়াল সামনে। হাতের পেছন দিকটা ব্যথা করছে, ঠিক যেখানে গত রাতে মেয়েটা আঁচড় দিয়েছিল।

সেইকি বুক সমান বাঁশের খুঁটিগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াল, খুঁটিগুলো মেয়েটার কফিনের সাথে সংযুক্ত। সেইকির হাত এত ব্যথা করছিল মনে হচ্ছিল কেটে রক্ত বের হচ্ছে।

ও কোদাল দিয়ে কুপিয়ে গর্ত খুঁড়তে শুরু করল।

অন্ধকারে কাজ করছিল, কেউ যাতে টের না পায়। আর সারাদিন আকাশ জুড়ে মেঘ থাকলেও, রাতে আকাশ একদম পরিস্কার। ঠিক গত রাতের মতই চারপাশ চাঁদের ফ্যাকাসে আলোতে স্নান করছে। রাস্তা থেকে কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না, আর ও নিজেও নিরবে কাজ করে যেতে লাগল। একমাত্র শব্দ আসছিল মাটির উপর কোপ পড়া ওর কোদাল থেকে। ওর তখনও মাথা ঝিমঝিম করছে। জ্বর হলে শরীর যেমন দূর্বল লাগে সেরকম লাগছে। গর্ত খুঁড়তে খুঁড়তে ও মনে করার চেষ্টা করল ছেলেটা পোর্চে বসে কী বলেছিল।

“শুনে মনে হলো ওর উপর দিয়ে কঠিন সময় গিয়েছে, কিন্তু এখন ও ঠিক আছে, নিরাপদে আছে। মাত্রই ফোনে কথা বললাম। ওর বাসায় যাচ্ছি এখন-আমাকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।”

চা ঠান্ডা হওয়ার আগেই ছেলেটা কথাগুলো বলে উঠে বো করে তারপর বেরিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো।

সেইকি প্রায় পলক না ফেলে ছেলেটার কথা শুনল, কথাগুলোর অর্থ ওর মগজে প্রবেশ করছিল না। কি বলছে এসব? কোনভাবেই মেয়েটার পক্ষে মাটির নিচ থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়।

ছেলেটা বেরিয়ে যাওয়ার আগে সেইকির এরকম ধাঁধায় পড়া চেহারা খেয়াল করল না।

সেইকি পোর্চ থেকে নেমে জুতো পড়ে ওর পিছু পিছু গেল।

“মেয়েটা…মেয়েটা বাসায় ফিরে এসেছে..?”

অবশ্যই মিথ্যা কথা হবে। কিন্তু প্রশ্নটা না করে ও পারল না।

“হ্যাঁ। কথা শুনে মনে হলো এখনো শকের মধ্যে আছে। চিন্তা করবেন না, আশা করছি সে তাড়াতাড়িই ধকল কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে।”

ছেলেটা গেট দিয়ে বের হয়ে পার্কের দিকে এগিয়ে গেল।

সেইকি গেট পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেল। গেটে হাত রেখে ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করতে করতে ছেলেটার চলে যাওয়া দেখল।

ছেলেটা চৌরাস্তার শেষ মাথায় গিয়ে মোড় নেয়ার সময় কাকে যেন হাত নাড়ল। সেইকির ওখান থেকে দেখা যাচ্ছিল না অন্য মানুষটিকে। পরের মুহূর্তেই মানুষটি রাস্তার কোনা থেকে এসে ছেলেটির পাশে দাঁড়াল। লম্বা চুলের মেয়েটিকে এক নজর দেখেই সেইকি চিনে ফেলল।

চিনে ফেললেও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না ও। হা করে মেয়েটার চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকল-সুন্দর চেহারা, ফ্যাকাসে রঙের তৃক। এই মেয়েকে সে গতকাল নিজ হাতে জ্যান্ত কবর দিয়েছে। ছেলেটার সাথে কথা বলছিল মোরিনো।

সেইকি কি স্বপ্ন দেখছে? ওর এত মাথা ঘোরাচ্ছে যে আশেপাশের বাড়িঘর, টেলিফোনের খাম্বা সব নড়তে লাগল। রাস্তা আর দেয়ালগুলো পুকুরের পানিতে সৃষ্ট ঢেউয়ের মত নড়াচড়া করছে…

ও বাঁশের খুঁটিগুলোর দিকে তাকাল, যেখানে মেয়েটাকে কবর দিয়েছে। সেখানে দৌড়ে গেল এবার। যে মুহূর্তে সেইকি ওদের থেকে চোখ ফেরাল, ছেলেটা ওর দিকে ফিরে তাকিয়ে আছে কিন্তু সেইকির মাথায় তখন একমাত্র চিন্তা কবরটাকে নিয়ে।

মেয়েটাকে যেখানে কবর দিয়েছে সেখানে গিয়ে বাঁশের খুঁটি দিয়ে কথা বলল সেইকি। কোন উত্তর পেল না। নিচ থেকে কোন শব্দ এল ভেতর দিয়ে খালি গাঢ় অন্ধকার দেখা যাচ্ছিল।

মেয়েটা নিশ্চয়ই পালিয়েছে।

না, সেইকি এই ধারনাটা বাতিল করে দিল। কবরের মাটি এদিক ওদিক হয়নি। তাহলে…তাহলে সে কাকে কবর দিয়েছে..?

বাঁশের খুঁটি দিয়ে সে কয়েকবার ডাকল, অন্ধকার নেমে আসা পর্যন্ত। কিন্তু মেয়েটা একবারও উত্তর দিল না। অনেক মাথা ঘামিয়েও সেইকি এই রহস্যের কোন অর্থ বের করতে পারল না। এক পর্যায়ে গিয়ে ও সিদ্ধান্তে পৌঁছল যে রাত গম্ভীর হওয়ার পর ঢাকনা খুলে দেখছে।

চাঁদের আলোয়, মাটিতে কোদালের কোপ পড়া ছাড়া আর কোন শব্দ ছিল না। সেইকি ওর পুরো মনোযোগ কাজের মধ্যে ঢেলে দিয়েছিল। বনের কালো দেয়ালগুলো মনে হচ্ছিল চারপাশ থেকে ওর দিকে তাকিয়ে কাজ কারবার দেখছে। রাতের ভ্যাপসা বাতাসে চিরহরিৎ গাছগুলো থেকে ভেসে আসা গন্ধ আরো জোরালো হয়ে নাকে এসে লাগছিল।

সেইকি অনুভব করছিল যে মাটি কেটে কোদাল ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। কোদাল টেনে তোলার সময় মাটির ভারও টের পাচ্ছিল। কিন্তু ওর মনে হচ্ছিল ও যেন কোন দুঃস্বপ্নের মধ্যে আটকা পরে গিয়েছে। সেই একই কাজ অনন্তকাল ধরে করে যাচ্ছে কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। একসময় ওর বিশ্বাস হচ্ছে না যে, ও আসলেই বাস্তব পৃথিবীতে অবস্থান করছে কিনা। সে হয়তো মনুষ্যরুপি কোন কিছু যা আঁধারের ফাঁদে আটকা পড়ে গেছে কোনভাবে আর অনন্তকাল ধরে মাটি খুঁড়ে যাচ্ছে।

ওর হাত ব্যথা করতে লাগল। ও নিশ্চিত যে ওর হাতে মেয়েটার খামচে দেয়া দাগগুলো কোন অভিশাপ বয়ে এনেছে।

ওর পায়ের তলে আসলে কি মাটি চাপা দেয়া ছিল? যত গর্ত বড় হতে লাগল তত ওর আত্মবিশ্বাস কমতে লাগল। গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে শুরু করল। প্রতি কোপে মাটি তোলার পর ওকে কাঁধ দিয়ে চোখ মুছতে হচ্ছিল দৃষ্টি পরিস্কার করার জন্য। যে জিনিসটা মটিতে কবর দেয়া হয়েছে সেটার কথা ভাবতেই ওর আতংক বোধ হচ্ছিল। ওর করা জঘন্য অপরাধ আসলে সেখানে শুয়ে আছে। ওর মনে হচ্ছিল সেটা কোন আয়নার মত কিছু একটা হবে, ওর ভেতরে লুকিয়ে থাকা অমানুষটার প্রতিফলন মাত্র।

সেইকির মনে হচ্ছিল ও অনন্তকাল ধরে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু এক সময় কাজ শেষ হলো। যে কাঠের বাক্সটা ও বানিয়েছিল সেটা একসময় গর্তের ভেতর দেখা দিল। গর্তের চারপাশ তখন সাদা কুয়াশা আর মাটির ঘ্রাণ ঘিরে রেখেছে, চাঁদের ফ্যাকাসে আলোতে স্নানরত। ঢাকনাটা পেরেক দিয়ে আটকানো ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল না খোলার চেষ্টা করা হয়েছে। ঢাকনার উপর বৃদ্ধাঙ্গুলির সমান দুটো গর্ত। বাক্সটা ওর আতংক বাড়িয়ে দিল। মনে হচ্ছিল যেন কোন ঠান্ডা অন্য জগতের থেকে আসা কোন বস্তু। ফোঁপাচ্ছে। সেইকি ক্রোবার দিয়ে ঢাকনাটা ভোলা শুরু করল।

প্রথম যে জিনিসটা ওর ইন্দ্রিয়তে ধরা পড়ল তা হল রক্তের গন্ধ। গন্ধটা এত জোরালো ছিল যে ওকে ধাক্কা দিয়ে পিছে সরিয়ে দিল। তারপর ও দেখল একটা ইউনিফর্ম পরা মেয়ে শুয়ে আছে। পিঠ নিচে রেখে হাত দুটো বুকের উপর রাখা। মুখটা একদিকে বাঁকানো, আর পুরো বাক্স গাঢ় একধরনের তরলে ডুবে আছে।

রক্ত! মেয়েটার গলা থেকে বের হওয়া রক্ত। ওর হাতে একটা মেকানিক্যাল পেন্সিল ধরা। ঠিক যেমনটা সে বলেছিল, পেন্সিল গলায় ঢুকিয়ে আত্মহত্যা করেছে।

রক্ত নিশ্চয়ই ফোয়ারার মত ছিটকে বেরিয়ে ঢাকনায় লেগেছে। সেইকি গর্ত থেকে সরে গিয়ে নিজের গালে চড় লাগাল। বাগানের দেয়াল ধরে কাঁপতে লাগল। হাটুগুলো আর ওর শরীরের ভার বহন করতে পারছে না, বসে বমি করে ফেলল ও। সারাদিন কিছু না খাওয়ায় এসিড রস ছাড়া আর কিছুই বের হল না পেট থেকে।

“আপনি হয়তো খেয়াল করেছেন, মেয়েটা মোরিনো ইয়োরু নয়..”

কথাগুলো কানে আসতেই সেইকি ভয়ে কেঁপে উঠল। প্রথমে ও ভেবেছিল কথাগুলো ওর নিজের মাথা থেকে এসেছে কিন্তু কথাগুলো আসলে বলেছিল সকালে যে ছেলেটার সাথে ওর দেখা হয়েছিল।

“সেইকি, আপনি সেফ ওকে মোরিনো ভেবেছিলেন।”

কারো পায়ের শব্দ সেইকির কানে এল। সেইকি মুখ উঁচু করে দেখতে পেল কুয়াশার ভেতর থেকে একটা অবয়ব দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলো পেছন দিকে থাকায় অবয়বের চেহারা দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু তারপরেও সেইকি নিশ্চিত ছিল অবয়বটা ঐ ছেলেটা ছাড়া আর কেউ নয়।

দূর থেকে আরেকজনের পায়ের শব্দ আসতে শোনা গেল। চিরহরিৎ গাছগুলোর আড়ালে আরো কেউ একজন ছিল। তারা দুজন সেইকিকে পাশ কাটিয়ে কবরটার দিকে গেল। অন্য ছেলেটিও একই বয়সেরই হবে খালি একটু লম্বা আর গাট্টাগোট্টা ধরনের। সেইকি চাঁদের আলোতে ছেলেটার মুখ দেখলেও চিনতে পারল না।

কি হচ্ছে এখানে? সেইকি কিছু বুঝতে পারছিল না। এটা কি বাস্তব নাকি ও কোন স্বপ্ন দেখছে? নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব ছিল না সেইকির পক্ষে। সেইকি দেখল লম্বা ছেলেটা মাথা ঝাঁকাল আর কাঁদতে লাগল।

“ও আমাদের ক্লাসমেট। যে মেয়েটাকে আপনি কবর দিয়েছিলেন সে ছিল ওর গার্লফ্রেন্ড। ওর নাম…।”

ছেলেটা যে নাম বলল সেটা সেইকি আগেই শুনেছিল।

“ওহ…তাহলে ও হলো সেই ছেলে…”

মেয়েটা যে ছেলের নাম বলেছিল।

ছেলেটা গর্তে নেমে গেল। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। সেইকি খালি ওর পিঠ দেখতে পাচ্ছিল। ছেলেটা মেয়েটার নাম ধরে ডাকছিল। সেইকি দেখল ওর পিঠ কাঁপছে, সম্ভবত মেয়েটার কাঁধ ধরে ঝাঁকাচ্ছিল ছেলেটা।

মেয়েটার সাথে কথা বলছিল সে। প্রথমে আস্তে আস্তে, যেন মনে হচ্ছিল মেয়েটা ওর সাথে মজা করছে-কিন্তু পরে যখন দেখল মেয়েটা একদমই উত্তর দিচ্ছে না, ওর গলার স্বরও পাল্লা দিয়ে জোরালো হতে লাগল।

“যে মেয়েটাকে দেখলেন ওর চেহারায় কোন তিল ছিল?” সকালের ছেলেটা জিজ্ঞেস করল। সেইকি মাথা নাড়ল।

“সকালে যখন আপনি বললেন একটা মেয়েকে আপনি প্রতিদিন রাস্তায় দেখেন কিন্তু আজকে দেখেননি…মেয়েটার চোখের নিচে একটা তিল আছে। তখনই আমি আপনাকে সন্দেহ করি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম আপনি মোরিনো আর এই মেয়েটার মধ্যে গুলিয়ে ফেলেছেন।”

“কিন্তু মেয়েটার ব্যাগে একটা আইডি কার্ড ছিল..”

“মোরিনো ওর কার্ডটা হারিয়ে ফেলেছিল। আর এই মেয়েটা কার্ডটা পেয়ে মোরিনোকে ফেরত দিতে যাচ্ছিল। মোরিনো আজকে সকালে স্কুলে আমাকে বলেছে সেটা। সেজন্যই আমি বুঝেছি যে আপনি ছবি দেখে তিলের কথা জেনেছেন। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো ওকে গাড়ি চাপা দিয়েছেন, চেহারা বোঝার উপায় ছিল না তাই ছবি দেখে আন্দাজ করে নিয়েছেন তিলটার কথা।”

সেইকি নিজের হাত দুটোর দিকে তাকাল। যখন ও মেয়েটাকে গাড়িতে ঢোকাচ্ছিল তখন মার খেয়ে মেয়েটার চেহারার অবস্থা এমনিতেও ভয়াবহ ছিল। আর কফিনে ঢুকানোর সময় ও ভালো করে মেয়েটার দিকে তাকায়নি। ধরেই নিয়েছিল আইডি কার্ডের মেয়েটা আর এই মেয়েটা একই মেয়ে।

ধীরে ধীরে সেইকি ও ওর ভুলের পরিধি অনুভব করতে শুরু করল। ঐদিন সকালে মেয়েটা কেন পাগলের মত হাসছিল? এখন সেইকি বুঝতে পারছে মেয়েটা হাসছিল কারণ ও মেয়েটাকে আরেকজনের নামে ডেকেছিল। সেইকির ভুল ধরতে পেরে সে হাসছিল।

সেইকি গর্তের দিকে তাকাল। মেয়েটার পাশে বয়ফ্রেন্ডটা বসে আছে। সেইকি ওদের সম্পর্কে তেমন কিছুই জানত না। ওদের প্রেমের গভীরতা সম্পর্কে ওর কোন ধারণা ছিল না। কিন্তু ওর সাথে মেয়েটার যেটুকু কথা হয়েছিল তা থেকে কিছুটা আঁচ করেছিল। ঐ ছোট অন্ধকার জায়গাটায় চাপা পড়লেও মেয়েটা কখনো সেইকির কাছে হার মানেনি। মেয়েটার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ছেলেটা ওকে উদ্ধার করতে আসবে।

ছেলেটা ওর পাশে বসে আছে এখন। আর কোন কথা বলছে না, চুপ করে কফিনের দিকে তাকিয়ে আছে।

“সেইকি, আমি বুঝতে পেরেছিলাম আপনি মেয়েটাকে আপনার বাড়িতে কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন কিন্তু তখন আমার কোন ধারণা ছিল না কোথায় লুকিয়েছেন। কিন্তু যে মুহূর্তে আপনি দেখলেন মোরিনো বেঁচে আছে, ঘোরাফেরা করছে, আপনার চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। বাগানের দিকে তাকালেন। তারপর সেখানে ছুটে গেলেন। তখন আমি আন্দাজ করে নিলাম যে আপনি ওকে বাগানে কোথাও মাটি চাপা দিয়েছেন।”

ছেলেটা মোরিনো ইয়োরুকে ইচ্ছা করেই ওর সেলফোন থেকে ফোন করেছিল, সেইকির কি প্রতিক্রিয়া হয় তা দেখার জন্য। আর প্রতিক্রিয়া দেখেই সে বাগানের ব্যাপারটা ধরে ফেলেছিল।

“তুমি…”

সেইকি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গিয়েও কথা হারিয়ে ফেলল। কে এই ছেলে? ক্লাসমেটের জন্য প্রতিশোধ নিতে আসা কেউ? কিন্তু ছেলেটার কথা বলার ভঙ্গিতে কোন রাগের চিহ্ন ছিল না, ছিল না

সেইকির অপরাধের প্রতি কোন ধিক্কার। একদম শান্ত, নরম গলায় কথাগুলো সে সেইকিকে বলছিল।

এই ছেলের সাথে দেখা না হলে হয়তো ওর অপরাধ কোনদিন ধরা পড়ত না। কেন এই ছেলে এসবের সাথে জড়িয়ে পড়ল?

তখন ওর আইডি কার্ডের কথা মনে পড়ল। আইডি কার্ড খুঁজতে গিয়েই ছেলেটার সাথে দেখা।

“আমার আইডি কার্ড…ওটার কি হল?” সেইকি জিজ্ঞেস করল।

ছেলেটা মাথা নাড়ল। “ও, আপনি তাহলে আইডি কার্ড খুঁজছিলেন সেখানে?”

ছেলেটা ওর আইডি কার্ড দেখেনি।

“তোমার কাছে না থাকলে ওটা কোথায় গেল..?”

“শেষ কখন দেখেছেন সেটা?”

“অফিসে, আমার জ্যাকেটের পকেটে.” তারপর হয়তো…সে মুহূর্তে আরেকটা আইডিয়া ওর মাথায় এল।

“তুমি একটু ওর জামাকাপড় পরীক্ষা করে দেখবে.. সেইকি মেয়েটার দিকে আঙুল তুলে ইশারা করল। কবরটার কাছে যাওয়ার কোন ইচ্ছা ওর নেই। “হয়তো ওর কাছেই আছে আইডি কার্ডটা।”

গাড়ির ভেতর ও মেয়েটাকে ওর জ্যাকেট দিয়ে ঢেকে রেখেছিল, আর মেয়েটার যদি আগেই জ্ঞান ফিরে থাকে…

ছেলেটা সেইকির পাশ থেকে সরে গিয়ে নিশ্চুপ বয়ফ্রেন্ত্রে পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর বুকে মেয়েটার পকেটগুলো হাতড়ে দেখল।

“এই যে এখানে,” সে সোজা হয়ে বলল, হাতে আইডি কার্ডটা। আর এই যে ওর নিজের আইডি কার্ড। স্কার্টের পকেটে ছিল।”

কার্ড দুটো সে সেইকির হাতে দিল।

তার মানে সারাটা সময় আইডি কার্ডটা মেয়েটার কাছে ছিল। সে হয়তো আইডি কার্ডটা নিয়েছিল ওর পরিচয় জানতে। পরে বাক্সের ভেতর নিজের সাথে রেখেছিল কোনদিন লাশ পাওয়া গেলে যাতে খুনিকে চিহ্নিত করা যায়। ওর এইসব কাজই সেইকির জন্য দুর্ভাগ্য ডেকে এনেছিল।

মেয়েটা মাটির তলে থেকেও ওকে খেলায় হারিয়ে দিয়েছে। যে মুহূর্তে ও তাকে কবর দিয়েছে সেই মুহূর্তেই নিজের অজান্তে ফাঁদে পা দিয়েছে।

“সেইকি, আপনি..” ছেলেটা ওর আইডি কার্ডের দিকে তাকিয়ে আছে।

সেইকি বুঝতে পারছিল ছেলেটা কি ভাবছে। সেইকি হাঁটুর সাথে মাথা লাগিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল।

“হ..হ্যাঁ,”

ও চায়নি কেউ ব্যাপারটা জানুক।

সেইকি মুখ তুলে ছেলেটার দিকে তাকাতে পারছিল না। ছেলেটার দৃষ্টি ওর শরীরে যন্ত্রণা সৃষ্টি করছিল। লজ্জায় ওর মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল।

ছেলেটা দেখে ফেলেছে যে আইডি কার্ডটায় বিভাগীয় পুলিশ ডিপাটমেন্টের নাম সোনালি অক্ষরে লেখা। সেই সাথে সেইকির ছবি আর র‍্যাঙ্কও লেখা।

এরকম হওয়ার কথা ছিল না। সেইকি অনেক পরিশ্রমী ছিল, লোকজন ওকে বিশ্বাস করত। ও যখন টহল দিত তখন সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপ করত। কৌসুকির বাবা-মা ওকে নিজেদের সন্তানের মত বিশ্বাস করতেন। একটা সময় ছিল যখন ও বিশ্বাস করত ওর মত দয়ালু মানুষের এ পেশায় আসা উচিত। আর এখন ও আইনের সাথে বেঈমানি করেছে, নিজের অবস্থানের সাথে বেঈমানি করেছে, নিজের দাদির সাথে করেছে যে কিনা ওকে লক্ষ্মী ছেলে বলত। এই দুনিয়ার সবকিছুর সাথে ও বেঈইমানি করেছে।

“প্লিজ…আমি জানি…দয়া করে আর কিছু বোল না..” ও অনুনয় করল। ওর হাঁটু মাটিতে নামানো, মুখ নিচু করে আছে। সেইকি টের পেল ছেলেটা ওর দিকে এগিয়ে আসছে।

“তাকান আমার দিকে, ছেলেটা বলল।

ইতস্তত করে সেইকি ওর দিকে তাকাল। ছেলেটা আইডি কার্ডটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে রেখেছে।

সেইকি মাথা বো করে কার্ডটা হাতে নিল। উঠে দাঁড়ানোর কোন ক্ষমতা ওর ছিল না।

“সেইকি, আমার কিছু প্রশ্ন ছিল। যখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আপনি মোরিনো আর মেয়েটার মধ্যে গুলিয়ে ফেলেছেন তখন আমার ধারণা ছিল আপনি হয়তো একটা এক্সিডেন্ট ঘটিয়ে ফেলেছেন। যে কারনে আপনি মেয়েটা কেমন দেখতে তা বুঝতে পারেননি। পুরো ব্যাপারটার এরকমই একটা ব্যাখ্যা হতে পারে বলে আমার মনে হয়েছিল।”

সেইকি আইডি কার্ডটা শক্ত করে চেপে ধরে ছেলেটার কথা শুনছিল।

“কিন্তু কোথাও কোন রক্তের দাগ নেই, না পার্কের ওখানে, না মাটিতে, না আপনার গাড়িতে। আর এখন মেয়েটাকে পরীক্ষা করে বুঝলাম আঘাত পেলেও, দুএকটা হার ভাঙলেও, একমাত্র ইঞ্জুরি আসলে গলার কাছে ক্ষতটা। যেটা দেখে মনে হচ্ছে আত্মহত্যা। তার মানে এক্সিডেন্টে ওকে খুন করে এখানে এনে মাটি চাপা দেননি আপনি।”

সেইকি মাথা ঝাঁকাল। ছেলেটা এসে ওর হাঁটুতে হাত রাখল। “তাহলে কেন কবর দিয়েছেন ওকে?”

ছেলেটার কথা শুনে মনে হচ্ছিল না মেয়েটার মৃত্যুর জন্য সেইকিকে দায়ি করছে, সে সেফ জানতে চাইছিল। সেইকি প্রশ্নটার কোন সহজ উত্তর খুঁজে পেল না বলার জন্য। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে মাথা নাড়ল। “জানি না। আমি ওকে কবর দিয়েছি কারণ আমার ইচ্ছা হয়েছিল।”

যা সত্যি তাই ও উত্তরে বলল।

কেন ও কৌসুকিকে খুন করেছিল? কেন ওকে ভুতে পেয়েছিল যে জ্যান্ত মানুষ ধরে ধরে কবর দিতে হবে?

কোন কারণ নেই এর পেছনে। সেইকি এই দু-জনকে কবর দিয়েছিল কারণ ওর জন্মই হয়েছিল যেন এই কাজ করার জন্য।

“আমি ওদের দুজনকে কবর দিয়েছি কারণ আমার ইচ্ছা হয়েছিল।” ও আবার বলল। ওর বুক ব্যথা করছিল। এই উত্তর কোন মানুষের পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। ওর হাত কাঁপছিল, আইডি কার্ডটা হাত থেকে মাটিতে পড়ে গেল। “আমি..”

কিভাবে ও বেঁচে থাকবে? ওর সত্যিকারের সত্ত্বার অস্তিত্ব জেনে যাওয়ার পর? কি ভয়াবহ জঘন্য একটা সত্য। ওর সামনে আর কি করার আছে এরপর?

কেন এরকম একটা হৃদয় নিয়ে ওকে জন্ম গ্রহণ করতে হল? কেন ও অন্য মানুষদের মত সাধারণ কেউ হতে পারল না? ওর মনের ভেতর প্রশ্নের পর প্রশ্ন জাগছিল, আর হৃদয় ভেসে যাচ্ছিল দুঃখ কষ্টে।

একজন সাধারণ মানুষের মতই তো সে বাঁচতে চেয়েছিল, খুন থেকে কোন আনন্দ পাওয়ার জন্য নয়। সে কখনো চায়নি মানুষজনকে জ্যান্ত কবর দিয়ে আনন্দ পেতে, মাঝরাতে গর্ত খুঁড়ে নিজেকে শান্ত করতে…সে শুধু কারো কোন ক্ষতি না করে বাঁচতে চেয়েছে।

বেশি কিছু তো চায়নি। অল্পতেই ও খুশি ছিল। ওর চাওয়া ছিল একটা সাধারণ জীবনের-যেমন ওর ইস্ত্রি করা শার্ট পরা কলিগের মত, কিংবা বাচ্চাদের ছবি ডেস্কে রাখা ওর বসের মত। ওরকম সৌভাগ্যবান হলে কত ভালোই না হত?

সেইকির গাল বেয়ে অশ্রু নেমে এল। সে ওখানেই হাঁটু মুড়ে বসে থাকল, অশ্রুগুলো ওর গাল বেয়ে নেমে মাটিতে হারিয়ে গেল। তার কোন ধারণা ছিল না এরপর আর কি করার আছে। পুরো দুনিয়া অন্ধকারে ঢেকে গেল, তার মনে হচ্ছিল অদৃশ্য এক কফিনে আটকা পড়ে গিয়েছে সে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল ওর।

***

কিছুক্ষনের জন্য ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। হুঁশ ফেরার পর সেইকি দেখল ও পোর্চে বসে আছে। চারপাশে তখনো অন্ধকার, কিন্তু পাখির ডাক শুনে বোঝা যাচ্ছিল ভোরের সময় হয়ে এসেছে।

ঘরের বাতি জ্বলছে, আর কেউ সেখানে হাঁটাহাঁটি করছে। সেইকির শরীরে কোন শক্তি ছিল না যে উঠে গিয়ে দেখে। ওর হাতগুলো তখনো কাঁপছিল।

ও মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, একসময় ছেলেটা এসে হাজির এল।

ওদের মধ্যে চোখাচোখি হলে ছেলেটা জিজ্ঞেস করল এখন ভালো বোধ করছে কিনা। জানা গেল ছেলেটাই ওকে পোর্চে নিয়ে এসেছে।

“আমার মনে হয় স্মৃতিভ্রষ্ট হয়েছে।”

“আপনি অনেক কান্নাকাটি করেছেন এতক্ষন।”

সেইকি নিজের গালে হাত দিয়ে দেখল তখনো ভেজা।

“আশা করছি আমি যে অনুমতি ছাড়া বাড়ির ভেতরে গিয়েছিলাম সেজন্য আপনি রাগ করেননি,” ছেলেটা বলল।

সেইকি আবার বাগানের দিকে তাকাল। ও যে গর্ত খুঁড়েছিল তার কোন চিহ্নও নেই। চারটা খুঁটি আগের মতই দাঁড়িয়ে আছে। এক সেকেন্ডের জন্য ওর মনে হল ঘটনাগুলো ওর কল্পনা ছিল।

“ঐ বাঁশের খুঁটিগুলো কফিনের সাথে লাগানো হয়েছিল যাতে ভেতরের মানুষটা নিঃশ্বাস নিতে পারে, তাইনা?” ছেলেটা সেইকিকে জিজ্ঞেস করল। জানা গেল ছেলেটা গর্তটা আবার ভরাট করে ফেলেছে। কিন্তু কেন? আর সাথে সাথে পুলিশ ডাকেনি কেন?

মেয়েটার বয়ফ্রেন্ডটাকে আশেপাশে দেখা গেল না। সে কি বাড়ির ভেতরে? ঘুমাচ্ছে? নাকি সেইকির মত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে?

মেয়েটা বিশ্বাস করত ওর বয়ফ্রেন্ড ঠিকই ওকে খুঁজে বের করবে আর ওকে একা ফেলে যাবে না। সেইকি ওদের ভালবাসার স্বপ্ন ভাঙার মূল্য কখনোই পরিশোধ করতে পারবে না।

সেইকি ঘুরে বাড়ির ভেতর তাকাল।

ছেলেটা ওর সেল ফোন দিয়ে কাউকে ফোন করছিল।

“আমি রাস্তায় তোমার আইডি কার্ডটা খুঁজে পেয়েছি,” ছেলেটা ফোনে বলল। বোঝা গেল ও আসল মোরিনো ইয়োরুর সাথে কথা বলছিল।

ছেলেটার কথা শেষ হতেই লাইন কেটে গেল। ফোন হাতে বিড়বিড় করতে করতে বলল, “তাইতো, একটু বেশি সকালেই ফোন করে ফেলেছি।” মোরিনো জানেও না ওর হারানো আইডি কার্ডের কারনে সেইকির জীবনে কি তোলপাড় হয়ে গিয়েছে।

তে শুরু করেছে। পোর্চে বসে পুবে তাকিয়ে সেইকি চিরহরিৎ গাছগুলোর সারি দেখতে পাচ্ছিল। গাছগুলোর কালো ছায়ার পেছনে আকাশ লাল হতে শুরু করেছে। সাদা কুয়াশা ইতিমধ্যে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছে।

ছেলেটা এসে সেইকির বাম দিকে বসল।

দু-জনে অনেকক্ষণ বাঁশের খুঁটিগুলোর দিকে চেয়ে থাকল। যে কোদাল দিয়ে গর্ত ভরাট করা হয়েছে তা ছেলেটার পাশে মাটিতে ফেলে রাখা ছিল।

সূর্য গাছগুলো ছাড়িয়ে উপরে উঠে গেলে আলো এসে ওদের মুখে পড়ল। আলোর উজ্জলতায় কিছুক্ষনের জন্য সেইকির মনে হল অন্ধ হয়ে গিয়েছে। ছেলেটার শরীরে আলো পড়লেও, মুখ ছায়ার ভেতর ছিল। ফলে চোখগুলো আরো ওর স্মৃতিতে গেঁথে গেছে।

ছেলেটার চোখগুলোতে কোন অনুভুতির ছোঁয়া ছিল না। একদম শূন্য। ওগুলো দেখতে ছিল একদম সেইকির চোখের মত যখন ও শিকার খুঁজতে যাওয়ার আগে রিয়ারভিউ মিররে নিজের চেহারা দেখেছিল। চোখগুলো জুড়ে গভীর অন্ধকার।

সেইকি টের পেল ওর অনুভূতিগুলো নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছে, অশ্রু শেষ, মাথাও আর ঝিমঝিম করছে না।

“আমার..” সেইকি বলল।

ছেলেটা ওর দিকে ঘুরল, মনোযোগ দিল ওর দিকে।

“আমার মনে হয় পুলিশকে আমার সব কিছু জানানো উচিত, যা যা করেছি আমি,” কথাগুলো ওর ঠোঁটগুলো থেকে যেন গড়িয়ে পড়ল। সব টেনশন কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে। আবার ওর চোখ দিয়ে অশ্রু বেয়ে পড়তে লাগল। এবার আর কষ্টের অশ্রু নয়, সূর্যের আলোতে সেগুলো চকচক করছে।

ওর জীবন হয়তো এখানেই শেষ। অনেকেই হয়তো ওকে ঘৃণা করবে এখন, তাদের দৃষ্টি ওর দেহে তীরের মত গিয়ে বিধবে। কিন্তু ওর আর কিছু আসে যায় না। ও ওর সমস্ত পাপের স্বীকারোক্তি করবে আর শাস্তির জন্য অপেক্ষা করবে-একজন মানুষ হিসেবে ওর যা করা উচিত।

“আমি আনন্দিত…আমি আনন্দিত যে এই সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি।”

কত অসংখ্যবার সে নিজের ভেতরের মনুষ্যত্বের অভাবের কারনে কষ্ট পেয়েছে? কত অসংখ্যবার সে নিজের সত্তার জন্য, ওর ঘৃণ্য আকাথাগুলোর জন্য নিজেকে অভিশাপ দিয়েছে? কিন্তু এখন অবশেষে ওর অবশিষ্ট মনুষ্যত্ব যা রয়েছে তা জয়ী হয়েছে।

“আমি জানি আমার পাপ এতে মাফ হয়ে যাবে না, কিন্তু নিজের কাছে ভালো লাগছে যে আমি সিদ্ধান্তটা নিতে পেরেছি।”

ছেলেটা ওর মুখ খুলল। “আপনি জেলে যেতে চাইলে আমি কোন বাধা দেব না, কিন্তু সেইকি, আপনি কি আরো ছয় মাস অপেক্ষা করতে পারবেন?”

সেইকি কারণ জানতে চাইলে ছেলেটা উঠে দাঁড়াল।

“আমি এখন বাসায় যাচ্ছি। সেইকি, দয়া করে ছয় মাস অপেক্ষা করুন। ছয় মাস না পারলে অন্তত এক মাস পরে পুলিশের কাছে যান। যদি আপনি আসলেই অতটা অনুতাপ বোধ করে থাকেন, তাহলে পুলিশকে গিয়ে বলুন আপনি কী কী করেছেন।”

তারপর সেইকিকে প্রতিজ্ঞা করাল ছেলেটা আর ইয়োৰু সম্পর্কে মোরিনো পুলিশের কাছে যেন কিছু না বলে।

“মনে রাখবেন, সে এরকমই চেয়েছিল। এ নিয়ে নিজেকে অপরাধি মনে করার কোন কারণ নেই। আপনি যদি ওকে উদ্ধার করতে চান তাহলেও সে বাধা দেবে। কিন্তু আপনার সবাইকে জানাতে হবে আপনি কী করেছেন। আমি কোন সূত্র রাখিনি। আপনি যদি কাউকে আমার কথা বলেনও, কেউ বিশ্বাস করবে না আমি এখানে ছিলাম।”

ছেলেটা ওর জুতো পরে পোর্চ থেকে নেমে গেল।

সেইকি ওর শেষের কথাগুলো কিছু বুঝতে পারল না। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ছেলেটা নিরবে কোন বিদায় না জানিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেল। ছেলেটা চিরহরিৎ গাছগুলোর মধ্য দিয়ে উধাও হয়ে গেল, পেছনে ফেলে গেল সকাল, বাগান আর সেইকিকে।

সে মহর্তে সেইকি ওর কথাগুলো উপলদ্ধি করতে পারল, ছেলেটা যদি একা বাড়ি ফিরতে থাকে তাহলে বয়ফ্রেন্ডটা কি এখানেই কোথাও রয়ে গিয়েছে?

সেইকি উঠে দাঁড়াল।

ওর মনে একটা সন্দেহ জেগেছে।

কাঁপা কাঁপা পায়ে ও খালি পায়ে বাগানে নামল। ওর নিঃশ্বাস সকালের ঠান্ডা বাতাসে ধোঁয়ার মত আকার নিচ্ছিল।

বাগানের শেষ মাথার বাঁশের খুঁটিগুলো নিখুঁতভাবে সোজা হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কফিনটা আবার খুঁটিগুলোর নিচে কবর দেয়া হয়েছে।

সবচেয়ে কাছের খুঁটিতে সেইকি কান পাতল।

ভেতর থেকে হালকা একটা স্বর ভেসে আসছে, কফিনের দেয়ালে যেন প্রতিধ্বনি তুলছে সেটা। কফিনের ভেতর একজন পুরুষ কণ্ঠ, ফোঁপানোর কারনে একটু আঁটকে যাচ্ছে তার শব্দ। মেয়েটার নাম বার বার প্রতিধ্বনি তুলছে সেই কণ্ঠ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *