৩. সারমেয়

সারমেয়

আমার প্রতিপক্ষ রক্তক্ষরণ নিয়ে ঘাসের আড়ালে লুকানোর চেষ্টা করল। কিন্তু ওর চারপাশে বৃত্তাকারে ঘুরে আসা আমার জন্য কোন ব্যাপারই ছিল না। চতুষ্পদ জন্তুটি আঘাতের পর আঘাতে বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিল, দ্রুত নড়াচড়া করার কোন অবস্থা ওর ছিল না।

আমার মনে হল ওর কষ্টের পরিণতি টানার সময় হয়ে এসেছে। পাল্টা আঘাত করার ক্ষমতা আর নেই।

জটার গলা আমার দুই চোয়ালের মধ্যে নিলাম। ঘাড় ভাঙার শব্দ মুখ বেয়ে উঠে এসে সারা শরীরে শিহরণ জাগাল। জন্তুটা স্থির হয়ে দলার মত আমার মুখ থেকে ঝুলতে লাগল।

আমি কোন দয়া প্রদর্শন করিনি। যদিও এসব কিছু করতে চাইনি, একদমই না-কিন্তু ইয়ুকা চেয়েছে আমি করি, সুতরাং আমাকে আমার প্রতিপক্ষকে খুন করতেই হলো।

চোয়াল হাঁ করলাম, জন্তুটার মৃতদেহ ধুপ করে মাটিতে পড়ে গেল। একদম নিখুপ, চোখ দুটোয় আলো নিভে গিয়েছে।

জোরে হুংকার ছাড়লাম।

ইয়ুকা আর আমি চারপেয়ে জন্তুটাকে এখানে নিয়ে এসেছিলাম, এই ব্রিজের নিচে। আমরা যাচ্ছিলাম, তখন একটা বাড়ির সামনে থেকে ইয়ুকা চুপচাপ ওটাকে তুলে এনেছিল। কেউ দেখেনি। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি জন্তুটা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

ইয়ুকা বলেছিল, “আজকের রাতের শিকার হবে এটা।”

এমন না যে, আমি ইয়ুকার শব্দগুলো বুঝতে পারি, কিন্তু তারপরেও জানতাম ও কী বলছিল আমাকে।

এসব ঘটনা সবসময় রাতের বেলায় হয়। প্রতিদিন না, মাঝে মাঝে। এখন পর্যন্ত কতবার হয়েছে আমার মনে নেই। শহর থেকে আমরা কোন একটা শিকার জোগাড় করি, তারপর ব্রিজের নিচের এই গোপন জায়গায় নিয়ে আসি। এই জায়গার কথা আমি আর ইয়ুকা ছাড়া কেউ জানে না। তারপর ইয়ুকা চায় জন্তুটার সাথে আমি লড়াই করি।

আমি ওর আদেশমত কাজ করি। প্রতিপক্ষের দিকে ছুটে যাই, আঘাত করে শুইয়ে ফেলি। যেসব চারপেয়ে প্রাণীর সাথে আমি লড়াই করেছি সবগুলোই আমার চেয়ে আকারে ছোট ছিল, সুতরাং ওদেরকে কাবু করতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। আমার আঘাতে ওগুলোর হাড় ভেঙে যায়, রক্ত ছিটকে পড়ে।

যখন আমি জিতি, ইয়ুকা হাসে। ওকে অনেক খুশি দেখায়। শব্দ দিয়ে হয়তো যোগাযোগ হয় না আমাদের মধ্যে, কিন্তু ওর অনুভূতিগুলো ঠিকই নদীর পানির মত আমার মধ্যে দিয়ে বয়ে যায়। যে কারনে ও খুশি হলে আমি সবসময়ই বুঝতে পারি।

যখন অনেক ছোট ছিলাম তখন থেকেই ইয়ুকা আমার বন্ধু। ওর সাথে। যখন প্রথম দেখা হল তখন আমি আমার মায়ের গা ঘেসে ঘুমাচ্ছিলাম। ইয়ুকা আগ্রহের সাথে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে সেদিনের কথা।

আমার হুংকারের অর্ধেকটা রাতের আকাশে মিলিয়ে গেল। বাকি অর্ধেক ব্রিজের নিচে প্রতিধ্বনি তুলতে লাগল। উপরের দিকে তাকিয়ে আমি খালি রাতের কালি ঘোলা আকাশ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না।

নদীটা বেশ চওড়া ছিল। ব্রিজটাও বিশাল। নদীর তীরে ব্রিজের আশেপাশে লম্বা লম্বা ঘাসের সমুদ। কোথাও যেতে হলে সেগুলো ঠেলে যেতে হয়। কিন্তু ব্রিজের নিচে জায়গাটা খোলা, গোলাকৃতির, কোন ঘাস নেই। কারন সূর্যের আলো সেখানে পৌঁছতে পারে না। আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি এখানে।

গ্রীষ্মের একদিনে আমি আর ইয়ুকা জায়গাটা খুঁজে পেয়েছিলাম। খোলা একটা জায়গা, চারপাশে লম্বা ঘাসের দেয়াল। সেই থেকে জায়গাটা আমাদের খেলার গোপন জায়গা।

কিন্তু এখন এখানে ইয়ুকা আমাকে লড়াই করতে বলে।

আমি কোন প্রাণীকে আঘাত করতে কিংবা খুন করতে চাই না, কিন্তু ইয়কা চায় আমি করি। ও যখন আমাকে আদেশ দেয় তখন ওর চোখগুলো রাতের মত গাঢ় হয়ে যায়, সেখানে কোন আলো থাকে না।

ইয়কা গোলাকৃতি জায়গাটার কোণায় বসে এতক্ষন ধরে সবকিছু দেখছিল। এখন সে উঠে দাঁড়াল। বাড়ি ফেরার সময় হয়েছে। ও কি ভাবছে আমি বুঝতে পারছিলাম। আমাদের মধ্যে অন্যরকম একটা যোগাযোগ রয়েছে যা কিনা সকল ভাষার বাইরে।

মৃতদেহটা তুলে নিয়ে ভোলা জায়গাটার বাইরে একটা গর্তে ফেললাম আমি। ছোট শরীরটা গড়াতে গড়াতে নিচে নেমে গেল। গর্তটা তেমন গভীর না কিন্তু তলাটা ছিল অন্ধকার, উপর থেকে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। লাশটা নিচে পড়ার শব্দ কানে ভেসে এল।

জায়গাটা যখন আমরা খুঁজে পেয়েছি তখন থেকেই গর্তটা এখানে ছিল। কেউ হয়তো কোন কারনে খুঁড়েছিল, হয়তো কোন কিছু পুঁতে রাখার জন্য। অন্ধকারের কারনে কিছু দেখা না গেলেও গর্তটা এখন মৃত জন্তুর লাশে পূর্ণ, যেগুলোকে খুন করতে আমাকে বাধ্য করেছে ইয়ুকা! গর্তের কাছাকাছি গেলে জঘন্য দুর্গন্ধ নাকে এসে বাড়ি মারে।

প্রথমবার যখন ব্রিজের নিচে আমরা এরকম কাজ করেছিল, ইয়ুকা আমাকে আদেশ করেছিল লাশ নিয়ে গর্তে ফেলতে। তখন আমি ঠিকমত লড়তে জানতাম না, প্রতিপক্ষের মতই বেশ আঘাত পেয়েছিলাম। প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হয়ে মাথার ভেতরটা শূন্য হয়ে গিয়েছিল, বুঝতে পারছিলাম না কি করব। কিন্তু এখন আমি লড়াইয়ে দক্ষ হয়ে উঠেছি। শান্তভাবে এখন আমার প্রতিপক্ষের জান কবচ করতে পারি। আমাকে দক্ষ হয়ে উঠতে দেখে ইয়ুকাও খুশি।

কামড়াকামড়ির সময় প্রতিপক্ষের শরীরের নোম আমার মুখে রয়ে গিয়েছিল। আমি সেটা গিলে ফেলে ঘাস ঠেলে পানির দিকে এগুলাম। পানির রং কালো দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে নদী নয় বরং অন্ধকার ভেসে যাচ্ছে। ব্রিজের আলো অপর পাড়ের পানিতে আলো ফেলছিল।

পানি দিয়ে মুখে লেগে থাকা রক্ত ধুয়ে নিয়ে ইয়ুকার কাছে ফিরে গেলাম।

“যাওয়ার সময় হয়েছে,” ইয়ুকা সিঁড়ির দিকে এগুতে এগুতে এরকম কিছু একটাই বলল।

সিঁড়িটা আড়াআড়িভাবে ব্রিজের দিকে উঠে গিয়েছে। খোলা জায়গাটা থেকে সিঁড়ির কাছে যেতে লম্বা ঘাসগুলো ঠেলে সরিয়ে যেতে হয়। আমি দৌড়ে ওর পাশে গেলাম। আমরা একসাথে হাটি।

সিঁড়ির কাছাকাছি পৌঁছুতেই আমার মনে হল কিছু ঘাস নড়তে দেখলাম-ঘাসের মাথা হালকা দুলছে। এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হল কেউ ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। চিন্তিত হয়ে উঠলাম। ভালো করে কান পেতে শুনলাম। কিন্তু না। মনে হয় বাতাসের জন্য।

ইয়ুকা ততক্ষণে সিঁড়ি বেয়ে উপরে পৌঁছে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে ওর কাছে গেলাম, আমাদের গোপন জায়গাটা পেছনে পড়ে রইল।

***

স্কুলের পর স্টেশনের সামনে গিয়ে আমার ক্লাসমেট মোরিনোর সাথে দেখা করলাম। টারমিনালের কাছে একটা বড় বাস দাঁড়ানো। পাশেই ফোয়ারা আর কিছু ফুল গাছ। কয়েকটা বেঞ্চও আছে, কিছু লোকজন সেখানে বসে অলস সময় ব্যয় করছিল।

মোরিনো ঐ বেঞ্চগুলোর একটায় বসে ছিল। রাস্তা থেকে সবচেয়ে দূরে ছিল যেটা, সেটা গাছপালার ছায়ায় ঢাকা। হাতে সময় থাকলেই ও বই নিয়ে বসে থাকে। আজকে অবশ্য কোন বই পড়ছে না। বইটা বন্ধ করে পাশে রাখা।

মোরিনো সামনের দিকে ঝুঁকে আছে। মাথা নামানো। ঘন কালো চুলগুলোর পেছনে ওর চেহারা ঢাকা পড়ে গেছে, পর্দার মত।

কাছাকাছি যেতেই ও মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। ওর ত্বক পোরসেলিনের মত ফ্যাকাসে সাদা, যেন কোনদিন সূর্যের আলো পড়েনি। বাম চোখের নিচে ছোট্ট একটা তিল। ওর অঙ্গভঙ্গি পুতুলের মত, মনে হয় যেন কোন জীবন নেই। নড়াচড়া না করলে দোকানে রাখা ম্যানিকুইন বলে চালিয়ে দেয়া যাবে ওকে।

ও চুপচাপ নিচের দিকে ইশারা করল। ওর পায়ে কিছু কাদা লেগে ছিল। ভালো করে তাকাতে মনে হল কিছু একটা নড়ছে।

একটা প্রজাপতির দেহাবশেষ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে কিছু পিপড়া। পাথরের ছায়ার ভেতর মনে হচ্ছিল কোন ইয়ট ভেসে যাচ্ছে। মোরিনো একদৃষ্টিতে সেটার দিকে তাকিয়ে আছে।

এই জায়গায় আমাদের দেখা করার পেছনে বিশেষ কোন কারন নেই। হয়তো সুবিধা হত যদি আমরা একসাথে স্কুলের পর বের হতাম। কিন্তু মোরিনো আবার একটু বেশি বিখ্যাত মানুষ। ও যেরকম দেখতে আর ওর যে ভাবভঙ্গি, ওকে নিয়ে সবসময় গুজব ঘুরপাক খায়। ও হেঁটে গেলে লোকজন ঘুরে ওর দিকে তাকায়। আমি চাই না কেউ আমাকে ওর সাথে দেখুক।

মোরিনোর অবশ্য এসব নিয়ে কোন মাথাব্যথা ছিল না। ও সবার সাথেই একই রকম আবেগহীন, অভিব্যক্তিহীন ব্যবহার করত। মনে হত মানুষের যে নার্ভগুলো দুশ্চিন্তা করে, ওর সেগুলো অনেক আগেই কোনভাবে পুড়ে টুরে গিয়েছে বা এরকম কিছু। অথবা এমনও হতে পারে ও হয়তো কখনো খেয়ালও করেনি লোজন ওরদিকে তাকিয়ে থাকে। ও কখনো কখনো এরকম উদাসই থাকে।

“চল,” বলেই হাঁটা শুরু করল ও।

আমিও হাঁটতে লাগলাম ওর সাথে সাথে। ও যেই বইয়ের দোকানে। নিয়মিত যায় সেটা আজকে আমাকে চিনিয়ে দেয়ার কথা।

আমি যখন ওকে দোকানের নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম, তখন ও বলেছিল-”খুবই ছোট দোকান, আমি ছাড়া কোন ক্রেতা নাই।” দোকানটা কোথায় হতে পারে তার একটা সাধারণ ধারণা দিয়েছিল আমাকে, কিন্তু কাজ হয়নি। তারপর আমি ওকে বললাম একটা ম্যাপ এঁকে দিতে। ও এমন এক ম্যাপ আঁকল যেটার সাথে এই পৃথিবীর কোন জায়গার কোন মিল পাওয়া গেল না, খুঁজে পাওয়া তো পরের কথা। আরো আঁকাআঁকির পর দোকানটা গিয়ে নদীর মাঝখানে দাঁড়াল। সেটা কিভাবে সম্ভব তার কোন ব্যাখ্যাও দিতে পারল না ও। শেষে আমরা ঠিক করলাম ও নিজেই আমাকে সরাসরি সেখানে নিয়ে যাবে।

আমরা হাঁটতে হাঁটতে দোকান ছাড়িয়ে ঘরবাড়ি ছাড়িয়ে যেতে লাগলাম। সেদিন আকাশ একদম পরিস্কার ছিল, পিঠে সূর্যের তাপ টের পাচ্ছিলাম। রাস্তাটা সোজা চলে গেছে। দুই ধারে মধ্যম আয়ের লোকজনের ঘরবাড়ি সারিসারি দাঁড়ানো। মোরিনোর হাঁটা দেখে মনে হল সে প্রায়ই এই রাস্তা দিয়ে যাওয়া আসা করে।

“তুমি কি কুকুর কিডন্যাপিং সম্পর্কে কিছু শুনেছ?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“কুকুর কিডন্যাপিং?” সে প্রতিধ্বনি তুলল। কিছু শোনেনি।

আমি ওকে বিস্তারিত জানালাম। আমাদের এলাকা থেকে বেশ কিছুদিন ধরে অনেকগুলো পোষা কুকুর নিখোঁজ হয়েছে। সকালে বাসায় বাবা-মাকে এই নিয়ে আলাপ করতে শুনেছি।

“এইবারই তো প্রথম না,” মা বিড়বিড় করছিল। আমি সবসময় খবরের দিকে নজর রাখি, কোন আজব কিছু ঘটলে মনোযোগ দিয়ে শুনি। কিন্তু এলাকার গুজব-টুজৰ আমার মায়ের চেয়ে ভালো কেউ জানে না।

তার বক্তব্য অনুসারে, সপ্তাহে দুইদিন-বুধবার আর শনিবার সকালে-যেসব লোকজন ঘরের বাইরে তাদের পোষ প্রানীগুলো রাখে তাদের অনেকেরই পোষা প্রাণী নিখোঁজ হচ্ছে। তার মানে সেগুলো মঙ্গলবার আর শুক্রবার চুরি যায়। এখন পর্যন্ত চুরি যাওয়া সবগুলো পোষাপ্রাণীই হচ্ছে কুকুর। যে কারনে লোকজন এখন ভয়ে তাদের কুকুরগুলোকে রাতেরবেলা ঘরের ভেতর রাখছে।

মোরিনো আগ্রহসহকারে আমার কথা শুনল। পুরোটা বলা শেষ হওয়ার পর জিজ্ঞেস করল, “আর কিছু?” আমি মাথা নাড়লাম। ও মনে হল ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে।

কুকুর কিডন্যাপিংয়ের ব্যপারে ওর আগ্রহ দেখে একটু অবাকই হলাম। ওর মুখে কখনো কোন পোষা প্রাণীর নাম নিতে শুনিনি। না কুকুর, না বিড়াল, হ্যামস্টার পর্যন্ত না। জন্তু-জানোয়ারের প্রতি ওর কোন মায়া মমতা আছে বলে আমার মনে হয়নি।

“কিডন্যাপার ঐ জিনিসগুলোকে কিডন্যাপ করে কি করে?”

“জিনিস মানে?”

“ঐ যে, ওইসব আর কি, চার পা ওয়ালা নোংরা জিনিস, অনেক চেঁচামেচি করে যে।”

ও কি কুকুর বোঝাতে চাইল?

মোরিনো দূরে তাকিয়ে নিজের মনে বিড়বিড় করল, “আমার মাথায় আসে না কেন কেউ এতগুলো জিনিসকে একসাথে জড়ো করবে? ওগুলো নিয়ে সে কি করতে চায়? কোন ধরনের সৈন্যদল বানানোর ইচ্ছা নাকি? গোলমেলে ব্যাপার।”

ও নিজের মনে কথা বলছিল বলে আমি কোন উত্তর দিলাম না।

“দাঁড়াও,” ও হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল।

আমিও থামলাম।

বাঁক নেয়ার আগে তখনো আমাদের সামনে বেশ খানিকটা রাস্তা পড়ে আছে। কী সমস্যা বোঝার জন্য ওর দিকে তাকালাম আমি।

“চুপ,” ঠোঁটে এক আঙুল তুলে বলল সে।

ওর সমস্ত ইন্দ্রিয় এতটাই সজাগ যে, মনে হল যেকোন পরিস্থিতির জন্য তৈরি। আমার মনে হলো ওর কানগুলো মনে হয় কিছু শোনার চেষ্টা করছে।

আমিও শোনার চেষ্টা করলাম, অস্বাভাবিক কোন কিছু কানে ধরা পড়ল না। দূরে কোথাও কুকুর ডাকছে। সাধারণ এক নিস্তব্ধ দুপুর। সূর্যের গরম আলো পিঠে এসে পড়ছিল।

“না আমরা এই দিক দিয়ে আর যেতে পারব না,” অবশেষে ও ঘোষণা দিল।

আমি সামনে তাকালাম। কোন রকম বাঁধা দেখা গেল না, কোন কন্সট্রাক্সনের কাজ চলছে বা কিছু, এমনকি আমাদের পাশ কাটিয়ে এক বুড়ো লোক সাইকেল চালিয়ে চলে গেল।

“বুকস্টোরের জন্য বেশি হয়ে যাচ্ছে। এই রাস্তা দিয়ে…”

আমি ওর কাছে কারন জানতে চাইলাম। কিন্তু স্রেফ মাথা নাড়ল সে। তারপর যেদিক থেকে এসেছিলাম সেদিকেই হাঁটা শুরু করল।

নিজের মনের কথা মত চলার অদ্ভুত এক প্রবণতা আছে মোরিনোর মধে। কে কী ভাবল তাতে ওর কিছুই আসে যায় না। ক্লাসের আর কারো সাথে মেশে না, ওকে নিয়ে কে কী বলল তাতে কান দেয় না। অবসর সময়টা ও একাকি কাটায়, মুখে কোন অভিব্যক্তি ছাড়া। কিন্তু এই মুহূর্তে ওকে বিপর্যস্ত দেখাল…নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কিছু হয়েছে।

আমি চারপাশে আরেকবার ভালো করে তাকালাম। রাস্তার দুধারে ঘরবাড়ি। একটা বাড়ির গেটের ভেতর একটা ডগ হাউজ দেখলাম। একদম নতুন। নতুন কুকুর এনেছে নাকি? কুকুরের কোন শব্দ পেলাম না। ভালোমতো শোনার চেষ্টা করলাম।

অনেকক্ষণ সময় লাগল আমার বুঝতে।

ইতিমধ্যে মোরিনো অনেকখানি সামনে চলে গিয়েছে। আমি ওর দিকে এগিয়ে গেলাম কিন্তু ও আবারো থামল। এক হাত তুলে আমাকে সংকেত দিল।

“বিপদ! আমরা আর সামনে এগুতে পারব না।” সে সোজা সামনে তাকিয়ে আছে, দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছে। আমাদেরকে ঘিরে ফেলা হয়েছে,” গোঙানির মত শব্দ করল ও। টেনশন টের পাওয়া যাচ্ছিল ওর কথা বলার মধ্যে।

একটা বাচ্চা মেয়ে আর বড় একটা কুকুর আমাদের দিকে হেঁটে আসছিল।

কুকুরটা গোল্ডেন বিট্রাইভার প্রজাতির। শরীরে সুন্দর পশম। গলায় ফিতে লাগিয়ে মেয়েটা ওকে নিয়ে যাচ্ছিল। ছোট, শুকনো ধরনের একটা মেয়ে, কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল। চুলগুলো প্রতি পদক্ষেপে দুলছিল। মেয়েটা মনে হচ্ছে মাত্র থার্ড গ্রেডে পড়ে।

আমাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েটার কুকুরের সাথে আমার চোখাচোখি হল-বড়, কালো গভীর চোখ। নিজের ছায়া দেখতে পাচ্ছিলাম সেখানে। মনে হচ্ছিল আমাকে ঐ চোখগুলো টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে নেবে, ব্ল্যাকহোলের মত।

মেয়েটা আর কুকুরটা আমাদের পেছনে ফেলে কাছের একটা লাল চালার একতলা বাড়িতে গিয়ে ঢুকল।

“আমি এসেছি,” মেয়েটার গলা শুনতে পাচ্ছিলাম আমি। গোল্ডেন বিট্রাইভারটাও মেয়েটার সাথে সাথে দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। সামনের উঠোনে কোন ডগ হাউজ নেই, তার মানে কুকুরটা ঘরের ভেতরেই থাকে।

মেয়েটা আর তার কুকুরটা অদৃশ্য হয়ে গেলে মোরিনো দেয়াল থেকে সরে (এতক্ষন ও দেয়ালের সাথে লেপ্টে ছিল) হাঁটা শুরু করল, যেন কিছুই হয়নি। আমার মনে হচ্ছিল কিছু বলবে, কিন্তু কিছু বলল না। ও এরকমই, দৈনন্দিন জীবনের সাথে খাপ খাওয়ানো ওর জন্য বিশাল সমস্যা।

“আমার কোন ধারনাই ছিল না এই রাস্তায় এত বিপদ,” মোরিনো গজগজ করতে করতে বলল।

আমি জানতে চাইলাম অন্য কোন রাস্তা দিয়ে ঐ বইয়ের দোকানে যাওয়া সম্ভব কিনা, কিন্তু জানা গেল অন্য রাস্তা দিয়ে যেতে হলে অনেক ঘুরে যেতে হবে। মোরিনো ইতিমধ্যে আমাকে সেখানে নেয়ার পরিকল্পনা বাদ দিয়েছে।

ওর পিছু যেতে যেতে আমি আবার নিখোঁজ কুকুরগুলোর কথা চিন্তা করলাম। কেন সপ্তাহে দু-বার? আর কেনই বা শুধু শুক্র আর মঙ্গলবার রাতে? নিখোঁজ কুকুরগুলোর পরিণতি কি?

মোরিনো আর আমি অদ্ভুত সব কেস খুঁজে বের করি, যেগুলোয় জড়িত ব্যক্তিরাও অদ্ভুত-ডার্ক। দুঃখজনক মৃত্যু যা মানুষের হৃদয়কে বিদীর্ণ করে দেয়, যেসব মৃত্যু এতটাই নিষ্ঠুর যে শুনলে লোকজন চিৎকার করে উঠতে চায়-সেরকম যে কোন ঘটনার প্রতি আমাদের সীমাহীন আগ্রহ। আমরা খবরের কাগজ থেকে এসব আর্টিকেল কেটে রাখি। মানুষের মনের গভীরের অন্ধকার কুয়ায় ডুব দিতে ভালো লাগে আমাদের।

বেশিরভাগ মানুষ এধরনের আগ্রহ হজম করতে পারে না-কিন্তু আমাদের কাছে ব্যাপারটা যাদুবিদ্যার মত আকর্ষণীয় মনে হয়।

এইবার অবশ্য কোন অস্বাভাবিক কেস বলা যাবে না, কুকুর হারানোর সাধারণ কেস। কিন্তু ঘটনাগুলো ঘটেছে আমাদের বাসার খুব কাছে। ঘরের পাশের ছোট ঝামেলা বরং অন্য দেশের বড় ঝামেলার চেয়ে বেশি আকর্ষণীয়।

“তুমি কি জাতে আগ্রহি, কে এই কুকুরগুলোকে চুরি করছে?” আমি প্রশ্ন করলাম।

“যদি জানতে পার, আমাকে জানিয়ে, সে তার অভিব্যক্তিহীন চেহারা নিয়ে বলল। আমি ধরে নিলাম সে এর মধ্যে জড়িত হতে চায় না…বিশেষ করে যেখানে কুকুর জড়িত।

***

ইয়কা আর আমি আম্মুর সাথে থাকি। কিন্তু আম্মু কখনো বাসায় থাকে না। সকালে বেরিয়ে যায়, ফেরে গভীর রাতে। সারাদিন আমি আর ইয়কা বাসায় থাকি।

আমি যখন একদম ছোট, তখন থেকে ইয়ুকার সাথে আছি। আমার ভাইদেরকে আমার জন্মের পরই সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। তারপর থেকেই আমি ইয়কার সাথে আছি।

বেশিরভাগ সময়ই টিভির সামনে সময় কাটায় ইয়কা। আমি ওর পাশে গিয়ে ওর পিঠে মাথা দিয়ে খবরের কাগজের উপর শুয়ে থাকি।

টিভি দেখতে দেখতে আমরা বিরক্ত হয়ে গেলে উঠে হাত-পা টানটান করি। ইয়ুকা কিচেন আর বাথরুমে ঘোরাঘুরি করে, আমি পিছে পিছে থাকি।

তারপর আমরা বাইরে হাঁটতে যাই। বাইরে হাঁটতে আমার ভালো লাগে-ইয়ুকা আর আমি একসাথে হাঁটি। হাঁটার সময় আমাদের মধ্যে একটা দড়ি থাকে। আমি অন্য দিকে যেতে থাকলে ইয়ুকা আমাকে টেনে ঠিক পথে নিয়ে আসে।

মাঝে মাঝে আরেকজন আমাদের বাসায় আসে, একজন বড় মানুষ। আম্মু সাথে করে নিয়ে আসে তাকে। সে যখন বাসায় থাকে তখন বাতাস কেমন যেন গুমোট লাগে। যে আরামদায়ক বাসায় আমি আর ইয়কা থাকি সেটা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।

সে যতবারই আসে, সবসময়ই আমার মাথায় হাত বুলায়, আম্মুর দিকে তাকিয়ে হাসে-কিন্তু কখনো সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকায় না। আমার মাথায় তার হাতের স্পর্শ পেলেই তাকে আমার কামড়াতে ইচ্ছা করে।

ইয়ুকা আর আমি দু-জনেই তাকে ঘৃণা করি। কারন আম্মু যখন থাকে তখন সে সবসময় ইয়ুকাকে আঘাত করে।

প্রথমবার যখন ব্যাপারটা ঘটল, আমি ভেবেছিলাম আমি হয়তো কল্পনা করছি। আম্মু আমাকে আর ইয়ুকাকে লোকটার সাথে এক রুমে রেখে গিয়েছিল কিচেনে গিয়েছিল।

ইয়ুকা লোকটার পাশে বসে ছিল। এমন সময় হঠাৎ লোকটা কনুই দিয়ে ইয়ুকাকে গুতা মারল। ইয়ুকা অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল।

লোকটা হাসল, মাথা নামিয়ে ফিসফিস করে কিছু একটা বলল ইয়ুকাকে।

আমি ঘরের আরেক কোণায় ছিলাম, কথাগুলো শুনতে না পেলেও দেখতে পারছিলাম ইয়ুকার চেহারা বদলে যাচ্ছে।

ভয়ের একটা স্রোত আমার শরীর দিয়ে বয়ে গেল। ইয়ুকার কাছ থেকে আমি দূরে বসে ছিলাম ঠিকই কিন্তু আমাদের মন সবসময়ই একজন আরেকজনের সাথে যুক্ত। আমি ওর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম।

আম্মু রুমে ফিরে এলে লোকটা থামল। ইয়ুকা ভীত চেহারায় আম্মুর দিকে তাকালেও আম্মু কিছু খেয়াল করল না।

ইয়ুকা সাহায্যের জন্য আমার দিকে তাকাল, কিন্তু আমি সামনে পেছনে আগপিছ করা ছাড়া আর কিছু করতে পারছিলাম না।

এরপর প্রতিবার যখন সে আসত, ইয়ুকার প্রতি তার ব্যবহার খারাপ থেকে খারাপতর হতে লাগল। এমন কি সে কয়েকবার ইয়ুকার পেটে লাথিও মেরেছিল! ব্যথায় মেঝেতে শুয়ে পড়ে কাশছিল ইয়ুকা। দৌড়ে গিয়ে ওর আর লোকটার মাঝে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। লোকটা খুবই বিরক্ত হয়েছিল।

প্রতি সপ্তাহে একই রাত্রে লোকটা বাসায় আসত। ঐ রাতগুলোতে ইয়ুকা আর আমাকে এক কোণায় লুকিয়ে নিজেদের রক্ষা করতে হতো। সে বাসায় থাকলে চারপাশে কেমন এক অশুভ পরিবেশের সৃষ্টি হতো। ইয়ুকা ভয়ে ঘুমাতে পারত না।

শেষে আমরা আর থাকতে না পেরে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতাম।

লোকটা আসার পর থেকে ইয়ুকা আমাকে জম্ভগুলো খুন করতে বাধ্য করতে লাগল। ও অনেক কান্নাকাটি করত। ওর চোখে অন্যরকম এক আঁধার ভর করেছিল তখন, যা দেখলে অনেক কষ্ট লাগত আমার।

“আমরা বিষয়টা খেয়াল করেছি রাত এগারোটার দিকে,” কোলে থাকা ঘুমন্ত বাচ্চা দোলাতে দোলাতে অল্পবয়সি গৃহিণীটা বললেন। আমরা প্রথমে কিছু ভদ্রতাসূচক সামাজিক কথা-বার্তা দিয়ে শুরু করি। তিনি জানালেন, তাদের বাচ্চার বয়স মাত্র তিন মাস।

“ঘুমাতে যাওয়ার আগে, আমার স্বামী দেখতে গিয়েছিল পাভলভ ঠিক আছে কিনা, তখন খেয়াল করল সে বাড়িতে নেই…” পাভলভ তাদের কুকুরের নাম। দুই সপ্তাহ আগের মঙ্গলবার রাত থেকে সে নিখোঁজ। পিওরব্রিড প্রজাতির কুকুর, যে প্রজাতির নাম আমি আগে কখনো শুনিনি।

ভদ্রমহিলা আর আমি বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। পশ্চিম এলাকার ছোট একটা বাড়ি। আমার বাসা থেকে দূরত্ব এক মাইলের বেশি হবে না।

স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যেসব বাড়ি থেকে কুকুরগুলো নিখোঁজ হয়েছে সেগুলোতে গিয়ে একটু খোঁজ খবর নিব।

মহিলাকে বললাম আমি স্কুলের খবরের কাগজে কাজ করি। আর আশেপাশের এলাকার কুকুর নিখোঁজের ঘটনার উপর তদন্ত করছি। যখন তাকে জানালাম, আমার তদন্ত থেকে অপরাধির ধরা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তখন তিনি আমাকে সাহায্য করার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন।

“এখন মনে পড়ছে, রাত দশটার সিকে পাভলভ কিছুক্ষণ চিৎকার করেছিল। কিন্তু আমরা পাত্তা দিইনি, কারন লোকজন আশপাশ দিয়ে গেলেই ও চিৎকার করে।”

“তাহলে তখনই শেষবার আপনি ওর চিৎকার শুনেছেন?” আমি নিশ্চিত হতে চাইলাম।

মহিলা মাথা ঝাঁকালেন।

দরজার ওখানে দাঁড়িয়ে একটা ছোট উঠোনমত দেখতে পেলাম। এক কোণায় একটা ডগ হাউজ রাখা–মোটামুটি বেশ বড়। কুকুরের ফিতে লাগানোর জন্য বাইরে একটা মেটাল হুক লাগানো আছে।

“কিডন্যাপার তাহলে ফিতে খুলে কুকুরটাকে নিয়ে গিয়েছে?” আমি বললাম।

মহিলা আবারো মাথা ঝাঁকালেন। “তারা ফিতেটা ফেলে গিয়েছে-আর একটা আধখাওয়া চিকেন নাগেট।”

নিশ্চয়ই কিডন্যাপার নাগেটটা ফেলে গিয়েছে, তিনি ব্যাখ্যা করলেন।

যখন আমি জানতে চাইলাম, নাগেটটা কি দোকানের কেনাগুলোর কিনা, তিনি অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললেন সম্ভবত বাসায় বানানো।

কুকুরটাকে শান্ত করার জন্য কিডন্যাপার বাসা থেকে কিছু একটা নিয়ে এসেছিল, তারপর ছুঁড়ে ফেলে দেয়। আধ খাওয়া চিকেন নাগেট পুরো ব্যাপারটার চেহারা বদলে খুবই সাধারণ রূপ দিচ্ছে। পেশাদার চোররা এরকম কোন ভুল করবে না।

আমি মাথা ঝুঁকিয়ে সাহায্যের জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় নিলাম।

তিনি দুঃখিত চোখে ডগ হাউজের দিকে তাকালেন, “আশা করছি যে কাজটা করেছে তাকে তুমি খুঁজে পাবে।” তার স্বর নিচু থাকলও কথার মধ্যে কোথায় যেন একটা খুনি ক্রোধ লুকানো ছিল।

কোলের বাচ্চাটা হাঁচি দিতে শুরু করলে আমি গুডবাই বলে চলে আসলাম। বের হওয়ার সময় খেয়াল করলাম রাস্তার অপর দিকের বাসাতেও একটা কুকুর আছে। যদিও দরজা লাগানো, তারপরেও কুকুরটা দেখা যাচ্ছিল। একটা বড় কালো কুকুর, আমার অর্ধেক সমান উচ্চতা হবে।

“ওর নাম চকলেট,” তিনি পেছন থেকে বললেন।

আমি বললাম যে ওটা ওখানে ছিল এতক্ষন একদম টের পাইনি।

“হ্যাঁ, ও প্রায় কখনোই চিৎকার করে না।”

পাভলভের চেয়ে চকলেটের ঘর আরও পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। হয়তো কুকুরটা চুপচাপ বলে কিডন্যাপার সেটাকে খেয়াল করেনি।

বাসায় গিয়ে দেখি মা আর আমার বোন সাকুরা, দুজনে মিলে ডিনার তৈরি করছে। মা একটা পাতিলে কিছু নাড়ছে আর বোন সবজি কাটছে।

আমার বোন আমার চেয়ে দু বছরের ছোট, হাই স্কুল ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমনিতে সে সারাদিন ক্রাম স্কুলে থাকে, কিন্তু আজকে স্কুল বন্ধ ছিল। গত বসন্ত পর্যন্ত ওর চুল অনেক লম্বা ছিল, কিন্তু এই গ্রীষ্মে কেটে ছেলেদের মত ছোট করে ফেলেছে।

ওর ব্যক্তিত্ব আমার পুরোপুরি উল্টো, বাসার কাজে অনেক সাহায্য করে। কোন কিছুতে সাহায্য করতে বললে কখনো ও ফেলতে পারে না। যেমন, হয়তো আমার মা টিভির সামনে বসে স্নাক্স খাচ্ছে, সাকুরার দিকে তাকিয়ে দু-হাত এক করে বলল, “সাকুরা মা, একটু থালা-বাসনগুলো ধুয়ে দাও না?” সাকুরা প্রথমে রাজি হবে না।

“পারব না! তুমি নিজে কর গিয়ে!”

কিন্তু আমার মা দুঃখি দুঃখি চেহারা করবে, যেন দুনিয়া যেকোন মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। সাকুরা তা দেখা মাত্র লাফ দিয়ে উঠবে, “ঠিক আছে। ঠিক আছে! কান্নাকাটি কোরো না,” তারপর গিয়ে থালা বাসন ধুবে। ওদিকে মা আবার টিভি দেখায় ব্যস্ত। আমি মাঝে মাঝে চিন্তা করি সাকুরা কি জানে মা অভিনয় করছে? আমার তো মনে হয় সারাজীবন ওকে বুড়ো বাপ-মা পালতে হবে।

সাকুরার একটা বড় গুণ ছিল, অন্তত আমার কাছে তা মনে হলেও ওর কাছে এটাকে অভিশাপ মনে হতো, সেটা হল বেশিরভাগ সময় ওকে একজন সাধারণ মানুষ মনে হতো।

“তুমি কি আবার গেইম সেন্টারে গিয়েছিলে নাকি?” আমাকে দেখে মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানতে চাইল। ভিডিও গেমস আমার তেমন পছন্দ না, কিন্তু বাসায় দেরি করে ফেরার অজুহাত হিসেবে আমি সেটাকে ব্যবহার করি।

কিচেনে একটা চেয়ার টেনে বসে ওদের রান্নাবান্না দেখতে লাগলাম। ওরা চুপচাপ তাল মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছিল। আমার মা তখন সবজি ফ্রাই করছিলেন, কোন কথা না বলে খালি হাতটা সাকুরার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমার বোন ঠিক জানত মা কি চাইছিলেন, সে লবণ এগিয়ে দিল। মা একটু চেখে দেখলেন ফ্রাই ঠিক আছে কিনা। এরপর তিনি মিরিন (রাইস ওয়াইন) চাওয়ার আগেই সাকরা সেটা এনে দিল।

ওরা দুজনেই আমার সাথে কথা বলছিল, আমিও উত্তর দিচ্ছিলাম। ওরা হাসছিল। সাকুরা একটু জোরেই হাসে, হাসতে হাসতে খাবি খায়।

“আমাদের আর হাসিয়ো না, টেবিলটা গোছও। তো তারপর টিচার কি করলেন?” সাকুরা বলল।

আমি তখন স্কুল নিয়ে বলছিলাম। মাঝে মাঝে আমি খেয়াল হারিয়ে ফেলি কী নয়ে কথা বলছি আর কেনই বা আমার আশেপাশের সবাই হাসাহাসি করছে। যেসব গল্প বলি সেগুলো সেই জায়গায় বসে তখনই বানানো। কিন্তু কখনো ধরা পড়িনি বা কোন সমস্যা হয়নি।

দেখে হয়তো মনে হবে আমি চমৎকার একটা হাসিখুশি পরিবারের সদস্য। বাসার লোকজন মনে করে আমি খুবই মিশুক ধরনের একটা ছেলে-যে কিনা পড়াশোনায় তেমন ভালো না কিন্তু লোকজনকে ভালো হাসাতে পারে।

কিন্তু আমার কাছে যা মনে হয় তা হলো, আমার মা-বোনের সাথে আমার আসলে কোন কথা হয় না। কিছুক্ষণ পরেই আমি ভুলে যাই কি বলছিলাম। মনে হয় যেন আমি সেখানে পাথরের মত বসেছিলাম, কোন কথা ছাড়া, আর আশেপাশের সবাই নড়াচড়া করছে, ফেটে পড়ছে, কোন অদ্ভুত পরাবাস্তব স্বপ্নের মত।

“কিরির কুকুর এখনো নিখোঁজ, থালাবাসন ধুতে ধুতে সাকুরা বলল। আমার কান নড়ে উঠল, এতক্ষন কিছু শুনছিলাম না, হঠাৎ মনে হল কানে কিছু ঢুকছে। “ও ভেবেছিল কুকুরটা নিজে নিজে বাড়ি ফিরে আসবে কিন্তু…”

আমি বিস্তারিত জানতে চাইলাম।

সাকুরা জানাল ওর ক্লাসমেটের কুকুর গত সপ্তাহের বুধবার থেকে নিখোঁজ। সবাই ধারণা করছে কিডন্যাপার তুলে নিয়ে গিয়েছে ওটাকে।

“কিডন্যাপার সম্ভবত এক টুকরো সসেজের লোভ দেখিয়ে ওকে তুলে নিয়ে গিয়েছে।”

“ওহ হো,” মা বিড়বিড় করলেন, দোকান থেকে সসেজ কিনতে ভুলে গিয়েছেন তিনি।

“কি কুকুর ছিল? সাইজ কি ছিল?” আমি জানতে চাইলাম।

সাকুরা ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকাল। আমি ভুলে এমন একটা চেহারা করে ছিলাম যেটা সাধারণত পরিবারের সামনে আমার লুকানো থাকে।

“ক-কি হল?” আমি তোতলাচ্ছিল, চাপা দেয়ার চেষ্টা।

“কুকুরটা ছিল একটা মাট, কিন্তু খুবই ছোট ধরনের।”

হঠাৎ মনে হলো, পাভলভের মালিককে এই প্রশ্নটা করতে আমি ভুলে গিয়েছি। কথা শেষ হতেই দৌড়ে দরজার দিকে ছুটে গেলাম। তখনো স্কুলের ইউনিফর্ম আমার পরনে। মা পেছনে থেকে ডাকতে লাগলেন, ডিনারের সময় প্রায় হয়ে গিয়েছে।

পাভলভের বাসায় যখন পৌঁছলাম তখন চারদিকে অন্ধকার হয়ে এসেছে। বেল বাজাতে একই ভদ্রমহিলা আবার দরজা খুললেন। এখন অবশ্য কোলে বাচ্চাটা নেই। আমাকে দেখে তিনি বেশ অবাক হলেন।

“আপনাকে আবার বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। কিন্তু একটা প্রশ্ন করতে ভুলে গিয়েছিলাম। পাভলভের সাইজ কেমন ছিল?”

“এটা জানার জন্য আবার এতদুর এসেছো?” হতবুদ্ধি হয়ে বললেন। তারপর জানালেন পাভলভ পূর্ণ বয়স্ক কুকুর ছিল না, ছোটখাটই ছিল।

“তার মানে কুকুরছানার চেয়ে একটু বড়?”

“হ্যাঁ। যদিও ওর প্রজাতির কুকুর অনেক বড় হয়। যেকারনে ডগ হাউজটা বড় কেনা হয়েছে।”

আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম। কিডন্যাপার যখন কুকুরগুলো চুরি করছিল, ফিতেগুলো নেয়নি। তাহলে কুকুরগুলো কিভাবে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? কিডন্যাপার নিজের ফিতে নিয়ে এসেছিল? ডগ হাউজ থেকে ফিতেটা খুলে টেনে নিয়ে গেলে ব্যাপারটা কি সহজ হত না? তার মানে কিডন্যাপার কুকুরের গলা থেকে ফিতেটা খুলে কোলে করে নিয়ে গিয়েছে।

এখন প্রশ্ন হল, কেন পাভলভকে চুরি করা হলো, কিন্তু রাস্তার ওপারের চুপচাপ কুকুরটাকে করা হলো না? আমি চোর হলে তো যে কুকুর শব্দ করে তাকেই চুরি করতাম। ব্যাপারটা সবদিক থেকে সহজ হত না?

আমার ধারণা পাভলভকে চুরি করা হয়েছে কারন ও সাইজে ছোট। কোলে করে নিয়ে যাওয়া সহজ ছিল। আমার বোনের বান্ধবির যে কুকুর চুরি হয়েছে সেটাও ছোট ধাঁচের কুকুর। মনে হচ্ছে কিডন্যাপার তাহলে শুধু ছোট ধরনের কুকুরই চুরি করছে।

কিন্তু কেন যেসব কুকুর বহন করা সহজ সেগুলোই চুরি করতে হবে? একটা সম্ভাবনা হলো, কিডন্যাপারের কাছে কোন গাড়ি বা অন্য কোন যানবাহন নেই বড় কুকুর বহন করার মত। হ্যাঁ, ব্যাপারটা খাপ খাচ্ছে। সেজন্যই বড় কুকুর এড়িয়ে যাচ্ছে কিডন্যাপার।

এখন পর্যন্ত যা যা তথ্য জোগাড় করতে পেরেছি তাতে যেসব এলাকার কুকুর চুরি গিয়েছে কোনটাই বড় কুকুর নয়। গাড়িওয়ালা চোর হলে এলাকা বদল করত। এক এলাকায় এত চুরি করে ধরা পড়ার সম্ভাবনা বাড়াত না।

একটা আর্টিকেলের কথা মনে পড়ল আমার, একটা অ্যানালাইসিস দেখিয়েছিল কারন ছাড়া খুনের উপর। মজা করতে গিয়ে খুন’-আর্টিকেলে খুনির শিকার খোঁজার ধরন নিয়ে বলেছিল। খুনি নিজের অজান্তেই এমন সব শিকার নির্বাচন করত যারা কিনা শারীরিকভাবে তারচেয়ে দূর্বল। যেমন, তার সব শিকার ছিল লম্বায় পাঁচ ফুটের কম। একজনও পাঁচ ফুট তিনের ধারে কাছে ছিল না। সেক্ষেত্রে ধরে নেয়া যায় খুনির উচ্চতা পাঁচ থেকে পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চির মধ্যে। নিখোঁজ কুকরের কেসেও একই সম্ভাবনা কাজে লাগতে পারে।

বাসায় ফিরে দেখি, বাবা ফিরেছে অফিস থেকে, সবাই ইতিমধ্যে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। আমি তাদেরকে বললাম যে শপিং মলে গিয়েছিলাম। তারপর গল্পে যোগ দিলাম। গল্পের মাঝে সাবধানে অন্য টপিকে গেলাম যেন কেউ কিছু সন্দেহ না করে। আশেপাশের বাসাগুলোতে কারা কারা কি কুকুর রাখে জানতে চাইলাম।

“ঐ বাড়িতে একটা কুকুর আছে খুবই কিউট। আমি জানি না কেন ওরা কুকুরটাকে ঘরের বাইরে রাখে। কুকুরটা একদমই ছোট,” সাকুরা বলল।

“হয়তো অনেক চেঁচামেচি করে,” বাবা বললেন।

আমি ঠিকানা নিলাম। আজকে মঙ্গলবার রাত। সুতরাং কিডন্যাপার হয়তো আজকে ঐ বাড়িতে হামলা করলেও করতে পারে, কে জানে?

***

যে বাড়িটা নিয়ে কথা হচ্ছিল সেটা ছিল একটা জাপানি কন্সট্রাকশনের পুরনো বাড়ি। দেয়ালের উপর দিয়ে চারদিকে তাকালাম। একটা বড় বাগানের শেষ মাথায় ডগ হাউজটা রাখা। দেখে মনে হলো হাতে বানানো, কাঠের বাক্সর মত দেখতে। বাইরে একটা খুঁটি পোঁতা আছে যেখানে ফিতে দিয়ে কুকুরটা বাঁধা।

কুকুরটার চোখগুলো ছিল বড় বড়। যে মুহূর্তে সে আমাকে দেখল, গলা ফাঁটিয়ে চেঁচামেচি লাফালাফি শুরু করে দিল। একদম ছোট কুকুর, যে কোন বাচ্চাও কোলে করে নিয়ে যেতে পারবে।

আমি বাড়িটা থেকে সরে গিয়ে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়ালাম। এখানে আশেপাশে কোন আলো নেই, অন্ধকারের মধ্যে কেউ আমাকে দেখতে পাবে না।

ঘড়ি দেখলাম, অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। তবে একটা সুইচে চাপ দিতে ডায়ালের ভেতর আলো জ্বলে উঠল। রাত দশটা। দুই সপ্তাহ আগে এরকম সময়েই পাভলভ চুরি হয়েছিল। কিডন্যাপার যদি আজকে এই কুকুরটাকেও চুরির প্ল্যান করে থাকে তাহলে এরকম সময়েই আসার কথা।

পায়ের নিচের মাটি পাতায় ঢেকে আছে, একটু নড়লেই ডালপালায় লেগে কাছের ঝোপগুলো নড়ে উঠছে। হেমন্তের শুরু হলেও দিনের বেলায় গরম থাকে। রাতে একটু ঠান্ডা পড়ে।

পকেটে হাত ঢুকিয়ে চুরির স্পর্শ নিলাম, যদি কোন প্রয়োজন হয় সেজন্য সাথে করে এনেছি।

কিডন্যাপারটার চেহারা যদি দেখতে পাই, পুলিশকে জানানোর কোন ইচ্ছে আমার নেই। আমি শুধু স্রেফ দূর থেকে অদৃশ্য হয়ে দেখতে চাই সে কী করে। সুতরাং অস্ত্রের কোন প্রয়োজন পড়বে বলে মনে হয় না। কিন্তু তারপরেও কোন কিছু চিন্তা না করেই আমার ছুরির সেট থেকে একটা ছুরি পকেটে করে নিয়ে এসেছি। খোলা ব্লেডে নিজেকেই আহত করে ফেলতে পারি, সেজন্য একটা লেদার কেসে ঢুকিয়ে রেখেছি ওটা।

কোন মানুষকে অস্বাভাবিক কোন অপরাধ করতে দেখতে আমার ভালো লাগে। এই শখের কারনে আমার এমন একজন লোকের মুখোমুখি হতে হয়েছিল যে কিনা একাধিক নারীকে হত্যা করেছিল। আমি তার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে তেইশটা ছুরির একটা সেট চুরি করেছিলাম। যেগুলো এই মুহূর্তে আমার রুমের বইয়ের সেলফের পেছনে লুকানো আছে। বাসায় থাকলে আমি ওগুলো বের করে দেখি। সিলিংয়ের লাইটের আলো ধাতব ব্লেডের উপর পড়ে চকচক করে ওঠে। সাদা আলোতে মনে হয় যেন ওগুলো ভিজে আছে।

মাঝে মাঝে ব্লেডের উপর আমার প্রতিচ্ছবি বদলে ঐ মেয়েগুলোর চেহারা ভেসে ওঠে, যাদেরকে এই ছুরিগুলো দিয়ে খুন করা হয়েছে। আমি জানি ব্যাপারটা চোখের ধাঁধা মাত্র, কিন্তু আমার কাছে মনে হয় ওদের সমস্ত ব্যথা আর কষ্টগুলো যেন ছুরিগুলোর ভেতর অনন্তকালের জন্য আটকা পড়ে গিয়েছে।

আবার ঘড়ি দেখলাম। বুধবার হয়ে গিয়েছে। একজন লোকও এদিকে আসেনি। কে জানে কিডন্যাপার কোথায় থাকে। বাসস্থানটা জানলে সম্ভাব্য শিকারের তালিকাটাও ছোট করে আনা যেত। যাই হোক, মনে হচ্ছে না। আজকে আর কিডন্যাপারের দেখা পাবো।

আরো দশ মিনিট অপেক্ষা করে বাসায় ফিরে এলাম।

বাবা-মা তখন ঘুমে। সাকুরা পরীক্ষার জন্য পড়ছে। সে টের পেয়েছে আমি বাসায় ফিরেছি। নিচে এসে জিজ্ঞেস করল কই গিয়েছিলাম। তাক জানালাম, শপিং মলে গিয়েছিলাম।

***

আমার জানা ছিল লোকটা আজকে আসবে, ঘুমিয়ে পড়া একদম উচিত হয়নি। ইয়ুকার চিৎকারে লাফিয়ে উঠলাম। লিভিং রুম থেকে ওর গলার শব্দ ভেসে আসছে। দৌড়ে গেলাম ওর কাছে।

ও আমার পেছনে লুকিয়ে ছিল। লোকটা নিশ্চয়ই ওকে টেনে লিভিং রুমে নিয়ে গিয়েছে। আম্মু বাসায় নেই। লোকটা ইয়ুকাকে একা পেয়ে গেছে।

ইয়ুকা দলামোচা হয়ে পড়ে গোঙাচ্ছে, শব্দ শুনে মনে হলো ব্যথার সাথে যুদ্ধ করছে ও।

লোকটা ওর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ওর দিকে ভাবলেশহীন মুখে তাকিয়ে আছে। তাকে বিশাল দেখাচ্ছে, মনে হচ্ছে মাথাটা গিয়ে সিলিঙে ঠেকেবে। আর ইয়ুকাকে একদম ক্ষুদ্র লাগছে তার সামনে। মাটিতে পড়ে অসহায়ের মত ব্যথায় গোঙাচ্ছে সে।

আমার মাথার ভেতরটা ক্রোধে জ্বলে উঠল। গলার পুরো জোর দিয়ে আমি একটা হুংকার ছাড়লাম।

লোকটা আমার দিকে ঘুরল, চোখে তার বিস্ময়। এক পা পিছিয়ে ইয়ুকা থেকে সরে গেল সে।

ইয়ুকা ওখানে পড়ে কাতরাচ্ছে, কিন্তু ওর দৃষ্টি আমার উপর। সে দৃষ্টিতে আমি পরিস্কার আমার প্রতি ওর ভালবাসা দেখতে পাচ্ছি। মনের গভীর থেকে টের পাচ্ছি ওকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার।

সামনের দরজা খোলার শব্দ কানে এল, কেউ ডাকছে। আম্মু শপিং থেকে ফিরে এসেছে। এই লোককে এখানে রেখে সে শপিঙে গিয়েছিল!

আমি লোকটার হাতে কাপড় দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আম্মু আমাকে পেছন থেকে ধরে ফেলল। এক ইঞ্চির জন্য হাতটা ফসকে গেল।

কিন্তু ওটুকু সময় ইয়ুকার জন্য যথেষ্ট ছিল উঠে দাঁড়ানোর জন্য। আম্মু যখন রাগি গলায় কিছু একটা বলছে, ইয়ুকা তখন দৌড়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমিও ওর পিছুপিছু দৌড়ে গেলাম। দু-জনেই আমরা দৌড়ে বাসা থেকে পালালাম।

যত জোরে সম্ভব আমরা দৌড়ালাম। আম্মু পেছন থেকে আমাদের ডাকছে শুনতে পাচ্ছি কিন্তু ফিরে তাকালাম না। রাতের অন্ধকারের মধ্যে আমরা দৌড়ে মিশে গেলাম।

অন্ধকার রাস্তা, দু-ধারে নিস্তব্ধ ল্যাম্প পোস্টের সারি। শুধুমাত্র আমাদের পায়ের তলার মাটি উজ্জ্বল হয়ে আছে। আমাদের দুজনের ছোট ছায়াগুলো এক ল্যাম্প পোস্ট থেকে আরেক ল্যাম্প পোস্টে ছুটে যাচ্ছে। যতদূর দৃষ্টি যায় চারদিকে শুধু বিস্তৃত রাত। ইয়ুকা সাথে থাকায় কোন ভয় পাচ্ছি না। কিন্তু ওর কথা ভাবলেই আমার কষ্ট হচ্ছে।

ইয়ুকা কাঁদছে না কিন্তু আমি জানি ও ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে। আমিও অনুভব করতে পারছিলাম। মাঝে মাঝে ব্যথা এত বের যাচ্ছে যে, ওকে থেমে থেমে বিরতি নিতে হচ্ছে। আমার খুব খারাপ লাগছে, কিন্তু ওর পাশে থাকা ছাড়া আমার পক্ষে আর কিছু করার নেই।

বিকেলে আমরা যে জন্তুটাকে দেখেছিলাম সেটাই হবে রাতের প্রতিপক্ষ-ইয়ুকা বলেছিল। সেদিন আমরা হাঁটতে বেরিয়ে ওটাকে দেখতে পেয়েছিলাম, সহজে তুলে আনা যাবে। আমরা ঐ বাড়ির দিকে এগুতে লাগলাম।

আমি নিশ্চিত ইয়ুকাও ব্যাপারটা খেয়াল করেছে-জন্তু চুরি করা আর আগের মত সহজ নেই। এখন সবাই তাদের জন্তুকে ঘরের ভেতর রাখে। আমাদেরকে ঠেকানোর চেষ্টা করছে আর কি।

আমার এখন অনেক দুশ্চিন্তা হয়, কেউ যদি দেখে ফেলে আমরা কি করছি?…সেজন্য সবসময় সতর্ক থাকি, কোন ছায়া নড়তে দেখলেও চমকে

ইয়ুকাকে ভয় নেই আমার, আম্মুকেও না। এমনকি ঐ খারাপ লোকটাকেও ভয় পাই না। আমি ভয় পাই অচেনা মানুষকে। আমরা যখন জম্ভগুলি চুরি করে নিয়ে যাই, কেউ একজন আমাদের পেছন পেছন আসে। সে হয়তো একসময় জেনে যাবে, ব্রিজের নিচে আমরা কি করি। তারপর কি হবে অনুমান করা কঠিন কিছু নয়। সবাই জেনে গেলে ইয়ুকা আর আমাকে আলাদা করে ফেলা হবে। আমি না থাকলে ইয়ুকাকে রক্ষা করার জন্য কেউ থাকবে না আর। আমি সেটা হতে দিতে পারি না।

আজকের বাড়িটা দেখতে পাচ্ছি আমরা। রাস্তার আলো বাড়ির ছাদে পড়ায় আশপাশ পুরো অন্ধকারে ডুবে আছে। বিকেলে যাওয়ার সময় আমরা দেখেছিলাম বাড়িটা এক কোণায়, উঠোনের আরেকদিকে, একটা ছোট কুকুর আছে।

“চল,” ইয়ুকা বলল। আমরা সামনে পা বাড়ালাম।

কিন্তু সে মুহূর্তে কিছু একটা চোখে পড়ল আমার, সাথে সাথে মৃদু স্বরে ইয়ুকাকে ডাকলাম। আমরা দুজনেই বরফের মত শক্ত হয়ে গেলাম তখন। ইয়ুকা হতবুদ্ধি হয়ে আমার দিকে তাকাল।

এক মুহূর্ত আগে বাড়িটার বাইরের অন্ধকার অংশে একটা হালকা আলো দেখেছি আমি। খুবই হালকা আলো, অল্প সময়ের জন্য ছিল, কিন্তু ওখানে কেউ আছে নিশ্চিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট। আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় ঐ নির্দিষ্ট জায়গাটার দিকে কেন্দ্রিভুত। দেখা যাচ্ছিল না কিন্তু কেউ সেখানে দাঁড়িয়ে বাড়িটার উপর নজর রাখছিল। আমার কি ভুল হতে পারে? নাহ, আমি নিশ্চিত কোন ভুল হয়নি।

আজকে বাদ, আমি চোখের দৃষ্টি দিয়ে ইয়ুকাকে বললাম। সে আরেকবার বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আমার কথায় রাজি হলো।

সে রাতে আমরা কোন জন্তু চুরি করিনি। ব্রিজের নিচে কিছু সময় কাটিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম। ইয়ুকা চাচ্ছিল আমি খুন করি কিন্তু আমাকে তা করতে হয়নি বলে হাফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম।

তারপরেও দুশ্চিন্তা হচ্ছে। যে ছায়া আমাদের পিছু নিয়েছে তা এখন আকার ধারন করেছে, নিজের উপস্থিতি প্রদর্শন করেছে। ব্যাপারটা তার মানে আমার কল্পনা ছিল না, একদম বাস্তব ছিল।

মঙ্গলবার রাতে কিডন্যাপারকে ধরার প্ল্যান আমার বৃথা গেল। পরেরদিন, বুধবার, গল্পেরছলে আমি আমার পরিবারের লোকজন আর ক্লাসমেটদের প্রশ্ন করে বের করার চেষ্টা করলাম নতুন কোন কুকুর নিখোঁজ হয়েছে কিনা। কিন্তু সব খোঁজ খবরের পর মনে হলো সে-রাতে কিডন্যাপার কিছু চুরি করেনি। কিংবা চুরি হলেও হয়তো এমন কোথাও হয়েছে যার খবর আমার কাছে আসেনি।

“তোমার কোন ধারণা আছে, কী ধরনের মানুষ এর পেছনে আছে?” লাঞ্চ ব্রেকে কেমিস্ট্রি লেকচার হলের কোণায় বসে মোরিনো আমাকে প্রশ্ন করল, তার হাতে বই।

আমি মাথা নাড়লাম, কোন ধারণা নেই।

“প্রথমত, কেউ কেন ঐ প্রাণীটাকেই চুরি করবে? পশুপাখি বিক্রির দোকানে বিক্রি করার জন্য?” মোরিনো এমনভাবে প্রশ্ন করল যেন ওর মাথায় আসছে না কেন এই বিশেষ প্রাণীটা চুরি করতে যাবে কেউ!

“আমার সন্দেহ আছে কিডন্যাপার টাকা চায় কিনা-পেট শপে যে সব পিওরব্রিড বিক্রি হয় সেগুলো সেখানে থাকতে থাকতে বড় হয়ে যায়। প্রায় কেউই ওগুলো কেনে না।”

কেউ মার্কেট থেকে নিলে গবেষণার জন্য নেয়, পোষার জন্য নয়। পোষা কুকুর মানুষদের বিশ্বাস করে, যে কারনে সেগুলোর দেখাশোনা করা বন্য কুকুরের চেয়ে সহজ। ব্ল্যাক মার্কেটে ভালো দাম পাওয়া যায় বলে আমি শুনেছি। . “কুকুর কিডন্যাপিঙের একমাত্র কারন যেটা হতে পারে বলে আমার মনে হয়, সেটা হলো, ওগুলোকে নিয়ে নির্যাতন করা। কিছু মানুষ আছে যারা ইন্টারনেট থেকে পরিত্যক্ত কুকুর-বিড়াল সংগ্রহ করে এসব করার জন্য।”

“তার মানে বলতে চাইছে, কিডন্যাপার মজা করার জন্য প্রাণীগুলোকে চুরি করে খুন করছে? সাংঘাতিক তো।” মোরিনো বলল।

কিন্তু এখানে একটা ঝামেলা আছে। ব্যাপারটা যদি তা-ই হয় তাহলে নির্যাতনটা করা হচ্ছে কোথায়? বাসায় তো অবশ্যই না। যখন খবরে মাঝে মাঝে পার্কে পোষা প্রাণীর লাশ পাওয়ার খবর পাওয়া যায় তখন প্রাণী নির্যাতন সংক্রান্ত অনেক কথাবার্তা হয়। কিন্তু ইদানিংকালের মধ্যে এরকম কোন খবর আমার কানে আসেনি।

***

সেই বুধবার আর বৃহস্পতিবার, স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে, যেসব বাড়ি থেকে পোষা কুকুর নিখোঁজ গিয়েছে সেগুলোতে গিয়ে খোঁজ নিলাম। প্রতিদিন একটা করে। বাড়ির লোকজন একটুও সন্দেহ করেনি, আমি আসলেই স্কুলের পত্রিকায় কাজ করি কিনা। সবাই যতটুকু সম্ভব সাহায্য করেছে।

কিন্তু অপরাধির ব্যাপারে আমি নতুন কোন ভালো তথ্য খুঁজে পেলাম না। দুই বাড়িতেই চুরি যাওয়া কুকুরগুলো ছিলো মাট, আর একদম ছোট। একজনের মালিক আধ খাওয়া খাবার পড়ে পেয়েছে, আরেকজন পায়নি।

শুক্রবার আমি আরেকটা বাড়িতে যাওয়ার জন্য বাসে চরলাম। যে তথ্য পেয়েছি তাতে এই বাসা থেকেই সবার আগে চুরি গিয়েছিল, আর আমার বাসা আর স্কুল থেকেও জায়গাটা সবচেয়ে দূরে। নদীর পাশের বাড়িগুলোর একটা।

ম্যাপের ঠিকানারগুলোর সাথে মিলিয়ে সহজেই বাড়িটা খুঁজে পেলাম। নতুন বাড়ি। বেল বাজালাম। কেউ মনে হলো নেই ভেতরে।

বাড়ির সাথে ছোট একটা টিউলিপের বাগান, আর একটা খালি ডগ হাউজের সামনে খাবারের থালা রাখা। প্লাস্টিকের থালা। খানিকটা নোংরা। উপরে বাচ্চাদের মত আঁকাবাঁকা করে লেখা মার্বেলের থালা।

সেখান থেকে বের হয়ে আবার বাস নিয়ে ফেরত চলে এসে বাসার সামনে বাস স্টপে নামলাম।

আজকে শুক্রবার, আরেকটা কুকুর আজকে চুরি হওয়ার কথা। এসব যখন ভাবছিলাম, কে জানি আমাকে ডাক দিল। ঘুরে দেখি সাকুরা, জুনিয়র হাই স্কুলের ইউনিফর্ম পরে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার সাথে তাল মেলাতে সাইকেল নিয়ে জোরে জোরে হাঁটতে লাগল।

সে সবসময় বাসায় ফেরার আগে ক্রাম স্কুলে যায়, সেখানে কয়েক ঘন্টা পড়াশোনা করে। তাই আমি জিজ্ঞেস করলাম এত তাড়াতাড়ি এসে সে কী করছে।

“কাহিনী হয়েছে, ক্রাম স্কুলে যেতে পারিনি আজকে,” বলল সে। ওকে কিছুটা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। সাইকেল সোজাসুজি টানতেও পারছে না।

“আবার কিছু দেখেছো?” আমি ওর থেকে সাইকেল নিয়ে বললাম।

মাথা ঝাঁকাল সে।

সাকুরার শনির সমস্যা আছে। আমি বলব এটা ওর গুণ কিন্তু ও এটাকে অভিশাপ হিসেবেই দেখে। সেটা হলো, ও প্রায়ই মৃত লাশ খুঁজে পায়।

প্রথমবার এমন হলো যখন ও এলিমেন্টারি স্কুলে পড়ত। স্কুল থেকে পাহাড়ে একটা টিপে নিয়ে গিয়েছিল। ফার্স্ট গ্রেডে ছিল ও, অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়েছিল। তো একসময় ও একটা ডোবার কাছে গিয়ে হাজির হয় আর দেখে পানিতে একজন মানুষের লাশ ভাসছে।

দ্বিতীয়বারের ঘটনা এর চারবছর পর। সাকুরা ওর এক বন্ধুর পরিবারের সাথে সমুদ্র দেখতে গিয়েছিল। এবারও সে কিভাবে যেন আলাদা হয়ে পড়ে। সাগরে ভেসে এসে পাথরে আটকে থাকা একটা লাশ খুঁজে পায়।

তৃতীয়বারের ঘটনা আরো তিনবছর পরের, জুনিয়র হাইস্কুলের দ্বিতীয় বর্ষের ঘটনা। ওর ভলিবল ক্লাব ক্যাম্পে গিয়েছিল। জগিংয়ের সময় রাস্তা ভুলে অন্যদিকে চলে যায়। একটা নির্জন এলাকায় গিয়ে হাজির হয়। পায়ের নিচে মড়মড় শব্দ হতেই দেখে একটা মানুষের মাথার খুলির উপর পা পড়েছে ওর।

প্রতিবার লাশ পাওয়ার পর ওর মুখ শুকিয়ে ফ্যাকাসে হয়ে যায়। পরের এক সপ্তাহ জ্বর নিয়ে বিছানায় পড়ে থাকে।

“কেন আমার সাথেই এমন হতে হবে?” কাঁদতে শুরু করল সে।

ওর লাশ খুঁজে পাওয়ার চক্রের মধ্যে সময় ধীরে ধীরে কমে আসছে। চতুর্থ বার লাশ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা এই বছরে কিংবা আগামি বছরে ছিল। ওর যখন আরো বয়স হবে তখন হয়তো প্রতি দুই-তিন মিনিটে একটা করে লাশ চোখে পড়বে কে জানে!

“তো, আজকে কি খুঁজে পেলে?” আমি ওকে প্রশ্ন করলাম।

“ক্রাম স্কুলে যাওয়ার পথে আমি কিছু একটা দেখেছি…তারপর শরীর খারাপ লাগছিল তাই ক্লাস না করে চলে এসেছি।”

ওর জুনিয়র স্কুল আর ক্রাম স্কুলের মধ্যে একটা নদী পড়ে। নদীর উপর কংক্রিটের তৈরি একটা বড় ব্রিজ আছে, গাড়ি চলাচল করে। পথচারি আর সাইকেলের জন্য আলাদা লেন আছে।

“সাইকেলের ঝুড়িতে আমার ভোয়ালে আর ব্যাগ রাখা আছে।”

নীল-সাদা রঙের একটা ভোয়ালে যেটা সে নিয়মিত ব্যবহার করে। পাশ দিয়ে একটা ট্রাক যাওয়ার সময় বাতাসের তোড়ে ভোয়ালেটা উড়ে গিয়ে নিচে পড়ল। ও রেইলিং দিয়ে তাকিয়ে দেখে তোয়ালেটা নদীতে পড়েনি, তীরের কাছে ঘাসের উপর আটকে আছে।

“আমি নিচে গেলাম ভোয়ালেটা তুলে আনতে।”

ব্রিজের শেষ মাথায় একটা সিঁড়ি আছে যেটা দিয়ে নদীর তীরে নামা যায়। সাকুরা নিচে নেমে দেখে চারপাশে লম্বা সুচালো সবুজ ঘাস। প্রায় ওর সমান লম্বা। ও সেগুলো সরিয়ে সামনে গেল। ঘাসের বন ঘন হলেও সরিয়ে সামনে যাওয়া যাবে না তা নয়।

“উপর থেকে বোঝা যাচ্ছিল না কিন্তু ব্রিজের নিচে একটা খোলা জায়গা আছে যেখানে ঘাস নেই।” একটা গোলাকৃতির শুকনো জায়গা, চারপাশে ঘাসের দেয়াল। অনেকটা খাঁচার মত।

বিশাল ব্রিজটা ছাদ হিসেবে কাজ করছে। সাকুরা উপরে তাকালে আকাশের অর্ধেকটা দেখতে পেল।

“আমি আমার তোয়ালে খুঁজছিলাম, কিন্তু…” ও পোকামাকরের গুনগুন শব্দ শুনতে পেল-মাছির একটা ঝাঁক। কাছাকাছি যেতে দেখতে পেল মাছিগুলো একটা জায়গা ঘিরে রেখেছে।

“আমি ওদিকেই যাচ্ছিলাম কারন তোয়ালেটা ওদিকেই পড়েছিল..”

যেতে গিয়ে সাকুরা নাকে পচা একটা গন্ধ পেল। মাছির ঝাকের কাছের ঘাস সরিয়ে দেখে পায়ের কাছে একটা গর্ত। গর্ত না বলে বরং ঢালু একটা জায়গা বলাই ভালো। তিন ফুটের মত চওড়া আর তিন ফুটের মত গভীর। আরেকটু হলে ও প্রায় পড়েই যাচ্ছিল সেটার ভেতর। নিচে তাকিয়ে বুঝতে পারল দুর্গন্ধটা কোত্থেকে আসছে…

***

গর্তটা অসংখ্য মাংসের স্তূপ দিয়ে ভর্তি। কোন আকার আকৃতি নেই, টুকরো টাকরা দেখে আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি ওগুলো কি ছিল, স্রেফ কালো আর লাল মাংসের স্তূপ।

দুর্গন্ধ উপেক্ষা করে উপুড় হয়ে কাছ থেকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম।

চোয়াল, লেজ, ধর-সব কুকুরের। কেঁচোর মত পোকা কিলবিল করছে। ওগুলোর উপর। মাংসের স্তূপের উপর স্তূপ জমে আছে গর্তের ভেতর। ওগুলোর সবগুলোর শরীরে একসময় প্রাণ ছিল। সূর্যের আলোর নিচে কুকুরগুলো একসময় হয়তো তিরিং বিরিং করত। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি, মৃত্যু আর ধ্বংস দিয়ে গাঁথা।

গর্তটা থেকে পচা দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। লাশগুলোর দিকে তাকিয়ে আমার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের কিছু ছবির কথা মনে পড়ল। গর্তটার দৃশ্যর সাথে ঐ ছবিগুলোর বেশ মিল আছে।

আশেপাশে খেয়াল করলাম। সাকুরা যেমন বলেছিল, চারপাশে ঘাস ছাড়া আর কিছু নেই। সূঁচালো ঘাসগুলো উপর দিকে মুখ করে আছে আর ওগুলোর উপর দিয়ে মাছি ভন ভন করছে। মাছিগুলো মনে হয় আমাকে তাদের বন্ধু ভেবেছিল, বার বার মুখে আর গায়ে এসে বসছিল। সূর্যাস্তের আলোয় সব কিছু লালচে দেখাচ্ছে।

সাকুরা যখন ওর আবিস্কারের কথা আমাকে বলল, আমি সাথে সাথে অনুমান করলাম কুকুর কিডন্যাপিং আর গর্তটার মধ্যে কোন সম্পর্ক আছে। যে জায়গাটা খুঁজছিলাম সেটাই এই জায়গা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

আমি ওকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে ব্রিজের দিকে চলে এলাম। সিঁড়ি বেয়ে নদীর তীরে নেমে ঘাসের ভেতর খোলা জায়গাটা খুঁজে পেতে কোন বেগ পেতে হলো না। একটু দূরেই মাছির মেঘ দেখা যাচ্ছে।

গর্তের ভেতর মার্বেল আর পাভলভের লাশও আছে।

তারপর সেখান থেকে বাসায় চলে এলাম। এখন শুধু রাত নামার অপেক্ষা।

ঘড়িতে যখন রাত দশটা বাজলে পকেটে ছুরিটা নিয়ে রুম থেকে বের হলাম আমি। সাকরা তখনো লাশগুলো দেখার শক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। লিভিং রুমের সোফায় শুয়ে মায়ের সাথে টিভি দেখছে। আমি যখন দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি মা জিজ্ঞেস করল কই যাই। বললাম শপিং মলে যাচ্ছি। সাকুরা বিড়বিড় করল, “শপিং মলের মাঝরাতের প্রহরি!”

ব্রিজের নিচের খোলা জায়গাটায় ফিরে এলাম। শুক্রবার, সুতরাং ভালো সম্ভাবনা আছে কিডন্যাপারের দেখা পাওয়ার।

হাঁটতে হাঁটতে আমি কল্পনা করার চেষ্টা করলাম এরকম প্রাণী হত্যা করতে কী রকম আনন্দ হতে পারে। কিডন্যাপার যে মরা কুকুরগুলোকে নিয়ে গর্তে ফেলছে তা যেন আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।

সম্ভব হলে আমি লোকটার কাজ দেখতে চাই। লাশগুলো ফেলার আগে কি রকম আনুষ্ঠানিকতা হয় না হয় তা জানতে আমার কৌতূহল হচ্ছে।

ইর, নির্মম ব্যাপার সবসময় আমাকে আকর্ষণ করে। আমার ক্লাসমেটদের সাথে যেসব আলোচনা হয় কিংবা পরিবারের লোকজনের সাথে যেরকম উষ্ণ আচরণ করি তা আসলে আমার সাথে খাপ খায় না। ওরা কেমন যেন স্থিতিশীল ধরনের। অনেকটা একটা রেডিওর মত, যেটা কিনা ঠিকমত টিউন করা হয়নি।

রাতের বেলায় নদীটা অন্ধকারে একদম কালো হয়ে আছে। যেন তারা শূন্য মহাবিশ্ব এসে ছড়িয়ে শুয়ে আছে এখানে। ব্রিজের আলোতে নদীর পানি খুব কমই আলোকিত হতে পেরেছে। এখন পর্যন্ত কারো উপস্থিতির চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না, তার মানে কিডন্যাপার এখনো এসে পৌঁছায়নি এখানে।

আমি সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে নেমে ঘাসের ভেতর গিয়ে ঢুকলাম। ঢোকার সময় আসার আগে মোরিনোর সাথে হওয়া টেলিফোনে কথা মনে পড়ল।

“কুকুর পছন্দ করে এমন একজনের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি, তুমি আসতে চাও?”

“যেতে পারলে ভালো হত কিন্তু আমাকে হোমওয়ার্ক করতে হবে।”

“কিন্তু আজকে তো কোন হোমওয়ার্ক নেই।”

“হোমওয়ার্ক মানে বাসায় কাজ আছে। আম্মুর অসুস্থতা আরো বেড়েছে। উনি মৃত্যু শয্যায়।”

“ঠিক আছে, কোন অজুহাতের দরকার নেই। তুমি যদি কুকুর ভয় পাও, তাহলে আমি জোরাজুরি করব না,” বললাম আমি, আর কল্পনার বাইরে একটা প্রতিক্রিয়া পেলাম।

“কি বএছা তৃ-তুমি? কুকুর ভয় পাই মানে? বাজে কথা বোল না! আমি মোটেও ওইসব জিনিস ভয় পাই না!”

ওর কথা শুনে মনে হলো ওকে খেপানো ঠিক হবে না। ওকে শান্ত করার জন্য ক্ষমা চেয়ে ফোন রেখে দিলাম।

আর এখন ঘাসের ভেতর লুকিয়ে আছি আমি।

মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পকেট থেকে ডিজিটাল ক্যামেরাটা বের করলাম। যা আলো আসছে তা আসছে ব্রিজের উপর থেকে। এই আলোতে কোন ছবি তোলা যাবে বলে মনে হয় না। ক্যামেরার অ্যাপারচার ওপেন করে শাটার স্পিড একদম কমিয়ে দিয়ে ফ্ল্যাশ অফ করে দিলাম। ফ্ল্যাশ ব্যবহার করলে কিডন্যাপার আমার উপস্থিতি টের পেয়ে যাবে, সেটা আমি চাই না।

খুনিকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেয়ার কোন ইচ্ছে আমার নেই। কিডন্যাপার আমার উপস্থিতি না জানাই ভালো। আমার নিয়ম হলো কোন কিছুতে জড়িয়ে না পড়া। তৃতীয় পক্ষ হিসেবে পাশ থেকে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করা। আমি রিপোর্ট না করলে আরো কুকুর কিডন্যাপড হবে, আরো লোকজনের মন খারাপ হবে, কান্নাকাটি করবে। কিন্তু তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমি এরকমই।

যেখানে লুকিয়ে আছি সেখান থেকে ব্রিজ থেকে নেমে আসা সিঁড়ি আর খোলা জায়গাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমার মনে হয় গর্তের কাছে যাওয়ার জন্য কিডন্যাপার খোলা জায়গাটার উপর দিয়েই যাবে, আর সে সময় আমি একটা ছবি তোলার চেষ্টা করব।

নদী দিয়ে বিপুল স্রোতে পানি বয়ে যাচ্ছে। ঘাসের আড়াল থেকে পানি বয়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। একটু আগে দেখা কালো নদীর চেহারা মনে পড়ল আমার। ঠান্ডা বাতাস বইছিল, আশেপাশের ঘাস দুলছিল। একটা ধারালো ঘাস খোঁচা লাগাল আমার গালে।

ঘড়িতে যখন বারোটা বাজে তখন ব্রিজের উপর একটা ছায়া দেখা গেল। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল ছায়াটা। আমি মাথা নামিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস ফেলছিলাম নিজের উপস্থিতি আড়াল করার জন্য।

ছায়াটা সিঁড়ি বেয়ে নিচে এসে ঘাসের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় লোকটা ছায়ার মধ্যে থাকায় দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু খোলা জায়গাটায় আসার পর ব্রিজের আলোয় তাকে আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম।

একটা মেয়ে আর একটা কুকুর। মেয়েটা খুবই শুকনো আর ছোট খাট, কাঁধ পর্যন্ত চুল। কুকুরটা একটা গোল্ডেন বিট্রাইভার। সেদিন মোরিনোর সাথে যাওয়ার সময় যাদেরকে দেখেছিলাম সেই মেয়ে আর কুকুরটাই।

মেয়েটার কোলে আরেকটা ছোট কুকুর। কুকুরটা কুকু করে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু মেয়েটার কুকুর কোলে নেয়ার অভ্যাস আছে, মোচড়ামুচড়িতে হাত থেকে ফেলে দিল।

ক্যামেরা রেডি।

***

আমি আর ইয়ুকা প্রথম যেদিন ব্রিজের নিচের খোলা জায়গাটা খুঁজে পাই, সেদিন ছিল গ্রীষ্মের অত্যন্ত গরম একটা দিন। আকাশে এক ফোঁটাও মেঘ ছিল না।

ইয়কা আর আমি হাঁটতে বের হয়েছিলাম। সবসময়ের মত খেলাধুলা করছিলাম। যতক্ষণ পর্যন্ত হাঁফ না উঠে যায় ততক্ষন পর্যন্ত দৌড়াচ্ছিলাম। তারপর নদীর পাশের রাস্তায় থেমেছিলাম বিশ্রাম নেয়ার জন্য।

কংক্রিটের রেলিঙ্গে হেলান দিয়ে বিশ্রাম করছিলাম আর নিচের বাসের সমুদ্র দেখছিলাম। হালকা বাতাস বইছিল, মনে হচ্ছিল অদৃশ্য কোন হাত এসে ঘাসগুলো নাড়াচ্ছে।

ইয়ুকা আমাকে ডাকল। আমি ওর দিকে ঘুরে দেখি ও ব্রিজের শেষ মাথায় লাগানো সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে আছে।

আমরা যখন নিচে নামছি তখন ওর মনে অ্যাডভেঞ্চারের অনুভূতি টের পাচ্ছিলাম। সিঁড়ির শেষে সবুজের দুনিয়া শুরু। আমরা যত ভেতরে যেতে লাগলাম ঘাসের গন্ধে নাক ভরে উঠল আমাদের।

সাধারনভাবে হাঁটতে ইয়ুকার হয়তো বিরক্ত লাগছিল, যে কারনে ও আমার দিকে একবার তাকিয়ে হঠাৎ সামনে দৌড় দিল। বুঝলাম, ও চাচ্ছে ওর পিছু নিই। আমরা যে হাঁপিয়ে গিয়েছি তা ভুলে গিয়ে বাসের ভেতর দিয়ে আবার দৌড়াদৌড়ি শুরু করলাম।

গরমের দিন, একসময় আমি ঘেমে সেদ্ধ হয়ে গেলাম। তারপরেও ঘাসের ভেতর ইয়ুকার পিছুপিছু দৌড়াচ্ছিলাম। ওর হাসি শোনা যাচ্ছিল, আমি শব্দের দিকে ছুটে যাচ্ছিলাম, ও আরেকদিকে পালাচ্ছিল।

হঠাৎ আমরা একটা খোলা জায়গায় এসে পড়ি। মনে হয় একটা নতুন দুনিয়া। ঘাসের গন্ধ কম, চারপাশে হালকা বাতাস বইছে। খোলা জায়গাটায় কোন ঘাস নেই।

ইয়ুকাই প্রথম জায়গাটা খুঁজে পেল। খোলা জায়গাটার মাঝখানে ও অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এরপর আশেপাশে তাকাতে গিয়ে ও দেখল আমি ঘাসের দেয়ালের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসছি। প্রথমে জায়গাটা পেয়ে আমাদের দুজনেরই বোকা বোকা লাগছিল। পরে মনে হলো যেন বিশেষ কিছু একটা খুঁজে পেয়েছি। আমি ওর চোখে আনন্দের ঝলক দেখতে পাচ্ছিলাম।

কতদিন আগের ঘটনা এটা? মনে হচ্ছে যেন কত আগে ঘটেছে।

খোলা জায়গাটা খুঁজে পাওয়ার কিছুদিন পরেই লোকটা নিয়মিত আসতে লাগল। সেই সাথে ইয়ুকা আর আমিও আমাদের মাঝরাতের হাঁটাহাঁটি শুরু করলাম। দিন দিন বাতাস ঠান্ডার দিকে যাচ্ছিল। সেদিনের মত গ্রীষ্মের উষ্ণতা আর অনুভব করতে পারছিলাম না।

এমনকি দিনে হাঁটতে বের হলেও আমরা আর আগের মত ছোটাছুটি করতাম না। খেলাধুলা করতাম না আগের মত। শুধু কুকুরওয়ালা ঘরগুলো খুঁজতাম। রাতের বেলা শিকার করা সহজ ছিল।

ইয়ুকা আমাকে নির্দেশ দিয়েছিল কী করতে হবে। আমি জানি না এর পেছনে কারণ কি ছিল, যাই থাকুক তা অন্তত মজার কিছু ছিল না। ইয়ুকার চোখগুলো আর হাসত না। ওর দুঃখ আর ঘৃণা বাকি সব অনুভূতিগুলোকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। ওর নির্দেশ অমান্য করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

আগেরবারের চেয়ে এবার বাতাস একটু বেশি ঠান্ডা। ব্রিজের উপর বেশ ভালো গাড়ির ভিড়। গাড়িগুলোর আলো আমাদের দিকে ছুটে আসছে, আমাদের ছায়াগুলো বারবার সরে গিয়ে সরু হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে।

উপর থেকে আমরা ঘাসের দিকে তাকালাম। ওগুলোও অন্ধকারে প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল। বাতাসে ঘাসগুলো দুলছে, অন্ধকারের দিকে স্রোতের মত বয়ে যাচ্ছে। ব্রিজের উপরের স্ট্রিট লাইট থেকে আসা মলিন আলোতে আমরা অল্প কিছু দেখতে পাচ্ছি।

ইয়ুকা আর আমি সিঁড়ি দিয়ে নেমে খোলা জায়গাটার দিকে গেলাম। ভালো করে চারপাশের ঘাসের দেয়াল লক্ষ্য করলাম আমি। কেউ কি ওখানে লুকিয়ে আছে? মনে হলো যেন বাতাসে কোন আগন্তুকের গন্ধ পাচ্ছি?

সমস্ত ইন্দ্রিয় খাড়া হয়ে গেল আমার। এমন সময় ইয়ুকা আমাকে ডাকল। সময় হয়েছে।

যে কুকুরটাকে আমরা সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম ওটাকে ভোলা জায়গাটার মাঝখানে রাখা হলো। এবারেরটা কুকুরছানার মত ছোট না, আবার পূর্ণ বয়স্ক কুকুরের মত বড় না। শৈশব মাত্র শেষ হতে যাচ্ছে ওটার। কুকুরটা মুখ তুলে অবাক হয়ে আমাদের দেখল। আসার পথে কুকুরটাকে আমরা চুরি করেছিলাম।

আমরা যখন কুকুরগুলোকে চুরি করি ওরা তখন চিৎকার করে ওদের মালিকদের ডাকডাকি শুরু করে। তখন খাবার দিয়ে আমরা সেগুলোকে শান্ত করি।

ইয়ুকা এক কোনায় সরে গেল। ও সবসময় ওখানে বসে পুরো দৃশ্যটা দেখে।

আমি আমার প্রতিপক্ষর চোখে চোখ রাখলাম, ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তৈরি। কুকুরটা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কুঁকড়ে গিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। আমার ইন্দ্রিয়গুলো সম্পূর্ণ সজাগ, ইয়ুকার আদেশের জন্য অপেক্ষা করছে।

আমার প্রতিপক্ষের কোন ধারণা নেই ওর জন্য সামনে কী অপেক্ষা করছে। ভয় পেয়ে কু-কু করছিল-নিজের মালিককে খুঁজছিল সে।

এক দফা ঠান্ডা বাতাস শব্দ করে বয়ে গেল ঘাসের মধ্যে দিয়ে। তারপর নিরবতা নেমে এল। ব্রিজের উপরে গাড়ির স্রোতও থেমে গেল মনে হয়, আমার কানে কোন শব্দ আসছে না। সমস্ত নিস্তব্ধতার মাঝেও আমি উত্তেজিত বোধ করছি। বাতাসে চড়চড় শব্দ করে উঠল। ছোট গর্তটা ধ্বংস আর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে আর আমি আমার স্নায়ু টানটান করে শুরু করার জন্য অপেক্ষা করছি।

আমার সামনের কুকুরটা নার্ভাস হয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে। বাতাসের টানটান উত্তেজনা টের পেয়ে সে গুটিয়ে গেছে। আবারো করুণভাবে কুউকুউ করছে।

ইয়ুকা ছোট কিন্তু স্পষ্ট করে নির্দেশ দিল : “আক্রমণ করো!”

আমি ছুটে সামনে গেলাম। অপ্রস্তুত কুকুর আর আমার মধ্যে দূরত্ব মুহূর্তেই কমে গেল। আমাদের কাঁধের মধ্যে সংঘর্ষ হলে কুকুরটা ধাক্কা খেয়ে একদিকে গড়িয়ে পড়ল। আমি হুঙ্কার দিলাম। আমার প্রতিপক্ষ দাঁত বের করে দেখাল, কিন্তু তখনো সে বিভ্রান্ত, বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে। ওর চোখে সেটা স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে।

আমার হৃদপিণ্ড জোরে জোরে বাড়ি খেতে লাগল। পায়ের নিচের মাটি আর বয়ে যাওয়া বাতাস আমি স্পষ্ট অনুভব করছি। আমার মনে শুধু খেলা কাছে প্রতিপক্ষ আর আমার মধ্যের দূরত্বটা পার হতে আমার কতক্ষন লাগতে পারে।

কুকুরটা ছোটখাট নড়াচড়া থেকে আন্দাজ করার চেষ্টা করছিলাম ওর পরবর্তি পদক্ষেপ কোনদিকে হতে পারে। এখন পর্যন্ত অনেকগুলো লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা হওয়ায় আমি এ ব্যাপারে দক্ষ হয়ে উঠেছি।

কিন্তু মনে মনে আমার খারাপ লাগছে। আর কতদিন ইয়ুকা আমাকে এসব করতে বাধ্য করবে? আমি সত্যি সত্যি কোন খুন করতে চাই না। সারা জীবনে কখনো ভাবতেও পারিনি আমার চোয়াল কখনো এই কাজে ব্যবহৃত হবে।

করটা ডানে সরল। কিন্তু আমি সেটা আগেই বুঝতে পেরেছিলাম সুতরাং আমিও ওর সামনেই চলে এলাম। বাতাসে ওর লোম ছড়িয়ে পড়ল। ছিটকে পড়ল রক্ত। টলতে লাগল ওটা। অন্ধকার আমাদের ঘিরে ধরুল যেন।

আরো কিছুক্ষণ লড়াই করলাম আমরা। তারপর ইয়ুকা উঠে দাঁড়াল।

“শেষ করে দাও!” ঘৃণাভরা নির্দেশ দিল সে। ঐ অনুভুতিগুলো আসলে ঐ লোকটার জন্য, আর সে আসার পর থেকেই ইয়ুকা আমাকে এসব করতে বাধ্য করছে। তার সব কষ্ট সে এভাবে আমাকে খুন করতে বাধ্য করার মাধ্যমে মুক্ত করছে।

রক্তাক্ত কুকুরটার দিকে এগুতে এগুতে আমি ইয়ুকার দিকে তাকালাম, তারপর হুঙ্কার ছাড়লাম। আমার হুঙ্কার ব্রিজের নিচে প্রতিধ্বনি তুলল। আমার মাথা গরম হয়ে উঠেছে। এরকম কেন হচ্ছে? কেন আমরা আগের মত হাসিখুশিভাবে খেলাধুলা করতে পারছি না?

কুকুরটা কেঁপে উঠে অন্ধকারের ভেতর নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করল। বাঁধা দেয়ার কোন ক্ষমতা আর নেই। কোনমতে দাঁড়াতে পারছে, মৃত্যুভয়ে খরখর করে কাঁপছে ওটা।

আমার এখন এর সমাপ্তি টানতে হবে, নিজের মনে বলতে বলতে আমি গরপেয়ে প্রাণীটার দিকে এগিয়ে চোয়াল হা করে ওর ঘাড়ে কামড় বসালাম। আমার দাঁত চামড়া ভেদ করে গভীরে ঢুকে গেল। গরম রক্ত ছিটকে এসে মুখ ভরে গেল আমার।

সেই গ্রীষ্মের দিনে আনন্দ চারদিকে খেলা করছে। ইয়ুকা আর আমি ঘাসের মধ্যে দৌড়ে খেলতে গিয়ে খালি জায়গাটা খুঁজে পেয়েছিলাম। আমি ইয়ুকার উপর লাফ দেয়ায় ও পড়ে গিয়েছিল। এক মুহূর্তের জন্য আমার দুশ্চিন্তা হয়েছিল ব্যথা পেল কিনা। কিন্তু ওকে হাসিখুশি দেখাচ্ছিল। আমি ওর পাশে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম। একসাথে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম দু-জনে। সূর্যের আলো আমাদের শরীর গরম করে তুলছিল, আমাদের ঘামের গন্ধ আর আশেপাশের ঘাসের গন্ধ আমাদের নাক ভরে তুলছিল…

চোয়ালের মধ্যে ঝুলে থাকা জন্তুটার নড়াচড়া ততক্ষণে থেমে গেছে। আমার মুখ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। জটার শরীর শীতল হয়ে আসছে সব শব্দ কমে যাচ্ছে আমাদের চারপাশে।

আমি খুন করায় পারদর্শি হয়ে উঠেছি। জানি না এটা কোন ভালো কাজ কিনা কিন্তু ইয়কা আমাকে শিখিয়েছে কী করে আমার চোয়ালটাকে একটা অস্ত্রে পরিণত করা যায়।

মৃত জিনিসটা থেকে সমস্ত উষ্ণতা বেরিয়ে গেছে, শুধু পড়ে আছে এক দলা ঠান্ডা মাংস।

ও আমাকে শিখিয়েছে, আমি আবারো ভাবলাম।

কুকুরটাকে নিয়ে ইয়ুকের সামনে রেখে ওর মুখের দিকে তাকালাম। ও আমার চোখে তাকিয়ে আছে।

আমি বুঝতে পারছিলাম ও কী চাইছে। ওর শক্তি আমার ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মনে হয়।

ও কেন আমাকে দিয়ে এই প্রাণীগুলোকে খুন করাল?

আগে এর কারণ বুঝিনি-কিন্তু এখন বুঝতে পারছি। এতদিন আসলে ইয়ুকা আমাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। সে আমাকে এসব প্রাণী খুন করতে বাধ্য করেছে যাতে আমার অনেকবার মৃত্যু-অভিজ্ঞতা হয়। আর এই অভির কারনেই যখন প্রয়োজন হবে তখন সঠিক পদক্ষেপ নিতে আমার মধ্যে যেন কোন দ্বিধা না হয়।

ইয়ুকা ঐ লোকটার সাথে লড়াই করতে পারবে না। কিন্তু আমি আমার ধারালো দাঁত দিয়ে ওকে রক্ষা করতে পারব।

ইয়ুকা মাথা ঝাঁকাল। সে বুঝেছে, আমি এখন বুঝতে পেরেছি। সে আমার কাজ দেখার জন্য অপেক্ষা করছে।

আমার আর কোন প্রশিক্ষনের প্রয়োজন নেই, ওকে বললাম আমি।

লোকটা রাতে ঘুমাতে আসবে। আমরা সকালে ব্যাপারটা ফয়সালা করব। ইয়ুকা ফিসফিস করে সেটা আমাকে বলল।

আমি মৃত জন্তুটাকে নিয়ে গর্তটায় ফেলে নদীর পানিতে রক্ত আর লোম ধুয়ে ফেললাম। এখন আমরা বাসায় যাব-অপেক্ষা করব সকালের জন্য।

ইয়কা আর আমি ব্রিজের নিচের খোলা জায়গাটা ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। ঠিক যে মুহূর্তে আমরা ঘাসে দেয়াল ঠেলে ঢুকতে যাব তখন থমকে দাঁড়ালাম। ইয়ুকা ততক্ষনে ঘাসের ভেতর ঢুকে গেছে। থেমে ঘুরে দাঁড়াল ও।

“কি হলো?” আমি টের পাচ্ছি ও জানতে চাইছে।

আমি ওর দিকে তাকালাম, তারপর আমার পেছনের ঘাসের ভেতর খুঁজলাম। এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হয়েছিল কিছু একটা অদ্ভুতভাবে নড়তে দেখেছি।

কিছু না, আমি ভাবলাম। চল, যাওয়া যাক। আমি ইয়ুকার দিকে ফিরে দৌড়ে ওর পাশে গেলাম।

হয়তো ওখানে কেউ একজন ছিল। আমি নিশ্চিত কেউ একজন সেখানে ছিল-ঐ একই লোক, যে আমাদের পিছু নিয়েছিল, আমাদেরকে ধরার চেষ্টা করছে। আর এখন সে লুকিয়ে দেখে ফেলেছে আমরা কী করছিলাম।

এতদিন আমি ধরা পড়া নিয়ে ভয়ে ভয়ে ছিলাম। এখন আর সেই ভয় নেই। আমি জানি আমাকে কী করতে হবে, এসব নিয়ে আমার আর কোন দুশ্চিন্তা নেই। আমাদের আর কোন প্রাণী হত্যা করতে হবে না। আমার প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে। আমাদের আর পিছু নেয়া ছায়াকে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই।

আমরা সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম। আমি আরেকবার পিছু ফিরে ঘাসের সমুদ্রের দিকে তাকালাম, অন্ধকারে ডুবে আছে ওটা। যে ওখানে লুকিয়ে আছে তাকে বলতে চাইছি, আমি আর ইয়ুকা কী করতে যাচ্ছি। আমি তাকে বলতে চাইছি ইয়ুকার সাথে কী হয়েছে আর কেন সে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আমিও এখন তা চাই।

***

“হ্যালো..?” সেলফোনের অপর পাশ থেকে মোরিনোর ঘুম জড়ানো কণ্ঠস্বর ভেসে এল। ওর গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছে কিভাবে কেউ অন্য কাউকে এই ভোরবেলায় ফোন করতে পারে তা ওর ধারনার বাইরে।

জানালা দিয়ে বাইরে আলো ফুটছে এখন। আমি মাত্র তিন ঘন্টা ঘুমিয়েছি, কিন্তু আমার ঘুমের অভ্যাসকে আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, যে কারনে ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হলে আমার কোন সমস্যা হয় না।

আমি ওকে জানালাম, কিডন্যাপারকে খুঁজে পেয়েছি।

“ওহ্, আচ্ছা,” বলে সে ফোন রেখে দিল। ওকে ঐদিনে রাস্তায় দেখা ছোট মেয়েটা আর তার গোল্ডেন রিট্রিভার কুকুরটার কথা বলার কোন সুযোগই পেলাম না। কিডন্যাপার কে সেটার চেয়ে ঘুমানো অনেক বেশি জরুরি মোরিনোর কাছে।

আমার ফোন বাজল। মোরিনো। কলটা ধরতেই সরাসরি মূল কথায় চলে গেল সে।

“ছবি তুলেছো?”

আমি বললাম, ডিজিটাল ক্যামেরা নিয়েছিলাম কিন্তু অন্ধকারে কোন ছবি তোলার মত অবস্থা ছিল না। ব্রিজের নিচে যথেষ্ট আলো পাইনি, তাই ছবিতে কিছুই ওঠেনি।

“ওহ, আচ্ছা,” বলে আবার ফোন রেখে দিল সে।

আমি পোশাক বদলে রুম থেকে বের হলাম। বাসার লোকজন তখনো গভীর ঘুমে, পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ। জুতা পরে বের হয়ে দেখি পুবের আকাশ লাল হয়ে আছে। কালো আকৃতি ধারন করেছে ল্যাম্পপোস্টগুলো।

“কাল সকালে,” গত রাতে ব্রিজের নিচে মেয়েটাকে ফিসফিসিয়ে বলতে শুনেছিলাম। ছোট কুকুরটা হত্যা করার পর গোল্ডেন রিট্রিভারের কানে কানে বলছিল সে।

আমি যেখানে লুকিয়ে ছিলাম সেখান থেকে পুরো লাইনটা শুনতে পাইনি। কাল, শনিবার সকালে কি কিছু হতে চলেছে?

তারা কি আবার একই জিনিস করবে?

আমি মেয়েটার বাসার দিকে গেলাম, হাতে ক্যামেরা। ওর বাসা কোথায় তা আমার জানা আছে। সেদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখেছি কোন বাসায় ও আর কুকুরটা ঢুকেছিল। ওইটাই নিশ্চয়ই ওর বাসা। আমার প্ল্যান হল চুপচাপ ওদেরকে ফলো করা আর ওরা কী করে তা দেখা।

ঘর থেকে বের হওয়ার পর পরই খেয়াল করলাম কিছু একটা ভুলে গিয়েছি। আমার সাথে ওয়ালেট আর ক্যামেরা আছে। পকেট হাতড়ে উপরে আমার রুমের জানালার দিকে তাকালাম। ছুরিটা ভুল করে রুমে ফেলে এসেছি।

ছুরিটা আনতে আবার উপরে যাব? কোন কাজে তো লাগে না। নাকি সোজা মেয়েটার বাড়ি যাব?

সময় নষ্ট করতে চাইছিলাম না। না ফিরে যাওয়াই সহজ হতো। কিন্তু এসব ভাবলেও ফিরে গিয়ে বুককেসের পেছন থেকে লুকানো ছুরিটা বের করলাম। ছুরির ফলার সাদা উজ্জ্বলতা দেখে নিজের হাত কাটার ঝোঁকটা অনেক কষ্টে দমালাম। লেদারের খাপে ছুরিটা ভরে পকেটে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে এলাম আমি। প্রচণ্ড পিপাসা বোধ হচ্ছে। ছুরির ফলাটা যেন শুকনো মরুভূমির মত আমার ভেতর থেকে সব পানি শুষে নিয়েছে।

পুবদিকে তাকিয়ে দেখি রক্ত বর্ণ ধারন করেছে আকাশ।

***

সকাল হয়ে গিয়েছে।

চোখে আলো পড়তেই আমি আর ইয়ুকা জেগে উঠলাম। পর্দার ফাঁক দিয়ে সরু একটা আলোক রশ্মি এসে কার্পেট, বিছানা, ফুটোন পার হয়ে আমাদের মুখের উপর পড়ছে। এক মুহূর্তের জন্য আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম।

আগে ইয়কার সাথে একসাথে ঘুম থেকে উঠতে মজা লাগত। একজন আরেকজনকে গুতোগুতি করতে করতে ভাবতাম আজকে কি কি খেলা যায়। সেই সময়টা আমি কখনো ভুলতে চাই না। যদি আমাদেরকে আলাদা করে ফেলা হয় তবুও আমি ওকে সবসময় এভাবে মনে রাখতে চাই।

সূর্যের আলোয় ভেসে থাকা ধুলোর দিকে তাকিয়ে আমরা নিজেদের মনস্থির করে বিছানা থেকে উঠে পড়লাম। দরজা খুলে বাইরে তাকালাম আমি।

আম্মুর রুম থেকে লোকটার নাক ডাকার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। বাসায় এলে সে সবসময় ঐ রুমে ঘুমাত। ভোরবেলা উঠে কাজে চলে যেত আম্মু। আর লোকটা একা একা সারা সকাল নাক ডেকে ঘুমাত।

ইয়ুকা আর আমি আস্তে আস্তে পা ফেলে হলওয়ে পার হয়ে বেডরুমের সামনে গেলাম। আম্মুর রুমটা বাড়ির একদম পেছন দিকে, হল আর রুমের মধ্যে একটা স্লাইডিং ডোর আছে। কিন্তু দরজাটা সকালে লাগাতে আম্মু ভুলে গিয়েছিল। যেটুকু খোলা আছে তা দিয়ে ভেতরে ঢোকা আমার জন্য কোন ব্যাপারই না।

ফাঁক দিয়ে নাক ঢুকিয়ে আমি পুরো রুমটা লক্ষ্য করলাম।

তাতামির উপর একটা ফুটোন বিছানো ছিল। সেখানে লোকটা চিত হয়ে ঘুমাচ্ছে। মুখ অর্ধেক হা করা, গলার অংশটা পুরো উন্মুক্ত। দাঁড়ানো অবস্থায় লোকটাকে দেখতে দৈত্যর মত লাগে, ঐ অবস্থায় আমি কখনো ওর গলা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারতাম না। কিন্তু এখন ঘুমে বিভোর বলে ওর গলা আমার নাকের ডগায় চলে এল।

কোন শব্দ না করে আমি দরজা দিয়ে পিছলে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। হাঁটার সময় কাঠের তাতামি একটু ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করল। ইয়ুকা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখছে। ওকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত লাগছে আমার।

আমি লোকটার মাথার কাছে পৌঁছে গেলাম। সে তখনো কিছু টের পায়নি। ঘুম ভাঙার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। চোখ বন্ধ। ফুটোনের অর্ধেকটা পেটের উপর উঠে আছে। নিঃশ্বাসের সাথে সাথে ফুলে উঠে আবার নেমে যাচ্ছে।

চোখের কোনা দিয়ে কিছু একটা নড়তে দেখলাম। জানালার দিকে তাকিয়ে দেখি পর্দার পেছন থেকে একটা ছায়া সরে গেল।

আমার চেহারা খেয়াল করল ইয়ুকা। ওকে হতভম্ব দেখাল, মুখ শুকিয়ে গেছে।

জানালার বাইরে কি কেউ ছিল? নাকি পর্দা নিজে নিজে নড়েছে? হতে পারে গাছের ছায়া ছিল? যাই হোক আমি চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম। সামনে শোয়া মানুষটাকে নিয়েই আমার সমস্ত চিন্তা এখন।

লোকটার মুখের দিকে তাকাতেই আমার মনে পড়ল সে কিভাবে ইয়কাকে কষ্ট দিচ্ছিল। ক্রোধে আমার মন বিষিয়ে উঠল এবার।

ঘুরে ইয়ুকার দিকে তাকালাম।

শব্দের কোন প্রয়োজন নেই আমাদের মধ্যে। আমি জানতাম সে কী চায়, ওর চোখে সবকিছু স্পষ্ট পড়তে পাচ্ছি।

আস্তে করে আমার চোয়াল হা করলাম। কোন ইতস্তত করলাম না। এই কাজ আমি আগে অনেকবার করেছি ব্রিজের নিচে।

কামড় বসালাম।

আমার দাঁতগুলো লোকটার গলায় ঢুকে গেল। চামড়া কেটে রক্ত বেরিয়ে এল। আমি আরো গভীর কামড় দিয়ে ওর টুটি ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছিলাম কিন্তু দেখা গেল মানুষের গলা আমার ধারনার চেয়ে অনেক বেশি শক্ত। শক্ত কিছুতে দাঁত আটকে গেল, বেশি গভীরে ঢুকল না।

লোকটা চোখ খুলে উঠে বসল, আমার দাঁত তখনো তার গলায় বিধে আছে। উঠে বসাতে আমি কামড় দেয়া অবস্থায় ঝুলতে লাগলাম। লোকটা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে চিৎকার করার চেষ্টা করল। গলার গুরুত্বপূর্ণ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারনে, তেমন একটা আওয়াজ বের হল না। সে আমার মুখে ঘুষি মারল কিন্তু তাও আমি ঝুলে থাকলাম।

লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে ঝাঁকি দিয়ে আমাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। তখন আমি ছিটকে তাতামির উপর পড়ে ডিগবাজি খেলাম।

সেই মুহূর্তে মনে হল যেন চারপাশের সময় থেমে গিয়েছে।

রক্তের লাল ফোঁটা টপ টপ করে লোকটার পায়ের কাছে ঝরে পড়ছে। আমি লোকটার পায়ের কাছে থেকে তাঁর মুখের দিকে তাকালাম। সে তখন গলায় হাত দিয়ে আছে, হতভম্ব। গলার একটা অংশ ছিঁড়ে আলাদা হয়ে ঝুলে আছে। সেদিক দিয়ে রক্ত ছিটকে বের হচ্ছে। লোকটা হাত দিয়ে চেপে থাকলেও আঙুলের ফাঁক দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসছে।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে মুখের ভেতর যেই জিনিসটা ছিল সেটা থু করে ফেললাম ফুটোনের উপর। এক দলা মাংস, যেটা লোকটার গলা থেকে ছিঁড়ে নিয়েছিলাম।

সে যখন মাংসের টুকরোটা দেখল, তার চোখ প্রশস্ত হয়ে গেল, হাঁটু গেড়ে বসে হাত দিয়ে মাংসের টুকটা তুলে চেপে গলায় লাগানোর চেষ্টা করল। কিন্তু রক্তের সোতে সেটা খুলে আসছিল। তার হাত কাঁপছিল, মাংসের টুকরাটা হাত গলে নিচে পড়ে গেল। লোকটা আবার সেটা ভোলার চেষ্টা করল না। বরং মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল। তার মুখ ভয়াবহ দেখাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল যে কোন সময় কেঁদে ফেলবে। হা করে সে হুংকার ছাড়ল। হুংকারের সাথে গলা থেকে অদ্ভুত একটা হিসহিস শব্দ হলো। তারপরেও হুংকারটা যথেষ্ট জোরাল ছিল, ঘরের দেয়ালে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনি তুলল।

তারপর সে আমাকে আক্রমণ করল। লোকটা অত্যন্ত শক্তিশালী। পেটে লাথি খেয়ে আমি প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলাম।

ইয়ুকা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চিৎকার করল। ও সেখানে জমে গিয়েছে, কী করবে বুঝতে পারছে না।

“পালাও!” আমি চিৎকার করলাম, কিন্তু সে আমাকে ফেলে কোথাও গেল না। দাঁড়িয়েই থাকল।

লোকটা হাত দিয়ে তার গলা ধরে আমাকে রক্তাক্ত তাতামির উপর লাখি মারতে লাগল। সেই সাথে অশ্রাব্য গালিগালাজ। কথা বলার সময় তার মুখ থেকে থুথু আর রক্ত ছিটকে বেরিয়ে আমার গায়ে পড়ছিল।

আমি লোকটার হাত কামড়ে ধরলাম। সে সাথে সাথে হাত টেনে নিল। ইক সময়ই আমাদের জন্য যথেষ্ট ছিল। আমি আর ইয়কা এক সাথে দৌড় লাগালাম।

নোটার প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল কিন্তু এই রক্তক্ষরণে মরবে মনে হচ্ছে না। কোন কুকুর হলে হয়তো এতক্ষণে হার মেনে নিত কিন্তু মানুষের কথা আলাদা। লোকটা ক্রোধে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল, পাল্টা আক্রমন করেছিল।

আমি আর ইয়ুকা যখন দৌড়ে হলওয়ে পার হচ্ছিলাম তখন পেছনে বজ্রপাতের মত জোরালো শব্দ হলো। লোকটা স্লাইডিং ডোর দিয়ে এমনভাবে উড়ে বেরিয়ে এসেছে যে একটুর জন্য দরজাটা ভেঙে পড়েনি।

আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। কোনভাবেই একে খুন করা আমার ক্ষমতার মধ্যে নেই। সে আমার চেয়ে অনেক অনেক গুণ শক্তিশালী। আমি হয়তো তাকে বারবার কামড় দিতে পারতাম কিন্তু সে সেফ দাঁড়িয়ে আমাকে লাখি মারলেই হতো। আর সে যদি আমাকে মেরে ফেলতে পারে তাহলে এরপর ইয়কাকে মারবে। আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করব।

আমরা মূল দরজার দিকে ছুটতে লাগলাম। লোকটার পায়ের শব্দ কানে আসছিল, সে আমাদের পেছন পেছন দৌড়ে আসছে। শব্দটা ক্রমেই নিকটতর হচ্ছে।

আম্মুর ঘর থেকে বেরিয়ে একটা বাঁক নিলেই সোজা হলওয়ে। মূল দরজা একদম কাছে হলেও আমাদের মনে হচ্ছিল অনন্তকাল লাগছে।

দরজার প্রায় কাছে পৌঁছে যেতেই ইয়ুকা পা পিছলে মেঝের উপর উলটে পড়ল।

“ইয়ুকা!” আমি চিৎকার করলাম। থামার চেষ্টা করলাম, কিন্তু অনেক জোরে দৌড়াচ্ছিলাম, সহজে থামতে পারলাম না। দরজার কাছে রাখা জুতায় লেগে বাড়ি খেলাম দরজায়, তারপর পড়ে গিয়ে থেমে গেলাম।

আমি ঘুরে উঠে ইয়ুকার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে চাইলাম। কিন্তু আমার পাগুলো যেন ভয়ে জমে গেছে।

লোকটা ইয়ুকার সামনে দাঁড়িয়েছিল, গলা দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখতে ভয়াবহ লাগছিল। সে কিছু একটা বলছিল কিন্তু কথাগুলো বোঝার অবস্থায় ছিল না।

সে আমার দিকে এগিয়ে এল, দু-হাত সামনে বাড়ানো যেন আমি পালিয়ে যেতে না পারি।

আমি নড়তে পারছিলাম না। দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ইয়ুকাকে একা ফেলে বেরিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।

এখন আমি কি করব? চিন্তা করে কোন কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না। ক্রোধ আর হতাশা আমাকে পেয়ে বসেছিল। লোকটা আমাকে আরেকবার তাকে আক্রমণ করার কোন সুযোগই দেবে না।

আমি পরাজয় মেনে নেয়ার জন্য তৈরি হয়ে গেলাম।

লোকটা ইয়ুকাকে ঘৃণা করত, ওর সাথে খারাপ অনেক কিছু করেছিল, অথচ আমি এতটাই দূর্বল ছিলাম যে ওকে রক্ষা করতে পারলাম না। যত কিছুই চেষ্টা করি না কেন আমি আসলে দূর্বল। যদি আরেকটু শক্তিশালী হতাম তাহলে হয়তো ইয়ুকাকে রক্ষা করতে পারতাম লোকটার কাছ থেকে…

হাতগুলো প্রায় আমার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল।

মেঝেতে পড়ে থাকা অবস্থা ইয়ুকা তাকাল আমার দিকে।

“দুঃখিত, আমি পারলাম না,” ফিসফিসিয়ে বললাম তাকে। ওর থেকে চোখ সরিয়ে ফেললাম। মাথা নামিয়ে অন্তিম মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

আলো নেভানো থাকলেও জানালা দিয়ে বাইরের আলো এসে ঘরটা আলোকিত করে তুলেছিল। মাথা নিচু করে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম লোকটার হাতের ছায়া আমার দিকে এগিয়ে আসছে। হলওয়ে থেকে দরজার কাছে ছায়াটা খালি লম্বাই হচ্ছে।

দুঃখিত, আমি তোমাকে রক্ষা করতে পারলাম না… ছায়ার সাথে সাথে গলা থেকে গড়িয়ে পড়া রক্তের ফোঁটাও সামনে এগিয়ে আসছিল। সামনে পড়ে থাকা জুতার উপরও কয়েক ফোঁটা পড়ল।

যদি আমরা আগের মত আবার খেলতে যেতে পারতাম…

লোকটার ছায়া আমার ছায়ার কাছে পৌঁছে গেল। আমি মাথা নিচু করেই থাকলাম, নড়ছিলাম না। লোকটার দু হাত আমার মুখের দুপাশে পৌঁছে গেল। চোখের কোনা দিয়ে আমি রক্তাক্ত লাল হাতগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম। তার ছায়া আমাকে এমনভাবে ঢেকে ফেলল যেমনভাবে সূর্য অস্ত গেলে চারদিক আঁধারে ঢেকে যায়।

ইয়ুকা…

আমার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।

সেই মুহূর্তে আমার পেছনে কিছু একটা শুনতে পেলাম। আমার পেছনে দরজার বাইরে জুতার শব্দ। একটা কাঁচকোঁচ শব্দ হলো তারপর আমার পায়ের কাছে ধাতব কিছু একটা এসে পড়ল।

মাথা নিচু করে ছিলাম বলে জিনিসটাকে ঝনঝন করে পড়তে দেখলাম। লোকটার ছায়া পড়ার পরও জিনিসটা চকচক করছিল।

ঝনঝন শব্দের কারনে আমার দুপাশে হাত দুটো থেমে গেল। এক মুহূর্তের জন্য সব শব্দ থেমে গেল। যেন সময়ই থেমে গিয়েছিল।

আবার জুতার শব্দ শোনা গেল। কিন্তু সেগুলো এবার দূরে সরে যাচ্ছিল। খবরের কাগজ দেয়ার জন্য দরজায় একটা সুট লাগানো ছিল। ক্যাঁচকোঁচ শব্দটা ওটার থেকে এসেছে।

আমি জানতাম আমাদের যে পিছু নিয়েছিল এটা সেই লোকটা। যার ছায়া আমি একটু আগে জানালায় দেখেছিলাম।

ছায়ার উপস্থিতি আগে থেকে আমার জানা থাকার কারনে লোকটা আবার তৈরি হওয়ার আগেই আমি সরে যেতে পারলাম। এক মুহূর্তের সুযোগ আমাদের ভাগ্য তৈরি করে দিল…

***

মেয়েটা আর তার কুকুর দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল। আমি অন্যদিকে এক কোনায় লুকিয়ে ছিলাম। ওরা আমাকে খেয়াল করেনি।

ওরা দৃষ্টির আড়াল হওয়ার পর আমি বাড়িতে গিয়ে ঢুকলাম। সামনের দরজা লক করা ছিল না। ভেতরে লোকটার মৃতদেহ চিত হয়ে পড়ে আছে। পরিস্কার দেখতে পাচ্ছিলাম ছুরিটার হাতল পর্যন্ত সরাসরি লোকটার হৃদপিণ্ডে ঢুকে আছে। রক্তের একটা পুকুর সৃষ্ট হয়েছে লোকটার চারপাশে। হল থেকে রক্তের একটা ধারাও চলে এসেছে দরজা পর্যন্ত। ভালো করে সবকিছু লক্ষ্য করলাম। খেয়াল রাখলাম যেন কোন কিছু স্পর্শ না করি। লোকটা কে তা আমার জানা ছিল না। অনুমান করছি মেয়েটার বাবা হবে। ওর কোন মা নেই? আমি একটা ছবি তুলে নিয়ে সেখান থেকে চলে আসলাম। আসার সময় ভাবছিলাম ছুরিটা নিয়ে আসব কিনা, পড়ে ভাবলাম থাক-দেখে মনে হচ্ছিল ছুরিটা তার প্রকৃত জায়গা খুঁজে পেয়েছে।

চলে আসার আগে জামার হাতা দিয়ে দরজার নব ভালো করে মুছে এলাম। আমার হাতের ছাপ কোথাও পাওয়া যাক তা অবশ্যই চাই না।

বাসায় ফিরে দেখি সাকুরা টিভি দেখতে দেখতে হোমওয়ার্ক করছে।

“কোথায় গিয়েছিলে?” সে জানতে চাইল।

ওকে বললাম শপিং মলের কথা। তারপর নাস্তা করলাম।

নাস্তার পর আবার মেয়েটার বাসার দিকে গেলাম। দূর থেকেই হৈচৈ কানে আসছিল। কাছাকাছি যেতেই দেখতে পেলাম লোকজনের ভিড়। পুলিশের গাড়ি দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই কেউ ফোন করে পুলিশে খবর দিয়েছে।

পেট্রোল কারের লাল আলো বাড়ির দেয়ালে ঘুরে ঘুরে পড়ছিল। রাস্তায় দাঁড়ানো লোকগুলো ফিসফিস করছিল। তারা সম্ভবত প্রতিবেশি হবে-এপ্রন পরা গৃহিণী আর পাজামা পরা মধ্যবয়স্ক লোকজন সব। আমি ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে বাড়িটার দিকে তাকালাম, আর ওদের কথা শোনার চেষ্টা করলাম।

যা শুনলাম তাতে মনে হল যে মহিলা এই বাড়িতে থাকে, সে বাসায় ফিরে দেখতে পায় লোকটা বুকে ছুরি নিয়ে মূল দরজার কাছে পড়ে আছে।

তার মানে লোকটা মেয়েটার বাবা ছিল না।

আমি আস্তে ধীরে এপ্রন পরা এক মহিলার সাথে খাতির জমিয়ে ফেললাম। বাড়িটার বাসিন্দাদের সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাইলাম। সে যদিও আমাকে চিনত না, কিন্তু খুশি মনে আমার প্রশ্নের উত্তর দিল। উত্তেজনার চোটে কোন সন্দেহ করল না।

বাড়িতে এক মহিলা, তার মেয়ে আর একটা কুকুর থাকত। ডিভোর্সের কারনে মেয়েটার বাবা ছিল না। মেয়েটা স্কুলে যেতে চাইত না। তার বদলে সে সারাদিন কুকুরটাকে নিয়ে ঘরেই থাকত।

এপ্রন পরা মহিলার দেয়া তথ্য অনুযায়ি মেয়েটা আর কুকুরটা নিখোঁজ। কেউ জানে না তারা এখন কোথায়।

আমি ভিড় থেকে সরে এসে হাঁটতে লাগলাম। এক ব্লক দূরে এসে দেখলাম কিছু বাচ্চাকাচ্চা সাইকেল চালিয়ে ক্রাইম সিন দেখতে যাচ্ছে, যেন কোন উৎসব হচ্ছে সেখানে।

***

এক সারি কংক্রিটের সিঁড়ি ব্রিজ থেকে নদীর তীর পর্যন্ত নেমে গিয়েছে, যে জায়গাটা সবুজ ঘাসের সমুদ্রে ঢাকা।

দিনটা সুন্দর ছিল। সিঁড়ির উপর পরিস্কারভাবে আমার ছায়া পড়ছিল। সূর্যের আলোয় সবুজ ঘাসগুলো ঝকমকিয়ে উঠছে, আর বাতাসে সেগুলোর উপর দিয়ে ঢেউ বয়ে যাচ্ছে যেন।

সিঁড়ির শেষে পৌঁছে আমি দেখলাম চারদিকে শুধু ঘাস আর ঘাস, লম্বায় আমার সমান। উপরে তাকালে বিশাল ব্রিজটা দেখা যায়, সাথে মেঘহীন আকাশ।

ঘাস ঠেলে আমি সামনের খোলা জায়গাটায় গেলাম। একটা গোল্ডেন রিট্রিভার চুপচাপ খোলা জায়গাটার মাঝখানে বসে আছে। মেয়েটার কোন চিহ্ন নেই।

কুকুরটা কোথাও বেঁধে রাখা ছিল না। তারপরেও ঘাসের দেয়াল দিয়ে ঘিরে থাকা জায়গাটায় সে মূর্তির মত বসে ছিল। যেন সে জানত কেউ একজন তার খোঁজে কোন এক সময় সেখানে আসবে। কী সুন্দর একটা কুকুর, আমি ভাবলাম। চোখগুলোতে বুদ্ধির ছটা।

আমি ভেবেছিলাম কুকুর আর মেয়েটা, দু-জনকেই সেখানে পাব। কিন্তু আমার অনুমান অর্ধেক সত্যি হলো।

কাছে গিয়ে কুকুরটার মাথায় হাত বোলালাম। কুকুরটাকে ভীত মনে হলো না, আমাকে স্পর্শ করতে দিল।

ওর কলারের সাথে একটা কাগজ গোঁজা ছিল। সেটা বের করে নিলাম।

“যে আমাকে ছুরিটা দিয়েছে তার জন্য,” উপরে লেখা।

মেয়েটা আমাকে একটা চিঠি লিখেছে। সে অনুমান করেছে আমি তাকে খুঁজতে এখানে আসব।

চিঠির কাগজটা একটা নোটবুক থেকে ছেঁড়া, আর পেন্সিল দিয়ে লেখা। সম্ভবত সিঁড়িতে বসে লেখা, ভাঙাচোরা লেখা দেখে তাই মনে হলো।

যদিও লেখা উলোটপালট ছিল কিন্তু তাও আমি মোটামুটি এর অর্থ বুঝতে পারলাম। সে লিখেছে কেন সে কুকুরগুলোকে চুরি করত আর সেগুলোকে ব্রিজের নিচে এনে কি করত। সে লোকটার হিংস্রতার বর্ণনা দিয়েছে আর আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছে ছুরিটা তাকে দেয়ার জন্য। একদম শিশুসুলভ লেখা, কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম সে তার মত করে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে।

শেষে লিখেছে কুকুরটাকে আমি যেন গ্রহণ করি। এটা লিখতে নিশ্চয়ই তার অনেক সময় লেগেছে। অনেকবার লিখে মোছা হয়েছে আবার লেখা হয়েছে। নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট করে লিখেছে। আমার ধারণা ও বুঝতে পেরেছিল কুকুরটাকে ওর সাথে পাওয়া গেলে হয়তো সেটাকে মেরে ফেলা হতে পারে।

আমি চিঠিটা পকেটে রেখে ধৈর্য ধরে বসে থাকা কুকুরটার দিকে তাকালাম। কুকুরটার গলায় শুধু কলার পরানো ছিল, কোন ফিতা ছিল না। কিভাবে এটাকে নিয়ে যাব ভাবছিলাম। নাকি এখানেই ফেলে যাব?

গতকাল দেখেছিলাম মেয়েটা ইশারা করতেই কুকুরটা পিছু পিছু গিয়েছিল, আমিও সেরকম চেষ্টা করলাম। কুকুরটা সুন্দর মত আমার পিছু পিছু আসতে থাকল।

বাড়ি ফেরা পর্যন্ত পুরো রাস্তা কুকুরটা আমার পেছন পেছন হেঁটে এল। আমি ভেবেছিলাম যদি অন্যদিকে যায় তাহলে আর ডাকব না। কিন্তু সে তা করেনি।

বাবা-মা বাসায় ছিল না, কিন্তু সাকুরা টিভির সামনে বসে ওর হোমওয়ার্ক করছিল। কুকুর দেখে ও চমকে গেল। আমি ওকে বললাম এটা এখন থেকে আমাদের কুকুর। সাকুরা চমকে গেলেও তাড়াতাড়ি মানিয়ে নিল। লাশ দেখার চেয়ে কুকুর অনেক ভাল। ও চিন্তা করতে শুরু করে দিল কুকুরটার নাম কি রাখবে। আমি ওকে সেখানেই থামিয়ে দিলাম। ব্রিজের নিচে আমি কুকুরটার প্রাক্তন মনিবকে ওর নাম ধরে ডাকতে শুনেছিলাম। চিঠিতেও নামটা লেখা ছিল। সাকুরাকে বললাম, কুকুরটার নাম ইয়ুকা।

সকালে জানালা দিয়ে মেয়েটার ঘরে কি দেখেছিলাম মনে পড়ল। মেয়েটা তখন লোকটার গলায় কামড় বসাচ্ছিল। প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি কি হচ্ছিল-চিঠিটা পড়ার পর বুঝতে পেরেছি। মেয়েটা অন্য কুকুরগুলোর সাথে ব্রিজের নিচে লড়াই করে নিজেকে প্রস্তুত করছিল ঐ লোকটাকে খুন করার জন্য।

ইয়ুকাকে সাকুরার হাতে ছেড়ে দিয়ে আমি সোফায় বসে চিঠিটা বের করে আবার পড়লাম। পেন্সিলে লেখা চিঠিটা পড়ে বোঝা যাচ্ছিল অন্য অনেক বাচ্চার মত সেও কঠিন সময় পার করছিল। বুঝতে পারছিলাম ও ওর কুকুরের উপাসনা করত।

আগের রাতের কথা মনে পড়ল আমার। লড়াইয়ের আগে মেয়েটা রিট্রিভারটার দিকে তাকাত। জামাকাপড় যাতে নোংরা না হয় সেজন্য সেগুলো আগে খুলে নিত।

মেয়েটা কুকুরের সাথে এমনভাবে কথা বলছিল যেন ঐশী বানী শুনতে পারছিল। চিঠিতেও সে স্পষ্ট লিখেছে যে সে কুকুরটার কথা বুঝতে পারত।

“এই কুকুরটা আমাদের কী করে হলো?” সাকুরা জানতে চাইল।

আমি বললাম কুকুরটা আমার এক বন্ধুর ছিল। কিন্তু ওর সৎ বাবা কুকুর ঘণা করে আর কুকুরটার উপর অত্যাচার করত। তাই বন্ধু আমাকে বলেছে এটার দায়িত্ব নিতে। কথাটা সত্যির থেকে খুব একটা দূরে নয়। চিঠিতে লেখা ছিল মেয়েটার মায়ের বয়ফ্রেন্ড কিভাবে কুকুরটার উপর অত্যাচার করত। যে কারনে সে লোকটাকে খুন করার প্ল্যান করতে বাধ্য হয়।

“কে এরকম একটা সুন্দর কুকুরের উপর অত্যাচার করতে পারে?” সাকুরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল। ইয়কা মাথা ঘুরিয়ে ওর গভীর কালো চোখগুলো দিয়ে সাকুরার দিকে তাকাল। আমি জানি না মেয়েটা যা বলেছে কুকুরটা সম্পর্কে, সেটা আসলেই সত্যি কিনা, কুকুরটা আসলেই এত কিছু জানত কিনা। মেয়েটা হয়তো স্রেফ কুকুরটার চোখে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখত।

আমার সেল ফোন বাজল। মোরিনো ফোন করেছে। আমি ইয়ুকা আর সাকুরাকে রেখে উপরের তলায় গেলাম। মোরিনো আমাকে আমাদের পাশের এলাকায় হওয়া একটা খুনের খবর দিল।

“আমরা সেদিন যে রাস্তা দিয়ে গেলাম না? ওদিকেই হয়েছে খুনটা! মহিলাটা তার বাড়ির দরজার সামনে লোকটাকে পড়ে থাকতে পেয়েছে।”

“আচ্ছা,” আমি বললাম। তারপর লোকটার গলায় কিভাবে দাঁতের দাগ এল, বেডরুম থেকে দরজা পর্যন্ত রক্তের দাগ, আর কিভাবে আরেকজনের এগিয়ে দেয়া ছুরিটা দিয়ে লোকটা খুন হলো সব ওকে ব্যাখ্যা করলাম।

“তুমি এত কিছু জানো কী করে?”

“আমরা সেদিন যে পিচ্চি মেয়েটাকে হেঁটে যেতে দেখেছিলাম সেই আসলে খুনি,” বলে ফোন রেখে দিলাম।

অপরাধিদের কর্মকাণ্ড দেখতে আমার ভালো লাগে। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে। আমি সবসময়ই একজন তৃতীয় পক্ষ, কখনো ঘটনার সাথে নিজেকে জড়াই না। এইবার আমি সেই শর্ত ভঙ্গ করেছি। মেয়েটাকে আর কুকুরটাকে দরজার দিকে দৌড়ে যেতে দেখলাম, পিছু পিছু লোকটাও ছুটে গেল। আমি নিজে কিছু বোঝার আগেই কখন যেন মেয়েটার দিকে ছুরিটা ছুঁড়ে দিলাম।

কাজটা খারাপ করেছি বলে আমার মনে হয় না। ন্যায়-অন্যায় নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। হয়তো আমার মনে হয়েছিল ছুরিটা তার ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছে। ছুরিটা চেয়েছে এই ঘটনার মধ্যে অংশগ্রহণ করতে।

***

কয়েক ঘন্টা পর মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। উড্রান্তের মত ঘোরাঘুরি করছিল। তাকে নিরাপত্তা কাস্টডিতে নেয়া হয়। ওর মুখে আর কাপড়ে রক্ত লেগে ছিল।

মোরিনোর থেকে পাওয়া মেসেজে আমি এই তথ্য জানতে পারলাম। আমার রুম অন্ধকার আর নিস্তব্ধ হয়ে ছিল। আমি কখনোই মিউজিক শুনি না। নিচের তলা থেকে আসা শব্দ থেকে বুঝতে পারছিলাম সাকুরা কুকুরটার সাথে খেলছে।

আমি চোখ বন্ধ করে কল্পনা করতে লাগলাম গ্রীষ্মের কোন গরমের দিনে মেয়েটা আর কুকুরটা ব্রিজের নিচে খেলছে। আর সবুজ লম্বা ঘাসগুলো ওদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *