৪৪. সমুদ্র উদ্যান

সমুদ্র উদ্যান

৪৪. গোয়েন্দা গোলক

আমাদের আরো এক সপ্তাহ লাগবে ক্যালিপসোকে মেরামত করতে-ডিরেক্টর বলেছিলেন। এবং আমাদের ভাগ্য ভালো যে আমরা জাহাজটা খুঁজে পেয়েছি। থ্যালসায় এটা মাত্র একটিই আছে। আমরা আবার এটাকে হারানোর ঝুঁকি নিতে পারিনা।

বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. ভার্লে ভাবছিলেন, এই লক্ষণগুলো আমার চেনা। এমনকি পৃথিবীর শেষ দিনগুলোতেও কিছু গবেষগুগারের পরিচালকরা তাদের সুন্দর যন্ত্রপাতি ঠিক কাজে ব্যবহার না করে সযত্নে রেখে দিতে চাইতেন।

–যতক্ষণ ক্র্যাকান অথবা ক্র্যাকানের বাচ্চা গোলমাল না করছে ততক্ষণ তো কোন সমস্যা নেই। এবং ভূতাত্ত্বিকেরা তো বলেছেনই যে আগামী পঞ্চাশ বছরে তার আর কোন সম্ভাবনা নেই।

-সে ব্যাপারে আমি তাদের সঙ্গে বাজী ধরতে রাজি আছি। কিন্তু আপনি এটাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন কেন? কি সংকীর্ণ চিন্তা, ভার্লে ভাবল। যদিও সে, সমুদ্রপদার্থবিদ কিন্তু তারপরেও তো সামুদ্রিক প্রাণী সম্বন্ধে তার নূন্যতম আগ্রহ আশা করা যায়। তবে হয়তোবা আমি তাকে ভুল বুঝেছি। সে হয়তো কিছু বলতে চাইছে…

-কাঁকড়াগুলো আকর্ষণীয়। বহির্বিশ্বের যে কোন বুদ্ধিমত্তাই একদিন খুব গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে দেখা দিতে পারে। এবং আপনাদের জন্য সেটা আরো বেশী–কারণ ঘটনাটা আপনাদের দরজার সামনেই।

-আমি সেটা মানি। কিন্তু ভাগ্য ভালো যে আমরা দুই পরিবেশে আছি।

কিন্তু কত দিন? বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ভাবলেন। যদি মোজেস ক্যালডর ঠিক হয়…

-আমাকে একটু বলুনতো গোয়েন্দা গোলকটা কি জিনিস? একটা বেশ ষড়যন্ত্রের গন্ধ দিচ্ছে।

হাজার বছর আগে প্রতিরক্ষা এবং গোয়েন্দা বিভাগগুলো এটা বানিয়েছিল। কিন্তু এর আরো অনেক ব্যবহার আছে। কিছু আছে পিনের মাথার মতো আবার কিছু ফুটবলের মতো বড়। ভার্লে নকশাটা পরিচালকের টেবিলে বিছিয়ে দিলো। এটা হচ্ছে পানির নিচে ব্যবহারের জন্য বিশেষভাবে তৈরী। আমি অবাক হচ্ছি আপনি এটা সম্বন্ধে জানেন না দেখে। কারণ এর আবিষ্কারের সময়কাল দেয়া আছে ২০৪৫। আমরা প্রকৌশল স্মৃতিতে পুরোটা খুঁজে পেয়েছি এবং তৈরী করেছি। প্রথমটা কাজ করেনি। কেন তা আমরা এখনও জানি না। তবে দ্বিতীয়টা খুব ভালো কাজ করেছে।

এখানে আছে একটা শব্দ উৎপাদনকারী যন্ত্র, দশ মেগাহার্টজের সুতরাং আমরা মিলিমিটার পর্যন্ত বিবর্ধন পাব। ভিডিও মানসম্পন্ন না হলেও কাজের জন্য যথেষ্ঠ। সংকেত পাঠাবার জিনিসটা বেশ ভালো। যখন গোয়েন্দা গোলক চালু হবে এটা একটা সংকেত পাঠাবে যা বিশ থেকে ত্রিশ মিটারের মধ্যকার সব জিনিসের একটা শব্দের প্রতিচ্ছবি তৈরী করবে। দুইশ কিলোহার্টজের একটা তরঙ্গ এর সংকেত উপরে বয়ার কাছে পাঠাবে। সেটা আবার তা মূল কেন্দ্রে পাঠাবে। প্রথম ছবিটা পেতে দশ সেকেন্ডের মতো লাগবে। তারপর গোয়েন্দা গোলক আবার সংকেত পাঠাবে। যদি ছবিতে কোন পরিবর্তন না হয় এটা শূন্য সংকেত দেবে। কিন্তু কোন পরিবর্তন হলে নতুন ছবির জন্য এটা আবার সংকেত পাঠাবে। তার মানে আমরা প্রতি দশ সেকেন্ডে একটা ছবি পাচ্ছি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটা যথেষ্ঠ। যদি আবোরা দ্রুত ঘটনা ঘটতে থাকে তাহলে প্রতিচ্ছবিটা খারাপ হয়ে যাবে। তবে সবকিছুই একসঙ্গে আপনি চাইতে পারেন না। এটা যে কোন জায়গায় কাজ করে। অন্ধকারে এটা খুঁজে পাওয়াও কষ্টকর। আর খরচও বেশ কম।

পরিচালক যতটাই আগ্রহী লুকিয়ে রাখতেও সে ততটাই চেষ্টা করছে।

-বেশ চালাক খেলনা, হয়তোবা কাজ দেবে। আপনারা কি এর কয়েকটা দেবেন?

-হ্যাঁ অবশ্যই। আপনাদের রেপ্লিকেটারে যাতে আপনারা বানাতে পারেন, সেজন্যে আমরা দেখিয়ে দেবো। তবে প্রথম কয়েকটা আমরা কাঁকড়াদের বাসায় ফেলবো। এবং তারপর অপেক্ষা করবো কি ঘটে তা দেখার জন্যে।

৪৫. টোপ

ছবিগুলো ছিল ভাঙ্গা ভাঙ্গা। ভালোভাবে দেখার জন্যে কৃত্রিমভাবে রং দিয়েও মাঝেমাঝে বোঝা যাচ্ছিল না। সমুদ্রের তলদেশের ৩৬০ ডিগ্রী সমতল ভূমি চোখে পড়ছে। দূরে বামে কিছু সামুদ্রিক গুল, মাঝে কিছু পাথর। ডানেও গুল্ম। যদিও ছবিটা স্থির ছবির মতোই কিন্তু বামদিকের নীচে নম্বরের পরিবর্তন সময়ের পরিবর্তন বোঝাচ্ছিল। আর হঠাৎ ছবিটা ঝাঁকি দিয়ে পরিবর্তিত হচ্ছিল যখন কিছু নড়ে যাচ্ছিল। টেরা নোভার মিলনায়তনে আমন্ত্রিত অতিথিদের ড, ভার্লে বলেছিলেন,

–আপনারা দেখছেন কোন কাঁকড়া এখানে ছিল না। কিন্তু তারা আমাদের জিনিস ফেলাটা বুঝেছিল বা শুনেছিল। এক মিনিট বিশ সেকেন্ড পর প্রথম পরিদর্শক এসেছিল।

এখন ছবিটা দশ সেকেন্ড অন্তর অন্তর বদলাচ্ছে এবং প্রতি ছবিতে কাঁকড়ার সংখ্যা বাড়ছে। আমি এই ছবিটা ধরে রাখছি, যাতে আপনারা ভালো বুঝতে পারেন। ডান দিকের কাঁকড়াটা দেখেছেন? এর বাম দাঁড়ার দিকে দেখুন। প্রায় পাঁচটা ধাতুর রিং! এবং মনে হচ্ছে এই হচ্ছে কর্তৃস্থানীয়। পরের ছবিটায় দেখুন অন্য কাঁকড়াগুলো এর জন্য রাস্তা ছেড়ে দিচ্ছে–এখন সে রহস্যময় বস্তুটাকে পরীক্ষা করছে–এটা বেশ ভালো ছবি দেখুন সে কিভাবে দাঁড়া এবং মুখের আঙ্গুলগুলো ব্যবহার করছে–একটা শক্তির জন্য, অন্যটা সূক্ষ্মতার জন্য–এখন সে জিনিসটা টানছে-কিন্তু আমাদের উপহারটা তার জন্য বেশ ভারী–এর আচরণটা দেখুন–কসম করে বলছি এটা নির্দেশ দিচ্ছে, যদিও কোন সিগনাল আমরা পাইনি হয়তোবা তা শব্দ সীমার নীচে এখন আসছে আরেকটা বড়সড়

ছবিটা হঠাৎ কাত হয়ে গেল।

–এখন দেখুন তারা টেনে নিয়ে যাচ্ছে জিনিসটা এবং ড. ক্যালডর আপনিই ঠিক-তারা পাথরের পিরামিডের গর্তের দিকে এগুচ্ছে-কিন্তু জিনিসটা ভেতরে নিয়ে যাবার জন্য বেশ বড়, অবশ্য ইচ্ছেকৃতভাবেই এটা করা এবং এটা হচ্ছে আকর্ষণীয় একটা অংশ। কাকড়াদের বেশ ভালোই চিন্তা করতে হয়েছে। যদিও এটা মূলত আবর্জনার তৈরী, কিন্তু সেটা সুচিন্তিতভাবেই বাছাই করা। এখানে আছে স্টীলের, তামার, এলুমিনিয়ামের এবং সীসার পাত, কাঠের টুকরো, প্লস্টিকের পাত এবং টিউব, লোহার চেইনের অংশ, একটা ধাতব আয়না। পুরো স্তূপটার ওজন প্রায় একশ কেজি এবং এমনভাবে সাজানো যাতে কেবল একত্রেই পুরোটা নাড়ানো যায়। গোয়েন্দা গোলকটা এক কোণায় যত্নের সঙ্গে আটকে রাখা হয়েছে চারটা ছোট আলাদা চেইনের সঙ্গে। এবার দুটো বড় কাকড়া আবর্জনার স্তূপটাকে আক্রমণ করছে। বেশ দৃঢ়সংকল্প এবং বলা যায় সুচিন্তিতভাবেই। তাদের শক্তিশালী দাঁড়া পেচাননা তারগুলোকে ছিঁড়ে ফেলল। এবং তারা কাঠের আর প্লাস্টিকের টুকরোগুলোকেও সরিয়ে ফেলল। বোঝাই যাচ্ছে তারা শুধু ধাতুতে আগ্রহী। আয়নাটা তাদের থমকে দিল। তারা এটাকে তুলে নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখছে।

আমরা আশা করেছিলাম তারা আক্রমণ করবে। মাছেদের চৌবাচ্চায় আয়না দিলে বেশ ভালো যুদ্ধ শুরু হয়। সম্ভবতঃ তারা তাদের চিনেছে। এটা বুদ্ধিমত্তার বেশ ভালো চিহ্ন।

কাকড়াগুলো আয়না ফেলে বাকি আবর্জনা সমুদ্র সমতলে বিছাতে আরম্ভ করল। এর পরের ছবিগুলো হতাশাজনকভাবে ধোয়াটে। যখন আবার ছবি আসল তখন ছবিটা পুরো ভিন্ন।

আমাদের ভাগ্য ভালো যে আমরা যেভাবে চেয়েছি ঠিক সেভাবে হয়েছে। তারা গোয়েন্দা-গোলকটাকে রক্ষী প্রহরারত গর্তের দিকে টেনে নিচ্ছে। তবে এটা তাদের রানীর ঘর নয়- রানী আছে কিনা আদৌ সেটাই বেশ তর্কের ব্যাপার…

দর্শকরা অদ্ভুত দৃশ্য থেকে বেশ কিছুক্ষণ থমকে রইল। তারপর কেউ একজন বলল, এটা একটা ভাগাড়।

-কিন্তু কোন একটা উদ্দেশ্য আছে…

-দেখ, ওটা একটা দশ কিলোওয়াটের মোটর –কেউ নিশ্চয়ই ফেলে দিয়েছে।

-আচ্ছা এখন বুঝলাম কারা আমাদের নোঙরের শেকল চুরি করে।

-কিন্তু কোন কিছুই তো বুঝতে পারছি না।

-কিছু একটা তো ব্যাপার আছেই।

মোজেস ক্যালডর দৃষ্টি আকর্ষণকারী গলা খাকরানী দিলেন–যেটা অবশ্য প্রায়ই ব্যর্থ হয়।

-এটা একটা তত্ত্ব মাত্র। তবে দেখা যাচ্ছে নতুন তথ্যগুলো একেই সমর্থন করছে। আপনারা লক্ষ্য করুণ এখানে সবই ধাতু, সতর্কতার সঙ্গে বিভিন্ন জায়গা থেকে জড়ো করা।

এখন একটা বুদ্ধিমান সামুদ্রিক প্রাণীর কাছে ধাতু হলো রহস্যময় একটা জিনিস। সমুদ্রের অন্যান্য যে কোন জিনিস থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। দেখা যাচ্ছে তারা প্রস্তর যুগেই রয়ে গেছে এবং আমাদের পৃথিবীর স্থলচর প্রাণীদের মতো তারা সেখান থেকে এগুতে পারছে না। জলের ভিতর আগুন ছাড়া তারা একটা প্রাযুক্তিক কানা গলিতে পরে গেছে। আমার মনে হয় আমরা এখানে বহু আগের পৃথিবীরই পুরোনো একটা ঘটনা দেখতে পাচ্ছি। আপনারা কি জানেন আদিম মানুষ কোথায় তার প্রথম লোহা পেয়েছিল? আকাশ থেকে! আপনাদের আশ্চর্য হওয়াতে আমি অবাক হচ্ছি না। কিন্তু খাঁটি লোহা প্রকৃতিতে কখনো পাওয়া যায় না। খুব শিগগিরই মরিচা পড়ে যায়। প্রাচীন মানুষের এক মাত্র উৎস ছিল উল্কা। কোন অবাক ব্যাপার নয় যে সেগুলোর উপাসনা হতো। আশ্চর্যের নয় যে আমাদের পূর্বপুরুষরা আকাশের বাইরে দেবতায় বিশ্বাস করত। এখানেও কি সেই একই প্রক্রিয়া চলছে? আমি আপনাদের ব্যাপারটা সতর্কতার সঙ্গে ভাবতে বলি। আমরা এখনও জানিনা কাঁকড়াগুলো কি পরিমান বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী। এমনও হতে পারে তারা কেবল তাদের–কি বলব যাদুকরী সম্পদের লোভে ধাতু যোগাড় করে। কিন্তু তারা কি আবিষ্কার করতে পারবে কিভাবে এগুলো প্রদর্শনীর চাইতেও বেশী কাজ করতে পারে। তারা কতদূর এগুতে পারবে? তারা ঠিক ওখানেই বসে থাকবে সবসময়?

বন্ধুরা, আমার মনে হয় আপনাদের কাঁকড়া সম্বন্ধে যতটুকু জানা যায় জেনে রাখা ভালো। এমনও হতে পারে আপনারা আরেকটি বুদ্ধিমান প্রাণীর সঙ্গে এই গ্রহটি ভোগ করছেন।

আপনারা কি শান্তি অথবা যুদ্ধ বেছে নেবেন? এমনকি কাঁকড়াগুলো যদি খুব বুদ্ধিমান নাও হয় তাহলেও হতে পারে মারাত্মক হুমকি অথবা কার্যকর যন্ত্র। হয়তো আপনারা এর চাষ করবেন। আপনারা রেফারেন্সের জন্য কার্গো বিশ্বাস-এ দেখতে পারেন।

এই গল্পের পরবর্তী অধ্যায় জানতে পারলে আমি খুশি হতাম। সেখানে কি কাঁকড়া দার্শনিক আছে?

এমনকি এখন গুল্মের জঙ্গলে বসে তারা আমাদের সম্পর্কে কি করতে চাচ্ছে? সুতরাং দয়া করে ডিপ-স্পেস এন্টেনাটা ঠিক করবেন। ম্যাগেলানের কম্পিউটার আপনাদের তথ্যের জন্যে অপেক্ষা করবে যাতে সাগান-২ এ আমরা দেখতে পাই।

৪৬. ঈশ্বর যেখানেই থাক…

–ঈশ্বর কি? মিরিসা জিজ্ঞেস করল।

ক্যালডর শতাব্দীর প্রাচীন প্রদর্শনী থেকে ফিরে তাকাল।

–এহ হে, তুমি আবার এটা জিজ্ঞেস করছ কেন?

-কারণ লোরেন গতকাল বলছিল, “মমাজেস চিন্তা করছে কাঁকড়াগুলো ঈশ্বর খুঁজছে।”

-সে তাই বলেছে? আমি তার সঙ্গে কথা বলব পরে। এবং দ্র মহিলা তুমি আমাকে যা জিজ্ঞেস করেছ, তা মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে হাজার বছর ধরে আছন্ন করে রেখেছে এবং মানব ইতিহাসে যে কোন বিষয়ের চাইতে বেশী কথা লেখা হয়েছে। এই সকালে তোমার হাতে কতটুকু সময় আছে?

মিরিসা হাসল-অন্ততঃ এক ঘন্টা। তুমি একবার বলেছিলে যে কোন গুরুত্বপূর্ণ জিনিস একটি মাত্র বাক্যে বলা যায়।

–উমম্ হ্যাঁ। আমি বেশ বড়, প্যাচালো কিছু বাক্য জানি। এখন কোত্থেকে শুরু করি…

সে তার চোখ দুটো লাইব্রেরীর জানালা দিয়ে বাইরের প্রথম অবতরণের নিস্তব্ধতার দিকে মেলে দিল।

এখানে এই গ্রহের মানব জীবন শুরু হয়েছিল, এটাকে সে জন্যই আমার ইডেনের মতো লাগে। আর আমি কি সেই সাপ, যা এর সরলতা ভাঙ্গতে চলেছি?

কিন্তু মিরিসার মতো বুদ্ধিমান মেয়েকে তো আমি এমন কিছু বলিনি যা সে জানে বা অন্ততঃ আন্দাজ করে না। সে আস্তে আস্তে শুরু করল,

…ঈশ্বর শব্দটার সমস্যা হচ্ছে যে, এটা কখনোই দু’জন মানুষের কাছে এক অর্থ প্রকাশ করে না, অন্ততঃ দার্শনিকদের কাছে তো নয়ই। সেজন্য তৃতীয় সহস্রাব্দে কথাটা উঠেই যাচ্ছিল, কেবল হঠাৎ ব্যাথার প্রকাশ ভঙ্গি ছাড়া। কোন কোন সমাজে এটাকেও অসংস্কৃত হিসেবে ধরা হতো। তার বদলে এটা কিছু বিশেষ শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়ে গেল। এটায় লাভ হলো যে মানুষের এটাকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়াটা আগের মতো রইল না। ব্যক্তিগত ঈশ্বর যাকে কখনও এক ঈশ্বর বলে ডাকা হতে পরিণত হল আলফায়। এটা হচ্ছে একটা কল্পিত জিনিস যা প্রতিদিন প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি প্রাণীর উপর নজর রাখে। এবং ভাললাদের পুরস্কৃত এবং মন্দদের শাস্তি দেন, সাধারণত মিথ্যেমিথ্যি বর্ণিত মৃত্যুর পরের এক জীবনে। তুমি পূজা বা উপাসনা কর আলফার, বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন কর, বিশাল মন্দির, মসজিদ তৈরী কর এর সম্মানে…

আরেক দলের ঈশ্বর ছিলেন, যিনি এই মহাবিশ্ব তৈরী করেছিলেন কিন্তু তারপর হয়তো কিছু করেছেন অথবা কিছু করেননি এই মহাবিশ্ব নিয়ে। ইনি হচ্ছেন ওমেগা।

ঈশ্বরের ব্যবচ্ছেদ করতে দার্শনিকরা গ্রীক বর্ণমালার বিশটা বা তারও বেশী বর্ণ ব্যবহার করেছিলেন। তবে আলফা আর ওমেগাই মনে হয় আজকের জন্য যথেষ্ঠ। আমার মনে হয় না দশ মিলিয়ন মানুষের বেশী এর সম্বন্ধে আলোচনা করেছে।

আলফা ধর্মের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিল–সে জন্যই পরে সেটা ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ে। এটা অবশ্য পৃথিবী ধ্বংসের শেষ পর্যন্ত ভালোভাবেই টিকে থাকতো যদি বিভিন্ন প্রতিযোগী ধর্মানুসারীরা পরস্পরকে ছেড়ে দিত। কিন্তু তারা সেটা পারেনি। কারণ প্রত্যেকেই দাবী করত তারাই একমাত্র সত্যকে ধারণ করে আছে। যার ফলে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ধর্মকে ধ্বংস করতে হবে। যার মানে হল শুধু অন্য ধর্মই নয় বরং নিজেদের মধ্যে উপদলগুলোকেও।

অবশ্য এটা একদম সরলীকৃত। ভালো মানুষও ছিল, যারা পরস্পরের প্রতি সহনশীল এবং বিশ্বাস বিনিময়ে বিশ্বাসী। এবং প্রাথমিক মানব সমাজে ধর্মের প্রয়োজনটা হয়তো অত্যাবশকীয় ছিল। অতিপ্রাকৃতিক বন্ধন ছাড়া হয়তো মানুষ কখনোই গোষ্ঠীসত্ত্বার ওপরে উঠতে পারত না। এবং ক্ষমতা আর সুবিধা দিয়ে নষ্ট হবার আগে এটা সমাজের বিরুদ্ধে যায়নি। কিন্তু এর অনেক ভাললাদিকই ঢেকে গেল বড় খারাপ দিকগুলো দিয়ে। তুমি নিশ্চয়ই কখনো শোননি রোমের-ধর্ম বিচার সভা, ডাইনী-হত্যা অথবা ক্রুসেড আর জিহাদের নাম। তুমি কি বিশ্বাস করবে, এমনকি মহাকাশ যুগেও এমন জাতি ছিল যেখানে বাবা-মা রাষ্ট্রিয় আলফার অনুসারী না হওয়ায় তাদের সন্তানদের সরকারীভাবে উৎসর্গ করা হতো। তুমি আহত হয়েছ, কিন্তু এরকম এবং এর চাইতেও জঘন্য ঘটনা ঘটেছে–যখন আমাদের পূর্ব পুরুষরা মাত্র সৌর জগতে পা ফেলছিল। তবে মানবজাতির সৌভাগ্য যে আলফা ২০০০ এর প্রথম দিকে ম্লান হয়ে আসছিল। এটা অবশ্য শেষ হয়ে গিয়েছিল সংখ্যাতাত্ত্বিক ধর্মতত্ত্বের দ্রুত বিকাশের ফলে। আর কতক্ষণ আছে? বুবি কি অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেনি?

মিরিসা জানালা দিয়ে এক ঝলক তাকাল। ঘোড়াটা শান্তভাবে ঘাস খাচ্ছে।

-যতক্ষণ খাবার আছে ততক্ষণ এটা ঠিক আছে। সংখ্যাতাত্ত্বিক ধর্মতত্ত্বটা কি জিনিস?

-শয়তান ব্যাপারে এটাই শেষ আঘাত–যেটা একটা অস্বাভাবিক গোষ্ঠির জন্ম। দিয়েছিল। তারা নিজেদের বলত নব্য ক্ষ্যাপা, কেন বলতো সেটা জিজ্ঞেস করো না। এটা প্রায় ২০৫০ সালে। এবং ঘটনাক্রমে এটাই প্রথম মহাকাশ নির্ভর ধর্ম। যদিও অন্যান্য ধর্মও কৃত্রিম উপগ্রহ দিয়ে ধর্ম প্রচার চালাত কিন্তু এরা কেবলই উপগ্রহ নির্ভর ছিল।

টেলিভিশনের পর্দা ছাড়া তারা আর কোথাও মিলিত হতো না।

তবে প্রযুক্তি ছাড়া বাকীটা ছিল বহু পুরোনো ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা। তারাও বিশ্বাস করত আলফা আছে, কিন্তু সে সম্পূর্ণ অশুভ। এবং মানবজাতির চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে এর মুখোমুখি হয়ে একে ধ্বংস করা। তারা তাদের বিশ্বাসের স্বপক্ষে ইতিহাস। এবং জীববিদ্যা ঘেটে অসংখ্য প্রমাণ জোগাড় করত। আমার ধারণা তারা ছিল অসুস্থ–কারণ তার ঐ সব ভয়ংকর তথ্য জোগাড় করতে মজা পেত।

যেমন ধরো আলফার অস্তিত্বের এক প্রিয় প্রমাণ ছিল ‘পরিকল্পনার যুক্তি। আমরা এখন জানি যে পুরোটাই ফালতু, কিন্তু তারা এটাকে বেশ বিশ্বাসযোগ্য করে বলত। যদি তুমি একটা সুন্দর পরিকল্পনার ব্যবস্থা পাও, যেমন ডিজিটাল ঘড়ি তখন। তার পেছনে অবশ্যই একজন পরিকল্পনাকারী থাকবে, একজন সৃষ্টিশীল লোক থাকবে এর পেছনে। এখন তুমি তাকাও প্রকৃতির রাজ্যে–এবং তারা সেভাবেই দেখতো, অবশ্য এটা প্রতিহিংসার ভাব নিয়ে। পরজীবিবিদ্যা ছিল তাদের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা-অবশ্য তোমরা জানই না যে, তোমরা থ্যালসানরা কতটা ভাগ্যবান। আমি অবশ্য তোমাকে সেই অসাধারণ সব পদ্ধতি যা দিয়ে বহু প্রাণী অন্য প্রাণীর ভেতরে বিশেষত মানুষের মধ্যে বাস করত, শোষণ করত ধ্বংশ হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তা বলে বিরক্ত করব না। শুধু তোমাকে তাদের একটা প্রিয় পোষ্য ইফনিউমোন মাছি সম্বন্ধে বলি।

এই চমৎকার পোকাটি অন্য পোকাদের অবশ করে তাদের ওপর ডিম পাড়ত যাতে তার ছানারা বেরিয়েই একদম তাজা, জ্যান্ত খাবার পায়।

তারা এভারে ঘন্টার পর ঘন্টা চালাতে পারত। প্রকৃতির বৈচিত্র্যকে আলফার প্রমাণ হিসেবে দেখিয়ে চূড়ান্ত অশুভ শক্তি হিসেবে দেখানো। যদি তাই নাই হবে, মানুষে মানুষে এতো পার্থক্য হল কিভাবে। আর একটা তাদের প্রিয় প্রমাণ ছিল, ধ্বংসের প্রমাণ। একটা পরিচিত উদাহরণ যা বহুবার হয়েছে, আলফার জন্য সমবেত প্রার্থনারত মানুষ বিপদের সময় বহুবার ভবন ধ্বসে মারা গেছে অথচ ঘরে বসে থাকা মানুষ রক্ষা পেয়েছে।

এরা প্রচুর ভয়ংকর ঘটনা সংগ্রহ করেছিল, হাসপাতাল, বৃদ্ধাশ্রম পুড়ে যাওয়া, ভূমিকম্পে শিশুদের স্কুল তলিয়ে যাওয়া, অগ্ন্যুৎপাত বা প্লাবনে শহর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার বিশাল সে তালিকা। অবশ্যই আলফার লোকজনও বসে ছিলনা। তারা সমান সংখ্যক উদাহরণ বিপরীতে সংগ্রহ করেছিল। বিশ্বাসীদের বাঁচাতে যে চমৎকার সব ঘটনা ঘটেছে তার তালিকা।

এভাবে বহু হাজার বছর এটা চলছিল। কিন্তু ২১ শতাব্দীতেই, নতুন তথ্য প্রযুক্তি এবং সংখ্যা তাত্ত্বিক গবেষণা আর বিস্তৃত অনুমানতত্ত্ব ব্যাপারটার ফয়সালা করে।

কয়েক দশক লেগেছিল উত্তরটা আসতে এবং আরও কয়েক দশক সব বুদ্ধিমান মানুষের স্বীকার করতে যে খারাপ জিনিস ভালো জিনিসের মতোই আসে। অনেক আগে থেকেই যা সন্দেহ করা হচ্ছিল, তাই সত্যি- মহাবিশ্বও সহজভাবে গানিতিক সম্ভাবনাকে মেনে চলে। আসলেই সেখানে কোন অতিপ্রাকৃত শক্তির অস্তিত্ব নেই না ভালো না মন্দ। তাই অশুভ শক্তির ব্যাপারটা আর রইল না। মহাবিশ্বকে দয়ালু ভাবার মানেটা হচ্ছে ভাগ্য নির্ভর একটা খেলার প্রতিটিতে জেতা।

অবশ্য তারপরও কোন কোন ধর্মগোষ্ঠী তাদের আলফাঁকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল। তারা উচ্চ কণ্ঠে বলত আলফার ধর্ম অভিন্ন এবং একটা ঘন্টার মতো রূপক তাদের বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে দেখাত। বলাই বাহুল্য এতো বিমূর্ত জিনিস খুব বেশী উৎসাহ আনেনা। গণিতের আরেকটা জিনিস আলফাঁকে আঘাত করেছিল। একজন প্রতিভাবান তেরান, কূট গোডলে প্রমাণ করে যে জ্ঞানের মৌলিক কিছু সীমাবদ্ধতা থাকবেই। তাই সর্বজ্ঞানী সত্ত্বা যা কিনা আলফার একটা সংজ্ঞা যুক্তিসম্মত নয়।

শেষ সহস্রাব্দের মাঝে আলফা মানুষের মন দিয়ে প্রায় মুছেই গেল। সব চিন্তাশীল মানুষই মহান দার্শনিক লিওক্রিস্টাসের কঠিন মন্তব্যের সঙ্গে একমত হলেন, সমস্ত ধর্মই আসলে অনৈতিক, কারণ অলৌকিক বিশ্বাস ভালোর চাইতে খারাপটাই বেশী ছড়িয়েছে। যদিও কিছু পুরোনো বিশ্বাস টিকে ছিল একদম শেষ পর্যন্ত, তবে পুরোটাই পাল্টে গিয়ে। শেষ দিকে মর্মন এবং নবীর মেয়েরা নিজেরাই বীজবহনকারী মহাকাশযান বানিয়েছিল। আমার জানতে ইচ্ছে হয়, সেগুলোর কি অবস্থা।

আলফা মুছে গেলে, টিকে ছিল ওমেগা, সব কিছুর স্রষ্টা। একে মোছা সহজ ছিল, এবং মহাবিশ্ব কিছুটা প্রমাণ দিত। দিত কি? একটা পুরোনো দার্শনিক কৌতুক বলি– যেটা আসলে বেশ সূক্ষ্ম। প্রশ্ন মহাবিশ্ব এখানে কেন? উত্তর, আর কোথায় এটা থাকতো? আমার মনে হয় এক সকালে এই যথেষ্ঠ।–ধন্যবাদ মোজেস, মিরিসা বলল। তাকে সামান্য বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। তুমি এগুলোর সবই আমাকে বলেছ। নয় কি?

-অবশ্যই বহু বার। এবং প্রতিজ্ঞা করো।

-কি?

-আমি যা বলেছি তার একফোঁটাও বিশ্বাস করোনা। কোন জটিল দার্শনিক সমস্যার কখনোই সমাধান হয় না। ওমেগা তো এখনও টিকে আছে। আর মাঝে মাঝে আমি অবাক হয়ে ভাবি আলফা…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *