২১. ক্র্যাকান

ক্র্যাকান

২১. একাডেমী

থ্যালসার একাডেমীর সদস্যপদ অত্যন্ত কঠোর ভাবে একটা সুন্দর বাইনারী নম্বর ১০০০০০০০০-বা আঙ্গুলে গুনলে ২৫৬-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। ম্যাগেলানের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এই কড়াকড়িটাকে সমর্থন করেন। এটা মান বজায় রাখতে সাহায্য করে। একাডেমী তাদের দায়িত্বটাকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নেয়। এবং প্রেসিডেন্ট তার কাছে স্বীকার করলেন যে এই মুহূর্তে মাত্র ২৪১ জন সদস্য আছে এবং শূন্য স্থানগুলোর জন্য উপযুক্ত যোগ্যতা সম্পন্ন লোক পাওয়া যায়নি।

২৪১ জনের মধ্যে ১০৫ জনের মতো সশরীরে মিলনায়তনে উপস্থিত আছেন আর ১১৬ জন তাদের যোগাযোগের যন্ত্রের সাহায্যে সংযোগে আছেন। এটা একটা রেকর্ড উপস্থিতি –ড, অ্যানি ভার্লে খুব পুলকিত হচ্ছিলেন। যদিও বাকি বিশ জনের অনুপুস্থিতির ব্যাপারে তার কৌতূহল ছিল।

আর পৃথিবীর একজন অন্যতম জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত হতেও তার সামান্য অস্বস্তি লাগছিল যদিও ম্যাগেলানের পৃথিবী ত্যাগের পর কথাটা সত্যিই। প্রাক্তন স্কলোডস্কি লুনার মানমন্দিরের, প্রাক্তন পরিচালক হিসেবে কেবলমাত্র সময় ও সুযোগের কারণেই সে এরকম একটা সুযোগ পেয়েছে। সে খুব ভালো ভাবেই জানে সে আর্কলে বা চন্দ্রশেখর বা হার্শেলের মতো বিশালদের সঙ্গে তুলনা করার মতোই যযাগ্য নয় –গ্যালিলিও, কোপার্নিকাস বা টলেমীর কথাতো বাদই।

ম্যাপটা দেখুন, সে আরম্ভ করল। আমি নিশ্চিত যে, আপনারা সবাই সাগান-২ এর এই ম্যাপটা দেখেছেন। বেতার হলোগ্রাম আর বিকিরণ থেকে এপর্যন্ত করা গেছে। বিস্তারিত কিছুই নেই-বড়জোড় দশ কিলোমিটার পার্থক্য করা যায়। তবে আমাদের মূল তথ্যের জন্য এটাই যথেষ্ঠ।

এর ব্যাস হচ্ছে পনেরোশো কিলোমিটার–পৃথিবীর চেয়ে সামান্য বড়। নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ অত্যন্ত ঘন আবহাওয়ামন্ডল। এবং সৌভাগ্যই বলতে হবে যে। কোন অক্সিজেন নেই।

“সৌভাগ্য” কথাটা সব সময়ই মনোযোগ আকর্ষণ করে। শ্রোতারা একটু নড়ে চড়ে বসলেন।

আমি বুঝতে পারছি, আপনারা অবাক হয়েছেন। শ্বাস নেবার ব্যাপারে প্রতিটি মানুষেরই একটা পক্ষপাতিত্ব আছে। কিন্তু ধ্বংসের আগের দশকগুলোতে মহাবিশ্বের। প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক ঘটনার কারণেই বদলে গিয়েছে।

বর্তমান এবং অতীতে যেহেতু কোন জীবিত প্রাণীর খোঁজ আমাদের সৌরজগতে পাওয়া যায়নি এবং ষোলটি দেশের “সেটি” (SETI) প্রোগ্রামের ব্যর্থতা প্রত্যেককে মানতে বাধ্য করল যে, মহাবিশ্বের অন্য কোথাও জীবন থাকার সম্ভাবনা খুবই কম, আর তাই জীবন অত্যন্ত মূল্যবান।

তাই বলা হলো যে, সব ধরনের জীবনকেই সম্মান করতে হবে এবং তাদের যত্ন নিতে হবে। অনেকে এমনও বললেন যে, ক্ষতিকর পরজীবি এবং অসুখের পোষকগুলোও ধ্বংস করা ঠিক না বরং তাদের কঠিন সতর্কতার মধ্যে রেখে দেয়া উচিত। “জীবনের প্রতি সম্মান শ্লোগানটি শেষের দিকে পৃথিবীতে একটা জনপ্রিয় শ্লোগান ছিল। এবং অনেকে বিশেষতঃ মানুষের ক্ষেত্রে এটা প্রয়োগ করতেন।

জীবনের প্রতি হস্তক্ষেপ না করার ব্যাপারটি যখন একটি নীতিতে পরিণত হল, তখনই কিছু বাস্তব ঘটনার জন্ম হলো। সিদ্ধান্ত হলো, মানুষ কোন বুদ্ধিমান জগতে বসতি স্থাপন করবে না। নিজস্ব পৃথিবীতেই মানুষের অত্যন্ত খারাপ ইতিহাস আছে। সৌভাগ্যবশতই হোক আর দুর্ভাগ্যবশতই হোক সে অবস্থা অবশ্য আর হচ্ছে না।

কিন্তু তর্কটা এখানেই থামল না। ধরা যাক, মাত্র প্রাণীজগৎ হয়েছে, এমন একটা গ্রহ আমরা পেলাম। আমরা কি বিবর্তনকে তার নিজস্ব পথে এগুতে দেবো, যাতে বহুবছর পরে যদি বুদ্ধিমান জীব জন্মায়, সেই আশায়।

কিংবা আরও পেছনে যাই যেখানে কেবল উদ্ভিদ জগৎ বা শুধু আণুবীক্ষনিক জীব আছে। আপনাদের হয়তো অবাক লাগছে যে, যখন মানুষের নিজের জীবনই বিপন্ন তখনও মানুষ এধরণের বিমূর্ত আদর্শ আর দার্শনিক প্রশ্ন নিয়ে তর্ক করছিল। কিন্তু মৃত্যুই মনকে সত্যিকারের সব প্রশ্নের দিকে একত্রীভূত করে আমরা কেন এখানে আছি এবং আমাদের কি করা উচিত?

“সর্বোচ্চ আইন” আমার ধারণা আপনারা সবাই শব্দটা শুনেছেন –খুব জনপ্রিয় শব্দ ছিল। সমস্ত বুদ্ধিমান প্রাণীর জন্য কোন নৈতিক নির্দেশনা তৈরী করা সম্ভব, শুধুমাত্র পৃথিবী গ্রহে রাজত্ব করা দ্বিপদ, বায়ু গ্রহণকারী প্রাণীর জন্য যা প্রযোজ্য হবে না। ঘটনাক্রমে, ড. ক্যালডর ছিলেন এই বিতর্কের একজন নেতা। যারা ভাবত “হোমোস্যাপিয়েন” একমাত্র বুদ্ধিমান জীব হিসেবে গণ্য থাকায় তাদের বেঁচে থাকাটাই সবকিছুর ওপর প্রাধান্য পাওয়া উচিত, তাদের বিরুদ্ধাচারণ তাকে বেশ অজনপ্রিয় করে তুলেছিল। “মানুষ না নোংরা জেলি–আমরা মানুষের পক্ষে এধরনের শ্লোগানও তোলা হল। তবে সৌভাগ্যবশতঃ আমরা যতদুর জানি যে কোন সরাসরি সংঘাত হয়নি। সমস্ত বীজ বহনকারী মহাকাশযান হতে তথ্য পেতে আরও শতাব্দী লাগবে। আর যদি কেউ কোন সংবাদ নাই পাঠায় –বেশ, ধরে নেয়া হবে যে নোংরা জেলি ফিসগুলোই জিতে গেছে…

৩৫০৫ সালে, বিশ্ব সংসদের চূড়ান্ত অধিবেশনে কিছু মূলনীতি- যা জেনেভা ঘোষণা হিসেবে বিখ্যাত তাতে ভবিষ্যতে অন্য গ্রহে বসতি গড়ার ব্যাপারে কিছু নীতি গৃহীত হল। মনে হতে পারে এটা খুব বেশী মাত্রায় আদর্শিক, তবে আর কোন দিকে যাবার রাস্তা তাদের ছিল না। সেটা ছিল মহাবিশ্বের প্রতি মানুষের শেষ ভালোবাসার প্রকাশ, যা উপলব্ধির ক্ষমতা এর কোনদিনই হবে না। সেই নিদের্শনাগুলোর একটি নীতি আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে। যদিও এটা সবচাইতে অভিনন্দিত আর বিতর্কিত তবে এটাই আমাদের আরও কয়েকটা সম্ভাবনাময় লক্ষ্য থেকে সরিয়ে দিয়েছে। কোন গ্রহের আবহাওয়া মন্ডলে কয়েক ভাগ অক্সিজেন, সে গ্রহে জীবনের নির্ভুল চিহ্ন। এ জিনিসটা এতো বেশী মাত্রায় বিক্রিয়াশীল যে এটাকে মুক্ত অবস্থায় পেতে হলে একে ক্রমাগত উদ্ভিদ বা ওই জাতীয় কোন উৎস হতে আসতে হবে। অবশ্যই অক্সিজেন মানে প্রাণী জগৎ নয়, তবে তার জন্য একটা ইশারা। এবং যদিও প্রাণী জগৎ খুব কমই বুদ্ধিমত্তার দিকে যায়, তবে অন্য কোন পদ্ধতি এখনও দেখা। যায়নি।

তাই সর্বোচ্চ আইন অনুসারে অক্সিজেন সমৃদ্ধ গ্রহগুলো নিষিদ্ধ। অবশ্য আমার মনে হয় যে, কোয়ান্টাম ড্রাইভ যদি আমাদের অসীম ক্ষমতা আর শক্তি না দিত তাহলে এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া হতো না।

এখন আমি আমাদের পরিকল্পনা বলছি। সাগান-২-তে আমরা যখন পৌঁছাবো, আপনারা সবাই ম্যাপে দেখছেন যে অর্ধেকের বেশী গ্রহ বরফে ঢাকা প্রায় তিন কিলোমিটার পুরু। চূড়ান্ত কক্ষ ঠিক করার সময় ম্যাগেলান তার কোয়ান্টাম ড্রাইভ ব্যবহার করবে। ড্রাইভের পুরোটা বা আংশিক একটা টর্চ হিসেবে কাজ করে বরফকে গলিয়ে ফেলবে এবং একই সঙ্গে বাস্পটাকে হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনে পরিণত করবে।, হাইড্রোজেন খুব শিগগিরি মহাবিশ্বে উড়ে যাবে। প্রয়োজনবোধে আমরা এটাকে লেজার দিয়ে আরও দ্রুত করতে পারি। অক্সিজেন থেকে যাবে।

বিশ বছরেই সাগান-২ আবহাওয়া মন্ডলে দশ ভাগ অক্সিজেন থাকবে। যদিও নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং অন্যান্য বিষাক্ত গ্যাসে এটা ভর্তি থাকবে। আমরা সে সময় বিশেষভাবে অভিযোজিত ব্যাকটেরিয়া বা এমনকি গাছও নামাতে পারি পদ্ধতিটাকে দ্রুত করতে। তবে এতো উত্তাপ সরবরাহের পরও গ্রহটার তাপমাত্রা থাকবে অত্যন্ত শীতল। নিরক্ষীয় অঞ্চলে দুপুরে কয়েক ঘন্টা ছাড়া সমস্ত গ্রহের তাপমাত্রা থাকবে শুন্যের নীচে।

তাই তখন আমরা আমাদের কোয়ান্টাম ড্রাইভ ব্যবহার করব- সম্ভবতঃ শেষ বারের মতো। ম্যাগেলান–যা তার সারা জীবন মহাশূন্যে কাটিয়েছে। অবশেষে গ্রহের মাটিতে নেমে আসবে।

এবং তারপর কোন পাথুরে ভূমির উপর প্রতিদিন পনেরো মিনিটের জন্য কোয়ান্টাম ড্রাইভ চালানো হবে। আমরা জানি না পুরো অভিযানে কত সময় লাগবে, যতক্ষন না আমরা প্রথম পরীক্ষাটা করব। এমনকি প্রথম জায়গাটা ভূতাত্ত্বিকভাবে স্থির না হলে, আমাদের জাহাজকে আবারও সরাতে হতে পারে।

প্রাথমিক ভাবে মনে হয়, ড্রাইভটাকে প্রায় তিরিশ বছর ধরে ব্যবহার করতে হবে। যতক্ষণ না গ্রহের ঘূর্ণন যথেষ্ঠ পরিমান আস্তে হয়, যাতে সূর্যের রশ্মি এর পৃষ্ঠে উষ্ণতা আনবার মতো সময় পায়। এরপর গ্রহের কক্ষপথকে বৃত্তাকার করতে আরও প্রায় পঁচিশ বছর ড্রাইভ চালাতে হবে। তবে তার অনেক আগেই সাগান-২ বাসযোগ্য হবে–অবশ্য চূড়ান্ত কক্ষে না আসা পর্যন্ত শীতটা ঠিকভাবে কাটবে না।

তাহলে আমরা পাচ্ছি একটা কুমারী গ্রহ পৃথিবীর চাইতে বড়, চল্লিশ ভাগ সমুদ্র আর পঁচিশ ডিগ্রী তাপমাত্রাসহ। আবহাওয়া মন্ডলে পৃথিবীর তুলনায় সত্তর ভাগ অক্সিজেন থাকবে। যেটা আরও বাড়বে। সে সময় শীতনিদ্রায় থাকা মানুষকে জাগিয়ে তোলা হবে এবং তাদের দেয়া হবে নতুন এক গ্রহ।

এটা হচ্ছে সম্ভাব্য চিত্র, যদি না কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনা বা আবিষ্কার ঘটে, যার জন্য আমরা সরে দাঁড়াতে বাধ্য হব। আর যদি সবচাইতে খারাপটা আসে তাহলে তো।

ড. ভার্লে ইতস্ততঃ করলেন, তারপর মৃদু হাসলেন।

-না, যাই হোক না কেন, আপনারা আমাদের আর দেখবেন না। যদি সাগান-২ সম্ভব না হয়, তাহলে আরেকটা লক্ষ্য আছে। সেটা আরও তিরিশ আলোক বর্ষ দূরে। সেটা হয়তো আরও ভালো হবে।

হয়তো আমরা দুটোতেই বসতি করব। তবে তা বলার সময় এখনও হয়নি।

আলোচনাটা আরম্ভ হতে একটু সময় নিল। সভ্যদের অধিকাংশই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল।

তাদের প্রেসিডেন্ট, দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় যিনি আগে থেকেই কিছু প্রশ্ন তৈরী করে রাখেন- তিনিই আরম্ভ করলেন।

-একটা সামান্য প্রশ্ন, ড. ভার্লে। সাগান-২ কার বা কিসের নামে রাখা?

–তৃতীয় শতাব্দীর একজন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীকারের নামে।

প্রেসিডেন্টের প্রত্যাশা মতোই এটা জমাট বরফকে ভেঙ্গে দিল।

–ড. আপনি বলেছেন সাগান-২ এর একটা উপগ্রহ আছে। আপনারা কক্ষ পরিবর্তনের সময় ওটার কি করবেন?

–কিছু না, অল্প এদিক সেদিক করতে পারি হয়তো! এটা তার আপন পথেই ঘুরবে।

–যদি নীতিমালা কত যেন-৩৫০০, ৩৫০৫ এর আগে প্রতিষ্ঠিত হতো, তাহলে আমরা কি এখানে থাকতাম? মানে থ্যালসাও কি নিষেধের আওতায় পড়ত?

–এটা খুব ভালো প্রশ্ন। আমরাও এটা নিয়ে তর্ক করি। ২৭৫১ সালে যে মহাকাশযানটা –অর্থাৎ আপনাদের দক্ষিণ দ্বীপের মহাকাশযানটা অবশ্যই এই নীতির বিরুদ্ধে যেত। তবে সৌভাগ্যবশতঃ তখন সমস্যাটা জাগেনি। আর যেহেতু এখানে কোন স্থলচর প্রাণী নেই, সেহেতু হস্তক্ষেপের প্রশ্ন এখানে উঠছে না।

-এটা তো অনুমানমূলক। একজন তরুণ সদস্য বয়স্কদের হাসাহাসি সত্ত্বেও বলে উঠল। অক্সিজেন মানেই যে জীবন তা মেনে নিলেও, তার উল্টোটা যে সম্ভব নয় সেটা সম্বন্ধে আপনারা কিভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন? কোন অক্সিজেন এমনকি কোন আবহাওয়ামন্ডল ছাড়া গ্রহেও তো প্রাণী–এমনকি বুদ্ধিমান প্রাণীও থাকতে পারে। অনেক দার্শনিকও তো বলেছেন যে, যদি আমাদের পূর্বপুরুষরা মেশিন হতেন তা হলে তারা জং পড়ে না এমন আবহাওয়া পছন্দ করতেন। সাগান-২ কত পুরোনো? যদি এমন হয় যে তারা অক্সিজেন ভিত্তিক জীবন পেরিয়ে গেছে সেখানে একটা যান্ত্রিক সভ্যতা অপেক্ষা করছে।

দর্শকদের মধ্য থেকে কিছু গোঙানীর শব্দ ভেসে এল, কেউ বিদ্রুপের সুরে বলল “কল্পকাহিনী।” দর্শকদের বিরক্তি দূর হবার জন্য ড, ভার্সে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বিস্তারিত ভাবে বললেন,

-সেটা ভেবে আমরা ঘুম নষ্ট করতে রাজি নই। আমরা যদি কোন সম্পূর্ণ যান্ত্রিক সভ্যতার মধ্যে গিয়ে পড়ি তাতে আমাদের হস্তক্ষেপ না করার নীতি কোন প্রভাব ফেলবে না। বরং আমি বেশী ভয় পাব যে ঐ সভ্যতা আমাদের প্রতি কি করবে।

একজন অত্যন্ত বৃদ্ধ ব্যক্তি-থ্যালসায় ড. ভার্লের দেখা সবচে বয়স্ক লোক, রুমের পেছন দিকে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। চেয়ারম্যান একটা দ্রুত নোট পাঠালেন, প্রফেসর ডেরেক উইন্সলেড ১১৫-সজেব থ্যাব, বিজ্ঞান-ঐতিহাসিক। ড. ভার্লে ‘সজেব’-এর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর হঠাই তিনি বুঝতে পারলেন ‘সজেব’ মানে হচ্ছে সর্ব জেষ্ঠ্য ব্যক্তি।

তিনি ভাবলেন, এটাই স্বাভাবিক যে ল্যাসান বিজ্ঞানের ডীন কোন ঐতিহাসিকই হবেন। সাতশ’ বছরের ইতিহাসে তিনটা দ্বীপ হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র মৌলিক চিন্তাবিদের জন্ম দিয়েছে।

এটা অবশ্য মেধার সমালোচনা নয়। ল্যাসানদের শূন্য থেকে অবকাঠামো তৈরি করতে হয়েছে। বাস্তব প্রয়োগ নেই এমন কোন গবেষণার সুযোগ বা চেষ্টা ছিল না। এছাড়া আর একটা বড় সমস্যা হল জনসংখ্যা। কোন মৌলিক গবেষণা করার জন্য যতগুলো নূন্যতম মস্তিষ্কের প্রয়োজন তা কখনোই থ্যালসায় পাওয়া সম্ভব নয়।

কেবলমাত্র গণিত-সঙ্গীতের মতোই একটা বিরল ব্যতিক্রম। রামানুজ বা মোজার্টের মতো একজন নিঃসঙ্গ প্রতিভাবান হঠাৎ করে এরকম একটা অদ্ভুত সাগর পাড়ি দেবার ক্ষমতা রাখে। ফ্রান্সিস জোলান (২১৪-২৪২) এমন একজন বিখ্যাত ল্যাসান বিজ্ঞানী। পাঁচশ বছর পরও তার নাম উচ্চারিত হয়। তবে তার সন্দেহাতীত প্রতিভা সমন্ধেও ড. ভার্লের কিছু মন্তব্য আছে। তা হলো, তার পর্যবেক্ষণে, কেউই এখানে হাইপারট্রান্সফিনেট সংখ্যার ওপর তার কাজকে বুঝতেই পারেনি। সেগুলো আর সম্প্রসারিতও হয়নি। সেটা তার মেধাকেই অবশ্য প্রমাণ করে। এমনকি, এখন পর্যন্ত তার শেষ ‘প্রস্তাবিত তত্ত্ব’ কে প্রমাণিত বা অপ্রমাণিত হিসেবে ধরা হয়।

সে সন্দেহ করে। যদিও সেটা তার ল্যাসান বন্ধুদের সামনে খুব সতর্কতার সাথে তুলে ধরে যে জোলানের দুঃখজনক মৃত্যু তার খ্যাতিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বেঁচে থাকলে তার মাথা আরও কি বের করত– এই ভেবে। উত্তর দ্বীপে সাঁতার কাটার সময় তার নিখোঁজ হয়ে যাওয়া নিয়ে অনেক রোমান্টিক মিথ আর তত্ত্বের জন্ম দিয়েছে ভালোবাসায় ব্যর্থতা, প্রতিহিংসা, জটিল আবিষ্কারের ব্যর্থতা, হাইপার ইনফিনেটের ভীতি- অবশ্য কোনটাই আসল সত্যটাকে তুলে ধরে না। তবে সবাই থ্যালসার জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বকে এভাবেই দেখে- সবচে মেধাবী যে কিনা তার সাফল্যের চূড়ায় থেকে বিদায় নিলেন।

বৃদ্ধ প্রফেসর কি বলছেন? ওহহো–সব সময়ই আলোচনার সময় এমন একজনকে পাওয়া যাবে যে কিনা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন বা নিজস্ব কোন তত্ত্ব হাজির রাখবে। সাধারণতঃ একটা হাসি দিয়েই ড. ভার্লে এদের মোকাবেলা করেন। কিন্তু তাকে তো সজেব’, এর প্রতি আরও স্র হতে হবে যেখানে তিনি তার অনুজপ্রতিম সহকর্মীদের মাঝে সম্মানিত আসনে আছেন।

প্রফেসর-অ্যাঁ-উইন্সডেল-“উইন্সলেই”-চেয়ারম্যান ফিসফিসিয়ে বললেন।

অবশ্য ড. ভার্লে জানেন যে কোন শোধরানোর চেষ্টা ব্যাপারটাকে আরও ঘোলাটে করবে।

-আপনার প্রশ্ন খুব ভালো হলেও তা আরেকটা আলোচনার ব্যাপার। বা আসলে অনেকগুলো আলোচনার ব্যাপার। এমনকি তারপরও বিষয়বস্তুটা ভালোভাবে বোঝা যাবে কিনা সন্দেহ।

তবে আপনার প্রথম পয়েন্টটার ব্যাপারে বলছি। এই সমালোচনা প্রায়ই আমরা শুনলেও, জিনিসটা ঠিক নয়। আপনাদের কথামতো কোয়ান্টাম ড্রাইভের গোপন তত্ত্ব আমাদের ভেতরে আমরা লুকিয়ে রাখতে চাইছি–কথাটা ঠিক নয়। পুরো তত্ত্বটা মহাকাশযানের আর্কাইভে আছে।

আপনাদের যে জিনিসগুলো দেয়া হয়েছে তার মধ্যেও তত্ত্বটা আছে।

কিন্তু এটা বলে আমি আপনাদের হতাশ করতে চাই না। মহাকাশযানের কোন ক্রু এই তত্ত্বটা পুরোপুরি বোঝে না। আমরা কেবল এটা ব্যবহার করতে পারি মাত্র। কেবল মাত্র তিনজন বিজ্ঞানী শীতনিদ্রায় আছে যারা এই ড্রাইভের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ। সাগান-২-এ পৌঁছার আগে তাদের জাগিয়ে তোলাটা আমাদের জন্য বিশাল অসুবিধার ব্যাপার।

সুপারস্পেসের জিওমেট্রোডাইনামিক কাঠামোকে দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপ দিতে গিয়ে মানুষ পাগল হতে বাকী থেকেছে। মহাবিশ্ব কেন এগার মাত্রার, যেখানে দশ বা বার মাত্রার সুন্দর সাম্য নেই- এ কথার প্রশ্ন এখনো অজানা। আমি যখন উৎক্ষেপণের প্রাথমিক প্রশিক্ষণে যাই, আমার প্রশিক্ষক বলেছিলেন, “কোয়ান্টাম ড্রাইভ যদি তুমি বুঝতেই পারতে, তাহলে তুমি এখানে আসতেই না। তুমি ল্যাগরেঞ্জ-১ এর অগ্রসর বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে থাকতে। এবং তার এই কথাটা আমাকে ঘুমাতে সাহায্য করেছিল। কারণ টেন টু দি পাওয়ার মাইনাস থার্টি থ্রি সেন্টিমিটার জিনিসটার কল্পনার চেষ্টা আমার দুঃস্বপ্নের ভেতর দেখা দিচ্ছিল।

আমার প্রশিক্ষক আমাকে বলেছিলেন, “ম্যাগেলানের ক্রুরা শুধু ড্রাইভটা কিভাবে কাজ করে সেটা জানবে। বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রকৌশলীদের মতো তাদের কাজ। শক্তিটা কিভাবে ব্যবহার করা যায় এটা জানলেই হবে। শক্তিটা কিভাবে তৈরি হচ্ছে তা জানার দরকার নেই। সাধারণ তেল চালিত ডায়নামো, কিংবা সৌর শক্তি বা জলবিদ্যুতের মতো সহজ ভাবে সেটা তৈরী হতে পারে।

অথবা আরও কোন জটিল ভাবেও বিদ্যুৎ আসতে পারে। যেমন ফিউশন রিএ্যাক্টর, থার্মোনিউক্লিয়র ফিউশন বা মাও ক্যাটালাইজার বা পেনরোজ নোড অথবা হকিং স্করশিল্ড কারনেল-মানে অনেক ভাবেই। কোন এক জায়গায় তাদের বোঝার চেষ্টা ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু তা হলেও তারা প্রত্যেকে যোগ্য প্রকৌশলী, প্রয়োজন মতো তারা বৈদ্যুতিক শক্তি চালু বা বন্ধ করার যোগ্যতা রাখে।

ঠিক সে ভাবেই আমরা ম্যাগেলানকে পৃথিবী থেকে থ্যালসা পর্যন্ত নিয়ে এসেছি, আশা করি সাগান-২ পর্যন্ত নিতে পারব কিন্তু কিভাবে করছি, সেটা না জেনেই। তবে হয়তো একদিন, সম্ভবতঃ শতাব্দীর মধ্যেই আমরা কোয়ান্টাম ড্রাইভ তৈরীর মতো মেধাবীদের তৈরী করতে পারব।

আর-কে জানে? আপনারা হয়তো আমাদের আগেই পারবেন। ভবিষ্যতে একজন ফ্রান্সিস জোলান হয়তো থ্যালসায় জন্মাবে। তখন আপনারাই আমাদের দেখতে আসবেন। সে অবশ্য তা বিশ্বাস করে না। তবে শেষ করার জন্য এটা একটা সুন্দর উপায়-তুমুল করতালির মধ্যে দিয়ে।

২২. ক্র্যাকান

কোনো সমস্যা ছাড়াই এটা আমরা করতে পারব, ক্যাপ্টেন বে চিন্তিত স্বরে বললেন, পরিকল্পনা হয়ে গেছে কম্প্রেসারের কম্পনের সমস্যাটার সমাধান হয়েছে। এর পরে জায়গা দেখতে যাওয়া হবে।

বাড়তি মানুষ আর যন্ত্র আমাদের আছে-কিন্তু দেয়াটা কি ঠিক হবে? টেরানোভার কনফারেন্স রুমের উপবৃত্তাকার টেবিল ঘিরে বসা তারা পাঁচজন সিনিয়র অফিসারদের দিকে তিনি তাকালেন। তারপর সবাই ড. ক্যালডরের দিকে তাকালেন। তিনি হাত ছড়িয়ে বসে ছিলেন।

-তা হলে এটা কেবলমাত্র যান্ত্রিক সমস্যা নয়। আমার যেটা জানার দরকার সেটা জানাও আগে।

-এই হচ্ছে অবস্থা ডেপুটি ক্যাপ্টেন ম্যালিনা বললেন। বাতিগুলো ম্লান হয়ে গেল। আর টেবিলের মাঝখানে, সেন্টিমিটার খানেক উঁচুতে তিন দ্বীপ ভেসে উঠল। এটাকে একটা মডেলের মতো মনে হলেও এটা কোন মডেল নয়। যদি যথেষ্ঠ বড় করা হয় তাহলে কেউ ল্যাসানদের ব্যস্ততা দেখতে পাবে।

-আমার ধারণা ল্যাসানরা এখনও ক্র্যাকানকে ভয় পায়। যদিও এটা খুব লক্ষ্মী একটা আগ্নেয়গিরি। যাই হোক না কেন, এটা তো কাউকে মেরে ফেলেনি। আর এটাই হচ্ছে আন্তঃদ্বীপ যোগাযোগ ব্যবস্থার মূল চাবি। সাগরপৃষ্ঠ হতে ছয় কিলোমিটার উঁচুতে এর চুড়াটা হচ্ছে গ্রহের সবচাইতে উঁচু জায়গা। তাই এটাই

হচ্ছে এ্যান্টেনা বসাবার আদর্শ জায়গা। দূরের যে কোন জিনিস এটায় ধরে আবার দ্বীপগুলোয় পাঠানো যাবে।

–আমার মাঝে মাঝে খুব অবাক লাগে যে, ক্যালডর বললেন–দু’হাজার বছর পরও আমরা বেতার তরঙ্গের চাইতে ভালো কিছু আবিষ্কার করতে পারিনি।

–মহাবিশ্ব কেবলমাত্র একটা বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বিচ্ছুরণ দিয়ে ভর্তি ড. ক্যালডর। আমাদের এর সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে। আর ল্যাসানরা ভাগ্যবান–কারণ উত্তর ও দক্ষিণ দিকে সব শেষের বিন্দুটাও তিনশ কিলোমিটারের মধ্যে-ক্র্যাকান পর্বত তাদের দুটোকেই পুরোপুরি ঢাকতে পারে। কোন বিশেষ যন্ত্র ছাড়াই কাজ চালাতে পারবে।

কেবল যাওয়াটা–অর্থাৎ আবহাওয়াটাই সমস্যা। আর চালু রসিকতা হচ্ছে যে ক্র্যাকানই হচ্ছে গ্রহের একমাত্র জায়গা যেখানে আবহাওয়া বলে কোন বস্তু আছে। কয়েক বছর পর পর কাউকে পাহাড়ে উঠতে হয়। অ্যান্টেনা ঠিক করে কিছু ব্যাটারী আর সৌর কোষ বদলায় এবং একগাদা বরফ নিয়ে নেমে আসে। কঠিন কাজ তবে ঝামেলা নেই।

-যেটা, সার্জন কমান্ডার নিউটন বললেন, ল্যাসানরা পারতপক্ষে এড়িয়ে চলে। অবশ্য আমি তাদের দোষ দিচ্ছি না। কারণ তারা তো আবার আরও বেশী গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যেমন খেলা বা শরীরচর্চার জন্য শক্তি জমিয়ে রাখে। সে অবশ্য ‘প্রেম করা শব্দটা যোগ করতে চাইছিল। কিন্তু সেটা ইতিমধ্যেই তার কয়েক জন সহকর্মীর জন্য যথেষ্ঠ সংবেদনশীল শব্দতে পরিণত হয়েছে সুতরাং ওটা ব্যবহার না করাই ভালো।

-তারা পাহাড়ে চড়বে কেন? ক্যালডর জিজ্ঞেস করলেন। তারা ওড়ে না কেন? তাদের কি সোজা উপরে উঠে যাবার মতো বিমান নেই?

–আছে, কিন্তু ওখানে বাতাস খুব পাতলা। কিছু বড় ধরনের দুর্ঘটনার পর ল্যাসানরা কঠিন পথটাই বেছে নিয়েছে।

–আচ্ছা ক্যালডর চিন্তিত ভাবে বললেন, সেই পুরোনো হস্তক্ষেপ করা না করার প্রশ্ন। আমরা কি তাদের আত্মশক্তি কমিয়ে দিচ্ছি? অবশ্য খুব কম মাত্রায়, অন্ততঃ আমি বলব। আর আমরা যদি তাদের এই সামান্য অনুরোধটাও না শুনি তাহলে তিক্ততার জন্ম হতে পারে। তারা বরফ কলের জন্য যে সাহায্য করেছে তাতে এটা করা যেতে পারে।

-আমারও ঠিক তাই মনে হয়। কোন আপত্তি? বেশ। তা মি. লোরেনসন আপনি ব্যবস্থা নিন। যে কোন মশন্যবিমান প্রয়োজনে আপনি নিয়ে নিন। বরফের জন্যতো ওগুলোর দরকার নেই।

মোজেস ক্যালডর পাহাড় ভালোবাসেন। এটা তাকে ঈশ্বরের কাছে নিয়ে যাবার অনুভূতি দেয়–যদিও ঈশ্বরের অস্তিত্বহীনতার ব্যাপারটাও সে এখন তিক্ততার সঙ্গে স্বীকার করে। চূড়া থেকে সে লাভার সমুদ্রের দিকে তাকালো। যেটা অনেক আগেই জমে গেলেও এখনও ধোয়া ছাড়ছে। তারও দূরে পশ্চিমে বড় দুটো দ্বীপই পরিষ্কার। দেখা যাচ্ছে।

ঠান্ডা আর নিঃশ্বাসের সক্রিয় চেষ্টা প্রতিটি মুহূর্তকেই আনন্দময় করে তুলেছে। বহু আগের প্রাচীন কোন ভ্রমণ বা অ্যাডভেঞ্চার বই এ ‘মাতাল করা বাতাস পড়ার সময় তার মনে হয়েছিল লেখককে জিজ্ঞেস করে সে নিজে কতটা গিলেছে। কিন্তু মনে হচ্ছে কথাটা মিথ্যে নয়।

–সবকিছু গুছিয়ে ফেলা হয়েছে মোজেস। আমরা ফিরব।

-ধন্যবাদ লোরেন। ইচ্ছে করছে সবাইকে সন্ধ্যায় নেয়ার সময়টা পর্যন্ত থাকি। তবে এত উচ্চতায় ততক্ষণ থাকাটা বিপদজনক।

-ইঞ্জিনিয়ারদের কাছে অক্সিজেন আছে।

–আমি সেটা ভাবছি না। একটা পাহাড়ের ওপর আমার সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়েছিল।

–দুঃখিত, বুঝলাম না।

–বাদ দাও, ওটা অনেক, অনেক আগের কথা।

পাহাড় থেকে উড়ে যাবার সময় কাজের লোকজন খুশিতে হাত নাড়ল। সব জিনিস নামানো হয়েছে। তারা ল্যাসান প্রজেক্টের প্রাথমিক কাজগুলি করছে। কেউ কেউ চা বানাচ্ছিল। লোরেন সাবধানে এ্যান্টেনার জটিল কাঠামো বাঁচিয়ে উপরে উঠতে লাগল। যদি কোন কাঠামোতে লেগে যায় তাহলে দূরের দুটো দ্বীপের দিকে তাক করা এ্যান্টেনাগুলো অসংখ্য গিগাবাইটা তথ্য হারাবে। আর ল্যাসানরা তখন সাহায্য চাওয়ার জন্যই পস্তাবে।

-তুমি তারনার দিকে যাচ্ছ না?

–কি? ওহ, ক্র্যাকান।

শব্দটা দুটো দিক থেকেই ঠিক। তাদের নীচের মাটি শ’খানেক মিটার চওড়া উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। আর এর চূড়ায় আছে নরক।

নতুন একটা বিশ্বের হৃদয়ের উত্তাপ ঠিক এর নীচেই জ্বলছে। একটা হলদে জ্বলন্ত নদী ধীরে সাগরের দিকে যাচ্ছে। ক্যালডর অবাক হয়ে ভাবল, কিভাবে এরা নিশ্চিত যে আগ্নেয়গিরিটা ঠান্ডা হয়ে গেছে, আর কখনো এটা বিস্ফোরিত হবেনা। তবে লাভার নদীটা তাদের উদ্দেশ্য নয়। এরপর আরেকটা ছোটা খাদ প্রায় কিলোমিটার খানেক চওড়া। যার মাঝে একটা প্রায় ধ্বসে যাওয়া টাওয়ার। কাছে গিয়ে তারা আরও বুঝতে পারল যে, সেখানে মোট তিনটা টাওয়ার ছিল। তবে বাকী দুটোর কেবল ভিত্তিটাই আছে।

খাদের মেঝে ধাতব পাত আর বাঁকানো তার দিয়ে ভর্তি। নিশ্চয়ই এটা সেই বিশাল বেতার প্রতিফলক যা এখানে বসানো হয়েছিল। প্রেরক আর গ্রাহক যন্ত্রটা বৃষ্টির পানি নেমে যাবার পুকুরে পড়ে আছে।

পৃথিবীর শেষ সূত্রের অবশেষ–কেউই কোন কথা বলল না। অবশেষে লোরেন নিস্তব্ধতা ভাঙল।

-এটা ভেঙে গেছে কিন্তু সারানো অসম্ভব নয়। সাগান-২ মাত্র ১২ ডিগ্রি উত্তরে পৃথিবীর চাইতেও কাছে। একটা খারাপ এ্যান্টেনাও লক্ষ্যভেদ করবে।

-দারুণ পরিকল্পনা। আমরা আমাদের বর্ম শেষ করে, তাদের সাহায্য করতে পারি।

অবশ্য তাদের তাড়াহুড়ো নেই, খুব সাহায্যও তাই লাগবে না। আসলে চারশ বছর লাগবে তাদের আমাদের কাছে থেকে আবার তথ্য পেতে– তাও যদি আমরা নেমেই তথ্য পাঠাই।

লোরেন জায়গাটা রেকর্ড করে নিল। প্রায় একহাজার মিটার নামার পর ক্যালডর দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল।

-উত্তরে ধোয়াটা কিসের? একটা সংকেত এর মতো লাগছে।

দিগন্তের মাঝামাঝি, থ্যালসার নীল আকাশের বিপরীতে সাদা একটা স্তম্ভ তৈরী হয়েছে।

কয়েক মিনিট আগেও নিশ্চিত একটা ছিল না।

–চল দেখা যাক। হয়তো কোন বোট সমস্যায় পড়েছে।

–আমার কি মনে হচ্ছে জান? ক্যালডর বলল।

লোরেন একটা শ্রাগ করে উত্তর দিল।

–একটা তিমি। সেগুলো যখন শ্বাস নিতে আসত তা তখন পানির বাস্পের একটা স্তম্ভ তৈরী করত। এটা একদম সেরকম।

-তোমার আকর্ষণীয় তত্ত্বটায় দুটো ভুল আছে। স্তম্ভটা প্রায় কিলোমিটার উঁচু তিমি!

-মানছি এবং তিমিরটা মাত্র কয়েক সেকেন্ড থাকে আর এটা অবিরাম। দ্বিতীয় আপত্তিটা কি?

-চার্ট অনুযায়ী– ওটা কোন মুক্ত পানির এলাকা নয়। অতএব বোটতো নয়ই।

–কি বলছ থ্যালসাতো পুরোটাই সাগর। ও আচ্ছা গ্রেট ইস্টার্ণ প্রেইরী….

–হ্যাঁ ওটা তার প্রান্ত।

–কিন্তু তুমি যেভাবে বললে যেন ওটা কোন জমি।

তারা দ্রুত ভাসমান সামুদ্রিক আগাছার কাছে চলে এল। এগুলো প্রায় সারা সাগর ঢেকে আছে- এবং গ্রহের অক্সিজেন তৈরী করছে। দেখতে প্রায় শক্ত সবুজ পাতের মতো মনে হয় যেন হাঁটা যাবে। কোন পাহাড় বা উঁচু জিনিস না থাকায় এমন অবস্থা।

কিন্তু এক কিলোমিটার দূরে, ভাসমান প্রেইরী–সমতলও নয় বা অবিচ্ছিন্নও নয়। একটা জল ফুটছে যা বাস্পের বিশাল মেঘ তৈরী করছে।

-আমার মনে থাকা উচিত ছিল, ক্যালডর বলল। ক্র্যাকানের সন্তান।

–হুঁ। আমরা আসার পর এই প্রথম এটা সক্রিয় হয়েছে। দ্বীপগুলো তাহলে এভাবে তৈরী হয়েছে।

হ্যাঁ, আগ্নেয়গিরিটি পূবদিকে এগুচ্ছে। কয়েক হাজার বছর পর হয়তো ল্যাসানরা পুরো একটা মহাদেশ পাবে।

তারা আরও কয়েকবার চক্কর দিয়ে পূর্ব দ্বীপের দিকে ফিরল। অধিকাংশ দর্শকের কাছেই একটা ডুবন্ত আগ্নেয়গিরি –যা কিনা জন্মাতে চেষ্টা করছে, খুব একটা দর্শনীয় ঘটনা না।

তবে যে মানুষেরা একটা সৌরজগতের ধ্বংস দেখেছে তাদের কাছে এই জন্ম। একটা ঘটনার চাইতে অনেক বেশী কিছু।

২৩. বরফ দিবস

গত তিনশ বছরের মধ্যে, প্রেসিডেন্টের প্রমোদতরী, অ্যালিয়াস আন্তদ্বীপ ফেরী নং এক, কোনদিন এতো সুন্দর সাজেনি। ফেস্টুন ওড়ানো ছাড়াও এটাকে নতুন সাদা রং করা হয়েছে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে রং বা উৎসাহ যেটার ঘাটতির কারণেই হোক না কেন কাজটা সম্পূর্ণ শেষ হয়নি। তাই ক্যাপ্টেনকে বাধ্য হয়েই সতর্কভাবে রং করা দিকটাকেই পাড়ের দিকে রেখে নোঙর করতে হচ্ছে।

প্রেসিডেন্ট ফারাদীনও বিশেষ উপলক্ষ্য হিসেবে চমকপ্রদভাবে সেজে এসেছেন। মিসেস প্রেসিডেন্টের ডিজাইনে তৈরী পোশাকটিকে রোমান সম্রাট আর প্রথম দিককার নভোচারীদের পোষাকের মিশ্রণ বলা যেতে পারে। এবং তিনি এই পোশাকে যে খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন তাও বোধ হচ্ছে না। ক্যাপ্টেন বে সাদা প্যান্ট, ভোলা গলার জামা, কাঁধের ব্যাজ আর স্বর্ণখচিত ক্যাপ পরে বেশ ভালো বোধ করছিলেন। সম্পূর্ণ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলেও কবে শেষ এই পোশাক তিনি পরেছিলেন তা তার খেয়ালও নেই।

প্রেসিডেন্টের পোশাক ছাড়া আনুষ্ঠানিক এই ভ্রমণটি অত্যন্ত ভালো হয়েছিল। আর বরফ তৈরীর কলটির মডেলটা একেবারে ঠিকঠাক কাজ করছিল। পানীয় ঠান্ডা করার জন্য ছোট্ট ও পাতলা বরফের টুকরো এটা অন্তহীনভাবে তৈরী করছিল। অবশ্য তুষারপাত নামটি দেয়ার সার্থকতা অতিথিরা কেউই বুঝল না। সেটা তাদের দোষ নয়–তারা জীবনে অনেকেই বরফ দেখেনি।

এরপর তারা মডেল ছেড়ে আসল জিনিসটা দেখতে গেল। এটা তারনার উপকূলের কয়েক হেক্টর জায়গা নিয়ে নিয়েছে। প্রেসিডেন্ট এবং তার সঙ্গীরা, এবং তার অফিসারদের এবং সকল অতিথিদের নিতে বেশ কিছুটা সময় লাগল। এখন দিনের শেষ আলোয় বিশ মিটার চওড়া, দুই মিটার পুরু ছ’কোনা বরফ পাতের সামনে তারা সবাই সশ্রদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রইল। এটা তাদের দেখা সবচাইতে বড় বরফখন্ডই নয় –সম্ভবত: সত্যিকার অর্থেই গ্রহের বৃহত্তম। কারণ এমনকি মেরু অঞ্চলেও বরফ তৈরী হবার খুব সুযোগ পায় না। স্রোতের তোড়ে সেগুলো খুব দ্রুতই ভেসে বা গলে যায় পানির সঙ্গে।

-কিন্তু এটার এই আকৃতি কেন? প্রেসিডেন্ট জিজ্ঞেস করলেন।

ডেপুটি ক্যাপ্টেন ম্যালিনা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। নিশ্চয়ই এই জিনিসটা তাকে কয়েকবার বোঝাতে হয়েছে।

–কোন তরলকে একইরকম টুকরো দিয়ে ঢাকার ব্যাপারে এটা একটা পুরোনো ব্যবস্থা। আপনি তিন ধরনের টুকরো নিতে পারেন। চতুর্ভুজ বা ত্রিকোন বা ষড়ভুজ। আমাদের ক্ষেত্রে ছ’কোনা জিনিস বেশী সুবিধার আর কাজের। এই টুকরোগুলো প্রায় দু’শর ওপর, প্রতিটির ওজন ছয়শো টন। বর্মটা তৈরী করতে একটার সঙ্গে আরেকটাকে লাগিয়ে দিতে হবে। এটা হবে একটা তিনপ্রস্থ স্যান্ডুইচের মতো। আমরা যখন চলব, তখন সব টুকরোগুলো মিশে গিয়ে একটা বিশাল পাত তৈরী করবে। কিংবা একটা বড় কোণও হতে পারে।

–আপনি আমাকে বেশ ভালো একটা পরিকল্পনা দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট সারা বিকালের মধ্যে সবচাইতে মনোযোগ দিয়ে বললেন। থ্যালসায় কোন আইস-স্কেটিং হয়না। এটা খুব সুন্দর খেলা। এছাড়া আইস-হকি নামেও একটা খেলা আছে। অবশ্য ভিডিও দেখে সেটা আমরা আবার আবিষ্কার করতে পারব কিনা কে জানে। তবে আপনারা যদি একটা বরফ-মাঠ করে দিতে পারেন অলিম্পিকের জন্য তাহলে খুব ভালো হয়। সেটা কি সম্ভব?

-আমি চিন্তা করব, ডেপুটি ক্যাপ্টেন ম্যালিনা স্নানভাবে উত্তর দিলেন। এটা চমৎকার চিন্তা। কতটুকু বরফ লাগবে সেটা আমাকে জানাবেন।

-আনন্দের সঙ্গে। কাজ শেষ হয়ে গেলে বরফ কলটাকে আমরা এতে ব্যবহার করতে পারি। একটা হঠাৎ বিস্ফোরণ ম্যালিনাকে উত্তর দেয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল। আতশবাজী আরম্ভ হয়ে গেছে। পরবর্তী বিশ মিনিট দ্বীপের ওপরের আকাশ বহুবর্ণের আলোয় ভাস্বর হয়ে উঠল।

ল্যাসানরা আতশবাজী খুব পছন্দ করে আর সুযোগ পেলেই ব্যবহার করে। তারা লেজার প্রতিরূপ ব্যবহার করে যা সূক্ষ্ম এবং নিরাপদ, কিন্তু গানপাউডারের শেষের সেই সুন্দর পোড়া গন্ধ হতে বঞ্চিত। সব শেষ হয়ে গেলে যখন ভিআইপিরা জাহাজ ত্যাগ করছে, ডেপুটি ক্যাপ্টেন ম্যালিনা অন্যমনস্কভাবে বলল,

-প্রেসিডেন্ট অদ্ভুত লোক, যদিও এক ধরনের নির্দিষ্ট চিন্তার বাইরে যেতে পারে না। তার ওই ঘোড়ার ডিমের কাল্পনিক কথা শুনে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। তবে বরফের মাঠ তৈরীর চিন্তাটা দারুণ এবং আমাদের জন্য অনেক সুনাম বয়ে আনবে।

-তবে আমি আমার বাজী জিতেছি, লেঃ কমান্ডার লোরেন লোরেনসন বলল।

–কি বাজী? ক্যাপ্টেন বে জিজ্ঞেস করলেন।

ম্যালিনা হেসে ফেললেন।–এটা কখনো বিশ্বাস করিনি। কখনো কখনো ল্যাসানরা কোন কৌতূহল দেখায় না। সবকিছুই তারা মেনে নেয়। অবশ্য আমাদের প্রাযুক্তিক জ্ঞানের ওপর তাদের বিশ্বাসের জন্য আমার বোধহয় গর্ব হওয়া উচিত। তারা বোধহয় ভাবে যে আমাদের অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি বল আছে।

লোরেন বলেছিল বর্ণনার সময় বাদ দিতে। এবং সেই ঠিক। প্রেসিডেন্ট ফারাদীন কোন প্রশ্নই করলেন না, যে কিভাবে আমরা একশ পঞ্চাশ হাজার টন বরফ ম্যাগেলানের জন্য ওপরে নিয়ে যাব।

২৪. আর্কাইভ

মোজেস ক্যালডর একাকী থাকতেই পছন্দ করে। উপাসনালয়ের মতো সমাহিত জায়গায় যত ঘন্টা বা দিন কাটানো যায়। মানুষের সব শিল্প আর জ্ঞানের সামনে নিজেকে তার আবার ছাত্রের মতো মনে হয়। অভিজ্ঞতাটা উত্তেজনাকর এবং অবসন্নময়। সমগ্র বিশ্ব তার আঙ্গুলের ছোঁয়ায় দাঁড়িয়ে, কিন্তু একজীবনে এর সামান্যটাই দেখা যায়। মাঝে মাঝে সে প্রবল ইচ্ছায় তাড়াহুড়ো করে বসে। তার অবস্থা হল একজন ক্ষুধার্ত মানুষের মতো, যাকে এতো খাবার দিয়ে বসিয়ে দেয়া হয়েছে যে তার খাবার ইচ্ছেই মরে গেছে।

এবং এই সভ্যতা আর কৃষ্টির সম্পদও মানব জাতির সমগ্রের ভগ্নাংশ মাত্র। মোজেস ক্যালডর যা জানে আর ভালোবাসে তার অনেকটাই নেই। এবং সে জানে সেটা কোন দুর্ঘটনাবশতঃ নয় বরং ইচ্ছাকৃত।

হাজার বছর আগে মেধাবী আর চিন্তাশীল ব্যক্তিরা ইতিহাসকে ঢেলে লিখেছিলেন, আর লাইব্রেরীর সংগ্রহের মধ্যে কোনগুলো থাকবে আর কোনগুলো আগুনে পুড়বে তাও ঠিক করলেন। বাছাইয়ের পদ্ধতিটা সোজা হলেও ব্যাপারটা ছিল দুরূহ। নতুন বিশ্বের টিকে থাকা আর সামাজিক স্থিরতায় সাহায্য করবে এমন সাহিত্য, ইতিহাস বীজ বহনকারী মহাকাশযানে দেয়া হল।

কাজটা ছিল অসম্ভব এবং হৃদয়বিদারক। চোখের জলে ভেসে বাছাই কমিটি বেদ, বাইবেল, ত্রিপিটক, কোরান এবং এদের ওপর ভিত্তি করে সব সাহিত্যকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। এগুলো যতই সৌন্দর্য্য ধারণ করুক না কেন, তারা আবার সেই প্রাচীন ধর্মীয় ঘৃণা, ঐশ্বরিক বিশ্বাস, আর অর্থহীন পবিত্রতা-যা বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষকে নিজেদের মধ্যে কাটাকাটি করে মৃত্যু ঘটিয়েছে, তাকে পুনরায় নতুন একটা গ্রহকে দূষিত করার সুযোগ দিতে পারেন না।

প্রধান ঔপন্যাসিক, কবি এবং নাট্যকারদের সৃষ্টির বহু কিছু বাদ পড়ল। যা কিনা দার্শনিক এবং সাংস্কৃতিক পটভূমি ছাড়া অর্থহীন। হোমার, তলস্তয়, শেক্সপিয়ের, মিল্টন, মেলেভী, প্রাউস্ট ইলেকট্রনিক মাধ্যম ছাপাখানাকে উঠিয়ে দেবার আগেকার শ্রেষ্ঠ লেখকদের লেখা বাছাই করা কয়েকশ হাজার প্যারাগ্রাফের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলো। যুদ্ধ, অন্যায়, নৃশংসতা এবং ধ্বংসাত্মক সব কিছুই বাদ দেয়া হল। যদি নতুনভাবে পরিকল্পিত এবং আশানুযায়ী উন্নত সভ্যতা তৈরী হয়, তাদের নিজেদেরই সাহিত্য হবে। তাদের তাতে পুরোনো অপরিণত উৎসাহ দেবার কোন দরকার নেই।

অপেরা ছাড়া সঙ্গীত এবং শিল্পকর্ম এর চাইতে ভালো করল। তবুও এর পরিমাণ এতোই বেশী যে বাছাই করাটা অপরিহার্য। যদিও কখনো বিতর্কিত। অনেক বিশ্বের বহু প্রজন্মই মোজার্টের প্রথম আট সিফনী, বেটোফেনের দ্বিতীয় ও চতুর্থ এবং সিবেলিসের তিন থেকে ছয় শুনে আশ্চর্য হবে।

মোজেস ক্যালডর গভীরভাবে তার দায়িত্ব সম্বন্ধে এবং একইসঙ্গে তার অক্ষমতা সম্বন্ধেও বা যে কোন মানুষের অক্ষমতা সম্বন্ধে জানে–যত মেধাবীই সে হোক না কেন। উপরে ম্যাগেলানের বিশাল মেমরী ব্যাঙ্কে যা নিরাপদে রাখা আছে, তার অধিকাংশই থ্যালসার মানুষ দেখেনি। এমনকি তারা বুঝতেও পারবে না। পঁচিশশো সালের পুননির্মিত ওডেসী, কেইন বার্গের শেক্সপিয়রের ট্র্যাজেডীর অনুবাদ: লি কোসের ওয়র এন্ড পিস –পুরো দিন কেটে যাবে শুধু নাম বলতেই।

প্রথম অবতরণের লাইব্রেরীতে বসে মাঝে-মাঝে ক্যালডরের এই যৌক্তিক কারণে সুখী আর নির্ঝঞ্ঝাট মানুষগুলোর মধ্যে দেবতার মতো হতে ইচ্ছে করে। এখানে বসে মহাকাশযানের মেমরী ব্যাঙ্কের সঙ্গে সে মিলিয়ে দেখে যে কি বাদ বা পরিবর্তন করা হয়েছে। যদিও নীতিগতভাবে সে কোন সেন্সরশীপ সমর্থন করেনা–তবে অন্ততঃ কোন কলোনী হবার প্রাথমিক সময়ে সে একে মেনে নেবে। তবে এখন যেহেতু জিনিসটা হয়ে গেছে সেহেতু কিছুটা ধাক্কা বা সৃষ্টির বেদনা হয়তো দেয়া যায়….

কখনো কখনো সে অবশ্য মহাকাশযান হতে তরুণ ল্যাসানদের দল যারা তাদের ইতিহাস ভ্রমণে এসেছে তাদের ডাকে বাধাগ্রস্ত হয়। সে অবশ্য বিরক্ত হয় না এবং অন্ততঃ একজন আছে যার ডাক ভালোই লাগে।

খুব কাজে তারনায় আটকে না গেলে, অধিকাংশ বিকেলেই মিরিসা তার চমৎকার “বুবি” চড়ে বেড়াতে আসে। থ্যালসায় ঘোড়া দেখে আগন্তুকরা অবাক হয়েছিল। কারণ তারা পৃথিবীতেই জীবিত ঘোড়া দেখেনি। কিন্তু ল্যাসানরা প্রাণী পছন্দ করে। জেনেটিক ফাইলের বিশাল স্তূপ ঘেঁটে তারা আবার তা তৈরী করেছে। মাঝে মাঝেই তারা অপ্রয়োজনীয় এমনকি বিরক্তিকর। যেমন, থ্যালসার বাড়ী ঘরের ওপর বসে থাকা ছোট বদরগুলো।

মিরিসা সাধারণত কিছু নিয়ে আসে –ফল বা পানীয়, ক্যালডর যা আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করে। তবে তার চাইতেও আনন্দের সঙ্গে সে তার সঙ্গ উপভোগ করে। কে বিশ্বাস করবে যে পাঁচ মিলিয়ন মানুষ –শেষ প্রজন্মের অর্ধেক লোকের সামনে সে ভাষণ দিত। আর এখন মাত্র একজন শ্রোতাকেই…।

মোজেস বলছিল, যেহেতু তুমি অনেকদিন ধরে লাইব্রেরীর সঙ্গে যুক্ত, তুমি শুধু মেগাবাইটের কথাই চিন্তা কর। কিন্তু তুমি কি জান পাঠাগার শব্দটি এসেছে ‘বই’ থেকে। তোমাদের থ্যালসায় কি কোন বই আছে?

-অবশ্যই আছে, মিরিসা ক্ষুণ্ণ স্বরে বলল। বেচারী এখনও ক্যালডরের কৌতুকগুলো ঠিক ধরতে পারে না। মিলিয়ন… না হোক, হাজারের বেশি। উত্তর দ্বীপে একজন লোক আছে। সে প্রতিবছর দশটার মতো ছাপে। কয়েকশ’ করে কপি। সেগুলো খুবই সুন্দর আর খুব দামী। সেগুলো বিশেষ সব দিনের উপহার হিসেবেই চলে যায়। আমার একুশতম জন্মদিনে আমি একটা পেয়েছিলাম –অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড।

-আমি একদিন সেটা দেখব। আমি সব সময় বই পছন্দ করি। মহাকাশযানে প্রায় শ’খানেক আছে। তাই বোধহয় যখন কেউ ‘বাইট’ শব্দটা উচ্চারণ করে আমি মনে মনে সেটাকে বইয়ের আকারে ভাগ করে ফেলি… এক গিগাবাইট প্রায় মানে হাজার খানেক বই।

-তোমাদের লাইব্রেরীটা কত বড়?

ক্যালডরের ওপর থেকে চোখ না সরিয়েই মিরিসা কি বোর্ডের ওপর তার আঙ্গুল বুলিয়ে গেল।

–এটা একটা জিনিস যা আমি পারি না, মোজেস বলল–কেউ একজন বলেছিল যে একুশ শতকের পর থেকে মানব জাতি দুই প্রজাতিতে ভাগ হয়ে গেছে। মৌখিক এবং ডিজিটাল। আমি ডিজিটাল কিবোর্ড ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু আমি মৌখিক নির্দেশেই কাজ করতে পছন্দ করি।

-শেষ ঘন্টার হিসেব হচ্ছে ছয়শ’ পঁয়তাল্লিশ টেরাবাইট, মিরিসা বলল।

–হুম, প্রায় এক বিলিয়ন বই। আচ্ছা প্রথমে এর আকার কেমন ছিল?

–এটা অবশ্য না দেখেই আমি বলতে পারি। ছয়শ’ চল্লিশ।

–তার মানে সাতশ’ বছরে।

–হ্যাঁ, হ্যাঁ আমরা কেবল কয়েক মিলিয়ন বই লিখেছি।

-আমি সমালোচনা করছি না। তাছাড়া গুণগত মানের ব্যাপারটা সংখ্যার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ। আমি চাই তুমি তোমাদের ল্যাসানদের সবচে ভালো বই, সঙ্গীত আমাকে দেখাবে। আমাদের সমস্যা হচ্ছে আমরা তোমাদের কি দেব। ম্যাগেলানের সাধারণ ডাটা ব্যাঙ্কে প্রায় হাজারটা টেরাবাইট রয়েছে। তুমি কি চিন্তা করতে পার ব্যাপারটা?

-হ্যাঁ বললে তো তুমি চুপ করে যাবে। আমি অতটা নিষ্ঠুর নই।

-ধন্যবাদ। সত্যি বলছি। এটা একটা ভীতিকর সমস্যা যা আমাকে বছরব্যাপী তাড়িত করেছে। মাঝেমাঝে আমি ভাবি যে, পৃথিবী কারও জন্য আগে ধ্বংস হয়নি, মানবজাতি ধ্বংস হয়েছে যে তথ্য তারা উৎপাদন করত তা দিয়েই।

দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষ দিকে, এটা বছরে মাত্র মিলিয়ন খানেক বই উৎপাদন করত। এবং এগুলো হচ্ছে যে তথ্য বা বই সংরক্ষণ করা হত তার হিসেব। তৃতীয় সহস্রাব্দে সংখ্যাটা প্রায় একশ’ গুণ বেড়ে গেল। লেখা আবিষ্কার হবার পর থেকে পৃথিবী ধ্বংস হবার আগ পর্যন্ত, ধরা হয় যে প্রায় দশ হাজার মিলিয়ন বই লেখা হয়েছে। আর তার মাত্র দশ ভাগ আমাদের জাহাজে আছে। এর সব যদি তোমাদের আমরা দিয়ে দেই, ধরা যাক তা রাখার জায়গাও, তোমাদের ডাটা ব্যাঙ্কে হল–তোমরা বিভ্রান্ত হয়ে যাবে। এটা কোন সৌজন্য হবে না। বরং এটা তোমাদের সাংস্কৃতিক এবং বৈজ্ঞানিক উন্নতিকে থামিয়ে দেবে। এবং এর অধিকাংশই তোমরা কিছু বুঝবে না। শত শত বছর লাগবে তোমাদের সেখান থেকে মূল বস্তুটি বের করতে।

আশ্চর্য-ক্যালডর মনে মনেই নিজেকে বলল, এই সাদৃশ্যটা কখনওততা আমি ভাবিনি। এই কারণেই ভিনগ্রহের বুদ্ধিমান জীবদের সন্ধানের ব্যাপারে একটা বিপরীত মত গড়ে উঠেছিল। আমরা অবশ্য কখনোই কোন গ্রহান্তরের জীবের দেখা পাইনি, এমনকি সন্ধানও নয়। কিন্তু ল্যাসানরা সেটা পেয়েছে আর ভিনগ্রহের জীবগুলো হচ্ছি আমরা…

অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষিত থেকে আসলেও, তার এবং মিরিসার অনেক কিছুই মিলে যাবে। মিরিসার কৌতূহল এবং বুদ্ধি অবশ্যই উৎসাহব্যঞ্জক। তার মহাকাশযানের অনেক সদস্যের সঙ্গে কথা বলেও সে এমন উৎসাহ পায় না। অনেক সময় উত্তর দিতে গিয়ে ক্যালডর এমন বিপদে পড়ে যে, পাল্টা প্রশ্ন করে এড়ানো ছাড়া আর উপায় থাকে না। একদিন নাক্ষত্রিক রাজনীতির ব্যাপারে অনেকটা আলোচনার পর মোজেস বলল, আমি আশ্চর্য হচ্ছি যে তুমি এখনও তোমার বাবার কাছ থেকে এ জায়গাটার পুরো দায়িত্ব নাওনি। এটাই তোমার উপযুক্ত জায়গা।

-আমার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বাবাকে দেখেছি তো। সারা জীবন অন্যদের কৌতূহল মেটাতে আর উত্তর দ্বীপের আমলাদের ফাইল তৈরী করতে গিয়ে বেচারা নিজের জন্য কিছু করার সময় পেল না।

-আর তুমি?

-তথ্য জোগাড় করতে আমারও ভালো লাগে। কিন্তু সেগুলো ব্যবহার করতে আরও ভালো লাগে। সেজন্যই তারা আমাকে তারানা উন্নয়ন কমিটির উপ পরিচালক বানিয়েছে।

-সেটা মনে হয় আমাদের আসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মেয়রের অফিস থেকে আসার সময় পরিচালক আমাকে বলছিলেন।

-তুমি তো জান ব্র্যান্ট অতটা গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে না। এটা একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, যার শুধু কয়েকটা সম্ভাব্য সমাপ্তি তারিখ আছে। যদি অলিম্পিক বরফ ষ্টেডিয়াম আমাদের এখানে হয় তাহলে পরিকল্পনা আবার বদলাতে হবে; অবশ্য ভালোর জন্যই। অবশ্য উত্তরের লোকজন চায় ওটা তাদের ওখানে। হোক। তারা মনে করে প্রথম অবতরণের জায়গাই আমাদের জন্য যথেষ্ঠ।

ক্যালডর মৃদু হাসল। সে দুই দ্বীপের মধ্যকার বহু পুরোনো রেষারেষির কথাটা জানে।

-তাই নয় কি? এছাড়া এখন তোমরা আমাদেরকে বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে পাচ্ছ। তুমি নিশ্চয়ই খুব হিংসুক নও।

তারা পরস্পরকে এতোটাই চিনেছে যে, তারা থ্যালসা বা ম্যাগেলানকে নিয়ে নিরপেক্ষভাবে কৌতুক পর্যন্ত করতে পারে। তারা এমনকি ব্র্যান্ট এবং লোরেনকে নিয়েও কথা বলে। এবং অবশেষে মোজেস ক্যালডর পৃথিবীর কথাও বলা আরম্ভ করল।

-ওহ মিরিসা, আমি আমার বিভিন্ন কাজের কথা ভুলেই গেছি। অবশ্য তার অধিকাংশই খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। সবচে বেশিদিন কাজ করেছিলাম মঙ্গলের কেমব্রিজের সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে। এবং বোঝে ব্যাপারটা কি পরিমাণ বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে, কারণ ইংল্যান্ডে এই নামে একটা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বহু আগে।

অবশ্য শেষের দিকে, আমি আর ইভলিন তৎকালীন সামাজিক সমস্যার ব্যাপারে বেশি জড়িত হয়ে পড়েছিলাম; বিশেষত মহাপ্রস্থানের পরিকল্পনা তৈরীতে। আর দেখা গেল, আমার একটা বাগ্মিতার প্রতিভা আছে যা কিনা মানুষকে তার অবশ্যম্ভাবী ভবিষ্যৎকে মেনে নিতে সাহায্য করে।

যদিও আমরা বিশ্বাস করত। না যে আমাদের জীবনকালেই সব শেষ হয়ে যাবে-কেই বা বিশ্বাস করে বল। আর কেউ যদি বলত যে, আমাকে পৃথিবী ত্যাগ করতে হবে, যেখানে আমার সব ভালোবাসার জিনিসগুলো ছড়িয়ে আছে…

এক পশলা আবেগ তার মুখের ওপর খেলা করে গেল। মিরিসা সহানুভূতির সঙ্গে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তার এতো প্রশ্ন করার আছে, যার উত্তর দিতে একটা জীবন কেটে যাবে কিন্তু নক্ষত্রের পথে উড়ে যাবার আগে তার হাতে আছে মাত্র একটি বছর।

তারা যখন বলল, আমাকে তাদের প্রয়োজন আমি আমার সমস্ত তার্কিক এবং দার্শনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেছিলাম তাদের ভুল প্রমাণ করার জন্য। আমি অনেক বৃদ্ধ। আমার যা জ্ঞান আছে তা ওই মেমরী ব্যাঙ্কেই জমা আছে, অন্যরা আরও ভালো কাজ করবে… সবকিছুই বলেছিলাম, আসল কারণটা ছাড়া।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য ইভলিন আমার সিদ্ধান্ত তৈরী করে দিয়েছিল। এটা সত্যি মিরিসা যে, মেয়েরা অনেক দিক থেকেই ছেলেদের চাইতে শক্তিশালী, কিন্তু আমি তোমাকে এগুলো বলছি কেন?

-তাদের তোমাকে প্রয়োজন তার শেষ কথা। আমরা চল্লিশ বছর এক সাথে আছি। আর এখন মাত্র একমাস বাকী। তুমি আমার ভালোবাসাকে নিয়ে যাও তোমার সাথে। আর কখনো আমাকে খুঁজো না।

আমি আর কখনোই জানব না, সৌরজগত ছেড়ে আসার সময় পৃথিবী শেষ হয়ে যাবার যে দৃশ্য আমরা দেখেছি, সেটা সে দেখেছে কিনা।

২৫. কাঁকড়া

এর আগের সমুদ্রযাত্রায় সে ব্র্যান্টের উদোম শরীর দেখেছে, কিন্তু সেটা যে এতোটা চমৎকার পেশীবহুল তা সে বুঝতে পারেনি। যদিও লোরেন সব সময়ই শরীরের যত্ন নেয়, কিন্তু পৃথিবী ত্যাগের পর কোন খেলাধুলা বা ব্যায়ামের সুযোগ কমই ছিল। তবে ব্র্যান্ট যে প্রতিদিন কোন না কোন আয়াসসাধ্য কাজে জড়িত ছিল, তা বোঝা যায়। তার সঙ্গে মুখোমুখি লড়তে গেলে প্রাচীন পৃথিবীর মার্শাল আর্ট না জানলে লোরেনের কোন আশাই নেই এবং সেই আর্ট সে জানেও না।

পুরো ব্যাপারটাই কিম্ভুত। এখানে তার জুনিয়র অফিসাররা পেঁতো হাসি হাসছে। ক্যাপ্টেন বে একটা স্টপওয়াচ নিয়ে বসে আছেন। আর মিরিসা এমন একটা ভাব নিয়ে আছে যেন একটা তৃতীয় শ্রেণীর নায়িকা।

….দুই…এক…শূন্য…শুরু! ক্যাপ্টেন বললেন। ব্র্যান্ট একটা আহত কোবরার মতো মুচড়ে উঠল। লোরেন আঘাত এড়ানোর চেষ্টা করল এবং ভীতির সঙ্গে দেখল যে তার শরীরের কোন নিয়ন্ত্রণ তার নেই… তার পাগুলো যেন সীসার তৈরী… সে শুধু মিরিসাকে নয় সমগ্র মানবজাতিকেই হারাতে চলেছে…

ঠিক সে মুহূর্তে লোরেনের ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। কিন্তু স্বপ্নটা তাকে তাড়াতে থাকে। সে এখনও এ ব্যাপারে মিরিসাকে বলেনি।

সে ব্র্যান্টকেও এখন পর্যন্ত কিছু বলেনি। যদিও সে এখনও পুরোপুরি বন্ধুসুলভ তবুও তার সঙ্গে দেখা হলে একটা অস্বস্তি ঘিরে ধরে। তবে সে আজকে নিশ্চিত যে, নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যাপার ছাড়াও আরও বড় কিছু নিয়েই তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব।

বরফ কলে সমুদ্রের পানি আনার একশ’ মিটারের মতো লম্বা, বাঁধাই করা নালাটা একটা পুকুরের মতো জায়গায় এসে শেষ হয়েছে। সেই গোলাকার জায়গাটা একটা বরফ চাকতি তৈরীর মতো পানি ধারণ করে। যেহেতু শুধুমাত্র পানি দিয়ে চাকতিগুলো তৈরী হয়, তাই সামুদ্রিক গুলোর আঁশ মিশিয়ে দিয়ে এদের শক্ত করা হয়। এই বরফের খন্ডগুলোকে কেউ কেউ বরফের ইট বলে, যা কিনা ম্যাগেলানের দীর্ঘ যাত্রায় হিমবাহের মতো নড়াচড়া করবে না। সেই পুকুরটার পাশে দাঁড়িয়ে জলজ উদ্ভিদের সবুজ আবরণের একটা ভাঙ্গা অংশের দিকে দেখিয়ে লোরেন ব্র্যান্টকে বলল –ঐযে, দেখ।

সামুদ্রিক গুলা খেতে থাকা প্রাণীটা দেখতে অনেকটা কাঁকড়ার মতো কিন্তু আকারে মানুষের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ!

–এরকম কিছু আগে কি তুমি দেখেছ?

-না, ব্র্যান্ট শিউরে উঠে বলল, এবং সেজন্য আমি দুঃখিত নই। কি ক্ষানব একটা! ধরলে কিভাবে?

-আমরা ধরিনি। এটা নিজেই হেঁটে অথবা সাঁতরে নালা বেয়ে চলে এসেছে। তারপর এটা গুল্ম পেয়েছে এবং একটা ভালো নাস্তা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা যে সে পছন্দ করছে তাতে সন্দেহ নেই। তবে ওগুলো খুব শক্ত।

-যাক তবুও এটা নিরামিষশাসী।

–আমার সেটা পরীক্ষা করার কোন খায়েস নেই। আমি মনে করি, তুমি এটা সম্বন্ধে কিছু বলতে পারবে।

-ল্যাসান সাগরের শতশত জীব সম্বন্ধে আমরা কিছু জানি না। আমরা ভবিষ্যতে একটা গবেষণাগার বানাবো গভীর পানির জন্য। কিন্তু সব সময়ই আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু থাকে এবং খুব কম লোকই আগ্রহ দেখায়। তারা খুব শিগগিরি করবে-লোরেন ভাবল। লোরেন ভাবছিল, দেখা যাক ব্র্যান্ট কতক্ষণে নিজে নিজে বের করতে পারে…

-বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ভার্লে রেকর্ড খুঁজে দেখেছে। সে আমাকে বলেছে মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে এ ধরনের কিছু একটা ছিল। জীবাশ্মবিজ্ঞানীর এর একটা ভালো নাম দিয়েছেন। সমুদ্র কাঁকড়া। প্রাচীন সমুদ্র নিশ্চয়ই খুব উত্তেজনাকর ছিল।

-কুমার যে ধরনের জিনিস চায়। তোমরা এটাকে নিয়ে কি করবে?

–দেখব এবং যেতে দেব।

–তোমরা তো এটাকে চিহ্ন দিয়ে দিয়েছ।

আচ্ছা! ব্র্যান্ট তাহলে দেখেছে। ভালো!

–না আমরা করিনি। ভালোভাবে দেখ।

চৌবাচ্চার পাশে ঝুঁকে থাকা ব্র্যান্টের মুখে একটা হতভম্ব ভাব ফুটে উঠল। অবশ্য সেই দানব কাঁকড়া ব্র্যান্টকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে তার খাওয়া চালিয়ে যেতে লাগল।

প্রাণীটার একটা দাঁড়া অন্যান্যগুলোর মতো নয়। এর ডান দাঁড়ার মধ্যে একটা ধাতব তার এমনভাবে কয়েকবার পেঁচানো হয়েছে; যেটাকে প্রাচীন ধরনের ব্রেসলেট বলা যায়।

ব্র্যান্ট ধাতব তারটাকে চিনতে পারল। এবং তার মুখ হা হয়ে গেল–কয়েক সেকেন্ড সে কোন কথাই বলতে পারল না।

-তাহলে আমি ঠিকই অনুমান করছিলাম, লোরেন বলল। তোমার প্রথম ফাঁদের কি হয়েছিল সেটা নিশ্চয়ই তুমি এখন বুঝেছ। আমার মনে হয় আমরা ড. ভার্লের সঙ্গে আবার কথা বলতে পারি, তোমাদের বিজ্ঞানীদের কিছু না জানিয়েই।

-আমি একজন জ্যোতির্বিদ, ম্যাগেলানের অফিসে বসে অ্যানি ভার্লে আপত্তি জানালেন, তোমাদের যা দরকার তা হচ্ছে প্রাণীবিদ, জীবাশ্মবিদ, নৃতত্ত্ববিদ এবং আরও কিছু ‘বিদ’দের খিচুড়ী। আমার পক্ষে যতটুকু ভালোভাবে খোঁজা যায় তা আমি খুঁজেছি। এবং তোমরা সে তথ্য জমা-২ এর কাকড়া’ নামের ফাইলে পাবে। এখান তোমাদের যা করতে হবে তা হলো ‘খোঁজা’ আশা করি সেটা তোমরা ভালোই করবে।

ড. ভার্লে চেঁচামেচি সত্ত্বেও যে কাজ করেছেন তা তার যোগ্যতার পরিচয়ই দেয়; বিশেষতঃ মূল তথ্য ভান্ডারের বিশালত্বের পরিমাপে। একটা ব্যাপার অবশ্য এখন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, প্রাণীটার সমস্ত আগ্রহ চৌবাচ্চাটাকে ঘিরে, যারা আসছে যাচ্ছে বা তাকে পর্যবেক্ষণ করছে, সে ব্যাপারে তার কোন আগ্রহ নেই।

যদিও সে দেখতে ভয়ংকর, তার দাঁড়াগুলোই প্রায় এক মিটার লম্বা এবং এক আঘাতেই সম্ভবত যে কারও. মাথা পড়ে যাবে। তবে এটা মোটেও আক্রমণাত্মক নয়। এর পালাবার কোন ইচ্ছে নেই, সম্ভবতঃ প্রচুর খাবারের কারনেই। সাধারণভাবে ধরা হচ্ছে যে, সামুদ্রিক গুল থেকে বের হওয়া কোন রাসায়নিক নিঃসরণই তাকে এখানে আকৃষ্ট করেছে।

সে যদিও বা সাঁতার কাটতে জানে তা দেখাবার কোন চেষ্টা এখনও পর্যন্ত সে করেনি। ছয় দাঁড়া দিয়েই সে ক্রমাগত হেঁটে চলছে। এর চার মিটার লম্বা দেহটা রঙ্গীন বহিঃকঙ্কাল দিয়ে আবৃত। আর এর সংযোগগুলো একে বিস্ময়কর রকম নমনীয়তা দিয়েছে।

আরেকটা বিস্ময়কর জিনিস হচ্ছে এর ঠোঁটের মতো মুখের পাশে আঙ্গুলের মতো বা বলা যায় শুড়ের মতো জিনিসটা। এর অস্বস্তিকর রকমের সাদৃশ্য আছে মানুষের আঙ্গুলের সঙ্গে। খাবার নেয়াটাই যদিও এর প্রাথমিক কাজ বলে মনে হয়, কিন্তু এটা নিশ্চিত যে, এটা তার চাইতে অনেক বেশি কাজই করতে পারে। আর কাঁকড়াটা তার দাঁড়ার সঙ্গে যেভাবে সেটাকে কাজ করায় তাও আশ্চর্যজনক।

এর দুজোড়া চোখ আছে। এক জোড়া বড় এবং সম্ভবতঃ ম্লান আলোর জন্য, কারণ দুপুরের সময় সে দু’টো বন্ধ আছে–এবং সম্ভবতঃ খুব ভালো কাজ দেবে সেগুলো। সব মিলিয়ে, প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে চলতে এবং প্রভুত্ব করতে প্রয়োজনীয় সব অঙ্গই এর আছে, যা বুদ্ধিমত্তার প্রাথমিক চিহ্ন।

অবশ্য ডান দাঁড়ায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে তার লাগান না থাকলে কেউই এই কিস্তুত জীবটার মধ্যে বুদ্ধিমত্তা খুঁজত না। তবে সেটাও কিছু প্রমাণ করে না। কারণ, রেকর্ডে দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীতেও মানুষের তৈরী জিনিসপত্র সংগ্রহ করে এবং ব্যবহার করে এমন বহু প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল। ঠিকমতো প্রমাণ না দেয়া না থাকলে সম্ভবতঃ কেউই বিশ্বাস করত না অস্ট্রেলিয়ার দর্জি পাখী বা উত্তর আমেরিকার এক জাতের ইঁদুরের রঙ্গীন এবং উজ্জ্বল জিনিস সংগ্রহের বাতিক ছিল; এমনকি সেগুলো তারা বেশ শৈল্পিক ভাবেই সাজাত। পৃথিবীতে এমন বহু রহস্য ছিল। যার সমাধান অবশ্য আর কখনোই হবে না। থ্যালসার দানব কাঁকড়া সম্ভবত সেই মননশূন্য ধারারই এক দুর্বোধ্য অংশ মাত্র।

বেশ কয়েকটা তত্ত্ব এখন এসেছে। সবচে জনপ্রিয়টা হল যে এটা একটা গহনার মতো–যেহেতু এটাই এর মননশীলতাকে সবচেয়ে কম গুরুত্ব দেয়। এটাকে এমনভাবে সাজাতে নিশ্চয়ই বেশ পরিমাণ দক্ষতা লাগে এবং তার জন্য কোন সাহায্যকারী লাগে কিনা তা নিয়ে বেশ ভালো রকম বিতর্ক চলছে।

অবশ্য সে সাহায্যকারী মানুষও হতে পারে। হতে পারে কাঁকড়াটা কোন প্রাচীন বিজ্ঞানীর পোষা প্রাণী। যদিও তা বাস্তবিকই অসম্ভব। যেহেতু থ্যালসায় সবাই সবাইকে চেনে, সেজন্য কোন গোপন ব্যাপারই দীর্ঘদিন গোপন থাকে না।

আরেকটা কষ্ট-কল্পিত তবে সেটাই সবচে দুশ্চিন্তার-তথাপি সম্ভাবনাময় ব্যাখ্যা-ব্রেসলেটটা কোন ধরনের পদমর্যাদার চিহ্ন!

২৬. তুষার

লেঃ ইয়েন ফ্লেচারের কাজটায় যেমন দক্ষতার দরকার আছে, তেমনি এটায় আছে প্রচুর একঘেঁয়ে অবসর। যার ফলে লেঃ ফ্লেচার অনেক সময় ধরেই অনেক কিছু ভাবে।

তার কাজ হচ্ছে, প্রায় ছয়শ টন ওজনের অসম্ভব শক্তিশালী একটা তারকে গুটানো। যেটা দিনে একবার স্বয়ংক্রিয়ভাবেই থ্যালসায় নেমে যায়। সেসময় প্রায় তিরিশ হাজার কিলোমিটার লম্বা একটা বাঁকা, জটিল তারের পথ তৈরী হয়। স্বয়ংক্রিয়ভাবেই এটা নিচের অপেক্ষমান ওজনের সঙ্গে লেগে যায় এবং সব ঠিকঠাক হলে তা ওপরে ওঠানো আরম্ভ হয়।

এর মধ্যে তুষার ফলকগুলোকে বরফ কল থেকে ওঠানোর মুহূর্তটা আর ম্যাগেলানের এক কিলোমিটারের মধ্যে বিশাল তুষারফলকগুলোকে চূড়ান্তভাবে রাখার সময়টা হচ্ছে সবচেয়ে সূক্ষ্ম কাজ। ওঠানোর কাজ শুরু হয় মধ্যরাতে। ছয় ঘন্টার মধ্যে সেটা সম্পন্ন হয়।

এই কাজটা দিনে করা হয় না, কারণ তাহলে ওই বরফকে থ্যালসার সূর্যের তাপে বাষ্প হওয়া থেকে রক্ষা করতে আরেকটা বর্ম বানাতে হবে। তাই গ্রহের নিরাপদ ছায়ার নীচে রোবট পরিবহনকারীরা তাপ-নিরোধক পাত দিয়ে ঘেরা বরফগুলোকে উপরে নিয়ে যায়।

উপরে যাবার পর, ওঠানোর যন্ত্রটাকে বরফ থেকে সরিয়ে নিয়ে আবার ফেরত পাঠানো হয়। কখনো কখনো ওঠানোর যন্ত্রটা, যাকে দেখতে কোন দানবের রান্নাঘরের বিশাল ধাতব ছ’কোনা সসপ্যানের মতো লাগে, বরফের সঙ্গে এমনভাবে আটকে যায়, যে খুব সাবধানে সামান্য গরম করে সেটাকে ছাড়াতে হয়।

সবশেষে নিখুঁত ছ’কোনা বরফপাতগুলো ম্যাগেলান থেকে একশ’ মিটার দূরে নিশ্চল হয়ে ভেসে থাকে। এবং তখনই সত্যিকারের সূক্ষ্ম কাজ আরম্ভ হয়। ছয়শ’ টন বরফপাতকে মাধ্যাকর্ষণবিহীন অবস্থায় কোন মানুষ এক করতে পারে না। একমাত্র কম্পিউটারই বলতে পারে কতটুকু শক্তি কোনদিক থেকে দিতে হবে। তারপরও একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়, যে এমন কোন পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে, যার সমাধান সবচে বুদ্ধিমান রোবটের পক্ষেও সম্ভব নয়। অবশ্য ফ্লেচারের সামনে এমন কোন পরিস্থিতি আসেনি, তবে সে তার অপেক্ষায় আছে।

সে নিজেকেই বলল, আমি একটা বিশাল বরফের মৌচাক তৈরী করছি। এই মৌচাকের প্রথম পরত তৈরী হয়ে গেছে প্রায়, আরও দুই পরত বাকী। কোন দুর্ঘটনা না হলে আর একশ পঞ্চাশ দিন পর পুরোটাই তৈরী হয়ে যাবে। তারপর ম্যাগেলানকে আস্তে চালিয়ে এর দৃঢ়তাটা পরীক্ষা করেই শুরু হবে নক্ষত্রের পথে যাত্রা।

ফ্লেচার তার কাজটা ঠিকভাবেই করছে, বেশ মনোযোগ দিয়েই করছে, তবে মন দিয়ে নয়। কারণ সেটা আপাতত থ্যালসায় হারিয়ে গেছে।

সে জন্মেছিল মঙ্গলে, তার মাতৃভূমিতে যে সব সুন্দর জিনিস ছিল না, তার প্রতিটিই এই গ্রহে বর্তমান। সে দেখেছে তার পূর্বপুরুষদের প্রজন্মের পর প্রজন্মের শ্রমে গড়া সভ্যতাকে আগুনে পুড়ে যেতে। সেই সভ্যতাকে আবার একশ বছর পরে গড়ার কি দরকার, যখন এখানেই একটা স্বর্গ বর্তমান!

এবং অবশ্যই তার জন্য একটি মেয়েও প্রতীক্ষায় আছে, নীচের দক্ষিণ দ্বীপে… সে প্রায় সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে, যখন সময় আসবে, সে মহাকাশযান থেকে পালাবে। তেরানরা তাকে ছাড়াই যেতে পারবে; তাদের নিজস্ব জ্ঞান এবং দক্ষতা দিয়েই। এবং সম্ভবতঃ সাগান-২ এ তাদের হৃদয় এবং শরীর দুইই বিধ্বস্ত হবে সেই পাথুরে গ্রহে। সে তাদের সৌভাগ্যই কামনা করে। তবে তার কাজ শেষ হলে, তার গ্রহ হবে এটাই। তিরিশ হাজার কিলোমিটার নীচে, ব্র্যান্ট ফ্যাকনরও সে মুহূর্তে একটি স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত নিল। –আমাকে উত্তর দ্বীপে চলে যেতে হবে।

মিরিসা চুপচাপ শুয়ে ছিল। ব্র্যান্টের মনে হল অনেকক্ষণ পর মিরিসা জিজ্ঞেস করল।

-কেন? কোন বিস্ময়, কোন প্রশ্ন তাতে নেই। কতটাই পরিবর্তন, ভাবল ব্র্যান্ট। তবে সে কিছু জবাব দেবার আগেই মিরিসা বলল, তুমি সেখানেও এটা পছন্দ করবে না।

–সম্ভবতঃ এখানকার চাইতে ভালো হবে; অন্ততঃ এখন যা হচ্ছে। এটা এখন আর আমার বাড়িও নয়।

-এটা সব সময়ই তোমার বাড়ি থাকবে।

–যতক্ষণ ম্যাগেলান আকাশে আছে, ততক্ষণ নয়।

মিরিসা আস্তে করে অন্ধকারের দিকে এগিয়ে গেল।

–ব্র্যান্ট, আমি এটা চাইনি। এমনকি সম্ভবতঃ লোরেনও নয়।

–তাতে কি আমার কোন আনন্দিত হবার কারণ আছে? সত্যি বলতে আমি ভেবে পাইনা, তুমি তার মধ্যে কি পেয়েছ?

মিরিসা প্রায় হেসে দিচ্ছিল। আশ্চর্য! মানব ইতিহাসে কত পুরুষ কত নারীকে এবং কত নারী কত পুরুষকে এই কথাটা বলেছে, ‘ওর মধ্যে তুমি কি পেয়েছ?

কোন উত্তর অবশ্য সে দিল না। অবশ্য দেয়ার চেষ্টাও বোকামী। তা শুধু ব্যাপারটাকে আরও জঘন্য করে তোলে। তবে কখনো কখনো সে নিজেই নিজের সন্তুষ্টির জন্য সঠিকভাবে বের করতে চায় যে, কি জন্যে সে আর লোরেন সেই প্রথম চোখাচোখির পর এমনভাবে এক হয়ে গেল।

এর বেশীর ভাগটা অবশ্য ভালোবাসার সেই অজানা রসায়ন, যা কোন যৌক্তিক বিচারের বাইরে, যা অন্যকে বোঝানো যায় না, কল্পনার ভিন্নতার কারণেই। তবে এছাড়াও অন্যান্য ব্যাপার আছে যা যুক্তির সাহায্যে বোঝা যায়। পরস্পরকে ভালোভাবে চেনা উচিত। সেটা পরবর্তী বিচ্ছেদকে সহজে মেনে নিতে সাহায্য করে।

প্রথমত, তেরানদের ঘিরে যে বিষাদময় গৌরব আছে, তার একটা প্রভাবতো আছেই। কিন্তু সেটাতো লোরেনের অন্যান্য সাথীদের মধ্যেও আছে। লোরেনের মধ্যে এমন কি আছে, যা ব্র্যান্টের মধ্যে নেই?

প্রেমিক হিসেবে দুজনের মধ্যে ফারাক খুব কম। লোরেন একটু বেশি কল্পনাবিশ্বাসী, ব্র্যান্ট বেশী সহনশীল, যদিও শেষ কয়েক সপ্তাহে সে একটু খুঁতখুঁতে হয়ে উঠেছে। সে দু’জনের সঙ্গে সুখী। তাহলে জিনিসটা কি?

সম্ভবতঃ সে এমন কোন উপাদান খুঁজছে যার কোন অস্তিত্ব নেই। কোন বাড়তি গুণ নয়, সামগ্রিক বিচারে হয়তো লোরেন ব্র্যান্টের চাইতে কয়েক পয়েন্ট বেশী পেয়ে এগিয়ে গেছে, ব্যাপারটা হয়তো এমনই হবে।

তবে একটা ব্যাপারে লোরেন ব্র্যান্টের চাইতে কয়েকগুণ এগিয়ে আছে। তার একটা গতি আছে, আকাঙ্খা আছে যা কিনা থ্যালসায় দুর্লভ। আসলে এজন্যই লোরেনকে সে পছন্দ করছে।

ব্র্যান্টের কোন উচ্চাকাংখা নেই; যদিও তার ইচ্ছাশক্তি কম নয়। তার এখনও অসমাপ্ত মাছ ধরার ফাঁদ সেটাই প্রমাণ করে। মহাবিশ্বের কাছে তার একমাত্র চাওয়া হল মজার কোন যন্ত্র। মিরিসার মনে হয়, সেও ব্র্যান্টের কাছে তেমন কোন মজার যন্ত্র।

বিপরীত দিকে লোরেন হচ্ছে বরেণ্য অভিযাত্রী আর আবিষ্কারকদের উত্তরসূরী। সে ইতিহাস তৈরী করছে, ইতিহাসের সঙ্গে চলছে না। এবং সে ক্রমেই আরও উষ্ণ এবং মানবীয় হয়ে উঠছে।

–উত্তর দ্বীপে তুমি করবে? ফিসফিসিয়ে সে এটাই প্রমাণ করল যে সে মেনেই নিয়েছে।

-তারা ক্যালিপসোকে ঠিক করতে সাহায্য চেয়েছে। উত্তরের লোকেরা সাগরকে বোঝে না।

মিরিসা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। ব্র্যান্ট পালিয়ে যাচ্ছে না। কাজেই যাচ্ছে। কাজ তাকে স্মৃতির ব্যাপারটা ভুলিয়ে রাখবে-সম্ভবতঃ যতদিন আবার তাকে জাগিয়ে তোলার সময় না হবে।

২৭. পেছনের আয়না

মোজেস ক্যালডর মডিউলটাকে আলোর দিকে এমনভাবে তুলে ধরলেন, যেন তিনি তার মাঝের জিনিসটা পড়ে ফেলতে পারছেন। তিনি বলছিলেন,

আমার কাছে এটা একটা জাদুর মতো মনে হয় যে, আমি আমার বুড়ো আঙ্গুল আর তর্জনীর মাঝে প্রায় এক মিলিয়ন বই ধরে রাখছি। আমার অবাক লাগে যে, ক্যাক্সটন ও গুটেনবার্গ এটা দেখলে কি ভাবতেন?

–কে? মিরিসা জিজ্ঞেস করল।

-–ওঁরাই মানব জাতিকে বই পড়তে শিখিয়েছেন। কিন্তু আমার প্রতিভাহীনতার কারণে এখন আমাদের মূল্য দিতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে আমি দুঃস্বপ্ন দেখি যে, এরকম একটা মডিউল, যাতে কোন মূল্যবান তথ্য ধর, মহামারী ঠেকানোর উপায় সমন্ধেই বলা আছে-তা বের করার ঠিকানাটা আমরা হারিয়ে ফেললাম। তথ্যটা ওই বিলিয়ন পৃষ্ঠার কোথাও আছে, কিন্তু ঠিক কোথায় সেটা আমরা জানি না। কি দুর্ভাগ্যজনক হবে চিন্তা কর যে, তথ্যটা তোমার হাতের মুঠোয় কিন্তু তুমি তা খুঁজে বের করতে পারবে না।

-সেটা কোন সমস্যাই না, ক্যাপ্টেনের সেক্রেটারী বললেন। জন লিরয় তথ্য জমা এবং খুঁজে বের করায় একজন এক্সপার্ট। এ মুহূর্তে তিনি মহাকাশযান এবং থ্যালসার আর্কাইভের ভেতর তথ্য বিনিময় করছেন। তুমি মূল শব্দগুলো জানলেই হল। আমরা তখন একটা খোঁজার প্রোগ্রাম করব। বিলিয়ন পৃষ্ঠার মধ্যেও কয়েক সেকেন্ডে তা তথ্য বের করে আনবে।

-তুমি আমার দুঃস্বপ্নটা মাটি করলে-হতাশ স্বরে ক্যালডর বলল। তারপরই আবার হঠাৎ অনুপ্রাণিত হয়ে জিজ্ঞেস করল-কিন্তু তুমি তো মূল শব্দ বা কি ওয়ার্ড হারিয়ে ফেলতে পার। আচ্ছা তুমিই বল, জীবনে তুমি কতবার এমন কোন তথ্যের সম্মুখীন হয়েছ, যা তোমার লাগবে, অথচ সেই প্রয়োজনটাই তুমি জানতে না।

-তোমার প্রোগ্রামিংটা একেবারেই গোলমেলে–লেঃ লিরয় মন্তব্য করল।

তারা এই তর্কটা বেশ উপভোগ করে। এবং মিরিসা প্রায়ই বোঝে না, কখন এটাকে গুরুত্ব দিয়ে নিতে হবে।

জন এবং মোজেস কখনোই চায় না, মিরিসা তাদের কথার বাইরে থাকুক। কিন্তু তাদের অভিজ্ঞতার পরিধি এতো বিশাল, যে মিরিসার মাঝে মাঝে মনে হয়, সে কোন দুর্বোধ্য ভাষা শুনছে।

-যাই হোক, এতে মূল সূচীটা অছে। অন্যান্য জায়গায় কি আছে, তা আমরা দু’জনেই জানি। এখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কি তথ্য আমরা নিচে দেব। কারণ, পঁচাত্তর আলোক বর্ষ দূরে বসে কোন তথ্য দেয়াটা একটা কষ্টদায়ক কাজ হয়ে যাবে, খরচের কথা বাদই দিলাম।

-আমাকে তোমরা মনে করিয়ে দিলে, মিরিসা মুখ খুললো। যদিও তোমাদের বলা আমার উচিত না। তবে, গত সপ্তাহে উত্তর দ্বীপ থেকে একটা প্রতিনিধিদল এসেছে প্রেসিডেন্ট এবং বিজ্ঞান একাডেমীর কাছে।

-দাঁড়াও, অনুমান করছি। কোয়ান্টাম ড্রাইভ!

-ঠিক।

–তারা কি প্রতিক্রিয়া দেখাল।

-তারা আনন্দিত এবং অবাকও হয়েছে যে, এটা সত্যিই আছে। তারা একটা কপি নিয়ে গেছে।

–তাদের সৌভাগ্যই কামনা করি। এবং তুমি সেটা ওদের বলতে পার। একবার একজন বলেছিল যে, মহাবিশ্ব জয়ের জন্য কোয়ান্টাম ড্রাইভের আসলে কোন প্রয়োজন নেই।

আমাদের এই শক্তিটা লাগবে সেই দিন, যখন মহাবিশ্ব আদি ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবার জন্য সংকুচিত হবে। তখন সেটাকে ঠেকিয়ে নতুন ভাবে মহাবিশ্বের প্রসারণ ঘটানোর জন্য আমাদের এটা প্রয়োজন হবে।

-এই প্রশাসনের জীবদ্দশায় নয়। এসো কাজ করা যাক। এখনও প্রায় গিগাবাইট বাকি।

আর কখনো কখনো ক্যালডর প্রথম অবতরণের পাঠাগার থেকে বেরিয়ে পড়ে বিশ্রামের জন্য। এরপর সে কম্পিউটার নির্দেশিত চিত্র প্রদর্শনীর একটা ভ্রমণ নেয় (কখনোই এক ভ্ৰমণ পথ নয়, সে যতটা সম্ভব দেখতে চায়)। যাদুঘরটা তাকে পুরানো দিনে নিয়ে যায়। সেখানে সারাক্ষণই ছাত্রদের বা বাচ্চাসহ বাবা-মায়ের বিশাল ভীড় থাকে। মাঝে মাঝে মোজেস ক্যালডরের অপরাধীই লাগে নিজেকে, যখন সে বিশেষ সুবিধা প্রাপ্ত হিসেবে ভীড়ের একদম মাথায় ঢুকে যায়। সে নিজেকেই স্বান্তনা দেয় এই বলে যে, থ্যালসানদের সারা জীবনটাই পড়ে আছে এই অমূল্য সম্পদ দেখার, যে বিশ্বের সঙ্গে তারা কোন দিনই পরিচিত হতে পারবে না। অথচ তার হাতে আছে মাত্র এক বছর, এই পুরোনো স্মৃতি উসকে দেবার। তার নতুন বন্ধুদের মোজেস ক্যালডর মাঝে মাঝে বোঝাতে পারে না যে, অনেক কিছুই যা তারা একসাথে দেখছে, তা মোজেস আগে দেখেনি। যা কিছু সে দেখছে, তা অন্ততঃ আটশ’ বছরের পুরোনো, তার সময় হতে। থ্যালসার মহাকাশযান পৃথিবী ছেড়েছে ২৭৫১ সালে; আর সে জন্মেছে ৩৫৪১ সালে। তারপরও মাঝে মাঝে এমন সব চেনা জিনিস দেখা যায়, যা তার স্মৃতিকে ধরে ভীষণ নাড়া দেয়।

‘রাস্তার পাশের ক্যাফে’ হচ্ছে সবচেয়ে অপ্রাকৃত প্রদর্শনী এবং সবচে স্পর্শকাতর। একটা চাঁদোয়ার নীচে এককাপ কফি বা ওয়াইন নিয়ে সে ছোট্ট টেবিলটায় বসে থাকে, আর তখন ব্যস্ত একটা নগরীর জীবন তার চারপাশ দিয়ে বয়ে চলে। যতক্ষণ না সে টেবিল থেকে উঠে দাঁড়ায়, ততক্ষণ বাস্তব আর এই বিভ্রমের মধ্যে সে কোন ফারাক করতে পারে না। ক্ষুদ্র ভাবেই, পৃথিবীর বিখ্যাত শহরগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে। রোম, প্যারিস, লন্ডন, নিউইয়র্ক-গ্রীষ্মে এবং শীতে-দিনে এবং রাতের প্রেক্ষাপটে সে দেখে টুরিস্ট আর ব্যবসায়ী, ছাত্র আর প্রেমিক প্রেমিকারা হেঁটে চলছে। এটা যে রেকর্ড করা তা মনে থাকলেও যখন তারা শতাব্দীর প্রাচীন সময়ে থেকে তার প্রতি হাসি ছুঁড়ে দেয়, সে সাড়া না দিয়ে পারে। বাকি যে দৃশ্যগুলো ওখানে আছে, তাতে কোন মানুষ বা তার সৃষ্টি নেই। মোজেস ক্যালডর আবার তাকিয়ে দেখে, যেমন সে দেখেছে আরেক জীবনে, ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের উঠে আসা ধোয়া, গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের উপরে উঠে আসা চাঁদ, হিমালয়ের তুষার মুকুট, অ্যান্টাকর্টিকার বরফ। শহরের দৃশ্যের মতোই হাজার বছর পরেও রেকর্ডে তাদের এতোটুকু পরিবর্তন হয়নি। এবং যদিও তারা মানুষের চাইতে বহু আগে থেকেই বেঁচে ছিল, মানব সভ্যতা তাদের চাইতে বেশি বাঁচেনি।

২৮. ডুবন্ত অরণ্য

কাঁকড়াটার খুব একটা তাড়া ছিল না। পঞ্চাশ কিলোমিটার অতিক্রম করতে এটা দশ দিন সময় নিল। শব্দ তৈরীর যে যন্ত্রটা কিছুক্ষণ পর পর এর জায়গা বুঝিয়ে দেয় (যন্ত্রটা পরাতে কষ্ট না হলেও কাঁকড়াটা বেশ রেগে গিয়েছিল) সেটা দিয়ে একটা কৌতূহলোদ্দীপক যে তথ্য পাওয়া গেল-কাঁকড়াটা ঠিক সোজা পথে চলছে অর্থাৎ কোথায় যেতে হবে এটা জানে।

গন্তব্যটা যেখানেই হোক না কেন, বোঝা গেল এটা সেখানে পৌঁছে গেছে। প্রায় আড়াইশ’ মিটার গভীরে, সেখানে যাবার পর এটা ঘোরাফেরা করছিল, কিন্তু খুব নির্দিষ্ট গন্ডীর ভেতরেই। এভাবে দুদিন যাবার পর হঠাৎ করেই একদিন সংকেত দেবার মাঝপথে যন্ত্রটা চুপ করে গেল।

কাঁকড়াটাকে এর চাইতেও বড় কিছু খেয়ে ফেলেছে, এমন একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হল খুবই আদিম ধরনের। কারণ যন্ত্রটা শক্ত ধাতুর পাতে মোড়ানো। এটাকে কোন দাঁত বা দাঁড়া দিয়ে ভাঙ্গতে গেলেও মিনিটখানেক সময় লাগবে আর কেউ গিলে ফেললেও পেটের মধ্যেও এটা কাজ করবে।

আর দুটো ব্যাখ্যা ছিল। তার প্রথমটা উত্তরের সমুদ্র তলদেশের পরীক্ষাগারের লোকজন দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখান করল।

-প্রতিটি জিনিসের একটা করে বিকল্প ছিল। পরিচালক বলছিলেন, তাছাড়াও মাত্র দু’সেকেন্ড আগে সব কিছু ঠিক থাকার সংকেত দিয়েছে যন্ত্রটা। এটা কোন যান্ত্রিক গোলযোগ হতেই পারে না।

তাহলে আর বাকী থাকল একটা অসম্ভব ব্যাখ্যা। যন্ত্রটার সুইচ অফ করে দেয়া হয়েছে। আর সেটা করতে হলে উপরের বন্ধ ঢাকনাটা খুলতে হবে।

আর সেটা কোনো দুর্ঘটনা হতে পারে না, সেটা হবে একটা ইচ্ছাকৃত চেষ্টা।

দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট, বিশ মিটার লম্বা ক্যালিপসো জাহাজটা থ্যালসার সবচে বড় জাহাজ না হলেও একমাত্র সামুদ্রিক গবেষণার জাহাজ। লোরেন অবাক হয়ে আবিষ্কার করল যে উত্তর দ্বীপে রাখা এই জাহাজটির বৈজ্ঞানিক সদস্যরা এবং তারানার যাত্রীদের মধ্যে যে পরিহাস চলে, তাতে বোঝা যায় এরা তাদের অশিক্ষিত জেলে বলেই ভাবে। যেমন, দক্ষিণের লোকেরা কখনোই মনে করিয়ে দিতে ভোলে

যে, তারা কাঁকড়াগুলোকে আবিষ্কার করেছে। লোরেন অবশ্য কখনোই বলেনা যে, ঘটনাটা ঠিক সে রকম নয়।

ব্র্যান্টের সঙ্গে আবার দেখা হওয়াটা অবশ্য সামান্য অনাকাংখিত। তবে লোরেন জানত যে এটা হবে। বিশেষতঃ সে যখন ক্যালিপসোর নতুন যন্ত্রপাতিগুলো দিয়েছে। তারা পরস্পরকে শীতল ভদ্রতার সঙ্গে স্বাগত জানাল-অন্যান্য যাত্রীদের উৎসুক দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করেই। থ্যালসায় গোপন জিনিস বলে খুব কম জিনিসই আছে। ইতিমধ্যেই সবাই জেনে গেছে যে, লিওনার্দদের প্রধান অতিথি রুমে এখন কে থাকছে।

জাহাজের পাটাতনে রাখা ছোট সাগরতলের অনুসন্ধানী যন্ত্রটা গত দু’হাজার বছরের মধ্যকার যে কোন অনুসন্ধানীর কাছে পরিচিতই মনে হবে। এতে আছে তিনটি টেলিভিশন ক্যামেরা, একটা ধাতব জাল-যার ভেতর একটা রোবট হাতের মাধ্যমে বিভিন্ন নমুনা রাখা হয় আর বিভিন্ন দিকে চালানোর জন্য একটা পানি চালিত জেট। পানিতে নামার সঙ্গে সঙ্গে এর রোবটটা একটা ফাইবার অপটিক ক্যাবল–যা পেন্সিলের সীসার চাইতেও চিকন-সেটার সাহায্যে তথ্য ও ছবি পাঠাতে থাকে। প্রযুক্তিটা হাজার বছরের পুরোনো, কিন্তু কাজের জন্য যথেষ্ঠ।

ডাঙ্গার চিহ্ন একসময় মুছে গেল, এবং এই প্রথমবারের মতো লোরেন নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমুদ্রের মধ্যে আবিষ্কার করল। তার মনে পড়ল ব্র্যান্ট আর কুমারের সঙ্গে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে গিয়েই সে কি ভয় পেয়েছিল। অবশ্য এবার সে কিছুটা ভালো বোধ করছে, সম্ভবত জাহাজটা একটু বড় বলেই।

আশ্চর্য ব্র্যান্ট বলল। আমি এতো দক্ষিণে কখনো আগাছা দেখিনি।

প্রথমে লোরেন কিছুই দেখল না। তারপর সে পানির নিচে গাঢ় বর্ণটা ঠাহর করতে পারল। কয়েক মিনিট পর জাহাজটা এক ভাসমান গুল্মের সাগরের মধ্যে এগোতে থাকল এবং ক্যাপ্টেন এক পর্যায়ে গতি খুব কমিয়ে আনলেন।

-আমরা প্রায় এসে গেছি, তিনি বললেন, আমাদের উপস্থিতি জানানোর কোন প্রয়োজন নেই। তাই না ব্র্যান্ট?

-হ্যাঁ। আমরা সংকেত দেয়া যন্ত্রটা বন্ধ হয়ে যাবার জায়গা থেকে পঞ্চাশ মিটার দূরে আছি। গভীরতা দু’শ দশ। জিনিসটাকে ফেলা যাক।

-এক মিনিট! উত্তর দ্বীপের এক বিজ্ঞানী বলে উঠলেন। যন্ত্রটা বানাতে আমাদের অনেক সময় এবং অর্থ ব্যয় হয়েছে। এবং এর কোন দ্বিতীয়টি তৈরী হয়নি। যদি এটা এই হতচ্ছাড়া আগাছায় আটকে যায়?

একটা চিন্তাশীল নীরবতা নেমে এল। এরপর কুমার, যে কিনা আজকে বিসদৃশ রকমের চুপচাপ-সম্ভবতঃ উত্তরের দ্বীপের উচ্চ শ্রেণীর জ্ঞান দেখে সে থমকে গেছে, কথা বলে উঠল, এটাকে দেখতে বেশি খারাপ লাগছে। দশ মিটার নীচে কোন পাতাই নেই, শুধু কান্ড। জঙ্গলের মতোই তার মাঝে প্রচুর জায়গা আছে।

লোরেন ভাবল, সত্যিই এটা একটা ডুবন্ত অরণ্য। বিজ্ঞানীরা যখন প্রধান ভিডিও এবং যন্ত্রপাতিগুলোকে দেখছে, সে তখন একটা গগলস্ পরে নিল, যাতে তার চোখের সামনে রোবটের সামনের দৃশ্যই শুধু ভেসে উঠল। মানসিকভাবে সে এখন ক্যালিপসোতে নেই। তার পাশের লোকদের কথা যেন ভেসে আসছে অন্য এক জগৎ থেকে। সে এক নতুন জগৎ আবিষ্কার করছে। এ জগতে কেবল নরম নীল। আর সবুজ রং-এর খেলা, আর দৃষ্টিসীমা মাত্র তিরিশ মিটার।

-দু’শ পঞ্চাশ মিটার। আমরা খুব শিগগিরি তলদেশ দেখতে পাব। আমরা কি আলো জ্বালব, যে অবস্থা আলোর।

লোরেন কোন পরিবর্তন দেখল না। কারণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে উজ্জ্বলতা তার যন্ত্রে ঠিক করা হচ্ছিল। তবে সে বুঝতে পারল, এই গভীরতায় মানুষের চোখ কিছুই দেখবে না।

-না, দরকার না হওয়া পর্যন্ত কিছু পরিবর্তনের দরকার নেই। যতক্ষণ ক্যামেরা কাজ করছে ততক্ষণ এই আলোই থাক।

-আমরা তলদেশে চলে এসেছি। সবটাই প্রায় পাথর, বালি খুব কম।

-তাই তো হওয়া উচিত। ম্যাক্রোসিষ্টিম থ্যালাসির জন্য পাথর লাগে। তারা বালিতে বাঁচতে পারবে না।

লোরেন বুঝতে পারল বক্তা কি বলতে চাইছে। পাথরগুলোকে শেকড়গুলো এমনভাবে আঁকড়ে রেখেছে যে, তারা স্রোতে ভেসে যাচ্ছে না। অরণ্যের সঙ্গে তুলনাটা আসলেই ঠিক।

খুব সাবধানে রোবট যন্ত্র এই শেকড়ের মধ্য দিয়ে চলতে লাগল। চলতে অবশ্য খুব একটা ঝামেলা হচ্ছিল না, কারণ এই বিশাল গাছগুলোর মধ্যে বেশ ভালো। জায়গা খালি আছে। যেন মনে হয় ইচ্ছে করেই…

বিজ্ঞানীরা যারা মনিটর দেখছিল, তারাও এই অবিশ্বাস্য সত্যটি আবিষ্কার করল লোরেনের কয়েক সেকেন্ড পর!–ক্র্যাকান-কেউ ফিসফিসিয়ে উঠল–এটা কোন স্বাভাবিক অরণ্য নয়। এটা একটা বাগান।

২৯. স্যাব্রা

তারা নিজেদের বলত স্যাব্রা। প্রথম বসতি স্থাপনকারীদের পরে প্রায় দেড় হাজার বছর পর তারা জেগে ওঠে পৃথিবীর প্রতি আক্রমণাত্মক ভাব নিয়ে। অবশ্য মঙ্গলের স্যাব্রারা একদিক থেকে ছিল ভাগ্যবান। কারণ তাদের কোন মনুষ্য শক্র ছিল না। শুধু ছিল গরম, কষ্টসাধ্য আবহাওয়া আর গ্রহের বিশাল বালিঝড়। আর এ সমস্ত বাধার সঙ্গে যুদ্ধ করে তারা এটাই বলতে ভালোবাসত যে, তারা শুধু টিকেই থাকেনি, বরং তারাই যোগ্যতম। এই মন্তব্যটি অবশ্য অসংখ্য জিনিসের মতো পৃথিবী থেকে আমদানিকৃত, যদিও তাদের হিংস্র স্বাধীনতা সেটাকে কখনোই স্বীকার করত না।

প্রায় হাজার বছর ধরে তারা একটা ঘোরের মধ্যে ছিল প্রায় ধর্মের মতোই। এবং সব ধর্মের মতোই এটা তাদের সমাজে অত্যাবশ্যক ছিল। এটা তাদের জীবনকে একটা লক্ষ্য দিয়েছিল, জীবনের চাইতেও বড় কোন উদ্দেশ্য।

যতক্ষণ না হিসাব কিতাব দেখাচ্ছিল, ততক্ষণ তারা বিশ্বাস করত–অন্ততঃ আশা করত-মঙ্গল পৃথিবীর মতো ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে। যদিও দুটোই খুব কাছাকাছি, তবুও বাড়তি দূরত্বটুকু পঞ্চাশভাগ বিকিরণ কমিয়ে আনবে-সেটা হয়ত বাঁচিয়ে দেবে। দুই মেরুর প্রাচীন কিলোমিটার পুরু বরফের বাষ্প হয়ত রক্ষা করবে। সম্ভবতঃ মঙ্গলবাসী বাঁচতে পারবে যখন পৃথিবীবাসী বাঁচবে না। এমনকি সেখানে একটা ফ্যান্টাসী ছিল যদিও খুব কম লোকই তা বিশ্বাস করত–যে মেরুর সব বরফ গলে গিয়ে তাদের মৃত সমুদ্র আবার ভরে যাবে। এবং তখন হয়তো মানুষ খোলা আকাশের নিচে সাধারণ অক্সিজেন মাস্ক এবং তাপ-নিরোধক পোশাক পরেই ঘুরতে পারবে।

কিন্তু সব শেষে নির্ভুল হিসাব এই সত্যিটাকে নিষ্ঠুরভাবে মেরে ফেলল। কোন চেষ্টা বা হিসাবই তাদের ধ্বংস হতে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিল না। তারাও তাদের কোমল মাতৃগ্রহের মতোই বিলীন হয়ে যাবে।

অবশ্য এখন, ম্যাগেলানের নীচের গ্রহটা মঙ্গলবাসীদের শেষ প্রজন্মের স্বপ্নের আবার প্রতীক হয়ে এসেছে। ইয়েন ফ্লেচার যখনই নীচের অন্তহীন সাগর দেখে, একটা চিন্তা তার মাথায় বাড়ি দিতে থাকে।

নাক্ষত্রিক ছবি অনুযায়ী সাগান-২ অনেকটা মঙ্গলের মতো যেজন্য সে এবং তার সাথীদের এই অভিযানের জন্য নেয়া হয়েছে। কিন্তু তিনশ বছর বা পঁচাত্তর আলোকবর্ষ পর সেই যুদ্ধ আবার আরম্ভ করার কি মানে হয়? যেখানে বিজয় এখানে এসে গেছে এখনই? ফ্লেচার এখন মোটেই শুধু পালানোর কথা ভাবছে না। তাতে অনেক কিছু ছাড়তে হবে। থ্যালসায় লুকিয়ে থাকাটা সহজ হবে। কিন্তু ম্যাগেলান। যখন উড়ে যাবে তার যৌবনের বন্ধু এবং সাথীদের নিয়ে, কেমন লাগবে তার?

বারজন স্যাব্রা শীতনিদ্রায় আছে। যে পাঁচজন জেগে আছে তাদের মধ্যে দু’জনের সঙ্গে সে হালকা ভাবে কথাটা বলেছে এবং একটা ইতিবাচক উত্তর পাওয়া গেছে।

যদি আরও দু’জন রাজী হয়, ঘুমানো ডজনের পক্ষে তারাই কথা বলবে।

ম্যাগেলানের নক্ষত্র-যাত্রার সমাপ্তি এখানেই ঘটাতে হবে, এই থ্যালসায়।

৩০. ক্র্যাকানের সন্তান

ক্যালিপলো যখন তারনার দিকে বিশ ক্লিক গতিতে ফিরছে তখন খুব কম কথাবার্তাই হচ্ছিল। এর যাত্রীরা নীচ থেকে আসা ছবিগুলোর ব্যাপারেই চিন্তায় ডুবে ছিল। লোরেন তখনও গগলস পরে আগের ডুবন্ত জঙ্গলের দৃশ্য আবারও দেখছিল পারিপার্শ্বিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে।

যান্ত্রিক মাকড়সার মতো তার ছেড়ে দিয়ে রোবটটা বিশাল কান্ডগুলোর মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। যেগুলো উচ্চতার কারণে অনেক চিকন মনে হলেও আসলে তা মানুষের চেয়েও মোটা। এটা যে নিয়মিত সারিবদ্ধভাবে লাগানো তা এখন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। তাই যখন একটা খালি জায়গায় এসে পৌঁছান হলো তখন কেউই অবাক হল না। এবং সেখানে কলকজাগুলো সব জড়ো হয়ে আছে।

আলো জ্বালানো ঠিক হবে না, কারণ প্রাণীগুলো অন্য কারও উপস্থিতি সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। কাঁকড়াগুলোর ব্যস্ততা লোরেনকে পিঁপড়ে, মৌমাছি বা উইয়ের ওপর দেখা ভিডিওর কথা মনে করিয়ে দিল। প্রথম দেখায় এটা বিশ্বাস করা কষ্ট যে কোন নিয়ন্ত্রণকারীর বুদ্ধিমত্তা ছাড়া একাজটি হচ্ছে। তবুও তাদের ব্যবহার পৃথিবীর গোষ্ঠীবদ্ধ পোকার মতোই সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় হতে পারে।

কিছু কাকড়া বড় কাণ্ডগুলোকে ভাসিয়ে রেখেছে। অন্যরা সমুদ্র তলদেশে পাথর, পাতা এবং স্থূল কিন্তু নিশ্চিতভাবেই জাল ও ঝুড়ি জাতীয় জিনিস নিয়ে চলাচল করছে। তাহলে কাঁকড়াগুলো যন্ত্রপাতি বানাতে জানে। যদিও এটাও বুদ্ধিমত্তাকে নির্দেশ করে না। কিছু পাখী খুব সুন্দরভাবে বাসা বানাত, সাধারণ লতাপাতা দিয়েই। নিজেকে মহাবিশ্বের আগুন্তক বলে মনে হচ্ছে, লোরেন ভাবল। যে কিনা প্রস্তর যুগের পৃথিবীবাসীদের দেখছে, মানুষ যখন সবে কৃষি শিখেছে। সে কি ঠিকভাবে এধরনের একটা সার্ভে থেকে বুদ্ধিমত্তার আসল স্তরটা বের করতে পারত? অথবা নীচের এগুলো কি শুধুই স্বয়ংক্রিয় ব্যবহার?

প্রোবটা এখন এতই নীচে নেমে গেছে যে আশেপাশের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে না। এরপর একজনের মুখ থেকে একটা হঠাৎ বেরিয়ে আসা শব্দ, যা পরবর্তীতে পরিচিতিমূলক বা বৈজ্ঞানিক রিপোর্টে স্থান পেত তাই সবার মনের কথা বলে দিল–কাকড়ার ডুবন্ত শহর।

এটা অনেকটা বসবাস ও বাণিজ্যকেন্দ্রের সমন্বয়। পাঁচ মিটার উঁচু একটি পাথরের বেরিয়ে থাকা অংশ এখানে বিরাজ করছে। এর মুখে অসংখ্য কাল ছিদ্র, যার ভেতর দিয়ে একটা কাকড়া যেতে পারে এমন গর্তে ভর্তি। যদিও সেগুলো অনিয়মিত কিন্তু তবুও তার আকারটা এতই সামজ্ঞস্যপূর্ণ যে, তা যে প্রাকৃতিক নয় তা বলাই বাহুল্য। মনে হয় যেন পুরোটা একটা প্রাগৈতিহাসিক এপার্টমেন্ট।

কাঁকড়াগুলো গর্তগুলো দিয়ে ঢুকছে বেরুচ্ছে এমনভাবে যা টেলিযোগাযোগ বিহীন পুরোনো শহরের অফিস কর্মচারীদের ব্যস্ততা মনে করিয়ে দেয়। তাদের কাজকর্ম যদিও অর্থহীন মনে হচ্ছে, মানুষদের কাজকর্মও তাদের কাছে অর্থহীন মনে হবে- লোরেন ভাবল।

-আচ্ছা ওটা কি? কেউ একজন বলল। একদম ডানে, আরও কাছে যাওয়া যায় কি?

কথাটা ঝাকুনী দিয়ে মুহূর্তের জন্য লোরেনকে সমুদ্র তলদেশ থেকে জাহাজে নিয়ে এল।

প্রোব ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যটা বদলে গেল। এটা একটা আলাদা পিরামিডের মতো পাথরের কাছে নিয়ে এল। পাথরটা দশ মিটারের মতো উঁচু। দুটো কাঁকড়া নীচ থেকে সেটাকে দেখছে। এবং সেখানে একটা মাত্র ঢোকার গর্ত। লোরেনের কাছে প্রথমে কোন অস্বাভাবিকতাই ধরা পড়ল না। পরে ধীরে ধীরে কিছু ব্যতিক্রম তার কাছে স্পষ্ট হলো, আশপাশের কাঁকড়াপল্লীর পরিচিত দৃশ্যের চাইতে ভিন্ন।

অন্য সব কাকড়াই ব্যস্তভাবে চলাফেরা করছে। কিন্তু এদুটো চুপচাপ দাঁড়িয়ে ক্রমাগত মাথা নাড়ছে। এবং আরেকটা ব্যাপার হল কাঁকড়াগুলো অনেক বড়। যদিও এখানে কতটা বড় তা বোঝা কষ্টসাধ্য তবুও আশেপাশেরগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে ওগুলো প্রায় দেড় গুণ।

–ওগুলো কি করছে? কেউ ফিসফিসিয়ে বলল।

–আমি বলছি –ওগুলো গার্ড, সেন্ট্রি। অন্য একজন উত্তর দিল।

–আসলেই তাই, কেউ প্রতিবাদও করল না।

–কিন্তু ওরা কি পাহারা দিচ্ছে?

–রানী, যদি থাকে।

–কিভাবে বুঝব। যন্ত্রটা ভেতরে যাবার জন্য অনেক বড়।

এখান থেকে আলোচনাটা তত্ত্বীয় পর্যায়ে চলে গেল। রোবট পোবটা এখন পিরামিডের চূড়ার দশ মিটার ওপরে। আরও নীচে যাতে নেমে না যায় সেজন্য অপারেটর জেট কন্ট্রোলের ছোট্ট একটা মটর চালু করল। এর শব্দ বা কাঁপুনী সম্ভবত: পাহারাদারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। দুজনেই হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল। দ্রুতই তারা পিরামিডের চূড়ায় চলে এল। রোবট প্রোব থেকে মাত্র কয়েক মিটার নীচে।

–এরা লাফ দেবার আগে ভাগি, অপারেটর বলল। এরা তুলার মতোই আমাদের যন্ত্রটা ভেঙ্গে ফেলব।

কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। একটা ইতিমধ্যেই রোবটের তলা ধরে ফেলেছে এবং অন্যটা উঠছে। অপারেটরের মনুষ্য রিফ্লেক্স অবশ্য সমানই দ্রুত এবং উন্নত যান্ত্রিক সহায়তা প্রাপ্ত। সে দ্রুতই এটা ওপরে ওঠাল, রোবটের হাত বাড়িয়ে দিল যুদ্ধের জন্য এবং সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র হিসেবে সে ফ্লাড লাইট জ্বেলে দিল।

কাকড়াগুলো নিশ্চয়ই অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মানুষের মতোই বিস্ময়ে এর চোয়াল খুলে গেলে এবং এটা কোন যুদ্ধ ছাড়াই পাথরে নেমে গেল।

সেকেন্ডের জন্য লোরেনও অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর ক্যামেরা ঠিক হলে দূরে কাঁকড়াগুলো দেখা গেল। এবং এদের ডান দাঁড়ায় লাগানো ধাতব রিং-গুলো দেখে সম্ভবত কেউই অবাক হলো না।

ক্যালিপসো যখন তীরের দিকে ফিরছে সে তখনও এই দৃশ্যগুলো দেখায় এতই মগ্ন যে জাহাজের নীচ দিয়ে চলে যাওয়া মৃদু শকওয়েভ সে টেরই পেল না। কিন্তু এরপর সে চারপাশের চিৎকার হট্টগোল টের পেল। সে গগলস খুলে প্রখর রোদে প্রায় অন্ধ হয়ে গেল। কোনমতে তাকিয়ে দেখল যে দক্ষিণ দ্বীপ থেকে তারা এখনও কয়েকশ মিটার দূরে। তাহলে আমরা রীফে ধাক্কা খেয়েছি সে ভাবল। এরপর পূবদিকে যা সে দেখল তা থ্যালসার শান্ত পরিবেশে একদম বেমানান। দু’হাজার বছর ধরে মানুষের দু:স্বপ্নের মতো বিশাল এক ব্যাঙের ছাতার মতো ধোয়ার স্তম্ভ।

ব্র্যান্ট কি করছে? তীরের দিকে না গিয়ে দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে সে সমুদ্রের দিকে ছুটছে।

-ক্র্যাকান। একজন উত্তরের বৈজ্ঞানিক বলল। প্রথমে লোরেন ভাবল এ বুঝি সেই ল্যাসান বাগধারা। তারপর সে বুঝল সাময়িক একটা স্বস্তিও পেল।

-না, কুমার বলল। লোরেনের প্রত্যাশার চাইতে সে বেশীই উদ্বিগ্ন। ক্র্যাকান না। এটা আরও কাছে, ক্র্যাকানের সন্তান। জাহাজের রেডিও এর মধ্যেই অবিরাম অ্যালার্ম শুনিয়ে চলছে, মাঝে মাঝে কিছু সতর্কবাণীসহ। লোরেন এতসব হজম করার সময় পেল না, যখন অদ্ভুত কিছু একটা দিগন্তে ঘটল। ওটা ঠিক জায়গায় নেই। পুরোটাই গোলমেলে। তার মনের অর্ধেকটা এখনও কাঁকড়ার রাজ্যে। রোদ মনে হয় তার চোখে এখনও কিছু সমস্যা করছে। কারণ যদিও এখনও ক্যালিপসো হালের ওপর আছে তার মনে হচ্ছে এটা সোজা সমুদ্রের তলদেশের প্রতি ছুটছে।

না আসলে তা নয়, সমুদ্রই ক্যালিপসোকে গিলে ফেলতে চাইছে। প্রচন্ড গর্জনে আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। তাদের ওপর যে জলোচ্ছ্বাস ভেঙ্গে পড়ছে তার উচ্চতা মাপার সাহস তার হল না। এতক্ষণে সে বুঝল কেন ব্র্যান্ট গভীর সমুদ্রের প্রতি ছুটছে। অগভীর পানিতে এই ঢেউ বোট ভেঙে ফেলবে।

একটা বিশাল হাত ক্যালিপসোকে শুন্যে উঁচিয়ে ধরল। লোরেন অসহায়ভাবে ডেকের ওপর পিছলে পড়ে গেল। আশে পাশে কিছু ধরবার আগেই সে নিজেকে আবিষ্কার করল পানিতে।

জরুরী ট্রেনিংএর কথা ভাবো, লোরেন ক্রুদ্ধভাবে নিজেকেই বলল। মহাশুন্য কি সমুদ্র সব জায়গাতেই জরুরী অবস্থা এক। আসল বিষয়টা হচ্ছে ঘাবড়ে না যাওয়া, সুতরাং মাথা ঠান্ডা রাখ…

ডুবে যাবার কোন ভয় নেই। তার গায়ে লাইফ জ্যাকেট আছে। কিন্তু এটা ফোলাবার লিভারটা কই। তার কাঁপা আঙ্গুলগুলো বহুকষ্টে কোমড়ের কাছে ঠান্ডা ধাতব বস্তুটা খুঁজে পেল। সেটা অবশ্য সহজেই ঘুরে গেল এবং স্বস্তিকর ভাবেই তার চারপাশে জ্যাকেটটা ফুলে গেল।

এখন একমাত্র সত্যিকারের বিপদের কারণ হবে ক্যালিপসো যদি তার মাথায় আছড়ে পরে। কোথায় সেটা?

দূরে ওটা ভাসছে। প্রায় সব কুই ডেকে। এখন তারা তার দিকেই দেখাচ্ছে। কেউ একজন একটা লাইফ বেল্ট ছোঁড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

পানিতে অনেক আবর্জনা, চেয়ার, বাক্স, যন্ত্রপাতির টুকরো। বুদবুদ তুলে সেগুলো ধীরে ডুবে যাচ্ছে। আশা করি তারা এগুলো উদ্ধার করতে পারবে, নাহলে এটা হবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল যাত্রা, লোরেন ভাবল। কাঁকড়াদের কাছে আবার যেতে তাহলে বহু সময় লাগবে। নিজেকে এত স্থির দেখে তার বেশ গর্ব হতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে।

কিছু একটা তার ডান পায়ে আটকে গেছে। স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সে ডান পাটা ছুঁড়ল। এটা বেশ বিরক্তিকর তবু ভয়ের না, কারণ সেতো ভাসছেই আর প্রকাণ্ড ঢেউগুলো চলে যাচ্ছে।

আরেকটু সতর্কভাবে সে আবার পা ছুড়ল। এবার তার অন্য পা-টাও ঐ জিনিসে আটকে গেল। এবং এখন সে আর আগের অবস্থায় নেই। লাইফ জ্যাকেট সত্ত্বেও কিছু একটা তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নীচে।

এবার প্রথম লোরেন লোয়নসন ভয় পেল। নীচের সেই বিশাল গুল্মের কথা তার এই প্রথম মনে এল। যদিও সেগুলো নরম কিন্তু তার চরিত্র দড়ির মতো।

সে হয়তো নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারত কিন্তু তার আগেই কিছু পানি তার মুখে এক অপ্রত্যাশিত ঢেউয়ের কারণে ঢুকে গেল। কাশতে কাশতে ম বন্ধ অবস্থায় সে ফুসফুস পরিষ্কার করতে চাইল এবং পানি ও বাতাস, জীবন ও মৃত্যুর মাঝে যে মাত্র মিটার খানেক দূরত্ব সেই দূরত্ব অতিক্রমের শক্তি তার আর রইল না।

এসময় মানুষ নিজে বাঁচা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। কোন স্মৃতি, কোন অনুশোচনা, এমনি মিরিসার কথাও তার মনে এল না।

যখন সে বুঝল সে মারা যাবে কোন ভয় তার লাগেনি। শুধু পঞ্চাশ আলোকবর্ষ পেরিয়ে এমন সাধারণ মৃত্যুর জন্য তার কিছু রাগই লাগল।

তাই লোরেন লোরেনসন দ্বিতীয়বার দুশ বছর পর থ্যালসার সাগরে দ্বিতীয় মৃত্যুবরণ করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *