১০. দক্ষিণ দ্বীপ

দক্ষিণ দ্বীপ

১০. প্রথম পরিচয়

মোজেস ক্যালডর নিজেকেই বলল, বোধহয় আমার আর একটু আস্তে খবরটা ভাঙ্গা উচিত ছিল। এরা সবাই স্থির হয়ে গেছে। কিন্তু এটাই ভালো হবে, যদিও এরা প্রযুক্তির দিক থেকে অনেক পিছিয়ে আছে (গাড়ীটার অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়)। তবু তারা এটুকু অন্ততঃ বুঝবে প্রযুক্তির কি যাদু আমাদের পৃথিবী থেকে থ্যালসায় এনেছে। তারা প্রথমে আশ্চর্য হবে যে, কিভাবে আমরা এটা করেছি, এবং তারা অবাক হবে এই ভেবে, কেন?

সত্যিকার অর্থেই মেয়রের মনে এটাই ছিল প্রথম প্রশ্ন। ছোট্ট যানটার এই দুইজন মানুষ নিশ্চয়ই ভ্যানগার্ড। কক্ষপথে নিশ্চয়ই এদের হাজার এমনকি মিলিয়নও থাকতে পারে। আর থ্যালসার জনসংখ্যা কঠিন নিয়মের কারণেই আসলে পরিবেশ ভারসাম্যের নব্বই ভাগই ব্যবহার করে বসে আছে…

দুজনের মধ্যে বয়স্ক জন বললেন,

-আমি মোজেস ক্যালডর। আর ইনি হচ্ছেন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার লোরেন লোরেনসন, অ্যাসিসট্যান্ট চীফ ইঞ্জিনিয়ার-মহাকাশযান ম্যাগেলান। আমরা এই বাবল স্যুট পরার জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। এটা আমাদের পারস্পরিক সংক্রমণ হতে বাঁচার জন্যই করা হয়েছে। আমরা বন্ধুত্ব নিয়ে আসলেও আমাদের ব্যাকটেরিয়া সেরকম নাও ভাবতে পারে।

মেয়র নিজেকেই বললেন, কি চমৎকার কণ্ঠস্বর। পৃথিবী ধ্বংসের কয়েক দশক আগে এটাই ছিল পৃথিবীতে সব চাইতে পরিচিত কণ্ঠস্বর। যা মিলিয়ন মানুষকে কখনো শান্ত, কখনো খেপিয়ে তুলেছে।

মেয়রের চঞ্চল চোখ অবশ্যই মোজেস ক্যালডরের ওপর বেশীক্ষণ থাকল না। নিশ্চয়ই তার বয়স ষাট। আর মেয়রের তুলনায় সেটা একটু বেশীই। অপেক্ষাকৃত তরুণ ব্যক্তিটি বরং অনেক আকর্ষণীয়। তবে ঐ ফ্যাকাসে চামড়া সে কখনো সহ্য করতে পারবে কিনা সন্দেহ। লোরেন লোরেনসন (কি চমৎকার নাম!) দুই মিটারের মতো লম্বা, এবং তার চুল প্রায় রূপার মতো ব্লন্ড। সে অবশ্য অতটা বড় কাঠামোর নয়, যেমন ব্র্যান্ট-তবে অবশ্যই অনেক বেশী সুদর্শন।

মেয়র নারী পুরুষ উভয় ক্ষেত্রে বেশ ভালো বিচারক। সে লোরেনসনকে খুব দ্রুত ছকে ফেলে দিল। এর মধ্যে আছে বুদ্ধিমত্তা, একাগ্রতা এবং নিষ্ঠুরতাও। সে তাকে শত্রু হিসেবে পেতে কখনো আগ্রহী হবে না। তবে বন্ধু হিসেবে পেতে সে আগ্রহীই হবে অথবা আরও

একই সঙ্গে তার এবিষয়েও সন্দেহ নেই যে ক্যালডর একজন চমৎকার ব্যক্তি। তার চেহারা এবং স্বরে খুব সহজেই প্রজ্ঞা, স্থৈর্য এবং এক প্রগাঢ় দুঃখ মিশে আছে। কিছুটা অবাক করা হলেও এই দুঃখের ছায়ার নীচেই তার বাকী জীবনটা কাটাতে হবে।

অভ্যর্থনা কমিটির বাকী সবাই নিজেদের পরিচিত করাল। ব্র্যান্ট বিশাল ভদ্রতা দেখানোর পর সোজা বিমানটার কাছে গিয়ে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।

লোরেন তাকে অনুসরণ করল। একজন সতীর্থ ইঞ্জিনিয়ারকে পেয়ে সে তার কাছ থেকে থ্যালসানদের প্রতিক্রিয়াটা দেখতে চাইল। সে ঠিকই অনুমান করেছিল যে, ব্র্যান্টের প্রথম প্রশ্ন কি হতে পারে। অবশ্য ব্র্যান্ট ভারসাম্য রক্ষা করেছিল।

–এটার উড্ডয়ন ব্যবস্থাটা কি? এর জেটের ফুটোগুলো অদ্ভুত রকমের ঘোট। সত্যিই কি এরা এতোটা ছোট?

এটা অত্যন্ত সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ। প্রথমে যতটা প্রাযুক্তিক দিক থেকে আদিম মনে হয়েছিল এরা ততটা নয়। তবে সে যে উঁচু ধারণা করেছে তা একে দেখানোর প্রয়োজন নেই। বরং উল্টো আঘাত করেই তাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বোঝানো যাক।

-এটা একটা কোয়ান্টাম র‍্যামজেট। বাতাসে চলার জন্য তৈরী। যা তরল বাতাসকেই জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করে। প্ল্যাংকের সূত্র থেকে তুমি নিশ্চয়ই জান টেন টু দি পাওয়ার মাইনাস থার্টি থ্রি সেন্টিমিটার ব্যাপারটা। তাই আশেপাশে বাতাস থাকলে এটা অন্তহীন ভাবে যেতে পারে।

তাকে আবারও ব্র্যান্টকে কৃতিত্ব দিতে হবে। সে চোখ পিটপিট করে কোনভাবে বলল, দারুণ তো! যদি সে সত্যিই তাই মনে করে।

-আমি কি ভেতরে যেতে পারি।

লোরেন ইতস্ততঃ করল। আপত্তি করাটা অভদ্রতা যেহেতু এরা বন্ধুত্ব করতে অত্যন্ত আগ্রহী। তার চেয়ে বড় কথা হলো, এটা প্রমাণ করবে যে, কে এখানে আসলে প্রভুত্বপরায়ন।

-অবশ্যই। তবে কোন কিছু স্পর্শ করার ব্যাপারে সাবধান থেকো। ব্র্যান্ট অবশ্য “প্লিজ” শব্দটা শোনার চাইতে ভেতরটা দেখার জন্যই বেশী উৎসাহী। লোরেন মহাশূন্যবিমানের ছোট্ট বাতাস নিরোধক জায়গায় নিয়ে গেল। সেখানে মাত্র দু’জনের থাকার মতো জায়গা। আর ব্র্যান্টকে বাড়তি বাবল স্যুট পরাতে রীতিমত জটিল জিমন্যাস্টিক করা লাগল।

-আমার মনে হয় না এটা বেশীদিন লাগবে। কিন্তু আণুবীক্ষণীক পরীক্ষা সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা এটা পরব। জীবানুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত চোখ বন্ধ করে রাখবে। ব্র্যান্ট হালকা গোলাপী রঙ দেখেছিল আর সেখানে গ্যাসের হিসহিস আওয়াজ শোনা গেল। তার পর ভেতরের দরজা খুলে গেল তারা ভেতরের রুমে ঢুকল। পাশাপাশি বসলেও, শক্ত স্বচ্ছ আবরণটা তাদের নাড়াচাড়া অনেকটা সঙ্কুচিত করেছে। এটা তাদের এমনভাবে আলাদা করেছে যেন তারা দুই বিশ্বের, অবশ্য অনেক অর্থেই তারা তাই।

লোরেনকে স্বীকার করতেই হবে যে, ব্র্যান্ট একজন ভালো শিক্ষার্থী। কয়েক ঘন্টা সময় দিলেই সে এই যন্ত্রটা চালাতে পারবে। অবশ্য এর ভেতরে তত্ত্বটা হজম করার শক্তি তার কখনোই হবে না। অবশ্য এ ব্যাপারে প্রচলিত কথাই হলো যে, মাত্র কয়েকজন মানুষই সত্যিকার অর্থে সুপারস্পেসের জিওডাইনামিক্স বুঝত এবং তার সবাই শতাব্দীরও আগে মারা গেছে।

তারা প্রাযুক্তিক আলোচনায় এতো মগ্ন হয়ে গিয়েছিল যে, বাইরের বিশ্ব সম্বন্ধে ভুলেই গিয়েছিল। হঠাৎ একটা চিন্তিত কণ্ঠ কন্ট্রোল প্যানেল থেকে ভেসে এল,

–লোরেন? মহাকাশযান থেকে বলছি। কি হয়েছে? আধ ঘন্টা হল তোমাদের কোন খবর নেই? লোরেন অলসভাবে সুইচের দিকে হাত বাড়াল,

-তোমরা যেখানে দুটো ভিডিও আর পাঁচটা অডিও চ্যানেলে আমাদের দেখছ সেখানে এটা একটু বেশী বলা হল না? সে আশা করল ব্র্যান্ট তার মর্মার্থটা বুঝবে। আমরা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রেখেছি এবং আমরা নিশ্চিত না হয়ে কিছু করি না।

-মোজসকে দিলাম। সেই কথাবার্তা চালাচ্ছে বরাবরের মতো।

বাঁকা জানালা দিয়ে তারা দেখতে পাচ্ছিল যে ক্যালডর আর মেয়র একান্ত আলাপে মগ্ন, আর কাউন্সিলর সিমন্স মাঝে মাঝে তাতে যোগ দিচ্ছে। লোরেন একটা সুইচ চালাতেই তাদের কণ্ঠস্বর বেড়ে গিয়ে কেবিন ভরে ফেলল।

-আমাদের আতিথেয়তা। কিন্তু আপনি বুঝবেন যে জমির দিক থেকে চিন্তা করলে এটা একটা অসম্ভব ছোট বিশ্ব। আপনার জাহাজে কতজন আছে যেন বলেছিলেন।

-ম্যাডাম মেয়র, আমি কোন সংখ্যা বলেছি বলে তো মনে পড়ে না। থ্যালসা খুব সুন্দর হলেও আমাদের খুব অল্প লোকই এখানে নামবে। আমি তোমাদের ব্যাপারটা বুঝি। কিন্তু সামান্যতম সংকোচের কোন কারণ নেই। সবকিছু ভালোভাবে চললে এক বা দুই বছরের মধ্যে আমরা আবার রওয়ানা দেব।

আমরা বেড়াতে আসিনি। আমরা কাউকে এখানে আশাই করিনি। আর আলোর অর্ধেক গতিতে চলা কোন মহাকাশযান খুব ভালো কারণ না হলে এমনি এমনি থামবে না। তোমাদের এমন কিছু আছে যা আমাদের দরকার এবং তোমাদের দেয়ার মতো কিছু আমাদেরও আছে।

-যেমন, যদি কিছু মনে না করেন?

-আমাদের কাছ থেকে তোমরা যদি চাও শিল্প আর বিজ্ঞানের শেষ শতাব্দীর মানিষ্কার নিতে পার। অবশ্যই আমি তোমাদের সাবধান করব, তোমাদের সংস্কৃতিতে আমাদের উপহার কি প্রভাব ফেলবে সে ব্যাপারে সতর্ক থেক। আমরা যা দেব তার সবই নেয়াটা ঠিক হবে না।

-আমি আপনাদের সততা ও উপলব্ধির প্রশংসা করছি। আপনাদের কাছে নিশ্চয়ই অমূল্য সম্পদ আছে। কিন্তু বিনিময়ে আমরা কি দেব?

ক্যালডর অট্টহাসি দিলেন।

-সৌভাগ্যবশত, সেটা কোন সমস্যা না। এমনকি আমরা না বলে নিলেও তোমাদের চোখে পড়ত না।

থ্যালসা থেকে আমরা যা চাই তা হচ্ছে কয়েক হাজার টন পানি। আর ঠিক ভাবে বলতে–বরফ।

১১. দূত

থ্যালসার প্রেসিডেন্ট মাত্র দু’মাসের জন্য তার অফিসে এসেছেন এবং এখনও তার দূর্ভাগ্যের জন্য দুঃখ করেন। কিন্তু তার কিছু করার নেই, কেবলমাত্র তিন বছরের একটা খারাপ চাকরীকেই ভালো মতো করে যাওয়া ছাড়া। আবার গণনা করতে বলে কোনো লাভ নেই। বাছাই প্রোগ্রাম যেটা প্রজন্ম আর হাজার অক্ষরের সংখ্যার ওপর নির্ভরশীল তাকে মানুষের নিখাদ ভাগ্য বলেই মানতে হয়।

প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ (বিশটা রুম, একটা একশ জনকে বসানোর মতো বড়) থেকে বেরিয়ে যাবার ঠিক পাঁচটা পথ আছে। তোমাকে হয় তিরিশের নীচে বা সত্তরের ওপরে হতে হবে, তোমাকে নিরাময় অযোগ্য অসুস্থ হতে হবে, তুমি মানসিক রোগগ্রস্ত হতে পার কিংবা গুরুতর কোন অপরাধ করতে পার। প্রেসিডেন্ট এডগার ফারাদীনের সামনে শেষ পথটাই ভোলা এবং সে সেটা নিয়ে গভীর ভাবেই ভাবছে। তার ব্যক্তিগত ক্ষতি করলেও সে অবশ্যই স্বীকার করে যে, মানবজাতির জন্য এই সরকারটিই সম্ভবতঃ সর্বশ্রেষ্ঠ।

মাতৃগ্রহ প্রায় দশ হাজার বছর সময় লাগিয়েছে এই ব্যবস্থাটা গড়তে এবং তাও বহুবার চেষ্টা ও বীভৎস ভুলের মাধ্যমে।

যখন সমগ্র জনসংখ্যা এর সর্বোচ্চ (অনেক সময় আরও বেশী) জ্ঞান দ্বারা সিঞ্চিত হয়, প্রকৃত গণতন্ত্র তখনই সম্ভব। আর চূড়ান্ত রূপটি হল সেন্ট্রাল কম্পিউটারের মাধ্যমে প্রত্যেকের মধ্যে ব্যক্তিগত যোগাযোগ। ঐতিহাসিকদের মতে ২০১১ সালে প্রথম সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় নিউজিল্যান্ড নামের এক দেশে।

এরপর থেকে একজন রাষ্ট্রপ্রধাণ পছন্দ করা অপ্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়। যখন সবাই একমত হল যে, ঐ পদটির প্রতি সক্রিয় চেষ্টাই হবে অযোগ্যতা, তখন থেকে সব পদ্ধতিই সমান। তবে লটারী হল সবচে সহজ পদ্ধতি।

কেবিনেট সেক্রেটারী বললেন,

-মি. প্রেসিডেন্ট। অতিথিরা লাইব্রেরীতে অপেক্ষা করছে।

-ধন্যবাদ লিজা। বাবল স্ট ছাড়াই।

-হ্যাঁ সব ডাক্তারী বিদ্যাই সে কথা বলছে, এটা সম্পূর্ণ নিরাপদ-তবে স্যার আমি আপনাকে সাবধান করছি। তাদের গায়ে সামান্য গন্ধ আছে।

-ক্র্যাকান! কি ভাবে?

সেক্রেটারী হাসল,

-দুর্গন্ধ নয়। অন্তত আমার মনে হয়নি। নিশ্চয়ই এটা তাদের খাবারের সঙ্গে জড়িত। হাজার বছরে আমাদের বায়োকেমিস্ট্রি নিশ্চয়ই কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। “অ্যারোমেটিক” বললে এটা ঠিকভাবে হয়তো বোঝানো যায়।

প্রেসিডেন্ট অবশ্য ঠিকভাবে ব্যাপারটা বুঝলেন না বরং একটা বিব্রতকর প্রশ্ন। জিজ্ঞেস করবেন কিনা চিন্তা করলেন।

-আমাদের গন্ধ তাদের কাছে কি রকম লাগবে বলে তুমি মনে কর?

তার পাঁচজন অতিথি অবশ্য একে একে পরিচিত হবার সময় কেউই নাসিকা কুঞ্চিত করল না। তবে তার সেক্রেটারী এলিজাবেথ ইশিহিয়া বেশ বুদ্ধিমান। কারণ তিনি এখন “অ্যারোমেটিক” কথাটার আসল অর্থ ধরতে পেরেছেন।

অশ্ব খুরাকৃতি টেবিলে বসে থ্যালসার প্রেসিডেন্ট নিজেকে সুযোগ আর ভাগ্যের মধ্যে হাবুডুবু খেতে দেখলেন, যা নিয়ে তিনি অতীতে খুব একটা ভাবেননি। সুযোগ তাকে আজ এখানে এনেছে। এখন তার সঙ্গী ভাগ্য আবার আঘাত হেনেছে। কি অদ্ভুত, খেলার সামগ্রী তৈরীকারক, উচ্চাভিলাষহীন একজন লোক, এই ঐতিহাসিক মিটিং-এ বসেছে। তবে কাউকে তো এটা করতেই হবে এবং সে এর মধ্যেই এটা উপভোগ করতে আরম্ভ করেছে। অন্ততঃপক্ষে তার স্বাগত বক্তব্য দেয়া কেউ বন্ধ করতে পারবে না।

বক্তব্য বেশ ভালোই হয়েছিল। তবে কিনা এমন ঐতিহাসিক মুহূর্তের জন্যও কিছুটা বড়। অবশ্য শেষ দিকে তিনি বুঝতে পারছিলেন যে অতিথিদের নম্র মনোযোগ আস্তে আস্তে তুচ্ছ জিনিসে চলে যাচ্ছে। তাই তিনি শেষ দিকে কিছু উৎপাদন উপাত্ত আর দক্ষিন দ্বীপের নতুন পাওয়ার গ্রীডের ব্যাপারটা বাদ দিয়ে দিলেন। তিনি বসে পড়ে এটুকু নিশ্চিত হলেন যে একটা উদ্যমী, বর্ধনশীল উঁচু প্রযুক্তিসম্পন্ন সমাজের ছবি আঁকা গেছে। থ্যালসা পিছিয়ে বা নীচুতে নেই। এর আছে প্রাচীন প্রজন্মের রেখে যাওয়া সর্বোচ্চ রীতিনীতি।

-ধন্যবাদ মি. প্রেসিডেন্ট। একটু থেমে ক্যাপ্টেন বললেন, থ্যালসা যে বেঁচেই নেই বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে এটা অবশ্যই চমৎকার বিস্ময়। এটা আমাদের এখানে অবস্থান আরও মধুর করেছে। এবং আমরা আশা করি যাবার সময়ও আমাদের দু’পক্ষের ভেতর সদিচ্ছা ছাড়া আর কিছু থাকবে না।

-আমাকে ক্ষমা করবেন, একটা প্রশ্ন তোলা খুব রূঢ় মনে হতে পারে। তবু বলছি, কতদিন আপনারা থাকবেন এখানে? আমরা দ্রুতই জানতে চাই। কারণ। তাহলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারব।

-আমি বুঝতে পেরেছি মি. প্রেসিডেন্ট। কিন্তু এখনই আমরা নিশ্চিত হতে পারব না। কারণ আপনি কতজন সাহায্যকারী দিতে পারবেন তার ওপরও এটা নির্ভর করবে। আমার মনে হয় কমপক্ষে এক বছর, দুই বছরও হতে পারে।

এডগার ফারাদীন, অন্যান্য ল্যাসানদের মতোই তার আবেগ লুকাতে দক্ষ নয়। ক্যাপ্টেন বে প্রধাণ নির্বাহীর মুখের ওপর দিয়ে সমর্থন সূচক বা ধূর্ত বললেও হয়, ভাবটা যাওয়াতে চমকে উঠলেন।

-মহামাণ্য, মনে হয় আমরা কোন সমস্যা করিনি।

হাত ঘষতে ঘষতে সে বলল,

-আমাদের দেশে, আপনারা হয়তো জানেন না, আমাদের ২০০ তম অলিম্পিক আগামী দুবছর পর। যুবক অবস্থায় ১০০০ মিটারে আমি ব্রোঞ্জ পেয়েছিলাম। বাইরে থেকে আমরা কিছু প্রতিযোগী আনতে পারি।

কেবিনেট সেক্রেটারী বললেন,

–মি. প্রেসিডেন্ট। আমার মনে হয়, এরকম কোন নিয়ম–

-সেটা আমি বানাব। প্রেসিডেন্ট দৃঢ় স্বরে বললেন, ক্যাপ্টেন আমাদের আমন্ত্রণ অথবা আপনি মনে করলে প্রতিযোগিতা মনে রাখবেন।

ম্যাগেলানের কমান্ডার সব সময় দ্রুত আলোচনা সারতেই অভ্যস্ত। কিন্তু এবার হঠাৎ করেই তিনি থমকে গেলেন। আর এই ফাঁকে প্রধান চিকিৎসক ঢুকে পড়লেন।

সার্জন কমান্ডার মেরী নিউটন বললেন,

-সেটা অবশ্যই আপনার অসীম দয়া, মি. প্রেসিডেন্ট। তবে একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি বলছি যে আমাদের সবার বয়স তিরিশের ওপর। আমরা সবাই ট্রেনিং এর বাইরে। এছাড়া থ্যালসার মধ্যাকর্ষণ ছয় পার্সেন্ট বেশী পৃথিবীর চাইতে। তাই এগুলোর সবগুলোই আমাদের বিপক্ষে। তাই যদি অলিম্পিকে দাবা অথবা কার্ড ঢোকানো… প্রেসিডেন্টকে হতাশ দেখাল। অবশ্য দ্রুত তিনি সেটা কাটিয়ে উঠলেন।

-ঠিক আছে। তবে ক্যাপ্টেন বে, আপনাকে পুরস্কার বিতরণীর সময় থাকতেই হবে।

-আনন্দের সঙ্গে। সামান্য হতবুদ্ধি কমান্ডার বললেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে, মিটিংটা তার হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে এবং এখনই আলোচ্যসূচীতে ফিরতে হবে।

-মি. প্রেসিডেন্ট আমাদের এখানকার করণীয় সম্বন্ধে আমি কি ব্যাখ্যা করতে পারি?

-নিশ্চয়ই, কিছুটা নিরাসক্ত উত্তর এল। তিনি সম্ভবতঃ এখনও অন্য জগতে অবস্থান করছেন। হয়তো তিনি এখনও তার যৌবনের জয়কে ভাবছেন। তারপর অনেক চেষ্টায় তিনি বর্তমানে মনোযোগ দিলেন। আমরা আপনাদের আসায় সত্যি খুশী, আর স্তম্ভিত। এখানে খুব সামান্যই আছে যা আপনাদের দেয়া যায়। আমাকে বলা হয়েছে বরফের কথা, নিশ্চয়ই সেটা রসিকতা।

-না, মি. প্রেসিডেন্ট। আমরা অবশ্যই সিরিয়াস। ওটাই আমরা চাই। আমরা কিছু খাবারের নমুনাও নিয়েছি। বিশেষত দুপুরের খাবারের চীজ আর ওয়াইনের ব্যাপারে বলা যায় যে, আমরা হয়তো এর চাহিদা বাড়াব। তবে বরফ অবশ্যই। আমাকে ব্যাখ্যা করতে দিন। প্রথম দৃশ্য প্লিজ।

মহাকাশযান ম্যাগেলান–দুই মিটার লম্বা, প্রেসিডেন্টের সামনে ভাসছে। দেখার মতো কেউ না থাকলে তিনি নিশ্চয়ই ছবিটা ধরে দেখার চেষ্টা করতেন।

-আপনারা দেখছেন যে আমাদের মহাকাশযানটি উপবৃত্তাকার। চার কিলোমিটার লম্বা, এক কিলোমিটার চওড়া। যেহেতু আমরা মহাশূণ্য দিয়েই জ্বালানী সংগ্রহ করি, সেহেতু আমাদের গতির সীমা তত্ত্বীয় ভাবে আলোর সমান পর্যন্ত। কিন্তু বাস্তবে এর এক পঞ্চমাংশেই, আন্তঃনাক্ষত্রিক ধুলা আর গ্যাসের জন্য সমস্যার সম্মুখীন হই। এবং সেকেন্ডে ষাট হাজার মাইল বা তার চাইতে বেশী গতিসম্পন্ন কোন বস্তুর জন্য কোন বস্তুকে আঘাত করা একটা ভয়ংকর ব্যাপার। এমন কি এই গতিতে একটা হাইড্রোজেন পরমাণুও যথেষ্ট ক্ষতি করতে পারে।

তাই আদিম মহাকাশযানগুলোর মতো ম্যাগেলানও একটা রক্ষাবর্ম তার সামনে রাখে। যে কোন পদার্থই যথেষ্ঠ পরিমানে হলে এই কাজ করতে পারে। এবং প্রায় শূণ্য ডিগ্রী তাপমাত্রায় বরফের চাইতে ভালো আর কিছুই হতে পারে না। সস্তা, সহজ আর বিস্ময়কর রকমের শক্ত। সামনের গোলাকার জিনিসটা আমাদের ছোট্ট হিমবাহ যখন আমরা সৌরজগত ছাড়ি; দশ বছর আগে। আর এটা হচ্ছে এখনকার রূপ। ছবিটা ঝাপসা হল, তারপর আবার ফিরে এল। জাহাজটা অপরিবর্তিত হলেও সামনের ভাসমান জিনিসটা পাতলা হয়ে গেছে।

এটা হচ্ছে গ্যালাক্সীর এই ময়লা অংশ দিয়ে পঞ্চাশ আলোকবর্ষ চলার ফল। আমাদের হিসেবের চাইতে ক্ষয়ের পরিমাণ শতকরা পাঁচ ভাগের মতো বেশী। তবে সেটা কোন বিপদ নয়। অবশ্য সত্যিকারের বড় কিছুর সঙ্গে আঘাতের সম্ভাবনা থেকেই যায়। আর সেক্ষেত্রে কোন আবরণই সেটা থেকে আমাদের বাঁচাতে পারবে না। সেটা বরফেরই হোক আর স্টীলেরই হোক।

আমরা ভালোভাবেই আরও দশ আলোকবর্ষ পেরুতে পারতাম। কিন্তু সেটা যথেষ্ঠ নয়। আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে সাগান-২ গ্রহ, পচাত্তর আলোকবর্ষ দূরে।

সুতরাং মি. প্রেসিডেন্ট নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পারছেন, কেন আমরা থ্যালসায় থেমেছি। তাই আমরা আপনাদের কাছে ধার হিসেবে, আসলে সাহায্য হিসেবেই বলা ভালো, যেহেতু আমরা ফেরত দিতে পারব না, কয়েক হাজার টনের মতো পানি চাচ্ছি। আমাদের উপরের কক্ষপথেই আরেকটা বরফের বর্ম তৈরী করতে হবে, যেটা আমাদের নক্ষত্রের পথটা পরিষ্কার করে দেবে।

-আমরা কিভাবে আপনাদের সাহায্য করব? প্রযুক্তির দিক থেকে তো আপনারা শত শত বছর এগিয়ে।

-আমার সন্দেহ আছে। অবশ্য কোয়ান্টাম ড্রাইভ ছাড়া। আমাদের ডেপুটি ক্যাপ্টেন ম্যালিনা আমাদের বিবেচনার জন্য পরিকল্পনাটা পেশ করবে।

-নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।

-প্রথমে আমাদের বরফ কলের জায়গাটা ঠিক করতে হবে। অনেক জায়গাতেই সেটা হাতে পারে-উপকূলের যে কোন আলাদা জায়গায় এটা হতে পারে। এটা পরিবেশের ওপর বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া ফেলবে না। আর যদি আপনারা চান, তাহলে আমরা এটাকে পূর্ব দ্বীপেও বানাতে পারি। আশা করি ক্র্যাকান কাজ শেষ হবার আগেই জেগে উঠবে না।

কলের পরিনা পুরোটাই করা আছে। কেবল বসানোর জায়গা হিসেবে একটু এদিক ওদিক করতে হবে। অধিকাংশ মূল যন্ত্রগুলো সঙ্গে সঙ্গেই কাজ আরম্ভ করতে পারবে। এটা খুব সহজ সরল প্রক্রিয়া। দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রযুক্তি –পাম্প, শীতল অংশ, উষ্ণতা বিনিময়, ক্রেন সবই।

সব কিছু ঠিক থাকলে নব্বই দিনের মধ্যেই আমরা প্রথম বরফ পাব। আমরা প্রমাণ সাইজ ব্লক তৈরী করব। প্রতিটি দশ টনের সমতল, ছ’কোনা পাত। উৎপাদন আরম্ভ হলে আমরা প্রতিদিন এই তুষারচাকগুলো উপরে নিয়ে যাব। সেখানে কক্ষপথে সেগুলো জুড়ে বর্মটা তৈরী হবে। প্রথম ওঠানো থেকে শেষ তৈরী পর্যন্ত দু’শ পঞ্চাশ দিনের মতো লাগবে। এবং এর পর আমরা যাত্রার জন্য তৈরী হয়ে যাব। ডেপুটি ক্যাপ্টেন যখন শেষ করলেন প্রেসিডেন্ট ফারাদিন এক মুহূর্ত থমকে রইলেন, তারপর প্রায় নিমগ্ন স্বরে বললেন।

-বরফ আমি কখনো দেখিনি, ওই পানীয়ের তলানীতে ছাড়া।

হ্যান্ডসেক করে অতিথিদের বিদায় দেবার সময় প্রেসিডেন্ট ফারাদীন অবাক হয়ে উপলব্ধি করলেন যে অ্যারোমেটিক গন্ধটা তেমন পাওয়া যাচ্ছে না।

তিনি কি ওটায় অভ্যস্ত হয়ে গেছেন না গন্ধ শোঁকার শক্তি তার হারিয়ে গেছে? দুটোই অবশ্য ঠিক ছিল। তবে মাঝরাতের দিকে তিনি দ্বিতীয়টাকেই স্বীকার করে নিলেন। তিনি উঠে বুঝলেন তার চোখ জ্বলছে আর নাক এতো বন্ধ যে নিঃশ্বাস নেয়াই প্রায় দুঃসাধ্য।

-কি হয়েছে! মিসেস প্রেসিডেন্ট শঙ্কিতভাবে জিজ্ঞেস করলেন। প্রধান নির্বাহী বললেন,

-ডাক্তার ডাক। হ্যাঁচ্ছো! আমাদের আর মহাকাশযানের কাউকে। তারা কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে আমি তাদের –হ্যাচ্ছো-কিছু বলতে চাই। তোমারও হয়নি বলে আশা করি।

প্রেসিডেন্ট পত্নী তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে কিছু হয়নি-অবশ্য নাক মুছতে মুছতে। তারা অসন্তুষ্ট ভাবে বিছানায় দু’জন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

প্রেসিডেন্ট বললেন,

আশা করি সাত দিনের মধ্যেই এটা সারবে। তবে শেষ শতাব্দীতে চিকিৎসা নিশ্চয়ই কিছু এগিয়েছে।

তার আশা কিছুটা হলেও পূর্ণ হলো। বীরত্বপূর্ণ চেষ্টায়, কোন জীবনহানি না ঘটিয়েই সংক্রমনটি শেষ হয়ে গেল, দুটি বিরক্তিকর দিন পর। হাজার বছর ধরে বিচ্ছিন্ন দুই ভাইয়ের মধ্যেকার সাক্ষাতের জন্য অবশ্য এটা কোন শুভসূচনা নয়।

১২. উত্তরাধিকার

ইভলিন; এখানে আমরা প্রায় দু’সপ্তাহ। থ্যালসার হিসাবে মাত্র এগারো দিন। অবশ্য আজ বা কাল আমাদের পুরোনো বর্ষপঞ্জী ফেলে দিতেই হবে। কিন্তু আমার হৃদয় ঐ প্রাচীন পৃথিবীর ছন্দেই চলবে।

বেশ ব্যস্ত এবং আনন্দদায়ক সময় গেণ। স্বাস্থ্যগত অবশ্য একটা সমস্যা। হয়েছিল। আলাদা করে রাখা সত্ত্বেও ল্যাসানদের প্রায় বিশভাগই কোন একটা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। এবং আমাদের কারও কোন লক্ষণ না দেখায় আমরা আরও দোষী হয়ে গেছি। ভাগ্যিস কেউ মরে যায়নি। তার জন্য স্থানীয় ডাক্তারদের কোন কৃতিত্ব দেয়া যায় না। চিকিৎসা বিজ্ঞান এখানে অনেক পিছিয়ে। তারা আগেকার স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার ওপর এতো নির্ভরশীল যে নতুন কিছুই তারা সামলাতে পারে না।

অবশ্য আমাদের ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতেই দেখা হয়েছে। ল্যাসানরা খুব ভালো মানুষ, আমুদে জাতি। তারা ভাগ্যবান-বেশীই ভাগ্যবান। বিশেষত তাদের গ্রহের ব্যাপারে। আর এটা সাগান-২ কে আরও বেশী মলিন করে দিয়েছে।

জমির স্বল্পতাই তাদের মূল সমস্যা। অবশ্য তারা বুদ্ধিমানের মতো সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সংখ্যার নীচেই জনসংখ্যা স্থির রেখেছে। তারা এটাকে কখনো বাড়াতে চাইলে পৃথিবীর শহরগুলোর অতীত ইতিহাসের সতর্ক সংকেত পেয়ে যাবে।

তারা এতোই ভালো আর চমৎকার যে, তাদের সংস্কৃতি নিজস্ব প্রক্রিয়ায় উন্নত হবার চাইতে আমাদের সাহায্য করতে ইচ্ছা করে। সত্যিকার অর্থে তারা তো আমাদেরই সন্তান। তবে সব বাবা মাকেই এটা মানতে হয় যে, আজ অথবা কাল তাদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতেই হবে।

অবশ্য আমাদের উপস্থিতিটাই কিছু প্রভাব ফেলেছে। আমরা অপ্রত্যাশিত, তবে অনাহুত নই এই গ্রহে। আর তারা কখনোই ভোলে না যে, ম্যাগেলান ঠিক তাদের মাথার ওপর ঘুরছে। পৃথিবীর শেষ চিহ্ন।

আমি প্রথম অবতরণের জায়গায় আবার গিয়েছিলাম। ওটা ওদের জন্মস্থান। আর একটা ট্যুরেও গেলাম, যেটায় প্রতিটি ল্যাসান অন্তত জীবনে একবার হলেও যায়। এটা জাদুঘর আর স্মৃতির মিশ্রণ। সম্ভবত গ্রহের একমাত্র জায়গা যেটা সমন্ধে “পবিত্র” শব্দটা ব্যবহার করা যায়।

মহাকাশযানটা এখন শূন্যগর্ভ হলেও, মনে হয় যেন এইমাত্র নেমেছে। নিশ্চুপ যন্ত্রেরা রাসায়নিক কারখানা, তাদের রোবট সাথী সহ আর প্রথম প্রজন্মের নার্সারী স্কুল।

প্রথম যুগের প্রায় কোন রেকর্ডই নেই। সম্ভবতঃ ইচ্ছাকৃত। পরিকল্পনাকারীদের সব যোগ্যতা আর সাবধানতা সত্ত্বেও নিশ্চয়ই ভুল-ত্রুটি হয়েছিল। আর সেই সব ভুল নির্মম ভাবে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। কোন রক্তমাংসের বাবা-মা না থাকাটাও একটা বিশাল মানসিক আঘাত।

তবে সেই সব ট্র্যাজেডী আর দুঃখ আজ শতাব্দীর পেছনে। সব অভিযাত্রীর কবর যেভাবে নতুন সমাজ নির্মাতারা ভুলে যায়।

এখানে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দিলে ভালো হতো। থ্যালসায় নৃতত্ত্ববিদ, মনোবিজ্ঞানী আর সমাজতত্ত্ববিদদের একটা বিশাল বাহিনীর প্রয়োজনীয় রসদ আছে। আর আমার সবচে ইচ্ছা জাগে আমার কিছু গতায়ু সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে যে, আমাদের দীর্ঘ ঝগড়ার অবসান হয়েছে।

ঐশ্বরিক ভীতির কোন নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই একটা যুক্তিবাদী মানব সংস্কৃতি তৈরী করা যায়। কোন সেন্সরশীপকে সমর্থন না করলেও যারা থ্যালসার আর্কাইভ তৈরী করেছিল তারা অবশ্য একটা অসাধ্য সাধন করেছে। তারা দশ হাজার বছরের ইতিহাস আর সাহিত্যকে সংশোধন করেছে। এবং তাদের চেষ্টা ফলবতী হয়েছে। আমরা যত অসুন্দরই হোক না কেন, একটা জিনিস সরাবার আগে চিন্তা করি। থ্যালসানরা মৃত ধর্মগুলোর ক্ষয়িষ্ণু উপজাত দিয়ে দূষিত হয়নি। গত সাতশ বছরে কোন নবী, নতুন কোন বিশ্বাস নিয়ে আসেনি। “ঈশ্বর” শব্দটি তাদের ভাষা থেকে মুছেই গেছে। এবং ওই শব্দ কখন আমরা ব্যবহার করতাম সেটা ভেবে তারা প্রায়ই অবাক হয়।

আমার বৈজ্ঞানিক বন্ধুরা অবশ্য একটা উদাহরণ খুব কম বলে সবসময় উল্লেখ করত। তাই এই সমাজে ধর্মের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি খুব কমই প্রমাণ করে। আমরা

জানি থ্যালসানরা জেনেটিক বাছাই এর ব্যাপারে খুব সতর্ক, যাতে সামাজিক বিশৃংখলা না হয়। হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি জানি মানুষের ব্যবহারের মাত্র পনেরো ভাগ জিন নিয়ন্ত্রণ করে। তবে এই অংশটাও গুরুত্বপূর্ণ। ল্যাসানরা অসহিষ্ণুতা, ঈর্ষাকাতরতা, ক্রোধ এসমস্ত অপ্রিয় জিনিস থেকে মুক্ত। এটা কি শুধুই সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের ফসল?

ছাব্বিশ শতাব্দীর ধার্মিকদের প্রেরিত বীজ মহাকাশযানের ফলাফল জানতে পারলে কি খুশিই আমি হতাম। কনভেন্টের বাতি, নবীর তলোয়ার আরও কত জিনিস দেয়া সেটায়। যদি তারা সফল হয়, তাদের সাফল্য, ব্যর্থতায় ধর্মের ভূমিকা কি হবে? হয়তো যেদিন আঞ্চলিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে, সেদিন আমরা প্রথম দিকের অভিযানগুলো সম্বন্ধে জানতে পারব। তবে নাস্তিকতার কারণে এদের ভাব প্রকাশ কমে গেছে। যখন কোন ল্যাসানের পায়ে কিছু পড়ে, সে তখন কথা খুঁজে পায়না। শরীরের ভাবই যা প্রকাশ করে। একমাত্র “ক্র্যাকান” শব্দটি দিয়েই তারা সব কিছু বোঝায়। চারশ বছর আগে ক্র্যাকান পর্বতের অগ্ন্যুৎপাত তাদের মনে ছাপ রেখে গেছে। আমি মনে হয় যাবার আগে একবার ওটা দেখতে যাব।

আরও বহুমাস আছে সামনে। আমি ভয় পাচ্ছি। আমার বিপদ নয়, তবে মহাকাশযানের যদি কিছু হয়। এর মানে হল পৃথিবীর সঙ্গে আর তোমার সঙ্গেও সম্পর্কের একটা সুতো ছিন্ন হয়ে যাওয়া।

১৩. টাস্ক ফোর্স

-প্রেসিডেন্ট এটা পছন্দ করবেন না, মেয়র ওয়াডের্ন বললেন, আপনাদের উত্তর দ্বীপে নেবার জন্যই তিনি মনস্থির করেছেন।

-আমি জানি, ডেপুটি ক্যাপ্টেন ম্যালিনা উত্তর দিলেন, তাকে হতাশ করতে হলো বলে, আমরাও দুঃখিত। তিনি অত্যন্ত বন্ধুভাবাপন্ন। কিন্তু উত্তর দ্বীপ খুব বেশী পার্বত্য এলাকা আর ভালো উপকূলীয় এলাকাগুলোও গড়ে উঠেছে। আর এখানকারটা একটা সম্পূর্ণ মরুময় উপকূল-সুন্দর ঢালু সৈকত। তারনা থেকে মাত্র নয় কিলোমিটার দূরে।

-ভালোই লাগছে শুনতে। কিন্তু, এটা মরুময় কি হিসাবে?

-ওটা একটা ম্যানগ্রোভ প্রজেক্ট। আমরা এখনও জানি না কেন,তবে সব গাছই মরে গেছে। কেউ ওই বিশৃংখলাকে গোছানোর চেষ্টাও করেনি। এটা দেখতে ভয়ংকর, আর জঘন্য গন্ধ।

-তাহলে এটা এখনই একটা পরিবেশগত বিপর্যয়ে আছে। তাহলে ক্যাপ্টেন আপনারা স্বাগতম। আপনারা কেবল জিনিসটার ভালোই করবেন।

-আপনাকে আমি নিশ্চিত ভাবে বলছি যে, প্ল্যান্টটা খুব চমৎকার আর তা আপনাদের পরিবেশের সামান্য বিপর্যয়ও আনবে না। আর আপনারা না চাইলে, যাবার সময় আমরা ওটা ধ্বংস করে যাব।

-ধন্যবাদ। তবে কয়েকশ টন বরফ দিয়ে প্রতিদিন আমরা কি করব তা নিয়ে আমার প্রচুর সন্দেহ আছে। আর এর মধ্যে তারনা কি সুবিধা দিতে পারে বাসস্থান, খাদ্য, পরিবহন? আমরা কিছু করতে পারলে খুশী হব। আমার মনে হয় অনেকেই কাজ করতে আসবে।

–সম্ভবতঃ একশ। আপনার আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ। তবে মনে হয় আমরা একটু অদ্ভুত অতিথি। আমাদের মহাকাশযানের সঙ্গে প্রতি ঘন্টায় যোগাযোগ রাখতে হবে। তাই আমাদের একত্রে থাকতে হবে সবসময়। আমরা খুব শিগগিরিই ছোট একটা বসতি গড়ে তুলব; আর যন্ত্রপাতি নিয়ে আসব। এটা অকৃতজ্ঞের মতো মনে হতে পারে কিন্তু অন্য কিছু হবে অবাস্তব।

-হয়তো আপনারা ঠিক। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়র বললেন। সে অবাক হয়ে ভাবল কিভাবে প্রটোকল আর আতিথেয়তার ব্যাপারটা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার লোরেনের বদলে ডেপুটি ক্যাপ্টেন ম্যালিনার কাছে যায়। সমস্যা অমোচনীয় মনে হলেও এখন আর সমস্যাটাই উঠবে না।

১৪. মিরিসা

বৃদ্ধা হবার পরও মিরিসা লিওনার্দ লোরেনের সঙ্গে তার প্রথম চোখাচোখিটা স্পষ্ট মনে করতে পারবে। সেখানে কেউ উপস্থিত ছিল না, এমনকি ব্র্যান্টও।

নতুনত্বের কারণে এটা হয়নি। লোরেনের সঙ্গে দেখা হবার আগে তার সঙ্গে আরও কয়েকজন পৃথিবীবাসীর সঙ্গে দেখা হয়েছে এবং কেউই তার মনে কোন বিশেষ ছাপ ফেলতে পারেনি। সূর্যের স্পর্শ ছাড়া ল্যাসানরাও কয়েকদিনের মধ্যে ওরকম হয়ে যাবে।

কিন্তু লোরেন অন্যরকম। তার চামড়া কখনোই তামাটে হবে না। আর তার চুল হয়তো আরও রূপালী হয়ে যাবে। অন্ততঃ মেয়র ওয়াডেনের অফিস থেকে দু’জন সহকর্মী নিয়ে বের হবার সময় তার সেরকমই মনে হয়েছিল। তাদের প্রত্যেকের চোখে ছিল হতাশ একটা দৃষ্টি-যা কিনা থ্যালসার অফিস এবং কঠিন আমলাতন্ত্রের সঙ্গে একটা সাক্ষাতের পর প্রকাশ পাবেই।

এক মুহূর্তের জন্য তাদের চোখদুটো মিলেছিল। মিরিসা আরও কয়েকপা হেঁটে গিয়ে অবচেতন ভাবেই একদম থেমে পেছনে চেয়ে দেখতে পেল যে, আগন্তুক তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন তারা ইতিমধ্যেই জেনে গেছে যে তাদের জীবন বদলে গেছে।

সে রাতেই ভালোবাসার ঝড় থামলে সে ব্র্যান্টকে জিজ্ঞেস করল,–তারা বলেছে, কতদিন থাকবে?

-আর সময় পেলে না জিজ্ঞেস করার, সে জড়ানো স্বরে বলল। অন্তত এক বছর। হয়তোবা দুই। ঘুমাও শুভরাত্রি।

আর যে কোন প্রশ্ন করা যাবে না, সেটা মিরিসা জানত। তবুও অনেকক্ষণ তার খোলা চোখ দেখল, কিভাবে ভেতরের চাঁদের দ্রুতগামী ছায়া মেঝের ওপর দিয়ে, তার পাশের গভীর ঘুমে ডুবে থাকা মানুষটাকে কোমল ভাবে ছুঁয়ে সরে যায়।

ব্র্যান্টের আগে সে খুব বেশী লোককে চিনত না। কিন্তু একসঙ্গে থাকার পর অন্য কারও মধ্যে সে বিশেষ তেমন কিছু দেখেনি। কিন্তু তারপর এই হঠাৎ কৌতূহল কেন? সে এখনও একে কৌতূহলই বলতে চায়। তাও এমন একজনের প্রতি যে। কিনা তার প্রতি মাত্র কয়েকমুহূর্ত তাকিয়েছে আর তার ভালো নামটুকুও সে জানে না। মিরিসা নিজস্ব সততা আর পরিষ্কার চিন্তার জন্য গর্ব বোধ করত। যে সমস্ত মানুষ আবেগে চলে তাদের সে নীচু চোখেই দেখত। সে অবশ্য নিশ্চিত, তার। আকর্ষণের কিছুটা হচ্ছে নতুনত্বের-নতুন দিগন্তের হাতছানি। এমন কারো সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হওয়া যে সত্যি সত্যি পৃথিবীর শহরগুলোতে হেঁটে বেড়িয়েছে, দেখেছে সৌরজগতের মৃত্যু, আর এখন যাচ্ছে এমন এক নতুন সূর্যের দিকে যার কল্পনা সবচে বুনো স্বপ্নটারও অসাধ্য। এটা তাকে ব্র্যান্টের সঙ্গের আনন্দের নীচে বয়ে চলা থ্যালসার অলস, একঘেয়ে জীবনের দুঃখ সম্বন্ধে সচেতন করে তুলল।

সত্যি সত্যি সে কি চায়? এই নক্ষত্রের আগন্তুকদের কাছে যে কি খুঁজছে সে নিজেও জানে না। তবে তারা যাবার আগে সে একবার চেষ্টা করে দেখবে।

ঐদিন সকালেই ব্র্যান্ট মেয়রের অফিসে গিয়েছিল। তবে বরাবরের মতো উষ্ণ অভ্যর্থনা সে পায়নি। সে তার মাছ ধরার ফাঁদের টুকরাগুলো ডেস্কে রাখল,–বুঝলাম যে তুমি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু এ ব্যাপারটা নিয়ে কি করবে?

মেয়র উৎসাহহীন ভাবে স্তূপ করা তারগুলো দেখল। নাক্ষত্রিক রাজনীতির মধ্যে দৈনন্দিন কাজে মনোযোগ দেয়া দুঃসাধ্য ব্যাপারই বটে!

-তোমার কি মনে হয়?–এটা ইচ্ছাকৃত। দেখ, কিভাবে না ভাঙ্গা পর্যন্ত তারগুলো মোচড়ানো হয়েছে।

একটা তার না, পুরো একটা অংশ সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আমার মনে হয় না। দক্ষিণ দ্বীপের কেউ এটা করবে। কি লাভ তাদের? তবে খুব শিগগিরি আমি বের করব… ব্র্যান্টের কথা হঠাৎ থেমে তারপরের অবস্থা বুঝিয়ে দিল।

-কাকে সন্দেহ হয়?

-যখন থেকে আমি বৈদ্যুতিক ফাঁদ নিয়ে কাজ করছি তখন থেকেই রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে আমাকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। তারা ভাবে যে, সমস্ত খাদ্যকেই কৃত্রিম হতে হবে, কেননা জীবন্ত প্রাণীকে ধরে খাওয়াটা নশংসতা।

–রক্ষণশীলদের একটা যুক্তি আছে। তোমার ফঁদটা তোমার দাবী অনুযায়ী কর্মক্ষম হলে, এটা পরিবেশ বিপর্যয় ঘটাতে পারে।

-নিয়মিত রীলিফ শুমারীর সময়ই তা বেরিয়ে আসবে। আমরা তখন বন্ধ করব। আর আমার ফাঁদ তিন থেকে চার কিলোমিটার দূরের মাছ আকৃষ্ট করবে। তাছাড়া তিন দ্বীপের সবাই যদি শুধু মাছ খায়, তবুও তা সমুদ্রের ভান্ডারে ছাপও ফেলবে না।

-আমি আশা করি তুমিই ঠিক অন্ততঃ ঐ মাছ সদৃশগুলো ব্যাপারে। ওগুলো। খুবই বিষাক্ত। আর তুমি কি তেরানের মজুদ সম্বন্ধে নিশ্চিত?

ব্র্যান্ট শ্রদ্ধার সঙ্গে তাকাল। মেয়র তাকে ক্রমেই অবাক করছে। তার এর আগে কখনো মনে হয়নি যে, চোখাচোখি করা ছাড়াও মেয়রের এমন কোন গুণ আছে, যা কিনা তাকে এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে বহুদিন থাকতে দিয়েছে।

-আমার মনে হয় না, টুনা মাছ টিকে থাকতে পারবে। সমুদ্রকে তাদের উপযুক্ত পরিমাণে লবনাক্ত হতে আরও কয়েক বিলিয়ন বছর লাগবে। তবে ট্রাউট আর স্যামন টিকে যাবে।

–তারা আসলেই সুস্বাদু। এমনকি কৃত্রিমের সমর্থকদের নৈতিকতা ভাঙ্গার মতো। আমি অবশ্য তোমার আকর্ষণীয় তত্ত্বটা গ্রহন করছি না। ওসব লোক বলে অনেক কিছু তবে করে কম।

-তারা কয়েক বছর আগেই একটা পরীক্ষামূলক খোয়াড় থেকে পুরো একটা গৃহপালিত পশুর পাল ছেড়ে দিয়েছিল।

-তারা চেষ্টা করেছিল। গরুগুলো সোজা খোয়াড়ে ফিরে গিয়েছিল। আর সবাই এতো বেশী মজা পেয়েছিল যে তারা লজ্জায় আর কিছু করেনি। আমি মনে করি না, তারা এতো বড় কিছু করবে।

-এটা এমন কোন কঠিন কাজ নয়। রাতের বেলা ছোট একটা নৌকা, কয়েকজন ডুবুরী। আর পানিতে মাত্র বিশ মিটার গভীর।

ঠিক আছে আমি তদন্তের ব্যবস্থা করছি। তবে এর মধ্যে তোমাকে দুটো কাজ করতে হবে।

-কি? ব্র্যান্ট তার গলার সন্দেহ লুকাবার বৃথাই চেষ্টা করল।

-জিনিসটা মেরামত কর। স্টোর থেকে যা নেবার নাও। আর একশ ভাগ নিশ্চিত না হয়ে কাউকে দায়ী করো না। কারণ তোমার ভুল হলে তোমাকেই বোকা বনতে হবে। এবং তোমাকে মাপ চাইতেও হতে পারে। আর তুমি ঠিক হলেও তোমার কথা তাদের সতর্ক করে দেবে। বুঝেছো?

ব্র্যান্টের চোয়াল কিছুটা ঝুলে পড়ল। সে কখনো মেয়রকে এতো স্থিরচিত্ত দেখেনি। সে কোনভাবে বেরিয়ে এল।

সে হয়তো আরও কিছুটা ধাক্কা খেত কিংবা হয়তো তেমন খেত না, যদি জানত যে মেয়র আর তার প্রতি তেমন আকৃষ্ট নয়।

বিলক্ষণ, অ্যাসিটেন্ট ইঞ্জিনিয়ার লোরেন লোরেনসন একজনের বেশী মহিলার উপরই সেদিন প্রভাব ফেলেছিল।

১৫. টেরা নোভা

পৃথিবীর কথাকেই স্মরণ করিয়ে দেয় এমন কোন নাম অবশ্যই বসতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু কেউ স্বীকার না করলেও বেস ক্যাম্প কথার চাইতে সেটা অনেকটাই সৌকর্যময়, তাই সেটাই দ্রুত গৃহীত হয়ে গেল। আগে থেকেই বানানো জটিল ঘরগুলো অসম্ভব গতিতে বসানো হয়ে গেল সত্যিকার অর্থে এক রাতেই। পৃথিবীবাসীদের তার চাইতে বলা ভালো পৃথিবীর রোবটদের এটাই তারনার প্রতি প্রথম কাজের উদাহরণ। এবং পুরো বসতিই দারুণ ভাবে প্রভাবিত হল। এমনকি ব্র্যান্ট যে কিনা ঝামেলা আর একঘেয়ে কাজ ছাড়া রোবটদের কাজের চেয়ে অকাজেরই বেশী মনে করে সেও দ্বিতীয় বারের মতো ভাবতে বাধ্য হল। সেখানে একটা বিশাল, সব ধরনের কাজ করতে সক্ষম, চলনক্ষম নির্মাণ যন্ত্র ছিল যার কাজ অনেক সময় দেখাটাই দুঃসাধ্য হয়ে যেত। যেখানেই এটা যেত না কেন, সবসময়ই এর পেছনে ল্যাসানদের ছোট একটা ভীড় লেগেই থাকতো। আর কেউ পথে পড়লে, এটা বাধা দূর না হওয়া পর্যন্ত চুপ করে বসে থাকতো। ব্র্যান্ট ঠিক করল, এরকম একটা সাহায্যকারীই তার দরকার। সম্ভবত আগন্তুকদের কাছে এটা চাওয়া যায়…

ঠিক এক সপ্তাহ পর টেরা নোভা কক্ষপথের ঘূর্ণনায়মান বিশাল মহাকাশযানের আণুবীক্ষণীক কর্মস্থল রূপ পেয়ে গেল। সেখানে সাধারণ কিন্তু একশ জনের উপযুক্ত বাসস্থান হয়ে গেল সব ব্যবস্থা সহ। যেমন লাইব্রেরী, ব্যায়ামগার, সুইমিং পুল আর মঞ্চ। ল্যাসানরা এই সুবিধাগুলোকে সমর্থন করল আর ব্যবহার করতেও দ্বিধা করল না। ফলে টেরা নোভার জনসংখ্যা কখনোই অন্ততঃ অনুমিত একশর দ্বিগুনের কম রইলনা।

অধিকাংশ অতিথি আমন্ত্রিত হোক আর অনাহুতই হোক, আগন্তুকদের সাহায্য করতে আর তাদের অবস্থানকে আনন্দদায়কই রাখতে চাচ্ছিল। ওরকম বন্ধুত্ব খুব প্রত্যাশিত আর কাম্য হলেও প্রায়ই অত্যন্ত বিব্রতকর। ল্যাসানরা অত্যন্ত কৌতূহলী, আর একান্ত ব্যক্তিগত শব্দটার সঙ্গে তারা পরিচিতই নয়।

দয়া করে বিরক্ত করবেন না– এধরনের চিহ্ন একটা ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ হিসেবেই ধরা হয়। যার ফলাফলটা অবশ্যই বেশ আকর্ষণীয় সমস্যা…

-আপনারা সবাই পদস্থ কর্মকর্তা, বুদ্ধিমান ও প্রাপ্তবয়স্ক, শেষ স্টাফ কনফারেন্সে ক্যাপ্টেন বে বলেছিলেন। তাই আপনাদের এটা ভেঙ্গে বলার দরকার নেই। আপনারা চেষ্টা করবেন কোন ধরনের ইয়ে মানে ঝামেলায় না জড়ানোর জন্য। যতক্ষন না আমরা ওসব ব্যাপারে সব জানছি। তারা সহজ ভাবেই সব নিচ্ছে কিন্তু সেটা প্রতারণাও হতে পারে। ড. ক্যালডর আপনি কি বলেন?

-ক্যাপ্টেন, আমি না বলব না। বিশেষতঃ এই অল্প কদিনের পর্যবেক্ষণেই। তবে একটা চমৎকার ঐতিহাসিক সাযুজ্য আছে। যখন পৃথিবীর পুরোনো পাল তোলা জাহাজ বিশাল সমুদ্র যাত্রা শেষ করে নোঙর করত। আমার মনে হয় তোমরা অনেকেই সেই ক্লাসিক ভিডিও গুলো দেখেছ।

-ড. ক্যালডর নিশ্চয়ই আমাকে ক্যাপ্টেন কুকের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে না?

-এটা কোন অপমান নয়। সে একজন মেধাবী নাবিক ছিল। এমুহূর্তে আমাদের দরকার হচ্ছে সাধারণ বুদ্ধি, ভালো ব্যবহার আর আপনি যেটা বললেন ধৈৰ্য্য। লোরেন অবাক হল যখন ড. ক্যালডর তার দিকে তাকিয়ে কথা শেষ করল। নিশ্চয়ই এখনই এটা তেমন বেশী কিছু হয় নি…

দাপ্তরিক কাজেই ব্র্যান্টের সঙ্গে অন্তত ডজন খানেক বারের বেশী তার দেখা হয়েছে। ইচ্ছা থাকলেও মিরিসাকে পাশ কাটাবার উপায় নেই। তারা একত্রে এখনও কোন সময় কাটায়নি। এমনকি এখন পর্যন্ত কয়েকটা ভদ্রতা সূচক কথা ছাড়া তেমন কথাও হয়নি। তবে খুব বেশী কিছু বলার দরকারও বোধহয় নেই।

১৬. অনুষ্ঠান

এই হচ্ছে একটা শিশু, মিরিসা বলল। দেখতে যেমন লাগুক না কেন একদিন এই বড় হয়ে বড় মানুষে রূপ নেবে।

ভেজা চোখেই সে হাসছিল। লোরেনের আকর্ষণ লক্ষ্য করার আগে কখনোই তার এমন হয়নি। সম্ভবতঃ তারনার এই ছোট বসতিতে যে পরিমাণ বাচ্চা আছে পৃথিবীর শেষ দিনগুলোতে সমগ্র পৃথিবীতেও সেই প্রায় শূন্য জন্মহারে এতো শিশু ছিল না।

-এটা কি তোমার? সে দ্রুত জিজ্ঞেস করল।

-এ্যাই, প্রথম কথা হচ্ছে একে এটা বলা চলবে না। এ হচ্ছে ব্র্যান্টের ভাইপো লিস্টার। ওর বাবা-মা উত্তর দ্বীপে গেলে আমরা ওর দেখাশোনা করি।

-কি সুন্দর! আমি ওকে নিতে পারি?

লিষ্টার অবশ্য তারস্বরে কান্না জুড়ে দিল।

-মনে হচ্ছে সেটা ভালো হবে না- মিরিসা হাসল। সে বাচ্চাটাকে তুলে নিয়ে কাছের বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বলল,

-আমি ওর ভাব বুঝি। ব্র্যান্ট বা কুমার তোমাকে চারিদিক ঘুরিয়ে দেখাক। ততক্ষণ আমরা অন্যান্য অতিথিদের জন্য অপেক্ষা করি।

ল্যাসানরা অনুষ্ঠান খুবই পছন্দ করে। আর অনুষ্ঠান করার কোন সুযোগই তারা হাতছাড়া করেনা। ম্যাগেলানের আবির্ভাব, সত্যিকার অর্থেই এক না, বহু জন্মেরই ঘটনা। যদি সব আমন্ত্রণ গ্রহণ করার মতো সময় আগন্তুকদের থাকতো তা হলে, তাদের কাজের পুরো সময়টাই কোন আনুষ্ঠানিক বা অআনুষ্ঠানিক নিমন্ত্রণ খেতেই শেষ হয়ে যেত। অবশ্য খুব শিগগিরি ক্যাপ্টেন তার একটা নির্দেশ দিয়ে দিলেন। “বের বজ্র” নামে ডাকা এই নিয়মে একজন পাঁচদিনে একটির বেশী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারবে না। ল্যাসানদের আতিথেয়তার অত্যাচারের চাইতে এটাতেই অবশ্য অনেকে খুশী হল।

লিওনার্দের এক তলা বাড়ি, যাতে এখন মিরি, ব্র্যান্ট আর কুমার থাকছে তা প্রায় ছয় প্রজন্ম ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে। দোতলা বাড়ী অবশ্য তারনায় খুব কমই আছে। প্রায় তিরিশ মিটার ঘাসের লন এর সামনে। তার মাঝে একটা পুকুর। পুকুরের মাঝে শীর্ণ এক পাম গাছ নিয়ে ছোট্ট দ্বীপ। একটা কাঠের সেতু দিয়ে সেখানে যাওয়া যায়।

–তারা গাছটাকে বদলাতে বলছে- ব্র্যান্ট কৈফিয়তের সুরে বলল। কিছু গাছ খুব ভালো হয়, কিন্তু বাকীগুলি যত রাসায়নিকই দেই না কেন মরে যায়। মাছ নিয়েও এই একই সমস্যা। মিষ্টি পানির মাছ ভালোই টেকে, কিন্তু তাদের জন্য তো জায়গাই নেই। এতো মিলিয়ন গুণ বড় সাগর, কিন্তু আমরা ব্যবহারই করতে পারছি না।

লোরেনের ব্যক্তিগত মত হচ্ছে যে, যখন ব্র্যান্ট ফ্যাকনর সাগর নিয়ে কথা বলে তখন তার মতো বিরক্তিকর আর কেউ নেই। তবে মিরিসার প্রসংগের চাইতে এটা অনেক নিরাপদ।

লোরেন নিজেকেই শুধায়, কখনও স্বপ্নেও কি সে এরকম একটা অবস্থায় পড়বে বলে ভেবেছিল? সে আগেও প্রেমে পড়েছে। কিন্তু সেই স্মৃতি এমনকি নামগুলোও মহাকাশযানের অন্যান্য সবার মতোই যত্ন করে স্মৃতি থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। তার মনে করার ইচ্ছাও নেই। যে অতীত নিষ্ঠুরভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে তাকে মনে করার দরকারটা কি?

এমনকি কিতানির মুখও ঝাপসা হয়ে গেছে। যদিও মাত্র এক সপ্তাহ আগেই তাকে সে শীতল প্রকোষ্ঠে দেখে এসেছে। কিন্তু সে হচ্ছে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সাথী। যার বাস্তবায়ন এমনকি কখনো নাও হতে পারে। আর মিরিসা এখন, এখানেই উপস্থিত তার সব হাসি আর উচ্ছলতা নিয়ে। কোন অন্তহীন শীতনিদ্রায় নয়। সে তাকে আবার একবার পরিপূর্ণ করেছে পৃথিবীর নিষ্ঠুর শেষ দিনগুলো, যা তার তারুণ্যকে মুছে ফেলেছিল তাকে আবার জাগিয়ে তুলেছে।

প্রতিবার দেখা হলেই তার বলতে ইচ্ছে হয় যে, সে আবার একজন নতুন মানুষ হয়েছে। এই চাপটা মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত, সে তার কাজও ঠিকভাবে করতে পারছে না। ম্যানগ্রোভ উপকূলের পরিকল্পনা আর তথ্য দেখার সময় কতবার মিরিসার ছায়া তাকে “স্থগিত নির্দেশ দিতে বাধ্য করেছে। আর কথাগুলো মনে মনেই বলতে বাধ্য। হয়েছে। মিরিসার কয়েক মিটারের মধ্যে থেকেও, কয়েকটা ভদ্রতাসূচক কথার বেশী বলতে না পারাটা এক ধরনের অত্যাচার।

লোরেনকে বাঁচাতেই ব্র্যান্ট হঠাৎ তাকে ছেড়ে তাড়াহুড়ো করে চলে গেল। লোরেনও অবশ্য দ্রুতই কারণটা বুঝতে পারল।

-কমান্ডার লোরেনসন, মেয়র ওয়াডের্ন বললেন। আশা করি তারনা ভালো লাগছে। লোরেন ভদ্রতা করে মাথা ঝাঁকালো। সে জানে মেয়রের প্রতি তার আরও নম্র হওয়া উচিত। তবে সামাজিকতা বড় কোন ব্যাপার নয়।

-হ্যাঁ অবশ্যই, ধন্যবাদ। আমার মনে হয় না, আপনি এই ভদ্রলোকদের সঙ্গে পরিচিত। প্রয়োজনের চাইতে অতিরিক্ত জোরেই সে একদল সহকর্মীকে ডাকল। ভাগ্য ভালো যে নতুন দলটার সবাই লেফটেন্যান্ট। কাজে না থাকলেও উপরের র‍্যাঙ্ক সবসময়ই সুবিধা পায়, আর সেটা ব্যবহারে তার কোন সঙ্কোচও নেই।

-মেয়র ওয়াডের্ন এ হচ্ছে লেঃ ফ্লেচার। ওয়েন তোমার তো এই প্রথম নীচে নামা? লেঃ ওয়েরনার, লেঃ রঞ্জিত উইলসন, লেঃ কার্ল বোসেলি…সবসময় লুকোচুরি খেলা। নতুন ছেলেগুলো অবশ্য ভালোই। আর তার মনে হয় না যখন সে চুপিসাড়ে কেটে পড়ল মেয়র তা লক্ষ্য করতে পারল।

ক্যাপ্টেনের সঙ্গেই কথা বলতে চাচ্ছিল ডোরেন চ্যাং। কিন্তু তিনি দ্রুত আসলেন, একটা ড্রিঙ্ক নিলেন, তার পরই গৃহকর্তার কাছে ক্ষমা চেয়ে বিদায় নিলেন।

–কেন তিনি আমাকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন না? সে ক্যালডরকে জিজ্ঞেস করল। ক্যালডরের অবশ্য তেমন কাজ নেই এবং এর মধ্যেই কয়েকদিন ভি.ডি.ও বা অডিও এর সামনে তিনি বসেছেন।

-ক্যাপ্টেন সিরডার বে-সে উত্তর দিল, একজন বিশেষ ব্যক্তি। আমাদের অন্যদের মতো, তাকে ব্যাখ্যাও দিতে হয় না বা মাপও চাইতে হয় না।

-তোমার গলায় কিছুটা ভয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে? থ্যালসা ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের সবচে দামী সংবাদপাঠিকা জিজ্ঞেস করল।

-না তা নয়। আমি তাকে বেশ পছন্দ করি। এমনকি আমার সম্বন্ধে মন্তব্যগুলোও মেনে নেই- পুরোপুরি নয় অবশ্য, এ্যাই তুমি কি রেকর্ড করছো?

-এখন না। খুব বেশী গোলমালের শব্দ হচ্ছে।

-ভাগ্য ভালো যে আমি তোমাকে বলিনি।

-অবশ্যই এটা রেকর্ডের বাইরে থাকবে। মোজেস, তোমার সম্বন্ধে সে কি ভাবে?

-সে আমার দৃষ্টিভঙ্গী পছন্দ করে, আমার অভিজ্ঞতাও। কিন্তু খুব গুরুত্বের সঙ্গে কখনোই নেয় না। এটা আমিও জানি কেন। সে একবার আমাকে বলেছিল “মোজেস, তুমি ক্ষমতা পছন্দ কর কিন্তু দায়িত্ব না। কিন্তু আমি দুটোই উপভোগ করি” এটা খুব রুক্ষ কথা। কিন্তু এটাই আমাদের পার্থক্যের মূল কথা।

-তুমি কি উত্তর দিলে?

-আমি কি বলব? এটা একদম সত্যি। সত্যিকারের রাজনীতিতে আমি একবারই যোগ দিয়েছিলাম, সেটা ভয়ংকর নয়-তবে আমি সত্যিই সেটা উপভোগ করিনি।

-ক্যালডর ক্রুসেড সমন্ধে?

-ওহ তুমিও জানো। ফালতু বিশেষণ আর আমাকে সেটাই ভয় পাইয়ে দেয়। ওটা আমার আর ক্যাপ্টেনের মধ্যকার আরেকটা পার্থক্য। সে ভাবত এবং আমি জানি এখনও ভাবে, জীবন সম্পন্ন, যে কোন গ্রহ সরাসরি আমাদের এড়িয়ে যাবার নির্দেশ একটা মানবীয় ফালতু দুর্বলতা।

-আশ্চর্য। তুমি একদিন এটাকে রেকর্ড করতে দেবে।

-কক্ষনো না। ওখানে কি হচ্ছে? ডোরেন চ্যাং একজন সহনশীল মহিলা। এবং সে জানে কখন থামতে হবে।

-ওটা হচ্ছে মিরিসার প্রিয় গ্যাসীয় ভাষ্কর্য। তোমাদের পৃথিবীতেও নিশ্চয়ই ছিল।

-অবশ্যই। আর রেকর্ডের বাইরে বলছি আমার মনে হয় না, ওটা কোন শিল্প। তবে আকর্ষণীয়।

উঠোনের এক অংশের মূল বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। আর প্রায় ডজন খানেক অতিথি  প্রায় এক মিটার চওড়া, সাবানের বুদবুদের মতো একটা জিনিসের কাছে জড়ো হয়েছে। চ্যাং আর ক্যালডর সেদিকে আগাতে আগাতেই তারা দেখল, একটা রঙীন ফিতা ভেতরে তৈরী হচ্ছে। একটা স্পাইরাল নেবুলার জন্মের মতো।

-এটাকে “জীবন” বলা হয়, ডোরেন বলল। মিরিসার পরিবার প্রায় দু’শ বছর ধরে এটা রাখছে। গ্যাসটা অবশ্য লীক হয়ে যাচ্ছে। আমার মনে আছে এটা আরও অনেক উজ্জ্বল ছিল।

তা হলেও এটা এখনও আকর্ষণীয়। ইলেকট্রন বন্দুক আর লেজারকে এর গোড়ায় কোন পুরোনো শিল্পী এমন ভাবে বসিয়েছেন, যাতে একসারি জ্যামিতিক আকৃতি ধীরে ধীরে জটিল জৈব যৌগের আকৃতি নিতে থাকে। কেন্দ্র থেকে পরিধির দিকে আরও জটিল রূপ দেখা যায়। আর একটা আরেকটাকে ক্রমাগত প্রতিস্থাপিত করতে থাকে। এক পর্যায়ে, একটা পেচানো জিনিস দেখা যায়, যাকে অনেকটা ডি.এন.এ অনুর মতো মনে হয়। আর প্রতিটা পদক্ষেপেই কিছু নতুন জিনিস যুক্ত হয়ে সেটা কয়েক মিনিটের মধ্যে অ্যামিবা থেকে মানুষ হবার মহাকাব্য দেখিয়ে দেয়।

শিল্পী তার পরেও যেতে চেয়েছেন। ক্যালডর অবশ্য সেটা বুঝল না। উজ্জ্বল গ্যাসের আলো খুব বেশী জটিল আর বিমূর্ত হয়ে গেছে। আরও কয়েকবার দেখলে হয়তো একটা প্যাটার্ন ধরা যেতে পারে।

-শব্দের কি হলো? ডোরেন সব আলো নিভে গেলে জিজ্ঞেস করল। এখানে কিছু খুব সুন্দর সুর ছিল, বিশেষত শেষে।

-আমার আশঙ্কা ছিল কেউ জিজ্ঞেস করবে। মিরিসা কৈফিয়তের সুরে বলল,–আমরা বুঝতে পারছি না, সমস্যাটা কি আবহ সঙ্গীতের না প্রোগ্রামের ভেতরে।

-নিশ্চয়ই একটা বিকল্প ছিল।

-হ্যাঁ ছিলো তো বটেই। কিন্তু বাড়তি মডেলটা কুমারের রুমে। হয়তো তার ক্যানুর কোথাও হবে। তার রুম না দেখলে এন্ট্রপি কি জিনিস তোমরা বুঝবেনা।

-ওটা ক্যানু নয় কায়াক, কুমার প্রতিবাদ করল। সে মাত্রই একটা সুন্দর স্থানীয় মেয়েকে নিয়ে ঢুকেছে–আর এন্ট্রপিটা কি জিনিস?

একজন তরুণ বোকার মতোই জিনিসটা বোঝাতে চাচ্ছিল। কিন্তু বেশী দূর যাবার আগেই একটা সুর ভেসে আসল।

-তোমরা দেখলে–কুমার জোরে চেঁচালো, অবশ্যই একটু গর্বের সঙ্গে-ব্র্যান্ট যে কোন জিনিস সারাতে পারে।

যে কোন জিনিস? লোরেন ভাবল। মনে হয় না….

১৭. নিয়মের শৃংখল

উৎস: ক্যাপ্টেন

লক্ষ্য: সকল কর্মীবৃন্দ

ক্রমপঞ্জী

এ ব্যাপারে অপ্রয়োজনীয় সন্দেহ দেখা দেয়ায় আমি নিম্নলিখিত জিনিসগুলো পরিষ্কার করছি।

১. মহাকাশযানের সব রেকর্ড ও সময় পৃথিবী সময় (পৃ.স.) অনুযায়ী থাকবে আপেক্ষিকতার প্রভাবকে সংশোধিত করে। এ যাত্রার শেষ পর্যন্ত সব ঘড়ি এবং সময় সংরক্ষক ব্যবস্থা পৃ.স. হিসাবে রাখবে।

২. গ্রহে অবস্থানকারী কর্মীরা সুবিধার জন্য থ্যাসলার সময় (থ্যা. স.) ব্যবহার করলেও তাদের সব রেকর্ড পৃ.স. হিসাবে রাখবে।

৩. সবার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে থ্যালসার সৌর দিবস পৃ.স. ২৯.৪৩২৫ ঘন্টা।
৩১৩.১৬৬১ দিনে থ্যালসায় বছর হয়। যেটাকে ২৮ দিনের ১১ মাসে ভাগ করা হয়েছে। ক্যালেন্ডার থেকে জানুয়ারী বাদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু ৩১৩ দিনের হিসাবের জন্য ডিসেম্বরের শেষ দিনের পর বাড়তি পাঁচ দিন যোগ করা হয়। ছয় বছরে লিপ ইয়ারের বাড়তি দিন যোগ হয়। তবে আমাদের অবস্থানের মধ্যে এটা হবে না।

৪. যেহেতু থ্যালসার দিনগুলো পৃথিবীর দিনের চাইতে ২২%বেশী আর অন্যদিকে দিনের সংখ্যা ১৪% কম, সেহেতু থ্যালসার বছর পৃথিবীর চাইতে মাত্র ৫% বেশী। তোমাদের সবার বোঝা উচিত, জন্মদিনের বেলায় এর একটা গুরুত্ব আছে। থ্যালসা ও পৃথিবীর সময়পঞ্জী প্রায় এক। একজন ২১ বছর বয়সী থ্যালসান পৃথিবীবাসী হলে ২০ বছরের হতো। ল্যাসান ক্যালেন্ডার ৩১০৯ পৃ.স. প্রথম অবতরণ থেকে গণনা করা হয়। বর্তমান বছর হচ্ছে ৭১৮ থ্যা.স., ৭৫৪ পৃথিবী সময় পরে।

৫. সবশেষে আমি একটা ব্যাপারকে ধন্যবাদ দেই কারণ থ্যালসার সময় ভাগ মাত্র একটাই।

সিরডার বে (ক্যাপ্টেন)

৩৮৬৪.০৫.২৬.২০৩০ পৃ.স.
৭১৮.০০.০২.১৫.০০ থ্যা.স.

একটা সহজ জিনিসকে কিভাবে কেউ এতো জটিল বানাতে পারে, মিরিসা হেসে দিল। তখন টেরা নোভা বুলেটিন বোর্ডে মাত্র নোটিশটা উঠেছে- আমার মনে হয় এটা একটা সেই বিখ্যাত বে’র বজ। ক্যাপ্টেন কেমন মানুষ? আমি তার সঙ্গে কখনো কথা বলার ঠিকমতো সুযোগ পাইনি।

-তাকে খুব সহজে চেনা যায় না, মোজেস ক্যালডর বলল। আমার মনে হয় না ডজনখানেকের বেশী আমি তার সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপ করেছি। এবং সেই হচ্ছে। একমাত্র ব্যক্তি যাকে মহাকাশযানের প্রত্যেকে “স্যার” বলে ডাকে–সবসময়। অবশ্য একান্তে থাকলে ডেপুটি ক্যাপ্টেন ম্যালিনা হয়তোবা বলেনা। এটা অবশ্য সে অর্থে বে’র বজ্র নয়। এটা প্রধানত তত্ত্বীয়। সিনিয়র অফিসার ভার্লে আর সেক্রেটারী লেলিরয় মিলে নিশ্চয়ই এটা লিখেছে। ক্যাপ্টেন বের প্রাযুক্তিক জ্ঞান আমার চাইতে অনেক বেশী ভালো হলেও, সে প্রধানত একজন প্রশাসক। আর মাঝে মাঝে সর্বাধিনায়ক।

-তার দায়িত্বকে আমি ঘৃণা করি।

-এটা কাউকে না কাউকে তো করতেই হবে। সাধারণ সমস্যা সাধারণত সিনিয়র অফিসার বা কম্পিউটার ব্যাঙ্কের সাহায্যেই সমাধান করা যায়। কিন্তু কখনো কখনো একজনকেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় এবং তাকেই তা প্রয়োগ করতে হয়। তাই একজন ক্যাপ্টেন দরকার। তুমি সব সময় একটা মহাকাশযান একটা কমিটি দিয়ে চালাতে পারবে না।

-ভাগ্য ভালো যে থ্যালসা এভাবে চলছে না। প্রেসিডেন্ট ফারাদীনকে তুমি কি একজন ক্যাপ্টেন হিসেবে চিন্তা করতে পার?

-পীচগুলো ভারী সুস্বাদু, ক্যালডর চালাকী করল। যদিও সে জানে ওগুলো লোরেনের জন্য আনা হয়েছে। কিন্তু তোমরা ভাগ্যবান। গত সাতশ বছরে তোমরা সত্যিকারের কোন বিপদে পড়নি। তোমাদের নিজেদের লোকেরাই কি বলে না যে থ্যালসার কোন ইতিহাস নেই, আছে শুধু উপাত্ত।

-এটা ঠিক না। ক্র্যাকান পর্বতের অগ্ন্যুৎপাতকে তুমি কি বলবে?

-ওটা একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। অবশ্যই বড় ধরনের। আমি রাজনৈতিক সমস্যা বা গৃহযুদ্ধ এধরনের কথা বলছি।

-সেজন্য আমরা পৃথিবীকে ধন্যবাদই দেই। জেফারসন মার্ক-৩ এর সংবিধান যেটাকে অনেকে দুই মেগাবাটের ইউটোপিয়া বলতো, খুব ভালো কাজ করেছে। তিনশ বছরেও ঐ প্রোগ্রামে কেন পরিবর্তন করতে হয়নি। মাত্র ছ’টা সংশোধনী আনা হয়েছে।

-যতদিন আমরা এখানে আছি, ক্যালডর বলল, আমার ভাবতে ভালো লাগবে না যে, সপ্তমটি আমাদের জন্য হবে।

যদি এটা হয় প্রথমে এটাকে আর্কাইভের মেমরী ব্যাঙ্কে দিতে হবে। তোমরা আবার কখন আমাদের এখানে বেড়াতে আসবে? কত কিছু যে আমি তোমাকে দেখাতে চাই।

-আমি যতটা দেখতে চাই ততটা নিশ্চয়ই নয়। সাগান-২ এ লাগবে এমন অনেক কিছুই নিশ্চয়ই আছে, যদিও সেটা একেবারে অন্যরকমের গ্রহ, অনেক আকর্ষণহীনও বটে। সে স্বগত বলল।

তাদের কথা বলার সময়ই লোরেন ব্যস্তভাবে অভ্যর্থনা কক্ষে এল। নিশ্চয়ই খেলার রুম থেকে গোসলে যাবার পথে।

-নিশ্চয়ই সবগুলোতে জিতেছ বরাবরের মতো। তোমার একঘেয়ে লাগে না? লোরেন মাথা চুলকালো।

-কিছু তরুণ ল্যাসান প্রতিশ্রুতি ভালোই দেয়। একজন তিন পয়েন্ট তো নিয়েই নিয়েছিল। অবশ্য আমি বা হাতে খেলছিলাম।

-এটা অবশ্য অসম্ভব মিরিসা, যে কেউ তোমাকে বলেনি লোরেন পৃথিবীতে টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়ন ছিল।

-বাড়িয়ে বলো না মোজেস। প্রথম পাঁচজনের মধ্যে ছিলাম। আর শেষের দিকে মান খুব নীচুতে নমে গিয়েছিল। তৃতীয় শতকের যে কোন চীনা খেলোয়ার আমাকে হারাতে পারবে।

-নিশ্চয়ই তুমি ব্র্যান্টকে শেখানো আরম্ভ করনি- ক্যালডর হঠাৎ বলল, সেটা বেশ আকর্ষণীয় হতো।

বেশ বড় একটা নিস্তব্ধতা গ্রাস করল সবাইকে। লোরেন আস্তে করে বলল, এটা ঠিক না।

মিরিসা বলল, ব্র্যান্ট তোমাকে কিছু দেখাতে চায়।

-তাই।

-তুমি নাকি কখনো বোটে চড়নি।

-হ্যাঁ।

-তাহলে ব্র্যান্ট এবং কুমার তোমাকে কাল সকালে সাড়ে আটটায় পিয়ের তিন এ আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।

লোরেন ক্যালডরের দিকে তাকাল,

-এটায় যাওয়া কি আমার জন্য নিরাপদ? সে কৃত্রিম গাম্ভীর্যের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, আমি সাঁতার জানি না যে।

-দুঃশ্চিন্তার কিছু নেই-ক্যালডর ভরসা দিল। তারা যদি তোমার চিরযাত্রার পরিকল্পনা করেই থাকে, তাহলে ওতে কোন লাভ হতো না।

১৮. কুমার

আঠারো বছরের জীবনে কুমার লিওনার্দের একটিই মাত্র দুঃখ আছে। সে তার প্রত্যাশার চাইতে দশ সেন্টিমিটার ছোট। তাকে পেছনে যখন কেউ “ছোট্ট” সিংহ বলে ডাকে তখন তাতে অবাক হবার কিছু নেই। অবশ সামনাসামনি ডাকার সাহস কারও নেই। তার উচ্চতার এই ঘাটতি পূরণ করতেই সে স্বাস্থ্যের প্রশস্ততার প্রতিই বেশী মনোযোগ দিয়েছে। মিরিসা বহুবার বলেছে “কুমার শরীর চর্চার সময়টা যদি তুমি মস্তিষ্ক চর্চায় দিতে তাহলে থ্যালসার সবচে বড় প্রতিভা তুমিই হতে।” তবে যেটা কখনোই সে কুমারকে বলেনা, এমনকি নিজের কাছেও নিজে স্বীকার করেনা সেটা হল প্রতিদিনের সকালের ব্যায়াম দেখার সময় তার বুকেও একটা অ ভগ্নীসুলভ ব্যাপার জেগে ওঠে এবং আশেপাশের প্রশংসা তাদের প্রতি তার একটা হিংসাই লাগে। কুমারের আশেপাশে অবশ্য তার বয়সীরাই থাকে। তারনার সমস্ত মেয়ে আর অর্ধেক ছেলের সঙ্গে তার যে প্রেমকাহিনী বাতাসে ছড়িয়ে আছে তার মধ্যে সত্যের বদলে অতিরঞ্জনই বেশী।

তবে কুমারের সঙ্গে তার বোনের মস্তিষ্কের ক্ষমতায় বিশাল পার্থক্য থাকলেও সে হাবা নয়। কোন কিছু তার একবার সত্যিকারের পছন্দ হলে, যত সময়ই লাগুক না কেন সেটার শেষ সে দেখে ছাড়ে। গত দুবছর ধরে সে একজন দুর্দান্ত ডুবুরী। ব্র্যান্টের বিচ্ছিন্ন কিছু সাহায্য নিয়েই সে চার মিটার লম্বা একটা কায়াকও বানাচ্ছিল। হাল হয়ে গেছে তবে পাটাতনের কাজ সে এখনও ধরেনি।

একদিন সে প্রতিজ্ঞা করল যে, সে এটাকে পানিতে ভাসিয়ে সবার হাসি বন্ধ করে দেবে। কারণ ইতিমধ্যেই “কুমারের কায়াক” তারনায় যে কোন অসমাপ্ত কাজ বোঝাতে বাগধারায় পরিণত হয়েছিল।

এটা অবশ্য থ্যালসানদের সাধারণ দীর্ঘসূত্রিতার অভ্যাসের জন্য নয়। কুমারের মূল সমস্যা হল তার অভিযাত্রী মানসিকতা আর কিছুটা বিপজ্জনক বাস্তব রসিকতা করার অভ্যাস। এবং সবাই বিশ্বাস করে এটাই তাকে একদিন একটা বড় বিপদে ফেলবে।

কিন্তু তার সবচেয়ে সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া দুষ্টমীতেও কেউ রাগ করতে পারে না। কেননা সেগুলোর ভেতর একদমই কোন বিদ্বেষের চিহ্ন থাকেনা। সে একদম খোলামেলা স্বচ্ছ। কেউ তাকে মিথ্যা বলতে স্বপ্নেও চিন্তা করবে না। এটার জন্যই সে প্রায়ই এবং আসলে সব সময়ই ক্ষমা পেয়ে যায়।

আগন্তুকদের আসাটাই হচ্ছে তার জীবনের সবচে বড় রোমাঞ্চকর ঘটনা। সে তাদের যন্ত্রপাতি, শব্দ ভিডিও, সুক্ষ্ম রেকর্ডিং, তাদের গল্প-আসলে তাদের সবকিছু দিয়েই অত্যন্ত মুগ্ধ। আর যেহেতু লোরেনের সঙ্গে তার সবচে বেশী দেখা হতো সে স্বাভাবিক ভাবেই তার সঙ্গে জুটে গেল।

লোরেন অবশ্য এই সম্পর্ক গড়াটায় খুব বেশী খুশী হয়েছে তা নয়। কারণ অসহিষ্ণু সাথীর চাইতেও অগ্রহণযোগ্য হল একটা প্রশ্রয়ে বখে যাওয়া, গায়ে পায়ে লেপ্টে থাকা বাচ্চা ভাই।

১৯. সমুদ্র যাত্রা

আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না লোরেন– ব্র্যান্ট ফ্যাকনর বলল- তুমি কখনো বোটে এমনকি জাহাজেও চড়নি।

-একটা রাবারের ডিঙিতে একটা পুকুর পার হয়েছিলাম এমন একটা জিনিস মনে পড়ে। অবশ্য তখন আমার বয়স মাত্র পাঁচ।

-তাহলে তোমার ভালোই লাগবে। শরীর খারাপ করার মতো কোন ঢেউ নেই। সম্ভবত তুমি আমাদের সঙ্গে ডুবও দিতে পার।

-না, ধন্যবাদ একবারে একটা জিনিস হজম করাই ভালো। আর অন্যরা কাজ করার সময় শেখার নামে তাদের বিরক্ত করার কোন মানে নেই।

ব্র্যান্ট ঠিকই বলেছিল। তার ভালোই লাগছে। পানির ইঞ্জিন প্রায় নিঃশব্দে তাদের রীফ থেকে বের করে নিয়ে এল। তবে খুব শিগিগিরি স্থলভাগের নিশ্চিত নিশ্চয়তা ছোট হয়ে এল। সে সামান্য একটু ভয় অনুভব করল।

শুধু একটা অদ্ভুত চিন্তা তাকে স্থির রাখল। এই গ্রহে আসতে সে পঞ্চাশ আলোকবর্ষ পাড়ি দিয়েছে। এ পর্যন্ত কোন মানুষের জন্য সবচে দীর্ঘযাত্রা। আর সে কিনা স্থল থেকে মাত্র কয়েকশ মিটার যেতে ভয় পাচ্ছে।

অবশ্য কোন ভাবেই সে চ্যালেঞ্জটা ফেলতে পারছিল না। সে গলুই এ বসে ফ্যাকনরের হাল ধরা দেখতে লাগল (তার কাঁধে ওই সাদা দাগটা কিসের। ওহ্ হো বছরখানেক আগে একটা ছোট ওড়ার যন্ত্রের ভূপাতিত হবার গল্প করেছিল…) এই ল্যাসানের মনে কি বয়ে যাচ্ছে জানতে তার আগ্রহ হচ্ছে।

এটা খুবই আশ্চর্যজনক যে, কোন মানব সভ্যতা তা যতই আলোকপ্রাপ্ত বা সহজ সরল হোক না কেন, সেটা হিংসা বা যৌন আধিপত্যের চিন্তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকবে।

অবশ্য এখন পর্যন্ত এমন কিছু হয়নি যার জন্য ব্র্যান্ট হিংসা করবে। মিরিসার সঙ্গে মনে হয় সে একশ শব্দের বেশি কথা বলেনি। তারও বেশির ভাগই তার স্বামীর সঙ্গে থাকা অবস্থায়। ভুল হয়ে গেল–থ্যালসায় প্রথম সন্তান না হওয়া পর্যন্ত কাউকে স্বামী-স্ত্রী বলা হয় না। যদি কোন ছেলে হয়, তাহলে মা সাধারণত (তবে সব সময় নয়) ছেলের বাবার পদবী গ্রহণ করে। আর মেয়ে হলে দু’জনেই মায়ের পদবী রাখে অন্ততঃ দ্বিতীয় (এবং সেটাই শেষ সন্তান জন্ম পর্যন্ত।

খুব কম জিনিসই আছে যা ল্যাসানদের আঘাত করে। আঘাত করার মতো সেরকম একটা জিনিস হল বাচ্চাদের প্রতি নিষ্ঠুরতা। আর তৃতীয় গর্ভধারণ হচ্ছে আরেকটা বিশেষতঃ এরকম মাত্র দু’শহাজার বর্গকিলোমিটারের একটা বিশ্বে। এখানে শিশু মৃত্যুর হার এতই কম যে, দুটো সন্তানই একটা নির্দিষ্ট জনসংখ্যা রাখতে যথেষ্ঠ। থ্যালসার ইতিহাসে একটিই কেবল বিখ্যাত ঘটনা আছে–সেটায়

একবার এক মহিলা পাঁচ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। বেচারী মাকে এর জন্য দায়ী না করা গেলেও এলাকায় তার নাম বেশ মজার স্মৃতি হিসেবে চিহ্নিত।

আমাকে খুব, খুব সাবধানে চলতে হবে। লোরেন মনে মনে ভাবল। সে ইতিমধ্যেই জানে যে মিরিসা তকে খুব পছন্দ করেছে। তার গলার স্বর আর ভঙ্গিই তা বুঝিয়ে দেয়। আর আচমকা হাত বা শরীরের নরম কোন স্পর্শ প্রয়োজনের চাইতে বেশিক্ষণ লেগে থেকে সেটাকেই একদম প্রমাণিত করে দেয়।

তারা দুজনেই জানে যে, এটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এবং লোরেন। নিশ্চিত যে ব্র্যান্ট সেটা জানে। অবশ্য তাদের মধ্যে এ দ্বন্দ্ব থাকলেও তারা এখনও। যথেষ্ঠ বন্ধুত্ব রেখেই চলছে। জেটের শব্দ থেমে গেছে। পানিতে হাবুডুবু খাওয়া একটা বড় কাঁচের বয়ার কাছে এসে বোটটা থামল।

-এটাই আমাদের শক্তির উৎস, ব্র্যান্ট বলল। মাত্র কয়েকশ’ ওয়াটের ব্যাপার তো-সৌরকোষ দিয়েই হয়ে যায়। মিষ্টি পানির সমুদ্রের সুবিধা এটা। পৃথিবী হলে সম্ভব হতো না। তোমাদের সমুদ্র তো খুব লবণাক্ত ছিল সেটা প্রচুর কিলোওয়াট খেয়ে নিত।

-কাকু তুমি মন পরিবর্তন করনিতো? কুমার খোঁচা দিল।

লোরেন মাথা নাড়ল। অল্পবয়সী ল্যাসানদের এই সাধারণ ব্যবহৃত বিশেষণটি প্রথমে তাকে একটু ধাক্কা দিলেও, এখন অবশ্য হঠাৎ করে এতোগুলো ভাইঝি, ভাইপো পেতে ভালই লাগছে।

-না থাক। আমি এখান থেকেই দেখব, যদি তোমাদের হাঙরে খায় আর কি।

-হাঙর! কি চমৎকার প্রাণী। আমাদের এখানে যদি কিছু থাকতো! এটা ডুব দেয়াটা আরও উত্তেজনাকর করে ফেলত।

ব্র্যান্ট আর কুমারের যন্ত্রপাতি ঠিক করার ব্যাপারটা লোরেন একজন প্রযুক্তিবিদের উৎসাহ নিয়েই দেখল। মহাশূন্যে বের হতে যা পরতে হয় তার চাইতে এটা অনেক সহজ। প্রেসার ট্যাঙ্কটা এতোই ছোট যে হাতের তালুতে এটে যায়।

সে মন্তব্য করল,–অক্সিজেন ট্যাঙ্কটা তো কয়েক মিনিটের বেশি কাজ করবে না।

ব্র্যান্ট আর কুমার পরস্পরের দিকে তাকাল।

–অক্সিজেন! ফোঁস ফোঁস করে ব্র্যান্ট চেঁচাল। ওটাতো বিশ মিটার পানির নিচে মারাত্মক বিষ। বোতালটায় আছে কেবল বাতাস- তাও জরুরী প্রয়োজনে। পনেরো মিনিটের মতো চলে।

সে কানের পেছনের কানকোর মতো যন্ত্রটা দেখাল।–তোমার যা অক্সিজেন দরকার তা তো সমুদ্রের পানিতেই আছে। অবশ্য যদি তুমি তা বের করতে পার। পাম্প আর ফিল্টার চালানোর মতো শক্তি সম্পন্ন শক্তিকোষ থাকলেই হল। এরকম একটা যন্ত্র দিয়ে আমি দরকার হলে একসপ্তাহও থাকতে পারব। তার বাঁ হাতের কব্জিতে জ্বলজ্বল করা কম্পিউটার ডিসপ্লেতে সে চাপ দিল।

-এটা আমাকে সব তথ্য দেয়। গভীরতা, শক্তিকোষের অবস্থা, ওঠার সময়।

লোরেন আরেকটা বোকার মতো প্রশ্ন করে বসল,

-তুমি একটা মুখোস পড়েছ! কুমার পরোনি কেন?

–না, আমি পড়েছি-কুমার হাসল। ভালো ভাবে খেয়াল কর।

–ওহ, আচ্ছা…খুব সূক্ষ্ম তো!

-তবে ওটা ফালতু ব্র্যান্ট বলল। যদি তুমি কুমারের মতো সত্যিকার অর্থেই পানিতে থাকতে চাও। আমি একবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পানিটা খুব চোখে লাগে। সেজন্য আমি পুরনো মডেলটাই পছন্দ করি। ঝামেলা কম। তৈরি!

-তৈরী, কাপ্তান!

তারা একই সঙ্গে ঢালের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল। তাদের গতি এতোই মসৃণ যে, নৌকাটা মৃদু দুলল মাত্র। হালের কাঁচ দিয়ে লোরেন দেখল দু’জনে রশি ধরে সহজ ভাবে চলে যাচ্ছে। সে জানে দেখতে অনেক কম মনে হলেও তারা এখন প্রায় বিশ মিটার নীচে।

যন্ত্রপাতি তার আগেই ফেলা আছে। দুই ডুবুরী দ্রুত মেরামতে লেগে গেল। মাঝে মাঝে ইশারায় কথা বললেও, অধিকাংশ সময়েই তারা নিঃশব্দে কাজ করছিল। প্রত্যেকে নিজের এবং সঙ্গীর কাজ জানে, তাই কথার প্রয়োজনটা কি!

লোরেনের সময় খুব দ্রুত কাটছিল। তার মনে হচ্ছিল আসলেই সে একটা নতুন বিশ্বের দিকে তাকাচ্ছে। প্রাচীন সমুদ্রের ওপর অসংখ্য ভিডিও সে দেখলেও তার নীচের বয়ে যাওয়া এ জীবন সম্পূর্ণই তার অপরিচিত। সেখানে ছন্দময় গোলাকার জেলিফিস, তরঙ্গায়িত গালিচা বা ত্রুর মতো প্যাঁচ থাকলেও দ্রুত গতির সত্যিকার মাছ বলতে কোন জিনিস যা কল্পনায় আসে-তার অস্তিত্ব নেই। শুধু একটা টর্পেডোর মতো একটা জিনিস সে একবার দেখল। মনে হয় ওটা পৃথিবীরই কিছু। পানির তলের ইন্টারকমের মধ্যে কথা না শুনলে সে ভাবত, ব্র্যান্ট আর কুমার বুঝি তার কথা ভুলেই গেছে।

-আসছি। বিশ মিনিটের মধ্যে হয়ে যাবে। সবকিছু ঠিক আছে?

-হ্যাঁ। যে মাছটা একটু আগে গেল সেটা কি পৃথিবীর?

-আমি দেখিনি।

-কাকু ঠিক বলেছে ব্র্যান্ট। পাঁচ মিনিট আগে প্রায় বিশ কেজির একটা ট্রাউট মাছ গেছে। তুমি তখন ওয়েল্ডিং করছিলে।

তারা এখন নোঙরের রশি বেয়ে আস্তে আস্তে উপরে উঠে আসছে। পাঁচ মিটার বাকী থাকতে তারা থামল।

প্রতিটি ডুবের এটা হচ্ছে সবচে একঘেয়ে অংশ ব্র্যান্ট বলল। আমাদের প্রায় পনের মিনিট থাকতে হবে এখানে। চ্যানেল ১২তে দাও, আর আস্তে–।

চাপমুক্ত হবার সময়কার গানটা নিশ্চয়ই কুমারের পছন্দ। এর তীব্র ঝংকার পানির নীচের ঐ শান্তির জীবনে একদম বেমানান। এর সুরের মধ্যে বন্দী না হওয়ায় লোরেন বেঁচে গেল এবং দুই ডুবুরী ওঠা শুরু করতেই সে ওটা বন্ধ করে দিল।

-সকালের কাজ বেশ ভালো হল ব্র্যান্ট কাঁপতে কাঁপতে বলল। ভোল্টেজ আর বিদ্যুৎ সমান। এবার আমরা ফিরতে পারি।

যন্ত্রপাতি খুলে রাখাতে লোরেন এর সাহায্য তারা কৃতজ্ঞ চিত্তেই নিল। দু’জনেই কয়েক কাপ উষ্ণ, মিষ্টি তরল (ল্যাসানে চা নামে পরিচিত হলেও পৃথিবীর ওজাতীয় কোন তরলের সঙ্গে তা মেলে না) খেতেই চাঙ্গা হয়ে উঠল। কুমার ইঞ্জিন চালিয়ে রওয়ানা দিল আর ব্র্যান্ট গিয়ারের কাছে একটা ছোট রঙীন বাক্স খুলল।

-না, ধন্যবাদ-লোরেন বলল। যখন তাকে ব্র্যান্ট হালকা নেশার ট্যাবলেট দিল।

-আমি এমন কোন স্থানীয় অভ্যাস নিতে চাইনা যা কিনা সহজে ছাড়া যাবে না। কথাটা বলেই সে অনুতপ্ত হল। তার অবচেতন মনের পাপবোধই তাকে এই মন্তব্যটা করিয়েছে। ব্র্যান্ট অবশ্য এর অন্তর্নিহিত মানে বোঝার কোন লক্ষণ দেখালো না। সে মাথার নীচে হাত দিয়ে মেঘমুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।

-দিনের বেলাতেও কিন্তু ম্যাগেলানকে দেখা যায়–প্রসংগটা ঘোরানোর আশায় লোরেন বলল। অবশ্য ঠিক কোন জায়গায় থাকবে, তা তোমাকে জানতে হবে।

-আমি অবশ্য কখনো চেষ্টা করিনি-মিরিসা প্রায়ই দেখে।

কুমার মাঝখানে বলে উঠল।

-আমাকে ও শিখিয়েছে। কোন মহাশূন্যচারীকে ফোন করে প্রদক্ষিণের সময়টা জানবে আর তারপর চিৎ হয়ে কেবল শুয়ে থাকলেই চলবে। ঠিক মাথার উপরে খুব উজ্জ্বল তারার মতো এটা চলতে থাকে। মনে হয় যেন, এটা একদম নড়ছে না। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও যদি অন্যদিকে তাকাও এটাকে তুমি হারিয়ে ফেলবে।

হঠাৎ করেই কুমার ইঞ্জিনটা পুরো বন্ধ করে দিল। লোরেন অবাক হয়ে দেখল যে তারনা অন্ততঃপক্ষে এখনও এক কিলোমিটার দূরে। এ জায়গাটার পাশেই “প লেখা আর লাল পতাকা ওড়ানো একটা বড় বয়া ভাসছে।

-বন্ধ করলে কেন? লোরেন জিজ্ঞেস করল।

কুমার ছোট একটা পাত্রকে সমুদ্রে খালি করছিল। ভাগ্য ভালো যে এটা এতোক্ষন বন্ধ ছিল।

ভেতরের জিনিসটা অনেকটা রক্তের মতো দেখতে হলেও গন্ধটা খুবই ভয়ংকর। বোটের ছোট্ট সীমার মধ্যে লোরেন যতটা পারল চেপে গেল।

-একজন পুরোনো সাথীকে ডাকছি। ব্র্যান্ট খুবই নরম ভাবে বলল। নড়ো না, শব্দ করো না। সে আবার খুব নার্ভাস।

-সে? লোরেন চিন্তা করল। কি হচ্ছে এসব?

পাঁচ মিনিটের মধ্যে কিছুই হলো না। লোরেন না দেখলে বিশ্বাসই করত না যে কুমার এতোক্ষন নিথর হয়ে বসে থাকতে পারে। তারপর সে দেখল বোট থেকে কয়েক মিটার দূরে, পানির নীচে থেকে একটা কালো, বাকা মতো জিনিস উঠে আসছে। সে কিছুক্ষণ লক্ষ্য করে বুঝল, যে এটা একটা বৃত্ত তৈরী করে তাদের ঘিরে ফেলছে। একই সঙ্গে ঠিক ঐ মুহূর্তে বুঝতে পারল যে, কুমার আর ব্র্যান্ট ঐ জিনিসটা দেখছে না, দেখছে তাকে। আচ্ছা তাহলে তারা আমাকে অবাক করতে চাচ্ছে–সে নিজেকেই বলল। বেশ দেখা যাক…

তারপরও যখন লোরেন তার চারপাশে উজ্জ্বল-না, বরং বলা যায় পচে যাওয়া, গোলাপী মাংসের স্তূপকে সমুদ্র থেকে জেগে উঠতে দেখল, তার সমস্ত ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে সে চিৎকার দেয়া থেকে বিরত হল। এটা তাদের চারপাশে প্রায় আধা মানুষ সমান উঁচু, গোলাপী একটা দেয়াল তৈরী করেছে। আর সবচে ভয়ংকর হল। এর উপরের অংশটা প্রায় পুরোটাই লাল-নীল রং এর মোচরানো সাপ দিয়ে ঢাকা।

গভীর সমুদ্র থেকে অসংখ্য লতানো বাহুসহ একটা বিশাল মুখ তাদের গ্রাস করতে এল… তবে নিশ্চিত যে কোন বিপদ নেই। তার সঙ্গীদের ভাব-ভঙ্গীই তা প্রমাণ করে।

-ওহ ঈশ্বরের, ক্র্যাকানের কসম কি এটা? সে প্রাণপনে গলা স্বাভাবিক রেখেই বলল।

-তুমি চমৎকার সামলেছো? কুমার প্রশংসার সুরে বলল। অনেকে বোটের তলায় গিয়ে লুকায়। এটা অমেরুদন্ডী প্রানীর একটা সমষ্টি, বিশেষ ধরনের বিলিয়ন কোষের সমষ্টি যা একসঙ্গে কাজ করে। এধরনের জিনিস তোমাদের পৃথিবীতেও ছিল–তবে হয়তো এতো বড় নয়।

-তুমি নিশ্চিত থাক সে ব্যাপারে-লোরেন উত্তর দিল। আর যদি কিছু মনে না করো তাহলে একটা কথা জিজ্ঞেস করি? এটাকে কিভাবে এখানে আনলে? ব্র্যান্ট কুমারের দিকে মাথা ঝাঁকাল। সে তখন ইঞ্জিনকে পুরো শক্তিতে আনতে ব্যস্ত। সঙ্গে সঙ্গে তাদের চারপাশের জীবন্ত দেয়ালটা অসম্ভব দ্রুততায় আবার গভীরে চলে গেল। একটা বৃত্তাকার পানির ঢেউ ছাড়া আর কোন চিহ্নই রইল না।

-এটা কম্পনকে ভয় পায়, ব্র্যান্ট ব্যাখ্যা দিল। পর্যবেক্ষণ কাঁচের মধ্য দিয়ে দেখ, পুরো প্রাণীটাকেই দেখতে পাবে।

তাদের নীচে দশ মিটার পুরু, কাঠের ঘড়ির মতো একটা জিনিস সমুদ্র তলের দিকে ফিরে যাচ্ছে। লোরেন এতোক্ষণে বুঝল যে “সাপ” গুলো হচ্ছে কেবল সাঁতারের জন্য লতানো বাহু। পানির ভেতর সেগুলো ভেসে আছে।

-কি দানবরে বাবা! এতোক্ষণ পরে সে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল। একটা গর্ব, এমনকি প্রফুল্ল ভাব তার ওপর খেলা করছে। সে কুমার আর ব্র্যান্টের একটা পরীক্ষায় পাশ করেছে। ব্র্যান্ট আর কুমারের কাছ থেকে সে সম্মান আদায় করে নিয়েছে।

-জিনিসটা কি ভয়ংকর না?

–অবশ্যই। সে জন্যই তো ওই বিপদ সূচক বয়া দেয়া।

–সত্যি বলছি, ওটাকে আমার মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে।

–কেন? ব্র্যান্ট আহত স্বরে জিজ্ঞেস করল, এটা তো কোন ক্ষতি করেনি।

–বেশ, ওরকম আকৃতির প্রাণী নিশ্চয়ই প্রচুর মাছ শিকার করে।

-হ্যাঁ–তবে আমরা শুধুই মাছ খাইনা। আর এই জিনিসটা কিভাবে মাছ ধরে তা নিয়েও বেশ প্রশ্ন ছিল। কারণ সবচে ক্যাবলা মাছগুলোও তো এর ভেতর সাঁতরে যাবে না। মানে দেখা গেল যে, কিছু রাসায়নিক জিনিস এটা নিঃসরণ করে। এরপরই আমরা বৈদ্যুতিক ফদের ব্যাপারে চিন্তা করি। যেটা আমাকে মনে করায় ব্র্যান্ট তার যোগাযোগের যন্ত্রটার দিকে ঝুকল।

-তারনা তিন। তারনা স্বয়ংক্রিয় রেকর্ডকে ব্র্যান্ট বলছি। তারটা ঠিক করা হয়েছে। সব কিছু স্বাভাবিক ভাবে চলছে। উত্তরের দরকার নেই। বার্তা শেষ। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে একটা পরিচিত স্বর সঙ্গে সঙ্গেই সাড়া দিয়ে উঠল।

–হ্যালো ব্র্যান্ট, ড, লোরেনসন। শুনে খুশী হলাম। তোমাদের জন্য কিছু আকর্ষণীয় খবর আছে। শুনতে চাও?

-অবশ্যই মেয়র, দুজনের পারস্পরিক নিঃশব্দ সম্মতিতে ব্র্যান্ট উত্তর দিল। বলুন।

-কেন্দ্রীয় আর্কাইভ কিছু অদ্ভুত জিনিস আবিষ্কার করেছে। এব্যাপারটা আগেও হয়েছে। আড়াই’শ বছর আগে উত্তর দ্বীপে বৈদ্যুতিক তলানী পদ্ধতির মাধ্যমে তার। রীফ বানাতে চেয়েছিল–যে পদ্ধতি পৃথিবীতে খুব ভালো কাজ দিয়েছিল। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর পানির নীচের তারগুলো ছেঁড়া পাওয়া গেল-কিছু চুরিও হয়েছিল। পরীক্ষাটা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল বলে জিনিসটা নিয়ে আর কোন ঘাটাঘাটি করা হয়নি। পানিতে অত খনিজই নেই কাজ করার মতো। সুতরাং রক্ষণশীলদের তুমি দোষ দিতে পারছ না। তাদের ওসময় অস্তিত্বই ছিল না।

ব্র্যান্ট এতোটাই অবাক হল যে, লোরেন হেসে দিল।

-তুমি আমাকে অবাক করতে চাইছ! বেশ তুমি এটা অন্ততঃ প্রমাণ করেছ যে সাগরে অনেক জিনিস আছে যা আমার কল্পনারও বাইরে। কিন্তু এমন কিছু জিনিস ওখানে আছে, যার কল্পনা করা তোমারও অসাধ্য।

২০. স্বপ্ন সময়

তারনার লোকজন প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাইল না। তারা মজা করেই বলল,

-প্রথমে তুমি বললে যে তুমি কখনো বোটে ওঠনি। আর আবার এখন তুমি বলছ যে, তুমি সাইকেল চালাতে জানো।

-তোমার লজ্জা হওয়া উচিত- মিরিসা চোখ টিপে স্ক্রিপ করল। যাতায়াতের সবচাইতে কার্যকর পদ্ধতিটা তুমি কখনো চেষ্টাই করনি।

-মহাকাশযানে তো আর ব্যবহার হয় না। ওদিকে শহরের জন্য ওটা খুব বিপদজনক। লোরেন বাঁচতে চাইল, ঠিক আছে, শিখে নেব।

এবং খুব শিগগিরি সে আবিষ্কার করল, দেখতে যেমন সোজা লাগে বাইসাইকেলে চড়া তার চাইতে ঢের কঠিন। অবশ্য এই ছোট চাকার মেশিনটা যার ভারকেন্দ্র অনেক নীচে, সেখানে থেকে মাটিতে পড়ে যাওয়া খুব সহজ নয়। তবে প্রাথমিক চেষ্টাটা তার জন্য বেশ হতাশাব্যঞ্জকই ছিল। সে হয়তো ছেড়েই দিত, যদি না মিরিসা তাকে বোঝাত যে এটাই দ্বীপটাকে চেনার জন্য সবচে ভালো বাহন। আর তার নিজস্ব আশাটা হল অবশ্য, মিরিসাকে চেনার জন্যও এটাই সবচে ভালো বাহন।

প্রাথমিক কিছু অসুবিধার পর সে বুঝতে পারল কৌশলটা আসলে চালানোর সমস্যাটাকে সজ্ঞান চিন্তার ওপর ছেড়ে না দিয়ে, শরীরের নিজস্ব প্রতিক্রিয়ার ওপরই ছেড়ে দিতে হয়। এটাই যুক্তিগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত। কেউ যদি প্রতিটি পদক্ষেপই চিন্তা করে দিতে চায়, তবে স্বাভাবিক ভাবে হাঁটা একেবারেই অসম্ভব হবে। অবশ্য এই উপলদ্ধিটাকে বুদ্ধি বৃত্তির ভেতর ঠাই দিতে লোরেনের কিছুটা সময় লাগল। আর একবার এই বাধা অতিক্রম করার পর, পরবর্তী অগ্রগতিটা হল দ্রুত। এবং সবশেষে তার আশা অনুযায়ীই মিরিসা তাকে দূরের পথগুলোতে ঘোরার জন্য আমন্ত্রণ জানাল।

বসতি থেকে পাঁচ কিলোমিটারও তারা আসেনি। অথচ এর মধ্যেই মনে হচ্ছে যে এই বিশ্বে এখন শুধু তারাই দু’জন আছে। অবশ্য সত্যিকার অর্থে সাইকেল চালানোর সরু পথে তারা তার চাইতে বেশী পথই অতিক্রম করেছে। পথটা সবচাইতে লম্বা করার জন্যই ছবির করে মতো করে তৈরী করা হয়েছে। অবশ্য লোরেন খুব সহজেই তার তাৎক্ষণিক স্থান নির্ণায়ক যন্ত্রটির মাধ্যমে নিজের অবস্থান বের করতে পারে, কিন্তু তার তা করতে ইচ্ছে করছে না। হারিয়ে গেছে- এমন চিন্তা করতেই বরং ভালো লাগে।

যন্ত্রটাকে রেখে আসলেই মিরিসা খুশী হতো।

-ওটা কেন তোমাকে নিতেই হবে? তার বাম কব্জির ব্যান্ডটা দেখিয়ে সে বলল, মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন থাকতেই তো ভালো লাগে।

-আমি জানি, কিন্তু মহাকাশযানের নিয়ম কানুন খুব কড়া। যদি ক্যাপ্টেন বের জরুরী দরকার হয় আর আমি উত্তর দিতে না পারি?

-কি, কি করবে সে? তোমাকে জেলে ভরবে?

–তার ঝাড়ি খাবার চাইতে সেটাই আমি পছন্দ করব। আমি অবশ্য এটাকে নিষ্ক্রিয় রেখেছি। যদি তারপরও মহাকাশযান থেকে যোগাযোগ করে তাহলে সেটা অবশ্যই একটা জরুরী অবস্থায় করবে। আমাকে যেতেই হবে।

হাজার বছর ধরে সমস্ত তেরানদের মতোই লোরেন বরং জন্মদিনের পোশাকে থাকতে চাইবে, কিন্তু ওই যন্ত্রটা ছাড়া সে থাকবে না। পৃথিবীর ইতিহাস অসংখ্য বেপোরোয়া এবং নির্বোধ লোকদের ভয়ংকর মৃত্যুর কাহিনী দিয়ে পূর্ণ-যারা নিরাপদ স্থানের মাত্র কয়েক মিটারের মধ্যে মারা গেছে শুধু মাত্র লাল জরুরী বোতামটায় চাপ না দিতে পারায়।

সাইকেল চালানোর রাস্তাটা নিঃসন্দেহে কোন বড় যানবাহনের জন্য তৈরী হয়নি। এটা এক মিটারেরও কম চওড়া। লোরেনের প্রথম মনে হচ্ছিল সে যেন একটা রশির ওপর দিয়ে চলছে। ঠিক থাকার জন্য সে মিরিসার পেছন দিকে তাকিয়ে ছিল এবং সেটা খুব একটা প্রীতিকর কাজ নয়। তবে কয়েক কিলোমিটারের পর তার আত্মবিশ্বাস চলে এল। সে পাশের দৃশ্য উপভোগ আরম্ভ করল। অন্যদিক থেকে কাউকে আসতে দেখলে দু’পক্ষকেই নেমে যেতে হবে। পঞ্চাশ ক্লিক গতিবেগে চলা দুটো সাইকেলের সংঘর্ষ চিন্তাই করা যায় না। বিধ্বস্ত একটা বাই সাইকেল নিয়ে বাসার দূরত্বটা একটু বেশীই হয়ে যায়।

রাস্তাটা নিথর, নিস্তব্ধ, মিরিসা কোন অন্যরকমের গাছ বা সুন্দর জায়গা দেখানোর সময় থেমে যাচ্ছিল। এরকম নিস্তব্ধতার অভিজ্ঞতা লোরেনের সারা জীবনে হয়নি। পৃথিবী সব সময়ই শব্দময় ছিল-আর মহাকাশযানের জীবনতো পুরোটাই যান্ত্রিক শব্দের ছন্দে ভরা, কেবল মাঝে মাঝে ভয়ংকর সব অ্যালার্মের শব্দ ছাড়া।

আর এখানে গাছগুলো যেন একটা অদৃশ্য, শব্দশোষণ করা কম্বলে ঢাকা। তাই প্রতিটি শব্দই মুখ থেকে বের হবার সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যায়। প্রথম প্রথম এটা ভালোই লাগে। কিন্তু লোরেনের এখন মনে হচ্ছে, এই শূন্যতা ভরার মতো কিছু থাকা উচিত। একবার সে মনে করল তার যোগাযোগের যন্ত্রের হালকা আবহ। সঙ্গীতটা বাজায়। কিন্তু মিরিসার আপত্তির কথা মনে রেখে, সেটা আর করা হল না।

তাই যখন দূরের গাছগুলোর ভেতর দিয়ে পরিচিত হয়ে আসা থ্যালসানদের নাচের সুর শুনতে পেল সে রীতিমতো অবাকই হল। কিন্তু সরু রাস্তাটা যেহেতু দু’তিনশ মিটারের বেশি খুব একটা সোজা যায় না তাই একটা তীক্ষ্ণ বাঁক নেয়ার আগ পর্যন্ত সে বুঝতেই পারল না, সুরটা কোত্থেকে আসছে। বাঁকের পরই একটা বিশাল সুরময় যন্ত্র তাদের দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছিল। তারা নেমে যখন এটাকে পাশ দেবার জন্যে দাঁড়িয়ে রইল, তখন লোরেন বুঝল যে, আসলে জিনিসটা কি। এটা একটা স্বয়ংক্রিয় রাস্তা মেরামতকারী।

–বাজনাটা কি জন্যে? সে জিজ্ঞেস করল, এর কাজের সঙ্গে তো খাপ খায় না। সে যখন এটা নিয়ে ঠাট্টা করছে তখন যন্ত্রটা তাদের দিকে ঘুরে দাঁড়াল আর কয়েকবার বলল–আমার আশেপাশের একশ’ মিটারের সীমার মধ্যে রাস্তায় উঠবেন না। ওটা এখনো শক্ত হচ্ছে। আমার আশেপাশের একশ’ মিটারের সীমার মধ্যে রাস্তায় উঠবেন না। ওটা এখনো শক্ত হচ্ছে। ধন্যবাদ। মিরিসা হেসে উঠল তার অবাক হওয়া দেখে।

-তুমি ঠিকই বলেছ। এটা খুব বুদ্ধিমান নয়। সুরটা হচ্ছে রাস্তার অন্যদের সাবধান করার জন্য।

-এর জন্য সাইরেন কি আরও ভালো হতো না?

–হতো, কিন্তু ওটা কেমন অবন্ধুসুলভ মনে হয়।

তারা সাইকেল থামিয়ে সংযুক্ত ট্যাঙ্ক, কন্ট্রোল মেশিন, রাস্তা মসৃণ করার যন্ত্র চলে যাবার জন্য অপেক্ষা করল। লোরেন রাস্তাটা স্পর্শ না করে থাকতে পারল না। নতুন রাস্তাটা উষ্ণ, সামান্য ফুলে ওঠা এবং দেখতে ভেজা হলেও একদম শুকনো। অবশ্য সেকেন্ডের মধ্যে এটা পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেল। লোরেনের আঙ্গুলের ছাপ হালকা ভাবে ফুটে রইল রাস্তায়। তার মনে হঠাৎ একটা চিন্তা খেলে গেল–থ্যালসায় আমার চিহ্ন রয়ে গেল-যতদিন না রোবটটা আবার ফিরে আসে। রাস্তাটা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে যাচ্ছিল। লোরেন তার উরু আর পায়ের অপরিচিত মাংসপেশীগুলোর আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছিল। এর জন্য বাড়তি শক্তির দরকার হলেও মিরিসা বৈদ্যুতিক শক্তি হিসেবে কাজ করল। মিরিসা যেহেতু গতি এতোটুকুও কমায়নি, লোরেন কিভাবে কমায়? সুতরাং জোরে শ্বাস নিয়ে লোরেন তাকে ধরে ফেলল।

সামনের হালকা গুঞ্জনটা কিসের? নিশ্চয়ই দক্ষিণ দ্বীপে কেউ কোন রকেট ইঞ্জিন পরীক্ষা করছে না। তারা সামনে প্যাডেল মারতেই আওয়াজটা আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল। দেখার এক মুহূর্ত আগে লোরেন জিনিসটা বুঝতে পারল। পৃথিবীর মানদন্ডে জলপ্রপাতটা খুব আহামরি নয়-সম্ভবত একশ’ মিটার উঁচু আর বিশ মিটার চওড়া। এর শেষ মাথায় ঝকঝক করা একটা ধাতব ব্রীজ আছে।

মিরিসা সাইকেল দিয়ে নেমে তার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে বলল,

-অদ্ভুত কিছু দেখছ?

–কি অদ্ভুত? চারদিকে দেখতে দেখতে লোরেন উত্তর দিল। যা দেখা যাচ্ছে তা হলো গাছ আর গুল্মের ঘন জঙ্গল, আর রাস্তাটা জলপ্রপাতের অপর পাশে চলে গেছে।

-গাছ, গাছগুলো!

–কি তাতে? আমি উদ্ভিদ বিজ্ঞানী নই।

–আমিও না। কিন্তু ভালোভাবে দেখো-তাহলেই বুঝবে।

সে তবুও হতবুদ্ধি হয়েই তাকাল। আর হঠাৎই সে বুঝতে পারল–কারণ গাছগুলো প্রতিটি একটা প্রাকৃতিক প্রকৌশলের অংশ। আর সে নিজেও একজন প্রকৌশলী। জলপ্রপাতের এপাশে কোন অন্য প্রকৌশলী কাজ করেছে। সে যদিও গাছগুলোর নাম বলতে পারবেনা, কিন্তু সেগুলো চেনা চেনা লাগছে নিশ্চয়ই ওগুলো পৃথিবীর …হ্যাঁ নিশ্চয়ই ওটা ওক। আর বহু আগে কোন জায়গায় সে ওই ছোট ঝোঁপের চমৎকার হলুদ ফুলগুলো দেখেছিল।

কিন্তু ব্রীজের ওপাশে একটা আলাদা জগৎ। গাছগুলো ওগুলো কি সত্যিই গাছ?

কেমন অসম্পূর্ণ আর কদর্য। কিছু আছে খুব ছোট মোটা কান্ডবিশিষ্ট যা দিয়ে ছোট কিছু শাখা বের হয়েছে। অন্যগুলো বিশাল ফার্ণের মতো। অন্যগুলো দানব বিশেষ, কঙ্কালসার শাখার সংযোগে গর্ত আর কোন ফল নই…

-বুঝতে পেরেছি। থ্যালসার আসল উদ্ভিদ।

-হ্যাঁ, সমুদ্র থেকে মাত্র কয়েক মিলিয়ন বছর হল এরা ডাঙায় এসেছে। আমরা এটাকে পার্থক্য রেখা বলি। কিন্তু আসলে এটা হল মুখোমুখি যুদ্ধরত দুটো সেনাবাহিনী। এবং কেউই জানে না, কে জিতবে। আমরাও সাহায্য করতে পারব না। পৃথিবীর উদ্ভিদগুলো উন্নত প্রজাতির। কিন্তু স্থানীয়গুলো গ্রহের আবহাওয়ার সঙ্গে ভালো পরিচিত। সময় সময় একদল আরেকটা গ্রাস করতে চায়। তবে তখন আমরা থামিয়ে দেই।

-কি অদ্ভুত, ছোট্ট ব্রীজটার ওপর দিয়ে সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে লোরেন ভাবল। থ্যালসায় নেমে আমার মনে হচ্ছে যে, সত্যি আমি এক ভিনগ্রহে এসেছি… এই অগোছাল গাছ আর বিকট ফার্ণগুলো কয়লা খনি তৈরী করে, যা মানব জাতিকে শিল্পবিপ্লবের শক্তি দিয়েছিল-তাই এক সময়ে মানবজাতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তার মনে হচ্ছিল যেন এখনই একটা ডাইনোসর এসে আক্রমণ করবে-অবশ্য তারপরই তার মনে পড়ল যে, ঐ ভয়ংকর সরীসৃপ আসতে আরও একশ’ মিলিয়ন বছর লাগবে যদি পৃথিবীর মতো এই গ্রহ ফুলে ফলে শোভিত হয়। ফিরে আসার সময় লোরেন বিরক্তি প্রকাশ করল-ধুত্তোর! ক্র্যাকান!

-কি হয়েছে?

লোরেন মসের মতো দেখতে একটা ঘন আস্তরে আটকা পড়েছে।

–উহ! দাঁতে দাঁত চেপে সে পায়ের পেশীগুলোকে চেপে ধরল।

–দেখি। মিরিসা আত্মবিশ্বাসী মনোযোগর সুরে বলল।

তার আরামদায়ক, অভিজ্ঞ যত্নে খিচ লাগাটা ছেড়ে গেল।

–ধন্যবাদ, লোরেন কিছুক্ষণ পর বলল-অনেকটা ভালো লাগছে। বন্ধ করো না।

–তোমার কি সত্যি তাই মনে হয়? মিরিসা ফিসফিসিয়ে বলল। এবং দুই বিশ্বের মাঝে তারা হঠাৎ এক হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *