০১. থ্যালসা

দূর পৃথিবীর ডাক / সায়েন্স ফিকশন – আর্থার সি. ক্লার্ক / অনুবাদ: মিজানুর রহমান
প্রথম প্রকাশ : বইমেলা ফেব্রুয়ারী ২০০১

মহাকাশযান ম্যাগেলান–পুড়ে যাওয়া পৃথিবীর শেষ। উপহার তার সন্তানদের প্রতি। পঞ্চাশ আলোকবর্ষ দূরে সাগান-২ এহকে মানুষের নতুন পৃথিবী করার সংকল্প নিয়ে ছুটে চলেছে সে। যাত্রাপথে বিরতি হিসেবে যাত্রা বিরতী হল থ্যালসায়। ছোট্ট সে বিশ্বে। পুরনো পৃথিবীর মানুষ আবিষ্কার করল তাদেরই উত্তরসূরীদের। ভিন্ন দুই প্রেক্ষাপট থেকে আসা দুই সংস্কৃতির মানুষ কিভাবে পরস্পরকে আবিষ্কার করবে? তারা কি পরস্পরকে বুঝতে পারবে? ধ্বংস হওয়া

মা পৃথিবীর স্মৃতি, থ্যালসার বর্তমান সৌন্দর্য আর সাগান-২ এর কঠিন ভবিষ্যত কি একই সুতোয় বাঁধা থাকবে? নাকি পালতোলা সেই ক্যাপ্টেন কুকের ম্যাগেলানের মত ঝঞ্ঝা বিক্ষুদ্ধ ঘটনা পাড়ি দিতে হবে কোয়ান্টাম ড্রাইভের শক্তিসম্পন্ন মহাকাশযান ম্যাগেলানকে। পাঁচশ বছরের যাত্রায় সব কিছুই সম্ভব। পৃথিবীবাসী ও থ্যালসার অধিবাসীদের সম্পর্ক। নৃতাত্ত্বিক অভিঘাত, পুড়ে যাওয়া পৃথিবীর বিষণ্ণতা আর সব ছাপিয়ে ওঠা মানুষের জয়ের কাহিনী বলা হয়েছে এ-গ্রন্থে। এ-কাহিনী যত না আজকের তারচেয়ে বেশী আগামীর। হয়তো আগামীতে কোন। দূর গ্রহে বসে এই কাহিনী পড়ে কেউ বিস্মিত হবেন লেখকের প্রজ্ঞার কথা ভেবে। বিশ্বের সব সম্মানিত সায়েন্স ফিকশন পুরস্কার যে লেখকের করায়ত্ব।

অনুবাদকের উৎসর্গ : আব্বা-আম্মা-সোহাগ এবং সাদিয়া শবনম সোমা –আমার কাছের পৃথিবীর মানুষেরা

অনুবাদকের কথা

আর্থার সি ক্লার্ক বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখক। তার সাহিত্য কর্মের ভেতর The Songs of Distant Earth একটি শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। এ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীটি একটি Hard Scince Fiction অর্থাৎ এটি নিছক কোন ফ্যান্টাসী নয়। বর্তমান বিজ্ঞানের আবিষ্কারের ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতে যা হতে পারে তার একটা সম্ভাব্য বিবরণ। কোয়ান্টাম ড্রাইভের ব্যাপারটিই কেবল এখানে কল্পিত। এছাড়া বাকী সবকিছুই বর্তমান বিজ্ঞানের স্বাভাবিক অগ্রগতিতেই আসার কথা। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী আর নিছক ফ্যান্টাসীর ভেতরের পার্থক্যটা এই উপন্যাসটি স্পষ্ট করে দেয়।

মহাকাব্যিক ঢঙে লেখা এ উপন্যাসটিতে বিজ্ঞান, নৃতত্ব, ভালোবাসা আর বিষাদ এক সঙ্গে মিলেমিশে এক অসাধারণ কাহিনীর জন্ম দিয়েছে যার সঙ্গে সম্ভবতঃ বাংলাভাষী পাঠকরা এর আগে খুব বেশি পরিচিত হয়নি।

মিজানুর রহমান (শাওন)

থ্যালসা

১. তারনার সৈকতে

বোটটা রীফে ঢোকার আগেই মিরিসা বুঝতে পরল যে ব্র্যান্ট রেগে আছে। হালের পেছনে তার রাগী দাঁড়ানো ভঙ্গি আর শেষ পথটুকু কুমারের বিশ্বস্ত হাতে ছেড়ে না দেয়াটাই প্রমাণ করে যে, কিছু একটা তাকে রাগিয়ে তুলেছে।

মিরিসা আস্তে আস্তে পাম গাছের ছায়া ছেড়ে বেরিয়ে এল। ঠান্ডা বালি যেন পা কামড়ে ধরছে। সে যখন সমুদ্রের কাছাকাছি পৌঁছালো, ততক্ষনে কুমার সবকিছু গুটিয়ে এনেছে। তার “বাচ্চা” ভাইটা (এখন অবশ্য তার সুঠাম পেশীবহুল দেহটা প্রায় মিরিসার সমানই হয়ে গেছে) ফুর্তিতে দৌড়ে এলো। কতবার মিরিসা আশা করেছে যে কুমারের এই সহজ ভালোমানুষী ভাবটা যদি ব্র্যান্টের থাকতো–কোন সমস্যাই যাকে আক্রান্ত করতে পারে না। ব্র্যান্ট অবশ্য বোট পাড়ে ভেড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল না। কোমর পানিতেই লাফিয়ে নেমে, রাগের সঙ্গে আসতে লাগল। একটা ধাতব, বাঁকানো ফেসটুন জাতীয় জিনিস, তাতে আবার কিছু ছেঁড়া তার ঝুলছে–সেটাই মিরিসাকে দেখানোর জন্য তুলে দেখাল।

চেঁচালো, দেখ! তারা আবার এটা করেছে। আর খালি হাতটা দিয়ে একই সঙ্গে উত্তর দিকটা দেখালো, এবার আমি ছাড়ছি না। আর ঐ মেয়র তার যা খুশী করুক।

মিরিসা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। ওদিকে দুই কাঠামো বিশিষ্ট ছোট নৌকাটা, প্রাচীন কোন সামুদ্রিক প্রাণীর মতো বালিতে ঢেউয়ের তোড়ে আছড়ে পড়ল। বাইরের চাকাগুলোর সাহায্যে সেটা আস্তে আস্তে জলসীমার উপরে উঠতেই কুমার নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ করে, রাগে ফুঁসতে থাকা তার কাপ্তেন এর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। সে বলল,

-আমি ব্র্যান্টকে বারবার বলেছি যে এটা দুর্ঘটনা। হয়তো একটা নোঙর ফেলা হয়েছিল। এছাড়া উত্তরের লোকজন ইচ্ছাকৃতভাবে এমন কেন করবে?

–তারা করবে, কারণ তারা কোন প্রযুক্তি বের করার মতো কর্মঠ নয়, কারণ তারা ভয় পাচ্ছে যে আমরা অনেক বেশী মাছ ধরব। কারণ…

কুমারের সেঁতো হাসি চোখে পড়তেই সে থামল, আর জিনিসটা ছুঁড়ে মারল তার দিকে। কুমার অবশ্য সহজেই ধরে ফেলল।

-যাই হোক না কেন। যদি এটা দুর্ঘটনাও হয় তবুও তাদের ওখানে নোঙর ফেলা উচিত হয়নি। ওই জায়গাটা চার্টে পরিষ্কার ভাবে দাগিয়ে দেয়া আছে। “গবেষণাক্ষেত্র –দূরে থাকুন।” আমি একটা প্রতিবাদ পাঠাতে যাচ্ছি।

ব্র্যান্ট অবশ্য এতোক্ষণে তার স্বাভাবিকতা ফিরে পেয়েছে। তার সবচাইতে কড়া রাগটাও কয়েক মিনিটের বেশী থাকে না। তাকে ঠিক রাখতে মিরিসা তার পিঠের ওপরে আঙ্গুল ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে সবচাইতে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,

-ভালো মাছ পেয়েছ?

কুমার উত্তর দিল,

–মোটেই না। তার আগ্রহ হচ্ছে কেবল উপাত্ত নেয়াতে। কিলোগ্রাম পার কিলোওয়াট এসব হাবিজাবি আর কি। ভাগ্য ভালো যে আমি রডটা নিয়েছিলাম। রাতের জন্য একটা টুনা মাছ ধরেছি।

সে বোটে গিয়ে প্রায় এক মিটার লম্বা সুন্দর মাছটা তুলে ধরল। এর রং অবশ্য দ্রুত বিবর্ণ হচ্ছে, চোখটা মৃত্যুর ছোঁয়ায় চকচকে হয়ে গেছে। সে গর্বের সঙ্গে বলল,

-এতবড় সবসময় পাওয়া যায় না।

তারা যখন সবাই এর প্রশংসায় ব্যস্ত ঠিক তখন ইতিহাস ফিরে এল থ্যালসায়। আর যে সহজ নিরুদ্বিগ্ন জগতে তাদের তারুণ্য কাটছিল হঠাৎ করেই তা শেষ প্রান্তে চলে এল।

এর প্রমাণটা চলে যাচ্ছিল আকাশ দিয়ে। যেন একটা দৈত্য নীল আকাশে বিশাল এক চক দিয়ে দাগ টেনে দিয়েছে। তারা দেখছিল উজ্জ্বল ধোয়ার পথটা তার প্রান্তের দিক দিয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে। তারপর সেটা খন্ড খন্ড মেঘ হয়ে গেল আর যেন বরফের একটা সেতু তৈরী হল দিগন্ত থেকে দিগন্তে।

আর একটা দূরাগত গর্জন ধেয়ে আসতে লাগল আকাশ থেকে। এটা সেই আওয়াজ যা থ্যালসা গত সাতশ বছরে শোনেনি। তবে এমনকি বাচ্চারাও একবার শুনলেই এই আওয়াজ চিনে ফেলবে।

বিকেলের গরম সত্ত্বেও মিরিসা কেঁপে উঠল। মিরিসা ব্র্যান্টের হাত ধরলেও সে সেটা টের পেল কিনা সন্দেহ। সে তখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। এমনকি কুমারও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ছিল। অবশ্য সেই প্রথম কথা বলল,

-যে কোন একটা কলোনী আমাদের খুঁজে পেয়েছে।

ব্র্যান্ট মাথা নাড়ল, তবে খুব দৃঢ় বিশ্বাসে নয়।

-তাদের দরকারটা কি? তাদের কাছে পুরানো ম্যাপ তো আছেই। তারা তো জানেই যে থ্যালসা প্রায় পুরোটাই সাগর। তাদের এখানে এসে কোন লাভ নেই।

-বৈজ্ঞানিক কৌতূহল? মিরিসা বলল, আমাদের কি হয়েছে তা দেখতে। আমি সব সময় বলেছি যে আমরা কমিউনিকেশন লিঙ্কটা ঠিক করি।

এটা একটা পুরোনো তর্ক, যা কয়েক যুগ পর পর চাঙ্গা হয়। এক সময় বেশীর। ভাগ লোকই মনে করত যে থ্যালসার উচিত পূর্ব দ্বীপের বড় ডিসটা মেরামত করা। যেটা নাকি চারশ বছর আগে ক্র্যাকানের অগ্নৎপাতের কারণে ধ্বংস হয়েছিল। কিন্তু এর মধ্যে অনেক কিছুই এল, যা নাকি আরও গুরুত্বপূর্ণ বা আরও মজাদার।

ব্র্যান্ট চিন্তার সঙ্গে বলল।

-একটা মহাকাশযান তৈরী বিশাল ব্যাপার। আমার মনে হয় না, কোন কলোনী সেটা করতে পারবে যতক্ষণ না পৃথিবীর মতো…।

সে চুপ করে গেল। এতো শত বছর পর এটা একটা কঠিনই নাম উচ্চারণের জন্য। তারা দ্রুত পুবে ফিরল, যেখানে নিরক্ষীয় রাত দ্রুত নামছে সমুদ্র অতিক্রম করে। কিছু উজ্জ্বল তারা এর মধ্যেই ফুটে উঠেছে। পাম গাছের ওপর ছোট্ট নির্ভুল ত্রিভুজ।

এ তিনটি নক্ষত্র একই ম্যাগনিচুডে। দক্ষিণে থাকলে কয়েক সপ্তাহের জন্য আরও উজ্জ্বল দেখা যায়।

এর ক্ষয়ে যাওয়া চারপাশটা এখনও দেখা যায়, মাঝারী মানের টেলিস্কোপেই, কিন্তু কোন যন্ত্রই সেই পুড়ে যাওয়া পৃথিবীকে দেখতে পায় না।

২. ছোট্ট, নিরপেক্ষ এক

প্রায় এক হাজার বছর পরে একজন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ১৯০১-২০০০ সালকে “শতাব্দী–যখন সব হয়েছিল” হিসাবে বলেন, তখন তিনি এটাও উল্লেখ করেন যে ঐ সময়ের মানুষরাও তার সঙ্গে একমত হবে, তবে সম্পূর্ণ এক ভুল কারণে। তারা অবশ্য যৌক্তিক গর্বের সঙ্গেই দেখাবে বাতাসের ওপর প্রভুত্ব, আনবিক শক্তি, জীবনের মূল সূত্রের আবিষ্কার, ইলেক্ট্রনিক আর যোগাযোগ বিপ্লব, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শুরু আর সবচাইতে বড় জিনিস সৌরজগৎকে ছাড়িয়ে যাওয়া আর চাঁদে প্রথম পদার্পন। অবশ্য ঐ ঐতিহাসিক যথার্থ ভাবেই দেখান যে, হাজারে একজনও সেই আবিষ্কারের কথা শোনেনি যা কিনা সব ঘটনাকেই ছাড়িয়ে যায়, এবং সব কিছুকে একদম অপ্রাসঙ্গিক করে তোলে।

এটাকে ক্ষতিকর মনেই হয়নি, যেমন মনে হয়নি হিরোশিমায় আনবিক বোমা পড়ার পঞ্চাশ বছর আগে বেকরোলের পরীক্ষাগারে ফটোগ্রাফিক প্লেটের ছবিকে। বস্তুত, এটা ছিল ঐ পরীক্ষারই একটা উপজাত এবং অবশ্যই সমান নিরীহ।

প্রকৃতি খুব শক্তভাবে তার ভারসাম্য রক্ষা করে। তাই পদার্থবিদরা খুবই অবাক হলেন, যখন তারা আবিষ্কার করলেন যে কিছু আনবিক বিক্রিয়ায় সব যোগ করলেও সমীকরণের এক পাশে কিছু কম হয়ে যাচ্ছে।

অডিটরের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য হিসাব রক্ষক যেমন নতুন হিসাব দেখায়, পদার্থবিদরাও তেমন একটা নতুন কণার সৃষ্টি করলেন। এবং গরমিলের হিসাবের একাউন্টের মতোই এটা ছিল অদ্ভুত। এর না ছিল ভর, না ছিল চার্জ এবং আশ্চর্যভাবে কোন বিক্রিয়া ছাড়াই এটা ভেদ করতে পারত–এমনকি বিলিয়ন কিলোমিটার পুরু সীসার দেয়ালও। এর ডাক নাম দেয় হল “নিউট্রিনো” নিউট্রন+ব্যমবিননা। এটাকে অবশ্য চিহ্নিত করার কোন আশা কারও ছিল না। কিন্তু ১৯৫৬ সালে পদার্থবিদরা যন্ত্রের সাহায্যে প্রথম কিছু নমুনা ধরতে পারলেন। এটা অবশ্য তাত্ত্বিকদের জন্য এক বিশাল বিজয়। তারা তাদের সমীকরণের নির্ভুলতার প্রমাণ পেলেন।

অবশ্য সমগ্র বিশ্ব এ ব্যাপারে শোনেনি কিংবা পাত্তাও দেয়নি। কিন্তু শেষের দিনের হিসাব আরম্ভ হয়ে গেল।

৩. কাউন্সিল

তারনার আঞ্চলিক যোগাযোগ কখনোই শতকরা পচানব্বই ভাগের বেশী কিংবা পচাশি ভাগের কমে কর্মক্ষম থাকে না। থ্যালসার অন্যান্য যন্ত্রের মতোই এটা বহু আগেকার মেধাবীদের তৈরী। তাই হঠাৎ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা একেবারেই অসম্ভব। এমনকি যদি অনেকগুলো অংশও খারাপ হয়ে যায়, তবুও এটা কাজ করে, যতক্ষন। না কেউ একজন রেগেমেগে এটাকে ঠিক করে।

সেন্ট্রাল কম্পিউটারের তথ্য অনুযায়ী, নেটওয়ার্কটা এখন প্রায় পচানব্বইভাগ সেবা দিচ্ছে। এবং মেয়র ওয়াডের্ন এর পরিমান কম হলেই খুশী হতেন। গত আধ ঘন্টায় পুরো বসতিই তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে এবং অন্তত পঞ্চাশজন বয়স্ক আর শিশু কাউন্সিল চেম্বারের দিকে রওয়ানা দিয়েছে। সেখানে সবার দাঁড়াবার জায়গাই হবে না। আসনের কথাতো বাদই।

একটা সাধারণ মিটিং এর ফোরাম পূর্ণ করতে বারোজন লাগে এবং সে পরিমাণ মানুষ জোগাড় করতে প্রায়ই ঘাম ছুটে যায়। তারনার বাকী পাঁচশ ষাটজনের সে মিটিং দেখার কথা এবং ভোট দেয়ার কথা। অবশ্য যদি তারা আগ্রহী হয়।

প্রাদেশিক সরকার থেকেও দুটো বার্তা এসেছে। একটা প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে অন্যটা উত্তর দ্বীপের সংবাদ সংস্থা থেকে। প্রত্যেকেরই অপ্রয়োজনীয় অনুরোধ। এবং প্রত্যেকেই একই ছোট জবাব পেয়েছে- কিছু ঘটলে অবশ্যই আমরা তোমাদের জানাব-তোমাদের আগ্রহের জন্য ধন্যবাদ।

মেয়র ওয়াডের্ন রোমাঞ্চ পছন্দ করেন না। আঞ্চলিক প্রশাসক হিসেবে তার মোটামুটি সাফল্যের চাবিকাঠি এটাই। তবে সব সময় তার ভেটো কাজ করে না। যেমন ৫৯ সালের হারিকেন–সেটা অবশ্য এ শতাব্দীর মানে আজ পর্যন্ত সব চাইতে উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

তিনি চিৎকার করলেন,

–সবাই চুপ করুন। রিনা খোলশগুলো রেখে দাও। এগুলো আনতে অনেক কষ্ট হয়েছে। তোমার বিছানায় যাবার সময় হয়েছে। বিলি টেবিল থেকে নাম, এক্ষুনি।

তার বিস্ময়কর দ্রুত নির্দেশ বোঝালো যে, বসতির লোকজন তার কথা শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে বসে আছে। তিনি তার হাত-ফোনের জ্বলতে থাকা সুইচটি চালু করলেন।

-সত্যি বলতে তোমরা যা জান তার চাইতে খুব বেশী আমিও জানি না। এবং কয়েক ঘন্টা ধরে আমরা কোন তথ্যও পাচ্ছি না। এটা অবশ্যই কোনো ধরনের মহাকাশযান। এবং এরই মধ্যে এটা ঢুকে পড়েছে থ্যালসায়। যেহেতু এখানে আর কোন জায়গা নেই তাই সম্ভবতঃ এটা আবার তিন দ্বীপের কাছেই ফিরবে। গ্রহকে পুরো ঘুরতে এর হয়তো ঘন্টা খানেক লাগবে।

-কোন রেডিও যোগাযোগ করার চেষ্টা? কেউ একজন বলল।

-হয়েছে। তবে কোন লাভ হয়নি।

-আমাদের কি চেষ্টা করা ঠিক? আরেক উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর।

পুরো সভায় লম্বা বিরতি পড়ে গেল। তারপর কাউন্সিলর সিমন্স (মেয়র ওয়াডেনের প্রধান অনুচর) বললেন,

-এটা ফালতু। যাই আমরা করি না কেন, তারা আমাদের দশ মিনিটের মধ্যে বের করে ফেলবে। আর মনে হয়, তারা জানেও ঠিক কোথায় আমরা আছি।

মেয়র বললেন।

-কাউন্সিলরের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। যে কোন কলোনিয়াল যানের কাছে থ্যালসার সম্পূর্ণ ম্যাপ আছে। যেটা হাজার বছরের পুরোনো হতে পারে কিন্তু তা প্রথম অবতরণকে দেখাবে।

-কিন্তু ধরো, মানে শুধুই কল্পনা করো-এরা ভিনগ্রহের জীব।

-কোন ভিনগ্রহের জীব নেই। অন্ততঃ মহাকাশ যাত্রার মতো বুদ্ধিমান। আমরা একশ ভাগ নিশ্চিত নই-কিন্তু পৃথিবী হাজার বছর ধরে তন্নতন্ন করে খুঁজেছে।

মিরিসা কুমার আর ব্র্যান্টের মাঝে দাঁড়িয়ে পিছন থেকে বলে উঠল।

–আরেকটা সম্ভাবনা আছে।

প্রত্যেকেই তার দিকে তাকাল। ব্র্যান্ট একটা বিরক্তি প্রকাশ করল। মিরিসাকে ভালোবাসলেও মাঝেমাঝে তার মনে হয় যে মিরিসার জ্ঞানজ্ঞম্যি ভালো নয়। আর মিরিসার পরিবার গত পাঁচ প্রজন্মে আর্কাইভের দায়িত্বও পায়নি।

-কি সেটা?

এবার মিরিসার পালা বিরক্ত হবার। যদিও সে তার বিরক্তিকে গিলে ফেলল। সে এমন কারও জন্য নীচুতে নামতে চায় না, যে কিনা খুব একটা বুদ্ধিমান নয় অথচ ধূর্ত। ঘটনাটা হচ্ছে মেয়র ব্র্যান্টের প্রতি কিছু পরিমানে আকৃষ্ট। মিরিসার অবশ্য বয়স্ক এক মহিলার প্রতি কিছুটা সহানুভূতিই জাগে।

-এটা তো রোবট চালিত বীজবহনকারী মহাকাশযান হতে পারে। যেমন একটা আমাদের পূর্বপুরুষদের জিন প্যাটার্ন নিয়ে এসেছিল।

-কিন্তু এখন, এতো পরে?

-কেন নয়? প্রথম দিকের বীজ বহনকারী মহাশযানগুলো কেবল আলোর বেগের কয়েক শতাংশ বেগে যেতে পারত। পৃথিবী সেগুলোর উন্নতি ঘটাতে লাগল একদম ধ্বংস পর্যন্ত। শেষ মডেলগুলো প্রায় দশগুন দ্রুত। সেগুলো প্রথম দিকেরগুলোকে এক শতাব্দীর মধ্যে অতিক্রম করে এগিয়ে গেল। এবং তাদের অনেকেই এখনও পথে আছে।

ব্র্যান্ট তুমি কি বল?

মিরিসা সবসময় সতর্কভাবে যে কোন আলোচনায় তাকে টেনে আনে, এবং যান সম্ভব হয়, চিন্তাটা তার মাথা দিয়ে এসেছে এমন ধারণা দেয়। ব্র্যান্টের হীনমন্যতা সম্বন্ধে সে ভালোই জানে এখানে কিছু যোগ করতে সে মোটেই চায় না। ব্র্যান্ট বলল,

-এটা একটা আকর্ষণীয় ধারণা। ঠিক হতেও পারে।

যদিও ইতিহাস খুব একটা শক্তিশালী যুক্তি নয়। ব্র্যান্ট ফ্যাকনরের একজন প্রযুক্তিবিদের জ্ঞান আছে। বিশেষতঃ থ্যালসাকে কলোনী করার জটিল পদ্ধতি সমন্ধে। সে যোগ করল, আমরা কি করব? যদি আরেকটা মহাকাশযান আমাদের এখানে আবার কলোনী করতে চায়। ধন্যবাদ, আজ নয় আরেকদিন।

কিছু নার্ভাস হাসির শব্দ শোনা গেল। কাউন্সিলর সিমন্স চিন্তাশীল ভাবে বললেন,

–আমার মনে হয় এ ধরনের কোন ব্যাপার আমরা ঠিক করতে পারব। রোবটগুলোর কি এতোটুকু বুদ্ধি হবে না যে প্রোগ্রামটা বাতিল করবে। যেহেতু তা আগেই হয়ে গেছে।

-সম্ভবত। কিন্তু চিন্তা কর, তারা আরও ভালো করবে। যাইহোক, পৃথিবী থেকে পরের মডেল হলেও কোন এক ধরনের রোবট হবে সেটা।

এটা অবশ্য ব্যাখ্যার কোন দরকার ছিল না। সবাই জানে আন্তনাক্ষত্রিক ভ্রমণের অসুবিধা আর ব্যয়ের কথা। যদি যান্ত্রিক উৎকর্ষতায় সম্ভবও হয়, রোবটরা হাজার গুণ শস্তায় তা করে দেবে।

মেয়র বললেন–এটা হয়ত আমাদের সমস্যা নয়। সবাই ভাবছে যে, আমাদের এখানেই অবতরণ হবে, কিন্তু কেন? উত্তর দ্বীপ তো আরও বেশী…

মেয়র প্রায়ই ভুল প্রমাণিত হন, তবে এতো দ্রুত কখনোই নয়। শব্দটা যখন তারনার আকাশে হল, সেটা অবশ্যই আয়োনোস্কেয়ার হতে কোন গর্জন নয়। বরং দ্রুত গতির একটা জেটের শীষ। প্রত্যেকে কাউন্সিল চেম্বার থেকে বেরিয়ে এল। প্রথম কয়েকজন কেবল দেখতে পেল যে, ভোতা মাথার একটা জিনিস পৃথিবীর সঙ্গে যোগসূত্রের পবিত্র স্থানটিতে নামছে।

-ব্র্যান্ট, তুমি সেখানে দ্রুত যেতে পারবে। তোমার ঘুড়িটা বের কর।

তারনার প্রধান মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার অবাক হয়ে তাকালো। এই প্রথম সে। মেয়রের কাছ থেকে সরাসরি কোন নির্দেশ পেল।

-একটা নারকেল কয়েকদিন আগে ডানায় লেগেছে। মাছ ধরার ফাঁদের কাজে ব্যস্ত থাকায় আমি মেরামতের সময় পাইনি। এছাড়া এটা রাতে ওড়ার জন্য উপযুক্ত নয়। মেয়র কঠিন দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন,

-আমার গাড়ীটা কি কাজ করছে?

–অবশ্যই, জ্বালানী ভর্তি।

এটা অবশ্য অস্বাভাবিক যে মেয়রের গাড়ী কোথাও যাবে। বিশ মিনিটের মধ্যে যে কেউ তারনা হেঁটে ফেলবে। আঞ্চলিক খাবার আর যন্ত্রপাতি ছোট ঠেলাগাড়ীতে যায়। সত্তর বছরের অফিসিয়াল সার্ভিসে গাড়িটিকে একশ হাজার কিলোমিটারেরও কম পথ যেতে হয়েছে। দুর্ঘটনা না হলে এটা আরও একশ বছর কমপক্ষে চলবে। কেউ অবশ্য ভাবেনি যে, যাত্রীদের চাইতে বয়স্ক এই গাড়ীটা এরকম একটা ঐতিহাসিক যাত্রা করবে।

৪. সতর্ক সংকেত

পৃথিবীর বিদায় ঘন্টা বাজার প্রথম শব্দটা কেউ শুনতে পায়নি। এমনকি যে বৈজ্ঞানিক কলোরাডোর পরিত্যক্ত সোনার খনিতে, মাটির বহু নীচে সেই ভয়ংকর আবিষ্কারটা করেছিলেন, তিনিও না।

এটা ছিল একটা দুঃসাহসিক পরীক্ষা। বিংশ শতাব্দীর মাঝ পর্যন্ত যা একেবারেই সমর্থনযোগ্য ছিল না। নিউট্রিনো আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই বোঝা গেল যে, মানবজাতি মহাবিশ্বের এক নতুন জানালা খুলেছে। পাতলা কাঁচের মধ্যে দিয়ে আলো যাবার মতোই যা একটা গ্রহকে ভেদ করে, তা নক্ষত্রের ভেতর দেখতেও ব্যবহৃত হতে পারে।

বিশেষত সূর্য। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সূর্যের ভেতরের শক্তি উৎপাদনকারী বিক্রিয়াগুলো সম্বন্ধে নিজেদের জ্ঞান নিয়ে নিশ্চিত ছিলেন। যার উপরে কিনা পৃথিবীর জীবন নির্ভরশীল। সূর্যের কেন্দ্রে অসম্ভব চাপ ও তাপে হাইড্রোজেন হিলিয়ামে পরিণত হয় এবং এক গুচ্ছ বিক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি নিঃসরিত হয়। এবং একই সঙ্গে তৈরী হয় একটা উপজাত- নিউট্রিনো। সৌর নিউট্রিনোগুলো তাদের জন্মস্থান থেকে বেরিয়ে পড়ে আলোর বেগে, আর ট্রিলিয়ন টনের ভর তাদের সামনে একখন্ড ধোয়ার বাধার বেশী কিছু মনে হয় না। দুই সেকেন্ডের মধ্যে তারা মহাশুন্যে পৌঁছে যায়। এবং মহাবিশ্বের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। যত গ্রহ-নক্ষত্রই আসুক না কেন, তাদের অধিকাংশই ঐ সব “অলীক পদার্থ” কে ফাঁকি দিয়ে যায় এবং তখন সময়ও নিজের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ায়।

সূর্যকে ছাড়ার আট মিনিট পর, প্রবল সৌর নিউট্রিনো ধারার সামান্য অংশ পৃথিবীর ওপর দিয়ে যায় আর তারও সামান্য অংশ কলোরাডোর বিজ্ঞানীরা ধরতে পেরেছিলেন। তারা প্রায় এক কিলোমিটার মাটির গভীরে তাদের যন্ত্রপাতিগুলো বসিয়েছিলেন, যাতে অন্যসব স্বল্পভেদী বিকিরণগুলো আটকে যায় আর সূর্যের বুকের ভেতরকার দুর্লভ খাঁটি বার্তাবাহকদের যেন ধরা যায়। তাদের আশা ছিল, আটকাননা নিউট্রিনোগুলো দিয়ে বিস্তারিতভাবে গবেষণা করা, যা কিনা এতদিন মানুষের জ্ঞানের বা পর্যবেক্ষণের জন্য বন্ধ ছিল।

পরীক্ষাটা সফল হলো, নিউট্রিনোও পাওয়া গেল। কিন্তু তা ছিল খুবই কম। বিশাল যন্ত্রগুলো ঠিক হলে, তিন থেকে চারগুণ নিউট্রিনো পাবার কথা।

পরিষ্কার বোঝা গেল যে কিছু একটা ভুল আছে। এবং ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এই হারানো নিউট্রিনোগুলো একটা বৈজ্ঞানিক বদনাম হিসেবেই টিকে রইল। যন্ত্রপাতিগুলো বারবার পরীক্ষা করে দেখা হলো, তত্ত্বগুলো খুটিয়ে দেখা হলো এবং কয়েকবার পরীক্ষাটা করে দেখা হলো। কিন্তু প্রতিবারই সেই হতবুদ্ধিকর ফলাফল।

বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে, জ্যোতিপদার্থবিদরা একটা বিরক্তিকর সমাধানে পৌঁছুতে বাধ্য হলেন, যদিও কেউই এর পরিপূর্ণ প্রভাব বুঝল না।

আসলে যন্ত্রেরও কোন দোষ নেই। তত্ত্বেরও নেই। সমস্যাটা হচ্ছে সূর্যের ভেতরে। আন্তর্জাতিক অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়নের ইতিহাসের প্রথম গোপন মিটিংটা হয়েছিল ২০০৮ সালে অ্যাসপানে-কলোরাডোতে প্রাথমিক পরীক্ষার স্থান থেকে খুব একটা দূরে নয়–যে পরীক্ষাটা কিনা এখন অনেকগুলো দেশেই হচ্ছে। এক সপ্তাহ পর ইউনিয়নের বিশেষ বুলেটিন নং ৫৫/০৮ “সৌর বিক্রিয়া নিয়ে কিছু তথ্য” শিরোনামে সমস্ত সরকারের হাতে পৌঁছে দেয়া হলো। কেউ কেউ ভাবতে পারেন যে,পৃথিবী ধ্বংসের খবরটা আস্তে আস্তে ফাঁস হয়ে গেলে, বেশ একটা ভীতির সৃষ্টি হবে। বাস্তবে সাধারণ প্রতিক্রিয়া হল এরকম- হঠাৎ একটু চুপ, তারপর কাঁধ ঝাকুনী দিয়ে দৈনন্দিন জীবনে ফিরে যাওয়া।

খুব কম সরকারই তাদের সামনের নির্বাচনের বেশী ভাবতে পারে, বা খুব কম লোকই তাদের নাতিদের পরের সময়কে দেখতে পায়। আর জ্যোতির্বিদদের ভুল হবার সম্ভাবনা তো রয়েই যাচ্ছে…।

মানব জাতির মৃত্যুর পরোয়ানা এলেও, মৃত্যুর দিনটা তখনও অনিশ্চিত। আর সূর্য যেহেতু আগামী এক হাজার বছরের মধ্যে ধ্বংস হচ্ছে না সুতরাং কে আর চোদ্দ পুরুষের পরের ধ্বংসের জন্য কান্নাকাটি করে।

৫. নিশি যাত্রা

ব্র্যান্ট, মেয়র ওয়াডের্ন, কাউন্সিলর সিমন্স, দু’জন বয়োজ্যেষ্ঠকে নিয়ে যখন গাড়ীটা তারনার বিখ্যাত পথ ধরে যাচ্ছিল, তখন দুটো চাঁদের একটাও আকাশে ওঠেনি। যদিও ব্র্যান্ট তার স্বাভাবিক দক্ষতায় গাড়ীটা চালাচ্ছিল, কিন্তু মনে মনে মেয়রের কড়া কথার জন্য সে জ্বলছিল। এমনকি মেয়রের হাত তার ভোলা কাঁধ অসতর্ক ভাবে ছুঁয়ে থাকলেও জিনিসটা সে ভুলছিল না। রাতের শান্ত সৌন্দর্য, আর পাম গাছের সম্মোহনী ছন্দ, তার স্বাভাবিক রসবোধকে শিগগিরিই ফিরিয়ে আনল। আর এমন ঐতিহাসিক একটা মুহূর্তে, নিজস্ব ক্ষুদ্র অনুভূতি কিভাবে আসতে পারে? দশ মিনিটের মধ্যে তারা প্রথম অবতরণের স্থান যেখান থেকে তাদের ইতিহাস শুরু সেখানে চলে আসল। এখানে কি অপেক্ষা করছে? একটা জিনিস নিশ্চিত, যে আগুন্ত-করা প্রাচীন বীজ বহনকারী মহাকাশযানের অনির্বান আলোকসঙ্কেতের সঙ্গে পরিচিত। তারা এটাও জানে যে কোথায় খুঁজতে হবে। সুতরাং নিশ্চয়ই এটা মহাশুন্যের এদিককার কোন কলোনী থেকে এসেছে।

হঠাৎ করেই ব্র্যান্ট একটা বিদঘুঁটে চিন্তায় ধাক্কা খেল। যে কেউ বা কিছু আলোকসংকেত দেখতে পারে, যা কিনা বুদ্ধিমত্তার কথা ছড়িয়ে দিচ্ছে মহাবিশ্বে। তার মনে পড়ল কয়েক বছর আগেই এটাকে বন্ধ করে দেবার কথা উঠেছিল। কারণ এর কোন ব্যবহারিক মূল্য নেই। বরং এটা কোন ক্ষতিই করতে পারে। সামান্য ভোটে প্রস্তাবটা বাতিল হয়–অবশ্য কোন যৌক্তিক কারণে নয় বরং আবেগের জোয়ারেই। থ্যালসা হয়তো খুব শিগগিরি ঐ সিদ্ধান্তের জন্য দুঃখ করবে। যদিও তখন আর কিছুই করার থাকবে না।

কাউন্সিলর সিমন্স পিছনের আসন থেকে ঝুঁকে মেয়রকে বললেন, হেলগা। ব্র্যান্ট এই প্রথম তাকে মেয়রের প্রথম নাম ধরে ডাকতে শুনল। তুমি কি মনে কর আমরা যোগাযোগ করতে পারব। তুমি তো জান রোবটের ভাষা খুব দ্রুত পরিবর্তিত হয়।

মেয়র জানে। তবে সে তার অজ্ঞানতা লুকিয়ে ফেলতে আরও ভালো জানে।

-সেটা সমস্যার সবচে ঘোট অংশ। আগে তো পৌঁছাই। আর ব্র্যান্ট, তুমি কি একটু আস্তে চালাতে পারো না? আমি ওখানে জীবিত পৌঁছুতে চাই। এই পরিচিত রাস্তায় বর্তমান গতি সম্পূর্ণ নিরাপদ। তারপরও ব্র্যান্ট গাড়ীর গতি কমালো। ব্র্যান্ট ভাবল, মেয়র কি মুখোমুখি হওয়াটা এড়াতে চাইছে। অবশ্য গ্রহের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো কোন মহাকাশযানকে মোকাবেলা করা বিশাল দায়িত্বের কাজ। পিছনের সীট থেকে একজন বলে উঠল।

-ক্র্যাকান! কেউ কি ক্যামেরা এনেছে?

-ফিরে যাবার সময় নেই। ছবি তোলার জন্যে অনেক সময় পাওয়া যাবে। আমার মনে হয় না, তারা “হ্যালো” বলেই চলে যাবে।

তার গলা অবশ্য সামান্য হিস্টিরিয়ার মতো শোনাল। ব্র্যান্ট তাকে দোষ দিল না। কে জানে, পরবর্তী পাহাড়ের পর তাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে?

মেয়র গাড়ীর রেডিওতে বললেন,

-কিছু বলার মতো থাকলে আমি সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে বলব মিঃ প্রেসিডেন্ট। ব্র্যান্ট বার্তাটা শুনতেই পায়নি। সে এতোটাই তার স্বপ্নে মগ্ন ছিল। জীবনে এই প্রথমবারের মতো তার মনে হল ইতিহাসটা আরেকটু শেখা উচিত ছিল।

তবে অবশ্যই সে মূল তথ্যগুলোর সঙ্গে পরিচিত। থ্যালসার প্রতিটা শিশুই ওগুলো জেনে বড় হয়ে ওঠে। সে জানে কিভাবে নির্মমভাবে এগিয়ে আসছিল টিক টিক করে শতাব্দীগুলো। আর জ্যোতির্বিদদের দেয়া সময়টাও নির্ভুল হয়ে আসছিল। ৩৬০০ খ্রীস্টাব্দে, অবশ্য ৭৫ বছর এদিক ওদিক হতে পারে, সূর্য নোভায় পরিণত হবে। খুব বিশাল কিছু নয়। তবে যথেষ্ঠ পরিমানেই বড়।

এক প্রাচীন দার্শনিক একবার বলেছিলেন যে পরদিন সকালে ফাঁসির আদেশ একজন মানুষের মনকে আশ্চর্যভাবে স্থির করে দেয়। চার হাজার সালের দিকে পা দেবার সময় ঠিক এমন একটা অবস্থা হল সমগ্র মানবজাতির। ২৯৯৯ থেকে ৩০০০ সালের পা দেয়ার ৩১ শে ডিসেম্বর শেষ মুহূর্তে সমগ্র মানবজাতি এক মুহূর্তে এই সত্যটি উপলব্ধি করল যে, ৩ থেকে ৪ এর পরিবর্তন দেখার জন্য কেউ থাকবে না।

অবশ্য এখনও আরও পাঁচশ বছর আছে। আরও যে তিরিশটা প্রজন্ম আসবে তারা ইচ্ছে করলে তাদের পূর্বপুরুষদের মতো অনেক কিছুই করতে পারবে। অন্ততঃ তারা তাদের জাতির জ্ঞান আর শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মগুলোকে রক্ষা করতে পারবে।

এমনকি মহাকাশ যুগের একদম প্রথম দিকেও রোবট চালিত মহাকাশযানগুলো সৌরজগতের বাইরে সঙ্গীত, বার্তা আর ছবি নিয়ে যেত এই উদ্দেশ্যে যে, যদি তা মহাবিশ্বের অন্য কোন অনুসন্ধানীর হাতে পরে। যদিও নিজস্ব গ্যালাক্সীতে বুদ্ধিমান কোন জীবের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি সবচে আশাবাদীরাও বিশ্বাস করে যে হয়তো অন্য লক্ষ গ্যালাক্সীর কোথাও না কোথাও বুদ্ধিমান জীব আছে।

তাই শত বছর ধরে মানব জাতির জ্ঞান আর সভ্যতার টেরাবাইট, টেরাবাইট তথ্য এন্ড্রোমিডা নেবুলা আর তার দূরবর্তী প্রতিবেশীদের জন্য পাঠানো হয়েছে। অবশ্য কেউই জানে না যে ওই সঙ্কেতগুলো কেউ ধরেছিল কিনা, কিংবা ধরলেও সেটা বুঝতে পেরেছিল কিনা। কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল একটাই। শেষ একটা তথ্য রেখে যাওয়া মানব জাতির পক্ষ হতে-দেখ একদিন আমিও বেঁচে ছিলাম।

৩০০০ সালের দিকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এটা বিশ্বাস করলেন যে, তাদের বিশাল টেলিস্কোপগুলো অন্তত সূর্যের চারপাশে পাঁচশ আলোক বর্ষের মধ্যে সমস্ত গ্রহগুলোকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে। এরমধ্যে ডজন খানেক প্রায় পৃথিবীর সমান গ্রহও আবিস্কৃত হল। এমনকি কাছের কয়েকটার মোটাদাগের মানচিত্রও তৈরী করা গেল। এর মধ্যে কিছুর আবহাওয়ামন্ডলে জীবনের নির্ভুল চিহ্ন-উঁচুমাত্রায় অক্সিজেন দেখা গেল। মানুষের ভালো একটা সম্ভাবনা আছে সেখানে বেঁচে থাকার। অবশ্য যদি কেউ পৌঁছুতে পারে তবেই।

মানুষরা পারবেনা তবে মানুষ পারবে।

প্রথম বীজ বহনকারী মহাকাশযানটা ছিল আদিম ধরনের। যদিও তখনকার প্রযুক্তির সর্বোচ্চটাই ব্যবহার করা হয়েছিল। ২৫০০ সালের উড্ডয়নশক্তির সাহায্যে দু’শ বছরের মধ্যেই সবচে কাছের সৌরজগতে যাওয়া যাবে। নিয়ে যাওয়া যাবে হিমায়িত ভ্রুণ। তবে সেটা ছিল তাদের কাজের সামান্য অংশ। তাদের আরও নিতে হবে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি, যা কিনা ঐ সব সম্ভাবনাময় মানবকে সম্ভাব্য প্রতিকূল পরিবেশে শিক্ষা দেবে এবং লালন পালন করবে। নিরীহ নগ্ন অবোধ শিশুদের সাহারা বা এন্টার্টিকার মতো একটা বিশ্বে ছেড়ে দেয়াটা হবে অর্থহীন নিষ্ঠুরতা। তাদেরকে শিক্ষা দিতে হবে, যন্ত্রপাতি দিতে হবে, দেখাতে হবে কিভাবে স্থানীয় সম্পদ খুঁজতে আর ব্যবহার করতে হয়। বীজ বহনকারী মহাকাশযানগুলো অবতরণের পরই বদলে যাবে পালক মহাকাশযানে। যা কিনা এর সন্তানদের প্রজন্মের জন্য লালন করবে। শুধু মানুষই নয় সমগ্র জীবজগৎ, উদ্ভিদ (যদিও তাদের জন্য মাটি পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ) গৃহপালিত পশু, বিশাল বৈচিত্রের প্রয়োজনীয় পতঙ্গ এবং আনুবিক্ষণীক জীবও নিতে হবে এই কারণে যে, কোন কারণে স্বাভাবিক খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়লে হয়তোবা মূল কৃষিতেই ফিরে যেতে হতে পারে।

তবে এ ধরনের নতুন আরম্ভের একটা সুবিধা আছে। সব অসুখ আর পরজীবিদের আগুনে পরিশুদ্ধ করার জন্য পৃথিবীতে রেখে যাওয়া যাবে।

ডাটা ব্যাঙ্ক “বিশেষ ব্যবস্থা” যা কিনা যে কোন অবস্থা মোকাবেলায় সক্ষম, এবং জরুরী ব্যবস্থা সবই ডিজাইন এবং তৈরী করতে হবে, যেটা কিনা ভালো সময় ধরে কাজ করবে।

এই কাজ যদিও মনে হচ্ছিল সম্ভব নয়। তবে এটা অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক যে, সমগ্র মানবজাতি এ কাজের জন্যই ঐক্যবদ্ধ হল। এটা একটা দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য, শেষ লক্ষ্য–যা কিনা জীবনের কোন মানে বহন করে। এমন কি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও।

২৫৫৩ সালে প্রথম বীজ বহনকারী মহাকাশযানটি সৌরজগৎ পেরুলো। লক্ষ্য সূর্যের কাছের যমজ–“আলফা সেঞ্চুরী-এ”। যদিও পৃথিবীর সমান প্যাসডেনা গ্রহটি চরমভাবাপন্ন তবু তারপরের বি এর তুলনায় এর দুরত্ব প্রায় অর্ধেক। সিরিয়াস-দশের পথের সময় প্রায় চারশ বছর। ততদিনে পৃথিবী হয়তো টিকবেও না।

কিন্তু প্যাসডেনাকে যদি ঠিকভাবে কলোনী করা যায়, তবে হয়তো সুখবরটা শোনার জন্য যথেষ্ঠ সময় থাকবে। দু’শ বছর লাগবে যাত্রার জন্য, পঞ্চাশ বছর একটা ছোট ট্রান্সমিটার বসানো ও তৈরীর জন্য, আরও চার বছর সেই সংকেত পৃথিবীতে পৌঁছাবার জন্য। ২৮০০ সালের দিকেই হয়তো রাস্তায় চিৎকার শোনা। যাবে… বাস্তবে ২৭৮৬ সালেই প্যাসডেনা ভবিষ্যৎবাণীর চাইতে ভালো করল। খবরগুলো ছিল সাংঘাতিক এবং পরিকল্পনাকে নতুন করে উৎসাহ দিল। এর মধ্যে অবশ্য একদল মহাকাশযানকে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। প্রতিটি তার আগেরটার চাইতে উন্নত প্রযুক্তি সমৃদ্ধ। শেষ মডেলগুলো আলোর বিশ শতাংশ গতিবেগে পৌঁছুতে পারে। আর হাতের মধ্যে অন্ততঃ পঞ্চাশটা লক্ষ্য আছে।

এমনকি যখন প্যাসডেনার সঙ্কেত প্রাথমিক অবতরণের পর আর কোন সংকেত পাঠাল না, তখনও হতাশাটা ছিল সাময়িক। যেটা একবার করা গেছে সেটা আবার করা যাবে, আবারও এবং অনেক বেশী সাফল্যের নিশ্চয়তা সহ।

২৭০০ সালে হিমায়িত ভ্রুণ নিয়ে যাবার স্থল পদ্ধতিটা বাতিল হয়ে গেল। ডি এন. এ. এর সর্পিল কাঠামোতে প্রকৃতি যে জেনেটিক তথ্যগুলো রেখে দেয়, শক্তিশালী কম্পিউটারের স্মৃতিতে অনেক বেশী সহজে, নিরাপদে এবং গুছিয়ে রাখা যায়। তাই লক্ষ জিনোটাইপ হাজার যাত্রীবহনকারী বিমানের সমান একটা মহাকাশযানেই রেখে দেয়া যায়। একটা সম্পূর্ণ সম্ভাব্য জাতি, নতুন সভ্যতার জন্য সমস্ত যন্ত্রপাতিসহ, কয়েকশ বর্গমিটার জায়গার মধ্যে জায়গা করে নক্ষত্রগুলোর দিকে পাঠিয়ে দেয়া যায়।

ব্র্যান্ট জানে, সাতশ বছর আগে থ্যালসায় তাই ঘটেছিল। যে রাস্তাটা এখন পাহাড়ের উপরে উঠছে এর পাশেই তাদের পূর্বপুরুষদের তৈরীর জন্য রোবট খননকারীরা কাঁচামাল জোগাড়ের জন্য যে গর্ত খুড়েছিল, তা পড়ে আছে। এক মুহূর্তের মধ্যে তারা বহু আগের পরিত্যক্ত প্রথম প্রজন্মকে তৈরীর কারখানাটা দেখতে পাবে।

কাউন্সিলর সিমন্স ফিসফিসিয়ে বলল–ওটা কি?

–থাম। মেয়র নির্দেশ দিলেন।

ব্র্যান্ট ইঞ্জিন বন্ধ করল। সে গাড়ীর মাইক্রোফোনের দিকে ঝুকল।

-মেয়র ওয়াডের্ন বলছি, আমরা সাত কিলোমিটারের চিহ্নে আছি। আমাদের সামনে একটা আলো আছে, আমরা গাছের মাধ্য দিয়ে দেখতে পাচ্ছি। আমি এটাও বলতে পারি যে ওটা ঠিক প্রথম অবতরণের জায়গা। কিছুই আমরা শুনছি না। আমরা আবার যাচ্ছি। ব্র্যান্ট নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করল না। স্পীড কন্ট্রোলকে আস্তে সামনে ঠেলে দিল। ৫৯ সালের হারিকেনের পর তার জীবনে এটাই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রোমাঞ্চকর ঘটনা।

সেটা অবশ্য রোমাঞ্চের চেয়ে বেশী কিছু ছিল। তার ভাগ্য ভালো যে সে বেঁচে গিয়েছিল। হয়তো এখানেও বিপদ আছে, যদিও সে তা পুরোপুরি বিশ্বাস করে না। রোবটরা কি আক্রমনাত্মক হতে পারে? বন্ধুত্ব আর জ্ঞান ছাড়া থ্যালসা থেকে বাইরের আর কেউ কি আশা করতে পারে? কাউন্সিলর সিমন্স বললেন,

-গাছের ওপারে যাবার আগে আমি ভালোভাবে ওটাকে দেখতে পেয়েছিলাম। আমি নিশ্চিত ওটা এক ধরনের বিমান। বীজ বহনকারী মহাকাশযানের কখনোই ডানা বা সরু ধোয়া বের হবে না। আর ওটা খুব ছোটও।

ব্র্যান্ট বলল,

যাই হোক না কেন আমরা পাঁচ মিনিটের মধ্যে জানব। আলোটা দেখ, এটা ১. পৃথিবী উদ্যানে নেমে এসেছে। আমাদের কি গাড়ী বন্ধ করে হেঁটে যাওয়া ৬৩।

প্রথম অবতরণের পূর্বদিকে যত্ন করে উপবৃত্তাকার ঘাসের ‘পৃথিবী উদ্যান’ তৈরী করা হয়েছে। সেটা অবশ্য এখন গ্রহের সবচাইতে পুরোনো, পবিত্র মনুমেন্ট-পালক মহাকাশযানের কালো, লম্বা ছায়ায় ঢাকা পড়ে আছে। তার ওপর একটা সিলিন্ডারের ধার বেয়ে বয়ে যাচ্ছে আলোর বন্যা।

-জাহাজের কাছে পৌঁছাবার ঠিক আগে গাড়ী বন্ধ করবে, মেয়র নির্দেশ দিলেন। এরপর আমরা বের হব এবং উপরে উঠব। বাতিটা নেভাও। আমি চাইনা আমরা চাইবার আগেই তারা আমাদের দেখুক।

-তারা না ওটা?

একজন যাত্রী হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো বলল। সবাই অবশ্য তাকে অগ্রাহ্য করল। গাড়িটা মহাকাশযানের ছায়ার কাছে এসে থামল। আর ব্র্যান্ট এটাকে একশ আশি ডিগ্রী ঘুরিয়ে রাখল। সে অবশ্য ব্যাখ্যা দিল।

-যদি দ্রুত ভাগতে হয় আরকি!

অর্ধেকটা গুরুত্ব আর অর্ধেকটা উত্যক্ত করার জন্য। সে এখনও বিশ্বাস করে না সত্যি সত্যি কোন আসল বিপদ হবে। এমনকি মাঝে মাঝে তার মনেই হচ্ছে না সত্যিই এটা ঘটছে।

সে হয়তো ঘুমিয়ে আছে আর এটা একটা দুঃস্বপ্ন।

তারা দ্রুত গাড়ী থেকে বের হয়ে মহাকাশযানে উঠল এবং আলোর পরিষ্কার দেয়ালটার কাছে গিয়ে ঘিরে দাঁড়াল। ব্র্যান্ট হাত দিয়ে চোখ ঢেকে আধবোজা চোখ দিয়ে দেখতে চেষ্টা করল।

কাউন্সিলর সিমন্স পুরোপুরি ঠিক। এটা কোনো ধরনের বিমান। আর খুব ছোট। উত্তরের লোকেরা কি? না অসম্ভব। এই ছোট তিন দ্বীপে এটা ব্যবহারের মতো কোন পথ নেই। আর এটা লুকিয়ে বানানোও সম্ভব নয়।

ভোতা তীরের মাথার মতো এটার গঠন। এবং নিশ্চিতভাবে এটা লম্বালম্বি ভাবে নেমেছে। কারণ আশে পাশের ঘাসে নামার কোন চিহ্ন নেই। সরু একটা কোন পেছনের জায়গা থেকেই তীব্র আলো ভেসে আসছে। আর ছোট্ট একটা লাল সঙ্কেত তার ঠিক ওপরে জ্বলে আছে। সব মিলিয়ে নিশ্চিত এবং হতাশাব্যঞ্জক একটা সাধারণ যন্ত্র। যেটা ডজনখানেক আলোকবর্ষ পেরিয়ে কাছের কলোনীতেই যেতে পারবে না। হঠাৎ করে দর্শনার্থীদের অন্ধ করে প্রধান আলোটা নিভে গেল। যখন। তারা রাতের দৃষ্টি ফিরে পেল তখন ব্র্যান্ট মেশিনটার সামনের জানালা দিয়ে ভেতরের জিনিস দেখতে পেল। এটা তো দেখতে মনুষ্য চালিত যন্ত্রের মতো, রোবট চালিত নয়।

মেয়রও এই বিস্ময়কর সিদ্ধান্তে পৌঁছুলেন।

-এটা রোবট নয় এতে মানুষ আছে। আর সময় নষ্ট নয়। তোমার ফ্ল্যাশলাইটটা আমার ওপরে ধরো। যাতে তারা আমাকে দেখতে পায়।

চাঁদে প্রথম অবতরনকারী মানুষটা দুই হাজার বছর আগে ঠিক কি বলেছিল?

একটা ছোট পদক্ষেপ… তারা বিশ সেকেন্ডের মতো সময় নিল দরজা খোলার জন্য। তারপর দু’ভাঁজ করা একটা মই বেয়ে দু’জন মানুষ সদৃশ জীব নেমে এল।

সেটা অবশ্য ব্র্যান্টের প্রথম প্রতিক্রিয়া। তারপরই সে বুঝল যে তাদের গায়ের চামড়ার রঙ অথবা স্বচ্ছ, নমনীয় পুরো শরীর আবৃত করা আবরণ দেখে সে ভুল বুঝেছিল।

তারা মানুষ সদৃশ নয় তারা মানুষ। সে যদি আর কখনো রোদে না বের হয় সেও সম্ভবতঃ এদের মতো হবে।

মেয়র তার হাত দুটো “কোন অস্ত্র নেই” সেই প্রাচীন ঐতিহাসিক পদ্ধতিতে বের করে রেখেছিলেন। সে বলল,

-আমি আশা করি না তোমরা বুঝবে। তবু বলছি থ্যালসায় স্বাগতম।

আগুন্তকরা হাসল। দুজনের মধ্যে বয়স্ক, ষাটের শেষের কোঠায়, ধূসর চুলের সুদর্শন ব্যক্তি তার হাত বাড়িয়ে দিলেন।

-ভুল হলো। তিনি বললেন। ব্র্যান্ট কখনো এতো গভীর অনুরণিত স্বর শোনেনি। আমরা তোমাদের পুরোপুরি বুঝতে পারছি। তোমাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমরা আনন্দিত।

এক মুহূর্তের জন্য অভ্যর্থনাকারীরা নিস্তব্ধ রইলো। ব্র্যান্ট অবশ্য আশ্চর্য হওয়াটাকে ফালতু ভাবল। তাদের তো দু’হাজার বছর আগের মানুষের কথা বুঝতে সামান্য অসুবিধা হয় না। শব্দ যখন রেকর্ড করা গেল এটা সমস্ত ভাষার মূল ভাবটা জমিয়ে রাখল। শব্দভান্ডার বাড়ে, ব্যাকরণ বদলাতে পারে, কিন্তু উচ্চারণ হাজার বছর ধরে অপরিবর্তিত থাকে।

মেয়রই প্রথম ঘোর ভাংল। যে শান্তভাবেই বলল,

-তাহলে তো অনেক ঝামেলা থেকে বাঁচা গেল। কিন্তু তোমরা এসেছে কোত্থেকে? আমি আশংকা করছি, আমরা তোমাদের মানে আমাদের প্রতিবেশীদের যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের ডিপ স্পেস এ্যান্টেনাটা নষ্ট হয়ে গেছে।

বয়স্ক লোকটি তার লম্বা সঙ্গীর দিকে তাকালো এবং কোন নিঃশব্দ বার্তা তাদের মধ্যে বিনিময় হয়ে গেল। তারপর সে আবার অপেক্ষমান মেয়রের দিকে ফিরল। তার কণ্ঠের বিষণ্ণ ভাবটায় কোন ভুল নেই। এর পরেই সে উদ্ভট দাবীটা করল।

-তোমাদের বিশ্বাস করাটা হয়তো কষ্টের ব্যাপার। কিন্তু আমরা তোমাদের কোন কলোনী থেকে আসিনি। আমরা সরাসরি পৃথিবী থেকে এসেছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *