অপ্রাকৃতিক নির্বাচন

অপ্রাকৃতিক নির্বাচন

‘দ্য স্লেভস অব লাইফ’ বইটা পড়ে আমাদের ব্যারন [অভিজাতদের মধ্যে সর্বনিম্ন উপাধি] সাহেব প্রচণ্ড বিরক্ত হয়েছেন। বইটাতে তিনি পড়েছেন, “অভিজাত শ্রেণির শিশুরা হয়ত মারাই যেত যদি নীচু শ্রেণির কোন মা তাদেরকে বুকের দুধ পান না করাত।” ব্যারন সাহেব ডারউইনও পড়েছেন। সারমর্ম হিসেবে তাঁর মনে হয়েছে “প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে অভিজাত শ্রেণির শিশুরা ‘মানুষ’ প্রজাতির আরও উন্নত প্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভূত হয়।” কিন্তু ‘বংশগতি বিদ্যা’ পড়ে তিনি তাঁর অনাগত সন্তানের জন্য নার্স ঠিক করার ব্যাপারে বেশ অনিচ্ছুক হয়ে উঠেছেন–নীচু শ্রেণির কোন নার্সের দুধ পান করলে অভিজাত শ্রেণির শিশুর রক্তে নীচু ধ্যানধারণা ঢুকে যেতে পারে, এই ভয়ে। সবকিছু মিলে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, তাঁর স্ত্রী নিজেই সন্তানের দেখাশোনা করবেন, আর কোন কারণে সেটা সম্ভব না হলে, সন্তানকে বোতলের দুধ পান করানো হবে। অবশ্য, গরুর দুধেও আপত্তি নেই; কারণ গরুগুলোকে তো তিনিই খাওয়াচ্ছেন, তিনি খাইয়ে বাঁচিয়ে না রাখলে তো বাছুরগুলো জন্মই নিতে পারত না! সুতরাং, গরুর দুধও গ্রহণযোগ্য।

যথাসময়ে সন্তানের জন্ম হলো–পুত্রসন্তান। ব্যারন সাহেব স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত না-হওয়া পর্যন্ত বেশ চিন্তিত ছিলেন। কারণ, ব্যক্তিগতভাবে তাঁর নিজের তেমন কোন সম্পত্তি না থাকলেও, তাঁর স্ত্রী অঢেল সম্পদের মালিক। এবং প্রচলিত আইন অনুযায়ী, তাদের কোন সন্তানাদি না-হওয়া পর্যন্ত, এই সম্পত্তি তিনি দাবি করতে পারবেন না। অতএব, সন্তান হওয়াতে তাঁর আনন্দ সীমাহীন, এবং তা যথেষ্ট যৌক্তিকও বটে! যাহোক, শিশুটিকে দেখে আপাত দৃষ্টিতে নিখুঁত বলেই মনে হচ্ছিল। ওর মোমের মত ত্বকের নীচের নীলাভ শিরা-উপশিরাগুলো চকচক করছিল। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায় শিশুর শরীরে রক্তের অভাব। কারণটা অবশ্য ওই রক্তেই নিহিত! ওর মা দেখতে পরীর মত; সেরা-সেরা খাবার খাইয়ে, চারপাশের যাবতীয় খারাপ কিছু থেকে দূরে সরিয়ে রেখে, তাঁকে বড় করা হয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরও মুখের ফ্যাকাসে ভাবই বলে দিত। তিনি অভিজাত গোত্রভুক্ত। এবং সঙ্গত কারণেই, তাঁর শরীরে পুষ্টির ঘাটতি ছিল। এই ঘাটতি এখন তাঁর সন্তানের মধ্যেও প্রবাহিত হয়েছে। যাহোক, ব্যারনের স্ত্রী নিজেই সন্তানের দেখাশোনা করতে লাগলেন। ফলে, সন্তান পালনের জন্য নীচু জাতের কোন মেয়ের কাছে আর ঋণী থাকতে হলো না। ধুর! কে বলেছে নীচু জাতের মায়েরা দুধ না-খাওয়ালে অভিজাত ঘরের শিশুরা বাঁচে না? সব ভুয়া কথা!।

ইদানিং, রাতবিরেতে শিশুর চিৎকার শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। অবশ্য, সব শিশুই চিৎকার করে, ওতে খারাপ কিছু বোঝায় না। কিন্তু এখানে বোঝালো। ধীরে ধীরে শিশুর ওজন কমতে থাকল। ভীষণ শুকিয়ে গেল। অগত্যা ডাক্তার ডাকা হল। ডাক্তার এসে শিশুর বাবার সঙ্গে আলাদা বসে কথা বললেন–“যদি আপনার স্ত্রী-ই শিশুকে খাওয়ানোর দায়িত্বে থাকেন, তাহলে নির্ঘাৎ শিশুটি মারা যাবে। কারণ প্রথমত, ব্যারনের স্ত্রী ছিলেন অস্বাভাবিক শুকনো; এবং দ্বিতীয়ত, শিশুকে খাওয়ানোর মত পর্যাপ্ত খাবার তাঁর শরীরে মজুদ ছিল না। ব্যারন সাহেব পড়লেন বিরাট দুর্ভাবনায়। শিশুর কতটুকু দুধ প্রয়োজন, আর কতটা সে পাচ্ছে, তা নিয়ে হিসেবে (রীতিমত গাণিতিক হিসাব!) বসে গেলেন। ফলাফল বেরোলো এই যে, শিশুকে খাওয়ানোর পদ্ধতিগত পরিবর্তন না-আনলে এর মৃত্যু ঠেকানো অসম্ভব।

কী করা যায়?

আর যা-ই হোক, মারা তো যেতে দেয়া যায় না।

“বোতল নাকি নার্স?” দ্বিতীয়টির তো প্রশ্নই ওঠে না। তাহলে, বোতলেই সই! যদিও ডাক্তারের পছন্দ ছিল দ্বিতীয়টি।

হল্যান্ডের সবচাইতে উন্নত জাতের গরুটিকে আলাদা করা হলো। বলা বাহুল্য, এ গরু জেলার সেরা গরু হিসেবে সোনার মেডেলপ্রাপ্ত। সবচেয়ে উন্নত জাতের খাবার খাওয়ানো হতে লাগলো সেটিকে। ডাক্তার এসে দুধ পরীক্ষা করে গেলেন–“সবকিছু একদম ঠিকঠাক।”

বাহ্! কী সহজ সমাধান! ভাবতেই অবাক লাগছে, আগে কেন মাথায় আসেনি!

অতএব, নার্সের ঝামেলা চুকলো। বাচ্চার জন্য নার্স রাখা মানে তো এক স্বৈরাচারীকে ঘরে আনা! সে যেভাবে যা বলবে তা-ই শুনতে হবে। কোথাকার কোন অকর্মার ঢেঁকি! তাকে খাইয়ে-পরিয়ে মোটা বানাতে হবে। আর, তার যদি কোন সংক্রামক রোগবালাই থাকে তাহলে তো কথাই নেই।

কিন্তু বিধি বাম! শিশুর চিৎকার থামছেই না। সেই সাথে ওজন হ্রাসের চলমানতা। দিন গড়িয়ে রাত, রাত গড়িয়ে দিন–চিৎকার বিরামহীন। বোঝাই যাচ্ছে, শিশু পেটের অসুখে ভুগছে। তবে উপায়?

নতুন গরু কেনা হলো। নতুন করে দুগ্ধ বিশ্লেষণ। এবারে, দুধের সঙ্গে পানি মিশিয়ে গুণে-মানে কিছুটা পরিবর্তন করা হলেও, শিশুর চিৎকার অপরিবর্তনীয়।

“নার্স নিয়োগ ব্যতীত আরোগ্য অসম্ভব”, ডাক্তারের স্পষ্ট বক্তব্য।

–“ওহ্! এছাড়া কি আর কোনও উপায় নেই? একজন এসে অন্যজনের সন্তানের দায়িত্ব নেবে এটাতো প্রকৃতিবিরুদ্ধ। ইয়ে, মানে, তাছাড়া, বংশগতির কী হবে? এই জাতীয় নানান কথায় ব্যারন সাহেব যখন প্রকৃতিবিরুদ্ধতা নিয়ে বিরাট ফিরিস্তি দিতে বসেছেন, তখন ডাক্তার তাঁকে থামালেন–“প্রকৃতিকে যদি তার নিজের মত করে চলতে দেয়া হত, তাহলে সমাজে অভিজাত সম্প্রদায় বলে কিছু থাকত না, তাদের সহায়-সম্পত্তি ধূলায় লুটাত। কারণ, অভিজাত সম্প্রদায়ের সৃষ্টিই হয়েছে প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করে।”

হতোদ্যম ব্যারনের যেন জাত গেল! প্রমাণিত হলো, তাঁর স্ত্রী নিজের গর্ভের ফসলকে টিকিয়ে রাখতে অক্ষম। অতএব, হয় তাকে অন্য স্ত্রীলোকের থেকে দুধ কিনতে হবে, নয়তো চুরি-ডাকাতি করে আনতে হবে! ব্যারনের বংশ চুরির সম্পত্তিতে টিকে থাকবে? এ-ও ছিল ঘটে!

–কিন্তু পয়সা দিয়ে দুধ কিনলে তাকে কি চুরি-ডাকাতি বলা যায়?

–অবশ্যই বলা যায়। কারণ, যে টাকা দিয়ে এটা কেনা হল, সেটা তো। কারও না কারো পরিশ্রমের ফসল। কার পরিশ্রম? অবশ্যই সাধারণ জনগণের পরিশ্রম; কেননা, অভিজাত সম্প্রদায় তো আর যা-ই করুক পরিশ্রম করে না।

হুমম! ডাক্তার ব্যাটা তাহলে সমাজতান্ত্রিক!

অবশ্য, ডারউইনের অনুসারীও হতে পারে–কথার মধ্যে কেমন একটা অন্যরকম গন্ধ আছে! তবে, যে যা-ই বলুক না কেন, ডাক্তার সাহেব নিজে এগুলোর কোনটাতেই গা করেন না। এসব তাত্ত্বিকতা নিয়ে মাথা ঘামানোর মত যথেষ্ট অবসর তাঁর নেই।

কিন্তু “পয়সা দিয়ে কেনা মানে ডাকাতি করা “ এ বড় শক্ত কথা। এক্ষেত্রে বিধান কী বলে? “যদি ঐ টাকা দিয়ে কেনা হয়, যে টাকা পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত হয়নি!” সংশয়ী ব্যারনের প্যাচালো জিজ্ঞাসা।

“অর্থাৎ, কায়িক পরিশ্রমের কথা বলছেন তো?” ডাক্তার সাহেবের সরলীকরণ।

“ঠিক তাই।” আনন্দে হাতে কিল দিলেন ব্যারন।

কিন্তু এভাবে চিন্তা করলে তো দেখা যায় ডাক্তারও ডাকাতি করে!

হুমম! ঘটনাতো তা-ই দাঁড়াচ্ছে।

তবে, যা-ই হোক না কেন, সত্য স্বীকারে ব্যারন পিছপা হবেন না, এমনই তাঁর প্রতিজ্ঞা। কিন্তু গুরুগম্ভীর আলোচনার এ পর্যায়ে খানিক বিঘ্ন ঘটলো। সঠিক সিদ্ধান্ত চেয়ে ব্যারন সাহেব এক খ্যাতনামা প্রফেসরের কাছে। লোক পাঠিয়েছিলেন। তিনি বলে পাঠিয়েছেন, “স্পষ্টত ব্যারন একজন খুনী; কারণ, তাঁর উচিত ছিল আরও আগেই নার্স নিয়োগ করা।”

তবে আর কী!

এবার তাহলে বউকে রাজি করানোর পালা। ব্যারনকে তাঁর আগের অবস্থান থেকে সরে আসতে হল। পূর্ববর্তী সকল যুক্তি ত্যাগ করে একটাই অবস্থান তৈরি হল–‘সন্তানের প্রতি ভালোবাসা’ (যদিও এখানে উত্তরাধিকার আইনের প্রভাব কতটা, তা বলা যাচ্ছে না!)।

কিন্তু মূল সমস্যা তো মূলেই রইল! নার্স পাওয়া যাবে কোথায়? শহরে খোঁজা উচিত হবে না, কারণ শহুরে মানুষের নীতি-নৈতিকতা বলে কিছু নেই। নাহ্! গ্রাম থেকেই আনতে হবে। তবে, একটা ব্যাপারে বউয়ের ঘোরতর আপত্তি আছে, “অবিবাহিতা কোন নার্স হলে চলবে না।” অবিবাহিতা মেয়ে অথচ তার বাচ্চা আছে, এমন মেয়েতো দুশ্চরিত্রা। আর, এমন কারও বুকের দুধ পান করলে তাঁর ছেলের স্বভাবেও খারাপ কিছু ঢুকে যেতে পারে!

অতএব, এ-ব্যাপারেও ডাক্তারকে হস্তক্ষেপ করতে হলো–“যেসব নার্স অন্যের বাচ্চাদের দুধ খাওয়ায়, তারা সবাই-ই অবিবাহিতা; কারণ, একজন সামর্থ্যবান স্বামী কখনোই তার স্ত্রীকে অন্যের বাড়ি গিয়ে, অন্যের সন্তানকে স্তন্যপান করাতে দেবে না। বরং চাইবে, স্ত্রী-সন্তান তার নিজের কাছেই থাকুক।

ব্যারনের কপালে চিন্তার ভাজ, এবং অতঃপর… ইয়েস! আইডিয়া পাওয়া গেছে। তারা যদি কোন গরীব ঘরের মেয়েকে নিজেদের পরিচিত কোন মজুরের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয়?

তবুও তো অন্তত নয় মাস অপেক্ষা করতে হবে।

তাহলে ধরা যাক, বাচ্চা আছে এমন কোন মেয়েকে তারা বিয়ে দিয়ে দিল?

হুম! সেটা অবশ্য মন্দ নয়!

তিন মাসের একটা বাচ্চা আছে এমন এক মেয়েকে ব্যারন চিনতেন। বেশ গভীরভাবেই চিনতেন বলা যায়; কারণ, তিন বছর সম্পর্কের পর ‘ডাক্তারের নির্দেশে তিনি মেয়েটিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। অগত্যা, সেই মেয়েটির কাছেই প্রস্তাব নিয়ে গেলেন–অ্যানডার্স নামের এক মজুরকে যদি সে বিয়ে করতে রাজি হয়, তবে তাকে আস্ত একটা ফার্ম দিয়ে দেয়া হবে। মেয়েটা চিন্তা করে দেখল–একা একা লাঞ্ছনা সহ্য করার চেয়ে এমন লোভনীয় প্রস্তাবে রাজি হওয়াটাই বুদ্ধিমতির কাজ হবে। সুতরাং, পরের রোববার বিয়ের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ হল। এবার, বউকে রেখে পরবর্তী দুমাসের জন্য অ্যানডার্সকে তার গ্রামের বাড়ি চলে যেতে হবে।

একটা বিষয় নিয়ে ব্যারন সাহেব মনে মনে হিংসায় জ্বলে মরছিলেন ‘নার্সের বাচ্চা ছেলেটা। বড়-সড়, শক্ত-পোক্ত একটা বাচ্চা। যদিও দেখতে ভালো নয়, কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যায় এ জিনিস অনেকদিন টিকবে! বেঁচে থাকার জন্যই এর জন্ম হয়েছে, স্বপ্নপূরণের জন্য নয়। তবে, ব্যারনের ছেলে আর নার্সের ছেলে তো এক বাড়িতে, এক মায়ের দুধ খেতে পারে না, তাই না? তাই, কায়দা করে নার্সের ছেলেটিকে এতিমখানায় পাঠিয়ে দেয়া হল। প্রথমদিকে অ্যানা (নার্স) ভীষণ কান্নাকাটি করল। কিন্তু এ বাড়ির এলাহী খানাদানা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তার কান্না থামাতে সমর্থ হল (তার খাবার আসত ঘরের ভেতর ডাইনিং রুম থেকে; আর, মদ তো যখন যেমন খুশি চলতই)। বাড়ির বাইরে যাবার ব্যাপারেও তার অবাধ স্বাধীনতা ছিল। মস্ত ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে, গার্ড সাথে নিয়ে সে বেড়াতে বের হত। অবসরে আরব্য রজনীর গল্প পড়ত। জীবনে এত সুখ কখনও সে কল্পনাও করেনি।

দুমাস পর আবার অ্যানডার্সের দেখা মিলল। এ অব্দি সে ফার্মেই ছিল। এতদিন খাওয়া আর ঘুমানো ছাড়া কিছুই করেনি। এবার আবদার করল অ্যানাকে কাছে পাবার জন্য। “মানে, অ্যানাকে কি অন্তত মাঝে মাঝে দু’ একদিনের জন্যও পাঠানো যায় না?”

“অসম্ভব!” ব্যারনের বউয়ের বজ্রনিনাদ। “কোনও রকম জারিজুরি চলবে না।”

এবার, অ্যানাকে রোগে ধরল। ক্রমাগত সে শুকাতে থাকল, সেই তালে ব্যারনের ছেলের ক্রমাগত কান্না। দৃশ্যপটে আবারও ডাক্তার।

–ওকে কিছুদিন স্বামীর সাথে থাকতে দিন।

–কিন্তু বাচ্চার সমস্যা হবে যে!

–না-না, অল্প কয়েকদিনে তেমন কিছু হবে না।

কিন্তু অ্যানডার্সটাকে আগে তলিয়ে দেখতে হবে। কোন বদ মতলব আছে কি না জানা দরকার! অ্যানডার্স গড়িমসি করতে থাকল… এবং…, ‘তলিয়ে দেখা সম্পন্ন হল। প্রক্রিয়াটি অবশ্য খুব জটিল কিছু না–কতগুলো ভেড়া পেয়েই অ্যানডার্স সন্তুষ্ট। তার গড়িমসি বন্ধ হল। বন্ধ হল ব্যারনপুত্রের কান্নাও।

কিছুদিন পর, এতিমখানা থেকে এক দুঃসংবাদ এলো–অ্যানার ছেলেটা ডিপথেরিয়ায় মারা গেছে।

অ্যানা যেন কেমন হয়ে গেল। সব সময় মনমরা হয়ে থাকে, কাজেকর্মে সাড়া পাওয়া যায় না, সব কিছুর প্রতি কেমন একটা উদাস-উদাস ভাব। ফলাফল যা হবার তাই হল–আবারও ব্যারনপুত্রের ক্রন্দনরোল। এবার আর কোন মধ্যবর্তী পন্থা চিন্তা করা হল না, অ্যানাকে চাকরি হারাতে হল। ওকে অ্যানডার্সের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে নতুন নার্স নিয়োগ দেয়া হল।

শেষ পর্যন্ত, বউ ফিরে পেয়ে অ্যানডার্সততা আহ্লাদে আটখানা। অবশ্য, এ আহ্লাদ আর্তনাদে পরিণত হতেও খুব বেশি সময় নিল না–অ্যানা বড় খরুচে হয়ে গেছে। ব্রাজিলিয়ান কফি না-হলে তার মুখে রুচে না, প্রতিদিন একই খাবার পছন্দ হয় না। সপ্তাহে ছয়দিন মাছ খেতে-খেতে তার স্বাস্থ্যহানি ঘটে, ফার্মে কাজ করতে ভীষণ কষ্ট হয়। ফলে, ফার্মের উৎপাদন কমে গেল। লোকসান সামলাতে না-পেরে, বছর ঘুরতে-না-ঘুরতেই অ্যানডার্সকে ফার্ম ছাড়তে হল। এইবেলা ব্যারন বেশ দয়া দেখালেন ওদেরকে ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকতে দিলেন।

*** *** ***

অ্যানা এখন ব্যারনের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে। হামেশাই ব্যারনপুত্রের সঙ্গে তার দেখা হয়। অ্যানাকে সে চিনতে পারে না। অবশ্য চিনতে চায় না বলাটাই যথার্থ হবে। এমনই তো হবার কথা ছিল–ব্যারনপুত্রকে নিজের বুকের দুধ খাইয়েছে সে, তাকে বাঁচাতে গিয়ে পেটের ছেলেকে বলি দিয়েছে; আজ কৃতজ্ঞতা স্বরূপ (!) ব্যারনপুত্র তাকে চিনবে না সেটাই তো স্বাভাবিক, সেটাই তো আভিজাত্য। যাহোক, অ্যানা কিন্তু যথেষ্ট উৎপাদনশীল ছিল। পরবর্তীতে তার আরও অনেকগুলো ছেলেপুলে হয়েছে, যারা ক্ষেতে-খামারে মজুর হিসেবে, কিংবা কুলি হিসেবে রেলওয়েতে কাজ করে। একজন আবার দাগী আসামি, এখন জেল খাটছে।

ব্যারন সাহেব এখন পুত্রের বিয়ের দিন গুনছেন। নাতি-নাতনীর মুখ দেখতে আকুল তিনি। পুত্র অবশ্য খুব একটা শক্তপোক্ত হয়নি। যে-কারণে ব্যারন সাহেব মাঝে মাঝেই অন্যরকম ভাবেন–সেই এতিমখানায় মারা যাওয়া পুত্রটি যদি আজ তাঁর উত্তরাধিকারী হত, তবে তিনি অনেকটাই নিশ্চিন্তে থাকতে পারতেন। ইত্যবসরে, দ্বিতীয়বারের মত ‘দ্য স্লেভস অব লাইফ’ পড়ে ব্যারন সাহেব স্বীকার করতে বাধ্য হলেন–“উঁচু শ্রেণি টিকেই থাকে নীচু শ্রেণির দয়ার ওপর।” ডারউইনের পুনঃপঠনে তিনি অস্বীকার করতে পারলেন না–“প্রাকৃতিক নির্বাচন ব্যাপারটা সবসময়ই অলঙ্ঘনীয়। যে যা-ই বলুক না কেন এ সত্য চিরদিন ধ্রুব হয়েই থাকবে।”

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *