দেনা-পাওনা

দেনা-পাওনা

মিস্টার ব্ল্যাকউড ব্রুকলিনের কাছে একটা জাহাজ-জেটিতে কাজ করেন। সম্প্রতি মিস ড্যাঙ্কওয়ার্ড নামের এক ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করে মোটা অঙ্কের যৌতুক পেয়েছেন। স্ত্রীর প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা। তিনি চিন্তা করে দেখলেন, বাসা-বাড়িতে থাকলে কাজ করতে গিয়ে স্ত্রী হয়তো মন ছোট করে থাকতে পারেন; কিংবা, নিজেকে হয়তো পরাধীন বলে ভাবতে পারেন! তাই ঝামেলা এড়াতে স্ত্রীকে নিয়ে তিনি একটা হোটেলে উঠলেন। এখন থেকে এখানেই থাকা হবে!

হোটেলে সারাদিনে স্ত্রীর করার মত তেমন কোন কাজ নেই। সময় কাটে বিলিয়ার্ড খেলে, আর পিয়ানো বাজিয়ে। রাতের অর্ধেকটা কাটে নারী অধিকার নিয়ে নানা বিপ্লবী আলোচনা করে, আর হুইস্কি খেয়ে।

স্বামীর বেতন পাঁচ হাজার ডলার। এর পুরোটাই তিনি স্ত্রীর হাতে তুলে দেন, এবং তৎক্ষণাৎ সেটা স্ত্রীর সম্পত্তিতে পরিণত হয়। এর বাইরেও পোশাক আশাকের খরচা বাবদ তাকে আরও পাঁচশ ডলার দেয়া হয়, যেটা দিয়ে সে যা খুশি তাই করতে পারে।

কিছুদিন পর তাদের সন্তান হল। সন্তানের দেখাশোনার জন্য একশো ডলার দিয়ে একজন নার্স রাখা হল। এই নার্সই মায়ের মত করে বাচ্চাটির যত্নআত্তি করে। সময়ের সাথে সাথে তাদের আরও দুটি সন্তান হল। সন্তানেরা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। কিন্তু এসব নিয়ে ব্ল্যাকউডপত্নীর কোন মাথাব্যথা নেই। তার বরং দিন-দিন আরও বেশি একঘেয়ে লাগে।

একদিন সকালে কিঞ্চিৎ মাতাল অবস্থায় স্ত্রীকে নাস্তার টেবিলে দেখা গেল। স্বামী মোটামুটি দুঃসাহসিক পর্যায়ের(!) একটা কাজ করলেন, স্ত্রীকে বলে বসলেন–“তোমাকে অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে।” এ-কথা শুনে স্ত্রীরতো রীতিমত মৃগীরোগীর মত অবস্থা! খাবার টেবিল ছেড়ে তিনি খাটে গিয়ে পড়লেন। খবর পেয়ে হোটেলের অন্যান্য রুমের মহিলারা ফুল নিয়ে তাকে দেখতে এলেন। অত্যাচারী স্বামীর প্রতি নানা বিষোদ্গার করলেন। এরা চলে গেলে ধীরে-সুস্থে এলেন স্বামী। যথাসম্ভব মমতাভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি এত মদ্যপান কেন কর, বলতো? কোন কারণে কী তুমি নিজেকে অসুখী মনে কর?”

“আমি কীভাবে নিজেকে সুখী মনে করি, বলো? আমার পুরো জীবনটাই যে অপচয় হল!” কান্নাভেজানো কণ্ঠে জবাব দিলেন স্ত্রী।

“এসব তুমি কী বলছ?” স্বামী যেন আকাশ থেকে পড়লেন। “অপচয় বলতে তুমি কী বোঝ? তোমার তিন-তিনটা ছেলেমেয়ে আছে। চাইলেই ওদের দেখাশোনা করে, শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে তুমি সময় পার করতে পার।”

–নিজের ছেলেমেয়েদের কোন বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানো আমার পছন্দ না।

–তাহলে তুমি সমাজের সুবিধাবঞ্চিত বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করতে পার। সেক্ষেত্রে, তোমার জীবনের একটা মহান লক্ষ্য থাকবে, তোমার জন্য অন্যেরা উপকৃত হবে, আর সর্বোপরি পুরো সমাজ তোমাকে সম্মান দেবে। অন্তত, জাহাজ-জেটির কর্মচারীর চেয়ে বেশি সম্মানতো বটেই!

–হুম, সবই ঠিক আছে। কিন্তু ইস! আমি যদি স্বাধীন হতাম!

স্বামী এবারে মরিয়া হয়ে উঠলেন, “তুমি অবশ্যই স্বাধীন; অন্তত আমার চেয়ে বেশি স্বাধীন। ভেবে দেখ, সবসময় তুমিই সিদ্ধান্ত নাও আমার উপার্জন কীভাবে, কোনপথে খরচ হবে। আমি বরং তোমার কর্তৃত্বে থাকি। নিজের ইচ্ছামত খরচের জন্য তুমি মাসে পাঁচশ ডলার হাতখরচ পাও; অথচ আমাকে দেখ, আমার কিন্তু কোন হাত-খরচ নেই। আমার কোন খরচাপাতি লাগলে, এমনকি সিগারেট কেনার টাকাও তোমার থেকে চেয়ে নিতে হয়। এত কিছুর পরও তোমার মনে হয় না, তুমি আমার চেয়ে স্বাধীন?”

স্ত্রী কোন জবাব দিলেন না। মনে হল, শেষের প্রশ্নটা তিনি শুনতেই পাননি! তবে এ আলোচনার ফলাফল বেশ ব্যাপক হল। সিদ্ধান্ত হল, হোটেল ছেড়ে এবার তারা বাসাবাড়িতে উঠবে। বাড়ির পরিবেশে হয়ত মন চনমনে থাকবে। তাছাড়া বাড়ির খরচাপাতির খুঁটিনাটি হিসাব রাখার ব্যাপারেও মনস্থির করা হল–এতে অন্তত করার মত কিছু কাজ পাওয়া যাবে।

*** *** ***

কিছুদিন পরের ঘটনা। ব্ল্যাকউডপত্নী তার এক বান্ধবীকে চিঠি লিখলেন

বন্ধু,

আমি অসুস্থ। ক্লান্ত-শ্রান্ত আমি যেন দিন-দিন মৃত্যুর দিকে এগুচ্ছি। জানি, এমন কষ্টের মধ্য দিয়েই আমাকে যেতে হবে। কারণ যে নারীর জীবনের কোন উদ্দেশ্য নেই, তার জন্য জগতে কোন সান্ত্বনা নেই, তার মত দুঃখীও কেউ নেই। কিন্তু আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব। জগৎকে দেখিয়ে দেব, স্বামীর টাকায় খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার মত মেয়ে আমি নই। আর একারণেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি কাজ করতে শুরু করব; মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত কাজ করে যাবো আমি….

অতঃপর, ব্ল্যাকউডপত্নীর কর্মময় জীবন শুরু হল। প্রথমদিন তিনি সকাল নয়টায় ঘুম থেকে উঠলেন। স্বামীর রুমটা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করলেন। কাজের লোককে সরিয়ে দিয়ে নিজেই রান্নাবান্না করতে শুরু করে দিলেন। দুপুর একটার সময় ব্ল্যাকউড সাহেব যখন লাঞ্চ করতে বাড়ি এলেন, খাবারদাবার তখনও পুরোপুরি তৈরি হয়নি। দোষটা অবশ্য কাজের লোকেরই হল! যাহোক, স্ত্রীর কালিঝুলিমাখা ক্লান্ত চেহারা দেখে স্বামী বেচারা খাবার নিয়ে কোন অভিযোগ করলেন না। চুপচাপ একখানা আধপোড়া কাটলেট খেয়ে আবার কাজে বের হয়ে গেলেন। যাবার সময় স্ত্রীকে বলে গেলেন “এত খাটাখাটনি করো না, সোনা! শরীর খারাপ করবে।”

সন্ধ্যাবেলায় ব্ল্যাকউডপত্নী এত বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়লেন যে বাকি কাজ শেষ করা আর সম্ভব হল না। দশটার দিকে তিনি ঘুমুতে গেলেন।

পরদিন সকালবেলা ব্ল্যাকউড সাহেব স্ত্রীর রুমে গেলেন। বেশ অবাক হলেন তিনি স্ত্রীকে আজ অন্যদিনের চেয়ে একটু উজ্জ্বল দেখাচ্ছে যেন! ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে জিজ্ঞেসই করে বসলেন, “রাতে নিশ্চয়ই ভালো ঘুম হয়েছে?”

“হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন?” স্ত্রীকে সন্দিগ্ধ দেখালো।

“কারণ, আজ তোমাকে অন্যদিনের চেয়ে বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে” হাসতে হাসতে বললেন স্বামী।

“আমাকে সু……র দেখাচ্ছে?” থেমে থেমে শব্দটা উচ্চারণ করলেন স্ত্রী।

“হুম! একটু-আধটু কাজ করাটা বোধহয় তোমার জন্য ভালোই।” স্বামীর সপ্রশংস মন্তব্য।

তবে এর ফল কিন্তু হল উল্টো।

–“একটু-আধটু? একে তোমার একটু-আধটু কাজ মনে হয়েছে? তা কতটুকু হলে তোমার কাছে বেশি কাজ মনে হবে, শুনি?” স্ত্রীর চোখ-মুখ দিয়ে যেন ঝাঁজ বেরুচ্ছে।

স্বামী বেচারা ঘাবড়ে গেলেন–“দেখ, আমি কিন্তু সে রকম কিছু বলিনি। তোমাকে কষ্ট দেয়ার কোন ইচ্ছাই আমার নেই।”

“অবশ্যই আছে” আগের মতই রেগে আছেন স্ত্রী। “তুমি স্পষ্ট বোঝাতে চেয়েছ, গতকাল আমি যথেষ্ট কাজ করিনি! অথচ ভুলে গেছ, সবার আগে আমি তোমার রুমটাই পরিষ্কার করেছি। মানে, আমি বোধহয় কাজের লোক হলেই ভালো হত, না? সারাদিন কাজ করতাম, রান্না। করতাম, ঘর গোছাতাম। তাহলে নিশ্চয়ই তুমি খুশি হতে। তুমি অস্বীকার। করতে পার আমি তোমার দাসী নই?”

স্বামী এ অবস্থাকে আর দীর্ঘায়িত হতে দিলেন না। চুপচাপ রুম থেকে চলে এলেন। বাইরে যাবার সময় কাজের লোককে বেশ শাসিয়ে গেলেন “এখন থেকে সকাল সাতটায় উঠে আমার রুম পরিষ্কার করবি। ম্যাডামকে যেন আর তোর কাজ করতে না হয়।”

সন্ধ্যাবেলা ব্ল্যাকউড সাহেব বেশ খোশমেজাজে ঘরে ফিরলেন। স্ত্রী কিন্তু তখনো রেগে ছিলেন। আমাকে তোমার রুম পরিষ্কার করতে দেয়া হল না কেন?” থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করলেন।

–কারণ ‘তুমি আমার দাসী’, এই অভিযোগ আমি মানতে পারি না।–কেন মানতে পার না?

–আমি ওভাবে কখনো চিন্তাও করিনি। ওভাবে চিন্তা করতে আমার কষ্ট হয়।

–ও আচ্ছা, এই কথা! কিন্তু আমাকে দিয়ে রান্নাবান্না করাতে, ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করাতে কষ্ট হয় না?”

স্বামী এ-প্রশ্নের কোন উত্তর দিলেন না। স্ত্রীর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, অন্যরুমে চলে গেলেন। পরদিন ট্রামে করে অফিসে যাবার পথে, পুরো সময়টা তিনি এইসব ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা করলেন। সন্ধ্যায় যখন বাড়ি ফিরলেন, ততক্ষণে তাঁর বেশ গোছালো চিন্তাভাবনা হয়ে গেছে। এবার স্ত্রীকে নিয়ে বসলেন তিনি–“শোন ডার্লিং, বাড়িতে তোমার অবস্থান নিয়ে খুব গুছিয়ে একটা চিন্তা করেছি। তবে তার ফল কিন্তু তুমি যা বলেছিলে তার পুরোপুরি বিপরীত দাঁড়িয়েছে। কোনভাবেই আমার মনে হয়নি, তুমি এ বাড়ির কাজের লোক বা আমার দাসী। কিন্তু তবুও, তোমার যেহেতু মনে হয়েছে, আমরা একটা মধ্যবর্তী কোন উপায় বের করতে পারি। আমার মতে সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি হচ্ছে, এখন থেকে তুমি নিজেকে বোর্ডিং হাউসের মালিক বলে মনে করবে, আর আমি বোর্ডার হিসেবে মাসে-মাসে তোমাকে ভাড়া দেব। অর্থাৎ, কী তুমিই থাকলে। আমি যে বোর্ডিংয়ে খাওয়াদাওয়া করছি, সেই বাবদ খরচও তোমার কাছেই দেব।”

স্ত্রী কেমন হকচকিয়ে গেলেন–“কী বলতে চাইছ?”

–বললামতো, খুব সহজ! আমরা এখন থেকে মালিক আর ভাড়াটিয়া হলাম। তবে ব্যাপারটা আমরা শুধু মনে মনেই রাখবো, আমাদের সম্পর্কে এর কোন প্রভাব পড়বে না।

–আচ্ছা বেশ! তা তুমি আমাকে কী পরিমাণ ভাড়া দেবে?

–সেই পরিমাণ, যে পরিমাণ দিলে আমাকে তোমার কাছে ঋণী থাকতে না হয়! আশা করি, এতে আমার নিজের অবস্থানেরও উন্নতি হবে। কারণ তখন আমার আর মনে হবে না, আমি কারও দয়ার ওপর বেঁচে আছি!

–দয়ার ওপর?

“নয়তো কী? তুমি আমাকে খেতে দিচ্ছ আধাসিদ্ধ খাবার; অথচ, বলে বেড়াচ্ছ–তুমি আমার চাকরানি, আমার জন্য কাজ করতে করতে তুমি মরে যাচ্ছ!” কথাগুলো বলার সময় স্বামীকে বেশ আত্মবিশ্বাসী দেখালো।

“তুমি আসলে ঠিক কী বোঝাতে চাইছ, বলতো?”

–তেমন বিশেষ কিছু না। শুধু বলছি, বোর্ডার হিসেবে দিনে ত্রিশ ডলার দিলে চলবে তো? অন্য যেকোন বোর্ডিং হাউস কিন্তু বিশ ডলারেই রাজি হবে।

–চলবে, ত্রিশ ডলারেই চলবে।

“বেশ, তাহলে মাসে দাঁড়াচ্ছে প্রায় হাজার ডলার। আর আমি প্রথম মাসের টাকাটা অগ্রিম দিচ্ছি–এই নাও এক হাজার ডলার।” পকেট থেকে একটা হাজার ডলারের নোট আর কাগজ-কলম বের করলেন ব্ল্যাকউড সাহেব। স্ত্রীর হাতে নোটটা গুঁজে দিয়ে, সংসারের পুরো মাসের খরচ একটা বিল আকারে লিখলেন। বিলটা এরকম

ভাড়া–৫০০ ডলার

নার্সের বেতন–১০০ ডলার

রাধুনির বেতন–১৫০ ডলার

স্ত্রীর ভরণপোষণ–৫০০ ডলার

স্ত্রীর হাত-খরচ–৫০০ ডলার

নার্সের আনুষঙ্গিক খরচ–৩০০ ডলার

রাধুনির আনুষঙ্গিক খরচ–৩০০ ডলার

ছেলেমেয়েদের ভরণপোষণ–৭০০ ডলার

ছেলেমেয়েদের জামাকাপড়–৫০০ ডলার

জ্বালানি, কাঠ, অন্যান্য–৫০০ ডলার

সর্বমোট–৪০৫০ ডলার

এবার স্ত্রীকে বললেন, “সংসার যেহেতু দুজনেরই, অতএব এই ৪০৫০ কে ২ দিয়ে ভাগ কর। কত হল? ২০২৫ ডলার। অর্থাৎ, আমাদের যার-যার ভাগে পড়ল ২০২৫ ডলার করে। তাহলে তোমাকে কিছুক্ষণ আগে যে ১০০০ ডলার দিলাম, সেটা তোমার ভাগের ২০২৫ ডলার থেকে কেটে রেখে, বাকি ১০২৫ ডলার আমাকে ফেরত দাও!”

স্ত্রী মনে হল সব গুলিয়ে ফেলেছেন। কোনমতে আমতা-আমতা করে বললেন, “ইয়ে মানে, তুমি কী চাচ্ছ যে, আমি এখন তোমাকে টাকা দেব?”

“অবশ্যই, যেহেতু আমরা সমান-সমান, অতএব ব্যাপারটাতো তা-ই দাঁড়াচ্ছে। সেক্ষেত্রে, তোমার আর সন্তানদের খরচের শুধু অর্ধেকটা আমার বহন করার কথা, তাই না? নিয়মতো তা-ই বলে।” খুব যত্ন করে গুছিয়ে কথাগুলো বললেন স্বামী। তাঁর কথা তখনো শেষ হয়নি, “নিয়ম ভঙ্গ করে পুরো খরচ আমি একাই দেব এমনটা নিশ্চয়ই তুমি আশা কর না? কারণ, সেক্ষেত্রে তো আমাকে ৪০৫০ ডলার ছাড়াও বোর্ডিং ভাড়া বাবদ অতিরিক্ত ১০০০ ডলার তোমাকে দিতে হবে। কিন্তু আমি তো আমার ভাগের ২০২৫ ডলারের বাইরেও শুধু ভাড়া বাবদ ১০০০ ডলার তোমাকে দিচ্ছিই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ২০২৫ ডলারের বিনিময়ে আমি কী পাচ্ছি? পাচ্ছি, অতি উপাদেয়(!) খাবারদাবার। শুধু এই অতি-উপাদেয়(!) খাবারের জন্য নিশ্চয়ই আমাকে পুরো ৪০৫০ ডলার দিতে হবে না?

এতক্ষণ হাঁ করে সব শুনছিলেন স্ত্রী। তাঁকে যে কিছু জিজ্ঞেস করা হয়েছে, তা বুঝতেই পারেননি। স্বামী দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করার পর কোনমতে শুধু বললেন, “বুঝতে পারছি না।”

“শুরুতে আমিও বুঝিনি। তবে এটুকু পরিষ্কার যে, আমার ভাগের টাকাটা দিয়ে দেবার পর আমি আর কোনভাবেই তোমার কাছে ঋণী থাকবো না। খুব ছোট্ট একটা ঘটনা খেয়াল কর–সবকিছুর মত কাজের লোকের খরচেও আমার ভাগ আছে, অথচ ওরা কিন্তু সারাদিন তোমার কাজই করে। তোমার তত্ত্ব মেনে নিয়ে, তুমি-আমি যদি সত্যিই সমান হই; কিংবা, যদি সত্যিই পুরুষ মানুষ সবকিছুতে বেশি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে, তাহলে কিন্তু এমন হবার কথা না। তোমার ঘরের কাজের প্রতি (সত্যিই যদি কিছু করে থাকো!) সম্মান দেখিয়েই বলছি তোমার তত্ত্ব অনুযায়ী, ঘরের কাজই যদি বেশি মূল্যবান হয়, তাহলে তোমার এটাও ভুলে যাওয়া উচিত হবে না, গৃহস্থালির খরচ বাবদ ৫০০ ডলারের বাইরেও হাত খরচ হিসেবে তুমি আরও ৫০০ ডলার পাচ্ছ; অথচ আমার কিন্তু হাত-খরচ বলতে কিছু নেই।”

এবার যেন স্ত্রীর চোয়াল ভেঙে পড়ল। অসহায়ভাবে বললেন, “আমি সত্যিই তোমার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।”

স্বামীও হাল ছাড়ার পাত্র নয়। এবার অন্যভাবে শুরু করলেন–“ঠিক আছে, ‘বোর্ডিং হাউস তত্ত্ব বাদ দেয়া যাক। তার চেয়ে বরং, ডেবিট ক্রেডিট পদ্ধতিতে হিসাব করি চল।” এবার আরও গুছিয়ে, রীতিমত ব্যাংক হিসাবের আদলে একটা হিসাবপত্র দাঁড় করালেন ব্ল্যাকউড সাহেব।

বরাবর

মিসেস ব্ল্যাকউড

বিষয় : মিসেস ব্ল্যাকউডকে ঘর-গৃহস্থালির খরচ বাবদ দেয়া অর্থের হিসাব

বাড়ি ভাড়া এবং আনুষঙ্গিক–১০০০ ডলার তাঁর

কাপড়চোপড়–৫০০ ডলার

তাঁর হাত-খরচ (নগদ প্রদান)–৫০০ ডলার

বাচ্চাদের খরচ–১২০০ ডলার

কাজের লোকের (যারা শুধু তাঁর কাজই করে) খরচ–৮৫০ ডলার

সর্বমোট–৪০৫০ ডলার

যার অর্ধেক অর্থ প্রদান করতে বাধ্য থাকবেন—

জনাব ব্ল্যাকউড, জাহাজ-জেটির কর্মচারী

……………………..

স্বাক্ষর

স্ত্রীর পক্ষে আর সহ্য করা সম্ভব হল না, “উফ! তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে বিলের হিসাব করছ, ছিঃ!”

–না না, শুধু স্ত্রীর খরচের হিসাবতো করছি না। স্ত্রীর কাছে নিজের পাওনার হিসাবও করছি।

ব্ল্যাকউডপত্নী এবারে বিলের কাগজগুলো খপ করে নিজের হাতে নিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। কোমরে হাত দিয়ে স্বামীর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন–“তাহলে কি তোমার সন্তানদের লেখাপড়ার খরচও আমাকে দিতে হবে?”

“তাই-ই তো দেয়া উচিত। কিন্তু ঠিক আছে যাও, সন্তানদের পড়ালেখার পুরো খরচটা না-হয় আমিই দেব; তোমাকে এক পয়সাও দিতে হবে না। তবে মনে রেখ, এটা কিন্তু সমতা হল না। যাহোক, সন্তানদের পড়ালেখা আর কাজের লোকের খরচের টাকাটা আমার ভাগে নিলাম; তারপরও, তোমার কাছে আমার আরও কিছু পাওনা থেকে যায়। সেগুলো গুছিয়ে নিয়ে আরেকটা বিল তৈরি করে দেব?”

স্ত্রী আর কোন বিল চাইলেন না।

তিনি আর কখনোই কোন বিল চাননি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *