৮. উত্তরসত্য

৮. উত্তরসত্য

২০২০র ১৪ মে ভারত সরকারের এক মন্ত্রী বক্তৃতায় বললেন, আগের তিন মাসে ভারতবর্ষে একটি লোকও অনাহারে থাকেনি। আগে-পরে অনুরূপ দাবি সরকারের অন্য মুখপাত্রেরাও করেছেন, মায় দেশের সর্বোচ্চ আদালতে দাঁড়িয়ে। ভারত সম্বন্ধে এমন দাবি করা যে-কোনও সময়েই দুঃসাহসিক, উপরন্তু সেই তিন মাস ভারত তথা সারা বিশ্ব করোনা ভাইরাসের আক্রমণে বিপর্যস্ত। ২৫ মার্চ থেকে ভারতবর্ষে সমস্ত যানচলাচল নিষিদ্ধ। অসংখ্য নিঃসম্বল অভিবাসী শ্রমিক (বিভিন্ন হিসাবে সংখ্যায় এক থেকে চার কোটি) ভিন রাজ্যে আটকে পড়ে গ্রীষ্মের গরমে হাজার কিলোমিটার হাঁটছেন দূর গ্রামের উদ্দেশে, নইলে কোনও মতে মাথা গুঁজে প্রাক্তন কর্মস্থলেই পড়ে আছেন। প্রতিদিন সংবাদের পাতায় ও পর্দায় অজস্র শিশু বৃদ্ধ অন্তঃসত্ত্বা ও অন্যান্য হতভাগ্য মানুষ বলেছেন তাঁদের দুর্গতির কথা, যার একটা বড় অঙ্গ অবশ্যই খাদ্যাভাব। তাঁদের সঙ্গে সরেজমিনে কাজ করছিল যে সব সমাজসেবী সংস্থা, তারাও একবাক্যে এই কথা বলেছে। শীর্ষ নেতাদের বক্তৃতায় অবশ্য বিষয়টা থেকেছে প্রায় অনুক্ত।

এই পরিস্থিতিতে মন্ত্রীমশাই কী করে ওই দাবি করলেন? প্রশ্নটা দু’দিন সমাজমাধ্যমে ঝড় তুলল। উত্তর মেলেনি বলা বাহুল্য। প্রশ্নটাও ছিল আলঙ্কারিক— ইংরেজিতে যাকে বলে rhetorical question, অর্থাৎ উত্তরটা প্রশ্নের মধ্যেই নিহিত: বোঝাই যাচ্ছে, দাবিটা অসংগত। এমন অসংগত দাবির কী কারণ হতে পারে? কেউ বলবেন, কারণের দরকার নেই, ক্ষমতাবান লোকে যা খুশি বলতে পারে। কিন্তু এমন ‘খুশি’ তাঁর হল কেন? কেউ বলতে পারেন (সমাজমাধ্যমে অনেকে বলেছেন) এটা স্রেফ মিথ্যা কথা। তাও প্রশ্ন: সঠিক অবস্থা যেখানে দেশসুদ্ধ মানুষ জানেন, মিথ্যা বলে লাভ কী? এর পিছনে উঁকি দিচ্ছে আসল প্রশ্ন: সত্যিই কি দেশসুদ্ধ মানুষ এটা মিথ্যা বলে জানেন বা মানেন? যাঁরা সত্যিই খবর রাখেননি (ভারতবর্ষে এমন মানুষ ছিলেন কি?), তাঁদের কথা বলছি না কিন্তু। বলছি যাঁরা কাগজ টিভি সমাজমাধ্যমে সড়গড়, পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে বহু বিবৃতি দেখেছেন। তা সত্ত্বেও অনেকে বলবেন, সব বাজে কথা, কেউ না খেয়ে ছিল না। এমন ধারণার সমর্থনে যুক্তি-তথ্য দর্শাবেন না, তবে সমালোচকদের গালমন্দ করতে পারেন।

ভাল কথা শুনতে সকলেরই ভাল লাগে। সবাই চাই এমন খবর শুনতে যাতে খুশি হব, আশ্বস্ত হব, ফলে জীবনটা শান্তিতে কাটাতে পারব। দেশ বা দুনিয়ার হাল সত্যি করে এমন চমৎকার বড় হয় না, তাই খবরগুলো সাজিয়ে কেটেছেঁটে রং মাখিয়ে মনের মতো করে নিতে হয়। টিভির অনেক সংবাদ চ্যানেল সিনেমা-খেলা-সিরিয়ালের সঙ্গে পাল্লা দেবার জন্য তাই খবরের মধ্যেও বিনোদনের মিশেল দেয়, জন্ম হয় ‘ইনফোটেনমেন্ট’এর। এই চ্যানেলগুলির কাছে খবরই পণ্য, অন্য যে-কোনও পণ্যের মতো তার বিপণনের জন্য গল্পের অবতারণা করা যেতেই পারে— বিশেষত যেখানে গল্পের বাহন হতেই হবে বিপণনকৌশলের আদর্শ মাধ্যম অর্থাৎ টেলিভিশন। অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রে বলেছিলাম, যতই গল্প-স্লোগান-ছবি-গান দিয়ে চাহিদা সৃষ্টি হোক, শেষ অবধি বাস্তব সামগ্রীটা ক্রেতার হাতে তুলে দিতে হবে, সেই ‘রিয়ালিটি চেক’ এড়াবার জো নেই। ইনফোটেনমেন্টের সে বালাই নেই, সেখানে খবরই পণ্য, খবরই বিজ্ঞাপন; উপরন্তু তার আগে-পরে থাকছে অন্য পণ্যের বিজ্ঞাপন, দর্শকের মনকে ইচ্ছা আর চাহিদার সুরে আরও কষে বেঁধে দিচ্ছে। সব মিলিয়ে আসল-নকল, বাস্তব আর স্বপ্ন, তথ্য আর কল্পনার মধ্যবর্তী রেখাটা মুছে যাচ্ছে।

শুধু এই বলে ছেড়ে দিলে সৎ সংবাদ চ্যানেলগুলির প্রতি ঘোর অবিচার হবে। বেশ কয়েকটি চ্যানেল (ও ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের সাংবাদিকেরা) বলিষ্ঠভাবে, হয়তো রীতিমত ঝুঁকি নিয়ে এমনকী চ্যানেলের অস্তিত্ব বিপন্ন করে সত্য উদ্ঘাটন করেন। সাম্প্রতিক কালে নানা দেশে অনেকগুলি বড় অনাচারের কথা মানুষ টিভির মাধ্যমেই জানতে পেরেছে। তবে এমন চ্যানেলের কর্তা-কর্মীরাই স্বীকার করেন, দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমের ফলে যেমন একদিকে তথ্যনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে সুবিধা হয় (যেমন কোনও ঘটনা বা উক্তির অকাট্য চাক্ষুষ প্রমাণ দিয়ে), তেমনি ওই মাধ্যম সম্বন্ধে দর্শকের একটা চটুল প্রত্যাশা থাকে, যার সঙ্গে জুঝতে হয় এবং খানিক আপস করতে হয়। আরও বেশি করতে হয় এই কারণে, যে পাশাপাশি অন্য অনেক চ্যানেল পুরোপুরি ইনফোটেনমেন্টের চাহিদা পূরণ করে শুধু দর্শক নয়, সরকার এবং বৃহৎ পুঁজির বিজ্ঞাপনদাতাদের (যাঁরা প্রায় সর্বদা ব্যবসার স্বার্থে সরকারের অনুগামী) আর্থিক ও রাজনৈতিক সমর্থন পায়। জনসাধারণ বিশেষ ধরনের খবর একটা বিশেষ বয়ানে শুনতে চান; যাঁরা খবর হয়ে ওঠেন সেই বিশিষ্টজনেরা জনপ্রিয়তার স্বার্থে সেই চাহিদা মেটান; এবং সাংবাদিকেরা প্রায়শ খবর পরিবেশন করেন একই চাহিদা মাথায় রেখে।

পরিস্থিতির উলটো পিঠ দেখা যাক। মনোরঞ্জক খবর যতই প্রচার হোক, বাঁচতে হলে কতক বাস্তব সত্য স্বীকার করতেই হয়, যেমন ব্যক্তির তেমন রাষ্ট্রের। দেশটা কেমন চলছে, তা জানতে হলে কিছু তথ্য ও পরিসংখ্যান দরকার; সবচেয়ে দরকার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জন্য— সোজা কথায়, দেশবাসীর সুষ্ঠুভাবে বাঁচার তাগিদে। সেই তথ্যগুলি সংগ্রহ করতে হয় নির্ভেজাল বাস্তব থেকে, খুঁটিয়ে নির্মোহভাবে। অথচ নানা দেশে বাস্তবের সঙ্গে এই অপরিহার্য বৌদ্ধিক যোগটা ছিন্ন হয়েছে বা হতে চলেছে, তথ্য ও সংখ্যা নিয়ে কারিকুরি করে বা একদম হাপিস করে দিয়ে। ডনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে জেতামাত্র মার্কিন বিজ্ঞানীরা ঊর্ধ্বশ্বাসে বিভিন্ন সরকারি ওয়েবসাইট থেকে নানা রকম তথ্য— সর্বোপরি পরিবেশ সংক্রান্ত তথ্য— ডাউনলোড করে নিজেদের কম্পিউটারে পুরতে লাগলেন। তাঁরা জানতেন, ট্রাম্প যে নীতি অনুসরণ করতে চান তথ্যগুলি তার পরিপন্থী, ফলে তাঁদের ভয় ছিল একবার পদে অধিষ্ঠিত হলে তিনি তথ্য মুছে দেবেন বা ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেবেন; হয়েছিলও তাই। একচ্ছত্র কমিউনিস্ট দেশগুলির সূর্য যখন মধ্যগগনে, আন্তর্জাল ছিল না বটে, কিন্তু সে যুগের পদ্ধতিতে তথ্যবিকৃতি তাদের রাষ্ট্রনীতির প্রায় স্বীকৃত অঙ্গ ছিল। আজও চিনের মতো দেশে কেবল এমন তথ্য প্রকাশ পায় যা রাষ্ট্রের স্বার্থ বা গৌরববৃদ্ধি করে; আন্তর্জাতিক মহলে তাই চিনের সরকারি পরিসংখ্যানে কেউ বড় আস্থা রাখে না।

তুলনায় ভারতের পরিসংখ্যান ব্যবস্থা স্বাধীনতার পর প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের আমল থেকে ছিল দেশ-বিদেশে সম্মান ও গর্বের বস্তু। গত কয়েক বছর কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ভারত সরকার তার নিজের তথ্য নিয়ে নিজেই প্রশ্ন তুলছে, বার বার বদলাচ্ছে, প্রকাশ করে ফের প্রত্যাহার করছে বা আদৌ প্রকাশ করছে না; কিংবা তথ্য সংগ্রহের প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি বাতিল করে বিনা ব্যাখ্যায় বিতর্কিত নতুন পদ্ধতি চালু করছে। দেশের অগ্রগণ্য অর্থবিদ ও রাশিবিজ্ঞানীদের প্রায় সকলেই এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। একটি সমীক্ষা সরকার কর্তৃক প্রত্যাহার হবার পর জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশনের অধিকর্তা প্রতিবাদে পদত্যাগ করে বলেন, সমীক্ষার তথ্য ‘সরকারের গল্পের সঙ্গে মিলছে না’ বলেই ভারত সরকার তা চেপে দিতে সচেষ্ট।১১১ এটা সবচেয়ে বেশি ও হানিকরভাবে ঘটছে আর্থনীতিক তথ্য নিয়ে, কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, যেমন অপরাধের বা চাষিদের আত্মহত্যার পরিসংখ্যানে। কর্তৃপক্ষ যেন কোনও ‘রিয়ালিটি চেক’ই আর বজায় রাখার ঝুঁকি নিতে চাইছেন না।

এইভাবে দেশের একটা কাল্পনিক চিত্র আঁকা হতে থাকে, আর প্রচারিত হতে হতে সেটাই আসল বলে প্রতিপন্ন হয়। তার চেয়েও বিস্ময়কর আর মর্মান্তিক এক পরিণতি ঘটে: দেশের বহু মানুষ সেই মনোরম চিত্রে এত মজে যান যে নিজেদের কল্পনা থেকেই তেমন আঁকতে শুরু করেন, সরকারের বা সংবাদমাধ্যমের কষ্ট করতে হয় না। পরিযায়ী শ্রমিকদের বিবরণ সব সংবাদমাধ্যম তথা সমাজমাধ্যমে যথেষ্ট আলোচিত হয়েছে; তবু বহু লোকে সেটা দেখেও দেখতে নারাজ, তাঁদের মনগড়া আশ্বাসকর ব্যাখ্যায় বেদনাদায়ক ওই দৃশ্যগুলি সম্পূর্ণ মুছে দিতে পেরেছেন। মন্ত্রীমশায়ের মতো এই নাগরিকেরাও তাই নির্ভয়ে তাঁদের বাস্তববিরোধী দাবি করতে পারছেন।

বইয়ের গোড়া থেকে একটা তত্ত্বের উল্লেখ করছি: আমরা সরাসরি বাস্তবের সঙ্গে যোগস্থাপন করি না, বহির্বাস্তবের একটা মানসিক চিত্র বা প্রতিরূপের মাধ্যমে তাকে বুঝি। সাধারণ অবস্থায় দুটোর মধ্যে মিল থাকে, বাইরে যা আছে সেটা মোটামুটি সঠিকভাবে চেতনায় প্রতিফলিত হয় এবং ভাষায় প্রকাশ পায়। অনেক সময় কিন্তু দুটোর মধ্যে সংযোগ কেটে যায়, ফলে নির্দেশক সংকেত সঠিক জিনিসটা নির্দেশ করে না। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আমরা দেখেছি, ভাষা জিনিষটার মধ্যে স্বভাবতই একটা অনিশ্চয়তা অস্পষ্টতা আছে, একজন বলে এক অন্যজন বোঝে আর এক। সাদা মনে কথা বললেও এমন নিত্য ঘটে যায়; ঠকাতে চাইলে, বিভ্রান্ত করতে চাইলে তবে কী না হতে পারে। আর যে বলছে সে যদি নিজেই বিভ্রান্ত হয়? ব্যাপারটা কি দাঁড়াবে ইয়েটসের কবিতার সেই ছায়াবাজির মতো, আয়না থেকে আয়নায় নিরন্তর প্রতিফলন?

কতগুলি অসুখে লোকে এমন কিছু দেখে, শোনে বা ভাবে যার আসলে অস্তিত্ব নেই। সভ্যতার একটা অসুখ, আমরা বাস্তব আর তার উপলব্ধির মধ্যে যোগটা প্রায়ই কৃত্রিমভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিই। এভাবে খারাপ বা অপদার্থ লোকের কাল্পনিক সদ্গুণ, বা মহৎ লোকের কাল্পনিক অনাচারের কাহিনি ব্যাপক হারে জনমানসে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। কিংবা দেশ জুড়ে যুদ্ধের জিগির তুলে, বা কোনও বিশেষ জাতি-ধর্ম-গোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ জাগিয়ে, আর্থনীতিক বা অন্য অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে দেশবাসীর দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়া হয়— ব্যথা কমাবার ওষুধ যেমন ব্যথার স্থলে উপশম ঘটায় না, জায়গাটার সঙ্গে মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ব্যথার বোধ দূর করে।

আমার আলোচনায় বারবার ‘গল্পের’ প্রসঙ্গটা ফিরে এসেছে। আমরা দেখেছি, গল্প কেমন বাস্তব আর কল্পনার সীমানা পারাপার করে, দুটোকে সৃষ্টিশীলভাবে মিলিয়ে দেয় আবার গুলিয়ে ধাঁধিয়ে বিভ্রান্তি পাকায়, এবং ভাল মন্দ উভয় প্রয়োগে আমাদের জীবনে কতভাবে নাড়া দেয়। দেখেছি, পণ্য বিপণনের স্বার্থে গল্পের কেমন নিপুণ ব্যবহার হয়, পণ্য কিনে সেই গল্পের জগৎটা আমরা নিজেদের জীবনে বাস্তব করে তুলি। আরও গুরুতর প্রয়োগে দেখেছি, অতিকথার গল্পের আকর্ষণে রাষ্ট্রীয় জীবনের ব্যাখ্যান আমাদের পরম বিশ্বাসবস্তু ও আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। সেই ব্যাখ্যানের কিছু উপাদান পৌরাণিক, কিছু ঐতিহাসিক, কিছু তাত্ত্বিক— অর্থাৎ সবগুলিই খানিক দূরস্থ ও অস্পষ্ট।

এবার যা দেখব, তা হল রাষ্ট্রিক ব্যাখ্যানে (সেই সঙ্গে অন্যান্য ক্ষেত্রেও) নিকট সমসাময়িক পরিস্থিতি কেমন গল্পে পরিণত হচ্ছে: বাস্তব আর কল্পনা মিশছে একেবারে চাক্ষুষ স্তরে, দেশবাসীর দৈনিক জীবনের সুখদুঃখ ভালমন্দ নির্ধারণে। এই গল্পে প্রত্যক্ষ বাস্তবের বাছাই-করা উপাদান পুরোপুরি চালান হচ্ছে অবাস্তবের সীমানার ওপারে। তথ্যের সারবত্তা হাওয়ায় ভাসিয়ে একটা মেকি বাস্তবতা প্রতিষ্ঠা হচ্ছে: হান্না আরেন্ট ব্যাপারটাকে স্মরণীয়ভাবে বলেছেন ‘বিতথ্যকরণ’, defactualization।১১২ এই ছায়া-তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের বলা হচ্ছে দেশ বা দুনিয়া নিয়ে এমন ব্যাখ্যানে সায় দিতে ও তার রূপায়ণে অংশ নিতে যা আদতে বাস্তববিরোধী, ফলে তার রূপায়ণ সম্ভবই নয়। বহির্বাস্তব আর মানসিক চিত্রের মধ্যে যে বিচ্ছেদের কথা বলেছি, এটা তার সবচেয়ে প্রকট দৃষ্টান্ত।

অবাস্তব কথা লোকে মানবে কেন? একটা কারণ হতে পারে, ভয়ে। যে দেশে রাষ্ট্রীয় জীবনের বানানো গল্প সবচেয়ে জোর দিয়ে প্রচার করা হয়, সে রাজত্বগুলি প্রায়ই একচ্ছত্র ও দমনকারী। রাষ্ট্রিক অতিকথা এই ধরনের রাজত্বে সবচেয়ে প্রবলভাবে জাহির করা হয়, আর বর্তমান ও ভবিষ্যতের আদর্শায়িত চিত্র হয় সেই অতিকথার অংশ। ভারত সহ নানা দেশে রাষ্ট্রের প্রচার বা জনরবের বিরোধিতা করলে (এমনকী বিরুদ্ধমত পোষণ করলে) দণ্ডিত, নিগৃহীত এমনকী নিহত হবার আশঙ্কা আছে। রাষ্ট্রীয় অতিকথায় বিশ্বাস রাখা নাগরিক আনুগত্যের পরীক্ষা হিসাবে দেখা হয়; সেই অতিকথা বাস্তবের যত বিপরীতে যাবে, আনুগত্যের প্রমাণ তত অকাট্য হবে। মনে করুন পঞ্চম অধ্যায়ের গোড়ায় যিশুর সেই কথা, ‘যারা না দেখেও বিশ্বাস করে তারাই ঈশ্বরধন্য’, যদিও যিশু নিশ্চয় কথাটা এমন পরিস্থিতি ভেবে বলেননি।

এটাও কিন্তু ঠিক, কেবল দমন-পীড়নের দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনা করা সহজ বা সুখকর নয়, শেষ বিচারে নিরাপদও নয়। পাঁচশো বছর আগে মাকিয়াভেল্লি সূত্রটা ধরিয়ে দিয়ে গেছেন: প্রজাদের শাসককে ভয় পাওয়া দরকার, কিন্তু শাসক যেন তাদের ঘৃণা বা বিদ্বেষের উদ্রেক না করেন, বরং সচেষ্ট হন সুখী করে তাদের সমর্থন পেতে।১১৩ বিচক্ষণ শাসক চাইবেন, প্রজারা নিজে থেকেই অতিকথায় সায় দিক; রাষ্ট্রের বয়ানে কাঁচা অসত্য বা বিভ্রান্তি থাকলেও তা কেবল অগ্রাহ্য নয়, সক্রিয়ভাবে গ্রহণ করুক। স্বৈরাচারী শাসন তখনই পোক্ত হয়, প্রজারা যখন স্বেচ্ছায় এমনকী আগ্রহের সঙ্গে সেই স্বৈরাচার মেনে নেয়।

একচ্ছত্র শাসন সম্বন্ধে হান্না আরেন্টের অভিজ্ঞতালব্ধ বিবরণ এখানে প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক। আরেন্ট বলছেন, স্বৈরাচারী শাসকের ক্ষমতার আসল ভিত্তি মারকুটে লেঠেলবাহিনী নয়, শান্তিপ্রিয় নির্বিকার রক্ষণশীল নাগরিকগোষ্ঠী। তারা চায় ধরাবাঁধা নির্ঝঞ্ঝাট জীবন, অবান্তর চিন্তা আর উটকো ঝামেলা এড়িয়ে। তাই রাষ্ট্রের বশ্যতা তারা আগ্রহের সঙ্গে স্বীকার করতে রাজি: জটিল বাস্তবের চেয়ে সহজ সরল সংগতিপূর্ণ একটা মিথ্যার জগৎ (‘lying world of consistency’)১১৪ মেনে নিতে পারলেই তাদের স্বস্তি। ফলে তাদের মানসিক জগৎ হয়ে পড়ে এক সোনার পাথরবাটি, ‘কাল্পনিক বাস্তব’ (‘fictitious reality’),১১৫ আসল নয় কিন্তু ভাবা যায় আসল। আরেন্টের পরবর্তীকালে অর্থাৎ আজকের পৃথিবীতে তার প্রকোপ এত বেড়েছে যে তার একটা নাম চালু হয়েছে: post-truth, উত্তরসত্য। উত্তরসত্যের সঙ্গে অতিকথার প্রচুর যোগ আছে; বিশেষত রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে অতিকথার প্রয়োগে উত্তরসত্য একটা অপরিহার্য অনুষঙ্গ বলা চলে।

আরেন্ট আরও বলছেন, অধিকাংশ প্রজা যেখানে এই অবাস্তব জগৎ মেনে নিতে উদ্গ্রীব, রাষ্ট্রের তাদের উপর খবরদারি করতে হয় না; মুষ্টিমেয় প্রতিবাদীর উপর নেমে আসে রাষ্ট্ররোষ, তাদের ফাঁসাবার জন্য ফাঁদা যায় যে কোনও গল্প (‘story’)১১৬— তাও হয়ে পড়ে ‘কাল্পনিক বাস্তবের’ অংশ। সেটা বিশ্বাসযোগ্য না হলে ক্ষতি নেই— বরং মিথ্যা গল্পের ফাঁদেও যে কাউকে ফাঁসিয়ে দেওয়া যায়, সেটা অনেক বেশি ভীতিপ্রদ বার্তা। পাশাপাশি চলে আর এক প্রস্থ গল্পের চাষ— রাষ্ট্রের চাহিদামতো নতুন করে ইতিহাস রচনা, যেমন আরেন্টের দুই বিখ্যাত উদাহরণে, হিটলার আর স্তালিনের জমানায়।

সবচেয়ে বড় কথা, এই কল্পনা বা অতিকথা অঙ্গীভূত হয় রাষ্ট্রের বর্তমান কর্মকাণ্ডে। ফলে— পুরো প্রক্রিয়াটার সবচেয়ে উজ্জ্বল ও মর্মান্তিক সাফল্য— কল্পনা সত্যিই বাস্তবায়িত হয়, গল্প সত্য হয়ে ওঠে। আরেন্টের চরম (অবশ্যই কল্পিত) উদাহরণ: বলা হল ‘শ্রীমতী স্মিথ মারা গেছেন’, আর কথাটা সত্য প্রতিপন্ন করার জন্য তাঁকে খুন করা হল।১১৭ সত্যের স্বাভাবিক ধর্ম অনুসরণ করে অবশ্যই এমন হতে পারে না; এটাকে বলা যেতে পারে কৃত্রিম বা নির্মিত সত্য। সেটাও সোনার পাথরবাটি, উত্তরসত্যযুগে খাঁটি সত্যের বিকল্প।

আর একটা বিকল্পকে বলা যায় ঝুটো সোনার পাথরবাটি। এক্ষেত্রে শ্রীমতী স্মিথ মারা যান না, মিথ্যা প্রচারের দ্বারা মানুষকে তেমন বোঝানো হয় কেবল। তাতে খুনের পাপ থেকে রেহাই পাওয়া যায়, কিন্তু মিথ্যাভাষণের অপরাধ বেড়ে যায়। এটাই উত্তরসত্যের মার্কামারা কৌশল: অসত্যের মিশ্রণে বাস্তবের অনুপাত কমতে কমতে শূন্যে ঠেকে, আর সেই ‘নির্ভেজাল ভেজাল’ রাষ্ট্রীয় তথা সামাজিক অতিকথায় অক্লেশে মিশে যায়। এমন কীর্তি বোঝাতে উদ্ভাবন হয়েছে এক কৌতুককর শব্দ, truth-making, সত্যকে তৈরি করা বা বানানো। এই বইয়ে নানা প্রসঙ্গে নির্মাণের কথা উঠেছে, বিশেষ করে গল্প বা আখ্যানের কথা। সেই গল্প যে বাস্তব ও কল্পনার সংমিশ্রণে গড়ে ওঠে, তাও বারবার দেখা গেছে। সে সব পিছনে ফেলে এবার পৌঁছনো গেল এক বিচিত্র ভাবনায়, সত্যি কথা বানিয়ে বলা!

এমন কেরামতির চূড়ান্ত সাফল্য আসে যখন যার সম্বন্ধে মিথ্যা বলা হচ্ছে, সে নিজেই কথাটা বিশ্বাস করে— যেন শ্রীমতী স্মিথ নিজেই ভাবছেন তিনি মারা গেছেন। ইনগ্রিড বের্গমান অভিনীত গ্যাসলাইট ছবির নামে জন কীন এই কৌশলটার নাম দিয়েছেন ‘গ্যাসলাইটিং’।১১৮ ছবিতে এক স্বামী তাঁর স্ত্রীকে বিশ্বাস করাতে চাইছেন যে তিনি, অর্থাৎ সেই মহিলা, পাগল হয়ে গেছেন। স্বৈরাচারী রাষ্ট্রে তেমনি নাগরিকের মনে নিজের ও নিজের পরিপার্শ্ব সম্বন্ধে এমন সন্দেহ ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যে সে কোনও কিছুতেই ভরসা রাখতে পারে না, নিজের কোনও উপলব্ধি সঠিক বলে নিশ্চিত হতে পারে না। তাকে আবোলতাবোল স্ববিরোধী অনেক কিছু বলা হয়, আবার কিছুই বলা হয় না বিভ্রান্তি ঘোচাতে; শেষে উদ্ভ্রান্ত হয়ে সে মেনে নেয় সে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না— অতএব রাষ্ট্র তাকে যা খুশি বোঝাতে পারে।

ব্যাপারটা বুঝতে সাহায্য করবে অপসত্যের কারবারের এক ক্লাসিক কল্পকাহিনি, জর্জ অরওয়েলের উপন্যাস নাইনটিন এইটি-ফোর। ১৯৪৯এ প্রকাশিত এই কাহিনির কল্পিত ঘটনাকাল ছত্রিশ বছর আগে পেরিয়ে গেছে। অরওয়েল লিখছিলেন অপপ্রচারের দুই কুশীলবকে মাথায় রেখে, হিটলার আর (তখনও জীবিত) স্তালিন। অরওয়েলের কল্পিত রাষ্ট্রে প্রচারমন্ত্রকের নাম ‘সত্যমন্ত্রক’, ‘মিনিস্ট্রি অভ ট্রুথ’। তার প্রবেশপথে খচিত রাষ্ট্রীয় ব্যাখ্যানের তিনটি মূল নীতি: ‘যুদ্ধই শান্তি। মুক্তিই দাসত্ব। অজ্ঞানতাই শক্তি।’১১৯ বিপরীতের এই মেলবন্ধনের চাবিকাঠি রাষ্ট্রের প্রচারিত ‘নতুন ভাষা’ বা নিউস্পীক-এর একটা মোক্ষম শব্দ, ‘কালোসাদা’ (blackwhite)। এই একটি শব্দে নিহিত আছে দুটি বিপরীত কিন্তু পরিপূরক সূত্র: এক, দলের সদস্যদের মধ্যে যদি কালোকে সাদা বলা হয়, সেটাই মেনে নেবে; দুই, প্রতিপক্ষের সামনে সাদা জিনিস দেখলে জোর গলায় সেটা কালো বলবে।১২০

এ তো গেল গালগল্প। তবে বাস্তব থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন নয় বোধহয়, হিটলার-স্তালিনের পর ধারাটা অবলুপ্ত হয়েছে তাও বলা চলে না। উত্তরসত্যের নজির ইতিহাস জুড়ে মিলবে, কিন্তু তা নিয়ে তাত্ত্বিক চর্চা কবে শুরু হল? যুগে যুগে ‘সত্য’ ব্যাপারটা নিয়ে দার্শনিকেরা অনেক গভীর চিন্তা করেছেন। কান্ট আর নীট্‌ঝ়ের মতো মনীষীদের নাম উত্তরসত্যের আলোচনায় চলে এসেছে।১২১ এঁদের চিন্তা কিন্তু চেতনা বা উপলব্ধির তারতম্য নিয়ে, পরিকল্পিত অসত্য নিয়ে নয়। তারও অনেক আগে, ষোলো শতকের দার্শনিক ও প্রাবন্ধিক মঁতায়েন সত্যের একটা তাকলাগানো নতুন সংজ্ঞার প্রস্তাব করেছিলেন, যার সঙ্গে উত্তরসত্যের আপাত মিল কিন্তু আসলে মৌলিক প্রভেদ। আমরা ভাবি সত্য হল অভিন্ন ও স্থিতিশীল। মঁতায়েন কিন্তু বলছেন, কোনও জিনিসই স্থিতিশীল নয়, আর এই যে আমি সেগুলো দেখছি আমিও নই। অতএব সত্য হল বিচিত্র ও অনিত্য: আমি যা দেখছি বা মনে করছি, সেটাই আমার কাছে এই মুহূর্তে সত্য, তবে আর কারও কাছে নয়, আমার কাছেও অন্য সময়ে নয়।১২২ মঁতায়েন সত্যকে কৃত্রিমভাবে সরল করতে রাজি নন, মনগড়া কিছু বলার তো প্রশ্নই ওঠে না। তাঁর ‘মিথ্যা’র সংজ্ঞা আগে উল্লেখ করেছি: মিথ্যা হল, আমি যা সঠিক বলে জানি তার অন্যরকম কিছু বলা। তাঁর ব্যক্তিসিদ্ধ পরিবর্তনশীল সত্যের বয়ান তাই মিথ্যা তো নয়ই, বরং বিশেষভাবে খাঁটি— উত্তরসত্যের ঠিক উলটো।

সি জি প্রাদোর কথায়, উত্তরসত্যও বস্তুনিষ্ঠ খাঁটি সত্যের বদলে আপেক্ষিক ব্যক্তিনির্ভর একটা দাবি।১২৩ কিন্তু মঁতায়েনের দার্শনিক আপেক্ষিকতার সঙ্গে তার আসমান-জমিন ফারাক। মঁতায়েনের সত্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বাস্তবকে অনুসরণ করে, বাস্তব বদলালে সত্যের স্বরূপও বদলায়। উত্তরসত্য কিন্তু কোনও অবস্থাতেই বাস্তব সত্যকে প্রতিফলিত করে না; প্রাদো তাই বলছেন, উত্তরসত্য হল সত্যের সংজ্ঞার চরম অবনমন। উত্তরসত্যের উপপাদ্য ‘যা নয় তাই’: মত বা দৃষ্টিভঙ্গির স্তরে নয়, আক্ষরিক তথ্যের স্তরে অসত্য। শুধু তাই নয়, এই মিথ্যা ছড়ানো হয় জেনেশুনে, পরিকল্পিত ভাবে।১২৪ সাদা মনে ভুল খবর ছড়ালে তাকে উত্তরসত্য বা ‘জাল খবর’ (ফেক নিউজ) বলা উচিত নয়, বাজারি গুজবকেও নয়; যদিও মানতে হবে, বহু গুজব ঠান্ডা মাথায় চক্রান্ত করে রটানো হয়। প্রায়ই বলা হয়, উত্তরসত্যে নিজের ইচ্ছা বা সুবিধামতো কোনও কিছুকে সত্য বলে মানা হয়, যদিও তা বাস্তবসম্মত নয়। প্রথম অধ্যায়ে দেখেছি কোনও শব্দ, বিশেষত কোনও মূল্যবাচক বা ভাববাচক শব্দ, বিভিন্ন লোকে বিভিন্ন ভাবে গ্রহণ করে: ‘বুদ্ধিমান লোক’ কিংবা ‘সুন্দর জায়গা’ কিংবা ‘অনেক টাকা’ সকলের কাছে এক জিনিস বোঝায় না। কিন্তু এতো গেল বিচার, রুচি বা অনুমানের ব্যাপার। অসংগতিটা যখন আক্ষরিক পর্যায়ে পৌঁছয়, সোজাসুজি কালোকে সাদা, দিনকে রাত প্রতিপন্ন করার চেষ্টা হয়, তখন বলতে হবে সত্য কোন ছার, ব্যাপারটা আদৌ গ্রাহ্য উপলব্ধির পর্যায়ে নেই, ওটা উত্তরসত্যের মায়ার বিস্তার।

যে-কোনও শাসক দল নিশ্চয় বলতে চাইবে, তাদের রাজত্বে সব কিছু খুব ঠিকঠাক চলছে। এতে তাদের মন ভাল থাকবে, আত্মবিশ্বাস বাড়বে; সবচেয়ে বড় কথা, জনগণ এমন ভাবলে তবেই তাদের আগামী নির্বাচনে ভোট দেবেন। একটু আগে দেখলাম, ভক্ত নাগরিকেরাও মনের আরামের জন্য এমন ভাবতে চাইবেন। যা হওয়া উচিত যুক্তি-তথ্যের বিচার, প্রচারক ও গ্রাহক উভয়ের দৃষ্টিতেই অতএব তা স্বার্থতাড়িত বিশ্বাসের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এটা সবসময় মিথ্যাভাষণ বলা চলে না, হতে পারে সত্যিই তাঁরা (অন্তত নাগরিকেরা) নিজেদের এমন বুঝিয়েছেন। কিন্ত তাঁদের ব্যক্তিগত আবেগতাড়িত অবস্থানের বাইরে ব্যাপারটার অস্তিত্ব নেই। ২০১৬ সালে মার্কিন নির্বাচনের সময় ডনাল্ড ট্রাম্পের এক সহায়ক সাংবাদিককে বলেছিলেন: ‘ওঁর কথা এত আক্ষরিকভাবে নেওয়ার কী আছে? উনি মুখে কী বলছেন তা নয়, ওঁর মনে কী আছে সেটা দেখুন।’১২৫

অসত্য এভাবে মান্যতার সিলমোহর পেয়ে যাচ্ছে, কালো টাকা সাদা করার মতো। ফলে মিথ্যা ধারণাটা কাজে বাস্তবায়িত হচ্ছে, অর্থাৎ এক অর্থে (হয়তো সব অর্থেই) সত্য হয়ে উঠছে। সাম্প্রতিক ইতিহাসে এর কুখ্যাত উদাহরণ ইরাক যুদ্ধের সাফাই হিসাবে ইরাকের হাতে গণনিধনের অস্ত্র (weapons of mass destruction) মজুত থাকার দাবি। কৌতূহলের বিষয়, এই দাবির সবচেয়ে পরিচিত উচ্চারণ যুদ্ধের প্রধান কুশীলব মার্কিন দেশের কোনও সূত্র নয়, ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টোনি ব্লেয়ারের জবানবন্দি। যুদ্ধের শেষে দেখা গেল— অনেকে যা আগেই বলেছিলেন— এই দাবি একেবারে অসার, এমন কোনও অস্ত্র ইরাকের হাতে ছিল না। দাবির সমর্থনে যে নথি পেশ হয়েছিল, পরবর্তী তদন্তে সেগুলি নিয়ে প্রবল সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। ব্লেয়ার কিন্তু কিছু খুচরো ভুলত্রুটি মানলেও যুদ্ধে নামার মূল সিদ্ধান্ত নিয়ে কখনও ভুল স্বীকার করেননি বা অনুশোচনা প্রকাশ করেননি; বরং অদ্যাবধি বলে আসছেন যে তাঁর হাতে যে তথ্য ছিল, তার ভিত্তিতে তিনি সরল বিশ্বাসে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। এক বক্তৃতায় কথাটা বলেছেন বিচিত্রভাবে: ‘আমি যা বিশ্বাস করি, কেবল সেটুকুই জানি’ (‘I only know what I believe’)।১২৬ আমার উপরের আলোচনার বড় চমৎকার দৃষ্টান্ত।

ব্লেয়ারের মনে কী ছিল ব্লেয়ারই জানেন। ভূল ধারণাবশত ইতিহাসে অনেক যুদ্ধ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে যা বিশেষ তা হল ইরাকের কাল্পনিক মারণাস্ত্র নিয়ে দুনিয়াভর প্রচারের ঝড় বয়ে গিয়েছিল, কাঠখড় পুড়িয়ে বিশ্বের মানুষকে বোঝানো হয়েছিল সেই অস্ত্র সত্যি মজুত আছে। অর্থাৎ এটা কেবল ভুল নয়, ভেবেচিন্তে গল্প ফাঁদা, অতিকথা সৃষ্টি— ইরাক সম্বন্ধে আগে থেকে পাশ্চাত্যে যে নেতিবাচক বিদ্বেষপ্রসূত অতিকথা ভাসছিল তার চূড়ান্ত পর্যায়।১২৭ তার আড়ালে আগ্রাসী দেশগুলির আর কী স্বার্থ ছিল তা আজও বিতর্কের বিষয়। সাদ্দাম হোসেন নাহয় সত্যিই স্বৈরাচারী শাসক ছিলেন, কিন্তু এ বিতর্কে সেটা প্রায় অবান্তর (ব্লেয়ার যদিও পরে আত্মপক্ষ সমর্থনে সেই যুক্তি পেড়েছেন)। এক কথায়, যুদ্ধ ঘোষণার ভিত্তি ছিল কেবল বৈরিতা নয়, মিথ্যা ও জাল তথ্য, এবং সেই মর্মে বিশ্বব্যাপী রব বা গুজব। এমন রব, বিশ্বাস বা অতিকথা, যার বাস্তব ভিত্তি অনিশ্চিত বা অনুপস্থিত কিন্তু যা মানুষের মন অধিকার করে বাস্তব বলে স্বীকৃত হয়, সেটাই উত্তরসত্য। পঞ্চম অধ্যায়ে আমরা দেখেছি, সৎ বিশ্বাস অধিষ্ঠিত হয় বলে কয়ে যুক্তি-তথ্যের অতীত একটা স্তরে, তাও প্রায়ই যুক্তি-তথ্যের অল্পবিস্তর সাহায্যে। এখানে কিন্তু বিশ্বাসবস্তুটা বাস্তব তথ্যের ছদ্মবেশ ধরে আসছে, তথ্যের মান্যতা দাবি করে আমাদের ঠকাচ্ছে।

এর ফলে দেখা দেয় উত্তরসত্যের সবচেয়ে ভয়াবহ লক্ষণ, হান্না আরেন্টের চিন্তায় যার ইঙ্গিত ছিল: ভ্রান্ত বিশ্বাস (নাকি তার মিথ্যা দাবি?) কাজে রূপায়িত হয়, সুতরাং বাস্তবের নিরিখে মিথ্যাটা সত্যের স্বীকৃতি পায়। একবার যুদ্ধ বাধলে বুশ-ব্লেয়ারের বিচার ঠিক কি ভুল ছিল তা অবান্তর হয়ে পড়ল, কারণ সেটাই হয়ে দাঁড়াল বাস্তব সত্য অতএব ‘ঠিক’। বুশ সরকারের এক আধিকারিক বলেছিলেন, ‘আমরা যখন কাজে নামি, নিজেদের বাস্তব নিজেরাই তৈরি করি।’১২৮

শুধু নৈতিক নয়, বৌদ্ধিক মূল্যবোধও এভাবে বিধ্বস্ত হয় জেদ ও অনাচারের কাছে। নৈতিক বিপর্যয় নাহয় সব যুদ্ধ-বিগ্রহের অঙ্গ, যুদ্ধ ব্যাপারটাই মানবিক বিচারে দূষণীয়; বৌদ্ধিক বিপর্যয়টা উপরি পাওনা। না ভেবেচিন্তে বা ভুল ভেবেচিন্তে যুদ্ধে নামার কথা বলছি না— সেটা চিরকাল হয়ে আসছে। বাড়তি ব্যাপার হল, যে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সচরাচর যুদ্ধ ঘোষণা হয়, সেই ভিত্তিটা পরিকল্পিতভাবে অসার অবান্তর করে দেওয়া, সেটা সত্য না মিথ্যা সেই প্রশ্নটাই কাটিয়ে যাওয়া: আমাদের যুদ্ধ করার ইচ্ছা হয়েছে, সেই ইচ্ছা অনুসারে একটা গল্প খাড়া করে লড়াইয়ে নামলাম। এটাও নিশ্চয় নতুন নয়, যুদ্ধবাজ রাজা-রাজড়া চিরকাল এমন করে এসেছেন; তবে এত খোলাখুলি তথ্যের প্রতিকূলে যাওয়া, অথচ একই সঙ্গে তথ্যনিষ্ঠ বলে নৈতিক মান্যতা দাবি করা অসাধারণ তো বটেই।

আগের যুগে তথ্য এত সহজলভ্য ছিল না; ফলে মিথ্যাটা ধরা পড়ত না, জবাবদিহির প্রশ্ন উঠত না। তা ছাড়া যতই বলি গণতন্ত্র আজ বিপন্ন, অল্পবিস্তর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অধিকাংশ দেশে চালু আছে, তার একটা মহড়া বজায় রাখতে হয়। ফলে অনাচারের সাফাই গাইতে আজ নতুন কৌশল ভাবতে হচ্ছে, উত্তরসত্যের চাষ যার মধ্যে প্রধান। এটা জনগণেশের জয় বলে উৎফুল্ল হবার অবকাশ নেই, কারণ এর ফলে অসত্য ও অপযুক্তি রাষ্ট্রীয় এমনকী আন্তর্জাতিক স্তরে মান্যতা পেয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি মান্যতা পাচ্ছে উপরোক্ত কারণে, যে এগুলি বাস্তবে রূপায়িত হচ্ছে; ফলে এদের কার্যকারিতা, অতএব গ্রহণীয়তা, শেষ অবধি স্বীকার না করে উপায় থাকছে না। অবাস্তব হয়ে উঠছে বাস্তব, কুযুক্তি হচ্ছে যুক্তিসংগত, অন্যায় হচ্ছে ন্যায়সিদ্ধ।

ভুল তথ্যের দৃষ্টান্ত দেখলাম। এবার শব্দের অর্থহরণ আর অপযুক্তির নজির দেখা যাক। তার ভরপুর খনি ইজরায়েল-পালেস্তাইন বিরোধ মেটাতে ট্রাম্পের ‘শান্তি থেকে সমৃদ্ধির’ প্রস্তাব,১২৯ যা কেবল ইজরায়েলের প্রতি ঘোরতর পক্ষপাতদুষ্ট নয়, আন্তর্জাতিক ন্যায়ালয়ের রায়ের বিরোধী। (এই রায়ের উল্লেখমাত্র নথিতে নেই।) প্রস্তাবটির শর্তাবলি এখানে আলোচ্য নয়; আমার লক্ষ্য কেবল ভাষা ও যুক্তির দু’ একটা দিক। নথির তরল একপেশে প্রচারধর্মী ভাষা বাদ দিলাম, যদিও তা প্রচলিত কূটনৈতিক বয়ানের সম্পূর্ণ বিপরীত; তবে শব্দের অর্থহরণের এক বিচিত্র নজির না দেখলেই নয়। ইজরায়েল ও পালেস্তাইনকে সমমানের দুটি রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার পরিকল্পনা অদ্যাবধি নিষ্ফল হলেও বহুদিন আলোচিত; বর্তমান প্রস্তাবের লক্ষ্য, সেটা বাতিল করে পালেস্তাইনকে কার্যত ইজরায়েলের অধীনস্থ উপরাষ্ট্রে পরিণত করা। সুতরাং পালেস্তাইনের sovereignty বা সার্বভৌমত্বের দাবিটা নিষ্ক্রিয় করা চাই। সেইমতো প্রস্তাবে বলা হচ্ছে: ‘সার্বভৌমত্বের ধারণার কোনও নির্দিষ্ট রূপ নেই। … ওটা সুস্থিত সংগতিপূর্ণ ধারণা বলে ভাবার ফলে অতীতে অনেক আলোচনা অনাবশ্যকভাবে হোঁচট খেয়েছে। তার চেয়ে বেশি জরুরি, নিরাপত্তা আর সমৃদ্ধি নিয়ে বাস্তবসম্মত কার্যকর চিন্তাভাবনা।’১৩০ আগে যাকে ফাঁপা ভাষা বলেছি, এটা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

একটু পড়লেই প্রকট হয়ে ওঠে প্রস্তাবটির অপযুক্তি ও দ্বিচারিতা। একদিকে বলা হচ্ছে, বর্তমান স্থিতাবস্থা (status quo) অসার ও পরিত্যাজ্য: কেবল স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীরাই তা সমর্থন করবে।১৩১ অথচ পালেস্তাইনের জমিতে ইজরায়েলের বর্তমান বেআইনি দখলকে মান্যতা দেওয়া হচ্ছে, এমনকী জেরুসালেম শহরের বর্ধিষ্ণু অংশের উপর পালেস্তাইনের দাবি নাকচ করে তার বদলে তাকে দেওয়া হচ্ছে মরুভূমির কিছু অংশ, যার আয়তন নিয়েও বিতর্ক: এক জায়গায় বর্তমান এলাকার ‘অনেক বেশি’, আধ পাতা বাদেই ‘মোটামুটি সমান’১৩২— কারণ এক জায়গায় ধরা হচ্ছে যতটা জমি পালেস্তাইনের দখলে, অন্যখানে আইনত যতটা তার প্রাপ্য। এক কথায়, পুরো প্রস্তাব জুড়ে অতীত আর বর্তমান, বিধান আর বাস্তব, ভৌগোলিক দখল আর আইনি মালিকানার দাবি গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই ইচ্ছাকৃত বিভ্রান্তির আড়ালে যে কুযুক্তি, তর্কশাস্ত্রে তাকে বলে অব্যাপ্য মধ্যপদের ভ্রান্তি, fallacy of the undistributed middle— আলাদা আলাদা জিনিসকে এক করে দেখিয়ে সেই ভিত্তিতে ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছনো। এক্ষেত্রেও কিন্তু আরেন্টের অনুমান ফলে যাবে। প্রস্তাবটা একবার রূপায়িত হলে সেটাই হবে অনস্বীকার্য অবস্থান: অপযুক্তিটা বাস্তবসিদ্ধ, অতএব ‘ঠিক’, হয়ে যাবে।

একই গোত্রের কুযুক্তি সম্প্রতি দেখা গেল কোভিড মহামারির পর ত্রাণ ও পুনর্নির্মাণে ভারত সরকারের প্রায় ২১ লক্ষ কোটি টাকার বরাদ্দ ঘোষণায়, যা কিনা জাতীয় আয়ের দশ শতাংশ। একের পর এক বিশিষ্ট অর্থবিদ ও অর্থসংস্থা দেখিয়েছেন, ওই অঙ্কের মধ্যে ধরা আছে (১) পূর্বে (এমনকী মহামারির পূর্বে) ঘোষিত প্রকল্পের পুনরুক্তি; (২) এমন প্রকল্প যার সঙ্গে মহামারির ত্রাণের সম্পর্ক নেই; (৩) সরকার নয়, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক প্রমুখ অন্য সংস্থার বরাদ্দ; (৪) নানা ব্যক্তি ও সংস্থাকে প্রস্তাবিত ঋণ, সরকার যার জামিনদার মাত্র। এই অঙ্কগুলি বাদ দিলে সরকারের ভাণ্ডার থেকে সত্যি যেটুকু ব্যয় হবে, তা জাতীয় আয়ের কমবেশি এক শতাংশ।

আর্থিক ও প্রশাসনিক বিচার আমার আলোচ্য নয়; সুতরাং মহামারি ও তৎসহ শাসনবিপর্যয়ে যাঁরা সত্যিই সর্বনাশের মুখে, এই বরাদ্দ থেকে তাঁদের কতটুকু লাভ হবে, সে প্রশ্নে যাচ্ছি না। কিন্তু বৌদ্ধিক কৌশলটাও দুর্ভাগ্যজনক: নানা খাতে নানা অঙ্কের টাকা, যার উৎস ও উদ্দেশ্য ভিন্ন ভিন্ন, জারিজুরি করে এক হিসাবের আওতায় আনা হল, দেশবাসীকে বোঝানো হল সবটাই ত্রাণের জন্য। বিশাল বিশাল সংখ্যার মহিমায় দেশবাসী বিমুগ্ধ হলেন, তার আড়ালে হলেন বিভ্রান্ত: অঙ্কগুলি ভিন্ন সূত্রে পাওয়া, ভিন্ন কাজে বরাদ্দ— সবগুলো এক হিসাবে থাকারই কথা নয়। একটা গোরু, একটা ঘোড়া আর একটা মহিষ যোগ করলে তিনটে হাতি হয় না— কিছুই হয় না, যোগ করা অর্থহীন। এটা গণিতের নয়, সাধারণ যুক্তিবোধের বিপর্যয়।

উত্তরসত্যের স্বীকৃত প্রতিষ্ঠা (অস্তিত্ব হয়তো চিরকাল ছিল) একাধারে নীতিতত্ত্ব বা ethics এবং জ্ঞানতত্ত্ব বা epistemologyর একটা অশুভ যুগ্ম বিপ্লব। আগের অধ্যায়ে বলেছিলাম যে নিষ্ঠাবান বৌদ্ধিক চর্চার একটা নৈতিক মাত্রা আছে। নিরপেক্ষভাবে তথ্য বেছে যাচাই করতে হয়, সতর্ক ও নিরপেক্ষভাবে যুক্তি দিয়ে সাজাতে হয়: এক কথায়, পাঠক বা শ্রোতা যাতে বিভ্রান্ত না হন, তা দেখতে হয়। অথচ উত্তরসত্যের মর্মকথাই হল ফাঁকি: সোজা কথায়, তাতে মানুষকে ঠকানো হয়— এক-আধজন মানুষ নয়, দেশকে দেশ, শেষ অবধি সারা দুনিয়া। এমনটা কেবল ঘটতে পারে না, ঘটতে বাধ্য: সেটাই উত্তরসত্যের চরিত্র।

সেই সঙ্গে রাষ্ট্রচিন্তার নৈতিক মূল্যায়নেও একটা বিপ্লব এসেছে: এটা উত্তরসত্যের সবচেয়ে আলোচিত দিক। একটা বিপ্লব এসেছিল ষোলো শতকে মাকিয়াভেল্লির আমলে: যে সব অনৈতিক কাজ, হিংসা স্বৈরাচার মিথ্যাচার, রাজপুরুষেরা চিরকাল করে আসছেন, সেগুলি শাসনতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বলে খোলাখুলি স্বীকার করা হল। ঠিক নৈতিকভাবে ভাল বলা হল না, কিন্তু শাসনকার্যে অপরিহার্য বলা হল— যে শাসনের উদ্দেশ্য হয়তো অন্য বিচারে উপকারী এমনকী মহৎ। একুশ শতকে উত্তরসত্যের তত্ত্ব সাজিয়ে আর এক প্রস্থ অনৈতিক শাসনকে বৌদ্ধিক মান্যতা দেওয়া হল, সেজন্য যুক্তিপন্থার স্বীকৃত প্রণালী জলাঞ্জলি দেওয়া হল। ষোলো শতকের পরিবর্তনে এমন বৌদ্ধিক বিপর্যয় ঘটেনি, বরং যুক্তিবিচার ও তথ্যপ্রমাণ ছিল মাকিয়াভেল্লির চিন্তার স্তম্ভ। সেখানে বেশি বিপদ ছিল সরাসরি নৈতিক বিকারের, আজ উত্তরসত্যের ক্ষেত্রে বৌদ্ধিক বিকারের। সেটা ঘটলে মিথ্যাচারের নৈতিক স্বীকৃতি— প্রশস্তি না হলেও কার্যকরভাবে গ্রহণ, তারপর অনুমোদন— সময়ের অপেক্ষায় মাত্র।

আরও বড় বিপদের সম্ভাবনা আছে। মাকিয়াভেল্লির চিন্তাবিপ্লব রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে আবদ্ধ ছিল; তাঁর তত্ত্ব তিনি বৃহত্তর সামাজিক জীবনে খাটানোর চেষ্টা করেননি, ব্যক্তিগত সম্পর্কে তো নয়ই। কিন্তু ষোলো শতক শেষ হতে না হতেই সামাজিক জীবনে, মানুষে-মানুষে সম্পর্কে তার প্রয়োগ দেখা যেতে লাগল। এই প্রসারে ফ্রান্সিস বেকনের একটা বড় ভূমিকা ছিল। উত্তরসত্যের প্রসার ঘটেছে উলটো পথে। উত্তরসত্য দৃষ্টি আকর্ষণ করে রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির আসরে, বিশেষত কিছু দেশনেতাকে ঘিরে, সারা বিশ্বে যাঁদের মুখ্য হলেন ডনাল্ড ট্রাম্প। উত্তরসত্যের আদি চাষ কিন্তু সামাজিক বিকার-বিদ্বেষের জমিতে, সেখান থেকে তার প্রতিরোপণ রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে। অর্থাৎ আবার দেখা যাচ্ছে, বিকারটা রাষ্ট্র জোর করে দেশবাসীর উপর চাপিয়ে দিচ্ছে না, দেশবাসীর অনুকূল মনোভাব এমনকী উৎসাহের ফলেই রাষ্ট্র উত্তরসত্য অবলম্বন করতে পারছে।

সামাজিক স্তরে উত্তরসত্যের প্রকোপ সবচেয়ে উৎকটভাবে দেখা যায় কোনও জাতি বা সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষে। নাৎসি জার্মানির ইহুদিনিধন অবশ্যই এর চরম দৃষ্টান্ত। পরবর্তীকালে হয়তো সবচেয়ে কাছাকাছি এসেছে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময়, ১৯৯০এর দশকে বসনিয়া আর রোয়াণ্ডায়, এবং বর্তমানে মায়ানমারে রোহিঙ্গিয়াদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক হিংসায়। এমন জাতিনিধন বা গণহত্যা অবশ্যই একটা বিশেষ ভয়াবহ স্তরে, আর কিছুর সঙ্গে তুলনা হয় না। কিন্তু ‘স্বাভাবিক’ সমাজগত ক্ষেত্রে আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের চিরাচরিত বিদ্বেষ, সেই সঙ্গে স্প্যানিশভাষী লাতিনোদের প্রতি (বিশেষ করে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আগত পরিযায়ীদের প্রতি ট্রাম্প শিবিরের) বিদ্বেষ, আর অপর দিকে আজকের ভারতে মুসলিমবিদ্বেষের মধ্যে কিছু উদ্বেগজনক মিল পাওয়া যায়। উভয় দেশে নিশানা-করা সম্প্রদায়কে একজোটে নানা সম্ভব-অসম্ভব অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়— খুন, চুরি-রাহাজানি ইত্যাদি তো বটেই, সবচেয়ে স্পর্শকাতর যে অপরাধ সেই ধর্ষণ। ভারতে অল্প দিন আগে উদ্ভটভাবে ব্যাপক আগ্রাসী ধর্ষণের চক্রান্ত আরোপ করা হয়েছিল একটি আন্দোলনের উপর, যার নেতৃত্ব ও প্রধান সদস্যবৃন্দ সকলে নারী। আর একটা আজব ভীতিও উভয় দেশে উসকে দেওয়া হয়, যে এই সংখ্যালঘুর দল প্রবল হারে বংশবৃদ্ধি করে অচিরে সংখ্যাগুরুদের হটিয়ে দেশের দখল নিয়ে বসবে।

বলা বাহুল্য, এই ভীতি ও অভিযোগ চরম অবাস্তব: হয় একেবারে কাল্পনিক, নয় তথ্য বিকৃত করে খাড়া হয়েছে, একটু তলিয়ে দেখলেই ফাঁকি ধরা পড়ে। ভিন্ন মহাদেশের দুই দেশে, সম্পূর্ণ ভিন্ন আর্থিক, সামাজিক ও জনতাত্ত্বিক পরিবেশে যদি বিদ্বেষের রূপ এতটাই এক ধরনের হয়, মনে হতে বাধ্য যে এর ভিত্তি বাস্তব নয় মনগড়া, হয়তো মনুষত্বের কোনও মৌলিক বিকার। মনস্তাত্ত্বিক আর নৃতাত্ত্বিকরা ভালই জানেন, অতিকথার কয়েকটা বাঁধা ছক আছে, তাই বিচ্ছিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে একই আখ্যান দেখা যায়। বিদ্বেষের এই পূর্বসংস্কারগুলি প্রায় এক ছাঁদে আরও পাওয়া যাবে কুর্দদের নিয়ে তুরস্কের সংখ্যাগুরু মানুষের মধ্যে, আলবেনীয়দের নিয়ে কসোভোবাসীদের, রোয়াণ্ডায় টুটসিদের নিয়ে হুটুদের।

একটু আগে যা বললাম, বিদ্বেষটা সচরাচর সমাজে ব্যক্তি-নাগরিকদের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে। রাষ্ট্রের অর্থবল ও আইনবল সেটা বাড়িয়ে ফাঁপিয়ে পুরোদস্তুর অশুভ অতিকথায় পরিণত করছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের তা সমর্থন করতে উৎসাহিত করছে, হয়তো কিছু টোপও ফেলছে (যথা, আক্রান্ত সম্প্রদায়ের সম্পত্তি দখলের সুযোগ)। এভাবে সরকারের হাত ঘুরে সেই অতিকথা দ্বিগুণ শক্তিতে সমাজে জেঁকে বসছে, উত্তরসত্যের বৃত্তটা সম্পূর্ণ হচ্ছে। মাঝে মাঝে বিশ্বাসটা সমাজে অত পরিস্ফুট থাকে না, রাষ্ট্রই উদ্যোগ নিয়ে বাড়িয়ে তোলে। মোট কথা, রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি-নাগরিক— এই তিন পক্ষের নিবিড় সংযোগেই অতিকথা পৌঁছয় উত্তরসত্যের পর্যায়ে: কার কত অবদান বোঝা কঠিন, বোঝার দরকারও নেই। এটুকু বুঝলেই হল, উত্তরসত্যের একটা বড় অংশ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় অতিকথার উৎকট অর্বাচীন রূপ।

আমরা দেখেছি, একচ্ছত্র স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্রে দেশবাসীদের একটা বড় অংশ স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রের ব্যাখ্যানে সম্মতি দিয়ে এসেছে— শুধু ভয়ে নয়, ভক্তিতে। ইদানীং যা দেখছি তা আরও তাজ্জব ব্যাপার: মার্কামারা স্বৈরতন্ত্রী রাজত্বের বাইরেও উত্তরসত্যের প্রসার দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বের অগ্রগণ্য গণতন্ত্র বলে খ্যাত, এমন সব দেশেও তার রমরমা। সবচেয়ে আলোচিত উদাহরণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র; ভারতও বড় পিছিয়ে নেই। ভাষ্যকারেরা সাবধান করে দিচ্ছেন: উত্তরসত্যের প্রভাব যত বাড়বে, দেশ তত স্বৈরাচার ও আধিপত্যবাদের দিকে এগোতে থাকবে, কারণ তার শাসককুল তথ্যনিষ্ঠ যুক্তিবিচার খারিজ করে নিজের মনোমতো দেশের চিত্র গড়েপিটে নিতে চাইবে ও পারবে।১৩৩

মার্কিন মুলুক বিজ্ঞানে বিশ্বের বৃহত্তম পীঠস্থান। মার্কিন রাষ্ট্রপতি অতএব ভাবতেই পারেন, দেশের তরফে তিনিও বিজ্ঞানের দখলদার। এই আত্মবিশ্বাসে তিনি পরামর্শ দিলেন, করোনার আক্রমণ ঠেকাতে ইঞ্জেকশন দিয়ে শরীরে জীবাণুনাশক ঢোকাতে; শুনে স্কুলের ছাত্র থেকে তাবড় বিজ্ঞানী একযোগে শিউরে উঠলেন। ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি বোলসোনারো আর এক ধাপ এগিয়ে বললেন, কোভিড-১৯ তেমন কোনও অসুখই নয়, তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেবার দরকার নেই। ফলত বহুদিন ধরে সারা বিশ্বে কোভিড মহামারিতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, দ্বিতীয় স্থানে ব্রাজিল; প্রথমে বোলসোনারো তারপর ট্রাম্প নিজেরাও আক্রান্ত হন। পরে অবশ্য অন্যান্য কারণে ভারত ব্রাজিলকে ছাড়িয়ে গেছে।

উত্তরসত্যের ভাষ্যকার তিৎসিয়ানা আন্দিনা বলছেন, বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতেরা উত্তরসত্য প্রচার করেন না (যদিও তাদের নামে তা ছড়ানো হতে পারে); করে আনাড়ি লোকে, এবং সে জন্যই সাধারণ মানুষের কাছে তা আরও সহজবোধ্য ও আকর্ষণীয় হয়।১৩৪ দুঃখের বিষয়, এটাই শেষ কথা নয়। ভারতে কোভিড মহামারির সময় কিছু বিজ্ঞানাগারে নির্দেশ গেল, যে ওষুধের মানবদেহে পরীক্ষা শুরুই হয়নি, সেটা দেড় মাসে বাজারে ছাড়তে হবে। শুনে দেশের লোক হতচকিত হলেন, তুমুল প্রতিবাদ করলেন বিজ্ঞানী সমাজ, ফলে বিজ্ঞপ্তি প্রত্যাহার হল। কিন্তু যা প্রায় অবিশ্বাস্য, হুকুমটা জারি করেছিল ওষুধের গবেষণা ও অনুমোদনের জন্য দেশের শীর্ষ সরকারি সংস্থা, সারা দেশে কোভিড প্রতিরোধে যার মুখ্য ভূমিকা। একই সংস্থা তাদের বিজ্ঞানীদের বাধ্য করেছে, গবেষণাপত্রে কোভিড সংক্রমণ সম্বন্ধে কিছু তথ্য চেপে যেতে।১৩৫

যে কোনও বিজ্ঞানগ্রাহ্য তথ্য বা যুক্তির অপপ্রয়োগ বা অপব্যাখ্যা হতে পারে। অর্ধশতক আগে ধূমপানের কুফল সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক গবেষণা নস্যাৎ করতে সিগারেট প্রস্তুতকারকেরা উঠেপড়ে লেগেছিল। আজ আমরা দেখছি তার সহস্রগুণ ব্যাপক ও বিপজ্জনক নজির, যা শেষ অবধি মানবজাতির অস্তিত্ব বিপন্ন করছে: তা হল বিশ্বের পরিবেশ সমস্যা অস্বীকার করার সংগঠিত উদ্যোগ। পরিবেশ আন্দোলনের বিরুদ্ধে এটাও একটা জোরালো প্রতি-আন্দোলন হয়ে উঠেছে। এই climate deniersদের অঢেল অর্থ জোগায় কিছু বিশ্বায়িত ব্যবসায়ী সংস্থা, মুনাফার তাগিদে যারা পরিবেশ ধ্বংস করে; এবং তাদের রক্ষাকর্তা (ও প্রায়ই তাদের অর্থপুষ্ট) কিছু দেশের সরকার ও শাসকগোষ্ঠী।

বৃহৎ শিল্পের আগমনের পর সভ্য মানুষের ভোগবাদী জীবনযাত্রায় শুধু প্রকৃতির রসদের অপচয় ও বিনাশ ঘটছে না, প্রকৃতির মৌলিক ভারসাম্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে— এটা আজ বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলে এতটাই সুপ্রতিষ্ঠিত যে অস্বীকার করা পাগলামি। তবু (অন্য যে কোনও চর্চাক্ষেত্রের মতো) সামান্য কিছু গবেষণা (এক হিসাবে ৩ শতাংশ১৩৬) উলটো কথা বলে। (প্রায়ই দেখা যায়, তার অর্থ জুগিয়েছে কোনও পরিবেশধ্বংসী প্রতিষ্ঠান।) তা ছাড়া সব বৈজ্ঞানিক গবেষণাই এগোতে থাকে আগের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলে: তাতে সেই সিদ্ধান্তগুলি ভুল প্রমাণিত হয় না, বরং নতুন গবেষণার ফলে প্রায়ই আরও পাকাভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সদর্থক আপত্তিগুলির অপব্যাখ্যা করে, সেই সঙ্গে মুষ্টিমেয় ভিন্নধর্মী গবেষণাকে তুলে ধরে ও তার খণ্ডনকারী গবেষণাকে স্রেফ অগ্রাহ্য করে, একটা রব সৃষ্টি হয়েছে যে বিশ্বপ্রকৃতি দিব্যি ভাল আছে, পরিবেশ আন্দোলন ব্যাপারটাই ধাপ্পা।

যে কটি দেশ (বা বলা উচিত, তাদের বর্তমান সরকার) খোলাখুলি এই মত জাহির করে, এবং সেই অনুসারে তাদের পরিবেশনীতি ঠিক করে, তাদের পুরোভাগে দুটি: সারা বিশ্বে মাথাপিছু সবচেয়ে দূষণকারী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এবং যে দেশের দখলে আছে পৃথিবীর বৃহত্তম অরণ্য অর্থাৎ পরিবেশ ভারসাম্যের চাবিকাঠি, সেই ব্রাজিল।১৩৭ ভারত সহ অধিকাংশ দেশ তুলনায় সংযত মনে হতে পারে। তারা নীতিগতভাবে পরিবেশ সমস্যা স্বীকার করে, হয়তো তার প্রশমনে কিছু সৎ উদ্যোগও নেয় (ভারত যেমন পরিবেশবান্ধব শক্তির প্রসারে সত্যিই নিচ্ছে); কিন্তু এই ইতিবাচক অবস্থানের আড়ালে বহু হানিকর প্রকল্পের (অরণ্য ও জলাভূমি ধ্বংস, পরিবেশসংকুল জায়গায় খনি ও কারখানা স্থাপন) ছাড়পত্র দেওয়া হয় বিভ্রান্তিকর রিপোর্টের ভিত্তিতে। এখানে লোকচক্ষুর আড়ালে ‘ক্লাইমেট ডিনায়াল’ ঘটছে খুচরো ভাবে কিন্তু অসংখ্য ক্ষেত্রে, যার যোগফল আক্ষরিক অর্থেই মারাত্মক। স্বভাবসিদ্ধভাবে এ বিষয়েও ভীতিপ্রদ আতিশয্য দেখান ফিলিপিন্সের রাষ্ট্রপতি রোদ্রিগো দুতের্তে। তিনি পরিবেশরক্ষার সোচ্চার সমর্থক, কিন্তু তাঁর শাসনকালে শতাধিক পরিবেশকর্মীর আন্দোলনের মূল্য হিসাবে প্রাণ দিতে হয়েছে।

দেখা যাচ্ছে, কোনও তথ্যনিষ্ঠ জ্ঞানপ্রণালীই উত্তরসত্যের নাগালের বাইরে নয়: না গণতন্ত্রের ধারা, না আধুনিক বিজ্ঞান। করোনা মহামারির সময়ে ডনাল্ড ট্রাম্পের এক উক্তি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মহামারি ঠেকাতে তাঁরই সরকারের নির্দেশ অমান্য করতে তিনি দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করলেন এই স্লোগানে, ‘Liberate Minnesota’ (বা অন্য যে কোনও রাজ্য): ‘মিনেসোটাকে মুক্ত করো’, অর্থাৎ কোয়ারেন্টাইন বিধি মেনো না। স্বাস্থ্যবিধি থেকে এই ‘মুক্তির’ সঙ্গে গণতন্ত্রে নাগরিক স্বাধীনতার কোনও যোগ নেই তা শিশুকেও বোঝাতে হয় না; দ্বিতীয় মুক্তিটাই ট্রাম্পের আমেরিকায় কিঞ্চিৎ বিপন্ন বলে অনেকে মনে করেন। মাত্র দুটি শব্দে একাধারে রাজনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক শুভবুদ্ধি ধূলিসাৎ করা কম কথা নয়।

এটা খুচরো উদাহরণ। পাইকারি হারে রাষ্ট্রীয় ব্যাখ্যানে ইতিহাস যেমন বিকৃত করা হয়, বিজ্ঞানও হয় সুযোগ জুটলেই। জুটেও যায়, কারণ বিজ্ঞান সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের মনে একটা রহস্যমণ্ডিত মোহ আছে, ফলে বিজ্ঞান স্বধর্ম ত্যাগ করে যুক্তিবিহীন অতিকথা হয়ে উঠতে পারে। জ্যোতিষশাস্ত্রের সমর্থনে তাই তার আদ্যন্ত বিপরীতধর্মী আধুনিক বিজ্ঞানের শরণ নেওয়া হয়, আরও বিপজ্জনকভাবে হয় ভুয়ো ওষুধের প্রচারে। সপ্তম অধ্যায়ের গোড়ায় ভারতে গত দু’-তিন বছরে অপবিজ্ঞানের একগুচ্ছ উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের উল্লেখ করেছি। এই অপবিজ্ঞানের কৃষ্টি কত ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে তা দেখা গেল করোনার প্রতিষেধক হিসাবে গোমূত্রের প্রচারে। (দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি থাবো মবেকি যেমন বলেছিলেন রসুন আর লেবুর রসে এডস সারে।১৩৮) প্রচারের শিকার মানুষগুলির হাসপাতালে ঠাঁই হল, প্রচারকদের সংশোধনাগারে হবার লক্ষণ নেই। এটা স্রেফ অশিক্ষিত কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেবার জো নেই, কারণ পঞ্চগব্যের মহিমা আজ ভারতীয় রাষ্ট্রের স্বীকৃত। তার প্রচারে সরকার যথেষ্ট অর্থব্যয় করছে, গবেষণা চলছে দেশের সেরা বিজ্ঞানকেন্দ্রে। সেটা ভাল কথা, সত্যিই কোনও গুণ থাকলে তা মানুষের হিতার্থে আবিষ্কার হওয়া জরুরি। সমস্যা হল, এই গবেষণা মঞ্জুর হয়েছে পঞ্চগব্যের গুণ সম্বন্ধে কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই নিশ্চিত বলে— অর্থাৎ বিজ্ঞানের (তথা সাধারণ যুক্তিবোধের) গতি ঘুরিয়ে আগে আবিষ্কার তারপর গবেষণা, আগে ফল পরে গাছ। এই কর্মকাণ্ডে বিজ্ঞান স্থান পাচ্ছে অতিকথা অর্থাৎ গোভক্তির অনুষঙ্গ হিসাবে, ও সেহেতু রাষ্ট্রীয় ব্যাখ্যানেরও অনুষঙ্গ, বলা যেতে পারে তল্পিবাহক।

আবার একটু তত্ত্বকথা ভাবতে হচ্ছে। আমরা অনেকবার দেখলাম গল্প বা নির্মাণ বা আখ্যান কী করে বাস্তব আর কল্পনার সীমা পেরিয়ে এপার-ওপার বাণিজ্য চালায়। এই ধারণাটা আর এক ধাপ এগিয়ে নেওয়া যাক। বাস্তব আর কল্পনার সংমিশ্রণ— যে অনুপাতেই হোক না কেন— বাস্তব হতে পারে না, কারণ তাতে কল্পনার মিশেল আছে। উলটোটা কিন্তু খাটে না: কল্পনার নির্মাণে বাস্তবের মিশেল শুধু থাকতে পারে না, থাকতে বাধ্য। বাস্তবকে একদম বিসর্জন দিয়ে, তার কোনও উপাদান আদৌ ব্যবহার না করে, কল্পনায় কিছু নির্মাণ করা অসম্ভব: কল্পনার নির্মাণকে হতেই হবে কোনও না কোনও ভাবে বাস্তবের প্রতিফলন, একটা বানানো গল্প যেমন গড়া হয় বাস্তব জীবনের উপকরণ দিয়ে। বাস্তবের এই উপস্থিতি কল্পনাকে গ্রহণযোগ্য করে তোলে; একই সঙ্গে বলা চলে, কল্পনার এই নির্মাণের মাধ্যমে বাস্তবকেও আমরা আরও ভাল বুঝি, কোনও মহান উপন্যাস পড়লে যেমন জীবন সম্বন্ধে আমাদের ধারণা আরও স্পষ্ট আর গভীর হয়।

সাহিত্যের গল্প আক্ষরিক সত্যতার দাবি করে না, তাই স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। রবীন্দ্রনাথের ‘ভাষা ও ছন্দ’ কবিতায় নারদ বাল্মীকিকে বলছেন:

সেই সত্য যা রচিবে তুমি,

ঘটে যা তা সব সত্য নহে।১৩৯

অনেক পরের একটা রচনায় কবি বলছেন, ‘হীরে-বসানো সোনার ফুল কি সত্য, তবুও কি সত্য নয়?’১৪০ শিল্পরচনা পুরোপুরি মননের স্তরে আবদ্ধ থাকে, ফলে সেখানে আসল-নকল, সত্য-মিথ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি হতে পারে না। যে সব গল্পের বাস্তব প্রয়োগ আছে, কোনও না কোনও কাজে লাগে, সেখানে বাস্তব আর কল্পনার লুকোচুরি আরও জটিল ও অনিশ্চিত। পণ্য বিপণনের গল্পে দেখেছি, তা আমাদের মুহূর্তেক কল্পলোকে নিয়ে যায়, কিন্তু শীঘ্রই ধরাছোঁয়ার আওতায় একটা নিরেট বস্তুপণ্যে ফিরিয়ে আনে। রাষ্ট্রিক ক্ষেত্রে কোনও গল্প— নির্মাণ, আখ্যান, অতিকথা যাই বলি— অবশ্যই জাগতিক স্তরের, কিন্তু কোনও পণ্য বা বাস্তব জোগান (deliverable) সরবরাহ করে না: এখানে কোনও ‘রিয়ালিটি চেক’ নেই।

শুনে আমরা বলতে পারি, নেই কে বলল? জনজীবন, নাগরিক অভিজ্ঞতা, তার পিছনে ইতিহাস ঐতিহ্য আচার সংস্কৃতি— রাষ্ট্র আমাদের যাই গল্প বলুক, সব কিছু তো আমরা সেই জীবন্ত বাস্তবের কষ্টিপাথরে যাচাই করে দেখছি। ইতিমধ্যেই কিন্তু আমরা যথেষ্ট প্রমাণ দেখলাম যে আদতে তা হয় না; বরং রাষ্ট্র যা বলছে, তাকে মান্য করে সেই ছাঁচে নাগরিকেরা তাঁদের অভিজ্ঞতা ঢেলে সাজান। ঘুরে ফিরে এলাম সেই আগের জায়গায়: বাস্তবকে টেক্কা দিচ্ছে উত্তরসত্য, তারপর সেটাই বাস্তবে রূপায়িত হয়ে অবশেষে নতুন সত্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

আজকের ভারতে কয়েকটা বিদ্বেষমূলক ও বিস্ফোরক ধারণা বহুপ্রচলিত, যেমন হিন্দু নারীদের নিশানা করে মুসলিমদের ‘লাভ জেহাদ’। এর সত্যতা স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেওয়া হয়, প্রমাণ দিতে হয় না; যেমন দিতে হয় না দেশকে ‘টুকড়ে টুকড়ে’ করার চক্রান্তের, যার তথাকথিত সাক্ষ্য একটা জাল ভিডিও। এই কল্পিত অপরাধীদের ধরপাকড়ের জন্য প্রশাসনের কাছে আদেশ যায়; অথচ প্রশাসন কবুল করেছে১৪১ যে ‘টুকড়ে টুকড়ে’র দল বা ‘শহুরে নকশাল’ বলতে কাদের বোঝায় তারা জানে না, ওই আখ্যাগুলি কোনও আইন বা নির্দেশাবলিতে নেই।

এগুলি এক একটা সাধারণ ধারণা, কোনও সবিশেষ তথ্য নয়। তাই সপক্ষে প্রমাণ না মিললেও পুরোপুরি মিথ্যা প্রমাণ করা দুষ্কর: যারা বিশ্বাস করতে চান তাঁরা বলবেন, ‘একদম প্রমাণ নেই, বা কোনওদিন ঘটেনি, জানলে কী করে?’ হয়তো টেনেটুনে নজির হিসাবে খাড়া করবেন কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা, বা বাস্তবের কোনও বিকৃতি, তাও না জুটলে আদ্যোপান্ত মনগড়া কিছু। শেষেরটাই সবচেয়ে সুবিধার, কারণ তাহলে দরকারমতো বিবরণ গড়েপিটে নেওয়া যায়।

পূর্বোক্ত যত অনাচারের মতো এমনটাও নতুন নয়। একটা পুরনো নজির দেখা যাক: ১৭৫৬ সালে তথাকথিত ‘কলকাতার অন্ধকূপ’এর কাহিনি। সিরাজউদ্দৌলার আদেশে নাকি ১৪৬ জন ইংরেজকে দুর্গের একটা ছোট বদ্ধ ঘরে আটক রাখা হয়েছিল, মারা গেছিলেন ১২৩ জন। আজ মোটামুটি প্রমাণিত যে এই বিবরণ পুরো মিথ্যা না হলেও খুবই অতিরঞ্জিত। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অতিকথায় কিন্তু এই কাহিনির বিশিষ্ট স্থান ছিল, আজও বহু লোকে বিশ্বাস করে। (২০২০র মে মাসে উইকিপিডিয়ার দীর্ঘ নিবন্ধে বিবরণের সত্যতা নিয়ে কোনও সন্দেহ প্রকাশ হয়নি।) এই গল্পের তবু খানিক বাস্তব ভিত্তি থাকতে পারে। তুলনা করা যাক ২০১৭র একটা ঘটনা, যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাতটি মুসলিম দেশের নাগরিকদের আমেরিকায় ঢোকা বন্ধ করতে উদ্যত হয়েছিলেন, আদালতের নিষেধে শেষ অবধি পারেননি যদিও। তাঁর সিদ্ধান্তের সমর্থনে এক অনুগত আধিকারিক নজির দেখান, অল্পদিন আগে কেন্টাকি প্রদেশে এক মুসলিম গোষ্ঠীর আয়োজিত গণহত্যার। তাজ্জব কথা, এমন কোনও ঘটনা ঘুণাক্ষরে ঘটেনি, এটা আদ্যোপান্ত মনগড়া। উলটোটাও ঘটে, বাস্তব কোনও কিছু হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। সার্বিয়ায় রাষ্ট্রপতির ভাইয়ের এক বৃহৎ ব্যবসায়ী সংস্থা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ল। তাঁর মালিকানা যদিও আষ্টেপৃষ্ঠে নথিভুক্ত, দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিল যে সংস্থাটার সঙ্গে তাঁর কস্মিনকালে যোগ নেই, নথিপত্র সব জাল। ঘটনার এক ভাষ্যকার একে বলেছেন ‘উত্তর-তথ্য রাজনীতি’ (post-factual politics)।১৪২

‘ফেক নিউজ’ বা ‘জাল খবর’ কথাটা আজ সর্বত্র শোনা যায়। জনজীবনে প্রায় যে কোনও বিতর্কে উভয় পক্ষ পরস্পরের বিরুদ্ধে জাল খবর ছড়াবার অভিযোগ আনে। স্থানীয় বাজারি গুজব, বা অজান্তে প্রচারিত ভুল খবরও ওই তকমায় ভূষিত হয়। সঠিক অর্থে ‘ফেক নিউজ’ কিন্তু কেবল ভুল বা অসত্য খবর নয়, বা এমন গুজব নয় যা মনুষ্যসমাজের চিরাচরিত নিয়মে আপনি ছড়িয়ে পড়ে।১৪৩ ‘ফেক নিউজ’ এমন অসত্য যা জেনেশুনে বানানো হয় এবং ব্যাপক ও পরিকল্পিতভাবে প্রচার করা হয়, সচরাচর সমাজমাধ্যম ও অন্যান্য বৈদ্যুতিন প্রযুক্তির সাহায্যে পাইকারি হারে। সেই প্রযুক্তির আবির্ভাবের আগে ‘সাচ্চা জাল খবরের’ অস্তিত্ব সম্ভব ছিল কিনা সেটা প্রশ্ন। গুজব অবশ্যই ছড়াত, কিন্তু সাবেক গুজবের সঙ্গে ফেক নিউজের সম্পর্ক বেড়ালের সঙ্গে বাঘের মতো। ছাপাখানা আসার পর গুজব ছড়ানো (ও সেই সঙ্গে ব্যঙ্গ, আক্রমণ ও অন্যান্য রাজনৈতিক প্রচার) অনেক সহজ ও ব্যাপক হয়ে পড়ল। তার একটা বিখ্যাত নজির আঠারো শতকের ফ্রান্সে ফরাসি বিপ্লবের আগে সস্তা পত্রিকা ও ইস্তাহারে রাজদ্রোহী প্রচার। কিন্তু বৈদ্যুতিন মাধ্যম ও তার পরাকাষ্ঠা আন্তর্জালের কল্যাণে প্রচারের ব্যাপকতা আজ অকল্পনীয় হারে বেড়ে গেছে।

জনমানসের মুক্ত প্রসার এবং তার সার্বিক নিয়ন্ত্রণ— দুটো বিপরীত সম্ভাবনাই বৈদ্যুতিন মাধ্যমে যত নিবিড়ভাবে উপস্থিত, অন্য কোনও প্রকাশমাধ্যমে তার ধারেকাছেও নয়। তাই এই মাধ্যমের অনন্য উপকারিতা, আবার চূড়ান্ত বিপদ। একটা বৈদ্যুতিন ফাইলের আদি দশা হচ্ছে খোলা, open, সকলের নাগালে— উপযুক্ত সফটওয়ার মজুত থাকলে যে কেউ ফাইল খুলে ইচ্ছামতো যোগ-বিয়োগ করতে পারে, একটা ছাপা বইয়ে যা পারে না। যদি আমরা এমনটা না চাই, ফাইলটা তালাবন্ধ রাখার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হয়। বলা চলে, বৈদ্যুতিন মাধ্যমের মূল চরিত্র গণতান্ত্রিক। তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা দেখেছি, জনপ্রিয় সমাজমাধ্যমের কল্যাণে অগুনতি মানুষ আজ নিজের কথা সকলের কাছে তুলে ধরতে পারছেন, হোক না তা অকিঞ্চিৎকর রূপে। বহু মানুষ গুরুতর মতও ব্যক্ত করছেন; বহু সংগঠন তাদের কার্যসূচি শুধু ঘোষণা নয়, পরিচালনা করছে সমাজমাধ্যমের সাহায্যে, কারণ তা এভাবে অক্লেশে সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। সমাজমাধ্যম তাই সাধারণ নাগরিক সমাজের ছোটবড় নানা বক্তব্য, প্রস্তাব, প্রতিবাদ ও আন্দোলনের বাহন হয়ে উঠেছে। তার বিশেষ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দশ-বারো বছর আগের ‘আরব বসন্ত’, একটার পর একটা আরব দেশে স্বৈরতন্ত্র আর অপশাসনের বিরুদ্ধে যখন প্রতিবাদের ঢেউ বয়ে গেছিল। এই আন্দোলনের সূচনা, প্রসার ও পরিচালনায় সমাজমাধ্যমের, বিশেষত ফেসবুকের, ভূমিকা আজ কিংবদন্তি। অসহিষ্ণু একচ্ছত্র শাসকগোষ্ঠীদের সেদিন থেকে স্থায়ী চিন্তা, তাদের প্রজারা পাছে এই পথ মাড়ান; ফলে এমন দেশে সমাজমাধ্যমের ব্যবহারে নানা নিষেধ আর খবরদারি জারি থাকে।

এ ব্যাপারে সবার আগে নাম করতে হয় চিনের। বিশ্বায়িত সমাজমাধ্যমগুলি চিনে হয় নিষিদ্ধ নয় কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত, যেমন অবশ্যই নিয়ন্ত্রিত চিনের নিজস্ব প্ল্যাটফর্মগুলি (যদিও বিশ্বের অন্যত্র ব্যবসা ফেঁদে তাদের উন্মুক্ত প্রচার, সম্প্রতি ভারত, আমেরিকা প্রভৃতি দেশে খানিক ধাক্কা খেলেও)। দেশবাসীরা কোথায় কী বার্তা পোস্ট করছেন তার উপর সরকারের কড়া নজর, শাস্তির খাঁড়া সদা উদ্যত। সাধারণভাবে আন্তর্জালে কী কী সাইট দেখা যাবে, নিয়ন্ত্রণ তার উপরেও। আন্তর্জালের অধিপতি যে বিশ্বজয়ী সংস্থাগুলি, তাদের আপত্তি অবধি খাটে না, বরং চিনের মতো বিশাল বাজার হাতছাড়া হবার ভয়ে তারাই সরকারি শর্ত মেনে নেয়। আমরা যারা আন্তর্জাল তথা সমাজমাধ্যমের অবারিত সু্যোগ উপভোগ করি, কল্পনা করতে পারব না এই সুবিধার অভাবে সাধারণ সামাজিকতা থেকে উচ্চতর পঠনপাঠন গবেষণা সব কিছু কতদূর ব্যাহত হয়, একুশ শতকের দুনিয়ার কত বৌদ্ধিক সম্পদ থেকে বঞ্চিত হতে হয়। (চিকিৎসা, ব্যবসা, প্রশাসন ইত্যাদি ক্ষেত্রের কথা ছেড়ে দিলাম।) সাময়িক বা আঞ্চলিকভাবেও আন্তর্জাল বন্ধ থাকলে শুধু যে বিশ্বের জ্ঞানসম্ভার অধরা থেকে যায় তা নয়, সজীব আধুনিক চিন্তাপ্রণালী অসম্ভব হয়ে পড়ে।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও বিশেষ পরিস্থিতিতে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ ব্যাপারে ভারতের খতিয়ান গৌরবময় নয়। বিশ্বের যত দেশ গণতান্ত্রিক বলে সাধারণভাবে স্বীকৃত, তাদের মধ্যে এখানেই সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাল বন্ধের নজির: ২০১৮য় ১৩৪ বার, ২০১৯এ ১২১ (অন্য হিসাবে ১০৬) বার। (২০১২য় ছিল মাত্র তিনবার।) এই দুই বছর পৃথিবীর আর কোনও দেশে ১২ বারের বেশি হয়নি।১৪৪ বিগত এক বছর কাশ্মীরে আন্তর্জাল হয় পুরো বন্ধ, নয় তার পরিষেবা অত্যন্ত সীমিত ও দুর্বল। (একটানা আরও বেশিদিন বন্ধের নজির একমাত্র চ্যাড আর মায়ানমারে।) এর ফলে জনজীবন বিপর্যয়ের যে বিবরণ বছরভর পাওয়া গেছে, তা প্রত্যয়িত করেছে প্রাক্তন বিচারপতিসহ অতি বিশিষ্ট এক নাগরিকগোষ্ঠীর প্রামাণ্য রিপোর্ট: আন্তর্জালের অভাবে রাজ্যের নিরাপত্তা নিশ্চয় সুরক্ষিত হচ্ছে, কিন্তু ‘জনজীবন, শিল্প, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সংবাদমাধ্যমের প্রভূত ক্ষতি হয়েছে।’১৪৫ সমাজমাধ্যমের ব্যবহারও কার্যত বন্ধ।

এমন রিপোর্ট আরও উদ্বেগজনক কারণ সাধারণভাবে চিনের তুলনায় ভারতের মুক্ত আন্তর্জাল ব্যবস্থা আমাদের বিপুল বৌদ্ধিক ও সামাজিক সম্পদ। চিনে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা গত কয় দশকে নাটকীয়ভাবে অগ্রসর হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার বিদ্যাব্যবস্থায় কিছু বিরাট ফাঁকও ক্রমশ ধরা পড়ছে; বিশেষত সমাজবিজ্ঞান ও বিশ্বসংস্কৃতির চর্চায় তা সমান মাত্রায় পিছিয়ে। আন্তর্জালের উপর বিধিনিষেধ নিঃসন্দেহে এর অন্যতম বৃহত্তম কারণ। তথ্যের প্রবাহ বাধা পেলে, এবং মুক্তভাবে সবরকম চিন্তা ও সৃষ্টির আদানপ্রদানের সুযোগ না থাকলে, এমন হতে বাধ্য। তার নানা দীর্ঘমেয়াদী কুফলের মধ্যে এটা প্রধান যে বিপুল আর্থিক ও রাজনৈতিক শক্তি সত্ত্বেও বৃহত্তর চিন্তা ও শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে (যাকে কোমল শক্তি বা সফট পাওয়ার বলা হয়) বিশ্বের প্রাঙ্গণে চিনের শোচনীয় অনুপস্থিতি; তুলনায় ভারতের উজ্জ্বল অবস্থান। সবচেয়ে বড় কথা, চিনে যে ব্যাপারটা রাষ্ট্রের হাজার চেষ্টাতেও চেপে রাখা যাচ্ছে না, বরং ক্রমে আরও প্রকট হয়ে পড়ছে, তা হল সেখানকার জনগণের মধ্যে মুক্ত চিন্তার প্রবল তাড়না, এবং সেই চিন্তা দমন ও দণ্ডিত করতে শাসকপক্ষের নির্দয় পদক্ষেপ।১৪৬

সাধারণ শিক্ষিত মানুষের মধ্যে আজ মুক্ত চিন্তার সবচেয়ে ব্যাপক ও সহজলভ্য বাহন সমাজমাধ্যম, তাই স্বৈরাচারী ও একচ্ছত্র শাসক তার ব্যবহার ও প্রসার নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। আরব বসন্তের সময় বিদ্রোহীরাই মূলত সমাজমাধ্যম ব্যবহার করতেন; সরকারপক্ষের লক্ষ্য ছিল তা নিষিদ্ধ করা, তাই ফেসবুক টুইটার প্রভৃতি পরিষেবা এমনকী পুরো আন্তর্জালই তারা বন্ধ করে দিত। তাতে কার্যসিদ্ধি হয়েছিল: অন্য নানা দমনপীড়নের সঙ্গে এটাও প্রতিরোধ চুরমার করতে সাহায্য করেছিল। উদ্বেলিত প্রায় প্রতিটি দেশে ‘বসন্ত’ পার হয়ে আবার স্বৈরাচারের রুদ্র গ্রীষ্ম ফিরে এসেছে, দাবদাহ হয়তো বেড়েছে আরও।

এটা কিন্ত সমাজমাধ্যম নিয়ে জটিল টানাপোড়েনের এক দিক মাত্র। অচিরেই বিশ্ব জুড়ে স্বৈরাচারী শাসকশ্রেণি বুঝতে পারল, তাদের নিজেদের স্বার্থে বৈদ্যুতিন প্রযুক্তি কী বিপুলভাবে কাজে লাগানো যায়। এই প্রযুক্তির যে অসামান্য ব্যাপ্তি ও দ্রুততা, ফলে যে হারে বার্তা ছড়ানো যায়, তার পূর্ণ সদ্ব্যবহারের রসদ একমাত্র রাষ্ট্রশক্তিই জোগাতে পারে: প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এমন অসম আধিপত্যের সুযোগ তারা লুফে নিতে লাগল। ফলে যে মাধ্যম ছিল চূড়ান্ত ও মৌলিকভাবে সর্বজনীন, তার সেই সর্বজনীন চরিত্রটাই হয়ে দাঁড়াল একচ্ছত্র শাসনযন্ত্রের মস্ত হাতিয়ার— একদিকে প্রচার ও চিন্তার নিয়ন্ত্রণ, অন্যদিকে খবরদারি আর ধরপাকড়ের জন্য।

আজ দুনিয়াভর সবাই জানে, নানা দেশে স্বীকৃত রাজনৈতিক দল তো বটেই, আরও অনেক প্রকাশ্য ও নেপথ্য সংগঠন মায় সরকারি প্রচার বিভাগ ও গোয়েন্দা বিভাগ (দুটির ব্যবধান সর্বদা স্পষ্ট নয়) এই সর্বগ্রাসী বৈদ্যুতিন আগ্রাসনের জন্য দক্ষ পেশাদারের দল নিযুক্ত করে। আন্তর্জাল মারফৎ উত্তরসত্যের বিস্তার একটা রমরমে ব্যবসা, তার ওস্তাদদের চাহিদা জগৎ জুড়ে। তাঁরা শুধু বার্তা ছড়ান না, কীভাবে ছড়াচ্ছে, কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, কম্পিউটারে সব কিছুর হিসাব রাখেন এবং সেইমতো তাঁদের অভিযানকে আরও ফলপ্রসূ করে তোলেন। যন্ত্রমেধার (artificial intelligence) তাক-লাগানো অগ্রগতি এই কাজে নিত্য নতুন মাত্রা যোগ করছে। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁদের নিয়োগকর্তারা এই হিসাবগুলো বৃহত্তর রাজনৈতিক ছক কষতে কাজে লাগান; ব্যাপারটার তাই নাম দেওয়া হয়েছে algorithmic politics— বাংলায় বলা চলে ‘যন্ত্রগণিতের রাজনীতি’। তার সবচেয়ে কুখ্যাত নজির ২০১৬য় মার্কিন নির্বাচনের আগে Cambridge Analytica সংস্থাটি যেভাবে লক্ষ লক্ষ ফেসবুক গ্রাহকদের তথ্য আয়ত্ত করে নির্বাচনী প্রচারের কাজে লাগিয়েছিল। এটা করা হয়েছিল ব্যাপকভাবে আইন ভেঙে, ফলে মার্কিন সংসদ পর্যন্ত জল গড়িয়েছিল এবং স্বয়ং ফেসবুকের মালিককে জবানবন্দি দিতে হয়েছিল। কিন্তু ভুললে চলবে না, বৈদ্যুতিন মাধ্যমে, বিশেষত সমাজমাধ্যমে, এমন তস্করবৃত্তি যে কোনও সময়ে ঘটতে পারে, প্রযুক্তির মধ্যেই সেই সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে।

নাৎসি রাজ সম্বন্ধে কাস্‌সিরেরের মন্তব্য মনে পড়তে পারে: ফাসিস্ত রাষ্ট্রে অতিকথা প্রচারের জন্য বহাল ছিল ‘অত্যন্ত দক্ষ ও ধুরন্ধর’ কর্মীর দল। (তাদের, এবং স্তালিনের রাশিয়ায় অনুরূপ প্রচারসাম্রাজ্যকে মাথায় রেখে জর্জ অরওয়েল তাঁর নাইন্টিন এইটি-ফোর উপন্যাস লেখেন।) অপপ্রচার আর মগজধোলাইয়ের মহাগুরু হিসাবে আজও নাৎসি প্রচার-প্রধান গোয়েবেলসের নাম করা হয়। তাঁর নামে একটা উক্তি বহুপ্রচলিত: চটকদারভাবে ক্রমাগত বলে যেতে থাকলে শেষ অবধি প্রতিষ্ঠা করা যায় যে একটা চৌকো জিনিস আসলে গোল।১৪৭ গোয়েবেলস সম্ভবত ঠিক এই ভাষায় এমনটা বলেননি, কিন্তু ধারণাটা তাঁর মার্কামারা। গোয়েবেলসের নেতা হিটলার তাঁর আত্মজীবনীতে একই কথা আরও তাত্ত্বিকভাবে লিখেছেন: সাধারণ মানুষের ‘আদিম সরলতার’ কারণে তাদের ‘ছোট মিথ্যার’ চেয়ে ‘বড় মিথ্যা’ বিশ্বাস করানো অনেক সহজ। ছোটখাট মিথ্যা তো সবাই বলে, অন্যে বললে তাই ধরতেও পারে। কিন্তু বিপুল মাত্রায় মিথ্যা বললে তাদের সন্দেহ জাগে না, কারণ অত বড় মিথ্যা যে কেউ বানাতে পারে, বানালেও সাহস করে প্রচার করতে পারে, সেটা তাদের চিন্তার অতীত। তারা ধরে নেয়, এমন অবিশ্বাস্য কথা সত্য না হলে কেউ বলত না। হিটলারের শেষ টিপ্পনী সবচেয়ে মোক্ষম: শেষ অবধি যদি মিথ্যাটা ধরাও পড়ে, তবু তার একটা প্রভাব মানুষের মনে থেকে যায়।১৪৮ তবে সফলভাবে কাজ হাসিল করতে হলে মিথ্যাটা বারবার, নিরন্তর বলে যেতে হবে।

এই সর্বব্যাপী অবিচ্ছিন্ন প্রচারের সুযোগ আধুনিক বৈদ্যুতিন মাধ্যমের ফলে অকল্পনীয় হারে বেড়ে গেছে। মুহূর্তের মধ্যে যে কোনও বার্তা— অতএব জাল বার্তাও— বিশ্বময় ছড়িয়ে দেবার এমন উপায় বিশ বছর আগে আমরা ভাবতে পারতাম না। একই বার্তা একযোগে অনেক সূত্র থেকে পাঠানো যায়, তাতে প্রাপক সরল মনে ভাবেন কথাটা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে, সবাই সায় দিচ্ছে। অনেক নজিরের মধ্যে একটা দেখা যাক। সাইবার-অপকীর্তির মহাকাশে রাশিয়া এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার প্রচারপদ্ধতি সম্বন্ধে এক বিস্তৃত সমীক্ষা থেকে চারটি মূল সূত্র উঠে এসেছে:

• এই প্রচার চলছে নানা সূত্র বা চ্যানেল দিয়ে।

• তা দ্রুত, বিরামহীন ও উচ্চগ্রাম, একই কথা জোর দিয়ে বার বার বলা হচ্ছে।

• এতে তথ্য-প্রমাণের কোনও দায় নেই।

• সমঞ্জস ও সংগতিপূর্ণ হবারও দায় নেই।১৪৯

এই সমীক্ষাও একেবারে নিরপেক্ষ ভাবার কারণ নেই, তবে তার ফলাফলের বিশদ ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, এবং মোটের উপর সব অভিমতের সঙ্গে মিলে যায়।

এখানেই বৈদ্যুতিন মাধ্যমের নিহিত জনমুখী চরিত্রের, অর্থাৎ সকলের সক্রিয় অংশ নেওয়ার এবং বক্তব্য যোগ করার প্রযুক্তির, অপপ্রয়োগের অভাবনীয় সুযোগ এসে যাচ্ছে, নেওয়াও হচ্ছে আঠারো আনা। বৈদ্যুতিন উপায়ে উত্তরসত্য প্রচারের মোক্ষম সহায় কতগুলি জনপ্রিয় সমাজমাধ্যম। বার্তার সৃষ্টিকারেরা যদি সেটা হাজার ঠিকানায় পাঠায়, সেই ঠিকানার মালিকরা প্রত্যেকে পাঠায় গড়ে বিশজন নতুন লোককে, তারা প্রত্যেকে আরও বিশজনকে, বার্তা ছড়িয়ে যাবে জ্যামিতিক হারে। যেহেতু বার্তাগুলি সচরাচর অত্যন্ত সহজ, চুম্বকধর্মী (এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছি), লোকে সহজেই বোঝে, মেনে নেয়, আত্মস্থ করে। আর যেহেতু সেটা পায় সমাজমাধ্যমে চেনা লোকের থেকে, ফের পাঠায় চেনা লোককে, ওটা হয়ে ওঠে আপামর মানুষের ‘আমাদের’ বার্তা। তারাই যেন এর প্রবর্তক ও ধারক, অন্য কেউ তাদের চালিত করছে এমন ঘুণাক্ষরেও মনে হয় না; প্রবাহের উৎসে যে প্রচারক, এবং তারও নেপথ্যে যে দল, গোষ্ঠী বা অন্য বৃহৎ শক্তি, তারা অদৃশ্য থেকে যায়। স্বৈরাচারী শাসকের সঙ্গে জনসাধারণের যে যোগ এমনকী সহমর্মিতার কথা একাধিকবার বলেছি, এটা সেই প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত প্রকাশ: শাসকগোষ্ঠীর সরাসরি উপস্থিতি কেন, উল্লেখেরও দরকার নেই, সাধারণ মানুষে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রক্রিয়াটা এগিয়ে নিয়ে যায়। তার ফল সবচেয়ে সফল ও সার্বিক হয় যখন (আমার আগের বিবরণমতো) এমন অতিকথা প্রচার হয় যার মূলে কোনও সনাতন বিশ্বাস, সংস্কার বা বিদ্বেষ: সেটাই শাসক নিজের মতো সাজিয়ে নতুন করে জনগণের মধ্যে বপন করে।

এই অবস্থা থেকে জন্ম নেয় সবচেয়ে মোক্ষম পরিণতি: খোলামেলা গণতান্ত্রিক সমাজেও এমন ছাঁচে-ঢালা অভিসন্ধিমূলক প্রচার ছড়িয়ে পড়ে, কারণ তাতে মানুষের স্বাধীনতাবোধ বা আত্মসম্মান ক্ষুণ্ণ হয় না, বরং মনে হয় এটা তাদেরই স্বাধীন বাক্বিনিময়ের প্রকাশ। ফলে গণতান্ত্রিক রাজত্বেও স্বৈরাচারের প্রবেশপথ খুলে যায়। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ জুড়ে আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে সোভিয়েত গোষ্ঠীর যে ঠান্ডা লড়াই দুনিয়াকে গরম রেখেছিল, আজ তার স্থান নিয়েছে আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে প্রবল ‘তথ্যযুদ্ধ’; ভাবাদর্শের দিক দিয়ে কিন্তু দুই শিবির আর প্রতিপক্ষ নয়, বরং একই খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বী। মোটের উপর দেখা যাচ্ছে, উত্তরসত্যের প্রচারে বিপুলভাবে এগিয়ে আছে বিশ্বের দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি (বিশেষত যাদের পাশ্চাত্যে ‘অল্ট-রাইট’ বলা হয়),১৫০ কিন্তু চরিত্রগতভাবে তা যে কোনও রাষ্ট্রিক কাঠামোর সঙ্গে খাপ খেতে পারে: তার বৈশিষ্ট্য কোনও বিশেষ বিষয়বস্তু বা আদর্শ নয়, বাচন ও প্রচারের এক বিশেষ প্রযুক্তিলব্ধ ধারা। আন্তর্জালে রাজনৈতিক প্রচারের অধিকাংশ কারিগর সম্পূর্ণ পেশাদারি কায়দায় যে-কোনও মত বা ভাবাদর্শের হয়ে পরিষেবা দান করেন।

কিন্তু এমন প্রচারের বিরোধী কিছু ধারাও গড়ে উঠেছে। বিরোধটা শুধু আদর্শগত নয়, পদ্ধতিগত: বিকল্প পদ্ধতির মধ্য দিয়েই আদর্শের তফাতটা প্রকাশ পাচ্ছে। বৈদ্যুতিন প্রচারপদ্ধতি ষোলো আনা প্রয়োগ করেও প্রতিরোধীরা তার সঙ্গে যোগ করছে জীবন্ত মানুষের হস্তক্ষেপ: বুদ্ধি-বিবেচনা, যুক্তি-প্রমাণ, নীতি-ন্যায্যতার অবতারণা করে, তথ্যপ্রযুক্তির যান্ত্রিক বাইট-মাপা ‘তথ্যের’ বিরুদ্ধে বাস্তবের প্রকৃত তথ্য তুলে ধরে। এই প্রতিরোধের একটা বড় লক্ষ্য বৈদ্যুতিন উপায়ে অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করে জাল খবর শনাক্ত করা— ইংরেজি প্রবাদের ভাষায়, চোর দিয়ে চোর ধরা। এই কাজ করেন কম্পিউটার ও আন্তর্জাল বিশেষজ্ঞদের কিছু সংগঠন। ভারতেও এমন কয়েকটি সক্রিয় ও উপকারী সংস্থা আছে, প্রত্যেক দায়িত্ববান নাগরিকের কর্তব্য তাঁদের সমর্থন করা।

একেবারে অন্য ভাবে আরও গভীরে কাজ করে যাচ্ছেন কিছু ব্যতিক্রমী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, যাঁরা একচ্ছত্র রাজশক্তির বৈদ্যুতিন প্রচারের প্রতিরোধে নিজেরাও বৈদ্যুতিন মাধ্যমের অভিনব প্রয়োগ করেন। ওয়েবসাইট ও সমাজমাধ্যম ঘেঁটে, আন্তর্জালের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করে এই সংগঠনগুলি একদিকে বৃহৎ শক্তির স্বৈরাচারী উত্তরসত্যের স্বরূপ ও অভিসন্ধি তুলে ধরেন, অন্য দিকে বৃহত্তর জনমতের গতিপ্রকৃতি অনুসরণ করেন। অর্থাৎ এক অর্থে এঁরাও ‘যন্ত্রগণিতের রাজনীতি’ অনুসরণ করছেন, কিন্তু অন্য অবস্থান থেকে অন্য উদ্দেশ্যে: বৈদ্যুতিন কৌশল আরও তুঙ্গে নিয়ে যেতে নয়, বরং মানবিক স্তরে ফিরিয়ে আনতে।

বিশ্ব জুড়ে এমন গোষ্ঠী ও সংগঠনের সংখ্যা কম নয়। তাদের অনেকগুলির অনুপ্রেরণা বা সরাসরি পরামর্শদাতা বিশিষ্ট রাজনৈতিক সংগঠক ও প্রশিক্ষক, সার্বিয়ার নাগরিক স্রদা পোপোভিক (Srda Popović)।১৫১ তাঁর আদ্যোপান্ত ‘অহিংস বিপ্লবের’ প্রবর্তক সংস্থা Centre for Applied Non-Violent Actions and Strategies (CANVAS) আজ বিশ্বখ্যাত। বলা বাহুল্য, আজকের দিনে গণতন্ত্র আর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার যে-কোনও অহিংস আন্দোলনের একটা প্রধান মাধ্যম বৈদ্যুতিন প্রচার। এই ধরনের প্রতিরোধকে জন কীন বলেছেন ‘বৈদ্যুতিন বিদ্রোহ’, digital mutiny:১৫২ উত্তরসত্য ও অপপ্রচার মোকাবিলায় সমাজমাধ্যমে বার্তা ছড়িয়ে, আন্তর্জালে প্রতিবাদী খবর, ছবি ও ভাষ্য তুলে দিয়ে, কর্তৃপক্ষের রক্তচক্ষু এড়িয়ে প্রচার চালু রাখার উপায় বার করে।

মেক্সিকোয় গত এক দশকে স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী বিপুল হারে বৈদ্যুতিন প্রচারে নেমেছিল। প্রাথমিক, সম্পূর্ণ যান্ত্রিক স্তরে তাদের হাতিয়ার ছিল ‘বট’ অর্থাৎ স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটার প্রণালীতে বার্তা সম্প্রচার, মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়া। পরের পর্যায়ে আসরে নামত ‘সাইবর্গ’ বাহিনী: এরা মানুষ, বট যে কাজটা শুরু করেছে তা অবস্থা বুঝে চালিত করত, তবে মাপা প্রণালী (program) অনুসারে ছক-বাঁধা রাস্তায়। এমন প্রণালী দক্ষ হাতে প্রস্তুত হলে মানুষকে পাইকারি হারে প্রভাবিত করা যায়, বার্তার অস্ত্রেই প্রতিবাদীদের ছত্রভঙ্গ করা যায়— ধরপাকড় লাঠি গুলির দরকার পড়ে না। প্রতিরোধীরাও আন্তর্জাল ঘেঁটে বার করতেন, কী কী পালটা বার্তা তাঁদের সমর্থকদের সবচেয়ে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করবে, এবং সেগুলির সম্প্রচারে নামতেন। এমন উদাহরণ আরও মিলবে। ফিলিপিন্সে সর্বশেষ ক্ষমতার লড়াইয়ে বৈদ্যুতিন মাধ্যমের গুরুতর ভূমিকা ছিল, ফলে অবধারিতভাবে দেখা গিয়েছিল ভাবী রাষ্ট্রপতিকে ঘিরে অতিকথা ও উত্তরসত্যের বিস্তার; তিনি ক্ষমতায় আসার পরও তার ধারা অব্যাহত। যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে সেই মিথ্যা ধরিয়ে দিতে সক্রিয় ছিল এবং আছে প্রতিরোধ বাহিনী, তাদেরও সংগ্রামের মাধ্যম আন্তর্জাল।১৫৩ দেশে-দেশে সাফল্যের মাত্রায় প্রচুর তারতম্য: কখনই চূড়ান্ত নয়, প্রায়ই নগণ্য বা অস্থায়ী।

এমন সাইবার-সংঘাতে দুই পক্ষের মধ্যে অসমতা ও পদ্ধতিগত তফাতটা নাটকীয়। শাসকের প্রচার পুরোপুরি বৈদ্যুতিন, নৈর্ব্যক্তিক: একটা তৈরি গল্প যান্ত্রিকভাবে দূর থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাদের প্রতিপক্ষের অবস্থান বাস্তব, মানবিক: শাসকের প্রচারের শিকারকে তাঁরা মানুষ হিসাবে দেখছেন, তাঁদের মানসিক প্রতিক্রিয়ার দিকে দৃষ্টি দিচ্ছেন; কম্পিউটার ব্যবহার করছেন সেই প্রতিক্রিয়া সংগ্রহ আর বিশ্লেষণের জন্য, সেই অনুসারে আবার মাথা খাটিয়ে পন্থা নির্ধারণ করছেন। দুই প্রতিপক্ষের পার্থক্য কেবল রাজনৈতিক পন্থা বা ভাবাদর্শের নয়, মৌলিকভাবে পৃথক দুটো বৌদ্ধিক দর্শনের: একটা বাস্তব ও মানবিক, অন্যটা বিষয়বস্তুর বিচারে যান্ত্রিক, বিমূর্ত, প্রায় অলীক, অথচ ফলের বিচারে পরম কার্যকর ও বাস্তব।

একটা সতর্কবার্তা মাথায় রাখতে হয়। কোনও বড় সাইবার-অভিযানের উৎস এতই দুর্জ্ঞেয় যে সত্যি কার সঙ্গে কার সংঘাত, কে বড় কে ছোট শরিক, কী উদ্দেশ্যে কে কোন গল্প ফাঁদছে, তা নিয়ে ধন্দ থেকেই যায়। প্রতিপক্ষের অ্যাকাউন্ট হস্তগত করে বিভ্রান্তিকর প্রচারও বিরল নয়। ২০২০র জুন মাসের গোড়ায় জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর বর্ণবিদ্বেষের প্রতিবাদে আমেরিকা যখন তোলপাড়, বামপন্থী মোরচা আন্টিফার নামে জাল টুইটার অ্যাকাউন্ট খুলে এক কট্টর দক্ষিণপন্থী সংগঠন অপরাধমূলক বার্তা ছড়াচ্ছিল, আন্টিফাকে ফ্যাসাদে ফেলার জন্য। তবে যে পক্ষের আসল পরিচয় যাই হোক, প্রণালী ও কৌশলের পার্থক্য সেজন্য দূর হয় না। আমেরিকাতে ২০২০র রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দীর্ঘ পালায় করোনা বিধির জন্য বাধ্য হয়ে প্রচারের কাজ অনেকটা ফোনে ও আন্তর্জালে সারা হয়েছে। তুলনায় উদারপন্থী ডেমোক্র্যাটরা সেখানেও সশরীরে মুখোমুখি প্রচারের অভাব বেশি বোধ করেছেন; বৈদ্যুতিন মাধ্যমের সাফল্যে তাঁরা কখনও উৎফুল্ল কখনও হতাশ।১৫৪ নির্বাচন সাঙ্গ হলে ‘মানবিক বনাম যান্ত্রিক’ প্রচারপ্রণালী সন্বন্ধে একটা সম্যক নজির বা ‘কেস স্টাডি’ পাওয়া যাবে।

উত্তরসত্য আর তার অনুষঙ্গ জাল খবরের মর্মকথায় আমরা পৌঁছে গেছি। তার মূলে একটা সোজাসুজি প্রযুক্তির ব্যাপার: অভূতপূর্ব দ্রুত ও ব্যাপকভাবে বার্তা সম্প্রচার, আর তার সদ্ব্যবহার করে সমাজমাধ্যমের অকল্পনীয় প্রসার। গতি ও আয়তনে এমন তাক-লাগানো পরিবর্তন হলে গুণগত পরিবর্তন হতে বাধ্য; আরও বাধ্য কারণ কম্পিউটার প্রযুক্তির অন্য নানা উন্নতি, বিশেষ করে যন্ত্রমেধার নাটকীয় অগ্রগতির দরুন প্রচুর উদ্ভাবন ঘটেই চলেছে। ফলে একবার প্রাথমিক বার্তাটুকু তৈরি হয়ে গেলে প্রচারের প্রক্রিয়াটা চালানো যায় পুরোপুরি যান্ত্রিক উপায়ে, মানুষের ভূমিকা বিনা বা নগণ্য স্তরে এনে। প্রচার-অভিযানের যাঁরা লক্ষ্য বা শিকার, বার্তা ছড়াবার কাজটা তাঁরাই ক্রমবর্ধমান গতিতে নিজেদের ঘাড়ে তুলে নেন। ফলে এটাও কার্যত হয়ে দাঁড়ায় মনুষ্যচালিত যান্ত্রিক প্রক্রিয়া, আচরণবিজ্ঞানের অঙ্ক অনুসারে চলতে থাকে।

যে গুজব মুখে মুখে ছড়ায় তা যত ছড়ায় তত বদলায়, অজান্তে বা মতলবে। ছাপার অক্ষরও হাতে-হাতে ঘুরতে ফিরতে প্রচুর নতুন আদানপ্রদান হয়— অনেক সময় সেই প্রতিক্রিয়াটাই আসল, ছাপা পাঠটা উপলক্ষ মাত্র। এভাবে একটা ছাঁকনির কাজ হয়, ‘রিয়ালিটি চেক’ থাকে; নতুন ভেজাল অবশ্যই ঢোকে, সেটা ধরার অবকাশও থাকে। বৈদ্যুতিন বার্তার ব্যাপার আলাদা। আগে বলেছি, সমাজমাধ্যমের বার্তা একজন তার চেনা লোকদের পাঠায়, তারা পাঠায় তাদের পরিচিতদের, ফলে বার্তাটা ‘আমাদের’ বলে ধারণা জন্মায়। এটা কিন্তু মূল প্রক্রিয়ার অনুষঙ্গ মাত্র, আর সেই প্রক্রিয়া একদম ভিন্নমুখী। আদি পর্যায়ে বার্তা আসছে সার্ভার থেকে সোজা আমার নিজস্ব যন্ত্রে। একসঙ্গে যাচ্ছে আরও লাখো মানুষের কাছে হুবহু এক বয়ানে, কিন্তু তাঁদের সঙ্গে আমার যোগ নেই। এ ভারী অদ্ভুত ব্যাপার: ‘সমাজমাধ্যমের’ এই চেহারাটা চূড়ান্ত অসামাজিক। শুরু থেকে শেষ অবধি এই আদি গ্রাহকের ভিড় থেকে যাচ্ছে অচেনা অনামী— পরস্পরের কাছে, বার্তাপ্রেরকের কাছে: মানুষ নয়, কম্পিউটারের আই পি অ্যাড্রেসের কাতার। এখানেও দ্বিতীয় অধ্যায়ের সেই ‘ডিভিজুয়ালের’ গল্প। পরবর্তী পর্যায়ে বার্তাটা শেয়ার করা হচ্ছে, গ্রাহকরা নিজেরাই দল বাড়াচ্ছেন আর যোগস্থাপন করছেন, নতুন মন্তব্যও করছেন কেউ কেউ; কিন্তু বার্তার বাস্তবতা তাতে বাড়ছে না, যান্ত্রিকতা অতিক্রম করে সত্যিকারের মানবিক মাত্রা যোগ হচ্ছে না— আলোচকদের মন্তব্যও কম্পিউটারের হিসাবে ধরা আছে। বার্তাটা কার্যত ঘুরছে-ফিরছে কোনও যাচাই বা ছাঁকনি বিনা, বাস্তবের মাটি কোথাও না ছুঁয়ে।

আন্তর্জালের জাল খবর তাই হতে পারে ‘খাঁটি জাল’, একেবারে বাস্তববিচ্ছিন্ন— এতই অবাস্তব যে আমরা বুঝতেও পারি না। এমন মাধ্যম হিটলারের ‘বড় মিথ্যার’ আদর্শ বাহন: ভাগ্যিস নাৎসি আমলে আন্তর্জাল আবিষ্কার হয়নি। লোকে ‘ছোট মিথ্যা’ বলে সাবধানে মেপেসেপে, পাছে ধরা পড়ে যায়, কারণ মিথ্যাটা ঘিরে আছে অনেক সত্য বা বাস্তব ঘটনা। ‘বড় মিথ্যা’ প্রচার হয় বুক ফুলিয়ে বেপরোয়া আস্ফালনে, বাস্তবকে কাছে ঘেঁষতেই দেওয়া হয় না। বৈদ্যুতিন বার্তা যেন এমন চাহিদার ফরমাশমতো গড়া। হাজার লক্ষ মানুষ তা নিয়ত পড়ছে, খবরটা ক্রমাগত তাদের মগজের কড়া নাড়ছে; কিন্তু বিস্তারে যতই ব্যাপক হোক, বার্তার বস্তু সীমিত ও প্রসঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন, সত্যমিথ্যা বিচারের কোনও মাপকাঠি নেই।

একটা তুলনায় ব্যাপারটা বোঝা সহজ হবে। কোনও ঘটনার বিবরণ পড়ে বোঝা না যেতে পারে সেটা সত্য ঘটনা নাকি বানানো গল্প; তেমনি কোনও বাক্যালাপের রেকর্ড আসল কথাবার্তা না নাটকের সংলাপ, একটা ভিডিও ক্লিপ আসল ঘটনার না সিনেমার দৃশ্যের। সেটা বুঝতে গেলে বাইরের কোনও সূত্র থেকে (যথা, বইয়ের মলাট বা ভিডিওর গোড়ার ফ্রেম) বাস্তব অবস্থাটা জানতে হবে। কিন্তু সাইবার দুনিয়ার জাল খবর এমন নিটোল অভেদ্য মোড়কে বাঁধা, এত মসৃণভাবে সার্ভার থেকে চলে আসছে যে কোথাও টক্কর খাবার অবকাশ নেই: অন্য কিছুর সঙ্গে মিলিয়ে দেখা বা কারও মতামত নেওয়ার ফাঁক রাখা হচ্ছে না, তেমন করার কথা আমাদের মনেই হচ্ছে না— যদিও অনেক ক্ষেত্রে ওই একই যন্ত্র থেকে গুগল সার্চ করে আমরা সহজেই সত্যতা যাচাই করতে পারি। আরও আশ্চর্য, একই বার্তা হয়তো শেয়ার হচ্ছে সমাজমাধ্যম জুড়ে, কিন্তু তা নিয়ে চিন্তা করছে, ভুল ধরছে অল্প লোকেই; বেশিরভাগ মানুষ গ্রহণ করছে বিনা প্রশ্নে, সমাজমাধ্যমের ‘সমাজে’ অংশ নেবার আনন্দে মশগুল হয়ে।

এটা সেই ফাঁকির গণতন্ত্র, যা আগে আমরা দেখেছি পণ্য বিপণনের ক্ষেত্রে: আমরা ভাবছি আমরা স্বাধীন, নিজের খুশিতে দেখছি বাছছি কিনছি, কিন্তু আড়াল থেকে সুতো টানছে অদৃশ্য শক্তি। আরও মনে করুন দ্বিতীয় অধ্যায়ে নব্য অর্থব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের ভূমিকা সম্বন্ধে যা বলেছি। সেই অভিনব জটিল ব্যবস্থার তাঁরা বোঝেন অল্প বা আদৌ কিছু নয়, ছোটখাট কিছু লেনদেনে অংশ নেন মাত্র; সেটুকুর ফলেই তাঁদের আর্থিক অস্তিত্ব বৃহৎ সংস্থাগুলির হাতে চলে যাচ্ছে, তাঁরা টের পাচ্ছেন না। একই বৃহৎ স্বার্থগুলি সমাজমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে আমাদের পুরো মানসিক জীবন সেই ক্ষমতাবানদের অধীনে চলে যাচ্ছে, আর যাচ্ছে আমাদের সোৎসাহ সম্মতিক্রমে।

ভিডিও ক্লিপের উদাহরণটা আর একটু ভেবে দেখার মতো। গুহাযুগ থেকে আমাদের মজ্জাগত বিশ্বাস, যা চাক্ষুষ দেখছি তা সত্যি: ইংরেজি প্রবাদের ভাষায় Seeing is believing। এমনটা যে নাও হতে পারে, তার প্রমাণ ইতিহাস তথা সাহিত্য জুড়ে— বেশি দূর যেতে হবে না, শেকসপিয়রের অন্তত ডজনখানেক নাটকের গল্প সাক্ষী। (ভিন্ন স্তরে নাটক ব্যাপারটাই সাক্ষী, চোখের সামনে মঞ্চে যা দেখছি তা বাস্তব ঘটনা নয়।) আর যদি কিছু দেখি সরাসরি নয়, ছবির মাধ্যমে, ঠকার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায় তাও আমরা যুক্তিতে বুঝি, কাজে প্রায়ই নয়। আন্তর্জালে জাল খবরের বিপুল অংশ জাল ছবি, আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে যা খুশিমতো তৈরি করা যায়। যে হিতৈষী প্রযুক্তিবিদরা জাল খবর শনাক্ত করেন, ছবির জালিয়াতি ধরা তাঁদের একটা বড় কাজ। এর রকমফের ঘটে যেখানে ছবিটার কারিকুরি হচ্ছে না কিন্তু তার বিবরণ ভুয়ো, পাঁচ বছর আগে মুম্বাইয়ের ছবি গত পরশু কলকাতার ঘটনা বলে চালানো হচ্ছে। এমন মিথ্যা বর্ণনা আকছার ঘটছে সবাই জানি। দুঃখের বিষয়, মিথ্যা ফাঁসের বার্তা আদি মিথ্যাটার এক শতাংশও প্রচার পায় না, কারণ সেই বহরের প্রচারযন্ত্র নেই; অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিথ্যাটা ধরাই পড়ে না, পড়া সম্ভব নয়। মিথ্যার এই রাজসংস্করণ কখনও বা নকলের নকল: যে দৃশ্য এমনিতেই কাল্পনিক, যেমন সিনেমার অংশ, সেটা বাস্তব ঘটনা বলে চালানোর চেষ্টায়। যে ‘সংকেতের সংকেত’-এর কথা প্রথম অধ্যায়ে বলেছি, এ যেন তার উৎকট প্যারডি, একরকম বৌদ্ধিক অশ্লীলতা।

বাস্তব জনজীবনে এমন মিথ্যা আরোপের ফলে প্রভূত ক্ষতি হয়, জ্বলে ওঠে হিংসা বিদ্বেষ হানাহানি। তাতে যেন উৎসাহিত হয়ে এমন প্রতারণা বেড়েই চলেছে; আর প্রযুক্তিটা এত সহজ, যে পেশাদার জালিয়াতদের দেখাদেখি প্রচুর শখের জালিয়াত আসরে নেমেছে। উপরে বলেছি, বৈদ্যুতিন মাধ্যম সকলকে সর্বস্তরে সক্রিয় অংশ নেবার সুযোগ দেয়: সেটাই তার আদি ও স্বাভাবিক অবস্থা, default mode। ফলে যে মানুষ শুরুতে বৈদ্যুতিন প্রণালীর কেবল গ্রহীতা, দেখছে পড়ছে শুধু, পরের দফায় সে হতে পারে তার সক্রিয় অংশীদার, ফাইল খুলে অদলবদল করতে পারে। এটা বৈদ্যুতিন মাধ্যমের বিশাল গুণ, তার সৃষ্টিশীল গণমুখী চরিত্রের প্রকাশ; কিন্তু সব স্বাধীনতার যেমন অপব্যবহার হতে পারে— সেই সুযোগ না থাকলে প্রকৃত স্বাধীনতাই নয়— তেমনি হতে পারে সব সৃষ্টিশীল প্রণালীর; তারই নজির আমরা এখানে দেখছি। জালিয়াতরা ‘স্বাধীনভাবে’ সৃষ্টিতে মাতছে। মর্মান্তিক কৌতুকের বিষয়, তারা আসলে মোটেই স্বাধীন নয়: আগেই তাদের মগজধোলাই হয়ে গেছে, বা নিছক টাকার জন্য কাজ করছে; ফলে তারা যাই করুক, করছে কোনও বৃহৎ অভিসন্ধির ক্রীড়নক হিসাবে। এবার তাদের পালা, কেরামতি খাটিয়ে ক্ষুদ্র ক্রীড়নকের সংঘ সৃষ্টি করার।

এই পরিস্থিতির একটা তাত্ত্বিক দিক আছে। উপরোক্ত ক্ষেত্রে ছবি ও তার বর্ণনার মধ্যে একটা বিচ্ছেদ ঘটছে। ছবিটা কোনও চাক্ষুষ দৃশ্যের প্রতিরূপ, অর্থাৎ সংকেত। তার সাংকেতিক ভূমিকাটা কার্যকর করতে আর একটা সংকেতপ্রণালী চাই, তা হল ভাষা: ছবিটা কীসের, ভাষায় তা বোঝাতে হবে। ভাষার সংকেত বিমূর্ত: চোখের সামনে কোনও দৃশ্য তুলে ধরছে না, বাস্তব দৃশ্যের একটা মানসিক চিত্র শব্দের দ্বারা নির্দেশ করছে। (‘শব্দার্থের ত্রিভুজ’ সম্বন্ধে প্রথম অধ্যায়ের বক্তব্য দেখুন।) ছবির সংকেত দৃশ্যমান, চাক্ষুষ বাস্তবের প্রতিরূপ। ভাষা যে মানসিক চিত্রকে নির্দেশ করছে, ছবি যেন তারই একটা বাহ্য প্রতিমা, যেটা আবার নির্দেশ করছে ‘আসল’ দৃশ্যবস্তুকে। ভাবা যাক একটা গাছের কথা। ‘গাছ’ শব্দটা নির্দেশ করছে আমাদের মগজের মধ্যে গাছের একটা চিত্রকে। গাছের ছবিতে সেই মানসিক চিত্রটা আসল হয়ে উঠছে। এটাও একটা মানসিক সৃষ্টি: শিল্পী ফটোগ্রাফের মতো গাছের হুবহু প্রতিচ্ছবি আঁকছেন না, তাঁর চেতনায় তাকে একটা স্বকীয় রূপ দান করে সেটাই আঁকছেন। এই সব কিছুর বাইরে আছে আসল গাছটা।

মিথ্যা বর্ণনার ফলে এখানেই গণ্ডগোল ঘটছে: ভাষায় বর্ণনার সঙ্গে ছবির, আবার ছবির সঙ্গে বহির্বাস্তবের আসল যোগ ছিন্ন করে মিথ্যা যোগ স্থাপন করা হচ্ছে: সোজা কথায়, ছবির মিথ্যা পরিচয় দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু মিথ্যাটা ধরার কোনও উপায় নেই। তত্ত্বের ভাষায় বললে, সংকেতগুলো কেবল অকেজো নয়, ভুল নির্দেশ দিচ্ছে, যা অনেক বেশি ক্ষতিকর। বটগাছকে তালগাছ বলে চালানো হচ্ছে, যারা গাছ চেনে না তারা ভুল শিখছে। এই অধ্যায়ের গোড়ায় বাস্তব আর তার উপলব্ধির মধ্যে বিচ্ছেদের কথা বলেছিলাম: সেই বিকারের স্বরূপ এখানে উদ্বেগজনকভাবে প্রকট।

এই বইয়ের গোড়া থেকে দেখে আসছি, ভাষা ও অন্যান্য সংকেতপ্রণালী যুগের চাহিদায় হয়ে উঠছে লঘু, অতিসরল; শেষ অবধি যেন আর সংকেতই থাকছে না, অন্য কিছু নির্দেশ করছে না: অর্থবহতা বিসর্জন দিয়ে একটা সীমিত নির্দিষ্ট ব্যবহারিক বস্তু হয়ে পড়ছে, নিজের মধ্যেই তার অস্তিত্ব ফুরিয়ে যাচ্ছে। বৈদ্যুতিন সমাজমাধ্যমে, বিশেষত টুইট ও হ্যাশট্যাগের ভাষায়, এই লক্ষণগুলো পুরোমাত্রায় দেখেছি। এতক্ষণ তবু এটুকু বলা যাচ্ছিল, ভাষার আক্ষরিক অর্থ যেহেতু পুরোপুরি বিলুপ্ত হয় না, একেবারে মৌলিক স্তরে একটা অর্থবহতা রয়ে যাচ্ছে। সেটা রয়ে যাচ্ছে উত্তরসত্যের প্রকাশেও— শব্দগুলির আক্ষরিক বা আভিধানিক অর্থ বহাল আছে, নইলে বার্তাটা বোঝাই যেত না। কিন্তু এতক্ষণ যা দেখিনি, এবার তাই দেখছি: ভাষা আমাদের সঙ্গে বেইমানি করছে।

কথাটা হালকাভাবে বলছি না। মিথ্যা বলার জন্য ভাষা চিরকাল ব্যবহার হয়ে আসছে, এতে নতুন কিছু নেই। যা নতুন তা হল একগুচ্ছ যুগান্তকারী প্রযুক্তি, যাতে শুধু যোগাযোগ ও প্রচার নয়, আমাদের মৌলিক জ্ঞানপ্রক্রিয়ায় বিপ্লব এসেছে। তার নানা আশীর্বাদের সঙ্গে একটা অশুভ পরিণতি আমাদের বাস্তবচেতনাকে শুধু প্রভাবিত নয়, আমূলভাবে বিভ্রান্ত ও বশীভূত করার উপায়: মিথ্যা নির্মাণকে নিশ্ছিদ্র পরিপূর্ণ স্বয়ংসিদ্ধ করে তোলার, বোধশক্তিকে আচ্ছন্ন করে ফেলার। রচনা, ব্যাখ্যান, অতিকথা— যে স্তরেই ভাবি না কেন, একটা বিশাল সুবিন্যস্ত অথচ বাস্তববিচ্ছিন্ন নির্মাণ সৃষ্টি হয়ে চলেছে। বলতেই হয়, এটা এক অভিনব জ্ঞানপ্রণালী। সবচেয়ে বড় বিস্ময়, এই মর্মান্তিক বিপ্লব সাধিত হচ্ছে এত সহজে, এত উপকারী আনন্দদায়ক অনুষঙ্গ নিয়ে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে এমন সুন্দর মিশে গিয়ে, যে এর স্বরূপ সম্বন্ধে আমাদের খেয়ালই নেই।

অনেক পাঠক আমার এই বিবরণ শুধু অতিরঞ্জিত নয়, আজগুবি এবং হয়তো অপমানকর ভাববেন। বলবেন, ‘আমরা কি অতই বোকা? আমরা ফেসবুক টুইটার হোয়াট্সঅ্যাপ করি, নানা অ্যাপ ব্যবহার করে কত কাজ কত সহজে করি, কম্পিউটার গেম খেলে মজা পাই আর ছেলেমেয়েদের খেলতে দিই— তো বেশ করি, তাতে আমাদের কোনও ক্ষতি হচ্ছে? আমাদের কাজকর্ম জীবনযাত্রা লেখাপড়া ভাবনাচিন্তার ধরন বদলে থাকতে পারে, কিন্তু খারাপ কিছু হয়েছে, না আমরা খারাপ কিছু করছি?’

এমন প্রতিবাদ অসংগত নয়। সবিনয়ে জানাই, আমিও জ্ঞানপাপী: নইলে একুশ শতকে জীবনযাপন করা দুষ্কর, অনেক আনন্দ ও উপকার থেকে বঞ্চিত হতে হবে। উত্তরসত্যের যে কুফলের কথা বলছি, তা কদাচ সার্বিক হয়। অধিকাংশ মানুষ যেমন বায়ুদূষণের তেমনি উত্তরসত্যের সঙ্গে সহাবস্থান করে জীবন কাটিয়ে দেন। তা বলে বায়ুদূষণের সমস্যা যাঁরা স্বীকার করেন না, বা প্রতিরোধের চেষ্টা করেন না, তাঁরা আত্মঘাতী অসামাজিক: নিজের ও আপনজনের কী ক্ষতি হয়ে চলেছে জানেন না, ভাবেন না পরিবেশ আরও ধ্বংস হলে আমরা কোথায় থাকব কী খাব। উত্তরসত্যের ক্ষেত্রেও এক কথা খাটে। না ভাবলেই নয়, বিষাক্ত বায়ুর মতো অদৃশ্যভাবে এর ফলে সমাজে কত অজ্ঞতা, বিদ্বেষ ও অনাচার ছড়িয়ে পড়ছে বা পড়তে পারে, রাষ্ট্র ও বৃহৎ বিশ্বায়িত পুঁজি আমাদের জীবন কেমন দখল করে নিতে পারে বা ইতিমধ্যেই নিয়েছে।

আমরা দেখেছি, উত্তরসত্যের আপাত গণতান্ত্রিক চেহারা আদতে কীভাবে আমাদের মানসিক স্বাধীনতা হরণ করতে পারে: খাতাকলমে গণতান্ত্রিক সমাজেও ফাসিস্ত শাসনের কিছু শর্ত আরোপ করতে পারে, আমাদের অজান্তে বা সক্রিয় সম্মতিতে; সেই সঙ্গে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার তরল ‘চয়েস’এর আড়ালে নাগরিককে আর্থিক তথা সামাজিক নিয়ন্ত্রণের যে অভিসন্ধি, সেটা আরও মোক্ষমভাবে জারি করতে পারে। শেষ অবধি এই ফলগুলি আমাদের পক্ষে মঙ্গলদায়ক হবে কিনা, ভেবে দেখার বিষয়।

এইজন্য বলছিলাম, উত্তরসত্যযুগে ভাষা বেইমানি করছে: অর্থাৎ সংকেতের কাজ করতে গিয়ে নতুন ভাবে প্রতিশ্রুতিভঙ্গ করছে, স্বধর্ম থেকে চ্যুত হচ্ছে। কোনও বিশেষ ক্ষেত্রে অসত্য বার্তা দিচ্ছে সেটা তুচ্ছ ব্যাপার, বিপুল হারে হলেও। ভাষার অর্থবহতা হ্রাস পাচ্ছে, সংকেত আর সংকেত থাকছে না— এমনটা গোড়া থেকে দেখছি, সেটাও চূড়ান্ত ক্ষতি নয়। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, কোনও উক্তির অর্থ আপাতভাবে বজায় থাকছে, মনে হচ্ছে তা কোনও তথ্য নির্দেশ করছে, বহির্বিশ্বের সঙ্গে আমাদের চেতনার সেতুবন্ধন করছে— ঠিক যেমন ভাষার করা উচিত; অথচ এই আশ্বাসের আড়ালে যে জগৎটা গড়ে উঠছে তা বহির্বিশ্ব থেকে পৃথক, আমাদের বোধকে বিপথে চালিত করছে।

চতুর্থ অধ্যায়ে আরশিনগরের কথা বলেছিলাম, এখানে আবার বলা চলে। আরশির ছবি যেমন বাস্তবের হুবহু প্রতিবিম্ব কিন্তু একেবারে অবাস্তব, এও তাই। উপমা পালটে বলা যায়, ঘড়ি পুরোপুরি থেমে গেলে বোঝা যায়; চূড়ান্ত বিভ্রান্তি হয় খানিক থেমে ফের চলতে শুরু করলে — এখানেও তেমন ঘটছে। আরও একটা তুলনা করা যায়। ধরুন পথনির্দেশের একটা সাইনবোর্ড অস্পষ্ট হয়ে পড়ল, পড়া মুশকিল। এতে পথিকের নিঃসন্দেহে অসুবিধা হল। তারপর সেই সাইনবোর্ডের উপর কেউ সিনেমার বিজ্ঞাপন সেঁটে দিয়ে গেল, সাইনবোর্ডটা নির্দেশক হিসাবে অকেজো হয়ে একেবারে অন্য বার্তা বহন করতে লাগল। কিন্তু এবার যদি সেটা নতুন রং করে, যে রাস্তা বহরমপুর যাচ্ছে তাতে লিখে দেওয়া হয় ‘বর্ধমান’— সেই বিভ্রান্তিটা একেবারে অন্য স্তরের হবে না কি?

আবার বলছি, এটা আটপৌরে মিথ্যাভাষণের ব্যাপার নয়: কেবল বার্তাটা মিথ্যা নয়, বার্তা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যটাই মিথ্যা। ভাষার সংকেতাবলি— সেই সঙ্গে ছবি, ধ্বনি ইত্যাদি আরও সবরকম সংকেত— আর বাইরের জগৎ নির্দেশ করছে না; তার দৃষ্টি ভিতর দিকে, নিজের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভুয়ো ভূগোলের সাইনবোর্ডের মতো, মনগড়া জগতের একটা উপাদান আর একটাকে নির্দেশ করছে: বৌদ্ধিক আত্মরতিতে সেগুলি এখন পরস্পরের সংকেত— সব মিলিয়ে এক নিটোল স্বয়ংসিদ্ধ স্বয়ংসম্পূর্ণ নির্মাণ, যাকে বিকল্প বাস্তব বলে গ্রহণ করতে মন যায়। আমরা বলে থাকি, মিথ্যা বলতে হলে সাবধানে বলবে, নইলে অসংগতি ধরা পড়লে ফেঁসে যাবে— ভুলো না, মিথ্যাটাকে ঘিরে আছে বাস্তব জগৎ! উত্তরসত্যের নির্মাণ একেবারে বাস্তববিচ্ছিন্ন, তাই নিটোল নিখুঁত, তাতে অসংগতির অবকাশ নেই। এটা সম্ভব হচ্ছে অভিনব প্রযুক্তির দৌলতে।

সেই প্রযুক্তি এমন ব্যাপক হারে কাজে লাগাতে যে ক্ষমতা আর সম্পদ দরকার, উত্তরসত্যের হোতাদের তা প্রচুর মাত্রায় আছে, এবং সফল কার্যসিদ্ধির দরুন নিরন্তর বেড়ে চলেছে। এটাও উত্তরসত্যের পটভূমির গুরুতর অঙ্গ। উত্তরসত্য একটা নৈর্ব্যক্তিক নিরপেক্ষ জ্ঞানপ্রণালী নয়: তা নিয়ন্ত্রণ করছে বৃহৎ রাষ্ট্রীয় শক্তি ও অতিবৃহৎ বিশ্বায়িত পুঁজি। বারবারা বিয়েসেকার বলছেন, যেমন বলেছেন আরও অনেকে, যে উত্তরসত্য সত্যের যে বিশেষ অনুশাসন, তা অদ্বিতীয়ভাবে নব্য-উদারপন্থী শাসনব্যবস্থার শেষ পর্যায়ের উপযুক্ত।১৫৫

উত্তরসত্যের মাধ্যম ও সঞ্চালক যে বৈদ্যুতিন তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প, তার প্রথম ও প্রধান নিবাস পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতে, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এই শিল্প বিশ্বায়িত ধনতন্ত্রের সবচেয়ে নবীন ও বর্ধিষ্ণু ক্ষেত্র। গণতন্ত্র আর ধনতন্ত্র— অনেক ক্ষেত্রের মতো এখানেও দুটোর মধ্যে আপাত (ও খানিকটা সত্যিকারের) সহাবস্থান, তার নীচে সমূহ বিরোধ। একদিকে আন্তর্জাল ও সমাজমাধ্যম বিশ্ব জুড়ে লক্ষকোটি সাধারণ মানুষকে ভাষা জুগিয়েছে, তথ্য সরবরাহ করেছে, নানা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে প্রভূত সাহায্য করেছে। কিন্তু একই সঙ্গে এই মাধ্যম বিশ্বের জনগণকে কতগুলি প্রবল শক্তির আধিপত্য মেনে নিতে শিখিয়েছে—শান্তিতে, আরামে, উপভোগ করতে-করতে, তাই বলতে গেলে অজান্তে। দরজা খুলে দিয়েছে— ব্যক্তিগতভাবে কেউ ঢুকি না ঢুকি, ঢুকলেও বেশিদূর এগোই না এগোই— বাস্তবের বদলে একটা অবাস্তব তথা অতিবাস্তব জগতের, সেখানকার উত্তরসত্যের রাজত্বের।

দুটো তুলনা দিলে বুঝতে সুবিধা হবে। একটা হল বৈদ্যুতিন পোষ্য: একটা যন্ত্র যাকে পোষা প্রাণীর মতো দেখভাল করতে হয়, খাওয়াতে ঘোরাতে আদর করতে হয়, ভালবাসতে হয়। ‘পোষ্য’টিও আওয়াজ করে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে, অবহেলা করলে অসুস্থ হয়, ‘মরে’ যেতে পারে পর্যন্ত। মনে হতে পারে, সাবেক কথা-বলা পুতুলের সঙ্গে এমন কী তফাত? তফাত এই, পুতুলটা ছিল কল্পনা বিস্তারের ভরকেন্দ্র; তার হাঁটা বা কথা বলার মতো দু-একটা ‘ক্ষমতা’ ঘিরে তার ক্ষুদ্র অভিভাবকটি নিজে নানা গল্প তৈরি করত। যান্ত্রিক পোষ্যের ক্ষেত্রে অনুকরণটা এমন বিশদ স্তরে যে কল্পনার অবকাশ নেই: গল্পটা কারখানা থেকে তৈরি হয়ে আসছে, ফলে যন্ত্রটাই মনিবকে চালিত করছে। বৈদ্যুতিন শক্তির অসামান্য দ্রুত ও নিবিড় ক্রিয়ার ফলেই এমন সার্বিক অনুকরণ সম্ভব হচ্ছে। আবার দেখছি, বৈদ্যুতিন জগতে গতি ও বিস্তারের বিস্ময়কর বৃদ্ধি কীভাবে গুণগত রূপান্তর ঘটাচ্ছে। ‘বৈদ্যুতিন বিপ্লবের’ এটাই মূল সূত্র। শেষ অবধি যা তৈরি হচ্ছে, তাকে বলা চলে ‘বৈদ্যুতিন বাস্তব’— দ্বিতীয় বা বিকল্প বাস্তব, অবাস্তবের বাস্তব। চতুর্থ অধ্যায়ে টিভির বিজ্ঞাপনের যে বিকল্প বাস্তবের কথা বলেছি, সেটা ছিল তুলনায় নেহাত ফিকে আর ক্ষণস্থায়ী।

দ্বিতীয় উদাহরণটা বিধ্বংসী। আমরা অনেকে অল্পবিস্তর কম্পিউটার গেম খেলি। কিছু লোক আছেন যারা শুধু খেলেন না, কম্পিউটার গেমের জগতেই বেঁচে থাকেন। এমন কিছু গেম অত্যন্ত আকর্ষক, বলতে গেলে সর্বগ্রাসী। তাতে ঢুকতে গেলে নিজের একটা নতুন নাম ও পরিচয় খাড়া করতে হয়, যা ক্রমশ একটা বিকল্প সত্তা, শেষ অবধি হয়তো মুখ্য সত্তা হয়ে দাঁড়ায়। এই নতুন পরিচয় সম্বল করে একজন মানুষ একটা পুরোদস্তুর কাল্পনিক জগতের বাসিন্দা হয়ে যেতে পারেন: কাজ করতে পারেন, ঘর করতে পারেন, যোগাযোগ বন্ধুত্ব এমনকী প্রেম করতে পারেন, টাকা রোজগার করে সেই জগতের নিজস্ব লেনদেনে খরচ করতে পারেন। এমন মানুষদের কাছে বাস্তব জগৎটা গৌণ, প্রায় অলীক— বেশির ভাগ লোকের কাছে গেমের কাল্পনিক জগৎটা যেমন। যতক্ষণ তাঁরা এই বৈদ্যুতিন বাস্তবে আবদ্ধ থাকতে পারেন, সমস্যা নেই। কিন্তু যখন তাঁদের অবধারিতভাবে ‘আসল’ বাস্তবে প্রবেশ করতে হয়— আর কিছু না হোক, খেতে শুতে রোজগার করতে— দুটো জগতের মধ্যে কী করে তাঁরা ভারসাম্য রাখেন? অনেকবার দেখলাম, গল্প মাত্রেই বাস্তব আর কল্পনার কেমন খেলা চলছে, এক এক গল্পে এক এক ভাবে। বৈদ্যুতিন বাস্তবের রাক্ষুসী গল্পে দুটোকে কীভাবে মেলাব? সেটা তো একাধারে আদ্যোপান্ত কল্পনা আর জলজ্যান্ত বাস্তব।

এও শেষ নয়। ব্যাপারটা আজ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বাস্তব জগৎটাই পুরোপুরি কল্পনায় নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছে, আদ্যোপান্ত নতুন করে ব্যাখ্যা হচ্ছে এক অলীক ধারণার বশে। ‘কিউএনন’ (QAnon) নামে এক বিচিত্র সামাজিক ব্যাধি আমেরিকাকে গ্রাস করে ইউরোপেও জাল বিস্তার করতে লেগেছে।১৫৬ অতি-দক্ষিণপন্থী এই বিকার (চিন্তা বা ভাবধারা বলার প্রশ্ন নেই) দুনিয়ার যত বিধান ও কাজকর্ম, বিশিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ঘিরে বিশ্বব্যাপী চক্রান্ত আর পাপাচারের এক অবিশ্বাস্য আষাঢ়ে গল্প ফাঁদে আর সেটাই বেদবাক্য মনে করে— বলে, তা থেকে মুক্তির একমাত্র পথ অতি চরম দক্ষিণপন্থী কোনও নেতা বা গোষ্ঠীর অনুসরণ। ‘স্বাভাবিক’ অবতারেই অতি-দক্ষিণ মনোভাব সামান্যতম উদার বা মানবিক অবস্থানকে সন্দেহ করে, আক্রমণ করে, অতি-বাম আতিশয্যের সঙ্গে একাকার করে ফেলে; কিন্তু সবটাই করে বাস্তবের গণ্ডীর মধ্যে, অতএব এমন চিন্তা কাজে পরিণত হয়ে বাস্তব সমাজে যথেষ্ট ছাপ ফেলে, হয়তো গোটা দেশের শাসনব্যবস্থার দখল পায়। কিউএননের কল্পনা কেবল আজগুবি অবাস্তব নয়, অমানবিক ও ক্ষতিকর। জাতিবিদ্বেষ, প্রতিষ্ঠান ধ্বংস ইত্যাদি প্রচলিত লক্ষ্য ছাপিয়ে তার অপবিশ্বাস আক্রমণ করে স্বাস্থ্যবিজ্ঞান অর্থব্যবস্থা প্রভৃতি সমাজের অপরিহার্য ভিত্তিগুলি, অকথ্য পাপের অভিযোগ আনে খ্যাতিমান সম্মানিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে।

কিউএনন যেন মানসিক মাদক। যারা এর পাল্লায় পড়ে, তাদের পক্ষে অভ্যস্ত সামাজিক ও পারিবারিক জীবনযাপন অসম্ভব হয়ে পড়ে; তারা গুটিয়ে যায় এক অসুস্থ একাকিত্বে। আসল বিপদ কিন্তু অন্য। সব অর্থেই চূড়ান্ত অ-সামাজিক এই মানুষগুলি নিজেদের মধ্যে নিবিড় সখ্যবিস্তার করে— ফলে আর একাকী থাকে না, হয়ে ওঠে এক অশুভ সামাজিক শক্তি। সবচেয়ে চিন্তার কথা, কিছু রাজনীতিক এদের অসুস্থ কল্পনাকে নিজেদের প্রোপাগান্ডার সঙ্গে যুক্ত করে ফয়দা লোটার চেষ্টা করেন। ২০২০র মার্কিন নির্বাচনে কিউএনন বলে-কয়ে আসরে নেমেছে। এই অতি-দক্ষিণ বাতুলতা যদি পার্শ্বশক্তি হিসাবেও দেশশাসনে ক্ষুদ্রতম ভূমিকার সুযোগ পায়, ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটতে পারে বলা বাহুল্য। অনুরূপ যে ধারণাগুলি ভারতে দানা বাঁধছে, তা নিয়ে আমাদেরও একই শঙ্কা হতে পারে।

ভয়ের সর্বশেষ কারণ আরও গভীরে। এই পাগলামি অল্প লোককেই পুরোপুরি গ্রাস করে; কিন্তু প্রচুর মানুষকে আংশিকভাবে আচ্ছন্ন করতে পারে, কিছু আপাত সুস্থ ব্যক্তি যেমন রোগের সংক্রমণ ছড়ায়। কিউএনন অসুস্থ অসম্ভব কল্পনার অফুরন্ত ভাণ্ডার। কিছু ‘স্বাভাবিক’ মানুষ যদি তার এক-আধটা গ্রহণ করে, সেই সঙ্গে আর সব দিকে বাস্তব জীবনের শর্ত মেনে চলে, সমাজের স্বীকৃত পরিচিত কাঠামোর মধ্যে সেই অবাস্তব মিথ্যাটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। অর্থাৎ কিউএননের বিশ্বাসগুলি আর ব্রাত্য প্রান্তিক ‘ফ্রিঞ্জ’এ আবদ্ধ থাকে না, সমাজের কেন্দ্রস্থিত হয়, উত্তরসত্যের রাজত্ব আরও কায়েম করে।

এখানেই উত্তরসত্যের মজ্জাগত বিপদ। আবার বলছি, অল্প লোকই আসল-নকল দুই জগতের জাঁতাকলে প্রাণান্তকভাবে আটকে পড়েন। কিন্তু তাঁদের দশা যেন একটা রূপক: বৈদ্যুতিন যুগে আমরা প্রায় সকলে অল্পবিস্তর এই দোটানায় পড়ে গেছি। বৈদ্যুতিন মাধ্যম আমাদের সামনে একটা বিকল্প জগৎ মেলে ধরে। সমাজমাধ্যমে দেখা যায় এই অবস্থার একটা বিশেষ আকর্ষক ও বিভ্রান্তিকর রকমফের। সমাজমাধ্যমে আমরা বেশিরভাগটা নিজেদের জীবনই মেলে ধরি। ভাবতেই পারি, এক্ষেত্রে বাস্তবের বাইরে যাওয়া দূরে থাক, আমরা তো দৈনন্দিন বাস্তবটাই প্রকাশ করছি। ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। সমাজমাধ্যমের প্রযুক্তি আমাদের ক্ষুদ্র পরিসরকে বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত করছে, টুকরো মুহূর্তগুলোকে বহুমাধ্যমে ধরে রাখছে। ফলে অভ্যস্ত বাস্তবেও একটা অচেনা উপাদান ঢুকে যাচ্ছে, আবহে আঙ্গিকে একটা বিকল্প অস্তিত্ব ইশারা করছে— দৈনন্দিনের মধ্যে থেকেও নতুন কিছু, বাড়তি কিছু। এতে নিঃসন্দেহে আছে মন মেলে দেওয়ার, নিজেকে প্রকাশ করার সত্যিকারের অবকাশ; তেমনি কিন্তু আছে জীবনটাকে একটা মনগড়া মনভোলানো রূপ দেওয়ার ঝোঁক, অবাস্তবের আমেজে ছেয়ে ফেলার আকর্ষণ।

সেই হাতছানিতে পুরোপুরি বিভ্রান্ত হন অল্প লোকে, কিন্তু সকলেই এক-আধটু সাড়া দিই। অগোচরে অবচেতনে ওই মাধ্যমের রীতিনীতি আমাদের ব্যবহারিক জীবনের রূপ পালটে দেয়, প্রত্যক্ষ বাস্তবটা যেন সেই ফ্রেমের মধ্যে দেখতে থাকি। ঘরে যাই ঘটুক, তা নিয়ে ফেসবুকে একটা পোস্ট না করলে, হোয়াট্সঅ্যাপে কটা ছবি না পাঠালে, মনে হয় অভিজ্ঞতাটা সম্পূর্ণ হল না। ভুললে চলবে না, উত্তরসত্যের ক্রিয়া কেবল বিষয়বস্তুতে নয়, মাধ্যমের প্রণালী ও প্রেক্ষিতে— শুধু ‘কী’ নয়, ‘কীভাবে’। যতই কম মাত্রায় হোক, এই মাধ্যমের প্রত্যেক অংশীদার হয়ে পড়েন একটা বিকল্প জগতের বাসিন্দা। কথাটা বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে? সাদামাটা ইমেলের সঙ্গে ফেসবুকের পার্থক্য ভেবে দেখুন, বুঝতে পারবেন— লুপ্তপ্রায় হাতে-লেখা চিঠির সঙ্গে তো বটেই।

আমাদের এই আটপৌরে বৈদ্যুতিন-বিলাসকে এবার তুলে আনা যাক রাজ্যপাটের স্তরে, বৃহৎ পুঁজির স্তরে, দুনিয়ার মালিকানার স্তরে। সেখানেও দেখব, নেতা-নির্ধারকেরা তাঁদের কর্মকাণ্ডকে দেখছেন ফ্রেমের মধ্য দিয়ে, বা রীতিমতো জাদু-চশমা দিয়ে। বাস্তবটা আর বাস্তব থাকলে চলছে না, এমন একটা কল্পবাস্তবে পালটাতে হবে যা দেখতেও ভাল লাগে (নিজের এবং অপরের চোখে), আবার যাতে মনে হয় দুনিয়াটা আমার একশো ভাগ দখলে আছে, এখানে আমি সত্যিই রাজা। আমরা দেখি, এই সর্বশক্তিমানেরা মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করছেন ফেসবুক-টুইটারের মাধ্যমে। এটা বহির্প্রকাশ মাত্র: তাঁদের পুরো কর্মকাণ্ড, পুরো দায়িত্বভার তাঁরা যেন পুরে দিতে চান সমাজমাধ্যমের একটা বিশ্বজোড়া অতিকায় সংস্করণের কাঠামোয়। সেই স্বয়ংসিদ্ধ বিকল্প জগৎ হঠাৎ দেখে আসলটার মতো লাগবে, কিন্তু তাতে সব কিছু হবে ঠিক যেমনটা তাঁরা চান। আসল দুনিয়াটাকে পোষ মানানো মুশকিল। সত্য বড্ড বেয়াড়া জিনিস, তাই চাই উত্তরসত্য।

এই বইয়ে আগাগোড়া দেখতে দেখতে আসছি, অন্যান্য সাংকেতিক প্রণালীর মতো ভাষা কেমন তার সাংকেতিক ধর্ম হারাচ্ছে, কমে আসছে তার অর্থবহতা। উত্তরসত্যের প্রক্রিয়া আরও কুটিল ও বিভ্রান্তিকর। তাতে মনে হয় ভাষা তার ধর্ম পালন করে চলেছে, বহির্বাস্তবের নানা জিনিস ইঙ্গিত করে তাদের সম্বন্ধে আমাদের অনেক কিছু জানাচ্ছে। মুশকিল হল, এই ধারণা ঠিক নয়। বহির্বাস্তবের কথা বলার ছলে উত্তরসত্যের ভাষা আমাদের বলছে তার স্বনির্মিত একটা জগতের কথা। একবার এই জগতে ঢুকে পড়লে আমরা সব কিছু বুঝতে ও বিচার করতে থাকি তারই নিয়মের দ্বারা; বাস্তবকেও এই জগতের অধীনস্থ করে ফেলি এবং তার মানদণ্ডে বিচার করি। এটা আমরা সহজে বুঝতে পারি না: উত্তরসত্যের জগৎ আপাতভাবে এতটাই আসলের মতো যে তফাত ধরা মুশকিল। তফাতটা কিন্তু মৌলিক: বিশেষ বিশেষ তথ্যের মিথ্যা বা বিকৃতি নয় (সেটা তো চিরকাল কাঁড়ি কাঁড়ি হয়ে আসছে), একটা আস্ত বিকল্প মানসিক জগৎ নির্মাণ, তার নিজস্ব জ্ঞানপ্রণালী সমেত— প্রায় জীবনপ্রণালী বলা যায়।

‘মানসিক জগৎ’ বললাম, বললাম ‘জ্ঞানপ্রণালী’; ইংরেজি হলে বলতাম mental universe, epistemology। উত্তরসত্যের প্রতিশ্রুত এই জ্ঞান আর বুদ্ধি কিন্তু ফাঁকির খেলা, কারণ তার সাহায্যে আমরা আসল বা বাস্তব কিছু জানছি না, বরং জানার থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। টাকার বাজারে টাকা যেমন বিমূর্ত অ-সাংকেতিক, ভাষার বাজারি চুম্বকধর্মী প্রয়োগে ভাষাও অর্থনিঃস্ব অ-সাংকেতিক, তেমনি উত্তরসত্যের বাজারে (বাজার বলছি কারণ তার লক্ষ্য কোনও রাষ্ট্রিক বা আর্থিক কার্যসিদ্ধি) জ্ঞানকণিকাগুলি সাচ্চা তথ্যপ্রদান করছে না: একটা অলীক বার্তা দিয়ে সমান অলীক অন্য একরাশ বার্তাকে সমর্থন করছে, বাঁচিয়ে রাখছে।

তত্ত্বকথা ছেড়ে বাস্তব দৃষ্টান্ত দিলে আমার বক্তব্য স্পষ্ট হবে— এতই স্পষ্ট ও সরল যে মনে হবে, ‘এই ব্যাপার! এ তো সবাই জানি, এ নিয়ে বলার কী আছে।’ মনে করিয়ে দিই, উত্তরসত্যের জগতে আমরা খুব সহজে স্বাভাবিকভাবে ঢুকে যাই, টেরই পাই না। ধরুন একটি লোক কোনও কাজের কাজ করে না, তবু সকলে তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ব্যাখ্যা চেয়ে শুনলেন, ‘না না, তুমি জানো না ওর কত গুণ, কত কীর্তি।’ সেই কীর্তির নজির মিলবে না, বা দেখা যাবে তাতে কারও উপকার হয়নি। অথবা কোনও জিনিস কিনে ঠকলেন, কিন্তু বিক্রেতা বা প্রস্তুতকারক তো বটেই, অন্য লোকেও বলল, ‘বললেই হবে, অত বড় সংস্থার তৈরি!’ ‘অত বড় সংস্থা’র ধারণাটা কায়েম হয়েছে যত না আয়তনের ভিত্তিতে, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রচারের দৌলতে, ব্র্যান্ড খাড়া করে।

একই ব্যাপার আরও বড় মাত্রায় দেখি যখন কোনও রাজনৈতিক দল তেমন কোনও উপকার না করে, বা বিশেষভাবেই খারাপ কাজ করে, ফের ভোটে জিতে ক্ষমতায় ফেরে। অনুগামীরা বলেন, ‘হবেই তো, এরা কত ভাল কাজ করেছে!’ সেই ভাল কাজের হিসাব মেলে না, পরিসংখ্যান অন্য কথা বলে; কিংবা দেখা যায় ভাল কাজের খারাপ ফলই বেশি; বা কাজগুলো প্রচারের স্তরে রয়ে গেছে, বাস্তবে প্রায় কিছুই হয়নি। ‘ভাল কাজ’টা যদি পূর্বতন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অঙ্গ হয়, তার সাফল্যের অতিরঞ্জিত বা মিথ্যা বিবরণ প্রচার হয়। তাতেও না কুলোলে জোটে অজুহাত আর স্তোকবাক্য, কথার সমর্থনে তথ্যপ্রমাণের বদলে আরও আরও কথা— আরশির একটা ছায়ার পিঠে আর একটা ছায়া। এটাই উত্তরসত্যের জগৎ: কী আছে বা কী করছি তা নয়, কী বলছি বানাচ্ছি, একটা মনগড়া জগৎ কী দিয়ে সাজাচ্ছি, মানুষকে কী গ্রহণ করাতে বা অশিষ্ট ভাষায় ‘খাওয়াতে’ পারছি।

এমন ক্ষেত্রে বাস্তব পরিস্থিতিটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেও অনুগামীদের ভক্তিতে চিড় ধরে না। আসল কথা, তাঁদের উপাস্যদের ঘিরে অতিকথা সৃষ্টি হয়েছে, লোকে তাতে বিশ্বাস করে। সেই অতিকথার জগতে পুরোপুরি মজে গেলে, বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও বাস্তব না মানলে, বলা চলে আমরা উত্তরসত্যের নাগরিক। আলোচক লী ম্যাকিন্টায়ার সখেদে বলেছেন, উত্তরসত্যের জগৎ হচ্ছে এমন, যেখানে রাজনৈতিক নেতারা বাস্তব তথ্য অস্বীকার করলে তাঁদের বিন্দুমাত্র খেসারত দিতে হয় না।১৫৭ ডনাল্ড ট্রাম্প স্বমহিমায় আরও মুগ্ধকর দাবি করেছেন: তিনি যদি নিউ ইয়র্কের রাজপথে কাউকে গুলি করে মারেন, তাতেও তাঁর বিন্দুমাত্র ভোট কমবে না।১৫৮ তবে আপত্তিকর, অশ্লীল ও ভীতিপ্রদ উক্তিতে ট্রাম্পকে বহু যোজন ছাড়িয়ে গেছেন ফিলিপিন্সের রাষ্ট্রপতি রোদ্রিগো দুতের্তে।

ঈশ্বরবিশ্বাসের সমর্থনে প্রমাণ চাওয়া হয়তো অনুচিত, কারণ সেটা ব্যক্তিবিশেষের মানসিক অবস্থান। কিন্তু যে মানুষ বা সংস্থা বা ব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের বাস্তব জীবনমরণের সম্পর্ক, তাদের কীর্তির যাচাই না করে যুক্তি-তথ্য-প্রমাণের ঊর্ধ্বে তুলে ধরা অসমীচীন মনে হতে পারে, যেন ঈশ্বরের সমগোত্রীয় ভাবা হচ্ছে। যে মানুষ (বা সংস্থা বা ব্যবস্থা) সত্যি হিতকর, তাঁদের ভাবমূর্তি সংকেতের মতো। তাঁদের কথা ভাবলে আমাদের দৃষ্টি যায় তাঁদের সম্পন্ন কোনও কাজে, এবং তার লাভ বা উপকারের দিকে: সেটাই তাঁদের মহত্ত্বের প্রমাণ। আর যদি ‘প্রমাণ’ হয় নিছক তাদের মহিমাকীর্তন, দৃষ্টি তাঁদের উপরই আবদ্ধ থাকে, বুঝতে হবে আমরা অতিকথা ও উত্তরসত্যের অনুগামী।

উত্তরসত্যের জগতের তাই বিশেষ করে তুলনা চলে টাকার বাজারের সঙ্গে, যেখানে টাকার বাস্তব বিনিময়মূল্য বড় কথা নয়। তার বদলে টাকারই একটা যদৃচ্ছ মূল্য ধরে, একটা বিমূর্ত পণ্যের মতো সেটা নিয়েই লেনদেন হয়; বাস্তব পণ্যের সঙ্গে আদৌ যোগ থাকলে তা নেহাত মনগড়া, ব্যবসার প্রয়োজনে ফাঁদা গল্প। দ্বিতীয় অধ্যায়ে ‘ডেরিভেটিভস’এর কথা বলেছিলাম, যেখানে বাস্তব পণ্যের লেনদেনের ভিত্তিতে অন্য বায়বীয় লেনদেন দফায় দফায় হতে থাকে, হতেই থাকে: আসল পণ্যটা ক্রমে অদৃশ্য হয়ে যায়, তার মূল্যের সঙ্গে এই কাল্পনিক লেনদেনের কোনও যোগ থাকে না। উত্তরসত্যের গতিবিধি হুবহু এক ধাঁচের। কাজ-উৎপাদন-উপকারিতা-জনকল্যাণ সংক্রান্ত সব দাবি, সব নির্মাণের বাস্তব প্রয়োগ থাকা স্বাভাবিক। তার বদলে যদি দেখি

• কাজ নিয়ে আলোচনাতেও আদানপ্রদান হচ্ছে কথার পিঠে কথার;

• প্রতিশ্রুতি আর তার পূরণ দুটোই মন কাড়ছে একই ম্যাজিক-দেখানো রেটরিকের জোরে;

• জরুরি সরকারি নীতিনির্দেশের ভাষা ও ঘোষণার ঢং পণ্য প্রচারের বিজ্ঞাপনের মতো;

• গণরাজ্যের নৈর্ব্যক্তিক নীতি ও প্রকল্প কোনও ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নামাঙ্কিত;

• সব সরকারি তথ্য শুনে খুশি লাগছে আর বেয়াড়া তথ্যগুলো হারিয়ে যাচ্ছে—

বুঝব এটা উত্তরসত্যের আরশিনগর। তার ভাষার কোনও ‘অর্থমূল্য’ নেই, পোক্ত গ্রাহ্য বাস্তবের স্তরে কোনও কিছু নির্দেশ করছে না।

ঘোর বাস্তবের চিত্র তুলে ধরলাম, কিন্তু আমার আসল উদ্দেশ্য তার অস্তিত্বের ব্যাখ্যা। আমার সমস্ত আলোচনার মধ্য দিয়ে যে মূল ধারণাটা বইছে তা হল, মানুষ বাস করে সংকেতের আবহে। সংকেতের মাধ্যমেই আমরা বহির্বিশ্বকে নির্দেশ করি, তার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করি, তাকে জানি বুঝি বদলাই। আজকের দুনিয়ায় সব সংকেতপ্রণালীর অবক্ষয় ও অবমূল্যায়ন ঘটছে। তার ফলে আমাদের চটজলদি কিছু সুবিধা হতে পারে কিন্তু গভীর বৌদ্ধিক ক্ষতি হচ্ছে, জগৎকে আমরা কম করে বুঝছি। উপরন্তু— যদিও সেটা আমার আলোচ্য ছিল না— এই বৌদ্ধিক অবনমনের সঙ্গে নৈতিক অবনমনের একটা যোগ আছে। নৈতিক মূল্যবোধের মূলে আছে যুক্তির প্রয়োগ, ন্যায্যতার বিচার। বুদ্ধির বিকারের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে ও রাষ্ট্রে মূল্যবোধের বিকার, ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও মঙ্গলসাধনে বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কা।

এগুলি যদি আমরা উদ্বেগের কারণ বলে মনে করি, প্রতিকারের প্রথম ধাপ হতে হবে বুদ্ধি আর চিন্তার সংস্কার। এই বই সেই উদ্দেশ্যে শিশুর প্রথম পদক্ষেপের মতো। দান্তের কথা আর একবার মনে করা যাক। আবেগ-অনুভুতি-প্রবৃত্তি পশুদেরও আছে, বুদ্ধি আছে কেবল মানুষের। বুদ্ধিভ্রংশ হলে আমাদের রইল কী?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *