৬. অতিকথা

৬. অতিকথা

এই বইয়ের গোড়া থেকে আমার আলোচনায় মুখ্য স্থান পেয়েছে যুক্তিপন্থী মনন ও তার সাংকেতিক রূপায়ণ। গত অধ্যায়ে পাশাপাশি আর একটা দৃষ্টিকোণ উপস্থিত করেছি। বলেছি, যুক্তিপন্থার বৌদ্ধিক জগৎ, এবং ভাষার মাধ্যমে তার সাংকেতিক প্রকাশ ও বিস্তার, মানুষের ইতিহাসে অপেক্ষাকৃত নতুন ধারা। মানবসভ্যতার বৃহত্তম অংশ জুড়ে থেকেছে (এবং আজও আছে) চেতনার অন্য এক ধারা, যার অবস্থান বিশ্বাসের বিস্তীর্ণ ভূমিতে। তার মননের পদ্ধতি যুক্তিমুক্ত; ঐকান্তিক গ্রহণ ও ব্যাপক প্রচলনের মধ্য দিয়ে তা স্বীকৃতি পায় ও মানুষের জীবনে স্থান করে নেয়।

এটাও কিন্তু দেখেছি, বিশ্বাসের মধ্যে প্রায়ই প্রচুর বৌদ্ধিক উপাদান থাকে, যুক্তি-প্রমাণকে অগ্রগণ্য না মানলেও অনেকটা জায়গা ছেড়ে দেওয়া হয়। সভ্যতার ইতিহাস জুড়ে যত ভাবনাচিন্তা সৃষ্টিশীলতা, যত ফলপ্রসূ উদ্ভাবন ও কল্যাণকর কাজ, তার একটা বড় অংশের চালিকাশক্তি হল বিশ্বাস, বিশেষ করে ধর্মবিশ্বাস। বিজ্ঞানের সঙ্গেও ধর্মবিশ্বাসের সহাবস্থান ঘটে, বহু কৃতী বিজ্ঞানী নিষ্ঠাবান ধার্মিকও বটে। মোটামুটি বলা চলে, আধুনিক পৃথিবীতে যুক্তিপন্থার সঙ্গে বিশ্বাস ও আরও কিছু যুক্তিমুক্ত ধারার শুধু সহাবস্থান নয়, যথেষ্ট আদানপ্রদান আছে। দুটি ক্ষেত্রের বৌদ্ধিক লক্ষ্য বিপরীত হলেও জ্ঞানপ্রণালীতে (epistemology) যথেষ্ট সমাপতন আছে; প্রায় বলা চলে, তারা অনেকটা একই জ্ঞানপ্রণালী বিপরীত উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করছে।

এই আধুনিক পরিশীলিত বিশ্বাস যেন যুক্তিমুক্ত জগতের সামনেকার খোলামেলা প্রান্তর। তার পিছনে আছে এক বিস্তীর্ণ উপত্যকা, মিথ (myth) বা অতিকথার রাজত্ব। অতিকথা নিয়ে পাশ্চাত্যে ভাবনা শুরু হয় প্রথমে গ্রীক-লাতিন, ক্রমে ভারতীয় সমেত অন্যন্য সভ্যতার প্রাচীন পৌরাণিক আখ্যান কেন্দ্র করে। ঔপনিবেশিক যুগে ইউরোপীয়দের বিশ্বময় ভ্রমণ শুরু হলে, তার সঙ্গে যোগ হয় তৎকালীন নানা সমাজের— প্রায়ই তথাকথিত ‘আদিম’ বা ‘অনুন্নত’ জনগোষ্ঠীর— ‘জীবন্ত’ অতিকথার নৃতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ। তারপর বিশ শতকের গোড়ার দিকে অবচেতন মনের ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, সব মানুষেরই অবচেতনের গভীরে অতিকথার একটা স্তর লুকিয়ে আছে।

একটা সাবেক ধারণা তাই আজও দূর হয়নি যে, আধুনিক শিল্পযুগের সভ্যতায় অতিকথার বিশেষ ভূমিকা নেই, ওটা প্রাচীন বা ‘আদিম’ সভ্যতার বৈশিষ্ট্য। আমরা ভাবতে চাই, অতিকথার মানসিকতা আধুনিক মননের বিপরীত মেরুর, কালের যাত্রায় তাকে পিছনে ফেলে যুক্তির জগতে আমরা অবতীর্ণ হয়েছি। এমনকী আধুনিক বিশ্বাসেও যুক্তির একটা ভূমিকা আছে, যা প্রাচীন অতিকথার জগতে ছিল না। হিন্দুধর্মে পৌরাণিক উপাদানের যে বিশিষ্ট স্থান, তার সূত্র অবশ্যই অতিকথা, কিন্তু পরবর্তীকালের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা অতিকথার প্রণালীতে নয়।

নৃতাত্ত্বিক আর সমাজতাত্ত্বিকেরা কিন্তু বহুদিন এমন ভাবা ছেড়ে দিয়েছেন। অতিকথার মননপ্রণালী আজ আদিম-প্রাচীন-আধুনিক সবরকম চেতনার সঙ্গেই যুক্ত করা হয়। বিশেষ করে রোলাঁ বার্ত, ক্লদ লেভ়ি-স্ত্রাউসের মতো গঠনবাদী (structuralist) চিন্তাবিদেরা নানাভাবে দেখাবার চেষ্টা করেছেন, সব সভ্যতার মূল মানসিক কাঠামোতে অতিকথার গঠনরীতি উপস্থিত। অতিকথা আদ্যিকালের কল্পকাহিনি নয়, মননের একটা সজীব স্বকীয় ধারা, আমাদের ক্রিয়াকলাপ ভাবনাচিন্তায় প্রভাব বিস্তার করছে। তার দৃষ্টিভঙ্গি ও মননপ্রণালী কালের বিচারে প্রাচীন, সেই অর্থে ‘আদি’ এমনকী ‘আদিম’, এবং আধুনিক চিন্তাপ্রণালীতে প্রায়ই নেপথ্য ও অস্বীকৃত। তার মানে এই নয় যে সেই মননপ্রণালী লুপ্ত বা লুপ্তপ্রায়, পুরাকালের ভগ্নাবশেষ মাত্র। এই দুর্জ্ঞেয় শক্তি যতটা আদিম ততটাই সমকালীন, যতটা ‘ওদের’ ততটাই ‘আমাদের’। নৃতাত্ত্বিক এডওয়ার্ড এভান্স-প্রিচার্ডের সুচিন্তিত মন্তব্য:

প্রশ্নটা ‘আদিম বনাম সভ্য’ মানসিকতার নয়; প্রশ্ন হল যে-কোনও সমাজে আদিম ও সভ্য, উভয় ধরনের চিন্তার পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে, মনন ও উপলব্ধির বিভিন্ন স্তর নিয়ে। … সভ্য ও আদিম চিন্তাপ্রণালীর বিরোধ নয়, যে-কোনও সমাজে বা সাধারণভাবে মানবসমাজে উভয়ের কী কী প্রক্রিয়া, এটাই জিজ্ঞাস্য।৬২

‘আদিম’ আর ‘সভ্য’— এই তফাতটা না করলেই সবচেয়ে ভাল, যদিও কখনও কখনও করতেই হয়, যেমন পরে একটা বিশেষ প্রসঙ্গে আমার এই আলোচনাতেই।

সুতরাং দেখা যাক, অতিকথার বৈশিষ্ট্য কী। কাজটা সহজ নয়: অতিকথার গূঢ় প্রণালী আমাদের স্বীকৃত মানসিক প্রণালী থেকে আদ্যোপান্ত আলাদা, একটার ভাষায় অন্যটা আলোচনা করা কঠিন। তা ছাড়া অতিকথা নানা রকমের হয়, সব কথা সব ক্ষেত্রে খাটে না। অনেক তত্ত্ব ঘেঁটে অতিকথার ভাষ্যকার জি এস কার্ক শেষ অবধি এটুকুই বলতে পেরেছেন, অতিকথার সাধারণ লক্ষণ ফ্যান্টাসি— বাস্তববহির্ভূত বা বাস্তববিরোধী কল্পনা, বিশেষ করে স্বপ্নে অবাস্তবের যে রূপ দেখা যায়। বাস্তববিরোধী চরিত্রটা একেবারে সার্বিক: ‘স্বাভাবিক ক্রিয়া, স্বাভাবিক যুক্তি, স্বাভাবিক সম্পর্কের প্রত্যেকটা নিয়ম মুলতবি থাকছে বা বিকৃত হচ্ছে।’৬৩

এটা বলা যথেষ্ট নয়। যে-কোনও স্বপ্নের বিবরণকে আমরা অতিকথা বলব না, যেমন বলব না বিজ্ঞানকল্পের কাহিনিকে। আমি তাই আর একটা মৌলিক লক্ষণ যোগ করব: অতিকথার ফ্যান্টাসি (সব ফ্যান্টাসির মতোই) বাস্তববহির্ভূত, কিন্তু একই সঙ্গে তা গভীরভাবে বাস্তবের সঙ্গে সম্পৃক্ত, অতিবাস্তব উপায়ে বাস্তবকেই তুলে ধরছে, তার ব্যাখ্যা করছে বা প্রয়োগ করছে: সেটা হতে পারে প্রকৃতির কোনও ঘটনা বা প্রক্রিয়া, সমাজের কোনও অনুশাসন, বহির্বিশ্বের সাধারণ কোনও লক্ষণ বা সূত্র। দিকপাল নৃতাত্ত্বিক ক্লদ লেভ়ি-স্ত্রাউস কার্যত বলছেন, আধুনিক বিজ্ঞান অপেক্ষাকৃত হালে যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, অতিকথা সেখানে পৌঁছে গেছে অনেক আগেই: বিচিত্র অবিন্যস্ত উপাদানে ভরা এই জগৎটাকে একটা সংহত রূপ দেওয়ার কাজে। বরং অতিকথাই কাজটাকে আরও বড় করে হাতে নিয়েছে (আর সেজন্যই অত সফল হয়নি): অতিকথা অনেক কিছু যুক্ত করে, এক করে দেখে, যা আমরা আধুনিক দৃষ্টিতে দেখি পৃথক ও বিচ্ছিন্ন হিসাবে।৬৪

অতিকথা সর্বার্থে যুক্তিবিরোধী নয়। ‘যুক্তি’ মানে তো ‘যুক্ত’ করার ক্ষমতা, একটা জিনিসের সঙ্গে আর একটা যোগ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছনো। অতিকথার নিজস্ব প্রণালীতে তার দৃষ্টান্ত সর্বত্র। অতিকথার একটা বড় ভূমিকা হেতুজ্ঞাপক (aetiological), অর্থাৎ কোনও কিছুর কারণ বা উৎপত্তির বিবরণ দেওয়া, কার্যকারণ সম্বন্ধ স্থাপন করা: একটা নদী বা পর্বত কী করে সৃষ্টি হয়েছে, কোনও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া কী করে ঘটে ইত্যাদি। বা যোগটা উলটে অতিকথার উদ্দেশ্য হতে পারে কোনও কিছু ঘটানো: বৃষ্টি নামানো, ফসল ফলানো, অসুখ সারানো প্রভৃতি।

আর এক প্রয়োজনেও অতিকথা বিভিন্ন জিনিস ‘যুক্ত’ করে: তা হল সেগুলি শ্রেণিভুক্ত করার জন্য। এই কার্যকারণ নির্দেশ বা শ্রেণিভাগের সূত্র আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে মিলবে না, কিন্তু তার নিজস্ব ‘যুক্তি’ অবশ্যই আছে। সেই যুক্তি অনুসারে কিন্তু সব প্রাণী একটা ভাগে বা বর্গে, তেমনি সব গাছ, সব তারা, সব নদী ইত্যাদি এক-এক ভাগে ফেলা হচ্ছে না। একেবারে অন্য বিচারে হয়তো একটা তারা, একটা প্রাণী, একটা গাছ আর একটা মানুষ একত্র করা হচ্ছে কোনও কল্পিত গুণ বা উৎপত্তির বিচারে; আর একপ্রস্থ তারা-প্রাণী-গাছ-মানুষ তেমনি আর এক সমষ্টিতে। সূত্রটা ‘কল্পিত’ বললাম বটে, কিন্তু ওই মননপ্রণালীতে ওটাই ভাবসিদ্ধ, ওটাই যথার্থ। আমরা সচরাচর যুক্তি বলতে যা বুঝি, তা থেকে অতিকথার যুক্তি শুধু আলাদা নয়, প্রবল ও মৌলিকভাবে স্বকীয়, এবং— সবচেয়ে বড় কথা— গ্রাহ্য বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন। অতিকথার মননের ধারা অবরোহী (deductive), মন থেকে কিছু ঠিক করে সেটা বহির্বাস্তবে প্রয়োগ করে। যুক্তিপন্থার ধারা আরোহী (inductive), বহির্বাস্তব থেকে কোনও সূত্র জোগাড় করে সেই অনুসারে মনস্থির করে।৬৫ একটা নদী পাহাড় থেকে নামছে। বিজ্ঞান বলবে, ওটা গ্রীষ্মের তাপে গলা বরফ; অতিকথা বলতে পারে ওটা এক শোকার্ত দেবতার অশ্রু, শোকের কাহিনিও একটা তৈরি করে ফেলবে। আর এক দিক দিয়ে বলা যায়, অতিকথার প্রণালী সংশ্লেষক (synthetic), তাতে অনেক জিনিস সমন্বয় করে একটাই সামগ্রিক সত্তা হিসাবে দেখা হয়; যুক্তিপন্থার প্রণালী বিশ্লেষক (analytic), তাতে একটা জিনিসই ভেঙে তার উপাদানগুলি আলাদা আলাদা করে দেখা হয়, জিনিসটার গঠন কী তা বোঝার চেষ্টা হয়।

আরও কিছু গুরুতর বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা বাকি; কিন্তু তার আগে একটা জবানবন্দি। অতিকথার উন্মেষ, গঠন ও চরিত্র নিয়ে নৃতাত্ত্বিকদের বিতর্কের শেষ নেই। এর পর কিছুক্ষণ আমি যে ধারা অনুসরণ করব, তার মুখ্য প্রবক্তা বিশ শতকের প্রথমার্ধের জার্মান দার্শনিক এর্ন্স্ট কাস্‌সিরের। নৃতত্ত্বে গবেষণা তারপর নানা পথে বহুদূর এগিয়েছে, কাস্‌সিরেরের বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে;৬৬ তবে তাঁর চিন্তা এখনও সমাদৃত। আমি তাঁকে অনুসরণ করছি বিশেষ করে এইজন্য যে অতিকথা সম্বন্ধে তাঁর ভাবনা বর্তমানকাল নিয়ে আমার আলোচনার পক্ষে গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক। কাস্‌সিরের ছিলেন ইহুদি, হান্না আরেন্টের আগের প্রজন্মের। ইনিও হিটলার-রাজ থেকে আশ্রয় নিয়ে জীবনের শেষ ক’টা বছর আমেরিকায় কাটান, যদিও আরেন্টের মতো নাৎসিদের হাতে বন্দি বা নিগৃহীত হননি। তাঁর গবেষণার দুটো প্রধান বিষয় ছিল সংকেততত্ত্ব আর অতিকথা। এই দ্বিবিধ চর্চার ভিত্তিতে তাঁর শেষ বই রাষ্ট্রিক অতিকথা (দ্য মিথ অভ দ্য স্টেট)-এ তিনি নাৎসি রাজত্বের স্বরূপ সন্ধান করেছেন, বিচার করেছেন রাষ্ট্র নিয়ে তার অতিকথা এবং সেই অতিকথা নির্মাণে ভাষার ভূমিকা। তাঁর চিন্তায় যুক্ত হয়েছে অতিকথার প্রাচীন ও আধুনিক পর্যায়, নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োগ। কাস্‌সিরের মারা যান ১৯৪৫ সালের এপ্রিলে, বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার (এবং বইটি প্রকাশ হবার) কয়েক মাস আগে। বলা চলে, একুশ শতকের দুনিয়ার হালচাল তাঁর চিন্তার প্রচুর নতুন প্রমাণ জুগিয়েছে। আমার পরবর্তী আলোচনা কিছুটা তাঁর ভিত্তিতে, তবে বিশদ পর্যবেক্ষণ ও অনেক তত্ত্বচিন্তা একান্তই আমার।

অতিকথার মননপ্রণালীর আলোচনায় ফিরে যাই। এই প্রণালীতে কোনও কিছু অধিগত হয় সাংকেতিক পদ্ধতিতে নয়, সরাসরি। সেটা আমরা উপলব্ধি করি একটা অবিচ্ছেদ্য বোধ হিসাবে, যা বিশ্লেষণ করে বুঝতে হয় না, একটা উপাদানের সঙ্গে আর একটার সম্পর্কস্থাপন করতে হয় না, সবটা একসঙ্গে গ্রহণ করতে হয়। একটা বস্তুকে ঘিরে যদি ভাব বা শক্তির পরিমণ্ডল থাকে, দুটোকে আলাদা করা হয় না; বস্তুটাকে ওই ভাব বা শক্তির কেবল প্রতিভূ নয়, তার বাস্তব রূপ বা অবতার হিসাবে দেখা হয়, এবং সেই অবতারকে প্রায়ই দেখা হয় একটা প্রাণবন্ত সত্তা হিসাবে।

একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। এই মানসিকতার বহুচর্চিত প্রকাশ (নৃতাত্ত্বিকদের কাছে প্রায় বস্তাপচা) হচ্ছে কোনও প্রাকৃতিক শক্তিকে দেবতা হিসাবে দেখা। দেবতার মূল সত্তা বা দৈবপরিচয় থেকে তাঁর মূর্ত অবয়বকে আলাদা করে দেখা হয় না, এবং কোনওটাই আলাদা করা হয় না তিনি যে প্রাকৃতিক বস্তু বা শক্তির অবতার, তার থেকে। ইন্দ্র কেবল বজ্রধারী দেবতা নন, বজ্রের মূর্তিমান প্রতিভূ। আবার বজ্র হল ইন্দ্রের দৈব সত্তার প্রতিভূ: বজ্রপাত শুধু তাঁর শক্তির প্রকাশ নয়, স্বয়ং ইন্দ্রের উপস্থিতি বা আবির্ভাব। দেবতার মূর্তিমান রূপ, বজ্রের প্রাকৃতিক রূপ, আর বজ্রের নিহিত শক্তি, যা দেবতার শক্তি বলে ভাবা হচ্ছে— সবগুলি এক যুগ্ম সত্তায় মিলিত হচ্ছে। প্রকৃতির যত শক্তি, বস্তু বা প্রাণী— নদী-মাঠ-পাহাড়, গাছপালা, জীবজন্তু— বা মানুষের মনের যত ক্ষমতা, ধারণা ও প্রবৃত্তি— যে কোনওটা অবলম্বন করে এমন যুগ্ম নির্মাণ গড়ে উঠতে পারে। দেবতা এবং প্রাণী বা বস্তু, আধিভৌতিক আর আধিদৈবিক, দৃশ্য রূপ আর অদৃশ্য ভাব বা শক্তি— সব মিলে একটাই সত্তা হিসাবে দেখা হয়। এই যে ‘সব মিলে’ বললাম, যেন আদতে এগুলি আলাদা আলাদা উপাদান, এটাও আমাদের আধুনিক চিন্তার প্রতিফলন। অতিকথার অনুভূতিতে এগুলি অবিচ্ছেদ্য, একই সত্তার অখণ্ড প্রকাশ।

কালের বিচারে এটা অবশ্যই মানবচেতনার প্রাচীন ও সেই অর্থে ‘আদিম’ স্তর। বহির্জগৎকে যুক্তি ও পর্যবেক্ষণ দিয়ে জানাবোঝার আগে, নিজের মানসিক শক্তি দিয়ে সাংকেতিক প্রণালীতে (অর্থাৎ ভাষায়) ব্যক্ত করার আগে, মানুষ জগৎটাকে জেনেছে বুঝেছে এমন প্রত্যক্ষ অবিশ্লেষিত রূপে: সরাসরি যা দেখছে সেটাকেই গ্রহণ করেছে, গুরুত্ব দিয়েছে, সেটা ঘিরে নির্মাণ করেছে ব্যাখ্যান (discourse) নয়, আখ্যান বা কাহিনি (narrative)। সে কাহিনি নির্মাণে অবশ্যই মনন আছে, যুক্তি আছে; কিন্তু তার চরিত্র পরবর্তী যুগের কাহিনির মতো নয়, দুনিয়াটা একেবারে অন্যভাবে তুলে ধরছে।

কাহিনি মানে তো গল্প। আধুনিক পৃথিবীর চাহিদা মেটাতে গল্পের ব্যবহার আমরা দেখেছি, দেখেছি সেখানে কল্পনা আর বাস্তব কেমন পরস্পরের সঙ্গে খেলা করে। অতিকথায় কিন্তু বাস্তব আর কল্পনা এক অভিন্ন চেতনার বস্তু। মানুষের মনের যত নির্মাণ, যত ভাব অনুমান অনুভূতি (আজ যাকে আমরা কল্পনা বলি) সবই অঙ্গীভূত বহির্বাস্তবের উপলব্ধির মধ্যে— সেটা ‘নিয়ে’ বা ‘সম্বন্ধে’ নয়, সেটার অবিচ্ছেদ্য উপাদান হিসাবে। বহির্বস্তুকে মানুষ গ্রহণ করছে চিন্তার মধ্য দিয়ে ছেঁকে নয়, সরাসরি— ওটাকেই একমাত্র অনুধেয় হিসাবে; সে সম্বন্ধে নিজে যা কিছু ভেবেছে সৃষ্টি করেছে, তাও দেখা হচ্ছে বস্তুর অন্তর্গত গুণ হিসাবে, মানুষের আরোপিত বলে নয়। বস্তুর ওই স্বকীয় উপস্থিতিটাই আসল, মানুষ বা মানুষের উপলব্ধি নয়— সেই উপলব্ধির কোনও পৃথক সজ্ঞান অস্তিত্বই নেই। বাস্তব আর মনোগত, প্রাকৃত আর অতিপ্রাকৃত— সব মিলিয়ে একটা অভেদ্য সংমিশ্রণ। বস্তুটাতে যদি কোনও আধিদৈবিক গুণ আরোপ করা হয়, সেটাকে একেবারে দেবতা বানিয়ে ফেলা হচ্ছে।

তেমন অভেদ্য যোগ বস্তু আর উচ্চারণে। এই আদি স্তরে ভাষার ব্যবহারও বিশ্লেষক নয়, সংশ্লেষক: কথা নয়, অতিকথা। অতিকথার ভাষা শুধু সংকেত হয়ে বস্তুকে নির্দেশ করে না; বস্তুটা অতিপ্রাকৃত বা আধিদৈবিক পরিচয় লাভ করে, আর সেই আধিদৈবিক শক্তি তার নামের মধ্যে নিহিত থাকে, ভাষায় বা উচ্চারণে সঞ্চারিত হয়— ভাষা হয়ে ওঠে মন্ত্র বা জাদুর বচন, বাঙ্ময় শক্তির আধার। এই ভূমিকায় ভাষা সাংকেতিক নয়, তদ্ভব: বস্তুকে নির্দেশ করছে না, প্রকাশ করছে, বস্তুটার অঙ্গ বা গুণ হয়ে উঠছে।৬৭

ভাষাচেতনার এই পর্যায়ের বিপরীত মেরুতে আছে আমাদের অভ্যস্ত ভাষাপ্রণালী, যেখানে বস্তু আর উচ্চারণ দুই পৃথক সত্তা, ভাষার ভূমিকা মন্ত্রের নয় সংকেতের। প্রথম অধ্যায় থেকে দেখে আসছি, আধুনিক ভাষাচিন্তায় নির্দিষ্ট বস্তু আর নির্দেশক শব্দের কোনও অঙ্গাঙ্গি যোগ নেই: বস্তুটা বহির্বাস্তবের অঙ্গ কিন্তু শব্দটা মনগড়া, বস্তুটাকে নির্দেশ করছে কেবল ওই ভাষাগোষ্ঠীর অভ্যাস বা প্রচলনমতো। ভাষার এই সাংকেতিক প্রণালীর মাধ্যমে জগৎটা আমাদের চিন্তায় একটা সম্যক রূপ পায়, সেটা ব্যক্ত করার ও তার উপাদানগুলি সংগঠিত করার একটা উপায় সৃষ্টি হয়। এর পরের পর্যায়ে, ভাষার আর এক দফা ব্যবহারে, তত্ত্ব যুক্তি ও পর্যবেক্ষণ দিয়ে সেই জগৎকে ব্যাখ্যা করা হয়। আমরা দেখেছি, অতিকথাও জগৎকে ব্যাখ্যা করতে চায়, তার অসংখ্য পৃথক উপাদানকে একটা সংহত উপলব্ধির মধ্যে আনতে চায়; লেভ়ি-স্ত্রাউসের ভাষায়, ‘বহুত্ব ছেঁচে তুলে আনে একত্ব, একত্ব ছেঁচে বহুত্ব; বৈচিত্র্য ছেঁচে অভিন্নতা, অভিন্নতা ছেঁচে বৈচিত্র্য।’৬৮ আধুনিক বিজ্ঞানের কর্মসূচি সম্বন্ধেও এ কথা বলা যায়, কিন্তু জ্ঞানপ্রণালীর বিপরীত মেরু থেকে।

এই চিন্তার সঙ্গে যুক্ত করা যায় লেভ়ি-স্ত্রাউসের আর একটা পর্যবেক্ষণ।৬৯ তিনি বলছেন, একটা প্রতিরূপ বা প্রতিমা (image) দু’ভাবে দেখা যায়: তার নিজস্ব রূপ বা বিষয়বস্তু হিসাবে, এবং অন্য কিছুর প্রতীক বা নির্দেশক হিসাবে। (ভাষা সম্বন্ধে ভর্তৃহরির মন্তব্য মনে পড়তে পারে: দ্বিতীয় অধ্যায় দ্রষ্টব্য।) প্রথম ক্ষেত্রে আমরা যা জানতে পারি তা প্রতিরূপের মধ্যেই আছে, তা থেকে সরাসরি প্রাপ্ত উপলব্ধি (percept); দ্বিতীয় ক্ষেত্রে যা জানি তা ওই প্রতিরূপ দ্বারা নির্দিষ্ট তার বাইরে কোনও উপলব্ধি (concept)। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে প্রতিরূপটা সংকেতের কাজ করছে, প্রথম ক্ষেত্রে নয়: প্রথম ক্ষেত্রে যে বিশেষ রূপে ও পরিস্থিতিতে (‘concrete situation’) প্রতিরূপটা দেখা যাচ্ছে, তার মধ্যেই তার তাৎপর্য নিহিত আছে। লেভ়ি-স্ত্রাউস বলছেন, অতিকথার চিন্তাপ্রণালী এই দুটো অবস্থানের অর্থাৎ percept ও conceptএর মাঝামাঝি: মাঝামাঝি, কারণ percept বা চোখে-দেখা প্রতিরূপে পুরোপুরি আবদ্ধ থাকলে কোনও মানসিক ক্রিয়াই সম্ভব নয়। (ফরাসি কবি পল ভ়ালেরির নামে একটা কথা চলে, কোনও কিছুর দিকে তাকালে আমরা জিনিসটার নাম ভুলে যাই।) অতিকথায় যে মননের উপাদান তাও ওই প্রতিমূর্তি বা বস্তুরূপকে আশ্রয় করে: সেটা আঁকড়ে মনের ভাব যেন মূর্ত রূপ পাচ্ছে। অপর দিকে আধুনিক চিন্তাপ্রণালী সাংকেতিক, মূর্ত রূপকে ছাড়িয়ে একটা ভাবাশ্রয়ী উপলব্ধির দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

ভবিষ্যৎ আলোচনার স্বার্থে অতিকথার এই বিশদ লক্ষণগুলি পাঠককে মনে রাখতে বলব:

• অতিকথা সব কিছু দেখে নিজস্ব দৃষ্টিতে, যা যুক্তিপন্থী বিচারে মনে হয় অবাস্তব বা উদ্ভট, ফ্যান্টাসি।

• অতিকথা যেভাবে বিভিন্ন জিনিসের মধ্যে সম্বন্ধ খুঁজে পায়, ফলে যেভাবে জগৎটা ঢেলে সাজায়, তা যুক্তি-তথ্যের পদ্ধতি থেকে একেবারে আলাদা।

• অতিকথার মনন অবরোহী, আরোহী নয়। অতিকথা আগে থেকে একটা কিছু ভেবে নিয়ে সেই মনগড়া নির্মাণটা বহির্জগতে প্রক্ষেপ করে।

• অতিকথার প্রণালী সংশ্লেষক, বিশ্লেষক নয়। অতিকথা অনেক কিছু যুক্ত করে দেখে, যা যুক্তির বিচারে দেখা হয় পৃথক করে। ফলে অতিকথার দৃষ্টিতে অনেক কিছুর ভাল আর মন্দ, দরকারি আর অবান্তর, দুটোই নির্বিচারে গ্রহণ করতে হয়; এবং একটা জিনিসের দরকার পড়লে সঙ্গে আরও পাঁচটা গ্রহণ করতে হয় যা যুক্তির বিচারে অপ্রয়োজনীয়।

• অতিকথা প্রাকৃতিক আর অতিপ্রাকৃত, আধিভৌতিক আর আধিদৈবিক, বাস্তব আর কাল্পনিকের মধ্যে তফাত করে না, সবটা একই সত্তায় মিলিত করে।

• সেই সম্মিলিত সত্তা তাই হতে পারে দেবতা বা অতিমানব; তার ক্ষমতা, অবস্থান, মনন সবই অতিবাস্তব স্তরে।

• অতিকথায় ভাষার ভূমিকা অর্থবহ সংকেত হিসাবে নয়, শক্তিসম্পন্ন মন্ত্র হিসাবে।

এই কথাগুলি পরবর্তী আলোচনার প্রেক্ষাপট হিসাবে জরুরি, সব সময় প্রত্যক্ষভাবে আলোচনায় না এলেও। এগুলি মাথায় রেখে নতুন কিছু বিষয় দেখা যাক।

প্রথম নতুন বিষয়: কাস্‌সিরের জোর দিয়ে বলছেন মানুষের মনে অতিকথার এই গূঢ় প্রণালীর দুর্বার প্রভাবের কথা। এতে বস্তুর মানসিক রূপ নয়, সরাসরি বস্তুটাই প্রত্যক্ষ ঘনিষ্ঠ বাস্তব হিসাবে উপলব্ধ হয় বলে চেতনায় তীব্র আঘাত করে, পুরোপুরি দখল করে নেয়। কাস্‌সিরেরের ভাষায়, ‘এভাবে বিমোহিত হলে আর সব কিছুর চৈতন্য হারিয়ে যায়।’৭০ ভাষার সাধারণ সাংকেতিক বা বৌদ্ধিক নির্মাণের বিপরীতে, সরাসরি বাস্তব স্তরে এই অন্তরঙ্গ তদ্ভব উপলব্ধিই কাস্‌সিরেরের মতে অতিকথার প্রাণশক্তি। তার বিমুগ্ধকারী সর্বগ্রাসী রূপ মানুষকে খেপিয়ে তুলতে পারে।

কাস্‌সিরেরের সূত্র ধরে আর কিছু কথা জুড়ে দিই। যে বিশ্বাসের আলোচনা গত অধ্যায় থেকে করে আসছি, অতিকথা তার একটা মৌলিক রূপ— মৌলিক বলেই প্রবল, আপসহীন, শুধু কালের নয় মনস্তত্ত্বের বিচারে আদি এমনকী আদিম। গত অধ্যায়ের শেষে বলেছি, আধুনিক কালে বিশ্বাসের প্রকাশ অনেক নতুন রূপ পেয়েছে, তার অতিকথা-লব্ধ আদি বস্তু প্রচুর পরিমার্জিত হয়েছে; তথাকথিত ‘উচ্চতর’ ধর্মবিশ্বাসে যুক্তি-তথ্য-প্রামাণ্যতাকে অনেকটা জায়গা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে; যে বিশ্বাসবস্তুকে শেষ অবধি চূড়ান্ত মান্যতা দেওয়া হচ্ছে, তাতে পর্যন্ত বড় জায়গা— প্রায়ই মুখ্য স্থান— পেয়েছে অতিকথা নয়, তত্ত্ব। অতিকথার গূঢ় আকর্ষণ কিন্তু মানুষের চেতনা থেকে মুছে যায়নি— কেবল তার কাহিনি নয়, চেতনার সেই সুপ্ত প্রক্রিয়ার আকর্ষণ, একান্তভাবে উপলব্ধ বাইরের কোনও বৃহত্তর সত্তার কাছে নিজের বোধশক্তি সঁপে দেওয়ার উত্তেজক আকর্ষণ। আজও, প্রায়ই অজান্তে, অতিকথার নতুন নির্মাণ তাই ঘটতেই থাকে, চেতনার অনেকটা জায়গা জুড়ে থাকে, সজ্ঞান বৌদ্ধিক প্রক্রিয়াগুলি শুধু প্রভাবিত নয়, থেকে থেকে আচ্ছন্ন করে; আর কিছুদিন বাদে বাদে কোনও দর্শনীয় অবতারে, আধুনিক বেশে তার পুরাগত প্রবৃত্তিকে সজ্জিত করে, অতিকথা ইতিহাসের মঞ্চে অবতীর্ণ হয়। মানবজীবনে যুক্তিবহির্ভূত যে নিরবচ্ছিন্ন ধারার কথা গত অধ্যায় থেকে বলে আসছি, অতিকথার এই আবির্ভাবগুলি তার সবচেয়ে প্রকট, শক্তিশালী ও খোলাখুলি যুক্তিহীন রূপ।

কাস্‌সিরের তাঁর শেষ বইয়ে যে অতিকথার ইতিহাস তুলে ধরেছেন, তার লীলাক্ষেত্র ধর্ম নয়, রাজ্যপাট। যুক্তিপন্থার ইতিহাসের যে প্রেক্ষাপট আমি আগে সাজিয়েছি, কাস্‌সিরেরের দৃষ্টিতে তা একটু অন্যভাবে দেখতে হবে। কাস্‌সিরের বলছেন, উনিশ শতক থেকেই ইউরোপে Enlightenment বা জ্ঞানোন্মেষের ধারা অস্তগামী। তার যুক্তিনিষ্ঠ স্বাধীন চিন্তার স্থান দখল করেছে অতিকথার পুনরুজ্জীবিত রূপ। সেই অতিকথার বিষয়বস্তু রাষ্ট্রিক, আর তা পরিপূর্ণতা লাভ করেছে বিশ শতকের ফাসিজ়মের প্রকোপে, সর্বোপরি নাৎসি জার্মানির একচ্ছত্রবাদী (totalitarian) রাজত্বে। কাস্‌সিরের মারা যান ১৯৪৫ সালে। আর কয় দশক বেঁচে থাকলে হয়তো মানতেন, বিশ্বযুদ্ধের তীব্র প্রতিক্রিয়ায় কয়েক দশক দুনিয়াভর সত্যিই মুক্তচিন্তা যুক্তিবিচার ন্যায্যতার আদর্শ একটা স্বীকৃতিলাভ করেছিল। বিশ শতকের শেষ থেকে ইতিহাস আবার অন্য মোড় নিয়েছে।

নাৎসি তথা ফাসিস্ত শাসনের যে লক্ষণগুলি কাস্‌সিরের বিবৃত করছেন, তার মধ্যে প্রধান হল:৭১

• এই শাসন কেবল একচ্ছত্র নয়, একনায়কবাদী। কাস্‌সিরেরের ভাষায়, ‘পূর্বেকার সামাজিক বন্ধনগুলি— আইন, ন্যায়বিচার, সাংবিধানিকতা— মূল্যহীন ঘোষিত হয়, থাকে কেবল নেতার আধিদৈবিক (mystical) ক্ষমতা আর কর্তৃত্বের অধিকার। নেতার ইচ্ছাই চূড়ান্ত আইন।’৭২ তার সঙ্গে যোগ করা যায় হান্না আরেন্টের একটা কথা: নেতা কখনও ভুল করতে পারেন না।৭৩ স্মরণ করা যায়, চিনের ‘বিরাট উল্লম্ফনে’ কয়েক কোটি মানুষ অনাহার তথা অত্যাচারে মারা যাবার পাঁচ বছর বাদে বেজিং-এর প্রধান দৈনিকে লেখা হয়, মাও জে-দং বিশ্বের মহত্তম প্রতিভা। তাঁর অনেক নির্দেশ আমরা এখনই নাও বুঝতে পারি, কিন্তু যেগুলি ‘সাময়িকভাবে বুঝতে পারছি না’ সেগুলিও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা চিনা নাগরিকের কর্তব্য।৭৪

• জাতি বা সম্প্রদায়গত পরিচয়কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। রাষ্ট্রগঠন করা হয় সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে, প্রায়ই বিদ্বেষের বশে। এর ফলে মুক্তচিন্তা ও মূল্যবোধ বিধ্বস্ত হয়। কাস্‌সিরের race কথাটা ব্যবহার করেছেন; কিন্তু বলা বাহুল্য, নাৎসিদের প্রধান বলি ইহুদিরা কেবল জাতির নয়, ধর্মের বিচারেও সংখ্যালঘু ছিল। তাদের প্রতি সংখ্যাগুরু খ্রিস্টানদের একটা বড় অংশের চিরাচরিত বিদ্বেষ পরিকল্পিত কুপ্রচারের দ্বারা চরমে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল।

• সমাজজীবন ভরে ওঠে রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্ম উৎসব-অনুষ্ঠানে, সবই রাষ্ট্রের দ্বারা নির্ধারিত এবং কঠোরভাবে বলবৎ করা। এ বিষয়ে কাস্‌সিরেরের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য: ‘একচ্ছত্র রাজত্বে যেহেতু রাজনৈতিক জগতের বাইরে কোনও স্বাধীন ব্যক্তিগত পরিসর নেই, মানুষের পুরো জীবনটাই জোয়ারের স্রোতের মতো নতুন নতুন [রাজনৈতিক] ক্রিয়াকর্ম অনুষ্ঠানে ছেয়ে যায়। … আর আদিম সমাজের মতো এখানেও তার কোনওটা ঠিকমতো পালন না করলে কপালে জোটে দুর্দশা ও মৃত্যু।’৭৫

• রাষ্ট্রীয় শক্তি, ও তার শীর্ষে একক রাষ্ট্রনেতা, ঘিরে যে অতিকথা গড়ে ওঠে তা মুক্ত ও স্বতঃস্ফূর্ত নয়। সেটা নিপুণভাবে গড়ে তোলে ‘অত্যন্ত দক্ষ ও ধুরন্ধর’ কারিগরের দল।৭৬

• এমন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের তরফে অকাতরে প্রতিশ্রুতি বিতরণ হয়, যতই তা অসাধ্য হোক না কেন। ‘বারংবার স্বর্ণযুগের আশ্বাস দেওয়া হতে থাকে’,৭৭ যেন কেবল প্রতিশ্রুতি নয়, ভবিষ্যৎবাণী।

• শেষ লক্ষণটার কথা কাস্‌সিরের বলেননি, কিন্তু এত অবধারিত যে আমি যোগ করলাম: এই ধরনের রাষ্ট্রে সেনাবাহিনীর একটা প্রাধান্য থাকে। যুদ্ধ চলুক আর না চলুক, রাষ্ট্রশাসনের সুর বাঁধা থাকে জঙ্গি যুদ্ধবাজ পর্দায়; রাষ্ট্রীয় আচার-অনুষ্ঠানের আবহও হয় অনুরূপ। নাগরিক জীবন চলে অল্পবিস্তর মিলিটারি ঢঙে, কঠোর ও প্রায়ই অত্যধিক বিধিবদ্ধভাবে।

এই লক্ষণগুলির গভীরে কাজ করে যে মৌলিক চেতনা ও মানসিক অভ্যাস, তারও কয়েকটি বৈশিষ্ট্য কাস্‌সিরের চিহ্নিত করেছেন:

• এই একচ্ছত্রবাদ ঘোর অসহিষ্ণু— অন্য কোনও মত, মূল্যবোধ বা জীবনধারাকে লেশমাত্র স্থান দিতে রাজি নয়।৭৮ সাম্প্রতিক ভাষ্যকার ব্র্যাডফোর্ড ভ়িভ়িয়ানের মত এখানে প্রাসঙ্গিক: গণতান্ত্রিক শাসনও সবসময় সত্যনিষ্ঠ হয় না, কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজে ‘সত্যের মুক্ত বৈচিত্র্য প্রকাশের সবচেয়ে বেশি অবকাশ থাকে’।৭৯ স্বৈরাচারী শাসনে মাত্র একটা সত্য স্বীকৃত হয়— সত্য বলে নয়, শাসকপুষ্ট বলে; ফলে সত্য হিসাবে তার মূল্য কমে যায়।

• এমন রাষ্ট্রশাসনে ভাষার ব্যবহার বদলে যায়। তা আর সাংকেতিক অর্থবহ ভূমিকা পালন করে না, হয়ে পড়ে ‘কতগুলি নির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়া ঘটাবার ও নির্দিষ্ট আবেগ উদ্রেক করার জাদুমন্ত্র’।৮০

• আদিম মানুষ যেমন ওঝা-পুরুতের মন্ত্রশক্তিকে সমীহ করত, এই আধুনিক রাষ্ট্রের নাগরিক বিশ্বাস করে একটা যুক্তিবিহীন ‘সামাজিক মন্ত্রশক্তি’তে (social magic)।৮১ তার চাবিকাঠি নেতার হাতে, ফলে সবাইকে মানতে হয় যে তিনি তথ্য-যুক্তি-বাস্তব জলাঞ্জলি দিয়েও রাষ্ট্রের মঙ্গলসাধন করতে পারেন। যখন বাস্তব বিচারে সব কিছু স্পষ্টত অধঃপাতে যাচ্ছে, দেশ বিপর্যয়ের মুখে, তখনও নেতার উপর বিশ্বাস হারানোর প্রশ্ন ওঠে না। রাষ্ট্র পরিচালনা আর যুক্তিপন্থার বিষয় নয়, আধিদৈবিক লীলা।

এই লক্ষণগুলির সূত্র ধরে আর একটু ভাবা যাক। এমন রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা কেবল বিশ্বাসের দ্বারা চালিত হচ্ছে না, বিশ্বাসকে একটা চরম স্তরে নিয়ে গেছে। রাষ্ট্ররীতি বা ধর্মবিশ্বাস, কোনওটাই সাধারণত এত অসহিষ্ণু আগ্রাসী রূপ ধারণ করে না, ব্যক্তিপরিসরকে এত পুরোপুরি গ্রাস করে না। এমন সমাজে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রনায়ক, রাষ্ট্রচালিত জীবনের প্রত্যেক খুঁটিনাটিতে একটা অতিবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়: সব কিছুই গুরুভার, অতিকায়, অতিবাস্তব, larger than life।

‘মিথ’-এর বাংলা প্রতিশব্দ ‘অতিকথা’ এ দিক দিয়ে খুব মানানসই। লঘু প্রয়োগে ইংরেজি ‘মিথ’ শব্দটা ব্যবহার হয় মিথ্যা কথা বোঝাতে; কিন্তু মিথের আসল মানে মিথ্যা নয়, বরং অতি-সত্য। আগেই দেখেছি, অতিকথার আখ্যান যতই অবাস্তব হোক, তা আদতে বাস্তবেরই রূপান্তর, অতিবাস্তব উপায়ে বাস্তবকে তুলে ধরছে। এও দেখেছি, রূপান্তর ঘটছে কারণ চেতনার বস্তুকে ভাষার মাধ্যমে বৌদ্ধিক উপলব্ধিতে পরিণত না করে সরাসরি বস্তু বা ক্রিয়া হিসাবে গ্রহণ করা হচ্ছে। তার সম্বন্ধে আমাদের নিজেদের যা ভাবনা, সেটাও ওই জিনিসটার অঙ্গ বা লক্ষণ বলে মনে করছি: ওটাই হয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রধান বা একমাত্র বিবেচ্য, আমরা কেউ নই। যা দেখছি তা যদি হয় কোনও মানুষ, তাকে দেখছি অতিমানব রূপে, বা পুরোপুরি দেবতা হিসাবে। যদি হয় প্রাণী, গাছ, এমনকী জড়বস্তু (বিশেষত কোনও অস্ত্র বা যন্ত্র, যা দিয়ে কিছু করা যায় অর্থাৎ ‘যেটা কিছু করতে পারে’), তাতে চেতনা, বুদ্ধি এমনকী আধিদৈবিক ক্ষমতা আরোপ করছি, দেবতাই বানিয়ে ফেলছি হয়তো। ফলে জগৎটা যেভাবেই জানছি বুঝছি, মন থেকে যা কিছু উপলব্ধি করছি, সবই কেন্দ্রীভূত হচ্ছে ওই ব্যক্তি বা বস্তু বা প্রাণীর অতিবাস্তব ভাবমূর্তিতে। অতিকথার জীবন্ত ও জড় পাত্রপাত্রীরা হয়ে দাঁড়াচ্ছে সামাজিক অস্তিত্বের পরাকাষ্ঠা, আমাদের জীবনবোধের মূর্তিমান প্রতিরূপ।

আগেই দেখেছি, অতিকথার যুক্তি আর আধুনিক যুক্তিপন্থার যুক্তি একেবারে ভিন্নগোত্রীয়; মননের অভীষ্ট লক্ষ্য হয়তো এক, অর্থাৎ পরিপার্শ্বকে জানা বোঝা ও প্রভাবিত করা; কিন্তু দুইয়ের পদ্ধতি বা প্রণালী বিপরীত মেরুতে। ধরা যাক কার্যকারণের ধারণাটা। চতুর্থ অধ্যায়ে রাজনৈতিক প্রচার বা ‘বিপণন’ প্রসঙ্গে রোলাঁ বার্তের একটা মজার দৃষ্টান্তের উল্লেখ করেছিলাম। যে বইয়ে এই বক্তব্য, তার নাম অতিকথাসংগ্রহ (Mythologies)। তাঁর উদাহরণে সবজির দাম কমাটা সরকারের কেরামতি হিসাবে প্রচার হচ্ছে, যদিও ব্যাপারটা আদৌ তা নয়: নতুন ফসল উঠেছে, দাম এমনিতেই কমার কথা। দাম কমার সঙ্গে নতুন ফসল বাজারে আসার কার্যকারণ সম্পর্ক, স্বাভাবিক বা বাস্তব (‘natural’) যোগ; কিন্তু সরকারের সাফল্যের সঙ্গে যোগটা কৃত্রিম, মেকি (‘artificial, false’)।৮২ একমাত্র অতিকথার ‘যুক্তি’তেই এমন যোগ ঘটতে পারে: ‘রাজা আশীর্বাদ করলেন, মন্ত্রের মতো খেতে ফসল ফলল।’ আধুনিক রাষ্ট্রে এমন যুক্তির অবতারণায় দেশবাসীর মনে ‘সামাজিক মন্ত্রশক্তি’র ধারণাটা গেঁথে দেওয়া হয়।

উপমাকে আক্ষরিক অর্থে নিলেও কার্যকারণের বিপর্যয় ঘটে: দুটো ভিন্ন জিনিসের মধ্যে তুলনার বদলে সরাসরি সংযোগস্থাপনের চেষ্টা হয়— একটা যেন অন্যটা হয়ে গেছে, বা বরাবর ছিল। উপমার প্রয়োগে যখন কাউকে ‘দেবতুল্য’ বলি, কারও প্রভাবে বা উপস্থিতিতে নানা মুগ্ধকর ফল দাবি করি, অতিকথনের মাত্রা একটা পর্যায়ে পৌঁছলে উপমার গণ্ডি অতিক্রম করে অজান্তেই ভাবতে শুরু করি, নেতা-প্রশাসক নয়, দেবতার উপাসনা হচ্ছে। অতদূর না গেলেও, জনসভায় যখন চড়া পর্দায় কোনও নেতার উত্তুঙ্গ প্রশস্তি করি, মনে মনে জানি (শ্রোতাও জানে) ওগুলি কথার কথা, লোকটা অতি সাধারণ বা রীতিমতো বদ। কিন্তু বলতে বলতে শুনতে শুনতে যে ভাবমূর্তি সৃষ্টি হয় তাতে নেতা মহোদয়ের বারোয়ারি পরিচয় সত্যি ওই চড়া পর্দায় বাঁধা পড়ে, ওটাই হয়ে যায় জনতার চোখে তাঁর কার্যকর সত্তা। অতিকথার বিস্তারে আমাদের জনজীবনের অসারতা এভাবে বেড়ে চলে।

অতিকথা মানে অতিকথন নয়। অতিকথন মানে স্রেফ বেশি বলা বা বাড়িয়ে বলা। অতিকথা বা মিথ মানে কোনও ব্যক্তি বা বস্তুকে একটা অন্য স্তরে উন্নীত করা, যেখানে তাকে আমরা দেখি জনচেতনার মূর্তিমান পরিচায়ক হিসাবে। এমন ব্যক্তি একদিকে আমাদের সকলের প্রতিনিধি, সমাজের প্রবক্তা ও প্রাণপুরুষ; অন্যদিকে (নেতা ও প্রাণপুরুষ বলেই) সবার উপরে ও আলাদা, স্বকীয়, বিশিষ্ট। এই অতিমানবকে স্থান দিতে গিয়ে সাধারণ মানুষের অস্তিত্বের পরিসর— হয়তো আক্ষরিক অর্থে জীবনের দাম— কমে যায়।

গণতন্ত্রের তত্ত্ব অনুসারে এমন হওয়ার কথা নয়, কিন্তু নানা দেশে হয়েছে এবং হয় তা অনস্বীকার্য। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রণালীগত বিচারে আধুনিক, তার উৎস ইউরোপীয় জ্ঞানোন্মেষের চিন্তাধারায়। তার মানসিকতা বিশ্লেষক ও যুক্তিপন্থী, তার ব্যাখ্যান বিশদ ও সুস্পষ্ট। গণতন্ত্রে জনগণের প্রতিনিধি সত্যিই প্রতিনিধি, অর্থাৎ তাঁর ভূমিকা সাংকেতিক। যাঁদের প্রতিনিধি, তাঁরাই আসল বা প্রাথমিক; তিনি তাঁদের প্রতিভূমাত্র, গৌণ বা আনুষঙ্গিক অবস্থানে। কার্যত কিন্তু দেখা যায়, বহু গণরাজ্যে শাসক ও জনপ্রতিনিধিদের জীবনযাত্রা, নিরাপত্তার বহর, সৈন্যসামন্ত পাত্রমিত্রের ঘটা, প্রবল ক্ষমতা— সব কিছু তাঁদের নিয়ে যায় একটা বিচ্ছিন্ন অতিবাস্তব স্তরে। সেটাকে আরও ফাঁপিয়ে-ফুলিয়ে তুলে ধরলে, অতিশয়োক্তি আর জমকালো আচার-অনুষ্ঠানে আসর মাতিয়ে রাখলে, অতিকথার আবহ সৃষ্টি হয়— হয়তো কোনও বিশেষ নেতাকে কেন্দ্র করে, হয়তো পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই, কিংবা একসঙ্গে দুটো। আধুনিক রাষ্ট্রের স্বাভাবিক মূর্তির মধ্যেই অতিকথার বীজ লুকিয়ে আছে। কখন সে বীজ নেপথ্যে বেড়ে উঠছে তা দেশবাসীর খেয়াল থাকে না, যতক্ষণ না পল্লবিত হয়ে ফুলে ফলে দেশের মাটি রীতিমতো ছেয়ে ফেলেছে। রাষ্ট্র হয়ে ওঠে বিস্ময় ও ভীতিমিশ্রিত একটা ভিন্ন পরিমণ্ডল; সাধারণ নাগরিক তাঁর অভ্যস্ত বাস্তব গণ্ডির বাইরে এসে সন্ত্রস্ত চিত্তে তার সম্মুখীন হন। গণতন্ত্রের তত্ত্ব অনুসারে এমন হওয়ার কথা নয়, কিন্তু হয়।

আরও মোক্ষম কতগুলি ফল দেখা দেয়। অতিকথার সবচেয়ে খোলাখুলি বিস্তার প্রাচীন পৌরাণিক আখ্যানে, কারণ সে যুগে ওটাই ছিল অভ্যস্ত বৌদ্ধিক প্রণালী, মূলত ওভাবেই জগৎকে দেখা আর বোঝা হত। পৌরাণিক কাহিনিতে রাজা ও মহারথীদের দেখানো হয় অতিমানব হিসাবে, কখনও বা আর একটা প্রমোশন দিয়ে দেবতার রূপে। (Euhemerism নামে অতিকথার একরকম ব্যাখ্যার প্রতিপাদ্যই হল, পৌরাণিক দেবতারা পুরাকালের বিশিষ্ট মানুষদের রূপান্তর।) এইভাবে অতিকথা মিশে যায় ধর্মের সঙ্গে। ফলে প্রাচীন ‘অতিকথার যুগের’ অবসান হয়ে যুক্তিপন্থার প্রবেশ ঘটলেও ধর্মবিশ্বাসের দৌলতে প্রাচীন অতিকথা সমাজে একটা বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে থাকে। শুধু যে তার কাহিনি বা তত্ত্ব জনজীবনে চালু থাকে তাই নয়; আরও অনেক মোক্ষমভাবে, অতিকথার উপযুক্ত চিন্তা ও মননের পদ্ধতি মানুষের মনে জেগে থাকে। স্বীকৃত আধুনিক বৌদ্ধিক প্রক্রিয়ার পাশাপাশি একেবারে বিপরীত একটা প্রক্রিয়া কাজ করে চলে কেবল পুরাণকালের নয়, বর্তমান জগতের উপাদান নিয়ে। পৌরাণিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রের বাইরে, আপাত অনাধ্যাত্মিক ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়েও তাই অতিকথা নির্মাণের জমি তৈরি হয়, তাতে একটা ধর্মীয় মাত্রা যোগের পথ প্রশস্ত হয়।

রাজনীতির অতিকথার সঙ্গে ধর্মের অতিকথার সংযোগ ঘটার অবকাশ ভারতে বিশেষভাবে প্রশস্ত— বলতে কী, আজকের পৃথিবীর আর কোনও বৃহৎ প্রভাবশালী দেশে এতটা নয়, কারণ এমন কোনও দেশের বর্তমান ধর্মে পৌরাণিক অতিকথার এমন বিপুল উপস্থিতি নেই। সংখ্যাগুরু ভারতীয়ের ধর্মবিশ্বাসে অসংখ্য দেবদেবী, ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে পৌরাণিক কাহিনির নিবিড় যোগ। সমান যোগ পৌরাণিক জগতের সঙ্গে প্রাচীন কালের বাস্তব ইতিহাসের, অতএব সেটাও একই মানসিক জগতের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে, আর সবটাই চর্চিত হচ্ছে বর্তমান ভারতীয় জনজীবনের পটভূমিকায়। বিভিন্ন যুগ, সভ্যতা ও জ্ঞানপ্রণালীর এক অসাধারণ সন্নিবেশ ঘটছে, যা অতিকথা চাষের উর্বর ভূমি।

বলা বাহুল্য, এই সন্নিবেশ কোনও তাৎক্ষণিক সমাপতন নয়। এ হল ভারতসভ্যতার মৌলিক যোগ, এর বিস্তার ও জটিলতা বিস্ময়কর। চতুর্থ অধ্যায়ে সাধারণভাবে জাতীয় ব্যাখ্যানের (national discourse) ধারণা নিয়ে আলোচনা করেছি, সেটা এবার ভারতের প্রেক্ষিতে দেখা যাক। ভারতের ইতিহাস ও জনজীবনের গূঢ় বৈশিষ্ট্যকে আমরা ‘বহুর মধ্যে এক’ ইত্যাদি শব্দবন্ধে অভিহিত করি। সেই বহুত্ব কেবল সংমিশ্রণ নয়, সত্যিকারের সংশ্লেষ: উপাদানগুলি কেবল একসঙ্গে জড়ো হয়েছে তা নয়, পরস্পরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিলেছে— ফলে প্রত্যেকটিই রূপান্তরিত হয়েছে, চূড়ান্ত জাতীয় সত্তা তাদের যোগফলের অতিরিক্ত কিছু। ভাষা থেকে শুরু করে যত সংকেতপ্রণালীতে একটা সুবিশাল সভ্যতা প্রকাশ হতে পারে, সবগুলির একত্রিত ‘অতিভাষা’ এই পরিপূর্ণতার ধারক। তার বৌদ্ধিক উপলব্ধি দীর্ঘ ও দুরূহ কাজ, অসংখ্য জ্ঞানক্ষেত্র কর্মক্ষেত্র জুড়ে। ভারতের আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে তার সমাজ ও শাসনতত্ত্বের জটিল যোগ সঠিক ও সম্পূর্ণভাবে উদ্ধার করা সহজ নয়।

অথচ আমরা দেখেছি, চটজলদি তাগিদে কোনও জটিল ও সূক্ষ্ম ব্যাখ্যানকে কেমন সরল ও দ্বিমাত্রিক করে ফেলা হয়, তার অর্থবহ সংকেতরাশি উদ্ধারের বদলে একটা তরল সংক্ষিপ্ত রূপ আলগাভাবে প্রয়োগ হয় কোনও বিশেষ জাগতিক উদ্দেশ্যে। কারণটা রাজনৈতিক হতে পারে, ধর্মীয়ও হতে পারে। ধর্মের ক্ষেত্রে এই শর্টকাট পদ্ধতিতে দেখেছি বিশ্বাসের যুক্তিমুক্ত বাণীর সবচেয়ে সহজলভ্য প্রকাশ, চুম্বক বা স্লোগানের পর্যায়ে। আরও দেখেছি, সেই ধর্মের আখ্যানে প্রায়ই অতিকথা থাকে। এই অতিকথার মাধ্যমে যুক্তিমুক্ত এমনকী যুক্তিবিরোধী বিশ্বাসকে গ্রহণ করা আরও সাবলীল, প্রায় সহজাত হয়ে পড়ে। অতিকথার গুণই এই যে তাতে বিশ্লেষণের মাত্রা নেই, তার প্রভাব সার্বিক ও তাৎক্ষণিক: অন্যান্য বিশ্বাসের চেয়ে গভীরে, একেবারে নাড়ির টানে পুরো জগৎটাকে যুক্তিবিহীন কিন্ত দুর্বারভাবে লভ্য ও আকর্ষক করে তুলে ধরে।

এ তো গেল উপলব্ধির প্রণালীর কথা। বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে দেখেছি, পুরাণের বড় অংশ জুড়ে আছে আখ্যান অর্থাৎ গল্প। তারও আগে তৃতীয় অধ্যায়ে দেখেছি, গল্প কেমন বাস্তব আর কল্পনার মধ্যে আনাগোনা করে, একটার সাহায্যে অন্যটাকে ঋদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় করে তোলে, সেই সঙ্গে একটার আমেজ অন্যটায় এনে সুখকর বিভ্রান্তিও সৃষ্টি করে। বাস্তব হয় কল্পনার ছোঁয়ায় রঙিন, কল্পনা হয় বাস্তবের ছোঁয়ায় বলিষ্ঠ।

বাস্তব আর কল্পনার এই সহাবস্থান আমরা প্রথম দেখেছি আধুনিক দুনিয়ায় পণ্যপ্রচারের গল্পে। সেটা অপেক্ষাকৃত সহজ ও লঘু দৃষ্টান্ত, একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে জেনেবুঝে ব্যবহার: যে গল্পটা ফাঁদছে সে জানে, যে ফাঁদে পা দিচ্ছে সেও নেহাত না বুঝে দিচ্ছে না, গল্পের আকর্ষণের কাছে কিছুটা সজ্ঞানেই হার মানছে। প্রাচীনকাল থেকে যে পৌরাণিক অতিকথা চলে আসছে, তার প্রভাব আরও অনেক গভীর ও ওতপ্রোত। বাস্তব আর কল্পনা সেখানে দুটো পৃথক উপাদান নয়, যা কোনও গল্পকার ভেবেচিন্তে মেলাচ্ছে; বরং একই চেতনার অঙ্গ, বাস্তবের মধ্যে অতিবাস্তবকে সমন্বিত করে দেখছে। আমরা দেখেছি, অতিকথার দৃষ্টিতে ধরাছোঁয়ার বাস্তব যতটা আসল, তাকে ঘিরে যে মানসিক কল্প বা নির্মাণ সেটাও ততটাই আসল। বিশ্বাসের যে যুক্তিমুক্ত মাত্রা, অতিকথা সেটাকে আখ্যানের রূপ দিয়ে শুধু আরও আকর্ষক নয়, আরও বাস্তবায়িত করে তোলে, কারণ আখ্যান বা গল্পে বাস্তবের উপাদান থাকতেই হবে। অতিকথার অতিবাস্তব তাই শেষ অবধি অতিসত্যের পরিচয় ধারণ করে। যে ধর্মের নাগালে প্রচুর পৌরাণিক উপাদান, সে ধর্ম তার অন্তরীণ বিশ্বাসটা সহজপাচ্য ও মনোগ্রাহী করে তুলতে পৌরাণিকতার আশ্রয় নেয়, পুরাণের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠে ধর্মের তাত্ত্বিক মাত্রা।

রাজনীতি বা রাজ্যশাসনের ক্ষেত্রে বিশ্বাসের প্রশ্ন এ যাবৎ তুলিনি, কারণ আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তায় (যার প্রধান উৎস ইউরোপীয় জ্ঞানোন্মেষের চিন্তাধারায়) ওটা ধর্মভিত্তিক নয়; তার ঘোষিত আদর্শ যুক্তিপন্থা, বাস্তবে যাই হোক বা না হোক। পঞ্চম অধ্যায়ে দেখেছি, যুক্তিপন্থী আর যুক্তিমুক্ত শিবির সম্মুখীন হলে যুক্তিমুক্তদের একটা সুবিধা থাকে। ধর্মবিশ্বাসকে ভিত্তি বা অন্তত উপাদান হিসাবে রাখলে একই সুবিধা ভোগ করে কোনও রাজনৈতিক শক্তি। সেই শক্তি তখন যুক্তিবহির্ভূত কৌশল ব্যবহার করতে পারে, যুক্তিবিরোধী তত্ত্ব উপস্থিত করতে পারে, আর এইভাবে আবেগ-অনুভবের প্রায় অবচেতন স্তরে মানুষের মন জয় করতে পারে, যা শুধুমাত্র সচেতন যুক্তিসিদ্ধ উপায়ে সম্ভব হত না। উপরন্তু সেই ধর্মের যদি একটা পৌরাণিক মাত্রা থাকে, তবে অতিকথার মুগ্ধকর প্রভাবকে কাজে লাগানো যায়।

সজ্ঞানে ‘কাজে লাগানো’রও হয়তো প্রশ্ন নেই, কারণ উপাদানগুলি এমনভাবে সাজালে প্রক্রিয়াটা আপনি ঘটতে থাকে, উদ্যোগ নিয়ে ঘটাতে হয় না। ধর্ম, আচার আর রাজনীতির এই সংশ্লেষে ধর্মীয় অতিকথা গোড়া থেকেই প্রবল, জনজীবনের আচার-অভ্যাসেও তার নিবিড় উপস্থিতি। অতিকথা গ্রহণ করার, তাকে উপভোগ করার ও মান্যতা দেবার উপযুক্ত মানসিকতা এমন আবহে এমনিতেই ব্যাপকভাবে উপস্থিত। রাজনৈতিক অতিকথার ভাষ্যকার ঝ়র্ঝ় সোরেল বলেছেন, ‘অতিকথা খণ্ডন করা যায় না, কারণ গভীরতম স্তরে তা গোষ্ঠীর বিশ্বাসের সঙ্গে মিলে যায়।’ তাঁর আরও দুটো কথা ভাবার মতো: এক, অতিকথা খণ্ডে খণ্ডে বিশ্লেষণ করা যায় না, সবটা সামগ্রিকভাবে চিন্তা করতে হয়; দুই, তার কারণ অতিকথা কেবল ইতিহাসের আখ্যান নয়, বর্তমান কর্মকাণ্ডের চালিকাশক্তি।৮৩ লক্ষণীয় যে সোরেল প্রাচীন না আদিম সভ্যতার কথা বলছেন না, বলছেন আধুনিক নগরসভ্যতার কথা, আর তার ভিতরেও তাঁর বিশেষ প্রতিপাদ্য, সহিংস গণবিপ্লবের কথা। ১৯০৮এ প্রকাশিত তাঁর বই হিংসা নিয়ে চিন্তা পরবর্তী সোভিয়েত রাষ্ট্রের অতিকথার একটা সূত্র হতে পারত, কিন্তু ইতিহাসের খেয়ালে তার অনেক বেশি প্রভাব পড়ে দক্ষিণপন্থী ফাসিস্ত শাসনের উপর, বিশেষত মুসোলিনির রাজ্যপাটে।

জনমানসে যদি অতিকথার শিকড় গাঁথাই থাকে, সেটা কৌশলে বাড়িয়ে পল্লবিত করার জমিও প্রস্তত হয়ে আছে। কৌশলটা হল সমকালীন রাজনীতি ও তার নেতা-কুশীলবদের সনাতন ধর্ম ও পৌরাণিক অতিকথার জগতে নিয়ে আসা, একই আখ্যানের অন্তর্ভুক্ত করা। এমনটা ঘটাতে পারলে সেই নেতাদেরও আমরা দেখতে শুরু করি পৌরাণিক বীরের আদলে, এমনকী দেবসুলভ মহিমায় মণ্ডিত করে। একই ভাবে আজকের রাজনৈতিক ঘটনাবলি হয়ে দাঁড়ায় কোনও পৌরাণিক আখ্যানের রূপান্তর। অতিকথার একটা লক্ষণ হল, তার বিশ্বাসবস্তু কালাতীত। যে কোনও ক্লাসিক আখ্যানের মতো তার অশেষ তাৎপর্য ও প্রযোজ্যতা: একই ঘটনা যেন বহিরঙ্গ পালটে যুগ যুগ ধরে ঘটে চলেছে, আর সেইভাবে আরও বেশি করে সত্য হয়ে উঠছে। ফলে আজকের কোনও নেতাকে রামচন্দ্রের অবতার বলে মানা যায়, নির্বাচনের পাট হয়ে ওঠে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। এমন অসম প্রতিযোগিতায় নিছক কলিযুগের অর্বাচীন প্রতিপক্ষের এঁটে ওঠা মুশকিল।

তাত্ত্বিক ধর্মবিশ্বাসের চেয়ে অতিকথার প্রভাব তাই অনেক গভীর ও সুদূরস্পর্শী। কোনও রাজনৈতিক ধারা ধর্মের নামে সমর্থন পেতে পারে, কিন্তু সেটা নেহাত দলভারী করার ব্যাপার— বলা যেতে পারে ভোটের আশায়, বড়জোর কোনও বাস্তব কর্মসূচি রূপায়ণের জন্য। ধর্মনিরপেক্ষ যুক্তিপন্থী কোনও পক্ষও হয়তো তাদের ভিন্ন পথে চলে একই ফল পেতে পারে। রাজনীতিতে ধর্মীয় যোগের আসল বিধ্বংসী তাৎপর্য, তা সমাজের চেতনাকে অতিকথার আবহে আবদ্ধ করে ফেলছে, যুক্তিমুক্ত ধারাকে অপ্রতিরোধ্য হৃদয়গ্রাহী আখ্যানের ছাঁচে ঢেলে ভাবনাচিন্তার ধরনটাই পালটে দিচ্ছে। এটা এক আমূলভাবে ভিন্ন মানসিক প্রণালী: যুক্তিপন্থার বিপরীত তো বটেই, কিন্তু আরও বড় কথা, ধর্মবিশ্বাস এবং যুক্তিমুক্ত চিন্তার যে ব্যাপকতর চিত্র গত অধ্যায়ে দেখেছি, তারও সাধারণ স্তরের অতিরিক্ত কিছু।

আবার খেই ধরার পালা। আগে যা দেখেছি, তা হল:

• আধুনিক সংকেতনির্ভর ব্যাখ্যান ও প্রচলনের অবক্ষয় ঘটছে, যার ফলে ভাষা তার সমৃদ্ধি হারিয়ে হয়ে পড়ছে কাজ হাসিলের সূচক বা উপলক্ষ মাত্র। তার নিজের তাৎপর্য নিজের মধ্যেই ফুরিয়ে যাচ্ছে, অর্থবহ ব্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে সার্থক হয়ে উঠছে না।

• এর পাশাপাশি আমাদের মানসিক জীবনে বিশ্বাস এখনও বিরাট ভূমি অধিকার করে আছে, যদিও আধুনিক পৃথিবীতে কিছু মুখ্য ব্যাখ্যান মৌলিকভাবে বিশ্বাসনিরপেক্ষ, তাদের সঞ্চালক শক্তি যুক্তি-তথ্য-প্রামাণ্যতা-ন্যায্যতা। বিশ্বাসের জগতেও এই প্রণালীগুলির গুরুত্ব থাকতে পারে, কিন্তু তার মূল চালিকাশক্তি যুক্তিমুক্ত আত্মস্থ সম্মতি ও সমর্পণ। শেষ বিচারে, বিশ্বাস করি বলেই করি।

• সেজন্য বিশ্বাসের বিশেষ করেই প্রবণতা থাকে, পূর্ণ সমৃদ্ধ ব্যাখ্যানকে পরিত্যাগ করে তার তাৎপর্যকে একটা তাৎক্ষণিক প্রভাবশালী রূপ দিতে।

এবার অতিকথার অবতারণায় এই চিত্রে কী কী সংযোজন হল দেখা যাক।

• বিশ্বাসবস্তু গ্রহণে অতিকথা একটা নতুন উত্তেজক নাটকীয় মাত্রা আনে। অতিকথা প্রায়ই আখ্যানধর্মী, সেই গল্পের আকর্ষণ ধর্মের উপাদানকে অনেক বেশি সহজগ্রাহ্য ও মনোগ্রাহী করে তোলে।

• অতিকথার পরিসর কেবল পুরাকালে আবদ্ধ থাকে না, তার একটা সর্বকালীন মাত্রা আছে। পৌরাণিক অতিকথায় বিশ্বাসীরা তাই তাঁদের বিশ্বাসবস্তুকে বর্তমান বাস্তবের অঙ্গ হিসাবে গ্রহণ করতে পারেন।

• এই বাস্তব যোগের কারণে অতিকথার মাধ্যমে ধর্ম আর রাজনীতি আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হতে পারে। ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্র বাঁধা হতে পারে একই সূত্রে, ফলে ধর্ম ও রাজনীতি দুটোই চেতনার আরও গভীরে প্রবেশ করতে পারে, শিকড় গাড়তে পারে অবচেতন স্তরে, যা যুক্তিভিত্তিক রাজনৈতিক ব্যাখ্যান পারে না।

• অতিকথার নায়ক দেবতা বা অতিমানব; তাদের মনোভাব আচার-আচরণ সাধারণ মানুষের মতো নয়, ক্রিয়াকলাপ অভিসন্ধিও নয়। অতিকথার সঙ্গে বাস্তবের ঘনিষ্ঠ যোগ থাকতে পারে, কিন্তু তা বাস্তবকে তুলে ধরে বিচিত্র, পরিবর্তিত, ‘অ-বাস্তব’ রূপে। ফলে জনমানসে অতিকথার অনুপ্রবেশ ঘটলে আমরা বর্তমান জীবনে ও সমাজে অনেক কিছু মেনে নিতে পারি যা সাধারণ নীতি-যুক্তি-বিচারবোধে বা বাস্তব কাণ্ডজ্ঞানে মানতাম না।

• অতিকথার দৃষ্টিতে আজকের নেতা-নায়কদেরও ভাবতে পারি পৌরাণিক দেবতা বা অতিমানবের মতো এক ভিন্ন স্তরের সত্তা হিসাবে— মহাবলী, স্বয়ম্ভূ, প্রায় প্রকৃতির নিয়মে আধিপত্যের অধিকারী। তাদের মুখ চেয়ে আমরা ক্ষতিস্বীকার ও আত্ম-অবনমন করতে পারি, গণতান্ত্রিক শাসকদের ক্ষেত্রে যা কখনওই করতাম না। রাষ্ট্রের রূপ অতিকথার আদলে নির্মিত হলে তাই স্বৈরতন্ত্র ও একচ্ছত্রবাদের পথ খুলে যায়।

একচ্ছত্র রাজনীতির জন্য ধর্মীয় অতিকথা মোটেই অত্যাবশ্যক নয়। প্রাচীন ইউরোপে রোমের সম্রাটকে দেবতা মনে করা হত, স্থান দেওয়া হত প্রাচীন গ্রীস-রোমের অসংখ্য দেবদেবীর বহুস্তরীয় সমারোহের মধ্যে। তারপর কিন্তু গত সতেরোশো বছর ইউরোপ অধিকার করে আছে একেশ্বরবাদী খ্রিস্টধর্ম, তাতে স্বীকৃত পৌরাণিক উপাদান আদৌ নেই। (গৌণ স্তরে বা ছদ্মরূপে ক্বচিৎ থাকতে পারে, তার গুরুত্ব সামান্য।) তা বলে পাশ্চাত্যে জবরদস্ত স্বৈরাচারী সাম্রাজ্যবাদী শাসন কিছু কম ঘটেনি। গত দুই শতকেই দেখা গেছে নাপোলিয়ঁর রাজত্ব, বিশ্ব জুড়ে ব্রিটিশ ও ফরাসি সাম্রাজ্যের বিস্তার, আর অবশ্যই হিটলার ও মুসোলিনির একচ্ছত্র ফাসিস্ত শাসন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণভেদ। মার্কিন নব্য সাম্রাজ্যবাদেরও নাম করতে হয়। সোভিয়েত সাম্রাজ্য তো কোনও ধর্মবিশ্বাসকেই স্বীকার করেনি, যেমন করে না সমকালীন চিনের একচ্ছত্র রাষ্ট্র। কিন্তু সবগুলি (এবং অন্য বহু) ক্ষেত্রে রাষ্ট্রই প্রায় এককভাবে অতিকথার উপজীব্য হয়ে উঠেছে, তাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে (অবশ্যই ভিন্ন ভিন্ন ধাঁচে ও মাত্রায়) অযুক্তি ও অতিবাস্তবের ভীতিবিস্ময়কর রোমাঞ্চক পরিমণ্ডল বা mystique; প্রজার ব্যক্তিসত্তা বাঁধা পড়েছে রাষ্ট্রিক সত্তার কাছে। অতিমানবেরও আবির্ভাব ঘটেছে অনেক ক্ষেত্রে: নাপোলিয়ঁ, হিটলার, মুসোলিনি, স্তালিন। মার্ক্স বলেছিলেন, ইতিহাসের ট্রাজেডি ফিরে আসে প্রহসন হয়ে। সেইমতো যেন দেখা যাচ্ছে, ডনাল্ড ট্রাম্পও তাঁর ভক্তবৃন্দের কাছে অতিমানব। তাঁরা নিষ্ঠাবান খ্রিস্টান, ট্রাম্পকে ঈশ্বর বলতে তাই বাধে, তবে ঈশ্বরপ্রেরিত বলতে মানা নেই, মানা নেই বাইবেল ও খ্রিস্টীয় ইতিহাসের নানা চরিত্রের সঙ্গে মেলাতে। কৃষ্ণাঙ্গ ধর্মযাজকও তাই নেতাকে নিয়ে উচ্ছ্বাস করতে পারেন: ‘এক, ওঁর রং সাদা। দুই, উনি ঈশ্বরের লোক।’৮৪

ইসলামও একেশ্বরবাদী ধর্ম। ইসলামিক দুনিয়ায় জবরদস্ত স্বৈরাচারী শাসকের অভাব আগেও ঘটেনি, আজও নয়। সেখানে কিন্তু অবস্থাটা ভিন্ন। ধর্ম আর রাজনীতি তথা রাষ্ট্রশক্তি ইসলামিক দুনিয়ার বহু দেশ জুড়ে যত নিবিড়ভাবে মিশেছে, আজকের বিশ্বে আর কোথাও নয়। এ ক্ষেত্রে যেন ইসলাম ধর্মের কঠোরভাবে একেশ্বরবাদী চরিত্রই বিবর্ধিত ও গৌরবান্বিত হয়ে অতিকথার মতো আকর্ষণ সৃষ্টি করছে, রাষ্ট্র অঙ্গীভূত হচ্ছে তারই পরিমণ্ডলে।

মোটের উপর বলা চলে রাষ্ট্রের যুক্তিমুক্ত সত্তা, এবং অতিকথায় তার সম্যক প্রকাশ, একটা স্বকীয় বিবর্তনের ধারা। ধর্ম আর ধর্মীয় অতিকথার সঙ্গে তার যোগ থাকতেই হবে এমন কথা নেই। কিন্তু দুটোর মধ্যে প্রবল চারিত্রিক সাদৃশ্য আছে, ফলে একটার প্রবর্তকেরা অন্য পক্ষের সমর্থন পেলে উভয়ের লাভ, উভয়ের শক্তিবৃদ্ধি। ভারতের পরিস্থিতি এ দিক দিয়ে অতিবিশেষ, কারণ ভারতের প্রধান ধর্মে পৌরাণিক অতিকথা একটা কেন্দ্রীয় উপাদান। শাসক চাইলে, সেটা রাষ্ট্রীয় অতিকথার একটা মস্ত বাড়তি অবলম্বন হতে পারে।

আর দুটো বিষয় আলোচনা করে এই অধ্যায় শেষ করব। আজকের নিষ্ঠাবান ধার্মিকেরা প্রায়ই পৌরাণিক কাহিনিতে দেবদেবীদের কীর্তিকলাপ দেখে অস্বস্তিবোধ করেন, কারণ তা আধুনিক রক্ষণশীল নীতিবোধকে পীড়া দেয়। সেকালেও প্লাতোন গ্রীক দেবতাদের নানা অপকীর্তির কাহিনিকে ভ্রান্ত ও ক্ষতিকারক সাব্যস্ত করেছিলেন, বিধান দিয়েছিলেন সেগুলি যেন তাঁর আদর্শ গণরাজ্যের হবু শাসকদের শেখানো না হয়।৮৫ আরও ব্যাপকভাবে বলা যায়, পৌরাণিক অতিকথায় দেবদেবীই হোন আর মানব বা অতিমানব হোন, সাধারণ নীতিবোধ মূল্যবোধ তাঁরা মেনে চলেন না— কেনই বা চলবেন, কারণ তাঁরা তো ‘সাধারণ’ নন। তাঁদের আধিদৈবিক বা অতিমানবীয় সত্তার প্রকাশ ঘটে দাপটের সঙ্গে, হয়তো প্রচণ্ডতায় জগৎ তোলপাড় করে। তাতে ক্ষুদ্র মানুষের যেমন লাভ তেমন ক্ষতি হতে পারে, তা নিয়ে আক্ষেপ বৃথা; বরং বাঁচতে চাইলে— লাভবান হতে চাইলে তো বটেই— সেই উচ্চতর সত্তাকে তুষ্ট করতে হবে, তার নিঃশর্ত আধিপত্য মানতে হবে।

রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে অতিকথার বৃত্তান্ত হুবহু এক। তার দুটো শর্ত যুগ্মভাবে কাজ করে। এক, রাষ্ট্রীয় শক্তি কোনও যুক্তি ন্যায্যতা মানবে না— চলবে নিজের মতো, বিনা ব্যাখ্যায় বিনা অনুশোচনায়। দুই, রাষ্ট্রের কাছে সাধারণ নাগরিক অসহায়, তটস্থ ও মর্যাদাহীন। এটুকু শুনেই আমাদের অন্তরাত্মা বলে উঠবে এমন রাষ্ট্রকে আমরা সবাই চিনি, এ তো চিরাচরিত আমলাতন্ত্রের পীঠস্থান। বলতে মন যায়, রাষ্ট্রীয় অতিকথার সবচেয়ে হীন অবজ্ঞেয় রূপ হল সাবেক পাতি আমলাতন্ত্র। কিন্তু সেই আমলাতন্ত্র সত্যিকারের স্বৈরাচার আর সত্যিকারের অতিকথা, দুটোরই ফিকে অনুকরণ মাত্র, সিংহের চর্মধারী গর্দভের মতো। তার কারণ, এই আমলাতন্ত্র নিয়মনীতির সৎ উদ্দেশ্যগুলি যতই জলাঞ্জলি দিক, পুথিগতভাবে নিয়মনীতির কাঠামো পরিত্যাগ করে না, বরং তাকে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়। সাংকেতিক উপায়ে অর্থাৎ ভাষায় লিপিবদ্ধ ন্যায়-যুক্তির যে প্রশাসনিক ব্যাখ্যান, আমলাতন্ত্র সেটা অনুসরণ করে, তাতেই আবদ্ধ থাকে, অন্তত ঘোষিতভাবে তার বাড়া কোনও মানদণ্ড স্বীকার করে না। ফলে যতই ক্ষতিকর হোক, সেই একই আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে, বা তার অনুষঙ্গ বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে, সুরাহার একটা আশা থাকে।

যে রাষ্ট্র অতিকথার উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, সেখানে আমলাতন্ত্রের গুণগত পরিবর্তন হবে এমন কথা নেই, অন্তত রাতারাতি বড় ঘটে না। তলিয়ে না দেখলে নাগরিকেরা বুঝতে পারেন না, কত বড় ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে: ভাবেন আগের অবস্থার সঙ্গে তফাতটা নেহাত গৌণ, শাসকে-শাসকে যেমন হয়েই থাকে। ক্রমশ ধরা পড়ে, ব্যবধানটা মৌলিক: শাসনের ধারা একেবারে পালটে গেছে, এক খাত ছেড়ে পুরোপুরি অন্য খাতে বইছে। ‘গণতন্ত্রের মৃত্যু’র অনুসন্ধানে নেমে লেভিট্‌স্কি ও জ়িবল্যাট বারবার এই কথা বলছেন: গণতন্ত্র স্বৈরতন্ত্রের দিকে গোড়ায় অগ্রসর হয় ছোট ছোট ধাপে, লোকে ধরতেই পারে না।৮৬ প্রত্যেক ধাপ মনে হয় তুচ্ছ, উপরন্তু আইনসংগত এমনকী উপকারী। ন্যায়নীতির এই ঠাটের আড়ালে সংবাদমাধ্যমকে বশে আনা হয়, অন্য সমালোচকদেরও নীরব করে দেওয়া হয়। সবচেয়ে বড় কথা, গণতন্ত্র রক্ষার যে প্রতিষ্ঠানগুলি আছে— সংবিধান, আদালত, বিভিন্ন স্বশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সংস্থা— নামে বহাল রেখেও সেগুলির ক্ষমতা ও নিরপেক্ষতা নষ্ট করে দেওয়া হয়, ফলে আইনস্বীকৃত অনাচারের পথ প্রশস্ত হয়ে যায়: জন কীনের ভাষায়, ‘আইন দিয়েই আইনের শাসনকে পর্যুদস্ত করা হয়।’৮৭

পুরোদস্তুর স্বৈরাচারী শাসনের একপ্রস্থ লক্ষণ কাস্‌সিরেরের অনুসরণে আগে বিবৃত করেছি। আরও সূক্ষ্ম স্তরে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বৈরতন্ত্রের অনুপ্রবেশ বুঝতে লেভিট্‌স্কি ও জ়িবল্যাট চারটি প্রধান লক্ষণ নির্দিষ্ট করেছেন:

• গণতান্ত্রিক নিয়মনীতি ও কার্যপদ্ধতি পরিত্যাগ বা ক্ষীণ সমর্থন

• রাজনৈতিক বিরোধীপক্ষের বৈধতা অস্বীকার

• হিংসার প্রতি সহিষ্ণুতা বা হিংসায় প্ররোচনা

• সংবাদমাধ্যম সহ সব প্রতিপক্ষের নাগরিক স্বাধিকার হরণ

প্রত্যেকটি মূল লক্ষণের একাধিক ভাগ আছে, সারণির আকারে সাজানো। সব মিলে একটা স্কোরকার্ডের মতো: যে কোনও দেশের নাগরিক মিলিয়ে দেখে নিতে পারেন, তাঁদের দেশের কতগুলি লক্ষণ মিলে যায়। লেখকদ্বয় বিশদভাবে দেখিয়েছেন, ডনাল্ড ট্রাম্প কীভাবে স্বৈরাচারের এই চারটে ধারা ও অনেক উপধারা পূরণ করছেন, যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদত গণতান্ত্রিক কাঠামোর দৌলতে প্রায়ই সেটা কথার স্তরে রয়ে গেছে, কাজে পরিণত করার সুযোগ মেলেনি।৮৮

এই শর্তগুলি একবার কায়েম হলে অতিকথার নতুন রাজ্যপাটে শাসনতন্ত্রের চেহারা পালটে যায়; এবং তার প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে, কারণ সমস্যাটা আর কেবল অবহেলা বা অপটুতার নয়, একরোখা অভিপ্রায়ের। এজন্য ব্যাপকভাবে আইন সংশোধন শুরু হয়; আর আইনকানুন নিয়মনীতি যাই থাক, সেই আইনের বিধান হয়ে পড়ে স্বীকৃতভাবে গৌণ, রাষ্ট্রের গূঢ় প্রয়োজনে যে কোনও সময়ে অগ্রাহ্য হতে পারে। রাষ্ট্র আর কাজ করে না ভাষার সংকেতে মেলে-ধরা ব্যাখ্যাসক্ষম বিধি বা কার্যাবলির মধ্য দিয়ে, ধাপে ধাপে পর্যালোচনা করে; এখন বড় মাপের সিদ্ধান্তও নেওয়া হতে পারে তাৎক্ষণিক বাহ্য বিচারে, গা-সয়ে-যাওয়া অতিবিশেষ ক্ষমতার প্রয়োগে। সাবেক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ছিল দীর্ঘসূত্রিতা আর অতিসতর্কতার সমস্যা: সব দিক ভাবতে ভাবতে কাজটা আর হয়েই উঠত না। নতুন ব্যবস্থায় বরং দেখা যেতে পারে বেপরোয়া দ্রুততা, আলোচনা আর ব্যাখ্যায় অনীহা, তার বদলে একটা নতুন স্বেচ্ছাচারী রোখ।

এই পন্থায় একটানা শাসন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব একমাত্র যদি রাষ্ট্রের অতিকথা ফেঁপেফুলে রাজপুরুষদের দেয় এক অ-সাধারণ ‘অতিনাগরিক’ ক্ষমতা। এই অবস্থা কেবল দমন-পীড়নের দ্বারা সৃষ্টি করা, বা করলেও বাঁচিয়ে রাখা, অসম্ভব: প্রজাদের নিঃশর্ত আনুগত্য চাই, যা প্রায় দেবভক্তির পর্যায়ে পৌঁছতে পারে। কাস্‌সিরের বলছেন, এমন রাষ্ট্র মানুষের উপর ভাবাদর্শ চাপিয়ে দেয় না, মানুষগুলিকেই এমন পালটে দেয় যে তারা স্বেচ্ছায় সেই ভাবাদর্শ গ্রহণ করে, তার কার্যসূচি অনুসরণ করে। সেটা সম্ভব হয় কারণ ভাবাদর্শের বাহন হচ্ছে রাজনৈতিক অতিকথা।৮৯ এই স্বেচ্ছাবশ্যতার কথা বহু ভাষ্যকার বলেছেন, বলতে বাধ্য; কাস্‌সিরের, তাঁর পরে আরেন্ট ও নিশ্চয় আরও অনেকে পুতুলনাচের উপমা ব্যবহার করেছেন।৯০ জন কীন আর এক পা এগিয়ে বলেছেন seduction— প্রলোভন, প্রায় যেন যৌন প্রলোভন।৯১

আরেন্ট বলেছেন আরও মর্মান্তিক একটা প্রবণতার কথা: অত্যাচার, ক্ষতি এমনকী আপনজনের মৃত্যু সত্ত্বেও এই আনুগত্যে চিড় ধরে না, রাষ্ট্রের হাড়িকাঠে নাগরিক মাথা পেতে দেয়। এমন চরম দৃষ্টান্তের দরকার নেই; দৈনন্দিন স্তরে দেখা যায়, যে দল সরকারে থেকে কোনও উপকার করতে পারেনি, বরং ক্ষতি আর অপকীর্তির খতিয়ান রেখে গেছে, তাকেই দেশবাসী আবার ভোট দিয়ে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনছে। এটা স্বাধীন ব্যক্তিনাগরিক হিসাবে তাদের যুক্তিনিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নয়, অতিকথার কুশীলবদের প্রতি বিশ্বাস ও ভক্তির প্রকাশ। সময়টা খারাপ গেলে আমরা ঠাকুরঘরের নারায়ণকে ত্যাগ করি না, বরং বেশি করে পুজো দিই। তাতে সত্যিকারের দেবতা তুষ্ট হতে পারেন, মনুষ্যরূপী নারায়ণ ব্যাপারটা দেখতে পারেন দ্বিগুণ স্বৈরাচারের ছাড়পত্র হিসাবে।

ক্ষমতাবান শাসক যুক্তিবিচার বা নীতিশাস্ত্র কোনওটাই মেনে চলবে না, এতে নতুন কিছু নেই। তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ রাজপুরুষ-এ মাকিয়াভেল্লি বলছেন, ক্ষমতা অর্জন ও রাজ্যশাসনের দুটো উপায়: ন্যায় অনুসরণ করে আর শক্তি প্রয়োগ করে।৯২ প্রথমটি অবশ্যই শ্রেয় ও মনুষ্যোচিত, কিন্তু তাতে প্রায়ই ক্ষমতা রক্ষা হয় না, ফলে বাধ্য হয়ে দ্বিতীয় পন্থার আশ্রয় নিতে হয়। এই দুই পন্থার সঙ্গে এতক্ষণ আলোচিত ন্যায়-যুক্তির শাসন আর যুক্তিবিহীন শাসনের যথাক্রমে মিল পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু ধুরন্ধর মাকিয়াভেল্লির চিন্তাতেও একটা সারল্য আছে, যুক্তিবিহীন শাসন তিনি দেখছেন স্রেফ জোরজার আর জারিজুরি হিসাবে। মাকিয়াভেল্লির শাসক ধর্মকে নিজের স্বার্থে খুবই ব্যবহার করেন, কিন্তু অতিকথার আশ্রয় বড় নেন না, তা সে ধর্মীয় অতিকথা হোক বা নিছক রাজনৈতিক। অতএব তিনি কখনওই নিজের অবস্থান সম্বন্ধে নিঃশঙ্ক নন: নিজের প্রজাদের বিষয়ে সদা সন্দিহান থেকে, সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে, রীতিমতো দিনকে দিন লড়ে জিতে তাঁকে টিঁকে থাকতে হয়। সে যুগে ধর্মগুরু পোপ নিজে জাগতিক রাজ্যপাটের অধিপতি ছিলেন, তিনিও চুটিয়ে যুদ্ধ আর কূটনীতির শামিল হয়েছেন অন্য যে কোনও শাসকের মতো।

শেষ বিচারে মাকিয়াভেল্লির নির্দিষ্ট দুই বিকল্প শাসনকৌশল, ন্যায়ের অনুসরণ আর শক্তিপ্রদর্শন, দুটোই যুক্তি-তথ্য-বাস্তবনির্ভর; বিশ্বাস, ধর্ম বা অতিকথা দুটোর একটারও অঙ্গাঙ্গি উপাদান নয়, মূল ভিত্তি তো নয়ই। মাকিয়াভেল্লির চিন্তাধারা বাস্তবধর্মী, যুক্তিসিদ্ধ, তথ্যনিষ্ঠ। রাষ্ট্রিক জীবনে যে অজ্ঞেয় অনির্দেশ্য ধারাটা লোকে ভাগ্যদেবীর (Fortuna)৯৩ নাম করে ছেড়ে দেয়, সেটাকেও তিনি যুক্তিতথ্য দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চান। মাকিয়াভেল্লির উল্লেখ এখানে প্রাসঙ্গিক, কারণ শাসনতন্ত্রের যে স্বৈরাচারী অপযুক্তির পরাকাষ্ঠা কাস্‌সিরের দেখতে পাচ্ছেন নাৎসি রাজত্বে, তার সূত্রপাত তিনি পেয়েছেন মাকিয়াভেল্লির চিন্তায়। পরবর্তীকালের বিভিন্ন শাসকের সঙ্গেও মাকিয়াভেল্লির নাম যুক্ত হয়েছে।

মাকিয়াভেল্লির সম্যক আলোচনা আমার উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু তাঁর একটা বক্তব্য রাষ্ট্রীয় অতিকথার তাত্ত্বিক আলোচনার সূত্রপাত বলা চলে। সেটা কী? যদিও মাকিয়াভেল্লির আদর্শ শাসক রীতিমতো স্বৈরাচারী— নইলে ক্ষমতায় টিঁকে থাকতেন না— জনমত ও জনসমর্থনকে মাকিয়াভেল্লি যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন। জনসমর্থন লাভের শ্রেষ্ঠ উপায় অবশ্যই সৎ ও কল্যাণকরভাবে রাষ্ট্র শাসন করা; কিন্ত নানা কারণে প্রায়ই তা সম্ভব হয় না। অতএব একমাত্র উপায় মহত্ত্বের ছল করা, স্বার্থান্বেষী কার্যকলাপকে জনমুখী করে দেখানো:

একজন রাজপুরুষের পক্ষে উপরোক্ত সব গুণের অধিকারী হবার প্রয়োজন নেই; কিন্তু যাতে আপাতভাবে তাঁকে সেগুলির অধিকারী মনে হয়, তার একান্ত প্রয়োজন আছে। বরঞ্চ আমি এটাই বলব যে এই সব গুণ থাকলে এবং প্রয়োগ করলে রাজপুরুষের সর্বনাশ হতে পারে, কিন্তু কেবল আপাতভাবে বর্তমান থাকলে উপকারে আসে— যেমন আপাতভাবে দয়ালু, বিশ্বস্ত, মানবিক, সৎ ও ধার্মিক হওয়া … কিন্তু এমন মানসিক প্রস্তুতি থাকা উচিত, যাতে প্রয়োজনে নিজেকে পাল্টে ঠিক বিপরীত আচরণ করতে পারা যায়।৯৪

মাকিয়াভেল্লির চারশো বছর পর (ততদিনে তাঁর স্বপ্ন পূরণ করে ইতালি সত্যিই সংযুক্ত রাষ্ট্র হয়েছে) তাঁর দেশে এক নেতার আবির্ভাব হল যিনি মাকিয়াভেল্লির কল্পিত রাজপুরুষের পরাকাষ্ঠা বলা চলে। তাঁর নাম বেনিতো মুসোলিনি। তাঁর এক স্মরণীয় উক্তি, ‘বিশ্বাসে পাহাড় টলে, কারণ বিশ্বাস এই বিভ্রম সৃষ্টি করে যে পাহাড় টলছে। বিভ্রমই হয়তো জীবনে একমাত্র বাস্তব।’৯৫ উক্তিটা আরও কৌতূহলজনক, কারণ তা যিশুখ্রিস্টের এক উক্তির মর্মান্তিক প্রতিবর্তন: ‘যদি তোমাদের একটা সর্ষেদানার মাপের সামান্য বিশ্বাসটুকুও থাকে, তবে এই পাহাড়টাকে বলবে “টলো”, আর সে টলবে।’৯৬ যিশুর প্রচারিত ঐকান্তিক ধর্মবিশ্বাস ফাসিস্ত নেতার চিন্তায় পরিণত হয়েছে বিশ্বাসের কৌশলী বাহ্যপ্রয়োগে। তিনি কবুল করছেন তিনি তত্ত্বটা বিশ্বাস করেন না, জেনেশুনে ধোঁকা দিতে অন্যের বিশ্বাসের সুযোগ নিচ্ছেন। মুসোলিনি জীবন শুরু করেছিলেন নিরীশ্বরবাদী হিসাবে, কিন্তু ক্রমে ক্যাথলিক চার্চের আশীর্বাদপ্রার্থী হন এবং বক্তৃতায় নিয়মিত ঈশ্বরের বিধানের উল্লেখ করতেন।৯৭

মুসোলিনি মাকিয়াভেল্লির ভক্ত ছিলেন, তাঁর উপর একটা নিবন্ধও লিখেছিলেন।৯৮ মাকিয়াভেল্লির রাজপুরুষ বইটা তিনি ব্যাখ্যা করেন পুরোপুরি একনায়কবাদের দৃষ্টি থেকে। কিন্তু মনে হয়, মাকিয়াভেল্লির কাছ থেকে তাঁর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হল প্রচারতত্ত্ব। মাকিয়াভেল্লির অনেক মৌলিক অবদানের মধ্যে একটা, তিনি রাজনৈতিক প্রচার বা প্রোপাগান্ডার আদি প্রবর্তক। উপযুক্ত ভাষায় জুতসই প্রচারবার্তা যে রাজ্যশাসনে একটা মস্ত হাতিয়ার হতে পারে, সেটা তিনি বিলক্ষণ বুঝেছিলেন। এই বার্তা ধর্মগ্রন্থ বা অন্য প্রতিষ্ঠিত সূত্র থেকে আসার দরকার নেই, যদিও দরকারমতো তেমন সূত্র ব্যবহার করা যেতেই পারে। (শাসকের ধার্মিক ভাবমূর্তি যে গুরুত্বপূর্ণ, তা তিনি একাধিকবার বলেছেন।) তার চেয়েও বড় কথা, প্রচারবার্তা আদৌ সত্য হবার দরকার নেই। যখন যে কথা প্রজারা শুনতে চাইবে, বা তাদের শোনালে শাসকের সুবিধা হবে, সেটাই দরকারমতো বানিয়ে সাজিয়ে সামনে ধরতে হবে, ধরে যেতেই হবে। ইউরোপীয় ধ্রুপদী চিন্তায় যাকে রেটরিক বলে (ভারতীয় অলঙ্কারের ধারণা থেকে তা অনেকটাই পৃথক), অর্থাৎ জনমানস প্রভাবিত করতে ভাষার নিপুণ ব্যবহার, রাজনীতি ও জনজীবনে তার মৌলিক গুরুত্ব আধুনিক যুগে মাকিয়াভেল্লি প্রথম বুঝতে পারেন ও তার প্রয়োগকৌশল তুলে ধরেন। মাকিয়াভেল্লির মানসপ্রপৌত্র মুসোলিনি সম্বন্ধে বিখ্যাত ইতালীয় ভাষাবিদ ও সংকেততাত্ত্বিক উমবের্তো একো (যাঁর ছেলেবেলা কেটেছিল মুসোলিনির রাজত্বকালে) বলেছেন, ‘মুসোলিনির কোনও দর্শন ছিল না, ছিল কেবল রেটরিক।’৯৯

প্রোপাগান্ডার মহিমা হল, তার উদ্দেশ্য স্বৈরাচারী হলেও প্রয়োগ জনমুখী, জনমানসকে হাতের মুঠোয় আনছে শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থে চালিত করতে। ষোলো শতকে ইউরোপে (এবং অন্যত্র) প্রায় সব দেশ ছিল রাজতন্ত্র বা গোষ্ঠীতন্ত্র; সেখানে জনসমর্থনের দরকার ছিল স্রেফ দাঙ্গা বা অভ্যুত্থান এড়াতে আর যুদ্ধের সময় অনুগত সৈন্য পেতে। আধুনিক কালে বিশ্বের অধিকাংশ রাজত্ব অন্তত নামে গণতন্ত্র, ভারতসহ অনেকগুলি মোটের উপর বাস্তবেও তাই। সেখানে প্রকৃত ক্ষমতা ভোগ করতে গেলে কোনও না কোনও ভাবে জনগণের বৃহৎ অংশের সমর্থন চাই। কেবল বলপ্রয়োগের দ্বারা সেটা আদায় করা অবাঞ্ছিত, হয়তো অসম্ভব। তার চেয়ে ভাষা দিয়ে জনসাধারণকে বশ করতে পারলে আরও পরিচ্ছন্নভাবে কাজ হাসিল হয়, প্রভাবও হয় অনেক সুদূরপ্রসারী। ভাষার আসল শক্তি শব্দের কারিকুরিতে নয়, তার নিহিত মননপ্রণালীতে। সফল প্রোপাগান্ডা ভাষা দিয়ে নাগরিকের মানসিক গঠন ও চিন্তার ধারা রাষ্ট্রের প্রয়োজনমতো গড়ে পিটে নেয়। তার মানে শুধু সরাসরি রাষ্ট্রের মহিমাকীর্তন ও শাসননীতির সমর্থন নয়, অন্যান্য সব বিষয়ে নাগরিকদের অবস্থান হয় রাষ্ট্রের পক্ষে নিরাপদ ও সুবিধাজনক। চূড়ান্ত সাফল্য আসে যখন নতুন কোনও পরিস্থিতিতে নাগরিকের প্রতিক্রিয়া আপনাআপনি রাষ্ট্রের বিধিমতো হয়, শিখিয়ে দিতে হয় না।

আলোচনার গর্ভগৃহের দুয়ারে পৌঁছে গেছি। গোড়া থেকে যে বক্তব্যগুলি তুলে ধরার চেষ্টা করছি, পরের দুটি অধ্যায়ে তা উপসংহারে নিয়ে যাব। দেখব, মননের কী প্রক্রিয়ায় আজকের শাসক জনগণের উপর মানসিক আধিপত্য বিস্তার করতে পারে। আর সব ক্ষমতা তারই অনুষঙ্গ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *