২. অর্থ ও অনর্থ

২. অর্থ ও অনর্থ

শেকসপিয়রের নাটক দ্য মার্চেন্ট অভ ভেনিস-এর কল্যাণে ইউরোপীয় মধ্যযুগের আর্থনীতিক চিন্তার একটা তত্ত্ব আজও আমাদের পরিচিত। (শেকসপিয়র অবশ্য লিখেছিলেন মধ্যযুগ শেষ হবার খানিক পরে, তবে ধারণাটা তখনও যথেষ্ট চালু ছিল।) উপার্জনের দুটি মাত্র অনুমোদিত পথ: পণ্যের উৎপাদন, এবং শ্রম বা পরিষেবা দান। বাদ যাচ্ছে সুদে টাকা খাটানো বা তেজারতি কারবার। তার একটা যুক্তিও আছে: তেজারতির ভিত্তি না প্রকৃতিদত্ত কোনও সম্পদ, না মানুষের প্রকৃতিদত্ত শক্তির প্রয়োগ। তেজারতি হল টাকা থেকে টাকা উৎপন্ন করা, যা কিনা প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধ। (এই ধারণার উৎস আরিস্ততেলেসের চিন্তায়।১৮) গাছ বা পশুর সংখ্যাবৃদ্ধি হয় প্রজননের দ্বারা। ধাতুর প্রজনন হয় না, তাই ধাতু থেকে ধাতু (অর্থাৎ মুদ্রা) উৎপাদন করা প্রকৃতিবিরুদ্ধ অনাচার। শেকসপিয়রের নাটকে নীতিবান ব্যবসায়ী আন্তোনিও সুদখোর শাইলককে বলে: ‘তোমার সোনা-রুপা কি স্ত্রী আর পুরুষ ভেড়া, যে তুমি তাদের বংশবৃদ্ধি ঘটাবে?’১৯

সুদের কারবারের বিরুদ্ধে এই বিশেষ যুক্তিটা আজ অচল (ইসলামিক দেশগুলিতে ব্যাঙ্কিং নীতি প্রসঙ্গে অনুরূপ কিছু তত্ত্ব শোনা গেলেও)। আধুনিক যুগে টাকা খাটিয়ে টাকা রোজগারের ধারণাটা সর্বজনীন হয়ে পড়েছে। সামান্য সংগতি থাকলে আমরা সবাই সুদের কারবারি: আমাদের ব্যাঙ্কে আমানত আছে, অর্থাৎ সুদের পরিবর্তে আমরা ব্যাঙ্ককে টাকা ধার দিচ্ছি। ব্যাঙ্ক সেই টাকা বেশি সুদে অন্য লোককে (বা আমাদেরই) ধার দিচ্ছে, দুটো হারের তফাত হল ব্যাঙ্কের লাভ। আর এক ধাপ এগিয়ে অনেকে শেয়ার বাজারে লগ্নি করি, সরাসরি অথবা মিউচুয়াল ফান্ড মারফত— অর্থাৎ ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের টাকা ধার দিই, কার্যত তাদের ব্যবসায় অংশ নিই এবং লাভের বখরা পাই।

যে আর্থিক ও বাণিজ্যিক লেনদেন দু’-তিন শো বছর আগে কয়েকটি বিশেষ গোষ্ঠীর উপজীব্য ছিল (এবং আমাদের দেশে বাঁধা পড়েছিল বর্ণাশ্রমের ফাঁসে), সমস্ত সমাজ আজ তার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তুলনা করা যেতে পারে সাক্ষরতার সঙ্গে। লিপির ব্যবহার ও ভাষায় রচনার প্রচলন বহু সমাজে দু’-তিন হাজার বছর ধরে চলে আসছে, কিন্তু লিখতে-পড়তে অভ্যস্ত ছিল অল্প কিছু মানু্ষ, পেশার তাগিদে: পুরোহিত, আইনজীবী, চিকিৎসক, বিদ্যাজীবী, প্রশাসক, হিসাবরক্ষক। বাকি লোকে লেখাপড়ার দরকার বোধ করত না, একটু সচ্ছল ‘ভদ্রঘরের’ ছেলে হলে বড়জোর পাঠশালায় প্রাথমিক তালিমটুকু অর্জন করত; মেয়েদের তারও প্রশ্ন ছিল না। সর্বজনীন সাক্ষরতার কথা ইউরোপে প্রথম এক-আধটু শোনা যায় রেনেসাঁসের যুগে, এবং মাত্র উনিশ শতকে আদৌ গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা করা হয়।

আরও একটা বিষয় আলোচনায় আনা দরকার। শেকসপিয়রের যুগে আর্থনীতিক বৃদ্ধি বা উন্নয়নের ধারণা বড় দেখা যায় না। শ্রম-জ্ঞান-প্রযুক্তির দ্বারা যে জাতির মোট উৎপাদন, অতএব সম্পদ, বাড়তে পারে, এবং সেই বাড়তি ভাণ্ডার থেকে সকলেই লাভবান হতে পারে, এমন ভাবার অবকাশ ছিল কম, কারণ প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের অগ্রগতি ছিল মন্থর। কার্যত ধরে নেওয়া হত যে দেশের বা বিশ্বের ধনভাণ্ডার মোটের উপর স্থাবর ও সীমিত, সেটাই ভাগাভাগি করে নিতে হবে; একজনের লাভ হলে অন্য এক বা একাধিক জনের ক্ষতি হতে বাধ্য, কারণ তাদের ধনটাই প্রথম ব্যক্তি করায়ত্ত করছে।

সাম্রাজ্যবাদের ভরা জোয়ারে এই ধনের চালাচালিটা বিশ্ব জুড়ে প্রবল হয়ে উঠল। এশিয়া ও আফ্রিকা নিঃস্ব হয়ে পড়ল ব্রিটেন, ফ্রান্স বা বেলজিয়ামের শ্রীবৃদ্ধির স্বার্থে; দক্ষিণ আমেরিকা আগেই হয়েছিল, স্পেনের কবলে পড়ে। বহু দেশে জমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভাগীদার কমাতে জনজাতিদের নির্মূল করে ফেলা হল। কিন্তু একই সঙ্গে একটা নতুন জিনিস দেখা গেল: ঔপনিবেশিক মালিক-দেশগুলির আরও পোক্তভাবে আর্থিক বৃদ্ধি ঘটল শিল্পবিপ্লবের কল্যাণে— কেবল অধিকৃত দেশের কাঁচামাল আত্মসাৎ করে নয়, নতুন উন্নত প্রযুক্তি খাটিয়ে উৎপাদনের গুণগত বৃদ্ধি ঘটিয়ে। ঔপনিবেশিক যুগের অবসানে ভারত থেকে শুরু করে সদ্য-স্বাধীন দেশগুলি যে আর্থিক পরিকল্পনা করতে লাগল, তারও একটা প্রধান লক্ষ্য হল প্রযুক্তির দ্বারা দেশের অভ্যন্তরীণ ধন বাড়ানো। সেজন্য বৃহত্তর বিশ্ব-অর্থনীতি থেকে এই দেশগুলি নিজেদের অল্পবিস্তর বিচ্ছিন্ন করে রাখতেও পিছপা হল না। কিছুকাল বাদে কিন্তু দেখা গেল, অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশ এই পথ থেকে সরে এসে সমৃদ্ধ বিশ্বের বাজার-অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হতে লেগেছে। উদ্দেশ্য, উন্নয়নের গতি দ্রুততর করা; কিন্তু এর ফলে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বাড়ুক আর না বাড়ুক, সেই সম্পদের একটা অংশ আবার বিদেশে চলে যেতে শুরু করল।

ইতিমধ্যে (বিশেষত সোভিয়েত সাম্রাজ্য পতনের পর) বিশ্ব-অর্থনীতির মূল ভাবধারা ও কর্মকাণ্ডে একটা অভূতপূর্ব পরিবর্তন এসেছে, যার ফলে বাস্তব সম্পদ সৃষ্টির সঙ্গে আর্থিক সমৃদ্ধির যোগ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। অতএব বিদেশি লগ্নিকারী যে নিজের স্বার্থে আমাদের দেশের সম্পদ বাড়াতে উদ্যোগী হবে তার আশা আগের চেয়েও কম। তা বলে এও নয় যে তারা সাবেক ঔপনিবেশিক ঢঙে যজমান দেশগুলোর উৎপাদন খোলাখুলি বিদেশে পাচার করবে, যদিও সুযোগ পেলে অবশ্যই করতে পারে। আসল কথা, তাদের লাভের ভিত্তিটাই বদলে গেছে। আজ বিশ্ব-অর্থনীতির প্রধান ও বৃহত্তম বাজার পণ্য বা পরিষেবার নয়, টাকার। ফিরে এলাম অধ্যায়ের গোড়ার কথায়।

বদলটা বোঝার জন্য কার্ল মার্ক্সের মতো ভবিষ্যৎমুখী এক চিন্তানায়কের অবস্থান দেখা যাক। ১৮৫৯ সালে মার্ক্স টাকা আর পণ্যের লেনদেনের একটা বিশ্লেষণ করেছিলেন, পরে সেটা বাড়িয়ে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন পুঁজি (দাস কাপিটাল)-এ। এই প্রক্রিয়া তিনি দেখেছিলেন দুটো দৃষ্টিতে: এক, যেখানে পণ্য অর্জনই প্রধান, টাকার লেনদেন তার উপায় বা মাধ্যম; দুই, যেখানে টাকা অর্জনই প্রধান, পণ্যের ব্যবসা তার উপায় বা মাধ্যম। প্রথম ক্রম ‘পণ্য>টাকা>পণ্য’। চাষি গম বেচে টাকা পেল, সেই টাকা দিয়ে সে দরজির কাছ থেকে জামা কিনল। এই বইয়ে এ পর্যন্ত আমরা এই প্রেক্ষিতেই লেনদেনের আলোচনা করেছি। কিন্তু পণ্য লেনদেনের চাকা ঘুরতেই থাকে, আর প্রত্যেক পণ্য লেনদেন মানে টাকারও লেনদেন। বরং বলা চলে, নানা পণ্য সাময়িকভাবে এই প্রক্রিয়ায় ঢোকে আর বেরোয়, কিন্তু টাকা সবসময় উপস্থিত— টাকা ছাড়া কোনও লেনদেনই হতে পারে না। ফলে লেনদেনের একটা উলটো ক্রমও থাকে, ‘টাকা>পণ্য>টাকা’। শুরুতেও টাকা, শেষেও টাকা, কিন্তু টাকার এই প্রবাহ বইছে পণ্যের কারবারের মধ্য দিয়ে, নইলে বইত না। মার্ক্স স্পষ্ট বলেছেন, ‘টাকার প্রবাহের প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে পণ্যের প্রবাহ।’২০

এই কথাটা আজকের অর্থনীতির দুনিয়ায় খাটবে না। টাকা দিয়ে সরাসরি টাকা রোজগারের সম্ভাবনা, অর্থাৎ পণ্যের মধ্যস্থতা বিনা স্রেফ ‘টাকা>টাকা’, মার্ক্স ক্ষেত্রবিশেষে স্বীকার করেছেন— সুদের কারবারে (এই অধ্যায়ের গোড়ায় ফিরে যান), এবং জুয়া-ফাটকায়।২১ তার চেয়ে অনেক বড় কথা, তাঁর মূল বিবেচ্য বিষয় পুঁজি সম্বন্ধেও বলছেন, পুঁজি হিসাবে টাকা লেনদেনের প্রবাহ একটা স্বয়ম্ভূ প্রক্রিয়া, বাজারে টাকা খাটিয়ে সেটার বৃদ্ধি ঘটানোই উদ্দেশ্য।২২ তবে মার্ক্সের কাছে সেই বৃদ্ধির স্বাভাবিক উপায় পণ্যের কারবারের মাধ্যমে। পুঁজি-র পরবর্তী খণ্ডে বলছেন এক বিশেষ শ্রেণির পুঁজির কথা, যা পুঁজি হিসাবেই পণ্য হয়ে ওঠে;২৩ কিন্তু এখানেও সুদে-খাটানো সেই পুঁজি হচ্ছে পণ্যশিল্পের মুনাফার একটা অংশ, নিছক টাকার কারবার থেকে পাওয়া নয়। অর্থাৎ টাকাই যে পণ্য হতে পারে, সেটা বিলক্ষণ মার্ক্সের চিন্তায় আছে, কিন্তু বস্তুপণ্যের কারবার থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে দেখতে পারছেন না। আজকের টাকার ব্যবসার প্রাথমিক রূপের তবু আভাস দেখছেন ‘শেয়ার-বাজারের ফাটকাবাজি আর ব্যাঙ্কতন্ত্রে’।২৪ পুঁজিবাদ সম্বন্ধে তাঁর সাধারণ তত্ত্বের গণ্ডী পেরিয়ে সেই সম্ভাবনাটাই আজ ধনতন্ত্রের পরাকাষ্ঠা হিসাবে অধিষ্ঠিত: বিশ্ব জুড়ে সবচেয়ে বড় ব্যবসা হল টাকা নিয়ে ব্যবসা। এখানে পুঁজি স্থায়ীভাবেই টাকার রূপ ধারণ করে থাকে, পণ্যরূপ থেকে পরিবর্তনের দরকার পড়ে না। অন্য কোনও পণ্যের কথা আদৌ যদি ওঠে, সে এক সুদূর, অদৃশ্য, প্রায় কাল্পনিক বস্তু হিসাবে।

কেউ বলতে পারে, টাকার বাজার চলবে কী ভাবে? টাকা কিনে-বেচে লাভের অবকাশ কোথায়? বারো টাকা দিয়ে তো কেউ দশ টাকা কিনবে না, আট টাকায় বেচবেও না। তা হলে? বিদেশি টাকার বেচাকেনা হতে পারে, কিন্তু সেটা তো টাকা নিয়ে ব্যবসার একটা অংশ মাত্র।

এই প্রশ্নের সহজ উত্তর, হাতে হাতে নগদে কেউ বারো টাকা দিয়ে দশ টাকা কিনবে না ঠিকই, কিন্তু ভবিষ্যতের কথা ভেবে করতে পারে, করেও আকছার। তার সবচেয়ে অভ্যস্ত উদাহরণ ঋণ। টাকা ধার নেওয়া মানে আমি কারও কাছ থেকে হাজার টাকা ‘কিনলাম’ এগারোশো বা বারোশো টাকা ‘দামে’; দাম মেটাব এক বছর বাদে। বলা চলে সুদটা সেই বিলম্বের দাম; ঋণদাতা যে ঝুঁকি নিচ্ছেন তারও বটে, কারণ আমি ঋণ নাও শোধ করতে পারি। ঝুঁকির মাশুলের একটু জটিল উদাহরণ বিমা। বিমা সংস্থাকে দশ হাজার টাকা দিয়ে আমি বোঝাপড়া করলাম, আগামী এক বছরে আমার বাড়িটা দুর্বিপাকে ধ্বংস হলে সেটা আবার বানাবার জন্য তারা আমাকে পঞ্চাশ লাখ টাকা দেবে। বিমার পণ্য হল বাড়ি ধ্বংস হবার সম্ভাবনা বা ঝুঁকি, বিমা সংস্থা সেটা আমার হাত থেকে তাদের হাতে নিয়ে নিচ্ছে অর্থাৎ আমার কাছ থেকে ‘কিনছে’। কিন্তু ঝুঁকি তো ভাল জিনিস নয়, সেটা দাম দিয়ে কে কিনবে? দামটা তাই হাত বদলাচ্ছে উলটো মুখে: আমার ঝুঁকি তাদের ঘাড়ে তুলে নেবার জন্য আমিই বিমা সংস্থাকে দশ হাজার টাকা ‘দাম’ দিচ্ছি।২৫

আর একটু দেখা যাক। ঝুঁকি বিক্রির তত্ত্ব ক’টা লোকে বোঝে? আমরা সোজাসুজি ভাবি, দশ হাজার টাকা দিয়ে বিমা সংস্থার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি পেলাম। ধার নেওয়াও একটা প্রতিশ্রুতি: আমি কথা দিচ্ছি, অমুক তারিখে সুদে-আসলে টাকাটা ফেরত দেব। বলা চলে, হাতে হাতে নগদ লেনদেন বাদে টাকার যত কারবার, সবেরই ভিত্তি কোনও-না-কোনও প্রতিশ্রুতি, ভবিষ্যতে কিছু দেবার বা করার; অতএব আসছে ঝুঁকি, কারণ প্রতিশ্রুতি মাত্রেই অনিশ্চিত। (এ প্রসঙ্গে ফিরে আসব।)

আগের অধ্যায়ে টাকার নোটের উদাহরণ মনে পড়তে পারে: সেটাও টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি। একটা মৌলিক তফাত আছে কিন্ত। নোটের ভূমিকা পুরোপুরি সাংকেতিক: ওটা মুদ্রার বদলে ব্যবহার হচ্ছে, সেই নিরিখে টাকার একটা নির্দিষ্ট অঙ্ক বোঝাচ্ছে, বেশি-কমের প্রশ্ন নেই (ক্রয়ক্ষমতা বাড়তে-কমতে পারে, সেটা অন্য ব্যাপার)। উপরন্তু নোটের উপর টাকা দেবার যে প্রতিশ্রুতি ছাপা আছে, তা প্রত্যয়িত করছেন স্বয়ং সরকার; ফলে ঝুঁকির অবকাশ নেই, যার ক্ষতিপূরণ হিসাবে দামের দাবি উঠবে। কাজেই নগদ টাকার নিজস্ব কোনও ক্রয়মূল্য নেই। একটু আগে যে প্রশ্ন উঠেছিল, নগদের ক্ষেত্রে তা একদম ঠিক: দশ টাকার নোট কেউ বারো টাকায় কিনবে না, আট টাকায় বেচবে না।

টাকা নিয়ে অন্য বোঝাপড়া ঘিরে কিন্তু বিলক্ষণ বেচাকেনা চলে। টাকার বাজারে একটা মামুলি কারবার হল পাওনার ফ়্যাক্টরিং। আমি ব্যবসায়ী, এক খরিদ্দারের থেকে কিছুদিন বাদে আমার হাজার টাকা পাওনা আছে। হাতে হাতে টাকা পেতে আমি আজই পাওনাটা আর একজনকে নগদ ন’শো টাকায় বেচে দিলাম। সে হয়ে গেল নতুন পাওনাদার, যথাসময়ে খরিদ্দারের থেকে পুরো হাজার টাকা আদায় করবে, লাভ করবে একশো টাকা।

ক্রেডিট কার্ডের রমরমার এটাই ভিত্তি (যদিও ‘ফ়্যাক্টরিং’ কথাটা সেখানে অন্য অবাঞ্ছিত অর্থে ব্যবহার হয়)। ক্রেডিট কার্ড সংস্থা কোনও পণ্য বেচে না, অন্যান্য বিক্রেতাদের পাওনা টাকা ক্রেতাদের থেকে আদায় করে কেবল। পরিবর্তে সেই বিক্রেতারা কার্ড সংস্থাকে কমিশন দেন, ক্রেতারাও পাওনা মেটাতে দেরি হলে চড়া হারে সুদ দেন। অর্থাৎ ক্রেতাদের ধার ও বিক্রেতাদের পাওনাই হল কার্ড সংস্থার পণ্য— লেনদেনের অঙ্কগুলোই পণ্য, কী জিনিস কেনা হচ্ছে তা অবান্তর। অবস্থা অনুসারে সেই অঙ্কের হেরফের ঘটে। কোনও ক্রেতা হাজার টাকার জিনিস কিনে একশো টাকা সুদ সমেত পাওনা মেটালে তার কাছে লেনদেনের কার্যকর মূল্য এগারোশো টাকা, বিক্রেতার কাছে (কার্ড সংস্থার কমিশন কেটে) হয়তো ন’শো আশি টাকা, কার্ড সংস্থার কাছে একশো কুড়ি টাকা। ক্রয়মূল্যের বিচারে টাকার দাম নাও বদলাতে পারে; কিন্তু ব্যক্তিবিশেষের (বা সংস্থাবিশেষের) ব্যয় বা প্রাপ্তির তারতম্যে, এবং মেয়াদ অর্থাৎ সময়ের তারতম্যে, দামটা এক-এক সময়ে এক-এক রকম।

এই উদাহরণগুলো টাকার বাজারের সহজ ও পরিচিত কারবার। আমাদের অধিকাংশের ধারণা নেই (কবুল করছি, আমার মোটেই নেই) এই বাজার আদতে কত বিশাল, তার কর্মকাণ্ড কত বিচিত্র ও দুর্বোধ্য। এই ‘ফ়াইন্যান্সিয়াল মার্কেট’ আজ বিশ্বের অর্থব্যবস্থার সবচেয়ে বৃহৎ ও লাভজনক ক্ষেত্র, বলা চলে তুরীয় স্তর। উৎপাদনশিল্প, এবং পণ্য ও পরিষেবার প্রচলিত ব্যবসা, যত বড় হোক না কেন, তুলনায় অনেক সীমিত আর আটপৌরে ব্যাপার। ঝ়াঁ বদ্রিইয়ার লিখেছেন (সূত্র উল্লেখ না করে) যে ১৯৯০ সালে বিশ্ব জুড়ে পুঁজির যত লেনদেন হয়েছে, প্রথাগত পণ্যের ব্যবসা তার পঁয়তাল্লিশ ভাগের মাত্র এক ভাগ।২৬

দেখা যাচ্ছে, উপরোক্ত লেনদেনের ক্ষেত্রে সময় একটা বড় বিবেচনা। পাওনা টাকা আগে পেতে বা দেনার টাকা দেরিতে মেটাতে লোকে খরচ করতে রাজি, পড়তায় পোষালেই হল। ‘সময়ের দাম’ কথাটা এখানে আক্ষরিক সত্য। আরও দেখা যাচ্ছে, ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা থেকে বাঁচতে লোকে টাকা খরচ করে। ঋণদাতা কিছু টাকা গচ্চা দিয়েও বাকি পাওনা হাতে পেলে আদায়ের ঝুঁকিটা অন্যের ঘাড়ে চালান করতে চায়। সময় আর ঝুঁকি, মূলত এই দুটো শর্ত ভাঙিয়ে লাভের মাত্রা তুঙ্গে নিয়ে যেতে টাকার ব্যবসায় অদ্ভুত জটিল নানা কারবার চালু আছে; সেগুলির নেপথ্যে কাজ করছে কতগুলি অভিনব যুক্তি আর মানসিকতা।

ভবিষ্যৎ বাজারদরের ভিত্তিতে একরকম কারবারের নামই ফ়িউচারস ট্রেডিং। তাতে লেনদেন হয় আজকের নয়, ভবিষ্যতের অনুমিত দরের ভিত্তিতে। আমি পাটকলের মালিক, আড়তদারের থেকে কাঁচা পাট কিনি। আগামী বছর কী দামে কিনব, এখনই ঠিক করে নিলে আমার সুবিধা, আড়তদারেরও। দু’জনে তাই চুক্তি করলাম, বারো মাস বাদে সে আমাকে এত পরিমাণ পাট এত দামে সরবরাহ করবে। যথাসময়ে আসল বাজারদর তার বেশি হলে আমার লাভ, কম হলে আড়তদারের লাভ; কিন্তু চুক্তিবদ্ধ দামটা মোটামুটি ন্যায্য হলে উভয় পক্ষই সন্তুষ্ট ও নিশ্চিন্ত হবে।

বোঝাপড়াটা যতক্ষণ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মধ্যে, এমন বন্দোবস্ত বাস্তবের মাত্রা ছাড়ায় না। বিপত্তি বাধে যখন বাইরের লোক আলগা টাকা কামাতে আসরে নামে। কোনও তৃতীয় পক্ষ যদি ভাবে পাটের দর ভবিষ্যতে কমবে, অর্থাৎ উপরোক্ত চুক্তি অনুসারে জোগানদারের লাভের অঙ্ক বাড়বে, হাতে হাতে নগদের টোপ ফেলে আড়তদারের কাছ থেকে সে আজই চুক্তিপত্রটা কিনে নিতে পারে, ফের কাউকে বিক্রিও করতে পারে। এই পরবর্তী লেনদেনগুলো পুরোদস্তুর টাকার ভিত্তিতে, পাটের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই; সম্পর্ক শুধু পাটের দামের ওঠা-নামার সঙ্গে।

এটা খুব সরল উদাহরণ, টাকার বাজারের ব্যাপারীরা পড়ে হাসবেন। এই ধরনের লেনদেন কল্পতরুর রূপ ধরে অত্যন্ত জটিল পর্যায়ে, উপর্যুপরি কেনাবেচার ফলে যখন খেই রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। একই চুক্তির এক-এক অংশ ভেঙে আলাদা আলাদা বন্দোবস্ত হয়, মিলিয়ে দেওয়া হয় এক বা একাধিক অন্য চুক্তির পুরোটা বা কিয়দংশের সঙ্গে। এইভাবে ধাপে ধাপে সব চুক্তিই তাদের আদি বাস্তব চরিত্র হারায়: কীসের চুক্তি, কোন পণ্য বা পরিষেবার জন্য, তা শুধু অবান্তর নয় অভেদ্য হয়ে পড়ে, লেনদেনটা হয় পুরোপুরি টাকার বিনিময়ে টাকার। ফলে সেই পণ্যের আসল বাজারের হয়তো ক্ষতি হয়, ক্রেতা বিক্রেতা উপভোক্তা সকলেই বেশি দাম দিতে বাধ্য হন বা জিনিসটা আদৌ পান না। একইভাবে ঋণপত্র বারবার হাতবদল হতে থাকে, যতক্ষণ কোনও দুঃসাহসী ক্রেতা পাওয়া যায়।

এসব উদ্যোগে কোনও বাস্তব দায়বদ্ধতা থাকে না। একরাশ বায়বীয়, বলতে গেলে কাল্পনিক লেনদেনের ভারে তলিয়ে যায় বাস্তব দুনিয়ার তাগিদ, মানুষের সত্যিকারের চাহিদা। বাস্তবে মাল জোগানের দায়িত্ব না থাকলে যে-কোনও দামে ও শর্তে আমি তা সরবরাহের চুক্তি নিয়ে লেনদেন করতে পারি: চুক্তিটা অন্য কাউকে হস্তান্তর করলেই কেল্লা ফতে। উদার কিস্তিতে ঋণ দিতে পারি, কিস্তি মেটাবার সংগতি নেই এমন লোককেও দিতে পারি, যদি জানি সেই ঋণ আমায় আদায় করতে হবে না, ঋণপত্রটা আর কাউকে বেচে দেব। ২০০৮ সালে যে ভয়াবহ মন্দা আমেরিকা থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল, তার মূলে ছিল গৃহঋণের লাগামছাড়া বিতরণ, তারপর সেই ঋণ নিয়ে অবিশ্বাস্য জটিল লেনদেনের পালা। যতদিনে বোঝা গেল সেই ঋণ শোধের কোনও সম্ভাবনা নেই, দেনাদার পাওনাদার উভয়ের মাথায় হাত, ততদিনে ঋণপত্রগুলো বারবার বিচিত্র পথে হস্তান্তর হয়েছে, তার কুশীলবেরা নাগালের বাইরে।

আদত লেনদেনের বাস্তব উৎস থেকে উদ্ভূত হয়ে বা ‘ডিরাইভ’ করে, ধাপে ধাপে বাস্তব থেকে সরতে সরতে সহস্র যোজন দূরে অবস্থিত এই ‘ডেরিভেটিভস’-এর জগৎ। প্রথম অধ্যায়ের শেষে বলেছিলাম, সংকেতের পিছনে সংকেত, তার পিছনে ফের সংকেতের অশেষ অনুক্রমের কথা। সংকেতশাস্ত্রের এই তত্ত্বটা আজকের টাকার বাজারের লেনদেনে প্রয়োগ করেছেন রবিন গুডম্যান। তিনি লিখছেন: ‘স্থির অর্থনির্দেশ বা মূল্যায়নকে এভাবে মুলতুবি রাখার আর্থনীতিক প্রেক্ষিতটা নব্য-উদার অর্থনীতির যুগে বিশেষ করেই চোখে পড়ে।’ তিনি এতদূরও বলছেন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের উন্নয়নের কর্মকাণ্ড পর্যন্ত অর্থবাজারের কুশীলবেরা আর্থিক পণ্যে পরিণত করে অন্য অর্থব্যবসায়ীদের কাছে বেচে দিচ্ছে, যাদের আসল কারবার অন্যদিকে।২৭ এ এক দূরস্থ বিচ্ছিন্ন আরশিনগর: ব্যবসা বলতে চিরকাল লোকে যা বুঝে এসেছে, যার প্রত্যক্ষ না হলেও নিকট ভিত্তি কোনও পণ্য বা পরিষেবা, তা থেকে এ কেবল আলাদা নয় বিপরীত: একটার নিয়ম অন্যটায় খাটে না, একটার ভাল হলে প্রায়ই অন্যটার মন্দ।

এ রকম অনেক লেনদেনের চরিত্র জুয়া বা ফাটকার মতো— ভবিষ্যতে কী ঘটবে, তা বাজি রেখে টাকা লগ্নি। (সাবেক সাট্টার জুয়াখেলা চলত তুলোর বাজারে ভবিষ্যৎ দরের উপর বাজি রেখে।) ব্যবসায়ে বরাবর অনিশ্চয়তা আছে, তার কিছু প্রচলিত রক্ষাকবচও আছে (যেমন বিমা); কিন্তু আজকের টাকার বাজারে অনিশ্চয়তার চরিত্র আলাদা, ফলও আলাদা। এই বৈশিষ্ট্যগুলি চমৎকার তুলে ধরেছেন অর্জুন আপ্পাদুরাই, তাঁর ব্যাঙ্কিং অন ওয়ার্ডস বইয়ে।২৮ তাঁর মতে, কয়েকটা অভূতপূর্ব বৈশিষ্ট্য হল এই, সাবেক বাণিজ্যিক তথা সামাজিক প্রথা এমনকী প্রচলিত যুক্তি ও বাস্তববোধের উলটো পথে হেঁটে:

• এই লেনদেনের গতিবিধির সঙ্গে আদি লেনদেনের কোনও যোগ নেই: সেটায় লোকসান হলেও এটায় লাভ হতে পারে। তার কারণ সেই জুয়া বা বাজির মহিমা: পণ্যের দর উঠুক বা নামুক, জোগানদারের লাভ হোক বা ক্ষতি, যে-কোনও পরিণতির উপরই আমি বাজি রাখতে পারি— চাইলে দু’ দিকেই, যাতে এক তরফের লোকসান অন্য তরফে সামাল দেওয়া যায়। ফলে আদি ব্যবসায়ীর সর্বনাশ আমার পৌষ মাস হতে পারে।

• এ সব কারবারে ঝুঁকি বা অনিশ্চয়তার সংজ্ঞা পালটে যাচ্ছে। সাবেক ব্যবসায়ীর কাছে ঝুঁকি একটা সমস্যা, দূর হলেই মঙ্গল। এমনকী বিমার মতো ব্যবসা, ঝুঁকিই যার উপজীব্য, তারাও চায় না গ্রাহকদের বিপদ ঘটে: যত কম ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, বিমার ব্যবসায় তত বেশি লাভ। টাকার বাজারের নতুন উদ্যোগীরা কিন্তু ঝুঁকির মধ্যেই সুযোগ খোঁজে, ঝুঁকি ভাঙিয়ে খায়। যে অনিশ্চিত বিপন্ন পরিস্থিতি থেকে অন্য ব্যবসায়ীরা সরে আসে, এরা সেখানেই ঝোপ বুঝে কোপ মারে।

• এ সব লেনদেন যেহেতু হাওয়ায়-ভাসা টাকার অঙ্কের ভিত্তিতে, পণ্য বা পরিষেবার আসল দামের সঙ্গে এর কোনও যোগ নেই। নৈতিক অর্থে নয় (বা হলেও তা অন্য স্তরে), নিছক বৌদ্ধিক অর্থেই এই নতুন জগতে কোনও ‘মূল্যবোধ’ নেই। বাস্তব সমাজে কোনও জিনিসের দাম স্থির হয় তার উপকারিতা বা আকর্ষণীয়তার বিচারে, মানুষের কোনও-না-কোনও চাহিদা মেটায় বলে; সেই সঙ্গে তা জোগাড় বা প্রস্তুত করতে কত খরচ হয় তার হিসাবে। বাস্তববিচ্ছিন্ন বিমূর্ত অর্থের বাজারে পণ্যের ভূমিকা নেই, পণ্য কেনাবেচার অঙ্কগুলো ছেঁকে তুলে কেবল সেই অঙ্ক নিয়ে পরের পর প্রস্থে ‘বিশুদ্ধ’ টাকার লেনদেন চলছে। এমন লেনদেন সোনা-রুপা-রাংতা সব কিছু নিয়েই হতে পারে। তার ‘দাম’ হতে পারে বাজারদর থেকে একদম আলাদা: কিছু এসে যায় না, কারণ আসল জিনিসটার তো কেনাবেচা হচ্ছে না। বাস্তববিচ্ছিন্ন বলে সেই দাম মনগড়া ভিত্তিতে স্ফীত হতে পারে, অতএব মাত্রাছাড়া হতে পারে লাভের পরিমাণও।

• দামের বদলে এই নতুন অর্থনীতিতে বিবেচ্য বিষয় হল হস্তান্তরযোগ্যতা বা বাণিজ্যযোগ্যতা (tradability)। সবই ‘বিশুদ্ধ’ অর্থের মামলা, বাস্তব পণ্য বা পরিষেবার সঙ্গে যোগ নেই; ফলে বাস্তবকে শিখণ্ডী করে টাকার বোঝাপড়াটাই হাতে হাতে ঘোরে-ফেরে-বদলায়, একটা লেনদেনের এক ভাগের সঙ্গে অন্য লেনদেনের আর এক ভাগ জোড়া হয়, আর প্রত্যেক রূপান্তরে কোনও পক্ষ তা থেকে লাভ (বা কপাল পুড়লে লোকসান) করে।

• শেষ লক্ষণটা সবচেয়ে তাজ্জব। এই বাজারে নাকি কোনও সাধারণ নিয়ম কাজ করে না। প্রত্যেক লেনদেন বোঝাপড়া একদম আলাদা, তৎকালীন, নতুন ভাবে তার মোকাবিলা করতে হয়: নজির বা মডেল বলে কিছু নেই, পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগে না। ফলে প্রতি মুহূর্ত শুধু সজাগ নয়, তটস্থ থাকতে হয়, পরিপার্শ্বের সঙ্গে লড়াই করতে হয়। এমন কারবারিদের মধ্যে যে প্রবল স্নায়বিক চাপের কথা শোনা যায়, সেটা অপ্রত্যাশিত নয়।

এই শেষ লক্ষণ হয়তো চূড়ান্ত শিক্ষামূলক, আবার হয়তো নয়। বাস্তব জগৎ যতই রকমারি হোক, তার প্রকাশে পৌনঃপুনিকতা থাকে। এক ধরনের ঘটনা বারবার ঘটে বলে তা থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি, সেই ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অনুমান করতে পারি। বাস্তব পর্যবেক্ষণ থেকে সাধারণ সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর এই পদ্ধতিকে দার্শনিকরা বলেন আরোহ (induction)। শৈশব থেকে এভাবেই আমরা পরিপার্শ্ব সম্বন্ধে ধারণা করি; বিজ্ঞানীরাও এই পদ্ধতিতে তাঁদের জ্ঞানভাণ্ডার গড়ে তোলেন। নতুন বিশ্বে সেই প্রক্রিয়াটাই বরবাদ হবে নাকি? যাঁরা উপরোক্ত কথাটা বলছেন, তাঁরা বোধহয় অত তলিয়ে ভাবেননি। অভ্যস্ত বৌদ্ধিক প্রক্রিয়া এতটা বিপন্ন হতে দেখলে তবু চিন্তা হয়। প্রশ্ন জাগে, মুষ্টিমেয় মানুষের বিপুল ধনলাভ ছাড়া এই যুগক্রান্তি থেকে আর কিছু উপকার আমরা আশা করতে পারি কি?

ব্যাপারটা আর এক ভাবে দেখা যায়, যা সরল বিচারে অবশ্যই নৈতিক কিন্তু গভীর বিচারে বৌদ্ধিকও বটে। আপ্পাদুরাই নীতি কপচাতে নামেননি; কিন্তু একটা বিষয় তাঁকে বারবার চিন্তায় ফেলছে, তা হল নতুন ব্যবস্থায় আস্থা বা বিশ্বাসের অভাব। যাঁরা নিজেরা ব্যবসা করেন না, তাঁদের একটা প্রবণতা আছে ব্যবসার জগৎকে নীতিহীন বা ‘নোংরা’ ভাবার। ব্যবসার একটা মূল শর্ত কিন্তু অংশকারীদের পারস্পরিক আস্থা, প্রতিশ্রুতি দেওয়া ও রাখা, যার আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হল চুক্তি। ডেরিভেটিভসের বাজারও চুক্তি বা বোঝাপড়ার ভিত্তিতে চলে; কিন্তু সেই বোঝাপড়ার ক্ষেত্র হল টাকার বিমূর্ত অ-পদার্থ রূপ। বাস্তব পণ্য লেনদেনের থেকে তা এত দূরে সরে এসেছে, সেই প্রাগৈতিহাসিক চুক্তির উপাদান এত হাত ঘুরেছে, এত ভেঙে-দুমড়ে ভোল পালটেছে, যে তা আর মানুষে-মানুষে বোঝাপড়ার সাক্ষ্য নয়, নৈর্ব্যক্তিক স্বয়ংক্রিয় অর্থসর্বস্ব একটা প্রক্রিয়া। বরং মানুষের কাজ বা সিদ্ধান্ত এই আর্থিক লীলাখেলার উপাদান মাত্র: তাও যাচাই হয় টাকার মূল্যে, তা নিয়ে লেনদেন চলে। ক আর খ-এর চুক্তি হলে খ চুক্তিভঙ্গ করবে কি না, তা বাজি রেখে গ আর ঘ আর একটা চুক্তি করতে পারে।

শেষ একটা বিষয় দেখা দরকার— বা সঠিক বললে, দুটো আপাতবিপরীত কিন্তু যুক্ত বিষয়। আমাদের নিহিত ধারণা, ইতিহাস জুড়ে মানুষ তার সমষ্টিগত পরিচয় ক্রমশ ত্যাগ করে প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজস্ব পরিচয় লাভ করছে; ফলে সমষ্টি বা সমাজও নতুনভাবে গঠিত হয়ে চলেছে। বিশেষত ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিসত্তাকে আপাত গুরুত্ব দেওয়া হয়, প্রত্যেক ব্যক্তির স্বাধীন বিচরণ ও মতগঠনের পক্ষে সওয়াল করা হয়; এক ধাপ এগিয়ে এই অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা দাবি করা হয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য সংস্থার পক্ষে। কার্যত কিন্তু দেখা যায়, বৃহৎ প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা ব্যক্তিস্বাধীনতাকে গ্রাস করছে— কখনও প্রকটভাবে, বেশিরভাগটা ছলে-কৌশলে, বহুনন্দিত ব্যক্তি-ইচ্ছা বা পছন্দ (চয়েস) কোনও বিশেষ দিকে প্রবাহিত করে অর্থাৎ আদতে কেড়ে নিয়ে। এই প্রক্রিয়ায় একটা বড় ভূমিকা থাকে প্রচার ও বিজ্ঞাপনের; সে প্রসঙ্গে চতুর্থ অধ্যায়ে আসব।

ফলে একটা আস্ত ব্যক্তি-মানুষের অন্য সব গুণাগুণ অগ্রাহ্য করে তাকে দেখা হয় একটাই দৃষ্টিতে: সচরাচর ক্রেতা, গ্রাহক বা ভোক্তা হিসাবে— কেবল টাকাকড়ি কেনাকাটা নয়, চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ, পরিষেবা, ভোটদান প্রভৃতি সব ক্ষেত্রে। কেবল একটা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার ফলে (তাও প্রচুর লোকের ভিড়ে একটা ক্ষুদ্র অনামী অংশ হিসাবে), যে ব্যক্তিকে ভেবে আসছি ‘ইন্ডিভ়িজুয়াল’ — in-dividual, অখণ্ড অবিভাজ্য সম্পূর্ণ মানবসত্তা— সে পর্যবসিত হচ্ছে ‘ডিভ়িজুয়াল’ বা খণ্ডব্যক্তিতে, একটা মানুষের ভাঙা টুকরো বা বিচ্ছিন্ন অংশ মাত্রে। এই অর্থে খণ্ডব্যক্তির ধারণা প্রবর্তন করেছেন দার্শনিক ঝ়ীল দেল্যুজ়, যদিও নৃতত্ত্বে কথাটা আগে থেকে ব্যবহার হচ্ছে।২৯ ‘ডিভ়িজুয়াল’ হল কোনও ব্যক্তির একটা ক্ষুদ্র আংশিক পরিচয় যা কম্পিউটার কোডে পরিণত করা যায়, অতএব সেই একটি পরিচয়ে তাকে আবদ্ধ রেখে কম্পিউটার প্রণালীর দ্বারা অনুসরণ ও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এভাবে একটি মানুষ ভাগ হয়ে যায় বিভিন্ন কম্পিউটারগ্রাহ্য তথ্যখণ্ডে। এক-একটা খণ্ডপরিচয় অকিঞ্চিৎকর, স্বল্পস্থায়ী, কিন্তু নিরন্তরভাবে একটার পর একটা দখলে এনে মানুষটাকে ধারাবাহিক নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এমন সমাজকে দেল্যুজ় বলছেন ‘নিয়ন্ত্রক সমাজ’, societies of control.

লক্ষণ দুটো আপাতবিপরীত: একটা স্বাধীনতা, অন্যটা নিয়ন্ত্রণ। এই ব্যবস্থায় যে একসঙ্গে দুটোই কাজ করছে, সেটাই তার সাফল্যের সূত্র। প্রথম লক্ষণটায় ফিরে যাওয়া যাক: সেটা হল গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতার একটা স্বীকৃতি, যতই সীমিত হোক না কেন। এই ব্যবস্থার মহিমা, ব্যক্তির যে বিশেষ খণ্ডসত্তা নিয়ে তার সেই মুহূর্তের কারবার— ক্রেতা, ভোক্তা, গ্রাহক, ভোটদাতা, যে ভূমিকাই হোক— তার খণ্ডিত স্বল্প পরিসরের মধ্যে মানুষটির ব্যক্তিপরিচয়কে মর্যাদা দিয়ে তাকে সদস্য বা অংশীদার করে নেয়: এটুকু গণতান্ত্রিক চরিত্র ব্যবস্থাটা চালু রাখার স্বার্থেই বজায় থাকে। ফলে দ্বিতীয় লক্ষণ, অর্থাৎ সামাজিক নিয়ন্ত্রণ, কার্যকর করা সহজ হয়: লোকে খুশিমনে রাজি হয় নিয়ন্ত্রিত হতে, বা হচ্ছে বলে বুঝতে পারে না; ভাবে এ তো দিব্যি ব্যবস্থা, আমাদেরই ঝোঁক বুঝে চলছে, উপকার করছে, লাভ এনে দিচ্ছে। ব্যবস্থাটার বৃহত্তর ফলাফলের দিকে তাদের দৃষ্টি যায় না; বা গেলেও তার নীরব প্রক্রিয়া এত জটিল ও অপরিচিত যে বোধগম্য হয় না, ভালমন্দ বিচারের প্রশ্ন ওঠে না।

এই প্রক্রিয়ার অতিপরিচিত উদাহরণ, ছোটবড় যে কোনও কম্পিউটার অ্যাপ ব্যবহারের আগে আমাদের অ্যাপকর্তাদের শর্তে সায় দিতে হয়। খুদে অক্ষরে বিশাল শর্তাবলি কেউ পড়ে দেখি না, অবলীলায় রাজি হয়ে অ্যাপটা কাজে লাগাই। খেয়াল করি না, এভাবে অ্যাপকর্তাদের কাজও হাসিল হয়ে গেল: আমাদের নানা তথ্য তাদের হাতে তুলে দিলাম, তাদের নেপথ্য নজরদারির দখলে এলাম— আর যেহেতু নেপথ্য, বুঝতেও পারলাম না কোনও দিন।

যে নব্য অর্থব্যবস্থার কথা বলছি, তার সম্বন্ধে কথাটা বিশেষভাবে খাটে। আলোচনার গোড়ায় বলেছিলাম, আজকাল সাধারণ মানুষও টাকা খাটিয়ে টাকা রোজগারে রপ্ত হয়েছে: আমরা ব্যাঙ্কে আমানত করি, ধার নিই, বিমা করি, ক্রেডিট কার্ড রাখি। বলা চলে, এভাবে আমরা সস্তা টিকিটে টাকার খেলার মাঠে ঢুকে পড়ি; তা বলে কর্তাদের বোঝাপড়া, খেলোয়াড় কেনাবেচা, ম্যাচ গড়াপেটায় আমাদের হাত থাকে না। অধিকাংশ নাগরিকের আর্থিক জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা (যদি আদৌ থাকে) কতগুলো সহজ সাবেক প্রক্রিয়ার বেশি নয়। নব্য অর্থব্যবস্থার যে গূঢ় জটিল অভিনবত্ব, সে সম্বন্ধে তাঁদের প্রায় কারও কোনও ধারণা নেই। তার নতুন ব্যাকরণ নতুন দর্শনের সঙ্গে এঁদের যোগ অধমর্ণ হিসাবে, অংশীদার হিসাবে নয়। এঁদের মধ্যে যাঁরা সবচেয়ে শিক্ষিত সচ্ছল ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত, তাঁরাও এই ব্যবস্থার মোকাবিলা করেন অল্পবিস্তর বিভ্রান্ত ও অরক্ষিত দশায়। অর্থজগতের নতুন ক্ষমতাবান শ্রেণির ভাবনাচিন্তার ধারাই আলাদা— কী জানেন বা ভাবেন কেবল তাই নয়, যেভাবে জানেন বা ভাবেন। দর্শনের ভাষায় বললে, এ এক নতুন জ্ঞানপ্রণালী বা এপিস্টেমলজি। এই মানসিকতা নিয়ন্ত্রকদের একক সম্পদ, তার জোরেই তাঁরা প্রতিষ্ঠালাভ করেছেন; আমরা বাকিরা অনেকটা অজ্ঞানে ও অসহায়ভাবে তাতে মজে যাচ্ছি।

বিশ শতকে ঔপনিবেশিক যুগের শেষে একটা স্বপ্ন দেখা গিয়েছিল: বিশ্ব জুড়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার নতুন বিন্যাস ও প্রযুক্তিচালিত উন্নয়নের দরুন বেশির ভাগ মানুষের চিরাচরিত হীনাবস্থা থেকে মুক্তি পাবার স্বপ্ন। তার রূপায়ণ লক্ষণীয় হলেও পর্যাপ্ত হয়নি, সেটা আজ ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। বিশ্বে তথা ভারতে বিপুল সংখ্যক মানুষ আজও ক্ষমতাহীন, আজও হতদরিদ্র— সচরাচর একসঙ্গে দুটো। তার মূল কারণ, সম্পদ যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে সে হারে বণ্টিত হয়নি; কট্টর পুঁজিবাদী অর্থবিদরাও মানছেন দুনিয়া জুড়ে অসাম্য বেড়ে চলেছে, আর সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি হারে বাড়ছে ভারতে— কোভিডের পর আরও ভয়াবহভাবে।৩০ এই ক্রমবর্ধমান অসাম্যের এক প্রধান কারণ অর্থের নতুন বাজারের রমরমা— টাকা যেখানে মূলধন নয় পণ্য, যার বিশ্বায়িত প্রতাপে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং পণ্য-পরিষেবার অভ্যস্ত বাজার কোণঠাসা।

একটা কথা স্পষ্ট করে নিই। আমার আলোচনায় অবধারিতভাবে সমাজনীতির, এবং মাঝে মাঝে রাজনীতি ও ব্যক্তিগত মূল্যবোধের, প্রশ্ন উঠেছে এবং উঠবে। এগুলো কিন্তু আমার আলোচনার মূল লক্ষ্য নয়। বরং আমার বক্তব্য, সমাজের যে বিকার এবং ব্যক্তি-নাগরিকের যে আচরণ আমাদের ক্ষতিকারক মনে হয়, নৈতিক বিচারে আমরা যার নিন্দা ও প্রতিবাদ করি, তার আসল সূত্রপাত গভীর ও প্রায়ই অস্বীকৃত কতগুলি বৌদ্ধিক প্রবণতায়। অর্থব্যবস্থায় তার উপস্থিতি কিছুটা আলোচিত হলেও ব্যাপক সামাজিক ক্ষেত্রে এ সম্বন্ধে আমরা প্রায় পুরোপুরি অচেতন। এই ধারাগুলি শনাক্ত করতে পারলে শুধু আর্থসামাজিক জীবন নয়, আমাদের বৃহত্তর মানবিক অস্তিত্বকে আমরা নতুন দৃষ্টিতে দেখব।

অর্থব্যবস্থার এই আলোচনা থেকে সেই বিশ্লেষণের পক্ষে সবচেয়ে গুরুতর তত্ত্ব দিয়ে এই অধ্যায় শেষ করি। প্রথম অধ্যায়ে দেখেছিলাম, ভাষার মতো টাকাও একটা সাংকেতিক প্রণালী: তার আসল তাৎপর্য নিজের মধ্যে নয়, তার দ্বারা চিহ্নিত বা নির্দিষ্ট অন্য কিছুতে। টাকা সরাসরি বস্তুস্তরে আমাদের কাজে লাগে না, কিন্তু অন্য যা-যা লাগে সব কিছুর প্রাপ্তিমূল্য হিসাবে, বলা যায় সংকেত হিসাবে, কাজ করে। মানবসমাজে টাকার চিরাচরিত ব্যবহার সেই দরকারি জিনিসগুলো জোগাড় করতে।

টাকার বাজারে কিন্তু টাকা অন্য কিছুর তুল্য নয়, বিনিমেয় নয়, সংকেত নয়। বরং তা তদ্ভব, স্বয়ম্ভর— আর সব কিছু তার আত্মলিপ্ত অস্তিত্বের আংশিক ও সাময়িক উপলক্ষ মাত্র: টাকার লেনদেনের প্রসঙ্গে দরকারমতো অন্যান্য পণ্যের কথা পাড়া হয়। দর্শনশাস্ত্রে এই দশাকে বলা হয় আত্মসত্ত্ব, solipsism: যেখানে মূল সত্তা একটাই, আর সব কিছু তার খণ্ডিত প্রকাশ বা রূপভেদ। সেই মূল সত্তা অতএব অন্য কিছুর সংকেত হতে পারে না, বরং অন্য সব কিছু তার অঙ্গীভূত: মূলের সঙ্গে এই গৌণ সত্তাগুলির সম্পর্ক সংকেত নয় লক্ষণা, metaphor নয় metonymy। এখানে দুটি ভিন্ন কিন্তু তুলনীয় জিনিসের (টাকা ও পণ্য) সদৃশতা বিচার হচ্ছে না; তার বদলে একটাই বড় জিনিসের (টাকার বিস্তারের) পুরোটার সঙ্গে তার অংশ বা অনুষঙ্গের (কোনও বিশেষ পণ্যের) যোগ দেখা হচ্ছে।

এই প্রসঙ্গে এসে পড়ে সন্ত আউগুস্তিনের একটা মজার প্রশ্ন। তিনি বলছেন, ভাষার প্রতিটি শব্দ তার বাইরে অন্য কিছু নির্দেশ করছে, অর্থাৎ তার সংকেত হিসাবে কাজ করছে; কিন্তু ‘ভাষা’, ‘শব্দ’, ‘কথা’— এই শব্দগুলো তো নিজেদেরই নির্দেশ করছে, এরা কীসের সংকেত?৩১ এরা কি তবে নেহাত দ্বিমাত্রিক, অন্যান্য শব্দের ‘পিছনে’ বা ‘ভিতরে’ যে অর্থ থাকে তার ভারমুক্ত? নাকি সাংকেতিক প্রক্রিয়াটা আত্মস্থ করে নিজের ভিতরে নিজেকেই দেখছে— অর্থাৎ বিশেষ ভাবে অর্থগর্ভ, অন্যান্য শব্দের চেয়ে আরও প্রগাঢ় সাংকেতিক ভূমিকা পালন করছে?

কিছুটা এক মর্মে আরও জটিল কথা বলেছেন ভর্তৃহরি; তাঁর তত্ত্ব পরবর্তীকালে অনেকটা প্রতিফলিত হচ্ছে প্রথম অধ্যায়ে বর্ণিত অগডেন ও রিচার্ডসের ‘শব্দার্থের ত্রিভুজের’ ধারণায়। ভর্তৃহরির মতে, শব্দের দুটো নির্দেশক ভূমিকা আছে। প্রথমটা তার আত্মমুখী পরিচয়, যেখানে সে নিজেকেই নির্দেশ করছে; দ্বিতীয়টা যে ভূমিকায় সে অন্য কিছু বোঝাচ্ছে— সেটা মুখ্যত বক্তার চেতনায় একটা ভাব বা মানসিক নির্মাণ, যার পিছনে আছে বহির্বাস্তবের কোনও বস্তু।৩২ ‘বাঘ’ শব্দটা প্রাথমিকভাবে নিজেকে অর্থাৎ শব্দ হিসাবে তার অস্তিত্ব ঘোষণা করছে; তারপর দ্বিতীয় দফায় নির্দেশ করছে একটা প্রাণীকে, বা সঠিক বললে সেই প্রাণী সম্বন্ধে আমাদের মানসিক ধারণাকে। দ্বিতীয় ভূমিকা অবশ্যই সাংকেতিক; প্রথমটা কী?

এই কূট প্রশ্নে যাচ্ছি না। কিন্তু একটা কথা মানতেই হবে: ভাষার মূল পরিচয় তো সংকেত হিসাবে, সে কাজটা করে বলেই আমরা ভাষা ব্যবহার করি। সেই সাংকেতিক পরিচয়ের ভিত্তিতেই আউগুস্তিন বা ভর্তৃহরি তাঁদের তাত্ত্বিক প্রশ্ন তুলতে পারছেন। ভাষা-বাচক এই কটা শব্দের ক্ষেত্রে সেই পরিচয় ত্যাগ করলে ভাষা কি তার ‘ভাষাত্ব’ হারায় না?

একই যুক্তিতে, টাকা যদি তার সাংকেতিক উপকারিতা হারায়, অন্য জিনিসের তুল্য প্রতিরূপ না হয়ে শুধু নিজের বিমূর্ত সংখ্যাগত পরিচয়টা আঁকড়ে থাকে, তাকে আদৌ টাকা বলা যায় কি? এতক্ষণ বলেছি বটে (পরেও বলব) টাকা দিয়ে টাকা কেনাবেচার কথা, টাকাকে ব্যবসার মাধ্যম নয় পণ্য হিসাবে দেখার কথা— এমন বলায় কি কোথাও একটা গণ্ডগোল আছে? টাকার কারবারিদের ব্যাঙ্কে যে মুনাফা জমা পড়ে, সেটা তাঁরা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে গতানুগতিক অর্থেই টাকা হিসাবে ব্যবহার করেন নিশ্চয়, অর্থাৎ তা দিয়ে নানা ভোগসম্পদ ও পরিষেবা ক্রয় করেন। কিন্তু যে বস্তুটা ব্যবসায় খাটিয়ে এই মুনাফা জমছে, সেটা কি টাকা না অন্য কোনও অভিনব কল্পনাসৃষ্ট পণ্য?

পাঠককে আহ্বান, এই অধ্যায়ে অর্থব্যবস্থা নিয়ে যে অনধিকারচর্চা করলাম, তার আক্ষরিক বিবরণটা একবার উপমার স্তরে নিয়ে ভাবুন তো, আজকের সামাজিক মানসিকতার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় কিনা? যদি যায় বলে মনে করেন, তবে অনুমতি চাইব এই তত্ত্ব খাড়া করতে যে তার কিছুটা নয় সবটা, উপমা নয় বাস্তব প্রক্রিয়া হিসাবে আমাদের ভাষার ব্যবহারে ও চিন্তার প্রকাশে প্রোথিত হয়ে আছে, সেখান থেকে চালিত করছে আমাদের জীবন ও সমাজব্যবস্থাকে। বইয়ের বাকি অংশে এই ব্যাপারগুলো অনুসন্ধান করব। এসব বিষয়ে আমরা বড় সচেতন নই। আমাদের মানসিক অস্তিত্বের বহ গভীরে সেগুলো আত্মগোপন করে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *