১. টাকা, ভাষা, সংকেত

১. টাকা, ভাষা, সংকেত

আমরা ব্যাগে বা পকেটে কিছু রঙিন কাগজের টুকরো বয়ে বেড়াই। কাগজের টুকরোর কোনও দাম নেই, নেহাত জঞ্জাল। এই কাগজগুলো কিন্তু আমরা যত্নে আগলে রাখি, কারণ সেগুলোর অনেক দাম— দশ-বিশ টাকা তো বটেই, একশো, পাঁচশো, দু’ হাজার পর্যন্ত। কেন? কী বিশেষত্ব ওই কাগজগুলোর?

বিশেষত্ব এই, এক উঁচু পদের রাজপুরুষ তাতে ছেপে দিয়েছেন, কাগজগুলো রিজার্ভ ব্যাঙ্কে তাঁর দপ্তরে জমা দিলে তার বদলে তিনি আমাদের ওই পরিমাণ টাকা দেবেন। তাঁর কথায় আমরা বিশ্বাস রাখি বলে কষ্ট করে কেউ আর রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অবধি যাই না, তাঁর প্রতিশ্রুতি-ছাপা কাগজগুলো নিয়েই লেনদেন করি। ভদ্রলোকের কথার দামই দু’ হাজার টাকা।

কিন্তু টাকা ব্যাপারটাই বা কী? যদি আমি একটা দু’ হাজারি নোট রিজার্ভ ব্যাঙ্কে জমা দিই, তার বদলে যে ‘টাকা’ আমাকে দেওয়া হবে, সেটা কী বস্তু, তার চেহারা কেমন? সত্যি বলতে কী আজকের দিনে এ প্রশ্নের উত্তর কী হবে, আমি জানি না। কিন্তু আগেকার দিনে এমন অবস্থায় ব্যাঙ্কে নোট নিয়ে গেলে সত্যিই পরিবর্তে সোনা-রুপার মুদ্রা দেওয়া হত। এটা জানলেও সমস্যা মিটল না কিন্তু। মুদ্রা পেয়েই বা কী লাভ হল? ওগুলো দিয়ে খাওয়া পরা মাথায় মাখা কিছুই তো সম্ভব নয়। তবে হ্যাঁ, ওই সব প্রয়োজন এবং আরও অনেক চাহিদা আমরা মেটাতে পারি টাকার বিনিময়ে।

ওটাই আসল ব্যাখ্যা। শিশুপাঠ্যের মতো অতিসরল করে গল্পটা বললে, আদিযুগে মানুষ নিজেদের প্রয়োজন মেটাত বিনিময় মারফত। আমি চাষি, আমার উৎপন্ন ধানের বদলে আমি তাঁতির কাছ থেকে কাপড় জোগাড় করলাম, তাঁতিও পরিবর্তে ধান পেল, উভয়েরই খাওয়া-পরার সংস্থান হল। তবে এ ব্যবস্থার নানা অসুবিধা। তাঁতি যদি আমাকে বলে ‘না বাপু, আমার যথেষ্ট ধান মজুত আছে, আর রাখার জায়গা নেই’, তবে আমার কাপড় জোগাড় হবে না, যতই দরকার থাকুক। তা ছাড়া এ ব্যবস্থায় আমি কাছেপিঠে যে-ক’জন লোকের দেখা পাচ্ছি, তাদের উৎপাদিত জিনিসই জোগাড় করতে পারি, আর কিছু নয়। অর্থাৎ আমার চাহিদা একটা সীমার মধ্যে বাঁধা থাকে। সেটা নানা দিক দিয়ে ভাল হতে পারে, কিন্তু আমার আশ হয়তো তাতে মিটবে না।

এই সমস্যার সমাধান করতে— আর সেই সঙ্গে অশেষ নতুন সমস্যার সৃষ্টি করতে— টাকার উদ্ভাবন হল। কড়ি হোক, বিশেষ কোনও পাথর হোক, সোনা-রুপার মতো কোনও ধাতু হোক, তার একটা নির্দিষ্ট সংখ্যা বা পরিমাণের সঙ্গে তুলনা হতে লাগল অন্য সব জিনিসের। এমন ব্যবস্থায় চাষি কলু বা কামারকে ধান বেচে টাকা পাবে, সেই টাকা দিয়ে তাঁতির থেকে কাপড় কিনবে, তার ধানের দরকার থাক আর না থাক। তাঁতি আবার সেই টাকা গাড়োয়ানকে দেবে, তার বোনা কাপড়গুলো হাটে নিয়ে যেতে। আর এক ধাপ এগিয়ে, আমি পুরো ধানটা সরাসরি মহাজনের কাছে বা সরকারের কাছে বেচে দিয়ে এক লপ্তে সবটা টাকা পেয়ে যাব, তা দিয়ে দরকার মতো বিভিন্ন ব্যবসায়ীর থেকে চাহিদা মতো জিনিস কিনব।

এমন ব্যবস্থার ফলে একটা নতুন ধারণা তৈরি হয়, সেটা হল ‘দাম’ বা ‘মূল্য’। বিনিময় ব্যবস্থায় খুচরো ভাবে দুটো জিনিসের পারস্পরিক সমতা ঠিক করতে হয়: এক মন ধানে দুটো ধুতি, দুই হালি ধানে এক পোয়া সরষে ইত্যাদি। তাঁতি সরষে আনতে গেলে ধানের বিনিময়মূল্য জেনে লাভ নেই, হিসাব কষতে হবে কাপড়ের বদলে সরষের। টাকার প্রচলন হলে কিন্তু সব কিছু একই মাপকাঠিতে মাপা যায়, অতএব চাষি তাঁতি কলু কামার সবাই এক ভিত্তিতে অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে মুদির কাছ থেকে ডাল-মশলা কিনতে পারে। তাতে আরও একটা সুবিধা হচ্ছে, টাকায় লেনদেনের ফলে এমন সব জিনিস মুদির দোকানে আমদানি হতে পারে (আবার সেই মহাজনের মারফত) যা স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন হয় না। আমরা নতুন-নতুন জিনিস উপভোগ করে জীবনটা আরও সমৃদ্ধ করতে পারি; হরেক নতুন উৎপাত-অশান্তিও ডেকে আনতে পারি অবশ্যই।

অতএব দেখা যাচ্ছে, টাকা জিনিসটা একটা চিহ্ন বা সংকেত। ‘চিহ্ন’, ‘সংকেত’, একটু ভিন্ন ব্যঞ্জনায় ‘প্রতীক’— এই কথাগুলো আমরা ব্যবহার করি এমন কিছু বোঝাতে যার তাৎপর্য নিজের মধ্যে আবদ্ধ নয়, যা দিয়ে অন্য একটা কিছু বোঝানো হচ্ছে বা নির্দেশ করা হচ্ছে। টাকা হল ধনের একটা নির্দিষ্ট অঙ্ক বা পরিমাণকে চিহ্নিত করার উপায়। এই কাজটা হতে পারে দু’ ভাবে। ‘টাকা’ কথাটা শুনলে যে চিহ্ন আমাদের মনে আসে, তা হল ওই মূল্যের স্বীকৃত প্রতীকস্বরূপ কোনও বস্তু, যেমন মুদ্রা, বা সেই মুদ্রার প্রতীকস্বরূপ নোট। টাকার অঙ্ক কিন্তু আরও এক ভাবে বাস্তবে চিহ্নিত করা যায়, সমমূল্যের কোনও জিনিস হিসাবে। আমি যখন বাজারে যাই, একশো টাকার ‘মানে’ আমার কাছে কখনও তিন কিলো চাল, কখনও পাঁচশো গ্রাম মাছ, কখনও একটা সাবানের প্যাকেট। একশো টাকার একটা নোট এই সব পণ্যের প্রতীক না হোক প্রতিশ্রুতি বা প্রতিনিধি বলা চলে। উলটো দিক থেকে দেখলে চাল বা মাছ বা সাবান হচ্ছে একশো টাকার এক-একটা বাস্তব প্রতিরূপ বা অবতার। উভয়ের আড়ালে টাকার আসল উপস্থিতি, সেটা ধনের অঙ্ক বা পরিমাণের বিমূর্ত ধারণা। তাই মুদ্রাও নয় পণ্যও নয়, টাকা চিহ্নিত হতে পারে স্রেফ হিসাবের খাতায় লেখা বা কম্পিউটারে ঢোকানো ক’টা সংখ্যা দিয়ে।

প্রথমে প্লাতোন, তারপর আরিস্ততেলেসের একটা বক্তব্য অনুসরণ করে বলা চলে, একজন লোক একটা নয়, দুটো কাজ একসঙ্গে করে: একটা তার বিশেষ পেশা (চাষ, তাঁত বোনা ইত্যাদি), অন্যটা অর্থ রোজগারের কাজ, যেটা সকলের ক্ষেত্রেই এক।১ একজন ব্যবসায়ী কিন্তু কেবল দ্বিতীয় কাজটাই করছে: তার পণ্যবস্তু সে সরাসরি কাজে লাগাচ্ছে না, সেটা বিক্রি করে টাকা রোজগার করছে। একটা লাঙলকে দু’ ভাবে দেখা যায়: চাষের যন্ত্র হিসাবে, আবার ব্যবসার পণ্য হিসাবে। লাঙল দিয়ে চাষ করে ধান ফলিয়ে, সেই ধান আমি খেতে পারি বা বিক্রি করে আয় করতে পারি; আবার সরাসরি লাঙল বিক্রি করেও আয় করতে পারি, সেই আয়ের টাকা থেকে চাল কিনে খেতে পারি। প্রথম ক্ষেত্রে পাচ্ছি লাঙলের বাস্তব বা প্রায়োগিক পরিচয়, দ্বিতীয়টায় লেনদেনের জন্য একটা সাংকেতিক পরিচয়, টাকার মূল্যে নির্ধারিত: লাঙলের লাঙলত্ব সেখানে বড় কথা নয়। লাঙলের বদলে বাসন বা কাপড় বেচেও উপার্জন করা যায়, কিন্তু বাসন বা কাপড় দিয়ে চাষ করা যায় না।

লাঙলটা আমি কত টাকায় কিনেছি, মাঠে চাষ করার সময় তা অবান্তর, চাষের খরচের হিসাব বা ‘কস্টিং’ করার সময় নয়। একটা হিসাব কষা যায়, এত টাকা দিয়ে লাঙল কিনলে, এবং বীজ সার কাস্তে প্রভৃতি চাষের প্রয়োজনীয় অন্য সব যন্ত্র ও উপকরণ অমুক অমুক দামে কিনলে, কতটা ধান ফলিয়ে কত টাকায় বিক্রি করলে খরচ পুষিয়ে আমার লাভ থাকবে। এই হিসাবটা কষার সময় আমি আর চাষি নই, হিসাবরক্ষক: লাঙল কাস্তে বীজ সার ইত্যাদি আর বাস্তব সামগ্রী থাকছে না, এক-একটা টাকার অঙ্কে রূপান্তরিত হচ্ছে। এতগুলি বিষয় পাশাপাশি রেখে একত্রে চিন্তা করা যেত না, যদি না সবগুলিকে এক জমিতে এক চেহারায় দাঁড় করাতে পারতাম, অর্থাৎ টাকায় পরিণত করে না ভাবতে পারতাম। টাকা এমন একটা জিনিস যার নিরিখে আমরা সব রকম সামগ্রী শ্রম পরিষেবা একভাবে এক ভিত্তিতে দেখতে পারি, একটার সঙ্গে একটা যুক্ত করতে পারি বা তাদের তুলনা করতে পারি— বলা চলে, এক ভাষায় প্রকাশ করতে পারি। পদ্ধতি হিসাবে সব কিছু মাপার, বোঝার, প্রকাশ করার এমন একটা সামগ্রিক উপায় আমাদের ভাবনাচিন্তা বিচার-বিশ্লেষণের মস্ত সহায়। টাকাকড়ি ছাড়া জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতির প্রয়োগ হতে পারে ও হয়, অন্য মাধ্যম ব্যবহার করে।

জগৎটাকে কেবল টাকার বিচারে দেখা ভাল নয়। এতে সব কিছু নিছক পণ্য হয়ে দাঁড়ায়, কোনও জিনিসের আসল উপকারিতার বদলে তা থেকে টাকা করাটাই বড় হয়ে ওঠে। মানুষকে আর মানুষ হিসাবে নয়, মাল বা শ্রমের জোগানদার হিসাবে দেখা হয় কেবল; প্রকৃতিকে রক্ষার বদলে লুটে ছারখার করা হয়; ক্ষুধার্তের অন্ন মুমূর্ষের ওষুধ পর্যন্ত মুনাফার তাগিদে কেড়ে নেওয়া হয়। কার্যকর হোক আর না হোক, এমন অনাচার ঠেকাবার জন্য সমাজে আরও কিছু ভাবনা চালু আছে, যাকে আমরা বলি মূল্যবোধ। এই মূল্য অর্থমূল্য নয়, অন্য কোনও মানদণ্ডে যাচাই করা উপকারিতা। সেই মানদণ্ড হতে পারে সামাজিক মঙ্গল বা মানবকল্যাণ। হতে পারে যুক্তি বা প্রমাণগ্রাহ্যতা, বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিরা যার উপর বিশেষ জোর দেন। হতে পারে নিছক ভাল লাগা বা মানসিক সন্তুষ্টি— একজন লোকের, কি একটা গোষ্ঠী, জাতি বা দেশের, কিংবা (অন্তত অনুমানে) সমস্ত মানবজাতির।

এখানে একটা খুব মৌলিক প্রশ্ন ওঠে। অর্থমূল্য যদিও বিমূর্ত ধারণা মাত্র, তার মূলে আছে একটা বাস্তব মাপ বা আন্দাজ: কোনও কিছুর অর্থমূল্য যাচাই করতে দরকার হলে আমরা ফিরে যেতে পারি বিনিময়ের জগতে, সেই ‘এক মন ধানে দুটো ধুতি’র হিসাবে। সামাজিক বা নৈতিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অত সহজ নয়। সেখানে সাদামাটা বস্তুগ্রাহ্য স্তরে বিচার চলে না, কারণ বিষয়টা কেবল একটা (অর্থাৎ আর্থিক) দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হচ্ছে না, নানা নীতি ও উপসর্গ এসে পড়ছে। তার মোকাবিলা করতে আরও অনেক অনেক ব্যাপক কোনও সংকেতপ্রণালী চাই, যাতে যা কিছু আমরা দেখি বা ভাবি, বাস্তবে থাক বা না থাক মগজে ঢুকে চিন্তার অঙ্গ হয়ে পড়ে, সবটাই চিহ্নিত করা যায়। এমন প্রণালী দুনিয়াভর চালু আছে, যদিও ভিন্ন ভিন্ন রূপে বা অবতারে। তাকে আমরা বলি ভাষা।

‘ভাষা’ শব্দটা আমার আলোচনায় খানিক আগে উঠে এসেছে। টাকার হিসাবে সব কিছু দেখা বা ব্যাখ্যা করার প্রচলনকে বলেছি একটা ভাষা, কারণ তাতে বিভিন্ন জিনিসকে একই সংকেতপ্রণালী অর্থাৎ অর্থমূল্য দিয়ে নিরূপণ করা হচ্ছে। গণিতে সংখ্যা পরিমাপ ইত্যাদি বোঝাতে চিহ্নের যে সম্ভার সেটাও একটা সংকেতপ্রণালী, অতএব অবশ্যই ভাষা। গণিতের কারবার সূক্ষ্ম সুনির্দিষ্ট হিসাব নিয়ে, প্রায়ই এমন বিমূর্ত পর্যায়ে যে সাধারণ বোধ দিয়ে ধারণা করা অসম্ভব। গণিতের চিহ্নগুলি (অল্প ক’টা বাদে) বিশেষভাবে সেই তুরীয় চিন্তার সংকেত, ফলে অন্য কোনও কাজে লাগে না। সাধারণভাবে যে প্রণালীকে আমরা ‘ভাষা’ বলি, যার দ্বারা দৈনন্দিন জীবনে ভাব প্রকাশ ও বিনিময় করি, সেটা অত সূক্ষ্ম সুনির্দিষ্ট নয়, সেজন্যই আরও ব্যাপক ও সার্বজনিক।

ভাষার ব্যবহারের সঙ্গে বরং টাকার ব্যবহারের বিলক্ষণ সাদৃশ্য। টাকার ক্ষেত্রে দেখেছি, একটা বস্তুর ভিত্তিতে (কড়ি, পাথর, মুদ্রা ইত্যাদি) দুনিয়ার সব জিনিস যাচাই করা ও তা নিয়ে কারবার করা যাচ্ছে; সব চেয়ে বড় কথা, একটা জিনিসের সঙ্গে অন্য পাঁচটার কী যোগ, তাদের তুলনায় এটার কী অবস্থান ও গুরুত্ব (সোজা কথায়, কী দাম) তা বিচার করা যাচ্ছে। নতুন কোনও পণ্য বাজারে এলে তার দামও টাকার বিচারে ঠিক করা যাচ্ছে, নতুন কোনও মানদণ্ডের দরকার পড়ছে না। অর্থব্যবস্থা বাস্তব কেজো ব্যাপার, তার সীমা-পরিসীমা আছে (বা ছিল— এই মোক্ষম বিষয়টিতে ফিরে আসব); ভাষার ক্ষেত্র অপার, সব কিছু নিয়ে তার কারবার। ফলে আরও বেশি দরকার এই অসংখ্য উপাদানকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসা, সেগুলি নির্দেশ করার একটা সার্বিক উপায় বার করা। বহুকে একের আওতায় নিয়ে আসার, এক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করার এই উপায় হতেই হবে সাংকেতিক, অল্প কিছু চিহ্ন দিয়ে যা সব কিছু বোঝাতে পারবে।

এমন কোনও উপায়ের অভাবে ভাবের প্রকাশ ও বিনিময় কেমনতর হয়, তার মজাদার ইঙ্গিত আছে জনাথান সুইফটের ব্যঙ্গাত্মক কল্পকাহিনি গালিভার্স ট্র্যাভেলস-এ।৩ তার তৃতীয় ভাগে পাচ্ছি উড়ন্ত দ্বীপ লাপুটার আজব বিজ্ঞানমন্দির লাগাডোর বিবরণ। সেখানে একদল বিজ্ঞানীর মতে ভাষা কেবল ফাঁকা আওয়াজ, বায়বীয়; তাঁদের কারবার সাচ্চা বাস্তব নিয়ে। তাই তাঁরা পেল্লায় বস্তা ঘাড়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ান, আলোচনায় উঠতে পারে এমন হরেক জিনিসে ঠাসা; ভাব বিনিময় করতে হলে দরকারমতো জিনিস বার করে পরস্পরকে দেখিয়ে নিঃশব্দে আদানপ্রদান চলে।

মন্তব্য বাহুল্য; তবে একটা বিষয় না বললেই নয়। আমাদের ভাষায় যত কথা বা শব্দ, তার অল্পই জড়বস্তু বোঝায়, যা ঝুলিতে বয়ে বেড়ানো চলে। অধিকাংশ শব্দ বোঝায় কোনও গুণ বা ভাব বা ক্রিয়া; বিশেষ্যপদেরও একটা বড় অংশ ভাববিশেষ্য। তার কিছু-কিছু হয়তো ইশারায় অভিনয়ে খানিক বোঝানো যায়, বেশিরভাগ আদৌ যায় না। আমাদের চেতনা ও অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করার সার্বিক মাধ্যম (অর্থাৎ ভাষা) তাই একেবারে অন্য ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। সব যুগের সব জাতির মানুষ এ ব্যাপারে আশ্চর্যভাবে এক: বলা চলে, এটা মানবজাতির মৌলিক বৈশিষ্ট্য। আরিস্ততেলেস থেকে আগামবেন৪ অবধি দার্শনিকেরা বলে আসছেন, মানুষ ছাড়া অন্য কোনও প্রাণী ভাষা ব্যবহার করে না (যেমন টাকাকড়িও করে না)। খুব স্থূল মৌলিক বার্তা প্রকাশ করতে অস্ফুট ধ্বনি উচ্চারণ করতে পারে, বড়জোর মৌমাছির ‘নাচ’-এর মতো একটা ক্ষুদ্র বাঁধাধরা ইঙ্গিতমালা প্রয়োগ করতে পারে। ‘ইঙ্গিত’ বলছি, ‘সংকেত’ নয়। মানুষের ভাষা চূড়ান্ত ও মৌলিকভাবে সাংকেতিক।

ভাষার মূল উপাদান স্বরযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত কিছু ধ্বনি। এই ধ্বনিগুলোর নিজস্ব কোনও তাৎপর্য নেই; সেগুলো জুড়ে ভেঙে সাজিয়ে আমরা প্রথমে শব্দ, তারপর বাক্য প্রভৃতি শব্দসমষ্টি তৈরি করি। একটা ভাষাগোষ্ঠীর সব মানুষ রাজি হয় প্রত্যেক শব্দের এক-একটা নির্দিষ্ট তাৎপর্য মেনে নিতে, অর্থাৎ ধ্বনিগুলোকে সেই তাৎপর্যের সংকেত হিসাবে গ্রহণ করতে। শব্দ হল নির্দেশক (signifier), তাৎপর্যটা তার দ্বারা নির্দিষ্ট (signified), শব্দটার ‘অর্থ’ বা ‘মানে’। এই ধারণা বিশ শতকের গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সুইস ভাষাতাত্ত্বিক ফের্দিনাঁ দ্য সস্যুর।৫ এখন তা ভাষাবিজ্ঞানের গোড়ার কথা।

স্বরযন্ত্র দিয়ে যত ধ্বনি উচ্চারণ করা যায়, কোনও বিশেষ ভাষাগোষ্ঠী তার সামান্য অংশই ব্যবহার করে— হয়তো চল্লিশ পঞ্চাশ বা বড়জোর একশোটা; কিন্তু যোগ ও বিন্যাসের নিয়মে (permutation and combination) সেগুলির সম্ভাব্য যোগ ও রকমফের কার্যত অ-সংখ্য, অ-গুনতি। ফলে সামান্য ক’টা ধ্বনির সাহায্যে বিশ্বের প্রায় সব কিছু প্রকাশ বা নির্দেশ করা চলে। অল্প কিছু ধ্বন্যাত্মক (onomatopoeic) শব্দ অর্থাৎ বাস্তব ধ্বনির অনুকরণে গঠিত শব্দ বাদ দিলে, কোনও শব্দের ধ্বনির সঙ্গে তার নির্দিষ্ট বস্তু বা ভাবের অন্তর্জাত যোগ নেই: ওটা সেই বস্তু বা ভাবের সংকেত মাত্র, অতএব স্থান-কালের সঙ্গে বদলাতে পারে। যে প্রাণীটাকে বাংলায় আমরা বলি কুকুর, হিন্দিতে তা কুত্তা, ইংরেজিতে dog, ফরাসিতে chien। নামগুলোর কোনও স্থায়িত্ব নেই, সেগুলো উপলক্ষ মাত্র। সেই সংকেত মারফত যা নির্দিষ্ট হচ্ছে, সেটাই আসল।

দেখা যাচ্ছে, মানুষ স্বভাবত সংকেতপ্রবণ: তার সব জাগতিক প্রয়োজন মেটাতে অর্থব্যবস্থা, আরও বিস্তীর্ণভাবে সব মানসিক প্রয়োজন মেটাতে ভাষার ব্যবহার করে। (এই দুই সাংকেতিক বিনিময়প্রণালীর ধারণার— একটা সব পার্থিব বস্তুকে, অন্যটা তার অনুরূপ মানসিক ভাববস্তুকে নির্দেশ করছে— প্রাথমিক আভাস দিয়েছিলেন আঠারো শতকে ফরাসি দার্শনিক তুর্গো।৬) মানুষের জগতে ধ্বনি আর অস্ফুট আওয়াজ থাকে না, অর্থবহ বাকধ্বনি (phoneme) বা তার সমন্বয়ে অর্থকণিকা (sememe) হয়ে দাঁড়ায়; শরীরের ভঙ্গি হয়ে ওঠে ইশারা, বস্তুবিশেষ হয় প্রতীক। কুকুর বা বেড়ালের সামনে তর্জনী তুলে দূরে নির্দেশ করুন: সে তর্জনীর দিকেই তাকিয়ে থাকবে, যেমন থাকবে খুব ছোট শিশু। একটু বড় হলে কিন্তু শিশুটি তর্জনীর দিকে নয়, তাকাবে দূরে যে দিকে আপনি তর্জনী দিয়ে ইঙ্গিত করছেন। ততদিনে সে বুঝে গেছে, তর্জনীর ওই ভঙ্গি একটা ইশারা বা সংকেত, যার মানে ‘ওইদিকে তাকাও’। বাচ্চাটি যে বুদ্ধিশুদ্ধিতে ‘মানুষ’ হয়ে উঠছে, এভাবে সংকেতের ব্যাখ্যা করতে শেখা তার একটা লক্ষণ।

সংকেত বিনা মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটত না। কারণটা রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়েছেন:

পাখিরে দিয়েছ গান, গায় সেই গান,

তার বেশি করে না সে দান।

আমারে দিয়েছ স্বর, আমি তার বেশি করি দান,

আমি গাই গান।

অন্য কোনও প্রাণী তার সহজাত স্থবির অস্তিত্বের বাইরে অন্য কিছু, নতুন কিছু, পরিবর্তনশীল কিছু উপলব্ধি করতে পারে না। তার সীমিত অভ্যস্ত প্রয়োজন মেটাতে মোটা দাগের ক’টা ধ্বনিই যথেষ্ট, যা জন্মের সময়েই তার মগজে পুরে দেওয়া হয়েছে। মানুষ নিত্য নতুন জিনিস দেখে, সৃষ্টি করে, চিন্তা করে। আলাদা আলাদা উপায়ে তার প্রত্যেকটিকে প্রকাশ ও বিবেচনা করা অসম্ভব হত: না পারতাম এত উপায় ভেবে বার করতে, না মাথায় রাখতে, না একটার সঙ্গে আর একটা মেলাতে। অতএব একমাত্র সমাধান সংকেতের ব্যবহার— এমন এক সংকেতমালা যার উপাদান হবে অল্প, ধরাছোঁয়ার মধ্যে; সেই উপাদান অশেষভাবে সাজিয়ে নিত্য নতুন বক্তব্য প্রকাশের চাহিদা মিটবে।

টাকার গল্পের মতো ভাষার গল্পেরও একটা দ্বিতীয় ভাগ আছে। টাকার ক্ষেত্রে দেখেছি, বিনিময়ের আদত বস্তু বা পণ্যের বদলে আসছে সংকেতরূপী মুদ্রা বা টাকা, তারপর সেই ‘আসল’ টাকার বদলে কাগজের নোট। ভাষার ক্ষেত্রে বস্তু বা ভাবের স্থান নিচ্ছে সাংকেতিক ধ্বনি। কিন্তু ধ্বনির আদানপ্রদান করতে গেলে দু’ পক্ষের সামনাসামনি উপস্থিত থাকতে হয়: যান্ত্রিক উপায়ে ধ্বনি সংরক্ষণ ও সম্প্রচারের পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে মাত্র উনিশ শতকে। ভাষার নাগাল আরও বাড়াতে, দূরে পাঠাতে বা ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করতে তার কয়েক সহস্রাব্দ আগে উদ্ভাবন হয়েছে আর এক পদ্ধতির: ধ্বনিগুলো বোঝাতে দৃশ্যমান চিহ্ন অর্থাৎ লিপির ব্যবহার। ভাষায় উচ্চারিত ধ্বনিগুলোই ছিল সাংকেতিক; লিপি অতএব সংকেতের সংকেত, দেরিদার ভাষায় signifier of the signifier,৮ ধাতব মুদ্রার বদলে নোটের মতো।

এই যে সংকেতের সংকেত সৃষ্টি, তার ফলে বাস্তব বহির্জগতের জিনিসগুলো ধাপে-ধাপে ভাবে বা তত্ত্বের উপাদানে পরিণত হয়। কোনও কিছুর জড় বস্তুগত পরিচয় লোপ করে সেটাকে বিমূর্ত ভাববস্তুতে পরিণত করা (dematerialization) যেন মানুষের স্বভাবগত বৌদ্ধিক প্রবণতা: সেই ভাববস্তুটা জড়বস্তুর সংকেতের কাজ করে। অর্থব্যবস্থায় বাস্তব পণ্য পরিণত হয় টাকার একটা বিমূর্ত অঙ্কে। (এখানে ও এই বইয়ে আগাগোড়া, ‘পণ্য’ বলতে ক্রয়যোগ্য পরিষেবাও বোঝাচ্ছে।) প্রাচীন গ্রীক আমলে টাকাকে তাই বলা হত ‘অদৃশ্য বস্তুসম্পদ’ (invisible substance)।৯ সেই টাকার অঙ্কটা ক্রমে মুদ্রা বা নোটের বাহ্য প্রকাশ ঘুচিয়ে হয়ে যায় স্রেফ হিসাবের খাতায় বা কম্পিউটারের পরদায় একটা সংখ্যা, ফাঁক-ভরাট-করা উপস্থিতি বা ‘এন্ট্রি’, শেষ বিচারে নিছক একটা মানসিক উপলব্ধি।১০

ভাষার ক্ষেত্রে আজ মোটামুটি সবাই মানি, কোনও শব্দের দ্বারা যা নির্দিষ্ট হচ্ছে তা সরাসরি কোনও বস্তু নয়, আমাদের চেতনায় সেই বস্তুটার ধারণা বা মানসিক রূপ। এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠালাভ করে ফ়ের্দিনাঁ দ্য সস্যুর-এর চিন্তা থেকে।১১ তত্ত্বটার বিখ্যাত চিত্রায়ণ ১৯২৩-এ সি কে অগডেন ও আই এ রিচার্ডসের মানের মানে (The Meaning of Meaning) বইয়ে ‘শব্দার্থের ত্রিভুজ’-এ।১২ এই ত্রিভুজের এক কোণ হচ্ছে বহির্জগতের কোনও বস্তু; দ্বিতীয় কোণ আমাদের চেতনায় সেই বস্তুর মানসিক রূপ; তৃতীয় কোণ সেই শব্দ যা দিয়ে আদত বস্তুটা নয়, তার ওই ভাবলব্ধ প্রতিরূপটা নির্দেশ করা হচ্ছে। মজার ব্যাপার, বিশ শতকের এই তাত্ত্বিকদের প্রায় ২৪০০ বছর আগে আরিস্ততেলেস যেন তাঁদের ধারণাটার একটা ভাষ্য লিখে গেছেন। তিনি বলেছেন, বস্তুর মানসিক রূপ সব মানুষের কাছেই এক, কিন্তু সেটা বোঝাচ্ছে যে শব্দ তা এক নয়, প্রত্যেক ভাষায় আলাদা: অর্থাৎ মানসিক রূপটার সঙ্গে বাস্তবের সরাসরি যোগ আছে, শব্দটার সঙ্গে নেই।১৩ আমরা আগেই দেখেছি, শব্দের সঙ্গে তার নির্দিষ্ট বস্তু বা ভাবের অন্তর্জাত যোগ নেই। মানসিক রূপটা আমাদের মৌলিক চেতনার অঙ্গ, ভাষাগত চিহ্নটা প্রথা বা অভ্যাসপ্রসূত। বস্তু থেকে ভাব, ভাব থেকে ভাষা— ধাপে ধাপে আমরা বাস্তব থেকে আরও দূরে সরে আসছি, যোগটা শিথিল হয়ে যাচ্ছে।

এখানে ‘সংকেতের সংকেত’ ব্যাপারটা এক নতুন অবতারে দেখা যাচ্ছে। আমাদের চেতনায় কোনও বস্তুর যে প্রতিরূপ, সেটা আসল বস্তুর প্রতিফলন বা চিহ্ন, অর্থাৎ সাংকেতিক রূপ; তা বোঝাচ্ছে যে শব্দ, সেটা ওই প্রতিরূপের সংকেত। ধারণাটা আরও বাড়িয়ে দার্শনিক চার্লস স্যান্ডার্স পের্স এই তত্ত্ব খাড়া করেছেন যে ভাষার মাধ্যমে কোনও কিছু উপলব্ধির চেষ্টা হল এক সংকেতের পিছনে আর একটা, তার পিছনে আবার একটা, এভাবে নিরন্তর সংকেত থেকে সংকেত, প্রতিরূপ থেকে প্রতিরূপে ধাওয়া করা। হতে পারে পথের শেষে সত্যিই একটা সারবস্তু অপেক্ষা করে আছে, কিন্তু কখনই তাতে পৌঁছনো যাবে না!১৪

ইয়েটস শেষ জীবনে একটা কবিতায় লিখেছিলেন, জ্ঞানলাভের ফলে আমাদের অবাস্তববোধ বেড়ে যায় কেবল: ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়ায় স্রেফ আয়না থেকে আয়নায়, তা থেকে ফের আয়নায় প্রতিফলন (‘That knowledge increases unreality, that / Mirror on mirror mirrored is all the show’)।১৫ আমাদের সব উপলব্ধি ভাবনাচিন্তা জ্ঞান-বিজ্ঞান কি তবে মনগড়া একটা রূপকথার রাজ্য, সংকেতের গোলোকধাঁধা— যা থেকে বেরিয়ে ‘আসল’ জগৎটার নাগাল পাওয়া অসম্ভব, তেমন কোনও জগৎ আদৌ আছে কি না তাই অনিশ্চিত?

এই নেই-চিত্রটাও নিশ্চিতভাবে আঁকা যায় না। কেবল এটুকু বলা যায় যে থাক বা না থাক, বাস্তব বহির্জগৎ বলে একটা কিছুর অস্তিত্ব আমরা চেতনায় স্বীকার করি; কিন্তু সেটা বিশদভাবে জানতে হলে কোনও সাংকেতিক ব্যবস্থার শরণ নিতে হয়, গণিতের ভাষা হোক বা মানুষের প্রকৃতিলব্ধ স্বাভাবিক ভাষা (natural language) হোক। ভাষার সাংকেতিক প্রণালী আমাদেরই মস্তিষ্কলব্ধ, তাই তাতে ব্যক্ত হলে অনুমিত বাস্তবটা আমাদের বোধগম্য হয়। সেই প্রণালী মারফত ‘বাইরে’ যা দেখছি শুনছি তা আত্মস্থ অন্তরস্থ করে সংকেতে অর্থাৎ ভাবের সামগ্রীতে রূপান্তরিত করছি: জগৎটা উপলব্ধি করছি মূলত বাস্তব বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপে নয়, মননের উপাদানের সম্ভার হিসাবে। ভাষার দ্বারা মানসিকভাবে আয়ত্তে আসছে বলেই আমরা জগৎটাকে বুঝতে, বিচার করতে, এমনকী বদলাতে পারছি; নইলে আমাদেরও লাগাডোর বিজ্ঞানীদের মতো ভূতের বোঝা টেনে বেড়াতে হত। সবচেয়ে বড় সুবিধা, আদৌ বস্তায় পোরা যায় না এমন বিমূর্ত ভাব-ক্রিয়া-প্রক্রিয়াও সাংকেতিক উপায়ে প্রকাশ করা যায়, জড়ের দাসত্ব থেকে চিন্তার আকাশে মুক্তি পাওয়া যায়। একটা মানসিক উপলব্ধির জগতে আমাদের প্রবেশ ঘটে, যা আমাদের দখলে ও নিয়ন্ত্রণে।

দখলটা কিন্তু নিরঙ্কুশ নয়। অঙ্কের ক্ষেত্রে— তা সে সৃষ্টিতত্ত্বের অঙ্ক হোক বা বাজারের হিসাব— সংকেতগুলি সুনির্দিষ্ট: তার তাৎপর্য বাঁধাধরা, প্রসঙ্গ বা ব্যঞ্জনার প্রশ্ন নেই, কারও ব্যক্তিগত উপস্থিতি নেই, ফলে একটা বই দুটো ব্যাখ্যার অবকাশ নেই। সাধারণ ভাষার ক্ষেত্রে যত সমস্যা— আবার সেই সঙ্গে যত মজা যত আকর্ষণ— শব্দের নির্দিষ্ট আভিধানিক অর্থ ছাপিয়ে তার ব্যঞ্জনা নিয়ে। এই ব্যঞ্জনা প্রত্যেক শ্রোতা বা পাঠকের চেতনায় আলাদা, ফলে শব্দ বা সংকেতের সঙ্গে ভাবের সমন্বয় চূড়ান্ত অস্থাবর ও পরিবর্তনশীল: কথাগুলো বলতে-বলতে শুনতে-শুনতে প্রত্যেকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করছি। বলা চলে, খুব মামুলি কিছু বাক্যবিন্যাস বাদ দিলে প্রতিটি শব্দের প্রতিটি ব্যবহারই সূক্ষ্মভাবে নতুন, তাতে বিশেষ প্রসঙ্গলব্ধ কোনও ব্যঞ্জনা ফুটে উঠছে, যদিও আভিধানিক অর্থে পরিবর্তন নেই।

‘গাছে পাখি ডাকছে’ বাক্যটা এইজন্য অর্থবহ যে সবার মাথায় গাছ আর পাখি সম্বন্ধে একটা ধারণা আছে, ডাকা ব্যাপারটা কী তারও; বক্তা আর শ্রোতা, বা লেখক আর পাঠক, উভয়ের ধারণা মিলে যাচ্ছে বলেই একজনের কথা অন্যজন বুঝছে। কিন্তু নরওয়ের আর কঙ্গোর অধিবাসীর মনে গাছ আর পাখির ছবি একদম আলাদা হবে না কি? সে ক্ষেত্রে বক্তার উদ্দিষ্ট অর্থও কি শ্রোতার কাছে পৌঁছবার পথে বদলে যাবে?

নির্দিষ্ট বিষয়টি কোনও ভাব বা গুণ হলে আরও সমস্যা। যদি বলি ‘রামবাবু বুদ্ধিমান লোক’, বা ‘সবুজগ্রাম খুব সুন্দর জায়গা’, আমার শ্রোতা কথাটার মানে বুঝবেন; কিন্তু বুদ্ধি বা সৌন্দর্য সম্বন্ধে তাঁর ধারণা আমার সঙ্গে নাও মিলতে পারে, ফলে আমার ভরসায় তিনি রামবাবুর সঙ্গে আলাপ করলে বা সবুজগ্রামে বেড়াতে গেলে হতাশ হতে পারেন। একজন মাসে দশ হাজার টাকা মাইনে পেলে বলবেন ‘প্রচুর রোজগার করি’, আর একজন দশ লাখ পেলেও নয়। কোনও ক্ষেত্রেই শব্দটার আক্ষরিক মানে বুঝতে ভুল নেই, কিন্তু তার ভিত্তিতে যে বিচার বা উপলব্ধি, সেখানে পাত্রে-পাত্রে বিস্তর ব্যবধান। ভাষার বাস্তব ব্যবহারিক প্রয়োগে এই আত্মগত (subjective) উপলব্ধি শব্দের মূল অর্থ থেকে কার্যত অবিচ্ছিন্ন: ‘ভাল’ বা ‘সুন্দর’ বা ‘প্রচুর’-এর নৈর্ব্যক্তিক আভিধানিক সংজ্ঞা আছে, কিন্তু মানুষে-মানুষে আদানপ্রদানের সময় সেটা প্রায় অবান্তর। শব্দগুলো গুণবাচক, তখনই আমরা ব্যবহার করি যখন কোনও মত, বিচার বা মূল্যবোধ ব্যক্ত করতে চাই, আর সেগুলো প্রত্যেকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করি।

ফলে দৈনন্দিন জীবনে যা আমরা পদে-পদে দেখি, তত্ত্বকথাও তাই বলছে। হ্বিটগেনস্টাইনের কথায়, ভাষা চিন্তাকে ঢেকে রাখে, ছদ্মবেশ পরায়।১৬ ভাষার যে-কোনও লেনদেনে ভুল বোঝাবুঝির অশেষ বিপদ, যতই সরল মনে স্পষ্ট করে বলার চেষ্টা করি না কেন। নিজের অজান্তে আমরা অসত্যভাষণ করে ফেলি, আবার অন্যের কথায় লুকানো অসত্যটা ধরতে পারি না। ‘অসত্য’ বললাম, ‘মিথ্যা’ নয়, কারণ ব্যাপারটা প্রায়ই ইচ্ছাকৃত নয়; কথার পরতে পরতে যে ফাঁক, তা বক্তার অজান্তে অনিচ্ছায় পরিণত হয় ফাঁকিতে। যা মনে হচ্ছে নৈর্ব্যক্তিক আদানপ্রদান, তাতেও মানবিক ও নৈতিক মাত্রা ঢুকে পড়ে।

এত কথা বলার উদ্দেশ্য, সেই মাত্রা সম্বন্ধে আমাদের সচেতন করা। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সকলেই জানি, ভেবেবুঝে শব্দ মেপে কথা না বলার ফলে কত অনর্থ বাধে। এও জানি, চতুর লোকে রীতিমতো ভেবেচিন্তে মেপে মেপে এমন কথা বলে, যার বয়ানে কোনও খুঁত নেই কিন্তু যা গভীরভাবে বিভ্রান্তিকর, যার উদ্দেশ্য শ্রোতাকে ঠকানো। বিপরীত এই দুই দৃষ্টান্তে একই সমস্যা ফুটে উঠেছে, তা হল ভাষার অমেয় অনিশ্চিত এই মানসিক মাত্রা। অভিধানে যে অর্থ লেখা আছে, আমি যা মাথায় নিয়ে বলছি, আর একজন শুনে যা বুঝছে— এই তিনের মধ্যে অল্পস্বল্প তফাত থাকতে বাধ্য, প্রচুর পরিমাণেও থাকতে পারে। মোক্ষমভাবে বললে, ভাষার নিহিত ঝোঁকটাই যেন ভুলের দিকে, অসত্যের দিকে, অমিল আর বিভ্রান্তির দিকে। সদিচ্ছা থাকলেও সত্যি কথা, খাঁটি কথা বলা সহজ নয়, বলার ভাষাই পদে পদে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। এ যেন রবারের ছুরি দিয়ে জটিল অপারেশন করার চেষ্টা। শল্যচিকিৎসকেরা তাঁদের সূক্ষ্ম কাজের জন্য বিশেষ ধরনের ছুরি ব্যবহার করেন; তেমনি যাঁদের নিখুঁত অনুপুঙ্খ তথ্য-তত্ত্ব নিয়ে কারবার, যেমন গণিতজ্ঞ বা বিজ্ঞানী, তাঁরা ব্যবহার করেন বিশেষ এক ভাষা, অঙ্কের ভাষা বা বৈজ্ঞানিক পরিভাষা, যেমন আরও সহজ স্তরে করেন হিসাবরক্ষক। আর এক শ্রেণির মানুষ আছেন যাঁদের পক্ষে সূক্ষ্ম সুনির্দিষ্ট চিন্তা অপরিহার্য: তাঁরা দার্শনিক। তাঁরাও মাঝে মাঝে অঙ্কের ভাষা ব্যবহার করেন; বাকি সময় সাধারণ ভাষা দিয়েই কাজ চালান, কিন্তু প্রয়োগ করেন বিশেষ স্পষ্টতা ও সতর্কতার সঙ্গে।

টাকাকড়ির জগতে তো বটেই, বিজ্ঞানের জগতেও অঙ্কে ভুল হয়; এবং বিশেষ করে প্রথম ক্ষেত্রটির পরিকল্পিত মিথ্যাচারের ব্যাপক দুর্নাম আছে। সেই ভুল ও মিথ্যাচার অঙ্কের নিজস্ব দুর্বলতার জন্য নয়, যে অঙ্ক কষছে তার দরুন। ভাষার প্রয়োগে যে বিভ্রান্তির কথা বলছি, তা কিন্তু বাসা বাঁধে ভাষার গূঢ় মজ্জাগত স্তরে। দার্শনিক পরিভাষা একটু টেনেটুনে অন্যত্র আমি এটাকে বলেছি ভাষার আধিবিদ্যক (metaphysical) মাত্রা,১৭ তার মৌলিক সত্তা বা ‘ভাষাত্ব’।

আমার বক্তব্য বোঝাতে আবার দেখতে হবে টাকাকড়ির জগতে কী ঘটে এবং ঘটছে। সেখানে সাম্প্রতিক ক্রান্তিকারী ঘটনা হল টাকাকড়ির জগতের সঙ্গে ভাষার বৃহত্তর অর্থবহ জগতের স্থান বিনিময়। আর্থনীতিক কর্মকাণ্ডের ভাবনা ও প্রণালী এখন অন্যান্য ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করছে— প্রায়ই নীরবে নেপথ্যে, আমাদের অগোচরে। আমার পরের আলোচনায় এটা একটা মূল প্রতিপাদ্য। মার্ক্সীয় ধনতন্ত্রের মডেলেও অর্থব্যবস্থা এত সার্বিকভাবে বিশ্বময় মানুষের সমগ্র মানসিক জীবন দখল করে বসেনি। ফলে ভাষার সাধারণ ব্যবহার এবং তার নিহিত চিন্তাপ্রণালী বরাবরের তুলনায় উলটোমুখে চলছে। কথাটা আবেগ বা নীতিবোধের বশে বলছি না, বলছি নৈর্ব্যক্তিকভাবে, জ্ঞানতত্ত্ব বা epistemologyর প্রেক্ষিতে। এই ভোলবদলের ফলে আমরা ভাষা ব্যবহার করছি একেবারে অন্য প্রণালীতে, অন্য উদ্দেশ্যে; আমাদের সমাজ ও মননের আমূল রূপান্তর ঘটছে।

পরের অধ্যায় শুরু করার আগে একটা প্রসঙ্গ মনে করিয়ে দিই, তা হল ‘অর্থ’ শব্দের অর্থ। টাকাকড়ি আর ভাষা— জীবনের একেবারে ভিন্ন দুটো ক্ষেত্রে শব্দটা এত গুরুত্ব পেল কী করে? মানেও যেন আলাদা, কিন্তু আসলে নয়। কথাটার আদি তাৎপর্য প্রার্থনা বা প্রার্থিত বস্তু, যা চাওয়া হয় বা উদ্দেশ করা হয়। টাকাকড়ি ধনসম্পদ যে আমরা চাইব তা আশ্চর্যের কী। আর ভাষার ক্ষেত্রে মানেটা ‘যা বোঝাতে চাই’, ‘যে উদ্দেশ্যে কথাটা ব্যবহার করছি’। এটুকু বাচ্চাও বুঝবে, কিন্তু তার উপসর্গ কিঞ্চিৎ জটিল। ‘যা চাই’ মানে ‘এখন যা নেই’: ইচ্ছা আর অভীষ্ট, উদ্দেশ আর উদ্দিষ্টের মধ্যে একটা ফাঁক বা দূরত্ব আছে। সাংকেতিক বার্তার এটাই লক্ষণ। চিহ্ন আর চিহ্নিত, নির্দেশক আর নির্দিষ্ট, এক হতে পারে না: তা হলে তো আসল জিনিসটাই আমাদের দখলে থাকত, নির্দেশের দরকার হত না। বর্ধমান শহরের মধ্যেকার রাস্তায় ‘বর্ধমান’ বলে পথনির্দেশের দরকার পড়ে না।

ফাঁক মানেই কিন্তু অভাব নয়। ফাঁক পূরণ করা যায়, পূরণের অপেক্ষায় থাকে। আমরা টাকা চাই কারণ আর যা কিছু চাই তা টাকা দিয়েই পাব: অভীষ্টের পিছনে আর একটা অভীষ্ট আছে। এটা কবি ইয়েটসের আয়নার খেলা নয়; বরং সেই দূরের অভীষ্ট— আসলে যে জিনিসটা চাই— লাভ হলে বলা যায়, নিকট অভীষ্ট অর্থাৎ টাকা লাভ করা সার্থক হল। ফাঁকটা যদি না দেখি, ভাবি নির্দেশকটাই নির্দিষ্ট, টাকার মানে কেবল টাকা, তার ওপারে কিছু নেই, তা হলেই সমস্যা— বৌদ্ধিক, ব্যবহারিক, নৈতিক সমস্যা।

পরের অধ্যায়ে টাকার জগতের দৃষ্টান্ত দিয়ে দেখব সেই সমস্যাগুলো কী হতে পারে। তারপর বিস্তারে দেখব কেমন করে ভাষা— অতএব বৌদ্ধিক ও সামাজিক আদানপ্রদান— আত্মসর্বস্ব হলে একইভাবে তার স্বধর্ম, বা অন্তত প্রচলিত ধর্ম, হারাতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *