৯. মহুলিয়ার বিকেল ভীষণ কুঁড়ে

মহুলিয়ার বিকেল ভীষণ কুঁড়ে। ফুরোতেই চাইছে না। মলয়দার বাড়ির বিছানায় বসে জানলার বাইরে চোখ রেখেছে আরশি। দুই বিনুনির স্বর্ণতোয়া আরশির সামনে বসে অঙ্ক কষছে। কিছুই করার নেই বলে ওকে পড়াতে বসেছে আরশি। খানিক আগে উঠোনে দুটো ছাগলছানার সঙ্গে খেলছিল মেয়েটা। বিকেলের রোদে তখন হলুদ আভা। উঠোনের ধুলোও যেন রঙিন। বাড়ির সীমানায় গোলাপি করবী আর গেরুয়া পলাশ। চারপাশে এত রং কেন? কাল দোল বলেই কি? মহুলিয়ায় অবশ্য দোলের দিন রং খেলা হয় না। পরের দিন, মানে হোলির দিন হয়। মহুলিয়া পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে হলেও যেহেতু ঝাড়খণ্ডের বর্ডারে, হিন্দিভাষীদের রীতি-রেওয়াজই চলে।

এখানে আরশির আসার কোনও কথাই ছিল না। জেদ ধরে এসেছ। প্রেরণা রিহ্যাব সেন্টার থেকে ফেরার সময় শৌর্য বলেছিল, ‘‘বহুত খিদে পেয়েছে। কাছাকাছি একটা ধাবা আছে। সেরকম ঝকঝকে কিছু নয়, তোমার অসুবিধে হবে না তো খেতে?’’

‘‘তোমার অসুবিধে না হলে, আমার কেন হবে? আমি কি কোটিপতির মেয়ে?’’ বলেছিল আরশি।

হেসে ফেলে শৌর্য বলল, ‘‘টাকাপয়সার ব্যাপার নিয়ে তোমার যে কোনও ধারণা নেই, এতেই বোঝা যায়। অ্যাডজেক্টিভ হিসেবে কেউ আর ‘কোটিপতি’ কথাটা ব্যবহারই করে না। এখন প্রত্যেক পাড়ায় দু’-চার বাড়ি অন্তর কোটিপতি। আমি শিয়োর তুমি কোটিপতিরই মেয়ে।’’

কথা বাড়ায়নি আরশি। বৈষয়িক ব্যাপারে সত্যিই তার কোনও জ্ঞান নেই। ধাবায় খেতে বসেছিল ওরা। তখন প্রায় দুপুর দেড়টা। খিদে আরশিরও পেয়েছিল। ধাবাটা খুব একটা পরিষ্কার নয়। খিদের সময় অত কিছু দেখলে চলে না। ওখানে বসেই নবকৃষ্ণবাবুকে ফোন করেছিল শৌর্য, ‘প্রেরণা’ রিহ্যাব সেন্টার থেকে যা জানা গিয়েছে সব বলল। খাওয়া শেষ করে ধাবা থেকে বেরিয়ে শৌর্য যখন বাইকে ঝোলানো হেলমেট নিয়ে পরতে যাচ্ছে, থমকে গিয়েছিল। বলল, ‘‘তোমার হেলমেটটা কোথায় গেল? এখানেই রেখেছিলে তো?’’

‘যার হেলমেট, তাকে ফেরত দিয়ে এসেছি’ বলেনি আরশি। আশ্চর্য হওয়ার ভান করে বলেছিল, ‘‘বাইকেই তো রেখেছিলাম!’’

শৌর্য বলল, ‘‘দেখেছ কাণ্ড, চোখের সামনে রেখেছি গাড়িটা, হেলমেটটা নিয়ে পালাল!’’

খানিক দূর গিয়েই একটা গ্যারেজ থেকে আরশির জন্য হেলমেট কিনেছিল শৌর্য। বাইকে যেতে-যেতে আরশি বলেছিল, ‘‘নবকৃষ্ণবাবুকে ইনফর্মেশনগুলো তো দেওয়া হল। এরপর আমাদের করণীয় কী?’’

শৌর্য বলেছিল, ‘‘অপেক্ষা। নবকৃষ্ণদা কী খবর আনে দেখে নিই। ওই রাস্তা ধরে এগোতে হবে। র‌্যান্ডামলি খোঁজ শুরু করলে গুলিয়ে যাবে গোটা ব্যাপারটা।’’

কথাটা যুক্তিসংগত মনে হয়েছিল আরশির। পরের দুটো দিন পূর্বাদের বাড়িতে শুয়ে-বসে কাটল আরশির। নবকৃষ্ণবাবুকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল, কাজ কতদূর এগোল। পরক্ষণই মনে হচ্ছিল মানুষটাকে ব্যস্ত করা ঠিক হবে না, যথেষ্ট সিনসিয়ার। কোনও খবর হলেই শৌর্যকে জানাবেন। শৌর্য ফোন করবে আরশিকে। ফোন করল শৌর্য, তবে মায়ের খবরের জন্য নয়। বলল, মহুলিয়ায় যেতে হবে। সুমিতদা অদ্ভুত একটা বায়না ধরেছে। মহুলিয়ার সেই বাড়ির মালিককে বলতে হবে আপনার বাড়িটাকে রংচটা করে দেব। সেটের লোক দিয়ে বাড়ির গায়ে শ্যাওলার দাগ, পাঁচিল ফাটিয়ে গাছ লাগানো হবে। প্লাস্টিকের গাছ। যতটা সম্ভব পুরনো লুক দিতে হবে বাড়ির। তার জন্য বাড়ির যা ক্ষতি হবে, টাকার বিনিময়ে পূরণ করা হবে সেটা। ওঁরা বাড়িটা সারাই করে নিতে পারবেন। সুমিতদা বলছে, যে করে হোক ওদের কনভিন্স করতে হবে আমাকে। প্রোডিউসর ধরে রাখার এটাই একমাত্র উপায়।

প্ল্যানটা সত্যিই অদ্ভুত। কেমন যেন বানানো মনে হচ্ছিল আরশির। এটা কি কোনও অজুহাত? শৌর্য নবমীকে নিয়ে ওই পথে যাবে বলে বানিয়েছে? সুমিত ঘোষকে ফোন করে সত্যিটা জানা যাবে না। বাড়ি পুরনো করার প্ল্যানটা হয়তো শৌর্যই দিয়েছে ওঁকে। উনি এতটাই হতাশ, শৌর্যকে বলেছেন, ‘‘দ্যাখ যদি রাজি করাতে পারিস।’’

আরশি জানতে চেয়েছিল, ‘‘কবে যাবে?’’

‘‘ভাবছি কাল সকালেই বেরিয়ে যাব,’’ বলেছিল শৌর্য।

আরশি বলল, ‘‘আমিও যাব।’’

শৌর্য অবাক হয়ে বলেছিল, ‘‘তুমি গিয়ে কী করবে? তোমার ওখানে কী কাজ?’’

‘‘ঘুরতে যাব। বাড়িতে বসেই আছি এমনি-এমনি। ঘুরে আসি নতুন জায়গায়।’’

শৌর্য কিছুতেই রাজি নয়। বলতে থাকে, ‘‘কোনও মানে হয় না বাইকে অতদূর জার্নি করার। যাতায়াত প্রায় পাঁচশো কিলোমিটার। এমনিতে যথেষ্ট ঘোরাঘুরি যাচ্ছে তোমার। একটু রেস্ট নাও।’’

আরশি জেদ ধরল, ‘‘আমি যাবই।’’

‘‘যদি না নিয়ে যাই?’’ বলেছিল শৌর্য।

আরশি বলল, ‘‘দেখবে কী করি… নিয়ে তোমাকে যেতেই হবে।’’

‘‘যা ইচ্ছে করে নাও। তোমায় নিয়ে যাচ্ছি না আমি। এমনিতে এক রাত কাটাতে হবে ওবাড়িতে। গতবার রিকোয়েস্ট করেছিল থাকতে, থাকিনি। এবার গিয়ে থাকব। আরও কাছাকাছি যেতে পারব ওদের। প্রস্তাবটায় রাজি করাতে সুবিধে হবে আমার। মাঝে তুমি ঢুকে গেলে, অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট।’’

কথা শেষ করে ফোন কেটে দিয়েছিল শৌর্য।

আজ ভোরবেলা রুকস্যাকে নিজের সমস্ত লাগেজ পুরে পূর্বাদের বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল আরশি। কারসার্ভিস অ্যাপ থেকে ট্যাক্সি ডেকে দিয়েছিল পূর্বা। জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘কাকু ফোন করলে কার সঙ্গে, কোথায় গিয়েছিস বলব তো?’’

‘‘বলিস,’’ বলেছিল আরশি। ট্যাক্সি পৌঁছে গেল শৌর্যদের বাড়ি। দরজা শৌর্যই খুলল। রেডি হচ্ছিল বেরোনোর জন্য। ঘরে ঢুকতে-ঢুকতে আরশি বলেছিল, ‘‘নবমীকে বলে দাও, ওর যাওয়া হচ্ছে না।’’

‘‘এতক্ষণে বুঝলাম, কেন এত জেদ করছিলে!’’ বলল শৌর্য।

চা-বিস্কুট খেয়ে বেরিয়ে পড়েছিল দু’জনে। মাসিমা বলছিলেন, ব্রেকফাস্ট সেরে বেরোতে। শৌর্য বলল, ‘‘ছেড়ে দাও। অনেকটাই রাস্তা। মাঝে কোথাও খেয়ে নেব।’’

কলকাতা পার করে হাইওয়ের দু’পাশে যখন ধু ধু মাঠ, বাইক চালাতে-চালাতে শৌর্য বলেছিল, ‘‘সুমিতদা এখানকার কাজটা দেওয়ার পর আমি কিন্তু সত্যিই নবমীকে ফোন করে বলেছিলাম আমার সঙ্গে যেতে। আগ্রহ দেখাল না। আর্জেন্ট কাজের অজুহাত দিল। তুমি কি কলকাঠি নেড়ে রেখেছ কিছু?’’

‘‘কী করে নাড়ব? আমার কাছে কি ওর ফোন নম্বর আছে? ওই দিনই তো সামান্য যা একটু আলাপ হল, আমাকে তেমন পাত্তাও দেয়নি!’’ বলেছিল আরশি।

শৌর্য বলল, ‘‘তা অবশ্য ঠিক। তা হলে তুমি কী করে ধরে নিলে ওকে সঙ্গে নিতে পারি। ওর ব্যাপারে তোমাকে তো বিশেষ কিছু বলিনি।’’

‘‘রিহ্যাব সেন্টারের বাইরে তোমাদের প্ল্যানপ্রোগ্রাম তো শুনলাম! নবকৃষ্ণবাবুর বাড়ি থেকে বেরোনোর পর যখন ফোন এসেছিল মেয়েটার, বাইকে বসে ফোনের অনেক কথাই শুনেছি, সহ্য না করতে পেরে নেমে গিয়েছিলাম। এরপর কি বুঝতে কিছু বাকি থাকে?’’ বলেছিল আরশি। শৌর্য ওর কথায় হাসতে থাকে। আরশির আত্মনিবেদনকে সিরিয়াসলি নিচ্ছে না শৌর্য। এমন ভাব করছে, যেন ভালবাসা দু’জনের খেলার সামগ্রী। শৌর্য ধরে নিচ্ছে আরশি যে অ্যাটেনশনটা তার প্রতি দিচ্ছে, সেটা আসলে নির্ভরতা। মাকে খুঁজে পেতে শৌর্যর সাহায্য ভীষণ দরকার। তাই আরশি প্রেমে পড়ার ভান করছে।

সত্যিই কি তাই? আরশির অবচেতন মনে এরকম কোনও উদ্দেশ্যই কি কাজ করছে? আরশিও জানে প্রেম শর্তসাপেক্ষে হয় না। স্কুল-কলেজের বন্ধুদের দেখেছে ভাল লাগা থেকে কত মধুরভাবে তাদের সম্পর্ক বদলে যাচ্ছে ভালবাসায়। তার জন্য আয়োজনের শেষ নেই তাদের। সাজ-পোশাক পালটে যাচ্ছে। মুখে কারণে-অকারণে হাসি, বাড়তি উচ্ছ্বাস। আরশি ভাবত তার জীবনেও এরকম একটা সময় আসবে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিপাতের মতো কোনও একজনের প্রতি ভাল লাগায় ভরে যাবে তার মন। তেমনটা হল না। মোটর সাইকেলের বেগে তার জীবনে এসে পড়ল শৌর্য। ভাল লাগা বা ভালবাসার জন্য কোনও বিলাসী সময় পেল না আরশি। শৌর্যর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল। এখন আর কাছছাড়া করতে চায় না। সেই জন্যেই কোনও চান্স নেয়নি। শৌর্যর সঙ্গে চলে এসেছে মহুলিয়ায়। নবমীকে এতটা পথ উপহার দেওয়ার কোনও মানে হয় না। কোথা থেকে কী হয়ে যায়! দেখা গেল, তারপর শৌর্য আর আরশির দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না!

কিন্তু শৌর্যই বা আরশির জন্য কেন এত করছে? ভাল মনের মানুষ বলে? দুঃখী মেয়েটাকে সাহায্য করা উচিত মনে করে? এর মাঝে কি এতটুকু ভালবাসা জন্মায়নি? কে জানে!

কারণ যাই হোক, মহুলিয়া আসাটা সার্থক হয়েছে আরশির। প্রকৃতির এই রূপ তার অদেখা ছিল। জলপাইগুড়ির আশপাশে অনেক জায়গায় বেড়াতে গিয়েছে। সেখানের প্রকৃতি সজল, গাছপালায় ভরা আর এখানে চারপাশ রুক্ষ, রাঙা ধুলো, এলোপাথাড়ি হাওয়া আকাশের ঢাল অবধি চলে যায় দৃষ্টি, অদ্ভুত উদার-উদাত্ত এক সৌন্দর্য। মন খারাপ স্থায়ী হতে পারে না। মহুলিয়ায় ঢোকার পর আরশি দেখেছে তকতকে সাঁওতালি পল্লি, মাটির বাড়িগুলোর দেওয়ালে আলপনা। পুকুর খুব একটা চোখে পড়ল না। বিশাল-বিশাল ইঁদারা বেশ ক’টা। যার একটার পারে উঠে কপিকলের দড়ি টেনে জল তুলছে সাঁওতালি কিশোরী। আরশি শৌর্যকে বলেছিল, ‘‘দ্যাখো, কী রিস্ক নিয়ে জল তুলছে মেয়েটা!’’

শৌর্য বলেছিল, ‘‘ওরা এতেই অভ্যস্ত। ঝুঁকি বলে মনেই করে না।’’

বাইক যখন ইঁদারাটা ক্রস করছে, বাচ্চা মেয়েটা এক হাতে বালতির দড়ি ধরে অন্য হাত দিয়ে আরশিদের টা টা করেছিল।

এ বাড়িতে যখন এসে পৌঁছল আরশিরা, বাড়ির লোকরা এমন আনন্দে আপ্যায়ন করেছিল যেন, শৌর্য ওদের কতদিনের চেনা! মাত্র একটা বেলা এখানে কাটিয়েছে শৌর্য, সেই গল্পটা আরশিকে বলেছে আজ এখানে আসার পথে। ফেরার সময় হাতির পথ আটকানোটাও। আরশিকেও কত তাড়াতাড়ি আপন করে নিল এরা, যেন আরশির আসার কথা ছিলই।

চন্দ্রাবউদি, মলয়দা কেউই রাজি হলেন না শৌর্যর প্রস্তাবে। তাদের মতো এ বাড়িটা সারানো হয়েছে বড় যত্ন করে। শাবল-গাঁইতি দিয়ে ভাঙতে গেলে আঘাত লাগবে বাড়ির চার সদস্যের শরীরে। বাড়িও তো পরিবারেরই একজন।

এরকম সেন্টিমেন্টাল স্ট্যান্ডের বিরুদ্ধে কোনও যুক্তি খাটে না। শৌর্য তাই আর বোঝাতে যায়নি। দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর মলয়দা শৌর্যকে নিয়ে বেরোল অন্য বাড়ি দেখাতে। সে বাড়ি অনেক দূরে। মলয়দার বাইকে গিয়েছে শৌর্য। বিকেল না ফুরোনো অবধি ফিরবে না। আলো থাকবে ফোটো তোলার। এদিকে বিকেল যে শেষ হতেই চাইছে না। আজ যখন অন্য বাড়ি দেখার সিদ্ধান্ত হল, আরশি বলেছিল, ‘‘আমিও যাব।’’

শৌর্য বলল, ‘‘তুমি গেলে বাড়তি কী উপকারটা হবে শুনি? খামোকা দুটো বাইক বের করতে হবে। আমরা তো আর বেড়াতে যাচ্ছি না, কাজে যাচ্ছি। আসার পথে যা-যা দেখেছ, আমাদের সঙ্গে গেলে তাই দেখবে।’’

আরশি বলে ফেলতে যাচ্ছিল, ‘আমি তোমার সঙ্গটাই চাই!’ সামনে মলয়দা-বউদি ছিল বলে গিলে নিতে হয়েছিল কথাটা। চন্দ্রাবউদি বলে উঠেছিল, ‘‘কী দরকার রোদে-রোদে ঘোরার। তার চেয়ে ভাল, খাওয়াদাওয়ার পর ফ্যানের তলায় শুয়ে আমি তুমি গল্প করব।’’

গরম তেমন না থাকলেও, বাইরে তখন চোখ-ধাঁধানো রোদ। তার আগে অনেকটা পথ রোদ মাথায় করেই এ বাড়িতে এসে পৌঁছেছিল আরশিরা। বউদি এমনভাবে থেকে যেতে বলল, যেন ছায়াতলার আহ্বান। থেকেই গেল আরশি। বাচ্চা দুটোকে উপরের ঘরে শুইয়ে, বউদি এল একতলায় আরশির পাশে শুতে। অনেক গল্প হল চন্দ্রাবউদির সঙ্গে। মায়ের ব্যাপারটাও বলে ফেলল আরশি। সদ্য পরিচিতের কাছে এত ব্যক্তিগত কথা না বলাই উচিত। এদের আন্তরিকতা আর শান্ত পরিবেশের কারণেই বোধহয় মুখে চলে এল সব। মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিল বউদি, ‘‘চিন্তা কোরো না। আজ না হয় কাল মাকে ঠিক পেয়ে যাবে। শৌর্যর মতো ছেলের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়াটাই তার ইঙ্গিত। উপরওয়ালার ইচ্ছেতেই কাছাকাছি এসে পড়েছ তোমরা।’’

কখন যেন একটু চোখ লেগে গিয়েছিল আরশির। ঘুম যখন ভাঙল, পাশে বউদি নেই। উঠোন থেকে ভেসে আসছিল স্বর্ণতোয়ার হাসি। বিছানা থেকে নেমে আরশি ঘরের বাইরে এসে দেখে বউদি রান্নাঘরে রান্না চাপিয়েছে। চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আরশি জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘কী ব্যাপার! এত তাড়াতাড়ি রান্না বসিয়ে দিলে? আয়োজন দেখে তো রাতের রান্না বলেই মনে হচ্ছে।’’

‘‘হ্যাঁ, রাতেরই… তাড়াতাড়ি করার কারণ আছে, পরে বলছি,’’ বলেছিল বউদি। কে জানে, কী কারণ! আরশি গিয়েছিল উঠোনে। ছাগলছানার সঙ্গে খেলছিল মেয়েটা। ছেলেটাকে আশপাশে দেখা যাচ্ছিল না। আরশি জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘তোর দাদা কোথায় রে?’’

‘‘জানি না!’’ আরশির দিকে না তাকিয়ে উত্তর দিয়েছিল তোয়া। এতই মত্ত খেলায়, তাকানোর ফুরসত নেই। তূণীরটার জন্য চিন্তা হচ্ছিল আরশির। কোথায় গেল ছেলেটা? খুঁজে দেখবে কি? তারপর ভাবল, না, থাক। এখানে হয়তো এটাই স্বাভাবিক, বেড়াহীন শৈশব। ভয়ের যদি কিছু থাকত, ছেলেমেয়ের খোঁজ করত বউদি। সে তো নিজের মনে রান্না করে যাচ্ছে। শহরের মায়েরা এত নিশ্চিন্ত হতে পারে না। চোখের আড়াল হতে দেয় না ছেলেমেয়েকে। তোয়া খেলে যাচ্ছে। আরশির কিছুই করার নেই। তোয়াকে বলেছিল, ‘‘অনেক খেলেছিস। চল, তোকে পড়াই। তোর খাতা বইগুলো দেখি।’’

ও মা, চট করে রাজি হয়ে গেল মেয়েটা। বলল, ‘‘পড়াবে? চলো।’’

ধুলোহাত ঝাড়তে-ঝাড়তে এগিয়ে এসেছিল তোয়া। কোনও বাচ্চাকে এত সোৎসাহে পড়তে আসতে দেখেনি আরশি। নিজে হলেও আসত না। বিছানায় বসে তোয়াকে যখন পড়াতে শুরু করেছিল আরশি, দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল তূণীর। আরশি বলল, ‘‘যা, তুইও বইখাতা নিয়ে আয়।’’

তূণীর দাঁড়িয়েই রইল। চন্দ্রাবউদি রান্নাঘর থেকে বলেছিল, ‘‘যা না, আন্টির কাছে হোমওয়ার্কগুলো করে নে।’’

সেই যে পালাল তূণীর, আর আসেনি। বউদি একবার ঘরে এল। বলল, ‘‘ছেলেটা বসেনি তো? ওটা এরকমই, লাজুক। বোধহয় দোতলার ঘরে পড়ছে।’’

‘‘আন্টি, হয়ে গিয়েছে অঙ্কটা।’’

তোয়ার ডাকে অন্যমনস্কতা কাটল আরশির। জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে তোয়ার খাতাটা নিল। চোখ বোলাচ্ছে, ঘরে দু’কাপ চা নিয়ে ঢুকল বউদি। বলল, ‘‘চা খাও তো?’’

‘‘খাই, তবে নেশা নেই,’’ বলল আরশি। বউদির হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে তোয়াকে বলে, ‘‘একদম ঠিক হয়েছে অঙ্কটা। তুই তো দারুণ ইন্টেলিজেন্ট মেয়ে!’’

লজ্জা পাওয়ার হাসি হাসছে তোয়া। শহরের বাচ্চা হলে এতক্ষণে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে দিত। বউদি তোয়াকে বলে, ‘‘যা, এবার। দাদার কাছে গিয়ে পড়তে বোস।’’

বইখাতা গোছাচ্ছে তোয়া। আরশি চায়ে চুমুক দেয়। একটা কথা বললে অদ্ভুত শোনাবে, তবু বলতে ইচ্ছে করছে বউদিকে। তোয়া ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর বলেই ফেলে, ‘‘বউদি, আমি যদি তোমার বাচ্চা দুটোকে পড়াই, এই বাড়িতে থাকি, আমার খাওয়াপরা দিতে পারবে না?’’

‘‘ধুর পাগলি, না পড়ালেও খাওয়াপরা দিতে পারব, তবে শৌর্যকেও সঙ্গে রাখতে চাইলে পারব না! তোমার দাদার অত মাইনে নয়!’’ বলে হাসতে থাকে চন্দ্রাবউদি। আরশিও যোগ দেয় হাসিতে, কাপ থেকে চা চলকে পড়ে কোলে। হঠাৎ করে হাসি থামিয়ে চন্দ্রাবউদি বলে ওঠে, ‘‘তুমি একদিনেই জায়গাটাকে এত ভালবেসে ফেললে, আর আমি ঘাটশিলায় থাকতে তোমার দাদার সঙ্গে রোজ ঝগড়া করেছি। বলেছি, অত ফাঁকা নির্জন জায়গায় আমি থাকেত পারব না, তুমি মিছিমিছি বাড়িটা কিনছ। তোমার দাদা কথা শোনেনি। কিনে ফেলল বাড়িটা। বাড়ির কাগজপত্র আমার হাতে দিয়ে বলেছিল, ‘ওখানে থাকতে-থাকতে দেখবে ঠিক অভ্যেস হয়ে যাবে, ওখানে কি মানুষ থাকে না? একান্ত যদি না থাকতে চাও, তোমাকে তো কাগজপত্রগুলো দিলাম, ছিঁড়ে ফেলে দাও!’ তোমার মলয়দা অত বড়লোক নয় যে, ছিঁড়ে ফেলব ওর কষ্টের টাকায় কেনা বাড়ির দলিল। রেখে দিলাম আলমারিতে।’’ থেমে চায়ে চুমুক দিল বউদি। আরশি বলল, ‘‘তারপর?’’

‘‘ঘাটশিলার বাড়ি বিক্রির জন্য লোক খুঁজতে লাগল। পাওয়া গেল তাড়াতাড়ি। ওদের সঙ্গে শর্ত হল, টাকা নেওয়ার দু’মাস পর বাড়ি ছাড়ব আমরা। আসলে ওই টাকাতে এই বাড়িটা রেনোভেশন হবে। শর্তে রাজি হল ওরা। দিনের পর দিন অফিস কামাই করে এই বাড়িটা মিস্ত্রিদের দিয়ে সারাই করাল মলয়। আমরা থাকতে চলে এলাম। মাসদুয়েক যেতে না-যেতে এমন ভাল লেগে গেল জায়গাটা, আমি এখন দু’-চার দিনের বেশি থাকতে পারি না বাপের বাড়ি বা অন্য কোথাও। এত আওয়াজ সেখানে, মাথা ভারী হয়ে আসে। আমার ছেলেমেয়ে দুটোও বাইরে বেশিদিন থাকতে চায় না!’’ বলে থামল চন্দ্রবউদি। ফের কাপে চুমুক দিয়ে মিটিমিটি হেসে বলল, ‘‘আজ রাতে তোমাকে নিয়ে একটা জায়গায় যাব।’’

‘‘কোথায়?’’

‘‘খুব দূরে নয়। এক কিলোমিটার মতো হাঁটতে হবে, খালি পায়ে।’’

‘‘খালি পায়ে কেন?’’

‘‘পুজো দিতে যাব তো, সেইজন্য। তাই তো রান্নাবান্না আগে থাকতে সেরে নিলাম।’’

‘‘কী পুজো গো?’’

‘‘কুরঙ্গ পূর্ণিমা।’’

‘‘এরকম পুজোর নাম শুনিনি তো কখনও! কোন দেবতার পুজো?’’

‘‘যখন যাব, তখন বলব কোন দেবতার পুজো। মেয়েরাই কেন শুধু পুজোটা করে। করলে, কী পায়।’’

‘‘শুধু মেয়েরাই পুজোটা করে? অনেকটা ব্রতপুজোর মতো?’’

আরশির প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয় না চন্দ্রার। বাতাসে কান পেতে বলে, ‘‘ওই, ওরা ফিরছে।’’

জানলার দিকে মুখ ফেরায় আরশি, কই, কেউ তো ফিরছে না। বাইকের আওয়াজও পাচ্ছে না সে। চন্দ্রাবউদি ঠাট্টা করছে না তো? আরশি একজনের প্রতীক্ষায় অস্থির, তাই হয়তো খেপাচ্ছে। বউদি হাসছে কিনা দেখতে যাবে আরশি, কানে আসে বাইকের গুড়গুড় আওয়াজ। বউদির কান কী শার্প! নাকি আরশিই ক্রমশ বধির হয়ে পড়ছে শহরে বসবাস করে। জলপাইগুড়িতেও এখন প্রচুর আওয়াজ… ওই তো দেখা যাচ্ছে ওদের। বাইকটা এগিয়ে আসছে।

ঘরে ঢুকেই শৌর্য বলল, ‘‘আরশি, সরি। তোমাকে না নিয়ে যাওয়াটা ভুল হয়েছে। কী দারুণ স্পট ভাবতে পারবে না। ওদিকে জঙ্গল, টিলা সব আছে। কী অসাধারণ সানসেট হল! ফোটোগুলো দেখো।’’

রাগে মাথা গরম হয়ে গিয়েছে আরশির। চন্দ্রাবউদি বলে ওঠে, ‘‘জঙ্গল তো আমাদের বাড়ির পিছনেও আছে। এক কিলোমিটার দূরে। রাত নামলে আরশিকে নিয়ে যাব।’’

‘‘আমিও যাব!’’ বলল শৌর্য।

বউদি বলল, ‘‘আজ সন্ধে থেকেই ছেলেদের ওই দিকে যাওয়া বারণ।’’

‘‘কেন বারণ?’’ অবাক হয়ে জানতে চায় শৌর্য।

বউদি বলে, ‘‘বলা যাবে না।’’

উত্তরের জন্য মলয়দার দিকে তাকায় শৌর্য। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল মলয়দা। আশ্চর্য ব্যাপার! এ বিষয়ে কিছু বলাও বারণ নাকি পুরুষদের?

‘‘‘কুরঙ্গ’ মানে হচ্ছে হরিণ, পুজোটাকে হরিণ পূর্ণিমাও বলতে পারো!’’ বলল চন্দ্রা বউদি।

আরশির মাথায় এখনও কিছু ঢুকছে না। বউদির সঙ্গে-সঙ্গে পুজো দিতে বেরিয়ে পড়েছে। খালি পা তো বটেই, শাড়িও পরেছে আরশি। বউদির শাড়ি। হাতে তালুর মধ্যে ধরে যায় এমন একটা মাটির সরা। তাতে ফুল মিষ্টি। আকাশে বড় চাঁদ, রাস্তা দেখতে অসুবিধে হচ্ছে না। আরশিদের সামনে পিছনে প্রচুর মেয়ে হাতে সরা নিয়ে চলেছে পুজো দিতে। সত্যিই তো, একটাও পুরুষ মানুষ চোখে পড়ছে না! আরশি জানতে চায়, ‘‘এটা শুধু মেয়েদের পুজো কেন?’’

‘‘তা হলে গোড়া থেকেই ব্যাপারটা বলি। আমরা এখন যে জঙ্গলের দিকে যাচ্ছি, তার সামনে একটা সরোবর আছে। কুরঙ্গ সরোবর। জলে দেখা যাবে নিটোল চাঁদ। দোল পূর্ণিমার আগের রাত তো, তাই। পিছনের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসবে শরীরে আলো পিছলোনো একটা হরিণ। হাজার-হাজার বছর ধরে হরিণটা আসছে। সেই রামায়ণের সময় থেকে।’’

‘‘ধ্যাত, বাজে কথা বোলো না তো। হরিণের অত আয়ু হয় নাকি! তা ছাড়া রামায়ণের সময় বলে কিছু ছিল কি না, তা নিয়েও অনেকের মনে সন্দেহ আছে।’’

‘‘তা হলে হয়তো পাঁচ-দশ বছর অন্তর নতুন হরিণ আসছে। এখানকার আদিবাসীরা বিশ্বাস করে ওটাই। বহু-বহু বছর ধরে ওই একটাই হরিণ আসছে।’’

‘‘তারপর কী হবে?’’

‘‘পাড়ে নেমে সোনারঙের হরিণ জল খাবে সরোবরের। জলে পড়ে থাকা চাঁদের গোল ছায়া ভেঙে যাবে। আমরা যারা এ পারে থাকব, কোনও শব্দ করব না। এতটাই নিঃশব্দ, যে হরিণের জল খাওয়ার আওয়াজটা কানে আসে। আবার জঙ্গলে ফিরে যাবে হরিণ। রাজ হরিণ বা হরিণ ঠাকুর। যে, যেমন মনে করে।’’

‘‘তারপর আমরা কী করব? হাতের সরায় ফুল-মিষ্টির কী হবে?’’

‘‘ফুল-মিষ্টি ভাসিয়ে দেব সরোবরে। সরায় ভরে নেব জল। ফিরে আসব।’’

‘‘সেই জলটা নিয়ে কী করব?’’

‘‘সেটা পরে বলছি।’’

দূরে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে শাড়িপরিহিতা মহিলারা। ওখানেই নিশ্চয়ই সরোবর। চন্দ্রাবউদি বলল, ‘‘তাড়াতাড়ি পা চালাও। আমরা বোধহয় দেরি করে ফেললাম।’’

সরোবরের পাড়ে পৌঁছে গেল আরশিরা। সরোবর ঠিক বলা যায় না, বড় পুকুর, হয়তো কোনও এক সময় সরোবর ছিল। জলে পড়ে রয়েছে পূর্ণিমার আগের দিনের চাঁদ। মৃদু হাওয়া বইছে। তাতে খুব মিষ্টি একটা গন্ধ। নেশা ধরে যাওয়ার মতো। পাড়ে একে-একে উবু হয়ে বসে পড়ছে মেয়েরা। আরশি চাপা গলায় চন্দ্রাকে বলে, ‘‘কী সুন্দর একটা গন্ধ পাচ্ছি, কীসের গন্ধ গো?’’

‘‘মৃগরাজ কাছে চলে এসেছে, তার নাভির গন্ধ!’’ বলার পর ফিচ করে হাসে চন্দ্রা। বলে, ‘‘এটা আসলে মহুয়া ফুলের গন্ধ। ওই জঙ্গল থেকে আসছে। সকলেই জানে সেটা। কস্তুরীর গন্ধ মনে করতে ভালবাসে।’’

বেশ খানিকটা সময় কেটে যায়। ও পারের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে অচেনা সব শব্দ। কিছুক্ষণ আগেও আশপাশে ফিসফিস করে কথা বলছিল মেয়েরা। হঠাৎ সকলেই চুপ। যেন এখনই কিছু ঘটতে চলেছে। জঙ্গলের দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকে আরশি। চাঁদের আলো একটু যেন কমে এল। আকাশের দিকে মুখ তুলল আরশি, না, চাঁদ আগের মতোই উজ্জ্বল। আবার চাপা গুঞ্জন, চোখ নামাল আরশি, দেখে চাঁদের ছায়া ভেঙে গিয়েছে। মেয়েরা ফুল-মিষ্টি ভাসিয়ে দিচ্ছে জলে। চন্দ্রাবউদিও ভাসাতে যাচ্ছে ফুল-মিষ্টি, আরশি বলে ওঠে, ‘‘কী হল, হরিণ তো এল না!’’

‘‘এই তো এসে জল খেয়ে গেল! তুমি খেয়াল করোনি… ভাসিয়ে দাও ফুল, জল ভরে নাও সরায়,’’ বলল চন্দ্রাবউদি।

চাঁদের মায়া আলোয় কোনও ভ্রম হয়েছে এদের। কেন যেন ভ্রমটাকেই মানতে ইচ্ছে করছে আরশির! আক্ষেপ হচ্ছে, মৃগরাজকে একটুর জন্য দেখা হল না!

বাড়ি ফিরছে আরশিরা, সরোবর ছেড়ে অনেকটাই এগিয়ে এসেছে। চন্দ্রাবউদি বলল, ‘‘হরিণ মোটেই আসে না। সকলেই কল্পনা করে নেয়। কোনও এককালে হয়তো আসত।’’

‘‘সে না হয় বুঝলাম, এবার বলো সরার জলটা নিয়ে কী করব?’’ নিজের সরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল আরশি।

বউদি বলে, ‘‘জলটা যে যার পুরুষমানুষের গায়ে-মাথায় ছিটিয়ে দেবে। যাতে তার পুরুষটি তাকেই সারাজীবন ধরে ভালবাসে, অন্য কোনও মেয়েকে নয়।’’

‘‘দারুণ ব্যাপার তো! এটা তো অসাধারণ পুজো!’’ ডগমগ গলায় বলে ওঠে আরশি।

ফের চন্দ্রাবউদি বলে, ‘‘পুরুষটি কিন্তু একবারও জিজ্ঞেস করবে না, কেন গায়ে জল ছিটোলে, কীসের জল? জিজ্ঞেস করলেই জলের সমস্ত গুণ নষ্ট। পুরুষরা এই পুজো নিয়ে একটা কথাও বলে না। যেন কুরঙ্গ পূর্ণিমা বলে কোনও পুজোর নামই শোনেনি। অথচ নিজের মহিলাটির জন্য রাত জেগে বসে থাকে। মাথা পেতে জলের ছিটে নেয়। ওরা সবই জানে, হরিণ যে আসে না, সেটাও।’’

খিলখিল করে হেসে ওঠে আরশি। চন্দ্রাবউদি বলে, ‘‘সামলে, সরার জল পড়ে যাবে।’’

আরও খানিকটা এগিয়ে যাওয়ার পর কিছু যেন মনে পড়ে বউদির। বলে ওঠে, ‘‘আর হ্যাঁ, জলের ছিটে দেওয়ার পর সরাটা কিন্তু গোড়ালি দিয়ে ভেঙে দিয়ো।’’

‘‘কেন?’’ জানতে চায় আরশি।

হাসতে থাকে বউদি। বলে, ‘‘সরায় যদি একফোঁটাও কুরঙ্গ সরোবরের জল থাকে এবং অন্য কোনও মেয়ে সেটা চুরি করে ছিটিয়ে দেয় পুজারিণীর প্রিয় পুরুষটির গায়ে, হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে পুরুষটি। কোনও চান্স রাখবে না বলেই ভেঙে দেয় সরা।’’

আবারও হাসি উপচে আসে আরশির মুখে, কোনও রকমে নিজেকে সামাল দেয়। সরার জল ফেলা চলবে না।

বাড়ির কাছে এসে আশ্চর্য হয় আরশি, মলয়দা তো বটেই, তার পুরুষটিও এখনও জেগে! দু’জনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে দোরগোড়ায়। আরশিরা পৌঁছয় দরজার সামনে। মাথা পেতে দেয় মলয়দা। চন্দ্রাবউদি সরার জল ছিটিয়ে দেয় তার পুরুষটির গায়ে। সরা মাটিতে ফেলে গোড়ালি দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়।

মলয়দাকে নিয়ে ঢুকে যায় ঘরে। গোটা কাণ্ডটা অবাক দৃষ্টিতে দেখল শৌর্য! কিছুই বুঝতে পারছে না সে। আরশি দাঁড়ায় তার প্রিয় পুরুষটির সামনে। চাঁদের আলো পিছলে যাচ্ছে পুরুষটির গা থেকে। কুরঙ্গপূর্ণিমার জল ছিটিয়ে দেয় আরশি। সরা ফেলে দেয় মাটিতে। শৌর্য জানতে চায়, ‘‘কী ব্যাপার বলো তো? কীসের জল…’’

আর কিছু বলতে দেয় না আরশি, নিজের ঠোঁট দিয়ে শৌর্যর ঠোঁট বন্ধ করে দেয়। বলতে দিলেই সমস্ত গুণ নষ্ট। ওই অবস্থাতেই আরশি গোড়ালির চাপে ভেঙে দেয় সরা।

১০

শৌর্যরা কলকাতায় ফিরে এসেছে। নবকৃষ্ণদার ফোন এসেছিল মহুলিয়াতেই। বললেন, ‘‘বিরাট খবর। বেঁচে আছে রায়া সেন। তবে টাকাপয়সার অবস্থা খুবই খারাপ। হেরোইনের নেশাটাও ছাড়তে পারেনি। যে দোকান থেকে কিনতে আসে পুরিয়া, ঠিকানা জোগাড় করেছি।’’

ফোন কানে নিয়ে উত্তেজনায় তখন কাঁপছিল শৌর্য। বলেছিল, ‘‘বলুন ঠিকানাটা…’’

‘‘ডেঞ্জারাস এলাকা! বেলেঘাটা খালের ধারে একটা গুমটি দোকান, দিনে চা, বিড়ি-সিগারেট বিক্রি হয়, ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যায় সন্ধে নামলেই। তখন হেরোইনের কাস্টমাররা আসতে থাকে,’’ বলে থেমেছিলেন নবকৃষ্ণদা। শৌর্যর পাশে তখন আরশি দাঁড়িয়েছিল। কে ফোন করেছে, জানে। কলটা ধরার আগে শৌর্যই বলেছিল, নবকৃষ্ণদার ফোন। যেহেতু ফোনের কথা শুনতে পাচ্ছিল না আরশি, অধৈর্যের প্রকাশ ঘটাচ্ছিল শৌর্যর কনুইয়ে, খামচে ধরেছিল। একটু ভেবে নিয়ে শৌর্য বলে, ‘‘রায়া সেন কবে কখন আসেন দোকানে, সে খবর পেয়েছেন? সেটা না জানলে তো আমরা ধরতেই পারব না তাকে।’’

‘‘না, অত নির্দিষ্ট কিছু খবর পাইনি। পাওয়া যাবেও না মনে হয়। মাল যখন ফুরোবে তখনই আসবে কিনতে। কখন ফুরোবে মাল, আগে থেকে কি বলা যায়? আর তোমরাও দিনের পর দিন সন্ধে থেকে রাত আবধি ওখানে গিয়ে বসে থাকতে পারবে না। এলাকার লোকের সন্দেহ হবে। প্রশ্নের মুখে পড়বে তোমরা। লোকগুলো তেমন সুবিধের নয়। জায়গাটা অ্যান্টিসোশ্যালে ভরতি।’’

নবকৃষ্ণদার কথার পিঠে শৌর্য বলেছিল, ‘‘ভয় না দেখিয়ে উপায়টা বলুন, রায়া সেনকে কীভাবে ধরা যায়। আর এই খবরটা আপনাকে দিল কে? সে কোন সোর্সে জানাল রায়া সেন ওই দোকানে পুরিয়া কেনেন?’’

নবকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘‘সে আমার মতোই মেকআপ আর্টিস্ট। ইন্ডাস্ট্রির পুরনো লোক। ও যে পাতাখোর, স্টুডিয়োপাড়ার কেউ জানত না। আমি রায়া সেনের খোঁজ নিচ্ছি, কানে গিয়েছে ব্যাটার। নিজেই এল আমার কাছে। বলল, হাজারদুয়েক লাগবে, পাক্কা খবর দেবে রায়া সেনের। বললাম, খবর সঠিক হলে তবেই টাকা পাবি। তখন বলল গুমটিটার কথা। নিজে একদিন পুরিয়া নিতে গিয়ে দেখতে পেয়েছ রায়া সেনকে। চেহারা দেখে প্রথমটা চিনতে পারেনি। মনে হবে যেন ঝুপড়িবাসী। কিন্তু ও-ও তো মেকআপ আর্টিস্ট। একবার কোনও একটা মুভিতে রায়া সেনের মেকআপ করেছিল। আমি যেমন করিনি। রায়া সেনকে দেখেছি বেশ কয়েকবার। আমার ভুল হলেও, ওর হবে না।’’

‘‘তা হলে কী বলছেন, দোকানটায় যাব একবার? জিজ্ঞেস করব রায়া সেনের খবর?’’ পরামর্শ চেয়েছিল শৌর্য। নবকৃষ্ণদা বললেন, ‘‘যেতে পারো। উত্তর পাবে কিনা, বলতে পারছি না। পুরিয়া বিক্রি করার সময় কোনও কথা বলে না ওরা। টাকা নেয় মাল দেয়। ওই দোকানে এখন এক পুরিয়া তিনশো টাকা। সঙ্গে আরও টাকা রেখো। পুরিয়া তো কিনতেই হবে, কথা বলানোর জন্য বাকি টাকা। আবারও ভয় দেখাচ্ছি, এলাকাটা কিন্তু সুবিধের নয়। পালানোর রাস্তা খোলা রেখে তবেই গুমটির কাছে যাবে।’’

‘‘ঠিক আছে, সে আমি দেখছি… গুমটিটা কী করে চিনব? সেটা বলুন,’’ জানতে চেয়েছিল শৌর্য।

নবকৃষ্ণদা বললেন, ‘‘রাস্তার দিকে মুখ করে খালধারে পরপর কয়েকটা গুমটি। একটা-দুটো গুমটি খোলাও থাকতে পারে। সেগুলোতে খোঁজ করার প্রশ্ন নেই। বন্ধ গুমটিগুলোর যেটার ডালা-দরজায় আবছা করে বাংলার চার মানে ইংরেজি আট লেখা থাকবে, সেই ডালায় গুনে-গুনে পাঁচবার চাপড় মারবে। গুমটির সাইডের দরজা খুলে হাত বাড়াবে কেউ। মানে পুরিয়ার টাকা চাইবে। তারপর তুমি কীভাবে খবর নেবে, সেটা তোমার উপর। পুলিশ নিয়ে যেয়ো না। কাজের কাজ হবে না কিছুই। গোটা এলাকায় নজর রাখে ওদের লোক। পুলিশকেও টাকা খাইয়ে রাখে নিশ্চয়ই। এখন ছাড়ছি। কী হল না হল, রেজ়াল্ট জানিয়ো। চিন্তায় থাকব।’’

ফোন কেটেছিল নবকৃষ্ণদা। মোবাইল পকেটে রেখে কী কথা হল, আরশিকে জানিয়েছিল শৌর্য। আরশি বলল, ‘‘চলো, আজই যাই দোকানটায়।’’

শৌর্য বলেছিল, ‘‘এখনই দশটা বাজে। মলয়দারা দুপুরের খাবার না খাইয়ে ছাড়বে না। তারপর যদি বেরোই, কলকাতায় ঢুকতে সন্ধে। তখনই এতবড় কাজটায় যাওয়া ঠিক হবে না। টানা বাইক চালিয়ে টায়ার্ড থাকব। তার চেয়ে বরং কাল সন্ধেবেলা যাওয়া ভাল। রেস্ট নিয়ে একদম ফ্রেশ মাইন্ডে কাজ করতে পারব।’’

শৌর্যর প্রস্তাব মেনে নিয়েছিল আরশি। মলয়দারা বিকেলেও ছাড়তে চাইছিল না। হোলির আগের দিন নাকি ওদের ওখানে হোলিকা রাক্ষুসি পোড়ানো হয়। সেটা কী জিনিস জানে না শৌর্য। জিজ্ঞেস করার মতো মুডও ছিল না। রাবণ পোড়ানোর মতো কিছু একটা হবে হয়তো।

এবার দোলে রং থেকে বাইরেই থাকল দু’জন। হাইওয়েতে রং ছোড়ার কেউ ছিল না। পায়নি আবিরের গন্ধ। কলকাতায় ফিরে আরশিকে পূর্বাদের বাড়িতে রেখে এসেছিল শৌর্য। আজ বিকেলে ওখান থেকে বাইকে তুলল। সন্ধে নেমে গিয়েছে অনেকক্ষণ। বেলেঘাটা খালধারে এসে পড়ল শৌর্যরা। বিশ্রী একটা গন্ধ। খালের ময়লার। আগে বারকয়েক শৌর্য এই রাস্তা দিয়ে দিনের বেলা বাইক চালিয়ে গিয়েছে। বস্তি অঞ্চল। সাবধানে গাড়ি চালাতে হয়, ছাগল-মুরগি চরে বেড়ায় রাস্তায়। বাচ্চারাও যখন-তখন চলে আসে গাড়ির সামনে। সাইকেল-লরি কেউই ট্রাফিক রুল মানে না। ওই এলাকাই সন্ধেবেলা এমন ফাঁকা হয়ে যায়, আন্দাজ করা যায়নি। স্ট্রিটলাইট অনেক দূর অন্তর। তাও আবার কয়েকটা জ্বলছে না। পিছনে বসা আরশি বলে ওঠে, ‘‘ওই তো গুমটিগুলো।’’

চোখ যায় শৌর্যর, ঠিক আন্দাজ করেছে আরশি। কোনও গুমটিই খোলা নেই। গাছের নীচে গুমটিগুলোর সামনে অন্ধকার বেশি জমাট। আরশি গুমটি দেখাতেই, গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করেছিল শৌর্য। এখন বলল, ‘‘গাড়ি নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। এখানেই থাক। তুমি পাহারা দাও, কথা বলে আসছি।’’

‘‘না, না। আমিও যাব। তুমি লক করো গাড়ি।’’

আরশি যে এ কথাই বলবে জানত শৌর্য, তবু চাইছিল ওকে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে। সংখ্যা লেখা গুমটির সামনে পৌঁছে গেল দু’জনে। চাপড় মারার আগে শৌর্য খেয়াল করল তার হার্টবিট বেড়ে গিয়েছে। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে একদম গুনে-গুনেই পাঁচবার ডালায় চাপড় মারল শৌর্য। খানিক অপেক্ষা পর শৌর্যর যখন মনে হচ্ছে কোনও ভুল হল কি? এই গুমটিই তো? পাঁচবারের কম বেশি মারেনি তো চাপড়? খুলে গেল গুমটির পাশের দরজা। বেরিয়ে এল পুরুষ হাত। খুবই রোগা হাতটা। শৌর্য পাঁচশোর নোট ধরিয়ে দিল হাতে। একটু পরেই বেরিয়ে এল দুশো ফেরত সমেত একটা পুরিয়া। শৌর্য পুরিয়াটা তুলে নিয়ে বলল, ‘‘ওটা থাক, একটা খবর দিতে পারবেন?’’

এবার লোকটা মুখ বাড়াল। তোবড়ানো গাল, খোঁচা-খোঁচা দাড়ি-গোঁফ। কলপ উঠে গিয়ে সাদা চুল উঁকি মারছে মাথায়। বলল, ‘‘কী খবর জানতে চাও?’’

‘‘রায়া সেন কি এখান থেকে পুরিয়া নেন?’’

‘‘কে রায়া সেন?’’

আরশি বলে ওঠে, ‘‘সিনেমায় অভিনয় করতেন। খুব বেশি পরিচিত নয় অবশ্য।’’

লোকটা ভিতর থেকে মোবাইল নিল হাতে। বোধহয় রায়া সেনের ব্যাপারে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু না, কাউকেই কল করল না। বলল, ‘‘কোনও সিনেমা আর্টিস্ট এখানে পুরিয়া নিতে আসে না। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তোমরা নতুন। নেশাটেশা করো তো, নাকি শুধু খবর নিতে এসেছ?’’

‘‘না, না, দু’জনেই নেশা করি, সবে ধরেছি…’’ বলল শৌর্য। লোকটা জানতে চায়, ‘‘এই ঠেকটা কে চেনাল?’’

‘‘মানাদা,’’ বলল শৌর্য।

কপালে ভাঁজ ফেলে লোকটা বলে, ‘‘কে মানাদা?’’

‘‘সে কী, চেনেন না! আপনার রেগুলার খদ্দের। হকার ইউনিয়নের…’’

বাকিটা আর বানাতে হয় না শৌর্যকে, মাছি তাড়ানোর মতো লোকটা বলে ওঠে, ‘‘যাও তো ভাই। কোনও ফিল্মআর্টিস্ট, মানাফানা কাউকেই আমি চিনি না।’’

শৌর্য বোঝে এখান থেকে খবর বেরোবে না। অপেক্ষা করে লাভ নেই। আরশির কনুই ধরে টানে শৌর্য। পা বাড়ায়, পিছনে লোকটার গলা পায়, কাকে যেন ফোনে বলছে, ‘‘হ্যাঁ, নতুন। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে…’’ খবর দিচ্ছে কাউকে। শৌর্য বোঝে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এলাকা ছাড়া উচিত।

রাস্তায় উঠে বাইকের দিকে এগোতে যাবে দু’জনে, হাতে লাঠিসোটা নিয়ে ছুটে আসতে দেখে বেশ কিছু ছেলেকে। শৌর্য আরশিকে বলে, ‘‘তুমি পালাও। দৌড়ে গিয়ে বাসটাস কিছু ধরে নাও।’’

আরশি পালায়নি। চোখের সামনে দেখল ছেলেগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ল শৌর্যর উপর। কোনও প্রশ্ন করছে না। বেধড়ক মেরে যাচ্ছে, লাঠি-রড-লাথি-চড়। মাটিতে পড়ে গিয়েছে শৌর্য। আরশি চিৎকার করছে, ‘‘কেন মারছ তোমরা?’’ মার আটকাতে যাচ্ছে। ওরা ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে আরশিকে। মুখ ঢাকা দিয়ে মার সহ্য করছে শৌর্য। এখনও বলে যাচ্ছে, ‘‘আরশি পালাও… পালাও তুমি!’’

ফাঁকা রাস্তার দু’দিকে পর্যায়ক্রমে মুখ ঘুরিয়ে আরশি চিৎকার করে যাচ্ছে, ‘‘হেল্‌প! হেল্‌প! মেরে ফেলবে এরা। বাঁচান। বাঁচান আমাদের প্লিজ়…’’

আলো-অন্ধকার রাস্তার মাঝে হঠাৎ করে দেখা দিল পাঁচ-ছ’টা মূর্তি। শাড়িপরা অথচ পুরুষকণ্ঠে হুংকার দিতে-দিতে এগিয়ে আসছে, ‘‘অ্যাই শালারা, কী হয়েছে রে, সবাই মিলে মারছিস কেন ছেলেটাকে?’’

আরশি বুঝতে পারে এরা বৃহন্নলা। কোনও বাড়িতে সন্তান হলে আশীর্বাদ করতে এসে টাকা পায়, বৃহন্নলাদের তেড়ে আসতে দেখে পালাল গুন্ডাগুলো। আরশি ছুটে যায় শৌর্যর কাছে। ঢাকা দিয়েও মুখ অক্ষত রাখতে পারেনি, রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আরশি কাঁদতে-কাঁদতে বলে, ‘‘আমি তো এখানকার কোনও হাসপাতাল চিনি না। তুমি নবমীর ফোন নম্বরটা কষ্ট করে বলো।’’

‘‘কী হয়েছে রে মেয়ে, কেন মারছিল ছেলেটাকে?’’ বৃহন্নলাদের একজন জিজ্ঞেস করল।

আর একজন অন্যজনকে বলল, ‘‘একটা ট্যাক্সি ডাক, হাসপাতাল নিয়ে যেতে হবে।’’

শৌর্যকে ঝুঁকে দেখছে একজন। দেখা শেষ করে আরশির হাত ধরে দাঁড় করায়। জানতে চায়, ‘‘কেন মারছিল, কী করেছিলি তোরা?’’

‘‘মাকে খুঁজতে এসেছিলাম,’’ ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলে আরশি।

‘‘কে তোর মা? তোকে দেখে তো মনে হয়ে না, তোর মা বস্তিতে…’’

চোখের পাতা দুটো বাটখারার মতো ভারী লাগছে শৌর্যর, অনেক কষ্টে একটু খুলতে পারে, এক অদ্ভুত দর্শন মহিলা আরশিকে কীসব বোঝাচ্ছে! কার সঙ্গে কথা বলছে আরশি? বেচারি কলকাতার কিছুই চেনে না। আবার কোনও বিপদে পড়তে যাচ্ছে না তো? আরশিকে কথা বলতে মানা করার শক্তি নেই শৌর্যর। চোখ বুজে আসে।

১১

প্রায় এক মাস হতে চলল, শৌর্য বিছানায়, এখন বাড়ির। গুন্ডাগুলো অত মারল, তবু হাসপাতালে সাতদিনের বেশি থাকতে হয়নি। মানুষের শরীর যে কতটা শক্তপোক্ত এটাতেই টের পাওয়া যায়। অজ্ঞান হওয়ার আগে শৌর্যর মনে হয়েছিল, এই বুঝি পৃথিবীকে শেষ দেখা।

বিরাট উপকার করেছে বৃহন্নলার দল। শৌর্যকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল ওরাই। শৌর্যর জ্ঞান ফেরার পর পুলিশ এসেছিল হাসপাতালে। তার খানিক আগেই আরশির সঙ্গে আলোচনা হয়েছিল শৌর্যর, পুলিশকে আসল ঘটনা বলে লাভ নেই। কেস ঘুরে যাবে রায়া সেনের দিকে। পুলিশ রায়া সেনকে খুঁজতে শুরু করলে তিনি আরওই নাগালের বাইরে চলে যাবেন। পুলিশকে বলা হল, বাইক ছিনতাই করতে এসেছিল গুন্ডার দল, ওদের আটকাতে গিয়ে মার খেতে হয়েছে।

হাসপাতালে, বাড়িতে প্রচুর আত্মীয়-পরিজন দেখতে এসেছে হাতে-পায়ে ব্যান্ডেজ করা শৌর্যকে। অনেকে হাসপাতাল বাড়ি দু’জায়গায় বারবার এসেছে। হাসপাতালে থাকার এই একটাই প্লাসপয়েন্ট, বোঝা যায় কত মানুষ ভালবাসে। সুমিতদা হাসপাতালে তো গিয়েছিলই, একদিন বাড়িতে এল ঝুলনদিকে নিয়ে। বলল, ‘‘তাড়াতাড়ি সুস্থ হ। ঝুলনকে বিয়ে করছি। এবার মেয়ে চাপ দিচ্ছে। বিরাট করে পার্টি দেব।’’

নবমী এসেছিল হাসপাতালে। কীভাবে, খবর পেয়েছিল, কে জানে! জিজ্ঞেস করার অবস্থায় ছিল না শৌর্য। নিবেদিতা দেখা করে গিয়েছে বাড়িতে। ওকে নাকি আরশি বলেছে সিরিয়ালে অভিনয় করবে না। নিবেদিতার অ্যাসিস্ট্যান্ট হবে ও। শিখবে প্রোডাকশনের খুঁটিনাটি কাজ। বাড়িতে একদিন নবকৃষ্ণদা এসে হাজির। শৌর্য ভেবেছিল টাকা চাইতে এসেছেন। দেখা গেল তা নয়, শৌর্যকে দেখতেই এসেছেন। ওঁর টাকা মিটিয়ে দিয়ে এসেছে আরশি। নবকৃষ্ণদা এখনও নতুন চশমা কিনে উঠতে পারেননি। শৌর্যর কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলেছিলেন, ‘‘এবার বুঝতে পারছ তো, কেন সাবধান করতাম। ঘোলাটে চশমাতেও তোমার চেয়ে আমি ভাল চিনি কলকাতাকে।’’

কথাগুলো ফিসফিস করে বলার কারণ, আরশি ওঁকে বলে দিয়েছিল, ‘‘শৌর্যকে যদি দেখতে যান, কী কারণে মার খেয়েছে, এই প্রসঙ্গ তুলবেনই না।’’

নবকৃষ্ণদা ছাড়া কাউকে বলা হয়নি আসল ঘটনা। বাইক ছিনতাইয়ের গল্পটাই চালানো হয়েছে। পূর্বার বাবাকে সঙ্গে নিয়ে আরশির বাবা দেখা করে গিয়েছেন। পূর্বা নিজেও এসেছিল। একটা ব্যাপারে বেশ আশ্চর্য হয়েছে শৌর্য, সে বাড়ি ফেরার পর আরশি কিন্তু এখানে আস্তানা গাড়েনি। যেটা ওর এতদিনকার আচরণের সঙ্গে মিলল না। তবে ফোনে যোগাযোগ রাখছিল। প্রায় এক সপ্তাহ হতে চলল ওর কোনও ফোন নেই! শৌর্যও করেনি। সবাই এত ফোন করে খবর নিচ্ছে, শৌর্যর ফোন করার অভ্যেসটাই চলে গিয়েছে। যত দিন যাচ্ছে, কমছে শুভানুধ্যায়ীদের ফোন। হাতে-পায়ে প্লাস্টার নিয়ে বেরোচ্ছে শৌর্য। ছোটবেলায় বেড়াতে গিয়ে যখন শখের ফোটো তুলত, বাবা উৎসাহ দিত এই বলে, ‘‘ফোটো তুলে যা মন দিয়ে। সময় তো দাঁড়ায় না, নিজের মতো বয়ে যায়। ফোটোগ্রাফাররাই পারে পৃথিবীর সুন্দর মুহূর্তগুলোকে ধরে রাখতে।’’

আরশিও তো শৌর্যর জীবনে সুন্দর একটা অধ্যায়। তাকে কি হারাতে চলেছে শৌর্য? প্লাস্টার করা হাতেই মোবাইল সেট তুলে নিল শৌর্য। দু’হাতেই প্লাস্টার। কল করে আরশিকে। বেজে গেল ফোন। ধরল না। এরকম তো হওয়ার কথা নয়!

আধঘণ্টা পর আবার ফোন করল আরশিকে। একই রেজ়াল্ট। কপালে ভাঁজ পড়ল শৌর্যর। এবার কল করল পূর্বাকে। আরশিই নম্বরটা দিয়ে রেখেছিল। বলেছিল, ‘‘আমাকে যদি ফোনে না পাও, পূর্বাকে একটা কল কোরো।’’

আরশির এখন পূর্বাদের বাড়িতে থাকার কথা। কল রিসিভ করল পূর্বা। বলল, ‘‘কেমন আছেন?’’

‘‘ভাল,’’ বলার পর শৌর্য জানতে চাইল, ‘‘আরশি কোথায় গো? পাচ্ছি না ফোনে…’’

‘‘আমাদের বাড়িতে তো আসেনি। কোথাও বেরিয়েছে বুঝি?’’

প্রশ্নটা গোলমালের ঠেকছে। শৌর্য জিজ্ঞেস করে, ‘‘ও কি এখন তোমাদের বাড়িতে থাকছে না?’’

‘‘না। দিনদশেক হল আপনাদের বাড়ি যাচ্ছে বলে বেরিয়ে গিয়েছে। যায়নি বুঝি! মাঝে কিন্তু আমাকে ফোন করেছিল, অন্য কোথাও আছে… এ কথা তো বলল না!’’

শৌর্যর টেনশন হতে থাকে, আবার গন্ডগোল শুরু করেছে মেয়েটা। দুশ্চিন্তাটা ছড়াতে না চেয়ে শৌর্য পূর্বাকে বলে, ‘‘মনে হচ্ছে নিবেদিতার কাছে উঠেছে। ওর অ্যাসিস্ট্যান্ট হবে বলছিল। দাঁড়াও নিবেদিতাকে ফোন করে দেখি।’’

‘‘ওকে, কী খবর হল আমাকে জানাবেন,’’ বলে ফোন রাখল পূর্বা।

নিবেদিতাকে কল করল শৌর্য। তুলল নিবেদিতা বলল, ‘‘হ্যাঁ, বলো। আগে বলো কেমন আছ? সলিড বোর হচ্ছ নিশ্চয়ই।’’

‘‘তা হচ্ছি। শোনো না, যে কারণে ফোন করেছি, আরশির সঙ্গে যোগাযোগ আছে তোমার?’’

‘‘আছে। ফোনে। অনেকদিন দেখা করেনি। কেন বলো তো?’’

‘‘না, সেরকম কিছু না। দু’দিন ধরে ওর ফোন আউট অব রিচ, তাই জিজ্ঞেস করছি।’’

‘‘চিন্তা কোরো না। ফোন আউট অব রিচ হলেও, ও তোমার রিচের মধ্যেই থাকবে। ব্যাপক ভালবাসে তোমায়,’’ বলে হাসতে-হাসতে ফোন কেটে দিল নিবেদিতা। শৌর্যর মুখ গম্ভীর হয়ে গেল আরও। আরশি কি বাড়ি ফিরে গেল? ওর বাবাকে একটা ফোন করা যায় কি? করলেও খবরটা ঘুরিয়ে জানতে হবে। রজতবাবুকে কল করল শৌর্য। ছ’টা এখনও বাজেনি। অফিসেই আছেন মনে হচ্ছে। ফোন ধরলেন রজতবাবু, ‘‘আরে, তুমি! কোথায় আমি ফোন করে খোঁজ নেব তোমার…’’

‘‘সে তো আপনি নেন। আমি ফোন করেছি পূর্বার নম্বরটা নেওয়ার জন্য। আরশিকে ফোনে পাচ্ছি না। পূর্বাকে ফোন করে দেখি কোথায় গিয়েছে!’’

‘‘পূর্বাকেও পাও কি না দেখো, দুই বন্ধু খুব ঘুরছে, আরশি তো কালই ফোন করেছিল আমাকে! পূর্বার নম্বর এক্ষুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি… হতে পারে মেট্রোয় আছে দু’জনে!’’ ফোন কেটে গেল। বুক ধড়াসধড়াস করছে শৌর্যর। আরশির বাবার এসএমএস ঢুকল মোবাইলে। নম্বরটার কোনও দরকার নেই। শৌর্য টের পায় কপালে ঘাম এসে গিয়েছে তার। মেয়েটা কি মাকে খুঁজতে গিয়ে নিজেই নিরুদ্দেশ হয়ে গেল? এতদিন মেয়ের সঙ্গে মাকে খুঁজেছে, এবার কি একা-একাই মেয়েকে খুঁজতে বেরোতে হবে! তবু ভাল, ওর ফোনটা এখনও বাজছে। নিজেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে রাখেনি। ফের আরশির নম্বরে কল করে শৌর্য।

১২

চন্দ্রাবউদির সঙ্গে হাটে গিয়েছিল আরশি। এইমাত্র ফিরল। শৌর্য ফোন করেছে, এটা ছ’নম্বর। ফোন ভাইব্রেট মোডে রেখেছে আরশি, চন্দ্রাবউদি টের পায়নি। এখন শৌর্যর কলটা ধরল আরশি। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। বাচ্চা দুটো লেখাপড়া করছে বিছানার উপর। ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল রাগ-অভিমান মিশ্রিত শৌর্যের গলা, ‘‘কী ব্যাপার, ফোন ধরছ না কেন? টেনশনে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। কোথায় আছ এখন?’’

‘‘নিরাপদেই আছি।’’

‘‘নিরাপদ-টিরাপদ শুনছি না। জায়গায় নাম বলো। তুমি পূর্বাদের বাড়িতে নেই, নিজের বাড়িতেও না, নিবেদিতাও তোমার খবর জানে না। তা হলে আছ কোথায়?’’

‘‘মায়ের কাছে, মাকে একটু সুস্থ করে নিই, তারপর তোমার সঙ্গে দেখা করব… কোথায় আছি বলব না! তার চেয়ে বরং নিজে সুস্থ হয়ে আমায় খুঁজে বের কোরো, কেমন?’’ বলেই ফোন কেটে দিল আরশি। কী মনে করে ফোনসেট অফ করে দিল। আরশি জানে, এই আচরণে তাদের সম্পর্ক মোটেই আলগা হবে না। শৌর্য একমাত্র তারই হয়ে গিয়েছে। সব কথা বলাই যেত শৌর্যকে, মাকে মহুলিয়ায় রাখার ব্যাপারে রাজি হত না। রিহ্যাব সেন্টারে পাঠাতে চাইত। মাকে কাছছাড়া করতে চাইছে না আরশি। কত-কত বছর পর কাছে পেল!

শৌর্য যখন মার খেয়ে পড়েছিল রাস্তায়, তখন সেই বৃহন্নলা মানুষটি খোঁজ দিয়েছিল মায়ের। রায়া সেন নামটা চিনতে পারেনি, অথচ শোভা নামটা বলতেই বুঝে গেল। বলল, ‘‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, শোভা এক সময় সিনেমা করত শুনেছি। সে তো বহু বছর আগের কথা। এখন শিয়ালদা স্টেশনের সামনে পুরিয়া বিক্রি করে।’’

‘‘ক’টা নাগাদ, ঠিক কোনখানে গেলে পাব?’’ জানতে চেয়েছিল আরশি।

বৃহন্নলা বলল, ‘‘ওভাবে বলা যায় না। চক্কর কেটে দেখ ক’দিন, ঠিক পেয়ে যাবি।’’

সকাল-দুপুর-বিকেল তিনটে আলাদা সময় ধরে তিনদিন মাকে শিয়ালদা স্টেশনের সামনে খুঁজল আরশি। চারদিনের দিন পেল, সন্ধের দিকে। ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল মা, মায়ের কোনও ছবির সঙ্গে ওই চেহারার মিল নেই। কী করে চিনল আরশি, কে জানে! কাছে গিয়ে ‘মা’ বলে ডাকতেই, চমকে উঠে ছুটে পালিয়েছিল। মিশে গিয়েছিল ভিড়ে। আরশি পড়ল চিন্তায়। শৌর্য হাসপাতালে, তার একার পক্ষে মাকে উদ্ধার করা মুশকিল বা বলা ভাল অসম্ভব। মনে পড়েছিল প্রেরণা সেন্টারের কথা। ওখানে বললে হয়তো লোক পাঠিয়ে তুলে নিয়ে যাবে। পরমুহূর্তে মনে হয়েছিল, উমেশবাবুর প্রভাব আছে ওই সেন্টারে। ওখানে রাখা ঠিক হবে না মাকে। অগত্যা বাবাকেই ফোন করে বলল সব কথা। বলেছিল, ‘‘তুমি চলে এসো, দু’জনে মিলে মাকে নিয়ে যাই বাড়িতে।’’

বাবা কিছুতেই রাজি নয়। বলেছে, ‘‘শোভা, এখন তোর মা নয়, আমার স্ত্রী-ও নয়। ও এখন অন্য মানুষ। ড্রাগের নেশা মানুষকে বদলে দেয়। ওর কী অবস্থা তুই বুঝতে পারছিস না! ড্রাগ বিক্রি করে ড্রাগের নেশা করতে হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, শোভার ওই চেহারা আমি স্ট্যান্ড করতে পারব না। গা বমি-বমি করবে আমার।’’

বাবার যখন ঘেন্না হচ্ছে, মাকে সামনে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। ঘৃণা দিয়ে সারিয়ে তোলা যায় না কাউকে। শৌর্য সুস্থ না হওয়া অবধি ওর থেকে পরামর্শও নেওয়া যাচ্ছে না। তখন সে ছিল হাসপাতালে। ওখানেই দেখা হয়ে গেল নবমীর সঙ্গে। শৌর্যকে ফোন করেছিল নবমী, মাসিমার কাছে ছিল ফোন। খবর শুনে দেখা করতে এসেছিল। ওকে দেখে আরশির মনে পড়ল সেই ঘটনা, পেশেন্টকে ডিটক্সিফিকেশন করে প্রেরণা রিহ্যাব সেন্টারে নিয়ে এসেছিল নবমী। ওর কাছে মায়ের ব্যাপারে সাহায্য চাওয়া যেতে পারে। নবমীর কন্ট্যাক্ট নম্বর নিয়েছিল আরশি। পরের দিন ওর হাসপাতালে গিয়ে মায়ের ব্যাপারে সব জানাল। একই সঙ্গে বলে রেখেছিল, ‘‘এসব শৌর্যকে জানিয়ো না।’’

নবমী বলেছিল, ‘‘আচ্ছা, বলব না। মাকে নিয়েও চিন্তার কোনও কারণ নেই। তুমি শিয়ালদা স্টেশনে গিয়ে লুকিয়ে নজর রাখো মায়ের উপর। যখনই দেখতে পাবে ফোন করবে আমাকে। আমি লোক নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স সমেত পৌঁছে যাব। সব ব্যাপার আমার উপর ছেড়ে দাও। শুধু তোমার মাকে যখন তোলা হবে অ্যাম্বুলেন্সে, একদম কাছেই থেকো। রেল পুলিশকে জবাবদিহি করতে হতে পারে। তুমি যেহেতু ওঁর মেয়ে, মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছ। পুলিশ কিছু বলবে না। মনে করে নিজের আইকার্ডটা সঙ্গে রেখো।’’

দু’দিন পরেই মাকে পাওয়া গেল একেবারেই প্রতিরোধহীন অবস্থায়। শিয়ালদা স্টেশনের সামনের চাতালে ঘুমোচ্ছিল মা। আরশি যখন এবার শিয়ালদা স্টেশন থেকে পা রেখেছিল কলকাতায়, মা হয়তো ওই ভাবেই ঘুমোচ্ছিল এখানে।

নবমীকে ফোন করে দিয়েছিল আরশি। অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে চলে এল ওরা। মা বাধা দেওয়া বা পালানোর চেষ্টা করেনি। নবমী বলেছিল, ‘‘ইনটক্সিকেটেড অবস্থায় আছেন।’’

হাসপাতালে থেকে অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠল মা। উইথড্রল সিম্পটম নেই। সমস্যা শুধু একটাই, কথা খুবই কম বলে। আরশির দিকে তাকিয়ে থাকে টানা। চোখের কোণ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে তখন। নবমী বলল, ‘‘ওঁকে কোনও হোমে রাখতে পারো। মাসছয়েকের মধ্যে নর্মাল লাইফে ফিরে যেতে পারবেন বলেই আশা করছি।’’

হাসপাতালের বিল মেটাতে অসুবিধে হয়নি আরশির। বাবা ওর অ্যাকাউন্টে নতুন করে বড় অ্যামাউন্টের টাকা দিয়ে রেখেছে। ডেবিট কার্ডে বিল পে করেছে আরশি। মাকে হোমে না রেখে মহুলিয়ায় নিয়ে যাওয়াই মনস্থ করল। আরশিরও ইচ্ছে করছিল এই পরিবেশে মায়ের সঙ্গে থাকতে। অন্য কোথাও, মানে আত্মীয়-পরিজনের কাছে থাকলে, মায়ের প্রতি করুণা প্রকাশ করত তারা। আরশির সেটা মোটেই ভাল লাগত না। শহরে থাকার একটা ঝুঁকিও আছে, মা পালিয়ে গিয়ে আবার নেশার কবলে পড়তে পারত। মহুলিয়ায় তার কোনও সুযোগ নেই। শহর বহুদূর। মা সেখানে পৌঁছনোর আগেই ধরে ফেলা যাবে। মা হাসপাতালে থাকাকালীন চন্দ্রাবউদিকে ফোন করেছিল আরশি। মাকে ফিরে পাওয়ার ঘটনা জানিয়ে বলেছিল, ‘‘হোমে না রেখে মাকে নিয়ে যদি তোমার ওখানে উঠি খুব অসুবিধে হবে?’’

চন্দ্রাবউদি তো রীতিমতো অভিমান করে বসল। বলেছিল, ‘‘তুমি আমাকে একথা বলতে পারলে! তোমার সঙ্গে আমার সেরকম সম্পর্ক!’’

সম্পর্ক অথচ মাত্র একদিনের! কলকাতা থেকে গাড়ি ভাড়া করে মাকে এখানে তুলেছে আরশি। মা ধীরে-ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে। শরীর থেকে সরে যাচ্ছে যশ-খ্যাতির গ্রহণ। চন্দ্র-সূর্যেরও তো গ্রহণ হয়। তার থেকে কি তারা বেরিয়ে আসে না? এত পুরনো একটা উদাহরণ হাতের কাছে থাকতে, গ্রহণ লাগা মানুষকে কেন যে তার পরিজনেরা শেষ হয়ে গিয়েছে বলে ধরে নেয়, কে জানে!

‘‘তোমার চা,’’ বলে চায়ের কাপ এগিয়ে ধরল বউদি, অন্য হাতে নিজের কাপ।

কাপ হাতে নেওয়ার আগে আরশি বলে,‘‘মাকে একবার দেখে আসি, নাকি? এসে চা খাচ্ছি।’’

‘‘আমি দেখে এসেছি। এই মাত্র ওঁকে চা দিয়ে দোতলা থেকে নামলাম। খাচ্ছেন চা। কোনও সমস্যা নেই।’’

বউদির থেকে কাপ নিয়ে চায়ে চুমুক দেয় আরশি। বলে, ‘‘খানিক আগে শৌর্য ফোন করেছিল। বলিনি কোথায় আছি। আন্দাজ করে তোমাদের ফোন করতে পারে। বলবে না এখানে আছি। ও না থাকলে মাকে কোনও দিন খুঁজে পেতাম না। ও এখনও পুরো সুস্থ নয়। মায়ের ব্যাপারে আবার জড়িয়ে পড়ুক, চাইছি না। খুব খারাপ লেগেছিল, ও যখন হাসপাতালে, আমি দু’দিনের বেশি দেখতে যেতে পারিনি। মাঝে-মাঝে হাসপাতালে ফোন করে খবর নিয়েছি। কিন্তু তারপর মাকে পেয়ে এক মুহূর্তের জন্যও মাকে চোখের আড়াল করতে সাহস হয়নি! যদি আবার হারিয়ে ফেলি। শৌর্য নিশ্চয়ই আমাকে ভুল বুঝবে না, বলো?’’

‘‘ও তো জানেও না তুমি এখন কোথায়… ওর থেকে অত দূরে-দূরে থাকলে, যদি তোমাকে ভুলে যায়?’’ কপট ভয় দেখায় চন্দ্রাবউদি।

মিচকি হেসে আরশি বলে, ‘‘একটু খুঁজুক না হয় আমায়! আর ভুলে না যাওয়ার ব্যবস্থা তো তুমি করেই দিয়েছ। কুরঙ্গ পূর্ণিমার জল ছিটিয়ে দিয়েছি মাথায়।’’

চা খেয়ে দোতলার ঘরে উঠে এসেছে আরশি। দরজার দিকে মায়ের পিঠ। বিছানার উপর হাঁটুতে থুতনি রেখে বসে আছে মা। সারাক্ষণ কী যে ভাবে একমনে! এ বাড়ির একটা গল্পের বই পড়তে দিয়ে গিয়েছিল আরশি। খুলেও দেখেনি মনে হচ্ছে। বন্ধ অবস্থায় পড়ে রয়েছে সামনে। চা-টাও পুরো খায়নি। অর্ধেক হয়ে আছে কাপ। কোনও কিছুতেই তেমন উৎসাহ পায় না। ওটাই ফেরাতে হবে। এগিয়ে গিয়ে মায়ের পিঠে হাত রাখে আরশি। মা চমকায় না। ধীরে ঘাড় ফেরায়। অভিমানের গলায় বলে ওঠে, ‘‘কোথায় ছিলি এতক্ষণ?’’

উত্তর দেওয়ার আগে থমকায় আরশি। মনে হয় আয়না দেখছে! মায়ের মুখের সঙ্গে তার এত মিল! ছোটবেলায় সবাই বলত সুখী হবে আরশি, যেহেতু সে পিতৃমুখী। আরশির কি কোনও বিভ্রম হচ্ছে? মায়ের মুখে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে সে। আরশি মাকে বলে, ‘‘ছাদে যাবে মা? এখানকার আকাশ খুব পরিষ্কার। আমাদের জলপাইগুড়ির মতো। কলকাতার আকাশ বড় ঘোলাটে। ছাদে চলো। দেখবে জলপাইগুড়ি সঙ্গে কী মিল! গিজগিজ করছে তারা, ধবধবে চাঁদ…’’

মা প্রস্তুতি নিচ্ছে বিছানা থেকে নামার। আরশির মুখে ছড়িয়ে পড়ে খুশি। কে বলেছে মাতৃমুখী মেয়ে সুখী হয় না?

অন্ধকার সিঁড়ি ধরে ছাদে যাচ্ছে মা-মেয়ে। যেন আরশি আর আয়না। আকাশের চাঁদ-তারারা আজ এদের দিকে ঝুঁকে পড়ে মুখ দেখবে নিজেদের।

———

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *