৫০. রাষ্ট্রধর্ম
বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী অশোক কুমার ঘোষ সংবিধান থেকে রাষ্ট্র ধর্ম বাদ দেওয়ার জন্য সরকারের লোকদের আইনী নোটিশ পাঠিয়েছিলেন। সেই আইনী নোটিশ পরদিনই ঘোষবাবুকে প্রত্যাহার করতে হয়েছে। দেশের অবস্থা বোঝার জন্য এর চেয়ে চমৎকার উদাহরণ আর কিছু নেই।
১৯৮৪ সাল থেকে রাষ্ট্রধর্ম থাকার বিরুদ্ধে আমি লিখছি, বলছি। তাতে ঘোড়ার ডিম হয়েছে। বরং আমার আত্মজীবনীর যে খণ্ডটিতে রাষ্ট্রধর্ম না থাকার পক্ষে আমি মত ব্যক্ত করেছিলাম, সেই খণ্ডটি পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার নিষিদ্ধ করেছে ২০০৩ সালে। এমনিতে কমিউনিস্টরা রাষ্ট্রধর্ম মানেন না, কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম যদি ইসলাম হয়, তাহলে তাঁদের আপত্তি নেই।
অশোক কুমার ঘোষ ব্যর্থ হয়েছেন, এক পা এগিয়ে দু’পা পিছিয়েছেন। কিন্তু আইনী নোটিশ পাঠাবার জন্য এক পা যে এগিয়েছিলেন অর্থাৎ যে সাহসী পদক্ষেপটি করেছিলেন, সেই পদক্ষেপটির জন্য তাঁকে কুর্ণিশ করি। কেন তিনি পরে নোটিশটি উইথড্র করেছেন? তিনি আসলে বাধ্য হয়েছেন করতে। তাঁর এই ব্যর্থতার দায় তাঁর নয়, এই ব্যর্থতার দায় তাঁর কপালপোড়া দেশটির।
৫১. সংশয়
কট্টর সুন্নি মুসলমানরা হিন্দুবিরোধী, ইহুদিবিরোধী, খ্রিস্টান বিরোধী, নাস্তিকবিরোধী, সুফিবিরোধী, শিয়াবিরোধী, আহমদিয়া বিরোধী, জোরোয়াস্ত্রিয়ান বিরোধী, বাহাই বিরোধী…..।
আর কট্টর হিন্দুরা মুসলমান বিরোধী, মুসলমান বিরোধী এবং মুসলমান বিরোধী।
হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান নাস্তিক আস্তিক লিবারেল কট্টর ইত্যাদি মিলিয়ে যে বাঙালি সমাজ—সেটিকে দেখতে পাই ফেসবুকে।
আর কিছুটা অবাঙালি ভারতবর্ষকে দেখি টুইটারে। ফেসবুকের তুলনায় টুইটার ভয়াবহ জায়গা। আমাকে হিন্দুত্ববাদীদের গালি খেতে হয় সকাল বিকাল। যা কিছুই বলি না কেন, তারা খোঁজে ভারত সম্পর্কে বা হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে তিল পরিমাণের হলেও কোনও কটাক্ষ করেছি কিনা। কটাক্ষ না করলেও তাদের কাছে মনে হতে থাকে এই বুঝি কটাক্ষ ওই বুঝি কটাক্ষ।
কাল কিছু মুসলমান তরুণ মানব বন্ধন করে একটি মন্দিরকে রক্ষা করতে চাইছে উন্মত্ত মুসলিমদের হাত থেকে—এই ছবিটি টুইটারে পোস্ট করার পর উথালপাথাল গালি শুরু হল হিন্দুদের। ওটা নাকি ফেইক নিউজ। বড় মিডিয়াগুলো ছাপিয়েছে, ভিডিওও বেরিয়েছে, ফেইক নিউজ নয়। কিন্তু কোনও মুসলমান যে মানবিক হতে পারে এ তারা বিশ্বাস করে না বলেই ওটি ফেইক নিউজ। কাল ব্যাঙ্গালোরের মুসলিম সন্ত্রাসের ঘটনা স্মরণ করে লিখেছিলাম রিলিজন ইজ দ্য রুট কজ অব রিলিজিয়াস টেরোরিজম। অমনি বন্যার জলের মতো গালি এসে ভেসে গেল আমার আঙিনা। দোষটা কী আমার? তারা ধরেই নিয়েছে ওই রিলিজন শব্দের মধ্যে হিন্দু ধর্ম আছে (যদিও তারা তাদের ধর্মকে ধর্ম বলে, রিলিজন বলে না। ধর্ম এবং রিলিজন যে আলাদা তাও বলে)। আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম তোমরা কি রিলিজিয়াস টেরোরিজম করো? উত্তর এলো, না। প্রশ্ন, তাহলে কেন ভাবছ হিন্দু ধর্মের কথা বলা হয়েছে এখানে? যারা ধর্মীয় সন্ত্রাস করে, শুধু তাদের কথা বলা হয়েছে। কে শুনবে কার কথা? প্রধানমন্ত্রী এবং গৃহমন্ত্রীকে ট্যাগ করে আমার ভিসা বাতিল করার শত শত উপদেশ পাঠিয়ে দেওয়া হল।
আজ টুইট করেছি ট্রাম্পকে নিয়ে। কমলা হারিসের নাগরিকত্ব নিয়ে ট্রাম্প সংশয় প্রকাশ করছেন, ঠিক যেমন ওবামার নাগরকিত্ব নিয়ে করেছিলেন।—এটিকে ট্রাম্পের বর্ণবাদী মানসিকতা বলে যে-ই না উল্লেখ করেছি, যেই না বলেছি ট্রাম্পের মা-ও তো ইমিগ্র্যান্ট ছিলেন, স্কটল্যান্ড থেকে আসা, তাহলে কি ইউরোপ থেকে মা বাবা এলে ঠিক আছে, শুধু এশিয়া আর আফ্রিকা থেকে এলেই ঠিক নেই? (ডেমোক্রেট পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী কমলা হারিসের মা ভারত থেকে, বাবা জামাইকা থেকে, কমলা জন্মেছেন আমেরিকাতেই।) ও মা, আমার দিকে ধেয়ে এল গালির তুফান। কমলা নাকি এন্টি ইন্ডিয়া। ট্রাম্পকে সাপোর্ট না করে কমলাকে ডিফেণ্ড করেছি কেন, নিশ্চয়ই আমি ভেতরে ভেতরে মুসলমান! আবারও ট্যাগ। আবারও একই উপদেশ, এর ভিসা বাতিল করো।
হিন্দুদের ইনসিকিউরিটি দেখি। দেখি আর বুঝে পাই না, কীভাবে এর আশু সমাধান হবে। যেভাবে হিন্দুদের মধ্যে বাস করে কিছু মুসলমান জ্বালাও পোড়াওয়ে মেতে ওঠে, এতে হিন্দুদের ঘৃণা আর বেড়ে যায়, রাগ আরও বেড়ে যায়, ইনসিকিউরিটিও আরও বেড়ে যায়। আমার ভয় হয় হিন্দু মুসলমানে আবার কোনদিন না রায়ট লেগে যায়। আমরা তো দেশভাগ না দেখলেও দেশভাগের ভয়াবহ রক্তপাত দেখেছি। ভয় হয়।
মাঝে মাঝে ভাবি ভাগই যখন হয়েছিল দেশ, তখন ঠিক ঠাক ভাগ হওয়াই হয়তো উচিত ছিল। সব মুসলমান পাকিস্তানে, সব হিন্দু ভারতে। সেক্যুলার ভারত কি সত্যিই সেক্যুলার ভারত? সেক্যুলার হলে মুসলিমদের জন্য ধর্মীয় আইন থাকতো না। সেক্যুলার হলে মন্দির মসজিদ ধর্ম টর্ম নিয়ে রাষ্ট্র মাথা ঘামাতো না। দেশভাগ হয়েছে ৭৩ বছর আগে, আজও ভারতে পাকিস্তানে, পাকিস্তান থেকে টুকরো হওয়া বাংলাদেশে, ধর্মটা কোনও ধর্ম নয়, স্রেফ রাজনীতি।
এ অঞ্চলের মুসলমানের প্রায় সকলেরই পূর্বপুরুষ/পূর্বনারী ভারতীয় হিন্দু। একই রক্ত বইছে দু’পক্ষের শরীরে। একই ভাষা আর সংস্কৃতি দু’পক্ষের। তাই হিন্দু-মুসলমানের বন্ধুত্বের আশা করেই যাচ্ছি নিরবধি। এ কি দেখা হবে আমার জীবনকালে? সংশয়।
৫২. রায়ট
ব্যাঙ্গালোরে ক্ষুব্ধ মুসলমানরা রাস্তায় বেরিয়ে গাড়ি টাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। কেন? কে নাকি ফেসবুকে শেষনবী মুহম্মদ সম্পর্কে কী লিখেছে। পুলিশ গুলি ছুঁড়লে তিন জন মারা গেছে। বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস না থাকলে মানুষ এভাবে জ্বালাও পোড়াও করে। আর পুলিশও পছন্দ না হলে গুলি ছোঁড়ে। দোষ কার? যে ফেসবুকে লিখেছে, নাকি যারা জ্বালাও পোড়াও করেছে, নাকি পুলিশের লোক যারা গুলি ছুঁড়েছে? আমি এসব নিয়ে গবেষণা করতে চাই না। এসব দেখতে দেখতে আমি অতিষ্ঠ। কয়েকবছর আগে বোরখা নিয়ে আমার একটি লেখা কর্ণাটকের লোকাল পত্রিকা রিপ্রিন্ট করার পর কর্ণাটকের দুটো শহরে রায়ট লেগেছেল, দু’জনের মৃত্যু হয়েছিল।
এই মৃত্যুগুলো বড় অহেতুক। এগুলো অসুখ বিসুখের মৃত্যু নয়, দুর্ঘটনার মৃত্যু নয়, এগুলো ডেকে আনা মৃত্যু। অনেকটা আত্মহত্যার মতো। যে কেউ যে কাউকে নিয়ে যা খুশী বলবে, তাতে তোমার কী এলো গেলো? আসলে মুশকিলটা হল ছোটবেলাতেই মানুষের মগজধোলাই হয়ে যায় এই মন্ত্র দিয়ে—’তোমার ধর্মের জন্য, তোমার রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য, যে দেশে তোমার জন্ম হয়েছে সেই দেশের জন্য প্রয়োজনে প্রাণ দেবে’। নিজের প্রাণের চেয়ে কিছুই যে বড় নয়, না ধর্ম না রাজনীতি না দেশ—তা তাদের বোঝাবে কে!
আজ নবী মুসাকে গালি দাও, ইহুদিরা কোথাও আগুন জ্বালাবে না, আজ নবী ঈসাকে গালি দাও, ক্রিশ্চানরা কোথাও আগুন জ্বালাবে না, কিন্তু শেষনবী নিয়েই ঝামেলা। আমি এখনও জানিনা দেবদেবীকে গালি দিলে কী ঘটনা ঘটবে।
কে কত সভ্য তা কী করে বুঝবো? তুমি কি সভ্য? তোমাকে আমি সভ্য বলবো তখন, যখন তোমার বিশ্বাসকে পায়ে মাড়িয়ে কেউ চলে যাবে, আর তাতে তোমার কিচ্ছু যাবে আসবে না।
৫৩. ভ্রাতৃত্ব
ব্যাঙ্গালোরের কংগ্রেস নেতা অখণ্ড শ্রীনিবাস মূর্তির ভাইপো নবীন লিখেছে ফেসবুকে শেষনবীকে নিয়ে। ক্ষুব্ধ মুসলিম রাস্তার গাড়ি তো পুড়িয়েইছে, অখণ্ডর বাড়িও পুড়িয়ে দিয়েছে।
কিন্তু সব মুসলিমই কি পুড়িয়েছে? না। কিছু মুসলিম হাতে হাত ধরে মানব বন্ধন তৈরি করেছে। কেন? একটি মন্দিরকে বাঁচানোর জন্য। উন্মত্ত মুসলিমরা যেন মন্দিরের কোনও ক্ষতি না করতে পারে।
মুসলিম মন্দির রক্ষা করবে, হিন্দু মসজিদ রক্ষা করবে। এই ভ্রাতৃত্ব বড় দরকার এ অঞ্চলে।
৫৪. নাস্তিকতা
কিছু নাস্তিক মনে করে আমি যেহেতু নাস্তিক, আমার দিন রাতের কাজ হল আল্লাহ ঈশ্বর ভগবান বলতে যে কিছু নেই, ধর্মগ্রন্থগুলো যে ফালতু, হাস্যকর, ভুলে ভর্তি—তা নিয়ে লেখা, তা নিয়ে বলা, তা নিয়ে মেতে থাকা। আমি সেটা কদাচিৎ করি। নাস্তিকতা প্রচার আমার মূল উদ্দেশ্য নয়। আমার মূল উদ্দেশ্য নারীর সমানাধিকারের জন্য, মানবাধিকারের জন্য, মানবতার জন্য, মত প্রকাশের অধিকারের জন্য, রাষ্ট্র আর ধর্মের পৃথকীকরণের জন্য, মানুষকে কুসংস্কারমুক্ত করার জন্য, বিজ্ঞানমনস্ক করার জন্য, নারী-পুরুষের সমানাধিকারের ভিত্তিতে আইন তৈরির জন্য, সমকামী-উভকামী-রূপান্তরকামী-উভলিঙ্গ-কুইয়ার যারাই নিপীড়িত তাদের অধিকারের জন্য, নিচুজাত-আদিবাসী-উপজাতি ইত্যাদি ট্যাগ লাগিয়ে যাদের অত্যাচার করা হয় তাদের অধিকারের জন্য, দারিদ্র দূরীকরণের জন্য, সমতার সমাজ নির্মাণের জন্য সরব হওয়া। এর ফলে কিছু মানুষও যদি সচেতন হয়, তাহলেই আমি সার্থক।
৫৫. নিষিদ্ধ মত
১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে যা ঘটেছিল, সে নিয়ে আমার দ্বিখণ্ডিত বইটির কয়েকটি পৃষ্ঠায় আমার মত প্রকাশ করেছিলাম, আমার মত পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের পছন্দ হয়নি। তারা আমার গোটা বইটিই নিষিদ্ধ করেছিল ২০০৩ সালে। ওই নিষিদ্ধ বইয়ের নিষিদ্ধ মত সেন্সরহীন অবস্থায় এখানে—
”রাস্ট্রপতি এরশাদ জনগণের এরশাদ হঠাও আন্দোলনের চাপে পারলৌকিক মুলো ঝুলিয়েছেন সামনে। সংবিধানে নতুন একটি জিনিস তিনি বলা নেই কওয়া নেই ঢুকিয়ে দিলেন, জিনিসটির নাম রাষ্ট্রধর্ম। এখন থেকে এ দেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। কেউ কি দাবি করেছে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা চাই? না কেউ করেনি। দেশে কি মুসলমানদের ধর্ম পালনে কিছু অসুবিধে হচ্ছিল যে রাষ্ট্রধর্ম না হলে তাদের আর চলছিল না? তাও নয়, খুব চলছিল, বেশ চলছিল। বহাল তবিয়তেই ছিল মুসলমানরা। মসজিদ মাদ্রাসা গড়ে গড়ে দেশের বারোটাই বাজাচ্ছিল, যেখানে সেখানে যখন তখন গজাচ্ছিল লোক ঠকানোর পীর, এখন এরশাদ নিজেই ধর্মের ঢোল নিয়ে মাঠে নেমে পড়লেন। নাচুনে বুড়োদের তাল দিচ্ছেন বেশ। রাষ্ট্রের কি কোনও ধর্মের প্রয়োজন হয়! মানুষের না হয় হয়, কিন্তু রাষ্ট্র কি কোনও মানুষ! রাষ্ট্র তো সব ধর্মের সব সংস্কৃতির সব ভাষার মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য। রাষ্ট্র যদি নিরপেক্ষ না হয়, রাষ্ট্র যদি অনেকগুলো সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি সম্প্রদায়ের পক্ষ নেয়, তবে সেই রাষ্ট্রের মানুষের মধ্যে বিরোধ আর বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। হতে বাধ্য।
অমুসলমানরা এ দেশে নিরাপত্তার অভাবে ভুগবে, ভুগতে বাধ্য। সভ্যতার দিকে যেতে হলে যে প্রথম পদক্ষেপটি গ্রহণ করতে হয়, তা রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে আলাদা করা। সভ্য দেশগুলোয় তাই হয়েছে। যে যুগে ধর্ম ছিল রাষ্ট্রের মূলমন্ত্র, সে যুগকে বলা হয় অন্ধকার যুগ। অন্ধকার যুগে শত শত মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হত। অন্ধকার যুগে মানুষের বাকস্বাধীনতা বলে কিছু ছিল না। আমার আশঙ্কা হয় এই দেশটি ধীরে ধীরে অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে। আমার আশঙ্কা হয় ধর্ম নামের কালব্যাধির যে জীবাণু ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, এতে ভীষণ রকম আক্রান্ত হতে যাচ্ছে দেশের মানুষ। এরশাদ নিজের গদি বাঁচাতে নানারকম ছলচাতুরীর আশ্রয় নিচ্ছেন, সংসদ বাতিল করে নির্বাচন করলেন, কোনও বড় দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি যেহেতু, ছোট কিছু দল আর সতন্ত্র কিছু লোক নিয়েই লোক ভুলোনো নির্বাচনের খেলা সারলেন। খেলায় জিতে দেখাতে চাইলেন তাঁর রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা কিছুমাত্র অবৈধ নয়। কিন্তু তাঁর এই টোপ কেউ গিলছে না। ক্ষমতার লোভ এমনই লোভ যে আন্দোলনের ভূমিকম্প যখন তার গদি নাড়িয়ে দিচ্ছে, খুঁটি আঁকড়ে ধরার মত করে তিনি রাষ্ট্রধর্ম আঁকড়ে ধরলেন। জনগণের নাকের ওপর পারলৌকিক মুলোটি ঝুলিয়ে দিলেন। এবার যাবে কোথায় ধর্মভীরুর দল! বিরোধী দলগুলো জোট বেঁধেছে, নানারকম সাংস্কৃতিক দলও জোট বেঁধেছে শহরে গ্রামে সবখানে। এরশাদ-বিরোধী রাজনৈতিক জোট থেকে রাষ্ট্রধর্ম বিষয়ে খুব যে কথা বলা হচ্ছে, তা নয়। কারণ ইসলাম যদি কোথাও এসে বসে, সে বসা অবৈধ হোক, একে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করার বুকের পাটা সবার থাকে না। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক দলগুলো থেকে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর। হাতে গোণা কিছু সাহিত্যিক সাংবাদিক রাষ্ট্রধর্মের বিরুদ্ধে লেখালেখি করছেন, এটুকুই। এর বেশি উচ্চবাচ্য নেই।
একাত্তরে বাঙালি মুসলমান অত্যাচারী অবাঙালি মুসলমান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে প্রমাণ করেছে মুসলমান হলেই এক সঙ্গে বাস করা যায় না। একাত্তরে বাঙালিরা প্রমাণ করেছে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতভাগ ছিল সম্পূর্ণ ভুল একটি সিদ্ধান্ত। একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া বাঙালির স্বপ্ন ছিল অবাঙালি মুসলমানদের বিদেয় করে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভালোবেসে বাংলা নামের একটি দেশ গড়ে তোলা। দীর্ঘ ন মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীন একটি দেশ জুটল। শেখ মুজিবুর রহমান দেশ চালাতে শুরু করলেন। একশ একটা ভুল তাঁর থাকতে পারে, নেতা হিসেবে তিনি অসম্ভব জনপ্রিয় হলেও রাষ্ট্রপরিচালনায় তাঁর হাত কাঁচা হতে পারে, কিন্তু বলিষ্ঠ একটি সংবিধান তৈরি করেছিলেন, যে সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর সমাজতন্ত্র সহ ধর্মনিরপেক্ষতা স্থান পেয়েছিল। কোথায় সেই ধর্মনিরপেক্ষতা এখন! কোত্থেকে কোন এক মেজর জিয়া এসে ক্ষমতা দখল করে কোনও কারণ নেই কিছু নেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে ঘাড় ধরে বিদেয় করে দিলেন। জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আরও এক সেনানায়ক একটি চরম অন্যায় করলেন সংশোধনের নামে সংবিধানে একটি কালসাপ ঢুকিয়ে দিয়ে। হা কপাল! দেশের কপালে এই ছিল! বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি! এই গান গাওয়ার মতো আর বুঝি কোনও মঞ্চ রইল না। জুন মাসের সাত তারিখ, ১৯৮৮ সাল, বাংলার ইতিহাসে একটি কালি মাখা দিন। চমৎকার একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ার সম্ভাবনাকে গলা টিপে হত্যা করার দিন। অনেকটা সামনে এসে বিস্তর অর্জন করে পেছনে শূন্যতার দিকে ফেরার দিন, অসত্য অন্যায় অবিচার আর অন্ধকারের দিকে ফেরার দিন। এক দুই বছর পেছনে নয়, হাজার বছর পিছিয়ে যাবার দিন।
এ সময় শেখ হাসিনাই হতে পারেন সহায়। শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসেছেন একাশি সালে, আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হয়েছেন। ফিরে আসার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের মানুষ, যারা জিয়াউর রহমানের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন তিনি স্বাধীনতার শত্রুদের এমনকি গোলাম আযমের মতো একাত্তরের গণহত্যাকারীকে দেশে ঢোকার অনুমতি এবং অবৈধ ধর্মীয় রাজনীতিকে বৈধতা দিয়েছিলেন বলে, সংবিধানে বিসমিল্লাহ যোগ করা, ধর্ম নিরপেক্ষতা তুলে দেওয়া এসব দুষ্কর্ম তো আছেই—শেখ হাসিনার ওপর ভরসা করলেন। কিন্তু এই হাসিনাই এরশাদের ফাঁদে পা দিয়ে জামাতে ইসলামিকে নিয়ে নির্বাচনে যোগ দিলেন ছিয়াশি সালে। খালেদা জিয়া কিন্তু এরশাদের টোপ মোটেও গেলেননি। এরশাদ নিজের ক্ষমতাকে বৈধ করার জন্য নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন, তা বুঝে হাসিনা শেষপর্যন্ত সংসদ বর্জন করলেন কিন্তু জামাতে ইসলামির মতো দলের সঙ্গে ভিড়ে যে কালিটি তিনি লাগিয়েছেন গায়ে, তা খুব সহজে দূর হবে না। তারপরও প্রগতিশীল মানুষের আশা তিনি ক্ষমতায় এলে তাঁর বাবার আদর্শে সংবিধানের হারিয়ে যাওয়া সম্পদ আবার পুনরুদ্ধার করতে পারেন। কিন্তু আপাতত এরশাদ বিরোধী জোটকে সমর্থন করা যাক, জোটের আন্দোলন যেন দুশ্চরিত্র স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামাতে পারে। সাত বছর আগে ক্ষমতা দখল করেছে ব্যাটা, আজও ছাড়ার নাম নেই। দেশের লোক চাইছে না তাকে, তাতে কী আসে যায়, আমার কাছে অস্ত্র আছে, ধর্ম আছে, আমি এগুলোর ভয় দেখিয়ে দেখিয়ে গদিতে বসে আয়েশ করব।
কোনও রাজনৈতিক দলের আমি কোনও সদস্য নই, তবু এ মুহূর্তে দুর্যোগের দিন পার হয়ে একটি সুন্দর আগামীর দিকে যাবে বলে যারা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তাঁদের ওপর বিশ্বাস রেখে একটি সম্ভাবনার অঙ্কুরের গোড়ায় আমি জল সার দিই।
এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে রাজনৈতিক জোটের সভা চলছে, মিছিলে কাঁপছে নগরী। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক ছাত্রছাত্রী সংগঠনও বড় ভূমিকা পালন করছে এই আন্দোলনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিছিলের ওপর ট্রাক চালিয়ে দিয়ে অনেককে হত্যা করেছে এরশাদের পুলিশবহিনী। এখনও রক্তের দাগ মোছেনি ওই এলাকা থেকে। সাংস্কৃতিক জোটও নিরলস অনুষ্ঠান করে যাচ্ছে বিক্ষোভের, প্রতিবাদের। গাঢ় অন্ধকারে নিরাশার খরস্রোতা নদীতে সাঁতরে সাঁতরে আশার একটি ক্ষীণ আলোর দিকে যেতে থাকি। এই আলো কি সত্যিই আলো, নাকি মরীচিকা! যতীন সরকার আগামীর দিকে তাকিয়ে আছেন, সমাজতান্ত্রিক দল ক্ষমতায় এলে, তাঁর বিশ্বাস, এরশাদের এই পারলৌকিক মুলোকে পরলোকে পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু কবে ক্ষমতায় আসবে ওই দল! দলটি জামাতে ইসলামির চেয়েও দিনে দিনে ছোট আকার ধারণ করেছে। কমরেড ফরহাদ মারা গেলে বিশাল জানাজার আয়োজন হল ইসলামি নিয়মে। কমিউনিস্টরাই যদি ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে, হোক না সে লোক দেখানো, বেরোতে না পারে, তবে বাকি দলগুলো কী করে বেরোবে! ধর্ম এমনই এক সর্বনাশা জিনিস, এটিকে না মানো ক্ষতি নেই, কিন্তু এটিকে দূর করতে গেলেই গোল বাঁধে। অশিক্ষা আর অজ্ঞানতার কারণে মানুষের ভেতরে একটি অন্ধবিশ্বাসের জন্ম হয়েছে। এই বিশ্বাস কোনও যুক্তি মানে না। মুক্তবুদ্ধিকে পরোয়া করে না। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে যদি বিদেয় না করা হয়, তবে দেশটি হয়তো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ থেকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র হতে সময় নেবে না। ধর্ম হল কর্কট রোগের মতো, একবার পেয়ে বসলে একের পর এক ধ্বংস করতে থাকে হাতের কাছে যা পায় তা-ই। এর কোনও নিরাময় নেই। সুস্থতার দিকে কিছুতে মুখ ফেরাতে দেয় না এই রোগ। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের কারণে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ধর্ম বিশ্বাসী মানুষকে অথবা ধর্মে বিশ্বাস না করলেও যারা ওই ধর্মাবলম্বীদের সন্তান, তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকতে হবে। কেউ যদি ইসলামের প্রেরণায় আল্লাহর আদেশ পালন করে সাচ্চা মুসলমান হতে চায়, তবে পবিত্র গ্রন্থ কোরান থেকে খুব সহজেই দীক্ষা নিতে পারে যেখানে লেখা ইহুদি আর খিস্টানদের সঙ্গে অর্থাৎ বিধর্মীদের সঙ্গে কোনওরকম বন্ধুত্ব না করার, করলে তাদেরও আল্লাহ ওই বিধর্মীদের সঙ্গে দোযখের আগুনে নিক্ষেপ করবেন। কেবল এই নয়, যেখানে বিধর্মী পাও, ধ্বংস কর, খতম কর। যেখানেই অবিশ্বাসী পাও, কেটে ফেলো এক কোপে বাম হাত আর ডান পা, আরেক কোপে ডান হাত আর বাম পা। মুসলমানরাই যে খুব সুখে থাকবে তা নয়। মেয়েদের ওপর চলবে ধর্মের বুলডোজার। বুলডোজারের তলায় পড়ে মেয়েরা আর মেয়ে থাকবে না, খণ্ড খণ্ড মাংসপিণ্ডে পরিণত হবে।
কিছুতেই আমি মেনে নিতে পারি না ধর্ম কোনও আলো এনেছিল কোনও কালে। অন্ধকার ছাড়া আর কিছু পৃথিবীতে ছড়ায়নি ধর্ম। মানুষের অজ্ঞানতা আর মৃত্যুভয় থেকে জন্ম নিয়েছে ধর্ম। একেশ্বরবাদী পুরুষেরা ধর্ম তৈরি করেছে তাদের আনন্দের জন্য, ইহলৌকিক সুখভোগের জন্য। ইসলামের ইতিহাস বলছে আরবের লোকেরা গুহায় বাস করত, কন্যা জন্ম নিলে জীবন্ত কবর দিত আর সেই দুরবস্থার অবসান ঘটিয়েছেন মোহাম্মদ। দুরবস্থা, আমার যা বিশ্বাস, আগের চেয়ে বেশি এসেছে ইসলাম আসার পর। আগে মেয়েরা বাণিজ্য করত, যুদ্ধে অংশ নিত, নিজের পছন্দমতো বিয়ে করত, তালাকও দিত স্বামীদের। মোহাম্মদের প্রথম স্ত্রী খাদিজা ব্যবসায়ী ছিলেন, মোহাম্মদ ছিলেন তাঁর তিন নম্বর স্বামী, বয়সেও তাঁর অনেক ছোট ছিলেন। মেয়েদের জ্যান্ত পুঁতে ফেললে তো মেয়ের সংখ্যা কম হওয়ার কথা। এই যে এত গুলো বিয়ে করত পুরুষেরা, এত মেয়ে কোথায় পেত তবে! মেয়ে পুঁতে ফেললে তো মেয়ের অভাব হওয়ার কথা। তা কিন্তু হয়নি। আরবের লোকেরা স্ফূর্তিতে আমোদে দিন কাটাতো, খেতো, পান করত, বিশ্বাস করত এই জীবনের পরে আর কোনও জীবন নেই, এই জীবনেই যত আনন্দ আছে করে নিত। এই বিশ্বাসের ওপর ধ্বস নামালেন মোহাম্মদ। নিজের সৃষ্ট এই ধর্মকে ক্ষমতা দখল করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন তিনি। নির্দ্বিধায় মানুষ খুন করে, ভিন্ন গোত্রের লোকদের রক্তে স্নান করে, ভিন্ন ধর্মের মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে, ইহুদি এলাকায় নিজের সৈন্য নামিয়ে দিয়ে তাদের সম্পদ লুঠ করে মেয়েদের ধর্ষণ করে তিনি বিজয় নিশান উড়িয়ে দিলেন। এই ধর্ম কখনও তাঁর আধ্যাত্মিক ব্যাপার ছিল না, ছিল প্রথম থেকে শেষ অবদি, রাজনৈতিক। ইহলৌকিক কোনও আনন্দ থেকে নিজেকে তিনি বঞ্চিত করেনি। যখন যা ইচ্ছে হয়েছে, করেছেন। দোহাই দিয়েছেন আল্লাহর। কাউকে খুন করে এসে বলেছেন আল্লাহ তাঁকে খুন করতে বলেছেন, তাই করেছেন। আল্লাহর আদেশের ওপর যে কোনও কথা বলা যাবে না তা আগে ভাগেই অবশ্য বলে রেখেছিলেন। হারেমের এক ডজনেরও বেশি স্ত্রীর সঙ্গে কাটানোর জন্য মোহাম্মদ রাত ভাগ করে নিয়েছিলেন। স্ত্রী হাফসার সঙ্গে যে রাতটি তাঁর কাটাবার কথা, সেদিন তিনি একটি কাণ্ড ঘটিয়েছিলে। সে দিন হাফসা বাপের বাড়ি গিয়েছিলেন কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগে বাড়ি ফিরে দেখেন শোবার ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বন্ধ কেন? ঘরে কে? ঘরে তাঁর পয়গম্বর স্বামী, আল্লাহর পেয়ারা নবী, মোহাম্মদ, মারিয়া নামের এক ক্রীতদাসীর সঙ্গে সম্ভোগে রত। হাফসা রেগে আগুন হয়ে হারেমের বাকি বউদের এ কথা জানিয়ে দিলেন। নিজের দোষ ঢাকতে মোহাম্মদ আকাশ থেকে আল্লাহকে নামালেন, বললেন, এ তাঁর নিজের ইচ্ছেয় ঘটেনি, ঘটেছে আল্লাহর ইচ্ছেয়, আল্লাহর হুকুম তিনি পালন করেছেন, এর বেশি কিছু নয়। বাংলায় একটি কথা আছে, চুরি আবার সিনা জুড়ি। ব্যাপারটি এরকমই। দোষ করার পর কোথায় একটু নতমস্তকে দাঁড়িয়ে নম্রস্বরে কথা বলবেন স্ত্রীদের সঙ্গে, তা নয়, বরং উঁচু গলায় সাবধান বাণী দিয়ে দিলেন সঙ্গে সঙ্গে, আল্লাহ নাকি তাঁকে বলেছেন, ‘যদি তুমি তোমার কোনও স্ত্রীকে তালাক দাও, তবে আল্লাহ তোমার জন্য আরও সুন্দরী, আরও সহনশীল, আরও পবিত্র, আরও নত, আরও লজ্জাবতী, আরও বিশ্বস্ত কুমারী বা বিধবা মেয়ে দেবেন বিয়ে করার জন্য।’ নিজের ছেলের বউ জয়নবকে বিয়ে করেও মোহাম্মদ তাঁর অপকর্মকে জায়েজ করেছেন আল্লাহর ওহি নাজেল করে, আল্লাহ নাকি তাঁকে বলেছেন তাঁর ছেলের বউকে বিয়ে করার জন্য। মোহাম্মদের অল্পবয়সী সুন্দরী এবং বিচক্ষণ স্ত্রী আয়শা চমৎকার একটি কথা বলেছিল, বলেছিল, ‘তোমার প্রভুটি তোমার সব শখ মেটাতে দেখি খুব দ্রুত এগিয়ে আসেন।’ এই আয়শার দিকে তাঁর বন্ধুরা তাকাতো বলে হিংসেয় জ্বলে পুড়ে নিজের স্ত্রীদের পর্দার আড়াল করলেন, এরপর ধীরে ধীরে সব মুসলিম মেয়ের শরীরে বাড়তি কাপড় ঝুলিয়ে দেওয়ার আইন করলেন। ইসলাম নাকি মেয়েদের মর্যাদা দিয়েছে খুব। এই হল মর্যাদার নমুনা। আল্লাহর গমগমে আওয়াজ ভেসে আসে সাত আসমানের ওপর থেকে, ‘পুরুষের অধিকার আছে নারীর ওপর আধিপত্য করার, কারণ আল্লাহ পুরুষকে নারীর চেয়ে উন্নততর মানুষ হিসেবে তৈরি করা করেছেন এবং পুরুষ তার ধন সম্পদ ব্যয় করে।’
কী বলব, এই হল আমাদের পয়গম্বর ব্যাটার চরিত্র, আর তার জোব্বার আড়ালে লুকিয়ে থাকা আল্লাহ নামের ধোঁকা। এই ইসলামকে পৃথিবীর কোটি কোটি বুদ্ধু আজও টিকিয়ে রাখছে, এর পেছনে আর কিছু না, আছে রাজনীতির খেলা।
‘বাংলাদেশের অবস্থাও তথৈবচ। তরী ডুবছে এরশাদের তাই উপায়ান্তর না দেখে ইসলামকে আঁকড়ে ধরে তিনি কূলে ভিড়তে চাইছেন।’
৫৬. যদি
যদি বাংলাদেশের মুসলমানদের বলি—
‘তোমাদের এত যে বিজ্ঞানমনস্ক করতে চাইতাছি, হইবা না, নামাজ রোজা যখন করবাই করো, মসজিদ বানাইবাই যখন বানাও, এমনকি রাষ্ট্রকেও যদি ইসলামিক রাষ্ট্র বানাইয়া ফেল, তাইলেও হিন্দুদের মাইরো না, লক্ষ রাইখো নানান গোষ্ঠী বর্ণ জাত ধর্ম সংস্কৃতির মানুষ যেন শান্তিতে সেই রাষ্ট্রে বাস করতে পারে’।
যদি ভারতের হিন্দুদের বলি—
‘তোমাদের এত যে বিজ্ঞানমনস্ক করতে চাইতাছি, হইবা না, পূজা আচ্চা যখন করবাই করো, মন্দির বানাইবাই যখন বানাও, এমনকি রাষ্ট্রকেও যদি হিন্দুরাষ্ট্র বানাইয়া ফেল, তাইলেও মুসলমানদের মাইরো না, লক্ষ রাইখো নানান গোষ্ঠী বর্ণ জাত ধর্ম সংস্কৃতির মানুষ যেন শান্তিতে সেই রাষ্ট্রে বাস করতে পারে’।
ওপরের দুইটা লেখা পড়লে কি রাগ ওঠে? কার ওপর রাগ ওঠে, লেখকের ওপর, সিস্টেমের ওপর নাকি সরকারের ওপর? যদি কারও ওপর রাগ না ওঠে তাইলে সমস্যা। যদি দুইটার মধ্যে একটার জন্য রাগ ওঠে আরেকটার জন্য ওঠে না, তাইলেও সমস্যা।
৫৭. গির্জা
যেদিন অযোধ্যার রায় বেরোলো, ২০১৯-এর ৯ নভেম্বরে, সেদিনই লিখেছিলাম ”আমি যদি বিচারক হতাম, তাহলে ২.৭৭ একর জমি সরকারকে দিয়ে দিতাম আধুনিক বিজ্ঞান স্কুল বানানোর জন্য, যে স্কুলে ছাত্রছাত্রীরা ফ্রি পড়তে পারবে। আর ৫ একর জমিও সরকারকে দিয়ে দিতাম আধুনিক হাসপাতাল বানানোর জন্য, যে হাসপাতালে রোগীরা বিনে পয়সায় চিকিৎসা পাবে”। আমার এই মতের ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়েছে, আগামী ১০০০ বছরে সম্ভব নয় ধর্মীয় উপাসনালয়ের জায়গায় অন্য কিছু নির্মাণ করা। কেউ কেউ বলেছে, স্কুল, একাডেমি, গবেষণাগার, হাসপাতাল, ফুলের বাগান এগুলো বানানোর জায়গার কি অভাব পড়েছে? তা ঠিক, অভাব পড়েনি। তাই ২.৭৭ একর জমিতে মন্দির হতে যাচ্ছে, আর ৫ একর জমিতে হতে যাচ্ছে মসজিদ। মানুষ প্রার্থনা করবে অলৌকিক ঈশ্বরের কাছে, যে ঈশ্বরের অস্তিত্বের আজও কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
উত্তর-ইউরোপের গির্জাগুলো দেখলে চমকিত হই। খালি পড়ে থাকে বছর ভর। রোববারে হাতে গোণা কয়েকজন আসে কী আসে না। গির্জা চলে পযটকদের জন্য। ওরাই শিল্প স্থাপত্য দেখতে আসে। উপাসনালয়গুলো ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে জাদুঘরে। আমাদের অঞ্চলের উপাসনালয়গুলোয় হয়তো একদিন ভিড় কমতে থাকবে। মানুষ ব্যস্ত থাকবে মানুষের সেবায়। সেবাই তো সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উপাসনা।
৫৮. নিলয় নীল
পাঁচ বছর আগে আগস্ট মাসের সাত তারিখে, এই দিনে, এরকম দুপুরবেলায় বাংলাদেশের নাস্তিক ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় ওরফে নিলয় নীলের ঢাকার ফ্ল্যাটে চার পাঁচ জন মুসলিম সন্ত্রাসী ঢুকে ওকে কুপিয়ে মেরেছিল। নিজের রক্তের ওপর নিথর পড়ে ছিল আমাদের নিলয়। ২০১৫ সালটা ছিল ভয়াবহ। এক এক করে খুন করা হচ্ছিল নাস্তিক ব্লগারদের। অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর বাবু, অনন্ত বিজয়। তারপর নিলয় নীল। পুলিশকে নিলয় জানিয়েছিলেন তিনি নিরাপত্তার অভাব অনুভব করছেন, কারণ তিনি লক্ষ করেছেন কিছু লোক তাঁকে অনুসরণ করছে। এরপরও পুলিশ নিলয়ের জন্য নিরাপত্তার কোনও ব্যবস্থা করেনি। নিলয় দর্শনে মাস্টারস করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, তুখোড় মেধাবী এবং বিজ্ঞানমনস্ক তরুণ ধর্ম বিষয়ে বুদ্ধিদীপ্ত ব্লগ লিখতেন। দুনিয়ার সব ধর্মেরই সমালোচক ছিলেন, কিন্তু একটি ধর্মের সন্ত্রাসীরাই তাঁকে আর বাঁচতে দেয়নি। খুনীদের কি শাস্তি হয়েছিল? না, আজ পর্যন্ত নাস্তিক ব্লগারদের একটি খুনীকেও শাস্তি দেওয়া হয়নি। সরকারের অশেষ কৃপায় তারা নিশ্চয়ই এখন নিরাপদে নিশ্চিন্তে আর বহাল তবিয়তে আছে।
এই আমার সোনার বাংলাদেশ। সোনার ছেলেরা মৃত। দু’একজন ছাড়া কোনও বুদ্ধিজীবীই প্রতিবাদ করেননি ওই সব বীভৎস হত্যাকাণ্ডের। জনগণ ব্লগারদের দোষ দিয়েছিল, ইসলামের সমালোচনা করা ব্লগারদের নাকি উচিত হয়নি, দোষ খুনীর নয়, দোষ নাকি সমালোচনার। ইসলাম নিয়ে প্রশ্ন করলে নৃশংসভাবে খুন হয়ে যেতে হবে, যাওয়া উচিত—অধিকাংশ মানুষের এমনই বিশ্বাস।
মনে আছে ২০১৫ সাল জুড়ে কী ভীষণ উদ্বিগ্ন আমি, দিন রাত ঘুম নেই। অভিজিৎ আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু ছিল, ওয়াশিকুর ছিল আমার ফেসবুকের বন্ধু, অনন্ত ছিল সমমনা যুক্তিবাদী। তখন প্রতিদিন ব্লগ লিখছি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করে, আর বাকস্বাধীনতার পক্ষে চিৎকার করে। আমার ফ্রি থট ব্লগ থেকে ইউরোপ আমেরিকার মুক্তচিন্তক-নাস্তিক মানুষেরা জানতে পারছেন কী ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চলছে বাংলাদেশে। তাঁরাও পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরাও উদ্বিগ্ন। আবেদন করছি বিভিন্ন সংগঠনের কাছে যেন তারা বাংলাদেশের নাস্তিক ব্লগারদের জীবন বাঁচানোর জন্য যা করা দরকার করে। সে বছর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাখারভ পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে দু’দুবার আমি আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম পার্লামেন্টে বক্তৃতা করার জন্য, শুধু তাই নয়, বেলজিয়ামের সেনেট, ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয় এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো বরাবরের মতো আমন্ত্রণ জানিয়েছিল আমাকে সেমিনারে, লেকচারে; প্রতিটি প্লাটফর্ম আমি ব্যবহার করেছি বাংলাদেশের নাস্তিক ব্লগারদের জীবন বাঁচানোর জন্য আবেদন করে, যেন ব্লগারদের বাংলাদেশ থেকে বের করে ইউরোপ-আমেরিকায় নিয়ে আসা হয়। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট এবং সদস্যদের সঙ্গে দিনভর বাইল্যাটারাল মিটিংও করেছি ও নিয়ে। যে সংস্থাগুলো ব্লগারদের ইউরোপে আশ্রয় দিয়েছে, নিরাপদ জীবন দিয়েছে, সেই সংস্থাগুলোর ফাণ্ড ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট থেকে যায়। কী স্বস্তি যে পেয়েছি নাস্তিক ব্লগাররা যখন নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে গেছেন, যে দূরত্বে গেলে ইসলামি সন্ত্রাসীদের হাত তাঁদের নাগাল পায় না। আমি সামান্য মানুষ। ক্ষমতাবান নই, প্রভাবশালী নই। আমার ওই চেষ্টার ফলে কতটুকু কী হয়েছে হিসেব করে দেখিনি। তবে আমার ওই যে ঝাঁপিয়ে পড়া, যে মানুষগুলোর পাশে দেশের কেউ দাঁড়াচ্ছে না, তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের মূল্যবান জীবনকে বাঁচানোর জন্য যে মরিয়া হয়ে ওঠা—এরকম দিন এলে মনে পড়ে সেসব।
মাঝে মাঝে লক্ষ করি বিদেশের নিরাপদ জীবনে বসে কিছু ব্লগার আমার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন। তা করুন। বাকস্বাধীনতার জন্য লড়াই যখন করি, তাঁদের বিষোদ্গার করার স্বাধীনতার জন্যও লড়াই করি। তাঁরা নিরাপদে আছেন, এ ভেবেই আমি সুখী। শুধু আফসোস, নিলয় নীলের জন্য কিছুই করতে পারিনি। পুলিশ যদি নিরাপত্তা দিত, তাহলে হয়তো বেঁচে যেতেন নিলয়। প্রতিভাবান মুক্তচিন্তককে অকালে আমাদের হারাতে হত না। কিন্তু পুলিশ বাহিনী তো কোনও নাস্তিকের জন্যই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেনি। পর পর আরও ক’জন নাস্তিককে হত্যা করা হয়েছে। তাঁদের রক্তের ওপর ইসলামের বিজয় নিশান সেই যে ওড়ানো হয়েছে, এখনও উড়ছে সেই নিশান। আমার সোনার বাংলার নিশান!
৫৯. দেওয়ালে পিঠ
ধর্মান্ধ বদগুলো যেমন তক্কে তক্কে থাকে আমার স্খলন কিছু হল কিনা দেখার জন্য, যেন খপ করে ধরে দামামা বাজিয়ে আমার আরও কিছু সর্বনাশ করতে পারে, তেমন সেক্যুলার নামধারী কিছু হিন্দু-মুসলমানও একই মতলব নিয়ে তক্কে তক্কে থাকে। এরকম কিছু গতকাল ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমার পোস্টের ওপর। কী পেয়েছে তারা? ‘কম্প্রোমাইজ’। তসলিমা কম্প্রোমাইজ করে না বলেই লোকে জানে, এই জানাটাকে যদি গুঁড়িয়ে দেওয়া যায়, তবেই না আনন্দ! দুদিন আগে তসলিমা যুক্তিবাদ আর নাস্তিকতার পক্ষে পোস্ট দিয়েছে, তার আগের দিন ধর্মের রূপকথাকে নস্যাৎ করে। আজ তসলিমা ‘সাম্প্রদায়িক’! যারা অভিযোগ করছে তারা নিশ্চয়ই আমার চেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক, আমার চেয়েও বড় সেক্যুলার, বা আমার চেয়েও বড় নাস্তিক, আমার চেয়েও বড় মানববাদী, আমার চেয়ে বেশি ভুগেছে নিজের মতবাদের জন্য, সাম্প্রদায়িকতা আর ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে আমার চেয়ে বেশি বই লিখেছে, আমার চেয়েও বেশি ফতোয়ার শিকার তারা, তাদের মাথার দাম আমার মাথার দামের চেয়ে বেশি, আমার চেয়েও বেশি তারা গৃহহীন, দেশহীন, আমার চেয়েও বেশি নিষিদ্ধ!!
এরাই তো বলে লজ্জা লিখে বিজেপির কাছ থেকে টাকা পেয়েছি, যেন লজ্জা লেখার আর কোনও কারণ ছিল না, যেন ভয়ানক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর হিন্দুদের দেশত্যাগ যথেষ্ট কারণ নয় লজ্জা লেখার জন্য! এরা বিশ্বাসই করতে পারে না স্বার্থের জন্য নয়, আদর্শের জন্য কেউ কেউ জীবন বাজি রাখতে পারে। মুসলিম মৌলবাদীরা আমার মাথার দাম ঘোষণা করলে এরাই তো দূর থেকে সার্কাস দেখে, প্রতিবাদের একটি শব্দও উচ্চারণ করে না। যখন দেখে বিজেপি ক্ষমতায় এসে আমার এক বছরের ভিসার মেয়াদ কমিয়ে দু’মাস বা তিন মাস করে, তখন কি এরা নিন্দে করে বিজেপির তসলিমা-বিরোধিতার? না। যখন করভাচৌত, সিঁদুর খেলা, রাখি নিয়ে প্রশ্ন করে, ভাইফোঁটার মতো বোনফোঁটা উদ্যাপন করার কথা বলে, মনুসংহিতার সমালোচনা করে, সতীদাহের নিন্দে করে, যখন রামদেব, সত্য সাঁই বা বাবাদের নিয়ে সংশয় প্রকাশ ক’রে, অযোধ্যার রামমন্দিরের জায়গায় বিজ্ঞান স্কুলের এবং মসজিদের জায়গায় আধুনিক হাসপাতালের প্রস্তাব দিয়ে প্রচণ্ড আক্রান্ত হই কট্টর হিন্দু দ্বারা, তখনও আমাদের ‘সেক্যুলার হিন্দু-মুসলমান’ চোখ নাচিয়ে সার্কাস দেখে।
মসজিদ বানানো হলে কটা ‘সেক্যুলার হিন্দু মুসলমান’ প্রতিবাদ করে? নিশ্চয়ই একটিও না। তাহলে হিন্দুরা তাদের মন্দির বানালে এত গেল গেল রব কেন? হিন্দুদের মহাসমারোহে মন্দির বানানো, ধর্মান্ধ হওয়া, মুসলিম-বিরোধিতা সবই এই সময়ের বাস্তবতা। ভুলে গেলে চলবে না এই উপমহাদেশ হিন্দু মুসলমান পরস্পরকে কচুকাটা করে দেশভাগ করেছে। দশ লক্ষ মানুষের রক্তের ওপর বসানো হয়েছে বিভেদের কাঁটাতার। বাংলাদেশের মসজিদ, হিজাব, বোরখা, হিন্দু-বিরোধিতাও এই সময়ের বাস্তবতা। এই বাস্তবতা তৈরিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা উপমহাদেশের স্বার্থান্বেষী দূরদৃষ্টিহীন রাজনীতিকদের। এই দুঃখজনক বাস্তবতার মধ্যে বর্বরতা আর হিংস্রতা যত কম হয়, সেই চেষ্টা করতে হয়।
মাদ্রাসার ইমাম যখন ধর্ষণ করে, তখন বলি, মাদ্রাসায় যেন আর একটিও ধর্ষণ না হয়। আমি মাদ্রাসা বিলুপ্ত করার কথা না বলে ধর্ষণ বন্ধ করার কথা বলেছি, তার মানে এই নয় যে আমি মাদ্রাসা সিস্টেমে বিশ্বাস করি। কোথাও নারী নির্যাতন হলে বলি নারী নির্যাতন বন্ধ করো। কমিউনিস্টরা যেমন বলে—”নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার দরকার নেই, কমিউনিজম এলে নারী নির্যাতন এমনিতেই বন্ধ হবে’, তেমন করে বলি না ‘আগে পুরুষতন্ত্র বিলুপ্ত হোক, তখন নারী নির্যাতন এমনিতেই বন্ধ হবে’। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চলতে থাকলেও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আলাদা করে প্রতিবাদ করতে হয়।
মন্দির বানানো বন্ধ করো বললেই মন্দির বানানো বন্ধ হয় না, ঠিক যেমন মসজিদ বানানো বন্ধ করো বললেই মসজিদ বানানো বন্ধ হয় না কোথাও। ধর্ম বিলুপ্ত হোক বলে চেঁচালেও ধর্ম অদূর ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হবে না। তার চেয়ে ধর্মে ডোবা এই সমাজ থেকে যেন যুক্তিবাদি আর মুক্তচিন্তকের জন্ম হয়, সেই চেষ্টা করি। এই যুক্তিবাদিরাই একদিন সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে, সমাজ বদলাবে—এই স্বপ্ন নিয়ে।
এদেশে ধর্ম এবং কুসংস্কার প্রায় সবাই মানে। শিক্ষিত অশিক্ষিত সবাই। শনি-মঙ্গল-বৃহস্পতিবারে আমিষ খায় না, একশো রকম পুজো আচ্চায় উপোস করে, বারো মাসে তেরো নয়, তেরোশো পুজোর আয়োজন করে। গাছের গায়ে লাল দাগ দেখলেও নমস্কার করে। দোকানীরা দোকান খুলে টাকার পুজো আগে সেরে নেয়। বিজ্ঞানীরাও গাড়ি কিনে গাড়ির পুজো করে তারপর গাড়ি চালায়। এটাই বাস্তবতা। রাম মন্দির ঠিক সেরকমই বাস্তবতা। বাংলাদেশে পাড়ায় পাড়ায় একশ মসজিদ যেমন বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মানুষকে ধর্মবিমুখ করা, বিজ্ঞান মনস্ক করা দীর্ঘ মেয়াদি সংগ্রাম। আপাতত কী করতে হবে? যেন হিন্দু মুসলমান পরস্পরকে কচুকাটা না করে, কেউ কাউকে নির্যাতন না করে, যেন ভায়োলেন্স থেকে বিরত থাকে, যেন ঘৃণা দূর করে মন থেকে, যেন বিদ্বেষ বিদেয় করে। তুমি যখন ধর্ম মানবেই, মন্দির মসজিদ বানাবেই, সংখ্যাগরিষ্ঠের মত নিয়ে রাষ্ট্রকে ধর্মভিত্তিকও যদি করে ফেলো, বিধর্মীদের নির্যাতন কোরোনা, পারলে সৌহার্দের সম্পর্ক রেখো।
দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে দাবির প্রশ্ন অবান্তর, করজোড়ে শুধু অনুরোধ করা যায়।
৬০. ভূমি পূজা
ভূমি পূজা দেখলাম, যেমন কাবা পরিক্রমণ দেখি, মিনা শহরের দেওয়ালে শয়তানের উদ্দেশে পাথর ছোড়া দেখি, সেন্ট প্যাট্রিক ডে’র প্যারেড দেখি, গির্জার সারমন দেখি, পুরোনো জেরুজালেম শহরের ওয়েস্টার্ন ওয়ালে ইহুদিদের মাথা ঠোকা দেখি। ওইসবে অংশগ্রহণ আমার কাজ নয়, অবলোকন আমার কাজ। রাম মন্দির তৈরি হচ্ছে বলে আমি শোক করছি না, সুখও করছি না। ভারতের হিন্দুদের অধিকাংশই চাইছে রাম মন্দির তৈরি হোক, সুতরাং তৈরি হোক। দুনিয়াতে একেশ্বরবাদের ভিড়ে এবং আধিপত্যে এখনও একটি প্রাচীন বহুঈশ্বরবাদ নানা ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যে টিকে আছে। টিকে থাকা একটা চ্যালেঞ্জ বটে। টিকে থাকুক।
ইতিহাস জুড়ে কত যে গির্জাকে মসজিদ করা হয়েছে, ফের মসজিদকে গির্জা করা হয়েছে, কত যে সিনেগগকে মসজিদ করা হয়েছে, আবার মসজিদকে সিনেগগ। কত যে হিন্দুর, আর জোরোস্ত্রিয়ানদের মন্দিরকে ভেঙে মসজিদ করা হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। কাবাই তো ছিল মক্কার বহুঈশ্বরবাদীদের মন্দির। শেষ নবী মুহম্মদ সেই মন্দিরের ৩৬০টি দেব দেবীর মূর্তি ভেঙ্গে কাবা দখল করে নেন। যে-ই ক্ষমতা দখল করেছে কোনও অঞ্চলের, সে-ই সেই অঞ্চলে তার বিশ্বাসের ইমারত নির্মাণ করেছে। কোথায় এখন অলিম্পিয়া পর্বতের সেই দেবতারা, কোথায় শক্তিশালী রোমান ঈশ্বরেরা! কোথায় মিশরের দেবদেবী? সবই বিলুপ্ত। এক ধর্ম সরিয়ে আরেক ধর্ম এসেছে, এক ধর্মের উপাসনালয় আরেক ধর্মের উপাসনালয়ে পরিণত হয়েছে। স্পেনের আন্দালুসিয়া অঞ্চল দখল করার পর গির্জাগুলোকে মসজিদ বানিয়েছিল মুসলমান শাসকেরা। কয়েক শতক পর মুসলমানরা যুদ্ধে পরাজিত হলে মসজিদগুলোকে ফের গির্জা বানিয়েছে স্পেনের খ্রিস্টান শাসক। এভাবেই চলছে জগৎ। কোনও একদিন রোবটেরা যদি দখল করে নেয় পৃথিবী, বা কোনও এলিয়েন, তাহলে আমাদের মন্দির মসজিদ, গির্জা প্যাগোডা, সিনেগগ গুরুদুয়ারাকে কী বানাবে ওরা কে জানে, হয়তো নাটবল্টুর ওয়্যারহাউজ।
ভারতের হিন্দুরা এখন যদি মুসলমানরা যেমন পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ গড়ে তোলে, তেমন মন্দির গড়ে তোলে পাড়ায় পাড়ায়, তাহলে আপত্তি করার তো কিছু নেই! মুসলমানদের মতো আপাদমস্তক ধার্মিক এমনকি ধর্মান্ধ হওয়ার অধিকার তাদেরও আছে। হিন্দু হলে সেক্যুলার হতে হবে, কে দিব্যি দিয়েছে! আসলে সেক্যুলার নামধারী যারা আছে ভারতবর্ষে, তারা হিন্দু মুসলমান যে-ধর্মেরই হোক না কেন, ধর্মে তাদের গভীর বিশ্বাস। এদেশে নাস্তিক খুব চোখে পড়ে না।
ইসলাম ধর্ম যেমন শেখায় বিধর্মীদের কাছ থেকে দূরে থাকতে, অবিশ্বাসী আর অমুসলিমদের পেছন থেকে হাত পা কেটে ফেলতে, তেমন শিক্ষা হিন্দু ধর্মের লোকেরা তাদের ধর্মগ্রন্থ থেকে পায় না। তেমন শিক্ষা বাইবেল থেকেও ইহুদি আর খ্রিস্টানরা পায় না। তেমন শিক্ষা বৌদ্ধরাও তাদের ত্রিপিটক থেকে পায় না। এখন যদি হিন্দুরা বিধর্মীদের বা অহিন্দুদের ধরে ধরে হত্যা করে, তাহলে বুঝতে হবে তারা তাদের ধর্মের শিক্ষার বাইরে গিয়ে হত্যা করছে। তারা মুসলমানের ধর্মগ্রন্থকে নিজের ধর্মগ্রন্থ ভাবছে, তারা ইসলাম থেকে প্রেরণা পাচ্ছে, বা মুসলিম সন্ত্রাসীদের তারা আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করছে।
হিন্দুরা নিজ ধর্মে ডুবে থাকতে চাইলে ডুবে থাক। এভাবেই বিরুদ্ধ স্রোতে ধর্মকে তারা বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সাচ্চা হিন্দু হওয়া জরুরি, সাচ্চা মুসলমান নয়। এই উপমহাদেশে বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া সহজ নয়। এখানে বিজ্ঞানীরাও বিজ্ঞানমনস্ক নয়। এখানে সাচ্চা কমিউনিস্টরাই সাচ্চা ধার্মিক। আপাতত ভায়োলেন্স আর ঘৃণাকে সমস্ত মনোবল দিয়ে দূরে রাখুক। হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খিস্টান সকলে। যদি ভারতবর্ষ একদিন হিন্দু রাষ্ট্র হয়ে ওঠে, তাহলেও যেন মুসলমানদের রাষ্ট্রের মতো সেই রাষ্ট্র না হয়, যেন নানা গোষ্ঠীর নানা বর্ণের নানা জাতের নানা মতের নানা বিশ্বাসের নানা ধর্মের নানা সংস্কৃতির সৌহার্দপূর্ণ সহাবস্থানে সমৃদ্ধ হয় সেই রাষ্ট্র।
৬ ১. ফ্যাক ফ্যাক
আমি লক্ষ করেছি আমি যখন করোনা ভাইরাস থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চাই, তখন কিছু ধার্মিক লোক ফ্যাক ফ্যাক করে হাসে আর বলে, নাস্তিক হয়েও মৃত্যুকে ভয় পায়। যেন তরবারির সামনে গিয়ে বুক পেতে দেওয়াই নাস্তিকদের জন্য সঠিক কাজ। আরে বাবা, নাস্তিক বলেই তো জীবন বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করি, কারণ নাস্তিক বলেই জানি পরকাল আর পুনর্জন্ম বলে কিছু নেই, জীবন একটাই, জীবন যেহেতু একটাই জীবন খুব মূল্যবান, মৃত্যুকে যত বাধা দেওয়া যায় তত ভালো কারণ মৃত্যুতেই ঘটে মূল্যবান জীবনটির সমাপ্তি।
যারা পরকালে আর পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে, মৃত্যুকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই তাদের, কারণ তারা বিশ্বাস করে মরে গেলেও আবার তারা একদিন ঠিকই বেঁচে উঠবে। ধার্মিকদের কাছে ইহকালের চেয়ে পরকালের মূল্য বেশি, তাই তারা ইহকালে হেন মন্দ কাজ নেই যে করে না। ইহকালের পাপের শাস্তি পরকালে পেতে হবে বলে তাদের খুব একটা ভয় থাকার কারণও নেই। কারণ ইহকালে যত রকম অন্যায় আছে ক’রে একসময় আকাশে বসে থাকা ওপরওয়ালার গুণগান গেয়ে তার কাছে ক্ষমা টমা চেয়ে নিজের আখের গুছিয়ে নিতে পারার সুযোগ তাদের আছে।
নাস্তিকদের মধ্যে বদ লোক যে একেবারে নেই তা নয়। তারাও বদ কর্ম করে আস্তিকদের মতো। তবে নাস্তিকদের মধ্যে যারা ভালো কাজ করে, তারা পরকালে পুরস্কার পাওয়ার জন্য ভালো কাজ করে না। তবে আস্তিকরা যারা ভালো কাজ করে সবই কিন্তু পুণ্যের লোভে, পরজন্মে বা পরকালে রিওয়ার্ড পাওয়ার আশায়। এই পার্থক্যটা বোঝা কিন্তু জরুরি। একজন নিঃস্বার্থ ভাবে ভালো কাজ করছে, আরেকজন স্বার্থের জন্য করছে।
৬২. বিশ্বাস
অনেকে বিশ্বাস করে হনুমান কাঁধে করে গোটা গন্ধমাদন পর্বত নিয়ে এসেছিল, মুসার আদেশে সমুদ্র দু’ভাগ হয়ে গিয়েছিল, যীশু সমুদ্রের ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলেন, মুহম্মদ ডানাওয়ালা ঘোড়ায় চড়ে আকাশে উড়ে গিয়ে বেহেস্ত আর দোযখ দেখে এসেছিলেন, আল্লাহর সঙ্গেও বাৎচিত হয়েছিল তাঁর।
বিশ্বাস একটা অদ্ভুত জিনিস। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার জজ ব্যারিস্টার হলেই যে অলৌকিকতা থেকে বিশ্বাস চলে যাবে, তা কিন্তু নয়।
ছোটরা রূপকথা পড়ে ভালোবেসে, বড়রা রূপকথা পড়ে ভয়ে। আমি ছোটদের রূপকথায় বিশ্বাসী, কারণ ওই রূপকথা হার্মলেস।
৬৩. কাঁদা
আমি কাঁদলে লোকে বলে, কাঁদা নাকি আমাকে মানায় না। কেন মানায় না? আমি স্ট্রং, তাই। স্ট্রং হলে দুঃখে কষ্টে কাঁদতে নেই, এই ধারণা থেকেই মানুষ পুরুষলোক কাঁদছে এই দৃশ্য দেখতে চায় না। ছিঃ ছিঃ, পুরুষ হয়ে মেয়েদের মতো কাঁদছে কেন! স্ট্রং মেয়েরা, জীবনে যা কিছুই ঘটুক, কাঁদবে না। কাঁদলে তাকে আর স্ট্রং মনে হয় না। আর পুরুষ মাত্রই, যেহেতু বিশ্বাস করা হয়, সবাই স্ট্রং। তাই কোনও পুরুষ কাঁদলে তাকে আর ‘পুরুষ’ বলে মনে হয় না। কাঁদাটা কাদের জন্য? নরম কোমল সেন্সিটিভ মেয়েদের জন্য।
দুঃখে কষ্টে যন্ত্রণায় বেদনায় কোমল এবং কঠিন মানুষ কাঁদে, লিঙ্গ নির্বিশেষে কাঁদে, কাঁদাটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের সমাজে ছোটবেলা থেকেই ছেলেরা না কাঁদতে শেখে। বাবা মারা শেখায়। ছেলে হয়ে জন্ম নিলে নাকি কাঁদতে হয় না।
যারা কাঁদে না, তাদের আমার খুব ভয়ংকর মানুষ বলে মনে হয়। আবেগ কি পুরুষের নেই? নিশ্চয়ই আছে। যে আবেগ থেকে রাগ ঘৃণা প্রতিশোধস্পৃহা, হাসি খুশি আনন্দ ইত্যাদি উৎকটভাবে প্রকাশিত হয়, সে আবেগ থেকেই তো মানবিক ক্রন্দন উঠে আসার কথা।
অন্যের জন্য কাঁদার মতো সুন্দর কী আছে জগতে! মুসলমানেরা দেখলাম কাঁদার বিরুদ্ধে। আমার মা যখন মারা গেল, লক্ষ্য করলাম, যারা মা’কে হারিয়ে চিৎকার করে কাঁদছিল, তাদের থামিয়ে দিল কিছু সাচ্চা মুসলমান। তাদের ভাষ্য, ‘আল্লাহর বান্দাকে আল্লাহ দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলেন, আল্লাহ এখন নিয়ে যাচ্ছেন। শব্দ করে কাঁদলে আল্লাহ নারাজ হবেন, যদি নিতান্তই কাঁদতে হয়, নীরবে কিছুটা চোখের জল ফেলো, ব্যস’।
ধর্মের নামে, পুরুষতন্ত্রের নামে, মানুষের ভালোবাসা আর আবেগের মতো গুণগুলোকে বিদেয় করার চেষ্টা চলছে, মানুষকে পাথর বানাবার চেষ্টা চলছে। যে যত পাথর সে তত পুরুষ সে তত স্ট্রং! যুক্তিবাদীদের কাঁদতে নেই কে বললো! আবেগে কাঁদার পর মানুষের ব্যাথা বেদনা কম হয়, টেনশান কমে, মন ভালো হয়, চোখের স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। যুক্তিবাদীরা এই বেনেফিটটা বোকার মতো হারাবে কেন?
আমি যখন মা’কে নিয়ে আমার ‘নেই কিছু নেই’ বইটি লিখছিলাম, লেখার সময় আমি প্রতিদিন মা’র জন্য কাঁদতাম, মা’র না থাকার কষ্টে কাঁদতাম। বইটি লেখার পর আমার কী যে ভালো লেগেছে তা বোঝাতে পারবো না। কান্না আমাকে সেই ভালো লাগা, সেই প্রশান্তি দিয়েছে।
৬৪. মনুষ্যত্ব
খুব খুব খুবই ভালো ফিল্ম না হলে আমি দেড় দু’ঘণ্টা সময় নষ্ট করি না। বাংলা আর হিন্দি ফিল্ম দেখতাম কিশোর বয়সে, পৃথিবীর ভালো ফিল্মের স্বাদ পেয়ে যাওয়ার পর খুব বেছে ছবি দেখি। বাংলা হিন্দি একেবারেই দেখা হয় না এখন তা নয়, দেখা হয়, যদি খুব খুব ভালো হয় সেসব। ‘দিল বেচারা’ আমার দেখার কথা নয়। সাধারণ মানের ছবি এটি। কিন্তু দেখলাম সুশান্ত সিং রাজপুতের জন্য। প্রচণ্ড প্রতিভাধর একজন শিল্পীর চলে যাওয়া, তাও আবার আত্মহত্যা করে, খুব স্বাভাবিক, কষ্ট দেয়। দিল বেচারাতেও সুশান্ত প্রমাণ করেছেন স্ক্রিপ্ট যেমনই হোক, ছবি যে মানেরই হোক, উনি খুব বলিষ্ঠ অভিনেতা। ইমানুয়েল রাজকুমার জুনিওরের চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুশান্ত। যখন ইমানুয়েল মারা যায়, চোখে আমার জল জমে একাকার। আমি বুঝিনি এই জল কি ছবির ইমানুয়েল চরিত্রটির মরে যাওয়ার কারণে, নাকি ওই চরিত্রে অভিনয় করা বাস্তবের সুশান্ত সিং রাজপুতের মরে যাওয়ার কারণে!
ক্যান্সার রোগটি আমার ফ্যামিলিতে। আমার মা, দাদা, মামা, কাকা সব ক্যান্সারে গেছেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই কোনও ক্যান্সারে আক্রান্ত মানুষের কথা শুনলে বা পড়লে সে ফিকশান হলেও, এমনকি পর্দায় তাদের দেখলেও, সে ফিচার ফিল্ম হলেও, অভিনয় হলেও, চোখ আমার ভিজে ওঠে। জানি সবাই আমরা মরে যাবো, তারপরও প্রিয়জনদের তো বটেও অন্য কারোর অকাল মৃত্যুই, এমন কী অচেনা কারোর, মেনে নিতে কষ্ট হয়। আমরা তো এখন মৃত্যুপুরীতে বাস করছি। প্রতিদিন খবর আসছে মৃত্যুর। মৃত্যু দেখতে দেখতে আমাদের তো অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার কথা। আমি কেন এখনও অভ্যস্ত হচ্ছি না বুঝি না! এখনও আমার দিল বেচারা বেদনার দৃশ্য দেখলে ককিয়ে ওঠে। মানুষের জন্য মানুষের এই অনুভূতি, এর নামই হয়তো মনুষ্যত্ব। এই মনুষ্যত্ব বাদ দিলে মানুষ নামক প্রাণীর বিশেষ কিছু অবশিষ্ট থাকে না।
৬৫. আত্মা
কোনও এক স্টিভ হাফ দাবি করছেন তিনি নাকি সুশান্ত সিং রাজপুতের ‘আত্মা’র সঙ্গে কথা বলেছেন। ভিডিওও পোস্ট করেছেন দুখানা। মানুষ তো হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, বিশ্বাসও করছে আজগুবি কথোপকথন। কবে যে বিজ্ঞানমনস্ক হবে মানুষ, কবে যে ভূত প্রেত, আত্মা ফাত্মা ইত্যাদির যে অস্তিত্ব নেই বুঝবে। হয়তো এমনই হওয়ার। কিছু লোক বুঝবে, কিছু লোক বুঝবে না, হয়তো কেউ পরে বুঝবে, কেউ আবার কোনওদিনই বুঝবে না। মানুষ সব এক নয়। কমিউনিজম সব মানুষকে এক করতে চেয়েছিল, যাদের আছে তারা দেবে, যাদের নেই, তারা খাবে। এতে কিছু লোক রাজি হলেও সব লোক রাজি হয়নি। সব লোক সব কিছুতে এক মত হয় না। এই ভয়ংকর করোনার দুর্দিনে যখন প্রাণে বাঁচার জন্য মাস্ক পরা সবার জন্য অত্যন্ত জরুরি, তখন কিছু লোক রাস্তায় নেমেছে মাস্ক পরবে না ঘোষণা দিয়ে। মানুষ চাঁদে গেলেও কিছু মানুষ থাকে বিশ্বাস না করার যে মানুষ চাঁদে গিয়েছে। আকাশে কোনও ঈশ্বর বসে আছে, এর প্রমাণ আজও মেলেনি। তারপরও ঈশ্বরে বিশ্বাসী মানুষের অভাব নেই। কোনও পুনর্জন্ম নেই, কোনও পরকাল নেই। মানুষকে কেউ সৃষ্টি করেনি—বহু আগেই বিবর্তন তত্ত্ব তা বুঝিয়ে দিয়েছে। তারপরও কিছু মানুষ বিশ্বাস করবেই এসব। ভূত পেতনি, আত্মা—এসব মানুষের কল্পনা থেকে রচিত। আর এগুলোকে সত্যি বলে মেনে এই বিজ্ঞানের যুগেও মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে ‘আত্মা’র কথা শুনতে। এরা আছে বলেই স্টিভ হাফের মতো লোক-ঠকানোর ব্যবসায়ীরা করে খাচ্ছে। পৃথিবী এমনই, বিজ্ঞান আর অবিজ্ঞানের, সংস্কার আর কুসংস্কারের, বুদ্ধিমান আর মূর্খের, সত্য আর মিথ্যের, যুক্তি আর বিশ্বাসের মিশেল।
৬৬. প্লাজমা
প্লাজমা বিক্রি হচ্ছে লাখ টাকায়। চার লাখ, পাঁচ লাখ। হাসপাতালের আইসিইউতে কোনও রোগীকে বাঁচানোর জন্য প্লাজমা দরকার। কোথায় করোনা থেকে সুস্থ হওয়া লোকেরা নিজের প্লাজমা দান করতে হাজির হবে, না, তারা প্লাজমার বিনিময়ে মোটা অংকের টাকা হাঁকছে। টাকাটা না দিতে পারলে রোগী মারা যাবে। এতে এন্টিবডিতে ভরপুর এমন প্লাজমা নিয়ে যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার কিছু যায় আসে না। মানুষ মরে গেলে মরে যাক। তার টাকা চাই। টাকা টাকা টাকা। পৃথিবীতে মানুষের ভবিষ্যৎ যত অন্ধকার হচ্ছে, যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে, তত সেই ভবিষ্যতে সুখভোগের জন্য ধন দৌলত জড়ো করছে মানুষ। যে গরিব লোকটি প্লাজমা দান করবে, তাকে বিত্তবানদের সাহায্য করা দরকার। কিন্তু জীবন নিয়ে বেচাকেনা বন্ধ হোক। আমার ভয় হয় করোনার ভ্যাক্সিন এলেও কেউ কেউ গুদামজাত করবে ভ্যাক্সিন, তারপর আকাশছোঁয়া দামে বিক্রি করবে। ৭.৮ বিলিয়ন লোক এই পৃথিবীতে। সবার জন্য ভ্যাক্সিন তৈরি করতে কমপক্ষে তিন বছর লাগবে। এই তিন বছরে কি নকল ভ্যাক্সিন বের হবে না? মানুষের চরিত্র সম্পর্কে যতটা ধারণা পেয়েছি, তাতে মনে হয় বের হবে। একেবারে দেখতে আসল টিকার মতো। মানুষ ভুল করে কিনবে, টিকা নেবে, বিশ্বাস করবে সে এখন নিরাপদ, আসলে নয়, যে কোনও সময় করোনায় আক্রান্ত হবে।
দুর্যোগের সময়, আকালের সময়, মানুষ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়, এ কথা আমি আগে বিশ্বাস করতাম, এখন আর করি না। মানুষের চরিত্রের যে মন্দ দিক, তা যেন তখন আরও উলঙ্গ হয়ে বেরিয়ে আসে।
পৃথিবীর সব দেশেই ইউনিভার্সাল ভ্যাক্সিনেশান প্রোগ্রাম আছে। প্রতিটি দেশের সরকারই বিনামূল্যে জনগণকে ভ্যাক্সিন দেয়। রোগশোক দূর করার জন্য, মানুষকে বাঁচাবার জন্য। সরকারের হাতের বাইরে যেন করোনার ভ্যাক্সিন চলে না যায়। তাহলে মহা বিপদ।
৬৭. সেনা
বাংলাদেশে চৌধুরি হাসান সারোয়ার্দি নামে এক লেফটেন্যান্ট জেনারেলকে সেনানিবাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁর অপরাধ, বলা হয়েছে, ১। একাধিক নারীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, ২। স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়েছে। ৩। ডিভোর্সের পর দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। তবে বিয়ের আগে সেই নারীর সঙ্গে মেলামেশা করেছে, এমনকি তাকে নিয়ে বিদেশে বেড়াতে গিয়েছে। ৪। যাকে বিয়ে করেছে, সে এক বিতর্কিত নারী।
সেনাবাহিনী জিনিসটা আমি পছন্দ করি না। অস্ত্রটস্ত্র আমার একেবারেই ভালো লাগে না। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর লোকদের তো করার কিছু নেই, ক্যু করা ছাড়া আর বসে বসে সস্তায় খাওয়া ছাড়া আর বোকা-সুন্দরীদের বিয়ে করা ছাড়া। এই লেঃ জেনারেলকে কোনও কারণে অন্য সেনাদের পছন্দ নয়, তাঁকে তাই লাথি মেরে তাড়িয়েছে। কিন্তু যে কারণগুলো বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে, তা যদি সত্যি হয় তবে সত্যিই চিন্তার বিষয়। চিন্তার বিষয় এই জন্য যে, এগুলো অতি স্বাভাবিক ঘটনা, এগুলো কোনও অন্যায় নয়, কোনও অপরাধও নয়। সবারই অধিকার আছে ডিভোর্স করার, প্রেম করার, প্রেমিক বা প্রেমিকার সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর, পুনরায় বিয়ে করার, যাকে খুশি তাকে বিয়ে করার। লক্ষ্য করেছি বিবৃতিতে যত না ঘৃণা প্রকাশ হয়েছে লেঃ জেনারলের প্রতি, তার চেয়ে বেশি উনি যে নারীদের সঙ্গে সম্পর্ক করেছেন, তাদের প্রতি।
দেশটা মানুষ হল না।
৬৮. মাস্ক
যারা মাস্ক পরছে, তারা অনেকে মনে করে তারা বোধহয় নিজেকে করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা করার জন্য মাস্ক পরছে। আসলে মাস্ক কিন্তু অন্যকে রক্ষা করার জন্য, নিজেকে নয়। যারা করোনায় আক্রান্ত, উপসর্গ থাকুক বা না থাকুক, তারাই যেহেতু ভাইরাস ছড়ায়, তারা ঠিকঠাক অর্থাৎ কোনও ফাঁক টাক না রেখে মাস্ক পরলে তাদের হাঁচি কাশি কথা আর নিঃশ্বাসের সঙ্গে যে বড় এবং ছোট ড্রপলেট বেরোবে, তা ছুটে বেরোতে পারবে না, মাস্কে অনেকটাই আটকা পড়বে। ড্রপলেটগুলোই যেহেতু ভাইরাস বহন করে, ড্রপলেট না বেরোলে অন্যরা ভাইরাস থেকে বাঁচবে।
কেন মাস্ক অন্যকে রক্ষা করার জন্য, নিজেকে রক্ষা করার জন্য নয়? কারণ বাতাসে ভাসা ছোট ড্রপলেটগুলো নিজের সার্জিক্যাল মাস্ক বা কাপড়ের মাস্ক দিয়ে ঠেকানো যায় না। নিজেকে অন্যের মুখ থেকে বেরোনো ছোট ড্রপলেটে চড়ে যে ভাইরাস আসে, তা থেকে রক্ষা করতে গেলে এন৯৫ রেস্পিরেটর পরতে হয়। এই রেস্পিরেটর ল্যাবে যে বিজ্ঞানীরা ভাইরাস নিয়ে কাজ করছেন, যে ডাক্তাররা সারাক্ষণ হাসপাতালে করোনা রোগীদের মধ্যে কাটাচ্ছেন তাঁদের জন্য দরকার। তাঁরা এন৯৫ ব্যবহারের নিয়ম কানুন জানেন। এই রেস্পিরেটর কখন পরতে হয়, কীভাবে পরতে হয়, রেস্পিরেটরের কোথায় স্পর্শ করা যায়, কোথায় যায় না, কীভাবে একে ফেলতে হয় তাঁরা জানেন। সাধারণ মানুষ এন৯৫ রেস্পিরেটর ব্যবহার করলে বিপদে পড়তে পারেন। কারণ অনেক সময় এই রেস্পিরেটরই শ্বাসকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
রেস্পিরেটর, সার্জিক্যাল মাস্ক এগুলো কিন্তু একবার ব্যবহারের পর ফেলে দিতে হয়। প্রশ্ন হল, কেন মাত্র একবার ব্যবহার, কেন বারবার নয়। একবার ব্যবহার করার পর মুখের ব্যাক্টেরিয়াগুলো বের হয় মাস্কে জমা হয়, নিজের ঘামের সঙ্গে মিশে, ব্যাক্টেরিয়াগুলো সংখ্যায় বাড়তে থাকে। আবার সেটি পরলে ব্যাক্টেরিয়ার স্তূপ মুখে ঢুকে শ্বাসনালীতে চলে গিয়ে ইনফেকশান ঘটায়। সার্জিক্যাল মাস্ক ধোয়ার জন্য নয়। কিন্তু কাপড়ের মাস্ক ধুয়ে পরিষ্কার করে বারবার পরা যায়। যারা কাপড়ের মাস্ক পরেন, তাদের প্রতিদিন সাবান দিয়ে সেটি ধুয়ে শুকিয়ে তারপর কিন্তু পরতে হবে, এতে মুখের ব্যাক্টেরিয়াগুলো কাপড় থেকে দূর হবে।
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হয় কেন? বলা হয় কারণ করোনা আক্রান্ত কারও মুখের মাস্কে যে ছোট ড্রপলেটগুলো আটকা পড়ে না, তারা অনেকটা দূর পর্যন্ত ভেসে যেতে পারে। আগে বলা হত ৬ ফুট, দেখা গেছে তার চেয়েও বেশি দূর ভাইরাস যায়। কতক্ষণ বাতাসে থাকে ভাইরাস? ১৬ ঘণ্টা। এইজন্যই এই করোনা ভাইরাসকে বায়ু বাহিত বলা হচ্ছে। বায়ু বাহিত বলেই এই ভাইরাস এমন ভয়ানক সংক্রামক।
আমরা কেন বাইরে থাকা আসা সবকিছু ধুয়ে নিই? ধুয়ে নিই, কারণ জিনিসপত্রের গায়ে মানুষের মুখ থেকে বড় ড্রপলেট ছিটকে পড়তে পারে। যাদের শরীরে করোনা আছে, তাদের ড্রপলেটে থাকবে ভাইরাস। বড় ড্রপলেটে ২০,০০০ পর্যন্ত ভাইরাস থাকতে পারে। ছোট ড্রপলেট যেগুলো বাতাসে ভাসে, সেগুলোয় কম থাকে ভাইরাসের সংখ্যা। বড় ড্রপলেটগুলো বাতাসে ওড়ে না, তারা শুধু কোনও কিছুর গায়ে সেঁটে থাকে। সেইজন্যই সাবান দিয়ে সবকিছু ধুয়ে নিই। হাতও সে কারণে ধুই।
সবাই যদি হাত ধুয়ে বড় ড্রপলেটের ভাইরাসগুলো হাত থেকে দূর করতো, সবাই যদি ঠিকঠাক মাস্ক পরে বাইরে বেরোতো, একে অপরের কাছ থেকে অন্তত ১২ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে চলতো, তাহলেই কারও আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকতো না। কেউ আক্রান্ত না হলে ভাইরাসকে একদিন বিদেয় নিতে হত। ভ্যাক্সিনেরও হয়তো দরকার পড়তো না।
৬৯. বন্দিত্ব
চার মাস বাড়ির বাইরে পা ফেলিনি। মানুষের মুখোমুখি হইনি চার মাস। কাটাচ্ছি কিডনি নষ্ট হতে থাকা ১৬ বছর বয়সী একটি বেড়ালের সঙ্গে। অনলাইন শপ থেকে চাল ডাল আনাজপাতি আসে, পাড়ার মাছের বাজার থেকে মাছ আসে। যারা দিতে আসে, তারা ওসব সদর দরজার বাইরে রেখে চলে যায়। আমি একসময় ভেতরে ঢুকিয়ে নিই। ভাইরাস কতই হয়তো ঢুকেছে বাড়িতে। এখনও কণ্ঠদেশের নাগাল পায়নি। যদি দেখতে পেতাম বাড়ির কোথায় কোথায় এরা কিলবিল করছে! মুশকিল এটাই, এদের খালি চোখে দেখা যায় না। এদের সামনে কী ভীষণ অসহায় আমরা। অদৃশ্য শত্রু আমাদের।
কেউ কেউ বলে করোনার দুর্যোগ জুড়ে অঢেল সময় পেয়েছো, একটা উপন্যাস লিখে ফেলো। আমাদের বাঙালি লেখকদের তো কেউ কেউ ২০০/৩০০ উপন্যাস লিখে ফেলেছেন। এত উপন্যাস অন্য কোনও ভাষার লেখকরা লেখেন বলে মনে হয় না। মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে, লিও টলস্টয় তো মাত্র ৩টে উপন্যাস লিখেছেন, তাঁকে কি লোকেরা বলতো, লিও আরও কিছু উপন্যাস লিখুন? আলবেয়ার কাম্যুকে কি বলতো, শুধু ৫টা উপন্যাস লিখলে চলবে, আরও কিছু লেখো। ছোট লেখকদের হয়তো প্রচুর লিখতে হয়, বড় লেখকদের কম লিখলেও চলে। অবশ্য শেক্সপিয়ার প্রচুর লিখেছিলেন। তাঁর মতো বড় কবি আর কে আছেন!
আমি বরাবরই ফিকশানের চেয়ে নন-ফিকশান লিখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। পৃথিবীতে সত্যিকার যেসব ঘটনা ঘটছে সেসব তো ফিকশানের চেয়ে রোমহর্ষক, এবং অবিশ্বাস্য।
৭০. ঠিক কি না?
প্রধানমন্ত্রীর পেয়ারা বান্দারা লুটে পুটে দেশ সাবাড় করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শুনেছিলাম কত লক্ষ কোটি টাকা হাওয়া করে দিয়েছেন তেনারা। মন্ত্রী মশাইগণ ইউরোপ আমেরিকায় টাকা পাচার করে বাড়িটাড়ি বানিয়ে ফ্যামিলি পাঠিয়ে দিয়েছেন। এক পা দেশে দিয়ে রেখেছেন দেশের অবশিষ্ট সম্পদ পাচারের জন্য। যাঁর ছাতার তলায় বসে এতসব কুকর্ম চলে, তিনি বিরোধী দলের কোনও চিহ্ন রাখেননি, গণতন্ত্রকে ভীষণ ভয় পান কিনা। পেয়ারা বান্দারা বিনা বাধায় দেশের বারোটা বাজিয়ে খুশি থাকুন, এ তিনি মন থেকেই চান।
তেনার এক পেয়ারা বান্দা দু’দিন আগে বোরখা পরে বর্ডার পার হতে গিয়ে ধরা পড়েছেন। কেন বর্ডার পার হতে গেলেন? হতে গেলেন কারণ পেয়ারা বান্দাটির কীর্তিকলাপ সব ফাঁস হয়ে গেছে। ফাঁস হয়ে গেলে তিনি কিন্তু মুখ ফিরিয়ে নেন, বেইজ্জত করার অর্ডার দিয়ে দেন। সুতরাং যতক্ষণ ধরা না পড়ছো, ততক্ষণ তুমি আমার।
চোরকে নিয়েও না, বাটপারকে নিয়েও না, যে জিনিসটাকে নিয়ে কথা বলতে চাইছি, সেটা কালো বোরখা। বোরখা যত না মেয়েদের প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন পুরুষের। ক্রিমিনাল পুরুষেরা চুরি ডাকাতি আর খুন খারাবি করতে গিয়ে বোরখা পরেন, অবৈধ ভাবে বর্ডার পার হওয়ার সময়ও বোরখা পরেন। এ ছাড়া বোরখার আর কোনও উপকারিতা আমি তো দেখি না। বোরখা ব্যান করলে অন্তত ক্রিমিনাল পুরুষেরা আরও সহজে ধরা পড়তে পারতো। ঠিক কি না?
৭ ১. সিংহী
কেনিয়ার উত্তরে সাম্বুরু জঙ্গল। সেখানে এক সিংহীর সামনে পড়েছিল এক সদ্যজাত হরিণ শাবক। শাবকটিকে না খেয়ে নিজের সন্তানের মতো লালন পালন করেছিল সিংহীটি। সিংহীটির কাজই ছিল জঙ্গলের বাঘ চিতা সিংহ হায়েনার থাবা থেকে শাবকটিকে বাঁচানো। শাবককে একা রেখে কোথাও শিকার করতে যেতে পারতো না সিংহী, কারণ হরিণ-শাবকেরা সিংহ-শাবকদের মতো এক জায়গায় বসে অপেক্ষা করে না মায়েদের জন্য। হরিণ-শাবকটি আবার দূরে কোথাও চলে গিয়ে কী না কী বিপদে পড়ে সেই জন্য মাসের পর মাস সিংহীটি কোনও কিছু শিকার করেনি, খায়নি। একবার শাবকটি হরিণের পালের সঙ্গে মিশে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু সিংহীটি ওকে ফেরত নিয়ে আসে।
এটিই প্রথম নয়, সিংহীটি আরও পাঁচটি হরিণ-শাবককে মায়ের মতো লালন পালন করে বড় করেছে। যাঁরা এই সিংহীর জীবনকে গোপনে লক্ষ করেছেন এবং ক্যামেরায় বন্দি করেছেন, তাঁরা সিংহীর নাম দিয়েছেন কামুনিয়াক। কেনিয়ার ভাষায় কামুনিয়াক মানে আশীর্বাদপ্রাপ্ত। কামুনিয়াক কেন নিজের শিকারকে নিজের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করেও সেবা যত্ন এবং নিরাপত্তা দিয়েছে, তা আজও কেউ জানে না। আমি যখনই কামুনিয়াককে দেখি হরিণ-শাবককে লালন পালন করছে, চোখে আমার জল আসে।
তুমি নিজের সন্তানকে লালন পালন করো, তুমি করবেই। তুমি যদি অন্যের সন্তানকে একই আদর দাও, তাহলেই তো তুমি অনন্য। জঙ্গলের সিংহীরা যেভাবে শিকারকে ধরে এবং কামড়ে খায়, তা দেখে অভ্যস্ত আমরা। যদি তাদের মতো ভয়ংকর প্রাণীর মধ্যে অন্যের জন্য, তাদের শিকারের জন্য, দয়া মায়া দেখি, তাদের মহত্ত্ব দেখি, তখন তো ভালো লাগায় মন ভরবেই। আর ভালো লাগা থেকেই ওই চোখের জল।
৭২. ধনী
মুকেশ আম্বানি তো এখন ওয়ারেন বাফেটের চেয়ে বেশি ধনী হয়ে গেলেন। আম্বানির সম্পদ এখন ৬৮.৩ বিলিয়ন ডলার, আর বাফেটের ৬৭.৯ বিলিয়ন ডলার। আমার কাছে অবশ্য ওয়ারেন বাফেটকে বেশি ধনী মনে হয়, কারণ তিনি তাঁর সম্পদের প্রায় সবটাই মানুষের কল্যাণে দান করে দিয়ে যাচ্ছেন।
৭৩. সাজ
আমাদের ছোটবেলায় সাজগোজের স্বাধীনতা ছিল না। আমার বাবা আমাদের মুখে কোনও রকম রঙ লাগানো সহ্য করতো না। চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপ্সটিক, গালে রুজ সবই ছিল নিষিদ্ধ। কানে দুল, গলায় মালা, হাতে চুড়িও বাবা সহ্য করতো না। বাবা মনে করতো সাজলে লেখাপড়ায় আমাদের মন বসবে না। সুতরাং আমাদের শৈশব কৈশোর কেটেছে সাজগোজহীন। ভেতরে ভেতরে তাই সাজগোজের প্রতি একটা আকর্ষণ ছিল। সেই আকর্ষণটিকে প্রশ্রয় দিত আমার দুই দাদা। তারা আমাদের ওইসব এনে দিত। কৈশোরোত্তীর্ণ আমি বাবার চোখের আড়ালে সেজেগুজে সাজগোজের স্বাধীনতা নিয়েছি। সেই স্বাধীনতা পাওয়ার পর আবার নিজেই না-সাজার স্বাধীনতা ভোগ করেছি দীর্ঘকাল। এখন ইচ্ছে হলে সাজি, ইচ্ছে না হলে সাজি না।
৭৪. নারীকে মানুষ কেন এত ঘৃণা করে?
মানুষ লেখাপড়া করছে কিন্তু শিক্ষিত হচ্ছে না। মানুষের জীবনযাপনের মান উন্নত হচ্ছে, কিন্তু মানুষ সভ্য হচ্ছে না। এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে পৃথিবীর সব রকম তথ্যের নাগাল পাচ্ছে মানুষ, ভালো এবং মন্দ, ন্যায় এবং অন্যায়, শান্তি এবং অশান্তি, ভালোবাসা এবং ভায়োলেন্স, সমতা এবং বৈষম্য, সততা এবং অসততা, নারীর সমানাধিকার এবং নারী নির্যাতন, মানবাধিকার এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিজ্ঞান এবং কুসংস্কার, যুক্তিবাদ এবং ধর্মান্ধতা। বাংলাদেশের মানুষ যারা মন্দকে বেছে নিচ্ছে, তারা তো জেনে বুঝেই নিচ্ছে। তারা জেনে বুঝেই অন্যায়, অশান্তি, ভায়োলেন্স, বৈষম্য, অসততা, নারীনির্যাতন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, কুসংস্কার এবং ধর্মান্ধতার প্রতি ঝুঁকেছে। এরা জ্ঞানপাপী, এদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা খুব কঠিন।
কিন্তু যে যুবসমাজকে সৎ এবং সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা যেত, সঠিক পথ যাদের দেখানো যেত, সুস্থ সুন্দর জীবনকে গ্রহণ করার প্রেরণা দেওয়া যেত, শিশুকাল থেকেই তাদের দিয়ে দেওয়া হয়েছে এক পাল অসৎ, নারী-নির্যাতক, ধুরন্ধর, ধর্ষক, দুর্নীতিবাজ বদ লোকের হাতে। তারা প্রতিনিয়ত তাদের অমানবিক, নির্মম নিষ্ঠুর হওয়ার জন্য ইন্ধনই যোগাচ্ছে না, তারা নারীকে ঘৃণা করার জন্য নারীর বিরুদ্ধে যত কুৎসিত কুকথা বলা দরকার বলছে। নারীর কোনও অধিকার বা স্বাধীনতা থাকতে নেই, নারীর শিক্ষা এবং স্বনির্ভরতার প্রয়োজন নেই, নারীর জন্ম হয়েছে পুরুষের সেবা ও সঙ্গমের জন্য,পুরুষের সন্তান গর্ভে ধারণ করার জন্য, নারীর দুশ্চরিত্রা, নারী ডাইনি, নারীর ঘাড়ের একটি হাড় বাঁকা, নারী পাপী, একে বিশ্বাস করো না, একে মারো, একে ঘৃণা করো, কোনও পবিত্র জায়গায় একে প্রবেশাধিকার দিও না। যুব সমাজের মস্তিষ্কের কোষে কোষে ঢুকে যাচ্ছে নারীবিদ্বেষ। নারীবিদ্বেষী ওয়াজিদের বক্তৃতা শুধু শহরে বন্দরে গ্রামে গঞ্জে সীমাবদ্ধ নয়, অন্তর্জালে তাদের উপস্থিতি ভয়াবহ রকম। সন্ত্রাসী দল আইসিসে যারা যোগ দিয়েছিল, তারা কিন্তু ইউটিউব থেকে ইসলামী সন্ত্রাসীদের দ্বারা মগজধোলাই হওয়া তরুণ তরুণী!
২
দিন দিন ধর্ষণ বাড়ছে। বাংলাদেশে ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে কিছু যুবককে গ্রেফতার হতে হয়েছে। এ কেমন অদ্ভুত আচরণ। ধর্ষণের বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদই তো হওয়া উচিত। পুলিশের কাজ রাতে টহল দেওয়া, চোর ছ্যাঁচড়, গুন্ডা বদমাশ, ধর্ষক নির্যাতক, খুনী সন্ত্রাসীদের ধরা, শহর বন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অথচ আশ্চর্য, বাংলাদেশের পুলিশ ধর্ষণের বিরুদ্ধে যে সচেতন ছাত্রছাত্রী গ্রাফিতি আঁকছিল, তাদের মেরে ধরে ভ্যানে উঠিয়ে থানায় নিয়ে রাতভর অত্যাচার করেছে। পুলিশ বলছে ধর্ষণের বিরুদ্ধে গ্রাফিতি আঁকতে অনুমতি নিতে হয়। ধর্ষণ করতে গেলে কি অনুমতি নিতে হয়? অবশ্যই নয়। অনুমতি ছাড়া অন্যায় করা যাবে, অনুমতি ছাড়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যাবে না।
দেশটা নষ্ট হতে হতে একেবারে গলে গেছে। দেশের মস্তিষ্ক থেকে এখন দুর্গন্ধ পুঁজ বেরোচ্ছে। এই দেশই তো মৌলবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলাম বলে দেশ থেকে বের করে দিয়েছে আমাকে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আমাকে বলা হয়েছিল, ‘লেখালেখি পত্র-পত্রিকায় ছাপাতে চাইলে আমাদের অনুমতি নিতে হবে’। মৌলবাদীরা যে দেশ জুড়ে নারী নির্যাতন করে বেড়াচ্ছিল, তাতে অবশ্য তাদের অনুমতি নেওয়ার কথা কেউ বলেনি।
ভালো কাজ করার সময় যে সরকার অত্যাচার করে, নির্বাসনে পাঠায়, জেলে ভরে, সেই সরকার নিজের ভালো ছাড়া আর কারও ভালো চায় না। দেশের ভালো তো চায়ই না।
৩
শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা উপমহাদেশেই নারীনির্যাতন ভয়ংকর অবস্থায় পৌঁচেছে। মনীষা বাল্মিকী নামে উত্তরপ্রদেশের এক গরিব মেয়েকে চারটে বীরপুরুষ ধর্ষণই শুধু করেনি, মনীষার মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে, জিভও কেটে নিয়েছে। কেন করেছে ওরা এই নির্যাতন? কারণ মনীষা মেয়ে। অন্যদের মতো আমি বলবো না কারণ মনীষা নিচু জাত। কেন, উঁচু জাত বুঝি ধর্ষণের শিকার হয় না? হয়। ভারতে এই জাতপাত আইনত নিষিদ্ধ হলেও এটি সকলে মেনে চলে। ওপরে ওপরে না মানলেও ভেতরে ভেতরে মানে। আমার কত প্রগতিশীল বন্ধুর সার্টের ফাঁক দিয়ে দেখেছি উঁকি দিচ্ছে সাদা পৈতে। জাত গোত্র হাবিজাবি সব দেখে তবে এরা বিয়ে করে। পুরুষতন্ত্রের বিচারে মেয়েদের একটাই জাত, সেটা হল নিচু জাত। সুতরাং মেয়েদের উচুঁনিচু সব জাতের পুরুষই ধর্ষণ করতে, হত্যা করতে দ্বিধা করে না।
মনীষা শেষপর্যন্ত বাঁচতে পারেনি। গরিবের মৃত্যুতে কারও কিছু যায় আসে না। কিন্তু যেহেতু মনীষার হাল অনেকটা নির্ভয়ার মতো, গণধর্ষণের পর মৃত্যু—তাই পুরোনো প্রতিবাদ মনে পড়েছে লোকের। চেঁচিয়ে কিচ্ছু হবে না। চেঁচিয়ে, ধর্ষকদের ফাঁসি দিয়ে কিচ্ছু হয়নি, ধর্ষণ বন্ধ করা যায়নি। ফাঁসির চেয়েও যেটি ভয়াবহ, সেটির নাম পুরুষতন্ত্র। পুরুষেরা ফাঁসির ভয় ভুলে যায়, পুরুষতন্ত্রের শিক্ষা ভোলে না।
যতদিন নবজাতকের পুরুষাঙ্গ দেখে পরিবারের লোকেরা আনন্দে আত্মহারা হবে, যতদিন মেয়ে-জন্ম অনাকাঙ্ক্ষিত থাকবে, যতদিন পণপ্রথা টিকে থাকবে, যতদিন মেয়েরা যৌনবস্তু হিসেবে চিহ্নিত হবে, যতদিন মেয়েরা বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি থাকতে যাবে, যতদিন সিঁদুর শাঁখা হিজাব বোরখা পরতে হবে, যতদিন স্বামীর নামে পরিচিত হবে, যতদিন পুরুষ প্রভু নারী দাসি’র কাঠামো রয়ে যাবে, যতদিন বেশ্যাপ্রথার অস্তিত্ব থাকবে, যতদিন পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্র বজায় থাকবে, ততদিন ধর্ষণ চলবে। কারণ ধর্ষণ ব্যাপারটা আগাগোড়া পুরুষতান্ত্রিক, আগাগোড়াই নারী-বিদ্বেষ। ধর্ষণ যারা করে তারা জন্মের পর থেকেই পুরুষতন্ত্র দ্বারা মগজধোলাই হওয়া, তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে নারীকে ভোগ করা, নির্যাতন করা, নারীকে মেরে ফেলা, কেটে ফেলার একশোভাগ অধিকার তাদের আছে।
৪
বাংলাদেশের একটি খবর, একটি ভিডিও এখন দাবানলের মতো ছড়িয়ে গেছে চারদিকে। ”এক মেয়েকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করেছে কিছু পুরুষ”। কেন খবরটি ভাইরাল হল? ওই ‘বিবস্ত্র’ শব্দটির জন্য। স্বামীকে বেঁধে রেখে নির্যাতন করেছে ওরা। কেউ কেউ বলছে ধর্ষণ করতে চেয়েছিল, সম্ভব না হওয়ায় বিবস্ত্র করেছে। বিবস্ত্র করার ভিডিও করেছে ওরা, ফেসবুকে ভিডিও আপ্লোড করবে বলে। মেয়েটির শরীর শুধু ওরা নয়, আরও হাজার লোকে দেখবে, এর চেয়ে বড় শাস্তি একটি মেয়ের জন্য ওরা মনে করে না আর কিছু আছে।
যদি একটি পুরুষকে বিবস্ত্র করে অত্যাচার করা হত, তাহলে কি খবরটা এমন ছড়াতো? মানুষ তখন পুরুষকে মারধর করার বিরুদ্ধে কিছু হয়তো বলতো, বিবস্ত্র করার বিরুদ্ধে নয়। পুরুষ বিবস্ত্র হলে ঘটনা ভয়ানক নয়, মেয়ে বিবস্ত্র হলে ঘটনা ভয়ানক। দুটোই শরীর। দুটো শরীরে শুধু যৌনাঙ্গগুলো ভিন্ন। তাহলে এক যৌনাঙ্গ প্রকাশ হলে ক্ষতি নেই, আরেক যৌনাঙ্গ প্রকাশ হলে ক্ষতি কেন?
যদি খবরটি এমন হত—’একটি মেয়েকে নির্যাতন করেছে কিছু পুরুষ’, তাহলে কারও কিছু যেত আসতো না। বিবস্ত্র শব্দটি শুনে লোকে লাফিয়ে উঠেছে। কী, এত বড় স্পর্ধা, বিবস্ত্র করেছে! তার মানে মেয়েটির বুক মুখ পেট পিঠ হাত পা এমন কী যৌনাঙ্গ পর্যন্ত দেখে ফেলেছে! কী সর্বনাশ।
মেয়েরা তো শুধু স্বামীর সম্পত্তি নয়, মেয়েরা কোনও না কোনও ভাবে সমস্ত পুরুষের সম্পত্তি। সে কারণেই সব পুরুষই মেয়েদের শরীর নিয়ে চিন্তিত, এই শরীর আবার কেউ না দেখে ফেলে! সে কারণেই তো মেয়েরা কী পোশাক পরবে, তা পুরুষেরাই নির্ধারণ করে। বিবস্ত্র না করে নির্যাতন করলে সেটিকে অন্যায় বলে মনে করা হত না। বিবস্ত্র না করে জবাই করে ফেললেও মানুষ এতটা ক্ষিপ্ত হতো না, যতটা বিবস্ত্র করায় ক্ষিপ্ত।
মেয়েকে বিবস্ত্র করাটা লোকের কাছে বড় নির্যাতন মনে হয়েছে, ওই চড় ঘুসি, লাথির চেয়েও। কারণ মানুষ বিশ্বাস করে, মেয়েরা আস্ত একখানা ‘শরীর’ ছাড়া কিছু নয়। যেহেতু মেয়েরা শুধুই ‘শরীর’, তাই শরীরের সবকিছু আগলে রাখতে হবে, ঢেকে রাখতে হবে, কারণ ওগুলো মেয়েটির হলেও মেয়েটির নয়, ওগুলো মেয়েটির মালিক অর্থাৎ স্বামীর খাদ্য, ওই খাদ্যে মালিক ছাড়া কারো নজর পড়লে, ওই খাদ্যে মালিক ছাড়া আর কারও লালা ঝরলে, ওই খাদ্যে মালিক ছাড়া আর কারও ছোঁয়া লাগলে খাদ্য নষ্ট হয়ে যায়, ভক্ষণের অযোগ্য হয়ে পড়ে।
যে মানসিকতা মেয়েদের বোরখায় ঢেকে রাখে, মেয়েদের বিবস্ত্র করাকে অন্যায় বলে বিচার করে, কারণ মেয়েরা তো শুধুই ‘শরীর’, এই শরীরটাই উলঙ্গ হয়ে গেলে শরীরের আর কিছুই থাকে না—এই একই মানসিকতা মেয়েদের বিবস্ত্র করে, ধর্ষণ করে, কারণ মেয়েরা তো শুধুই ‘শরীর’।
৫
অনেকে পুরুষকে অনুরোধ করে নারীকে শ্রদ্ধা করো, নারীকে মা, বোন, কন্যা হিসেবে দেখো, নারীকে সম্মান করো। আমি মনে করি না, নারীকে এত ফেভার করা উচিত। নারীকে মা বোন কন্যা হিসেবে দেখার দরকার নেই, নারীকে মায়ের জাত হিসেবে শ্রদ্ধা করারও দরকার নেই, নারীকে নারী বলে সম্মান করারও দরকার নেই। কই, পুরুষকে বাপের জাত হিসেবে সম্মান করার কথা বলা হয় না, পুরুষকে তো মানুষ হিসেবে দেখার অনুরোধ করা হয় না! কারণ পুরুষ বলে তাদের কেউ অসম্মান করে না, পুরুষ বলে তাদের কেউ ঘৃণা করে না। যেভাবে নারীকে করে।
তাহলে কী করতে হবে? কী করলে নারী নির্যাতন বন্ধ হবে? আমি মনে করি, শিশুকাল থেকে মানুষের মগজধোলাই হয়েছে যা দিয়ে সেসব শুধু মগজ থেকে বিদেয় করতে হবে। কী সেটা? সেটা হল কুশিক্ষা বা ভুল শিক্ষা, যেমন : নারী যৌনবস্তু, নারী পুরুষের ভোগের সামগ্রী, নারীকে নির্যাতন করা, ধর্ষণ করা কোনও অপরাধ নয়, নারীর কোনও স্বাধীনতা বা অধিকার থাকতে নেই, নারীর জন্য শিক্ষা আর স্বনির্ভরতা নয়, নারীকে পরনির্ভর হতে হবে, নারীকে পিতা, স্বামী এবং পুত্রের অধীনে বাস করতে হবে, পুরুষের ক্রীতদাসী আর সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র ছাড়া নারী কিছু নয়—এইসব হাজারো নারীবিদ্বেষী শিক্ষা। এই বিদ্বেষগুলো মগজ থেকে বিদেয় করতে পারলেই যথেষ্ট, তাহলেই নারী পুরুষে সমতা আসার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
৭৫. ধর্ষণ বন্ধ করার উপায়
ধর্ষণ ধর্ষণ ধর্ষণ। আর ভালো লাগে না এই শব্দটি উচ্চারণ করতে। কিন্তু তারপরও প্রতিদিন শুনতে হয়, পড়তে হয় এই শব্দটি। এমন কোনও দিন কি আসবে যেদিন এই শব্দটি আর কেউ উচ্চারণ করবে না, কারণ ধর্ষণ বলে কিছু আর ঘটবে না দুনিয়াতে?
ভারতের উত্তরপ্রদেশে মনীষা বাল্মিকী নামে এক ১৯ বছর বয়সী মাঠে গরুর জন্য ঘাস কাটতে গিয়েছিল, সেখানেই তাকে ওড়না ধরে টেনে নিয়ে চার জন পুরুষ তাকে ধর্ষণ করে, জিভ কেটে ফেলে, মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলে। মনীষাকে প্রায়-মৃত ফেলে রেখে গিয়েছিল ওই চার ধর্ষক। ১৫ দিন ভোগার পর গতকাল মনীষার মৃত্যু হয়েছে দিল্লির হাসপাতালে। কেন ওই পুরুষেরা মনীষাকে ধর্ষণ করেছে? কারণ মনীষা মেয়ে। কারণ মনীষা নিচু জাত। আর ওরা ধর্ষকরা? ধর্ষকরা পুরুষ, ধর্ষকরা উঁচু জাত। তাহলে কি শুধু উঁচু জাতের লোকেরাই ধর্ষণ করে? নিচু জাতের লোকেরা করে না? উঁচু জাতের মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হয় না? হয়। সব জাতের, সব ধর্মের, সব ভাষাভাষীর, সব রঙের, সব শ্রেণীর, সব গ্রামের, সব শহরের, সব দেশের, সব বয়সের মেয়েরাই ধর্ষণের শিকার হয়, এবং সব ধরনের পুরুষই ধর্ষণ এবং নির্যাতন করে মেয়েদের। ধর্ষণ ততদিন বন্ধ হবে না যতদিন এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ টিকে থাকবে, কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মানুষকে এই শিক্ষা দিয়ে মগজধোলাই করে যে পুরুষেরা প্রভু, মেয়েরা নিতান্তই দাসিবাঁদি আর যৌনবস্তু। দাসিবাঁদি আর যৌনবস্তুকে ধর্ষণ করবে না তো কি তাদের পুজো করবে? দাসিবাঁদি আর যৌনবস্তুকে হাসতে হাসতে হত্যা করাও তো আলাদা এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। পুরুষেরা এই রোমাঞ্চের স্বাদ নিতে চায়। ধরা পড়বে না, ধরা পড়লেও শাস্তি পাবে না, এই বিশ্বাস থেকেই স্বাদ নিতে চায়।
কয়েক বছর আগে যখন দিল্লিতে নির্ভয়া অর্থাৎ জ্যোতি সিংকে গণধর্ষণ করা হল চলন্ত বাসে, মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে হেরে যেতে হল নির্ভয়াকে, নির্ভয়ার মৃত্যু হল, তখন হাজারো মানুষ পথে নেমেছিল। ধর্ষণের প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল ভারত। নির্ভয়াকে ধর্ষণ করার অপরাধে প্রাপ্ত বয়স্ক ধর্ষকদের ফাঁসি হল। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তো একেই বলে। কিন্তু ধর্ষণ কি বন্ধ হয়েছে? লাগাতার চলছে ধর্ষণ।
ভারতে গতবছর প্রতিদিন গড়ে ৮৭টি করে ধর্ষণের মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। পুরো দেশে নারীর ওপর নথিভুক্ত অপরাধের সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৫ হাজার ৮৬১টি। নথিভুক্ত করা হয়নি’র সংখ্যাটা নিশ্চয়ই বেশি। নথিভুক্ত একটি সংখ্যা দেখলে, বিশেষ করে এই উপমহাদেশে, সেই সংখ্যার দ্বিগুণ -ত্রিগুণ এমনকি চতুর্গুণ একটি সংখ্যাকে সত্যিকারের সংখ্যা হিসেবে আমাদের কল্পনা করে নিতে হয়। নিতে তো হয়ই, ক’টা মেয়ে আর ক’টা অপরাধ নথিভুক্ত করে! পুরুষের অপরাধ নথিভুক্ত করে পুরুষের সমাজে অক্ষত অবস্থায় বেঁচে থাকবে কোন মেয়ে, কার এত বড় দুঃসাহস! মুখ গুঁজে বেঁচে থাকতে মেয়েদের বাধ্য করা হয়, এতেই ওদের অভ্যাস হয়ে গেছে।
নারী নির্যাতন কমছে না, বরং বাড়ছে। ২০১৮ সালে নারী নির্যাতন যা ছিল, তার চেয়ে, পরের বছরে, ৭ ভাগ বেড়েছে। ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (এনসিআরবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ৩ লাখ ৭৮ হাজার ২৩৬টি নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছিল। ২০১৮ সালে ভারতে ধর্ষণের মামলার সংখ্যা ছিল ৩৩ হাজার ৩৫৬। ২০১৭ সালে নথিভুক্ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল ৩২ হাজার ৫৫৯টি। সংখ্যাটা প্রতিবছর বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে কি আকাশ ছোঁবে? মেয়েরা তো শিক্ষিত হচ্ছে, স্বনির্ভর হচ্ছে, ধর্ষকদের ফাঁসি হচ্ছে, যাবজ্জীবন হচ্ছে, ধর্ষণের বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়ানোর সব রকম চেষ্টা হচ্ছে, সরকারি বেসরকারি নানা রকম সংগঠন দিন রাত ধর্ষণ বন্ধ করতে চাইছে, তাহলে ধর্ষণ কেন বন্ধ হচ্ছে না? এই প্রশ্নটি করতে হবে বারবার, এবং উত্তরটি, নকল উত্তরটি নয়, আসল উত্তরটি খুঁজে বের করতে হবে।
শুধু কি ভারতেই নারী-নির্যাতন, ধর্ষণ আর নারীহত্যার উৎসব চলে? বাংলাদেশও কিছু অংশে পিছিয়ে নেই। গত ৮ মাসে শুধু ধর্ষণই নথিভুক্ত হয়েছে ৮৯২টি। নথিভুক্ত নয় এমন ধর্ষণকে আমাদের নিজ দায়িত্বে যোগ করে নিতে হবে। গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর খুন, ধর্ষণের কারণে মৃত্যু, ধর্ষণের পর আত্মহত্যা এমন ঘটনাগুলোও আমাদের যোগ করতে হবে।
সেদিন পাহাড়ের একটি চাকমা মেয়েকে ৯ জন বাঙালি পুরুষ ধর্ষণ করেছে। শুনে কি আমি অবাক হয়েছি? মোটেও না। যদি কোনও পুরুষ ধর্ষণ থেকে বিরত রাখে নিজেকে, সে রাখে আইনে ফেঁসে যাবে বা লোকে পেটাবে—এই ভয়ে। আজ এমন আইন হোক, যে আইনে পুরুষেরা যা খুশি করুক শাস্তি পাবে না, তাহলে হয়তো একটি পুরুষও ধর্ষণ না করে একটি দিনও বসে থাকবে না।
আজই খবরে পড়লাম, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে মনির হোসেন নামে এক লোক তার নাবালিকা কন্যাকে দীর্ঘকাল ধরে ধর্ষণ করছে। শেষ অবধি মনির হোসেনের স্ত্রীই স্বামীর কুকীর্তির কথা পুলিশকে জানায়। কন্যাটিও মনির হোসেনের সামনে পুলিশকে বলেছে, কী করে সে তার পিতা দ্বারা ধর্ষণের শিকার হত। মনির হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু মনিরের মতো লোকের অভাব সমাজে নেই।
আমাদের দুঃখ এই, আমরা মেয়েরা সংখ্যাগুরু হই, সংখ্যালঘু হই আমরা কেউ নিরাপদ নই। কারণ আমাদের দুর্ভাগ্য এই, আমরা এক সমাজে যাদের সঙ্গে বাস করি, তারা সকলেই পুরুষ নয়, তারা অনেকেই চক্ষুকর্ণহীন বোধবুদ্ধিবিবেকহীন পুরুষাঙ্গ। এই পুরুষাঙ্গগুলো যতদিন না পুরুষ হয়ে উঠবে ততদিন ধর্ষণ বন্ধ হবে না। পুরুষাঙ্গ হওয়া কোনও গৌরবের ব্যাপার নয়। যদিও আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাদের পুরুষাঙ্গ হয়ে ওঠার প্রেরণাই জীবনভর জুগিয়েছে। জন্মের সময়ই তো নবজাতকের পুরুষাঙ্গ দেখে পরিবারে খুশির ফোয়ারা ছোটে। সেই থেকে শুরু। তারপর পরিবারের পুত্রধনকে যে হারে সেবা যত্ন করা হয়, তার পেছনে ধনসম্পদ যেভাবে ব্যয় করা হয়, তার জন্য আশা আকাঙ্ক্ষা যেভাবে জমানো হয়, যত স্বপ্ন দেখা হয় তাকে নিয়ে—তাকে একরকম সম্রাট বানিয়ে দেওয়া হয়। সম্রাট তো হবেই অহংকারী, করবেই ধরাকে সরা জ্ঞান। তাকে তো জন্ম থেকে শেখানো হয়, সে ছেলে বলে সে মূল্যবান, আর অজস্র যে মেয়ে আছে পরিবারে, সমাজে, তারা কেউ তার মতো মূল্যবান নয়। মেয়েদের জন্ম পুরুষের সেবা করার জন্য, পুরুষের ভোগের বস্তু হওয়ার জন্য, পুরুষের সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য। যেমন শেখে, তেমন ব্যবহার করে। যতদিন এই সমাজ পুরুষকে মেয়েদের চেয়ে মূল্যবান মানুষ হিসেবে মানবে, ততদিন ধর্ষণ চলবে। ধর্ষণ যারা করে, তারা সবাই মগজধোলাই হওয়া লোক। পরিবার, সমাজ, এবং রাষ্ট্র তাদের অবিরাম মগজধোলাই করেছে। রাষ্ট্রের তৈরি পারিবারিক আইনে পুরুষের অধিকার বেশি। সমাজের রীতিনীতি পুরুষ তৈরি করেছে, পুরুষেরই জয়জয়কার সেসবে, পরিবারে পুরুষই হর্তাকর্তা। এই সব পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে ফেলতে হবে, তবেই না সমতা আসবে। নারী এবং পুরুষের সমানাধিকার চর্চা না হলে ধর্ষণ বন্ধ হওয়ার কোনও কারণ নেই। প্রভুরা দাসিদের নির্যাতন করে। প্রভু দাসির সম্পর্ক আদিকাল থেকে এমনই। ধর্ষণ একধরনের নির্যাতনের নাম। সমতার সমাজ তৈরি করা, নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত করা, পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে ফেলাই ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতন বন্ধ করার উপায়।
৭৬. কুকুর নিধন বন্ধ হোক
বাংলাদেশে কুকুর নিধন করার আর্জি নিয়ে মানববন্ধন হয়। এ বড় অভিনব মানববন্ধন। কুকুর নিধন তো চলছেই। পৌরসভা থেকে তো বটেই, ব্যক্তিগত উদ্যোগেও পাড়ায় পাড়ায় এই নিধন যজ্ঞ চলে। নৃশংসতার ভয়াবহতা কত দূর পৌঁছোলে অসহায় প্রাণীদের নির্বিচারে হত্যা করতে পারে মানুষ। একটি দেশ কতটা সভ্য তা নির্ভর করে সেই দেশ তাদের অসহায় প্রাণীদের কতটা নিরাপত্তা দেয় তার ওপর। যে দেশ কুকুর বেড়াল হত্যা করে, সে দেশ অসভ্যই শুধু নয়, ভয়ংকর নির্মম।
অরণ্যের নেকড়ে প্রজাতি থেকেই বিবর্তনের ফলে কুকুরের জন্ম, শৃগালের সঙ্গেও প্রজাতিগত আত্মীয়তা রয়েছে কুকুরের। এরা অরণ্য ছেড়ে লোকালয়ে চলে আসে বহু আগে। ১২ হাজার বছর ধরে ঘনিষ্ঠভাবে বাস করছে মানুষের সঙ্গে। এদের কাজ ছিল দূরপাল্লার পথিকদের সঙ্গ দেওয়া, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আর শিকারীদের শিকারে সঙ্গ দেওয়া। কুকুর সঙ্গে নিয়ে শিকারে যেত শিকারীরা, কুকুরের ঘ্রাণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি মানুষের ঘ্রাণ এবং দৃষ্টিশক্তির চেয়ে বেশি ধারালো বলে শিকারে কুকুরদের সাহায্য দরকারী ছিল। শুধু কি শিকারী আর পথিকের উপকারই করতো কুকুর? সব মানুষেরই উপকার করতো। ভেড়ার পালকে চড়াতে নিয়ে যাওয়া, গবাদি পশুকে পাহারা দেওয়া, বরফের দেশে স্লেজগাড়ি চালানো, ভার বওয়া, সব কাজই কুকুর করতো, এখনও করে। প্রাচীন মিশর তো কুকুর বেড়ালকে দেবতা মানতো। তারা কুকুর বেড়ালের উপকারকে যথাযথ মূল্য দিয়েছিল। বেড়ালেরা শস্যক্ষেতের ইঁদুর মেরে মিশরের মানুষকে দুর্ভিক্ষের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল।
কুকুর বেড়ালদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক সৃষ্টি করা, তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার কাজটি এখন উত্তর আমেরিকা আর ইউরোপের লোকেরা করছে। অনুন্নত দেশগুলোয় এখনও কুকুর বেড়ালকে খাদ্য হিসেবে, আপদ হিসেবে বা চোর তাড়ানোর প্রহরী হিসেবে দেখা হয়। কুকুরকে তো নাপাক প্রাণী হিসেবে অনেক দেশেই ঘৃণা করা হয়। এশিয়ার উচ্চবিত্তরা পাশ্চাত্যের দেশগুলোর মতো কুকুরে কুকুরে মিশ্রণ ঘটিয়ে পছন্দসই শাবক প্রসব করিয়ে তবে পোষে। কিন্তু দেশি কুকুরেরা পথে পথে ঘোরে, দেশি মানুষেরা তাদের খাদ্য দেয় না, আশ্রয় দেয় না। এই কুকুরেরা অভুক্ত অবস্থায় ডাস্টবিন ঘেঁটে পচা গলা কিছু পেলে খায়, তা না হলে ওভাবেই অভুক্ত অবস্থায় রয়ে যায়। কুকুরকে মেরে পা ভেঙে দেওয়া, কুকুরকে পিটিয়ে মেরে ফেলা, বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা—এসব অহরহই অসভ্য সমাজে ঘটে চলেছে। রাস্তার জীবন্ত তরতাজা কুকুরগুলোকে হত্যা করে করে ভোরবেলায় ট্রাক বোঝাই করতে দেখেছি। কুকুর কামড় দিলে মানুষের
র্যাবিস হতে পারে। এর সমাধান তো কুকুরদের মেরে ফেলায় নয়। এর সমাধান ওদের র্যাবিসের টিকা দেওয়ায়।
মানুষ কি চাইলেই কিছুটা উদার হতে পারে না? আমি তো মনে করি রাস্তার কুকুরদের ঘরে ঘরে নিয়ে পোষা উচিত। তাহলেই রাস্তায় কোনও কুকুর থাকবে না। এ যদি না করা হয় তাহলে কুকুরদের বন্ধ্যাত্বকরণের ব্যবস্থা হোক। মহল্লা মহল্লায় কুকুরের আশ্রয় স্থল থাকুক। যেখানে তারা খাবে, ঘুমোবে। কুকুরদের পশু হাসপাতালে নিয়ে বন্ধ্যা করলেই তো কুকুরের জনসংখ্যা কমবে। হত্যাযজ্ঞ করে কুকুরের সংখ্যা কমানো যায় না। নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা অনুশীলন করে সভ্য হওয়া যায় না, শিক্ষিতও হওয়া যায় না।
আমি বেড়াল পুষি। আমার বেড়ালটিকে দোকান থেকে জাত দেখে কিনে আনিনি। দেশি বেড়াল আমার। বেড়ালটিকে কলকাতার এক মাছের বাজার থেকে তুলে নিয়ে এসেছিলাম। হ্যাঁ রাস্তার বেড়াল। আজ আমার বেড়ালের বয়স ১৭ বছর। মানুষের হিসেবে ওর বয়স ৮০। ১৭ বছর দেশি বেড়ালরা বাঁচে না। রাস্তাঘাটে মানুষের মার খেয়ে অসুখে অনাহারে দুর্ঘটনায় মারা যায় অল্প বয়সেই। পুষেছি বলেই বেঁচেছে এত কাল। ভালো খাদ্য পেয়েছে, নিরাপত্তা পেয়েছে। এই বেড়াল অতি বুদ্ধিমতি। আমি পৃথিবীর নানা দেশের নানা জাতের বেড়াল দেখেছি, এত বুদ্ধিদীপ্ত কোনও বেড়াল দেখিনি। সিয়ামিস জাতের বেড়ালের বুদ্ধি বেশি লোকে বলে, কিন্তু আমাদের দেশি বেড়ালের ঘটে নিঃসন্দেহে বুদ্ধি তার চেয়েও বেশি ধরে, এত প্রতিকূল পরিবেশে বুদ্ধি না থাকলে বেঁচে থাকতে পারতো না। নির্বংশ হয়ে যেত অনেক আগেই। ওর বুদ্ধিমত্তার খবরে শহরে চাউর হয়ে গিয়েছিল। ওর ফুটবল শো দেখানো হয়েছে টিভিতে, ওকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, সেই চলচ্চিত্র জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছে। শুধু বেড়াল নয়, কুকুরও প্রখর বুদ্ধি ধারণ করে। সে কারণেই বিরুদ্ধ পরিবেশে আজও টিকে আছে। দেশি কুকুর পোষ মানে না বলে যে প্রচার হয়, সেটা ভুল। ভারত-বাংলাদেশের রাস্তা থাকে কুকুরের বাচ্চা ধরে নিয়ে আমেরিকায় পুষেছে এমন লোকের ঘরে গিয়ে দেখে এসেছি আমাদের দেশিগুলো কুকুরশ্রেষ্ঠ হয়ে সোফায় রাজা বাদশাহর মতো বসে আছে। খাবার পেলে, নিরাপত্তা পেলে, আরাম আয়েশ পেলে, আদর পেলে রাস্তার অসহায় প্রাণীও সুন্দর পোষ্য হয়ে ওঠে, প্রভুভক্ত হয়ে ওঠে। কুকুরের প্রভুভক্তি তুলনাহীন। ইউরোপ-আমেরিকার রাস্তায় গৃহহীন মানুষকে কুকুর পাশে নিয়ে শুয়ে থাকতে কত যে দেখেছি। কুকুর যতই ক্ষিধেয় কষ্ট করুক, তার ভিক্ষুক-বন্ধুকে ছেড়ে কোথাও সে যায় না, প্রভু শব্দটির চেয়ে বন্ধু শব্দটি ভালো। কুকুর নিয়ে বসলে মানুষের ভিক্ষেও ভালো জোটে। কারণ কুকুর না খেয়ে থাকবে, উদার পথচারীরা এ সইতে পারে না।
আমি কুকুর পুষি না এখন। কিন্তু আমার গাড়িতে কুকুরের খাবার সবসময় থাকে, রাস্তায় কুকুর দেখলেই আমি গাড়ি থামিয়ে থালায় করে ওদের খাবার দিই, দাঁড়িয়ে থাকি যতক্ষণ খাওয়া শেষ না হয়। রাস্তার বেড়ালদের খাওয়ানোর জন্য ডে কেয়ার সেন্টারই খুলেছি। এই কাজটি করে আমি স্বস্তি পাই। অসংখ্য অসহায় ক্ষুধার্ত কুকুর বেড়ালের সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, সে সম্পর্কের মূল্য আমার কাছে অনেক মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের চেয়ে বেশি। এতে কোনও রাজনৈতিক বাণিজ্যিক সাহিত্যিক স্বার্থ নেই, এই স্বার্থ না থাকাটাই আমাকে অপার আনন্দ দেয়। নিঃস্বার্থ কাজের একটি সৌন্দর্য আছে। সেই সৌন্দর্যটি, দুঃখ এই, সকলে দেখতে পায় না।
অনেকে আমাকে দোষ দেয়, রাস্তার কুকুর বেড়ালকে খাওয়াচ্ছি, কিন্তু রাস্তার ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়াচ্ছি না! রাস্তার ক্ষুধার্ত মানুষকে আমি খাওয়াচ্ছি না, এ কথা ঠিক নয়। তাদের খাওয়াচ্ছি, তরে রাস্তার মানুষের চেয়ে রাস্তার কুকুর বেড়ালদের প্রতি আমার দরদ বেশি, বেশি কারণ মানুষকে সাহায্য করার জন্য অনেক সংস্থা সংগঠন আছে, কুকুর বেড়ালকে সাহায্য করার জন্য নেই। কুকুর বেড়ালদের মানুষ ঘৃণা করে, তাদের নিধন করে, তাদের হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার বেশি কেউ নেই। তাই আমি তাদের পাশেই দাঁড়াই। কিন্তু আমার একার পক্ষে তো বেশি কিছু করা সম্ভব নয়। সরকারি বেসরকারি সংগঠনের এগিয়ে আসতে হবে, কুকুরদের আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য খাদ্য দিতে, টিকা দিতে, বন্ধাত্ব দিতে। আশ্রয় কেন্দ্র থেকেই অনেকে পোষার জন্য ঘরে নিয়ে যাবে কুকুরদের।
দেশি বেড়াল পুষেছি অনেক কাল, যদি বেঁচে থাকি, একটি দেশি কুকুরের বাচ্চা এনে পুষবো। ভালোবাসা আর নিরাপত্তা পেলে দেশি কুকুরও জার্মান শেফার্ডকে টেক্কা দেবে।
রাস্তার কুকুরের চিৎকারে কান্নায় অনেক বিরক্ত, তাই কুকুর নিধনের চিন্তা তাদের মাথায় আসে। আমি বুঝি না তাদের কেন মাথায় আসে না, কুকুর হয়তো ক্ষিধেয় চিৎকার করছে, কেন তাদের মাথায় আসে না কুকুরকে খাবার দেওয়ার। খাবার দিলেই তো খেয়ে শান্তিতে ঘুমোবে ওরা। এই সহানুভূতি তো মানুষের সমাজ থেকে ওরা আশা করতে পারে। মানুষের সেবা করেছে ওরা হাজার হাজার বছর, আজ ওরা ব্রাত্য, আজ সামান্য খাদ্যের আশায় উদ্ভ্রান্ত ঘোরে। ওদের কষ্ট যন্ত্রণা ওদের অসহায়তা, অসুখ, অশান্তি, অনিরাপত্তা একমাত্র আমরাই দূর করতে পারি, ওদের জীবনের সুখ দুঃখ আমাদের ওপরই নির্ভর করে। আমাদের নিঃস্বার্থ হতে হবে। নিঃস্বার্থ হওয়াই শ্রেষ্ঠ মানবিক গুণ।
৭৭. কেন এত মুসলিম-বিদ্বেষ?
ঘন ঘন দাঙ্গা হচ্ছে ভারতবর্ষে। ভারতের উগ্র হিন্দুদের মধ্যে মুসলিম-বিদ্বেষ প্রচণ্ড। কারও কারও ঘৃণা এমনই ভয়াবহ যে পারলে মুসলমানদের ধরে ধরে খুন করে, অথবা ভারত থেকে তাড়িয়ে দেয়। সংখ্যালঘু মুসলমানদের পাশে কিন্তু দাঁড়ায় হিন্দুদের মধ্যে যাঁরা প্রগতিশীল, যাঁরা মুক্তচিন্তক, তাঁরা। একই রকম অন্যান্য দেশেও। বিশ্বের মানবতা আর মানবাধিকারের জন্য সেরা দেশ বলে খ্যাত ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়েয় বাড়ছে মুসলিম-বিদ্বেষী ইমিগ্রেন্ট-বিরোধী নয়া- নাৎসির সংখ্যা। আজ তারা কোরান পোড়াবার উৎসব করে জনসভা ডেকে। ডেনমার্কের উগ্র দক্ষিণপন্থী মুসলিম বিরোধী রাজনীতিক রাসমুস পালুডান ‘নাম’ কামিয়েছেন মুসলিম-বিরোধী কাজকর্ম ক’রে। ইউটিউবে কোরান পোড়ানোর ভিডিও আপ্লোড করতেন, একবার তো শুকরের মাংসে মুড়িয়ে কোরান পুড়িয়েছিলেন। লোকটি ২০১৭ সালে ‘স্টাম কুর্স’ নামে একটি রাজনৈতিক দল বানিয়েছেন। যে দলের লোকেরা ভয়াবহ রকম ঘৃণা পোষে উত্তর-ইউরোপে বাস করা মুসলিম অভিবাসিদের বিরুদ্ধে। পালুডান ডেনমার্ক থেকে ৩ লক্ষ মুসলিম অভিবাসিকে তাড়িয়ে দেবেন, ডেনমার্কে ইসলাম ধর্মকে নিষিদ্ধ করবেন এরকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে গত নির্বাচনে প্রায় জিতে যাচ্ছিলেন। ডেনমার্কের সবাই যে পালুডানকে সমর্থন করেন, তা নয়। বেশ ক’বার জেল খেটেছেন সোশ্যাল মিডিয়ায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর জন্য। এই চরম বর্ণবাদী রাসমুস পালুডানই আসতে চাইছিলেন সুইডেনের মালমো শহরে, তাঁর মতো উগ্র-দক্ষিণপন্থী মুসলিম-বিদ্বেষীদের অনুষ্ঠানে, ঘটা ক’রে কোরান পোড়াবার জন্য। সে কারণেই পালুডানকে সুইডেনে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তাঁকে দু’ বছর সুইডেনে ঢুকতে দেওয়া হবে না, এমনও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। পালুডানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সুইডেনের বর্ণবাদী নেতা ড্যান-পার্ক। এই ড্যান পার্কও ইমিগ্রেন্ট-বিদ্বেষ ছড়িয়ে উগ্র দক্ষিণপন্থীদের প্রিয়ভাজন হয়েছেন। পালুডান-ভক্তরা, বা সুইডেনের স্টাম কুর্সের সদস্যরা মালমোর রাস্তায় জমায়েত করেছে, বিক্ষোভ দেখিয়েছে, রাস্তায় পেট্রোল ঢেলে কোরান পুড়িয়েছে, সেই কোরান পোড়ানোর ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়ার পরই শহরের ৩০০ মুসলিম রাস্তায় বেরিয়ে আল্লাহু আকবর স্লোগান দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে, পুলিশের দিকে ঢিল ছুঁড়েছে, গাড়ির টায়ারে আগুন ধরিয়েছে। ওই আগুন থেকে ধোঁয়া উঠেই মালমোর আকাশ কালো করেছে।
৭৮. কেন এত মুসলিম-বিদ্বেষ বিশ্বের সেরা মানবাধিকারের দেশগুলোয়?
২০১৩-২০১৪ সালে সিরিয়ার ৭০,০০০ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে সুইডেন। শুধু আশ্রয়ই নয়, স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দিয়েছে। এরপর, ২০১৫ সালে সিরিয়া, ইরাক আর আফগানিস্তান থেকে আসা এক লক্ষ বাষট্টি হাজার শরণার্থীকে গ্রহণ করেছে। এর ফলেই সুইডেনে ইমিগ্রেন্ট-বিরোধী উগ্র-দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ‘সুইডেন ডেমোক্রেট’ নামে সুইডেনের উগ্র দক্ষিণপন্থী যে দলটি এখন সুইডেনের সংসদে তৃতীয় বৃহত্তম দল, সেটি নয়া-নাৎসিবাদে বিশ্বাস করে। সুইডেন ছিল বিশ্বের সবচেয়ে ভালো ওয়েলফেয়ার স্টেট বা কল্যাণব্রতী রাষ্ট্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে প্রতিটি নাগরিকের শিশুপালন, শিক্ষা, চিকিৎসা, বেকার ভাতা ইত্যাদি রাষ্ট্রই জোগায়। এখন সেই ওয়েলফেয়ার স্টেট একটু একটু করে ভেঙে পড়ছে। এর কারণ, দক্ষিণপন্থীরা মনে করে, অভিবাসীরা। অভিবাসিদের মধ্যে কাজকর্ম না ক’রে বসে বসে ভাতা খাওয়ার প্রবণতা খুব বেশি। ওয়েলফেয়ার রাষ্ট্রের সুবিধে ভোগ করতে অভিবাসীরা এক পায়ে খাড়া। শিক্ষাদীক্ষা এবং দক্ষতার অভাবে চাকরিবাকরি করাও অবশ্য অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। সুতরাং সুইডিশদের করের টাকায় চলা কল্যাণব্রতী রাষ্ট্রের দুর্বল হয়ে যাওয়ার জন্য অভিবাসিদেরই দায়ি করা হচ্ছে। ২০১৮ সালে সুইডেনের বেকার সংখ্যা ৩.৮% থেকে লাফ দিয়ে ১৫%-এ ওঠে। এসব কারণেই উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং বর্ণবাদ ইউরোপের প্রতিটি দেশেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
সুইডেনের মালমোয় আগুন জ্বলার পর নরওয়ের রাজধানী অসলোতেও আগুন জ্বলেছে। উগ্র-দক্ষিণপন্থীরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে, স্থানীয় মুসলমানরা বিক্ষোভের প্রতিবাদ করেছে। ফলে শান্তিপ্রিয় ছোট্ট দেশটিতেও দাঙ্গা বেঁধেছে। যে কারণে সুইডেনে এবং ডেনমার্কে মুসলিম-বিদ্বেষ বাড়ছে, একই কারণে নরওয়েতেও বাড়ছে সেটি। এইসব দেশে অভিবাসীদের মধ্যে মুসলিমের সংখ্যাই বেশি। সুতরাং বর্ণবিদ্বেষী, অভিবাসী-বিদ্বেষী হওয়া মানে মুসলিম-বিদ্বেষী হওয়া। এই মুসলিম-বিদ্বেষ বন্ধ করার উপায় কী? কোরান যারা পুড়িয়েছে, তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, ঘৃণা ছড়িয়ে দাঙ্গা বাঁধাবার জন্যও বর্ণবাদীদের গ্রেফতার করা হয়। কিছুদিন জেল খাটার পর এরা তো বেরিয়ে আসে। মানুষকে জেলে ভরা যায়, মানুষের বিদ্বেষকে তো জেলে বন্দি করা যায় না। সেটি তো আগুনের মতো ছুটে যায় এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। আমার মনে হয় না জেল জরিমানা ক’রে এই বিদ্বেষের সমাপ্তি ঘটানো সম্ভব। লক্ষ লক্ষ মুসলমান আজ সারা বিশ্বের অমুসলিম দেশগুলোয় বাস করছে। যারা সন্ত্রাসী, তারা তো সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত হচ্ছেই। কিন্তু যারা সন্ত্রাসী নয়, যারা ধর্মীয় মৌলবাদী নয়, সন্ত্রাসী নয়, ভায়োলেন্সে বিশ্বাসী নয়, যারা সাদাসিধে ভালো মানুষ, নিজেদের মুসলমান বলে পরিচয় দেয়, তাদের কেন ঘৃণা পেতে হবে, যেহেতু কিছু মুসলমান সন্ত্রাস করেছে বিশ্বময়? কিছু সন্ত্রাসী মুসলমানের অপকর্মের দায় এখন প্রতিটি মুসলিমকেই নিতে হবে! পাশ্চাত্যের দেশগুলোয়, যে দেশগুলোয় মুসলমানরা নিজেদের দেশ ত্যাগ করে শরণার্থী হয়েছে, বা অভিবাসী হয়েছে, সে দেশগুলোর অমুসলিম নাগরিকদের মধ্যে দিন দিন মুসলিম বিরোধিতা বাড়ছে। একে ঠেকানোর উপায় তো বের করতে হবে। ঘৃণা নিয়ে বাস করা মুসলিম অমুসলিম কারও জন্যই ভালো নয়। ঘৃণা চিরকালই শারীরিক এবং মানসিক ক্ষতির কারণ। বাস্তবতা এই যে, মুসলমানরা নিজেদের মুসলিম দেশে বাস করার চেয়ে উন্নত এবং সভ্য অমুসলিম দেশেই বাস করতে আগ্রহী, কারণ ওসব দেশে তাদের নিজের দেশের চেয়ে বেশি মানবাধিকার, বেশি মানবতা, বেশি বাকস্বাধীনতা তারা ভোগ করতে পারে, শুধু তাই নয়, বিনে পয়সায় উন্নত শিক্ষা, উন্নত চিকিৎসা এবং বিভিন্ন ভাতা পাওয়ার সুবিধেও তারা পেয়ে যায়। এ কারণে মুসলিম দেশ থেকে মানুষ ইউরোপ আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি সভ্য দেশগুলোয় পাড়ি দিতেই থাকবে। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করে কোনও লাভ নেই।
এক সময় ইউরোপের বর্ণবাদী ক্রিশ্চানরা তাদের দেশের সংখ্যালঘু ইহুদিদের প্রচণ্ড ঘৃণা করতো। ঘৃণার চূড়ান্ত রূপ দেখিয়েছিল জার্মানির হিটলার এবং তার নাৎসি দল। ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করেছে নাৎসিরা। বর্ণবাদী ক্রিশ্চানরা আজ ইহুদিদের ঘৃণা করে না। মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিদের শেকড় হলেও ইহুদিদের তারা আজ ইউরোপীয় বলেই মনে করে। ইহুদিরাও আর ক্রিশ্চানদের ঘৃণা করে না, বরং ঘৃণা করে মুসলমানদের। ইহুদি খুবই ক্ষুদ্র এক জনগোষ্ঠী, এই জনগোষ্ঠী এককালে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল ইউরোপময়। বর্ণবাদের শিকার হয়েছে, নাৎসিদের কন্সেন্ট্রেশান ক্যাম্পে অবর্ণনীয় অত্যাচার সয়েছে, গ্যাস চেম্বারে মরেছে কিন্তু দমে যায়নি, প্রতিশোধ নেয়নি, সন্ত্রাস করেনি, যুদ্ধে নাৎসিদের পরাজয় হলে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়নি, নাৎসিদের গ্যাস চেম্বারে নিয়ে নিয়ে হত্যা করেনি, বরং পড়েছে, শিক্ষিত হয়েছে, সেরা ডাক্তার, সেরা ইঞ্জিনিয়ার, সেরা বিজ্ঞানী, সেরা দার্শনিক হয়েছে, সেরা ফিল্ম মেকার, সেরা সাহিত্যিক হয়েছে। আজ ইহুদিরা সবচেয়ে বেশি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষ লোকদের মধ্যে ইহুদিদের সংখ্যাই বেশি। কারা করবে তাদের ঘৃণা?
মুসলমানদেরও শিক্ষিত হতে হবে। তা না হলে অশিক্ষিত, আর অসভ্য হয়ে জীবন কাটালে, নারী পুরুষের সমানাধিকারে, বাকস্বাধীনতায়, গণতন্ত্রে, ধর্ম নিরপেক্ষতায়, বিজ্ঞানে, বিবর্তনে বিশ্বাস না করলে, অমুসলমদের ঘৃণা করলে, ১৪০০ বছর আগের আইন মেনে চললে ঘৃণাই জুটবে, শ্রদ্ধা জুটবে না। মুসলমানদের আধুনিক হতে হবে। অমুসলিমদের দেশে অমুসলিমদের ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে ঘৃণা করে শুধু প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ, আর দাঙ্গা হাঙ্গামা ক’রে কোনও বেঁচে থাকাই সুখকর নয়। তার চেয়ে অমুসলিমদের শ্রদ্ধা অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। সভ্য শিক্ষিত সচেতন মানুষ হিসেবে পরিচিত হতে হবে। ধর্মীয় অনুভূতি এত ভঙ্গুর হলে চলবে না। একে ইস্পাত কঠিন করতে হবে। আজ কোথাও বাইবেল পোড়ালে যেমন দাঙ্গা বাঁধবে না, তেমন ভাবে কোরান পোড়ালেও যেন দাঙ্গা না বাঁধে। ক্রিশ্চানরা একসময় ভয়ংকর বর্বর ছিল। কেউ ঈশ্বরে অবিশ্বাস পোষণ করলে তাকে হত্যা করতো। সেই বর্বরতার দিন নিজেরাই শেষ করেছে ওরা। সত্যি কথা হল, ধর্ম কোনো গ্রন্থে থাকে না। ধর্ম থাকে অন্তরে। সহিষ্ণুতা, উদারতা, মানবতাই সত্যিকার ধর্ম। সেটিকেই লালন করা শিখতে হবে।
৭৯. বোরখা পরে মেয়েরা ক্রিকেট খেলবে, সাঁতার কাটবে, এভারেস্টে উঠবে
বোরখা বা খিমার পরা একটি মেয়ে তার মাদ্রাসায় পড়া পুত্রের সঙ্গে ক্রিকেট খেলছে, এই ছবি পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার পর এবং সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ভাইরাল হওয়ার পর মানুষ নানারকম মন্তব্য করছে। মন্তব্যগুলো মূলত এরকম :
১। মেয়েদের খেলাধূলা করা ইসলামে হারাম। এই মেয়ে ইসলামবিরোধী কাজ করেছে। এই মেয়ে জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে।
২। বোরখা পরে মেয়েরা সবরকমের কাজ করতে পারে, এমনকি ক্রিকেট খেলতেও পারে। বোরখা কোনও কাজের জন্য বাধা নয়।
৩। নিজের আশা আকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দিয়ে ইসলামের নির্দেশে অন্দরমহলে বন্দি থাকতে হয় মেয়েদের। এই অবস্থায় একটি মেয়ে যদি বাইরে বের হয়ে ক্রিকেটের ব্যাট হাতে নিয়ে খেলে, তাহলে এই উদ্যোগকে অবশ্যই স্বাগত জানানো উচিত।
৪। যারা খেলার ফটো তুলে পত্রিকায় ছাপিয়েছে এবং মেয়েটি যে অন্যের চাপে নয়, নিজের ইচ্ছেয় বোরখা পরেছে—তা প্রকাশ করেছে, তারা বোঝাতে চাইছে বোরখা পরা মানে অনাধুনিক হওয়া নয়। বোরখা পরেও মেয়েরা ক্রিকেট খেলতে পারে, সাঁতার কাটতে পারে, এভারেস্টে উঠতে পারে।
৫। মেয়েটির নাম ঝর্ণা আক্তার। খেলোয়াড় ছিল, দৌড়, লং জাম্প ইত্যাদি খেলতো। তার ছোট ভাই জাতীয় ফুটবল দলে খেলে। ছোট ভাইকে খেলা ছাড়তে হয়নি, কিন্তু মেয়েটিকে মেয়ে বলেই খেলা ছাড়তে হয়েছে। এই খেলোয়াড় মেয়েটিকে এখন গৃহবধূর জীবন বরণ করতে হয়েছে। অনেকে বলছে মেয়েটি ক্রিকেট খেলছে। না, মেয়েটি ক্রিকেট খেলছে না, সে তার ছেলেকে সঙ্গ দিচ্ছে। নিজের সাধ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে তার পুত্রের সাধ আহ্লাদ পূরণ করছে। আদর্শ মা হিসেবে মেয়েরা এভাবেই বিজ্ঞাপিত হচ্ছে। সংসারের জন্য, সন্তানের জন্য খেলোয়াড় তাঁর খেলা ছেড়ে দেবেন, শিল্পী গান ছেড়ে দেবেন, চিত্রকর ছবি আঁকা ছাড়বেন, পেশাজীবী পেশা ছাড়বেন, শিক্ষার্থী পড়ালেখা ছাড়বেন, ডাক্তার হাসপাতাল ছাড়বেন, নাট্যকর্মী মঞ্চ ছাড়বেন… তবেইনা নারী ‘ভালো মা’ ‘ভালো মেয়েমানুষ’ হয়ে উঠবেন!! নারীর নিজের কোন জগৎ থাকবে না, যোগ্যতা থাকবে না, পরিচয় থাকবে না, সক্ষমতা থাকবে না, দক্ষতা থাকবে না, নারী কেবল সন্তানের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবেন, স্বামীর সেবা করবেন, সবাইকে সুখে শান্তিতে রাখবেন, তবেইনা নারীর সার্থকতা!! ‘মাতৃত্বেই নারীর সার্থকতা’, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’।
৬। হিজাব বোরখা নিকাব আবায়া খিমার কোনওটাই মেয়েদের ‘চয়েজ’ নয়, ঠিক যেমন পতিতাবৃত্তি মেয়েদের ‘চয়েজ’ নয়। এসবই আদিকাল থেকে মেয়েদের জন্য পুরুষের ‘চয়েজ’। পুরুষের চয়েজের চাপাতির তলায় মেয়েদের ইচ্ছেরা বলি হয়। মেয়েরা ভুল করে মনে করে এ বুঝি তাদের ইচ্ছে, তাদের ‘চয়েজ’। পুরুষেরা কেন পুরুষদের জন্য বোরখা নিকাব খিমার আবায়া ‘চয়েজ’ করে না? কেন পতিতাবৃত্তি তাদের ‘চয়েজ’ নয়? কারণ তারা জানে যে এসব মানুষের স্বাধীনতা, অধিকার সব নষ্ট করে দেয়, মানুষকে কারাগারে বন্দি করে।
৭। ছবি দেখে মনে হচ্ছে আফগানিস্তানের ছবি। তাহলে কি বাংলাদেশ আফগানিস্তান হয়ে যাচ্ছে?
৮। একজন মাদ্রাসাপড়ুয়া ছেলে ক্রিকেট খেলছে, এটা প্রগতির লক্ষণ।
একজন অবরোধবাসিনী মা স্টেডিয়ামে এসে সন্তানের সঙ্গে ক্রিকেট খেলছেন, এটা সমাজ অগ্রগতির লক্ষণ।
৯। কোন নারীই নিজের ইচ্ছেয় পছন্দ করে বোরখা পরে না। নারীকে নির্দেশ দেওয়া আছে যে তুমি তোমাকে আবৃত করে রাখবে। তুমি হচ্ছো সুস্বাদু রসগোল্লার মতো, পুরুষের খাওয়ার জিনিস। তোমাকে দেখলে চোখের যেনা। তুমি নিজেকে অনাবৃত রেখে সেই যেনায় অংশ নিচ্ছ, সেই জন্যে তুমি জাহান্নামের আগুনে অনন্তকাল জ্বলবে ইত্যাদি। এটা হচ্ছে তার বিশ্বাসের নির্দেশ। সাথে আছে সামাজিক এবং পারিবারিক চাপ। পর্দা কর, হিজাব পর বোরকা পর, তাহলে লোকে তোমাকে ভালো বলবে, নাহলে মন্দ বলবে।
১০। ছোটবেলা থেকে যাকে নরকের ভয় দেখানো হয়েছে, আগুনে জ্বালাবার আর অনন্তকাল শাস্তি দেয়ার ভয় দেখিয়ে ছোটবেলা থেকেই তাকে এভাবে গড়ে তোলা হয়েছে, সে স্বাভাবিকভাবেই বোরখাই পরবে। সামাজিক এই ধারণা তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, এবং তাকে বোঝানো হয়েছে, বোরখা সে নিজেই পছন্দ করে বেছে নিয়েছে। সে ভেবেছে সে নিজেই ইচ্ছে করে বোরখা পরেছে, অথচ তার এই ইচ্ছেটি খুব সুকৌশলে তাকে করতে বাধ্য করা হয়েছে। তার এই ইচ্ছে স্বাধীনভাবে নেয়া কোন পছন্দ নয়। ভীতির মাধ্যমে আদায় করে নেয়া সম্মতি। যার পেছনে কাজ করেছে অন্ততকালের শাস্তির ভয়, সামাজিকভাবে হেয় করার আর ধর্ষণের পরোক্ষ হুমকি। বোরখা পরে ক্রিকেট খেলা ওই নারী ইসলামের একটি শেকল ভাঙতে পেরেছে। এটাই তো অনেক বড় ব্যাপার। অন্য শেকলগুলো সে ভাঙতে পারুক না পারুক, সে অনুপ্রেরণা হয়ে উঠুক অন্য নারীদের। পাখীকে খাঁচায় বন্দী করে রাখলে সে খাঁচার ভেতরেই উড়তে চাইবে। এমনকি ডানা কেটে ফেললেও সে উড়তে চাইবেই।
১১। বোরকা না শর্টস, আফগান না বাংলা, চয়েস না ফোর্সড এসব আলাপে আমাদের ব্যস্ত রেখে মিড়িয়া কিন্তু এক দারুণ দাবার চালে আপসে দু’দুটো কিস্তিমাত করে ফেলেছে তুমুল হই চই করে। ঝর্ণা আক্তারের মুখে দুটো পুরোনো অথচ ভয়ংকর শক্তিশালী পুরুষতান্ত্রিক স্টেটমেন্টকে নতুন করে বেশ পোক্ত করে দিয়েছে। ”…..আমার অ্যাথলেট জীবন আমি পিছে ফেলে এসেছি, সামনের নিজের জন্য কিছু চাই না। কেবল চাই আমার ছেলেটাকে বিকেএসপি পর্যন্ত পৌঁছে যেন দিতে পারি।”
১২। মা যখন সন্তানকে প্রকাশ্যে স্তন্যপান করান, তখন তাতে আমরা মা সন্তানের ভালোবাসা বা ভালোবাসায় পূর্ণ কাটানো সময় খুঁজে পাই না। তখন আমরা তাতে কেবল খুঁজে পাই নগ্নতা আর অশ্লীলতা। মা যখন খিমার পরে ক্রিকেট খেলে তখন আমরা ওখানে মাতৃত্বের বন্ধন আর অতি সুন্দর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ সময়ের উপস্থাপন দেখতে পাই।
১৩। অনেকে মনে করে বোরখা পরা বা পর্দা করা মানে সে হয়তো বাইরে গিয়ে অন্যদের মতো লেখাপড়া, খেলাধূলা, চাকরি, ব্যবসা এসব স্বাভাবিক কাজ করতে পারবে না, যা সম্পূর্ণ ভুল। বোরখা পরেও ক্রিকেট খেলা যায় এই সচেতনতা বাংলাদেশের মতো একটি ৯৯% ইসলামিক দেশে অত্যাধিক জরুরি। পর্দার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে আমাদের মুশফিক-মাহমুদুল্লাহ ভাইয়েরা তাদের পরবর্তী একটা সিরিজে দলীয়ভাবে বোরখা পরিধান করে মাঠে নেমে খেলে সবাইকে দেখিয়ে দিতে পারে আসলে বোরখা পরেও ক্রিকেট খেলা সম্ভব, তাহলে হয়তো আরও অনেক বোন পর্দার ব্যাপারে উৎসাহী হবে। আমাদের বুঝতে হবে, পর্দার ভিতরেই নারী সব করতে পারে কেননা ইসলাম নারীকে দিয়েছে সর্বোচ্চ সুবিধা। আমিন।
১৪। পোশাককে ওভারলুক করে সন্তানের প্রতি মায়ের স্নেহটাকেই বড় করে দেখা উচিত।
১৫। দাসত্বকে বরণ করে বিপ্লবের ডাক দেয়া যায় না, সন্তানের মুক্তির আগে নিজের মুক্তির বিষয়টি বিবেচনায় আনা উচিত।
আলোচনা অনেক সময় ঝর্ণা আক্তারের বোরখা পরে ছেলের সঙ্গে ক্রিকেট খেলার বাইরে চলে গিয়ে বোরখা নিয়ে এবং মিডিয়ায় একে হাইলাইট করার উদ্দেশ্য নিয়ে হয়েছে। যা কিছু নিয়ে হোক, এই যে বিতর্ক চলছে, এটি খুব দরকারি। যে কোনও বিতর্ককেই স্বাগত জানানো উচিত। সুস্থ সমাজেই বিতর্ক হয়। বিতর্ক হলেই মানুষ নানা মত সম্পর্কে জানতে পারে এবং নিজের অবস্থানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যে সমাজে বিতর্কের জায়গা নেই, সেই সমাজ ভয়ংকর। বাংলাদেশ এখনও আফগানিস্তান হয়ে যায়নি, এখনও এ দেশ পিছিয়ে থাকা আরব দেশগুলোর মতো নয়। হিজাব বোরখা খিমার নিকাব আবায়া ইত্যাদি যদি বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তবতা, তাহলে মেয়েদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় চাকরি ব্যবসা খেলাধূলা কোনও কিছুতেই যেন পর্দা কোনও বাধা না হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ এখনও ইরান হয়ে যায়নি। পর্দা করা বাধ্যতামূলক নয়। পর্দা না করারও অধিকার এখন অবধি বাংলাদেশে আছে। আমি অবাক হব না যদি একসময় ইরান এবং সৌদি আরবের মতো পর্দা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। গত তিন দশকে বাংলাদেশে মসজিদ মাদ্রাসা, নামাজ রোজা, পর্দা পুশিদা বেড়েছে। এসব বাড়ার কারণে নৈতিকতা বেড়েছে তা কিন্তু নয়। বাইরের আবরণ বদলে গেছে তা ঠিক। প্রদর্শন বেড়েছে। নীতিবোধ আগে যা ছিল, তা-ই আছে অথবা কমেছে। নৈতিকতা কিছু কম ছিল না বাংলাদেশে। সাত এবং আটের দশকে আমি ইস্কুল কলেজে পড়েছি। ইস্কুল কলেজের মেয়েরা তখন হিজাব বোরখা পরতো না, নামাজ রোজাও খুব একটা করতো না, কিন্তু নীতিবোধ সবারই ছিল, ভালোমন্দের জ্ঞান ছিল। মন্দটাকে এড়িয়ে চলতো, ভালোটাকে গ্রহণ করতো। পুরুষের কপালেও নামাজের দাগ ছিল না সাত/আটের দশকে, দাড়ি গোঁফে, পোশাক আশাকে ধর্মের ছোঁয়া এখনকার মতো লাগেনি। কিন্তু মানুষ হিসেবে অধিকাংশই মন্দ ছিল না। প্রচুর আদর্শবাদীর দেখা মিলতো। চোর ডাকাত খুনী ধর্ষক মিথ্যুক জালিয়াত আগেও ছিল, এখনও আছে। তবে আগে তাদের শরীরে এত বেশি ধর্মীয় পোশাক ছিল না, এখন আছে। ধর্মীয় পোশাক আগে মানুষ লোভ লালসা বিসর্জন দিয়েই গায়ে চড়াতো। এখন জিরো নৈতিকতা নিয়েই গায়ে চড়ায়। এতে ধর্মীয় পোশাক পরা মানুষের ওপর থেকে অনেকের বিশ্বাস সরে যাচ্ছে। এ ভালো লক্ষণ নয়।
৮০. মসজিদে মৃত্যু আর নয়
মসজিদ পবিত্র স্থান। পবিত্র স্থান অবৈধভাবে নির্মিত হলে বড় দুঃখ হয়। গ্যাস পাইপলাইনের ওপর যারা মসজিদ নির্মাণ করে, তারা নিশ্চয়ই রাজউকের অনুমতি ছাড়াই করে। যে কোনও সময় গ্যাসের পাইপে দুর্ঘটনা ঘটে নিরীহ নামাজিদের মৃত্যু হতে পারে, জেনেই করে। যাদের কাছে মানুষের জীবনের মূল্য নেই, তারা কি ভালো লোক? তাদের দ্বারা সমাজের আদৌ কি কোনও উপকার হয়? এই যে ২৮ জন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হল একটি মসজিদে, সেটির দায় কাদের? অপরাধীদের কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়াটা জরুরি যেন ভবিষ্যতে আর কেউ অবৈধ ভাবে মসজিদ নির্মাণে উৎসাহ না পায়। কোনও বাড়ি-ঘর দালান-কোঠাই অবৈধভাবে বানানো উচিত নয়। যেসব স্থানে প্রচুর মানুষের সমাগম হয়, সেসব নির্মাণে কোনওরকম খুঁত রাখা রীতিমতো অপরাধ। ধর্ম-ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম এত বেড়েছে যে আজ তারা পবিত্র স্থানকে অপবিত্র করতে এবং ঝুঁকিপূর্ণ করতে দ্বিধা করছে না।
মসজিদের ছ’টি এসিতে বিস্ফোরণ ঘটেছে, খবরটি শুনে তো আমি হতবাক। এক মসজিদের ভেতর ছটি এসি? মসজিদে যে এসি থাকে, সেটাই তো জানা ছিল না। ‘এই আরাম আয়েশ কবে থেকে’? এক দেশি ভাইকে সেদিন জিজ্ঞেস করলাম। ও বললো, ‘আজকাল মসজিদগুলো এক একেকটা রাজদরবারের মতো’। ছোটবেলায় আমি যে মসজিদ দেখেছি, সেসব ছিল সাধারণ। মার্বেল পাথর, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ইত্যাদির বালাই ছিল না। ধনী গরিব সেসব মসজিদে এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তো। মসজিদের যে দানবাক্স থাকে, সেসব বাক্সে প্রচুর দরদী মানুষ টাকা পয়সা দান করেন। সেসব টাকায় মসজিদকে রাজা বাদশাহর দরবারখানা না বানিয়ে গরিবদের দেওয়া উচিত, তাদের খাওয়ায়, শিক্ষায়, চিকিৎসায় ব্যয় করা উচিত।
একসময় মুসলমানদের খানকাশরিফ ছিল। সেই খানকাশরিফে সব ধর্মের মানুষের প্রবেশ অবাধ ছিল। কোনও দরিদ্র, কোনও বিধর্মী, কোনও ছোটজাতকে দূরে ঠেলে দেওয়া হত না। ব্রাহ্মণ শূদ্র আশরাফ আতরাফ এক থালা থেকে খাবার খেতো। যে ক্ষুধার্ত তাকে খাদ্য দেওয়া হত, যে আশ্রয়হীন তাকে আশ্রয় দেওয়া হত, যে বস্ত্রহীন তাকে বস্ত্র দেওয়া হত, যে বুদ্ধিপরামর্শ চাইতো, তাকে বুদ্ধিপরামর্শ দেওয়া হত। খানকাশরিফের উদারতার কারণে ভারতবর্ষের বহু অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করেছিল। কোথায় সেই উদারতা আজ? আজ মানুষের জন্য খরচ না করে ইমারতের জন্য খরচ করা হচ্ছে। মসজিদের চাকচিক্য বাড়লে পুণ্য বাড়ে না, মানুষের অন্তর শুদ্ধ হলে, মানুষ উদার হলে,ক্ষমাশীল, দয়াশীল হলে পুণ্য বাড়ে। যারা নবীজীর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন, তারা কি শুধু দাড়ি রেখে, জোব্বা পরে, মেসওয়াক করেই দায়িত্ব শেষ করতে চান? নবীজী কি তাঁর গরম-দেশে এসির আরামে বসে নামাজ পড়তেন? নবীজী মরুভূমির যে গরম সহ্য করেছেন, সেই গরম তো তাঁর উম্মতদেরও সহ্য করা উচিত। অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন তিনি, তাঁর মতো সাধারণ জীবন তো তাঁর উম্মতদেরও যাপন করা উচিত। আজকাল হুজুরদের দেখি গাড়িতে, এমনকি হেলিকপ্টারে চড়েও ওয়াজ করতে যান। লাখ লাখ টাকা নেন ওয়াজের জন্য। অথচ কোরান হাদিসের কথা তো বিনামূল্যেই শোনানো উচিত। ধর্ম যদি বাণিজ্য হয়ে ওঠে, তবে ধর্ম যে কোনও দ্রব্য সামগ্রীর মতোই মানুষ ওতে ভেজাল মেশাবে। ধর্ম তো মুনাফা লোটার জন্য নয়।
এ খবর বড় দুঃখজনক যে মসজিদে নিষিদ্ধ মাদক ইয়াবা লুকিয়ে রাখা হয়, কিছু ইমাম জড়িত মাদক ব্যবসায়। কিছু ইমাম বাচ্চাদের ধর্ষণও করেন। কিছু ইমাম আবার মসজিদের জন্য বরাদ্দ টাকা পয়সা নিজের পকেটে ঢোকান। মসজিদের বাইরে চিরকাল সাইনবোর্ড দেখেছি ‘জুতা চোর হইতে সাবধান’। কিছু লোক নাকি মসজিদে নামাজ পড়ার পর অন্যের জুতো পায়ে গলিয়ে দিব্যি বাড়ি চলে যায়। চোরও তাহলে মসজিদে গিয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে মাথা নোয়ায়! মুশকিল হল মাথা নোয়ালেই চোর ডাকাত ধর্ষক খুনী ভেবে বসে তাদের সকল অপরাধের জন্য তারা ক্ষমা পেয়ে গেছে। মানুষের ভয়ংকর ক্ষতি করার পর, সর্বনাশ করার পর ক্ষমা কেন পেয়ে যাবে বদ লোকেরা? তাহলে তো যাবতীয় অন্যায় নিশ্চিন্তেই করবে তারা, কারণ নামাজ রোজা হজ করলেই ক্ষমা পেয়ে যাবে বলে তারা যেহেতু বিশ্বাস করে। আল্লাহ অতি মহান, অতি উদার, সে কারণে অপরাধীকেও না হয় ক্ষমা করে দেন। কিন্তু রাষ্ট্রের উচিত তাদের শাস্তি দেওয়া। শাস্তি না দিলে ধর্মের নামে হেন অপকর্ম নেই যে এরা করবে না। তেতো সত্য এই, প্রচুর বদ-বদমাশ ধর্মকে নিজের অপকর্ম আর অপরাধ আড়াল করার জন্য ব্যবহার করে। সমাজের সকলের উচিত বদ-বদমাশদের চিহ্নিত করা। ধর্মের লেবাস পরলেই তাকে ক্ষমা করা উচিত নয়, মসজিদ মাদ্রাসায় দৌড়োলেই কারও সাত খুন মাফ হয়ে যায় না।
অবৈধভাবে নির্মিত মসজিদ এবং যে সব মসজিদে অবৈধ কাজ কর্ম চলে, সেইসব মসজিদের দরজায় তালা লাগিয়েও সরকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। মানুষকে বুঝিয়ে দিতে পারে যে অবৈধভাবে কোনও ইমারতই, এমনকি মসজিদও নির্মাণ করা যাবে না। কারণ বারবার দুর্ঘটনা ঘটলে লোকে মসজিদে যেতেই ভয় পাবে। আল্লাহতায়ালা সদা সর্বদা মসজিদকে রক্ষা করবেন— এই বিশ্বাসও মানুষের মন থেকে উঠে যাবে। অবৈধ কাজকর্ম চলতে থাকলে লোকে মসজিদকে পবিত্র এবং নিরাপদ স্থান বলে ভাববে না। ধর্মের ওপর লক্ষকোটি নিরীহ মানুষ নির্ভরশীল, বিশ্বাসই তাদের ভরসা, এই বিশ্বাস যদি টুকরো টুকরো হয়ে যায়, তাহলে তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন কিছু থাকবে না।
মসজিদকে নিরাপদ এবং মানুষের কল্যাণের জন্য উৎসর্গ করতে চাইলে আরও কিছু পদক্ষেপ করতে হবে। যেমন শিয়া, আহমদিয়া, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, এবং নারীর প্রতি যেন ঘৃণার উদ্রেক হয়, এমন কোনও বক্তব্য যেন কোনও ইমাম পরিবেশন না করেন। মসজিদ হবে মানবতার জায়গা, কোনও হিংসে, ঘৃণা, বর্বরতা, সন্ত্রাস ছড়ানোর জন্য মসজিদকে ব্যবহার করা ভয়ানক অন্যায়। মসজিদ রাজনীতির জায়গা নয়। মসজিদে ইবাদতের জায়গা। যত উদার হবে মানুষ, ইবাদত তত বিশুদ্ধ হবে। ইসলামকে উচ্চ মর্যাদায় আসীন করার দায়িত্ব মুসলমানের। ইসলামকে ঘৃণা মুক্ত, বিদ্বেষ মুক্ত করার দায়িত্ব মুসলমানের, আর কারও নয়।
আমার মা’র মতো ধার্মিক আমি আজকাল আর দেখি না। মা নামাজ রোজা করতেন। কোরান পড়তেন নিয়মিত। কোরান বুঝে পড়ার জন্য আরবি শিখেছিলেন। আমার মা সকলের মঙ্গল চাইতেন। আমাদের বাড়ি ছিল হিন্দু পাড়ায়। মা হিন্দুদের যে কোনও অসুখে অভাবে পাশে দাঁড়াতেন। তাদের মানুষ বলে ভাবতেন। দরিদ্রর দারিদ্র ঘোচানোর জন্য সবরকম চেষ্টা করতেন।সমাজে সমতা চাইতেন। কারও মানবাধিকার লঙ্ঘন করা একেবারেই মেনে নিতেন না। মা অসম্ভব সৎ ছিলেন। অসম্ভব উদার ছিলেন। এমন ধার্মিকই তো কাম্য। কিন্তু দিন দিন লক্ষ করছি, যত বেশি ধার্মিক বাড়ছে দেশে, তত বেশি ভেজাল ধার্মিকের সংখ্যা বাড়ছে। অসৎ, দুর্নীতিবাজ, মিথ্যুক, ধর্ষক, খুনীও আজকাল দাবি করে তারা ধার্মিক। তারা মসজিদ মাদ্রাসাকে, এমনকি ধর্মকেও নিজের স্বার্থে কুক্ষিগত করেছে। এই বদ-বদমাশদের হাত থেকে ধর্মকে বাঁচাতে হবে।
৮ ১. বিয়ে নারীকে কী দেয়?
ব্যান্ড তারকা জেমসের প্রথম স্ত্রী রথিকে মনে আছে? ফটোসুন্দরী হয়েছিলেন, এক সময় বিজ্ঞাপনচিত্রে, নাটকে, টেলিছবিতে এমনকি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। সেই রথিকে বিয়ের পর অভিনয় ছাড়তে হয়েছিল, কারণ স্বামীর আদেশ। স্বামী জেমস সোজা বলে দিয়েছিলেন নাটক সিনেমা করা চলবে না। শেষ অবধি দুটো সন্তান জন্মাবার জেমস তালাক দেন স্ত্রীকে। অন্য একটি বিয়েও তখন তিনি করে নিয়েছেন। সন্তান নিয়ে রথিকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হয় ২০০৩ সালে। সেই থেকে তিনি নিজেই সন্তান বড় করেছেন। আমাদের জনপ্রিয় জেমস সন্তান লালনপালনে কোনওরকম সাহায্য করেননি, নিজের ধনদৌলতের কিছুই খরচ করেননি তাদের জন্য। বিয়ের পর রথিকে তাঁর অভিনয় থেকে সরে আসতে হয়েছিল, জেমসকে কিন্তু তাঁর গান থেকে সরে আসতে হয়নি। আজও সমাজে এমন ঘটনা ঘটে। মেয়েদের স্বাধীন এবং স্বনির্ভর হওয়ার পথে শিক্ষিত সচেতন পুরুষ বলে যাঁদের বিশ্বাস করি, তাঁরাই সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ান।
বিয়ে প্রথাটি আমাদের এই উপমহাদেশে নারী-পুরুষের বৈষম্যের ওপর এই একবিংশ শতাব্দীতেও দাঁড়িয়ে আছে। পৃথিবীর সকল প্রাণী যেমন প্রতিনিয়ত বিবর্তিত হচ্ছে, প্রাণীর তৈরি নিয়মনীতিগুলোরও বিবর্তন ঘটছে। কিন্তু বিয়ের বিবর্তন প্রায় হচ্ছে না বললেই চলে। এখনও মেয়েকে শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে উঠতে হয়। হিন্দু মেয়েদের সিঁথিতে সিঁদুর পরতে হয়, নানা কুসংস্কারের প্রতীক শাঁখা, পলা, লোহাও পরতে হয় হাতে। গলায় পরতে হয় মঙ্গলসূত্র। দীর্ঘদিন যাবৎ নারীর সমানাধিকার জন্য দেশে বিদেশে আন্দোলন চলছে, ওতে প্রভাবিত হয়ে কিছু শিক্ষিত এবং সচেতন মেয়ে শাঁখা সিঁদুর পরা বাদ দিয়েছেন। কোথায় প্রগতিশীলরা অন্তত মেয়েদের এই স্বাধীনতাকে সাদরে গ্রহণ করবেন, তা নয়, গৌহাটি হাইকোর্টের বিচারকরাই সেদিন প্রমাণ করলেন এখনও বৈষম্যকে আঁকড়ে ধরে আছে সমাজের প্রভাবশালী ক্ষমতাধর মানুষেরা। গৌহাটির হাইকোর্ট বিবাহ বিচ্ছেদের একটি মামলায় বিচ্ছেদ মঞ্জুর করার পক্ষে কারণ দেখালেন, স্ত্রীটি যেহেতু শাঁখা সিঁদুর পরছেন না, সেহেতু ধারণা করা যায় তিনি তাঁর স্বামীকে আর স্বামী হিসেবে মনে করেন না। বিচারকদের মতে শাঁখা-সিঁদুর না-পরা মানে নিজেকে অবিবাহিতা মনে করা বা সেই বিয়ে মেনে না-নেওয়া। এটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং নারীবিরোধী মানুষের বিচার হতে পারে, একে আদালতের বিচার বলে তো মানা যায় না। যে আদালতের কাজ লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠা করা, মানবাধিকার এবং নারীর সমানাধিকার রক্ষা করা, সেই আদালতই যদি বিয়ের চিহ্ন হিসেবে শাঁখা-সিঁদুর পরা মেয়েদের জন্য বাধ্যতামূলক বলে মনে করেন, তাহলে নিশ্চয়ই তা দুর্ভাগ্যজনক। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন যতদিন না হবে, ততদিন নারীকে ভুগতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক তো বটেই। ভুলেই গিয়েছিলাম আদালত সমাজের বাইরের কিছু নয়। এর বিচারকরাও এই সমাজেরই লোক।
মুশকিল হল, বাপ মায়ের বাড়িতে বিয়ে করে বউ তোলে পুরুষেরা, আজো। পুরুষেরা প্রাপ্তবয়স্ক হতে চায় না। তারা মা বাপের ‘কোলের শিশু’ হয়ে আজীবন কাটিয়ে দিতে চায়। বাপ মা ভাই বোন গায়ে গতরে বড় হওয়া পুরুষটির দেখভাল করে, তারপর যোগ হয় বধূ। আরেক সেবাদাসি। প্রাপ্ত বয়স্কের মতো নিজের দায়িত্ব নেওয়ার কাজটি আজও আমাদের বেশিরভাগ পুরুষ দ্বারা সম্ভব হচ্ছে না। বধূটি সম্পূর্ণ একটি নতুন পরিবেশে হিমশিম খায়। সবার মন রক্ষা করে চলতে হবে, না হলে লোকে তাকে মন্দ বলবে। নিজের স্বকীয়তা স্বাধীনতা সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে শ্বশুরবাড়িতে থাকতে হয় মেয়েদের। এক্ষুনি আমি জানি শয়ে শয়ে মেয়ে এসে বলবে তাদের শ্বশুর শাশুড়ি কত ভালো, একেবারেই তাদের স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে হয়নি। কিন্তু কথা হচ্ছে, একটি মেয়েকে কেন স্বামীর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে বাস করতে হবে, স্বামীকে তো মেয়ের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে বাস করতে, এবং সবার মন জুগিয়ে চলতে বলা হয় না! বিয়ে হলে একটি মেয়েকে আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধব, পাড়া প্রতিবেশী, চেনা পরিবেশ, চেনা এলাকা ত্যাগ করে স্বামীর বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়। একটি পুরুষকে বিয়ের কারণে কিছুই ত্যাগ করতে হয় না। অসাম্যের একটা সীমা থাকা দরকার। বিয়ে সব সীমা ছাড়িয়ে যায়।
আসামের যে লোকটি স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন, তাঁর অভিযোগ ছিল, স্ত্রী শ্বশুরবাড়িতে বাস করতে চান না। এটিই লোকটির তালাক দেওয়ার কারণ। স্ত্রী যদি পছন্দ না করেন স্বামী ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে বাস করতে, তখন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষেরা স্ত্রী নিয়ে আলাদা সংসার করেন, কিন্তু মা বাপের কোলের শিশুরা মা বাপের সঙ্গে বাস করার জন্য গোঁ ধরেন, স্ত্রীকে ত্যাগ করতে আপত্তি নেই তাঁদের। আমাদের পুরুষেরা কি শুধু মা বাপের কোলের শিশু? তাঁরা তো ছলে বলে কৌশলে স্ত্রীদেরও কোলের শিশু বনে যান। স্ত্রীরা তাঁদের নাওয়া খাওয়া থেকে শুরু করে তাঁদের জুতো মোজারও তদারকি করবেন— এটাই চান তাঁরা।
আসামের অপদার্থ লোকটির প্রাপ্তবয়স্ক এবং দায়িত্বশীল পুরুষ হওয়ার কোনও ইচ্ছে নেই। তাই তালাকের আয়োজন। দুজন মানুষ একত্রে বাস করতে না চাইলে, দুজনের মধ্যে ভালোবাসা অবশিষ্ট না থাকলে, কেউ একজনও ভেবে চিন্তে তালাকের সিদ্ধান্ত নিলে কোনওরকম সমস্যা ছাড়াই তালাক সম্পন্ন হওয়া উচিত। হয়েওছে তাই। তালাক নিয়ে আপত্তি নেই। কিন্তু বিচারকের মন্তব্যটি নিয়ে আপত্তির আওয়াজ কানে আসছে। বিচারক বলেছেন বিবাহিত মেয়েদের শাঁখা সিঁদুর পরতে হবে। ওদিকে বিবাহিত পুরুষ মানেই কিন্তু অবিবাহিত পুরুষ। একটি পুরুষকে দেখে কেউ বলতে পারবে না সে বিবাহিত না কি অবিবাহিত। বিবাহিত এবং অবিবাহিত পুরুষেরা দেখতে একই। বিবাহিত পুরুষদের সকাল সন্ধে কোনও বিবাহের চিহ্ন বহন করতে হয় না। তাদের কোনও শাঁখা সিঁদুর পরতে হয় না। অসাম্যের একটা সীমা থাকা দরকার। সীমা যে নেই, আমরা জানি। বলছি, মেয়েদের, এমনকি স্বামীকে ভালোবাসেন এমন মেয়েদেরও যদি ইচ্ছে না করে শাঁখা সিঁদুর পরতে? তাহলে নিশ্চয়ই তাদের স্বাধীনতা থাকা উচিত ওসব না পরার? বিয়েটা বন্দিত্ব না হয়ে মুক্তি কেন হতে পারে না?
ইউরোপ আমেরিকায় বিবাহিত ক্রিশ্চান আর ইহুদি পুরুষ এবং নারী উভয়েই অনামিকায় বিয়ের অঙ্গুরি পরে। ওটিই তাদের বিয়ের চিহ্ন। কোনও দম্পতির যদি ইচ্ছে না হয় অঙ্গুরি পরার, পরে না। সব ধর্মের মানুষদের মধ্যে এই স্বাধীনতা থাকা উচিত। মুসলমান পুরুষকে তো নয়ই, মুসলমান মেয়েকেও বিয়ের কোনও চিহ্ন বহন করতে হয় না, ব্যাপারটি ভালো। কিন্তু বিয়ের চিহ্ন বহন করতে হয় না বলে মুসলমান মেয়েরা যে অন্য ধর্মের মেয়েদের চেয়ে অধিক স্বাধীনতা ভোগ করে তা নয়। মুসলমান মেয়েরাও একই রকম পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভুক্তভোগী।
বিয়েটা দিন দিন ক্রমশ অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে। প্রভু-দাসির সম্পর্ককে আইনত বৈধ করার জন্য বিয়ে নামক ব্যবস্থা শুরু হয়েছিল। মেয়েদের দুর্বল, পরনির্ভর ভাবা হত বলে, মেয়েদের শুধু যোনী আর জরায়ু ভাবা হত বলে শুরু হয়েছিল। মেয়েদের শরীরকে পুরুষের অধিকারভুক্ত করার জন্য শুরু হয়েছিল। ওইসব কারণের প্রতিটি এখন অকেজো এবং অর্থহীন। যে মেয়ে দুর্বল নয়, যে মেয়ে স্বনির্ভর, যে মেয়ের পরিচয় যোনী আর জরায়ু নয়, যে মেয়ে নিজের স্বাধীনতা এবং অধিকারে বিশ্বাস করে, যে মেয়ে প্রভু-দাসির সম্পর্ক মানে না, সমতা এবং সমানাধিকারে বিশ্বাস করে, সে মেয়ে বিয়েটা কোন দুঃখে করবে? বিয়েটা দরকার কিছু কোলের শিশু হওয়ার বাসনায় বুড়ো আঙুল চুষছে যে পুরুষগুলো, তাদের। কোনও বোধ বুদ্ধি সম্পন্ন প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষিত সচেতন নারী পুরুষের জন্য বিয়ের দরকার নেই।
আসলে বিয়ের মতো একটি প্রাচীন প্রথাকে টিকিয়ে রাখতে হলে এর পরিবর্তন এবং বিবর্তন জরুরি। এর নারীবিদ্বেষী আদি রূপটিকে বিদেয় করে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের ভিত্তিতে একে আধুনিক করতে হবে। বিয়ে যেন স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ককে প্রভু-দাসির সম্পর্ক না করে। দুজনের ভালোবাসা আর বিশ্বাসের ওপর যেন গড়ে ওঠে এই সম্পর্ক। কারও মানবাধিকার যেন খর্ব না হয় এই বিয়ের কারণে। বিয়ে যেন বন্দি না করে মেয়েদের, এ যেন হয়ে ওঠে বরং সবরকম বন্দিত্ব থেকে মুক্তি, এ যেন হয়ে ওঠে স্বাধীনতার আরেক নাম।
৮২. সামাজিক নেটওয়ার্কে নারীর নিরাপত্তা
যা সমাজে আছে, তা সামাজিক নেটওয়ার্কে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। সমাজের মানুষ অন্তর্জালে ধরা পড়েছে। সমাজের মানুষের যে মানসিকতা, সেই একই মানসিকতা আমরা অন্তর্জালের মানুষের মধ্যে দেখি। তবে, একটু বেশিই দেখি। কারণ অনেকে আড়ালে থেকে নিজের মত প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। যে মেয়েটির বা ছেলেটির ইচ্ছে হয় কবিতা লিখতে, আশেপাশের মানুষকে যে কথা সে জানাতে লজ্জাবোধ করে, সে কথা সে একঝাঁক অচেনা মানুষের হাটে হুট করে জানিয়ে দেয়, নিজেকে আড়ালে রেখে জানিয়ে দেয়, যাদের জানায় তারাও আড়ালে, সে জন্য জানাতে সে সংকোচবোধ করে না। অথবা মানুষ যেন দেখে, যেন শোনে, কোনও একদিন নিজে একটি গান গেয়ে ফেলে। অনলাইনে প্রতিভার স্ফুরণ দেখি। প্রতিভার ওপর আক্রমণও দেখি। যা সবচেয়ে বেশি দেখি, তা হল মেয়েদের যেভাবে হেনস্তা করে পুরুষেরা, যেভাবে গালিগালাজ করে, যে নোংরাভাবে প্রকাশ করে তাদের নারীবিদ্বেষ, যে উৎকটভাবে ছুড়ে দেয় ঘৃণা, যে জঘন্যভাবে নারীকে অপমান করে, যে কুৎসিতভাবে নারীকে মানসিক নির্যাতন করে।
পুরুষেরা যে ভাষায় নারীকে অপদস্ত করে, হেনস্থা করে, সেই ভাষার উল্লেখ এখানে করা যাবে না, সেই বাক্যগুলো উদ্ধৃত করাও যাবে না, কারণ সেই ভাষাটি এতই কুৎসিত, সেই বাক্যগুলো এতই অকথ্য এবং অসভ্য এবং অশ্লীল যে এই পত্রিকার সম্পাদক তা ছাপার অযোগ্য বলে বিবেচনা করবেন। পাঠক নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন, নারীকে ছোট করতে, কলুষিত করতে, নিচু করতে, বিপর্যস্ত করতে পুরুষেরা কী ভাষা ব্যবহার করে। অনলাইনে, বিশেষ করে ফেসবুকে, টুইটারে, আমাকে খুব নোংরা ভাষায় আক্রমণ করা হয়। আশি-নব্বইয়ের দশকে আমার ওপর যে আক্রমণ হত, তা হত পত্রিকায়, ম্যাগাজিনে, মেলায়, উৎসবে। অধিকাংশ নিন্দুক, হিংসুক, নারীবিদ্বেষী আমার নাগাল পেতো না। তারা এখন আমার নাগাল পেয়ে যায় সহজেই। আমি এখন তাদের এক ক্লিক দূরত্বে। যত ঘৃণা আছে তাই উগরে দিচ্ছে, যত হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা আছে, উগরে দিচ্ছে। দিয়ে শান্তি পাচ্ছে। টুইটারে এবং ফেসবুকে এই গালিবাজ নারীবিদ্বেষীদের টাইমলাইনে গিয়ে দেখেছি তারা সবাই ভদ্রলোক হিসেবে সমাজে পরিচিত, স্ত্রী সন্তান পরিবার পরিজন নিয়ে অতি সুন্দর সুষ্ঠু সামাজিক জীবনযাপন করে, ভালো চাকরিবাকরি ব্যবসাবাণিজ্য করে, প্রবলভাবে ধর্ম বিশ্বাসী এবং প্রবলভাবে পুরুষতন্ত্রে বিশ্বাসী। এই লোকগুলো সমাজের রীতিনীতির সঙ্গে চমৎকার খাপ খাইয়ে চলে। আমাকে অন্যায়ভাবে অশ্লীলভাবে গালিগালাজ করার জন্য তাদের কোথাও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় না। তাদের নারীবিদ্বেষকে অত্যন্ত যৌক্তিক বলে বিবেচনা করা হয়। আমি না হয় আমার তরুণ বয়স থেকেই নারীবিদ্বেষী পুরুষদের অশ্লীলতার আগুনে পুড়ে অঙ্গার না হয়ে ইস্পাত হয়েছি, কিন্তু সব নারীর পক্ষেই তো এমন আঘাত সামলে ওঠা সম্ভব নয়। আমার ফেসবুকের ইনবক্সে ‘শিক্ষিত সচেতন’ ভদ্রলোক বলে পরিচিত, ধার্মিক সজ্জন বলে পরিচিত পুরুষেরা পুরুষাঙ্গের অসংখ্য ছবি, নারী পুরুষের সংগমরত ছবি, নারীর নগ্ন শরীরের ছবি, মূলত পর্নোগ্রাফি পাঠিয়ে পাঠিয়ে আমাকে কী করে তারা ধর্ষণ করবে, তাই লেখে, প্রতিদিন লেখে। তারা সকলেই আমার অচেনা। তারা পড়েছে অথবা শুনেছে আমি নারীর সমানাধিকার চাই, তাই তাদের রাগ, তারা পড়েছে অথবা শুনেছে আমি মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী, আমি যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক। সে কারণে, শাস্তিস্বরূপ, ধর্ষণ করতে চায়, শুধু তাই নয়, কুকুর দিয়ে ধর্ষণ করাতে চায়। আমি ভেবেছিলাম আমার ওপর যেহেতু মৌলবাদী নারীবিদ্বেষীদের রাগ বহু পুরোনো, সে কারণে আমাকে এভাবে হেনস্থা করছে এরা। কিন্তু অবাক হয়ে যাই যখন শুনি ইনবক্সে পুরুষেরা এভাবে পর্নোগ্রাফি পোস্ট করে ধর্ষণ করার ইচ্ছে প্রকাশ করে সব মেয়েদের, ফেসবুকে নতুন আসা কিশোরীদেরও ছাড় দেয় না। ওই কিশোরীদের কী দোষ? দোষ এই, ওরা হয়তো নিজের কোনও মত প্রকাশ করেছে তা ধর্মের নিয়ম অনুযায়ী, বা পিতৃতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী সঠিক নয়। অথবা কিশোরীরা শুধু কিশোরী বলেই, নারী বলেই, হেনস্থা করা হয়। আমি হলফ করে বলতে পারি, সামাজিক নেটওয়ার্কে আসা কোনও মেয়েই, সে শিশু হোক, কিশোরী হোক, তরুণী হোক, যুবতী হোক, বৃদ্ধা হোক—কেউ অশ্লীলতা, অসভ্যতা, নোংরামি, ইতরামি, মানসিক অত্যাচার-নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি। মেয়েদের আঘাত না করে পুরুষের যেন শান্তি নেই। এই অভিযোগ করলে পুরুষেরা সমস্বরে চিৎকার করে, তাদের দাবি, সব পুরুষ নারীকে হেনস্থা, নির্যাতন, ধর্ষণ ইত্যাদি করে না, পুরুষ মাত্রই নারীকে সম্মান করে, যারা অসম্মান করে তারা পুরুষ নয়। কথাটা কি সত্যি? যারা নারীকে অসম্মান করে, যৌন নির্যাতন করে, তারা পুরুষ নয়? তারা তাহলে কী? সত্যি কথা হল, তারাও পুরুষ। চেহারা দেখে আমাদের উপায় নেই বোঝার কোন পুরুষ ধর্ষণ করবে, কোন পুরুষ করবে না। কথা শুনে, ব্যবহার দেখে, প্রোফাইল পড়েও আমাদের বোঝার উপায় নেই কে ভালো, কে ভালো নয়। সকলেই মুখোশ পরে থাকে। কোন পুরুষ খুন করবে, কোন পুরুষ করবে না, তা কেউ হলফ করে বলতে পারে? সুখে ঘর সংসার করা বড় অফিসার-পুরুষদের দেখি স্ত্রীকে কুপিয়ে টুকরো টুকরো করে রেফ্রিজারেটরে রেখে দিয়েছে। এটা ঠিক, সব পুরুষ বর্বরতা করে না। কিন্তু সব পুরুষই কিন্তু বর্বরতা করার ক্ষমতা রাখে। এই ক্ষমতা পুরুষতন্ত্র তাদের দিয়েছে। পুরুষেরা জানে তারা চাইলে বর্বরতা করতেই পারে, এতে কেউ তাদের একঘরে করবে না। তাদের অনেকে বর্বরতা করছে না, সেটার হয়তো কোনও কারণ আছে, কিন্তু খুব কম কারণই নারীকে মানুষ হিসেবে গণ্য করার কারণ।
সমাজে একটি মেয়েকে যত হেনস্থা হতে হয়, অনলাইনে তার চেয়ে বেশি হতে হয়। অনলাইনে একটি মেয়ে শত লোক দ্বারা সহস্রবার ধর্ষিত হয়। এই ধর্ষণের কারণে একটি মেয়ে স্বস্তিতে তার কাজ করতে পারে না, লেখাপড়ায় মন বসাতে পারে না, তার গা ঘিন ঘিন করে, তার আত্মবিশ্বাস কমে শূন্যের কোঠায় দাঁড়িয়ে যায়। কোনও কোনও মেয়ে লজ্জায় অপমানে আত্মহত্যা করে। অনলাইনের জীবনও বাস্তব জীবন। কারণ অনলাইনে যাদের সংগে দেখা হচ্ছে, বা কথা হচ্ছে, তারাও বাস্তবের রক্ত-মাংসের মানুষ। সে কারণে অনলাইনের জীবনকে তুচ্ছ করার কোনও উপায় নেই।
আমি আমার ফেসবুক পোস্টে মন্তব্য করার অধিকার শুধু বন্ধু তালিকায় থাকা মানুষদের দিয়েছি। মাঝে মাঝে যখনই দুয়ার খুলে দিই, মন্তব্য করার অধিকার জনগণকে নির্বিচারে দিয়ে দিই… তখনই পুরুষের অশ্লীলতার বাঁধ ভেঙে যায়। মন্তব্যের পাতা উপচে পড়ে অশ্রাব্য গালিতে। ওইসব গালি পড়ে, এত দীর্ঘকাল পুরুষের অশ্লীলতা দেখে অভ্যস্ত আমিই মুষড়ে পড়ি, তাহলে কিশোরী তরুণী অথবা অনভ্যস্ত নারীদের মানসিক অবস্থার কী হয়, ভেবে শিউরে উঠি।
একটা ভালো কাজ করা যায় না? অনলাইনেই পুরুষদের মানুষ হওয়ার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায় না? কী করে নারীকে মানুষ ভাবতে হয়, তাদের অধিকারকে সম্মান করতে হয়, তা শেখানো যায় না? আলবৎ যায়। সেটিই করতে হবে। নারীকে যৌন হেনস্থা করা যে কতখানি বর্বরতা, নারীকে নির্যাতন করা যে কতখানি নির্বুদ্ধিতা… তা বোঝাতে হবে। অনেক কিশোরই আজ অনলাইনে। তারা ঘর থেকে, বিদ্যালয় থেকে, রাস্তাঘাট থেকে, টিভি কম্পিউটার থেকে নারীর সমানাধিকারের ব্যাপারে কোনও জ্ঞানার্জন করতে পারছে না। তাদের এবং নারীবিদ্বেষী পুরুষদের সকলকেই শেখানো হোক কী করে নারীকে যৌন বস্তু ভাবা বন্ধ করতে হয়, কী করে নারীকে হেনস্থা করা বন্ধ করতে হয়, কী করে নোংরা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাকে বিদেয় করে দিতে হয়। মানুষ ক্রমশ নির্ভর করছে অনলাইনের ওপর। এখানেই ভবিষ্যৎ। এই জগৎটিতে যদি প্রতিনিয়ত নারীকে নারী হয়ে জন্ম নেওয়ার কারণে অপমান করা হয়, তবে নারীর কোনও সম্মান ভবিষ্যতের জগতেও নেই। অলৌকিক চরিত্রকে অসম্মান করলে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মানুষকে গ্রেফতার হতে হয়, কিন্তু রক্ত-মাংসের লৌকিক চরিত্র নারীকে চূড়ান্ত অসম্মান করলেও, নিগ্রহ নির্যাতন করলেও কোনও আইনে তার শাস্তি নেই, সম্ভবত লৌকিক চরিত্রটি নারী বলে। নারীর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। পুরুষতন্ত্র নারীর ক্ষতি যতটা করেছে, তার চেয়ে বেশি করেছে পুরুষের ক্ষতি। পুরুষতন্ত্রের কারণে নারী হয়েছে অনুগত, বশ্য। আর পুরুষ হয়েছে হিংস্র, আর স্বার্থপর, নিষ্ঠুর আর বর্বর।
৮৩. থাপ্পড়
আজকাল বাংলাদেশের খবরের কাগজে তালাকের খবর বেশ পড়ি। মিথিলার তালাক হয়ে গেছে, শমীর তালাক হয়ে গেছে, অপুর তালাক হয়ে গেছে, শাবনূরের তালাক হয়ে গেছে। তালাক হওয়ার পর আমরা জানতে পারি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক ভালো ছিল না। তালাকের আগে আমাদের কাছে মনে হত আদর্শ দম্পতি, সুখী দম্পতি। তাহলে কি আদর্শ সুখী দম্পতি বলতে কিছু নেই? নিশ্চয়ই আছে। তবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আদর্শ সুখী দম্পতির চিত্রটা এরকম—স্বামী সুখী, সুতরাং স্ত্রী পুরুষতান্ত্রিক নিয়ম অনুযায়ী নিজেকে সুখী বলে মনে করে। আসলে সুখী হওয়ার ভান করে। সংসারে স্ত্রী যদি নিজের সব আশা আকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দিয়ে স্বামীর আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য যা কিছু করার করে—তাহলেই স্বামী সুখী। স্ত্রীদের মাথার ভেতরে জন্মের পর থেকেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, স্বামীর সুখই স্ত্রীর সুখ। স্ত্রীর পৃথক অস্তিত্ব, পৃথক স্বপ্ন, পৃথক সুখ থাকার কোনও অর্থ হয় না। সত্যিকার সুখী হওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই কোনও স্ত্রীর।
গতকাল ‘থাপ্পড়’ নামে নতুন একটি হিন্দি ছবি দেখলাম। ঠিক এই বিষয়টিই ছবিতে বলেছেন পরিচালক অনুভব সিনহা। নিজের সব আশা আকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দিয়ে, খুব মন ঢেলে টুয়েন্টি ফোর সেভেন স্বামীর সেবা করছিল, শাশুড়ির সেবা করছিল, ঘর সংসার সামলাচ্ছিল এক শিক্ষিত মেয়ে। তারপর একদিন স্বামীর ভীষণ এক থাপ্পড় খেয়ে তার টনক নড়ে। সে যে নিজের জীবনটাকে উৎসর্গ করেছে অন্যের জন্য, যার থাপ্পড় খেতে হয়, যে কোনওদিন যার লাথিঝাঁটাও খেতে হতে পাবে—টনক নড়ে। তারপরই সে সিদ্ধান্ত নেয় স্বামীকে ত্যাগ করার, তাকে তালাক দেওয়ার।
যারা হাউজওয়াইফ নয়, রীতিমতো স্বনির্ভর, তাদেরও অত্যাচার সইতে হয়। তারাও বাধ্য হয় স্বামীকে তালাক দিতে। সামান্য আত্মসম্মান যে নারীর আছে, সে নারীর পক্ষে সম্ভব নয় সেই পুরুষকে নিয়ে একসঙ্গে বাস করা, যে পুরুষ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ঘোর বিশ্বাসী। আসলে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তো এই মন্ত্র দিয়েই একটি ছেলেকে বড় করে যে, সে রাষ্ট্রের, সমাজের, এবং পরিবারের অমূল্য সম্পদ। সুতরাং অমূল্য সম্পদকে দেখভাল করার দায়িত্ব পড়ে বাড়ির মেয়েদের ওপর। এর ফলে মেয়েরা চিহ্নিত হয় সম্পদের সেবিকা হিসেবে, সম্পদ হিসেবে নয়। এই অমূল্য সম্পদ যখন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তখন সে চোর হোক গুণ্ডা হোক, তাকে দেখভাল করার দায়িত্ব পড়ে স্ত্রীর ওপর। স্ত্রী স্বনির্ভর হোক, পরনির্ভর হোক, দায়িত্ব একই।
যে স্বামী অত্যাচারী, মানসিক পীড়নকারী বা যে স্বামী স্ত্রীকে ভালোবাসে না, অবজ্ঞা করে, তুচ্ছ করে, বাড়ির চাকরবাকর ছাড়া, সন্তানের জন্মদাত্রী বা লালনপালনকারী ছাড়া কিছু মনে করে না, সেই স্বামীকে তালাক দিচ্ছে তারাই, যারা আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে চায়। আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচার ইচ্ছে খুব কম নারীরই আছে। জন্মের পর থেকে তাদের এভাবেই বড় করা হয় যেন আর যা কিছুই থাক, আত্মসম্মান বলে জিনিসটা না থাকে। পুরুষের যে জিনিস থাকা ভালো, নারীর সে জিনিস থাকা খারাপ। পুরুষের আত্মসম্মান থাকতে হবে, নারীর আত্মসম্মান থাকা চলবে না। পুরুষের রাগ থাকেই, নারীর রাগ থাকলে চলবে না। পুরুষকে সংসারী হওয়ার দরকার নেই, নারীকে সংসারী হতে হবে। পুরুষের জন্য রান্নাবান্না, সন্তান লালন পালনের প্রশ্ন ওঠে না, নারীকে সেসব করতেই হবে। পুরুষকে চালাক চতুর হতে হবে, নারীকে অত চালাক চতুর হওয়া মানায় না। পুরুষকে কর্মস্থলে উন্নতি করতে হবে, উন্নতির পেছনে নারীর না দৌড়োনোই উচিত। পুরুষকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যৌথ-জীবনে কী করতে হবে না হবে, নারীকে পুরুষের সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হবে। পুরুষ অথবা নারীকে কাউকে যদি জব করা বা বাড়ির বাইরে কাজ করা ছাড়তে হয়, তাহলে কার দিকে আঙুল তোলা হয়, কাকে ছাড়তে হয় সব, ঘরে বসে ঘর-সংসার দেখার, সন্তান লালন পালন করার কাজটি কাকে দেওয়া হয়? নারীকে দেওয়া হয়, টাকা উপার্জনের দায়িত্বটি, ক্ষমতার দায়িত্বটি নিঃসন্দেহে পুরুষকে।
থাপ্পড় ছবিতে অনুভব সিনহা বলেছেন, আত্মসম্মান নিয়ে যদি বাঁচতে চাইতো মেয়েরা, তাহলে অর্ধেকের চেয়ে বেশি মেয়ে স্বামীকে ত্যাগ করতো। সংসারগুলো টিকে আছে, আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে মেয়েরা শেখেনি বলে, এবং চায় না বলে।
বাংলাদেশে দেখছি কিছু নায়িকা বা গায়িকা তালাক দিচ্ছেন স্বামীকে। উচ্চপদে কর্মরত নারী বা স্বাবলম্বী কিছু নারীই এই সাহস দেখিয়েছেন। যদি আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে চাইতো, যদি শুধু পুরুষের মতো মেয়েরাও নিজেদের আশা আকাঙ্ক্ষা স্বপ্ন সাধ পূরণকে অগ্রাধিকার দিতো, তাহলে প্রায় সব মেয়েকেই হয়তো সংসার ত্যাগ করতে হত। পুরুষতান্ত্রিক নিয়মে চলা একটি সংসারও বৈষম্যহীন নয়। এই নিয়মকে ভেঙে ফেললে কিন্তু ঠিকই বৈষম্যহীন সম্পর্ক তৈরি করা যায়। নারী পুরুষ দুজনই নিজেদের স্বপ্ন সাধ পূরণ করার চেষ্টা করবে। সংসারে ঘর গোছানো, বাড়ি পরিষ্কার, রান্নাবান্না, শিশু পালন, বাগান চর্যা ভাগাভাগি করে করবে। এই কাজগুলোকে ছোট কাজ বলে ভাবা হয়, যেহেতু এই কাজগুলো মেয়েরা করে। করুক পুরুষেরা, কাজের মূল্য যাবে বেড়ে।
আমি যখন তালাক দিয়েছিলাম, একা থাকতে শুরু করেছিলাম, লোকে ছি ছি করেছে। গত তিরিশ বছরে লোকেরা আরও কিছু তালাক দেখেছে, অনেকটাই অভ্যস্ত হয়েছে। আমাকে যে ভাষায় গালাগালি করেছে আশির দশকে, এখন সে ভাষায় গালাগালি করা বন্ধ করেছে। তবে গালাগালি যে একেবারে থেমে গেছে তা নয়। মানুষ যত সভ্য হবে, তত অভ্যস্ত হবে তালাকে।
মানুষ যখন বিয়ে করে, তখন যে রকম জীবন মনে মনে চায়, তা না-ও পেতে পারে। শুধু নারী নয়, পুরুষের চাওয়া পাওয়াও ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যায়। আমি আমার বড় দুই ভাইয়ের ক্ষেত্রেই দেখেছি, নিষ্ঠুর নির্মম স্ত্রী নিয়ে জীবন যাপন করেছে। এমন উদাহরণ খুব কমই দেশে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েরাই ভোগে। মেয়েরাই চুপ থাকে। মেয়েরাই সহ্য করে। মেয়েরাই বিসর্জন দেয়। মেয়েরাই ত্যাগী হয়। মেয়েরাই থাপ্পড় খায়। শুধু স্বামীর নয়, সবার।
নারীবাদী নেত্রী সুসান বি এন্থনী বলেছিলেন স্বামীকে স্ত্রীর তালাক দেওয়া অনেকটা বর্বর প্রভুর কাছে থেকে ক্রীতদাসীদের মুক্তি পাওয়ার মতো। ক্রীতদাস প্রথা বন্ধ হলে আমরা খুশি হই। কিন্তু স্ত্রী যখন স্বামীকে ত্যাগ করে চলে আসে, আমরা খুশি হই না কেন? এই প্রশ্নটি একটি বড় প্রশ্ন। এখানেই লুকিয়ে আছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা মেনে চলার জন্য সবারই মগজধোলাই হওয়া মগজ। ধোলাই হওয়া মগজকে ধোলাই হওয়ার আগের অবস্থায় ফেরত নিতে হবে। এ ছাড়া উপায় নেই।
সোজা কথা এবং সাফ কথা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বৈষম্যহীন পরিবার তৈরি করা সম্ভব নয়। যদি সম্ভব কেউ করতে চায়, তবে তাদের ব্যক্তিগতভাবে সম্পূর্ণ পুরুষতন্ত্র-মুক্ত হতে হবে। পুরুষতন্ত্র জিনিসটাই নারী পুরুষের বৈষম্যকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এই বৈষম্যকে বিদেয় করতে হলে সম্মিলিত সংগ্রামের যেমন প্রয়োজন, তেমন পুরুষতন্ত্রের গন্ধস্পর্শহীন ব্যক্তিগত জীবনও যাপন করা প্রয়োজন।
যে স্ত্রীরা একবার নির্যাতন সহ্য করে, তারা কিন্তু বার বার নির্যাতন সহ্য করতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। যার এক থাপ্পড়ে টনক নড়ে না, তার শত থাপ্পড়েও টনক নড়ে না। বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের টনক নড়াটা খুব জরুরি। পুরুষতন্ত্রের নাগপাশ থেকে শুধু নারীকে নয় পুরুষকেও বের হয়ে আসতে হবে। বৈষম্যে ভরপুর একটা পচা পুরোনো সমাজ ব্যবস্থা আঁকড়ে পড়ে থাকা পুরুষের জন্যও সম্মানজনক নয়।
৮৪. নির্বাসনের ২৬ বছর
আমার দাদা সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতো, কবিতা লিখতো। দেখে দেখে আমিও ১৩ বছর বয়স থেকে কবিতা লিখতে শুরু করি। আরেকটু বড় হয়ে আমিও সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করি। এইভাবেই বিজ্ঞানের ছাত্রী শিল্প সাহিত্যের মধ্যে সময় এবং সুযোগ পেলেই ডুবে যেতাম। বইপোকা বলে সুনাম বা দুর্নাম ছিল ছোটবেলা থেকেই। মেডিক্যাল কলেজে একসময় পড়ার চাপ এত বেশি বেড়ে গিয়েছিল যে আমাকে সাহিত্য পত্রিকার প্রকাশনা স্থগিত রাখতে হয়েছিল। ডাক্তার হওয়ার পর, হাসপাতালের চাকরির ব্যস্ততার মধ্যেও লিখতে থাকলাম কবিতা প্রবন্ধ, গল্প উপন্যাস। সেগুলো বই হয়ে বেরোতে লাগলো। নিয়মিত কলাম ছাপা হতে লাগলো জাতীয় সাপ্তাহিকগুলোয়। লেখাগুলো প্রচণ্ড জনপ্রিয় ছিল, বইও ছিল বেস্ট সেলার লিস্টে, কিন্তু নারীর সমানাধিকারের পক্ষে আমার লেখাগুলো বাংলাদেশের নারীবিদ্বেষী সমাজের কর্তারা অবশ্য ভালো চোখে দেখলেন না। সব ধর্মই নারীর সমানাধিকারের বিরুদ্ধে—এ কথা লিখেছি বলে সব ধর্মের ঘোর বিশ্বাসীরা আমার ওপর ভীষণ ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলো। ইসলামের সমালোচনা করেছি বলে মুসলিম মৌলবাদীরা সারা দেশে আমার ফাঁসি চেয়ে বড় বড় মিছিল মিটিং শুরু করলো। মোল্লা মুফতিরা আমার মাথার দাম ঘোষণা করতে শুরু করলো। রাজনৈতিক দলগুলো আমার পাশে না দাঁড়িয়ে দাঁড়ালো নারী বিদ্বেষী মোল্লা মৌলবিদের পাশে। সমাজের মানবাধিকার সংগঠনগুলো, এমনকি নারীবাদী দলগুলোও চুপ হয়ে রইলো। এমন সময় সরকার আমার বিরুদ্ধে ব্লাসফেমির মামলা করলেন। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হল। জীবন বাঁচাতে আমাকে দু’মাস লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল। দেশের আনাচেকানাচে পুলিশ আমাকে খুঁজছে, মোল্লারা আমাকে খুঁজছে মেরে ফেলার জন্য। সে সব ভয়াবহদিনগুলোর কথা ভাবলে এখনও শিউরে উঠি। শেষ অবধি ১৯৯৪ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশ সরকার আমাকে বের করে দেয় দেশ থেকে।
সেই থেকে পড়ে আছি দেশের বাইরে। আজ ২৬ বছর পার হল। জীবন এভাবেই ফুরিয়ে যাচ্ছে। এভাবেই বিদেশ বিভুঁইয়ে একদিন মরে পড়ে থাকবো। যখন দেশ থেকে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল আমাকে, আমি কল্পনাও করতে পারিনি ওই যাওয়াই আমার শেষ যাওয়া। আমি কল্পনাও করতে পারিনি, দেশের কোনও সরকারই আমাকে আর কোনওদিনই দেশে ফিরতে দেবে না। ধীরে ধীরে আমার কাছের মানুষগুলো এক এক করে মরে যাবে, আমার মা, আমার বাবা, আমার নানি, প্রিয় খালারা, প্রিয় মামারা, আমার দাদারা, আমার শিক্ষকেরা, যাদের ভালোবাসতাম, শ্রদ্ধা করতাম। আমি কল্পনাও করতে পারিনি আমি কারও কাছে একটিবারের জন্যও যেতে পারবো না। কাউকে শেষবারের মতো দেখতে পাবো না।
নির্বাসিত জীবনে কত কিছু ঘটেছে। পশ্চিম ইউরোপ আমাকে নিয়ে এক যুগ উৎসব করেছে। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিয়েছে, নাগরিকত্ব দিয়েছে, মান মর্যাদা দিয়েছে। যেখানেই গিয়েছি, আমাকে দেখার জন্য, আমার কথা শোনার জন্য উপচে পড়েছে মানুষ। বিভিন্ন দেশের প্রকাশকেরা আমার বই বিভিন্ন ভাষায় ছাপিয়েছেন। এত নাম এত খ্যাতি,—কিন্তু সব ছেড়ে আমি দেশে ফিরতে চেয়েছি। দেশের দরজা বন্ধ বলে এক সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাস করতে শুরু করেছি। কিন্তু রাজনীতি আমাকে বাধ্য করেছে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, ভারত ত্যাগ করতে। এই যে আমাকে তাড়ানো হয় দেশ থেকে, রাজ্য থেকে, শহর থেকে, পাড়া থেকে, ঘর থেকে—২৬ বছরে আজও পায়ের তলায় মাটি নেই—তারপরও কিন্তু আমি দমে যাইনি, হতাশায় ভেঙে পড়িনি। যতবারই আমাকে লাথি মারা হয়েছে, ততবারই উঠে দাঁড়িয়েছি। মুক্তচিন্তার জন্য, আর মানবাধিকারের জন্য আমার সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছি। শত দুঃসময়েও আমি এক চুল বিচ্যুত হইনি আমার আদর্শ থেকে। আমাকে একটা ইসলাম- বিরোধী ট্যাগ দিয়ে ধুরন্ধর রাজনীতিকরা রাজনীতি করেছেন আমাকে নিয়ে। আমি যে মানবতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছি, সে কথা বলতে অনেকের আপত্তি। মানবাধিকারের পক্ষে লেখা আমার ৫টি বই বাংলাদেশ সরকার নিষিদ্ধ করেছে। বই নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে, বাকস্বাধীনতার বিরুদ্ধে একটি লোকও মুখ খোলে না দেশটিতে। দেশটি ক্রমে ক্রমে ইসলামী মৌলবাদীদের দাপট বেড়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সরকারও নিষিদ্ধ করেছিল একটি বই। নিষেধাজ্ঞার দু’বছর পর সেটিকে অবশ্য হাইকোর্ট মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, নিষেধাজ্ঞা কেন জারি করেছিল সরকার? কাউকে কি মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে দেওয়া হবে না?
আমি ইউরোপের নাগরিক হয়েও, আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়েও ভারতকে বেছে নিয়েছি বাস করার জন্য। আমি ধর্মে বিশ্বাস করি না, তাই ধর্মের কারণে হওয়া ভারত ভাগেও আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। ভারতকে নিজের দেশ ভাবতে আমার কোনও অসুবিধে হয় না। আমি তো ভারতেরই অনেকগুলো ভাষার একটি ভাষায় লিখি, কথা বলি। যেখানেই বাস করি, নারীর সমানাধিকারের জন্য জীবনের শেষদিন পর্যন্ত লিখে যাবো, গণতন্ত্রের পক্ষে, বাকস্বাধীনতার পক্ষে, বৈষম্যহীন সুস্থ সুন্দর সমাজ গড়ার জন্য লিখে যাবো, মানবতার জন্য লিখে যাবো, নির্যাতনের বিরুদ্ধে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হবো। এতে আমার মাথায় চাপাতির কোপ পড়বে তো, পড়ুক।
২৬ বছর নির্বাসনে আছি। কী দোষ করেছিলাম আমি ? মানবতার পক্ষে লেখালেখি করেছি এটিই আমার দোষ। শুধু কি তাই! এখনও ফতোয়া দেওয়া হয়, এখনও হুমকি আসে, এখনও পায়ের তলার মাটি সরে যায়! আর কত অনিশ্চয়তা, আর কত দুর্ভোগ পোহাতে হবে আমাকে? আসলে বেশ বুঝি, পৃথিবীর কোনও দেশই আমার দেশ নয়। আমার ভাষাটিই আমার দেশ, যে ভাষায় আমি কথা বলি, লিখি। আমার কাছ থেকে আমার যা কিছু ছিল, ধন দৌলত সব কেড়ে নেওয়া হল, ভাষাটি আশা করছি কেউ চাইলেও কেড়ে নিতে পারবে না।
২৬ বছর দীর্ঘ সময়। আমার ওপর নির্বাসনই শুধু নয়, ভারতেও বই নিষিদ্ধ হয়েছে, ব্ল্যাক লিস্টেড হয়েছি, গৃহ বন্দিত্ব জুটেছে, ফতোয়া জুটেছে, শুধু বই নয় নিজেও নিষিদ্ধ হয়েছি বিভিন্ন শহরে আর রাজ্যে, শারীরিক হামলা হয়েছে আমার ওপর, মানসিক তো অহর্নিশি হচ্ছেই। আমার লেখা ছাপানো বন্ধ করেছে মিডিয়ার বড় একটি অংশ, সাংঘাতিকভাবে সেন্সরের শিকার হয়েছি, রাজনৈতিক খুনের শিকার হতে হতে বেঁচে গিয়েছি। সোজা কথা, সুতোর ওপর বিপজ্জনক হাঁটা হাঁটছি। তারপরও এই ভারতেই থাকবো বলে পণ করেছি। কারণ ভারত অন্তত বলতে পারবে, বাকস্বাধীনতার মর্যাদা উপমহাদেশের একটি দেশ হলেও দেয়। ভারত ভিন্ন মতকে ফাঁসি দেয় না, জেলও পোরে না, বরং নিরাপত্তা দেয়। সত্যিকার গণতন্ত্র তো একেই বলে।
৮৫. আমাদের বাকস্বাধীনতা
সেই দিনগুলো দুঃস্বপ্নের মতো আজও। মনে পড়ে কী করে আমাকে প্রথমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে, তারপর রাজস্থান থেকে, তারপর পুরো ভারত থেকেই তাড়ানো হয়েছিল। কী করে আমাকে গৃহবন্দি করা হয়েছিল। কী ভীষণ অনিরাপদ ছিলাম আমি রাষ্ট্রের ‘নিরাপদ গৃহে’। সরকার আমাকে ছলে-কৌশলে দেশ থেকে তাড়াতে চাইছে, আর আমি অসহায় এক নির্বাসিত লেখক—যার পাশে কোনও রাজনৈতিক দল নেই, সংগঠন নেই, সাধারণ কিছু মানুষ ছাড়া নামী দামি মানুষ নেই—একা বিশাল এক রাষ্ট্রযন্ত্রের সামনে অনড় দাঁড়িয়ে থেকেছি, সরকারি কোনও উপদেশ বা আদেশ মানিনি, শুধু মনোবল ছাড়া আর কিছুই ছিল না সম্বল। আমি কোনও অন্যায় করিনি, আমি কেন শাস্তি পাবো! পৃথিবীর সন্তান আমি, ভালোবেসে যে দেশটিতে বাস করতে চাইছি, সে দেশটিতে বাস করার কেন আমার অধিকার থাকবে না! সেক্যুলার গণতন্ত্র বলে দাবি করছে যে দেশ, সে দেশ কেন একজন সৎ. সাহসী আর সেক্যুলার লেখককে দেশ থেকে তাড়াবে, কিছু নারীবিরোধী, অসৎ আর অসহিষ্ণুমৌলবাদীকে খুশি করার জন্য!
একসময় জীবন বাঁচাতে ভারত থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম বটে, কিন্তু শত নিষেধ, শত বাধা, শত তাণ্ডব, আর শত হুমকি সত্ত্বেও ফিরে এসেছি ভারতে। ভারত ছাড়া আমার উপায় নেই বলে নয়, ভারত যেন মুক্তচিন্তাকে সম্মান করে, সে কারণে। আমি আমার মত প্রকাশ করবো, সে মত অন্যের মতের চেয়ে ভিন্ন হোক, এবং ভারতে বাস করবো। ভারতকে দেখে যেন শেখে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলো যেন অনুপ্রাণিত হয় তারা, যারা এখনও জানে না বাকস্বাধীনতা ঠিক কাকে বলে। এখনও যে আমি খুব নিশ্চিন্তে বাস করি ভারতবর্ষে তা নয়। এখনও মৃত্যুর হুমকি পাচ্ছি। কলকাতার এক ইমাম আমার মুখে চুনকালি মাখিয়ে দিয়ে আমাকে অপদস্থ করার মূল্য কুড়ি হাজার ঘোষণা করেছিলেন, তারপর মাথার মূল্য ধার্য করেছিলেন পঞ্চাশ হাজার টাকা, এরপর তো বলেই ফেললেন ‘আনলিমিটেড অ্যামাউন্ট অব টাকা দেবেন আমার মুণ্ডুটি যে কেটে নিয়ে যেতে পারবে, তাকে। উত্তরপ্রদেশ থেকে মুসলিম ল’ বোর্ডের এক পরিচালক ঘোষণা করেছিলেন পাঁচ লক্ষ টাকা। নতুন ফতোয়া তো আগের চেয়ে ভয়ংকর। কেরালার আইসিস গোষ্ঠী ফেসবুকে ঘোষণা করেছিল আমাকে যেন অতি শীঘ্র মেরে ফেলা হয়। পার্লামেন্টে একজন বড় নেতা তো ধর্ম সম্পর্কে কবে কোথায় আমি কী বলেছি, তা নিয়ে ভীষণ ক্ষুব্ধ। বলে দিয়েছেন ধর্ম সম্পর্কে আমি যেন ভারতীয় কোনও মিডিয়ায় আমার মত প্রকাশ করার সুযোগ না পাই। সরকার কোথায় মৌলবাদীদের রুখবে তা নয়তো মৌলবাদীদের দাবিই এক এক করে মেটায়। আমার বই নিষিদ্ধ করা, আমাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাড়ানো, পত্র পত্রিকায় আমার লেখালেখি বন্ধ করা, টিভিতে আমার মেগা সিরিয়ালের প্রচার বন্ধ করে দেওয়া, ভারত থেকে আমাকে তাড়ানো এসবের পেছনে আছে ভোটব্যাংকের হিসেব, মৌলবাদীদের চোখ রাঙানিকে ভয় অথবা তাদের তোষণ। এই তোষণের রাজনীতি গণতন্ত্রকে বড় দুর্বল করে দেয়। রাজনীতিকরা কি জানেন না যে ধর্মীয় মৌলবাদীরা সমাজকে অন্ধকারে ফেলে রাখতে চায়, তারা নারীর অধিকারে তো নয়ই, মানবাধিকারেই বিশ্বাস করে না, তাদের মতের সঙ্গে যারা একমত নয়, তাদের বাক স্বাধীনতায় তারা বিশ্বাস করে না। হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান—সব মৌলবাদীদের চরিত্র কিন্তু একই। তারা সকলেই কিন্তু মুক্তচিন্তার বিরোধী।
পৃথিবীতে শুধু আমি নই, আরও অনেক লেখককে সইতে হচ্ছে নির্যাতন। লেখককে চাবুক মারা হচ্ছে, জেলে ভরা হচ্ছে। নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে অথবা মেরে ফেরা হচ্ছে। বাকস্বাধীনতার গুরুত্ব এখনও একনায়করা তো নয়ই. অধিকাংশ গণতান্ত্রিক সরকারও বুঝতে চায় না। বাকস্বাধীনতার কথা বলতে গেলে অনেককে বলতে শুনি, এটির একটা সীমা আছে। বাকস্বাধীনতা মানে কারও অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া নয়। কখনও কারও অনুভূতিতে কোনও আঘাত লাগবে না—এভাবে সারাজীবন বাঁচতে চাওয়ার দাবি করাটা খুব অদ্ভুত। অন্যের কথায় এবং কাজে আমাদের সবার মনে অহরহই আঘাত লাগছে। মনে আঘাত লাগবেই, কারণ সমাজে নানা মানসিকতার মানুষ বাস করে। কারও মতের সঙ্গে নিজের মত না মিললে যদি অনুভূতিতে আঘাত লাগে, সে আঘাতকে পুষিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা আমাদের সবারই থাকে। শুধু কিছু কট্টর লোক অনুভূতির আঘাতকে সহ্য করবে না বলে চারদিকে অশান্তি করছে।
গণতন্ত্র অর্থহীন হয়ে যায় যদি মানুষের বাকস্বাধীনতা বা মত প্রকাশের অধিকার না থাকে। সমাজ বদলাতে হলে নানান লোকের নানান অনুভূতিতে আঘাত লাগে। কারও কোনও অনুভূতিতে আঘাত দিতে না চাইলে সমাজটাকে বদলানো যাবে না। রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করতে গেলে বা নারীবিরোধী আইন দূর করতে গেলেও মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে। ধর্মানুভূতিতে আঘাত না দিয়ে খুব বেশি ভালো কাজ আজ অবধি সমাজে হয়নি। ইউরোপ থেকে গির্জার দুঃশাসন বন্ধ করার সময়ও প্রচুর লোকের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লেগেছিল। গ্যালিলিওর কথায়, ডারউইনের ভাষ্যে লোকের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লেগেছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে কুসংস্কাচ্ছন্ন মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে। কিন্তু তাদের আঘাত লাগবে বলে যদি আমরা মত প্রকাশ করা বন্ধ করে দিই, যদি আমরা বিজ্ঞানের আবিষ্কার এবং ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দিই, সভ্যতার চাকাকে থামিয়ে রাখি, তবে সমাজটাকে স্থবির জলাশয় হিসেবেই রেখে দিতে হবে, একে আর স্বতঃস্ফূর্ত স্রোতস্বিনী করে গড়ে তোলা হবে না আমাদের। যে কথা সকলে শুনতে পছন্দ করবে, সেই কথাই যদি বলতে হয় তাহলে মত প্রকাশের অধিকারের কোনও প্রয়োজন পড়ে না। বাকস্বাধীনতা একমাত্র তাদের জন্যই, যাদের মতের সঙ্গে অধিকাংশ লোকের মত মেলে না। যে কথাটা তুমি শুনতে চাও না, সে কথাটি বলার অধিকারের নামই বাকস্বাধীনতা। বাকস্বাধীনতা তাদের দরকার নেই যাদের মত শুনে কেউ মনে আঘাত পায় না। বাকস্বাধীনতার পক্ষে না থেকে যখন সরকার বাকস্বাধীনতা বিরোধীদের পক্ষ নেয়, তখন নিজের দেশটার ধ্বংস নিজেই ডেকে আনে।
ভারতের মত-প্রকাশ-বিরোধী কয়েকটি কালো আইনের একটি বাতিল করার লড়াইয়ে হাতে গোনা কয়েকজনের মধ্যে ছিলাম আমিও। এই আইনটির কারণে অনেক নিরপরাধ মানুষের ভোগান্তি হয়েছে। আমারও হয়েছে। নারীবিরোধী-ও-মানবতাবিরোধী-ধর্মান্ধদের তথাকথিত ধর্মানুভূতিতে যেন আঘাত না লাগে, সে কারণে জগত সজাগ। এখনও কি জগতের সময় হয়নি সবাইকে সমান চোখে দেখার! ধর্মান্ধদের বাড়তি খাতির না করার! যুক্তিবাদীদের মানবাধিকারকে সম্মান করার!
শুধু ভারতবর্ষেই নয়, সারা পৃথিবীতেই এই লড়াই চলছে। লড়াইটা কিন্তু বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে নয়, এই লড়াই দুটো মতবাদের মধ্যে, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং মৌলবাদ। লড়াইটা বিজ্ঞানমনস্কতা আর ধর্মান্ধতার মধ্যে, যুক্তিবাদিতা আর কুসংস্কারের মধ্যে, জ্ঞান আর অজ্ঞানতার মধ্যে, সচেতনতা আর অচেতনতার মধ্যে, স্বাধীনতা আর পরাধীনতার মধ্যে। এই লড়াইয়ে আমি জানি, আমি কোন পক্ষ। বিপক্ষের মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে আমি, কিন্তু তার মতকে মেনেও নিতে চাই না, শ্রদ্ধাও করতে চাই না। তার মানে এই নয় যে ভোরবেলায় বিপক্ষের কেউ যখন মর্নিং ওয়াকে বেরোবে, আমি তাকে গুলি করে মারবো বা সে যখন ফুটপাতে হাঁটতে থাকবে, তাকে আমি চাপাতি চালিয়ে খুন করবো। না, কারও মত আমার অপছন্দ হলে তাকে আমি চুমু খাবো না, তার গালে আমি চড়ও দেবো না। আমি লিখবো। লিখে আমি আমার মত প্রকাশ করি। কারও যদি আমার লেখা পছন্দ না হয়, লিখে আমার লেখার প্রতিবাদ করতে পারেন, আমার মতের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করতে পারেন, কিন্তু আমাকে মারতে আসতে পারেন না। বাকস্বাধীনতার এই শর্তটি আজকাল অনেকেই জানেন। জানলেও কিছু কিছু মৌলবাদী-সন্ত্রাসী এই শর্তটি মোটেও মানতে চান না।
এভাবে কি ধর্ম টিকে থাকে? পৃথিবীতে শত শত ধর্ম ছিল। এখন তারা বেশিরভাগই বিলুপ্ত। কোথায় আজ অলিম্পিয়া পাহাড়ের সেই ডাকসাইটে গ্রীক দেবতারা, কোথায় শক্তিশালী রোমানদের নামীদামি ঈশ্বর? কোথায় মিশরীয় ফারাওদের ঈশ্বর? সব আজ ইতিহাস। ইসলাম, ক্রিশ্চান ধর্ম, ইহুদি ধর্ম, বৌদ্ধ বা হিন্দু ধর্মও একসময় ইতিহাস হবে। যুগোপযুগি নতুন ধর্ম আসবে অথবা যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানমনস্কতায় মানুষের বিশ্বাস বাড়বে।
এভাবেই হয়তো চলবে পৃথিবী। অশিক্ষা, জড়তা আর মূর্খতা চলবে শিক্ষা আর সচেতনতার পাশাপাশি। ধর্মান্ধ আর রাজনীতিক নিজেদের স্বার্থ দেখবে, সমাজটাকে অন্ধকারেই ফেলে রাখবে, শুধু সুস্থ সচেতন মানুষই সমাজ পাল্টাবে। হাতে গোণা কিছু মানুষই সমাজ পালটায়। চিরকাল তাই হয়েছে।
শুধু মত ভিন্ন হওয়ার কারণে পৃথিবীর আর কারও যেন নির্বাসন দণ্ড ভোগ করতে না হয়। আর কাউকে যেন আমার মতো ভুগতে না হয়।
৮৬. দেশটাকে রক্ষা করবে কে?
—গণতন্ত্রে কী থাকতে হয়? বাকস্বাধীনতা থাকতে হয়। ঠিক না বেঠিক?
—ঠিক।
—বাংলাদেশে কি বাকস্বাধীনতা আছে? আছে কি নাই? চিল্লাইয়া বলেন।
—নাই।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার অজুহাতে আজ থেকে ২৫ বছর আগে দেশের একজন নারীবাদী লেখককে বাংলাদেশ সরকার নির্বাসনে পাঠিয়েছিল। নারীবিরোধী মৌলবাদী অপশক্তিকে খুশি করার জন্য পাঠিয়েছিল। সরকার বদলেছে, মৌলবাদী অপশক্তির সঙ্গে আপসের বদল হয়নি। আজ অবধি সেই লেখককে দেশে ঢুকতে দেওয়া হয় না। আজও ফতোয়াবাজ ধর্মব্যবসায়ীদের, আজও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মানবাধিকারবিরোধীদের তুষ্ট করে চলতে হয় দেশের সরকারকে। দেশের সরকার মনে হচ্ছে এই অপশক্তির হাতে জিম্মি।
কয়েক বছর যাবৎ দেশের বুদ্ধিদীপ্ত মুক্তচিন্তকদের এক এক করে কুপিয়ে মেরেছে ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা। এই সন্ত্রাসীদের আজও বিচার হয়নি। যে কেউ যে কোনও কিছুতেই যে কারও বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে বলে চেঁচিয়ে উঠছে। পচা পুরোনো একটা আইন দেখিয়ে মুক্তবুদ্ধির শিক্ষিত সচেতন নিরপরাধ মানুষকে ফাঁসাচ্ছে সরকার। জেলে ভরছে। ভিন্নমত যাঁদেরই ছিল, যাঁরাই সমাজের সংস্কার চেয়েছেন, ধর্মনিরপেক্ষতার দাবি করেছেন, ভয়ে দেশ থেকে পালিয়েছেন।
কারা তাহলে দেশে বাস করবে? দেশ কাদের? এক পাল চাটুকার, আর অশিক্ষিত অসভ্য মোল্লা হুজুর, আর তাদের অসংখ্য বুদ্ধিসুদ্ধিহীন শিষ্য? সরকার কি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নয়? অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে বটে, কিন্তু নৈতিক অবনতি যে হচ্ছে? যদি শিক্ষা-সংস্কৃতিই না থাকে, যদি আধুনিকতা- সভ্যতাই না থাকে, তাহলে টাকাপয়সা দিয়ে কী করবে মানুষ।
দেশের টাকাপয়সা সহায় সম্পদ লুঠ করে দেশপ্রেমিকরা নাকি বেশ পালাচ্ছে আজকাল। বিদেশে পাকাপাকিভাবে বাস করার সব আয়োজন সারা। ইউরোপ আমেরিকার প্রাসাদে এক একজন সুখে শান্তিতে বাস করবে। ধর্ম কর্মও করবে নিশ্চয়ই। পাপমোচনের জন্য তো হজ্বে যাবেই।
সুফি সংগীত, পালাগান, বাউল ভাটয়ালি মুর্শেদি গাওয়ার লোকেরাই বোধহয় বাকি ছিল। এদের গর্দান নেওয়ার জন্য তৈরি ধর্মের তলোয়ার। নিরীহ গোবেচারা শরিয়ত বয়াতিকে জেলে ঢোকানো হয়েছে। রিতা দেওয়ান নামে এক সুফি বাউলের ওপর আক্রমণ চলছে। তিনি তাঁর মতো করে গান গেয়েছেন, গান গাওয়ার আগে তাঁর মতো করে আধ্যাত্মিক বয়ান দিয়েছেন। তাঁর আধ্যাত্মিক বয়ান ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের পছন্দ হয়নি, তার তারা সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে। রিতা দেওয়ান এই বর্বরদের হাত থেকে বাঁচার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন, ভয়ে তটস্থ তাঁর দুটি মেয়েও হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়েছে। কী নিদারুণ সেই দৃশ্য। একজন শিল্পীকে ক্ষমা চাইতে হয় তাঁর শিল্পের জন্য। তাঁর অসহায়তা আর নিরাপত্তাহীনতা আমি হাড়ে মজ্জায় উপলব্ধি করেছি। চোখে জল এসেছে আমার। হ্যাঁ জল এসেছে আমার চোখে। আমার মনে হয়েছে রিতা দেওয়ান আমার বাংলাদেশ। আমার বাংলাদেশকে এক পাল ধর্ষক- খুনীর সামনে নতজানু হয়ে হাত জোড় করতে হয়েছে, কাতর অনুনয় করতে হয়েছে যেন তাকে বাঁচতে দেয়।
বাংলাদেশকে ওরা নিজের মতো করে বাঁচতে দেয়নি। দেশের মেয়েদের যেভাবে পাক সেনারা ধর্ষণ করেছিল একাত্তরে, পাক সেনাদের এদেশি ভক্তরা দেশকে সেভাবে ধর্ষণ করছে আজ অনেক বছর।
সুফি সংগীতশিল্পী রিতা দেওয়ানের বক্তব্য আমি শুনেছি, ওয়াজিদের আস্ফালনও শুনেছি, রিতা দেওয়ানের ক্ষমা চাওয়ার দৃশ্যও আমি দেখেছি। শরিয়ত বয়াতির বক্তব্যও আমি শুনেছি। আমি বুঝে পাই না, কী কারণে এই সুফি সাধকদের গ্রেফতার করা হল। ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস। কে কিভাবে তার ঈশ্বরকে কল্পনা করে নেবে, সেটা সম্পূর্ণই তার ব্যাপার। আমার কল্পনার সংগে তার কল্পনা না মিললে সে দোষী—এরকম যে ভাবে, তাকে নিশ্চয়ই আমরা অসহিষ্ণু বলবো। অসহিষ্ণুতে ছেয়ে গেছে গোটা দেশ।
আহমদীয়ারা মুসলমান নয়,—এই ফতোয়া দিচ্ছে ধর্ম ব্যবসায়ীরা। সমকামীদের হত্যা করো, সুফিদের খতম করো, নাস্তিকদের কতল করো— হুমকি দিয়েই যাচ্ছে। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের বিরুদ্ধে যারা এই হুমকি দেয়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে সরকার, কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করি সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বরং ওদের সুরে সুর মেলাচ্ছে। ওদের সুরে সুর মিলিয়ে মুক্তচিন্তক প্রগতিশীলদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।
কোনও সুস্থ মস্তিষ্কের সংস্কৃতিবান মানুষ বাংলাদেশ বাস করতে চায় না। তারা সুযোগ পেলেই দেশ ছাড়ছে। যারা আজও দেশে বাস করছে, তারা বাধ্য হয়ে বাস করছে। তাদের আর কোনও উপায় নেই বলে বাস করছে। এটি দেশের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক নয় কি? যদি শিক্ষিত সভ্য বুদ্ধিমান প্রতিভাবান কেউই দেশে বাস করতে না চায়, সুযোগ পেয়েই দেশ ত্যাগ করে, দেশ তবে কাকে নিয়ে সমৃদ্ধ হবে? বাংলাদেশ একটি ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নিশ্চয়ই।
হয় তোমাকে সরকারের চাটুকার হতে হবে, তা না হলে মরতে হবে। হয় তোমাকে ধর্মান্ধ হতে হবে, মৌলবাদী হতে হবে, তা না হলে মরতে হবে। তুমি স্বাধীনতা এবং অধিকার নিয়ে ভাবো, হয় তোমাকে মুখ বন্ধ করে থাকতে হবে, তা না হলে তোমাকে মরতে হবে।
বাংলাদেশে মুখ বন্ধ করে থাকা, পালিয়ে যাওয়া, জেলে যাওয়া, নির্বাসনে যাওয়া, মরে যাওয়া গোষ্ঠীটির নাম সভ্যতা, আর চেঁচানো দাপিয়ে বেড়ানো ক্ষমতাবান গোষ্ঠীটির নাম অসভ্যতা। অসভ্যতার জয় জয়কার এখন। সরকারের কাছে সুস্থ চিন্তার চেতনার মানুষের আবেদন, বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতি লোকগীতি পালাগান কবিগান বাউল ভাটিয়ালি ভাওয়াইয়া আধ্যাত্মিক গানকে বেঁচে থাকতে দিন, প্রগতিশীল প্রতিভাবান সংস্কৃতিবানদের বেঁচে থাকতে দিন। বাংলার হাজার বছরের সংস্কৃতিকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে বিজাতীয় ওয়াজ সংস্কৃতিকে জনপ্রিয় করা হচ্ছে। এটিকে প্রশ্রয় দেওয়া মানে মোল্লাতন্ত্রকে প্রশ্রয় দেওয়া। এরাই দিন দিন বিকট আকার ধারণ করছে। এরাই গণতন্ত্রের কবর খুঁড়ে বসে আছে, এরাই একে কবর দেবে। নারীনেত্রীত্বের বিরুদ্ধে এরাই দেশ জুড়ে তাণ্ডব করবে। কয়েক যুগ এদের সঙ্গে সরকারের আপোস, কয়েক যুগ বুদ্ধিজীবীদের মুখ বুজে থাকা অথবা স্বার্থান্বেষী চাটুকারে রূপান্তরিত হওয়া—দেশকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়েছে। এই অন্ধকার থেকে আলোয় আসা এখন খুব কঠিন কাজ। এই কঠিন কাজটি কার দ্বারা সম্ভব অনেকের মতো আমারও জানা নেই।
আজ শরিয়ত বাউলকে জেল থেকে মুক্ত করার এবং নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। আজ রিতা দেওয়ানকে নিরাপত্তা দেওয়ার এবং মুক্ত কণ্ঠে তাঁকে পালাগান গাওয়ার পরিবেশ দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। বাংলার বাউলরা যেন মন খুলে গান গাইতে ভয় না পান। যারা ভয় দেখায়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্বও সরকারকে নিতে হবে।
বাকস্বাধীনতার এবং মত প্রকাশের অধিকারের বিরুদ্ধে দেশে যত আইন আছে, সবগুলোকে বাতিল করলে ইসলাম নিয়ে এদের রাজনীতি বন্ধ হবে। ইসলাম একটি ধর্ম। কিন্তু এই ধর্মকে কুচক্রিরা রাজনীতি হিসেবে ব্যবহার করছে। ধর্মের রাজনীতি কেন গণতন্ত্রের রাজনীতিকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিচ্ছে। কেন পিছিয়ে যাচ্ছে গণতন্ত্রের রাজনীতি। গণতন্ত্র শক্তপোক্ত হলে কিন্তু ধর্মকে ধর্ম হিসেবে ব্যবহার না করে রাজনীতি হিসেবে ব্যবহার করা যেত না। যার যার ধর্ম তার তার কাছে। ধর্ম যেভাবে যে মানতে চায়, সে সেভাবে মানবে। কিন্তু যখন কে কীভাবে মানবে, তা বলে দেওয়া হয়, যখন হুমকি ধামকি দেওয়া হয়, যখন ধর্ম বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতা বলে কিছু থাকে না, যখন আইন প্রয়োগ করা হয়, ধর্ম এভাবে না মেনে ওভাবে মানলে জেল ফাঁসি হবে, তখন ওটি আর ধর্ম নয়, ওটি তখন রাজনীতি। ধর্মীয় অনুভূতি বলে যখন এক অদ্ভুত অনুভূতিকে আবিষ্কার করা হয়, এবং ঘোষণা দেওয়া হয় যে এটিকে আঘাত করা চলবে না, এমন কী দেশে আইন তৈরি করা হয় এটিকে স্পর্শ করলে বা আঘাত করলে জেল জরিমানা হবে—তখন সেটি ধর্ম নয়, সেটি রাজনীতি। সুস্থ রাজনীতিকরা, যারা সত্যিকার দেশপ্রেমিক, তারা ধর্মকে রাজনীতিতে নামতে বাধা দেন। ধর্মকে ধর্মের জায়গায় রাখেন—কেউ বিশ্বাস করলে করবে, না করলে না করবে, যার যেভাবে ধর্ম মানতে ইচ্ছে করে—অন্যের কোনও ক্ষতি না করে, অন্যকে বিরক্ত না করে, অন্যের স্বাধীনতা নষ্ট না করে—মানবে। যে শাসকরা এই জরুরি কাজটি দেশের স্বার্থে করতে ব্যর্থ হন, তাঁরা মূলত ব্যর্থ। অশিক্ষিত অসভ্য বর্বর দেশও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হতে পারে, আমরা কিন্তু ওই দেশগুলোকে সভ্য দেশ বলি না। ওই দেশগুলো নিশ্চয়ই আমাদের মডেল নয়। আমরা তবে কোনদিকে এগোচ্ছি?
৮৭. কাঁদো প্রিয় দেশ, কাঁদো
২৬ বছর আগে এসবের শুরু। আমার মাথার দাম ঘোষণা করেছিল সিলেটের এক মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল। কারও মাথার দাম ঘোষণা করা, অর্থাৎ জনগণকে বলা—তোমাদের মধ্যে ওর মুণ্ডুটা যে ব্যক্তি কেটে নিয়ে আসতে পারবে, অর্থাৎ তাকে হত্যা করতে পারবে, তাকে আমি মোটা অংকের টাকা দেব—নিশ্চয়ই খুব বড় এক অপরাধ। কিন্তু এসব অপরাধীর বিরুদ্ধে তখনকার সরকার কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। মামলা করা, গ্রেফতার করা, জেলে ভরা তো দূরের কথা, সামান্য তিরস্কার পর্যন্ত করেনি। প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমানকে বরং টিকিট দিয়েছিল ভোটে দাঁড়ানোর জন্য। প্রকাশ্যে মাথার দাম ঘোষণা করার পর অপরাধীর জনপ্রিয়তা যদি দেশের রাজনৈতিক দলগুলোয় বেড়ে যায়, তাহলে তো নিশ্চিতই দেশ ভয়াবহ ভবিষ্যতের দিকেই যাত্রা করবে।
ফতোয়ার উচ্ছ্বাসে রাস্তায় তখন প্রায় প্রতিদিন মিছিল হত। এক বদলোক থেকে বাকি বদলোক উৎসাহ পায়। সরকারের মৌনতাকেই লোকেরা সমর্থন বলে মনে করে। মিছিলে লোক আনা হত বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে। তারা জানতোই না তসলিমা কে, কী লেখে, কিন্তু তার ফাঁসি চাইতো। তসলিমা নাকি তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে। মিছিল দিন দিন ফুলে ফেঁপে বড় হতে থাকে, এক সময় ‘অনুভূতির রাজনীতিক’রা হরতালের ডাক দেয়, সেই হরতাল সফল হয়। লং মার্চের ডাক দেয়, মানিক মিয়া এভিনিউতে ৪ লাখ মোল্লার সভা হয়। এক লেখিকার ফাঁসির দাবিতে তখন স্কুল কলেজ অফিস আদালত বন্ধ থাকে, যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। উগ্র ধর্মান্ধ, আর জঙ্গি মুসলমানরা তখন রাস্তাঘাটে অবাধে চরম উচ্ছৃঙ্খলতা, রক্তপাত, আর নারকীয় উল্লাসে ব্যস্ত। সরকার ওদের শাস্তি তো দেয়ইনি, ওদের শান্ত করার কোনও ব্যবস্থাও নেয়নি। উলটে আমাকে শাসিয়েছে, আমার বিরুদ্ধে খালেদা সরকার মামলা করেছে, আমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয়েছে, আমাকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করেছে।
যারা দুদিনের মধ্যে চার লাখ লোকের জমায়েত ঘটিয়ে দিতে পারে, রাজনৈতিক দলগুলোর জিভ তখন তাদের দলে টানার মতলবে বেরিয়ে এসেছে। ওইসব বর্বর ফতোয়াবাজ আর ধর্ম ব্যবসায়ীদের অনেকেই পরে সংসদে বসেছে। আমি কোথায়? চিরকালের নির্বাসনে। কী অপরাধ ছিল আমার? আমার অপরাধ ছিল—নারীর সমান অধিকার দাবি করা, মানবাধিকারের লঙ্ঘন যেন না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখার কথা বলা, ধর্মীয় আইনের বদলে নারী পুরুষের সমানাধিকারের ভিত্তিতে আইন তৈরি করার দাবি করা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং ধর্ম নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য আবেদন করা।
আমার প্রিয় দেশটিকে সেদিন দেখেছি কী রকম ভয়ংকর উন্মত্ত হতে। বর্বরদের উন্মত্ততাকে বারবার উস্কে দিয়েছে, প্রশ্রয় দিয়েছে শাসকের দল। শুধু আমাকেই নির্বাসনে পাঠিয়ে শান্ত হয়নি ওরা, কত বুদ্ধিদীপ্ত তরুণকে বর্বরগুলো নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। সমাজ হয় ওদের ভয়ে তটস্থ, অথবা সহজে মগজধোলাই হয়ে এক একটা জড় পদার্থ হয়ে বসে আছে। পঙ্গপালে ছেয়ে গেছে দেশ। এই দেশকে বর্বরদের কবল থেকে কে বাঁচাবে? আমি তো কাউকে দেখিনা। যে দলকে নিয়ে আশা ছিল, সে দল ওদের সঙ্গে আপোস করেছে। বাকিরা ব্যস্ত সরকারের চাটুকারিতা করে আখের গুছিয়ে নিতে। মানবাধিকারে, বাকস্বাধীনতায়, গণতন্ত্রে, নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাস করা সৎ, নিষ্ঠ, আদর্শবাদী মানুষ আজ নেই বললে চলে।
দেশ কতটা নষ্ট হলে একজন সুফি গায়ককে গ্রেফতার করতে পারে, রিমাণ্ডে পাঠাতে পারে, জেল-হাজতে ভরতে পারে, তা সামান্য বিবেক যাদের আছে, তারা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারে। ইসলামে গান নিষিদ্ধ নয়,—এ কথা জোর দিয়ে বলেছিলেন শরিয়ত সরকার বাউল। মোল্লাতন্ত্র খুশি নয় শরিয়ত বাউলের ওপর, সে কারণে গ্রামে গঞ্জে পালাগান গাওয়া এই সুফিকে বন্দি করা হয়েছে। দেশে গণতন্ত্র নেই, আছে মোল্লাতন্ত্র। মোল্লাতন্ত্র আছে বলেই অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ মুক্তচিন্তকদের হয় নিহত হতে হয়, নয়তো নির্বাসন জীবনযাপন করতে হয়।
শরিয়তকে দোষী সাব্যস্ত করা মানেই ইসলামে গান বাজনা নিষিদ্ধ তা প্রতিষ্ঠিত করা। তাহলে কি বাংলাদেশে আজ থেকে সব গান বাজনা নিষিদ্ধ? রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল গীতি, পল্লী গীতি, বাউল গান, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, ব্যান্ডের গান, আধুনিক গান, গণ সংগীত, জীবনমুখী গান, জাতীয় সংগীত—সব নিষিদ্ধ? তাহলে সব নিষিদ্ধই করে দেওয়া হোক। শিল্প সাহিত্য সব নিষিদ্ধ হোক। ইস্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হোক। শুধু মাদ্রাসা খোলা থাকুক। শুধু কোরান, হাদিস পড়া হোক। সুর বলতে কোথাও যদি কিছু থাকে, তা শুধু আজানের সুর। দেশ জুড়ে শুধু মসজিদ বানানো হোক, কোনও একাডেমী নয়, লাইব্রেরি নয়, জাদুঘর নয়। টুপি আলখাল্লা আর বোরখাই হোক নারী পুরুষের পোশাক, অন্য কিছু নয়। মাথার সামান্য চুল যদি বেরিয়ে আসে বোরখার ফাঁক দিয়ে, তাহলে রাস্তাঘাটে ধর্ম-পুলিশেরা পেটাবে মেয়েদের, যদি বোরখার তলায় যদি ট্রাউজার পরে কোনও মেয়ে, তাহলেও একশ’ চাবুক মারবে। দেশে কোনও আদালত নয়, থাকবে শুধু শরিয়া কোর্ট। জনতার সামনে তলোয়ারের এক কোপে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীর ধর থেকে মুণ্ডু ফেলে দেবে। জনতা আল্লাহু আকবর বলে জয়ধ্বনি করবে। শুধু স্বামী-সন্তানের সেবা আর সন্তান উৎপাদনের জন্য ঘরবন্দি করা হোক নারীকে। আল্লাহর শাসন চলবে দেশে। পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হবে তাদের যারা নামাজ রোজায় গাফিলতি করবে, যারা ব্যাভিচার করবে, যারা ইসলাম নিয়ে প্রশ্ন করবে। কোনও গণতন্ত্র, কোনও মানবাধিকার, নারীর অধিকার, কোনও বাকস্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার থাকবে না দেশে।
আমি সত্যি চাইছি এমনই ভয়ংকর দিন আসুক বাংলাদেশে। মানুষ পরাধীনতার শেকলে বন্দি থাকতে থাকতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠুক। মানুষের দম বন্ধ হতে হতে শ্বাস নেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠুক। শেষ অব্দি মানুষই মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে উঠুক। মানুষ মানুষকে বাঁচাবার জন্য সত্যিকার গণতন্ত্র আনুক, সত্যিকার ধর্মনিরপেক্ষতা আনুক, সমাজকে সত্যিকার শিক্ষিত আর সভ্য করার জন্য দিন রাত পরিশ্রম করুক। ফিরিয়ে আনুক, সাহিত্য, সংগীত, সংস্কৃতি। ভুলে গেলে চলবে না বাংলার সংস্কৃতি বর্বর আরবদের সংস্কৃতি থেকে ভিন্ন। ধর্ম একটি ব্যক্তিগত বিশ্বাসের নাম, ধর্ম কোনও সংস্কৃতির নাম নয়, কানুনের নাম নয়। এটিকে ব্যক্তিগত চৌহদ্দি থেকে যদি বাইরে আসতে দেওয়া হয়, তাহলে ধর্ম ব্যবসায়ীরা একে নিয়ে ধুন্ধুমার ব্যবসা শুরু করবে। তাই করেছে। রাজনীতি শুরু করবে, তাই করেছে। এখন কিছু কি বাকি আছে বাংলাদেশের সৌদি আরব, সুদান, সোমালিয়া বা সিরিয়া হওয়ার?
১৯৭১ সালে একটি ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি নিয়ে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল। আমদের স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দিয়েছে বিভিন্ন স্বৈরাচারী শাসক। আজ যে সরকার একাত্তরের রাজাকারকে ফাঁসি দেয়, সেই সরকার বর্তমান রাজাকারদের চুমু খায়। যে সরকার সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনে, সে সরকার রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখে। যে সরকার মানুষকে উদারপন্থী হতে বলে, সে সরকারের আনা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে উদারপন্থী হওয়ার অপরাধে মানুষকে জেলে যেতে হয়। তারপরও সরকার চুপ। যেভাবে চুপ ছিল এক এক করে যখন মুক্তচিন্তকদের হত্যা করেছিল জংগিরা। শুধুই গদি হারানোর ভয়।
সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক যখন অন্যায়কে সমর্থন করে, আমাদের ক্ষমতাবান সরকারপ্রধানও মনে করেন, অন্যায়কে সমর্থন করতে হবে, তা না হলে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন হারাতে হবে। আজ যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক ভেড়ায় পরিণত হয়, তবে তাদেরকে ভেড়ায় পরিণত করার দায় কিন্তু সবচেয়ে বেশি সরকারের। ভেড়ার সমর্থনের বদলে ভেড়াকে যুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন চিন্তাশীল, প্রগতিশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্বও কিন্তু সবচেয়ে বেশি সরকারের। এই দায়িত্ব যদি আজ সরকার না নেয়, যদি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো একটি কালা কানুন আজও বাতিল না করে, আজও যদি বাউল বয়াতিদের মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা না করে, যদি মুক্তচিন্তকদের দেশে ফিরিয়ে না আনে, যদি মানুষের বাকস্বাধীনতা রক্ষা আজও না করে—তবে আমরা নিশ্চিত যে দেশটিকে অন্ধকারের অতল গহবর থেকে বাঁচাবার সুযোগ পেয়েও বাঁচায়নি এই সরকার।
দেশটিকে তাহলে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার অপরাধে অপরাধী সব সরকারই।
৮৮. ধর্ষণের শিকাররা মুখ লুকোয় কেন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ছাত্রীটির নাম কী? নাম কেন বলা হচ্ছে না? তার চেহারাও কেন দেখানো হচ্ছে না? আমরা কিন্তু ধর্ষকের চেহারা দেখে ফেলেছি, তার নাম যে মজনু তাও জেনে ফেলেছি। ধর্ষণের শিকারকে কেন মুখ লুকোতে হবে? ধর্ষকরা তো দিব্যি নাম ধাম সাকিন জানিয়ে দেয়, ক্যামেরার দিকে তাকাতে তাদের তো লজ্জাবোধ হয় না! তাহলে কি ঘটনা এই যে সমাজের ভয় একজন ধর্ষিতার আছে, কিন্তু একজন ধর্ষকের নেই? কেন নেই? এককালে না হোক, আজকাল তো ধর্ষকদের পুরুষেরাও মেনে নেয় না। তারা ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে নিজেরা যে ধর্ষক নয়, তা প্রমাণ করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়, বলতে থাকে সব পুরুষ ধর্ষক নয়, ধর্ষককের জন্য কঠিন কঠিন শাস্তির প্রস্তাব দিতে থাকে, ফাঁসি, পুরুষাঙ্গ কর্তন, কত কী। তাহলে কেন আজও এই একবিংশ শতাব্দীতেও মেয়েরা নিজের পরিচয় লুকোতে বাধ্য হয়?
আমরা জানি কেন লুকোয় পরিচয়। কারণ যতই মানুষ ধর্ষণের বিরুদ্ধে বলুক, যতই ধর্ষককে গালি দিক, মানুষ আজও মেয়েকেই দোষী বলে মনে করে। মেয়েটি কী পোশাক পরেছিল? কোনও ছোট পোশাক? মেয়েটি যদি কোনও ছোট পোশাক না পরে থাকে, তবেও দোষ, কেন হিজাব পরেনি, যদি হিজাব পরে থাকে, তবেও দোষ কেন বোরখা পরেনি। মেয়েটি বান্ধবীর বাড়িতে যাচ্ছিল, কেন একা যাচ্ছিল, একা গেলে তো এরকম হবেই। কেন কোনও পুরুষ আত্মীয় ছিল না সঙ্গে? কেন সন্ধ্যেয় যাচ্ছিল, দিনের বেলায় তো যেতে পারতো! দোষের শেষ নেই। ধর্ষণকে পুরুষের অধিকার বলে যারা বিশ্বাস করে, তারা পদে পদে মেয়েদের দোষ খুঁজে বেড়াবে বলার জন্য অন্য মেয়েরা তো ধর্ষণের শিকার হয় না, ও হলো কেন, নিশ্চয়ই ও খারাপ। নিশ্চয়ই ধর্ষিতা হতেই সে চেয়েছে! ধর্ষণের কারণ যে পুরুষের নারীবিদ্বেষ, নারীকে যৌনবস্তু ভাবার মানসিকতা, নারীকে নির্যাতন করাই যায়, নারী তো নিতান্তই তুচ্ছাতিতুচ্ছ বস্তু—এই বিশ্বাস, তা অনেকে জানে না। অথবা জানলেও না জানার ভান করে।
ধর্ষণের শিকার হলে হাজারো মেয়ে সাধারণত মুখ বুজে থাকে। তারা রাষ্ট্র করে না খবর। এই মেয়েটি জানিয়েছে সব্বাইকে। নিঃসন্দেহে সাহসী মেয়ে। কিন্তু সে ততটুকু সাহসী নয়, যতটুকু সাহসী হলে পাছে লোকে কী বলবে তার তোয়াক্কা করে না। দিল্লির বাসে যে মেয়েটিকে গণধর্ষণ করা হয়েছিল, মৃত্যুর সঙ্গে যখন সে লড়ছিল, সারা পৃথিবীর সমর্থন সহানুভূতি পেয়েছিল সে, তারপরও নিজের নাম যে জ্যোতি সিং, তা বলেনি। তার নাম দেওয়া হয়েছিল নির্ভয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীটির নামও কি তবে ওই জাতীয় কিছু একটা দেওয়া হবে?
আর কতদিন এই ভিতু মেয়েদের আমরা নির্ভয়া বা সাহসীনী বলে ডাকবো?
ধর্ষণের শিকার যারা, তারা যেন আর মুখ না লুকোয়। যদি এমন হয় যে ধর্ষণের শিকার হলে তাকে হেনস্থা করা হচ্ছে, তাহলে যারা হেনস্থা করছে, তাদের চিহ্নিত করা হোক। তাদেরও শাস্তির ব্যবস্থা হোক। শুধু ধর্ষণ যে করে, সে-ই দোষী? ধর্ষকের পক্ষ নিয়ে যারা তার শিকারকে ঘৃণা করে, একঘরে করে, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, নির্যাতন কবে—তারাও তো ধর্ষকের মতোই। ধর্ষক করে শারীরিক নির্যাতন, সমাজের ভদ্রলোকেরা করে মানসিক নির্যাতন। এখনও শারীরিক নির্যাতনকে নির্যাতন হিসেবে ধরা হয়, মানসিক নির্যাতনকে নয়। ধর্ষণের পর একটি মেয়েকে পরিবার এবং সমাজ মানসিক নির্যাতন করে, এ কারণেই মেয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়, আত্মহত্যা করে। শারীরিক নির্যাতনের চেয়ে মানসিক নির্যাতন হাজার গুণ ভয়ংকর।
ধর্ষণ পুরুষতন্ত্রের উপসর্গ ছাড়া আর কিছু নয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এই ঘোষণা দেয় যে নারী দুর্বল, পুরুষ সবল। পুরুষের জগৎ বাইরে, নারীর জগৎ ঘরে। পুরুষ অর্থকড়ি উপার্জন করে, নারী ঘর সংসার করে, শিশু পালন করে। নারীকে তার পিত্রালয় থেকে উঠিয়ে স্বামীগৃহে স্থান দেওয়া হয়। শৈশব কৈশোরে মেয়েরা পিতার অধীন, যৌবনে স্বামীর অধীন। নারীকে স্বামীর সেবা যত্ন করতে হবে, সন্তান, বিশেষ করে পুত্র সন্তান জন্ম দিতে হবে। নারী এবং পুরুষকে ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকায় বেঁধেছে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। এই ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকাই প্রমাণ করে নারী নিতান্তই পুরুষের দাসি, যৌনদাসি। যৌনদাসিকে তাই খুব সহজেই রাস্তাঘাটের লোকেরা তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করতে পারে। কোনও ধর্ষক ভাবে না সে অন্যায় করছে। ঘরে ঘরে নারী নির্যাতন চলছে, যে নির্যাতনকে বৈধ বলে মনে করে দেশের প্রায় সবাই। ঘরে ঘরে ধর্ষণ চলছে। স্ত্রীকে ধর্ষণ করছে স্বামী। আজও স্বামীর ধর্ষণকে ধর্ষণ বলে মানা হয় না। আজও গণিকালয়ে গিয়ে পুরুষেরা যে ধর্ষণ করে, সেই ধর্ষণ এবং যৌন নির্যাতনকেও বৈধ বলে মানা হয়।
ঘরে এবং বাইরে পুরুষ যা করে অভ্যস্ত, তা ধর্ষণ। তবে কেন একটি মেয়েকে সুযোগ পেলে অন্ধকারে নিয়ে ধর্ষণ করবে না? পুরুষকে তার পেশি, তার জোর, তার ক্ষমতা, তার সাহস নিয়ে, মোদ্দা কথা তার পৌরুষ নিয়ে গর্ব করতে শেখানো হয়েছে। ধর্ষণ সেই গর্ব থেকেই করে পুরুষ।
মজনু নামক ধর্ষকটির কাছে শিক্ষিত অশিক্ষিত সব মেয়েই সমান। নারী, তার কাছে, যৌনাঙ্গ ছাড়া কিছু নয়। প্রচুর পুরুষ, ধর্ষক অথবা ধর্ষক নয়, নারীকে আস্ত একটি যৌনাঙ্গ বলেই বিচার করে। মজনু এমন কোনও অস্বাভাবিক কোনও পুরুষ নয়। সে সমাজের আর দশটা পুরুষের মতোই পুরুষ। তারও হয়তো বউ বাচ্চা আছে, অথবা বাবা মা ভাই বোন আছে। সে এই দেশেরই সন্তান। সে আসমান থেকে পড়েনি।
মজনুরা আর কতকাল ধর্ষণ করবে মেয়েদের? পুরুষদের কি এখনও সময় হয়নি ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার? পুরুষেরা যেন পুরুষদের সেই ভাবে শিক্ষা দেয়, যেভাবে শিক্ষা দিলে পুরুষেরা ধর্ষণ করবে না, বা ধর্ষণ করলেও ধর্ষণ করা বন্ধ করবে। নারীরা চিৎকার করলে পুরুষেরা কান দেয় না। নারীরা জানে না কী করলে বা কী বললে পুরুষেরা ধর্ষণ বন্ধ করবে। পুরুষেরাই জানে পুরুষের মন। সুতরাং পুরুষের শিক্ষক, উপদেষ্টা পুরুষকেই হতে হবে। পুরুষকেই দল বেঁধে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ মানব সমাজে বাস করতে হলে, নারীর সঙ্গে এক সমাজে বাস করতে হলে, পুরুষকে নারী নির্যাতন বন্ধ করতেই হবে। এ ছাড়া উপায় নেই।
৮৯. কয়েকটি জরুরি প্রসঙ্গ
১
সুশান্ত সিং রাজপুতকে নিয়ে এখনও বিতর্ক চলছে। ওঁকে কেউ হত্যা করেছে, নাকি নিজেই ফাঁসিতে ঝুলেছেন, যদি এ আত্মহত্যাই হয় তবে কারণ কী তার, স্বজনপোষণ নাকি অন্য কিছু ? পুলিশ কোনও খুনের আলামত পাচ্ছে না, কিন্তু বিতর্ক থামছে না। হোমড়া চোমড়াদের জিজ্ঞাসাবাদে নিচ্ছে পুলিশ।
জিয়া খান তো আত্মহত্যা করেছিলেন, কই তাঁর ওই আত্মহত্যা আসলেই আত্মহত্যা কিনা, নাকি কেউ তাকে হত্যা করেছিল, এ নিয়ে কোনও তোলপাড় তো হয়নি। দিব্যা ভারতিকে কি হত্যা করা হয়েছিল নাকি তিনি পাঁচ তলার জানালা দিয়ে নিজেই লাফ দিয়েছিলেন মরবেন বলে, আজও কিন্তু এই প্রশ্নের সন্তোষজনক কোনও উত্তর মেলেনি। সবচেয়ে অবাক হই, শ্রীদেবীর মতো বিখ্যাত অভিনেত্রীর রহস্যজনক মৃত্যু নিয়েও কোনও সংশয় প্রকাশ করেনি বড় কোনও মিডিয়া বা সংগঠন, বা নামি দামি কেউ অথবা বলিউডের কেউ। আগের দিন নাচলেন মানুষটা। পরের দিন বাথটাবের জলে ডুবে মরে গেলেন!! ঘরে একজন উপস্থিত ছিলেন সেসময়। ডেথ সার্টিফিকেটও আনাড়ি হাতে লেখা ছিল। এ নিয়ে কাউকে জেরা করা হয়নি। বিদেশের মাটিতে মারা গেলেই কি জবাবদিহি করতে হয় না, আর সাত খুন মাফ হয়ে যায়?
পুরুষেরা আত্মহত্যা করলে সহজে বিশ্বাস করা হয় না এ আত্মহত্যা, মেয়েরা আত্মহত্যা করলে এ আত্মহত্যা বলেই মানুষ চটজলদি বিশ্বাস করে ফেলে। কারণ তো ওই একই, মেয়েদের হৃদয় এত কোমল, তাদের এত আবেগ, তারা পারে না বাস্তবতার মুখোমুখি হতে।
কত মেয়েকেই তো হত্যা করা হয়, কত মেয়েকেই তো আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে সমাজ। এসব নিয়ে কি সত্যিই তোলপাড় হয়? হয়তো মেয়েদের জীবনকে মূল্যহীন ভাবা হয় বলে তাদের মৃত্যুকেও মূল্যহীন ভাবা হয়। সাধারণ মেয়েদের অপঘাতে মৃত্যু হলে কেউ পরোয়া করে না, অসাধারণ মেয়েদের বেলায় অনেকটা তাই। কিছু কিছু ব্যাতিক্রম নিশ্চয়ই আছে।
আজ টুইটারে আমি এই প্রশ্নটি করেছিলাম, সুশান্তর বেলায় প্রশ্ন উঠছে হত্যা না আত্মহত্যা, শ্রীদেবীর বেলায় কেন প্রশ্ন ওঠেনি হত্যা না ড্রাউনিং? একজন বল্লেন, ‘বয়সটা ম্যাটার করছে। শ্রীদেবীর বয়স বেশি, কেরিয়ারের শেষ। সুশান্তের অল্প বয়স, কেরিয়ারের শুরু।’ তাই বুঝি? জিয়া খানের বয়স তো সুশান্তের চেয়েও কম ছিল, তাতে কী হয়েছে!
শ্রীদেবীর বয়স বেশি বলে তেমন কোনও তরঙ্গ সৃষ্টি হয়নি! অমিতাভের তো বয়স শ্রীদেবীর চেয়েও বেশি। আজ তিনি গত হলে মানুষ হাউমাউ করে কাঁদবে না? শুধু কি কাঁদবেই! সুশান্তর জন্য কত ছেলেমেয়ে আত্মহত্যা করে ফেললো, অমিতাভ’র জন্য হয়তো আরও বেশি করবে।
২
সংযুক্ত আরব আমিরাত বলে দিয়েছে জনগণ যেন বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রিয়জনকে ঈদের উপহার দেওয়া থেকে বিরত থাকে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দেখা সাক্ষাতের পরিবর্তে সামাজিক মাধ্যম, ই-মেইল ও টেলিফোনে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে বলা হয়েছে। আত্মীয় ও পরিবারের সঙ্গে দেখা করা যদি অতিজরুরি হয়, তা হলে সাক্ষাতের সময় সামাজিক দূরত্ব যেন অবশ্যই বজায় থাকে। গৃহকর্মীদের বলা হয়েছে বাইরের কারও সঙ্গে যেন সাক্ষাৎ না করে এবং কিছু জরুরি জিনিস যদি তাদের গ্রহণ করতেই হয়, যেন পিপিই পরে গ্রহণ করে। আরব আমিরাতে এ পর্যন্ত করোনায় মারা গেছে ৩৪৫ জন। কিন্তু আরব দেশ হয়েও ঈদের মতো মূল ধর্মীয় উৎসবের অনেকটাই বন্ধ রাখার পরামর্শ দিয়েছে। বড় জমায়েত বন্ধ রাখতে হবে, এর মানে ঈদের নামাজটাই বন্ধ রাখতে হবে। মানুষে মানুষে সৌহার্দের আলিঙ্গনই তো ঈদের মূল আনন্দ, সেই আলিঙ্গনও করা চলবে না। করোনার কামড় থেকে বাঁচতে হলে এই পথই অনুসরণ করতে হবে। আরব আমিরাতের সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত সকলেরই গ্রহণ করা উচিত। বাংলাদেশে এক এক করে অনেকেরই তো মৃত্যু হচ্ছে করোনায়। ঘরেই ঈদের নামাজ পরা, ঘরেই স্বজনদের সঙ্গে ভালোমন্দ খাওয়া—এটুকুতেই ঈদের উৎসবকে সীমিত রাখা উচিত। মহামারীর সময় বড় বড় গরু জবাই করে খানাপিনার উৎসব করলে পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষের করোনার করুণ মৃত্যুকে মোটেও পরোয়া করা হয় না। আমরা কি শোকের সময় আনন্দ করি? বাড়িতে কারও মৃত্যু হলে তো চুলোই নাকি ধরাতে হয় না। বাড়িতে বাড়িতে তো মৃত্যু হচ্ছেই, আমাদের গোটা গ্রহই তো আমাদের বাড়ি। এই গ্রহে গত কয়েক মাস যাবৎ আনন্দ তো নেই। ঈদের পর যদি করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যায়, তবে কিন্তু মুসলিমদের ওপর রাগ বাড়বে মানুষের। মুসলিমদের নির্বুদ্ধিতা, ধর্মান্ধতা ইত্যাদি নিয়ে পৃথিবী আবারও চিৎকার করবে।
লোকে যত চিৎকারই করুক, এ কথা সত্য যে আরব দেশে মানুষ ক্রমশ বিজ্ঞানমনস্ক হচ্ছে, এ নিশ্চয়ই খুব ভালো লক্ষণ। কিছুদিন আগে সংযুক্ত আরব আমিরাত মঙ্গল গ্রহে যান পাঠালো। কে বলেছে মহাশূন্যে শুধু ইউরোপ আমেরিকাই যান পাঠাবে, আর আরব দেশগুলো পড়ে থাকবে মাটিতে, ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে! যত বেশি অন্ধকার কাটিয়ে আলোয় আসবে মানুষ, তত স্পষ্ট হবে তারা, তাদের বুদ্ধিদীপ্ত অবয়ব।
৩
সাদ্দাম হোসেনকে খুন করে ইরাককে গণতন্ত্র উপহার দিয়েছিল আমেরিকা। গণতন্ত্রের পথেই নাকি ইরাকে সুখ-শান্তি ফিরে আসবে। কোথায়, অনেক বছর তো হয়ে গেল! গণতন্ত্রের সব শাসকই তো জনতাকে শোষণ করছে। দুর্নীতি, বেকারত্ব, দারিদ্র, সন্ত্রাস, হত্যাকাণ্ড এসব ঢেলে দেশটাকে কি হাল করেছে, দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়। সাদ্দামের অত্যাচারে অনেকে অতিষ্ঠ ছিল তা ঠিক, কিন্তু সাদ্দামকে সরিয়ে যারা এলো, তাদের অত্যাচারেও তো জনগণ অতিষ্ঠ। তেল উৎপাদন করে দেশ, অথচ ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও বিদ্যুতের অভাবে মানুষকে ভুগতে হয়। মুসলমানের দেশে দুর্নীতি কেন ঘটে? মানুষ যদি ধর্ম পালন করেই, তা হলে দুর্নীতি কেন করে? ধর্ম তো লোভ, লালসা, অন্যকে ঠকানো, অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করার বিপক্ষে বলেছে। তা হলে দুর্নীতিবাজরা যদি ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়েও, তিরিশটা রোজা রেখেও দুর্নীতি বন্ধ না করে, তবে নামাজ-রোজার জন্য আদৌ কি পুণ্য হবে তাদের? অনেকে মনে করে ওরা দুর্নীতি বেশি করে বলেই নামাজ, রোজাটা বেশি করে।
ইরাকের সরকার বিরোধী মিছিলে গুলি চালিয়ে তিনজনকে মেরে ফেলেছে সরকারের পুলিশ বাহিনী। গত বছর মিছিলের ৫৫০ জনকে মেরে ফেলেছিল, আর ৩০,০০০ মানুষকে আহত করেছিল। প্রতিবাদ মিছিলে যে সরকার গুলি চালায়, সে সরকার কোনও গণতান্ত্রিক সরকার নয়। একনায়ক সাদ্দাম হোসেনের জীবনের বিনিময়ে গণতন্ত্র আসার কথা ছিল ইরাকে, আজও আসেনি। আদৌ কোনওদিন আসবে কি না কে জানে।
৪
আরব দেশগুলো যেভাবে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, তা সত্যিই প্রশংসা পাওয়ার দাবি রাখে। অবৈধভাবে হজ পালনের চেষ্টা করায় গতকাল হজ সিকিউরিটি ফোর্স ২৪৪ জনকে আটক করেছে। সৌদি প্রশাসন জানিয়েছে, অনুমতি না পাওয়ার পরেও তারা প্রটোকল ভেঙে হজ পালনের চেষ্টা করছিল। তাদের গ্রেফতার করে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। প্রশাসন আরও জানিয়েছে, করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে কড়া নিরাপত্তা বজায় রেখে সীমিত পরিসরে হজ পালন হচ্ছে। অনুমতি না থাকলে কেউ যেন এ বছর হজ পালনের চেষ্টা না করে। এবারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বড্ড কঠিন।
৫
চীন আর ভারত কি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে? আমি কোনওদিন কোনও ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করিনি। কিন্তু আজ প্রকৃতির কাছে আমার প্রার্থনা— পৃথিবীতে যেন আর কোনওদিন এক দেশের সঙ্গে আর এক দেশের যুদ্ধ না বাঁধে। এই করোনা মহামারীই কি বুঝিয়ে দেয়নি অদৃশ্য ভাইরাসের কাছেও আমরা মানুষেরা কত অসহায়? মানুষ এখন সব এক হয়ে মিলেমিশে মানুষের সব শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, তা নয়, মানুষ মানুষকেই ঘৃণা করছে, মানুষকেই হত্যা করার পরিকল্পনা করছে। এর চেয়ে বড় অকল্যাণ আর কী হতে পারে! পারমাণবিক বোমার দুটো দেশে যখন ঝগড়া বাঁধে, আমরা জনগণ তো এমনিতে অসহায়, আমরা আরও অসহায় হয়ে পড়ি।
৯০. হুমকির রাজনীতির শিকার আজ প্রগতিশীল মানুষ
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সারা বাংলাদেশে উন্মত্ত মৌলবাদীরা ধর্মের নামে তাণ্ডব শুরু করেছিল। রাস্তাঘাট মাঠ-ময়দান ছিল তাদের দখলে। তারা আমাকে, একজন লেখককে, ফাঁসি দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। সরকারের দয়াদাক্ষিণ্যে মৌলবাদীরা দিনে দিনে কত ভয়ংকর হয়ে উঠেছে, তা বাংলাদেশের মানুষ প্রথম লক্ষ্য করেছিল। তাদের ডাকা হরতাল, লং মার্চ সবই তখন সফল হয়েছিল। সরকার ওই গণতন্ত্র-বিরোধী, বাকস্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে তখন নিয়ন্ত্রণ করার বদলে আমাকে শাস্তি দিয়েছিল, আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল, আমাকে গ্রেফতার করার হুলিয়া জারি করেছিল, আমাকে দেশ থেকে বের করে দিয়েছিল। কয়েক মাস জুড়ে উন্মত্ত যে তাণ্ডব চলছিল, তা আপাতত থেমেছিল। সরকার হয়তো ভেবেছিল, আপদকে বিদেয় করা হয়েছে, এখন জনতা শান্ত। পরিস্থিতিকে সামাল দিতে, দেশের ভালোর জন্য সেটিই কি সরকারের করণীয় ছিল? অবশ্যই নয়। আসলে দেশের ভালোর জন্য যা করণীয় ছিল তা হল আমাকে শাস্তি না দিয়ে, উন্মত্ত অপশক্তিকে শাস্তি দেওয়া, যারা দেশের আইনের তোয়াক্কা না করে, গণতন্ত্রের প্রধান শর্ত মত প্রকাশের অধিকারকে অস্বীকার করে লেখকের মাথার মূল্য ঘোষণা করেছিল, বাড়িঘর, দোকানপাট, বাস, ট্রাক ভেঙেছিল, পুড়িয়েছিল। আমাকে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত একজন ডাক্তারকে, এবং মানবাধিকার, নারীর অধিকার, আর মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে লেখা বইয়ের একজন লেখককে দেশ থেকে বিতাড়ন করা দেশের মৌলবাদী সমস্যার সমাধান ছিল না। যারা দেশের মঙ্গল চায় না, বরং দেশকে ধর্মের নামে রসাতলে নিয়ে যেতে চায়, তারা যা দাবি করেছিল, তা মেনে নিয়ে ভয়ংকর একটি ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা করেছিল দেশ। আমাকে হারিয়ে দিয়ে মৌলবাদীদের জিতিয়ে দিয়েছিল সেদিনের সরকার। শতগুণ শক্তি নিয়ে যে মাঠে ফিরে আসবে মৌলবাদীরা, দূরদৃষ্টিহীন রাজনীতিকেরা সেটা বুঝতে পারেনি। অথবা বুঝেও আমল দেয়নি। দেশ নিয়ে সত্যিই কি তাদের কোনও ভাবনা আছে? ফতোয়াবাজদের, লং মার্চের উদ্যোক্তাদের, ধর্মের নামে যারা দেশ থেকে গণতন্ত্র হঠিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তাদের বন্ধু ভেবে আলিঙ্গন করেছিল রাজনীতিকরা, তাদের দলে টেনেছিল, তাদের সংসদে বসিয়েছিল।
আজও তার মাশুল দিতে হচ্ছে প্রতিটি সরকারকেই। আজ মৌলবাদীদের উপঢৌকন দিয়ে, তাদের অন্যায় আবদার মিটিয়ে, তাদের কাছে নতজানু হয়ে তাদের খুশি রেখে গদি ঠিক রাখতে হয়। আমাদের সরকাররা জনগণের খাদ্য-বস্ত্র-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের ব্যাপারে যত না চিন্তিত, তার চেয়ে বেশি চিন্তিত নিজের গদি নিয়ে। গদি বাঁচানোর জন্য যা যা করা দরকার বলে মনে করে, তাই করে। নানা কিসিমের অপরাধ করতেও দ্বিধা করে না। কেউ কেউ এই ফাঁকে আখেরও গুছিয়ে নেয়। এই সন্ত্রাসী মৌলবাদীরা যখন মুক্তচিন্তকদের এক একজনকে কুপিয়ে মেরে ফেলে, তখন সরকারকে চুপ হয়ে থাকতে হয়, একটি বাক্য উচ্চারণ করার সাহস হয় না। সেদিন, নব্বইয়ের শুরুতে মৌলবাদের উত্থানকে যদি ঠেকাতো সরকার, তবে আজ তারা এত বড় জল্লাদ হতে পারতো না। দোষ কিন্তু শুধু সরকারের নয়, দোষ বুদ্ধিজীবীদেরও। যে মানুষটি মৌলবাদীদের দ্বারা নির্যাতিত, তার বিরুদ্ধে যখন সরকারি হামলা হল, যখন নব্বইয়ের দশকে একের পর এক আমার বই নিষিদ্ধ করতে লাগলো সরকার, ক’জন বুদ্ধিজীবী এর প্রতিবাদ করেছিলেন? প্রকাশকরা কী করেছিলেন? আমার বই ছাপানো বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আর পত্রিকার সম্পাদকরা, যে সম্পাদকদের আমরা প্রগতিশীল বলে জানতাম, তাঁরাই মৌলবাদী অপশক্তি আর দূরদৃষ্টিহীন সরকারের মতো আমাকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। আর ফাঁকা মাঠে তখন একশ্রেণীর মৌলবাদী প্রচারযন্ত্র আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছিল। কেউ এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করেনি। আমার কণ্ঠরোধ, তার ওপর বিরুদ্ধ-মিডিয়ার অপপ্রচারের অবাধ স্বাধীনতা। সবই, আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে ভয়ে মুখ বুজে থাকার এক ভয়ংকর সংস্কৃতি উপহার দিয়েছিল। মানুষ যেন তসলিমাকে ঘৃণা করে, তসলিমার যে পরিণতি হয়েছে, সেই পরিণতিকে ভয় পেয়ে তার মতো হওয়ার, তার মতো কথা বলার চেষ্টা যেন না করে। তাই তো হয়েছে। যে কথা বলেছে, তাকে হুমকি দিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, অথবা দিনেদুপুরে চাপাতি চালিয়ে খুন করেছে।
আজ মানুষকে মুখ বুজে থাকতে হয়। লেখক, প্রকাশক, সম্পাদক সকলে ভয়ে তটস্থ। মুক্তচিন্তার প্রকাশ দেশটিতে নিষিদ্ধ। শিল্পীরা তটস্থ। চিন্তাশীল, প্রগতিশীল, সকলে সিঁটিয়ে আছে আতঙ্কে। এসব দেখলে নব্বইয়ের শুরুতে মৌলবাদীদের উত্থানের কথা মনে পড়ে। কিছু কাজ ঠিক সময়ে না করলে বড় ক্ষতি হয়ে যায়। সকলে মিলে একজন নারীবাদী লেখকের ক্ষতি করতে গিয়ে আসলে দেশের খুব বড় ক্ষতি করে ফেলেছে। এত কথা এইজন্য বলছি যে বাংলাদেশের ইউটিউবার এবং অনলাইনে শিক্ষাদান কর্মসূচি পরিচালনা বিষয়ক সংস্থা টেন মিনিট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী আয়মান সাদিককে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে টেন মিনিট স্কুলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা সাকিব বিন রশীদকেও। আয়মান সাদিক বলেছেন, ‘ফেসবুক, ইউটিউবসহ অনেক জায়গায় আমাকে মেরে ফেলার জন্য বলা হচ্ছে।’ টেন মিনিট স্কুলের অনেক মানুষকে মেরে ফেলার জন্য বলা হচ্ছে। টেন মিনিট স্কুলকে বয়কট করার জন্য বলা হচ্ছে। ফেসবুকে হুমকিদাতারা লিখেছে, ‘এই মুরতাদকে যেখানেই আপনারা পাবেন, তাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিবেন। হাজার হাজার মানুষ সেটা শেয়ার করছে’। সাকিব বন রশীদকে বলা হচ্ছে তিনি নব্য মিশনারি, কাফিরদের এজেন্ট, পশ্চিমা অপসংস্কৃতি প্রচার করার এজেন্ট। এই ভাষা আমার খুব চেনা। সেই নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু, আমাকে মুরতাদ, ইসলাম বিরোধী, কাফির, পশ্চিমা অপসংস্কৃতির এজেন্ট বলা হতো। এই দোষগুলো দিলে তারা মনে করে তারা সাধারণ ধর্মভীরু মানুষের সমর্থন পাবে। তারা কিন্তু ভুল নয়। ধর্মের ধ্বজা উড়িয়ে জগতে হেন অপরাধ নেই যে তারা করছে না, আর সাধারণ মানুষ চোখে ঠুলি এঁটে বসে আছে, আর মন প্রাণ দিয়ে অজ্ঞতা আর মূর্খতার চর্চায় নিজেদের ডুবিয়ে দিয়েছে। সরকার এবং ধর্মান্ধ কেউ চায় না দেশে মুক্তবুদ্ধির চর্চা চলুক। চললে দু-পক্ষেরই অসুবিধে কিনা।
কী দোষ আয়মান সাদিকের এবং তার স্কুলের? দোষ তাঁরা মেয়েদের ঋতুস্রাব যে অপবিত্র কিছু নয়, তার ব্যাখ্যা করেছেন। যৌন মিলনের জন্য সম্মতির প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। এতে নারীবিরোধী ধর্মান্ধ অপশক্তির বড় রাগ। কারণ তারা ধর্ষণে বিশ্বাস করে, তারা বিশ্বাস করে ঋতুস্রাব খুব নোংরা ব্যাপার, ঋতুস্রাব মেয়েদের অপবিত্র করে। তারা ঘোষণা দিয়েছে, এই ভিডিও দুটো ইসলাম-বিরোধী। যারা ভিডিও বানিয়েছেন তাঁরাও ইসলাম-বিরোধী। ইসলাম-বিরোধী—এই তকমা কাউকে দিলে তার সর্বনাশ হয়ে যায়। যেমন আমার হয়েছে। আমি কিন্তু ভয়ে আমার কোনও বই বা লেখা ছিঁড়ে ফেলিনি। কিন্তু আয়মান সাদিক তাঁর ভিডিও দুটো অনলাইন থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। শুধু সরিয়েই দেননি, ক্ষমাও চেয়েছেন। বলেছেন, ঋতুস্রাব ও সম্মতি নিয়ে করা ওই দুটো ভিডিও অনেকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার কারণে তারা দুঃখিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী। এর চেয়ে বড় পরাজয় আর কী হতে পারে? মৌলবাদীদের তিনি জিতিয়ে দিলেন। বার বার প্রগতিশীলদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হচ্ছে মৌলবাদী অপশক্তি।
এতে সরকারের ভূমিকা কী? প্রগতিশীলদের পাশে থাকা? না, বরং মৌলবাদীদের পাশে থাকা। নব্বইয়ের শুরু থেকে তো সব সরকারই মৌলবাদীদেরই পাশে থাকছে। সত্যিকার জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা বাংলাদেশে হতে দেবে না মৌলবাদীরা। গণতন্ত্র-বিরোধী, নারী-বিরোধী, মানবাধিকার-বিরোধী, মানবতা-বিরোধী লোকগুলো ধর্মের নামে সমাজকে অসুস্থ বানানোর ষড়যন্ত্রে বহু বছর থেকেই লিপ্ত। এদের হাতের মুঠোয় আজ বন্দি রাষ্ট্র, সমাজ, এবং জনতা।
এই ধর্মান্ধ বদলোকগুলোকে ধর্ম রক্ষার দায়িত্ব কে দিয়েছে? আজ তারা এত সহজে দেশকে ধ্বংস করে দিতে পারছে কেন? কে তাদের সাহায্য করছে? দেশের সর্বনাশ করার জন্য তারা সবচেয়ে বড় যে হাতিয়ারটি নিয়েছে, সেটি ইসলাম। এই ধর্ষক, ইয়াবা ব্যবসায়ী, নারীবিদ্বেষী বদলোকগুলো যেভাবে ইসলাম পালন করার নির্দেশ দেবে, মানুষ কেন বাধ্য থাকবে সেভাবে ইসলাম পালন করতে? ইসলামকে তারা যেন হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করতে পারে, সেটির ব্যবস্থা সরকার আর কবে করবে? দেরি কি যথেষ্ট হয়নি? তাদের হাত থেকে চাপাতি কেড়ে নেওয়ারও কি সময় আজও আসেনি?
৯ ১. করোনা ভাইরাসের সঙ্গে জীবনযাপন কি সম্ভব?
দিন দিন খারাপ খবর আসছে। ঘরে বসেও রক্ষে নেই, বাতাসের সঙ্গে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়তে পারে করোনা। করোনা আক্রান্ত লোকেরা হাঁচি কাশি দিলে তো বটেই, এমনকি কথা বললেও, নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেললেও নাক মুখ থেকে বেরোবে ড্রপলেটস বা জলফোঁটা, ভাইরাস কিলবিল করছে যে সব জলফোঁটায়। বড় জলফোঁটাগুলো মাটিতে পড়ে যায়, আর ছোটগুলো বাতাসে ভাসে। কত দূর যেতে পারে বাতাসে, ছ’ফুট, বারো ফুট, দু’মিটার, ছ’মিটার এরকম শুনেছি আগে। থাকে কতক্ষণ? থাকে দু’তিন ঘণ্টা। এখন আরও গবেষণার পর কী বলছেন বিজ্ঞানীরা? বলছেন ছোট জলফোঁটাগুলো বাতাসে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত ঘুরে বেড়ায়। অনেকটা দূরেই এই ভাইরাস যেতে পারে। এক ঘরে কেউ নিঃশ্বাস ফেলছে, পাশের ঘরে বসে আর এক লোক বাতাসে ভাসা ভাইরাস তার ফুসফুসে শ্বাসের সঙ্গে নিতে পারে। আমাদের চারপাশে প্রচুর লোক নিঃশ্বাস ফেলছে। সুতরাং বাতাসে সারাক্ষণই ভাইরাস ভাসছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা ভাইরাসের এই ধ্বংসাত্মক চরিত্রটি নিয়ে তেমন কিছু বলেনি আগে। বলেছে বড় জলফোঁটাগুলো যেসব জায়গায় পড়তে পারে, সেসব জায়গায় হাত না দিতে, সেসব জায়গা সাবান দিয়ে ধুয়ে দিতে, হাতও সাবান দিয়ে বারবার ধুতে। মানুষ বড় জলফোঁটার কথাই বেশি জানে। আর ছোট জলফোঁটাগুলোকে তো কোনো সাবান বা স্যানিটাইজার বা ডিসিনফেক্টেন্ট দিয়ে ধোয়া যায় না! এই ফোঁটাগুলোই তো শ্বাসের সঙ্গে ঢুকে পড়ছে আমাদের ফুসফুসে! এই তথ্যটি জানিয়ে কেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জনগণকে সতর্ক করেনি, এ নিয়ে বেশ অনেক বিজ্ঞানীই ক্ষুব্ধ। সে কারণেই ৩২টি দেশের ২৩৯ জন বিজ্ঞানী জনগণকে শুনিয়েই বলে দিয়েছেন যেন তথ্য না লুকিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জগতকে জানিয়ে দেয় যে করোনা ভাইরাস—যে ভাইরাসটি কোভিড১৯ নামের রোগ ঘটাচ্ছে—সেটি বায়ু বাহিত। বলে কী লাভ। এই যে শুনছি করোনা ভাইরাস বায়ুবাহিত, এ আমাদের কী দিচ্ছে হতাশা ছাড়া! কী করে অবিশ্বাস্য রকম সংক্রামক বায়ুবাহিত ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে সেটা আমরা কতটা আর জানি! তারপরও হতাশা থেকে গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে একসময় ভাঙ্গা মনোবল জোড়া দিয়ে নিজেরাই বলি, এমন মাস্ক পরলে কিন্তু চলবে না, যে মাস্ক পরলেও ফাঁক থেকে যায—যে ফাঁক দিয়ে বাতাসে ভাসা ভাইরাস ঢুকে পড়তে পারে মুখে। হায়! এত যে ভয়ংকর এইডসের ভাইরাস, সেটিও তো বায়ুবাহিত নয়, হামের ভাইরাস খুবই সংক্রামক, সেটিও বাতাসে দু’ঘণ্টার বেশি থাকে না। যক্ষার জীবাণু থাকে বড়জোর ছ’ঘণ্টা। আর আমাদের এই ভাইরাস যেটি পুরো পৃথিবীকে পঙ্গু করে ফেলেছে, সেটিই থাকে সবচেয়ে বেশি। ১৬ ঘণ্টা।
ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে থাকাও নাকি এখন আর নিরাপদ নয়। বন্ধ বাতাসে করোনা নাকি চমৎকার পেয়ে বসে। দরজা-জানালা খুলে রাখার উপদেশ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। রেস্তোরাঁ, ক্লাসঘর, অফিস, উপাসনালয়—যেসব বন্ধ জায়গায় মানুষ দীর্ঘক্ষণ থাকে, সেসব জায়গা নিরাপদ নয়। ঘরেও আসলে মাস্ক পরে থাকা উচিত। আর কাহাতক এসব যন্ত্রণা সহ্য হয়। মানুষের স্বাধীনতা কমতে কমতে শূন্যতে এসে দাঁড়িয়েছে। এদিকে আরও একটি খারাপ খবর এসেছে, খবরটি হল, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে রক্তে যে এন্টিবডি তৈরি হয় করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য, যুদ্ধে জেতার পর সেই এন্টিবডি দু’ তিন মাসের মধ্যেই হাওয়া হয়ে যায়। এর মানে, করোনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় থাকে মাত্র ২/৩ মাস, আবার যে কে সেই! আবারও করোনায় আক্রান্ত হতে পারে করোনা থেকে সবে সুস্থ হওয়া মানুষ। বিজ্ঞানীরা একসময় যে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ দিয়ে করোনাকে ঘায়েল করার কথা ভেবেছিলেন, সেটি কোনওদিনই সম্ভব নয়। হার্ড ইমিউনিটির ব্যাপারটা এমন, প্রচুর মানুষ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে উঠবে, তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকবে, এত প্রতিরোধ পেয়ে ভাইরাস টিকে থাকতে পারবে না, এই প্রতিরোধই, এই দেওয়ালই, যারা এখনও আক্রান্ত হয়নি, তাদের রক্ষা করবে। করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তোলা সম্ভব নয়, কারণ মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতার সময়সীমা অত্যন্ত কম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, মহামারী আরও খারাপ আকার ধারণ করবে। এই তো আমাদের গোটা জীবনে দেখা সবচেয়ে খারাপ সময়, এর চেয়েও যদি খারাপ সময় আসে, তবে সেই খারাপটি ঠিক কীরকম কল্পনা করতেও ভয় হয়। কল্পবিজ্ঞানের সেইসব চিত্র মনে পড়ে, সব মানুষ মরে গেছে পৃথিবী খালি হয়ে গেছে, হাতে গোনা কিছু মানুষ শুধু ভয়ে ভয়ে পথে প্রান্তরে হাঁটছে আর খাবার খুঁজছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদের এও জানিয়ে দিয়েছে, পুরোনা দিনের মতো নিশ্চিন্তের দিন আমরা হয়তো আর ফেরত পাবো না।
কেউ কেউ বলে কেউই রেহাই পাবে না, সবাইকেই ধরবে এই করোনা। যাদের বয়স কম, যাদের শরীরে রোগ বালাই নেই, তারা বেঁচে যাবে, আর বাকিরা মরে যাবে। হ্যাঁ পৃথিবীটা হবে শিশুদের, কিশোর-কিশোরীদের, আর সুস্থ সবল তরুণ-তরুণীদের। পৃথিবীতে সরকারি হিসেবে গত ছ’মাসে পাঁচ লাখ বাহাত্তর হাজার মানুষ মানুষ মারা গেছে করোনায়। যারা চুপচাপ বাড়িতে মারা গেছে, তাদের সংখ্যাটা গুনলে হিসাবটা ৮ বা ৯ লাখও হতে পারে। করোনা আমাদের ধ্বংস না করে ছাড়বে না, মন্দটা আগে ভেবে নেওয়াই ভালো। মন্দটা ভেবে রাখলে যখন দুর্যোগ আসে, তখন বিস্ময়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। মন্দই কি শুধু চারদিকে। কত মানুষ বেঁচে উঠছে, বাঁচার সংখ্যাটাই তো বেশি। ডাক্তার জাফরুল্লাহর কথা ভাবলে কিন্তু আশা জাগে। ডাক্তার জাফরুল্লাহর মতো ডায়ালাইসিসে বাঁচা বয়স্ক মানুষ করোনার সঙ্গে যদি যুদ্ধ করে বেঁচে উঠতে পারেন, তাহলে আমাদেরও চান্স আছে যুদ্ধ করে বাঁচার। কঠোর কঠিন নিষ্ঠুর নির্মম বাস্তবতাকে যেমন মেনে নিতে হবে, তেমন চান্সের আশাও মনে মনে রাখতে হবে। আমাদের বিবর্তনটাও ছিল এক চান্সের খেলা।
খুব বেশি সুস্থ হওয়া মানুষ প্লাজমা দান করছে না। প্লাজমায় যে এন্টিবডি থাকে, তা তো অন্তত কিছু লোককে বাঁচাতে পারতো। এইসময় টিকাই যদি অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন করতে পারে। দু’দিন পর পর টিকা বানানোর আশ্বাস পাই এ-দেশ ও-দেশ থেকে, তারপর আবার সব চুপ হয়ে আসে। কেউ বলে এ বছরের শেষ দিকে, কেউ বলে আগামী বছরের মাঝামাঝি, কেউ বলে ২০২২ সাল ছাড়া হচ্ছে না। টিকা নেওয়ার পর কি পুরোনো দিন ফেরত পাবো, বড় জানতে ইচ্ছে করে। আবার কি মাস্ক ছাড়া ঘুরে বেড়াতে পারবো, ভিড়ের রাস্তায় হাঁটতে পারবো, রেস্তোরাঁয় বসে নিশ্চিন্তে খেতে পারবো, শপিং সেন্টারে চলতে পারবো, সিনেমা-থিয়েটারে বসতে পারবো, স্টেডিয়ামে হাজার মানুষের সঙ্গে বসে খেলা দেখতে পারবো, ট্রেনে-বাসে-উড়োজাহাজে ভ্রমণ করতে পারবো আগের মতো? পারারই তো কথা। তা হলে কেন বিজ্ঞানীরা বলেন, পুরোনো জীবন সুদূর ভবিষ্যতে আর ফিরে পাবো না! বিজ্ঞানীদের বার্তা মাঝে মাঝে যেমন আশা জাগায়, তেমন আবার ভয়ও জাগায়।
কিছু দেশে করোনার ভয়াবহতা বেড়ে চলেছে, কিছু দেশে কমেছে। কমে যাওয়া দেশেও আবার যে কোনও সময় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে করোনা। নিউজিল্যান্ডে কমে গেছে, তাইওয়ানে আবার বাড়ছে। একে বিশ্বাস নেই। মানুষ হয়তো ইচ্ছে করলেই একে বিদেয় করতে পারতো। কিন্তু করেনি। কারণ সবাই করোনার ব্যাপারে এক মত হতে পারেনি। করোনার সংক্রমণের ক্ষমতাকে আমলে আনেনি। ব্যাবসাবাণিজ্য চালু করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। মিছিলও তো কম হল না। এলন মাস্কের মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানীও করোনার ভয়াবহতা অনুধাবণ করতে পারেননি। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট করোনার তাণ্ডবের চার মাস পর তীব্র সমালোচনার চাপে মাস্ক পরেছেন। কত লোককে এঁরা মাস্ক না পরার জন্য ইন্ধন জুগিয়েছেন তার শেষ নেই। এসবের মাশুল তো দিতেই হবে এখন।
অদ্ভুত লাগে ভাবতে, একা একা বাস করার জন্য মানুষ হতাশায় ভুগতো বলে একা মানুষকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য সরকারি-বেসরকারি কতরকম আয়োজন চলতো। অসুস্থদের মন ভালো করার জন্য টাচ থেরাপিও জনপ্রিয় ছিল। মানুষকে আরও সামাজিক হওয়ার জন্য, মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হত। মানুষের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে থাকতে মানসিক সমস্যায় ভুগতে ভুগতে এক আমেরিকাতেই বছরে দেড় লাখ মানুষ মারা যেত। আর এখন, মানুষের সংস্পর্শে আসার কারণে, মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণে দেড় লাখের চেয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে।
করোনার সঙ্গে বাস করা মানে মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রুর সঙ্গে বাস করা। এ বসবাস বড় কঠিন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো বলবো না, ‘কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’। করোনার সঙ্গে এই দুঃসহবাসকে ভালোবাসার কিছু নেই। শুধু দাঁতে দাঁত চেপে প্রচণ্ড মনোবল নিয়ে এর বিরুদ্ধে লড়ে যেতে হবে।
৯২. সমাজ আর কত পেছনে হাঁটবে
একটা সময় ছিল যখন মেয়েদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া আর চাকরি করা পুরুষলোকেরা পছন্দ করতো না। বিয়ের সময় পাত্রী দেখতে গিয়ে মধ্যবিত্ত ঘরের শিক্ষিত পুরুষেরাও বলে আসতো, বিয়ের পর লেখাপড়া করা বা চাকরি করা চলবে না। এভাবেই চলছিল সমাজ। এভাবেই চিরকাল চলতো, যদি না কিছু দৃঢ়চিত্তের মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাইতো। সমাজে ধীরে হলেও কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন ভালোও যেমন, মন্দও তেমন। এক পা এগোলে আর এক পা পেছোয়—এমন পরিবর্তন। লেখাপড়া করছে, চাকরি করছে, এমন মেয়ের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, পুরুষতন্ত্রে মগজ ধোলাই হওয়া মেয়ের সংখ্যাও তেমন বেড়েছে।
সমাজের অজস্র প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে কিছু মেয়ে ঠিকই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করেছে, চাকরি বাকরি করেছে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। এই মেয়েরাই কোনও কোনও সংসারে সবচেয়ে বড় সহায়। সংসারে খরচ দিচ্ছে, ভাই-বোনকে পড়াচ্ছে, মা-বাবার চিকিৎসা করাচ্ছে। পুত্র’র ওপর যে ভরসাটি করতো মানুষ, কন্যার ওপর দেখেছে একই ভরসা করা যায়। টাকাপয়সা আসলে সমস্ত তন্ত্রমন্ত্র ডিঙিয়ে যেতে পারে। পুরুষতন্ত্র মেয়েদের শিক্ষিত এবং স্বনির্ভর হওয়ার কথা বলে না। বরং ঘরে বসে স্বামী সন্তানের সেবা করতে বলে। কিন্তু এবার পুরুষতন্ত্র দেখলো, মেয়েরা টাকাপয়সা রোজগার করে সংসারে খাটালে সংসারের অভাব যায়, সংসারে চেকনাই বাড়ে। তাই বিয়ের বাজারে আগের মতো ফর্সা, সুন্দরী, ঘরোয়া মেয়ের যেমন চাহিদা ছিল, সেই চাহিদা তো রইলোই, যোগ হল রোজগেরে মেয়ের চাহিদা। মেয়েদের দিয়ে স্বামী সন্তানের সেবা হল, শ্বশুরবাড়ির সকলের সেবা হলো, টাকা রোজগারটাও হল। এ বাড়তি সুবিধে। টাকার গন্ধ পেলে সমাজ-সংসারের জিভ বেরোবে না, এ কোনও কথা। এমন সময় যদি শুনি, সুমাইয়া বেগম নামের একটি মেয়ে পড়াশোনা বন্ধ করেনি বলে, বা চাকরি করতে চায় বলে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাকে প্রাণে মেরে ফেলেছে, তাহলে অবাক হতেই হয়। এমন আজকাল শোনা যায় না। বরং শোনা যায়, বাপের বাড়ি থেকে যৌতুকের টাকা না আনাতে বাড়ির বউকে পিটিয়ে, পুড়িয়ে, মেরে ফেলা হয়েছে।
ওই যে বলেছিলাম কয়েক যুগে যে পরিবর্তন ঘটেছে সমাজে, তার মধ্যে মন্দের সঙ্গে ভালোও আছে। ভালোটা হল এই, প্রচারমাধ্যমে নারী-নির্যাতনের খবরগুলো, যদিও সব আসে না, সামান্য কিছুই আসে, তবু তো আসে। আগেও মেয়েদের খুন করা হত, আগেও ধর্ষণ হত, নারী-নির্যাতন হত, মানুষ জানতে পারতো না। এখন জানার সুযোগ হওয়ার ফলে সমাজ কতটা পুরুষতান্ত্রিকতার কাদায় ডুবে আছে; কতটা মূর্খ, অসভ্য, বর্বরদের বাস সমাজে—তা অনেকটাই অনুমান করা যায়। আগে নারী-নির্যাতনকে স্বাভাবিক বলে মনে করা হত। এখনও হয়। তবে কিছু মানুষ সচেতন হয়েছে। তারা প্রশ্ন করতে শিখেছে। এখন বর্বরতা আর খুন, ধর্ষণ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়। এই প্রতিবাদ, যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, হতে পারছে কারণ মানুষ বর্বরতা আর খুন, ধর্ষণ, নির্যাতনের ঘটনাগুলো জানতে পারছে। সমাজের সব লোক কিন্তু প্রতিবাদে অংশ নেয় না। কারণ সমাজের সব লোক বিশ্বাস করে না নারী-নির্যাতন আদপেই অন্যায় কিছু। এখনও সমাজের অধিকাংশ লোক বিশ্বাস করে, স্বামীর আদেশ অমান্য করা কোনও মেয়েরই উচিত নয়। এই হত্যাকাণ্ডে, সত্য তথ্য এই, অনেক লোকের সমর্থন আছে, কিছু লোক হত্যাকাণ্ডকে বাড়াবাড়ি মনে করলেও সুমাইয়া যে স্বামীর আদেশ না মেনে অন্যায় করেছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত।
সুমাইয়ার পিতা একজন ধর্মগুরু। সম্ভবত ওয়াজ মাহফিল করে বেড়াতেন। এমন লোক সাধারণত মেয়েদের শিক্ষার বিরুদ্ধে বলেন। সেখানে সুমাইয়ার পিতা সিদ্দিকুর রহমান কন্যাকে বাধা দেননি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার ব্যাপারে, বরং নিজেই অর্থকড়ি দিয়ে সাহায্য করেছেন। অবশ্য বিষয় বেছে দিয়েছেন, ইসলাম। উচ্চশিক্ষার জন্য কোনও বিষয়ই মন্দ নয়। সুমাইয়া পদার্থ-বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, গণিত বিজ্ঞান, বা নারীর সমানাধিকার, পুরুষতন্ত্রের অপকারিতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেনি, সে নারীবাদীও হবে না, বিজ্ঞানীও হবে না। সে পড়াশোনা করেছে ইসলাম নিয়ে, আরও বেশি ইসলাম সম্পর্কে জানবে, আরও বেশি ধর্মপ্রাণ হবে—এতেও স্বামী-শ্বশুরের আপত্তি। আপত্তি আসলে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ব্যাপারে। স্বাবলম্বি মেয়েরা সাধারণত ক্রীতদাসী হতে চায় না। ক্রীতদাসী না হলে বাড়ির বউকে মানাবে কেন! স্বামীর অবাধ্য হওয়া কোনও মেয়েকে আজও এই একবিংশ শতাব্দীতেও মানুষ পছন্দ করে না। মেয়েরা যদি নিজের স্বপ্নপূরণ করতে চায়, এই নারীবিরোধী সমাজে কারও না কারও তো অবাধ্য হতেই হয়, এ ছাড়া তো স্বপ্নপূরণ সম্ভব নয়।
বধূহত্যা কোনও নতুন ঘটনা নয়, বধূ স্বাবলম্বি হতে চেয়েছে, ঘরের বার হতে চেয়েছে, যদিও হিজাব পরেই ঘরের বার সুমাইয়া হত, তাতেও মানতে পারেনি স্বামী-শ্বশুর, অতএব নির্যাতনই ভরসা। ঘৃণা থেকে যে নির্যাতনগুলো করা হয়, সেগুলোতে নির্যাতনকারীদের হুঁশ থাকে না। কণ্ঠদেশ কতটা চেপে ধরলে মানুষ শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা পড়ে, সেটা বেমালুম ভুলে যায়।
সুমাইয়া হত্যার খবরটা আমরা পেয়েছি যেহেতু সুমাইয়ার মা মামলা করেছেন এবং প্রচারমাধ্যমকে জানিয়েছেন। এরকম কত সুমাইয়াকে প্রতিদিন নির্যাতন করা হচ্ছে, কত সুমাইয়াকে মেরে ফেলা হচ্ছে, কত সুমাইয়া বর্বরতার শিকার হয়ে আত্মহত্যা করছে—সে খবর কে রাখে! মেয়েরা নিহত হলে সাধারণত নিঃশব্দে সৎকার করা ফেলা হয়, নিজেদের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফেলে ভাগ্যে ছিল তাই মরেছে অথবা থানা-পুলিশ করে কী লাভ, যে গেছে সে তো আর ফিরে আসবে না জাতীয় কথাবার্তা কয়েকদিন বলে টলে ব্যাপারটির নিস্পত্তি করার হয়।
স্বনির্ভর মেয়েদের অহংকার বেশি থাকে, তারা উঠতে বললে ওঠে না, বসতে বললে বসে না, এরকম একটি বিশ্বাস সুমাইয়ার স্বামী-শ্বশুরদের ছিল। কিন্তু তাদের জানা ছিল না, আজকালকার পুরুষতন্ত্রে বিশ্বাসী মেয়েরা রোজগার করে স্বামীর হাতে টাকা তুলে দেয়, এবং পরনির্ভর মেয়ের মতোই মুখ বুজে স্বামী-শ্বশুরদের সেবা করে। সুমাইয়ার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা খুব বড় ভুল করেছে, তারা অনায়াসে লাভবান হতে পারতো সুমাইয়া দ্বারা। সুমাইয়ার অর্থ এবং শ্রম থেকে এখন তারা বরং বঞ্চিত। সুমাইয়া স্বামী-সংসার ত্যাগ করতে চায়নি। সে ধর্ম মেনে চলে, তাই হিজাব পরে। ধর্ম বলেছে স্বামীকে সদা সুখী রাখতে, স্বামী যখন যা চায় তাই দিতে, নিজের জীবনকে অপূর্ণ করেও স্বামীর জীবনকে পূর্ণ করতে। সুমাইয়াও নিশ্চয়ই তাই করতো। সুমাইয়া ঘরে টাকা আনলে বেকার স্বামী স্বস্তি পাবে, সুখ পাবে, এই ভেবেই হয়তো ভালো চাকরি পাওয়ার উদ্দেশে সে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
মেয়েদের জীবন সম্পূর্ণ নির্ভর করে স্বামী কী চায় বা না চায় তার ওপর। স্বামী যদি না চায় স্ত্রী বেঁচে থাকুক, তাহলে স্ত্রীর বেঁচে থাকার খুব বেশি উপায় থাকে না। স্বামী যদি স্ত্রীকে নির্যাতন করতে চায়, তবে নির্যাতন থেকেও স্ত্রীর বাঁচার খুব উপায় থাকে না। অসুখী দম্পতির মধ্যে যত ডিভোর্স হওয়া উচিত, তত হচ্ছে না। সমাজের ভয়েই হচ্ছে না। সমাজের ভয় মেয়েদেরই। যত মন্দ কিছু ঘটে, দোষ মেয়েদের। পুরুষকে ক’জন লোক ঘেন্না দিয়ে বলে, ‘আপনি তো সংসার করতেই পারছেন না, নিশ্চয়ই আপনার চরিত্র খারাপ।’
পুরুষের চরিত্র খারাপ এবং মেয়েদের চরিত্র খারাপ—এই দুই খারাপের মধ্যে সমাজ কিন্তু পার্থক্য করে। পুরুষের চরিত্র খারাপ হওয়া সমাজের চোখে ততটা কুৎসিত নয়, যতটা কুৎসিত মেয়েদের চরিত্র খারাপ হওয়া।
মেয়েরা স্বামী দ্বারা নির্যাতিত হলে সমাজ বরং মেয়েদেরই দোষ দিয়ে বলে নিশ্চয়ই ওর কোনও দোষ ছিল, তা না হলে স্বামী পেটাবে কেন। স্বামী মন্দ লোক বলে স্বামী পেটায়, এই সত্যটা বেশি লোক ভাবতে জানে না।
সুমাইয়ার বাপের বাড়ি প্রভাবশালী হলে সুমাইয়ার হত্যাকারীরা শাস্তি পাবে, তা না হলে পাবে না। কত হত্যাকারী নিশ্চিন্তে নিরাপদে হাটে-ঘাটে মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তা নিশ্চয়ই সবাই জানে।
সারা পৃথিবীর জরিপে দেখা যায়, মেয়েদের নির্যাতন করে, অত্যাচার করে, হত্যা করে তার পরিবারের লোকেরাই বেশি, বিশেষ করে স্বামীরা। তারপরও এই নারীবিরোধী সমাজে বিবাহের হিড়িক পড়ে। কেউ স্বীকার করুক আর না করুক, মেয়েরা তাদের সম্ভাব্য হত্যাকারীকেই বিয়ে করে। এরপর যদি সংসার সুখের হয়, সে পুরুষের গুণে।
৯৩. আমাদের বর্ণবৈষম্য
ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় অর্থাৎ সাদাদের দেশগুলোয় যখনই কোনও বর্ণবৈষম্যের খবর পাই, তখন ভীষণ ক্ষিপ্ত হই আমরা, বিশেষ করে আমাদের লোকেরা যদি আক্রান্ত হয়। কালোরা আক্রান্ত হলে আমাদের খুব একটা অবশ্য যায় আসে না। কালোদের কি আমরা ঘৃণা করি না? আমরা ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ, আমরা দু’শ বছর ঔপনিবেশিক শক্তির অপশাসন আর শোষণের শিকার হয়েছি। সাদা ব্রিটিশ শাসকেরা কালো আফ্রিকানদের যেমন ঘৃণা করতো, ভারতীয়দেরও তেমনই ঘৃণা করতো। কিন্তু ভারতীয়রা চিরকালই কালো আফ্রিকানদের চেয়ে নিজেদের উন্নত জাতের মানুষ বলে ভেবে এসেছে। আফ্রিকার কোনও কোনও জাত মানুষখেকো, ব্রিটিশরা বলেছিল। শিক্ষাটা এত গভীরে ঢুকেছে যে আজ ঔপনিবেশিক শাসন নেই ৭০ বছরের চেয়েও বেশি, তারপরও আফ্রিকার যে কোনও লোককে দেখলেই মানুষখেকো বলে আমাদের অনেকেরই সংশয় হয় । আফ্রিকা থেকে ভারতে অনেকেই লেখাপড়া করতে আসে। তাদের যে কী হেনস্থা হতে হয় গায়ের রঙ কালো বলে! সুদান, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া, ইরেত্রিয়া যেখান থেকেই আসুক, সব ছাত্রছাত্রীকে ভারতীয়রা ‘নাইজেরিয়ান’ বলেই ডাকে। এবং সব নাইজেরিয়ানকেই তারা মনে করে মাদক ব্যবসায়ী, এবং পতিতার দালাল। মনে আছে দিল্লির ফরেনার রেজিস্ট্রেশান অফিসে একবার ভিসা বাড়ানোর জন্য গিয়েছিলাম। একজন আফ্রিকার লোকও ভারতীয় এক মহিলার সঙ্গে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হওয়ায় ভারতে বাস করার ভিসার জন্য ওখানে গিয়েছিলেন। যে অফিসার আমাকে বসিয়ে চা খাওয়াচ্ছিলেন, তিনিই আফ্রিকার লোকটির সঙ্গে জঘন্য ব্যবহার করলেন, জঘন্য গালি দিলেন। আমাকে বললেন আফ্রিকার লোকেরা খুব খারাপ, এরা মানুষখেকো, এবং মাদক ব্যবসায়ী। রেগে ফেটে পড়লেন সেই সব ভারতীয় মহিলার বিরুদ্ধে, যারা আফ্রিকার লোকদের বিয়ে করে। একই অফিসার চমৎকার ব্যবহার করেছিলেন ভিসার জন্য আসা সাদা ইউরোপিও লোকদের সঙ্গে। আমেরিকায় কালোদের একসময় নিগ্রো বলে ডাকা হত, নিগ্রো শব্দটি এখন গালি হিসেবে প্রচলিত। ভারতেও নিগ্রোর মতো নাইজেরিয়ান শব্দটি একটি গালি। এত উপেক্ষা, এত অপমান জোটে, আফ্রিকানরা তারপরও ভারতকে ভালোবেসেই ভারতে আসে।
আফ্রিকার লোকদের ওপর ভারতীয়রা প্রায়ই হামলা চালায়। ২০১৭ সালে ৫ জন নাইজেরিয়ার ছাত্রকে ভারতীয়রা লোহার রড, ছুরি ইত্যাদি দিয়ে হামলা করেছিল। একটি অল্পবয়সী ছেলের মাদক সেবন করে মৃত্যু হয়েছিল, ছেলেটির বাবা জানিয়েছিল যে ছেলেটি মাদক পেয়েছিল এক নাইজেরিয়ানের কাছ থেকে। এর প্রতিশোধ নেওয়া হয় নাইজেরিয়ার ছাত্রদের অমানুষের মতো পিটিয়ে। মানুষ দেখেছে এই পেটানো, কেউ ওদের থামায়নি, পুলিশকেও খবর দেয়নি। দেবে কেন, কালো লোকদের তো তারাও ঘৃণা করে। ভারতে আফ্রিকার নাগরিকের ওপর হামলা নতুন কিছু নয়। দিল্লিতে ২০১৬ সালে কংগোর এক লোককে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল ভারতীয়রা। এর আগে তানজানিয়ার এক ছাত্রীকে ব্যাঙ্গালরে টেনে কাপড় খুলে দিয়েছিল। ২০১৩ সালে গোয়ায় এক নাইজেরিয়ান লোককে ছুরি দিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলা হয়েছিল। আফ্রিকার ছাত্রদের রাস্তাঘাটে গালি শুনতে হয়, বাড়িওলা তাদের ঘর ভাড়া দিতে চান না, প্রচুর ডকুমেন্টস দেখাতে হয় ভাড়া পেতে গেলে। বিদেশ থেকে যে সাদা লোকেরা আসে পড়তে, গবেষণা করতে, চাকরি বা ব্যবসা করতে, তাদের কিন্তু এই অসুবিধে হয় না।
শুধু যে আফ্রিকার লোকদের গায়ের রঙকে আমরা অপছন্দ করি তা নয়। নিজেদের মধ্যে যাদের গায়ের রঙ কালো, তাদেরও তো আমরা গ্রহণ করি না। তারা সুন্দরী হলেও তাদের আমরা সুন্দরী বলে ডাকি না। গায়ের রঙ ফর্সা করার ক্ষতিকর কেমিক্যালে ছেয়ে গেছে আমাদের গোটা অঞ্চল। উপজাতিদের মধ্যে যারা কালো, দলিতদের মধ্যে যারা কালো তাদের মানুষ বলেই মেনে নিই না। নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশের মানুষ কালো নয়, কিন্তু ওরা দেখতে অধিকাংশ ভারতীয়দের মতো দেখতে নয়, আমাদের মতো দেখতে নয়। তাই ওদেরও কিন্তু একই হাল করা হয়, যথেষ্ট ঘৃণা উথলে উঠলে ওদেরও পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। আমরাই মেরে ফেলি।
চলচ্চিত্র নির্মাতা মাইকেল মুর একবার নিউইয়র্কের রাস্তায় দুজন লোককে ট্যাক্সি ডাকার জন্য দাঁড় করিয়েছিলেন, একজন কালো, তিনি হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, আর এক জন সাদা, তিনি একজন বড় সড় ক্রিমিনাল। ট্যাক্সি সাদার কাছে থেমেছে। কালোর কাছে একটি ট্যাক্সিও থামেনি। নিউইয়র্কে বাংলাদেশের বাঙালিরা ট্যাক্সি চালায়, আফ্রিকান আমেরিকানদের আগে ‘কাইল্যা’ বলে গালি দিয়ে তারপর ওদের সম্পর্কে কথা বলে। আমাদের রঙ যতই কালো হোক, নিজেদের আমরা কালোদের থেকে পৃথক বলে ভাবি। অনেক সময় আমরা তো নিজেদের সাদা বলে ভাবতে থাকি, বিশেষ করে যখন কালোদের কীর্তিকলাপের দিকে তাকাই।
দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয়রা কিন্তু কালোদের মতো জাতিগত বৈষম্যের শিকার হয়েছে। তারপরও ভারতীয়রা সবাই মিলেমিশে থাকে না। ওদের মধ্যে জাতপ্রথা বা কাস্ট সিস্টেম নেই। ভারত থেকে সমুদ্রপথে আসার সময় জলে ডুবিয়ে দিয়েছিল ওই প্রথা। তা ঠিক, কিন্তু যারা চুক্তিভুক্ত শ্রমিক ছিল, আর যারা গিয়েছিল বাণিজ্য করতে, এই দুই ধরনের ভারতীয়দের মধ্যে ফারাক ছিল। এই শ্রেণির ফারাকের বাইরে আরও একটি ফারাক ছিল এবং এখনও আছে সেটি হল, ভারতীয়দের মধ্যে কারও গায়ের রঙ কালো, কারও গায়ের রঙ বাদামি। কালো ভারতীয়দের খানিকটা নিম্নমানের মানুষ হিসেবেই মনে করে বাদামি ভারতীয়রা। দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয়রা সদ্য বিলেত-ফেরত ব্যারিস্টার মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে উকিল হিসেবে নিয়ে গিয়েছিলেন। ওখানে গান্ধী নিজেও তো দেখতে অনেকটাই কালো, কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার কালো লোকদের নিম্নমানের মানুষ বলে মনে করতেন। ওদের গালি দিতেন ‘কাফির’ বলে। দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘কাফির’ খুব অপমানজনক গালি। বছর দুই আগে ঘানা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে ছাত্রছাত্রীরা এ কারণেই গান্ধীর মূর্তি সরিয়ে ফেলেছে। এত বড় মহাত্মাই যদি বর্ণবাদী, আমরা কোন ছার!
বর্ণবাদী নয়, এমন লোক ভারতীয় উপমহাদেশে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এখানে মানুষ নিজের ধর্ম, বর্ণ, জাতের চেয়ে অন্যের ধর্ম, বর্ণ, জাতকে নিম্নমানের বলে মনে করে। ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ খ্রিস্টান সবাই ধর্মবাদী, বর্ণবাদী, গোষ্ঠীবাদী, জাতবাদী, জাতীয়তাবাদী, শ্রেণিবাদী। যারা এসবের ঊর্ধ্বে উঠেছে, তাদের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য।
আমেরিকায় বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে এই করোনা ভাইরাসের মহামারীর সময় যে প্রতিবাদ হল তার তুলনা হয় না। এ নিয়ে যতবারই আমি টুইটারে লিখেছি, ততবারই অজস্র মানুষের কটাক্ষ শুনেছি। তারা ভারতীয় উপমহাদেশেরই লোক। তারা লুটপাট করার জন্য কালোদের দোষ দিচ্ছে, সে দিক। দোকানপাট যারা লুঠ করেছে, তারা অন্যায় করেছে, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু হাঁটু দিয়ে চেপে জর্জ ফ্লয়েড নামের কালো লোককে মেরে ফেলা? ওটিকে টুইটারের ভারতীয়রা বলছে জর্জ ক্রিমিনাল ছিল, মেরেছে বেশ করেছে অথবা বলছে নিজের অসুখ বিসুখের কারণে জর্জ মারা গেছে, শ্বাসরোধ হয়ে মরেনি।
এই হচ্ছি আমরা। আমরা কালোদের যত ঘৃণা করি, তত ঘৃণা সাদারাও করে না। নিজেদের গায়ের রঙ কালো হলে আমরা নিজেদেরই ঘৃণা করি। আমার এক অন্ধ্রপ্রদেশের বন্ধুর ত্বক খুব কালো। দক্ষিণ ভারতের অধিকাংশ মানুষের গায়ের রঙ কালো। কিন্তু সেই বন্ধুটি কিছুতেই তার গায়ের কালো রঙকে মেনে নিতে পারে না। নিজেই নিজের রংকে কুৎসিত ভাষায় গালি দেয়। বারবারই বলে সে আসলে বাদামি, কিন্তু ক’দিন রোদে ঘোরা হয়েছে বলে কালো দেখাচ্ছে। নিজে সবসময় এক স্পেশাল সাবান রাখে সঙ্গে, ওটা দিয়ে মুখটা পনেরো কুড়ি মিনিট ধরে ঘসে একটু যেন উজ্জ্বল দেখায়। এই তো আমরা। আমরা এমনই। আমাদের বর্ণবৈষম্য পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়ংকর বর্ণবৈষম্য। মেয়ে কালো হলে তাকে আমরা জন্মের পরই মাটিতে জ্যান্ত পুঁতে ফেলি। অথবা তাদের সংগে আমরা প্রেম করি না, তাদের আমরা বিয়ে করি না, বিয়ে যদি করিই টাকার জন্য করি, বিরাট অংকের যৌতুক নিই, অথবা ঘরের নোংরা সাফ করার জন্য রেখে দিই।
আমাদের বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আমরা প্রতিবাদ করি না। কারণ আমরা ততটা সভ্য এখনও হইনি, যতটা সভ্য হলে বৈষম্যহীন সমাজের জন্য আপোসহীন সংগ্রাম করা যায়।
৯৪. মানুষ মরছে
মানুষ মরছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন আমেরিকায় দেড় থেকে আড়াই লাখ লোক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবে। ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা মে মাসের মাঝামাঝি হবে ১৩ লাখ। চীন বলেছিল বন্যপ্রাণীর বাণিজ্য বন্ধ করবে। কোথায়? ফের তারা তাদের ‘ভেজা বাজার’ খুলে বসেছে, যেখানে মানুষের খাদ্য হিসেবে বিক্রি করছে বাদুড়, প্যাংগলিন, কুকুর ইত্যাদি।
লকডাউনে কেউ বেশিদিন থাকতে চাইছে না। অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হচ্ছে সুতরাং কাজকম্ম শুরু করতে হবে।
না, আশা নেই। মানুষ বোধহয় আর বয়স্ক মানুষের কথা ভাবতে চাইছে না। ইয়ং দিয়েই দুনিয়া চলবে। সুতরাং ইয়ং বেঁচে থাকলেই হল।
মানবপ্রজাতি বিশাল হুমকির মুখে। দিন দিন পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। কিন্তু, অবাক হয়ে দেখি মানুষের কোনও হেলদোল নেই। এখনও কিছু লোক হিন্দু- মুসলমান করছে। জীবনে ঘৃণাই যাদের সম্বল, তারা বোধহয় শিয়রে মৃত্যু এসে বসলেও ঘৃণা করতে থাকবে, কারণ এটি ছাড়া অন্য কিছু তারা সারাজীবনে শেখেনি।
৯৫. মৃত্যু
ইতালিতে ১০ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। আজই তো ন’শ মানুষ মরলো। স্পেনে আজ মারা গেছে প্রায় সাতশ’। ইউরোপ তো মরে সাফ হয়ে যাবে মনে হয়। ওদিকে আমেরিকাও বসে নেই। ১ লাখ ১৬ হাজার মানুষ আক্রান্ত, দিন দিন বাড়ছে সংখ্যা। ভারতে, বাংলাদেশে, পাকিস্তানে, ভয় পাচ্ছি, কখন না দিনে লাখের ওপর মরতে শুরু করে। সভ্য দেশ, উন্নত আধুনিক দেশ! তারাই জ্ঞানী বিজ্ঞানী! তারাই চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ, তারাই পিঁপড়ের মতো মরছে। আমরা তো ইমিউনিটি নেই ম্যালনিউট্রেশনে ভোগা ডেন্সলি পপুলেটেড দেশে গাদাগাদি করে বস্তিতে বাস করা মূর্খ অশিক্ষিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ। আমরা যখন মরতে থাকবো, মহামারী কাকে বলে দুনিয়া দেখবে। ভালো যে আফ্রিকার গরিব দেশগুলোতে খুব একটা কামড় বসায়নি করোনা। বসালে শ্মশান হয়ে যেত দেশগুলো।
আপাতত ভ্যাক্সিন ছাড়া আর কিছু চাওয়ার নেই। ভ্যাক্সিন বের হতে নাকি ১৮ মাস। ১৮ মাস কী করবো, ঘরে বসে থাকবো? আমার মতো রিস্ক ক্যাটাগরির লোক ভ্যাক্সিন অবধি টিকে থাকতে পারে কি না সন্দেহ। ভাইরাস তো শুনেছি থেকেই যাবে পৃথিবীতে। জানিনা কী হবে, কেউ কি সত্যিই জানে? যাঁরা গবেষক, তাঁরাও হয়তো সঠিক জানেন না, শুধু অনুমান করছেন।
এই পৃথিবীতে মানুষ তো আর শুধু আমরাই ছিলাম না, আরও নানান জাতের মানুষ ছিল। সব কটাকে মেরে ফেলেছি আমরা। কী ভয় কী ভয়! আমরা ছাড়া অন্য কেউ রাজত্ব করতে পারবে না। নিজেদের একসময় নাম দিলাম ‘সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব’। শিম্পাঞ্জির বংশধরেরা নাকি শ্রেষ্ঠ জীব! খুনোখুনি আর বর্বরতা করে শ্রেষ্ঠ সেজেছি। জীবজন্তু, পশুপাখিকে মেরেধরে সর্বনাশ করেছি। এর লোম দিয়ে ওভার কোট বানাবো, ওর চামড়া দিয়ে হ্যান্ডব্যাগ বানাবো, এর থাবা দিয়ে ছাইদানি বানাবো, ওর দাঁত দিয়ে গয়না বানাবো, আমাদের শখের শেষ নেই। এই পৃথিবী যে শুধু আমাদের নয়, ওদেরও— যেন ভুলেই গিয়েছিলাম।
এখন ওই ‘ইতর’ পশুপাখিগুলোই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবগুলোকে একঘরে করে রেখেছে, এতটাই ওদের শক্তি। আর আমরা জানিইনা ভবিষ্যত বলতে আমাদের কিছু আছে কি না।
৯৬. করোনাকথা
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী, অস্ট্রেলিয়ার স্ব্ররাষ্ট্রমন্ত্রী, ইরানের উপস্বাস্থ্যমন্ত্রী, ওদিকে প্রিন্স চার্লস, সবাইকেই ধরেছে করোনা ভাইরাস। জানি না কে বাঁচবে, কে মরবে। চীন স্বাভাবিক করতে চাইছে জীবনযাত্রা, যেহেতু আক্রান্ত মানুষের এবং মৃত্যুর সংখ্যা কমে গেছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনে দ্বিতীয়বার নতুন সংক্রমণের জোয়ার শুরু হতে পারে। ঘরবন্দির সময়সীমা আরও বাড়ালে দেরি করে আসবে সেটি। চীনকে যদি মাসের পর মাস ঘরবন্দি থাকতে হয় বাঁচার জন্য, আমাদেরও তাই থাকতে হবে। ইউরোপ, আমেরিকার কী হবে বুঝতে পারছি না। আমেরিকায় আক্রান্তের সংখ্যা এখন চীনকেও ছাড়িয়ে গেছে। টেস্ট কিট পর্যাপ্ত থাকলে আরও টেস্ট হত, আরও রোগী বাড়তো।
কিছুতে মন বসছে না। না পড়তে পারছি, না লিখতে পারছি। রোবটের মতো ঘরের এটা সেটা করছি। যদি মরতেই হয়, ঘুমের মধ্যে মরে গেলেই ভালো। অথবা মরছি এটা না জেনে যন্ত্রণাহীন মরে গেলে বেশ। দরজার বাইরে মৃত্যু দাঁড়িয়ে আছে, ঘরের খিল এঁটে বসে আছি সবাই। কত দিন, মাস, বছরের জন্য, জানি না।
একজন মজা করে বললো চীনের সেই বাঁদুড়টাকে নাকি সব পশুপাখি হাইফাইভ করছে। সেই বাঁদুড়, যে তার ভাইরাসটা প্যাংগলিনকে দিল, আর প্যাংগলিন দিল আমাদের। চীন কি এখন বনের পশুপাখি খাওয়া বন্ধ করবে? মানুষ তো ভুলে যায়। এ যাত্রা বেঁচে উঠলে ফের হয়তো কয়েক বছর পর খেতে শুরু করবে, কে জানে।
চীনের লাল পতাকায় তারকার জায়গায় করোনা ভাইরাসের ছবি দিয়ে কার্টুন বানানো হয়েছে। চীনের ওপর রাগ মানুষের। বাইশ হাজার মৃত্যু, আর কত মৃত্যু যে আসছে! বাঁদুড়, প্যাংগলিন এগুলো না খেলে ওদের চলতো না? অবশ্য এমন যে হবে ওরা তো জানতো না। জানলে নিশ্চয়ই খেতো না। করোনা ভাইরাসকে কেন চাইনিজ ভাইরাস বলা যাবে না? জায়গার নামে তো কত ভাইরাসের নামকরণ হয়েছে, জিকা ভাইরাস, ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস। এবোলা ভাইরাস তো আফ্রিকার এক নদীর নামে নাম। চীন এমন শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে চীনকে ক্ষেপাতে কেউ সাহস পায় না। মনে আছে এক সুপার বাগকে নাম দেওয়া হয়েছিল নিউ দিল্লি বাগ? তো? কোভিড১৯ রোগটি যে চীন থেকে এসেছিল তা আমরা কেউ কি কোনওদিন ভুলে যাবো? কোনওদিন?
করোনা ভাইরাসের প্যান্ডেমিক হওয়ার পেছনে অনেকে ষড়যন্ত্র খোঁজে। আমার মনে হয় না কোনও ষড়যন্ত্র আছে এতে। নিতান্তই দুর্ঘটনা। কত প্রাণঘাতী ভাইরাসকে মানুষ ধরাশায়ী করেছে, শুধু এটির কাছেই ধরাশায়ী হল।
সামনে কী আছে?
৯৭. করোনা কালে ১
না আমি প্যানিক শপিং করিনি। করি না কখনও। কবে চাল-ডাল-নুন তেল কিনেছিলাম মনেও নেই। কয়েক মাস আগে হয়তো। কিছুদিন আগে শুধু হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিনতে চাইলাম, দোকানেও নেই, আমাজনেও নেই। অগত্যা আইপিপি এলকোহল কিনতে বেরিয়েছিলাম, ওটা দিয়ে নিজে স্যানিটাইজার বানাবো বলে। ওটা কোথায় পাওয়া যায় ধারণাই নেই। মদের দোকানে গিয়ে চাইলাম, ওরা বুঝতেই পারেনি কী চাইছি। অগত্যা ওটি পাওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছি।
ভারতের ইউপি, বিহার, রাজস্থানের অনেককে দেখেছি, পেঁয়াজ বা টমেটো ছাড়া রান্না কী করে হবে বুঝতে পারে না। অন্ধ্রপ্রদেশের লোকেরা বিশ্বাস করে না লাল মরিচ ছাড়া রান্না হতে পারে। প্রচুর লোকের প্রতিদিন কিছু না কিছু সবজি চাই; চাইই চাই, অথবা দুধ চাই, চাইই চাই। আমার এরকম কোনও বাতিক নেই। ঘরে চাল না থাকলে আটা থাকলেও আমার চলে। ভাত না হলে রুটি। তাও না থাকলে মুড়ির সঙ্গে ডাল নিয়ে নিই। চাল, ডাল, আটা, চিড়ে, মুড়ি কিছুই না থাকলে নুডলস পাস্তা বানাই। তাও না থাকলে সবজি সেদ্ধ আর মাছ করে নিই। যদি মাছ না থাকে মাংস না থাকে, মশলাপাতিও না থাকে, তাহলে দুধ দিয়ে ওট বানিয়ে নিই। যদি দুধ না থাকে, জলে ওট সেদ্ধ করে নিই। যদি ওটও না থাকে, তাহলে ডালিয়া সেদ্ধ করে নিই, অথবা কুসকুস। এ কৌটো সে কৌটো খুঁজে দেখি কী পাওয়া যায়। তেল না থাকলে ডিম সেদ্ধ করে, শশা গাজর দিয়ে দিব্যি চমৎকার লাঞ্চ না হলেও ব্রাঞ্চ হয়ে যায়। এক্সট্রা ভারজিন অলিভ অয়েল ছিটিয়ে দিলেই তো ইয়ামি। খাওয়া দাওয়া নিয়ে মূলত আমি যা করি, তা হলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা। নানারকম খাবার খেতে জানলে ক্রাইসিসের সময় খুব একটা অসুবিধে হয় না। ভাত, ডাল, নিরামিষ, মাছ ভাজা, মাছের ঝোল থাকতেই হয় না প্রতিদিন। প্রতিদিন একইরকম একই স্বাদের একই গন্ধের একই উপাদানের খাবার খাওয়াটা বোরিং। কিচেনের সবগুলো কৌটো বয়াম খালি হয়ে গেলে অগত্যা আমি অনলাইনে বাজার সদাইয়ের অর্ডার করবো, ঘরের দরজায় ওরা রেখে যাবে ওসব, ব্যস।
খাবারদাবারের জন্য আমি প্যানিক হই না, আমি প্যানিক হই ইতালির হাসপাতালে জায়গা নেই, রোগীকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে। স্পেনে মানুষ ভাইরাসের কামড়ে প্রতিদিন চারশ পাঁচশ করে মারা যাচ্ছে দেখে। ভারতের বস্তিতে একবার যদি ভাইরাস ঢুকে পড়ে, কত কোটি মানুষকে মরতে হবে, তা ভেবে। আমি প্যানিক হই এখনও কেন টিকা আবিষ্কার হচ্ছে না এই নিয়ে ভেবে। ইমিউনিটি বাড়াতে হলে এক্সারসাইজ করতে হবে, ভিটামিন সি টি খেতে হবে। নাহ উৎসাহই পাচ্ছি না। মনে হয় না ইমিউনিটি বাড়ালেও করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হতে পারবো। তার চেয়ে কিছু লেখাপড়া করি এই সময়টায়। বাড়িতে তো কাউকে ঢুকতে দিচ্ছি না, না কাজের লোক, না পড়শি, না বন্ধু, না প্রেমিক। শুধু নিজের জন্য এমন সময় আর কবে পাবো কে জানে।
৯৮. করোনা কালে ২
লকডাউনে আমার খুব একটা অসুবিধে হচ্ছে না। ইউরোপ, আমেরিকায় দীর্ঘকাল বাস করার কারণে রান্নাবান্না করা, বাসন ধোয়া, ঘরদোর গোছানো, ডাস্টিং, ঝারু মোছা, কাপড় কাচা, টয়লেট পরিষ্কার ইত্যাদি হাজার রকমের কাজ নির্বিঘ্নে করে ফেলতে পারি। একা থাকতেও কোনও অসুবিধে কখন হয়নি কারণ জীবনের অর্ধেকটা বয়স একাই থেকেছি আমি।
লকডাউনটা টিকা আবিষ্কার হওয়া পর্যন্ত চালু থাকলে ভালো হয়। এই সময় গরিবদের ঘরে ঘরে চাল, ডাল আর টাকাকড়ি পৌঁছে দেওয়া দরকার। কিছু দেশ তো তাই করছে।
এই সার্স কোভ ২ ভাইরাস খুব বেশি বিবর্তিত না হলে টিকা আবিষ্কারে খুব বেশি দেরি হবে না। বিজ্ঞানীরা বলছেন ফ্লুর টিকার মতো প্রতি বছর নতুন নতুন টিকা নয়, এই টিকা একবারই নিতে হবে, হাম আর গুটি বসন্তের টিকার মতো।
ইতালি আর স্পেনের দিকে তাকানো যায় না। পিঁপড়ের মতো মানুষ মরছে। ইরান, আমেরিকায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের শরীরে ভাইরাস ধরা পড়ছে। মানুষের জীবন যে কতটা কচু পাতায় জল, তা হাড়ে মজ্জায় যেন বোঝা হল আবারও। মানব প্রজাতির সবচেয়ে বড় দুর্যোগের দিনে যারা ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, স্বার্থপরতা নিয়ে থাকছে, অন্যের ক্ষতি হলে যাদের কিছু যায় আসে না—তাদের কিন্তু চীনে রাখা বড় জরুরি।
দেখা যায় না এমন ছোট ভাইরাস আজ আমাদের প্রজাতির সবচেয়ে বড় শত্রু। গোটা পৃথিবী লকডাউন, যেন নীল ডাউন হয়ে ভাইরাসের কাছে প্রাণভিক্ষে চাইছে। মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার এবং বাস করার সব আয়োজন আমরা করে ফেলেছি, কত শক্তিশালী আমরা, অথচ কত শক্তিহীন!
এই সময় আমরা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখলেও মানসিক দূরত্ব যেন ঘুচিয়ে ফেলি। ভাইরাস আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, আমরা মানুষ—এই আমাদের আসল পরিচয়। নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি, নাস্তিক, ছোট-বড়, ধনী-গরিব, সাদা-কালো, বাদামি, হলুদ, ফরাসি, চৈনিক, সিরীয় ভারতীয় আরব, ওলন্দাজ আমরা সব এক। দেশে দেশে যে বেড়া দিয়েছি, তা নিতান্তই অর্থহীন।
৯৯. আজকালের রোজনামচা
১। যুক্তরাজ্য থেকে দুটো খবর এসেছে, একটি খারাপ, একটি ভালো। খারাপটি হল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে করোনার টিকাটা বানানো চলছিল, সেটির ট্রায়ালে ভুল ডোজ দেওয়া হয়েছে। যদিও গবেষকরা বলছেন, এই ভুলটাকে ভিন্নভাবে সংশোধন করে ট্রায়ালের কাজ চালিয়ে যাওয়া হবে, তারপরও সংশয় জাগে। শেষপর্যন্ত এই ভুল ডোজের কারণে পুরো টিকাটাই বাতিল হয়ে যাবে না তো! বাতিল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা কিন্তু আছে। কত লক্ষ কোটি টাকা আর কত দিন রাতের পরিশ্রম পণ্ড হবে, ভাবা যায়!
দ্বিতীয় খবরটি ভালো, ভেন্টিলেটরে যে করোনা রোগীদের রাখা হয়, তাদের অধিকাংশই মারা যায়, কিন্তু ডেক্সামেথাসন নামের একটি স্টেরয়েড দিয়ে দেখা গেছে তাদের অনেকে বেঁচে যাচ্ছে। সুতরাং এই স্টেরয়েড ওষুধটিকে ভীষণভাবে করোনায় আক্রান্ত হওয়া মৃত্যুপথযাত্রীকে বাঁচানোর ওষুধ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে এটিই করোনা ভাইরাসের সংগে যুদ্ধ জেতার হাতিয়ার। যে ওষুধই বিপদের সহায় হোক না কেন, করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেলে করোনার টিকা ছাড়া আমাদের উপায় নেই। কিন্তু অতল সমুদ্রে যখন ডুবছি, হাতের কাছে বড় জাহাজ না হোক, ছোট একটি ডিঙি নৌকো তো পাওয়া গেছে।
২। ভারতের এক বলিউড তারকার আত্মহত্যা, দেশটিকে স্তব্ধ করে দিয়েছে কিছুক্ষণের জন্য। সুশান্ত সিং রাজপুত বেশ কিছু ছবিতে চমৎকার অভিনয় করেছেন। নাম-যশ-খ্যাতি-প্রতিপত্তি যখন দ্রুত বাড়ছিল, তখনই কিনা মানুষটি মাত্র ৩৪ বছর বয়সে নিজের জীবনের ইতি ঘটিয়ে দিলেন। চরম বিস্ময়কর ঘটনা তো বটেই। সুশান্ত অন্যান্য তারকার মতো ছিলেন না, বলিউডের তারকারা সাধারণত অল্প শিক্ষিত, প্রচণ্ড ধর্মান্ধ এবং প্রচণ্ড কুসংস্কারাচ্ছন্ন। সুশান্ত নিজে অত্যন্ত ভালো ছাত্র ছিলেন, পদার্থবিজ্ঞান তাঁর প্রিয় বিষয়ই শুধু নয়, তাঁর অবসেশান। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর তৃতীয় বর্ষে পড়াকালীন সব ছেড়েছুঁড়ে নাচ আর অভিনয় শিখতে ঢুকে গেছেন। যা হতে চেয়েছেন হয়েছেন, অভিনেতা। তাঁর ৫০টি স্বপ্নের কথা লিখে গেছেন, এমন স্বপ্ন বলিউডের কোনও অভিনেতা দেখেন না, এ আমি হলফ করে বলতে পারি। নাসায় তিনি ওয়ার্কশপ করেছেন, আবার আর এক ওয়ার্কশপের স্বপ্ন তাঁর। নভচারী হওয়ার স্বপ্ন তাঁর। বিমান চালানোর স্বপ্ন তাঁর। নাসায় ১০০০ কিশোর কিশোরী পাঠাতে চেয়েছেন মহাশূন্য সম্পর্কে যেন জ্ঞান লাভ করতে পারে। সুইজারল্যান্ডে বেড়াতে গেলে অন্যান্য অভিনেতারা আর যেখানেই যাক, সার্নে যাবেন বলে মনে হয় না, সুশান্ত সার্নে গেছেন, যে বিজ্ঞানগবেষণা কেন্দ্রে গবেষণা হচ্ছে আলোর গতির চেয়ে দ্রুত আমাদের গতি হবে কি না কখনও। সুশান্ত খুব দামি টেলিস্কোপ কিনেছেন, ও দিয়ে রাতের আকাশ দেখেন, কোটি কোটি নক্ষত্র, গ্রহ, গ্যালাক্সি দেখেন। সুশান্তর স্বপ্নের মধ্যে আছে পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কে আরও পড়া, আরো জানা। এমন জ্ঞানপিপাসু, কৌতূহলী, প্রতিভাবান তরুণ ছিলেন বলিউডের গোবরে পদ্মফুল।
সুশান্তর মানসিক রোগ ছিল, এ কথা তাঁর প্রেসক্রিপশানই বলে। তাঁকে ডিপ্রেশানের ওষুধ দিয়েছিলেন তাঁর মানসিক রোগের চিকিৎসক। তাঁর কাছের লোকেরা বলছেন, সুশান্ত নাকি অনেকদিন ওষুধ খাননি। ঠিক কী কারণে হাতের নাগালে তারকাখ্যাতি থাকার পরেও, ৫০টি স্বপ্নের বেশিরভাগই এখনও পূরণ না হওয়ার পরও তিনি নিজের জীবনের ইতি ঘটাতে চাইলেন, তা আমরা জানি না। তাঁর মস্তিষ্ক তাঁকে কী বলছিল সেই সকালে, যে কারণে তিনি দড়ি নিয়েছিলেন হাতে, সেটা আমরা কোনওদিন জানতে পারবো না। মস্তিষ্কই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে জটিলতম জিনিস।
সব মানুষই কমবেশি ডিপ্রেশানে ভোগে। তবে সুস্থ মানুষের ডিপ্রেশান আর মানসিক ব্যাধির ডিপ্রেশান এক নয়। একটি ডিপ্রেশান, আর একটি ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার। ডিপ্রেশান থেকে উঠে আসা সহজ, কিন্তু ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার থেকে উঠে আসা সহজ নয়। একে সামাল দিতে নিয়মিত থেরাপি এবং ওষুধের দরকার হয়। অনেকে বলে, ভালোবাসা না পেলে, বা একাকীত্বে ভুগলে ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারে ভোগা মানুষ আত্মহত্যা করে। তা ঠিক নয়। এই ডিসঅর্ডার যাদের আছে, তারা অগুনতি মানুষের, পরিবারের সবার এবং বন্ধুবান্ধবদের নিখাদ এবং অফুরন্ত শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-স্নেহ পেলেও আত্মহত্যা করে। প্রচুর ভালো বন্ধু তাদের ঘিরে থাকলেও তারা আত্মহত্যা করে, কারণ তাদের মস্তিষ্ক তাদের অন্য বার্তা দেয়, যেটার সঙ্গে তাদের বাস্তব জীবনের কোনও সম্পর্ক নেই।
৩। বাংলাদেশের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপিকাকে গ্রেফতার করা হয়েছে কারণ তিনি ফেসবুকে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মৃত্যুর পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সামান্য কিছু লিখেছিলেন। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের এক টেলিভিশান এক তথ্য-তদন্ত-চিত্রে দেখিয়েছিল পাবনার এক সরকারি হাসপাতালে ঢাকার এক প্রাইভেট কোম্পানি হাসপাতালের জন্য কী কী সরঞ্জামাদি কিনতে হবে তা লিস্ট করে পাঠিয়ে দিয়েছে এবং অর্ডারে সই করতে অনুরোধ করেছে। হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ-ডাক্তার বলেছেন, তাঁর হাসপাতালে ওই সরঞ্জামাদির প্রয়োজন নেই তাই তিনি অর্ডারের কাগজে সই করবেন না। এর কিছুদিন পর পাবনার ওই হাসপাতাল থেকে কর্তৃপক্ষ-ডাক্তার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আসা বদলির কাগজ পান। রোমহর্ষক ঘটনা। তদন্ত করলে আরও জানা যায় যে ওই প্রাইভেট কোম্পানিটি দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে অর্ডার পাঠিয়ে দেন। একটি হাসপাতালে কী কী দরকার, তা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বুঝবেন, কিন্তু প্রাইভেট কোম্পানিকে কে দায়িত্ব দিয়েছে বোঝার, এবং কোনও হাসপাতাল যদি কোম্পানি থেকে সরঞ্জামাদি না কেনে, তাহলে শাস্তি পাওয়ার ব্যবস্থাটা ওই কোম্পানি কী করে করে! কোম্পানির সংগে খুব প্রভাবশালী লোকেরা জড়িত, তা সহজেই অনুমেয়।
এসব দেখে যদি কেউ দুর্নীতির সমালোচনা করেন, তাহলে তাঁকে কি গ্রেফতার করাটা উচিত? যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে বিচার করলে বলতে হয়, নিশ্চয়ই উচিত নয়। দুর্নীতি বাড়তে থাকলে, অরাজকতা বাড়তে থাকলে, বাকস্বাধীনতা কমতে থাকে, গণতন্ত্র হতে থাকে অর্থহীন একটি শব্দ। সেইজন্যই ভয় হয়। মাঝে মাঝে ভাবি, দেশটায় গণতন্ত্রের কতটুকু অবশিষ্ট আছে। গণতন্ত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে বাকস্বাধীনতা। গণতন্ত্রকে সম্মান করলে বাকস্বাধীনতাকে সম্মান করতেই হয়।
এইসব ছোটখাটো অগণতান্ত্রিক আচরণ মানুষকে খুব স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন করে। এখন পৃথিবীর কোথায় কী ঘটছে, তা পৃথিবীর সবাই আধুনিক প্রযুক্তির আশ্রয় নিয়ে মুহূর্তেই জেনে যেতে পারছে। সুতরাং আমি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, কিন্তু আমার মতের সঙ্গে মেলে না, এমন কোনও মতকে আমি সহ্য করি না, এই সহ্য না করার ব্যাপারটা শুধু দেশের মধ্যেই গোপন থাকবে—এটি শত চাইলেও আজকাল আর সম্ভব নয়।
বেগম রোকেয়া ছিলেন একজন সাহসী মানবতাবাদী, নারীবাদী। তিনি বাকস্বাধীনতায় ভীষণ বিশ্বাস করতেন বলেই যে যুগে মেয়েদের অন্দরমহলে মুখ বুজে বাস করাই ছিল নিয়ম, তিনি সেই নিয়ম ভেঙে কথা বলেছেন, মেয়েদের পড়ালেখা করার, অর্থ উপার্জন করার, ঘরে-বাইরে সর্ব ক্ষেত্রে সমানাধিকার পাওয়ার কথা খুব জোর দিয়ে বলেছেন। তিনি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারে, মত প্রকাশের অধিকারে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতেন। তাঁর নাম দিয়ে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ হয়েছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি তাঁর আদর্শকেই মূল্য দেওয়া না হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থেকে তাঁর অর্থাৎ বেগম রোকেয়ার নাম সরিয়ে দিয়ে অন্য কারও নাম বসানো হোক, যে নামের মানুষ বাকস্বাধীনতার জন্য জীবন ভর সংগ্রাম করেননি। তা হলে অন্তত আমাদের শ্বাসগুলি এত দীর্ঘ হবে না যত দীর্ঘ হচ্ছে এখন।
সেদিন আমি আমার এক পরিচিত বাংলাদেশি লোককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কেউ কেউ বলছে দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবা, হাসপাতাল ইত্যাদির নাকি বারোটা বেজেছে? স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ অনেক টাকাই নাকি নানান লোকে নিজেদের পকেটে ভরেছে? এটা কি সত্যি যে নিজের অসুখ হলে দেশে চিকিৎসা না ক’রে চিকিৎসার জন্য খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিদেশে যেতে চেয়েছিলেন?’ লোকটি আমার প্রশ্ন শুনে মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন। গলা কাঁপছিল যখন বলছিলেন যে কাকপক্ষী যেন না জানে আমার এই প্রশ্নগুলো তিনি শুনেছেন। আরে প্রশ্ন তো আপনি করেননি, করেছি আমি! না এতেও তাঁর ভয় কাটেনি। বুঝতে পারলাম সরকার সম্পর্কে সমালোচনা করা তো অপরাধই, সমালোচনা শোনাও অপরাধ, এমনকি সরকারকে নিয়ে কারও কোনও প্রশ্ন শোনাও অপরাধ।
লোকটির প্রতিক্রিয়া দেখে আমার মনে পড়েছে চীনের অভিজ্ঞতার কথা। আমার এক প্রশ্ন শুনে আমার দোভাষী চৈনিক ভদ্রমহিলার যে প্রতিক্রিয়া দেখেছিলাম, তাতেই আমি চীনের বর্তমান অবস্থা বুঝেছিলাম। তিয়ানানমান স্কোয়ারে দাঁড়িয়ে আমি শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আচ্ছা, এখানে সেদিন, ১৯৮৯ সালে, মোট কতজন মানুষকে মারা হয়েছিল?’ সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রমহিলা ছিটকে সরে গেলেন, থরথর করে কাঁপতে লাগলেন, কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘কিছু জানি না, কিছু জানি না, আমরা কিছু জানি না সেদিন কী ঘটেছিল, আমরা কিছু দেখিনি, কিছু পড়িনি, কিছু শুনিনি, কিছু জানি না।’
Leave a Reply