অনড় দাঁড়ালাম- তসলিমা নাসরিন / প্রথম প্রকাশ : ডিসেম্বর ২০২০
উৎসর্গ : রাস্তার বেড়াল-কুকুরদের
১. বন্ধ হোক হত্যাকাণ্ড
প্যারিস, নিস, ভিয়েনা, কাবুল। জঙ্গি হামলা চলছেই। যত জঙ্গি হামলা চলবে, যত নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে খুন করবে মুসলিম জঙ্গিরা, দক্ষিণপন্থী-কট্টর-রাজনীতি তত জনপ্রিয় হবে। ইসলামের নামে সন্ত্রাস যত বেশি ঘটবে, তত বেশি ইসলামবিদ্বেষীরা ক্ষমতায় আরোহণ করবে, তত বেশি বর্ণবিদ্বেষ এবং ইসলামবিদ্বেষ গ্রহণযোগ্যতা পাবে। বিশ্ব জুড়ে একের পর এক জিহাদি আক্রমণ ঘটতে দেখে ইসলামকে নিয়ে যত কটূক্তি মানুষ করে, তত কটূক্তি গত পাঁচশ’ বছরে মানুষ করেছে কিনা সন্দেহ। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘পুট ইওরসেলফ ইন মাই সুজ’। নিজেকে আমার জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেখ। মুসলিমরা যদি অমুসলিমদের জায়গায় নিজেদের দাঁড় করায়, তাহলে? মুসলিম বিশ্বে যদি অমুসলিমদের আশ্রয় দেওয়া হতো, আর সেই অমুসলিম লোকেরা তাদের ধর্মের নামে যদি মুসলিমদের হত্যা করতো, আমরা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারি কী হতো মুসলিমদের প্রতিক্রিয়া। অমুসলিমদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে মুসলিম বিশ্ব থেকে বের করে দিত, অমুসলিমদের শায়েস্তা করার জন্য তারা অমুসলিমবিরোধী রাজনীতিককে দেশের প্রধান বানাতো, যেন অমুসলিমদের জন্য মুসলিম বিশ্বের দুয়ার চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। মুসলিমরা যা যা করতো, আজ অমুসলিমদের দেশে অমুসলিমরা ঠিক তা-ই করতে চাইছে।
আমি বুঝি না নিজেদের মুসলিমপ্রধান দেশ ফেলে, ইসলামি আইন যেসব দেশে বলবৎ সেসব দেশে নির্বিঘ্নে ধর্মচর্চা না করে মুসলমানেরা কেন পাড়ি দেয় অমুসলিমের দেশে যেখানে ইসলামি আইন এবং সংস্কৃতির লেশমাত্র নেই? পাড়ি যদি কোনও কারণে দিলই তবে সন্তানদের কেন সে দেশের সংস্কৃতি থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে? সে দেশের সংস্কৃতিকে পছন্দ হয়না তো সেই দেশে বাস করা কেন? তাদের উদারনীতি, আর তাদের অর্থনীতির সুবিধে ভোগ করার জন্যই তো? এ তো নিতান্তই স্বার্থপরতা। এই স্বার্থপরতা এতকাল অমুসলিম দেশের লোকেরা গ্রহণ করেছে কিন্তু এখন আর করতে চাইছে না। কেনই বা করবে যখন তুমি ওদের ধরে ধরে জবাই করছো? তুমি কি তোমার মুসলিম বিশ্বে পাড়ায় পাড়ায় গির্জা আর মন্দির বানাতে দিতে? ওরা কিন্তু অমুসলিম হয়েও তোমাকে পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ বানাতে দিয়েছে। তুমি ধর্মীয় স্বাধীনতা উপভোগ করেছো। ওদের ভাতা খেয়েছো। ওদের দয়ায় খেয়েছো, পরেছো। তারপর ওদেরই গলায় ছুরি বসিয়েছো, ওদেরই বুক লক্ষ করে গুলি ছুঁড়েছো। তুমি না ছুঁড়লেও তোমার ভাই ছুঁড়েছে, তোমার ধর্মের নাম নিয়ে ছুঁড়েছে। তুমি তখন তোমার ভাইয়ের অন্যায়ের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী না হয়ে যাকে হত্যা করা হয়েছে, তাকে দোষ দিচ্ছ, তার দেশকে দোষ দিচ্ছ, অতীতে সেই দেশ কী কী অন্যায় করেছে সেই তালিকা দিচ্ছ, আর হত্যাকাণ্ডের ন্যায্যতা প্রমাণের চেষ্টা করছো।
ইউরোপ আর আমেরিকা গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে বহুকাল অন্যায় করেছে। সাম্রাজ্যবাদ আর আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠা করা, নিজেদের পুতুল সরকার বসিয়ে রাজত্ব করা, লাগাতার শোষণ করা, বিপ্লবীদের খতম করে দেওয়া, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকে ধ্বংস করে দেওয়া। সে তো সুদূর অতীত, নিকট অতীতেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে। যেহেতু ওরা ভুল করেছে, তাই তোমাদেরও ভুল করতে হবে? একটি ভুলের প্রতিশোধ নিতে আরেকটি ভুল করা, এই অংকটা খুব ভুল অংক। ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করেছে নাৎসি জার্মানি। ইহুদিরা কিন্তু প্রতিশোধ নিতে নিরীহ জার্মানদের খুন করতে নামেনি। বরং নিজেরা পারদর্শী হয়েছে সর্ববিদ্যায়, আজ তাঁরা নমস্য। জার্মানরা আজ ইহুদিদের কুর্ণিশ করে। এর চেয়ে চমৎকার প্রতিশোধ আর কী হতে পারে! বাইবেল বলে চোখের বদলে চোখ নিতে। গান্ধী বলেছিলেন, সবাই যদি চোখের বদলে চোখ নিতে শুরু করে, তাহলে গোটা বিশ্বই তো অন্ধ হয়ে যাবে!
সবচেয়ে ভালো কথা বলেছেন অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর সিবাস্টিয়ান কুর্জ। বলেছেন ‘এই সংগ্রাম খ্রিস্টান আর মুসলিমের মধ্যে নয়, অস্ট্রিয়ান আর মাইগ্রেন্টদের মধ্যে নয়, এই সংগ্রাম যারা শান্তি চায় এবং যারা শান্তির বদলে যুদ্ধ চায়—তাদের মধ্যে। এই সংগ্রাম সভ্যতা এবং বর্বরতার মধ্যে।’ এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সভ্যতা নাকি বর্বরতা, কোনটি চাই।
চোখের বদলে চোখ না নিয়ে বরং অন্ধজনকে আলো দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। নিজেকে সত্যিকার শিক্ষিত সচেতন করে গড়ে তুলে বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে হবে জঙ্গিবাদ তোমার ধর্ম নয়। এ না হলে আর কোনও উপায় নেই বাঁচার। মুসলিমদের বাস করতে হবে এই বিশ্বে, নানা মতের নানা বিশ্বাসের মানুষের সঙ্গে পাশাপাশি। আমার ধর্মই ঠিক ধর্ম, বাকি ধর্ম ভুল ধর্ম, আমার ঈশ্বরই ঠিক ঈশ্বর, বাকি ঈশ্বর ভুল ঈশ্বর—এইসব অহংকার একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক বিশ্বের জন্য অচল। আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্র একটি অতি প্রয়োজনীয় তন্ত্র। এই তন্ত্রটি বিশ্বের সকল মানুষকে সমান মর্যাদা দেয়। এই গণতন্ত্রকে অস্বীকার করলে একঘরে হয়ে যেতে হবে। এ তো কাম্য নয়।
বাম রাজনীতির মুখোশ খুলে গেছে, এই রাজনীতি ইসলামি সন্ত্রাসবাদকে ছলে বলে কৌশলে সমর্থন করে। বাম রাজনীতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বিরোধী, কিন্তু কী কারণে এই রাজনীতি ইসলামি দর্শন—যে দর্শন আগাগোড়া দক্ষিণপন্থী—তা অনুধাবন করতে পারছে না? নাকি জেনেশুনেই বিষ পান করছে! ইসলামি দর্শন চরম দক্ষিণপন্থী তো বটেই। দক্ষিণপন্থী বলেই ধর্মীয় মৌলবাদের স্থান এই দর্শনে সবার ওপরে। শ্রেণী বৈষম্যও বেশ বহাল তবিয়তে উপস্থিত। দক্ষিণপন্থী বলেই নারীর সমানাধিকার এই দর্শনে স্বীকৃত নয়, সমতা স্বীকৃত নয়, শিল্প সংস্কৃতি, নৃত্যসংগীত এবং কোনও সুকুমারবৃত্তি আদৃত তো নয়ই, বরং ধিকৃত। বাম রাজনীতিকরা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন না হয়ে ইসলামি মৌলবাদের মতো চরম দক্ষিণপন্থী মৌলবাদী মতবাদকে আলিঙ্গন করে ঐতিহাসিক এক ভুল করেছেন। এই ভুলের খাদ থেকে অচিরে তাঁদের পাড়ে ওঠা উচিত।
পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো যেদিন থেকে সমাজতন্ত্রকে হটিয়ে দিল, সেদিন থেকে বাম রাজনীতির পতন শুরু হয়েছে। আর যেদিন থেকে এই রাজনীতি মুসলিম মৌলবাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, সেদিন থেকে এর জনপ্রিয়তা তলানিতে নেমে গেছে। মানুষ এখন ভরসা করছে দক্ষিণপন্থীর ওপর, তাও আবার কট্টর দক্ষিণপন্থীর ওপর। কারণ একমাত্র তারাই আস্থা দিয়েছে মুসলিম সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তারা রুখে দাঁড়াবে। ট্রাম বর্ণবিদ্বেষী হয়েও, নারীবিদ্বেষী হয়েও, রাজনীতিক না হয়েও, ইনকামট্যাক্স না দিয়েও, মারণ ভাইরাসের কামড়ে গোটা বিশ্ব যখন কুঁকড়ে আছে, যখন নিজের এবং অন্যের বাঁচার জন্য মাস্ক পরা অবশ্য কর্তব্য, তখন মাস্কের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করে করোনা ভাইরাসের অস্তিত্ব নিয়ে হাসি তামাশা করেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রচুর ভোট পেয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করছেন ডেমোক্রেট প্রার্থীর সঙ্গে।
ইসলামকে কেন মানুষ ভয় পাচ্ছে? কারণ ইসলামের নামে সন্ত্রাসীরা মানুষ হত্যা করছে। যে কেউ যে কোনও সময় খুন হয়ে যেতে পারে। আফগানিস্তানে ২২ জন শিক্ষার্থী খুন হয়ে গেল সন্ত্রাসী আক্রমণে। তার কিছুদিন আগে ২৪ জনের প্রাণ হরণ করেছে সন্ত্রাসীরা। যে মানুষই তাদের জিহাদে সায় দেয় না, সে মানুষকেই তারা শত্রু বলে মনে করে। শত্রুরা মুসলমান, অমুসলমান, অবিশ্বাসী, নাস্তিক যে কেউ হতে পারে। জিহাদে বিশ্বাস করা মানুষই শুধু তাদের বন্ধু, বাকিরা সবাই শত্রু। সুতরাং জিহাদ কোনও দেশের জন্যই নিরাপদ নয়।
মুসলিম দেশগুলো কোথায় ফ্রান্সে অস্ট্রিয়ায় জিহাদি কর্মকাণ্ডের নিন্দে করবে, তা নয়তো ইউরোপেকেই দোষ দিচ্ছে তাদের মত প্রকাশের অধিকারের জন্য। তুরস্ক, পাকিস্তান, মালোশিয়ার মুসলিম নেতারা জঙ্গিবাদকে তো সমর্থনই করলেন। রাষ্ট্রনেতার কাজ বর্বরতার বিরুদ্ধে কথা বলা, অথচ ওঁরাই বর্বরতার পক্ষে দাঁড়ালেন। এতে ওঁরা মুসলিম মৌলবাদীদের বাহবা পাবেন। আজকে মৌলবাদ তোষণ করলে কাল জঙ্গির জন্ম হয়। এই জঙ্গি কি শুধু পাশ্চাত্যেই হত্যাকাণ্ড চালাবে? প্রাচ্যেও চালাবে। আফগানিস্তানের মতো মৌলবাদি দেশও বাদ যায় না জঙ্গি হামলা থেকে। জঙ্গিবাদ মুসলিম অমুসলিম উন্নত অনুন্নত কোনও দেশের জন্যই শুভ নয়। অতএব একে রোধ করতেই হবে। মৌলবাদিদের ভোট পাওয়ার জন্য, ক্ষমতায় দীর্ঘদিন টিকে থাকার জন্য দেশে জ্ঞান চর্চা, বিজ্ঞান চর্চা বন্ধ করে কেবল ধর্ম চর্চা বিস্তার করে আখেরে লাভ হয় না, বরং ক্ষতিই হয়। এই ক্ষতির চিহ্ন প্রতিটি মুসলিম দেশে স্পষ্ট।
যে মুসলমানরা জিহাদি আদর্শে বিশ্বাসী নয়, তাদের প্রতিবাদ কোথায়? বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ লোকের মিছিল হয়েছে জিহাদিদের পক্ষে। এককালের ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ মাত্র তিন দশকের মধ্যেই মৌলবাদের দেশ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। কুমিল্লায় বাংলাদেশি জিহাদিরা পুড়িয়ে দিয়েছে অমুসলিমদের ঘরবাড়ি। সম্ভবত তারা চায় না দেশে কোনও অমুসলিম বাস করুক। প্রগতিশীল মানুষেরা নিহত নয়তো দেশান্তরি। তাহলে এটাই সত্য যে দেশের ভেতর কোনও প্রগতিশীলতার ঠাঁই নেই, কোনও মুক্তচিন্তার ঠাঁই নেই, কোনও মত প্রকাশের অধিকারের ঠাঁই নেই!
সরকারের দায়িত্ব মৌলবাদ দমন করা। মৌলবাদ দমন না করলে দেশ অচিরে দারুল ইসলামে রূপ নেবে, এ বিষয়ে কারও সংশয় থাকার কোনও কারণ দেখি না। আর সেই দারুল ইসলামে নারী নেতৃত্বের কিন্তু কোনও স্থান নেই। আমাদের নারী নেত্রীরা নিশ্চয়ই এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল।
২. হাসিনা
হাসিনা যত ক্ষতি করেছেন বাংলাদেশের, তত ক্ষতি অন্য কোনও প্রধানমন্ত্রী করেননি। হাসিনা জমায়েতের ডাক দিলে আজ যত লোক হবে, তার চেয়ে বেশি হবে কোনও পীর বা হুজুর ডাক দিলে। এই ব্যবস্থাটি হাসিনাই করেছেন। ওই লিঙ্গপালগুলোর দয়ায় আর কিছু গোলাম-সাংবাদিকদের করুণায় তিনি অবৈধভাবে অনন্তকাল ক্ষমতায় টিকে থাকতে চান। আছেনও। রাজনৈতিক সব বিরোধীদলকে পঙ্গু করে দিয়ে শক্তিশালী করেছেন ধর্মান্ধ জিহাদিদের। এই ক্ষতিপূরণ ২০০ বছরেও সম্ভব নয়।
চরমোনাইয়ের পীরের ডাকে ২/৩ লাখ লোক নেমেছিল রাস্তায়। হেফাজতি ইসলামের ডাকে ৫/৬ লাখ। এরা জিহাদিদের সমর্থনে মাঠে নেমেছিল, যে জিহাদিরা নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে ইউরোপের শহরগুলোয় নির্মমভাবে হত্যা করছে। হাসিনা পাশ্চাত্যের দয়া দাক্ষিণ্য দু’হাত পেতে নিচ্ছেন, তারপরও পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে ধর্মান্ধদের জিহাদি জমায়েতকে তিনি ঠেকানোর চেষ্টা করেননি। কোথায় পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ে, মেরে ধরে ছত্রভঙ্গ করবে মিছিল, তা নয়, ওদের রাজনৈতিক মোনাজাতে পুলিশও অংশগ্রহণ করেছে। ধর্ম শেষপর্যন্ত চোর গুণ্ডা ধর্ষক খুনী আর আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে কোনও ফারাক রাখে না।
হাসিনা ক্ষমতায় এলে দেশের হিন্দুরা নিরাপদে থাকবে—এমন আশার বাণী কত যে শুনেছি জীবনে! গতকাল বাংলাদেশের কুমিল্লায় ১০টা হিন্দু বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে জিহাদিরা। যে ক’জন হিন্দু আছে দেশে, ওরাও এরপর আর ওই দেশে থাকতে চাইবে না। জিহাদিদের আম্মির কাছ থেকে কোনও সুস্থ সুন্দর শান্তির সমাজ আশা করাটাই তো বোকামো। উনি ভেবেছেন অর্থনীতি ভালো করলেই বুঝি তাঁর সাত খুন মাফ। আরব দেশের কত ধনী দেশকে জিহাদিরা খেয়ে ছিবড়ে করে দিয়েছে। এত যে বলছি, কী লাভ! যিনি কানে দিয়েছেন তুলো পিঠে বেঁধেছেন কুলো—তিনি মরে যাবেন কিন্তু শোধরাবেন না।
৩. পবিত্র কিতাব
পবিত্র কিতাবের কিছু কিছু পবিত্র পৃষ্ঠায় বিধর্মীদের বা অবিশ্বাসীদের মেরে ফেলার পবিত্র বাণী রয়েছে। এই বাণী যখন উচ্চারণ করি, পবিত্র কিতাবের বিশ্বাসীগণ ধেয়ে আসেন বলতে বলতে, ”আউট অব কন্টেক্সট, আউট অব কন্টেক্সট”। তাঁদের ভাষ্য মাঝখান থেকে একটি বাণী উঠিয়ে আনলে বাণীর সত্যিকার অর্থ বোধগম্য হবে না, বাণীটির আগে পরের বাক্যও উচ্চারণ করতে হবে, তা হলেই অর্থটা সঠিক বোঝা যাবে। বিশ্বাসীরা ঠিকই বলেছেন। আগে পরে যা আছে, সব সহ বাণীটি উচ্চারণ করার পর অর্থ দাঁড়িয়েছে, ”চারদিকে লাল নীল হলুদ ফুলের বাগান, ফুলে খুব সুগন্ধ, আমরা ফুল খুব ভালোবাসি”।
৪. বর্বরতা
বাংলাদেশে তো মিছিল করার, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার লোক প্রচুর। সেদিন তো এক পীরের ডাকেই চল্লিশ হাজার বেরিয়ে পড়লো।
গতকাল যে লালমনিরহাটে এক মুসলমান লোক, যে কিনা মসজিদে নামাজ সেরে বেরোচ্ছিল—মসজিদের বইয়ের তাকে তার পা পড়েছিল বলে, আর সেই পায়ের কড়ে আঙুল তাকে রাখা কোরানে লাগলেও লাগতে পারতো এই গুজব ছড়িয়ে পুলিশের নিরাপত্তা থেকে তাকে যে উঠিয়ে নিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে আল্লাহু আকবর বলে চিৎকার করতে করতে আগুন জ্বালিয়ে দিল শত শত উন্মত্ত নামাজি—এই বর্বরতার প্রতিবাদে মিছিল বেরোবে না? গতকাল যে ফ্রান্সের নিস শহরে তিন জন নিরপরাধ মানুষকে এক মুসলিম নির্মমভাবে আল্লাহু আকবর বলতে বলতে হত্যা করলো, বেরোবে না এর প্রতিবাদে মিছিল? আর আল্লাহু আকবর বলতে বলতে শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটির মুণ্ডু কেটে যে রাস্তায় ফেলে রাখলো আরেক মুসলিম—বেরোবে না এর প্রতিবাদে মিছিল?
গাজায় মুসলিমদের ওপর অত্যাচার হলে তো মিছিল বেরোয়। মুসলিমরা অন্যের ওপর অত্যাচার করলে মিছিল বেরোয় না কেন? তাহলে কি বুঝতে হবে মুসলিমদের করা অত্যাচারে সমর্থন আছে মুসলিমদের?
অন্তত আল্লাহু আকবর—এই ‘পবিত্র শব্দদুটি’—সন্ত্রাসের কাজে, মানুষ হত্যার কাজে, বর্বরতা এবং নৃশংসতার কাজে তাদের মুসলিম ভাইয়েরা যেন আর ব্যবহার না করে, এই আর্জিটা তো করতে পারে তারা!
৫. সন্ত্রাস
তিউনেসিয়া থেকে ইতালিতে এল সেপ্টেম্বরে। ওখানে ভাইরাসের কারণে রয়ে যেতে হল অনেকদিন। ইতালি থেকে ফ্রান্সে পা রাখলো অক্টোবরের শুরুতে। বয়স কত? ২১। তিন সপ্তাহ যেতেই ছুরি নিয়ে এসে তরতাজা ৩ জন মানুষকে খুন করে ফেললো। এর তো কোনও জঙ্গি প্রশিক্ষণ হয় নি। মাত্র ১৩ দিন আগে যে ১৮ বছর বয়সী চেচেনটি শিরোচ্ছেদ করেছিল একজনের, ওরও তো জঙ্গি প্রশিক্ষণ হয়নি। তাহলে কী করে পারে মানুষের ধড় থেকে মুণ্ডু কেটে আলাদা করতে? কে তাদের শরীরে অত বীভৎস শক্তি দেয়? কী তাদের মনকে অমন হিংসেয় আর হিংস্রতায় কুৎসিত বানিয়ে ফেলে? ধর্ম?
৬. নবীপ্রেম
বাংলাদেশের লিঙ্গপালগুলো, যেগুলো ঢাকা শহরে মিছিল করলো ফরাসি পণ্য বর্জন করবে বলে কারণ ফরাসি সরকার চায়নি ফরাসি নাগরিকরা এক এক করে জবাই হয়ে যাক, সেগুলো, সেই লিঙ্গপালগুলো কৈশোর থেকে গরু জবাই করতে করতে হাত পাকিয়েছে, আর ধর্ষণ করতে করতে লিঙ্গ পাকিয়েছে। এই লিঙ্গপালগুলো ফ্রান্সে থাকলে ফরাসি মেয়েদের হুর ভেবে ধর্ষণ করতো আর হাতের কাছে যাকে পেতো তাকেই জবাই করতো। এদের ফেলো নবীপ্রেমিকগুলো তো ফ্রান্সের খেয়ে ফ্রান্সের পরে এই মহান কম্মটিই করছে।
৭. পণ্য বয়কটের ডাক
আমি যদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতাম, এই সময় আমি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁকে আমন্ত্রণ জানাতাম, বিশাল সম্বর্ধনা দিতাম তাঁকে, রাজধানীকে ফুল আর রঙিন কাগজ দিয়ে সাজাবার বদলে শার্লি এব্দোর কার্টুন দিয়ে সাজাতাম। আর পঙ্গপাল থুড়ি লিঙ্গপালের কেউ যেন কেশাগ্র বের করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করতাম। এভাবেই যদি লিঙ্গপালকে গণতন্ত্র কাকে বলে, মত প্রকাশের অধিকার কাকে বলে, বাকস্বাধীনতা কাকে বলে শেখানো যায়।
কিন্তু ঘটনা তো উলটো। কওমি মাতা তুরস্কের এরদোয়ানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, যে এরদোয়ান প্রথম ফরাসি পণ্য বয়কটের ডাক দিয়েছেন। ওঁর ডাকে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ লিঙ্গপালের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তাই তো রাস্তায় আরব দেশের পোশাক পরে নেমে গেছে। ওই পোশাক যে আসলে আরবের ৩৬০টি ভগবানের পূজা করা বিধর্মীদের পোশাক, তা বোঝার মস্তক কোথায় ওদের। মস্তক তো বন্ধক দেওয়া। এরদোয়ান কোভিডের জন্য খয়রাত দেবেন বাংলাদেশকে। খয়রাতই যদি ঘটনা, খয়রাত তো ম্যাক্রোঁ আরও বেশি দিয়েছেন!
৮. লিঙ্গপাল
বাংলাদেশে মূর্খ মোল্লাদের মিছিল হল, তারা নাকি ফরাসি জিনিসপাতি আর কিনবে না। আরও কিছু মুসলিম দেশেও ফরাসি কিছু কিনবে না, ফরাসি কিছু বিক্রি করবে না—এই স্লোগান উঠেছে। মূর্খের সংখ্যা যখন বেশি হয়ে যায়, তখন সমস্যা। এই মূর্খগুলোর দাবি শুনে সরকার প্রমাদ গোণে। মূর্খ তৈরির কারখানা তো অতি- চালাক-সরকারদেরই তৈরি করা। এদের গণতন্ত্র না শিখিয়ে, বাকস্বাধীনতা কী কাহাকে বলে না শিখিয়ে মূর্খ হওয়ার ছবক দিয়েছে। কার ক্ষতি ফরাসি পণ্য বর্জন করলে? তোদের স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধুকে নামিয়ে ফেল। ওটা তো ফরাসি দেশে তৈরি। ৫৭ লাখ মুসলিমকে যদি ফরাসি দেশ বর্জন করে, তাহলে কী উপায় হবে? বর্জন এক তরফে কেন, দুই তরফেই তো হওয়া উচিত। ফরাসি দেশে বসে থাকা মূর্খগুলো কী করতে চায়? ওরা তো দ্রব্যও বর্জন করতে চায় না, দেশও বর্জন করতে চায় না। ওরা বরং ছুরি শানায় আর কারও মুণ্ডু আল্লাহু আকবর বলে ধড় থেকে আলাদা করা যায় কি না।
মূর্খদের মস্তিষ্ক থাকে ওদের লিঙ্গে। ওই লিঙ্গ দিয়েই ওরা চিন্তাভাবনা করে। খোয়াব দেখে ৭২ হুরের সঙ্গে অনন্তকাল বিরতিহীন সঙ্গমের, খোয়াবটা দেখায় ওই লিঙ্গ। যে এই খোয়াবের ব্যবস্থা করে দিয়েছে, তাকে নিয়ে মশকরা? রক্তের সাগরে ওরা ডুবিয়ে ফেলবে দুনিয়া!
৯. কার্টুন
ইউরোপের এক বিশাল বিলবোর্ডে দেখলাম ওই কার্টুনটি দেখানো হচ্ছে। ওই কার্টুনের কারণে উম্মতেরা কাকে হত্যা করেছে, তাও দেখানো হচ্ছে। কার্টুন দেখতে দেখতেই উম্মতদের চোখ সইবে। চোখ সওয়ানোটা খুব জরুরি। মধ্যযুগে উনির উম্মতেরা তো উনির প্রচুর মিনিয়েচার এঁকেছেন! তখন তো আগুন জ্বলেনি! কে বলেছে আমরা মধ্যযুগে ফিরে গেছি। মধ্যযুগ এই যুগের চেয়ে ঢের ভালো ছিল। মুসলিমদের মধ্যে জ্ঞানচর্চা বাড়ছিল, মুসলিমরা আলোকিত ছিল, সেই মুতাজিলার সময়ে তো কোরান মানুষের লেখা বলে প্রচুর মুসলিম ঘোষণা করেছিল, না, কেউ তাদের হত্যা করেনি। আমরা ১৪০০ বছর আগেও ফিরিনি। ১৪০০ বছর আগে উনি রাজত্ব দখল করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তার আগে তো মানুষ যুক্তি দিয়ে কথা বলতে পারতো, উনির আসমানের গল্প নিয়ে বিদ্রুপ করতে পারতো, উনিকে পেটাতেও পারতো, একবার তো মেরে দন্ত মোবারক ভেঙে দিয়েছিল।
আমরা আসলে বর্তমানেই আছি, যে বর্তমানটি সব যুগের চেয়ে ভয়ংকর যুগ। এই যুগে কথা বলা যাবে না, চোখ তোলা যাবে না, চুল দেখানো যাবে না, বাহু দেখানো যাবে না, ছবি আঁকা যাবে না, কার্টুন আঁকা যাবে না, নাচা যাবে না, গাওয়া যাবে না।
১০. ধর্মীয় অনুভূতি এবং বাকস্বাধীনতা
লাখো মুসলমানের ঢল নেমেছিল ঢাকা শহরে। ভিডিওতে এই দৃশ্য দেখে আমি চমকে উঠলাম। ফরাসি পণ্য বয়কটের ডাক কয়েকটি মুসলিম দেশে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের মতো এত বড় মিছিল আর কোনও দেশে হয়নি। যখন দেশে ছিলাম, মোল্লা মুসল্লিদের মিছিল দেখেছি অনেক। কিন্তু এত বড় তো দেখিনি। দিন দিন এরা সংখ্যায় বাড়ছে। অবশ্য সংখ্যায় বাড়া সরকারের কল্যাণেই সম্ভব হয়েছে। সাধারণত প্রগতিশীল মানুষের মত প্রকাশের বিরুদ্ধে, তাঁদের ফাঁসির দাবিতে, তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মিছিল বের করতো ওরা। ওদের কখনও দেখিনি সমাজের মঙ্গলের জন্য মিছিল বের করতে। ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, দারিদ্র, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, ইত্যাদির প্রতিবাদ কখনও করতে দেখিনি। তারা শুধু ধর্মীয় অনুভূতির জন্য পথে নামে। তাদের ওই অনুভূতিতে যেন কখনও কোনও আঘাত না লাগে, এই হুমকি দিতেই নামে। মানুষের নানা অনুভূতিতে দিনভর আঘাত লাগছে, প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এসব আঘাত সামলে নিতে পারে। যারা অনুভূতিতে আঘাত লাগলে অন্যকে খুন করে, বা খুন করাকে সমর্থন করে, তাদের নিয়ে সমাজে সমস্যা হয়।
ফ্রান্সের পণ্য বাংলাদেশ বয়কট করলে ফ্রান্সের খুব হয়তো অর্থনৈতিক অসুবিধে হবে না। কিন্তু বাংলাদেশের পণ্য ফ্রান্সে না রফতানি করলে কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে। গার্মেন্টস ব্যবসায় ক্ষতি হলে বাংলাদেশের মানুষই ভুগবে। আর বাংলাদেশের মুসলমানদের যদি ফ্রান্স থেকে বর্জন করা হয়, তাহলে সমস্যা কি ফ্রান্সের হবে, নাকি বাংলাদেশি মুসলমানদের হবে? ফ্রান্সের কাছে অনেক সাহায্য সহযোগিতার জন্যই তো ঋণী বাংলাদেশ। মুসল্লিদের রাগ দেখে মনে হচ্ছে, ওরা ফ্রান্সে তৈরি বাংলাদেশের স্যাটেলাইটকেও মহাকাশ থেকে নামিয়ে আনবে। নামিয়ে আনলে কার ক্ষতি? কার আর, বাংলাদেশের!
কূটনৈতিক সম্পর্ক টিকিয়ে রেখে সমস্যার সমাধানে আলাপ আলোচনা করতে হবে। জ্বালাও পোড়াও করে কোনও সম্পর্ককে বন্ধুত্বপূর্ণ করা যায় না। ফ্রান্সের ধর্মনিরপক্ষতা আর মত প্রকাশের অধিকার ওরা দীর্ঘ সংগ্রামের পর অর্জন করেছে, ওদের এই মূল্যবান অর্জনকে কোনও মিছিল আর পণ্য বর্জনের হুমকি দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা আর মত প্রকাশের অধিকার রক্ষার কোনও বালাই নেই। যেটা আছে, সেটা হলো ধর্মীয় অনুভূতি। অন্য হাজারো অনুভূতিতে আঘাত লাগলেও এই ধর্মীয় অনুভূতি যেন অনন্তকাল অক্ষত অবস্থায় থাকে, তার গ্যারেন্টি চাই সবার। এই গ্যারেন্টি বাংলাদেশের সরকার দিয়েছে, কিছু প্রগতিশীল ব্যক্তি দিতে পারেনি বলে তাদের খুন করা হয়েছে এবং নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে।
কেবল নিজের মত প্রকাশের অধিকারেই কিন্তু এরা বিশ্বাস করে। অন্যের মত প্রকাশের অধিকারে করে না। ফ্রান্সে তো কম জঙ্গি হামলা হয়নি এ পর্যন্ত। ফরাসিদের মনে হয় সহ্যের সীমা পার হয়ে গেছে। একটি নিরীহ শিক্ষকের প্রাণও চলে যায় উন্মত্ত ধর্মান্ধের হাতে। প্রায় ৬০ লাখ মুসলমান বাস করে ফ্রান্সে। আমার তো ভয় হয়, যদি ফ্রান্সে কখনও ঘোষণা করে দেয়, ৬০ লাখ মুসলমানকে তারা আর ফ্রান্সে থাকতে দেবে না, তবে? কোথায় যাবে এই ৬০ লাখ?
ফ্রান্স মুসলমানদের উপকার কি কম করেছে? জমজমের পানিতে নাইট্রেট, আর্সেনিক, ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি পাওয়া গেছে বলে বিবিসির খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন ফ্রান্সের কারসো-লেসেল ল্যাবই তো পরীক্ষানিরীক্ষা করে জানিয়ে দিয়েছিল বিশ্বকে যে জমজমের পানি নিরাপদ! ফ্রান্সের এই সার্টিফিকেট সৌদি আরবকে কতটা উপকার করেছিল, তা সৌদি আরবই ভালো জানে।
ফরাসি পণ্যের মধ্যে শুধু তো সুগন্ধি আর রূপচর্চার জিনিসপত্র নয়, অস্ত্রও পড়ে। মুসলিম দেশগুলো নিজেরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে রাখতে বদ্ধ পরিকর, সুতরাং তাদের অস্ত্র চাই। কে কী কার্টুন ছাপিয়েছে, এতে কার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে, কোথায় আগুন লেগেছে, তারা থোড়াই পরোয়া করে। তারা মুসলিম হয়ে অন্য মুসলিমকে কী করে খুন করতে হয়, কী করে তাদের বাড়ি ঘর শহর গ্রাম ধ্বংস করে দিতে হয়, শিখে ফেলেছে। এটি করতে বোমা চাই, যুদ্ধবিমান চাই, আধুনিক সব অস্ত্র চাই। তখনই তো ফ্রান্স এবং পাশ্চাত্যের দেশগুলোর দিকে হাত বাড়ায় তারা। পাশ্চাত্য যতই ইসলাম-বিরোধী হোক, তাতে তাদের কিছু যায় আসে না।
মুসলিমদের মধ্যে ঐক্য নেই। কিছুদিন আগে কিছু মুসলিম দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। সৌদি আরব তার তেলের ব্যবসার স্বার্থে মুসলিম-বিরোধী শক্তিকে আলিঙ্গন করতে কোনও আপত্তি করে না। জ্বালাও পোড়াও শুধু গরিব মুসলমানের আবেগ। যেটিকে পাশ্চাত্য কেন, ধনী মুসলিম দেশই প্রশ্রয় দেয় না। মুসলমানরা কিন্তু অমুসলিমদের পাশ্চাত্যে বাস করে বেশি মর্যাদা এবং সম্মান পায়, মুসলিম দেশে বাস করে সেটা পায় না। সৌদি আরবে কত গরিব মুসলিমকে নির্যাতিত হতে হয়। কত বাংলাদেশের নারী শ্রমিককে ধর্ষিতা হয়ে ফিরতে হয়েছে তা কি গুণে শেষ করা যাবে!
মুসলিম মুসলিম ভাই ভাই মিথ্যে কথা। সাধারণ মুসলিম জনতাকে কারা সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত করে? মুসলিম-দেশগুলোর মুসলিম সরকার। সাধারণ মানুষের দারিদ্র ঘোচানো, তাদের শিক্ষা স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করা, তাদের সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার কোনও কাজই সরকার করে না। তারা শুধু জনতাকে ধর্মান্ধ বানানোর সবরকম ব্যবস্থা করে দেয়। এতে খরচ কম, পরিশ্রম কম। পঙ্গপালের মতো মূর্খ জনতার জন্ম হতে থাকে, আর সরকার ব্যস্ত আখের গুছোতে। দেশের সম্পদ লুঠ করে দেশের সর্বনাশ করতে ক্ষমতাসীন লোকদের জুড়ি নেই। মুসলিমদের ধর্মান্ধ করে গড়ে তোলা সহজ। মুসলিমদের সভ্য শিক্ষিত সচেতন দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার কাজটি কঠিন। এই কঠিন কাজটি কোনও সরকারই করতে চায় না। অথচ এটিই সবচেয়ে জরুরি। মুসলিম জঙ্গিরা যেদিন থেকে ধর্মের নামে আর মানুষ খুন করবে না, সেদিন থেকে সাধারণ মুসলিমদের সমস্যা হবে না পৃথিবীতে। তাদের কেউ ঘৃণা করবে না, তাদের কেউ ভয় পাবে না।
প্রায় ২০০ কোটি লোক পৃথিবীতে মুসলমান। দিন দিন এই সংখ্যাটি বাড়ছে। এই ধর্ম নিয়ে গেল গেল রব তোলার কোনও অর্থ হয় না। মুসলমানরা যত গভীরভাবে ধর্মে বিশ্বাস করে, সেরকম গভীরভাবে অমুসলিমরা তাদের ধর্মে বিশ্বাস করে না। ইহুদি এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অধিকাংশই ধর্মে নয়, বিজ্ঞানে বিশ্বাসী। সুতরাং ধর্ম টিকে থাকলে ইসলামই টিকে থাকবে। এই ধর্মই সারা বিশ্বে দাপিয়ে বেড়াবে। কিন্তু এতেই কি ধর্মের সার্থকতা? কোনও ধর্মকে ভালোবেসে যদি মানুষ তার উদারতা, স্বার্থহীনতা, ক্ষমাশীলতা ইত্যাদি গুণগুলো নষ্ট করে ফেলে, তবে কি তা ভালো লক্ষণ? নিশ্চয়ই শুভবুদ্ধির মানুষেরা রাজনৈতিক ইসলাম চায় না, চায় উদারনৈতিক ইসলাম।
১ ১. শব্দ
আমার লেখা একটি গল্পের বই পড়ে কলকাতার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী আমাকে বললো, ”বইটির শেষ পাতায় একটা গ্লসারি থাকলে ভালো হতো।”
শুনে আমি অবাক। বললাম—বাঙালি পাঠকের জন্য বাংলায় লেখা বইয়ে গ্লসারি থাকবে কেন?
তারপর কথোপকথন এইভাবে চললো।
—কিছু শব্দ তো বাঙালি পাঠকরা বুঝবে না, সে জন্য বলছিলাম।
—কোন কোন শব্দ বুঝবে না?
—খালা, দোযখ…
—বলতে চাইছো বাঙালি হিন্দুরা বুঝবে না ওই শব্দগুলোর অর্থ? বাঙালি মুসলমানরা তো মাসি, নরক এই শব্দগুলোর অর্থ বোঝে। হিন্দুরা বুঝবে না কেন? ওরা তো হাজার বছর ধরে এক ভূমিতে বাস করছে মুসলমানের সঙ্গে। এই শব্দগুলো মুসলমানের মুখ থেকে এতকাল শোনেনি?
—না, বাঙালিরা জানে না এইসব শব্দ।
—না জানা তো গর্বের কথা নয়, বরং লজ্জার কথা। আমি নতুন কোনও শব্দ পেলে ডিকশেনারিতে সঙ্গে সঙ্গে অর্থ দেখে নিই। এতে নতুন একটি শব্দ শেখা হয় আমার। বাঙালি হিন্দুরা তাহলে আমার বই পড়ে অনেক নতুন শব্দ শেখার সুযোগ পাবে। তাহলে তো ওদের জন্য ভালো হল।
—বলছিলাম…
—বাংলা ভাষায় প্রচুর বিদেশি শব্দ আছে, আরবি ফার্সি ইংরেজি পর্তুগীজ। এক কালে কলকাতার কোর্টের ভাষা ফার্সি ছিল। বাইরে থেকে যত শব্দ ঢুকবে ভাষায়, ভাষা তত সমৃদ্ধ হবে। কুয়োয় সাঁতরে আনন্দ নেই, সমুদ্রে সাঁতরাতে হয়।
—কী বললে, ফার্সি শব্দ বাংলা ভাষায় আছে? কোন শব্দ? আমরা বলি?
—ও তুমি বলতে চাইছো বাঙালি হিন্দুরা বলে কি না? হাঁ নিশ্চয়ই বলে। আওয়াজ, জায়গা, চাকরি, দেরি, দোকান, বাগান, রোজ, পছন্দ, চশমা, পর্দা, রাস্তা, কাগজ, কানুন, খারাপ, খালি, খুব, চালাক, চাকু, চাদর, জরুরি, তাপ, তীর, তোশক, দরজা, নরম, পিঁয়াজ, বরফ, বাচ্চা, বন্দর, শক্ত, হাজার, আবাদ, আমদানি রফতানি, আরাম, আসর, আস্তানা, আস্তাবল, আস্তে, কারখানা, কারচুপি, কারিগর, কিনার, কুর্ণিশ, হিন্দু, রঙ, মামুলি, নারিকেল, দলিল, তারিখ, গরম, বালিশ, শিশি, হরেক, হাঙ্গামা, হুঁশ এরকম হাজারো শব্দ।
—বল কী?
—সেটাই।
—এত মুসলিম শব্দ বাংলা ভাষায়, বিশ্বাস হচ্ছে না।
—শব্দের বা ভাষার কোনও ধর্ম নেই। কোনও শব্দই মুসলিম বা হিন্দু শব্দ নয়। ভাষা অঞ্চল ভিত্তিক। একই অঞ্চলে বাস করা নানা ধর্মের, সংস্কৃতির লোক এক ভাষায় কথা বলে। পারস্য দেশে মুসলিম আসার আগে থেকেই ফার্সি ভাষাটি ছিল। আরবি ভাষাটিও আরবেরা মুসলমান হওয়ার আগেও ছিল। বাংলা ভাষাটি বাংলায় বাস করা হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম খ্রিস্টান সব বাঙালিরই।
১২. আত্মসমালোচনা করতেই হবে
১
ইরানের নাজাফবাদ শহরে একটি মেয়ে হিজাব না পরে সাইকেল চালিয়েছে। দুটো অপরাধ মেয়েটি করেছে, সাইকেল চালিয়েছে, এবং হিজাব পরেনি। ইচ্ছে করেই অপরাধ দুটো করেছে মেয়ে। চেয়েছে শহর দেখুক সে যে আইন ভাঙছে, সাইকেল চালাতে চালাতে, খোলা চুল ওড়াতে ওড়াতে, ডান হাতখানা নাড়াতে নাড়াতে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছে সে। লুকিয়ে চুরিয়ে কিছু করেনি। যার হিজাব পরার ইচ্ছে, সে হিজাব পরুক, যার ইচ্ছে নেই, তাকে জোর করা হচ্ছে কেন। মেয়েদের আপত্তি এই জোর করা নিয়েই। নাজাফবাদের মেয়েটিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মেয়েটি নিশ্চয়ই জানতো তাকে গ্রেফতার করা হবে, তাকে শাস্তি দেওয়া হবে। জেনেশুনেই সে বিষপান করেছে। শিক্ষিত সচেতন মেয়েরা আর কতকাল এই অত্যাচার সহ্য করবে! এই যে যা হয় হোক বলে বেরিয়ে পড়েছে স্বাধীনতার ডান হাত উত্তোলন করে, এ একদিনের সিদ্ধান্ত নয়। এ নিছক মজা করা নয়। চল্লিশ বছর ধরে জড়বস্তুর জীবন কাটাতে কাটাতে শ্বাসকষ্ট হতে থাকা কিছু প্রাণ শ্বাস নিতে বেরিয়েছে খোলা হাওয়ায়। এই মেয়েরা স্বাধীনতার প্রতীক। এই মেয়েরা ইতিহাস। কোনও একদিন ইরানে ঠিকই আধুনিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে, যে সমাজে নারীর সমানাধিকার থাকবে। নাজাফবাদের সাহসী এই মেয়েটির নাম সেই আধুনিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়ে যাবে। নারীবিদ্বেষের জগদ্দল পাথর সে সরাতে পারেনি। একটি নুড়ি তো সরিয়েছিল!
১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লব ঘটিয়ে মোল্লারা ক্ষমতা দখলের পর থেকে মেয়েদের হিজাব না পরে রাস্তায় বেরোনো অপরাধ। সাইকেল চালানোটা বৈধ ছিল। কিন্তু কয়েক বছর আগে সাইকেল চালানোর বিরুদ্ধে মোল্লাগুরু একখানা ফতোয়া জারি করেন। এদিকে ইরানের কিছু শহরে বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলাকালে কলের গাড়ি বাদ দিয়ে মানুষ যখন পায়ে-চালানো-সাইকেলকে যখন আশ্রয় করছে, তখনই এই ফতোয়া। সাইকেল-চালানো-মেয়েরা তো রুখে দাঁড়ালো। ইসলামের কোথায় আছে মেয়েদের সাইকেল চালানো চলবে না? কোথাও তো নেই! ১৪০০ বছর আগে সাইকেল নামে কোনও বস্তু ছিল না। তাহলে? ইসলামের নামে তাহলে মেয়েদের ন্যায্য অধিকার সবই হরণ করার চেষ্টা চলছে! ইরানের মেয়েরা সহজে ছেড়ে দেয় না। কিছু মেয়ে তো মাথা পেতে যা আদেশ আসে, তা-ই বরণ করে। তাদের কথা আলাদা। কেউ কেউ কিন্তু আদেশ বরণ করতে চায় না, কিন্তু বরণ করতে বাধ্য হয়। কিছু মেয়ে প্রতিবাদ করে। সারা বিশ্ব দেখেছে হিজাবের বিরুদ্ধে ইরানি মেয়েদের অভিনব প্রতিবাদ। রাস্তার কিনারে উঁচু কোনও জায়গায় দাঁড়িয়ে এরা লাঠির মাথায় হিজাব বেঁধে পতাকার মতো উড়িয়েছে। ওটিরই আরেক নাম ছিল স্বাধীনতা। সারা বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষ সাহসী ওই মেয়েদের বাহবা দিয়েছে। দূর থেকে তো বাহবাই দেওয়া যায়। যারা মোল্লাতন্ত্রের অধীনে বেঁচে থাকে, তারাই জানে বেঁচে থাকাটা ঠিক কেমন দুঃসহ।
ধর্মের নামে যে নির্যাতন মেয়েদের ওপর চলে, তার তুলনা হয় না। পিতৃতন্ত্র তো আছেই নির্যাতনের জন্য, তার সঙ্গে, মোল্লাতন্ত্রের দাপটে ধর্মকে যোগ করা হয়েছে। পিতৃতন্ত্র আর ধর্মের যখন মিলন ঘটে, তখন মেয়েদের ওপর নির্যাতন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। মেয়েদের কার্যত বন্দি করা হয়। মেয়েরা বাধ্য হয় ঘরবন্দি হতে, পর্দার আড়ালে চলে যেতে; বাধ্য হয় পরনির্ভর হতে, সমাজের চোখে অপবিত্র অচ্ছুত হতে, অকিঞ্চিৎকর হতে, ক্ষুদ্র তুচ্ছ নগণ্য হতে। বিশ্বের সভ্য রাষ্ট্র ধর্মকে দূরে সরিয়েছে। মুশকিল হল মুসলিম রাষ্ট্রগুলো এই একবিংশ শতাব্দীতেও ধর্মকে আঁকড়ে ধরে আছে। আধুনিক রাষ্ট্রের কোনও ধর্ম থাকতে নেই, এ কথা জানার পরও যে নেতারা ধর্মকে রাষ্ট্র এবং রাজনীতিতে মেশায়, তারা সভ্যতা এবং আধুনিকতা কোনওটিই চায় না। তাদের এই না চাওয়ার ফলে সবচেয়ে বেশি যারা ভোগে, তারা নারী।
২
প্যারিসের উপকণ্ঠে একটি স্কুল। স্কুলের ৪৭ বছর বয়সী ইতিহাস-ভূগোলের শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটি ১৩/১৪ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের ‘মত প্রকাশের অধিকার’ বিষয়ে পড়িয়েছেন, পড়াতে পড়াতে মত এবং ভিন্নমতের উদাহরণ দিয়েছেন। এই উদাহরণের জন্য শিক্ষকরা হাতের কাছে শাসক এবং ধর্মগুরুদের ব্যঙ্গচিত্র রাখেন। যেহেতু ব্যঙ্গচিত্র আঁকলে শাসক এবং ধর্মগুরুদের ভক্তকুল এবং সমর্থকবৃন্দ ক্রোধে উন্মাদ হয়ে ওঠে। যে মতটি সকলকে তুষ্ট করতে পারে না, সেটিই ভিন্নমত, এবং এই ভিন্নমতটির জন্যই প্রয়োজন ‘মত প্রকাশের অধিকার’। কয়েক বছর আগে প্যারিসের শার্লি এব্দো পত্রিকা-অফিসে নবী মুহম্মদের একটি ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করার কারণে ১২ জনকে খুন করেছিল মুসলিম সন্ত্রাসীরা যারা ভিন্নমত প্রকাশের অধিকারে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করে না। এই কাহিনী বলতে বলতে স্যামুয়েল প্যাটি ব্যঙ্গচিত্রটি শিক্ষার্থীদের দেখিয়েছেন। অবশ্য দেখানোর আগে মুসলিম শিক্ষার্থীদের, যারা ওটি দেখতে চায় না, শ্রেণীকক্ষ থেকে আপাতত প্রস্থানের জন্য অনুরোধ করেছেন।
স্যামুয়েল প্যাটি শিক্ষার্থীদের কিছু মুসলমান অভিভাবক স্কুল-প্রধানের কাছে অভিযোগ করলেন শিক্ষকের বিরুদ্ধে। কেন তিনি ওই কার্টুনটি শিক্ষার্থীদের দেখিয়েছেন! অভিভাবকদের এই প্রতিবাদের ভিডিও কোনও এক অভিভাবক ফেসবুকে প্রচার করেছিলেন। সেটিই নজরে পড়ে আব্দুল্লাখ আনজরভের। আব্দুল্লাখ আনজরভ ওই ইস্কুলের শিক্ষার্থী না হয়েও, কোনও শিক্ষার্থীর অভিভাবক না হয়েও ইস্কুলে প্রবেশ করে, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে খোঁজ নেয় ক্লাসে কী ঘটেছিল। কয়েকটি শিক্ষার্থীকে সে ৩০০ ইউরো দিয়েছে যেন স্যামুয়েল প্যাটি ঠিক কোন লোকটি তা দেখিয়ে দেয়।
ওদিকে একের পর এক হুমকি পেয়ে স্যামুয়েল প্যাটি পুলিশকে জানান। পুলিশ তাঁকে পরামর্শ দেন যে পথে তিনি বাড়ি যান, সেই পথে না গিয়ে এখন থেকে অন্য পথে বাড়ি যেতে। তা-ই করছিলেন প্যাটি, কিন্তু বাঁচাতে পারলেন না নিজেকে। চেচনিয়ার ১৮ বছর বয়সী সন্ত্রাসী আব্দুল্লাখ আনজরভ তাঁকে শুক্রবার বিকেলে স্কুলের বাইরের রাস্তায় দিব্যি জবাই করে ফেলে রাখলো, হ্যাঁ জবাই। বড় একখানা মাংস কাটার ছুরি দিয়ে আল্লাহু আকবর বলতে বলতে সে বীভৎস হত্যাকাণ্ডটি করে।
এটিই আসল ইসলাম। অনেক মুসলিমই শান্তিপ্রিয়, ইসলাম কিন্তু তাদের শান্তিপ্রিয় করেনি, করেছে সভ্যতা, আধুনিকতা,জাগতিক সুশিক্ষা।
বিশ্ব তো কম দেখেনি সন্ত্রাস। মাথা ঠান্ডা রেখে বড় বড় সন্ত্রাসীরা বহুদিন ধরে হিসেবনিকেশ করে বড় বড় সন্ত্রাস ঘটাচ্ছে। এর মধ্যে অমুসলিম আছে, মুসলিমও আছে। মূলত রাজনীতিই কারণ। কিন্তু ধর্মের নামে যে সন্ত্রাস ঘটছে, অধিকাংশ সন্ত্রাস শুধু মুসলিমই ঘটাচ্ছে।
আব্দুল্লাখ আনজরভ চেচনিয়ার ছেলে। ১০ বছরের ভিসা নিয়ে সপরিবার প্যারিসে বাস করতে এসেছিল। মনে আছে বোস্টন ম্যারাথনে প্রেশার কুকার বোমা নিয়ে গিয়েছিল তামেরলান আর জোখার জারনায়েভ দুই ভাই? ওরাও ছিল চেচনিয়ার। চেচনিয়াও সন্ত্রাসী তৈরি করে। আমার তো ভয় হয়, কোনওদিন হয়তো শুনতে হবে পাশ্চাত্যের কোথাও পয়গম্বরের কোনও ছবি বা কার্টুন দেখে যে ছেলেটি মানুষের মুণ্ডু কেটেছে, সে বাংলাদেশের ছেলে। হতেই তো পারে, গুলশানের ক্যাফেতে যারা অমন নৃশংস ঘটনা ঘটিয়েছিল, তারা তো বাংলাদেশের ছেলেই ছিল। ইসলামের প্রতি মানুষের ভয় যে বাড়ে, ঘৃণা যে বাড়ে, মুসলিমদের কাছ থেকে মানুষ যে দূরে থাকতে চায়, তার তো কারণ আছে। এসবই কারণ।
যত বেশি ধর্মীয় সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটাবে মুসলমানেরা, তত বেশি তারা ক্ষতি করবে মুসলমানদের। মুসলমানদের আর শরণার্থী হিসেবে, উন্নত শিক্ষা বা উন্নত চিকিৎসার জন্য ইউরোপ-আমেরিকায় প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। পাশ্চাত্যের সর্বত্র মানুষ মুসলমান দেখলে ভয় পাবে, তাদের ঘৃণা করবে। শান্তিপ্রিয় মুসলমানদেরও মানুষ সন্ত্রাসী ভেবে সন্দেহ করবে। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি আসলে মুসলমানরাই করে। চিরকালই করে এসেছে।
৩
নিজের মুসলিম-দেশ ছেড়ে যে মুসলিমরা ইউরোপ আমেরিকায় বসে নানা সুযোগসুবিধে ভোগ করছেন, তাঁদের অধিকাংশই বড় অবলীলায় সেই দেশগুলোর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন। বিষোদ্গার করতে তাঁদের দু’বার ভাবতে হয় না কারণ তাঁরা ভালো করেই জানেন তাঁরা বাকস্বাধীনতা ভোগ করতে পারেন একমাত্র ওসব দেশেই। বিষোদ্গারের জন্য তাঁদের কেউ জেলে ভরবে না, তাঁদের মুণ্ডু কেটে কেউ রাস্তায় ফেলে রাখবে না। তাঁরা তখনই পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে সরব হন, যখনই মুসলিম সন্ত্রাসীরা ইসলামের নামে সন্ত্রাস করে, বোমা মেরে উড়িয়ে দেয় সভ্যতা, নিরীহ মানুষদের জবাই করে। পশ্চিমি দেশগুলো মূলত সেক্যুলার (রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করা), তারপরও তাঁরা দেশগুলোকে ‘খ্রিস্টান দেশ’ বলবেন। লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে পশ্চিমি দেশ আশ্রয় দিয়েছে, তারপরও বলবেন দেশগুলো মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে, মুসলমানদের ঘৃণা করে, ইসলামকে ঘৃণা করে। মোদ্দা কথা, জিহাদি হত্যাযজ্ঞের ন্যায্যতা প্রমাণ করার জন্য একটা ”যুক্তি” বের করেন তাঁরা। এতে কাদের লাভ হয়? লাভ হয় জিহাদিদের। তারা যে ঠিক কাজ করছে, এ ব্যাপারে তাদের ধারণা আরও পোক্ত হয়। অগুনতি মুসলিম তরুণও জিহাদি দলে যোগ দেওয়ার প্রেরণা পায়।
মুসলিমরা কেন সন্ত্রাস করছে, কেন দেশে দেশে অমুসলিম বা ইসলামে – অবিশ্বাসীদের হত্যা করছে? যেহেতু কোনও এক কালে অমুসলিমরা মুসলিম-দেশগুলোকে উপনিবেশ করেছিল, যেহেতু ইসলামি খেলাফত ভেঙে দিয়েছিল, যেহেতু ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, যেহেতু ইরাকে বা আফগানিস্তানে বোমা ফেলেছিল। সব অন্যায়ের ফল এখন ভোগ করতে হবে। আবার তাঁরা এও বলেন, জিহাদি নাকি পাশ্চাত্যের সৃষ্টি, সন্ত্রাসী বাম দলগুলোও নাকি পাশ্চাত্যের সৃষ্টি, এমনকি মুসলিম সমাজে যে মুক্তচিন্তক জন্ম নিচ্ছেন, মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করার উদ্দেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মৌলবাদের বিরুদ্ধে বলছেন, ইসলামের সমালোচনা করছেন, তাঁরা নাকি মুক্তচিন্তক নন, তাঁরা নাকি যুক্তিবাদি নন, তাঁরা নাকি পশ্চিমা বিশ্বের ভাড়া করা লোক। এর মানে তাঁরা বিশ্বাস করেন খ্রিস্টান, ইহুদি, হিন্দু, বৌদ্ধ ধর্মীয় সমাজে মুক্তচিন্তক এবং যুক্তিবাদি জন্মাতে পারেন, কিন্তু মুসলিম সমাজে জন্মাতে পারেন না। তাঁরা, যা তাঁদের পছন্দ নয়, সব কিছুর ক্রীড়নক হিসেবে পশ্চিমা বিশ্বকেই চিহ্নিত করেন। এতে বিরাট যে সুবিধে, তা হল আত্মসমালোচনা করার প্রয়োজন হয় না।
তাঁরা মুসলিমদের ধর্মনিরপেক্ষ, আধুনিক, গণতন্ত্রে-বাকস্বাধীনতায় -সমানাধিকারে বিশ্বাসী করতে চান না। তাঁরা চান এভাবেই মুসলিম সমাজ অন্ধকারে পড়ে থাকুক, আর তরুণ তরুণী ধর্মান্ধ হতে থাকুক, আর সন্ত্রাস করতে থাকুক। তাঁদের কাজ মুসলিম দেশগুলোর যা কিছু খারাপ, দারিদ্র, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক দুরবস্থা, সবকিছুর জন্য তো বটেই, সন্ত্রাসীদের অপরাধের জন্যও, পাশ্চাত্যকে দায়ী করা।
ইহুদিরা যত অত্যাচারিত হয়েছে, তত আর কারা হয়েছে ইতিহাসে? ইহুদিরা কি কোনও এককালের নাৎসি ইউরোপে বোমা মেরে মেরে প্রতিশোধ নিচ্ছে? জরথুস্ট্রপন্থী বা পার্সিরা আজও কিছু অবশিষ্ট আছে, তারা কি মুসলিমরা তাদের অঞ্চল দখল করে নিয়েছে, বলে মুসলিমদের মুণ্ডু কাটছে? পাশ্চাত্যের ভুল তো আছেই, কিন্তু তারা ভুল করেছিল বলেই আমাদের ভুল করতে হবে? তারা অন্যায় করেছিল বলে আমাদের অন্যায় করতে হবে?
মুসলিম সমাজের সবচেয়ে বড় মুশকিল এই, যাঁদের কাজ মুসলিম সমাজকে মৌলবাদের আগ্রাসন থেকে মুক্ত করা, রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পৃথক করা, আইনকে সমানাধিকারভিত্তিক করা, নারীর অধিকার নিশ্চিত করা, সেই মুসলিম বুদ্ধিজীবীরাই, শিক্ষিত সচেতন লোকেরাই মুসলিম সমাজের কোনও পরিবর্তন চান না, তাঁরাই ছলে কৌশলে জিহাদিদের ঘৃণ্য কার্যকলাপকে যৌক্তিক বলে মনে করেন।
আত্মসমালোচনা না করলে কোনও মানুষ বড় হতে পারে না, কোনও সম্প্রদায় সভ্য হতে পারে না।
১৩. মৃত্যু
আমরা আসি, আমরা চলে যাই। যেখান থেকে আসি, সেখানেই চলে যাই। আমরা ‘কোথাও না’ থেকে আসি, ‘কোথাও না’ তে চলে যাই। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কাছে আমাদের থাকা না-থাকার কোনও মূল্য নেই। ৩৫০ কোটি বছর ধরে প্রাণের জন্ম হচ্ছে, সূর্য নিভে যাওয়ার আগ অবধি হয়তো হতেই থাকবে। হতে পারে তার আগেই প্রাণের বিলুপ্তি ঘটে যাবে। সব একযোগে ডায়নোসোরের মতো মরে যাবে। মৃত্যুই আমাদের শেষ ঠিকানা। সে এককভাবেই হোক, বা সম্মিলিত ভাবে হোক।
মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের সব কিছু, সারাটা জীবনের কাজ কম্ম, হাসি আনন্দ, দুঃখ শোক, সবকিছু ভিডিওগেমের মতো। কোথাও সুইচ টেপা হয়ে যায়, আর সব শেষ হয়ে যায়।
১৪. চরম দক্ষিণপন্থী
টুইটারে কিছুদিন ট্রাম্পের কীর্তিকলাপ নিয়ে লিখেছি, আর আক্রমণের শিকার হয়েছি। কে আক্রমণ করেছে আমাকে? আমেরিকার সাদা বর্ণবিদ্বেষী গোষ্ঠী? আমেরিকার চরম দক্ষিণপন্থী দল? না। আক্রমণটা এসেছে ভারতীয় হিন্দুদের কাছ থেকে। তারা ট্রাম্পের সমর্থক। ট্রাম্প তো সাংঘাতিক বর্ণবিদ্বেষী লোক, কালো আর বাদামী লোকদের ঘৃণা করেন! না, এতে তাদের কোনও আপত্তি নেই, ট্রাম্প মুসলিমদের ঘৃণা করেন, ট্রাম্প মুসলিমদের আমেরিকায় ঢুকতে দেবেন না, ট্রাম্প মুসলিমদের বারোটা বাজাবেন—এই কারণেই তারা ট্রাম্পকে ভালোবাসে, এই কারণেই তারা ট্রাম্প আবার জিতুন চায়। ট্রাম্প দক্ষিণপন্থী, তারাও দক্ষিণপন্থী, এই একখানা মিল আছে বটে। কিন্তু দুই দক্ষিণপন্থীতে আবার অমিলও প্রচুর। দক্ষিণপন্থী ক্রিশ্চান আবার দক্ষিণপন্থী অক্রিশ্চানদের, দক্ষিণপন্থী সাদা আবার দক্ষিণপন্থী কালোদের, দক্ষিণপন্থী ধনী আবার দক্ষিণপন্থী গরিবদের অতটা কাছের লোক বলে মনে করে না। সুতরাং অসাদা বাদামিগুলোকে ‘মুসলিম’ হিসেবে ভাবতে তাদের কোনও অসুবিধে হয় না। কিছু শিখ লোককে মুসলিম ভেবে ওরা তো গুলি করে মেরেই দিয়েছে। ত্বকের রঙ বাদামি হলে ‘মুসলিম’, মাথায় টুপি বা টারবান পরলে ‘মুসলিম’, ইমিগ্রেন্ট হলে ‘মুসলিম’। অস্পৃশ্যতার আরেক নাম এখন ‘মুসলিম’। তুমি মুসলিম নও বলে, তুমি হিন্দু বলে ট্রাম্প তোমাকে পছন্দ করবে, তা কিন্তু নয়। আজ ট্রাম্প মুসলিম-বিরোধী বলে তুমি ট্রাম্পকে ভালোবেসে ফেলেছো, এমনও হতে পারে মুসলিমদের ভোট পাওয়ার জন্য, বা অন্য কোনও স্বার্থে পার্টি থেকে আদেশ এলো, ট্রাম্পকে খুব মুসলিমপ্রীতি দেখাতে হবে, ব্যস ট্রাম্প তখন মুসলিম-বিরোধিতা বন্ধ করে দেবেন। রাজনৈতিক স্বার্থে হিন্দু-বিরোধীও হয়ে উঠতে পারেন, বলা যায় না। সুতরাং সাদা বর্ণবিদ্বেষী রাজনীতিকদের এত বুক ভরা ভালোবাসা না দান করাই ভালো। বুক ভরা ভালোবাসা বরং সৎ এবং নিঃস্বার্থ মানুষের জন্য রেখে দেওয়া উচিত।
১৫. উনি
উনি কাবাঘরে ঢুকে ৩৬০টি মূর্তি ভেঙেছিলেন। না ভেঙে উপায় ছিল? উনি তো উনির বিরোধীদের পেছন থেকে আক্রমণ করতেন, উনি তো শতশতকে কচুকাটা করার হিম্মত রাখতেন, গনিমতের মাল নিজে একা ভোগ করতেন না, বন্ধুদের মধ্যেও বণ্টন করতেন। উনির কানে তো শয়তান কথা বলে যেত, উনি এত সহজ সরল যে বুঝতে পারতেন না, ভাবতেন ফেরেস্তা। উনি তো ক্রীতদাসির সঙ্গে, শিশুর সঙ্গে, পুত্রধূর সঙ্গে ইয়ে করতেন। উনির কী দোষ, সবাই তো উনিকে চাইতো। মানুষের দুঃখে কেঁদে কেটে একবার তো ডানাওয়ালা ঘোড়ায় চড়ে সাত আসমানে পৌঁছে ৫০কে ৫ করে নিয়ে এলেন। সোজা ব্যাপার? ভাইয়েরা, উনি ছিলেন মহান। উনির মতো মহান হওয়া দুনিয়ার কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তাই বলি মহান হওয়ার চেষ্টা বাদ দিয়ে বরং মানুষ হও।
১৬. ট্রাম্পের কোভিড
ট্রাম্পের করোনাভাইরাস একটু দেরিতেই হল। আমি তো আশঙ্কা করেছিলাম আরও আগেই হবে। উনি মাস্ক পরবেন না, উনি কারও সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখবেন না। হোয়াইট হাউজের রোজ গার্ডেনে সেদিন পার্টি হল, প্রায় কেউই মাস্ক পরেননি। নির্বাচনী প্রচারণায় যাচ্ছেন, তিনি তো মাস্ক পরেনই না, তাঁর কাছের লোকদেরও মাস্ক পরতে দেন না। হোয়াইট হাউজের সাংবাদিক সম্মেলনে মাস্ক পরা সাংবাদিকদের কী হেনস্থাই না করেন। তাঁর মাস্ক বিরোধী প্রচারণার কারণেই তো গড়ে উঠেছে অ্যান্টি-মাস্কার দল, যারা মিছিল করে বেড়ায়, রাস্তায় রেস্তোরাঁয় মাস্ক না পরা লোকদের অভিনন্দন জানায় আর মাস্ক পরা লোকদের অপমান করে। ট্রাম্প তো করোনাভাইরাসকে প্রথম থেকেই গুরুত্ব দেননি। চীনা ভাইরাস বলে একে ডেকেছেন, চিকিৎসক না হয়েও মানুষকে করোনাভাইরাসের চিকিৎসা দিয়েছেন, হাইড্রক্সিক্লরোকুইন, এমনকি ডিজইনফেক্টেন্ট খেতে বলেছেন। বিশেষজ্ঞদের জানাতে হয়েছে হাড্রোক্সিক্লরোকুইন করোনাভাইরাস সারায় না, লাইজল কোম্পানী তড়িঘড়ি মানুষকে সতর্ক করে দিয়েছে, ভুলেও কেউ যেন ডিজইনফেক্টেন্ট লাইজল খাবার চেষ্টা না করে।
২ লক্ষ লোক মরে গেল, তারপরও ট্রাম্পের কোনও হেলদোল নেই। এত বড় ক্ষমতাবান দেশের ক্ষমতাবান প্রেসিডেন্ট, তাঁর তো উচিত ছিল গোটা বিশ্বকে মহামারীর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সবরকম চেষ্টা করা, মানুষকে ঘরে থাকা, মাস্ক পরা আর সামাজিক শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য অনুরোধ করা, উৎসাহ দেওয়া। তা নয়, তিনি তাঁর অজ্ঞতা, অশিক্ষা আর অহংকারের প্রদর্শনই করেছেন। ভাইরাসের অস্তিত্বকে অস্বীকার করলে তো ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়া যায় না। লড়তে গেলে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতে হবে, মানুষকে জানাতে হবে, এবং বিশেষজ্ঞদের উপদেশ মেনে সবরকম পদক্ষেপ করতে হবে।
শুধু তিনি নন, তাঁর স্ত্রী মেলানিয়া, সেনেটর মাইক লী, সেনেটর টম টিলিস, রিপাব্লিক্যান পার্টির ন্যাশনাল কমিটির চেয়ারপারসন রোনা ম্যাকডানিয়েল, হোয়াইট হাউজের তিনজন সাংবাদিক, উপদেষ্টা হোপ হিক্স, পুরোনো উপদেষ্টা কেলিয়ান কনওয়ে, নির্বাচনী প্রচারণা ম্যানেজার বিল স্টেপিয়েন সকলেই করোনায় আক্রান্ত। কে কাকে সংক্রামিত করেছে, তার কোনও হদিশ পাওয়া যাবে না।
ট্রাম্প বলেছিলেন যুব সমাজ কাজে যোগ দাও, আমরা বয়স্কদের দেখভাল করবো। বয়স্ক তো তিনিও, সম্ভবত ভুলেই গিয়েছিলেন। প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী এবং প্রচণ্ড বিত্তশালীর আশেপাশে করোনা ভাইরাস উঁকি দিতেও পারবে না, এরকম একটা বিশ্বাস বোধহয় ওঁদের মধ্যে কাজ করে। বিলিওনিয়ার এলোন মাস্কও করোনা ভাইরাসকে মোটেও আমল দেননি।
হোয়াইট হাউজের ভেতরেই চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকে, কিন্তু হাসপাতালে যাওয়া মানে ট্রাম্পের অবস্থা যতটা ভালো তিনি বলছেন, ততটা ভালো নয়। বেঁচে যদি যান এ যাত্রা, ভালো। আমি চরম শত্রুরও মৃত্যু কামনা করি না। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন যেমন হাসপাতালে ক’দিন ভুগে ফিরেছিলেন, হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন কোভিড-১৯ কী জিনিস। তেমন ট্রাম্পও ক’দিন ভুগে ফিরুন। হাড়ে হাড়ে তিনিও টের পান কোভিড-১৯ কী জিনিস। এরপর যদি তিনি ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার আনায়, করোনার টিকা বানানো ত্বরান্বিত করায়, বিশ্বের সকলকে বিনামূল্যে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করায়, নিজের দম্ভ কমানোয় মন দেন ভালো। প্রচুর কাজ, করতে চাইলেই করা যায়। অবশ্য আসছে নির্বাচনে তাঁর জেতার সম্ভাবনা খুবই কম।
১৭. শরীর
বাংলাদেশের একটি খবর, একটি ভিডিও এখন দাবানলের মতো ছড়িয়ে গেছে চারদিকে। ”এক মেয়েকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করেছে কিছু পুরুষ”। কেন খবরটি ভাইরাল হল? ওই ‘বিবস্ত্র’ শব্দটির জন্য। স্বামীকে বেঁধে রেখে নির্যাতন করেছে ওরা। কেউ কেউ বলছে ধর্ষণ করতে চেয়েছিল, সম্ভব না হওয়ায় বিবস্ত্র করেছে। বিবস্ত্র করার ভিডিও করেছে ওরা, ফেসবুকে ভিডিও আপ্লোড করবে বলে। মেয়েটির শরীর শুধু ওরা নয়, আরও হাজার লোকে দেখবে, এর চেয়ে বড় শাস্তি একটি মেয়ের জন্য ওরা মনে করে না আর কিছু আছে।
যদি একটি পুরুষকে বিবস্ত্র করে অত্যাচার করা হত, তাহলে কি খবরটা এমন ছড়াতো? মানুষ তখন পুরুষকে মারধর করার বিরুদ্ধে কিছু হয়তো বলতো, বিবস্ত্র করার বিরুদ্ধে নয়। পুরুষ বিবস্ত্র হলে ঘটনা ভয়ানক নয়, মেয়ে বিবস্ত্র হলে ঘটনা ভয়ানক। দুটোই শরীর। দুটো শরীরে শুধু যৌনাঙ্গগুলো ভিন্ন। তাহলে এক যৌনাঙ্গ প্রকাশ হলে ক্ষতি নেই, আরেক যৌনাঙ্গ প্রকাশ হলে ক্ষতি কেন?
যদি খবরটি এমন হত—’একটি মেয়েকে নির্যাতন করেছে কিছু পুরুষ’, তাহলে কারও কিছু যেত আসতো না। বিবস্ত্র শব্দটি শুনে লোকে লাফিয়ে উঠেছে। কী, এত বড় স্পর্ধা, বিবস্ত্র করেছে! তার মানে মেয়েটির বুক মুখ পেট পিঠ হাত পা এমন কী যৌনাঙ্গ পর্যন্ত দেখে ফেলেছে! কী সর্বনাশ।
মেয়েরা তো শুধু স্বামীর সম্পত্তি নয়, মেয়েরা সমস্ত পুরুষের সম্পত্তি। সে কারণেই সব পুরুষই মেয়েদের শরীর নিয়ে চিন্তিত, এই শরীর আবার কেউ না দেখে ফেলে! সে কারণেই তো মেয়েরা কী পোশাক পরবে, তা পুরুষেরাই নির্ধারণ করে। বিবস্ত্র না করে নির্যাতন করলে সেটিকে অন্যায় বলে মনে করা হত না। বিবস্ত্র না করে জবাই করে ফেললেও মানুষ এতটা ক্ষিপ্ত হতো না, যতটা বিবস্ত্র করায় ক্ষিপ্ত।
মেয়েকে বিবস্ত্র করাটা লোকের কাছে বড় নির্যাতন মনে হয়েছে, ওই চড় লাথি, লাঠির মারের চেয়ে। কারণ মানুষ বিশ্বাস করে, মেয়েরা আস্ত একখানা ‘শরীর’ ছাড়া কিছু নয়। যেহেতু মেয়েরা শুধুই ‘শরীর’, তাই শরীরের সবকিছু, বুক মুখ পেট পিঠ, ঢেকে রাখতে হবে। ঢেকে রাখতে হবে, কারণ ওগুলো মেয়েটির হলেও মেয়েটির নয়, ওগুলো মেয়েটির মালিক অর্থাৎ স্বামীর খাদ্য, ওই খাদ্যে মালিক ছাড়া কারও নজর পড়লে খাদ্য খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে।
যে মানসিকতা মেয়েদের বোরখায় ঢেকে রাখে, মেয়েদের বিবস্ত্র করাকে অন্যায় বলে বিচার করে, কারণ মেয়েরা তো শুধুই ‘শরীর’, তার শরীর উলঙ্গ হয়ে গেলে তার আর কিছুই থাকে না—এই একই মানসিকতা কিন্তু বলে মেয়েদের বিবস্ত্র করা যাবে, ধর্ষণ করা যাবে, কারণ মেয়েরা তো শুধুই ‘শরীর’।
১৮. বাপের জাত
আমেরিকার পেন্সিলেনিয়ার এক ফুটবল কোচ, ব্ল্যাক ডায়মণ্ড কন্সট্রাকশান কোম্পানীর মালিক অস্টিন স্টিভেন্স তার ১০ মাস বয়সী শিশুকন্যাকে প্রচণ্ড ধর্ষণ করেছে। ২৯ বছর বয়সী পিতার ওই ধর্ষণ সওয়ার মতো শরীরের জোর ছিল না শিশুটির। প্রচুর রক্তপাত ঘটেছে, শিশুটির মৃত্যু হয়েছে। তখন কী করেছে অস্টিন? অস্টিন গুগলে উত্তর খুঁজেছে এসবের—”শিশু যদি শ্বাস না নেয়”, ”যদি শিশুর হৃদপিণ্ডের শব্দ না শুনি”, ”শিশু মরে গেছে কি না বুঝবো কী করে”। দুটো মহিলার সঙ্গে তখন চ্যাটও করেছে।
বাপের জাতকে কী করে বিশ্বাস করবে মানুষ! বাপের জাতকে কী করে শ্রদ্ধা করবে মানুষ! প্রাণীজগতে মেয়েরাই বোধহয় একমাত্র প্রাণী যারা তাদের শত্রুর সঙ্গে, তাদের ধর্ষক এবং খুনীর সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে বাস করে, এক ঘরে, এক পাড়ায়, এক সমাজে!
১৯. শত্রু নেই
বড় কিছু বাঙালি লেখক সম্পর্কে খুব গর্ব করে বলা হয় তাঁদের কোনও শত্রু নেই। শুনে আঁতকে উঠি আমি। শত্রু নেই, তাহলে কেমন লেখক তাঁরা, কী লেখেন যে শত্রু তৈরি হয়নি? তাঁরা এমন লেখা লেখেন, যে লেখা পড়ে সবাই খুশি থাকে। বামপন্থী ডানপন্থী কট্টরপন্থী নরমপন্থী সকলেই খুশি, ধনী গরিব নারীবিদ্বেষী নারীবাদী সকলেই খুশি, কেউ লেখার কোনও বিষয়ে আপত্তি করে না, মন খারাপ করে না, রুখে ওঠে না। কারণ আপত্তি করার, মন খারাপ করার বা রুখে ওঠার কিছু থাকে না তাঁদের লেখায়।
আমার ভয় হয় এমন লেখকের নাম শুনলেই। এই লেখকেরা এক নষ্ট সমাজে বাস করছেন, কিন্তু নষ্ট সমাজের নিন্দে করেননা, করলে নষ্ট সমাজের হর্তাকর্তারা তাঁদের পছন্দ করবেন না তাই। এই লেখকেরা বৈষম্যের মধ্যে বাস করেন, কিন্তু বৈষম্যের প্রতিবাদ করেননা, প্রতিবাদ করলে শত্রু তৈরি হবে, বৈষম্যে বিশ্বাস করা মানুষ তাঁদের ঘৃণা করবে এই ভয়ে। এই লেখকেরা বিস্তর জাতীয় পুরস্কার পান, বড় বড় সাহিত্য সভায় সভাপতিত্ব করেন, পুরু পুরু ফুলের মালা পরেন গলায়, উদ্বোধনের ফিতে কাটেন, প্রকাশকেরা এই লেখকদের রচনাবলী প্রকাশ করেন। এই লেখকেরা নিষিদ্ধ হন না, বরং বিক্রি হন ভালো।
২০. কন্যা দিবস
কত কিছুর দিবস যে পালিত হচ্ছে। শুনলাম কাল নাকি ‘কন্যা দিবস’ ছিল। জানিনা পুত্র দিবস বলে কোনও দিবস আছে কিনা। আসলে পুত্র দিবস তো প্রায় প্রতিদিনই পালিত হয়। কন্যা যেহেতু অনেক সংসারেই অবহেলিত, তাই কন্যাকে মূল্য দেওয়ার জন্য, আমার ধারণা, একটি দিবস তৈরি করা হয়েছে। আমার কন্যাও নেই, পুত্রও নেই। যৌবনে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিলেও সন্তান না জন্ম দেওয়ার সিদ্ধান্তটি আমার সঠিক ছিল। ৭৮০ কোটি লোকে পৃথিবী উপচে পড়ছে, এই দুঃসময়ে জনসংখ্যা বাড়ানোর কোনও প্রয়োজন নেই। যারা জন্মেছে তারা কি সবাই খেতে পরতে পাচ্ছে, শিক্ষা স্বাস্থ্য পাচ্ছে?
ইতর প্রাণীর মধ্যে বংশ বিস্তারের ইচ্ছেটা কিলবিল করে, এই কিলবিল ব্যাপারটি নিয়ন্ত্রণ করতে তারা পারেনা। মানুষের মধ্যেও এই ইচ্ছেটি আছে, তবে এটি আরোপিত। আরোপিত বলেই এটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। অনেকে সন্তান জন্ম দেওয়ার ইচ্ছে নেই বলে সন্তান জন্ম দেয় না। কিছু মানুষ, আমার অবাক লাগে, মনে করে সন্তান জন্ম না দিলে তাদের জীবনই ব্যর্থ, অর্থহীন। তারা সন্তানের জন্য ইতর প্রাণীদের মতো কিলবিল করা ইচ্ছের আমদানি করে। আমার এক বোন উচ্চশিক্ষিতা, নামী কলেজের অধ্যাপিকা, কিন্তু সন্তান নেই বলে এমনই দুঃখে কষ্টে ডুবে থাকে যে তার জীবনটিই সে উপভোগ করে না। তার এমন অর্থপূর্ণ জীবনটিকে সে যে অর্থহীন মনে করছে, এ দোষ কার বা কাদের? তার কানের কাছে যারা শৈশব থেকে গুনগুন করেছে সন্তান না জন্মালে জীবনের কোনও মানে নেই, দোষ নিশ্চয়ই তাদের অনেকটা, বাকি দোষ তাদেরও যারা যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে নারীবিদ্বেষী রীতিগুলোকে ভাঙার কোনও চেষ্টা করে না।
প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যদি প্রজননের প্রয়োজন পড়তো, কথা ছিল। এখন তো দেখা যাচ্ছে মানুষের আধিক্য একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। লক্ষ কোটি অরণ্য-নির্ভর প্রাণীর আবাসস্থল উড়িয়ে দিয়ে মানুষের জন্য শহর নগর বানাতে হয়েছে। পৃথিবীর কত প্রজাতি যে আমাদের মানুষ-প্রজাতির হিংস্রতা আর বোধবুদ্ধিহীনতার কারণে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই গ্রহে আমাদের যতটা অধিকার, ততটা অধিকার তো তাদেরও। অস্ত্রের জোরে কী অরাজকতাই না আমরা চালিয়েছি! আমরা পৃথিবীর বন জঙ্গল ধ্বংস করেছি, নদী সমুদ্র আকাশ বাতাস দূষিত করেছি আমাদের স্বার্থান্ধ জীবন যাপন এবং আমাদের অর্থহীন জনসংখ্যা দিয়ে। অনেকে মনে করেন, জ্ঞানীগুণীদের সন্তান জন্ম দেওয়া উচিত। কিন্তু বারবার প্রমাণিত হয়েছে, জ্ঞানীগুণীদের সন্তান জ্ঞানীগুণী হয় না। আর কত প্রমাণ দরকার! মৃত্যুতেই জীবনের চিরকালীন সমাপ্তি। বংশ রয়ে গিয়ে, রক্তের ছিটেফোঁটা রয়ে গিয়ে কারও কোনও লাভ হয় না।
আজ এতকাল পরও নিজেকে আরেকবার ধন্যবাদ দিই, না পুত্র না কন্যা কিছুই জন্ম না দিয়ে আমি একটি স্বাধীন এবং অর্থপূর্ণ জীবনযাপন করেছি বলে। তুমি সন্তান জন্ম দিয়ে জীবনকে অর্থপূর্ণ করার চেষ্টা কোরো না। তুমি তোমার কাজ দিয়ে জীবনকে অর্থপূর্ণ করো। তুমি কে, তুমি কী সেটাই বড়। সন্তান যে কেউ জন্ম দিতে পারে, যে কোনও গণ্ডমূর্খই, এ কোনও উল্লেখযোগ্য ব্যাপার নয়।
২ ১. শার্লি আবদো
ফ্রান্সের শার্লি আবদো কার্টুন ম্যাগাজিনের কথা মনে আছে? পয়গম্বরের কার্টুন ছাপিয়েছিল বলে পয়গম্বরের এক পাল সশস্ত্র সন্ত্রাসী অনুসারী ম্যাগাজিনের অফিসে ঢুকে যাকে পেয়েছে তাকেই খুন করে এসেছে! সেই ম্যাগাজিন মহাসমারোহে বাকস্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করছে, এই উপলক্ষে বিশাল একখানা সংকলন ছাপিয়েছে, এতে যে প্রবন্ধ নিবন্ধ জায়গা পেয়েছে, তার মধ্যে আমার একখানা নিবন্ধ আছে। আজ সকালে শার্লি আবদোর এই উপহারটি পেয়ে আমার আনন্দে নাচলো মন। বাকস্বাধীনতার জন্য চল্লিশ বছর লড়ছি। বাংলা আমাকে স্বীকৃতি কোথায় দেবে, বরং আবর্জনায় ছুঁড়ে ফেলেছে। দূরের কোনও দেশে যাঁরা বাকস্বাধীনতার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তো বটেই এমনকি জীবন বিসর্জন দিয়ে লড়াই করছেন, স্বীকৃতি তাঁদের কাছ থেকেই এলো।
২২. কমপ্লেইন
কমপ্লেইনের শেষ নেই। ইসলাম নিয়ে লিখলে হিন্দু ধর্ম নিয়ে লেখো না কেন। হিন্দু ধর্ম নিয়ে লিখলে ইসলাম নিয়ে লেখো না কেন। ইউরোপ নিয়ে লিখলে আফ্রিকা নিয়ে লেখো না কেন। ইলিশ নিয়ে লিখলে উমর খালিদ নিয়ে লেখো না কেন। নারীর সমস্যা নিয়ে লিখলে পেঁয়াজের দাম নিয়ে লেখো না কেন। কমপ্লেইন চলছেই। যেন আমাকেই দুনিয়ার সব সমস্যা নিয়ে লিখতে হবে। যখন ক সমস্যা নিয়ে লিখেছি, আমাকে খ সমস্যা, গ সমস্যা থেকে শুরু করে চন্দ্রবিন্দু সমস্যা পর্যন্ত লিখতেই হবে, তা না হলে আমি ভালো লোক নই। আমি জানি সবাইকে খুশি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আসলে কাউকে খুশি করতে আমি লেখালেখি করি না।
বাপু, তোমরা লেখো তোমাদের মনে যা উদয় হয় সেইসব নিয়ে। আমি চল্লিশ বছরের বেশি হল লিখছি। বইও চল্লিশটার ওপরে। আমার জ্ঞান বুদ্ধিতে যতটা কুলোয় ততটাই তো লিখবো। ছোট একখানা মস্তিষ্কে আর কত বিষয় ধরে!
২৩. ঘরকন্না
সাত মাস আমি ঘরের বার হচ্ছি না, ঘরে কাউকে ঢুকতেও দিচ্ছি না। সংসারের সমস্ত কাজ একা হাতে করছি। কী করে পারছি? পারছি কারণ এক যুগ আমি ইউরোপে ছিলাম। ইউরোপে বাস করার সুফল এটাই, কোনও কিছুর জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করার দরকার হয় না। একাই সব কাজ এমনকি নোংরা কাজ বলে যে কাজগুলোকে ভাবা হয়, যেমন টয়লেট পরিষ্কার, ডাস্টবিন পরিষ্কার, বেড়াল কুকুরের গু-মুত পরিষ্কার, কোনওরকম নাক না সিঁটকে করে ফেলা যায়। ঘর ঝাড়ু দাও ঘর মোছো বাসন মাজো কাপড় কাচো—কিছুতে তো অনীহা নেই। একবারও তো মনে হয় না, এই কাজগুলো গরিব লোকের কাজ, আমাদের কাজ খাটে বসে বা সোফায় বসে আরাম করা? এই যে গরিব লোকদের মানুষ বলে মনে করা, তাদের সমীহ করে কথা বলা, তাদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে খাওয়া, এটি আমার মনে হয় না ইউরোপে দীর্ঘকাল না কাটালে সম্ভব হত। সমতার সমাজে বাস করলে সমতা অনুশীলন করতে হয়, ওই করতে করতেই একসময় চরিত্রে গেঁথে যায় সমতার বোধ। শুধু বই পড়ে, সমতা সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করেই সমতার জীবনযাপন করা যায় না। সমতার দিশি পণ্ডিতদের দেখেছি গরিবদের তুই তোকারি করতে, চাকরবাকরদের সঙ্গে ঘেউ ঘেউ করতে।
বাঙালি পুরুষ যারা কোনওদিন রান্নাঘরে ঢোকেনি, কী চমৎকার এক একজন রাঁধুনী বনে যায় বিদেশে গিয়ে। দেশে বাস করলে তারা লজ্জা পায় রান্না করতে, কারণ রান্না তো মেয়েদের কাজ, ছোটলোকদের কাজ! কিন্তু বিদেশ-জীবনে তারা গর্ব করে বলে তারা কী কী রান্না জানে, তারাও ঘরবাড়ি পয় পরিষ্কার করাটা লজ্জার বলে মনে করে না।
ইউরোপ কতদিন তাদের আদর্শ সমাজ টিকিয়ে রাখতে পারবে জানি না। তবে ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়েও যতটুকুই গড়েছে ওরা, তারই স্পর্শে আমাদের চরম বৈষম্যে ঠাসা নষ্ট ভ্রষ্ট পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মানুষগুলো সবটা না হলেও কিছুটা মানুষ তো হয়েছে। কিছুটা উপকৃত তো আমিও হয়েছি।
২৪. চক্ষু কর্ণ হীন বোধ হীন বিবেক হীন
আদিবাসী একটি মেয়েকে ৯ জন বাঙালি পুরুষ ধর্ষণ করেছে। শুনে কি আমি অবাক হয়েছি? মোটেও না। আমি অবাক হব যেদিন শুনবো বাংলাদেশে পুরুষেরা আর ধর্ষণ করে না। এদের পবিত্র গ্রন্থই যখন বলে স্ত্রীকে ধর্ষণ বৈধ, দাসিকে ধর্ষণ বৈধ; এরা যে সমাজ তৈরি করেছে, সেই সমাজই যখন বলে পতিতালয় নামের বাড়িতে অসহায় মেয়েদের ধর্ষণ করা বৈধ; এরা শৈশব পার করেই যখন শোনে দরিদ্র অনেক মেয়ের নাম বেশ্যা, যাদের এরা যখন খুশি ধর্ষণ করতে পারে, কারণ বেশ্যাদের ধর্ষণ করা বৈধ—তাহলে রাস্তাঘাটে কোনও মেয়ে দেখলে কেন এদের মনে হবে না এটিকেও ধর্ষণ করা বৈধ, এটিরও আছে বেশ্যাদের মতো নাক চোখ মুখ বুক পেট যৌনাঙ্গ?
আসলে এদের সব মেয়েকেই ধর্ষণের যোগ্য বলে মনে হয়। স্ত্রীকে তো বটেই, বোন, কন্যা, বৌদি, মা, মামী, কাকী, নাতনি, পুত্রবধূ কাকে ছেড়েছে এরা? এরা তো পুরুষ নয়, এরা পুরুষাঙ্গ। এরা স্বর্গে গিয়েও ধর্ষণ করবে, সে রকমই টোপ দেওয়া হয়েছে এদের। তাই শর্টকাট স্বর্গে গিয়ে ধর্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়তে এরা খুনখারাবি পর্যন্ত করতে দ্বিধা করছে না। যদি কোনও পুরুষ ধর্ষণ থেকে বিরত রাখে নিজেকে, সে রাখে আইনে ফেঁসে যাবে বা লোকে পেটাবে— এই ভয়ে। আজ এমন আইন হোক, যে আইনে পুরুষেরা যা খুশি করুক শাস্তি পাবে না, তাহলে দেখবে বিশ্ব একটি পুরুষও ধর্ষণ না করে একটি দিনও বসে থাকবে না।
আমাদের দুঃখ এই, আমরা সংখ্যাগুরু হই, সংখ্যালঘু হই আমরা কেউ নিরাপদ নই। কারণ আমরা বাস করি চক্ষুকর্ণহীনবোধহীনবিবেকহীণ লক্ষকোটি পুরুষাঙ্গের সঙ্গে।
২৫. কুকুর
চারটে কুকুরকে করোনা ভাইরাস শনাক্ত করার প্রশিক্ষিণ দেওয়া হয়েছে। শুধু শুঁকেই বলে দিতে পারবে শরীরে করোনা ভাইরাস আছে কী নেই। ফিনল্যান্ডের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এখন কুকুরেরা করোনায় আক্রান্ত যাত্রীদের শনাক্ত করার কাজে ব্যস্ত। বোমা, মাদক দ্রব্য, নানারকম রাসায়নিক পদার্থ এভাবেই তো শনাক্ত করে কুকুর। হারিয়ে যাওয়া মানুষের ব্যবহৃত কিছু একটা শুঁকিয়ে দাও, সে মানুষটিকে মুল্লুক খুঁজে বের করবে। সাধারণ একজন মানুষের ঘ্রাণশক্তি যত, তার চেয়ে কুকুরের ঘ্রাণশক্তি ১০ হাজার থেকে ১ লাখ গুণ বেশি। ২০ কিলোমিটার দূরের জিনিসের গন্ধ পায় কুকুর। মানুষকে কুকুরেরা বারো হাজার বছর আগে সাহায্য করা শুরু করেছে, এখনও করছে। ফারাও-এর আমলে মিশরে কুকুরকে দেবতা মানা হত। কুকুরের মন্দির ছিল। লক্ষ লক্ষ কুকুরের মমী পাওয়া গেছে মিশরের কবরখানায়। আমরা কুকুরকে দেবতা না মানি, কুকুরকে তো তার প্রাপ্য ভালোবাসা দিতে পারি। তা কেন করবো, বিশ্বস্ত এই প্রাণীটির নাম আমরা গালি হিসেবে ব্যবহার করি। কুকুর নিশ্চয়ই জানে, মানুষের মতো এত নিকৃষ্ট এ জগতে আর কোনও প্রাণী নেই।
২৬. আল্লামা
বাংলাদেশে একটা আল্লামা মরছে, মনে হইতাছে আল্লাহ মরছে। এলাহি কাণ্ড শুরু হইয়া গেছে। জানাজায় ১০ প্লাটুন পুলিশ দিতাছে সরকার। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী তো আছেই বেবাক মন্ত্রী আমলা কান্দাকাটি শুরু করছে। আল্লামার বয়স হইছিল ১০৪। অথচ ডায়বেটিস হাইপারটেনশান সব ছিল। এত রোগ থাকতে বাঁচে কেমনে এত বছর? ওইসব রোগ মানুষের থাকলে আয়ু অর্ধেক কইমা যায়। তার কেন বাড়লো? মানুষকে রোগশোকে পল্যুটেড পড়াপানি খাওয়াইলেও সে নিজের অসুখবিসুখ সারাইতে বিদেশের বড় বড় ডাক্তারের কাছে বড় বড় হাসপাতালে উইড়া উইড়া গেছে। ভালো ট্রিটমেন্ট পাইছে তাই বাঁচছে। এখন তো মরছে, আপদ বিদায় হইছে। কিন্তু এলাহি কাণ্ড কেন? কার জন্য? ওই লোক কী ভালো কাজটা করছে জীবনে? মৌলিবাদী তৈরির কারখানা মাদ্রাসা বানাইসে, যেই মাদ্রাসায় মগজধোলাই কইরা দেশের ভবিষ্যতের সর্বনাশ করা হয়। আর কী করছে? যে আল্লাহ বিশ্বাস করে না তারে মাইরা ফেলার কথা কইছে। মানুষরে খুনী সন্ত্রাসী হওয়ার ইন্ধন জুগাইছে। আর? মেয়েদের ফাইভ ক্লাসের বেশি পড়তে না করছে, স্বামীর বান্দিগিরি কইরা জীবন পার করতে কইছে আর এক পা ঘরের বাইর হইলে বোরখায় আপাদমস্তক ঢাকতে কইছে কারণ মেয়েরা নাকি তেঁতুল, খোলা থাকলে পুরুষলোকের লালা ঝরবে, খালি খাইতে ইচ্ছা করবে। বড় মাপের নারীবিদ্বেষী, সমাজ-ধ্বংসকারী কুলাঙ্গারের জন্য হাহাকার করতাছে দেশের লক্ষ লক্ষ ছোট মাপের নারীবিদ্বেষী, সমাজ-ধ্বংসকারী কুলাঙ্গাররা। আল্লামার দেখাইয়া দেওয়া পথে হাঁটবে তারা। মেয়েদের তেঁতুল মনে কইরা চাটবে, খাবে। মেয়েদেরে কীভাবে ভোগের বস্তু, চাকরবাকর আর ইতর জাতীয় নোংরা কিছু ভাবতে হবে, এবং ঘৃণা করতে হবে তা ব্যাটা সুন্দর কইরা গুছাইয়া শিখাইয়া দিয়া গেছে পুরুষজাতরে। এই শিক্ষকরে হারাইয়া পুরা দেশবাসী চোখের পানি ফেলবে, কানবে, চিল্লাইয়া কানবে—এ তো নিউ নরমাল।
২৭. বাড়ি
আমাদের বাড়ি ছিল সেক্যুলার বাড়ি। শিল্প সাহিত্যের বাড়ি। সেই বাড়ি এখন কট্টর মুসলমানের বাড়ি। হাদিস কোরানের বাড়ি। আমার বড় মামা পাঁড় নাস্তিক তো ছিলেনই, নামী কমিউনিস্ট ছিলেন। তাঁর ছেলেমেয়েরা সবাই ধার্মিক। কেউ কেউ তো পাঁচ বেলা নামাজ পড়ে, বোরখা পরে। কেউ হজ্বে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। আমার এক মামা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ধর্ম কর্মের ধার ধারতেন না। তাঁর সবকটা কন্যা শুধু বোরখা নয়, নিকাব, হাতমোজা, পা-মোজা সবই পরে। আমার বাকি মামারাও বদলে গেছে আমূল। যাদের সঙ্গে শৈশব কেটেছে, তারা আমার নাম উচ্চারণ করাও মনে করে পাপ।
আমার কোনও সন্তান নেই। কিন্তু পরিবারে নতুন জেনারেশন বেশ আছে। আমার বড় দাদার দুই ছেলে। ছোট দাদার এক ছেলে এক মেয়ে। আর আমার বোনের এক মেয়ে। এরা কেউ কি আমার লেখা পড়ে? জানে আমি কী লিখি? না। জানার একফোঁটা আগ্রহ নেই কারো।
আমার লেখা আমার বাবা মা, আমার দাদারা পড়তো। কেউ নেই এখন। বোন পড়ে লেখা। তাছাড়া আত্মীয়স্বজনের বাইরের মানুষই পড়ে। তাদের অনেকে আমাকে জানে, বোঝে। তারাই আমার আপন।
২৮. জিন্নাহ
জিন্নাহ বিয়ে করেছিলেন একজন অমুসলিমকে। জিন্নাহর একমাত্র সন্তান দিনাও বিয়ে করেছিলেন এক অমুসলিমকে। দিনা তো ভারত ছেড়ে পাকিস্তানেই যাননি। জিন্নাহর নাতি নাতনি কেউই মুসলমান নয়, নাতি নাতনিদের বংশধরও কেউ মুসলমান নয়। জিন্নাহ নামাজ রোজা করতেন না, সম্ভবত নাস্তিক ছিলেন, অথচ ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করেছিলেন এত বড় দেশটাকে। অবশ্য একা তো ভাগ করা যায় না, নেহরুর ষোলো আনা না হলেও এগারো আনা সম্মতি ছিল। জিন্নাহ যদি দেখতে পেতেন কী হাল হয়েছে তাঁর বানানো দেশটার, নিশ্চয়ই গভীর অনুশোচনা করতেন। দেশ ভাগের পর তো ঠিকই বুঝেছিলেন দ্বিজাতিতত্ত্ব ভুল তত্ত্ব, তাই এর বিপক্ষে জনতাকে দাঁড়াতে বলেছিলেন। পাকিস্তানের হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান সবাইকে এক জাতি হিসেবে এক দেশে শান্তি, সম্প্রীতি, সৌহার্দ বজায় রেখে বাস করার আহবান জানিয়েছিলেন।
জিন্নাহ যদি দেখতে পেতেন, কী দেখতেন আজ? দেশ ফের ভাগ হয়েছে দেখতেন। ধর্মবাদ, মৌলবাদ, সন্ত্রাসবাদে ছেয়ে গেছে দেশের দুটো অংশ দেখতেন। অনুশোচনা তো করতেনই।
বোম্বের মালাবার হিলে তাঁর কী সুন্দর বাড়িটিই না তিনি ছেড়ে গিয়েছিলেন! বাড়িটি তো তাঁর একমাত্র উত্তরাধিকারী দিনাও নেননি। ‘জিন্নাহ হাউজ’কে ‘জিন্নাহ মিউজিয়াম’ বানানো যায় না? যে মিউজিয়ামে থাকবে দেশভাগের ভুল সিদ্ধান্তের নথিপত্র, ধর্মান্ধতা থেকে বাঁচাবার বদলে দূরদৃষ্টিহীন রাজনীতিকরা উপমহাদেশকে ধর্মান্ধতার নরককুণ্ড বানাবার যে নীল নকশা এঁকেছিলেন সেই নীল নকশা, হিন্দু মুসলমান পরস্পরকে যেন চিরকালীন শত্রু ভাবতে পারে সেই বন্দোবস্তটি যে মস্তিষ্ক থেকে এসেছিল সেই মস্তিষ্কটি। ভুক্তভোগীরা দেখতে যাবো সেসব! শুনেছিলাম ইতিহাস থেকে মানুষ শিক্ষা নেয়। শিক্ষা কি আদৌ নেয়? নাকি একই ভুল বারবার করে!
২৯. বোরখা
বোরখা নারীনির্যাতনের একটি প্রতীক। কিন্তু একদা সেক্যুলার বাংলাদেশের ভয়াবহ বাস্তবতা এই যে অধিকাংশ মেয়ে মগজধোলাই হয়ে হোক, পারিবারিক চাপে হোক, সামাজিক চাপে হোক হিজাব বা বোরখা পরে। এখন কী করা উচিত মেয়েদের? গৃহবধূ হয়ে যাও, স্বামী সন্তানের সেবা করো আর পরকালে জান্নাতবাসী হওয়ার জন্য আল্লাহর দরবারে মাথা ঠুকতে থাকো? জান্নাতে বসে অসংখ্য হুরের সঙ্গে স্বামীর দিবারাত্তির সঙ্গম দেখতে দেখতে নিজের বুড়ো আঙুল চুষতে হবে অনন্তকাল। না, ওইপারে মেয়েদের জন্য কোনও লোভনীয় জীবন অপেক্ষা করে নেই। ইহজগতই তাদের ভরসা। খাঁচা থেকে মেয়েদের বেরিয়ে আসতে হবে। হিজাব বোরখা পরো বা না পরো, শেকল ছিঁড়তে হবে পায়ের। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে, স্বাবলম্বী হতে হবে, স্বাধীনতা উপভোগ করতে হবে, অধিকার ছিনিয়ে নিতে হবে। এই না করলে মেয়েদের ওকূল তো গেছে, একূলও যাবে।
৩০. বাংলা
মাঝে মাঝে মনে হয় আমার চেয়ে বেশি বাংলাকে কেউ ভালোবাসে না। বাংলাকে ভালোবেসে আমি ইউরোপ-আমেরিকা ত্যাগ করেছিলাম। এমন নয় যে ইউরোপ-আমেরিকায় আমি নিতান্তই এক নোবডি ছিলাম। তখন আমার বই ছাপাচ্ছে ইউরোপ আমেরিকার বড় বড় প্রকাশনী। তখন আমার দু’কথা শোনার জন্য লোকে টিকিট কেটে সেমিনারে যায়। তখন আমি খবরের কাগজের প্রথম পাতায়। তখন আমি নিরাপত্তা প্রহরী বেষ্টিত। এমন সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমাকে যেহেতু বাংলাদেশে ফিরতে দেওয়া হচ্ছে না, আমি পশ্চিম বঙ্গে বাস করবো। আমার সিদ্ধান্ত হয়তো ভুল ছিল, সিদ্ধান্তে আবেগ ছিল শতকরা নিরানব্বই ভাগ, আর যুক্তি ছিল এক ভাগ—সে আমি জানি। কিন্তু যে করেই হোক, আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করেছি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একখানা ফেলোশিপ পেয়েছিলাম, সেটি শেষ করেই, ইউরোপ-আমেরিকাকে গুডবাই বলে আমি কলকাতায় বাস করতে শুরু করেছি। তখন, আশ্চর্য, যে বাঙালিরা আমার মাঝে মাঝে এসে কলকাতায় সপ্তাহ দু’সপ্তাহ থাকায় উচ্ছ্বসিত ছিল, তাদের অনেকে আর উচ্ছ্বসিত নয়। আমি তখন আর আকর্ষণীয় কিছু নই। আমি তখন তাদের মতোই গড়িয়াহাটে বাজার করা, তাদের মতোই কলেজ স্ট্রিটে হাঁটা, বা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়া পাশের বাড়ির কেউ। আমি তো পাশের বাড়ির কেউই হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে এড়িয়ে চলা তো চাইনি, আমাকে একঘরে করা তো চাইনি। বাংলাকে ভালোবেসে কলকাতায় এসে বাস করাটা অনেকের কাছে বোকামো মনে হয়েছে। ঘরবাড়ি ছিল প্যারিসে, প্যারিস থেকে হার্ভার্ডে গিয়ে ফেলোশিপ করছি, এ শুনে আমার কাছে আসতে যাদের আনন্দ হত, তাদের অনেকের আনন্দই দেখেছি নিভে গেছে যখন আমি তাদের মতো কেউ হয়ে গেলাম। আমার জনপ্রিয়তা রাতারাতি কমে গেল। তাই বলে বাংলা এবং বাংলা ভাষা থেকে আমার ভালোবাসা কিন্তু উবে যায়নি। আমি আরও আঁকড়ে রইলাম বাংলাকে। বাংলা থেকে নষ্ট রাজনীতি আমাকে চিরবিদেয় দিয়ে দেওয়ার পরও।
লক্ষ করেছি ব্যক্তি নয়, তার ব্যক্তিত্ব নয়, তার ভাবনাচিন্তা নয়, সে কোথায় বাস করে, তার ওপর তাকে শ্রদ্ধা করাটা নির্ভর করে। ইউরোপ আমেরিকার কথা বাদ দিচ্ছি। কলকাতার যে বাঙালি ব্যাঙ্গালোরে বা বোম্বেয় বাস করে, তাদের মূল্যটা বেশি। আবার ওদিকে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গঞ্জে যারা বাস করে, তাদের কাছে বড় শহরে অর্থাৎ কলকাতায় বাস করা মানুষের মূল্য বেশি। এ শুধু পশ্চিমবঙ্গের কাহিনী নয়, বাংলাদেশেরও একই কাহিনী। বাংলাদেশের প্রায় সবাই দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার জন্য অস্থির। আমেরিকাকে উঠতে বসতে গালি দিলেও আমেরিকায় বাস করার সুযোগ পেলে বাঙালি হাতে স্বর্গ পায়। বাংলা বাদ দিয়ে কেউ অন্য ভাষায় কথা বলতে পারলে তাকে বিদ্যান এবং বুদ্ধিমান বলে মনে করা হয়। তাই বলি, বাংলাকে খুব কম বাঙালিই ভালোবাসে। আমি না হয় বোকাই ছিলাম, বোকাই আছি। দুঃখ এ কারণে একফোঁটা নেই। ভারতবর্ষে বাস করাটা বিশাল এক চ্যালেঞ্জ। পায়ের তলায় মাটি বলতে কিছু নেই। তারপরও বাংলা যে দেশের অনেক ভাষার একটি, সে দেশকে দেশ বলে মনে হয় বলে বাস করি। এও হয়তো বোকামো। ওই যে বললাম বোকাই ছিলাম, বোকাই আছি, এতে দুঃখ নেই।
৩ ১. দলিত সাহিত্য
একবার ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের রেস্তোরাঁয় বসে খাচ্ছি। হঠাৎ একদল নারী পুরুষ আমাকে দেখে ছুটে এলেন, কী, আমার সঙ্গে ফটো তুলবেন। নিজেরাই বললেন তাঁরা দলিত সাহিত্যিক। সাহিত্য অ্যাকাডেমিতে দলিত সাহিত্যের ওপর একটি অনুষ্ঠান ছিল, কিছু দলিত সাহিত্যিক পুরস্কার পেয়েছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম দলিত সাহিত্য মানে কী? আপনারা দলিতদের নিয়ে লেখেন, নাকি আপনারা দলিত? ওঁরা বললেন, ওঁরা দলিত। মনে হচ্ছিল, দলিত বলে ওঁদের আনন্দ হচ্ছে, কারণ দলিত বলেই সাহিত্য অ্যাকাডেমিতে আমন্ত্রিত হওয়ার, পুরস্কার পাওয়ার সুযোগ ওঁরা পেয়েছেন। ওঁরা নিজেদের টেবিলে ফিরে যাওয়ার পর আমি ভাবতে বসলাম দলিত সাহিত্য, দলিত সাহিত্যিক এ কেমন জিনিস, দলিতদের মূলস্রোতের সাহিত্য থেকে আলাদা করে দেওয়া হচ্ছে। এককালে বাংলার কিছু মুসলমান ‘মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা’ প্রকাশ করতেন। সেটিও ছিল চরম বিদঘুটে। সাহিত্য অ্যাকাডেমির পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে ভারতবর্ষের সব ভাষা, এমনকি অসংখ্য ছোট ছোট প্রায়-মৃত ভাষার সাহিত্যিকদের পুরস্কৃত করা হয়, সেটি, আমি মনে করি, ভাষাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ভালো উদ্যোগ। কিন্তু দলিত সাহিত্যিকদের আলাদা করলে ব্রাহ্মণ সাহিত্যিক, কায়স্থ সাহিত্যিক, বৈদ্য সাহিত্যিকদেরও আলাদা করতে হয়! শুনেছি দলিতরা দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমির দাবি করছেন। অথবা দলিতদের ভোট পাওয়ার জন্য দলিতদের সাহিত্য অ্যাকাডেমি গড়ে দিতে চাইছেন ধুরন্ধর রাজনীতিক। দলিত অ্যাকাডেমি যদি গড়ে তোলা পলিটিক্যালি কারেক্ট, তবে বিভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য আলাদা অ্যাকাডেমি গড়ে তোলাও পলিটিক্যালি কারেক্ট। কারণ বিভিন্ন গোষ্ঠীও তাঁদের বঞ্চনার কিছু না কিছু কাহিনী সামনে আনতে পারেন। এ কথা ঠিক দলিতদের শিক্ষা থেকে দীর্ঘকাল বঞ্চিত করা হয়েছে, সাহিত্য রচনায় তাঁরা হয়তো পিছিয়ে আছেন, কিন্তু তাঁদের সাহিত্যকে দলিত সাহিত্য বলে যেন উপেক্ষা না করা হয়, সেটি দেখার দায়িত্ব সাহিত্য অ্যাকাডেমির। আলাদা অ্যাকাডেমি হলেই যে সাহিত্যের মান বাড়বে তা তো নয়। আলাদা অ্যাকাডেমি গড়ার পেছনে যত না সাহিত্যিক কারণ, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক কারণ।
সাহিত্যের বিচার সাহিত্য দিয়েই হওয়া উচিত। সাহিত্যকে দলিত সাহিত্য, মুসলিম সাহিত্য, শূদ্র সাহিত্য, বা উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত সাহিত্যে, নারী এবং পুরুষ সাহিত্যে ভাগ করলে শুধু সাহিত্যিকদের অপমান নয়, সাহিত্যেরও অপমান। ভাগের কোনও শেষ নেই। বড় গোষ্ঠী থেকে ছোট গোষ্ঠী, ছোট থেকে ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর—ভাগ হতেই থাকবে। তার চেয়ে সব বিভেদকে দূরে সরিয়ে এক হয়ে যাওয়া ভালো। সাহিত্য শিল্পের ক্ষেত্রেই তো বিভেদের কোনও স্থান নেই। জাতপ্রথা নিষিদ্ধ হলেও এই প্রথা মানার লোকের অভাব নেই সমাজে। সমাজকে সুস্থ সুন্দর করার দায়িত্ব তো কিছুটা সাহিত্যিকেরও। জাতপ্রথার ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষকে যুগ যুগ ধরে সাহিত্যিকরাই সচেতন করেছেন। সাহিত্যিকদের একটিই পরিচয়, তাঁরা সাহিত্যিক। দলিতদের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা নিয়েই বলছি এভাবে সাহিত্যকে গোষ্ঠীভুক্ত করা অনুচিত। সাহিত্য হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান, তথাকথিত ছোটজাত বড়জাত, মুসলমান, নাস্তিক, ধনী গরিব, কালো সাদা বাদামি, নারী পুরুষ যে-ই লিখুন না কেন, যে ভাষাতেই লিখুন না কেন, তাকে ‘সাহিত্য’ হিসেবে দেখতে হবে। নামদেও ধাসাল, অরুণ কুম্বলে, মীনা কান্দাসামি, উর্মিলা পাওয়ার, বাবুরাও বাগুলদের আমরা ‘দলিত লেখক’ বলি না, আমরা তাঁদের ‘লেখক’ বলি। মেয়েদের লেখা সাহিত্যকেও মূলস্রোতের সাহিত্য থেকে পৃথক করার পুরুষতান্ত্রিক ষড়যন্ত্র আমরা দেখেছি। ভার্জিনিয়া উলফ, টনি মরিসন, মার্গারেট এটউড, এলিস ওয়াকার এঁদের আমরা ‘লেখক’ বলি, ‘মহিলা লেখক’ বলি না।
৩২. মৌলবাদী
বাংলাদেশের মৌলবাদীরা দুই ধরনের। এক ধরনের মৌলবাদী মাদ্রাসায় পড়েছে, পাঁচ বেলা মসজিদে যায়, কপালে নামাজের কালো দাগ তাদের, তারা ৩০টা রোজা রাখে, গোঁফ কামায় দাড়ি রাখে, মাথায় টুপি পরে, টাকনুর ওপর পাজামা পরে। মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, ওয়াজের হুজুর, মাদক পাচারকারী ইত্যাদি নানা পেশায় তারা জড়িত। তারা তাদের পুত্রদের মাদ্রাসায় পাঠায়, কন্যাদের বোরখা পরায়, অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেয়।
আরেক ধরনের মৌলবাদী সার্ট প্যান্ট জুতো মোজা পরে, দেশ বিদেশ ঘোরে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। বড় বড় ব্যবসা বা চাকরি করে, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক স্থপতি মন্ত্রী কী নয় তারা!
এই দুই ধরনের মৌলবাদীর বেশভূষা, লাইফস্টাইল আলাদা হলেও তাদের বিশ্বাস এক। তারা বিশ্বাস করে ইসলাম জগতের শ্রেষ্ঠ ধর্ম। বিশ্বাস করে ইহুদি খ্রিস্টান হিন্দু বৌদ্ধ সক্কলে ইসলামকে ধবংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বিশ্বাস করে মুসলমান মেয়েদের হিজাব বোরখা পরা উচিত, যদি ইস্কুল কলেজে যেতেই হয়, অফিস আদালতে যেতেই হয়, হিজাব বোরখা পরেই যাবে, এমন কী ডাক্তারি মোক্তারি যদি করতেই হয়, হিজাব বোরখা পরেই করবে, হিজাব বোরখা পরেই ক্রিকেট খেলবে, সাঁতার কাটবে, এভারেস্টে উঠবে।
প্রগতিশীল বলে বাংলাদেশে যারা ছিল, তাদের অধিকাংশের মৃত্যু হয়েছে, অবশিষ্টরা মৌলবাদে কনভার্ট করে গেছে।
৩৩. ইলিশ
দুর্গাপূজা উপলক্ষে বাংলাদেশ ১৪৭৫ টন ইলিশ পাঠাচ্ছে পশ্চিমবাংলায়। জেসচার অব গুডউইল! জানতে চাইছি, আমরা যারা কলকাতার বাইরে বাস করতে বাধ্য হচ্ছি, তারা কি পদ্মার ইলিশের স্বাদ পাবো এ বছর? কত যে গুজরাটের ইলিশকে পদ্মার ইলিশ ভেবে খেয়েছি, আর ওয়াক করেছি! তা বাংলাদেশের সরকার, এত যে সেক্যুলার সেক্যুলার একখানা ভাব দেখাচ্ছ বছর বছর দেশের বাইরের দুর্গাপূজায় ইলিশ পাঠিয়ে, দেশের দুর্গা মূর্তিগুলো যে বছর বছর ভাঙচুর হয়, সেটি ঠেকানার চেষ্টা করো কি? সংবিধান থেকে রাষ্ট্র ধর্মটি বাদ না দিলে কিন্তু সত্যিকার সেক্যুলার হওয়ার কোনও পথই খোলা নেই। জেনেও না জানার ভান আর কতদিন?
৩৪. মুসলিম উম্মাহ
মুসলিম ব্রাদারহুড, মুসলিম উম্মাহ তো ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন মুসলমানের শত্তুর ইজরাইলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফেললো। জর্দান আর মিশর তো আগেই মিলিয়েছে। সৌদি আরবের সঙ্গে ইজরাইলের মাখামাখি অনেকদিনের। রইলো বাকি কোন দেশ? তুরস্ক আর ইরান এখনও শত্রুপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। আসলে ধর্মের মিল দিয়ে কিছু দিন সম্পর্ক ধরে রাখা যায়, বেশিদিন যায় না। রাজনীতি অর্থনীতি সমাজের রীতিনীতি গণতন্ত্র মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে মতের মিলই আসল। সব না হলেও কিছুটা মিলে গেলে কে কোন দেবতার পায়ে নিভৃতে মাথা ঠেকালো তা কেউ দেখে না। ধর্মীয় বন্ধুত্ব অর্থনৈতিক বন্ধুত্বের কাছে হার মেনে যায়। মুসলিম-পাকিস্তানের সঙ্গে অমুসলিম-চীনের বন্ধুত্ব অটুট যদিও চীন উইঘুর মুসলিমদের অত্যাচার করছে। রাজনীতি আর অর্থনীতির সামনে ধর্ম যদি এতই জবুথবু, তবে ধর্ম কেন টিকে আছে আজও? টিকে আছে ধর্মকে রাজনীতির একটা অংশ করা হয়েছে বলেই। রাজনীতির শরীর থেকে ধর্মকে ঝেড়ে ফেললে ধর্মের অস্তিত্ব অচিরে বিলীন হতে বাধ্য।
৩৫. সমাজ নষ্ট হয় বুদ্ধিজীবীরা নষ্ট হলে
বোরখার সমালোচনা করেছি সাতের দশকে, ঘরে বাইরে আন্দোলন করেছি। বোরখার বিরুদ্ধে আটের দশক থেকে লিখছি। ২০১০ সালে বোরখা নিয়ে আমার একটি লেখার কারণে মুসলমান মৌলবাদীরা দাঙ্গা বাঁধিয়েছে কর্ণাটকে। আগুনে পুড়িয়েছে বাস ট্রাক দোকানপাট, ভাঙচুর করেছে পত্রিকা অফিস, দু’জনের মৃত্যুও হয়েছে। বোরখার নিন্দে করলে কী ভয়ানক কাণ্ড ঘটে যেতে পারে, তা প্রত্যক্ষ করেছি। বোরখা সম্পর্কে আমার অগুনতি রচনা পড়ে কারও কারও চক্ষু খুলেছে। কিন্তু সে তো হাতে গোনা। অগুনতি মেয়ে আজকাল বোরখায় শরীর মুড়িয়েছে। আজ আমি বোরখা নিয়ে মন্তব্য করার বদলে প্রশ্ন করতে চাই বাংলাদেশের মেয়েরা কেন বোরখা পরছে, দোষ কার? বাংলাদেশে হাট মাঠ ঘাট দখল করে নিয়েছে ধর্ম ব্যবসায়ীরা, দোষ কার? বাংলাদেশের ইস্কুল কলেজ অফিস আদালত দখল করে নিয়েছে কূপমণ্ডূক ধার্মিকেরা, দোষ কার? বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল, প্রচারমাধ্যম, সংগঠন সংস্থা দখল করে নিয়েছে মৌলবাদীরা, দোষ কার? দোষ কী ধর্মের? ধর্ম একটা আইডিওলজি। আইডিওলজির কোনও দোষ নেই, একে না মানলেই এ মরে যায়। সরকারের দোষ? সরকার পালের হাওয়া যেদিকে, সেদিকেই নাও ভাসায়। সরকারেরও দোষ ততটা নয়। দোষ তাহলে কার? দোষ বুদ্ধিজীবীদের। কারণ বুদ্ধিজীবীরা জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন। ছেড়ে দিয়েছে বলেই হাট মাঠ ঘাট দখল করেছে সমাজের শত্রুরা। যেখানে বুদ্ধিজীবী এবং শিল্পী সাহিত্যিকদের নাটক থিয়েটার নৃত্য আবৃত্তি সংগীত পালাগান করার কথা, মুক্তবুদ্ধি আর মানবাধিকার বিষয়ে যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করার কথা, মানুষকে সভ্য শিক্ষিত সচেতন করার কথা, সেখানে আজ ধর্ম ব্যবসায়ীরা নারী-বিরোধী ওয়াজ শুনিয়ে মানুষের মগজ ধোলাই করে। বুদ্ধিজীবীদের যেখানে ইস্কুল কলেজ অফিস আদালতকে ধর্ম থেকে দূরে রাখার কথা, সেখানে ধর্ম ব্যবসায়ীরা মসজিদ মাদ্রাসা খুলে ছেলেমেয়েদের মগজ ধোলাই করে। কী করেছেন বুদ্ধিজীবীরা এতকাল? কী আর করেছেন? ক্ষমতাসীনদের পেছনে দৌড়েছেন, এই পুরস্কার ওই সুবিধে বাগিয়েছেন আর আখের গুছিয়েছেন। সমাজ উচ্ছন্নে গেলে তাঁদের কিচ্ছু যায় আসেনা। এই যে দল সংগঠনগুলো নিরবধি ধর্মের নাম জপছে, কেন? বুদ্ধিজীবীরা মুখ বুজে থেকে এই সর্বনাশটি হতে দিয়েছেন।
আমি আগেও বলেছি, আজও বলছি, মৌলবাদীরা ধর্মের ব্যবসা করে আসছে, করবে। এটাই তাদের পেশা। রাজনীতিকরাও স্বার্থান্ধ। সরকার তো নিতান্তই চোর গুণ্ডার সমষ্টি। এরা নষ্টই, এরা নষ্ট হলে সমাজ নষ্ট হয় না। কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা নষ্ট হলে সমাজ নষ্ট হয়। বাংলাদেশের সমাজ আজ নষ্ট সমাজ। সম্পূর্ণই বুদ্ধিজীবীদের কারণে।
৩৬. অক্ষয়ের মূত্রপান
বলিউড তারকা অক্ষয় কুমার সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। খুব ফিট যাকে বলে। অক্ষয় কুমার জানিয়েছেন তিনি প্রতিদিন গোমূত্র পান করেন। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র থেকেই প্রেরণা পেয়েছেন, জানিয়েছেন। আয়ুর্বেদ ১০০০ বছর আগের প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি। আয়ুর্বেদে গোমূত্রের উপকারিতার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে গরু যখন মাঠে খায়, তখন স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী নানারকম লতা পাতা খায়। সেগুলো কিছুটা তো প্রস্রাবে পাওয়া যায়ই। গর্ভবতী গাভীর প্রস্রাবেও হরমোন এবং খনিজ দুই-ই পাওয়া যায়। মিনারেল বা খনিজ পদার্থ মানুষের শরীরে থাকা দরকার, সে কারণেই গোমূত্র পান করলেই শরীরে খনিজের অভাব দূর হয়, পুষ্টি যা দরকার, তাও গোমূত্রেই মেলে। আয়ুর্বেদ বলছে, সকালে খালি পেটে গোমূত্র পান করলে বিভিন্ন অসুখ সেরে যায়, এর মধ্যে আছে কুষ্ঠ রোগ, ডায়বেটিস, টিউমার, যক্ষা, পেটের অসুখ বিসুখ, ক্যান্সার। আয়ুর্বেদ আরও দাবি করছে গোমূত্র যদি কালো নুন, দই এবং ঘি’র সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া হয়, তাহলে জ্বর সারে। রক্তশূন্যতা সারানোর ওষুধ ত্রিফলা, গোমূত্র আর গরুর দুধ। আয়ুর্বেদ আরও বলছে, যে, গোমূত্র শরীরের ভেতরের সব টক্সিন বের করে দেয়, সুতরাং কোনও ক্রনিক অসুখের ঝুঁকি থাকে না। তাছাড়া গোমূত্র দিয়ে সাবান আর শ্যাম্পুও তৈরি করা যায়। এসব আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের দাবি।
কিন্তু বিজ্ঞান কী বলছে? বলছে আয়ুর্বেদের দাবিগুলোর কোনও প্রমাণ মেলেনি। বলছে গোমূত্রে সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্রিয়েটিনিন, ফসফরাস, এপিথেলিয়াল সেল পাওয়া যায়, কিন্তু গোমূত্র মানুষের অসুখ বিসুখ সারায় না। খনিজ থাকার ফলে গোমূত্র মাটির জন্য উপকারী হতে পারে, কিন্তু মানুষের জন্য নয়।
অক্ষয় কুমারের গোমূত্রে বিশ্বাস। তাঁর ভক্তকুল ইতিমধ্যে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে অক্ষয়ের সুস্বাস্থ্যের কারণ গোমূত্র। আসলে তাঁর সুস্বাস্থ্যের পেছনে আছে তাঁর ভালো জিন, ভালো এক্সারসাইজ, ভালো ডায়েট। কিন্তু ক্রেডিট যাচ্ছে গোমূত্রে। কিছু লোক উটের প্রস্রাবও পান করে, তাদের বিশ্বাস ওই প্রস্রাব তাদের রোগ সারাবে। এ আমরা দেখে অভ্যস্ত যে, ডাক্তার রোগ সারাবার পর সব ক্রেডিট মানুষ দেয় ঈশ্বর, ভগবান, আল্লাহকে। খুব সম্ভবত ঈশ্বর, ভগবান, আল্লাহর অস্তিত্ব নেই, কারণ তাদের অস্তিত্বের আজও কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
মানুষ সর্বগুণে গুণান্বিত নয়। কারও একদিকে বুদ্ধি খেলে, আরেকদিকে খেলে না। যেদিকে বিশ্বাস আছে, সেদিকে সাধারণত বুদ্ধির ছিটেফোঁটা দেখতে পাওয়া যায় না। তারপরও যুক্তিবুদ্ধিহীনবিশ্বাস জিনিসটা আদিকাল থেকেই আছে। হয়তো আরও বহু শতাব্দী থাকবে।
৩৭. ধর্ম
সব ধর্মের জন্মই অদ্ভুত। সব নবীকে গপ্প ফাঁদতে হয়েছে। মুসাকে বলতে হয়েছে উনি নদী ভাগ করে পথ বানিয়েছেন মিশর থেকে হিব্রু ক্রীতদাসদের ইজরাইলে নিয়ে আসার জন্য। পাহাড়ের ওপর তাঁর হাতে পাথর দিয়ে গেছেন ঈশ্বর, সেই পাথরে লেখা ১০ খানা আদেশনামা। ইহুদি যুবক যীশুকে জেরুজালেমের রাস্তায় আমি নবী আমি ঈশ্বর বলে চেঁচাতে হয়েছে,বহুঈশ্বরবাদী রোমানদের মন্দির ভাঙার চেষ্টা করলে সন্ত্রাসী হিসেবে তাঁকে শাস্তি দেওয়া হল, কাঠের ওপর পেরেক মেরে মৃত্যু হওয়া অবধি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল শরীর, এভাবেই অপরাধীদের তখন শাস্তি দিত রোমানরা। সব পাগলেরই শিষ্য জোটে, যীশুরও জুটেছিল কিছু, শিষ্যরাই বানিয়ে বানিয়ে নানারকম অলৌকিক ভূতের গপ্প ব’লে ব’লে আর যাদু দেখিয়ে দেখিয়ে, মানুষকে দলে টেনেছে। মরে যাওয়ার ৩ দিন পর নাকি যীশু কবর থেকে উঠে আকাশে চলে গেছেন এরকম কত গপ্প। আর মুহম্মদকে বলতে হয়েছে উনিই ‘শেষ নবী’, ওঁর বুক পেট চিরে ভেতরে যা কিছু ছিল ধুয়ে শুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে, ওঁর কানে নানা কিছু নিয়ে ফিসফিস করে বলার জন্য দো জাহানের মালিক স্বর্গ থেকে মর্ত্যে দূত পাঠাতেন। মুহম্মদও একদিন ডানাওয়ালা ঘোড়ায় চড়ে সাত আসমানে বসা সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে দেখা করে এসেছেন।
মাঝে মাঝে মনে হয় কী হত যদি রোমের সম্রাট কন্সটেন্টিন খ্রিস্টান না হতেন আর সাম্রাজ্যের সবাইকে ভয় দেখিয়ে রক্ত ঝরিয়ে জবরদস্তি খ্রিস্টান না বানাতেন!! কী হত যদি দেশে দেশে মানুষকে ধর্মান্তরিত না করতেন মুহম্মদের শিষ্যরা? তাহলে তিন ধর্মই মধ্যপ্রাচ্যের লোকাল ধর্ম হিসেবেই রয়ে যেত। আর দুনিয়ার মানুষ বিচিত্র সব বহুঈশ্বরবাদ নিয়ে আগে যেমন ছিল, তেমনই থেকে যেত। কী ফারাক একেশ্বরে আর বহুঈশ্বরে? দুটোতেই মিথ্যে গল্পের ছড়াছড়ি। দুটোই মানুষকে ভয় দেখায়, লোভ দেখায়।
কুসংস্কার থেকে, মিথ্যে থেকে যারাই দূরে সরাতে পারে নিজেকে, তারাই বুদ্ধিমান। ধর্ম কখনও পালটায় না, যেখানে আছে সেখানে থাকে। মানুষ পালটায়। বিবর্তন ঘটে মানুষের। আধুনিক হয় মানুষ।
৩৮. মসজিদ
বাংলাদেশের এক মসজিদের ভেতর শীতাতপনিয়ন্ত্রক যন্ত্রে বিস্ফোরণ ঘটেছে। মূলত গ্যাস পাইপলাইনের ওপর নির্মিত মসজিদটির ভেতর পাইপ ফেটে গ্যাস ঢুকে বিস্ফোরণটি ঘটায়। এর ফলে ২৩ জন মরেছে, প্রচুর আহত হয়েছে। বড় দুঃখজনক সংবাদ। কিন্তু প্রশ্ন হল, গ্যাস পাইপলাইনের ওপর কেন মসজিদ বানানো হল? এই ভয়ংকর অপরাধটি করতে কেউ কি অনুমতি দিয়েছে? অনুমান করছি কেউ দেয়নি অনুমতি। মুশকিল হল, অবৈধ কার্যকলাপের জন্য আল্লাহর অনুমতি ছাড়া মোল্লা মুফতিগুলো আর কারো অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, মসজিদে এসি কেন থাকে? শুনেছি রাজদরবারের মতো দেখতে একেকটা মসজিদ, ঝাড়বাতিও হয়তো ঝোলে। একাধিক শীতাতপনিয়ন্ত্রক যন্ত্র মসজিদে। মুসলমানরা শুনেছি শেষ নবীর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। তাঁর মতো জোব্বা পরেন, দাড়ি রাখেন, দাড়িতে মেহেদি লাগান, চোখে সুর্মা পরেন, নিমের দাঁতন দিয়ে মেসওয়াক করেন, একাধিক বিয়ে করেন। শেষ নবী কি তাঁর গরম-দেশে এসির আরামে নামাজ পড়তেন? নিশ্চয়ই না। তখনও তো ইহুদি- ক্রিশ্চানরা এসি আবিষ্কার করেনি। নবীর উম্মতদের এখন এসি ছাড়া, গাড়ি ছাড়া, টেলিভিশন ছাড়া, কম্পিউটার ছাড়া, মোবাইল ফোন ছাড়া চলে না। অথচ শেষ নবীর একখানা কম্বল ছিল সম্বল। পদাঙ্ক অনুসরণ করো তো ঠিকঠাক অনুসরণ করো। ইহুদি-খ্রিস্টানদের আবিষ্কৃত জিনিসপত্রের ওপর লোভ সংবরণ করো। ১৪০০ বছর আগের আইন এবং রীতিনীতি রিচুয়াল মেনে চলতে পারো তাহলে তখনকার সাদাসিধে জীবন কেন মেনে চলতে পারো না? শেষ নবী তো বারবারই বাহুল্য বর্জন করতে বলেছেন। তাঁর উপদেশ মেনে না চললে কেমন উম্মত!
অনেক মসজিদ অবৈধ ভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। ব্যস্ত রাজপথের ওপর, অন্যের জমির ওপর, গ্যাস পাইপলাইনের ওপর। পাইপ ফেটে গ্যাস বেরিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানোর আশঙ্কা আছে জানার পরও মসজিদ বানানো বন্ধ হয়নি। জনগণ বাধা দিতে ভয় পায়, কারণ ধার্মিকরা আজকাল সন্ত্রাসীতে রূপ নিয়েছে। সরকারও বাধা দেয় না, সম্ভবত সরকারও ভয় পায় অথবা ধার্মিক সাজার ভান করে। অনেক মসজিদেরই বিদ্যুৎ বিল মেটানো হয় না কোনওকালেই। অনেক মসজিদই অবৈধ কাজকর্মের আখড়া। খুন ধর্ষণ মাদক ব্যবসা কী না হয় মসজিদে! মসজিদ বলেই এর ভেতরে ঘটা সাত খুন মাফ।
আগুন যদি আজ আশেপাশের দোকানপাটে বাড়িঘরে লাগতো, কিন্তু মসজিদে না লাগতো, তাহলে বলা হত মসজিদে আগুন লাগেনি, কারণ আল্লাহ মসজিদকে রক্ষা করেছেন। আর এখন আশেপাশের দোকানপাটে বাড়িঘরে আগুন লাগেনি, লেগেছে শুধু মসজিদে। তাহলে কী বলা যাবে? আল্লাহ সবাইকে রক্ষা করেছেন, শুধু মসজিদকে করেননি। আল্লাহ সদা সর্বদা মসজিদ রক্ষা করবেন, এরকম ভাবা ঠিক নয়।
যে মসজিদ অবৈধ জমির ওপর, যে মসজিদের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা হয় না, যে মসজিদের ভেতর আইনবিরোধী কর্মকাণ্ড চলে, সেইসব মসজিদ বন্ধ করে দেওয়া হোক। এই সরকার কোনও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী রাখেনি,ক্ষমতা হারানোর ভয় নেই, সমালোচক নিন্দুকদের মুখও সেলাই করে দিয়েছে, তাহলে যারা অপরাধী, সন্ত্রাসী, যারা দেশের সর্বনাশ করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এত দ্বিধা কেন? এর একটিই উত্তর হতে পারে, সরকারও হয়তো ওই মৌলবাদী ধর্ম ব্যবসায়ীদের মতোই, দেশের সর্বনাশ চায়।
৩৯. খবর আছিল
দুনিয়ার বেশিরভাগ মুসলমান আরবি বোঝে না। তারা কোরান মুখস্থ করে অর্থ না বুইঝা। অর্থ না বোঝাডা যে কত ভালো। বুঝলে খবর আছিল। সব আইসিসে নাম লেখাইত।
৪০. কুয়ো
আমেরিকায় গিয়ে বাংলাদেশের বাঙালিরা কী করে? মুসলমানরা মসজিদ বানায়, হিন্দুরা মন্দির বানায়। শুরু হয়ে যায় মহাসমারোহে ধর্মের কুয়োয় সাঁতার কাটা। আজ একটা খবর পড়লাম বাঙালি মুসলমানরা সুন্নি আন্দোলন করছে নিউইয়র্কের জামাইকায়। ডলার কামাবে, দেশের রাজনীতি নিয়ে এর ওর সাথে অর্থহীন কিছু কথা বলবে, আর ধর্ম করবে। এ ছাড়া বেশি কিছুতে আগ্রহ তাদের নেই। অথচ কত কিছু করার আছে দেশটিতে, কত কিছু জানার আছে, শেখার আছে! কত রকম আন্দোলন চলছে মেইনস্ট্রিমে, নারী-অধিকার আন্দোলন, মানবাধিকার আন্দোলন, সমকামী-রূপান্তরকামীদের আন্দোলন, বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন, সেক্যুলার আন্দোলন, সবার জন্য ফ্রি শিক্ষা ফ্রি চিকিৎসার আন্দোলন, মুক্তচিন্তার আন্দোলন, আদিবাসীদের জন্য—কালোদের জন্য—অভিবাসীদের জন্য আন্দোলন, অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন, অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন, আরও কত সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন! কিছুতে নেই বাঙালি। পড়ে আছে কুয়োয়। অথচ সমুদ্র কাছেই, সমুদ্রে সাঁতরাবে না।
বাংলাদেশের কুয়ো থেকে বেরিয়ে ইউরোপ আমেরিকাতেও এরা নিজেদের জন্য কুয়ো বানিয়ে নেয়।
৪ ১. মধ্যযুগ
মধ্যযুগই তো অন্ধকার যুগ। সে যুগে ছিল ছোট ছোট রাজ্য। সেই রাজ্যের রাজারা ছিল প্রচণ্ড ক্ষমতালোভী, ক্ষমতার জন্য নির্বিচারে মানুষ খুন করতো, প্রজাদের তারা দু’পয়সার দাম দিত না। ছিল স্বার্থান্ধ, ছিল ধর্মান্ধ, ছিল নির্মম, নিষ্ঠুর, কেউ যদি মাথা না নোয়াতো, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতো, তার সর্বনাশ করতো রাজারা।
হাজার বছর পার হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর রাজাদের এখন প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি বলে ডাকা হয়। সময় বদলেছে, প্রজা বদলেছে, রাজ্য বদলে রাষ্ট্র হয়েছে, রাজতন্ত্র গিয়ে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ইত্যাদি নানা তন্ত্র এসেছে, কিন্তু রাজাদের চরিত্র বদল হয়নি।
৪২. মানববন্ধন
কুকুর নিধন করার কুবুদ্ধি দিতে মানববন্ধন। মানবের মতো হিংস্র বর্বর কুৎিসত কদাকার জন্তু আর নেই। কুকুর রাস্তায় কেন, না খেয়ে থাকে কেন, ডাস্টবিনে খাবার খোঁজে কেন? কুকুরদের ঘরে নিয়ে পোষো। মানুষ পোষার চেয়ে কুকুর পোষা ভালো। তা পুষবে কেন? দেশি কুকুর যে! বড়লোকি দেখানোর জন্য পুষবে বিদেশি কুকুর!!
৪৩. জলদস্যু
মধ্যযুগে ইউরোপের জলদস্যুদের জীবন ঠিক কেমন ছিল, তা জানতে গিয়ে পেলাম বিধর্মীদের খুন করে তাদের ধন সম্পদ জায়গা জমি দখল করতো বহুঈশ্বরবাদী পেগান জলদস্যুরা। এটিকে তারা তাদের ধর্মীয় কর্তব্য বলে মনে করতো। যুদ্ধের মাঠে বিধর্মীদের হাতে মৃত্যু হলে, তারা বিশ্বাস করতো, তারা সোজা ভালহালায় যাবে। ভালহালা মানে বেহেস্ত। ভালহালায় তারা চরমানন্দে বাস করবে, সুরা পান করবে, সুস্বাদু খানা খাবে। ইসলামেও তো একই জিনিস। ‘দারুল ইসলাম’ তো বিধর্মীদের মেরে তাদের জায়গা জমি দখল করার নামই। আর বিধর্মী দ্বারা খুন হওয়া মানেই তো শহিদ হওয়া, শহিদ হলে সোজা বেহেস্ত, ঠিক সোজা ভালহালার মতো। বেহেস্তেও ভালহালার মতো অপেক্ষা করছে সুরা আর সুস্বাদ্য খানা।
নামাজ রোজা হজ মজ সব তো আরবের মূর্তিপুজক পেগানদের কালচার রিচুয়াল।
আর আদম হাওয়ার গপ্প? ও তো বাইবেল থেকে কপি পেস্ট।
তাইলে কী দাঁড়াইলো?
কী দাঁড়াইলো তা আমরা টের পাইতাছি।
আসল কথা হল, জলদস্যুরা কি এখন জলদস্যু? না। তারা কি এখন বিধর্মীদের খুন করে জায়গা জমি দখল করায় বিশ্বাস করে? না। তারা কি বিশ্বাস করে বিধর্মী দ্বারা খুন হলে তারা ভালহালায় যাবে? না। ইহুদি খ্রিস্টানরা কি আদম হাওয়ার গপ্পে এখন বিশ্বাস করে? কিছু গোবর-মাথা ছাড়া কেউ বিশ্বাস করে না।
কাদের এইসব রূপকথা পুরাণকথায় সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস?
৪৪. আমি
বই পড়তে পড়তে বই বন্ধ করে দিতে হয়, ছবি দেখতে দেখতে পজ বাটন টিপতে হয়—যখনই দুঃখের কোনও ঘটনা আসে। কারও কোনও কষ্ট বা কোনও মৃত্যু আমি সইতে পারি না। সেই যে ছোটবেলায় গল্পের বই পড়তে পড়তে বালিশ ভেজাতাম, এখনও সেইরকমই। সিনেমা হল থেকে কত যে চোখের জল মুছতে মুছতে বেরিয়েছি। গত কয়েকদিন নেটফ্লিক্সে দ্য লাস্ট কিংডম সিরিজটা দেখছিলাম। টানা বেশিক্ষণ দেখতে পারি না। বার বার পজ বাটন টিপতে হয়। যখনই রাজা আলফ্রেড তাঁর যোদ্ধা উট্রেডের সঙ্গে জঘন্য ব্যবহার করেন, সোজা কথা বেইমানি করেন, তাঁকে প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করেন, তখনই আমাকে পজ বাটন টিপতে হয়। যখনই কোনও সংঘর্ষে এ ওর গলা চিরে দেয়, ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোয়, আমি অন্যদিকে তাকিয়ে থাকি, অথবা ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে অন্য দৃশ্যে নিয়ে যাই। কোনও যুদ্ধ, কোনও বর্বরতা, কোনও রক্তপাত আমি নিতে পারি না। উট্রেড যখন হাসিখুশি, যখন ওকে ভালোবাসে কেউ, তখন ভালো লাগে দেখতে। যখন মানুষ খাচ্ছে, পান করছে, হাসছে, জোক করছে, ভালো লাগে। র্যাগ্নার যখন অসুস্থ উট্রেডকে সেবা করে সুস্থ করে তোলে, ভালো লাগে। উট্রেড যখন র্যাগ্নারকে জড়িয়ে ধরে, ভালো লাগে।
এত পালকের মতো নরম কেন আমার মন! আমি নিজেই বুঝে পাই না। অথচ এক জীবনে কত ভয়ংকর ভয়ংকর বিরোধিতা, শত্রুতা, এমনকি আমাকে হত্যা করার নীল নকশার সামনে অনড় এবং দৃঢ় দাঁড়িয়েছি। ভাঙিনি তো কোনওদিন! তাহলে কি নিজের দুঃখ সইতে পারি, অন্যের দুঃখ পারি না?
৪৫. বিষফোঁড়া উপন্যাস নিষিদ্ধ
এভাবে আমার বইগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। লজ্জা, আমার মেয়েবেলা, উতল হাওয়া, ক, সেইসব অন্ধকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা হবে না, ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত লাগবে ইত্যাদি বুলশিট কারণ দেখিয়ে নিষিদ্ধ করেছে বাংলাদেশ সরকার। নিষিদ্ধ করে নারীবিরোধী মৌলবাদী অপশক্তিকে জিতিয়ে দিয়েছে।
এবার মাদ্রাসায় শিশু ধর্ষণ নিয়ে উপন্যাস নিষিদ্ধ করে ধর্ষকদের পক্ষে সরকার দাঁড়ালো। ধর্ষক যেহেতু ধার্মিক, তাই ধার্মিকের পক্ষে দাঁড়ালো সরকার। ধার্মিক যত অন্যায়ই করুক ধার্মিকের সাত খুন মাফ।
লেখকদের লেখা গল্প উপন্যাস কবিতা প্রবন্ধের বই জননিরাপত্তার জন্য কখনো হুমকি নয়। মাদ্রাসার শিশু ধর্ষকেরা জননিরাপত্তার জন্য হুমকি।
৪৬. ধর্মান্ধ
এক ধর্মান্ধ গোষ্ঠী আরেক ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে ধর্মান্ধ হওয়ার অপরাধে গালি দিচ্ছে। সব ধর্মান্ধই মনে করে তার ধর্মই অন্য সব ধর্মের চেয়ে ভালো। তার ধর্মই সেরা।
ধর্মান্ধরা একে অপরকে অনুকরণ করে। তারা ওপরে ওপরে শত্রু, ভেতরে ভেতরে বন্ধু।
মধ্যযুগের ইউরোপ যেমন ধর্মান্ধ এবং বর্বর ছিল, আমরা এখন তেমন ধর্মান্ধ এবং বর্বর। ওপরে ওপরে আধুনিক, ভেতরে ভেতরে প্রাচীন ।
৪৭. গ্রন্থ
কোনও ধর্মগ্রন্থই সমতার কথা, সমানাধিকারের কথা বলেনি। বাইবেলও তো বলেছে বিধর্মীকে মেরে ফেলার কথা, নারীকে তাদের প্রাপ্য অধিকার না দেওয়ার কথা, কিন্তু ইহুদি খ্রিস্টানরা তো বাইবেলের উপদেশ মেনে চলছে না। তারা ধর্মগ্রন্থের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রের সংবিধানও লেখেনি, আইনও তৈরি করেনি। মুসলমানের দেশই শুধু ধর্মগ্রন্থ আঁকড়ে পড়ে আছে। ১৪০০ বছর আগে আরব দেশের বর্বর লোকেরা যে সমাজ তৈরি করেছিল, আজ এই একবিংশ শতাব্দীতেও সারা বিশ্বের মুসলমান সেই সমাজকে অনুকরণ করছে। মুসলমানদের সংবিধানে, রাষ্ট্রে, সমাজে, আইনে, রীতিতে সবখানে প্রাচীন কোরান হাদিস।
বাইবেল, কোরান পালটানো যায় না। কারণ ওসব অন্যের লেখা গ্রন্থ। কিন্তু সমাজ পালটানো যায়। ধর্মগ্রন্থে যা-ই লেখা থাকুক, যতই বৈষম্য, অসাম্য, থাকুক, সমাজকে সমতার ভিত্তিতে গড়ে তোলা সম্ভব। ইউরোপের খ্রিস্টানরাই প্রমাণ করেছে সম্ভব। এখনকার মুসলমান সমাজের মতো খ্রিস্টানরাও ঈশ্বরে অবিশ্বাসীদের এক কালে হত্যা করতো। এখন ঈশ্বরে অবিশ্বাস করাটাই আধুনিকতা। মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থে সভ্যতার কথা নেই বলে মুসলমানেরা কোনওদিন সভ্য হবে না, এ আমি বিশ্বাস করি না। তারাও একদিন সংবিধান থেকে, আইন থেকে, সমাজের রীতিনীতি থেকে ধর্ম দূর করবে। সভ্য হওয়ার তাগিদেই করবে।
৪৮. জন্মদিন
জন্মদিন টন্মদিন আমার পালন করতে ইচ্ছে করে না। হিসেব করে দেখলাম আমার এখন যে বয়স, সে বয়সে আমার মা মারা গিয়েছিলেন। এই বয়সে পৌঁছোনোর আগে বুঝিনি, এখন বুঝি যে মা খুব অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন। জন্মদিন আসা মানে কবরের দিকে আরও একটি বছর এগিয়ে যাওয়া। আমি তো মৃতদেহ দান করেছি হাসপাতালে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণার কাজে। সুতরাং আমার মৃতদেহ কবরে যাবে না, চিতায় উঠবে না, জলে ভাসবে না, কফিনে ঢুকবে না, আমার মৃতদেহ শুয়ে থাকবে হাসপাতালের শব ব্যবচ্ছেদ কক্ষে, অথবা ল্যাবে। এর চেয়ে ভালো সৎকার আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু মৃত্যুর কথা আমি ভাবতে চাই না। যেদিন চলে যেতে হবে, সেদিন চলে যাবো। কিন্তু শেষদিন পর্যন্ত যেন ভাবতে পারি, বলতে পারি, লিখতে পারি। যেন বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারি। সব নিষেধাজ্ঞাকে যেন উড়িয়ে দিতে পারি। শেষদিন পর্যন্ত।
আজ কত মানুষ যে জন্মদিনের শুভেচ্ছা পাঠাচ্ছে আমাকে! দেখে মনে হয় এতকাল আদর্শের জন্য সংগ্রাম ক’রে শুধু কি নির্বাসন, ফতোয়া, প্রত্যাখ্যান, নিষেধাজ্ঞা, অবজ্ঞা, অপবাদ, উপেক্ষা, নিন্দা আর ঘৃণাই জুটেছে? ভালোবাসাও তো পেয়েছি অনেক। আমি এক ভালোবাসার সামনেই মাথা নোয়াই।
৪৯. ভাইকিং
ভাইকিংরা কী বীভৎস বর্বর ছিল, কী অসভ্য, কী জঘন্য লোক ছিল ওরা! ওরা দস্যু ছিল, নৌকা দিয়ে বিভিন্ন দেশে যেত, যাকে পেতো তাকেই কুড়োল দিয়ে কুপিয়ে মারতো, আর অন্যের দেশ থেকে সোনা রূপা লুঠ করে নিয়ে আসতো। এটিই ছিল ওদের কাজ। অশিক্ষিত বর্বর, ধর্মান্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভাইকিংদের উত্তরসূরিরাই আজ ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ের নাগরিক। আজ ওসব দেশ বিশ্বের ধনী দেশই শুধু নয়, সভ্য দেশ, উন্নত দেশ, ধর্ম এবং কুসংস্কারমুক্ত দেশ, গণতন্ত্রের, বাকস্বাধীনতার, আর মানবাধিকারের জন্য শ্রেষ্ঠ দেশ।
৭৯৩ থেকে ১০৬৬ সাল। যে সময় ভাইকিংরা খুন আর লুটতরাজে ব্যস্ত, কী করছেন তখন আমাদের এ অঞ্চলের পূর্বসূরিরা? কাব্য রচনা করছেন, সংগীত সাধনা করছেন, দর্শন আওড়াচ্ছেন, শিল্প, স্থাপত্য আর সংস্কৃতির চর্চা করছেন। অত শিক্ষা সভ্যতা দিয়ে কী হল? আজ এ অঞ্চল পিছিয়ে থাকা, দারিদ্রে, ধর্মান্ধতায়, মূর্খতায়, অসভ্যতায় ডুবে থাকা। এতে সত্যিকার গণতন্ত্র নেই, বাকস্বাধীনতার বও নেই, মানবাধিকার তো নেইই।
Leave a Reply