০১. শেষ রাত্রের বাতাস

মহাকালের রথের ঘোড়া – সমরেশ বসু
প্রথম সংস্করণ: জুলাই ১৯৭৭

ভূমিকা

ইতিহাস লিখতে বসি নি। ভুগোলও না। অতএব, উক্ত দুই বিচারে ত্রুটিমুক্ত নই। চরিত্র ও ঘটনার কি কোনো বাস্তব সম্পর্ক আছে? নেই। কল্পনায়? আছে। লেখকের কল্পনা যেখান থেকে উদ্ভাবিত হয়, এ কাহিনী সেখান থেকে গৃহীত, পরিণতিও তেমনই সৃষ্টিছাড়া, আর একান্ত আপন।।

স. ব.

.

….সারথ্য করেছেন যাঁরা
নেপথ্যে ভূমিকা মন্ত্রণাদাতার
নেতা যাঁরা মত ও পথের নীতির স্রষ্টা
সৈনাপত্যবিদ্যাকুশলী যারা
ধারক মারণাস্ত্রের নিপুণ গাণ্ডীবধারী
হুংকার করেছেন বীরদর্পে
কেহ বা বয়সোচিত অভিজ্ঞতায়
ছিলেন স্থিতপ্রজ্ঞ বিষন্ন
ভয়ংকর জ্ঞাতি বিবাদে।
হা সত্য ! গৌরব করি হে তোমার
ধিক্কার, মিথ্যা! তোরে
যে যাঁর কণ্ঠে নিয়ে বাণী
করেছেন প্রচার।
ইতিহাসে খ্যাতনামা তাঁরা
কী হয় বিচার আঠারো অক্ষৌহিণীর।
দলীয় বিশ্বাসে বিশ্বস্ত।
সমর্পিত-প্রাণ-নেতাদের প্রতি
লড়েছিল জান কবুল কী নাম ওদের? শহীদ ?
অতীতেও লড়েছিল ওরা মরেছিল নামহীন
তারো পরে হাজার হাজার বছর
বহু মত ও পথের সিদ্ধান্তে
নয়া নয়া নীতির ধ্বজা ঘাড়ে
লড়ে চলেছে ওরা নামহীন আঠারো অক্ষৌহিণী।
বিশ্বস্ত প্রশ্নহীন যোদ্ধারা লড়ে চলে
লেখা হয়ে চলে ইতিহাস।
ধ্বংস আর নব-নির্মাণের মাঝে
অখ্যাত সেই কোটিদের নাম কী।

যেন দেখি নিরন্তর
ছুটে চলে মহাকাল।
বিশ্ব নিয়মের অধীন ওরা অশ্ববাহিনী
চিরকাল টেনে চলে রথ।

শেষ রাত্রের বাতাস গায়ে লাগলেই টের পাওয়া যায়। রাত্রি শেষের বাতাসের স্পর্শের স্বাদ আলাদা। চোখ বুজে থাকলেও টের পাওয়া যায়, রাত তাড়ানো বাতাস বইছে। দিন এল। অভিজ্ঞতাটা অনেক দিনের পুরনো, আর তা থেকেই মোটামুটি এক রকম জানা হয়ে গিয়েছে। সব ঋতুতেই ভোরের দিকে রাত তাড়ানো বাতাস বহে। গরমে বর্ষায় শীতে।।

ঝিমুনি বা ঘুম, রুহিতনের চোখে কোনওটাই নেমে আসেনি। কিন্তু সে চোখ দুটো বুজে ছিল। ঘুম যা হবার প্রথম রাত্রেই হয়েছিল অফিসের বেঞ্চির ওপরে।

তিন রাত্র ধরে এ রকম একটা ব্যাপার চলেছে। এ রকম বলতে এক রকম না, নানা রকম। গতকাল রাত্রে তাকে গাড়িতে তোলা হয়েছিল মধ্য রাত্রের কিছু পরেই। অথচ জানানো হয়েছিল, সকালবেলাই যাত্রা। আগের দিন রাত্রেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সকালবেলা যাত্রা।

আসল শুরুটা হয়েছিল সাত দিন আগে। আজ থেকে সাত দিন আগে, প্রথম সে জেল ওয়ার্ডারের কাছ থেকে জানতে পেরেছিল, তাকে নাকি অন্য কোনও জেলে নিয়ে যাওয়া হবে। ওয়ার্ডার কথাটা মিথ্যা বলেনি। কিন্তু কেন বলেছিল, রুহিতন তা অনুমান করেছিল। কয়েক দিন পরে। জেল কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই ওয়ার্ডারকে এই রকম শিখিয়ে দিয়েছিল—শেখানো মানে নির্দেশ, রুহিতনকে জানাতে হবে, সেই দিনই তাকে অন্য জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সাত দিন আগে, সকালবেলা বদলি ডিউটিতে এসে ওয়ার্ডার কথাটা তাকে যখন বলেছিল, তখন সেখানে রাত্রের বিদায়ী ওয়ার্ডার আর কয়েকজন বন্দি ছিল। বন্দিদের সকলের সঙ্গেই রুহিতনের চোখাচোখি হয়েছিল। বন্দিরা সকলেই তার জেলের বাইরের পরিচিত ছিল না, দু জন ছাড়া। কিন্তু সকলের ওপর একই শ্রেণীর অভিযোগ ছিল। খুন জখম লুট আগুন লাগানো অরাজকতা সৃষ্টি করা। এবং সর্বোপরি রাজদ্রোহিতা, বলপূর্বক রাষ্ট্রক্ষমতা দখল। সকলের উদ্দেশ্যও এক, অতএব তারা সমধর্মী। যদিও রুহিতন এ বিষয়ে নিশ্চিত ছিল না সকলেই তারা সমধর্মী, সকলেরই এক উদ্দেশ্য, সকলেই দলের। কথাটা ভাবলেই দাঁতে দাঁত চেপে বসে। চোখের কোণে অনিবার্য সন্দেহ ধারালো হয়ে ওঠে। বুকের মধ্যে ঝলকিয়ে ওঠে ঘৃণা। কারণ অভিজ্ঞতা বড় তিক্ত। বিশ্বাসঘাতকতা আর ক্ষতির পরিমাণ ভয়াবহ, যার কোনও বদলা নেই। পাহাড়ের জোঁকের মতোই অনেক তথাকথিত সমধর্মী ঘাসের সঙ্গে ঘাসের রঙে মিশে থাকে। খাঁটি আর ভেজালে আলাদা করা কঠিন। লাল মাটির সঙ্গে মিশে থাকা মেটে বোরার মতো। এমনকী তার আচমকা ফণাও নেই। হিসিয়ে বা উচিয়ে ওঠে না দুরন্ত ফণা। যে সাপগুলোকে সাহসী দপী মনে হয়। এই লাল মেটে সাপগুলো, বা ঘাস-রং পাহাড়ি জোঁকগুলো বাইরের থেকে আমদানি করা দালাল। কর্তৃপক্ষের পোষা, ইশারায় চলে। এরা অজানতেই ছোবল মারে।

রুহিতন সাবধান, সচেতন, তবু সবাইকেই সে বিশ্বাস করতে চায়, বন্ধুর মতো থাকতে চায়। যদিও কোনও কোনও বন্দির ক্ষেত্রে তা প্রায় অসম্ভব। সে নিরুপায়। কিন্তু সাত দিন আগে, ওয়ার্ডারের মুখে কথাটা শুনে, বন্দিদের সঙ্গে সে কেন চোখাচোখি করেছিল, অথবা অন্য বন্দিরাই বা কেন, সে কি জানত? তার এবং অন্তত কয়েকজন বন্দির চোখগুলো হঠাৎ কেমন ঝিলিক হেনে উঠেছিল। কেন? কেনই বা রুহিতনের বুকে ঢাকের বাদ্যির মতো ধকধকিয়ে উঠেছিল? কোনও দুরন্ত আশা? না, কোনও ভীষণ ভয়?

ভয়? রুহিতন কুরমি সে। এই তার নাম। নামটা নাকি তার নানা, বাবার বাবা রেখেছিল। রুহিতন। তাসের নাম। ঠাকুরদা কেন তাসের নামে নাম রেখেছিল, কে জানে? লোকটা ছিল তিন পুরুষের চা বাগানের মজুর। রুহিতন চা বাগানে ছেলেবেলায় কিছুদিন কাজ করেছিল। তার বাবাকে নিয়ে, তরাইয়ের চা বাগানে চার পুরুষ। সে পাঁচ পুরুষ। কিন্তু তার বাবা পোশ্পত্(পশুপতি) প্রথম বাগানের কাজ ছেড়ে, আবাদের কাজে লেগেছিল। চা বাগান ছাড়িয়ে ভিতর দিকে, নদীর কিনারে। রুহিতনও আর কখনও চা বাগানে ফিরে যায়নি। সে বাবার সঙ্গে চাষ আবাদের কাজেই লেগে গিয়েছিল। চাষ-আবাদ মানেই ঘর গৃহস্থালি। চা বাগানের জীবন না! এক টুকরো জমি পোশ্পত্ কুরমি কোরফা রায়ত হিসাবে জোগাড় করতে পেরেছিল। সামান্য এক টুকরো, ভূমিহীন কৃষক নাম ঘোচাবার মতো যথেষ্ট না। জোতদারদের জমি চাষ করাই ছিল আসল কাজ। তবু চার পুরুষের সেই পরিবর্তনের মধ্যে, নিজেকে ফিরে পাবার একটা নতুনের স্বাদ আর উৎসাহ ছিল। ছিল স্থিতি আর স্থায়িত্বের একটা আশা। নেশা না, একটা তৃষ্ণা জমি-চাষ-আবাদ সম্পন্ন গৃহস্থালি। রক্তের মধ্যে এই তৃষ্ণা।

সেই জায়গাটার নাম এখন দুনিয়া জানে। যেখান থেকে রুহিতনদের বাস ছিল, নীচের দক্ষিণ-পূর্বে। তরাইয়ের মেচি নদীর বালুচর থেকে, ঝোরার গা বেয়ে উঁচুতে উঠে যাওয়া বন ঘেরা অঞ্চল। সেই জায়গাটার মতোই, দুনিয়া এখন রুহিতন কুরমির নামটাও জানে। রুহিতন কি ভয় পেয়েছিল, ওয়ার্ডারের ইচ্ছাকৃত প্রচারে, তাকে অন্য জেলে নিয়ে যাওয়া হবে শুনে?

মরার বাড়া নাকি গালি নেই। গালি মানে ভয়। মৃত্যুভয়, শেষ ভয়। সব থেকে বড় ভয় তা-ই ওর থেকে বড় গালিই বা আর কী থাকতে পারে। মারতে হলে মরতেও হয়। প্রাণ পণ রাখা লড়াই তাকে বলে। রুহিতন মরার ভয় জলাঞ্জলি দিয়েছিল এ লড়াইয়ের শুরুতে না! ছেলেবেলায় তীর ধনুক নিয়ে যখন শিকারের খেলায় হারিয়ে যেত বনের মধ্যে, তখন থেকেই বাঁচা মরা সমান ছিল। মারা আর মরা, লড়াইয়ে এটা হল সমার্থক। মারতে হলে যেমন মরতে হয়, তেমনি মারার জন্যই বাঁচতে হয়। রুহিতন জানে। জেনেছে, মরা দেখে। বন্ধুদের মৃত্যু দেখে সে বাঁচার দরকার কেন তা জেনেছে। জেলের বাইরে মৃত্যু ছিল পায়ে পায়ে। জেলের ভিতরে ছায়ার মতো গায়ে গায়ে। ভয় আর মৃত্যু সমান। দুটোই সে জীবন থেকে খারিজ করেছে।

ভয় না, একটা তীক্ষ্ণ সন্দেহ ঝলকিয়ে উঠেছিল। তার সঙ্গে নিশ্চয়ই একটা আশা ! যত সামান্য হোক, তবু অসামান্য সেই আশা। সেই আশার নাম মুক্তি। অথবা পলায়ন। অথবা একটা অপ্রত্যাশিত সুযোগ! সেই জন্যই চোখগুলো ঝিলিক হেনে উঠেছিল। আর সন্দেহের কারণ খতম। অন্য জেলে নিয়ে যাবার নাম করে, চিরদিনের জন্য লোপাট। পুলিশি খতমের এটা একটা পদ্ধতি। এক জেল থেকে আর এক জেলে নিয়ে যাওয়ার পথে, কোনও গভীর জঙ্গলে, গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে গিয়ে, অথবা কোনও খরস্রোতা নদীর পাড়ে—অন্ধকার রাত্রে, কোমরের বেল্ট থেকে খোলা চেমবার’-এর কয়েকটা গুডুম গুম শব্দ। ওরা বড় সুখী। কেউ কোনও দিন জানবে না, রুহিতন কুরমি কোন জেলে আছে। রুহিতন কুরমি কোন জেলে? রুহিতন কুরমি কোন জেলে?…একটি ঘোষণাঃ ‘রুহিতন কুরমি পলাতক।’ চোখগুলো আসলে ঝিলিক হেনে উঠেছিল এই দুই কারণে। দুটি বিপরীত কারণে, আশায় আর সন্দেহে।

রুহিতন চোখ মেলে তাকাল। ধরা পড়ে, জেলে আসার পরেও, অনেক দিন সে ঘুমোতে পারেনি। ঘুমানো সম্ভবও ছিল না। ঘুমোতে দেওয়া হত না। জিজ্ঞাসাবাদ আর তার কায়িক পদ্ধতিগুলো এমন ছিল, ঘুম আসত না। কখনও কখনও ওরা ঘুমের ওষুধ দিলে আলাদা কথা। ইদানীং সে জেলের মধ্যে ঘুমাত। খাঁচার বাঘ যেমন পদচারণা করতে করতে এক সময় ক্লান্তিতে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। যে ঘুমে, ঘুমের সুখ নেই। নিশ্চিন্তি নেই। কারণ মেচি নদীর দূর তীরের জঙ্গল উত্তর আর দক্ষিণ আর পশ্চিমের তরাইয়ের দিগবিসারি কর্ষিত ভূমি, জঙ্গল আর ঝোরার কলকলানি অষ্টপ্রহর হাতছানি দেয়। প্রতি মুহুর্তেই দেয়। দু বার দুই জেলে মোক্ষম হাতছানির মার সামলাতে গিয়ে রক্তাক্ত অচৈতন্য হয়ে পড়ে থাকতে হয়েছিল। অথচ মরেনি। সেজন্য তার বন্ধুরাই সব থেকে আশ্চর্য হয়েছিল। দুবারের চেষ্টাই ছিল খুব কাচা, তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।

রুহিতন এখন চলন্ত জিপ গাড়িতে। চলন্ত গাড়িতে ঘুমোবার কোনও প্রশ্নই নেই। তবু চোখ বুজেছিল। তাকিয়ে দেখবার কিছুই ছিল না। অন্ধকারে চারটে মানুষের আর চারটে অস্পষ্ট রাইফেলের অবয়ব ছাড়া। পিছন থেকে ঘাড়ে আর কানের পিঠে ভোরের বাতাসের ছোঁয়া তাকে রাত্রি শেষের সংকেত দিল। সে চোখ খুলে তাকাল। চোখ খুলে তাকিয়ে, সামনে একটা অস্পষ্ট লাল আভা দেখতে পেল। দেখতে পেয়েই তৎক্ষণাৎ চোখ বুজল। গাড়ির পিছন দিকে তার মুখ ফেরানো। পিছন দিকটা তো ঢাকা। লাল আভাটা কীসের? তার ভুরু কুঁচকে উঠল। সারা মুখে ফুটল একটা কষ্টের ভাব।

সে জিপের সামনের আসনের গায়ে পিঠ রেখে বসেছে। জিপের পিছনের দুদিকে বসার জায়গার মাঝখানে, ছোট একটা কাঠের চারপায়ার ওপর তার বসবার ব্যবস্থা হয়েছে। কালো কম্বল ঢাকা পা দুটো সামনের দিকে ছড়ানো। তার গায়েও কম্বল ঢাকা ছিল। এখন কাঁধের কাছ থেকে কম্বল খানিকটা খসে পড়েছে। ঢেকে দিতে পারলে ভাল হত। কারণ তার শীত করছে। এখন ঠাণ্ডা লাগবার কথা না। ভোরের এই রাত তাড়ানো বাতাসে বরং আরাম লাগবার কথা। কিন্তু তার শীত শীত লাগছে।

আজকাল প্রায়ই এ রকম লাগে। শরীরটাও যেন গরম হয়ে থাকে। জ্বর হয় কি না সে বুঝতে পারে না। কারোকে কখনও বলেনি। সাত বছর জেলবাসের মধ্যে বছর খানেক এরকম জ্বর জ্বর ভাব লাগে মাঝে মাঝে। এমন কিছু একটা কষ্ট বা যন্ত্রণার ব্যাপার কিছু না। এ নিয়ে কারোকে কিছু বলতেও ইচ্ছা করেনি। কিন্তু এখন কাঁধে ঘাড়ে গলায় কম্বলটা জড়িয়ে নিতে ইচ্ছা করছে। চলন্ত গাড়ির বাতাসে শীতটা কেমন কাঁটার মতো ফুটছে। অথচ উপায় নেই। তার হাতে আর পায়ে লোহার বেড়ি পরানো। পায়ের বেড়ির সঙ্গে হাতের বেড়ি জোড়া। এ অবস্থায় হাঁটু মোড়া যায় না। কুঁচকির নীচে থেকে পরানো লোহার বলয়ের সঙ্গে, দুই পায়ে ফ্রেমের মতো করে বেড়ি পরানো। দু হাতে পরানো হ্যান্ডকাফ তার সঙ্গেই আটকানো।

রুহিতনকে অবিশ্যি জেলে এ রকম বেড়ি পরিয়ে রাখা হয় না। কখনও রাখা হয়নি, তা না। দু বার পালাতে ব্যর্থ হয়ে, তাকে জেলের মধ্যেই এরকম ভান্ডা-বেড়ি পরতে হয়েছিল। স্বাভাবিক চলাফেরা বন্ধ ছিল। এখন বেড়ি পরানোটা সাময়িক। তিন দিন আগেই পরানো হয়েছে। এটা ওদের ভয় আর সাবধানতা। পিছনে চারজন রাইফেলধারী তার দু পাশে। সামনে তিনজনই সশস্ত্র। ড্রাইভার, আর দুজন অফিসার। এক জেল থেকে আর এক জেলে পৌছুবার পথে, রুহিতন কুরমি যেন পালাবার কোনও চেষ্টা না করতে পারে, সেইজন্য এই বেড়ি। রুহিতন জানে, জীবিত পালানোর থেকে তার মৃতদেহও যেন সরকারে জমা পড়ে। তা হলেও এদের ক্ষমা আছে। না হলে এদের ক্ষমা নেই। যারা তাকে তিন রাত্র ধরে বিভিন্ন সময়ে পাহারা দিয়ে নিয়ে চলেছে। রুহিন আরও জানে, পিছনে আর একটা গাড়ি আসছে। সামনের সমস্ত থানায় খবর দেওয়া আছে।

এই মুহূর্তে তিন রাত্রের কথাটাই শেষ না। রুহিতনের কাছে সবই অনিশ্চিত। আদৌ তাকে কোনও জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কি না, অথবা এই রকম আরও রাত্র সামনে আসবে, আর তারপরে এক জায়গায় হঠাৎ হয়তো গাড়ি দাঁড়াবে, আর তাকে নামিয়ে নেওয়া হবে, আর তারপরেই—তারপরেই….।

রুহিতন প্রস্তুত সেই সময় ও মুহুর্তের জন্য। কারণ সেই সময় ও মুহুর্তটি কেবল ওদেরই সুযোগ না। অপ্রত্যাশিত সুযোগ এনে দিতে পারে রুহিতনকেও। যদিও হিসাবে ঠিক সাতটা রাইফেল আর পিস্তল ওদের কাছে আছে। তবে রুহিতন একটা ব্যাপার বুঝতে পারছে। প্রতি মুহুর্তে কালভার্ট, ঘন ঘন দীর্ঘ সেতু আর উঁচু-নিচু রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে না। সমস্ত রাস্তাই প্রায় সমতল। এত লম্বা সমতল রাস্তা কোথায় চলে গিয়েছে?

আজ থেকে সাত দিন আগে, ওয়ার্ডার দিয়ে তাকে অন্য জেলে নিয়ে যাবার কথা জানানো হয়েছিল। কিন্তু দু দিন কোনও সংবাদ আসেনি। জেল কর্তৃপক্ষ তাকে কিছু বলেনি। কিন্তু তারা বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছিল। তারা জানত, ওয়ার্ডারের কথা মিথ্যা হলেও, নিশ্চয়ই সেই প্রচারের মধ্যে কোনও উদ্দেশ্য আছে। বিনা মতলবে ওরা কখনও মুখ খোলে না, কোনও কথা বলে না। তারপরেই, আজ থেকে পাঁচ দিন আগে হঠাৎ সন্ধ্যাবেলায় তাকে অফিসে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সকলের সামনেই জানানো হয়েছিল তাকে অন্য জেলে নিয়ে যাওয়া হবে। রুহিতন ভেবেছিল, সেই রাত্রেই তাকে নিয়ে যাওয়া হবে। হয়নি। বরং অফিসে রাত্রি ন’টা পর্যন্ত সশস্ত্র প্রহরায় রেখে, সেই জেলেরই অন্য এক অংশে একটি নির্জন সেলে তাকে রাখা হয়েছিল। দুই রাত্র আর পুরো একটা দিন তাকে সেই পাঁচিল ঘেরা নির্জন এলাকার সেলে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। বাইরে গিয়ে তাকে কোনও পাইখানা ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি। সেলের মধ্যেই লোহার চারপায়া লাগানো কমোড (ওটাকে যে কমোড বলে, রুহিতন প্রথম গ্রেপ্তারের পরেই অভিজ্ঞতাতেই জেনেছিল।) দিয়েছিল। চান করার কোনও সুযোগ দেয়নি। খাবার দেওয়া হয়েছিল সেলের মধ্যেই।

নির্জনে পাশাপাশি সেই কয়েকটা সেল ছিল, পাঁচিল ঘেরা পোড়া জমির ওপরে। অন্য কোনও সেলে আর কেউ ছিল না। সেলগুলো ছিল ঠাণ্ডা, স্যাঁতসেঁতে। পুরনো ইঁট আর শ্যাওলার গন্ধ ছিল। পোড়ো জমির ওপরে একজন করে ওয়ার্ডার বিভিন্ন সময়ে ঘুরে ঘুরে ডিউটি দিত। রুহিতন যেচে কোনও কথা বলত না। ওয়ার্ডাররাও তার সঙ্গে কোনও কথা বলত না। সেই নির্জন সেলে একটাই মাত্র লোক তাকে খাবার দিতে আসত। খাবার ঢুকিয়ে দিত গরাদের নীচের ফাঁক দিয়ে। দু বার একটাই মাত্র লোক নাকে মুখে কাপড় জড়িয়ে, আলগা কমোডের লোহার বালতির মতো পাত্র বদলিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। তখন সঙ্গে সশস্ত্র প্রহরী থাকত। কিন্তু কেউ-ই তার সঙ্গে একটি কথাও বলেনি।

নিজের কাছে ফাঁকি চলে না। রুহিতন কারোকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি, কিন্তু তার মনের ভিতরটা নির্বিকার ছিল না। তাকে আদৌ অন্য কোনও জেলে নিয়ে যাওয়া হবে কি না, সে ঠিক অনুমান করতে পারছিল না। ওদের মতলবটা সে ঠিক ধরতে পারছিল না বলেই, নানা রকম ভাবনা তার মাথায় পাক খাচ্ছিল। সে জানত, ভাবনা অর্থহীন। যে কোনও রকম ঘটনার মুখোমুখি হতে সে মনে মনে প্রস্তুত ছিল। ঘটনা মানে, দুর্ঘটনা। মনে মনে প্রস্তুত থাকার মতো, ভাবনাটাও ছিল অনিবার্য। সে বুঝতে চাইছিল, তাকে নিয়ে ওরা কী করতে চায়। একই জেলখানার মধ্যে, হঠাৎ তাকে সকলের কাছ থেকে আলাদা করে নির্জনে একলা রাখার নানা কারণ থাকতে পারে। রুহিতনের মনে কোনও সন্দেহ ছিল না তার বন্ধুরা জানত না, সেই জেলেরই অন্য এক জায়গায় তাকে রাখা হয়েছে। সম্ভবত যে সব ওয়ার্ডার, প্রহরী আর অন্য দু-একজন আসত, তারা আর জেলের কর্তাব্যক্তি কয়েকজন ছাড়া, জেলের কেউ-ই জানত ন! সে কোথায় আছে।

‘রুহিতন।’ জিপের সামনের আসন থেকে মোটা স্বরে ডাক ভেসে এল।

রুহিতন চোখ মেলল না। কোনও জবাব দিল না। তার ভুরু আর মুখের চামড়া কুঁচকে উঠল। যেন সে একটা আঘাত বা যন্ত্রণা পেল। অথচ সামনের আসনের স্বরে কর্কশতা বা হুকুম ছিল না। বরং এক্ষেত্রে যা প্রায় অস্বাভাবিক, নাম ধরে ডাকলেও, কিছুটা যেন সম্রম আর অমায়িকতা রয়েছে সেই মোটা স্বরে। রুহিতনের জবাব না পেয়েও, সামনের আসন থেকে মোটা স্বরে জিজ্ঞাসা ভেসে এল ‘সিগারেট ধরাবে নাকি একটা?’

রুহিতন তথাপি, তৎক্ষণাৎ কোনও জবাব দিল না। কিন্তু সিগারেটের নামে তার মুখের ভিতরটা ভিজে উঠল। গাড়িতে ওঠার পরে সে একটাই সিগারেট খেয়েছিল। রাত্র তখন কটা ঠিক জানা ছিল না। বারোটা হতে পারে, দুটোও হতে পারে। তিন রাত্র এই ভাবেই চলেছে। ঠিক এক ভাবে না। সেই নির্জন সেল থেকে পরশু রাত্রি ন’টার পরে তাকে আবার অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যাবার আগে, সেই সেলের মধ্যেই তাকে হাতে পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিয়েছিল। সশস্ত্র প্রহরীদের সামনে দুজন ওয়ার্ডার তাকে বেড়ি পরিয়েছিল। একমাত্র তখনই সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল ‘এখন বেড়ি পরাবার মানে?’ সম্ভবত তার মাজা মাজা রং বিশাল শরীরটা শক্ত হয়ে উঠেছিল।

‘হুকুম আছে।’ একজন ওয়ার্ডার নিচু কঠিন স্বরে জবাব দিয়েছিল। সেলের হলদে আলোয়, রুহিতন প্রহরী আর ওয়ার্ডারদের মুখের দিকে তাকিয়েছিল। তাদের সকলের মুখগুলোই ভীষণ গম্ভীর আর শক্ত দেখাচ্ছিল। তাদের ছায়ায় সেলের গোটা মেঝেটা আর সাদা স্যাঁতসেঁতে দেওয়ালের অর্ধেক ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। তারা কেউ সোজাসুজি না চোখের কোণ দিয়ে যেন ক্রুর দৃষ্টিতে রুহিতনের দিকে দেখছিল। কিন্তু রুহিতনের মনে হয়েছিল আসলে ওরা ক্রুর বা নিষ্ঠুর কিছুই না। তার ধারণা, হুকুম পালনে ওরা এমনই তটস্থ, আপনা থেকেই শক্ত আর কাঠ হয়ে যায়। রুহিতনদের ওরা কখনওই খুব সোজা চোখে দেখে না!

সেল থেকে বেড়ি পরিয়ে অফিসে নিয়ে গিয়ে, পাশের একটা ঘরে বেঞ্চির ওপর শুতে দিয়েছিল। রুহিতন জানত প্রশ্ন করা বৃথা। তার খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। এ রকম বেড়ি পরা অবস্থায় শুতে কোনও অসুবিধা নেই। শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসতেই যা কষ্ট। কারণ কোনও অবস্থাতেই হাঁটু মোড়বার কোনও উপায় থাকে না। দুহাত জোড়া লাগানো থাকে উরতের কাছে, বেড়ির সঙ্গে। রুহিতন বেঞ্চির ওপরেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। বেঞ্চির ওপরে যে রকম ঘুমানো সম্ভব। পড়ে যাবার ভয় ছিল। একটা ঘুম ঘুম তন্দ্রার ঘোরের মধ্যেই, এই মোটা গলার স্বরের ডাক সে শুনতে পেয়েছিল। জিপের সামনের আসন থেকে যে-স্বর এখন তাকে ডেকে সিগারেট খাবার কথা জিজ্ঞেস করছে।

রুহিতন তন্দ্রার ঘোরে, একটু অবাকই হয়েছিল। জেলের কোনও অফিসার বা কারোর পক্ষে তাকে ওরকমভাবে ডাকা সম্ভব ছিল না। যেন চেনাশোনা পড়শি বা নিজেরই আপনার লোক কেউ, ডেকে বলেছিল, ‘কই রুহিতন ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?’

রুহিতন তন্দ্রা ভেঙে কিছুটা ব্যস্ত ত্রস্ত হয়ে উঠতে যাচ্ছিল। এই স্বরই ব্যস্তভাবে বলে উঠেছিল, ‘আহা কর কী কর কী? পড়ে যাবে যে।’ বলে এগিয়ে এসে ঘাড়ের নীচে হাতের ঠেলা দিয়ে তুলে বসিয়ে দিয়েছিল। রুহিতন লোকটার দিকে তাকিয়ে দেখছিল। খাকি ইউনিফর্ম পরা একজন অফিসার। কোমরের বেল্টের সঙ্গে খাপে ঢাকা রিভলবার। মাথার সামনের দিকটা প্রায় ফাকা, বিশেষ চুল নেই। লম্বা চওড়া শক্ত চেহারার মানুষ। বোঁচা নাকে আর চোখের কোলে ভাজ পড়ে যাওয়া হাসিতে একটা চেনা বন্ধুর ভাব ফুটে উঠেছিল।

রুহিতনের নাকটা অবিশ্যি ফুলে উঠেছিল। ভুরু জোড়া কুঁচকে উঠেছিল। অফিসারটিকে চিনতে পেরেছিল সে। না চেনবার কোনও কারণ ছিল না। এইবার নিয়ে লোকটির সঙ্গে তার চার বার দেখা। প্রথম দেখেছিল বছর দশেক আগে। লোকটি তখন ছিল খড়িবাড়ি থানার একজন দারোগা। ছোটবাবু। তখন চেহারাটা আর একটু রোগা ছিল। প্রায় মাথা ভরতি চুল ছিল। কিন্তু চোখ নাক ভুরুই বোধ হয় মানুষকে চিনিয়ে দেয়। তিন বছর পরে, রুহিতন যখন যুদ্ধ করে ধরা পড়েছিল, তখন এই লোকটির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। রুহিতন একলাই রক্তাক্ত ছিল না। এই লোকটিও রক্তাক্ত ছিল। লোকটির কাঁধের কাছে রুহিতনদেরই কারোর হাতের ধনুক থেকে তীর বিঁধেছিল। নিশ্চয়ই বিষমাখা তীর ছিল না। তা হলে লোকটির বেঁচে থাকার কথা না। আক্রমণটা আচমকা ঘটেছিল। প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত হওয়াই যায়নি। উপরন্তু রুহিতনদের বহু অস্ত্র ধরা পড়ে গিয়েছিল। এই লোকটির হাতে তার রিভলবার এমনভাবে উদ্যত হয়েছিল, যেন যে কোনও মুহূর্তে রুহিতনদের কারোকে গুলি করতে পারত। কিন্তু তার কোনও দরকার ছিল না। ধৃত রুহিতনরা এমনিতেই পর্যদস্ত ছিল। প্রহারে প্রহারে ছিল জর্জরিত। রুহিতনের দিকেই ওদের লক্ষ্য ছিল বেশি। অবিশ্যি রুহিতন নিজে কখনওই তার নাম বলেনি, বরং পরিচয় অস্বীকারই করেছিল। তাতে অবিশ্যি কোনও ফল হয়নি। এই লোকটি তার চেম্বার তুলে, দাঁতে দাঁত পিষে বলেছিল,’ তুমি যদি রুহিতন কুরমি না হতে, তা হলে এতক্ষণে তোমার মাথাটা আমি গুলি করে উড়িয়ে দিতাম। আমি নিজে দেখেছি, তোমার হাতে আমাদের একজন হেড কনস্টেবল মরেছে।’

রুহিতনের রক্তাক্ত মুখ ভাবলেশহীন ছিল। ভাবলেশহীন চোখেই সে লোকটির দিকে তাকিয়ে ছিল। একই ইচ্ছা তার মনেও ছিল, মাথা উড়িয়ে দেবার। কিন্তু পুলিশের আচরণ আর বিভিন্ন কথাবার্তায় তখনই তার সন্দেহ হয়েছিল, ওরা অনেক খবর জানে। তার সন্দেহ হয়েছিল, দলের মধ্যে কি কেউ বিশ্বাসঘাতক আছে? রুহিতনদের এত সব অতি গোপন সংবাদ এরা পেল কেমন করে?

তারপরে কয়েক মাসের মধ্যেই, এই অফিসারটির সঙ্গে তার আবার দেখা হয়েছিল। জায়গাটা যে কোথায়, রুহিতন তা কোনও দিন জানতে পারেনি। সেটাকে একটা পুলিশ ক্যাম্প আর পুরনো হাজতখানা বলা যায়। হতে পারে, কার্শিয়াং, কালিম্পং বা শিলিগুড়ির সাবজেল। অথবা জলপাইগুড়ি জেলখানা। দার্জিলিং জেল হলে অনেক বেশি শীত করত। রুহিতন জায়গাটা চিনতে পারেনি। তার চেনা বন্ধুরাও সেখানে কেউ ছিল না। কেবল এক বারই, জিজ্ঞাসাবাদের মাঝখানে তাকে হঠাৎ ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কতগুলো গাছপালার ভিতর দিয়ে। এক জায়গায় দাঁড়াতে বলে, ডান দিকে তাকাবার নির্দেশ দিয়েছিল।

রুহিতন তাকিয়ে দেখেছিল, প্রায় একশো হাত দূরে, তার এক নেতা কমরেড, খোলা জায়গায় টেবিলের সামনে, একজনের মুখোমুখি বসে সিগারেট টানছে, কী যেন বলাবলি হচ্ছে। রুহিতনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সে তার নেতাকে দেখতে পাচ্ছে কি না? রুহিতন স্পষ্টই জানিয়েছিল, কে নেতা? লোকটাকে সে আদৌ চেনেই না। কিন্তু তাকে জানানো হয়েছিল, ওই নেতাই রুহিতনের সম্পর্কে সব কথা জানিয়ে দিয়েছে। অতএব তার স্বীকারোক্তি না করার কোনও মানে হয় না।

রুহিতন দাঁতে দাঁত চেপে ঘৃণায় আর রাগে মনে মনে হেসেছিল। সে জানত, সবটাই ওদের বানানো ঘটনা, গল্প। মনের মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টির ধাপ্পা। সেই নেতা ছিল পাথরের মতো শক্ত আর খাঁটি। আসলে সেই নেতাকেও ধরে এনেছিল ওরা। সেই কমরেডকে ছাড়া, আর কোনও চেনা বন্ধুকেই সে সেই জায়গায় দেখতে পায়নি।

সেই সময় চলছিল জিজ্ঞাসাবাদ আর স্বীকারোক্তির পালা। এই লোকটিকে সে এক বারের জন্য সেখানে দেখেছিল। লোকটির গায়ে তখন কোনও ইউনিফর্ম ছিল না, সাদা পোশাক বলতে যা বোঝায় তাই ছিল। রুহিতন ভেবেছিল, লোকটি বোধ হয় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে, আবার তার ওপরে কায়িক অত্যাচার চালাবে। তার কিছুক্ষণ মাত্র আগেই, প্রচণ্ড প্রহারে সে জর্জরিত ছিল। কিন্তু লোকটি হেসে বলেছিল ‘কী হবে আর এত চেপে রেখে। যা জানো তা বলেই দাও। আজ না হোক দু দিন বাদে আমরা সবই জেনে যাব। তোমাদের আসল কেল্লা তো আমরা চুরমার করে দিয়েছি।’ কিন্তু বলেনি, ‘তোমাদের সব নেতাদেরই আমরা ধরে ফেলেছি।’ বরং একটা নড়বড়ে টেবিলের ওপরে, রুহিতনের পেতে রাখা মাথার কাছে একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘সিগারেট চলবে নাকি?’

রুহিতন মাথা না তুলেই, সন্দিগ্ধ চোখে লোকটির দিকে তাকিয়েছিল। তার শরীরে তখন অসহ্য যন্ত্রণা। বিশেষ করে গুহ্যদ্বারে। সেখানে একটা মোটা রুলের অনেকখানি ঢুকিয়ে চাড় দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে রক্তপাত হচ্ছিল। বিড়ি সিগারেটে সে বরাবরই আসক্ত। একটু সিগারেট টানতে পারলে হয় তো যন্ত্রণা ভোলা যেত। কিন্তু লোকটা সিগারেট খাইয়ে, তারপরে আবার কথা আদায়ের জন্য জমিয়ে বসবে না তো? তবু সে মাথা একটু তুলে, একটা হাত বাড়িয়ে সিগারেটটা নিয়েছিল। লোকটি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেশলাইয়ের কাঠি ধরিয়েছিল। রুহিতন সিগারেট ঠোঁটে চেপে, ধরিয়ে নিয়েছিল। লোকটি প্রায় তাকে অবাক করে দিয়ে বলেছিল, ‘চলি, আমার এখানকার কাজ শেষ।’

বলেই চলে গিয়েছিল। তারপরে তিন দিন আগে, রাত্রের অজানা প্রহরে জেলের অফিস ঘরে দেখা হয়েছিল। প্রায় সাত বছর পরে দেখা হলেও, রুহিতন চিনতে পেরেছিল। তার খুশি হবার কোনও কারণ ছিল না। লোকটিকে দেখেই মনে হচ্ছিল, সে আর খড়িবাড়ি থানার নিতান্ত সাব ইন্সপেক্টর নেই। তার চালচলন, আর জেলের কর্মচারীদের, তার প্রতি আচরণ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, লোকটির পদোন্নতি হয়েছে, অফিসার হয়েছে। রুহিতন এখন এ সব সহজেই বুঝতে পারে।

কিন্তু অফিসারটি ঘাড়ের পিছনে হাত দিয়ে ঠেলে তুলে না দিলে, মেঝেতে পড়ে যেত সে। তা ছাড়া, ওভাবে হাসবারই বা মানে কী? কোনও অফিসার রুহিতনের দিকে তাকিয়ে ওভাবে হাসলে, তার অস্বস্তি হয়। মন সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে।

অফিসার একলা ছিল না। সেই জেলের সুপারিনটেনডেন্ট, জেলার, আরও কয়েকজন ছিল। অফিসারটি বেশ সহজভাবেই বলেছিল, ‘কেমন আছ রুহিতন কুরমি? অনেক কাল বাদে আবার দেখা হল, তাই না? তোমার সঙ্গে দেখছি, আমার কী একটা ব্যাপার আছে,অ্যাঁ? এত বচ্ছর বাদে, কয়েক ঘাটের জল খেয়ে, আবার তোমাকে নিয়ে যাবার জন্য আমাকে আসতে হল।’

কথাগুলো মিথ্যা না। কিন্তু অফিসারের মতো তার হাসবার কোনও কারণ ছিল না। রুহিতনের হাসি পায়নি। তাদের দুজনের মধ্যে হাসির কোনও সম্পর্ক নেই। তবু রুহিতনকে মনে মনে মানতে হয়েছিল, অফিসারটির কথাবার্তা ভাবভঙ্গি একটু অন্য রকম। সকলের সঙ্গে ঠিক মেলানো যায় না। তার জবাব দেবারও কিছু ছিল না। সে বেঞ্চি থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল। জেলার বলেছিল, ‘এখনও পাঁচ-দশ মিনিট দেরি আছে, এখনই উঠতে হবে না।’

অফিসারটি সলেছিল, হ্যা, পায়খানা পেচ্ছাব পেলে সেরে যাও রুহিতন। ভোর বেলাই আমরা পৌঁছে যাব, তার মধ্যে কোথাও দাঁড়ানো চলবে না।’

গন্তব্য কোথায়, রুহিতন পরশু রাত্রেও যেমন কিছু জানত না, এখনও কিছুই জানে না। সে একজন ওয়ার্ডারের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “আমার বাকসের মধ্যে সিগ্রেট আর শলাই আছে, দিতে হবে। পিসাবখানায় এক বার যেতে লাগবে।’

সেই ঘরেরই একটা ন্যাড়া টেবিলের নীচে রুহিতনের টিনের সুটকেস ছিল। ওয়ার্ডার না অফিসের একজন কর্মচারী সুটকেসটা টেবিলের ওপর তুলে, ঢাকনা খুলে সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই বের করে দিয়েছিল। সস্তা সিগারেট। দামি সিগারেট কবেই বা রুহিতন খেয়েছে? কিন্তু এখন তার সিগারেট খাবার অনুমতি আছে। জেল থেকেই সরবরাহ করা হয়। রুহিতন বেঞ্চির ওপরে বসে মাথা নিচু করে বেড়ি জড়ানো অবস্থাতেই দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে সিগারেট ধরিয়েছিল। সেই ফাঁকেই সশস্ত্র রক্ষীরা নির্দেশ পেয়ে গিয়েছিল। ওয়ার্ডারকে অনুসরণ করে রুহিতন যখন অফিসের প্রস্রাবখানায় গিয়েছিল, দুজন রক্ষী সঙ্গে গিয়েছিল।

তারপরে সকলের সঙ্গেই সে জেল গেটের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। এই অফিসার, তার সঙ্গী, রক্ষী, ওয়ার্ডার, জেল সুপার, আর জেলারও। যেন ওরা রুহিতনকে গেট অবধি পৌঁছে দিতে এসেছিল। নিয়মের কোনও ব্যতিক্রম হয়নি। জেলার নিজেই গেটের প্রহরীর হাতে খালাসপত্র তুলে দিয়েছিল। গেটের এক ধারে, এক জনের বেরোবার মতো এক ফালি দরজা কেবল খোলা হয়েছিল। সামনে পিছনে অফিসার আর রক্ষীদের সঙ্গে গেটের বাইরে বেরিয়ে, এই জিপ গাড়িটাই দেখতে পেয়েছিল। পিছন দিক দিয়ে রক্ষীরাই তাকে জিপে উঠতে সাহায্য করেছিল।

এখন যে ভাবে রুহিতন বসেছে, এবং অফিসার সামনে, পিছনে সশস্ত্র রক্ষী চার জন, দু দিন আগে রাত্রেও সবাই এ রকম ভাবেই বসেছিল। জিপ চলবার আগে, জিপের বাইরে কয়েক জনের ব্যস্ত চলাফেরার শব্দ ভেসে এসেছিল, আর নিচু স্বরের অস্পষ্ট কথাবার্তা। তারপরেই বাইরে থেকে কেউ কিছু একটা বলেছিল। জিপের এঞ্জিন গর্জন করে উঠেছিল।

রুহিতন সে সব কিছুই শুনছিল না। হাতে পায়ে বেড়ি পরানো একলা তার পক্ষে ওদের কথাবার্তা শুনে কিছু লাভও ছিল না। একটা অদ্ভুত গন্ধ তার নাকে আসছিল। খুবই চেনা কোনও ফুলের গন্ধ, নাকি কোনও পাতার গন্ধ, অথবা কোনও গাছের গা থেকে নির্গত রসের গন্ধ, সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। গভীর রাত্রে ঘুম ভেঙে ঘরের বাইরে গেলে, কাজে কর্মে চলাফেরা করতে গেলে, এ গন্ধটা পাওয়া যেত।

রুহিতন গন্ধ পেয়ে ভেবেছিল, সে কখনও আশা করেনি, জীবনে গন্ধটা কোনও দিন পাবে। চলন্ত গাড়িতে সে কিছুতেই মনে করতে পারেনি, গন্ধটা কীসের। কিন্তু তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল অনেক ছবি, অনেক মুখ আর আরও অনেক চেনা গন্ধ।

পরের দিন ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই আর একটা জেলখানার গেটের সামনে জিপ দাঁড়িয়েছিল। রুহিতন তখনই শব্দ পেয়েছিল, আর একটা গাড়ি পিছন পিছনেই এসে দাঁড়াল। টের পেয়েছিল, তখনও পিছনের গাড়িটার আলো জ্বলছে। কোন জায়গা, কোথাকার জেলখানা, কিছুই সে জানতে পারেনি। সেই জেলখানার চেহারা একটু ভিন্ন রকম। মনে হয়েছিল, ছোটখাটো জেল। সেখানেও তাকে নির্জনে একলা একটা সেলে রাখা হয়েছিল। রুহিতন বুঝতে পেরেছিল, ব্যবস্থা করা ছিল সব আগেই। সব কিছু প্রস্তুত ছিল। তার সেলের মধ্যে আলো জ্বলছিল, আর আশেপাশে কেমন অন্ধকার থমথম করছিল। এই অফিসার বলেছিল, ‘চলি রুহিতন, পরে আবার দেখা হবে।’

রুহিতন জানত না পরে আবার কোথায় কবে দেখা হবে। সে ধারণা করেছিল নতুন সেই জেলেই তাকে বদলি করা হল। কিন্তু কী অপরাধে যে তখনও তাকে হাতে পায়ে বেড়ি পরিয়ে রেখেছিল তা বুঝতে পারছিল না।

এদের অনেক কিছুই বোঝা যায় না। যদিও এখন—এই তিনরাত্রি শেষের ভোরে এদের সমস্ত ব্যাপারটাই বেশ সরল মনে হচ্ছে। পরশু ভোরে রুহিতনকে একটা জেলখানার সেলে ঢোকানো হয়েছিল। সারা দিন তার সেখানেই কাটে আর সেখানেই তার খাওয়া, প্রাকৃতিক কাজকর্ম ঘটে। হাত দুটো তখন পায়ের বেড়ি থেকে খুলে দেওয়া হয়েছিল। সন্ধ্যা রাত্রেই আবার তাকে হাতের বেড়ি পায়ে জুড়ে দিয়ে অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অফিসে তখন পুলিশ অফিসার কর্মচারীদের বেশ ভিড় ছিল। সকলেই রুহিতনকে বারে বারে দেখছিল। যেন সে একটা ধরা পড়া পাগলা দাঁতালে হাতি, শেকল পরানো। সকলের চোখে কেমন একটা ভয় ভয় ভাব।

আবার এই অফিসারই এসে দাঁড়িয়েছিল তার সামনে। বলেছিল, ‘রুহিতন তোমার পাইখানা পেচ্ছাব সব হয়ে গেছে তো? আমরা এখনই বেরিয়ে পড়ব আর ঘণ্টা পাঁচ-ছয়েক একদম দাঁড়াতে পারব না।’

রুহিতন নির্বিকার স্বরে বলেছিল, “ঠিক আছে।’

কিন্তু ঠিক ছিল না। গাড়িতে ওঠবার পরেই এই অফিসার বলেছিল, ‘রুহিতন একটা সিগারেট চলবে নাকি? এই নাও।’ বলে নিজের সিগারেটই সামনের আসন থেকে পিছন দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল।

রুহিতনের অস্বস্তি হয়েছিল। এ সব খুব স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেওয়া যায়ে না তার মনে পড়েছিল প্রায় সাত বছর আগে পুলিশ ক্যাম্পে এই অফিসার তাকে সিগারেট দিয়ে চলে গিয়েছিল। তবু মনের সন্দেহ ঘুচতে চায় না। সে বলেছিল, ‘আমার সিগ্রেট শলাই তো আছে।’

অফিসার বলেছিল, ‘আরে সে তো জানি আমি। কিন্তু আবার তোমার বাকসো খুলতে হবে। তোমার হাতে সিগারেট ধরানোও তো অসুবিধে।’

কথাগুলো কোনওটাই মিথ্যা না। অথচ অস্বস্তি যেতে চায় না। তার পক্ষে হাত তুলে সিগারেট নেওয়া সম্ভব ছিল না। অফিসার তা বুঝেই যেন তাকে অবাক করে দিয়ে তার ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট গুঁজে দিয়েছিল। ধরিয়ে দিয়েছিল লাইটার জ্বালিয়ে। সেই আলোয় রুহিতন দেখেছিল, চার জন সশস্ত্র রক্ষী যেন পাথরের চোখ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। অস্বস্তি আর সন্দেহ ঘোচানো সম্ভব ছিল না, কিন্তু সিগারেটে টান দিয়েছিল। অফিসার নিজের সিগারেট ধরিয়ে বলেছিল, ‘আমার একটা সিগারেট খেলে তোমার আমার কারই বা কী ক্ষতি হতে পারে? অবিশ্যি মানুষের জীবন কখনও এক রকম হয় না। তোমার জীবন এক রকম, আমার আর এক রকম। সাত বছর আগে তোমার হাতে তো আমিও মরতে পারতাম।’ বলতে বলতে অফিসার হেসে উঠেছিল। স্বাভাবিক ভাবে যা মনে হয়েছিল, সে রকম ব্যঙ্গ ছিল না লোকটার হেসে ওঠার মধ্যে। আবার বলেছিল, ‘কিন্তু যেভাবেই হোক মরতে তো একদিন হবেই। সবাইকেই। একটা সিগারেট খেলে, কার কী ক্ষতি হতে পারে। কী বলেন মিস্টার নাগ?’

অফিসার সম্ভবত তার পাশের সঙ্গী অফিসারকে কথাটা বলেছিল। জবাব শোনা গিয়েছিল ‘তা যা বলেছেন স্যার!’

রুহিতন ও সব কথা মনে মনে মেনে নিতে পারেনি। পৃথিবী আর মানুষ সম্পর্কে তার ধারণা আলাদা। মরতে একদিন সবাইকেই হবে। কিন্তু সব মরা এক রকম না। সকলের বাঁচাও এক রকম না।

অফিসার আবার বলেছিল, ‘আমাকে আর কে চেনে? রুহিতন কুরমির নাম এখন দুনিয়ার লোক জানে। বুঝলে রুহিতন, তুমি এখন জগৎবিখ্যাত লোক। তুমি আমার একটা সিগারেট খেলে, আমার আনন্দ। কী বলেন মিস্টার নাগ?’

‘যা বলেছেন স্যার। সম্ভবত পাশের অফিসারটিই বলেছিল।

রুহিতন পিছন দিকে—অর্থাৎ, গাড়ির সামনের দিকে তাকিয়ে দেখেনি। দুনিয়ার লোক তার নাম জানে। কথাটা সত্যি হোক, মিথ্যা হোক, তার কিছু যায় আসে না। সে খুশি হয়নি, দুঃখ বোধও করেনি। সেই মুহূর্তে তার কাছে একমাত্র বাস্তব ছিল তার হাতে পায়ে বেড়ি। চলন্ত গাড়িতে তার সামনে পিছনে সাত জন সশস্ত্র লোক। সে এখনও জানে না, গতকাল রাত্রেও জানত না, তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কী তার ভবিষ্যৎ। সত্যি কোনও জেলে, অথবা কোনও বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তার কোনও ধারণা নেই। সমস্ত কিছুর জন্যই সে প্রস্তুত। তবু বারে বারেই তার মনে হচ্ছিল রাত্রের এই গাড়িটা যে পথ দিয়ে তাকে নিয়ে চলেছে সে পথটা কেমন? তার দু পাশে কি গভীর জঙ্গল, মাঠ আর গ্রাম আছে? না কি কোনও শহরের ওপর দিয়ে চলেছে? রাস্তাঘাট বেশ নির্জন। মাঝে মাঝে পাশ দিয়ে অন্য গাড়ি চলে যাবার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। কোনও শহর হলেও রাত্রে বোঝার উপায় ছিল না। হয়তো রুহিতনের কোনও কোনও বন্ধুর চোখে এই জিপ গাড়িটা পড়ে থাকবে। রুহিতনদের দলের লোক কি দেশের সবখানেই নেই? কিন্তু তারা কোনও দিন জানতে পারবে না তাদের চোখের ওপর দিয়ে রুহিতন কুরমিকে নিয়ে যাচ্ছে।

রুহিতন এখন, এই তৃতীয় রাত্রের ভোরে, মোটামুটি ব্যাপারটা অনুমান করতে পারছে। কেন সাত দিন আগে সকালের ওয়ার্ডার, সেইদিনই তাকে অন্য জেলে নিয়ে যাবার কথা প্রচার করেছিল। কেন দু দিন কেউ কিছু বলেনি, আর পাঁচ দিনের দিন সন্ধ্যাবেলা অফিসে ডেকে নিয়ে গিয়ে, সেই জেলেরই এক নির্জন সেলে দু দিন আটকিয়ে রেখেছিল। তারপরে এই তিন রাত্রের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জেল থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। প্রথম রাত্রের মাঝামাঝি বা তারও পরে কোনও এক সময়ে তাকে তুলে নিয়ে জিপ ছেড়েছিল। পরশু প্রায় সন্ধ্যারাত্রেই তাকে তুলে নিয়ে জিপ ছুটেছিল। গতকাল আবার রাত্রের মাঝামাঝি কোনও এক সময়ে তাকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। গতকালও সারা দিন এবং রাত্রের কিছু সময় তাকে অন্য এক জেলের নির্জন সেলে রাখা হয়েছিল। এই সব কিছুরই হয়তো একটাই কারণ, সাবধানতা। সাত দিন আগের প্রচারের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে, রুহিতনকে নিয়ে নিরাপদে ঠিক জায়গায় পৌঁছানো। সে ঠিক জায়গাটা যেখানেই হোক।

রুহিতন জানে না, তাকে নিয়ে এই জিপ উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম কোন দিকে ছুটছে। তবে এদের দুদিনের কার্যকলাপ দেখে মনে হয়, অল্প সময়ের মধ্যেই কোনও জেলের মধ্যে আবার তাকে ঢোকানো হতে পারে। দিনেদুপুরে তাকে নিয়ে এরা চলাফেরা করতে চায় না। কাকপক্ষী জেগে ওঠার মধ্যেই কাজ শেষ। কিন্তু এ সময়েই অফিসারের কথা শুনে, সে আবার অস্বস্তি বোধ করছে। আবার সেই সিগারেট খাবার কথা।

অবিশ্যি, একদা বরাবরের নিয়মে এ সময়টা তার ধূমপানের সময় ছিল। সে যখন জেলের বাইরে ছিল, কাকপক্ষী ডাকবার আগেই সে ঘুম থেকে উঠত। বিড়ি ধরিয়ে মাঠে যেত। প্রাকৃতিক কাজ সেরে, চোখে মুখে জল দিয়ে ঘরে ফিরলেই কাঠের আগুনের ধোঁয়ার গন্ধ পেত। একই চালার নীচে তার সংসার। পরিবারের সকলের থাকা খাওয়া রান্না শোয়া আর দুটো বলদের আস্তানা। রাত্রের অন্ধকার তখনও পুরোপুরি কাটত না। কিন্তু আলো জ্বালা হত না। বাইরের ঢাকা দাওয়ায়, ছোট লকড়ি কুটোকাটির আগুনের শিখাতেই সব দেখা যেত। সে ডেকে না দিলেও মঙ্গলা উঠে পড়ত ঠিকই। পোড়া মাটির ছোট উনানে কাঠকুটো জ্বেলে, অ্যালুমিনিয়ামের একটা পুরনো বাটির মুখ ঢেকে জল বসিয়ে দিত। রুহিতনের মা চা খায়। বেঁচে থাকতে তার বাবাও খেত। তার বুড়ি মায়ের সঙ্গে নাতি-নাতনিগুলোও হা হা করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু মঙ্গলা চায়ের জল বসিয়েই বলদ দুটোকে খাওয়াতে চলে যেত।

‘এই নাও।’সামনের আসন থেকে অফিসারের গলা শোনা গেল। একটা সিগারেট বোধ হয় তার কানের কাছে স্পর্শ করল। তার বুকের কাছেই বোধ হয় অফিসারের কনুই, আর সিগারেটটা এসে ঠেকল রুহিতনের ঠোঁটে।

রুহিতন তথাপি চোখ খুলল না। কিন্তু অনিচ্ছা আর অস্বস্তির মধ্যেও সিগারেটটা ঠোঁটে চেপে ধরল। ভোরের এই রাত তাড়ানো বাতাসের সঙ্গে ধূমপানের একটা সম্পর্ক আছে। নেই শুধু কাঠের আগুনের সঙ্গে গোবরের গন্ধ। সেই সঙ্গে আরও অনেক কিছুর গন্ধ। চেনা মানুষদের, গাছপালার, আর….।

লাইটারের আলোটা খচ শব্দে চোখের সামনে জ্বলে উঠতেই রুহিতন চোখ মেলে তাকাল। জ্বলন্ত শিখায় সিগারেটটা ধরিয়ে নিতে নিতেই সশস্ত্র চার রক্ষীর জ্বলজ্বলে চোখগুলো রুহিতন এক বার দেখে নিল। ওদের চোখ কি কখনওই বোজে না। ওদের মুখে কখনওই প্রায় কোনও কথা শোনা যায় না। মুখগুলো সবসময়েই শক্ত, ভাবলেশহীন। ওদের চোখগুলো এ রকম জ্বলে কেন? অন্ধকারে যাদের চোখ জ্বলে অনেকটা সেই রকম। অথচ এমনিতে ওদের কেমন নিরীহ দেখায়। যেন ওদের গলায় কেউ চেন দিয়ে বেঁধে রেখে দিয়েছে।

রুহিতন আবার চোখ বুজল। তার বন্ধ চোখে এখনও লাইটারের লাল শিখাটা জ্বলছে। ঠিক লাল না, লালচে। অনেকটা রক্তহীন বাসি মাংসের মতো। ঠিক লাল না।লালচে মেটে। লাইটারের আলোর রংটা কি সত্যি এই রকম? জ্বলন্ত সিগারেট তার ঠোঁটে, মুখের লালায় খানিকটা ভিজে উঠেছে। জ্বলন্ত সিগারেটের অঙ্গারের তাপ ভাল লাগছে। তাপটা লাগছে তার নাকের ডগায়, কিছুটা ছড়িয়ে যাচ্ছে মুখে। আরাম লাগছে। বাতাসটা বেশ ঠাণ্ডা লাগছে। ঘাড়ে কাঁধে কাঁটার মতো ফুটছে। কম্বলটা ঢাকা দিতে পারলে ভাল হত। বৃষ্টিবাদলায় ঘুরে, ঠাণ্ডা লাগলে, গা হাত-পা যেমন ব্যথা করে জ্বর আসে, ঠিক সে রকম না। অথচ যেন জ্বর রয়েছে গায়ে। রুহিতন নিজেই তা টের পায়। কিন্তু কোনও কারণ নেই। কেনই বা শুধু শুধু জ্বর আসবে তার? আজকাল প্রায়ই এ রকম মনে হয়। এমন না যে খিদে পায় না। যেমন ছিল, সবই ঠিক আছে। তবু প্রায়ই এই রকম জ্বর-জ্বর ভাব হয়। এ রকম হলে চান করতে ইচ্ছা করে না। করেও না। বন্দিরা কেউ জিজ্ঞেস করলে জবাব দেয়, ‘একটু ঠাণ্ডা লেগেছে। সেরে যাবে।’

একটু ঠাণ্ডা লাগা, একটু গা গরম করা এমন কিছু ব্যাপার না। কিন্তু তার থেকেও অনেক বেশি খারাপ লাগে এই লালচে রংটা। কীসের রং এটা? অনেকটা যেন রক্তহীন বাসি মাংসের মতো মেটে রং। রুহিতন আজকাল চোখ বুজলেই এ রংটা দেখতে পায়। অনেক সময় চোখ তাকিয়েও এ রকম একটা রঙের আভাস ভেসে ওঠে। বিশেষ করে এ রকম শীত শীত জ্বরভাব হলেই এ রকম একটা মেটে রং ভেসে ওঠে চোখের সামনে। আর সেই লালচে মেটে রঙের গায়ে লাল লাল তারা বা চক্রের মতো।

বহুকাল আগে যখন সে টুকারিয়াঝাড়ের জঙ্গলে শিকার করতে যেত তখন এ রকম রঙের একটা সাপ দেখেছিল। ও রকম সাপ সে আগে বা পরে আর কখনও দেখেনি। সাপটাকে দেখে তার তেমন ভীষণ হিংস্র মনে হয়নি। সাপটা তেমন লম্বা ছিল না, কিন্তু বেশ মোটা ছিল। রুহিতনকে দেখেও সাপটার পালাবার কোনও তাড়া ছিল না। কামড়াতেও আসেনি। তার গা কেমন ঘিনঘিন করে উঠেছিল সাপটাকে দেখে। সেটার মেটে রঙের গায়ে লাল চাকা চাকা ঘায়ের মতো দাগ ছিল। তার সঙ্গে ছিল নেপালি জোতদার মোহন, মোহন ছেত্রীর ছেলে বড়কা। বড়কার হাতে বন্দুক ছিল। বড়কা খুব ভাল বন্দুক চালাতে পারত। শিকারিও খুব ভাল ছিল, বেপরোয়াও ছিল সেই রকম। সে বন্দুক তুলে তাগ করেছিল সাপটাকে মারবার জন্য। সাপটার তবু নড়বার নাম ছিল না। যেন মানুষ বন্দুক তীর ধনুক কিছুই তার জানা নেই। মাঝে মাঝে চেরা জিভ লকলকিয়ে উঠছিল। রুহিতনের মনে হয়, সাপটার চেরা জিভও লাল ছিল। ঠিক কেন্নোর মতো আস্তে আস্তে নরম ভেজা মাটির ওপর দিয়ে সে যাচ্ছিল।

রুহিতন হাত তুলে বড়কার বন্দুকের নলটা অন্য দিকে সরিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘এটাকে আবার বন্দুক দিয়ে মারতে হবে নাকি? যেতে দে।’

বড়কা বলেছিল, ‘কী এটা? সাপ না?’

রুহিতন বলেছিল, ‘কী জানি। দেখে আমার গা ঘিনঘিন করছে। ওটাকে আমার মারতেও ঘেন্না করছে।’

বড়কা বন্দুকটা সরিয়ে নিয়েছিল। একটা শুকনো গাছের ডাল কুড়িয়ে নিয়ে, সাপটাকে খোঁচা মেরেছিল। খোঁচা খেয়ে সাপটা উলটে গিয়েছিল। পালাবার চেষ্টা করেনি, কামড়াতেও আসেনি। যেন কুৎসিত জন্তুটার নড়াচড়া করার ক্ষমতা ছিল না। বড়কা হেসে বলেছিল, ‘এটা সাপ না, অন্য কিছু।বলে গাছের ডাল দিয়ে কয়েক বার আঘাত করেছিল। তবু সাপটার কোনও তাড়া দেখা যায়নি। রুহিতন আর বড়কা হেসে উঠেছিল। বড়কা গাছের ডালটা সাপের গায়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। দিয়ে দুজনেই অন্য দিকে চলে গিয়েছিল।

রুহিতন সেই সাপটার (যদি ওটা সত্যি সাপ হয়, কারণ তার মনে একটা সন্দেহ থেকে গিয়েছিল।) কথা ভুলেই গিয়েছিল। এ পর্যন্ত কখনও কোনও কারণে মনে পড়েনি। সম্প্রতি এই বিশ্রী উপসর্গটা দেখা দিয়েছে। তার এই গা-গরম জ্বর-জ্বর ভাবের সঙ্গে চোখ বুজলেই কেমন একটা লালচে আভা ফুটে ওঠে। রক্তহীন বাসি কাচা মাংসের মতো সেই রং, আর তার সঙ্গেই সেই সাপটা। লালচে মেটে রঙের সেই সাপ, আর তার গায়ে লাল চাকা চাকা দাগ। এখনই যেন সে বেশি বুঝতে পারে, সাপটা জ্যান্তই ছিল, অথচ যেন শরীরটা অসাড়।

কেন? কেন সেই কুৎসিত নোংরা জীবটা তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে? ওঠার সঙ্গে তার জীবনের কী যোগাযোগ আছে? কিছুই নেই। তার সেই পনেরো-ষোলো বছর বয়সের একটা ঘটনা, চোখে দেখা একটা জীব, এত কাল বাদে কোথা থেকে এসে হাজির হল? সে রুহিতন কুরমি—তার জীবনের সবটাই প্রায় ওলট-পালট হয়ে গিয়েছে। তার বাবা পোশপত কুরমি পর্যন্ত জীবনের একটা ধারা। রুহিতন কুরমির জীবনের ধারা সম্পূর্ণ আলাদা। পিছনের সবকিছুই সে ছুড়ে ফেলে এসেছে। এখন তার বাইশ বছর বয়স আরও বেড়ে গিয়েছে। এত বছর সেই কুৎসিত জীবটা তার ভিতরে লুকিয়েছিল নাকি? অথচ সে কখনও জানতে পারেনি।

রুহিতনের এ রকম ভাবনা হলেই মনে হয়, সেই অদ্ভুত আর বিশ্রী দেখতে সাপটাকে মেরে ফেললেই বোধ হয় ঠিক হত। যা কিছু খারাপ, কুৎসিত আর বিশ্রী তার গা ঘিনঘিনে নোংরা তা শেষ করে দেওয়াই বোধ হয় উচিত। তার কোনও চিহ্ন রাখতে নেই। কই বড়কার কথা তো কখনও তার মনে পড়ে না। কোনও কারণে চোখ বুজলে কখনওই বড়কার চেহারা তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে না। বড়কাও তার চোখে পরে হয়ে উঠেছিল খারাপ কুৎসিত আর নোংরা। বড়কার বেলায় সে ভুল করেনি। তা-ই কি চোখ বুজলেও বড়কার মূর্তি ভেসে ওঠে না?

রুহিতন আবার চোখ তাকাল। জিপের পিছন দিকটা ঢাকা। মোটা কালো ঢাকা পরদার গায়ে স্বচ্ছ কাচের মতোই পলিথিন জাতীয় কোনও কিছুর একটা চৌকো জানালা রয়েছে। মুখ তুলে উঁকি দিয়ে দেখলে, ওই স্বচ্ছ কাচের মতো জানালা দিয়ে নিশ্চয়ই বাইরের দৃশ্য দেখা যায়। রুহিতন দেখতে পাচ্ছে না। সে আছে অনেকটা দূরে। সামনের আসনের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে পিছন ফিরে বসেছে সে। পলিথিনের কাচের মতো চৌকো জানালায় সে কেবল একটা লাল আভা দেখতে পাচ্ছে। মাঝে মাঝে লাল আভার ওপর দিয়ে কালো ছায়া ছিটকে চলে যাচ্ছে। ছিটকে যাওয়া কালো ছায়াগুলো কি রাস্তার ধারের গাছপালা? আর লাল আভা কি সদ্য ভোরের ? হয়তো, কিন্তু রুহিতন চোখ রাখতে পারছে না। সে শেষ হয়ে আসা সিগারেটটা ঠোঁট থেকে পাশ ফিরে জিভ দিয়ে ঠেলে ফেলে দিল। তারপরেই চোখ বুজল। চোখ বুজেও সেই লালচে মেটে রং তার বন্ধ চোখের মধ্যে ভেসে উঠল। লাল চাকা চাকা দাগ নিয়ে রংটা নড়েচড়ে উঠল। তার গলা দিয়ে একটা অস্বস্তিকর গোঙানির শব্দ হল।

‘কী রুহিতন, কিছু বলছ?’ সামনের আসন থেকে অফিসারের গলা শোনা গেল।

রুহিতন চোখ না খুলেই বলল, ‘আমার গায়ের কম্বলটা খুলে গেছে ওটা তুলে দিতে লাগবে।’

‘তোমার শীত করছে নাকি?’ অফিসারের অবাক স্বর শোনা গেল।

রুহিতন কোনও জবাব দিল না। অফিসার বা তার সঙ্গী, যে-কেউ হোক কম্বল তুলে তার ঘাড়ে পিঠে গলায় জড়িয়ে দিল। রুহিতন খানিকটা আরাম বোধ করল। অফিসারের গলা আবার শোনা গেল, ‘আচ্ছা রুহিতন, তোমার গলার আওয়াজটা কি বরাবরই এ রকম ছিল নাকি? আমি আর কতটুকুই বা তোমার কথা শুনেছি। আমার মনে নেই। নাকি ঠাণ্ডা-ফাণ্ডা লাগিয়েছ? তোমার গলার স্বর বেশ ভাঙা আর ফ্যাসফেসে শোনাচ্ছে।’

কথাগুলো মিথ্যা না। সত্যি রুহিতনের গলার স্বরটা আজকাল কেমন ভাঙা ভাঙা শোনায়। অনেকটা বসে যাওয়া, ফ্যাসফেসে মতোই। অথচ সেজন্য যে গলায় কোনও কষ্ট হয় , তা নয়। কোনও ব্যথা দরদ যন্ত্রণা কিছুই নেই। সর্দি কাশি বা গলায় কফ জমে থাকার মতো কিছু বোঝা যায় না। তবু কথা বলতে গেলেই গলার স্বরটা কেমন ভাঙা ফ্যাসফেসে শোনায়। কেন? ঠাণ্ডা লাগে নাকি?

কে জানে। শরীর নিয়ে রুহিতন ভাববার বেশি সময় কবে পেয়েছে? বেশি জলে ভিজলে বা শীতের রাত্রে ঘোরাঘুরির সময় গরম জামা না থাকলে, জ্বরজ্বালা মাঝে মধ্যে হয়েছে। উত্তরের মিরিক পাহাড়ের বর্ষা আর শীত, কোনওটাই ছেড়ে কথা বলে না। জলে ভেজাটা যদি বা সহ্য হত শীতটা একেবারেই না। তরাই অঞ্চলে শীত আর বর্যার প্রকোপই বেশি। জ্বরজ্বালা হলে গা হাত পা ব্যথা হলে মা কী সব গাছের ছাল লতাপাতা ছেঁচে, জ্বাল দিয়ে ফুটিয়ে খাইয়ে দিত। মায়ের চোখে ছানি পড়ার পরে, মঙ্গল দিত। মঙ্গলা তার মায়ের কাছ থেকেই শিখে নিয়েছিল। বেশি বাড়াবাড়ি হলে, দোকান থেকে ডাক্তারি বড়ি কিনে খেত। তবে তার বিশেষ দরকার হত না। গাছের ছাল লতাপাতা ফোটানো নির্যাসেই কাজ হয়ে যেত। ডাক্তারের দোকানের ওষুধের দাম কত! বেজায়। আর তা কি কাছেপিঠে পাবার উপায় ছিল? তা ছাড়া, মঙ্গলা কী সব তুকতাক করত!….মঙ্গলার মুখটা মনে পড়ছে। চোখের সামনে ভাসছে। রুহিতনের কী হাসিই পেত, মঙ্গলা যখন তার মাথার যন্ত্রণা হলে, একটা কাঠি দিয়ে কপালের ওপর কী সব আঁকিবুকি কেটে দিত। রুহিতনের বুকের ওপর পড়ে, নুয়ে এসে, ঠোঁট নেড়ে নেড়ে যেন কোনও মন্ত্র উচ্চারণ করত আর এক কানের কাছ থেকে শুরু করে, কপালের ওপর দিয়ে কাঠি নানাভাবে বুলিয়ে আর এক কানের কাছে নিয়ে যেত। যেন মঙ্গলা কোনও মন্ত্র আওড়াত আর তা-ই লিখে দিত রুহিতনের কপালে। মাথার যন্ত্রণা কি তাতে কমত? হয় তো না, তবু কেমন একটা আরাম বোধ হত। সেটা ছিল মঙ্গলার স্পর্শের গুণ।

রুহিতনের চোখের সামনে মঙ্গলার মুখটা ভেসে উঠল। সারা মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ওর চোখ দুটো বরাবরই খুব শান্ত। দুধেল গাভীর মতো স্নেহপরায়ণ আর শান্ত। ছেলেমেয়ের কান্না শুনলেই পাহাড়ি মণির (কুণ্ডের) কালো জলের মতো চোখ দুটো ত্রাসে ভরে উঠত। মঙ্গলা সেই একরকমভাবেই তাকাতে জানত। রুহিতনের দিকেও সে সেই রকম দৃষ্টিতেই তাকাত। হাসি আর কৌতুকের ছটাও কি ছিল না? আর লাজিয়ে ওঠা চোখের দৃষ্টি নিজের পায়ের দিকে? সবই ছিল, তবু শান্ত আর গভীর ভরাট মনে হত।

‘তোমার চেহারার মধ্যে কেমন অন্য একটা ভাব এসে গেছে।’ সামনের আসন থেকে অফিসারের স্বর আবার ভেসে এল।

রুহিতন মনে মনে চমকিয়ে উঠল। তার নিজের কাছেই অবাক লাগল। বাড়ি— মঙ্গলার কথা ভাবছিল সে? অফিসার লোকটি কি সেই থেকে কথা বলেই যাচ্ছিল নাকি? রুহিতন কিছুই খেয়াল করেনি। অবিশ্যি অফিসারের সঙ্গে কথার জবাব দেবার তার কিছুই ছিল না। কারণ সে কোনও বিষয়েই অফিসারের সঙ্গে কথাবার্তা বা আলোচনা করতে চায় না। তাদের সে সম্পর্ক না। কিন্তু মঙ্গলার কথা কেন ভাবছিল সে? এমনকী, তার বুকের ওপর পড়া মঙ্গলার স্পর্শের কথা, তার নিশ্বাসের গন্ধও যেন সে পাচ্ছিল। কিন্তু এ রকম হওয়া উচিত না। এ সব ভাবনা তার জন্য না। এ সব মনকে দুর্বল করে। তার লড়াই তো কেবল নিজের জীবনকে পণ করে না। তার সমস্ত কিছুকে পণ করে সবাইকে পণ করে। মঙ্গলা আলাদা কিছু না। কেউ না। মঙ্গলা যদি নিজের থেকে আলাদা করে ভাবে বা কিছু করে, তার সঙ্গে রুহিতনের কিছু নেই। কিন্তু মঙ্গলার মধ্যে সে রকম কিছুই দেখা যায়নি। বরং সে ছিল রুহিতনদেরই একজন। ওর সাহসের কথা অনেকেই জানে না। অথচ ইদানীং—হ্যাঁ, ইদানীং-ই রুহিতনের মনের অবস্থা এ রকম হয়েছে। মঙ্গলা, ছেলেমেয়ে আর মায়ের কথা হঠাৎ তার মনে পড়ে যায়। এত বেশি মনে পড়ে যায়, যেন সবাই তাদের স্পর্শ আর গন্ধ নিয়ে তার সামনে এসে পড়ে।

‘কিন্তু তুমি তা হতে দেবে কেন?’ অফিসারের গলা আবার সামনের আসন থেকে ভেসে এল, ‘শরীর খারাপ হলে, জেলের ডাক্তারকে সব কথা বলবে। ভাল করে চিকিৎসা করাবে। ওতে তোমার পুরোপুরি হক আছে। সাত বছর আগের সেই দিনকাল আর নেই। বুঝেছ? তোমাকে ফাঁসি দিয়ে মেরে ফেললে আলাদা কথা ছিল। ফাঁসি অবিশ্যি তোমার এখনও হতে পারে, তোমার বিরুদ্ধে সেই চার্জ এখনও আছে। কিন্তু অসুখবিসুখ করলে তার চিকিৎসা তো করাতে হবে। আমি তো দেখলাম, তোমার মুখের চেহারাটাই কেমন বদলে গেছে। যেন অনেক বয়স বেড়ে গেছে মুখের চামড়া-টামড়াগুলো—হ্যাঁ, ভুরুগুলোর লোমওঠা মতো। তোমার সেই সাজোয়ান চেহারা, আমার তো মনে আছে। সেই হিড়িম্ব না কীচক-টিচকের মতো চেহারা তোমার—অবিশ্যি আবলুস কাঠের মতো কালো কুচকুচে তুমি ছিলে না,’… বলতে বলতে, হঠাৎই অফিসার তার গলার স্বর বদলিয়ে তৎক্ষণাৎ আবার বলল, ‘রুহিতন, সামনের দিকে এক বার মুখ ফিরিয়ে তাকাও না। তোমার বাঁ দিকে। দ্যাখো তো, ওটা কী যাচ্ছে, চিনতে পারো কি না?’

রুহিতন ভালই খেয়াল করতে পারছে, তিন দিনের মধ্যে, আজ ভোরেই অফিসার অনেক বেশি কথা বলছে। এ কদিনের তুলনায় লোকটি এখন অনেক বেশি সহজ হয়ে উঠছে। যেন সে এখন অনেকটাই নিশ্চিন্ত। কিন্তু কী দেখতে বলছে তাকে? জিপের বাইরে খুব কাছেই গোঁ গোঁ ঝমঝম শব্দ শোনা যাচ্ছে। বেশ ভারী কিছুর শব্দ। সে বাঁ দিকে ফিরে বাইরে তাকাল। দেখেই মনে হল, রাস্তার এক ধার দিয়ে একটা ছোট রেলগাড়ি চলে যাচ্ছে। কিন্তু তার ধোঁয়া নেই। গাড়িটার কিছুটা অংশ দেখা যাচ্ছে। এই জিপের সঙ্গে গাড়িটা দৌড়ে পাল্লা দিতে পারছে না। গাড়িটার খোলা জানালার ধারে যারা বসেছিল, তারা কেউ কেউ জিপটার দিকে তাকিয়ে দেখছিল। ভিতরে আলো জ্বলছে, সামনেও আলো জ্বলছে। রুহিতন গাড়ির চালককে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। রেলের ড্রাইভারের মতোই সামনের দিকে, টুপি মাথায় চালক দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার ধারে বড় বড় বাড়ি আর এখনও বাতিগুলো জ্বলছে। অথচ দিনের আলো ফুটে উঠতে আরম্ভ করেছে। জিপের পিছনের পলিথিনের কাচের মতো চৌকো জানালায় যে লালচে আভাটা সে দেখতে পেয়েছিল, সেটা আসলে সূর্যোদয়ের আসন্ন আভা। তার মানে, আকাশটা বেশ পরিষ্কারই আছে। পুব দিকের আকাশ নিশ্চয়ই লাল হয়ে উঠেছে, তারই আভা ছড়িয়ে পড়েছে।

কিন্তু কী গাড়ি এটা, জিপের প্রায় পাশাপাশিই চলেছে? বড় বড় বাড়িগুলো দেখে, জায়গাটাও তান্য রকম লাগছে। আহ! চকিতেই তার মনে পড়ে গেল এটা কলকাতা। গাড়িটার চেহারা অনেকটা লম্বা ট্রাম গাড়ির মতো। ট্রাম ট্রামই তো এটা! চৌদ্দ বছর কিংবা পনেরো বছর হবে, আথবা কে জানে, তারও কিছু কম বেশি হতে পারে, রুহিতন এক বার কলকাতায় এসেছিল। কলকাতার মনুমেন্টের তলায় বিরাট জমায়েত হয়েছিল। শ্রমিক কৃষকের জমায়েত। কলকাতা না এটা? নিশ্চয়ই কলকাতা।

ট্রাম গাড়িটাকে ছাড়িয়ে জিপটা এগিয়ে গেল। রুহিতন বাঁ দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে ডান দিকে তাকাল। জিপটা যেন বেঁকে অন্য দিকে চলে যাচ্ছে। ট্রামটার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু এই রাস্তা, এই সব বড় বড় বাড়ি ঘর, রাস্তার মাঝে মাঝে, ঠিক চৌরাস্তার মোড়ে একটা করে পোস্ট, এ নির্ঘাত কলকাতা। এ শহর কখনওই শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি মালবাজার না। কিণগঞ্জ কাটিহার পূর্ণিয়াও না। চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যাওয়া ট্রাম গাড়িটাই তার সবথেকে বড় প্রমাণ, এটা কলকাতা।

রুহিতন এক বার মাত্র কলকাতায় এসেছিল। তখন দিনকাল আর দলের চেহারা ছিল অন্য রকম। তরাইয়ের চা শ্রমিক আর ভূমিহীন কৃষকদের নেতৃত্ব করে নিয়ে এসেছিল সে। অবিশ্যি সে কলকাতার কিছুই জানত না। তার মাথার ওপরে ছিল দিবা (দিবাকর) বাগচি, ভবানী রায়, আরও কেউ কেউ। তরাইয়ের বাগানে আর জোতে, তারাই ছিল সংগঠক নেতা। কলকাতার জমায়েতে কারা যাবে না যাবে, বাছাই করার দায়িত্ব ছিল তার ওপরে। ভাদুয়াও সঙ্গে ছিল। ভাদুয়া মুণ্ডা, চা বাগানের জবরদস্ত লড়িয়ে নেতা। রুহিতনকে দলে এনেছিল দিবা বাগচি। দিনক্ষণ হিসাব করেই সবাই রেল গাড়িতে উঠেছিল। পরের দিন নেমেছিল বর্ধমান স্টেশনে। সেখান থেকে সবাই মিছিল করে কলকাতায় পৌঁছেছিল। শুধু তারাই না। বর্ধমানে দেখা হয়েছিল আরও অনেক কারখানা আর খনি শ্রমিকদের সঙ্গে। তাদের সকলেরই যাত্রা কলকাতায়, মনুমেন্টের নীচে।

রুহিতনের জীবনে সেটা একটা নতুন অভিজ্ঞতা। হাজার হাজার মেয়ে আর পুরুষ। সে মেতে উঠেছিল। এক ধরনের বীরত্বপূর্ণ খুশিতে তার মন ভরে উঠেছিল। একটা বিরাট কিছু ঘটছে, সে বিষয়ে তার মনে কোনও সন্দেহ ছিল না। প্রমাণ ছিল সারাটা পথে পথে। পথের দুধারে মানুষের হাততোলা চিৎকার আর হাসির উল্লাসে। পথের নানা জায়গায় তাদের খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। রুটি তরকারি চিঁড়ে মুড়ি। পেট ভরল কি না, সে কথা মনে হয়নি। এমন একটা উত্তেজনা ছিল, খাওয়ার কথা বিশেষ মনেই আসেনি। চারদিনের দিন দুপুরের দিকে তারা কলকাতায় পৌঁছেছিল।

কলকাতায় পৌঁছুনোটা আর এক উত্তেজনা। কলকাতায় ঢোকবার মুখেই, সেখানকার লোকজনও যেন পাগল হয়ে উঠেছিল। চা বাগানের মালিক বলো আর তরাইয়ের বড় বড় জোতের জোতদার বলো, সবাইকেই কী তুচ্ছ মনে হয়েছিল। সব মিলিয়ে এমন একটা বিশাল আর প্রচণ্ড শক্তি মনে হয়েছিল, যে কোনও শক্তিকে চুর্ণ বিচুর্ণ করে দেওয়া যায়। মনের মধ্যে কেমন একটা বেপরোয়া ভাব এসে গিয়েছিল। আবার নানা রকম কৌতুহলে, প্রায়ই আনমনা হয়ে যাচ্ছিল। সেটা ছিল কলকাতা দেখার বিস্ময়। সেই সময়েই অবাক চোখে ট্রাম দেখেছিল। ট্রামের মাথায় একটা লগা দিয়ে ছোঁয়ানো বিজলি তার। এ সব কথা শোনা ছিল, চোখে দেখা সেই প্রথম। বিজলিতে চললে আর ধোঁয়া বেরোবে কেমন করে।

একেবারেই আচমকা ব্যাপার। রুহিতন প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু পলকের মধ্যেই সেই পুরনো দিনের ছবিটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। ওটা ট্রাম গাড়ি। রুহিতনকে এরা তা হলে কলকাতার ওপর দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? এটা যে কলকাতা শহর, তাতে আর কোনও সন্দেহ নেই। অবিশ্যি কলকাতাকে নিয়ে তার সেই উত্তেজনা আর ছিল না।

মনুমেন্টের নীচে সভাটা হয়েছিল প্রকাণ্ড। মানুষ মানুষ আর মানুষ। কিন্তু রুহিতন যে কী আশা নিয়ে গিয়েছিল, নিজেই তা জানত না। সভা শেষ হতেই তার মনটা কেমন হতাশায় ভরে উঠেছিল। সভায় অনেক অনেক বক্তৃতা হয়েছিল। কী বেজায় হাততালি আর হইচই, তারপরেই যেন ঠিক ভাঙা মেলার হাল। ফিরে যাবার সময় কলকাতাকে আর মোটেই পাগল হতে দেখা যায়নি। রাত্রিটা মাঠে-ময়দানে শহরের বন্ধ দোকানপাটের আশেপাশে আর স্টেশনে কেটে গিয়েছিল। ফেরবার সময় কেউ আর একটি কথাও ডেকে জিজ্ঞেস করেনি। হাততালি দিয়ে চিৎকার করেও কিছু বলেনি। খাবারও দেয়নি কেউ।

মঙ্গলার আসার কথা ছিল। নেহাত পেটে বাচ্চা ছিল, তা-ই আসেনি। কথাটা এখন মনে পড়ল রুহিতনের। দিবা বাগচি বরাবরই রুগি মানুষ। আসবার সময় সে আর কয়েক জন রেলগাড়িতে কলকাতা অবধি এসেছিল। কলকাতায় দিবা বাগচির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ফেরার সময়, দিবা বাগচিই রেল গাড়িতে সবাইকে তুলে নিয়েছিল। বলতে নেই, দিবাবাবু কার ছেলে দেখতে হবে তো। শিলিগুড়ির ধনে-মানে বড় মানুষ দীনু বাগচির ছেলে। মোহন ছেত্রীর থেকেও বড় জোতদার। ফাঁসিদেওয়ায় দীনু বাগচির বিরাট জোত। গোটা কয়েক চা বাগানের অংশীদার। রুহিতন নিজের চোখে তাকে দেখেছে। দেখলে একটা আধ ল্যাংটা ভূমিহীন কৃষক ছাড়া কিছু মনে হয় না। যতই ধুতি কুর্তা পরে সাজগোজ করুক। বিড়ি দিয়ে দাঁত খোটে, কথায় কথায় প্যাচ প্যাচ করে থুতু ফ্যালে। চোখ দুটো এমনিতেই সবসময় লাল। কটকট করে তাকায়। কিন্তু দিবা বাগচির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। একমাত্র ছেলে দিবা বাগচি। ধনী-মানী লোকটা ভেবেছিল, ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে, বাগানের তদারকি করতে পাঠাবে। সাহেব করবে। বুড়োর সে আশায় ছাই দিয়ে দিবা বাগচি একেবারে উলটো দিকে পথ নিয়েছে।

দীনু বাগচিকে বুড়া অবিশ্যি বলা যায় না। সে দিক দিয়ে দেখতে গেলে ব্যাটার থেকে বাপ জোয়ান। লেখাপড়ার কি এই দোষ? রুহিতনের মনে অবাক জিজ্ঞাসা। তা না হলে দিবা বাগচির এত রোগ ব্যামো কেন? যেন বোঙার কোপ। অর্থাৎ অপদেবতার। বাপের হাতে পায়ে দশটা পুরুষের বল। ছেলে যেন উকা (পাটকাটি)। শরীরে হাজারটা রোগ। তবে উল্কার মতোই জ্বলে ওঠে থেকে থেকে। উকা আর উল্কাতে ফারাক কিছুই নেই। উকা জ্বেলেই উল্কা হয়। দিবা বাগচির বল তার চোখের আগুনে, মুখের কথায়। সে লেখাপড়া করতে করতেই চা বাগানে আর ক্ষেতে জোতে ঘুরে বেড়িয়েছে। দেশ স্বাধীন হবার দু বছরের মধ্যে পুলিশ ধরে নিয়ে জেলে পুরে দিয়েছিল। তিন বছর পরে জেল থেকে ফিরে আসার পরে দীনু বাগচি অনেক আশা নিয়ে একমাত্র ছেলের বিয়ে দিয়েছিল।

যার আশা, তার আশা। ফাঁসিদেওয়ার জোতদারের ছেলে দিবা বাগচি কিছুকাল ঘরে ছিল। পুরুষ মানুষ সে। বিয়ে দেয় বাপ, বউ হয় ছেলের। মাটির যেমন টান বউয়ের তেমনি একটা টান আছে। দিবা বাগচিরও ছিল। দীনু বাগচিকে গুটি তিনেক নাতি নাতনি দিয়ে সে আবার যেমন মানুষ তেমনি হয়েছিল। যেখানকার মানুষ সেখানেই ফিরেছিল। সেই সময় থেকেই রুহিতনের সঙ্গে তার দেখাশোনা। ছেলের সঙ্গে বাপের বনিবনা হয়নি। বাপের ঘরের সুখ তার প্রাণে সয়নি। আসলে চায়নি। সে আবার বাগানে ক্ষেতে জোতে ঘুরে বেড়াতে আরম্ভ করেছিল। নিজে কখনও বাপের জোতদারি এলাকা ফাঁসিদেওয়ায় যেত না। দলের আর এক নেতা খেলু চৌধুরী যেত। অবিশ্যি সবাইয়ের থেকে বড় ছিল দিবা বাগচি। যারা জানত, তারা জানত দিবাবাবু দীনু বাগচির ছেলে। বাগান মাঠের মজুরেরা সবাই জানত না।

রুহিতন কলকাতা থেকে ফেরার পথে মনে মনে বিপদ গনেছিল। দিবা বাগচি যদি জিজ্ঞেস করে কলকাতার এত বড় হাট হট্টমেলা কাণ্ডকারখানা কেমন লাগল সত্যি কথা কেমন করে বলবে সে? ভাদুয়ার কেমন লেগেছিল ? ভাদুয়া মুণ্ডা, চা বাগানের লড়িয়ে নেতা। রুহিতন কারোকেই কিছু জিজ্ঞেস করেনি। দেখেছিল কারোর মুখেই হাসি নেই। শুকনো মুখ সকলের চোখেই নিজেদের জায়গায় ফিরে যাবার একটা উৎকণ্ঠিত ব্যাকুলতা। সারা রাত্র প্রায় কারোর পেটেই কিছু পড়েনি। মনে আছে দলের মধ্যে এগারোজন মেয়ে ছিল। মেয়ে মানে বউ। নিজেদের মরদদের সঙ্গে তারা এসেছিল। তারা সকলেই ছিল বাগানের। দুজনের কোলে বাচ্চা ছিল। সকলেই কিছু একেবারে পরের ভরসায় আসেনি। কারোর কারোর কাছে সামান্য পয়সাকড়ি ছিল। ছিল তাই রক্ষা। রাত্রে বউ বাচ্চাদের মুখে কিছু যাহোক দেওয়া গিয়েছিল। কিন্তু একটা কথা মানতে হবে। নিবে যাওয়া উৎসবের মধ্যেও কলকাতাকে দেখার কৌতুহল ছিল অনেকেরই। রুহিতনের নিজেরও ছিল। আর মঙ্গলার কথা তখন খুব বেশি করে মনে পড়ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *