গুড ইউমেন (গল্প)

গুড ইউমেন (গল্প)

হেনরিয়েত্তা আর আর্মিদোরো ওরফে আমেলিয়া আজ কিছুদিন হলো এ বাগানে বেড়াতে আসছে। এখানে সামার ক্লাবের সদস্যরাও আসে। কিন্তু অন্য সদস্যরা আসার আগেই ওরা চলে আসে, কারণ এই নির্জন অবকাশে ওরা দুজনে পরস্পরের একান্ত নিবিড় সান্নিধ্যে পরস্পরের কাছে আসার সুযোগ পায়, ওদের আসক্তি আর আনন্দলিন্সার উত্তাপটা বেশ কিছুটা শীতল হয়। ওরা আশা করে শীঘ্রই ওরা মিলিত প্রেমসম্পর্কের স্থায়ীবন্ধনে। 

হেনরিয়েত্তার মনটা ছিল হাসিখুশিতে ভরা। সে তার বান্ধবী আমেলিয়াকে দূর থেকে দেখতে পেলেই ছুটে যেত তাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য। কিন্তু প্রায় দিন দেখা যেত সামার হাউসের বসার ঘরে অ্যামেলিয়া একমনে বই ও পত্রপত্রিকাগুলো উল্টে পাল্টে দেখতে অথবা পড়তে শুরু করে দিয়েছে। এটাই তার অভ্যাস। এই জন্যই সন্ধ্যার দিকে প্রায় দিন সে এখানে আসে। আসে শুধু পড়ার জন্য। অন্য সবাই যখন গল্পগুজব করে, পাশা খেলে, ও তখন কোনো দিকে না তাকিয়ে কোনও শব্দে বিচলিত না হয়ে একমনে বই পড়ে যায়। কোনও যুক্তিপূর্ণ কথা কথা ছাড়া অন্য কথায় যোগ দেয় না। 

হেনরিয়েত্তা কিন্তু বেশ কথা বলত। অল্পতেই খুশি হতো সে আর যাকে-তাকে যখন-তখন প্রশংসা করত। পরে সিনক্লেয়ার নামে তৃতীয় এক ব্যক্তি এসে যোগ দেয় তাদের সঙ্গে। 

সেদিন সামার হাউসে হেনরিয়েত্তা ও আমেলিয়া দুজনেই যখন বসেছিল তখন সিনক্লেয়ার এসে হাজির হতেই হেনরিয়েত্তা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, কি খবর? 

সিনক্লেয়ার তার ব্যাগটা খুলতে খুলতে বলল, একটু পরেই দেখতে পাবে। একটা খবর তোমাদের দিচ্ছি। তোমাদের দেখাবার জন্য কয়েকটা যুবতী মেয়ের ছবি বার করছি। এ বছরের ক্যালেন্ডারের বারোটা পাতায় ওদের ওই ছবিগুলো ছাপা হবে। 

হেনরিয়েত্তা হাসিমুখে বলল, তুমি নিশ্চয় আমাদের বুদ্ধি পরীক্ষা করছ না। আমি ভাবছি কি এমন নূতন ঘটনা ঘটল যার অভিজ্ঞতা মেয়েদের সম্বন্ধে তোমার ধারণাটা খুব উঁচু করে দিল।

সিনক্লেয়ার কোনও উত্তর না দিয়ে নীরবে শুধু হাসল। আমেলিয়া প্রথমে ধীর স্থিরভারে সিনক্লেয়ারকে দেখে নিয়ে বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে বলল, আমি ওর মুখ দেখে বুঝতে পারছি ও এমন কিছু দেখাবে যা আমাদের ভালো লাগবে না। পুরুষ মানুষরা সব সময় মেয়েদের এমন একটা কিছু খুঁজে বেড়ায় যা তাদের হাস্যস্পদ করে তুলবে। 

সিনক্লেয়ার বলল, তুমি কথাটাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছ অ্যামেলিয়া, এবং বিদ্রূপ করতে চাইছ। আমি তাহলে দেখাব না ছবিগুলো। আমার প্যাকেট খুলব না। 

হেনরিয়েত্তা বলল, না না, দেখাও, ছবিগুলো। 

সিনক্লেয়ার বলল, আমরা ওদের শ্রেণীভুক্ত নই। ওদের সমাজ যেমন আমাদের ভালো লাগে না তেমনি ওদের ছবিগুলো না দেখলেও চলবে। 

তবু সিনক্লেয়ার দেখতে চাইল ছবিগুলো আর হেনরিয়েত্তা সঙ্গে সঙ্গে সিনক্লেয়ারের হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে তার থেকে ছটা ছবি খুলে টেবিলের উপর রাখল। ছবিগুলো একবার দেখে তাসের মতো গুটিয়ে রাখল হেনরিয়েত্তা। নাকে এক টিপ নস্য নিয়ে বলল, চমৎকার! ছবিগুলো জীবন্ত দেখাচ্ছে। এই ছবিটা দেখে মনে হচ্ছে মাদাম অমুকের যার সঙ্গে আজ সন্ধের সময় দেখা হবে আমাদের। এই ছবিটা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের বাবার পিসির মতো। এই সব ছবির মেয়েগুলো আকারে কুৎসিত হলেও মনে হচ্ছে এগুলো আমাদের চেনাজানা কোনও না কোনও মেয়ের থেকে তোলা। 

আমেলিয়া কিন্তু কোনো আগ্রহ দেখাল না ছবিগুলোর উপর। সে তার চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, এই সাদৃশ্যের কোনও মানে হয় না। কোনও কুৎসিত বিকৃত মেয়ের সঙ্গে কোনও কুৎসিত চেহারার মেয়েরই সাদৃশ্য থাকতে পারে, সুন্দরের সঙ্গে সুন্দরের সাদৃশ্য হয়। এদের সঙ্গে আমাদের কোনও মেয়েদের কোনও সাদৃশ্য থাকতে পারে না। 

সিনক্লেয়ার বলল, কোনও কুৎসিত ও বিকৃত চেহারার লোকের ছবি থেকে আমরা যা মজা পেতে পারি, তত মজা কিন্তু কোনও সুন্দর লোকের ছবি থেকে তা পেতে পারি না। 

আর্মিদোরো এতক্ষণ জানালার ধারে বসে সব কিছু শুনছিল। সে হঠাৎ বলে উঠল, সৌন্দর্য আমাদের মন উন্নত করে। কিন্তু অসুন্দর বা কুৎসিত আমাদের মনকে নিচে নামিয়ে আনে। 

কথাটা বলেই সে আলোচনার টেবিলে না এসে পাশের ঘরে চলে গেল। সামার ক্লাবের সদস্যসংখ্যা এখন অনেক বেড়েছে। বিভিন্ন ধরনের ও বিভিন্ন বয়সের মানুষ এখানে আসে। একজনের সঙ্গে একজনের বন্ধুত্ব ও মেলামেশার সম্পর্ক ক্ষণস্থায়ী। কার প্রতি কার আগ্রহ বা আসক্তি কতদিন থাকবে তা কেউ বলতে পারে না। তবে যারা এখানে আসে তারা সাধারণ সূক্ষ্ম রুচির লোক। তারা পরস্পরের গুণ বা যোগ্যতার মূল্য দিতে কুণ্ঠিত হয় না। প্রত্যেক আপন আপন রুচি অনুসারে আমোদ-প্রমোদের উপকরণ গ্রহণ করে। তবে এখানে যে সব সাধারণ আলোচনা হয় তা প্রায় সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। 

এই সময় লিটন নামে এক ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে নিয়ে এসে হাজির হলো। ব্যবসার ব্যাপারে লিটনকে নানা জায়গায় ঘুরতে হয় এবং নানা লোকের সঙ্গে কথা বলতে হয়, এজন্য লিটনের অভিজ্ঞতা প্রচুর। তবে তাস খেলায় তার ভালো হাত আছে। তার স্ত্রীও একজন সুযোগ্য মহিলা। স্বামীর বিশেষ বিশ্বাসভাজন। তবে সে বাড়িতে একা একা থাকতে পারে না। তাই সময় পেলেই ক্লাবে বা কোনও সংগঠনে চলে আসে। 

ক্লাবের সদস্যরা পরস্পরের পরিচিত হলেও এখানে তারা পাঠকের কাছে অপরিচিত আগন্তক হিসাবেই গণ্য হবে। আমরা তাদের সঙ্গে একে অনেক পরিচয় করিয়ে দেব। 

লিটন টেবিলের কাছে এগিয়ে এসে ছবিগুলোর পানে তাকাল। হেনরিয়েত্তা বলল, আমাদের মধ্যে তর্ক বেধেছে। আমার মতে হাস্যকর কোনও বিকৃত চেহারার লোকের ছবির মধ্যে এমন কিছু একট আছে যা ছবির ভেতর আকর্ষণ করে আমাদের। 

আমেলিয়া বলল, কারও অনুপস্থিতিতে নিন্দা করতেও খুব ভালো লাগে। সে নিন্দার একটা আকর্ষণ আছে। 

হেনরিয়েত্তা বলল, কিন্তু যাই বলল, এই ছবিগুলো কি মনে রেখাপাত করে না? 

আমেলিয়া বলল, আর এই জন্যই তো আমি এগুলো ঘৃণা করি। অবাঞ্ছিত বস্তু দুর্বার আকর্ষণই কি অশুভ শক্তির তো আমাদের জীবনকে বৃহত্তর আনন্দের ক্ষেত্র বলে টেনে নিয়ে সরিয়ে নিয়ে যায় না? 

হেনরিয়েত্তা বলল, তোমার মতামত ব্যক্ত করো লিটন। 

লিটন বলল, আমি তোমাদের মধ্যে শান্তি স্থাপন করব, বিরোধের অবসান ঘটাব। আমার কথা হলো, মানুষের মধ্যে ভালো-মন্দ দুই-ই আছে। শিল্পীরা যেমন সুন্দর দেবদূতের ছবি আঁকবে তেমনি তারা কালো কুৎসিত শয়তানদের ছবিও আঁকবে। সুতরাং তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। 

আমেলিয়া বলল, আমার কথা হচ্ছে ব্যঙ্গচিত্রের শিল্পীরা নিজেদের অধিকারের সীমা ছাড়িয়ে যায়। আমার আপত্তি সেইখানে। 

লিটন বলল, তোমার কথা ঠিক। তবু আমি বলব যে সব শিল্পীরা শুধু সুন্দরের কারবার করে তারা নিজেদের সীমা অনেক সময় ছাড়িয়ে যায়। 

আমেলিয়া বলল, কিন্তু যে সব ব্যঙ্গচিত্রশিল্পী মহাপুরুষদের ছবি বিকৃত করে আঁকে তাদের প্রতি আমার কোনও সহানুভূতি নেই। 

হেনরিয়েত্তা বলল, এটা আমারও মনের কথা। এই ধরনের শিল্পীরা বড় বড় প্রতিভাবান মানুষদের ছবি বিকৃত করে মানুষের মনে রেখাপাত করতে চায়। এই ভাবে মানুষকে আনন্দ দিতে চায়। 

সিনক্লেয়ার এতক্ষণ চুপ করে বসেছিল। এবার সে বলল, হে মহিলাবৃন্দ, এবার আমার ছবিগুলোর কথা হোক।

লিটন বলল, আমার মতে এখানে এক কুকুরপ্রীতির পরিচয় দেওয়া হয়েছে, তাও কোনও শিল্পসম্মত উপায়ে হয়নি। 

আমেলিয়া বলল, এ কথায় আমার কোনও আপত্তি নেই। আমি আবার ঐ জন্তুটাকে দেখতে পারি না। 

সিনক্লেয়ার বলল, তাহলে বলতে হবে আপনি ব্যঙ্গচিত্রের শত্রু। আর কুকুর জাতিরও মিত্র নন। 

আমেলিয়া বলল, কেন কুকুররা তো মানুষদেরই এক ব্যঙ্গাত্মক রূপ। 

লিটন বলল, তোমার হয়ত মনে আছে কোনো এক নাবিক এক শহর সম্বন্ধে বলেছিল সে শহরে শুধু কুকুর আর আধ-পাগলা কতকগুলো বোকা লোক থাকে। 

সিনক্লেয়ার বলল, পশুদের প্রতি আমাদের আসক্তি আমাদের স্বাভাবিক স্নেহমমতার আবেগকে কমিয়ে দেয়। 

আমেলিয়া বলল, কুকুরদের সামনে আমাদের আবার যুক্তিবোধ বজায় থাকে না। 

সিনক্লেয়ার বলল, একমাত্র মাদাম লিটন ছাড়া এখানে আর কারও কুকুরের প্রতি আসক্তি নেই। উনি ওঁর সুন্দর গ্ৰেহাউন্ডটার প্রতি খুব বেশি আসক্ত। 

লিটন বলল, এ আসক্তি আমারও আছে। আমি একটা প্রমাণ দিতে পারি জন্তুরা কি ভাবে মানুষের মনকে তাদের প্রেমের বস্তু হতে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। 

এই বলে লিটন তার স্ত্রীর মত নিয়ে গল্প বলতে শুরু করে দিল। 

আমি একটি মেয়েকে ভালোবাসতাম। আমাদের বিয়ের একরকম ঠিক হয়ে গিয়েছিল। এমন সময় হঠাৎ কোনো এক জরুরি কাজের জন্য দূর দেশে যেতে হলো আমায়। সেখানে আমাকে বেশ কিছুদিন থাকতে হলো। যাবার সময় আমি আমার গ্ৰেহাউন্ড কুকুরটাকে নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলাম। কুকুরটা আমার প্রেমিকার বাড়িটা জানত। আমার সঙ্গে সে বহুবার তাদের বাড়ি গিয়েছে। তাই আমার অবর্তমানে সে আমার প্রেমিকার বাড়িতে রয়ে গেল। আমার প্রেমিকাও কুকুরটাকে খুব ভালোবাসত। তার সাহচর্যে আনন্দ পেত। আর কুকুটার নাম ছিল মেটা। প্রথম প্রথম সে আমার প্রেমিকার কাছে ভালোই ছিল। সে জানত আমি শীগগির ফিরে আসব। কিন্তু আমার যখন ফেরার কথা ছিল তখন ফিরতে পারলাম না। অনেক দেরি হতে লাগল। তখন কুকুরটা আমার জন্য ভেবে ভেবে মারা গেল। 

এদিকে আমি আর আমার কুকুরটা না থাকায় আমার প্রেমিকার নিঃসঙ্গতা অসহ্য হয়ে উঠল। বাড়িতে মন টিকত না তার। এমন সময় একটি যুবক তার বাড়িতে প্রায়ই আসা-যাওয়া করত। বাড়িতে ও বেড়াতে যাবার সময় তাকে সঙ্গ দান করত। তবু কিন্তু কুকুরটার কথা ভুলতে পারল না আমার প্রেমিকা। 

আমাদের পাড়ায় আমার এক বিচক্ষণ বন্ধু ছিল। তারও একটা গ্ৰেহাউন্ড কুকুর ছিল। কুকুরটা দেখতে ছিল আমার কুকুরের মতো। সে একদিন কুকুরটা নিয়ে আমার প্রেমিকার বাড়িতে যেতেই আমার প্রেমিকার মনে হলো সেই মরা কুকুরটা যেন আবার ফিরে এসেছে। সে খুশি হয়ে কুকুরটাকে বাড়িতে রেখে দিল। কুকুরটাকে দেখে আমার কথা ও আমার সেই কুকুরটার কথা তার মনে হলো। তার সব দুঃখ দূর হয়ে গেল।

আমি ফিরে এসে দেখলাম আমার কুকুরটাই যেন আমার প্রেমিকার বাড়িতে রয়েছে। কিন্তু সে আমাকে আসতে দেখে ঘেউ ঘেউ করতে লাগল। তা দেখে বললাম প্রাচীনকালের সেই বিশ্বস্ততা আমাদের কুকুরটা ভুলে গেছে। বিশ বছর পরেও ইউলিসেসকে দেখে চিনতে পেরেছিল তার কুকুর। আমার প্রেমিকা তখন বলল, তবে ওই কুকুরই তোমার পেনিলোপের সতীত্ব রক্ষা করেছে। 

কথাটার মানে পরে আমাকে বুঝিয়ে বললে আমি সব বুঝতে পারলাম। আমার প্রেমিকার বিশ্বস্ততায় আমি খুশি হলাম। আমাদের প্রেমসম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়ে উঠল। 

এমন সময় মাদাম লিটন তার স্বামীকে বলল, তুমি তো এখন নিশ্চয়ই তাস খেলবে, আমি ইতিমধ্যে ঘণ্টাখানেকের জন্যে বেড়িয়ে আসি। 

লিটন তার স্ত্রীর হাত ধরে দরজার কাছ পর্যন্ত এগিয়ে বলল, কুকুরটাকেও নিয়ে যাও প্রিয়তমা। 

তখন উপস্থিত সকলে এ গল্পের তাৎপর্য বুঝতে পেরে হাসতে লাগল। সিনক্লেয়ার বলল, তুমি এমন একটি কাহিনী বললে, যা তোমাদের বিবাহে সাহায্য করেছে। কিন্তু আমি একটি কাহিনী জানি যাতে দেখবে কুকুরের প্রভাব একটি প্রেমসম্পর্ককে নষ্ট করে বিবাহের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। গল্পটা বলি। 

আমি একটি মেয়েকে ভালোবাসতাম। আমার ভাগ্যেও এমনি বাইরে যাবার ঘটনা ঘটে। আমিও যাবার সময় একটি কুকুর রেখে যাই আমার প্রেমাস্পদের কাছে। তবে আমাদের বিয়ের কথাটা পাকা হয়নি। আমি যথাসময়ে ফিরে এসে আমার প্রেমাস্পদের কাছে যাই। আমার ভ্রমণের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা থাকে শোনাতে ইচ্ছা হয় আমার। আমি বিশেষ উৎসাহ ও আগ্রহ নিয়ে তাকে সব কথা বলি। আমার ধারণা ছিল এ সব শুনে সে খুশি হবে। কিন্তু আমি দুঃখের সঙ্গে দেখলাম, আমার প্রেমিকা শুধু কুকুর নিয়েই ব্যস্ত। আমি তখনকার মতো চলে গিয়ে আবার ফিরে এলাম। এবারও দেখলাম তার সমস্ত মন জুড়ে আছে তার কুকুরের প্রতি এক অস্বাভাবিক প্রীতি আর মমতা। এমত অবস্থায় আমাদের প্রেমসম্পর্কে সমস্ত উত্তাপ ক্রমশ শীতল হয়ে এল। আমি একদিন সে সম্পর্ক ছিন্ন করে করে দিলাম এবং বুঝলাম এর একমাত্র কারণ হলো একটা কুকুর। 

আর্মিদোরো পাশের ঘর থেকে এসে আলোচনায় আবার যোগদান করল। সে বলল, মানুষের উপর ইতর প্রাণীর প্রভাব নিয়ে যত গল্প আছে সেগুলো এক জায়গায় সংকলন করা উচিত। আমি একটি গল্প বলব যাতে দেখা যাবে একটি প্রাণী কিভাবে এক মর্মান্তিক ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। 

ফার্দিনান্দ আর কার্দানো ছিল সামন্ত পরিবারের দুটি যুবক। ছোট থেকেই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে। রাজসভার লোক থেকে সামরিক অফিসার হয় তারা দুজনেই। একসঙ্গে দুজনে নানা ধরনের প্রচুর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে। কার্দানোর কাছে একমাত্র আকর্ষণের বস্তু ছিল সুন্দরী মেয়ে। ফার্দিনান্দ ভালোবাসত খেলাধুলা। কার্দানো ছিল উদ্ধত ও দাম্ভিকপ্রকৃতির। অন্য বন্ধুটি ছিল সন্দেহপ্রবণ এবং স্বল্পভাষী। 

কার্দানোর স্বভাবটা ছিল বড় অদ্ভুত। সে একের পর এক এক-একটি মেয়েকে ভালোবাসত আর কিছুদিন পর তাদের ছেড়ে দিত। আর প্রতিবারই একটি মেয়েকে ছেড়ে যাবার সময় একটি কুকুরকে রেখে যেত তার কাছে।

ক্রমে ফার্দিনান্দ কার্দানোর এই স্বভাবের কথা জানতে পারে। কিন্তু সেদিকে তার কোনও আগ্রহ ছিল না। সে নিজে যথাসময়ে বিয়ে-থা করে ঘর-সংসারে মন দেয়। এমন সময় কার্দানো একবার তার বাড়িতে ও তাদের পাড়ায় এসে কিছুদিন থাকে। 

কার্দানো তার বাড়ি থেকে চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে তার স্ত্রীর কাছে একটি মনোরম কুকুর দেখে আশ্চর্য হয়ে যায় ফার্দিনান্দ। সঙ্গে সঙ্গে আগ্রহ সহকারে তার স্ত্রীর কাছে জানতে চায় এ কুকুর কোথায় সে পেল। তার স্ত্রী তখন বলে, কার্দানো যাবার সময় এটা তাকে দিয়ে গেছে। 

মুহূর্ত মধ্যে মাথাটা ঘুরে যায় ফার্দিনান্দের। কুকুরটা কোল থেকে সজোরে ফেলে দেয় মাটিতে। রাগে গর্জন করতে করতে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। কার্দানোর নোংরা স্বভাবের কথাটা মনে পড়ে যায় তার আর সঙ্গে সঙ্গে সন্দেহ জাগে স্ত্রীর চরিত্রের উপর। তার মনে হয় নিশ্চয় কার্দানো গোপনে আসক্ত ছিল তার স্ত্রীর প্রতি। তার স্ত্রীকে ভালোবাসত সে এবং অন্যক্ষেত্রের মতো এক্ষেত্রেও সে তার ব্যর্থ প্রেমের প্রতীকস্বরূপ রেখে গেছে এই কুকুরটা। 

কারো কোনও আবেদন-নিবেদনে কাজ হলো না। প্রকাশ্যে বিবাহবিচ্ছেদ না করলেও দাম্পত্যসম্পর্ক ছিন্ন করে চলে গেল ফার্দিনান্দ। 

আর্মিদোরোর গল্প শেষ হতেই ঘরে ঢুকল আমেলিয়া। সে একজন গুণবতী মহিলা এবং নামকরা লেখিকা। তার সঙ্গ সবাই চায়। সে ঘরে ঢুকতেই ছবিগুলো তাকে দেখিয়ে তার মতামত চাওয়া হলো। 

আমেলিয়া বলল, এই ছবিগুলো ক্যালেন্ডারে ছাপার জন্য ঠিক হয়েছে। তবে কোনও লেখক এর অর্থ বলতে পারবে না। 

সিনক্লেয়ারও তাই মনে করে। ছবিগুলো একেবারে নিন্দার যোগ্য নয়। প্রত্যেকটা ছবির একটা করে নাম আছে। কিন্তু সেগুলো ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতে হবে। তা না হলে শিল্পীর উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। 

আমেলিয়া বলল, প্রথমেই একটি ছবির কথা ধরো। এতে আছে এক যুবতী কোনও কিছু লিখতে লিখতে তার আর্মচেয়ারে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর একটি নারী তার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে একটি ছোট্ট বাক্স তার সঙ্গীর হাতে তুলে দিচ্ছে। এর অর্থ কী?

সিনক্লেয়ার বলল, আমি এর অর্থ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে দেখব কি? আমার মনে হয়, যে মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়েছে সে একজন লেখিকা আর তার পাশে যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে সে তার মহিলাভৃত্য, তার হাতে আছে একটা দোয়াত যাতে লেখিকা ঘুম থেকে উঠেই আবার তার লেখা শুরু করতে পারে। 

কিন্তু ক্লাবের অন্যতম সদস্য প্রতিভাবান শিল্পী আর্বন এ অর্থ মেনে নিতে পারল না। সে বলল, প্রত্যেক লেখক বা লেখিকার দোয়াত রাখার জায়গা থাকে। কিন্তু এখানে একজন ভৃত্যের হাতে দোয়াত রাখার প্রয়োজন কি? তাছাড়া যখন তার কোনও প্রয়োজনই নেই, যখন লেখিকা লেখার কাজ করছে না তখন তার দোয়াত ধরে দাঁড়িয়ে থাকার অর্থ কি এবং তার চোখের জল মোছারই বা অর্থ কি হতে পারে? 

হেনবিয়েত্তাও একথা সমর্থন করল। সিনক্লেয়ার বলল, আমি শিল্পীর সমর্থনে শুধু এই কথাই বলতে চাই যে শিল্পী ইচ্ছা করেই একটা হেঁয়ালি রেখেছে যাতে দর্শকরা ও সমঝদারেরা কিছু একটা কল্পনা করতে পারে।

আর্বন বলল, আমার মতে যাদের ছবি আঁকা হয়েছে সেই সব মূর্তির মুখে অল্প করে কথা লিখে দিতে বলো। তাহলে ব্যাপারটা বুঝতে পারা যেত। 

সিনক্লেয়ার বলল, এমন ছবি বুদ্ধিমানের জন্য। যে-সে এমন ছবির অর্থ বুঝতে পারবে না। একমাত্র বুদ্ধিমানরাই এর থেকে বুদ্ধিগত আনন্দ লাভ করতে পারে। 

আর্মিদোরো বলল, ঐ অশ্লীল ছবিগুলো নিয়ে এখনও আলোচনা চলছে? ওগুলো ভালো ছবি হলে এতক্ষণে সরিয়ে রাখা হতো। 

আমেলিয়া বলল, এই ছবিগুলো ক্যালেন্ডারে ছাপা হলেও একবার দেখার সঙ্গে সঙ্গেই এ ক্যালেন্ডার কেউ কারও হাতে উপহার হিসাবে তুলে দিতে পারবে না। কোনও লোক ছেলেমেয়দের জন্য ঘরে নিয়ে যাবে না। 

আর্মিদোরো বলল, আমার একটা প্রস্তাব আছে। আমাদের যে লেখিকা রয়েছে। সেই আমেলিয়া এর ব্যাখ্যা করে এই ছবিগুলোর ভালো দিকটাকে দেখাবে। 

সিনক্লেয়ারও এ প্রস্তাব সমর্থন করল। বলল, ওঁর ফেয়ারি টেল গল্পটা আমরা গতকাল বিশেষভাবে উপভোগ করেছি। 

আমেলিয়া বলল, গল্পটা আমার নয়। আমার এক বান্ধবীর।

আর্মিদোরো বলল, এ গল্পের উৎসের কথা জানতে আশ্চর্য হয়ে যাবেন আপনারা।

আমেলিয়া সে কাহিনী শুরু করল। 

আমি একবার এক জায়গায় বেড়াতে গিয়ে একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচিত হই। তার কতকগুলো সদগুণ ছিল। সে একবার দারুণ বিপদে পড়ে। মেয়েটি এক ভদ্রলোকের। সঙ্গে কয়েকটি কারণে বাধ্যবাধকতার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। লোকটি অবশ্য মেয়েটিকে বিয়ে করবে বলে কথা দেয়। কিন্তু বিয়ের আগেই মেয়েটির মনে বিশ্বাস উৎপাদন করে দেহসংসর্গে লিপ্ত হয় ভদ্রলোক।এমন সময় অবস্থার তাড়নায় ভদ্রলোককে ফ্রান্স যেতে হয়। অথচ মেয়েটি তখন তার গ্রামের বাড়িতে সব সময় এই ভয় করছিল যে বুঝিবা সে মা হতে চলেছে। মেয়েটি তার সব কথা চিঠির মাধ্যমে আমাকে জানাত। আমি তাকে ধৈর্য ধারণ করতে উপদেশ দিতাম। আমি তাকে প্রায়ই এই কথা বলতাম যে যদি তার সন্তান হয় তাহলে বিচলিত হলে চলবে না। তাকে তার মার কর্তব্য পালন করে যেতেই হবে। আমি তাকে কতকগুলো রূপকথার গল্প সাজিয়ে দিয়েছিলাম। ফলে সে এইগুলো পড়ে সময় কাটাতে পারত। বর্তমান জীবনের দুর্বিষহ অবস্থায় ও নানারকমের দুশ্চিন্তায় মনটা যখন তার হাঁপিয়ে উঠেছিল তখন আমার পাঠানো রূপকথাগুলো পেয়ে সে খুশি হলো। সে একজন কল্পনার জগৎ খুঁজে পেল। সে তখন তার অতীত জীবনের যত সব সুখ-দুঃখের কথা লেখার চেষ্টা করতে লাগল। 

আর্মিদোরো তখন বলল, আর লিখতে গিয়ে সে হয়তো দোয়াতটাকে রাখতে ভুলে গিয়েছিল। 

আমেলিয়া বলল, মেয়েটির সব চিঠিগুলো আমার কাছে আছে। এই সব চিঠিতে তার বাস্তব অভিজ্ঞতার কথাগুলো, যেমন তার প্রেম, মা হবার ভয়, তার সন্তানপ্রসব, তার স্বামীর ফিরে আসা এবং তার বিয়ে কল্পনাসমৃদ্ধ করে লেখা হয়েছে। তার বিয়ের দিনে শেষ হয় তার কাহিনী যে কাহিনী আপনারা গতকাল শুনেছেন। 

লিটল বলল, আগেকার কালে ডায়েরি রাখার প্রচলন ছিল। কিন্তু এখন এটা সেকেলে ব্যাপার হয়ে গেছে। আমি জানি এক শিক্ষয়িত্রী ডায়েরি রাখত। রোজকার ঘটনা যথাযথভাবে ডায়েরিতে লেখা তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। কোনও কথা সে গোপন রাখত না। সব ডায়েরিতে লিখত আর মাঝে মাঝে তা পড়ে সবাইকে শোনাত। কিন্তু ডায়েরিটা হাতছাড়া করত না কখনও। কাউকে দিতও না। একদিন ডায়েরিটা তার স্বামীর হাতে পড়ে এবং সে কৌতূহলবশত তা পড়তে পড়তে এমন কতকগুলো কথার সম্মুখীন হয় যাতে তার ডায়েরি পড়ার সব আনন্দ চিরদিনের মতো চলে যায়। 

হেনরিয়েত্তা বলল, আমাদের আলোচনা কিন্তু সৎ মেয়েদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। অবাঞ্ছিত মেয়েদের কোনো কথা আমরা বলতে বা শুনতে চাই না। 

লিটন বলল, কেন, ভালো-মন্দ সব রকম মেয়ের কথাই ধরা উচিত। 

সিনক্লেয়ার বলল, তাহলে তো ক্যালেন্ডারের এই ছবিগুলো ঠিকই নির্বাচিত হয়েছে। এতে ভালো-মন্দ সব রকম মেয়ের ছবিই আছে। 

আমেলিয়া বলল, এই ক্যালেন্ডারের শিল্পী যেমন বাজে মেয়েদের ছবি নিয়ে আমাদের নারীজাতির অপমান করেছে তেমনি আমি চাই এমন কতকগুলো মেয়ের ছবি ও ইতিবৃত্ত সংগ্রহ করতে যারা সংসারের মুকুটমণি, যে সব নারীদের সদগুণাবলি সংসারকে সুন্দর করে তোলে। 

লিটন বলল, তাহলে বলি শোনো। একবার একটি যুবক একটি হোটেল লিজ নিয়ে চালাতে শুরু করে। সে সকলের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করত। তবে তার মদ খাওয়ার অভ্যাস থাকায় রোজ একবার করে মদের দোকানে যেত। কিন্তু নিজের দৈনন্দিন কাজকর্মে কোনও অবহেলা করত না। সে যথাসময়ে বিয়ে করে। তার স্ত্রী ছিল খুব বুদ্ধিমতী আর হিসেবী। যুবকটি কিন্তু ব্যবসাগত লেনদেন বা টাকা-পয়সার কোনও হিসাবে রাখত না। তার উপর কিছু বাজে খরচ এবং দানও করত। হোটেলের বাসিন্দারা যখন কোনও মোটা টাকা দিত যুবকটিকে, সে তখন সে টাকা জমা করে ব্যাঙ্কে রাখার ব্যবস্থা করত না, তার থেকেই খরচ করতে শুরু করে দিত। খরচ করতে করতে টাকাটা ফুরিয়ে যেত। এইভাবে সে সমস্ত আয় খরচ করে ফেলত। একটা পয়সাও সঞ্চয় করতে পারেনি কারবার থেকে। তার বুদ্ধিমতী স্ত্রী এইসব ভালোভাবে দিনের পর দিন লক্ষ করে একটা মতলব আঁটল। সে তার স্বামীর টাকা থেকে রোজ কিছু করে গোপনে সরিয়ে রাখতে লাগল। তার স্বামী কিছুই টের পেল না। এইভাবে সে অনেক টাকা জমাল। প্রথমে অল্প অল্প পরে বেশি করে সরাতে লাগল। একদিন তার স্বামী টাকার টানাটানিতে পড়ল। তার স্ত্রীর কাছে এসে যুবকটি বলল, বাড়িওয়ালার ভাড়া দিতে হবে, অথচ টাকা নেই ক্যাশে। কি করে কি হলো, কি করে সব টাকা ফুরিয়ে গেল তা বুঝতে পারছি না। কোন হিসেব না রাখার জন্য তার স্ত্রী তাকে অনেক তিরস্কার করল। লোকটি তার ভুল স্বীকার করল। তারপর স্ত্রী ঘর থেকে অনেক টাকা বার করে আনল। সে যত টাকা এতদিন ধরে সরিয়েছে তা সব হিসেব করে গুছিয়ে রেখেছে। সে টাকায় সব ঋণ শোধ করেও অনেক বেচে রইল। এরপর থেকে যুবকটি টাকা-পয়সার সব ভার তার স্ত্রীর উপর ছেড়ে দিল। তার স্ত্রীর তার হিসেবী বুদ্ধির দ্বারা সঞ্চয়ের মাত্রা বাড়িয়ে সেই টাকায় গোটা হোটেলটা বাড়িওয়ালার কাছ থেকে কিনে নিল। সুখে-শান্তি উজ্জ্বল হয়ে উঠল তাদের সংসার। মেয়েটির নাম ছিল মার্গারেট। 

সিনক্লেয়ার বলল, এখন দেখছি মেয়েটির সমস্ত প্রেম, সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততার উদ্দেশ্য হলো সংসারের সব কর্তৃত্বভাব অর্জন করা। নারীদের প্রভুত্বপৃহা সম্বন্ধে তোমার মতামত আমি জানতে চাই।

আর্মিদোররা বলল, আমেলিয়া, তুমি লেখিকা হিসাবে নিজের জাত সম্পর্কে নিরপেক্ষ। তোমার লেখায় নারীজাতিকে বড় করার বা তাদের দোষ ঢাকার কোনও প্রচেষ্টা নেই। 

আমেলিয়া বলল, দেখুন, আপনারা যাকে প্রভুত্ব বলছেন তা এক স্বাধীনতা কামনা বা স্বাতন্ত্র্যবোধ ছাড়া কিছুই নয়। নিজের প্রভুত্ব সবাই উপভোগ করতে চায়। সব মানুষই তাই চায়। নারীরাও মানুষ। কিন্তু সমাজে পুরুষের স্বাধীনতা ও প্রভুত্ব বেশি বলে নারীদের কোথাও কোনো প্রভুত্ব দেখলে সেটা বেশি চোখে পড়ে। তাই নারীরা একবার অতি কষ্টে কোনওরকমে প্রভুত্ব পেয়ে গেলে জোর কামড় দিয়ে ধরে থাকে, ছাড়তে চায় না। 

লিটন বলল, যে সব মেয়েরা কর্মঠ, পরিশ্রমী এবং সঞ্চয়ী তারা ঘরে প্রভুত্ব অর্জন করে। সংসারের সব কর্তৃত্ব তাদেরই হাতে আসে। আর যারা সুন্দরী তাদের প্রভুত্বের ক্ষেত্র প্রসারিত হয় সারা সমাজের সর্বত্র। তাদের সব জায়গায় জয়। আবার যারা কোনও না কোনও বিষয়ে কৃতিত্ব অর্জন করছে তারাও সমাজের এক বিশেষ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা ও প্রভুত্ব লাভ করে। 

আমেলিয়া বলল, তাহলে আমরা তিন শ্রেণীতে বিভক্ত। 

সিনক্লেয়ার বলল, কিন্তু সব নারী এই তিন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত নয়। এর বাইরেও এক শ্রেণীর নারী আছে। তাদের কথা ধরলে নারীজাতির প্রতি আমাদের সব প্রশংসা নিন্দায় পরিণত হবে। 

সিনক্লেয়ার বলল, প্রথম তিন শ্রেণীর নারীরা সংসারে ও সমাজে বিভিন্ন প্রভাব বিস্তার করে। 

হেনরিয়েত্তা বলল, আর যে কোনও দিকে আমাদের কর্মক্ষেত্র প্রসারিত হতে পারে? 

সিনক্লেয়ার বলল, হতে পারে অনেক দিকে। আমি বলছি এক শ্রেণীর মেয়েদের কথা যারা কোনও কাজই করে না। যারা কুঁড়ে অকর্মণ্য, তারা কোনও কাজ না করেও শুধু অন্যদের কাজে বাধা সৃষ্টি করে এক ধরনের প্রভুত্ব অর্জন করে। 

হেনরিয়েত্তা বলল, কিন্তু তোমার চতুর্থ শ্রেণীর নারীর খবর কি? তার কথা বলো। 

সিনক্লেয়ার বলল, আমাদের দেশের কথা বলছি না। কিন্তু এখনও এমন অনেক দেশ আছে সেখানকার নারীরা স্বাধীনতা পায়নি। তারা সব সময় বিষাদে আচ্ছন্ন। থাকে। অবশ্য আমাদের প্রতিবেশী কোনও কোনও দেশে এমন অনেক মেয়ে আছে যাদের অকারণে মুখটা সব সময় ভার-ভার থাকে। তারা কাউকে শান্তি দিতে পারে না। নিজেরাও শান্তি পায় না। এই বিষাদ একটা রোগ, এই রোগ কিছুটা শারীরিক, কিছুটা মানসিক। আমি এ বিষয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম। 

সিনক্লেয়ার বলল, কিন্তু আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলো। আমি ভেবেছিলাম এই ক্লাবে বিভিন্ন রকমের লোক আসে। তাদের কেউ না কেউ আমার ছবিগুলোর অর্থ ঠিকমতো ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেবে। কিন্তু এর আগে মেয়েদের এই ছবিগুলোকে সবাই শুধু অহেতুক গালাগালি দিল। কেউ বোঝার চেষ্টাও করল না। সুতরাং আমি বিদায় নিচ্ছি। 

আর্মিদোরো সিনক্লেয়ারকে লক্ষ করে বলল, তোমার ইচ্ছাই পূরণ হলো। আজকে যা যা আলোচনা হয়েছে আমি তার সব নোট নিয়ে রেখেছি। পরে সেগুলো সম্পাদনা করলে দেখা যাবে শিল্পী মেয়েদের অকারণে আক্রমণ করেননি। মেয়েদের ব্যঙ্গ করে যে ছবিগুলো এঁকেছেন আর একটা করে অর্থ আছে। সবাই ভালো মেয়ে নয়। 

হেনরিয়েত্তা প্রতিবাদের সুরে বলল, এটা কিন্তু ঠিক কাজ করনি আর্মিদোরো। আমরা সহজভাবে ভোলা মন নিয়ে মেলামেশা করি। কিন্তু অসতর্ক মুহূর্তে বলে ফেলা আমাদের কথাগুলো যদি লিখে রাখো এবং সেগুলোকে ছেপে আর পাঁচজনকে মজা দান করো তাহলে সেটা কিন্তু ভালো হয় না। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *